আমার স্বপ্ন সুখের আঙিনা

 

(ছোটগল্প)

 

সুমাইয়া মীম

 

‘আম্মুউউউ…!’

 

হুট করে আমার এমন চিল্লানি শুনে আমার শাশুড়ী আম্মু হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ছুটে এলেন। এসেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে বউমা..? শরীর খারাপ লাগছে..? আমি এই জন্য তোমাকে বারবার নিষেধ করেছিলাম যে এই শরীর নিয়ে রান্নাঘরে এসো না। কিন্তু তুমি কি আর আমার কথা শোনার পাত্রী! আজ খোকা ঘরে আসুক, আচ্ছামতো একটা বকা খাইয়ে দিবো তোমাকে। এরপর দেখবো রান্নাঘরে কীভাবে আসো।”

 

শাশুড়ী আম্মু একনাগাড়ে কথাগুলো বলে তবেই থামলেন। আমি কিছু মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম! কি জন্য ডেকেছিলাম সেটাই ভুলে ভুলে গেলাম। এরপর শাশুড়ী আম্মুর হাতের উল্টো পিঠে একটা চুমু খেয়ে মিষ্টি হেসে বললাম, ‘আম্মু, আপনি শুধু শুধুই অস্থির হচ্ছেন। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না, আলহামদুলিল্লাহ আমি একদম ঠিক আছি।’

 

‘তাহলে এভাবে ডাক দিলে যে?’

 

 

 

‘ইয়ে না মানে আম্মু, আসলে খিচুড়ির চিনিটা ঠিক হয়েছে কি না সেটা দেখানোর জন্য ডেকেছিলাম আরকি।’

 

আমার শাশুড়ী এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন উনার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা শুনেছে। ‘কী বললে তুমি? খিচুড়ির চিনি? হায় হায় খোকা, দেখ মেয়ের কান্ড। লবণের জায়গায় চিনি দিয়ে ফেলেছো?’

 

“আরে না না আম্মু, এটা চিনিরই খিচুড়ি, যাকে বলে ওনটান খিচুড়ি। জামিলের থেকে শিখেছি।’ ‘আস্তাগফিরুল্লাহ বউ মা। এই জামিল আবার কে? তোমার কোন ছেলেবন্ধু ছিল আগে জানতাম না তো।’ “ইন্না লিল্লাহ আম্মু! জামিল আমার বন্ধু হতে

 

যাবে কেন?”

 

‘তাহলে কে..?’

 

‘আম্মু আপনাকে আমি ‘আঁধার মানবী’ বইটা পড়তে দিয়েছিলাম না, পুরোটা পড়েছিলেন?’ “না গো! তোমার শশুড় বলেছেন বইটা উনাকেও পড়ে শুনাতে। প্রতি রাতে দুই পৃষ্ঠা করে আমি পড়ি আর উনি শুনেন। তাই এখনো শেষ করতে পারিনি।’

 

‘ওই বইয়ের মূল চরিত্র জামিল আছে না? ওকে ওর বড় বোন এই ওনটান খিচুড়ির রেসিপি • শিখিয়েছে। সেটা ও একদিন বন্ধু মামুনকে নিয়ে বানিয়ে খেয়েছিল। সেখানেই রেসেপির সব জিনিসপাতির কথা লেখা ছিল। তাই আরকি আমি ওটা দেখে দেখে চেষ্টা করলাম।’ আম্মু কতক্ষন আমার দিকে অবাক নয়নে চেয়ে রইল! এরপর হেসে মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘পাগলী মেয়ে! খিচুড়িতে চিনি দিয়েছে তার মানে এই না যে লবণ না দিয়ে শুধু চিনিই দিয়েছে। আসো আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।’ এরপর আম্মু আমার পাশে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ খিচুড়ি রান্না করলেন, আর আমি দেখে শিখে নিলাম। আল্লাহ ভালো জানেন এটার কেমন টেস্ট হবে!

