আগুন ঝরার দিনে

তামান্না স্মৃতি

 

 

১ম পর্ব

মানুষটা অনেকটা আগুনের মত। অন্ধকারে হোক কিংবা আলোতে, নির্জনে কিংবা ব্যস্তমুখর কোনো কোলাহলে হোক মানুষটার উপস্থিতি বড় বেশী প্রকট। গায়ের রং অসম্ভব ফর্সা আর বাঙালী ছেলেদের তুলনায় উচ্চতা খানিকটা বেশী বলে মানুষটাকে অনেক ভিড়ের মাঝেও আলাদা করা যায়। রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে প্রেমে পড়েছে। ভুল জায়গায়, ভুল সময়ে সে একটা ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছে। সজল নামের একটি ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে মাস তিনেক আগে। সামনে ঈদের পরেই সজলের সাথে তার বিয়ে। বাবা যখন সজলের প্রস্তাব নিয়ে রুহির সামনে এসেছিলেন তখন রুহির না করার কোনো কারন ছিল না। দেখতে বেশ সুদর্শন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিরত সজলের ছবি দেখে রুহি এক বাক্যেই বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল। তবে বাধ সাধলো দিন পনের আগে। যখন এই মানুষটা গত জানুয়ারি মাসের এগারো তারিখে তাদের ফ্যাকাল্টিতে এসিসটেন্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করলেন। মানুষটাকে এক নজর দেখেই রুহির মনোজগতে ভীষণ রকমের তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই তো সেই মানুষ যার জন্য সে এতদিন ধরে অপেক্ষা করে রয়েছে।

– এক্সকিউজ মি। হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।

রুহি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, ক্লাস ভর্তি ছাত্র ছাত্রীর সামনে মানুষটা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুহির কয়েক সেকেন্ড বুঝে উঠতে সময় লাগলো মানুষটা বোধহয় তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছেন।

রুহি মনে মনে প্রমোদ গুনলো। এতক্ষণ ইকোনোমিক্সের এই প্রফেসর ক্লাসে কী পড়িয়েছেন তা রুহির মাথাতেও ঢুকেনি। অবাক হলেও সত্য, পড়ানোর টপিকটা পর্যন্ত সে জানে না। 

রুহি ফ্যালফ্যাল করে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। 

– আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? খুব বেশী খারাপ লাগলে আপনি ক্লাসের বাইরে যেতে পারেন। একটু খোলা হাওয়ায় দাঁড়ালে আপনার হয়ত ভালো লাগবে।

রুহি আর কথা বাড়াল না। বই খাতা গুলো ব্যাগে গুছিয়ে সে মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। সে খুব ভালো মত জানে আজ ক্লাসে তাকে নিয়ে বেশ বড় রকমের একটা গুঞ্জন শুরু হবে। কারন আশফাক নামের এই মানুষটা ক্লাসে কাউকে অ্যাবসেন্ট মাইন্ডে দেখলে কোনো না কোন ভাবে তাকে হেনস্থা করেন। তবে রুহির ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটলো না। অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে মানুষটা তাকে মস্ত বড় অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।

– এই রুহি।

রুহি সামনের দিকে তাকিয়ে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার সামনে সজল দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলে প্রায়ই অফিস কামাই করে তার ক্যাম্পাসে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমদিকে বিষয়টা খুব ভালো লাগলেও এখন রুহির খুব বিরক্ত লাগে। এত অফিস কামাই করেও সজল তার চাকরিটা করছে কীভাবে কে জানে!

রুহি নিজের বিরক্তিটা লুকিয়ে বলল, তুমি এই সময়?

সজল হাসিমুখে বলল, এটাই তো তোমার আজকের শেষ ক্লাস ছিল, তাই না? একটা কাজে তোমার ক্যাম্পাসের পাশে এসেছিলাম ভাবলাম তোমাকে নিয়ে বাসায় ফিরি।

রুহি অবাক হয়ে বলল, বাসায় ফিরি মানে?

– না মানে তোমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে যাব।

রুহি মুখ গোজ করে বলল, তুমি এখন চলে যাও। পড়া পারিনি বলে স্যার আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন। এখন ক্লাস শেষে সুমির কাছ থেকে আমার আজকের নোটগুলো তুলতে হবে। 

– বেশ তো। আমি থাকি। তোমার নোট তোলা শেষ হলে তবে নাহয় যাবো। আমার তো আজ আর কোনো কাজ নেই।

রুহি বুঝল, সজল তার সামনে মিথ্যে কথা বলছে। সে নিশ্চয়ই আজ তার সাথে দেখা করবে বলে অফিস থেকে হাফ বেলা ছুটি নিয়েছে। রুহি খুব মোনোযোগ দিয়ে সজলকে লক্ষ্য করল। ছেলেটার চোখ দুটো  আশ্চর্য রকমের সুন্দর। খুব মোনোযোগ দিয়ে তাকালে মনে হয়, কেউ বুঝি খুব আলতো করে তার চোখের নিচে কাজল দিয়ে দিয়েছে! রুহির মন খারাপ হয়ে গেল। সে জানে কাজটা খুব অন্যায় হচ্ছে। এই ছেলেটার তো কোনো দোষ নেই। সে তার ভাবী স্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য তার ক্যাম্পাস পর্যন্ত এসেছে অথচ রুহির ভালোলাগার বদলে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রুহি মন খারাপ করে বলল, থাক বাদ দাও। সুমির কাছে নোট কাল তুলে নিব। চলো আজ নাহয় বাসায় ফিরি।

– বাসায় ফেরার আগে কোথাও খেতে যাবে নাকি? তোমরা মুখটা দেখতে আজ বেশ শুকনো লাগছে।

রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, চলো কোথায় খেতে যেতে চাও।

                              ……………

অনেকক্ষন থেকে একটানা রিং বেজে চলেছে। আশফাক হতাশ চোখে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে একবার ফোন করা শুরু করলে না ধরা পর্যন্ত আর নিস্তার নেই। ফোন সে এক টানা দিয়ে যাবে। একবার সে টানা একাশি বার ফোন করেছিল। কোনো মানে হয়! আশফাক বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো।

– হ্যাঁ দীপা বলো।

– কী ব্যাপার ফোন ধরছিলে না যে?

– ক্লাসে ছিলাম।

– মোটেও না। এই সময় তোমার ক্লাস নেই আমি খুব ভালো মত জানি। আজ শুধু মাত্র তোমার একটা ক্লাস। তাও বিকেল চারটায়।

আশফাক একটু অবাক হলো। দীপা কি কোনোভাবে তার উপর নজর রাখে? আজ আসলেই তার কোনো ক্লাস ছিল না। আশফাক কথা ঘুরিয়ে বলল, কী বলার জন্য ফোন করেছ তাই বলো?

– নিজের বৌ বাচ্চার কোনো খবর আছে তোমার! আমি কিছু বুঝি না ভেবেছ? নায়কের মত এই লালটু মার্কা চেহারা দেখিয়ে তুমি তোমার কচি কচি ছাত্রীদের ইমপ্রেস করতে চাও। তাই তো কোনো ক্লাস না থাকলেও সারাদিন ক্যাম্পাসে যেয়ে বসে থাকো।

– বাজে কথা বলো না দীপা। গত তিন মাস আগে রাগ করে আমি তোমায় ছেড়ে যাইনি। বরং তুমি ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যেয়ে বসে আছো।

– তবুও ছেলেকে দেখতে একবার আসতে পারতে না তুমি? কেমন বাপ তুমি? ছেলের কথা তোমার গত তিনমাসে একবারও মনে পড়েনি!

আশফাক আর কথা বাড়াল না। দীপার মুখের উপরেই ফোনটা রেখে দিল। দীপার সাথে কথা বাড়িয়ে কোনো  লাভ নেই। এই মেয়ে শুধু কথা টানতে জানে। আর কিছু জানে না। অথচ বিয়ের প্রথম দুটো বছর এই দীপার সাথে তার দিনগুলো খুবই চমৎকার কেটেছিল। তবে ছেলেটা হবার পর দীপা যেন আমূলে বদলে গেল। তার মাথার মধ্যে কোথা থেকে যেন এক গাদা সন্দেহের পোকা ঢুকল। প্রথম দিকে আশফাক অনেক মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। দীপাকে অসংখ্যবার বুঝিয়েছে অন্য নারীর প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। তবে কে শোনে কার কথা। দীপা যেন অবুঝ। সে কিছুতেই চায় না আশফাক ক্যাম্পাসে শিক্ষকতা করুক। তার ধারনা আশফাকের পেছনে তার ছাত্রীরা সব সময় লেগে থাকে। দীপার ধারনাটা যে একেবারে ভুল তা অবশ্য বলা যায় না। আশফাক তার ছাত্রী মহলে আসলেই ভীষণ জনপ্রিয়। রাত বিরাতে তার ছাত্রীরা যে তাকে আননোন নম্বর থেকে ফোন করে, টেক্সট করে সেটা সে খুব ভালোমত বোঝে। তবে এগুলো আশফাককে সেভাবে আলোড়িত করে না। নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হয় সেটা সে খুব ভালোমত জানে। তবে এটাও ঠিক, দীপাকে নিয়ন্ত্রন করার উপায় তার জানা নেই। সে দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাচ্ছে। আশফাক নিজের অজান্তেই দুদিকে মাথা নাড়াল। একটু পর তার থার্ড সেমিষ্টারের একটা ক্লাস আছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। আশফাক একটু বিরক্তি নিয়ে টিচার্স রুম থেকে ক্লাস রুমের দিকে পা বাড়াল।

ক্লাস নেয়ার ফাঁকে আশফাকের জীবনে যে ঘটনা কখনো ঘটেনি সেই ঘটনা আজ ঘটলো। আশফাকের চোখ আজ কেন যেন বার বার বড় বড় দুই চোখের একজন মালিকের উপর পড়ছিল। নিজের উপর তার নিয়ন্ত্রন অবিশ্বাস্য। তবে আজ আশফাক নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছিল না। অনেকটা নিজেকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই আশফাক বড় বড় চোখের সেই মালিকটিকে অসুস্থতার কথা বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। মেয়েটি বেরিয়ে যেতেই ক্লাসের অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের গুঞ্জন শুনে আশফাক জানতে পারলো, রুহি! মেয়েটার নাম ছিল রুহি!

 

 

 

 

 

 

 

২য় পর্ব

 

– তোকে স্যার ডাকছে।

রুহি সুমির দিকে বেশ অবাক হয়ে তাকাল। আজ সকালের প্রথম ক্লাসটা আশফাক স্যারের ছিল। রুহি তাই ইচ্ছে করেই সকালের ক্লাসটা মিস করেছে। সে ক্যাম্পাসে এসেছে দুপুর বারোটার দিকে। কারন দ্বিতীয় ক্লাসটা দুপুর বারোটার পর। 

রুহি অবাক হয়ে বলল, কোন স্যার ডাকছেন আমাকে?

– আশফাক স্যার।

রুহির ভেতরটা ধক করে উঠল। আশফাক স্যার তাকে ডেকেছেন কেন? সে ফাঁকিবাজ টাইপের ছাত্রী নয়। খুব জরুরি কিছু না ঘটলে সে সহজে ক্লাস মিস করে না। তবে আশফাক স্যারের ক্লাস পরপর দুইদিন মিস হয়ে গেছে! হয়ত এই কারণেই স্যার তাকে ডেকেছেন। টিচার্স রুমে গেলে নিশ্চয় তিনি তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করবেন। রুহির হাত, পা ঠান্ডা হয়ে গেল। এই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কারনটা অবশ্য আশফাক স্যার অপমান করবেন এই জন্য নয় বরং তার সামনাসামনি পড়তে হবে এই ভয়ে। রুহি দুরুদুরু বুকে টিচার্স রুমের দিকে রওনা হলো।

টিচার্স রুমে আশফাক স্যার ছাড়া আর কেউ নেই। পুরো রুম খালি। রুহি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার আসব।

আশফাক স্যার বোধহয় তার কথা শুনতে পাননি। এই মুহুর্তে তার মন হয়ত ইকোনোমিক্সের কোনো এক বইয়ের পাতায় ডুবে আছে। রুহি আবারো বলল, স্যার আসব।

এবার বোধহয় স্যার রুহির কথা শুনতে পেলেন। তিনি  ভ্রু কুঁচকে রুহির দিকে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার! আপনি এই সময় এখানে কেন?

এবার রুহির অবাক হবার পালা। স্যার নিজেই তাকে এখানে ডেকে এখন দিব্যি ভুলে বসে আছেন। নাকি সুমিটা তার সাথে এমন বাজে মজা করেছে! রুহি থতমত হয়ে বলে, সরি স্যার। আমার এক বন্ধু জানাল আপনি আমায় ডেকেছেন। সে বোধ ভুল বলেছে স্যার। আমি খুব-ই দুঃখিত।

আশফাক স্যার মুখ শক্ত করে জানালেন, তাই হবে হয়ত। আমি আপনাকে ডাকতে যাব কেন?

রুহি চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। পেছন থেকে স্যারের গলা আবার শোনা গেল। আজকে আমার ক্লাসটা করেছেন আপনি?

রুহি মাথা নিচু করে বলল, না স্যার। 

– কেন করেন নাই জানতে পারি। এখন তো দেখি দিব্যি ফিটফাট হয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমার ক্লাসের সময় কী সমস্যা ছিল আপনার?

রুহি আশফাক স্যারের প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। এই মুহুর্তে সে নিজের কান্না চেপে রাখার প্রাণপন চেষ্টা করছে। স্যার ডেকেছেন শুনে সে এক ফাকে কমন রুমে যেয়ে চোখে কাজল দিয়ে এসেছে। এখন তার ভয় হচ্ছে চোখের পানিতে তার কাজল বোধহয় পুরোপুরি লেপ্টে যাবে। কাজল লেপ্টে যেয়ে আশফাক স্যারের সামনে তাকে ভূতের মত দেখাবে।

আশফাক স্যার আবারো বললেন, কী হলো জবাব দিচ্ছেন না কেন? ঠিক আছে আপনি যদি মৌখিক কোনো জবাব দিতে না চান তবে আমার কাছে লিখিত জবাব দিন। আজ বিকেল চারটার মধ্যে আপনি আমাকে লিখে জানান, আজ সকলে ইকোনোমিক্সের ক্লাসটা কেনো করেননি আপনি?

কথাগুলো বলার পর আশফাক স্যার রুহির মুখের দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। তিনি কঠিন মুখে আবার নিজের বইয়ের দিকে মনোযোগ  দিলেন। 

রুহি প্রায় দৌড়ে টিচার্স রুমের সামনে থেকে চলে এল। যে কেউ তাকে দেখলে ভাববে তার উপর দিয়ে বড় রকমের একটা ঝড় বয়ে গেছে। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য ওয়াশরুম থেকে সে নিজের মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে এলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সারে বারোটা বাজে। একটু পরেই দ্বিতীয় ক্লাসটা শুরু হবে। রুহি ক্লাস রুমের দিকে এগুলো। নিয়ম মাফিক পুরো ক্লাসটাও করল। কিন্তু ক্লাসে এক বিন্দু মোনোযোগ দিতে পারল না। তার সামনে বারবার আশফাক স্যারের রাগী কঠিন চেহারাটা ভেসে উঠছে। কী এমন করেছে সে? একটা ক্লাস করেনি এই তো! এই জন্য এত রাগ! নিজের অজান্তেই রুহির চোখ ভর্তি করে পানি এলো।

                       ……………….

