গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন ২মুখোশ

ট্রেইলার পর্ব

“”একটা ঘন জঙ্গল , লতাপাতায় আচ্ছাদিত জঙ্গলের মাঝের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে গেলো একটা প্রাইভেট কার , বর্তমানকার প্রাইভেট কার নয় , দেখতে ১৯ শতকের শেষ দিকের টয়োটা গাড়ি গুলোর মতো , গাড়ির ভিতরে সামনের সিটে বসে রয়েছে দুজন যুবক , তাদের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ , যেন কোন কিছুর থেকে তারা বেঁচে পালানোর চেষ্টা করছে , গাড়ির পিছনের সিটে রয়েছে ২ জন যুবতী নারী , একজনের প্রসব বেদনা উঠেছে , প্রসব বেদনা উঠা নারীটা তার পাশের মেয়েটার মাথায় শুয়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে , পাশে থাকা মেয়েটা তাকে কোলে শুইয়ে দিয়ে তার হাতে নিজের হাত গুলো ঘসছে , প্রসব বেদনা উঠা মেয়েটার পায়ের দিকে বসে রয়েছে একটা ১২ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে , তার চোখে মুখেও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট , প্রসব বেদনা উঠা মেয়েটা ব্যাথায় চিৎকার দিচ্ছে , পাশে থাকা মেয়েটা ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা ছেলেটার উদ্দেশ্য বলছে তাড়াতাড়ি চালাতে , ছেলেটা গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দেয় , যে করেই হোক এই এলাকা থেকে তাদেরকে বের হতেই হবে , না হলে যে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত , ভয়ে ছেলেটার গাল বেয়ে এই শীতের সময়েও ঘাম বেয়ে পড়তে থাকে, সে বারবার সাইড গ্লাস দিয়ে দেখছে যে তাদের পিছনে “সে” আসছে কি না , কিন্তু না পিছনে কাউকে আসতে দেখা যাচ্ছে না , তখনই আমরা দেখতে পাই গাড়ি যেই পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে সজোরে চলছে সেই পিচ ঢালা রাস্তায় গাড়িটা থেকে তরল কিছু পড়ে যাওয়ার দাগ দেখা যাচ্ছে , তারমানে গাড়ির তেলের ট্যাঙ্কার কেউ ফুটো করে দিয়েছে , ফুটোটা কে করেছে ? সে নয়তো আবার ? 

গাড়িটা সজোরে চলে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যেকার রাস্তাটা দিয়ে , একটা বড় মোটা বট গাছ , সেটাকেও পিছনে ফেলে ছুটে চললো গাড়িটা , তখনই আমরা দেখতে পাই সেই বটগাছের পিছন থেকে একজন বেড়িয়ে আসছে , দেখতে বয়স্ক কেউ মনে হচ্ছে , গাঁয়ে, চোখে মুখে শাল জড়ানো , সে এসে একটা দিয়াশালাই এর কাঠি বের করে , এবং সেটা জ্বালিয়ে সেই রাস্তায় পড়ে থাকা তেলের লাইন টার উপর ফেলে দেয় , সাথে সাথেই লাইন অনুযায়ী ছড়িয়ে পড়তে থাকে আগুন , আগুন ছড়িয়ে সেই লাইন অনুযায়ী চলে যেতে থাকে গাড়ির পিছু পিছু , লোকটা আবার সেই জঙ্গলের ভিতরের দিকটায় চলে যায় , 

ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে থাকা ছেলেটা তার সাইড লুকিং আর গ্লাস দিয়ে দেখতে পায় একটা আগুনে জলন্ত শিখা রাস্তা দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে ঠিক তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে , সে সাথে সাথেই তার পাশে বসে থাকা বন্ধুকে বলে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে , পিছনের সিট থেকে প্রসব বেদনা উঠা মেয়েটার চিৎকার , আর্তনাদ বেড়েই চলছে , এ যেন এক অভিশপ্ত পরিস্থিতি , আগুন টা তাদের গাড়ির খুব কাছে চলে আসে , আরেকটু হলেই তাদের গাড়িতে আগুন ধরে যাবে , মেয়েটার চিৎকার আরো বেড়েই চলছে ।  ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা ছেলেটা প্রাণপণে চেষ্টা করছে এই গ্রাম থেকে বেড়িনোর , হঠাৎ গাড়ির পিছনের সিটের বাম দিকের দরজাটা আপনা আপনিই খুলে যায় এবং একটা অদৃশ্য শক্তি সেই ১২ বছরের কিশোরী মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বাহিরে ফেলে দেয় , মেয়েটা চলন্ত গাড়ি থেকে ছিটকে জঙ্গলের লতাপাতা গুলোর উপর গিয়ে গড়িয়ে পড়ে আর সাথে সাথেই গাড়িটাতে আগুন লেগে যায় ।

কিশোরী মেয়েটার থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর পরই এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে সেই গাড়িটার , গাড়ির ছাদ উড়ে গিয়ে পড়ে এক গাছের উপরিভাগে এবং জলন্ত আগুনের শিখা সহ গাড়িটা গিয়ে সজোরে আছড়ে পড়ে এক মোটা গাছের গুঁড়ির সাথে , হঠাৎ এই বিকট শব্দে আশেপাশের গাছের পাখি গুলো উড়ে যেতে থাকে , তখনই আমরা দেখতে পারি সেই চাঁদর গায়ে জড়ানো বৃদ্ধ টা গাছের গুঁড়ির পিছন থেকে সামনে আসছে । এসে জলন্ত গাড়ির পিছনের দিকের একটা দরজা খুলে , ভিতরে জ্বলতে থাকা একটা মেয়ের দেহ থেকে একটা বাচ্চা সন্তান বের করে আনে , যেন মাত্রই জন্ম হয়েছে সেই বাচ্চাটার , লোকটা সেই ছোট্ট বাচ্চাটাকে তার শালের চাদর দিয়ে ভালোভাবে পরম যত্নে জড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকে জঙ্গলের ভিতরের ‌দিকটায় , হাসতে থাকে এক আনন্দের হাসি , এদিকে সেই জলন্ত গাড়িটা থেকে পিছনে কিছুদূরে আমরা দেখতে পাই সেই ১২ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েটা অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে ।

 

কারা ছিলো তারা যারা গাড়ি ছুটিয়ে পালবার চেষ্টা করছিলো ? আর সেই জলন্ত প্রসূতি নারীর ভিতর থেকে কীভাবে একটা সুস্থ,সবল বাচ্চা বের হলো ? এটা কী আদেও বাচ্চা ? না অন্য কিছু ? 

সিজন ১ এর শেষে মৃত দের মাথা খুজে না পাওয়া , নুপুরের নরকঙ্কাল টায় মাংস গজাতে থাকা এবং সেটা নড়ে উঠা , 

প্রতিমাসে একটা করে নিলগিড়ি জঙ্গলের মধ্যে থেকে পাওয়া যাওয়া ক্ষতবিক্ষত জীবজন্তুর খাওয়া লাশ , 

এসব কীসের ইঙ্গিত ? 

 

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ২৭

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

[১৮+ রেড এলার্ট 🛑]

 

“””২০শে ডিসেম্বর, ১৯৯৬। লতাপাতায় আচ্ছাদিত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে এক রাস্তা। রাস্তাটা বেশ নির্জন। আনন্দ পুর গ্রামের এই একটায় রাস্তা যেটা দিয়ে গ্রামের বাইরে বের হওয়া যায়। নির্জন রাস্তার টার গা ঘেঁষে রয়েছে একটা বাড়ি। এটা ছাড়া রাস্তার আশেপাশে কোন বাড়ি নেই। আশপাশে শুধুই গাছ আর গাছ। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারপাশ। 

বাড়ির ভিতরে বারান্দার উঠোনে বসে চাল থেকে ধান বাছাই করছে তাসনুবা (২৪)। পড়নে হালকা খয়েরী রঙের শাড়ি। ঘরের আঙিনায় রোদ পড়েছে আজ দারুণ। শীতের শেষে এই সোনালী রোদ্দুরের আগমন। তাই এই রোদ্দুরে গা ভিজিয়ে তাসনুবা আনমনে চাল থেকে ধান বাছাই করছে। তখনই বাসার গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে ক’জন ছেলে মেয়ে। তাসনুবা তাদের লক্ষ্য করেনি। তারা এসে তাসনুবার সামনে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে থেকে একজন ছেলে বলে উঠে , 

– তাসনূ ,

তুসনুবা সাথে সাথেই মুখ তুলে চায়। এই ডাক টা যে তার ভিষণ চেনা। চেয়ে দেখে তার প্রিয় চাচাতো ভাই রাফি(২৮) এসেছে। রাফির পাশেই দাঁড়ানো তার বাল্যকালের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী সাবিনা(২৩)। আর তাদের পাশে দাঁড়ানো একটা রাফির বয়সীই ছেলে আর একটা ছোট্ট মেয়ে। তাসনুবা চালের কুলাটা পাশে রেখে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। সাবিনাকে জড়িয়ে ধরে। ৮ বছর পর দেখা তাদের। এতোদিন পর সাবিনার দেখা পাবে তা যে তার মস্তিষ্কের নিউরন অনুধাবনই করেনি। তাসনুবা তাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদেই ফেলে। 

– জানিস আমি তোকে কত মিস করছি। তুই আমাকে একটা বারও দেখতে এলিনা। এতোটাই পর হয়ে গেছি এখন। (সাবিনা তাসনুবা কে ছাড়িয়ে ভালোভাবে দাঁড় করিয়ে বলতে থাকে)

– তুইই তো আমাদের নাম কেটে দিয়েছিস। আমাদের ছেড়ে চলে এসেছিস। (একটু থেমে) আচ্ছা বাদ দে সেসব। কেমন আছিস তুই ? 

– এইতো আল্লাহ আমার কপালে যেমন লিখেছেন।(একটা হতাশা সূচক হাসি দেয় তাসনুবা। তারপর আবার বলে)

– ভাইয়া আসো ভিতরে আসো। এতোদিন পর আসলে তোমরা। 

– না তাসনু, আমরা এখানেই ঠিক আছি। (ছোট মেয়েটার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট টা নিয়ে তাসনুবার হাতে ধরিয়ে দেয় রাফি)

– এইনে। আর সোহেল ভাই কোথায় ?

– উনি ঘরে আছেন। ভাইয়া তোমরা ভিতরে আসো না। এতোদিন পর আসলে একটু চা নাস্তা কিছু খেয়ে যাও। 

– আমাদের প্রতি টান তাহলে এখনো তোর আছে ? ৮ বছর আগে এই টান কোথায় ছিলো তোর ? কেন গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাতব্বরের শিক্ষিত মেয়েটা এমন একটা একঘরে পরিবারের একটা শারীরিক প্রতিবন্ধীকে বিয়ে করার জন্য বাড়ি ছেড়ে পালালো ? 

তাসনুবা মাথা নিচু করে ফেলে। সে কী বলবে? কিছুই যে তার বলার নেই।

– তুই জানিস তোর বাবা-মা কতটা কষ্ট পেয়েছিলো ? তুই চাচ্চুদের একমাত্র মেয়ে ছিলি। তোকে এইরকম হয়ে যেতে দেখে ওরা ভিতরে ভিতরে কতটা আঘাত পেয়েছিলো জানিস ? (একটু থেমে) এখন আর এসব বলে কী হবে। এখন তুই ৮ বছর বয়সী একটা ছেলের মা। সংসারী হয়ে উঠেছিস। ওসব কথা এখন উঠিয়ে আর কী লাভ। 

– নোমান কেমন আছেরে তানসুব ? নোমান কোথায় ওকে যে দেখছিনা। (সাবিনা বলে)

– ও ঘরে আছে। খেলনা নিয়ে খেলছে। (মাথা নিচু করেই কথা গুলোর উত্তর দেয় তাসনুবা)

– এই নে ধর। এগুলো নোমান কে দিস। ওর পছন্দ হবে নিশ্চয়ই।(ছোট মেয়েটার হাত থেকে কিছু খেলনা আর চকলেট, চিপস নিয়ে তাসনুবার দিকে এগিয়ে দেয় সাবিনা। তাসনুবা মাথা উঠায়। রাফির দিকে একবার তাকায় তারপর সাবিনার দিকে একবার। সাবিনা মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। তাসনুবা সেগুলো গ্রহণ করে। 

– আচ্ছা ভাইয়া তোমার পাশে যে উনি দাঁড়িয়ে আছেন, উনি কে ? 

– ও ? ও আমার বন্ধু সিহাব(২৪)। পাশের ছোট মেয়েটা ওর বোন। ও বললো ও নাকি আমার গ্রাম দেখবে তাই ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছি। 

– আচ্ছা একমিনিট। তাসনুব, তোর মুখে এগুলো কীসের দাগ ? আমি এতক্ষন ধরে বিষয় টা খেয়ালই করিনি। (সাবিনা উৎসুক হয়ে বলে)

কথাটা শুনেই শাড়ির আঁচল টেনে মুখ চেপে ধরতে থাকে তাসনুবা। 

– হ্যা আসলেই। এই তাসনু তোর মুখে এসব কীসের দাগ? দেখি। মুখের উপর থেকে কাপড় সড়া।

রাফিকে অনেক ভয় পায় তাসনুবা। এই একজন যার ধমকের ভয়ে তাসনুবা সবসময় মান্য হয়ে চলতো। 

কিছুক্ষণ পর কাপো কাপো হাতে মুখের উপর থেকে শাড়ির আঁচলটা সড়াতে থাকে তাসনুবা। 

– হায় আল্লাহ। এতো সুন্দর মসৃণ মুখটাতে এসব দাগ কীভাবে এলো? (সাবিনা)

– ন,না মানে আমি পা পিছলে টিউবওয়েল পাড়ে পড়ে গিয়েছিলাম তখন, তখন কিছু সুচোলো ডালপালা আমার মুখে লাগে। এইজন্যই। (হঠাৎ রাফির হাত ধরে) ভাইয়া, মাকে প্লিজ এসব বলিও না। মা অনেক কষ্ট পাবে। 

– কষ্ট দিতে আর বাকিইবা রেখেছিস কী। তোর মা এখনো তোর আলমারি খুলে তোরে কাপড় গুলোকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে। অনেক বার এখানে তোর সাথে দেখা করতে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু চাচ্চু তোর উপরে অনেক রাগ করে থাকায় অনুমতি দেয়নি। তাই চাচি আম্মু আমাদের পাঠিয়েছেন তোকে একবার দেখে আসতে। 

তাসনুবা কথা গুলো শুনে রাফির হাত ছেড়ে দেয়। অনুতাপে মাথা নিচু করে ফেলে। তার অনেক কাঁদতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করেই কেন সে একদিন এ বাড়িতে চলে এসেছিলো? কেনই বা সে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিলো। সে নিজের কষ্ট টাকে চেপে রাখতে চেষ্টা করে। তখনই রাফি বলে উঠে।

– আসসালামুয়ালাইকুম ,

তাসনুবা মাথা উঠায়। উঠিয়ে পিছনে ফিরে দেখে তার শশুর আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। পড়নে একটা ধুতি,ফতুয়া আর তার উপরে একটা শাল। তিনি একদম ক্ষীণ দৃষ্টিতে রাফিদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। রাফি সালাম শুনার পরই তার প্রতিউত্তর না দিয়ে বারান্দা থেকে রুমের ভিতরে চলে যান। রাফির এতে একটু অপমানিত বোধই হয়। রাফি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। সে এতো বছর পর তাসনুবার সামনে তারই শশুর বাড়িতে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছে না। তখনই তাসনুবা নিম্ন গলায় বলে।

– ভাইয়া। উনি এরকমই। তুমি কিছু মনে করোনা।

– না আমি কিছু মনে করিনি।(একটু থেমে) শুনলাম, তুই নাকি প্রেগন্যান্ট? 

তাসনুবা মাথা নিচু করে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়।

– কত মাস চলছে ? (সাবিনা)

– ৫ মাস। (মাথা উঠিয়ে) কিন্তু জানিস দোস্ত আমার ভিতরে আমি কাউকে ফিল করতে পারিনা। নোমান যখন পেটে ছিলো তখন ওর নড়াচড়া, ছোট্ট ছোট্ট পা দিয়ে লাথি দেওয়া আমি অনুভব করতে পেতাম। কিন্তু এবার, এবার আমি কোন কিছুই অনুভব করতে পারছিনা। মনে হচ্ছে আমার মধ্যে যেন কিছুই নেই। 

– কী বলিস এসব ? বাবুর উপস্থিতি টের পাসনা ? 

– না পাইনা। আর জানিস ? আমি সেই নোমানে হওয়ার পর থেকে আর কখনো উনার সাথে ঘুমাইনি। আমি আলাদা থাকতাম। তবুও ,(এক করুণ মুখ নিয়ে মাথা তুলে রাফি,সাবিনাদের দিকে তাকায় তাসনুবা)

তাসনুবার কথা শুনেই রাফি আর সাবিনা একে অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। তারপর আবার বলে,

– তুই কী বলছিস তা কী তুই বুঝতে পারতেছিস ? একসাথে না থাকলে,

– তাসনুবা , তাসনুবা , নোমানের খিদা লাগছে ঘরে আয়।

(রাফিরা ঘরের ভিতর থেকে তাসনুবার উদ্দেশ্য দেওয়া ডাকটা শুনতে পায়। তাসনুবা রাফিদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে।

– ভাইয়া, তোমরা বসো আমি একটু ঐদিকে দেখে আসছি।(বলেই ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হয় তাসনুবা। তখনই রাফি বলে,

– আমরা আজকে যাই বোন। তুই তোর খেয়াল রাখিস। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস। 

– চলে যাবা তোমরা। একটু দাঁড়াও আমি খালি ভিতরে যাবো আর আসবো। 

– না রে দোস্ত। আমরা আবার তোর সাথে দেখা করতে আসবো। ভালো থাকিস। (সাবিনা)

তাসনুবা, সাবিনাকে আবার জড়িয়ে ধরে। আবেগি হয়ে পড়ে সে।

– আমার আসবি কিন্তু। আমার তোদেরকে ছাড়া একদম ভালো লাগে না।(সাবিনাকে ছেড়ে দিয়ে তার গাল দুটো ধরে) আসবি কিন্তু আবার‌।

– আচ্ছা আসবো। নিজের খেয়াল রাখিস।

– তাসনুবা, তাসনুবা,

– আমাকে আবার ডাকছে। আমি যাই এখন। ভাইয়া ভালো থেকো। আসসালামুয়ালাইকুম। গেলাম দোস্ত। 

– আচ্ছা যা। 

বলেই হনহন করে ঘরের দিকে চলে তাসনুবা। রাফি,সিহাব,সাবিনা ও তাদের সাথে আসা ছোট্ট মেয়েটা চলে যেতে থাকে বাড়ি থেকে। তারা বাড়ির বাহিরে বের হয়। জঙ্গলের রাস্তার সাথেই বাড়িটা লাগানো তাই তারা তাদের গাড়িটাকে বাসার দরজার সামনেই রেখেছিলো। তারা সবাই এক এক করে গাড়িতে উঠে এবং চলে যেতে থাকা রাস্তাটা দিয়ে।

 

– তোরে আমি কতবার ডাক দিছি ? আহোস নাই ক্যা ? 

– আমার ভাইয়া, বান্ধবীরা এসেছিলো। ওদের সাথেই কথা বলছিলাম। (মাথা নিচু করে ধীর গলায় বলে তাসনুবা)

– তুই, তুই আমার কথা না শুইনা শালাগো কথা শুনতে যাস বান্দির বাইচ্চা,! তরে আমি, তরে আমি  (বলেই বিছানা থেকে নেমে দেয়ালে ঝুলতে থাকা বেল্ট টা খুলে নিয়ে হনহন করে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে তাসনুবার দিকে।

– আমাকে মারিও না। আমাকে মারিও না। 

– তুই আমার ডাক শুনস নাই ক্যা। (বলেই একটা ঘুষি মেরে তাসনুবাকে মাটিতে ফেলে দেয় সোহেল। তারপর দিকবিদিক না দেখে সরু চিকন বেল্ট টা দিয়ে জোরে জোরে মারতে থাকে তাসনুবাকে। 

– আহ, ওহ, আমাকে আর মারিও না। আমি মরে যাবো। আমাকে আর মারিও না। 

– বান্দির বাইচ্চা তুই পোয়াতি হইছস কইনতে। কার লগে ফষ্টিনষ্টি কইরা বাচ্চা পেডে নিয়া ঘুরস খানকি,! তোর দেমাগ আমি বাইর করমু। বহুত বারছস তুই।

– আল্লাহগো আর মারিও না। আহ, আল্লাহ, ওমাগো আর মাইরোনা। আমি, আমি মইরা যামু, আআআআআআ,

 

ঘুম থেকে এক চিৎকার দিয়ে উঠে পড়ে দিথী। চোখে মুখে ঘাম।  জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে সে। সে হাত দিয়ে নিজের মাথাটাকে ধরে। এ কী স্বপ্ন দেখছিলো সে ? সে মাথা ঝাঁকিয়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা পানির গ্লাস টা হাতে নিয়ে এক ঢোকে পুরোটা খেয়ে ফেলে দিথী। খেয়ে গ্লাস টা হাতে রেখেই জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। বিগত দুইদিন ধরে এইরকম ই স্বপ্ন দেখছে ও। আর প্রতিবারই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ওর ঘুম হঠাৎ ভেঙে যায় আর ও হাঁপাতে থাকে। সে গ্লাসটা পাশের টেবিলে রাখে।  দুই হাত দিয়ে নিজে চোখ,মুখের ঘাম মুছতে থাকে। সে টেবিলে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে এখন ভোর ৫.২৫ বাজে। তখনই সে দেখে তার পাশে শুয়ে থাকা সামিহাও ঘুমের মধ্যে কিছু একটা বলছে। সে সামিহার দিকে ফিরে তাকায়। সামিহার ঘুমন্ত মুখ দেখে মনে হচ্ছে স্বপ্নে ও খারাপ কিছু দেখছে। ওর ঘুমন্ত চোখ মুখ নড়ছে। গাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। এবং একটা পর্যায়ে সে চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে বসে। বসেই বড় বড় ‌নিঃশ্বাস নিতে থাকে। চোখ গুলো বড় বড় করে লেপের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকে।

দিথী এসব দেখে বেশ অবাক হয়। সে সামিহার কাঁধে হাত দিতেই সামিহা চমকে উঠে পাশে ফিরে তাকায়। দিথী তাকে হাত দিয়ে আশ্বস্ত করতে থাকে যে এটা অন্য কেউ নয়। সামিহা সামনে ফিরে হাঁপাতে থাকে। মাথায় বালিশের পাশে হাত দিয়ে খুঁজতে থাকে তার চশমাটা। চশমাটা চোখে পড়ে নিয়ে মুখের ঘাম মুছতে থাকে সে। দিথী টেবিলে থাকা গ্লাসটায় পানি ঢেলে সামিহার দিকে এগিয়ে দেয়। সামিহা এক ঢোকে পানিটা শেষ করে গ্লাস টা দিথীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। দিথী গ্লাস টা নিয়ে টেবিলে রেখে সামিহার কাঁধে হাত রেখে বলে। 

– তুমি ঠিক ‌আছো আপু ? 

– হ,হ্যা। এখন, এখন ঠিক আছি। 

– কী হয়েছিলো তোমার? কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে কী ? 

– হ্যা। স্বপ্নটা জানি কিরকম। আগে দেখতাম না। কিন্তু ইদানিং বিশেষ করে এই দুইদিন থেকে প্রতি রাতেই এই স্বপ্ন টা দেখছি আমি। 

– শান্ত হও আপু। (একটু থেমে) কিরকম স্বপ্ন দেখছিলে তুমি ? 

– আমার স্বপ্নে, আমার স্বপ্নে আমি কিছু ছেলেমেয়েদের দেখতে পাই। নামটা কী যেন (চোখ বন্ধ করে মনে করতে থাকে) হ্যা, তাসনুবা। তাসনুবা সেই নামটা। আজকে দেখি তার ভাইয়ারা তাকে দেখতে এসেছে। তারপর পড়ে যখন তার ভাইয়ারা চলে যায় তখন সেই তাসনুবার স্বামী তাকে বেল্ট দিয় বেধরম মারতে থাকে, গালাগাল দিতে থাকে।(একটু থেমে দিথীর দিকে ফিরে) মেয়েটার আর্তনাদ, এখনো আমার চোখে ভাসছে। 

(দিথী যেন সামিহার কথা গুলো শুনে ‘থ’ হয়ে যায়। এইসব কিছু তো সেও দেখলো আজ স্বপ্নে। দুজনের স্বপ্ন একই কীভাবে হয়, !

– আপু আমিও এই স্বপ্নটাই দেখেছি আজ। 

– তাসনুবাকে মারে অনেক তাইনা। আর,আর তাসনুবার শশুরের চাহনিটাও আমার কাছে কেমন জানি লাগে। আশ্চর্যজনক আর তার সাথে রহস্যময়ও। 

– আপু, আপু তুমি শান্ত হও। হয়তো আমাদের দুজনেরই একসাথে একই স্বপ্ন দেখাটা কাকতালীয় বিষয়। আসো নামাজ পড়ে নেই। আযান দিয়ে দিয়েছে হয়তো। 

– হমম চলো। নামায পড়লে নিজেকে চাপ মুক্ত লাগে। চলো অযু করে আসি। 

 

দিথী মশারী টা উঠিয়ে লেপ থেকে পা গুলো বের করে খাট থেকে নামায়। বেশ শীত পড়ে ভোরের দিকে তাই শীতের‌ কাপড় পড়ে নিতে লাগলো সে। সামিহাও শীতের সোয়েটার পড়ে নেয়। তারপর তারা বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে। টিউবওয়েল পাড়ের দিকে চলে যেতে থাকে অযু করার জন্য। দিনের আলো এখনো ফুটেনি। তবে কুয়াশা আর ঠান্ডার তীব্রতা অনেক।‌ এক কথায় যাকে বলে হাড়কাঁপানো শীত। তারা অযু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়।

 

 

সকাল ৮ টা। দোতলা একটা বাড়ি। জমিদার আমলের বাড়ি বললেও ভুল হবেনা। বাড়িটা বেশ পুরোনো। ১৯ শতকের তৈরিকৃত বাড়ি। বাড়িটার চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাড়িটার ডান পার্শ্বে রয়েছে একটা বাগান। সকালের হালকা রোদ এসে পড়েছে বাড়িটার উপরে। প্রাচীর গেইট দিয়ে ঢুকে তারপর বাড়ির অন্দরমহলের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। আপনারা হয়তো বুঝতে পারছেনা না এটা আসলে কার বাড়ি বা মহল। ফারুককে হয়তো আপনারা ভুলেননি। নিপার যার সাথে সম্পর্ক রয়েছে সেই ফারুকের কথা বলছি। ফারুকরা খাঁন বংশ। ফারুকের দাদা এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। তিনি এককালে এই গ্রামের মাতব্বর ছিলেন। অনেক জমিদারি ছিলো তার। তবে এখন তারা জমিদারির দিক দিয়ে নয় ব্যবসায়ীক দিক দিয়ে প্রভাবশালী।

ফারুকের পুরো নাম রায়হান খাঁন। ফারুক নামে তাকে গ্রামের লোকেরা ডাকে। বাসায় কিংবা ঢাকায় তাকে সবাই তার আসল নাম রায়হান খাঁন নামেই চিনে। রায়হানের দাদা আব্দুল ওহাব খাঁন জমিদার থাকলেও তিনি তার দুই ছেলে নজরুল খান ও শাহেদ খানকে শহরে পড়ালেখা করিয়ে শিক্ষিত করে ব্যবসা খাতে লাগিয়ে দেন। আর তারপর থেকেই রায়হানের মানে ফারুকের বাবা নজরুল খাঁন ও তার চাচা শাহেদ খাঁন মিলে গড়ে তুলতে থাকে তাদের ব্যবসা।‌ তারা ডেইরি ফার্ম, পোল্ট্রি শিল্প আর মাছের হ্যাচারি ব্যবসার সাথে যুক্ত। গ্রামের তাদের ফার্ম এর সংখ্যা কম হলেও ঢাকায় তাদের কম্পানির ভালো খ্যাতি রয়েছে। “আর আর এস” পোল্টি এন্ড হ্যাচারি লিমিটেড এর নাম ঢাকায় বেশ প্রসিদ্ধ। রায়হানের দাদা এখন বিছানায় পড়েছেন। নজরুল খাঁনেরও বয়স হয়ে গিয়েছে তাই তিনি আর তার ভাই শিহাব খাঁন এই সম্পূর্ণ ব্যবসার দায়িত্ব তাদের ছেলেদের উপরে দিয়ে দিয়েছেন। এখন তাদের ছেলেরাই এসব দেখাশোনা করে। রায়হানও ঢাকাতেই এসব ব্যবসা দেখা শোনা করতো। এই এক মাস হলো সে গ্রামে এসেছে একটু অবসর সময় কাটাতে। 

 

বাড়ির ভিতরে অন্দরমহলের ডান পার্শ্বে সোফা রাখা আর বাম পার্শ্বে ডায়নিং টেবিল। অন্দরমহলের দুই পাশ দিয়ে দুটো সিড়ি উপরে উঠে গিয়েছে দোতলায় যাওয়ার জন্য। অন্দরমহলের মাঝখানে ঝুলছে একটা বড় ঝাড়বাতি। বেশ খানিকটা রাজকীয় ফিল পাওয়া যায়।

 ডান পাশের সিঁড়িটা দিয়ে নামছেন সুমনা বেগম। তিনি রায়হানের মা। তার গাঁয়ে গয়না রয়েছে হালকা। পড়নে বাদামী শাড়ি ও শাল। তিনি নেমেই ডায়নিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যান। 

– আঁখি, আঁখি,

ডাক শুনেই রান্নাঘর থেকে দৌড়ে ছুটে আসতে থাকে ছিমছাম গড়নের একটা মেয়ে। বয়স ১৬ কী ১৭ হবে। দৌড়ে এসে সুমনা বেগমের সামনে এসে দাঁড়ায় আঁখি।

– রায়হান কই গেছে ? 

– খালাম্মা, খালাম্মা আমিতো সকালে দেখলাম রায়হান ভাইয়ায় ব্যায়াম করার লাইগা বাড়ি থেইকা বাইর হইছে। 

– নাস্তা করছিলো ও ? 

– না খালাম্মা। আমি নাস্তা করতে কইছিলাম কিন্তু ভাইজানে কয় পরে খাইবো।

– ওহহ আচ্ছা যা। আর শোন। তোর খালুজান ঘুমাচ্ছে। ডাক দিতে যাবিনা। 

– আইচ্ছা ঠিক আছে খালাম্মা। (একটু থেমে) আর খালাম্মা, আপনার কী কিছু লাগবো ? 

– না, আর শোন আজ দুপুরে আমার জন্য নিরামিষ রান্না করবি। আর রায়হান যদি আমিষ খেতে চায় তাইলে তার জন্য আলাদা করে রান্না করিস। বুঝতে পারছিস?

– জি খালাম্মা বুইজ্যা গেছি। 

– আমি একটু বাগানের দিকে গেলাম। ঐদিকে রহিমকে যে বলছিলাম সকাল সকাল ফুলের গাছ গুলাতে পানি দিতে, দিছে না নাই কে জানে। 

বলতে বলতেই অন্দরমহলের ফটক দিয়ে বের হয়ে যান সুমনা বেগম। 

আঁখি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সুমনা বেগম যেমন ঠান্ডা তেমন রাগী। কোন খুদ খুঁজে পেলে তার খবর করে দিবে। সে এসব ভাবতে ভাবতেই পিছন ফিরে রান্না ঘরের দিকে যেতে যাবে তখনই নিচতলার ঘর থেকে বের হয়ে আসলো আলিশা(১৭)। আলিশা এর মা সুরাইয়া বেগম রায়হানের ফুফু হয়। অর্থাৎ রায়হানের বাবারা ৩ ভাই বোন। 

আলিশার পড়নে একটা গোল জামা তার উপরে সোয়েটার। সে এসে হাই তুলতে তুলতে আঁখিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকলো,

– আঁখি, আমাকে একটা কফি দিয়ে যাতো। (বলেই পাশে থাকা সোফায় বসে পড়লো আলিশা। সোফার টেবিলের উপরে থাকা একটা ম্যাগাজিন ‌নিয়ে সেটাতে চোখ বুলাতে লাগলো সে। 

এদিকে আলিশার কাছ থেকে আদেশ পাওয়ার পর আঁখি ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে।

– সব ফাইফরমাশ সব খালি আমারেই খাটতে হয়। এরথেইকা ভালা হইতো যদি বিয়া কইরা ভাতারের বাড়িত থাকতাম। কী কপাল আমার,! 

– কিছু বললি আঁখি , ?(ম্যাগাজিনের উপর থেকে চোখ না উঠিয়েই আলিশা বললো)

– ক,কই না তো আফা। আমি অহনি রকেটের গতিতে যাইতাছি আর কফি লইয়া বিমানের গতিতে আইতাছি।

– হ যা। আর কয়টা দিন যাক তারপর রহিমের সাথে তোর বিয়ে দিয়ে ভাতারের বাড়িতে থাকার শখ পূরণ করে দিবো। 

– হায় আল্লাহ আফামনি সব শুইনা লাইছে। শরম শরম,! (ওড়না দিয়ে মুখ চেপে হনহন করে রান্না ঘরের দিকে চলে যেতে থাকে আঁখি। ওর এমন কান্ড দেখে মুচকি হেসে আবার ম্যাগাজিন এর দিকে তাকায় আলিশা। ম্যাগাজিন পড়া ওর শখ। তাও আবার সব ম্যাগাজিন সে পড়ে না। তার পছন্দের নায়ক রোশানকে নিয়ে যত গুলো ম্যাগাজিন বের হয়েছে সে শুধু সেগুলাই সংগ্রহ করে আর পালাক্রমে পড়ে। পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেলেও সে প্রতিদিন সকালে শোয়েটার গায়ে সোফায় বসে রোশানের ছবি ছাপানো ম্যাগাজিন পড়বেই পড়বে।

 

 

কনস্টেবল নয়ন হাত ভর্তি গাট্টি গাট্টি ফাইল নিয়ে স্টোর রুম থেকে রিয়াদের রুমে ঢুকলো। রিয়াদ তার নিজের চেয়ারে বসে একের পর এক ফাইল চেক করেই যাচ্ছে। নয়ন গিয়ে ফাইলের থাক টা টেবিলের কোণায় রাখলো।

– আস্তে রাখতে পারোনা ? দেখতেছো কাজ করতেছি ডিস্টার্ব করো কেনো ? 

– সরি স্যার। আর হইবোনা।

– যাও এখান থেকে। (নয়ন মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকে। রিয়াদ আবার নিজে নিজে বলতে থাকে।

– এই কেসের জ্বালায় মনে হয় আর পৃথিবীতে থাকা যাবে না। ভাবলাম কেস সলভ, বাসায় গিয়ে নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাবো, না নুপুরের লাশ টাকে এখনি চুরি যাইতে হইলো। যত্তসব ফাউল,!

নয়ন কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে তাকিয়ে বললো 

– স্যার, আমার তো মনে হয় নুপুরের লাশ টা নিজে নিজেই কোথাও চইলা গেছে। ঐদিন পুলিশ স্টেশনের সব দরজা বন্ধ ছিলো। জানালার গ্রিল কিংবা দরজা কোনডাই ভাঙা ছিলোনা। তারপরও নুপুরের নরকঙ্কাল গায়েব। আমার তো মনে হয়,(একটু থেমে) আমার তো মনে হয় কঙ্কাল টা নিজে থেইকাই হাইটা কোনহানে চইলা গেছে ,!