 

“আম্মু, এটা আগে আপনার ছেলেকে

 

খাওয়াবো!’

 

‘কেন? খেতে তো মন চেয়েছে তোমার।’ * না মানে আম্মু উনি আগে খেয়ে বলুক কেমন

 

হয়েছে। ভালো হলেও উনি আগে খাবে আর

 

 

খারাপ হলেও!’ এই বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলাম ।

 

আম্মু হঠাৎই কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে আমার

 

দিকে চেয়ে বললেন, ‘যাহরা! আজ শুক্রবার

 

মনে আছে?? ‘জি আম্মু!’

 

‘আজ কি করতে হবে?’ ‘সুরা কাহাফ পড়তে হবে।’

 

‘যাও গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে আসো। খোকা আর তোমার শশুড় একদম নামাজ পরেই বাড়ি আসবে।”

 

আমি মুচকি হেসে ধীরে ধীরে আমার ঘরে এসে গোসল করতে ঢুকলাম। গোসল শেষে চুল মুছতে মুছতে হঠাৎই আয়নায় চোখ পড়ল আমার। পেটটা বেশ উঁচু হয়েছে আগের থেকে এই তো আর এক মাস, এরপরেই পৃথিবীর আলো দেখবে আমাদের ছোট্ট সোনামনিরা! আম্মুর ডাক পড়ায় যথাসম্ভব দ্রুত আম্মুর ঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি আম্মু দুটো রেহালের উপর দুটো কুরআন শরীফ নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই মুচকি হেসে বললেন, ‘আসো, আজকে কুরআন শরীফটাই আগে পড়ো। এরপর নামাজ পড়ে নিবো একসাথে।’ কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে, নামাজ পড়ে আম্মুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি আর আম্মু মাথায় বিলি দিতে দিতে উনার গর্ভবতী অবস্থার গল্প শুনাচ্ছিলেন। বউ শাশুড়ীর এই সুন্দর মুহূর্ত একদম সহ্য হলো না আমার স্বামী নামক মহাপুরুষটির। এসেই নাক-মুখ ফুলিয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ আম্মু! সব ভালোবাসা শুধু যাহরাই পাবে? তোমার খোকার কি হবে?’

 

আমি ভেংচি দিয়ে বললাম, “কেন কেন? সেই জন্মের পর থেকেই তো ভালোবাসা আদর সব আপনি একাই পেয়েছেন। আমি পেয়েছিলাম

 

তখন?’

 

‘তখন তোমার জন্ম হয়েছিল বুঝি? উনি হালকা রসিকতার সূরে কথাটা বলে উঠলেন। আর আমি হালকা অভিমানের সূরে আম্মুকে

 

বললাম, ‘দেখছেন আম্মু! উনি এইভাবেই আমাকে শুধু হিংসা করে। আম্মু আমাদের দু’জনের কাহিনী দেখে হাসতে

 

লাগলেন। এরপর উনার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আয়, বউমার পাশে শুয়ে পড়। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।’ উনি যেন এই কথার অপেক্ষাতেই ছিলেন। টুস করে আমার পাশে আম্মুর কোলে শুয়ে পড়লেন

 

***

 

‘শুনেন! এই যে এই রেসিপিটা, একদম স্পেশাল আপনার জন্য তৈরি করা হয়েছে, বুঝেছেন

 

