দুইবোন

 

১ম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

*******************

গানের শব্দ শুনেই জাহরা বুঝতে পারল নোভা উঠে পড়েছে।সকালে ঘুম ভাঙার পরই মিউজিক ছেড়ে আধাঘন্টা ব্যয়াম করে ও।

চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে নোভার দরজায় টোকা দিল-“নোভা,দরজাটা খোল্ তো”!

মিনিট দুয়েক পড়ে দরজাটা খুলে গেলে দেখা গেল ঢোলা একটা গেজ্ঞী আর টাইলস পরিহিতা নোভা উপুড় হয়ে দুই হাত দিয়ে দুই পায়ের টো ছোঁবার চেষ্টা করছে।

জাহরা মাথা নাড়ল ছোট বোনের অবুঝপনা দেখে।এগিয়ে গিয়ে খট করে মিউজিক সিস্টেম অফ করে দিতেই নোভা মুখ তুলে তাকাল-“কি হলো,বন্ধ করলি ক্যান?”

জাহরা ঘড়ি দেখিয়ে বলল-“ক’টা বাজে দেখেছিস?আধাঘন্টার উপরে হয়ে গেল তুই ব্যয়ামই করছিস।গোসল করে তৈরী হয়ে নে,তোর না কোথায় যাবার কথা?”

নোভা জোড়া পায়ে দুই তিনবার হালকা জাম্প করে থামল-“স্যরি,ডিয়ারি আপু,যথাসময়ে কথাটা মনে করিয়ে দেবার জন্য তোকে অসংখ্য থ্যাংকু।”

-“হমম…বুঝলাম।কিন্তু এই ব্যয়াম ট্যায়াম না করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে সেটা আরো ভালো ব্যয়াম হতো’এই কথাটা কতবার মনে করিয়ে দিয়েছি বল্ তো?”

-“উফ্,…সকাল সকাল শুরু হয়ে যাসনা তো!নাস্তা কি?”

-“কি আবার?আব্বু আর আমি তো মজা করে পরোটা মাংসের ঝোল খেলাম।তুই তো আর সেটা খাবিনা কারন তোর ফিগার নষ্ট হবে।তাই তোর জন্য এক বাটি ওটস,ছোট্ট একটা আপেল আর এককাপ হালকা লিকারের র’ টি!”

-“হমম,থ্যাংকস।তোর মত গড গিফটেড ফিগার আর গায়ের রং নিয়ে তো জন্মাইনি তাই এই বাড়তি সচেতনতাটুকু না করলে পাবলিক পাত্তাও দিবেনা।তোর তো আর সেই ভয় নেই।কোথাও গেলে লাগাস এক বোরকা…ব্যস!সারা দুনিয়া অন্ধকার।কি করে যে পারিস বাবাহ্!”বলে টাওয়েলটা নিয়ে বাথরুমে ঢোকার আগে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল-“আব্বু কই? বেরিয়ে গেছে?”

-“হ্যাঁ,তুই গোসল সেরে তাড়াতাড়ি আয় নাস্তা দিচ্ছি।”বলে জাহরা কিচেনে চলে গেল আর নোভা বাথরুমে ঢুকল।

.

এই অবসরে ওদের দুবোন সম্পর্কে একটু বলে নেই।নোভা আর জাহরা দুবোন একই মায়ের গর্ভের কিংবা একই বাবার ঔরসজাত নয়।জাহরার বয়স যখন দুই বছর তখন জাহরার আম্মু  মারা যান।ছোট্ট জাহরাকে দেখেশুনে রাখার জন্য জাহরার দাদু জাহরার বাবা আশফাক হোসেনকে দেখেশুনে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দেন।আশফাকের দ্বিতীয় স্ত্রী ‘মায়া’ ছিলেন বিধবা ও এক কন্যা সন্তানের জননী।দেড় বছরের নোভাকে কোলে নিয়ে আশফাকের সাথে তাঁর বিয়ে হয়।জাহরা নতুন মা আর ছোট একটা পুতুলের মত বোন পেয়ে সাংঘাতিক খুশি হয়।মায়াও নোভার মত করেই জাহরাকে ভালবাসতে চেষ্টা করেন তার যত্ন নেন। জাহরার কখনো মায়াকে সৎ মা বলে মনে হয়নি।সুখেই কাটছিলো ওদের দিনগুলো।কিন্তু মাত্র দুবছর আগেই মায়া হ্রদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে যান।যাবার দিন উনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।ওনাকে ক্লিনিকে নেয়া হলে একফাঁকে উনি জাহরার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন-“মা গো,আমার যদি কিছু হয়ে যায় নোভাকে তুই দেখে রাখিস।ও বড় অবুঝ আর চঞ্চলমতি।তোর হাতে তোর ছোট বোনটাকে তুলে দিলাম মা।ওকে কখনো কষ্ট দিসনা!”জাহরাও কান্না চেপে মায়াকে আশ্বস্ত করে-“তুমি ভেবোনা মা,নোভা আমার ছোট বোন,ওকে আমি দেখে রাখবো ইনশাআল্লাহ।তুমি শুধু সুস্থ হয়ে বাড়ী এসো।”কিন্তু মায়া আর ফেরেননি।সেদিনের পর থেকে নোভাকে জাহরা এবং আব্বু দুজনই কঠিন কন্ঠে কোন কথা বলেন না।ওর আব্দার যথাসম্ভব মেনে নেন।

নোভা ছেলেবেলা থেকেই নাচ গানের প্রতি অনুরক্ত ছিল।স্কুলেও কয়েকবার গান তেয়ে পুরস্কার কুড়িয়েছে।মাষ্টার্স পাশ করে সে আজ গানকেই পেশা হিসাবে নিয়েছে।বাজারে ওর গানের ক্যাসেটও বের হয়েছে এবং সেগুলো খুব হিটও করেছে।নোভা এখন গানের সুবাদে দেশের বাইরেও যায় বিভিন্ন দলের সাথে।অবশ্য নোভার এই পেশা জাহরার একদম পছন্দ না।ওকে এই পেশাতে যেতে জাহরা বারবর নিষেধ করেছিল।কিন্তু কে শোনে কার কথা?উচ্চাকাঙ্খা নোভাকে ঘিরে ধরেছে।যখন যেখানে গানের ডাক আসে সে সেখানেই ছুট দেয়।একবার তো না বলেই এক প্রোগ্রাম থেকেই সোজা সিলেট চলে গিয়েছিল।জাহরা যখন চিন্তায় অস্থির হয়ে পাগলের মত এদিক সেদিক ফোন করছে তখনি নোভার ফোনটা এল-“স্যরি,জাহরা।তোকে বলে যাবার একদম সময় পাইনি।সিলেটের গ্র্যান্ড সুলতানে বড় বড় স্টার সিঙ্গারদের সাথে গান গাওয়ার সুযোগ সহজে পাওয়া যায়না।তাই অফারটা পেয়েই আর দেরী করিনি।প্লিজ,আব্বুকে সামলে নিস।কবে ফিরবো তোকে জানাবো,বাই!”কট করে লাইন কেটে দিল নোভা।বয়সে ওরা ছ’মাসের ছোটবড় হলেও নোভা ওকে নাম ধরেই ডাকে।

নোভা সকালের নাস্তা শেষ করতে না করতেই গাড়ড়ীর হর্ণ বাজল।নোভা দ্রুত জানালার সামনে গিয়ে দেখল তারপর দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকানোর আগে জাহরাকে উদ্দেশ্য করে বলল-“এই,জাহরা…এক্ষুণি সউদ আসবে।ওকে দুমিনিট বসতে বলো আমি পাঁচ মিনিটে রেডী হয়ে আসছি,প্লিজ ডিয়ারী আপু!ম্যানেজ হিম…!”বলে ধুম করে দরোজা লাগিয়ে দিলো।জাহরা পেছন থেকে ওকে ডাকল-“এ্যাই,তোর এসব সউদ ফউদের সামনে আমি যেততে পাবোনা,তুই সবসময় আমাকে ঝামেলায় ফেলিস!”

-“প্লিইইইজ,আপি,প্লিজ,এক্ষুনি হয়ে যাবে আমার”!বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বলল নোভা।

জাহরা আরো কিছু বলতে যাবে তখনি বেল বাজল।

ওড়নাটা খুলে খুব ভালোভাবে মাথা ঢেকে দরোজা খুলে সালাম দিল জাহরা। আগত ভদ্রলোক সালামের উত্তর দিয়ে বলল-

-“এটা কি নোভাদের বাসা?”

-“জ্বী,আপনি কিছুক্ষণ বসুন,ও তৈরী হচ্ছে।”

সউদ ঘড়ি দেখে অগত্যা ড্রইং রুমে বসল।জাহরা ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে নিলে পেছন থেকে সউদ বলল-“আপনিই সম্ভবত জাহরা,তাই না?”

জাহরা মাথা নাড়ল,ছোট্ট করে জবাব দিল-“জ্বী,”!

-“নোভা তো তাহলে খুব কমই বলেছে দেখছি’।

-“মানে?”

-“জ্বী না কিছুনা।”নিজেকে দ্রুত সামলে নিল সউদ।

-“আপনি বসুন প্লিজ।”বলে জাহরা বেরিয়ে গেল।

.

কিছুক্ষণের মধ্যেই নোভা সেজেগুজে দরোজা খুলল।জাহরা বেশ অবাক হলো-“বাব্বাহ,এতো সেজেছিস?”

-“উফ,তুই বুঝবিনা রে।ড্রইং রুমে যেটা বসে আছে… সেটার উপর আমি ফুললি ক্রাশড।যেমন হ্যান্ডসাম তেমনি রিচ।ওকে বগলদাবা করার চেষ্টায় আছি,বুঝলি….!”বলে জাহরার গালটা চিমটি কাটর নোভা।-“তখন আমারে পায় কে…আজ লন্ডন কাল আমেরিকা”!

-“হয়েছে,বুঝেছি,যা তাড়াতাড়ি,ভদ্রলোক বসে আছেন।

-“বাই…!”জাহরার দিকে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল নোভা।

…..

চলবে…….!

 

দুইবোন

২য় পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

********************

 

গাড়ী চালাতে চালাতে দুবার নোভার দিকে তাকাল সউদ।মনে মনে ভাবল-‘”মেয়েটা আজ এতো সেজেছে কেন?আমাকে ইমপ্রেস করতে চায় নাকি?”

.

এদিকে নোভা মনে মনে পুলকিত বোধ করছে,সউদ-বিন-মাসুদের সঙ্গে এক গাড়ীতে চড়ার সৌভাগ্য সব মেয়ের হয়না।তার হয়েছে কারন সে সউদের পছন্দের গায়িকা।

এক ককটেল পার্টিতে সউদ নিজে থেকেই যেচে ওর সাথে পরিচিত হয়।নোভা বুদ্ধিমতী মেয়ে সে বুঝে নিয়েছে সউদকে নিজের করে পেতে গেলে ওকে সউদের সাথে বন্ধুত্ব বাড়াতে হবে।সউদের পছন্দ অপছন্দের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে আর সউদের মনের মত করে গাইতে হবে।সেদিন থেকেই সউদের সমস্ত প্রোগামে নোভা সব কাজ ফেলে হাজির থাকে।

আচমকা সউদের কথায় ওর ধ্যানভঙ্গ হলো।

-“তোমার বড় আপু নাকি ওটা?”

-“কোনটা?ওহ্…বাসায়?আরে জারাহ আমার ছ’ মাসের বড়।ওকে আমি আপু ডাকিনা নাম ধরেই ডাকি।অবশ্য ওর মধ্যে বড়বোন মার্কা স্বভাবটা প্রবল।সারাক্ষণ আমাকে আগলে রাখতে চায়”!

-“ভালোইতো।এমন বোন পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়।

-“হমম…আচ্ছা।আপনার গেট টুগেদার পার্টিটা কোথায় রেখেছেন?”

-“আমাদের পুরোনো গেস্ট হাউজে।”

-“ওয়্যাও….দারুন মজা হবে!সেখানে আমি তোমার প্রিয় গান গুলো গাইব…(বলেই জিভ কাটল নোভা)উপস্….স্যরি,তুমি বলে ফেললাম!”

সউদ হাসল-“সমস্যা নেই,তুমিই বলো!”

 

***

 

দুতিনদিন পরের ঘটনা।

আশফাক সাহেব ভাত খেতে বসে নোভার কথা জানতে চাইলেন!জাহরা বাবাকে ভাত বেড়ে দিতে দিতে জানাল।আজ নোভার বড় একটা প্রোগাম আছে।বাবা চিন্তিত মুখে বললেন-“কোথায় কিছু জানিস?”

জাহরা হাসল-“জানি বাবা,বাংলাদেশের নামকরা শিল্পপতি মাসুদুর রহমানের গেষ্টহাউজে। নোভা যেখানেই যাক, ফোন নম্বর ঠিকানা আমি রেখে দেই,তুমি ভেবোনা বাবা।ওর সাথে যোগাযোগ হয়েছে।

-“হমমম…মেয়েটা যে দিনদিন এতো লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে, কি করি বলতো?

-“বিয়ে দিয়ে দাও!”হেসে বলল জাহরা।

-“কি বলিস না বলিস…তোকে রেখে ওকে দিবো কেন? তুই তো ওর বড়! ”

-“এসব কিছুনা বাবা,বিয়ে হলে ওর পায়ে বেড়ী পড়বে।আর আমার কথা ভেবোনা,আমার এত উচ্চাকাঙ্খা নেই।আমার একটাই চাওয়া আমার জীবনসঙ্গী যেন ধার্মিক মেজাজের হয়।”মা নেই বলে বাবার সাথেই বন্ধুর মত কথা বলে জাহরা।তাই এই কথাটা বলতেও সংকোচ করলোনা।

 

রাত প্রায় এগারোটা।

নোভা আগেই জানিয়ে দিয়েছে  আজ ওর ফিরতে অনেক রাত হবে।সউদের গাড়ী পৌঁছে দেবে ওকে।জাহরা যেন চিন্তা না করে।

.

পরপর তিনটা গান গেয়ে নোভা একটু ক্লান্ত।একজন মেল সিঙ্গারের হাতে মাউথপিস ধরিয়ে দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে এল নোভা।আজ সে জমকালো একটা শাড়ী পড়েছে।সউদ ওকে দেখে হাসল-“ওয়াও,সন্ধ্যেটা ভরে দিয়েছো তুমি।চমৎকার তোমার গানের গলা।

-“থ্যাংকস।ইয়ে…..আমার একটু ফ্রেশ হতে হবে।ওয়াশরুমটা….!”নোভা বলল।

সউদ উঠে দাঁড়াল-“চলো।”

নোভা সউদের পেছনে পেছনে একটা রুমে ঢুকল।

রুমটা বেশ সাজানো গোছানো।সউদ ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে আসতে চাইলে নোভা পেছন ওর শার্টটা টেনে ধরল-“একটু বসো না,প্লিজ গল্প করি!”

সউদ ফিরে তাকাল-“,গল্প করবে?এখানে?

-“হমম,একটু রিল্যাক্সড হতে চাচ্ছি।কিছুক্ষণ বসে তারপর আবার পার্টিতে ফিরে যাবো,কি বলো?”

-“ওকে..!”কাঁধ ঝাঁকাল সউদ।তারপর নোভার অনুরোধে বয়কে ডেকে দুই গ্লাস জুস দিতে বলল সউদ।বয় ট্রেতে করে জুস দিয়ে গেলে সউদ একটা গ্লাস নোভার হাতে তুলে দিল আরেকটা নিজে তুলে নিতে যাবে তখনি নোভার কাশি শুরু হলো।সউদ গ্লাস রেখে বলল-“কি হলো?  কোনো সমস্যা?”

-“একটু পানি দাও প্লিজ !”নোভা গলায় হাত রেখে বলল।সউদ পানির কথা বলার জন্য উঠতেই নোভা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে ওর পার্স থেকে ছোট্ট একটা পুরিয়া বের করে তার ভেতরের সাদা পাউডারটা সউদের গ্লাসে ঢেলে দিল।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গলা চেপে ধরে জুসের গ্লাসটা নিল।সউদ বয়কে ডেকে আনলে দেখল নোভা জুসে চুমুক দিচ্ছে-“পানি খাবেনা?”

-“না,থাকা,জুসেই চলবে।তুমি বসো তো।”

সউদ বসলে নোভা জুসের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরল।সউদ মুচকি হাসল-“থ্যাংকস!”

.

নোভা স্বাভাবিক ভাবেই গ্লাস শেষ করল।সউদ জুস খেতে খেতে দুবার মাথা ঝাঁকাল।তার যেন কেমন নেশা নেশা লাগছে।নোভা উঠে দাঁড়াল-“চলো!”

সউদও উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে নোভার কাঁধ খামচে ধরল।নোভা ওকে দ্রুত জড়িয়ে ধরল-“এই কি হয়েছে তোমার?”

সউদ সামনে কিছু পরিস্কার দেখতে না পেয়ে দুই হাত দিয়ে নোভার দুই কাঁধ ধরতেই নোভা ওকে জড়িয়ে ধরল।

তারপরের কথা আর সউদের মনে নেই।

…..

 

ভোরে চোখ খুলে দেখল একপাশে নোভা শুয়ে আছে।সউদ মাথাটা দুতিন বার ঝাঁকাল।গতরাতের কথা মনে করার চেষ্টা করল।কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছেনা ও..!”নোভা এখানে কেন?ওর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঢোক গিলল সউদ।তার দ্বারা এমন কাজ হতে পারেনা।কখনো না! সউদ দ্রুত বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।

….

গাড়ীতে একদম চুপচাপ বসেছিল নোভা।সউদ ডান হাতের উল্টো পিঠ বারবার কামড়ে ধরছে।তারপর বিব্রত স্বরে বলল-“আমি আমার নিজেকে চিনি নোভা।ইট কুড নেভার পসিবলি ডান বাই মি! নেভার….এভার! অথচ তুমি বলছো…..উফ্! আমি….আমি বুঝতে পারছিনা কি থেকে কি হলো!আচ্ছা,তুমিতো সময়মত সরে যেতে পারতে….!”কাতর স্বরে বলল সউদ।

-“থাক,বাদ দিন।আমার যা হবার হবে।আপনার তো আর কিছু হবেনা।ঐ পার্টির সবাই জানলো আপনার সাথে আমার….!”

-“তুমি কি বলতে চাও!তাছাড়া আমিইবা এখন কি করবো?”আব্বুর মানসম্মান জড়িত এতে।কেউ যদি তার কানে তুলে দেয় খুব বিশ্রী হবে সেটা।আব্বু আমাকে খুব বিশ্বাস করেন”!

-“আমি কি বলবো,আপনার বিবেক কি সায় দেয় বলুন!”নোভা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।

সউদ বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাতে চুল খামচে ধরল।কোনো উত্তর দিলোনা।নোভার বাড়ীর সামনে এসে গাড়ী থামিয়ে বলল-“আমাকে ভাবার জন্য একটু সময় দাও…প্লিজ।আমার মাথা কাজ করছেনা।”

.

নোভা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর মনে মনে বাঁকা হাসি হাসল নোভা-“আমাকে বিয়ে না করে আর কোনো উপায় নেই তোমার”।তারপর ‘বাই’ বলে নেমে গেল।

….

চলবে…..

 

 

 

 

 

দুইবোন

 ৩য় পর্ব

লেখাঃমোর্শেদা রুবি

*******************

 

এক অসম্ভব মানসিক যন্ত্রনা কুড়ে খাচ্ছে সউদকে।

সে কিভাবে সুযোগ পেয়ে একটা মেয়ের ক্ষতি করে বসল?এটা কিভাবে সম্ভব?

সিগারেটে দুটান দিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিল সে।সিগারেটও বিস্বাদ লাগছে।পুরো বিষয়টা মনের মধ্যে উল্টে পাল্টে দেখার চেষ্টা করছে।আসলে কি ঘটেছিল।

সে হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলো কিভাবে?আর নোভা’ই বা সেখানে বসে ছিল কেন? সে তো পীড়াপীড়ি করতে পারত।নিজের সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য তো মানুষ কত কিছুই করে।

নাহ্,নিজেকে সাধু সাজানোর জন্যই এসব যুক্তি তার মাথায় আসছে।হয়ত নোভা চেষ্টা করেছিল কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে হৈ চৈ করেনি কিংবা……উউহ্…মাথার শিরাগুলো ফেটে যেতে চাচ্ছে।নিজের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিল আর আজ?

নাহ্,সে জেনেশুনে একটা মেয়ের ক্ষতি করতে পারবেনা।নোভাকে বিয়ে করার প্রয়োজন হলে তাকে তাই করতে হবে কারন এর সাথে জড়িয়ে আছে একটি মেয়ের সম্মানের প্রশ্ন।

নোভার কথা ভাবল সে,ওর গান সউদের ভালো লাগে,সে দেখতেও সুন্দর কিন্তু তার প্রতি কোনো বিশেষ টান সউদ অনুভব করেনা।যাকে ভালোবাসেনা তাকে বিয়ে করবে কিভাবে?এসব

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল।

-“হ্যালো?”

-“কেমন আছো?”

-“ওওহ্…নোভা তুমি?”ক্লান্ত স্বরে বলল সউদ।

-“বিরক্ত করলাম?”

-“নাহ্,বিরক্ত কিসের!বলো!”

-“তোমার সাথে দেখা করতে চাই,সময় হবে?”

সউদ খানিক চুপ থেকে বলল-“কোথায় দেখা করতে চাও?”

….

 

কফি শপের দোতলাটা নিরিবিলি।সেখানেই বসল দুজন।নোভা যথাসাধ্য নিজেকে আবেদনময়ী লুকে সাজিয়েছে কিন্তু সউদের যেন সেসবে মন নেই।নোভা লাজুক হেসে বলল-“সত্যি করে বলো তো!তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?”

সউদ বোকার মত তাকাল,কি জবাব দেবে বুঝে পেলনা।নোভা লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল-“গতকাল তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসার কথা বলেছো।তাই আমি সবার সামনে তোমাকে ছোট করতে পারিনি।”

-“সত্যিই,আমি…..এসব বলেছি?”সউদ বিস্মিত।

-“মমমমম”!দুচোখ বন্ধ করে বলল নোভা।

-“আমার মনের অস্থিরতাটা কাটছেনা,বুঝলে?’

-“তুমি এত স্ট্রেশ নিচ্ছো কেন?নিজেকে সময় দাও,তাড়াহুড়ার কিছু নেই।আমি জানি বিয়ে নিয়ে আমার মতো তোমারও অনেক স্বপ্ন আছে।আমরা আমাদের বিয়েটা অনেক গর্জিয়াসলি করবো,কি বলো?”

নোভা মনে মনে হাসল-বেচারা,মড়ার মত সারারাত ঘুমিয়েছে অথচ ভাবছে সে নোভার সর্বনাশ করেছে।ছেলগুলো এতো বোকা হয় কিভাবে?

.

সউদ তাকিয়ে আছে নোভার দিকে,ভাবছে,’বিয়ে করবো এমন সিদ্ধান্ত কখন দিলাম?আসলে মেয়েটা বড় সরল আর আমাকে মন থেকে ভালোবাসে বলেই অকপটে এসব বলে যাচ্ছে।

সউদ নিজের মনটাকে নোভার দিকে ফেরাতে চেষ্টা করল।হঠাৎ হেসে বলল-“চলো আইসক্রিম খাই!”

-“বাহ্,তুমি কিভাবে জানলে আমার মনের খবর?”

