ঋতুস্রাবের মতো অসহ্য যন্ত্রনা আর মনের ক্ষত নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমিকের  বউ সেজে বাসর ঘরে বসে আছে রোদেলা। সে বেশ বুঝতে পারছে তার আগামী দিন গুলো খুব একটা সুখকর হবে না। যদিও বা অতীতে শেষ কবে হেসেছিল সেটা রোদেলার মনে নেই বললেই চলে। 

 

রোদেলার পাশেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তার  এক মাসের নবজাতক ছেলে। কবুল বলার আগ মূহুর্তে সে আর ছেলেকে ফিড করাচ্ছিল। রোদেলাই বুঝি প্রথম কোন মেয়ে যে বউ সেজে নিজের হবু বরের সামনে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল। অবাকজনক হলেও এটাই সত্য! এমনটাই ঘটেছে তার সাথে৷ 

 

পরনে তার  লাল শাড়ি আর ঘোমটা। গলায় আর হাতে খুবই চিকন সোনার একটা চেইন আর চিকন  চুরি। বাসর ঘরের ছিটেফোঁটা ও নেই। কেউ বলবেই না এটা বাসর ঘর।আজকে রোদেলার বিয়ে সম্পন্ন হলো তারই মামাত ভাইয়ের সাথে। যে কিনা এতো দিন তার বান্ধবির প্রেমিক ছিল। ভাইয়া যদিও তার চেয়ে সাত বছরের বড়। তবুই ভাইয়া ছিল আনম্যারিড। কিন্তু রোদেলা? সে তো বিবাহিত ছিল! তারপরও ভাগ্যের পরিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো বউ সেজে   আবারো একবার বিয়ের পীড়িতে বসতে হলো তাকে।

 

রোদেলা তার ছেলেকে কোলে দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। কেন যেন তার ভাগ্যে এতো যন্ত্রনা লেখা  আছে। কে জানে কবে এই কষ্ট থেকে পরিত্রান পাবে সে?  

 

রোদেলা কাদছে। থেকে থেকে কেদে উঠছে সে।  সে তো এমন কিছু কোন দিন ই চায়নি। তবুও কেন সৃষ্টিকর্তা তার ভাগ্যেই এতো যন্ত্রণা লিখে রেখেছে? 

 

সে ডুকরে ডুকরে কেদে বলে, কেন আমার সাথেই এমন হলো? ভাইয়াকে তো আমি বিয়ে করতে চাই নি! আর রিশাদ! ছিঃ! একটা মানুষ কতোটা জঘন্য কিভাবে  হতে পারে! যে কিনা  নিজের সন্তানের দায়িত্ব নিতে চায়না। সন্তান আর মৃত প্রায় বউকে রেখে অন্য কারো কাছে চলে গেল। 

 

রোদেলা হুহু করে কেদেই চলেছে। তার চোখের পানি যেন কোন বাধই মানছে না।প্রতিটা চোখের জল অশ্রমালা হয়ে টপটপ করে গাল বেয়ে পড়ছে। 

 

এখন রাত দেড়টা বাজছে।কিন্তু  রোদেলার বর্তমান স্বামীর আসার কোন নাম নেই।রোদেলা তার ছেলে বাবুকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে আছে। রোদেলার ছেলে মায়ের বুকে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। সে তো আর জানে না তার মায়ের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে!  

 

 এরইমধ্যে রোদেলা রুমের গেট খোলার আওয়াজ পেল। সে নড়েচড়ে বসে নিজের ছেলেকে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে।  

 

★★★

 

এদিকে আবেগ তার বাসর ঘরে ঢুকল। ঢোকার কোন ইচ্ছা ছিল না। তাকে জোড় করে ঢোকানো হয়েছে। হাতে জলন্ত সিগারেট! 

 

আবেগ ধীর পায়ে রুমে ঢুকল। ঢুকতেই রোদেলার মুখটা দেখতে পেল। তাতেই রেগে উঠে আবেগ। কিন্তু রাগ করেই না কি লাভ? আবেগ সিগারেট টানতে লাগে। 

 

আবেগ দেখল, রোদেলা তার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। 

 

আবেগ রেগে থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়ে, ভেতরে ঢুকে। 

 

রোদেলা তাকে দেখে বাবুকে বিছানায় শুইয়ে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাড়ালো এবং ঘোমটা ঠিক করে আবেগের সামনে গেল৷ 

 

রোদেলা গুটিগুটি পায়ে আবেগের সামনে গিয়ে দাড়ালো। আবেগ তখনো ভাবলেশহীন ভাবে সিগারেট ফুকছে৷ 

 

যেই না রোদেলা ঝুকে আবেগের পা ছুইয়ে সালাম করবে, ওমনি আবেগ সরে এসে কর্কশ কন্ঠে বলে, 

 

আমার পায়ের নখের সমান যোগ্যতাও তোমার নেই। বুঝছো? আর এইসব নাটক বাদ দাও।আমি জাস্ট এসব নিতে পারছিনা। 

 

রোদেলা ছলছল চোখে আবেগের দিকে তাকালো। 

 

রোদেলাকে কাদতে দেখে আবেগ তাচ্ছিল্যের  হেসে বলে, যা চেয়েছো তা তো হাসিল করেই ফেললে তো এখন কান্না করার কি আছে? তোমার তো হাসা উচিত। হাসো না! (রাগী গলায়) 

 

রোদেলা চোখ তুলে তাকালো। তারপর শান্ত স্বরে বলল,

 

“আবেগ,আমি মোটেও তোমাকে বিয়ে করতেই চাই নি৷ সেটা তুমিও ভালো করে জানো আর আমিও জানি।”

 

আবেগ যেন একথা শুনে রেগে ফেটে পড়ল।সে রোদেলার দুই কাধ ধরে খানিকটা জোড়ে ঝাকুনি দিয়ে হুংকার দিয়ে বলে, তুমি আমাকে ভালোবাসতা না? আমার জন্য পাগল ছিলা তাই না? আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবা না এমন কথাও তো বেশরমের মতো সবার সামনে মুখ ফুটে বলেছিলে এক সময়। সো হু নোস? তুমিই বাবাকে বাধ্য করিয়েছো আমাকে  বিয়ে করার জন্য! 

 

রোদেলা আবেগের গা থেকে মদের বুদবুদ গন্ধ পেতে লাগে৷ তার নাকে এই ব্রিশি গন্ধ যেতেই গা গুলিয়ে এলো। মনে হচ্ছে মুখভর্তি বমি করে দিবে৷ এমনি রোদেলার শরীর খুব দুর্বল। এমনি উটকো গন্ধ সে আগে থেকেই নিতে পারেনা। কিন্তু কথা হচ্ছে আবেগ মদ কেন খেয়েছে? রোদেলা যতোদূর জানে আবেগ নামাজ পড়ে। যে ছেলে নামাজ পড়ে সে কিভাবে এসব খায়? 

 

আবেগ রোদেলার গাল চেপে ধরে বলে, এই বিয়ে আমি মানি না। অসম্ভব! তোমার আর তোমার বাচ্চার দায়িত্ব নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।  আমি নেহাকে ভালোবাসি! তোমাকে বউ হিসেবে মানা পসিবল না। সর‍্যি আমি পারব না। 

 

রোদেলা আবারো ছলছল চোখ আবেগের দিকে তাকালো। 

 

আবেগ আবার একটা জোড়ে ঝাকুনি দিল রোদেলাকে। 

 

এতে রোদেলা আহ করে চেচিয়ে উঠে। 

 

আবেগ রোদেলার দিকে তাকিয়ে দেখে রোদেলা পেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে৷ 

 

সে তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিল রোদেলার মাত্র একমাস আগে অপারেশন হয়েছে। সিজারের কাচা সেলাই বোধহয় শুকায় নি এখনো। 

 

রোদেলা মাটিতে বসে পড়ে। আর গোঙাতে লাগে। মনে হয় খুব ব্যথা পাচ্ছে৷ 

 

আবেগ রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে কিছু বলবে,,,,,,,, তার আগেই তার কানে রোদেলার গোঙানোর আওয়াজ  ভেসে উঠে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেল নাতো আবার! 

 

চলবে৷ 

 

#অশ্রুমালা

Part–1

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

[ আসসালামু আলাইকুম। সবাই কেমন আছেন? আশা করি সকলেই ভালো আছেন। পাঠকপ্রিয়তার উপর ভিত্তি করে আগামী পর্ব পাবলিশ করা হবে। ধন্যবাদ সকলকে আর প্রথম পর্ব কেমন লাগলো সবাই জানাবেন দয়া করে।  ]

 

#অশ্রুমালা

Part–2

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

 

আবেগ ঘাবড়ে গেল। যদি সিজারের সেলাই খুলে গিয়ে রক্তপাত শুরু হয়? তখন কি করবে সে? এমনি রোদেলার অপারেশনটায় কমপ্লিকেশন ছিল। সে নিজেই তো অপারেশনের একজন সদস্য ছিল। যদিও বা শুধু অপারেশন থিয়েটারে গিয়েছিল। কোন ধরনের  কাজে অংশ গ্রহন করেনি। আবেগ নিজে তো জানে কতোটা রিস্ক ছিল রোদেলার জন্য সেই সময়টায়। অথচ এমন কম্পলিকেট ওটি পেশেন্টের সাথে এমন অমানবিক আচরণ কিভাবে করতে পারল সে? নিজের উপরই এখন তার রাগ লাগতে শুরু করেছে৷ 

 

আবেগ ধপ করে ফ্লোরে বসে  পড়ল। রোদেলা পেটে হাত দিয়ে কুকিয়ে উঠছে। আবেগ দ্রুত তার কাছে গেল। 

 

এবং আবেগ  বিচলিত হয়ে বলে, ব্যথা করছে? 

 

উত্তরে রোদেলার ব্যথিত কন্ঠে শুনতে পেল, নাহ। 

 

রোদেলার মুখ থেকে নাহ শোনার পর ও আবেগ স্বস্তি পেল না। এই ‘না’ জবাব টাই যেন তাকে অশান্ত করে তুলল। 

 

আবগে এক মূহুর্তে দেরি না করে রোদেলাকে উঠে বসালো এবং পরমূহুর্তে বিছানায় শুইয়ে দিল। 

 

এবং শাড়ি থেকে আচলটা হালকা সরালো। এতে সিজারের কাটা সেলাই তার চোখে পড়ল৷ 

 

নাহ। সব ঠিক আছে। আবেগ তো ভয় পাচ্ছিল যদি রোদেলার সেলাই ফেটে যায় বা ছিড়ে যায়? কিন্তু এমন কিছু ই হয়নি। 

 

তাই আবেগ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। 

 

সে রোদেলাকে পরখ করে দেখে নিল। মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। 

 

আচ্ছা রোদেলার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? আবেগ রোদেলার কাছে গিয়ে বসল। 

 

রোদেলার চোখ বন্ধ। কিন্তু পিটপিট করে বন্ধ চোখজোড়া নড়ে উঠছে থেকে থেকে৷ 

 

আবেগের মনে আছে, যখন রোদেলার সিজার হয় তখন পাঁচ ব্যাগ রক্ত লেগেছিল। কি দুর্দশা ঝেঁকে বসেছিল তাদের মধ্যে  আবেগ তো একটা সময় আশাই ছেড়ে দিয়েছিল যে রোদেলা হয়তো আর বাচবে না! 

 

আবেগ কিছু বলতে যাবে আর আগেই রোদেলা পেটে হাত দিয়েই আস্তে করে উঠে বসে। 

 

তাকে বসতে দেখে আবেগ গমগমে আওয়াজে বলে, পেইন কিলার খাবে? 

 

রোদেলা উঠে দাড়ালো এবং শাড়ির আচল কাধে ঠিক মতো ঝুলিয়ে নিয়ে বাথরুমের দিকে হাটা ধরল কিছু না বলেই।  

 

এতে আবেগের মেজাজ চটে গেল। আবেগ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে অথচ তার উত্তর না দিয়ে পরাগপর হওয়া —এটা কেমন আচরণ? 

 

একে তো তার উপর দয়া করে আবেগ এই বিয়ে করেছে। অথচ সে! তার মুখের উপর অপমান করছে? কতোটা অকৃতজ্ঞ রোদেলা? 

 

আবেগের দৃষ্টি গেল বিছানার মাঝখানে শুয়ে থাকা ছোট্ট বাবুটার উপর। তার বিছানায় কোন দিন কোন বাচ্চা ঘুমায় নি৷ আজকেই প্রথম তার বিছানায় কোন বেবি ঘুমাচ্ছে৷ 

 

আবেগ আনমনে হেসে দিল বাচ্চাটাকে দেখে৷ আসলে ছোট্ট বাবুরা কিছুটা ম্যাজিকের মতো হয়। এদের দেখলে মনটা বিষন্ন হয়ে থাকতে পারে না৷ ওই ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা গুলো আর ফোকলা হাসির দিকে তাকিয়ে মনে হয় একজন দশ খুনের আসামীও খানিকটা হলেও হাসবে৷ 

 

সেই সুত্র ধরে আগালে, আবেগের ও বাবুকে দেখে মনটা কিছু টা ভালো হওয়ার কথা। হলোও তাই! 

 

আবেগ নিজে থেকে বাচ্চাটার কাছে গেল।এবং বাচ্চাটার গা ঘেষে বসল৷ 

 

বারবার বাচ্চা বা বাবু বলার কারন হলো বাবুর নাম এখনো রাখা হয় নি। একটা পরিবারে যখন কোন নতুন সদস্যা আসে সবাই খুশি হয়। কিন্তু রোদেলার বাচ্চা হওয়ার সময়কার পরিস্থিতি টা ছিল খুব জটিল। হবেই বা না কেন? 

 

একে তো রোদেলা অপুষ্টিহীনতায় ভুগছিল তারপর রোদেলার ছিল কমপ্লিকেশন প্রেগ্ন্যাসি। কিন্তু আবেগের তো মনে হয় রোদেলার প্রোপার ট্রিটমেন্ট করা হত। এই পযন্ত যদি রোদেলার অবস্থা থাকত তবে যেকোন  দায়িত্ববান ডাক্তার ই  সিজারিয়ান পদ্ধতি তে রোদেলার ডেলিভারি করতে পারত৷ এতে রোদেলা লাইফ রিস্ক হত না। 

 

কিন্তু রোদেলার সাথে যা ঘটেছিল,,,,,,, এইটুকু ভাবতেই আবেগ বাবুর কান্নার শব্দ পেল৷ 

 

সে বাবুর দিকে তাকাতেই দেখল পিটপিট করে চোখ খুলে হালকা গলায় কান্না করছে বাবু। 

 

আবেগ বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে? সে বাবুটার ছোট্ট হাত জোড়া ধরে আদর মাখা গলায় বলে উঠে, না, বাবা কাদে না। 

 

এতে মনে হয় না বাচ্চাটার মধ্যে কোন ভাবান্তর আসল। সে তার মতো কেদেই চলেছে আর পিটপিট চোখে আবেগকে দেখছে। 

 

আবেগ বাবুটার বুকে হাত রেখে  আস্তে করে হাত উঠা-নামা করতে লাগলো। বাচ্চা দের ঘুম পাড়ানোর সময় বাবা-মা রা যা করে সেটাই করতে লাগলো আর আস্তে আস্তে বলা শুরু করে, কাদে না বাবা। তুমি না ভালো ছেলে। আম্মুর কাছে যাবে? আরো অনেক কিছু বলা শুরু করে দেয়। 

 

এতে যা হলো বাবুটা কান্না থামিয়ে আবেগ কে দেখতে লাগে আর ফোকলা হাতে হাসি দিল। 

 

আবেগও বিনিময়ে একটা হাসি দিয়ে বাবুটার ছোট্ট হাত দুটি তার হাতের সাথে নিয়ে খেলতে লাগে তার সাথে৷  

 

রোদেলা বাথরুম থেকে বের হয়েই এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠে। সে প্রথমে ভেবেছিল আবেগ বুঝি তার বাচ্চাকে মারছে। কারন এই সময়ে আবেগ সম্ভবত মাতাল অবস্থায় আছে৷যদি তার বেবিকে কিছু করে বসে আবেগ? 

 

রোদেলার বুক ছ্যাত করে উঠে। সে এই অবস্থায় ও বড় বড় পা ফেলে বেডের কাছে গেল। কিন্তু সে যা ভেবেছে তার উল্টাটা হয়েছে। 

 

আবেগ তো তার ছেলের সাথে খেলা করছে। আর তার ছেলেও কি সুন্দর আবেগের সাথে হাসছে যেন কতো দিনের পরিচয় তাদের। এই সিনটা দেখে রোদেলার মনটা যে কি প্রশান্ত হলো তা বুঝিয়ে বলার মতো না। কিন্তু রোদেলার পেটে চিনচিন ব্যথা আরাম্ভ হলো। হয়তো জোড়ে জোড়ে হেটে আসার জন্য হয়েছে! 

 

রোদেলা দাতে দাত চেপে ব্যথা সহ্য করে মৃদ্যু গলায় বলে উঠে, আবেগ! 

 

আবেগ রোদেলার কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকালো। এবং ভ্রু কুচকালো কারন রোদেলার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ব্যথা পাচ্ছে। অন্য কেউ না বুঝলেও আবেগ বেশ ভালো করেই ধরতে পারল ব্যাপার টা৷ 

 

আবেগ উঠে দাড়ালো এবং বলল, ব্যথা করছে খুব? 

 

রোদেলা হু বলল। 

 

আবেগ হন্তদন্ত হয়ে বলে, কোথায়? সেলাইয়ের জায়গায়? 

 

–হু। 

 

আবেগ এ কথা শুনে রোদেলাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। 

 

রোদেলা বলে উঠে, ডাক্তার আফরোজাকে কল দিবে? 

 

আবেগ শান্ত গলায় বলে, আমিও তো ডাক্তার! 

 

রোদেলা আর কিছু বলল না৷ 

 

আবেগ রোদেলা কে বলল, মেডিসিন দিব? 

 

রোদেলা ছোট করে উত্তর দিল, হু। 

 

ঠিক সেই সময় বাবু কেদে দিল। 

 

আবেগ তা দেখে বলে, ওর খিদা লাগছে। খাওয়াও ওকে। আমি মেডিসিন আনছি৷ 

 

বলে হনহন করে আবেগ রুমের বাইরে গেল।আবেগের মাথা চক্কর দিচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে তবুও সে রোদেলার মেডিসিন আনতে রুমের বাইরে গেল।  

রোদেলা মাথা উচিয়ে একবার আবেগকে দেখে নিয়ে বাবুকে খাওয়াতে লাগলো । পেট ব্যথা করছে। চিনচিনানি ব্যথা করছে৷

 

রোদেলা বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে।ঘুম যেন দুই চোখে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। চোখের পাতা যেন খুলে রাখতেই পারছে না রোদেলা। 

 

এদিকে আবেগ ড্রয়িং রুমে আসল। তাদের ড্রয়িং রুমে একটা শোকেস আছে। সেই শোকেসের নিচের ড্রয়ারে সব ধরনের ঔষধ রাখে আবেগ।  রোদেলার মেডিসিন ও আছে। আবেগ হাতে নিল মেডিসিন গুলো তারপর রুমের দিকে এগালো। 

 

রুমে প্রবেশ করতেই দেখে রোদেলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মা-ছেলে পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে৷ 

 

তাদেরকে দেখে আবেগ মৃদ্যু হাসল। তারপর পরক্ষনে তার কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠল। 

 

রোদেলা তো ঘুম। মেডিসিন খাবে কিভাবে? ব্যথা নিয়েই ঘুমিয়ে গেল? কি করবে সে? 

 

আবেগ এমবিবিএস ডাক্তার। আবেগ যেই হাসপাতালের ডাক্তার সেখানেই রোদেলার অপারেশন হয়েছে। সেখানকার ই গাইনোলজিস্ট হলো ডাক্তার আফরোজা৷ খুব ভালো ডাক্তার উনি। ডাক্তার আফরোজা বারবার বলে দিয়েছে ব্যথা উঠলে মেডিসিন টা দিতে। এখন কি সে রোদেলা কে ডাকবে? ডাকা তো উচিত। 

 

আবেগ গিয়ে রোদেলাকে ডাকতে লাগে। কিন্তু তার কোন ভাবান্তর নেই। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। 

 

আবেগ তার ডাকলো না। সে দেখল রোদেলা মাঝ খানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে আর বাবু বাম পাশে৷ 

 

তাকে যদি শুতে হয় তবে ডান পাশে শুতে হবে। ডান পাশে জায়গাই আছে অল্প একটু। অর্থাৎ শুতে হলে আবেগকে রোদেলার গা ঘেষে শুতে হবে।কিন্তু আবেগের রোদেলার সাথে গা ঘেষে শোয়ার না আছে ইচ্ছা আর না আছে শখ! 

 

সে সোফায় গিয়ে বসল। আজ রাত এখানেই ঘুমাবে। তার  বিছানায় মা-বাচ্চা আরাম করে ঘুমাক৷ 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা

Part–3

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে সুখী যারা শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। আর এমন সুখী হওয়ায় সৌভাগ্য আবেগের হয় নি। তাই তো এক ঘন্টার ও বেশি হয়ে যাওয়ার পর ও তার চোখে ঘুম নেই। আবেগ উদাসিন দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে৷ রাত এখন গভীর। মনে হয় না কেউ জেগে আছে! 

 

একে তো সোফায় শুয়ে আরাম পাচ্ছে না তারপর উপর ঘুম আসছে না। খুব বিরক্ত লাগছে আবেগের। 

 

এদিকে রুমে পিনপিনে নিরবতা! কেবল তার এবং রোদেলার নিশ্বাসের শব্দ তার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘড়ির কাটার টিকটিক আওয়াজ। 

 

আবেগ সোফা থেকে উঠে বসল। ঘাড় লেগে গেছে। সে ঘাড়ে হাত নিয়ে গিয়ে ম্যাসাজ করতে লাগলো। আবেগের চোখ রোদেলার উপর গিয়ে পড়ল। আবেগ না চাইতেও রোদেলার দিকে তার নজর গিয়ে ঠেকল। কারন সোফার বিপরীত বরাবর বিছানা তাই সোফায় বসলে বেডের দিকেই সর্বপ্রথম চোখ যাবে। 

 

আবেগ দেখতে পেল, রোদেলা নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে ঘুমাচ্ছে। এমন ঘুম ঘুমাচ্ছে যেন সে খুব শান্তিতে আছে। কিন্তু হওয়ার কথা উল্টো। 

 

আবেগের এমন শান্তিতে ঘুমানো উচিত আর রোদেলার রাত জাগা দরকার! কারন রোদেলাই কষ্টে আছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যত তার সামনে। অথচ কতো আরামে ঘুমাচ্ছে। 

 

আচ্ছা! রোদেলা কি কোন ক্রমেই ভাবছে না আবেগ যদি তার আর তার সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব না নেয় তবে সে কিভাবে এই জীবনযুদ্ধ পাড়ি দিবে? 

 

আবেগ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা শ্বাস ফেলে নিজেই নিজে বলতে লাগে, মনে তো হয় না এসব নিয়ে রোদেলার কোন মাথা ব্যথা আছে? থাকলে কি এতো আরামে ঘুমাতে পারত? 

 

বাই এনি চান্স, আবেগ যদি রোদেলার জায়গায় থাকত তবে হয়তো না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হ্যালুয়েশন হয়ে  মানসিক রোগী হয়ে যেত। 

 

আবেগ চোখের দুই পাতা বন্ধ করল। চোখ জ্বালা করছে। না ঘুমানোর ফল এটা! 

 

ঘড়ির কাটা চারটা ছুইছুই!  সে ওইভাবেই সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে থাকল। এভাবে কতোক্ষন কেটে গেল জানে না আবেগ। সে তখন ই চোখ খুলল যখন বাবুর কান্নার শব্দ ভেসে উঠে তার কানে৷ 

 

আবেগ চোখ খুলে তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। এবং বিছানার দিকে পা বাড়ায়৷ 

 

আবেগ বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। আবেগ দিব্যি বুঝতে পারছে বাবুর খিদা লেগেছে৷ খিদা লাগারই কথা সেই কখন খাওয়ানোর পর ঘুম পাড়িয়েছে তাকে রোদেলা৷ এরপর আর একবারো খায় নি বাচ্চাটা! অথচ এতো ছোট বাচ্চার তো এক ঘন্টা পরপর খাওয়ানো উচিত! অথচ তার মা! গভীর ঘুমে মগ্ন। কোথায় রাতে উঠে বাচ্চাকে খাওয়াবে না তা করে ঘুমাচ্ছে৷ 

 

এমন দায়িত্ব হীন নারী মা হওয়ারই যোগ্য নয় –মনে মনে কথাটা বলল আবেগ। 

 

তারপর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই রোদেলাকে ডাকতে লাগে৷ আবেগ ভেবেছিল এবার ও রোদেলা উঠবে না কিন্তু তাকে ভুল প্রমানিত করে দিয়ে রোদেলা হুড়মুড় করে চোখ খুলে। 

 

মাথার সামনে আবেগ কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে যেই না চট জলদি উঠে বসতে ধরবে ওমনি আবেগ তার হাত ধরে ফেলে এবং কর্কষ গলায় বলে, আস্তে! উঠার দরকার নাই! বাবুকে খাওয়াও তো। খিদা লাগছে জন্য কাদছে। 

 

রোদেলা দেখতে পেল বাবু আবেগের কোলে কান্না করছে। 

 

এইটুকু বলেই আবেগ রোদেলার পাশে শুইয়ে দিল বাবুকে। বাচ্চাটা তখনো কেদে যাচ্ছে৷ রোদেলা তার কপালে চুমু খেয়ে খাওয়ানো আরম্ভ করল। 

 

আবেগ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বারান্দায় গেল। বারান্দায় গিয়ে দাড়াতেই আযানের ধ্বনি শুনতে পেল। এতো দ্রুত ভোর হয়ে গেল? 

 

আবেগ আশেপাশে তাকালো। আলো এখনো ফোটা শুরু করে নি। আজকে ফজরের ওয়াক্তের প্রথম আযান বুঝি এটা। তার মনটা কেমন করে উঠল। একদিন হয়ে গেল তার বিয়ের? সময় এতো দ্রুত কেন বয়? 

 

রোদেলা বাবুকে খাওয়ানোর পর আস্তে করে উঠে বসে এবং তাকে কোলে নেয়। মায়ের কোলে যাওয়ার সাথে সাথে বাবুটা হেসে দেয়৷ তা দেখে রোদেলা নিজেও হেসে দিয়ে বলে, ওরে! আমার দুষ্টু বাবুই! কিছুক্ষন আগেই না কাদছিলে এখন আবার হাসো! 

 

বাবু টা কিছু বুঝলো কিনা জানে না রোদেলা তবে এইকথাও সে মনে হয় আনন্দ পেয়ে আবারো হেসে দিল। 

 

রোদেলা নিজের ছেলেকে বুকের সাথে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। তার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল তো এই বাচ্চাটাই আর,,,,,

 

এইটুকু ভেবেই একবার রোদেলা বারান্দায় তাকালো তারপর মনে মনে বলে, যাকে আমি নিজের বেঁচে থাকার সম্বল ভাবছি সে কি আমায় আদৌ চায়? মনে তো হয় না! 

 

রোদেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে দেখল বাবু আবারো ঘুমিয়ে গেছে। রোদেলা আস্তে  করে বাবুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সাইডে একটা বালিশ ও দিয়ে দিল। 

 

এমন সময় আবেগ রুমে ঢুকল। রোদেলা কে উদ্দেশ্য করে আবগে বলতে লাগলো, বাচ্চাকে এক ঘন্টা অন্তর অন্তর খাওয়াবা। রাত হলেও খাওয়াতে হবে দুধ।  ও তো আর আমাদের মতো না যে রাতে  ভাত খেয়ে ঘুমাবে আর সকালে উঠে নাস্তা খাবে। বুঝেছো? 

 

রোদেলা মাথা ঝাকালো৷ 

 

আবেগ সোফায় গিয়ে বসতে ধরলেও থেমে গেল এবং আবারো গমগম কন্ঠে বলে, একটু ওই দিকে সরো। আমি বিছানায় শুব। 

 

–আচ্ছা বলেই রোদেলা তার ছেলের গা ঘেষে শুয়ে পড়ে এবং অনেক খানি জায়গা ফাকা করে দেয় আবেগের জন্য । 

 

আবেগ সংকোচ নিয়েই রোদেলার পাশে শুয়ে পড়ে। শোয়ার সাথে সাথে আবেগের নাকে একটা সুমিস্টি যুক্ত ঘ্রাণ এসে ধাক্কা খায়। তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে এটা কিসের গন্ধ তা বুঝতে। পরে বুঝতে পারে এটা হলো রোদেলার গায়ের গন্ধ!  ঘ্রাণটা চাপা রজনীগন্ধা ফুলের মতো কিছুটা! 

 

আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। মেয়েটা পেটে হাত দিয়ে শুয়ে আছে৷ 

 

তা দেখে আবেগ প্রশ্ন করে, এখনো ব্যথা আছে? তাইলে মেডিসিন খেয়ে নাও৷ 

 

রোদেলা আবেগের কন্ঠ শুনে কেপে উঠে।  সে আবেগের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে  ফিরে তাকায়। রোদেলা বুঝতে পারল তাদের মধ্যে দূরত্ব খুব কম। এতো কাছ থেকে কোন দিন আবেগকে সে দেখে নি। রোদেলার সারা শরীরে কেমন যেন এক অনুভূতি বয়ে গেল! 

 

সে শীতল দৃষ্টিতে আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, ব্যথা নেই। 

 

–সত্যি বলছো? 

 

–হু। 

 

আবেগ উঠে বসল। এবং রোদেলার পেটে হাত রাখল। যেই জায়গায় সেলাই পড়েছে সেই জায়গা সহ তার আশপাশ কিছু টা ফুলে আছে। 

 

ডাক্তার আফরোজা বলেছে, সিজারের প্রথম তিন মাস রোদেলার একদম প্রোপার ট্রিটমেন্ট করাতে। এক বিন্দু হেলা-ফেলা করা যাবে না। রোদেলার সেলাইয়ে একটু সমস্যা হয়েছে তাই তো এক্সট্রা কেয়ারে রাখতে বলা হয়েছে।  

 

আবেগের হাত ছোয়া পেতেই রোদেলা আবারো কেপে উঠে আবেগের হাতটা সরিয়ে দিল। 

 

আবেগ আবারো রোদেলার পাশে শুয়ে পড়ে। আবেগ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। 

 

এদিকে রোদেলা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে৷ তার আর ঘুম আসছে না। 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা

Part–4

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রোদেলা আবেগের দিকে তাকালো। আবেগকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে রোদেলা ভেবে নেয় যে আবেগ ঘুমিয়ে গেছে তাই তো সে আস্তে করে আবেগের দিকে ঘুরে শোয়। আবেগ চোখ বন্ধ করে আছে। রোদেলা জানে না যে আবেগ জেগে ছিল । সে তো ভেবেই নিয়েছে আবেগ ঘুমিয়ে আছে।তাই তো আবেগের দিকে পাশ ফিরে সে দুই হাত এক সাথে মাথার নিচে রেখে শুন্য দৃষ্টিতে আবেগের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন কারন ছাড়াই রোদেলার চোখ বেয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। 

 

হুট করে আবেগ রোদেলার দিকে মুখ করে ফেলে। তখন তার চোখ খোলা ছিল যার জন্য রোদেলার দিকে পাশ ফিরতেই  আবেগের চোখের সামনে রোদেলাকে দেখতে পেল সে।

 

এমন কোন ঘটনার জন্য উভয়েই অপ্রস্তুত ছিল৷ রোদেলা ও আবেগ একসাথেই হচকচিয়ে উঠল। 

আবেগ দ্রুত রোদেলার দিক থেকে সরে উপুড়  হয়ে শুয়ে পড়ে। দুজনই চুপ। আশপাশ ও  শান্ত। দুজনের মনেই হাজারো ধরনের সংকোচ বিরাজ করছে।  রোদেলা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। 

 

আবেগ কপালে তার হাত রাখল এবং অন্যন্ত শান্ত গলায় বলায়, এভাবে না শোয়াই বেটার 

পেটে চাপ পড়বে।  

 

একথা শোনামাত্র রোদেলা আবেগের দিক থেকে সরে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। এভাবে শুতেই তার চোখের সামনে সিলিং ফ্যানটা দেখতে পেল। সিলিং ফ্যানটা আস্তে আস্তে ঘুরছে৷ নভেম্বর মাসের শুরু জন্যই হয়তো আস্তে ঘুরছে ফ্যানটা! 

 

কিছুক্ষন পিনপিনে নিরবতা। তারপর হুট করেই আবেগ বলে উঠে, তোমার চোখে পানি কেন? 

 

এ প্রশ্নটা শোনামাত্র রোদেলার বুকে এক অজানা উত্তাল খেলে গেল। কেমন যেন এক শিহরণ জাগ্রত হলো তার ছোট্ট হৃদয়খানার মধ্যে । তবে কি আবেগ তার চোখে পানি সহ্য করতে পারে না? 

 

রোদেলা হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে আবেগের দিকে  তাকিয়ে দেখে আবেগ এখনো সেইভাবেই শুয়ে আছে। রোদেলা আবেগের প্রশ্নের উত্তর দিল না। 

 

রোদেলার কাছ থেকে কোন জবাব না পেয়ে আবেগ নিজ থেকে রোদেলার দিকে ঘুরে তার তর্জনী আঙুৃল দিয়ে রোদেলার গালে লেগে থাকা অশ্রু মুছে দিল। এবং সেই ভাবে কিছুক্ষন এক ধ্যানে রোদেলার দিকে চেয়ে থেকে উঠে পড়ল। 

 

তাকে আধ ঘন্টার মধ্যে হাসপাতাল যেতে হবে। ইমার্জেন্সি কাজ আছে একটা। সে তড়িঘড়ি বাথরুমে ঢুকে যায়৷ 

 

এদিকে রোদেলা হতবিহ্বল হয়ে শুয়ে আছে৷ মাত্র কি ঘটে গেল তা সম্পূর্ণ তার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে৷ আবেগ তার চোখের পানি মুছে দিয়েছে? স্পর্শ করেছে তাকে? মাত্র ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘটনায়  রোদেলা কেবল হতবাক ই নয় বরং কিংকর্তব্যবিমৃঢ়! 

 

আসলে মানুষ  খুব সুক্ষ্ম বিষয়ের আকস্মিকতায় হতবাক বনে যায় আর বড় বড় ঘটনার আকস্মিকতায় তারা থাকে নির্বিকার। সবার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য কিনা তা জানে না রোদেলা কিন্তু এই বানী যে নিজের জীবনের এক বাস্তব উদাহরণ তা দিব্যি বুঝে গেছে রোদেলা। 

 

বেশ খানিকক্ষণ আবেগের যাওয়ার পানে চেয়ে রইল রোদেলা। তারপর পাশ ফিরে ছেলেকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে৷ 

 

আবেগ ফ্রেস হয়ে একেবারে রেডি হয়ে নিল। ঘড়ির কাটায় সাতটায় ছুই ছুই। 

 

সে দ্রুত বাথরুম থেকে বের হলো। তারপর ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফোন আর ঘড়ি টা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে আয়নার ভেতর থেকে রোদেলাকে একবার পরখ করে দেখে নিয়ে একটা টু শব্দ না করে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। 

 

এদিকে রোদেলা যে আবেগকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার সময় পর্যন্ত পেল না । অগত্যা কিছু জানতে পারল না সে৷ রোদেলার মনে হলো আবেগ হাসপাতালে যাচ্ছে৷ এছাড়া আর কই বা যায় আবেগ? 

 

রোদেলা নিজেও উঠে পড়ে। আবেগ যাওয়ার আগে গেট সম্পূর্ণ খুলে থুয়ে গেছে। সে শাড়ির আচলটা ঠিক করে নেয় এবং বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়। বাবু উঠে গেছে কিছুক্ষন আগেই। 

 

রোদেলা বেসিনের কল খুলে চোখে-মুখে পানি দিল। কালকে রাতে সে খুব ভালো ঘুমিয়েছে৷ অনেক গভীর ঘুম যাকে বলে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়  সাউন্ড স্লিপ! 

 

ফ্রেস হয়ে নিল সে। তারপর বের হতেই চোখ গেল বেডে। 

 

বেডে বাবুর সাথে ইভানা বসে আছে। বাবুর সাথে খেলছে ইভানা। 

 

তা দেখে মৃদ্যু হাসে রোদেলা। রোদেলাকে বেরুতে দেখে ইভানা এক গালে হেসে বলে, আপু, ভাইয়া কোথায়? রুমে নেই তো। 

 

রোদেলা অপ্রস্তুত বনে গেল। সে কি বলবে? নিজেও তো প্রোপারলি জানে না আবেগ কোথায় গিয়েছে? 

 

তাও উত্তরে বলল, তোমার ভাইয়া  কিছুক্ষন আগেই বের হলো। 

 

ইভানা বাবুকে কোলে নিয়ে বলে, ও। আপু না মানে সর‍্যি ভাবি, আজকে তো তোমার এই বাসায় ফাস্ট দিন। একটা ভালো দেখে শাড়ি পড়ো। 

 

রোদেলা কিছু বলল না। শুধু মাথা ঝাকালো। ইভানা বাবুকে নিয়ে রুমের বাইরে চলে গেল। 

 

ইভানা মেডিকেল থার্ড ইয়ারে পড়ে। করোনার জন্য মেডিকেল আপাতত বন্ধ। আর রোদেলা ইংরেজি সাহিত্যে অর্নাস করেছে ইডেন কলেজ থেকে। রোদেলার ও মেডিকেলে পড়ার ইচ্ছা ছিল। অনেক প্রচেষ্টা ও করেছিল চান্স পাওয়ার! কিন্তু ভাগ্যে  যে নাই তাই তো কাটায় কাটায় ৩৯ পেয়ে এক মার্কসের জন্য ফেইল করেছিল মেডিকেল ভর্তি পরিক্ষায়। অতঃপর ইডেন মহিলা কলেজে এডমিট হয় সে। 

 

রোদেলা ভেবে পাচ্ছে না আজকে কি তুমুল ঝড় বয়ে যাবে বাসায়। মামী এই বিয়েতে মোটেও খুশি না। মামার জোড়াজুড়ি তে আবেগ এই বিয়ে করেছে। কালকে মামা আর আবেগের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল কেবল তার জন্য। 

 

রোদেলা একটা হতাশার নিশ্বাস ফেলল। আজকে যে আবার কি হয়?  

 

রোদেলা ধীর পায়ে বের হলো। যা হওয়ার তা হবে। সবকিছুর জন্য সে প্রস্তুত। মামী আর যাই করুক তার উপর অত্যাচার তো আর করবে না। হয়তোবা কথাই শুনাবে। রিশাদের সাথে সংসার করতে গিয়ে এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। 

 

★★★

 

আবেগ তার চেম্বারে বসে রুগী দেখছে। আজকে অনেক রুগী। সপ্তাহের প্রথম দিনে রুগীর সিরিয়াল ও থাকে অনেক। শ্বাস ফেলার ও সময় নেই। এরই মধ্যে সে সাতটা রুগী দেখে ফেলেছে৷

এখন তার সামনে যেই রুগী বসে আছে তার কোলে সাত মাসের একটা বাচ্চা।এই বাচ্চাটাকে দেখেই তার রোদেলার বাবুর কথা মনে পড়ে গেল। আল্লাহর রহমতে তাদের বাবুটা সুস্থ আছে! 

 

বাচ্চাটাকে দেখে নিয়ে প্রেস্ক্রিবশনে মেডিসিন লেখার আগে বাচ্চার নাম জিজ্ঞেস করতেই বাচ্চার মা বলে উঠে আবরার নাম ওর। 

 

আবেগের কলম থেমে গেল। সে ভাবতে লাগলো তাদের বাবুটার ও তো একট নাম রাখতে হবে। কিতো দিন ই বা বাবু বাবু বলে ডাকবে ? 

 

সে দ্রুত মেডিসিন লিখে দিয়ে রুগীর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তিন দিন এই ঔষধ খাওয়ান। কাজ না করলে আবার আসবেন। এন্টিবায়োটিক দিইনি। ছোট বাচ্চা তো এন্টিবায়োটিক না খাওয়াই ভালো। 

 

–আচ্ছা, ডাক্তার সাহেব বলে বাচ্চা আর বাচ্চার মা উঠে চলে গেল। 

 

আবেগ ভাবতে লাগলো, বাবুর তো আকিকা করা হয় নি। আকিকা করে সুন্দর একটা নাম রাখতে হবে। 

 

মাস্কের ভেতর থেকে তৃপ্তি করে নিশ্বাস নিতে পারল না আবেগ। সে এক দন্ড ঠায় বসে থেকে চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ল কারন তার কেবিনে ডা,আফরোজা এসেছেন। যেহুতু উনি সিনিয়র তাই রেসপেক্ট দেওয়ার জন্য আবেগ দাড়িয়ে গেল। 

 

উনি কিঞ্চিৎ হেসে বলে উঠে, রোদেলার বাচ্চার তো সার্টিফিকেট নিলে না? ও  এই হাসপাতালে  জন্ম গ্রহন করেছে সেটার লিগ্যাল কাগজ নিবে না? 

 

আবেগ বলে উঠে, আসলে৷ ভুলে গিয়েছিলাম।  পরিস্থিতি কেমন ছিল তা তো আপনি জানেন ই। সর‍্যি। আমি আজকেই নিয়ে নিব। 

 

আফরোজা হালকা হেসে বলে, রোদেলার হাসবেন্ডের উপর কোন একশন নিবে না তোমরা?  

 

আবেগ কিছু না বলে জাস্ট বলল, ওর এক্স হাসবেন্ড। 

 

–হ্যা। হ্যা। ওইতো।  পুলিশ কেস করবে না? 

 

–নাহ। 

 

–কেন? (ভ্রু কুচকে) 

 

–রিশাদ রাজনীতির সাথে জড়িত।  আমাদের সমস্যা হতে পারে৷  

 

–হুম। আচ্ছা। আমি যাই। 

 

–ম্যাম শুনেন? 

 

–হুম। বল? 

 

–বাচ্চাটার বাবার নামের জায়গায়  আমার নাম লিখবেন।

 

ডা, আফরোজা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আবেগের দিকে৷ 

 

আবেগ শান্ত গলায় বলে, কালকে আমার সাথে রোদেলার  বিয়ে হয়ে গেছে। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা

Part-5

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আমার সোনার টুকরা ছেলের তুলনায় তুমি কিছুই না। ওর পায়ের নখের ও যোগ্যতা নেই তোমার রোদেলা। তুমি হচ্ছো পোড়া কপালি। এক ঘরে তো সংসার করতে পারো নাই এখন আসছো আমার ছেলের মাথা খেতে। 

 

এক দন্ড থেমে ফের ফোড়ন কেটে বলে উঠে, 

 

-আমার ছেলেটার জীবনটা শেষ করে দিয়ে এখন বসে বসে টিভি দেখছো? 

 

উপরের কথাগুলো কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে আবেগের মা জাবেদা খাতুন। 

 

রোদেলা বিষ্ময় চোখে তার শ্বাশুড়ির দিকে একবার তাকালো। তারপর চোখজোড়া নিচে নামিউএ নিল সেই সাথে মাথায়। যদি জাবেদা খাতুন একটু ঠিক ভাবে রোদেলার দিকে তাকাতেন তাহলে দেখতে পেতেন রোদেলার চোখে পানি! কিন্তু রোদেলার চোখের পানি  সে দেখতে পেলনা আর দেখলেও   খুব একটা প্রভাব বিস্তার করত না তার মাঝে। 

 

জাবেদা খাতুনের মনে যত আগুন আছে সব নিয়ে জ্বলে একাকার! তিনি সাপের মতো হিসহিস করছেন৷ 

 

রোদেলা দ্রুত টেবিলের উপর থেকে রিমোটটা নিয়ে দ্রুত টিভি অফ করে দিল। টিভিতে মনপুরা মুভিটা চলছিল। এই মুভিটা একসময় ভীষণ প্রিয় ছিল রোদেলার। যখন প্রথম রিলিজ হয় ওইসময় সে টিনএজার ছিল তাই তো সিনেমা হলে গিয়ে তিনবার দেখেছে বান্ধবীদের সাথে। আজকে হঠাৎ টিভিতে মুভিটা হচ্ছে দেখে ইভানাই জোড় করে তাকে বসিয়ে দিল টিভির পর্দার সামনে। 

 

মাত্র নাস্তা সেরেছে রোদেলা। তাতেই ইভানা তাকে ডাক দিল। সেও ইভানার ডাকে সাড়া দিয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। ইভানা তাকে জোড় করে বসিয়ে দেয়। বাবু তাদের বেডরুমে ঘুমাচ্ছে। তাই রোদেলা ইভানার জোড়াজুড়ি তে সোফায় বসে পড়ে। হুট করে ইভানার কল আসায় সে অন্য রুমে চলে যায়। এরই মধ্যে রোদেলার শ্বাশুড়ি বাইরে থেকে ফিরেই তাকে এতো এতো কথা শুনালেন। 

 

জাবেদা খাতুন কিছু বলবেন তার আগেই রোদেলা তাড়াহুড়ো করে রিমোট রাখতে গিয়ে থাম করে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রিমোট ভেঙে ব্যাটারি দুইটা দুই দিকে ছড়িয়ে গেল। 

 

হুট করে যে এমন কোন ভুল রোদেলার মাধ্যমে ঘটে যাবে তার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলনা রোদেলা। তার মুখটা কালো হয়ে গেল। 

 

রোদেলা মিনমিন সুরে বলে, আমি উঠাচ্ছিস মামী। 

 

জাবেদা খাতুন কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে, তার কোন দরকার নাই বাপু। এই সময় ঝুকলে যদি ব্যথা বাড়ে আবেগ এসে আমাকেই কথা শুনাবে।

 

রোদেলা মৃদ্যু হাসলো কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তার মামীর স্বভাবটাই এমন। বাইরে যতোই চটাং-চটাং বলুক না কেন ভেতরের দিকটা নরম। এমন না যে উনি মানুষ টা খারাপ। আপাতত সে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না৷ না পারাই কথা৷ আবেগের সাথে রোদেলার বিয়ে হবে এটা তো রোদেলা নিজেই আবেগকে ভালোবাসার পর ও কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনি৷ 

 

মামীর তার সাথে এমন করাটা জায়েজ আছে।কোন মা ই মানতে পারবে না তার অবিবাহিত সুপুরুষ ছেলের সাথে কোন কোন বিবাহিত নারীর বিবাহ। তাও যদি ছেলে ডাক্তার হয়। বাংলাদেশে তো এমনি ডাক্তারের কদর হিমালয় ছুইছুই । পাত্র-পাত্রী বাজারে সবচেয়ে আর্দশ হলো ডাক্তার পাত্র। সেরকম একটা অবস্থায় আবেগ তাকে বিয়ে করেছে। তার ছেলের সৎ বাবাও হয়ে গেছে। 

 

ভেতর থেকে বাবুর কান্নার শব্দ ভেসে আসল। 

 

জাবেদা খাতুন বলে উঠে, যাও। বাচ্চা সামলাও। 

 

রোদেলা কিছু না বলে৷ উঠে গেল। এবং রুমে ঢুকে বাবুকে কোলে তুলে নিল৷ 

 

তারপর বলে উঠে, কি হয়েছে বাবাই? কাদো কেন? 

 

রোদেলা বাবুকে নিয়ে হাটতে লাগলো। বাবুকে কোলে নিয়ে হাটলে চুপ হয়ে যায় সে তাই রোদেলা আস্তে আস্তে হাটছে। হাটতে হাটতে সে বারান্দায় গেল। বারান্দায় যেতেই ইভানার মৃদ্যু আওয়াজ ভেসে আসল। এখনো ফোনে কথা বলছে ইভানা? কার সাথে এতোক্ষন ধরে কথা বলছে সে? 

 

রোদেলা এ নিয়ে আর মাথা ঘামালো না। বাবু চুপ হয়ে গেছে। এখন বেলা একটা বাজে। বাবুকে গোসল করাতে হবে। 

 

রোদেলা   গরম পানি আনতে গেল। 

 

★★★

 

আবেগ ডা. আফরোজার কেবিনে বসে আছে।  উনি একটা ফর্ম আবেগের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, বাচ্চার নামের জায়গাটা ফাকা রাখলাম। তুমি লিখে দিও পরে। 

 

–আচ্ছা ম্যাডাম। 

 

 ডাক্তার আফরোজা তার কেবিনের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বলে, রোদেলাকে সাত দিন পর আমার কাছে  আনবে। চেক আপ করতে হবে৷  ঔষধ ঠিক মতো খেতে বলবে। 

 

–জি৷ 

 

–তুমি নিজেই তো ডাক্তার তাই আর কিছু বলব না।

 

–হুম। 

 

আফরোজা বলে উঠলেন, তোমার কিন্তু বিশ  হাজার টাকা ডিউ আছে। 

 

–জি ম্যাডাম। আমি আগামী মাসের বেতন পেলেই দিয়ে দিব৷ 

 

–ইটস ওকে। আমি কি আর হাসপাতাল থেকে কোথাও যাচ্ছি নাকি? তোমার সুবিধা মতো দিয়ে দিও। 

 

–থ্যাংকস ম্যাম। 

 

–বাচ্চার নাম কি রাখবে ঠিক করেছো? 

 

–উহু। 

 

–ভালো দেখে সুন্দর একটা নাম রাখবে।

 

–আচ্ছা। আমি যাই তাহলে। 

 

–ওকে। 

 

আবেগ তার রুম থেকে বের হলো। রোদেলাকে পাক্কা সাত দিন হাসপাতালে রাখতে হয়েছিল। সব মিলিয়ে অনেক খরচ হয়ে গিয়েছিল যার সবটা আবেগ নিজে পে করেছে। কিন্তু তারপর ও বিশ হাজার টাকা এখনো দিতে পারেনি। এই হাসপাতালে চাকরি করে জন্য সে থার্টি পাসেন্ট ডিসকাউন্ট পেয়েছে। তারপর ও বিশ হাজার ডিউ আছে। 

 

আবেগ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আকিকা করতে কত টাকা লাগবে? কুরবানী দিতে হবে। ছোট করে হলেও আকিকা করতে হবে। আজ-কালের মধ্যে হাসপাতালের বিল মেটাতে হবে। আবেগ মনে মনে ঠিক করল, আজকেই ব্যাংকে যাবে।  টাকা তুলবে। তার নিজের জমানো দশ লাখ টাকা আছে। সেখান থেকেই দুই লাখ তুলতে হবে৷ এই টাকা সে নেহাকে দেনমোহর দিবে বলে জমাচ্ছিল কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তা আর সম্ভব না। রোদেলাকে সে মাত্র বিশ হাজার টাকা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করেছে৷ আবেগের বুকে ফেটে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। 

 

তার অর্থের অভাব জিনিসটা একদম অপছন্দ  কিন্তু মধ্যবিত্ত প্রতিটা ঘরেই মনে হয় একবার না একবার অর্থের সংকট কাড়া নাড়বেই!

 

আবেগের মনে হচ্ছে তার যদি কোন টাকার গাছ থাকত তাইলে সেখান থেকে পাতা ছিড়ে ছিড়ে ব্যবহার করত সে! 

 

আবেগ বেশ ক্লান্ত। চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে না দিতেই ইর্মাজেন্সিতে ডাক পড়ল। অগত্যা সে উঠে পড়ল রোগী দেখতে যাওয়ার জন্য। 

 

★★★ 

রোদেলা সবেমাত্র বাবুকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে গোসল করাবে জন্য। হুট করে জাবেদা খাতুন এসে বাজখাঁই গলায় বললেন, এটা কোন সময় হলো বাচ্চা গোসল করানোর? বাচ্চাদের সকাল-সকাল গোসল দিতে হয়। বেলা পড়ে যাওয়ার পর না। এইসবের জ্ঞান যদি না থাকে তাহলে কেমনে হবে? এখন তো ঠান্ডা লেগে যাবে আর তোমাকে ডাক্তার নিচে হেলে বসতে মানা করেছে না? তাও কেন বসছো? 

 

–বাবুকে গোসল করানোর জন্য। দুই দিন ধরে গোসল করানো হয়না। 

 

জাবেদা খাতুন বললেন, উঠে দাড়াও৷ আমি ময়নার মাকে পাঠাচ্ছি৷ 

 

রোদেলা বাবুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জাবেদা খাতুন হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে আসলেন।কিছুক্ষন পর ই আবেগের বাসার সাহায্যকর্মী ময়নার মা এলেন। উনি এসে বাবুকে গোসল করিয়ে দিলেন৷  

 

বাবুকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রোদেলা  নিজে গোসল করতে গেল। 

 

আবেগ অফিস থেকে বের হলো। আজকে ব্যাংকে যাবে। কিছু কাগজ-পত্র লাগবে জন্য বাসায় এই অসময়ে ফিরে আসছে। একটা রিকশা ঠিক করে সেটায় বসতেই তার ফোন বাজতে লাগলো। সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল নেহার ফোন। সাথে সাথে তার চেহারার রং পালটে গেল। আবেগ ঢোক গিলল। এতোক্ষনে তার বিয়ের খবর নেহার কান অব্দি যাওয়ার কথা! 

 

সে ফোন ধরতেই নেহার কান্নার শব্দ পেল। ওপাশ  থেকে কেবল নেহা কেদেই যাচ্ছে। ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে সে৷ কোন কথা বলছে না। একবার অস্ফুট স্বরে আবেগ বলেছে শুধু। 

 

আবেগ ফোন কেটে দিল। কি যে হচ্ছে আর কি হবে কিছুই জানে না সে৷ শুধু স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলেছে সে! স্রোত যেদিকে যাচ্ছে সেও সেদিকে বয়ে চলছে! এছাড়া আর কি বা করার আছে তার? 

 

★★★

রোদেলা গোসল করে বের হতেই চমকে গেল। আবেগ একদম তার মুখ বরাবর দাড়িয়ে আছে।

 

 এই অসময়ে কেন ঘরে ফিরেছে আবেগ? মনে মনে বলে রোদেলা। সে আবেগের দিকে তাকালো। সম্পূর্ণ ঘেমে-নেয়ে একাকার সে! শার্টটা ঘামের জন্য ভিজে গেছে৷ 

 

আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে রোদেলা হাতে গামছা পেচিয়ে রেখেছে। চুল গুলো ভেজা। টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে রোদেলার চুল থেকে৷ 

 

আবেগ রোদেলাকে দেখতে লাগলো। রোদেলার চুল গুলো কোমড় পর্যন্ত ছড়ানো। আবেগ হুট করে রোদেলার হাত থেকে ভেজা গামছাটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। 

 

রোদেলা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থেকে। আস্তে করে বলে উঠে, আমার চুল মোছা হয় নি তো! 

 

আবেগ এই কথার জবাব দিল না।। 

 

কিছুক্ষন পর,

 

দুপুরে খেতে বসেছে সবাই। আবেগ ও বসেছে। রোদেলাও আবেগের পাশে বসে আছে। খেতে খেতে আবেগ সবার উদ্দেশ্য বলে, আগামী শুক্রবার বাবুর আকিকা করব।  আত্মীয়-স্বজন যাকে যাকে দাওয়াত দিতে চাও দিতে পারো। 

 

জাবেদা খাতুন কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আবেগের বাবা ইমতিয়াজ সাহেব বলে উঠে, আচ্ছা। ঠিক আছে। 

 

স্বামীর কথার বিরোধিতা না করতে পেরে জাবেদা খাতুন খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন। 

 

যা আবেগের চোখ এড়ালো না।

 

খাওয়ার পর  রোদেলা-আবেগ রুমে আসল। আবেগ রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, বাবু কে কি বলে ডাকো তুমি? 

 

রোদেলা শান্ত গলায় বলে, বাবু বলেই ডাকি। 

 

–কোন নাম ঠিক করেছো তুমি? 

 

–নাহ। 

 

–তাহলে কি নাম রাখতে চাও? 

 

রোদেলা কিছুক্ষন ভেবে বলে, পলাশ। 

 

আবেগ মুখ বাকিয়ে বলে, এটা কোন নাম? সেই পুরান আমলের। 

 

–তাহলে প্রেম রাখি? 

 

আবেগ আবারো বিরক্ত মাখা গলায় বলে, আমার ছেলে  কি সালমান খানের মুভির চরিত্র যে প্রেম নাম রাখব? 

 

রোদেলা আরো এক দফা বিষম খেল। তার ছেলেকে আবেগ নিজের সন্তান মানে? খুশিতে রোদেলার চোখ চিকচিক করতে লাগে। সে তা আবেগকে বুঝতে না দিয়ে বলে, তাহলে তুমিই ঠিক করো। 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা

Part–6

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আবেগ বিরক্তমাখা মুখ নিয়েই রোদেলাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রোদেলা এখনো অবাক হয়ে চোখ কিছু টা বড় করে আবেগের দিকে তাকিয়ে আছে। 

 

আবেগ তার ফোন রেখে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। 

 

সে বাথরুমে ঢুকতেই তার ফোন বাজতে লাগলো। ফোনের ভাইব্রেশন রোদেলার বুকে কম্পম সৃষ্টি করে। 

 

আবেগ বাথরুম থেকেই বলে উঠে, ফোনটা ধরো রোদেলা। 

 

একথাটা শোনার মিনিট এক পর রোদেলা ফোন ধরার জন্য টেবিলের কাছে গেল কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ফোন কেটে গেল। 

 

রোদেলা আবেগের ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল লিস্টে গেল। সে দেখল হাসপাতাল থেকে কল এসেছিল এটার দেখার পর পর ই রোদেলার চোখ নিচে যেতেই রোদেলা আরেকটা দফা কেপে উঠে। তার মাথা ভোভো করতে লাগে৷ স্ক্রিনে ইংরেজি ওয়াডে লেখা “Neha” 

 

রোদেলা অস্পষ্ট ভাবে নেহা বলে উঠে। 

 

ঠিক সেই সময় আবেগ বাথরুম থেকে বের হয়ে

এভাবে রোদেলাকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে যায় এবং ছো মেরে নিজের ফোনটা রোদেলার হাত থেকে কেড়ে নেয়। 

 

তারপর আবেগ কড়া গলায় বলে, কারো ফোন তার পারমিশন ছাড়া ধরতে হয় না৷ ইটস ব্যাড ম্যানারস। নেক্সট টাইম থেকে আমার ফোন আর ধরবা না।  

 

রোদেলার কানে আবেগের কোন কথাই যাচ্ছে না। তার মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে।বহু কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে এখুনি পা জোড়া গুরগুর করে ভেঙে যাবে। নেহার নাম আবেগের ফোনে দেখে রোদেলার বুকের ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো!

 

নেহা যদি তার কাছে জবাব চায়? কি জবাব দিবে সে ? ফ্রেন্ড হয়ে ফ্রেন্ডের সুখ কেড়ে নেওয়ার অপরাধ যে তার কাধে এসে জমবে৷ 

 

রোদেলার দুই চোখ বেয়ে দুই ফোটা অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়ে৷ 

 

আবেগ এখনো ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। চুল গুলো এখনো শুকায় নি। ভেজাই আছে। আবেগ মূলত রোদেলা কে পর্যবেক্ষন করছে। মেয়েটাকে দেখে অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে! কি এতো ভাবছে?

 

আবেগ আবারো রোদেলাকে পাশ কাটিয়ে বেডে গিয়ে বসল। সে ফোনের সেটিং এ গিয়ে পাসওয়ার্ড দিয়ে দিল। তারপর ফোন রেখে শুয়ে পড়ল। আধ ঘন্টা রেস্ট নিয়ে ব্যাংকে যেতে হবে তাকে।  চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতেই কানে বাবুর কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। সে চোখ খুলে দেখে রোদেলা রুমে নেই। কি আশ্চর্য! 

মেয়েটার কি বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই নাকি? বারবার বাচ্চা রেখে কই চলে যায়? 

 

বাচ্চা সামলাতেই জানে না!—বিরবিরিয়ে বলে উঠে আবেগ। তারপর বাবুকে কোলে তুলে নেয় এবং কান্না থামানোর চেষ্টায় নেমে যায়। 

 

★★★

 

নেহা বালিশে মুখ গুজে দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। এছাড়া তার আর কি করনীয় ই বা আছে? কাদা ছাড়া তার আর কোন অপশন নাই। কাদতে কাদতে হিচকি তুলে ফেলেছে সে। সেই সকাল থেকে একাধারে কেদেই যাচ্ছে নেহা। আজকে সকালে আবেগের বিয়ের খবরটা অথৈয়ের কাছ থেকে  পেয়েছে সে। অথচ আবেগ নিজে থেকে তাকে জানায় নি৷ জানাবেই না কোন মুখে? চোর কি কোন দিন চুরি করে বলে আমি চোর ওমুক জায়গায় চুরি করেছি।  ঠিক তেমন ই আবেগ ও ফোন দিয়ে কি বলত? নিজের প্রেমিকাকে তো আর নিজের বিয়ের কথা বলা যায় না?  

 

নেহা আবারো কেদে দিল। কি করবে সে এখন? আবেগ ছাড়া যে তার জীবন শুন্য! বুকের ভেতরের শুন্যতা নিয়ে সে কিভাবে বাকি জীবন পার করবে? কিভাবে? কিভাবে? —চিৎকার করে উঠে নেহা। তার এই আর্তনাদ সে কেবল নিজেই শুনতে পেল। 

 

★★★

রোদেলা চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে জাবেদা খাতুনের রুমের সামনে। মামা দুপুরের পর দোকানে যান। মামার ইলেকট্রনিক্সের দোকান আছে। সেখানেই বসেন মামা। দুপুরে খেতে আসেন বাসায়। 

 

রোদেলা বিড়ালের মতো ধীর পায়ে রুমে ঢুকল। মামী এই সময় চা খান। তাই আজকে সে বানিয়ে দিল। আগে প্রায় ই এই সময়টায় ক্লাস করে মামার বাসায় আসত। দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিয়ে বিকেলের দিকে আবেগ গিয়ে রেখে আসত তাকে। আবেগরা ফার্মগেট থাকে। ফার্মগেট থেকে ইডেন কলেজ অনেক কাছে হয় তাই রোদেলা মাঝে মাঝে আসত মামার বাসায়। তখন দেখত প্রায়ই মামী এই সময়টায় চা খেতেন। মামী রোদেলাকে তুই বলেই ডাকে কিন্তু কালকে থেকে তুমি করে ডাকছে। এতে বেশ হতাশ রোদেলা। কারন তার কাছে মনে হয় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের অন্যতম ভাষা হলো ‘তুই’। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ইংরেজিতে তুই বলে কোন শব্দ নাই। সবাই হচ্ছে ইউ (You)।

 

এই কারনে যারা রোদেলাকে তুই বলে ডাকে তাদেরকে সে একটু অন্য নজরে দেখে। 

 

রোদেলা মৃদ্যু সুরে মামী বলে ডেকে উঠে। 

 

জাবেদা খাতুন  শুয়ে ছিলেন। তাকে ডাকতে শুনে উঠে বসলেন বিছানার উপর৷ রোদেলা কে দেখে সে বুঝি একটু বেজার ই হলো। মুখটা কালো করে ভাবলেশহীন ভাবে বলে, কি চাই? 

 

–মামী তোমার জন্য চা বানালাম৷ 

 

উনি মুখ টা বাকিয়ে বলে, যতোসব আদিখ্যেত! এসব করে আমাকে গলাতে চাচ্ছিস তুই? আমি বরফ না চেয়ে গরম পেলেই গলে যাব৷এই জাবেদা খাতুনের   মনটা লোহার মতো শক্ত। তোর কোন কাজেই আমার মন গলবে না।যা আমার সামন থেকে। দূর হ। 

 

রোদেলা হালকা হেসে মনে মনে বলে, লোহাও ১৫৩৮°C তাপমাত্রাতে গলে যায় মামী!  

 

এইটুকু ভেবে সে মামীর রুমের বাইরে চলে আসে। 

 

রোদেলা যাওয়ার পরপর জাবেদা খাতুন টেবিল থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চা খেতে থাকেন। তার বড্ড চায়ের তৃষ্ণা পাচ্ছিল। কিন্তু উঠে গিয়ে চা বানানোর শক্তি পাচ্ছিল না সে।এই সময় চা খেতে পেরে বেশ ফ্রেস লাগছে তার! 

 

রোদেলা রুমে যেয়েই দেখে আবেগ বাবুকে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করছে৷ রোদেলাকে আসতে দেখে আবেগ তার কাছে গিয়ে বলে, 

 

তোমার সমস্যা টা কি বল তো,? বাচ্চা রেখে কোথায় হাওয়া হয়ে যাও বল তো শুনি? 

 

–আবেগ আমি রান্নাঘরে ছিলাম। 

 

আবগ আর কিছু বলল না। তার এখন যেতে হবে বাইরে এটা যেমন একটা কারন তেমনি আরেকটা কারন হলো তার রোদেলার সাথে কথা বলতে মন সায় দেয় না। ভালো লাগে না। কোথায় যেন একটা বাধা কাজ করে। সে রোদেলার কোলে বাবুকে দিয়ে হনহন করে রুম ছেড়ে বের হতে লাগলো। 

 

রোদেলা তড়িঘড়ি করে বলে, কোথায় যাচ্ছো এই সময়? 

 

আবেগ পেছনে না ফিরেই বলে, নান অফ ইউর বিজনেস। 

 

রোদেলা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রোদেলা একবার ঘড়িতে দেখে নিল। সময় জানান দিচ্ছে সাড়ে চারটা বাজে। এই অবেলায় কই যাচ্ছে আবেগ? রোদেলার মনে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু উত্তর মেলাতে পারল না সে৷ 

 

আবেগ ব্যাংকের কাজ শেষ করে বের হতেই আবারো নেহার ফোন আসল। আবেগ বুকে সাহস সঞ্চার করে ফোন রিসিভ করে। 

 

ওপাশ থেকে নেহার কান্না ভেসে আসছে৷ নেহার কান্নার শব্দ শুনে আবেগের বুকটা ছ্যাত করে উঠে। সে নরম স্বরে বলে, কান্না থামাও নেহা। স্টপ ক্রায়িং। 

 

এরপর পাক্কা দশ মিনিট উভয় পাশের ব্যক্তিরা নিরব। যার বেনিফিট কল সেন্টার পাচ্ছে।

 

নেহা কাপা স্বরে বলে, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। 

 

আবেগ ছোট বাক্যে জবাব দেয়, সম্ভব না। 

 

নেহা আবারো করুন সুরে বলে উঠে, প্লিজ!  

 

আবেগ নেহার অনুরোধ ফেলতে পারল না তাই তো নেহার বলা রেস্টুরেন্টে না চাওয়া সত্ত্বেও গেল। 

 

কখনো কখনো আমরা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু কাজ করে থাকি। আবেগের মনে হয়, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা যেসব কাজ করে বসি সেই সময় টা হচ্ছে সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর! ওই সময়টায় নিশ্বাস নিতেও যন্ত্রনা লাগে! 

 

আবেগ বসে আছে৷ ধানমন্ডির এক রেস্টুরেন্টে। তার সামনে নেহা বসে আছে। নেহাকে দেখার পর থেকে তার বারবার মনে হচ্ছে কেন এলো সে? না আসাই হাজার গুন বেটার ছিল। নেহার ফোলা ফোলা লাল টকটকে একদম রক্তজবার মতো চোখ দুটি দেখে যে তার বুকটা কেপে উঠল। এই সময় আবেগের বুকে কেউ স্টেথিস্কোপ ধরলে নিশ্চয়ই রেটিং অনেক পেত!  

 

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা হেসে বলে, কিছু ওর্ডার দিব? 

 

নেহা তার দিকে তাকালো একথা শুনে৷ 

 

নেহার সাথে চোখাচোখি হতেই আবেগের বুক হুহু করে উঠে তাও নিজেকে শক্ত করে বলে, তোমার ফেভারিট থাই স্যুপ আর অন্থন ওর্ডার দিই? 

 

নেহা কিছুটা উচু আওয়াজে বলে উঠে, আর ইউ জোকিং উইথ মি? 

 

— অভবিয়াসলি নো। 

 

নেহা থমথমে গলায় বলে উঠে, তুমি কি রোদেলাকে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছো? 

 

আবেগ একথার উত্তর না দিয়ে নেহার চোখের দিকে তাকালো। নেহার লাল চোখ দেখে যা যা বলতে চাচ্ছিল সব গুলিয়ে ফেলে সে। 

 

নেহা কঠিন গলায় বলে, কি হলো চুপ করে আছো কেন? উত্তর দাও। 

 

–হু।(ছোট করে) 

 

–হু কি?  ঠিক মতন জবাব দাও। চুপ থেকো না প্লিজ। তোমার নিরবতা আমার বুকে নতুন আশা জাগিয়ে তুলছে। 

 

আবেগ যান্ত্রিক গতিতে বলে উঠে, হুম। নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছি৷ 

 

একথা শুনে হতাশ হয় নেহা। মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে আবেগ নিজ ইচ্ছাতে বিয়ে করে নি কিন্তু আবেগের মুখে কথাটা শুনে মনে পুষে রাখা আশাটা কাচ ভাঙ্গার মতো টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

 

সে হতাশ হয়ে গেল এবং করুন গলায় বলে, আমার কথা ভাবলে না একবারো? আমি যে তোমাকে ছাড়া কিছুই বুঝি না! তাও আমাকে ফেলে দিলে? কি দোষ ছিল আমার আবেগ? 

 

আবেগ নেহার দিকে না তাকিয়ে বলে, তোমার বাবা আমাকে পছন্দ করেন না। 

 

–তো? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। প্লিজ তুমি ফিরে আসো। আমার তুমি ব্যতিত আর কিছু লাগবে না। কেবল এবং কেবলমাত্র তোমাকে চাই আমি! 

 

–ভুল সুত্র প্রয়োগ করেছো। ভুলে যাও আমাকে। (ক্লান্ত গলায়)  

 

নেহা কেদে দিয়ে বলে, আমার সবটা জুড়ে যে তুমি! কিভাবে ভুলি তোমায়? 

 

আবেগ এতোক্ষন ধরে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।  নেহাকে যা যা বলবে সেসব কথা গুছিয়ে নিয়ে নেহার কথা শেষ হতেই বলে উঠে, 

 

যখন আমরা কোন অংক করতে যেয়ে দেখি ভুল সুত্র প্রয়োগ করেছি তখন কি করি? ভুল সুত্রের মাধ্যমে আগাই? (নেহাকে প্রশ্ন করল) 

 

নেহা কিছু বলল না। 

 

আবেগ নিজ থেকে বলে দিল, নিশ্চয়ই না। পুরো অংকটা কেটে দিয়ে নতুন করে শুরু করি।  সঠিক ল এপ্লাই করি। ঠিক তেমনি আমি হয়তোবা তোমার জীবনে একটা ভুল সুত্র ছিলাম তাই তোমার হিসাব মিলছে না। আমাকে কেটে ফেলে নতুন সুত্র দিয়ে অংক করো। দেখো! মিলে যাবে। মুভ অন নেহা। 

 

নেহা বাজখাঁই গলায় বললো, খুব তো বললা মুভ অন করতে? কিন্তু কিভাবে? আমার তো একটা সুত্রই জানা আছে সেটা হলো তুমি। আর কিছু জানি না আমি আর না জানতে চাই। 

 

–উঠলাম। 

 

–আবেগ? 

 

আবেগ উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলে, একটা গনিত বইয়ে কিন্তু সব অংক থাকে না। পরীক্ষার হলে যা শিখেছি সেখান থেকে লিখি। হুবহু সব কিছু না পরীক্ষায় কমন পাওয়া যায় আর না জীবনে! খুজে নিতে হয়,বুঝে নিতে হয় আর শিখে যেতে হয়! আসি তাহলে। (শান্ত গলায়) 

 

নেহা আবেগের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল আর বলল, প্লিজ আমাকে একা রেখে যেও না। আমি পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে। খুব ভালোবাসে ফেলেছি তোমাকে। 

 

আবেগের কান অব্দি একথা গেল কিন্তু সে কিছু বললো না। কারন এই কঠিন কথাটার পাল্টা জবাব তার শব্দ ভান্ডারে নেই৷ 

 

আবেগ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো ।

 

রাস্তার সাইড দিয়ে বড় বড় পায়ে হাটছে।আগামীকাল শুক্রবার।   কুরবানির জন্য গরু আজকেই কিনবে। আবেগ ঠিক করেছে তার ছেলের নাম সাদবিন রহমান সমুদ্র রাখবে। 

 

জগৎ টা বড্ড অদ্ভুত! ক্লাস লাইনে রসায়ন পড়তে গিয়ে শিখেছিল কিছু বন্ধন ভেঙে তবেই নতুন বন্ধন সৃষ্টি হয়! আজকে এই শিক্ষাটা তার জীবনে ঘটে গেল। 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা

Part–7

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

চাই না মেয়ে তুমি অন্য কারও হও

পাবেনা কেউ তোমাকে তুমি অন্য 

কারো নও

চাইনা মেয়ে তুমি অন্য কারও হও

পাবেনা কেউ তোমাকে তুমি অন্য 

 কারো নও

তুমি তো আমারই যানোনা হো ও ও ও

এ হৃদয় তোমারই ও ও ও

তোমাকে ছাড়া আমি,

বুঝি না কোন কিছু যে আর 

পৃথিবী যেনে যাক 

তুমি শুধু আমার! 

 

আবেগ পরম আবেশে চোখ বুঝে গান গাচ্ছে আর লুকিয়ে  লুকিয়ে রোদেলা মুগ্ধ নয়নে তাকে দেখেই যাচ্ছে। রোদেলার মনে হচ্ছে গানটা আবেগ তার জন্যই গাচ্ছে। তাকে ডেডিকেট করেই গাওয়া হচ্ছে এই গান। আবেগের কন্ঠে  গানটা  শুনে রোদেলার সদ্য প্রেমে পড়া হৃদয় বারবার বলে উঠে, আবেগ বুঝি তাকে ছাড়া কিছু বুঝে না৷ সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চায় সে রোদেলাকে ভালোবাসে। আবেগের মুখ থেকে “তুমি তো আমারই যানোনা হো ও ও ও ” লাইন টা শোনা মাত্র রোদেলার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। বুকের ভেতর রঙিন পাখি ডানা ঝাপ্টাতে লাগলো সেই সাথে দুচোখ জুড়ে লাল-নীল-সবুজ স্বপ্নেরা উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে। রোদেলার মনে জমা সব স্বপ্নের শুরু ও আবেগ দিয়ে, সমাপ্ত ও আবেগের মাধ্যমে! এমন কি মাঝের সেতু ও তো আবেগ! 

 

সময়টা রোদেলার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার  পরের কাহিনি।  সে ফার্মগেটে রেটিনায় কোচিং করার জন্য আবেগদের বাসায় উঠেছে। ফার্মগেটে  সব ভর্তি কোচিংয়ের মূল ব্যাঞ্চ তাই রোদেলাকে ফার্মগেটের রেটিনায় ভর্তি করানো হলো। রোদেলার বাসা মিরপুর। রেটিনায় সে টানা তিন দিন ক্লাস করার সিডিউল নেয় এজন্য সপ্তাহের তিন দিন আবেগদের বাসায় থাকত আর সপ্তাহের অন্যান্য দিন নিজের বাসায় পড়াশোনা করত।  

 

রোদেলা গতকালকে মামার বাসায় এসেছে৷ কালকে বিকেলের পর এসেছে। তার বাবা এসে রেখে গেছেন। কালকে আসা থেকে রোদেলা আবেগকে এক ঝলক দেখার জন্য ছটফট করছে কিন্তু সাহেবের দেখা মিললে তো! হবু ডাক্তার সাহেব তো তার রুমে পড়া নিয়ে ব্যস্ত। কারো সাথে সাক্ষাৎ করার টাইম নেই তার। আগামীকাল নাকি আবেগের প্রফ। এমনটাই শুনল রোদেলা মামীর কাছ থেকে। 

 

তাই তো মনের ছটফটানি নিয়ে সারা সন্ধ্যা পার করে দিল রোদেলা। মনে তীব্র আশা ছিল রাতে খাওয়ার টেবিলে দেখা হবে তাদের কিন্তু তার আশার আলোকে অন্ধকার করে দিয়ে আবেগ খেতে বের হলো না কারন তার নাকি পড়া শেষ হয় নি এখনো বাকি আছে। বাকি পড়া সে তার রুমে খেতে খেতেই পড়বে। 

 

খাওয়ার টেবিলে মামী বললেন, ছেলেটা আমার সেই বিকাল পাচটায় পড়তে বসছে আর এখন সাড়ে দশটা  বাজে! দেখো তো এখনো ওর নাকি পড়াই শেষ হয় নি। 

 

রোদেলা হালকা হেসে দিল। 

 

মামী তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মেডিকেলে কিন্তু অনেক পড়া। সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে বসে থাকতে হবে রে রোদেলা! আবেগকেই দেখ, দিন নাই রাত নাই, খালি পড়া আর ক্লাস! প্রতিদিন  ই ক্লাস টেস্ট হ্যান-ত্যান। জানো না তো! আবেগ যেদিন এটোপসি ক্লাস করে এসেছিল বেচারা আমার ছেলেটা রাতে ভাত খাইতেই পারে নি। যেই শার্ট পড়ে লাশঘরে ঢুকছে ওই টা আর কোন দিন পড়ে নি ও। 

 

রোদেলা ছোট করে ও বলে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগলো। তার খেতে অস্বস্তি লাগছে। আজকে মেন্যুতে গরুর কলিজা। রোদেলা গরুর কলিজা খায় না।  কেমন যেন লাগে তার । তাই খেতে পারে না। খিদাও পেয়েছে বেশ।

 

 রোদেলার মনে হয়,অন্য কোথায় বেড়াতে গেলে খিদা বেশি লাগে৷ 

 

রোদেলা খাচ্ছে না দেখে মামা জিজ্ঞেস করল, কি রে? খাচ্ছিস  না কেন? তরকারি ভালো লাগে নি? 

 

তখনি ইভানা হুট করে বলে দিল, আল্লাহ! রোদেলা আপু তো কলিজা খায় না৷ 

 

মামা চিন্তিত মুখ নিয়ে বলে, আগে বলবি না? এই ময়নার মা জলদি একটা ডিম ভাজো তো। 

 

রোদেলা ইতস্তত করে বলে  মামা, লাগবে না। ঝোল দিয়ে খেয়ে নিব। 

 

–আরে কেন? এখনি ভাজা হয়ে যাবে। ময়নার মা একটু জলদি করো। 

 

ময়নার মা৷ রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলে, জি ভাজতে দিসি তা পিয়াজ-মরিচ দিব ডিম ভাজিতে? 

 

রোদেলা বলল, হ্যা দিয়েন৷ 

 

ময়নার মা বলে, আচ্ছা। আবেগ বাবা আবার ডিম ভাজিতে পিয়াজ-মরিচ খায় না তো তাই জিজ্ঞেস করলাম। 

 

মামা বলে উঠে, আবেগের তো গরুর কলিজা খুব পছন্দ। খেয়েছে ও? 

 

মামী জবাব দিল। হ্যা। 

 

রোদেলা একথা শুনে মৃদ্যু হাসল। 

 

পরের দিন ঘুম থেকে উঠার আগেই আবেগ চলে যায় প্রফ দিতে। 

 

রোদেলা নিজেও কোচিংয়ে যায়। বিকেলে এসে ফ্রেস হয়ে হাতে এক কাপ চা নিয়ে ছাদে উঠে যায় এবং তখনি আবেগের কন্ঠে এই গান শুনে তার মন-মেজাজ মূহুর্তের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। সব ক্লান্তি চুকে যায়৷ মনে কেবল ভালোবাসার রঙ উড়াউড়ি করতে লাগে। সেই অনুভূতির কথা হয়তো লিখে প্রকাশ করা যাবেনা।

 

হুট করে বাবুর আওয়াজে অতীতের এক মধুর বিশেষ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো রোদেলা। এতোক্ষন ধরে সে ভাবনার জগতে বিরাজ করছিল এখন বর্তমানে এসে পৌছালো। 

 

সে  দ্রুত বাবুর কাছে ছুটে যায় আর বাবুকে কোলে তুলে নেয়। সাথে সাথে বাবু কান্না থামিয়ে দেয়। 

 

★★★

 

নেহা এখনো রেস্টুরেন্টেই বসে আছে৷ উঠার কোন নাম-গন্ধ নাই। সে অনবরত কেদেই যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের মানুষ বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু বলছে না। সবাই শুধু দেখেই যাচ্ছে৷ 

 

কিছুক্ষন পর রেস্টুরেন্টে অথৈ ঢুকে হন্ন হয়ে নেহাকে খুজতে লাগলো। 

 

অথৈয়ের চোখ কর্ণারের টেবিলে গিয়ে ঠেকল। সে দেখল নেহা চেয়ারে বসে কেদেই যাচ্ছে। তাকে দেখে অথৈয়ের কষ্ট হতে লাগে। সে বড় বড় পা ফেলে নেহার কাছে গেল এবং নেহার কাধে হাত রাখল। 

 

কাধে হাত রাখা সত্ত্বেও নেহার মনে কোন ভাবান্তর হলো না। তাই অথৈ নেহাকে তার দিকে ঘুরিয়ে নেয় এবং নেহাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, কান্না থামা আর আবেগ ভাই কই?

 

একথা শুনে নেহা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, কোথায় আবার? বউয়ের কাছে গেছে৷ 

 

অথৈ ভ্রু কুচকে বলে, তোকে এই অবস্থায় রেখে চলে গেল? 

 

নেহা কান্না থামিয়ে বলে, কেন যাবে না? কে হই আমি ওর? যে সাথে থাকবে? কেউ হই না।  

 

–আচ্ছা, আচ্ছা। এগজ্যাক্টলী কি কি বলেছে ভাইয়া তোকে?  

 

নেহা অসহায় গলায় বলে, কি আর বলবে? জাস্ট বলেছে  মুভ অন করতে।

 

অথৈ হা হয়ে গেল। সে আবেগের কাছ থেকে এটা মোটেও আশা করে নি। আবেগকে সে যথেষ্ট সম্মান করে। অথৈ ভাবতেও পারেনি আবেগ এভাবে  নেহাকে ডিচ করবে! সে আহত গলায় বলে, মুভ অন মানে? 

 

নেহা দাতে দাত চেপে বলে, ওকে ভুলে যেতে বলেছে। 

 

–হুয়াট! আর রোদেলা,,, অথৈ এইটুকু বলতেই

 

 নেহা রাগী স্বরে চেচিয়ে বলে, খবরদার ওই মেয়ের নাম আমার সামনে নিবি না! সি ইজ এ বিচ! আমার সব কেড়ে নিল। দেখিস রোদেলা কোন দিন সুখী হবেনা। কোন দিন ও না,,,,,,,,কেদে দিয়ে বলে নেহা। 

 

নেহার কথা শুনে অথৈয়ের কষ্ট হতে লাগে। কারন রোদেলাও তার বেস্টফ্রেন্ড। সে শুধু বলল, এভাবে বলিস না রে! 

 

–কেন বলব না? কারো সুখ কেড়ে নিয়ে কেউ সুখী হয় না। 

 

–দেখ! এখানে ওর কি করার ছিল। 

 

নেহা কেদে দিল এবং বলল, ওর হাতেই সব ছিল৷ কেন ও আমার আবেগকে বিয়ে করল? হুয়াই? আই ওয়ান্ট মাই আন্সার! রোদেলা কে প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। অনেক বোঝাপোড়া বাকি ওর সাথে! 

 

অথৈ বলে উঠে, চল বাসাই যাই। 

 

নেহা বলে উঠে, চল। 

 

নেহা গাড়ি সঙ্গে এনেছিল। অথৈ তাকে গাড়ি তে বসিয়ে দিল। নেহার গাড়ি চলা শুরু করলে অথৈ মনে মনে বলে।,পাচ বছর ধরে রিলেশন করার পর এখন কিভাবে আবেগ ভাই নেহাকে এভাবে চিট করে? আর কোন মুখেই বা বলে মুভ অন করতে! এরপর সে আবারো বলে উঠে, আমি তো ভুলেই গিয়েছি আবেগ ভাই কার বন্ধু। দুই বন্ধুর মধ্যে মিল না থাকলে বন্ধু হলো কিভাবে? তাই কাজ-কর্মে তো সাদৃশ্য থাকবেই! 

 

★★★

আবেগ তার এক পরিচিত ভাইয়ের মাধ্যমে পঞ্চাশ  হাজার টাকা দিয়ে একটা গরু কিনল।আজকে রাতে গরুটাকে গ্যারেজে রাখবে। কালকে সকালের মধ্যে ই কুরবানি দিবে৷ মওলানা আর কশাইয়ের সাথে কথা বলে ফেলেছে।

 

আবেগের ঘরে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সে এসে কোন  দিকে না তাকিয়েই রমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে শুয়ে পড়ে। শোয়ার আগে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় রোদেলা আছে কিনা। কিন্তু নাহ সেই সময় রোদেলা রুমে উপস্থিত ছিল না। আবেগ চোখ বন্ধ করে ফেলে। বড্ড ক্লান্ত সে। 

 

এদিকে রোদেলা বাবুকে নিয়ে ইভানার রুমে বসে আছে। একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছিল না দেখে ইভানার রুমে এসে বসে আছে সে। ইভানার সাথে গল্প-গুজব করার জন্য আবেগ যে ঘরে এসেছে তা বুঝতে পারেনি সে। কেবল সাড়ে আটটা  বাজে। এই বাসায় দশটার আগে কেউ ডিনার করে না।  

 

 আরো বেশ কিছুক্ষন পর রোদেলা কি মনে করে বাবুকে ইভানার কাছে রেখে তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে ঢুকতেই আবেগের গায়ের গন্ধ ভেসে উঠে তার নাকে। সে চোখ বুলিয়ে দেখে আবেগ বিছানায় শুয়ে আছে৷ মনে হয় ঘুমাচ্ছে। রোদেলা রুমে ঢুকতেই গরুর হ্যাম্বা হ্যাম্বা শব্দ শুনতে পেল।

 

রোদেলা অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে যায়। এখন তো কুরবানির ঈদ না। ঢাকা শহরে কুরবানির ঈদ ছাড়া গরু-ছাগলের ডাক শোনা যায় না। 

 

সে আবেগের কাছে গিয়ে আবেগকে ডাকতে লাগে।

 

আবেগের ঘুম মাত্র লেগে এসেছিল।আর তখনি রোদেলার আওয়াজ শুনে সে বিরক্ত হয়ে পড়ল। মন-মেজাজ কিছু টা খারাপ করে চোখ খুলল। চোখের খোলার আগে সে ঠিক করে নেয় রোদেলা কে চরম কিছু কঠিন কথা বলবে। কিন্তু চোখ খোলার পর চোখের সামনে রোদেলাকে দেখে সে আর কিছু বলতে পারল না। রোদেলা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রোদেলার চোখে উপচে পড়া মায়া! এই মায়ার অতলে যে কেউ ডুবে যায়!  

 

সেজন্য আবেগ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আবেগের মতে যেখানে মায়া আছে সেখানেই আগুন লুকিয়ে  থাকে! মায়াকে নাগাল পেলেই আগুনে পুড়বে। তাই তো মায়া থেকে দূরে থাকতে চায় কিন্তু চাইলেই কি আর পারা যায়। বারবার মায়ায় জড়াতে হচ্ছে। আগুনে পুড়তে হচ্ছে। 

ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়! 

 

আবেগ রাগ করার ভান করে বলে, চেচাচ্ছো কেন? 

 

রোদেলা মুখ কাচুমাচু করে বলে, গরু। 

 

আবেগ এবার সত্যি সত্যি রেগে গিয়ে বলে, কিহ? তুমি আমাকে গরু বললা? হাউ ডেয়ার ইউ? আমি সোরোয়ার্দী মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পাশ করছি আর আমাকে গরু বলছো? (কর্কশ কন্ঠে)

 

রোদেলা হন্তদন্ত করে বলে, না তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি তোমাকে কেন গরু বলব? আমি তো বলতে চাচ্ছিলাম গরুর ডাক কোথা থেকে আসছে। 

 

আবেগ বিরক্ত হয়ে গেল এবং বলল, কোথাও থেকে আসছে না। এই ফালতু কথা বলার জন্য আমার ঘুম নষ্ট করলে? 

 

বলে আবেগ আবারো শুয়ে পড়ে যেই না চোখ বন্ধ করল ওমনি গরু ডেকে উঠে। আর রোদেলাও এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে, এই যে গরু ভ্যাবাচ্ছে । শুনতে পেয়েছো? 

 

আবেগ আরেক দফা বিরক্ত হয়ে বলে উঠে, গরুর ভ্যাবানির না শুনলেও তোমার ভ্যাবানির শব্দ  স্পষ্ট শুনেছি। 

 

একথা শুনে রোদেলা মুখ কালো করে বলে,কোথা থেকে আসছে শব্দ? 

 

–নিচ থেকে। গরু কিনে এনেছি।  কালকে আকিকা করা হবে। সকাল দশটার আগেই কুরবানি হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। 

 

আবেগের জবাব শুনে আর কিছু বললো না রোদেলা। চুপচাপ থাকলো। সে রাতে আর আবেগ উঠে নি। এক ঘুমে রাত পার। কিন্তু রোদেলার ঘুম হয় নি। 

 

আবেগের প্রতি রোদেলার পুরোনো অনুভূতিদ্বয় পুরনায় মনের মধ্যে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। 

 

রোদেলা কোথায় যেন পড়েছিল, আমরা নাকি কারো ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ি! তার ক্ষেত্রে ও বুঝি তাই হচ্ছে! 

 

পুরোনো সব জিনিসের মূল্য কমে যায় কদর শেষ হয়ে যায়। কিন্তু  পুরোনো অনুভূতির মূল্য দিন দিন আরো বেড়ে যায়! 

 

রোদেলা আবেগের দিকে তাকালো। তার মনের মধ্যে জলোচ্ছ্বাস বয়ে যেতে লাগলো। 

 

পরের দিন পরিকল্পনা মাফিক দশটার মধ্যে কুরবানী হয়ে যায়। মওলানা এসে দোয়া পড়ে আকিকা করে । নাম আবেগ যা ঠিক করেছে সেটাই রাখা হলো। 

 

নামটা রোদেলার বেশ মনে ধরেছে।” সমুদ্র” খুবই সুন্দর নাম। এই নামটা বুঝি কোন দিন পুরোনো হবে না। রোদেলা খুব করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করল তার ছেলেটার মন ও যেন সমুদ্রের মতো সুবিশাল হয়। 

 

কুরবানির মাংস সমান তিন ভাগ করা হলো। এক ভাগ গরীবদের জন্য, আরেক ভাগ আত্মীয়ের জন্য আর শেষ ভাগ তাদের জন্য। সব বিতরনের পর কয়েক কেজি মাংস ময়নার মা রান্না করার জন্য বসিয়ে দিল। আত্মীয় তেমন কেউ আসেনি। হাতে গোনা কয়েকজন আত্মীয় এসেছে। যারা এসেছে তাদের সাথে আবেগ আর রোদেলার রক্তের সম্পর্ক। 

 

সমুদ্রের চুল কামানো হলো।

 

সব কাজ শেষ করে বাসায় ঢুকতেই আবেগের কানে আসল, তার মা ড্রয়িং রুমে বসে তার চাচীর সাথে দুঃখ প্রকাশ করে বলছে, এই দিন ও দেখা লাগলো! আমার ছেলে অন্য বংশের ছেলের আকিকা দিচ্ছে। কি কপাল আমার। 

 

আবেগ ঘরে ঢুকতেই তার মা চুপ হয়ে গেলেন। আবেগ পালটা জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। 

 

এদিকে রোদেলা সমুদ্রকে খাইয়ে মাত্র উঠলো তাতেই তার ফোনে কল আসে৷ 

 

সে ফোন হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। 

 

রোদেলা রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে, হ্যালো?।

 

অপর প্রান্তের লোক চুপ। রোদেলা আবারো বলে, কে বলছেন? 

 

ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠে বলে, কেমন আছো জানেমন! 

 

রোদেলা এই কন্ঠ শুনে অস্ফুটস্বরে বলে উঠে, রি,,,,,রি,,রিশা,,,দ! 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা

Part–8

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রোদেলা দরদর করে ঘামতে লাগল। আশেপাশে সব অন্ধকার দেখতে লাগলো। মাথার মধ্যে চিনচিন ব্যথা করা শুরু করলো তার। বড় বড় ঢোক গিলতে লাগলো সে। প্রচুর তৃষ্ণা পেতে লাগলো তার। রিশাদ তাকে কল দিয়েছে৷ এটা যেন আজরাইল দেখার চেয়েও ভয়ংকর তার কাছে!  কিন্তু কেন? এতো কিছুর পর ও কি চাই তার? 

 

রোদেলা ভয় পেতে শুরু করে৷ ওপাশ থেকে রিশাদের ভয়েস আবারো পেল। রিশাদের কন্ঠ শুনতেই রোদেলার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। চোখ-মুখ রক্তশুন্য হতে লাগলো। 

 

রোদেলার মুখ দিয়ে কোন শব্দ ই বের হতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরে রেখেছে৷ 

 

রিশাদ বলে উঠে, কি গো সুন্দরী! কি করছো? কেমন আছো? আমার কথা মনে আছে? আমি তোমার স্বামী! 

 

রোদেলা অনেক কষ্টে বলে উঠে,  আমার স্বামী  আবেগ।  আমার হাসবেন্ড আবেগ তুমি না।  আর কি চাই? 

 

রিশাদ হোহো করে শয়তানী হেসে বলে, তোমাকে চাই গো! 

 

–জাস্ট সাট আপ। 

 

–আমি তোমাকে নিতে আসছি। আমার ছেলেটাকে কত দিন ধরে দেখি না! 

 

রোদেলা মনে সাহস জুগিয়ে বলে উঠে, কে তোর ছেলে? সমুদ্র শুধু মাত্র আমার ছেলে। 

 

ওপাশ থেকে রিশাদ বলে, বাহ! সমুদ্র নামটা তো দারুণ! তবে তোমার আর আমার  নাম থেকে মিলিয়ে রাখলে বেটার হত। আফটার ওল, বাবা-মায়ের অংশ ই সন্তান! 

 

–খবরদার সকুদ্রকে নিজের ছেলে বলবে না৷ 

 

–কেন বলবো না? আমার রক্ত বইছে আমার ছেলের গায়ে! অস্বীকার তো করা যাবে না। 

 

রোদেলা কঠিন গলায় বলে, এখন তোর ছেলে? আগে তো মেরে ফেলতে চাইতি। এখন কোন সাহসে বলিস আমার ছেলে তোর ছেলে হয়? 

 

–কি করব বল? পিতৃত্ব বোধ জেগে উঠছে। হাহাহা। 

 

–জানোয়ার তুই একটা! ভুলে ও আমার ছেলের দিকে নজর দিবি না। ও শুধু আমার ছেলে। মনে রাখিস, জন্ম দিলেই পিতা হওয়া যায় না৷ 

 

একথা শুনে রিশাদ বলে উঠে, একটু ভুল বললে জানেমন! জন্ম আমি দিই নি তো তুমি দিয়েছো। আমি জাস্ট স্পার্ম সাপ্লাই দিয়েছি। 

 

রোদেলা এটুকু শুনে ফোনের লাইন কেটে দিল। 

 

ফোন কেটে দিয়েই সে ধপাস করে বিছানায় বসে কান্না করতে লাগলো। কি হচ্ছে তার সাথে? রিশাদ কেন আবার ঝামেলা করছে। রিশাদ যেন কোন ঝামেলা করতে না পারে সেজন্য ই তো আবেগকে বিয়ে করেছে। ডিভোর্স এর পর ও রিশাদ রোদেলাকে হ্যারেস করছিল। বারবার ফোর্স করছিল যেন রোদেলা আবারো ফিরে আসে তার কাছে। কিন্তু ডিভোর্স তো হয়ে গেছে ততোদিনে! 

 

কিন্তু  এই ডিভোর্স নাকি রিশাদ মানে না। তাই তার বউকে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। যেহুতু রিশাদ ক্ষমতাসীন তাই রিশাদ তিন দিন আগে রোদেলাদের বাসায় হামলা করে৷ ভাগ্যিস কোন ক্ষতি করতে পারেনি রিশাদ তাদের। পাড়ার সব ছেলে-পুরুষ আর প্রতিবেশী রা এসে রোদেলা আর তার মা-বাবা কে বাচিয়ে দিয়েছিল। রিশাদ হাতে-গোনা দশটা ছেলে আনছিল আর রোদেলাদের এলাকার অনেক মানুষ  এক জোট হয়ে সেদিন রক্ষা করেছিল রোদেলাকে। এতো মানুষ দেখে ঘাবড়ে যায় রিশাদ তাই তো সুরসুর করে পালিয়ে যায়। সেদিন রাতেই মামা সিদ্ধান্ত নেন যেন রোদেলার বিয়ে আবেগের সাথে হবে। আর তার পর দিন ই বিয়ে হয়ে গেল। রোদেলা নিজেও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল রিশাদের এমন আক্রমণে। সে আর কোন ভাবেই রিশাদের কাছে ফিরতে চায় না। মরে গেলেও না। আর সমুদ্রের সুরক্ষার জন্য হলে বাধ্য হয়ে স্বার্থপরের মতো আবেগকে বিয়ে করে নিজের মাথার উপর একটা ঢাল বানিয়ে নিল। একটা বিবাহিত মেয়েকে তো আর রিশাদ হ্যারেস করতে পারবে না। রোদেলার মা-বাবা রোদেলার বিয়ে দিয়েই গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। ওখানে রোদেলাদের সব  আত্মীয় স্বজনরা থাকে। গ্রামে রোদেলার বাবা অনেক সম্ভ্রান্ত ঘরের লোক তাই সেইভ থাকবে গ্রামে। রোদেলাকে রিশাদের মতো পিচাশের জন্য বাচানোর জন্য ই তার  মামা তথা ইমতিয়াজ রহমান তার ছেলের সাথে রোদেলার বিয়ে দিয়ে দেন এবং রোদেলার মা-বাবা কে গ্রামে পাঠিয়ে দেন। 

 

রোদেলা জানে সে খুব স্বার্থপরের মতো কাজ করে ফেলেছে। আবেগ আর নেহার মধ্যে চলে এসেছে৷ কিন্তু কি করবে? মায়েরা তো স্বার্থপর ই হয়! সন্তানের সুরক্ষা আর সুখ ছাড়া কিছু বুঝি না। 

 

রিশাদের এমন আক্রমণে রোদেলা খুব ভয় পেয়ে গেছে কারন রিশাদের এভাবে হামলা করার একমাত্র কারন হলো সমুদ্র। রিশাদ কোন কালেই চাইত না রোদেলার বাচ্চা ভূমিষ্ট হোক। যখন থেকে তারা বাবু হওয়ার খবর পেয়েছে রিশাদের অত্যাচার বেড়ে যায়। রিশাদ অনেক চেষ্টা করেছিল রোদেলাকে এবার্শন করানোর কিন্তু রোদেলা তার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল৷ সে কিছুতেই তার বাচ্চাকে মারবে না। চারমাস প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায় সে তার বাবার বাসা চলে আসে। তাই তো বাচ্চাটাকে রক্ষা করতে পেরেছিল রোদেলা। 

 

কাহিনি যদি এখানেই শেষ হতো তাও মানা যেত কিন্তু এরপর রিশাদ যা করেছিল সেটা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। একজন  সুস্থ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব কিনা জানে না রোদেলা। 

 

রোদেলার প্রেগ্ন্যাসির লাস্ট উইক চলছিল। এক সপ্তাহ পর ডেলিভারি ডেট। সেদিন বিকেলে রিশাদ হুট করে রোদেলার বাসায় চলে আসে। তখনো রোদেলা আর রিশাদের ডিভোর্স হয় নি। প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায় নাকি ডিভোর্স বা বিয়ে হয় না তাই ডিভোর্স স্থগিত ছিল। 

 

যেদিন বিকেলে রিশাদ আসে ওই দিন রোদেলা বাসায় একা ছিল। রোদেলার মা-বাবা একটু বাইরে গিয়েছিল। হয়তোবা রিশাদ তাদের উপর নজরদারি রাখত তাই রোদেলার বাবা-মায়ের অনুপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। তাই তো রিশাদ  বাসায় ঢুকে রোদেলার পেট বরাবর লাথি মারে। তার  একটাই কথা — বাচ্চা চাই না। এই বাচ্চাকে নাকি সে কিছুতেই পৃথিবীতে আসতে দিবে না।

 

 অথচ আজকে কি বলছে পিতৃত্ববোধ আসছে তার মধ্যে! 