রিয়াদ মাথা নিচু করে ফাইল দেখছিলো। হঠাৎ কনস্টেবল নয়নের এই কথা শুনে রাগে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত কড়মড়িয়ে বলতে থাকে।

– মাথা এমনিতেই খারাপ আছে। আরেকটা কথা বললে একদম লকাপে ঢুকিয়ে সবটুকু রাগ কিন্তু তোর উপরেই ঝাড়বো। 

– স, সরি স্যার। সরি (বলেই হনহন করে রিয়াদের রুম ত্যাগ করে থানার পাশের রুমে চলে গেলো নয়ন। 

রিয়াদ যেই ফাইল টাকে দেখেছিলো সেটা বন্ধ করে ছুঁড়ে ফেললো রুমের একটা কোণে। চেয়ারে হেলান দিয়ে উপরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিয়াদ। নুপুরের কেস টা তো সলভ ই করে ফেলেছিলো তারা। শুধু কেসের রিপোর্ট আর লাশ টা প্রমাণ স্বরুপ কমিশনার সাহেব কে দেখালেই কেস ক্লোজ। 

“কিন্তু না, চোর আর চুরির সময় পাইলোনা। শেষ মুহূর্তে লাশ চুরি করে দৌড়, ” ভেবেই রিয়াদ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলের উপর রাখে। সোজা হয়ে বসে আবার ফাইল চেক করাতে মনযোগ দেয়। লাশ চুরি গিয়েছে তা আজ দিয়ে হলো দু’দিন। পুরো গ্রামে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছে এই দুইদিন রিয়াদ তার পুরো ফোর্স নিয়ে। কিন্তু কারো বাসায় কিছু পায়নি। এখন সে বসেছে এই গ্রামে আগে যতবার লাশ চুরি গেছিলো সেই গুলার ফাইল নিয়ে। কিন্তু প্রায় সবগুলোই কবর থেকে চুরি যাওয়া লাশ তাও আবার যারা বজ্রপাতে মারা গেছে তাদের গুলাই। রিয়াদ এই একই বিষয়ের ফাইল আজ সকাল থেকে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। 

রিয়াদ নিজের চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে থানার বাহিরের দিকে।  বাইরে গিয়ে যদি ওর মাথাটা একটু ঠান্ডা হয় আর নিজেকে একটু ফ্রেশ করতে পারে। রিয়াদ বের হয়ে যায়। তখনই কনস্টেবল নয়ন উঁকি দেয় পাশের রুম থেকে। উঁকি দিয়ে দেখে যে রিয়াদ বেড়িয়ে গিয়েছে। সে আশেপাশে দেখতে থাকলো কেউ আছে কি না। দেখে কেউ নেই। সে আস্তে আস্তে হেঁটে রিয়াদের টেবিলের দিকে আসতে থাকে। এসে রিয়াদের টেবিলের উপর থাকা ফাইল গুলোর মধ্যে থেকে একটা হলুদ ফাইল বের করে নিজের শার্টের নিচে লুকিয়ে নিলো। তারপর চারপাশ আবার ভালোকরে তাকিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে যেতে লাগলো।

 

 

একটা করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেউ। তার পায়ে বুট জুতো, গায়ে কালো হুডি চেইন খোলা, আর ফরমাল কালো প্যান্ট। হেঁটে যাওয়ার শব্দটা চারপাশে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। লোকটার চেহারা দেখানো হয়না আমাদের। শুধু কাঁধ থেকে নিচের অংশ টুকুই দেখানো হয়। করিডোরের উপরে একের পর এক লাইট জ্বলছে। লোকটা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করিডোরের একটা রুমের দরজার সামনে থামে। কাঠের দরজা। দরজার সামনে লেখা A24। লোকটা দরজার হাতল টা ধরে দরজাটা খুলে ফেলে। ভিতরে একটা মেয়েকে দুটো ছেলের সাথে বিছানায় দেখতে পায় সে। তারা নিজেদের উপর কাঁথা ঢাকা নিয়ে ছিলো। লোকটা ঘরের ভিতরে ঢুকে। তাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বিছানায় বসে থাকা তারা উঠে পড়ে। বিছানার ছেলে দুটো একটা গামছা পেঁচিয়ে বিছানা থেকে নামতে থাকে। মেয়েটা নিজের গায়ে বিছানার চাদর টা জড়িয়ে নিয়েছে। লোকটা সেই দুটো ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– তোরা এখানে কী করিস ? আর এ? এনা হাবিবা ? এর না আজকে খবর করার কথা ছিলো ? এ এখানে কী করে ? 

– বস , ডাক্তার সিমিন কইছে এই মাইয়ার ক্যান্সার আছে। সরিলে মেলা যায়গায় বলে ক্যান্সারের বাসা। এরলাইগা এইডা চলবোনা।

– তো এরে এখনো বাঁচায় রাখছিস ক্যান‌ ? তোরা কী নিয়ম ভুলে গেছিস না নতুন করে তোদের আবার শিখাইতে হবে ? 

– না মানে বস আমরা এই মাইয়াডারে মারতেই আইছিলাম তহনি মাইয়াডা আমাগোরে (একটু থেমে) আমাগোরে তার রুপের নেশায় ডুবাইয়া দিছিলো। (বলেই মাথা নিচু করে ফেলে ছেলে দু’জন)

– ও সব খুলে দিলো আর তোরাও গলে গেলি ? যা, গিয়ে চাপাতি নিয়ে আয় , এখনো দাঁড়ায় আছে। যা,

– ওকে বস, 

ওরা দুজনই মাথা নিচু করে রুমের বাইরে চলে যায় চাপাতি আর বস্তা আনতে। তখনই বিছানায় চাদর জড়িয়ে বসে থাকা মেয়েটা তার শরীরের উপর থেকে চাদর সড়িয়ে দিয়ে লোকটার সামনে এক মুচকি হাসি দিয়ে বলতে থাকে।

– নিজে খাবি বইলা ঐ দুইডারে বাইরে পাডায় দিলি ? আয়, আয় খা, সব তোর ,

লোকটা একদম সোজা হয়ে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে, কোন কথা বলেনা। 

– কীরে । ও বুজ্জি। তোরে মনে হয় আগে গরম করা লাগবো। হ্যাঁ ।

বলেই মেয়েটা তার শরীর থেকে সবটুকু চাদর সড়িয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামতে থাকে। মেয়েটার গায়ে কোন কাপড় ছিলোনা। মেয়েটা খারাপ অঙ্গভঙ্গি করতে করতে লোকটার কাছে আসে। এসে লোকটার গাঁয়ের সাথে নিজের বস্ত্র বিহীন দেহ ঘষতে থাকে। লোকটা এখনো কোন কথাও বলছেনা, মেয়েটাকে ছুঁয়েও দেখছেনা। মেয়েটা ছেলেটার হাত ধরে তার স্তনের উপর দিয়ে দেয়। কিন্তু সাথে সাথেই লোকটা হাত নামিয়ে নেয়। 

– ও বুজ্জি। তুই এহনো গরম হসনাই , ! তোর তারিফ করা লাগে ক। এরকম একটা হট মাইয়া সামনে দাঁড়াইয়া থাহার পরও তোর কোন ফিলিং ই আইতাছে না। (লোকটার কানের কাছে মুখ এনে) নাকি তোর দাঁড়ায় না হ্যা। 

তখনই ঘরের মধ্যে সেই দুই ছেলে চাপাতি আর বস্তা নিয়ে ঢুকে পড়ে। মেয়েটা সেসব দেখেই কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সে লোকটাকে গলাতে চেষ্টা করে। লোকটার সামনে খারাপ অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। পিছনে দাঁড়ানো দুজন ছেলে তো এসব দেখে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তখনই লোকটা তার হাত বাড়ায়। পিছন থেকে দুজন ছেলে সেই হাতে চাপাতি ধরিয়ে দেয়। চাপাতি টা হাতে নিয়েই লোকটা সেই মেয়েটাকে এক জোড়ে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। মেয়েটা একদম ফ্লোরে পড়ে যায়। মেয়েটা পড়ে গিয়ে আরো খুশিই হয়। ভাবে যে শেষমেষ লোকটাকে সে গলাতে পেড়েছে। তখনই লোকটা সামনে এসে মেয়েটার মুখ টা বুট জুতো দিয়ে ফ্লোরের সাথে চিপে ধরে। মেয়েটা তার দু হাত দিয়ে জুতোটা উঠানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পাড়ছেনা। এই বিশাল দেহীর কাছে সে একটা ক্ষুদ্র পিঁপড়া মাত্র। সাথে সাথেই পিছনে থাকা দুজন ছেলে এসে দুই পাশে মেয়েটার হাত চেপে ধরে। মেয়েটার মুখ একপাশে ফিরানো আর গাল টায় লোকটা পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। এতোটাই জোড়ে যে মেয়েটা ব্যাথায় চিৎকার করছে। মেয়েটা লোকটার হাতে চাপাতি টা দেখেনি তাই সে জানতোও না এখন তার সাথে কী হতে চলেছে। 

লোকটা সাথে সাথেই সেই চাপাতি টা দিয়ে মেয়েটার গলা কাটতে শুরু করে। মেয়েটা জোড়ে জোড়ে চিৎকার দিতে থাকে। হাত পা ছুড়তে থাকে বাঁচার জন্য। হাত গুলো সেই ছেলেদুটো শক্ত করে ধরে ছিলো তাই সে নিজেকে বাঁচানোর শেষ রক্ষাটাও করতে পারেনি। লোকটা চাপাতি দিয়ে কাটতে কাটতে এক সময় পুরো মাথাটাই সে কেটে ফেলে মেয়েটার শরীর থেকে। শরীরের হাত পা নাড়ানো থেমে যায় মেয়েটার। রক্তে ফ্লোর ভেসে যায়। লোকটা চাপাতিটা ফ্লোরে ফেলে দেয়। হাতে লেগে থাকা ‌রক্ত নিজের সোয়েটারের সাথে মুছতে থাকে। মুছার পর একটু হেলে সেই কাটা মাথাটা হাতে তুলে। দেখে একপাশের গালে তার পুরো বুট জুতার ছাপ পড়ে গেছে। 

মাথাটায় একটা চোখ খোলা ছিলো আরেকটা আধ খোলা। লোকটা কাঁটা মাথা হাতে নিয়ে বলতে থাকে।

– হুঁ। মাগি একটা। বেঁচে থাকতেও বেইশ্যা ছিলো। মরার সময়েও আমার সাথে‌ নষ্টামি শুরু করছিলো। ভাবছিলো ওর দেহের রুপে পাগল হয়ে আমি ওকে খেয়ে ছেড়ে দিবো। আমাকে এতোটা সহজ না গলানো। এই ব্ল্যাক রন্জু শুধু বিয়ের পর তার বউ ছাড়া আর কারও জন্য গলবে না। কারো জন্য না। (একটু থেমে) লাশ টাকে বস্তায় ভরে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আয়। আমার ভোজন না হোক অন্তত জঙ্গলের ভিতরে শিয়াল, কুকুরদের পিকনিকের রোষ্ট তো হতেই পারে এই মাগি টা। থুঁ ,(সেই কাটা মাথাটায় থু থু মেরে সেটা লাশের দিকে ছুঁড়ে ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে থাকে রন্জু নামক লোকটা। একবারের জন্যও আমাদেরকে তার মুখ কিন্তু দেখানো হয়নি। সবসময় তার কাঁধ থেকে নিচের অংশ টুকু কিংবা তার পিছন থেকে তাকে দেখানো হয়েছে। 

 

রঞ্জু চলে যাওয়ার পর পরই সেই দুজন লেগে পড়ে কাজে। মেয়েটার পুরো রক্তাক্ত দেহটাকে বস্তায় ভরতে থাকে। কাঁটা মাথা টাকেও বস্তায় ভরে দুইজনে সেই বস্তা ধরে নিয়ে যেতে থাকে সেই রুম টা থেকে। রুমের ফ্লোরে শুধু থেকে যায় রক্ত আর রক্ত।

 

 

একজন নারী ঘুমিয়ে রয়েছে একা ঘরে। উপরের ডিমলাইটের আলোতে তার চেহারা কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বয়স ৩৫/৩৬। ঘরের আসবাবপত্র দেখে মনে হচ্ছে ‌তিনি শহরে, আধুনিক পরিবেশেই থাকেন। হঠাৎ উনি ঘুমের মধ্যে বেশি বেশি শ্বাস নিতে থাকেন। হাত নাড়াতে থাকেন। বিছানার চাদর জড়িয়ে হাতের মুঠোদিয়ে টানতে থাকেন। আবার পরমুহূর্তেই হাত গুলো উপরের দিকে ছুঁড়তে থাকেন। এমন ভাবে হাত নাড়াচ্ছেন যেন তিনি কাউকে থামার জন্য বলছেন। হাত দিয়ে জোড়ে কাউকে জোরে ধাক্কা দেওয়ার মতো করেই হঠাৎ চিৎকার দিয়ে তিনি উঠে বসেন। বসে হাঁপাতে থাকেন। তাড়াতাড়ি পাশের টেবিল ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে দেন তিনি। দিয়েই পাশের টেবিলে থাকা পানির গ্লাস টা হাতে নেন। এক ঢোকে পুরোটা খেয়ে থামেন। শ্বাস নিতে থাকেন বারবার। চোখ,মুখ তার ঘামে ভিজে গিয়েছে। তিনি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। এক হাত দিয়ে মাথা চিপতে চিপতে বিরবির করে বলতে থাকেন।

– এতোবছর পর, এতো বছর পর আবার সেই স্বপ্ন কেনো দেখছি আমি ? এই ২ দিন থেকে খালি এই স্বপ্নই দেখছি। 

বলেই পাশের টেবিলে থাকা ছোট ঘড়িটা হাতে নেন তিনি। দেখেন এখন সময় রাত ৩ টা ২০। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর তার ঘুম ধরতে চায়না। তিনি বিছানা থেকে নামেন। হাই তুলতে থাকেন। হেঁটে চলে যেতে থাকেন কিচেনের দিকে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি কফি হাতে রাতের আকাশ উপভোগ করতেই পছন্দ করেন। তিনি এই ফ্ল্যাটে একলা থাকেন। একটা এনজিওতে চাকরি করেন। বাবা-মা নেই।

কিছুক্ষণ পর কিচেন থেকে এক কাপ কফি হাতে বের হন তিনি। এক কাপ কফি নিয়ে রুমের পাশের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ান। শীতের সময়। আকাশ পরিষ্কার। ৪ তলার উপর থেকে বেশ সুন্দর ভাবেই চারপাশ উপলব্ধি করা যায়। জোছনা পড়েছে হালকা আজ। দূরের উঁচু পাহাড় গুলো আর তার চূড়ায় থাকা আকাশ তারা গুলো যেন রাতের সৌন্দর্য টাকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

“ধোঁয়া ওঠা কফি, তার সাথে একটা উনি হলে মন্দ হতো না। এই রাতের আকাশ, আমরা একসাথেই দেখতাম। ” কথাটা ভেবেই তার মনের ভিতর টা খা খা করে উঠে। 

“এরকম রাত তো আমাদের এসেছিলো। কিন্তু সে রাত আর দীর্ঘ হলো না।(একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হয়তো ঐ বড় তাঁরা টাই উনি। আমার জন্য এসে মিটিমিটি করে জ্বলছেন। বলছেন আমিও আছি তোমার সেই ধোঁয়া ওঠা কফির সঙ্গী, চিনে নিও আমায় তোমার ঐ অপলক দৃষ্টির সহীত। ” ভাবতে ভাবতেই মনের অজান্তে উনার চোখের কোনে পানি চলে আসে। বেলকনির রেলিং এ হেলান দিয়ে ঘরের দিকে মুখ করে তাকান তিনি। কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন আর কিছুক্ষণ পর পর আকাশের সেই উজ্জ্বল বড় তারাটার সাথে কথা বলছেন।

হঠাৎ ঘরে কিছু পড়ার আওয়াজ । এমন হঠাৎ আওয়াজে মেয়েটা চমকে উঠে। এতো রাতে ঘরের মধ্যে কিছু পড়ার আওয়াজ , ! 

– কে ওখানে ? আমি বলছি কে ওখানে ? 

বারান্দার দরজার পাশে একটা লাঠি জাতীয় কিছু জিনিস দেখতে পেয়ে সেটা হাতে নেন। নিয়ে ধীর পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। হৃদস্পন্দন বেড়েই চলেছে। হাত পা কাঁপতে থাকে। ধীর হাতে দরজার পর্দাটা সড়িয়ে দেখেন।

না কেউ নেই। তাহলে ঐ আওয়াজ টা ? তখনই হঠাৎ ঘরের ডেসিন টেবিল কাঁপতে থাকে। মেয়েটা চমকে উঠে। ডেসিন টেবিলের উপর থেকে সব জিনিস গুলো নিচে পড়ে যায়। মেয়েটা চিৎকার দিয়ে উঠে ভয়ে। ডেসিন টেবিল টা এমন জোড়ে জোড়ে কাঁপছে যেন আরেকটু হলে ভেঙ্গেই যাবে। তখনই মেয়েটা দেখতে পায় তার ডেসিন টেবিলের নিচে পড়ে যাওয়া একটা লিপস্টিক হাওয়ায় ভাসছে। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার দেওয়ার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলে। সে নড়তে চাইছে কিন্তু নড়তে পারছেনা। যেন কোন কিছু তাকে জমিয়ে দিয়েছে। লিপস্টিক টা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ডেসিন টেবিলের আয়নার কাছে আসে। নিজে নিজেই কিছু একটা লেখে দিতে থাকে আয়নাটায়। নিজে নিজে নয়। মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেও লেখাটা লিখছে। লিপস্টিক টা কিছু একটা লিখে হঠাৎ আবার নিচে পড়ে যায়। মেয়েটার ঠোঁট কাঁপছে। গাল বেয়ে শীতের মধ্যেও ঘাম বেয়ে পড়ছে। সে আয়নার দিকে তাকায়। দেখে সেখানে লিপস্টিক এর লাল রং দিয়ে লেখা।

 

“”” তার পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। ফিরে যাও সেই আনন্দপুরে। সব হত্যার জবাব দিতে তোমাকে যেতেই হবে তানিয়া। ফিরে যাও সেখানে। ফিরে যাও “””

 

চলবে ,,,,,

 

(গল্পের মধ্যে কিছু ১৮+ শব্দ ব্যবহার করার জন্য দুঃখিত। সেই শব্দ গুলো শুধু মাত্রই চরিত্র গুলোকে ফুটিয়ে তোলার সার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আমি জানি অনেকেই ঐ কথাগুলো পরে আনকমফর্টেবল ফিল করেছে। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তার জন্য। গল্পের পর্ব গুলো পাবেন প্রতি একদিন পর পর ঠিক ‌রাত ৯ টায়। জানাবেন কেমন হচ্ছে।)

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ২৮

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া 

 

– কে ওখানে ? আমি বলছি কে ওখানে ? 

বারান্দার দরজার পাশে একটা লাঠি জাতীয় কিছু জিনিস দেখতে পেয়ে সেটা হাতে নেন। নিয়ে ধীর পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। হৃদস্পন্দন বেড়েই চলেছে। হাত পা কাঁপতে থাকে। ধীর হাতে দরজার পর্দাটা সড়িয়ে দেখেন।

না কেউ নেই। তাহলে ঐ আওয়াজ টা ? তখনই হঠাৎ ঘরের ডেসিন টেবিল কাঁপতে থাকে। মেয়েটা চমকে উঠে। ডেসিন টেবিলের উপর থেকে সব জিনিস গুলো নিচে পড়ে যায়। মেয়েটা চিৎকার দিয়ে উঠে ভয়ে। ডেসিন টেবিল টা এমন জোড়ে জোড়ে কাঁপছে যেন আরেকটু হলে ভেঙ্গেই যাবে। তখনই মেয়েটা দেখতে পায় তার ডেসিন টেবিলের নিচে পড়ে যাওয়া একটা লিপস্টিক হাওয়ায় ভাসছে। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার দেওয়ার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলে। সে নড়তে চাইছে কিন্তু নড়তে পারছেনা। যেন কোন কিছু তাকে জমিয়ে দিয়েছে। লিপস্টিক টা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ডেসিন টেবিলের আয়নার কাছে আসে। নিজে নিজেই কিছু একটা লেখে দিতে থাকে আয়নাটায়। নিজে নিজে নয়। মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেও লেখাটা লিখছে। লিপস্টিক টা কিছু একটা লিখে হঠাৎ আবার নিচে পড়ে যায়। মেয়েটার ঠোঁট কাঁপছে। গাল বেয়ে শীতের মধ্যেও ঘাম বেয়ে পড়ছে। সে আয়নার দিকে তাকায়। দেখে সেখানে লিপস্টিক এর লাল রং দিয়ে লেখা।

 

“”” তার পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। ফিরে যাও সেই আনন্দপুরে। সব হত্যার জবাব দিতে তোমাকে যেতেই হবে তানিয়া। ফিরে যাও সেখানে। ফিরে যাও “””

 

লেখাটা পড়ার সাথে সাথেই হাতে থাকা কফির মগ টা ফ্লোরে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। সেই শব্দে তানিয়া আঁতকে উঠে। সে হাতের লাঠি টা ফেলে আস্তে আস্তে ডেসিন টেবিল টার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। টেবিল টার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। তানিয়ার এখন ভয় কম লাগছে। কম লাগছে কারণ আয়নায় আনন্দ পুর নিয়ে লিখা। সে ধীর পায়ে হেঁটে ডেসিন টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত উঠিয়ে সেই লেখাটাকে ছুঁতে থাকে। সে লেখাটা ছুঁতে ছুঁতেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে। ধীর গলায় বলে উঠে।

– ভাইয়া। ত, তুমি এসেছিলে। ভাইয়া আমাকে একবার দেখা দিলে না কেনো। এটা, এটা তোমারই হাতের লেখা। তোমার স্নেহ ভরা ভালোবাসা আমি অনেক খুঁজে ফিরি। কিন্তু পাইনা। (হাতে দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে) আমি যাবো। যাবো সেই আনন্দ পুরে তোমাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। তাকে, তাকে বিনাশ করেই এই তানিয়া তার ঘরে ফিরবে। তাতে এই তানিয়ার জান টাও যদি চলে যায়। যাক। তোমার হত্যার প্রতিশোধ, আমার, আমার তুষারের হত্যার প্রতিশোধ , আমি নিবো। অবশ্যই নিবো। 

হাত মুঠ করতে থাকে তানিয়া। তার ভিতরে এখন প্রতিশোধের আগুন। দীর্ঘ ১৮ টা বছর সে এই যন্ত্রনায় ছটফট করেছে। এই যন্ত্রনা তাকে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেয়নি। তার স্বামী, সন্তান,ভাই সবাইকে কেড়ে নিয়েছে। সে মাথা নিচু করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে থাকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দাঁত কড়মড়িয়ে বলতে থাকে।

– হয় মারবো। নয় মরবো,!

বলেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ডেসিন টেবিলের উপর সজোরে রাখে।

 

 

একটি শীতের সকাল। চারপাশে কুয়াশার আস্তরণ। পাখিরা তাদের নীড় ছেড়ে বেড়িয়েছে খাবারের খোঁজে। একয়দিনে শীতের তীব্রতা বেড়েছে কয়েকগুণ। উত্তর বঙ্গের শীত বলে কথা। হাড় একটু আধটু যদি না কাঁপায় তাহলে সেই শৈত্যপ্রবাহ শীতের বংশেরই না। মতিন মেম্বারের বাড়ি আজ খেজুরের রস এর গন্ধে মই মই করছে। রান্না ঘর থেকে খেজুরের রস জাল দেওয়ার ধোঁয়া কুয়াশার চাদর ভেদ করে উপরে উঠে যাচ্ছে। আজ রাতে শাহারিয়া ঢাকা চলে যাবে। তাই শিউলি বেগম সবরকমের পিঠে পুলি আয়োজন করার ব্যবস্থা করছেন, আর তার সাথে গরম গরম খেজুরের রস। শিউলি বেগম রান্না ঘরে ফুলমতির হাতে খেজুরের রস জাল দেওয়ার ব্যাপার টা ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে এলেন। ফুলমতি এখনো সেই ট্রমাটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই সবসময় সে মনমরা হয়ে থাকে। শিউলি বেগম তাই ওকে ঘরে একলা একলা না রেখে তার সাথে সবসময় রাখেন। কাজের মেয়ের মতো না একদম নিজের মেয়ের মতো করে। 

শিউলি বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে আঙিনা পেড়িয়ে বারান্দায় উঠেন। লায়লা ঘর থেকে দুই হাত ভর্তি নারকেল নিয়ে বের হলো। শিউলি বেগম কে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো।

– চাচি। এই ৫ টাই নারিকেল আছিলো ঘরে। এইগুলাই হইবো না আরো লাগবো ?

– এই গুলাই হইবো। আর শোন। ওরা ঘুম থেইকা উঠার আগেই তুই যাইয়া পানি গরম দিয়া দে। এতো ঠান্ডা পানি দিয়া হাতমুখ ধুইলে আবার ঠান্ডা লাইগা যাইতে পারে।

– আইচ্ছা চাচি। আর চাচি। ভাইজানের ব্যাগ কী আমি গুছায়া দিমু না আপনে গুছাইবেন ?

– অর ট্রেন রাইতে। আমি দুপুরের ‌দিকে গুছায়া রাখমুনে। তুই অহন জলদি যা গিয়ে নারকেল গুলা ফাটায়া ছ্যাচতে থাক। আমি ঘর গুলা গুছায়া আহি।

– আইচ্ছা চাচি। আমি অহনি যাইতাছি।

লায়লা দু কদম সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে যেতে থাকে রান্না ঘরের দিকে। শিউলি বেগম তার আঁচল কাঁধে দিয়ে চলে যেতে থাকেন ঘরের দিকে।

ফয়সাল বের হয় তার রুম থেকে। শিউলি বেগমদের ৩ রুম পড়ই তার রুম। রুম টায় ফয়সাল একলাই থাকে। ঘুম ঘুম চোখে হাতে ব্রাশ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে বারান্দার কোনায় থাকা বেসিনের দিকে। ব্রাশ করতে শুরু করে। বেসিনের সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে থাকে। তখনই আয়না দিয়ে দেখতে পায় নিপা তার ঘর থেকে বেড়িয়েছে। পড়নে সাদা কলেজ ড্রেস। ডান কাঁধে ব্যাগ। মাথার চুল গুলো সুন্দর বেনুনী করা। ফয়সাল আয়না দিয়েই তাকে দেখতে থাকে। নিপা বারান্দার দরজার সামনে এসে জুতা পড়তে থাকে। ফয়সাল মাথা ঘুরিয়ে আড় চোখে নিপার দিকে তাকায়। খারাপ দৃষ্টি দিতে থাকে নিপার দিকে। নিপাকে সাইড থেকে দেখে নিজের চোখ গুলাকে শান্তি দিতে থাকে সে। 

নিপার জুতা পড়া হয়ে গেলে সে বারান্দা থেকে নেমে আঙিনায় দাঁড়ায়। তখনই রায়হান বাসায় ভিতরে আসে। গায়ে শীতের জ্যাকেট। নিপা আঙিনায় নেমে রায়হানের সাথে কথা বলতে থাকে। ফয়সাল এসব দেখে ব্রাশ ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে বিরবির করে‌ বলতে থাকে। 

– আরেব্বাছ। তেম্পু দেখি তলে না ছইলা উবরে উবরে ছলতাছে।

নিপা রায়হানের সাথে কিছু কথা বলে তারপর বাড়ির দিকে ফিরে তার মা’কে উদ্দেশ্য করে বলে।

– মা, আমি গেলাম।

– ভালা কইরা যাইস। আর নাস্তা ডা খায়া যাইতে পারতি মা।

– না মা। দেরি হইয়া যাইতাছে। আমি বাইরে কিছু খায়া লমুনে। গেলাম আমি।

– আইচ্ছা যা।

শিউলি বেগম ঘরের ভিতর থেকেই হাঁক দিয়ে কথা গুলো বললেন। নিপা আর রায়হান একে অপরের হাত ধরে চলে যেতে থাকে ঘর থেকে।

ফয়সাল তাদের এমন হাত ধরাধরি দেখে আবার মাথায় হাত দেয়। ফেনা মুখে বলতে থাকে।

– হায় হায়। এইছব ছলতাছে তোগো। খারা। আইছ ছাছিরে খালি কইতে দে। তোর ফ্রেম ছাছি বাইর করবো। দেহিছ। ”

বলেই বেসিনের ‌দিকে মুখ করে ফেনা ফেলে কুলি করতে থাকে ফয়সাল। ওর ভিতরে নিপার প্রতি কোন ফিলিংস নাই। তবে প্রশ্নটা যদি হয় নিপাকে ভোগ করার। তখন ফয়সাল এক পা’ও পিছোবেনা। কারণ ও ভালো স্টুডেন্ট হলেও ওর চরিত্র নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। যা ওর কলেজ লাইফ ঘাটলেই বোঝা যায়।

 

 

জার্মান সার্ভে এনজিও “রেলটিলিফ” এর সিলেট শাখা অফিস।এই এনজিও বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সার্ভে করে তার রেজাল্ট নির্ধারণ করে। একের পর এক পাশাপাশি লাগানো ডেস্কে কাজ করছে কর্মচারীরা। তাদের প্রত্যেকের সামনেই একটা করে কম্পিউটার। অফিসের মেইন দরজার দিয়ে ভিতরে ঢুকলো তানিয়া। এখন তাকে দেখতে অমন বয়স্ক লাগছেনা। পড়নে সালোয়ার, কামিজ। বয়স ৩৫/৩৬ হলেও এখন দেখতে ২৫/২৬ বছর বয়সী মেয়েদের মতো লাগছে। অনেকেরই বয়স বেশি হলেও তা বাহ্যিক সৌন্দর্যের কারণে বোঝা যায় না। তানিয়াও সেই দলেরই সহ-সভাপতি। 

তানিয়া হেঁটে হেঁটে তার চেম্বারের দিকে এগোচ্ছে। মাথায় কাল রাতের ঘটনা। তাই মুখে একটু গোমড়া ভাব। কর্মচারীদের ডেস্ক পেড়িয়ে সে তার চেম্বারের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে। এই অফিসে সে চাকরি করছে প্রায় অনেক দিন। তাই তার পদোন্নতি হতে হতে এখন সে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট দায়িত্বে এসেছে। তবুও সে এখনো কর্মচারীদের প্রজেক্ট বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে। 

সে গিয়ে তার চেম্বারের চেয়ারে বসে। হাত ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করে দেখে এখন সময় ১০ টা ২৫। 

– আরে, রিতু কই? ও তো প্রতিদিন আমার আগে এসে উপস্থিত থাকে। আজকে সাড়ে ১০ টা বাজতে চললো কিন্তু এখনো নাই ?”

রিতু(২২) তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। সে যেই প্রজেক্ট গুলো নিজের জন্য রাখে সেই প্রজেক্ট এর কাজ গুলো করতে রিতু তাকে সহযোগিতা করে। 

তানিয়া নিজের ফোনে রিতুর নাম্বার টা বের করে কল দেয়। কিন্তু না। নাম্বার টা বন্ধ বলতেছে। 

– রিতুর নাম্বার বন্ধ ? এরকম টা তো আগে কখনো হতে দেখিনি ? ও তো ওর অফিস নাম্বার সবসময় খোলাই রাখতো , ! 

 

তখনই তার চেম্বারের দরজায় কেউ একজন নক করে। 

– ম্যাডাম। আসবো ? 

– বোরাদ ? আসো ভিতরে আসো। 

ছেলেটা ভিতরে আসে। বয়স ২৪ কী ২৫। এই অফিসেরই ইমপ্লই। বোরাদ এসে তানিয়ার ডেস্ক টেবিলের সামনে থাকা দুটো চেয়ারের পাশে দাঁড়ায়। বলে।

– ম্যাডাম, মজুমদার স্যার একটু আপনাকে ডেকেছেন।

– মজুমদার স্যার ?(একটু থেমে) কোন প্রজেক্টে ফল্ট পাওয়া গেছে নাকি ? 

– না না ম্যাম। অন্য বিষয়ে ডেকেছেন।

– অন্য কী বিষয় হতে পারে ? (আনমনে ভাবতে থাকে তানিয়া) আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি। 

– ওকে ম্যাম।

বলেই বোরাদ তানিয়ার চেম্বার রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়।

তানিয়া ভাবতে থাকে। “এখন আবার কেনো ডাকতেছে? নতুন কোন প্রজেক্টের ব্যপারে নাকি আবার ? হইতেও পারে। যাই দেখে আসি।”

বলেই আসন থেকে উঠে হাত ব্যাগ আর ফোন টা হাতে নিয়ে চলে যেতে থাকেন। চেম্বারের দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে যান। 

তখনই আমরা দেখতে পাই, তার টেবিলের কোনে থাকা একটা ডায়েরি মেলে যায়। ঘরে কোন পাখা চলছিলো না। তবুও ডায়রির পাতা গুলো একটার পর একটা পাল্টাতেই থাকে। এবং এভাবে ওলট পালট হতে হতে একটা পেইজে এসে ডায়েরির পাত উল্টানো বন্ধ হয়ে যায়। সেই পাতায় লাল কালি দিয়ে বড় করে লেখা ছিলো “” আদরি আসুভে “”

 

– স্যার, আসবো ? 

– হ্যা তানিয়া, ভিতরে আসো।

তানিয়া, মজুমদার স্যারের চেম্বারে ঢুকে। মজুমদার স্যার এই ব্রান্ঞ্চের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তানিয়া আস্তে আস্তে হেঁটে মজুমদার স্যারের টেবিলের সামনে রাখা চেয়ার দুটির দিকে এগিয়ে যায়। চেয়ার দুটির একটিতে আগে থেকেই বসে ছিলো একটি মেয়ে। বয়স ১৭ কী ১৮ হবে। তানিয়া গিয়ে সেই মেয়ের পাশের চেয়ার টিতে বসে যায়।

– স্যার আমাকে ডেকেছিলেন? কোন প্রজেক্ট এর রিপোর্টে কী ফল্ট আসছে ? স্যার আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত এমন টা হলে। আমি এখনি সেই প্রজেক্টের ফাইল আবার রেডি করছি। 

– আরে না না তানিয়া। তুমি বেকারই এতো টেনশন নিচ্ছো। তেমন কিছুই না। আসলে আমি তোমাকে এখানে ডেকেছি দু’টো কারণে। এক তোমাকে একটা নতুন প্রজেক্ট দিবো। আর দুই (সেই কমবয়সী মেয়ে টার দিকে তাকিয়ে) তোমার নতুন এসিস্ট্যান্ট এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।

– নতুন এসিস্ট্যান্ট ? কার নতুন এসিস্ট্যান্ট স্যার ? আর আমার এসিস্ট্যান্ট রিতু তো আছেই। তবে ? 

– রিতু চাকরি থেকে রিজাইন নিয়েছে। ওর রিজাইন লেটার আজ সকালেই সে আমাকে মেইল করেছে।

– রিতু রিজাইন নিয়েছে ? কিন্তু, কিন্তু কেনো? ও তো আমার প্রজেক্টে বেশ ভালোভাবেই কো-অপারেট করছিলো। কাল রাতে ঘুমানোর আগেও প্রজেক্ট নিয়ে তার সাথেই কথা হয়েছে আমার। আজকে প্রথম ধাপের ফাইল রেডি করে আনার কথা ছিলো। 

– সে আমাকে সেই ফাইল গুলোও মেইল করেছে। 

– মেইল করেছে ? 

– হ্যা মেইল করেছে। ওর বলে কী এক সমস্যার কারণে হঠাৎ চাকরি থেকে রিজাইন নিতে হচ্ছে। তবে, (একটু থেমে) তবে ও কিন্তু তোমার কাজের সহযোগী হিসেবে একজন কে পাঠিয়েও দিয়েছে। (নতুন মেয়েটার দিকে ইশারা করে) এই হচ্ছে সে।

– আসসালামুয়ালাইকুম আপু। আমি সুমু। সুমু আক্তার। আমাকেই রিতু আপু পাঠিয়েছে। উনি বলে আবার ঢাকায় ফিরে যাবেন কোন এক জরুরি দরকারে। তাই আমাকে পাঠিয়েছেন।”

তানিয়া মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো শুনে। কথা গুলো এখনো তার জানি কেমন কেমন লাগছে। সে আবার উৎসুক হয়ে মজুমদার স্যার কে জিজ্ঞেস করেন।

– স্যার ও তো ছোট। ও কী পারবে ? 

