বসন্ত বিষুব

নাসিমা আখতার লেকচারার (অর্থনীতি)

মুহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুল অ্যাণ্ড কলেজ

মার্চের ২১ তারিখ, দক্ষিণের বারান্দায় চেয়ারে বসে, লাঠিটা দু’হাতে ধরে থুতনিতে বাধিয়ে, বৃদ্ধা দূরে দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ ধানখেতের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন । আসরের নামাজ পড়ার পর তিনি এখানে বসে একটু দোয়া-দরূদ পড়েন। এ সময় তাঁর কাছে তেমন কেউ আসে না। পরিচারিকা মেয়েটি সব কাজ সেরে দুপুর নাগাদ চলে যায়, আবার সন্ধ্যার আগে-আগে এসে রাতের খাবারটা গুছিয়ে টেবিলে দিয়ে যায় । বৃদ্ধা এখানে একাই থাকেন, শখ করেই থাকেন । পাঁচটি ছেলে-মেয়ে তাঁর, চাকরির সুবাদে সবাই বিভিন্ন জায়গায় থাকে। শীতের ছুটিতে তারা দল বেঁধে দু’চার দিনের জন্য আসে-হই-চই করে চলে যায়-তারপর সারা বছর বাড়িটা খাঁ-খাঁ পড়ে থাকে । তাই তিনি একরকম জোর করেই এবার শীতের শেষ দিকে এই গ্রামের বাড়িতে এসেছেন । বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত থাকবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নানা টুকটাক কাজকর্ম তদারক করা, অন্য শরীকের বউ-ঝিদের আনাগোনাতে দিনগুলো বেশ ভালভাবেই কেটে যায়, তবে বিকেল থেকেই সুনসান নীরবতা আর একাকীত্ব তাঁকে মুষড়ে ফেলে। এই যে মাঠের দিক থেকে হু-হু করে মিষ্টি বাতাস চারদিক উথাল-পাথাল করে, এলোমেলো পাতা উড়িয়ে ছুটে আসছে-বসন্তের এই বাতাসে, পাতার মর্মর ধ্বনিতে ব্যাকুল কোকিলগুলোর কুহু-কুহু ডাকের মধ্যে কী যেন একটা হারাই-হারাই, পালাই পালাই ভাব মনের মধ্যে হাহাকার জাগিয়ে তোলে ।

শক্তপোক্ত বৃদ্ধা-মনের মধ্যেও কী যেন ঝড় ওঠে, সে ঝড় বাইরের কাউকে দেখানো যায় না, বলাও যায় না। এ সময়টাতেই তিনি ছেলেমেয়ে- নাতিপুতিদের অভাবটা তীব্রভাবে অনুভব করেন। আহা! সামনের উঠনটুকুতে যদি দুষ্টু নাতিগুলো হুটোপুটি করত, বউ বা মেয়েরা কেউ যদি এক কাপ চা নিয়ে পাশে এসে বসত! একটা বড় শ্বাস ফেলে পশ্চিমের বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা একটু শিহরিত হয়ে ওঠেন। গাছগুলোয় কী সুন্দর নতুন পাতা ছেড়েছে-লিচু আর গাবগাছের নতুন পাতায় কেমন কমলাটে-গোলাপী রঙ ধরেছে! এমন রঙ কি বাস্তবের কোন শিল্পী তার তুলিতে ফুটিয়ে তুলতে পারে? বৃদ্ধা নিজের মনেই মাথা নাড়েন-নাহ, এ অসম্ভব। গ্রাম নিয়ে আঁকা অনেক চিত্রকর্ম তিনি দেখেছেন, বর্ষা, শীত বা বসন্তের কোন চিত্রে নতুন পাতার এমন পেলব কোমল গোলাপী রঙের সমারোহ, পিছনে বাঁশঝাড়ের সবুজ চিরল চিরল পাতার ফাঁকে ধানখেতের অবারিত সবুজের ক্যানভাস-এ কোন শিল্পীই মনে হয় আঁকেনি।

দখিনা সমীরণের দোলায় গাছের পাতাগুলোর তা-থৈ, তা-থৈ নাচন দেখে একটু নড়েচড়ে বসেন তিনি। হঠাৎ তাঁর মনের মধ্যে একটা কষ্টের ঢেউ খেলে যায়। তাঁর মেঝ মেয়েটি খুব প্রকৃতিপ্রেমিক। সময় আর সুযোগ পেলেই সে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। অথচ এই গ্রামের বাড়িতে প্রকৃতির এমন অপরূপ শোভা, একসাথে নদী-পুকুর, ফসলের খেত, গাছ-গাছালিতে ঘেরা এই বসতবাড়ির স্নিগ্ধ শ্যামল কোমল কোলটিতে এসে বসার জন্য দু’দণ্ড সময় করতে পারে না! মনের মধ্যে অভিমানের সঙ্গে একটু বুঝি ক্ষোভও তৈরি হয় তাঁর। হঠাৎ সামান্য চমকে ওঠেন তিনি, দূরে-কাছে কোকিলের ক্রমাগত হঠাৎ কুহু-কুহু তানের মধ্যে পাড়ার কোন ছোট ছেলের কণ্ঠের ‘মা-মা’ ডাক ভেসে আসে কানে। ছোট ছেলেমেয়েদের এমন ডাকে মাঝে-মাঝেই তিনি চমকে ওঠেন, ভাবেন কেউ ডাকে নাকি তাঁকে! আবার নিজেই নিজের মনকে প্রবোধ দেন- নাহ, এ সময় কে তাঁকে ‘মা-মা’ করে ডাকবে!