 

ওই দিন রোদেলা মরতে মরতে বাচছে। আল্লাহ বুঝি আবেগকে উছিলা করে পাঠিয়েছিল রোদেলা কে বাচানোর জন্য। 

 

রিশাদ রোদেলার পেটে লাথি মারলে রোদেলা সেই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়। হয়তো ব্লিডিং শুরু হয়ে গিয়েছিল ততোক্ষনে । 

 

এরপর আর রোদেলার কিছু মনে নেই। বাকিটা মায়ের মুখে শুনেছিল রোদেলা। আবেগ নাকি তাকে দেখতে এসেছিল আর ভেতরে ঢুকে রোদেলাকে এভাবে  মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে এবং  তারপর দ্রুত হাসপাতালে এডমিট করায়,,,,,,,

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা

Part–9

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

ভাতের মাড় গালতে রান্নাঘরে ঢুকল মেঘ। সে একটা চামচে করে ভাতের হাড়ি থেকে কয়েকদানা ভাত উঠিয়ে হাত দিয়ে দেখে নিল ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা। না হয় নি। এখনো কিছুটা শক্ত আছে। সে মুখটা বিকৃত করল। আজকে ভাত আর ডিম ভাজি খেতে হবে তাকে। আর ভালো লাগে না। বাইরেও তো খাওয়া সম্ভব না রোজ রোজ। কিন্তু এই একই খাবার খেতে খেতে ডিম ভাজির উপর বিরক্ত ধরে গেছে তার! 

 

কিন্তু কিছু করার নাই। সে ডিম ভাজি ছাড়া আর কিছু ই পারে না৷ 

 

মেঘ দ্রুত ভাতের মাড় ফেলল। মেঘ মনে মনে ঠিক করল কালকে থেকে বসা ভাত খাবে। তাইলে আর এই মাড় গালা নিয়ে ঝামেলা থাকবে না। 

 

কোথায় এই বয়সে বউ মজার মজার রান্না করবে আর সে আয়েস করে খাবে তা না হয়ে,।

 

তাকে বাধ্য হয়ে টানা পনের দিন ধরে  ডিম ভাজি আর ভাত খেয়ে যেতে হচ্ছে। এটাই বুঝি ‘তার’ দেওয়া অভিশাপ । 

 

‘তার’ কথা মনে পড়তেই মেঘের ঠোঁটের ডগায় হাসির রেখা ফুটে উঠল। 

 

“কন্যা তোমার দেওয়া কালো যাদুর তাবিজ ও আমার জন্য শুভ!”বিরবির করে বলে উঠে মেঘ। 

 

মেঘ খাওয়া শেষ করে ফোন হাতে নিল। তারপর আবেগকে কল লাগালো। আবেগের সাথে কথা বলা দরকার। পড়শু বিয়ে হয়েছে। আবেগের বিয়েতে গেস্ট হিসেবে বুঝি সে একাই ছিল। মেঘ আবেগের জন্য খুব খুশি। কারন রোদেলা আবেগকে খুব ভালোবাসে এটা তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আর তাছাড়া মেঘের কেন জানি রোদেলার উপর একটা মায়া কাজ করে। উহু! ভালোবাসার মায়া নয়, স্নেহের মায়া কাজ করে। যেটা নেহার জন্য একটু কম কাজ করে। মানুষ অনেক স্বার্থপর! 

 

এই যে আবেগের সাথে রোদেলার বিয়ে হওয়ায় সে সবচেয়ে খুশি! অথচ নেহার জন্য সে খুব একটা কষ্ট পাচ্ছে না। 

 

ফোনটা কেটে গেল। মেঘ কিছুটা অবাক হলো। আবেগ কোন দিন তার কল ইগনোর করে না। আজ কি হলো তবে? 

 

মেঘ হেসে দিয়ে  ভাবলো সংসার নিয়ে ব্যস্ত বুঝি আমার বন্ধু ! 

 

★★★

 

এদিকে আবেগ রুমে ঢুকতেই দেখল রোদেলা কাদছে। আবেগের মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না। আবেগ বুঝে পাচ্ছে না —হুট করে সে এতো কঠোর কেন হয়ে গেল? 

 

কালকে নেহাকে কান্না করতে দেখেও তার খুব যে কষ্ট হয়েছে এটা বললে তা ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই না। তার মধ্যে কোন কিছুর অনুভূতি জাগছে। কারো কথাই কানে যাচ্ছে না। 

 

আবেগ এক পলক রোদেলাকে দেখে নিয়ে বাথরুমে গেল। 

 

বাথরুমের গেট লাগানোর শব্দে রোদেলা টের পেল আবেগ রুমে এসেছে। সে দ্রুত তার চোখ মুছে নিল। আবেগ কে কি বলবে রিশাদ কল করেছে? নাকি ব্যাপার টা চেপে যাবে? এম্নিতেই আবেগ তার জন্য খুব টেনশনে আছে। আর এক্সট্রা ভাবে তার টেনশন বাড়ানো কি ঠিক হবে? 

 

ঠিক সেই সময় রোদেলার ফোন বাজতে লাগলো। ফোনের রিংয়ে সে কেপে উঠে। ভয় পেয়ে যায়। যদি আবার রিশাদ হয়? 

 

রোদেলা ফোনের স্ক্রিন দেখে স্বস্তি পেল। মেঘ ভাইয়ার কল। সে দ্রুত ফোন রিসিভ করল। 

 

ওপাশ থেকে মেঘ বলে উঠে, আবেগ কোথায়? 

 

রোদেলা হালকা আওয়াজে বলে, বাথরুমে গেছে। 

 

–ও আচ্ছা। 

 

–আপনি আসলেন না কেন? 

 

–সর‍্যি। আজকে ব্যস্ত ছিলাম। কালকে আসব। আমার জন্য গরুর মাংস রেখে দাও আর কালকে এসে বাবুকে দেখে যাব। আর উপহার ও দিব। 

 

–লাগবে না ভাইয়া। শুধু দোয়া করবেন আর কিছু লাগবে না। 

 

মেঘ ওপাশ থেকে বলে উঠে, তোমার ভয়েস এমন শুনাচ্ছে কেন? কাদছিলে কি? 

 

–নাহ। 

 

–ডোন্ট লাই। কেউ কিছু বলেছে? আবেগ নিশ্চয়ই কিছু বলছে তাই না? 

 

–উহু৷ 

 

–তাহলে? 

 

রোদেলা হুট করে বলে ফেলে, রিশাদ কল দিয়েছিল। 

 

এটা শোনার সাথে সাথে মেঘ রেগে ফেটে পড়ল আর দাতে দাত চেপে বলে৷ ওই হারামি কেন কল দিবে তোমাকে? আর তুমি কেন ওর কল রিসিভ করেছো? 

 

–আননোন নাম্বার থেকে কল দিয়েছিল। 

 

–নাম্বার টা আমাকে পাঠাও। আমি দেখছি কি করা যায়। আবেগকে এবিষয়ে কিছু বলেছো? 

 

–না৷ 

 

–আচ্ছা। পরে বলিও। আমি দেখছি ব্যাপারটা। তুমি চিন্তা করবে না। 

 

–আচ্ছা৷ 

 

মেঘ বলে উঠে, তোমার বান্ধবীরা কেমন আছে জানো কিছু? 

 

–না।কারো সাথে আমার কথা হয় নি। মনে হয় না  ওরা দুজন কেউ আমার সাথে কথা বলবে। 

 

–না বলার ই কথা। মাঝে মাঝে একটু সেলফিস হতে হয় রোদেলা। সবসময় সবার কথা ভাবলে চলবে না! আবেগকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত একদম ঠিক নিয়েছো। কেউ জানুক বা জানুক আমি তো সব জানি। আই এম ওলওয়েস উইথ ইউ। 

 

–থ্যাংক্সস। 

 

–রাখি তাহলে। 

 

রোদেলা ফোন রাখতেই আবেগ পেছন থেকে বলে উঠে, কার সাথে কথা বলছিলে? 

 

রোদেলা আবেগের দিকে ঘুরে বলে, মেঘ ভাইয়া কল দিয়েছিল। 

 

–ওহ। 

 

–উনি কালকে আসবেন। 

 

আবেগ রোদেলা দিকে তাকালো। রোদেলার পরনে একটা সুতি শাড়ি। আজকে কি আকিকা উপলক্ষ সে শাড়ি পড়েছে? ব্যাপার টা আগে লক্ষ্য কেন করে নি সে? 

 

আবেগ আবারো রোদেলার দিকে তাকালো। পরনে সুতির কাজ করা নীল শাড়ি। শাড়িটার ভেতরে সাদা সুতির কাজ। রোদেলার গায়ে বেশ মানিয়েছে শাড়িটা। রোদেলা চুল গুলো খোপা করে রেখেছে। তারপর ও মুখের উপর কিছু ছোট  চুল এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বারান্দা খোলা থাকার ফলে রোদ এসে রোদেলার গায়ে পড়ছে। রোদের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠছে রোদেলার মুখখানা। কেমন যেন একটা আকর্ষণ অনুভব করছে আবেগ রোদেলার উপর। ঠিক যেমনটা দক্ষিন মেরু উত্তর মেরুর উপর একটা অজানা আকর্ষণ অনুভব করে। এই টান বা আকর্ষণের কোন নাম নেই। নামহীন, গন্তব্যহীন এক অবান্তর মায়া এটি! 

 

রোদেলা আবেগকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু হুট করে শাড়ির সাথে পা লেগে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে আবেগের বুকে গিয়ে আছাড় খেল রোদেলা।

 

হুট করে বুকে রোদেলা এসে পড়ায় আবেগ নিজেই কেপে উঠে এবং রোদেলা কে ধরে শক্ত করে ধরে ফেলে। 

 

আবেগের স্পর্শ পেতেই রোদেলা চোখ বুজে ফেলে। ফলে দুফোটা মোটা মোটা টাটকা অশ্রুমালা রোদেলা আবেগকে উপহার দিল।

 

রোদেলার চোখের পানিতে আবেগের শার্টের সামান্য অংশ ভিজে উঠতে লাগে। 

 

রোদেলা আবেগের বুকে মাথা ঠেকিয়ে আছে। আবেগের গায়ের গন্ধ তার নাকে এসে লাগছে। সে স্পষ্ট আবেগের হৃদস্পন্দন শুনতে পেল। আবেগের বুকের ধুকপুক আওয়াজ শুনে রোদেলার নিজের মনের  মধ্যে উথাল-পাতাল বয়ে। 

 

আবেগ রোদেলার বাহু ধরে তাকে সোজা করে  দাড় করিয়ে দিয়ে রুম ছেড়ে যায়।

 

আবেগ রুম ত্যাগ করলেই রোদেলা আরেক দফা হুহু করে কেদে দেয়। ইদানীং কি হয়েছে জানে না সে। আবেগকে দেখলেই তার কান্না পায়! কেন পায় জানে না সে? 

 

★★★

 

নেহা বাসায় ঢুকতেই তার মা জহির শেখ,  নেহার সামনে এসে বললেন,কোথায় গিয়েছিলে তুমি? 

 

–কোথাও না। (কঠিন সুরে) 

 

–তোমার সাথে কথা বলাই মিনিংলেস। আসলে তোমার সাথে না বোকাদের সাথে কথা বলাই ইউস লেস। 

 

নেহা মাথা নিচু করে ফেলে। বাবার সাথে কোন ধরনের আর্গিউমেন্টে যাওয়ার কোন ইচ্ছা বা এনার্জি তার বর্তমানে নেই। এই পাঁচ বছরে বহুবার বাবার সাথে দ্বন্দে গিয়েছে। আজকে আর না! ক্লান্ত সে। বড্ড! বড্ড বেশি ক্লান্ত! 

 

নেহা তার রুমে গিয়ে একটা হট শওয়ার নিল। 

 

★★★

 

ফেসবুক গ্রুপ ফুডব্যাংকে একজনের পোস্ট দেখে খুশিতে লাফ দিল প্রাচুর্য। এই মাসের প্রতি রবিবার  “লে মেরিডিয়ান” এ নাকি মাত্র ১ ইউ এস ডলার অর্থাৎ ৮৫ টাকায় আইসক্রিম বুফে চলছে। প্রাচুর্য বিছানায় লাফালাফি শুরু করে দিল। আজকের দিনটা তার জন্য খুব ই লাকি বলা চলে! পর পর বেশ ক’টা খুশির নিউস শুনেছে। এখন আবার এই অফারটার কথা জানতে পারল। প্রাচুর্য এমনি সব ধরনের  রেস্টুরেন্টের অফার খেতে যেতে পছন্দ করে আর সেটা যদি লে মেরিডিয়ান হয়! তাইলে তো ভাই কথাই নাই! তাও নাকি মাত্র ৮৫ টাকায়! 

 

প্রাচুর্য ফোন রেখে নিল। আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে খবর পেয়েছে আবেগের নাকি বিয়ে হয়েছে তার কাজিন রোদেলার সাথে। এই সুসুসুসুসু-সংবাদ শুনে সে সত্যি পাগল হতে বসেছিল। এতোবার সু বলার কারন হলো আবেগের বিয়ে হওয়াটা তার কাছে খুব খুশির খবর তাই তো সংবাদ টা এতো সুখের যে একটা সু দিয়ে হচ্ছে না তাই তো সে নিজেই একটা বাংলা ওয়াড বানিয়ে নিল। মোটামুটি সুখের সংবাদ হলে সুসংবাদ আর অনেক অনেক খুশির  সংবাদ হলে তা হবে “সুসুসুসুসু-সংবাদ” 

প্রাচুর্যের মনে হয় আবেগের বিয়েতে তার চেয়ে বেশি খুশি এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। 

 

এই খবর শুনে কোন রকম ব্রাশ করে গোসল করে তারপর ওযু করে বিশ রাকাত নফল নামাজ পড়েছে সে। সত্যি আল্লাহ যদি চায় অসম্ভব ও সম্ভব হবে।পাহাড় ও ডুবে যাবে, সাগর ও শুকিয়ে যাবে যদি আল্লাহ পাক চান। 

 

নফল নামাজ পড়া শেষ করতেই তার আম্মু খবর দিয়ে গেল তার সবচেয়ে ফেভারিট কাজিন মিতু আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী শুক্রবার আকদ৷ 

 

প্রাচুর্য আবার ফোন অন করে আজকে কি বার তা দেখে নিল। আজকেই তো রবিবার। সে মনে মনে বলে উঠে, তাহলে আজকে ১২-৪ টা পর্যন্ত পেটে পড়ুক লে মেরিডিয়ানের চকলেট আইসক্রিম! 

 

★★★

 

রুম ছেড়ে আর কোথায় যাবে আবেগ? বাড়ির বাইরে যেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার চেয়ে সে ছাদে গেল। আবেগ জানে না তার মনের মধ্যে কি চলছে? 

 

মন আর আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা বড় দায়! কখন যে কি হয়ে যায় নেই তার খবর! 

 

কিছু দিন আগেও সে নেহাকে ভালোবাসত। অথচ আজকে নেহার জন্য কোন কিছু অনুভূতি আসছে না।এমনকি নেহার কথাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে না। আবেগের মনে হচ্ছে কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে নেহা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেন? 

 

আর না চাইতেও বারবার রোদেলার চেহারা টা ভেসে উঠছে। বিশেষ করে সেদিনকার অবস্থায় দেখা রোদেলার নিস্তেজ চেহারা তার চোখ বরাবর ভাসতে থাকে। 

 

ফ্লাশব্যাকঃ

 

আবেগ সেদিন কি মনে করে রোদেলাদের বাসায় গিয়েছিল। মূলত রোদেলাকে দেখতে। আর সাতদিন পর ডেলিভারি। একবার দেখতে যাওয়া উচিত। দায়িত্ববোধ থেকেই গিয়েছিল দেখা করতে। বাসায় গিয়ে বেল বাজাবে তার আগেই আবেগ লক্ষ্য করে মেইন গেট খোলা। তার মনে কু ডাকতে লাগে। সে কোন কিছু না ভেবে বাসার ভেতরে ঢুকে যায় এবং ড্রয়িং রুমেই রোদেলা কে পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। এক মূহুর্তের জন্য সব কিছু অন্ধকার দেখতে লাগে আবেগ। চারপাশ রক্ত দিয়ে বয়ে গেছে। সাদা ফ্লোর লাল হয়ে গেছে। রোদেলার মুখটাও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আবেগের হাত-পা কাপতে লাগে। তার মনে হতে লাগলো, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নয়তো তার দুনিয়াই শেষ হওয়ার পথে! 

 

সেদিন আবেগ ক্লিয়ারলি বুঝতে পেরেছিল রোদেলার প্রতি এমন একটা অনুভূতি আছে তার যেটার জোর নেহার প্রতি ভালোবাসার চেয়েও বেশি। কিন্তু রোদেলার প্রতি অনুভূতি টা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। কেন যেন সেদিনের পর থেকে বারংবার নেহার প্রতি নিজের ভালোবাসায় সন্দেহ জাগছে! 

 

আবেগ নিজেই নিজের প্রতি বিরক্ত! সে চোখ বুজে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে রোদেলার চেহারা ভেসে উঠলো। সেজন্য আবেগ আবারো চোখ খুলে ফেলে। 

 

বাসা থেকে শব্দ পেতে লাগল আবেগ।  তাই তড়িঘড়ি করে নিচে নামতেই তার চোখ প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম। রিশাদ তার বাসায় এসেছে৷ 

 

রিশাদকে দেখে আবেগের গা থরথর করে কাপতে লাগল। মনে চাচ্ছে  রিশাদের গলা চেপে মেরে ফেলতে। 

 

আবেগ নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে রিশাদের কাছে গিয়ে বলে, কি চাই? 

 

রিশাদ খুব সাবলীল ভাবে বলে, আমার বউকে নিতে আসছি। আমার বাচ্চাটাকে কতদিন ধরে দেখি না। 

 

একথা শোনামাত্র আবেগ রিশাদের কলার চেপে ধরে। 

 

তা দেখে রিশাদ শয়তানি হাসি হেসে বলে, আস্তে ডাক্তার সাহেব! মাস্তানদের মতো কলার টেনে ধরলেন কেন? ছাড়ুন। 

 

আবেগ কড়া চোখে রিশাদের দিকে তাকাতেই রিশাদ হোহো করে হেসে বলে, রোদেলাকে নিতে এসেছি। আমার বউ আমার ঘরে থাকবে। আমি কোন ঝামেলা চাই না। আমাকে আমার বউ বুঝিয়ে দাও আমি চলে যাব।। 

 

একথা শুনে আবেগেত রক্ত মাথায় উঠে গেল। সে এলোপাতাড়ি ভাবে রিশাদকে মারতে শুরু করে। কোন দিকে হুশ নেই তার। রিশাদ ও মার খেতে লাগলো আবেগের হাতে।  এক পযায়ে গিয়ে রিশাদ ও আবেগকে মারতে লাগে। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। হুট করে রিশাদ আবেগের মাথায় একটা ফুলদানি ছুড়ে মারে  

 

এবং আবেগ মেঝেতে বসে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে।  

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা

Part–10

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আবেগ মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করল। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে এবং মাথার যে অংশে লেগেছে সে জায়গাটায় দুহাত দিয়ে চেপে ধরল। মূহুর্তের মধ্যে তার হাত ভিজে উঠতে লাগে। আবেগ বড় বড় করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চালায়।চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল। সে আবছা চোখে দেখলে রোদেলা তার কাছে আসছে।সে চোখ  বন্ধ করে  নেয়। 

 

এদিকে রোদেলা শোরগোল শুনে বাইরে বের হতেই আবেগকে মেঝেতে এভাবে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সে দিশাহারা হয়ে যায়। রোদেলার চোখ তখনো কেবল আবেগের দিকেই ছিল তাই তো রিশাদকে সে দেখে নি! 

 

রোদেলা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আবেগকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিয়ে বলে, কি হয়েছে তোমার? 

 

তারপর পরখ করে আবেগকে দেখতেই রোদেলার বুকটা ছ্যাত করে উঠে। 

 

সে আরো জোরে কেদে দিয়ে বলে, আল্লাহ! ও আল্লাহ! তোমার মাথা থেকে রক্ত কেন বের হচ্ছে? 

 

আবেগ চোখ পিটপিট করে খুলে। সে রোদেলাকে দেখতে পেল। রোদেলা কে দেখার সাথে সাথে তার কেন যেন ব্যথাটা একটু কমতে লাগে। রোদেলা তার ওড়না দিয়ে আবেগের মাথায় চেপে ধরে আর কাদতে কাদতে বলে, কি হয়েছে তোমার? আর কিভাবে এতো জোরে আঘাত পেলে কিভাবে ? 

 

আবেগ অনেক কষ্টে বলে উঠে, আব্বা কই? 

 

–বাসায় নেই তো আম্মাকে নিয়ে বাইরে গেছে আর ইভানা তো সমুদ্র কে একটু বাইরে গেল মাত্র। (বিচলিত হয়ে) 

 

পেছন থেকে এসব কথা শুনে নিল রিশাদ। সে শয়তানি হাসি হাসল। বাসায় কেউ নেই। কেবল তারা তিনজন বাদে! আর আবেগের অবস্থা তো নাজেহাল! রইল বাকি রোদেলা। রোদেলা কে একটা ফু দিলেই উড়ে যাবে। 

 

সে বাকা হেসে আবেগ আর রোদেলার দিকে আগাতে লাগে। আজকেই সময়! উঠিয়ে নিয়ে যাবে তার বউ কে আবেগের চোখের সামনে৷ 

 

রোদেলা আবেগের মাথা খুব শক্ত করে ওড়না দিয়ে চেপে রাখায় রক্তপাত কিছু টা কমে আসল৷ 

 

রিশাদ রোদেলার পেছন দাড়িয়ে তাকে হ্যাচকা টান দিল। এতে রোদেলার পেটে গিয়ে কিছুটা চাপ পড়ল এবং সে ব্যথায় আহ বলে চেচিয়ে উঠে। 

 

রিশাদ রোদেলাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দাতে দাত চেপে বলে, কিরে? নতুন ভাতারের জন্য মোহাব্বত উতলে পড়ছে আর আমার জন্য কোন সোহাগ নাই। বলি, আমাকেও একটু সোহাগ দাও সখী!  কথাটা শেষ করেই হোহো করে হাসতে লাগলো রিশাদ। 

 

আচমকা রিশাদকে দেখে ঘাবড়ে গেছে রোদেলা৷ সে ভীত গলায় বলে উঠে, তুমিই আবেগের মাথায় আঘাত করেছো তাই না? 

 

–ইয়েস জানেমন। 

 

এইটুকু বলে রিশাদ রোদেলার আরো কাছে আসতে লাগলো। রোদেলা তড়িঘড়ি করে রিশাদকে ধাক্কা মারল। 

 

ফলে রিশাদ কিছু টা দূরে সরে গেলেও রোদেলার দুই হাত ধরে রাখায় সে আবারো রোদেলা কে টান মারল ফলে রোদেলা আবারো ব্যথা পেয়ে কেদে দিল এবং পেছন ঘুরে আবেগের দিকে তাকালো। 

 

আবেগকে দেখেই তার বুকটা হুহু করে উঠে। আবেগ মাথায় হাত চেপে উঠার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। ফ্লোরে রক্ত পড়ে আছে। আবেগের কষ্ট হচ্ছে দেখে রোদেলার বুক দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। সে রিশাদের বাধন ছিন্ন করে আবেগের কাছে ছুটে যেতে চাইলেও পারল না। রিশাদ তার হাতজোড়া খুব শক্ত করে ধরে আছে।সে রিশাদের সাথে পেরে উঠতে পারছে না।  রোদেলা কেদে দিল এবং রিশাদের কাছে মিনতি করে বলে, ছাড়ো আমাকে। আমি আবেগের কাছে যাব৷ ওর কষ্ট হচ্ছে— বলেই সে ঘাড় ঘুরালো। 

 

আবেগ তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রোদেলা একাধারে কেদেই যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর খুব জ্বালা হচ্ছে। বহু আগে থেকেই সে আবেগকে যন্ত্রণায় দেখতে পারে না। আবেগের কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না। অথচ আজ চোখের সামনে না চাওয়া সত্ত্বেও আবেগকে কাতরাতে দেখছে। 

 

রোদেলা আবারো আবেগের কাছে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করলে রিশাদ স্বজোড়ে একটা থাপ্পড় বসায় রোদেলার গালে। 

 

রোদেলা গালে হাত দিল। অনেক জোড়ে লেগেছে তার গালে। মনে হচ্ছে গাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে যাবে। 

 

রোদেলাকে থাপ্পড় মারতে দেখে আবেগ আরো খেপে গেল। সে রোদেলার প্রতি অত্যাচার সহ্য করতে পারল না। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে রিশাদের সামনে গিয়ে রোদেলার হাত জোড়পূর্বক ছাড়িয়ে নেয় এবং রোদেলা কে বলে, রুমে গিয়ে মেঘকে কল দাও। 

 

রোদেলা আবেগের কথা মতো রুমে যেতে চাইলে রিশাদ রোদেলাকে আবারো ধরে ফেলে এবং রোদেলা কে একটা বাজে গালি দিয়ে  হুংকার দিয়ে বলল, খবরদার কাউকে কল দিবি না। আজকে তোর স্বামীকে জিন্দা পুতে ফেলব৷

 

রোদেলা ভয় পেয়ে গেল। যদি রিশাদ আবেগের কিছু করে ফেলে?।

 

আবেগ আবারো রিশাদের হাত রোদেলার বাহু থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এবং রোদেলা কে কল লাগাতে বলে। 

 

রোদেলা জানে এখানা যদি সে থাকে তাহলে কোন কিছু ই ভালো হবে না।বরং মেঘ ভাইয়া কে কল দিলে সে যদি সময়ের মধ্যে চলে আসতে পারে তাইলে উত্তম হবে। 

 

রোদেলা ছুট লাগায় তার রুমে। 

 

এদিকে রিশাদ রোদেলাকে থামাতে চাইলে আবেগ আটকে দেয়। 

 

দুইজনের মাঝে আবারো ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। এবার ও আবেগ রিশাদের সাথে পেরে উঠতে পারছে না। তবুও তাকে আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো। 

 

রোদেলা রুমে ঢুকে ফোন খুজতে লাগলো। কিন্তু ফোন খুজে পাচ্ছে না। সে মনেই করতে পারছে না ফোনটা কোথায় রেখেছে৷ অনেক খোঁজার পর বালিশের নিচ থেকে ফোন পেল। সে দ্রুত মেঘকে কল লাগায়৷ একবার রিং হতেই ধরে ফেলে মেঘ। 

 

ওপাশ থেকে মেঘ বলে উঠে, কি হয়েছে রোদেলা? ইস এভ্রিথিং ওকে? 

 

রোদেলা কাদতে কাদতে বলে, ভাইয়া! আবেগ! 

 

–কি হয়েছে আবেগের? 

 

–বাসায় রিশাদ এসে আবেগকে মারধর করছে । কেউ নেই বাসায়৷ আপনি আসুন প্লিজ৷।

 

এইটুকু বলতে বাইরে থেকে আবেগের গোঙানোর শব্দ রোদেলার কানে ভেসে উঠে। সে দৌড়ে রুমের বাইরে আসতেই দেখল রিশাদ আবেগের পেটে কিল-ঘুষি, লাথি মারছে। 

 

এই দৃশ্য দেখে রোদেলার মাথা ভোভো করতে লাগলো। আতকে উঠে সে আবেগকে এভাবে মার খেতে দেখে। সে প্রচন্ড জোরে কান্না করতে লাগলো সেই সাথে চিৎকার দিয়ে আবেগের কাছে গেল৷ 

 

রিশাদ এবার থামলো। সে বুঝি ক্লান্ত হয়ে গেছে৷ রোদেলা রিশাদের দিকে তাকালো। তাকে দেখে বোঝার কোন উপায় নাই যে  সে একটা মানুষ। এই অবস্থায় রিশাদকে দেখলে যে কেউ তাকে জন্তু ভেবে  নির্দ্বিধায় ভুল করতে পারবে৷ 

 

আবেগ পেটে হাত দিয়ে হাপাচ্ছে। রোদেলা তাকে সর্বোশক্তি দিয়ে ধরে আছে আর কান্না করছে। 

 

রিশাদ তা দেখে বাকা হাসি হেসে বলে, বাহ! কি মোহাব্বত! 

 

তারপর আবারো রোদেলা কে একটা গালি দিয়ে বলে, তোকে কতবার মানা করছিলাম বাচ্চাটা নিস না৷  মেরে ফেল। কেন শুনিস নি আমার কথা? 

 

রিশাদের মুখ মূহুর্তের মধ্যে শক্ত হয়ে এলো। আবেগ রিশাদের কোন কথাই বুঝতে পারছে না। তাই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল।  

 

রিশাদ রোদেলার কাছে আসতে আসতে বলে, খুব দেমাগ না তোর? দাড়া আজকেতোর সব দ্ম

দেমাগ  সব বের করব। তোর পেট থেকে বের হওয়া এই বাচ্চার জন্য আমার এমপি হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। আজকে তোকেই আমি শেষ করে দিব ! একবার তোর পেটে লাথি মারে তো মরলি না। আজকে আবার মারব। আজকে মেরেই ফেলব তোকে। তুই মরলে তোর বাচ্চাও মরবে। 

 

বলে রোদেলার কাছে গিয়ে রোদেলাকে আবেগের সামন থেকে টেনে হিচড়ে নিজের সামনে এনে আবারো রোদেলার পেটে লাথি মারতে এগিয়ে গেল রিশাদ। 

 

 

রোদেলা চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে বুঝে যায় আজকে আর রেহাই পাবে না সে।রিশাদ আজ তাকে মেরেই ফেলবে! রোদেলা চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলে আর মৃত্যুযন্ত্রনা সহ্য করার প্রতিক্ষা করতে শুরু করে৷  কিন্তু না পাঁচ মিনিট যাওয়ার পর ও কিছু হয় নি। সে চোখ বন্ধ অবস্থায় বুঝতে পারছে কারো ছায়া তার মুখে এসে পড়ছে। কেউ তার সামনে দাড়িয়ে আছে।

 

 রোদেলা চোখ খুলতেই দেখে আবেগ তার সামনে দাড়িয়ে আছে এবং রিশাদকে আটকে রেখেছে। 

 

আবেগ এবার রিশাদের নাক বরাবর ঘুষি দিল। সে নিজেও বুঝতে পারছে না হুট করে তার মধ্যে এতো শক্তি কোথা থেকে এলো?  

 

রোদেলা আবারো কেদে দিল। 

 

আবেগ অনবরত পেটাতে লাগে রিশাদকে। রিশাদ ও কম না আবেগকে সে ও মারছে৷ এক কথায় কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। 

 

রিশাদ আবারো ফুলদানি টা হাতে নিল। তা দেখে রোদেলা চেচিয়ে উঠে যার ফলে আবেগ সতর্ক হয়ে যায়। এবং দুজনের মধ্যে হাতাহাতি চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ভুল কিংবা দুর্ঘটাবশত রিশাদের মাথায় গিয়ে ফুলদানির চোখা অংশ গিয়ে লাগে। 

 

তা দেখে আবেগ কিছু টা ঘাবড়ে যায়। ঠিক সেই সময় মেঘ বাসার ভেতরে ঢুকে। 

 

আবেগকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে মেঘ ও বিচলিত হয়ে আবেগের কাছে ছুটে গিয়ে বলে৷ দোস! এতো ব্যথা কিভাবে পেলি? তুই ঠিক আছিস? 

 

আবেগ ছোট করে হু বলে। 

 

রোদেলা কেদে দিল এবং বলল, ও ঠিক নাই ভাইয়া। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চলেন। ওর অনেক লেগেছে (কান্না করতে করতে) 

 

এবারে আবেগ রিশাদ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রোদেলার কাছে গিয়ে তাকে আস্তে করে বলে, তুমি ঠিক আছো? 

 

রোদেলা আবারো কেদে দেয়। 

 

আবেগ তার হাতে হাত রেখে বলে, তুমি ঠিক থাকলেই হলো। 

 

রোদেলা আবেগের দিকে তাকায়। আবেগের মাথা থেকে এখনো ফোটা ফোটা রক্ত ঝড়ছে। কপাল বেয়ে গাল-নাকে গড়িয়ে পড়ছে। রোদেলা আতকে উঠে। 

 

রোদেলার বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। সে দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স আনে।

 

আবেগ রোদেলাকে কিছু করতে না দিয়ে নিজেই বক্সটা নিয়ে রিশাদের কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে রিশাদ যে জায়গায় ব্যথা পেয়েছে সেটায় ব্যান্ডেজ দিল। যেহুতু আবেগ এমবিবিএস ডাক্তার তাই এসব কাজ তার চেয়ে বেটার করার সম্ভাবনা অন্য কারো পক্ষে খুব কম। আবেগ বাসায় মাঝে মাঝে রুগী দেখে তাই মোটামুটি অনেক কিছু ই আছে বক্সে। 

 

রিশাদকে ড্রেসিং করিয়ে নিজেও করে নেয় এবং মেঘকে বলে, রিশাদ কে বাসা থেকে বের করে দিতে। 

 

মেঘ তো আবেগের উপর খেপা৷ কোথায় আবেগ রিশাদকে আরো মারবে তা না করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। আজব! 

 

তাও কিছু না বলে রিশাদের কলার ধরে টেনে নিয়ে গেল বাসার বাইরে। 

 

মেঘ বের হতেই আবেগ রোদেলার হাত ধরে তাকে রুমে আনল এবং একটা পেইন কিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, এটা খেয়ে নাও৷ তাহলে আর ব্যথা উঠবে না। 

 

রোদেলা কান্না করতে করতেই মেডিসিন টা খেয়ে নিল। 

 

–কান্না থামাও রোদেলা। 

 

রোদেলা কাদার বেগ আরো বাড়িয়ে দিল। 

 

সে ঝাপটে এসে আবেগকে ধরে ফেলে। এতে আবেগ পেটে সামান্য ব্যথা পেলেও চুপ থাকল। 

 

রোদেলার উষ্ণ উত্তাপ এসে আবেগের বুকে লাগছে। আবেগের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। কেমন জানি লাগতে লাগলো। এই পরিবর্তন টা শুধু মাত্র মনের পরিবর্তন! 

 

শারিরীক সব ব্যথা  মনে হচ্ছে প্রশমিত হচ্ছে! ঠিক যেমন ঔষধ সেবনে ব্যথা প্রশমিত হয়। তাহলে কি রোদেলা তার জন্য ঔষধ নাকি??? 

 

রোদেলার কান্নার শব্দে আবেগের চিন্তার অবসান ঘটল। সে রোদেলা কে তার বুক থেকে সরিয়ে নিল এবং হালকা গলায় বলে, বাসার কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলবে না। কেমন?

 

 রোদেলা মাথা ঝাকালো। এবং মৃদ্যু স্বরে আবেগকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি খুব ব্যথা অনুভব হচ্ছে? 

 

আবেগ হালকা হেসে বলে, আরে না! একদম ই ব্যথা করছে না। 

 

একথা শোনার চেয়ে রোদেলা সান্ত্বনা পাওয়ার চেয়ে আরো দ্বিগুন কষ্ট পেল। তার চোখ দিয়ে পানি পড়েই যাচ্ছিল। 

 

কিছুক্ষন পর মেঘ আসল। মেঘ আসার মিনিট দুই পর আবেগের মা আর বাবা বাসায় ঢুকল৷ 

 

আবেগরা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে ছিল বিধায় বাসায় ঢোকার সাথে সাথে জাবেদা খাতুন আবেগকে দেখতে পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ আবেগের কপালে গেল। ব্যান্ডেজ করা দেখে উনি চমকে উঠে ছেলের কাছে গিয়ে বিচলিত হয়ে বলে, কি হয়েছে তোর? কিভাবে ব্যথা পেলি বাবা? 

 

রুমের পরিবেশ থমথমে।  কেউ কোন কথা বলছে না। মেঘ আবেগের দিকে তাকিয়ে আছে রোদেলা ও। 

 

জাবেদা খাতুন আরো বলে উঠে, কেউ কিছু বল? কি হয়েছে আমার ছেলেটার? 

 

–মা, বাথরুমের দরজার সাথে লেগে কপালে ব্যথা পেয়েছি। 

 

জাবেদা খাতুন বলে, কিন্তু কিভাবে বাবা? 

 

–জানি না৷ আমিও বুঝলাম না।  প্রেসারটা একটু লো ছিল তাই এমন হয়ে গেছে৷ 

 

জাবেদা খাতুন আক্ষেপ করে বলে, ইশ! আমার ছেলেটার কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল। বাবা তুই বসে আছিস কেন? রুমে গিয়ে রেস্ট কর৷ 

 

তারপর রোদেলাকে দেখে নিয়ে বলে, রুমে গিয়েও তো শান্তি নাই তোর। অশান্তি ই রুমে বসে থাকে৷

 

একথা শুনে রোদেলা বুঝল তাকেই অশান্তি বলা হচ্ছে তবুও প্রতিবাদে কিছু বললো না। 

 

আবেগ তার রুমে চলে গেল। 

 

মেঘ এখনো বসে ই আছে সোফায়।

 

মামা কিছু টা চেচিয়ে উঠে  বলে, আমার ভাগ্নি মোটেও অশান্তি না৷ ও এই বাসার রহমত!, 

 

রোদেলা এবার ও প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। মেঘ হালকা হাসল। 

 

তার কিছু ক্ষন পর ইভানা এসে বাবুকে রোদেলার কোলে দিল এবং মেঘকে দেখে বলে, আরে! মেঘ ভাই যে! কখন আসলেন? 

 

–বেশ কিছুক্ষন আগে। 

 

ইভানা বলল, আপনি বসেন আমি আপনার জন্য গরুর মাংস আর পরোটা আনছি। 

 

–আজকে না ইভানা। অন্য কোন দিন। 

 

—কিন্তু কেন? 

 

–ভালো লাগছে না। অন্য আরেকদিন৷ 

 

ইভানা আর জোড় করল না। সে তার রুমে চলে গেল। রোদেলা ও বাবুকে নিয়ে ড্রয়িং থেকে চলে গেল। 

 

রোদেলা যেই না আবেগের রুমে গিয়ে ঢুকবে ওমনি জাবেদা খাতুন এসে তাকে আটকিয়ে বলে, আমার ছেলেটাকে একটু শান্তিতে আরাম করতে দাও। তুমি অন্য রুমে গিয়ে বস। 

 

রোদেলা একথায় আহত হলো। তার এই সময় আবেগের পাশে থাকতে মন চাচ্ছে। কিন্তু মামীর অবাধ্যতা না করে সে বারান্দায় গেল। 

 

বারান্দায় যেতেই চোখ পড়ল একটা পুলিশের জীপ এসে থেমেছে তাদের বাসায়৷ তার কিছু সময় বাদে বেল বেজে উঠল। 

 

রোদেলা বারান্দা থেকে শুনতে পেল মেঘ ভাইয়া কে একজন বলছে, ডাক্তার ইশরাক রহমান কোথায়? ওনার বিরুদ্ধে কেস ফাইল করা হয়েছে৷ 

 

রোদেলা মনে মনে বলে, ইশরাক রহমান তো আবেগের ভালো নাম। 

 

চলবে। 

 

 

 

 

 

#অশ্রুমালা 

Part–11( বোনাস) 

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রোদেলা সমুদ্রকে কোলে নিয়েই ড্রয়িং রুমে গেল। সত্যি খাকি পড়া দুইজন  পুলিশ  এসেছে। তাদের দেখে হতভম্ব হয়ে যায় রোদেলা৷ 

 

পুলিশ দুটোর সাথে মেঘ ভাইয়া কথা বলছে৷ 

 

রোদেলাকে আসতে দেখে মেঘ রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, রিশাদ আবেগের বিরুদ্ধে কেস করেছে। আবেগ নাকি তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। জিডি করেছে৷ পুলিশ আবেগকে তদন্তের জন্য স্টেশন নিয়ে যেতে চাচ্ছে৷ 

 

একথা শুনে রোদেলার পা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখাই কষ্টদায়ক হয়ে পড়ল। বহু কষ্টে সমুদ্র কে শক্ত করে ধরে রেখে পুলিশ দুটোর উদ্দেশ্য বলল, মিথ্যা কথা অফিসার। রিশাদ নিজে আবেগকে মারতে চাচ্ছিল। আবেগ সেল্ফ প্রোটেকশনে ওর গায়ে  সামান্য হাত তুলেছে তাও নিজেই রিশাদের ব্যান্ডেজ করে  দিয়েছে। 

 

পুলিশ বলে উঠে, দেখেন আমাদেরকে ওনাকে স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার ওর্ডার দেওয়া হয়েছে৷ আমাদের বলে লাভ নাই৷ ওনাকে ডাকুন৷ 

 

রোদেলা  মেঘের দিকে তাকিয়ে অসহায় হয়ে বলে, ভাইয়া কিছু করো! তুমি না  এসপি? ওকে স্টেশন নিয়ে যেতে আটকাও। প্লিজ ভাইয়া।

 

মেঘ বলল, রোদেলা, তুমি টেনশন করিও না। আবেগের কিছু হবে না। ওকে ডাকো৷ আপাতত স্টেশন যাক। আমি আছি তো আর ও তো ইনোসেন্ট। সো কিছু হবে না। ডোন্ট ওরি৷ 

 

রোদেলা বলল, ও তো কিছু ই করে নি। কেন যাবে ও পুলিশের সাথে। স্টেশন গেলে রিশাদ যাবে। 

 

মেঘ কিছু টা দুর্বল গলায় বলে, জোর যার মুল্লুক তার! রিশাদ রাজনীতিবীদ ওকে জেলে পাঠানো এতো সহজ না! আর এদিকে আবেগ,,,,,, 

 

তারপর একটা শ্বাস নিয়ে বলে, ও তো ডাক্তার। যেখানে রুগী মারা গেলে পেশেন্ট এর পরিবার ডাক্তার পিটায় মারে। সেখানে না আছে কিছু বলার আর না করার! ডাকো আবেগকে। সময় অপচয় করে লাভ নেই। 

 

রোদেলা বলে উঠে, আবেগ যাবে না। ওকে আমি যেতে দিব না পুলিশ স্টেশনে। 

 

মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ওকে ডাক দাও। আসুক। কথা বলুক। তারপর দেখা যাবে। ওপর থেকে ওর্ডার এসেছে। যাও আবেগকে ডাক দাও। 

 

রোদেলা না চাইতেও আবেগের রুমে গেল। রুমে গিয়ে দেখে আবেগ লম্বা করে শুয়ে আছে। ডান হাত কপালে দিয়ে রেখেছে। আবেগকে দেখতেই রোদেলার বুকটা হুহু করে উঠে। 

 

আবেগের সাথে যা হচ্ছে সব তার জন্যই হচ্ছে। মামী ঠিক ই বলেছে সব অশান্তির মূলে সে।

রোদেলা আবেগের কাছে গিয়ে আস্তে করে ডাক দিল। 

 

রোদেলার কন্ঠ শুনে আবেগ চোখ খুলে ভ্রু কুচকে বলে, কি? 

 

আবেগের কথা শুনে রোদেলা কেদে দিয়ে বলে, বাসায় পুলিশ এসেছে, আবেগ। 

 

পুলিশ এসেছে শুনে টাস্কি খায় আবেগ। তারা যথেষ্ট ভদ্র এবং সম্মানিত পরিবার থেকে বিলং করে। কখনোই পুলিশ আসার মতো কাজ তাদের পরিবারে কেউ করে নি৷ 

 

সে উঠে পড়ল এবং বিচলিত হয়ে গেল। তারপর এক দন্ড ভেবে বলে, মেঘের জন্য এসেছে নাকি? ও তো পুলিশেরই লোক। আসতেই পারে৷ 

 

রোদেলা ছলছল চোখে আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, উহু। তোমার বিরুদ্ধে রিশাদ কেস করেছে। 

 

আবেগ শক খেয়ে বলে, হুয়াট! 

 

রোদেলা কান্না করার বেগ বাড়িয়ে দিল। 

 

আবেগ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে, বাইরে পুলিশ আছে? 

 

–হু। 

 

এইটুকু শুনে আবেগ বাইরে হাটা ধরল  

 

রোদেলা ও তার পিছু পিছু যেতে লাগলো। 

 

ততোক্ষনে বাড়ির সবাই ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে৷ 

 

মামী অগ্নিদৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে যেনে এখুনি রোদেলাকে চাবিয়ে খেয়ে নিবে। আর মামা অসহায় হয়ে একবার মেঘের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার পুলিশ দুটোর দিকে। 

 

মামা করুন গলায় পুলিশ দুজন কে বলতে লাগলো, আমার ছেলে এমন না। ও তো ডাক্তার। কতো মানুষের বিনা টাকায় চিকিৎসা দেয়। রাত নাই দিন নাই, ঈদ নাই ছুটি নাই ছেলেটা আমার মানুষ বাচানোর জন্য ছুটে যায় হাসপাতালে। আর সে কি না মানুষ মারার চেষ্টা করবে। 

 

বলে মামা কেদে দিল। রোদেলার খুব কষ্ট হতে লাগলো। মনে হচ্ছে সবকিছু যদি মূহুর্তের মধ্যে ঠিক করে দিতে পারত। কিন্তু সে নিজে সবচেয়ে বেশি অসহায় সেই সাথে দুর্বল ও! 

 

মেঘ বলল, চাচা আপনি চিন্তা করিয়েন না৷ আমি তো আছি তাই না? আবেগের কিছু ই হবে না। 

 

আবেগ পুলিশ দুটোর কাছে গিয়ে বলে, আমাকে কি যেতে হবে আপনার সাথে? 

 

–জি। 

 

আবেগ তার বাবা-মা  আর রোদেলার দিকে একবার তাকিয়ে নেয় দেন বলে উঠে, চলুন। 

 

আবেগকে পুলিশ তাদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে লাগলো। মেঘ তাদের পেছনে পেছনে যেতে গেলে রোদেলাও আবেগের সাথে যেতে চাইলো। 

 

মামা বলে উঠে, ওকে নিয়ে যাও৷ আমি যাই তোমার সাথে।  

 

মেঘ বলল, চাচা৷ আপনি বাসায় থাকেন৷ আমি আর রোদেলা যাই৷ 

 

রোদেলা ইভানার কোলে সমুদ্র কে দিয়ে মেঘের সাথে গেল।  

 

আবেগ জীপে গেলেও মেঘ আর রোদেলা সিএনজি করে গেল। সিএনজি তেই মেঘ তার বসকে ফোন দিয়ে অনেক অনুরোধ করতে লাগলো । আবেগকে যেন রিমান্ডে না নেয়। আইজির সুপারিশ থাকলে কিছু টা হলেও মওকুফ করা সম্ভব তাই আইজি সাহেবকে অনুরোধ করতে লাগে মেঘ। 

 

পুলিশ স্টেশনে এসে আবেগকে ভেতরে নিয়ে গেল। মেঘ যেহুতু এসপি তাই সেও ভেতরে ঢুকে। ভেতরে যাওয়ার আগে রোদেলা কে একটা জায়গায় বসিয়ে রেখে যায়। 

 

ভেতরে কি হচ্ছে জানে না রোদেলা। তার মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রোদেলা চুপচাপ চেয়ারে বসে ছিল। প্রায় আধাঘন্টা পর কোথা থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে নেহা আর অথৈ আসল। 

 

তাদের কে আসতে দেখে কিছু টা অবাক হয় রোদেলা। 

 

নেহা সোজাসুজি রোদেলার কাছে গিয়ে কঠিন গলায় বলে, আবেগ কোথায়? 

 

রোদেলা এক পলক চেয়ে থেকে উত্তর দেয়, ভেতরে৷ 

 

নেহা রোদেলার উত্তর শুনে আশেপাশে তাকাতে লাগে। 

 

ভাগ্য ভালো ছিল ওই সময়ে মেঘ রোদেলার কাছে আসছিল। সে নেহা আর অথৈ বিশেষ করে অথৈকে দেখে থমকে গেল। 

 

বেশ কিছুক্ষন পর থমথমে খেয়ে দাড়িয়ে থাকার পর সে যথাসম্ভব নিজেকে ঠিক রেখে রোদেলার কাছে গিয়ে বলে, বাসায় যাবে তুমি? 

 

মেঘের কন্ঠ শুনে রোদেলা সেদিকে ঘুরে মেঘকে প্রশ্ন করে, ভাইয়া, আবেগ কোথায়? 

 

মেঘ বলে, ভেতরে আছে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারপর রিলিজ দিবে। আবেগ বারবার বলছিলি তোমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে। এভাবে বসে থাকতে নাকি ডাক্তার তোমাকে বারন করেছে। 

 

একথা শুনে নেহা সাপের মতো হিসহিস করে বলে, আবেগ সবার ভালো চাইলেও দিনশেষে সবাই ওকেই ছোবল মারে৷ 

 

নেহার কথায় রোদেলা আর মেঘ তার দিকে তাকায়। 

 

নেহা রোদেলাকে সোজাসাপটা বলে দেয়, তুই একটা কালনাগিনী। তোর জন্য আবেগকে জেলে আসতে হলো। জানিস এই ইন্সিডেন্টটা  ওর ক্যারিয়ারে কতোটা ইফেক্ট ফেলবে। এতো বছর ওর হিস্ট্রিতে একটা দাগ ও ছিল না কতো ক্লিয়ার ছিল ওর ব্যাকগ্রাউন্ড । আর তুই আসলি ওর লাইফে। ব্যস! সব তছনছ করে দিলি। 

 

মেঘ অধৈর্য্য হয়ে বলে, ইনাফ নেহা। 

 

নেহা ছোবল মারার মতো করে বলে, সি এজ এ বিচ। 

 

মেঘ বলে উঠে, রোদেলা বিচ না। সি এস এ ব্লেসিং। 

 

একথা শুনে অথৈ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠে, এতো দরদ রোদেলার জন্য! বাহ! 

 

মেঘ ভ্রু কুচকে বলে, এতোক্ষন তো চুপ ছিলে। হুট করে মুখে বুলি ফুটলো কেন?চুপ থাকো।  

 

ঠিক সেই সময় প্রাচুর্য ও আসল। তাকে দেখে অথৈ বলে উঠে, আসেন। আপনার ই অপেক্ষায় ছিলাম। 

 

নেহা প্রাচুর্য কে দেখে কটমট করে বলে৷ কি চাই এখানে? কেন এসেছো? 

 

মেঘ প্রাচুর্য কে দেখে বলে, শেখ প্রাচুর্য সাহেব, আপনি তো অনেক ক্ষমতাশীল ব্যক্তি। একটু হেল্প করতে পারবেন?  ওরা আমার রেফারেন্সে ও  কালকের আগে আবেগকে ছাড়বে না। যদি আপনি একটু কিছু করতেন আবেগের জন্য। কৃতজ্ঞ থাকতাম তাইলে। 

 

একথ শুনে প্রাচুর্য হালকা হেসে এই থানার ইনচার্জ অফিসারের কাছে গেল। এবং নিজের পরিচয় দিল। 

 

ইনচার্জ অফিসার দাতের ফাকে টুথপিক খিল করতে করতে বলে, আপনি শেখ ইন্ড্রাস্ট্রির মালিকের একমাত্র ছেলে তো আমি করব? আপনার পা ধুয়ে পানি খাব? 

 

অফিসারের কথায় প্রাচুর্য হতভম্ব হয়ে যায়। সে জোর গলায় বলে, অফিসার রেসপেক্ট মি৷ আমার দাদা বীর বিক্রম ছিল। তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। 

 

লোকটা এবার টুথপিক রেখে বলে, সত্যি ভাই? 

 

–আজ্ঞে হ্যা। 

 

–আসলে আমি কারো চাটুকারিতা পছন্দ করিনা। বাদ দেন। মনে কিছু নিয়েন না। 

 

বলে হাক পেড়ে বলে উঠে, এই লোকমান মুক্তিযোদ্ধার নাতির জন্য চা আর এনার্জি বিস্কুট আন। 

 

প্রাচুর্য বলল, লাগবে না। আপনি আবেগ মানে ইশরাক রহমানকে  ছেড়ে দেন৷ 

 

–আচ্ছা। দিব। চা খান। এটা স্পেশাল চা। খাটি দুধের চা। চায়ের মধ্যে সর ও দেওয়া হয়। খুব স্বাদ।

 

–আচ্ছা। দেন তাইলে। এক কাপ চা খেয়ে যাই। 

 

–আচ্ছা। 

 

প্রাচুর্য মুখটা কালো করেই আছে। সে তো আবেগকে তার শক্র ভাবে। আর তাকেই কিনা বাচাচ্ছে? 

 

১৯৭১ রে বাঙালী স্লোগান গেয়েছিল, 

 

ইয়াহিয়া খানের চামড়া তুলে নিব আমরা!

 

আর ২০২০ এ এসে সে স্লোগান বানিয়েছে,

 

ইশরাক রহমানের চামড়া তুলে নিবে প্রাচুর্য! 

 

অথচ সেই কিনা আবেগকে দ্রুত রিলিজ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করল। মেঘ রিকুয়েষ্ট না করলে সে কোন দিন ই সুপারিশ করত না। আর নেহাকে ইম্প্রেস করার জন্য ও হলেও সুপারিশ করল৷ কারন সে নেহা নামক এই জেদী মানবীর প্রেমঘাতকে আঘত সেনাপতি! 

 

রোদেলা একটানা বসে থাকায় পেটে ব্যথা অনুভব করতে লাগলো । আজকে তার উপর অনেক ধকল গেছে। একে তো সে প্রোপারলি সুস্থ না তার উপর এতো এতো ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চিনচিন ব্যথা করতে লাগলো তার পেটের নিচ দিকটায়! 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

Part–12

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রোদেলা রা এখনো স্টেশনেই বসে আছে। আবেগকে এখনো ছাড়া হয় নি। কিছুক্ষন আগে মেঘ গিয়ে খবর আনলো মিনিট দশেক পর আবেগকে ছেড়ে দিবে। 

 

দশ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার অপেক্ষায় সবাই বসে আছে। পরিবেশটার মাঝেও একটা পিনপিনে নিরবতা! 

 

প্রাচুর্য গিয়ে নেহার পাশে দাড়ালো। এতে বিরক্ত হলো নেহা।মুখে কিছু বললো না। 

 

প্রাচুর্য নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলে, সারা রাত তো এখানেই কাটায় দিলি। চাচ্চু আজকে তোর সাইজ করবে। ত্রি আঙেল থেকে সার্কেল বানায় দিবে তোর হাহা।

 

নেহা চোখ গরম করে প্রাচুর্যের দিকে তাকালো। প্রাচুর্য চুপ বনে যায়। নেহার রাগী চোখ দেখে আর কিছু বলার সাহস জোটে না তার। 

 

রোদেলা মাথা নিচু করে বসে আছে৷ আর দোয়া পড়ছে। এরকম পরিস্থিতি তে দোয়া করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই। যদিও বা দোয়ার চেয়ে বেশি কিছু করার মতো সামর্থ্য কারো নাই। 

 

অথৈ রোদেলার বিপরীতে বসেছে। তার একটু দূরে নেহা আর প্রাচুর্য দাঁড়িয়ে আছে৷ 

 

রোদেলার পাশের চেয়ারে মেঘ বসে আছে। অথৈ মেঘের দিকে তাকালো। মেঘের চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। গুরুগম্ভীর ভাব চলে এসেছে। চুল গুলোও সুন্দর করে কাটা। গোছানো। হাতে এখন আর বেসলেট পড়ে না। তার পরিবর্তনে ঘড়ি পড়ে। পাক্কা এক বছর পর মেঘের সাথে দেখা হলো তার৷ শেষ দেখা হয়েছিল রোদেলা আর রিশাদের বিয়ের দিন। এরপর আর দেখা মেলে নি। তবে অথৈয়ের কানে খবর এসেছে মেঘ নাকি ক্যাডার হয়েছে। এতে অবশ্য অথৈ বেশ খুশি হয়েছে। অথৈ একটা লম্বা শ্বাস ফেলল। 

 

রুমটা কিছুটা ঘুপছি। হুট করে একটা মশা এসে অথৈয়ের পায়ে  কামড় দিল। সে নড়েচড়ে উঠে। 

 

মেঘ এবার সোজাসুজি তার দিকে তাকালো। অথৈকে হাত দিয়ে মশা তাড়াতে দেখে সে মৃদ্যু হেসে দেয়। 

 

মেঘের জানা আছে, অথৈকে মশারা খুব ডিস্টার্ব করে। কাউকে মশা কামড়াক না কামড়াক অথৈকে কামড়াবেই। এইজন্য আগে বহুত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে মেঘকে। 

 

কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে কেবল বসেছে ওমনি অথৈ ঝামেলা শুরু করে দেয় যে এখানে থাকবে না। মশায় কামড়ায়। কতো রেস্টুরেন্টে বসেও যে এই অথৈকে মশায় কামড়ায় বলে রেস্টুরেন্ট থেকে উঠে আসতে হয়েছে তার হিসাব নাই। 

 

মেঘ তো আগে মজা করে বলত, অথৈ তোমার রক্ত বুঝি খুব মিস্টি তাই তো মশারা খুব মজা করে তোমার রক্ত খায়। 

 

অতীত থেকে বের হলো মেঘ। সে আশেপাশে তাকালো। কোন দোকান থেকে মশার কয়েল কিনে আনবে? পাওয়া যাবে এই ভোরে? কিংবা দোকান খোলা থাকবে? এছাড়াও প্রাক্তনের জন্য কি এতো মায়া দেখানো উচিত? 

 

মেঘ মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবেগ এখনি বেরিয়ে আসবে। শুধু শুধু এখন বাইরে গেলে যদি তার কোন দরকার পড়ে? তার জানা মতে, সুপারিশ করেছে জন্য একটা সিগনেচার দিতে হবে। 

 

এসব ভাবতে ভাবতেই রুমের ভেতর আবেগ ঢুকল। তাকে দেখে সবার মনেই প্রশান্তির ছোয়া বয়ে গেল। 

 

রোদেলা উঠে দাড়ালো। তার চোখে এখনো পানি চিকচিক করছে। 

 

নেহা ও আবেগের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু প্রাচুর্য একবারো তাকাচ্ছে না সেদিকে। 

 

আবেগ রুমে ঢুকে ই সর্বপ্রথম হন্তদন্ত হয়ে রোদেলার কাছে গেল।

 

 নেহা ভেবেছিল আবেগ তার কাছে আসবে।কিন্তু নাহ! আবেগ একদন্ড না থেমে রোদেলার কাছে গেল। এতে আহত হয় নেহা। 

 

আবেগ রোদেলার কাছে গিয়ে সর্বোপ্রথম যা জিজ্ঞেস করল তাহলো, তুমি ঠিক আছো? এতোক্ষণ যাবত এখানেই ছিলে? পেটে ব্যথা লাগছে? 

 

আবেগের কথাগুলো শুনে রোদেলা আর নিজেকে আটকাতে পারল না। সে হুমড়ি খেয়ে আবেগের বুকে আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কেদে দিল।  

 

রোদেলাকে কাদতে দেখে আবেগের বুকটা মোচড় দিতে লাগলো। এখন যেই কষ্টটা সে অনুভব করছে সেটা তো আগে কোন দিন অনুভূত হয় নি? 

 

সে কি ভেবে যেন রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে মিনিট পাঁচেক থাকার পর আবেগ রোদেলাকে তার কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করলেও রোদেলা সরতে চায় না। সে এখনো তাকে জড়িয়ে ধরে সমান তালে কেদেই যাচ্ছে। 

 

এবার মেঘ তাদের কাছ এসে বলে, রোদেলা। সব ঠিক আছে তো। আবেগের আর কোন বিপদ নাই। ওকে আর কোন দিন পুলিশ এই অভিযোগের কারনে স্টেশনে আনবে না। আমি সব ক্লিয়ার করে দিয়েছি। তুমি শান্ত হও। 

 

বাকি সবাই আবেগ আর রোদেলার দিকেই তাকিয়ে আছে। 

 

প্রাচুর্য রোদেলা আর আবেগকে এতো কাছাকাছি দেখে খুব আনন্দ পায়। সে বারবার নেহার দিকে তাকাচ্ছে। নেহা তো বুঝি তেলে-বেগুনে জ্বলে মরছে! 

 

এদিকে অথৈ পড়েছে বিপাকে। না সে পারছে রোদেলা কে পুরোপুরি সাপোর্ট দিতে কারন তার মনে হয় রোদেলা কিছুটা হলেও দোষী। তাই তো সম্পূর্ণ ভাবে নেহাকেই সাপোর্ট দিচ্ছে। কিন্তু কেন জানি তার রোদেলার জন্য মায়া লাগছে।  নেহার চেয়ে তার বন্ধুত্ব টা বেশি স্ট্রং ছিল রোদেলার সাথে। রোদেলা কে সব গোপন কথা বলত।নেহাকেও বলত। কিন্তু রোদেলাকে সবচেয়ে বেশি ক্লোস ভাবত। 

 

রোদেলা আবেগকে ছেড়ে দিল। আবেগ হালকা করে রোদেলার চোখের পানি মুছে দিল। 

 

মেঘ বলে উঠে, বাসায় যা। আবেগ। আংকেল-আন্টি চিন্তা করছে৷ 

 

আবেগ হু বলে সামনে পা বাড়ালো। তার সাথে রোদেলা ও হাটা ধরল। 

 

আবেগ নেহা আর প্রাচুর্যের সামনে থেমে মৃদ্যু গলায় বলে, থ্যাংকস আমার বিপদে পাশে থাকার জন্য। আমি কৃতজ্ঞ থাকব। আসি তাহলে। 

 

নেহাকে কিছু বলার সময় না দিয়ে আবেগ সামনে পা বাড়ালো। 

 

মেঘ তাদের সাথে এসে একটা সিএনজি ঠিক করে দেয় এবং বলল, সাবধানে যাস। 

 

আবেগ বলল, তুই ও চল আমাদের সাথে। 

 

মেঘ কিঞ্চিৎ হেসে বলে, নারে, দোস। বিকেলে অফিসের পর আসব৷ এখন বাসায় যাই। 

 

–আচ্ছা। 

 

নেহা আর প্রাচুর্য বের হলো। তাদের পেছনে অথৈ বেরুতে লাগলো। 

 

অথৈকে দেখে মেঘ বলে উঠে, চল তোমাকে বাসায় নামায় দিই। আমার বাসা ও তো ওইদিকেই।  

 

অথৈ তার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে, 

 

লাগবে না। আমি ঢাকা শহরে জন্ম থেকেই আছি। চলাফেরা করছি।  তোমার মতো গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে ভার্সিটিতে পড়তে আসি নাই। গেট ইট?  

 

মেঘ মুখ কালো করে বলে, এইজন্য কারো ভালো করতে নেই। 

 

বলে হাটা ধরল। ততোক্ষনে আলো ফুটে গেছে। চারিদিকে স্নিগ্ধ আলোয় ভরপুর। 

 

নেহা আর প্রাচুর্য গাড়ি করে গেল। অথৈকে নামিয়ে দিতে চাইল কিন্তু সে যাবে না তাদের সাথে।  একাই যাবে। জেদ ধরে অথৈ একাই হাটা ধরল।

 

কিন্তু  এখন তার মনে হচ্ছে নেহার সাথে যাওয়াই উত্তম ছিল৷ আশেপাশে কোন রিকশা দেখছে না। পুরো রাস্তায় সে একা। তার ভয় হতে লাগলো। কি করবে সে? 

 

অথৈ সামনে আগাতে লাগে। কিন্তু ভয়ের চটে পা বেশি দূর যাচ্ছে না। আটকে আটকে আসছে। সে ঘামতে লাগল। হুট করে পেছন থেকে কারো শব্দ পেল সে। 

 

অথৈ ভয় পেয়ে যায়। একা এই ফাকা রাস্তায় কে তার পেছনে? তার কি কোন ক্ষতি হতে চলেছে? 

 

চলবে৷ 

 

#অশ্রুমালা 

part–13

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

সিএনজি তে করে বাড়ি ফিরছে আবেগ এবং রোদেলা। দুজন পাশাপাশি বসে আছে। রোদেলার দৃষ্টি আবেগের দিকে। আবেগ চোখজোড়া বন্ধ করে রেখে হেলান দিয়ে বসে আছে। 

 

রোদেলা মনে মনে ভাবে, হয়তো আবেগ খুব বেশি ক্লান্ত। 

 

বাসার গেটের সামনে সিএনজি এসে থামলো। রোদেলা বের হলো। 

 

আবেগ নামতেই ড্রাইভার বলে উঠে, দুইশ টাকা ভাড়া। 

 

আবেগ পকেটে হাত দিয়ে দেখে সঙ্গে মানিব্যাগ নেই। সে রোদেলা কে জিজ্ঞেস করল, টাকা আছে তোমার সাথে? 

 

রোদেলা উত্তর দিল, না। 

 

–উপর থেকে নিয়ে আসো। 

 

–আচ্ছা। বলে রোদেলা উপরে গেল। 

 

আবেগদের বাসা তিনতলায়। সে সিড়ি বেয়ে বাসায় ঢুকতেই মামা-মামীর সম্মুখীন হতে হলো। 

 

রোদেলা কে দেখেই মামা প্রশ্ন করে, আবেগ কোথায়? মেঘ তো বললো ওকে রিলিজ করে দিয়েছে। তাহলে কোথায় ও? 

 

রোদেলা কিঞ্চিৎ হেসে বলে, হু। নিচে দাঁড়িয়ে আছে৷ 

 

মামী কাঠ গলায় বলে, নিচে কেন দাঁড়িয়ে আছে ও? 

 

–মামী, আমাদের কাছে টাকা নেই। সিএনজি ওয়ালাকে ২০০ টাকা দিতে হবে। 

 

একথা শুনতেই মামা বলল, মা তুই রুমে যা। আমি দিয়ে দিচ্ছি। 

 

বলে মামা নিচে নেমে গেলেন। 

 

ইমতিয়াজ রহমান নিচে নেমে আসলেন। তিনি দেখলেন, আবেগ সিএনজি চালকটার সাথে কথা বলছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কোন কথা চলছে। 

 

আবগ তার বাবাকে নেমে আসতে দেখে বলে উঠে, আব্বা তুমি কেন আসতে গেলে? কাউকে পাঠিয়ে দিতে। 

 

–দরকার কি? আমিই নেমে আসলাম। বলে উনি আবেগের হাতে টাকা দিলেন। 

 

আবেগ সিএনজি ওয়ালাকে টাকা দিতে দিতে বলল, আপনার পায়ে ইনফেকশন হয়েছে। এন্টিবায়োটিক যেটার নাম লিখে দিলাম সাত দিন খান। ব্যথা না কমলে ডাক্তার দেখাবেন। দিনে একটা মানে হলো চব্বিশ ঘন্টায় একটা খাবেন। আর অবশ্যই ভরা পেটে খাবেন। 

 

লোকটা টাকা পকেটে ঢুকিয়ে বলে, আচ্ছা ডাক্তার সাহেব৷ 

 

আবেগ হাটা ধরল সামনের দিকে। তার বাবা পিছনে পিছনে এসে বলে, শোন আবেগ? 

 

আবেগ থেমে গিয়ে বলে, কি? 

 

–তুই কি আমার উপর রেগে আছিস? 

 

আবেগ কথা না বাড়িয়ে সোজাসোজি বলে, রাগ করে কি কোন লাভ হবে আব্বা? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে তাই না? 

 

এরপর কঠিন গলায় বলে, আর যা চেয়েছো তাও হয়েছে। আর তুমি চিন্তা করিও না। সমুদ্রের দায়িত্ব আমার। ওর দায়িত্ব টা আমি নিজের মনের সম্মতি তে নিয়েছি। সমুদ্র কে নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। ওকে বড় করার দায়িত্ব আমার। সমুদ্রকে আমি  নিজের সন্তান মানি। আগামীতে ওর বাবা হিসেবেই সবাই কে পরিচয় দিব। 

 

এইটুকু বলে আবেগ আগাতে যাবে তার আগেই ইমতিয়াজ রহমান বলে উঠে, আর রোদেলা? ওকে মেনে নিয়েছিস? 

 

আবেগ হাটা না থামিয়ে আগাতে আগাতে বলল, জানি না। এটার উত্তর অন্য কোনদিন দিব। তবে অবশ্যই চেষ্টা চালাব। যদি সফল হই তাহলে খুবই ভালো আর,,,,,

 

ইমতিয়াজ রহমান বলে উঠে, আর না হলে কি করবি? ছেড়ে দিবি? 

 

আবেগ বিরবির করে বলে, জানি না। তবে যতটুকু জানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তো বিয়ে করিনি! 

 

আর কোন কিছুর উত্তর দিল না আবেগ। উপরে উঠে গেল। 

 

বাসার সামনে আসতেই আবেগ বুঝতে পারল, তার মা নিশ্চয়ই রোদেলাকে কঠিন কোন কথা শুনাচ্ছিলেন। রোদেলার মুখটা কালো হয়ে আছে। 

 

আবেগ সেদিকে কর্ণপাত না করে ভেতরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। 

 

মামী রাগীচোখে রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে, আমার ছেলেটার জীবনটাই শেষ করে দিচ্ছে এই অলক্ষী মেয়েটা। 

 

রোদেলা প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে ফেলে। 

 

মামা উপরে আসলে মামা-মামী তাদের রুমে চলে যায়। 

 

রোদেলা ইভানার রুমে গেল। 

 

সে দেখল সমুদ্র আর ইভানা দুজন ই ঘুমিয়ে আছে। 

 

রোদেলা সমুদ্র কে কোলে তুলে নিল। খাওয়াতে হবে সমুদ্র কে। সেই কখন খাইয়েছে তারপর তো সে ছিল ই না বাসায়। রোদেলা ছেলের কপালে চুমু খেয়ে নিল। 

 

রুমে কারো উপস্থিতি দেখে ইভানা চোখ খুলে। সে উঠে বসে বলে, ভাবি! ভাইয়া কোথায়? ঠিক আছে ও? 

 

–হ্যা। আবেগ ঠিক আছে। রুমে গেল মাত্র৷ বাবু কি কান্না করেছিল? 

 

–প্রথমের দিকে ঠিক ছিল। কিন্তু রাত তিনটার দিকে খুব কান্না করছিল। থামতেই ছিল না। আমি তো আর কান্না থামাতে পারি না। 

 

রোদেলা বিচলিত হয়ে গেল এবং বলল, তারপর কিভাবে ঘুমালো? 

 

–আম্মু ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। সমুদ্র বেবিকে কাদতে দেখে আমার রুমে এসে ওকে নিয়ে গেল। ঘন্টাখানেক পর আমার পাশে শুইয়ে দিয়ে গেল। ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি মা ওকে। 

 

রোদেলা মৃদ্যু হাসল। যাক মামীর একটু হলেও তার ছেলের জন্য মায়া আছে। এটাই তার কাছে অনেক বড় পাওয়া। 

 

রোদেলা সমুদ্র কে নিয়ে রুমে গেল। রুমে যেতেই দেখল আবেগ দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হয় তার আসারই অপেক্ষায় ছিল। 

 

রোদেলাকে আসতে দেখে আবেগ বলে উঠে, এতোক্ষন কোথায় ছিলে? 

 

–ইভানার রুমে। তুমি ফ্রেস কেন হও নি? 

 

এই কথার জবাব না দিয়ে আবেগ উঠে দাড়ালো এবং তার কাছে গিয়ে উকি মেরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেন,সমুদ্র তো ঘুমাচ্ছে। 

 

রোদেলার সমুদ্রকে কোলে নিয়েই একটু নড়াচড়া করে বলে, হু। ঘুমিয়ে আছে৷ 

 

–ওর কি খিদা লাগে নি? 

 

রোদেলা একবার আবেগের দিকে তাকালো তারপর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, খিদা লাগলে তো উঠে কান্না জুড়ে দিত। তাহলে মনে হয় না খুদা লেগেছে। ঘুম থেকে উঠলে খাওয়াব। কিন্তু তুমি ফ্রেস হও নি কেন? 

 

আবেগ সাবলীল ভাবে বলে, একটা হেল্প লাগবে। 

 

আবেগের মুখে এমন ফর্মালিটিমার্কা কথা শুনে রোদেলা কিছুটা টাস্কি খেল। 

 

এবং বলল, হ্যা বল। 

 

আবেগ তার ডান হাত নাড়াতে নাড়াতে বলে, আমার হাতটা মচকে গেছে বোধহয় । নড়াতে পারছি না। নড়াতে গেলেই ব্যথা করছে। 

 

–এজন্য বাথরুমে যাও নি?

 

আবেগ মাথা নাড়িয়ে বলে, হ্যা। শার্ট খুলতে পারছি না। একটু বোতাম গুলো খুলে দাও৷ 

 

রোদেলা সমুদ্র কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবেগের সামনে দাড়ালো। 

 

তারপর দুই হাত আবেগের শার্টের প্রথম বোতাম ঘরে রাখতে গিয়ে থেমে গেল। কেমন যেন একটা দ্বিধা কাজ করছে তার। 

 

আবেগ বললো, কোন সমস্যা? সমস্যা থাকলে ইটস ওকে। আমি ম্যানেজ করে নিব। 

 

–না। না করছি বলেই রোদেলা শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো। আলতো ছোয়া লেগে যাচ্ছে আবেগের বুকে। এতে যেন রোদেলাই কেপে উঠছে। তার মনে বৃহৎ পরিমাণ সংকোচ! সে ইচ্ছা করেই মাথা নিচু করে রেখেছে। আবেগের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার।  

 

শার্ট খুলে দিতেই আবেগ থ্যাংকস বলে বাথরুমে চলে গেল। 

 

তখনি সমুদ্র জেগে উঠে। রোদেলা শার্ট সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে সমুদ্রের কাছে গেল। 

 

মাকে দেখতে পেয়েই ছোট্ট সমুদ্র হেসে দিল। রোদেলা তার গালে চুমু দিয়ে খাওয়াতে শুরু করে। 

 

ঠিক তখনই আবেগ বাথরুম থেকে বের হলো। রোদেলাকে এই অবস্থায় দেখে সে কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে উঠে, আমি বারান্দায় যাচ্ছি। 

 

রোদেলা নড়েচড়ে উঠে বলে, সমস্যা নাই৷ তুমি শুয়ে পড়ো।অনেক ক্লান্ত তুমি। 

 

 বলে খানিকটা সরে এলো৷ কিন্তু আবেগ রোদেলার কথা শুনল না। সে বারান্দায় চলে গেল। 

 

★★★

 

অথৈ  আগাচ্ছে। জোড়ে জোড়েই আগাচ্ছে সে। কিন্তু পেছন থেকে আসা পায়ের শব্দ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সে৷ পায়ের শব্দটা তাকে ফলো করেই চলেছে৷ অথৈয়ের  গা ভিজে শেষ ঘামে। কপালে, নাকের ডগায়, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। সে একটা ঢোক গিলল। আসার সময় ফোন ও আনে নি সঙ্গে। এখন কি করবে সে? যদি পেছন থেকে কোন দুষ্টু লোক এসে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলে? এইসব ভাবতেই তার কান্না চলে এলো। কি করবে সে! 

 

অথৈ বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে কিন্তু নাহ দূর দূর কেউ নেই। সে থেমে গেল। তারপর রাস্তার এক সাইড থেকে একটা ইট কুড়িয়ে নিল। এবং অন্য হাতে এক মুঠো বালি হাতে পুড়ে নিল। 

 

পায়ের শব্দটা নিকট থেকে নিকটতর হতেই অথৈ কোন কিছু পরোয়া না করে নিজের চোখ  বন্ধ করে পেছন ঘুরে সামনের দিকে না তাকিয়েই তার হাতে পুরে রাখা বালুর দলা সামনের ব্যক্তির চোখের উপর ছিটকে মারল। 

 

আর সঙ্গে সঙ্গে মেঘ চিৎকার দিয়ে বলে ,ও মা গো! আমার চোখ! 

 

মেঘের কন্ঠ পেতেই অথৈ চোখ খুলে ফেলে এবং দেখতে পেল মেঘ তার দুই হাত দিয়ে চোখ ঘষছে। 

 

অথৈ বুঝতে পারল সে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। কিডন্যাপারের জায়গায় মেঘের চোখে বালু দিয়ে দিয়েছে। 

 

চোখ ঘষতে ঘষতে মেঘ বলে উঠে, কি সমস্যা টা কি তোমার?  সস্যা কি মাথায় নাকি অন্য জায়গায়? আমার চোখে বালু কেন মারলা? 

 

তারপর মেঘ এক দন্ড থেমে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিয়ে কটমট গলায় বলে, বাই এনি চান্স তুমি কি ছিনতাই করতে চাচ্ছিলা নাকি? এরকম নির্জন রাস্তায় পথচারীকে একা পেয়ে আক্রমণ করে টাকা-পয়সা, মানিব্যাগ কেড়ে পালাতে নাকি? 

 

একথা শুনে অথৈ টাস্কি খেল। বলে কি ও? সে কেন ছিনতাই করতে যাবে? বরং তাকে কেউ কিডন্যাপ করতে চাচ্ছে। 

 

মনের কথা মনে রেখেই অথৈ বলে,  তোমার কি আছে যে ছিনতাই করব? মানিব্যাগে দুই টাকাও পাওয়া যাবে না। 

 

একথা শুনে মেঘ কিছু না বলে শুধু  বলল, পানির বোতলটা দাও। চোখে পানি দিব। খচখচ করছে৷ 

 

অথৈ কিছু না বলে ব্যাগ থেকে পানি বের করে দিল। 

 

মেঘ জানত অথৈয়ের ব্যাগে পানি থাকবেই। অথৈর স্বভাব হলো কোথাও যাওয়ার আগে সঙ্গে এক বোতল পানি নিবে। 

 

সে বোতল খুলে পানি চোখে দিল। কিছুটা আরামবোধ করলে পানি দেওয়া থামিয়ে দিয়ে মুখ লাগিয়ে পানি খেতে লাগলো। 

 

সঙ্গে সঙ্গে অথৈ চেচিয়ে উঠে বলে, বোতলে মুখ কেন লাগাচ্ছো? উপর দিয়ে খাও। 

 

মেঘ শুনেও না শোনার ভান ধরে মুখ লাগিয়ে পানি খেল। সে আবার বোতল উপর করে  মুখ হা করে পানি খেতে পারে না।সে বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়ে নিল।  

 

অথৈ মেঘের হাত থেকে বোতল টা নিয়ে ফেলে দিল। 

 

তা দেখে মেঘ অবাক হয়ে গেল এবং বলল, বোতলটা ফেলে দিলা কেন? 

 

 অথৈ বলে, আমি কারো মুখ লাগানো বোতলে পানি খাই না। 

 

মেঘ এবার বলল, এবার বল তো! কি করতে চাচ্ছিলে তুমি?আমার কাছ থেকে জিনিসপত্র নিয়ে কোথায় পাচার করতে? তোমাদের দলের লিডার কে? সব ইনফরমেশন দাও। 

 

অথৈ গলার তেজ বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তোমার মতো ফকিরের কাছে ছিনতাই করার শখ আমার নাই। 

 

একথা শুনে মেঘ তার ওয়ালেট বের করল। এবং ওয়ালেট থেকে ক্যাশ দশ হাজার টাকা বের করে অথৈয়ের সামনে এনে বলে, দশ হাজার ক্যাশ নিয়ে ঘুরি আর আমার ফোনটাও দামি! চল্লিশের কাছাকাছি। ওয়ান প্লাস কোম্পানির। 

 

অথৈ চোখ-মুখ লাল করে বলে, তুমি আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছো? আমাকে? (থরথর করে৷ কাপতে কাপতে বলল) 

 

অথৈ আবারো রাগী গলায় বলে উঠে, দুই দিনের বৈরাগী ভাতকে যে অন্ন বলে এই প্রবাদ তোমাকে দেখেই সৃষ্টি হয়েছে। আর দামি ফোনের অহংকার দেখাচ্ছো আমাকে? ভুলে যেও না তোমার প্রোফাইলে যত গুলো ডিপি আর কভার পিকচার আছে না? সব আমার ফোনে তোলা। আগে তো কমদামি ফোন ইউস করতা এখন ক্যাডার হয়ে আমাকে টাকার গরম দেখাচ্ছো? 

 

মেঘ বুঝতে পারছে অথৈ রেগে গেছে। এখন এসব উল্টা-পাল্টা কথা বলতেই থাকবে। এটাও অথৈয়ের একটা বৈশিষ্ট্য৷ রেগে গেলে যা খুশি তাই বকতে থাকবে। 

 

মেঘ এবার মুখ খুললো এবং বললো আচ্ছা যাও আজকে বাসায় গিয়েই তোমার ফোনে তোলা সব ছবি অনলি মি করে দিব তারপর আস্তে করে বলে, ছবি অনলি মি করে দিতে পারলেও তোমাকে অনলি মি করতে পারলাম না। ব্যর্থতা!

 

অথৈ ততোক্ষণে হাটা ধরেছে৷ 

 

মেঘ জোড়ে আওয়াজ করে অথৈ বলে ডেকে উঠে। 

 

এক বছর পর মেঘের মুখে নিজের নাম শুনে থময়ে যায় অথৈ। তার চোখ ভিজে উঠতে লাগে তাই তো পিছনে তাকালো না। সে চায় না মেঘ তাকে দুর্বল ভাবুক। কোন ক্রমেই সে এটা চায় না৷ 

 

মেঘ কিছুক্ষন চুপ থাকল। প্রতিউত্তরে কিছু শোনার আশায়। কিন্তু অথৈ না কিছু বললো আর না পেছনে তাকালো। বরং তাকে উপেক্ষা করে আগাতে লাগলো। 

 

মেঘ এবার বলে, ফ্লাস্কটা নিয়ে যাও। এটা পেপসি-মিরিন্ডার বোতল না যে ফেলে দিবা। উঠায় নিয়ে যাও। গরম পানি দিয়ে ধুলেই হবে। 

 

কিন্তু অথৈ মেঘের কোন কথায়ই কান না দিয়ে অনেক জোড়ে জোড়ে হাটতে লাগলো। 

 

তার দিকে কিছু সময় হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে মেঘ বোতলটা কুড়িয়ে নিল। 

 

তারপর অথৈয়ের পিছে আসতে লাগল। কিন্তু মেঘ এবার আর অথৈয়ের হাটার গতির সাথে পারল না। তাদের মাঝে অনেকটা, অনকটা দূরত্ব চলে এসেছে! 

 

ঠিক যেমন তাদের মনের মাঝে বিঘা বিঘা জমি পরিমাণ দূরত্ব বিরাজ করছে। 

 

★★★

 

প্রাচুর্য আর নেহা ঘন্টা খানেক আগেই নেহার বাসায় এসেছে। তারা বর্তমানে নাস্তার টেবিলে বসে আছে।  শুধুমাত্র প্রাচুর্যের জন্য আজকে নেহা তার বাবার কাছ থেকে বকা খাওয়া থেকে বেচে গেছে৷ 

 

নেহা বাসায় ঢুকতেই দেখতে পায় তার বাবা-মা গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে। 

 

নেহার বাবা রাগী চোখে তাকিয়ে ছিল। বাবাকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় নেহা। সে তো ভেবেছিল আজকে আর রক্ষা পাচ্ছে না সে! 

 

কিন্তু প্রাচুর্য এসে তাকে বাচিয়ে দিল। সে বাসায় ঢুকে বলে, চাচ্চু! কেমন আছো? 

 

নেহার বাবা প্রাচুর্য কে কিছুটা স্বস্তি পেয়ে বলে, ভালো। তুমি আর নেহা একসাথে ছিলে? 

 

–হ্যা। চাচ্চু। আসলে কাজিনরা নাইট স্ট্রে করছিলাম কালকে আমাদের ফার্মহাউসে। মিতু আপুর বিয়ে ঠিক হওয়ার সেলিব্রেশন করছিলাম। 

 

–আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না?নেহা বাসায় নেই, কিছু বলে যায় নি। চিন্তায় আমার আর ওর মায়ের ঘুম হয় নি৷ 

 

–সর‍্যি চাচ্চু। আর এরকম ভুল হবে না। 

 

নেহার বাবা বলে উঠে, ওকে। এইবারের মতো মাফ করলাম। নেক্সটে যেন আর না হয়। ব্রেকফাস্ট করে যাবে কিন্তু। 

 

প্রাচুর্যের কথা বিশ্বাস করে নেয় তিনি। তাই নেহাকে আর কিছু বলেন নি। 

 

ব্রেকফাস্ট এ প্রাচুর্য আর তার বাবা নাস্তা খাচ্ছে৷ কিন্তু নেহার খাওয়ার একদম ইচ্ছা নেই। সে খুব করে অন্য রুমে চলে যেতে চাচ্ছে কিন্তু বাবার জন্য পারছে। 

 

প্রাচুর্য নাস্তা শেষ করে বলে, চাচ্চু আমি বিকেলে নেহাকে শপিংয়ে নিয়ে যাব৷ 

 

–আচ্ছা। 

 

প্রাচুর্য উঠে দাড়ালো এবং বলল, ওকে রেডি থাকতে বললেন। 

 

★★★

 

আটটা কিংবা সাড়ে আটটা বাজে। আবেগের ঘুম ছুটে গেল। আজকে সমুদ্রকে মাঝখানে দেওয়া হয়েছিল আর রোদেলা ওপাশে শুয়েছে। 

 

আবেগের চোখ জোড়া খুলতেই সমুদ্রের কাছ গেল। একি! সমুদ্র তো জেগে গেছে। 

 

আবেগ মৃদ্যু হেসে কোলে তুলে নেয় সমুদ্র কে। 

 

তারপর রোদেলার দিকে তাকায়। রোদেলা ঘুমাচ্ছে। 

 

আবেগ কি ভেবে সমুদ্র কে বারান্দায় নিয়ে গেল। সকালের সূর্য এর আলো বাচ্চাদের গায়ে মাখাতে হয়। 

 

বারান্দায় গিয়ে বোধহয় সমুদ্র খুব খুশি হলো। তার আর হাসি থামছেই৷ 

 

আবেগ আদরমাখা গলায় বলে উঠে, আব্বাহুজুর! আপনার ভালো লাগছে? 

 

সমুদ্র বুঝলো কিনা কে জানে কিন্তু হেসে দিল। 

 

তা দেখে আবেগ নিজেও হেসে সমুদ্র কে আদর করতে লাগলো। অনেকগুলো  চুমু খেল সমুদ্রের হাতে৷ 

 

তারপর বলল, দেখো আব্বাহুজুর! কি সুন্দর একটা বিড়াল! ( রাস্তার পাশ দিয়ে একটা বিড়াল যাচ্ছিল)

 

সমুদ্র আবারো হেসে দিল। 

 

এভাবে এক ঘন্টা থাকার পর রুমে আসল আবেগ। ততোক্ষনে সমুদ্র আবারো ঘুমিয়ে গেছে। তাকে বিছানায় শোয়াতে গিয়ে রোদেলার মুখোমুখি হতে হলো আবেগকে। 

 

আবেগ রোদেলা কে দেখতে লাগলো। রোদেলার সামনের ছোট ছোট চুল গুলো মুখের উপরে এসে পড়েছে। 

 

আবেগ কোন রকম সংকোচ না করে রোদেলার চুল গুলো সরিয়ে দিল এবং হুট করে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে বসে তা হলো রোদেলার কপালে চুমু দিয়ে দেয়! 

 

হুট করে এমন কাজ কেন করে বসলো জানে না আবেগ! কিন্তু এই কান্ড ঘটানোর পর পাক্কা দশ মিনিট সে হা হয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে ছিল। 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

part–14

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রোদেলা ঘুমের মাঝেই হালকা নড়ে উঠল। খানিকটা মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো ঘুমের মধ্যেই রোদেলা। এরপর অন্য পাশ ফিরে সমুদ্রের জন্য যেই কোলবালিশ রাখা হয়েছে সেটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। 

 

এই দৃশ্য দেখে আবেগ কেন যেন আনমনে হেসে দিল আর মনে মনে বলল, কে বলবে এই মেয়ে কোন বাচ্চার মা! 

 

আবেগের মনটা মূহুর্তের মধ্যে বিষিয়ে গেল৷ কেন যে হুট করে মন খারাপ হলো বুঝে উঠতে পারল না। 

 

রোদেলা আবারো নড়চড় করতে লাগলো। এক পলকের জন্য আবেগের মনে হলো রোদেলা সজাগ আছে। যখনি এমন ভাবনা মাথায় এলো তখনি আবেগের মধ্যে একটা লজ্জা কাজ করতে লাগলো। সে মনেপ্রাণে চাচ্ছে রোদেলা যেন বুঝতে না পারে একটু আগে সে কি কান্ড করেছে। 

 

এই চিন্তার সাথে আবেগের মাথায় একটা উদ্ভট চিন্তা এলো তাহলো এই যে সে সমুদ্র কে কতো গুলো চুমু খেল কই তখন তো এতো সংকোচ বা লাজলজ্জা গ্রাস করেনি তাকে?  কিন্তু রোদেলার বেলায় তার মরে যেতে মন চাচ্ছে৷ তাহলে কি বয়স ভেদে  ঔষধের মতো আদর করার প্যাটার্ন বদলে যায়? 

 

অবশ্য ই! একটা বাচ্চার মতো যদি কোন মেয়েকে কেউ আদর করে চুমু খায় তাইলে তো সেই লোকের একটা হাড্ডিও আস্ত থাকবে না। 

 

আবেগ নিজের চিন্তার করার টপিক দেখে ভ্রু কুচকালো। এসব কি চিন্তা করছে সে? উল্টা-পাল্টা জিনিস সম্পর্কে কেন সে চিন্তা করবে?

 

আগে তো সময় পেলেই পড়তে বসত। আবেগ ঠিক করল আজকে সারা দিন স্টাডি করবে।ডাক্তার হওয়ার  ফাস্ট এন্ড ফরেফাস্ট কন্ডিশন হচ্ছে চুল পাকা অব্দি পড়াশোনা করে যেতে হবে! 

 

আবেগের খুব ইচ্ছা কার্ডিওলোজির উপর ডিগ্রি নেওয়ার। একজন কার্ডিওলজিস্ট হতে চায় সে! 

 

বাংলাদেশে আজকাল এমবিবিএস ডাক্তারের কোন খাওয়াই নেই। সব ডাক্তারদের নামের আগে কতো গুলো করে ডিগ্রি ঝুলানো! সেখানে সে মাত্র একজন এমবিবিএস ডাক্তার। ডাক্তারি পড়ে বেরুনোর বেশি দিন হয় নি। মাত্র পাঁচ বছর হয়েছে পাশ করার। এখন তার বয়স বত্রিশ। সাতাশে পাশ করেছে ডাক্তারি। আবেগের সিনিয়র রা বলে তার নাকি ডাক্তারি হাত খুব ভালো। আবেগের রেজাল্ট ও আউটস্ট্যান্ডিং ছিল বরাবর সব প্রফেই। লাস্ট এন্ড ফাইনাল প্রফে সবচেয়ে ভালো ছিল তার রেজাল্ট! আবেগের মনে আছে ফাইনাল প্রফের আগের দিন সেই যে সন্ধ্যা ছয়টায় পড়তে বসেছে এক বোতল পানি নিয়ে। পরের দিন সাতটায় চেয়ার ছেড়ে ফ্রেস হয়ে মেডিকেলে গিয়েছে। সন্ধ্যা ছয়টা টু সকাল সাতটার মাঝে জাস্ট বাথরুম করতে আর খেতে উঠেছে। এখন চাকরি আর জীবিকার তাড়নায় সেভাবে পড়া হচ্ছে না৷ 

 

আবেগ তার বুক সেল্ফের দিকে এগিয়ে গিয়ে বই বের করে পড়তে লাগে। 

 

 “পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। “– এইটা কতোটুকু সত্য প্রবাদ জানে না আবেগ কিন্তু তার এখন খুব করে মন চাচ্ছে সমুদ্র যেন গাড়ি করে স্কুলে যেতে পারে! এটা তার একটা অপূর্ণ ইচ্ছা যা অপূর্ণ ই রয়ে গেছে! 

 

আগে যখন স্কুল যেত তখন তার কয়েকজন বন্ধু তাদের বাবার গাড়ি করে স্কুলে আসত তার খুব সেই অনুভূতি টা উপভোগ করার ইচ্ছা। 

 

কেমন লাগে স্কুল ব্যাগটা কাধে না ঝুলিয়ে গাড়ির সিটের এক পাশে রেখে এসি গাড়িতে হেলান দিয়ে স্কুল গেটের সামনে নামতে? নিশ্চয়ই খুব চমৎকার এক অনুভূতি!!!

 

সমুদ্র কে এই অনুভূতির ভাগীদার করতে চায় আবেগ। খুব করে চায়।

 

 সে একবার পেছন ঘুরে তাকালো বিছানার দিকে। মা-ছেলে নিশ্চিতে ঘুমিয়ে আছে। 

 

রোদেলা আমার কাধে সব দায়িত্ব দিয়ে নিজে কতো আরামে ঘুমাচ্ছে! —নিজের আনমনে বলে উঠে আবেগ। তারপর ছোট একটা শ্বাস নিয়ে পড়ায় মন দেয়৷ 

 

সমুদ্র কে সবার প্রথমে আবেগ ই কোলে নিয়েছে। সাধারণত বাচ্চাদের কে সবার আগে তার বাবা কোলে নেয় কিন্তু সমুদ্রকে সে নিয়েছিল কারন হয়তো বিধারা আগে থেকেই জানত আবেগ ই সমুদ্রের বাবা হবে! 

 

রোদেলা কে হসপিটালে নেওয়ার পর ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে সমুদ্র জন্ম নেয়। ডক্টর আফরোজা অনেক ভালো আর অভিজ্ঞ গাইনোলজিস্ট জন্য সমুদ্র বেচে গিয়েছিল আর অক্ষত ই ছিল।অবশ্যই আল্লাহর ইচ্ছা ছিল জন্য ই সমুদ্রের জন্ম হয়েছে। 

 

 

 

অপারেশন থিয়েটারে আবেগ নিজেও দাড়িয়ে ছিল। তার হাত-পা কাপছিল বারবার আল্লাহ আল্লাহ করছিল যেন বাচ্চাটা বেচে যায়। আবেগ তো সে সময় রোদেলার  দিকে ভুলেও তাকায় নি একবারো। 

 

বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর মোরশেদা আপা রক্ত মুছে ক্লিন করে তার কোলে দিয়েছিল সমুদ্র কে। নরম তুলতুলে একটা বাচ্চা পুতুল কে কোলে নিয়ে আবেগের কেমন যেন অনুভূত হতে থাকে! এমন না যে এর আগে এতো ছোট বাচ্চা দেখে নি। এস এ ডক্টর কাজের ছলে অনেক বেবি দেখেছি কিন্তু এমন ফিলিং তো হয় নি৷ 

 

কি যে খুশি লাগছিল তখন সেটা কেবল এবং কেবলমাত্র আবেগ ই জানে। খুশিতে তার চোখে পানি চলে এসেছিল। 

 

সমুদ্রের চোখে সে-ই টর্চ মেরে চোখ খুলিয়েছিল। সমুদ্র চোখ খুলে সবার আগে তাকেই তো দেখেছিল। 

 

তখনো আবেগ জানত না রোদেলাকে রিশাদ ধাক্কা মেরেছে। রোদেলার যেহুতু জ্ঞান ছিল না তাই আবেগ জানতে পারে নি রোদেলার এমন ক্রিটিকাল অবস্থার জন্য রিশাদ দায়ী। সেদিন রোদেলার বাসায় ঢুকে সে রিশাদ কে দেখতে পায়নি কাজেই ভেবেছিল রোদেলা মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। 

 

রোদেলা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় নিজের বাবার বাসায় চলে এলেও রোদেলার বাবা-মা, আবেগের মা এবং বাড়ির মুরুব্বিরা চাচ্ছিলেন রোদেলা যেন ফিরে যায় তার শ্বশুড়বাড়ি। এভাবে যেন সংসার না ভাঙ্গে! ডিভোর্স না দেয় রিশাদ কে। রোদেলাকে বারবার বাচ্চা হওয়ার পর সব মিটিয়ে আবার সংসারে মন দিতে প্রেশারাইজ করছিলেন সবাই।মেনে নিয়ে চলতে আদেশ দেওয়া হচ্ছিল। এই কাজে আবার আবেগের মা সবার আগে ছিলেন। উনি প্রায়ই রোদেলা কে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ই ফিরে যেতে বলতেন। কিন্তু রোদেলা যাই নি। আবেগরা সবাই ভেবেছিল রিশাদ আর রোদেলার ঝগড়া হয়েছে তাই রোদেলা রেগে আছে। 

 

তাই তো সমুদ্র হওয়ার দিন রোদেলার কমপ্লিকেশন যখন বেড়ে যায় আবেগ নিজে গিয়ে রিশাদ কে ডাকতে যায়। নিজের বাচ্চা আর বউ দেখার জন্য রিশাদকে ডাকতে গিয়েছিল । কিন্তু রিশাদরোদেলা কে দেখতে যেতে সাফ মানা করে দেয়। ওইদিন রিশাদ অনেক জঘন্য ব্যবহার করে আবেগের সাথে। আবেগের সাথে মেঘ ও ছিল। 

 

কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তো রিশাদ সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বলেই দেয়, রোদেলার পেটের বাচ্চা নাকি তার না। এটা রোদেলার জারজ সন্তান। এই বাচ্চা নাকি আবেগ আর রোদেলার পাপের ফসল হেন-তেন আরো অনেক কিছু বলে রিশাদ। 

 

আবগ লজ্জার মাথা খেয়ে চলে আসে রিশাদের বাসা থেকে। সেদিন আরো একটা বিষয় বুঝে গিয়েছিল আবেগ আর মেঘ। তা হলো রিশাদের চরিত্র ভালো না। একে তো ব্যবহার ভালো না ই সেই সাথে চরিত্রে দোষ আছে। এটা বোঝার কারন হলো আবেগ আর মেঘ যখন সমুদ্র হওয়ার খবর দিতে  রিশাদের বাসায় যায় তখন তারা রিশাদকে একটা মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে। 

 

দুজন ই ব্যাপার টা চেপে যায়৷ এরপর রোদেলা হালকা সুস্থ হলে যখন তাকে কেবিনে শিফট করা হয় তার পরের দিন হাসপাতালে এসে হাজির হয় রোদেলার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন। যেহুতু আবেগরা সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার তাই রোদেলার ট্রিটমেন্ট এর খরচ রিশাদের কাছে চাওয়া হয়েছিল। ডিভোর্স তখনো হয় নি তাদের। বাচ্চা যেহুতু রিশাদের তাই দায়িত্ব তো তাকে পালন করতেই হবে। কিন্তু নাহ রিশাদ বিল তো দেয় নি বরং নিজের সন্তানকে স্বীকার করে নি 

রিশাদের ভাষ্যমতে, এই বাচ্চা তার না। রোদেলা আর আবেগের বাচ্চা। 

 

আবেগ ও কম না। ওইদিন ঠিক সেই মূহুর্তেই ডিএনএ টেস্ট করিয়েছিল কিন্তু রিপোর্ট আসতে তো সময় লাগবে। সেই সময়টুকুতে ই রিশাদ যা নয় তাই বলতে আরম্ভ করে দেয়। 

 

মৃত্যুর হাত থেকে বেচে আসা মেয়েটাকে যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করে রিশাদ। এমন কাজে রিশাদের মাও তাকে সাপোর্ট দেয়। 

 

পুরা হাসপাতালেরর সামনে আবেগকে অপমান, লাঞ্জনা, অপবাদ দেওয়া হয়। একজন ডাক্তারের কাছে তার সম্মান যে কি জিনিস এটা কেবল সেই ডাক্তারই জানে। হাসপাতালের স্টাফ, নার্স৷ ওয়াড বয়, ডাক্তার সবার সামনে আবেগের চরিত্রে আঙুল তোলা হয়৷ 

 

রিশাদ যেন এতেও ঠান্ডা হয় নি। এতো কিছু করার পর ও তার মন ভরে নি। সে সবার সামনে রোদেলার গায়ে হাত তুলে।ব্যস আবেগ অনেক রেগে যায় । এমন কি! নিজের  হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়। তাই তো সে রিশাদকে পেটাতে শুরু করে।  

 

হাসপাতালের বাকি স্টাফ রাও আবেগের দেখাদেখি রিশাদকে মারতে চলে আসে। কারন একটা অবলা মেয়েকে তার স্বামী লোকালয়ে পিটাচ্ছে এটা বাঙালী সাধারণ  জনতা সহ্য করবে না তাই তো রিশাদকে পিটিয়ে গনধোলাই দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। 

 

আবেগ ভাবতে লাগলো, রিশাদ বুঝি সেদিনের শোধটাই নিল তার উপর? 

 

রোদেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখে আবেগ টেবিলে বসে পড়ছে। সে ভ্রু কুচকে ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে আটটা বাজে। এতোক্ষনে তো আবেগের অফিস যাওয়ার কথা! 

 

সে উঠে পড়ল। এবং আবেগের কাছে গিয়ে বলে, হাসপাতালে যাবে না আজকে? 

 

আবেগ পড়তে পড়তে জবাব দেয়, না। 

 

রোদেলা আবারো প্রশ্ন করে, কেন? 

 

–আজ শুক্রবার। 

 

–ওহ! 

 

আবেগ পড়ায় মনোযোগ দেয়। এতে রোদেলার হাসি পেয়ে যায়। এতো দামড়া ছেলেকে পড়তে দেখে তার হাসি পাচ্ছে 

হাসি দমিয়ে রেখে সে বাথরুমের দিকে হাটা দেয়। 

 

রোদেলা যখন হেটে যেতে থাকে তখন আবেগ তার দিকে তাকালো এবং অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখল। 

 

রোদেলা হাটছিল সেই সাথে আস্তে আস্তে করে তার খোপা বাধা চুল উম্মুক্ত হয়ে যায়। এবং ছড়িয়ে পড়ে কোমড়ের নিচ অব্দি। 

 

অদ্ভুত এক মুগ্ধতা গ্রাস করে নেয় আবেগের মনে! কিছু একটা হয়ে গেল তার মনে যার পূর্বাভাস পেলেও ফলাফল হাতে পায় নি! 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা

Part–15 (বোনাস) 

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

–এটা কি চা নাকি অন্য কিছু রোদেলা? (শান্ত গলায় বলে উঠে আবেগ) 

 

রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, সর‍্যি? 