– ওর কলেজ রিপোর্ট ভালো। রিসার্চ করাতে ও দারুন পটু। আর আমাদের সংস্থার কাজই তো হলো রিসার্চ করা আর ফল তৈরি করা। ওর বাকি কোন কিছুর যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, রিসার্চে সে পটু তাই আমি রিতুর কথা অনুযায়ী তাকে তোমার এসিস্ট্যান্ট পদে নিয়োগ দিয়েছি।”

তানিয়া কিছুই বলে না। সে চুপচাপ থাকে। কিছুক্ষণ পর মজুমদার স্যার বলতে থাকেন।

– হ্যা তো শোনো, এখন যেহেতু আগের প্রজেক্ট তোমার ক্লোজ হয়ে গেছে তাই আমি তোমাকে নতুন প্রজেক্ট দিতে চাচ্ছি। (একটু থেমে ) আমি এই কাজ টা অন্যান্য কর্মচারীদেরও দিতে পারতাম। কিন্তু আমি জানি ওরা তোমার মতো পাকা হাতের কাজ করতে পারবেনা। তাই তোমাকেই এই প্রজেক্ট টা দিতে চাচ্ছি।‌

– প্রজেক্ট টা কী বিষয়ক স্যার ? (ধীর গলায় তানিয়া বলে)

– প্রজেক্ট টা একটা বেসরকারি প্রজেক্ট। গ্রাম ও শহরের মধ্যেকার পরিবেশ গত পার্থক্য তোমাকে রিপোর্ট করে আনতে হবে। গ্রামের বাতাসে বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি কতটুকু আর শহরের বাতাসের মধ্যে কোন কোন উপাদান কতটুকু রয়েছে তার পার্থক্য করে রিপোর্ট জমা দিতে হবে তোমায়। আর তার সাথে গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে বনভূমি শতকরা কত অংশ কম তাও বের করতে হবে তোমাকে। এইটুকুই এই প্রজেক্টের কাজ।

– এক কথায় পরিবেশ গত পার্থক্য করতে হবে আমায়‌, ?

– হ্যা। এটাই। তুমি কাজে লেগে পড়ো। তার আগে তোমার নতুন এসিস্ট্যান্ট সুমুর সাথেও পরিচিত হয়ে নাও। নিজেদের মধ্যে আন্ডাসট্যান্ডিং টা ভালো করো। আর ফাইল জমা দিতে হবে এক মাস পর। (একটু থেমে) বেশি সময় দেওয়া হয়েছে যাতে তুমি কাজটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ফলাফল আনতে পারো।

– ওকে স্যার। আমি আজ থেকেই প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করবো। 

– আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা তাইলে এবার আসতে পারো। (বলেই একটা ছোট্ট স্মাইলি ফেইস করে মজুমদার স্যার। তানিয়া আর তার নতুন পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট সুমু চেয়ার থেকে উঠে চলে যেতে থাকে চেম্বার রুমের দরজা খুলে। মজুমদার স্যার তার টেবিলে রাখা একটা ফাইল হাতে নিয়ে সেটা দেখতেই থাকেন।

 

তানিয়া আর সুমু যেই তাদের চেম্বারের দরজা খুলে সাথে সাথেই সেই খোলা ডায়েরিটা বন্ধ হয়ে যায়। তারা রুমের ভিতরে আসে। তানিয়া গিয়ে তার চেয়ারে বসে। সুমু গিয়ে ঠিক তার পাশে দাঁড়ায়।

– আরে না না সুমু। আমার পাশে পাশে দাঁড়াতে হবে না। তুমি আমার সহযোগী। তারমানে আমার বন্ধু। এভাবে বন্ধু আমার পাশে সবসময় দাঁড়িয়ে থাকলে আমার নিজের কাছে কেমন যানি ফিল হয়। তুমি আমার সামনের চেয়ারে বসো। 

– ওকে ম্যাম।

সুমু গিয়ে তানিয়ার টেবিলের সামনের দু’টো চেয়ারের মধ্যে একটায় বসে পড়ে। তানিয়া তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– চা-কফি কিছু নিবে ? 

– না না ম্যাম আমার কিছু লাগবেনা। আমি ঠিক আছি।

– তুমি আমাকে আজকে থেকে ম্যাম না। আপু বলে ডেকো কেমন? 

– আচ্ছা আপু। (একটু থেমে) আর আপু। আমরা সিলেটের কোন গ্রামে গিয়ে সার্ভে করবো ? শহরের টা তো ঢাকায় গিয়ে করতে হবে। গ্রামের টা এই সিলেটের কোথায় বা কোন গ্রামে গিয়ে করবে ? 

তানিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর তার চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি করে রুমের কোনের দিকে এগিয়ে যায়। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দুই হাত একসাথে করে বলে।

– আমরা যাবো, আমরা যাবো আনন্দ পুরে। সেখানে গিয়ে সার্ভেও করবো আর বিনাশও

– কী বিনাশের কথা বলছো আপু ? 

– এক রক্তিম অধ্যায়ের , !!!

 

 

একটা ফ্লাটের দরজা খুলতে দেখি আমরা। দেখে কোন এপার্টমেন্টের ফ্লাটের মতো লাগছে। দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে এক ৫০ উর্ধ মহিলা। পড়নে‌ শাড়ি। ঘরের সবকিছু একদম শহুরে পরিবেশের মতো গোছানো। দেয়ালে দেয়ালে চিত্রকর্ম টাঙানো। একপাশে বইয়ের সেলফ। সোফার পাশের টেবিলে টেবিল ল্যাম্প রাখা। মহিলাটা দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেই চারপাশ দেখেন আর নিজে নিজেই কথা বলতে শুরু করেন।

– আইজ আইতে দেরি হইয়া গেলো বাপু। রিতু আপায় তো মনে হয় এতোক্ষণে অফিসের লাইগা বাইর হইয়া গেছে গা। (একটু থেমে চারদিক দেখে) রিতু আফায় তো দেহি ‌ঘরের লাইট সব অফ কইরা গেছে। জানালা ডিও বন্ধ। আফায় যে কী করে বুঝিনা। আইজ ঘর এরকম আন্ধার কইরা ক্যান রাইখা গেছে কে জানে। (বলেই ঘরের লাইট কিছু জ্বালিয়ে দিয়ে‌ জানালা গুলো খুলতে থাকেন সেই মহিলা। জানালা গুলো খোলা হয়ে গেলে তিনি রান্না ঘরের দিকে যান। গিয়ে একটা ঝাড়ু নিয়ে বেড়িয়ে আসেন।

– ঘর দোর আইজ এতো বালি ‌বালি করতাছে ক্যা। রিতু আফামনি মনে হয় ঘরেই জুতা পইড়া বাইর হইছে। উফফ। আফামনি দিন দিন আরো ছুডু হইয়া যাইতাছে মনে হয়। একদম বাচ্চাগো মতো কাম। (বলেই ড্রয়িং রুম ঝাড়ু দিতে থাকেন সেই মহিলা। দিতে দিতে নিজে নিজেই বলতে থাকেন।

– আইজ যে কী রান্ধুম মাথায় আইতাছে না। আইতেও দেরি হইলো। আফামনির ধারে নাইলে যাইনা নিতাম আইজ কী রান্ধা লাগবো। (একটু থেমে ঝাড়ু দিতে দিতে) আইজ,আইজ রিতু আফামনির পছন্দের তরকারি ডাই রাইন্ধা রাহি। সরিষা ইলিশ খাওনের টেবিলে দেখলে আফামনির আর কিছুই লাগতো না। হি হি। যাই ফ্রিজের থে মাছ ডি বাইর কইরা ভিজায়া দেই। ছুটতে তহন দেরি হইয়া যায়। এমনিতেই আবার শীতকাইল। (বলেই ড্রায়িং রুম ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে রিতুর বেড রুমে ঢুকেন তিনি। সেখানেই ফ্রিজ রাখা। তিনি গিয়ে রুমের লাইট টা জ্বালিয়ে দিয়ে ফ্রিজের কাছে যান। ফ্রিজের দরজাটা খুলেন) ও মায়া মায়া গো। কী ঠান্ডা বাতাইস। এই ফ্রিজের মধ্যে এমন কী রাহে যে এতো ঠান্ডা হয়। মুই বাপু হেইসব জানিনা। এই মাছের পটলা ডা, হমম এইডাই ইলিশ হইবো। (মাছের প্যাকেট টা কাছে নিয়ে দেখে বলেন) হ এইডাই। আফা আইজ সরিষা ইলিশ দেইখা বহুত খুশি হইয়া যাইবো। (বলেই তিনি মাছের প্যাকেট টা নিয়ে বেডরুম থেকে বেরোতেই যাবেন তখনই হঠাৎ কিছু একটা তার চোখের ইশারায় পড়ে যায়। তিনি দুই কদম পিছিয়ে আসেন। মুখ ঘুরিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকান। খাটের নিচ থেকে একটা আঙ্গুলের নখ বেড়িয়ে আছে। হ্যা আসলেই সেটা একটা আঙ্গুল। মহিলার চঞ্চল স্বভাব যেন মুহুর্তের মধ্যেই উবে যায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যান বিছানার দিকে। হাঁটু গেড়ে হেলে বসেন। বিছানার চাদর টা একদম ফ্লোর পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। তিনি হাত এগিয়ে সেই চাদর টাকে সড়াতে যান। তার হাত কাঁপছে। গলায় ঢোক গিলে হাত টা দিয়ে সেই চাদর টা উঠিয়ে দেন। সাথে সাথেই তার চোখ মুখ বড় হয়ে যায়। এক চিৎকার দিয়ে পিছিয়ে আসেন

– আআআআআআআ,। রিতু আফা মনি, আআআআআআ , আআআআআআআ, ! 

চিৎকার দিতে দিতে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে হাত পা ছুড়তে ছুড়তে মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।

 

খাটের নিচে ছিলো রিতুর এক বিভৎস চেহারার লাশ। মুখের এক পাশ থেতলানো। সেই পাশের চোখের মণি বেড়িয়ে ঝুলে পড়েছে। মুখের আরেকপাশ দিয়ে একটা মোটা রড তার মাথার এফোর ওফর করে ঢুকানো। মুখের চোয়াল ভাঙ্গা।  ভাঙ্গা চোয়াল ফ্লোরে পড়ে ঝুলছে, শুধু একটু খানি মুখের সাথে লাগানো। পুরো শরীরের চামড়া ছিলে ফেলা ছিলো। শরীরে এক ফোঁটা রক্তও নেই। শুধু মুখের চোয়াল আর থেতলানো পাশ টা থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছে। চামড়া ছাড়া শরীরটার মধ্যে অনেক গুলো কাটা চামচ অর্ধেকটা করে ঢুকিয়ে দেওয়া। পা গুলো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেটে কয়েক টুকরো করে শরীরের উপর, ফ্লোরে উপর ফেলানো। মাথার চুল একটাও নেই। মাথার ঠিক উপর দিক থেকেও একটা ছুরি ঢুকিয়ে রাখা। কী বিভৎস দেখতে রিতুর লাশটাকে। এই লাশটাকে হঠাৎ যে কেউ দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তার বাড়ির কাজের বুয়া হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি, আজ তাকে বাড়িতে এসে এসব দেখতে হবে। কাজের বুয়া দেয়ালের সাথে হেলান দেওয়া অবস্থায় পা দুটো দুদিকে মেলে দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। আর তার হাতের পাশে পড়ে রয়ে যায় সেই মাছের প্যাকেট টা। 

 

 

গ্রামের কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে রয়েছে বড় বড় গাছের সাড়ি। দুই পাশে ফসলি খেত। এখন ধান কাটার মৌসুম। তাই কৃষকেরা ব্যস্ত মাঠের সোনালী ফসল ঘরে তোলার জন্য। রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে গেলো একটা সাইকেল। এখন দুপুর বেলা। এই দুপুর বেলাটাতেই সূর্যি মামার একটু দেখা মিলে। নাহলে সারা সকাল বিকাল তিনি লেপ তোষক নিয়ে খালি ঘুমিয়েই থাকেন। রাস্তা দিয়ে কিছু ছোট ছোট বাচ্চা টায়ার ঘুড়িয়ে তার পিছন পিছন দৌড়ে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে রায়হান আর নিপা। নিপার স্কুল ব্যাগ এখন রায়হানের কাঁধে। নিপার চুল গুলো এখন খোলা। রায়হান নিপাকে খোলা চুলে দেখতেই বেশি পছন্দ করে তাই নিপাও রায়হানের সাথে যখন থাকে তখন খোলা চুলেই থাকে। রায়হান তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে আর একটু পর পর দুষ্টুমি করে নিপার চুল গুলো তার মুখের সামনে এনে দিচ্ছে। নিপা যখনই রায়হান কে ঘুষি দিতে যায়। রায়হান সরে গিয়ে পিছিয়ে দাঁড়ায়। বেশ সুন্দর খুনসুটি করতে করতেই তারা এগিয়ে আসছে। রায়হান বার বার তার সাথে দুষ্টুমি করায় নিপা এবার একটু অভিমান করে। সে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রায়হান আবার তার চুল গুলো মুখের সামনে এনে দিয়ে হাসতে থাকে। 

– হা হা হা। একদম পাগলির মতো লাগছে। আ হা হা হা।”

নিপা ‌মুখ ফুলিয়ে থাকে। কিছুই বলেনা। সে ফিরে ধান ক্ষেত গুলোর দিকে মুখ করে তাকায়।

– এ নিপা। ঐ। এই দেখো কথা শুনে না। এই পাগলি,।

– যাও এখান থেকে।‌ তুমি কে। আমি তোমাকে চিনি না।

– আমি তোমার লাল্লু বর ‌গো জান পাখি। এই , শোনো না। দেখছো এভাবে রাগ করে থাকলে কী হবে, ! শোনো না গো।

– তুমি যাও এখান থেকে। বারবার বলতেছি চুলগুলো এমন করিও না তুমি বারবার করতেছো।‌ আমি তোমাকে চিনিনা যাও। হুঁ।

– ও নিপা। এই। আচ্ছা সরি আর করবোনা। এই যে কান ধরলাম।(বলেই নিপাল সামনে কান ধরে ফেলে রায়হান)

– তোমাকে বলছি আমি কান ধরতে ? তুমি অনেক পঁচা। খালি আমাকে জ্বালাতন করো। 

– জ্বালানোর আর দেখলাই বা কী। একবার বিয়েটা হইতে দাও। তারপর তোমাকে বুঝাবো জ্বালানো কত প্রকার আর ‌কী কী,!

– হইছে। যাও। তোমাকে আমি চিনি না।

– আচ্ছা ম্যাডাম সরি। আর হবেনা।

– ………..

– এই ।

– ……….

– এই নিপা। নিপা।

– আমি নিপা না।

– তো তাইলে তুমি কে ? 

– আমি সুবাইতা।

– সুবাইতা ? এটা আবার কে ? 

– আমি।

– আচ্ছা সুবা প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ,!

নিপা ‌ফোলানো মুখ নিয়ে ফারুকের দিকে ফিরে তাকায়। তারপর তাকে দেখেই হেসে ফেলে। ও মন খুলে হাসতে থাকে। রায়হান তার কান থেকে হাত নামিয়ে ফেলে।

– আরে সড়াইলা কেনো।‌ তোমাকে দেখতে অনেক সুন্দর ‌লাগতেছিলো। হা হা হা হা,

– হমম তোমাকে বলছে।

– হা হা হা হা। তোমার এই অভিমানি চেহারা টা দেখে অনেক হাসি পাচ্ছে আমার। হা হা হা হা।

– হাসি ‌থামাও।

নিপা পেটে হাত দিয়ে আরো হাসতেই থাকে।

রায়হান আশেপাশে চেয়ে দেখতে থাকে কেউ আছে কিনা। দেখে কেউ নেই। যেই কৃষক গুলো ধান কাটছিলো তারাও চলে গিয়েছে দুপুরের খাবার খেতে। নিপা এখনো হেসেই যাচ্ছে। তার হাসি যেন আর থামবারই নয়। ফারুক বলে।

– হাঁসি থামবা নাতো ? (একটু থেমে) তাইলে এই নেও।

বলেই তার হাসতে থাকা ঠোঁটে ‌নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। এরকম মুহূর্তের জন্য নিপা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। রায়হান ‌নিপার গাল দুটো ধরে নিপার ঠোঁটকে লেহন করে যাচ্ছে। নিপার প্রথম প্রথম নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ও বুজে গিয়েছে এই বিশাল দেহীর সাথে সে পেশির লড়াইয়ে পেড়ে উঠবেনা। নিপারও এখন ভিতরে ভিতরে কেমন যানি এক অজানা অনূভুতির‌ জানান দিচ্ছে। নিপাও নিজেকে রায়হানের সাথে মিলিয়ে নেয়। সেও রায়হানের পিঠে এক হাত দিয়ে ধরে আরেকহাতে রায়হানের গলা জড়িয়ে তার সহযোগী হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর নিপা তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। আর সাথে সাথেই তার পাশ থেকে মুখ সরিয়ে নেয় লজ্জায়। রায়হানও মাথা চুলকাতে থাকে। ভাবতে থাকে, হঠাৎ কী ভেবে সে এমন ভাবে চুমু খেলো নিপা কে। নিপা অন্যদিকে ফিরে বলতে থাকে।

– তুমি না অনেক দুষ্টু। একরম পাবলিক প্লেসে এসব,!

– আমি চারপাশ দেখেই করেছি।(একটু থেমে) আচ্ছা তো লজ্জা বতী আর লজ্জা পেতে হবেনা। আমি আজকেই বাবাকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে বলবো। এবার তো একটু ফিরে তাকাও।”

নিপা ফিরে তাকায়। লজ্জায় তার গাল,মুখ একদম লাল হয়ে গেছে।

– আহা। আমার বেগম সাহেবার মুখ দেখি লজ্জায় ‌লাল,!

– ধুরর, তুমিও না। 

– হমম। বিয়ের পরে কিন্তু আরো দুষ্টু হয়ে যাবো।”

নিপা ‌কিছু বলেনা। একটা মুচকি হাসি দিয়ে রায়হানের সাথে একসাথে চলতে শুরু করে সে। তারা হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে যেতে থাকে।

– আচ্ছা সুবাইতা কার নাম ? তুমি যে তখন বললে ? 

– আমারই নাম। আমার পুরো নাম তো সুবাইতা নুরান‌ নিপা।

– ওহহ আচ্ছা। আমাকে আগে বলোনি কেনো ? আমি আজ থেকে তোমাকে সুবা বলে ডাকবো। 

– সুবা ? সুবা কেনো ?

– সবাইতো তোমাকে নিপা নামেই ডাকে। কিন্তু সবাই আর আমি তো এক না।‌ আমি তো তোমার স্পেশাল কেউ। তাই আমি তোমাকে আলাদা নামে ডাকবো। সুবা নামে ডাকবো।

– নিপা থেকে সুবাইতা না ডেকে ডিরেক্ট সুবা , ! বাই দা ওয়ে নাম টা শুনতে বেশ ভালোই লাগছে।

– কে দিয়েছে দেখতে হবেনা ? এই রায়হান দিয়েছে।

– রায়হান ? এটা ‌আবার কে ?

– ও তোমাকে তো আমারো পুরো না টা বলা হয়নি। রায়হান খাঁন। আমার পুরো নাম রায়হান খাঁন।‌ গ্রামে আমাকে ছোট থেকে ফারুক বলে ডাকে আরকি। তাই তুমি ফারুক নাম টাই জেনেছো।

– ওহহ আচ্ছা। তোমারও তাইলে একটা ডাক নাম আরেকটা ভালো নাম। ঠিক আমার মতো।

– হ্যা।

– সুবা। 

– হমম,

– ও সুবা,!

– হমম বলো শুনছি। 

– তুমি কি আমার বউ হবা ?

– হ্যা হতে পারি। তবে যদি সিঙ্গেল থাকেন তবেই।

– আমি ? আমি পাক্কা ‌সিঙ্গেল আছি ম্যাডাম। 

– তাইলে বিয়ে পাকা।

– আমি তাইলে ডাকি কাজি। 

– যাও ডাকো। না করছে কে তোমায়। কিন্তু যাওয়ার সময় যদি কোন মেয়ের দিকে চোখ দিছো না তোমার চোখ তুলে আমি কাঁচা চাবিয়ে ফেলবো।

– সরি ম্যাডাম এমনটা হবেনা।

রায়হানের কথা শুনে সুবাইতা হেঁসে উঠে। রায়হানও তার সাথেই হেসে উঠে। আজ কলেজ থেকে আসার পথে বেশ ভালোই একটা সময় কাটালো তারা। দুষ্টুমি,আর তার সাথে কিসও করতে পেরেছে সুবাইতাকে রায়হান। দুইজনেই এমন একটা সময় কাটাতে পেরে ভিতর থেকে বেশ খুশি আর সাথে উৎফুল্লও। রায়হান সুবাইতার কাঁধে এক হাত রেখে তার সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে চলে যেতে থাকে।

 

 

দিথীর রুম। তার পোষা বিড়াল আবুলকে খাবার দিয়েছে সে। বিড়াল টা খাচ্ছে আর দিথী সেটার শরীরে আদর করে দিচ্ছে। বিড়াল দিথীর অসম্ভব পছন্দের। ছোট থেকেই বিড়াল পালার শখ। এই ছেলে বিড়াল টাকে ছানা অবস্থায় এনেছিলো। এখন ১ মাস চলছে বিড়াল টার। বিড়াল টাকে বিছানাতেই খাবার দিয়েছে সে। কিছুক্ষণ পর পর খাবার গুলো ঠিকঠাক করে প্লেটের এক যায়গায় দিচ্ছে। 

ঘরে প্রবেশ করলো সামিহা। গায়ে সোয়েটার, তার নিচে থ্রি-পিস। সামিহা তার কাঁধের ছোট্ট ব্যাগ টা আলনায় ঝুলিয়ে রেখে দিথীর পাশে এসে বসলো।

– ওকে খাবার দিয়েছো ? বিল্লু টা কিন্তু দারুন সুন্দর।

– হ্যা আপু। ওকে মামা বাসা থেকে নিয়ে এসেছিলাম। (একটু থেমে) তুমি কোথায় গেছিলে আপু ?

– দাদুকে দেখতে। একলা একলা থাকেন। নমিনা নানি এসে রান্না করে দিয়ে যান তারপরও দেখতে গেলাম কেমন আছেন না আছেন। ঔষধ গুলো ঠিকমতো নিচ্ছেন কিনা। এই আরকি।

– ওহহ,(ধীর গলায়)

– আজ কলেজ থেকে আসার সময় কী কিছু হয়েছে ? 

– কই নাতো আপু ? (বিড়ালের দেহে হাত বুলাতে বুলাতে দিথী বলে)

– তাহলে তোমাকে একটু মনমরা দেখাচ্ছে যে , ?

– না মানে আসলে। (একটু থেমে) শাহারিয়া আজ চলে যাবে।

– ওহহহ আচ্ছা। প্রিয়জনের জন্য মন খারাপ। তো তার সাথে যেনো যেতে পারো থাকতে পারো সেই ব্যবস্থা করো। আই মিন তার কথা চাচাজান কে বলো।”

দিথী কথাটা শুনেই এক ভয়ের দৃষ্টি নিয়ে সামিহার দিকে তাকায়। সামিহা তার হাত ধরে বলে।

– চাচা তোমাকে যথেষ্ট আদর করে। তিনি জানেন যে তুমি যেই সেই ছেলেকে পছন্দ করবে না। করলে ভালো কোন ছেলেকেই করবে। চাচার এইটুকু বিশ্বাস তোমার উপর আছে। ভয় না পেয়ে সামনাসামনি কথা বলাই উচিত।

– কিন্তু ওর পরিবার ? 

– ওর পরিবারকে ও ম্যানেজ করবে। আর তাছাড়া দেখো তোমাদের পরিবার আর ওদের পরিবারের মধ্যে কিন্তু কোন ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্যও নেই। উল্টো দু পরিবারের বন্ডিং টা আরো ভালো। আর তোমাদের এক হওয়া এই দুই পরিবারের বন্ডিং টাকে আরো গভীর করবে। 

– আমার সাথে তুমিও থেকো প্লিজ। আমার বাবার সামনে এগুলো কথা বলতে কেমন জানি লাগবে। তুমি কথাটা উঠাইয়ো। তারপর আমি বলবো।‌ প্লিজ,

– আচ্ছা সে দেখা যাবে। ঐদিকে তোমার আবুল খাওয়া শেষ করে তোমার দেহের সাথে ঘষাঘষি করছে। ওকে ধরো। (সামিহা নিজে উঠে বিড়াল টাকে হাতে নিতে থাকে) ছেলে বিড়াল তো। তাই ছেলেদের মতো মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করতেছে। হা হা হা হা। 

– আবুল কেও একটা বিয়ে করায় দিতে হবে। 

– আগে নিজের টা শেষ করেন ম্যাডাম জি। আবুলের জন্য আমি পাত্রি ঠিক করবো। তাই না আবুল,!(বিড়াল টাকে কোলে নিয়ে সেটার পেটে আদর করতে করতে সামিহা বলে)

– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আপু। আমি শেফালীকে বলছি তোমার খাবার দিতে। 

– আচ্ছা।

দিথী বিড়ালের খাওয়ার ছোট প্লেট টা নিয়ে ঘর থেকে চলে যায়। সামিহা বিড়াল টাকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে। সেটার সাথে কথা বলতে থাকে। ইদানিং দিথীর সাথে থাকার কারণে ‌দিথীর মতো সেও বিড়াল প্রেমী হয়ে গেছে। বিড়াল হাতের কাছে পেলেই খালি “ম্যাও ম্যাও” করবে আর হাত বুলিয়ে আদর করবে।

 

 

সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশের পাখিরা ফিরে যাচ্ছে তাদের নীড়ে। মেম্বার বাড়িতে লেগেছে হুড়োহুড়ি। শাহারিয়া সহ তার টিম মেম্বারস রা চলে যাবে। সাড়ে ৬ টায় ট্রেন। শিউলি বেগম, হরেক রকম পিঠেপুলি বড় বড় বক্সে করে প্যাকেট করেছেন শাহারিয়া দের দিবেন বলে। নিপা আর ফুলমতি শাহারিয়াদের ব্যাগ গুছাতে তাদের সাহায্য করছে। লায়লা একলা হাতে রান্না ঘরের দিকটা সামলাচ্ছে। এদিকে মতিন মেম্বার একজন নতুন চেলা নিয়োগ দিয়েছে। এটা তাদের গ্রামেরই ছেলে। ছোট থেকে বড় হতে দেখছে তাকে। তাই নির্দিধায় একেই নিয়েছে তার চামচা হিসেবে। নাম শৈশব দাস। মতিন মেম্বার তাকে গন্জে পাঠিয়ে দিলেন অটো বা ভ্যান আনার জন্য যাতে ঘর থেকে একদম ট্রেন স্টেশনের‌ উদ্দেশ্য বের হতে পারে শাহারিয়ারা। 

 

শাহারিয়াদের ব্যাগ গোছানো শেষ। রিয়াদ এসেছে দেখা করতে। সাথে রায়হান ও এসেছে। রিয়াদ গিয়ে শাহারিয়ার হাতে একটা টিফিন বাটি ধরিয়ে দেয়। 

– এটা নে। ভাবি তোর জন্য পাঠিয়েছে। ভাবি ভালো পাটিসাপটা পিঠা বানাতে পারেন। তাই তোর জন্য পাঠালেন।

– এসবের আবার কী দরকার ছিলো। আচ্ছা দে। (রিয়াদের হাত থেকে নিয়ে) রাতুল স্যার কে নিয়ে আসতে হয়। ঐযে একদিন দেখা হইলো আর দেখা করবার সুযোগই হইলো না।

– ভাইয়া ভাবিকে নিয়ে একটু ক্লিনিকে গেছে। 

– ক্লিনিকে ? ভাবির কিছু হইছে ?

– হইছে না হবে।

– কী ? 

– তুই আর আমি চাচা।(কানের কাছে গিয়ে আস্তে করে বলে)

– ওহহ আচ্ছা এই ব্যাপার। এখন তুই বল তোর টা কবে পাইতেছি ? 

– এই ধর ২-৩ বছরে। হা হা হা হা

– তুইও না। হা হা হা। এতো দেরি করিস না। তোর ভবিষ্যত বউ তখন বিরক্ত হয়ে তোকে ধরে ধোলাই দিবে‌ দেখিস। হা হা হা।

– সে দেখ যাবে। (পিছনে ফিরে) রায়হান, ভিতরে আসো।”

রায়হান বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছিলো সে ভিতরে আসে।

– আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি ফারুক না ? 

– হ্যা ভাইয়া। ফারুক গ্রামের মানুষেরা ডাকে। ভালো নাম রায়হান।

– ওহহ। তো কী করছো তুমি এখন ? 

– ভাইয়া আমাদের ব্যবসা আছে। “আরআরএস পোল্ট্রি” কম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমার বাবার কম্পানি।

– ওহোহো। ভালোই তো। আমি এটার নাম শুনেছি। বেশ প্রসিদ্ধ। তবে এটা যে তোমাদেরই তা জানতাম না। (রায়হানের কাঁধে হাত দিয়ে) বডিও তো দারুন বানিয়েছো। জিম করো নিশ্চয়ই?

– হ্যা ভাইয়া। ঢাকায় থাকতে করা হয়।

– আসিও আমার বাসায় বেড়াইতে। একলা মানুষ। বুঝোইতো।

– হ্যা ভাইয়া। যাবো একদিন। (একটু থেমে) তো ভাইয়া, ভাবি কবে পাচ্ছি।

– এই ধরো আল্লাহ দিলে এই বছরই।

– দোস্ত, বিয়ের দাওয়াত না দিলে কিন্তু তোর বাসর ঘরে পোকা ছেড়ে দিবো। (রিয়াদ)

– হা হা হা, আরে দোস্ত তুই তো আমার সাথে সাথেই থাকবি। তোকে দাওয়াত দিবোনা তো কাকে দিবো।

 

তখনই শিউলি বেগম তাড়হুড়ো করে এদিকে এগিয়ে আসেন।

– আরে বাজান তুই এদিকে গল্প করতাছোস। তোর সবকিছু ঠিকঠাক মতো নিছোস তো ?

– হ মা নিছি। সব রেডি। 

– রেডি হইলেই ভালা। ঐদিকে ঘড়ির সময় দেখছোস কয়ডা বাজে ? সাড়ে ৫ টা বাইজা গেছে। তাড়াতাড়ি জুতা পইড়া রেডি হ। অটো আইয়া পড়বো। 

– আমার হাতে দেও। আমি জুতো গুলো পড়ে নিবোনে। 

বলেই রিয়াদ দেরকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির গেটের দিকে যেতে থাকে শাহারিয়া। রিয়াদ রা ভিতরে দিকে চলে যায়। তখনই শিউলি বেগম শাহারিয়াকে পিছু ডেকে বলেন।

– কই যাস তুই ? 

– কবরস্থানে মা। 

– ও, হ বুজ্জি।(একটু থেমে) একটু তাড়াতাড়ি আওয়ার চেষ্টা করিস বাপ। বুজোসই তো। সময় কম।(ধীর শান্ত গলায় কথা গুলো বলেন শিউলি বেগম)

– আচ্ছা মা ঠিক আছে। 

(বলেই হাতের শু জুতো গুলো শিউলি বেগমের হাতে ফেরত দিয়ে গেইট থেকে বের হয়ে যেতে থাকে শাহারিয়া। শিউলি বেগমেরও কিছুটা মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি হাতে জুতো গুলো নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে আসেন।

শাহারিয়া হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা সামনেই তাদের পারিবারিক কবরস্থান। সে কবরস্থানের সামনে চলে আসে। সন্ধ্যা নেমেছে। চারদিকে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। শাহারিয়া কবরস্থানের গেইট খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। সে এক পা দু পা করে এগিয়ে যেতে থাকে ভিতরের দিকে। যতই এগোচ্ছে ততোই বুকের ভিতর টা খা খা করে উঠছে। সে হাঁটতে গিয়ে একটা কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কবর টার চারপাশের সাইড পাকা করা। কবরের সামনে লেখা 

“” মোছাঃ হাসিনা বেগম লিপি (১৯৭০-১৯৯৬)””

 সে গিয়ে তার পরনের স্যান্ডেল গুলো খুলে সেই কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। 

 – আসসালামুয়ালাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর।

বুকের ভিতর টা কেমন যেন চিন চিন করে উঠছে তার। তার নিজের মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তার ছোটো বেলার সেই মায়ের কোলের পরম উষ্ণতা সে ভুলে কী করে ? তার মায়ের হাতে খাবার খাইয়ে নেওয়া। স্কুলে যাওয়ার সময় তার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, সবই যেন এখন স্মৃতির পাতায় ঠাই নিয়েছে। সে তার চোখ গুলো বন্ধ করে ফেলে।

 

“” একটা কুয়া। কুয়ার চারপাশে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোকজন। কুয়ার একদম কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু পুলিশ। কুয়ো থেকে দড়ি দিয়ে টেনে পুলিশরা কোন কিছুকে উপরে তুলছে। কিছুদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৬ বছর বয়সী শাহারিয়া। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পাশে দাঁড়ানো তার বাবা। পুলিশরা কিছুক্ষণ পর দড়ি দিয়ে টেনে তোলে একটা মৃতদেহকে। ৬ বছর বয়সী শাহারিয়ার চোখের কোণ থেকে পানি বেয়ে পড়ে। তার মায়ের লাশ উঠানো হলো কুয়া থেকে। চোখ,মুখ হাত সব একদম সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। যেন দেহে এক ফোঁটা রক্তও অবশিষ্ট নেই। তার মায়ের সেই শাড়ির আঁচল টা ঝুলছে। টপ টপ করে পানি পড়ছে সেটা থেকে। ছোট্ট শাহারিয়া আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। বুক ভেঙে কান্না আসে তার। তার বাবাও তাকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাবাকে কখনো সে এভাবে কাঁদতে দেখেনি। তার বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছেন। ছোট্ট শাহারিয়ার একটি বার তার মায়ের লাশ টার দিকে হাত বাড়িয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে “আম্মু” বলে ডেকে উঠে। হয়তো সে ডাকটা তার মায়ের কান অব্দি পৌঁছায়নি, !”””