আশফাক আজ বেশ ভালো মুড নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল। গতকাল রাতে দীপা ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে। রোজবারের মত এবার আর আশফাককে দীপার রাগ ভাঙাতে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়নি। তবে আশফাকের ভালো মুডের কারন দীপার সন্তানসহ বাড়ি ফেরার চেয়েও অন্য কিছু ছিল। আশফাক খুব ভালো মতই জানে মানুষের জীবনে অন্যায়গুলো আসে খুব ছোট্ট কোনো পথ ধরে। সে পথগুলোকে শুরুরদিকে খুবই নির্দোষ এবং মসৃণ লাগলেও পরে তা বন্ধুর আকার ধারন করে। আশফাক যথেষ্ট ম্যাচিউর একটা মানুষ। গত বছর সে ঊনচল্লিশ পেরিয়ে চল্লিশে পা দিয়েছে। সে ন্যায় অন্যায় খুব ভালো বোঝে। তবুও তার আজ ক্যাম্পাসে আসার সময় মনে হয়েছিল, অসম্ভব মায়াময় সেই চোখের মালিকের সাথে তার আজ দেখা হবে। ক্লাস নেয়ার ফাঁকে দুই একবার সেই চোখে তার চোখ পড়বে! এর বেশী তো আর কিছু নয়!  এটুকু ভাবতেই আশফাকের ভেতর অসম্ভব ভালোলাগার একটা রেশ কাজ করছিল। তবে ক্লাসে এসে আশফাক অবাক হয়ে খেয়াল করল, মেয়েটি আজ তার ক্লাসে উপস্থিত নেই। রাগে, বিরক্তিতে আশফাকের মুখটা তিতকুটে স্বাদে ভরে গেল। যে টপিকের উপর সে এর আগে শতবার ক্লাস নিয়েছে সেই টপিকটা পড়াতে যেয়ে বার বার তার ভুল হয়ে গেল। মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে আশফাক টিচার্স রুমে চলে এলো। তবে আসার আগে সুমি নামের মেয়েটিকে বলে এলো রুহি ক্যাম্পাসে এলে যেন তার সাথে টিচার্স রুমে এসে দেখা করে।

 

 

 

 

 

 

 

৩য় পর্ব

 

 চারটা দশ বাজে। রুহি ভয়ে ভয়ে টিচার্স রুমের দিকে এগুলো। আশফাক স্যার তাকে বিকেল চারটার মধ্যে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারার কারন লিখিত ভাবে জমা দিতে বলেছিলেন। পরপর দুটো ক্লাস থাকার কারনে রুহির দশ মিনিট দেরী হয়ে গেল। সে টিচার্স রুমে উঁকি দিল। টিচার্স রুমে অনেকে স্যার ম্যাডামরাই আছেন তবে রুহি কোথাও আশফাক স্যারকে দেখতে পেল না। রুহি বেশ কিছুক্ষণ টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। সে অবাক হয়ে দেখল, টিচার্স রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে। এই ভালোলাগাটা একটু অন্যরকম। এই ভালোলাগা হচ্ছে প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষার, অজানা কোনো রহস্যকে ভেদ করার অপেক্ষার! রুহি এই প্রথম খুব ভালো মত জানল, কিছু কিছু অপেক্ষাও মধুর হয়।

– তুমি কি কারো জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছো?

রুহি দেখল, কেয়া ম্যাডাম কখন যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। রুহি একটু ইতস্তত করে বলল, ম্যাডাম আশফাক স্যার আমাকে আসতে বলেছিলেন। 

কেয়া ম্যাডাম ভ্রু কুঁচকে বললেন, সে তো এখানে নেই। একটু আগেই বেরিয়ে গেল। 

– স্যার চলে গিয়েছেন বুঝি?

– তাই তো মনে হলো। কিছুক্ষণ আগে আশফাকের মিসেস এসেছিল তাদের ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে। তাদের  একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান আছে সেখানেই গিয়েছে সম্ভবত। তুমি বরং কাল এসো।

রুহি মন খারাপ করে টিচার্স রুমের সামনে থেকে চলে এলো। হুট করেই তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই কান্নার উৎস সম্পর্কে তার কোনো ধারনা নেই। এর মাঝে আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। একটু পরেই

 বোধহয় মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। রুহি পুরো ক্যাম্পাসে তার কাছের বন্ধুদের কাউকে খুঁজে পেল না। সবাই বোধহয় রুহিকে ছাড়া যে যার মত বেরিয়ে গেছে। রুহির আবারো খুব কান্না পেল। আজকের দিনটা তার জন্য আসলেই খুব খারাপ। রুহি বাড়ি ফেরার জন্য একটা উবার কল করল এবং অবাক হয়ে দেখল, আজ উবারেও কোনো গাড়ি এভেইলেবল নেই। রুহি হতাশ হয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। রাস্তায় দুই একটা 

সি এন জি দেখা যাচ্ছে বটে তবে সেগুলো যাত্রী দিয়ে পরিপূর্ণ। রুহি চুপচাপ রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ইতিমধ্যে দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। রাস্তার লোকজন সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এদিক, সেদিক দৌড়াচ্ছে। রুহির জেদ চেপে গেল। সে রাস্তার পাশে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আরো জোরে বৃষ্টি আসলে আসুক! আজ সে কাকভেজা হয়ে ভিজলেও ভিজুক! যা ইচ্ছে হোক। আজ তার মন খারাপ হবার দিন। আজ কোনো কিছুতেই তার যায় আসে না। এক আকাশ বৃষ্টিতে ভিজলেও না!

……………..

আশফাক ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সারে তিনটা বাজে। চারটা বাজতে আরো ত্রিশ মিনিট বাকি। আশফাক নিজের উপর খুব বিরক্ত হলো। সে খুব ভালো মত জানে চারটা বাজলেও তার কোনো যায় আসে না। তার কাছে সারে তিনটাও যা, চারটাও তা। তবুও আশফাকের ভেতরে অদ্ভুৎ রকমের একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আশফাকের এসব অস্থিরতার মাঝেই ঠিক তিনটা পয়তাল্লিশ মিনিটে দীপা এলো তাদের ছেলেটাকে নিয়ে। বলা যায় তাদের মা ছেলের আশফাকের ক্যাম্পাসে প্রথম বারের মত ছোট খাটো একটা সারপ্রাইজ ভিজিট। দীপাদের দেখে আশফাকের একই সাথে খুব ভালো লাগলো, আবার মন খারাপও হলো। আশফাক নিজের মন খারাপ লাগাটুকুকে এক পাশে সরিয়ে রেখে হাসিমুখে দীপার দিকে এগুলো। 

দীপার চাচাতো বোনের আজ হলুদ সন্ধ্যা। এই অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল পাঁচটা থেকে। দীপা আজ তাই কোনো রিস্ক নেয়নি। সে আশফাককে খুব ভালো মত চেনে। দীপা তাকে বগলদাবা করে নিয়ে না গেলে সে তার বোনের হলুদ সন্ধ্যায় যাবে না। না যাবার কোনো না কোনো অজুহাত সে ঠিকই বের করবে। তাই দীপা  একেবারে তৈরি হয়ে আশফাকের ক্যাম্পাসে এসেছে। আশফাক অনুষ্ঠানে যা পরবে সেই সব কাপড় চোপড় পর্যন্ত সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

 আশফাক দেখল হলুদ শাড়ি আর খোপায় বেলী ফুলের মালায় দীপাকে খুব চমৎকার দেখাচ্ছে। অনেকদিন পর দীপাকে দেখে তার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। তবে এটাও সত্য যে,  হৃদয়ের কোনো এক কোনায় যেন এক জোড়া বড় বড় চোখ আশফাককে বড় বেশী অস্বস্তি দিচ্ছে। আশফাক তার অস্বস্তিটুকু একপাশে সরিয়ে রেখে দীপাদের দিকে মোনোযোগ দিল। আরো মিনিট দশেক টিচার্স রুমে কাটিয়ে সে দীপাদের সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল।

বিকেলটা খুব ভালো মতই শুরু হয়েছিল। তবে দীপাদের নিয়ে গাড়িতে ওঠার পরেই বিপত্তি ঘটলো। দীপার সাথে আশফাকের গাড়িতে ছোটখাটো একটা ঝগড়া বেধে গেল। ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটলো খুব ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে। গাড়িতে ওঠার পর দীপা আশফাকের জন্য যে পাঞ্জাবীটা নিয়ে এসেছিল সেটা দেখে আশফাকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দীপা তার জন্য ক্যাটকেটে টিয়া রংয়ের একটা পাঞ্জাবী নিয়ে এসেছে।

আশফাক অবাক হয়ে বলল, তোমার বোনের হলুদ সন্ধ্যায় আমি এই রংয়ের পাঞ্জাবী পরব?

দীপা নির্বিকার গলায় বলল, হুম পরবে। আজ ছেলেরা সবাই এই রংয়ের পাঞ্জাবী পরবে।

– আমি পরব না দীপা। দরকার হলে তোমার বোনের অনুষ্ঠানে আমি যাব না, তবুও এই রংয়ের পাঞ্জাবী আমি পরব না।

দীপা গম্ভীর গলায় বলল, বেশ তাহলে তুমি এক্ষুনি গাড়ী থেকে নেমে যাও। কারন অনুষ্ঠানে গেলে তোমাকে এটাই পরতে হবে।

– কী পাগলামি শুরু করলে বলো তো! ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে শুধু শুধু এমন পাগলামি কেন করো তুমি?

– কোনো পাগলামি আমি করছি না। যা বলছি তোমাকে তাই করতে হবে। তুমি হয় এক্ষুনি গাড়ী থেকে নেমে যাবে নয়ত এই পাঞ্জাবী পরে আজকের সন্ধ্যা তোমায় কাটাতে হবে। 

আশফাকের কেমন যেন জেদ চেপে গেল। সে থমথমে গলায় বলল, বেশ আমি তাহলে নেমে যাচ্ছি। আমার পক্ষে এই পাঞ্জাবী পরা সম্ভব নয়।

আশফাককে হতভম্ব করে দিয়ে দীপা তাকে সত্যি সত্যি গাড়ী থেকে নামিয়ে দিলো। আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ করেছে। একটু পরেই বোধহয় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। তবে দীপার নজরে এসব কিছুই এলো না। দীপা আশফাককে রাস্তার মাঝে নামিয়ে দিয়ে নির্বিকার ভাবে গাড়ী নিয়ে চলে গেল। আশফাক ঘড়িতে দেখল চারটা ত্রিশ বাজে। এই সময় বাড়ি ফেরার কোনো মানে হয় না। রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল তাই গাড়ী খুব বেশীদূর আসে নাই। আশফাক ভাবল, ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে আজ কিছুটা সময় কাটাবে। একটা রিক্সা নিয়ে ক্যাম্পাসে যেতে তার হয়ত খুব বেশী হলে মিনিট দশেক সময় লাগবে। আশফাকের রিক্সায় বসার পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টির কারনে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে তার আরো পনের মিনিট সময় লাগলো। ক্যাম্পাসের গেইট পর্যন্ত আশফাকের রিক্সাটা যখন পৌঁছালো তখন আশফাক অবাক হয়ে দেখল, তুমুল বৃষ্টির মাঝেও একটি মেয়ে ক্যাম্পাসের গেইটের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তুমুল বৃষ্টির তোড়ে  মেয়েটি পুরোপুরি ভিজে গেছে। ভেজা কাপড় তার পুরো শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। এমনকি মেয়েটি ঠান্ডাতেও অল্প অল্প কাঁপছে। তবুও যেন তার কোনো ভ্রুঁক্ষেপ নেই। আশফাক অবাক হয়ে দেখল, বৃষ্টিতে ভেজা সেই মেয়েটি আর কেউ নয়, সেই মেয়েটি হলো তার হৃদয়ের কোনে জমে থাকা বড় বড় সেই চোখের মালিক! যার নাম রুহি!

 

 

 

 

 

৪র্থ পর্ব

 

আশফাক অনেক খানি দোটানার মধ্যে পড়ে গেল। তার বিবেক বলছে, এই বৃষ্টির মধ্যে ক্যাম্পাসের মেইন দরজায় যে-ই দাঁড়িয়ে থাকুন না কেন তার কোনো যায় আসে না। তার এক্ষুনি, এই মুহুর্তে রিক্সা নিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যাওয়া উচিৎ। তবে হৃদয় বলছে অন্য কথা। তার হৃদয় বলছে, তার এই মুহুর্তে রিক্সা থেকে নেমে যাওয়া উচিৎ। যে মেয়েটি এভাবে কাক ভেজা হয়ে ভিজছে সেই মেয়েটি তার অতি পরিচিত। মেয়েটিকে তার এই অবস্থায় ফেলে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। মেয়েটির তাকে এখন প্রয়োজন। আশফাকের বিবেক, বুদ্ধি তার হৃদয়ের কাছে হার মানল। আশফাক বৃষ্টির মাঝেই রিক্সা থেকে নেমে পড়ল। 

রিক্সাচালক অবাক বলল, এহানে নামেন ক্যান? চলেন আপনারে ভেতরে রাইখ্যা আসি।

আশফাক বলল, দরকার নেই। তুমি আমাকে এখানে নামিয়ে দাও।

রিক্সাচালক বেশ অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। এই লোক পুরো রাস্তায় যেন না ভিজে এই নিয়ে সদা সতর্ক ছিল অথচ এখানে এসে কী এমন হলো যে এত বৃষ্টির মাঝে নেমে পড়তে হলো! রিক্সাচালক হতাশ হয়ে ভাবল, মানুষ আসলে বড়োই আজব কিসিমের প্রাণী! তার চেয়েও বড়ো আজব হলো মানুষের মন!

আশফাক যতক্ষনে রুহির কাছে পৌঁছালো ততক্ষনে সে নিজেও ভিজে একাকার হয়ে গেছে। এদিকে রুহি তখনও একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আশফাক রুহির কাছে যেয়ে বলল, তুমি এইখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?

রুহি কোনো জবাব দিল না। ফ্যালফ্যাল করে সে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আশফাকের মনে হলো, রুহি বোধহয় তাকে চিনতে পারেনি। পরোক্ষনেই তার ভুল ভাঙল। রুহি তাকে নরম গলায় বলল, আপনার জন্য।

এবার আশফকের অবাক হবার পালা। সে হতভম্ব হয়ে বলল, আমার জন্য? 

– হুম, আপনার জন্য।

– কেন বলো তো?

– আজ আপনি আমায় বিকেল চারটার সময় আপনার কাছে আসতে বলেছিলেন।

আশফাকের অনেকক্ষন সময় লাগল রুহির কথাটুকু বুঝতে। আজ সে রুহির কাছে বিকেল চারটার মধ্যে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারার কারন লিখিত ভাবে জমা দিতে বলেছিল বটে তাই বলে কোনো ভাবেই এই সময় এবং এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে নয়। রুহি কাগজটা কালকেও তার কাছে জমা দিতে পারত। তাছাড়া বিকেল চারটা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। আশফাক অবাক হয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে রইল। দীপা যদি আজ রাগ করে তাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে না দিত তবে এতক্ষনে সে হয়ত দীপার বোনের হলুদ সন্ধ্যায় থাকত। স্বাভাবিক সময় হলে, আশফাকের কোনোভাবেই এখন ক্যাম্পাসে ফিরে আসার কথা নয়। চারপাশে এত বৃষ্টি, ঝড়ো হিমেল বাতাস আর তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব মায়াবতী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আশফাকের মন কেমন করে উঠলো। এই মুহুর্তে যে কাজটি করা তার জন্য সবচেয়ে বেশী অনুচিৎ ছিল সেই কাজটি সে নির্দ্বিধায় করল। 

রুহির একটা হাত ধরে কোমল গলায় বলল, এমন পাগলামী কেন করছ তুমি? আমার সাথে কাল দেখা করলেও চলত তোমার। এই ভাবে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় কি?

আশফাক অবাক হয়ে দেখল রুহি তার কথা শুনে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল। তার দুই চোখ জুড়ে টলমল করছে অশ্রু, যদিও বৃষ্টির পানিতে অশ্রুগুলো সব ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যাচ্ছে তবুও রুহির কান্নাটুকু আশফাকের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছালো। আশফাক রুহির হাতটুকু একই ভাবে ধরে রইল। এর মাঝে বৃষ্টি থেমে এলো। সন্ধ্যাও নেমে এলো। কেউ জানলো না তবে দুই জন মানব মানবী জানল বৃষ্টি হয়ত থেমে গেছে, ঝড়ো বাতাসগুলোও স্থির হয়ে গেছে, তবে নতুন একটা অস্থির ঝড় বয়ে চলেছে, দুই জন অসম বয়সী মানব মানবীর হৃদয়ে!

………………….

রুহির প্রচন্ড জ্বর এসেছে। আজ বিকেলের বৃষ্টিতে সে বড়ো বেশী ভেজা ভিজেছে। তবে শরীরের এই জ্বরটুকু তার ভালো লাগছে। একটু আগে মা জোর করে তাকে একবাটি চিকেন স্যুপ খাইয়েছেন। যাবার আগে দুটো নাপা দিতেও তিনি ভোলেননি। নাপা খেয়ে রুহির জ্বর একটু কমেছে বটে তবে তার পুরো শরীর জুড়ে বিরাজ করছে অদ্ভুৎ এক আলস্যতা। এই আলস্যতাটুকু অবশ্য রুহী খুব উপভোগ করছে। আজ আশফাক স্যার তাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন। তারা দুজন এতটা পথ একসাথে একটা সিএনজি করে এসেছে। আশফাক স্যার পুরোটা পথ তার বৌ বাচ্চার গল্প করেছেন। রুহি বুঝতে পারছিল, তিনি ইচ্ছে করেই কাজটা করছেন। ইচ্ছে করেই রুহিকে জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনি একজন বিবাহিত পুরুষ যার দিকে রুহির তাকানো বারণ। রুহির হঠাৎ করেই মনে হলো, নাকি আশফাক স্যার আসলে রুহিকে বলা কথাগুলো নিজেকেই বলছিলেন? রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু আগে মনটা অসম্ভব যে ভালোলাগাটায় ভরেছিল এখন আর তা নেই। রুহি নিজের অজান্তেই দুইদিকে মাথা নাড়ালো। মরীচিকার পেছনে ছুটে আসলে কোনো লাভ নেই। মরীচিকা সব সময় দূর থেকে দেখা যায় কিংবা বলা যায় দূর থেকেই মরীচিকা দেখতে ভালো। কাছে গেলে মরীচিকার কোনো অস্তিত্ব থাকে না। রুহি ফোনটা হাতে নিল। অনেক দিন পর সে খুব আগ্রহ নিয়ে সজলকে ফোন করল।

……………..