সউদ নিজের মনকে একরকম জোর করেই নোভার প্রতি মনোযোগী করে তুলছে।আর নোভা তার সকল সময় সউদের পেছনেই ব্যয় করতে শুরু করল।এভাবে দুটো মাস কেটে গেল।ওদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে আরো গভীর হলো।তবে সউদের দিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে গিয়ে

নোভার হাতের কাজ কমে আসতে শুরু করল।আজকাল প্রোগামগুলোতে ওর ডাক কম আসতে শুরু করল।যেখানে নোভা প্রতিমাসে পনের বিশটা প্রোগাম এটেন্ড করতো সেখানে চলতি মাসে ওর মাত্র দু জায়গা থেকে ডাক এলো।নোভা বুঝতে পারল, এভাবে নিজের প্রতিভাকে জলাঞ্জলি দেবার কোনো মানে হয়না।যদি নিজেকে স্টারই বানাতে না পারে তাহলে সউদের কাছে ওর দামইবা কি থাকবে?সে তো ঘরের আর দশটা সাধারন মেয়ের মতই হয়ে যাবে।তখনকি বিশিষ্ট শিল্পপতি ‘সউদ-বিন-মাসুদ’ওকে বিয়ে করবে?একদম না!”

নোভা পেশায় মনোযোগ বাড়িয়ে দিল।আগের চেয়েও বেশী প্রোগাম পাবার আশায় সে সবধরনের প্রোগামে অংশ নেয়া শুরু করল।

.

এরই মধ্যে দুটো সুসংবাদ নোভাকে আনন্দে একেবারে আত্মহারা করে দিল।তার একটি হলো আজ সন্ধ্যে বেলাতেই সউদ ওকে বিয়ে করার ইচ্ছে জানিয়েছে কারন তার ছোট বোন ইটালিতে থাকে।সে বাংলাদেশে এসেছে।এমাসটাই থাকবে।ও থাকতেই বিয়ের অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলতে চায় সউদ।বাবাকে নোভার কথা বলেছে,প্রথমে একটু গররাজি হলেও পরে সউদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানান তিনি।

.

দ্বিতীয় সুসংবাদ হলো,বম্বে থেকে একটা মুভিতে হিন্দী সঙ প্লেব্যাক করার জন্য ওকেই চুজ করেছে পরিচালক  কমল মেহতা।কারন নোভার ভয়েস নাকি হিরোইনের সাথে খুব ম্যাচ করে।২য় সংবাদটি নোভাকে ১ম সংবাদের চেয়ে বেশী আনন্দিত করল।কারন এ ধরনের অফার ওর জীবনে এই প্রথম এবং অপ্রত্যাশিত।সউদের বিষয়টি আজ নাহয় কাল হবেই কারন সউদ এখন ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।

.

কিন্তু এই অফারটি ওকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দান করবে,ওকে সেলিব্রিটি বানিয়ে দেবে,দেশ বিদেশ থেকে নামীদামী পরিচালকরা নোভার বাড়ীতে ধর্না দেবে।তখন সউদের চেয়ে কত বড় বড় মানুষ ওর জীবনে আসবে..!যদিও ও সউদকেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করবে বাট নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে নয়।”.

.

ভবিষ্যত জীবনের রঙীন স্বপ্নে বিভোর নোভা।এদিকে সউদ বিয়েটা এ মাসেই সেরে ফেলতে চায়।কিন্তু নোভা চায় বম্বে থেকে ফিরে এসেই বিয়েটা সারতে।অবশেষে নোভা সউদের পীড়াপীড়িতে বম্বে যাবার আগের দিনই আকদ করতে রাজী হলো।পরের দিন ভোরেই ওর ফ্লাইট।

.

বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হলে সউদের বোন অনিতা মহানন্দে ভাইয়ের বিয়ের কেনাকাটা করতে লাগল।আর মাত্র চারদিন বাকি।এরই মধ্যে একদিন নোভার সাথে দেখা করতে গেল আনিতা কিন্তু নোভা ফিরেছে সেই রাত বারোটায়।অনিতা এসময়টুকু জাহরার সঙ্গে গল্প করে কাটিয়েছে।বাড়ী ফিরলে সউদ জানতে চাইল নোভাকে কেমন লেগেছে!অনীতার সাফ জবাব,দেখার আর কথা বলার সময় পেলাম কই।তবে ওর বড়বোনটা একসেলেন্ট।তুই জাহরার মত মেয়ে থাকতে নোভাকে কি দেখে পছন্দ করলি বলতো?সউদ কোনো জবাব দিলোনা।

.

আজ নোভার বিয়ে।খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করতে হলো।আজ শুধু আকদটা হবে,প্রোগাম হবে নোভা ফিরলে।বিয়ের পরে ওরা নিউজিল্যান্ড যাবে হানিমুনে।জাহরা আর ওর বাবা প্রচন্ড ব্যস্ত।ক্যাটারারকে সব দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয়েছে।তবু আত্মীয় স্বজন মেহমানদের সামলাতে জাহরা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে।এর মধ্যে নোভা সেই যে সকালে বেরিয়েছে আর খবর নেই।বলে গেছে লাগেজ ট্রুপ লিডার জাফর ভাইয়ের বাসায় আগে থেকেই রেখে আসবে কারন বিয়ের হুলুস্থুলে এসব টানাটানি ওর পোষাবেনা।তাছাড়া জাফর ভাইয়ের বাসা এয়ারপোর্ট সংলগ্ন নিকুঞ্জে।

.

জাহরা দুতিনবার ফোন দিয়েছে,নোভা সকালে একবার ধরেছিল এরপর আর পাত্তা নেই।বিকেলের দিকে জাহরার চিন্তা উদ্বেগে রূপ নিলো।সে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই নোভাকে,তাদের ট্রুপ মেম্বারদের ফোনে ট্রাই করছিল।কেউই সঠিকভাবে কিছু বলতে পারলোনা।সন্ধ্যের পরপরই বাবা এসে ধমক লাগালেন জাহরাকে-“নোভা আসছেনা কেন?এদিকে গেস্টরা তো সব একে একে  চলে আসছে।জাহরার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কা।বুক ধড়ফরাচ্ছে তার।খারাপ কিছু হলো না তো?আজ কি যে হবে…নোভা তুই কোথায় রে সোনা?”

.

রাত দশটা।সউদ বামহাত পকেটে পুরে দাঁড়িয়ে আছে।ডানহাতে মোবাইলটা সমানে টিপে চলেছে।কোনো নাম্বারেই লাগছেনা,যাদের পাচ্ছে তারা কিছু বলতে পারছেনা।সউদের বাবা মাসুদুর রহমানের চেহারা রাগে লাল হয়ে আছে।সউদ নিজে দাঁতে দাঁত চেপে সব কথা হজম করছে।অনীতা বোকার মত তাকিয়ে আছে।

.

আশফাক সাহেবের বুক ব্যথা শুরু হয়েছে তিনি ঘামছেন।জাহরার মোবাইলে একটু আগেই নোভার মেসেজ এসেছে-“ডিয়ারি আপুনি,শিডিউলটা হঠাৎই চেন্জ হয়ে গেল,আজ রাত দশটায় যাওয়া ফিক্সড হলো  কারন ফ্লাইট ডিলে করা হয়েছে। কি আর করবো বল্,আমার উপায় নেই, প্রত্যেকবারের মত তুই একটু সামলে নিস,বাই”!

জাহরা কাঁপা হাতে মেসেজটা সউদের কাছে পাঠালো।সউদ হতভম্ব।কোনো মেয়ে এতটা হাই এমবিশাস হতে পারে যে তার বিয়েটাও তার কাছে তুচ্ছ?

.

মাসুদুর রহমান রাগে ফেটে পড়লেন আশফাক হোসেনের উপর-“কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছেন যে আজ আপনার নাকটা কেটে দিয়ে গেলো?আপনার সাথে সাথে আমারো।কাল পত্রিকায় নিউজ হলেও তো কিছু করতে পারবোনা!সবাই বাজে রটনা করবে!বলুন,বাইরের মেহমানগুলোকে মুখ দেখাবো কি করে?”

আশফাক মাথা নিচু করে রাখলেন।মাসুদুর রহমান সউদের দিকে তাকালেন-“এই নাকি তোমার পছন্দ যে তোমাকে মূল্যায়নই করেনা?”সউদ লজ্জায় অপমানে ডানহাতে ধরা মোবাইলটা চেপে ধরল মনে হচ্ছে ভেঙ্গে ফেলবে।।তিনি উঠে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন-“চলো সবাই “!

.

সউদ এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভাবছিল হঠাৎ সে বাবাকে থামালো-“এক মিনিট আব্বু!”

মাসুদুর রহমান অবাক হয়ে ফিরে তাকালেন!সউদ আশফাক হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল-“আঙ্কেল,আপনি চাইলে বিষয়টা অন্যভাবে সমাধান হতে পারে অবশ্য আপনার যদি সম্মতি থাকে তাহলে আমি একটা প্রস্তাব রাখতে চাই।তাতে উভয় পক্ষেরই মানসম্মান রক্ষা পাবে!”

আশফাক বিভ্রান্ত চোখে তাকালেন।সউদ তার বাবার দিকে তাকিয়ে তারপর আশফাকের দিকে তাকাল-“আপনার অনুমতি থাকলে আমি আপনার প্রথম কন্যা জাহরাকে বিয়ে করতে চাই ! ”

মাসুদুর রহমান কিছু বলার জন্য মুখ খুললে তাকে অনীতা টেনে ধরে কানে কানে কিছু বললে তিনি শান্ত হয়ে যান।

আশফাককে চুপ দেখে মাসুদুর রহমান হাসলেন-“জানি,মেয়ের পরামর্শ ছাড়া জবাব দিতে পারবেন না তাই………”

মাসুদুর রহমান কথা শেষ করতে পারলেন না,আশফাক তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন-“ঐ যে তখন বললেন না,কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছি?তার উত্তরটা এখন আপনাকে দিচ্ছি।জাহরা আমার এমন সন্তান যার বিষয়ে পূর্ণ সিদ্ধান্ত দেবার মত সাহস আমার আছে।আমি আমার প্রথমা কন্যার ব্যপারে আপনাদের প্রস্তাব সানন্দে মেনে নিলাম!এ বিষয়ে আমার মতামতই চুড়ান্ত !”

 

সউদ চমকে মুখ তুলে তাকাল।মাসুদুর রহমানের চেহারার কঠিন ভাঁজগুলো সহজ হয়ে এলো।অনীতা ছোট বাচ্চাদের মত হাততালি দিল কারন তার জাহরাকে খুব পছন্দ।সউদ ভেবে অবাক হলো তার তো অস্থির লাগার কথা কিন্তু অন্তরটা এমন প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল কেন?”

….

চলবে…..

 

দুইবোন

৪র্থ পর্ব

লেখাঃমোর্শেদা রুবি

*******************

 

জাহরা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব বাবা ওর সামনে রাখবেন তা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি জাহরা।ঝাড়া তিন মিনিট কোনো কথা বললো না সে।

আশফাক সাহেব জাহরার মাথায় হাত রেখে বললেন-“জানি,হয়ত তুই আমার উপর রাগ করছিস,আমাকে খারাপ বাবা ভাবছিস কিন্তু মা…আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা।

 

জাহরার দুচোখ বেয়ে পানি নামল।কিছুক্ষণ পর বলল-“এটা তুমি কি করলে বাবা?”(কান্নার দমকে ওর কথা আটকে যাচ্ছে)”নোভাটা চিরদিনই বেহিসেবী তাই বলে ওকে এতবড় শাস্তি দেবে তুমি?ওকে কি জবাব দেবে? আমার কথা নাহয় না’ই ভাবলে!”

-“প্রস্তাবটা আমি রাখিনিরে মা,এটা কি কোনো বাবা যেচে বলতে পারে?প্রস্তাবটা সউদ-বিন-মাসুদ নিজে রেখেছে আর তার বাবা আমাকে তার কথার প্যাঁচে ফেলে আটকে ফেলেছে।বাড়ী ভর্তি মেহমান।ওরা সম্মানিত মানুষ।বিয়েটা না হলে ওরা মানুষের সামনে লজ্জিত হবে।ওদের তো কোন দোষ নেই।দোষ সব নোভার।”ক্ষোভ মেশানো রাগ নিয়ে বললেন বাবা।

-“তাই বলে আমি?আমার দিকটা একবারো ভাবলে না বাবা,আমি বোন হয়ে কিভাবে বোনের জায়গাটা কেড়ে নেবো?কি জবাব দিবো নোভাকে?””

-“কিসের কি জবাব,ও কি একবারো ভেবেছে আমরা কি জবাব দেবো সবাইকে?”

-“যত যাই হোক, বাবা।বিয়ে তো কোন ছেলেখেলা না।ওদের আমি ভালো করে চিনিনা পর্যন্ত।তাছাড়া ছেলেটা একদম আমার বিপরীত।সে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেও ইসলামের সাথে তার তেমন কোন সম্পর্ক নাই।গানবাজনা বান্ধবীদের নিয়ে খোলামেলা চলাফেরা করে,ওদের সাথে আমার কোনোদিক থেকেই মিলবেনা,বাবা।”

-“মা গো,আমি যে ওদের কথা দিয়ে ফেলেছি মা।তাছাড়া সউদ,তার বাবা তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছে।আমি ওদের বসিয়ে রেখে এসেছি।বলেছি,আমি আগে কথা বলে নেই তারপর আপনারা কথা বলবেন।মা গো,তুই একটু ওদের সাথে কথা বল্, মা আমার ভালো…!”

.

জাহরা এমন বিপদে জীবনে পড়েনি।তার প্রিয় বাবা সম্মানের ভয়ে কাতর হয়ে তার কাছে কাকুতি মিনতি করছে।সে কি এমন মেয়ে?কিন্তু নোভাকে বেকায়দায় পেয়ে তার জায়গা দখল করে তাকে বেদখল করাটা কতটুকু যুক্তিসংগত?সউদ যদি এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে এটা তার রাগের সিদ্ধান্ত।সউদ নোভাকে ভালোবাসে।এটা জেনে জাহরা কিভাবে সউদকে বিয়ে করতে পারে?

.

সাতপাঁচ ভেবে কোনো দিশা পাচ্ছেনা জাহরা।এমন সময় দরোজায় টোকা পড়ল।অনিতা উঁকি দিয়ে হালকা কেশে বলল-“আসতে পারি?”

জাহরা আলতো করে চোখের পানিটা মুছে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল।অনিতা ভেতরে ঢুকে বলল-“আব্বু একটু জাহরা আপুর সাথে কথা বলতে চায়,বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, আসতে বলবো?”

আশফাক হোসেন ত্রস্তে উঠে দাঁড়াল-“হ্যাঁ…হ্যাঁ….উনাকে ভেতরে নিয়ে এসো মা।জাহরা ভালো করে ঘোমটা টেনে দিল।নোভার বিয়ে উপলক্ষে সে আজ শখ করে নীল শাড়িটা পড়েছিল।তার লজ্জাও হতে লাগল খুব।

মাসুদুর রহমান ভেতরে ঢুকতে সালাম দিল জাহরা।

.

সউদ চুপচাপ বসে আছে।ওর ঘনিষ্ট দুজন বন্ধু ওর পাশে বসে আছে।মাসুদুর রহমান ড্রইং রুমে হাসিমুখে ঢুকে ছেলের পাশে বসলেন।ছেলের কানের কাছে এগিয়ে গিয়ে গলার স্বর নিচু করে বললেন-“আমি তো জানতাম তুই বুদ্ধিমান,এতো বড় বেকুব তা তো জানতাম না।”

-“কেন,কি করেছি আমি?”

-“কি করেছিস সেটা আর এখন বলে লাভ নেই বরর্ একটু আগে যেটা করলি তার জন্য তোর পেছনের দোষ ত্রুটি মাফ করলাম।”তারপর ছেলের কাধে মৃদু চাপড় মেরে বললেন-“মেয়েটা খুব ভালো লাগল, বুঝলি?একে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তুই জীবনের সবচে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিয়েছিস!যদিও নোভাকে শিক্ষা দেবার এরচে ভালো কোনো ওয়ে নাই।যাহোক,কথা বলবি ওর সাথে?”

-“উনি কি কথা বলতে চান আমার সাথে?”

-“সেটা তো জানি না!”

-‘থাক,বাদ দাও,ভালো লাগছেনা।বিয়েটা শেষ করো!”

মাসুদুর রহমান বুঝতে পারছেন তার ছেলে খুবই মানসিক ধন্ধে আছে।অবশ্য এরকম পররিস্থিতিতে নার্ভ ঠিক রাখা মুশকিল।

.

কাজী সাহেব বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন তার দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে।

জাহরা তখনো কাঁদছিলো।ওর ফুপু চাচীরা সবাই বুঝালেন ওকে।জাহরার এক মুখরা চাচী বলে বসলেন-“ভালো ঘর,ভালো বর পেয়েছো রাজী হয়ে যাও।নোভার কথা অত ভেবোনা, ও ঠিকই আরেকটা জুটিয়ে নিবে দেখো।তুমি তোমার বাবার মানসম্মান বাঁচাও।

 

অবশেষে জাহরার বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেল।চোখের জলে ভাসতে ভাসতে জাহরা কাবিননামায় সই করল।

বিয়ে সম্পন্ন হবার পর মাসুদুর রহমান নিজেই বর কনেকে কথা বলানোর উদ্যোগ নিলেন।আশফাক হোসেন কে জড়িয়ে ধরে বললেন-“তখনকার বলা কথাগুলোর জন্য ক্ষমা করে দেবেন বেয়াই সাহেব।

আশফাক হাসলেন-“না না,ঠিকআছে।”

-“সামনের ফ্রাইডে তেই আমি মামনি জাহরাকে নেবার ব্যবস্থা করতে চাই,বুঝলেন?”

-“জ্বী,আল্লাহভরসা।।আমার দিক থেকে সমস্যা নেই”!

-“মাশাআল্লাহ, খুব ভালো।আচ্ছা,ওদের অন্তত একসাথে কথা বলার সময়টুকু দেয়া উচিত।কারন সামনের সপ্তাহের আগে তো আর দেখা সাক্ষাৎ হবেনা,কি বলেন?”

-“জ্বী,আমি দেখছি।

.

আধাঘন্টা পরেই সউদ আর জাহরা মুখোমুখি হলো।

 

দুইবোন

৫ম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

********************

সউদ আগে থেকেই এই রূমটাতে চুপ করে একটা সোফায় বসেছিল।

অনিতা জাহরাকে ধরে নিয়ে এল।কাছাকাছি আরেকটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল-“নাও…এবার মন খুলে কথা বলো।তোমাদের সময় হলো এক ঘন্টা।”বলে সে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল-“দ্যা টাইম স্টার্টস নাও”বলে সউদের মাথায় ছোট্ট চাটি মেরে বিদায় নিল।যাবার আগে ডোরটা লক্ করতে ভুলল না ডেঁপো মেয়েটা।

.

অনিতা চলে যাবার পরও দুজনের কেউই কোন কথা বললোনা।সঊদ জাহরার দিকে তাকিয়ে দেখল জাহরা বউয়ের কোনো সসাজই দেয়নি।নীল একটা শাড়ী পড়ে আছে।মেকাপ বোধহয় হালকা যেটুকু ছিল সেটুকুও কান্নার জলে ধুয়ে গেছে।তবু তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

রুমে আসার পর থেকে একটি বারের জন্যেও চোখ তুলে তাকায়নি জাহরা।সে এখনো কাঁদছে আর তা ওর মাঝেমধ্যেই কেঁপে ওঠা দেখে বোঝা যাচ্ছে।চোখ আর নাকের ডগা লালচে হয়ে আছে।

সউদ কি বলবে ভেবে পেলনা।

.

অবশেষে সউদই প্রথম নিরবতা ভাঙ্গল।

-“আপনি কাঁদছেন কেন?

-“(জবাব নেই)!

-“আমি জানি আমাদের বিয়েটা খুব অদ্ভুতভাবে হয়েছে…আসলে…!”(জাহরা চুপ)

-“কিছু একটা বলুন”!

-“(খানিক চুপ থেকে)আমার কিছু বলার নেই।”

-“আমার এভাবে হঠাৎ বিয়ে করতে চাওয়াটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন জানিনা!কিন্তু এটার সাথে আমার গোটা জীবন জড়িত।বলতে পারেন অনেকটা নিজেকে বাঁচাতেই আপনাকে বিয়েটা করেছি।পুরো ব্যপারটা আপনি না বললে বুঝবেন না!”

জাহরা হঠাৎ কেঁদে ফেলল।

তারপর সউদের দিকে তাকিয়ে বলল-“আপনি আমাকে বিয়ে করতে গেলেন কেন?অন্য কোনো সমাধান ছিলোনা?”

সউদ একটু থতমত খেয়ে গেল, কি উত্তর দেবে এই কথার!”

জাহরা আবার বলল-“আপনি নোভার উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়েই আমাকে বিয়েটা করেছেন! যেন নোভা কষ্ট পায়, তাই না?”

সউদ চিন্তিত মুখে জাহরার দিকে তাকিয়ে রইল,উত্তর দিলোনা..কি বলবে সে ভাবছে।

জাহরা এতে কিছুটা ক্ষেপে উঠল-“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

-“কই,তাকিয়ে আছি?”সউদ থতমত খেয়ে গেল।

-“তাকিয়ে থাকবেন না প্লিজ….আমার অস্বস্তি লাগে”!

সউদ চোখ নামিয়ে নিল।মেয়েটাকে যত সহজ ভেবেছিল তত সহজ না।যথেস্ট ত্যাদোঁড় টাইপের বোঝা যাচ্ছে।

নোভা তো খুব বলতো জাহরা খুবই শান্ত মেয়ে।এই যদি হয় শান্তর নমুনা তো বাকি দিন যে কি হবে কে জানে?”

-“আমি উঠবো”! জাহরা সোজা হয়ে বসল।

-“উঠুন,মানা করেছে কে?”সউদ ওর দিকে তাকাল।

-“নোভাকে কি বলবেন,ভেবেছেন ?”

সউদ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল-“বিয়ের আগ পর্যন্ত নোভা আমার মাথাব্যথা ছিল,এখন এ মুহূর্ত থেকে আমি বিবাহিত পুরুষ।আর কোনো বিবাহিত পুরুষের জন্য নিজস্ব নারীর বাইরে পরনারী নিয়ে ভাবা উচিত না।কি বলেন?আমার কি অন্য নারীর কথা ভাবা উচিত? আপনিই বলুন।আপনি তো ধর্মীয় রীতিনীতি জানেন, মানেন!”

জাহরা সউদের দিকে তাকাল,মাথা দুলিয়ে বলল-“আচ্ছা,সেয়ানা তো আপনি?এমন ভাব করছেন যেন কতকালের চেনাজানা আমাদের।দুমিনিটেই সব ভুলে গেলেন?

-“চেনাজানা হলে মন্দ হতো না কি বলেন? তাহলে আপনার প্রেমেই পড়তাম আর বিয়ের পর এমন কটকট করে কথা শুনতে হতো না,দুচারটা মিষ্টি কথা শোনার ভাগ্য হতো,অথচ….!”

-“অথচ…কি?”

-“কি আর হবে?বিয়ের পর কেউ নতুন বরের সাথে এভাবে কথা বলে,বলুন?”

-“ভুলে যবেন না আপনি নোভার বর হতে এসেছিলেন।ঝামেলায় পড়ে আমার বর….!” এ পর্যন্ত বলে জাহরা থেমে গেল।কিছুতেই “আমার বর”শব্দটা উচ্চারন করতে পারলোনা।সউদ কৌতুকমাখা দৃষ্টিতে তাকাল।

-“হ্যাঁ..হ্যাঁ…বলুন বলুন,কি যেন বলছিলেন?”

জাহরা অযথাই ঘোমটা টানল।তারপর বলল-”

-“বিয়েটা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছিনা!”

-“কেন, আপনার পছন্দের অন্য কেউ আছে নাকি?”

-“সবাইকে নিজের মত ভাবেন কেন?”

-“নিজের মত মানে?”

-“জানিনা”!

জাহরা উসখুস করে উঠল-“আচ্ছা,কতক্ষণ হয় আমরা কথা বলছি?এক ঘন্টা শেষ হয়েছে?”

-“মমম…পঁয়ত্রিশ মিনিট গেছে।আরো পঁচিশ মিনিট সময় বাকি!”মোবাইলে ঘড়ি দেখে জানাল সউদ।

জাহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

-“অনীতাকে ডাকবো?”সউদ বলল!