 

শাহারিয়া তার দু চোখের পানি মুছে নিতে থাকে। ও কাঁদতে চাইছেনা। কিন্তু ওর মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছেনা। ওর মনে পড়ে যায় ছোট বেলার কথা। যখন সে একবার অঝোর ধারায় কেঁদেছিলো। তখন তার মা তার কাছে টেনে নিয়ে আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছে দিয়েছিলো। বলেছিলো 

“”কাদিস না। আয় আমার কোলে আয়। একদম কাদবিনা। সাহসীরা কখনো কাঁদেনা। তারা বুক ফুলিয়ে যুদ্ধ জয় করে আনে। তুই আমার সাহসী ছেলে , ! কাঁদলে হবে বল, ? সবসময় উদ্যমী থাকবি। আমার বাবু একদিন আমার মুখ ঠিক উজ্জ্বল করবে। আমি গর্বের সাথেই বলতে পারবো আমার বাবু এই করেছে। আমার বাবু সেই করেছে। আর কাদিস না। আয় আমার কোলে ঘুমোবি আয়। “”

 

শাহারিয়া নিজের হাত দিয়ে চোখ মুছতে থাকে। না ওকে ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। ওকে শক্ত হতে হবে। ওর মায়ের জন্য দোয়া করতে হবে।‌ শুনেছে মায়ের জন্য সন্তানের দোয়া সবচেয়ে বেশি কাজে আসে। শাহারিয়া তার মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ১ বার সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস ৩ বার ও দরুদ শরীফ ৭ বার পড়ে। তারপর তার জন্মদাত্রী মায়ের কবরের সামনে মোনাজাত ধরে।

 

” হে আল্লাহ। আমি জানিনা আমার মা এই কঠিন কবরে কেমন আছে। সেই রহস্যময় কবরে লাশের সাথে কী হয় তা আমাদের পক্ষে জানা অসম্ভব। আমি জানি আমার মা ইহকালে যা করেছেন তারই প্রতিফল তিনি পরকালে পাবেন। মা বুঝে বা না বুঝে যত যা ভুল ত্রুটি করেছে তুমি মাফ করে দেও।হে আল্লাহ, তুমি তার কবরের আজাব কমিয়ে দাও। তাকে তুমি তেমন ভাবেই লালন পালন করো যেমন ভাবে তিনি আমাদের ‌শৈশবে লালন করেছিলেন। তাকে তুমি জান্নাতুল ফেরদাউস দান করো আল্লাহ। তার পরকালে জান্নাতে যাওয়ার রাস্তা গুলো তুমি আরো সহজ করে দাও। একজন সন্তান তার মায়ের জন্য হাত তুলেছে আল্লাহ। তুমি আমার দোয়া কবুল করে নাও। কবুল করে নাও। আমিন”

 

শাহারিয়া হাত দুটো উঠিয়ে চুমু খেয়ে নেয়। চারপাশে অন্ধকার গাড় হতে ‌শুরু‌ করেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ‌শোনা যাচ্ছে। শাহারিয়া তার মায়ের কবরের মাঝের অংশ টুকু ডান হাতে ছুঁয়ে মনে মনে পণ করতে থাকে।

” মা। তোমার বাবু আজ সাহসী ছেলে হয়েছে। একটা ভালো যায়গায় গিয়েছে। খুব কষ্ট লাগছে তুমি আমার এই সফলতা দেখে যেতে পারলেনা। কিন্তু মা। এই আমি তোমার কবরের মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি। তোমাকে যারা খুন করেছে, তাদের আমি ছাড়বোনা। তাদেরকে খুঁজে বের করে নিজের হাতে এর বদলা নিবো।‌ নিজের হাতে প্রতিশোধ নিবো তোমার খুনের। আমি আজ চলে যাচ্ছি। ছেড়ে যেতে মন চাইছেনা। খুব ইচ্ছে করছে তোমার কবরের পাশে আরেকটু থেকে যেতে। কবরের মাটি গুলোর মাঝে তোমার পরশ গুলোকে খুঁজে নিতে। (আরেক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে) ভালো থেকো মা। আসসালামুয়ালাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর “”

 

চলবে ,,,,,

 

(বি:দ্র: গল্পের পটভূমি ২০২০ ধরা হয়েছে। গল্প কেমন হচ্ছে জানাবেন। গল্প অনুযায়ী গঠনমূলক মন্তব্য করুন❤️)

 

 

গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ২৯

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

“একজন সন্তান তার মায়ের জন্য হাত তুলেছে আল্লাহ। তুমি আমার দোয়া কবুল করে নাও। কবুল করে নাও। আমিন”

 

শাহারিয়া হাত দুটো উঠিয়ে চুমু খেয়ে নেয়। চারপাশে অন্ধকার গাড় হতে ‌শুরু‌ করেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ‌শোনা যাচ্ছে। শাহারিয়া তার মায়ের কবরের মাঝের অংশ টুকু ডান হাতে ছুঁয়ে মনে মনে পণ করতে থাকে।

” মা। তোমার বাবু আজ সাহসী ছেলে হয়েছে। একটা ভালো যায়গায় গিয়েছে। খুব কষ্ট লাগছে তুমি আমার এই সফলতা দেখে যেতে পারলেনা। কিন্তু মা। এই আমি তোমার কবরের মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি। তোমাকে যারা খুন করেছে, তাদের আমি ছাড়বোনা। তাদেরকে খুঁজে বের করে নিজের হাতে এর বদলা নিবো।‌ নিজের হাতে প্রতিশোধ নিবো তোমার খুনের। আমি আজ চলে যাচ্ছি। ছেড়ে যেতে মন চাইছেনা। খুব ইচ্ছে করছে তোমার কবরের পাশে আরেকটু থেকে যেতে। কবরের মাটি গুলোর মাঝে তোমার পরশ গুলোকে খুঁজে নিতে। (আরেক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে) ভালো থেকো মা। আসসালামুয়ালাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর “”

 

শাহারিয়া উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ফিরে চলে আসতে থাকে কবরের গেইটের দিকে। দুই হাত দিয়ে বারবার চোখের পানি মুছতে থাকে। ভিতর টা চিন চিন করে ব্যাথা করে উঠছে। একদম মন চাইছেনা ছেড়ে যেতে। শাহারিয়া হেঁটে আসার সময় একবার পিছনে ফিরে তাকায়। শেষ বারের মতো তার মায়ের কবর টাকে এক পলক দেখে আবার সামনে ফিরে চোখ মুছতে মুছতে পা চালিয়ে চলে যেতে থাকে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। পশ্চিম তীরে সূর্যের অবশিষ্ট লাল আভা দেখা যাচ্ছে। শাহারিয়া কবরস্থান থেকে বেড়িয়ে আসে। কবরস্থান রাস্তার সাথেই লাগানো। সে রাস্তায় উঠে দেখে সবাই এখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার টিম মেম্বারস রা অটোতে উঠে পড়েছে। ব্যাগ পত্র ‌সব উঠিয়ে নিয়েছে। শাহারিয়া গিয়ে শিউলি বেগম কে জড়িয়ে ধরে।

– কান্দিস না বাপ। আমি আছিতো। আমি তোরে তোর মায়ের অভাব বুঝতে দিমুনা। একদমই বুঝতে দিমুনা। (কোল থেকে শাহারিয়ার মাথা উঠিয়ে তার কপালে চুমু খেলেন) ঠিকঠাক মতো যাইস। ভালোভাবে থাহিস। আর পৌছাইয়া ফোন দিবি কিন্তু।

– আচ্ছা মা। তুমিও ভালো থেকো। (নিপার মাথায় হাত রেখে) ঠিকঠাক মতো পড়ালেখা করিস। মায়ের কথা শুনবি সবসময় , কেমন ! 

– আচ্ছা ভাইয়া।

– তোমাগো হইলো ? এদিকে যে পোনে ৬ ডা বাইজ্জা গেছে। শাহারিয়া উঠ তাড়াতাড়ি। ট্রেন মিস দিয়া ফেলবি তহন।

– মা গেলাম। নিপা, রিয়াদ গেলাম। 

শাহারিয়া অটোতে উঠে পড়ে। অটোতা চলতে শুরু করে। মতিন মেম্বার তাদেরকে ট্রেনে উঠিয়ে দিবেন বলে তাদের সাথে রওনা দিয়েছেন। পিছন থেকে সবাই তাদের বিদায় দিতে থাকে। তারাও শাহারিয়াকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায়।

 আসলে শাহারিয়া গ্রামে অনেক কম আসে। বাইরে পড়েছে,চাকরিও বাইরে। গ্রামে আসে ৩-৪ বছর পর পর। তাই যখন সে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে থাকে সবাই তাকে খুব আদরের সহীত বিদায় জানায়। চাকরি টাও এমন নিয়েছে কখন তার কী হয়ে যায় না যায় সেই চিন্তা তো আরো আছেই। 

 শাহারিয়াদের অটোটা গতি বাড়ায়। গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলে যেতে থাকে রেলস্টেশনের উদ্দেশ্য। সূর্যি মামা এখন একদম কাঁথা মুড়ি নিয়ে শুয়ে পড়েছেন। চারিদিকে কুয়াশার আস্তরণ পড়তে শুরু করেছে।

 

 

খাঁন বাড়ি। আজ খান বাড়ির অন্দরমহলে মানুষের সমাগম নেই বললেই চলে। আমাদের দেখানো হয় খান বাড়ির রান্না ঘর। রান্নাঘরের দরজাটা অন্দরমহলের বাম সাইডে থাকা ডায়নিং টেবিল টা থেকে একটু সামনে। রান্না ঘরে রান্না করছেন সুমনা বেগম। তাকে সাহায্য করছে আঁখি। রান্নাঘর টাও একদম শহুরে কিচেনের মতো তৈরি করেছিলেন রায়হানের দাদা। একটা রাজকীয় ভাব রয়েছে রান্নাঘর সহ পুরো বাড়িটায়। সুমনা বেগম রুই মাছের তরকারি রান্না করছেন। আঁখি ভাতের দিকটা দেখছে। রান্না ঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন সাথী পারভীন(৩৬)। তিনি এই বাড়ির ছোট বউ। মানে বাড়ির কর্তা রায়হানের দাদা আব্দুল ওহাবের দ্বিতীয় ছেলে শাহেদের বউ তিনি। গড়ন একটু পাতলা ছিমছাম, ডান চোখের নিচে একটা তিল আছে, চেহারার সৌন্দর্য মাশাআল্লাহ। শাহেদ সাহেব আর তার প্রেম করে বিয়ে হয়েছিলো। 

তিনি ধীর পায়ে রান্নাঘরের দরজা থেকে ভিতরে এগিয়ে যান। সুমনা বেগম তাকে খেয়াল করেননি। আঁখি ভাতের রাইস কুকারের ঢাকনা খুলে ভাত নেড়েচেড়ে দিচ্ছে। সাথী বেগম এগিয়ে গিয়ে আঁখিকে বলতে থাকে। 

– আঁখি। কোন কিছু কাটাকাটি কী বাকি আছে ? থাকলে আমায় দে। আমি কেটে দিচ্ছি। 

– আঁখি তুই ছোটকে বল ঘরে গিয়ে বিছানার উপর শুয়ে থাকতে। কোন আদিখ্যেতা দেখাতে ওকে এখানে আসতে হবে না। (কড়াইয়ে খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়তে নাড়তে সুমনা বেগম বলেন।)

– এমন করে কেন বলছেন আপা। আপনি তো জানেনই তো আমার অসুখ সম্পর্কে। আমি তো শুধু একটু কাজ আগিয়ে দিতে এসেছিলাম।

(খুন্তি টা জোড়ে চুলার উপর রাখেন সুমনা বেগম। রেখে বেসিনের দিকে গিয়ে ধনিয়া পাতা ধুতে ধুতে সুমনা বেগম বলেন)

– লাগবেনা সাহায্য। গাঁয়ে মানে না আপনে মরন। হুঁ। (বলেই ধনিয়ার পাতা গুলো ধুয়ে এনে তরকারির উপর দিয়ে দেন সুমনা বেগম) 

সাথী এক মলিন চেহারা নিয়ে একবার সুমনা বেগমের দিকে তাকান একবার আঁখির দিকে তাকান। তারপর বের হয়ে যেতে থাকেন রান্না ঘর থেকে। সাথী খাতুনের মেরুদন্ডে সমস্যা। একবার পুকুর পাড়ে পিছলে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়াতে তার মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে যায়। ডাক্তার তারপর থেকে তাকে সবধরনের কাজ করতে নিষেধ করেছেন আর সবসময় রেষ্টে থাকতে বলেছেন। কিন্তু সবসময় তার ঘরের মধ্যে থাকতে ইচ্ছে করেনা। মন চায় একটু এসে রান্না ঘরে রান্না করতে, একটু বেড়াতে। কিন্তু এদিকে তার সারাদিন শুয়ে থাকাটা সুমনা বেগম সহ্য করতে পারেন না। তার সাথী খাতুনের প্রতি হিংসে হয়। তাই তিনি সবসময় তার সাথে এমন ব্যবহার করেন।‌ সাথী খাতুনের খুব খারাপ লাগে এমন ব্যবহার দেখলে। তিনি তো আর নিজ ইচ্ছায় রোগ বাঁধিয়ে বসেন নি।

 

সাথী রান্না ঘর থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে অন্দরমহলের সোফা গুলোর দিকে যেতে থাকেন। তখনই অন্দরমহলের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে তার একমাত্র ছেলে সাদিক(২০)। হাতে একটা প্লাস্টিকের বস্তা। সাদিক সেটা হাতে হন হন করে সিঁড়ির পাশের কড়িডোরের দিকে যেতে থাকে। সাথী খাতুন তাকে ডেকে বলতে থাকেন।

– তুই এই রাত-বিরাতে কোথায় ঘুরে বেড়াস ? ঘরে থাকতে পারিস না একটু , !

– মম, তুমি জানো যে বাবার সাথে আমাকে কাজ গুলোর দেখা শুনা করতে হয়। সো এইসব রাত বিরাত আমাদের কাছে কিছুই না। আর তুমি ঘর থেকে কেন বেড়িয়েছো ? ডক্টর না তোমাকে সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে বলেছে ? 

– তুইও তোর বাবার রক্তই পেলি। সারাদিন ওসব নিয়েই পড়ে থাকিস। তাও ভালো যে তুই আমার খোঁজ খবর টা তাও নিস। তোর বাবা তো ঐসব কাজ ছাড়া কিছু বুজেনা, কিছুই না।(ধীর গলায় কথা গুলো বললেন সাথী)

– মম। তুমি ঐসব রাখোতো। এই বিজনেসে মানি বেশি। আর আমাদের তো দরকার শুধু মানি আর মানি। তুমি ঘরে যাও। গিয়ে রেস্ট করো। (বলেই সেই বস্তাটা নিয়ে করিডোরের ভিতরে চলে যায় সাদিক। সাথী খাতুন আর কিছুই বলেন না। তিনি চেয়েছিলেন সাদিক পড়াশোনা করে ভালো ডাক্তার হবে। তার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু না, সেও তার বাবার সাথে যোগ দিলো। 

এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন সাথী। চলে যেতে থাকেন তার ঘরের দিকে। 

 

 

সোফার রুমে বসে রয়েছে কানিজ(২৫)। পুরো নাম কানিজ ফাতেমা। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন চিত্রকর্ম টাঙানো। পাশের টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্প। কানিজ সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। একটা ট্রেতে দুটো কফির কাপ নিয়ে কিচেন থেকে বেড়িয়ে এলো তানিয়া। এসে সোফার সামনের টেবিলে ট্রে টা রেখে এক টা কাপ কানিজের হাতে দিলো। আরেক কাপ নিজে নিয়ে বসে পড়লো সোফায়। কানিজ তানিয়ার বেষ্ট ফ্রেন্ড। বেষ্ট ফ্রেন্ড বললেও ভুল হবে। বলা যায় তারা দুই মায়ের পেটের দুই আপন বোনের মতো। কানিজও তানিয়ার সাথে একসাথেই জব করতো। এখন সেই জব ছেড়ে দিয়ে সে অন্য এক যায়গায় চাকরি নিয়েছে। কানিজকে, তানিয়াই তার বাসায় ডেকেছে। তার জীবনের সবকিছু এই মানুষটার সাথে সে শেয়ার করে। এখন সে যেই নতুন পদক্ষেপে  পা দিতে যাচ্ছে সেটার সঙ্গী হিসেবে কানিজকে নেওয়ার জন্যই তাকে এখানে ডাকা।

 কফিতে একটা চুমুক দিয়েই কানিজ বলে।

– তোর কফি কিন্তু প্রত্যেকবারই দারুন হয়। কফির হাত কিন্তু এখনো তোর আগের মতোই আছে। ( বলেই আবার কফিতে চুমুক দেয় কানিজ)

– কফির হাত আগের মতো থাকলেও জীবনটা আর আগের মতো নেই। (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে চুমুক দেয় তানিয়া)

– কী রে , !  তোর কী মন খারাপ ? আবার কি কিছু হয়েছে ? 

কানিজের কথা শুনে তার দিক থেকে মুখ নামিয়ে কফিতে চুমুক দেয় তানিয়া। তারপর ধীর গলায় বলে।

– আমাকে আনন্দ পুর যেতে হবে। “আসুভে” ফিরে এসেছে।

– আসুভে মানে ? ও ঐ আসুভের কথা বলছিস ? (উৎসুক হয়ে) আসুভের পুনর্জন্ম কী তারমানে হয়ে গেছে ?

– হ্যা। (ধীর গলায়) আমার আদরের ছোট্ট মেয়ে, আমার ভাইয়া ,(কানিজের দিকে ফিরে) আমার তুষারের খুনির পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাসনুবার নতুন জন্মকে খুঁজে বের করতে হবে।(সামনের দিকে তাকিয়ে) একমাত্র সেই পারবে এর বিনাশ করতে। 

– কিন্তু তুই তাসনুবার নতুন জন্মকে কীভাবে খুঁজে বের করবি ? বইতে কী এর বিষয়ে কিছু লেখা আছে ? 

 

কানিজের কথা শুনে তার দিকে তাকায় তানিয়া।

– বইয়ের মতে তাসনুবা , তার ভাই , আমার ভাই আর তাসনুবার বান্ধবী সাবিনার পুনর্জন্ম হবে একই দিনে। তারা ঠিক আসুভের জন্মের ৬ বছর পর জন্মগ্রহণ করবে। আমাদের এখন আনন্দ পুরে গিয়ে এমন চারজনকে খুঁজতে হবে, যাদের জন্ম আজ থেকে ১৯ বছর আগে একই দিনে হয়েছিলো।

– কিন্তু কীভাবে করবি। তুই সেখান থেকে চলে এসেছিস অনেক বছর আগে। তাসনুবার পরিবারও সেই গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে গেছে তাসনুবার মৃত্যুর পর। তাইলে ?

– একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। তুই শোন, তুইও আমার সাথে যাবি। প্লিজ না করিস না। তুই ছাড়া আমি এই দুনিয়ায় কাউকেই ভরসা করতে পারিনা। প্লিজ না করিস না।

 

তানিয়ার মুখে এ কথা শুনে কানিজ একটু চুপ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে পিনপন নিরবতা বিরাজ করে। কিছুক্ষণ পর কানিজ নিরবতা ভেঙ্গে বলে।

– আমি যাবো। আমি তোর সাথে যাবো।

– সত্যি বলছিস, ! (নিজের সোফা থেকে উঠে কানিজের পাশে গিয়ে বসে।) আমি জানতাম তুই না করতে পারবিনা। আমার বেষ্টু তুই,!

– কবে যাচ্ছি আমরা ?

– উমম, এই সপ্তাহের মধ্যেই। আমি প্রজেক্ট টা গুছিয়ে নিয়েই ঐদিকে রওনা দিবো।

– আচ্ছা ঠিক আছে। তুই কিন্তু এখনো বদলাস নি। তোকে দেখে কেউ বলবেনা যে তোর বয়স ৩৫+। তোকে দেখে বলবে আমার সমবয়সী বা আমার বড় বোন। হা হা হা।

তানিয়া কথাটা শুনেই একটু মনমরা হয়ে যায়। মাথা নিচু করে ধীর গলায় বলে।

– আজ যদি ফাইজা বেঁচে থাকতো(একটু থেমে কানিজের দিকে তাকিয়ে) ওর বয়সও ঠিক তোর মতোই হতো। মাঝে মাঝে মনে হয় তুইই আমার মেয়ে। আমার মেয়ে ফাইজা। (বলেই কানিজ কে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে তানিয়া)

ফাইজা তানিয়ার মেয়ে ছিলো। হঠাৎ এক এক্সিডেন্টে তার স্বামী তুষার আর তার মেয়ে ফাইজা মারা যায়। ১০ বছর আগে এক দূর্ঘটনায় তাদের প্রাইভেট কার একদম দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিলো। ফাইজা আর তুষার খুবই খারাপ ভাবে মৃত্যু বরণ করেছিলো সেই রাতের দূর্ঘটনায়। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে তানিয়াও সেই গাড়িতে তাদের সাথে ছিলো। ৫ বছর বয়সী ফাইজা তার কোলে থাকার পরও তানিয়া বেঁচে যায়। তার শরীরে শুধু কিছু যায়গায় কেটে ছুড়ে যায়। অন্যদিকে তার কোলে থাকা ফাইজার মাথা পুরো থেতলে যায়। শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে এদিক সেদিক পড়ে রয়।

 এই ট্রমা তানিয়া কখনো ভুলতে পারেনি। রাতে ঘুম ভাঙলেই তার সেই অতীত কথা গুলো মনে পড়ে। ফাইজা,তুষারকে ফিল করার চেষ্টা করে। শুধু সেইবারই না, তানিয়া এই পর্যন্ত অনেক বারই দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু সবসময়ই সে অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছে। তার পাশের যাত্রির মুখ এক্সিডেন্টের পর চিনা না গেলেও সে ঠিকি অক্ষত অবস্থায় ছিলো। এরকম টা কেনো হয় তার সাথে এসবের উত্তর সে খুঁজে পায়নি। তবে সে এটা বুঝেছিলো তাকে সবসময় “আসুভে”ই মারার চেষ্টা করে। 

 

 

একটা রুম। একটা হসপিটালের বেড, উপরে জ্বলছে অপারেশন লাইট। একটা মেয়ের উলঙ্গ দেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে সেই বেড টার উপর। ডাক্তার সিমিন(২৪) সেই মেয়েটার দেহ থেকে অপারেশন করে কিছু একটা বের করছে। হসপিটালের বেড দুটোর দু পাশে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন লোক। তারা এই রুমের কাজের তদারকি করছে। ডাক্তার সিমিনের মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক, চোখে গগলস, পড়নে এপ্রোন। 

হঠাৎ রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে একজন বিশাল দেহি পুরুষ। পায়ে বুট জুতো, কালো ফরমাল প্যান্ট আর কালো হুডি। তার চেহারা আমাদের দেখানো হয় না। সে এসে ডাক্তার সিমিনের পাশে দাঁড়ায়। সিমিন তার কাজে এতোটাই ডুবে গেছিলো যে সে বুঝতেই পারেনি যে তার পাশে এসে একজন দাঁড়িয়েছে। সিমিন মাথা উঠাতেই হঠাৎ লোকটাকে দেখে এক প্রকার চমকেই উঠে। সাথে সাথেই সোজা দাড়িয়ে বলতে থাকে।

– স,স্যার আসসালামুয়ালাইকুম।

– ওয়ালাইকুম।(একটু থেমে) তুমি ভয় কেনো পাচ্ছো ?

– ন,না মানে স্যার আপনাকে দেখলেই আমার বুকটা জানি কেমন কেঁপে উঠে। ভ,ভয় করে। (মাথা নিচু করে কাপো কাপো কন্ঠে কথা গুলো বলে সিমিন)

 

লোকটা তার কাঁধে হাত রাখে। তাকে আশ্বস্ত করে বলে।

– খবর তো হবে শুধু এই কমবয়সী মেয়ে গুলার। তুমি কেনো ভয় পাও সবসময়, ? মন দিয়ে কাজ করো। তবে হ্যা ভয় পাওয়াটাও ভালো। (সিমিনের ভয় পাওয়া মুখ টা উঁচিয়ে ধরে) অন্যের চোখে নিজের জন্য ভয় দেখলে, এক আলাদাই ‌শান্তি লাগে।(একটু থেমে সিমিনের থুতনি ছেড়ে দিয়ে) যাইহোক। কাজ কতদূর এগোলো ?

– এ,এই তো স্যর। হ্রদপিন্ড নিয়েছি, চোখ গুলো আর কিডনি টুকু নেওয়া বাকি।

– তাড়াতাড়ি করো সিমিন তাড়াতাড়ি করো। আরো দুইটা মাল এখনো গোডাউনে পড়ে আছে। এই গুলোর ডেলিভারি কালকেই দিতে হবে। তাড়াতাড়ি করো। (বলেই সিমিনের পাশ থেকে হেঁটে দরজার দিকে চলে যেতে থাকে লোকটা। তখনই পিছন থেকে দুজন পাহারা দার দের মধ্যে একজন কাপো কাপো কন্ঠে বলে।

– র,রন্জু স্যার। কাইলকার লাইগা কোন মাইয়া জোগাড় করতে পারি নাই। অ,অহন কী করমু,?

রন্জু কথাটা শুনেই থেমে যায়। মাথা উঠায়। মুখ না ফিরিয়েই আঁধারের মধ্যে থেকে বলতে থাকে।

– তোর সৌভাগ্য টা কী জানিস ? কাল তোর বউ আর ছোট্ট মেয়েটার শরীর থেকে চোখ আর কিডনি বের করাটা নিজ চোখে দেখতে পারবি।

– না,না স্যার এমন ডা কইরেন না স্যার। এমন ডা কইরেন না। স্যার,স্যার।

লোকটা কান্নায় ভেঙে পড়ে রন্জূর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে তখনই আরেকজন গার্ড তার শরীরের দিকে তাক করে একের পর এক গুলি চালাতে থাকে। লোকটা চিৎকার করতে করতে মাটিতে পড়ে যায়। কাঁতরাতে কাঁতরাতে এক যন্ত্রনা দায়ক মৃত্যু হয় তার।

– ডাক্তার সিমিন, তোমার কাজ আরেকটু বেরে গেলো। এটারো একটু সাইজ করে দিও

– ও, ওকে স্যার। হয়ে যাবে।

ব্ল্যাক রন্জু তার ঠোঁটের কোনে একটা সুক্ষ্ম হাসি দিয়ে বের হয়ে যেতে থাকে সেই ঘর থেকে। ডাক্তার সিমিন আবার মাস্কটা মুখে উঠিয়ে তার কাজ শুরু করে দেয়। আর নিচে ফ্লোরে পড়ে থাকে সেই গার্ডের রক্তাক্ত লাশ। তার থেকে রক্ত পড়ে ফ্লোর ভেসে যেতে থাকে।

 

 

২২শে ডিসেম্বর,১৯৯৬,

লতাপাতায় বেষ্টিত নীলগিরি জঙ্গল। সময় টা বিকেল। আকাশে সূর্যের তেজ কম। আশেপাশ পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোর। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাকা রাস্তাটায় ছুটে চলছে একটা টয়োটা গাড়ি। গাড়ি চালাচ্ছে তাসনুবার বড় ভাই রাফি। রাফির পাশেই বসে রয়েছে তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু সিহাব। পিছনের সিটে বসে রয়েছে তাসনুবার বান্ধবী সাবিনা, মাঝখানে তাসনুবা আর তার পাশে সিহাবের ছোট বোন। অর্থাৎ সেই ছোট মেয়েটা। তাসনুবার মুখে টেনশন টেনশন ভাব। রাফি লুকিং গ্লাস দিয়ে তাসনুবার দিকে তাকিয়ে বলে।

– ভয় পাসনা। সময় মতো তোকে বাড়ি পৌঁছে দিবো। (একটু থেমে) আজ তোর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে আমাকে জানতেই হবে তোর পেটে বাচ্চা রয়েছে (একটু থেমে) না অন্যকিছু। (বলেই সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালানোর দিকে মনোযোগ দেয় রাফি।)

– বিকেলে ওরা ঘুমিয়ে থাকে বলে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তোমাদের সাথে আসতে পেরেছি। আসরের আযানের আগেই আমায় বাসায় পৌছে দিয়ো প্লিজ। ওরা আমাকে না দেখতে পেলে অনেক চিল্লাচিল্লি করবে। বিশেষ করে, বিশেষ করে সোহেল। 

– তুই চিন্তা করিস না। আমরা খালি যাবো আর আসবো।

– আচ্ছা সাবনু। লিপির কী খবর ? আমি তো পড়েছি এই বন্দি দশায়। কারো কোন খবরই নিতে পারিনি এই ৮ বছর। ও কেমন আছে ? ও আমি তুই কলেজে কত মজা করতাম বল,!

 

কথাটা শুনেই সাবিনার মুখটা মলিন হয়ে যায়। সাবিনা বলে।

– আসলে তাসনুব, তোকে যে কী করে বলি।

– কেন কি হয়েছে ? লিপিরো কী আমার মতো বিয়ে হয়ে গেছে? 

– আসলে তাসনুব।(একটু থেমে) লিপি মারা গেছে।

– কীহ ? এই তুই কী বলতেছিস এইসব ? 

– হ্যা রে। তুই তো কিছুই জানতি না এই বিষয়ে। ওরো বিয়ে হয়ে গেছিলো তোর বিয়ে হওয়ার ২ বছর পর। আমাদের গ্রামের মেম্বার আব্দুল চাচার ছেলে মতিন আছেনা ? ওর সাথেই বিয়ে হইছিলো। ওদের একটা বাবুও হইছিলো। বেশ ভালোই ছিলো ও ওর শশুর বাড়িতে। তারপর এই ৫ মাস আগে হঠাৎ ও একদিন একপ্রকার উধাও ই হয়ে যায়। অনেক খুজাখুজি করছিলাম আমরা। কিন্তু কোন খোঁজ পাই নাই। নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর আমাদের যে নীলপদ্ম পুকুরের পাশে পুরাতন কুয়া টা আছেনা ?(শীতল গলায়) ঐটা থেকে ওর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।(উৎসুক গলায়) জানিস ওর শরীর একদম সাদা ছিলো। যেন কেউ ওর শরীর থেকে সবটুকু রক্ত বের করে নিয়েছে। ওর ছোট্ট ছেলেটা আর মতিন দুলাভাইকে ঐদিন অঝোরে কাঁদতে দেখেছিলাম। আমার খুব খারাপ লাগছিলো। পরে এইটা নিয়ে কেস করা হইছিলো। কিন্তু কেউই ধরা পড়েনি।

 

তাসনুবা, সাবিনার কথা শুনে একদম থ হয়ে যায়। সাবিনার হাত ধরে বলতে থাকে।

– লিপি মারা গেছে। (কাঁদো কাঁদো গলায়) ও মারা গেছে, ? ওর সাথে আমরা কতো সুন্দর সময় কাটাতাম। তুই আর ওই ছিলো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ও,ওকে এভাবে কে মারলো।

– আমিও বুঝতেছিনা রে। গ্রামে হঠাৎ করেই কীসব জানি ঘটতেছে। সব জানি কেমন কেমন হয়ে গেছে।

– কেমন কেমন বলতে ,?

– গ্রামে,

(সাবিনার কথার মাঝেই রাফি বলে উঠে)

– হসপিটালে চলে এসেছি। গল্প বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ো। পরে তখন তাসনুবের বাড়িতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।

 

সাবিনা আর বাকি কথা টুকু বলে না। তারা দরজা খুলে নেমে দাঁড়ায়। গ্রামের প্রাইভেট ক্লিনিক। এটাই একমাত্র গ্রামের ভালো এবং বড় চিকিৎসালয়।

তারা নেমে গাড়িটাকে ক্লিনিকের দরজার সামনে রেখেই ভিতরে যেতে থাকে। ক্লিনিকটাকে দেখে নতুন মনে হচ্ছে। যেন কয়েকমাস আগে বানানো।

রাফি, তাসনুবাকে নিয়ে ক্লিনিকের দোতলায় যায়। আগে থেকেই ও সিরিয়াল দিয়ে রেখেছিলো তাই একদম সরাসরি আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমে ঢুকে পড়ে তারা। ভিতরে একজন মেয়ে ডক্টর ছিলেন। তিনি তাসনুবাকে একটা বেডে শুইয়ে দেন। বেডের পাশের টেবিলে মনিটর। ডাক্তার তাসনুবার পেটের উপরে একটা চাঁদর দিয়ে তার ভিতরে একটা পাইপ নিয়ে ধরে। তখনই পাশের টেবিলে থাকা মনিটর পেটের ভিতরের প্রতিচ্ছবি দেখাতে থাকে। ডাক্তার এক হাত দিয়ে তাসনুবার পেটের উপর পাইপ টা ধরে আছে। আর মুখ ফিরিয়ে মনিটরের দিকে তাকাচ্ছে। তিনি মনিটরে তাকিয়ে খুবই অবাক হন। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি যেন অসম্ভব কিছু দেখেছেন। ডাক্তার মনিটর দেখতে দেখতে বলতে থাকে।

– এ,এটা। এটা কী করে সম্ভব।(একটু থেমে) আমি,আমি আমার পুরো ডাক্তারির ক্যারিয়ারে এমন কেস দেখিনি।

– কি হয়েছে ডাক্তার ? কোন খারাপ কিছু ? 

– আপনারা মনিটরে দেখুন(তার কথাতে সবাই মনিটরের দিকে ফিরে তাকায়) দেখুন, তার পেটের ভিতরে ডিম্বাশয়ে শুধু কিছু ঘন লাল ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। বাচ্চার কোন চিহ্নই নেই।

 

মনিটরে দেখা যায় কিছু ঘন লাল ধোঁয়া তাসনুবার পেটের ভিতরে তারার মতো চিহ্ন করে রয়েছে। সেই লাল ধোঁয়ার তারা টা একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে ঘুরপাকও খাচ্ছে। রাফি উৎসুক মুখ নিয়ে বলে।

– বাচ্চার যায়গায় তারা আকৃতির লাল ঘন ধোঁয়া ? 

 

চলবে ,,,,,

 

(গল্প কোন দিকে মোড় নিতে চলেছে ? তানিয়া সবসময় সব দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে যেতো কেন ? গঠনমূলক মন্তব্য করুন। আজকের পর্ব একটু ছোট হয়ে গেছে। তবে সমস্যা নেই পরবর্তী পর্ব অনেক বড় করে দিবো ইনশাল্লাহ)

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ২৯

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(সে ফিরে এসেছে)

পর্ব :: ৩০

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

(১৮+ হলুদ এলার্ট 🟡)

 

– এ,এটা। এটা কী করে সম্ভব।(একটু থেমে) আমি,আমি আমার পুরো ডাক্তারি ক্যারিয়ারে এমন কেস দেখিনি।

– কি হয়েছে ডাক্তার ? কোন খারাপ কিছু ? 

– আপনারা মনিটরে দেখুন(তার কথাতে সবাই মনিটরের দিকে ফিরে তাকায়) দেখুন, তার পেটের ভিতরে ডিম্বাশয়ে শুধু কিছু ঘন লাল ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। বাচ্চার কোন চিহ্নই নেই।

 

মনিটরে দেখা যায় কিছু ঘন লাল ধোঁয়া তাসনুবার পেটের ভিতরে তারার মতো চিহ্ন করে রয়েছে। সেই লাল ধোঁয়ার তারা টা একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে ঘুরপাকও খাচ্ছে। রাফি উৎসুক মুখ নিয়ে বলে।

– বাচ্চার যায়গায় তারা আকৃতির ঘন লাল ধোঁয়া ? 

 

তার কথাটা শেষ হতে না হতেই মনিটরের স্ক্রিন টা ঝিরঝির করতে শুরু করে। ডাক্তার সাহেব মুখ দিয়ে “চ” সূচক বিরক্তিবোধক শব্দ বের করে পাইপ টা ভালো করে ধরতে থাকেন কাঁথার ভিতরে তাসনুবার পেটের উপর। মনিটর স্ক্রিনের ঝিরঝির বেড়েই যেতে থাকে। এবং একটা পর্যায়ে স্কিন পুরো ব্লাক হয়ে যায়। আর সাথে সাথেই মনিটরের ভিতর থেকে ধোঁয়া বেড়িয়ে আসতে থাকে। 

– এ,এই মনিটর টার আবার কী হলো ? (রাফি)

– আমিও বুঝছিনা। আচ্ছা আপনারা দাঁড়ান আমি দেখছি।(বলেই পাইপ টা বের করে বিছানা থেকে উঠে মনিটর চেক করতে যান ডাক্তার আপা। তাসনুবার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। সে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে। তার ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে কাপো কাপো কন্ঠে বলে।

– ভ,ভাইয়া। ওটা, ওটা কী ছিলো ? আমার দেহের ভিতর ওরকম তারার মতো ওটা কী ? 

– কিছু না বোন। তুই শান্ত হ। ভয় পাসনা। কিছু হয়নি।

– ভাইয়া প্লিজ । ও,ওটা। ওটা কী ছিলো ? 