আশফাকের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত এগারোটার মত বেজে গেল। সে বাসায় পৌছে দেখল দীপাও ইতিমধ্যে চলে এসেছে। আশফাক সরাসরি তাদের শোবার ঘরে ঢুকল। ছেলেটা বিছানার এক পাশে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। সাধারনত তার আর দীপার মাঝেই বাচ্চাটা ঘুমায়। কোনো কোনো বিশেষ দিনে ছেলেটাকে বিছানার একপাশে রাখা হয়। আশফাকের মন হলো আজ বোধহয় সেই বিশেষ দিন। দীপা ইচ্ছা করেই এই কাজটা করেছে। হয়ত আজ বিকেলের সেই ব্যবহারের জন্য দীপা মনে মনে অনুতপ্ত। আশফাক বুঝতে পারল না, তার খুশী হওয়া উচিৎ নাকি মন ভার করে রাখা  উচিৎ? আশফাকের ভাবনার মাঝেই দীপা ঘরে ঢুকল। তার চোখে স্পষ্ট আহবান। এই আহবান উপেক্ষা করার সাধ্য কোনো পুরুষ মানুষের নেই। তাছাড়া দীপার আহবান উপেক্ষা করার কোনো স্পষ্ট কারন কিংবা যুক্তি কোনোটায় আশফাকের কাছে নেই। সে সব ভুলে দীপার মাঝে ডুবে গেল।

 

 

 

 

 

 

৫ম পর্ব

 

রুহি আজ হালকা গোলাপী রংয়ের একটা শাড়ি পরেছে। গলায় জড়িয়েছে সাদা রংয়ের মুক্তোর মালা। তার কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে আছে। রুহি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।  আজ তার ক্লাসে একটা প্রেজেনটেশন রয়েছে। এই জন্য তার এত প্রস্তুতি। একটু পর সজল বাড়িতে আসবে। কাল রাতে সজলের সাথে তার কথা হয়েছে। সজল তাকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবে। রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেদিনের পর আশফাক স্যারের সাথে তার আর আলাদা করে কোনো যোগাযোগ হয়নি। এর মাঝে স্যার দুদিন তাদের ক্লাস নিয়েছেন বটে, রুহি সেই ক্লাসগুলোও করেছে তবে স্যার ক্লাসে একদম নিস্পৃহ ছিলেন। রুহির দিকে একবারের জন্যও  তাকাননি পর্যন্ত। ভাবটা এমন যেন রুহিকে তিনি চেনেননি, যেন রুহির সাথে সুন্দর একটি বিকেল তার কখনো কাটেনি!

 রুহির ভাবনার মাঝেই সজল এলো। সজল সরাসরি তার শোবার ঘরে চলে এসেছে। আর ক’দিন পর যে মেয়ের সাথে তার বিয়ে হবে সেই মেয়ের শোবার ঘরে ঢোকার জন্য অনুমতি নেয়ার সে কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। সজলের এই ব্যাপারটা রুহির খুব খারাপ লাগে। ছেলেটার মধ্যে এসব নূন্যতম ভদ্রতা কিংবা সূক্ষ্ম রুচিবোধের কোনো বালায় নেই।

রুহি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এভাবে হুট করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লে যে! ঢোকার আগে একটু নক করলে তো পারতে।

সজল হাসিমুখে বলল, বারে! দুদিন বাদে যে মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে সেই মেয়ের ঘরে নক করে ঢুকতে হবে কেন?

– তাই বুঝি? বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাই নক করার আর কোনো প্রয়োজন পড়বে না? এর মানে তুমি বলতে চাচ্ছো, বিয়ের পর একজন মানুষ আরেকজন মানুষের একেবারে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায়, তাই তো?

– তা তো একটু হয়েই যায়। কেন বিয়ের পর আমাদের শোবার ঘরে ঢোকার সময় তুমি কি আমার অনুমতি নিয়ে ঢুকবে নাকি?

রুহি সজলের কথার জবাবে কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেল। সজল হয়ত ভুল কিছু বলছে না। এমনটায় তো আমাদের সমাজে হয়ে আসছে। রুহি নিজেও তার  চারপাশে এসব দেখে বড় হয়েছে। রুহি সজলের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্রয়ের হাসি দিলো। আর এইভাবে হাসাটায় রুহির সবচেয়ে বড় ভুল হলো। রুহি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সজল তার ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু খেলো। রুহি কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল। সজল তার সাথে এমনটা করতে পারে তা সে কল্পনাও করেনি। রুহির চোখ ভর্তি করে পানি এলো। জীবনের প্রথম চুমু, প্রথম আদর নিয়ে প্রতিটা মানুষের মাঝেই কিছু আবেগ থাকে। রুহির মাঝেও ছিল। আজ এই সকালে রুহির সকল আবেগ এক নিমিষে নষ্ট হয়ে গেল এবং রুহি প্রথমবারের মত জানল, সজল সিগারেট খায়। সজলের মুখে সিগারেটের কটু গন্ধ। অথচ এতদিন অনেক জিজ্ঞাসার পরেও বিষয়টা সে রুহির কাছে বেমালুম চেপে গেছে।

রুহির চোখে পানি দেখে হয়ত সজল একটু বিব্রত বোধ করল। সে রুহির একটা হাত ধরে বলল, আই অ্যাম সরি রুহি। আমি আসলে বুঝিনি আমার একটা চুমুতে তুমি এতখানি মন খারাপ করবে। তোমাকে শাড়ি পরে আজ এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। 

সজল জবাবের আশায় রুহির দিকে তাকিয়ে রইল। রুহি সেই তখন থেকে ঠিক একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সজল আবারো বলল, রুহি প্লিজ। এবারের মত মাফ করে দাও। বললাম তো, এমন ভুল আর হবে না। 

 রুহি ঠান্ডা গলায় বলল, তুমি সিগারেট খাও?

এবার সজলের অবাক হবার পালা। সজল ভেবেছিল, রুহি বোধহয় চুমু খাবার ব্যাপারটা নিয়ে এতখানি মাইন্ড করেছে। তবে এখন তো দেখা যাচ্ছে ঘটনা ভিন্ন। সজল বুঝতে পারলো, সে আসলে চুমু খেয়ে সব দিক থেকে বিপদে পড়েছে। আজ এই চুমু খাবার কারনেই তার ধুমপানের বিষয়টা রুহির কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।

সজল একটু হেসে বলল, মাঝে মাঝে একটু আধটু খাই। সিগারেটের খুব বেশী নেশা নেই আমার।

– সিগারেট খাবার মত আর কী কী লুকিয়েছো আমার কাছ থেকে তুমি?

সজল দুইদিকে তীব্রভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, না না। বিশ্বাস করো আর কোনো কিছু আমি তোমার কাছ থেকে লুকোইনি।

                     ………………..

আশফাকের ক্লাসের প্রেজেনটেশনটা খুব ভালো মত শেষ হলো। ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা মোটামোটি ভালো করেছে। আর দুই একজনের পারফরমেন্স তো আউটস্ট্যান্ডিং। তার মধ্যে রুহি একজন। মেয়েটি যদিও প্রথমদিকে একটু নার্ভাস ছিল। আশফাকের  মনে হচ্ছিল, মেয়েটির খুব মন খারাপ যা তার নার্ভাসনেসের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। রুহির প্রেজেনটেশনের দুই এক মিনিট যেতেই আশফাক রুহিকে থামিয়ে কিছু কারেকশন দিয়েছিল। আর এতেই যেন ম্যাজিকের মত কাজ হয়েছিল। রুহি তার সকল জড়তা কাটিয়ে উঠে খুবই সাবলীল ভাবে তার প্রেজেনটেশন সম্পূর্ণ করেছিল। 

আশফাক অনেকক্ষন থেকে একাই টিচার্স রুমে বসে রয়েছে। তার সামনে বেশ কিছু কাগজপত্র এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। আশফাক সেগুলোর দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার আসলে যাবার কোনো জায়গা নেই। দীপার সাথে দিনগুলো তার ভালো যাচ্ছে না। রোজ ঝগড়া, খিটিমিটি লেগেই আছে। ছেলেটা না থাকলে আশফাক বোধহয় বাড়িতেও ফিরত না। যে ব্যাপারগুলো প্রথমে তুচ্ছ সন্দেহ নিয়ে শুরু হয়েছিল তা এখন বড় আকার ধারন করেছে। দীপার এখন সব কিছুতেই সমস্যা। আশফাকের বেশী আদরেও সমস্যা, কম আদরেও সমস্যা। দীপাকে বেশী সময় দিলেও সমস্যা, কম সময় দিলেও সমস্যা। তার মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে দীপারই বোধহয় তার সাথে সংসার করার কোনো ইচ্ছা নেই। সে বোধহয় অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। তাই এখন সে বিভিন্ন অজুহাতে আশফাকের সাথে ঝামেলা করছে। আশফাকের হঠাৎ করেই খুব একা লাগল। তার সব আছে তবুও কোথাও যেন কেউ নেই। আশফাক আনমনে তার সামনে পড়ে থাকা কাগজগুলো নিয়ে নাড়াচড়া করল। হঠাৎ করেই একটা কাগজের উপর তার চোখ পড়ল। এটা দুই সপ্তাহ আগে রুহি তার কাছে জমা দিয়েছিল। এই কাগজে রুহি তার ক্লাসে উপস্থিত থাকতে না পারার কারন ব্যাখ্যা করেছে। আশফাক এক দৃষ্টিতে কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি কাগজে লেখা কোনো ইংলিশ হরফের উপর ছিল না, তার দৃষ্টি ছিল কাগজে লেখা রুহির ফোন নম্বরের উপর! আশফাক মোহগ্রোস্থের মত পকেট থেকে তার ফোন বের করল। তারপর ডায়াল করল রুহির নম্বর!

 

 

 

 

 

 

৬ষ্ঠ পর্ব

 

প্রেজেন্টেশনটা খুব ভালো মত শেষ হলো।  প্রেজেন্টেশনের পর রুহির মনে হলো, তার শরীরে আজ ভর করেছে যেন নরম কোমল তুলোর ডানা! সে ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় আনন্দে ভেসে কাটালো। এই আনন্দটা যতখানি না প্রেজেন্টেশন ভালো হয়েছে সেই কারনে তার চেয়ে অনেকখানি বেশী তাকে বলা আশফাক স্যারের কথাগুলোর জন্য। প্রেজেন্টেশনের শুরুতে রুহি অনেকখানি নার্ভাস ছিল, নার্ভাসনেসের সাথে ছিল তার প্রচন্ড রকমের মন খারাপ। সকালে সজলের এমন ব্যবহার এবং এরপর সজলের সাথে তার যাচ্ছেতাই রকমের কথা কাটাকাটি, ঝগড়া সব মিলিয়ে রুহি প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল। সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর তার হৃদয়ে যে কোমল ভাবটা ছিল সজলের সাথে সেই ঘটনাটার পরে তার বিন্দুমাত্র কিছু অবশিষ্ট ছিল না। এমনকি ঝগড়ার রেশ ধরে সে সজলের সাথে তার ক্যাম্পাস পর্যন্ত আসেনি। নিজে একটা সি এন জি নিয়ে চলে এসেছিল।

প্রেজেন্টেশনের পর বিকেল পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আনন্দে ভাসতে ভাসতেই রুহির সময়টা কেটে গেল। এর মাঝে সজল কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। সে ফোন ধরেনি। বরং সজল যে কোনো মুহুর্তে ক্যাম্পাসে চলে আসতে পারে এবং রুহি তাকে প্রাণপনে এড়াতে চাচ্ছে বলেই সে ক্লাসের বন্ধুদের সাথে ক্যাম্পাসের পাশে একটা রেষ্টুরেন্টে চলে এলো। আর সেখানে সবাই মিলে আড্ডা দেয়ার মাঝেই ফোনটা এলো। রুহি অবাক হয়ে দেখল আশফাক স্যার তাকে ফোন করেছে। বিকেল পাঁচটা বাজে। এই সময় কোনোভাবেই আশফাক স্যারের তাকে ফোন করার কথা নয়। রুহি বন্ধুদের দিকে আড়চোখে তাকাল। সবাই যে যার মত গল্প নিয়ে ব্যস্ত। রুহির দিকে কারো মোনোযোগ নেই। রুহি তবুও সবার সামনে ফোনটা ধরল না। বন্ধুদের কাছে থেকে আড়ালে এসে সে ফোনটা রিসিভ করল। 

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভরাট একটা কন্ঠস্বর। আজ সেই কন্ঠে যেন এক রাশ আকুলতা ঝরে পড়ছে। কোনো ভুমিকা নেই, কোনো দ্বিধা নেই, রুহিকে অবলীলায় সেই কন্ঠস্বর বলল, কোথায় তুমি? আমার খুব একা লাগছে। একটু আসবে?

রুহি এতটুকু অবাক হলো না। সে এই কথাগুলোর মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতাও টের পেল না। যেন এমনটা হবারই কথা ছিল। আশফাক স্যার তাকে যে কোনো সময় ডাকবেন, সে সব কাজ ফেলে, বন্ধুদের ফেলে তার কাছে ছুটে যাবে এটাই যেন স্বাভাবিক। রুহি  ঘোর লাগা গলায় বলল, আসছি, আমি আসছি।

রুহি বন্ধুদের কাছ থেকে যত সহজে ছাড়া পাবে ভেবেছিল এত সহজে ছাড়া পেল না। রুহি চলে যাবে একথা শুনতেই সুমি চোখ ছোট করে বলল, হঠাৎ করে কোথায় যাচ্ছিস তুই? তুই না বললি আজ সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকবি। তোর নাকি খুব মন খারাপ। বাড়ি থেকে বের হবার সময় বলে এসেছিস আজ বাড়ি ফিরতে তোর দেরী হবে।

রুহি নরম গলায় বলল, হুম বলেছিলাম তো। তবে হুট করেই মাথাটা ধরে গেলো। এখন বাসায় না ফিরলে পরে মাথা ধরাটা আরো বেড়ে যাবে। 

সুমি বলল, সজল তোকে নিতে আসছে বুঝি?

– না, না। সজল আসবে কেন! আমি নিজেই চলে যাব।

 রুহি আর সুমির সাথে বেশী কথা বাড়াল না। তাকে কোনোরকম কথা বলার সুযোগও সে দিল না। রুহি রেস্টুরেন্ট থেকে তড়িঘরি করে বেরিয়ে গেল। 

 আশফাক স্যার তাকে ফোনে জানিয়েছেন, সে রেস্টুরেন্ট থেকে একটু দূরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহি পায়ে পায়ে গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আশফাক স্যার গাড়ির মধ্যেই বসে ছিলেন। রুহিকে দেখা মাত্রই তিনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। 

নরম গলায় বললেন, কোথায় যাবে?

রুহি হাতঘড়িতে দেখল বিকেল সারে পাঁচটা বাজে। হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। সাতটার দিকে বাড়ির দিকে রওনা দিলেই হবে। তবে রুহি মুখে কিছু বলল না। চুপচাপ একই ভাবে আশফাকের সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

আশফাক বোধহয় রুহির মনের কথাটা বুঝতে পারলো। রুহির দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়িতে ওঠো। তোমাকে সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাব।

তাদের দুজনের সুন্দর সেই জায়গাটায় যাওয়া হলো না। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। অফিস শেষে সবাই বাড়ি ফিরছে। রাস্তায় গাড়িগুলো যেন নড়ছেই না। আশফাক অনেক কষ্টে গাড়ি নিয়ে টি এস সির দিকে এগুলো। সেখানেও প্রচন্ড ভীড়! দুজনের কেউই গাড়ি থেকে  নামার সাহস করলো না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যাও নেমে এসেছে। রুহি যদি এখনো বাড়ির দিকে রওনা দেয় তবুও জ্যাম ঠেলে বাড়ি পৌঁছাতে তার রাত নয়টার মত বেজে যাবে। আশফাক রুহির বাড়ির দিকে গাড়ি নিয়ে এগুলো। গাড়ির মাঝে দুজনের কথা হলো খুব কম। আশফাককে খুব সাবধানে ড্রাইভিং করতে হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় মেজাজ ধরে রাখা খুব মুশকিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আশফাকের বেশী কথা বলার উপায় নেই। রুহিও চুপচাপ বসে রইল। এমনিতেই সে বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে। আশফাকের সামনে এলে তার শান্ত ভাবটা অনেকখানি বেড়ে যায়। তবুও রুহি যেন অনেকক্ষণ ভাবনার পর বলার মত কথা খুঁজে পেল।

সে নরম গলায় বলল, হঠাৎ ফোন করে ডাকলেন যে। জরুরী কোনো কথা ছিল কি?

আশফাক রুহির কথা শুনে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, বাব্বাঃ। এত ভাবনার পর এই কথা খুঁজে পেলে। ভালো, খুব ভালো।

– বারে! আপনি আমাকে ডেকেছেন কেন এটা জিজ্ঞেস করা আমার অপরাধ হয়ে গেল।

– আমি আবার এমন কিছু বললাম কখন!