ছেলে-মেয়েই তাঁর পাঁচ শহরে ভাল পদে চাকরি করে। ব্যস্ত তারা তাদের ছেলে-মেয়ে-সংসার নিয়ে। না, তাদের কারও প্রতি তাঁর কোন অভিযোগ নেই। এ-ই তো তিনি চেয়েছিলেন সারা জনম ধরে। জন্ম থেকে কিশোরী বয়স পর্যন্ত আধুনিক কলকাতা শহরে বড় হওয়া তিনি এই গ্রামে বিয়ে হওয়া, শ্বশুরবাড়ির গ্রাম্য পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া, খাপ খাইয়ে চলার যে কষ্ট সহ্য করেছেন, নিজের মেয়েদের জীবনে সে কষ্ট যেন না আসে সে জন্য তিনি

ধনুকভাঙা পণ করে সবাইকেই এম. এ. পর্যন্ত পড়িয়েছেন । সময়মত সবাইকে দেখে-শুনে বিয়ে দিয়েছেন, তারা নিজ যোগ্যতাতেই ভাল চাকরি করে, সংসারও বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। এ-ই তো তিনি চেয়েছিলেন। তবে কেন আজ আর এই পড়ন্ত বয়সে, কুঁচকে যাওয়া শরীরের ভিতরের শক্তপোক্ত মন থেকে কী যেন একটা হাহাকারের ঢেউ এসে গল্লা বুজিয়ে দেয়-বুকটা মুচড়ে ওঠে। কার জন্য? সন্তানদের কাছে পেলে মন ভরে ওঠে, সময় হু-হু করে কেটে যায়। কিন্তু অন্তরের
নিঃসীম শূন্যতা তো কাটে না, তা যেন এই অলস মন্থর বিকেলের বাতাসের সঙ্গে তীব্রতর হয়ে তাঁকে আরও উন্মনা করে তোলে । জানেন, তিনি জানেন, তাঁর এই বুক ভাঙা হাহাকার তাঁর সেই মুগ্ধ প্রেমময় স্বামীর জন্য, যাঁর কথা তিনি প্রাণপণে ভুলে থাকতে চান। তীব্র অভিমান আর কষ্টে তিনি তাঁর কথা ভুলে থাকতে চান। একটি শেষ কথা বলার সুযোগ না দিয়ে যে মানুষটি মাত্র বেয়াল্লিশ বছরের পূর্ণ যুবতী স্ত্রীকে একা ফেলে পরপারে পালিয়ে যান, তাঁর প্রতি অভিমান ছাড়া মনের মধ্যে আর কী-ই বা থাকতে পারে? আজ এই আশি বছর বয়সের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ন্যুব্জ দেহ-মনের মধ্যে আর কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, শুধু মনে হয়, এই বারান্দায় বসে যদি সেই প্রিয়তম স্বামীর হাতে হাত রেখে জীবনের পেরিয়ে যাওয়া দিনগুলোর গল্প করতে পারতেন! ছেলে-মেয়ে, নাতিপুতি কে কেমন হলো, ঘর-সংসারের নানা গল্প দু’জন মিলে করতে পারতেন, দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতে পারতেন, তা হলেই এই শেষ বয়সটা কত সুন্দর হতে পারত! ভাবেন আর চোখের কোল বেয়ে অশ্রু আপন মনে গড়িয়ে পড়ে । আবার তিনি ‘মা-মা’ ডাকে চমকে ওঠেন। মনে হয় পরিচারিকার ছেলেটি তার মাকে খুঁজতে বারান্দার কাছে এসে পড়েছে। তিনি যেমন চুপচাপ বসে ছিলেন তেমনি বসে থাকেন । চোখের জলটুকু মোছার চেষ্টাও করেন না । নাহ, ‘মা-মা’ ডাকটি যেন আরও কাছে-কণ্ঠ কেমন যেন ছোট ছেলের নয়-একদম হুড়মুড় করে বারান্দায় উঠে পড়ে সামনে এসে দাঁড়ায় তাঁর মেঝ মেয়ে-তাঁর গাছপাগল মেয়ে, যার কথা একটু আগেই তিনি ভাবছিলেন। বৃদ্ধা কাঁপতে থাকেন-যেন জড়িয়ে ধরার শক্তিটুকুও নেই তাঁর বাহুতে-হাত থেকে লাঠিটি পড়ে যায়, মেয়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়—ডেকে ওঠে আবার, ‘মা-মা!’

প্রতিদিনের মা ডাক শোনার মনের ভুল আজ এই বসন্ত বিষুবের বিকেলে এমন করে বাস্তব হয়ে ধরা দিল-আহ! আজকের বিকেলটা কী মনোরম! তিনি কোন কথা বলেন না- শুধু অনুভব করেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।