 

রাফি কিছু বলে না। সে তার হাত উঠিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। দেখে আসরের আযান দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। 

– তোকে পড়ে সব বলবো। তুই তাড়াতাড়ি চল, বাসা যেতে হবে। আযানের সময় হয়ে এসেছে। তোকে ওরা দেখতে না পেলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিবে। তাড়াতাড়ি চল।

– কিন্তু ভাইয়া,

তাসনুবার কোন কথাই শুনে না রাফি। তার হাত ধরে তাকে বেড থেকে নামায়। নামিয়ে ওকে নিয়ে ওরা সবাই চলে যেতে থাকে আল্ট্রাসনোগ্রাম এর রুম থেকে।

ডাক্তার আপা মনিটর টা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেন। সবকিছু দেখার পর মনিটরের কানেকশন লাইন টা খুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে।

– মনিটর টা মনে হয় গেছে। যাই ম্যানেজারকে বিষয় টা জানিয়ে রাখি। নাহলে পড়ে তখন আবার আমার দোষ হবে।

 

বলেই গলায় স্থেতস্কোপ যন্ত্র ঝুলিয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকেন সেই রুম থেকে। তার চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই রুম টা এখন একদম মানবশূন্য হয়ে পড়ে। অর্থাৎ একদম ফাঁকা। রুমে একদম নিরবতা বিরাজ করছে। হঠাৎ মনিটরের স্কিন টা চালু হয়ে যায়। স্ক্রিনে আবার ভাসতে থাকে সেই তাসনুবার পেটের ভিতরের চিত্র। সেই লাল ধোয়ার তারাটা আস্তে আস্তে একটা ডিমের আকৃতি নিতে থাকে। এবং ডিমের আকৃতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনিটর টা বিকট শব্দ করে বিষ্ফোরিত হয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। 

 

তাসনুবারা এতক্ষণে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়িতে ওঠার জন্য। তারাও সেই বিষ্ফোরণের শব্দ টা পায়। কিন্তু তারা আর সেদিকে ভ্রু ক্ষেপ করে না। তারা সবাই একে একে গাড়িতে উঠে যেতে থাকে। গাড়িটা চলতে শুরু করে। এবং চলে যেতে থাকে সেই নীলগিরি জঙ্গলের মধ্যকার রাস্তাটার দিকে।

দিথী চোখ মেলে। আজও ঘুমের মধ্যে সে সেই জগতে চলে গিয়েছিল। যেই জগতটাকে তার কাছে বাস্তবের মতো মনে হলেও বাস্তবিক অর্থে তার কোন অস্তিত্বই খুঁজে পায়নি সে। আজ অন্যান্য দিনের মতো তার চিৎকার করে ঘুম ভেঙ্গে যায়নি। অথবা সে ঘামেও যায়নি। সে স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসতে থাকে। তার পাশে আগে থেকেই সামিহা উঠে বসা ছিলো। দিথীকে উঠে বসতে দেখে সামিহা তার দিকে ফিরে তাকায়।

 

দিথী নিজের চোখ কচলাতে থাকে। সামিহা দিথীর কাঁধে হাত দিয়ে বলে।

– আজও তাসনুবা স্বপ্নে এসেছিলো। তাই না ? 

– হ্যা আপু। ওর স্বপ্ন গুলা কেমন জানি ধারাবাহিক ভাবে আমরা দেখছি। প্রথম দিন তার পরিচয়, তারপরের দিন তার ভাই, বান্ধবীদের তার সাথে দেখা করতে আসা। আর আজ,

– তার গর্ভের সম্পর্কে আমাদের জানানো। এমন টা মনে হচ্ছে যেন আমাদের কেউ ইচ্ছে করেই স্বপ্ন গুলো দেখাচ্ছে।

– আমারো তাই মনে হচ্ছে আপু। (একটু থেমে স্বাভাবিক হয়ে) একটা স্বপ্ন পরপর দুদিন দেখানো হয় আমাদের। তারপর আবার একটা নতুন স্বপ্ন। তারপর ওটাও পরপর দুদিন। মানে এমন ভাবে আমাদের কেউ স্বপ্নটা দেখাচ্ছে যেন আমরা স্বপ্নের ঘটনাবলীকে নিছক কাকতালীয় মনে না করি। কিন্তু এই স্বপ্ন গুলো এই কয়দিন ধরেই কেন আসছে ? (সামিহার দিকে ফিরে) আগে তো এমনটা হতো না,!

– কে জানে কেন হচ্ছে।(একটু থেমে) আচ্ছা বাদ দেও। চলো উঠে পড়ি। আযান দিয়ে দিবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। নামাজ টা পড়ে নেই। ঐসব নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। চলো,

 

দিথীও আর না করেনা। সেও গরম কাপড় পড়ে নিতে থাকে। সামিহার সাথে থাকার পর থেকে দিথী এখন ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কোনদিন নামাজ মিস দেয়না। কথায় যেমন আছে সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। ঠিক তেমনি দিথী পেয়েছে একটা সৎ সঙ্গ। ভালোর সাথে থেকে নিজেকেও ঝালাই করে হীরেতে পরিণত করতে চায় সে। 

তারা উঠে দরজা খুলে চলে যেতে থাকে টিউবওয়েল পাড়ের দিকে ওযু করতে। দিনের আলো এখনো ফুটেনি। তবে পুর্ব আকাশে হালকা লাল আভার দেখা মিলেছে।

 

 

খান বাড়ির পিছনের পুরোনো পুকুর। পুকুর টার নাম সাতরঙা। খাঁন বাড়ির পিছনের দিকে রয়েছে এই পুকুর টি। খাঁন বাড়ির মূল অংশের ডানে রয়েছে একটা ছোট্ট সুন্দর বাগান। তার কিছুটা ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা যায়গাটা বাড়ির প্রস্থের শেষ সিমানা পর্যন্তই বৃস্তিত। তারপর বাড়ির পিছনের দিকে রয়েছে এক পুকুর। পুকুর টা লম্বায় খাঁন বাড়ি আর বাগান দুটোর সমষ্টির সমান। আর এই বাগান, পুকুর বাড়ি সবটুকু অংশই উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা। পুকুর টাও বাড়ির মতোই অনেক পুরোনো। পুকুরটায় ঘাট বাঁধানো। পুকুরের সিঁড়ির শেষ ধাপে হেলে বসে হাত মুখ ধুচ্ছেন নজরুল সাহেব। গাঁয়ে শাল জড়ানো। আশেপাশে অনেক কুয়াশা। সূর্যি মামা এখনো এই কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। শীতের সকালে অন্যান্য যায়গার পানি বরফ ঠাণ্ডা হলেও পুকুরের পানি ঈষৎ উষ্ণ। ঠিক তেমনি গরম কালে বাকি সব যায়গার পানি সূর্যের মতো গরমাগরম থাকলেও এই পুকুরের পানি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল। পুকুর টা মৌসুম ভেদে বড়ই বিচিত্র রুপ দেখায়। 

নজরুল সাহেব হাত মুখ ধুয়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর পিছন ফিরে পাড়ের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতে থাকেন। উপরে উঠে শালের এক প্রান্ত দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে যেতে থাকেন বাড়ির দিকে। তখনই রায়হানের আগমন। গায়ে দামি সোয়েটার। বিজনেস ম্যান বলে কথা ! সে হেঁটে আসতে থাকে তার বাবা নজরুল সাহেবের দিকে। নজরুল সাহেব তাকে ইশারায় লক্ষ্য করেছেন। রায়হান এসে নজরুল সাহেবের সামনে দাঁড়ায়। নজরুল সাহেব এখনো হাত মুখ মুসছেন। রায়হান বলে।

– বাবা তুমি এখানে। ঐদিকে আমি তোমায় সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। 

– কেন। কি হইছে। তোর দাদার কী আবার ব্যাথা উঠছে ? 

– না না। মা তোমায় ডাকছে। কেন ডাকছে তা বলেনি কিন্তু তোমায় খুঁজছে।

– তো সে কী জানেনা যে আমি প্রতিদিন সকালে এই পুকুর পাড়ে নাহলে বাগানটার‌ ঐদিকে থাকি। 

– ওহহ তাইতো। আসলে আমিই ভুলে পুরো বাড়িতে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। চলো এখন।

– যাচ্ছি। তুই যা।

রায়হান যেতে উদ্যাত হয়েও আবার থেমে যায়। পিছন ফিরে ওর বাবার সামনেই মাথা একটু নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। নজরুল সাহেবের হাত মোছা হয়ে গেলে তিনি বাগানের দিকে হেঁটে যেতে থাকেন। রায়হানও পিছু পিছু যায়। তবে তার মাথা নিচু। সে ভাবছে “এখনি সময় ঐ কথাটা বলার। বাবার মুড এখন ঠান্ডা আছে। এখন যদি তিনি মেনে নেন।”

– বাবা। 

নজরুল সাহেব হাঁটতে হাঁটতেই উত্তর দেন।

– কিছু বলবি ? 

– ন,না মানে বাবা। আমাদের আরো বিদেশি পোল্ট্রি কম্পানির বায়ার দের সাথে কথা হয়েছে। তারাও আমাদের কম্পানির সাথে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক। তুমি কী বলো তাদের নিবো ? 

– হাই প্রোফাইল হইলে নিয়ে নে। এতে তো আমাদের বিজনেস আরো লাভের মুখ দেখবে। (একটু থেমে) নিয়ে নে।

– আর বাবা। (মাথা চুলকাতে থাকে রায়হান। নজরুল সাহেব সামনে থেকে বলেন)

– হ্যা বল। 

– দাঁড়াও একটু বাবা। আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

 

রায়হানের মুখে এমন নিম্ন স্বরে কথা শুনে নজরুল সাহেব একটু অবাকই হন। তিনি সামনে থেকে পিছন ফিরে রায়হানের দিকে তাকান। এতোক্ষণে তারা হাঁটতে হাঁটতে বাগানের মধ্যে চলে এসেছে। 

– কোন কিছু হয়েছে ? তুই এতো আমতা আমতা করছিস কেন ? যা বলার সব খুলে বল। (রায়হানের কাঁধে হাত রেখে) নির্দিধায় বল।

– না মানে বাবা(মাথা নিচু করে চোখ এদিক ওদিক করতে করতে)। আমি, আমি বিয়ে করতে চাই। 

 

কথাটা শুনেই যেন নজরুল সাহেবের ভ্রু কুঁচকে উঠলো। তিনি বললেন।

– এখনি ? তোর বড় ভাই রাফসানের তো এখনো,

– তার না হোক বাবা। আমি করতে চাই। ভাইয়া বিজনেস নিয়ে এতোটা মেতে থাকে যে এদিক নিয়ে তার কোন ভ্রক্ষেপই নেই। (মাথা নিচু করে ধীর গলায়) প্লিজ বাবা। আমি একজনকে পছন্দ করি। তাকে বিয়ে করে একটা সুন্দর সংসার করতে চাই। আমি আমার এই বিজনেস লাইফের একঘেয়েমি কাটাতে চাই বাবা। 

– বিয়ে করার পর বিজনেসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবিনা তো তখন আবার ? (ভ্রু কুঁচকে নজরুল সাহেব বলেন)

– না না বাবা। একদমই না। তখন আরো বরংচ আমার বিজনেসে ভালো মন বসবে। ফ্রেশ মাইন্ডে কাজ গুলো হ্যান্ডেল করতে পারবো। (নজরুল সাহেবের হাত ধরে) প্লিজ বাবা না করিও না।

নজরুল ‌সাহেব কিছুক্ষণ গোমড়া মুখ করে থাকেন। কিছু একটাই ভাবেন। রায়হান এদিকে ভাবছে তার বাবা কী হ্যা বলবে ? তারপর হঠাৎই একটা হাসি দিয়ে রায়হানকে জড়িয়ে ধরেন নজরুল সাহেব। বলতে থাকেন।

– এইটুকু কথা বলতে এতোটা ভয় পাস তুই ? এখনো সেই ছোটই রয়ে গেলি।

রায়হান তাকে ছেড়ে দিয়ে বলে।

– তারমানে বাবা তুমি মেনে নিচ্ছো ? 

– হ্যা। হ্যা। আমি কথা দিচ্ছি তোকে খুব তাড়াতাড়িই তোর পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিবো।

কথাটা শুনেই রায়হান খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। তার বাবাকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে ঘোরাতে থাকে। রায়হান খুব খুব খুশি হয়েছে তার বাবার কাছ থেকে সম্মতি সূচক বার্তা পেয়ে।

– আরে আরে পড়ে যাবোতো। ছাড়। পাগল ছেলে একটা।

– বাবা তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বেষ্ট ফ্রেন্ড। সবচেয়ে ভালো বন্ধু আমার।

– হইছে হইছে এবার নামা। ঐদিকে তোর মা আমাকে খুঁজে মরতেছে। নামা।

রায়হান, তার বাবাকে নামায়। নজরুল সাহেব হাসতে হাসতে রায়হানের কাঁধে হাত দিয়ে তার সাথে বাড়ির দিকে যেতে থাকে। আর তাকে বিজনেসের পরবর্তী ধাপ গুলো সম্পর্কে বলতে থাকে।

আসলে রায়হান তার বাবার সাথে সবচেয়ে বেশি ক্লোজ। ও ওর বাবার কাছে যখন যা চেয়েছে তখনই তাই পেয়েছে। তাই এবারো সে তার বাবার কাছেই বিষয় টা জানায় এবং গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে যায়। তার মায়ের সাথে তার কেনো যানি যোজন যোজন দূরত্ব। তার মায়ের সাথে সে তেমন একটা কথা বলেনা দরকার ছাড়া। ছোট থেকেই কেনো যানি সে এমন। হয়তো সে এমনিতেই এমন। নয়তো রইতে পারে কোন অতীত ইতিহাস,!

 

 

দিথীদের বাড়ির আঙিনা। একটা বেঞ্চে বসে রয়েছে দিথী আর সামিহা। ঠান্ডার তীব্রতা কাটাতে কিছু খড়কুটো একসাথে কুড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে শেফালী। তারা বেঞ্চ নিয়ে আগুনের কাছে বসে আগুন তাপছে আর গরম গরম ভাপা পিঠার সুখ নিচ্ছে। কিছুদূরেই বসে রয়েছেন দিথীর বাবা অন্তর সাহেব। হাতে খবরের কাগজ, পাশে একটা ছোট টেবিলে চায়ের কাপ রাখা। প্রতি সকালে চায়ের কাপের সাথে তার খবর কাগজ না হলে যেন জমে না। 

 আজ দিথীর কলেজ বন্ধ। দুজন মিলে পিঠা খাচ্ছে আর গল্প করছে। রাতের স্বপ্নটা নিয়ে নয়, ভবিষ্যত প্ল্যানিং নিয়ে। তাদের কথাবার্তার মাঝেই হঠাৎ বাসার গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো এক মহিলা। বয়স ৪০+। তার চোখে মুখে কাঁদো কাঁদো ভাব। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দিথীদের সামনে দাঁড়িয়ে সামিহাকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

 – সামিহারে। তোর দাদায় জানি কেমন করতাছে। তুই জলদি আয়। বারবার তোর নাম নিতাছে। 

কথাটা শুনেই যেন সামিহার গলাটা শুকিয়ে এলো। এই পৃথিবীতে তার দাদা ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই। তার বাবা-মাকে সেই ছোট বেলায় হারিয়েছে সে। ছোট থেকে যেই দাদুর কাছে বড় হওয়া তার সম্পর্কে এমন খবর শুনার সাথে সাথেই সামিহার হাতের পিঠাটা পড়ে যায়। সে তাড়াহুড়ো করে বেঞ্চ থেকে উঠেই দৌড়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। দিথী কী করবে বুঝতে না পেরে সেও তার পিছু পিছু দৌড় দেয়। হঠাৎ করেই যেন এক দমকা বাতাস এসে মেয়ে দুটোকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো। অন্তর সাহেব কিছুই বুঝতে পারেননা আসলে হয়েছে টা কী। তার মনযোগ এদিকে ছিলো না। শুধু তিনি দিথী আর সামিহাকে দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে দেখলেন।

 

সামিহাদের বাসা দিথীদের বাসা থেকে ৪ বাড়ি পর। একটা কাঁচা খড়ের বাড়ি। গেইট দিয়ে সামিহা ভিতরে ঢুকে দেখে বাড়ির আঙিনায় মানুষের ঢল নেমেছে একপ্রকার। সামিহা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সাইড করতে করতে ছোট্ট এক রুমের ঘর টার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দিথীও তার পিছু পিছু ছুটে চলেছে। সবাইকে ঠেলে রুমের কাঠের দরজা টা খুলে সামিহা। ভিতরে মানুষ এর ভিড়ের মাঝে বিছানায় শুয়ে আছেন তার দাদু। মাথায় পট্টি দেওয়া। গায়ে চাদর দেওয়া। সামিহা ছুটে গিয়ে বিছানায় তার দাদার পাশে বসে। দাদার পাশে বসা একটা মহিলা উঠে যায়। সামিহা গিয়েই তার দাদুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। দিথীও তার পাশে বসে তাকে সামলানোর চেষ্টা করে। সামিহা তার দাদুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর দাদু দাদু বলে ডাকছে। দিথী ওখানে থাকা একটা মহিলাকে জিগ্গেস করে।

– কী হয়েছিলো উনার ?

– রাইতে চিৎকার কইরা উডছিলো। আমি ঘরে আইয়া দেহি বুকে হাত দিয়া কাপতাছেন। কাছে যাইয়া গাঁয়ে হাত দিয়া দেহি অনেক জ্বর আইছে। আমি কাপড়ের পট্টি দিতে থাহি। তারপর আইজ সকাল থেইকা হাত পা নড়াচড়া একদম বন্ধ কইরা দিছে। হঠাৎ কইরা (কাঁদো কাঁদো হয়ে) হঠাৎ কইরা কী থেকে যে কী হইয়া গেলো।

– দাদু, দাদু কথা বলো দাদু। কথা বলো। (কান্নায় ভেঙে পড়ে সামিহা)

তখনই হঠাৎ সামিহার দাদুর চোখের পাতা নড়ে উঠে। তিনি চোখ মেলার চেষ্টা করতে থাকেন। তার ডান হাতের আঙ্গুল গুলোও নড়ে উঠে। দিথী বলে উঠে।

– দেখো উনি চোখ মেলার চেষ্টা করছেন।

সামিহা সাথে সাথে মাথা উঠায়। লোকজন সব উৎসুক হয়ে সামিহার দাদুর দিকে চেয়ে তাকায়। সামিহার দাদুর সম্পুর্ন চোখের পাতা মেলে দেন। মাথা ঘুড়িয়ে চারপাশে দেখতে থাকেন। তারপর ডান হাতটা উঠানোর চেষ্টা করেন। হাত টা উঠিয়ে সামিহার মাথা জড়িয়ে ধরেন। সামিহার কপালে একটা চুমু খান। সামিহা কান্না থামিয়ে তার দাদুর হাত ধরে চুমু খায়। তখনই হঠাৎ সামিহার দাদু মুখ ফুটে বলে উঠেন।

– স,সামিহা। ত,তুই এসেছিস মা,!

– দাদু, দাদু আমি এসেছি দাদু। তোমার কিচ্ছু হবেনা। তোমাকে আমরা এখুনি হসপিটালে নিয়ে যাবো। এখনি।

– থাম মা। তোর সাথে আমার কিছু। আহ,। কিছু কথা আছে।(কথা বলতে বলতে হঠাৎ শরীর ব্যাথা করে উঠে তার)

– হ,হ্যা দাদু। হ্যা দাদু বলো। 

– তুই একটু সবাইকে বাইরে যেতে বল। আমি, আমি তোর সাথে একান্তেই কথা বলতে চাই। 

– আপনারা, আপনারা সবাই একটু বাইরে যান। দাদু আমাকে একান্তেই কিছু বলতে চান। প্লিজ আপনারা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান।

সামিহার কথা শুনে রুমের মধ্যে থাকা সব লোকজন বাইরে চলে যেতে থাকে এক এক করে। দিথীও চলে যাওয়ার জন্য উঠে। তখনই সামিহার দাদু মুখ ফুটে বলে উঠেন।

– ত,তুমি থাকো মা। তুমি থাকো।

দিথী, দাদুর করা শুনে বসে পড়ে। ঘরের সব মানুষ গুলো চলে যায়। যাওয়ার সময় তারা দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে গেছিলো তারা। সামিহার দাদু কাপো কাপো কন্ঠে বলতে শুরু করেন।

– আ, আমার হাতে মনে হয় আর বেশি সময় নেই রে মা। আমাকে, আমাকে চলে যেতে হবে। তবে যাওয়ার আগে, যাওয়ার আগে তোদের কে সেই বক্সটা সম্পর্কে জানিয়ে দিতে চাই। (দিথীর দিকে তাকিয়ে) দিথী মা, মা ঐযে পাটাতনের উপর একটা হাড়ি দেখতে পাচ্ছো, তার ভিতরে একটা বক্স আছে। সেটা নিয়ে এসোতো মা,। একটু, একটু তাড়াতাড়ি করো। আ,আমার খুব যন্ত্রনা করছে। আহ,।

 

দিথী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেয়ালের সাথে থাকা কাঠের পাটাতনের উপর থাকা হাড়িটার ভিতর হাত ঢুকায়। একটা বক্স তার হাতের নাগালে আসে। দিথী সেই বক্স টা বের করে। তারপর আবার তাড়াহুড়ো করে দাদুর পাশে বসে। সামিহার দাদু বক্স টা হাত দিয়ে ছুঁতে থাকেন। বলেন।

– এই, এই বক্সটা তোমরা যত্ন করে সংরক্ষণ করে রেখো। এটা, এটা আমার কাছে এতো দিন আমানত হিসেবে ছিলো। এখন এটা, এটা তোমাদের হাতে হস্তান্তরের সময় এসে গেছে। (দিথীর দিকে তাকিয়ে) দিথী, মা তুমি এটা খুব যত্নে রেখো। একজন আসবে এটা খোঁজার জন্য। তাকে আমি কথা দিয়ে রেখেছিলাম এটা হেফাজত করার আর যদি এর আসল মালিক খুঁজে পাই তাহলে তাকে দিয়ে দেওয়ার। আমি অনেক বছর খুঁজেছি সেই আসল মালিককে। পাইনি। আজ, আজ যখন আমার চলে যাওয়ার সময় এলো তখনই আমি এটার আসল মালিককে খুজে পেলাম। দিথী মা, তুমিই সেই মেয়ে। এটা। আহহ,। এটা ওরা নেওয়ার অনেক চেষ্টা করবে। কিন্তু তুমি এটার রক্ষা করো। সেই মেয়েটা আসবে, এটা আর তোমার খোঁজে। এই বক্স টা শুধু তোমার হাতের স্পর্শেই খুলবে মা। তোমার হাতের স্পর্শেই খুলবে। আহহ,। আমার খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। স,সামিহাকে দেখে রেখো। ওকে আমি, ওকে আমি তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম মা। তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম (একটু থেমে উপরের দিকে দুই চোখ করে) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ।

সাথেই সাথেই সামিহার দাদু চোখ বন্ধ করে ফেলেন। 

– দ,দাদু। দাদুউউউউউউউউ,

সামিহার গগন বিদারি চিৎকার শুনে মুহূর্তেই ঘরের মধ্যে চলে আসে সব লোকজন। তারা এসে দেখে সামিহার দাদু মারা গিয়েছে। সবার উপস্থিতি দেখে দিথী সেই বক্সটাকে তার ওড়নার আড়ালে ঢেকে দেয়। সামিহা তার দাদুকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে। হঠাৎ তার দাদুর এমন কিছু হয়ে যাবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ঘরের উপস্থিত থাকা লোকদের চোখেও পানি চলে আসে সামিহার কান্নার আর্তনাদ দেখে। মুহুর্তের মধ্যেই যেন ঘরের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেন দিথীর বাবা অন্তর সাহেব। তিনি এগিয়ে গিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়ান। দেখেন সামিহা তার দাদুর লাশটাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে। অন্তর সাহেব মনে মনে বলে উঠেন। “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন” 

এক মহিলা গিয়ে সামিহাকে শান্ত করতে থাকেন। কান্না মিশ্রিত কন্ঠস্বরে সামিহাকে বলতে থাকেন।

– তোর বাপ-মাও মরলো। তোর দাদুডা ছিলো তোর শেষ মাথা গোজার ঠাঁই। হেও তোর বিয়া দেওয়ার আগেই চইলা গেলো। কান্দিস না মা। সবই উপর ওয়ালার ইচ্ছারে মা, সবই উপর ওয়ালার ইচ্ছা।

অন্তর সাহেব গিয়ে বিছানার ঠিক পাশে দাঁড়ান। দিথীর চোখেও পানি চলে এসেছে। তিনি ‌দিথীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন।

– আমি, আমি সামিহাকে আমার নিজের মেয়ে করে নিতে চাই। আজ থেকে ও আমার মেয়ে।

কথা শুনেই ঘরের মধ্যেকার পরিবেশ লোকজনের আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। অন্তর সাহেব আরো বলেন

– ওকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতো পড়ালেখা করাবো। তাকে ভালো ঘরে ধুমধাম করে বিয়ে দিবো। (একটু থেমে) আজ থেকে আমার দুই মেয়ে, দিথী আর (সামিহার দিকে চেয়ে) সামিহা।

তার কথা শুনে ঘরে উপস্থিত থাকা সকল লোকই খুশি হয়। অন্তর সাহেব গ্রামের একজন সৎ আর দায়িত্ববান চেয়ারম্যান। তিনি আজ পর্যন্ত গ্রামের অনেক উন্নয়ন করেছেন। প্রত্যেকটা পরিবারের খোঁজ খবর রাখেন। আজ এক এতিম মেয়ে সামিহাকে নিজের মেয়ে করে নেওয়ার জন্য তার প্রতি গ্রাম বাসী আবারো খুশি। 

দিথী উঠে দাঁড়ায়। অন্তর সাহেব সেখানে বসেন। সামিহার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত, স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। সামিহাকে নিজের বোন হিসেবে পেয়ে দিথীও খুব খুশি। তার চেহারায় ফুটে উঠা হাস্যৌজ্জল মুখ দেখেই তা বোধা যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ আজ আবার অন্তর সাহেবের মহানুভবতার নিদর্শন দেখলো। তিনি এই গ্রামের জন্য অনেক কিছু করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। এরজন্যই তো তিনি পরপর ৩ বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রতিযোগিও প্রায় নেই বললেও চলে। অনেক সময় তার কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী তার বিরুদ্ধে খারাপ কথা রটানোর চেষ্টাও করেছিলো, কিন্তু অন্তর সাহেব তাদের কোন শাস্তি না দিয়ে তাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়েছেন, মাফ করে দিয়েছেন। তারা অন্তর সাহেবের থেকে এরকম ব্যবহার দেখে ভিতরে ভিতরে অনুতপ্ত হয়েছে এবং ভালো পথে ফিরে এসেছে। লিডার হলে একজন সৎ, আদর্শ, ও দায়িত্ববানকেই হওয়া উচিত। অন্তর সাহেব এই সত্তা টাকেই নিজের মাঝে ধারন করেন। এবং অন্যকে উৎসাহিত করেন। “যেমনটা কর্ম হিসেবে করিবে তেমন টাই ফল হিসেবে বিপরীত থেকে পাইবে।” এটাকেই তিনি তার মূলমন্ত্র হিসেবে মেনে চলেন।

 

 

মেম্বার বাড়ি। সূর্যি মামা আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। অন্যান্য দিন দুপুরের আগে তার দেখা না মিললেও আজ সকাল ১১ টার দিকেই তাহার মুখখানি উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করিয়াছে। মেম্বার বাড়িতেও তাই লেগে গেছে কাপড় ধোয়ার ধুম। এতোদিন শুকাবেনা বলে জমিয়ে রাখা কাপড় গুলো আজ গোসল করে রোদ পোহাবার জন্য রেডি হচ্ছে। আর তাদের গোসল করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন শিউলি বেগম নিজেই আর তার কাজে হাত লাগাবার জন্য তো লায়লা,ফুলমতি আছেই ,! সবাই মিলে কলেপাড়ের দিকে গেছে কাপড় ধুতে। কাপড় বেশি জমেছিলো তাই পাকা গোসল খানায় কাপড় না ধুয়ে কলেপাড়ে গিয়েছেন তারা। কলেপাড় টা বাড়ির সিমানার ভিতরেই তবে বাড়ির আঙিনায় না। রান্নাঘর আর বাড়ির মাঝদিয়ে টিউবওয়েল পাড়ে যাওয়ার ছোট্ট রাস্তা আছে সেটা দিয়ে যেতে হয় সেদিকে। তারা তিনজনেই চলে গিয়েছে সেখানে গাট্টি গাট্টি কাপড়, কাঁথা নিয়ে। 

 

নিপা ঘরে একলা শুয়ে রয়েছে। আজ কলেজ নেই তাই ঘরেই সময় টা কাটাচ্ছে সে। সে তার কোলবালিশ টা জড়িয়ে ধরে বিছানায় খালি গড়াগড়ি খাচ্ছে এটা ভেবে যে আজ ও একলা ঘুমায়, কিন্তু বিয়ে হলে রায়হানের সাথে ও কীভাবে ঘুমাবে। তখন তো ও লজ্জায় একদম মাটি খুঁড়ে ভিতরে চলে যেতে মন চাইবে। ভাবছে আর মিটিমিটি করে হাসছে। কোন সময় হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে রাখছে। কখনো বা কোলবালিশ কেই রায়হান ভেবে তার সাথে কথা বলছে। কোলবালিশের সাথে কথা বলতে বলতেই তার মনে পড়ে গেলো ৭ মাস আগের কথা। ৭ মাস আগে তার প্রিয়তম এর সাথে তার প্রথম দেখা। সে উঠে বসে তার বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে একটা খাম বের করে। খাম টা গোলাপী রঙের, তার মাঝে বড় একটা লাভ আঁকা। নিপা খাম হাতে নিয়ে বিছানায় উপর উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। খাম টা খুলে ভিতরে থাকা চিঠিটা বের করতে থাকে। রায়হানের দেওয়া প্রথম চিঠি এটা। প্রথম দেখার পরের দিনই রায়হান চিঠিটাকে জিনিয়ার হাত দিয়ে তার কাছে পাঠায়। নিপা চিঠির খাম টা পাশে রেখে চিঠি টা খুলে ফেলে। পড়তে শুরু করে।

 

প্রিয়র চেয়ে প্রিয় স্রোতস্বিনী,

 

শ্রাবণ ধারার মাঝে তোমার ঐ অপলক রূপের সাক্ষী হওয়া এক নির্বাক প্রান্তর বলছি। সেইদিন টা হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও স্মরনীয় দিনগুলোর মধ্যে একটি ছিলো , ! আমার কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়না একমুহুর্তের জন্য রুখে দেওয়া রূপবতী নন্দিনী, তোমার খোলা চুলকে হাওয়ায় দোল খাওয়ানো যদি সেই দখিন হাওয়া হতাম, ! নিজেকে অনেক ধন্য মনে করতাম।‌ আমার পৃথিবী মুহুর্তের মধ্যে থমকে গিয়েছিলো তোমায় দেখে। ছাতা হাতে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে বৃষ্টির থেকে বাঁচতে, সেই তোমায় দেখে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম এক গহীন অরণ্যে, ! তোমার সেই ডাগর ডাগর চোখ দুটিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম একাকিত্বে। যদি হতে পারতাম আষাঢ়ের সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি কণা ! মেঘ ভেঙে এসে ভিজিয়ে দিতাম তোমার ঐ অমলিন মুখশ্রী, ! জানো, তুমি যখন তোমার বান্ধবীর সাথে কথা বলার মাঝে হাসছিলে, মন বলছিলো এই হাসির জন্য দুনিয়া এফোড় ওফোড় করে দিতেও রাজি, ! পুব আকাশে ঘটা মেঘের ঘনঘটা, তার মাঝে অঝোর ধারায় ধরিত্রীকে ভিজিয়ে দেওয়া বৃষ্টিকে বলেছিলাম। হে মেঘলা আকাশ, তোমার বর্ষণ তুমি থামিও না। এই অপলক সুন্দর মুহুর্তকে তুমিই পারো আরো একটু দীর্ঘ করতে,!

তোমার ঐ রুপনগরে অববাহিকায় বয়ে যাওয়া এক নদীর স্রোতধারায় নিজের গা ভাসিয়ে ছিলাম সেদিন। তাই তোমার নাম দেই স্রোতস্বিনী। আমি তোমার অববাহিকায় জনম জনমের মাঝি হিসেবে বৈঠা বাইতে চাই। এই অভাগা মাঝি কী পাবে সেই সুযোগ ? স্রোতস্বিনী কী আমায় তার স্রোতের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর ? নাকি এনে ফেলে দিবে এক জনমানবহীন দীপ পুন্জে ?

 স্রোতস্বিনী, তোমার সেই উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম,!

 

ইতি,

তটিনী তীরের এক অভাগা মাঝি

 

 চিঠিটা পরেই বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে নিপা। এই চিঠিটা যেদিন প্রথম পড়েছিলো সে, সেদিন নিজেকে তার অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়েছিলো। এতো সুন্দর চিঠি তার কুসুম কোমল মন টাকে একদম গলিয়ে নরম তুলতুলে করে তুলেছিলো। পরবর্তীতে সে এই চিঠির উত্তর হিসেবে সম্মতি সূচক চিঠি পাঠায়। রায়হানকে সে দেখেছিলো। রায়হানের চিঠির চেয়ে বেশি রায়হানের বডি ফিটনেস দেখে নিপা পাগল হয়েছিলো। দুজনের মনের সম্মতিতে তাদের সম্পর্কের সূচনা হয়। যা আর ক’দিন পর পূর্নতা পেতে চলেছে। এর থেকে খুশির মুহুর্ত তার কাছে কী হতে পারে ? 

বিয়ের কথা ভেবেই নিপা আবার লজ্জায় মুখ লুকোয় দু হাতের নরম তালুতে।

বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেনিসের দিকে যাচ্ছিলো ফয়সাল। হাতে সিগারেট। যখন কেউ থাকেনা তখন সে তার ঘরে সিগারেট খায়। বেসিনের দিকে যাচ্ছিলো হাত ধুতে। হাতে কীসের যানি ধুলো লেগেছে তাই।

 নিপার ঘর টা ক্রস করার সময়ই নিপার হালকা গলার হাসি শুনে তার পা থেমে যায়। নিপার দরজা হালকা একটু ফাঁকা করা। ফয়সাল নিপার ঘরের দিকে ঘুরে তাকায়। দেখে নিপা শুয়ে রয়েছে জানালার দিকে মুখ করে। গোল জামা পড়া, গায়ে ওড়না নেই। ফয়সাল দরজার সেই ছোট্ট অংশ টুকু দিয়ে নিপার দিকে তাকাতে থাকে। নিপার দুধের মতো সাদা শরীর যেন তাকে কাছে টানছে। সে নিপার পা থেকে মাথার দিক পর্যন্ত চোখ বোলাতে থাকে। 

– উফফ, কী হট। ইশশশ যদি ঐ নরম নরম পাহাড় গুলারে হাত দিয়ে ধরতে পারতাম। উফফ , সেই, ! 

ফয়সাল আশেপাশে তাকাতে থাকে। দেখে কেউ নাই। মনে মনে বলতে থাকে।

– চাচি গেছে কলেড়পারে। বাড়ি একদম ফাঁকা। আ হা,! ফয়সাল যা। এই সুযোগ আর কখনো পাবিনা। যা ফয়সাল যা,

 

ফয়সালের ভিতরে লুকানো খারাপ সত্তাটা যেগে উঠতে থাকে। হাত দিয়ে নিজের উত্তেজিত লিঙ্গের উপর কন্ট্রোল আনতে থাকে। সে ঘরের দরজাটা খুলে দেয়। তখনি পিছন থেকে আওয়াজ আসে,

– ফয়সাল , তুমি এহানে কী করতাছো ? 

কথাটা শুনেই ফয়সালের মুখ থেকে বিরক্তসূচক শব্দ বেড়িয়ে আসে।

– ধ্যাত বাল। চাচি আসার আর সময় পাইলোনা। 

 

চাচির ডাক শুনে ফয়সাল পিছনে ফিরে তাকায় আর নিপারো ঘোর ভাঙ্গে। সে উঠে বসে। দেখে ফয়সাল তার লিঙ্গ এক হাত দিয়ে চেপে ধরেছে আর বাহিরের পাশে মুখ ঘুরিয়েছে। ঘরের দরজাটাও মেলা। তার  আর বুঝতে বাকি রওলোনা যে ফয়সাল এতক্ষণ তার দিকে কুদৃষ্টি দিচ্ছিলো। সে সাথে সাথেই তার শরীরের কাপড় টেনে ঠিক করে দেয় আর বালিশের পাশে থাকা ওড়নাটা বুকের উপর দিয়ে দেয়। ফয়সাল পিছন ফিরে চাচিকে কিছু বলতেই যাবে তখনি শিউলি বেগম বলেন।

– পাখিতে তে হাত দিয়া রাখছো কেন বাজান ? মুতার বাথরুম তো ঐদিকে, ? 