– তাহলে বলুন আমাকে ডেকেছেন কেন।

– তার আগে তুমি বলো আমি ডাকলাম আর তুমি বন্ধুদের ফেলে আমার কাছে চলে এলে কেন? অন্য কেউ ডাকলে তুমি নিশ্চয় এই সময় এইভাবে বন্ধুদের ফেলে চলে আসতে না?

– না আসতাম না।

– তবে? কেন এলে তুমি?

রুহি মাথা নিচু করে বলল, জানি না। আমি সত্যি জানি না

আশফাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমিও জানি না রুহি। তোমাকে কেন ডেকেছি আমি নিজেও জানি না। তবে এটুকু জানি, আজকের পর তোমাকে আমি বার বার ডাকব। এরপরেও তোমাকে ডাকার কারন আমি তোমার সামনে হয়ত ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে এটাও জানি, আমি ডাকলে তুমি আসবে। আর এর কারন তুমি নিজেও হয়ত কখনো আমার সামনে ব্যাখ্যা করতে পারবে না।

 আশফাক রুহির দিকে তাকালো। সে হয়ত রুহির কাছ থেকে কোনো জবাবের প্রত্যাশ্যা করছে। তবে রুহি কোনো জবাব দিল না। কারন সব কথার জবাব হয় না। কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। কিছু কথা হৃদয় দিয়ে অনূভুব করেও নিতে হয়। তা না হলে এত সুন্দর সুন্দর সব কবিতার জন্ম হত না! এত চমৎকার চমৎকার সব গল্পও তৈরি হত না! রুহি কিছু না বলে একই ভাবে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল।

 

 

 

 

 

 

৭ম পর্ব

 

বেশ ক’দিন ধরে সজলের খুব মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপের কারনে সে কোনো কাজে মোনোযোগ দিতে পারছে না। বাসা, অফিস এমনকি বন্ধুদের আড্ডাতে কোথাও সজল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উপস্থিত থাকতেও পারছে না। সব সময় তীব্র মন খারাপের একটা কাঁটা তার মনের ভেতর খচখচ করে। তার এই মন খারাপের অন্যতম কারন হলো রুহী। এই মেয়েটির সাথে কয়েক মাস আগে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে রুহীর সাথে তার সময়গুলো বেশ ভালো কাটছিল। বিয়ের দিন কবে আসবে তা গুনতে গুনতেই যেন বিয়ের দিনটা দ্রুত ঘনিয়ে আসছিল।

 হিসেব মতো, রুহির সাথে আর পনের দিন পর তার বিয়ে হবার কথা ছিল। কিন্তু হুট করে বিয়ের দিনটা পিছিয়ে গেল। রুহির নানী গত সপ্তাহে মারা গিয়েছেন। রুহীর পরিবার চাচ্ছে বিয়ের দিনটা যেন দু মাস পেছানো হয়। রুহীর পরিবার সজলের বাবা মাকে বলতেই তারাও এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। বিরক্তিতে সজল ভ্রুঁ কুঁচকালো। তার মন বলছে সম্পূর্ণ অন্য কথা। তার মনে হচ্ছে এই বিয়ে রুহীর বাবা-মার ইচ্ছেতে নয় বরং রুহীর ইচ্ছেতে পেছানো হয়েছে। একটা মেয়ে সামান্য চুমু খাওয়াকে কেন্দ্র করে যে বিয়ে পেছানোর মত এত বড় একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারে তা তার ধারনাতেও ছিল না। সজল দেখল, এখন রাত দশটা বাজে। হিসেব মত রুহীদের বাড়ির সবার ডিনার খাওয়া শেষ হয়েছে। রুহীদের বাড়িতে সবাই নয়টার মধ্যে ডিনার সেরে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ে। সজল একটু ভেবে নিয়ে রুহীকে ফোন করলো। আজ সে রুহীর সাথে সরাসরি কথা বলবে। রুহীর ভেতরে কী চলছে তা সে জানতে চাইবে। জোর করে হলেও আজ সে রুহীর পেট থেকে কথা বের করেই ছাড়বে। রুহীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে, এই বিয়ে পেছানোর কারন আসলে কী? রুহীর নানীর মৃত্যু? নাকি অন্য কিছু কিংবা অন্য কেউ?

ফোনটা ক্রমাগত বেজে চলেছে। রুহী তীব্র হতাশা নিয়ে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। সজল ফোন করছে। টানা চারবার রিং হলো তারপর একসময় রিং বাজা বন্ধ হয়ে গেল। রুহী নিজের কাজে মোনোযোগ দিল। কাল তার একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে। রুহী এখন সেই অ্যাসাইনমেন্টের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একটু পর আবার ফোনটা বাজলো। রুহী প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই ফোনটা রিসিভ করল। 

ফোনের অপর প্রান্তের গলা শুনতেই রুহীর শরীর হিম হয়ে গেল। আশফাক স্যার ফোন করেছে। তার গলায় উৎকন্ঠা ঝড়ে পড়ছে। কী হলো মন খারাপ নাকি মেজাজ খারাপ?

রুহী তাড়াতাড়ি বলল, না না এমন কিছু নয়। আমি ভেবেছিলাম সজল ফোন করেছিল। আমি যখন আপনার ফোনটা রিসিভ করেছিলাম তখন আসলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাইনি।  

– কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?

রুহী একটু অবাক হয়ে বলল, কোন কাজটা?

– এই যে সজল ফোন করেছিল ভেবে তুমি তার সাথে ফোন ধরেই বাজে ব্যবহার করলে। যার সাথে দুমাস পর তোমার বিয়ে হবে তার সাথে এমন ব্যবহার করা কি ঠিক?

– কে বলল সজলের সাথে আমার দুমাস পর বিয়ে হবে?

– তুমি তো দুদিন আগেই বললে তোমার নানী মারা যাবার কারনে তোমাদের বিয়েটা দুই মাস পিছিয়েছে।

রুহী বলল, সজলকে আমি বিয়ে করব না। এই বিয়ে আমি ভেঙে দিব।

– কেন? বিয়ে ভেঙে দিবে কেন?

রুহী কিছু বলল না। চুপ করে রইল।

আশফাক আবারো বলল, তোমার উত্তর আমি পেলাম না রুহী। তুমি কি আমার কারনে সজলের সাথে তোমার বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইছো?

রুহী তীব্র ভাবে দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, না না তা নয়। সজলকে আমার ভালো লাগে না। তাকে আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।

– কারনটা কি জানতে পারি?

আজ রুহীকে পাগলামীতে পেয়ে বসেছে। সে অনায়াসে আশফাককে বলে বসল, জানেন সজল আমার সাথে কী করেছে? সে ক’দিন আগে আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করেই আমাকে চুমু খেয়েছে।

আশফাক হেসে ফেলল। রুহী ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আশফাকের হাসি ঠিকই টের পেল। আশফাক তরল গলায় বলল, সে তার হবু স্ত্রীকে চুমু দিয়েছে তাতে এমন দোষের কী!

রুহী থমথমে গলায় বলল, আপনি হলেও এমন করতেন বুঝি?

– অবশ্যই করতাম এবং করেছিও। দীপার সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর দীপাকে আমি জোর করে চুমু খেয়েছিলাম ঠিক সজলের মত।

রুহী রাগ করে বলল, আচ্ছা আমি রাখছি। 

– রাগ করছ কেন? তোমার কী ধারনা দীপাকে আমি কখনো চুমু খাইনি? চুমু না খেলে, তাকে প্রাণ ভরে  আদর না করলে আমাদের বাচ্চাটা কীভাবে হলো বলো তো?

আশফাকের কথা শুনে রুহীর কান দিয়ে গরম বাতাস বের হতে শুরু করল। লজ্জায় তার ফর্সা মুখটাও টকটকে লাল হয়ে গেছে। রুহী আবারো বলল, আমি রাখছি।

আশফাক একটু গম্ভীর হয়ে বলল, তোমাকে সত্যের মুখোমুখি হতে হবে রুহী। তুমি খুব ভালোমতই জানো, যেভাবে তুমি ভাবছো তা কখনো সম্ভব নয়। 

– কী ভাবছি আমি? আপনি কি ভাবছেন আপনার প্রেমে আমি পাগল হয়ে গেছি? আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি মুখিয়ে আছি?

– আমি তা ভাবছি না রুহী। কারন প্রেম কিংবা বিয়ে আমাদের দুজনের সাথে এসব কোনো সম্পর্কই স্বাভাবিক ভাবে যায় না রুহী। আমি তোমাকে আগেও বলেছি আমাদের সম্পর্কের কোনো স্বাভাবিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। যদি থাকত তাহলে রাত দশটার সময় সিগারেট কিনতে যাচ্ছি এই বাহানা করে আমাকে বাড়ির বাইরে আসতে হত না। 

রুহী একটু থেমে বলল, আমাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো এক্সপেক্টেশন নেই।

– থাকার কথাও নয়। তোমার মত অল্প বয়স্ক সুন্দরী একটা মেয়ে কেন আমার মত একজন মধ্য বয়স্ক বিবাহিত পুরুষের কাছে কোনো এক্সপেক্টেশন রাখবে। তোমার কাছে আমি কিছুই লুকোইনি রুহী। তুমি খুব ভালোমত জানো, দীপার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। তবুও আমি কোনো ভাবে চাই না আমার আর দীপার মাঝে কখনো সেপারেশন হোক। আমাদের ছেলেটা বাবা মা দুজনের আদর ভালোবাসায় বড় হোক এটাই আমার চাওয়া।

– আপনি কেন এই কথাগুলো বার বার বলেন আমাকে?

– কারন আমরা মানুষ তো। সব জেনে, সব বুঝেও আমরা বড় বড় ভুল করি। এই যেমন আজ সারাদিন তোমার সাথে আমার দেখা হয়নি, কথা হয়নি তাই মনটা খুব ছটফট করছিল। দেখো কেমন পাগলের মত রাতে তোমাকে ফোন দিয়ে বসলাম।

– তাহলে এবার আপনি বলুন, আমার সাথে কথা হয়নি বলে কেন আপনার মন ছটফট করছিল? কেন আপনি আমাকে রাতে ফোন দিয়েছেন? 

– আমি জানি না রুহী। আমি সত্যি জানি না।

রুহী আর কোনো কথা বলল না। ফোনটা রেখে দিল।

রুহী ফোনটা রেখে দেবার পর আশফাক বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করল। দীপার আগেও তার জীবনে আরো দুই একজন মেয়ে এসেছিল। এমনকি এখনো রুহীর চেয়ে অনেকগুন সুন্দর মেয়েরা তাকে নক করে, তার সাথে একটু মেশার জন্য, কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকে। অথচ অদ্ভুৎ ভাবে রুহী তাকে নিজের দিকে টানছে। অন্য কোনো মেয়ের প্রতি এতখানি তীব্র আকর্ষণ আশফাক এর আগে কখনো বোধ করেনি। আশফাক ভ্রুঁ কুঁচকে ভাবলো, এতক্ষণ ফোনে কথাগুলো কি সে আসলে রুহীকে শোনাচ্ছিল নাকি নিজেকেই?

 

 

 

 

 

 

৮ম পর্ব

 

আশফাক একটু আগে সিগারেট কিনতে বাইরে গেল। আশফাক বাইরে যেতেই দীপার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল। রাত দশটা বাজে। এত রাতে একজন স্বাভাবিক মানুষের সিগারেট কিনতে যাবার কথা নয়। তাছাড়া আশফাক তো আর কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া কোনো ছাত্র নয় যে যখন ইচ্ছে হলো তখন কোনো অজুহাত দেখিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল! 

দীপা অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। তাদের শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে বাড়ির সামনের রাস্তা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। কথাটা মনে হতেই দীপা বারান্দায় চলে এলো। রাস্তার যতটুকু অংশ দীপার চোখে পড়লো সেখানে কোথাও আশফাককে দেখা গেল না। দীপা বারান্দায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। আশফাক কি আদৌ সিগারেট কিনতে গেছে নাকি অন্য কোথাও গেছে এটা ঠিকঠাক না জানা পর্যন্ত তার মনে শান্তি মিলবে না। এদিকে দীপাকে দেখতে না পেয়ে ছেলেটা তারস্বরে কেঁদে চলেছে। দীপার ইচ্ছে করছে ছেলেটার গালে কষে একটা চড় মারতে। কিন্তু সে নিরুপায়। নিতান্ত বাধ্য হয়ে সে শোবার ঘরে চলে এলো। ছেলেটাকে খানিকটা আদর করে ঠান্ডা করতে করতেই মিনিট দশেক পেরিয়ে গেল। দীপা আবার তড়িঘড়ি করে বারান্দায় এলো। এবার আর তার পরিশ্রম বৃথা গেল না। সে আশফাককে দেখতে পেল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আশফাক ভীষণ মনোযোগ দিয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। আশফাক যতক্ষন ফোনে কথা বলল দীপা ঠিক ততক্ষন আশফাকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখের পলক পর্যন্ত পড়ল না। দীপা অবাক হয়ে দেখল, ফোনটা রাখার পরেও আশফাকের মধ্যে বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরালো।

বারান্দায় প্রচন্ড গরম। এর মধ্যেই দীপা ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে সে ঘরে এসে ফ্যানের নীচে দাঁড়াল। দীপা ঘরে এসে দাঁড়ানোর মিনিট পাঁচেক পর আশফাকও ফিরে এলো। দীপা ভেবেছিল, সিগারেট কেনার অজুহাত দেখিয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া নিয়ে আশফাককে আপাতত সে কিছু বলবে না। এই ব্যাপারগুলোতে আশফাক ভীষণ বিরক্ত হয়। অযথা সব বিষয় নিয়ে নজরদারী করা তার পছন্দ নয়। এর আগেও এসব নিয়ে তাদের মাঝে অসংখ্য বার ঝগড়া হয়েছে। তবুও দীপা নিজেকে সামলাতে পারলো না। আশফাক ঘরে ঢুকতেই সে আশফাকের দিকে প্রায় তেড়ে এলো। ইতিমধ্যে রাগে তার ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে। তীব্র ক্রোধে তার নাকের পাটা দুটো  ফুলছে।

আশফাক অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে দীপা? তোমার চোখ মুখের অবস্থা এমন কেন?

দীপা যেন আশফাকের কোনো কথা শুনতে পেল না। সে রাগে লাল হয়ে বলল, এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

– কোথায় আর যাবো। তোমাকে তো বলেই গেলাম নীচে সিগারেট কিনতে যাচ্ছি। 

– সিগারেট কিনতে এত সময় লাগে তোমার?

– কী আশ্চর্য দীপা! এমন করছো কেন? আমার প্রতি মিনিটের হিসেব তোমাকে দিতে হবে নাকি?

– তুমি না বললেও আমি জানিনা ভেবেছ তুমি নীচে কেন গিয়েছিলে?

– কেন গিয়েছিলাম?

– তুমি নীচে গিয়েছিলে তোমার গোপন প্রেমিকার সাথে ফোনে কথা বলতে। আমাকে এত বোকা ভেব না আশফাক। আমি সব জানি।

 দীপাকে কড়া একটা জবাব দিতে যেয়ে আশফাক থেমে গেল। একটু ভেবে নেয়ার পর তার মনে হলো, কড়া কোনো জবাব দেয়ার পর দীপার কাছ থেকে এত সহজে পার পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আজ দীপা যা বলছে তা ভুল কিছু নয়। জীবনে এই প্রথম বারের মত আশফাক দীপার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলল। নরম গলায় বলল, নীচে দাঁড়িয়ে আমি ফোনে কথা বলেছি ঠিকই তবে আমার কোনো গোপন প্রেমিকার সাথে নয়। আমার একজন কলিগের সাথে। বিশ্বাস করো দীপা, তুমি অযথা আমাকে সন্দেহ করছ।

দীপা একদৃষ্টিতে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে তার চোখ দিয়ে আশফাকের মনের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করছে। 

 দীপাকে স্বাভাবিক করার জন্য আশফাক বলল, খাবে না দীপা? আমার খুব খিদে পেয়েছে। চলো খেয়ে নিই।

 দীপা আর কথা বাড়ালো না। শান্ত মুখে টেবিলে খাবার গোছানো শুরু করল। দীপাকে স্বাভাবিক দেখে আশফাক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। 

সেই রাতে ছেলের জায়গা আবারো বিছানার একপাশে হলো। আশফাক দীপার মনোকামনা বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। ঠোঁটের কোনে একটা হাসি এঁকে সে দীপার দিকে এগুলো। এই প্রথমবারের মত তার মনে হলো, মাঝে মাঝে নিজেকে আড়াল করার জন্য একটি লুকোনোর জায়গা তার খুব  প্রয়োজন, বড় বেশী প্রয়োজন!

                         ………………..