 

আবেগ চায়ের কাপ টেবিলে শব্দ করে রেখে বলে, আমি যতদূর জানি চায়ের মূল উপকরণ হলো চিনি। কিন্তু তোমার বানানো চায়ে এর কোন ছিটেফোঁটা ও নেই। 

 

রোদেলা মাথা নিচু করে নিল। এমন না যে সে রান্না পারে না। বরং রোদেলাকে ছোট খাটো একজন সেফ বলা যায়। সে ইচ্ছা করেই আবেগের চায়ে চিনি দেয় নি। 

 

আবেগ বিরক্তিমাখা মুখ নিয়ে সামনে এগাতে চাইলে রোদেলা মুখ ফুটে বলে উঠে, চা খাবে না? 

 

–না। 

 

আর কিছু না বলে আবেগ বাথরুমে গোসল করতে গেল। সকালে নাস্তা সেরে এক কাপ চা খেতে চেয়েছিল আবেগ। সে তো ময়নার মাকে বানাতে বলেছে৷ কিন্তু বানিয়ে আনল রোদেলা। চা বানালো ভালো কথা। চিনি কেন দিবে না? 

 

চিনি ছাড়া এতো বিদঘুটে হয়! মুখটার স্বাদই নষ্ট হয়ে গেল তার। 

 

রোদেলা চায়ের কাপটা হাতে নিল। কাপে সম্পূর্ণ চা ই পড়ে রয়েছে। আবেগের যে রাগ! মনে তো হয় না এই চা দ্বিতীয়বার মুখে দিবে। মামা-মামী দুজনেরই ডায়বেটিকস। আবেগের ও সুগার বর্ডার লাইন বরাবর। অথচ চিনি ছাড়া নাকি সে চা খায় না। ডাক্তার হওয়ার পর ও এমন গাফলতি কিভাবে করতে পারে সে 

 

রোদেলা ছোট করে চায়ে চুমুক দিল। আসলেই চিনি ছাড়া চা খেতে মজা না কিন্তু আবেগ যেভাবে রিয়্যাক্ট করেছে এতোটা করার মতো খারাপ ও না। রোদেলা  চা খেতে লাগলো। কোথায় যেন শুনেছে, স্বামীর খাওয়া কাপ বা প্লেটে খেলে নাকি মোহাব্বত বাড়ে। 

 

আচ্ছা এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা কি? তেমন কিছু তো দেখছে না। কেবল স্বামীর মুখের ব্যাকটেরিয়া গুলোই স্ত্রীর মুখে ট্রান্সফার হবে! এই যা দেখছে সে! 

 

আমরা সবসময় যা দেখি সেটাই সবসময় ঠিক হয় না। 

 

রোদেলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। 

 

যেহুতু সে এই বাড়ির বউ হয়েই এসেছে সুতরাং আগেভাগেই রান্নাঘরের দায়িত্ব টা নিয়ে নেওয়া উচিত। 

 

ময়নার মা আদা বাটছে। তাকে দেখে বলে, আরে নতুন বউ তুমি? কি লাগবে? 

 

রোদেলা কাপটা ধুয়ে নিয়ে বলে, না। আজকে রান্না আমি করব। 

 

–আচ্ছা। 

 

এমন সময় মামা-মামীর আওয়াজ ভেসে আসল। 

 

মামা মামীকে কিছু বলছেন এতে ঘোর আপত্তি জানাচ্ছে মামী। 

 

রোদেলা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতেই মামা তাকে দেখে ফেলে এবং তিনি উচ্চস্বরে বলে, দেখ তো মা। তোর মামী নাকি কোয়ান্টামে যাবে না। ওখানে গেলে মনোবল বাড়বে কিন্তু এই মহিলা যাবে না। 

 

মামী ঠোঁট বাকিয়ে বলে, আমার মনোবলের দরকার নাই। 

 

–অবশ্যই আছে। রোদেলা তোর মামীকে বল  নামাজ পড়ে এসে  আমরা বেরুব। রেডি থাকে যেন৷ 

 

মামী জোড় গলায় বলে, আমি যাব না। ওরা কিসব বলে মাথা ওয়াশ করে ফেলে। 

 

মামা বিড়বিড় করে বলে, তোমার মাথাটা ওয়াশ করাই উচিত তাও রিন পাউডার দিয়ে। 

 

মামী কিছু শুনতে না পেয়ে বলে, কি বলছো তুমি? 

 

মামা হাসিমাখা মুখে বলে, বলছি চল আমরা বুড়া-বুড়ি একটু রোম্যান্স করে আসি। 

 

মামীর চেহারা তখন দেখার মতো ছিল। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় আবেগ ও কেন যেন বেরিয়ে ছিল। সে সব শুনে খুকখুক করে কাশতে লাগলো৷ 

 

মামী রাগী চোখে মামাকে বলে, বুড়ো বয়সে এসব কি ভিমরতী লাগিয়েছো শুনে? 

 

মামা আবারো মামীকে লজ্জা দেওয়ার জন্য বললো, আহা ভিমরতী কেন হবে গো? প্রেমে পড়েছি আমি তোমার! তুমি কি সিনামার নায়িকার চেয়ে কম! আমার কাছে তুমি শাবানার চেয়ে সুন্দরী। 

 

আবেগ একথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে। হন্তদন্ত হয়ে মাথা চুলকাতে থাকে। 

 

রোদেলা এবার শব্দ করে হেসে ই দিল। তাকে হাসতে দেখে ময়নার মা ও হোহো করে হাসতে লাগলো। রোদেলা আর ময়নার মাকে হাসতে দেখে মামাও  হেসে দিলেন৷ 

 

আসলে হাসি সংক্রামক রোগ বটে তাই তো আবেগ ও হেসে ফেলে। বেচারা হাসি চাপিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল প্রথম থেকেই কিন্তু পারল না । 

 

রোদেলা মুগ্ধ চোখে আবেগকে দেখতে থাকে।  ছেলেটাকে হাসলে বড্ড স্নিগ্ধ লাগে! 

 

মামী জোড়ে একটা ধমক দিলেন আর সবাই চুপ হয়ে গেল। হাসির আর একটা শব্দ ও মামীর কানে গেল না। 

 

মামী লজ্জা-লজ্জা ভাব নিয়ে সুরসুর করে তার রুমে চলে গেল। 

 

ইমতিয়াজ সাহেব ইচ্ছা করেই তার মিসেসকে ছেলের বউয়ের সামনে লজ্জা দিল। এখন এই লজ্জা এড়াতে জাবেদা খাতুন কোয়ান্টামে যাবে। 

 

কোয়ান্টামে যাওয়া খুব জরুরি তাদের জন্য। পাড়ার কয়েকটি শিক্ষিত ছেলে মিলে এই সংঘটা খুলেছে৷ এখানে খুব সুন্দর সুন্দর বানী, উক্তি বলা হয়। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা থেকে শুরু করে কিভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায় সবকিছু নিয়েই আলাপ করা হয়৷ মানসিক শান্তি  কিভাবে পাওয়া সাবে সব কিছু নিয়ে নতুন জেনারেশনের ছেলেরা আলাপ করে৷ 

 

ইমতিয়াজ রহমান জানে তার মিসেস কিছু টা কুটনি! কথা লাগাতে পছন্দ করে সিরিয়ালের ভিলেন মহিলাদের মতো। তাই তো ছলে বলে কৌশলে তিনি এই পদক্ষেপ টি নিচ্ছেন। যদি কিছু পরিবর্তন আছে জাদেবা খাতুনের মাঝে! 

 

★★★

 

রোদেলা গরুর মাংস বসালো। মামী সেই যে রুমে ঢুকেছে আর বের হননি! 

 

গোল গোল করে আলু কেটে মাংসের মধ্যে ছেড়ে দিল। আবেগের গরুর মাংস খুব প্রিয়। 

 

গরুর মাংস খাওয়ার একটা কায়দা আছে। এই খাবার কখনোই বাসি কিংবা ঠান্ডা খাওয়া যাবে না। সবসময় গরম গরম খেতে হবে৷ গরম ভাতের সাথে চুলা থেকে নামানো গরুর মাংস  সাথে শশা। 

 

রান্না করা শেষ করে রোদেলা রুমে গিয়ে দেখে আবেগ পাঞ্জাবি পড়ে রেডি। সম্ভবত মসজিদে যাবে। 

 

সাড়ে বারোটা বাজতেই আবেগ তার ফোন হাতে নিয়ে সুইচ অফ করে দিল। 

 

যা দেখে রোদেলা বুঝতে পারল আবেগ এখনি বের হবে। 

 

আবেগ আড় চোখে রোদেলাকে দেখে নিল। রোদেলা বসে বসে কাপড় ভাজ করছে। 

 

সে বড় বড় পা ফেলে সমুদ্রের কাছে গিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে রুম ত্যাগ করল। 

 

সবটা ঘটলো রোদেলার সামনে। সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। তার ছেলে এতো ভাগ্যবান! 

 

★★★

মামা আর আবেগ মসজিদ থেকে ফেরার পর দুপুরে খেতে বসেছে সবাই।কিন্তু  আবেগ খেতে পারছে না কারন তার ডান হাত মচকে গেছে৷ নাড়াতেই পারছে না হাত। আর মুখে খাবার তোলা তো দূরের কথা। গরুর মাংস (বাঙ্গালী পদ্ধতিতে রান্না করা)  এমন একটা খাবার যা চামচ দিয়ে  খাওয়া যায় না। 

 

সে অনেক ট্রাই করছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না।

 

মামা বলে উঠে, এক কাজ কর তো মা। আবেগকে খাইয়ে দে। 

 

একথা শুনে রোদেলার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সেই সাথে চোখ ও প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম। 

 

আবেগ মাথা নিচু করে ফেলে। আব্বার আজকে হয়েছেটা কি? কি আবোলতাবোল বকছে৷ 

 

মামী কিছুক্ষন বিষ্ফরিত চোখে মামার দিকে তাকিয়ে থেকে কটমট গলায় বলে, ও কেন খাওয়ায় দিবে? আমি দিচ্ছি আমার ছেলেকে খাওয়ায়৷ 

 

মামা মামীর হাতটা ধরে বলে, আহা তুমি কেন দিবে ওকে খাইয়ে? রোদেলা খাইয়ে দিবে৷ 

 

মামী বলে৷ না আমি দিচ্ছি। 

 

মামা।এবার দুষ্টুমি মাখা গলায় বলে, এতো শখ খাওয়ায় দেওয়ার তো আমাকে দাও না? দামড়া ছেলেটাকে না খাইয়ে দিয়ে আমার মতো বুড়ো মানুষ কে খাইয়ে দাও। আমার  একটু সেবা-যত্ন করো। 

 

এবারো মামীর চেহারা দেখার মতো৷ মামী বলে উঠে, আমার ছেলেকে আমি খাইয়ে দিব। রোদেলা কেন দিবে? 

 

–কেন দিবে না বল? রোদেলা তো বউ হয় আবেগের। তোমার মনে নাই? বিয়ের প্রথম প্রথম তুমি আমাকে প্রতিদিন রাতে খাইয়ে দিতে। বাধ্যতামূলক ছিল আমাকে খাইয়ে দেওয়া। 

 

মামীর তো চোখ-মুখ লাল হয়ে আসতে লাগে মামার কথা শুনে। 

 

আবেগ কোনমতে এক ঢোক পানি খেয়ে উঠে পড়ল। সেই সাথে মামী ও৷ 

 

রোদেলা মামীকে পিছু ডাকলেও উনি শুনলেন না৷ 

 

রোদেলা মামাকে বলে, কি দরকার ছিল মামা এসব বলার? উনি রাগ করে না খেয়ে চলে গেলেন। 

 

মামা তার প্লেট সরিয়ে বলে।,আজকে আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি বাইরে গিয়ে নান রুটি-শিক-কাবাব খাব। তুই আবেগ কে খাইয়ে দে। আমি যাই। 

 

ইভানা মিটমিট করে হেসেই চলেছে তার বাবার কান্ড দেখে। 

 

রোদেলা হালকা হেসে আবেগের প্লেট নিয়ে রুমে চলে আসল। 

 

রুমে এসে দেখে আবেগ বিছানায় বসে ফোন চালাচ্ছে। সে আবেগের পাশে গিয়ে বসে  পড়ল। আবেগ একবার রোদেলা কে দেখে নিয়ে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

 

রোদেলা ভাত মাখিয়ে আবেগের মুখের  সামনে তুললে আবেগ প্রশ্ন করে, কি হচ্ছেটা কি এখানে? 

 

রোদেলা মৃদ্যু গলায় জবাব দেয়, খাওয়াব তোমাকে। 

 

–দরকার নেই। আমার খাওয়া হয়ে গেছে৷ 

 

–কিছু ই তো খাও নি। সম্পূর্ণ ভাত পড়ে আছে। এতোগুলো খাবার ওয়েস্ট করা কি ঠিক? 

 

খাবার নষ্ট হবে শুনতেই ছোট বেলায় মায়ের বলা কথা মনে পড়ে গেল। আগে খেতে না চাইলে মা বলতেন,যে ক’টা দানা  নষ্ট করবে ঠিক সে ক’টা দানা খাবার আখিরাতে সাপ হয়ে এসে ছোবল মারবে। 

 

আবেগ প্লেটের দিকে তাকালো এবং ভাতের দানা গোনার মতো বৃথা চেষ্টা প্র‍য়াস করতে লাগলো। 

 

রোদেলা বলে উঠে, তোমাকে কি এখন বাচ্চাদের মতোন ভুলিয়ে -ভালিয়ে খাওয়াতে হবে নাকি? সেই কখন থেকে ভাত নিয়ে বসে আছি। খেয়ে নাও। 

 

আবেগ কি ভেবে যেন রোদেলার হাতে গোল করে রাখা ভাতের লোকমা টা তার মুখে পুরে নিল। 

 

হুট করে আবেগের মুখের গরম ভাব পাওয়ায় কেপে উঠে রোদেলা। সে কিছুটা অপ্রস্তুত বনে যায়। কিন্তু আবেগকে বুঝতে দেয় না। আবেগ যদি একবার বুঝে যে রোদেলা তাকে খাইয়ে দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। ব্যস আর খাবে না। এসব ব্যাপারে খুব ঘাড়ত্যাড়া আবেগ। 

 

আবেগের কাজ বলতে গেলে শুধু মুখের খাবার টা চাবিয়ে গিলে ফেলা। বাকি কাজ রোদেলা করছেই৷ 

 

আবেগ খেতে খেতে রোদেলার দিকে তাকালো। আবার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আবার রোদেলার দিকে তাকালো। এবং রোদেলার চোখ মুখ ঠোঁট, গাল পর্যবেক্ষন করতে লাগে নির্লজ্জের মতো!

 

আবেগ দেখল রোদেলার নাকে ছোট একটা নাক ফুল।  নাক কবে ফুটো করেছে রোদেলা? রিশাদের সাথে বিয়ে করার আগে? নাকি পরে? কিছু তেই মনে আসছে না। আবেগের একটা সমস্যা আছে তা হলো যখন যেটা মনে করার চেষ্টা করে সেটা কোন দিন ও মনে করতে পারবে না! 

 

রোদেলা শেষ লোকমা আবেগের মুখে তুলে দিল। তখনো প্লেটে একটা হাড্ডি অবশিষ্ট ছিল। তা দেখে রোদেলা বলে, হাড্ডি চাবাবে? 

 

আবেগ পানি খেয়ে উত্তর দেয়, আমি এসব হাড্ডি চাবাই না। 

 

রোদেলা হাড্ডিটা নেড়েচেড়ে বলে, এটা অনেক মজার হাড্ডি। শিনার হাড্ডি। মজা পাবে৷ চাবিয়ে। 

 

–তুমি চাবাও৷ 

 

একথা শুনে রোদেলা সত্যি সত্যি হাড্ডি চাবাতে শুরু করে দিল খুবই সাবলীল ভাবে৷ 

 

আবেগ হতভম্ব হয়ে যায়। পরমূহুর্তেই হতভম্ব ভাবটা মুগ্ধতা টায় রুপ নিল। 

 

হাড্ডি চাবানো অবস্থায় ও কাউকে এতোটা মায়াবতী লাগে! 

 

আবেগের মনে হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদ কিঞ্চিৎ ভুল বলেছে, যে মেয়েকে ঘুমালে সুন্দর লাগে সে প্রকৃত সুন্দর নহে বরং যে মেয়েকে হাড্ডি চাবানো অবস্থায় সুন্দর লাগে সে-ই আসল এবং সত্যিকার অর্থে সুন্দরী। শুধু সুন্দরী না। সুন্দরীর আগে বিশেষন  হিসেবে মারাত্মক বসবে!

 

★★★

 

মামা-মামী বের হতেই ইভানা এক প্রকার দৌড়ে এসে রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ভাবী আমি আমার ফ্রেন্ডের বাসায় যাব৷ 

 

রোদেলা সহজ ভাষায় বলল, যাও।

 

–না মানে সমুদ্র কে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। 

 

এবার আবেগ বলে উঠে, কেন ও নিবি সঙ্গে? 

 

ইভানা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, আ,,,আমার ফ্রেন্ডরা খুব করে বেবিকে দেখতে চাচ্ছে। নিয়ে যাই না? সঙ্গে ফিডার নিব। কিচ্ছু হবে না। সমুদ্র তো গুড বেবি। একদম কান্না করে না। নিয়ে যাই না? প্লিজ! 

প্লিজ! 

 

আবেগ রাজি হচ্ছিল না। ইভানা অনেক জোড়াজুড়ি করে বিধানায় রাজি হয়ে যায়। 

 

ইভানা দৌড়ে গিয়ে সমুদ্র কে কোলে নেয়। 

 

আবেগ তাকে থামিয়ে বলে, জামা চেঞ্জ করে নিয়ে যা। রোদেলা ওকে ভালো দেখে একটা গেঞ্জি পড়িয়ে দাও। 

 

রোদেলা মুখ ভার করে বলে, ওর তো সব এমন ই সুতি জামা। গেঞ্জি তো কেনা হয় নি। 

 

আবেগের মেজাজ বিগড়ে গেল। এটা কেমন কথা? তার ছেলে প্রথম বার বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে অথচ এই ফুটপাতের জামা পড়ে যাবে? 

 

আবেগের মন চাচ্ছে এখনি দোকানে গিয়ে একটা গেঞ্জি কিনে এনে পড়িয়ে দিক সমুদ্রের গায়ে। কিন্তু সেই সময় ইভানা দিল? বাবুকে নিয়ে চলে গেল বন্ধুর বাসায়। 

 

ইভানা যেতেই আবেগ বলে উঠে, রেডি হও। 

 

রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, কেন? 

 

–কাজ আছে। 

 

–খুব দরকারী? 

 

–খুব প্রয়োজনীয়। 

 

রোদেলা কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নেয়। বাসা তালা দিয়ে বের হল দুজনে। 

 

কিছুক্ষন পর রোদেলা বুঝল আবেগের প্রয়োজনীয় কাজটা আসলে কি? তারা একটা বেবি শপের সামনে এসেছে৷ 

 

আবেগ দোকানে ঢুকে সমুদ্রের জন্য সুন্দর সুন্দর জামা কিনল। সামনে শীত আসছে। তাই সুয়েটার। মুজা, টুপি, জুতা অনেক কিছু কিনল। সঙ্গে কিছু খেলনা কিনল। রোদেলা অনেকবার মানা করছিল৷ বারবার বলতে লাগে এতো খরচ করার কি আছে। 

 

এক সময় আবেগ তাকে ধমক দিয়ে বলে, প্লিজ চুপ করো তো। মানলাম আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিলং করি তাই বলে এতোও কম সার্মথ্য না আমার। ঢাকা শহরের ডাক্তার আমি। একজন রুগীর ভিজিট ই পাঁচশ করে রাখি। সো কাইন্ডলি সাপ আপ ইউর মাউথ। ফর গড সেক।। 

 

রোদেলা আর কিছু বলে নি৷ দোকানললং থেকে বের হয়ে আবেগের চোখ ফার্নিচারের দোকানে যায়৷ একটা রাজকীয় দোলনার দিকে চোখ আটকে যায় আবেগের। সে সেই দোকানে ঢুকে দোলনা কিনতে চায়। 

 

এবার রোদেলা মুখ খুললো। দোকানদারের সামনেই বলে উঠে, এটা কেনা অযথা। বাবু কিছু দিন পর ই হাটা শিখবে। তখন কি করবে এটার? 

 

দোকানদার ও কম না।  পাইছে আবেগের মতো কাস্টমার। হাত ছাড়া  করে কি কিভাবে? সে জোড় গলায় বলে, আরেকটা বাবু হবে যখন ওই বাবু দোল খাবে। টাকা উসুল হয়েই যাবে আপা দুই বাচ্চা দোল খেলে। 

 

রোদেলার চোখ বড় বড় হয়ে আসল। সে ঢোক গিলল। অস্বস্তি বিরাজ করতে লাগলো তার চারপাশে। তৃষ্ণা পেয়ে গেল তার। 

 

আবেগ এই কথায় রাগ করবে কি? আল্লাহই জানে! 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

Part–16

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

পূর্নিমা হোটেল থেকে নান আর শিক কাবাব খেয়ে কোয়ান্টামে পৌছালো জাবেদা খাতুন আর ইমতিয়াজ রহমান। রহান সাহেবের মনটা কেন যেন আজ ফুরফুরে বেশ। 

 

আগে প্রায়ই পূর্নিমা হোটেলে আসা-যাওয়া হত। কিন্তু এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে আর আসা হয় না। হোটেলটা অনেক পুরোনো। তাদের আমলের হোটেল। আভিজাত্য না বললেই চলে। কিন্তু খাবারের স্বাদ? যেকোন ফাইভ স্টার হোটেলকে হার মানাবে। নানরুটির সাথে একটা শশা দিয়ে সালাদ দেয় সেটার স্বাদ বলার বাইরে। 

 

কোয়ান্টামটা একটা বাসার নিচ তলায়। তিনরুমের একটা বাসায় তাদের এলাকার কিছু ছেলে-মেয়েরা মিলে খুলেছে। যা টাকা আয় করে সেটা ডোনেট করা হয়৷ মূলত স্বেচ্ছাসেবা কেন্দ্র৷ 

 

ছোট হলে কি হবে? খুব পরিপাটি করে সাজানো। ঢুকলেই মনে হবে অন্য কোন জগতে চলে এসেছে৷ সবকিছু সাদা৷ কর্মীদের পরনে সাদা শার্ট আর মেয়েরা সাদা সালোয়ার। আর অবশ্যই সবসময় মুখে একটা হাসি ঝুলবেই। 

 

খুব অদ্ভুত লাগে এদেরকে দেখলে জাবেদা খাতুনের! মনে হয় এরা ভীনগ্রহের ছেলে-মেয়ে! 

 

রহমান সাহেব জাবেদা খাতুনকে নিয়ে বসলেন। 

 

কিছুক্ষনের মধ্যে একটা কমবয়সী যুবক ঢুকল। 

 

তাকে দেখেই জাবেদা খাতুন মনমরা হয়ে যান। এই ছেলেটার কথা শুনলে তার নিজের ভেতর খুব লজ্জা আর অপমানবোধ হতে লাগে! ছেলেটার কথায় যাদুর মতো কিছু আছে। দেখতে সুদর্শন। সবসময় সাদা শার্ট ইন করে পড়বে। চুল গুলো গুছানো আর মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখবে। সপ্তাহে একদিন লেকচার দেয়। শুক্রবার করে। 

 

ছেলেটা আসতেই একজন বয়ষ্ক মহিলা বেশ  উৎসাহের সাথে বলে উঠে, শৌখিন বাবা, কালকে আমি এক ভিক্ষুকলে বাসায় ঢেকে বসে ভাত খাইয়েছি। 

 

সাদা শার্ট পড়া ছেলে টা মানে শৌখিন মুচকি হেসে বলে, আমি এম সো প্রাউড অফ ইউ। সবাই ওনার জন্য করতালি দিন প্লিজ৷ 

 

ক্লাসের সবাই তালি দিল। শৌখিন হাসি হাসি ভাব রেখে বললো, তাহলে শুরু করি? 

 

এরপর খানিকক্ষন চুপ থেকে বলে উঠে, আচ্ছা আমরা যে বলি, আমরা মানুষ। উই আর ম্যান। হিউম্যান। এই মানুষ বা হিউম্যান মানে টা কি? ম্যান ইজ ইমমরাল খুব তো বলি কিন্তু এই ম্যান মানে কি? 

 

সবার মাঝে অবাক ভাব বিরাজ করল। এটা আবার কেমন প্রশ্ন? মানুষ মানে কি? 

 

শৌখিন একজন কে উত্তর টা বলতে বলল। সে উঠে দাড়িয়ে বলল, যার দুটো হাত, দুটো পা আছে সেই মানুষ। 

 

এই উত্তর শুনে শৌখিন বলে, পাখির ও দুটো পা আছে। তারপর ডলফিনের ও তো হাতের মতো দুটো অঙ্গ আছে তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী ওরাও তো মানুষ হওয়ার কথা। 

 

এবার একজন বলল, যার মন আছে সেই মানুষ। 

 

উত্তর শুনে শৌখিন আবারো হাসি হাসি ভাব রেখে বলল, আপনরা খেয়াল করেন কি না জানিনা। কেউ যদি কোন কুকুর বা বিড়াল বা ছাগল পালে তাহলে সেই অবুঝ প্রানি গুলো মালিক না থাকলে তাকে খুজে। কেন খুজে? তারপর আদর করলে বিনিময়ে তারাও আদর দেয়। কেন দেয়? আমরা কি এ হতে বলতে পারি না? অন্যান্য জীবদের ও মন আছে। জগতের সবারই একটা মন থাকলেও কেন মানুষ কে জীব না বলে মানুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে? উত্তর টা আমিই বলছি, 

 

এরপর হুয়াইট বোর্ডে সে মানুষ লিখলো। কিছুটা স্পেস দিয়ে। এতে সবাই সহজে বুঝে গেল তিনটা আলাদা আলাদা শব্দ আছে

 

 এবার শৌখিন মানুষ লেখাটা বরাবর সাহায্য লিখল। 

 

সবাই ভ্রু কুচকে লেখা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর আগ্রহ নিয়ে৷ 

 

সে মুচকি হেসে বলে,মানুষ ও তিন অক্ষরের সাহায্য ও তিন অক্ষরের কিন্তু! আমরা মানুষ কারন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত এই বিশ্বজগতের প্রতিটা সৃষ্টিকে সাহায্য করে যেতে হবে। মানুষের কাজই সাহায্য করা। কি বুঝলেন তো এবার? মন সব প্রানীর  ই আছে। হাত-পা ও কারো কারো আছে কিন্তু সাহায্য সবাই করতে পারে না। কেবল মানুষ করতে পারে। বিধাতা তাকে এই ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছে তাই তো আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব! আমরা যে বলি না? টাকা কামাব, বড়লোম হব। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু উদ্দেশ্য অবশ্যই থাকতে হবে আমি অনেক টাকা কামাব যেন এখন যতটা সাহায্য করতে পারছে, বেশি টাকা আন করলে যেন এর চেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারি। আমি বড়লোক হব কারন আমাকে অসংখ্য মানুষ বা জীবকে সাহায্য করতে হবে।  মোট্ট যদি এটা হয় তাহলেই আপনি সৃষ্টির সেরা। অন্যথায় কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। মানুষ আর মানুষ থাকব্র না। আরো অনেক কিছু বলল ছেলেটা। 

 

জাবেদা খাতুন মনযোগ দিয়ে শুনেই যাচ্ছেন। 

 

শৌখিন এবার বলল, আপনাদের জন্য হোম টাস্ক হলো এই সাতদিনে সাতজন মানুষের মন ভালো করতে হবে। এই সাতজন যে কেউ হয়ে পারে। আপনার বাসার সাহায্যকমী। দারোয়ান, আবার আপনার মেয়ে, ছেলের বউ, স্বামী যেকেউ। কিন্তু মন ভালো করতে ই হবে। আমি কিন্তু আগামী শুক্রবার জিজ্ঞেস করব সবাইকে।কে কিভাবে আর কার মন ভালো করেছে। মনে থাকে যেন! আজকে এই পর্যন্তই । আসি তাহলে। 

 

★★★

 

রিকশা আপন গতিতে চলছে। রোদেলা রিকশার হুট ধরে বসে আছে। পাশেই বসে আছে আবেগ। বিকেলের মিস্টি রোদ তাদের গায়ে পড়ছে। বেশ ভালোই লাগছে রোদেলার। পাশ থেকে আবেগের গায়ের কড়া মাতাল করা পারফিউমের গন্ধ রোদেলার  নাকে আসছে। রোদেলা বুক ভরে গন্ধ টা নিচ্ছে। 

 

আবেগ রোদেলাকে বলল, দেখো আমাদেরকে ফলো করতে পারছে তো ভ্যানটা। রোদেলা রিকশা থেকেই পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো, দোলনা যেই ভ্যানে করে আনা হচ্ছে সেটা তাদের পেছন পেছন আসছে কিনা। 

 

দোকানে আবেগ কেন যেন কোন রিয়্যাক্ট করে নি। বেচারা দোলনাটার প্রতি এতোটাই মুগ্ধ যে দোকানদারের বলে উজবুক কথাও হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আবেগ দোকানদারকে প্রতিউত্তরে শুধু বলেছিল, আপাতত আমার প্রথম সন্তানই দোল খাক। পরেরটা পরে দেখা যাবে। 

 

এই সহজ কথাটা রোদেলা বুঝতে পারে নি। এর মানে কি? আবেগ কি চায় বুঝতে পারে নি এই কথার দ্বারা।। 

 

হুট করে একটা ঝাকুনি লাগায় রোদেলা টাল সামলাতে না পেরে রিকশা থেকে পড়ে যেতে ধরে কিন্তু ভাগ্য ভালো থাকায় আবেগ তার কোমড় জড়িয়ে ধরে। 

 

রোদেলার চিৎকারে রিকশা চালক গাড়ি থামিয়ে দেয়। 

 

আবেগ রোদেলাকে হাত দিয়ে টেনে এনে বসায় এবং প্রচন্ড ধমক দিয়ে, এখন যদি পড়ে যেতে তবে কি হত? 

 

রোদেলা কাচুমাচু করে বলে, ভ্যানটা চোখে পড়ছিল না তাই একটু বেশিই ঝুকে গিয়েছিলাম বোধহয়  

 

আবেগের চেহারায় ক্রোধ। সে রাগী গলায় বলে, 

 

সবসময় একটা না একটা প্রবলেম ক্রিকেট না করলে তোর মন ভরে না তাই না? 

 

রোদেলা একথা শুনে বিষ্মিত হয়ে গেল। সে কি এমন করল যে আবেগ তাকে এতো বড় একটা কথা বলে দিল৷ 

 

রোদেলা যন্ত্রের মতো করে বলে,কি করেছি আমি? তোমার আর নেহার মধ্যে এসেছি এইটাই তো। দোষ তোমার ও আছে। আমি কি জোড় করেছিলাম তোমাকে? কি দরকার ছিল বিয়ে করার আমাকে? আমি কখনোই কারো ক্ষতি চাই না। আর কারো জীবনেই প্রব্লেম ক্রিয়েট করি নি। 

 

আবেগ রোদেলার কোমড় জড়িয়ে ধরে রেখেই অন্য পাশে মুখ ফিরালো। সে নিজেও বুঝছে না কেন হুট করে এই কথাটা বলে ফেলল? শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে বসল। 

 

রোদেলার চোখে অটোমেটিক্যালি পানি চলে এসেছিল। এবার সে শব্দ করে কেদে দিল। 

 

রোদেলার দিকে আবেগ বিষ্ফরিত চোখে তাকায়৷ মেয়েটা কাদছে! 

 

কিন্তু তার কেন  এতো শোক হচ্ছে? হুট করে আবেগের বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হতে লাগলো। এই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত না! 

 

এর অপর কি ভালোবাসা নাকি করুণা? 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

part–17

#Arishan_Nur(ছদ্মনাম) 

 

অথৈ আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে নিল। হালকা বেগুনি রঙের একটা সুতির কাজ করা সালোয়ার কামিজ। এক রঙের একটা ওড়না গায়ে জড়িয়েছে সে। চুল গুলো খেজুর বেণি করা। কপালের সামনে কিছু চুল এসে পড়েছে। চোখে চিকন করে কাজল দেওয়া আর ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক। একদম ফর্মালভাবেই সেজেছে। ইন্টারভিউয়ে এভাবেই যেতে হয়। সে আবারো নিজেকে দেখে নিল সব ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য। নিজের মধ্যে কোন খুঁত পেল না অথৈ৷ 

 

অথৈ খুব নার্ভাস। সে খুব করে চাচ্ছে যে এই চাকরি টা যেন তার হয়ে যায়। একটা জবের খুব দরকার তার এই মূহুর্তে। অর্থের জন্য না বরং নিজের পায়ে দাড়ানোর জন্য হলেও এই জব দরকার তার। 

 

কিন্তু  অথৈয়ের রেজাল্ট ফাইনাল সেমিস্টারে খারাপ ছিল জন্য সিজিপিএ তেও গড়ে কিছু পয়েন্ট কমে গেছে তাই এখন জব সেক্টরে বেশ নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে। এক বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে সে। কিন্তু ফল পাচ্ছে না। একে তো প্রাইভেট ফার্মে লিংক বেশি দরকার পড়ে যেটা তার নেই। তার কোন মামা-চাচা নাই। তার বাবা দশ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও চাকরি পাইয়ে দিবেন না৷ অথৈ ছোট করে একটা নিশ্বাস ফেলল। সব দোষ ওই মেঘের৷ ওর জন্যই অথৈয়ের রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল। এমনি ইডেন আন্ডাররেটেড ভার্সিটি তার উপর সিজিপিএ কম! কিন্তু জবটা তার খুব দরকার  

 

অথৈ রুম থেকে বের হলো। সাড়ে নয়টা বাজে। 

 

অথৈকে দেখে তার মা বলল, নাস্তা করে নে। 

 

অথৈ চুপচাপ বসে পড়ে এবং মিনমিন সুরে বলে, বাবা অফিস গিয়েছেন? 

 

–হ্যা। কিছুক্ষন আগেই বের হলো। শোন? 

 

–হু? 

 

–তোর বাবা কিন্তু একটু রেগে আছে তোর উপর। 

 

অথৈ সহজ গলায় বলে, কেন? 

 

তার মা চা খেতে খেতে উত্তর দেয়,কালকে রাতে তুই বাসায় ছিলি না। আমরা কিন্তু ওই ধরনের পরিবার না। যে মেয়ে বাইরে থাকলেও সমস্যা নাই। তোর বাবা এজন্য রেগে আছে। বুঝে-শুনে চলিস একয়েকদিন। 

 

–আচ্ছা। 

 

অথৈ তার বাবা-মাকে বলেছিল যে সে নেহার বাসায় ছিল। তার কথা বিশ্বাস করে নিয়েছে তার মা-বাবা। সে নাস্তা করে রওনা দিতে গেলে তার মা বলে উঠে, শোন, কালকে তোকে ফোনে না পেয়ে ফয়সাল  তোর বাবাকে কল করেছিল। তোর বাবা আর ফয়সালের মধ্যে কথা হলো। ফয়সাল দ্রুত বিয়ে করে নিতে চাচ্ছে। ওর নাকি প্রোমোশন হয়েছে৷ 

 

মুহুর্তের মধ্যে অথৈয়ের চেহারা কালো হয়ে গেল। চারপাশ অন্ধকার দেখতে লাগে সে। চোখ দুটো টলমল করে উঠল। 

 

অথৈ টলমল চোখ নিয়েই যাত্রাপথে পা বাড়ালো। 

 

★★★

 

আবেগের কাছে কোন জবাব না পেয়ে রোদেলার চোখ ছলছল করে উঠে। চোখ বেয়ে পানি পড়া শুরু হয়ে যায়। 

 

সেটা দেখে আবেগ বিড়বিড় করে বলে, ইচ্ছা করে কাদো তাই না? খুব ভালো করেই জানো কাউকে কাদতে দেখলে আমি  আত্মসমর্পন করে নিই। নাইস ট্রিক। 

 

রোদেলা নাক টেনে বলে, এতোই যদি ভালোবাসো নেহা কে তাহলে ওর কাছেই যাও না। আমার আর সমুদ্রের সাথে থাকতে হবে না। আমাদের দায়িত্ব নিজের কাধে নিয়ে বোঝা বাড়াতে হবে না। 

 

আবেগ ফস করে বলে দেয়, তোমার একটা গতি করে দিই তারপর পরেরটা পরে দেখা যাবে। 

 

কথাটা আস্তে বললেও রোদেলার কানে পৌছায়। রোদেলা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। কিসের গতি করে দিতে চায় আবেগ? এই কথা দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছে আবেগ? 

 

রোদেলা তেজ গলায় বলে, কিসের গতি করে দিবে তুমি?

 

আবেগ কিছু বললো না। 

 

রোদেলা কান্না চাপিয়ে রেখে বলে, বাক্য টা শেষ কর। 

 

আবেগ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে, বাক্যটা এখানেই শেষ। 

 

–পরেরটা কি হবে সেটা জানতে চাচ্ছি আমি আবেগ। 

 

–বললাম তো পরের টা পরে দেখা যাবে। ভবিষ্যত নিয়ে কিভাবে মন্তব্য দিব? আমি কি জোতিষ্ক নাকি? 

 

রোদেলা দাতে দাত চেপে বলে, পরে আর কি করবে তুমি? আমার গতি করে দিয়ে নেহার কাছে ব্যাক করবে? 

 

আবেগের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো 

এমনি সে যথেষ্ট শান্ত স্বভাবের। সহজেই রেগে যাওয়া তার স্বভাব না। কিন্তু এই মূহুর্তে তার খুব রাগ লাগছে । প্রচন্ড রাগ যাকে বলে।আবেগ যখন রেগে উঠতে শুরু করে তখন তার কপালের রগ ফুলে উঠে। আজকেও তার কপালের রগ ফুলে উঠতে শুরু করেছে। 

 

এই মিস্টি রোদটাকেও তার অসহ্য লাগছে সেই সাথে রোদেলাকে অসহ্য লাগছে  শুধু রোদেলা না। এই মূহুর্তে পৃথিবীর সব কিছুই তার কাছে জাস্ট অসহ্য লাগতে শুরু করেছে। 

 

রোদেলা আবারো কিছুটা চেচিয়ে উঠে বলে, মুখ দিয়ে কোন কথা কেন বের হচ্ছে না তোমার? তুমি কিন্তু ভেজা বিড়াল না। 

 

আবেগ বিড়বিড় করে, আশ্চর্য আমি বিড়াল কেন হতে যাব? 

 

রোদেলা আরো কিছু বলছে কিন্তু সেগুলো আবেগ তার কানে নিল না। এই মূহুর্তে তার আরেকটা ভয়ংকর কাজ করে বসতে মন চাচ্ছে তা হলো রোদেলাকে ঠাস করে একটা চড় মারা। এই কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় কোন মেয়ে তার স্বামীর সাথে এরুপ আচরণ কিভাবে করতে পারে? 

 

আবেগের মুখ, চোখ লাল হতে লাগলো। সে সামনে তাকিয়ে দেখে রিকশাওয়ালা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রিকশা মাঝরাস্তায় থামা। 

 

সে কিছুটা ধমক দিয়ে বলে, রিকশা থামায় রাখছেন কেন? আগান। 

 

রিকশাওয়ালা রিকশা যেই না আগাবে রোদেলা চিৎকার দিয়ে বলে উঠে, খবরদার রিকশা আগাবেন না। 

 

আবেগ অবাক হয়ে রোদেলার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, তোমার আবার কি হলো? 

 

রোদেলা দরদর করে ঘামছে। সে রিকশাওয়ালা কে উদ্দেশ্য করে বলে, আমি এই লোকের সাথে যাব না। আপনি রিকশা সাইড করেন আমি নামব। 

 

আবেগ আশেপাশে তাকিয়ে বলে, কোন লোকের  সাথে যাবা না তুমি? কার কথা বলছো তুমি? আমি তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না তোমার কথা! 

 

রোদেলা বলল, তোমার সাথে যাব না আমি৷ 

 

আবেগ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, আমি লোক? 

 

রিকশাওয়ালা দাত বের করে হেসে দিয়ে বলে, তো ভাইজান আপনি কি মাইয়া লোক নাকি?

 

আবেগ কড়া চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই রোদেলা নেমে গেল অগত্যা আবেগ ও নামলো এবং রিকশাওয়ালার কছে টাকা ধরিয়ে দিয়ে সামনে পা বাড়ালো। 

 

রোদেলা জোড়ে জোড়ে হাটছে। এতে একটু ব্যথা লাগছে তার কিন্তু সে পরোয়া না করে হেটেই যাচ্ছে। থাকবে না আর আবেগের সাথে। সমুদ্র কে নিয়ে আজকেই বাবার কাছে চলে যাবে। 

 

আবেগ রোদেলার পিছনে পিছনে আগাতে লাগলো। কি একটা অবস্থা! এভাবে কোন দিন কারো পেছনে রাস্তায় দৌড়ানি খাওয়া লাগে নি। 

 

সে রোদেলার কাছাকাছি গিয়ে, উপায় না পেয়ে রোদেলার হাত ধরে ফেলে। হাত ধরার ইচ্ছা মোটেও ছিল না আবেগের। 

 

রোদেলা থমকে যায়। তার কেমন যেন লাগতে শুরু করে। সে পেছনে ঘুরে তাকায় না কিন্তু দাড়িয়ে যায়। আসলে রোদেলা হাটার শক্তিটুকু আর পাচ্ছে না। 

 

আবেগ নিজে রোদেলার সামনে গিয়ে মুখোমুখি দাড়ালো। 

 

রোদেলা মুখ ফিরিয়ে নিল। যদি আবেগ তার গতি করে দিয়েই চলে যেতে চায়। মুক্তি দিতে চায়। তাহলে শুধু শুধু  মায়া বাড়ানোর দরকার কি?

 

রোদেলার চোখ ভরে উঠতে লাগলো। সে চোখের পানি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। 

 

আবেগের চোখ তা সবার আগে ধরে ফেলে। কিন্তু সে কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।তখনো আবেগ রোদেলার হাত ধরেই রেখেছে। হাত ছেড়ে দিলে যদি ছুট লাগায়! 

 

রোদেলা নিজ থেকেই বলে উঠে, শুধু শুধু ঢং করার কোন মানে নেই আবেগ। আমার হাত ছাড়ো। আমি আজকেই গ্রামে যাব। 

 

আবেগ হাতের বাধনটা আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে, আচ্ছা যাও। সমস্যা নাই৷ 

 

আবেগের কাছ থেকে মোটেও এমনটা আশা করেনি রোদেলা। কতো সহজে বলে দিল চলে যাও! বাহ! চমৎকার! মনে মনে বলে উঠে সে৷ 

 

আবেগ মুখ খুলল এবং বলে, টিকিট কেটে আনব? নাইট কোচ নাকি সকালে রওনা দিবে? 

 

–এখুনি রওনা দিব। (কটমট করে)

 

–এখন কোন বাস নাই। হয় রাতে নাহয় কালকে যেতে হবে। 

 

রোদেলা আবেগের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা এমন কেন? কেন তাকে একবারো বুঝল না? সবসময় দূরে ঠেলে দেয়।  

 

রোদেলার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে পড়বে ভাব তখনি আবেগ রোদেলার চোখের পানি মুছে দিল এবং বলল, কান্না করা কোন সমাধান না। 

 

রোদেলা দাতে দাত চেপে কান্না দমিয়ে রেখে বলে, যদি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিতেই চাও তাহলে বিয়ে করার কি দরকার ছিল?

 

আবেগ নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয়, ছুড়ে ফেলতে চাই নি তো। দূরে যেতে দিতেও চাই না।তুমি নিজেই যেতে চাও। সব তোমার ইচ্ছাতেই হয়। 

 

 

রোদেলা একথায় চমকে উঠে বলে, মানে? 

 

–মানে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নাই। 

 

এবার রোদেলা আবেগের শার্টের কলার ধরে বলে, যদি আমাকে তোমার জীবনে না ই চাও তবে আজকে সকালে আমার কপালে ভালোবাসার পরশ কেন একেছিলে? 

 

একথা টা আবেগের কানে যেতেই সে শক খেল৷ তার প্রথম থেকেই সন্দেহ  হচ্ছিলো যে রোদেলা ওই সময় জেগে ছিল। ইশ কেন যে এই কান্ড ঘটাতে গেল? এখন কি জবাব দিবে সে? 

 

আবেগের চোখ-মুখে লজ্জার লাল আভা ফুটে উঠল। 

 

তা দেখে রোদেলার কেন যেন এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশেও হাসি পেয়ে গেল কিন্তু রোদেলা কান্নার মতো হাসি চাপিয়ে বলে, এখন মেয়েদের মতো লজ্জা কেন পাচ্ছো? বল কেন চুমু দিয়েছিলে? 

 

আবেগ অতি দ্রুত উত্তর দিল, ভুলে দিয়ে দিয়েছিলাম। 

 

রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, ভুলে কিভাবে কেউ কাউকে চুমু দেয়? এই ফাস্ট শুনলাম?

 

–আ,,সমুদ্র মনে করে দিয়ে দিয়েছি। 

 

–হুয়াট! 

 

–হুম। 

 

রোদেলা একথা শুনে শব্দ করে হেসে দিল। 

 

রোদেলার রিনরিনে হাসির শব্দে মাতোয়ারা হতে লাগলো আবেগ। বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে সে রোদেলার দিকে। 

 

সূর্যের সুমিস্টি রোদও যেন রোদেলার হাসির মায়ায় তলিয়ে যাচ্ছে সাথে আবেগকেও তাদের সঙ্গী বানানোর প্র‍য়াস করছে। এতোক্ষনে বাগে পাচ্ছিলো না কিন্তু এবার আবেগও সম্পূর্ণ রুপে রোদেলাতে মগ্ন হলো। 

 

রোদেলা হাসি থামালো। সে দেখল আবেগ তার দিকে ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। 

 

রোদেলা আবেগের কাছে গিয়ে তার কিছু টা কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, তুমি কি আমায় ভালোবেসে ফেলেছে আবেগ?  ডিড ইউ ফল ইন লাভ উইথ মি? 

 

আবেগের কেন যেন উত্তরে হ্যা বলতে মন চাইলো। কিন্তু আবেগ সহজেই মনের কথা শুনে না। নাম আবেগ হলে কি হবে? কাজ সে  বিবেকের কথা শুনেই করে। তাই তো নিশ্চুপ থাকে। 

 

সূর্য হেলে পড়ছে। রোদ কমতে লাগে সেই সাথে সদ্য উদয় হওয়া রোদেলার প্রতি মুগ্ধতা ও কমে যেতে লাগলো। 

 

★★★

 

ইভানা তার ফ্রেন্ডের বাসায় বসে বসে ফুলকপির বড়া খাচ্ছে৷ শীত মৌসুমে তার ভাজাপোড়া খেতে দারুন লাগে। তার বান্ধবী সমুদ্র কে কোলে নিয়ে খেলছে৷ 

 

ইভানা খাওয়া শেষ করে বলে, যাই রে এখন। 

 

–আরেকটু থাক না। তোকে বললাম না ছোটদা বাচ্চা খুব পছন্দ করে। ও এখুনি চলে আসবে। 

 

ইভানা আরো একটা ফুলকপির বড়া মুখে পুরে নিয়ে বলে, তোরা দুই ভাই-বোন তো দেখি টুরু বাচ্চা লাভার! 

 

শায়েরী সমুদ্র কে কোলে নিয়ে ওর হাত দুটো নিয়ে খেলছে আর ইভানার সাথে কথা বলছিল। সে একথা শুনে হেসে দিল এবং বলল, ছোটদা আমার চেয়ে বেশি পছন্দ করে বেবিদের। 

 

ইভানা খাবার চাবাতে চাবাতে বলে, তাহলে তো তোর ভাইয়ের বউয়ের কোন সমস্যা নাই।  তোর ভাই বাচ্চা পালবে আর তোর ভাবী পায়ের উপর পা তুলে ফোন চালাবে৷ 

 

ঠিক তখনি বেল বাজালো। শায়েরী বেলের শব্দ শুনে সমুদ্রের সামনে মুখ এনে বলে, কে এসেছে বাসায়? হু? কে এসেছে? 

 

সমুদ্র খিলখিল করে হাসছে৷ 

 

ইভানা তা দেখে বলে, এতো হাসি বাপরে বাপ! বাসায় কিন্তু এতো হাসে না ও। 

 

শায়েরী উঠে দাড়ালো এবং গেট খুলতে গেল সমুদ্র কে কোলে নিয়েই। 

 

রুমের বাহির থেকে কন্ঠস্বর পেতে লাগল ইভানা। পুরুষ কন্ঠস্বর পাচ্ছে। এই ছেলেটাই কি শায়েরীর ছোটদা নাকি? যার সাথে সমুদ্র কে দেখা করাবে জন্য  শায়েরী তাদের আটকে রেখেছে। 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

part–18

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আবেগের হাত টা এক ঝটলায় ছাড়িয়ে নেয় রোদেলা। এতে কেন যে আবেগ অপমানিত বোধ করে। এমনিতেই মেজাক চটে গিয়েছে তার। মাঝখানে ঠিক হতে ধরেছিল কিন্তু এখন আবার রাগ লাগছে। 

 

আবেগ কিছু বলতে যাবে তখন ভ্যানওয়ালা লোকটা এসে বলে, আপনারা এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন? কোন সমস্যা? 

 

আবেগ মাথা নাড়িয়ে বলে, সমস্যা নাই। হাতের বা দিক ধরে যান। কালো গেটটার সামনে থামবেন। 

 

ভ্যানওয়ালা আচ্ছা বলে আগাতে লাগে । 

 

রোদেলা ও সামনে আগাতে ওমনি আবারো আবেগ তার হাত ধরে ফেলে। এবারো রোদেলার মধ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়। সে থেমে যায়। পেছন হতেই আবেগ বলে উঠে, একা যাবে? 

 

রোদেলা পেছনে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলে, মানে? 

 

আবগ নির্লিপ্ত গলায় বলে, সমুদ্র থাক আমার সাথে। ওকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়ার কি মানে? আমার বলা কথা তোমার গায়ে লাগছে তো তুমি যাও। সমুদ্র কে নেওয়ার দরকার নাই। 

 

একথা শুনে রোদেলার রাগ লাগতে শুরু করে। রাগে তার গা থরথর করে কাপতে লাগলো। 

 

রোদেলা দাত কটমট করে বলে, আমি বাবুকে রেখে গেলে ওকে খাওয়াবে কে? তুমি ওকে বেলায় বেলায় খাওয়াবে? 

 

আবেগ রোদেলার কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বলে কি মেয়েটা! 

 

সে হ্যাবলার মতো রোদেলার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, তাহলে তোমার জন্য একটা টিকিট কাটলাম। এতো ছোট বাচ্চার টিকিট লাগে না। তুমি বাসায় যাও। আমি টিকিট কেটে আনছি। 

 

এবার রোদেলার সব রাগ পড়ে গিয়ে এক বুক হাহাকার জমতে লাগে মনে! সে আবেগের দিকে তাকালো। মাত্র একবার রোদেলা বলেছে সে গ্রামে যেতে চায়। ব্যস আবেগ ও তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। এখন যদি রোদেলা বলে সে গ্রামে যাবে না তার তো মনে হয় আবেগ তখন জোড় করে হলেও পাঠিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাচবে। আচ্ছা সে কি এতোই বিরক্তিকর? এতোই অপ্রয়োজনীয় আবেগের জীবনে? রোদেলার চোখ ভিজে উঠতে লাগে। 

 

সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব কিন্তু এখনো সন্ধ্যা হয় নি ঠিক যেমন আবেগ তার হয়েও হয় নি তার! 

 

আবেগ ঘেমে গেছে। শার্ট ভিজে উঠতে শুরু করেছে। কপাল বেয়ে ঘাম ছুটছে তার৷ 

 

এই নভেম্বর মাসের হালকা শীতেও তার গরম লাগছে। এতোক্ষন লাগছিল না যখনি রোদেলা তার মুখের উপর বলল, সে বাপের বাড়ি যেতে চায়। তখন থেকেই আবেগ মনে মনে ফুসছে। তখন থেকেই তার গরম লাগছে। কান দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে। সে বুঝে পাচ্ছে না কিছু একটা হলেই গ্রামে দৌড়াতে হবে রোদেলাকে?গ্রামে রেখে আসার জন্য তো বিয়ে করেনি সে রোদেলাকে? 

 

এই প্রশ্ন মাথায় আসতে ই আবেগ ভাবতে লাগলো, তবে কিসের জন্য বিয়ে করেছে সে? 

উত্তর টা সেও জানে না। তার ও জানা নেই। 

 

আবেগ ছোট করে দম ফেলল। তার জীবনে কি ঘটে কখনোই বুঝে না সেটা কেন ঘটছে। কি অদ্ভুত! এই যে পাচ বছর যে নেহার সাথে একটা সম্পর্কে আবব্ধ ছিল কিন্তু কেন ছিল? জানে না সে। শুধু সপ্তাহের শেষ দিনে  কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা করত আবেগ। আবেগ যেন হাজিরা দিত  গিয়ে। 

 

এসব আকাশ-কুসুম ভাবতে ভাবতেই  আবেগ খেয়াল করল রোদেলা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে তাকে রেখেই। 

 

আবেগ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, হাটা তো মাত্র শুরু করেছিলাম কিন্তু যাত্রার অগ্রভাগেই রেখে চলে গেলে!  

 

বলে সামনে পা বাড়ালো। 

 

দোলনা রুমে সেট করে দিয়ে ভ্যানওয়ালা টাকা নিয়ে চলে গেল। রোদেলা সোজা বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নিল। করোনাকালে যেখানেই যাক না কেন বাসায় ফিরেই গোসল সারতে হয়৷ 

 

গোসল করে বাথরুম থেকে বের হতেই তার শীত শীত করতে লাগলো। হুট করে  ঠান্ডা কেন লাগছে তার? 

 

রোদেলা সামনে পা বাড়িয়ে বাইরে থেকে কিনে আনা জামা গুলো আনপ্যাক করতে লাগলো। 

 

একটা হলুদ সোয়েটারের উপর নজর গেল রোদেলার। হলুদ সোয়েটারের বুকে লাল ফুল আকা। খুব সুন্দর সোয়েটারটা৷ রোদেলার খুব পছন্দ হয়েছে।বাবু আসলে এটাই সবার আগে পড়াবে। এখন তো শীত পড়েই গেছে তাই পড়ালে সমস্যা নেই। পাতলা সোয়েটার। 

 

রোদেলা সব সুন্দর করে ভাজ করে রেখে যেই না আলমারি তে ঢুকাবে ওমনি আবেগ রুমে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো। 

 

রোদেলার হাতে কাপড় দেখে আবেগ বলল, ওহ, প্যাকিং শুরু করে দিয়েছো এতো তাড়াতাড়ি? 

 

আবেগের কথা শুনে রোদেলার মেজাজ বিঘড়ে যায়। সে শব্দ করে আলমারি লাগিয়ে বলে, হ্যা। শুধু শুধু দেরি করার কি আছে? 

 

–না কোন কারন নেই। ইভানা তো এলো না এখনো। কল দিয়ে এখনি আসতে বল। 

 

রোদেলা ভাবতে লাগলো, বাবু এতোক্ষন তাকে ছাড়া কিভাবে আছে? কান্না করছে নাকি? পরক্ষনে ভাবলো, নাহ কান্না করলে ইভানা কি আর থাকত? চলেই আসত বাবুকে নিয়ে।  

 

★★★

 

বাইরে কারো শব্দ শুনে ইভানা হাতে ফুলকপির বড়া নিয়েই বের হলো। বের হতেই ইভানার চোখ চড়ক গাছে। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল৷ মুখ অটোম্যাটিকলি হা হয়ে যায় তার৷ মুখে যে খাবার আছে সেটা ভুলেই গেছে ইভানা। তার সামনে এক সুদর্শন পুরুষটা কে? 

 

শায়েরী তার ভাইয়ের কোলে সমুদ্র কে দিতে দিতে বলল, ভাইয়া তোর অপেক্ষায়ই ছিলাম৷ 

 

শায়েরীর  ভাই সমুদ্র কে কোলে নিয়ে খেলা আরম্ভ করে দিল৷ 

 

দুই ভাই-বোন তো সমুদ্র কে পেয়ে দিন-রাত বেমালুম ভুলে গেছে। ইভানা যে তাদের সামনে এসে দাড়িয়েছে সেটা কারো মনেই নেই৷ 

 

এদিকে ইভানা হা করেই বিষ্ময়ভরা চোখে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখেই যাচ্ছে। তার এই জীবনে অনেক সুন্দর ছেলে দেখেছে সে।কিন্তু এতো অপরুপ দেখতে, এতো সুন্দর আর এতো হ্যান্ডসাম ছেলে সে আগে কখনো দেখে নি!  উফ! কিভাবে সম্ভব? একটা ছেলে এতো সুন্দর  কিভাবে হয়? সাদা শার্ট পড়ায় তো মনে হচ্ছে সৌন্দর্য আরো একশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

 

এতোক্ষন যাবত শৌখিন একবারো আশেপাশে তাকায়নি। বাসায় আসতেই শায়েরী একটা বাচ্চা কোলে এনে বলল, তার ফ্রেন্ডের ভাইয়ের ছেলে। 

শৌখিনের বেবিটাকে দেখেই কোলে নিতে মন চাইলো তাই দেরি না করে শায়েরীর কাছ থেকে নিজের কোলে তুলে নেয়। 

 

শায়েরী বলল, ইভু তো সেই কখন যেতে চেয়েছিল। আমিই ধরে বেধে রেখেছি ওদেরকে। তোর সাথে মিট করানোর জন্য। 

 

শৌখিন বলল, ভালো করেছিস। 

 

বলে সমুদ্রের সাথে খেলায় মনোযোগ দিল৷ 

 

ইভানা এখনো দাড়িয়ে আছে। তার গা কাপছে। হুট করে পিপাসা পেয়ে গেল। ছেলেটা যতো নিকটে আসছে তার তৃষ্ণা পাওয়ার গতি ততো বাড়ছে৷ 

 

শায়েরী ইভানাকে দেখে তার ভাইয়ের উদ্দেশ্য বলে, ভাইয়া, ও ইভু। যার গল্প বলি  তোকে। 

 

শৌখিন সমুদ্রের দিক থেকে চোখ উঠিয়ে সামনে তাকালো এবং ইভানাকে দেখে সুন্দর করে, সালাম দিল। এতো স্পষ্ট করে সালাম দিল যে ইভানা উত্তর দেওয়ার কথা ভুলে গেল। 

 

দুই-তিন মিনিট নিরবতা। ইভানার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে৷ 

 

সালামের জবাব না পাওয়ায় শৌখিন একটু আহত হল কিন্তু আমলে নিল না৷ 

 

শায়েরী বলে উঠে, কি রে খাচ্ছিস না কেন? কোন সমস্যা? 

 

ইভানা সেটার ও উত্তর দিল না। সে শৌখিনকে দেখছে। দেখছে মানে যে শুধু দেখছে না তা একেবারে সিটিস্ক্যান থেকে শুরু করে ইসিজি সব করে ফেলেছে। 

 

সাদা শার্ট পড়ায় একদম সাদা পরীর মতো লাগছে ছেলেটাকে। কিন্তু পরী তো ছেলে হয় না! তাহলে কি? ছেলেটাকে একেবারে সাদা ফুটফুটে জ্বীনের মতো লাগছে? ইভানা নিজেই বিষম খেল। 

 

সে হেটে হেটে শায়েরীর রুমে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। আর এক মুহূর্ত ছেলেটার সামনে থাকলে ইভানা হয় মারাত্মক বড় ধরনের কিছু করে বসত আর না তাহলে অজ্ঞান হয়ে যেত। কি মোলায়েম চাউনি রে বাবা! উপেক্ষা করার কোন জো নেই। গলা কাঠ হয়ে গেছে। হাতে এখনো বড়া ধরেই আছে এমনকি মুখেও খাবার নিয়ে সে বসে পড়ল। হুট করে কি হলো তার? এমন কেন লাগতে শুরু করল তার? 

 

শৌখিন এভাবে ইভানাকে কোন কথা না বলে যেতে দেখে  তার বোনকে জিজ্ঞেস করে, ওনার কি কোন প্রবলেম নাকি? 

 

শায়েরী জোড়পূর্বক হেসে বলে, আরে না। কি প্রবলেম হবে। পড়তে পড়তে ও এমন একটু তার ছিড়া হয়ে গেছে। আমাদের মেডিকেলের বেস্ট স্টুডেন্ট ও! 

 

শৌখিন অবাক হয়ে গেল এবং বলে, উনি ডাক্তার? 

 

–হু। আমার সামনের রোল। 

 

–ও। 

 

–ওর ভাইয়াও ডাক্তার। 

 

–আচ্ছা। 

 

বলে শৌখিন ডাইনিং  রুমে বসে পড়ে। তাদের বাসাটা খুব ছোট। পাখির বাসাও বুঝি এর চেয়ে বড় হয়! দুইটা বেড রুম তাও খুব ছোট ছোট। একটা বিছানা আর আলমারি দিলেই রুমে আর জায়গা থাকে না। ড্রয়িং রুম নাই। ডাইনিং আর রান্নাঘর। দুইটা বাথরুম। 

 

শৌখিন সমুদ্র কে নিয়ে খেলতে লাগে। সমুদ্র ও বুঝি শৌখিনকে খুব পছন্দ করেছে৷ 

 

শায়েরী রুমে গিয়ে বলে, কি রে? তুই ওভাবে চলে এলি কেন? ছোটদা খারাপ ভাবলো না এভাবে কিছু না বলে চলে আসায়? 

 

ইভানা বলল, তোর ছোটদা আমাকে মারার প্লান করছে রে!

 

–বিড়বিড় করে কি বলিস বুঝি না তো! 

 

–তোর বোঝা লাগবে না গাধী মেয়ে কোথাকার। 

 

শায়েরী বলে উঠে, ভাইয়া আর বেবি খেলছে। তুই খাওয়া শেষ কর। 

 

ইভানা বহু কথা কষ্টে খাওয়া শেষ করল। তখনি রোদেলার ফোন আসে। ইভানা ফোন ধরেই বলে, আসছি। আসছি আমি। তারপর বিড়বিড় করে বলে, এক সেকেন্ডে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে৷ 

 

বলে দৌড়ে বের হলো। শায়েরী তার পেছনে এসে তার ভাইয়ের কাছ থেকে সমুদ্র কে নিয়ে ইভানার কোলে দিল৷। 

 

ইভানা ডানে-বামে না তাকিয়ে এক প্রকার দৌড়ে বের হলো শায়েরীর বাসা থেকে। 

 

শৌখিন ভ্রু কুচকে বলে, মেয়ের মাথায় তো বড়সড় সমস্যা আছে রে শায়েরী। 

 

শায়েরীও সায় দিয়ে বলে, তাই তো দেখছি! 

 

★★★

 

রোদেলা ব্যাগ গোছাচ্ছে। আলমারি থেকে তার জামা-কাপড় একে একে বের করে ব্যাগে ভরাচ্ছে সে। 

 

আর আবেগ সমুদ্র কে কোলে নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সমুদ্র কে কিছুক্ষন আগেই হলুদ সোয়েটারটা পড়ানো হয়েছে। একদম রাজপুত্রের মতো লাগছে। আধ ঘন্টা হলো ইভানা বাসায় ফিরেছে। সমুদ্র এতোক্ষন দোলনায় দুল খাচ্ছিল মাত্র আবেগ কোলে নিল। 

বাসার সবাই হতভম্ব। বলা নাই কওয়া নাই বাড়ির বউ বলে বাড়ি যাবে! এটা কেমন কথা? বিয়ের সাত দিন ও হয় নি আর এখনি বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছে৷ 

 

জাবেদা খাতুন পান চাবাতে চাবাতে বলে, ঘন ঘন বাপের বাড়ি যায় জন্য ই এই মেয়ের ঘর টিকে না। কই আমরাও তো সংসার করছি? বিয়ের সাতদিনের মাথায় তো বাপের বাড়ি যাওয়া তো দূর ভাবতেও পারি নাই৷ 

 

ইতয়িয়াজ রহমান বিরক্ত হয়ে গেল এবং বলে, ওই জানোয়ারের সাথে কেন আমাদের মেয়ে সংসার করবে? আর ওর যেতে মন চাইলে যাবে। সমস্যা কোথায়? 

 

★★★

 

–সমুদ্র কে না নিলে হয় না? তুমি একা যাও। 

 

আরেকবার এই কথা আবেগের মুখ থেকে শুনে রোদেলা পেচন ঘুরে বলে, দেখো, মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ কখনো বেশি হয় না। 

 

আবেগ রোদেলার কথা শুনে একদম রোদেলার সামনে এসে দাড়িয়ে যায়। এতে রোদেলার অস্বস্তি হতে লাগলো। 

 

আবেগ ভ্রু কুচকে আস্তে করে বলে, আমি ওর মাসী কেন হতে যাব? আই এম হিস ফাদার! 

 

বলে পাশ কেটে চলে গেল। রোদেলা কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। 

 

আবেগ বিছানায় হানিফ বাসের টিকিট রেখে দিল এবং রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। 

 

হুট করে রোদেলার খুব কান্না পেতে লাগল। তার মনে হতে লাগে –আর বুঝি এই বাসায় ফেরা হবে না। তাকে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না এই বাসায়

 

রোদেলা চোখ মুছে বের হলো রুম থেকে। 

 

ইমতিয়াজ রহমান বলে, আবেগ কই? ও রেখে আসত তোকে বাসস্ট্যান্ডে। 

 

রোদেলা তাচ্ছিলের হাসি দিল এবং সামনে পা বাড়ালো। গেটের সামনে বেবি ট্রলি রাখা। রোদেলা সেখানে সমুদ্র কে শুইয়ে দিল। 

 

ইমতিয়াজ সাহেব রোদেলার সাথে বের হয়ে বলে, ছেলেটা তো আমার দায়িত্ব হীন। আমিই রেখে আসি তোকে। 

 

রিকশা করে বাসস্ট্যান্ডে গেল তারা। ইমতিয়াজ রহমান রোদেলাকে কিছু শুকনো খাবার কিনে দিল। বারবার রোদেলার চোখ ভরে উঠছে। সে চোখ দ্রুত মুছে দেয়। 

 

ইমতিয়াজ রহমান বলে, কবে আসবি? 

 

রোদেলা শক্ত গলায় বলে, যেদিন আপনার ছেলের আমাকে প্রয়োজন হবে। 

 

তিনি আর কিছু বললেননা। গাড়ি ছাড়ার আগে সমুদ্র কে চুমু দিয়ে রোদেলার হাতে কিছু টাকা গুজে দিল। রোদেলা মামাকে জড়িয়ে কেদে দিল৷ 

 

মামা ভেজা গলায় বলে, বোকা মেয়ে কান্দিস কেন? কান্না থামা। 

 

রোদেলা কাদতে কাদতে বাসে উঠে পড়ে এবং সামনে যেখানে ফাকা পায় সেখানে বসে পড়ে৷ 

 

বাস ছেড়ে দেয়। যতোক্ষন মামাকে দেখা যাচ্ছিল দেখে নেয় রোদেলা। তার খুব কষ্ট হতে লাগলো  

 

সে সমুদ্র কে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে কান্না গলায় বলে, আমরা মা-ছেলেই যতো সমস্যার মূল! সবার বোঝা আমরা। আমি তো তাও অনেক পরে সবার  বোঝা হয়েছি কিন্তু তুই তো জন্মের আগে থেকেই সবার কাধের ঝামেলা । চোখের বালি তুই। 

 

এই কথা শুনেও সমুদ্র হেসে দেয়। রোদেলা বলে, এইটা কষ্টের কথা বাবাই! বড় হলে বুঝবি তোর মায়ের কতো কষ্ট! সবার কাছেই আমি অগাছা। না পারে ফেলে দিতে আর না পারে রেখে দিতে!

 

বেশ কিছু ক্ষন পর বাস থামল। কিছু যাত্রী উঠে পড়ে। তখনি হেল্পার এসে বলে, আপা এটা আপনার সিট না। আপনি পিছনে যান। আপনার সিট ই-২। 

 

রোদেলা আচ্ছা সর‍্যি বলে উঠে দাড়ালো এবং সামনে পা বাড়ায়। গাড়ি এতোক্ষন থামা থাকলেও এখন চলতে শুরু করে দিয়েছে৷ 

 

সে ই নং সিটের সামনে গিয়ে দাড়ালো এবং দেখল কেউ একজন বসে আছে। অন্ধকারে কেবল  অবয়ব দেখা যাচ্ছে। রোদেলা  একটু সামনে ঝুকে দেখার চেষ্টা করল এবং যখন আবছা আলোয় দেখতে পেল ব্যক্তিটাকে তখন ভুত দেখার মতো চমকে উঠে এবং চোখ বড় বড় করে বলে, তুমি?তুমি এখানে কি করছো? আর কিভাবে জানলে আমি এইখানে? 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

part–19

#Arishan_Nur(ছদ্মনাম) 

 

–টিকিট কেটে যখন দিয়েছিলাম তখন আমার চোখ আলমারি তে ছিল না। সাথেই নিয়ে রেখেছিলাম তাই জানি তুমি এখানে আছো। এই বাসে আছো। ক্লিয়ার? 

 

রোদেলার চোখ বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আবেগ তার পাশের সিটে বসে আছে। এটা কিভাবে সম্ভব! সে তো তাকে রাখতে পর্যন্ত আসে নি। এখন আলগা পিরিতি দেখানোর কি দরকার? 

 

আবেগ সমুদ্র কে যে ট্রলিতে করে শুইয়ে রাখা হয়েছে সেটা সিটের সামনে রাখলো। সমুদ্র জেগেই আছে। বাবার দিকে তাকিয়ে আছে সে। আবেগ সমুদ্রের কপালে চুমু খেল এবং রোদেলার দিকে তাকিয়ে তার ভ্রু কুচকে গেল৷ 

 

সে গমগম আওয়াজে বলে, দূরপাল্লার বাসে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? সিটে বসো। 

 

রোদেলার মাথা ভোভো করছে। তার কেন যেন খুব খুশি লাগছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে তার।  

 

হুট করে বাস সামান্য ঝাকুনি দিল। রোদেলা টাল সামলাতে না পেরে আবেগের উপর পড়ে গেল। 

 

আবেগ বিরক্ত হয়ে বলে, তখন যে বসতে বলেছিলাম তাও কেন এতোক্ষন ধরে দাঁড়িয়েই ছিলে? 

 

রোদেলা উত্তর দিল না। সে আবেগের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার কেন যেন এই মূহুর্তে আবেগকে জড়িয়ে ধরে পাক্কা এক ঘন্টা হাউমাউ করে কাদতে মন চাচ্ছে। যে সে কান্না না একেবারে মরা কান্না জুড়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগছে৷ কেন এমন ইচ্ছা জাগলো তার সে জানে না? আর না জানতে চায়৷ আবেগের মতো সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ায় সে আশাবাদী না৷ 

 

বরংচ সেই সব প্রশ্নই সবচেয়ে খাটি যার কোন উত্তর নেই। 

 

আবেগ আস্তে করে রোদেলাকে তার উপর থেকে সরিয়ে সিটে বসালো। এতে অবশ্য তাকে রোদেলাকে টাচ করার প্রয়োজন পড়েছিল। 

 

রোদেলা সিটে বসার সাথে সাথে সমুদ্র কান্না শুরু করে দিল। 

 

আবেগ সমুদ্র কে কোলে নিল তারপর রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে, ফিডার কোথায় ওর? 

 

রোদেলা কোন উত্তর দিতে পারল না৷ 

 

আবেগ আরেক দফা বিরক্ত হয়ে নিজেই ফিডার খুজে সমুদ্র কে খাওয়ালো৷ 

 

রোদেলা দুচোখ দিয়ে অপলক বিমুগ্ধ  নয়নে আবেগ আর সমুদ্র কে দেখে ই চলেছে৷ 

 

আবেগ নিজের সিটে একটু হেলিয়ে নিয়ে সমুদ্র কে ট্রলিতে শুইয়ে দিল এবং তার চোখ রোদেলার উপর পড়ল। সে দেখতে পেল রোদেলা তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ 

 

আবেগ তা দেখে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলো। তা দেখে রোদেলার বেশ লজ্জা হতে লাগে। ইশ! এই লজ্জাতেও কতো সুখ! 

 

আবেগ কিছু বললো না। সে জানালার পাশের সিটে বসেছিল। সিটে হেলান দিয়ে আধ শোয়া হয়ে জানালার দিকে তাকালো। অদ্ভুত এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আধো আলো আধো অন্ধকার! হালকা কুয়াশা। এই শীত তো এই উষ্ণতা! বাসে সম্ভবত গান চালানো হয়েছে। রবীদ্র সংগীত চলছে। 

 

বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে!

বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!

ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি

যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,

ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,

জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে।

অস্ফুটমঞ্জরী কুঞ্জবনে,

সংগীতশূন্য বিষণ্ন মনে

সঙ্গীরিক্ত চিরদুঃখরাতি

পোহাব কি নির্জনে শয়ন পাতি!

সুন্দর হে, সুন্দর হে,

বরমাল্যখানি তব আনো বহে,

অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়ে

হেরো লজ্জিত স্মিতমুখ শুভ আলোকে,,,,,,,,

 

আবেগ চিন্তা করতে লাগলো, এখানে কবি বধু বলতে কি তার প্রেয়সীকে বুঝিয়েছে? যদি বধু তার প্রেয়সী হয় তাহলে কি গানটার মর্ম এমন  কিছুটা হয় নাঃ প্রেয়সীর ভালোবাসার ঝলমলে আলো তার চোখ এসে পড়তেই সে বুঝতে সক্ষম হলো তার প্রেয়সী সূর্যলোকের চেয়ে ও দীপ্তিমান! ভালোবাসার আস্তরন পড়ে তার চোখ এমন হয়ে গেছে যে প্রেয়সীকে সূর্যের চেয়েও আলোকিত লাগতে শুরু করেছে? 

 

কিন্তু,,, কিন্তু ফিজিক্সের  মতে কোন মানবই দীপ্তিমান বস্তু না। যদিও বা রবীন্দ্রনাথের ছন্দের সাথে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র মেলানো বোকামি ছাড়া  আর কিছু ই না। 

 

আবেগকে গম্ভীর মুখে কিছু ভাবতে দেখে রোদেলা ধরেই নিল আবেগ নেহাকে নিয়ে কিছু ভাবছে না তো? 

 

একথা ভাবতেই রোদেলার গায়ে হিংসার আগুন জ্বলতে লাগে৷ মানুষ হলো বড্ড স্বার্থপর জীব। রোদেলাও খুব স্বার্থপর হয়ে গেছে কিন্তু কি করার? সে তো সিনামা বা সিরিয়ালে নায়িকা না যে অন্যের সুখের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিবে? নিজের অধিকার থাকা সত্ত্বেও সেটা ব্যবহার না করে অন্যের হাতে তা তুলে দিবে। এটা কেবল সিনেমায় মানায়। বাস্তব এমন না! সিনেমার সাথে বাস্তবতার মাঝে  ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন মাইলের ফারাক আছে! 

 

কিন্তু উপন্যাস বা গল্পের প্রতিটা চরিত্র কিন্তু সামান্য পরিমানে হলেও বাস্তবের একেক টা মানুষের মতোন হয়। বাস্তবিক না হলেও আজগুবি হয় না। উপন্যাস যে লেখে সে নিশ্চয়ই কোন  বাস্তব চরিত্রের দিকে তাকিয়ে একেকটা চরিত্র সাজায়৷ উপন্যাসে নায়ক-নায়িকারা সিনেমা জগতের হিরো-হিরোইনের মতো দামি পোশাক পড়ে না। হাই মেকাপ নেয় না৷ সবসময় তাদের জয় হয় না! আবার কোন গল্পের নায়িকা বা মূল চরিত্র মানেই এই না যে সে সাধু। ভুলের উর্ধে থাকবে সে এমনটা ভাবা নিশ্চিত বোকামি ছাড়া কিছু না! 

 

এই মূহুর্তে রোদেলার উপন্যাসের চরিত্র হতে মন চাচ্ছে! তাহলে সে এখন আবেগের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে চন্দবিলাস করত! 

 

রোদেলা মিনমিনে আওয়াজে আবেগকে তার নাম ধরে ডাক দিল। 

 

আবেগ জবাবে ফিসফিস করে বলে, কি? 

 

–জেগে আছো? 

 

আবেগ বিরক্তিমাখা কথা কন্ঠে বলে, এটা কেমন প্রশ্ন করলে তুমি? ঘুমিয়ে গেলে কি উত্তর দিতাম?

 

–আমি জানালার পাশের সিটে বসতে চাই। উঠবেন একটু প্লিজ? (করুন কন্ঠে) 

 

রোদেলার অনুরোধ ফেলতে না পেরে আবগ উঠে দাড়ালো এবং রোদেলাকে তার সিট ছেড়ে দিল। রোদেলা জানালার পাশে গিয়ে বসল। সে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে চুল ছেড়ে দিল। জানালা কিঞ্চিৎ খুলে  দেয়। 

 

আবেগ ডিস্টার্বড ফিল  করে এতে। এমনি শীত শীত ভাব। কি দরকার জানালা খুলে দেওয়ার! 

 

রোদেলার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু সে একথা একবারো আবেগকে বলে নি। জ্বর আধ ঘন্টা আগে থেকে এসেছে।বাসা গাথা শুরু করেছে দেহে।  মাত্র আধা ঘণ্টায় যে শরীরকে এভাবে কাবু করে নিবে তা ভাবতেও পারেনি রোদেলা। 

 

সে গুনগুন করে বাসে চালু করা গানটা গেতে লাগলো। 

 

বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে! 

বুঝি দীপ্তিলোকে ছিলে সূর্যলোকে! 

 ছিল মন তোমারি প্রতিক্ষা করি

যুগে যুগে দিন রাত্রী ধরি

 

আচ্ছা যদি কোন একদিন সে হারিয়ে যায়, অচীন ঘন কুয়াশায় লাপাতা হয়ে যায় কিংবা 

In the  middle of the deep osean, if she lost! 

 

আবেগ কি তার প্রতিক্ষা করবে? অপেক্ষায় চেয়ে রবে? কিংবা হারিয়ে যেতে দিবে? 

 

নাকি বলবে, যাও! সমুদ্রের জোয়ার-ভাটায় হারিয়ে যাও। আমি খুজব না তোমায়! 

 

রোদেলা ভাবতে লাগলো, আজকে থেকে সে সমুদ্র কে বাবু বলে ডাকবে না। ওসেন বলে ডাকবে। সমুদ্রের ইংরেজি যদিও সি কিন্তু সে ওসেন কথা ডাকবে। ওসেন এর আভিধানিক অর্থ মহাসমুদ্র হলেও সে সমুদ্র কে ওসেন বলেই ডাকবে।সবাই তাকে ওসেনের আম্মু বলে ডাকবে। তার চোখের সামনে বিশাল নীল জলরাশি ভেসে উঠে!  সেই জলরাশিতে সে পা ডুবিয়ে বসে আছে। 

 

আস্তে আস্তে অন্ধকার  জগতে তলিয়ে যেতে লাগলো সে। চোখ খোলা রাখা দায় পড়ে তার জন্য! 

 

অসুস্থ হওয়াও মজার। অসুস্থ হওয়ার মাঝেও আনন্দ  আছে। এক বিচিত্র অনুভূতি জাগ্রত হয় মনের মধ্যে তখন।  কারো সান্নিধ্যে আসতে মন চায়! কাউকে গভীরভাবে পাওয়ার তীব্র আকাক্ঘা জাগে! 

 

★★★

 

 বাড়ির সবার সামনে নেহার গালে চড় বসালেন শেখ সাহেব। নেহা থাপ্পড় খেয়ে তাজ্জব বনে গেল। এর আগেও বহুবার, অগনিত বার তার বাবার অবাধ্য হয়েছে, রুড বিহেভ করেছে কিন্তু কোন দিন তার আব্বি তার গায়ে হাত তুলে নি। 

 

নেহার চোখে বেয়ে পানি পড়তে লাগে। 

 

তা দেখে শেখ সাহেব চোখ সরিয়ে নিলেন এবং কড়া গলায় বলে, আমি কিছু শুনতে চাই না। তোমার বিয়ে প্রাচুর্যের সাথে হবে। দ্যাটস ইট। তোমার হুজুত্তি, বেয়াদবি সব মেনে নিয়েছি কিন্তু আর একটা কথাও শুনব না। আমি তোমাকে অনেক আগেই বলেছি আবেগের সাথে তোমার বিয়ে দিব না। কিন্তু তুমি আমার অবাধ্যতা করে ওর সাথে প্রনয় করেছো। আমার সামন দিয়ে, ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছো। আমি বাধা দিতে গিয়েও বাধা দিতে পারি নি। কিন্তু এখন  কাটা নিজেই রাস্তা থেকে সরে গেছে। তাই এবার আর তোমার কোন কথা শোনা হবেনা।  ক্লিয়ার? 

 

নেহা প্রতিউত্তরে কিছু না বলে হনহন করে তার রুমে চলে যায়। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শেখ সাহেব ছোট একটা শ্বাস ফেলে। 

 

প্রাচুর্যর সামনেই এসব ঘটল। সে শেখ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে, চাচ্চু আমি যাই? দেখি ওকে কনভিন্স করা যায় কিনা? 

 

–যাও। তোমাকেই তো দেখতে হবে। 

 

প্রাচুর্য মৃদ্যু হেসে পা বাড়ায় নেহার রুমের দিকে৷ 

 

নেহা রুমে গিয়েই রুমের সব জিনিসপত্র ভাংচুর করতে লাগলো। 

 

প্রাচুর্য রুমে ঢুকে তা দেখে আর আগানোর সাহস পেল না। সেখান থেকেই গলা খাকিয়ে বলে, কি রে বড়লোকের বেটি!  আদুরে মেয়ে। বাপের টাকার শেষ নাই তাই না? 

 

নেহা তার কন্ঠ শুন্ব পেছনে তাকালো। কি ধারালো সেই চাউনি! তলোয়ারের চেয়েও বেশি ধার সেই চাউনিতে! 

 

সব কিছু উপেক্ষা করা গেলেও এই মারাত্মক চাউনিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা নাই প্রাচুর্যের! 

 

সে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে থাকে নেহার দিকে। কি আছে এই চোখে? মায়া তো একদমই নেই। কেবল আছে জেদ আর জেদ! তারপর ও এই জেদরানীতে সে আক্রান্ত! 

 

নেহা কড়া গলায় বলে, যা এখান থেকে। দূর হ তুই আমার সামন থেকে। 

 

প্রাচুর্য জিভ কেটে বলে, ছিঃ! নিজের হ্যাসবেন্ড কে কেউ তুই বলে ডাকে! 

 

নেহা ফুসতে থাকে। পারলে এখনি প্রাচুর্য কে কাচা খেয়ে যাবে। 

 

নেহা নিজেকে শান্ত কথা করে বলে, তুই জানিস না আমি আবেগকে ভালোবাসি? তাও কেন এমন করছিস আমার সাথে? 

 

প্রাচুর্য নেহার সামনে গিয়ে বলে, এটা ভালোবাসা না! ভালোবাসা কোন দিন অশান্ত হয় না। ভালোবাসাকে নদীর মতো শান্ত হতে হয়। আর যা করছি তোর ভালোর জন্য ই করছি। আবেগ তোর ভালোবাসা না। বরং জেদের বশে করে ফেলা একটা ভুল মাত্র। 

 

নেহা বলল,  আবেগ ও আমাকে ভালোবাসে। 

 

প্রাচুর্য শান্ত গলায় বলে, সিরিয়াসলি ইউ থিক সো? হাহা। এক মিনিট আমি আগে হেসে নিই। তারপর কথা বলি! 

 

প্রাচুর্য সত্যি সত্যি এক মিনিট ঘর কাপিয়ে হাসল। তার পর বলল, আচ্ছা তোর তো শাড়ি পছন্দ না তাই না? 

 

–হ্যা৷ 

 

–একদম পছন্দ করিস না শাড়ি। সত্যি বলতে তোকে শাড়িতে মানায় না। কিন্তু আবেগ তোকে বারবার শাড়ি পড়তে বলত৷ কেন বলত? 

 

–ওর পছন্দ শাড়ি তাই বলত পড়তে৷ 

 

প্রাচুর্য নেহার মুখের সামনে এসে বলে, ছেলে মানুষেরা কখনোই ব্যক্তিগত ভাবে মেয়েদের সামগ্রী পছন্দ করে না। তার চোখে যে মেয়ের মায়া আটকে থাকে তার পছন্দের সামগ্রীসমুহই সে পছন্দ করে। এবার ঠান্ডা মাথায় উত্তর দে, শাড়ি কার খুব খুব পছন্দ? 

 

নেহার মনের অজান্তেই বলে ,রোদেলা। 

 

–আবেগ তোকে নাক ফুটা করতে বলেছিল না? অথচ তোর  তো কান ই  ফুটা করা নাই। রোদেলা কিন্তু কারনে অকারণে নাকে অলংকার পড়ে। আসলে কি জানিস?  আবেগ তোর মধ্যে বারবার রোদেলা কে চাইত। তাই তো ওর পছন্দ গুলো, ওর স্বভাব গুলো তোর মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে চাইত। আসলে এতে দোষের কিছু নাই। একটা পুরুষের মন যেই নারীর দখলে, সে সব জায়গায় কারনে -অকারনে তাকেই খুজবে। 

 

নেহা প্রাচুর্য কে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে গেলে।,প্রাচুর্য তার হাত ধরে বলে, সূর্য  পূর্ব দিকে উঠে।  সময় চলমান। আবেগ রোদেলাকে ভালোবাসে –এই তিনটা বাক্যই চিরন্তন সত্য। Universal Truth! 

 

চলবে৷

 

#অশ্রুমালা 

part–20

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

–রোদেলা,,,রোদেলা,,,,দেখি একটু কষ্ট করে চোখ খুলো। খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার কি?রোদেলা? (চিন্তিত গলায় আবেগ ডাকছে রোদেলাকে) 

 

রোদেলা অচেতনের মতো আবেগের কাধে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তার চারপাশে কোন হুশ নেই। কারো কথাই যেন কানে যাচ্ছে না তার৷ 

 

কিছুক্ষন আগে হুট করে বাসের ঝাকুনিতে রোদেলার মাথা আবেগের কাধে এসে পড়ে। আবেগ জেগেই ছিল। ফোন চালাচ্ছিল। 

 

কাধে রোদেলার মাথা ঠেকতেই সে উষ্ণতা অনুভব করে। এক মিনিটের মধ্যে তার কাধ মনে হচ্ছে এখনি জ্বলে যাবে। এতো উত্তাপ! তখনি আবেগ ফোন রেখে রোদেলা তে মনোযোগ দেয়। 

 

তার কপালে হাত রাখতেই বুঝে যায় প্রচন্ড জ্বর যাচ্ছে রোদেলার গা দিয়ে। আবেগ বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে? 

 

চলন্ত বাসে কিভাবে রোদেলার সেবা করবে? মেডিসিন সঙ্গে নেই যে খাইয়ে দিবে। এদিকে রোদেলা মরার মতো তার কাধে পড়ে আছে। সামান্য ঝাকুনি খেলেই পড়ে যাবে। আবেগ শাক্ত করে রোদেলাকে নিজের বুকের সাথে চেপে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে আবেগের বুকটাও উত্তপ্ত হতে লাগে। আবেগ রোদেলার ঘন ঘন নিশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে লাগলো। মেয়েটার হৃদস্পন্দন তার কানে  অস্পষ্ট ভাবে যাচ্ছে। আবেগের মনের মধ্যে তখন এক আকাশ পরিমান অস্থিরতা। রোদেলার শরীর যে মৃদ্যু কাপছে তা আবেগ বুঝতে পারছে, অনুধাবন করতে পারছে৷ রোদেলার গায়ের মিস্টি সুবাস আবেগের নাকে এসে লাগতে শুরু করল। 

 

আবেগ আবারো রোদেলাকে ডাক দিল। কিন্তু রোদেলা সায় দিল না ডাকে। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে সে। 

 

একজন ডাক্তার হওয়ায় পর ও আবেগ বেশ ভয় পাচ্ছে। এর চেয়ে কতো শত ভয়ংকর কেস সে হ্যান্ডেল করে। সেদিনই তো এক লোক আসল যার পায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেছে। রক্তাক্ত পা দেখে তো আবেগ ঠিক ই শান্ত ছিল। ঠান্ডা মাথায় সব ব্যবস্থা করল। 

 

তাহলে এখন সেই ডাক্তারই কেন একজন সামান্য জ্বরের রুগী দেখে চিন্তিত হচ্ছে। মস্তিষ্ক অনেক ভাবে আবেগকে বোঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু আবেগের চিন্তার পরিমাণ এক চিলকে কমল না। উলটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তা আরো বেড়েই চলেছে৷ 

 

আবেগ এবার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রোদেলার মুখে ছিটা দিল। রোদেলা নড়েচড়ে উঠে চোখ পিটপিট করে খুলেই আবেগকে চিন্তিত মুখে তার সামনে দেখতে পেল। 

 

রোদেলা কে চোখ খুলতে দেখে আবেগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। 

 

–এখন কেমন লাগছে রোদেলা? 

 

রোদেলা উত্তরে এতো আস্তে করে কি যেন বলল যা কানে এসে পৌছালো না আবেগের। 

 

সে রোদেলার মুখের সামনে বোতল ধরল। রোদেলা হালকা মাথা উচিয়ে পানি খেয়েই মুখ -চোখ কুচকালো। এতেই কিছুটা পানি রোদেলার গায়ে এসে ছিটকে পড়ল। 

 

আবেগ বলল, কি হয়েছে? 

 

–পানি অনেক তিতা লাগছে। 

 

আবেগ মৃদ্যু হাসল। সে বুঝতে পারল জ্বর হওয়ায় এমনটা হচ্ছে। 

 

আবেগ একটা টিস্যু বের করে রোদেলার গলায় পড়া পানি মুছে দিল৷ 

 

ওমনি রোদেলা আবেগকে জড়িয়ে ধরে খুব শক্ত করে। 

 

আকষ্মিক এমন করে রোদেলার কাছে আসাটা আবেগকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে যাচ্ছে। 

 

রোদেলা খুব শক্ত করে আবেগকে জড়িয়ে আছে। তার মাথা ভারী হয়ে গেছে। মাথা তুলে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে তবুও আবেগকে জড়িয়ে আছে। তার চোখ দিয়ে টুপটুপ করে চোখের পানি পড়ছে। রোদেলার চোখের মমতাময় অশ্রুতে আবেগের শার্ট খানা ভিজে উঠতে লাগে। 

 

আবেগ অস্থির হয়ে যাচ্ছে৷ কেন রোদেলা কাদছে? সে কি রোদেলাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে? মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছে? 

 

রোদেলা অস্ফুটস্বরে বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। 

 

কথাগুলোর মধ্যে এতোটাই জড়তা ছিল আবেগ শুনতে পায় নি। সে না পারছে রোদেলাকে জড়িয়ে নিতে  আর না পারছে তার থেকে রোদেলাকে সরিয়ে দিতে৷ উফ! এক মিশ্র অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে। এই মিশ্র অনুভূতির মধ্যে ভালো লাগাও আছে আবার সংকোচ, দ্বিধাও রয়েছে। 

 

রোদেলা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাপা কাপা স্বরে জ্বরের ঘোরে  বল উঠে, আবেগ? 

 

–হু। 

 

রোদেলা জ্বরের ঘোরে বলতে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না। 

 

 তাই বলল, না কিছু না। এখন বলতে ইচ্ছা করছে না। অন্য কোন দিন বলব। 

 

–আচ্ছা। রেস্ট নাও৷ 

 

★★★

 

ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে আছে মেঘ। তার গা থরথর করে কাপছে। চোখ লাল বর্ণ ধারন করেছে। দাতে দাত চেপে নিজেকে সংযম করছে সে। 

 

ফোনের স্ক্রিনে লেখা, অথৈয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। খুব শ্রীঘই তার বিয়ে। 

 

এই খবরটা সে এক মাধ্যমে থেকে মাত্র পেল। মেঘ ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। এতো দ্রুত অথৈ বদলে গেল? তার বোকাসোকা গার্লফ্রেন্ডটা এখন অন্য কারো সাথে বিয়ের পিড়িতে বসবে? আগে তো তাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না? আর এখন তাকেই বুঝে না। 

 

মেঘের চোখ ফেটে গরম জল পড়তে লাগে। কি এক অসহ্যকর যন্ত্রনা এটা। না পারে সইতে না পারে মরতে! 

 

কেন? কেন? তার ভালোবাসা কেই দূরে চলে যেতে হলো? কি এমন পাপ করেছে সে? 

 

অথৈয়ের সাথে দেখা হয়েছিল রোদেলার মাধ্যমেই! 

 

হ্যা রোদেলার মাধ্যমেই তো অথৈয়ের দেখা পেয়েছিল সে। 

 

ভর্তি কোচিং করেও যখন রোদেলা ডাক্তারি চান্স পেল না তখন ভারাক্রান্ত মনে ইডেনে ভর্তি হয় রোদেলা। তার বাবা-মায়ের রোদেলাকে ভালো মানের প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না।  রোদেলার ভালো মানের প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবাকে জোড় করে না। সে ছোট থেকেই খুব বাধ্য আর আর্দশ সন্তান ছিল বাবা-মায়ের। তাকে প্রাইভেটে এতো টাকা খরচ করে পড়াতে যে তার বাবার উপর রোলার কোস্টার যাবে তা বেশ বুঝতে পারে রোদেলা। 

 

এইচ এস সি তে এ প্লাস পায় নি। তাই ইঞ্জিনিয়ানিং সেক্টরে ট্রাই ও করে না। 

 

রোদেলা ভার্সিটি যাওয়া-আসা শুরু করে। ইডেন যেহুতু ন্যাশনাল ভার্সিটি সেই সাথে সরকারি তাই রেগুলার ক্লাস না করলেও চলে । এজন্য সপ্তাহে তিন দিন  মামার বাসায় থেকে সে টানা ক্লাস করে বাসায় যেত। কোচিং যেভাবে করেছে ভার্সিটিও সেভাবেই করতে লাগে রোদেলা। 

 

আবেগের তখন ইন্টার্ণ চলে। সকালে যেত, বিকাল বা সন্ধ্যা ফিরত। প্রায় দিন ই আবেগ রোদেলা এক সঙ্গে বের হত। রিকশায় করেই যাতায়াত করত তারা। 

 

পাশাপাশি বসে যখন আবেগ রোদেলা ঢাকার রাস্তায় শো শো করে এগিয়ে যেত তখন রোদেলার মন ও চোখ আবেগের মধ্যে ই সীমাবদ্ধ থাকত। রোদেলার  মনে তখন লাল-সবুজের মেলা! সে মেলায় হরেক রককের শখের হাঁড়ি আর প্রতিটা হাঁড়িতে আবেগের নামের চিরকুটে ভরা৷ 

 

আবেগের মনে কি চলছিল তা আবেগ নিজেই বুঝত না। কিন্তু প্রতিদিন রোদেলাকে ভার্সিটি না নিয়ে গেলে তার কেমন ছটফট লাগত। জানে না কেন এমন হত। দম আটকে আসত রোদেলাকে না দেখলে। আবেগ এটাকে শ্বাস কষ্ট ভাবা শুরু করে দেয়। তার ডিকশনারিতে ভালোবাসা বা প্রেম নাই। তার ডিকশনারিতে আছে কেবল, 

Grays Anatomy, Basic pathology, Medical Embryology,  Snells clinica Neuroanatomy, Appiled Physiology মতন মোটা মোটা বইয়ের প্রতিটা পাতা।  এসব বইয়ের কোন কোণায় ভালোবাসা বা প্রেম দিয়ে লেখা নাই তাই বোধগম্য নয় আবেগ প্রেম সম্পর্কে। 

 

মাঝে মধ্যে হাফ ব্রেকে আবেগ কোন কারন ছাড়াই রোদেলার ভার্সিটিতে যেত। সেই সময় মেঘও আসত তার সাথে। আবেগ ই তাকে ধরে বাধে আনত। মেঘ তখন পড়া শেষ করে একটা কম বেতনের জব করছিল। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে। 

 

রোদেলার বান্ধবী ছিল অথৈ৷ দুইজন ই ফাস্ট ইয়ার। মাত্র এক মাস হয়েছে ক্লাস করার। তাদেরকে এক কথায় ফ্রেশারস বলা যায়। 

 

রোদেলার সাথে আবেগ যখন দেখা করতে যেত তখনি মেঘের চোখ যায় অথৈয়ের উপর। 

 

অথৈকে প্রথম দেখাতেই প্রেমের হাওয়া দোলা দিয়ে যায় মেঘের হদয় জুড়ে। কি স্নিগ্ধ চাউনি অথৈয়ের ডাগর ডাগর চোখের। সবসময় রোদেলার সাথেই থাকত । রোদেলা ছাড়া বোধহয় বাথরুমেও যায় না —প্রথম দেখায় এমনই মনে হয় মেঘের অথৈকে দেখে। 

 

সেদিন আবেগ তাদেরকে নিউমার্কেট নিয়ে গিয়ে ট্রিট দেয়। কোন কারন ছাড়াই ট্রিট দেয়। সেদিন আবেগ রোদেলা, মেঘ আর অথৈকে নিউমার্কেট নিয়ে গিয়ে খাওয়ালো। ঝাল ফ্রাই আর নিউমার্কেটের বিখ্যাত ফুচকা আর লাচ্ছি। 

 

সেদিন খুব মজা করেছিল চারজন। মেঘ অথৈকে ইমপ্রেস করার জন্য অনেক জোকস, মজার কথা বলেছিল। যার জন্য আড্ডাটা জমে গিয়েছিল। রোদেলা মেঘের হাব-ভাব দেখেই বুঝে যায় মেঘ উইক হয়ে পড়েছে অথৈয়ের উপর। আর এদিকে মেঘ বুঝে যায় রোদেলা আবেগ নামক একটা নিরামিষ প্রানীর উপর ভয়ংকর লেভেলে আহত৷ 

 

কিন্তু আবেগ তো বুঝতে নারাজ। রোদেলা অবশ্য চেষ্টা করে না বোঝাতে আবেগকে।  সে চায় আবেগ  তাকে নিয়ে নিজে থেকে ই ভাবুক। 

 

এতোক্ষন পর্যন্ত খুব সুইট একটা মিস্টি মিস্টি প্রেম বা চারজনের একটা আড্ডাখানার গল্প চলছিল। যেখানে চার জন ভিন্ন বাসিন্দার মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের গল্প, হাসি -হতাশার বুলি বলা হত৷ 

 

কিন্তু কথায় আছে না? যেখানে মিস্টি আছে সেখানে মাছির উপদ্রব ও আছে। 

 

মাছি হিসেবে হয়ত নেহা এসেছে কিংবা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে। কে জানে? 

 

আবেগ আর রোদেলার মিস্টি মিস্টি কথোপকথন থামাতে আর চোখের ইশারায় ভালো লাগাকে রোধ করতে নেহার আগমন ঘটে। 

 

ফাস্ট ইয়ারের ছয় মাস ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর ইডেনে ভর্তি হয় নেহা। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে সে। বাংলাদেশের টপ প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়া শুরু করে কিন্তু  শেষ অব্দি সামলাতে পারে না। নেহা ছোট থেকেই ফাকিবাজ স্বভাবের। তাই তো তার বাবা ইডেনে ভর্তি করে দেয়। 

 

নেহার কারনে মেঘ আর অথৈয়ের সম্পর্কের অবনতি হয় নি। নেহা যখন ভর্তি হয় তখন মেঘ আর অথৈয়ের মধ্যে কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল। আবেগ আর রোদেলার মধ্যে তখনো কিছু হয় নি৷ 

 

 ওই যে জীববিজ্ঞানে আছে না? মাইটোসিস বিভাজন শুরু হওয়ার আগে কোষের নিউক্লিয়াস কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ করে। সেটাকে ইন্টার ফেস পর্যায় বলে। আবেগ আর রোদেলাও সম্পর্কে জড়ানোর আগের কিছুটা প্রস্তুতিমূলক কাজ করে নিজেদের প্রস্তুত করছিল কিংবা ইন্টার ফেস দশায় ছিল তারা।  

 

তখনি আগমন ঘটল নেহার। নেহা মেয়েটা খারাপ না। বেশ চটপটে স্বভাবের। চঞ্চল আর হাসি খুশি। ইডেনে সে একাই মনে হয় শার্ট-প্যান্ট পড়ত। 

 

মেঘ অতীত থেকে বের হয়ে এলো৷ এখন আর এসব ভেবে লাভ কি? সে হতাশাভরা শ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, তুমি সুখে থাকো অথৈ আর তোমার সুখ আমার মনে আগুন জ্বালাক! 