-“ডেকে কি বলবেন,একঘন্টা শেষ হলে তো ও নিজেই আসবে!”

-“তার মানে আমার সাথে এ ঘরে বসে থাকতে আপনার ভালোই লাগছে!”

-“বেশী বোঝা ভালো না!আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে,আর নোভাকে সেটাই বলবো!”

-“কে বাধ্য করেছে আপনাকে?আপনি স্বেচ্ছায় রাজী হয়েছেন!এখন দোষ অন্যের উপর চাপাচ্ছেন কেন?”

রাগে জাহরা’র মুখটা লালচে হয়ে উঠল।

-“আপনি খুব খারাপ!”

-“আর আপনি খুব ঝগরাটে…!”

এমন সময় দরোজায় টোকা পড়ল।তারপর অনীতা দরোজা খুলে প্রবেশ করল-“কথা হয়েছে?না আরো বলবি?”

-“হয়েছে।”সউদ জানাল।অনীতা হেসে বলল-“আরো মনের কথা বলার জন্য মোবাইল তো আছেই।ভাইয়া তোর মোবাইলে জাহরা ভাবীর নম্বর সেভ করে দিয়েছি আমি!”

সউদ উঠে দাঁড়ালে জাহরাও আস্তে করে উঠে দাঁড়াল।অনীতা বলল-“কি,এখনি যাবি? দাঁড়া আমি আসছি..!বলে অনীতা দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল।জাহরা সউদের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলল-“সবাইকে বলে দেবেন আমি যে এসব বলেছি?”

-“কেন,বলতে মানা করছেন?”

-“না…মানে,আমার খুব রাগ লাগছিল আপনার উপর তাই…..!”

-“এখন রাগ নেই বলতে চাচ্ছেন,এই তো?”

জাহরা কিছু বলতে যাবে তখনি অনিতা ট্রে হাতে প্রবেশ করল।তাতে এক গ্লাস শরবত।সউদ বলল -“এটা কি?”

-“বিয়ের শরবত। তুই অর্ধেক খেয়ে ভাবীকে দিবি!”

-“এ আবার কেমন নিয়ম?”সউদ বলল।

-“নিয়ম টিয়ম কিছ….বলা হয় এটা খেলে স্বামী স্ত্রীতে ভালোবাসা বাড়ে!”

সউদ চুপ হয়ে গেল।অনিতা ওর হাতে গ্লাস দিতে গেলে সউদ বললো-“ওনাকে দে,উনি খেলে পরে আমি খাবো!”জাহরা চোরাচোখে সউদের দিকে তাকাল।সউদও অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল।অনীতা জোর করেই সউদের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিল।সউদ সামান্য চুমুক দিয়েই তা রেখে দিতে নিলে অনীতা হা হা করে উঠল-আরে,কমপক্ষে অর্ধেকটা খেতে হবে”!

অগত্যা সউদ গ্লাসে চুমুক দিয়ে খেতে লাগল।অনিতা চিৎকার করে উঠল-“পুরোটা সাবাড় করবি নাকি,ভাবীর জন্য রাখ,কি ছেলে রে বাবা?”

অনিতা ওর হাত থেকে নিয়ে জাহরার হাতে দিলে জাহরা সউদকে অবাক করে দিয়ে গ্লাসটা হাতে নিল।তারপর যে স্থানে মুখ লাগিয়ে সউদ শরবত পান করেছে সে স্থানটাতে চুমুক দেবার জন্য গ্লাসটা মুখের সামনে তুলে থেমে গেল।সউদ ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছতে যেয়ে সেদিকে চেয়ে থেমে গেল।জাহরা মৃদুশব্দে বলল-“বিসমিল্লাহ” বলে শরবতে চুমুক দিল।সউদও আস্তে করে নিজের মুখটা মুছে নিল।

জাহরা গ্লাসটা অনীতার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে মুখ নিচু করে রাখল। সউদ যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তা দেখতে পায়নি।দেখলে হয়ত রেগে যেত!কে জানে?

……

চলবে…

 

দুইবোন

৬ষ্ঠ পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

******************

 

বিয়ে সম্পন্ন হলে সব অতিথিরা একে একে বিদায় নিতে লাগলেন।তাদের সবার মুখে নোভার প্রতি বিষেদগারই বেশী শোনা যাচ্ছিল’কি মেয়েরে বাবা..ণামিদামী হবার এতো শখ…বিয়ের দিন হাওয়া?…কার বিয়ে খেতে এলাম আর কার বিয়ে খেয়ে গেলাম…..যাক্,জাহরা বাবার দিক তাকিয়ে নিজের পছন্দ অপছন্দ বিসর্জন দিলো….

এমন নানান কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে সকল অতিথি বিদায় নিলেন।

জাহরা নিজের ঘরে চুপ করে বসেছিল।এক অদ্ভুত শূন্যতা ওর চোখে।দুহাঁটুর মদমাঝে মুখ গুঁজে আগত কান্না রোধ করল জাহরা।এমন সময় ওর কাঁধে কারো হাত পড়ল-“মা গো…আমি জানি তুই আমার উপর রাগ করেছিস…কিন্তু আজ যদি ওরা ফিরে যেতো সেটা এবাড়ীর জন্য কতটুক সম্মানজনক হতো তুই বল?”জাহরা নিরব।তিনি আবার বললেন-“আমাকে তুই মা….করে দে রে মা…!”বলে তিনি কেঁদে ফেললেন।জাহরা বাবাকে দ্রুত ধরে ফেলল-“ছিঃ বাবা…তুমি কাঁদছো কেন..তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই,, এটা আমার ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছি আমি।’

 

রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারলোনা জাহরা।নানান ভাবনা ওর মাথাটাকে ভার করে রেখেছে।গভীর রাতে চোখটা প্রায় লেগে আসছিল তখনি টুংটাং মেসেজের শব্দে ঘুমটা ছুটে গেল।জাহরা মেসেজ ওপেন করে দেখল, একটা আননোউন নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে।তাতে লেখা রয়েছে-♥Sorry for everything♥…

নাম না দেখেও জাহরানবলে দিতে পারবে এটা কার মেসেজ। সে কোনো রিপ্লাই দিলোনা তবে নাম্বারটা শেভ করে রাখল।

পরদিন অনিতা এলো দেখা করতে।জাহরাকে মার্কেটে নিয়ে যেতে চায় সে…!

জাহরা জানাল সে এমন হুটহাট করে বাইরে যেতে অভ্যস্ত নয়।তবু অনীতার পীড়াপীড়িতে জাহরাকে রাজী হতে হলো তবে জানিয়ে রাখল-“নামাজের ওয়াক্ত হলে সে চলে আসবে..!”

অনীতা বলল-“চিন্তা কোরোনা নামাজের সময় হলে তোমাকে মহিলাদরর জন্য নামাজের বহু ভালো ভালো জায়গা আছে সেখানে নিয়ে যাবো”!  জাহরা এবার বলল-“বাবার খাবার দাবার.কে দেখবে..অমনি আশফাক হোসেন নিজেই বলে উঠলেন-“ময়নার মা আছে…সে সব দেখবে…তুই যা তো মা..!”.”অগত্যা জাহরাকে যেতে হলো।!

..

 

সারাদিন এই মার্কেট সেই মার্কেট করে প্রচুর  কেনাকাটা করল আনীতা।তার উৎসাহ আর আনন্দ ছিলো দেখার মত।জাহরার বারন করা সত্ত্বেও প্রচুর শাড়ী আর থ্রিপিস কিনেছে সে।শেষমেষ দেখা গেল গাড়ীর ডিকি বন্ধ করা যাচ্ছেনা।

..

ফেরার পথে অনীতা বলল-“আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হচ্ছে ভাবী”!

-“এখন তুমি আইসক্রিম খাবে?বাসায় যাবে ককখন?

অনীতা হাসল-“বেশী দেরী হবেনা,তোমার

আসরের ওয়াক্ত ধরতে পারবে বাসায় গিয়ে!”

-“আচ্ছা..অনীতা,তুমি নামাজ পড়োনা কেন?”

-“মাঝে মধ্যে পড়ি ভাবী”(লজ্জিত স্বরে বলল অনীতা)

-“মাঝে মধ্যে….তুমি কি জানো যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে এক ওয়াক্ত নামাজ ছাড়ে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়?নামাজ আল্লাহর হক্ক।এটা নষ্ট করা একদম উচিত না।তাছাড়া তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো না কেন,মৃত্যুর ছোবল, তেকে তো বাঁচতে পারবেনা!”

-“ঠিকই বলেছো ভাবী..আম্মু সবসময় বলতো নামাজের কথা..এখন তো..!”

-“তোমার আম্মু এখন কবরে একা,কোনো আমল করার সামর্থ আজ তার নেই।

আজ তুমি আর তোমার ভাইয়া….তোমরা দুই ভাই বোনই তার জন্য যতটুকু দুআ করবে উনি তার ফলটাই ভোগ করবেন!..মা’ কে  কি শান্তি দিতে চাওনা?

-“কি বলো ভাবী….অবশ্যই চাই!”

-“তবে নামাজ ধরো”!

-“পড়বো,ইনশাআল্লাহ!”

গাড়ীটা একটা ক্যাফের সামনে রেখে জাহরাকে নিয়ে নেমে ভেতরে গেল অনীতা।একটা থাই গ্লাস দিয়ে ঘেরা রুমে বসল ওরা যার দরোজায় লেখা-“Think twice”!

অনীতা বারবার মোবাইল চাপছে।এরই মাঝে দুটো আইসক্রিমের অর্ডার দিলো সে।

জাহরা নিকাবটা নামিয়ে অনীতার কাছে ট্যিসু চাইল।তারপর পার্স থেকে আয়নাটা বের করে মুখের সামনে ধরল।ট্যিসু দিয়ে চেপে চেপে নাকের পাশের ঘাম মুছলো সে।হঠাৎ আয়নার তার মুখের পাশে সউদের মুখ দেখে দ্রুত হাতের আয়নাটা কট করে বন্ধ করে পেছনে তাকাল।সউদ কে দেখেই অনীতা হেসে দাঁড়িয়ে গেল-“তোরা বস্,আমি গেলাম!বাই ভাবী,ভাইয়াই তোমাকে পৌঁছে দেবে!”বলে সউদের দিকে তাকাল-“দেখিস,ভাবির নামাজ যেন মিস না হয়!”

 

জাহরার বিস্মিত দৃষ্টি  সামনে দিয়ে অনীতা বেরিয়ে গেল।সউদ চেয়ারটা টেনে বসে বলল-“হ্যাঁ…কেন ডেকেছেন,বলুন!”

-“আমি আপনাকে ডেকেছি কে বলল?”

-“তাহলে অনীতা যে বলল!”

-“অনীতা কেন বলেছে তার আমি কি জানি…আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন!”

সউদ টেবিলের বাটিগুলো দেখিয়ে বলল-“এগুলো শেষ করেই যাই..অযথা নষ্ট করে লাভ কি?”

ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে জাহরা একটা আইসক্রিমের বাটি টেনে নিল।সউদ মৃদু স্বরে বলল-“আপনি যে বোরকা পড়েন, তা তো জানতাম না..!”

-“জানলে কি করতেন?  বিয়ে করতে চাইতেন না,তাই না?”

সউদ খাওয়া বন্ধ করে একবার তাকাল জাহরার দিকে,কিছু বলল না।জাহরা আবার বলল-

-“আমি ও জানতাম না যে আপনি দাড়ী রাখেন না,নামাজ পড়েন না,দাড়ীচাঁছা মেয়েলী পুরুষ আমার দু চোখের বিষ”!

-“কেন,আপনি তো আমাকে একবার দেখেছিলেন,জানেননা বলছেন,কেন?”

-“অত তো খেয়াল করে দেখিনি..!”

-“খেয়াল করেন নি,সেটাও কি আমার দোষ?আচ্ছা,আপনি কি চান বলুন তো? দেখা হলেই ঝগড়া বাধাবেন,এটাই কি আপনার শখ?”

-“ঝগড়াটে মেয়ে ভালো না লাগলে স্বচ্ছন্দে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।আমাদের ফাংশান হবার আগেই সিদ্ধান্তটা নিতে পারেন!”

-“কিসের সিদ্ধান্ত?”সউদ অবাক হল।

জাহরা মৃদু স্বরে বলল-“আমাদের ডি..ডিভোর্সের!”

সউদের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

সোজা হয়ে বসে বাটিটা সামনে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল!তারপর হিপ পকেট থেকে দুটো পাঁচশ টাকার নোট বের করে প্লেটে রেখে কিছু না বলে সোজা বেরিয়ে এলো!জাহরাও দ্রুত নিকাব টেনে ওর পিছু পিছু দৌড় দিল।বাইরে এসে দেখলো গাড়ীর দরোজা খুলে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।জাহরা বোরকার ঘের সামলে তাতে উঠে বসলে ধুম করে গাড়ীর গেট বন্ধ করে ঘুরে নিজের সিটে উঠে বসল।গাড়ীটা সামান্য এগিয়েই হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে দ্রুত ছোটা শুরু করলে জাহরা ব্যাকরেস্টের সাথে সেঁটে গেল।সউদ আঁকাবাঁকা করে ওভারটেক করে গাড়ী চালাচ্ছে।ওর গাড়ী চালানোর ধরেনই বোঝা গেল ও খুব রেগে আছে।জাহরা একপাশে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল।পথে সউদ কোন কথা বললোনা।জাহরাদের বাড়ীর সামনে তীব্র শব্দে স্কিড করে গাড়ী থামিয়ে নিজে বের হলো তারপর জাহরার পাশের দরোজাটা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।জাহরা ধীর পায়ে নেমে এলে আবার সেই ‘ধুম’ শব্দে দরোজা লাগিয়ে নিজের সিটে উঠে বসল।সোজা টান মেরে গাড়ীটা জাহরার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো!”

….

চলবে……

 

দুইবোন

  ৭ম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

*******************

সবসময় যে স্পিডে চালায় তারচেয়ে বাড়িয়ে গাড়ী চালাচ্ছে সউদ।ওর মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।বিশেষ করে জাহরার শেষ কথাটায় ওর বুকে ঘাই এর মত লেগেছে।

সাধারনত খুব মন খারাপ হলে সউদ ওমরের কাছে যায়।আজ অনেকদিন হলো ওমরের সাথে দেখা হয়না।

সউদ গাড়ী ঘোরালো ওমরের বাড়ীর দিকে।তার আগে ওকে ফোন করে জেনে নেয়া দরকার সে এখন কোথায় আছে।

-“হ্যালো,বন্ধু কেমন আছিস রে?”

-“আরেব্বাবা..তুই এতদিন পরে কোত্থেকে?রং নাম্বার লেগে গেলো নাকি?”

-“হ্যাঁ…বল্..বল..সবাই বলে তুইই বা বাদ যাবি কেন!”

-“বলাবলি পরে,তার আগে বল্,কি মনে করে এই গোধূলি বেলায় মোরে স্মরণ করিলি!”

-“ভাঁড়ামি হচ্ছে, না? শালা..আমি মরি আমার জ্বালায় আর উনি আছেন মজায়!”

-“তা তুমি দশ বছর পরে হ্যালো বলবা আর আমি সত্য বললেই দোষ?”

-“আচ্ছা,এখন এসব কথা ছাড়..!.তুই কই আছিস সেটা বল্ ?”

-“কই মানে?বাংলাদেশে..!”

-“ওহ্ হো…বাংলাদেশে তো জানি,মানে বাসায় আছিস কিনা জানতে চাচ্ছি!”

-“জ্বী,আমি বাসাতেই আছি,বাসার ঠিকানা হলো…!”

-“দাঁড়া শালা আসছি,তোর বাদরামী আমি বের করছি!”

-“আয়..আয়…আমি তোর পথ চেয়ে বসে থাকবো..!”

আধাঘন্টা পর ওমরের বাড়ী পৌঁছুল সউদ।ওকে দেখে ওমর একগাল হাসি দিয়ে বলল-“তাহলে সত্যিই তুই এলি..?”

-“তোর কি মনে হয়,ফান করছিলাম?”

-“আয়..আয়……সত্যিই..সেই যে তোর গেষ্টহাউজে গেলাম তারপর আর কোনো খবর নেই!”

-“হুঁ..ঠিক বলেছিস!”

-“আগে বল্….চা না কফি..?”

-“কোনোটাই না রে,আইসক্রিম খেতে বসেছিলাম সেটাও পুরোটা জুটলো না!”সউদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

-“মানে..?”

-“বড্ড ঝামেলায় আছি রে ,বুঝলি?”

-“কিসের ঝামেলা? তোর চেহারাতো আপেলের মত চকচক করছে, দেখে তো মনে হচ্ছে ডুবে ডুবে খুব জল খাচ্ছিস!”

-“আর..জল বলিসনা …গরম জল বল্ !”

-” কি হয়েছে বলতো ?”

-“বিয়ে করেছি বুঝলি?এই গেল সপ্তাহে!”..

..সউদ ওমরের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য থামল!

..

ওমরের মুখ হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল-“ওঠ্ এখান থেকে!”

সউদ ওর পিঠে চাপড় মারল-“ধুস্..শালা আগে শোন্ না..এ বিয়ে তোদের গতানুগতিক সুখের বিয়ে নয়, এ বড় যন্ত্রনার বিয়ে…!”

-“মানে…?ওমর কিছুটা অবাক হলো।

-“পুরোটা বলছি শোন্,মাঝখান থেকে বললে বুঝবি না!”সউদের কথায় ওমর সিরিয়াস ভঙ্গিতে সামনে এসে বসল।

সউদ তখন বলল-“আমার গেষ্ট হাউজের সেই ফিমেল সিঙ্গারটার কথা মনে আছে?”

-“হ্যাঁ…হ্যাঁ..আরে..ঐ যে খুব গায়ে পড়া মেয়েটা..কি যেন নাম?”

-“নোভা!”সউদ বলল।

-“ও..ইয়েস!হ্যাঁ..তা কি হয়েছে ওর?”

..

তখন সউদ সেদিন রাতের ঘটনা থেকে শুরু করে নোভার বিয়ে করতে চাওয়া,সউদকে মেন্টালী প্রেসার ক্রিয়েট করা,বিয়ের দিন মুম্বাই চলে যাওয়া এবং পরিশেষে নোভার বোন জাহরাকে বিয়ে করার তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেবার সব কথাই জানাল সউদ।ওমর অবাক হয়ে বলল-“তুই নোভার বড় বোনকে বিয়ে করেছিস?”

-“উঁহুঁ..নোভার কোনো ভাইবোন নেই।বলতে পারিস ও নোভার সৎবোন!”

-“তা…তুই একেবারে একেবারে নোভার বোনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলি,কুচ্ বাত তো হ্যায়..!”

সউদ কিছু বলল না।

ওমর ওর দিকে ঝুঁকে বলল-“,তুমি তো শালা যাকে তাকে বিয়ে করার পাত্র নও।কত মেয়ের মন ভেঙ্গেছো সে খবর আছে?ভাবী দেখতে কেমন?”

সউদ মুচকি হেসে বলল-“সেইরকম!”

-“তাই নাকি?ছবি আছে সাথে?”

সউদ সামান্য গম্ভীর হলো-“নেই..আর থাকলেও দেখানো যেতো না কারন সে যথেষ্ট ইসলামিক মাইন্ডেড!পর্দা মেইনটেন করে!”

ওমর জিভ কাটল-“ওহ্,তাহলে তো বিষয়টা অন্যরকম।তা সুন্দরী ধার্মিক স্বপ্নের কন্যা পেয়ে যাওয়াতেই কি এই পাত্রী বদল?”ওমর চোখ মারল।

..

সউদ মাথা নাড়ল-“না রে বিষয়টা এমন না…আমি নিজেও খুব ভেবেছি হঠাৎ জাহরাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমার জন্য যথেষ্ট সাহসের বিষয়।তবে সত্যি বলতে কি,একটা অপরাধবোধের কারনেই নোভাকে বিয়ে করতে চাওয়া,যদিও মন সায় দিচ্ছিলো না তবু ভেবেছি…কিন্তু বিয়ের দিন নোভার হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ায় আমি খুব বেশী অবাক হইনি কারন নোভা খুবই পারসুয়েসিভ মেয়ে,নিজের কাজ আদায় করে নিতে ওস্তাদ।ওর বোনকে একদিন একঝলক দেখেছি,মনে গেঁথে গেছিল।তাছাড়া নোভার মুখে শুনেছি সে নাকি খুব সাদামাটা ধরনের মেয়ে!সবমিলিয়ে ঐ পরিস্থিতিতে নিজেকে নোভার খপ্পর থেকে বাঁচানোর এরচে ভালো সুযোগ আর মনে আসেনি।তবে এখন বুঝি..কাজটা স্বার্থপরের মতই হয়ে গেছে। সেদিন জাহরার মন জানতে চাইনি..!”

-“তা এখন সমস্যাটা কি?”

-“আরে কি বলবো!সেদিন বাবার চাপে পড়ে আমার প্রস্তাবে রাজী হলেও এখন সুযোগ পেলেই পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে।”সউদ হতাশ সুরে বলল।

-“ওহ্..হাউ রোমান্টিক!”

-“আমার অবস্থা কাহিল আর তুই বলিস রোমান্টিক?”

-“আরে সব ঠিক হয়ে যাবে,যখন তোর প্রেমে পড়ে যাবে না দেখবি জীবনটা কত মধুর,কারন ধার্মিক মেয়েরা তাদের মনপ্রাণ স্বামীকেই সঁপে দেয়,এদের মনোযোগ চতুর দিকে থাকেনা,স্বামীই এদের সব।”

-“আসলে কি থেকে যে কি হয়ে গেল!”

-“ভালোই হয়েছে!যাকে বলে ‘শাপেবর’ আর কি!”ওমর হাসল।

-“ভালো বলেছিস,যাই বন্ধু।ভালো কথা সামনের ফ্রাইডে কিন্তু তোকে থাকতেই হবে।”!

-“ও..ক্কে বস্..!”সউদ ওমরকে জড়িয়ে ধরল,দুই বন্ধু গলা মিলাল।

..

জাহরার বিশেষ অনুরোধে গায়ে হলুদটা বাদ দেয়া হলেও অনিতা এসে জাহরার সাথে দেখা করে গেল।খুব ধুমধাম করে শহরের গনমাণ্য ব্যাক্তিদের উপস্থিতিতে সউদের ওয়ালিমা সম্পন্ন হলো!

আশফাক মেয়েকে সউদের হাতে তুলে দিতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন!

-“আমার মা মরা মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম,বাবা।ওকে দেখে রেখো,কষ্ট দিয়োনা।সউদ তাঁর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল।মাসুদুর রহমান আশফাককে জড়িয়ে ধরে বললেন-“আপনি ভাববেন না বেয়াই সাহেব,আমি বউ নয় মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি।সে আমার মেয়ের মতোই সেখানে থাকবে।আপনার যখনই মন চাইবে,তখনি সোজা চলে আসবেন!”

সব অতিথি বিদায় নিতে নিতে রাত দুটোর ওপর বেজে গেল।অনিতা জাহরাকে ওর রুমে সাজানো পালঙ্কে বসিয়ে দিয়ে বিদায় চাইল-“যাই ভাবী,পা দুটো ব্যথায় টনটন করছে।এবার তোমার সংসার তুমিই সামলাও!”বলে অনীতা গেটটা টেনে দিয়ে গেল।জাহরার বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।এই ক্ষণটির ভয়ই সে করছিলো।এখন সেই অভদ্র লোকটির মুখোমুখি হতে হবে আজ।কি বলবে না বলবে… এসব সাত পাঁচ ভাবছে জাহরা!