আশফাক স্যারের মুখের উপর ফোনটা রেখে দেয়ার পর রুহী অনেকক্ষন কাঁদলো। এই কান্নার সঠিক কারনটা সে জানে না। কান্নার উৎস সম্পর্কেও তার কোনো ধারনা নেই। আশফাক স্যার ফোনে তাকে যে কথাগুলো বললেন, তাতে বিন্দুমাত্র ভুল কিছু ছিল না। বরং তিনি খুব সহজভাবে সঠিক কথাগুলো তাকে বলেছেন। তবুও রুহীর কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছে। নিজেকে সামলানোর রুহী প্রাণপন চেষ্টা করল। যে সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই শুধু শুধু সেই সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। রুহীর কান্নার মাঝে সজল আবার ফোন করল। রুহী এবার সজলের ফোনটা ধরলো। সজলের সাথে দুই তিন মিনিট স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলল। সজল বোধহয় তাকে কিছু বলার জন্য ফোন করেছিল। তবে রুহী সেগুলোর ধার দিয়ে গেল না। নিতান্তই সাধারন কিছু কথা বলে রুহী ফোনটা রেখে দিল। সজলও রুহীর মন খারাপ বুঝতে পেরে তাকে আর ঘাটালো না। ফোনটা রেখে দেয়ার পরেও অদ্ভুৎ ভাবে আজ তাকে মোবাইলটা টানছে। রুহী মোবাইলের ডাটা অন করতেই দেখল আশফাক স্যার অনলাইনে রয়েছেন। তার নামের পাশে টিমটিম করে ছোট্ট একটা সবুজ আলো জ্বলছে। রুহী অনেকক্ষন সেই সবুজ আলোর দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর যেন রুহী নয় রুহীকে দিয়ে কোনো অদৃশ্য শক্তি লেখালো, কী করছেন?

অনেকক্ষন কোনো উত্তর নেই। রুহী উত্তরের আশায় মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। দুই এক মিনিট যেতেই রুহীর চোখ ভরে জল এলো। আশফাক স্যার তার মেসেজটা সিন করেছেন ঠিকই অথচ এখনো কোনো উত্তর দেননি। রুহীর মনে হলো, তিনি বোধহয় ইচ্ছে করে তার মেসেজের উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি বোধহয় রুহীকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন। রুহী তীব্র অভিমানে একটু আগে আশফাক স্যারকে লেখা তার মেসেজটা ডিলিট করতে যাবে ঠিক তখন উত্তর এলো, আমাদের জীবনটা এমন কেন রুহী? যা করতে ইচ্ছে হয় না তাই আমাদের বার বার করতে হয়…যা নিয়ে আমাদের ভাবতে ইচ্ছে হয় না তা নিয়েই আমাদের ভাবতে হয়…

রুহী একটু ভেবে নিয়ে লিখলো, কেন? তা কেন? আমরা যা করি তার উপর অনেক সময় আমাদের নিয়ন্ত্রন না থাকলেও আমাদের ভাবনার উপর তো কারো নিয়ন্ত্রন নেই, তাই না? ভাবুন না আপনি, যা ইচ্ছে করে তাই নিয়ে ভাবুন, যাকে নিয়ে ইচ্ছে করে তাকে নিয়ে ভাবুন, কে আপনাকে বারণ করেছে?

আশফাক লিখল, বেশ, তবে তাই হোক…আমি ভাবছি রুহী…আমার যাকে সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে আমি তাকে নিয়ে ভাবছি… আমি তোমাকে নিয়ে ভাবছি রুহী…তোমাকে নিয়ে ভাবছি….

 

 

 

 

 

 

৯ম পর্ব

 

দিনগুলো যেন সোনালি ডানায় ভর করে চলছিল। জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত কিংবা সময় আসে যখন ন্যায় কিংবা অন্যায় অথবা ভালো কিংবা মন্দ এর বাছ বিচার করার চেয়ে নিজের জীবনের চাওয়াগুলো বেশী মুখ্য হয়ে ওঠে। রুহী এবং আশফাকের জীবনে এমনই এক অধ্যায় চলছিল। দুজনেই ভুলে গিয়েছিল, যে মিথ্যে মরীচিকার পেছনে তারা ছুটে চলেছে তা শুধু দুজনের জীবনে কালো অন্ধকার নামিয়ে আসবে, মৃদু আলোর সোনালি রেখা কখনোয় দুজনের সর্ম্পককে ছুঁয়ে যাবে না। তবুও দুজনেই যেন সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করছিল। দুজনেই  প্রাণপণে অপেক্ষা করতে শুরু করেছিল ক্যাম্পাস ছুটি হবার মুহূর্তটুকুর, দুজনের দেখা হবার মুহূর্তটুকুর। অদ্ভুত ভাবে তাদের সম্পর্কটুকু সবার কাছে লুকোনো ছিল। দীপা কিংবা সজল নিজেদের সম্পর্ক গুলোর মাঝে কোনো অস্বাভাবিকতা যে টের পাচ্ছিল না তা কিন্তু নয়। তবে বলার মত উপযুক্ত কোনো প্রমাণ কিংবা কারন তারা খুঁজে পাচ্ছিল না। সজল ছাড়াও আরেকজন মানুষ ছিল যে রুহীর মধ্যে অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছিল আর সে মানুষটা হলো সুমি। রুহীর সাথে সুমির বন্ধুত্ব সেই ছোট্ট বেলার। এক যুগেরও বেশী চেনা এই মানুষটির হঠাৎ অচেনা হওয়াটা সুমিকে ঠিকই নাড়া দিল। সময় সুযোগ মত সে একদিন রুহীকে ধরল। 

চোখে একগাদা সন্দেহ নিয়ে সে রুহীকে জিজ্ঞেস করল, তোর কী হয়েছে রে ?

রুহী ঠোঁট উল্টে বলল, কী হবে আমার?

– ক‘দিন থেকে খেয়াল করছি তুই যেন বেশ অন্যমনস্ক। কোনো কাজে মন নেই। ক্লাস গুলোও ঠিক মত করিস না। সব সময় উড়ুউড়ু ভাব। 

– কী যা তা বলছিস। ক্লাস ঠিক মত করি না কখন?  প্রতিদিনই তো ক্লাস করছি। 

– তা করছিস হয়ত। তবে তোর মন কিন্তু অন্য জায়গায়।

– তাই নাকি? তো কোথায় আমার  মন?

সুমি ভ্রুঁ নাচিয়ে বলেছিল, আমি খুব ভালো মত জানি রুহী কোথায় তোর মন। আমি তোকে  এক যুগেরও বেশী সময় ধরে চিনি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুই নিজেকে যতটুকু চিনিস তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী আমি তোকে চিনি। তাই আমার ভয় করছে রুহী। আমি চাই না তোর কোনো ক্ষতি হোক। কিংবা কোনো কারনে তুই কষ্ট পাস। তাছাড়া আমরা যে সমাজে বাস করি সেই সমাজের কথাও তোর ভাবতে হবে।

রুহী চোখ  বড় বড় করে বলেছিল, তুই কী বলছিস সুমি আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না।

– তুই সব বুঝছিস রুহী। কিংবা এখন হয়ত বুঝছিস না, তবে একদিন ঠিকই বুঝবি। এখনো সব কিছু তোর পক্ষে রয়েছে। তবে যখন সবাই জানবে তখন কিছুই আর তোর কন্ট্রোলে থাকবে না। তখন কী হবে একবার ভেবে দেখেছিস? 

রুহী অবাক হয়ে সুমির দিকে তাকিয়েছিল। 

সুমি রুহীর অবাক হওয়া দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলেছিল, ভয় পাস না রুহী। ওই যে বললাম, আমি তোকে খুব ভালো মত চিনি। তাই ব্যাপারটা এত দ্রুত আমি বুঝতে পেরেছি। এখনো কেউ কিছু জানে না। তবে সব কিছু জানতে খুব বেশী দেরী হবে না। এসব ব্যাপার চাপা থাকে না রুহী। তাই সময় থাকতেই প্লিজ বের হয়ে আয়। তাছাড়া তোর বিয়ের তো বেশী দেরী নেই। আর মাত্র মাসখানেক পর তোর বিয়ে, তাই না?

রুহী মিনমিন করে বলেছিল, হুম।

– তাহলে কেন সব কিছু ধ্বংস করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিস, বল তো? বাবা মার সম্মানের কথাও তো তোর একবার ভেবে দেখা উচিৎ, তাই না? রুহী তুই প্লিজ পাগলামী করিস না। এই সম্পর্ক থেকে তুই বেরিয়ে আয় প্লিজ।

সেদিন বিকেলেই রুহী থমথমে মুখে আশফাকের সামনে দাঁড়িয়েছিল। আশফাক চোখে একটু কৌতুহল ফুটিয়ে বলেছিল, কী হয়েছে? মন খারাপ?

– না মন খারাপ নয়।

– তবে? চাঁদের মত এমন মুখখানায় আঁধারের ছাঁয়া কেন?

রুহী গোমড়া মুখে  বলেছিল, আমার মনে হয় আমাদের বিষয়টা সুমি কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছে। 

– সুমি কে?

– ও আমার খুব কাছের বান্ধবী। আমরা দুজন ক্লাস ওয়ান থেকে এক সাথে পড়ছি। আজ সুমি আপনার কথা আমার সামনে বলছিল।

আশফাক অবাক হয়ে বলেছিল, আমার কথা?

– ঠিক আপনার কথা নয়। আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা।

– সুমি যেহেতু সরাসরি আমার নাম তোমার সামনে বলেনি তাই আমার ধারনা তুমি অযথা টেনশন করছ। এমন তো হতেই পারে, সে তোমার আর সজলের ব্যাপারে কিছু বলছে। আর তুমি ভাবছ সুমি আমার কথা বলেছে।

– না তা নয়। অযথা টেনশন দেয়ার মানুষ সুমি নয়। আমি একশ ভাগ নিশ্চিত সুমি কিছু জানে। সে আমাকে আজ বারবার সাবধান করলো।

আশফাক চোখে কৌতুক নিয়ে বলল, কী বলে সাবধান করল তোমাকে? বারবার করে বলল, আশফাক স্যার খুব খারাপ মানুষ। ওর কাছ থেকে তুই একশ হাত দূরে থাকবি। উনি তাকে সুযোগ পেলেই কপ করে খেয়ে ফেলবে।

রুহী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, সব সময় আপনার মজা। আপনি সিরিয়াস কখন হবেন বলুন তো?

আশফাক একটু গম্ভীর হয়ে বলল, কী নিয়ে সিরিয়ার হবো রুহী? তোমার আমার সম্পর্ক নিয়ে? নাকি আমার আর দীপার সম্পর্ক নিয়ে? 

রুহী মুখ নামিয়ে বলল, আমার মনে হয় সুমি যা বলেছিল সেটা হয়ত ঠিক। 

– কী বলেছিল সুমি?

– আমার এই সর্ম্পক থেকে বের হয়ে আসা উচিৎ। 

আশফাক তেতো গলায় বলল, তোমার আর আমার সম্পর্কের ব্যাপারে সে কথা বলার কে? আর তোমার যদি মনে হয় সুমির কথা ঠিক তবে তোমার এই সময় আমার পাশে বসে থাকার কথা নয় রুহী। তোমার এই সময় সজলের পাশে থাকার কথা। তাই না?

রুহী মুখ শক্ত করে বলল, সজলকে আমি বিয়ে করব না। কিছুতেই না।

আশফাক রুহী কে বোঝাতে যেয়ে থেমে গেল। এই মেয়েকে বোঝানোর সাধ্য তার নেই। তাছাড়া কী-ই বা সে বোঝাবে। আগুন নিয়ে খেলতে শুধু রুহী নামেনি, রুহীর সাথে সে নিজেও নেমেছে। যে খেলাটা শুরু হয়েছিল না জানা কিছু প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে সেই খেলাটা আজ প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় সরব হয়েছে। আশফাকের কখনো মনে হচ্ছে, প্রশ্নের উত্তরটা তবে দিয়েই ফেলা যাক কিন্তু পরমুহূর্তেই কয়েকটা মুখ চোখের সামনে বড় বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আশফাক দু এক দণ্ড ভেবে নিয়ে রুহীর হাতের উপর একটা হাত রাখলো।

 রুহী অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকালো। মানুষটা সহজে তার শরীর স্পর্শ করে না। আশফাকের মুখটা এই মুহূর্তে খুব মলিন দেখাচ্ছে। প্রিয় মানুষটির হাত ছোঁয়ার কোমল আনন্দটুকু তার চোখের মাঝে নেই। বরং সেখানে যেন এক রাশ বিষাদ খেলা করছে। রুহী তার হাতটুকু আশফাকের হাতের মধ্যে থেকে সরিয়ে নিলো।

আশফাক রুহীর দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল, আমাকে ভুল বোঝা খুব সহজ রুহী। আমার জায়গায় নিজেকে একবার দাঁড় করিয়ে দেখো তখন বুঝবে আমার জায়গাটা কতখানি কঠিন। 

একটু ভেবে নিয়ে রুহী নরম গলায় বলল, কে বলেছে আপনার জায়গাটা বোঝা আমার পক্ষে কঠিন? এই যে চেয়ে দেখুন, আমি আপনার পাশেই রয়েছি। যদি সুমির কথাগুলোই মেনে নিতাম তাহলে তো এই মুহূর্তে আপনার পাশে আমি থাকতাম না, তাই না ?

 

 

 

 

 

 

১০ম পর্ব

 

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। দীপা বারান্দায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে যে তার শাড়ি চুল সব ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে তার ভ্রুঁক্ষেপ নাই। দীপার বাবা এসে আজ ছেলেটাকে নিয়ে গেছে। ক’দিন সে নানা বাড়িতে থাকবে ।ছেলেটা তার নানা, নানুর ভীষন ভক্ত। মা ছাড়া তার চলবে তবে নানা নানী ছাড়া তার চলবে না। দীপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ। কারো একছত্র ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য তার কোনো দিনও নেই। এই যেমন নিজের একমাত্র সন্তান সে-ও নাকি দীপাকে বাদ দিয়ে তারা নানা নানুকে ভালোবাসে। ছোট বেলাতেও দীপার মনে হত, দীপার বাবা মা বোধ হয় তার চেয়ে বেশী তাদের বড় মেয়েকে ভালোবাসে। এসব নিয়ে দীপার মনে একটা লুকোনো কষ্ট থাকলেও একটু বড় হবার পর দীপা নিজেকে বোঝাতো এই ভেবে যে, যার সাথে তার বিয়ে হবে সেই মানুষটা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসবে। 

শুরুর ক’টা বছর এমনটাই মনে হয়েছিল। আশফাকের সাথে তার সময়গুলো অদ্ভুত রোমান্টিকতার মধ্যে দিয়ে কেটে যাচ্ছিল। তবে ধীরে ধীরে সব কিছু বদলে গেল। আশফাক তার ব্যাংকের জবটা ছেড়ে দিয়ে ভার্সিটিতে জয়েন করল। অসম্ভব মেধাবী ছিল বলে ভার্সিটিতে জয়েন করার পর খুব সহজেই তার প্রমোশন হয়ে গেল। অবাক হলেও সত্যি, ভার্সিটিতে জয়েন করার পর আশফাকের চেহারাটারও যেন পরিবর্তন হলো। আগেও সে হ্যান্ডসাম ছিল তবে তার চেহারার মাঝে কী যেন ছিল না যার কারনে তার চেহারাটা সবাইকে আকৃষ্ট করত না। কিন্তু আশফাকের চেহারায় সেই “ছিল না” ভাবটা ভার্সিটিতে জয়েন করার পর কীভাবে যেন  কেটে গেলো। দীপা অনেক ভেবে বের করেছে, আসলে একটা ভালো প্রফেশন, নিজের জবের প্রতি চূড়ান্ত রকমের ভালো লাগা একজন মানুষকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। আশফাকের ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছিল। ব্যাংকের চাকরিটা সে বাধ্য হয়ে করত। বরাবরই তার ভার্সিটিতে পড়ানোর স্বপ্ন। ওদের ক্লাসে যে ছেলেটা ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট হয়েছিল সেই ছেলেটারই আসলে ভার্সিটির এই চাকরিটা করার কথা ছিল। তবে সেই ছেলেটা চাকরিতে জয়েন করার কয়েক মাসের মধ্যে দেশের বাইরে একটা স্কলারশীপ পাওয়ায় সে চাকরি ছেড়ে চলে যায় আর তারপরেই চাকরিটা হয় আশফাকের।

দীপার মাঝে মাঝে মনে হয়, আশফাকের এই চাকরি হওয়াটাই তাদের সম্পর্কের জন্যে কাল হলো। নিত্য নতুন মেয়েদের, সহজ বাংলায় বলা যায় নিত্য নতুন ছাত্রীদের ফোন, ম্যাসেজ আশফাককে আমুলে বদলে দিল। এই বদলে যাওয়াটা তবুও মেনে নেয়ার মত ছিল তবে ক’দিন যাবত যা ঘটছে সেগুলো কিছুতেই মেনে নেয়ার মত নয়। আশফাকের মোবাইল এখন পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা। স্বাভাবিকভাবেই এই পাসওয়ার্ড দীপা জানে না। আগে কখনো এমনটা হয়নি। এর আগে ফোন লক করার প্রয়োজন কখনো আশফাকের পড়েনি। এছাড়াও আশফাকের এখন রোজ ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়। দীপা এসব পরিবর্তন গুলো খুব ভালো মতই টের পাচ্ছে। সব কিছু বোঝার পর কষ্টে তার বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কোনো মেয়েই চাইবে না তার এত দিনের সাজানো গোছানো সংসারটা ভেঙ্গে যাক। দীপাও এর ব্যতিক্রম নয়। সে যে কোনো মূল্যে তার এই সংসারটা বাঁচাতে চায়। তাই এবার সে অনেক ঠান্ডা মাথায় কাজ করছে। অহেতুক আশফাকের সাথে ঝামেলা করছে না। কারন সে খুব ভালো মতই জানে এবারের ব্যাপারটা অনেক জটিল। সে কোনো পাগলামী করলে, ঝামেলা করলে হিতে বিপরীত হবে। 

দীপা বারান্দা থেকে এসে ভেজা শাড়িটা পাল্টালো। ভেজা চুলগুলিও ভালো মত আঁচড়ালো। অনেক দিন হলো আশফাক তার কাছাকাছি আসে না। এর মাঝে যে দু একবার এসেছে সেটাও দীপার আগ্রহের কারনেই এসেছে। এই মুহূর্তে দীপার নিজের প্রতি খুব করুণা হলো। আজকেও সে আশফাকের জন্য নিজেকে সাজাচ্ছে। তবে এমনটা হবার কথা ছিল না। স্বাভাবিক ভাবে পুরুষেরাই নারীদের কাছাকাছি আসে, তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের বিশেষ ভাবে কামনা করে। নিজের ভাবনায় দীপার আবারও খুব মন খারাপ হয়ে গেল। বর্তমানে সে আসলে আশফাকের কাছে কোনো নারী নয়। সে এখন আশফাকের কাছে তার বিয়ে করা বউ। যার জায়গা আপাতত আশফাকের সাজানো এই সংসারে। তার হৃদয়ে যার কোনো ঠাঁয় নেই। দীপার এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝে কলিংবেল বাজল। আশফাক এসেছে। দীপা দরজাটা খুলল। দীপা খেয়াল করল, অন্যদিনের মত আজকেও আশফাকের শরীর দিয়ে অচেনা পারফিউমের গন্ধ ভুরভুর করে আসছে। দীপা সব বুঝেও স্বাভাবিক রইল। 

নরম গলায় বলল, এত দেরী হলো যে? এক্সট্রা ক্লাস ছিল বুঝি?