উনি আমার কথা শুনে সন্দিহান চোখে আমার আর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বউ-শাশুড়ী মিলে কি আবার আমাদের এই বাপ-বেটা দুই অসহায় পুরুষকে জব্দ করার কোন নতুন পদ্ধতি বের করেছো?” আম্মু মুখ টিপে হেসে উঠলেন। আর আমি হাসি চাপতে না পেরে একদম খিলখিল করেই হেসে উঠলাম। আমাদের হাসি দেখেই কোন ঘাপলা আছে বুঝতে পেরে আব্বু চুপ করে নিজে প্লেট হাতে নিয়েই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। আর উনি পড়েছেন চিপায়, যেই সেই চিপা না একদম মাইনকা চিপায় পড়েছেন। ‘ওসমান! খেয়েই দেখ না বাবা। বউমা আর আমি দুজনে মিলে রান্না করেছি। মজাই হয়েছে!’ *এতই যখন মজা হয়েছে তখন এভাবে কিটকিটিয়ে হাসলে কেন দু’জন হুঁ?’ এভাবে অনেক কথাবার্তার মাঝ দিয়ে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলো। ওনটান খিচুড়িটা আসলেই দারুণ ছিল। উনি তো খিচুড়ির থালা চেটেপুটে খেয়েছেন। উনার এই কান্ড দেখে আমার আর আম্মুর হাসতে হাসতে প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। মানুষটা প্রথমে খেতেই চায়নি আর এখন দেখো কি একটা অবস্থা। শেষ মুহূর্তে আব্বু ঘর থেকে বের হয়ে প্রচন্ড আফসোস করলেন এতো সুন্দর খিচুড়ি মিস করেছেন বলে

 

‘হয়েছে হয়েছে আরও ঘরে গিয়ে বসে থাকেন, তাহলে খিচুড়ি পাবেন।’ আম্মু হঠাৎই আব্বুকে ব্যঙ্গ করে কথাটুকু বললেন। আব্বু করুণ মুখ করে বললেন, ‘দেখেছো বউমা! তোমার শাশুড়ী বিয়ের এতো বছর

 

পরেও আমার পিছু ছাড়ল না। সুযোগ পেলেই খোঁচা একটা মেরেই দেয়।’ আমিও যেন আব্বুর এই কথায় একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। তাই হালকা অভিমানী মুখশ্রী নিয়ে বললাম, ‘আম্মু তো ঠিকই বলেছেন আব্বু । আপনি আর উনি আমার আর আম্মুর নতুন কোন রেসিপিকে সহজভাবে নিতে পারেন না। অদ্ভুত আর অখাদ্য ভেবে খেতে চান না। আজ তো ভাতের থালা নিয়ে উঠেই গেলেন। এই জন্যই মিস করে গেলেন। তবে পরেরবার ইনশাআল্লাহ আর মিস হবে না, সবার আগে আপনার পাতেই পড়বে ওনটান খিচুড়ি!”

 

দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে এলো যেন। আর মাত্র এক সপ্তাহ, এরপরেই আমার ডেলিভারি ডেট। প্র্যাগনেন্সির এই সময়টুকু আমার হজরতের থেকেও শাশুড়ী আম্মুর ভালোবাসা এবং কেয়ার বেশি ছিল। প্রতিটা মুহূর্ত আম্মু * আমার পাশে ছিলেন। এই সময়ের যত আমল আছে সব করিয়েছেন আমাকে দিয়ে। মানুষটা অনেক অমায়িক। প্রথম যখন এ বাড়িতে আসি মনেই হয়নি এটা পরের বাড়ি। মনে হয়েছে আমারই বাড়ি। আলহামদুলিল্লাহ কখনো কোন কিছু নিয়ে সংকোচ ছিল না।

 

কিন্তু এক সপ্তাহের এই সময়টুকুতে আমি বিপদে পড়ে গেলাম। আমার আম্মু চাচ্ছেন প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতেই হবে। আর শাশুড়ী আম্মু .. নাছোড়বান্দা, উনি উনার আদরের বউমাকে যেতে দিবেন না বাবার বাড়ি। একদিকে আম্মুর জন্যও মন কেমন করে আবার শাশুড়ী আম্মুকেও না করতে পারছি না। আমি প্রচন্ড দোটানায় পড়ে গেলাম। আমার এই দোটানার খুব সুন্দর একটি সমাধান দিলেন উনি। ওইদিনই বাসায় গিয়ে ভাইয়াসহ আম্মুকে এই বাসায় নিয়ে এলেন। আর বললেন, যতদিন মনে চায় আপনি এখানে থাকবেন মা! যত যাই হোক মেয়েটা তো আপনার। যদিও আপনাদের বাসাতে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আম্মুও যাহরার · জন্য পাগল! ওকে এতদিন দেখে রেখেছে শেষ সময়টুকুও ওর পাশে কতে চায়। আশা করি আপনার আপত্তি নেই কোন