হঠাৎ ‘খুট”শব্দ হতেই জাহরা নিজের ঘোমটাটা টেনে আরো লম্বা করে বেশ গুটিয়ে বসল।তারপর দীর্ঘক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই।জাহরা ঘোমটা সরিয়ে তাকাল।

লোকটা নেই!পুরো ঘর খালি।জাহরা অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল।দেখতে না পেয়ে হাঁটুগেড়ে দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে উঁকি মারতে লাগল,সুবিধের জন্য ঝোলানো ফুলের চাকতি থেকে একটা ফুলের দড়ি ধরে উঁকিঝুঁকি চালাতে লাগল।হঠাৎ পেছন থেকে ‘কি খুঁজছেন’ শব্দে জাহরা বিষম চমকে উঠলে ওর হাতের টানে গোটা ফুলের চাকতিটাই ওর ওপর পড়ে ওকে ঢেকে ফেলল!দুহাত দিয় সরাতে চেষাটা করেও পারলোনা,ফুল দিয়ে পুরো ঢেকে গেছে ও।সউদ একটানে চাকতিটা ওর ওপর থেকে সরিয়ে বলল-” কি…..ঠিকআছেন তো?”

-“জ্বী..আচ্ছা..এসব ফুল টুলের কি দরকার ছিলো বলুন তো?”

-“প্রশ্নটা আমাকে না করে অনিতাকে করলে সঠিক উত্তরটা পাবেন,আশাকরি”!

বলে সউদ বিছানায় বসে পড়ল।জাহরা খানিকটা সরে গেল।

সউদ বলল-“আমাকে যা খুশি তাই ভাবুন,সমস্যা নেই কিন্তু বিয়েটা যে নাটক করে হয়নি বা ছেলেখেলা নয় তা আমার পরিবারের আন্তরিকতা দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?”তাই আপনার প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে ক্যাফে ঝিলের ঐ বাজে কথাটা আর বলবেন না প্লিজ!”

জাহরা মুখ নামিয়ে কথাগুলো শুনলো।আড়চোখে সউদকে দেখল।গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ী জমেছে..বিয়ে উপলক্ষেও সে দাঁড়ী শেভ করেনি।দেখতে ভালো লাগছে..!”হঠাৎ নিজেকেই বকা দিল,এসব কি ভাবছে সে?”

সউদ দাঁড়ালো-“নিন্….শুয়ে পড়ুন…আপনি বিছানায় ঘুমান!”

-“আর আপনি?”জাহরা আস্তে করে প্রশ্নটা করলো!

-“আমার চিন্তাটা আমার উপরই নাহয় ছাড়ুন!”

বলে চাদর সরিয়ে বালিশটা নিয়ে চলে গেল সউদ।

….

চলবে…..

 

দুইবোন

 ৮ম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

*******************

একটা অপরাধবোধ জাহরাকে কুড়ে খেতে লাগল।

যার বাড়ী,যার ঘর-বিছানাপত্র সে না শুয়ে জাহরা শুয়ে আছে।মাত্র একঘন্টার মধ্যে এসে তাকে নিগৃহীত করেছে।এটা কেমন যেন লাগছে!

কোথায় শুয়েছে লোকটা?না দেখলে শান্তি পাচ্ছেনা।জাহরা উঠল,পা টিপে টিপে বারান্দা সহ পুরো ঘর খুঁজল,নেই।আরে?লোকটা গেলো কোথায়?

জাহরা বারান্দার গেটে দাঁড়িয়ে আছে তখন পেছন থেকে সউদ বলল-“কি? কোনো সমস্যা?”বাথরুমের দরোজা বন্ধ করে বলল সউদ।

দৃশ্যত কেঁপে উঠল জাহরা।

লোকটা কি অদ্ভুত! খুঁজলে তাকে পাওয়া যায়না,অথচ হঠাৎ করে জ্বীন-ভুতের মত উদয় হয়।

সউদ বলল-“কথায় কথায় এতো চমকে যান কেন?এতো ভীতু হওয়া তো ভালো না!কি খুঁজছিলেন, বলুন?”

-“ন্..না…শাড়ী বদলানোর জন্য কোন জায়গা নেই?”

-“কেন,এই রুমে?বলে সউদ সাথে নাথে বলল-“আপনি ডোর লক করে দিন,আমি বারান্দায় বসছি।”

বলে সউদ টাওয়েল ঘাড়ে রেখে ওয়্যারড্রব খুলে কাপড় হাতড়াতে লাগল।জাহরা কাছে যেয়ে বলল-“কি খুজছেন?”

-“এমনিই শার্ট খুঁজছি…থাক্…..আপনি আগে ফ্রেশ হোন,পরে শার্ট নেবো! রাত বাড়ছে,অযথা আমার জন্য আপনার দেরী হচ্ছে।”

সউদ টাওয়েল কাঁধে নিয়েই বারান্দায় চলে গেল।জাহরা ওর লাগেজ খুলে তা থেকে একটা থ্রি পীস বের করে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে পোষাক বদলালো।শাড়ীতে সে ততটা অভ্যস্ত না,তাই ওটা ঝামেলা লাগে পড়তে! কাজ শেষ হলে বাতি জালিয়ে সোফার ওপর পড়ে থাকা সউদের কোর্ট প্যান্ট টাইগুলো গুছিয়ে রাখলো,কোনোটা হ্যাঙ্গারে ঝোলালো!তারপর ড্রয়ার থেকে একটা ঢোলা টিশার্ট বের করে হাতে নিয়ে বারান্দায় গেল।

সউদ বারান্দার গ্রীলে দুই হাত দুপাশে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়েছিল।পায়ের শব্দে পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে মনে চমকে গেল।জাহরাকে ঘরোয়া পোষাকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে।

দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিল,তাকিয়ে থাকতে দেখলে আবার কি না কি বলে বসে!

-“নিন্,এটা চলবে?”টিশার্টটা এগিয়ে দিল জাহরা।

সউদ অবাক হয়ে বলল-“আপনি এনেছেন কেন?আমিইতো নিতে পারতাম!”

-“আমি দিলে তো সমস্যা নেই,হাতের কাছে পেলাম তাই নিয়ে আসলাম।

সউদ হাত বাড়িয়ে শার্টটা নিয়ে বলল-“থ্যাংকস।”

জাহরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।

সউদ বললো-“ঘরে যান,শুয়ে পড়ুন,বাইরে শীত বেশী”!

জাহরা পায়ে পায়ে ঘরে চলে এলো!বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল,’মাত্র ক’টা দিনের মধ্যেই তার জীবনটা কি আমূল বদলে গেল।আজ সে এই ঘরের ঘরণী,অথচ এই ঘরটাই তার না, সে যেন  উড়ে এসে জুড়ে বসেছে কারো অগোচরে…!

এসব ভাবতে ভাবতে কখন চোখ বন্ধ হয়ে গেল টেরই পেলোনা জাহরা।শেষরাতের শীতের কাঁপুনিতে ঘুম ছুটে গেল।পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা চাদর খুলে গায়ে জড়াতে গিয়েই ডিম লাইটের আলোয় চোখে পড়ল রুমের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা থ্রি সিটের সোফায় শুয়ে আছে সউদ।দুহাত দিয়ে দুইহাতকে ধরে রেখেছে,তারমানে সেও শীতার্ত।জাহরা চাদরটা নিয়ে আস্তে করে সউদের গায়ে উড়িয়ে দিল।

ঘড়ি দেখল,একটু পরেই আযান হবে।শীতে কাঁপতে কাঁপতে বাথরুমে গেল।গীজার থাকায় সুবিধে হয়েছে,অন করলেই টকটকা গরম পানি আসে।জাহরা অযু করে বেরোতেই আযান হলো দুর মসজিদে। জায়নামাজ খুঁজে নিয়ে নামাজ পড়ল।তারপর লাগেজ থেকে শাল বের করে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল।

সকালে অনীতার ডাকে ঘুম ভাঙ্গল।সউদ তখনো ঘুমে।জাহরা গেট খুলতে যেয়ে হঠাৎ মনে পড়তে থমকে দাঁড়াল-“অনীতা এভাবে দুজনকে দুজায়গায় দেখলে কি ভাববে?বলা যায়না শ্বশুড় তারপর জাহরার বাবার কানে চলে যাবে কথাটা।

দ্রুত সউদের কাছে গিয়ে চাপাস্বরে ডাকল-“এই যে,উঠুন তাড়াতাড়ি।অনীতা ডাকছে।

কয়েকবারের ডাকে সউদ চোখ মেলল-“কি হয়েছে?”

-“কিছু হয়নি,অনিতা ডাকতে এসেছে!”

-” তো যান না….গেটটা খুলে দিয়ে আসুন।আমি আরো ঘুমাবো….এখন উঠবো না…”বলে সউদ আয়েশ করে ওপাশ ফিরে ঘুমাল।

জাহরা এবার জোর তাগাদা দিল-“আরে,অনিতা এসেছে তো…আপনি বিছানায় আসুন,বোঝেননা কি বলছি…?”

সউদ এবার ঢুলতে ঢুলতে উঠে বসল।তারপর হেলেদুলে কোনমতে বিছানা পর্যন্ত যেয়েই ধপ করে গড়িয়ে পড়ল।চাদর বালিশ সব সোফাতেই পড়ে রইল।

-“উফ্..কি ঘুমকাতুরে রে বাবা…” বলে জাহরা একটু বিরক্ত হয়েই সোফা থেকে ওর পরিত্যক্ত বিছানা চাদর সব দুইহাতে আগলে বিছানায় নিয়ে রাখল।

সউদ জাহরার পরিত্যক্ত বালিশটা টান দিয়ে তাতে মুখ গুঁজল,একটা মিষ্টি মেয়েলী গন্ধ লেগে আছে তাতে,সউদ ঘুমের অতলে ডুবে গেল।

জাহরা দ্রুত চাদরটা সউদের গায়ে দিয়ে হাতের বালিশটা বিছানায় সাজিয়ে রাখল।তারপর দরোজাটা খুলে দেখল অনীতা হাসছে-“গুড মর্ণিং ভাবী”!

জাহরা মৃদু স্বরে সালাম দিলে অনীতা ভ্রু কুঁচকাল-“সকাল বেলাতেও সালাম দিতে হয়,জানতাম না তো?”

জাহরা হাসল-“বিষয়টা এমন না।সকাল সন্ধ্যা বলে কোনো কথা নেই,রাসুল সাঃ এর আদেশ হচ্ছে দুজন মুসলমান পরষ্পর দেখা হলেই সালাম দিবে তারপর কথা শুরু করবে।”

-“তাই?অনিতা হেসে সালাম দিলে জাহরা উত্তর দিয়ে বলল-“ভেতরে এসো?”

-“না,তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসো।আব্বু তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে।”

-“আমি ফ্রেশই আছি,চলো!”

অনিতা কিছুটা ইতস্তত করে বলল-“চলো”!

…..

মাসুদুর রহমানের সামনে যেয়ে জাহরা সালাম দিল।তিনি খুব খুশি হয়ে জাহরাকে কাছে ডেকে পাশে বসালেন।তারপর বললেন-“তোমার শ্বাশুড়ী বেঁচে থাকতে এবাড়ীতে কিছুটা ইসলামের চর্চা হতো, সে যাবার পর থেকে আমরা সবাই দুনিয়াবাদী হয়ে পড়েছি।এবার তুমি এসেছো আবার আমাদের ঘরে ইসলাম জিন্দা হবে,আশাকরি।”

জাহরা মৃদু হাসল।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শ্বশুড়কে নাস্তা এগিয়ে দিল।

অনীতাকে জিজ্ঞেস করল-“ভাইয়া নাস্তা খাবেনা?”

-“ও…ঘুমাচ্ছে ভাবী।

মাসুদুর রহমান নাস্তা খেতে খেতে বললেন-“বুঝলে বৌমা….আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন,তোমার ঐ গায়িকা বোন যদি আজ তোমার জায়গায় থাকতো তাহলে সে এখন ‘আব্বু টা টা বাই বাই’ বলে বেরিয়ে…….এ  পর্যন্ত বলেই অনীতার “উফ্ আব্বু”…শুনে মাসুদুর রহমান থেমে গেলেন!

ফ্যাকাসে হেসে বললেন-“স্যরি বৌমা,আসলে আমি অত ভেবে কথাটা বলিনি,তুমি কিছু মনে নিওনা।”

“বৌমা” শব্দটা জাহরার মনে অন্যরকম এক অনুভূতি সঞ্চার করল।যে অনুভূতির সাথে ওর আগে পরিচয় ছিলোনা।

সউদের ঘুম ভাঙ্গলো সেই বেলা এগারোটারও কিছু পরে।জাহরা নাস্তা নিয়ে ঘরে গেল।সউদ ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকে দেখল,জাহরা ছোট টি টেবিলটায় নাস্তা সাজাচ্ছে।

সউদ বলল-“আমি টেবিলে যেয়েই খেয়ে নিতাম…কষ্ট করে টেনে আনার কোনো দরকার ছিলোনা!”

তারপর নাস্তার প্লেট টেনে খেতে শুরু করল।একটু পরেই মনে হতে বলল-“ওহ্…আপনি খেয়েছেন?”

জাহরা মাথা নাড়ল।

তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে জাহরা বলল-“এভাবে আমাকে ‘আপনি’ ‘আপনি’ করে কথা বললে অনীতার সন্দেহ হতে পারে,পরে আব্বুকে যদি বলে দেয় তাই আপনি আমাকে তুমিই বলবেন”।

-“অনুমতি দেবার জন্য শুকরিয়া।”সউদ নিস্পৃহ গলায় বলল।

নাস্তা সেরে সউদ ড্রইংরুমে চলে গেল আগত কিছু অতিথিদের সাথে দেখা করার জন্য।অনীতা জাহরার রুমে এসে জাহরার সাথে গল্প জুড়ে দিল।

জাহরার একটু মন খারাপ হলো এটা ভেবে যে,আর কিছুদিন পর অনীতা চলে গেলে সে একা পড়ে যাবে!দেখতে দেখতে দিনগুলো একটা নিয়মের মধ্যে চলে এসেছে।সউদ নিজের মতো থাকে,খায় বাকি সময় অফিস আর ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ঘরে সাধারনত রাত ছাড়া আসেনা।এসে টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা বলে ঘুমিয়ে পড়ে।তবে জাহরার বিশেষ অনুরোধে সউদ বিছানায় আসতে রাজী হয়েছে আর জাহরা সোফায় ঠাঁই নিয়েছে।জাহরা তাকে বুঝিয়েছে-“অন্তত অনিতার যাবার দিন পর্যন্ত থাকুন।কারন আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা বেশ ঝক্কির কাজ।আমি সোফায় থাকলে চট করে উঠে সব গুছিয়ে ফেলতে পারবো…”!

সউদ সংকোচে হলেও রাজী হয়েছে।

দেখতে দেখতে অনিতা যাবার দিন এবং একইসাথে নোভা আসার দিনও ঘনিয়ে এলো।আগামী সপ্তাহে অনিতা চলে যাবে তার দুদিন পর নোভা আসার কথা যদি সব ঠিক থাকে তো!

অনীতার যাত্রা উপলক্ষে জাহরা অনিতা আর তার স্বামীর পছন্দ জেনে নিয়ে একগাদা গরুর মাংসের ঝুড়ি,সাদা কোরমা রান্না করেছে।গোটা আটেক ইলিশ মাছ ভেজে রেখেছে।কয়েক পদের পিঠা তৈরী করেছে।এসব ডিপ ফ্রিজে ভরে রেখে দিয়েছে।যাবার সময় অনীতার লাগেজে ভরে দেবে।অনিতার লাগেজও জাহরাই গোছাতে সাহায্য করছে।একপর্যায়ে অনীতা কেঁদেই ফেলল-“আম্মু’র কথা খুব মনে পড়ছে।আম্মু মারা যাবার পর থেকে এসব করে দেবার কেউ ছিলোনা,আব্বু ভাইয়া তো গাদাগাদা জিনিস কিনে সাথে দিয়ে দেয় কিন্তু এসব রান্না করে একমাত্র আম্মৃই দিতো”!

জাহরা মুচকি হাসল শুধু কিছু বললোনা।সে নিজেও ভাবছে যে এ বাড়ীতে আর আছিইবা কয়দিন! নোভা আসলে কি হয় কে জানে!বরং অনীতার জন্য এটুকু করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।আর অনীতা চলে যাবার কথা মনে হলে কষ্টও লাগছে।

যাবার আগের দিন অনীতা জাহরার হাত ধরে বলল-“ভাবী,আমরা দুইভাই বোন তোমার মতই মা হারা।তুমি মেয়ে মানুষ,মাতৃত্ব তোমার স্বভাবজাত তাই আমাকে আপন করে নিয়েছো।আমার বিশেষ অনুরোধ,তোমার বিয়ে যেভাবেই হোক না কেন,বিয়ে তো তোমার সাথেই হয়েছে।আমার ভাইটাকে কষ্ট দিওনা।আর কারো প্রতি সুবিচার করতে গিয়ে ভাইয়ার প্রতি অবিচার করোনা যেন।ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালোবাসে,জানো তো?”

শেষ কথাটায় চমকে উঠল জাহরা।-“কি বললে,সে আমাকে ভালবাসবে কেন?”

-“ভাবী তুমি অনেক বুদ্ধিমতী হলেও কিছু জিনিসে বোকা।ভাইয়ার আচরণ কত বদলে গেছে।আগে ফাটিয়ে গান শুনতো এখন ওর রেকর্ড প্লেয়ারে ধূলো জমেছে,দুটো দদিন যেতোনা দাঁড়ী শেভ করে ঘুরতো সেটা বন্ধ হয়েছে।বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাসায় জম্পেশ আড্ডা দিতো সেটা তো পুরোপুরিই বন্ধ,আর….!থাক্,এটা পরে বলবো!”

জাহরা চুপ হয়ে গেল।

অনিতা চোখ মুছে বলল-“,নোভা আসা পর্যন্ত থাকতে পারলে ভালো হতো,জানিনা আমার ভাইটার ভাগ্যে কি আছে!”

জাহরা চুপ করে ওর দিকে চেয়ে রইল।অনিতা হাত বাড়িয়ে দিল-“একটা কথা দাও ভাবী,যা’ই ঘটুক না কেন,তুমি ভাইয়াকে ছেড়ে যাবেনা!কথা দাও..!”

..

জাহরা দ্বিধায় পড়ে গেছে।

ওকে চুপ থাকতে দেখে অনিতা জাহরার হাত টেনে ধরে আবার বলল-“প্লিজ,ভাবী,প্রমিজ মি,তুমি দ্বীনদার মেয়ে,স্বামী তোমার মাথার তাজ।বিনাদোষে তাকে ছেড়ে গেলে আল্লাহর কাছে তোমাকে জবাব দিতে হবে।কথা দাও তুমি ভাইয়ার পাশে থাকবে?

বেশ কিছুক্ষণ চুপ খেকে জাহরা বলল-“কথা দিলাম,ওর সাথে কোনো অন্যায় করবোনা!”

অনিতা জাহরাকে জড়িয়ে ধরল।

..

অনিতা চলে গেল।বাসার সবারই মন খারাপ। সউদও কেমন আনমনা হয়ে গেছে।সেদিন জাহরা নিজেইঘুমাতে যাবার আগে সউদের পাশে বসে অনিতার কথা তুলল।সউদও অনিতার ছেলেবালার কিছু কথা বলল।সউদ বুঝে গেছে জাহরা কোন বিষয়গুলোতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনা বা চটে যায়,সউদ সেসব বিষয় সযত্নে এড়িয়ে চলে।

জাহরা উঠে চলে যাবার আগ মুহূর্তে বলল-“কাল,নোভা আসছে…জানেন তো!”

-‘মম..নাহ্..আমি কি করে জানবো?”

-“কালকে আমি বাসায় যেতে চাই,আপনি কি বলেন?”

-“যেতে ইচ্ছে হলে যাবে!”

জাহরা উঠে দড়াতে নিলে সউদ প্রশ্ন করল-“যাবে বলছো..ফিরবে কখন তা’তো বললেনা!”

জাহরা নিরব রইল। কারন তার ইচ্ছা দুটো দিন বাসায় থেকে আসতে।সেটা বলার জন্য মুখ খুলতেই সউদ শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলল-“আমি তোমাকে আনতে যাবো…যত রাতই হোক!ফোন দিলে নেমে আসবে,আমি ভেতরে যাবো না,বুঝেছো?”

-“ওও…আমিতো বাসায় দুটো দিন থাকতে চেয়েছিলাম”!থাকবো?”

সউদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল-“না”!

জাহরা চুপ করে বসে রইল।সউদ ততক্ষণে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুম!!

চলবে…..

 

দুইবোন

 নবম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

********************

জাহরাদের বাড়ীর সামনে গাড়ীটা রাখল সউদ।জাহরা নেমে গেলে সে স্মরণ করিয়ে দিল-“রাতে নিতে আসবো,ফোন দিলেই নেমে আসবে”!

জাহরা মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল।সে সউদের মনোভাব বুঝতে পারছেনা।তাকে সে বাড়ীতে থাকতে দিতে একদমই রাজী নয়,কেন,কে জানে!

..

বাসায় ঢুকে দেখল আশফাক পত্রিকা পড়ছে।জাহরাকে দেখে খুশি হয়ে বল্লেন-“আরে,এইতো আমার জাহরা মামনি চলে এসেছে”!

-“কেমন আছো, বাবা? নোভা কই?

-“ও তো এসেই গোসল সেরে শুয়েছে আর ওঠেইনি,জার্নি করেছে ক্লান্ত…তোর খবর কি?

-“সেদিনের খবর কি শুনেছে? কি বলল?”

-“বলার আর সময় পেলাম কই,এসেই তো ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো!”

-“আমার খুব চিন্তা হচ্ছে!”

-“না,চিন্তা করে কি হবে,যা বাস্তব তা ওকে শিকার করে নিতেই হবে।তাছাড়া আমরা তো সেধে সমন্ধ করিনি ওরাই প্রস্তাব করেছে।বিশেষ করে সউদ চেয়েছিল বলেই।আর তুই ও তো আমার দিকে তাকিয়ে রাজী হলি,এতে তোর তো কোনো দোষ নেই,আমার সম্মান বাঁচাতে তুই বাধ্য হয়ে রাজী হয়ে…বলে আশফাক সামনের দিকে তকিয়ে থমকে গেলেন। তার দৃষ্টি অনুসরন করে জাহরা পেছনে তাকিয়ে দেখলো নোভা অগ্নিদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।জাহরা ওর হাত ধরতে গেলে এক ঝটকায় হাত সররিয়ে দিয়ে আশফাক হোসোনকে উদ্দেশ্য করে বললেন-“কি বললে তুমি?কার বিয়ে?”

আশফাক শান্ত স্বরে বললেন-“যা বলেছি,তা তো শুনেছিস,আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

নোভা জাহরার দিকে তাকাল-“তোর সাথে তো আমার দু’বার কথা হয়েছে।তুই তো আমাকে একবারো একথা বলিসনি?”

জাহরা বিপন্ন বোধ করল-“নোভা,আমি তোকে কয়েকবার বলতে চেয়েছি কিন্তু তুই গানের পারফরমেন্স খারাপ হবার ভয়ে এদিকের কোন খবরই শুনতে চাসনি!তাছাড়া বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি

…সউদের বাবা….”!

নোভা দুই হাত ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল-“সব তোদের চক্রান্ত।তোরা বাপ-বেটিতে মিলে আমার স্বপ্নকে পায়ে দলে নিজেদের লোভ চরিতার্থ করেছিস।তুই….. তুই যতই ভালো হবার ভান করিমনা কেন,তোর মনে লোভ ছিল!তুই লোভী..লোভী..বলে নোভা হিস্টিরিয়া রুগীর মত চেঁচাচ্ছিল,ওদিকে জাহরা কেঁদে আকুল এমনসময় পটকা ফাটার মতো শব্দে জাহরা চমকে তাকাল দেখলো নোভা গালে হাত দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে…!

বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন-“অনেক সহ্য করেছি তোমার বেহায়াপনা,আর না!ইচ্ছে হয়েছে বিয়ের পাত্র যোগাড় করেছো,ইচ্ছে হয়েছে বরযাত্রা বাড়ী পর্যন্ত ডেকে এনেছো,ইচ্ছে হয়েছে বিয়ের দিন আমার সম্মানকে পায়ের নিচে ফেলে নিজের স্বপ্নপূরণে ছুটে গেছো! একবারো ভাবোনি যে আমাদের কি হবে,মানুষকে কি জবাব দেবো!তখন সেটা ঠিক ছিলো তাই না? লোভী জাহরা না তুমি? তুমি একটা বেয়াদব মেয়ে….তোমার দেয়া অপমান জাহরার কারনে সম্মান হয়ে আমাকে সমাজে অপদস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করেছে…!”

নোভা হিসহিসিয়ে বলল-“তুমি তো আমার বাবা না,এজন্যই এমন করলে,যদি আমার বাবা হতে তবে কিছুতেই এটা পারতে না!”

বলে ঘরে ঢুকে প্রবল শব্দে দরোজাটা বন্ধ করে দিল নোভা।

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছলেন।জাহরা বাবার কাছে এসে বলল-“ওকে মারলে কেন,বাবা?যদি রাগে অভিমানে উল্টা পাল্টা কিছু করে বসে?”

বাবা মাথা নাড়লেন-“লোভী মানুষেরা দুনিয়াপ্রেমী হয়,ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না!”

-“আমি যাই,দেখি ওকে বোঝাতে পারি কিনা!”জাহরা উঠে দাঁড়াল।

…..

নোভা হাতের কাছে কাঁচের গ্লাসটা আছড়ে ভাঙ্গল।তারপর বিছানায় দুহাঁটুতে বেড় দিয়ে বসে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো-“তুমি আমার সাথথে এমন করতে পারোনা,তোমার এতো সাহস হয় কি করে তুমি নোভাকে বিট দিতে চেষ্টা করো? মিঃসউদ তোমার বিয়ের সাধ আমি ঘুচাচ্ছি।আই’ল টিচ ইউ আ হার্ড লেসন।”

এমন সময় জাহরা গেট নক করল-“নোভা..সোনা বোন্…আমার একটা কথা শোন্..!একটু গেটটা খোল্..প্লিজ!”

নোভা মুখ বাঁকা করে হাসল,নিজেকেই যেন নিজে বলতে লাগল-“তোর উপর বিশেষ রাগ নেই আমার,কারন তোর অত সাহস নেই,এটা ঐ সউদ সাহেবের কাজ,সুযোগ পেয়েই আর দেরী করেনি!”

ওদিক দিয়ে নোভা দরজা ধাক্কাচ্ছে।নোভা বিরক্ত হয়ে উঠল।একটানে গেট খুলে বিরক্ত হয়ে বলল-“কি শুরু করেছিস?”

জাহরা ওর গালে হাত রেখে বললো-“আমি জানতাম তুই কষ্ট পাবি,বিশ্বাস কর্,পুরো ব্যপারটাতে আমার কোনো হাত ছিলোনা,আমি পরিস্থিতির শিকার!তুই আমাকে দেষারোপ করছিস,অথচ…!”

-“কেন করবোনা,বল্?সউদ সেদিন অপমানিত বোধ করেছে মানলাম,কিন্তু সে সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারতো…আমাকে অপমান কেতে পারতো…কিন্তু সেসব না করে সে তোকেবিয়ে করার প্রস্তাব দেয় কি করে?যেখানে সে তোকে এক নজর দেখে পর্যন্ত নাই….ব্যপারটা মোটেও সহজ না,জাহরা তুই যা’ই বলিস!”বলেই নোভা থমকে গেল-“সউদের সাথে তোর এর আগে দেখা হয়েছিল?”

জাহরা মাথা নাড়ল।ধীরে ধীরে বলল-“একদিনই দেখা হয়েছিলো…যেদিন তুই আমাকে দরোজা খুলতে বললি,তুই কাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে ওর সাথে বেরিয়ে গেলি,সেদিন! ”

নোভা উপর নিচে মাথা দোলালো-“ওউ….আচ…ছা….মনে পড়েছে।তারমানে…বিষয়টা তাহলে কি দাঁড়ালো?লাভ এট ফার্ষ্ট সাইট?মানে প্রথম দর্শনেই প্রেম? তাইতো বলি…..দেখা হলেই সউদ মিয়া খালি তোর কথা জিজ্ঞেস করতো,তোমার বোন কেমন আছে..কি করে..গান শোনে কিনা…কোন গায়ক পছন্দ..তারপর যখন শুনেছে তুই এসব পছন্দই করিসনা তখন থেমেছে।সত্যি করে বল্..সউদ লুকিয়ে তোর সাথে প্রেম করতো,তাই না?

জাহরা অবাক হয়ে  তাকালো-“এসব কি বলছিস?যা মুখে আসছে তাই বলে দিচ্ছিস? তুই ভালো করেই জানিস,আমি কেমন!তাছাড়া সউদ কি জানহো যে তুই বিয়ের দিন চলে যাবি?”

-“তাহলে সে তোকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলো কি করে?”

-“তার আমি কি করে বলবো? শোন্,সে যদি তোকে বিয়ে করতে চায়,আমি স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াবো!আমি…!”

-“জাহরা?”হঠাৎ আশফাকের কন্ঠ যেন চাবুকের মত আছড়ে পড়ল ঘরে।জাহরা চমকে তাকাল।আশফাক ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন-“শেষ পর্যন্ত তুই ও বোনের মতই বিয়েটাকে ছেলেখেলা বানিয়ে ফেললি? তোর বোনতো একশ লোকের সামনে আমার নাক নিচু করেছে আর এবার তুই সারা দুনিয়ার সামনে আমার মাথাটা কেটে ফেলতে চাস?”

জাহরা কিছু বলার আগেই নোভা বলে উঠল-“নোভা এতো সস্তা না যে কারো এঁটো চাঁটবে,হুঁহ্…!”বলে সে বারান্দায় চলে গেল।অমনি জাহরার ফোন বাজল।সে দেখল সউদ।যথাসম্ভব স্বর স্বাভাবিক করে সালাম দিল।ওপাশ থেকে সউদ জবাব দিয়ে বলল-“নিচে নেমে আসো,আমি গাড়ীতে অপেক্ষা করছি,উপরে আর উঠবোনা,রাখি!”

ফোন

জাহরা বাবার দিকে তাকাল।বাবা থমথমে গলায় বললেন-“ভালো হয়েছে,জামাই এসেছে।তুই বাড়ী যা!”

 

দশ মিনিটের মধ্যেই জাহরা নিচে নেমে এলো।ওর চোখগুলো লাল হয়ে আছে।সউদ গাড়ীর গায়ে হেলান দিয়ে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।জাহরাকে দেখে চোখে সানগ্লাসটা পড়ে নিলো তারপর জাহরার পাশের গেটটা খুলে দিলো।জাহরা গাড়ীতে বসতে নেবে তখনি ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ওর সামনে হাত লম্বা করে দিয়ে ওকে আটকালো-“এক মিনিট! চোখ দেখি?বলে জাহরার দিকে সামান্য ঝুঁকল।জাহরা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল-“সরুন,উঠতে দিন!”

-“উঁহুঁ..কিছু তো হয়েছে!আচ্ছা,চলো পরে শুনবো।এখন কি বাসায় যেতে চাচ্ছো?”

জাহরা তাকাল-“বাসায়ই তো যাবো!”

সউদ গাড়ীর চাবি দিয়ে কপালটা খানিকটা চুলকে বলল-“আপত্তি না থাকলে চলোনা,ডিনারটা বাইরে সারি..?”

জাহরা সামান্য মাথা নাড়ল।সউদ ওকে বসিয়ে গাড়ীর গেট আটকে নিজের সিটে ফিরে গেল।

….

ওপরে বারান্দা থেকে পুরো দৃশ্যটা দেখে নোভার গায়ে যেন আগুন ধরে গেল।সে বিড়বিড় করে বলল-“বাহ্,এতো প্রেম?সউদ সাহেব,এই ছিলো তোমার মনে?আমার নামও নোভা,তোমাকে দেখে নেবো আমি!”তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলে একটা নাম্বার টিপল-“হ্যাঁ,রাসেল ভাই,কাল্ স্টুডিওতে কখন বসবেন?…না..না..খুব দরকার…সেদিনের হেষ্ট হাউজে তোলা কিছু ছবি আছে টিপুর কাছে।সেগুলো নেবো..আরো কিছু কাজ আছে..!ওকে ছাড়ি,কাল দেখা হলে সব বলবো!”

ফোন রেখে নোভা নিজের বয়কাট চুলগুলো মাথা ঝাঁকিয়ে পেছনে ফেলে দিয়ে ক্রুর হাসি হাসলো!”

……

চলবে…..!

 

দুইবোন

 দশম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

*******************

সেদিনের সেই ক্যাফে শপটার কাছেই গাড়ী পার্ক করল সউদ।এখানে ও নিয়মিতই আসে বলে ওয়েটার ম্যানেজার সবাই ওকে ভালো করেই চেনে।তাছাড়া সউদ শপটা পছন্দ করে আরেকটা কারনে।একটা ঝিল এটার চারপাশ ঘিরে আছে।আর জায়গাটা খুব নিরিবিলি।মেইন রোডের একটু ভেতরে বলে গাড়ীর হর্ণের বিশ্রী শব্দটাও নেই।আর ক্যাফের দেয়ালগুলো পুরোটা স্বচ্ছ কাঁচের তৈরী বলে ভেতরে বসেই বাইরের ঝিলটা পুরোটা দেখা যায়।

গাড়ী থেকে জাহরা নামলে সউদ ওকে হাতের ইশারায় সামনে এগোতে বলল।সামান্য এগিয়েই থমকে দাঁড়াল জাহরা।কারন রাস্তা থেকে ঝিলে যাবার পথে গতরাতের বৃষ্টির পানি জমে আছে।অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রায় অনেকখানি পানি জমে ক্যাফে-ঝিলে যাবার পথটা বন্ধ হয়ে আছে।সউদও তা দেখতে পেল।চারপাশে তাকিয়ে দেখল আরেকটু সামনেই কয়েকটা বড় বড় ইট ফেলে ক্যাফেতে ঢোকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।সউদ জাহরাকে সেটা দেখালে জাহরা ওপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল,কারন ইটে পা দিলেও বোরকা ভিজে যাবার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।

সউদ বুঝতে পেরে বলল-“সমস্যাই বটে,উপায় নেই….তোমাকে বোরকাটা সামান্য উপরে তুলতে হবে!অসুবিধা নেই,তুলতে পারো…আশেপাশে কেউ নেই যে তোমার পা দেখবে।নাও,এগোও।”

জাহরা ফস করে জলে উঠল-“আশেপাশে কেউ নেই,না? আপনি তাহলে কি?”

-“ওহ্…স্যরি,স্যরি….আচ্ছা,আমি এগোই তুমি ধীরে সুস্থে পার হও!”বলে সউদ বিছানো ইট চারটাতে পা রেখে রেখে দুই লাফে ফুটপাথে উঠে গেল।পেছনে তাকিয়ে দেখে জাহরা দুই হাতে বোরকা পেঁচিয়ে ধরে দুইপা দুই ইটে রেখে কাঁপছে।সউদের আশঙ্কা হতে লাগল ঝুপ করে পানিতে পড়ে বেইজ্জতি কান্ড না ঘটিয়ে বসে।

সে পুনরায় ফিরে গিয়ে একপা ফুটপাথে, অন্য পা ইটের উপর রেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকল-“হাত ধরো আমার !”

-“লাগবেনা….পা..পারবো!”

-“পড়ে গেলে কিন্তু কাহিনী হবে ……..এই..এই….সউদ বলতে বলতেই জাহরা দ্বিতীয় বার পা বাড়ানোর আগেই বাম পা টা টলে উঠল। জাহরা ব্যালান্স হারিয়ে কাত হয়ে চিৎকার করে উঠল-“ও..মাগো…!” ততক্ষনে সউদ তাকে দ্রুত পাজাকোলা করে তুলে ফেলেছে।কয়েক সেকেন্ডের ব্যপার।তারপরই ফুটপাথের শক্ত মাটিতে ওকে নামিয়ে দিয়ে নিজেও সাবধানে ইট থেকে পা তুলল।

-“আগেই বলেছিলাম…এই গরীবের কথা কে শোনে,নাও এবার হাঁটো!”

জাহরা লজ্জায় মাথা নামিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল।সউদ ক্যাফের গেটে দাঁড়িয়ে ডাকল-“আরে..ঐদিকে কোথায় যাচ্ছো?এইতো গেট”!

জাহরা ফিরে এসে গেট দিয়ে ঢুকল।আড়চোখে চারপাশে দেখল,নাহ্,লোকজন তেমন নেই,দু একটা পথচারী আর রিক্সাওয়ালা ছাড়া।

ভেতরে ঢুকে দেখল এখানেও লোকজন খুব কম।জাহরা নিকাবটা সরাতে গিয়ে দেখল অদূরেই একটা মেয়ে ওকে বারবার দেখছে।মুখটা পরিচিত মনে হচ্ছে কিন্তু মেয়েটা যে কে সেটা মনে করতে পারলো না!”

সউদ টেবিলের উপর ঝুঁকে বলল-“কি খাবে,বলো?”

-“আপনার যেটা ইচ্ছে।”

সউদ কথা না বাড়িয়ে খাবার অর্ডার করল।তারার ম্যেনবুক একপাশে সরিয়ে রেখে বলল-“বৃষ্টি তো আল্লাহর রহমত তাই না?”

-“জ্বী..!”

সউদ মাথা নাড়ল।গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে অথচ আজ আমি তার সুফল ভোগ করলাম,আলহামদুলিল্লাহ!”

জাহরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল-“কিভাবে?”বলেই হঠাৎ মনে হলো বৃষ্টির ঐ জমে থাকা পানির কারনেই ওকে কোলে তুলে পার করতে হয়েছে সউদকে।ও হয়ত সেটাকেই ইঙ্গিত করছে।জাহরা মুখ নিচু করল।

সউদ এবার একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল-“তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল জাহরা।নোভার ব্যপারে।জাহরার মুখটাও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল।সউদ বলে চলছে-“আমি চাইনা,ও আমার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বলে তোমার কান ভারী করুক তাই পুরো বিষয়টি আমি তোমার সামনে রাখতে চাই,তুমি শুনবে সেকথা?”

-“এখানে বলাটা কি ঠিক হবে?”

-” মম..নাহ,বাড়ীতেই বলবো।”

জাহরা মাথা নাড়ল।আবার চোখ গেল সেই মেয়েটির দিকে।স্যুপে চুমুক দেবার মুহূর্তেই ধাঁ করে মনে পড়ল,আরে ও তো নোভার বান্ধবী,নামটা মনে নেই।জাহরা তাকিয়ে দেখল,মেয়েটা নেই চলে গেছে।

সউদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার পেছনের দিকে তাকাল-“কি দেখছো?”

-“না,কিছুনা!”

……

 

নোভা একটা স্টুডিওতে বসে আছে।স্টুডিওটা রাসেলের।ওর ছবি তোলার হাত অসাধারন।নাটকি বুঁচিদেরকেও অপ্সরা বানিয়ে দেয়।এখানে নোভার প্রচুর ফটোসেশন হয়েছে বলে নোভার এখানে অবাধ যাতায়াত।

নোভাকে কোল্ড কফি দেয়া হয়েছে।রাসেল বাইরে গেছে বলে নোভাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।একটু পরেই রাসেল ঢুকল-“স্যরি,একটু দেরী হয়ে গেল।অনেকক্ষণ বসে আছো,না?”

নোভা হাত নাড়ল-“না..সমস্যা নেই।আমার কাজ কদ্দুর,তাই বলো!”

রাসেল নিজের চেয়ারে বসে বলল-“তোমার কাজটা যথেষ্ট কঠিন।খুব বেশী ভালো ও হবেনা।কারন লোকটা ঘুমন্ত বোঝাই যাচ্ছে।তুমি যতই শাড়ীর আঁচল দিয়ে কায়দা কানুন করো না কেন,একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যাবে,লোকটা তোমাকে টাচও করেনি,বুঝলে?”

-“এতো বছর স্টুডিও চালিয়ে আমাকে এসব রঙ্গের প্যাচাল শোনাও??কেমনে কি করবা জানিনা,করে দিতে হবে,ব্যস্।আর ছবিটা কোন ঘাগু প্রফেশনালের কাছে যাচ্ছেনা যে ইনভেস্টিগেট করতে বসবে।এটা একজন অবলা দুর্বলা বোকাসোকা মহিলাকে দেখাবো যে ওর জামাই আমার সাথে….!”

-“কেন আরেকজনের ঘর ভাঙ্গতে চাচ্ছো…?”

-“তোমার কোনো সমস্যা?টাকা দিচ্ছি….টাকা নিয়ে কাজ করবে কথা শেষ।আর এই স্টিল ছবিগুলো দিয়ে ভিডিও তৈরী করা যাবে?”

-“কি যে বলোনা,নোভা!তা কি হয়?”

-“তোমার ঐ হারামী ফটোশুটারটারে তো লাত্থাইতে ইচ্ছা করে,ওরে ফোন করে সেদিন ডেকেছিলাম পর্যন্ত যে আমাদের দুজনের ছবিটাকে কায়দা করে ভিডিও করার জন্য।ভাগ্যিস কেউ আমাকে ঘর থেকে বেরোতে দেখেনি,নইলে ঠিক সউদ্দার কানে কথাটা লাগিয়ে দিতো।আর আমি ধরা পড়ে যেতাম।ঐ শালা আসলো দেরী করে, তার উপর স্টিল ক্যামেরা নিয়ে…!”রাগে গজগজ করে উঠল নোভা।ভিডিওটা করতে পারলে ওর বারোটা আমি বাজিয়ে দিতাম!

রাসেল চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল-“আচ্ছা,সেই ছ’সাত মাস আগের ঘটনা না এটা?”

-“হ্যাঁ..!”

-“তা এতদিন পরে এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করছো কেন?তখন তো শুনেছিলাম ঐ ভদ্রলোকের সাথে নাকি তোমার সাথে বিয়ে হবে?”

-“হয়নি..!”থমথমে মুখে বলল নোভা।

রাসেল কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নাড়ল-“বুঝতে পারছি..তা না হয়েছে তো কি? তোমার কি ছেলের অভাব?তোমার শতশত ফ্যানদের মধ্যে একটাকে বেছে নাও আর তোমার সিলিঙে ঝুলিয়ে বাতাস খাও।এতো ঝামেলায় যাচ্ছো কেন?”

-“আমার ব্যপার কি তুমি বুঝবে?ছবি কবে দিচ্ছো সেটা বলো,এখন ছবি দিয়েই কাজ সারতে হবে।”

-”

-“স্টিল ছবি তো রেডী,এই যে দেখো..!”

বলে চেয়ারে বসেই টেবিলের একপাশের ড্রআর চাবি দিয়ে খুলল,তারপর একটা খাম কের করে নোভার হাতে দিল।নোভা দাম্ভিক ভঙ্গিতে বাম ভ্রু উঁচু করে ছবিগুলো বের করল।

একটা ছবিতে সউদ ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে,বাকি ছবিগুলোতেও বিভিন্নভাবে কায়দা করে তোলা হয়েছে ছবিগুলো কিন্তু কোনোটাতেই সউদের চোখ খোলা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।প্রতিটাই তার ঘুমন্ত ছবি।নোভা দাঁত কিটকিটিয়ে উঠল।রাসেল হাসল-“,এই ছবি দিয়ে খুব সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয়না!”

নোভা উঠে দাঁড়াল-“না’ বলে কোন শব্দ নোভার অভিধানে নেই,অর্ধেক কাজ করবে তোমার এই ছবি,অর্ধেক আমার বুদ্ধি! আচ্ছা,আমি গেলাম।এই নাও, তোমার ফটোগ্রাফারের টিপ্স।”!

-“আমারটা কই?”

-“তুমি কোন কচুটা করছো যে তোমারে দিমু?”

বলে নোভা বেরিয়ে গেলে রাসেল বিড়বিড় করে একটা বিশ্রী গালি দিল নোভাকে।

সউদের ইচ্ছে ছিল জাহরাকে সব কথা আজ রাতেই বলবে কিন্তু সে যখন জাহরাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ী গ্যারেজে রেখে ফিরেছে তখন ঘরে ঢুকে দেখল জাহরা ঘুমে অচেতন।সে সম্ভবত কোনরকম বোরকাটা খুলেই শুয়ে পড়েছে,জামাও বদলায়নি। ওভাবেই বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে।সউদ আর ওকে জাগালোনা।আলতো করে ভেতরে ঠেলে দিল ওকে যেন পাশ ফিরতে গিয়ে পড়ে না যায়।

কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে তাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে জাহরা।ওর পায়ের অনেকখানি অনাবৃত দেখে সউদ মুচকি হাসল।তখন রাস্তা পারাপারের সময় এক ইঞ্চিও তুলবেনা আর এখন…?”

সউদ একটা পাতলা চাদর দিয়ে ওকে ঢেকে দিল।দুই হাতের উপর ভর করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ভালো করে জাহরার ঘুমন্ত মুখটাকে দেখল, জেগে থাকলে তো দেখাই যায়না,তাকালেই চোখ গরম করে তাকায়।অতিকষ্টে ওর কপালে চুমু খাবার ইচ্ছেটাকে গলাটিপে হত্যা করল।তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় ফিরে গেল।

সকালে জাহরার ঘুম ভাঙলে ও নিজেকে দেখে লজ্জা পেল।ছিঃ ছিঃ এ কি অবস্থা,পোশাক না বদলেই এরকম এলোমেলো হয়ে কখন ঘুমালো সে? তারপর নিজের গায়ের উপর চাদর দেখে সউদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ছেয়ে গেল।উঠে পড়ে অযু করল,নামাজ পড়ল।

সউদ ওকে রাতের ব্যপারে আর কিছুই জিজ্ঞেস করলোনা।নাস্তা খেয়েই বেরিয়ে গেল কেবল যাবার সময় জিজ্ঞেস করল-“শরীর ঠিকআছে তো?”

-“জ্বী।আসলে রাতে খুব ক্লান্ত  ছিলাম।”

-“হমমম,আসি,আল্লাহ হাফেজ!”

সউদ চলে গেলে জাহরা বিছানা গোছাত শুরু করল।তখনি সেল ফোনটা বাজল।হাতে নিয়ে দেখল,”নোভা”!

আনন্দে হেসে উঠে তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করল জাহরা!

-“কি রে আপু…তোর রাগ কমেছে? আমি মনে মনে তোর ফোনেরই অপেক্ষা করছিলাম রে! আমি জানি আমার নোভা আমার উপর রাগ করে বেশীক্ষণ থাকতে পারবেনা”!

জাহরার এমনতর কথায় নোভা বরাবরই একটু হকচকিয়ে যায়।আজ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-“তোর সাথে জরুরী কথা ছিল জাহরা!”

-“বল্..!”

-“ফোনে বলা যাবেনা…সামনা সামনি বলতে হবে!”

-“বাসায় আসতে বলছিস?”

-“না,বাসায় আব্বু আছে,তুই বাইরে দেখা করতে পারবি?”

-“সউদকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে..!”

-“আহ্..ওকে না বলে যেন কোথাও যাওয়া তোর বারন?”

-“না,বারন না কিন্তু কাজটা তো অনুচিত,তাই না?”

-“য’ই হোক,তুই যা বলে পারিস বের হ,বাট আমার সাথে দেখা করতে আসবি এটা ওকে বলিস না!”

-“,আ..আচ্ছা..দেখি,তোকে জানাবো,রাখি রে।”

চলবে…

…..

 

 

 

 

 

 

 

 

দুইবোন

পার্ট-১১

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

********************

রেকর্ডিং এর অবসরে আড্ডা দিচ্ছিল নোভা।তখনই সেল ফোন বেজে উঠল।

-“হ্যালা….(উচ্চারনটা এমনই ছিলো).!

-“নোভা,আমি রিংকী”!