আশফাক এক কথায় উওর দিল, হ্যাঁ।

দীপা আবারো বলল, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার গুছাচ্ছি। 

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে আশফাক জিজ্ঞেস করল, বাবু কই?

– বাবা আজ বিকেলে এসে ওকে নিয়ে গেছে। 

– হঠাৎ? কোনো অকেশন আছে নাকি?

– তোমার ছেলের নানুর বাড়িতে যাবার আবার কোনো অকেশন লাগে নাকি? আর কোনো অকেশন থাকলে তুমি যেতে না? আমি যেতাম না?

আশফাক আর কথা বাড়ালো না। সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেল।

অনেকদিন পর সেই বিয়ের শুরুর দিনগুলোর মত আশফাক আর দীপা মুখোমুখি খেতে বসেছে। আজকাল ছেলেটাকে খাইয়ে দীপা যখন খেতে বসে ততক্ষণে আশফাকের খাওয়া হয়ে যায়। সারাদিন পর রাতের এই একবেলা খাওয়াটায় আশফাকের বাড়িতে খাওয়া হয়। এদিকে ছেলেটাও অনেকক্ষণ ধরে ঝামেলা করে খায়। আশফাকের আর ততক্ষণ পর্যন্ত দীপার জন্যে অপেক্ষা করার ধৈর্য্য থাকে না। সে একাই রাতের খাবারটা খেয়ে নেয়। এতদিন পর দীপার সাথে খেতে বসে আশফাকের মনে হলো, কাজটা ঠিক হয়নি। মেয়েটা সারাদিন বাসায় একা থাকে। সে না থাকলে তার সংসারটা এত চমৎকার ভাবে সাজানো গোছানো থাকত না। তার বাসায় যারাই বেড়াতে আসে তারাই তার সাজানো গোছানো সংসার দেখে মুগ্ধ হয়। এসব কিছুর সব কৃতিত্ব দীপার একার। সে কখনোয় এসব কাজে দীপাকে সাহায্য করেনি। মাসে মাসে এক গোছা টাকা দিয়ে আর মাঝে মাঝে বাজার করার মধ্যে দিয়েই সে তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এমনকি আশফাকের বাবা মাও তাদের পুত্রবধূর উপর সন্তুষ্ট যা কিনা এই বাঙালি সমাজে বিরল। ধরতে গেলে, দীপার একটাই সমস্যা। আর তা হলো, তার প্রচন্ড রাগ আর সে খুব ঝগড়াটে এবং সন্দেহবাতিক। যদিও রুহীর ব্যাপারটা নিয়ে সে বোধহয় এখনো কিছু আঁচ করতে পারেনি। আঁচ করতে পারলে তার খবর ছিল। আশফাকের ভাবনার মাঝে দীপা তার প্লেটে আরেক টুকরো বড় মাছ তুলে দিল। দীপা আজ বোয়াল মাছের দোপেঁয়াজা করেছে। আশফাক খেয়াল করল, আজ টেবিলের সব খাবার তার পছন্দের। আশফাক মনোযোগ দিয়ে দীপাকেও খেয়াল করল। দীপাকে বেশ শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের নীচেও ঘন কালো দাগ পড়েছে যেন অনেক রাত সে আরাম করে ঘুমায়নি। এমনিতে দীপা তার সৌন্দর্য্যের ব্যাপারে খুব সচেতন। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে দীপা নিয়মিত রূপচর্চা করে। সেই দীপার চেহারার এই অবস্থা দেখে আশফাক বেশ অবাক হলো। তার মনে হলো, দীপার শরীর খারাপ করেনি তো? 

আশফাক চিন্তিত গলায় বলল, তোমার শরীর ঠিক আছে দীপা?

দীপা তার থালায় মাখানো ভাত খুঁটতে খুঁটতে বলল, আমার শরীরের আবার কী হবে? আমি ঠিক আছি।

– তোমাকে দেখতে খুব শুকনো লাগছে। তাছাড়া তোমার চোখের নীচেও ঘন কালো দাগ পড়েছে। রাতে ভালো ঘুম হয় না তোমার? কোনো কিছু নিয়ে কি খুব দুশ্চিন্তা করছো?

আশফাকের কথা শুনে দীপা নিজেকে আর সামলাতে পারলো না । সে এই মুহূর্তে আশফাকের সামনে নিজের দুর্বলতার কথা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে চায়নি। সে কোনো ভাবেই আশফাককে বোঝাতে চায়নি আশফাকের গোপন প্রনয়ের কথা সে খুব ভালো মতই আঁচ করতে পেরেছে। কিন্তু দীপা নিজের কাছে হেরে গেলো। সে এঁটো হাতেই আশফাকের উপরে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

আশফাককে কামড়িয়ে, খামচিয়ে প্রায় ক্ষতবিক্ষত করে বলল, কীভাবে পারলে তুমি? বোলো, তুমি কীভাবে পারলে? কারো সাথে সর্ম্পকে জড়ানোর আগে একবারও আমার কথা  ভাবলে না তুমি? তোমার সন্তানের কথা তুমি একবারও ভাবলে না? কীভাবে পারলে তুমি আশফাক? কীভাবে? 

 

 

 

 

 

 

১১ম পর্ব

 

রুহী অবাক হয়ে সুমির দিয়ে তাকিয়ে রইল যদিও  সুমির মধ্যে কোনো বিকার নেই। সে একই ভাবে ভাবলেশহীন চোখে রুহীর দিকে তাকিয়ে আছে। 

রুহী বলল, কে এসেছে বললি?

সুমি অবলীলায় বলল, দীপা নামের একটি মেয়ে তোর সাথে দেখা করার জন্য এসেছে।

– দীপা কে? আর তুই তাকে পেলি কোথায়?

– আমাদের ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে ডেকে তোর কথা জিজ্ঞেস করল। আর তুই শুধু শুধু ভাব ধরছিস কেন দীপা নামের কাউকে তুই চিনিস না? তুই জানিস না দীপা কে?

রুহী চুপ করে রইল। আজ বোধহয় আশফাক স্যার  ক্যাম্পাসে আসেননি। তিনি ক্যাম্পাসে আসলে এতক্ষণে নিশ্চয় তার সাথে একবার দেখা হত। এদিকে কাল রাতেও আশফাক স্যারের সাথে তার ফোনে কথা হয়নি। রুহী দেখেছে, কাল রাত দশটার পর থেকে আশফাক স্যার অনলাইনে ছিলেন না। রুহী আরেকবার মোবাইল চেক করলো। আশফাক স্যার এখনো অনলাইনে নেই। কাল রাত দশটা থেকে তিনি অফলাইনে। রুহী একবার ভাবলো আশফাক স্যারকে সরাসরি কল দেয়। সে সুমির দিকে আড়চোখে তাকালো। সে একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সুমির উপর একই সাথে রুহীর প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো আবার মায়াও হলো। সে খুব ভালোমত জানে, পুরো পৃথিবী তার বিপক্ষে গেলেও এই মেয়ে তাকে ছেড়ে  যাবে না। রুহী আশফাক স্যারকে সরাসরি ফোন করলো। আশফাক স্যারের ফোন বন্ধ। রুহী এবার ভীষণ অসহায় বোধ করল। আশফাক স্যারের সাথে গতকাল রাত থেকে তার কোনো যোগাযোগ নেই।  এদিকে স্যারের স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাস পর্যন্ত চলে এসেছে।

সুমি ভ্রুঁ নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কীরে তোর আশফাক স্যার ফোন ধরলেন না? এক রাতে বৌয়ের ঝাড়ি খেয়েই সব প্রেম উবে গেল?

রুহী বিরক্ত হয়ে বলল, তুই থামবি? আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত জানি না তাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে কী হয়েছে? কেন হয়েছে? আর কেনই বা আশফাক স্যার ফোন বন্ধ করে ঘরে বসে আছেন?

সুমি তার গলায় একগাদা বিদ্রুপ মিশিয়ে বলল, যা না। গিয়ে জিজ্ঞেস কর। তোর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যেই তো এত দূর থেকে আশফাক স্যারের বৌ ছুটে এসেছে।

রুহী এবার হতাশ চোখে সুমির দিকে তাকালো। এই মুহুর্তে সুমি ছাড়া কারো পক্ষে তার পরিস্থিতি বোঝার কথা নয়। অথচ সুমিও কেমন যেন অবুঝের মত আচরণ করছে। 

সুমি বোধহয় রুহীর মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। নরম গলায় বলল, টেনশন করিস না। যা, উনার সাথে কথা বল। সেই কখন থেকে তোর জন্য ক্যান্টিনে বসে আছেন। তোর ভয় নেই। কেউ কিছু জানে না। দীপা ম্যামকে ক্যান্টিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি তার সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলেছি। তাকে ক্যাম্পাসে দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাকে দেখেই আমি ধারনা করেছিলাম, তিনি তোর সাথে দেখা করার জন্য এখানে এসেছেন। 

রুহী বলল, তুই আশফাক স্যারের বৌ কে চিনিস?

– হুম চিনি। আমি কেন ক্যাম্পাসের অনেকেই তাকে চেনে। মাস দুয়েক আগে তিনি ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। আমার এটাই আফসোস রুহী, হাসিখুশি একটা পরিবারকে আমরা সবাই দেখলাম, সবাই সব বুঝলাম। শুধু তুই কিছু দেখলি না। তুই কিছু বুঝলি না কিংবা তুই সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলি।

সুমি ক্যান্টিন পর্যন্ত রুহীর সাথে এলো। ক্যান্টিনে ঢোকার মুহুর্তে রুহীর একটা হাত ধরে বলল, খুব স্বাভাবিকভাবেই উনি তোকে অনেক কড়া কড়া কথা শোনাবেন রুহী। তোর প্রতি তার সকল রাগ, ঘৃণা উনি হয়ত তোর মুখের উপরেই উদ্গীরণ করবেন। তোকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে রুহী। তোকে খুব ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে। তুই যদি আজ এই জায়গা থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বের হয়ে আসতে পারিস আমার বিশ্বাস সব বিপদ কেটে যাবে। আবার সব আগের মত হয়ে যাবে। তোর উপরে এখন সব কিছু নির্ভর করছে রুহী। শুধুমাত্র তোর উপরেই।

এর আগে অসংখ্য বার চিরচেনা এই ক্যান্টিনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত রুহী পার হয়েছে। এই ক্যান্টিনকে জড়িয়ে রুহীর অসংখ্য মধুর স্মৃতি রয়েছে। তবে আজ এই ক্যান্টিন তার জন্য কী রকম ভয়াবহ স্মৃতি তৈরি করে রেখেছে কে জানে? রুহীর যেন এইটুকু পথ পারি দিতে সহস্র বছর সময় লাগল। পা দুটো যেন অসম্ভব ভারী হয়ে গেছে। পাখির পালকের মত হালকা এই শরীরটাও আজ পাথরের মত ভারী! রুহী কোনোমতে নিজের শরীরটাকে টেনে কাঙ্ক্ষিত টেবিলটার সামনে দাঁড়ালো। সে দেখলো, দীপার সামনে একটা চায়ের কাপ অবহেলায় পড়ে রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চায়ের কাপটায় তার ঠোঁটের ছোঁয়া পর্যন্ত পড়েনি। গরম চায়ের উপর ইতিমধ্যেই ঘন সর পড়ে রয়েছে।

রুহীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপা কঠিন গলায় বলল, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। অনেকক্ষন বসিয়ে রেখেছ তুমি আমাকে। একসময় মনে হলো, তুমি আর আসবে না। আমার কথা শুনে বোধহয় পালিয়ে গেছো।

 দীপার কথা শুনে রুহী সরাসরি তার দিকে তাকালো। দীপার ঠোঁটের কোনে বিদ্রূপের হাসি। দীপার এই হাসিটুকু রুহীর ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিলো। অবাক হলেও সত্য, আজ দীপা যে টেবিলটাই বসেছে আশফাক স্যার এই টেবিলে প্রায়ই বসে চা খান। রুহীর খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, দীপা কি কাজটা ইচ্ছে করে করেছে? নাকি দীপার এই টেবিলে বসাটা সম্পূর্ণ কাকতালীয়?

দীপা আবারো বলল, বসো। তোমার সাথে আমার কথা এত অল্প নয় যে তোমার দাঁড়িয়ে থেকেই সব কথা শোনা হয়ে যাবে।

অগ্যতা রুহী বসল। রুহী কে বসতে দেখে দীপা কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এই যে তোমরা সব কিছু জেনে শুনে একজন বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ো, এটা আসলে কী ভেবে পড়ো? নিশ্চয় পুরুষটির শুধু রূপ দেখে নয়, তার ক্যারিয়ার দেখে, ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে, তাই নয় কী? 

এর আগে এত অসহায় বোধ রুহী কখনো করেনি। সে কাতর গলায় বলল, আমাকে এসব প্রশ্ন কেন করছেন আপনি?

– তুমি জানো না আমি কেন করছি?