 

★★★

 

রিশাদ তার গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুকছে। আবেগের বাড়ির কিছুটা সামনে দাঁড়ানো সে। রিশাদের মেজাজ বিঘড়ে আছে। ড্রাইভার কে সিগারেট আনতে বলেছিল। ব্যাটা সিগারেট এনেছে কিন্তু কমদামি সিগারেট এনেছে। রিশাদ আবার গোল্ড লিভ বা বেনসন ছাড়া খায় না। এসব কমদামি সিগারেট খেলে তার মনে হয় ধোয়া খাচ্ছে। তার চ্যালাদের মাধ্যমে মাত্র জানতে পারল, রোদেলা আর আবেগ নেই। তারা নাকি গ্রামে গেছে। এ নিয়েও চেতে আছে রিশাদ। 

 

হারামী গুলো আগে বললেই তো আর কষ্ট করে এদিকে তার আসার লাগত না। 

 

রিশাদ সিগারেট ফেলে দেওয়ার জন্য গাড়ির জানালা খুলতেই তার চোখ আটকে গেল। একটা কমবয়সী মেয়ের দিকে। মেয়েটার মুখে মাস্ক। ইদানিং এই করোনার জন্য সবাই মাস্ক পড়ছে। মেয়েটাও পড়ে আছে। হাতে প্যাকেট। খাবারের প্যাকেট৷ 

 

রিশাদের মেয়েটাকে দেখে আগ্রহ বাড়তে থাকল। মেয়ে দেখলে এমনি রিশাদের মাথা ঠিক থাকে না। সেখানে এই মেয়েটা বেশ সুন্দর। লম্বা, ফর্সা। চেহারা দেখতে পাচ্ছে না সে৷ 

 

মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে তার গাড়ির সামনে এসে, রাস্তার ধারে এসে থামল। তারপর মাস্ক খুলল। প্যাকেট থেকে খাবার বের করল। একটা প্রেস্টি ছিল। সে খুশি মনে কেকে কামড় বসালো এবং খেতে লাগলো। 

 

রিশাদের ও লোভ হতে লাগলো। একজন ভালো মানুষ হলে হয়তো কেকটা দেখে সেটার উপর তার লোভ জন্মত বা তার ও কেক খেতে মন চাইত৷ কিন্তু রিশাদ যেহুতু নোংরা মস্তিষ্কের তাই তার কেকের প্রতি না মেয়েটার প্রতি লোভ জন্মালো। মেয়েটা ভারী মিস্টি দেখতে। কিন্তু চেনা চেনা লাগছে৷ কোথায় যেন দেখেছে। রিশাদ লুকিয়ে মেয়েটার ছবি তুলে নিল। 

 

মেয়েটা সামনের দিকে পা বাড়ালো। রিশাদ ও তাকে ফলো করতে লাগলো। 

 

মেয়েটা সামনের বিল্ডিং এ ঢুকে পড়ল। রিশাদ হতভম্ব হয়ে যায়। আবেগ যে বিল্ডিং এ থাকে সেখানে ঢুকল। 

 

রিশাদ মোবাইলে মেয়েটার ছবি দেখতেই চিনে ফেলল। মেয়েটা আবেগের ছোট বোন। রোদেলার কাজিন। ইভানা নাম। এর আগে দেখেছিল সে। কিন্তু এই নজরে  তো দেখে নি। 

 

রিশাদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল এবং সে মনে মনে বলে, দুই বোনই তো সুন্দরী। তবে ইভানা বেশি সুন্দর। উফ! দেখেই তো নেশা ধরে গেল। 

 

ইভানা কেক খেতে খেতে বাসায় ঢুকল। সে মাঝে মধ্যে ই প্রেস্টি খায়। আজকে ডিনারের পর খেতে মন চাচ্ছিল তাই বের হয়ে নিজেই কিনে আনল। অন্য সময় দারোয়ান কে টাকা দেয় উনি কিনে আনে। কিন্তু আজকে ইভানা নিজেই বের হলো। সে খুব খুশি। ভাইয়া ও ভাবীর সাথে গ্রামে গেছে খবর পেয়ে সে খুব আনন্দিত হয়েছে৷ এজন্য ই সেলিব্রেশন করতে কেক খেল। 

 

চলবে। 

 

 

 

 

 

 

 

#অশ্রুমালা 

part–21(বোনাস) 

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

বাস এসে থামল তার গন্তব্যে। এতো লং জার্নি করে আবেগ বেশ ক্লান্ত। ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে। হবেই বা না কেন? রোদেলা যে সারা রাস্তা তার কাধে মাথা রেখে পার করে দিল। এদিকে আবেগ শটাং হয়ে এক জায়গায় স্ট্যাচুর মতো বসে ছিল ভুলেও নড়াচড়া করে নি। যদি রোদেলার ঘুম ভেঙে যায়। এর মাঝে দুই বার সে সমুদ্র কে ফিডার খাইয়ে দিয়েছে। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে সমুদ্র কে খাইয়ে দিয়েছে। ঘুম পাড়িয়েও দিয়েছে৷ 

 

বাস থামতেই আবেগ রোদেলাকে ডেকে তুলল। এবং বলল, পৌছে গেছি আমরা। উঠো। নামব। 

 

রোদেলা চোখ কচলে জানালার দিকে তাকালো। সত্যি বড় বড় অক্ষরে কুড়িগ্রাম বাস স্ট্যান্ড  লেখা। এখান থেকে বিশ মিনিটের রাস্তা রোদেলাদের বাসা। রোদেলা উঠে দাড়ালো। মাথাটা এখনো ভারী হয়ে আছে। ভোরের আলো চারপাশের পরিবেশ কে আরো স্নিগ্ধ করে তুলেছে। 

 

বাস থেকে নেমে আবেগ বোতল বের করে কুলি করে নিল৷ মুখ ধুয়ে বোতলটা রোদেলার দিকে এগিয়ে দেয়। 

 

আবেগের দেখাদেখি রোদেলা ও চোখে মুখে পানি দেয়৷ চোখ-মুখে পানি দেওয়ার পর কিছুটা সতেজ লাগতে শুরু করে তার৷ 

 

এদিকে বেশ শীত পড়ে গেছে। ভোরের কুয়াশায় চারপাশে ছেয়ে গেছে। আবগের ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। 

 

রোদেলা মুগ্ধ হয়েই বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে চারপাশে দেখতে লাগলো। 

 

কি দেখছে রোদেলা জানে না আবেগ। এমন কিছু আহামরি নাই যে দুচোখ ভরে দেখতে হবে। পুরাতন একটা কক্ষ। পাশে চা ঘর তাও এখন বন্ধ আছে। আর একটা ল্যাম্পপোস্ট। রোদেলা ল্যাম্পপোস্টের সামনে গিয়ে দাড়ালো। 

 

ল্যাম্পপোস্ট টা এখনো জ্বলছে। এতো ভোরে কেউ আর বন্ধ করে নি। হয়তোবা সকালে বন্ধ করে দিবে৷ 

 

ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় রোদেলা কে অন্য জগতের রহস্যময়ী নারী মনে হতে লাগলো আবেগের। 

 

আবেগ চোখ ছোট ছোট করে রোদেলাকে দেখতে লাগলো। রোদেলা শাড়ি পড়ে আছে। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি। শাড়ির পাড়ে সাদা সুতার কাজ। চুল গুলো হাত খোপা করে একটা ঝুনঝুনি দেওয়া স্টিক দিয়ে আটকানো। নাক ফুল টা ল্যাম্পপোস্ট টা ঝিলিক মেরে উঠছে। হাতে একটা চিকন চুড়ি। 

 

রোদেলা যে শাড়ি পড়ে আছে সেটা মাত্র খেয়াল করল আবেগ। এতোক্ষনে একবারো আমলে নেয় নি সে ব্যাপার টা। শাড়ি পড়ায় রোদেলার মধ্যে একটা গুরুগম্ভীর ভাব চলে এসেছে। 

 

আবেগ অদ্ভুত নয়নে চেয়ে আছে রোদেলার দিকে। 

 

চারপাশে কিচিরমিচির পাখির ডাকে এক অমায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সেই সাথে শীতকালের একটা গন্ধ পাচ্ছে আবেগ৷ 

 

শীতের ঋতুতে সকাল আর ভর সন্ধ্যায় আবেগ একটা কাঠপোড়া গন্ধ পায়। তার কাছে এই গন্ধ পাওয়া মানেই শীত পড়ে গেছে মনে হয়। এই গন্ধ অন্য কেউ পায় কিনা জানে না আবেগ। কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। 

 

তার এখন রোদেলা কে খুব করে জিজ্ঞেস করতে মন চাচ্ছে, রোদেলা? তুমি কি শীত কালে কাঠপোড়া গন্ধ পাও? 

 

কিন্তু করল না। সব প্রশ্ন সবাই কে জিজ্ঞেস করা যায় না। কিছু প্রশ্ন নিজের মধ্যে পু্ষে রাখতে হয়৷ 

 

রোদেলা হালকা হেসে বলে, জানো এই স্ট্যান্ডে না এক ধরনের লজেন্স পাওয়া যায়৷হলুদ রঙের।  খুব মজা খেতে। আর একটা ক্রিম ওয়ালা বিস্কুট পাওয়া যেত আগে৷ ওইটাও খুব মজা। এই দুইটা খাবার আমার ফেভারিট। জানি না এখনো পাওয়া যায় কিনা? তবে এই দুইটা খাবার আমি ঢাকায় কোথাও পাইনি। আগে যখন ই দাদাবাড়ী আসতাম বাবা  দিত। আসার সময় একবক্স আর ঢাকা ফেরার পথে একবক্স।  

 

বলে  মৃদ্যু হেসে আবেগের দিকে তাকালো। আবেগ ও বিনিময়ে একটা হাসি দিল। এই প্রথম আবেগ এতো সুন্দর করে হাসল তার কোন কথায়। অন্য দিনে তো বেশির ভাগ সময় তার কথায় বিরক্তি পোষন করে। 

 

আবেগ আশেপাশে তাকিয়ে বলে, এবার চল আগাই। রওনা দিই। ঠান্ডা লাগছে তো। 

 

–হু। চল। 

 

আবেগ একটু সামনে এসে রাস্তার কাছে দাড়ালো। সমুদ্র তার কোলে। রোদেলা একটু পেছনে দাঁড়িয়ে চারপাশে দেখছে৷ 

 

আবেগ রোদেলা কে জিজ্ঞেস করে, এখান থেকে বাড়ি কত দূর? 

 

–বেশ দূরে তো। 

 

আবেগ সমুদ্র কে শক্ত করে ধরে আছে। যেন তার শরীরের উষ্ণতা সমুদ্রের গায়ে মাখে আর শীত কম লাগে তার। 

 

–তাহলে তো রিকশা নিতে হবে। 

 

–হুম। 

 

আবেগ আশেপাশে তাকালো। এতো ভোরে কোথায় রিকশা পাবে? আবেগ একটা জিনিস বুঝে পাচ্ছে না এই গহীন গ্রামে রোদেলা কিভাবে একা একা আসার সাহস পায়? আজকে যদি সে না আসত তবে রোদেলা একা কিভাবে হ্যান্ডেল করত? এই বাস স্ট্যান্ডে এসে কি করত? এখন কোন টেনশন ছাড়াই আশপাশে দেখতে ব্যস্ত। আর সে না যদি আসত তবে কি হত তাই ভাবছে আবেগ? 

 

সাহস হয় কিভাবে রোদেলার একা একটা বাচ্চা নিয়ে বের হওয়ার? 

 

মেয়েরা স্বামীর সাথে ঝগড়া করলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বোধহয়। 

 

কোন রিকশা তো পেল না তবে একটা ভ্যান পেল। ভ্যান ওয়ালাকে বলতেই উনি রাজী হয়ে যায়৷ 

 

শহর থেকে এসেছে শুনে উনি খুশি মনেই আবেগকে উঠতে বলে তার ভ্যানে। 

 

রোদেলাকে উঠে বসালো আবেগ। তার ব্যাগ-পত্র নিয়ে নিজে বসে পড়ে। মুখোমুখি বসেছে তারা। 

 

ভ্যান চলছে আপন গতিতে। চারপাশে হালকা কুয়াশা। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবটাকে উপভোগ করছে দুজনই। 

 

রাস্তার দুইধারেই গাছ আর গাছ।  সবুজ এ ভরপুর। মাঝে -সাঝে ছোট ছোট পুকুর । পানি কমে গেছে পুকুর গুলোয়। হাটুর নিচে ঠেকবে পুকুরের গভীরতা। বেশ খানিকটা পর খেজুর গাছ দেখতে পেল তারা৷ 

 

বড় বড় উচু উচু গাছ। গাছের কান্ড, বাকলে হাড়ি। এদিকটায় দুই-এক জন মানুষ দেখা যাচ্ছে। 

 

বেশ মুগ্ধ হচ্ছে আবেগ। বহু আগে এসেছিল গ্রামে। আর আসা হয় নি। সম্ভবত দশ-বারো বছর আগে শেষ এসেছে।  সে গ্রামে মাত্র একবার এসেছে আর এইবার নিয়ে দ্বিতীয়বার। মাঝে মধ্যে হুটহাট করে গ্রামে আসা দরকার। মন টা মূহুর্তের মধ্যে সতেজ আর পুলকিত হয়ে যায়৷ 

 

রোদেলার দৃষ্টি আবেগের দিকে। আবেগ বিষ্ময়কর নয়নে গ্রামের পরিবেশ দেখায় ব্যস্ত। 

 

আবেগ ভ্যান ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলে, এতো তাড়াতাড়ি খেজুরের রস পাওয়া যায়? 

 

ভ্যান ওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে বলে, কি যে বলেন না! এখনি তো খেজুরের রসের আসল সময়। খান নি কোন দিন? 

 

আবেগ আফসোসের সুরে বলে, না। গ্রামে খুব কম আসি। এক কি দু বার এসেছি। 

 

–এইবার খায়েন।বহুত মিস্টি খেতে৷ 

 

–ও। 

 

কিচিরমিচির শব্দে চারপাশে জমজমাট ভাব। আবেগের মনে হচ্ছে সে পাখিদের দুনিয়ায় চলে এসেছে। পাখিরা তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে। এতো এতো পাখি সে তার এতো লম্বা জীবনে দেখে নি৷ ভ্যান থেকে উপরের দিকে তাকাতেই চোখ গেল বিভিন্ন গাছ-গাছালির উপর! পাখিরা বসে গান গাচ্ছে। পাখি রা না বসন্তে গান গায়? এটা তো শীত কাল। তাও কেন ডাকছে —প্রশ্ন জাগে আবেগের মনে। 

 

আকাশ ভর্তি পাখিদের মেলা। ছোট ছোট পাখিদের উড়তে দেখে আবেগের ও পাখিদের সাথে উড়তে মন চাচ্ছে! 

 

ভ্যানওয়ালা ভ্যান থামিয়ে দিয়ে সিট থেকে নামল এবং বলল, আপনারা নিচে বসেন। এখান  থেকে কাচা রাস্তা শুরু।  একটু ঝাকুনি লাগবে। তাই সিটে না বসে নিচের ফাকা জায়গায় বসেন৷ 

 

রোদেলা আচ্ছা বলে ভ্যানের উপরিভাগ থেকে নেমে নিচে বসল। তাকে দেখে আবেগ ও নিচে বসে পড়ল। 

 

ভ্যানওয়ালা কাচা মাটির রাস্তা দিয়ে সামনে  আগাচ্ছে। তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। 

 

ভ্যানটাও কিঞ্চিৎ দুলে দুলে উঠছে। 

 

★★★

 

শৌখিন সকাল সকাল উঠে সকালের জন্য নাস্তা বানালো। শুকনা রুটি আর চা। সে ঘড়ি দেখল। আজকে একটা ইন্টারভিউ আছে। যদি চাকরি টা পেয়ে যায় তবে সংসারের অভাবটা কমে।যাবে। যদিও বা এই সংসারে সে আর তার বোন ছাড়া কেউ নি। তার বোনটা বেশ মেধাবি জন্য সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তাও ঢাকা মেডিকেল। বাংলাদেশের বেস্ট মেডিকেল কলেজে।শৌখিন মাঝে মাঝে অবাক হয়। তার বোন পড়াশোনায় এসএসসি পর্যন্ত মোটামুটি লেভেলের ছিল। হুট করে এতো ভালো কিছু যে হবে শৌখিন ভাবতে ও পারেনি। শায়েরী যখন ইন্টারে তখন থেকেই শৌখিন একটু একটু করে নিজের হাত খরচ থেকে টাকা জমাচ্ছিল শায়েরীকে ভালো কোথায় পড়াবে জন্য। কিন্তু সেটা আর লাগে নি। শায়েরী খুব ভালো ফলাফল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়। শৌখিনের যেন বুক টা উচু হয়ে যায়। মেয়েটার সে ছাড়া আর কেউ নি। মেয়েটার বাবা ও সে আর মাও সে। 

 

শৌখিন আপাতত একটা ভালো চাকরির আশায় আছে। কিন্তু চাকরি আর সোনার হরিণ তো একই কথা । তাই আতিপাতি হয়ে  খুজেও ফলাফল শুন্যের কোঠায়৷ সে আবার সোশ্যাল ওয়ার্কার। সমাজের জন্য কাজ করতে তার ভালো লাগে। যেদিন সে কারো সাহায্য করতে সক্ষম হয় সে দিন রাতের ঘুমটা  তার খুবই আরামদায়ক হয়।  

 

নাস্তা সেরে সে ভালো দেখে একটা শার্ট গায়ে দিল। যদিও বা তার শার্ট আছেই তিনটা। একটা সাদা, একটা কালো আর হালকা নীল,।  এই তিন রঙের তিনটা শার্ট। তার মধ্যে  সাদাটা সবচেয়ে ভালো আছে। তাই আজকেও সাদাটাই পড়ল। তার হাতে টাকা আছে কিন্তু নিজের জন্য কিছু কিনছে না। কিছু দিন পর শায়েরীর জন্য একটা কংকাল কিনতে হবে। কংকালের নাকি অনেক দাম। সেকেন্ড হ্যান্ড গুলো বিশ হাজার ছুইছুই। কিন্তু সে চায় শায়েরীকে সব নতুন জিনিস দিবে। তার বোন কেন কারো ইউস করা জিনিস ব্যবহার করবে? 

 

সে বেরিয়ে গেল। শৌখিন পড়াশোনায় ভালোই ছিল। কিন্তু ইন্টার থেকেই পাট টাইম জবের ভারে রেজাল্ট টা কোন কালেই ভালো করা তার পক্ষে  সম্ভব হয় নি। 

 

পেটের খিদার তুলনায়  তো কাগজের ওই প্লাসের গ্রেন্ড কিছুই না! 

 

জীবন যে একটা রণক্ষেত্র তা হারে হারে টের পায় শৌখিন। যার বাবা-মা তার কেউ নেই। কেউ নেই বলতে কেউ নেই। সম্পূর্ণ একা। ছায়াহীন, ঢালহীন, অস্তিত্বহীন আর অসহায়।  বাবা-মা যে কি অমূল্য রতন ভালো করেই জানে শৌখিন। 

 

★★★

 

হুট করে ভ্যানের চাকা মাটির খালের সাথে ঘষা খাওয়ায় একটা ধাক্কা সৃষ্টি হয়। সেই ধাক্কার টাল সামলাতে না পেরে রোদেলা আবেগের গায়ের উপর এসে পড়ে৷ 

 

আবেগ চমকে উঠে। রোদেলার ছোয়া পেতেই সে এক অন্য জগতে চলে যেতে ধরে। রোদেলার গা এখনো কিছুটা গরম আছে। 

 

রোদেলা সরে আসতে গিয়ে দেখল তার চুলের কিছু অংশ আবেগের শার্টের বোতামের সাথে আটকে গেছে৷ 

 

রোদেলা আহ বলে উঠে। 

 

আবেগ ভ্রু কুচকে বলে, কি হলো? 

 

–আমার চুলে টান পড়ছে। 

 

–সর‍্যি? বুঝলাম না। 

 

রোদেলা মনে মনে বলে৷ তোমাকে বুঝতেও হবে না। 

 

সে হুট করে আবেগের শার্টের বোতামে হাত দেয়৷ ওমনি খপ করে আবগ রোদেলার হাত ধরে ফেলে এবং কর্কষ কন্ঠে বলে, এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি? 

 

রোদেলা আবেগকে ব্যঙ্গ করে বলে, এমন ভাবে বলছো যেন আমি তোমার ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছি। 

 

–আজব! এভাবে আমার শার্টের বোতাম ধরে টানাটানি কেন করবে? 

 

–চোখ টা একটু কাজে লাগাও। আমার চুল তোমার শার্টের বোতামে লেগে গেছে। এখন ছাড়াতে হবে৷ 

 

–ছাড়ানোর কি দরকার? ছিড়ে ফেল তোমার চুল।  

 

রোদেলা চোখ সরু করে বলে, আমার চুল কেন ছিড়ব? 

 

আবেগ আবারো বিরক্ত হয়ে গেল এবং প্রতিউত্তরে বলে, তোমার মাথায় অনেক চুল আছে এক-দুই টা ছিড়লে কিছু  হবে না। 

 

রোদেলা আবারো চোখ ছোট করে বলে, তাহলে তোমার শার্টের বোতাম ছিড়ে ফেলি? 

 

 –এই না! পাগল নাকি তুমি। শার্টের বোতাম কেন ছিড়বে? (ব্যতিব্যস্ত হয়ে) 

 

রোদেলা বলল, তাহলে প্লিজ বি কোয়াইট। আমি আস্তে করে কায়দা করে তোমার বোতাম থেকে চুল গুলো ছাড়িয়ে নিচ্ছি। 

 

রোদেলা অনেকক্ষন ধরে আবেগের বোতামটার সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে বোতামটা ছিড়ে ফেলে। 

 

সে মন খারাপ করে আবেগের হাতে বোতাম তুলে দিয়ে বলে, সর‍্যি। তোমার  অনেক বড় ক্ষতি করে দিলাম! 

 

একথা শুনে আবেগ হোহো করে হেসে উঠে। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–22

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

অথৈ মাত্র ইন্টারভিউ দিয়ে বের হলো। ইন্টারভিউটা বেশ ভালোই হয়েছে। মোটামুটি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে সে।  তাই সে মনে মনে অনেক খুশি। যাক এবার সে নিজের পা দাড়াতে পারবে যদি জবটা পায়।   আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে। অথৈ অফিসটার সামনে সিমেন্ট দিয়ে গাথা সিড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছুটা ঘেমে গেছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে ওড়নার পেছনের অংশ দিয়ে নাকের ডগার ঘাম মুছলো। ঘাম মোছার সময় তার মনে পড়ল গ্রামের মানুষরা বলে, যেই মেয়ের নাকের ডগায় ঘাম জমে তার স্বামী নাকি তাকে খুব ভালোবাসে! 

 

অথৈ জানে না এই কুসংস্কার টা কতোটুকু সত্য। যেহুতু কুসংস্কার তাই সত্য হবে  না –এটা অথৈ ও জানে। তবুও মনে ক্ষীণ আশা আছে যদি সত্যি খুব ভালোবাসা পায় সে স্বামীর কাছ থেকে?

 

অথৈয়ের বাবা খুব রাগীস্বভাবের আর অথৈ তার বাবাকে জমের মতো ভয় পায়। তার মায়ের সাথেও খুব একটা ভাব বা সখ্যতা নেই তার। বাবা-মায়ের সাথে কেমন যেন একটা দূরত্ব আছে তার। সেই টিনএজ থেকেই। ছোট বেলায় অবশ্য সে বাবা-মায়ের মাঝখানে ঘুমাত৷ কিন্তু দশ বছর বয়স থেকে হুটহাট বাবা-মায়ের সাথে একটা গ্যাপ চলে আসে। যেটা দিন দিন ক্রমশ বেড়ে চলছিল৷ মেঘের সাথে প্রেম হওয়ার পর বাবা-মায়ের সাথে আরো দূরত্ব চলে আসে। মায়ের সাথে তাও এক-দুইটা কথা হত। কিন্তু বাবা? ওনার সাথে তো কথাই হত না। অথৈ কেন যেন তার বাবার সাথে কথা বলতে পারে না। একটা সংকোচ কাজ করে তার মধ্যে। বাবার কাছে কোন আবদার করতে পারে না। কেন যে পারে না অন্য মেয়েদের মতো বাবার কাছে গিয়ে চুরি-ফিতার আবদারের মেলা পেশ করতে! অথৈয়ের মনে পড়ে না আদৌ সে নিজের মুখ ফুটে তার বাবার কাছে কিছু চেয়েছে? নাহ সত্যি তার মনে পড়ে না৷ তার বাবাও কি পারে না একবার তার রুমে এসে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই কিন্তু সব জড়তা চুকে যায়৷ 

 

অথৈ ছোট করে একটা শ্বাস নিল। ছোটবেলা থেকেই তার বাবা-মায়ের সাংসারিক সমস্যা দেখে আসছে অথৈ। ছোটবেলায় না বুঝলেও কিশোর বয়স থেকে ঠিক ই সব বুঝে অথৈ তাই তো বাবা-মায়ের সাথে এতোটা মনোমালিন্য তার। তাদের পরিবার ভাংতে গিয়েও ভাংগে নি। বাসায় সবসময়ই একটা গুমটে ভাব থাকবেই। একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। এজন্যই তো কখনোই কোন উৎসব অনুষ্ঠান পালন করা হয় নি বললেই চলে৷ না কোন দিন অথৈ কিংবা তার ভাইয়ের জন্মদিন সেলিব্রেশন হয়েছে আর না হয়েছে শুক্রবারে পোলাও-মাংসের একটা লাঞ্চ! 

 

অথৈ সামনে পা বাড়াবে এমন সময় ফোনে কল আসল। সে ফোন চোখের সামনে তুলে দেখে ফয়সাল কল করেছে৷ তার মনটা এমনি খারাপ ছিল এখন তো বিষ মাখা হয়ে গেল। এই লোকটার সাথে তার আর কিছু দিন পর বিয়ে। বাবাই কোথা থেকে যেন তুলে এনেছে ছেলেটাকে। 

 

অথৈ ফোন ধরল না। সামনে পা বাড়ালো। আবারো ফোন বেজে উঠল। এবার বাধ্য হয়ে ফোন ধরে অথৈ। 

 

ওপাশ থেকে ফয়সাল বলে উঠে, এতোবার কল দিচ্ছি ফোন কেন ধরো না? 

 

–বাইরে আমি৷ 

 

–বাইরে কেন,? বাইরে কি কাজ? 

 

,–জব ইন্টারভিউ দিতে এসেছি৷ 

 

–কেন? তুমি চাকরি করতে চাও নাকি? 

 

–অবশ্যই। চাই। নাহলে তো দূর কষ্ট করে পড়তাম নাকি! 

 

ফয়সাল তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, কই এতো দূর পড়লা? পড়ছো কি এক ন্যাশনাল ভর্সিটি থেকে।ওই ভার্সিটিতে ক্লাস হয় ঠিক মতোন?  মেয়েরা তো বাচ্চা নিয়ে ক্লাস করতে আসে। বাদ দাও। তুমি যে চাকরি করবা একবারো আমাকে জানাবে না? 

 

–প্রয়োজন মনে করি না। 

 

ফয়সাল হুংকার দিয়ে বলে, আমি চাই না আমার হবু বউ চাকরি করুক। প্রতিদিন অন্য পুরুষদের নিজের রুপ দেখাক। বাড়ির বউ বাসায় থাকবে৷ আল্লাহ দিলে আমার বেতন ভালোই। তোমার সব চাহিদা আমি মেটাতে পারব। কোন দরকার নাই তোমাকে জব করার৷ 

 

অথৈ কঠিন কিছু বলতে গিয়েও পারল না। সে খট  করে ফোন কেটে দিল এবং অসাবধানে রাস্তায় পা ফেলতে লাগে। চোখ ভরে আসছে। তার আর ভালো লাগে না কিছু। সব অসহ্য লাগে! 

 

সে হনহন করে হেটেই চলেছে। কোন দিকেই খেয়াল নেই। 

 

কানের হর্ণের শব্দ ভেসে আসছে কিন্তু তা আমলে নিল না অথৈ। আজকে যদি কোন বাস বা ট্রাক তাকে ধাক্কা দিয়েও চলে যায় আপত্তি নেই অথৈয়ের। 

 

হর্ণের শব্দ আরো নিকটে আসতে লাগল। সে একবারও পেছনে কিংবা আশেপাশে তাকালো না। 

 

হুট করে হাতের কনুই বরাবর হ্যাচকা টান অনুভূত হয় অথৈয়ের। সে তড়িৎগতিতে চোখ বন্ধ করে নেয়। তখনি দুই ফোটা গরম জল তার চোখ থেকে পড়ে গালের মাঝ বরাবর  গিয়ে ঠেকল। 

 

গালে আরো স্পর্শ পেতেই চোখ খুলে ফেলে অথৈ। অস্পষ্ট স্বরে বলে, মেঘ,,,,,,,,,,

 

★★★

 

রোদেলা উঠানের লম্বা পিলারে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সকাল দশটা বাজতে চলেছে। তাদের বাড়ি পৌছানোর। আবেগ এসেই ফ্রেস হয়ে দিয়েছে এক ঘুম। কিন্তু রোদেলার আর ঘুমানোর দরকার পড়ে নি। তার কেন যেন গ্রামের হাওয়া খেয়েই চাঙ্গা লাগছে। গায়ে জ্বর আছে কিন্তু তবুও মৃদ্যু শীতল বাতাস সে দাড়িয়ে দাড়িয়ে উপভোগ করছে৷ পরনে সালোয়ার কামিজের উপর একটা শাল৷ শালটা তার মায়ের। মায়ের শালটা গায়ে জড়াতেই রোদেলার নাকে মায়ের গন্ধ ভেসে উঠল। 

 

বাবা এই সকালেই হাটে গেছে। বড় মাছ কিনতে। কালকে রাতে হুট করে বলায় উনি কোন প্রস্তুতি নিতে পারেন নি৷ 

 

রোদেলার মা সমুদ্র কে খালি গা করে সরিষার তেল গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে আর সমুদ্রের সাথে খেলছে। নানীর সাথে ভালোই ভাব জমে গেছে সমুদ্রের। দুজনের অমূল্য হাসির পানে চেয়ে আছে রোদেলা। 

 

রোদেলা উঠানে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে নানী-নাতির কাহিনি দেখছে তার প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। রোদেলার হাতে একটা স্টিলের বাটি। বাটিতে খই আর গুড় সাথে নারকেল কুচি কুচি করে কেটে দেওয়া হয়েছে। রোদেলা শীতের

 উত্তাপ গায়ে মাখছে আর খই খাচ্ছে। মৃদ্যু হাওয়া বয়ে আসায় তার চুল গুলো হালকা নড়েচড়ে উঠে। 

 

আবেগ ঘুম থেকে উঠে রুমে কাউকে দেখতে পেল না। আশেপাশে তাকিয়ে ও রোদেলা র খোজ না পাওয়ায় সে রুম ছেড়ে বের হয়। তাকে বাথরুমে যেতে হবে৷ অগত্যা সে রুম ছেড়ে বের হয়ে বাথরুমে ঢুকল। কিন্তু ঝামেলা রয়েই গেল। 

 

প্রথম যে বার সে যখন বাথরুমে গিয়েছিল তখন বালতি তে পানি ছিল। এবার বালতি সম্পূর্ণ খালি। বাথরুমের সাথে টিউবওয়েল লাগানো। কিন্তু আবেগ টিউবওয়েল চেপে পানি বের করতে পারে না। এখন কি করবে সে? পানি খুব দরকার তার এই মূহুর্তে! 

 

উপায় না পেয়ে সে বের হলো বাথরুম না সেরেই। । রোদেলাকে খুজতে হবে। কিন্তু কোথায় ও? 

 

আবেগ উশখুশ করতে করতে উঠানে গেল। উঠানে যেতেই সে এক দফা চমক খেল। রোদেলা চুল ছেড়ে দিয়ে কার সাথে যেন হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। পরনে ঘিয়া শাল। এই শালটা পড়ায় তাকে মায়াবিনী লাগছে। কথার  ফাকে ফাকে রোদেলা বাটি থেকে কিছু একটা হাতে নিয়ে মুখে দিচ্ছে৷ খাবার টা হাতের মধ্যে নিয়ে কিছুটা ঝাকাচ্ছে তারপর মুখে দিচ্ছে৷ 

 

রোদেলাকে এই রুপে দেখে আবেগের হার্টবিট মিস হলো। সে ঘামতে লাগল। তার পিপাসা পেতে লাগল। মাথার মধ্যে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হলো। চারপাশের কিছু ই তার কানে যাচ্ছে না। কেবল রোদেলার রিনরিনে কন্ঠ। রোদেলা হুট করে খিলখিল করে হেসে উঠে৷ 

 

রোদেলার হাসিতে আবেগ ডুবে গেল। তলিয়ে যেতে থাকে কোন এক অজানা গভীরে। যেই গভীরতায় কোন অপবিত্রতা নেই। কেবল পবিত্রতা ছেয়ে আছে। কেমন যেন মোহ কিংবা মায়াজাল সৃষ্টি হতে লাগে আবেগের মনের গহীনে। সে বুঝতে পারছে রোদেলাতে কিছু একটা আছে যেটা অনেকয়া দুর্বল করে দেয় আবেগকে ৷ কুড়ে কুড়ে খাক করে দেয়। কি আছে? সেটা জানে না আবেগ কিন্তু কিছু একটা আছে সেটা নিশ্চিত। 

 

রোদেলা হাসি থামিয়ে পেছনে তাকাতেই আবেগকে দেখে আরো চুপ বনে গেল। আবেগের ঘোর তখনো কাটে নি। সে রোদেলার দিকে চেয়ে আছে নিষ্পাপ চোখে। 

 

এতে রোদেলা বেশ লজ্জা পায়। সে মাথা নিচু করে ফেলে। 

 

আবেগ হুট করে রোদেলার হাত ধরে ফেলে এবং তাকে উঠান থেকে সরিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়। 

 

রোদেলা হতভম্ব হয়ে যায়। উঠানে এক মাঝবয়েসী মহিলা তার সাথে গল্প করছিল। উনি কি ভাববেন? কি লজ্জার কাজ করে বসল আবেগ? এখন ওই মহিলার সামনে সে পরবর্তীতে কিভাবে যাবে? 

 

আবেগ বাথরুমের সামনে গিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে, আমাকে কল চেপে দাও তো। বালতিতে পানি নেই৷ 

 

রোদেলা বুঝলো শহরের ছেলের অসুবিধা হচ্ছে৷ সে মুচকি হেসে চুল খোপা করে নিল৷ এবং টিউবওয়েলের সামনে গিয়ে পানি চেপে দিল৷ 

 

আবেগ আরেকদফা মুগ্ধ হলো রোদেলার প্রতি৷ কি একটা অবস্থা! বারবার একই ব্যক্তির উপর মুগ্ধ হওয়ার তো কোন কারন দেখে না আবেগ? 

 

রোদেলার বালতি ভর্তি করে বাথরুমের বাইরে বের হয়ে এসে বলে, হয়েছে। যাও এবার৷ 

 

আবেগ এক মূহুর্তে দেরি না করে ছুট লাগায় বাথরুমে তা দেখে রোদেলা হেসে ফেলে। অনেক দিন পর তার মনটা আজকে খুব খুশি। সব কিছুতেই আনন্দ খুজে পাচ্ছে৷ কিশোরীর মতো খালি পায়ে ছুটে যেতে মন চাচ্ছে মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তায়! 

 

রোদেলার বাবা তালুকদার সাহেব। বাজার থেকে ইলিশ আর রুই আনলেন। ঠিক করা হলো দুপুরে পোলাও আর ইলিশ মাছ রান্না করা হবে। তাও সরষে ইলিশ। 

 

রোদেলার মা রান্নার আয়োজন শুরু করে দিলেন। গ্যাসের চুলা থাকা সত্ত্বেও রোদেলার 

আবদারের খাতিরে খড়ির চুলায় রান্না বসালেন তিনি৷রোদেলার খড়ির চুলার রান্না খুব প্রিয়। খড়ির চুলার রান্নায় স্বাদ বহু গুন বেড়ে যায়। 

 

 কিছুক্ষন বাদে উনি উঠে গেলে রোদেলাই চুলার পাড়ে বসে রান্না করতে লাগলো। 

 

আবেগ ও চুলার পাশে এসে দাড়ালো। সে মূলত রোদেলা  কে দেখতে এসেছে। আজ-কাল কি যেন হয়েছে। ঘন ঘন পিপাসা লাগার সাথে সাথে রোদেলাকে দেখার বাসনা জন্মে!যেমনটা অনেক আগে একবার হয়েছিল! যখন রোদেলা ভার্সিটি যাওয়া শুরু করে তখনকার দিনগুলো তে যেমন অনুভব করত তেমনি আজ-কাল তার রোদেলার প্রতি অনুভূতি গুলো মাথা নাড়া দিয়ে উঠছে। 

 

চুলার উত্তাপ গায়ে লাগায় বেশ ভালোই লাগছে আবেগের৷ 

 

আবেগ চুলার বিপরীতে বসে পড়ে৷ 

 

রোদেলা শিংটা দিয়ে চুলাউ ফুক দেওয়া শুরু করল। 

 

আর এদিকে ধোয়া চোখে লাগায় আবেগ আউ বলে চোখ কচলাতে 

লাগল। 

 

রোদেলা প্রথমে খেয়াল করেনি আবেগ তার বিপরীতে বসে আছে। চুলার কালো ধোয়া আবেগের চোখে লেগেছে তাই চোখ জ্বালা করা শুরু করে দিয়েছে৷ 

 

রোদেলা দ্রুত আবেগের কাছে গিয়ে তার চোখে ফু দিতে লাগলো। 

 

রোদেলার ছোয়া পেয়ে পিটপিট করে চোখ খুলল আবেগ। 

 

লাল রক্তিম চোখে রোদেলাকে দেখে পাগল হতে গিয়েও হলো না পাগল আবেগ! 

 

রোদেলা মায়া ভরা দৃষ্টিতে আবেগের চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ফু দিচ্ছে আর আবেগ মুগ্ধ হয়ে রোদেলা কে দেখছে। 

 

হুট করে আবেগ রোদেলার কোমড় জড়িয়ে ধরে৷ 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

part–23

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

হুট করে আবেগ রোদেলার কোমড় জড়িয়ে ধরায় রোদেলা বিমৃঢ় হয়ে পড়ে। বিষ্ফরিত চোখে আবেগের দিকে তাকালো। উঠানের নিচে খালি জায়গায়  চুলা ধরানো হয়েছে। বাড়ির ভেতর থেকে এখানে কি হচ্ছে তা দেখা দুষ্কর। তাদের মধ্যে এখন যা হচ্ছে সেটা ঠিক ভাবে দেখতে হলে সোজাসোজি উঠান পেরিয়ে নিচে নামতে হবে। রোদেলা দের উঠানটা বেশ উচু।  তিনটা সিড়ি দিয়ে বাধানো সেই উঠান। 

 

আবেগ হুট করে রোদেলার পেটে হাত দিল। রোদেলা শিউরে উঠে। তার হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগলো। সে নিজেই জমে যাচ্ছে এমন অনুভূতি হচ্ছে তার। হৃদপিণ্ড  প্রচুন্ড জোড়ে কম্পিত হতে লাগলো। এই বুঝি হৃদপিণ্ড ফেটে যাবে যাবে ভাব! 

 

রোদেলার হার্টবিট বুঝি আবেগ ও শুনতে পারল। আবেগ এবারে রোদেলার কোমড়টা তার ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে খুব শক্ত করে। এবং আরো একটু ঝুকে আসে রোদেলার দিকে। 

 

হুট করে একটা মেয়ের শরীর জড়িয়ে ধরার কোন মানে হয় না। তবুও রোদেলার পেটে হাত দিয়ে বসে আছে আবেগ। এটা খুব বড় অন্যায় করা হচ্ছে! রোদেলা যে অস্বস্তিবোধ করছে। উশখুশ করছে তা দিব্যি বুঝতে পারছে আবেগ৷ কিন্তু সে নির্বিকার। রোদেলার চোখে ভয়। মুখে ভয়ের আভা। এই ভর্য়াত দৃষ্টি রোদেলার সৌন্দর্য কে বহু গুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা কোন মেয়ে যদি ভীত হয় তবে কি তাকে বেশি অপরুপ লাগে? যদিও লেগেও থাকে তাহলে রিজন কি? 

 

রোদেলা আবেগকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু  আবেগ এক চুল ও নড়ল না। বরং রোদেলার আরেকটু গা ঘেষে আসল। 

 

আবেগ সামান্য ভুল বলেছে। সে অন্যায় করে নি। রোদেলার গা বেয়ে একটা বড় কালো পোকা কিলবিল করে হেটে যাচ্ছিল। সম্ভবত  রান্না করায় ব্যস্ত থাকায় সে টের পায় নি৷ মেয়েরা  আবার রান্না করতে বসলে পৃথিবী  ধ্বংশ হলেও খেয়াল রাখবে না! 

 

প্রথমে কোমড়ে হাটছিল জন্য কোমড়ে হাত দেয় আবেগ৷ কিন্তু তাও সরাতে পারে নি। পোকাটা পেটের দিকে চলে যাচ্ছিল তাই বাধ্য হয়ে সেখানেও আবেগের হাত বিচরণ করছিল। অবশেষে টুপ করে পোকাটা সরিয়ে ফেলে আবেগ। কিন্তু এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র জানা নেই রোদেলার। 

 

সে ভীত কিংবা লজ্জায় মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে৷ হুট করে আবেগ রোদেলার চুলে হাত দিল এবং চুলে বিলি কাটতে লাগে। 

 

রোদেলা ভীষণ জোড়ে কেপে উঠে। তার নিশ্বাস আটকে যাচ্ছে। দলা পাকিয়ে কান্না ফেটে পড়তে চাচ্ছে। হুটহাট কেদে দেওয়ার মতো বদঅভ্যাস রোদেলার আছে৷ 

 

আবেগ রোদেলার চুল গুলো এক সাথে হাতের মুঠোয় এনে খোপা করার বৃথা চেষ্টা চালালো। কতোটা সফল হলো সে জানে না কিন্তু চুল গুলো এক জোট হয়ে কাধে পড়ে রইল। কিন্তু সামনের অবাধ্য চুল গুলো এখনো রোদেলার কপালে উঁকিঝুকি মারছে৷ 

 

আবেগ আরেকবার অন্যায় করে বসে। সে রোদেলার ছোট চুল গুলো একসাথে করে কানের ভাজে গুজিয়ে দিল। প্রথম বার কানে গুজে দেওয়ার সাথে সাথে চুল গুলো আবারো বেরিয়ে আসল। রোদেলা আবেগের দিকে অদ্ভুত নজরে চেয়ে আছে। আবেগের মুখ-চোখে মুগ্ধতা বিরাজ করছে৷ 

 

আবেগ কখনোই এক কাজ দুবার করা পছন্দ করে না। কিন্তু রোদেলার চুল পুনরায় কানে গুজে দিতে পারায় সে নিজেকে সার্থক ভাবতে শুরু করল। রোদেলার চুলের সাথে খেলতে তার খুব ভালো লাগছে। চুল গুলো এতো সিল্কি। হাতে নিলেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। 

 

আবেগ এবার রোদেলার চোখ চোখ রাখল। তার কেন যেন মারাত্মক ধরনের একটা অপরাধ করে বসতে মন চাচ্ছে। কঠিন ধরনের অন্যায় করতে মন চাচ্ছে। যেহুতু সে এক দন্ডের ব্যবধানে পর পর বেশ কটা অন্যায় করে ফেলেছে তাই বেহায়া মন আরো একটা করতে চাচ্ছে! 

 

 

 

হুমায়ুন আহমেদ একটা কথা বলেছিল, অন্যায় কিছু টা চেইন রিয়্যাকশনের মতো! একবার অন্যায় করে ফেললে বারবার অন্যায় করতে হয়৷ 

 

আবেগ ও অন্যায় করে ফেলেছে৷ তবে খুব একটা অনুতপ্ত না সে। বরং এখন আরো একটা ভয়ংকর অন্যায় করার জন্য তার অবাধ্য মনে জলোচ্ছ্বাস বয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের অবাধ্য ঢেউয়েরা যখন বেতাল হয়ে ভূমির বুকে আছড়ে পড়ে ঠিক সেই রকম জটিল ভাবে একটা অন্যায় করার বাসনা জাগছে তার মনে। কিংবা শিকারকে ধাওয়া করা ঈগল যে বেগে দৌড়ায় সেরকম  ভাবে তার মন অন্যায় টা করার জন্য পাগল প্রায় হয়ে যাচ্ছে৷ 

 

কিন্তু! কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আবেগ নিজেকে সামলে নেয়। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার বহু আগে থেকেই জন্মেছে। তাই কেবল রোদেলার মুখের কাছে মুখ  এনে ফু দেয়। আবেগের মুখের গরম বাতাসে রোদেলা চোখ খুলে রাখতে পারেনা। দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে। 

 

আবেগ আস্তে করে উঠে পড়ে। সামনের দিকে পা বাড়ায় সে৷ আশেপাশে কি হচ্ছে কোন কিছু তেই আগ্রহ নেই তার। 

 

রোদেলা চোখ বন্ধ রেখেই চুলার কালো ধোয়ায় খুকখুক করে কেশে ফেলে সে বুঝতে পারল রান্না সম্ভবত হয়ে গেছে। 

 

খেতে বসে আজ অনেক দিন পর তৃপ্তি করে খেল আবেগ।ধোয়া উঠা সাদা পোলাও, সরষে ইলিশ সঙ্গে বড় বড় পিস করে বেগুন ভাজা আর সালাদ। বেগুন ভাজা মাত্র চুলা থেকে নামানো হয়েছে। হাত ই দেওয়া যাচ্ছে না ভাজিতে। তাই ইলিশ দিয়েই খাওয়া শুরু করে আবেগ। রান্না খুবই অসাধারণ হয়েছে। খেতে একেবারে অমৃত যেন! মনে হচ্ছে বেহেশতি খানা যদিও বেহেশতের কোন কিছু ই দুনিয়াতে উপভোগ করা সম্ভব না। এটা ছিল কথার কথা। খাবারের স্বাদ সম্পর্কে ধারনা দেওয়ার জন্য বলা বৈকি।

 

আবেগের প্লেটে দুই টুকরো ইলিশ তুলে দিল রোদেলার মা৷ তালুকদার সাহেব আর আবেগ খাচ্ছে। রোদেল আর তার মা পাশে বসে আছে। রোদেলা আবেগের দিকে তাকালো। আবেগ যে খাবার খেয়ে তুষ্ট তা দিব্যি বুঝতে পারছে সে৷ আবেগ বেশ মনোযোগ দিয়ে ইলিশ মাছের কাটা বেছে খাচ্ছে। আর রোদেলা ও তার চেয়েও দ্বিগুন মনোযোগ দিয়ে আবেগকে দেখেই চলেছে৷ 

 

রোদেলার মনে হচ্ছে ইশ যদি সে এখন অতীতে যেতে পারত! তবে কোন জন্মেও রিশাদ নামক কীটকে বিয়ে করত না। সে তো এমনিও করতে চায় নি। যদি জানত যার জন্য বিয়ে করল নিজের মনের বিরুদ্ধ গিয়ে, সে নিজেই আবার তার জীবনে আসবে তবে মাটি কামড়ে পড়ে থাকত তাও রিশাদকে বিয়ে করত না।  পরিস্থিতি আর চাপে পড়ে কতো বড় ক্ষতি করে বসল সে নিজের! অনেক ভেবেছে পরের কথা, অন্যের কথা কিন্তু কোন লাভ তো হয় নি। বরং নিজেরই ক্ষতি হলো। তাই রোদেলা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে এবার আর নিজের সত্তাকে হারাতে দিবে না। আর না হারাতে দিবে তার ভালোবাসাকে। একবার ভুল করেছে, দ্বিতীয়বার কোন ক্রমেই আর কোন ভুল করবে না। এতোটাও মহান না সে। 

 

আবেগ খেয়ে-দেয়ে উঠে পড়ে। আবেগ থাকায় রোদেলা ঠিক মতো খেতে পারে নি। আবেগ চলে যাওয়ার পর সে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়৷ 

 

দুপুরে রুমে এসে আবেগ সমুদ্রের পাশে শুয়ে পড়ে৷ 

 

সমুদ্র জেগে ছিল। আবেগ সমুদ্রের গা ঘেষে শুয়ে সমুদ্রের গায়ে ঠিক মতো কম্বল দিয়ে দিল। এখানে বেশ শীত পড়ে গেছে। সমুদ্র তাকে দেখে হাসি দিল। আবেগ হেসে সমুদ্র কে আদর করে বলে, আব্বাহুজুর! 

 

সমুদ্র এই এতো কম দিনেই বুঝে গেছে তার বাবা তাকে আব্বাহুজুর নামে ডাকে। তাই তো এই ডাক কানে আসলেই চোখ  বড় বড় মনি দুটি আশেপাশে ঘুরায় আর দাত ছাড়া মুখে ফোকলা হাসি দেয়। 

 

আবেগ সমুদ্রকে চুমু খেয়ে পাশে শুয়ে পড়ল। এই হাসির মাঝে একটা ম্যাজিক আছে তা হলো সমুদ্রের মন ভুলানোর হাসি দেখলে কেউ তার রেগে কিংবা মন খারাপ করে থাকতে পারবে না। 

 

বেশ জমিয়ে একটা ভুড়িভোজ হয়েছে। আবেগের আপনা আপনি চোখ লেগে আসছে। আবেগ ও একটা ভাত ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। পাতলা কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুম দিল। 

 

আসরের আযানের পর পর রোদেলা রুমে ঢুকল। আবেগ আর সমুদ্র কে পাশাপাশি শুয়ে থাকতে দেখে তার নয়ন জুড়িয়ে গেল। সে মুচকি হেসে সমুদ্রের পাশে শুয়ে পড়ে। নামাজ পড়া হয়ে গেছে তার। এখন একটু খাওয়াবে সমুদ্র কে। 

 

কারো মৃস্যু স্বর কানে ভেসে আসতেই আবেগের ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ বন্ধ করেই আছে। আলসেমির জন্য চোখ খুলছে না৷ কিন্তু কন্ঠটা পরিচিত হওয়ায় সে চোখ খুলে সমুদ্রের দিকে পাশ ফিরল। 

 

আবেগ দেখতে পেল রোদেলা সমুদ্র কে তার পায়ের উপর শুইয়ে পা দোলাচ্ছে আর কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে৷ 

 

রোদেলা আদরমাখা কন্ঠে সমুদ্র কে শোনাচ্ছে,

 

খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো

               বর্গী এলো দেশে । 

      বুলবুলিতে ধান খেয়েছে 

খাজনা দিব কিসে? 

ধান ফুরুলো, পান ফুরুলো 

খাজনার উপায় কি? 

আর কটা দিন সবুর কর

রসুন বুনেছি। 

 

আবেগ হতবিহ্বল হয়ে রোদেলা আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে  থাকল। তার মুখে অটোমেটিক্যালি এক ঝিলকে হাসি ফুটে উঠল। মা-ছেলের এই আদরের মূহুর্ত দেখে আবেগের মন সতেজ হয়ে যায়। তার মনে হচ্ছে এই মূহুর্তটা যদি  আটকে রেখে যাওয়া যেত? এমন কিছু কি কোন দিন আবিষ্কার হবে যে সময় কিংবা স্মৃতি আটকে রাখা যাবে? ছবি না ভিডিও না! ব্যস তার জীবনে কেবল এই একই ঘটনা ঘটবে। যদি এমন কিছু উদ্ভাবন করা সম্ভব হয় তাহলে সে এই মূহুর্তের মাঝে এক জীবন পার করে দিতে রাজী আছে! 

 

রোদেলা ছড়া শোনার মাঝে মাঝে তার চুল গুলো ঝারছে। কিঞ্চিৎ ভেজা রোদেলার লম্বা লম্বা চুলগুলো। গোসল করেছে কি কিছুক্ষন আগে রোদেলা? হবে হয়তো নাহলে কি আর চুল ভেজা থাকে। এবারে রোদেলা একটু জোড়ে চুল গুলো ঝাকালো যার দরুন আবেগের মুখে এসে ভীষণ জোড়ে আঘাত করল। আর আবেগ মুখ দিয়ে শব্দ করে। 

 

রোদেল শব্দ পেয়ে পেছন ফেরে। কারন সে যখম রুমে এসে সমুদ্র কোলে নেয় তখন আবেগ ঘুমাচ্ছিল। তাও গভীর ঘুম। এতো জলদি উঠেছে কেন দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই আবেগকে  নিজের থেকে দুই ইঞ্জি দূরে আবিষ্কার করল রোদেলা। 

 

এতো কাছে কেন এসেছে— নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে রোদেলা । তখনো তার ভেজা  চুল গুলো আবেগের মুখে লেপ্টে আছে। 

 

 চুলের ঝাপ্টাটা মুখে জোড়ে লাগলেও আবেগের নাকে যখন চুলের শ্যাম্পুর গন্ধ গেল তখন বেশ ভালো লাগল তার। রোদেলার গা থেকে এই গন্ধ টা মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়৷ সে প্রথমে বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে আর বিরক্ত থাকতে পারল৷ 

 

দ্রুত মুখ থেকে চুল সরিয়ে এক প্রকার ছুড়ে মারে চুল গুলো আবেগ। 

 

রোদেলা তাকে জিজ্ঞেস করল  তোমার কি খুব লেগেছে নাকি? 

 

আবেগ উঠে দাড়িয়ে বলে, তোমার প্রধান কাজ ই তো আমাকে আহত করা! 

 

রোদেলার আবেগের কথা গুলো বোধগম্য হলনা কিন্তু সে কষ্ট পেল। বেশ কষ্ট পেল। এখনি কেদে দিতে মনে চাইতে লাগল। সবসময় আবেগ একটা না একটা ঠেস মারা কথা বলবেই। না বললে তার পেটে ভাত হজম হবে না৷ 

 

রোদেলা ঝাঝালো কন্ঠে বলে, মানে কি বলতে চাইছো তুমি? ক্লিয়ারলি বল। আমি কেন তোমাকে আহত করব? তোমাকে ক্ষতি করে আমার কি লাভ? 

 

–নারীরা লাভ-ক্ষতি বুঝে না। তাও তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে, আমার ক্ষতি করছো এটাই তোমার লাভ। এর চেয়ে বড় লাভ কি কিছু হতে পারে? 

 

রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, থেকে থেকে তোমাকে কি জ্বিন-ট্বিন ধরে নাকি? আবোলতাবোল বকা শুরু করে দাও। 

 

–মেয়ে মানুষ অনেক ক্ষতিকর। এই মেয়ে মানুষের জন্য সভ্যতা পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে৷ হেলেন নামক এক নারীর জন্য পুরা টয় সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে তারপর  বিড়বিড় করে বলে, আমি অলমোস্ট ধ্বংস হতে চলেছি। আমার চেনা শহরটাও ধ্বংস হতে চলল! সব দোষ তোমার! 

 

রোদেলা আবেগের কথা শুনতে পায় নি তাই উঠে দাড়ালো এবং আবেগের সামনে গিয়ে বলে, কি বলতে চাও স্পর্শ ভাবে বল! আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি এটার উত্তর দাও৷ 

 

আবেগ মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল এবং বলল, পারব না উত্তর দিতে। মেয়ে মানুষ অযথা ঝগড়া করে। তিল থেকে তাল না সোজা তাল গাছ বানিয়ে গায়ে পড়ে ঝগড়া করা তাদের স্বভাব। এজন্য আমি। মেয়েদের থেকে দূরে থাকি৷ 

 

বলে হনহন করে চলে গেল রুম ছেড়ে। রোদেলা অবাক নয়নে চেয়ে থেকে কোলে থাকা সমুদ্র কে উদ্দেশ্য করে বলে, মেডিকেলের মোটা মোটা বই পড়তে পড়তে তোর বাবার মাথায় বড় ধরনের সমস্যা হয়ে গেছে রে! 

 

সমুদ্র গভীর মনোযোগ দিয়ে মায়ের কথা শুনতে লাগে। এতে রোদেলা উৎসাহ পেয়ে গেল এবং চিন্তিত গলায় বলে, এখন আমরা কি করব? খুব চিন্তাত বিষয় তো! 

 

আবেগ রুম ছেড়ে বের হতেই ফুফার সামনে পড়ল। উনি জিজ্ঞেস করলেন কিছু খেতে চায় কিনা আবেগ। আবেগ কোন লজ্জা না দেখিয়ে বলল, সে খেজুরের রস খেতে চায়৷ 

 

তালুকদার সাহেব হেসে বলে, কালকে সকালেই আনবে। 

 

তখনি রোদেলা বের হলো। তালুকদার সাহেব বলে, আবেগ কে নিয়ে গ্রাম ঘুরে আসো। ছেলেটা তো গ্রামে আসে না। ঘুরলে মন ভালো হবে। 

 

রোদেলা মাথা ঝাকালো। 

 

অগত্যা রোদেলা আবেগকে নিয়ে গ্রাম ঘুরানোর উদ্দেশ্য হাটা ধরে। সঙ্গে সমুদ্র যায় নি। তালুকদার সাহেব নিতে দেন নি। উনি নাকি নাতির সাথে খেলবেন। রোদেলা ও আর জোর করে নি৷ কিছু ক্ষন নানার সাথে খেলুক সমুদ্র। 

 

★★★

 

কাচা রাস্তা ধরে বেশ কিছুক্ষন ধরেই হাটছে আবেগ রোদেলা। রোদেলা আগে আগে হাটছে। আবেগ পিছে পিছে আসছে। আবেগ আস্তে আস্তে হাটছে। তার মধ্যে কোন তাড়া নেই। চারপাশ দেখছে আর হাটছে৷ 

 

গ্রামটা খুব একটা বড় না সম্ভবত। যদিও বা গ্রাম আকারে ছোট ই হয়! তবুও সুন্দর। ছিমছাম। কয়েকটা পাকা বাড়ি কিন্তু সব একতলা। দোতলা কোন বাড়ি চোখে পড়ে নি এখনো। এছাড়া মাটির ঘর ও দেখতে পেল। সে বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখছে। মাটির ঘর উপরে টিনের চালা। একদম ছবি আকার সময় যেমনটা আকা হয় ঠিক সেরকম। হঠাৎ হঠাৎ গরু বেধে রাখা। অনেক পল একজোট করে রাখা। সেখান থেকে গরু-ছাগল পল, ঘাস ইত্যাদি খাচ্ছে। 

 

রোদেলা খালি পায়ে হাটছে। তার মধ্যে এখন বুঝি কোন কিশোরীর আত্মা ভর করেছে। হুটহাট করে একটু দৌড় দিচ্ছে কিন্তু বেশিদূর দৌড়াতে পারছে না। আবেগ ধমকে উঠছে বিধায় থেমে যেতে হচ্ছে তাকে। 

 

তারা বিলের ধারে চলে আসল। রোদেলা বিল দেখাতেই এসেছে আবেগকে। এই বিলটা তাদের। মাছ চাষ করা হয়। বিলের দুই ধারে গাছ দিয়ে ভরা। কলা গাছ, আম গাছ, টমেটো গাছ, জামরুল গাছ, ফুলকপির গাছ, মুলা, জলপাই গাছে। বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির গাছ। যদিও বা গ্রামে তো গাছ লাগাতে হয় না, ,নিজে নিজেই উঠে,,বেশির ভাগই ফলহীন গাছ মানে গ্রামের মানুষ সেই সব গাছকে “মেলেরিয়া গাছ বলে থাকে” এগুলো পুকুরের পাশে উঠে।

 

বিল ধারে এসে থামল রোদেলা। আবেগ ও থেমে যায়। পানি নেই বললেই চলে বিলে৷ 

 

আবেগ মুগ্ধ হয়ে বিলের স্বচ্ছ পানি দেখছে। পানিতে রোদেলার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। বিলের এক পাশ থেকে আরেকপাশে ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে আর ডাকছে৷ 

 

বিলের গা ঘেষে কয়েকটা মৃতপ্রায় কচুরিপানা ভেসে আছে। আবেগ যা বুঝল তা হলো গ্রাম কিংবা বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কোন ধারনা ই নেই। নিজেকে অন্য জগতের বাসিন্দা মনে হচ্ছে। 

 

তবে সে রোদেলার প্রতিবিম্ব এর দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। দমকা হাওয়া মাঝে মাঝে বয়ে আসছে আর তাতে প্রান জুড়িয়ে যাচ্ছে৷ 

 

রোদেলা বলল, চল ওই পাশে যাই৷ 

 

–আচ্ছা৷ 

 

রোদেলা আগাচ্ছে। সেই সাথে আবেগ ও। ধান খেত পার হলো। ধান খেতে আর ধান নেই৷ কাটা শেষ হয়ে গেছে। গুটি কয়েক মানুষ সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। 

 

তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সামনে পা বাড়ালো আবেগ। 

 

আলুর খেতে চলে এসেছে তারা। দুই পাশে আলুর খেত৷ মাঝ খান দিয়ে আইল বানানো হয়েছে৷ তাও কিছুক্ষন আগে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হওয়ায় সেই রাস্তা ভেজা। কাদা কাদা। 

 

রোদেলা চিকন সেই রাস্তা ধরে আগালো সামনের দিকে।  দুই ধারে আলুর খেত আর মাঝে চিকন সরু মাটি দিয়ে উচু করে বানানো রাস্তা। আবেগ যেই না পা দিবে সে টের পেল নরম কিছুর উপর পা লেগেছে৷ 

 

নিচে তাকাতেই গন্ধ পেল। নাক কুচকে গেল তার। গোবরে পারা দিয়ে ফেলেছে আবেগ৷ 

 

অথচ এই রাস্তা দিয়ে মাত্র রোদেলা গেল। কিন্তু রোদেলার পায়ে গোবর লাগলো না। তার পায়েই লাগতে হলো। আবেগ কোন মতে পা ঘাসের মধ্যে মুছে চিকন রাস্তা ধরে হাটা ধরল । বেশ বিরক্ত সে। গোবরে পারা কেন যে  সে দিল? তার জায়গায় রোদেলাক গোবরে পা দিতে পারত কিন্তু না তাকেই দিতে হলো গোবরে পারা। আশ্চর্য! এটা কি ঠিক? 

 

আবেগ কাদা। মাখা চিকন রাস্তায় পা দিতেই বুঝল এটা ভেরি ডেঞ্জারাস রাস্তা। কাদা কাদা হওয়ার পা ফেলা দুষ্কর। সেই সাথে জুতা পড়ায় পায়ের সাথে কাদা আটকে যাচ্ছে। বলতে গেলে বড়সড় বিপদে পড়ে গেল আবেগ৷ 

 

আইলের মধ্যে অনেক বাচ্চা-কাচ্চা লাফিয়ে হাটছে৷ এদিকে আবেগ আস্তে হেটেও কুল পাচ্ছে না৷ 

 

রোদেলা তরতর করে হেটে যাচ্ছে। মাঝখানে আসার পর রোদেলা হাটার বেগ বাড়ালে আবেগ আবারো ধমক দিয়ে বলে, আস্তে হাটো পড়ে যাবে নয়তো। 

 

রোদেলা পেছনে ঘুরল। তাকে দেখে আবেগ হা হয়ে যায়৷ রোদেলাকে নির্ঘাত প্রকৃতির কন্যা মনে হচ্ছে! 

 

সে রোদেলার দিকে তাকিয়ে  থেকেই পা বাড়িয়ে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে পড়ে গেল খেতের মধ্যে  । আবেগ বুঝতে পারল না কি ঘটে গেল। 

 

শুধু বিড়বিড় করে বলে, আমি কি রোদেলার প্রেমে খালে পড়ে গেলাম? 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–24

#Arishan_Nur

 

রোদেলার খিলখিল হাসির শব্দে আবেগের ভাবনার অবসান ঘটলো। তার বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে একচুলি কি হয়ে গেল তার সাথে সেটা বুঝতে ৷ 

 

আবেগ বিভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকায়।  সে আলু খেতে পড়ে গেছে। বেশ কিছু গাছ তার গায়ের নিচে চাপা খেয়ে হয়তোবা নষ্ট হয়ে গেছে। তার জামা-কাপড়ে, হাত-পায়ে, মুখে কাদার মাখামাখি। কি একটা অবস্থা! 

 

চারপাশে মানুষ জোরো হয়ে গেছে। ছোট ছোট বাচ্চারা লাফাচ্ছে আর হাসাহাসি করছে তাকে দেখে কিন্তু ওদের সবার থেকে রোদেলার হাসির শব্দ বেশি তীক্ষ্ম প্লাস জোড়ে তার কানে ভাসছে৷ 

 

আবেগ রেগে গিয়ে রোদেলার দিকে ছোট ছোট চোখে তাকালোও, রোদেলাকে দেখা মাত্র তার রাগ ধপ করে পড়ে গেল৷ 

 

কি মায়াবী চেহারা। রোদেলার অট্টহাসি দেখে  সারা গ্রাম ও হেসে উঠছে। অদ্ভুত মায়া কাজ করছে রোদেলার উপর! 

 

রোদেলা কে অনেক দিন পর এমন প্রান খুলে হাসতে দেখে আর কিছুতেই রেগে থাকতে পারল না আবেগ।  রাগ গুলো কার্পূরের মতো উড়ে পালালো। 

 

কয়েকটি লোক এসে তাকে তুলে দাড়াতে সাহায্য করল। 

 

একজন জিজ্ঞেস করে, ডাক্তার সাব বেশি লাগছে নাকি? 

 

আবেগের  ভ্রু কুচকে গেল। এই লোক কিভাবে জানল সে ডাক্তার? 

 

সে প্রতিউত্তরে বলে, হাতে সামান্য লেগেছে৷ 

 

রোদেলা আবেগের সামনে আসতেই আবেগ রাগ দেখিয়ে বলল, এখন কেন আসলা? আরো হাসো না। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাও। খবরদার আমার সামনে আসবে না৷ 

 

বলে সামনে পা বাড়ালো। হাত দিয়ে জামা-কাপড়, মুখের কাদা মুছতে মুছতে সে হনহন করে আগাতে লাগে৷ 

 

হুট করেই তার রাগ লাগছে। খুব রাগ লাগছে। আসলে রাগ ব্যাপার টাই এমন। 

 

রাগ হুট করে আসবে, হুট করে পালিয়ে যাব! 

 

সে বড় বড় পা করে আগাচ্ছে।বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গেল সে।  কিন্তু কোন দিকে যাবে বা যাওয়া দরকার তা তো জানে না! রোদেলাদের বাসা কোন দিকে বা কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হয় সেটা অজানা আবেগের।

 

তাই পেছনে তাকালো সে। আর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।  রোদেলা তার পেছনে গুটিগুটি পায়ে আসছে। মাথা নিচু৷ সম্ভবত একটু পর পর ঠোঁট  চেপে হাসছে। 

 

আবেগ দাঁড়িয়ে গেল এবং রাগী গলায় বলে, তুমি আমার পিছনে আসছো কেন? 

 

রোদেলা মাথা নিচু থেকে মাথা উঠালো এবং আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি ভুল রাস্তায় চলে এসেছো। এইদিক দিয়ে গন্তব্যে যাওয়া যায় না। 

 

আবেগ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, গন্তব্যের উদ্দেশ্য ই তো হারিয়ে ফেলেছি। যার কোন গন্তব্যই নেই তার আবার যাত্রাপথ! হুহ৷ 

 

রোদেলা নিষ্পলক নয়নে আবেগের দিকে তাকালো। সেই সময় আবেগের ফোনে কল আসে৷ 

 

আবেগ পকেট থেকে ফোন বের করতেই স্ক্রিনে নেহা নাম ভেসে উঠে। আবগ অপ্রস্তুত হয়ে যায় এবং রোদেলার দিকে তাকায়। ফোন বেজেই যাচ্ছে। সে কি করবে বা করা উচিত তা তার জানা নেই। 

 

রোদেলা করুন গলায় বলে, ফোনটা ধরো৷ আমি ওই দিকে গিয়ে দাড়াচ্ছি। তোমরা কথা বলো৷ 

 

আবেগ রোদেলার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ফোন ধরে। 

 

ওপাশ থেকে নেহা বলে উঠে, কেমন আছো? 

 

প্রতিউত্তরে আবেগ স্বল্প ভাষায় বলল, ভালো।

 

তারপর উভয় পাশে নিরবতা। নিরবতা কাটিয়ে নেহা বলে উঠে, 

 

–আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না? 

 

–নাহ। 

 

–কেন? 

 

–এম্নি। মন চাচ্ছে না৷ 

 

নেহা শব্দ করে হেসে বলে, তুমি কবে থেকে মনের কথা শোনা শুরু করলে? 

 

আবেগ চমকে উঠে। তাই তো! হুট করে মনের আদেশ মানা শুরু করল কেন সে? 

 

সে মিনমিনে আওয়াজে বলে, কেমন আছো রোদেলা? 

 

তারপর এক সেকেন্ড থেমে বলে, সর‍্যি। সর‍্যি। নেহা৷ হুট করে এই ভুল কেন সে করে বসল নিজেও জানে না৷ 

 

নেহা আবারো শব্দ হেসে দেয় আর বলে, বাহ! দুইদিন বউয়ের সাথে থেকে আমার নাম পর্যন্ত ভুলে গেলে। এতো স্বার্থপর কেন তুমি?

 

আবেগ কিছু না বলে চুপ থাকে। কিন্তু কি আশ্চর্য! এই হাসির শব্দ অবিকল রোদেলার হাসির মতো। কোন হেরফের নেই এতে। নাকি সে ভুল শুনছে৷ আবেগের এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে সে শুন্য অবস্থায় করছে। মাথা ভারী লাগছে আর দেহ হাল্কা। খুব হালকা। একদম উড়ে যাওয়ার মতো হালকা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগে। পিপাসায় মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।  

 

ওপাশে থেকে কি বলছে কানে যাচ্ছে না আবেগের। 

 

সে চোখ ঘুরিয়ে রোদেলার দিকে তাকালো। সে কি! রোদেলার পরনে শাড়ি! কিছুক্ষন আগেই না দেখল সালোয়ার কামিজ পড়া। সব কিছু কেমন তাল-গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তবে কি সে ভুল দেখেছিল? নাকি এখন ভুল দেখছে? কেমন ধোয়াশে লাগছে সব কিছু! 

 

মেয়েটার তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি দেখছে মেয়েটা? তার দিকেই তো তাকিয়ে আছে বুঝি! কিন্তু কেন?

 

তার কানে ভোভো শব্দ আসতে লাগলো। চোখে ধাপসা দেখতে লাগলো সে। এক সময় সব শুন্য, সব অন্ধকার দেখল আবেগ। 

 

রোদেলা আবেগের দিকেই তাকিয়ে ছিল। দূরে সরে এলেও কেন যেন মনে একটা খটকা লাগতে শুরু করে। এক দন্ডের জন্য মনে হলো কেন দূরে সরে এলো সে? সেখানে থেকে তাদের কথোপকথন শুনলেই ভালো হত! আফসোস হতে লাগলো। তার মনে হচ্ছিল সে আবেগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এসব ছাইপাঁশ ভাবতে না ভাবতেই রোদেলা চিৎকার করে উঠে। 

 

আবেগ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেল। 

 

রোদেলা এক দৌড়ে আবেগের কাছে ছুটে যায় এবং হাটু গেড়ে বসে, আবেগের মাথা নিজের কোলে এনে তাকে ডাকতে লাগে৷ 

 

কিন্তু আবেগ নির্বিকার। রোদেলা চোখের পানি ফেলে দিল। হুট করে কি হলো আবেগের? কিছুক্ষন আগেও তো সুস্থ ছিল! 

 

তখনো লাইনে নেহা আবেগের উত্তরের প্রত্যাশায় রয়ে বসে ছিল। 

 

★★★

 

–এভাবে রাস্তায় বেখেয়ালি ভাবে হাটার মানে কি অথৈ? 

 

অথৈ মেঘের কাছ থেকে সরে এসে বলে, আমার ইচ্ছা৷ 

 

–তোমার ইচ্ছায় সব হবে না! (রাগী গলায়)

 

এইকথাটা মাথায় গিয়ে ঠেকল অথৈয়ের। আসলেই তো তার ইচ্ছা, আশা, স্বপ্ন কোন কিছুর ই মূল্য নেই৷ 

 

সে মাথা নিচু করে ফেলে। 

 

মেঘ কর্কষ কন্ঠে বলে, আমি না আসলে কি হতে পারত এখন? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? 

 

অথৈ নির্লিপ্ত গলায় বলে, কি আর হত? মরে যেতাম। তার চেয়ে বেশি কিছু কি হওয়ার আছে? 

 

মেঘের প্রচুর রাগ উঠে গেল। মাথার রক্ত টগবগ করতে লাগলো। এই মূহুর্তে অথৈকে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারতে মন চাচ্ছে। এই মেয়ের সাহস কি করে হয় মরার কথা মুখে আনার? সে কি জানে না “তার সুখে থাকার উপর ই মেঘের শান্তি তে থাকা নির্ভর করে “সেটা যে কারো সাথেই হোক না কেন! তবুও সুখে থাকুক এই প্রার্থনা করে মেঘ। 

 

যেহুতু অথৈয়ের উপর আর কোন অধিকার নেই তার। তাই কিছু বলল না। নিজের রাগ,দুঃখ, অভিমানকে চেপে রেখে মেঘ যেকোন অপরিচিত পথিকের ন্যায় আচরণ করে বলে, একটা রিকশা ঠিক কিরে দিচ্ছি। বাসায় চলে যাও। 

 

অথৈ কিছু বলল না। তাকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ রিকশা ডেকে আনল। 

 

অথৈ উঠে বসলে, মেঘ রিকশা ভাড়া দিয়ে দেয় এবং অথৈয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল এবং বলল, তোমার নতুন জীবনের জন্য রইল অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার তাই না? বুয়েট থেকে পাশ করেছে। ফয়সাল নাম। 

 

অথৈ চমকে গেল। মেঘ জানে ফয়সালের ব্যাপারে? জানে তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? এতো কিছু জানতে পারল অথচ এটা জানতে পারল না? সে একটা কাঠপুতুল! যার নিজের কোন ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই।

 

” আরেকটু খোজ লাগাতে, তাহলে হয়তো অনেক না বলা কথা জানতে পারতে “মনে মনে বলে উঠে অথৈ। 

 

মেঘ রিকশা ওয়ালাকে বলে, সামনে আগান। আর সাবধানে নিয়ে যাইয়েন।  

 

রিকশাওয়ালা মেঘের কথা শোনামাত্র শো শো করে খুব দ্রুত গাড়ি আগাতে লাগে। 

 

তা দেখে মেঘ মুচকি হেসে বলে, এতো তাড়া কিসের? 

 

তখনই মেঘের চোখের কোনের অশ্রুমালা  চিকচিক করে উঠে  সূর্যের কিরনে। 

 

কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, জগতে সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য কোনটা? 

 

মেঘ বলে দিত, চোখে পানি কিন্তু মুখে হাসি —সবচেয়ে, সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য এই বিশ্বব্রাহ্মণে। 

 

এই দৃশ্যের দিকে তাকালো যায় না। এই দৃশ্যের মাঝে প্রকৃতি বিপদের সতকবার্তা দিয়ে রেখেছে। এজন্য কেউ ই  এই দিকে  আসে না। কিন্তু ভুলে হাতে-গোনা কয়েকজন চলে আসে তার মতো! 

 

★★★

 

রিশাদের চোখে ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ করেও ঘুম নেই চোখে। 

 

সে মনে মনে বলে, ইশ! কি দেখিলাম ইহা আমি! আর তো চোখে ঘুম আসে না৷ হাহা করে হেসে সে উঠে বসল। 

 

তারপর ফোন বের করে এবং ইভানার অজান্তেই তোলা ছবিটার দিকে তাকালো। এরপর রোদেলার একটা ছবি এলবাম থেকে বের করে। দুইটা ছবি পাশাপাশি রেখে সে কুৎসিত হাসি হেসে বলে, ড.ইশরাক রহমান! আমার থেকে আমার বউকে কেড়ে নিয়েছিস তুই! তোকে কি করে এতো সুখে থাকতে দিই  আমি?বল? আমার বউকে নিজের বউ বানায় এখন তুই আরামে সংসার করবি তাতো হয় না! ইহা মেনে নেওয়া যায় না। এখন তোর সাথে যা করব তুই ভাবতেও পারবি না! আমি চাইলেই তোর পরিবারের উপর এই মূহুর্তে আক্রমণ করতে পারি কিন্তু আমার রোদেলাকেই চাই। 

 

রিশাদ রোদেলার ছবির দিকে তাকিয়ে বলে, ইশ কি মারাত্মক তোমার হাসি! তোমার এই রুপ আগে কেন চোখে পড়ল না? 

 

রিশাদ বিছানায় হেলান দিল এবং ভাবতে লাগলো, তার আর রোদেলার বিয়ের সম্ভবত এক বছর ও হয় নি। এতেই তার রোদেলার উপর বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। পুরাতন মনে হতে লাগলো। পানসে লাগতে লাগে! রুপ আর চোখে পড়ে নি। এর উপর ছিল রোদেলার চিল্লাচিল্লি! প্রতিদিন নেশা করার জন্য রোদেলা তার সাথে ঝগড়া করত। রিশাদ ও কম না। ইচ্ছা মতো পেটাত রোদেলাকে। বিয়ের তিন মাসের মধ্যে রোদেলার রুপ কমে যেতে লাগলো। সুন্দর মুখশ্রীতে দাগ, রক্ত, ঘা, পুচ, লাল ফুলে যাওয়া গাল,ঠোঁট কেটে যাওয়ার মতো বিশ্রি জিনিস দেখলেই রিশাদের মেজাজ চটে যেত। মেয়েটা আর আগের মতো সুন্দর ছিল না। কেমন কালো হয়ে গিয়েছিল।চোখের নিচে কালি। রোগা-রোগা ভাব চলে আসায় বিতৃষ্ণা চলে আসে রোদেলার উপর। তাই তো  অন্য মেয়েদের আনাগোনা দেখা দিতে লাগলো। রিশাদের বেড রুমে। 

 

এমনি রিশাদের এক মেয়ে বারবার ভালো লাগে না তাই তো রোদেলা কে ছুড়ে ফেলে। ঠিক তখন ই এমপি সাহেবের মেয়ের সাথে প্রেম করা শুরু করে। ওই মেয়ের সাথে বিয়েও ঠিক হয়। মেয়েটার বাবা কথা দেয় রিশাদকেও এমপি বানাবে। কিন্তু রোদেলা প্রেগন্যান্ট হওয়ায় সব ভেস্তে গেল৷  

 

কিন্তু এখন রোদেলাকে তার হুরের মতো সুন্দরী লাগছে৷ কি মিস্টি হাসি তার! উফ! সোজা বুকে গিয়ে বিধে। এই মেয়েকে তার চাই-ই-চাই। ভোগ করার জন্য হলেও আবারো চাই তার! সঙ্গে যদি হবু ডাক্তারনীকে পাওয়া যায়। ক্ষতি কি? এক ঢিলে দুই পাখি পাবে সে। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–25

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

মাথার পাশে রোদেলাকে বসে মুখ চেপে কাদতে দেখল আবেগ। বাইরে থেকে বৃষ্টির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের পোকার ডাকার শব্দ। আবেগ খেয়াল করে রোদেলা বেশ শব্দ করেই কাদছে৷ কেন কাদছে তা সম্পর্কে অবগত না আবেগ। সে বোঝার চেষ্টা করছে সে এখন কোথায়। কিন্তু সেটাতেও সক্ষম হচ্ছে না৷ কিছু মনেই পড়ছে না তার৷ কি হয়েছিল কিছু ই মনে পড়ছে না এই মূহুর্তে তার। 

 

আবেগকে চোখ খুলতে দেখে রোদেলা কান্না থামিয়ে দিল এবং তার মাথার কাছ থেকে সরে মুখের কাছে এসে বলে, এখন কেমন লাগছে? 

 

আবেগের কানে রোদেলার বলা কথাগুলো ঝনঝন করে বাজলো। তখনি আবেগ উপলব্ধি করে তার মাথার পেছনে ভীষণ ব্যথা৷ সে মাথায় হাত রাখতে ই বুঝল মাথার পেছনে ব্যান্ডেজ৷ 

 

সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকালো। 

 

রোদেলা কান্না মিশ্রিত গলায় বলে, তুমি অজ্ঞান হয়ে মাটতে পড়ে গিয়েছিলে তখন মাথায় আঘাত পেয়েছো। ডাক্তার চাচা এসে দেখে গেছে তোমাকে। উনিই ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। তোমার নাকি সুগার লেভেল লো৷ 

 

–সম্ভবত। 

 

রোদেলা কান্না করতে লাগলো। 

 

এতে বিরক্ত হয় আবেগ৷ সে কঠিন গলায় বলে, কান্না থামাও তো। কাদার কি আছে? অসহ্য লাগে এই ম্যা ম্যা করে কান্নার আওয়াজ। 

 

রোদেলা কান্না থামিয়ে অবাক নয়নে কিছুক্ষন আবেগের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠে, এই অবস্থায় ও কাকের মতা করে  কথা বলাটা কি খুব জরুরি আবেগ?  

 

আবেগ চমকে উঠে। এই প্রথম রোদেলা তার নাম ধরে ডাকছে। নাকি এর আগেও ডেকেছে। ডেকেছে হয়তোবা কিন্তু সে খেয়াল করেনি। 

 

যাইহোক আবেগের রোদেলার কথা শুনে খুব করে বলতে মন চাচ্ছে, কথা বলতে তো চাই অত্যন্ত মিস্টি গলায় কিন্তু কথা বলতে গেলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলার স্বর কাকের মতো কর্কষ হয়ে উঠে। এখানে আমি কি করতে পারি? 

 

রোদেলা আবেগের কপালে হাত রেখে বলে, একটু গা গরম করেছে। ডাক্তার চাচা বলল, নতুন জায়গা জন্য এমনটা হয়েছে৷ 

 

আবেগ জিজ্ঞেস করল।,এই ডাক্তার চাচা কি হাতুড়ে ডাক্তার? নাকি এমবিবিএস? 

 

–এমবিবিএস। আমাদের গ্রামের প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার। 

 

–ও। 

 

–তোমার জন্য বাবা খেজুরের রস এনেছে। আমি এনে দিচ্ছি। অপেক্ষা করো। 

 

আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। ঘন সন্ধ্যার আধারে রোদেলার নাক ফুল ঝিলিক মেরে উঠছে। আবেগের আবারো জানতে মন চাইলো, রোদেলা কবে নাকি ফুরিয়েছ? 

 

রোদেলা উঠে যাওয়ার সাথে সাথে আবেগের ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। সে আশেপাশে তাকালো। কোথায় এক ফোটা আলো নেই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে৷ ঝুমঝুম শব্দ তার কানে এসে বাজছে। সে চোখ বুজে ফেলে। গা থেকে থেকে কাপুনি দিয়ে উঠছে৷ এই মূহুর্তে যদি একটা কাথা বা কম্বল গায়ে জড়ানো যেত খুব আরাম পেত। উঠে গিয়ে কি কম্বলের খোজ করবে? এই বিছানায় ই তো একটা কম্বল ছিল । সেটা কোথায় গেল? আর এই অবেলায় বৃষ্টি কেন হচ্ছে? ষড়ঋতু রচনায় তো পড়েছে আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস বৃষ্টির মাস। তো এখন কেন বৃষ্টি হচ্ছে? আচ্ছা এটা বাংলা কি মাস? নভেম্বর এর ২৪ তারিখে বাংলা কোন মাসের অন্তর্ভুক্ত তা জানা নেই আবেগের! রোদেলা কে জিজ্ঞেস করবে। যদি সে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে তবে তাকে একটা চমৎকার উপহার দিবে। এবং উপহারে রোদেলা যা চাইবে তাই দেওয়া হবে৷।

 

রোদেলা রুমে আসল। সঙ্গে কোলে সমুদ্র কে নিয়ে। আর আরেক হাতে গ্লাস। 

 

আবেগ উঠে বসল। রোদেলা তার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিল। অন্ধকার থাকায় খেজুরের রস কি রঙের তা দেখতে পারেনা আবেগ। 

 

সে চুমুক দিল। মিস্টি খেতে। যদিও বা সে জানত খেজুরের রস খেতে মিস্টি। কিছুটা ডাবের পানির মতো লাগছে তার কাছে৷ কিন্তু ডাবের পানির  চেয়ে বেশি মিস্টি আর ঘনত্ব ও বেশি৷ 

 

সে ছোট ছোট চুমুক দিতে লাগে৷ জ্বর মুখে খেজুরের রস খেতে দারুণ লাগছে। আবেগের মনে হচ্ছে তার জ্বর এসে ভালোই হয়েছে৷ খেজুরের রসের ফ্লেভারটা বেশি উপভোগ করতে পারছে৷ অন্য সময় হলে এতোটা মজা পেত না। 

 

সে রোদেলা কে এক নজরে দেখে নিয়ে বলে, তোমাকে দুইটা প্রশ্ন করব। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই দিব৷ 

 

রোদেলা ভ্রু কুচকে বলে, যা চাব তাই দিবে? 

 

–ইয়েস। 

 

–সত্যি তো? 

 

–ইশরাক রহমান মিথ্যা বলে না৷ 

 

–প্রশ্ন করো। দেখি পারি কিনা। 

 

আবেগ নির্লিপ্ত গলায় বলে, নাক কবে ফুরিয়েছো? 

 

রোদেলা এক দন্ড ভেবে বলে, অনেক আগেই। 

 

–সেই অনেক আগেটা কবে? 

 

–আ,,,আ,ভার্সিটি সেকেন্ড ইয়ারে মেবি। হুট করে ঝোক উঠল নাক ফুটা করব। আমি আর আমার ফ্রেন্ড দিলে রুপসি পার্লার থেকে নাক ফুটা করে আসি। তারপর রাতে কি ব্যথা উঠল৷ লাল হয়ে গেল। পুচ জমে গিয়েছিল। তুমিই না মেডিসিন লিখে দিয়েছিলে। ভুলে গেছো? 

 

আবেগ ভ্রু কুচকে বলে, আমি ঔষধ প্রেস্ক্রাইব করেছিলাম? 

 

রোদেলা মাথা নেড়ে বলে, হু। সেফ থ্রি৷ ২০০ এমজি। চব্বিশ ঘন্টায় একটা করে তিন দিন খেয়েই ব্যথা চলে গিয়েছিল। 

 

–ভালো। 

 

–এবার সেকেন্ড কোয়েস্টেনটা করো? 

 

–আজকে কয় তারিখ? 

 

এটা ছিল প্রশ্ন? ২৪ তারিখ। 

 

–মাস? 

 

–নভেম্বর৷

 

–উহু। বাংলা কত তারিখ আর কি মাস? 

 

–ও। ৯ই অগ্রহায়ন, ১৪২৭। হেমন্তকাল। 

 

–ওহ৷ 

 

–উত্তর টা কিন্তু পেরেছি। 

 

–বল কি চাও? 

 

রোদেলা এক দন্ড ভেবে বলে, খাওয়া হয়েছে তোমার? 

 

–হু৷ 

 

— কেমন লাগলো? 

 

–খুব মজা। ভাবছি যাওয়ার সময় দুই লিটারের দুটা বোতলে ভরে ঢাকা নিয়ে যাব৷ 

 

রোদেলা জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো এবং জানালা খুলে দিল। সাথে সাথে রুমে হিম শীতল হাওয়া বইতে লাগলো। পুরো রুম বরফ ঠান্ডা হতে লাগলো। আবেগের মনে হতে লাগে সে নরওয়েতে প্রবেশ করে ফেলেছে৷ 

 

রোদেলা এই ঠান্ডা হাওয়ায় মধ্যে ই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ঝাপ্টা লাগছে তার। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা। চারপাশে থেকে ঝিঝি পোকা ডাকছে৷ 

 

রোদেলা নিরবতা ঠেলে কনকনে আওয়াজে বলে, ঢাকায় নিয়ে গেলে খেজুরের রসের স্বাদ বিদঘুটে লাগবে। ওইখানে বসে যদি খেজুরের রস খাও মনে হবে তিতা করলার রস খাচ্ছো। ঢাকা শহরে খেজুরের রস মানায় না। ওখানে ওরিও শেক বা নিউট্রেলা শেক মানায়। 

 

রোদেলার কণ্ঠে এক অদ্ভুত মাদকতা খুজে পায় আবেগ৷ রোদেলার কথা শতভাগ ঠিক। এই মেয়েটা বুদ্ধিমতী। বেশ সুক্ষ্ম চিন্তা-ভাবনা তার। 

 

 সমুদ্রের গায়ে কম্বল দিতে দিতে বলে, জানালা বন্ধ করে দাও শীত লাগছে তো। 

 

বোধহয় রোদেলা আবেগের কথা শুনতে পেল না। সে জানালার শিক ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। 

 

এতে আবেগের মেজাজ কিছুটা হলেও খারাপ হয়। মেয়েটা এতো অবাধ্য কেন? একে তো শীতের রাত। সে আর সমুদ্র তো কম্বলের নিচে। তাদের ঠান্ডা লাগবে না। কিন্তু রোদেলা? তার তো পরনে পাতলা একটা সুতির শাড়ি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। শীতের রাতে বৃষ্টি গায়ে লাগলে আবার জ্বর-ঠান্ডা লাগবে৷ অসুস্থ হয়ে যাবে৷ এম্নিতেই দুই দিন আগেই জ্বর থেকে উঠলো। 

 

সে আবারো রোদেলাকে ডাকল কিন্তু নাহ সাড়া দেয় না রোদেলা। 

 

আবেগ জানালার দিকে তাকালো। কুটকুটে অন্ধকার। কোন কিছু দেখার জো নেই। গ্রামে কারেন্ট থাকে না এই সময়। আজকে বৃষ্টি জন্য নাকি সারা রাত কারেন্ট আসবে না। একটা মোমবাতি জ্বলছে রুমের মধ্যখানের টেবিলে। যেটা মাত্র খেয়াল করে আবেগ৷ 

 

সেই জলন্ত মোমবাতির আলোয় কিঞ্চিৎ রোদেলাকে দেখা যাচ্ছে। চুল গুলো কোমড় পর্যন্ত ছাড়ানো। শাড়ির আচল বাতাসে একটু একটু করে নড়ছে। কেমন অশরীরী ব্যাপার-স্যাপার! 

 

আবেগ ঘাবড়ে গেল। রোদেলাকে ভুতে ধরে নি তো? পরক্ষনে নিজেই নিজেকে  গালি দিল। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এসব কি ভাবছে সে?

 

আবেগ উঠে দাড়ালো। তার নিজের ও শরীর খারাপ। জ্বর বেড়ে গেছে আগের তুলনায়। গা বেশ গরম। সম্ভবত ১০০° এর বেশি জ্বর। 

 

তাও সে জানালার কাছে গিয়ে জোড় করে রোদেলা কে সরিয়ে নেয় এবং জানালা শটাং করে বন্ধ করে৷ 

 

রোদেলা বলল, জানালা বন্ধ কেন করলে? 

 

–ফাইযলামি পেয়েছো তুমি? এখানে কতো ঠান্ডা! সেই খেয়াল আছে তোমার? তাও দাঁড়ায় আছো? 

 

তারপর রোদেলার হাতে হাত দিয়ে কড়া গলায়  বলে, তোমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। চুপচাপ খাটে এসে কম্বলের নিচে শুয়ে গা গরম করো৷ নাহলে এক্ষুনি জ্বর-নিউমোনিয়া বাধাবে তুমি। 

 

তারপর জোড় করে রোদেলাকে বিছানায় শোয়ালো আবেগ৷ মাঝে খানে শুয়ে পড়ে রোদেলা। 

 

রোদেলার বাম পাশে সমুদ্র। সে সমুদ্রের দিকে ফিরে সমুদ্র কে আদর করতে লাগলো । সমুদ্র নিশ্চিত মনে ঘুম। রোদেলা তার ছেলের কপালে চুমু খেয়ে আবেগের দিকে ঘুরে বলে, খুব ঠান্ডা লাগছে এখন। 

 

–আরো দাঁড়ায় থাকো জানালার সামনে৷ 

 

–আবেগ? 

 

আবেগ আবারো চমকে উঠে। তার হাসফাস লাগতে শুরু করে। তাও মুখে বলে, কি? 

 

–তুমি বললে না আমি যা চাইব তা দিবে আমাকে? 

 

–হু। বল কি চাও? 

 

–এখন বলব না। অন্য কোন দিন বলব৷ তবে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না কিন্তু  তখন। 

 

–আচ্ছা৷ 

 

আচ্ছা বললেও আবেগ ভেতরে ভেতরে টেনশন করতে লাগে৷ এমন কি বলতে পারে রোদেলা তাকে? এখনি জানার জন্য মনটা আকুপাকু করছে৷ 

 

রোদেলা কাপা কাপা স্বরে বলে, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারবে? খুব ঠান্ডা লাগছে। কম্বলেও হচ্ছে না। গা থরথর করে কাপছে। 

 

আবেগ জড়িয়ে ধরবে না ধরবে না ভেবেও মনের অজান্তেই রোদেলা কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।  নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। 

 

আবেগের গা তখনো উষ্ণ গরম আর এদিকে রোদেলার গা  যেন বরফ। 

 

পর্দাথ বিজ্ঞানের ক্যালোরিমিতির মূলনীতি বলে, বেশি তাপমাত্রার বস্তু কম তাপমাত্রার বস্তুর কাছে তাপ দিতে থাকবে যতক্ষন পর্যন্ত দুই বস্তুর তাপমাত্রা সমান হয়! উত্তপ্ত বস্তু ঠিক যতটুকু তাপ পরিত্যাগ করবে শীতল বস্তু ঠিক ততোটুকু তাপ গ্রহণ করবে। 

 

এই শীতল বৃষ্টিময় অগ্রহায়ণের মাসে আবেগের গায়ের উষ্ণতা রোদেলাকে উত্তপ করে দেয়। ঠিক ততোক্ষন পর্যন্ত রোদেলা উষ্ণতা  নিতে থাকে  যতক্ষন পর্যন্ত তাদের দুজনের দেহের তাপমাত্রায় সমতা আসে নি। 

 

★★★

 

ইভানা বসে বসে ফোন চালাচ্ছিল। এমন সময় ইমতিয়াজ সাহেব এসে বলে, মারে? তোর কোন কাজ আছে? 

 

–না। কি কাজ থাকবে? কলেজ বন্ধ তো৷ 

 

–চল আমাদের সাথে। ঘুরে আয় কোয়ান্টামে। 

 

–আমি গিয়ে কি করব ওখানে? 

 

–আরে। তোর ভালো লাগবে৷ চল না। বাসায় একা থাকবি নাকি তুই? 

 

ইভানা এক দন্ড ভেবে বলে, তাহলে কিছু খাওয়া তে হবে৷ 

 

ইমতিয়াজ সাহেব বলে, আচ্ছা একটা ম্যাংগো জুস খাওয়াব। আয় তুই। 

 

ইভানা মৃদ্যু হাসল। বাবাও না এখনো ম্যাংগো জুসেই পড়ে আছেন! সেই ক্লাস ওয়ান থেকে স্কুল থেকে বের হয়ে ম্যাংগো জুস কিনে দিতেন৷ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার দিন ও কিনে দিয়েছিলেন। এতো বড় মেয়ে হয়েও ইভানা সেদিন হলের বাইরে স্ট্রতে চুমুক দিয়ে সোসো করে জুস খেয়েছিল। কি অসাধারণ দৃশ্য ছিল! 

 

ইভানা কালো রঙের একট সালোয়ার কামিজ পড়ে বের হলো৷ 

 

আধ ঘন্টা পর তারা পৌছে গেল কোয়ান্টামে। জায়গা টা বেশ পছন্দ হয় ইভানার। সে একটা সিটে বসে পড়ে৷ 

 

কিছুক্ষন পর একটা ছেলে আসে। সাদা শার্ট পড়া৷ তাকে দেখে সবাই এক গাল হাসি দেয়৷ ছেলেটাও মুচকি হেসে ডায়াসের উপরে উঠে। 

 

কিন্তু ইভানা! সাদা শার্ট পড়া ছেলেটাকে দেখেই হার্টবিট মিস হয়ে যায় তার।  নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় সে। 

 

কি একটা অবস্থা! প্রেমে পড়লে কি মানুষ নিশ্বাস নেওয়ার কথাটাও ভুলে-টুলে  যায় নাকি? 

 

চলবে৷ 

 

#অশ্রুমালা 

part–26

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

শৌখিন ডায়াসে মুচকি হেসে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল, জয় ভাই আজকে আসে নি তাই ওনার পরিবর্তে আজকে আমি সেশন নিব। এতে কারো সমস্যা আছে? 

 

অনেকেই বলল যে তাদের কোন সমস্যা নেই৷ 

 

শৌখিনের মনে হলো সে আসায় বেশিরভাগ সদস্য খুশিই হয়েছে৷ তখনো শৌখিন ইভানাকে খেয়াল করে নি৷ আসলে ইভানা মাথা নিচু করে রেখেছে। তাও মাথায় কালো ওড়না দেওয়া। সে লজ্জায় মাথা উঠাতে পারছে না। হুট করে এক রাশ লাজুকলতা তার মধ্যে বিরাজ করতে লাগলো। কেন হঠাৎ তার এতো লজ্জা লাগছে? পেটের মধ্যে সুরসুরি লাগছে ইভানার৷ 

 

ছেলেটা হুয়াইট বোর্ডের দিকে মুখ করে। তখন টুপ করে ইভানা মাথা তুলে তাকালো ছেলেটার দিকে। 

 

ইশ! কতো লম্বা ছেলেটা! চুলে গোছা গোছা চুল! ঝকঝকে শার্ট।পরীর মেল ভার্সন যদি কিছু থেকে থাকে তবে এই ছেলেটাই সেটা! 

 

শৌখিন দুইটা হাড়ির ছবি আকলো। আজকেও সবাই উৎসাহ নিয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। 

 

একটা হাড়ির নিচে লিখলো দুই দানা ভাত আর আরেকটা হাড়ির নিচে লিখে দামি দামি মিস্টি৷ 

 

তারপর বলতে লাগলো, 

 

Always Remember! Life is not a race! Not A Competition that you have to win! 

It’s a journey! Just a beautiful journey! 

 

দিনশেষে তোমার হাঁড়িতে যা আছে সেইটাই তোমার! দুটো চাল থাকলেও  সেটা একান্তই তোমার! 

 

ঠিক তেমনই অন্যের হাঁড়ির দামি জিনিস খানাটাও তোমার না। তুমি চাইলেই তার হাঁড়ি থেকে মিস্টি নিজের পাতে তুলে নিতে পারবে না! 

 

বেলাশেষে অন্যের হাড়ির দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। নিজের যেই দুটো চাল আছে না? সেটা সেদ্ধ করেই খেতে হবে! অন্যের পাতের দিকে নজর না দিয়ে নিজের চাল ভেঙে পিঠা বানানোর একটা ক্ষীণ সম্ভবনা থেকে যায় কিন্তু! কি যায় না? 

 

তাই অন্যের কি আছে -কি নেই তা জানতে গিয়ে নিজের যা আছে আমরা সেইটা ভুলতে বসি! 

 

কার বাড়ি আছে কার গাড়ি আছে কার কতো ব্যাংক ব্যালেন্স আছে তা দেখতে গিয়ে ভুলেই যাই আমার যে একটা বিছানা আছে! সেই বিছানায় নরম একটা তুলার বালিশ আছে। আমি চাইলেই কিন্তু সেই নরম বালিশে মাথা রেখে নিশ্চিতে এক ঘুম ঘুমাতে পারি। কি পারি না? 

 

–নূর।

 

কথার ফাকে ইভানা আর শৌখিনের চোখাচোখি হয়ে গেল। আসলে ইভানা যে তখন মাথা তুলেছিল এর পর আর মাথা নিচু করে নি৷ ইভানা শৌখনের কথার ভীড়ে এতোটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে, সে হা করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তখনি চোখাচোখি হয় দুজনের। বিনিময়ে শৌখিন একটা হাসি দেয়৷ 

 

এই হাসির অর্থ হলো আমি তোমাকে চিনেছি কিংবা চিনি! 

 

ইভানার এই মূহুর্তে মাটির নিচে সাবমেরিন নিয়ে চলে যেতে মন চাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখলে তার বুক ব্যথা করে। আচ্ছ তার কি হার্টে ব্লক ধরা পড়ল নাকি? কি জানি? 

 

শৌখিন আরো কিছু কথা বলে ডায়াসের নিচে নেমে সদস্যের সামনে দাড়িয়ে জাবেদা খাতুন কে উদ্দেশ্য করে বলে, আন্টি ভালো আছেন? 

 

জাবেদা খাতুন একটা মুচকি হাসি হেসে বলে, হ্যা, বাবা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? 

 

শৌখিন বলে, আলহামদুলিল্লাহ। 

 

তখনি ইভানাদের উপর তলার আংকেল বলল, আজকে আমাদেরকে সঙ্গ দিতে একজন ডাক্তার এসেছে। 

 

শৌখিন মুখ ফসকে বলে দেয়, হুম। মিস ইভানা।

 

 

ইভানা চোখ বড় করে তাকায় শৌখিনের দিকে। ছেলেটা তার নাম জানে? ও আল্লাহ! কত লাকি সে! নিশ্চয়ই শায়েরী তার নাম বলেছে। 

 

কিন্তু রহমান সাহেব ভ্রু কুচকে ফেলেন। যতোই উনি মজার মানুষ হন না কেন, তার মেয়ের নাম অন্য কোন ছেলে জানবে আর তিনি চুপ তো থাকতে পারেন না। তাই বলে উঠে, তুমি কিভাবে আমার মেয়ের নাম জানলে? 