– না মানে চাচি। হইছে কী। মানে চাপ বেশি উঠছিলো এরলাইগা ভুইলা এই রুমে ঢুইকা যাইতাছিলাম। আ,আমি যাইতাছি। যাইতাছি।

বলেই এক প্রকার দৌড়ে সেখান থেকে বাথরুমের দিকে চলে গেল ফয়সাল।

 নিপা বিছানা থেকে নেমে দরজার সামনে আসে। শিউলি বেগম ভিজা শরীরেই চলে এসেছিলেন এদিক টায়। আসলে ফয়সাল এখান থেকে কেটে পড়ার চিন্তায় সেদিকটায় আর নজরই দেয়নি। নিপা বারান্দায় বেড়িয়ে এসে বলে।

– মা তুমি এহানে এমনে আইছো ক্যা ? তুমিও না। আব্বায় বাড়িত থাকলে কী হয়তো ? 

– তোর বাপে দেখলেই কী আর না দেখলেই কী ? বিয়া কর হেরপর বুঝবি এইডি। এহন তোরে গিল্লা খাওয়াইয়া দিলেও বুঝবিনা। হা হা হা হা

– ধুরু মা। তুমিও না।

– হইছে ছেড়ি আর লজ্জা পাওন লাগবো না। যা ঘর থেইকা আমার শাড়ি ডা আইনা দে। সব কাপড় লইয়া গেছি কিন্তু পড়ার শাড়ি ডা ভুলে থুইয়া গেছি।

– হ তুমি তো ভুলবাই। খারাও এইহানে।

বলেই শিউলি বেগমের ঘরের দিকে চলে যেতে থাকে নিপা। গিয়ে একটা শাড়ি আর একটা ব্লাউস এনে শিউলি বেগমের হাতে ধরিয়ে দেন।

– আরে আরে ব্লাউস লাগবোনা তো। 

– মানে ? এহন কী তুমি ব্লাউস ছাড়া শাড়ি পরবা নাকি ? 

– পড়লে মন্দ হয়না। হা হা হা।(একটু থেমে) আরে না ছেড়ি ব্লাউস নিয়া গেছিলাম শাড়িডা খালি থুইয়া গেছিলাম। ধর এইডা। (ব্লাউজ টা নিপার দিকে এগিয়ে দেন শিউলি বেগম। নিপা সেটা নিয়ে ঘরের দিকে চলে যায়। শিউলি বেগমও চলে যেতে থাকেন কলের পাড়ের দিকে।

 

 

ডিবি গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়, ঢাকা। শাহারিয়া তার ডেস্ক থেকে উঠে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মিটিং রুমের দিকে। শাহারিয়া সারারাত জার্নি করে এসে সকালেই অফিস জয়েন করেছে। হঠাৎ হেড স্যারের তলব। তাই আসতে হলো। শাহারিয়া মনে মনে ভাবছে তাকে কী নুপুর-নোমানের কেস টা নিয়ে কিছু জিগাবে ? নাকি নতুন কোন কেস এসেছে ? ভাবতে ভাবতেই শাহারিয়া মিটিং রুমের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ভিতরে ঢুকেই দেখে রুম টা ফাঁকা। না ঐ যে একজনকে দেখা যাচ্ছে। হয়তো ওকেও তার সাথে আজ মিটিংয়ে ডেকেছে। মিটিং রুমের মাঝ খান দিয়ে একটা বড় টেবিল আছে। তার দু পাশে সিরিয়াল করে চলে গেছে অনেক গুলো চেয়ার। আর একদম টেবিলের মাথায় মিটিং পরিচালনাকারি হ্যাড স্যারের আসন। এখনো স্যার আসেননি। শাহারিয়া হেঁটে গিয়ে একদম স্যারের কাছের দুটো চেয়ারের একটায় বসে। সামনে বসে আছে সেই ছেলেটা। যাকে সে এই রুমে ঢুকার সময় দেখেছে। ছেলেটার বয়স হবে ১৯ কিংবা ২০। শাহারিয়াই তাকে আগে কথা বলে।

– হ্যালো। আমি শাহারিয়া।

– হ্যালো ভাইয়া। আমি আহনাফ। (বলেই হ্যান্ডশেক এর জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় আহনাফ। শাহারিয়া হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে।)

– আচ্ছা আমার জানামতে তো ২২ বছরের নিচে গোয়েন্দা বিভাগে কারো চাকরি হয় না ? তোমাকে দেখলে তো ১৯/২০ বছরের যুবক মনে হয়, ! 

– হ্যা ভাইয়া আমার বয়স ১৯। আসলে,

আহনাফের কথার মাঝেই রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান, মানে শাহারিয়া যাকে স্যার বলে সম্বোধন করেছিলো। তিনি আসার পর পরই শাহারিয়া আর আহনাফ দু’জনেই দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। নাঈম স্যার তাদেরকে হাতের ইশারায় বসতে বলেন। তারা দুজন বসে পড়ে। নাঈম স্যার বলতে থাকেন।

– তোমাদের আজকে একটা সিক্রেট আর গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের জন্য ডেকেছি। ও হ্যা, এ হচ্ছে আহনাফ(আহনাফের পাশে গিয়ে। আহনাফ উঠে দাঁড়ায়।) হয়তো তোমার মনে হচ্ছে যে আহনাফের বয়স তো কম। এতো কম বছর বয়সে ওকে এখানে দেখছো। 

– হ্যা স্যার এমনটাই আমার মনে হয়েছিলো প্রথম প্রথম। তবে আপনি যেহেতু ওকে নিয়োগ দিয়েছেন কোন না কোন কারণ তো অবশ্যই থাকবে।

– এইতো গুড। তুমি বিষয় টা ধরতে পেরেছো তাইলে। আসলে ও আমাদের একটা কেস খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে সলভ করে ফেলছে। যা আমাদের নির্ধারিত টিম পারেনি। তাই ওকে আমি আমার অধীনে নিয়োগ দিয়েছি। (একটু থেমে) তো তোমাদের যেই জন্য এখানে ডাকা। আমাদের কাছে অনেকদিন থেকেই এই রিপোর্ট এসেছে কিন্তু পুলিশের অধীনে কেস টা থাকায় আমরা এটা নিয়ে ততটাও মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এখন এটা অনেক বড় প্রবলেম হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

– কী কেস স্যার ? বিষয় টা যদি একটু খুলে বলতেন স্যার।(শাহারিয়া বলে)

 

নাঈম স্যার তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। পায়চারি করতে করতে বলেন।

– দেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে হঠাৎ করে কম বয়সী মেয়েরা উধাও হচ্ছে। আর তারপর তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পেরেছি যে সেই মেয়েগুলোর অর্গান অর্থাৎ ফুসফুস, কিডনী,চোখ, হার্টের বিভিন্ন অংশ দেহ থেকে বের করে দেশের বাইরে পাচার করছে একটি চক্র। এই চক্রটির প্রধান হচ্ছে “রন্জু”। তাকে “ব্ল্যাক রন্জু” বলে ডাকে সবাই। এই রন্জুকে কেউ কখনো দেখেনি। তার সাথে আগে কাজ করতো এমন কিছু কিছু লোকদের আমরা ধরতে পেরেছিলাম। কিন্তু তাদের ভাষ্যমতে রন্জু সবসময় হুডি পড়ে তাদের সামনে আসতো। আর হুডির টুপি দিয়ে তার মুখের অর্ধেক ঢাকা থাকতো। শুধু তার ঠোট গুলো তারা দেখতে পেতো। সবসময় কালো হুডি,কালো প্যান্ট ‌আর‌ কালো বুট জুতো পড়ে সে। (শাহারিয়াদের দিকে ফিরে) তোমাদের দুইজনকে এই ব্লাক রন্জুকে ধরতে হবে। বের করতে হবে পুরো চক্র কে।(একটা থেমে) আমি তোমাদের দুজনকে এই অপারেশনের জন্য নির্ধারণ করেছি তোমাদের চাক্ষুসতা আর অন্যন্য গোয়েন্দা গুনের কারণে। পারবেনা এই মিশন কমপ্লিট করতে ? 

– পারবো স্যার। অবশ্যই পারবো। দেশ থেকে সব শত্রুদের উপড়ে ফেলে দেশকে সুশৃঙ্খল করতে আমরা বদ্ধপরিকর।(শাহারিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলে)

– গুড। এই এনার্জিটাই আমি দেখতে চাই তোমাদের দুজন থেকে। তবে সাবধান। রন্জু কিন্তু অনেক চালাক। তাকে ধরতে গিয়ে এর আগে আমাদের চারজন টিম মেম্বারস পুরা হাওয়াই হয়ে গেছে একপ্রকার। 

– স্যার। এই মিশনে আমরা জান প্রাণ দিয়ে কাজ করবো। আপনি চিন্তা করবেন না। শুধু আমাদের উপর ভরসা রাখুন।(আহনাফ ‌দাড়িয়ে বলে)

– সাবাস (আহনাফের পিঠ চাপড়ে)। তো তোমরা প্রস্তুত তো ? 

– ইয়েস স্যার। উই আর রেডি।

– তোমাদের অপারেশনের নাম হবে “অপারেশন ব্লাক ওয়্যার”

 

চলবে ,,,,,

 

(কী রয়েছে সামিহার দাদুর দেওয়া সেই বক্সে ? গল্প কোন দিকে মোড় নিতে চলেছে ? গঠনমূলক মন্তব্য করুন। আর নিপাকে দেওয়া রায়হানের ঐ চিঠিটা কেমন হইছেই জানাইয়েন। এই প্রথম বার এমন চিঠি লিখলাম 😅)

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩০

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩১

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

– পারবেনা এই মিশন কমপ্লিট করতে ? 

– পারবো স্যার। অবশ্যই পারবো। দেশ থেকে সব শত্রুদের উপড়ে ফেলে দেশকে সুশৃঙ্খল করতে আমরা বদ্ধপরিকর।(শাহারিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলে)

– গুড। এই এনার্জিটাই আমি দেখতে চাই তোমাদের দুজন থেকে। তবে সাবধান। রন্জু কিন্তু অনেক চালাক। তাকে ধরতে গিয়ে এর আগে আমাদের চারজন টিম মেম্বারস পুরা হাওয়াই হয়ে গেছে একপ্রকার। 

– স্যার। এই মিশনে আমরা জান প্রাণ দিয়ে কাজ করবো। আপনি চিন্তা করবেন না। শুধু আমাদের উপর ভরসা রাখুন।(আহনাফ ‌দাড়িয়ে বলে)

– সাবাস (আহনাফের পিঠ চাপড়ে)। তো তোমরা প্রস্তুত তো ? 

– ইয়েস স্যার। উই আর রেডি।

– তোমাদের অপারেশনের নাম হবে “অপারেশন ব্লাক ওয়্যার”

 

 

জানালার ধারে দেয়ালের গা ঘেঁষে বিছানায় বসে রয়েছে আয়ান। আয়ানকে হয়তো আপনারা ভুলেননি। রিয়ার সেই ছোট্ট ৬ বছর বয়সী ছেলেটা। হাতে একটা ছোট্ট ফটো ফ্রেম। জানালার দিকে সূর্যের উষ্ণতা নিতে নিতে সেই ফটো ফ্রেমে হাত বোলাচ্ছে আয়ান। ফটো ফ্রেম টা আমাদের কাছে নিছক প্লাস্টিকে মোড়ানো কাগজ মনে হলেও আয়ানের কাছে সেটা হীরের চেয়েও দামি। কারণ এই একটা ছবিই মায়ের সাথে একসাথে তার তোলা। ছবিটা এক বছর আগের। অর্থাৎ আয়ান যখন ৫ বছর বয়সের ছিলো‌। ছবিতে শাড়ি পড়া রিয়া তাকে কোলে নিয়ে ক্যামেরার দিকে চেয়ে এক মুচকি হাসি দিয়েছে। সেই হাসিটাই আজ আয়ানের সবচেয়ে গভীরে আঘাত করছে। আয়ান শুধু বার বার ফটো ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকা তার মায়ের উপর হাত বোলাচ্ছে। ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো রাশেদ। অর্থাৎ রিয়ার ছোট ভাই। ঘরে ঢুকেই সে গায়ের সোয়েটার খুলে আলনায় ঝুলিয়ে দিলো। পরিবারের একমাত্র ছেলে সে। বাবা-মা বিছানায় পড়েছেন অনেক দিন হলো। আগে তার আপু কী জানি কুটির শিল্পের কাজ না কী জানি করে টাকা এনে সংসার চালাতো। এখন রিয়ার গত হওয়ার পর থেকে তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। লেখাপড়া ছেড়েছে ১ মাস হলো। অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলো এবার। কিন্তু হঠাৎ আসা জীবন-জোয়ারে তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ভেসে গেছে। রাশেদ এখন গ্রামের বাজারে এক দোকানে কাজ নিয়েছে। কামারের দোকান। বেশ পরিশ্রম করতে হয়। আজ ২ দিন হলো কাজ শুরু করেছে সেখানে। আজ দুপুরে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। শরীর খারাপ লাগছিলো তাই। 

রাশেদ এতোক্ষণ কাপড় বদলাচ্ছিলো। বাড়ির লুঙ্গি গেঞ্জি পড়ে যখনই সে বাইরে যাবে তখনই তার খেয়াল হলো ঘরে তো আয়ানও আছে। সে আয়ানের দিকে তাকায়। দেখে আয়ান হাতে একটা ফটো ফ্রেম নিয়ে জানালার বাইরে উদাস পানে চেয়ে আছে। রাশেদ এসে বিছানায় বসে। আয়ানকে ডাকতে থাকে। 

– আয়ান। মামা কী করছো। 

আয়ান ফিরে তাকায়। এতোক্ষণ সেও রাশেদকে খেয়াল‌ করেনি। সে দেয়াল থেকে পিঠ উঠিয়ে সোজা হয়ে বসে। রাশেদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে‌।

– মামা তুমি কখন আসলে, !

– এইতো মামা মাত্রই। এসে খালি কাপড় গুলো বদলালাম। 

 

আয়ান এসে রাশেদের কোলে মাথা দেয়। রাশেদ, আয়ানের হঠাৎ এরকম হতে দেখে কিছুটা অবাকই হয়। সে আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিগ্গেস করতে থাকে।

– আরিয়ান। কী হয়েছে মামা। 

– মামা। আমার মাম্মাম কী আমাকে মিস করেনা , ! 

 

আয়ানের কথায় রাশেদ বুঝতে পারে আয়ানের মন খারাপের কারণ সম্পর্কে। সে নিজের কোলে থাকা আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে।

– করে তো মামা। (একটু থেমে ধীর গলায়) অনেক মিস করে। 

– মামা জানো। মাম্মামকে আমি শেষ বার যখন দেখেছিলাম, মাম্মামের মুখের সেই হাঁসি টা তখন খুব সুন্দর লাগছিলো। (একটু থেমে) মাম্মাম কী আকাশের তারা হয়ে গেছে মামা , ! 

 

আয়ানের এমন কথায় রাশেদ কী উত্তর দেবে ভেবে পায়না। সে আয়ান কে এখনো রিয়ার মৃত্যুর বিষয়টা বলেনি। কিন্তু আয়ান এতো দিন তার মা’কে না দেখতে পেরে হয়তো জিনিসটা আন্দাজ করতে পেরেছে। পরমুহূর্তে রাশেদ বলে।

– ন,না মামা। এসব বলতে নেই। তুমি, তুমি মন খারাপ করিও না।‌ ওরকম কিছুই হয়নি।

– আমি জানি মামা। আমায় নানু বলেছে। (একটু থেমে এক মলিন গলায়) জানো মামা। আমারো ইচ্ছে করে মাম্মামের মতো তারা হয়ে মাম্মামের কাছে চলে যেতে। গিয়ে মাম্মামের সেই সুন্দর হাসিটা দেখতে। মাম্মামের হাতে খাইয়ে নিতে।

 

কথা গুলো শুনে রাশেদের বুকের ভিতর টা ছ্যাত করে উঠে। ও আয়ানের কথা গুলো শুনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছেনা। রাখবেই বা কী করে। আর আয়ানেরই কী বা দোষ, তার মা’ও ছিলো খুনি, তার আসল বাবা আরমানও ছিলো খুনি। তারা একটা পরিবার নষ্ট করেছে। একটা ছেলের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। তাদের ফল তো তাদের পেতেই হতো‌। মাঝ খান দিয়ে তাদের দুজনের বলি হতে হলো আয়ানকে। না পেলো তার আসল বাবার পরিচয়, না পারলো তার মায়ের সান্নিধ্যে তার শৈশব কাল টুকু কাটাতে। মানুষ আসলেই বলে, পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। আজ আয়ান কষ্ট পাচ্ছে, রাশেদ তার বাবা-মা, সমাজে লজ্জিত হচ্ছে শুধু পরিবারের একজনের খারাপ কর্মের জন্য। 

 

রাশেদ তার চোখ মুছে। নিজেকে শক্ত করতে চেষ্টা করে। সে আয়ানের মাথায় উঁচিয়ে চুমু খায়। বলে।

– আয়ান, এসব কথা বলতে নেই। চোখ মোছো। আসো খাবার খেয়ে নেই। (আয়ানকে সাথে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে) আমাদের ‌কাঁদলে কী চলবে বলো, ! নানুদের কে দেখবে তখন। কাঁদিও না। চলো। খাবার খেয়ে নেই।  (একটু হাঁসি মুখে) সুরমা দাদি আজ রান্না করে দিয়ে গেছে নাকি আয়ান, ? 

– হ্যা মামা। আমি একটু এগিয়েও দিয়েছি তাকে জিনিস গুলো।

– এইতো, গুড বয়। এভাবেই থাকবে সবসময়। কোন সময় মন খারাপ করবে না। আমি তো আছি নাকি। (আয়ানের হাত ধরে) চলো খেয়ে নেই।

– আচ্ছা মামা চলো। 

 

আয়ানকে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় রাশেদ। রাশেদ একা হাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে পুরো পরিবারকে সেই ট্রমা টা থেকে উঠাতে। কখনো কখনো সেও ভেঙে পড়ে‌। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে বল এনে, নিজের আবেগ কে কাবু করে বাস্তবতার সার্থে নিজেকেও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ছেলেরা খুব সহজে কাঁদেনা। ভিতরে খুব কষ্ট পেলে, আঘাত পেলে তবেই তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। হয়তো এই সুপ্ত গুনের কারণেই রাশেদ তার পরিবারকে নিয়ে এক নতুন করে বাঁচার আশা দেখতেই পারে ,!

 

 

নিপা ঘরে ঢুকলো। দুপুরের খাওয়া শেষ করে এলো সে। এখন সময় দুপুর আড়াইটার কাছাকাছি। বাইরের দিকে সূর্যের তেজ যেন বেড়েই চলেছে। খাওয়ার পর পরই দেহ ভারি হয়ে ঘুম ধরে যাওয়াটা স্বাভাবিকই বটে। নিপাও এমনিতে প্রতি বিকেলে ঘুমায়। কলেজ থাকলে কলেজ থেকে এসে খাওয়া করে ঘুমায়। বিকেলে ঘুমানোটা একপ্রকার তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিপা ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি ভালো ভাবে লাগিয়ে দেয়। বিছানার কাছে এসে হাই তুলতে থাকে। 

– আজ মনে হয় একটু বেশিই খেয়ে ফেলছি। এইজন্যই মনে হয় শরীর বেশি ভার ভার লাগছে। 

নিপা গিয়ে জানালার একটা পাট বন্ধ করে দেয় আর একটা খোলা রাখে। রোদের আলো এসে বিছানার আংশিক কিছু অংশে পড়ে। নিপার এই বিষয় টা ভালো লাগে না। তাই জানালার একটা পাট লাগিয়ে দিলো। বিছানায় এসে বসলো সে। মাথার বালিশ টা যায়গা মতোই দিয়ে। শুয়ে পড়তে থাকে। গোসলের পর মাথার চুল গুলো ভেজা ছিলো। তাই চুল গুলো মেলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। বিছানায় তার সবসময় একটা কোলবালিশ থাকে। সেটাকে সে রায়হান কল্পনা করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়। আজও সেই কোলবালিশ টাকে কাছে টেনে নেয়। সেটাকে জড়িয়ে ধরে নরম বালিশে মাথা রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর জন্য তৈরি হয়ে যায় সে। 

হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। ফোন টা তার মাথার পাশের টেবিল টায় ছিলো। ঘুমের ভাব টা হঠাৎ কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ফোনটার উপর সে একটু বিরক্তই হয়। সে মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে উঠে বসে। পাশের টেবিলে থাকা ফোনটা হাতে নেয়। দেখে রায়হান ফোন করেছে। 

“এই সময় তো রায়হান সাধারণত ফোন করেনা , ! আজ হঠাৎ , ? ”

নিপা ফোনটা রিসিভ করে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে। ওপাস থেকে রায়হান বলে। 

– সুবা,। কী করো। 

– এইতো শুয়েছি একটু। 

– কী বলো , ! শরীর ঠিক আছে তো তোমার ? 

– আরে না। তেমন কিছু না। এমনিই আমি দুপুরে খাওয়ার পর একটা ছোট্ট ঘুম দেই। 

– ওহহ। সরি তোমার ঘুমের ডিসটার্ব করার জন্য। 

– আরে না। কী বলো তুমি। অবশ্য আমিও এখন তোমার কথাই ভাবছিলাম। 

– ও আচ্ছা , ! তো আমাকে নিয়ে কী ভাবছিলেন রাণী সাহেবা , ! 

– এইতো ভাবলাম আমার কোলবালিশ টা তুমি। আর তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। এইটুকুই, হিহিহি।

– আমার এখন তোমার কোলবালিশ টার উপর হিংসে হচ্ছে জানো। আমার যায়গায় ও তোমার উষ্ণতা নিচ্ছে। আমি এখনি তোমার কোলবালিশ কে উপরে পাঠিয়ে দিবো। আসছি তোমার বাসায়, দাঁড়াও। 

– যাও, ! আমার কোলবালিশকে ছুঁলে কিন্তু একদম ভালো হবে না বলে দিচ্ছি, ! 

– কেনো ? কোলবালিশ টা কে আমি আর কোন ভাবেই তোমার গাঁয়ের উষ্ণতা পেতে দিচ্ছি না। আমি এখুনি আসছি। 

– কোলবালিশ টাই আমার রায়হান। আর ওকে যেই ছুঁতে আসবে তাঁকে আমি ,

– হ্যা তাকে কী করবে, !

 

নিপা একটু লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলে,

– একটা পাপ্পি দিবো, হা হা হা হা।

– তাইলে তো আমি আরো আগে আসছি। তোমার ঐ তুলতুলে পাপড়ি গুলোর ছোঁয়া, যে আমার লুফে নিতেই হবে। 

– আচ্ছা আচ্ছা আসিও। তুমি দেখছি আমার কোলবালিশ কেও ছাড়ছো না আমার সাথে থাকার জন্য , ! 

– হ্যা অবশ্যই ছাড়বো না। কোলবালিশ তো ছোট কথা। কেউ যদি তোমার সাথে একটু বাজে ব্যবহার করে ওকে ডিরেক্ট মাটিতে পুঁতে ফেলবো। তুমি শুধু আমাকে বলবা খালি যে কে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। তারপর দেইখো আমি তার কি হাল করি, ! 

 

নিপা এই কথাটা শুনেই একটু চুপচাপ হয়ে যায়। হালকা ধীর কন্ঠে বলে। 

– জানো,। আমার দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই ফয়সাল আছে না। ও,ও আমার দিকে খারাপ নজরে তাকায়। আমার খুব অস্বস্তি বোধ হয়।‌ কাল জানো কী হয়েছে,। আমি বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে তোমার দেওয়া সেই প্রথম চিঠিটা পড়ছিলাম। তখন ফয়সাল দরজার আড়াল থেকে আমাকে নোংরা নজরে দেখেছে। ভাগ্যিস মা সময় মতো চলে এসেছিলো। কাল ওর চোখে আমি আমার প্রতি এক নোংরা চাহনি দেখেছি। আমার গা গুলিয়ে আসছিলো ওর এসব দেখে। 

 

কথা গুলো বলে শেষ করার সাথে সাথেই নিপা ফোনের ওপাস থেকে একটা গ্লাস ভাঙার শব্দ পায়। নিপা একটু অবাকই হয়।

 সে এই বিষয় নিয়ে যখনই কিছু বলতে যাবে। তখনই ওপাস থেকে রায়হান দাঁত কড়মড়িয়ে বলে উঠে।

 – ঐ ফয়সালের দুই চোখ আমি, আমি চাকু দিয়ে টেনে তুলে ফেলবো। ওর নোংরা মস্তিষ্ককে আমি পিষে, পিষে থেঁতো করে ফেলবো। থেঁতো করে ফেলবো। 

 – রায়হান, আমার কথাটা শোন। রাগ করিও না। ও আজকেই চলে যাবে।‌ তুমি প্লিজ মাথা ঠান্ডা করো।

 – (জোড়ে চিৎকার দিয়ে) কীসের মাথা ঠান্ডা। ওকে, ওকে আমি এতোটা কষ্ট দিয়ে মারবো, এতোটা কষ্ট দিয়ে মারবো, ও পরকালে গিয়েও ওর এই কুকর্মের জন্য আফসোস করবে। 

 – রায়হান প্লিজ ওকে লাত্থি ঘুষি যাই দেও মেরে ফেলো না। রায়হান শোনো আমার কথাটা। হ্যালো, হ্যালো। 

নিপা উঠে বসে ফোন হাত নিয়ে দেখে রায়হান ফোন কেটে দিয়েছে। নিপার চিন্তা হতে থাকে। রায়হান রাগের মাথায় কিছু ঘটিয়ে ফেলবে নাতো, ! 

 

 

সময়টা এখন বিকেল। সূর্যি মামার তেজ কমেছে, কুয়াশা তার বেড়াজাল নিয়ে উপস্থিত হতে শুরু করেছে। ঠান্ডা অন্যদিনের থেকে আজ একটু বেশিই পড়েছে মনে হয়। পড়ার ই কথা। উত্তরবঙ্গের জেলা তো। শীতের সময় শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে একটু আধটু হাড় না কাপিয়ে দিলে কী হয় , ! 

দিথীদের রুম। সামিহা একপাশ ফিরে ঘুমিয়ে রয়েছে। তার পাশেই বালিশে হেলান দিয়ে রয়েছে দিথী। সামিহা আজ খুব কেঁদেছে। অনেক কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক, ছোট থেকে বাবা-মায়ের আদর না পাওয়া সামিহার কাছে দাদু ছিলো তার মা-বাবার মতো। সামিহা যেন আজ একসাথে তার বাবা-মা দুজনকেই হারালো। 

সামিহার জ্ঞান ফিরিয়ে দিথী বাড়িতে নিয়ে আসে। এনে তাকে শান্ত করতে করতে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। বড়রা বলেন কান্নার পর ঘুম ভালো হয়। সামিহারও তাই ঘুম তাড়াতাড়ি এসে যায়। তার দাদুর জানাজা দুপুরেই করা হয়। আর দাফন কাফনের কাজও সম্পন্ন করা হয়। 

দিথী এখন ভাবছে সেই বক্স টা নিয়ে। আর কিইবা থাকতে পারে তার ভিতরে ? এটার সাথে কী তাদের স্বপ্নের কোন যোগসূত্র আছে ? 

দিথী বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। গিয়ে বক্স টা নিয়ে আসে। এসে আবার বিছানায় বসে। বক্স টা মাঝারি আকৃতির। দেখতে শক্ত কাঠের তৈরি মনে হচ্ছে।‌ সে বক্সটা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনা। তার মনে পড়ে যায় সামিহার দাদুর কথা এবং ফ্ল্যাসব্যাকে দেখানো হয় সামিহার দাদু বক্স টা দিথীর হাতে দিয়ে বলছেন “এই বক্সটা শুধু তোমারই হাতে খুলবে মা। আর অন্য কারো হাতেই না” আমাদের আবার বর্তমানে আনা হয়। দিথী বক্সটা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে এটা কেনো শুধু আমার হাতেই খুলবে ? সে দেখতে পায় বক্সের সামনে দিকে একটা ফুটো করা। পাশে একটা ছোট বৃদ্ধাঙ্গুলির ছবি।

– এই ফুটোতে বৃদ্ধাঙ্গুল ঢুকিয়ে এই বক্সটা খুলতে হবে নাকি ? 

 

বলেই সে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চেষ্টা করতে যায়। তখনই তার কী যেন একটা মনে হয় আর সাথে সাথেই পাশে শুয়ে থাকা সামিহার হাত টা উঠিয়ে ওর বৃদ্ধাঙ্গুলি ঢুকিয়ে চেষ্টা করতে থাকে বক্সটা খোলার। কিন্তু না। খুলছে না। সে ওর বৃদ্ধাঙ্গুলি টা বের করতে যায়। তখন দেখে বৃদ্ধাঙ্গুলি টা যেন এক প্রকার আটকেই গেছে। সে ভয় না পেয়ে ঠান্ডা মাথায় আস্তে আস্তে সামিহার বৃদ্ধাঙ্গুল টা বের করতে থাকে। এবং একটা পর্যায়ে বের করে ফেলে। তারপর সে বক্সটাকে নিজের কোলের উপর নেয়। নিয়ে তার নিজের হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল টা বক্সের কোটরিতে ঢুকাতে চেষ্টা করে। তার মনে ভয় হচ্ছে।‌ ভিতরে কী আছে তা সে জানে না। যদি খারাপ কিছু থাকে , ! সে সব চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে সড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল টা সেই কোটরিতে ঢুকায় এবং সাথে সাথেই বক্সটার লক খুলে যায়। বক্সের ঢাকনাটা হালকা একটু উপরে উঠে। সেই অল্পটুকু ফাঁক দিয়ে আলো বেড়িয়ে আসতে থাকে বক্সের ভিতর থেকে। সে কাপো কাপো হাতে বক্সের ঢাকানটার ধরে। আর এক টানে উপরে উঠিয়ে খুলে দেয়। আর সাথে সাথেই এক জোড়ালো আলোক রশ্মি বেড়িয়ে আসতে থাকে সেই বক্সটা থেকে। দিথী মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আলোটার তীব্রতা কিছুটা সময় স্থায়ী হয়।দিথী মুখ ফিরায় না। তারপর ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে সেই উজ্জ্বলতা। দিথী এবার বক্সের দিকে ফিরে তাকায়। দেখে একটা ফোম জাতীয় কিছুর উপর একটা আংটি। সাধারণ আংটি গুলার উপরে তো একটা দামী পাথর জাতীয় কিছু বসানো থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই আংটিতে একটা নীল পাথর খোদাই করে একটা ক্ষুদ্র তলোয়ার বানানো হয়েছে আর সেটা আংটিটার মাথায় রয়েছে। সেটা থেকেই আলোক রশ্মি বেড়িয়ে আসছে‌। এখনো জ্বল জ্বল করছে। দিথীর কৌতুহল বেড়ে যায়। সে আস্তে আস্তে হাত বাড়ায়। আংটিটাও যেন তাকে আকর্ষণ করছিলো। দিথী আংটিটা ধরে সেই বক্স থেকে বের করে। আংটির তুলনায় বক্সটা অনেক বড়। একটা গল্পের বইয়ের আকৃতির সমান বক্সটা। কিন্তু ভিতরে শুধু একটা তলোয়ার খচিত আংটি। দিথী সেই আংটিটা বের করে তার মধ্যাঙ্গুলিতে পড়ে নেয়। হঠাৎই সে তার ভিতরে ভিতরে একটা কিছু ফিল করতে থাকে। যেন অবিনশ্বর শক্তি চলে এসেছে তার মাঝে। দিথীর হঠাৎ ভয় লাগতে শুরু করে। যদি আংটিটা তার কোন ক্ষতি করে তাই সে সাথে সাথেই আংটিটা আঙ্গুল থেকে বের করে হাতে নেয়।‌ আংটিটার এক নিজস্ব আকর্ষণীয়তা আছে। যা যে কাউকে কাছে টানবে। দিথী আস্তে আস্তে সেই আংটিটা তার চোখের কাছে আনতে থাকে। খুব মনোযোগ দিয়ে আংটিটাকে চোখের সামনে এনে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। আংটিতে খচিত উজ্জ্বল ছোট তলোয়ার টা দেখতে থাকে। তলোয়ার টাকে দেখে যেনো একদম আসল মনে হচ্ছে। হঠাৎ তার নাম ধরে ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে শেফালী। দিথী এমন হঠাৎ ডাকে চমকে উঠে। এবং সাথে সাথেই তার হাত থেকে আংটিটা বিছানায় পড়ে যায়। দিথী তাড়াহুড়ো করে শেফালির দিকে চেয়ে বক্সটা বন্ধ করে তার হেলান দেওয়া বালিশের পিছনে লুকাতে থাকে। শেফালী দিথীর কাছে চলে আসে। এসে হন্তদন্ত হয়ে বলে।

– আফামনি। খালাম্মা আপনারে ডাকতাছে। নিবিড়ের হঠাৎ কইরা জ্বর আইছে। আপনে একটু তাড়াতাড়ি আহেন।

 

কথা শুনে দিথী কাপো কাপো কন্ঠে উত্তর দেয়।

– ক,কী বলো। জ,জ্বর আসছে। 

– হ। খালাম্মায় আপনারে লইয়া যাইতে কইছে আমারে। তাড়াতাড়ি আহেন।(বলেই তাড়াতাড়ি দিথীর হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকে শেফালী। দিথীও একপ্রকার জোর করেই তার সাথে যেতে থাকে। তার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে সে সেই আংটিটা দেখে ভীত সন্ত্রস্ত। শেফালী, দিথীকে নিয়ে ঘর থেকে চলে যায়। বিছানায় সামিহা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এবং তার হাতের পাশেই চকচক করছে পড়ে থাকা সেই অলৌকিক আংটিটি। 

 

 

সন্ধ্যা নেমেছে।‌ আকাশে পাখিরা ডাকতে ডাকতে তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে দলবেঁধে। গোধূলি আকাশে হলুদ আভা জড়ো হয়েছে। সূটকেসের হাতল আর কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে দুই ধাপ সিড়ি বেয়ে নিচে নামে ফয়সাল। আজ সকালে ঐরকম অবস্থায় চাচির সামনে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই সে একটু ইতস্তত বোধ করছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজই চলে যাবে সিলেটে। গিয়ে আবার হোস্টেলে উঠবে। পড়নে জ্যাকেট। যেহেতু রাতের দিকে শীত পড়ে বেশি, তাই। পিছন থেকে শিউলি বেগম তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– হঠাৎ কইরা চইলা যাইতাছো যে বাজান। কেউ কী তোমারে কিছু কইছে ? 