-“ওউ….হাই…কি খবর!কেমন আছিস?”

-“ভালো! তুই?”

-“বিন্দাশ!”

-“কিছু মনে করিস না রে,একটা কথা জিজ্ঞেস করি… তোর না সউদ-বিন-মাসুদের সাথে বিয়ে হবার কথা ছিলো?”

নোভার মুখের হাসিটা দপ্ করে নিভে গেল!বলল-“ছিল…বাট হয়নি।কজ…..আমার তেমন আগ্রহ ছিলোনা!”

-“ওও…তা সউদ সাহেব, জাহরা আপুকে বিয়ে করল কিভাবে? ওদের কি কোনো জানাশোনা ছিল?”

-“তুই কিভাবে জানলি”?

-“গত পরশু দিন ক্যাফে ঝিলে গেসলাম, দেখলাম….বলে জাহরা আর সউদের পুরো ঘটনাটা বর্ণনা দিল রিংকী!-“উরিব্বাবা,সউদ সাহেব তো জাহরাপুকে একেবারে কোলে তুলে পারলে বুকে জড়িয়ে ধরেন।আমি তো মিররের ভেতর থেকে দেখে ‘থ’! বউকে একেবারে এমন করে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিলেন যেন আসমানের চাঁদ পেয়েছেন!তুই যাই বলিস দুইজনে সেই প্রেম।রোমিও জুলিয়েট ফেল।সউদ সাহেব এখন কোনোদিকে তাকাননা খালি তার বউয়ের দিকে ছাড়া।পাশ দিয়ে গেলাম,চোখটা তুলে দেখলোনা,একটু পর পর বউরে দেখে,তুই যদি দেখতি…!”

-“হইসে, বাদ দে,শুনতে ইচ্ছা করছেনা,আর কোন কথা থাকলে বল নইলে রাখি!”

 

ফোন রেখে ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ল নোভা।ও যেন ওদের দুজনের সেই দৃশ্যগুলা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে।হঠাৎ কি মনে হতে জাহরাকে ফোন দিল-”

এই জাহরা,কই তুই তো আর ফোন দিলিনা,আমি তোর জন্য অপেক্ষা করে আছি!”

জাহরা ইতস্তত করল-“আসলে,ও..তো খুব ব্যস্ত,কাল রাতেও বারোটার পরে ফিরেছে। অনুমতি নিতে পারিনি।আচ্ছা,আজ বলবো।কাল তোর সাথে দেখ্ করার কথা।”

-“ইহহি…তোরে না বল্লাম আমার কথা বলবিনা,তোর খারুস জামাই…আমার সাথে পার্সোনালি কথা বলতে দেবেনা।তার থলের বিড়াল যে বেরিয়ে যাবে..!”

-“ম্…মানে?”

-“,মানে কি বলবো..!তুই আমার বোন তোকে এসব বলতে সংকোচ লাগে তবু তোর ভবিষ্যতের ভালোর জন্য বলি,সউদ হচ্ছে ‘নারী-খেকো-পুরুষ’ একটা,আলুর দোষ আছে।মেয়ে দেখলেই জিভে….!”

-“তাহলে তুই জেনেশুনে ওকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলি কেন?ও যখন এতই খারাপ?”জাহরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল।

সউদ সম্পর্কে কথাগুলো শুনতে কেন যেন খারাপ লাগছে ওর। গত দুই মাসে ওর মধ্যে এ জাতীয় কোনো কিছু তো চোখে পড়েনি বরং……!”

ওইদিকে নোভা বলেই চলেছে।জাহরা দুর্বল স্বরে বলল-“চুপ কর্ তো,আমার এসব শুনতে ভালো লাগছেনা!”

-“ভালো লাগছেনা কারন তুই বোকা,আবেগী মেয়ে…বর্তমান আধুনিক সময় সম্পর্কে তোর কোনো ধারনাই নেই।শোন্,তোকে আমি কিছু দেখাতে চাই,তাহলেই বুঝবি আমার কথা কতটুকু সত্য!সে আমাকে…..তুই বুঝতে পারছিস না আমি কি বলতে চাচ্ছি,সে কারনেই তো ওকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলাম।কিন্তু আমার ঐ বড় অফারটা না এলে তো তোর এমনটা হত না।আমার ভুলেই তো আজ তোর এই অবস্থা! এসব জেনেশুনে কিভাবে একটা লম্পটের সাথে তোকে ফেলে রাখি,বল্?আচ্ছা….তোর কি একবারো মনে হচ্ছেনা যে সে তোকে একবার কোনোরকম দেখেই সুযোগমত পেয়ে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেল, কেন? কারন সুন্দরী মেয়ে দেখলে ওর মাথা ঠিক থাকেনা…..!”

-“আচ্ছা,আমি রাখছি…!জাহরা বলল।

-“হ্যাঁ,রাখ্..কাল জানাইস কখন দেখা করবি।সত্যি জামাইরে পটানো কোনো মেয়ের জন্য কোনো ব্যপার?তোকে সব কিছু শিখিয়ে দিতে হবে? গাধী কোথাকার।রাখলাম।

জাহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রাখলো।মনটা খুব খারাপ লাগছে!

নোভার কথাগুলো বুকের ভেতরে অজানা আশঙ্কা জাগিয়ে তুলছে।ও আসলে কতটুকু সত্যি বলছে?নানান ভাবনায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে জাহরার।

রাতে সউদ দশটার মধ্যেই চলে এলো আজ।জাহরাকে দেখে ক্লান্ত হাসল-‘স্যরি,এই দুটোদিন আমার উপর দিয়ে কাজের এতো চাপ গেছে যে কি বলবো,আব্বু দেশে না থাকাতেই এমনটা হয়েছে বুঝলে।

জাহরা অল্প হাসল।মনের ভেতর নোভার কথাগুলো ঝড় তুলছে।

গত দুমাস একসাথে থাকতে গিয়ে জাহরার মন নিজের  অজান্তেই সউদের স্ত্রী’র স্থানে নিজেকে বসিয়ে ফেলেছে।স্ত্রী হিসেবে স্বামীর দুর্নাম সহ্য করা আজ ওর জন্য বড় বেদনাদায়ক হয়ে গেছে।

সউদ ওকে নিরব দেখে বলল-“তোমার মনে হয় শরীরটা ভালোনা,আমি নিজেই টেবিল থেকে নিয়ে খাচ্ছি।”

সউদ এটা বলল কারন অন্যান্য দিন বলার আগেই জাহরা ওর প্রতিটা প্রয়োজনের জিনিস হাতের কাছে এনে দেয়,ভাত বেড়ে ডাক দেয় আজ একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

সউদের এ কথায় জাহরা সচকিত হলো,”আরে না না চলুন,আমিও যাচ্ছি।সউদ খেতে খেতে বলল-“তোমাকে কিছু কথা বলবো বলেছিলাম,আজ তা বলবো,তোমার কি খুব ঘুম পাচ্ছে?

-“না,আমি শুনবো,খেয়ে ঘরে আসুন!”

খাবার পর সউদের চা খাবার অভ্যাস।জাহরা চা বানিয়ে এনে দেখল সউদ অন্ধকার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে নিচের রাস্তা দেখছে।

জাহরা চায়ের কাপ নিয়ে ওর পাশে দাঁড়াল-” আপনি এখানে,লাইট দেন নি কেন?চা টা খেয়ে ঘরে আসুন,নাকি এখানেই বসবেন!”

-“চাইলে বসতে পারো,সমস্যা নেই!”

দুজন দুই চেয়ারে বসল!সউদ চায়ে দুই চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল-“তুমি তো জানো নোভার গানের সূত্রেই ওর সাথে আমার পরিচয়।ওর গান আমার ভালো লাগত কিন্তু বিশ্বাস করো ওকে আমি ভালো কোনোদিনই বাসিনি!”

জাহরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

বুকটা দুরদুর কাঁপছে কার কথা বিশ্বাস করবে ও? সউদ চা শেষ করে কাপটা রেখে বলতে লাগল-“একবার গেষ্ট হাউজে আমি কয়েকজন সিঙ্গারকে দাওয়াত করি কারন আমার সব ফ্রেন্ডদের নিয়ে গেট টুগেদার এরেন্জ করেছিলাম সেদিন।রাতে গানের একফাঁকে নোভা ওয়াশরুমে যাবার কথা বলে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়।ওকে রুম দেখিয়ে চলে আসতে নিলে পেছন থেকে টেনে ধরে বলে বসুন,গল্প করি।ভদ্রতার খাতিরে আমি বসি তারপর জুস আনাই,এরই মাঝেই ও পানি চায়,আবার উঠতে হয় আমাকে,ফিরে এসে দেখি ও জুস খাচ্ছে।আমাকেও সে জুস হাতে তুলে দেয়।তারপর জুস শেষও করতে পারিনি এত্ত ঘুম যে কোত্থেকে এলো বুঝলাম না,তারপরে আর কিছু মনে নেই।সকালে দেখি…….!সউদ জাহরার দিকে তাকাতে পারছেনা।

..

দুহাতে মুখটা দুবার মুছে আবার বলতে থাকল-“হয়তো ভাবছো,তাহলে নোভাকে বিয়ে করতে চাইলাম কেন!নোভা আমাকে দায়ী করল সেদিন রাতের জন্য,অথচ আমার বিশ্বাস সেদিন কিছুই হয়নি কারন আমি ঘুমে অচেতন..তাছাড়া আমি নিজেকে জানি, আমার দ্বারা ওটা অসম্ভব কারন আমি একটা মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ কখনোই নিতে পারবোনা,তাছাড়া তুমিই বলো ঘুমে অচেতন আমি কি…..কিক্…..কিভাবে… মানে…!”বলে সউদ জাহরার দিকে তাকিয়ে দেখল জাহরা মাথাটা সোফার একপাশে কাত করে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সউদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল,পুরো কথাটা আবার বলা ওর জন্য খুবই পেইনফুল।সউদ এই বিষাক্ত স্মৃতি ভুলে যেতে চায়।বিশেষ করে জাহরাকে বউ হিসেবে পাবার পর ওর দুনিয়াটা বদলে গেছে।পৃথিবীর সবকিছু কে সে এখন অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে।জাহরাকে ও কতটা ভালবেসে ফেলেছে তা কাউকে বলে বোঝানো সম্ম্ভব নয়।

সউদ জাহরাকে ডাকল বারকয়েক।কিন্তু জাহরা ঘুমে অচেতন।সউদ আবার ডাকল-“জাহরা, ঘরে চলো,বিছানায় যেয়ে শোও..!”

জাহরা একইভাবে ঘুমাচ্ছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সউদ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ওকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় আস্তে করে শুইয়ে দিলো।সরে আসতে যাবে তখনি জাহরা ওকে কোলবালিশ স্টাইলে জড়িয়ে ধরল।সউদের ঘাড়ের কাছে ওর মুখ।নিজেকে আস্তে করে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করল সউদ।জাহরার মুখ ওর মুখের এক ইঞ্চি ব্যবধানে।সউদ এবার একটু শক্তি প্রয়োগ করেই জাহরার বাঁধন মুক্ত হবার চেষ্টা করল।

কোনোরকমে সরে এসে একটা চাদর তুলে জাহরাকে ঢেকে দিতে গেলে হঠাৎ জাহরা ওর হাতটাকে কোলবালিশ বানিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মাঝখানে আঁকড়ে ধরল।সউদ রীতিমত কেঁপে উঠল।কপালে ঘাম দেখা দিল ওর।

জাহরার হলো কি? কি শুরু করেছে আজ?

সউদের ধৈর্য্যের ধনুক টান টান হয়ে ছিঁড়ে যাবার দশা।হাতটা সরাতে গেলে ভয়াবহ ভাবে জাহরার গায়ের সাথে লেগে যাচ্ছে।সউদ একবার হাল ছেড়েই দিচ্ছিল।তারপর হঠাৎ সচেতন হয়ে একরকম টেনেই হাতটা সরিয়ে নিয়ে জাহরাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল নিজের কাছ থেকে।

জাহরার ঠোঁটের কোণে হালকা একটা মুচকি হাসির রেখা কিন্তু সউদ সেটা দেখলোনা।

….

পরদিন সকালে জাহরা ফুরফুরে মেজাজে ঘুম থেকে উঠল।সউদ নাস্তা খেতে বসে কোনো কথা বললো না।জাহরা বলল-“আজ,আব্বুকে দেখতে বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম,যাবো?

-“যাও..! ফিরবে কখন?”

জাহরা শান্ত স্বরে বলল-“যদি না ফিরি?”

সউদ তাকালো ওর দিকে।

জাহরা হঠাৎ কি মনে হতেই জিভ সামান্য বের করে ভেংচি কাটল-“সবসময় ফিরবে কখন…..ফিরবে কখন!”

সউদ ওর দিকে তাকিয়েই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল।বেসিনে হাত ধুলো।তারপর টাওয়েলে মুখ মুছে বলল-“ভুতে ধরেছে নাকি..?যাক্ গে…ফোন দিও,আমি তোমাকে পিক্ করবো!”

বলে সউদ বেরিয়ে গেল।জাহরা আপনমনেই হেসে ফেলল।

….

….

 

জাহরা হাতে ছবি নিয়ে মুখ থমথমে করে বসে আছে।নোভা ছবিগুলো দেখিয়ে বলল-“এবার তুই..ই বল্।

সে কেমন আমি দেখেছি…..বড্ড নারী লোলুপ।সুযোগ পেলেই……!

কথা শেষ করতে পারলোনা নোভা।জাহরার প্রচন্ড চড় ওর মুখের উপর এসে পড়ল।

নোভা চরম বিস্ময় ওর দিকে তাকাল।জাহরা এমন করতে পারে এটা ওর বিশ্বাসের বাইরে।

কেবল ফিসফিসিয়ে বলল-“জাহরা…?”

জাহরা রাগে দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে,তারপর হিসহিসিয়ে বলল-“একজন স্ত্রী’র চেয়ে বেশী আর কেউ জানে না যে তার স্বামী কেমন পুরুষ! ”

..

নোভার চোখে আগুন জ্বলতে দেখা গেল।

……..

চলবে…..

 

দুইবোন

  ১২ তম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

————★————–

জাহরা শান্ত মুখে হাতের ছবিগুলো ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে দিয়ে বলল-“যে নিজে গলা পর্যন্ত পাঁকে ডুবে থাকে সে তার চারপাশে পাঁক ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়না।এখনো সময় আছে,এসব থেকে বেরিয়ে আয়”।

নোভা গাল থেকে হাত সরিয়ে চুলগুলোকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে বলল-“খুব ভালোবাসা হয়ে গেছে দেখছি,নিজের বোনকে অবিশ্বাস করছিস?”

-“প্রশ্নটা নিজের বোন বলে নয়,সত্যি বলতে সউদের প্রতি আমারও যথেষ্ট রাগ ছিল,কিন্তু আজ তা যে কোন কারনেই হোক..নেই! সেইদিন তুই নিজের ক্যরিয়ার গড়তে আরেকজন সম্মাণিত মানুষকে সমাজে অপদস্থ করতে দ্বিধা করিস নি।তুই যদি সেদিনও আমাকে জানাতি যে সউদ ভালোমানুষ না বলে তুই কাজের বাহানায় সরে যাচ্ছিস তাহলে হয়ত তোর কথা আমি বিশ্বাস করে ফেলতাম! কিন্তু এটা তুই বলছিস আমার সাথে বিয়ে হয়েছে জানার পর।বিষয়টা এমন না তো, কোন ভালো জিনিস তোর হাতছাড়া হয়ে গেলো? তাছাড়া তুই কখনো শুনেছিস,কারো খারাপ করে সেই মানুষ আবার তাকে বিয়ে করে সম্মাণিত করতে চায়?তোর কথা যদি সত্যিও হয়, তবুও তো সউদই নিরপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে।বরং তোর আচরণ প্রমান করছে সউদ আসলে এধরনের অপরাধ করেইনি।”…অনেক গুলো কথা একসাথে বলে জাহরা হাঁপাতে লাগল।

নোভা ধপ করে সোফায় বসে পা গুলো উচুতে রেখে নাচিয়ে বলল-“তোর তো বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি,খুব গুছিয়ে কথা বলা শিখে গেছিস!”

-“এখানে গুছিয়ে কথা বলার কিছু নেই নোভা? আচ্ছা,একটা কথার উত্তর দে তো?তোদের এই অবস্থায় ছবিগুলো কে তুলল? যে তুলল সে তোকে ছবিগুলো দিয়েও দিলো?কারন এতে তো তোরই সম্মান যাবার কথা ছিল,তাই না? কিন্তু কি আশ্চর্য্য তুই ছবিগুলো দিয়ে সউদের জীবনে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছিস?”

জাহরা হঠাৎ হালকা হেসে ফেলে বলল-“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে,পুরো বিষয়টা তোরই প্রি প্ল্যানড….সউদকে হাতে রাখার একটা অপকৌশল।কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ এর চেয়ে বড় লোভনীয় অফার পেয়ে যাওয়ায় তুই সউদকে ছেড়ে সেই অফারের পিছনে ছুটেছিস আর সেকারনেই সেদিন ফোনে বলেছিলি..ওকে যেভাবে নাচাবো সেভাবেই নাচতে বাধ্য!…তখন কথাটা বুঝিনি কিন্তু এখন পুরো বিষয়টা পরিস্কার।যাক্…আমি যাচ্ছি,এসব কথা আমি সঊদকে জানাবো না কারন আমি চাইনা তোর এসব অপকর্মের কথা ও জানুক।অন্তত কিছুটা হলেও তোর সম্মান বাঁচবে।”বলে জাহরা নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল-“আমি গেলাম!”

নোভা কোনো কথা না বলে ওর যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে থাকল।

জাহরা বেরিয়ে গেল।পথে নেমে সউদকে ফোন দিলে সউদ তখনি ওকে নিতে আসতে চাইল কিন্তু জাহরা জানাল সে একাই চলে যেতে পারবে সউদের আসার দরকার নেই!সউদ বলল-“ঠিক পারবে তো?”

-“আরে..না পারার কি আছে…রাখি!”

 

….

জাহরা বাড়ী ফিরল প্রচন্ড মন খারাপ করে।এই কদিন না জেনে বুঝে সে সউদকে মন্দ ভেবে এসেছে।ভেবেছে সে তার বোনকে অপমান করার ইচ্ছাতেই তাকে বিয়ে করার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।কিন্তু ঘটনা তো এখানে সম্পূর্ণ অন্যরকম।সউদের সেদিনের সিদ্ধান্তটা একটা প্রশ্ন হতে পারে কিন্তু সহজভাবে দেখলে দেখা যায় যে,নোভার মত উড়নচন্ডী মেয়ের হাত থেকে বাঁচতেই সউদ তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনকে বড় ঝুঁকি এড়াতে ছোট ঝুঁকি গ্রহন করেছে।ওকে বিয়ে করেছে।

বিয়ের পর থেকে করা তার উল্টাপাল্টা আচরন আর সউদের ধৈর্যশীল ব্যবহারের কথাগুলো মনে পড়তে লাগল জাহরার।তার প্রতি সউদের নিরেট দায়িত্ববোধ,বাড়তি সচেতনতা,তার প্রতি উদ্বেগ একটা কথাই প্রমান করে সউদ তাকে ভালোবাসে।এ কথাটা মনে হতেই জাহরা আপনমনেই লজ্জিত বোধ করল।বিশেষ করে গতরাতের জাহরার অদ্ভুত ধরনের আচরনেও সউদ চরম সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে।

..

ওর প্রতি আকর্ষিত হবার সবচে বড় কারন আজ তার মধ্যে ইসলামিক মনোভাব গড়ে ওঠা।সউদ আজকাল খুব নিয়মিত না হলেও নামাজ আদায় করার চেষ্টা করে,দাঁড়ীতো রেখেছেই,তার আচরন আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তিত।এসব জাহরার চোখ এড়ায়নি।ভাবতে ভাবতে সোফাতেই গা এলিয়ে দিল জাহরা।

চোখটা প্রায় লেগে আসছিল ওর, এমন সময়ই দেখলো ঘরে সউদ প্রবেশ করেছে।জাহরা ওকে দেখে মৃদু হাসলে সউদ চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,”কি?” জাহরা তখন উঠে এসে কপট রাগের সাথে বলল-“আচ্ছা,আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন এটা কিন্তু বলেন নি…!”

-“আবার সেই প্রশ্ন?”সউদে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।

-“হ্যাঁ…কারন আমি জানতে চাই..!”

-“কারনটা যে জোরে বলা যাবেনা..!কাছে এসে কানে কানে শুনতে হবে!” সউদ গম্ভীর সুরে বলল।

জাহরা ভীরু-লাজুক পায়ে ওর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল।সউদ দুহাত কোমড়ে রেখে বলল-“উঁহুঁ…..এত দুর থেকে বলা যাবেনা,আরো কাছে আসতে হবে!”

জাহরা তার বাম ভ্রুটা সামান্য উঁচুতে তুলে দাম্ভিক ভঙ্গিতে বলল-“থাক্,লাগবেনা…শুনবোনা”… বলেই ঘুরে দৌড় দিতে চেষ্টা করলে সউদ ওকে ধরে ফেললে।

জাহরা প্রবল হাসিতে ভেঙে পড়ল-“আহ্…ছাড়ুন তো…!” বলে সামান্য ঝাঁকি খেয়েই ও উঠে বসল। চারপাশ তাকিয়ে দেখল ঘরে থোকায় থোকায় অন্ধকার জমাট  বেঁধেছে কারন ও বাতি না জ্বালিয়েই সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো..!”

.

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল জাহরা।দুহাতে মাথাটা  দুপাশ থেকে হালকা চাপ দিয়ে নিজের মনেই হাসল-“কি অদ্ভুত,এতদিন সউদকে অপছন্দ করে এসেছে অথচ কবে কখন সউদ ওর অন্তরটাকে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে জাহরা নিজেও বলতে পারবেনা।হাতের মোবাইলের দিকে তাকাল।আচ্ছা,লোকতো?একটা ফোন পর্যন্ত দিলোনা,জিজ্ঞেস তো করবে জাহরা বাড়ী পৌঁছাল কিনা!হয়ত খুব ব্যস্ত।

জাহরা আলমারী খুলে একটা সুন্দর শাড়ী বের করল,আজ এটা পড়বে।মনের মত করে সেজে সউদকে চমকে দেবে।দেখি,তোমার ধৈর্য্যের দৌড় কতটুকু…আজ তোমার পরীক্ষা সউদ বিন মাসুদ!জাহরা শাড়ীটা খুলে দেখতে লাগল।চমৎকার পিটানো কাজ করা।রয়েল ব্লু আঁচল আর পুরো জমিনটা লেমন ইয়েলো রঙের ধুপছায়া। খুবই সুন্দর।আজ মনের মত করে সাজবে ও!

মাগরিব হয়ে আসছে।জাহরা অযু করতে বাথরুমে ঢুকল।

….

সউদ ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল! চেহারা বিকৃত করে বলল-“কি বলছেন, এসব? কে আপনি?কখন ঘটলো এসব…?আ..আমি…আমি আসছি..!”

বলে ফোনটা রেখেই সউদ দ্রুতপায়ে প্রায় দৌড়ে অফিস থেকে বেরুল।জাহরার বাসা থেকে ওকে কেউ ফোন করছে,জাহরা বাড়ী ফিরতে গিয়ে পথে একসিডেন্ট করেছে,খুব খারাপ কিছু হয়নি তবে পায়ে নাকি খুব ব্যথা পেয়েছে তাই ওকে বাড়ীতেই ফিরিয়ে নিয়ে সেখানে রাখা হয়েছে।

..