রুহী কাতর গলায় বলল, আপনি প্লিজ আমাকে যেতে দিন। আপনার সাথে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। আমার খুব কস্ট হচ্ছে।

দীপা গলা নামিয়ে বলল, এই কথাটা  আমার বরের সাথে প্রেম করার আগে তোমার ভাবা উচিৎ ছিল। তাছাড়া তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই আমার নেই। আমি তোমাকে শুধু একটা কথা বলতে এসেছি। এই মুহুর্ত থেকে তুমি আর কখনো আশফাকের সাথে কথা বলবে না, কোনো রকম যোগাযোগ করবে না। আর যদি করো, আমার সম্পর্কে তোমার নিশ্চয় নূন্যতম ধারনা আছে। নিজের প্রতি অন্যায় মেনে নেয়ার মত মেয়ে আমি নই।

রুহী থেমে থেমে বলল, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনার ক্ষতি হোক, আপনার প্রতি অন্যায় হোক এমন কোনো কিছু আমি কখনো ভাবিনি।

– তুমি হয়ত জানো না রুহী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় অন্যায়গুলো, বড় বড় পাপগুলো এভাবে না বুঝে করা হয়। কোনো অন্যায়কারী বলবে না যে, সে সব বুঝে শুনে অন্যায় করেছে। 

রুহী নরম গলায় বলল, আপনি একটু শান্ত হন প্লিজ। আপনি হয়ত জানেন না আর ক’দিন পর আমার বিয়ে।

দীপা বলল, জানি। তোমার বান্ধবী সুমি আমাকে জানিয়েছে। সে অনুরোধ করেছে, তোমাকে একটা সুযোগ দিতে। তবে আমি তোমাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি রুহী। তোমাকে দেখে আমার শুধু একটা কথায় বারবার মনে হচ্ছে, একটা মেয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়ের পুরো জীবন নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লাগতে পারে! আমার খুব ইচ্ছে করছে, যে ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে হবে তাকে সব জানিয়ে দিই। অন্তত সে জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বাঁচুক। তবে এই কাজটা আমি করব না। তোমার বিয়ের পর আশফাকের জীবন থেকে তুমি এমনিতেই সরে যাবে এমন ভাবনা থেকে আমি তোমার হবু স্বামীকে কিছু জানাচ্ছি না তা কিন্তু নয়। তোমাকে আমি একটা সুযোগ দিচ্ছি। ধরে নাও, এই মুহুর্তে তোমার বন্ধুর কথাটা আমি রাখছি।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইল। একটু পর দীপা বোধহয় কোনো জবাবের আশায় রুহীর দিকে তাকালো। তবে রুহী কোনো জবাব দিল না। সে একই ভাবে মাথা নীচু করে বসে রইল।

 

 

 

 

 

 

 

১২ম পর্ব

 

আশফাকের ঘুম ভাঙলো অনেক বেলাতে। চোখ মেলে দিনের কড়কড়ে হলুদ আলো শরীরে লাগতেই তার দিনক্ষন সব গুলিয়ে গেল। চোখটা আবার বন্ধ করে নিজেকে কিছুটা সময় ধাতস্থ করার পর আশফাকের গতকাল রাতের কথা সব মনে পড়ল। গতকাল হঠাৎ করে দীপা তার উপর চড়াও হয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য আশফাক বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে! কেন হচ্ছে! বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে দীপা তার উপর চড়াও হয়ে গেল কেন? তবে কয়েক মুহুর্ত পর দীপা যখন বলছিল, অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর সময় তার কেন একবারও দীপার কথা মনে পড়লো না তখন আশফাক বুঝতে পেরেছিল, দীপা কোনোভাবে রুহীর ব্যাপারটা টের পেয়ে গেছে এবং এরপররেই সে সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেছিল। 

অনেকটা প্রতিরক্ষার ভঙ্গিতে সে দীপাকে বলেছিল, তুমি রুহীকে চিনলে কী করে? আর তুমি ভুল ভাবছ দীপা। রুহী শুধু আমার ছাত্রী। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

কথাগুলো বলার পর আশফাক করুণ চোখে দীপার দিকে তাকিয়েছিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে যে কোনো পুরুষই নিজ স্ত্রীর করুণা ভিক্ষা চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দীপার পরের কথাটায় আশফাক বুঝতে পেরেছিল, বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। সে বোকার মত দীপার ফাঁদে পা দিয়েছে। দীপা অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতই আশফাককে কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু সে নিজেই রুহীর প্রসঙ্গ তুলে দীপার কাছে সব কিছু পরিষ্কার করে দিয়েছে।

দীপা রাগে অন্ধ হয়ে বলেছিল, এর মানে আমি এতক্ষন যা বলেছি তা-ই ঠিক? তোমার জীবনে আসলেই কোনো মেয়ে রয়েছে? আর সেই মেয়েটির নাম রুহী? সে তোমার ছাত্রী? 

স্বাভাবিক ভাবেই আশফাক চুপ করেছিল। একবার কোনো কথা বলে ফেললে সেটা আর ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই। তবুও সে তার ভুলটা শুধরে নেয়ার একটা শেষ চেষ্টা করেছিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেছিল, আরে না না। আমি তো বললাম তুমি ভুল ভাবছো। রুহী কেন কোনো মেয়ের সাথেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

দীপা বলেছিল, তাহলে তুমি রুহীর কথা কেন বললে?

আশফাক সেই মুহুর্তে দীপার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দীপা কয়েকটা মুহুর্ত আশফকের জবাবের অপেক্ষা করেছিল। তারপর আশফাকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একটু বাঁকা হেসে বলেছিল, তোমার জবাবের আমার প্রয়োজন নেই আশফাক। খুব ভালো মতই বুঝতে পারছি, আমি নিছক কোনো সন্দেহ করিনি। তুমি এখন যায়-ই বলো না কেন আমি আর তোমাকে বিশ্বাস করছি না। একটা কথা খুব ভালো মত জেনে রেখো আশফাক, ভালোবাসা হয়ত ফিরে পাওয়া যায় তবে বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।

আশফাক কাতর গলায় বলেছিল, দীপা প্লিজ। একটু শান্ত হও। এভাবে মাথা গরম করো না।

দীপা কঠিন গলায় বলেছিল, আমার মাথা ঠিক আছে আশফাক। তবে আমার ভয় হচ্ছে তোমার আর তোমার ছাত্রীর মাথা ঠিক আছে তো? বিশেষ করে তোমাদের শরীর ঠিক আছে তো? নাকি ইতিমধ্যেই গরম শরীরগুলো তোমরা ঠান্ডা করে ফেলেছ?

আশফাক চুপ করেছিল। সত্যি বলতে কী আশফাক সেই মুহুর্তে দীপাকে রীতিমত ভয় পাচ্ছিল। 

আশফাকের দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে দীপা বলেছিল, থাক তোমার কিছু বলার দরকার নেই। আমি সত্যটা জানতে চাচ্ছি না। কিছু সত্য না জানাটায় হয়ত আমাদের দুজনের পক্ষে ভালো হবে।

তারপর আর কথা থাকে না। কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। অবাক হলেও সত্য, এরপর থেকে দীপা তার সাথে ভীষণ শীতল আচরণ করছিল। অন্য সময় সামান্য একটু মান অভিমান হলেই দীপা তাদের বিছানা আলাদা করে দেয় অথচ কাল রাতে দীপা দিব্যি তার পাশে শুয়েছিল। দীপার থেকে মাত্র কিছু দুরত্বে শুয়ে আশফাক দীপার ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্না করার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। আশফাক কয়েকবার দীপাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল তবে লাভ হয়নি। তাতে দীপার কান্নার গতি এতটুকু কমেনি। অনেক রাত অবধি আশফাক নিজেও ঘুমাতে পারেনি। বিছানার এপাশ ওপাশ করেই রাত পার হয়ে গিয়েছিল। আশফাকের স্পষ্ট মনে আছে ফজরের আজান পর্যন্ত সে জেগে ছিল। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। সারা রাত জাগরনের ক্লান্তিতে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল।

 আশফাক ঘড়িতে দেখল দুপুর বারোটা বাজে। ভাগ্য ভালো আজ সকালে তার কোনো ক্লাস ছিল না। তবুও ক্লাস রুটিনটা আরেকবার চেক করার জন্য সে মোবাইলটা এদিক ওদিক খুঁজল। তার স্পষ্ট মনে আছে গতকাল রাতে শোবার সময় মোবাইলটা সে বালিশের পাশে রেখেছিল। তবে মোবাইল গেল কোথায়? মোবাইলটা কী দীপা সরিয়েছে? আশফাক ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলো। মোবাইলটা যদি দীপা সরিয়েও থাকে তাহলেও কোনো লাভ হবে না। মোবাইল পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা রয়েছে। এই পাসওয়ার্ড বের করার সাধ্য দীপার নেই।

আশফাক পুরো বাড়িতে দীপাকে খুঁজলো। দীপা কোথাও নেই। ল্যান্ডফোন দিয়ে সে দীপাকে ফোন করল। কয়েকবার রিং বেজে যাবার পরেও দীপা ফোন ধরল না। আশফাক দীপার বাবার বাড়িতে একটা ফোন করল। দীপা সেখানেও যায়নি। আশফাক বেশ অবাক হলো। রাগ করে সে বাবার বাড়িতে যেতে পারত। এটা দীপার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। এর আগে অসংখ্যবার এমন ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া এখন সেখানে বাবু রয়েছে। তবুও দীপা আজ বাবার বাড়িতে না যেয়ে অন্য কোথাও গিয়েছে। আশফাক দীপার যাওয়ার সম্ভাব্য জায়গাগুলো নিয়ে চিন্তা করলো। দীপার ছোটবেলার এক বান্ধবীর বাসা আছে মিরপুরে। আশফাক সেখানে ফোন করল। দীপা সেখানেও নেই। আরো কয়েকজন কাছের বন্ধুবান্ধবকে ফোন করার পর আশফাক বেশ চিন্তায় পড়লো। দীপা আর কোথায় যেতে পারে এই সম্পর্কে তার ধারনা নেই। হঠাৎ করে আশফাকের মাথায় একটা ভাবনার উদয় হলো। দীপা তার ক্যাম্পাসে যায়নি তো? কাল যেহেতু আশফাকের কাছে সে রুহী সম্পর্কে ধারনা পেয়েছে তাই দীপা হয়ত রুহীর সাথে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাস পর্যন্ত গিয়েছে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই আশফাক ভেতরে ভেতরে তীব্র আতঙ্কে জমে গেল। একমাত্র আল্লাহ জানেন দীপা এতক্ষণে ক্যাম্পাসে যেয়ে কী ঝামেলাটা বাধিয়েছে!

 দীপা তার ক্যাম্পাসে যেতে পারে এই বিষয়টা তার আরো আগে ভাবা উচিৎ ছিল। আশফাক আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো। সারে বারোটা বাজে। দীপাকে খুঁজতে তার অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। আশফাক আরেকবার ল্যান্ডফোন থেকে দীপাকে ফোন করল। মোবাইলে একটানা রিং বেজে গেলে। দীপা ফোন ধরল না। এদিকে রুহীর মোবাইল নাম্বার তার মুখস্থ নেই। এই যুগে কেউ কারো মোবাইল নাম্বার মুখস্থ করে রাখে না। মোবাইলে নাম্বার সেভ করে রাখে। তাই রুহীকে ফোন করে কিছু জানানোর সুযোগটুকুও আশফাক পেলো না।

আশফাক বেশ কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। এই মুহুর্তে তার মাথা কাজ করছে না। আজ দুপুর দুইটার পর তার তিনটা ক্লাস আছে। ক্লাসগুলো জরুরী। না নিলেই নয়। হালকা কিছু খেয়ে আশফাক ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। 

…………

দীপা চলে গেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হলো। রুহী একই ভাবে ক্যান্টিনে বসে রয়েছে। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। অথচ পানি খাবার মত ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটায় তার নেই। সুমি অনবরত ফোন করছে। একটু পর ক্লাস আছে। ক্লাসটা সম্ভবত আশফাক স্যারের। এই মুহুর্তে আশফাক স্যারের মুখোমুখি হবার সাহস তার নেই। দীপার বলা কথাগুলো বারবার তার কানে বাজছে। দীপার গলায় যতই কাঠিন্য থাকুক না কেন তার চোখে একটা হাহাকার মেশানো যন্ত্রনা ছিল। এই হাহাকারটুকু রুহীর ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের সামান্য কিছু ভালোলাগার অনুভুতির জন্য সে আজ একটা মেয়ের জীবন নিজের অজান্তেই নষ্ট করে দিয়েছে। যদি সত্যি সত্যি আশফাক আর দীপার সম্পর্কটা ভেঙে যায় তাহলে দীপা আর তাদের বাচ্চাটার কী হবে? আর এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে সে কি পারবে আশফাকের সাথে সুখি হতে? কিংবা আশফাক কি সত্যি তাকে মন থেকে মেনে নিবে? নাকি দীপা ছেড়ে গেছে বলে মেনে নিতে বাধ্য হবে? তাছাড়া বাবা মা! তারা যখন এতকিছু জানবেন তখন কী হবে? তারা কি এত কিছু জানার পরও তাকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করবেন? রুহী আর কিছুই ভাবতে পারলো না। দিপা তাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। সেই প্রশ্নের উত্তর সে তখন দিতে পারেনি। এখন সেই প্রশ্নটা নিজেকে নিজেই একবার করলো। সে কি আসলেই আশফাককে ভুলে থাকতে পারবে? আশফাকের সাথে চিরদিনের মত যোগাযোগ বন্ধ করে সজলের সাথে সংসার করা তার পক্ষে কি আদৌ সম্ভব হবে? রুহীকে বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। তার সামনে উত্তরটা আপনাআপনি চলে এলো। রুহী অবাক হয়ে দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আশফাক। 

 

 

 

 

 

 

১৩ম পর্ব

 

রুহী অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্তত এই মুহুর্তে ক্যান্টিনে সবার মাঝে আশফাক স্যারকে সে আশা করেনি। তাছাড়া স্যারের এখন ক্লাস থাকার কথা। রুহী ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, তবে স্যার কি ক্লাস না নিয়ে তার খোঁজে ক্যান্টিন পর্যন্ত এসেছেন?

 আশফাক স্যারের কথায় রুহীর ভুল ভাঙলো। আশফাক স্যার চিন্তিত গলায় বলল, দীপা কোথায়? সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ফোন করলেও ফোন ধরছে না। আমার দীপার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। 

রুহী ফ্যালফ্যাল করে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। দীপা আশফাকের স্ত্রী। দীপার জন্যে তার চিন্তা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই মুহুর্তে আশফাকের চিন্তার কিছু অংশ বোধহয় রুহীরও পাওনা ছিল। রুহী আশফাকের কথার কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

আশফাক আবারো বলল, দীপা কি এসেছিল? তোমার সাথে তার দেখা হয়েছে?

আশফাকের কথার সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে রুহী বলল, আপনি কীভাবে জানলেন আমি এখানে?

– তোমার বান্ধবী সুমী বলল। তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল, দীপা ক্যাম্পাসে এলে সবার প্রথমে ক্যান্টিনে আসবে।

স্বাভাবিকভাবেই এত কোলাহলের মাঝে তারা দুজন নিজেদের মধ্যে ঠিক মত কথা বলতে পারছিল না। ক্যান্টিনে ছাত্র, শিক্ষক সহ অনেকেই আছে। এদের মাঝে কেউ কেউ আবার তাদের দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে। আশফাক চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে  বিরক্ত গলায় বলল, তুমি আর এখানে থেকো না। বাসায় চলে যাও। আমি তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করব।

রুহী আশফাকের চোখে চোখ রেখে বলল, পালিয়ে যেতে বলছেন?  

– না তা কেন! দেখছো তো সবাই আমাদের দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে। এভাবে কি কথা বলা যায়? তাছাড়া দীপাকে আগে খুঁজে বের করা দরকার। রাগের মাথায় সে কী করে বসে কে জানে! এদিকে আমার ফোনটাও খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ধারনা ফোনটা দীপার কাছে। তুমি আপাতত আমার সাথে যোগাযোগ করো না। আমি সময় সুযোগ পেলে তোমার সাথে যোগাযোগ করব।

কথাগুলো বলার পর আশফাক আর ক্যান্টিনে দাঁড়ালো না। যেভাবে ঝড়ের মত এসেছিল সেভাবে বেরিয়ে গেল। রুহী আবারো বসে পড়লো। আজ আর সে কোনো ক্লাস করবে না। মাথাটা একেবারে জট পেকে গেছে। অদ্ভুৎ ভাবে আজ সে আশফাকের চোখে নিজের ছায়া দেখতে পেলো না। অথচ এই ক’দিনে আশফাকের চোখে নিজের বসবাস দেখতে পাওয়াটা রুহীর কাছে অন্যতম সুখের কারন ছিল। 

রুহীকে বেশিক্ষণ একা একা বসে থাকতে হলো না। আশফাক চলে যাওয়ার একটু পরেই সুমি ক্যান্টিনে এলো। নরম গলায় বলল, বাসায় যাবি না? চল বাসায় চলে যাই। আজ আমিও তোর সাথে তোদের ওখানে যাব। একটু আগে বাসায় ফোন করে জানিয়েছি। আজ আমি তোর সাথে রাতে থাকব।

রুহী বলল, দরকার নেই তোর এত ঝামেলা করার। আমি ঠিক আছি।

– বললেই হবে তুই ঠিক আছিস। আমি তোকে চিনি না! বুঝতেই পারছি তোর মন ভেঙে একাকার হয়ে গেছে।

– মন ভাঙার মত কিছু ঘটে নাই সুমী। সব কিছু ঠিক আছে।

– মানে! তুই কি ভাবছিস আশফাক স্যার তোর সাথে এখনো যোগযোগ রাখবে? আর যদি যোগাযোগ রাখেও তোর নিজেরই উচিৎ উনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। 

রুহী অসহায় গলায় বলল, আমাকে আজকের দিনটা একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দে সুমী। আমার মাথা কাজ করছে না।

– ঠান্ডা মাথায় ভাবার আগে তোর জেনে রাখা দরকার, তাদের স্বামী স্ত্রীর কিন্তু একটু আগেই দেখা হয়েছে। দেখলাম তারা দুজনেই বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠল যেন তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই।

সুমীর কথাগুলো শুনে রুহী অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।

সুমী আবারো বলল, এত অবাক হবার কিছু নেই রুহী। পৃথিবীর কোনো মানুষই নিজের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের পতন ঘটুক তা চাইবে না। ঠিক তেমনভাবে নিজের অধিকারটুকুও কেউ সহজে হাতছাড়া করতে চাইবে না। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু অদ্ভুৎ ইচ্ছে থাকে, যা হয়ত অন্যের সামনে প্রকাশ করা অসম্ভব। সেই ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করার জন্য কিছুটা রিস্ক হয়ত নেয়া যায় তাই বলে সেই ইচ্ছে পূরনের জন্য নিজের জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাক সেটা কোনো মানুষই চাইবে না। 

রুহী অবাক হয়ে বলল, তুই মানুষের মনের খবর এত জানিস কীভাবে?