 

শৌখিন বিষম খায়। রহমান সাহেবের মেয়ে ইভানা? জানা ছিল না! কিন্তু এখন কি বলবে?কিভাবে রহমান সাহেব কে বলবে কালকে সারা দিন তার মেয়ের গল্প শুনেই পার করেছে সে। 

 

সে আমতাআমতা করে বলে, এন্ট্রির সময় নাম লিখেছিল সেটা আমি দেখেছি। যেহুতু সবাইকে চিনি। ওনার নামটা নিউ ছিল,আননোন লেগেছে আমার  সো নামটা মনে রেখেছি  আমি। আর আমার জানা মতে এখানে কেউ ডাক্তার না।  যেহেতু উনি নিউ এসেছে তাহলে সে ব্যতিত অন্য কারো ডাক্তার হওয়ায় চান্স নেই৷ 

 

সবাই মাথা ঝাকালো। রহমান সাহেব ও ব্যাপার টা বুঝলেন। ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান তোর তো। 

 

একজন শৌখিনকে তার নাম ধরে ডাক দেয় যার দরুন ইভানা জানতে পারল সাদস শার্ট পড়া শায়েরীর ছোটদার নাম হলো শৌখিন। 

 

“ইভানার শৌখিন” এটা বিড়বিড় করে বলে সে নিজেই লজ্জায় লাল হতে লাগলো। এসব কি ভাবছে সে? শৌখিন তার কেন হতে যাবে? 

 

আচ্ছা যদি হয়েও যায় কোন ভাবে তবে কি খুব ক্ষতি হবে?, না মানে তার আর এই সাদা শার্ট পড়া ছেলেটার মিল হলে কি নিউটনের সূত্র ভুল প্রমানিত হবে?

 

★★★

 

আবেগ ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে লাগলো। কালকে রাতে অনেক শান্তি তে ঘুমিয়েছে সে। একবারো জাগনা পায় নি রাতে৷  নিদ্রা ভাব যেতেই সে উপলব্ধি করে তার বুকটা ভারী হয়ে আছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে রোদেলা গুটিসুটি মেরে তার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে৷ 

 

আবেগ ভ্রু কুচকে ফেলে। রোদেলা কেন তার বুকে মাথা রাখবে?

 

পর মূহুর্তে কালকে রাতের কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটার শীত ভাব দূর করার জন্য সে নিজেই  রোদেলাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তবে একান্তই রোদেলার অনুরোধে!।

 

আবেগ উঠে পড়ে। সময় জানান দিচ্ছে এখন পাঁচটা পাচঁ বাজে। আবেগ জানে না ফযরের ওয়াক্ত আছে কিনা? তবুও উঠে রুমের বাইরে গেল। 

 

রুমের বাইরে গিয়ে ই দেখতে পেল ঘন কুয়াশায় সারা জমিন ছেয়ে গেছে৷ সে এই শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানি দিয়েই ওযু করে নিল৷ রোদেলা জেগে থাকলে তাকে গরম পানি করতে বলা যেত। সে ওযু করে নামাজ পড়ে নিল। এরপর বারান্দায় গেল। 

 

বারান্দা থেকে সে গুটগাট শব্দ পেতে লাগল। আবেগের ভ্রু কুচকে গেল। এতো সকালে কোথা থেকে শব্দ আসছে? বাসায় চোর ঢোকেনি তো আবার? কারেন্ট এখনো আসে নি৷ 

 

আবেগ নিজের সন্দেহ দূর করার জন্য আওয়াজ অনুসরণ করে উঠানে গেল এবং দেখল তালুকদার সাহেব ঝুকে কি যেন করছেন। 

 

আবেগ তালুকদার সাহেবকে আওয়াজ দেন। উনি পেচন ঘুরে আবেগকে দেখে একটা হাসি দেন৷ 

 

আবেগ ও বিনিময়ে হেসে বলে, এতো সকালে কি করছেন এখানে? 

 

–উঠান ঝাড় দিই আব্বা৷ প্রতিদিন সকালে ঝাড় দিই আমি। পাতা দিয়ে উঠান ভরে যায়। 

 

আবেগ দেখল উঠানের এক সাইডে এক গুচ্ছ পাতা জমিয়ে রাখা হয়েছে। 

 

আবেগ বলল, ঠান্ডা লাগবে না আপনার? 

 

–না৷ তুমি উঠেছো কেন এতো জলদি? 

 

–ঘুম ভেঙে গেল। 

 

 নামাজে পড়েছে এই কথাটা আগ বাড়িয়ে বলে রিয়া করতে চায় না আবেগ৷ 

 

তালুকদার সাহেব বলে, নামাজ পড়েছো আব্বা? 

 

–জি৷ আপনি? 

 

–আমি মসজিদে গিয়ে পড়ি৷ আমাদের এখানে বিশাল মসজিদ। দুই তলা করা হবে আগামী বছর। এছাড়া টাইলস দিয়ে মেঝে বাধানো। বাথরুমের ব্যবস্থা। সব আছে। 

 

–ও। 

 

–আব্বা শুনো? 

 

–বলেন। 

 

তালুকদার সাহেব অনুরোধের গলায় বলল, আমি আর তোমার ফুফু আর ঢাকা ফিরব না। শেষ বয়সটায় এখানেই থাকব। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। খুব খাটুনি খেটে চাকরি করেছি আর পারি না। শরীরে কুলায় না। মেয়েটার কোন শখ-আল্লাদ আমি পূরণ করতে পারি নি। সেই সার্মথ্য আল্লাহ পাক আমাক্ব দেন নি।যদিও বা আমার মেয়েটার কোন শখ কোন দিন ছিল না। একটা আবদার করেছিল,,,,,,, 

 

তারপর উনি বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে, সেটা পূরণ হলো ঠিকই কিন্তু,,,, 

 

–বাদ দেন এসব কথা। শুনতে ভালো লাগছে না। 

 

উনি জোড় করে একটা শ্বাস নিয়ে করুন গলায় বলে, মেয়েটা আমার খুব আদরের। ওকে সুখে রেখো। আমার মেয়েটা তো তোমার কাছে বেশি কিছু চায় নি। না চেয়েছে সোনা-দানা, কাড়ি কাড়ি টাকা। শুধু একটু ভালোবাসাই চেয়েছিল আমার মেয়েটা। তুমি ওকে হতাশ করোনা। এই ছোট্ট জীবনে বহুত কষ্ট সয়েছে মেয়েটা আমার । 

 

বলতে বলতে তালুকদার সাহেব কেদে দিলেন। আবেগ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কেউ কাদলে তাকে কি বলে সান্ত্বনা দিতে হয় জানা নেই আবেগের। এই মূহুর্তে সে করবে? 

 

তালুকদার সাহেবের সাথে তাল মিলিয়ে কাদবে? ইশ কি ফালতু চিন্তা-ধারা!  

 

আবেগ বলল, আমি চেষ্টা করব৷ 

 

তালুকদার সাহেব বলল, মানুষ চেষ্টা করলে সবই পারে আব্বা। 

 

–হু। আচ্ছা শুনেন ভাবছি আজ রাতের বাসেই ফিরে যাব ঢাকা। 

 

–আজকেই যেতে হবে? কাল-পরশু গেলে হয় না? 

 

–না। কাজ আছে। অন্য কোন সময় এসে লং টাইম থাকব৷ আপনি ও ফুফুকে নিয়ে আসবেন আমাদের বাসায়। 

 

–তা তো অবশ্যই। 

 

আবেগ চলে যাব ওমনি তালুকদার সাহেব আবেগের হাত ধরে বলে, আব্বা! কথা দাও আমার মেয়েটাকে কোন দিন কষ্ট দিবে না? 

 

আবেগ কথা দিল। এতে তালুকদার সাহেবের মুখে প্রশান্তির ছাপ বিরাজ করে। 

 

 আবেগ কথা দিল তালুকদার সাহেবকে যে রোদেলাকে কষ্টে রাখবে না কারন সে জানে রোদেলা কে কষ্ট সে দিবে না। এমনি কি যন্ত্রণা-কষ্টে রাখবে ও না। 

 

কষ্টে রাখা আর সুখে রাখার মাঝে বেশ তফাত আছে! কাউকে খুব সহজেই কষ্টে রাখা যায় কিন্তু সুখে রাখা খুব ডিফিকাল্ট! আবার অপরুপ ভাবে কাউকে কষ্টে না রাখা যত সহজ তার চেয়ে হাজার গুন কঠিন কাউকে সুখে রাখা! 

 

রুমে ঢুকে পড়ে আবেগ। রুমের মধ্যে শীত কম। দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় রুম উষ্ণ।আবেগ গিয়ে রোদেলার পাশে শুয়ে পড়ল। 

 

আগে না বুঝলেও এখন বুঝে রোদেলা মেয়েটা বেশ ঘুম কাতুরে। এই যে আবেগ উঠে গেল কিন্তু টের পায় নি রোদেলা। 

 

আবেগ শুয়ে পড়লেও তার চোখে ঘুম নেই। সে ভাবল সমুদ্র জেগে গেল তার সাথে কিছুক্ষন সময় কাটাবে কিন্তু সমুদ্র ও মায়ের মতো গভীরে ঘুমে আচ্ছন্ন। এখন সমুদ্র মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে শিখে যাচ্ছে।ঘুম থেকে উঠেই কান্না করে। 

 

আবেগ ঘাড় উঠিয়ে সমুদ্র কে দেখে নিয়ে রোদেলার দিকে তাকালো। 

 

তালুকদার সাহেব সঠিক বলেছেন৷ তার একমাত্র কন্যা তার কাছে কিছুই চায় নি শুধু চেয়েছিল ভালোবাসা! যেটা দিতে নারাজ ছিল আবেগ।  মেয়েটা তার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিল কিন্তু দয়া হয় নি আবেগের। 

 

আজো মনে পড়ে আবেগের সেই দিনটার কথা। তখন মাত্র পড়াশোনা শেষ রোদেলার। অর্নাস পাশ করে বের হলো ভার্সিটি থেকে। ব্যস পরিবারের সবাই উঠে-পড়ে লেগে গেল রোদেলার বিয়ে দেওয়ার জন্য। মেয়ের যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে! আরো দেরি করলে দুই বাচ্চার বাপ ছাড়া কেউ নাকি বিয়ে করবে না। এ দেশে অর্নাস পাশ করা মেয়ে নাকি মেয়ে না বরং মহিলা! 

 

যাইহোক তিন-চারটা পাত্র দেখার পর রোদেলা সবার সামনে মুখ ফুটে বলে ফেলে সে আবেগকে বিয়ে করবে চায়।

 

 আবগের বাবা রা দুই ভাই- এক বোন। সবার চেয়ে আবেগদের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। 

 

আবেগের মা তো রেগে গেলেন। সে ভাবতে লাগলো রোদেলাকে তাদের বাসায় থাকতে দিয়ে ই ভুল হয়েছিল। রোদেলা তার সহজ-সরল ছেলেকে ফাসাচ্ছে টাকার লোভে পড়ে।  

 

আবেগের মতো কোয়ালিফাইট ছেলের সামনে রোদেলা মানায় না। তার উপর রোদেলার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না। খুব অশোচনীয়। কোন মতে আছে আর কি! 

 

এমন মেয়েকে ঘরে বউ হিসেবে আনবে না জাবেদা খাতুন। তার খানদানি বংশের মেয়ে চাই। তার এক কথা ই ফাইনাল কথা। রোদেলাও কম না। আবেগকেই বিয়ে করবে৷ সে আবেগকে ভালোবেসে ফেলেছে। বারবার মুরুব্বি দের সামনে একই কথা রিপিট করতে থাকায় রোদেলাকে নিজের নামের আগে বেহায়া তকমা লাগাতে হয়। 

 

তারপর ও ইমতিয়াজ রহমান রাজি ছিলেন৷ কিন্তু বাধা দিল আবেগ৷ 

 

সে রোদেলা কে ভালোবাসে না স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ব্যাপার টা। ব্যস, জাবেদা খাতুনের পাল্লা ভারি হয়ে যায়। তাকে আর থামায় কে? যাকে রোদেলা বিয়ে করতে চায় সে নিজেই রাজি না। কাহিনি এখানেই ডিসমিস। 

 

এমন না যে তখন আবেগের নেহার সাথে খুব জম-জমাট প্রেম-প্রনয় —এ ধারণা ভুল। 

 

আবেগ কোন দিন নেহাকে ভালোবাসি বলেছে কিনা সন্দেহ। নেহার সাথেও রিলেশনে জড়াতে চায় নি আবেগ।জোড়-জবরদস্তি করে নেহা আবেগের সাথে রিলেশনে যায়। 

 

নেহা ভার্সিটি লাইফে থাকতেই আবেগকে প্রোপজ করে কিন্তু আবেগ রিজেক্ট করে দেয়৷ এই ঘটনার পর নেহা সুসাইড এটেম  করে বসে।ব্যস আবেগ ভয় পেয়ে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেহার প্রোপোজাল এক্সেপ্ট করে। তবে এখানে একটা কথা বলা উচিত, যেদিন টা থেকে নেহার সাথে আবেগের দেখা হয় সেদিন থেকে রোদেলার সাথে মিস্টি সম্পর্ক টা নষ্ট হতে থাকে। আবেগ কিছুটা হলেও মুগ্ধ হয়েছিল নেহার চাকচিক্যময় রুপের প্রতি! কিন্তু সেটা খনিকের জন্য! তা প্রথমে ই বুঝে যায় আবেগ কিন্তু নেহা সেটা বুঝতে নারাজ! 

 

রোদেলা জানত না আবেগ আর নেহার ব্যাপার টা। যখন রোদেলা আবেগকে বিয়ে করতে চাইল, সে সময় আবেগ খুব বিজি ছিল। ওয়ার্কশপ চলছিল তার।  এই ওয়ার্কশপ তার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক জরুরি তাই সে এসব থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছিল।ওয়ার্কশপ সিলেটে হচ্ছিল। তাই ঢাকায় থাকত না আবেগ।   কিন্তু রোদেলা নাছোড়বান্দা।তাকে ঢাকায় আনিয়ে ছাড়ে –মেয়েটা তবেই বুঝি স্বস্তি পায়!  

 

আবেগ ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না রোদেলা। একথা শুনে আবেগের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। রোদেলার বান্ধবী তার সাথে প্রেম করার জন্য সুসাইড করতে চায় আর এদিকে রোদেলা তাকে বিয়ে করতে চাওয়ার জন্য পাগল! 

 

আবেগ সাফ জানিয়ে দেয় সে রোদেলাকে বিয়ে করতে পারবে না। ঠিক সেই সময় রিশাদ প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাব জাবেদা খাতুন এনেছিল। সবাই রাজি হয়ে যায় রোদেলাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। রিশাদের মতো ছেলে নাকি হয় না। অনেক টাকা-পয়সা তাদের। 

 

আবেগ ও রোদেলা কে বুঝায় সে নেহাকে ভালোবাসে। এদিকে নেহা ও রোদেলা কে হুমকি-ধমকি দেয় যদিও আবেগের কাছ থেকে সরে না আসে তবে সে রোদেলার লাইফ স্পয়েল করে দিবে। সে নিজের ও ক্ষতি করে বসবে। জাবেদা খাতুন বারবার রোদেলা কে অনুরোধ করে তার সোনার টুকরা ছেলের থেকে দূরে থাকার জন্য আর রিশাসকে বিয়ে করতে। 

 

বেচারা রোদেলারই বা কি করার? বাধ্য হলো রিশাদকে বিয়ে করতে।রোদেলা সবার কথা শুনে, নেহার কথা ভেবে নিজের ভালোবাসা বলি দিয়ে বিয়ের পীড়িতে বসে এক বুক অভিমান আর হাজার -কোটি দুঃখ নিয়ে। 

 

 বিয়ের আগের রাতে সে আবেগের পা ধরে বলেছিল, আরেকবার ভাব্বার জন্য। 

 

বাট ভাবে নি আবেগ। রোদেলা কে সেই ভাবে কাদিয়ে রেখেই যাত্রা শুরু করে সিলেটের উদ্দেশ্য। তার কাছে রোদেলার চোখের অশ্রুমালার চেয়ে ক্যারিয়ারের সার্টিফিকেট বেশি মূল্যবান লেগেছিল! এখানে দোষের কিছু দেখে নি আবেগ। 

 

হুট করে সেই রাতের কান্না মাখা রোদেলার মুখটা ভেসে উঠে আবেগের চোখে। সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছ্যাত করে উঠে। 

 

সে রোদেলার দিকে তাকালো। নাহ আজকের এই চেহারার সাথে সেদিন কার সেই অসহায় চেহারার কোন মিল নেই। বরং আজ রোদেলাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ শান্তি তে আছে। 

 

হুট করে রোদেলা তার একটা হাত আবেগের বুকে দিয়ে দেয় ঘুমের মধ্যেই। আবেগ মুচকি হেসে আরেকটু রোদেলাকে ঘেষে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষন পর রোদেলা ঠিক ভোর  বেলার মতো আবেগের বুকে এসে মাথা রাখে। আবেগ ও পরম যত্নে রোদেলাকে তার বুকে ঠায় দেয়। 

 

আবেগের মনে প্রশ্ন জাগে, রিশাদের বুকেও কি এভাবে মাথা রাখত রোদেলা? একথা ভাবতে ই মাথা ধরে এলো তার। কিন্তু উত্তর জানার জন্য মন ছটফট করছে। ভালোবেসে কি রোদেলা কোন দিন রিশাদকে আলিঙ্গন করেছে? 

 

রোদেলার যেদিন বিয়ে হয় সেদিন সিলেট গিয়ে পৌছে আবেগ। প্রায় পাচ মাস সেখানে অবস্থান করে যার কারনে রোদেলার বিবাহিত লাইফ সম্পর্কে কোন ধারণা তার নেই। ফিরে আসার কিছু দিন পর ই তো রোদেলা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বাপের বাড়ি ফিরল। রিশাদের চরিত্র সম্পর্কে আবেগ তো সমুদ্র হওয়ার দিন জেনেছে। আসলে সে চাইলে বহু আগেই সব জানতে পারত। সে কি পারত না? রোদেলাকে ভালো দেখে একটা বিয়ে দিতে? আচ্ছা সে এসব কি ভাবছে?নিজের বউয়ের বিয়ের কথা সে কেন ভাববে? আচ্ছা এই মূহুর্তে যদি আবেগ মারা যায়  রোদেলা কি করবে? তৃতীয় বিয়ে করবে? আর যদি করেও সে কি কষ্ট পাবে? কিন্তু কথা হচ্ছে মরে গেলে কষ্ট পাবে কিভাবে? 

 

★★★

সারা রিসোর্ট জুড়ে হৈ-হোল্লা, গান-বাজনার আওয়াজ। ফুলের গন্ধ তে সারা রিসোর্ট ই যেন মো মো করছে। আজকে শেখ বাড়ির বড়ই আদরের কন্যা মিতুর গায়ে হলুদ। প্রাচুর্যের ব্যস্ততার সীমা নেই। চারিদিকে তার তদারকি! কোথায় কি করতে হবে সব মুখস্ত তার! ডেকোরেশনে  সামান্য তম ভুল হতে দিবে না সে। 

 

এসব মাত্রার বাইরের বাড়াবাড়িতে নেহা বিরক্ত। কি দরকার এতো আলগা ভালোবাসা দেখানোর! প্রাচুর্যকে তার জাস্ট অসহ্য লাগে। সেই ক্লাস নাইন থেকে তার পিছনে জোকের মতো লেগে আছে। ছ্যাচড়া ছেলে কোথাকার৷ কিছু বলle দাত বের করে হাসে। এতে আরো রাগ উঠে নেহার। ভর দুপুর এখন। ওইপাশটায় খাওয়া -দাওয়া চলছে। খাওয়ার গন্ধ নাকে আসছে। 

 

যেহুতু সম্পূর্ণ রিসোর্ট বুক করা  হয়েছে তাই নেহা নিশ্চিত মনে দোলনায় দোল খাচ্ছে আর কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনছে৷ পরনে তার কাচা হলুদ রঙের ওয়ান পিজ। সবাই শাড়ি পড়েছে। অথচ সে একটা ওড়না পর্যন্ত গায়ে জড়ায় নি। 

 

নেহা ইউব টিউবে গিয়ে  তু মিলা নামে একটা গান সার্চ দিল। এই গান সে আগে শোনে নি। তার এক খুবই ক্লোস ফ্রেন্ড তাকে সাজেস্ট করেছে তাই শুনতে লাগে সে। অদ্ভুত সুন্দর গানটা। 

 

নেহা তাল মিলিয়ে গাইতে লাগে,

 

 তু মিলা আইসে 

যেইসে বারিস কো মিলা জামিন। [হিন্দি গান শোনা হয় না তাই ভুল লিরিক লিখে থাকলে ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দিবেন কিংবা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]

 

হুট করে পেছন থেকে কেউ ভাউ করে শব্দ করে উঠে। আকষ্মিক এমন আওয়াজে নেহা ভয় পেয়ে যায় এবং তার হাত থেকে ফোন ধপ করে নিচে পড়ে গেল৷ 

 

তখনি নেহা প্রাচুর্যের হোহো হাসির শব্দ শুনে৷এবং সেদিকে তাকিয়ে দেখে প্রাচুর্য তার দিকে ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। 

 

নেহা ভর্য়াত চেহারা নিয়েই পালাতে যাবে ওমনি প্রাচুর্য নেহার হাত ধরে ফেলে। 

 

নেহা নিজেকে ছাড়াতে চাইলে, প্রাচুর্য এক হ্যাচকা টন মেরে নেহাকে তার কাছে এনে বলে, এখানে কি করিস? 

 

–তোর জানা লাগবে না। লিভ মি। 

 

–খাইতে আয়। 

 

—খাব না। 

 

–ও আল্লাহ কেন? কাচ্চি মিস করবি নাকি? কাচ্চি, নান রোস্ট, গ্রিল ও আছে। তাও বুফ্যে। নেহা রে না খাইলে গ্রেট লস। এই লস তুই জীবনে ও পূরণ করতে পারবি না৷ 

 

–তুই খা না। আমাকে ছাড়। 

 

–আমি ফাস্ট ব্যাচে একবার খাইছি৷ এখন আবার খাব। 

 

–খাদক একটা! 

 

–চল! তোর প্রিয় জর্দা পোলাও ও আছে।  

 

–আমার জর্দা পছন্দ না। 

 

–আমার তো পছন্দ জদা!  আর আমার পছন্দ মানে আজ থেকে তোর ও পছন্দ। 

 

–যত্তোসব! ডিসগাস্টিং! 

 

–আই লাভ ইউ নেহা! 

 

–সাট আপ। 

 

–কিছু কথা কে সাট আপ করা যায় না রে! 

 

নেহা প্রাচুর্যের দিকে তাকালো। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে। সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। চুল স্পাইক করা। হাতে ব্রান্ডের ঘড়ি। তাও নেহার মন জয় করতে পারল না প্রাচুর্য। 

 

★★★

 

আয়নার সামনে বসে চুল আছড়াচ্ছে অথৈ। এমন সময় বাবার ডাক পড়ে। সে গুটি পায়ে বাবার রুমে যায়৷ 

 

অথৈয়ের বাবা পেপার পড়ছিলেন। মেয়েকে দেখে থমথমে গলায় বলে, তুমি  নাকি জব পেয়েছো? 

 

অথৈ একথা শুনেই কেদে দিল এবং বলল, বাবা প্লিজ! আমি চাকরি করতে চাই। প্লিজ!

 

–আমাকে জানাও নি কেন আগে? 

 

–ভুল হয়ে গেছে? 

 

অথৈয়ের বাবা বলল, পজিশন কি? 

 

–জেনারেল এমপ্লয়ি। (মাথা নিচু করে বলে অথৈ)

 

অথৈয়ের বাবা হতাশ হয়ে বলে, কত শখ ছিল আমার তুমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাবার নাম উজ্জ্বল করবে।আচ্ছা থাক বাদ দাও৷ এইসব চাকরি করতে হবে না। ফয়সাল মানা করে দিয়েছে।  

 

–বাবা! এইটুকু বলে বাকি কথা  আর বলে না অথৈ। রুম ছেড়ে বের হয়ে আসে গোমরা মুখ করে । চোখে অজস্র কান্না দলা পাকিয়ে আসছে৷ 

 

★★★

 

মেঘ অফিসে বসে কাজ করছে। হুট করে ফোনে মেমোরি আসল। আজকে ২৫ শে নভেম্বর! 

 

তাদের প্রেমের  এনিভারসিরি! আজকে সম্ভবত ছয় বছর হত যদি তাদের মাঝে সব ঠিক থাকত! 

 

মেঘ মেমোরি দেখতে লাগলো। তার আর অথৈয়ের দুইটা ছবি। 

 

ধানমণ্ডির রেস্টুরেন্ট চেরি ড্রপসে এ তোলা।অথৈকে খুব সুন্দর লাগছে। চেরি ড্রপস এ একটা সাইড আছে যেখানে উচু উচু টেবিল এবং পাশে সাদা কাজ করা দেয়াল। সেই দেয়ালের সামনে হাত ধরাধরি করে তোলা দুইটা ছবি। চমৎকার লাগছে অথৈকে সেই ছবি তে৷ 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–29

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রোদেলা অবিশ্বাস্য চোখে আবেগের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বললো আবেগ মাত্র? সে কি কানে ভুল শুনেছে? হয়তোবা! আবেগ কোন দিন ই তাকে মানবে না সে এটা জানে। দুইদিন আগে জ্বর এসেছে অজ্ঞান ও হয়ে গিয়েছিল জন্য মাথায় কিছু একটা হয়ে আবেগ ভুল-ভাল বকছে। হ্যা এটাই হবে হয়তোবা৷ 

 

আবেগ বিরক্তি নিয়ে বলে, এভাবে হা করে তাকিয়ে কেন আছো? মুখে মাছি ঢুকে যাবে তো।কাইন্ডলি সাট ইউর মাউথ।  

 

রোদেলা টুপ করে মুখ বন্ধ করে নিল। আবেগ হালকা হাসলো এবং বলল, জানো? মুখ হা করে রাখায় তোমাকে একদম ব্যাঙের মতো লাগছিল! 

 

রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলে।আবেগ কেন তাকে পিঞ্চ মারছে?।

 

 হুট করে তার এখন বেশ লজ্জা লাগছে।  নতুন বউয়েরা বিয়ের পরের দিন সকালে যেমন লজ্জার মধ্যে থাকে সেও এখন এমন ই লজ্জার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। 

 

আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। মেয়েটা দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর। কেবল সুন্দর না মুখের চারপাশ দিয়ে একটা মায়াবি ভাব ফুটে উঠেছে৷ 

 

সাধারণত সুন্দর মেয়েরা মায়াবি হয় না। সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে মায়া নামক হরমোন টা নাই। এরা কঠিন স্বভাবের হয়। এদের চেহারায় একটা কাঠ কাঠ ভাব থাকে। মায়া শব্দটা কেন যেন শ্যামবর্ণার সাথে খুব মানায়! এটা আবেগের ব্যক্তিগত মনোভাব। কিন্তু রোদেলা এই থিউরি সামান্য ভুল প্রমানিত করেছে। দেখতে রূপবতী হলেও রোদেলার চেহারায় একটা মায়া ভাব আছে। সম্ভবত চোখের কারনে! 

 

একটা মানুষের সমগ্র সৌন্দয তার চোখের উপর নির্ভর করে। এটাও আবেগের ব্যক্তিগত মনোভাব। তার মতে, যার চোখ যতো সুন্দর সেই ব্যক্তি ততো বেশি সুন্দর! 

 

রোদেলার চোখের পল্লব বেশ ভারী। চোখের মনি অনেক কালো আর গভীর। চোখে অধিকাংশ সময় কাজল পড়ে থাকে রোদেলা। আবেগের মনে হয় রোদেলাকে কেবল কাজল দিলেই কাজলবতী লাগে! 

 

এর বেশি কিছু দিলে যেমন-মেকাপ করলে ওকে ভুতের মতো লাগবে!  

 

রোদেলার দুধে আলতা গায়ের রঙ। লম্বাও ভালোই।বাঙ্গালী মেয়েরা যেই হাইটের হয় তেমনি। আহামরি লম্বা ও না আবার খাটো ও বলতে ভুল হবে। 

 

আবেগ আরো একটা বিষয় খেয়াল করে, রোদেলার ডান পাশে ঠিক ঠোঁটের শেষ ভাগ বরাবর একটা কালো তিল আছে৷ তিলটার সাইজ ও মোটামোটি বড় আর কালো কুচকুচে। 

 

এই তিলটা যেন রোদেলার রুপকে বহু গুন বাড়িয়ে দেয় প্রতিনিয়ত।হাসলে মনে হয় তিলটাও তার সঙ্গে হাসছে! 

 

 রোদেলার আরো একটা বিষয় না বলতেই নয়। তাহলো তার কেশ! 

 

কোমড় ছাড়িয়ে গেছে। বেশ লম্বা, সিল্কি চুল রোদেলার। কিন্তু ঘন না। অনেক পাতলা তার চুল। তাও চুলের কারনে রোদেলাকে আরো বেশি সুন্দরী লাগে। বাঙ্গালী নারীর মতো খাড়া নাক। যার জন্য নাকফুল পড়লে বেশ মানায়। গাল গুলো একটু ফোলা ফোলা।আর টসটসে। 

 

 আবেগদের পরিবারের সব মেয়েদেরই গাল ফোলা। তার বোন, ফুফু, দাদি,রোদেলা সবার গাল একটু ফোলা ফোলা। 

 

রোদেলা কে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে, আবেগ রোদেলার গা ঘেষে বসল। তাদের মধ্যে বেশ খানিকটা দূরত্ব ছিল। আবেগ সমুদ্র কে ট্রলিতে শুইয়ে তার ফোন বের করে ইউবটিউবে গিয়ে একটা বেবি রাইম বের দিল। সমুদ্র মনোযোগ দিয়ে গান শুনতে লাগলো। খুব মজা পাচ্ছে। গানের তালে তালে একটু আঙুল নাড়াচ্ছে সে। 

 

 আবেগ রোদেলার অতি নিকটে গিয়ে বসে পড়ে। লজেন্স খাওয়ায় রোদেলার ঠোঁট কমলা হয়ে গেছে। আবেগ আগ্রহ নিয়েই রোদেলাকে দেখছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা! 

 

লিপস্টিক না দিয়েই ঠোঁটে রঙ হয়ে গেছে।সবচেয়ে মজার বিষয় হলো রংটা রোদেলার।চেহারার সাথে ফুটে উঠেছে। এর চেয়ে হালকা বা ডিপ হলে একদম বেখাপ্পা লাগত। 

 

রোদ অস্বস্তিবোধ প্রকাশ করে বলে, কিছু বলবে? 

 

–হুম। 

 

–কি? বল! 

 

আবেগ রোদেলার হাত চেপে ধরে। এতে রোদেলা অবাক হলো কিন্তু মুখে কিছু বলল না। 

 

আবেগ রোদেলার চোখে চোখ রেখে বলে, আমাকে বল তো, একচুয়ালি কোন কারনে তুমি রিশাদকে ছেড়েছো? আই ওয়ান্ট টু নো। 

 

রোদেলা অস্থির হয়ে পড়ল। কেন আবার সেই কাল রাতের দিন গুলোর কথা জানতে চাচ্ছে আবেগ? সে কি জানে? ওইসব দিনের কথা মনে করলেই রোদেলার গা হীম ঠান্ডা হয়ে আসে? 

 

রোদেলার ঠোঁট কাপতে লাগলো। সে ঘামছেও বুঝি। চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ!

 

আবেগ রোদেলার হাত আরো জোরে ধরে তাকে আশস্ত করে যে সে আছে তার পাশে৷ 

 

রোদেলা কি মনে করে যেন বলে উঠে,

 

 আমি আমার মনে কোন দিনই রিশাদকে জায়গা দিতে পারি নি। জানো আবেগ? আমাদের মনটা না একটা বাড়ির মতো? আমাদের মনের সেই বাড়িতে কয়েকটি কক্ষ থাকে। প্রতিটি কক্ষ প্রতিটি মনের মানুষের জন্য বরাদ্দ থাকে। আমার মনের বাড়িটা খুব একটা বড় না। ছোট্ট একটা পাখির বাসার মতো। সেই বাসার সবচেয়ে সুন্দর কক্ষটার দলিলে আমি তোমার মালিকানার স্বাক্ষর চেয়েছিলাম,,,,,,,,

 

আবেগের নিজেকে এবার অপরাধীর মতো লাগতে লাগলো। মেয়েটা তাকে কতো ভালোবাসত! অথচ সে তাকে বারেবারে ক্ষনে ক্ষনে অবজ্ঞা করে গেছে। 

 

রোদেলা নিচু গলায় বলে, তুমি জানতে চাচ্ছিলে না কেন আমি রিশাদকে  ছেড়ে চলে এসেছি? তাও চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়? 

 

–হুম। 

 

–আমি কি করতাম বল? আমিও নিরুপায় ছিলাম৷ আমার আর রিশাদের বৈবাহিক সম্পর্ক মাত্র এক বছর। এর মধ্যে আমি মাত্র ওর সাথে সাত মাস সংসার করেছি। এই সাতটা মাস আমার জীবন টাকে নরক বানিয়ে দিয়েছিল রিশাদ। প্রথম যেদিন গায়ে তোলে সেই দিনটা ছিল বিয়ের চতুর্থ দিন। ভাবতে পারো একটা মেয়েকে বিয়ের চারদিনের মাথায় তার হ্যাসবেন্ড গায়ে হাত তুলেছে৷ আসলে দোষটা আমার ই ছিল। প্রথম থেকেই আমি ওর অত্যাচার সহ্য করেছি। চুপ থেকেছি। প্রতিবাদ করি নি। বাসায় কাউকে কিছু বলিও নি রিশাদের অত্যাচারের ব্যাপারে  

 

–এই জায়গায় অনেক বড় ভুল করেছো। যেদিন প্রথম হাত তুলল সেদিন ই প্রতিবাদে কিছু করা উচিত ছিল। ফুফিকে জানাতে৷ 

 

–তোমরা সবাই তো আমাকে ততো দিনে বিকিয়েই দিয়েছিলে রিশাদের কাছে৷ তাই কাকে কি বলব? (আহত গলায়) 

 

আবেগ মাথা নিচু করল। 

 

রোদেলা জানালার দিকে তাকিয়ে কান্না মিশ্রিত চোখে বলে, অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছিল তাও আমি চুপচাপ সংসার করে গেছি। হয়তোবা তোমদের প্রতি অভিমান কিংবা অভিযোগ করেই কাউকে কিছু জানাতাম না। মুখ বুজে সহ্য করতাম। আমার তখন বারবার একটা কথাই মনে হতো– তোমাদের কে কেন বলব নিজের কষ্টের কথা? তোমরাই তো ঠেলে দিয়েছো নরকে। আর যে নরকে রেখে আসে, সে  কি নরক যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করবে কোন দিন? রিশাদের আরো একটা বিষয় আমি জানতে পারি। বিয়ের দুইমাসের মাথায়। ওর এক্সট্রা ম্যারিটিয়্যাল রিলেশন চলে অন্য মেয়েদের সাথে। শুধু তাই না, প্রস্টিটিউশনের ব্যবসার সাথেও জড়িত  সে।  এসব নিয়ে আমি ওর সাথে খোলাসা ভাবে ডিসকাস করি। এক রাতে তারিখ এখনো মনে আছে আমার। বারোই জুলাই। সে রাতে আমি ওর জানোয়ার রুপ দেখেছিলাম। হাতে পোড়া দাগ দেখেছিলে না? এই দাগ সে রাতেই হয়েছিল।

 

–ওহ। 

 

— এর পর আরো জঘন্য কাজ করা শুরু করল রিশাদ৷ আমি নাকি সুন্দর না। আমার রুপ নাই এসব কথা বলে বাসায় বাহিরের মেয়ে আনা শুরু করল।এতে ওর মাও ওকে সাপোর্ট দিত। বলত ছেলে মানুষ এমন একটু করবেই!

 

 সত্যি বলতে ওর এমন কান্ডে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হতাম না। এভাবেই সময় কেটে গেল।আমি প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর রিশাদ এবোর্শন করতে বলে। কেন সে সন্তান চায় না এটা অজানা আমার কাছে৷ কিন্তু আমি কিছুতেই রাজী হয় নি এবোর্শনের জন্য । উপায় না পেয়্ব সে জোর-জবরদস্তি করে আমাকে অজ্ঞান করে হাসপাতালে নিয়ে যায় বাচ্চা নষ্ট করার জন্য  কিন্তু কথায় আছে না রাখে আল্লাহ মারে কে? ওই হাসপাতালের ডাক্তার উনি রিশাদের কথা বিশ্বাস করেন নি তাই অপারেশন ও করে নি। আমার জ্ঞান আসার অপেক্ষায় ছিল। কি যেন বন্ড সিগনেচার করতে হয়। জ্ঞান ফেরার পর তখন আমি ওনাকে সব সত্য বলে দিই যে আমি বাচ্চা নষ্ট করতে চাচ্ছি না। সাহায্য চেয়েছিলাম ডাক্তাররের কাছে। তখন উনি আমাকে আমার বাসায় পৌছে দিয়ে আসে৷ তুমি ভাবতে পারছো আবেগ? যদি  সেই ভালো ডাক্তারটা আমার জ্ঞান  ফেরার অপেক্ষা না করেই অপারেশন শুরু করত, তবে আমি আমার ছেলেকে হারিয়ে ফেলতাম চিরতরে! 

 

আবেগের বুক হুহু করে উঠে। চূর্ণবিচূর্ণ হতে লাগলো হৃদয়! সমুদ্র কে জন্ম হওয়ার আগেই এতোটা লড়াই করতে হয়েছে কেবল মায়ের পেটে আশ্রয় পাওয়ার জন্য? 

 

আবেগের চোখে সমুদ্রের দিকে পড়ল। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে সমুদ্র। পরমে যত্নে কোলে তুলে নিল তাকে আবেগ। তারপর অনেক গুলো চুমু খেল সমুদ্রের কপালে।এতে সমুদ্রের ঘুম বিঘ্ন হলো। সে নড়েচড়ে উঠে। আবেগ রোদেলার দিকে তাকিয়ে দেখে রোদেলা ও তার দিকে তাকিয়ে আছে। 

 

আবেগ বুকের সাথে সমুদ্র কে জড়িয়ে রেখে সিটে হেলান দিল। কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না তার। বরং এই মূহুর্তে নিরবতা পালন করার বাসনা জাগছে সেই সাথে রোদেলাকে ও নিজের বুকে আগলে নেওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল থেকে প্রবলতর এবং প্রবলতম হচ্ছে! 

 

★★★

 

খাওয়ার টেবিলে বসে আছে অথৈ। পোলাও খায় নি সে। খাওয়ার রুচি নেই। তার বাবা খেতে আসলেন। তখনো অথৈ জোড়োসোরো হয়ে বসে আছে চেয়ারে। সামনে দই আর মিস্টির প্যাকেট। অথৈ দই আর সাদা জাম মিস্টি একসাথে খেতে খুব পছন্দ করে। বাবা ও সাদা জাম আর দই এনেছে। যা দেখে কিছু টা খুশি হলো অথৈ। সে একটা বাটিতে দই আর মাঝখানে মিস্টি তুলে নিয়ে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করছে কিন্তু খেতে মন চাচ্ছে না তার। 

 

আজিজুল সাহেব টেবিলে বসলেন এবং প্লেটে খাবার তুলে নিলেন। এই বাসায় কোন রুলস নাই। যে যার মতো খায়, ঘুমায়, বাইরে যায়। অথৈয়ের বাবা-মা আলাদা দুই রুমে থাকে। অথৈয়ের বড় ভাই এই বাসায় ই থাকে না। আলাদা ফ্লাট নিয়ে থাকে। বাবা-মায়ের সাথে সে কথা বলে না। তবে মাঝে মধ্যে অথৈয়ের সাথে কথা বলে। অথৈ ও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আর মেঘের সাথে প্রেমের কথা জানার পর তো অথৈয়ের বাবা-মা দুইজন ই তার উপর রেগে আছে। 

 

আজকে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য বশত তাদের টাইমিং মিলে গেছে। 

 

অথৈকে দেখে তার বাবা জিজ্ঞেস করে, ডিনার না করে কেবল মিস্টি খাচ্ছো কেন? 

 

অথৈ বলে, খেয়েছি আমি। যা ডাহা মিথ্যা। 

 

আজিজুল সাহেব আর কিছু বললেন না। উনি খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। অথৈ না পারছে উঠে যেতে আর না পারছে বসে  থাকতে। 

 

উনি প্রশ্ন করল, তোমার ভাই তোমার সাথে কথা বলে? 

 

অথৈ মাথা ঝাকালো। 

 

–কেমন আছে ও? 

 

–ভালো। 

 

–লাস্ট কবে কথা হয়েছে? 

 

অথৈ কাতর গলায় বলে, এক সপ্তাহ আগে৷ 

 

আজিজুল সাহেব বলেন, ভাইয়ের সাথে এতো কম যোগাযোগ কেন? প্রতিদিন কথা বলবে। আচ্ছা, তোমার ফর্মাল জামা আছে? 

 

অথৈ বুঝে পেল না। ফর্মাল জামা দিয়ে সে কি করবে? এখন ফয়সালের সাথে দেখা করার আগেও ফর্মাল লুকে যেতে হবে? 

 

অথৈ না বুঝে প্রশ্ন করে, কেন এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে? 

 

আজিজুল সাহেব কঠিন গলায় বলে, আজ-কাল এই প্রাইভেট কোম্পানির ঢংয়ের শেষ নাই৷ মিটিংয়ে ফর্মাল ড্রেস ছাড়া ঢুকতে দেয় না। 

 

অথৈ অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকালো। 

 

উনি কড়া গলায় বলে, এভাবে তাকানোর কি আছে? ড্রয়িং রুমে দুইটা সাদা সালোয়ার কামিজ আছে আর পাচ হাজার টাকা। পছন্দ হলে নিজের জন্য রেখে দিও। 

 

বলে উঠে পড়লেন আজিজুল সাহেব। 

 

অথৈ হতভম্ব হয়ে গেল। তার চোখ দুই দিয়ে বেয়ে পড়ে। তবে এটা দুখের না। সুখের৷ 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–30

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

সকালের আলো ফুটতে শুরু করার সাথে সাথেই বাস ও থেমে গেল। গন্তব্যে পৌছে গেছে যে বাস। আর তো চাইলেও সামনে যাওয়া যাবে না! যাত্রী নামতে শুরু করল। সবার মুখে ব্যস্ততার ছাপ।  

 

এতো শত ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই ঠেলাঠেলি সামলিয়ে বাসের উপর থেকে ব্যাগ বের করে নিচে নামল রোদেলা আর আবেগ।

 

ঢাকা মানেই ব্যস্ততা আর এই ব্যস্ততার ছোয়া সমস্ত ঢাকাবাসীর মধ্যে ছেয়ে গেছে।প্রতিটি ঢাকাবাসীর চেহারার মধ্যে একটা অদৃশ্য তাড়া আর বানোয়াট ব্যস্ততা বিরাজ করে।  গ্রাম যেমন শান্ত,ধীর-স্থির সেখানে বাস করা মানুষের মধ্যেও এক ধরনের স্থিরতা বিরাজ করে।

 

বাস থেকে নেমেই আবেগ আশেপাশে তাকালো। এখান থেকে আরো ঘণ্টা-খানেক পর বাসা পৌছাতে পারবে। ঘড়িতে ছয়টার কম বাজে। 

 

সে গাড়িতেই উবার কল করে রেখেছিল। আর দশ মিনিট পর গাড়ি আসবে। স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে আছে তারা। 

 

সব যাত্রী নেমে যে যার মতো চলে যেতে লাগলো। এতো পথ এক সাথে পাড়ি দিল সবাই কিন্তু এখন যে যার মতো  পৃথক পৃথক হয়ে যে যার ঘরে চলে যাচ্ছে। কারো জন্য কারো মায়া নেই। এজন্য বুঝি তাদের মুসাফির বলে! 

 

আমাদের প্রত্যকের জীবনে কেউ না কেউ মুসাফির হয়ে আসে। কিছু টা সময় একসাথে তাদের সাথে কাটাই, ক্ষনিকের জন্য পরিচিত হই, হালকা সাক্ষাৎ করি,কুশল বিনিময় করি।  কিন্তু যাত্রা শেষে যে যার মতো চলে যায়। কেউ কারো জন্য  এক দন্ডের জন্য থামে না।চঞ্চলতা আর ব্যস্ততা নিয়ে নিজ গন্তব্যে এগিয়ে যায়। তাদের বৈশিষ্ট্যই চলে যাওয়া যেমন পানির ধর্ম গড়িয়ে পড়া! 

 

 সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, তাদের জন্য কোন ধরনের মায়া কাজ করে না। নাকি করে?

 

আবেগের চোখের সামন দিয়ে বাসে তের ঘন্টা একসাথে যাত্রা করা সেই বুড়ি মহিলা কলার কাদি হাতে নিয়ে হেটে যাচ্ছে । কই মায়া তো লাগছে না আবেগের? বরং মনে হচ্ছে সে তো যাবেই! 

 

উবার ড্রাইভার আবেগকে ডাকতে লাগে। আবেগের হুশ ফেরে। সে দেখল, রোদেলা গাড়িতে বসে পড়েছে ইতিমধ্যে । 

 

আবেগ ও তড়িঘড়ি করে উঠে বসল গাড়িতে। 

 

গাড়ি শাশা করে আগাচ্ছে। থেকে থেকে সিগন্যালের কারনে থামছে। ঢাকার নিত্য চেনা লাল-সবুজ-হলুদ বাতি দেখে স্বস্তি বোধ করে আবেগ। সত্যি বলতে গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ, ঠান্ডা বাতাসে আরাম পেলেও কিছু টা অস্বস্তি লেগেছে তার। অচেনা লাগত সবকিছু ।যে যেখানে থেকে অভ্যস্ত সে সেখানেই শান্তি খুজে নিবে৷  

 

আবেগের কাধে রোদেলা মাথা ঠেকিয়ে দিল। ইচ্ছাকৃত ভাবেই। এতে বিরক্ত আবেগ। সে ড্রাইভারের সামনে কিছু বলতেও পারছে না রোদেলাকে। তাও আস্তে করে বলে, আশ্চর্য! আমার কাধে কেন মাথা রেখেছো? 

 

রোদেলা হাসিমুখে বলে, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। 

 

–সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাও। 

 

–উহু। সিটে হেলান দিতে কেমন জানি লাগে। কে না কে বসেছে! 

 

আবেগ আর কিছু বলল না। 

 

এবার রোদেলা ই নিজে থেকে বলে উঠে, তুমিই না রাতে বললে আমার সব আবদার পূরণ করার দায়িত্ব তোমার। আমার এখন ঘুমুতে মন চাচ্ছে। 

 

আবেগ নিশ্চুপ থেকে সম্মতি দেয়। রোদেলা যদিও বা ঘুমায় নি। কিন্তু পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে থাকে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি মনে বয়ে যাচ্ছে তার। 

 

গাড়ি থেকে নেমে বিল মিটিয়ে উপরে উঠে গেল তারা। বেল বাজাতেই ইমতিয়াজ রহমান গেট খুললেন। এখন বাজে সোয়া সাতটা। বাসায় সবাই সকাল-সকাল ই উঠে। 

 

ইমতিয়াজ রহমান হাসিমুখ করে বলে, আসলি তোরা এতো জলদি? আমি তো ভেবেছি দশটার আগে পৌছাবি না। 

 

আবেগ ব্যাগ মেঝেতে রেখে রুমে পা বাড়ালো  উত্তর টা রোদেলা দিল। সে বলল, মামা, রাস্তায় জ্যাম ছিল না একদম। 

 

–ও। ফ্রেস হয়ে নে মা৷ 

 

–হুম। 

 

রোদেলা সমুদ্রকে নিয়ে রুমে ফিরল। আবেগ বাথরুমে। রোদেলা নিজেও পড়নের জামা-কাপড় নিয়ে ইভানার রুমে গেল ফ্রেস হতে।

 

এই বাসায় ইভানাই একটু দেরিতে উঠে।

 ইভানা ঘুমাচ্ছিল। রোদেলা বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হলো এবং রান্নাঘরে গেল। 

 

সে জানে এভাবে হুটহাট গ্রামে যাওয়ায় বেজার মামী। তার উপর তার আদরের মানিকের টুকরো ছেলেও গিয়েছিল। এতে আরো রেগে থাকার কথা। তাই মামী হতে সাবধানে থাকতে হবে। কথা শোনানোর কোন সুযোগই দেওয়া যাবে না।

 

পরোটা আর সবজি রান্না করল সে। সাথে দুধ চা। তারপর প্লেটে সাজিয়ে  আবেগের কাছে গেল। 

 

আবেগ মাত্র বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। রোদেলা কে আসতে দেখে খুশিই হলো। মূলত চা দেখে সে খুশি হয়। তার মাত্র ই চা খেতে মন চাচ্ছিল। আর চা পেয়ে গেল। 

 

সে চায়ের কাপ হাতে নিল। রোদেলা সেই সাথে নাস্তার প্লেট ও ধরিয়ে দেয়। 

 

আবেগ বলে, ময়নার মা এসে গেছে? 

 

–না। আসেনি এখনো। 

 

–নাস্তা কে বানালো? 

 

–আমি মাত্র বানালাম। 

 

আবেগ ভ্রু যুগল কুচকে বলে, কেন? এতোটা জানি করে রান্না করতে গেলে? 

 

–তো? না খেয়ে ঘুমাবে? খেয়ে যতোক্ষন ইচ্ছা ঘুমাও। 

 

–তুমি খেয়েছো? 

 

রোদেলার টনক নড়ল। কেন যেন তার এই প্রশ্নটা খুব পছন্দের একটা প্রশ্ন। কেউ যখন তাকে জিজ্ঞেস করে খেয়েছে কিনা সে? তখন সে খুব খুশি হয় মনে মনে। ভালো লাগে তার৷ কিন্তু এই প্রশ্ন করার মানুষ বড্ড স্বপ্ল! 

 

এখনো মনে মনে খুশি হলো রোদেলা। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, খাই নি এখনো। 

 

রোদেলার জবাব শুনে আবেগ উঠে রুমের বাইরে গেল এবং কিছু সময় বাদে আরো একটা প্লেট আনলো। তারপর রোদেলার দিকে দিয়ে বলে, তুমিও খেয়ে শুয়ে পড়ো। ইউ নিড রেস্ট। 

 

রোদেলা মৃদ্যু হেসে খেয়ে নিল এবং সমুদ্রের পাশে শুয়ে পড়ে সে। 

 

আবেগ নাস্তা করে চা খেয়ে বারান্দায় গেল। সিগারেট ধরালো সে। গ্রামে গিয়ে একটাও সিগারেট  খায় নি। সিগারেট ফুকতে লাগলো আবেগ। কেন যেন ঘুম উবে  গেছে। চা খাওয়ার পর ঘুমটা কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। ভেতর থেকে কোন শব্দ আসছে। রোদেলা ঘুমিয়ে গেছে বোধহয়। 

 

★★★

 

মেঘ ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে কোনরকমে নাস্তা সেরে অফিসে গেল। আজকে আধ ঘন্টা লেইট করে ফেলেছে সে। কালকে সারারাত ঘুম হয় নি তার। নিঘুম পাড় করেছে পুরাটা রাত। এর পেছনে একটা কারন ও আছে। সেটা অবশ্যই অথৈ সংক্রান্ত। অথৈ রিলেটেড কোন সমস্যা ছাড়া তার জীবনে কোন সমস্যার দাম নাই। মেঘ ফয়সালের পিছনে একটা লোক লাগিয়েছিল। খবর-আপডেট ভালো আসে নি! ফয়সালের রিভিউ ভালো না৷ ছেলেটার নাকি আগেও রিলেশন ছিল। তার ও রিলেশন ছিল কিন্তু ফয়সাল নাকি প্লে বয় টাইপের। অথৈ যে বোকা! এই জনমে কোন দিন টের ই পাবে না ফয়সাল তাকে ঘোল খাওয়াচ্ছে৷ অথৈকে যে সতক করবে তার ও উপায় নাই।মেঘকে সব খান থেকে ব্লক মেরে রেখেছে অথৈ। যোগাযোগ করতে হলে কারো সাহায্য লাগবে। রোদেলার সাথে নাকি অথৈয়ের কথা হয় না।কেমন মেয়ে? নিজের ফ্রেন্ডের সাথেও কথা বলে না! 

 

তাহলে কি সে গিয়ে পারসোনালি সরাসরি করহা বলবে? কথা তো বলতেই হবে। নাহলে অথৈয়ের সাথেও খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। রিশাদকে দেখার পর সত্যি বলতে এখন অপরিচিত কোন ছেলের সাথে মেয়েদের বিয়ে হতে দেখলেই আত্মা কেপে উঠে। অবশ্য সবাইকে এক কাতারে ফেলা অপরাধ! তাও রোদেলার পরিনতি দেখে তার সত্যি অপরিচিত কারো সাথে বিয়ে হতে দেখলে ভয় লাগে। অথৈয়ের জন্য সে টেনশন করছে। অথৈ রোদেলার মতো এতো স্ট্রং না। এমন কোন পপরিস্থিতি তে অথৈ যদি পড়ত হয় ও আত্মহত্যা করত না হয় পাগল হয়ে যেত। একে তো ওর ফ্যামিলি প্রেসার অনেক। স্ট্রিক গাডিয়ান তারপর যদি ফয়সাল ভালো না হয়। আম ও যাবে ছালাও যাবে। 

 

মেঘ উঠে দাড়ালো এবং জানালার কাছে গেল। হুহু করে বাতাস আসছে। সে চোখ বুজে ফেলে। 

 

অথৈয়ের কি কপাল!  তার মতো এতো ভালো এক্স বয়ফ্রেন্ড পেয়েছে যে কিনা এক্স গার্লফ্রেডের   বিয়ের পাত্রের খবরাখবর বের করে যাচাই করে। 

 

মেঘ কেবিনের কাছে গিয়ে পানি ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে খেতে লাগলো। এই ফ্লাস্কটা অথৈয়ের দেওয়া। সে ফ্লাস্কটার গায়ে হাত বুলালো। 

 

তার আর অথৈয়ের ব্রেক আপ হয়েছে খুব ই তুচ্ছ কারনে। হুট করে একদিন অথৈ ফোন করে জানায় সে আর মেঘের সাথে সম্পর্কে থাকবেনা৷ 

 

কেন ব্রেক আপ করছে অথৈ ভ্যালিড রিজন নাই তার! মেঘের তো পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। কারন অথৈকে সে আসলেই খুব ভালোবাসে। এই টুয়েন্টি টুয়েন্টির যুগেও তার ভালোবাসা খাটি৷ অথৈ যে পরিবারের চাপে পড়ে ব্রেক আপ করেছে এটা মেঘ বুঝতে পেরেছে৷ এই জায়গায় অথৈ ভুল করছে৷ অথৈ কি পারে না তার মা-বাবার সাথে কথা বলতে? এভাবে চুপ থেকে অথৈ নিজেও কষ্ট পাচ্ছে, মেঘকেও কষ্ট দিচ্ছে। মেঘ একটা বড় করে দম নিল। কেন এমন করছে অথৈ। “ব্রেকআপ” বলে ওই যে ফোন কেটে দিল আর তো কথা হয় না। সুযোগ ও পায়নি মেঘ অথৈয়ের সাথে কথা বলার। মাঝে মধ্যে মেঘের খুব করে মন চায় অথৈকে ওর বাসা থেকে কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে করে ফেলতে। কিন্তু সে তো আর সিনেমার নায়ক না। তাই তো কোন দোষ না থাকার পরও নিজের প্রেমিকার বিয়ে দেখবে। তাও যেমন-তেমন পাত্র না প্লে বয় বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার পাত্র! 

 

ফয়সালের একটা ছবি মেঘের ফোনে আছে৷ সে ছবিটা বের করে নিজের চেহারার সাথে তুলনা করল। 

 

ফয়সালের চেয়ে সে হাজার গুন হ্যান্ডসাম। তার চুল কি সুন্দর সিল্কি হেয়ার। কপালে চুল পড়েও থাকে কয়েকটা। লম্বাও অনেক। ড্রাসিং ও কি কম? মেঘ নিজেই নিজের উপর ফিদা। তার বেশ কয়েকটা ফিমেইল কলিগ তার উপর ইন্ট্রারেস্টেড। 

 

আচ্ছা! অথৈ যদি তার বাবার সাথে কথা না বলে, তবে কি একবার কথা বলে দেখবে? লাস্ট অপারচুনিটি অথৈকে পাওয়ার হারাতে দেওয়া যাবে না। 

 

★★★

 

ইভানা ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে। কোন দিকে হুশ নেই। জাবেদা খাতুন দুই বার এসে কিসব বলে গেলেন যার একটাও কানে নেয় নি ইভানা।এতে মনে মনে ক্ষিপ্ত তিনি। তার মেয়ের এমনি আগে থেকেই ফোনের নেশা বেশি। ইদানিং আরো বেড়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ  জন্য বেশি কিছু বলতে ও পারে না।  ইভানা তো আর রোদেলা না যে বোকা দিলে বা কথা শুনালে মাথা নিচু করে সব শুনবে। 

 

ইভানা হচ্ছে এই বাসার কালবৈশাখী ঝড়। এটা অবশ্য আবেগের দেওয়া নাম। ওকে কেউ কিছু বললে প্রতিউত্তরে ঝগড়া করে। আর মেডিকেলে চ্যান্স পাওয়ার অযুহাত দেখিয়ে  বকা দিতে পারে না ইভানাকে। ইভানাকে বকা দিলে তার মেয়েতো প্রতিবাদ করবেই তার উপর আবেগ জানতে পারলে সে এসে তার মাক্ব জবাবদিহি করে, কেন তার আদরের ছোট বোন বকা দিচ্ছে। এজন্য আর কিছুই বলে না তিনি ইভানাকে। 

 

তিনি ইভানার দিকে তাকালো। মিটমিট করে হাসছে ইভানা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে।জাবেদা খাতুন বিরক্তি নিয়ে চলে গেলেন। 

 

ইভানা শৌখিনের সাথে চ্যাট করছে। কোয়ান্টাম থেকে এসেই মনে সাহস জুটিয়ে শায়েরীর কাছ থেকে আইডি নিয়ে নক দিয়েছিল। শায়েরী কিছুটা নার্ড টাইপের। তাই ইভানাকে একদম ই টিচ করে নি। ইভানা অবশ্য শায়েরীকে বলে ফেলেছে যে সে শৌখিনের উপর ক্রাশ খাইছে  শায়েরী প্রতিউত্তরে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে ছিল। ভিডিও কলের দরুন সেই লুক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ইভানার। এই নিয়ে চতুর্থ বার তারা চ্যাট করছে। প্রতিবার চ্যাটিং শুরু করলে পাক্কা দুই ঘন্টা ধরে চলতে থাকে। প্রতিবার ই ইভানায় নক দিয়েছে। খুব শৌখিন ও ইন্টারেস্টেড এটা চ্যাট করে বোঝা যাচ্ছে। ওপাশ থেকে শৌখিনের ম্যাসেজ আসল। আজকে বিকেলে দেখা করতে পারবে? 

 

এই ম্যাসেজ দেখে ইভানার গা কাপতে শুরু করে। এতো যেন মেঘ বা চাইতেই বৃষ্টি! সেও নাচতে নাচতে রাজী হয়ে যায়। শৌখিনের ম্যাসেজে লাভ রিয়্যাক্ট দিয়ে সে রিপ্লে দেয়, ওকে। টেস্ট্রি ট্রিটের গলির সামনে দাড়াবা। আমি ওখানেই আসব। 

 

শৌখিন বলে, আচ্ছা। বিকেল পাচটায় আসব৷ 

 

ইভানা সুন্দর করে সেজেগুজে বসে আছে। তার একা যেতে কেমন জানি লাগছে। আচ্ছা ভাবিকে নিয়ে গেলে কেমন হবে? শৌখিন নিশ্চয়ই চমকে যাবে। ছেলেটাকে চমকালে কেমন দেখাবে? আরো সুন্দর নিশ্চয়ই! 

 

ইভানা ঠিক করে,সে একা যাবে না। ভাবীকে সঙ্গে নিবে। আর শৌখিনকে একটা বড়সড় শক দিবে। 

 

বিকেল চারটার দিকে আবেগ চেম্বারের উদ্দেশ্য বের  হলো। আবেগের চেম্বার ট্রেস্টি ট্রিটের গলির একটু সামনেই। 

 

সাড়ে চারটায় ইভানা রোদেলা কে জোড়াজুড়ি করে বাইরে নিয়ে আসল। ইভানা একবার য বলবে তাই করবে। অগত্যা এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বের হয় রোদেলা। পড়নে সালোয়ার কামিজ তার। টেস্ট্রি ট্রিটের সামনে দাড়াতেই দেখল ফুচকার দোকান। তখনো পাচটা বাজে নি। তাই ইভানা রোদেলাকে ফুচকা খাওয়া ত্ব নিয়ে গেল। দুই প্লেট ফুচকা। বোম্বে মরিচ দিয়ে ওডার দেয়৷ 

 

কিছুক্ষনের মধ্যে ফুচকা চলে এলো। যেই না রোদেলা ফুচকা মুখে দিবে হুট করে কোথা থেকে যেন আবেগ এসে ছো মেরে ফুচকার প্লেট কেড়ে নিল। রোদেলা তো হতভম্ব! 

 

আবেগ ধমক মেরে বলে, এই করোনা কালে তুমি রাস্তায় দাঁড়ায় ফুচকা খাও কোন সাহসে? 

 

তারপর ইভানার দিকে তাকিয়ে বলে, আর তুই?তুই না ডাক্তার হবি আর দুই বছর পর? তার পর ও এই পপরিস্থিতি তে কিভানে স্ট্রি ফুড খাস আর মাস্ক কই তোদের? 

 

ইভানা রোদেলা দুইজন ই চুপ৷ মাস্ক পড়ার কথা মাথাতেই ছিল না। 

 

ইভানা আবেগের বকার হাত থেকে বাচার জন্য  বলে, ভাইয়া আমার একটা কাজ আছে। আমি যাই। 

 

আবেগ আবার আরেকটা ধমক দিয়ে পকেট মাস্ক বের করল। দুইটা। একটা রোদেলাকে দিল আর একটা ইভানা৷ 

 

ইভানা মাস্ক পড়েই হাওয়া। 

 

আবেগ রোদেলার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে, বাসায় গিয়েই গরম পানি আর স্যাভলন দিয়ে গোসল করবা৷ 

 

–আচ্ছা। 

 

চলবে। 

 

 

 

 

 

#অশ্রুমালা 

part–31

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

মাঝরাস্তায় রোদেলা মাস্ক নাক থেকে থুতনিতে টেনে  এনে লম্বা করে শ্বাস নিল। এই কান্ড দেখে আবেগ এমন ভাবে রোদেলার দিকে তাকালো যেন রোদেলা কোন অপরাধ করে ফেলেছে। শুধু অপরাধ না ঘোর অপরাধ! 

 

আবেগকে এভাবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রোদেলা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং মাস্ক ঠিক ভাবে পড়ে নিল। 

 

আবেগ কড়া গলায় বলে, স্ট্রেঞ্জ!  মাস্ক খুলে কেন ব্রিথ নিচ্ছো? 

 

রোদেলা সহজ গলায় বলে, মাস্ক পড়ে থেকে নিশ্বাস নিয়ে আরাম পাই না৷ 

 

আবেগ কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলে, তাহলে আমরা ডাক্তাররা কিভাবে সারাদিন ডাবল মাস্ক পড়ে সেবা দিচ্ছি? তাও হাতে গ্লোভস পড়ে গরমের মধ্যে বারো ঘন্টার বেশি ডিউটি করে গেছি। 

 

রোদেলা কাচুমাচু করে বলে, তোমরা ডাক্তার রা অনেক কিছু সহ্য করতে পারো যেটা একজন স্বাভাবিক মানুষ পারে না। 

 

–তাই নাকি?

 

–হুম। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আর্তনাদ, মৃত্যু মিছিল, আপনজন হারানোর হাহাকার, কান্না  দেখে  দেখে তোমরা ভেতর থেকে রোবট হয়ে গেছো। 

 

— এটা অবশ্য ঠিক বলেছো। একজন ডাক্তার সহজে কাদে না। মেন্টালি খুব শক্ত হয়। আসলে সে শিখে যায় কিভাবে শক্ত হয়ে হয় কেননা

একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট প্রথম ধাক্কা খায় যেদিন সে এনাটমী ডিপার্টমেন্টে দশ-বারো বছর পুরোনো লাশ দেখে। গাছের বাকলের মতো রক্তনালি, নার্ভগুলো বের হয়ে থাকতে দেখলে সযে কেউ আধ পাগল হবে৷ অথচ সেই লাশটার না চাইলেও কাটাকাটি দেখতে হয় তাকে। এরপর ফরেনসিকের কথা নাহয় বাদ ই দিলাম। তারপর হুট করে সুস্থ একজন পেশেন্ট কে কোন রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে দেখে তখন আস্তে আস্তে একজন ডাক্তারের চোখের পানি কমে যেতে থাকে। আচ্ছা এসব জটিল কথা বাদ দাও। ফুচকা খেতে চাইছিলে না? সামনের রেস্টুরেন্টে চল। এই রেস্টুরেন্টটা ভালো। নিট এন্ড ক্লিন। হাইজেনিক। পরিবেশ ও ভালো। 

 

রোদেলা কিছু বলল না। তার মাথায় কেবল আবেগের বলা কথাগুলো ভাসছে৷ ইশ! সে যদি ডাক্তার হতে পারব! কতো ভালোই না হত! 

 

আবেগ রোদেলার হাত ধরেই রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়ে। রেস্টুরেন্টে এসি চলছে। সেন্টের গন্ধ নাকে আসে রোদেলার। 

 

তারা মুখোমুখি দুইটি চেয়ারে বসে পড়ে। আবেগ হ্যান্ড স্যানিটাইজার বের করে রোদেলার হাতে দিল। তারপর এক প্লেট ফুচকা,ফ্রাইড রাইস প্ল্যাটার  আর কফি অর্ডার দিল৷ এখানে এক প্লেট ফুচকা দেড় শ টাকা দাম। কিন্তু স্বাদ একদম ই মজার না। বাইরের  মামার দোকানের ফুচকার সামনে এই ফুচকা কিছুই না। কিন্তু এটা তো আর আবেগ বুঝবে না। উলটো এই কথা বললে রোদেলা কে অকারণেই ধমক দিবে। এই মূহুর্তে রোদেলার ধমক খাওয়ার ইচ্ছা নাই তাই চুপ থাকল সে। 

 

তবে রোদেলা মনে মনে খুব খুশি কেননা এই প্রথম বিয়ের পর আবেগ তাকে কোন রেস্টুরেন্টে আনল। রোদেলা টেবিলে হাত রেখে এক ধ্যানে আবেগকে দেখেই যাচ্ছে। আবেগ নিচু হয়ে ফোন চালাচ্ছে। 

 

ছেলেটার মধ্যে “স্টাইল” বলে কোন কিছু নেই। তারপর ও আবেগকে খুব ই হ্যান্ডসাম লাগে! 

 

কিছুটা রোগা হয়ে গেছে সে। কিন্তু লম্বা। চুল গুলো সবসময় গোছানো থাকে আর খুব ঘন ও। এদিকে মেয়ে হয়েও রোদেলার চুল খুবই পাতলা। আবেগের চোখে চশমা থাকে। সবসময় না। হাসপাতাল, চেম্বার আর কিছু পড়ার সময় চশমা ইউস করে। ওর নাকি ডান চোখে মাইনাস পাওয়ার। মায়োপিয়া সম্ভবত। কত ডায়াপ্টরের চশমা পড়ে তা জানে না রোদেলা। 

 

আবেগের চোখের নিচে কালি আছে। ডান চোখটার নিচটা তুলনামূলক বেশি কালো বাম চোখের চেয়ে। শ্যামলা বর্ণের। রোদেলার শ্যামলা বা কালো ছেলেই ভালো লাগে। এটা সম্ভবত তার বাবা কালো হওয়ার জন্য ই কালো ছেলে ভালো লাগে। আবেগের দাড়ি আছে। তবে সেটা স্টাইল বা ফুংফাং দেখাবার জন্য না। বরং নবীর সুন্নত পালন করার জন্য রেখেছে। কিন্তু বেশি বড় না। চাপ দাড়ির মতোই সেটে রাখা। আবেগের নাকি দাড়ি বড় হলে গাল চুলকায়, এলার্জি হয়! 

 

রোদেলার মনে আছে, আবেগ ক্লাস টেন থেকে দাড়ি রাখে। মামা নাকি কড়াকড়ি করে বলেছে দাড়ি রাকতে। আবেগ ও বাধ্য ছেলের মতো আর কোন দিন শেইভ করে নি। সবসময় গালভর্তি দাড়ি রাখে। আবেগ আবার খুব মা-বাবা ভক্ত।  বাব-মায়ের অনুগত সন্তান।আবেগের সাথে একটা মজার ছোট বেলার স্মৃতি আছে রোদেলার। সে অনেক আগের কথা তা হলোঃ

 

গোল গোল চোখে আধ ভাঙ্গাস্বরে  রোদেলা বলেছিল , আমি আবেগ ভাইয়াকে বিয়ে করব! 

 

তখন হয়তো রোদেলা বিয়ে নামক ভারী শব্দটার অর্থের মানেও বুঝত না৷ কিন্তু সেদিন আবেগ থমকে গিয়েছিল এক পলকের জন্য! 

 

রোদেলার পাকা পাকা কথায় সবাই হেসে একাকার। কিন্তু সেদিন আবেগ হাসতে পারেনি সবার সাথে। তার কেন যেন তখন নিজেকে জামাই জামাই লাগতে লাগে৷ হুট করে এক রাশ লাজুকতা  বিরাজ করে তার মনের মধ্যে!  রোদেলা এহেন কথা শুনে আবেগ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে রুমে যে ঢুকে পড়েছিল। পরের দিন দুপুরে বের হয়েছে সেই ছেলে। অথচ রোদেলা কিন্তু বউ-বিয়ে-স্বামী মানে তখনো বুঝত না! এক পরিচিত ফুপির বিয়ে উপলক্ষে বাবা-মায়ের সাথে আবেগদের বাড়িতে এসেছিল। তখন বিয়ে শব্দটা নতুন শিখে সাথে সাথে এপ্লাই করে বসে রোদেলা। আর আবেগ! বেচারা লজ্জায় রাতে ভাত পর্যন্ত খায় নি। কান্নাকাটি নাকি করেছিল মামীর কাছে কেন রোদেলা তাকে বিয়ে করবে এজন্য কান্না আবেগের৷ আট-নয় বছরের হওয়ার পরও আবেগ কান্না করেছিল। এগুলো অবশ্য রোদেলা কে তার মা গল্প শুনিয়েছে। 

 

অতীতের মিস্টি স্মৃতি চারন করতে করতে রোদেলা হুট করে হেসে ফেলে। 

 

আবেগ দ্রুত ফোন রেখে রোদেলার দিকে তাকায়। মেয়েটা একা একা হাসছে কেন? মাথায় কোন বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিল না তো? 

 

রোদেলা হাসি থামালো আর বলল, সর‍্যি! 

 

আবেগ বিচলিত হয়ে বলে, রোদেলা! ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম? সমস্যা আছে কোন? 

 

–না তো। 

 

–তাহলে একা একা হেসে কি প্রমান করতে চাইছো? পাগল হয়ে যাচ্ছো না তো? 

 

একথায় আবারো রোদেলা হেসে ফেলে। 

 

আবেগ বিড়বিড় করে বলে, অতি হাসি পাগলের প্রাথমিক লক্ষন! 

 

রোদেলা হাসতে হাসতে বলল, সব জায়গায় ডাক্তারি বিদ্যা কাজে লাগাতে আসবে না৷ আমি তোমার রুগী না।এমনি হাসছিলাম। একটা কথা মনে পড়ে গেল তাই! 

 

আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। চারপাশের ডেকোরেশন খুব সুন্দর। আভিজাত্যর শেষ নেই। এক্সপেন্সিভ রেস্টুরেন্ট এটা। চারিদিকে চাকচিক্যময়। তবে এইসব চাকচিক্যময়ের মধ্যে ও রোদেলাকেই বেশি উজ্জ্বল লাগছে। রোদেলার হাসি মাখা চেহারায় ডুবে যাচ্ছে আবেগ। 

 

আবেগ মনে মনে বলে, অশ্রুমালা! তোমাকে হাসলে সবচেয়ে  বেশি, অনেক বেশি সুন্দর লাগে! একদম মুক্তা দানার মতো লাগে! 

 

খাবার চলে আসল। ফ্রাইড রাইসের দুইটা প্লেট্যার। এক প্লেট ফুচকা আর দুইটা  গরম গরম ক্যাপাচুনা কফি। 

 

প্লেট্যারে রাইসের সাথে বীফ চিলি অনিয়ন, প্রন্ড সিজলিং আর স্পাইসি চিকেন ফ্রাইস আছে। রোদেলার চিকেন ফ্রাই খুব পছন্দ। 

 

সে প্লাটার টা সামনে নিল তখনি আবেগ বলল, আগে ফুচকা খাও। 

 

রোদেলা প্লাটার সরিয়ে ফুচকা হাতে নিল। ফুচকা আলাদা ভাবে সাজানো, ছয় ধরনের টক একটা কাচের গ্লাসে সেই গ্লাসের উপর ফুচকা সাজানো। 

 এখানে আবার তেতুলের টক বলে না। বরং বলা হয় সস! 

 

রোদেলা ফোন বের করল। তারপর ছবি তুলল খাবারের। আবেগ রোদেলার এই আচরণ সম্পর্কে অবগত। রোদেলা খানা-পিনার ছবি তুলতে পছন্দ করে সেই বহু কাল আগে থেকে। এতো বড় হওয়ার পর ও এই শখ গেল না! থাক। কিছু শখ থাকা ভালো তাই কিছু বলল না আবেগ। 

 

রোদেলা ছবি তোলা থামিয়ে বলে, একটা সেলফি তুলি?

 

–নো। 

 

–প্লিজ। এমন বয়স্কদের মতো কেন তুমি?

 

আবেগ বিরক্ত হয়ে গেল এবং বলল, তুলো৷ জাস্ট একটা কিন্তু! 

 

রোদেলা ক্যামেরা বের করে বলে, মাস্ক খুলো৷ 

 

আবেগ বলল, না, না। মাস্ক খুলব না। 

 

–কেন? খুলো। নইলে খাবা কেমনে? 

 

আবেগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও খুলল মাস্ক। তারপর ছবি তুলে দুজন। 

 

রোদেলা ফুচকায় সস ঢুকালো  (দামি রেস্টুরেন্ট ফ্যাক্ট) এবং আবেগের মুখের সামনে ধরল। 

 

আবেগ একটু চমকে উঠে বলে, কি?

 

রোদেলা সহজ গলায় বলে, খাও৷ 

 

–তুমি জানো না আমি ফুচকা তেমন খাই না। 

 

–এটা তো হাইজেনিক প্লেস৷ একটা খাও প্লিজ৷ 

 

–না। তুমি খাও। 

 

–তুমি না খেলে আমিও খাব না কিন্তু! 

 

অগত্যা আবেগ হা করে রোদেলার হাত থেকে ফুচকা মুখে পুড়ে নিল। তা দেখে বেশ খুশি হয় রোদেলা।  

 

ফুচকা খাওয়ার পর রাইস খেতে লাগলো তারা। খাওয়ার মাঝখানে আবেগ বলল, কফিটা নেওয়া ঠিক হয় নি। রাইস খাওয়ার পর কোক পেপসি খেতে হয়। দাঁড়াও ওর্ডার দিচ্ছি। 

 

রোদেলা মেন্যু কার্ডে দেখল, কোকের দাম এক গ্লাস ষাট টাকা। অথচ বাইরে এক লিটার সেভেন আপ ই পঞ্চাশ টাকা। সে আবেগকে একথাটা জানিয়ে বলে, দরকার কি?বাইরে থেকে কিনে নিব। 

 

আবেগ আরেকদফা রোদেলার উপর বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, মেয়েদের কিপটা স্বভাবটা মানায় না। স্বভাবটা দ্রুত বদলাও। 

 

রোদেলা মুখ কালো করে আস্তে করে বলে,  আমি মোটেও কিপটা না। শুধু তোমার শ্রমের মূল্যায়ন করি। এতো কষ্টে দিন-রাত এক করে টাকা কামাও, আই রেসপেক্ট ইট! 

 

আবেগের কানে কথাগুলো গেল না। সে কোক অর্ডার দিল এবং কফি গরম করতে বলল। কফি গরম করার জন্য এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়। 

কফি খেতে খেতে আবেগ বলল, আরো কিছু খাবে? ডেজার্ট? 

 

রোদেলা বলল, না। না। আমার পেট ভরে গেছে। আচ্ছা তুমি যদি রেস্টুরেন্টে আসতেই চাইছিলে তাহলে ইভু তখন থামালে না কেন? ও আসত আমাদের সঙ্গে। ও তাও বাইরে খেতে খুব পছন্দ করে। 

 

আবেগ মনে মনে বলে, সব জায়গায় সবাইকে নেওয়া যায় না। 

 

তারপর বিল মিটিয়ে তারা বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো। 

 

★★★

 

ইভানা তাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে রেটিনা কোচিং এর সামনে এসে দাড়িয়ে আছে। মূলত শৌখিনের অপেক্ষায় আছে সে। ছেলেটা এতো বলদ! শৌখিন নাকি আধ ঘন্টা ধরে ট্রেস্টি ট্রিটের সামনে দাড়িয়ে ছিল অথচ তাকে ম্যাসেজ করে ইভানা এই জায়গায় আসতে বলেছে আধ ঘন্টা আগেই। সে নাকি মোবাইল চেক ই করে নি।ইভানা ফোন করায় এখন এদিকে আসছে শৌখিন। 

 

ইভানা মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার খুব অস্থির লাগছে।মাগরিবের আযান পড়ে যাবে কিছুক্ষন পর। কখন আসবে মহাশয়? আর তো অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। 

 

ইভানা দাঁড়িয়ে ছিল। হুট করে তার সামনে একটা মোটর সাইকেল এসে থামল। ইভানা প্রথমে কিছু বুঝতে পারে নি। কিন্তু পরক্ষনে মোটর সাইকেল থেকে একটা কালো মাস্ক পড়া লোক নেমে তার হাত ধরে দিল টান আর ব্যাগসহ মোবাইল লোকটার হাতে চলে গেল। 

 

ইভানা প্রথমে ভাবে ছিনতাইকারী বোধহয়! কিন্তু না এবার লোকটা তাকে টানতে লাগে। কি আজব কান্ড! লোকটা তার হাত খুব শক্ত করে ধরে সামনে এগুতে থাকে।  আতকে উঠে ইভানা। ভয়ে গা কাপুনি দিয়ে উঠছে। 

 

ইভানা ধস্তাধস্তি করতে শুরু করল।আশেপাশে মানুষ আছে কিন্তু সবাই চুপ। কেউ এগিয়ে আসছে না। ইভানা চারপাশে তাকিয়ে একবার সবাইকে দেখে নিয়ে  আর কেদে দিল। 

 

লোকটা তাকে টেনে যেই না মোটর সাইকেলে বসাবে ওমনি কেউ বাধা দেয়৷ 

 

ইভানা চোখ তুলে তাকায় সেদিকে। শৌখিন দাড়িয়ে আছে৷ হাতে টেস্ট্রি ট্রিটের ব্যাগ নিয়ে। তার ভ্রু কুচকে আছে। বোঝাই যাচ্ছে সেও ভয় পেয়ে গেছে। আতংকে আছে৷ 

 

শৌখিন লোকটাকে ইভানার হাত ছাড়তে বাধ্য করে। লোকটা স্বজোড়ে শৌখিনের পেটে ঘুষি মারে। শৌখিন কুকিয়ে উঠে। এর আগে শৌখিন কোন দিন কারো সাথে মারামারি করে নি। মারামারি হতে একশ হাত দূরে থাকা ছেলে সে৷ 

 

কিন্তু আজকে তার কি যেন হলো। মারামারি কোন দিন না করা ছেলেটাও ছিনতাইকারী লোকটার সাথে মারামারি শুরু করে দিল। লোকটাকে এমন মাইর মারল শৌখিন যে বেচারা ইভানার ব্যাগ রেখে কোন মতো মোটর সাইকেল নিয়ে দৌড়ে পালালো৷ শৌখিনের এক কিলেই ছিনতাইকারী লোকটার নাক ফেটে গেছে। সম্ভবত পাশে সুন্দরী মেয়ে থাকায় হুট করে ওতোটা জোশ চলে এসেছে শৌখিনের মধ্যে! 

 

এসব দেখে ইভানার চোখ অক্ষি গোলক থেকে বের হওয়ার উপক্রম। এমন কাহিনি সে টিভিতে দেখেছে। নায়ক এসে নায়িকাকে এভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। ও মাই গড! ইভানা কি তবে নায়িকা হয়ে গেল নাকি? 

 

শৌখিন পেছনে ঘুরে দাড়াতেই ইভানা তাকে ঝাপ্টে ধরে তাও খুব শক্তপোক্ত ভাবে৷ 

 

এতে ভড়কে যায় শৌখিন। এর আগে সে কোন দিন কোন মেয়ের সাথে কথা পর্যন্ত ঠিকঠাক ভাবে বলে নি আর আজকে একটা মেয়ে তাকে রাস্তা জড়িয়ে ধরেছে তাও আবার ডাক্তার মেয়ে! 

 

কি লজ্জা! কি লজ্জা! এই লজ্জা থেকে মুখ কই লুকাবে সে? 

 

★★★

 

মেঘ আজিজুল সাহেবের অফিসে এসেছে। সোজা তার কেবিনে চলে যায় মেঘ। আজিজুল সাহেব তার কক্ষেই ছিলেন। মেঘকে দেখে তার ভ্রু কুচকে গেল। 

 

মেঘ সাবলীল ভাবে উনাকে সালাম দিয়ে বলে, ভালো আছেন? 

 

উনি মাথা নাড়িয়ে বলে হ্যা৷ 

 

মেঘ বলল, বাসার সবাই ভালো আছে? 

 

–হ্যা। এসব বাদ দাও। কেন এসেছো তুমি?

 

মেঘ মাথা নিচু করে বলে, আরেকটাবার ভাবুন আংকেল। এটা অথৈয়ের সারাজীবনের সিদ্ধান্ত। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন। 

 

–সাট আপ এন্ড গেট আউট ফ্রম মাই রুম। (রেগে)

 

–দেখেন ফয়সাল ছেলেটা ভালো না। আপনি একটু চোখ-কান খুলে রাখলেই সবটা বুঝতে পারবেন৷ অথৈও আমাকেই ভালোবাসে৷ 

 

–এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই কথা বলাটা তোমার উচিত হলো না।আমার মেয়ের সাথে তোমার কোন যোগসূত্র নেই। নাও গো ফ্রম হেয়ার। 

 

–ফয়সালের চরিত্র ভালো না। ওর অথৈকে সুখে রাখার কোন যোগ্যতাই নাই। 

 

আজিজুল সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, তাহলে কি তোমার আছে? 

 

মেঘ মাথা নিচু করে বলে, হ্যা। 

 

–হাসালে আমাকে। অথৈয়ের বিয়ে ফয়সালের সাথেই হবে৷ 

 

–ফয়সাল ভাল ছেলে না। আমার কাছে প্রমাণ আছে। 

 

–Thanks for your concern! 

 

★★★

 

–রিকশা ঠিক করে দিলে একা যেতে পারবে বাসায় রোদেলা? 

 

রোদেলা মাথা নাড়িয়ে বলে। হুম পারব। 

 

এই জবাবে সন্তষ্ট হলো না আবেগ। সে রিকশা ঠিক করল। এবং রোদেলাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও চড়ে বসল। রোদেলা বিষ্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার না কাজ আছে? 

 

আবেগ রোদেলার কোমড় চেপে ধরে বসে বলে, সমস্যা নাই। 

 

রিকশা চলতে আরম্ভ করল। হুট করে ঝুপঝাপ শব্দ করে বৃষ্টি পড়তে লাগে। কোন আগাম বার্তা ছাড়াই বৃষ্টির আগমন এই পহেলা ডিসেম্বরে! 

 

ঝুমঝুম বৃষ্টির ছন্দ পতনের মাঝে আবেগ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে কিঞ্চিৎ ভুল বলা হলো! বৃষ্টি বলতে প্রকৃতির বৃষ্টির রুপে হারায় নি আবেগ। বরং তার বৃষ্টিবিলাসীর মধ্যে হারিয়ে মরছে ক্ষনে ক্ষনে! 

 

কি মনোমুগ্ধকর চাউনি তার! মুখে ফোটা ফোটা বৃষ্টির জল! ইশ! এতো রূপবতী কেন রোদেলা? 

 

আচ্ছা আবেগ কি রোদেলার প্রেমে পড়ে গেছে? সম্ভবত হ্যা!!! 

 

এই রোদেলা নামক মেয়েটা এমন ই! এই মেয়ের প্রেমে পড়তে বাধ্য আবেগ। প্রতি জনমে একবার করে রোদেলার প্রেমে পড়া আবেগের জন্য বরাদ্দ হয়ে থাকল। এই জনমেরটা ঘটে গেল মাত্র! 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

Part–32

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রিশাদ সারা ঘরময় পায়চারী করছে। সে বেশ রেগে আছে। কপাল কুচকানোর ভাজ স্পষ্ট হয়ে আছে। রিশাদ যখন প্রচন্ড রেগে থাকে তখন সে হাটাহাটি করে রাগ কমানোর  চেষ্টা করে। কিন্তু আজকে কিছুতেই রাগ কমছে না। বরং পার মিনিটে রাগ বেড়েই চলেছে চক্রবৃদ্ধি হারে! এই জন্য অবশ্য আরো একটা মূখ্য কারন আছে। 

 

আজকে বিকেলের দিকে আবেগের বাসার ওইদিকে গিয়েছিল রিশাদ। তখনি আবেগ আর রোদেলাকে রিকশায় করে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরতে দেখেছে রিশাদ। তাদেরকে এক সঙ্গে দেখে রিশাদের চোখ দিয়ে আগুন ঝড়তে থাকে।  দুজনের মাঝে কোন দূরত্ব ছিল না। গা ঘেষে বসে ছিল পাশাপাশি তারা! যা দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যায় রিশাদের। সে তখনি সেই মূহুর্তে ঠিক করে বসে আবেগের সব সুখ সে নিজ হাতে মাটিতে পুতে ফেলবে। 

 

তার ভাড়া করা লোক দিয়ে ইভানাকে ধরে আনতে চেয়েছিল কিন্তু হুট করে কোথা থেকে যেন একটা ছেলে চলে আসল ইভানাকে বাচাতে৷ রিশাদ বুঝে পায় না, রহমান বাড়ির দুই মেয়েকে তার হাতের থাবা থেকে রক্ষা করার জন্য কি সবসময় কেউ না কেউ প্রস্তুত থাকে? রোদেলা কে রক্ষা করল আবেগ। এদিকে ইভানাকে সাহায্য করল আরেকটা ছেলে! 

 

 রোদেলা আর আবেগের হাসিমাখা মুখ দেখে  মোটেও সহ্য হচ্ছে না রিশাদের। রোদেলা তার স্ত্রী। সে কেন আবেগের সাথে থাকবে?  কেন এক বিছানায় ঘুমাবে তারা? রিশাদ রোদেলার এই বিয়ে মানে না। কিছুতেই মানে না৷ আর এই ডিভোর্স টাও সে মানতে নারাজ৷ কেন মানবে সে? তাকে জোড় করে সিগনেচার করানো হয়েছে ডিভোর্স পেপারে। তাই সে এই ডিভোর্স মানে না। রোদেলাকেও আবেগের স্ত্রী হিসেবে সে মানবে না কোন দিন।  আবেগ ব্লাকমেইল  করে রিশাদের  স্বাক্ষর নিয়েছে ডিভোর্স পেপারে ।একটা মেয়ের সাথে খোলামেলা ভাবে মেলামেশার ভিডিও দেখিয়ে সিগনেচার করিয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। আবেগের দাবি ছিল, ডিভোর্স পেপারে সাইন না দিলে সে ভিডিও ভাউরাল করে দিবে। রিশাদের তখন এমপি সাহেবের মেয়ের সাথে সম্পর্ক চলছিল তাই তো ভিডিও ভাইরাল হলে সোনার হরিণ হাত ছাড়া হবে এই ভয়ে সে সিগনেচার করে ফেলে। কিন্তু আফসোস! মেয়েটার সাথে তার সব সম্পর্ক শেষ  হয়ে গেছে  । এমপি সাহেবের মেয়ে কিভাবে যেন জানতে পেরেছে রিশাদের চরিত্র ভালো না। তাই সঙ্গে সঙ্গে সব সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে সে নিউইয়র্ক চলে গেছে। 

 

রিশাস কালকেই জানতে পেরেছে এমপি সাহেবের মেয়ের কাছে  সব সত্য কথা ফাস করেছে আবেগ আর আবেগের বন্ধু মেঘ। 

 

আবেগ যদি এমপি সাহেবের মেয়েকে সব না জানাত তবে রিশাদের নজর ও আরেকদফা রোদেলার উপর গিয়ে ঠেকত না। 

 

রিশাদ বিড়বিড় করে বলে, সব দোষ আবেগের! ওই বালের ডাক্তারের জন্য আজকে আমার এমপি হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে গেল! এখন তার কিছু একটা করতে হবে। আবেগকে শাস্তি দিতে হবে। কঠিন শাস্তি! তার সাথে মাঠে খেলতে এসেছে আবেগ! আচ্ছা আবেগ কি ভুলে গেছে? আবেগ যদি খেলোয়াড় হয় তাহলে রিশাদ রেফারি! 

 

রিশাদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। এতোদিন মুখ বুজে নিজের বউকে অন্য এক পুরুষের সাথে থাকতে দিয়েছে কিন্তু আর না! ইনাফ ইস ইনাফ! কালকে থেকে তার বউ তার সাথে থাকবে। থাকতে না চাইলে জোর করে বেধে-ধরে, পিটিয়ে রাখবে। দরকার হলে জিন্দা লাশ বানিয়ে নিজের কাছে রাখবে রোদেলাকে তাও তার রোদেলাকেই চাই। 

 

★★★

 

রিকশা এসে থামল বাসার সামনে। রোদেলা নিচে নেমে গেল। আবেগ ভাড়া দিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ে৷ সে মনে মনে খুব শান্তিতে আছে। সত্যি বৃষ্টি ফোটা গুলো তার মাথার জট খুলে দিয়েছে। এতো দিন যেই বিষয়টা নিয়ে সে বিড়ম্বনায় ছিল তা দূর হয়ে গেছে। 

 

আবেগ পা বাড়ালো সামনের দিকে। রোদেলা তার অপেক্ষা করছে সিড়ির সামনে৷ রোদেলার চুল গুলো ভিজে গেছে বৃষ্টির পানিতে। ফলে চুল গুলো নেতিয়ে গেছে। এবং দলা পাকিয়ে  কাধের নিচে  পড়ে  কোমড় পর্যন্ত বয়ে গেছে।

 

আবেগ অপলক বিমুগ্ধ নয়নে তাকালো রোদেলার দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠে গেল।।

 

আবেগদের বাসা তিনতলায়। সিড়ি দিয়েই ওঠা-নামা করে আবেগ। সে লিফট উঠতে পারে না। লিফটের দরজা যখন বন্ধ হয় ওই সময় আবেগের ভয় খুব ভয় লাগে। মনে আতংক খেলা করে। বারবার মনে হয় লিফট ছিড়ে পড়বে। সেজন্য যতোটা সম্ভব লিফট এভোয়েড করে সে। 

 

বাসায় গিয়ে আগে আবেগ ফ্রেস হয়ে নিল। এরপর রোদেলা গোসল করে নেয়। 

 

রোদেলা গোসল করে বের হয়ে দেখে আবেগ সমুদ্রকে দোলনায় দোল খাওয়াচ্ছে আর ওর সাথে খেলা করছে। হাতে ফিডার নিয়ে কিছুক্ষন পর পর সমুদ্রের মুখে তুলে ধরছে৷ 

 

রোদেলা মুচকি হেসে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো। আজকে সেও মনে মনে খুব খুশি। এই প্রথম আবেগের চোখে সে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখেছে। রোদেলা আয়নার দিকে তাকালো। তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। সত্যি! তার চেহারায় পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো চোখে কালি নেই। মুখে ব্যথা বা ফুলে যাওয়ার কোন দাগ ও নেই৷ মুখটা চকচক করছে। আগের চেয়ে কিছুটা স্বাস্থ্য হয়েছে তার। রোগা রোগা ভাবটা দূর হয়েছে। চোখে দুঃখের কোন ছাপ নেই। চুল গুলোও সুন্দর হয়েছে। আগে চুল গুলো উষ্কখুষ্ক থাকত।  যত্ন নিত না ঠিক মতো৷ এখনো ঠিক মতো যত্ন নেয় না তাও কেন যেন চুল গুলো বেশ ঝলমলে হয়ে গেছে! 

 

রোদেলা চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে মুছতে লাগে৷

 

 

পেছন থেকে আবেগ আয়নায় রোদেল দেখে বলে উঠে,  হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাও। চুল ভেজা রাখলে ঠান্ডা লাগবে। 

 

–লাগবে না। আমি হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাই না৷ এতে চুল নষ্ট হয়ে যায়। 

 

–একদিন হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকালে কিছু হবে না। 

 

–না। লাগবে না। 

 

বলে রোদেলা চোখে কাজল দিতে লাগলো। তারপর বারান্দায় গেল টাওয়াল মেলে দিতে। 

 

আবেগ বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়ে গেল। কেউ তার কথার পিঠে কথা বললে তার ভালো লাগে না। আবার কাউকে যদি সে কিছু করতে বলে সেটা না করে অন্য কিছু করে তবে আবেগ মনে মনে ক্ষেপে যায়৷ সেই কেউটা যদি রোদেলা হয় তাহলে ক্ষেপে যাওয়ার মাত্রাটা আরো একটু বৃদ্ধি পায়। আপাতত সে মনে মনে ফুসছে। 

 

বারান্দা থেকে বের হতেই বারান্দার দরজার সামনে আবেগকে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোদেলা সামান্য চমকায়৷ 

 

তা দেখে আবেগ বলে, ভয় পেলে নাকি?

 

রোদেলা তড়িঘড়ি করে বলে, ভয় কেন পাব? 

 

–তা তো দেখতেই পাচ্ছি। 

 

রোদেলা আবেগকে পাশ কাটিয়ে যেতে ধরলে আবেগ তাকে আটকে দেয় এবং রোদেলার হাত ধরে ফেলে এবং সোজা আয়নার সামনে গিয়ে বসিয়ে দেয়। এবং হেয়ার ড্রায়ার অন করে আবেগ নিজেই রোদেলার চুল গুলো শুকাতে লাগে। 

 

রোদেলা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবেগের প্রতিবিম্বের দিকে। সাধারণ চেহারার অতি অসাধারণ মানুষটার মধ্যে কি আছে? যা অতি অসাধারণ মানুষের মধ্যে ও নেই? 

 

হুমায়ুন আহমেদ স্যার ঠিক বলেছেন, সাধারণ হওয়া নাকি অনেক কঠিন? আচ্ছা আবেগ কি সাধারণ? তার তো মনে হয় না! বরং তার মনে হয় আবেগ হওয়া চারটি খানি কথা না!   আবেগের মতো এতো সরল মনের মানুষ জগতে খুব কমই আছে। 

 

আবেগ মনোযোগ দিয়ে রোদেলার চুল শুকাচ্ছে। তার এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে রোদেলার চুল শুকানোর মতো কঠিন কাজ আর একটাও নেই। এর চেয়ে অপারেশন করাও বেশি সহজ মেবি! কি এক মসিবতে পড়ে গেল। চুল ধরলেই তড়তড় করে হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে এতোই সিল্কি যে হাতে ধরে রাখা যাচ্ছে না। তার উপর বাতাস করলে অন্য দিকে উড়ে যায়। ফলস্বরূপ আবেগ তার হাতকেই গরম হাওয়া পরিবেশন করছে। রোদেলা পুরোটা সময় ধরে আবেগকে দেখতে লাগে। 

 

হুট করে রোদেলার চোখ ভিজে উঠে। আচ্ছা এতো সুখ যদি তার সহ্য না হয়? যদি সুখ গুচ্ছ গুলো কার্পূড়ের মতো তার জীবন থেকে উবে যায়? রোদেলার চেহারায় মূহুর্তের মধ্যে একটা আর্তনাদের ছাপ পড়ে গেল। 

 

★★★

 

ইভানাকে শৌখিন নিজ দায়িত্বে তার বাসায় পৌছে দিয়ে গেল। ইভানা ভীষণ ভয়ে পেয়ে গেছে। তার হাত-পা এমনকি হৃদপিন্ড এখনো জোড়ে জোড়ে কাপছে। শৌখিন বাসার নিচে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে। সিড়ি বেয়ে উঠতেই ইভানা হাপিয়ে গেল। বড় বড় করে শ্বাস ফেলে সে বেল বাজায়। 

 

গেট খুলে রোদেলা। ইভানাকে দেখে তার ভ্রু কুচকে যায়। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। অথচ আবেগের কাছ থেকে ইভানা পাচটার দিকে দেখা করেছে। এই এতোটা সময় কই ছিল ইভানা? রোদেলা কে ইভানা শৌখিনের ব্যাপারে জানিয়েছে। কেবল রোদেলাই শৌখিনের ব্যাপারটা জানে। 

 

রোদেলা প্রশ্ন করে, শৌখিন এসেছিল? 

 

ইভানা মাথা নাড়ায়। 

 

–ওর সাথে ছিলে? 

 

–হুম। 

 

রোদেলা বলল, এতোক্ষণ একসাথে থাকা কি ঠিক হয়েছে? 

 

ইভানা মাথা নিচু করে ফেলে। সে কি ভাবীকে বলবে কি বিপদে পড়তে বসেছিল সে? 

 

রোদেলা মৃদ্যু হেসে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। নেক্সট টাইম থেকে এতো রাত করে বাইরে থাকবে না। তুমি তো জানোই মামী এসব পছন্দ করে না এবার যাও ফ্রেস হয়ে আসো। 

 

ইভানা হুম বলে তার রুমে পা বাড়ালো।ইচ্ছা করে ই কিছু জানালো না রোদেলা কে সে।  

 

রাতে খেতে বসেছে সবাই। আবেগ একটু লেটে আসল। ততোক্ষনে সবাই খেতে বসে গেছে। 

 

আজকে রাতের রান্নাও রোদেলা করেছে। ভাত আর পাতাকপি দিয়ে মুরগীর মাংস। রোদেলা একটু তেল-মশলা বেশি করে দিয়ে রান্না করে। এতে রান্না সুস্বাদু হয়। আজকেও স্বভাব মতো তেল বেশি দিয়ে ফেলেছে৷ মাংসের কড়াইয়ে এক সেন্টিমিটার জুড়ে তেল ভেসে আছে৷ 

 

জাবেদা খাতুন প্লেটে তরকারি তুলে নিতে নিতে মুখ কঠিন করে বলে, মাংসে এতো তেল দাও কেন? বলি টাকা কি তোমার বাবা দেয়? তেলের দাম জানো? বাজারে সবচেয়ে দাম বেশি হলো তেলের!  কিন্তু এই মেয়ে এমন ভাবে তরকারিতে তেল দেয় যেন আমাদের সয়াবিন তেলের খনি আছে! তুমি  লাট সাহেব হতে পারো । কিন্তু, আমাদের এতো টাকা-পয়সা নাই তোমার বাবার মতো। তোমার বাবার বহু আছে তাই বেশি করে তেল দিয়ে রান্না কর ৷ আমরা তোমাদের মতো এতো ধনী না বাপু! 

 

রোদেলার মনটাই বিষিয়ে গেল। মামী ইচ্ছা করেই তার বাবার কথা তুলেছে। সে খুব ভালো করেই জানে তার বাবার অবস্থা ভালো না।  অভাবের সংসার তাদের৷ সেই তুলনায় আবেগরা হাজার গুন ভালো আছে। তারপর ও কিভাবে ঠেস মেরে কথা বললেন মামী। 

 

জাবেদা খাতুন খেতে খেতে বলে, তোমার বাবা যদি এতোই ধনী হয় তাহলে মেয়েকে বাড়ি থেকে পাঠানোর আগে খই-মুড়ি দেয় কেন? 