সউদ হাতের মোবাইল গাড়ীর সিটে ছুঁড়ে মারল,তারপর বেপরোয়া ভাবে গাড়ী ষ্টার্ট দিলো।খুব অস্থির লাগছে ওর।মেয়েটাকে বারবার বলেছিল একা না বেরোতে।এখন হলো তো? সউদের মনে হচ্ছে ওর বুক থেকে লাফ দিয়ে হ্রৎপিন্ডটা বেরিয়ে যাবে।শার্ট ঘেমে ভিজে গেছে।জাহরাদের বাড়ীর গেটে গাড়ীটা কোনরকম থামিয়েই ভেতরে ছুটলো সে।চাবিটা পর্যন্ত নিতে ভুলে গেল।পাগলের মত সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় পৌঁছুলো।দ্রুতহাতে কয়েকদফা বেল বাজালো।দুহাত কোমড়ে রেখে সামান্য পায়চারী করে আবার পরপর দুবার বেল বাজালো।

একটানে গেট খুলে মিষ্টি হাসিতে সালাম দিলো নোভা-“বাব্বাহ্…এত্ত তাড়াতাড়ি চলে এসেছো?”

সউদ খানিক থমকে গেল-“জাহরা কোথায়? ওর এখন কি অবস্থা?”

-“আশ্চর্য্য বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলবে নাকি ? ভেতরে তো এসো…বসো! “নোভা সিরিয়াস কন্ঠে বলল।

অগত্যা সউদ ভেতরে ঢুকল-“জাহরা কোথায়?”

-“জাহরা কোথায়,মানে?তোমার বাড়ীতে?”

-“মানে? তাহলে আমাকে ফোন করে কে বলল যে জাহরার একসিডেন্ট হয়েছে?এখানে আছে..?”

-“নিশ্চয়ই আমি বলিনি..কোত্থেকে কি শুনে এসেছো?”

-“তারমানে জাহরা এখানে নেই?” বলে সউদ ঘুরে দাঁড়ালো!নোভা ওকে পেছন থেকে শার্ট খামচে ধরে বলল-“জাহরা নেই তো কি,আমি তো আছি,আমার সাথে বসে দুদন্ড কথা বলার ফুরসতও তোমার নেই?”

 

সউদ ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের তর্জনী দিয়ে টোকা মারার মত করে নোভার হাতটা সরাল-“সময় থাকবেনা কেন,রুচি হয়না তোমার সাথে কথা বলতে।তাছাড়া এটা অন্যায়,গুনাহ্। বিনা প্রয়োজনে আমি তোমার সাথে কেন কথা বলতে যাবো?”

নোভা পথ আগলে দাঁড়াল-“ওব্বাবা…গুনাহ্…এত্ত রাগ আমার উপর?সেদিন আমি বাড়ী খাকলে আমায় বিয়ে করতে না তুমি?”

-“সেটা হতো আমার জীবনের চরম দূর্ভাগ্য। তোমার দেয়া কথা রাখতে সেদিন আমি দায়বদ্ধ ছিলাম।কিন্তু আল্লাহর রহমত ছিলো বলেই জাহরার মত মেয়েকে জীবনসাথী হিসেবে পেয়েছি।”

-“কত ভালোবাসো ওকে?”

-“সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন দেখিনা তাছাড়া ভুলে যেওনা সে আমার স্ত্রী!আমার সমস্ত কিছুর হকদার কেবল সে!”

-“তাই….না?”নোভার সউদের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল।

সউদ চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই নোভা হঠাৎ পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল-“আমাকেও তোমার স্ত্রী করে নাও।সেদিনের ছোট্ট ভুলের সাজা এতবড় হতে পারেনা নিশ্চয়ই…প্লিজ!”

সউদ নোভাকে রীতিমত ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল-“আরে…আরে….সত্যিই.বড় জঘন্য মেয়ে তো… তুমি……!”বলে সউদ দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

নোভা পেটে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে খিলখিল করে হাসল কিছুক্ষণ।তারপর হাতের মোবাইলটা কানে ঠেকিয়ে বলল-“কাজ হয়েছে?”

-“হ,এ্যাক্কেরে খাল্লা..স!”

-“কেউ দেখেনি তো!”

-“কি যে কন আপা..এতদিনে আমারে এই চিনলেন?”

-“হমম,কাল টাকা পেয়ে যাবে! ”

-“অখন আহি?আমি তো অখনো এহেনেই আছি..?”

-“একদম না,ভুলেও এবাড়ীতে ঢুকবেনা,যাও!”

নোভা ফোন বন্ধ করে মুচকি হাসল-“যাও..সউদ-বিন-মাসুদ..তোমার জাহরার কাছে উড়ে উড়ে যাও…ব্রেক ছাড়া গাড়ীতে করে…টা..টা..বা..বাইই…!”

..

চলবে….!

 

দুইবোন

   ১৩ তম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

*******************

জাহরার মনে হলো সে ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছেনা।তবু নিজেকে প্রানপণে শক্ত রাখতে চাইল।

শ্বশুড় আব্বাও দেশে নেই।জাহরা একা কিভাবে সব সামলাবে..দ্রুত হাতে ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ভরে সে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

সউদকে ইমারজেন্সীতে নেয়া হয়েছে।আশফাককে দেখে জাহরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ‘বাবা’ বলে।আশফাক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-“শান্ত হ, মা!আল্লাহ আছেন!”

-“ও কেমন আছে?খুব কি আঘাত পেয়েছে ও?আমি একটু ওর কাছে যাবো!” জাহরা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল!তখনি ডাক্তারের কামরা থেকে ডাক্তার সহ আরেকজন লোক বেরিয়ে এল।সে ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।আশেপাশে আরো দুতিনজন লোক আছে তারা সম্ভবত সউদের অফিসের লোকজন।

জাহরা নিকাব ভালো করে টেনে একপাশে সরে দাঁড়ালো।

একজন এসে আশফাক সাহেবকে ডেকে বললেন-“আঙ্কেল,আল্লাহর রহমতে ওনার মারাত্মক কোনো ইনজ্যুরি হয়নি তবে বুকে আর মাথায় কিছুটা আঘাত পেয়েছেন।ভাগ্য ভালো যে, সিট বেল্ট বাঁধা ছিলেন! তবে তিনি শরীরের ভেতরের দিকে ইনজিওরড কিনা এটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তাররা ওনাকে রিলিজ দিতে চাচ্ছেননা।ভর্তি থাকতে বলছেন।আপনি ভাবীর সাথে পরামর্শ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন।

..

একঘন্টার মধ্যে সউদকে কেবিনে স্থানান্তর করা হলো।জাহরা বুঝতে পারল সউদকে এখানে অনেকেই চেনে জানে বিশেষ করে তার শ্বশুড় মাসুদুর রহমানের যথেষ্ট প্রভাব আছে এখানে তাই সবকিছু যথেষ্ট দ্রুতই হয়ে গেল।

জাহরা কেবিনের এককোণে জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদা শেষে পড়ে ছিল।পেছন থেকে আশফাক হোসেন এসে ওর মাথায় হাত রাখলেন।

সউদকে বেডে দেয়া হয়েছে।জাহরা এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে নার্সদের কাজকর্ম দেখছিল।

সউদের কপালে সাদা ব্যান্ডেজ তাতে চাপ চাপ রক্তের ছোপ।সউদ চুপ করে ছাদের দিকে তাকিয়ে পড়ে আছে।খুব অসহায় দেখাচ্ছে ওকে।ও এখনো জাহরাকে দেখেনি।ওকে বেডে দেবার আগে জাহরা ব্যাগ থেকে ঘরের একটা পুরোনো বেডশিট বের করে নার্সের হাতে দিল যেন এটা বিছিয়ে তারপর রুগীকে বেডে দেয়।নার্সরা তাই করল।সউদকে বেডে দিয়ে ওরা স্যালাইনের নল ঠিকঠাক করে দিয়ে চলে গেল।আশফাক হোসেন সউদের মাথায় হাত রেখে বললেন-“আল্লাহর বড় রহমত ছিলো তোমার উপর যে অল্পের উপর দিয়ে গেছে।বিশ্রাম নাও।রাতে বড় ডাক্তার এসে দেখে যাবে।”

সউদ মৃদু শব্দে বলল-“জাহরা কি জানে?”

আশফাক হাত দিয়ে জাহরাকে দেখালে সউদ চমকে কেবিনের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা জাহরাকে দেখে তাকিয়ে রইল।জাহরা প্রানপণে চোখের পানি রুখতে পারছেনা।অনবরত সেগুলো গাল বেয়ে পড়েই চলেছে।সউদ কোন কথা বললো না।আশফাক জাহরাকে বললেন-“আমি ঘন্টা খানেক পর আসছি!

আশফাক চলে গেলে জাহরা ধীর পায়ে সউদের সামনে এসে দাঁড়াল।সউদ ওর দিকে তাকিয়ে বলল-“কখন এসেছো?”

জাহরা নাক টেনে বলল-“এইতো…. কিছুক্ষণ আগে!”

-“কাঁদছো কেন?”

জাহরা জবাব দিলোনা!মুখ নামালো!

সউদ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“তোমাকে খুব ঝামেলায় ফেলে দিলাম”!

জাহরা চোখে রাগ নিয়ে তাকাল-“তাই মনে হচ্ছে?না?”

-“ঝামেলা না…বলো? একটা অভদ্র স্বার্থপর লোকের জন্য এই রাত বিরেতে….জাহরা আস্তে করে ওর ঠোঁটের ওপর হাত রেখে বলল-“কি চান আপনি,আমি এখন আপনাকে বলি যে..না..আপনি অভদ্র না,ভালো মানুষ।আপনাকে আমি….!”বলে থেমে গেল জাহরা।সউদ বলল-“কথা শেষ করো!”

..

জাহরা কোন কথা না বলে সউদের শার্টের বোতাম খুলে ওর বুকে পেটে হালকা হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল কোথাও কোনো জখম আছে কিনা।সউদ চুপ করে  ওর আদর যত্ন উপোভোগ করছে।হঠাৎ ‘আহ্’ করে উঠলে জাহরা ভীষণ চমকে বলল-“কি হলো?”

-“ব্যথা পাচ্ছি?”

কান্না কান্না গলায় বলল-“কোথায়,দেখি..?”

সউদ বলল-“শরীরে যেখানে যেখানে হাত বুলিয়েছো সেখানে সেখানে!”

-“কিন্তু এসব জায়গায় তো আল্লাহর রহমতে জখম নেই!ব্যথা কেন করছে?”জাহরা ব্যকুল হয়ে বলল।সউদ খুব শান্ত গলায় বলল-“আমার কামনার মানসপ্রিয়ার হাতটা পড়েছে যে,সহ্য হচ্ছেনা!”

জাহরার চোখের পানি অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে গেল।সেখানে একটু রাগ দেখা দিল-“আপনি তো আজব মানুষ! এই অবস্থায়ও এসব বলছেন?”

-“কি বলছি,তুমি জখম খুঁজে বেড়াচ্ছো।বুকের ভেতরে যে জখম তুমি করে রেখেছো সেটার খবর তো একদিনও নিলেনা!”

জাহরার মুখে লালিমা দেখা দিল।ওর হাতটা সউদের বাম হাতে ধরা ছিল।জাহরা মৃদু স্বরে বলল-“,জখমটা কোথায়, দেখি?”

সউদ বুকের বামপাশটা দেখিয়ে বলল-“এখানে..!”

জাহরা আস্তে করে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল-“সেরে যাবে!”

সউদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল-“খবরটা শুনে যে কেমন লেগেছিল,আপনাকে বলে বোঝাতে পারবোনা!”

সউদ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল।জাহরা বলল-“হঠাৎ এমনটা হলো কি করে?”

সউদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উড়ো কল আসা,তারপর জাহরাদের বাড়ী যাওয়া এবং সেখান থেকে ফিরতে গিয়ে গাড়ী দুর্ঘটনার কথা সংক্ষেপে বলল।জাহরা চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে।ওর গলা ভেঙ্গে গেল বলতে গিয়ে-“নোভা এমন কাজ করতে পারলো?”তারপরই শক্ত গলায় বলল-“আমি নোভার সাথে কথা বলতে চাই।আপনি সেরে উঠলে আমি বাসায় যাবো!”

-“উঁহুঁ…কোনো দরকার নেই।ওর কথা ছাড়ো।আমারই আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।তোমাকে কল দিতে পারতাম,তা না করে…বোকার মত…!”

এমন সময় দরজায় টোকা পড়লে জাহরা মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল।

রাতে নার্স এসে সউদের রক্ত পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেল।জানালো এক্সরে রিপোর্ট ভালো এসেছে।ব্লাড টেষ্ট রিপোর্ট ভালো হলে কালই রিলিজ পেয়ে যাবেন!জাহরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল-“আলহামদুলিল্লাহ!”

আশফাক জাহরাকে বাড়ী পাঠিয়ে হাসপাতালে নিজে থাকতে চেয়েছিলেন,জাহরা রাজী হয়নি!

তিনি সকাল সকালেই চলে আসবেন বলে চলে গেলেন।সাথে করে আনা খাবারগুলো দিয়ে গেলেন জাহরার হাতে।সউদের স্যালাইন খুলে ফেলা হয়েছে।নিজ হাতেই স্যুপ খেতে পারতো কিন্তু জাহরা দেয়নি।সে নিজের হাতে স্যুপ খাইয়ে দিয়েছে ওকে।পুরোটা সময় সউদ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো বলে জাহরা একবার আপত্তি জানালো-“কি শুরু করেছেন,চোখ ফেরান!”

-“আমার চোখ,আমি যেখানে খুশি দেখি,তোমার তাতে কি?তাছাড়া আমি হালাল জিনিস দেখছি হারাম কিছুতো দেখছিনা!”

-“আমার লজ্জা লাগছে!”

-“লজ্জা লাগার মতো তো এখনো কিছু করেছি বলে মনে হচ্ছেনা!”

জাহরা টিস্যু দিয়ে ওর মুখে চেপে মুছে দিল।জাহরা ওকে হালকা ঠেলা মেরে বলল-“শুয়ে পড়ুন,রাত কত হয়েছে দেখেছেন?”

-“তুমি কোথায় শোবে?”

-“ঐ যে,আরেকটা বেড আছে না?”

-“কিন্তু ওই বেডে তো কোলবালিশ নেই,এটাতে আছে,এখানে থাকো।”

-“কিসের কোলবালি….?”বলে জাহরার চেহারা রাঙা হয়ে উঠল! সে হালকা কিল মারল সউদকে!সউদ সাথে সাথেই-“আহ্..”করে উঠলে জাহরা রাগ ভুলে ওকে দ্রুত জড়িয়ে ধরল-“লেগেছে?স্যরি!”

সউদ ওর হাত ধরে বলল-“সত্যি,একফোঁটাও বিরক্ত করবোনা!বিশ্বাস করোনা আমাকে?”

-“করি..তো…কিন্তু আপনি অসুস্থ!এখানে আরাম করে ঘুমাবেন! তাছাড়া এই বেডে দুজনের ভালোমত জায়গাও হবেনা!”

-“ভাব থাকলে তেতুঁল পাতাতেও ঠাই হয়,জানো তো!”

জাহরা লজ্জিত হেসে সউদের কাঁধে মুখ গুজল।সউদ ওকে প্রবল শক্তিতে জড়িয়ে ধরল।

চলবে…!”

 

দুইবোন

  ১৪ তম পর্ব

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

*******************

সউদ বাসায় এসেছে প্রায় একসপ্তাহ হলো।

সউদের বাবা মাসুদুর রহমানও সংবাদ পেয়েই আর দেরী করেননি।গতরাতের ফ্লাইটেই তিনি ঢাকা ফিরেছেন।তিনি এসে এক্সিডেন্টের কারন জানার জন্য খুব তোড়জোড় শুরু করলেন,তদন্ত করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে উর্ধমহল থেকে চাপ প্রয়োগ করলেন।

পুলিশ একটু আগেই সউদের সাথে ড্রইংরূমে বসে ঘন্টাখানেক কথাবার্তা বলে চা নাস্তা খেয়ে গেছে।সউদ বিষয়টাকে নিজের অসাবধানতা বলেই শেষ করতে চাইল।পুলিশ কর্মকর্তাটি যাবার সময় হ্যান্ডশেক করে বলল-“সব তো শুনলাম…তবু কোনরকম সন্দেহের অবকাশ থাকলে প্রশাসনকে জানাতে দেরী করবেন না।আসলে আপনার ফাদার বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট এক্সাইটেড ফলে আমাদেরও একটিভ না হয়ে উপায় নেই!”

সউদ হেসে জানালো-“ঠিকআছে,সমস্যা নেই..আমি আব্বুকে ম্যানেজ করছি!”

….

সউদ ঘরে ফিরে দেখল জাহরা মুখ শুকনো করে বসে আছে।সউদ ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে জাহরা ভীরু চোখে ওর দিকে তাকাল।সউদ ওর পাশে গিয়ে বসল-“কি হলো তোমার?চাঁদমুখে অমাবশ্যা কেন?”

-“কি বললো পুলিশ?”জাহরা কিছুটা উদ্বিগ্ন!

-“ও…এই কথা? বোনের জন্য দুশ্চিন্তায় একেবারে ঠোঁট শুকিয়ে ফেলেছো?”বলে সউদ হেসে ওকে কাছে টেনে নিল-“পাগল নাকি..নোভার সাথে সাথে তোমার বাবা এবং গোটা পরিবারের সম্মান জড়িয়ে আছে।আমি সেসব কিছুই বলিনি যা বললে পুলিশ নোভার ব্যপারে সন্দেহ করবে!”

জাহরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সউদের বুকে মাথা রাখল-“আপনি আসলে অনেক ভালো মানুষ!”

-“বিরাট সার্টিফিকেট দিলে তো!জানোতো রাসুল সাঃ বলেছেন-“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো! আসলে নোভা হলো আমার একজীবনে করা কিছু ভুলের শাস্তি….!এমনিতে ব্যক্তিগত ভাবে আমি ওর ওপর রাগ নই বরং কিছুটা খুশিই আছি!”

-“মানে?”জাহরা মুখ তুলে তাকাল।

সউদ মুখ নামিয়ে ওর থুতনীতে ছোট্ট চুমু খেয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল-“এক্সিডেন্টটা না হলে কি তোমাকে এতো তাড়াতাড়ী নিজের করে পেতাম? না জানি আরো কতদিন সোফায় ঘুমুতে হতো!”

জাহরা লজ্জায় মুখ লুকালো-“যাহ্…!”

-“যাহ্…কি! মিথ্যা বলেছি?”

সউদ ওকে জড়িয়ে ধরে ওর মাথার ওপর থুতনী রেখে বলল-“আচ্ছা…শোনো…বাবাকে বলোনা কিন্তু এসব,উনি শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবেন!”

-“কার কথা বলছেন,আব্বুর কথা?”

-“দুই আব্বুর কথাই বলছি।ওঁরা শুনলে পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে।আর আমার বাপ শুনলে তো নোভার ক্যারিয়ারও শেষ”! সউদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।জাহরা সরে বসে বলল-“গতকাল আব্বু বলল,ও নাকি আপনার দুর্ঘটনার পরের দিনই ইন্ডিয়া চলে গেছে।সেখান থেকে নাকি গানের ডাক এসেছে!”

-“ওর কথা ছাড়ো তো!আমাদের কথা বলো!” সউদ খানিকটা অসহিষ্ণু স্বরে বলল!

-“আমাদের আবার কি কথা?”

-“এই যে,আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?”

-“আপনিই বলুন…আমি শুনি..!”

-“মমম…(জাহরাকে কাছে টেনে নিয়ে বলতে শুরু করল)আমার কিন্তু এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা চাই।তাদের সবগুলোকে কুরআনের হাফেজ বানাবো ইনশাআল্লাহ! তার পর তোমাকে নিয়ে হজ্জ করতে যাবো।জাহেলী জীবনে আর ফিরে যেতে চাইনা আমি,দুজনে হাত ধরে জান্নাতের পথে হাঁটবো,যেন সেখানে গিয়েও স্ত্রী হিসেবে তোমাকেই পাই! থাকবে তো আমার পাশে?”

জাহরা সউদের বুকের গভীরে মিশে গিয়ে বলল-“ইনশাআল্লাহ!’

-“আমি ইসলামের প্রতিটা হুকুম আহকাম জানতে চাই,পালনও করতে চাই!কারন আমি জান্নাতের মালিকের সন্তষ্টি চাই!”

-“আমিও…কিন্তু বলছেন যে পরে হজ্জে যাবেন,ততদিনে তো বুড়ি হয়ে যাবো, মরেও তো যেতে পারি…আর বুড়ো বয়সে হজ্জ করা কত কষ্ট জানেন?”

-“হজ্জে যাবার শর্ত কি?”

-“যখন কারো হজ্জে যাবার মত শারিরীক এবং আর্থিকভাবে সামর্থ থাকে তখনই তার উপর হজ্জ ফরয হয়ে যায়।সে হিসেবে আপনার উপর এখনি হজ্জ ফরয!”

-“বলো কি?”

-“জ্বী,ঠিকই বলেছি!”

-“দাঁড়াও..খোঁজ খবর করে দেখি।তারপর সম্ভব হলে এবছরই দুজনে হজ্জে যাবো..ইনশাআল্লাহ!”

জাহরা ভীষণ খুশিতে উচ্ছল হয়ে বলল-“ওহ্..আলহামদুলিল্লাহ! আসলে আমরা ইসলামের যত কাছাকাছি যেতে পারবো ততটাই সুখী হবো!”

-“হমম,সত্যি,একটা সময় জীবন বলতে বুঝতাম,খাও দাও ফুর্তি করো। বন্ধু আর বান্ধবীদের নিয়ে অবসর কাটানোটাকে জীবনের অন্যতম আনন্দ মনে করতাম। কিন্তু বড় ভুলের মধ্যে ছিলাম।জাহেলী জীবনে কিছুই পাইনি বরং বেগানা নারীদের সাথে মিশতে গিয়ে নোভার মত ফিতনা আমার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।জানিনা কোন পূণ্যে তোমার মত বউ পেয়েছি।আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া!”

-“আমিও…সবসময় দ্বীনদার পাত্রকে স্বামী হিসেবে চেয়ে এসেছি,হঠাৎ বিয়েটা আপনার সাথে হয়ে যাওয়ায় খুব রাগ হয়েছিল আপনার উপর”!

-“রাগ যে হয়েছিল তা তো আমি হারে হারেই টের পেয়েছি!”

-“আচ্ছা,বাই দ্যা ওয়ে…কাল রাতে তুমি যখন আমার প্রিয় নীল শাড়িটা পড়েছিলে তখন যদি একটা নীল টিপ দিতে আরো দারুন লাগতো!”

-“আপনি জানেন না যে,মুসলিম মেয়েদের টিপ পড়তে নেই?”

-“তাই নাকি..?জানিনাতো?কেন বলোতো?”

-“আমাদের মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আঃ কে যখন তৎকালীর বাদশাহ নমরূদ বিশাল অগ্নিকুন্ডে ছুঁড়ে মারার জন্য একটা চড়কগাছের সাথে বেঁধেছিল তখন অসংখ্য ফিরিস্তার জন্য মহা বাদশাহের লোকেরা চড়কগাছ থেকে নবীকে আগুনে ছুঁড়ে মারতে পারছিলো না।তখন ইবলিশ শয়তান মানুষের রূপ ধরে এসে পরামর্শ দিল যে বাজার থেকে কিছু বাজে মহিলা আনিয়ে তাদের দিয়ে এখানে অশ্লীল কাজ করালেই ফিরিস্তারা চলে যাবে।সাথে সাথে তাই করা হলো।কিছু ব্যাভিচারী মহিলা সেখানে এলো যাদের প্রত্যেকের কপালে টিপ ছিল,এটা তাদের সিম্বল।তাদের দেখে ফিরিস্তারা সরে যান আর নবীকে আগুনে ফেলা হয়।কিন্তু জানেন তো ইব্রাহিম আঃ কে আগুন পোড়ায়নি আল্লাহর আদেশে।

-“হমমম…সুন্দর ইতিহাস।আজ জানলাম।তুমি আমাকে এখন থেকে প্রায়ই বিভিন্ন নবী রাসুলের গল্প শোনাবে,কেমন?”