 

আম্মুও সেদিন হেসে গর্ব করেছিলেন, তার মেয়েজামাই নিয়ে। আমার মনেও তার জন্য শ্রদ্ধা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেল।

 

আম্মু আর শাশুড়ী আম্মু দুজনে মিলে চুলে বেণী করে দিচ্ছে। আম্মু ডান পাশেরটা আর শাশুড়ী আম্মু বাম পাশেরটা। আজকে হাসপাতালে যাবো, সন্ধ্যাতেই হয়তো নরমাল ডেলিভারি হবে। তাই উনারা দুই বেয়াইন মিলে মাথায় তেল দিয়ে দুই বেণী করে দিচ্ছে যেন আমার শুতে কোন অসুবিধে না হয়। এরপর শাশুড়ী আম্মু কি কি যেন দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন আর কপালে একটা চুমু খেলেন। আম্মুও দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে একটা চুমু খেল। আমি দুইজনকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম কতক্ষন। আমার দুইজন আম্মু!

 

“আম্মু গাড়ি চলে এসেছে যাহরাকে নিয়ে বের হয়ে আসেন আপনারা ।’ হঠাৎ উনার ডাকে ফিরে তাকালাম। মানুষটার মুখ কেমন মলিন হয়ে আছে। এরপরেও মুখে রয়েছে মিষ্টি এক হাসি। উনাকে দেখেই আম্মু আর শাশুড়ী আম্মু ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। উনি আমার কাছে এসে বসলেন। আমি উনার দুইহাত আমার হাতে মুঠোবন্দি করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাকে এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? আজ আপনার দুই দুইজন সোনামণি আসরে, আপনার তো খুশি হওয়ার কথা।”

 

উনি আমার হাতের মুঠোয় চুমু খেয়ে বললেন, ‘তুমি বুঝবে না আমি কেন মলিন হয়ে আছি। এ বুঝ তোমার হলে প্রশ্ন করতে না যাহরা।’ আমি উনার হাতে আলতো চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘শুধু শুধু বেহুদা চিন্তা করছেন। আপনারা সবাই আমার জন্য এতো দোয়া করেছেন যে আমার কিচ্ছু হবে না ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ ভরসা।’ এরপরে উনার হাত ধরেই গাড়িতে উঠে গেলাম। সারাটা রাস্তা উনি কি কি যেন দোয়া পড়ে আমাকে শুধু ফুঁ দিয়েছেন। মানুষটার মনে বড্ড ভয় আমাকে নিয়ে। ***

 

দীর্ঘক্ষণ পর বাবুদের কান্নার আওয়াজ শুনতেই আমার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। আমি আধো আধো চোখে তাকিয়ে দেখলাম উনি চোখে অশ্রু আর মুখে হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, উনার কোলে আমার মেয়ে। আর আমার আরেকপাশে শাশুড়ী আম্মু দাঁড়িয়ে আছেন আমার ছেলেকে। নিয়ে। দুইজন আমার দুইপাশে বাবুদের রাখলেন। আমি বাবুদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে কতক্ষন তাকিয়ে রইলাম। এরপর ছেলেটার কপালে চুমু খেয়ে কানে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘তুই আমার স্বপ্ন, বুঝেছিস বাবা।’ আর মেয়েটার কপালে চুমু খেয়ে বললাম, তুই আমার সুখ। আর ওই যে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তোদের বাবা, উনি আমার আঙিনা।’

 

আমার স্বপ্ন সুখের আঙিনা!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।