 

রোদেলা লজ্জায় চুপসে গেল। আজকে টেবিলে ইভানা নেই। 

 

মামা আর আবেগ আছে কেবল। আবেগ মাত্র এসে বসেছে কিন্তু মায়ের সব কথাই সে শুনে নিয়েছে। 

 

ইমতিয়াজ রহমান আজকে নিশ্চুপ। সে চাইলেই রোদেলার হয়ে জাবেদা খাতুন কে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু  সে চায় আবেগ যেন নিজ থেকে কিছু একটা বলুক তার মাকে। কেননা সে একশ টা কথা বললেও জাবেদা খাতুনের কিছুই যায় আসবে না কিন্তু আবেগের একটা কথাই জাবেদা খাতুনকে চুপ করতে বাধ্য। ইমতিয়াজ রহমান প্রতিদিন ইচ্ছা করেই রোদেলাকে নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়ান যেন রোদেলা ঠিক মতো খায়। নিজের মেয়ের মতো আদর করেন তিনি রোদেলাকে। আজকেও রোদেলা তার পাশে বসে আছে কিন্তু মুখে কিছুই তুলছে না। 

 

আবেগ সাবলীল ভাবে প্লেটে মাংস নিয়ে খাওয়া শুরু করল। সবাই চুপ। কারো মুখে কোন কথা নাই। 

 

দুই লোকমা খাওয়ার পর আবেগ বলে উঠে, ফার্মের মুরগী তে তেল-মশলা বেশি না দিলে কেমন গন্ধ করে। আমি খাইতে পারি না। নেক্সট বার থেকে আরো একটু বেশি করে তেল দিবা। আর আমাদের যথেষ্ট আছে আম্মা। আব্বার একটা প্রোডাক্ট সেলের টাকায় পাচ মাসের তেল কেনা যাবে। সো শুধু শুধু কথা শুনানোর আমি কোন কারন দেখি না। ইললজিক্যাল কথা-বার্তা আমার পছন্দ না।

 

আবেগের কথা শুনে রোদেলা তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। সেই চাউনিতে একরাশ ভালোবাসা! 

 

খাওয়া শেষ করে আবেগ উঠে যায়৷ ইমতিয়াজ রহমান খুব খুশি আবেগকে রোদেলার হয়ে কথা বলতে দেখে। তাই তিনি দুইবার ভাত নিলেন। খেতে খেতে বললেন, আহা! এতো মজার মুরগির মাংস আমি জীবনে খাই নি। শেষ বয়সে যে এতো মজার মজার খাবার খেতে পারছি এটা তো আমার ভাগ্য। 

 

জাবেদা খাতুন মুখ কালো করে উঠে পড়েন। রোদেলা সামান্য খেয়ে নেয় এবং সমস্ত কাজ করে রুমে আসে। ততোক্ষণে আবেগ শুয়ে পড়েছে। রোদেলা আবেগের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। 

 

পরের দিন সকাল-সকাল রোদেলা উঠার আগেই আবেগ বেরিয়ে যায়। 

 

রোদেলা নয়টায় ঘুম থেকে উঠে যাবতীয় সব কাজ শেষ করে ফেলে। দুপুরের রান্না বসিয়ে দেয় সে। 

 

ইভানা তখন এসে বলে, সে বাইরে যাবে। 

 

জাবেদা খাতুন যাওয়ার অনুমতি দেয়। 

 

রান্না শেষ করে  সমুদ্র কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে গোসল করে বের হয় রোদেলা। কি মনে করে ফোনটা হাতে নিল সে। 

 

তখনই জাবেদা খাতুন রুমে আসলেন আর ঠিক সেই মূহুর্তে রোদেলার ফোন বেজে উঠল। 

 

স্ক্রিনে রিশাদের নাম দেখে জাবেদা খাতুন তেলে বেগুন চেতে রোদেলাকে অনেক কথা শুনিয়ে পাশের বাসার ভাবীর কাছে যান। 

 

কিন্তু রোদেলা অস্থিরে মরে যাচ্ছে। রিশাদ কেন কল করেছে? 

 

তখনি আবারো কল আসে। রোদেলা ফোন ধরে। 

 

ওপাশ থেকে ধমকে রিশাদ রোদেলাকে বলে,এতোক্ষন লাগে ফোন ধরতে? 

 

রোদেলা কড়া গলায় বলে, কেন কল করেছো? 

 

–নিচে নামো। 

 

–কেন? 

 

–তোমার সাথে কথা আছে৷ 

 

–তোমার কথা থাকতে পারে বাট আমার কোন কথা বলার নেই। 

 

–রোদেলা তুমি যদি নিচে না নামো তাইলে তোমার পেয়ারি ননদকে আমার লোকরা তুলে নিয়ে যাবে৷ 

 

রিশাদের কথা শুনে রোদেলা চিৎকার দেয়। ওপাশ থেকে রিশাদ হোহো করে হেসে বলে, ডোন্ট লেট। সময় মাত্র এক মিনিট। 

 

রোদেলা ভয় পেয়ে যায়। সে আবেগকে কল করতে করতে নিচে নামে কিন্তু আবেগ ফোন ধরছে না। 

 

সে নিচে নেমে কোথাও রিশাদকে দেখতে পেল না। পেছনে ঘুরে বাড়ি ফিরবে ওমনি কেউ তার মুখ চেপে ধরে। 

 

রোদেলা চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–33

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রোদেলা চোখ বড় করে ফেলে। কেউ তার মুখ চেপে ধরে আছে রুমাল দিয়ে। যার জন্য সে ঠিক মতো নিশ্বাস ও নিতে পারছে না! রোদেলা নড়াচড়া-ছোটাছুটি শুরু করে দিল বাচার তাড়নায় কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি এক চুল পরিমাণ নড়ল না৷ রোদেলার নাকে একটা কেমন উদ্ভট গন্ধ এসে লাগলো। 

 

রোদেলা চারপাশে তাকাচ্ছে। দুপুর হওয়ায় আশেপাশে তেমন কেউ নেই। আর তাছাড়া আবেগদের বাসা টা একটু ভেতরে আর আবাসিক এলাকা হওয়ায় অযথা ঘুরঘুর স্বভাবের মানুষ দের এদিকে  খুযে পাওয়া যায় না। বাসার নিচেও দারোয়ান নেই। উনি এসময় খেতে যান। যে ব্যক্তি তাকে অপহরণ করতে চায় সে সব খবর নিয়েই এসেছে৷ এখন কি করবে রোদেলা? 

 

রোদেলার মুখে ক্লোরোফর্ম দেওয়া হয়েছিল। তাই ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে লাগলো রোদেলা।চোখ ধাপসা হতে লাগে তার। তারপর ও আশেপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে যদি কারো কাছে  সাহায্য নিতে পারে? 

 

রোদেলার চোখ বন্ধ হয়ে আসল। 

 

★★★

 

জাবেদা খাতুন পাশের বাসার ভাবীর কাছ থেকে গল্প-গুজব করে নিজের বাসায় ফিরছেন। পাশের বাসার ভাবী পাশের বাসায় থাকেন না। উপরের তলায় থাকেন।  তাও পাশের বাসার ভাবী বলেই তাকে ডাকা হয়। জাবেদা খাতুন পাক্কা দুই ঘন্টা পর নিচে নামছেন।আজকে দুপুরে ইমতিয়াজ রহমান বাসায় আসবেন না। আবেগ ও বিকেলে ফিরবে। তাই কোন তাড়া নেই তার। জমিয়ে আড্ডা দিয়ে এলেন তিনি। 

 

 সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই তার চোখ কপালে। বাসার গেট হাট করে খোলা। যে কেউ ঢুকে পড়বে! 

 

জাবেদা খাতুন মনে মনে রেগে গেলেন রোদেলার উপর। মেয়েটা তো ভারী দায়িত্ব-কর্তব্য হীন। এভাবে কেউ গেট খুলে রাখে! চোর ঢুকলেই তো সব শেষ! 

 

উনি বাসায় গিয়ে জোরে জোরে বার কয়েক রোদেলার নাম নেন। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া-শব্দ নেই।  জাবেদা খাতুন আরো ক্ষেপে যান। তিনি ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে ছিলেন। গেট লাগিয়ে আবেগের রুমে যেতে লাগলেন উদ্দেশ্য রোদেলা কে কড়া কিছু কথা শুনানো। 

 

কিন্তু আবেগের রুমের সামনে যেতেই সমুদ্রের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। উনি ভ্রু কুচকে রুমে ঢুকলেন। রোদেলা রুমেও নেই, রুমের বাইরেও নেই। বাচ্চাটা একাধারে কেদেই যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে মাকে খুজছে বুঝি।

 

উনি উঁকি মেরে বাথরুম দেখলেন। রোদেলা সেখানেও নেই। এদিকে সমুদ্রের কান্নার বেগ বেড়েই যাচ্ছে৷ 

 

সময় এখন সাড়ে তিনটা। উনি বাসা থেকে উপর তলার ভাবীর বাসায় যান দেড়টার দিকে। 

 

রোদেলা কে না পেয়ে উনি রুম থেকে বের হলেন। যার বাচ্চা তারই কোন হেল-দুল নাই। বাচ্চা কান্দে মা নাই! কই তার ও দুইটা বাচ্চা ছিল, নিজ হাতে মানুষ করেছে। এভাবে রেখে তো কোথায় যেত না। 

 

জাবেদা খাতুন রোদেলাকে আগেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে রোদেলার এই বাচ্চার দায়িত্ব সে একদমই নিবে না। এইজন্য মাত্র একবার কোলে নিয়েছে। 

 

সমুদ্র কেদেই চলেছে। উনি গেট লাগিয়ে দিলেন। যার বাচ্চা সে এসে থামাবে। 

 

উনি গিয়ে নিজের রুমে বসলেন। উপরতলার ভাবীর সাথে আজকে খেয়ে এসেছেন। বরবটি দিয়ে শিং মাছের ঝোল। উনি টিভি অন  করেন। 

 

প্রায় চারটার দিকে উনি বের হলেন রুম থেকে। সে কি বাচ্চা এখনো কান্না করে। তবে কান্নার তেজ কমে এসেছে। 

 

জাবেদা খাতুন আবেগের রুমে গেলেন। সমুদ্রের চেহারা সসম্পূর্ণ লাল হয়ে গেছে। মুখ-চোখ শুকায় গেছে। খিদা লেগেছে বুঝাই যাচ্ছে। 

 

জাবেদা খাতুন অনিচ্ছা  সত্ত্বেও কোলে তুলে নিয়ে ফিডার বানিয়ে সমুদ্র কে খাওয়ালেন। খাওয়ার পর ই সমুদ্র কান্না শুরু করল। জাবেদা খাতুন বিরক্ত হলেন। রোদেলা কই রেখে গেল বাচ্চাকে? এখন কি তাকে রোদেলার বাচ্চা সামলাতে হবে? নিজের নাতি হলে কথা ছিল। কার না কার বাচ্চা এখন তাকে দেখ-ভাল লরে বড় করতে হবে? ঠেকা পড়েছে তার! 

 

সমুদ্র একাধারে কেদেই চলেছে। কিছুতেই থামে না। দুধ খাওয়ার মিনিট পাচ পর হরহর করে বমি করে দিল। 

 

জাবেদা খাতুনের টনক নড়ল এবার। সমুদ্র বুঝি অনেকক্ষণ যাবত না খাওয়া ছিল! রোদেলা কি মাত্র বের হয়েছে নাকি সে উপরে যাওয়ার সাথে সাথে কোথাও বাচ্চা রেখে গেছে? বাচ্চাটার তো কষ্ট হচ্ছে মা কে ছাড়া! কেদে কেদে লাল হয়ে যাচ্ছে। জাবেদা খাতুন বুকে ছড়িয়ে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না। সমুদ্র থেকে থেকে শব্দ করে কানা জুড়ে দিচ্ছে৷ 

 

রোদেলা কিসব বলে  সমুদ্র কে! সেগুলো শুনে বাচ্চাটা চুপ থাকে। কিন্তু জাবেদা খাতুন তো আর এগুলো বলতে পারবেন না। উনি আবার দুধ খাওলালেন সমুদ্র। বাচ্চাটার চেহারা এই এক ঘন্টার মধ্যে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। শুকিয়ে যাচ্ছে মুখটা। চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে সমুদ্র। নিস্তেজ হয়ে গেছে সে। ঘুমু ঘুমু চোখে মাকে খুজতে খুজতে ঘুমিয়ে পড়ল সমুদ্র। 

 

হাফ ছেড়ে বাচলেন যেন জাবেদা খাতুন! 

 

বিকেলের দিকে আবেগ বাসায় ফিরল। বাসায় ফিরে রুমে এসে তার কেমন যেন লেগে উঠল। রুমে রোদেলা নেই। এতো দিনে রুমে ঢুকে রোদেলাকে দেখার অভ্যাস হয়ে গেছে তার। কিন্তু আজকে রুমে  সমুদ্র একা শুয়ে আছে। রুমের কোথাও রোদেলা নেই। আজকে হাসপাতালের একটা ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট এসেছিল তাই খুব বিজি ছিল আবেগ। একবার  ও ফোন দেয় নি বাসায় সে। 

 

ফ্রেস হয়ে এসে আবেগ সমুদ্র কে কোলে নিল। আজকে হাসছে না সমুদ্র। বরং তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চেহারায় মলিনতার ছাপ। মুখটা শুকনা আর লাল হয়ে আছে। আবেগ বিচলিত হল। সমুদ্র কি অসুস্থ হল? ওর কি কষ্ট হচ্ছে? আর সমুদ্র কে এই অবস্থায় রেখে রোদেলা কই গেল? 

 

আবেগ আব্বা বলে ডাকল। সমুদ্র চোখ খুলে তাকালো। কিন্তু আজকে মুখে-চোখে উল্লাস বা জৌলসতা নেক। সমুদ্র কে চুমু খেয়ে তাকে কোলে নিয়ে রুমের বাইরে গিয়ে আবেগ জাবেদা খাতুন কে প্রশ্ন করল, মা রোদেলা কোথায়? 

 

জাবেদা খাতুন টিভি দেখতে দেখতে উত্তর দেয়, তোর বউ তুই জানিস! আমি বলছি না ওই মেয়ের কোন কিছুই আমি জানতে চাই না। 

 

আবেগ কথা বাড়ায় না। সে ধরেই নেয় রোদেলা বাইরে কোন কাজে গিয়েছেব।যেতেই পারে। রোদেলা শিক্ষিত একটা মেয়ে। কোথাও হয়তোবা গিয়েছে। 

 

আবেগ বারান্দায় এসে দাড়ালো সমুদ্রকে নিয়ে। সে মূলত বারান্দায় দাড়িয়েছে যেন রোদেলা আসলেই তাকে সবার আগে নিচ থেকে দেখতে পারে। মনে মনে খানিকটা হলেও অশান্ত আবেগ। রোদেলা কে কল দিয়েছে কিন্তু ফোন অফ। সময় যতোই যাচ্ছে ততোই অস্থির হচ্ছে আবেগ। সাড়ে ছয়টা বাজতে চলল কিন্তু রোদেলার আসার নাম নেই। আবেগ অথৈকে কল করেছিল কিন্তু অথৈ রোদেলার ব্যাপারে কিছু ই জানে না। দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে তার মনে। এতো দেরি করার মতো মেয়ে রোদেলা না।

 

আবেগ অস্থিরতা নিয়েই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। তখনি জাবেদা খাতুন এসে দাড়ালেন বারান্দায়। 

 

আবেগ তাকে দেখে কিছু বলল না। 

 

জাবেদা খাতুন বললেন, কার জন্য অপেক্ষা করছিস? 

 

আবেগ ভ্রু কুচকালো। 

 

তিনি তুচ্ছ স্বরে বলে, ওই অপয়া মেয়েটার জন্য দাঁড়ায় আছিস নাকি?ওর অপেক্ষা করিস না বাবা। ওই মেয়ে তার বড়লোক প্রথম স্বামীর ঘরে চলে গেছে।  

 

আবেগ বিষ্ফরিত চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। 

 

উনি কঠিন গলায় বলে, তোকে বোকা পেয়ে মেয়েটা তোকে ফাসাইছে। এখন দেখ ঠিকই প্রথম স্বামীর সাথে ফূর্তি করতে গেছে। তোর উপর বাচ্চা গচ্ছায় দিয়ে মেয়ে পালাইছে৷ 

 

আবেগ এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুলে বলে, এসব কি আজেবাজে বকছো মা? রোদেলা কোথাও কোন কাজে গিয়েছে বোধহয়। চলে আসবে একটু পর। ফোন অফ জন্য কিছু জানাতে পারছে না। এই সামান্য ব্যাপারে ও তুমি রিশাদকে কেন টানছো? 

 

জাবেদা খাতুন তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, দুপুরে ওই মেয়ের প্রথম ভাতাড় আমার সামনেই ফোন দিছিল ওকে। তারপর থেকেই মেয়েটা দুধের বাচ্চা রাখে প্রথম ভাতাড়ের সঙ্গে পালায় গেছে।ছিঃ ছিঃ এগুলো কথা মুখেও নেওয়া যায় না রে বাবা। ওই মেয়ের চরিত্র ভালো না। রুপের জালে ফাসায় ছেলেদেরকে। তোলে ফাসাইছে জন্য তুই বুঝতেছিস না। নাহলে তুই ই বল তালাক হওয়ার পর ও কোন ঠেকায় রিশাদ ওকে ফোন দিবে? রিশাদের কি এমন দরকার পড়ছে ওর মতো মেয়েকে কল দেওয়ার? কিন্তু দিসে কল। মানে বুঝিস নি, ওদের মধ্যে এখনো সম্পর্ক আছে। 

 

আবেগ তার মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, প্লিজ চুপ করো না। রোদেলাকে নিয়ে অযথা কোন কথা বলবে না। 

 

জাবেদা খাতুন যেতে যেতে বলে, আমি নিজের চোখে রিশাদকে ফোন দিতে দেখছি রে বাবা। তোর বউ তোকে হাত করে নিসে তাই তুই কিছু বুঝতেছিস না। 

 

আবেগ মায়ের কথা  শুনে ভেঙে পড়ল ভেতরে ভেতরে। 

 

সে রুমে ঢুকল। ডেসিং টেবিলের সামনে রোদেলার ফোন। সে দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে দেখল চার্জ নাই ফোনে। 

 

ফোন চাজে দিয়ে অন করে ডায়াল লিস্টে যায় আবেগ। আবেগের বুক ব্যথা ব্যথা করে উঠে। রিশাদের কল এসেছিল। ঠিক দুপুরে কল এসেছিল। 

 

আবেগের চোখে ধাপসা হতে লাগলো। তবে কি মা ঠিক বলেছে? রোদেলা কি তার সাথে ছলনা করেছে? রোদেলা কি  তবে ছলনাময়ী? 

 

মূহুর্তের মধ্যে সব কিছু  অন্ধকার হতে গেল। সবকিছু  মানে সবকিছু! 

 

আবেগ বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে এবং সমুদ্র কে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। 

 

আসলে মানুষ যখন অতি কষ্ট পায় তখন আর চোখ খোলা রাখতে পারে না! সুখী থাকলে আর চোখ বন্ধ করতে মন চায় না। চোখ খুলে সব সুখ অনুভব করতে মন চায়৷ 

 

কিন্তু দুঃখ!  সে তো কালো! তাই চোখ খুলে রেখে তাকে পাওয়া যায় না! 

 

আবেগের হুহু করে কান্না করতে মন চাচ্ছে 

রোদেলা কোথায়? তার তো মন মানে না! 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–34

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আবেগের চোখ বেয়ে দুই ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে বিছানায় পড়ল। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। এই মূহুর্তে এখনি ঘুমিয়ে যেতে মন চাচ্ছে আবেগের। চোখ খুলে রাখার জন্য ইতিমধ্যে নিজের সাথেই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। 

 

আবেগ বহু কষ্টে চোখ খুলল। যদি সে ঘুমিয়ে পড়ে তবে এই ঘুম তার জন্য মোটেও সুখকর হবে না বরং যন্ত্রনাময় হবে। আবেগের মাথা ভোভো করছে। রোদেলা কোথায়? আবেগের তার মায়ের কথা মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রথমে খনিকের জন্য রিশাদের নাম দেখে কষ্ট লাগলেও এখন কেন যেন মনে হচ্ছে রোদেলার কোন সমস্যা হয়েছে। যে মেয়ে এতো বাধা অতিক্রম করে, রিশাদ হতে দূরে চলে এসেছে। রোদেলার ভাষায় জাহান্নাম ছিল রিশাদের সংসার! তাহলে জেনে বুঝে কেউ জাহান্নামে ঝাপ দিবে কেম? 

 

 বরং যে জাহান্নামে যাবে সেও প্রতিমূহুর্তে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে। দুনিয়ায় যে যতোই পাপ করুক না কেন কেউ ই জাহান্নামে যেতে চায় না। 

 

আবেগ উঠে বসল। রোদেলার ফোনটা আবারো হাতে নিল। ফোনটা ভালভাবে পর্যবেক্ষন করল, ডায়ালের প্রথমে রিশাদের নাম। এর আগে গতকাল বাবাকে করেছে, পড়শু চাচিকে আর বাসস্ট্যান্ডে থাকাকালে আবেগকে ফোন দিয়েছে। রিশাদের নাম সবার আগে। এরপর আর কারো কল আসে নি। 

 

আবেগ ফোন টা রাখতে গিয়ে খেয়াল করল, ফোনের কভারে লাল মাটি লেগে আছে। সে ভ্রু কুচকে ফেলে। এই ধরনের মাটি তো তাদের বাসার একদম পাশেই স্তুপ করে রাখা। সেই মাটি রোদেলার ফোনে আসল কিভাবে? ফোন তো বাসায় তাহলে নিচে থাকা মাটি ফোনে লাগল কেমনে? নাকি কালকে যখন বের হয়েছিল তখন লেগেছিল মাটি? ফোনটার স্ক্রিন ও ভাঙ্গা । কালকেই তো ঠিক ছিল। 

 

আবেগ মনে করার চেষ্টা করল, নাহ, রেস্টুরেন্টের ভেতরেই রোদেলা ফোন ব্যাগে ঢুকিয়েছিল আর বের করে নি। 

 

আবেগের মাথা হ্যাং মারল। সে খনিকের জন্য রোদেলাকে অবিশ্বাস করে বসলেও  এখন আর করছে না অবিশ্বাস। মেয়েটাকে সে চেনে। মরে গেলেও রিশাদের কাছে যাবে না। আর রিশাদ ও তো একটা জানোয়ার! তাদের বাসায় এসে কিভাবে রোদেলার উপর তার সামনেই অত্যাচার করতে ধরেছিল। 

 

ধপধপ করে মাথা, চোখ জ্বলছে আবেগের৷ আবেগ নিজের ফোন বের করল। সাইলেন্ট করা। ফোন বের করতেই রোদেলার এই নাম্বার থেকে ছয়টা কল। সে ভ্রু কুচকে ফেলে। কিন্তু রোদেলার ফোনে তো তার নাম ডায়াল লিস্টে নাম নেই।

 

 তবে কি তৃতীয় পক্ষের কেউ রোদেলার ফোন থেকে তার নাম ডিলিট করে দিয়েছে? 

 

আবেগের মনে খটকার পাহাড় জমতে লাগে। সে দ্রুত মেঘকে কল লাগায়। 

 

মেঘ কল ধরতেই গড়গড় করে সব বলে দেয়৷ একদম এ টু জেট সব। 

 

মেঘ সব শুনে প্রথমেই আবেগকে ঝাড়ি দিয়ে বলে, রোদেলা বিকেল থেকে বাসায় নেই আর তুই এখনো বাসায় বসে আছিস? সিরিয়াসলি আবেগ? এই তোর দায়িত্ব বোধ? তুই কিভাবে এক মিনিটের জন্য ও ভাবলি রোদেলা রিশাদের কাছে যাবে? সেইম অন ইউ। 

 

আবেগ কিছু বলতে পারছে না। তার হাত কাপছে। রোদেলা কি বিপদে আছে? 

 

না। না। বিপদে নেই। নিশ্চয়ই কোথায় গিয়েছে। চলে আসবে। 

 

আসলে আপনজন বিপদে আছে এটা কেউ মানতে চায় না। শতভাগ নিশ্চিত হলেও বারবার মনকে ভুল বুঝাতে লাগে। কেউ চায় না তার আপনজন বিপদে পড়ুক। 

 

আবেগ ঘামতে লাগল। তার কানে কিছুই যাচ্ছে না। বাইরে বোধ হয় বাবা মায়ের সাথে চিল্লাচ্ছে। ইভানার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে৷

 

 কি হয়েছে কি? তার রোদেলার কিছু হয়ে গেল নাতো? 

 

আবেগ আর কিছু ই ভাবতে পারছে না। সমুদ্রের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। সে সমুদ্র কে ঝাপ্টে ধরে কেদে দিল। 

 

আবেগের অনেক কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কেউ চলে যায়? রোদেলা কি একবার ও আবেগের কথা ভাবছে না? যদি ভেবে থাকে একবারো  তাহলে বাসায় ফিরছে না? মা কেন আজেবাজে কথা বলছেন? সে কি জানে? যেই মেয়েটার গায়ে মা এতো এতো অপবাদ লাগাচ্ছেন সেই মেয়েটা আবেগের বেচে থাকার চাবিকাঠি! 

 

সেই মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে আবেগও মারা যাবে! 

 

মেঘ দশ মিনিটের মধ্যে বাসায় ফিরল। এসেই আবেগদের বাসার সামনের সিসিটিভি ফুটেজ অন করল। ঠিক পনে দুইটায় একটা কালো মাইক্রোবাস এসে থামে তাদের বাসার সামনে। তার দশ মিনিট পর রোদেলা নামলে তাকে অজ্ঞান করে গাড়িতে ঢুকানো হলো। ফোনটা পড়েছিল নিচে। রোদেলা ফেলে দিয়েছিল। কেউ একজন (চেহারা বোঝা যাচ্ছে না) ফোন হাতে নিয়ে কি কি যেন করে উপরে উঠে গেল। গাড়ি থেমে ছিল না। ডানে বাক নিয়ে চলে গেল৷ 

 

এই ফুটেজ দেখেই আবেগ অজ্ঞান হতে গিয়েও পারল না। কি করবে সে? সত্যি ই তো রোদেলা বিপদে পড়েছে? বিপদে পড়লে কি করতে? দোয়া ইউনুস পড়তে হয়। কিন্তু এই মূহুর্তে তার কিছু তেই দোয়া ইউনুস মনে পড়ছে না। আবেগের ভাবখানা এমন দোয়া পড়লেই রোদেলা বাসার সামনে এসে দাঁড়াবে।আল্লাহ তো সাহায্য করে কিন্তু উছিলার মাধ্যমে। এইবার কে তার উছিলা? 

 

মেঘ আবারো ধমক দিয়ে বলে, কেদে লাভ আছে? এতোক্ষন চুপচাপ বসে না থেকে আমাকে কল দিলেও তো পারতি? তোরা কিছু করবি না ভালো কথা, করিস না। আমি ঠিকই আমার বোনকে  খুজে বের  করব। যা তোর মায়ের কোলে গিয়ে বসে থাক। যা। সর আমার সামন থেকে! 

 

আবেগ হতাশ চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে, সব দোষ আমার। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল রোদেলার কোন বিপদ হয়েছে। এভাবে এতোক্ষণ যাবত চুপ থাকা উচিত হয় নি আমার। আমি কল্পনাও করতে পারি কেউ রোদেলাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবে। 

 

মেঘ কঠিন গলায় বলে, কেন ভাবতে পারিস নি? তোর সামনেই তো রিশাদ দুই দুইবার এটাক করল তার পর ও এই ব্যাপার টা তোর কল্পনার বাইরে আর রোদেলার পালায় যাওয়াটা স্বাভাবিক। জাস্ট স্পিচলেস আমি। তুই জানিস না রিশাদের গুষ্টি শুদ্ধো  পলিটিক্স করে। ওদের কতো বড় ব্যসসা। ওদেরকে পল্টনে সবাই চিনে। আরে।,ওই ব্যাটা তো সন্ত্রাস! কিন্তু  তোর চিন্তাভাবনা দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। কিভাবে ভাবলি তুই রোদেলা তোদেরকে রেখে,,,,ছিঃ! 

 

–আমি কোন দিন ই রোদেলাকে সন্দেহ করি নি খনিকের জন্য ভড়কে গিয়েছিলাম। সেটা স্বল্প কিছুক্ষণের জন্য। 

 

–এসব বাদ দে। এভাবে কাউকে গুম করা সম্ভব না। বুঝলি, আমি গোয়েন্দা বিভাগে স্পেশালি কথা বলি। ওরা একশন নিবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দার কাজ বিদ্যুৎ গতিতে চলে। ওদের কাছে সবার ডাটা থাকে।  রিশাদ কই আছে সব বের করে ফেলবে। আমি যাচ্ছি। তুই ও আয়। 

 

–চল। 

 

★★★

গাড়িতে বসে আছে আবেগ আর মেঘ। মেঘের অফিসের জিপে আছে তারা। মেঘ কার কার সাথে যেন কথা বলছে। কিছু ই শুনছে না আবেগ। মেঘ ফোন রেখে আবেগকে উদ্দেশ্য করে বলে, গোয়েন্দা বিভাগ কেস নিসে। 

 

–এতো দ্রুত? 

 

–হুম। আমার পরিচয় দিতেই সঙ্গে সঙ্গে একশন নিচ্ছে৷ সবচেয়ে ভালো হতো মন্ত্রী টাইপের কেউ সুপারিশ করলে। ওদের কিন্তু এক মিনিটের খেল এইসব বের করা। কিন্তু ঢিলামি করে। বড় কেউ 

রিকুয়েষ্ট করলে কাজ দ্রুত করে। 

 

–ও। 

 

মেঘ চুপ থেকে বলে উঠে, সব দোষ তোর। রোদেলার কিছু হলে আমি তোকে জিন্দা মাটিতে পুতব। কি দরকার ছিল নাতাশার হেল্প করার? আরে! ও এমপির মেয়ে। ওর কিছু হলে ওর বাপ দেখত। দরকার কি ছিল রিশাদের সাথে ঝামেলা করার। মুরোদ তো নাই তোর কিছু করার আর হতে চাস  হাতেম তাই। এখন বুঝ!ডিভোর্স হইসে সরে আসতি সব কিছু থেকে। নাতাশাকে জানানোর দরকার কি ছিল? (রেগে গিয়ে) 

 

আবেগ শান্ত গলায় বলে, একটা মেয়ের সব জেনেও ক্ষতি হতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। মেয়েটা রিশাদকে ভালোবাসত। বিয়ে করার কথা ছিল। হয়তোবা আমি ওকে সব না জানালে বিয়ে হয়েও যেত। তখন মেয়েটাকেও রোদেলার মতো কষ্ট পেতে হত। ওর বাবা এমপি তাই বলে কি ওকে সেইভ করা যাবে না? ওকে কেন জানাব না আমি? মেয়েটার জীবন নষ্ট  হতে পারত! 

 

মেঘ বিরক্ত হয়ে গেল এবং বলল, এখন যে আমাদের রোদেলা বিপদে তার বেলায় কি? 

 

আবেগ জানালার দিকে তাকালো। তার মাথায় কি যেন একটা ব্যাপার আসল। 

 

সে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে, তুই মাত্র বললি না? বড় কোন নেতার সুপারিশ হলে গোয়েন্দা বিভাগ ভালো কাজ করে? 

 

–হুম। তো? 

 

–নাতাশার বাবা আমাকে অনেক বার বলেছে কোন প্রকার হেল্প লাগলে তাকে জানাতে। আমি কি ওনাকে কল দিব? 

 

–অবশ্যই। হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছস ক্যান? কল দে। 

 

আবেগ দ্রুত কল লাগায় এমপি সাহেবকে।উনি ফোন ধরলে আবেগ তার পরিচয় দেয়। 

 

উনি বলে উঠে, ওহ ডাক্তার সাহেব কেমন আছেন? 

 

–স্যার। আমার একটা হেল্প লাগত। 

 

–হ্যা হ্যা বল। কি হেল্প। ভালো কোন হাসপাতালে জব দিব তোমাকে? এই অফার টা আগেও করেছি বাট ইউ রেজেক্ট ইট। বাট এগেইন আস্কড ইউ। 

 

–না। না। আমি খুব বিপদে পড়েছি৷ 

 

–সেকি!আগে বলবে না? তোমার কি আর্থিক সাহায্য লাগবে? 

 

–না। 

 

তারপর এমপি সাহেবকে সব জানালো আবেগ। 

 

উনি সবটা শুনে কিছুটা চুপ থেকে বললেন, তুমি আমার মেয়ের জীবন বাচিয়েছো। তুমি সত্য না জানালে আমার মেয়েটার যে কি হত আল্লাহ ভালো জানে। তুমি চিন্তা করিও না। আজকেই এক ঘন্টার মধ্যে তোমার বউকে খুজে বের করার দায়িত্ব আমার। আমার অনেক বড় নেতা -মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ আছে। কোন একটা ব্যবস্থা হয়েও যাবে। 

 

–ধন্যবাদ স্যার৷ 

 

–আমি আজীবন তোমার উপর কৃতজ্ঞ, মাই সন। তুমি কোন চিন্তা নিও না। আমি সব হ্যান্ডেল করব। ওই র‍্যাসকেলটার ও একটা ব্যবস্থা নিব আমি। 

 

★★★

 

রোদেলা অগোছালো ভাবে মেঝের এক কোনায় পড়ে আছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় লাল দাগ। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝড়ছে তার। চুলগুলো নেতিয়ে গেছে। কালকেও তো কতো ভাল ছিল সে। আবেগ কতো যত্ন করে তার চুল মুছে দিয়েছিল। রোদেলা নিস্তেজ শরীর নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে৷ এই মূহুর্তে তার মরে যেতে মন চাচ্ছে। বারবার চোখে সমুদ্র আর আবেগের চেহারা ভাসছে। আবেগ কি তাকে খুজে পাবে? নাকি এখানেই মরে যাবে সে? 

 

তখনি রিশাদের আগামন ঘটে।এইবার প্রথম না। এর আগেও একবার এসেছিল সে। তারপর পাষবিক হিংস্রতা দেখিয়েছে রিশাদ। একা পেরে উঠতে পারে নি রোদেলা। 

 

রিশাদ এসে রোদেলার পাশে বসে পড়ে এবং জোড়ে করে বলে, বউ! শুধু শুধু আমাকে রাগাইলা। ক্ষতি কার হলো? তোমারি হলো।  কি দরকার ছিল আবেগেরর গুনগান গাওয়ার? আমি তোমার স্বামী। আমার প্রশংসা করবে। অন্য কারো না। আজকে থেকে আমরা আবারো একসাথে সংসার করব। ওকে? তুমি আর আমি! আর কেউ না! সমুদ্র ও না! 

 

রোদেলার মধ্যে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে চোখ বন্ধ করে আছে। অসহ্য যন্ত্রনা সারা শরীরময় প্রবাহিত হচ্ছে। 

 

রিশাদ আবারো বলল, কি গো? চুপ কেন? কথা বল? 

 

রোদেলা চোখ খুলে বলে, আমাকে প্লিজ যেতে দাও। 

 

–সে কি! জামাইয়ের বাসা ছেড়ে কই যাবা? 

 

–আমার স্বামী আবেগ। 

 

–উফ! আবার আবেগের নাম! জাস্ট হেইট দিস নেইম! আজকে থেকে তোমার মুখে কেবল আমার নাম থাকবে। বুঝলে? 

 

রোদেলা উঠে বসল তারপর বলল, আমি বাসায় যাব। আমাকে যেতে দাও রিশাদ৷ আমি আবেগের কাছে যাব। 

 

রিশাদের মাথা আবারো গরম হতে লাগলো। সে রোদেলার গাল চেপে ধরে বলে, এই আবেগের মধ্যে কি আছে যা আমার মধ্যে নাই? ওর চেয়ে বেশি টাকা-পয়সা আছে আমার। 

 

–তোকে আবেগের মতো হতে আরোও একশবার জন্ম নিতে হবে। আর তুলনা করলি না তোর আর আবেগের? তাহলে একটা কথা মনে রাখিস, চাদের সাথে ধুলার তুলনা করা যায়না। তুই আবেগের পায়ের ধুলার সমান ও না! 

 

রিশাদ অনেক জোড়ে রোদেলার গালে থাপ্পড় মারল। রোদেলা ছিটকে পড়ে যায় মেঝে তে। রিশাদ ধীরে ধীরে রোদেলার কাছে এগুতে লাগে। মুখে হিংস্রতার ছাপ! 

 

★★★

 

রাত দশটার দিকে গোয়েন্দা বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার মেঘের ফোনে একটা এড্রেস সেন্ট করে। 

 

মেঘ আর আবেগ দ্রুত সেই জায়গায় পৌছে গেল। জায়গা টা একটা গোডাউন। 

 

ভেতরে ঢুকে পড়ে তারা। আশেপাশে কেউ নেই। বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার আর মেঘ-আবেগ। 

 

একটা রুমে ঢুকতেই আবেগ দাড়িয়ে গেল। থমকে গেল। রোদেলা মেঝেতে পড়ে আছে। চারপাশে যেরকম ভাবে মালামাল পড়ে আছে ঠিক সেই ভাবে তার রোদেলা পড়ে আছে মেঝেতে। ফোনের ফ্লাশ অন করে মেঘ। রোদেলার চারপাশে রক্তে ভিজে উঠেছে৷ 

 

আবেগ তা দেখে কষ্টে চিৎকার দিয়ে উঠে। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–35

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আবেগ হাটু গেড়ে বসে পড়ে মেঝে তে। চোখ দিয়ে যন্ত্রণার ফোটা বইসে। গা থরথর করে কাপছে। বুকটা কষ্ট-হাহাকারে ফেটে যেতে চাইছে। চোখের সামনে যা দেখছে তা মানতে চায় না আবেগ। সব যেন ভ্রম হয়! দুঃস্বপ্ন হয়ে পালিয়ে যায়৷ 

 

মেঘ আবেগের কাছে এসে তার কাধে হাত দিয়ে বলে, শক্ত হ আবেগ। এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে কিভাবে চলবে? 

 

আবেগ মাথা নিচু করে ফেলে। চোখ অসম্ভব লাল হয়ে গেছে। চোখ ভর্তি পানি। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ পাথর নিক্ষেপ করছে। আল্লাহ এতো  কষ্ট কেন হচ্ছে তার। 

 

ততোক্ষনে রোদেলাকে একটা স্ট্রেচারে করে তোলা হয়ে গেছে। গোডাউনের বাইরে নেওয়া হলো রোদেলাকে। সম্ভবত গাড়িতে তোলা হচ্ছে। 

 

আবেগ উঠে দাড়ালো বহুত কষ্টে। তার কোন দিক-দিশা ঠিক নাই। বলতে গেলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে। 

 

আবেগ রোদেলার কাছে যেতে চাইলে মেঘ তাকে আটকে দিয়ে বলে, তোকে কিছু প্রশ্ন করব। সেগুলোর ঠিক ঠিক উত্তর দিবি। তারপর রোদেলার কাছে যাবি৷ 

 

আবেগ হতম্ভব হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে, এই অবস্থায় কি জানতে চাস তুই আমার কাছে? 

 

মেঘ নরম গলায় বলে, তুই এতোটাও নাদান না যে রোদেলার সাথে কি হয়েছে তা এতোক্ষনেও বুঝিস নি। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিস ওর সাথে কি কি হয়েছে। 

 

আবেগ চোখ বন্ধ করে ফেলে কষ্টে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে নিচে পড়ল৷ 

 

মেঘ কাপা গলায় বলে, এখন আবেগে ভেসে রোদেলার কাছে যাবি। ওকে মিথ্যা আশার আলো দেখাবি। এরপর তোর মা এসে বলবে রোদেলা চরিত্রহীন। ওমনি তুই সুরসুর করে মায়ের কথা শুনে রোদেলাকে ছেড়ে চলে গিয়ে রোদেলাকে জিন্দা লাশ বানায় রাখবি এটা আমি সহ্য করব না আবেগ! তার চেয়ে এখনি ঠিক কর, এই মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নে, আজীবন রোদেলার সাথে থাকবি? নাকি মাঝ সাগরে ফেলে চলে যাবি। 

 

আবেগ মেঘের দিকে তাকালো। মেঘের চোখও লাল। বেদনার ছাপ। 

 

মেঘ আবারো বলল, রোদেলা কে আজকের এই মর্মান্তিক ঘটনার পর ও কি সবসময় আগলে রাখতে পারবি? পারবি ওকে ভালোবাসতে?  নাকি ঘৃণা লাগবে?  যদি ভালোবাসতে পারিস তাহলে আয় আমার সাথে।  আর না পারলে প্লিজ চলে যা। কেউ তোকে জোড় করবে না। 

 

আবেগ নিশ্চুপ থাকল। উত্তর টা এতো জটিল কেন? কেন তাদের সাথে এমন হলো? কি এমন পাপ করেছে সে? 

 

মেঘ উত্তর না পেয়ে আর কিছু বলল না। শুধু বলল, তোর উপর কেউ জোর করবে না। তুই নিশ্চিত থাক। আংকেলও তোকে জোরজবরদস্তি করে এই সংসার টিকিয়ে রাখতে আর কোন দিন আদেশ দিবে না। 

 

আবেগ মাথা নিচু করে ফেলে এবং বলল,আমার কাছে রোদেলার সুস্থতাই সবার আগে। আমি ওকে ভালোবাসি। আমার জন্য ওর সুস্থতাই যথেষ্ট। 

 

মেঘ আর কিছু বলল না। পরিস্থিতি ও তাদের প্রতিকূলে। গোডাউনে রোদেলাকে পাওয়া গেলেও রিশাদ পলাতক। কি যে হবে সামনে? কে জানে? 

 

হাসপাতাল পৌছে রোদেলাকে ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো। ঢাকা মেডিকেলে শিফট করা হয়। রোদেলার কোন জ্ঞান নাই৷ পুরোটা সময় জুড়ে আবেগ রোদেলার হাত ধরে ছিল। বিধ্বস্ত রোদেলার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আবেগ তার আগুল দিয়ে রোদেলার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা রক্ত মুছে দেয়। রোদেলা কে ভেতরে ঢুকানো হলো। এবার আর আবেগ ঢুকতে পারল না ভেতরে। সে বাইরে দাড়িয়ে প্রহর গুনতে লাগলো। কি থেকে কি হয়ে গেল?

 

সব এভাবে শেষ না হলেও পারত! 

 

মেঘ আবেগের কাছে এসে বলে।,আবেগ? 

 

–হুম? 

 

–আমি আবারো জিজ্ঞেস করছি পারবি সবকিছু সামলাতে? রোদেলা কে যদি তুই এখন আপন করে নিস, তাহলে ভবিষ্যতে কিন্তু অনেক কিছু সহ্য করতে হবে। ঝড় যাবে তোর উপর দিয়ে! পারবি সামলাতে? 

 

–বারবার এক কথা বলার কোন মানে দেখি না আমি। 

 

— রোদেলা কে ভালোবাসিস? 

 

–অনেক। 

 

–এখনো ভালোবাসতে পারবি সব জানার পরও? 

 

–আগের চেয়ে এখন আরো বেশি ভালোবাসব। মানুষ ভুল বারবার করে না। মেঘ। 

 

–দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। বস। রেস্ট নে। 

 

মেঘ আবেগকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। দুইজনই চুপ।চারপাশে পিনপিন নিরবতা৷ আজকের নিরবতার মাঝেও এক ধরনের আহাজারি বিরাজ করছে। 

 

আবেগ চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে চোখ ডলছে। আসলেই কিভাবে এতো বড় ধাক্কা সামাল দেবে সে? আর যাইহোক না কেন আর ছাড়বে না সে রোদেলার হাত এই জনমে! 

 

আবেগের বাসায় মেঘ ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে বাড়ির সবাই চলে আসে। ইভানা, ইমতিয়াজ রহমান আর জাবেদা খাতুন। 

 

ইভানার কোলে ছিল সমুদ্র। ইভানার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। আবেগ তাদেরকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। 

 

ইভানার কোলে সমুদ্রকে দেখতে পেল আবেগ। বাচ্চাটা শুধু মাত্র একদিন মায়ের আদর পায় নি তাতেই কেমন রোগা রোগা হয়ে গেছে। সমুদ্র কান্না শুরু করে দিল। এই কান্নায় মায়ের প্রতি অভিযোগ আছে। মা কেন এতোক্ষন ধরে তার থেকে দূরে আছে? 

 

ইভানা কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সমুদ্র কেদেই যাচ্ছে তা দেখে আবেগ গিয়ে সমুদ্র কে কোলে নিল। সমুদ্র আবেগের কোলে গিয়ে কান্না থামালো। চুপ হয়ে গেল সে। মায়ের কমতি সে বাবার কাছ থেকে পূরন করে নিচ্ছে। আবেগ চুপচাপ সমুদ্রকে কোলে নিয়ে বসে রইল। সমুদ্র কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে যায়। আবেগ অসংখ্য বার সমুদ্রের কপালে চুমু খায়। 

 

★★★

 

ভোরের দিকে একজন নার্স এসে বলে, আপনাদের মধ্যে আবেগ কে? 

 

আবেগ সারারাত রোবটের মতো বসে ছিল৷ কিন্তু নার্সের এই কথায় তার টনক নড়ে। সে উঠে দাড়িয়ে বলে, আমি। 

 

–পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে৷ আপনার সাথে দেখা করতে চায়৷ 

 

আবেগ বিড়বিড় করে বলে, আলহামদুলিল্লাহ  

 

তারপর নার্সের সাথে রোদেলাকে যেই কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে গেল।

 

 রুমে ঢুকতে ই আবেগের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।রোদেলা বেডে শুয়ে আছে। হাতে এখনো ক্যানেল লাগানো৷ রক্তের ব্যাগ ঝুলছে। রোদেলার ব্লাড গিয়েছিল অনেক। তাই তিন ব্যাগ ব্লাড লেগেছে। একটা সিজারের সিলাই ছিড়ে গিয়েছিল।  সব মিলিয়ে জ্ঞান ফিরলেও সুস্থ নয় রোদেলা। 

 

আবেগ রোদেলার মাথার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল।  রোদেলা চোখ বন্ধ করেই নিস্তেজ বলে উঠে, আবেগ! 

 

আবেগ কিছু না বলে রোদেলার মাথায় হাত বুলাতে লাগে৷ রোদেলা হুট করে হুহু করে  কেদে দেয়৷ 

 

আবেগ রোদেলাকে কাদতে দেখে প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। তার ও বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। সে ফিসফিস করে বলে, কাদবে না রোদেলা। আমি আছি তো তোমার পাশে! 

 

একথা শুনে রোদেলার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়৷ 

 

রোদেলা নিস্তেজ গলায় বলে, আবেগ! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। 

 

আবেগ রোদেলার আরো একটু কাছে বসে বলে, ঠিক হয়ে যাবে। 

 

–আমাকে স্পর্শ করো না। আমি অপবিত্র যে! তুমিও অপবিত্র হয়ে যাবে,,,,,,,,,,

 

আবেগ একথা শোনামাত্র রোদেলা কে ঝাপ্টে ধরল। তারপর বলল, চুপ করো প্লিজ! 

 

রোদেলা মৃদ্যু কথা কন্ঠে বলে, আমি মনে হয় না আর বাচব। মরে যেতে চাই আমি। 

 

–একদম কোন কথা বলবে না। 

 

–তুমি গ্রামে থাকতে বলেছিলে না আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করবে? মনে আছে সেই কথা? 

 

–এখন কেন এসব বলছো? প্লিজ তুমি রেস্ট নাও। 

 

–বল আমার কথা রাখবে? প্লিজ?(করুন গলায়) 

 

আবেগ রোদেলার কথা উপেক্ষা করতে না পেরে বলে, আচ্ছা বল! 

 

রোদেলা কাপা গলায় বলে, আমি যদি আজকে এই মূহুর্তে মারা যাই, তাহলে আমার ছেলেটাকে একা ফেলে দিও না। নিজের সঙ্গে রেখো। বেশি কিছু দিতে হবে না শুধু তিন বেলা ভাত আর কাপড় দিও। এর বেশি কিছু লাগবে না ওর। 

 

আবেগ একথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। রোদেলার বুকের উপর ঝাপ্টে পড়ে কেদে দিল। রোদেলাও কাদতে লাগলো। 

 

আবেগ প্রলাপ করে বলতে লাগলো, ভালোবাসি আমি তোমাকে রোদেলা। আজকে তোমার কিছু হলে আমিও বাচব না। 

 

কাচের বাহির থেকে মেঘ সবটা দেখে সরে আসে। আবেগকে নিয়ে চিন্তিত সে। আবেগ মানুষ হিসেবে চমৎকার! কিন্তু কখন কি সিদ্ধান্ত নিতে হবে এসব বুঝে না। তাই জীবনে অনেক ভুল করে বসে। তবে এই প্রথম আবেগ নিযে থেকে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেঘ তার চোখ মুছল। সে খুব টেনশনে আছে। রিশাদকে পাওয়া যায় নি। নিশ্চয়ই সেইভ জোনে চলে গেছে৷ রিশাদ যদি আবার কিছু করে বসে? এসব ভাবতেই গা ঠান্ডা হয়ে এলো তার। যা করার তাকেই করতে হবে। আবেগ এখন এসব সামাল দেয়ার পরিস্থিতি তে নেই৷ খুব ভেঙে পড়েছে ও। 

 

মেঘ সরে এসে করিডোরে হাটছে।রিশাদকে আইনের আওতায় না আনলে ঝুঁকি কমবে না। রোদেলার উপর এখনো ঝুকি আছে। হুট করে তার ফোন বেজে উঠল। মেঘ ফোন হাতে নিয়ে দেখে অথৈয়ের কল। সে বিচলিত হলো না৷ ফোন ধরতেই অথৈ কান্না করতে করতে বলে, রোদেলার এখন  কি অবস্থা? 

 

–তুমি কিভাবে জানলে? 

 

–ইভানা জানিয়েছে৷ 

 

–ও। 

 

–বল না ও কি ঠিক আছে এখন? 

 

–তোমার জেনে লাভ কি?  নিজেকে রোদেলার ফ্রেন্ড বলবে না কোন দিন৷ ওর সাথে তো কথাই বল না। এখন কেন কল করেছো? 

 

ওপাশ থেকে অথৈ কান্না করছে আর বলছে, আমি এক্ষুনি আসব রোদেলা কে দেখতে। 

 

মেঘ ফোন কেটে দিল। তার সবপ্রথম কাজ রিশাদের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করা। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–36

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আবেগ বলে উঠে, এসব কি বলছো তুমি? সমুদ্র আমার ছেলে। নিজের থেকেও ওকে ভালোবাসি আমি! আর কোন দিন এভাবে বলবে না! আমার খুব কষ্ট হয়! সমুদ্র আমার ই ছেলে। 

 

রোদেলা চোখ বুজে ফেলে। চোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে তার। আবেগ সেই চোখের পানি মুছে দিয়ে রোদেলা কে আকড়ে ধরে। আবেগের চোখের পানিতে রোদেলার হাতে ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু দুইজন ই নির্বিকার। দুজনেই নিরবে চোখের পানি ফেলছে। কারো মুখে কোন কথা নেই৷ 

 

আচমকা আবারো রোদেলা শব্দ করে কেদে দিল। আবেগ রোদেলাকে থামালো না।

 

 কাদুক। কেদে বুক ভাসাক আজকে। এরপরে আর কোন দিন কাদতে দিবে না রোদেলাকে। 

 

রোদেলা কাদতে কাদতে অস্ফুটস্বরে বলে, এতো সব কিছু হওয়ার পর ও আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাই না আবেগ। এতো বড় দুর্ঘটনার পর আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসো! তারপর একদন্ড থেমে রোদেলা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আর আস্তে করে বলে, আমি অনেক লোভী তাই না? খুব স্বার্থপর আমি! এজন্যই আল্লাহ বারবার আমাকে শাস্তি দেয় তাও আমি শুধরাই নি। বারবার লোভ করে গেছি।   তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভ সামলাতে পারি নি৷ আমি খুব খারাপ তাই না? 

 

–চুপ কর প্লিজ! 

 

–কথায় আছে না, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! আমিও লোভ করেছি, পাপ করেছি, এখন ভুগছি! লোভ করার শাস্তি আল্লাহ নিজ হাতে দিয়ে দিলেন আমাকে। 

 

আবেগ রোদেলার মাথা বুলাতে বুলাতে বলে, ভালোবাসার লোভটাই পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটা পাপ যেই পাপের মধ্যে পূন্য লুকিয়ে আছে। তুমি কোন পাপ করো নি রোদেলা। আর যা হয়েছে এতে তোমার  কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার! আজকে আমার জন্য তোমার এই অবস্থা! 

 

শেষের কথা গুলো রোদেলা শুনে নি। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছিল রোদেলাকে যার দরুন এখন নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে রোদেলা। সব কিছু ভুলে ঘুমিয়ে গেল। 

 

এজন্যই বুঝি ঘুমকে অর্ধেক মৃত্যু বলে! এই যে কতো যন্ত্রণা  পুষছে মেয়েটা তার বুকে কিন্তু এখন এই মূহুর্তে সব যন্ত্রণা বিদায় নিয়েছে তার কাছ থেকে। ঘুম ছুটে গেলেই ঝড়ের গতিতে দুঃখরা আবারো চলে আসবে। 

 

আবেগের চোখ ভেজা। কোথাও যেন পড়েছিল ছেলেদের নাকি কাদতে হয় না! তাদের কাদা বারং! যে ব্যক্তি  এই নিয়ম বানিয়েছেন তাকে গিয়ে আবেগের বলতে ইচ্ছা করছে, আবেগের জায়গায় তিনি থাকলেও কি একই নিয়ম বানাতেন! নাকি নিয়ম পালটে অন্য এক প্রথা চালু করতেন!  যেই প্রথায় ছেলেরা কষ্ট  পেলেই কাদতে পারবে! 

 

ঘুমন্ত রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে আবেগ। একদিনের ব্যবধানে চেহারার এতো পার্থক্য! সেদিন ই তো কতো সুন্দর লাগছিল রোদেলাকে! ঝলমলে চুল, কাজল পড়া চোখ, মিস্টি হাসি!

 

 আর আজকে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল, চোখের নিচে কালি, ঠোঁটের বাম দিকে থেকে গাল বরাবর কাটা দাগ! এইসবের সাথে বহু দূরে হারিয়ে গেছে সেই বিখ্যাত মিস্টি হাসিটা! 

 

রোদেলার পাশেই বসে আছে আবেগ। রোদেলাকে এক মূহুর্তের জন্য নিজের থেকে দূর করতে মন চাচ্ছে না তার! মনে হচ্ছে সে সামান্য কিছুক্ষনের জন্য রোদেলার কাছ থেকে দূরে গেলেই আবারো সেই নরপিশাচটা এসে তার রোদেলা কে ছিনিয়ে নিবে।

 

 যুগ যুগ ধরে সবসময় ভালো মানুষের সাথেই খারাপ কিছু হয় এটাই বুঝি নিয়ম! খারাপের শক্তি সবসময়ই কি বেশি হতে হবে? কি হত যদি ভালোর শক্তি বেশি হত! আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখলো সে।  হাশরের ময়দানে প্রতিটা হিসাব সে নিবে! এক চুল পরিমাণ ছাড় দিবে না সেই নরপিশাচ কে। 

 

যুগ যুগ ধরে যে ভালোর সাথে খারাপ হয় এটার প্রমাণ তো স্বয়ং আমার নবীজি (সঃ)!  কতো শত কাটা, লজ্জা, যন্ত্রনা সহ্য করেছিলেন তিনি।আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি হওয়ার পর ও কষ্ট সহ্য করেছেন কতো  নবীজী(সঃ)। দিনশেষ ঠিকই তো বিনা রক্তপাতে সেই মক্কা জয় করেছেন যেই মক্কা ছেড়ে আল্লাহর নির্দেশে তাকে চলে যেতে হয়েছিল। 

 

আবেগ ও আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিয়েছে।  যা করার সব আল্লাহ পাক করবে৷ তবে সে হাত গুটিয়ে থাকবে না। রিশাদকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়েই ছাড়বে৷ ততোক্ষন অব্দি লড়বে যতোক্ষণ অব্দি রিশাদ শাস্তি পাচ্ছে না। 

 

রোদেলার কেবিনে ইতিমধ্যে আবেগ একা নয়। ইভানা, ইমতিয়াজ রহমান আর জাবেদা খাতুন আছেন। মেঘ বাইরে গিয়েছে। রোদেলার পাশে রাখা চেয়ারে আবেগ সমুদ্র কে কোলে নিয়ে বসে আছে। সকাল হয়ে গেছে৷ সাড়ে দশটা বাজে। 

 

ইভানা একটু পর পর এসে রোদেলাকে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু রোদেলার পাশে বসার শক্তি হচ্ছে না তার। রোদেলার চেহারাটা দেখলেই তার কান্না পাচ্ছে। সে এই মূহুর্তে কেদে ভাইয়াকে আরো দুর্বল বানাতে চায় না। 

 

জাবেদা খাতুন চুপচাপই বসে আছেন। এই অবস্থায় কিছু বলছেন না সে। তার ছেলের করুন অবস্থা দেখে সে ভয় পেয়ে গেছে। এক রাতেই আবেগের এই অবস্থা দেখে সে মনে মনে ভয়ে আছেন। ছেলেটাকে দেখে পাগল পাগল লাগছে। চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। শার্টের হাতা গুটানো। চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। 

 

মেঘ খাবারের প্যাকেট নিয়ে ফিরল। তারপর সবাইকে খেতে বলল। কারোই খাওয়ার ইচ্ছা নেই তাও জোর করে খেয়ে নেয়৷ 

 

আবেগকে এক প্রকার জোর  করে খাওয়ানো হলো৷ 

 

সেই সময় রোদেলার ঘুম ভেঙে যায়।রোদেলাকে চোখ খুলতে দেখে মেঘ মৃদ্যু হেসে দিল। 

 

রোদেলা চোখ ফিরিয়ে আবেগের দিকে তাকালো। আবেগের কোলে সমুদ্র কে দেখে রোদেলা সমুদ্র কে কোলে নিতে চাইল। 

 

মেঘ আস্তে করে রোদেলাকে উঠে বসিয়ে দিল। সমুদ্র কে কোল নিয়ে বেশ কয়েকটা চুমু খেল রোদেলা। সমুদ্র ও যেন এতোক্ষন পর মাকে পেয়ে খুব তৃপ্তি পাচ্ছে। প্রশান্তি তে চোখ ঘুরিয়ে মাকে দেখছে। 

 

রোদেলার চেহারায় হুট করে ভয়ের আভা ফুটে উঠল। সে ছটফট করতে লাগলো কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না। সম্ভবত ঘুম থেকে মাত্র উঠেছে জন্য এমনটা হচ্ছে! 

 

আবেগ রোদেলার আরো কাছে গিয়ে বলে, কি হয়েছে? এমন কেন করছো? 

 

রোদেলা সমুদ্রকে বুকের সাথে চেপে ধরে ব্যথা জর্জরিত গলায় বলে, ইভু কোথায়? ও কোথায়? 

 

মেঘ হতভম্ব হয়ে যায়। ইভানাকে দেখার জন্য এতোটা বিচলিত হচ্ছে কেন রোদেলা? 

 

রোদেলা আবারো মেঘকে জিজ্ঞেস করে, ইভু কি ঠিক আছে? ওর কি হয় নি তো? চুপ করে আছো কেন? বল না! ইভু ঠিক আছে কিনা? 

 

এমন সময় ইভানা দৌড়ে রোদেলার কাছে চলে আসে। মেঘের খটকা লাগতে শুরু করে। কিন্তু এই মূহুর্তে কিছু বলল না রোদেলাকে। 

 

ইভানাকে দেখে স্বস্তি পায় রোদেলা। যাক! ওর তো এট লিস্ট কিছু হয় নি! আজকে রিশাদ ইভানাকে কিছু করে ফেললে এখন যতোটা কষ্ট পাচ্ছে সে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেত রোদেলা! 

 

ইভানা রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয়। হুট করে রোদেলার চোখের পানি হাওয়া হয়ে গেল। কেন যে সে কাদতে পারছে না। কিন্তু রোদেলা খুব শক্ত করে ইভানাকে জড়িয়ে ধরে। 

 

কিছুক্ষন পর রোদেলা ইভানাকে ছেড়ে দেয়। তখন মেঘ রোদেলাকে প্রশ্ন করে, ইভানার জন্য এতো ব্যতিব্যস্ত হচ্ছিলে কেন রোদেলা? 

 

রোদেলা অসহায় চোখে আবেগের দিকে তাকালো। 

 

আবেগ মেঘকে থামিয়ে দিয়ে বলে,প্রশ্ন পরে করিস মেঘ। আগে ওকে সুস্থ হতে দে। 

 

মেঘ আরো কিছু বলবে তার আগেই রোদেলা নিজ থেকে বলে, আমিই সুস্থ আছি। এর চেয়ে সুস্থ আর কোন দিন আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না। 

 

রোদেলার কথা শুনে আবেগের বুকটা ছ্যাত করে উঠে। 

 

তারপর রোদেলা বলে উঠে, রিশাদ আমাকে ফোন করেছিল,,,,,,, 

 

মেঘ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। এই সময় ইমোশনাল হলে চলবে না। সবার আগে রোদেলার সেফটি দরকার। তাই সবটা জেনে একশন নিতে হবে। 

 

রোদেলা আবারো বলল, রিশাদ আমাকে ফোন করে ব্লাকমেইল করেছিল। 

 

মেঘ প্রশ্ন করে, কি বিষয়ে ব্লাকমেইল করেছে? 

 

–ইভু তখন বাইরে বেরিয়েছিল ওর ফ্রেন্ডের সাথে। বাসায় ছিল না। রিশাদ ফোনে বলেছিল আমি যদি এক মিনিটের মধ্যে নিচে না নামি তাহলে ওর লোক ইভানাকে তুলে নিয়ে যাবে। প্রথমে আমি এইকথা বিশ্বাস করি নি। এরপর রিশাদ ম্যাসেঞ্জারে ইভানার ছবি পাঠায়। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷ ইভানার যেন কোন ক্ষতি না করে তাই নিচে নেমে পড়ি৷ বাসার সামনে কাউকে ই দেখতে পাই নি৷ তাই ফিরে আসতে চেয়েছিলাম সেই সময় পেছন থেকে কে যেন আমার মুখ চেপে ধরে। আমি ইচ্ছা করেই ফোনটা একটু দূরে ফেলে দিয়েছিলাম। এর পর কিছু মনে নেই। জ্ঞান আসার পর নিজেকে একটা অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করলাম। তারপর,,,,, 

 

মেঘ বলে, আর কিছু জানতে চাই না আমি। 

 

ইভানা রোদেলার কাছে গিয়ে বলে, তোমার এতো বড় ক্ষতিটা শুধু মাত্র আমার জন্যই হয়েছে ভাবী। আমার ভুলের জন্য আজকে তোমার এই অবস্থা! 

 

রোদেলা কিছু বলল না শুধু ইভানার হাতট শক্ত করে চেপে ধরে। 

 

রোদেলার সব কথা ইমতিয়াজ রহমান আর জাবেদা খাতুন শুনে ফেললেন। 

 

জাবেদা খাতুনের মাথা ভোভো করছে। রোদেলার জায়গায় যদি আজকে তার নিজের মেয়ে থাকত? আল্লাহ না করুক! তার মেয়েটা এসব মোটেও সহ্য করতে পারত না! কি হত তার মেয়ে থাকলে? 

 

ইমতিয়াজ রহমান ছুটে গিয়ে রোদেলাকে জড়িয়ে নেন। রোদেলা চোখ বন্ধ করে নিরবে কাদতে থাকে। 

 

ইমতিয়াজ রহমান নিজেও কাদছেন। তবুও সান্ত্বনাস্বরুপ রোদেলাকে জড়িয়ে রেখে তার মাথায় হাত দিয়ে বলে, কাদিস না রে মা। তোরা কাদলে আমার খুব কষ্ট হয় রে! কাদিস না। আমরা আছি তো তোর সাথে। তোর এই বুড়া মামা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোর সাথে আছে রে মা। 

 

রোদেলা আরো বেশি জোরে শব্দ করে কাদতে লাগে। 

 

আবেগ উঠে   রোদেলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আবেগকে আসতে দেখে ইমতিয়াজ রহমান রোদেলাকে ঠিক ভাবে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজে ও রোদেলার মাথার কাছে দাড়িয়ে রইল।

 

রোদেলা চোখ তুলে আবেগের দিকে তাকালো। তখনো রোদেলা শক্ত করে সমুদ্রকে ধরে আছে। আবেগকে দেখতেই তার বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। লোকটার চেহারায় বিধ্বস্ততার ছাপ! এই লোকটার কথা ভেবেই তো কালকে রাতের সব অত্যাচার সহ্য করেছিল। শুধু একবার মরনের আগে সে আবেগকে দেখতে চেয়েছিল! ছুয়ে দিতে চেয়েছিল। ছুটে আসতে চেয়েছিল এই মানুষটার বুকে! মুখ-মনে শুধু তার ই নাম জবর কাটছিল! এটাই কি ভালোবাসা? 

 

অপবিত্র হওয়ায় পর ও সে চায় একটা পবিত্র হাত থাকে আকড়ে রেখে অজস্র ভালোবাসা দিয়ে তার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয় — এটাই কি তবে ভালোবাসার দাবি? 

 

আচ্ছা! রোদেলা কি আবেগের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে? তার কি আর সুখ পাওয়ার অধিকারটা নেই? আবেগ কি কেবল তার বাইরের অপবিত্রতা দেখবে নাকি মনের পবিত্রতা টাকে খুজবে? সে যে এখনো ভেতর দিয়ে ফুলের মতো পবিত্রই আছে  তা কি জানে আবেগ? রোদেলার পবিত্রতা  উপলব্ধি করতে পারবে তো আবেগ? 

 

আবেগ রোদেলার দিকে জুসের গ্লাস বাড়িয়ে দিল এবং বলল, একটু খাও।

 

–উহু। 

 

–প্লিজ! 

 

বলে রোদেলার মুখে গ্লাস ঢুকিয়ে দিয়ে জোড় করে এক গ্লাস জুস খাইয়ে দিল। 

 

কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে রোদেলাকে চেকআপ করে আবেগের সাথে কথা বলতে চাইলো৷ 

 

ডাক্তার সাহেব আবেগকে  নিয়ে কেবিনের  বাইরে এস বলে, আপনি কি পেশেন্টের হ্যাসবেন্ড? 

 

–হ্যা৷ 

 

–উনি এখন মোটামুটি সুস্থ। সিলাই খুলে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। আমরা পর্যাপ্ত সুচিকিৎসা করেছি। এখন আর ভয়ের কিছু নেই। উনি মেবি কিছুদিন আগেই সিজারিয়ান  অপারেশন  করেছেন। এজন্য ই এতো ক্ষতি হয়েছিল। যাইহোক আমরা সিজারিয়ান অপারেশনের পর দম্পতিকে বারবার শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে  সচেতন থাকতে বলি,,,,,,, 

 

–আমি ডাক্তার!

 

–ওহ! তাহলে আর ডিটেইলে বললাম না। আপনি তো সব জানেন ই৷ চাইলে পেশেন্ট কে বিকেলের পর বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন৷ 

 

–আচ্ছা! 

 

–আরো একটা কথা! 

 

–বলুন৷

 

–আই এম রিয়েলি প্রাউন্ড অফ ইউ ডক্টর! আমার জীবনে দেখা একজন বাস্তবিক বীরপুরুষ আপনি! সত্যি আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

 

আবেগ ওই ডাক্তারটার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বলল না। 

 

★★★

 

রিশাদ বিশাল বড় একটা বেডরুমে বসে আছে। চারিপাশে বড়লোকদের আভিজাত্যপূর্ণ আসবাবপত্র! রিশাদের চোখের সামনে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আকা মোনা লিসা ঝুলছে৷ মোনা লিসার রহস্যময় হাসির দিকে তাকিয়ে রিশাদ নিজেও হেসে দিল। তার হাতে বেনসনের একটা সিগারেট জ্বলছে। সে আয়েস করে সিগারেটে ফুক দিয়ে মোনা লিসা চিত্রাঙ্কনটার দিকে তাকিয়ে বলে, এই বেডিও তো দেখতে সুন্দর! 

 

সে সিগারেট খাওয়া শেষ করে হাতে ওয়াইনের বোতল নিল। আপাতত সে তার বিসনেস পাটনারের বাসায় বসে আছে আরাম করছে৷ কালকে তার বিসনেস পাটনার ই তাকে ইনফর্ম দিয়েছিল যে গোডাউনে গোয়ান্দা বিভাগ এটাক করবে। রিশাদ তো রোদেলাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিল কিন্তু তার বুদ্ধিমান বিসনেস পাটনার তাকে একা পালাতে বলে। 

 

রিশাদ বেডে আয়েস করে শুয়ে পড়ল৷।। কিছুক্ষন পর একজন এসে রিশাদকে ডাক দিল রুমের বাইরে থেকে । 

 

রিশাদ গেট খুলে একটা হাসি দিয়ে বলে, আরে ভাই আপনি! 

 

–হুম। 

 

–কোন কাজ ছিল? 

 

–আর কয় দিন আমার বাসায় থাকবেন রিশাদ? 

 

–এইতো সাত দিন৷ 

 

–ও।

 

লোকটা যেতে চাইলে রিশাদ তাকে আটকিয়ে বলে, রোদেলার ফোনটা কই রেখেছেন? 

 

–ওর বেডরুমে রেখে দিয়ে এসেছিলাম৷ 

 

–আপনি ওর  বাসাও চিনেন? 

 

— শেখ প্রাচুর্য চেনে না এমন জিনিস খুব কম আছে এই বাংলাদেশে। নিচে খাবারের ব্যবস্থা করা আছে। সাত দিন জাস্ট সাতদিন পর আমার বাসা থেকে আউট হবেন৷ 

 

–ওকে। ওকে। 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

part–37

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

বিকেল চারটা বাজে। রোদেলাকে বাসায় আনা হয়েছে। রুমটা গোছানোই আছে। এমন কি রোদেলার রেখে যাও টাওয়ালটা ও চেয়ারের হাতলের উপর ঝুলানো আছে। শুধু তফাৎ টা হলো সেটা আর ভেজা নেই। শুকিয়ে গেছে। 

 

রোদেলা পুরো রুম জুড়ে চোখ বুলানো। রোদেলার পাশেই আবেগ তার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। রোদেলার হাতের কনুইয়ের বিপরীত দিকে ব্যান্ডেজ করা। 

 

সে রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ে। রুমটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই রুমের মালিকের উপর কি ঝড়টাই না গেছে!

 

রোদেলার মনে হচ্ছে সে জড়বস্তু হলেই বুঝি ভালো হত। কোন অনুভূতি থাকত না। কষ্ট হত না! ব্যথা লাগত না! 

 

আবেগ রোদেলাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। রুমে ততোক্ষণে ইভানাও চলে আসে সমুদ্র কে নিয়ে। 

 

আবেগ ইশারায় ইভানাকে রোদেলার পাশে বসতে বলে রুম থেকে বের হয়। 

 

ইভানা সমুদ্রকে কোলে নিয়ে রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ে। রোদেলা তার খুবই প্রিয় একজন ব্যক্তি! ছোট বেলা থেকেই রোদেলা আপু তার খুব প্রিয়! সবসময় রোদেলার আশেপাশে সে ঘুরঘুর করত। রোদেলাও ইভানাকে খুব স্নেহ করে। 

 

আজ এমন একটা তুফান তাদের উপর দিয়ে বয়ে গেল যে কারোই কিছু করার ছিল না। পরোক্ষভাবে ইভানা বারবার নিজেকেই দোষারোপ করছে। কেন আগেই ভাবীকে তার সাথে হওয়া আক্রমণের ব্যাপারে কিছু জানালো না। যদি জানাত তাহলে আজকে আর এই দিন দেখতে হত না!  তারা আগেই সর্তক হয়ে যেত। এতো বড় একটা দুর্ঘটনার কথা তার উচিত হয় নি লুকানো। এই ঘটনাকে স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া মোটেও ঠিক হয় নি৷ ইশ, ওই দিন রাতে বাসায় ফিরেই ভাইয়া-ভাবীকে সব সত্যটা জানিয়ে দিলে আজকে ভাবী সুস্থ থাকত! 

 

রোদেলা ইভানাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মন খারাপ করিস না ইভু। আমি ঠিক আছি।

 

ইভানা রোদেলার দিকে তাকালো। এই অবস্থাতেও  ভাবী কেবল তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এই কথা বলছে? সে যেন কষ্ট না পায় তাই ভাবী এভাবে বলছেব।ইভানার বুকটা কষ্টে ভরে উঠে। 

 

রোদেলা মাথা নিচু করে বলে, তোর ভাই এখনো আমাকে ঠায় দিচ্ছে এটা ভেবেই আমি আশ্চর্য হচ্ছি। 

 

ইভানা ভ্রু কুচকালো।

 

রোদেলা ভেজা গলায় বলে, যদি আবেগ আমার সাথে আর সংসার করতে না চায় তাহলে আমি চলে যাব। 

 

একথা শুনে ইভানা রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। রোদেলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। 

 

★★★

 

আবেগ তার মায়ের রুমে প্রবেশ করল। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নক করে।এটা ভদ্রতাসূচক কাজ।  রুমের গেট খোলাই তাই সব দেখা যাচ্ছে। বাবা ভেতরে নেই। মা একা আছেন। ভালোই হলো।

 

এতোদিন যাবত আবেগ খুবই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগত। একদম কঠোর ছিল না। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে তার মনে হচ্ছে আজকে যদি সে কঠিন না হয় তবে বাকী জীবন পস্তাতে হবে তাকে। একটা ইংরেজি প্রবাদ আছে, “I have to be cruel only to be kind”

 

আবেগকেও এখন কেবল মাত্র রোদেলার জন্য কঠোর হতে হবে। 

 

আবেগের মা ভেতর থেকে বলে উঠে, আয় বাবা। 

 

আবেগ ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে বলে, আম্মা! আপনাকে কিছু বলার ছিল। 

 

জাবেদা খাতুন কিছুটা ভড়কে যায়। আবেগ লো

কোন দিন ই এভাবে কথা বলে না। উনি বলে উঠে, বল কি বলবি? 

 

–আপনি একবারো রোদেলার সাথে ঠিক ভাবে দেখা করেন নি। কথাও বলেন নি। 

 

–হু। 

 

—আপনি কি রোদেলার উপর কোন কারনে রেগে আছেন? 

 

–না তো! 

 

–আমার তো মনে হয় আপনি রোদেলাকে দেখতে পারেন না। আপনি সবসময়ই রোদেলাকে কথা শুনাতেন। পছন্দ করেন না এটা আমি জানি। কিন্তু কেন করেন না সেটা অজানা। আপনার কাছে একটাই অনুরোধ আজকের পর থেকে আর কোন দিন রোদেলা কে ওই বিষয় থেকে শুরু করে কোন  ছোট ধরনের বিষয়ে বা কারনে কথা শুনানো, টন্ট করা বন্ধ করবেন। আপনার যদি রোদেলার সাথে ঘটা দুর্ঘটনার জন্য তার সাথে এক বাসার ছাদে থাকতে অস্বস্তুি লাগে আমাকে বলতে পারেন। আমি ব্যবস্থা নিব। 

 

–কি ব্যবস্থা নিবি তুই? চমকে উঠে জাবেদা খাতুন প্রশ্ন ছুড়লেন। 

 

–অন্য কোথায় শিফট হবো। 

 

–মানে? 

 

–মানে টা খুব সহজ! আপনার জন্য যদি আগামীতে রোদেলা কষ্ট পায় তাহলে সেই দিনটা আমার এই বাসায় শেষ দিন হবে।  

 

জাবেদা খাতুন হা হয়ে গেলেন। আবেগ এসব কথা বলবে সে ভাবতেও পারে নি কোন দিন। 

 

আবেগ মাথা নিচু করেই বলে, কাউকে কোন কারন ছাড়া ঘৃণা করা খুবই জঘন্যতম কাজ আর কাউকে ইচ্ছাকৃত ভাবে আহত করা আমার কাছে পাপ মনে হয়!  একটা মানুষ কে বেত মারলেও সে ওতোটা কষ্ট পাবে না যতোটা মুখে কটু  কিছু বললে পাবে। জিব্হা হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষতিকর তলোয়ার যা মানুষের মনকে কেটেকুটে রক্তপাত করিয়ে দেয়। আম্মা আপনি শুনছেন আমার কথা? 

 

–হুম!

 

–আপনার জিব্হার তলোয়ারটা একটু বেশিই ধারালো। রোদেলা এমনি আপনার আর আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন আমাদের উচিত ওকে সুখে রাখার চেষ্টা করা। আজকে রোদেলার জায়গায় ইভানা থাকতে পারত। রোদেলা চাইলেই কিন্তু রিশাদকে বলতে পারত, ইভানার সাথে যা করার করো আমি নিচে নামব না৷ কি এটা রোদেলা বলতে পারত না? 

 

–পারত বোধহয়। 

 

–বোধহয় না আম্মা। অবশ্যই পারত। রোদেলা নিজের বাসায় নিজের রুমে ছিল। রিশাদ সহজে ওর ক্ষতি করতে পারত না কিন্তু ইভু ও বাইরে ছিল । মা?

 

–হু? 

 

–আজকে যদি আমাদের মধ্যে বন্ডিং ঠিক থাকত তাহলে কিন্তু অন্য ঘটনাও ঘটতে পারব! আপনি নাকি দেখেছিলেন রিশাদ ফোন করেছিল এটা সত্য? 

 

–হু। 

 

–সেই সময় যদি আপনি  রোদেলাকে আজেবাজে কিছু  না বলে  তাকে সাহায্য করতেন বা এট লিস্ট ওর পাশে থাকতেন তাহলে দুইজন মিলে অন্য কোন সমাধানে যেতে পারতেন। একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা যদি আলাদা আলাদা থাকি তাহলে ঠিক এভাবেই বাইরের মানুষ এসে আমাদেরকে ভেঙে দিবে আর যদি আমরা এক জোট হয়ে থাকি তাহলে বাইরের কেউ তো আমাদের ভাঙ্গতে পারবেই না বরং কেউ ক্ষতি করতে চাইলে আমরাই তাদেরকে খুব সহজে মোকাবিলা করতে পারব৷ কিন্তু আমি জানি, আমাদের এক জোট হওয়া সম্ভব না। আপনি দুই দিন পর ই রোদেলাকে দুশ্চরিত্রা বলবেন। আপনি বললে প্রতিবেশী রা ও এসে বললে। আর আমরা যদি শক্ত থাকি তাহলে সমাজ ও চুপ থাকবে। সমাজ হচ্ছে সুযোগ সন্ধানি। সুযোগ পেলেই লাফাবে। আমি চাই না সমাজকে সেই সুযোগ দিতে। আপনাকে আবারো বলছি আপনার কি সমস্যা হবে রোদেলা যদি এই বাসায় থাকে? 

 

জাবেদা খাতুন চুপ রইলেন। 

 

আবেগ বলে উঠে, আপনি সময় নিয়ে ভাবুন। আমি রাতে আবারো আসব উত্তর জানতে। আম্মা শেষ বারের মতো একটা কথা বলতে চাই, আমার সমস্ত সুখ রোদেলাতেই! যাই তাহলে। 

 

আবেগ রুম ছেড়ে বের হলো। 

 

রোদেলা চুপচাপ বসে আছে। পাশেই সমুদ্র শুয়ে আছে। হাত পা নাড়াচ্ছে সমুদ্র আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে। রোদেলা এক ধ্যানে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। আবেগ রুমে ঢুকল এবং রোদেলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। রোদেলা বিনিময়ে হাসল না। 

 

তখনি সমুদ্র কেদে উঠে। রোদেলা সমুদ্র কে কোলে নিল। আবেগ রোদেলার কাছে গিয়ে বসে পড়ল এবং বলল, দাও। আমি ঘুম পাড়িয়ে দেই। 

রোদেলা আবেগের দিকে না তাকিয়ে বলে, আমি রিশাদের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করতে চাই! 

 

আবেগ রোদেলাকে শক্ত করে ধরে বলে, মেঘ ব্যবস্থা নিচ্ছে। তুমি কোন চিন্তা করবে না প্লিজ। সব ভুলে যাও। 

 

রোদেলা করুন গলায় বলে, এতো সহজ সব ভোলা? 

 

–সহজ না কিন্তু অসম্ভব তো না। প্লিজ সব ভুলে যাও। আমরা নতুন করে সব শুরু করব। তুমি আমি সমুদ্র আমরা তিনজন মিলে তোমার মনের সেই ছোট্ট পাখির বাসার সমান বাসাটায় থাকব। সেদিন তুমি আমার নামে মালিকানা দিতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি অধম নিতে পারি নি। আজকে সৌভাগ্যক্রমে আবারো সুযোগ পেলাম। এবার আর হাতছানি করতে চাই না। এবার আমি নিজে থেকে তোমার মনের বাড়িটা কিনতে চাইছি। করে দিবে তোমার মনের নীড়টা আমার আর সমুদ্রের নামে? 

 

রোদেলা আবেগের দিকে তাকালো। চোখ আজকে কেবল তার না আবেগের ও ভেজা! 

 

–কি হলো কিছু তো বল! 

 

–মামা-মামী,  ইভু কি দোষ করল? ( রোদেলা) 

 

এতো কষ্টের মধ্যেও আবেগের হাসি পেয়ে গেল।সে খুশি মনে বলে উঠে, ওরাও থাকবে। 

 

রোদেলা মৃদ্যু হাসল।  এই হাসিতে বেদনার পরিমাণ বেশি! 

 

আবেগ প্রথমবারের মতো রোদেলার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। যদিও এর আগেও একবার দিয়েছিল। কিন্তু তখন রোদেলা ঘুমাচ্ছিল। 

 

আবেগের প্রসিদ্ধ ভালোবাসার ছোয়ায় রোদেলা সদ্য সাগর থেকে খুজে পাওয়া মুক্তার মতো পবিত্র হয়ে গেল! 

 

রোদেলা চোখ বুজে ফেলে। খুব শান্তি লাগছে তার। 

 

সেই ভয়ংকর রাতে সে আল্লাহর কাছে  মরন চেয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেনি বিধায় মনক্ষত হয়েছিল রোদেলা। কিন্তু আজকে সে উপলব্ধি করছে, হয়তো এই দিনটা দেখানোর জন্যই আল্লাহ তাকে  এখনো জীবিত রেখেছে! 

 

★★★

 

নেহা পুরা রুম জুড়ে পায়চারি করছে। খুব টেনশড সে। সাত দিন ধরে সে গৃহ বন্দী।  বাবা বাসা থেকে বের হতে দেয় না। ফোন ও নিয়ে গেছে।বাসার সব টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন নেহার বাবা। সে কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারেনি বিগত সাত দিন ধরে। কোন ফ্রেড তো দূরে থাক। কাজিনদের সাথেও পারছে না যোগাযোগ করতে। সাত দিন পর তার প্রাচুর্যের সাথে বিয়ে। পারিবারিক ভাবে। নেহা কিছুতেই এই বিয়েতে রাজী না। প্রাচুর্য জোড় করে তাকে বিয়ে করছে এতে আবার তার বাবা সায় দিচ্ছে। নেহার চোখ ভরে উঠল। সে চায় না প্রাচুর্যকে তার জীবনে। একদমই পছন্দ না প্রাচুর্যকে তার৷ কেন পছন্দ না তা নিজেও জানে না নেহা। 

 

নেহা মনে মনে ঠিক করল, আর যাইহোক সে কোনক্রমেই প্রাচুর্যকে বিয়ে করবে না! 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–38(বোনাস) 

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রাতের পরেই নাকি আলো  ফুটে। উজ্জ্বল একটা সকাল হয়! এটাই জগতের নিয়ম। রোদেলা কোথায় যেন শুনেছিল, যে রাত যত গভীর হয়, যতো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয় সেই রাতের পরে যে দিনটা শুরু হয় সেটা নাকি অনেক ঝলমলে হয়। কে জানে কথাটা কথা কত ভাগ সত্য। তবে আবেগ ও রোদেলা দুজনেই একটা উজ্জ্বল ঝলমলে আনন্দময় সকালের আশায় প্রহর গুনছে। 

 

আপাতত সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে। আযান পড়ে গেছে। সবাই নামাজ পড়ে আবেগ আর রোদেলার রুমে বসে আছে। সবাই বলতে আবেগ, মেঘ ইভানা আর রোদেলা। 

 

মেঘ আর ইভানা টুকটাক রোদেলার সাথে কথা বলছে। সবই সেই ভয়ংকর রাতের বিপ্রতীপ কথা-বার্তা। আবেগ তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। রোদেলার মধ্যে  অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। মানুষ গুলো তাকে একটু হাসানোর জন্য কতো প্রচেষ্টা করছে। সত্যি! আজকে এই প্রথমবারের মতো নিজেকে লাকি মনে হচ্ছে। মেঘ তার কেউ না তবুও নিজের ভাইয়ের মতো তার পাশে এসে দাড়িয়েছে। ইভানা ও তার অনেক আপন একজন। মামা তো তাকে নিজের মেয়েই ভাবে। 

 

মেঘ সমুদ্রকে কোলে নিতে নিতে বলে, সমুদ্রকে আমি ঠিক মতো আদরই করতে পারি নি৷ 

 

আবেগ বলল, তুই তো আসিস না আর আগের মতো তেমন একটা। 

 

মেঘ সমুদ্রকে চুমু খেয়ে বলে, বিজি ছিলাম অনেক।আচ্ছা শোন! আমি কি ভেবে রেখেছি জানিস? 

 

আবেগ উৎসাহের সাথে বলে, কি? 

 

–সমুদ্রের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিব। 

 

আবেগ ভ্রু কুচকে বলে, তোর মেয়ে? 

 

মেঘ বলে, ইয়েস, মাই ডটার! 

 

–কিন্তু তোর তো বিয়েই হলোনা মেয়ে আসল কোথা থেকে? পালিয়ে বিয়ে করেছিস নাকি? 

 

মেঘ মুখ বাকিয়ে বলে, আরে যখন হবে, তুই কি এখনি তোর ছেলের বিয়ে দিবি নাকি?  

 

–ও৷ 

 

রোদেলা মৃদ্যু হাসল। তা দেখে মেঘ বলে, দেখ, সমুদ্রের বিয়ে হওয়ার জন্য ও এট লিস্ট আমাকে একটা মেয়ে খুজে দাও আর কত কাল সিঙ্গেল থাকব। 

 

আবেগ আবারো প্রশ্ন করে, তোর কথার আগা মাথা কিছু ই বুঝি না। 

 

–তুই বুঝবিও না৷ 

 

এমন সময় মেঘের ফোন আসে। সে সমুদ্রকে বিছানায় শুইয়ে বারান্দায় চলে যায় ফোনে কথা বলতে। 

 

কলিং বেল বেজে উঠল। আবেগ ইভানাকে বলে, এখন কে আসল?

 

ইভানা বলে, জানি না তো! 

 

–গিয়ে দেখে আয়। আর আগে চেক করে নিবি৷ 

 

–আচ্ছা। 

 

বলে ইভানা গেট খুলতে চলে যায়। কিছু মিনিট পর সে আর অথৈ রোদেলার রুমে প্রবেশ করল। 

 

রোদেলা অথৈকে দেখে কিছুটা চমকালো। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না অথৈ তার সাথে দেখা করতে এসেছে। অথৈ হলো রোদেলার ভার্সিটি ফাস্ট ডে থেকে কনভোকেশন পর্যন্ত বেস্টফ্রেন্ড। পড়াশোনা শেষ করেও তাদের বন্ধুত্ব ঠিক ছিল। কিন্তু মাঝে আবেগের সাথে বিয়ের পর ফাটল ধরেছিল তাদের সম্পর্কে। 

 

কিছু দিন ধরে অথৈয়ের সাথে কোন যোগাযোগ নেই তার। সত্যি বলতে সে খুব মিস করে অথৈকে। অথৈ হচ্ছে তার সুখ-দুঃখের গল্প করার সাথী।  প্রত্যেকের জীবনে একটা করে বেস্টফ্রেন্ড থাকা ম্যান্টাডোরি! বেস্টফ্রেন্ড হলো কথা জমানোর ব্যাংক। তাকে সবকিছুই বলা যায়।  যা অন্য কাউকে বলা যায় না। রোদেলা আর অথৈ দুইজন ই খুটিনাটি সব শেয়ার করে পরস্পরের সাথে। 

 

অথৈকে আসতে দেখে আবেগ হেসে বলে, কেমন আছো অথৈ? 

 

অথৈ হালকা হেসে বলে, ভালো ভাইয়া৷

 

ইভানা আর অথৈ  পাশাপাশি রুমে দাঁড়িয়ে রইল। আবেগ চেয়ারে বসা আর রোদেলা সমুদ্র কে নিয়ে বিছানায় বসেছে। 

 

রোদেলা অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলে, দাড়িয়ে আছিস কেন? বস আমার পাশে। কতো দিন দেখা হয় নি তোর সাথে। কথা হয় নি অনেক দিন। 

 

অথৈ ধপ করে রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ল৷ সে কিছুটা সংকোচের মধ্যে ছিল কিভাবে সব নরমাল করবে। কিন্তু রোদেলার এমন স্বাভাবিক কথা-বার্তা পরিস্থিতিটা অনুকূলে এনে দিল। 

 

অথৈ কিছু বলবে তার আগেই রোদেলা অথৈয়ের হাতে হাত রেখে বলে প্রায় ফিসফিস করে  বলে যাতে অন্যরা শুনতে না পায় 

 

“আগে যা হয়েছে সব বাদ। আমি অতীতের সব কিছু ভুলে গেছি। কিছুটা মেমোরি লসের মতো সব অতীত ভুলে গেছি। তাই অতীতের কথা বাদ দিয়ে সব নতুন ভাবে শুরু করব। এক নতুন অধ্যায় যাকে বলে।   এই অধ্যায়ে তোকে আমার সাথে চাই।”

 

অথৈ কাদো গলায় বলে, আমি সবসময়ই তোর আছি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দে। আমাকে ভুল বুঝিস না প্লিজ। 

 

–আহা! মাত্র কি বললাম। আমি সব ভুলে গেছি তো! 

 

আবেগ বলে উঠে, দুই বান্ধবী কি ফুসফাস করছো? কিছুই তো শুনি না! 

 

রোদেলা বলল, শুনতে হবে না। এটা আমার আর ওর সিকরেট কথা। 

 

অথৈ আসায় রোদেলা কিছুটা স্বাভাবিক হলো। যার কারনে সবচেয়ে খুশি আবেগ। এতোক্ষণ একেবারে মূর্তির মতো চুপ থাকলেও এখন কিছুটা কথা বলছে রোদেলা। যা দেখে ভালো লাগলো আবেগের৷ 

 

মেঘ কথা বলা শেষ করে রুমে এসে অথৈকে দেখে শক খেল। অথৈ ও চমকে উঠে দ্রুত রোদেলার দিকে তাকালো। সে আর ভুলেও মেঘের দিকে তাকাবে না৷ 

 

মেঘ আবেগকে উদ্দেশ্য করে বলে, একটু বাইরে আয়। 

 

–চল। 

 

আবেগ আর মেঘ বাইরে এসে ইভানার রুমে গিয়ে ঢুকল। আবেগ লাইট জ্বালিয়ে দিল। 

 

মেঘ বলে উঠে, রিশাদের সাথে কেউ একজন ক্ষমতাধীন লোক আছে যে ওকে সেইভ জোনে রেখেছে। বুঝলি? পলিটিকস আছে এর মধ্যে। 

 

–কে ওই জানোয়ার কে হেল্প করছে? (আবেগ) 

 

মেঘ নির্লিপ্ত গলায় বলে, হবে কোন জানোয়ারই। 

আবেগ বলল, এখন কি করব? 

 

মেঘ বলল, তোকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি ই করব। তুই শুধু রোদেলার পাশে থাক আর নিজেও একটু রেস্ট নে। চেহারার হাল দেখেছিস? 

 

–হুম। 

 

— একয়েকদিন আর হাসপাতাল যাস না। বাসায় থাক।ইভানাকেও বাইরে বের দিস না। এক কথায় তোরা কেউ বাহির হবি না। সাবধান থাকা ভালো। 

 

–আচ্ছা৷ 

 

–তোদের গেস্ট রুমটা ঠিকঠাক করে দে। রিশাদ ধরা না পড়া পর্যন্ত আমি তোদের সাথেই থাকব ভাবছি। 

 

–থ্যাংকস। এই সময়ে তোকে খুব প্রয়োজন ছিল। সত্যি বলতে আমার নিজেরই আব্বা-আম্মা ইভু রোদেলাকে নিয়ে থাকতে ভয় লাগছে। কখন কি হয়ে যায়! 

 

— চিন্তা করিস না। তোদের বাসার নিচে একটা কালো মাইক্রো পার্ক করা আছে। ওখানে পুলিশ ফোর্স টহল দিচ্ছে। 

 

–হু।

–চল রোদেলার কাছে গিয়ে বসি। 

 

–চল। 

 

আবেগ রুমে ঢুকেই অবাক। তার মা বিছানায় বসে  আছেন। হাতে স্যুপের বাটি। তিনি রোদেলাকে জোড়াজুড়ি করে স্যুপ খাওয়াচ্ছেন৷ 

 

তা দেখে মেঘ আবেগকে ফিসফিস করে বলে, তোর বাসায় তো হ্যালির ধূমকেতু দেখা দিল রে দোস! 

 

আবেগ মনে মনে হাসল। যাক তার কথা টনিকের মতো কাজ করছে হুইজ ইস রিয়েলি গুড। 

 

এবার অথৈয়ের ফিরে যাওয়ার পালা। অথৈ যেতে ধরলে মেঘ প্রশ্ন করে, একাই যাবা? 

 

অথৈ ভাবলেশহীন ভাবে বলে, একাই এসেছি একাই যাব। 

 

বলে চলে গেল অথৈ।  মেঘ ও অথৈয়ের পিছে পিছে চলে যায় রুম ছেড়ে। কেউ তাদের কিছু বলল না। 

 

বাসার গেটের সামনে আসতেই  মেঘ অথৈকে আটকে দিয়ে বলে, একা যেতে হবে না। আমি পৌছে দিচ্ছি তোমাকে। দিনকাল ভালো ন একা যাওয়া লাগবে না। 

 

–লাগবে না। শুধু শুধু কষ্ট করে আসা,,,,

 

–ওইদিক থেকে সিগারেট কিনব। 

 

–সেটা তো এখান থেকেও কিনতে পারো। 

 

–কথা কম বল তো মেয়ে। (বিরক্ত হয়ে) 

 

অথৈ চুপ হয়ে গেল।। মেঘ তাকে নিয়ে রিকশাই উঠে বসল। 

 

দুজনের মাঝে কিছুটা ফাকা। অথৈ রিকশার হুট ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে৷ মেঘ বারবার রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিতে দিতে  বলছে, ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালান না৷ আমার কাজ আছে। 

 

অথৈ এহেন কথায় বিরক্ত হচ্ছে৷ রিকশায়ালা বিরক্ত নিয়ে বলে, এইডা রিকশা। হেলিকপ্টার না যে উইড়া যামু। এতো তাড়া থাকলে উড়োজাহাজ ভাড়া নিতেন৷ 

 

অথৈ হিহি করে হেসে দিল। মেঘ মুখ কালো করে বলে, তাও একটু দ্রুত আগানোর চেষ্টা করেন। আমার কাজ আছে। 

 

অথৈয়ের বাসায় এসে রিকশা থামল। অথৈ নেমে পড়ে  এবং বলে, এতো তাড়াই যখন ছিল শুধু শুধু আসতে গেলে। আমাকে নামাতে না এসে এই সময়টায় ওই কাজ টা করতে যার তাড়া আমার সামনে দেখাচ্ছো। 

 

মেঘ কিছু বলে নি। অথৈ উপরে উঠে গেল। 

 

অথৈ বাসায় এসে বাথরুমে গিয়ে সময় নিয়ে ফ্রেস হয়ে বারান্দায় গামছা নেড়ে দিতে এসে তার চোখ অক্ষিকোটরের বাইরে আসার জো। মেঘ এখনো রিকশা নিয়ে তার বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে৷ মেঘ আর রিকশা ওয়ালা দুইজন ই মাথা উচিয়ে তার বারান্দায় দিকে তাকানো৷ 

 

তাকে বারান্দায় আসতে দেখে রিকশাওয়ালা প্যাডেল ঘুরিয়ে সামনে আগালো। 

 

অথৈ বিড়বিড় করে বলে, পাগল-ছাগল কোথাকার। 

 

রিকশা চলছে আপন গতিতে। ডিসেম্বরের হুহু বাতাস গায়ে মাখাচ্ছে মেঘ। ভালোই লাগছে তার৷ রিকশা ওয়ালা নিজ থেকে ই বলে উঠে, বুঝলেন ভাই, আজ-কাল মাইয়ারা কোথাও নিরাপদ না৷ 

 

মেঘ ভ্রু কুচকে বলে, কেন এমন বললেন?

 

–আমার মাইয়াটার নাম ফুল৷ ফুলের মতোই সুন্দর আর স্নিগ্ধ। মেধাও খুব। ওর কলেজের শিক্ষক বলছে, ফুল নাকি ডাক্তার হওয়ার মতো মেধাবী। কিন্তু,,, 

 

—কিন্তু কি? (বিচলিত হয়ে বলে  মেঘ কারন ফুল নামক অচেনা মেয়েটার কথা শুনে তার বেশ মায়া ধরে গেছে) 

 

–আমার মাইয়াডার কলেজের এক পোলা ওরে খুব ডিস্টার্ব করে। বুঝলেন আগে মাইয়াডা প্রতিদিন কাদতে কাদতে বাসায় ফিরত। এখন কলেজ বন্ধ দেখে কলেজ যায় না। অনলাইনে ক্লাস হয়। ও করতে পারতেছে না৷ আমাদের ফোন নাই। মাইয়াডার জন্য চিন্তা হয় আমার। বাসায় ও আর ওর ছোট ভাই একা থাকে। না জানি আমি না থাকলে কি হয়। ওই ছেলে একবার আমাদের বাসায় এসে হুমকি-ধমকি দিয়ে গেছে। বিয়ে করতে চায় আমার মেয়েটাকে। কিন্তু ছেলেটা ভালো না। আর আমি চাই আমার মেয়ে ডাক্তার হবে এখনি বিয়ে দিতে চাই না। 

 

মেঘের মনটাই বিষিয়ে উঠল।আসলেই আমাদের দেশের মেয়েরা কিছুটা হলেও অনিরাপদ! ফুল নামের মেয়েটাকে তার সাহায্য করতে মন চাচ্ছে৷ 

 

রিকশা আবেগের বাসার সামনে এসে থামল। 

 

রিকশাওয়ালাকে তার বাসার এড্রেস দিতে বলল সে। রিকশাওয়ালা বলল, কেন? আমার বাসা ঠিকানা জেনে লাভ কি আপনার ? 

 

–আমি হচ্ছি অনেক বড় পুলিশ অফিসার । আমার আন্ডারে অনেক পোস্ট৷ আপনাকে সাহায্য করব। ওই ছেলেকে পুলিশ দিয়ে ক্যালানি দিব। প্রমাণ পাইলে জেল খাটাব৷ কালকে এই বাসার তিনতলায় আসবেন প্লিজ। 

 

রিকশা ওয়ালা অবাক হয়ে গেল । মেঘ তা উপেক্ষা করে উপরে উঠে গেল। 

 

★★★

 

খাওয়া শেষ করে রোদেলা বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। রাত যতোই হচ্ছে তার মনটা ততোই অস্থির হয়ে পড়ছে। রোদেলার চোখ ভেজা। কোন কারন ছাড়াই। কেউ কিচ্ছুটি বলে নি তাকে। বরং ভালোবাসার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে আগের তুলনায় ৷ এমন কি মামী ও তার সাথে ভালো করে কথা বলছে। 

 

 কিন্তু তবুও সে অনুতপ্ত। অনুশোচনায় ভুগছে। সে আবেগকে ঠকালো কি? 

 

রোদেলার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে। হুট করে আবেগ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। রোদেলা হালকা কেপে উঠে। 

 

আবেগ পেছন থেকে বলে উঠে, বারান্দায় ঠান্ডা তো। রুমে চল। 

 

–আবেগ? 

 

–হুম? 

 

–আমি কি তোমার অনুপযোগী? তুমি আমার চেয়ে বেটার কাউকে ডিজার্ভ কর তাই না?  আমি তোমার জীবনে কেবল সমস্যাই বয়ে এনেছি। কখনো সুখ দিতে পারি নি আজ পর্যন্ত! 

 

আবেগ রোদেলাকে পেছন  থেকে খুব শক্ত করে ধরে রোদেলার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, 

 

“i” এর পর যেমন কোন দিন “are” বসে না তেমন ই আবেগের পর শূন্যস্থানে অন্য কেউ বসবে না! 