-“জ্বী,ইনশাআল্লাহ্…শোনাবো,এখন উঠুন! অনেক গল্প হয়েছে, এবার যান গোসল-নামাজ সেরে ভাত খেয়ে ঔষধ খেতে হবে!”

অগত্যা সউদকে উঠতে হলো।

….

….

দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস চলে গেল।সউদ এখন আগের তুলনায় অনেক প্রাকটিসিং একজন মুসলিম।পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় লেকচারগুলো নিয়মিত শুনছে।মসজিদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে।জাহরাও অসম্ভব খুশি।ঠিক হয়েছে সামনের বছর ওরা হজ্জে যাবে।

এমনই পরিবর্তিত দিনগুলিতে সময়গুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল সউদ আর জাহরার।

প্রতিদিনের মত আজো সব কাজ শেষে সউদের জন্য চা নিয়ে যাচ্ছিল জাহরা।সউদের ফরমায়েশ মোতাবেক আজো একটা সুন্দর কলাপাতা রঙের জর্জেট পড়েছে।সামান্য একটু সেজেছেও।চুলগুলো খোলা ছেড়ে দিয়েছে এটাও সউদের বিশেষ ফরমায়েশ।তার ফরমায়েশির লিষ্ট বেশ লম্বা,সময় করে আরেকদিন পাঠককে শোনানো হবে ইনশাআল্লাহ।

বারান্দায় আসতেই সউদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।সে পা দুটো টি টেবিলের ওপর রেখে কোলের ওপর ল্যাপটপ বসিয়ে অফিসিয়াল মেইল গুলো চেক করছিলো।জাহরাকে দেখে স্থির হয়ে গেল,তারপর কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে ওকে টেনে কোলের ওপর বসালো!জাহরা লাজুক হাসিতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো,সউদ কি একটা যেন বলতে যাচ্ছিল এমন সময় জাহরার ফোনটা বেজে উঠল।

সউদ ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকাল-“এতো রাতে তোমার মোবাইলে ফোন?”

জাহরা নিজেও অবাক।হাতে নিয়ে দেখলো নোভার নম্বর থেকে ফোন।গত কয়েক মাসে সে একবারো যোগাযোগ করেনি,আজ এতগুলো দিন পরে হঠাৎ কি মনে করে? তাছাড়া ওর তো দেশের বাইরে থাকার কথা! জাহরা সউদের দিকে তাকালো!সউদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশারা করল রিসিভ করতে।জাহরা উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে সালাম দিলে ওপাশ থেকে নোভা বলল-“স্যরি,অনেক রাতে ফোন দিলাম..ঘুমিয়ে পড়েছিলি!”

-“না..কি বলবি বল!”জাহরার ভেতরে সেই পুরোনো কষ্ট রাগ যেন একসাথে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর নির্লিপ্ত কন্ঠ শুনে।

নোভা বলল-“কাল একটু বাসায় আসতে পারবি? আ…আমার খুব বিপদ!”

জাহরা শান্ত স্বরে বলল-“কথাটা ভেবে বলছিস তো? কারন তোকে দ্বিতীয় বার বিশ্বাস করার কোন যুক্তি নেই!”

ওপাশে নোভা চুপ মেরে গিয়ে আবার বলল-

-“যদি সউদ ভাই অনুমতি দেয় তাহলে আমি আসি তোর বাসায়?”

জাহরা সউদের দিকে তাকাল।সউদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

জাহরা সেদিকে তাকিয়ে বলল-“না,তোকে আমার হুট করে আমার বাসায় আসার অনুমতি দিতে পারিনা,তোর সমস্যা তোর,তার সাথে আমার কি সম্পর্ক?”

-“জাহরা প্লিজ,আমার খুব সমস্যা,তোদের সাহায্য দরকার!”

জাহরার ভেতরে মাতৃত্ব জেগে উঠতে চাইছে।এ সেই নোভা যাকে ও নিজের সন্তানের মত করে দেখেছে।সে আজ বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছে।জাহরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-“দশ মিনিট পরে জানাচ্ছি!”

মোবাইল কেটে দিয়ে সউদের দিকে তাকাল।সউদ হালকা গলায় বলল-“নোভা..তাই না? তা এবার কি খবর নিয়ে এসেছে?”

-“বলল..ওর নাকি খুব বিপদ,আমাদের সাহায্য চায়!”

-“,তাই নাকি?”

সউদ দাঁতে ঠোঁট দিয়ে চিমটি কেটে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।জাহরাও ভাবছে!

আগামী পর্বে সমাপ্ত!

 

দুইবোন

১৫(শেষপর্ব)

লেখাঃ-মোর্শেদা রুবি

★★★★★★★★★

 

সউদের সাথে পরামর্শ করে প্রায় পনের মিনিট পড়ে নোভাকে ফোন দিয়ে জাহরা!নোভা সাথে সাথেই রিসিভ করলো।জাহরা নোভাকে জানালো সে নিজেই আসবে।

নোভা হঠাৎ বলল-“আপু শোন্!”জাহরা মনে মনে চমকে উঠল।নোভা ওকে সাধারনত নাম ধরেই ডাকে।আজ হঠাৎ আপু বলছে,ব্যপারটা অবাক করার মতই।

জাহরা তবু স্বাভাবিক গলায়ই বলল-“বল্..!”

-“আ..আমি বাসায় উঠিনি…!শেরাটনে উঠেছি।রুম নম্বর হচ্ছে….!”

-“শেরাটনে কেন?জাহরার এ প্রশ্নে নোভা বলল-“তুই এলেই সব বুঝতে পারবি,আর তুই একা আসবি তো?”

-“কেন,গলা টিপে মেরে ফেলবি আমাকে?তোর পক্ষে তো সবই সম্ভব!”

নোভা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-“,তারচে তুই যদি আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলিস সেটাই ভালো হবে,বেঁচে যেতাম !”

জাহরা আর কথা বাড়ালো না-“রাখি” বলে রেখে দিল।

সউদ চিন্তিত মুখে তাকালো-“তুমি একা যাবে?”

-“হুঁ..যেতে চাই..যদি অনুমতি দেন কারন ওর কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হলো!”

সউদ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল,শুধু বলল-“আমি তোমাকে নিয়ে যাবো”!

….

 

পরদিন বিকেল বেলা জাহরাকে শেরাটনে নামিয়ে দিয়ে সউদ অপেক্ষা করবে বলে নিচেই বলরুমে রয়ে গেলো।জাহরাকে বলল-“কোনরকম সমস্যা দেখলেই ফোন দেবে! জাহরা মাথা নেড়ে লিফটে উঠে গেল।

বেল বাজাতে নোভা নিজেই দরজা খুলে দিলো।জাহরা ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে চমকে গেল।একি চেহারা হয়েছা নোভার!মাত্র ছয়মাসেই যেন ছয় বছর বযস বেড়ে গেছে ওর।চোখগুলো গর্তে বসা চোখের নিচে কালি,ঠোঁটের চারপাশে লালচে ঘায়ের মত কালশিটে পড়ে গেছে!

নোভা জাহরাকে দেখেই কেঁদে ওকে জড়িয়ে ধরল।জাহরা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রইল।নোভা কিছুটা শান্ত হলে জাহরা বলল-“তুই দেশে কবে এলি? বাবাতো আমাকে কিছুই বললো না!তাছাড়া বাসায় না উঠে হোটেলে কেন?”তোর চেহারারই বা এই অবস্থা কেন?”

নোভা জাহরার একটার পর একটা প্রশ্নের জবাবে কেবল কাঁদল,তারপর একটু থেমে বলতে লাগল-“তোদের অভিশাপ লেগেছে আমার নইলে এই দুর্গতি কেন হবে?”

-“কি হয়েছে কি?”

-“এখান থেকে মুম্বাই যাবার পর নতুন গানের অডিশন খুব ভাল হয়েছিল,ওই ছবিতে পাঁচটা গানের প্লেব্যাক সিঙ্গার আমিই।সেই সুবাদে ঐ ছবিরই প্রোডিউসরের সাথে খুব সখ্যতা গড়ে ওঠে আমার।ধীরে ধীরে সখ্যতা বন্ধুত্বে গড়ায়,বন্ধুত্ব রূপ নেয় প্রেমে…আমি নিজেই ওকে আঁকড়ে ধরি এই ভেবে যে সে আমার ওপরে ওঠার সিঁড়ি হবে।তার কথাবার্তা ব্যবহার খুবই চমৎকার,দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা যে,ওর ওই সুন্দর মুখের আড়ালে একটা পশু লুকিয়ে আছে।অবশেষে গত মাসে বিয়ে করে ফেলি আমরা।

কিন্তু মাত্র দুটো দিনেই আমি বুঝতে পারলাম আমি আমার জীবনের সবচে বড় ভুলটা করে ফেলেছি।সে মানুষ না রে জাহরা…সে একটা…কি বলবো ..  সে রীতিমত..একটা উন্মাদ…!”

নোভা ট্যিসু চোখে চেপে ধরল,নাক টেনে বলল-“তুই বোন হস্,তোকে কি বলবো,সে একটা বিকৃত রুচির মানুষ,তার বিকৃত বাসনা মেটাতে না পেরে আমি তাকে ডিভোর্স করার সিদ্ধান্ত নেই।এটা শোনার পর সে যা বলল তাতে আমি হতভম্ব হয়ে যাই।সে নাকি তার সাথে কাটানো আমার প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ভিডিও করে রেখেছে।যদি আমি তার ইচ্ছেমত না কাজ করি সে আমার সমস্ত ছবি বাজারে ছেড়ে দেবে,আমাকে চরম অপদস্থ করবে!আমি বিভিন্নভাবে তার হাত থেকে বাঁচার সবরকম চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি তাই নিরূপায় হয়ে গত পরশু পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি!”

জাহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল- “হমম,বুঝলাম..! তা এখানে আমি কি করবো বল্ তো?তুই বরং সে তোকে খুঁজে বের করার আগেই তুই তাকে ডিভোর্স দিয়ে তার ঠিকানায় মেইল করে দে।”

-“তাতে লাভ কি? আমার ছবিগুলো তো সে বাজারে ছেড়ে দেবে আমাকে চরমভাবে অপদস্থ করার জন্য,যাক্,আমি নিজেও এটাই করবো ভাবছি।তোদের দুজনের সাহায্য চেয়েছিলাম কারন বাবাকে এসব কথা জানাতে চাচ্ছিনা।ওকে ডিভোর্স করলে ও যদি ঝামেলা করে তখন সউদ ভাই যদি এতে হস্তক্ষেপ করে তাহলে ও বিশেষ সুবিধে করতে পারবেনা।”

জাহরা নিঃশ্বাস ফেলে বলল-“আমি ওকে বলে দেখবো!”

নোভা ভেবেছিলো,এতবড় দুর্ঘটনা ঘটানোর পরও সউদ আর জাহরা তাকে রেসক্যিউ করতে রাজী হবে না।কিন্তু ওর ধারনাকে ভুল প্রমান করে জাহরা আর সউদই এগিয়ে এলো।সউদের দেয়া আইনজীবির সাহায্যে নোভা তার স্বামীকে ডিভোর্স দেবার সকল আইনগত কাজ শেষ করে জাহরা আর সউদের কাছে ক্ষমা চেয়ে অষ্ট্রেলিয়া চলে গেল।এ ব্যপারেও সউদ বিভিন্নভাবে ওকে সাহায্য করল।এর পরে আর দীর্ঘদিন নোভার সাথে ওদের যোগাযোগ হয়নি।নোভাও যোগাযোগ করেনি।প্রায় পঁচিশ বছর চলে গেলো,নোভা কোথায় আছে,কেমন আছে জাহরা জানেনা।এরই মাঝে আশফাক হোসেনও মারা গেলেন।

….

…….

……….

……..

…..

দেখতে দেখতে বছরগুলো গড়িয়ে চলতে লাগল।সউদ আর জাহরার জীবন ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।সে বছরই ওরা দুজন হজ্জ করে এলো।হজ্জ করে আসার পর থেকে দুজনই পুরোপুরি পরিপূর্ণ মুসলিমের জীবন যাপন করতে শুরু করল।ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠে দুজন একসাথে তাহাজ্জুদ আদায় করে,সউদ নামাজের জন্য মসজিদে বেরিয়ে যায়,জাহরা ঘরে বসে নামাজটা আদায় করে নেয়।কখনো ওরা দুজনই নামাজের জন্য মসজিদে চলে যায়।তবে যেহেতু মেয়েদের জন্য ঘরেই উত্তম তাই জাহরা ঘরেই বেশীর ভাগ পড়ে।এরই মাঝে একবার অনীতার ওখানেও দুজনে ঘুরে গেল।

সেসময়টা চমৎকার কেটেছে ওদের দুজনের।বিয়ের পর ওটাই ছিল ওদের হানিমুন।অনীতাও এখন নামাজের পাবন্দী করতে প্রাণপন চেষ্টা করে।সৎ ভাবে ব্যবসা করায় সউদের ব্যবসা আরো যেন বরকতময় হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।ওর ব্যবসা এখন বহির্বিশ্বেও যথেষ্ট পসার জমিয়েছে।মাসুদুর রহমান মারা যাওয়ায় ব্যবসার কাজে সউদকে প্রায়ই দেশের বাইরে যেতে হয়।তবে হলেও সাথে সে জাহরাকে সবসময়ই রাখে।

….

এতসব কিছুর মধ্য দিয়ে ওদের জীবনেও বরকত আসে।ওদের সংসারে আসে নতুন অতিথি।সউদ জাহরার প্রথম সন্তান “দারা”!

সউদের ইচ্ছে ছিল সে একডজন সন্তানের বাবা হবে কিন্তু পুরোপুরি তেমনটি না হলেও সউদ আর জাহরা আজ এক হালি সন্তানের পিতামাতা।আর আল্লাহর রহমতে তাদের চারটি সন্তানই পুত্র।

সউদ খুব শখ করে তাদের নাম রেখেছে-১)দারা২)সুজা৩)মুরাদ৪)আওরঙ!

মোঘল সম্রাট শাহজাহানের চারপুত্রের নামকরন অনুযায়ী সে তার চার পুত্রের নাম রেখেছে।

বাস্তবেও তার চারপুত্র শৌর্যে বীর্যে সেসব মহানায়কদের চেয়ে কম হয়নি বরং আরো বেশীই হয়েছে।জাহরার খুব ইচ্ছে ছিল তাদের একটি মেয়ে হোক কিন্তু একে একে চারটি ছেলে হওয়ায় জাহরা কিছুটা হতাশ।সউদ ওকে সান্তনা দিয়ে বলে  -“চার পুত্রের জন্য চারটা বউ আনলেই তো আমরা চারটা মেয়ে পেয়ে যাবো।আল্লাহর ফায়সালার উপর আমাদের সবারই সন্তষ্ট থাকা উচিত”!

জাহরাও হেসে বলে-“জ্বী,আপনি ঠিকই বলেছেন।

দেখতে দেখতে সউদ জাহরার চার সন্তানই কুরআনের চমৎকার হাফেজ ক্বারীতে সুপ্রতিষ্ঠিত হলো।বড় দুই ছেলে লন্ডনের আদম একাডেমীতে হিফজুল ডিপার্টমেন্টের বরেন্য শিক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো,সেজ ছেলে মালয়েশিয়াতে আর ছোট ছেলে আড়ঙ’ও সম্রাট আওড়ঙ্গজেবের মতই বুদ্ধিমান,ধীমান এবং বিচক্ষন হয়ে বেড়ে উঠেছে।একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সে জেনারেল লাইনেও যথেষ্ট পান্ডিত্যের ছাপ রেখে চলেছে।

….

আজ সউদ জাহরার বিবাহিত জীবনের সফল ত্রিশ বছর পূর্ণ হলো।বড় তিন ছেলেরই বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন ওরা।খুব দেরী করেননি।যে সমময়ে বিয়ে করলে তারা জীবনকে উপোভোগ করতে পারবে,সেসময়ের মধ্যই তিন ছেলেকেই একে একে বিয়ে করিয়েছে।তারাও দ্বীনদার স্ত্রী পেয়ে সুখী।

আজ সউদ-জাহরার ছোট ছেলে ‘আড়ঙে’র বিয়ের আকদের জন্য ওরা সবাই জমায়েত হয়েছে কনের বাসায়।এই কদিন আড়ঙ দেশের বাইরে ছিল বলে কনে দেখতে পারেনি। তার মা জাহরাই কনে নিজে পছন্দ করে কথাবার্তা এগিয়ে রেখেছে।এটা আড়ঙেরই দাবী ছিল,তার জন্য মেয়ে তার মা পছন্দ করবে।তবে শর্ত একটাই মেয়েকে তার মায়ের মতই সৎ এবং ধার্মিক হতে হবে।জাহরা যখন ওকে ফোনে জানালেন মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে, তুই দেখে পছন্দ করলেই বিয়ে পড়িয়ে দেবো”!

ছটফটে তরুন আড়ঙ বলেছে-“আম্মু,তোমার পছন্দ হলে আমার অপছন্দ হবেনা।যদি বলো তো ফোনেই কবুল বলে দিতেও আমার আপত্তি নেই!”

জাহরা বলেছে-“আরে পাগল,তুই দেশে আয়, মেয়ে দ্যাখ্,তারপর বিয়ে হবে তার আগেনা।”

আড়ঙ দেশে ফেরার পর আজ তাদের পুরো ফ্যামিলির সবাই মিলে কনের বাসায় উপস্থিত।জাহরা আড়ঙকে মেয়ের ছবি দেখিয়েছে,বলে দিয়েছে কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে আজই যেন তা করে নেয়।

আড়ঙ চুপ করে বসে আছে।বয়স্কা একজন মহিলা কনে”উম্মে হানি”কে নিয়ে প্রবেশ করলেন।আড়ঙ তাকে সালাম দিলে বুড়ী দুষ্টামী করে বলল-“সালামটা কি শুধু আমাকেই দিলে নাকি হবু বধুর জন্যেও?”

আড়ঙ মুচকি হাসল-“দুজনের জন্যেই!”

বৃদ্ধা নিজের পরিচয় দিলেন তিনি ‘হানী’র দাদু হন।আড়ঙের সাথে বেশ কিছুক্ষণ জমিয়ে আলাপ করার পর বৃদ্ধা বললেন-“আমার সাথে খোশ গল্প করলেই হবে,তোমার হবুবধূকেও কিছু বলো!”

আড়ঙ হেসে বলল-“না,হবুবধূকে কিছুই বলবোনা,যা বলার বধূকেই বলবো।একটু নাহয় সবর করি।”

একথা শুনে ‘হানি’ মুখ নামিয়ে হেসে ফেললে আড়ং মুগ্ধ দৃষ্টিতে তা উপোভোগ করে বলল-“মাশাআল্লাহ”!

‘হানি’ হাসি চেপে চকিতে একনজর চোখ তুলে তাকালে দেখল আড়ং ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।সে রাতেই ওদের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল।কথা স্থির হলো পরের সপ্তাহেই ওয়ালিমা সম্পন্ন করে মেয়েকে নিয়ে যাবে তারা।

বিদায় নেবার আগে বর কনেকে কিছুক্ষণ কথা বলতে দেয়া হলো!

বর কনে দুজনেই এখন মুখোমুখি।

আড়ঙ সামান্য কেশে ডাকল-“এই মেয়ে শোনো…!”

‘হানী’ ওর এমন ডাকে চমকে তাকাল।

আড়ঙ হানির ডান হাতটা আলতো করে ধরে বলল-” তোমার সাথে আমার জরুরী কথাগুলো বলে ফেলি।আমার বহুদিনের লালিত কিছু স্বপ্ন আছে যা আমি বহুকষ্টে আগলে রেখেছি।জীবনে কোন নারীর দিকে তাকাইনি।সব আবেগ সঞ্চিত করে রেখেছি আমার নিজস্ব বাম পাজরের হাড় থেকে তৈরী হালাল নারীর জন্য।তুমিই হলে সেই মেয়ে।কাজেই আমার দাবীগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো!”

হানি মুচকি হেসে মুখ তুলে তাকাল-“বলুন,শুনছি..!”

আড়ং ওর চোখে চোখ রেখে বলল-

*আমাকে কিন্তু..ভীষন ভালবাসতে হবে।

প্রতিদিন খাইয়ে দিতে হবে।

যখন তখন হাত ধরতে দিতে হবে।

আঁচলে মুখ মুছতে দিতে হবে।

আমি কিন্তু খুব দুষ্ট,তোমাকেও দুষ্টামী করতে হবে।

কোলে মাথা রাখতে দিতে হবে।

এককাপ চা ভাগাভাগি করে খেতে হবে।

এক বালিশে ঘুমাতে হবে।

কখনো আমার ডান বাহুতেও ঘুমাতে হতে পারে।

আমি কিন্তু নাক ধরে জোরে টান দিবো,রাগ করতে পারবেনা।

শাড়ী পরিয়ে দেবো,ট্যাঁ..ফু..করতে পারবেনা।

চুলগুলো আমার সামনে খোলা রাখতে হবে।

এক আইসক্রিম দুজনে ভাগ করে খাবো।

পা ব্যথা হলে কোলে নেবো।

রাতে রাস্তায় হাঁটা খুব পছন্দ দুজনে হাত ধরে হাঁটবো।

খোলা মাঠে সুযোগ পেলে দৌড় প্রতিযোগিতা করবো যেমনটি আমাদের নবী সাঃ মা আঈষাকে নিয়ে করেছিলেন।

মাঝে সাঝে একসাথে গোসল করবো।

অসুস্থ লাগলে আমি রান্না করে দিবো।

প্রয়োজনে খাইয়ে দেবো।

আমি কিন্তু যথেষ্ট লম্বা আছি,তাই বুকের মধ্যে মাথা রাখা তোমার জন্য কোনো ব্যপার না।মাথায় থুতনী দিয়ে চাপ দিলে রাগ করতে পারবেনা।

টিভি সিরিয়াল দেখা চলবেনা।

তবে দুজনে বসে ভালো রোমান্টিক সিনেমা দেখতে পারি।

বাচ্চা হলে মারধোর করা চলবে না,তাদের আদর করতে হবে।

মাঝেমধ্যে মেজাজ খারাপ হলে ঝগড়া করবো,রাগ করতে পারবে কিন্তু বাপের বাড়ী যেতে পারবেনা।চিন্তা কোরোনা,অভিমান আমিই ভাঙাবো!

পাঁচওয়াক্ত নামাজ ঠিকঠাকমতো পড়তে হবে নইলে কিন্তু কথা বন্ধ।

আমি ছাড়া তোমার একটি লোমও যেন পরপুরুষে না দেখে সে বিষয় আমি কিন্তু সাংঘাতিক হিংসুটে।আমার গীরাহবোধ এ ব্যপারে খুব বেশী কারন আমি জানি তুমি আমার,একা আমার।তোমাকে নিয়ে জান্নাতের বাগানে বিচরণ করতে চাইই…কি..আমার সব শর্তে রাজী? ”

হানি দুচোখ বন্ধ করে বলল-“আলহামদুলিল্লাহ”!

আড়ং সামান্য ঝুঁকে তার বন্ধ চোখের দুপাতায় চুমু খেয়ে বলল-“যাজাকিল্লাহ”!

শুরু হলো আরেকটি জীবনের।

{ইসলামিক নিয়মে জীবন যাপন করলে তাতে ধনাঢ্যতা কখনো কম থাকলেও বরকত থাকে বলে সুখের কমতি থাকেনা।চলুন,আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানগুলো পালন করে চির যৌবনের দেশ জান্নাতের যাত্রী হয়ে যাই।শত বাধা বিপত্তিতেও আমাদের মহান রবকে না ভুলি।বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক না প্রেম না ভালোবাসা ওটা স্রেফ জেনা ব্যাভিচার।এটা বর্জন করুন।আপনার সবকিছু আপনার স্বামী/স্ত্রীর জন্য সুরক্ষিত রাখুন।ইসলামকে লালন করুন,পালন করুন।সুখে থাকবেন।ইনশাআল্লাহ}

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।