– ন,না চাচি। তেমন কিছু না। হঠাৎই কলেজে ডাক পড়ছে তো। তাই যাচ্ছি। 

– তোমার চাচার লগে দেহা করবানা বাজান।

– চাচা তো মনে হয় গন্জে আছে। আমি সেখানেই ‌দেখা করে নিবোনে। 

– ভালো কইরা যাইয়ো বাজান। দুগা ভাতও খাইলানা।

– বাইরে খেয়ে নিবো চাচি। আপনি ভালো থাকিয়েন। পরে আবার আসবোনে।

– তুমিও ভালো থাইকো বাজান। ভালা কইরা যাইয়ো।

– আচ্ছা চাচি। আসসালামুয়ালাইকুম,।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম বাজান।

চাচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে থাকে ফয়সাল। চাচিও ঘরের দিকে চলে যান। চাচির কথা শুনে আপনাদের মনে হতে পারে যে চাচি আজ সকালে ফয়সালের মতলব টা বুঝতে পারেননি। আসলে তা নয়। তিনি তো মা। তিনি সব বুঝেন কার মনে কী আছে আর কী থাকলে তার মেয়ের দরজা দিয়ে উঁকি মারতে পারে। কিন্তু ফয়সাল মতিন মেম্বার দের আত্মীয়। মতিন মেম্বারের দুঃসম্পর্কের এক বোনের ছেলে। তাই তাকে ডিরেক্ট কোন কথা বলে লজ্জায় ফেলতে চাননি তিনি। তবে ফয়সালের যাওয়াতে কিন্তু তিনি মনে মনে অনেক খুশি হয়েছেন।

ফয়সাল বাড়ির মূল দরজা দিয়ে বেড়িয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে। আকাশের সূর্য অর্ধেক অস্ত গিয়েছে। আর অর্ধেক ডুবন্ত অবস্থায় রয়েছে। সেই অর্ধেক ডুবন্ত সূর্যের সামনে দিয়ে উড়ে নিড়ে ফিরে যেতে থাকে এক ঝাঁক নাম না জানা পাখি।

 

 

শহুরে কিচেন। একটা মগে চামচ নাড়ছে শাহারিয়া। সেই মগের পাশেই আরেকটা মগ। চামচ দিয়ে নাড়া হয়ে গেলে চামচ টাকে পাশে রেখে মগ দুটো হাতে নিয়ে কিচেন থেকে বেড়িয়ে যেতে থাকে শাহারিয়া। সোফার রুমে বসে আছে আহনাফ। সোফার সামনের টেবিলে কতগুলো ফাইল খোলা অবস্থায় পরে রয়েছে। একটা ফাইল হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে চেক করছে সে।এখন সময় রাত সাড়ে ৭ টা। সুর্য যখন ডুবেছিলো তখন আহনাফ শাহারিয়ার বাসায় এসেছিলো। আহনাফের বসার সোফাটার পাশে একটা টেবিল ল্যাম্প জালানো। ঘরের সব লাইট অন। ঘরে প্রবেশ করলো শাহারিয়া। দু’হাতে দুটো মগ। শাহারিয়া সোফায় গিয়ে আহনাফের পাশে বসে। আহনাফ শাহরিয়াকে দেখে ফাইল টা এক হাতে নিয়ে আরেক হাত দিয়ে শাহারিয়ার কাছ থেকে কফির মগ টা নেয়। শাহারিয়া ওকে কফির মগ টা দিয়ে নিজে ঠিক হয়ে বসে। বসে কফিতে চুমুক দেয়। আহনাফও আরেক হাতে থাকা ফাইল টা দেখতে দেখতে কফিতে চুমুক দেয়। শাহারিয়া বলে। 

– এই কফিটুকুই আরকি আমার দারা ভালো বানানো সম্ভব। নাহলে যাই বানাতে বা রাঁধতে যাই সব উল্টাপাল্টা হয়ে যায়, পুড়ে যায়। হিহিহি। (কফিতে চুমুক দেয় শাহারিয়া)

– না স্যার, কফিটা আসলেই ভালো হয়েছে। থ্যাংকস ফর দিস।

– ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। (একটু থেমে একটা চুমুক দিয়ে) আচ্ছা আহনাফ, তোমার ফ্যামিলি নিয়ে তো জানা হলো না। কে কে আছে তোমার বাসায়, ?

 

আহনাফ ফাইল থেকে মুখ উঠিয়ে ধীর গলায় বলে।

– এখানে আমি আমার মায়ের সাথে থাকি। বাবা নেই। ছোট বেলায় বাবা আমার মা’কে ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে মা’ই আমাকে একলা হাতে বড় করছেন। আমার বাবাকে আমি আজও নিজের চোখে একটা বার দেখতে পারিনি (বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহনাফ)

– তোমার বাবা তোমাদের ছেড়ে কোথাও চলে গেছেন ? 

– হ্যা,। মায়ের মুখে শুনেছিলাম উনারা অনেক বড় লোক ছিলেন। আমার মায়ের সাথে ধুমধাম করে বিয়েও হয়েছিলো। হঠাৎ ৪ বছর পর আমার মা’কে ফেলে তিনি চলে যান। কেনো চলে গিয়েছিলেন তা জানতে পারিনি। তবে হ্যা, এটা জানি আমার বাবা আমার মা’কে ভালোবাসে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু হঠাৎ কী হয়েছিল তাদের মাঝে তা আমার মা আজও আমাকে বলেননি। 

– ওহহ, সরি আমি আসলে না জেনে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। সরি। 

– না না স্যার ইটস ওকে। (বলেই আবার ফাইলের দিকে তাকায় আহনাফ)

– এখন কী তুমি তোমার মায়ের সাথে ঢাকাতেই থাকো ? 

– হ্যা স্যার। ঢাকাতেই একটা ফ্ল্যাটে থাকি আমরা। মায়ের কাপড়ের ব্যবসা আছে। শুনেছিলাম, আমি ছোট থাকতে তিনি একটা টেইলার্সের দোকান দিয়েছিলেন। তা থেকেই সংসার চালাতেন। আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিধি বাড়ান। এখন লতিফা মার্কেটে আমাদের ৫ টা কাপড়ের দোকান আছে। সেই বিজনেস দিয়েই এখন সংসার চলছে। আর তার মাঝেই হঠাৎ আমার গোয়েন্দা পদে চাকরি। এই নিয়েই চলছে আরকি।(বলেই কফিতে চুমুক দেয় আহনাফ)

– তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায় ? 

– স্যার আমাদের দেশের বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার হরীষপুর গ্রামে। আমার নানা-নানু নেই। বসতভিটা টাও ২ বছর আগে মা বিক্রি করে দিয়েছেন।

– তোমাদের বাসা হরিশপুরে , ? আমার গ্রামের বাড়ি তোমাদের পাশের গ্রাম আনন্দপুরেই , ! তুমি তো তাইলে আমাদের দেশী মানুষ। 

– স্যার আপনার গ্রামের বাসা আনন্দ পুরে ? কাকতালীয় ভাবে তাইলে আমাদের গ্রাম একই উপজেলায়। আবার পাশাপাশিও , ! 

– হ্যা। কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। গ্রামে যাওয়া হয়না এখন আর ? 

– ঐযে স্যার বললাম। ২ বছর আগে মা বসতভিটা বিক্রি করে দিয়েছে। আমি জন্মের পর কখনো গ্রামে যাইনি। মা একাই যেতো। আমাকে নিয়ে যেতে বললে নিতো না। খালামনির কাছে রেখে যেতো। আনন্দপুর আর হরিশপুর এর ব্যাপারে আমি শুধু আমার খালামনির কাছ থেকে শুনেছি। মা এই বিষয়ে আমার সাথে কোন কথা বলেনা না কেনো জানি। (বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহনাফ)

– আচ্ছা সমস্যা নেই আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। এরপর যখন আনন্দ পুরে যাবো, তোমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে ঘুড়িয়ে আনবো। ঠিক আছে , ! 

– সত্যি স্যার , ! থ্যাংকিউ স্যার। থ্যাংকিউ।

– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তো এখন বলো অপারেশন ব্ল্যাক ওয়ার সম্পর্কে কী কী ইনফরমেশন কালেক্ট করেছো ? রন্জু সম্পর্কে কী কী তথ্য পেয়েছো ? 

– স্যার ব্ল্যাক রন্জুর চ্যাপ্টার টা শুরু হয় চট্টগ্রাম বাঁশখালীর এর ২ টো মেয়ে ওধাও হওয়ার মধ্য দিয়ে। মেয়ে দুটোর পরিবার হয়তো ভেবেছিল যে হারিয়ে গিয়েছে কিংবা কেউ কিডন্যাপ করেছে এবং পরবর্তীতে মুক্তিপণ চাইবে। কিন্তু ২ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। তারা লোকাল থানায় এই নিয়ে স্বাধারণ ডায়রি করে। পুলিশ এইটা নিয়ে তদন্তে নেমেছিলো কিন্তু কোন কুলকিনারা করতে পারেনি। পরে যখন তারা সেই মেয়ে দুটোর নাম্বার লিস্ট চেক করে তখন তারা একটা আননোন নাম্বার থেকে একটা মেসেজ দেখতে পায়। মেসেজ টা কিছুটা এমন ছিলো ” তুমি আমাদের প্রজেক্টের জন্য সিলেক্ট হয়েছো। প্রস্তুত থেকো।” তারপর কিছুটা স্পেস দিয়ে নিচে লেখা “ব্ল্যাক রন্জু”।

– পুলিশ যেই নাম্বার টা থেকে ঐ মেসেজ টা আসছিলো সেই নাম্বার টা ট্র্যাক করেনি পরে ?

– হ্যা স্যার করেছিলো। কিন্তু সেটার লোকেশন একবার সুইজারল্যান্ড দেখাচ্ছিলো একবার কানাডা একবার চীন মানে মিনিটে মিনিটে লোকেশন চেঞ্জ হচ্ছিলো এবং সব লোকেশনই দেশের বাইরের।

– ইন্টারেস্টিং, ! রন্জু তারমানে আটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছে , ! তারপর ? তারপর তার দ্বিতীয় কেস কী ছিলো ? 

– স্যার দ্বিতীয় কেস টা ছিলো খুলনায় বটখিল বাজার নামক একটা যায়গায়। এই খানে একসাথে ৪ টা মেয়ে একপ্রকার উধাও ই হয়ে যায়। তাদেরও কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। তাদের পরিবার প্রথমে এটাকে স্বাধারণ কিডনাপিং কেস ভাবলেও পরে ৩ দিন যাওয়ার পরও যখন তারা তাদের মেয়ের কোন হদিস পায়নি তখন তারা পুলিশের সাহায্য নেয়। পুলিশ খুজাখুজি করে কোন কুলকিনারা করতে পারেনি। পরে তখন তাদের ৪ জনেরই ফোন চেক করলে দেখা যায় তাদের নাম্বারেও ঠিক সেইম মেসেজ টাই এসেছিলো যেটা আগের চট্টগ্রাম বাঁশখালীর কেস টাতে ব্ল্যাক রন্জু পাঠিয়েছিলো। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই মেয়ে গুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

– কত বছর আগের ঘটনা এগুলো ?

– স্যার ঘটনার গুলোর‌ শুরু ৮ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালের জুলাই মাস থেকে। এরপর হাজার হাজার মেয়ে এভাবে গুম হয়েছে। পুলিশ কোন কুলকিনারাই করতে পারেনি।

– মেয়েগুলোর বয়স কত ছিলো ? মানে গড় বয়স কত হতে পারে ? 

– স্যার সব গুলো মেয়ের বয়সই ১৬-১৮ এর মধ্যে। এর চেয়ে বেশি বা কম বয়সী মেয়ে কিডন্যাপ হয়নি।

– হমম, আচ্ছা হেডস্যার বলছিলো আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ৪ জনকে রন্জুকে ধরার জন্য পাঠানো হয়েছিলো , ! ওরা কী ইনফরমেশন পাঠিয়েছিলো ? 

– স্যার ওরা যাওয়ার পর আর কোন ইনফরমেশন পাঠাতে পারেনি। তবে আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক চাক্ষুষ ইনফরমার ব্ল্যাক রন্জুর দেখা পেয়েছিলো।

– বলো কী , ? তারপর ? 

– স্যার সেই ইনফরমার দাবি করেছিলো একটা নীল কালারের মাইক্রোতে করে সে কিছু মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতে দেখেছিলো। তারপর সে সেটার ফলো করে। ঘটনাটা ঘটেছিলো বগুড়ায়। সেই মাইক্রো টা গিয়ে একটা বড় বাড়ির ভিতরে চলে গিয়েছিলো। আমাদের ইনফরমার সেই বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারেনি। মেয়েগুলো কে রাত ৮ টা কী ৯ টা হবে, এমন সময় কিডন্যাপ করা হয়েছিলো। আমাদের ইনফরমার সেই বাড়ির পাশেই একটা যায়গায় লুকিয়ে নজর রাখতে থাকে। আস্তে আস্তে সম বয়সী পেড়িয়ে যায়। হঠাৎ রাত ১ টার দিকে একটা বড় কন্টেনার ট্রাক আসে। এসে সেই বাড়িটার সামনে ‌দাড়ায়। ও হ্যা একটা কথা স্যার, আমাদের সেই ইনফরমার একজন মেয়ে ছিলো। সে দেখলো বাড়ির গেইট খুলে কিছু কালো কাপড় পরা, মাস্ক পরা ছেলে বের হয়ে আসে। কাঁধে বন্দুক ঝোলানো। তারা সেই ৩ তলা বাড়ির ভিতর থেকে লাইন করে একের পর এক মেয়েদের চোখ বেঁধে নিয়ে আসছিলো এবং ট্রাকের কন্টিনারে উঠাচ্ছিলো। মেয়েগুলো কাদছিলো। তাদের কে সেই কন্টিনার টায় উঠানোর সময় আমাদের ইনফরমারও চুপিচুপি গিয়ে সেই লোকদের চোখ এড়িয়ে সেই মেয়ে গুলোর লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। নিজের ওড়না দিয়ে চোখ বেঁধে নেয়। তাকে দেখে এক গার্ডের সন্দেহ হয়। গার্ড তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে থামায়। তখনই অন্য একজন গার্ড এসে তাকে কী জানি বলে ভিতরের দিকে নিয়ে যায়। ফলে সেই যাত্রায় আমাদের সেই ইনফরমার বেঁচে যায়। তারপর তিনিও কন্টিনার ট্রাকে উঠে পড়েন সব মেয়েদের সাথে। সেখানে বলে ১০০-১৫০ মেয়ে ছিলো। সবার চোখ আর হাত বাঁধা ছিলো। আমাদের ইনফরমার নিজের হাত রুমাল দিয়ে বাঁধার মতো করে পেঁচিয়ে ধরে ছিলো। তাই বাকি গার্ডদের চোখে পড়েনি। গাড়িটা চলতে শুরু করে। এবং গাড়িটা অনেকক্ষণ চলার পর একটা যায়গায় থামে। তাদের কে বের করে আনা হয় কন্টিনার থেকে। চোখ বাঁধা ছিলো তাই আমাদের ইনফরমার জায়গাটা ‌দেখতে পায়নি। তারপর তাদেরকে একটা যায়গায় নিয়ে রাখা হয়। একটা বদ্ধ ঘরে। তাদের সেখানে দেখাশোনা করা হতো এবং প্রতি রাতে ৫ জন মেয়েকে কোথায় জানি নিয়ে যাওয়া হতো। একদিন আমাদের ইনফরমার কেও ‌সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। একটা অপারেশন রুমের মতো ছিলো বলে সেই রুম টা। তারপর সে সেখানে গিয়ে দেখে রন্জু আসলে মেয়েদের কিডনাপ করে করেটা কী।

– রন্জূ কী করতো সেইসব মেয়েদের দিয়ে ? 

– সেইসব মেয়েদের শরীর থেকে সব অর্গান বের করে নিতো। আর তারপর সেই মৃতদেহ গুলো কোথায় জানি ফেলে দিতো। আমাদের ইনফরমারই একজন যে রন্জূকে সামনাসামনি দেখে ছিলো। কালো বুট , কালো ফরমাল প্যান্ট, আর কালো হুডি পড়া। হুডির টুপি টা দিয়ে অর্ধেক মুখ ঢাকা থাকতো। শুধু তার ঠোট দুটো দেখা যেতো। 

– আমাদের সেই ইনফরমার এখন কই ? 

– স্যার, (ধীর গলায়) তাকেও মনে হয়,(এক মলিন চেহারা নিয়ে শাহারিয়ার দিকে তাকায় আহনাফ)

– মনে হয় মানে ? সেও যদি মারা যায় তাইলে এই তথ্য গুলো আমাদের পর্যন্ত কীভাবে আসলো ? 

– আসলে স্যার। ঐ অপারেশন এর মতো রুমটায় রন্জূ তাদের ৫ জনকে দেখে চলে যাওয়ার পর পরই ৫ জনের মধ্যে থেকে একজন মেয়ের অপারেশন শুরু হয়। আমাদের ইনফরমার এর কাছে একটা ছোট বাটন সেট ছিলো। সেটা দিয়ে সে লুকিয়ে সেই ঘরে থেকে সব মেসেজ করে পাঠিয়েছিলো প্রথম থেকে এপর্যন্ত ঘটা সবগুলো ঘটনা। ঘরের বেশিরভাগ যায়গাই বলে অন্ধকার ছিলো তাই সে অন্ধকারের দিকটায় গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পেরেছিলো মেসেজ টা পাঠাতে। নাহলে হয়তো,(শাহারিয়ার দিকে তাকিয়ে) এসব সম্পর্কেও আমরা জানতে পারতাম না। 

– তারপর, ? তারপর আর কোন মেসেজ আসেনি ? 

– না স্যার। আর কোন মেসেজ আসেনি সেই নাম্বার থেকে। 

– নাম্বার টা কোথায় লোকেট করেছিলো ? কোন যায়গা ? সেটা বের করলেই তো আমরা রঞ্জুর ঠিকানা পেয়ে যাবো। 

– আসলে স্যার। তার ফোন নাম্বার টার লোকেশনও দেশের বাইরে দেখাচ্ছিলো। এবং বার বার চেন্জ হচ্ছিলো।

– কতদিন আগের ঘটনা এটা ? 

– এইতো স‌্যার, ফাইলে লেখা ৩ মাস। 

– ৩ মাস। (একটু থেমে কিছু ভেবে) আচ্ছা এখনো কী তার ফোন থেকে লোকেশনের সিগন্যাল টা আসে ? 

– হ্যা স্যার। আজও আমি আমাদের আইটি ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে চেক করেছি। আজও নাম্বার টা কোন ফোনে ঢুকানো। তবে ফোন দিলে রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না। হয়তো স্যার ফোন টা সাইলেন্ট ‌ই পড়ে ছিলো আর ইনফরমার সেটা ঘরের কোন অন্ধকার কোনে লুকিয়ে রেখেছিলো যাতে আমরা তা ট্রেস করে তাকে বাঁচাতে আসি। কিন্তু আমরা আর তাকে বাঁচাতে পারলাম না। (বলেই মাথা নিচু করে ফেলে আহনাফ)

শাহারিয়া উঠে দাঁড়ায় সোফা থেকে। উঠে পায়চারি করতে থাকে ঘরের মধ্যে। তারপর কিছুক্ষণ ভাবার পর বলে।

– আচ্ছা আহনাফ একটা বাটন ফোন মানে সবচেয়ে ছোট সাইজের বাটন ফোনের ব্যাটারি কত ক্যাপাসিটির হতে পারে ? 

– উমম , এই ধরুন ১০০০ এম এ এইচ। হাইয়েস্ট হইলে ২০০০ এম এ এইচ। এর চেয়ে বেশি হইতে পারে না।

– আচ্ছা। আর তুমি জানি কী বললা সে কবে এই মেসেজ টা পাঠিয়ে ছিলো ? 

– ৩ মাস আগে স্যার।

– নাম্বার টা কী তারই ছিলো ? মানে সেটা অফিস থেকে দেওয়া নাম্বার ছিলো ? 

– হ্যা স্যার।

– আচ্ছা মেসেজ টা কী আসার সাথে সাথেই অফিস থেকে চেক করা হয়েছিলো ? 

– স্যার ফাইলে ‌লেখা রিসিভ করার ৩ দিন পর চেক করা হয় মেসেজ টা।

– তিন দিন আগে নাম্বার টা কোথায় ছিলো তা ট্রেস করা যায়নি ? 

– না স্যার। সেটা কেনো জানি সিম কম্পানি ট্রেসই করতে পারছেনা। আর আমাদের আইটি বিভাগেরও কিছু করার নেই। সিম ট্রেস করার দিকটা সিম কম্পানির দাড়াই করানো হয়।

 

শাহারিয়া এবার আবার চুপ হয়। রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে।‌তারপর আহনাফের বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলতে থাকে‌।

– উমম, রন্জু আমাদের সাথে একটা সুন্দর মাইন্ড গেইম খেলছে। তিন মাস পর্যন্ত কোনভাবেই সেই ছোট ফোনে চার্জ থাকা সম্ভব না। সে যতই ফেলে রাখা ফোন হোক না কেনো। রন্জু সেই ফোনটা পেয়েছে। পেয়েছে বলতে সে জানতো আমাদের ইনফরমার তার সাথে চুপিচুপি গিয়েছে। 

– সে জানতো ? কিন্তু কীভাবে স্যার ? 

– ইনফরমার ওর মেসেজের মাঝখান টায় বলছিলো ওকে একটা গার্ড আটকেছিলো সন্দেহ করার কারণে, ঠিক তখনি আরেকটা গার্ড এসে প্রথম গার্ডটাকে ভিতরে নিয়ে যায়। আমি যদি এখন বলি রন্জুই দ্বিতীয় গার্ড টাকে বলছিলো প্রথম গার্ডকে নিয়ে আসতে আমাদের ইনফরমারের সামনে থেকে  ? 

– রন্জু বলছিলো ? মানে কী ? রন্জু যদি জানেই থাকে যে সে গোয়েন্দা সংস্থার ইনফরমার তাহলে তো তাকে যায়গায় মেরে ফেলার আদেশ দিতো। তাকে আরো সুযোগ কেনো দিলো ?

– এইটাই তো বুঝলেনা আহনাফ। রন্জু তো এটাই চাইছিলো। দেখো। প্রথমত, রন্জু যেখান থেকে এতো গুলা মেয়েদের গাড়িতে উঠায়। মেয়েদের কিডনাপ করে আনে রাখে সেখান টা নিশ্চয়ই সাদামাটা ভাবে সে রাখবেনা, ! সেখান টা সম্পূর্ণ সিসিটিভি ক্যামেরা দাঁড়া সিকিউর ছিলো। আর তা উপরের কোন তালা থেকে সচোখে দেখছিলো রন্জু। আর এতো গুলা গার্ড কে সে ফাঁকি দিয়ে মেয়েদের লাইনে ‌দাড়াতে পারলেও সিসি ক্যামেরার পাখির মতোন চোখ কে তো আর ইনফরমার ফাঁকি দিতে পারেনি। রন্জু তাকে দেখেছিলো। এবং সে চাইছিলোও যে আমাদের ‌ইনফরমার এইটা করুক। তাকে সামনাসামনি ইনফরমার দেখুক। তাই যখন একটা গার্ড তাকে সন্দেহ করে এগিয়ে আসতে থাকে তখনই রন্জূ আরেকটা গার্ডকে আদেশ দেয় প্রথম গার্ড টাকে ইনফরমারের সামনে থেকে নিয়ে আসতে। আর দ্বিতীয় গার্ড তাই করে।

– কিন্তু স্যার ও কেন চাইবে যে আমাদের ‌ইনফরমার তার দেখা পাক ?

– ও এজন্যই ‌চাইবে কারণ ওর বর্ণনা, ওর করা কাজ সম্পর্কে যেনো আমরা জানতে পারি আর তাকে ধরার অনেক চেষ্টা করি। আর তখনই ও আমাদের তখন ঘোল‌ খাইয়ে ছাড়বে আর খাইয়েছেও। পুলিশ , ডিবি তো কিছুই করতে পারেনি উল্টো আমাদের ৪ জন টিম মেম্বারস কে ও ফ্রি ফ্রি পেয়ে গেছে অর্গান বের করে ফেলার জন্য। 

– তারমানে ও নিজের জন্য অন্য মানুষকে খাটতে দেখতে ভালোবাসে ? অন্যের চোখে তাঁর জন্য ভয়, টেনশন তার পছন্দের? এইজন্যই ও আমাদের ইনফরমারকে তার ডেরা পর্যন্ত পৌছাতে দিয়ে সচোখে দেখালো এবং তার মাধ্যমে আমাদের জানালো যে ও কত বড় একটা কালোবাজারির সাথে জড়িত। আর ওর ক্ষমতা কতটুকু, !

– হ্যা। এবার তুমি ধরতে পেরেছো। ও নিজের কাজ কে ভাইরাল করতে চেয়েছিলো। এবং আমি নিশ্চিত ইনফরমার এর ফোন টা রন্জু পেয়েছে এবং সেটা থেকে সিম বের করে তার কোন ডিভাইসে লাগিয়ে রেখেছে যাতে লোকেশন এখানে,সেখানে দেখায়। এর মানে কী বুঝতে পারছো আহনাফ ?

– রন্জু সব জানতো আর মেসেজ যে করেছে তাও জানতো। কিন্তু এখানে আমার তো কিছু চোখে পড়ছে না যেটা দিয়ে আমরা তাকে ধরতে পারবো ? 

– এইযে। তুমি দেখি গোয়েন্দার মূলমন্ত্র টাই ভুলে গেছো। চোর চুরি করার সময় কোন না কোন ভুল করবেই। যতই সে চালাক চোর হোক না কেনো।

– কিন্তু ‌রন্জুর তো কোন ভুল আমার চোখে পড়লো না ? 

– রঞ্জু কিন্তু প্রথমে এই জিনিসটা মাথায় আনেনি যে ইনফরমার কে সে মেরে ফেলবে। সে চেয়েছিলো ইনফরমার কে সে খুব খারাপ ভাবে আহত করে ছেড়ে দিবে, যাতে তার কথা গুলো শুধু ইনফরমার আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু আমাদের ‌ইনফরমারের কাছে যে ফোন ছিলো তা সে জানতো না। বগুড়া থেকে ইনফরমার কন্টিনার ট্রাকে করে যেখানেই গেছে সেটার লোকেশন কিন্তু সিম কম্পানির কাছে আছে। আর যখন পর্যন্ত না ইনফরমার আমাদের মেসেজ পাঠায় ততক্ষণ পর্যন্তও রিয়েল লোকেশন ছিলো আর রন্জুও বিষয় টা জানতো না।‌ তারপরে যখন তাকে সিম কম্পানি থেকে জানানো হয় যে তার লোকেশন থেকে বাইরে একটা মেসেজ গেছে। তখনই সে বুঝতে পারলো ইনফরমার এর কাছে যে ফোনও থাকতে পারে সেই বিষয় ‌টা সে ভুলেই গিয়েছে। আর সাথে সাথে সে ইনফরমার কে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় আর ফোনের সিমটাকে খুলে বের করে তার লোকেশন চেন্জার ডিভাইসে লাগিয়ে রাখে। আর সিম কম্পানিকেও বলে দেয় সেই ৩ দিনের লোকশন আমাদের না দিতে আর পরবর্তী তার ডিভাইস থেকে যাওয়া ফেইক লোকেশন  এর রিপোর্ট আমাদের ডিপার্টমেন্টকে‌ দিতে। আর এভাবেই সে তার ভুল লুকানোর চেষ্টা করেছে। মানে এককথায় শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছে সে, বলতে পারো আরকি।

– তারমানে স্যার, এইসব কিছুর সাথে সিম কম্পানিও জড়িত ? আমরা তাদের কখনোই সন্দেহ করবোনা। সেইজন্য তাদের মাধ্যমেই রন্জু আমাদের ঘোল খাইয়ে দিলো , ! (একটু থেমে) আচ্ছা স্যার, মেসেজে যে বগুড়া জেলার কথা বলা হয়েছে সেটাও কী ফেইক ? 

– না । কারণ আমাদের ইনফরমার বগুড়া শহরে কাজ করতো আর মেসেজ তো সিম কম্পানি ইডিট করতে পারবেনা। তবে ইনফরমার ‌কিন্ত সেই বাড়ির ঠিকানা টা জানতো না। কারণ সে তো খালি ঐ মাইক্রো টার পিছু নিয়েছিলো। সেটা বগুড়ার কোথায় থেমেছে তা রাতে সে বুঝতে পারেনি। আর সেই সুযোগ টা কাজে লাগিয়ে ‌রন্জু সিম কম্পানির মাধ্যমে বগুড়া শহরের একটা ফেইক লোকেশন দিয়েছে আর পরবর্তীতে সেই ইনফরমার এর খোঁজে যখন আমাদের ডিপার্টমেন্টের ৪ জন  লোক গেলো তাদেরকেও সেখান থেকে কোনভাবে কিডন্যাপ করে ‌নিয়ে চলে গেছে, ! সিম্পল,! রন্জু কিন্তু মোটেও কাঁচা খেলোয়াড় না , !

– তারমানে,

– তারমানে আমাদের এখন টার্গেট হচ্ছে সেই সিম কম্পানি। ফাইলে দেখোতো সিম টা কোন কম্পানির ? 

 

আহনাফ সাথে সাথেই ফাইল টা হাতে নেই। তাড়াতাড়ি চেক করে উৎসুক মুখ নিয়ে বলে

– স্যার , ইনফরমারের ব্যবহৃত সিম কম্পানিটা বাংলালিংক, ! 

 

শাহারিয়া আহনাফের বিপরীতে ফিরে। হাত দুটো ট্রাউজারের পকেট থেকে বের করে, একসাথে করে বুকের উপর রেখে বলে।

– কাল সকালে আমাদের গন্তব্য হলো বাংলালিংকের মেইন অফিস কার্যালয়, ! 

 

 

মেইনরোড, দু’পাশে সাড়ি সাড়ি হয়ে চলে গেছে লম্বা লম্বা গাছ। ফয়সাল রোডের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আশপাশে অনেক কুয়াশা, রাস্তায় কোন গাড়িই দেখা যাচ্ছে না। ফয়সাল মেম্বার বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো তার আনন্দপুরেরই এক বন্ধুর বাসায়। সেখান থেকে বের হতে বের হতে দেরি হয়ে যায় তার। সে গন্জের দিক দিয়ে মেইন রোডে উঠেনি। তার বন্ধুর বাড়ির রাস্তা থেকেই একটা রাস্তা এসে বড় রোডে মিলেছে। সেই রাস্তা দিয়েই এসেছে সে। মাঝে মধ্যে দু একটা ঢাকা গামি নাইট কোচের দেখা মিলে রাস্তায় কিন্তু সেগুলো রাস্তা থেকে যাত্রীই নেয়না। তাই সে উঠতেও পারেনি। সে হেঁটে হেঁটে মেইন রোডের পাশ দিয়ে অনেকটা রাস্তা সামনে এগিয়ে এসেছে। আশেপাশে দূর দূরান্ত পর্যন্ত বাড়ির তো কোন চিহ্নই নেই। শুধু রাস্তার দুইপাশে সাড়ি সাড়ি বড় বড় গাছ। আর সেই সাথে কনকনে ঠান্ডা। হাত উঠিয়ে হাত ঘড়িতে দেখে রাত সাড়ে ১১ টা বেজে গেছে। এসময় সে কী গাড়ি পাবে ? দূরদূরান্ত পর্যন্ত খালি ফাঁকা রাস্তা। ফয়সাল দুটো জ্যাকেট পড়েছে তাও শীতে কাঁপছে।‌ শীত তার শরীরকে যেন বরফে জমিয়ে দেওয়ার ঠিকাদারি পেয়েছে।‌ রাস্তায় এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। পাশে বড় ব্যাগ টা। আর কাঁধে একটা ব্যাগ ঝোলানো।  তখনই আমরা দেখতে পাই তার থেকে কিছুটা পিছনে একটা মোটা তেঁতুল গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন। তারা এক নাগাড়ে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আপনি যদি একরম একটা পরিস্থিতিতে হতেন আপনার কতটা ভয় লাগতো ভাবুন একবার , ! লোক দুটো কিছুক্ষণ পর হঠাৎ নড়ে উঠে। একে অপরের দিকে ফিরে কথা বলতে শুরু করে। 

– তোর কিতা মনে হইতাছে ? মাল ডার‌ ধারে টাকা পয়সা থাকবোতো ? 

– আরে হ হ। দেহস না লগে বড় ব্যাগও আছে। নিশ্চিত শহুরে পোলা। এই মুরগি ডারে আজকে ধরতে পারলে আমরা দুইডা লালে লাল হইয়া যামু, কী কস, !

– হ চান ভাই। আইজ এই শীতের রাইতে এই মাল ডার পিছু নেওয়া তাইলে সার্থক হইবো , হাহা,

– এই চুপ(যে হাসছিলো তার মুখ চেপে ধরে অন্যজন) 

– কে ওখানে ? আমি বলছি কে ওখানে ? 