 

You এরপর যেমন সবসময়  are বসবে তেমনি আবেগের পর খালি জায়গায় কেবল রোদেলাই থাকবে! এটা অভিধান থেকে দেওয়া  নিয়ম। 

–নূর

 

রোদেলা বিষ্মিত হলো। মৃদ্যু শিহরণ বয়ে গেল তার গা বেয়ে। 

 

আবেগ রোদেলাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে, 

 

পা না ভিজিয়ে সাগর পাড়ি দেয়া যায় কিন্তু চোখের পানি না ফেলে জীবন পাড়ি দেয়া যায়না।(কালেক্টেড) 

 

রোদেলা আবেগকে জড়িয়ে ধরে। বাইরে হীম হাওয়া। তবুও বুকটা গরম হয়ে গেছে তার। উথাল-পাতাল চলছে মনে৷ 

 

আবেগ রোদেলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, মাত্র বললে না আমাকে সুখ দাও নি। ভুল বলেছো সামান্য। আমি নিজেই তো সুখের ঝুলি। কালকে থেকে এক নতুন আলোর সন্ধ্যানে আমরা যাত্রা শুরু করব। ঠিক আছে? 

 

–হুম। 

 

চলবে৷ 

 

#অশ্রুমালা 

part–39

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

 

প্রাচুর্য মাথায় হাত রেখে  তার অফিসের কেবিনে বসে আছে। সবে মাত্র সকাল। তাও শুক্রবার। তাই কর্মচারীর আনাগোনা খুব কম। চার-পাঁচ জন কর্মচারী এসেছে মাত্র।আজকে অফিস বন্ধ।  প্রাচুর্য এতো সকালে অফিসে আসে না। তার ঘুম খুব গভীর। নয়টার আগে চোখ খোলে না সে। নয়টার দিকেই প্রতিদিন উঠে, দশটা-সোয়া দশটায় অফিস  পৌছায় সে। কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটেছে৷ এখন কেবল মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। এতো জলদি এসে পড়েছে সে। কারন দুই রাত ধরে তার চোখে ঘুম নেই। প্রচুন্ড ক্লান্ত সে। চোখ জ্বালা করছে প্রাচুর্যের। এমনি সকালে উঠলে তার মাথা ব্যথা করে। আজকেও চিনচিন ব্যথা করছে মাথা। প্রাচুর্য চোখ বুজল। হুট করে ফোন বেজে উঠল। সে বিরক্তি প্রকাশ করে ফোনের শব্দে। ফোনের শব্দটা মাথার ভেতরে গিয়ে লাগে তার।  সে চোখ খুলে ফোন হাতে নিতেই বিরক্তিটা তিক্ততায় রুপান্তর হলো। রিশাদের কল। এই ব্যাট তাকে কেন এতো সকালে ফোন করছে? 

 

প্রাচুর্য ফোন রিসিভ করে বলে, কি হয়েছে কল দিচ্ছেন কেন? 

 

রিশাদ ওপাশ থেকে বলে উঠে, প্রাচুর্য আপনি আমাকে না বলে বাসার বাইরে কেন গিয়েছেন? 

 

প্রাচুর্য কটমট করে বলে, সিরিয়াসলি আপনার মনে হয় শেখ প্রাচুর্য আপনার পারমিশন নিয়ে বাইরে যাবে? 

 

–অবশ্যই।

 

–মাই ফুট। 

 

–মাই ফুট না আপনি বাধ্য প্রাচুর্য। বারবার ভুলে যান কেন? 

 

–রিশাদ আপনি কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করছেন৷ আপনি কি আমার সম্পর্কে কিছু জানেন না? জানেন না আপনি? আমি কতোবড় বিসনেস ম্যান। স্টিল আপনি আমার সাথে লড়তে এসেছেন। ফলাফল কিন্তু ভালো হবে না৷ 

 

রিশাদ রিল্যাক্স মুডে বলে, দেখেন ভাই, আপনি এখন আমার হাতের কাঠপুতুল। আমি যা বললো, তাই করতে হবে। 

 

–আই উইল কিল ইউ! (দাতে দাত চিবিয়ে প্রাচুর্যে) 

 

রিশাদ হোহো করে হেসে উঠে বলে, এতো মেজাজ ভালো না প্রাচুর্য ভাই৷ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলো রাগ।রাগ কম করবেন। ভুলে যাবেনা আপনার হবু বউয়ের ইজ্জত আমার কাছে! 

 

প্রাচুর্য ফোন বাম কান থেকে ডান কানে নিতে নিতে বলে, কোন দিন যে তোকে নিজের হাতে মাইরা ফেলাই সেই ভয়ে থাকে হারামজাদা৷ 

 

–গালি দিবেন না প্রাচুর্য। আমার রাগ উঠলে কিন্তু ক্ষতি আপনারই হবে। সো বি কেয়ারফুল।  আর শোনেন আজকে দুপুরে বিরিয়ানি করতে বলেন তো। খেতে মন চাচ্ছে। 

 

প্রাচুর্য ফোন খট করে কেটে দিল।  প্রাচুর্যের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে খুব বিচলিত। মূলত নেহাকে নিয়েই। নেহার একটা এমএমএস তার অজান্তেই রিশাদের কাছে কিভাবে যেন পৌছে গেছে৷কিংবা রিশাদ কোনভাবে নেহার আপত্তিকর ভিডিও ধারন করেছে৷ 

 

 সেই এমএমএস দেখিয়ে রিশাদ তাকে ব্লাকমেইল করে তার বাসায় আশ্রয় নিয়েছে৷ প্রাচুর্য সব জানে। রোদেলার সাথে রিশাদ কি করেছে সব জানা সত্ত্বেও  সে কিছুই করতে পারছে না। পারছে না রোদেলাকে সাহায্য করতে৷ রোদেলাকে সাহায্য করার চাইতে তার কাছে নেহাকে সেইভ রাখা বেশি দরকার। সেদিন রাতেই সে নিজেই রিশাদকে জানিয়েছিল পুলিশ গোডাউনে এটাক করবে। রিশাদ তো রোদেলাকে নিয়েই প্রাচুর্যের বাসায় লুকাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রাচুর্য রোদেলা আনতে দেয় নি। রিশাদকে আনার জন্য একটা মোটর সাইকেল ইচ্ছা করেই পাঠিয়ে দিয়েছিল যেন রিশাদ পাচ মিনিটের মধ্যে রোদেলাকে নিয়ে মোটর সাইকেলে উঠে বসতে না পারে।হয়েছেও তাই। রিশাদ একা রোদেলাকে মোটর সাইলেকে নিতে পারে নি, পুলিশ ও কাছাকাছি চলে এসেছিল তাই রিশাস একাই ভেগে এসেছে।এই ভুল করার  জন্য রিশাদ তার কাছে দশ লাখ টাকা চেয়েছে।  ব্যাটার সাহস দেখে প্রাচুর্য হতভম্ব! 

 

 ভাগিস  প্রাচুর্য বুদ্ধি ঘাটিয়ে মোটর সাইকেল ঠিক  পুলিশ আসার তিন-চার মিনিট আগে পাঠিয়েছে। তা নাহলে রোদেলা কে তারই বাসায় রিশাদ অত্যাচার করত আর সে অসহায়ের মতো চোখ বুজে সহ্য করত। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে তার। 

 

প্রাচুর্য অনেক বেশি নিরুপায়। রোদেলার জন্য তার খারাপ লাগছে। সে জানত না রিশাদ রোদেলার এক্স হ্যাসবেন্ড। ইন ফ্যাক্ট হুট করে আননোন নাম্বার থেকে  রিশাদ তাকে ব্লাকমেইল করতে লাগে সাত দিন আগে থেকে। প্রথমে টাকা চেয়েছিল। প্রাচুর্য সুন্দর মতো দিয়ে ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলে। কিন্তু রোদেলাকে কিডন্যাপ করার দিন আবারো তাকে ব্লাকমেইল করে নিজের অপকর্মের সাথে প্রাচুর্য কে জড়িয়ে ফেলে রিশাদ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোদেলার ফোন তার বেডরুমে রেখে আসে। প্রাচুর্য এখন পর্যন্ত যা যা করেছে সব রিশাদের নির্দেশে। কারন ব্যক্তিগত ভাবে তার রোদেলার সাথে কোন শক্রতাই নেই। আবেগের সাথে আগে ছিল কিন্তু সেই শক্রতার মাত্রা এতোটাও বৃহৎ না যে আবেগের এতোবড় ক্ষতি করবে সে। প্রাচুর্য কখনোই জেনে বুঝে কারো ক্ষতি করে না। প্রাচুর্যের সাথে টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস রিশাদের লোক থাকে। তবে প্রাচুর্য চুপ বসে নেই। সে গোপনে সেই ভিডিও খুজছে৷ একবার হাতে লাগলেই রিশাদকে কুত্তা দিয়ে কামড়িয়ে কামড়িয়ে তিলে তিলে মারবে সে৷ রিশাদের একয়া ব্যবস্থা না নেওয়া পযন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না কোনভাবেই। প্রাচুর্য এটাও বুঝে পাচ্ছে না রিশাদ তাকেই কেন ব্লাকমেইল করল? তার ঘাড়েই কেন মামদো ভূতের মতো বসে পড়ল?

 

 রিশাদের কোম্পানির সাথে তারা গত মাসে পাটনার শীপে গিয়েছে। সেই প্রজেক্টের কাজ সব শেষ। প্রাচুর্য ঠিক মতো কোন দিন রিশাদের সাথে কথাও বলেনি। তারপর ও কেন রিশাদ তাকেই টাগেট করল কে জানে ? 

 

প্রাচুর্য আবারো চেয়ারে হেলান দিল। সাত দিন পর তার বিয়ে। অথচ মাথায় এতো এতো লোড। কিভাবে সব হ্যান্ডেল করবে সে? প্রাচুর্যের মনে হচ্ছে তার মাথায় টেন ইনটু টেন টু দি পাওয়ার প্যাসকেল সমান চাপ প্রয়োগ করছে! 

 

★★★

 

–বিরিয়ানিতে কি কি মশলা দিতে হয়? প্রশ্ন করল আবেগ৷ 

 

রোদেলা হালকা গলায় উত্তর দেয়, সব ধরনের মশলাই দিতে হয়।আর বাসায় বিরিয়ানির মশলা থাকলে সেটাও দেওয়া যায়।  

 

–ও। আলু কি গোল গোল করে কেটে দিব? 

 

–হ্যা৷ 

 

–আচ্ছা। আর পিয়াজ বাটতে হবে? 

 

–না। ফ্রিজে বাটা পিয়াজ রাখা আছে। 

 

আবেগ সব শুনে বলল, তাহলে রান্না বসিয়ে দিই? 

 

রোদেলা মাথা নাড়িয়ে আবেগকে সায় দেয়। আবেগ খুব উৎসাহের সাথে চুলা জ্বালালো। চুলায় হাঁড়ি বসালো। আজকে কাচ্চি বিরিয়ানি করা হচ্ছে। আবেগ ঠিক করেছে আজকে সে রান্না করবে। আর তাকে হেল্প করবে রোদেলা। 

 

রোদেলা মাংস ধুয়ে রান্না বসালো। আবেগ রান্না করবে বললেই শেষমেষ রোদেলাই রান্না করল। আধ ঘন্টার বেশি রান্নাঘরে থেকে আবেগের অবস্থায় যায় যায়। পিয়াজের ঝাঝ, রান্নার ঝাঝে তার নাকের অবস্থা করুন। শীতেও সে ঘেমে গেছে। আবেগ রান্নাঘরে আসে না বললেই চলে। 

 

রোদেলা মাংসের মধ্যে পোলাওয়ের ঢেলে দিয়ে নাড়তে লাগলো। চুলার উত্তাপে থাকা যাচ্ছে না। আবেগ একটা হাচি দিয়ে বলে, তোমরা মেয়েরা এতোক্ষন কিভাবে রান্নাঘরে থাকো? শীতকালেই আমার এই অবস্থা! জানি না গরম আসলে কি অবস্থা হবে! 

 

রোদেলা মৃদ্যু হাসল। কিছু বলল না। সে রান্নায় মনোযোগ দিল। 

 

আবেগ বারবার উপরে তাকাচ্ছে তা দেখে রোদেলা বলল, উপরে তাকিয়ে কি দেখছো? 

 

আবেগ উপরে তাকিয়ে থেকেই চিন্তিত গলায় বলে, ভাবছি রান্নাঘরে একটা ফ্যান লাগাবো। বাইরে থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ এনে মাঝখানে সিলিং ফ্যান বসাব। 

 

রোদেলা প্রথমে ভ্রু কুচকালো তারপর শব্দ কিরে হেসে বলে, রান্নাঘরে কেউ কোন দিন ফ্যান লাগায় নাকি! 

 

–তোমাদের জন্যই এই প্রয়াস! যেন গরমকালে বেশি গরম না লাগে। 

 

রোদেলা হাসি থামিয়ে বলে, দরকার নেই। আমরা মেয়েরা রান্নাঘরের চুলের উত্তাপে অভ্যস্ত। তুমি যে আমাদেরকে নিয়ে ভেবেছো এটাই অনেক। এবার রুমে যাও। তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে। চোখ কি খুব জ্বলছে তোমার? 

 

–কিছুটা। 

 

রোদেলা নিজের ওড়না দিয়ে আবেগের কপালের ঘাম মুছে দিল। আবেগ মুগ্ধ দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে।এতে রোদেলা লজ্জা পায়। সে এক প্রকার জোর করে আবেগকে রান্নাঘর থেকে ঠেকে রুমে পাঠিয়ে দেয়। আবেগ যেতে চাচ্ছিল না কিন্তু তার সহধর্মিণীর সাথে কথাও পেরে উঠতে না পেরে রুমে গিয়ে বসে পড়ে। 

 

রোদেলা মুচকি হেসে চুলার আঁচ কমিয়ে দিল। তারপর ডাইনিং রুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো । 

 

ঠান্ডা পানি দিয়ে চোখ ধুলে আবেগের আরাম লাগবে৷ রোদেলা রুমে গিয়ে দেখ আবেগ ফোনে কথা বলছে। ফোনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল কোন পেশেন্টের সাথে কথা বলছে। 

 

আবেগ ইশারায় রোদেলা কে জিজ্ঞেস করল সে কেন এসেছে। রোদেলা কিছু বলল না। শুধু একটু হাসল। কালকে রাতটা তার খুব ভালো কেটেছে। প্রায় ভোর পর্যন্ত সে আর আবেগ গল্প করেই কাটিয়েছে৷ কতো পুরোনো কথা, গল্প হাসাহাসির মাধ্যমে রাত পাড় হয়েছে। 

 

আবেগ ফোন রেখে বলে, কি হয়েছে? 

 

–ঠান্ডা পানি দিয়ে চোখ ধোও। আরাম পাবে। 

 

–থ্যাংক ইউ সো মাচ! 

 

আবেগ সত্যি সত্যি চোখ ধুয়ে আসল। রোদেলা ততোক্ষনে আবারো রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। আবেগ রুমে এসে সমুদ্রকে কোলে নিল। 

 

আবেগ মনে মনে ভাবছে, সমুদ্র যে কবে বড় হবে? কথা বলা শিখবে কবে? হাটাই না কবে শিখবে? আর কতো দিন পর তার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনবে? আচ্ছা! সমুদ্র তো একসময় অনেক বড় হয়ে যাবে। তখন আবেগ বুড়া হবে। সমুদ্রের বিয়ে দিবে তারা। ভাবতেই কি অদ্ভুত লাগছে তার! তার এই ছোট্ট রাজপুত্র একদিন নিজের সঙ্গে করে একটা রাজকন্যা আনবে! এসব কি আদৌ সম্ভব হবে? সে কি সমুদ্রের বিয়ে দেখে যেতে পারবে? পরক্ষনেই আবেগ নিজেই বলে উঠে, অবশ্যই পারব। সমুদ্রের বিয়ে আমি সেনাকুঞ্জে দিব! তারপর নিজেই আনমনে হেসে দেয়। 

 

দুপুরে নামাজের পর সবাই খেতে বসল। রোদেলা সবাইকে পরিবেশন করে দিল খাবার। বিরিয়ানির প্রসংশা সবাই করল। এমন কি মামী নিজেও বলে উঠে, বিরিয়ানি টা তো খুব মজা হয়েছে। রোদেলা মনে মনে খুব খুশি হয়। 

 

খাওয়া শেষ করে গল্পের আসর পাতানো হলো। তখন সাড়ে তিনটা বাজে৷ আজকে গল্পের আড্ডায় ইমতিয়াজ সাহেব ও আছেন। ঠিক চারটায় বেল বেজে উঠল। 

 

প্রতিদিনের মতো ইভানাই গেট খুলতে গেল। এই বাসায় গেট খোলার দায়িত্ব হলো ইভানা। ইভানার মনে হয় বাড়ির সবার ছোট সদস্যর উপর এই দায়িত্বের বোঝা ঝুলে থাকে। 

 

সে গেট খুলে মুচকি হাসল। অথৈ এসেছে। রোদেলাই ডেকেছে৷ 

 

অথৈয়ের বাসা ফার্মগেটেই। আবেগদের বাসা আর অথৈয়ের বাসায় মধ্যে রিকশায় গেলে পনের মিনিটের মতো লাগে। 

 

অথৈ বিড়ালের মতো পা ফেলে রোদেলার রুমে আসল। তাকে দেখে রোদেলা খুব খুশি হয়। সেই সাথে আরেক জোড়া চোখ ও শান্তি পায়। 

 

সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে অথৈ যেতে গেলে আগের দিনের মতো মেঘ তার পিছনে আসে। আজকে অথৈ আর মানা করে না। শুধু তাই না। আজকে রিকশায় অথৈ আর মেঘের মধ্যে কথাও হয় বেশ! দুজনের মধ্যে দূরত্ব টা কিছুটা হলেও কমে আসে। এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট মেঘের৷ সে ইচ্ছা করেই অথৈ কে রাগিয়ে তার সাথে কথা বলতে লাগে। 

 

চলবে৷ 

 

#অশ্রুমালা 

Part–40

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

মানুষ দুঃখ খুব সহজে না ভুললেও একসময় ঠিকই সব কষ্ট ভুলে যায়। এটাই হয়তো নিয়ম।একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার পর মানুষ কষ্ট গুলো ভুলে যায়। এক্ষেত্রে সময়টা কারো জন্য একদিন, একবছর কিংবা কয়েকবছর হতে পারে! 

 

গ্রামবাংলায় একটা কথার প্রচলন আছে তা হলো, আপন মানুষ মারা গেলে প্রথম দিন খুব কষ্ট হয়, দ্বিতীয় দিনও কষ্ট হয় কিন্তু প্রথম দিনের তুলনায় কম। তৃতীয় দিন আরো কম কষ্ট লাগে। চল্লিশ দিন যেতে যেতে কষ্টটা সয়ে যায়। মানুষের মস্তিষ্ক ও দুঃখের অনুভূতি গুলো দাবিয়ে রেখে সামনে  আগানোর তাড়া দেয়। 

 

রোদেলার ক্ষেত্রেও সেইম ঘটন ঘটেছে। প্রথম তিন তিনটা দিন দুঃস্বপ্নের মতো পারি দিলেও আজকে ষষ্ঠ দিনের মাথায় সে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কষ্ট গুলো কমতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে আবেগের ভূমিকা অপরিসীম। আবেগের সাপোর্ট না পেলে রোদেলা পারত না নিজেকে সামলাতে। হেরে যেত নিয়তির কাছে। 

 

আজকে আবেগ হাসপাতালে গিয়েছে। মেঘ ও বাইরে গিয়েছে। সবাই প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। শুধু সে আর ইভানা বাইরে বের হয় না। বাসাতেই থাকে। জাবেদা খাতুন বেশ চুপচাপ হয়ে গেছেন। নিজের রুমেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। মামী আগে থেকেই খুব অলস। সুযোগ পেলেই কাজ থেকে বাচতে চান। তাই পরোক্ষভাবে রোদেলার হাতেই রান্না-বান্নার দায়িত্ব চেপেছে। সে অবশ্য একা না। ময়নার মাও আছে। শুধু রান্না-বান্না করলেই হয় আর কিছু করতে হয় না। ছুটা বুয়া আছে। সে এসেছে বাকি কাজ করে দিয়ে যায়। আর আরো অবশিষ্ট কাজগুলো করে ময়নার মা। 

 

কেবল সকাল দশটা বাজে। নাস্তা সেরে রোদেলা উপন্যাস পড়ছে। কৈশোর থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনেক আগ্রহ তার। লেখালেখি না করলে চমৎকার পাঠিকা সে! এমন ও দিন গেছে এক বসায় পাঁচশ পৃষ্ঠার উপন্যাস শেষ করে উঠেছে৷  যাকে একেবারে আর্দশ পাঠক বলে! আজকে অবশ্য উপন্যাস পড়ছে না সে বরং হুমায়ুন আহমেদের লেখা “বাসর” গল্প টা পড়ছে। চমৎকার লাগছে তার! আহসানের জন্য একটা অদৃশ্য মায়া কাজ করছে৷ লোকটা খুব ভালোবাসত নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে? এখনো মনে রেখেছে নিজের স্ত্রী কে। পড়তে বেশ ভালোই লাগছে রোদেলার। গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছে সে।

 

মিনিট দশেক পর ছোট গল্পটা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু রেশ হয়ে গেল গল্পটার। রোদেলার মাথায় ঘুরঘুর করতে লাগে, আহসানের তার মৃত বউয়ের প্রতি ভালোবাসা আর শেষে বলা ইংরেজি সেই দুই লাইনের কবিতাটা৷ 

 

রোদেলা ঝটপট নোটবুক বের করে, গোলাপি রংয়ের কলম দিয়ে কবিতাটা সুন্দর গোটা গোটা হাতে লিখতে লাগে, 

 

Since there is no help, come let us kiss and part  

 

Nay, i have done, you get no more of me 

 

And i am glad, yea glad with all my heart 

 

That thus so cleanly I myself can free 

 

Shake hand for ever, cancel all our vows 

 

And when we can meet any time again

 

Be it not seen in  either of our brows

 

That we  one jot of former love retain

 

Now at the last gasp of love’s latest breath

 

When his pulse failing, passion speechless lies,

 

When Faith is kneeling by his bed of death

 

And innocence is closing up his eyes

 

Now if thou wouldst, when all have given him over, 

 

From death no life thou might’st him yet 

recover! 

 

শেষের লাইন গুলি রোদেলার মন ছুয়ে গেল। রোদেলা এমনিতেই ইংলিশ কবিতার প্রতি দুর্বল।হয়তো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী জন্যই!  

 

সে ঠিক করল আবেগকে এই কবিতা শুনাবে তারপর  বাসর গল্পের চরিত্র তারিনের  মতো করে বলবে, বল তো, Since there is no help, come let us kiss and part  এর মানে কি? 

 

রোদেলা আনমনে হেসে দিল। তার একটা বদঅভ্যাস আছে তা হলো যখন কোন গল্প বা উপন্যাস পড়বে তখন সেই গল্পের চরিত্রের মধ্যে নিজেকে কল্পনা করে। তাদের বলা সংলাপ ব্যবহার করবে। এই স্বভাবটা একদম বাচ্চাদের মতোন তার। “আমি তপু” পড়ে সে নিজেকে তপুর জায়গায় কল্পনা করেছিল! মিসির আলী পড়ে নিজেকে মিসির আলী ভাবতে লাগত! কি সুন্দর ছিল ফেলে আসা দিনগুলো! কোন চিন্তা ছিল না মাথায়। রোদেলা বইটা সযত্নে রেখে দিয়ে রান্না করতে চলে গেল৷ 

 

★★★

 

আবেগ হাসপাতালে ওয়ার্ড ভিজিটিং করছিল। এমন সময় মেঘের কল আসল। আবেগ দ্রুত ফোন ধরে বলে, হ্যা বল! 

 

–দোস, রিশাদের খবর পাইছি। 

 

–কোথায় আছে ও? 

 

–এটা এখনো জানি না। কিন্তু ওকে কে হেল্প করছে এটা বের করতে পারছি। 

 

আবেগ কটমট করে বলে, কে সে? 

 

–শেখ প্রাচুর্য। 

 

–ওয়েট হুয়াট? কি বললি আবার বল!  (আশ্চর্য হয়ে আবেগ)  

 

মেঘ নিলিপ্ত গলায় বলে,  নাম  ঠিক শুনেছিস। নেহার কাজিন প্রাচুর্য ই রিশাদকে হেল্প করেছে। 

 

আবেগ বিচলিত হয়ে গেল এবং তাড়াতাড়ি করে বলে, কিন্তু কেন ও রিশাদকে হেল্প করেছে? 

 

–জানি না। ওরা বিসনেস পাটনার। মেবি প্রফিট এর জন্য ই হেল্প করছে৷ 

 

আবেগ বলে উঠে, আমি প্রাচুর্য কে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জানতাম। 

 

–আমিও তো ভালোই ভাবছিলাম। কিন্তু ব্যাটা তো রিশাদের চেয়েও শয়তান। হাউ ক্যান হি হেল্প রিশাদ? বিবেকে বাধছে না ওর? (মেঘ) 

 

আবগ বলে উঠে, প্রাচুর্যের তো বিশাল ব্যবসা। ও যদি রিশাদকে সাহায্য করতে থাকে আমরা কোন দিন রিশাদকে আইনের আওতায় আনতে পারব না। 

 

মেঘ চটাং করে বলে, কে বলছে পারব না? ওই প্রাচুর্য কি হইসে যে আইনের চোখে বালি দিবে? ওরে শুদ্ধে জেলে পাঠাব। শোন আরো একটা কথা? 

 

–কি? 

 

–প্রাচুর্য ওর বাসায় নাই। গত শুক্রবারের পর ও আর অফিস যায় নি। আমার মনে হয়, প্রাচুর্য আর রিশাদ একসাথেই আছে। 

 

–হতে পারে। তুই কি খোজা শুরু করেছিস? 

 

–হ্যা। দেখি কি হয়। তুই সাবধানে থাক। 

 

–হুম। বিকেলে আসবি না? 

 

মেঘ বলল, হ্যা। আসব। 

 

–আচ্ছা। 

 

★★★

 

বিকেলের দিকে আবেগ বাসায় ফিরল। ততোক্ষনে মেঘ ও চলে এসেছে৷ আবেগ বাসায় এসেই ফ্রেস হতে চলে যায়৷ ফ্রেস হয়ে এসে দেখে অথৈ ও চলে এসেছে। আজকে দুই দিন পর অথৈ আসল। অথৈয়ের চেহারা কালো হয়ে আছে। চোখ ও লাল মনে হচ্ছে আবেগের কাছে। 

 

আবেগ মুখে কিছু জিজ্ঞেস না করে রোদেলার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। সে বসতেই রোদেলা নাস্তা খেতে দিল সঙ্গে চা। নাস্তা সেরে চা মুখে দিতেই আবেগ সোজা রোদেলার দিকে চোখ বড় করে তাকালো।

 

রোদেলা ভাবলেশহীন ভাবে বলে, তোমার সুগার লেভেল কিন্তু বর্ডার বরাবর। আজকে থেকে আর চায়ে চিনি খাওয়া হবে না। 

 

আবেগ মৃদ্যু হাসল। 

 

এবার অথৈ বলে উঠে, আচ্ছা শুনো সবাই একটা কথা বলার ছিল? 

 

সবাই অথৈয়ের কথা শোনার জন্য তার দিকে তাকালো। মেঘ ফোন চালাচ্ছিল, অথৈয়ের কথা শুনে ফোন চালানো বন্ধ করে তার দিকে তাকায়। এতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অথৈ৷ 

 

সে নার্ভাস হয়ে গেল এবং আস্তে করে বলে, কালকে নেহার সাথে কথা হয়েছে। 

 

নেহার কথা শুনতেই আবেগ আর রোদেলার চেহারার রঙ কিছুটা বেরঙিন হয়ে গেল। আবেগ একটু বিরক্ত ও হলো। সে নেহার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। 

 

মেঘ গমগমে গলায় বলে, তো? কথা হতেই পারে তোমার ওর সাথে। এজন্য এখন মাইক এনে সবাইকে শুনাতে হবে। আজব! 

 

অথৈ তড়িঘড়ি করে বলে, ওর কালকে বিয়ে। 

 

রোদেলা অবাক হয়ে বলে।,কিহ! 

 

–হুম। ওর কাজিন প্রাচুর্যের সাথে। 

 

প্রাচুর্যের নাম শুনতেই মেঘ আর আবেগ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। যার সন্ধানে  আছে তারা, সে কিনা বিয়ে করবে? 

 

মেঘ মনে মনে বলে, বাহ! ভালোই হত, আসামীও এখন বিয়ে করবে। বাসর রাত করবে। আর আমরা পুলিশ বসে বসে ঘুমাব! 

 

রোদেলা বলে, এটা তো সুসংবাদ। আলহামদুলিল্লাহ। নেহা যেন সুখী হয় প্রাচুর্যের সাথে। 

 

অথৈ মুচকি হেসে একটা বিয়ের কার্ড রোদেলার হাতে দিল। রোদেলা বলে উঠে, নেহার বিয়ের কার্ড এটা? 

 

অথৈ কঠিন গলায় বলে, না। 

 

–তো কার বিয়ে লেগেছে? 

 

–পড়ে দেখ ব্রাইডের নাম । 

 

রোদেলা কার্ড খুলে ব্রাইডের নাম দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলে। 

 

মেঘ আর আবেগ উৎসুক জনতার মতো চেয়ে আছে রোদেলার দিকে। 

 

রোদেলা হতভম্ব হয়ে বলে, তোর বিয়ে? 

 

–হু। (মাথা নিচু করে) 

 

মেঘের  যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তার। বুকটা হুট করে খুব ভারী লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কেউ এক টন পাথর ঠেলে দিয়েছে। 

 

রোদেলা বলল, তুই তো কিছুই জানালি না। হুট করে বিয়ের কার্ড দিচ্ছিস এখন!  আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না রে তোর বিয়ে! 

 

অথৈ বিড়বিড় করে বলে, আমারো বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। কিন্তু মুখে বলে, বাবা আসলে দেরি করতে চাচ্ছেন না তাই দ্রুত বিয়ের ডেট এগিয়ে আনা হয়েছে। ফয়সাল ও দ্রুতই বিয়েটা করতে চাচ্ছে। আচ্ছা শোন তোদের জন্য বিয়ের মিস্টি এনেছি। খাবি কিন্তু। 

 

–অবশ্যই। (রোদেলা) 

 

মেঘ হুট করে রুম ছেড়ে বের হয়ে গেল। তাকে দেখে  আবেগ ও বের হয়ে যায় রুম থেকে। রোদেলা বুঝতে পারছে কেন মেঘ চলে গেল। পুরোনো কথা বলে অথৈকে আর কষ্ট দিতে চায় না রোদেলা তাই কথা ঘুরিয়ে বলে, জানিস, সমুদ্রের ঠান্ডা লাগছে৷ গা টা একটু গরম করেছে। 

 

অথৈ বলে, সেকি!  কিভাবে সমুদ্রের ঠান্ডা লাগত? 

 

–জানি না। তুই দেখ তো জ্বর এসেছে কিনা? 

 

অথৈ সমুদ্র কে কোলে নিয়ে তার কপাল, গায়ে হাত রেখে চেক করে বলে,না রে। জ্বর নেই। 

 

রোদেলা একটা সোয়েটার বের অথৈকে দিল আর বলল সমুদ্র কে পড়িয়ে দিতে সোয়েটার টা। 

 

অথৈ সমুদ্রের গায়ে সোয়েটার পড়িয়ে সমুদ্র কে আদর করতে করতে বলল, শোন, আমি আমার মেয়ের বিয়ে সমুদ্রের সাথেই দিব। সমুদ্র কে আমি বুক করে নিলাম। 

 

বিয়ের কথা শুনে সমুদ্র শব্দ করে হেসে হাত নাড়াতে লাগে। তা দেখে অথৈ উত্তেজিত হয়ে গেল এবং বলল, দেখেছিস! সমুদ্র ও আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য  খুশিতে লাফাচ্ছে। 

 

রোদেলা সমুদ্র কে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে, বাবাই টা আমার কতো খুশি আজকে! 

 

অথৈ মজা করব বলল,বিয়ের কথা শুনে হাসছে সমুদ্র বাবু। 

 

রোদেলা সমুদ্র কে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলে, মেঘ ভাইয়া তোর আগেই বুকিং দিয়ে ফেলেছে রে। সর‍্যি। 

 

অথৈ রোদেলার কথা বুঝে উঠতে পারছে না তাই বললন,বুঝলাম না। 

 

রোদেলা হেসে বলে, মেঘ ভাইয়া তার মেয়ের সাথে সমুদ্রের বিয়ে দিতে চায়। উনি তোর আগেই বুকিং দিয়ে গেছে রে। আর সিট নাই আমার ছেলের মনে। বুঝলি, আমার ছেলে তো আর দুইটা বিয়ে করবে না। তাই সর‍্যি। 

 

অথৈ ঠোঁট বাকিয়ে মনে মনে বলে, মেঘের মেয়ের সাথে বিয়ে দিস না রে রোদেলা। তোর ছেলের জীবন টা ত্যাজপাতা হয়ে যাবে। মেঘ যেমন বেয়াদব ওর মেয়েও হবে আস্ত একটা বেয়াদব। 

 

রোদেলা সমুদ্র কে বিছানায় শুইয়ে কম্বল মুড়ে দিতে লাগলো। 

 

অথৈ গোমড়া মুখে বলে, তোর মেঘ ভাই এতো সিউর কি করে হলো তার মেয়েই হবে। ওর ছেলেও তো হতে পারে। 

 

রোদেলা এবার অথৈ কে পালটা প্রশ্ন করে, তুই কিভাবে সিউর যে তোর মেয়ে হবে? তোরও তো ছেলে হতে পারে। 

 

অথৈ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, এভাবে তো ভেবে দেখি নি! 

 

রোদেলা মুচকি হেসে বলে, বিয়ের টপিক বাদ। এটা পরে দেখা যাবে। জানিস আমার না খুব শখ সমুদ্র কে ডাক্তার বানাব। 

 

অথৈ রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ে বলে, তোর তো নিজেরই ডাক্তার হওয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল৷ 

 

রোদেলা ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চুমু খেয়ে বলে, এজন্য ই তো চাই আমার ছেলে ডাক্তার হবে।  সাদা এপ্রোন পড়ে হাসপাতালে যাবে। অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা দিবে। সবাই ডাক্তার সাহেব বলে ডাকবে। 

 

–আবেগ ভাইয়ার মতো ডাক্তার বানাবি? 

 

–হু। তবে আবেগের চেয়েও বড় ডাক্তার হবে আমার ছেলে। ও আবেগ তো এমবিবিএস ডাক্তার। আমি চাই সমুদ্র কার্ডিওলজিস্ট হবে। দেশ-বিদেশে অপারেশন করতে যাবে। 

 

অথৈ রোদেলার কাধে হেলান দিয়ে বলে, তুই পারিস বটে। এতো অগ্রিম চিন্তা করে বসে আছিস। 

 

রোদেলা অথৈকে জিজ্ঞেস করে, তুই খুশি তো? 

 

অথৈ কিছু টা চুপসে গিয়ে রোদেলাকে মিথ্যা বলে, হুম । 

 

রোদেলা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

part–41 (বোনাস) 

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

–কষ্ট পাস না  রে। সব ঠিক হয়ে যাবে।  (আবগ হালকা গলায় মেঘকে কথাটা বললো।) 

 

মেঘ ভাঙ্গা গলায় জবাব দেয়, আমি পাচ্ছি  না কষ্ট । ওর সাথে তো একবছর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। 

 

–তাহলে চোখে পানি কেন তোর? (নরম সুরে আবেগ প্রশ্ন করে) 

 

মেঘ কিছুটা জোরে করেই বলে, আমি কি রোবট? যে আমি অনুভূতিহীন হব? আমার ও কষ্ট হয়, যন্ত্রনা হয়! 

 

–আই এম সর‍্যি। 

 

মেঘ বিরক্ত হয়ে বলে, তুই কেন সর‍্যি বললি? বাদ দে এসব। আমি জাস্ট অথৈকে নিয়ে চিন্তিত।

 

–কেন? 

 

–ফয়সাল ছেলেটা সুবিধার না রে। 

 

–অথৈকে বল তাহলে। 

 

–বলছি। বিশ্বাস করে না ও আমার কথা। ওর বাবাকে জানাইছিলাম  ফয়সালের কথা। আমার মনে হয় উনি ইচ্ছা করেই বিয়ের ডেট আগায় আনছে। 

 

–অথৈয়ের বাবা কেন তোকে মানতে পারে না?আগে তোর জব ছিল না কিন্তু  এখন তো ভালো পজিশনে আছিস তাহলে কি সমস্যা ওনার? 

 

— আমি এতিম এটা তার পছন্দ না। সে চায় তার মেয়ে একটা হ্যাপি ফ্যামেলিতে সবার সাথে থাকবে। তার মতে আমার মা-বাবা নাই মানে আমার কোন পরিচয় নাই। আর ওনার ইগো অনেক। একবার রিজেক্ট অস্তিত্বহীন। দেখ, সবার মা-বাবা হায়াত নিয়ে আসে না। আমার বাবা-মায়ের হায়াত কম ছিল জন্য তারা আজকে আমার সাথে নেই। এখানে আমার তো দোষ নাই কোন? আল্লাহর ইচ্ছা ছিল এটা তাই হয়েছে এমন। উনি আমাকে অস্তিত্বহীন ভাবে। 

তাই সেকেন্ড টাইম মেয়ের জন্য আমাকে প্রস্তাব দিবে না। তার মতে বাংলাদেশে ছেলের অভাব পড়ে নি যে প্রথমে পছন্দ না করা ছেলের কাছে মেয়ে দিতে হবে। সত্যি বলছে উনি! অভাব নাই বাংলাদেশে ছেলের কিন্তু ওনার মেয়েকে আমার চেয়ে বেশি অন্য কেউ ভালোবাসতে পারবে না। এটা গ্যারান্টি দিয়ে আমি বলতে পারব। 

 

বলে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ায় মেঘ। তারা এতোক্ষন ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। 

 

মেঘ নিচে অথৈকে দেখতে পেল। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অথৈয়ের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মেঘের বুকে মৃদ্যু কম্পন বয়ে গেল। সে একটা নিশ্বাস ফেলে। 

 

এবং আবেগ কে বলে।,আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে একটা জরুরি কথা বলব। 

 

আবেগ নিচুস্বরে হেসে বলে, অথৈকে বাসায় রাখতে যাবি তো? যা ওকে রেখে আয় আগে। তারপর কথা বলব। 

 

মেঘ জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে আবেগের দিকে তাকালো। আবেগ হালকা হেসে বলে, এই কয়েকদিনে তোর ডেইলি রুটিন আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি যা। দাড়িয়ে আছে ও তোর জন্য। 

 

মেঘ আবেগের কথামতো দ্রুত ছাদ থেকে নেমে নিচে যেতে লাগলো। আবেগ রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়িয়ে একবার নিচে তাকিয়ে অথৈকে দেখে নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। কোথাও যেন একটা বিষন্নতা খুজে পাচ্ছে সে৷ 

 

অথৈ বাইরে দাঁড়িয়ে গেটের দিকে এক ধ্যানে চেয়ে আছে। মেঘ আজকে কি  আসবে না? অথৈ মনে মনে বলে, না আসলে নাই। সে একাই চলে যেতে পারবে। কিন্তু তার অভ্যাস হয়ে গেছে মেঘের সাথে যাওয়াটা। 

 

অথৈ উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে যেই না চোখ ফেরাবে, ওমনি তার চোখ ধূসর রাঙা শার্ট পড়া মেঘের দিকে গেল। গ্যারেজ থেকে বের হলো মেঘ। মুখে কোন হাসির ছিটেফোঁটা ও নেই তার। 

 

মেঘ অথৈয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,রিকশা পাচ্ছো না.? 

 

–নাহহ। (মিথ্যা কথা বলল সে। অথৈ তো রিকশার খোজ করেই নি) 

 

মেঘ পকেট থেকে জীপের চাবি বের করে বলে,চল গাড়ি করে রেখে আসি। 

 

অথৈ ভড়কে গিয়ে বলে, না না। দরকার নেই৷ 

 

মেঘ দুষ্ট হাসি দিয়ে বলে, ভয় পাচ্ছো নাকি তুমি? 

 

–ভয় কেন পাব? 

 

–তাহলে আসো। 

 

মেঘ এক প্রকার জোর করেই অথৈকে গাড়িতে বসালো এবং নিজে ড্রাইভারের সিটে বসল।গাড়ি চলতে শুরু করে। 

 

মেঘ আবারো জিজ্ঞেস করে, তুমি কি ভয় পাচ্ছো যে আমি তোমাকে কিডন্যাপ করব? 

 

–আরে না। (জোড়পূর্বক হেসে অথৈ)

 

–হুম। বিয়ে কবে তোমার?  

 

–সামনের ২৩ তারিখ । 

 

–গত দুইদিন কেন এলে না? 

 

–এমনি। প্রতিদিন কি কারো বাসায় আসা যায়? 

 

 

—  তা অবশ্য ঠিক বলেছো। কালকে এখানে আসবে? 

 

–না। 

 

–ও৷ 

 

অথৈ নিজেকে থেকেই বলে, আমি আর আসব না। কালকে থেকে  অফিস যেতে হবে। অফিস শেষ ই হয়  ছয়টার দিকে।  তাই আসার টাইম পাব না৷ একয়েকদিন দিন টানা কাজ করব৷ শুক্রবার করেও। রোদেলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি। 

 

মেঘ আহত গলায় বলে, ও আচ্ছা। 

 

অথৈ চুপ হয়ে যায়। 

 

মেঘ বলে, তুমি সুখী হবে তো? 

 

–হুম। মিস্টি এনেছি। খাবে প্লিজ। 

 

মেঘ বাক নিতে নিতে বিড়বিড় করে বলে, মিস্টি না এনে ইদুর মারা বিষ আনলে বেটার হতো। 

 

অথৈয়ের বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। অথৈ নামতে ধরবে তার আগেই মেঘ তার হাত ধরে মিনমিনে সুরে বলে, আই স্টিল লাভ ইউ অথৈ! 

 

অথৈ একথা শুনে চমকে উঠে। তার চোখ ভিজে উঠতে লাগে । 

 

মেঘ ভেজা গলায় বলে, আরেকবার ভাবো না প্লিজ? তোমার বাবাকে বুঝাও। দরকার পড়লে আমি ও বুঝাই  প্লিজ? I can’t live without you! 

 

অথৈ হুহু করে কেদে দিল এবং কাদতে কাদতে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিও মেঘ। আমি পারব না আমার বাবার অমতে যেতে৷ আমাকে মাফ করে দিও। বাবা আমার কাছে এই প্রথম কোন কিছুর জন্য অনুরোধ করেছেন৷ আমি তার কথা ফেলতে পারব না। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। 

 

মেঘ অথৈকে ঝাপ্টে ধরে বলে, আচ্ছা যাও দিলাম ক্ষমা করে। তাও কান্না কইরো না। তুমি সুখে থাকো এইটাই  শুধু আমার চাওয়া। এখন এটা অন্য কারো সাথে সুখে থাকলেও আমি খুশি হব। 

 

অথৈ মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ চোখ সরিয়ে নিল কেননা ওই দৃষ্টির দিকে তাকালো মেঘ নিজে ভেঙে পড়বে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, তাহলে তো আর দেখা হচ্ছে না আমাদের। ভালো থেকো। সুখে থেকো। একটা বিষয় মনে রাখবে, এই এতো বড় পৃথিবীতে তোমার জন্য খুবই নগন্য কেউ একজন  আছে যে কিনা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত  তোমার জন্য দোয়া করবে। 

 

অথৈ কিছু না বলে কাদতে কাদতে গেট খুলে বাইরে বের হলো। বাসার ভেতরে ঢুকছে সে।  

 

মেঘ শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শেষবারের মতো অথৈকে দেখে নিচ্ছে। যতক্ষন অথৈকে দেখা গেল সে চোখ জুড়ে দেখে নেয়। আজকের পর আর যদি কোন দিন দেখা হয় তবে আর এই ভালোবাসার দৃষ্টিতে তার অথৈকে দেখতে পারবে না। তখন দৃষ্টি নামিয়ে রাখতে হবে কারন ততোদিনে অথৈ অন্য কারো হয়ে যাবে,,,,,,,,

 

মেঘের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। খুব করে হাউমাউ করে কাদতে মন চাচ্ছে তার। 

 

★★★

 

শৌখিন আর শায়েরী টিভি দেখছিল বসে বসে। শৌখিন এই সাতদিনে একবারো ইভানার সাথে কথা বলে নি। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ভাগ্যিস সময় থাকতে থাকতে তা উপলব্ধি করছে তা নাহলে কি মস্ত বড় ভুল হয়ে যেত তার মাধ্যমে। ইভানার সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না সে। সে দিব্যি বুঝতে পারছে, ইভানা তার প্রতি অতি মাত্রায় দুর্বল। সেও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল ইভানার প্রতি। যা তার মতো দরিদ্রদের জন্য দন্ডনীয় অপরাধ! 

 

ইভানার বাবাকে সে চেনে। এই এলাকার নামকরা লোক। সম্মান অনেক। বড় বাজারের সামনে বিশাল ইলেকট্রনিকসের দোকান। আর ইভানার ভাই সম্পর্কে ও জেনেছে সে। খুব ভালো একজন ডাক্তার। ইভানাও ডাক্তারি পড়ছে। এদিকে তার অবস্থা যায় যায়। কোন দিন ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যেতে হয় কে জানে? করোনার জন্য তার সব আয় বন্ধ। একটা স্কুলে টিচার ছিল। তাকে ছাটাই করে দিয়েছে। রোজা পর্যন্ত হাফ বেতন পেলেও ঈদের পর পর চাকরি থেকে বের করে দেয়। আপাতত সংসার দুইটা টিউশনির উপর দিয়ে চলছে। কত দিন তাদের এই ছোট্ট নীড় টিকে থাকে তা দেখা বাকি। বাসা ভাড়া তিন মাসের পাওনা আছে। বাড়িওয়ালা ভাল মানুষ দেখে এখনো এই বাসায় থাকতে দিচ্ছে।অন্য দিকে ইভানারা এপার্টমেন্টে থাকে।আবাসিক এলাকা। ওইদিকের প্রতিটা বাসার ভাড়াই ত্রশ হাজারের উপরের। শৌখিনের মনে হয় ওইটা ইভানাদের নিজের বাসাই।  

 

শৌখিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারা আয়োজন করে টিভি দেখছে। কারন কালকে টিভি টা বেচে দেওয়া হবে সাড়ে পাচ হাজার টাকায়। 

 

শৌখিন উদাস চোখে রং-বেরঙের টিভির পর্দায় চোখ দিল। বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখা ঘোর অপরাধ। এই সাত দিনে অনেক বার ইভানা তাকে কল করেছে কিন্তু সে ধরে নি। আর ধরবেও না কোন দিন। ভালোবাসা বুকে চেপে এক জীবন পাড় করা যায় কিন্তু অভাব বুকে চেপে জীবন অতিবাহিত করা খুব কঠিন। তার কষ্টের ভাগ সে ইভানাকে দিতে চায় না। যদি কোন দিন সম্ভব হয়, তাহলে সে অবশ্য ই আল্লাহর কাছে চাবে তার ভাগ্যে যতোটুকু ই সুখ  লেখা আছে সেটা যেন ইভানাই পায় আর ইভানার কষ্ট গুলো তাকে দিয়ে দেয়। শৌখিনের কষ্ট সহ্য করার অভ্যাস আছে সেই ছোট কাল থেকেই। সে ইভানাকে ভালোবাসে না মনে মনে এটা বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তার চোখ ভরে উঠল। সে দ্রুত অশ্রু মুছে নিল। 

 

একটা মেয়ে ভালোবাসার জন্য সব সেক্রিফাইজ করতে পারে এই কথা শৌখিন মানে না। ভালোবাসা থাকলেই বাবা-মায়ের রাজকন্যা কোন কুড়ে ঘরে গিয়ে উঠে আজীবন কষ্ট পাক এটা শৌখিন কোন দিন সমর্থন করবে না। যে মেয়ে কোন দিন গ্যাসের চুলাতেই রান্না করে নি তাকে আমরা যদি খড়ির চুলায় রান্না করতে দিই, তাহলে কেউ কি একবারো ভেবেছে সেই মেয়েটার কতো কষ্ট হবে? যে মেয়ে গাড়ি ছাড়া যাতায়াত করে নি সে কোন দিন লোকাল বাসের ঠেলাঠেলি সহ্য করতে পারবেনা। যতোই ভালোবাসা থাকুক তার কষ্ট হবেই। যার অভ্যাস এসি রুমে ঘুমানোর তার ফ্যানের হাওয়ায় ঘুম হবে না যতোই পাশে ভালোবাসার মানুষ থাকুক। শৌখিন এটাও বলছে না যে মেয়েরা তাহলে টাকা দেখেই বিয়ে করুক। না এটা সে মোটেও মিন করছে না। তার ছোট মাথা এটাই বুঝে,  সবার উচিত নিজে যেরকম পরিবেশে বড় হয়েছে ঠিক  সেরকম আর ওই লেভেলের কাউকে বিয়ে করুক। এতে এডজাস্ট করতে সুবিধা হবে।  বেচে থাকার জন্য ভালোবাসা হলো একটা  অন্যতম উপাদান। সবকিছু না। 

 

শায়েরী প্লেটে করে নিয়ে এলো মুড়ি। একে মুড়িমাখা বলে।,যেখানে মুড়ি চানাচুর সঙ্গে পেয়াজ-কাচামরিচ আর সরিষার তেল নিয়ে মাখানো থাকে। শৌখিন মৃদ্যু হেসে প্লেট থেকে মুড়ি মাখা নিয়ে টিভির দিকে তাকালো। ফুটবল খেলা চলছে। হয়তো আর কোন দিন এভাবে বসে টিভি দেখা হবে না যতোদিন না ঘরে নতুন টিভি আসছে। 

 

★★★

 

মেঘ আবেগদের বাসায় ফিরে এল। গ্যারেজ থেকেই মুখ ধুয়ে নিল সে। তারপর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে পড়ল। বেল বাজাতেই ইভানা গেট খুলে দিল। 

 

মেঘ দুইদিন ধরে ইভানাকে খেয়াল করছে। মেয়েটা মনমরা হয়ে আছে। মেঘ ইভানাকে এক কাপ চা দিতে বলল। এবং নিজে সোফায় বসে পড়ে। 

 

ইভানা কিছুক্ষন পর চা আনল। মেঘ চুমুক দিয়ে বলে, কি রে তোর কি হইসে? 

 

ইভানা ফোন চেক করে নিয়ে বলে, কি হবে আবার? 

 

–মন খারাপ? 

 

–নট এট ওল। 

 

–ডোন্ট লাই। 

 

ইভানা মেঘের দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে সেদিন তার সাথে হওয়া সব কিছু বলে দিল। 

মেঘ প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে বলে, তোর কোন দোষ নাই। যা হওয়ার ছিল হয়েছে। তবে তোর উচিত ছিল আগেই জানানো। চুপ থাকা উচিত হয় নি। 

 

ইভানা ভারাক্রান্ত গলায় বলে, সর‍্যি। 

 

মেঘ বলল, ছেলেটা কে রে? 

 

ইভানা ভ্রু কুচকে বলে, কোন ছেলে? 

 

মেঘ বলল, ঢং কম কর। যেই ছেলেটা ঢিষুম ঢিষুম করে গুন্ডাটাকে মেরে তোকে বাচালো। 

 

–ও।  আমার।ফ্রেন্ডের ভাই। ও না আমার ফোন ই রিসিভ করছে না আর সেদিনের ঘটনার পর থেকে কেন যেন।  

 

মেঘ মজা করে বলে, ভয় পাইছে। প্রথম ডেটেই এমন মাইর খাওয়াইচ্ছোস ওরে। ছেলে ভয় পেয়ে পালাইছে। 

 

–মোটেও না। ও অনেক ব্রেভ। 

 

মেঘ ভ্রু নাচিয়ে বলে, তোর ভাই জানে তুই ওই ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস? 

 

–উহু। ভাবী জানে। 

 

–ভালো। ছেলেটা কি কোন বিপদে পড়েছে? 

 

–জানি না। 

 

–কালকে ওর বাসায় যাস। 

 

ইভানা খুশি হয়ে গেল এবং বলল, সত্যি? 

 

–ইয়াপ। আচ্ছা  ছেলে কি করে? ডাক্তার নাকি  ইঞ্জিনিয়ার? 

 

ইভানা হালকা করে বলে, টিচার। 

 

–ও। 

 

★★★

 

আবেগ ছাদ থেকে নেম রুমে এসে দেখে রোদেলা সমুদ্র কে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। দুই মা-ছেলে ঘুম। 

 

আবেগ রোদেলার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। তারপর কিছুক্ষন পর রোদেলার চুলে বুলি কেটে দিতে লাগলো। সে নিজেও রোদেলার পাশে শুয়ে পড়ে এবং খুব শক্ত করে রোদেলা কে জড়িয়ে নেয়। রোদেলা প্রথমে একটু ঘুমের মধ্যে ই বিরক্তি প্রকাশ করে। তাও আবেগ তাকে ছাড়ে না। বাধন কিছুটা আলগা করে রেখে জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে চোখ বুজে। কি যে প্রশান্তি কাজ করছে  তার মনের মধ্যে তা বলে বোঝাতে পারবে না আবেগ। রোদেলা নড়াচড়া করতে করতে আবেগের বুকে এসে মাথা রাখল। আবেগ মৃদ্যু হেসে একটু শক্ত করে জড়িয়ে নেয় রোদেলা কে।

 

তারপর রোদেলার কপালে একটা চুমু দেয়। হুট করে একটা মশা এসে রোদেলার গালে এসে বসে। আবেগ দ্রুত মশাটা তাড়িয়ে দেয়৷ রোদেলাকে মশা কামড় দিবে এটা তো মানা যায় না। ঢাকা শহরে শীত কালে মশার উপদ্রব দেখা দেয়। হুট করে গেটে কেউ নক করে। আবেগ আস্তে করে রোদেলা কে বুক থেকে  সরিয়ে বালিশে আস্তে করে  মাথা পরম যত্নে রেখে, রোদেলাকে  শুইয়ে দেয়। এরপর গেট খুলতে যায়। 

 

গেটে মেঘ দাড়ানো। মেঘকে দেখে আবেগ বলে, তুই এসেছিস। আমি আরো ভাবলাম এখনো বাইরে তুই। 

 

মেঘ ব্যতব্যস্ত হয়ে বলে, নেহার ব্যাপারে কিছু বলব। 

 

–বল। 

 

— প্রাচুর্যের মতো ক্রিমিনালের সাথে ওর বিয়ে হোক সেটা আমি চাই না। 

 

–আমিও না। নেহা বেটার কাউকে ডিসার্ভ করে। 

 

–হুম। কিন্তু ওর বিয়ে তো কালকে। 

 

আবেগ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, নেহাকে কল দিয়ে সব জানা। 

 

মেঘ দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ওর ফোন অফ। সোস্যাল মিডিয়ায় একটিভ ও নেই। ওর বাসা যেতে হবে। আমি চাই তুই ও আমার সাথে চল। 

 

–আচ্ছা যাব। 

 

–এখনি যাব আমরা৷ 

 

–এখন কেন? 

 

–ওর বাবা বাসায় নাই। ইনফরমেশন পাইসি। 

 

আবেগ বিরক্ত হয়ে বলে, তুই সব আজাইরা ইনফরমেশন পাস। 

 

মেঘ খানিকটা চটে গেল এবং বলে  কোনটা আজাইরা রে? 

 

আবেগ বলে, প্রথমে বলছিলি রিশাদের সাথে মন্ত্রী-মিনিস্টারের হাত আছে৷ এখন জানালি প্রাচুর্য হেল্প করছে। আর রিশাদের খবর ও জানিস না। রিশাদের ইনফরমেশন বের না করে নেহার বাবা বাসার বাইরে গেছে এটা জানলি। 

 

মেঘ বলে, প্রথমে আমি আন্দাযে বলছি যে রিশাদের নেতার হাত আছে। আর রিশাদের ইনফো পাচ্ছি না কস ও আত্মগোপন করে আছে। মেঘ কোন কাজ আজাইরা করে না। বাইরে আয়। আমি নিচে দাড়ালাম। 

 

–আচ্ছা। 

 

মেঘ গেলে আবেগ সবার আগে রেডি হলো তারপর মশারি টাঙিয়ে নিল। রোদেলা আর সমুদ্র দুজনকেই চুমু দিয়ে ফোন হাতে  নিয়ে বেরিয়ে যায়। 

 

★★★

 

নেহার বাসায় ঢুকে পড়ে তারা ছদ্মবেশ ধরে। মেঘ আবেগ কে বলে,সে যেন নেহাকে সব সত্য জানায়। আবেগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেহার রুমে ঢুকে পড়ে৷ এভাবে এর আগে কোন দিন কোন মেয়ের রুমে ঢুকে নি। ইভানার রুমে ঢুকেছে কিন্তু ইভানা তার আপন বোন হয়। আবেগ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। নেহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আবেগকে বাইরে থেকে পাহাড়া দিচ্ছে। নেহাকে দেখা যাচ্ছে রুম থেকেই। চুল খুলে রেখেছে সে। মৃদ্যু হাওয়ায় চুল গুলো নড়ছে। রুমের ঝাড়বাতির আলোয় চুল গুলো জ্বলজ্বল করছে। 

 

আবেগ ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে একটা শুকনো কাশি কাশল। নেহা কারো শব্দ শুনে পিছনে তাকালো। আবেগকে দেখে চমকে উঠে  নেহা। বিষ্ফরিত চোখে তার দিকে তাকায়। আবেগের অস্থির লাগতে শুরু করে৷ নেহা এতোক্ষণ যাবত আবেগের কথাই ভাবছিল আর সে স্বয়ং তার সামনে দাড়িয়ে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। নেহার চোখ ছলছল করে উঠে৷ আজকে নেহা শাড়ি পড়েছে। সত্যি বলতে এই প্রথমবার আবেগ নেহাকে শাড়িতে দেখছে। তাই নেহাকে দেখে একটা ধাক্কার মতো খেল 

শাড়ি পড়ায় নেহার মুখে-চোখে অদ্ভুত মায়া বিরাজ করছে। 

 

নেহা আবেগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলে, তুমি? 

 

–কেমন আছো? 

 

নেহা আহত গলায় বলে , তুমি যেভাবে রেখে গিয়েছিলে সেভাবেই আছি।  

 

আবেগ মাথা নিচু করে বলে, প্রাচুর্যকে বিয়ে করো না। 

 

নেহা খুশি হয়ে বলে৷ কেন? তুমি আমাকে বিয়ে করবে? 

 

–নেহা! (জোড়ে ধমক দিয়ে) 

 

নেহা কাদো কাদো হয়ে বলে, তাহলে কেন মানা করলে? বিয়ে না করতে বললে কেন? হু? উত্তর দাও? 

 

আবেগ যা যা জানত সব বলে দিল। সব শুনে নেহা হতভম্ব হয়ে যায়। প্রাচুর্য এতো নিচ কিভাবে হলো? 

 

আবেগ বলল, আমি যাই। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। 

 

নেহা ছলছল চোখে আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে,আবেগ, আই লাভ ইউ জান! 

 

–সাট আপ নেহা। (চোখ বড় করে ধমকের সুরে) 

 

নেহা আবেগের হাত ধরে বলে, প্লিজ আমাকে বিয়ে কর। আমি তোমার দ্বিতীয় বউ হয়ে থাকতে ও রাজী। আমার কোন সমস্যা নেই 

রোদেলাকে নিজের সতীন বানাতে। আমি আর রোদেলা আলাদা আলাদা বাসায় থাকব। প্লিজ ম্যারি মি আবেগ। আই লাভ ইউ এ লট। 

 

আবেগ রেগে গিয়ে বলে, ফর গড সেক সাট আপ ইউর মাউথ। তোমার ভালোর জন্য এসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে আসাটাই আমার। আমাকে ভুলে যাও নেহা। আই ডোন্ট লাভ ইউ এনিমোর। 

 

বলে আবেগ গটগট করে নেহার রুম ছেড়ে চলে আসে। নেহা বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে কান্না জুড়ে দেয়। কেন . আবেগ এসে তাকে ভেতরে ভেতরে গুরগুর করে ভেঙে দিল?

 

★★★

 

প্রাচুর্য সিগারেট খাচ্ছে। পাশেই রিশাদ নুডুলস খাচ্ছে। প্রাচুর্যের গা জ্বলে যাচ্ছে রিশাদকে দেখে। প্রাচুর্য সিগারেট টা ফেলে দিয়ে বলে,কালকে আমার বিয়ে। যদি আমার বিয়েতে কোন সমস্যা হয় তাহলে কিন্তু আমি আপনাকে খুন করে দিব। 

 

রিশাদ খেতে খেতে বলে, আরে, চিল। আপনার বিয়ে তে কোন ঝামেলা করব না। কিন্তু আপনি চালাকি করবেন না। তাহলেই কোন প্রব হবে না। 

 

প্রাচুর্য রক্তবর্ণ চোখ তাকিয়ে আছে। ছয় দিন ধরে রিশাদ আর সে সাভারে তার ই একটা ফার্ম হাউসে আছে। ছয় দিন ধরে কারো সাথে তার যোগাযোগ নেই।প্রাচুর্য মায়ের  সাথেও কথা বলতে পারে নি। সবাই জানে সে বিসনেস মিটিং য়ে আছে। কালকে ফিরবে। রিশাদ তাকে এমন ভাবে ফাসিয়ে দিয়েছে যে সে না পারছে রিশাদকে মেরে ফেলতে আর না পারছে সহ্য করতে। তবে রিশাদকে সে নিজ হাতে মারবেই ডিসিশন ফাইনাল। তার গায়ের মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বইছে সে ভীতু না। 

 

চলবে৷ 

 

#অশ্রুমালা 

part–42

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

আবেগ রুমে ফিরতেই দেখে রোদেলা মাত্র ঘুম উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছে। চোখে ঘুমের ভাব লেগে আছে এখনো।যার কারনে রোদেলাকে আরো বেশি রূপবতী লাগছে।  চুল গুলো একটু অগোছালো হয়ে আছে।আবেগের চোখ রোদেলাতে আটকে গেল। 

 

 রোদেলা আবেগকে দেখে একটু ভ্রু কুচকে বলে, তুমি আবার কই গিয়েছিলে? 

 

আবেগ কিছুটা চমকে উঠে। সে রোদেলাকে জানাতে চায় না যে নেহায় বাসায় গিয়েছিল। তাই আবেগ বলল, কোথাও না তো। মেঘের সাথে ছাদের ছিলাম। 

 

রোদেলা হাই তুলতে তুলতে বলে, ও। 

 

–হুম। ঘুম হলো নাকি আরোও ঘুমাবে? 

 

রোদেলা চোখ কচলে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলে, অনেকক্ষন ধরে ঘুমিয়ে ফেলেছি তাই না?

 

 

–ছয়টা টু দশটা। বেশি কিনা কম জানি না। 

 

ফোনটা টেবিলে রাখতে রাখতে জবাবে বলে আবেগ। 

 

রোদেলা চোখ বড়বড় করে বলে, এখন দশটা বাজে? 

 

–জি। রাত দশটা এগারো মিনিট। 

 

রোদেলা তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। আবেগ তাকে আটকে দিয়ে বলে, কি হয়েছে সুনামির মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে কেন? 

 

রোদেলা বলল, আল্লাহ, এতোক্ষন ধরে ঘুমিয়েছি বাড়ির সবাই কি ভাববে বল? বাড়ির বউ কি কখনো  এতোক্ষন ধরে ঘুমায়? 

 

আবেগ নিশ্চিত গলায় বলে , অন্য কারো বউ না ঘুমাতে পারলে ও, আমার বউ ঘুমাবে তার যতোক্ষণ ঘুম পূরণ হয়! 

 

রোদেলার ঠোঁটের কোনে তার অজান্তেই হাসির রেখা গুটে উঠে। আবেগ  মুচকি হাসল। রোদেলা র কি যে খুশি লাগলো এই কথা শুনে সত্যি বলে বুঝানো সম্ভব না। 

 

আবেগ বলে, চোখে-মুখে পানি দিয়ে আসো। আজকে বাইরে থেকে খাবার আনা হয়েছে। 

 

রোদেলা মুখ কালো করে বলে, আমি ঘুমাচ্ছিলাম বলে রান্না হয় নি জন্য বাইরে থেকে আনিয়েছো? 

 

–না রে পাগলি। মেঘ আর ইভু চাইনিজ খাইতে চাচ্ছিল তাই কিনে আনা হয়েছে। 

 

রোদেলা একবার আবেগের দিকে তাকিয়ে বলে, বাইরে গিয়েছিলে কি? 

 

আবেগ ইতস্তত করে বলে, না তো। কেন এমন মনে হলো? 

 

রোদেলা শান্তসুরে বলে, এই শার্টটা তো বাইরে গেলে পড়। তাই জিজ্ঞেস করলাম কোথাও গিয়েছিলে কিনা। 

 

–বাসায় পড়া শার্ট টা খুজে পাচ্ছিলাম না তাই এটা পড়েছি। 

 

রোদেলা কিছু একটা ভেবে বলে, ওহ হ্যা। আলমারির বাম সাইডে সব শার্ট গুছিয়ে রেখেছি। তাই হয়তো খুজে পাও নি। 

 

–সমস্যা নাই। একেবারে রাতে চেঞ্জ করে গেঞ্জি পড়ব৷।চল খেতে আসো। 

 

–ফ্রেস হয়ে আসি। 

 

–যাও। 

 

রোদেলা ফ্রেস আসলে আবেগ প্রশ্ন করে, সমুদ্র কি উঠে যাবে এখন? 

 

রোদেলা উত্তর দিল, না। ও আর উঠবে না। একেবারে সকাল পাচটায় উঠে খেলবে। রাতে দুই-তিন বার ঘুমের মধ্যেই খাইয়ে দিলে আর উঠবে না রাতে সমুদ্র। 

 

–ওকে। 

 

ডাইনিং রুমে গিয়ে সবাই একসাথে চাইনিজ খেল। খাওয়া-দাওয়ার পর যে যার রুমে চলে আসে। আবেগ-রোদেলা রুমে এসে আবারো বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল। আজকে খুব শীত পড়েছে। ঢাকায় এতো দ্রুত শীত পড়ে যাবে তা ভাবে নি কেউই। আবেগ কম্বলের ভেতরে ঢুকে পড়ে রোদেলা চুলে বেনী করছিল তখন। 

 

আবেগ অপলক নয়নে তার বউকে দেখছিল। সে তো চোখের পলক ফেলার কথাও ভুলে গেছে। যদি চোখের পলক ফেলে তবে এই সুন্দরতর দৃশ্য থেকে সে পয়েন্ট জিরো জিরো ওয়ান সেকেন্ড বঞ্জিত হবে যেটা আবেগ মিস করতে চায় না। 

 

রোদেলার চুল বেশ বড় জন্য কাধ বেয়ে বাম সাইডে এনে তারপর আগার চুলগুলোতে বেনী করতে হয় তার। রোদেলার চোখ আবেগের উপর পড়ল। আবেগ তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। রোদেলা ইশারায় জিজ্ঞেস করে আবেগ কিছু বলবে কিনা? 

 

আবেগ মাথা নাড়িয়ে না-বোধক অর্থ প্রকাশ করে। 

 

আবেগ হুট করে রোদেলার গা ঘেষে বসে পড়ে। রোদেলা মৃদ্যু কেপে উঠল। অদ্ভুত ভালো লাগা বয়ে গেল তার শরীর জুড়ে! 

 

আবেগ রোদেলার কোমড় চেপে ধরে বলে ফিসফিস করে বলে, এতো দিন শুনে আসলাম আকাশে চাঁদ উঠে, আজকে দেখি আমার ঘরে পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে। 

 

রোদেলা আবেগে আটখানা হয়ে গেল এবং চোখ-মুখে লাল আভা ছেয়ে গেল তার। সে আদুরে গলায়, কি যে বল না তুমি! 

 

–সত্য বলছি! 

 

রোদেলা আবেগে আপ্লূত হয়েই বলে, কোথায় চাঁদ আর কোথায় আমি? 

 

আবেগ রোদেলার গালে হাত রেখে বলে, তুমি আমার চাঁদ! আকাশের চাদটা আর চোখে পড়ে না আমার। 

 

রোদেলা মাথা নিচু করে ফেলে। তার মনে একটা শঙ্কা, এতো সুখ টিকবে কি তার কপালে? সে তো পোড়াকপালি। সেই পোড়াকপালির ভাগ্য এতো ভালো হলো কি করে? 

 

আবেগ  ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে বলে, কি হলো রোদেলা? 

 

রোদেলা চোখ নিচে রেখেই বলে, আবেগ, এতো এতো সুখ-শান্তি কি আমি সইতে পারব? 

 

আবগ রোদেলার মুখ টা উচু করতেই দেখে, সে কাদছে। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে৷ আবেগ রোদেলার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, এমনি কি তোমার  নাম অশ্রুমাল রাখসি? এতো কান্দুরা স্বভাবের কেন তুমি? আর কোন দিন কাদবে না। ওকে? 

 

–হু। 

 

–তুমি বললে না সুখ সইয়ে কিনা এটার উত্তর আমি জানি না। তবে কোন দিন আল্লাহর অকৃতজ্ঞ হবে না। আর আল্লাহ পাক নারাজ হয় এমন কাজ করবে না। আল্লাহর ইবাদত করবে,নামাজ-রোযা পড়বে  আর সবসময় যিকিরের ভেতর থাকবে দেখবে আল্লাহ তোমার উপর সবসময়ই এভাবেই রহমত দিতে থাকবে। বুঝলে? 

 

–হুম! 

 

আবেগ রোদেলাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। আজকেও রোদেলা মাঝখানে শুয়েছে । আবগ রোদেলাকে টপকে সমুদ্র কে আদর করে দিল। তারপর শুয়ে পড়ে সে। 

 

★★★

 

নেহা সারারাত বারান্দাতেই কান্না করে কাটিয়ে দিয়েছে। ভোরের দিকে সে বারান্দা থেকে রুমে ঢুকল। আজকে তার বিয়ে। প্রাচুর্যের সাথে। তার হ্যাসবেন্ড হিসেবে সে কোন দিন আবেগ ছাড়া কাউকে মানতেই পারে নি। নেহা এই শীতের মধ্যেই ঠান্ডা পানি দিয়ে এতো সকালে গোসল করে একটা সালোয়ার কামিজ  পড়ল। সাদা রঙের কামিজে নিজের কাছেই নিজেকে স্নিগ্ধ লাগছে। 

 

কেউ মারা গেলে সাধারণত সবাই সাদা জামা পড়ে শোক প্রকাশ করে। আয়নায় দাঁড়িয়ে নেহা ভাবছে তাহলে সে কেন সাদা পড়ল? কেউ কি মারা গেছে? 

 

প্রশ্নটা মাথায় আসতেই নেহা নিজেই আয়নার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, মারা গেছে কেউ একজন। সেই কেউ একজন হলো আমার আত্মা! ইনার মি! ইনসাইড মি ইস ডেডথ ফ্রম টুডে। 

 

প্রমথ চৌধুরি একটা কথা বলেছেন তাহলোঃ “দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার না।” কথাটা তার ক্ষেত্রে ওয়ান হান্ড্রেন্ট পারসেন্ট কারেক্ট। আজকে তার ও আত্মার অপমৃত্যু ঘটলো কিন্তু হায় আফসোস দেখার কেউ নেই,   ডেডথ সার্টিফিকেট লিখে  দেওয়ার কেউ নেই। সত্যি কেউ নেই! বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে আজ!

 

মন ভাঙ্গা যদি অপরাধ হত তবে সে খুব বড় একটা শাস্তি দিত তার আবেগকে। সেই শাস্তিটা হতো আজীবন তার সাথে থাকতে হবে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়! তার ই তো আবেগ! আবেগ নেহাকে নিজের না মানলেও নেহা ঠিকই আবেগকে ভালোবেসে যাবে আজীবন। 

 

ভালোবাসা এতো সস্তা না। যে চলে গেলেই সেই ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা উড়ে যাবে। বরং ভালোবাসা হচ্ছে সেই অনুভূতি যেই অনুভূতিটা “সে” চলে গেলেও চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যেতে থাকে! গুনোত্তর ধারার মতো দ্বিগুন, চারগুন, আটগুন, ষোল গুণ বত্রিশ গুন হারে, পূর্ববতী মূহুর্তের অনুভূতির চেয়ে পরবর্তী মূহুর্তের অনুভূতিটা  ক্রম্ব ক্রমে বাড়তে  থাকে!! 

 

নেহা হুহু করে কেদে দিল। কেন আবেগ তার কপালে জুটলো না? কি কমতি আছে তার? নেহা খুব করে চায়  পৃথিবীতে যদি  আরেকবার জীবনটা পাওয়া যেত তবে যেন সেই নতুন জনমে সে-ই আবেগের মনের অধিকারিণী হয়!!! 

 

এইবার সে ব্যর্থ প্রেমিকা। পরের জনমে যেন রোদেলা ব্যর্থ প্রেমিকা হয়! নেহা একটা ব্যাগে করে কিছু জিনিস আর পাসপোর্ট ঢুকিয়ে কেচি গেট দিয়ে বের হয়ে গেল। বের হয়ে গেল বললে ভুল হবে পালিয়ে যাচ্ছে। তাকে সাহায্য করছে তারই বাবার খাস কর্মচারী আরিফ আংকেল। ছোটবেলা থেকেই আংকেল তাকে খুব আদর করে। নেহা শেখ –শেখ সাহেবের একমাত্র কন্যা। নেহার মা ডেলিভারির সময় মারা গেছেন। ডেলিভারির ঠিক ছয় ঘন্টা পর মারা গিয়েছিলেন নেহার মা। তাই মাকে দেখা ভাগ্যে জুটে নি নেহার। 

 

নেহা বাইরে আসতেই আরিফ ছুটে এসে বলল, মামনি, ওই কালো গাড়িতে করে চলে যাও। থাইল্যান্ড যাবা। এই যে টিকিট আর কিছু টাকা। ইনশাআল্লাহ তিন মাস ইউরোপ কান্ট্রিতে লাক্সারি ভাবে ঘুরতে পারবে। তাও লাগলে আমাকে বললেই হবে। কারো সাথে যোগাযোগ না রাখলেও আমাকে মাঝেমধ্যে কল দিও মামনি। আমি কোন দিন সিম বদলাব না। তোমার কলের অপেক্ষা করব আজীবন। 

 

নেহা হুম বলল তারপর জিজ্ঞেস করে, বাপি যদি বুঝে যায় এতো গুলো টাকা মিসিং তখন তো আপনি ধরা খাবেন। 

 

আরিফ সাহেব হোহো করে হেসে বলে, সাগর থেকে এক ফোটা জল নিলে যেমন কেউ টেরই পায় না তেমনি আপনার বাবার কাছেও এটা এক ফোটা পানির সমান। তার কাছে পুরো সমুদ্রটাই পড়ে আছে যে! 

 

নেহা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বাবা টাকা নিয়েই পড়ে থাকুক। টাকার সমুদ্র বানাতে গিয়ে কোন দিন যে সাগরে ডুবে মরে আল্লাহ জানে!

 

নেহা বাড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল গাড়ির কাছে। গাড়িতে উঠে বসতেই  শো শো করে গাড়ি চলা আরম্ভ করে। 

 

 আজকে থেকে তার নতুন জীবন শুরু। এ নিউ জার্নি স্টার্ট ফ্রম টুডে। 

 

নেহা নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, নেহা আশা রাখি তোমার আগামী দিন গুলো খুব খুব সুন্দর হবে। তোমার জন্য রইল অঢেল শুভকামনা! 

 

★★★

 

বেলা বারোটায় বিয়ের বর বাড়ি ফিরল। প্রাচুর্য সোজা নেহার বাসায় চলে এসেছে। তার সাথে সর্বোক্ষনের জন্য রিশাদের চ্যালারা ছিল এবং এখনো আছে। প্রাচুর্য কোন একশন নিতে পারেনি কারন তার মা একা থাকেন বাসায়। যদি মায়ের কিছু হয়ে যেত? এখন আর সেই ভয় নেই। চাচ্চুর বাসায় মা চলে এসেছে।  প্রাচুর্য নেহার বাসায় ঢুকতেই প্রাচুর্যের সাথে আসা রিশাদের লোকদের কে প্রাচুর্যের লোকরা এসে আটক করে ফেলে। প্রাচুর্য বাসার সামনে দাড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তার লোকদের ইশারায় বলল, ওদের মারধোর করতে।

 

রিশাদের লোকদের মাইর খাওয়াতে দেখে প্রাচুর্য খুশি হয়ে বাসায় ঢুকেই এক দফা চমক খেল। বাসায় আনন্দের ছিটেফোঁটা ও নেই। হয়েছেটা কি? প্রাচুর্য তার মাকে দেখে নিল। মা ঠিক আছে। এই ছয়দিন যখন সে মা ছাড়া ছিল তখন খুব চিন্তা লাগত। নিজের জন্য না। মায়ের জন্য। যদি রিশাদের লোকরা মায়ের উপর আক্রমণ করে বসে? 

 

এই কারনেই পুলিশকে জানাতে পারেনি। এখন সব ঠিক আছে। তার ফার্ম হাউসে সে রিশাদকে আটকে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে।এরমধ্যেই পুলিশ কল করে ফেলেছে সে। রিশাদ তার বাসা থেকে পালানোর আগেই পুলিশ চলে যাবে তাকে ধরতে। 

 

প্রাচুর্য তার মায়ের কাছে বসে বলে।, কি হয়েছে আম্মু? 

 

প্রাচুর্যের মা বলে, নেহা আজকে সকালে পালিয়ে গেছে। বাসায় নেই ও। 

 

প্রাচুর্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মা কি যা-তা বলছে! নেহা চলে গেছে? নেহা পারল তার মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে? নেহা কি তবে বুঝল না প্রাচুর্য তাকে কতোটা চায়। প্রাচুর্যের জীবনে নেহা কতোটা মূল্যবান? 

 

প্রাচুর্যের চোখ লাল হয়ে গেল। 

 

তার মা বলল, তোর চাচা অসুস্থ হয়ে গেছে।প্রেসার হাই হইসে। খুব টেনশন হচ্ছে রে। 

 

প্রাচুর্য প্রায় দুপুর পর্যন্ত মাথা নিচু করে সোফায় বসে থাকলে। পড়নে তার গোল্ডেন কালারের সুতার কাজ করা পাঞ্জাবি। আজকে তো তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কোথায় চলে গেল নেহা তাকে ছেড়ে? 

 

প্রাচুর্য কাউকে কিছু না বলে আরিফের কাছ গেল। তাকে জেরা করেও কোন লাভ হয় না। পরে অনুরোধ করলে উনি বলেন, সে নেহাকে পালাতে সাহায্য করেছে। তারপর যা বলল সেটা শোনার জন্য প্রাচুর্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷ কালকে রাতে নাকি নেহা সুসাইড করতে চেয়েছিল। আরিফ সাহেব ভাগ্যক্রে  নেহাকে দেখে ফেলে । এবং আত্যহত্যা করা থেকে আটকে দেন আর আজকে পালিয়ে যেতে এজন্যই সাহায্য করলেন। 

 

সব শুনে বাকরুদ্ধ প্রাচুর্য। চোখের কোনের পানি মুছে নিয়ে প্রাচুর্য মনে মনে বলে, এতো কষ্ট দিয়েছি তোকে নেহা? যে সুসাইড করতে চাইলি আবারো? আচ্ছা ঠিক আছে। তুই যা চাবি তাই হবে। করব তোকে বিয়ে। খুজব না তোকে আর! 

 

তারপর নেহার বাসা থেকে বেরিয়ে যায় প্রাচুর্য। সোজা পুলিশ স্টেশন। রিশাদকে পুলিশ ধরে এনেছে৷ সেখানেই যাচ্ছে প্রাচুর্য। রিশাদকে টুকরা টুকরা করে কেটে গায়ে নুন ছিটাবে।। 

 

★★★

 

আবেগ হাসপাতালে ছিল। মেঘ তার কেবিনে হুট করে ঢুকে পড়ে। তারপর আবেগকে  সঙ্গে নিয়ে এক প্রকার টানতে টানতে হাসপাতালের বাইরে এনে দাড় করায়৷ 

 

আবেগ বিচলিত হয়ে গেল এবং মেঘকে প্রশ্ন করে, হয়েছেটা কি তোর?এনি প্রবলেম?  

 

–দোস, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। প্রাচুর্য নির্দোষ। 

 

–মানে? 

 

মেঘ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, রিশাদ হারামজাদা ওরে ব্লাকমেইল করে ফাসায় দিসে রে। ছেলেটা ইনোসেন্ট।আজকে প্রাচুর্য নিজে রিশাদকে ধরিয়ে দিয়েছে পুলিশের কাছে৷ 

 

— আলহামদুলিল্লাহ! প্রাচুর্য কি তোকে ফোন করেছিল? 

 

–ধুর না।আমাকে কল দেয় নি।  ও হচ্ছে শেখ প্রাচুর্য। আইজি স্যারকে কল করছে। আইজি স্যার হ্যান্ডেল করছে কেস। 

 

–ও। 

 

–চল। পুলিশ  স্টেশন যাই। 

 

–হ্যা। চল। 

 

মেঘ আর আবেগ স্টেশন যায়। তাদের সাথেই প্রাচুর্য ঢুকে। তারা তিনজন রিম্যান্ডে রুমে যায়৷ 

 

প্রাচুর্য গিয়েই রিশাদের কলার ধরে ফেলে আর নাক বরাবর একটা ঘুষি দেয়৷ 

 

তা দেখে মেঘ আবেগকে বলে, তামিল মুভির একশন চলে দেখি! প্রাচুর্যের মতো একশন আমার মধ্যে নাই কেন? 

 

আবেগ প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাচুর্য ইচ্ছামতো মারল রিশাদকে। মেঘ এবার গিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, দেখেন। রিশাদের রিমান্ডে নেওয়া হবে। ছাড়ুন ওনাকে। 

 

প্রাচুর্য ছেড়ে দেয় রিশাদকে। আবেগ প্রাচুর্যের কাছে গিয়ে বলে, আপনার সাথে কথা ছিল। একটু যদি বাইরে আসতেন? 

 

প্রাচুর্য আর আবেগকে একসাথে যেতে দেখে মেঘও পেছন পেছন গেল। 

 

আবেগ বাইরে গিয়ে প্রাচুর্য কে বলল, প্রাচুর্য আই এম সর‍্যি। 

 

প্রাচুর্য ভ্রু কুচকে বলে, ফর হুয়াট? 

 

–আমি আমার ভুল বোঝার জন্য অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছি। নেহাকে আপনার ব্যাপারে ভুলভাল বলেছি৷ তারপর কালকের ঘটনার কথা জানালো আবেগ। 

 

–ও। আপনি কি জানেন নেহা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে৷ 

 

মেঘ পেছনে থেকে চিৎকার দিয়ে বলে, হুয়াট? 

 

–জি৷ 

 

আবেগ অনেক অনুতপ্ত বোধ করে পুনরায় প্রাচুর্যের কাছে ক্ষমা চায়৷ 

 

প্রাচুর্য একটা বেদনামূলক হাসি হেসে বলে, আপনি সম্পর্কে নেহার কাছ থেকে শুনেছি। আপনার ব্যক্তিত্ব দেখে আমি মুগ্ধ।  আপনার কোন দোষ নাই। নেহা আমার কপালে ছিল না তাই জোটে নি। এসব বাদ৷ দেন। ভুলে যান এসব ঘটনা । 

 

বলে প্রাচুর্য সামনে পা বাড়ালো। সেও সব ভুলে যাবে। নেহাকে ভুলবে না। মনে মনে ভালোবেসে যাবে। 

 

আবেগ মেঘকে বলে, ছেলেটা খুব ভালো রে। 

 

মেঘ বলে, তোর চেয়ে কম। 

 

আবেগ বিরক্তি নিয়ে বলে, আমার সাথে তুলনা করিস ক্যান? তুই ও খুব ভালো। রিকশাওয়ালার মেয়েটার কি হলো? 

 

–ওই ব্যাটা রে ক্যালানি দেওয়াইছি আর মেয়েটাকে ওয়াল্টনের স্মার্টফোন কিনে দিসি৷ 

 

–প্রাউড অফ ইউ৷ 

 

মেঘ মুচকি হেসে বলে, আজকে থেকে আর কোন চিন্তা নাই৷ এখন আপনি আপনার ম্যারিড লাইফে ফোকাস করেন ডাক্তার সাহেব। একটু রোম্যান্টিক হন প্লিজ! 

 

আবেগ মাথা নিচু করে হাসল। 

 

★★★

 

বিকেলের দিকে রোদেলা ছাদে বসে ছিল। আকাশ দেখছিল। আবেগ এখনো ফেরে নি। সন্ধ্যায় আসবে। 

 

তার আকাশ দেখতে খুব ভালো লাগে। সমুদ্র নিচেই আছে মামার কাছে। রোদেলা ছাদ থেকে নেমে তালা দিয়ে বাসার গেল। বাসায় ঢুকতেই বুঝল কারেন্ট নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রোদেলা ইভুকে ডাকতে লাগে। কিন্তু কারো কোন সাড়া মিলল না। সে চিন্তিত হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাসায় গা ছমছমে ভাব। রোদেলার মনের মধ্যে একটা চাপা ভয় দেখা দিচ্ছে। সে একটা ঢোক চিপে সামনে পা বাড়ালো। ডাইনিং রুমে ঢুকতেই কেউ তার দুটো হাত একত্রে নিয়ে সামনে এনে ধরে ফেলে এবং মুখে হাত দেয়। যেন আওয়াজ না করতে পারে। এর আগেও এই পরিস্থিতি তে পড়েছে সে। তাই ভীষণ ভয়ে পেয়ে যায় রোদেলা। গা ঘামতে লাগল। সে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। তাকে ধরে রাখা ব্যক্তিটা রোদেলার হাত দুটি আরো চেপে ধরে। রোদেলা চোখের পানি ছেড়ে দিল। সে কি আবারো বিপদে পড়েছে? আবেগ কোথায়? 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

Part-43

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

রোদেলার ভয়ে মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। রোদেলার মুখের বাধনটা আস্তে করে আলগা হয়ে গেল। হুট করে রোদেলা তার কোমড়ে কারো হাতের বিচরণ লক্ষ করল। 

 

রোদেলা যেন বরফের ন্যায় জমে যাচ্ছে। ভয়ে গলা কাঠ কাঠ। আতকে উঠায় বুকের ধুকপুক বহু মাত্রায় বেড়ে গেছে। 

 

হুট করে সেই ব্যক্তি তাকে কোলে তুলে নিল। রোদেলার চোখ কপালে! চমকে উঠে সে। 

 

কেউ তার কানে ফিরফিস করে বলে, আরে আরে,ভয় পেয়েছো নাকি? 

 

আবেগের কন্ঠ শুনে স্বস্তি অনুভব করে রোদেলা। তার তো জান বের হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল৷।আর একটু হলেই হার্ট ফেল হয়ে যেত তার। 

 

অন্ধকারের মধ্যেই রোদেলা আবেগের গলা জড়িয়ে ধরে। আবেগ হোহো করে হেসে দেয়। 

 

রোদেলা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, এইভাবে কেউ ভয় দেখায়?, আমার আত্মা শুকায় গেছিল৷ 

 

আবেগ আদুরে গলায় বলে, সর‍্যি বউ! 

 

রোদেলা মৃদ্যু হাসল। 

 

আবেগ সামনের দিকে পা বাড়ালো। ডাইনিং রুম ক্রস করে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে,

 

 আবেগ বলে উঠে, তোমার খাওয়া বাড়ায় দিতে হবে৷ 

 

–কেন? (আবেগের গলা জড়িয়ে ভ্রু কুচকে রোদেলা)

 

–হাইট আর  বিএমআই এর সাথে ওয়েট মিলে না।অনেক কম ওয়েট তোমার ।মিনিমাম পাচ কেজি ওয়েট বাড়াতে হবে। 

 

রোদেলা আবেগের হাতে আস্তে করে কিল মেরে বলে, সবসময় ডাক্তারগিরি না করলে তোমার চলে  না! না? 

 

–না চলে  না! 

 

রুমের সামনে এসে রোদেলাকে নামিয়ে দিল আবেগ। পুরা বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। রোদেলা গেট খুলতেই বিকট জোড়ে শব্দ হলো। রোদেলা কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। 

 

চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই শুনতে পেল সবাই একসাথে বলছে সারপ্রাইজ! 

 

সে আস্তে করে চোখ খুলে যা দেখল তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷ পুরা রুম জুড়ে বেলুন দিয়ে সাজানো। টেবিলের উপরে একটা চকলেট কেক আর মোমবাতি জ্বলছে৷ পাশেই একটা লাল গোলাপের তোড়া। রোদেলা অবাকের নয়নে চেয়ে রইল। চোখ-মুখে উপচে পড়া ভালোলাগা আর মুগ্ধতা! 

 

কেকের উপরে লেখা,

 

 “হ্যাপি থার্টি ডে’স অফ টুগেনারনেস!”

 

রোদেলার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। আজকে ১১ তারিখ। নভেম্বরের এগারো তারিখে তাদের বিয়ে হয়ে ছিল। দেখতে দেখতে মাত্র একটা মাস কেটেছে। কিন্তু রোদেলার মনে হচ্ছে কতো বছর হলো তার বিয়ের! 

 

বাড়ির সবাই উপস্থিত। মামা-মামী, ইভানা আর মেঘ। মামা একটা পাঞ্জাবি পড়েছে। মামী ভালো দেখে একটা শাড়ি আর ইভানা ও ভালো জামা পড়েছে। 

 

আবেগ রোদেলাকে টেবিলের সামনে নিয়ে গেল। তারপর চাকু তার হাতে তুলে দিয়ে বলল,নাও তাড়াতাড়ি কেক কাটো। কেক খাব। 

 

রোদেলার মুখভর্তি হাসি। চোখে আনন্দের ছাপ। তাকে আর আবেগকে ঘিরে  দাড়ালো সবাই। ইভানা সমুদ্র কে আবেগের কোলে দিয়ে দিল। 

 

রোদেলা আর আবেগ মিলে কেক কাটলো। তারপর রোদেলা সবার আগে মামীকে খাওয়ালো। জাবেদা খাতুন মুখ হাসি হাসি রেখে কেক খেলেন। সে নিরুপায়। তার ছেলেকে সে চেনে। এক কথার মানুষ। সত্যি যদি রোদেলা জাবেদা খাতুনের জন্য সামান্য তিল পরিমাণ ও কষ্ট পায় তাইলে আবেগ বাসা ছেড়ে চলে যাবে। শেষ বয়সে ছেলে ছাড়া থাকতে চান না তিনি। তাই রোদেলাকে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও মেনে নিয়েছেন তিনি৷ 

 

রোদেলা মামার কাছে গিয়ে কেক খাওয়ালো। ইমতিয়াজ রহমান নিজেও রোদেলা কে কেক খাওয়ায়৷ একে একে সবাইকে কেক খাওয়ালো রোদেলা। সবার শেষে আবেগকে কেক খাওয়ায় সে। আবেগ ও রোদেলাকে নিজ হাতে কেক খাওয়ালো। 

 

কেক কাটিং পর্ব শেষে সবাই ড্রয়িং রুমে গিয়ে আড্ডা দিতে লাগলো। আড্ডা দিতে  দিতে রাত হয়ে যায়। তারপর ডিনার করে নিল সবাই। আজকে রাতের রান্না মামী নিজ হাতে বানিয়েছিলেন। সবার খাওয়া শেষ হলে মেঘ সবার উদ্দেশ্য বলে উঠে, কালকে সকালে আমি চলে যাব। এখান থেকেই ডিরেক অফিস করে তারপর আমার বাসায় যাব।

 

মেঘ চলে যাবে শুনে সবাই একটু মন খারাপ করল। মেঘ থাকার কারনেই প্রতিদিনের আড্ডাটা দারুন জমত। 

 

ইভানা মনে মনে ঠিক করে,কালকেই সে শায়েরীর বাসায় যাবে।আজকেই যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ভাবীকে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে জন্য আর সে আর বাইরে যেতে পারে নি। 

 

খাওয়ার পর যে যার রুমে চলে যায়৷ রোদেলা রুমে ঢুকে সোজা ফ্রেস হতে চলে যায়। 

 

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে আবেগ তার জন্য বাথরুম গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে। রোদেলা মুচকি হাসল। 

 

আবেগ মাথা চুলকে বলে, বারান্দায় আসো তো একটু! 

 

রোদেলা না বুঝে প্রশ্ন করে, এই ঠান্ডায় এখন বারান্দায় কেন যাব? 

 

আবেগ তার উত্তর না দিয়ে হাত ধরে রোদেলাকে বারান্দায় নিয়ে গেল৷ 

 

আরেকদফা চমক খায় রোদেলা। পুরা বারান্দা জুড়ে মোমবাতি দিয়ে সাজানো। গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ইংরেজি তে আই লাভ ইউ লেখা। পাশেই রোদেলার পছন্দের চকলেট দিয়ে একটা বুকেট সাজানো। 

 

আবেগ কিছুটা সংকোচ নিয়ে রোদেলার সামনে গিয়ে দাড়ালো এবং তার নিজের হাত দিয়ে রোদেলার হাত দুটো আলতো করে ধরে, রোদেলার চোখে চোখ রেখে বলে, আমি জানি এই দিনটা তোমার-আমার জীবনে অনেক আগে আসলে তোমাকে এতো ভুগান্তি পোহাতে হত না। আমার জন্য তোমার জীবনের একটি বছর জাহান্নামে পরিনত হয়েছে। পৃথিবীতে জান্নাতের সুখ পাওয়া অসম্ভব! তাই তোমাকে জান্নাতের সুখ দিতে পারব না। কিন্তু চেষ্টা করব আখিরাতে যেন একসাথে জান্নাতে যেতে পারি। আর ইহকালে তোমার হাতের মুঠোয় পৃথিবীর সকল সুখ দিতে পারি যেটা তুমি ডির্জাভ করো। 

 

রোদেলার চোখ ভরে উঠতে লাগে। 

 

আবেগ তার আরো নিকটে গিয়ে বলে, খুব ভালোবাসি তোমায়! খুব সুখে রাখতে চাই আমি তোমাকে! আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলে দিতে পারব, আমি যতোটা ভালোবাসা দিব তোমায়, অন্য কেউ তোমাকে এতোটা ভালোবাসতে পারবে না! 

 

রোদেলার সারা শরীর বেয়ে মৃদ্যু কম্পন বয়ে গেল। সে ঝাপ্টে আবেগকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিল।কাদতে কাদতে অস্ফুটস্বরে বলে, অন্য কারো ভালোবাসা কি আমি কোন দিন চেয়েছি? 

 

 রোদেলার চোখের জলে আবেগের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। শীতের রাতেও শীত লাগছে না তাদের! 

 

আবেগ রোদেলার কান্না থামিয়ে দিয়ে বলে, এই কথাটা যদি আগে বলতাম তোমাকে তাহলে আর এতো ঝড় সইতে হতো না আমাদের! 

 

রোদেলা কাপা গলায় বলে,আগের কথা সব বাদ। যা হয়েছে সেটা বদলানো যাবে না। আমরা এখন কেবল ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববো।

 

আবগ একটা চকলেটের প্যাকেট খুলতে খুলতে বলে, চল,একটা কিটক্যাট খাই! 

 

রোদেলা জোড় গলায় বলে, তোমার ডায়বেটিস লেভেল কিন্তু একটা বর্ডার বরাবর।মাত্র এক পিস কেক খেয়েছো তাই এখন আর চকলেট  খাওয়া যাবে না। 

 

আবেগ কিটক্যাট টা মাঝ বরাবর ভেঙে, রোদেলার মুখের সামনে ধরে বলে, তোমাকে খাওয়াব জন্য খুলেছি। নিজে খাওয়ার জন্য না। 

 

রোদেলা চকলেট খেতে খেতে বলে, বাব্বা!ডাক্তার সাহেব আজকে  এতো রোম্যান্টিক হলো কিভাবে? সূর্য কি আজকে পশ্চিম দিকে উঠেছে নাকি? 

 

আবেগ রোদেলার আরো কাছে এগিয়ে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলে, আজকে সূর্য উত্তর দিকে উঠেছে তাই আজকে যা হবে অন্য কোন দিন তা হবে না! 

 

— সূর্য আবার উত্তর দিকে উঠে নাকি? 

 

— পৃথিবীতে যেদিন অবিশ্বাস্য কোন ঘটনা ঘটে সেদিন করে সূর্য উত্তর দিকে উঠে আর দক্ষিণ দিকে অস্ত যায়! 

 

রোদেলা হিহি করে হেসে দিল এবং সে আবেগের চোখের দিকে তাকালো। আবেগের চোখে নেশা কাজ করছে। 

 

আবেগ রোদেলার ঘাড় থেকে এক এক করে চুল সরাতে লাগলো। 

 

ঠান্ডা হীম হাওয়ার মধ্যে আবেগের বরফ ঠান্ডা হাতের ছোয়ায় রোদেলা বরাবরের চেয়ে একটু বেশিই কেপে কেপে উঠছে মনে হাজারো রঙিন স্বপ্ন উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে যার সবটা জুড়ে কেবল এবং কেবলমাত্র আবেগ! 

 

আবেগ রোদেলাকে একটা চিকন চেইন পড়িয়ে দিল আর বলল,আপাতত এই চিকন চেইন দিয়ে কাজ চালাও। আমি যখন আরো স্বচ্ছল হবো তখন মোটা একটা নেকলেস দিব তোমাকে৷ 

 

রোদেলা চেইনটাতে হাত বুলাতে লাগলো । কোন জড়বস্তুর উপর ও এতো মায়া কাজ করতে পারে না এই মূহুর্তে তা রোদেলা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। 

 

আবেগ একটা ডায়েরি বের করে সঙ্গে একটা কলম, রোদেলার হাতে দিয়ে বলে, আমাকে নিয়ে কয়েক লাইন লিখো তো৷ আমিও জানতে চাই তুমি আমাকে নিয়ে কি ভাবো?। 

 

রোদেলা ডায়েরি আর কলম হাতে নিয়ে মিনিট দশেক কি কি যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে ভেবে তারপর লেখা শুরু করে৷ আবেগ দেখার চেষ্টা চালায় কি লিখছে কিন্তু রোদেলা দেখতে দেয় না। লেখা শেষ করে একটা গোলাপের পাপড়ি ডায়েরির সেই পৃষ্ঠার  ভাজে সযত্নে রেখে মলাট বন্ধ করে আবেগকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমাদের বিয়ের যেদিন পঁচিশ বছর পূর্ণ হবে সেদিন এই ডায়েরির লেখাটা পড়বে তার আগে না কিন্তু! 

 

আবেগ হতভম্ব হয়ে গেল এবং বলল, লেখাটা পড়ার জন্য এখন আমাকে চব্বিশ বছর এগারো মাস অপেক্ষা করতে হবে? 

 

রোদেলা হেসে উত্তর দিল, ইয়েস! 

 

–নট ফেয়ার রোদেলা৷ 

 

–ওয়াদা করো — ডায়েরি টা  পঁচিশ বছরনা  হওয়ার আগে খুলে পড়বে না ? যদি আগে পড়ে ফেল তাহলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাব বলে দিলাম। 

 

–আচ্ছা যান করলাম ওয়াদা। তোমার কষ্ট দেওয়ার সাধ্য আমার নাই! এবার রুমে চল। ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার । (আবেগ) 

 

–আবেগ? (রোদেলা) 

 

–কি বল? 

 

–এক সাগরে যতোগুলো ঢেউ হয় ঠিক সেই পরিমাণ ভালোবাসি তোমায়! (রোদেলা) 

 

★★★

 

ডিসেম্বরের হালকা উত্তাপে ভরা সূর্যের কিরন অথৈ গায়ে মাখছে৷ আজকে দুপুরে ই বাসায় ফিরেছে সে। মনটা ভারাক্রান্ত তার৷ দিন গুলো এতো দ্রুত যাচ্ছে কেন! সময় ও যেন তাকে বিদায় জানাতে উঠে-পড়ে লেগেছে! কি নির্মম সময়? 

 

ধীরে ধীরে কেন বয় না সময়? অথৈ তার বাবার রুমের দিকে পা বাড়ালো। আজকে বাবাকে কিছু কথা সে বলবে। মেঘের ব্যাপারে না। সে তার বাবাকে কথা দিয়েছে যে সে মেঘকে ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করবে। যে কোন মূল্যেই কথাটা রাখবে অথৈ। 

 

বাবার রুমে গিয়ে অথৈ বলে, বাবা? ঘুমাচ্ছিলে? 

 

–না মা। আয় ভেতরে আয়। 

 

অথৈ গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এসে মাথা নিচু করে এক দন্ড না থেমে বলতে আরম্ভ করল, আজকে তোমার কাছে একটা দাবি নিয়ে এসেছি। আশা রাখছি আমার ইচ্ছাটা পূরন করবে। 

 

–বল কি ইচ্ছা? –কিছু টা বিচলিত হয়ে আজিজুল সাহেব  

 

অথৈ মাথা নিচু করে বলে, বিয়ের এক সপ্তাহের মতো বাকি। আমি চাই এই কয়েকটি দিন যেন আমরা একটা স্বাভাবিক পরিবারের মতো চলি। অন্যান্য সব ফ্যামিলি তে যেমন বাবা-মা এক রুমে থাকেন, সবাই একসাথে একত্রে বসে খায়, দিনের কোন এক সময় সবাই মিলে টিভি দেখে বা   একসাথে টাইম স্পেন্ড করেন,শুক্রবারে বাড়ির ছেলেরা একসাথে নামাজ থেকে ফিরলে সবাই মিলে দুপুরে বিরিয়ানি খায়।বিকেলে একসাথে ঘুরতে যায়। — আমি চাই আমার এ বাসার শেষ দিন গুলোর এভাবেই কাটুক। 

 

কথা গুলো বলার সময় অথৈয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। সে ঠিক করে এসেছিল এক ফোটা পানিও ফেলবে না। কিন্তু এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে কান্নাকাটি করে এবং একটা সমুদ্র বানিয়ে ফেললে মন্দ হয় না তো! 