সুমী করুন হেসে বলল, ভুলে যাচ্ছিস কেন আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার বাবা মার ডিভোর্স হয়েছে। আমি দেখেছি একটা অবৈধ সম্পর্কের কারনে  কীভাবে অনেকগুলো জীবন নষ্ট হয়, কীভাবে সুন্দর একটা সংসারের, নিত্য দিনের অভ্যাসগুলোর ছন্দপতন ঘটে। রুহী বিশ্বাস কর, এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমি আমার স্টেপ মাকে অভিসম্পাত করি না, এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমার নিজের মা সেই মহিলার কারনে চোখের পানি ফেলেন না। আর যদি বাবার কথা জিজ্ঞেস করিস তাহলে বলব আমার বাবাও নাকি সেই মহিলার সাথে ভালো নেই। বিয়ের এত বছর পরেও তাদের এখনো সন্তান হয়নি। শুনেছি বাবা নাকি দ্বিতীয় পক্ষের ঘরে সন্তান নিতে আগ্রহী নয়। কারন আমাদের দুই ভাই বোনের পড়ালেখার যাবতীয় খরচ বাবাকেই বহন করতে হয়। তাই বাবা হয়ত চাননি ওই পক্ষের কোনো সন্তান আসুক। সুতরাং বুঝতেই পারছিস, ওই মহিলা মনে কত কষ্ট নিয়ে আমার বাবার সাথে সংসার করছে। এসব দেখে আমার কখনো কখনো মনে হয়, আমার মা-ই হয়ত ওই মহিলার কাছে হেরে যাওয়ার পরেও জিতে গেছে।

…………….

দেখতে দেখতে পনের দিন পার হয়ে গেলো। এরমাঝে আশফাক স্যারের সাথে রুহীর কোনোরকম যোগাযোগ  হলো না। রুহী খুব স্বাভাবিক ভাবে ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। রুটিন অনুযায়ী আশফাক স্যারের সাথে তাদের যে  ক্লাসগুলো ছিল সেই ক্লাসগুলো অন্য একজন স্যার নিচ্ছেন। রুহী শুনেছে, আশফাক স্যার নাকি মাস খানেকের ছুটি নিয়েছেন। এদিকে সুমীও সেদিনের পর আর রুহীর সাথে আশফাক স্যারের বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। এসবের মাঝে রুহীর বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আর মাত্র আটাশ দিন পর রুহীর বিয়ে। গত সপ্তাহে সে সজলের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে বিয়ের শপিং করেছে। শপিং এর পর ডিনার শেষে বাড়ি ফেরার পথে সজল যখন ওর গালে একটা চুমু খেয়েছে তখনও সে বেশ স্বাভাবিক আচরন করেছে। রুহীকে স্বাভাবিক থাকতে দেখে সজলের সাহস আরো এক ধাপ বেড়েছে। আজ সকালে সে রুহীর শরীরের প্রাইভেট পার্টসে হাত দিয়েছে। রুহী এরপরেও কোনো রিয়াক্ট করেনি। আজ ক্লাস শেষ হবার পর সজলের তার ক্যাম্পাসে আসার কথা। রুহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক’মাস আগেও তার জীবনটা অনেক সহজ আর সুন্দর ছিল। এ ক’দিনেই কীভাবে যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সেদিন সুমী যে কথাগুলো তাকে বলেছিল তা যদি সত্য হয় তাহলে রুহী হয়ত আশফাক স্যারের জীবনের অদ্ভুৎ সেই ইচ্ছে ছিল যার জন্য সে নিজের জীবনের এতটুকু ছন্দপতন ঘটাতে রাজি নয়। তবে রুহী খুব ভালোমত জানে আশফাক স্যার তার জীবনের অদ্ভুৎ কোনো ইচ্ছে ছিল না। বরং তার জীবনে আশফাক স্যারের জায়গা ছিল এক টুকরো খোলা আকাশের মত, সতেজ মিষ্টি বিকেলের নরম হাওয়ায়র মত, ভেজা ঘাসের উপর দুলতে থাকা নরম শিশির কনার মত , এক চিলতে রৌদের মত…..

 রুহী ঝরঝর করে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলল। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা এসব ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়? একজন মানুষের পক্ষে কি আদৌ এগুলো ছাড়া বাঁচা সম্ভব? স্বাভাবিকভাবেই রুহী কোনো জবাব পেল না। নিজের প্রশ্নগুলো তাই উত্তরের পরিবর্তে শুধুই প্রতিধ্বনি হয়ে নিজের কাছে ফিরে এলো।

 

 

 

 

 

 

শেষ পর্ব

 

বাচ্চা একটি মেয়ের হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। বাইরে প্রচন্ড রৌদ। এই রৌদের মধ্যে বাচ্চা মেয়েটি পথচারীদের কাছে গোলাপগুলো বিক্রি করার প্রাণপন চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউই তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই সময় আসলে কারো মধ্যে ফুল কেনার তাড়া থাকার কথা নয়। এখন বাজে সকাল দশটা। সবার এখন অফিসে কিংবা নিজ নিজ কাজে পৌঁছানোর তাড়া রয়েছে। কার এখন সময় আছে ফুল কেনার। রুহী এতক্ষন একটা ছিমছাম রেঁস্তোরার ভেতর থেকে মেয়েটাকে দেখছিল। একটু পর রুহী রেঁস্তোরা থেকে বের হলো। বাচ্চা মেয়েটার জন্য তার খারাপ লাগছে। ফুলগুলো সে নিজেই নাহয় কিনে নিবে মেয়েটির কাছ থেকে। রুহী ফুলগুলো কিনে নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরল। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে তবুও মানুষটার কোনো দেখা নেই। অথচ এই মানুষটি তাকে গত কাল রাতে ফোন করে এখানে আসতে বলেছেন।

 রুহী তার হাতে ধরা ফুলের তোড়াটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ফুলের তোড়াটা এখানে রাখার কোনো মানে হয় না। একটু পর যে আসবে সে হয়ত ভেবে বসবে তোড়াটি রুহী তার জন্য কিনেছে। রুহী ভাবলো ফুলের তোড়াটি সে কোথাও সরিয়ে ফেলবে। তবে রুহী ফুলগুলো সরিয়ে ফেলার আগেই আশফাক স্যার তার সামনে চলে এলো। রুহী এক গুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে নিয়ে আশফাক স্যারের মুখোমুখি বসে রইল। 

অনেকক্ষন কেউ কোনো কথা বলল না। রুহী কয়েক বার উসখুস করল। একটা সময় ওয়েটারকে ডেকে দুই কাপ কফির অর্ডার করল। তবুও আশফাক স্যার চুপচাপ একই ভাবে বসে রইলো। এই ক’দিনে সে অনেক খানি শুকিয়ে গেছে যার কারনে তার লম্বা শরীরটাকে আরো লম্বা লাগছে। কিছুটা সময় পার হবার পর রুহী নরম গলায় বলল, কেমন আছেন?

রুহীর মনে হলো আশফাক স্যার যেন কিছুটা বাধ্য হয়ে তার কথার উত্তর দিল। খুব সংক্ষেপে বলল, ভালো।

রুহী আবার বলল, আপনি আমায় ডেকেছিলেন। কিছু বলবেন?

অনেকক্ষন কোনো কথা নেই। রুহীর কোনো কথা যেন মানুষটির কানে যেয়ে পৌঁছেনি। রুহী খুব অবাক হলো। এই ক’দিনে মানুষটা অনেকখানি বদলে গেছে। শরীরে, চেহারায় হয়ত মনেও। 

রুহীর ভাবনার মাঝে আশফাক স্যার বলে উঠল, আমি কাল চলে যাচ্ছি রুহী।

রুহী একটু হেসে বলল, আপনি তো অনেক আগেই চলে গিয়েছেন। এ আর নতুন কী!

– কাল আমি একেবারেই চলে যাচ্ছি।

রুহী একটুও অবাক না হয়ে বলল, আপনার কাছে যেমন আমার বিয়ে ভেঙে যাবার খবরটা কোনো না কোনো ভাবে পৌঁছে গেছে ঠিক তেমন আপনার একেবারে চলে যাবার খবরটাও আমার কাছে কোনো না কোনো ভাবে পৌঁছে গেছে। 

 মানুষটা কাতর কন্ঠে বলল, কেন তুমি এমন করলে রুহী! সজলের সাথে বিয়েটা তুমি কেন এভাবে ভেঙে দিলে?

রুহী খুব শান্ত গলায় উত্তর দিল, দেখুন সজলকে আমার প্রথম থেকেই ভালো লাগত না। সে ভীষণ ভাবে শরীর সর্বস্ব একজন মানুষ। কিন্তু এটা হয়ত সজলের সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে দেয়ার মূল কারন নয়। ভালোবাসা বা কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে শরীর ব্যাপারটা থাকবে সেটা আর নতুন কী!

– তবে? কেন এমন করলে রুহী? কেন তুমি আমাকে এভাবে অপরাধী বানালে?

রুহী একটু অবাক হয়ে বলল, আপনাকে অপরাধী বানাইনি তো! সজলের সাথে আমি সম্পর্কটা ভেঙেছি কারন আমার মনে হয়েছে সজলকে আমি ঠকিয়েছি। সজলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবার পর আপনার সাথে আমার একটা সম্পর্ক হয়েছিল। যদিও আপনার সাথে সম্পর্কটা আমার ভেঙে গেছে এবং সজল এই ব্যাপারে কিছুই জানত না তবুও আমার মনে হয়েছে সজলকে বিয়ে করলে আমার সারাজীবন ওর সাথে চোরের মত সংসার করতে হত। সবসময় সজলের কাছে ধরা পড়ে যাবার একটা ভয় আমাকে কুরে কুরে খেত। সেটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই ভাবলাম এভাবে ছোট হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা আমার জন্য বেশী সম্মানের।

– আমার উপর তোমার অনেক রাগ, তাই না?

– রাগ হবে কেন। তাছাড়া রাগ হলে তো নিজের উপর রাগ হওয়া উচিৎ, তাই না? কারন আমি সব জানতাম। আপনি তো আমার কাছে কিছু লুকোননি। বারবার আমাকে বলেছেন, আপনার পক্ষে নিজ সন্তান, স্ত্রীকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। 

আশফাক স্যার কিছু বলল না। রুহী যে কথাগুলো বলল সেই কথাগুলো হয়ত ঠিক। তবুও সে খুব ভালো মত জানে, রুহীর এই কথাগুলোর মধ্যে চরম একটা ফাঁক রয়েছে। তাদের সম্পর্কটা নিয়ে দীপার সব কিছু জানার পরেও হয়ত এই ফাঁকটা অনেকভাবে পূরণ করা যেত। অন্তত সেই সময় রুহীর পাশে দাঁড়ানো যেত। কিন্তু সে তা করেনি। নিজের গোছানো সংসারটাকে কোনোভাবেই ছাড়বে না এই অজুহাতে সে রুহীর কাছ থেকে কাপুরুষের মত পালিয়ে বেরিয়েছে। অশান্তি এড়ানোর জন্য দীপার কথা মত ক্যাম্পাস থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছে। পরবর্তীতে আরো দুই মাস সেই ছুটি এক্সটেনশন করিয়েছে। আবার দীপার চাপেই এখন দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে। 

রুহী আবার বলল, আপনার উপর যেমন আমার কোনো রাগ নেই ঠিক তেমন আমার নিজের উপরেও  আমার কোনো রাগ নেই। সজলের সাথে বিয়েটা ভেঙে দেয়ার পর নিজেকে বারবার বুঝিয়েছি, একটা ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে যেমন ভুল করেছিলাম ঠিক তেমন একটা ভুল সম্পর্ককে ভেঙে দিয়েও সঠিক কাজটা করেছি। আপনি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর আমি যদি বাবা মার কথা মত সজলকে বিয়ে করতাম তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি আমার নিজের এই সিদ্ধান্তের কারনে একসময় আমার নিজের উপর ভীষণ রাগ হত। বিশ্বাস করুন, আমি এই মুহুর্তে ভীষণ ভারমুক্ত একটা জীবন যাপন করছি। বাবা-মা হয়ত আমার উপর এখন অভিমান করে রয়েছেন তবে আমি জানি সময়ের সাথে সাথে একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আশফাক স্যার অসহায় গলায় বলল, তোমার সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না রুহী। আমাদের আর কোনোদিন একসাথে বসে পুরোনো সেই দিনগুলোর মত চাঁদ দেখা হবে না, বর্ষা নিয়ে গল্প হবে না, গরম চায়ের কাপে ডুবিয়ে গরম গরম ডালপুরি খাওয়া হবে না। অন্তত একই শহরে থাকলে দেখা হবার একটা সুযোগ হয়ত থাকত। হয়ত কোনো রেঁস্তোরা, হয়ত কোনো শপিং মলে কিংবা কোনো রাস্তায় দুজন মুখোমুখি হয়ে যেতাম। হয়ত কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলতাম না, তবুও চোখের উপর হয়ত চোখ পড়ত সেটাই বা কম কী!

রুহী একটু হেসে বলল, আমি জানি না আপনি ঠিক কী কারনে আমার সাথে আজ দেখা করতে এসেছেন। আমার ধারনা কাল আপনাদের ফ্লাইট বলে দীপা ম্যাম গোছগাছ নিয়ে অনেক ব্যস্ত। আপনিও হয়ত কোনো কাজের অজুহাত দেখিয়ে বের হয়েছেন। আমার সাথে দেখা করার জন্য আজকের দিনটা আপনার কাছে ভীষন নিরাপদ ঠিক যেমন নিরাপদ ছিল আপনার কাছে আমাদের নাম না জানা সেই সম্পর্কটি। তাই আপনি খুব ভালো মত জেনে রাখুন, আপনি এই শহরে থাকলে এমনকি আমার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হলেও আমার আর কিছু যেত আসতো না। যেখানে ভালোবাসাটায় মরে গেছে সেখানে এই ধরণের আবেগের কোনো মূল্য আমার কাছে নেই। 

– এখন আমার উপর সব দোষ চাপিয়ে দিতে চাইছো রুহী। প্রমাণ করতে চাইছো আমি তোমাকে ব্যবহার করেছি। তোমার আর আমার এই সম্পর্কের সব দায় আমার ছিল। তোমার কিছুই ছিল না। 

রুহী একটু হেসে বলল, আমি কিছুই প্রমান করতে চাইছি না। শুধু বলতে চাইছি আমি আপনার জীবনে শুধু মাত্র একটা “সেফ গেম” ছিলাম অনেকটা ছোটবেলায় স্কুল পালিয়ে সেই ভিডিও গেম খেলার মত। যা নিয়ে খেলতে খুব মজা তবে যেই না বাবা মা জানলো ওমনি লক্ষ্মী ছেলের মত সব খেলা ভুলে একেবারে পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম। রুহী একটু চুপ করে থেকে আবারো বলল, তবে বিশ্বাস করুন আপনি যা করেছেন খুব ঠিক করেছেন। ভাগ্যিস আমার সাথে আপনি এতদিন যোগাযোগ করেননি। তা না হলে আমি হয়ত খুব বড় একটা ভুল করে বসতাম। 

এরপর আর কথা চলে না। আশফাক স্যার চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। যাবার মুহুর্তে রুহীর হাতে ধরা ফুলগুলোকে দেখিয়ে বলল, ফুলগুলো কার জন্য। নিশ্চয় আমার জন্য নয়। 

রুহী শক্ত গলায় বলল, ঠিক ধরেছেন। ফুলগুলো আপনার জন্য নয়। আমার নিজের জন্য।

আশফাক স্যার একটু আগে চলে গেছেন। রুহী একই ভাবে রেঁস্তোরায় বসে রইল। আজ তার জীবনে নতুন একটা দিনের সূচনা হলো। ভুল শোধরানোর সুযোগ সবাই পায় না। প্রকৃতি সবার উপর এত খানি সদয় আচরন করে না। রুহী দৃপ্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালো। সামনে অনেক পথ বাকি। সে খুব ভালোমতই জানে সামনের পথগুলোও নিশ্চয় মসৃণ হবে না। তবে কাঁটাযুক্ত বন্ধুর পথে কীভাবে চলতে হয় সেই শিক্ষা রুহী এই ক’দিনে খুব ভালোমতই পেয়েছে। আসলে জীবনে কোনো কিছুই বৃথা যায় না। আশফাক স্যারের সাথে তার সম্পর্কটাও তাই বৃথা যায়নি। এই সম্পর্কটা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। রুহী আপন মনে হেসে ফেলল। এই হাসিটা অতীতের সব ভুলগুলো মুছে ফেলার আনন্দে নাকি অতীতের করা ভুলগুলোর কারনে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কোমল কোনো অনুভুতির জন্য তা অবশ্য বোঝা গেল না! 

“সমাপ্ত”

“আগুন ঝরার দিনে”র পাশে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। কেমন লাগলো প্লিজ মন্তব্য করে জানাবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।