 

অথৈ নাক টেনে বলে, ভাইয়া, আমি, তুমি, আম্মু– সবাই  একসাথে একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হয়ে এই এক সপ্তাহ থাকব– এই দৃশ্য আমি  দেখে যেতে চাই। দেখে যেতে চাই এজন্য বললাম কারন বিয়ের পর আমি আর কোন দিন এই বাসায় আসবনা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি। কেন আসব না কারনটা তোমার অজানা না। আমি তোমার অনুরোধ কিংবা আদেশ মেনে নিয়ে নিজের ভালোবাসা ত্যাগ করেছি। এবার তোমার পালা। আমার শেষ আবদারটা পূরণ করে আমাকে বাধিত কর৷ তুমি কল দিয়ে আসতেই বললেই ভাইয়া চলে আসবে। 

 

কথাগুলো এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে  বলে অথৈ নিজের রুমে চলে গেল। তার চোখ  থেকে কান্নার দলা বেরিয়ে আসতে চাইছে। 

 

তার ইচ্ছাটা কি বাবা পূর্ণ করবে এই নিয়ে সে বেশ সন্দিহান! হয়তো করবেন না! কিংনা শেষ ইচ্ছা জেনে করতেও পারেন! 

 

আজিজুল সাহেব হতবিহ্বল হয়ে মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে৷। তার চোখ ও ভিজে উঠতে শুরু করেছে৷ কি আশ্চর্য! চোখে কোন সমস্যা হলো না তো আবার?  হুটহাট করে চোখ দিয়ে পানি পড়া তো ভালো লক্ষন না। বয়স বাড়ার জন্য এমনটা হচ্ছে বুঝি৷ কালকেই চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে। চোখের পাওয়ার বাড়লো নাকি চেক করাতে হবে। 

 

চলবে।

 

#অশ্রুমালা 

part–44

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগনা পেল আবেগ। পাশের রাস্তা দিয়েই হকার রা বিকট শব্দ করে যাচ্ছে। সেসবের আওয়াজেই ঘুম ছুটে গেল আবেগের। 

 

“ধনিয়া পাতা-কাচা মরিচ” শব্দ করতে করতে লোকটা সামনে পা বাড়াচ্ছে৷ এই লোকটাকে কোন দিন দেখে  নি আবেগ। কিন্তু প্রতিদিন সকালের লোকটার কন্ঠ পায় সে৷ প্রায় আট-সোয়া আটটার দিকে এই লোকটা এই রাস্তা ধরে যায়। আবেগ চোখ কচলে শোয়া থেকে উঠে বসে। পাশেই গুটিসুটি মেরে রোদেলা ঘুমাচ্ছে।

 

সূর্যের আলো এসে রোদেলার গায়ে পড়ছে। আবেগ কিছুক্ষন রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হলো। এই সাতটা দিন ঠিক মতো হাসপাতালের কাজ করে নি। আজকে এক্সট্রা টাইমেও থাকবে ভাবছে সে৷ 

 

আবেগ একেবারে রেডি হয়ে বের হয়ে দেখে সমুদ্র জেগে গেছে। সে সমুদ্র কে দেখে দ্রুত তার কাছে গিয়ে কোল তুলে নিল।

 

সমুদ্র কে কিছুক্ষন কোলে করে সারা রুম পায়চারি করে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে ফিডার বানাতে গেল। 

 

বাসায় কেউ এখনো উঠে নি। সবাই ঘুম। শীতের সকালে সবাই দেরিতেই উঠে। ময়নার মাও দশটার দিকে আসবে৷ সে ফিডার খাইয়ে দিয়ে রোদেলার পাশে শুইয়ে দিল সমুদ্র কে। মায়ের পাশে বাচ্চার ঘুম ভালো হয়। সম্ভবত মায়ের গায়ের গন্ধ নাকে গেলে সে সুনিশ্চিত থাকে জন্য ঘুম থেকে আর জেগে যায় না৷ 

 

নয়টা বাজার আগেই রোদেলা ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে। আবেগ তখন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ 

 

রোদেলা দ্রুত উঠে তাড়াহুড়ো করে বলে, তুমি অফিস যাচ্ছো এখনি? 

 

–হুম৷

 

–আমাকে দশটা মিনিট দাও, আমি নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি৷ 

 

আবেগ রোদেলাকে বলল, লাগবে না। আমি ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিব৷ 

 

রোদেলা আবারো ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, জাস্ট পাচ মিনিটের মধ্যে নাস্তা বানাচ্ছি। একটু ওয়েট করো। 

 

আবেগ রোদেলাকে বাধা দিল। রোদেলাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলে, বললাম তো– লাগবে না। এতো অস্থির করছো কেন? তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। এবার একটু হাসো তো দেখি! হাসলে কেমন লাগে তোমাকে।  

 

রোদেলা আবেগের বুকে মাথা রেখে নিচু গলায় বলে, ভালোবাসি! 

 

আবেগ ও দ্বিগুন শক্তি প্রয়োগ করে রোদেলাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর রোদেলা তাড়া দিল অফিস যাওয়ার জন্য। আবেগ ও বেরিয়ে যায়। 

 

★★★

 

আজকের সকালটা অথৈয়ের জন্য একটা কল্পনার স্বপ্নের মতো! কল্পনার স্বপ্ন এজন্য ই বলা হচ্ছে কারন অথৈয়ের এতো বিষ্ময়কর দৃশ্য না তার কল্পনায় আসবে আত না  স্বপ্নে! 

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ডাইনিং টেবিলে ভাইয়া বসে আছে। ভাইয়া যে বাসায় এসেছে এই খবর সে জানে না। কখন আসল? রাতে? হতে পারে! সে কালকে বিকেলে বাবার রুম থেকে বের হয়ে আর   রুম থেকে বের হয় নি৷ 

 

ভাইয়ার বিপরীতে বসে আছে বাবা। মা রান্নাঘরে। অথৈকে আসতে দেখে আজিজুল সাহেব বললেন, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। 

 

অথৈ বসল না। সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। 

 

তার মা রুটি বেলছে। তাকে আসতে দেখে বলে উঠে, পরোটা একটু উলটে দে তো। তাড়াতাড়ি কর নাহলে পুড়ে যাবে। 

 

অথৈ পরোটা ভাজতে ভাজতে বলে, পরোটা কি ভাইয়ার জন্য? 

 

–হ্যা। অর্পন তো পরোটা খুব পছন্দ করে। 

 

–ভাইয়া কখন এসেছে? 

 

অথৈয়ের মাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে ছেলে আসায় সে খুব খুশি। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। উনি উত্তরে বলে, সকালে এসেছে। তুই কি রুটি খাবি না পরোটা? 

 

–তরকারি কি? 

 

 –সবজি। 

 

–তাহলে পরোটাই বানাও। আর ভাইয়ার জন্য ডিম পোচ করো। ও ডিম পোচ খেতে  পছন্দ করে। 

 

–আচ্ছা। 

 

অথৈ আর তার মা একসাথেই এসে বসলেন। সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। অথৈ আড় চোখে তার বাবার দিকে তাকালো। তার বাবার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। তিনি এক মনে খেয়ে যাচ্ছেন। অথৈও খাওয়া শুরু করেন। 

 

দুপুরের আগে আগে তারা শপিং এ গেল সবাই মিলে। ভাইয়ার মধ্যে কোন ধরনের রাগের উপস্থিতি খুজে পাচ্ছে না অথৈ।বরং  খোস মেজাযে আছেন বলেই মনে হচ্ছে তাকে। 

 

বিয়ের অনেক কেনাকাটা করা হলো।বিয়ের শাড়ি ও কেনা হলো।  অথৈ পুরাটা সময় শুন্যদৃষ্টিতেই বিয়ের লাল শাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে৷ 

 

বিয়ের প্রতিটা লাল শাড়িই একদিন না একদিন দোকাম থেকে বেঁচা হয়ে যাবে, কেউ না কেউ তো কিনবেই। প্রত্যেক টা লাল শাড়িই একদিন না একদিন একটা করে গল্পের সাক্ষী হয়ে থাকবে। কোন কোন বিয়ের জামদানী শাড়ির ভাজে প্রেমের গল্প লেখা থাকবে। কোনটাতে ভালোবাসার গল্প,আবার কোনটার ভাজে  মান-অভিমান ভঙ্গনের গল্প থাকবে! কিন্তু তার লাল শাড়ির ভাজে মন ভাঙ্গার গল্প লেখা থাকবে। 

 

শপিং শেষে তারা লাঞ্চ সারল বাহির থেকেই। কতোদিন পর যে তারা সবাই একসাথে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চে এসেছে মনে করতে পারল না সময়টা অথৈ! হয়তো বা নয় বছর পর! 

 

বিকেলের দিকে অথৈরা বাসায় ফিরল। অথৈ বেশ ক্লান্ত থাকায় এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় এবংং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। 

 

★★★

 

হাতে সাড়ে পাচ হাজার টাকা পেল শৌখিন। টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে সে একবার টিভি টার দিকে তাকালো। তার একটা বদ স্বভাব আছে তাহলে, খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারে মনটা বিরস হয় তার।আবার যেদিন কোন সুসংবাদ পায় সময় দিন ও তার মনটা খারাপ থাকে। 

 

 আজকেও অকারণেই তার মন খারাপ। টিভিটা বেঁচার পর থেকে এর মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। কষ্ট লাগছে তার। 

 

শৌখিন দোকান থেকে বের হলো। এই সাড়ে পাচ হাজারের মধ্যে চার হাজার আপাতত বাড়িয়ালাকে দিতে হবে। বাকি এক হাজার দিয়ে বাজার-খরচ। মিস্টি কিনবে। অনেক দিন মিস্টি খাওয়া হয় না। লাল লাড্ডু, কালো জাম আর সন্দেশ কিনবে বলে ঠিক করল শৌখিন। 

 

শৌখিন খুব হীনমন্যতায় ভুগছে। তার বোন ও কালকে থেকে টুউশনি শুরু করেছে।বড় ভাই থাকার পর ও যখন ছোট বোনকে কাজে নামতে হয় সেটা যে একটা ভাইয়ের জন্য কতোটা লজ্জাজনক ব্যাপার সেটা কেবল সেই ভাইটাই বুঝে। 

 

শৌখিন একটা ছোট করে নিশ্বাস ছেড়ে বাড়ির পথে এগিয়ে যেতে লাগলো। খুব ঠান্ডা পড়েছে আজকে। জ্যাকেট পড়েও তার ঠান্ডা লাগছে। কান ঠান্ডা হয়ে আসছে। নাকেও ঠান্ডা লাগছে। সে দ্রুত পা বাড়িয়ে বাসায় ফিরে আসল। আজকে বিকেলে বাড়িওয়ালার বাসায় যাবে। 

 

বেল বাজালো শৌখিন। দুবার বেল বাজাতেই গেট খুলে দিল ইভানা। 

 

ইভানাকে দেখে আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। কিন্তু শৌখিনের নিজের প্রতিক্রিয়া লুকানোর স্বভাব আছে। তাই সে যে চমকে গেলে এটা অন্য কেউ খুব সহজে ধরতে পারে না। সহসাই ইভানা ও ধরতে পারে নি। 

 

শৌখিন দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। সে খুব আস্তে বাসার ভেতরে ঢুকল। কোন কিছু জিজ্ঞেস করল না। চোখ বুলিয়ে শায়েরীকে খুজতে লাগে সে৷ 

 

তা দেখে ইভানা বলে,শায়েরী রান্নাঘরে।মাছ রান্না করছে। আজকে পাঙ্গাশ মাছ আর ভাত। আমি ভুনা ভুনা করে রান্না করতে বলেছি। শায়েরী প্রথমে আলু দিয়ে ঝোল করতে চাচ্ছিল। আমি মানা করে দিয়েছি। পাঙ্গাশ মাছ ঝোল দিয়ে খেতে আমার ভালো লাগে না তাই ভুনা করে রাধতে বলেছি। হাতে কি? বাজার করেছো নাকি?

 

–হুম। 

 

–তোমার কি ভুনা মাছ খেতে কোন সমস্যা আছে? 

 

–না কি সমস্যা থাকবে? 

 

–তাহলে ওকে রান্না শুরু করতে বলি? 

 

–আচ্ছা। 

 

শৌখিন এমন ভাবে আচ্ছা বলল যেন ইভানার তাদের বাসায় এসে কি রান্না হবে তা তদারকি করা খুব তুচ্ছ এবং স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। 

 

ইভানা আবারো বলে, ব্যাগটা দাও। আমি রান্না ঘরে নিয়ে যাই। 

 

–না। থাক। আমি রেখে দিচ্ছি। 

 

বলে শৌখিন সামনে পা বাড়ালো। কিন্তু সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না তাদের রান্নাঘর কোন দিকে? বাম দিকে? নাহ ওদিকে তো বারান্দা! তাহলে কি ডানে? ডান দিক কোনটা? 

 

শৌখিনের এই ছোট্ট বাসাটাই এখন অনেক বিশাল লাগছে। যার কোন কূল-কিনারা সে বেমালুম   চিনছেনা। সে যে একটা ঘোড়ের মধ্যে আছে তা দিব্যি টের পাচ্ছে। মাথা ভোভো শব্দ করছে।

 

এখন রান্নাঘর না নিজের রুমে যেতে মন চাচ্ছে তার। কিন্তু! সে এই মূহুর্তে নিজের রুম কোন দিকে সেটাই মনে করতে পারছে না। শৌখিন পাশে  থাকা একটা বেতের টুলে ধপ করে বসে পড়ে। 

মাথা নিচু করে ফেলে সে। 

 

ইভানা শৌখিনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ? 

 

–না। 

 

–তাহলে এভাবে বসে পড়লে কেন? মনে হচ্ছে অসুস্থ তুমি? 

 

তখন ই শায়েরী রান্নাঘর থেকে বের হলো। তাকে দেখে শৌখিন উঠে দাড়িয়ে বলে, আমি রুমে গেলাম। 

 

বলে নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখ জুড়ে ঘুম। মনে হচ্ছে এখনি ঘুমিয়ে যাবে সে কিন্তু ঘুমাতে পারলনা।  চোখ বুজে রেখে বুঝল কেউ তাকে পর্যবেক্ষন করছে। গভীর দৃষ্টিতে যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে এটা শৌখিনের অবচেতন মন বুঝতে পারছে৷ অবচেতন মন এটাও জানে ব্যক্তিটা কে! তাই সে চোখ খুলছে না। আপ্রাণ চেষ্টা করছে ঘুমে তলিয়ে যেতে। কিন্তু ঘুম আসতে না। 

 

এবার আর ইভানা পারল না। সে বেশ বিরক্ত। ছেলেটা এরকম অদ্ভুত আচরণ করছে কেন আসা থেকেই? কি হয়েছে ওর? 

 

ইভানা শৌখিনের বিছানায় গিয়ে পা উঠিয়ে বসে পড়ে। শৌখিনের খুব কাছাকাছি বসে সে। হয়তোবা ইভানার স্পর্শ পেয়েছিল শৌখিন তাই তো তড়িৎ গতিতে উঠে বসে দূরে ছিটকে যায় 

 

শৌখিনকে হুট করে উঠে এভাবে নড়তে দেখে ইভানা ভড়কে যায়। সে বলে উঠে, তোমার কি কিছু হয়েছে? 

 

শৌখিন আওয়াজ নিচু করে বলে, প্লিজ তোমার বাসায় চলে যাও এখনি এই মূহুর্তে। 

 

ইভানা অভিমানী গলায় বলে, কেন আমি এসেছি বলে ভালো লাগলো না? দুপুরে খেলে এক পিস মাছ এক্সট্রা লাগবে জন্য এখন তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছো? 

 

শৌখিন নড়েচড়ে বসে অদ্ভুত নজরে ইভানার দিকে তাকালো। আর কাঠ গলায় বলে, আমি গরিব হতে পারি কিন্তু মনটা ছোট না আমার!

 

ইভানা এই প্রথম শৌখিনকে কিছুটা রাগতে দেখল। সে শৌখিনের দিকে আরেকটু ঘেষে বসল। 

 

শৌখিন ঘাবড়ে গিয়ে তোতলানো তোতলানো বলে, ক,,কি স,,সমস্যা? ওইদ,,দিকে যাও। 

 

শৌখিনের  চেহাররা রিয়্যাকশন দেখে ইভানা ফিক করে হেসে দিয়ে বলে, এই শোন! আমার হাতের বেসলেটটা একটু খুলে দাও না! প্লিজ? 

 

শৌখিন বিষ্ফরিত চোখে ইভানার দিকে তাকিয়ে থেকে আরো দূরে বসে পড়ল৷ একেবারে বিছানার শেষ সাইডে। ইভানা থেকে বেশ দূরে। 

 

ইভানা ভ্রু কুচকে বলে, আচ্ছা আমার কি কুষ্ঠ রোগ যে দূরে দূরে থাকতে হবে? 

 

–এটা ঠিক না ইভু! তুমি প্লিজ এমন বাচ্চামি করিও না। আমার খুব কষ্ট হয়। চলে যাও। 

 

ইভানা শৌখিনের আরো কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আই লাভ ইউ। 

 

ইভানার মুখে এই কথাটা শুনে খুব খুব আনন্দ অয়ায় সে। মনে হচ্ছে আকাশের তারার চেয়েও দামী কিছু পেয়ে গেছে। কিন্তু প্রকাশ করে না। শৌখিন মুখে বলে,

 

–প্লিজ এমন বলবে না। এই কথা আর কোন দিন মুখে আনবে না। 

 

ইভানা একটু রগচটা স্বভাবের। সে শৌখিনের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তার শার্টের কলার খামচে ধরে বলে, কি বললি? আবার বল? 

 

শৌখিন ভীষণ লেভেলের ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ইভানার এই দস্যি রুপ দেখে। ইভানার নাক নিয়ে গরম হাওয়া বের হচ্ছে, সে দাতে দাত চেপে শৌখিনের কলার আরো অনেক শক্ত করে ধরে ফেলে। 

 

শৌখিন আস্তে করে বলে, ছাড়ো। শায়েরী চলে আসবে,,,,

 

–ওই হাদারামটাকে এদিকে আসতে মানা করেছি। ও আসবে না। 

 

–ও। 

 

ইভানা আরো একটু কাছে এসে শৌখিনের মুখ বরাবর তাকিয়ে বলে, সাত দিন ধরে লাইন ঠিকই মারবা মেয়ের সাথে, এখন প্রেম করার সময় তোর সমস্যা তাই না? 

 

শৌখিন চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে ইভানার দিকে। কি।বলবে বুঝে পাচ্ছে না। 

 

ইভানা দাতে দাত চেপে বলে,যদি সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছাই না থাকত তাহলে মায়া বাড়াইলি কেন? কি দরকার ছিল হিরো সেজে আমাকে রক্ষা করার? নিজ দায়িত্বে বাসায় রেখে আসবার আর প্রতিদিন আমার খোজ-খবর নেওয়ার? 

 

–ভুল হয়ে গেছে। 

 

ইভানা আরো জোড়ে শার্টটা ধরে টেনে আনে শৌখিনকে নিজের কাছে। 

 

শৌখিন বলে,আরে, আমার শার্ট ছিড়ে যাবে তো। 

 

–যাক ছিড়ে। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে৷ 

 

শৌখিন মাথা নিচু করে বলে, আমার চাকরি নাই তিন মাস ধরে। তোমাকে এই কথা বলি নি। 

 

–তো? চাকরির সাথে আমার কি? 

 

শৌখিন ইভানার গালে হাত রেখে বলে, তুমি খুব অবুঝ ইভানা। কিছু ই বুঝো না। 

 

–সব বুঝ তোমার একারই তাই না? 

 

–সেটা বলি নি। তোমার জন্ম সোনার চামচ মুখে দিয়ে হয়েছে আর আমি ছোট থেকে অভাবে বড় হয়েছি। যায় না তোমার সাথে আমার। আমি তোমার সামনে অনেক ক্ষুদ্র কেউ একজন! অতি নগন্য, নূন্যতম। 

 

ইভানার চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি পড়ল। সে কাপা গলায় বলে উঠে,আমার এই নগন্য মানুষটাকেই চাই! 

 

শৌখিন অপলক বিমুগ্ধ নয়নে ইভানার দিকে তাকিয়ে আছে। 

 

ইভানা নাক টেনে বলে,চাকরি নেই, পরে চাকরি পাবে। এটা কোন সমস্যা না।এখনি তো আমাকে বিয়ে করবে না। আমার নিজেরই পড়া শেষ না হলে আমি বিয়ে করব। 

 

শৌখিন বড়ই আশা নিয়ে বলল, তুমি কি আমার পাশে থাকবে? যদি সফল না হই তখন কি হবে? 

 

ইভানা হেসে বলে, কম্পাস দিয়ে বৃত্ত আকলে খাতায় কাটা কম্পাসের বিন্দুটার একটা ছোট দাগ হয় না? সেই পরিমান সাকসেসেও আমি তোমার পাশে থাকব। 

 

শৌখিন আনন্দে মাথা নিচু করে ফেলে। সে কি পাবে একটা ভালো চাকরি? মেয়েটাকে কে সুখে রাখার ক্ষমতা হবে তার? কে জানে কি হবে এগুলোর উত্তর? আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। 

 

চলবে৷ 

 

#অশ্রুমালা

#শেষপর্ব (প্রথম খন্ড) 

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

বিছানার এক সাইডে লাল শাড়ি, গহনা, ঘোমটা, নাকফুল সব সাজিয়ে রাখা আছে। বিয়ের সব জিনিস অথৈকে তার বাবা কিনে দিয়েছে। গায়ে হলুদের শাড়ি-গহনা ফয়সালের পরিবার দিবে। 

 

অথৈ শাড়ি টা হাতে নিল। লাল শাড়ির পাড়ে গোল্ডেন কাজ করা। সে খুটে খুটে শাড়িটা দেখছে৷ নেড়েচেড়ে দেখতে বেশ ভালো লাগছে তার। সত্যি বলতে, শাড়িটা তার খুব খুব পছন্দ হয়েছে৷ গায়ে জড়িয়ে দেখতে মন চাচ্ছে কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে না। 

 

অথৈ ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস পড়েছিল,বাঙালী মেয়েদের নাকি বিয়ের সবকিছু তার পছন্দ মতো কিনে দেওয়া হয় কিন্তু জীবনসঙ্গীটাই মন মতো দেওয়া হয় না। লেখাটা যখন পড়েছিল পাত্তা দেয় নি সে। আজকে মনে হচ্ছে তার ক্ষেত্রে কথাটা সত্য!

 

অথৈ বড় করে একটা শ্বাস নেয়। আজকে থেকে অফিস ছুটি। তিন দিন পর বিয়ে। ভাইয়া এখনো বাসায় আছে। বিয়ের পর যাবে৷ তারা প্রতিদিন একসাথে তিনবেলা খায়, গল্প গুজব করে। বিকেল করে দাবা খেলতে বসে। অথৈ প্রথমে ভেবেছিল বাবা নামক মানুষটার সাথে তার এতোটা মিশতে সংকোচ হবে কিন্তু তার এই ধারণা ভুল প্রমানিত হয়েছে৷ খুব তাড়াতাড়ি বাবার সাথে খাপ খাওয়াতে পেরেছে সে। 

 

এখন বিকেল। তাই ড্রয়িং রুমে গেল অথৈ। ইতার ভাই অর্পণ বসে আছে সোফায়। তাকে আসতে দেখে অপণ মুচকি হেসে বলে, চল এক দান দাবা খেলি। 

 

অথৈ অপর্ণের বিপরীতে বসে বলে, গুটি সাজা। 

 

–ওক্কেই। 

 

অপর্ণ দাবার বোড সাজিয়ে বলে, তুই আগে দান দে। 

 

অথৈ প্রথমে মন্ত্রীর সামনের পিলটা দিল। এই টেকনিক টা বাবা শিখিয়েছে।  খেলার শুরুতেই মন্ত্রী আর রাজার সামন থেকে নাকি পিল দিলে সুবিধা হয় খেলতে৷ 

 

এভাবে এক দান দুই দান করে খেলা মাঝে চলে আসে । অপর্ণ অথৈকে কাবু করে ফেলেছে৷ অথৈ বরাবর ই উইক খেলায়৷ চাল বুঝে কম। তারপর সে সবসময়ই চায় তার মন্ত্রী যেন সেইভ থাকে। এজন্য খুব মসিবতে পড়ে সে। 

 

এখন সে বিপাকে পড়ে গেছে। কি দান দিবে সে।

সে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কখন যে  আজিজুল সাহেব এসে দাঁড়িয়েছে অথৈ জানেই না। 

 

উনিই বলে উঠে, কালো হাতিটা অপর্ণেরর ঘোড়ার পাশে দাও। 

 

অথৈ বাবার আওয়াজ পেয়ে একবার তার দিকে তাকিয়ে নেয় পরে সেই দান ই দেয়। খেলা শেষ হলো। অপর্ণই জিতেছে৷ 

 

অপণ বলল, যাক তোর অবস্থা একটু হলেও ভালো হয়েছে। আগে তো ঘোড়ার দানই চালতে পারবি না। 

 

অথৈ ভেংচি কাটলো। তখনি ফয়সালের কল আসল। সে কল রিসিভ করতেই ফয়সাল জানায় সে অথৈয়ের সাথে দেখা করতে চায়৷ 

 

অথৈ অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেডি হলো। যাওয়ার আগে আজিজুল সাহেব বললেন, উনি অথৈকে রেস্টুরেন্টে রেখে আসবে। ওদিকে নাকি ওনার কি কাজ আছে। 

 

অথৈ তার বাবার সাথে রিকশা করে রেস্টুরেন্টের দিকে যাচ্ছে। এমন সময় জুনায়েদ ভাই নামে কেউ তাকে কল দিল। আজিজুল সাহেব নামটা দেখে বলে, কে এই ছেলেটা? 

 

অথৈ উত্তর দিল, তার সিনিয়র হয়। অফিসের বস। তাদের অফিসে কেউ স্যার-ম্যাডাম বলে ডাকে না।  এজেন্সি জন্য ভাইয়া-আপু ডাকে সবাই। 

 

জুনায়েদ ভাই ফোন দিয়েছে কারন তার ছেলের জন্মদিন তাই দাওয়াত দিল। 

 

কথা শেষ হতেই রেস্টুরেন্টে চলে আসে রিকশা। অথৈ নেমে সোজা রেস্টুরেন্টে চলে যায়। আজকে থেকে আজীবন তাকে অভিনয় করে চলতে হবে। তারই পূর্বপ্রস্তুতি নিচ্ছে সে৷ এবং আউটপুট যথেষ্ট ভালো। 

 

সে ভেতরে ঢুকে পড়ে। দেখতে পেল ফয়সাল চেয়ারে বসে ফোন চালাচ্ছে। 

 

অথৈ গিয়ে চেয়ারে বসল। ফয়সাল বলে উঠে, দেরি কেন হলো আসতে? 

 

অথৈয়ের মেজাজটা খারাপ হলো। সে তাও নিজেকে সামলে বলে, হুট করে ডাকলে কেন? কোন দরকার? 

 

ফয়সাল ফোন রেখে কিছুটা ধমকে উঠে বলে, আমার হবু বউকে আমি যখন-তখন ডাকতে পারি। গেট ইট? 

 

অথৈ মাথা নিচু করে ফেলে। প্রতিবাদ করার না আছে ইচ্ছা আর না শক্তি। তারচেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়। তখনি জুনায়েদ ভাই আবারো কল দিল৷ অথৈ ফোন কেটে দিল। আবারো কল হলো। অথৈ আবারো কেটে দেয়। তৃতীয়বার কল আসলে ফয়সাল বলে, ফোনটা আমাকে দাও তো।

 

অথৈ বিষ্ফরিত চোখে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে ফোনটা তার হাতে দিল।ফয়সাল ফোনটা হাতে কল কেটে দেওয়ার পর ফোনটা সজোরে ভেঙে ফেলল। অথৈ ভয় পেয়ে যায়। 

 

ফয়সাল দাতে দাত চেপে বলে,এই লোক তোমাকে কেন কল দিচ্ছে? 

 

অথৈ রক্তবর্ণ চোখে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি এই প্রশ্ন করে কি বুঝাতে চাচ্ছো? 

 

–এফেয়ার আছে নাকি তোমার এই লোকের সাথে। 

 

–জাস্ট সাট আপ ফয়সাল। তোমার কোন অধিকার নেই আমার সম্পর্কে এমন কোন মন্তব্য করার। তুমি খেয়াল কর নি জুনায়েদ এর পর ভাই লেখা আছে। 

 

ফয়সাল তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ভাইয়া কখন যে সাইয়া হয় কে জানে? লোকটার সাথে কয়বার ডেটে গেছো? 

 

অথৈ এবার হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। চোখ ফেটে পানি পড়বে পড়বে ভাব। সে নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিচ্ছে৷ কেদে দিলেই উপহাসের শিকার হতে হবে তাকে। 

 

ফয়সাল হুংকার দিয়ে বলে, তুমি মাঝখানে এক রাতে বাসায় ছিলে না। কোন জানি ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলে,,,নেহা নামের কোন ফ্রেন্ড। আমি খোজ নিয়েছি তুমি ওদের বাসায় ছিলে না ওইরাতে। নিশ্চয়ই এই লোকের সাথে কোথাও নাইট স্টে করেছো। তাই না অথৈ? নিজেকে ধোয়া তুলসি পাতা ভেবো না। 

 

অথৈ থমকে গেল। এখন সে কি বলবে? 

 

ফয়সাল উঠে এসে অথৈকে জোর করে দাড় করায় এবং প্রায় চিৎকার করে বলে, কি হলো উত্তর দাও৷ কার সাথে ছিলে সে রাতে? এই লোকের সাথে নাকি অন্যকারো সাথে? 

 

অথৈ আস্তে করে বলে, ফয়সাল এটা পাবলিক প্লেস৷ এখানে কোন সিনক্রিয়েট করবে দয়া করে৷ তোমার সম্মান না থাকলেও আমার সম্মান আছে। 

 

ফয়সাল বাজে করে হেসে বলে, আচ্ছা! তোমার সম্মান আছে। হাসাইলা আমাকে। কাজ তো করো ছোট পোস্টে। তুমি যেই পোস্টে জব করো না সেটা জব সেক্টর না, মেয়েরা ওই সেক্টরে কাজ করেই অফিসের বস সহ ক্লাইন্টদের শরীর দেখিয়ে খুশি করা। আমি বোধহয় এসব বুঝি না। 

 

অথৈ কাঠ গলায় বলে, চুপ করো ফয়সাল। না জেনে একদম কথা বলবে না। এতোই যদি সমস্যা থাকে তাহলে বিয়ে করছো কেন আমাকে? 

 

–সেটাই! কেন করছি বিয়ে তোমাকে? না আছে তোমাদের অঢেল টাকা-পয়সা আর তাছাড়া তুমিও সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস। 

 

–ফয়সাল! (রেগে মেগে চিৎকার করে অথৈ) 

 

অথৈ ভীষণ রেগে গিয়ে বলে, আর একটা বাজে কথা বললে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড় দিব না৷ 

 

ফয়সাল ও তেড়ে এসে অথৈয়ের হাত শক্ত করে ধরে বলে, তোর সাহস তো কম না আমাকে ধমকাস? 

 

–তুই-তুরাকি করছো কেন তুমি? তোমাকে তোমার বাবা-মা ভদ্রতা শেখায় নি?মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলতে জানো না তুমি? 

 

ফয়সাল রেগে গিয়ে অথৈয়ের গালে সজোরে থাপ্পড় বসালো। রেস্টুরেন্টের সবাই অবাক এবং হতভম্ব হয়ে অথৈয়ের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। 

 

অথৈয়ের চোখ ফেটে কান্না চলে আসল। সে এক মূহুর্ত সময় না থেমে সোজা বাইরে চলে আসে। 

 

সিড়ির সামনে যেতেই দেখল আজিজুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। অথৈ তার বাবাকে দেখে ঘাবড়ে গেল৷ পরক্ষণেই নিজেকে শক্ত করে বলে, তুমি এখানে! 

 

–হ্যা। তোকে খুজতে খুজতে এদিকটায় আসলাম। তোর হাতে কোন টাকা দেই নি। ভাবলাম কিছু টাকা দিয়ে যাই৷ 

 

অথৈয়ের খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু সে কান্না আটকে রেখে বলে, ওহ। আমিও বের হয়ে এলাম।বাসায় যাব এখন। তোমার না কাজ আছে? যাও কাজে। 

 

–নাহ। কাজটা হবে না। 

 

–ও। 

 

অথৈ সামনে এলোমেলো পা বাড়ালো। বাবা কি দেখে ফেলেছে ফয়সাল তাকে থাপ্পড় মেরেছে? মনে হয় না দেখেছে। বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল আর কাহিনি ঘটেছে রেস্টুরেন্টের ভেতরে৷ দেখার কোন চান্স নেই। 

 

আজিজুল সাহেব রিকশা ঠিক  করলেন। দুইজন পাশাপাশি বসে আছে। অথৈ অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছে।তাই সে মৃদ্যু কেপে উঠছে। 

 

বাসায় পৌছে অথৈ সোজা তার রুমে চলে যায়। বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে হাউমাউ করে কেদে দেয়। মুখে বালিশ চেপে কাদছে সে। যেন কেউ তার কান্নার শব্দ শুনতে না পারে। 

 

কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে সে৷ বেশ কিছুক্ষণ পর তার মা এসে তাকে ডেকে তুলে। 

 

অথৈ ফোলা চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে মা? 

 

–ফয়সাল রা এসেছে। তুই বাইরে আয়। 

 

–ওরা কেন এসেছে? 

 

–তোর বাবা ডেকেছে। আয় মা জলদি আয়। 

 

–আসছি৷ 

 

অথৈ মুখে পানি দিয়ে মাথায় হাজারো চিন্তা বহন করে ড্রয়িং রুমে পা বাড়ায়৷ 

 

ভাইয়া আর বাবা বসে আছে পাশাপাশি। অপর্ণ অথৈকে নিজের পাশে বসতে বলে। অথৈ তার ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। 

 

তার চোখ ফুলে আছে৷ পরনের জামাও চেঞ্জ করেনি সে। অথৈ ফয়সালের দিকে তাকালো। তাকে দেখে ফয়সাল হাসি দিল যা দেখে অথৈয়ের গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। এই হাসির মধ্যে সৌজন্যতা ছিল না। ছিল উপহাস! 

 

অথৈ মাথা নিচু করে নেয়। মেঘ তাহলে ঠিক বলেছিল! যদিও বা সেদিন মেঘ যা বলেছিল অথৈ বিশ্বাস করে নিয়েছিল। ফয়সালের জায়গায় মেঘ হলে কোন দিন ই তাকে থাপ্পড় মারত না। বরং তার সাথে জুনায়েদ ভাইয়ের ছেলের জন্মদিনে যাওয়ার বায়না ধরত!!! 

 

অথৈয়ের বাবা ফয়সালের বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,আপনাদেরকে একটা বিশেষ জরুরি কথা বলার জন্য এতো কষ্ট করে ডেকে এনেছি।

 

ফয়সালের  বাবা-মা বলে, জি বলুন। 

 

–এই বিয়েটা হচ্ছে না। দুঃখিত। ক্ষমা করে দিবেন। আমি আমার মেয়ে আপনার ছেলের হাতে তুলে দিতে পারব না। 

 

অথৈ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে  মাথা তুলে তার বাবার দিকে হতভম্বের চোখে তাকায়। 

 

অথৈ মা চমকে উঠে বলে,এসব কি বলছো তুমি? মেয়েটার কাল বাদে পড়শু বিয়ে আর তুমি বিয়ে ভেঙে দিচ্ছো? লোকে কি বলবে? 

 

ফয়সাল ও যেন বোকা বনে গেল। সে ভাবেও নি এমন কিছু হবে। 

 

অথৈ কান্না করে দিল খুশিতে। অপর্ণ তার হাত শক্ত করে ধরে নিজের বুকে বোন কে আগলে নিল। তারপর ফিসফিস করে অথৈ কে কানে কানে বলে, বাবা আমাকে সব জানিয়েছে। ফয়সাল তোকে রেস্টুরেন্টে এক গাদা মানুষের সামনে থাপ্পড় মেরেছে– বাবা এই দৃশ্য দেখে ফেলেছেন ভাগ্যক্রমে। ওর সাহস কিভাবে হয় আমার বোনকে থাপ্পড় মারার?ওর  হাত আমি কেটে ফেলব। 

 

অথৈ ভাইয়াকে  শক্ত জোড়ে করে আকড়ে ধরে।

 

আজিজুল সাহেব বলে, যেই ছেলে আমার মেয়েকে সম্মান করতে পারে না তার কাছে আমার মেয়ে সুখ পাবে না। যে ছেলে বিয়ের আগে আমার মেয়েকে সবার সামনে  থাপ্পড় মারতে দ্বিধাবোধব করে না সে বিয়ের পর আমার মেয়ের কি অবস্থা করতে পারে তা এখনি ভাবলে আমার রক্ত পানি হয়ে যাচ্ছে। আমার মেয়েকে সন্দেহ করে এখনি! তার চরিত্র নিয়ে অপবাদ দিতে এক সেকেন্ড সময় নেয় না তার কাছে আমার মেয়ে ভালো থাকবে না। এই বিয়ে হচ্ছে না৷ আপনারা এখন আসতে পারেন। 

 

ফয়সালের মা মিনমিন সুর তুলে বলেন, ফয়সালের ভুল হয়ে গেছে। ও সুধরে নিবে। আর ভুল হবে না৷ 

 

আজিজুল সাহেব কঠিন গলায় বলে, এই ধরনের ছেলেরা কোন দিন ঠিক হয় না। আপনার যান প্লিজ। 

 

অথৈ সবটা এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। 

 

এরপর যা হলো তা কল্পনাতীত! আজিজুল সাহেব নিজে থেকে অথৈকে বললেন, মেঘকে কল দিতে। সে নিজে মেঘের কাছে ক্ষমা চেয়ে তার মেয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠাবে। 

 

অথৈ কাদতে কাদতে অপর্ণের ফোন দিয়ে মেঘকে কল লাগায়। এ কান্না কিছু ভালো হওয়ার আশায়!

 

★★★

 

মেঘ স্টেশনে ছিল। রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে রিশাদের। সেটাই নিজ চোখে দেখে মনের ক্ষত মেটাচ্ছিল। রিশাদ কোন উত্তর ই ঠিকঠাক ভাবে দিচ্ছে না জন্য অফিসার দের কাছে উত্তম-মধ্যম ক্যালানি খাচ্ছে। তাও উত্তর দেয় না৷ 

 

মেঘের সামনেই রিশাদের গায়ে ফুটন্ত গরম পানি ঢালা হলো। রিশাদ আর্তনাদে কুকিয়ে উঠে, সব স্বীকার করে নেয় 

 

মেঘ রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ 

 

রিশাদ গড়গড় করে, সব সত্য বলে দেয়। তারপর এক দন্ড চুপ থেকে রিশাদ বড়াই করে বলে, তোরা আমার কিছুই করতে পারবি না। আমি দুইদিনের মধ্যে বের হয়ে যাব দেখে নিস৷ 

 

মেঘ বুকের উপর দুই হাত গুটিয়ে নিয়ে বলে, কিভাবে বের হবি? 

 

–টাক ঢাললেই বেইল পেয়ে যাব৷ 

 

–সেই টাকাটা কে দিবে? 

 

–আমার কি টাকার অভাব পড়ছে নাকি? 

 

মেঘ হোহো করে হেসে বলে, তুই দেখি কিছুই জানিস না। কেউ কিছু জানায় নি তোকে?।

 

রিশাদ ভড়কে গিয়ে বলে, কি জানি না আমি? 

 

–তোর , বাড়ি-ঘর, গাড়ি, ব্যাংকব্যালেন্স সব নিলামে উঠছে। সব দুর্নীতি করে কামাইছিস রেইট ফেলছিলাম কালকে ভোরে তোর বাসায়। শালা বাসাটাও দুই নাম্বারি করে বানাইছোস!।

 

রিশাদ অদ্ভুত ক্রোধ চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ 

 

মেঘ শিস বাজাতে বাজাতে বলে, আরো একটা খবর আছে। একদম লেটেস্ট নিউজ। তাহলো শেখ প্রাচুর্য তোর বিসনেস দখল করে নিসে। সো আল্টিমেটলি তুই এখন রাস্তার ফকিরের মতো হতদরিদ্র। তোর দুই টাকাও নাই এখন। বেইল করে ছাড়া পাওয়া তো দূরের কথা। তোর যে অবস্থা করছি না? অন্যান্য রাজনীতিবিদ রা তোর দিকে ঘুরেও তাকাবে না। 

 

রিশাদ ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। তার মাথায় হাত৷ 

 

মেঘ বের হয়ে গেল রিমান্ডে রুম থেকে। তখনি ফোন বেজে উঠল। আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে দেখে সে প্রথমে রিসিভ করে না। দ্বিতীয়বার কল আসলে সে ফোন ধরতেই অথৈয়ের কান্নার শব্দ পায় তাতেই তার হৃদপিন্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল৷ এই কান্নার শব্দটা তার বুককে ক্ষত-বিক্ষত  করে দিচ্ছে অপরপাশের ব্যক্তি কি তা বুঝতে পারছে?  

 

মেঘ ঘাবড়ে গিয়ে বলে, কি হয়েছে অথৈ? 

 

–মেঘ?

 

–হু বল। 

 

–আমাকে বিয়ে করবে তুমি? 

 

মেঘ প্রথমে বুঝতে পারেনি কি বলছে অথৈ। সে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকল। 

 

অথৈ কাদতে কাদতে বলে,জানি আমি অনেক স্বার্থপর। তোমার উচিত এই মূহুর্তে ফোন কেটে দেওয়া এবং আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য হলেও আমাকে বিয়ে না করে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে নেওয়া।  

 

মেঘ বলে উঠে, আসছি। আমি আসছি।জাস্ট এক মিনিট সময় দাও। 

 

মেঘ ফোন কাটল না। কল লাইনে রেখেই অথৈয়ের বাসায় পৌছে যায়। 

 

তারপর। তারপর?  যা হলো তা সত্যি রুপকথার গল্পের মতোন। সেদিন রাতেই ছোট্ট করে মেঘ-অথৈয়ের বিয়ে হয়ে যায় দশ হাজার দেনমোহর রেখে। 

 

মেঘ গিয়েই আবেগকে কল দেয়। আবেগ তার পরিবার নিয়ে অথৈয়ের বাসায় চলে আসে। মেঘের বাবা-মায়ের জায়গায় ইমতিয়াজ রহমান এবং জাবেদা খাতুন ভূমিকা পালন করেন। ইভানা আর রোদেলা মিলে অথৈকে সাজিয়ে দেয়। 

 

লাল শাড়ি তে একদম টুকটুকে লাল বউ লাগছিল অথৈকে। অথৈয়ের হাসির উজ্জ্বলতার কাছে মেকাপ ভাটা পড়ে গিয়েছিল সেদিন। 

 

 

অথৈ-মেঘের গায়ে হলুদ ও এরইমাঝে হয়ে যায়।অথৈকে মেহেদী ও পড়ানো হয়। এমন কি বিয়ের পর আয়নায় দুজনের শুভদৃষ্টি করা হয়েছিল। এমন কি বাসর ঘরে ঢোকার আগে টাকা নেওয়া সবই হয়েছিল। বাসর সাজানো হয়েছিল আবেগদের বাসায়। 

 

তারপর কি হলো? নিশ্চয়ই জানতে মন চাচ্ছে? তারপর যা হলো সেটা নির্দ্বিধায় সিন্ডেলার ফেইরিটেলকে ও হার মানাবে। 

 

আইনস্টাইন সময় নিয়ে একটা মতবাদ দিয়েছিলেন তাহল,কোন বোরিং কাজ করার সময় ‘টাইম’খুব আস্তে কাটলেও,যদি সুন্দরী কোন মেয়ের সাথে সময় কাটানো যায় তাহলে সময় খুব দ্রুত কেটে যাবে। আইনস্টাইনের মতবাদ কি আর কোন দিন ভুল হতে পারে? নিশ্চয়ই না! তাই তো সুন্দরী বউকে নিয়ে কিভাবে, কিভাবে, কিভাবে যে সাতটা বছর অতিবাহিত হলো তার হিসাব ডাক্তার সাহেব মেলাতে পারেননা। ডাক্তার জন্য ই হয়তো অংক মিলাতে পারে না। অংকবীদ হলে মিলে যেত সমীকরণ টা। আবেগের মনে হয় এই তো সেদিন ই তো সমুদ্র দুধ ছাড়া কিছুই খেত না। এরপর আস্তে আস্তে সুজি খাওয়া শুরু করল। খিচুড়ি খাওয়া শিখল। দাত গজালো, হাটা শিখল, কথা বলা শিখল। সমুদ্র সবার আগে বাবা  ডাক শিখেছিল। সমুদ্র যেদিন বাবা বলে ডাকে সেদিনটার কথা এখনো আবেগের মনে আছে৷ ২৩ শে আগস্ট ছিল তারিখটা। সেদিন সারা দিন আবেগ সমুদ্র কে কোলে নিয়ে ঘুরেছে।কি যে আন্দন পেয়েছিল আবেগ যেদিন সমুদ্র তাকে বাবা বলে ডেকেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। 

 

 এরপর হাতে খড়ি, ফাস্ট ডে এট স্কুল এবং সমুদ্রের বড় ভাই হওয়া সব এতো দ্রুত কিভাবে ঘটে গেল? 

 

আবেগ-রোদেলার কোল আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে রাজকন্যা। যার বয়স এখন সাড়ে পাচ মাস চলছে। আবেগ-সমুদ্র দুইজনেরই খুব আদরের সে। 

 

আবেগ শখ করে নাম রেখেছে পিউ। রোদেলার ইচ্ছা ছিল ‘আ’ দিয়ে কোন নাম রাখবে। কিন্তু আবেগ তার নামের সাথে মিল রেখে 

 

 ইচ্ছা করেই মেয়ের নাম রাখে নি। যদি ভবিষ্যতে সমুদ্র কষ্ট পায়? তার নামের প্রথম অক্ষর  বাবার নামের প্রথম অক্ষরের সাথে মিলে না  তবে ছোট বোনের টা কেন মিলল?এজন্য ই তাদের দুজনের নামের সাথে মিল না রেখে  ভিন্ন অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া নাম রাখল। 

 

আবেগ মুচকি হেসে হসপিটাল থেকে বের হলো। 

সাত বছরে সে মোটেও বুড়ো হয়ে যায় নি।কিন্তু আচরণে একটা গুরুগম্ভীর ভাব চলে এসেছে।হবেই বা না কেন? দুই বাচ্চার বাপ সে এখন!  

 

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সে পাকিং লটে অপেক্ষা করতে লাগলো। কালো গাড়ি এসে থামল। ডাইভার গেট খুলে দিল। আবেগ মৃদ্যু হেসে গাড়ি তে বসে পড়ে।

 

আবগ গাড়িতে বসে বলে, সমুদ্র আজকে স্কুল গিয়েছিল? 

 

–না। যায় নি। 

 

–ও। 

 

সমুদ্র স্কুল যেতে চায় না একদমই। সকালে ঘুম থেকে উঠতে চায় না। রোদেলা এক প্রকার যুদ্ধ করে সমুদ্র কে স্কুল পাঠায়। এই গাড়ি টা আবেগের কঠোর পরিশ্রমের ফসল। আবেগের ইচ্ছা ছিল তার ছেলে গাড়ি তে করে স্কুল যাবে। ইচ্ছা পূরণ করেই হাল ছেড়েছে৷ সমুদ্র এখন গাড়িতে করেই স্কুল যায়। 

 

কালো রংয়ের গাড়ি কিনেছে। রোদেলাই কালো রঙের কিনতে বলেছিল। আজো মনে আছে, যেদিন তারা গাড়ি কেনে পুরা পরিবার সহ ঘুরতে গিয়েছিল। আবেগ গাড়ি কেনার আগে ড্রাইভিং শিখে নিয়েছিল। প্রথম দিন মিলে রোদেলা কে নিয়ে  ঘুরতে বের হবে বলেই শিখেছিল ড্রাইভিং।। আবেগ শুধুমাত্র রোদেলা কে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু রোদেলা একা যাবে না। ফুল ফ্যামিলি মিলে যাবে । নাহলে যাবে না। পরে আর কি? সবাই মিলে হাতিরঝিল ঘুরে এসেছিল। ডিনার করে বাসায় ফিরেছিল। আবেগ রোদেলা  সামনের সিটে বসেছিল। সেদিনটা আবেগ কোন দিন ভুলবে না৷ 

 

বাসার গ্যারেযে গাড়ি এসে থামল। আবেগ গাড়ি থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে বাসার সামনে থেমে বেল বাজালো। গেট খুলে দিল রোদেলা। 

 

রোদেলার চেহারায় পাক্কা গিন্নি গিন্নি ভাব চলে এসেছে। আজকে এই ভাবটা একটু বেশিই জোড়ালো হয়ে আছে৷ আবেগকে দেখে সে মুচকি হাসল। আবেগ ও পালটা হেসে প্রশ্ন করে, সমুদ্র কোথায়? 

 

রোদেলা চুল খোপা করতে করতে বলে, তোমার ছেলে বিকেলে বাসায় বসে থাকার বাচ্চা? বাইরে গেছে খেলতে৷ 

 

আবেগ ব্যাগ রেখে বলে, বাচ্চা মানুষ বাইরে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবেই। তুমি ওকে একদম এজন্য বকবে না আর আমার রাজকন্যা 

কোথায়? 

 

–মাত্র উঠলো। খাওয়ালাম। 

 

আবেগ রুমে গিয়ে পিউকে দেখে ডাক দিল, পিউমনি? 

 

ছোট্ট পিউ চোখের নাটা পাকিয়ে বাবাকে খুজতে লাগলো। রোদেলা রুমে এসে বলে, যাও ফ্রেস হয়ে আসো। নাস্তা দিচ্ছি তোমাকে। 

 

–আচ্ছা। আব্বা-আম্মা কই? 

 

–হাটতে গেছেন৷ 

 

আবেগ ফ্রেস হয়ে এলে রোদেলা তার হাতে নাস্তার প্লেট দিল। আবেগ প্লেট হাতে না নিয়ে রোদেলার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নেয়। রোদেলা বিরক্ত হয়ে বলে,এসব কি শুরু করলে? কাজ আছে আমার। 

 

আবেগ ফুক দিয়ে রোদেলার চোখের উপরের চুল গুলো সরিয়ে দিল। রোদেলা চোখ বন্ধ করে ফেলে। আবেগ রোদেলার চোখে ঠোঁট হালকা করে ছুইয়ে বলে, এতো ব্যস্ততা দেখাচ্ছো কেন? 

 

রোদেলা অভিমানী গলায় বলে, আমি ব্যস্ততা দেখাই? তোমার আসার কথা ছিল দুপুরে। অথচ আসলে এখন! আর উনি বলেন  আমি ব্যস্ততা দেখাই। 

 

আবেগ রোদেলাকে নিজের সাথে মিশে নিয়ে বলে, সর‍্যি একটু লেট হয়ে গেছে।আচ্ছা বাদ দাও আমাকে খাইয়ে দাও। 

রোদেলা চোখ বড় করে বলে, আশ্চর্য তোমাকে কেন খাওয়ায় দিতেহবে? 

 

–একশ এক বার দিতে হবে৷ আমি অনেক ক্লান্ত। নিজে থেকে খেতে ইচ্ছা করছে না৷ 

রোদেলা আবেগের মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিল। আবেগ মুচকি হেসে খেতে লাগলো। খেতে খেতে আবেগ বলল, কালকে একটা সেমিনার আছে। গাজীপুরে যেতে হবে। আসতে আসতে রাত হবে। 

রোদেলা বলল, আচ্ছা। ঠিক আছে। 

 

কিছুক্ষন পর বেল বেজে উঠল। রোদেলা বলে উঠে, এসে গেছে বাদরটা। 

আবেগ হেসে দেয়। রোদেলা আর সমুদ্র কে সমুদ্র বলে ডাকে না। বরং বাদর, বান্দর, দুষ্টু রাজা বলে ডাকে। 

সমুদ্র এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আবেগ সমুদ্রকে চুমু খেল। 

রোদেলা এসে বলে, সমুদ্র সোজা বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হও। আমি নাস্তা সাজাচ্ছি। 

 

সমুদ্র মায়ের কথা শুনে ফ্রেস হয়ে এসে বাবার কাছে বসে। আবেগ সমুদ্র আর পিউকে নিজের কাছে বসিয়ে সে মাঝে বসে থাকে। সমুদ্র বাবার ফোন নিয়ে গেম খেলতে লাগে। এদিকে মা এসে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে।আবেগ মুগ্ধ নয়নে রোদেলা কে দেখছে৷ 

 

রাতে সমুদ্র আবেগকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল। রোদেলা পিউকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়ায়। দুই বাচ্চা ঘুমানোর পর আবেগ রোদেলার কাছে এসে তাকে ঝাপ্টে ধরে শুয়ে পড়ে।

 

পরের দিন, আবেগ গাজীপুরের উদ্দেশ্য রওনা হলো।রোদেলা সমুদ্র কে জোড় করে স্কুলে পাঠায়। 

 

রোদেলা একটা কলেজের ইংরেজির প্রফেসর। রোদেলা সমুদ্রকে স্কুলে রেখে এসে পিউকে নিয়ে থাকে। সমুদ্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে। দুই ঘন্টার মধ্যে ছুটি হয়ে যাবে। 

রোদেলা কিছুক্ষন পর আবারো সমুদ্র কে আনতে গেল। স্কুল ছুটির পর সমুদ্র বের হয়েই মায়ের কাছে আবদার করে আইসক্রিম খাবে৷ 

আশেপাশে কোন দোকান নেই। সে ভ্যানগাড়ি থেকে গোলা কিনে দিল। এখান থেকে সমুদ্র আইসক্রিম আগে খায় নি। আজকেই প্রথম খাচ্ছে।লাল রংয়ের গোলা খেতে খেতে বাসায় আসল সমুদ্র আর রোদেলা। 

 

বাসায় আসা থেকেই সমুদ্র বলতে লাগলো, তার খারাপ লাগছে। কেমন যেন লাগছে। 

 

রোদেলা পাত্তা দেয় না। সে বলে উঠে, সকাল ঘুম থেকে উঠেছো জন্য খারাপ লাগছে বাবাই। রেস্ট নাও ঠিক হয়ে যাবে। আমি কলেজ যাচ্ছি। বিকেলে এসে পাস্তা বানিয়ে দিব।ঘুমাও একটু। 

 

সমুদ্র চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল। রোদেলা তার কপালে চুমু খেয়ে চলে যায়। 

 

প্রায় দেড়ঘন্টা পর কলেজে থাকাকালীন রোদেলা  বাসা থেকে কল পায়। তার শ্বাশুড়ির কল আসে। সে রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে জাবেদা খাতুন অস্থির হয়ে বলতে লাগলো, রোদেলা দ্রুত বাসায় আস।সমুদ্র কেমন যেন করছে। মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে৷ আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি আসো। 

 

রোদেলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে কুল-কিনারাহীণ হয়ে যায়। কোন মতো ছুটে বের হয় কলেজ থেকে। হাসপাতালে পৌছাতে তার আধঘন্টার মতো লাগে। এই আধঘন্টা তাকে কি অসহ্য যন্ত্রণা দিয়েছে তা কেবল রোদেলাই জানে। কি হয়েছে তার ছেলের? সকালেই তো ভালো ছিল? 

 

হাসপাতালে পৌছে রোদেলা থমকে গেল। ছোট-খাটো একটা ঝট পেকে আছে। পাশ থেকে কেউ বলছে, আহারে, এতো ছোট বয়সে মারা গেল বাচ্চাটা? না জানি ওর বাবা-মা কিভাবে এই ক্ষতি সামলাবে। 

 

রোদেলার চোখে অজস্র পানি। সে ভীড় ঠেলে সামনে আগাচ্ছে আর বিড়বিড় বলছে, আমার বাবাইয়ের কিছু হয় নি। সমুদ্র ঠিক আছে।

 

রোদেলা একটা হাসপাতাল ওয়ার্ডে ঢুকল। ওয়ার্ড নং একশ ছয়। 

 

সমুদ্র শুয়ে আছে।তাকে ঘিরেই জটলাটা। সমুদ্রের জামা-কাপড় রক্তে ভেজা। চোখ বন্ধ।ফ্যাকাসে মুখ।  নিস্তেজ দেহখানা নিথর হয়ে বেডে পড়ে আছে। রোদেলা এক পা পিছিয়ে যায় এবং ধপ করে  মেঝেতে বসে পড়ে। 

 

পেছন কিংবা সামন থেকে চাপা কান্না শুনতে পাচ্ছে রোদেলা । জাবেদা খাতুন বিলাপ করে বলছে, আল্লাহ রে আল্লাহ কি হয়ে গেল?ও  আল্লাহ আমাকে উঠায় নাও। আল্লাহ কি হলো! ও আল্লাহ! 

 

রোদেলা কানে হাত দিয়ে বলে, আমার ছেলের কিছু হয় নি। ও ঠিক আছে। আমার বাবাই আমাকে ছেড়ে কোথায় যেতেই পারে না। সমুদ্র একদম ঠিক আছে৷ কিছু হয়নি ওর। ঘুমাচ্ছে ও। কিচ্ছুটি হয় আমার বাবাটার৷ এসব কিছু ভ্রম। আমার দুর্স্বপ্ন! ঘুম ছুটে গেলেই সমুদ্র দৌড়ে আমার বুকে আসবে। আমি আবারো জড়িয়ে নিব আমার বাবাইকে। 

 

চলবে। 

 

#অশ্রুমালা 

#শেষপর্ব (শেষ খন্ড) 

#Arishan_Nur (ছদ্মনাম) 

 

পিউ ঘুমাচ্ছিল। গভীর ঘুম যাকে বলে আরকি! হুট করে হুহু হীম শীতল হাওয়ায় তার ঘুম ছুটে যায়। সে তড়িৎ গতিতে উঠে বসে এবং চোখ খুলে দেখে তার মাম্মা জানালা খুলে দিয়েছে৷ এবার পিউ বুঝতে পারছে এতো ঠান্ডা লাগার কারন টা কি? সে প্রায় চেচিয়ে ইংরেজি তে বলে,মাম্মা জানাল কেন খুলেছে? বন্ধ করে দাও। ঠান্ডায় থাকা যাচ্ছে না। 

 

তার মাম্মা পেছনে ঘুরে মুচকি হেসে বলে, গুড মর্নিং বেবি। 

 

পিউ মৃদ্যু হেসে বলে, গুড মর্নিং। তারপর চোখ-মুখ কুচকে বলে উঠে, এখন বন্ধ করো জানালা।ঠান্ডায় মরে যাচ্ছি। 

 

–ওকে। ডিয়ার। 

 

বলে তার মা জানালা বন্ধ করে দেয়৷ 

 

পিউ হাই তুলতে তুলতে বলে,পাপা কোথায়? 

 

–ঘুমাচ্ছে। 

 

–ও। 

 

পিউয়ের মাম্মা পিউয়ের কাছে গিয়ে তাকে  চুমু খেয়ে বলে, ফ্রেস হও৷ আমি ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি৷ 

 

–সিউর। 

 

মাম্মা যেতেই পিউ উঠে পড়ল। তারপর বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নিল। পিউয়ের ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে আয়নায় দেখা একটা অভ্যাস। অভ্যাসগত ভাবে সে বিশাল বড় আয়নাটার সামনে গিয়ে দাড়ালো। পরনে  গেঞ্জি আর পালাজ্জো। চুল চুল কোমড় পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে৷ সম্পূর্ণ সোজা। এবং ব্রাউন কালারের রঙ করা চুলে। পিউ উচু করে চুল ছুটি বাধল। পিউয়ের গাল গুলোও ফোলা ফোলা। হাসলে কেবলমাত্র ডান গালে হালকা টোল পড়ে। খুব নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষন করলে তবেই কেউ ধরতে পারবে হাসলে পিউয়ের গালে টোল পড়ে! 

 

পিউ বেশ কিছুক্ষন ধরে নিজেকে আয়নায় দেখে নিল। তারপর ড্রয়ার থেকে নেইলপালিশ বের করে নখে লাগাতে লাগে। গাড় লাল রঙের নেইলপালিশ। লাল রংটায় পিউকে খুব মানায়। হয়তোবা সে দুধে আলতা গায়ের রঙের অধিকারী বলেই হয়ত!

 

পিউয়ের ফোন বেজে উঠল। সে ফোন রিসিভ করতেই তার ফ্রেন্ড বলে উঠে, পিউ আজকে তো হলিডে। চল হ্যাং আউট করি। 

 

পিউ খুশি হয়ে গেল এবং বলল, আমার বাসায় আয়। 

 

–নো। বাইরে হাইকিং এ যাবে। চল না প্লিজ। 

 

পিউ গোমড়া মুখে বলে,ইউ নো না পাপ্পা আমাকে বাইরে কোথাও যেতে দেয় না। 

 

–তাইলে কোনো রেস্টুরেন্টে হ্যাং আউট করি?

 

পিউ আবারক মুখ কালো করে বলে, আমার বাইরের খাবার খাওয়া মানা। বাসার খাবার ছাড়া আমি কখনো কিছু খাই না। জানিস ই তো তুই? পাপ্পা খেতে দেয় না৷ 

 

পিউয়ের ফ্রেন্ড ভেংচি কেটে বলে,তুই কিভাবে তোর বাবার ন্যাকামি টলেরেট করিস? 

 

পিউ ধমক দিয়ে বলে, রেসপেক্ট মাই পাপা। হি ইজ মাই লাইফ। এন্ড হি এস দ্যা বেস্ট ফাদার ইন দ্যা ওয়াল্ড। 

 

–ওকে ওকে কুল ডাউন। তুই তো দেখি পাক্কা ব্রাউন গার্ল এটিটিউট পেয়েছিস!  

 

–আর ইউ ডান? রাখলাম। বাই৷ 

 

–বাই। 

 

পিউ ফোন রেখে নেইলপালিশ পড়ায় মন দিল। 

 

★★★

 

আবেগ ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে পড়ে। চোখে ঘুম এখনো লেগেই আছে। কালকে খুব কড়া ঘুম হয়েছে তাই ফ্রেস লাগছে। আবেগ বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো এবং বাথরুমে গেল। ফ্রেস হয়ে এসে দেখল টেবিলে কফি দেওয়া। সে কফির মগ হাতে তুলে নিল। পাশেই একটা নিউজ পেপার পড়ে আছে। The New York times লেখা। সে পেপারে চোখ বুলালো। তারপর জানালার ধারে গিয়ে দাড়িয়ে পর্দা সরিয়ে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে সে সমুদ্রকে দেখতে পেল। তার মনটাই ভালো হয়ে গেল। সমুদ্র দূরেই আছে কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে৷ আবেগ মুচকি হেসে কফি খেতে খেতে সমুদ্র কে দেখতে লাগলো। 

 

বলা জরুরিঃ এই সমুদ্র তার ছেলে সমুদ্র নয়। বরং প্রকৃতির উপহার সমুদ্র! যেই সমুদ্র কোন দিন কাউকে রেখে চলে যায় না। সবসময়ই একই জায়গায় জোয়ার-ভাটা দিয়ে যায়। স্রোতের তালে তালে বয়েই যাওয়ার তার কাজ! সেই সমুদ্র কে দেখছে সে!!! 

 

আবগ রেডি হয়েই আছে৷ এখন হসপিটালে যাওয়ার পালা। সে রুম থেকে বের হলে একজন স্টাফ তার সামনে আসে এবং তাকে গুড মর্নিং উইশ করে। 

 

আবেগ মৃদ্য হেসে করে, গুড মর্নিং না স্মিথ। অনলি মর্নিং! 

 

–সর‍্যি স্যার। 

 

–ইটস ওকে। আজকে কয়টা ওটি আছে? 

 

–চারটা। 

 

–ওকে। ব্রেকফাস্ট করব না। ডিরেক হসপিটালে যাব৷ 

 

স্মিথ ইংরেজিতে বলে, ম্যাম, ব্রেকফাস্ট করতে বলেছেন। 

 

আবেগ এমন ভাবে স্মিথের দিকে তাকালো  যে  স্মিথ আর কিছু বলল না ভয়ে। স্মিথ ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আবেগের পিছনে হাটতে লাগলো। 

 

আবেগ বাসা ছেড়ে বের হতেই শীত অনুভব করে৷ দ্রুত একটা কালো গাড়ি এসে তার সামনে থামল। আবেগ কালো গাড়ি টা দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলে। 

 

স্মিথ গেট খুলে দেয়। সে গাড়ি তে বসে পড়ে। গাড়ি শোশো করে চলতে থাকে।  আবেগের চোখ বন্ধ ছিল। সে চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। বাইরে খুব সুন্দর  দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।  চারিদিকে স্লো ফলে ছেয়ে গেছে। সূর্যের আলো বরফ কণায় পড়ে তা মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। রোদেলার ভাষায়  যাকে বলা হয়, Shining like pearls! 

 

রাস্তা   থেকে স্নো সরানো হয়েছে৷ কিন্তু গাছে, বাড়ির ছাদে স্নো পড়েই আছে। সূর্য এর উত্তাপ নেই বললেই চলে। মৃদ্যু মিস্টি আলোটাই চারিদিকে ছেয়ে গিয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বাসার সামনে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়ে গেছে। কাল বাদে পড়শু ক্রিসমাস। স্নোনোম্যান ও বানানো হয়েছে রাস্তার ধারে। বাচ্চারা এই শীতেও স্নো নিয়ে খেলতে বের হয়েছে। বাচ্চারা ও পারে! তার সমুদ্রও তো কি পাজি ছিল! একবার তো ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দোতলার মজিদ সাহেবের জানালার কাচ ভেঙে ফেলেছিল রোদেলার কি রাগ! বাসায় নাকি ঢুকতে দিবে না ছেলে কে! 

 

আবেগ স্নো দেখতে দেখতে হাসপাতালের যাচ্ছে আর মনে মনে বলে, 

 

A day is incomplete without You!! 

As i sit on  the black Car!!  

The black Car remains me about You!!! 

I looked at You but didn’t find You!!! 

 

—Nur 

 

আবেগের চোখের কোনেও পানি চিকচিক করছে। সে চোখের পানি মুছে নিল। 

 

হাসপাতাল যেতেই ওটি শুরু করে দিল আবেগ। তার কোন দিকে তাকানোর দরকার নেই। কিংবা প্রয়োজন বোধ ও করে না। 

 

★★★ 

 

আজ আয়নার বিয়ে। সে খুব খুশি আজকে। এই দিনটার জন্য সে অনেক অপেক্ষা করেছে। অবশেষে সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেতে যাচ্ছে হালাল ভাবে। আয়না আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। গ্রামের লোকেরা বলে, বিয়ের দিন নাকি বিয়ের কনেকে চান্দের চেয়েও সুন্দর লাগে!কথাটা বুঝি সত্যি। 

 

 আয়না মুচকি হাসল৷ এই আয়নায় যেই প্রতিবিম্ব টা সে দেখছে, এই মেয়েটা কি সে নিজে? নাকি অন্য কেউ? এতো সুন্দর সে! 

 

এখন প্রশ্ন হলো আয়না কে? আয়না হলো মেঘ আর অথৈয়ের একমাত্র কন্যা। 

 

দেখতে দেখতে সময় এক বছর দুই বছর থেকে পাড়ি দিয়ে বহু বছরকে ফেলে এসেছে। দেখতে দেখতে বিশ বছর কেটে গেছে। 

 

মেঘ এসে তার মেয়ের পাশে বসল। মেয়েটাকে দেখে তার মন ভরে উঠল। ইশ! তার মেয়েটা এতো সুন্দর? কি সুন্দর তার মেয়েটার হাসি! কি মায়াবী লাগছে তার মেয়েটাকে। মনে হচ্ছে জগতের সব মায়া তার মেয়ের উপর উপচে পড়েছে আজকে। 

 

মেঘ তার মেয়েকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? মেয়ে ছাড়া যে মেঘ কিছুই বুঝে না। মেয়েটা তার কলিজার টুকরো। 

 

বিকেলে বিয়ে। এখন ফটোসেশন হবে। আয়না তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আব্বু গেলাম। 

 

মেঘ মুচকি হেসে যাওয়ার সম্মতি দিল। আয়না ভারী শাড়ি আর ঘোমটার তাল সামলিয়ে পা ফেলে চলে গেল। 

 

মেঘ হতাশার শ্বাস ফেলে। তখনি অথৈ রুমে এসে বলে, কি হলো? এভাবে বসে থাকলে চলবে,? কতো কাজ পড়ে আছে? গেস্ট আসা শুরু করে দিয়েছে। সবাই খুজছে তোমাকে। যাও সবার সাথে গিয়ে কথা বল। 

 

অথৈ প্রথমে মেঘকে খেয়াল করেনি। পরবর্তীতে যখন তার দিকে তাকালো তখন বিচলিত হয়ে গেল এবং বলল, একি! কাদছো তুমি? 

 

মেঘ মাথা নিচু করে বলে, মেয়েটাকে ছাড়া কিভাবে থাকব আমি?অফিস থেকে এসে এখন থেকে কেউ আর আমাকে জড়িয়ে ধরবে না। অথৈ, আয়না কে ছাড়া আমরা কিভাবে থাকব?

 

অথৈ মেঘের পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, শান্ত হও তো। মেয়ে মানুষ একদিন না একদিন বাবার কাছ থেকে চলে যাবেই৷ 

 

মেঘ হতাশ হয়ে বলে, এই সমাজব্যবস্থা ভাল না। চল না আমরা গারোদের সমাজব্যবস্থা ফলো করি। তাহলে আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে। 

 

অথৈ মুচকি হাসল। সে জানে মেঘ আর রাজকন্যা কে কতোটা ভালোবাসে। মেয়ে বলতে পাগল! 

 

মেঘ আর অথৈ বাইরে বের হলো। ছেলেপক্ষ থেকে গেস্ট আসা শুরু করে দিয়েছে মেঘ গিয়ে গিয়ে কথা বলছে সবার সাথে। আর আয়নার দিকে তাকাচ্ছে। আয়না স্টেজে দাড়িয়ে হাসি হাসি মুখে বিভিন্ন ধরনের পোস দিয়ে ছবি তুলছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আয়না অনেক খুশি। কি রকম সেলফিশ তার মেয়েটা? সে এদিকে কষ্টে মারা যাচ্ছে আর তার মেয়ে কিনা হেসেই চলেছে। আয়নার কি বাবাকে রেখে চলে যেতে কষ্ট হচ্ছে না? এতো শক্ত তার মেয়ে? নাকি অপরপ্রান্তের ব্যক্তির ভালোবাসার শক্তি অনেক? 

 

★★★

 

ইমতিয়াজ রহমান গেটের সাথে ঝুলানো বড় তালাটার  সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে তালা খুললেন। তালায় জং ধরে যাচ্ছে। সাতদিন পর পর এসে তিনি তালায় তেল মেখে যান। কিন্তু তাতেও লাভ হচ্ছে না। আজকেই একটা তালা কিনে এনে এই জং ধরা তালা সরাতে হবে। 

 

এই চিন্তা মাথায় আসতেই সে নিজে থেকে বলে উঠে, আজকে তো হবে না। মেঘের মেয়ের বিয়ে আজকে। মেঘ দুপুরের পর পর গাড়ি পাঠাবে। সেখানে উপস্থিত থাকার কড়া আদেশ জারি করা হয়েছে৷ ইমতিয়াজ রহমান বাসার ভেতরে ঢুকে আশেপাশে তাকালেন। সাতদিনেই ময়লা জমে গেছে। সে বুঝে পায় না ময়লা জমে কোন দিক দিয়ে?  সব জানালা তো বন্ধ করে দিয়েই যান তিনি। নাকি ভুলে জালানা খুলে চলে যান তিনি? কি জানি? বয়স বাড়ার সাথে সাথে এখন সে অনেককিছু ই ভুলে যান। ইমতিয়াজ রহমান সোফায় দিয়ে রাখা চাদরটা সরালেন। সেখানে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থেকে উঠে দাড়ালেন। তারপর নিজের রুমের দিকে হাটা ধরেন৷ এই বাসার আনাচে-কানাচেতে তার চেনা। এই বাসাটাই তো কতো সুমধুর স্মৃতির নিরব সাক্ষী আবার কতো কাল রাতের ও নিশ্চুপ দর্শক!

 

নিজের রুমে আসলেন তিনি। রুমটা ফাকা। কেবল খাটটা আছে। এই রুমের মালকিন ও আর নেই। জাবেদা খাতুন বছর দুয়েক আগেই বার্ধক্যের ভার সইতে না পেরে না ফেরার দেশে পারি জমান। ইমতিয়াজ রহমান ও আর কয়েকদিনের অতিথি। বয়স বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ দিন ই সে অসুস্থ ই থাকে। শুধু শুক্রবার করে তাদের বাসায় আসে কিছুক্ষন সময় কাটায়। তারপর জুম্মার নামাজে যান। নামাজ থেকে ফিরে মেয়ের বাসায় যান। এখন এই শেষ বয়সে মেয়ের কাছেই থাকেন। 

 

ইভানা এখন একজন ডাক্তার। দুই বাচ্চার জননী। আর ইভানার স্বামী হলো শৌখিন। শৌখিন আপাতত ব্যবসা করে। একজন উদ্যোক্তা সে। বেশ ভালোই সফল। কিছুদিন ধরে ডেলিভারি এজেন্সি খুলেছে যেটাতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে।

 

যেদিন ইভানা তার কাছে এসে বলেছিল,সে একটা ছেলেকে ভালোবাসে কিন্তু ওর ভালো চাকরি নাই। সেদিন চাইলেই ইমতিয়াজ রহমান মেয়েকে অন্য কোথায় বিয়ে দিতে পারতেন। কিংবা ডাক্তার ছেলের সাথে ইভানার বিয়ে দিতে পারতেন কিন্তু দেন নি। মেয়েটার ইচ্ছার প্রধান্য দিয়েছিলেন। আজকে তার মেয়েকে দেখলে মনে হয় সিদ্ধান্ত টা ঠিক ছিল। শৌখিন মেয়ে জামাই হিসেবে খুব ভালো। তার খুব যত্ন নেয়। আজকে ছেলেটার নিজের একটা ফ্লাট আছে। গাড়ি আছে। ছেলেটা তার বাসার সব রুমে বিশাল এলএডি টিভি লাগিয়েছে৷ এটা নাকি ওর শখ। ইমতিয়াজ রহমান এমন শখ দেখে বড়ই বিষ্মিত হন! 

 

সে হতাশ হয়ে রোদেলাদের রুমে এলেন। রুমটা নির্জীব হয়ে আছে। রুমের ফাক-ফোকরে ময়লা জমে আছে। রোদেলা ময়লা নোংরা একদম পছন্দ করত না। সবসময়ই তার রুম ঝকঝকে থাকত। ইমতিয়াজ রহমানের চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। সে দ্রুত বের হয়ে এলেন। এই রুমে আসলে তার হাসপাস লাগে। গুমটে অনুভব হিয়। হাহাকার জন্মে। পাচ মিনিটের বেশি থাকতে পারেন না এই রুম্ব। 

 

সে মসজিদে চলে গেলেন। এখন বেশিরভাগ সময় যিকির করেই কাটান তিনি। 

 

নামাজ শেষে ইভানার পুরা পরিবার সহ মেঘের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে  উপস্থিত হলো। মেঘ তাদের কে আসতে দেখেই রিসিভ করতে গেল। 

 

আয়না স্টেজ থেকে নেমে ইমতিয়াজ রহমান কে সালাম দিল। ইমতিয়াজ রহমান আয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, খুব সুখী হও মা। 

 

–দোয়া করবে দাদু। 

 

–তোদের জন্যই সবসময় দোয়া করি। তোরা ভালো থাক এটাই দিন-রাত দোয়া করি৷ 

 

আয়না স্মিত হাসল। তখনি অথৈ মোবাইল হাতে নিয়ে বলে, এই তোর নেহা আন্টি। কথা বল। 

 

আয়না মোবাইল হাতে নিয়ে নেহাকে হ্যালো বলল। 

 

নেহা ফোনের স্ক্রিনের ওপারে থেকে চেচিয়ে বলে,ও আল্লাহ! ইউ আর লুকিং লাইক এন এঞ্জেল। 

 

আয়না আবারো হাসল এবং মৃদ্যু গলায় বলে, পিউ কোথায়? 

 

নেহা মোবাইল পিউয়ের হাতে দিয়ে দিল। পিউ উৎসাহের সাথে বলে, লাল শাড়ি? 

 

আয়না মাথা নাড়িয়ে বলে, হুম। লালা শাড়ি লালা জমিন! 

 

পিউ অদ্ভুত নয়নে আয়নার দিকে তাকিয়ে নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলে, মাম্মা সি এস দ্য মোস্ট প্রিটিয়েস্ট ব্রাইড আই এভের স। 

 

–ইনডিড সি ইস। (এক গাল হেসে নেহা)

 

সাত সমুদ্র তের নদী দূরে থেকেও নেহা আর পিউ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া আয়নার বিয়েতে এটেন্ড করল। মোবাইল স্ক্রিন থেকে তারা দেখল,লাজুক বধুকে! লালা টুকটুকে বউ টা কিভাবে লজ্জা পেয়ে কবুল বলেই বাবার বুকে ঝাপ্টে পড়ে কাদা শুরু করে দিল। 

 

★★★

 

নেহা যে কিনা গল্পের প্রথমেই যাকে রোদেলা প্রতিস্থাপন করেছিল। আর আজকে গল্পের শেষ পাতায় রোদেলাকে পুনরায় প্রতিস্থাপন করল নেহা৷ 

 

আবেগ একবার নেহাকে বলেছিল,বন্ধন ভেঙেই নতুন বন্ধন গড়া হয়।  এটা যদি রসায়ন হয় তবে রসায়নে আরো একটা মজার ব্যাপার আছে। তাহলো, প্রতিস্থাপন। 

 

কোন অধিক সক্রিয় মৌল বা যৌগসমুহ অপর কোন কম সক্রিয় মৌল বা যৌগকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। যেমন, জিংকের সাথে সালফিউরিক  এসিড বিক্রিয়া করলে জিংক সালফেট আর হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে। তেমনি সেও বুঝি রোদেলাকে প্রতিস্থাপন করেছে। 

 

আয়নার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে নেহা তার রুমে গেল। আবেগ ঘুমাচ্ছে। গভীর ঘুম। মেডিসিন খেয়ে ঘুমাচ্ছে। নেহা আবেগের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। 

 

শেখ নেহা বর্তমানে আবেগের দ্বিতীয় স্ত্রী। নেহা আল্লাহর কাছে পরের জনমে আবেগকে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ এই জনমেই তার হাতে আবেগকে তুলে দিলেন। নেহাও বেশ আগলে রেখেছে। পিউকে কোন দিন সামান্য কিছুর অভাব পেতে দেয় নি। আসলে পিউ জানেই না নেহা তার নিজের মা না। পিউকে রোদেলা আর সমুদ্র সম্পর্কে কিছু জানায় নি আবেগ। নেহাও জানাতে ইচ্ছুক না। পিউকে নিজের চেয়েও ভালোবাসে নেহা। 

 

নেহার বাবা তার সম্পদ নেহার নামে করে দিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে আজকে নেহা একটা হসপিটালের মালিক। তাও আবার ওয়াশিংটনের মতো জায়গায় তার নিজের হাসপাতাল। সেই হাসপাতালেই জব করে আমেরিকার একজন নামকরা কার্ডিওলজিস্ট। নামটা অবশ্যই ইশরাক রহমান। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আবেগ নিজের কর্মক্ষেত্রে অনেক সফল হয়েছে। নেহার আগে থেকেই রেড পাসপোর্ট ছিল। নেহার জন্মই এই আমেরিকায় হয়েছে। তাই নিজ দেশে ব্যবসা দাড় করাতে তার সমস্যা হয় নি।বাবার সাথে কথা হয় নেহার। প্রাচুর্যের সাথেও কথা হয়েছিল। আবেগের সাথে বিয়ের পর পর প্রাচুর্য কল করে শুধু এতোটুকুই বলেছে, তোর ভালোবাসা ই খাটি। হারিয়ে ও ফিরে পেলি৷ সেদিন একটা প্রশান্তি বয়ে যায় নেহারর গা জুড়ে৷ 

 

প্রাচুর্য তার বিসনেস পাটনার কে বিয়ে করেছে। সুখেই আছে। 

 

এখন রাত। নেহা আবেগের দিকে তাকিয়ে আছে। সে নিজেও জানে না এই লোকটাকে সে এতোটা কেন ভালোবাসে? কারনটা আজো অজানা তার কাছে। নেহা আবেগের দিকে তাকিয়ে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ল। 

 

ভোরের দিকে আবেগের ঘুম ভেঙে যায়। সে উঠে বসতেই নেহাকে দেখতে পেল। এতে কিছুটা মন খারাপ হয় আবেগের৷ 

 

এখনো সে মাঝে মাঝে আশা করে ঘুম থেকে উঠে রোদেলার চেহারা টা দেখতে পাবে৷ আবেগ বিছানা ছেড়ে উঠে একটা ওভার কোট গায়ে জড়িয়ে ড্রয়ার খুলে একটা ডায়েরি বের করল।তারপর হাটা ধরল। 

 

এতো এতো শীতের মধ্যে ও আবগ হেটে হেটে সামনে যাচ্ছে৷ বাসা থেকে সমুদ্র টাকে।যতোটা কাছে মনে হয়। হাটা ধরলে বোঝা যায়, নাহ সি বীচ টা বেশ দূরেই আছে। 

 

আবেগ সি বীচের সামনে এসে থামল। হাপিয়ে গেছে সে। গাড়ি নিয়ে আসা দরকার ছিল৷ 

 

আবেগ অতীতের দিনে হারিয়ে গেল৷ 

 

গাজীপুরের সেমিনারে প্রচুর বিজি সে। ফোন ধরার ও সময় নাই। ফোনে চার্জ ও নাই তার।রোগীর ও তাদের স্বজনদের ভীড়ে অস্থির সবাই। একাধারে সেবা দিতে ব্যস্ত তারা। 

 

হুট করে খবর আসল একটা  বাচ্চাকে ট্রাক মেরে দিয়েছে। অবস্থা খুবই আশাঙ্গাজনক। 

ডাক্তার বলতে সে ছাড়া কেউ নেই। দুজন নার্স আছে। 

 

ঠিক সেই সময় টায় আবেগ সমুদ্রের মৃতুর সংবাদ পায়। সে বিশ্বাস ই করতে পারছিলনা। ফোনের ওপাশ থেকে ইভানা একাধারে কেদেই চলছিল। আবেগের নিশ্বাস আটকে যাচ্ছিল। কোন ক্রমেই শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না তার পক্ষে। ছুটে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু যখন সমুদ্রের বয়সী বাচ্চার বাবা তার পা ধরে অনুরোধ করল তার ছেলেকে বাচানোর জন্য। 

 

তখন আবেগ নিরুপায় হয়ে যায়। বুকে পাথর দিয়ে বাচ্চাটার চিকিৎসা করে তারা। সারাটা সময় সে কাদতে কাদতে কাজ করে। নার্স দুজন তাকে সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছিল। 

 

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে আসে। আবেগ এখনো বিশ্বাস করতে পারেনি সমুদ্র আর নেই। সে ভেবেই নিয়েছে ইভানা মজা করছে। 

 

কিন্তু বাসার সেই দমবন্ধকর পরিবেশ তার গলা চেপে ধরছিল বারেবারে। বাড়িটা আগরবাতির গন্ধে ছেয় গেছে।  চারিদিকে হাহাকার। কান্না। আর্তনাদ। মওলানারা কুরআন তেলায়ত করছেন। 

 

আবেগ হেটে হেটে সোজা রুমে যায়। গেট খুলতেই অন্ধকার রুম আবিষ্কার করে। লাইট অন করতেই বিধ্বস্ত রোদেলার চেহারা দেখে আবেগের বুক কেপে উঠে। 

 

রোদেলা সমুদ্রের একটা গেঞ্জি জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কি কি যেন বলছিল। চুল গুলো এলোমেলো। একদিনেই চোখে কালি পড়ে গেছে। 

 

রোদেলা আবেগকে দেখেই হুহু করে কেদে দেয়।আবেহ হাটু গেড়ে বসে পড়ে আর আস্তে করে বলে, আমার ছেলে কোথায়? 

 

রোদেলা আবেগের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে, কে তোমার ছেলে? তোমার কোন ছেলে আদৌও ছিল না। তোমার শুধু একটাই মেয়ে। তোমার কোন ছেলে নাই। 

 

–এসব কি বলছো রোদেলা? সমুদ্র কোথায়? আমার ছেলে কই? 

 

–খবরদার ওকে নিজের ছেলে বলবে না। ও শুধু আমার ছেলে। আর আজকে আমার বাবাইটা আমাকে রেখে অনেক দূরে চলে গেছে। আর কোন দিন ফিরবে না। 

 

–স,,,সমুদ্র কোথায়? 

 

রোদেলা রাগী চোখেই উত্তর দিল, দাফন করা শেষ। আর এখন এসেছো? যাও টাকা কামাও। আর কোন দিন সমুদ্র কে নিজের ছেলে বলে দাবী করবে না।  মানুষ ঠিকই বলে, সৎ বাবা কোনদিন নিজের বাবা হতে পারেনা৷ 

 

আবেগ চিতকার করে, রোদেলা বলে উঠে। 

 

রোদেলা দ্বিগুন জোড়ে চিল্লিয়ে।বলে, আজকে সমুদ্রের জায়গায় পিউ হলে।তুমি মৃতুর খবর পেয়ে ছুটে আসতে। 

 

আবেগ ঘাবড়ে গিয়ে বলে, ভুলেও পিউয়ের মৃত্যের কথা মুখে নিবে না৷ 

 

রোদেলা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, হ্যা৷ পিউয়ের কিছু হলে তোমার কষ্ট হবে। আর আমার ছেলেটাকে শেষ বারের জন্য ও দেখার সময় তোমার নাই। 

 

রোদেলা সমুদ্রের গেঞ্জিটা বুকে চেপে কেপে দিল। আবেগ ও কাদছে। 

 

রোদেলা চেচিয়ে বলে,খবরদার মিথ্যা কান্না করবে না। 

 

আবেগ বিষ্ফরিত চোখে রোদেলার দিকে তাকায়। আজকে রোদেলার চোখে মায়া নেই। বরং ক্ষোপ আছে৷ কি করে রোদেলা কে সে বুঝায় আরেকটা সমুদ্র কে সে হারাত্ব চায় নি। য়ার যেই কষ্ট না হচ্ছে সেটা অন্য আরেকজন কে দিতে চায় নি৷ কিভাবে একটা মাকে সে এটা বুঝাবে। আদৌ বোঝানো সম্ভব না! 

 

আবেগ আসার আগেই রোদেলার নির্দেশে সমুদ্র কে কবর দেওয়া হয়। এর পরের দিন গুলো আরো ভয়ংকর ছিল। রোদেলা আবেগকে দেখতে পারত না। দেখলেই চিৎকার-চেচামেচি করত।জিনিস ভেঙে চুরমার করত। দিনের বেশিরভাগ সময় সমুদ্রের খেলনাগুলোর সাথে কথা বলে একা একা হাসত-কাদত। এসব দেখে রোদেলা কে সাইক্রিয়েটিস্ট দেখানো হয়৷ 

 

ডাক্তারের আদেশে রোদেলাকে গ্রামে পাঠানো হয়। ডাক্তার বললেন, রোদেলা অনেক বড় একটা শক পেয়েছে৷ কিছু দিন অন্যখানে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। 

 

আবেগ গ্রাম থেকে ফেরার সময় রোদেলাকে রিকশায় বলেছিল, নেক্সট বার আরো সময় হাতে নিয়ে আসবে। কথাটা কিভাবে যেন সত্য হলো রোদেলার ক্ষেত্র। প্রায় চারমাস গ্রামে ছিল  রোদেলা। কোন উন্নতি তো হয় নি। বরং দিন দিন অবনতি হতে থাকে রোদেলার। ডাক্তারের দেওয়া ঔষধেও কাজ হয় নি। উপায় না পেয়ে সমুদ্র মারা যাওয়ার চার মাস পর আবারো ঢাকা আনা হয়। রোদেলা আবেগকে দেখতে পারত না। তাই আবেগ মেঘের সাথে থাকা শুরু করে। 

 

এমন না যে আবেগের কষ্ট হয় না। কিভাবে যে সেইদিন গুলো আবেগ পার করেছে তা কেবল আবেগই জানে। পিউকেও কোল নিত না রোদেলা। শেষের দিকে পিউকে চিনতে পারেনি রোদেলা। 

 

শেষের দিকে কেন বলা হলো? কারন,,,,,,

 

 ঢাকা আসার এক মাসের মাথায় রোদেলা হার্ট এটাক করে। 

 

হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাক্তার চিকিৎসা ও করে। আবেগের হাসপাতালেই এডমিট হয় রোদেলা। জ্ঞান ও ফিরে রোদেলার। 

 

আবেগ অনেক সাহস জুটিয়ে রোদেলার কাছে যায়। ভেবেছিল রোদেলা তাকে দেখে রিয়্যাক্ট করবে। কিন্তু নাহ, হসপিটাল বেডে শুয়ে থাকা নিস্তেজ রোদেলা আবেগকে দেখে তার পাশে বসতে বলে। 

 

আবেগ রোদেলার পাশে ধপ করে বসে পড়ে। সেদিন প্রায় পাচ মাস পর রোদেলা  স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছিল। 

 

রোদেলা আবেগের হাত ধরে বলে, তোমাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না? মাফ করে দিও।

 

আবেগ নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে হাউমাউ করে কেদে দেয়। 

 

রোদেলা তার আরো শক্ত হাত চেপে ধরে বলে, আমি চলে গেলে তুমি পিউয়ের জন্য একটা সুন্দর দেখে মা খুজে এনো।

 

–চুপ কর রোদেলা। তোমার কিছু ই হবে না। 

 

–ওয়াদা কর আনবে একটা সুন্দরী বউ নিজের জন্য। 

 

আবেগ কান্না করতে থাকে৷ 

 

রোদেলা একপ্রকার জোর করে আবেগকে দ্বারা ওয়াদা করায়। কিন্তু আবেগ ও কম না সে বলেছিল পিউয়ের জন্য মা আনবে। 

 

একটু পর রোদেলা আবেগকে জিজ্ঞেস করে, একটা ধাধা ধরি? 

 

–কি? 

 

–আমি এমন একজন যে কিনা মানুষের মধ্যে ও থাকি আবার প্রকৃতির মধ্যে ও থাকি বল তো আমি কে? 

 

–পারি না। (কান্না করতে করতে) 

 

–আচ্ছা আরেকটা ক্লু দিই।মানুষের কাছে যখন থাকি তখন খুব মূল্যবান আর প্রকৃতির কাছে তেমন একটা দামী না। এবার বল তো আমি কে? 

 

–পারব না। 

 

রোদেলা হতাশ হয়ে বলে, আচ্ছা বল তো! Since there is no help, come let us kiss and part এর মানে কি? 

 

–জানি না৷ 

 

রোদেলা মুচকি হেসে বলে, আমিও জানি না। হুমায়ুন স্যার কেন লিখে দেন নি এর মানে কি? তবে জানো আমার কাছে মনে হয়, Since there is no help,come let us kiss and part এর মানে মৃত্যু। বিচ্ছেদ। শোন? তোমার নতুন বউকেও জিজ্ঞেস করবে এই লাইনের মানে কি? আমার কেন যেন মনে হয় সে পারবে না। 

 

–আচ্ছা। ঘুমানোর চেষ্টা কর তো। 

 

–আমাকে ক্ষমা কিরে দিও। তুমি সমুদ্র কে খুব ভালোবাস তাই না? 

 

–চুপ করে রেস্ট নাও। 

 

–আচ্ছা। আমার খারাপ লাগছে। 

 

এর পর? এরপর আর কোন দিন রোদেলা চোখ খোলে নি। আবেগের সাথে কথা বলার চারঘন্টা পর রোদেলা মার যায়। 

 

আবেগ কেন যেন খুব ইজিলি রোদেলার মৃত্যুটা মেনে নেয়। রোদেলা যেদিন মারা গেল সেদিন আবেগ রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে  থাকে। 

 

ময়নার মা এসে চা দিয়ে যায়। সেই চাও সে খেয়েছিল। কি জঘন্য স্বাদ!! 

 

জাবেদা খাতুন  কাদছিল তখনো। সেই কান্নার আওয়াজ আবেগের বিরক্ত লাগে! 

 

এরপর পিউয়ের যখন এক বছর আবেগ ওয়াশিংটনে স্কলারশিপ পায়৷ এক মূহুর্ত দেরি না করে মেয়েকে নিয়ে চলে যায়৷ 

 

রোদেলা কে সমুদ্রের কবরের সাথেই কবর দেওয়া হয়। 

 

ওয়াশিংটন এসে বেকায়দায় পড়ে যায় আবেগ। ছোট্ট বাচ্চা সামলিয়ে মেডিকেল যাওয়া-আসা খুব ভোগান্তি তে পড়ে আবেগ। এদিকে নিজেও অসুস্থ থাকত। সারারাত কাদত সে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটাও দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক মতো খেত না। আগে মা আর ইভানা খেয়াল রাখলেও, ওয়াশিংটন যাওয়ার পর  সে একা ঠিক ভাবে পিউয়ের যত্ন নিতে পারত না। 

 

কি অসহনীয় দিন ছিল! হাহাকার ছাড়া কিছুই না! 

 

হুট করে হসপিটালে একদিন নেহার সাথে দেখা। নেহা তাকে দেখেই থমকে যায়। আবেগ পালিয়ে বাচতে চেয়েছিল নেহার কাছ থেকে কিন্তু পারেনি । নেহার জেদের সাথে পারেনি। তার মেয়েটাও নেহার কাছে খুব খুশি থাকত। রোদেলা কে দেওয়া ওয়াদার কথা ভেবে নেহাকে বিয়ে করে নেয় সে। 

 

আবেগ বুঝে পায় না নেহাই যদি তার ভাগ্যে ছিল তাহলে রোদেলা কেন এলো তার জীবনে? মায়া বাড়াতে? 

 

আবেগ সমুদ্রের ধারে হাটছে। হাতে ডায়েরি টা শক্ত করে ধরা। তাদের বিয়ের পচিশ বছর আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে। সে প্রতিদিন একবার করে রোদেলার লিখে যাওয়া চিঠিটা পড়ে৷ 

এটাকে।চিঠি বলা যায়। 

ডায়েরি তে লিখা থাকলেও লেখার স্টাইল চিঠির মত।

 

সেখানে গুটি গুটি সুন্দর অক্ষরে লেখা, 

 

প্রিয় ডা.ইমোশন, 

 

কেমন আছো? নিশ্চয়ই ভালো কিংনা ভালো না। এইকথা টা এইজন্য বললাম কারন আমি জানি এই লেখাগুলো তুমি বহুবার পড়বে৷ অনেকবার যখন পড়বে,তাই প্রতিদিন তো আর মন ভালো থাকবেনা।এইজন্য বললাম কোন দিন ভালো থাকবে আর কোন দিন দুঃখী।  জানো আবেগ, আমার কেন যেন মনে হয়, আমার কপালে সুখ জুটবে না। আমি এত সুখের ভাগীদার হতে পারব না। আমি সমুদ্রের বিয়ে দেখে যেতে পারব না। যদি সমুদ্রের বিয়ে হয় না! তাহলে ধুমধাম করে দিও। ওর পছন্দের মেয়ের সাথে। ও যেন হলুদে নীল পাঞ্জাবি পড়ে। 

 

পুশ্চৎঃ আমি যদি কোন দিন হারিয়ে যাই আমাকে খুজবে না। কেবল দুই ফোটা অশ্রু বির্সজন দিও।  জানো ডাক্তার সাহেব? কারো হাসি হওয়ার চেয়ে কান্না হওয়া বেশি সৌভাগ্যের! 

 

ইতি অশ্রুমালা।     

 

আবেগের লেখাটা মুখস্ত। সে চিঠিটা পড়ল। তারপর চোখের পানি মুছে আস্তে করে বলে, 

 

তোমার জন্য দুফোটা অশ্রু জল বরাদ্দ হই, অশ্রুমালা! 

 

সে হেটে হেটে বাসায় ফিরছে। ফোনে সো করছে আজকে নেহার জন্মদিন। ক্রিসমাস ইভেতে নেহার বার্থডে। চারপাশে ঝিকঝিক আলো ক্রিসমাস বলে।খ্রিস্টান দের মতে, এই বড়দিনে সান্টারক্লোস আসে৷ 

 

বাস্তবে সবার জীবনেই একটা করে সান্টারক্লোস আছে। আফসোস তার টা সে হারিয়ে ফেলেছে না সে হারিয়ে ফেলেনি। হারিয়ে গেছে৷ 

 

সমুদ্রের মৃত্যুটা ছিল দুর্ঘটনা। সে রাস্তার ধারের কেনা গোলা আইসক্রিম খেয়েছিল। আইসক্রিমে বিষাক্ত পর্দাথ ছিল। পরবর্তীতে তদন্ত করে জানা যায়, আইসক্রিমের বরফ একটা রাসায়নিক ফ্যাক্টরির কাছের পানির কল থেকে বানানো হয়েছে।কোন ভাবে রাসায়নিক ফ্যাক্টরির বিষাক্ত পর্দাথ কোন ভাবে সেই পানির সাথে মিশে গিয়েছিল। সেই পানি দিয়ে বরফ বানানো হয় আর সেই বরফ দিয়ে বানানো গোলা আইসক্রিম সমুদ্র খেয়েছিল। সেদিন সমুদ্র সহ আরো ছয়টা বাচ্চা মারা যায়। সবকিছুই প্রকৃতির ইচ্ছা অনুসারে হয়েছে। কারো হাত নাই এতে। 

 

ভোর হয়ে গেছে। বাসায় ঢুকতে ই নেহার চিন্তিত মুখটা দেখল আবেগ।। মেয়েটা নির্স্বার্থ ভাবে তার জন্য সব ত্যাগ করেছে। 

 

আবেগ নেহার কাছে গিয়ে বলে, শুভ জন্মদিন নেহা। 

 

নেহা হা হয়ে যায়। খুব ক মদিন আবেগ নিজ থেকে তার সাথে কথা বলেছে। আজকে কি সূর্য উত্তর দিকে উঠেছে? 

 

আবেগ ফিসফিস করে বলে, বল তো! Since there is no help, come let us kiss and part এর মানে কি? 

 

নেহা কিছুটা ভেবে জবাব দেয়, যদি সব দিক থেকেই তুমি অসহায় হয়ে পড়ো তাহলে কোন কিছু না ভেবে একবার আমাকে জড়িয়ে ধরো সব ঠিক হয়ে যাবে। 

 

একই লাইন কিন্তু এর অর্থ দুইজনের কাছে পুরোই ভিন্ন। এই জায়গায় ই একজন কবির সাফল্য। যখন তার কবিতা পড়ে একেক জন একেক মতামত দিবে। 

 

নেহা আবেগের হাত ধরে বলে, আবেগ আই লাভ ইউ! 

 

এই কথা প্রতিদিন ই নেহা তাকে বলে কিন্তু আজকে কি যেন হলো আবেগের? সে নেহাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাদতে লাগলো। কিসের কান্না এটা? 

 

পিউ সিড়ি থেকে তার বাবা-মা কে এভাবে দেখে  খুব খুশি হয়। সে দৌড়ে এসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে।

 

পিউ মনে মনে বলে, আই এম সো হ্যাপি টুডে! 

 

Why life is so peaceful??? 

 

★★৬

Once a wise man said, What is life? 

A mathmathesian replied life is like logarithm! 

 

 লগারিদমে একটা সুত্র আছে যখন ভিত্তি আর ঘাত মিলে যাবে অংক শেষ। মান উত্তর ১ আসবে। তেমনি যখনি দুটো মনের মিলন ঘটবে অংক শেষ। মান ১আসবে। 

 

ওয়াইজ ম্যান গনিতবীদকে বলল, মেনে  নিলাম এই ব্যখাটা! দুটি মনের মিলন মানে যদি অংকের ভাষায় লগের ঘাত আর ভিত্তি সেইম হয় তাহলে অবশ্যই অংক শেষ! তাহলে  সুখ জিনিস ট কখন আসবে? 

 

গনিতবীদ হেসে উত্তর দিল, ওই যে লগারিদমের ভিত্তি আর ঘাতকে এক বানানোর জন্য যে কয়েকটা লাইন লিখতে হয় সেটাই সুখ আর শেষ লাইনে যখন দুটোই মিলে যাবে অংক শেষ। গল্প ও শেষ। 

 

The End. 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।