– দেখছোস ? মালডায় বুইজ্যা গেছে। তাড়াতাড়ি ল, অয় ভাইগা যাওয়ার আগেই ওর থে সব লইয়া লই।

বলেই দুইজনেই যখনই গাছের আড়াল থেকে বের হতে যাবে দেখে ফয়সাল তাদের দিক থেকে রাস্তার দিকে চেয়েছে। তারাও রাস্তার দিকে ফিরে তাকায়। দেখে একটা গাড়ি আসছে। তারা আবার গাছের আড়ালে চুপচাপ লুকিয়ে পড়ে এবং দেখতে থাকে সবকিছু। 

ফয়সাল দেখে কুয়াশার চাদর ভেদ করে হেডলাইট জ্বালিয়ে তার দিকে আসছে একটা গাড়ি। কিছুটা কাছে আসার পর সে বুঝতে পারে এটা একটা মাইক্রো। ধূসর রঙের মাইক্রো। সে লাফিয়ে লাফিয়ে হাত নাড়তে থাকে। চিৎকার করে বলতে থাকে সেই মাইক্রো টাকে থামতে। মাইক্রো টা তার কাছাকাছি আসার পরই স্পিড স্লো করতে থাকে। এবং তার সামনেই থামায়। ফয়সাল বেশ খুশি হয় যে সে এবার বাসা যেতে পারবে তাহলে। সে এগিয়ে গিয়ে মাইক্রোটার সামনের একজনের সাথে জানালা দিয়ে কিছু বলতে থাকে। এদিকে গাছের আড়াল থেকে চোর দুইটা সব দেখছে। ফয়সাল গাড়ির সামনের দিকের লোকটার সাথে জানালায় কথা বলতে থাকে। হঠাৎ গাড়ির পিছনের দরজা মেলে দিয়ে মাইক্রো থেকে ৪-৫ জন লোক নামে। ফয়সাল মাথা ঘুরিয়ে তাদের দেখে কিছু বলতে যাবেই সাথে সাথে ৪ জন লোক তাদের পকেট থেকে বন্দুক বের করে ফয়সালের মাথা উদ্দেশ্য করে একের পর এক গুলি চালাতে থাকে। তারা তার মুখে অনবরত গুলি করতে থাকে। ফয়সাল কিছু বলার সুযোগ পাওয়ার আগেই তার ঝাঝড়া হওয়া মুখমন্ডল সহ দেহটা মাটিতে ধপ করে পড়ে যায়। ফয়সাল মারা গেছে তারপরও লোক গুলো অনবরত তার মুখে, চোখে মাথায় গুলি করতেই থাকে। ৪ জন মিলে এক নাগাড়ে প্রায় ২৫-৩০ রাউন্ড গুলি চালিয়ে ফেলেছে। তারপর সেই মুখোশ পড়া লোকদের মধ্যে দুইজন ফয়সালের মৃতদেহটাকে টেনে রাস্তার মাঝখানে আনে। এবং একদম চিত করে রাস্তার মাঝখানে তাকে শুইয়ে দেয়। চারপাশ নিরব হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। শুধু শোনা যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। সেই ৪ জন গাড়িতে উঠে পড়ে। তবে মাইক্রো এর দরজা লাগায় না। তারপর মাইক্রোটা কিছুটা ব্যাকে যায়। জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে ড্রাইভার ফয়সালের লাশ টা দেখে ঠিক সেই লাশটার মুখের উপর দিয়ে চাকা তুলে দেয়। ঝাঝড়া হওয়া মুখের উপর দিয়ে গাড়িটা একবার সামনে আগায়। আবার পিছনে ব্যাক দিয়ে পিছিয়ে আসে। ঠিক মুখ টার উপর দিয়ে চাকা উঠিয়ে নিয়ে আসে গাড়িটাকে ড্রাইভার নিজ হাতে। এভাবে কয়েকবার খালি তার মুখের উপর দিয়ে চাকা চালিয়ে দেওয়ার কারণে তার পুরো মাথা থেঁতলে যায়। চোখ, মস্তিষ্ক সব রাস্তার সাথে পিষে যায়। এভাবে কয়েকবার করার পর গাড়ির পিছন থেকে আবার ৪ জন নামে। দুইজন সেই ব্যাগ গুলোকে গাড়িতে তুলে আর দুজন দুটো কোদাল নিয়ে ফয়সালের পিষে যাওয়া মাথার বিভিন্ন অংশ গুলোকে ছেঁচে ছেঁচে পাকা রোড থেকে তুলতে থাকে। পিছনের দুইজন ব্যাগ রেখে দিয়ে এসে ফয়সালের মাথা ছাড়া বডি টাকেও নিয়ে যায়। কোদাল হাতে দুজন রাস্তার সাথে লেগে থাকা মাথার পিষে যাওয়া অংশটুকু কোদাল দিয়ে টেনে একটা বস্তার ভিতর ঢুকায়। ঢুকিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। আর বাকি দুজন গাড়ির ভিতর থেকে দু বালতি পানি এনে রোডের উপর থেকে সব রক্ত আর পিষে যাওয়া লেগে থাকা মাংস টুকু পরিষ্কার করতে থাকে। এতো তাড়াতাড়ি তারা কাজ গুলো করছে যেনো তারা খুবই দক্ষ এই কাজে। পাকা হাতের সহীত কাজ গুলো করলো। পরিষ্কার শেষে লোকদুটো গাড়িতে উঠে দরজা লাগিয়ে দেয়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত বেগে সেখান থেকে ছুটে চলে যায়। গাছের আড়াল থেকে সব টুকু দেখে সেই দুটি চোর। আশপাশ একদম নিরব হয়ে যায়। চারপাশে শুনশান। শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। দূরে কোথাও পেঁচার ডাক শোনা যায়। যেন সে এই নিরব প্রকৃতিতে একটু আগে ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ংকর ঘটনার নিদারুণ সাক্ষি হিসেবে নিজেকে জানান দিচ্ছে। 

 

চলবে ,,,,,

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩২

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া 

 

কোদাল হাতে দুজন রাস্তার সাথে লেগে থাকা মাথার পিষে যাওয়া অংশটুকু কোদাল দিয়ে টেনে একটা বস্তার ভিতর ঢুকায়। ঢুকিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। আর বাকি দুজন গাড়ির ভিতর থেকে দু বালতি পানি এনে রোডের উপর থেকে সব রক্ত আর পিষে গিয়ে লেগে থাকা মাংস টুকু পরিষ্কার করতে থাকে। এতো তাড়াতাড়ি তারা কাজ গুলো করছে যেনো তারা খুবই দক্ষ এই কাজে। পাকা হাতের সহীত কাজ গুলো করলো। পরিষ্কার শেষে লোকদুটো গাড়িতে উঠে দরজা লাগিয়ে দেয়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত বেগে সেখান থেকে ছুটে চলে যায়। গাছের আড়াল থেকে সব টুকু দেখে সেই দুটি চোর। আশপাশ একদম নিরব হয়ে যায়। চারপাশ শুনশান। শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। দূরে কোথাও পেঁচার ডাক শোনা যায়। যেন সে এই নিরব প্রকৃতিতে একটু আগে ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ংকর ঘটনার নিদারুণ সাক্ষি হিসেবে নিজেকে জানান দিচ্ছে। 

 

 

বেলকনির গ্লাসের দরজার উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দিলো তানিয়া। এক টুকরো সোনালী রোদ্দুরের আভা এসে পড়লো তার অমলিন মুখটায়। অতঃপর হাত দিয়ে চোখের উপরে পড়া সেই রোদ্দুর কে থামানোর এক ব্যার্থ চেষ্টা। ব্যালকনির গ্লাস দরজাটা খুলে দিল তানিয়া। নাইট ড্রেসে ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে বেলকনির রেলিং ধরলো সে। চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। নিচের রোডে মানুষের কর্মব্যস্ত সময় পাড় , ফেড়িওয়ালার হাঁক, সাথে গাড়ির চলাচলে এক কোলাহলময় অবস্থা। অমলিন মুখ খানি উপরের দিকে উঠায় তানিয়া।

ঐ দূরের উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য উঠেছে। শীতের মাঝেও জানান দিচ্ছে তার শক্তির। পাহাড়ের চূড়ায় থাকা মেঘ গুলো যেন অনেকদিন পর বেরোনো সূর্য কে আগলে ধরে রেখেছে। তানিয়া ঘুমের শরীর মোড়াতে থাকে। বেলকনির একপাশে রয়েছে একটা হেলানো চেয়ার আর তার সামনে একটা কাঁচের টেবিল। টেবিলের উপরে ২-১ টা ম্যাগাজিন আর একটা নোট প্যাড রাখা। তানিয়া হাই তুলতে থাকে। ৪ তলার উপর থেকে সিলেটের পাহাড় সহ দূর দূরান্তের চা বাগানের মনোরম দৃশ্য বেশ ভালোই উপভোগ করা যায়।‌ প্রকৃতির সবই আগের মতো রয়ে গেলেও তানিয়ার পাশের নির্ভরতার ছায়া টা হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।‌

তানিয়ার মনে পড়তে থাকে তুষারের সাথে জেগে ওঠা প্রতিটা সকালের কথা। মনে পড়তে থাকে এই রেলিং ধরে তুষারের কাঁধে মাথা রেখে ঐ দূরের পাহাড়ের অগ্রভাগে ঘটা সূর্যদয়, সূর্যাস্ত দেখার কথা। তানিয়ার আজো মনে হয় এই বুঝি তুষার তার কাঁধে হাত রেখে এক নতুন কাব্যের রচনা করবে। এই বুঝি তার খোলা চুলের মোহনীয়তায় হারিয়ে যাবে অনিকেত প্রান্তরে। তানিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ তার কাছে এসবই স্মৃতির ছেড়া পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। যে পাতা গুলোকে সে যত্ন করে মন গহীনে লুকিয়ে রেখেছে।

তানিয়া ব্যালকনি থেকে পা বাড়ায় ঘরের দিকে। চলে যেতে থাকে সকালের সেই চিরচেনা কফির মগের হাতল ধরতে। তানিয়ার ব্যালকনি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ব্যালকনিতে থাকা কাঁচের টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট নোট প্যাড টার ‌পৃষ্ঠা বদলাতে শুরু করে। যেন হাওয়ার পাতা গুলো উলট পালট হচ্ছে। কিন্তু আশেপাশে কোন হাওয়ার নাম বিন্দুও নেই। কিছুক্ষণ ওলটপালট হওয়ার পর নোট প্যাডের একটা পৃষ্ঠায় গিয়ে তা বন্ধ হয়। পৃষ্ঠা টায় বড় করে লেখা ছিলো “আদরি আসুভে”

তানিয়া কিচেনে প্রবেশ করে। কফি তার সবসময়ের এক নিদারুণ সঙ্গি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেও এই কফিই তার সঙ্গ দেয়, তেমনি ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখে কফিই তার পুরো দিনকে সতেজ করে তোলে। কফির একটা মেশিন ই সে এজন্য কিচেনে রেখেছে। এক কাপ কফি সেই মেশিন থেকে নিয়ে কিচেন থেকে বেড়িয়ে আবার বেড রুমের দিকে পা বাড়ায় তানিয়া। গন্তব্য আবারো সেই ব্যালকনির রেলিং। হঠাৎ বাড়ির কলিং বেজে উঠলো। তানিয়া থেমে দাঁড়ালো। মুখ উঠিয়ে ঘড়ির ‌দিকে তাকালো।‌ ৮ টা ১০ বাজে। “এই সময় আবার কে আসলো সকাল সকাল ? ” মুখে বিরবির করে বলেই বেড রুম থেকে সোফার রুমে চলে যায় তানিয়া। সোফার রুমেই মূল দরজা। সে এক হাতে কফির মগ ধরে আরেক হাতে দরজা খুলে। দেখে সুমু এসেছে। কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ। 

– আরে সুমু , ! আসো ভিতরে আসো। ‌

– থ্যাংকিউ ম্যাম। ম্যাম আজ আপনি অফিসে যাবেন না তাই বাসাতেই চলে আসলাম।

– ওহহ, বসো। 

সুমু সোফায় বসে। তানিয়াও দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে সুমুর পাশের সোফা টায় বসে। 

– চা, কফি কিছু খাবে , !

– না না ম্যাম। কিছু লাগবে না। (একটু থেমে) আসলে আমি এসেছিলাম আমাদের প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলতে। 

– হ্যা বলো। নতুন কোন আপডেট আছে ? 

– হ্যা ম্যাম। শহুরে কালচারের সব তথ্য কালেক্ট করা প্রায় শেষ। এখন শুধু ভাষা গত দিকটা সার্ভে করলেই শহুরে তথ্য ‌কালেক্টের বিষয় টা ক্লোজ।

– ওহহ গুড। (কফিতে চুমুক দিয়ে) আর এইটার সার্ভের ফাইল গুলো সব কাল-পরসুর মধ্যে রেডি করে নিয়ে এসো কেমন ,!

– ওকে ম্যাম। হয়ে যাবে। আর ম্যাম, গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিষয় টা , ! না মানে এই সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলেই তো এটার সার্ভে করে নেওয়া যেতো।

– হ্যা যেতো। কিন্ত তবুও আমাদের আনন্দপুরেই যেতে হবে ,।

– আনন্দপুর কী আপনার ‌গ্রামের বাসা ম্যাম ? 

– না না। সেখানে ‌তো আমি আমার ভাইয়ার সাথে ‌একসময় ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমাদের গ্রামের বাসা ‌রংপুরের মিঠাপুকুরে। বাবা-মা নেই। এখন সেখানে আমাদের আর কেউ থাকে না। (সুমুর দিকে ফিরে) আচ্ছা তোমার বিষয়ে‌ তো আমার জানাই হলো না। বাসায় কে কে আছে তোমার , ?

– বাসায় আমার বড় ভাইয়ার সাথে থাকি আমি। আমারো মা-বাবা ছোট বেলায় মারা গিয়েছে। (বলেই একটা মলিন মুখ করে মাথা নিচু করে ফেলে সুমু)

– ওহ আই এম সো সরি। আমি আসলে বিষয়টা জানতাম না।

– না না ম্যাম। ইটস ওকে। (একটু থেমে উৎসুক হয়ে) আচ্ছা ম্যাম আমরা আনন্দ পুরের উদ্দেশ্যে কবে রওনা দিচ্ছি , ? 

– উমম, এই ধরো ৩-৪ দিনের মধ্যেই। ও হ্যা একটা বিষয়। তোমার ভাইয়া কী তোমাকে আমাদের সাথে যেতে দিবেন ? 

– হ্যা ম্যাম অবশ্যই। আমাদের সাথে তো কোন ছেলে যাচ্ছে না। তাই নাও করবে না। আমি ভাইয়াকে ম্যানেজ করে নিবো।

– হ্যা নিলেই ভালো।‌ আচ্ছা তুমি একটু বসো আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।

– না না ম্যাম। (সোফা থেকে দাঁড়িয়ে) আমার ভাইয়া নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ একটু আমাকে কলেজে যেতে হবে গার্জিয়ান নিয়ে। তাই বাসা থেকে একটু আগে ভাগেই বের হয়েছি প্রজেক্টের নিউ আপডেট টা আপনাকে জানিয়ে যাবো ভেবে। অন্য একদিন খাবো ম্যাম। আজ দেরি হয়ে যাচ্ছে। 

– আচ্ছা তাইলে ঠিক আছে। আর ফাইল গুলা ‌মনে করে এসে দিয়ে যেও কিন্তু, ! 

– ওকে ম্যাম। আমি তাইলে আসি ম্যাম , !

– ওকে যাও। 

– আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাম,

– ওয়ালাইকুমুস সালাম।

সুমু চলে যেতে থাকে। দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার সময় দরজা টা খুলে রেখেই চলে যায় সুমু। তানিয়া উঠে দরজা টা লাগিয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে যায়। গিয়ে একটু উকি মেরে সুমুকে দেখে। তারপর দরজা লাগিয়ে ‌ভিতরের দিকে চলে যেতে থাকে। এখন তাকে নাস্তা বানাতে হবে। ” আজ মনে হয় আর বুয়া খালা আসবেনা। এদের ছেলেমেয়েরা যে মাসে কয়বার অসুস্থ হয় আল্লাহ মালুম।” মুখ দিয়ে বিরবির করতে করতে সোফা রুম থেকে ডিরেক্ট কিচেনে ঢুকে পড়ে তানিয়া।

 

 

রিয়াদ হন্তদন্ত হয়ে পুলিশ স্টেশনে ঢুকে। ঢুকেই তার চেয়ারে পাশে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর থাকা একটা ছোট্ট প্যাড খাতা খুলে দেখতে থাকে। সময় এখন সাড়ে দশটা। আজ অনেক দিন পর সূর্যের তেজের দেখা মিলেছে। আজ সকাল সকালই কুয়াশার প্রভাব কমে গিয়ে সূর্যের গরম আলো পরিবেশের ঠান্ডা টাকে কমিয়ে দিয়েছে। রিয়াদ প্যাড থেকে একটা নাম্বার তার ফোনে উঠায়। উঠিয়ে কল দিয়ে ফোনটা কানে ধরে। কিছুক্ষণ কল হওয়ার পর অপর পাশের ব্যাক্তি কল ধরে।

– স্যার। আমরা প্রস্তুত। (একটু থেমে অপর পাশের কথা শুনে) জ্বি স্যার। এই থানা থেকে সবগুলো কনস্টেবল যাবে।(একটূ থেমে) হ্যা স্যার , কোন সমস্যা হবে না। রাখি তাইলে স্যার , ! (একটু থেমে) আচ্ছা আচ্ছা স্যার। আসসালামুয়ালাইকুম।

 

বলেই কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নেয় রিয়াদ। নামিয়ে নিয়ে কনস্টেবল নয়ন কে ডাকতে শুরু করে সে। 

– নয়ন, নয়ন,

পাশের রুম থেকে ছুটে আসে কনস্টেবল নয়ন। এসে রিয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে রিয়াদকে একটা লম্বা স্যালুট দিয়ে বলতে থাকে।

– জ্বী স্যার বলেন।

– শোনো। একটা বড় কাজ এসেছে আমাদের। 

– কী কাজ স্যার ? আবারো নতুন কোন কেস ? 

– না। কেসের থেকেও বড় কিছু।‌

– কেসের থেকেও বড় কিছু , ! কি সেটা স্যার ?

– স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন আলমগীর দিনাজপুরে আসবেন। জনসভা করতে। 

– মন্ত্রী আসবেন , ! এটাতে ঘাবড়ানোর কী আছে স্যার , ! উনি তো আর আনন্দপুরে আসতে জাবেন না তাই না , ? 

– আরে গাধা উনি আমাদের কলেজ মাঠে জনসভা করবেন। আনন্দ মোহন কলেজ মাঠে। আগে কথা ‌ছিলো দিনাজপুর পলিটেকনিক এর মাঠে করবেন। এখন সিদ্ধান্ত বদলে আমাদের গ্রামের কলেজে জনসভা করতে আসতেছেন। এই মাঠ টার‌ মতোই নাকি বড় মাঠ খুঁজছিলেন‌ তিনি।

– এটাতো আমাদের জন্য আরো আনন্দের সংবাদ স্যার। আমাদের গ্রামের রাস্তা,ঘাট,সেতু এগুলো উন্নয়নের কথাও আমরা তাকে বলতে পারবো।

– আরে জনসভা মানে বুঝিস, ? আশেপাশের জেলা, গ্রাম থেকে শত শত লোক আসবে। আর এতো গুলা লোক থেকে মন্ত্রীকে সিকিউরিটি দেওয়া কী চারটি খানি কথা,!

– তাও অবশ্য ঠিক ‌স্যার। এখন আমরা ‌কীভাবে এতো চাপ সামলাবো , ?

– একটু আগে কমিশনার সাহেবের সাথে কথা হইছে। উনি বলছেন যে আমাদের পাশাপাশি আশেপাশের থানা ‌থেকেও ওসি সাহেব রা আসবেন এখান সিকিউরিটি দিতে। আমরাই এখানকার সিকিউরিটির প্রধান থাকছিনা। আমরা শুধু আমাদের পুলিশ স্টেশনের কনস্টেবল প্রদান করবো আর গ্রামটাকে ঐদিন যতটা সম্ভব কন্ট্রোলের মধ্যে রাখবো। ব্যাস।

– ওহহ আচ্ছা,।

– এখন আচ্ছা,বাচ্ছা বাদ ‌দেও। তুমি গিয়ে বাকিদের সব বুঝায় বলো। আর ঐদিন কেউ কোন ছুটি নিতে পারবেনা এটাও জানায় দেও।

– কয়টার সময় জনসভা স‌্যার , ? 

– এই ১০-১১ টার মধ্যেই হবে। তোমাকে এখন যেটা করতে বলছি ওটা করতে যাও।

– ওকে স‌্যার। (বলেই কনস্টেবল পাশের রুমে চলে যায়। 

রিয়াদও তার টুপি হাতে নিয়ে বেড়িয়ে যেতে থাকে পুলিশ স্টেশন থেকে। তার এখন গন্তব্য সমাবেশ মাঠের চারপাশ একদম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আছে কী না সেদিকটা দেখা আর মঞ্চ তৈরির কাজ কদ্দূর এগুলো তা পরখ করে নেওয়া। রিয়াদ বাইক ছুটিয়ে চলে যেতে থাকে গ্রামের কাঁচা রাস্তার মধ্যে দিয়ে।

 

 

নিপা ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। পড়নে গোল জামা। জামাটা খয়েথি রংয়ের আর ওড়নাটা লালচে খয়েরি রঙের। সিঁড়ির ‌দু ধাপ পেরিয়ে আঙিনায় নামে সে। শিউলি বেগম আঙিনার রশিতে কাপড় শোকাতে দিচ্ছেন। এখন সময় দুপুর ১২ টা ৫। রোদের তীব্রতা বেশি তাই ভেজা কাপড় গুলো নেড়ে দিচ্ছেন ভালো ভাবে। নিপা ওড়না ঠিক করতে করতে শিউলি বেগমের পিছনে দাঁড়ায়। বলে।

– মা, গেলাম।

– কই যাইতাছোস এই ভর দুপুরে , ? (মুখ না ফিরিয়েই)

– একটু কলেজে যাইতে হইবো। এসাইনমেন্ট দিছে ঐগুলা নিয়া আইতে হইবো।

– কতক্ষন লাগবো হুনি,।

– এইতো ধরো আধা ঘন্টা। এর থেইকা বেশি না।

– আইচ্ছা যা। ঠিকমতো যাইস। (একটু থেমে) আর শোন। তোর বাপে দুপুর বেলা খাইতে আইতে পাড়ে। একটু দেইখা শুইনা ‌রাস্তায় রংঢং করিস।

– কীহহ,! কীসের রংঢংয়ের কথা কও তুমি .?

– আগে থেইকা সাবধান কইর দিলাম মাইয়া। পড়ে বাপের হাতে ধরা পড়ার পর কইস না যে আমি আগে কইনাই।

– হইছে হইছে চুপ করো। আমি গেলাম। 

– সাবধানে যাইস।

– আইচ্ছা।

 

নিপা আঙিনা থেকে হেঁটে চলে যেতে থাকে মেইন গেটের দিকে। এদিকে‌ শিউলি বেগম খালি বালতিটা উঠিয়ে চলে যেতে থাকেন গোসল খানার দিকে। নিপা দরজাটা খুলতেই যাবে তখনই কেউ একজন দরজাটা খুলে দেয়। নিপা দেখে রায়হান একদম সময় মতো চলে আসছে। নিপা একটা মুচকি হাসি দিয়ে দরজা থেকে বের হয়। 

রায়হান নিপার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। রোদ উঠেছে তাই আশপাশ খুব কর্মচাঞ্চল্য হয়ে উঠেছে। ধান কাটার জন্য ক্ষেতে ক্ষেতে কৃষক দের যেন প্রতিযোগিতা লেগেছে। কাঁচা রাস্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে রায়হান,নিপা। তাদের পাশ দিয়ে একটা সাইকেল চলে গেলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নিপা বলে উঠে।

– তুমি কিভাবে জানলা আজকে কলেজে যাইতে হবে , ? 

– আমি ওসব খোঁজ খবর লাগিয়ে নিয়েছি। (বলেই নিপার কাঁধে হাত দিয়ে) একটা পুরা দিন আমি তোমাকে না দেখে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো আমার আকাশে পুরো একদিন চাঁদ উঠেনি। তবে আজ তোমায় দেখে (নিপার হাত নিজের হাত জড়িয়ে নিয়ে) আজ তোমায় দেখে আমার রাজাহীন রাজ্যে খুশির ধুম পড়েছে। হিহিহি।

– ও আচ্ছা তাই , ! তো ভাইয়া,

– কিহহ, ? কে ভাইয়া ? কোথায় ভাইয়া ?

– হা হা হা হা। মজা করলাম একটু। 

– তুমিও না। আমি আরো ভাবলাম আমার কী ফেইস চেন্জ হয়ে গেছে নাকি যে তুমি আমাকে ভাইয়া বলছো, ! 

– হিহিহি

– তারপর বলো। তোমার বাসায় কবে প্রস্তাব নিয়ে যাবো ,!

– কবে আর , ! যখন তোমার মন চাইবে। (একটু থেমে) তোমার আব্বু তোমাকে কিছু বলেনাই ? যখন তুমি আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছিলে ? 

– না না। আব্বু আমাকে অনেক আদর করে। আব্বু আরো উল্টা খুশিই হইছে।

– বলো কী।

– হ্যা। আমি খুব তাড়াতাড়িই তোমার বাসায় আসতেছি পাত্রি দেখতে। (বলেই নিপার নাকে আলতো ছোঁয়া দেয় রায়হান)

– যাও। রাস্তায় মানুষ জন আছে। 

– থাকুক গে। ঐসব আমি কেয়ার করি না।

– জানো, ফয়সাল কালকে চলে গেছে। যাওয়ার সময় আমার এতো খুশি লাগতেছিলো যে কী বলবো। হিহিহি।

– হ্যা চলে গেছে। (বির বির করে) অনেক দুরে চলে গেছে,

– কিছু বললা ? 

– ক,কই। নাতো। 

নিপা এক হাত রায়হানের পিঠে দিয়ে চলতে চলতে রায়হানের কাঁধে মাথা রাখে। রায়হানও নিপার কাঁধে এক হাত দেয়। এদিকটায় লোকজন কম। আশেপাশে আলুর ক্ষেত। কৃষকও‌ নেই। নিপা রায়হানের কাঁধে মাথা রেখে বলতে থাকে।

– জানো তোমার কাঁধে মাথা রাখলে মনে হয় আমি একটা সঠিক আশ্রয় পেয়েছি। একদম সুরক্ষিত আছি। তোমার সাথে এভাবেই যেন জনম জনম কাটিয়ে দিতে পারি রায়হান। আমাদের মনের মধ্যেকার মিষ্টতা যেন একদম জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া পর্যন্ত অটুট থাকে। অটুট থাকুক পরকাল অব্দি।(বলেই রায়হানের কাঁধে একটা ছোট্ট চুমু দেয় নিপা। রায়হান মুচকি হাসে। আরেক হাত দিয়ে নিপা গাল ছুঁয়ে বলে।

– স্রোতোসিনীর স্রোতে এই অভাগা মাঝি ভেসে থাকবে আজীবন। 

তারা দুজন হেঁটে চলে যেতে থাকে। পাশের গাছের ডালেও দুটো পাখি ঠিক তাদের মতো করেই একসাথে একত্রিত হয়েছে। আবহাওয়ার সাথে এই দুটো জুটিও যেন আজ তাদের সুন্দর সময় অতিবাহিত করছে। যেন দুজন দুজনারই প্রতিরূপ, মিষ্টতা আর ভালোবাসা, !

 

 

খাঁন বাড়ি। করিডোর দিয়ে হেঁটে অন্দরমহলের পা রাখলেন সাথী খাতুন। সাথে সাথেই দেয়ালে টাঙ্গানো পুরোনো দেওয়াল ঘড়িটায় বিকেল ৪ টা বাজার ঘন্টা বাজতে লাগলো। ঘড়িটার পেন্ডুলামের দিকে তাকিয়ে সাথী মনে মনে ভাবছেন। “পেন্ডুলাম টাই যেন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। কখনো একপাশ যাচ্ছে তো কখনো আরেক পাশ।” 

এখন বাড়ির প্রায় সব মানুষই দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বিকেল ঘুম দিয়েছে। বাড়ির সকল পুরুষ আজ দুপুরের খাওয়ার পরই বেড়িয়েছে। দিনাজপুরে বলে তাদের কম্পানির গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই তারা সবাই সেদিকেই গিয়েছে। বাড়িতে এখন শুধু আছেন রায়হানের দাদা আব্দুল ওহাব। তিনি বিছানায় পড়েছেন। রায়হানের মা সুমনা বেগম। রায়হানের ফুফু সুরাইয়া বেগম। তার মেয়ে আলিশা আর রায়হানের ‌চাচি সাথী খাতুন। সাথী খাতুন অন্দর মহল দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে দরজার দিকে যেতে লাগলেন। তখনই তার চোখ পড়ে সোফার দিকটায়। আলিশা ঘুমায় নি। সে সোফায় বসে গল্পের বই পড়ছে। বইয়ের নাম “আমি পম্মজা”। ইলমা বেহরোজ এর লেখা বইটা।

সাথী খাতুনও কলেজে থাকতে অনেক বই প্রেমী ছিলেন। এখন সময়ের ভারে সব আবেগ যেন মলিন হয়ে গেছে। তিনি আলিশাকে আর ডাকলেন না। তার পড়ার ঘোর নষ্ট না করেই তিনি ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে যান অন্দরমহলের মূল ফটকের দিকে। দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। পড়নে হালকা ঘিয়ে রঙের শাড়ি। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী নিয়ম মতো চলতে চলতে তার একদম একঘেয়েমি এসে গিয়েছে। ঘরের মধ্যে চারদেয়ালে বন্দি থাকতে আর ইচ্ছে করে না তার। তাই আজ বাড়ির সব পুরুষের অনুপস্থিততে বাগানের গিয়ে একটু প্রাণ ভরে সতেজ হাওয়া নিতে মন চাইছে তার। হেঁটে হেঁটে চলে এলেন বাগানের দিকটায়।

বাগানটা বাড়ির বাম পার্শ্বে। বাগান আর বাড়ির মাঝে ২ হাতের মতো ফাঁকা আছে পিছনের পুকুরে যাওয়ার জন্য। তিনি সেই পথ টার ঠিক মাঝ খান টায় বাগানের দিকে মুখ করে তাকান। নানা রঙের ফুলে বাগানের গাছ গুলো ভরে উঠেছে। বাগানের কোন টায় একটা বড় জারুল গাছ। সেই গাছে একটা ময়না পাখির বাসা ‌আছে। বাগানের তরতাজা ফুলের সুবাস যেন তার সর্বাঙ্গে এক সতেজতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাগানটা দেখেই বোঝা যায় বাগানটার খুব যত্ন করা হয়। রায়হানের মা সুমনা বেগম খোদ নিজের হাতেই বাগানটার‌ দেখা শোনা করেন। বাগান ‌করা তার শখ বলা যায়। সাথী যেখান টায় দাঁড়িয়েছেন ঠিক তার উপরেই রায়হানের রুমের ব্যালকনি। একদম ঠিক তার নিচেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

বিকেলের দিকে সূর্য পশ্চিম তীরে নুইয়ে পড়েছে। আশপাশে শীত আসতে শুরু করেছে। গাছের ডালে পাখির কলকাকলি আর তার সাথে এতো সুন্দর বাগানের স্নিগ্ধতা এক সুন্দর আবহের সৃষ্টি করেছে। সাথী কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য গ্রহণ করলেন। 

 

সময় পেড়িয়ে গেলো অনেকক্ষণ। সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে। সাথী চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে যান। তখনই বাড়ির দেয়ালের সাথে থাকা হালকা বনের অংশটা থেকে কিছু উজ্জল একটা কিছু থেকে প্রতিফলিত আলো তার চোখে পড়ে। আগে পড়েনি কারণ সূর্য তখন ‌আরো উপরে ছিলো এখন বেশি হেলে গিয়েছে তাই সেটার ‌আলো এসে বাড়ির দেয়ালের সাথে থাকা বনের ভিতরের কিছু একটাতে পড়েছে। সাথীর মনে কৌতুহল সৃষ্টি হয়। তিনি হেলে সেই জিনিসটাকে দেখতে যান। তখনই তার মেরুদন্ডে ব্যাথা করে উঠে। তিনি এক হাত দিয়ে পিঠি চেপে ধরে ধীরে ধীরে হেলে বসেন। আরেক হাত দিয়ে সেই ছোট্ট ছোট্ট বন গুলো সড়াতেই দেখেন সেখানে একটা ভাঙ্গা মোবাইলের টুকরো। ফোনের ভাঙ্গা ডিস্প্লেতে সূ্র্যের আলো পড়ায় সেটা প্রতিফলিত হয়ে চকচক করছিলো। তিনি ফোনের ভাঙ্গা টুকরো গুলো হাতে উঠান। ফোনটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ ছুরে মেরে ভেঙে ফেলেছে। তিনি ফোনের সব গুলো টুকরো হাতে তুলেন। ফোনের টুকরো গুলো ভালোভাবে কিছুক্ষণ দেখার পর তিনি ফোনটাকে চিনতে পারেন। মুখ দিয়ে বির বির করে বলেন

– আরে, ! এটাতো রায়হানের ফোন। এটাকে সে এভাবে ভেঙে ফেলেছে কেনো ? 

তিনি টুকরো গুলো নিয়ে উঠে দাঁড়ান। টুকরো গুলোর মধ্যে সিম,মেমরি কার্ড সবই ছিলো। তিনি ফোনের ভাঙ্গা অংশ গুলো নিয়ে চলে যেতে থাকেন সেই ছোট্ট পথ টা দিয়ে। অনেক সময় পেড়িয়ে গিয়েছে। বাড়ির পুরুষেরা চলে আসতে পারে। আর তারা এসে যদি দেখে যে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। বিশেষ করে তার স্বামী শাহেদ যদি দেখেন তাহলে তো অনেক কথা শুনিয়ে দিবেন তাকে। সাথী ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে। আর এদিকে বাগানটা আমাদের দেখানো হয়। বাগানের পাশের জারুল গাছটায় দুটো পাখি ফিরে এসেছে সারাদিনের খাবার খোঁজার পর। ডিম দিয়েছে। হয়তো কয়দিন পর সেগুলো ফেটে তাদের অনাগত ছোট্ট ছোট্ট ছানা আসবে , !!

 

 

মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠলো মায়া আর রাতুল। দু’জনেই ৫ ওয়াক্ত ‌নামাজ পড়া শুরু করেছে। রাতুল উঠে বিছানায় বসলো। মায়া, রাতুল আর তার যায়নামাজ টা উঠিয়ে ভাঁজ করে আলনায় রেখে দেয়। মাথার হিজাব টা খুলে সেটাও আলনায় রাখে। রেখে সে চলে যেতেই ধরে তখনই রাতুল বলে উঠে।

– কোথায় ‌যাচ্ছো , ?

– ও মা। রান্না বসাতে হবে না ? রাতে খাবে ‌কী ? 

রাতুল সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ায়। তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে।

– না না। ডাক্তার‌ তোমাকে কোন ভারি কাজ করতে নিষেধ করছে। আমি তোমাকে আর রান্না ঘরে দিচ্ছি না। 

– কী ‌বলো‌ তুমি। রাতে খাবে কী তখন ? আমি ঠিক আছি। কোন সমস্যা হবেনা, সড়ো। আমি তাড়াতাড়ি রান্না করেই চলে আসবো।

– না না। তোমাকে আমি কাজ করতে দিচ্ছি না। আজ, আজ আমি রান্না করবো।

– কী , ! তুমি ? হা হা হা হা। হাসালে আমায়।

– হ্যা আমি রান্না করবো। আমি কী রান্না পারিনা নাকি ? তুমি আসার আগে তো আমিই রান্না করতাম। তোমার এই অবস্থায় রান্না ঘরে একদম যাওয়া যাবেনা। আজ থেকে বাবু হওয়ার পর যতদিন না তুমি একদম পুরোপুরি সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছো ততদিন এই রাতুল মাষ্টার সব রান্না করবে। হুঁ (বুক ফুলিয়ে ফুলিয়ে মায়ার সামনে বলে রাতুল)

– ও আচ্ছা , ! তো আজকে কী রান্না করবা ভাবছো , ? 

– বাসায় কাঁচা তরকারি কী কী আছে ? 

– উমম, বেগুন আছে, ফুলকপি আছে, শিম আর গাজর আছে। এইগুলাই। 

– আর ফ্রিজে তো মাছ মাংস আছে তাই না ? 

– হ্যা আছে। 

– আচ্ছা। তাইলে আমি আজকে মাছ ভুনা করবো, আর গাজর, ফুলকপি দিয়ে একটা সবজি করবো আর বেগন ভাঁজা।

– বাব্বাহ , ! এতো কিছু , ! পারবা তো ? 

– অবশ্যই পারবো ম্যাডাম। আপনি খালি ঘরে রেষ্ট নিন। আপনার শেফ এখনি সব রান্না করে আপনার সামনে হাজির করবে, !

– আমিও যাই না তোমার সাথে। খালি দেখবো তুমি কীভাবে রান্না করো।

– না না ম্যাডাম। আজ তা আর হচ্ছে না। আজ কেনো, যতদিন না পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছো তোমাকে একদম সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে হবে।(মায়া কে আস্তে করে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে) তুমি এখান টায় বসো। পা গুলো উঠিয়ে পিছনে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকো। আর বোর লাগলে এইযে গল্পের বই আছে। (পাশের টেবিলে থাকা কয়েকটা গল্পের বই মায়ার পাশে রেখে।) এইগুলা পড়িও। নিজেও পড়িও, আর আমাদের অনাগত গুড্ডুটাকেউ শুনাইয়ো।

বলেই মায়ার গাল দুটো আলতো করে ধরে কপালে একটা চুমু দেয় রাতুল। মায়া মুচকি হেসে মুখ লুকায়। রাতুল উঠে চলে যেতে থাকে। এখন তাকে সব রান্না করে রেডি করতে হবে।

 

 মায়ার মনে এক আলাদা প্রশান্তি কাজ করছে। এমন এক দায়িত্ববান স্বামীই তো প্রত্যেকটা মেয়ে তাদের জীবনে পেতে চায়। আর মায়া এমন একজনকেই তার জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। যে সবসময় তার খেয়াল রাখছে, তার যত্ন নিচ্ছে। শুধু শারীরিক চাহিদাকে নয়, দুটো মনের অন্তঃস্থলের মিলন টাই বড় বিষয়। যা রূপ, জৌলুসতা হারানোর পরও থেকে যাবে দুজনের এক হয়ে থাকার প্রতীক হিসেবে, ! 

 

 

সোফায় বসে গোয়েন্দা গল্প ফেলুদার বই পড়ছে শাহারিয়া। ঘড়িতে রাত সাড়ে ৮ টা বাজে। আজ ঐ বিকেলে যে বই নিয়ে বসেছে আর উঠার কোন নাম গন্ধই নেই তার, ! নিজের গোয়েন্দা স্কিল কে বাড়ানোর জন্য সে বিভিন্ন গোয়েন্দা সমগ্র পড়ে। আর যখন বইতে ডুব দেয় তখন আর সময় ঘন্টার কোন খেয়ালই থাকে না তার। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠার শব্দে শাহারিয়া ঘোর ভাঙে। বইটা সোফার সামনের টেবিলের উপর রেখে দাঁড়ায় সে। গিয়ে দরজা খুলে দেখে আহনাফ এসেছে। 

– আসো ভিতরে আসো।

আহনাফ ভিতরে প্রবেশ করে। শাহারিয়া দরজা লাগিয়ে দেয়। আহনাফ এসে সোফায় বসে। শাহারিয়া তার পাশের সোফা টায় বসে। আহনাফ উৎসুক হয়ে জিগ্গেস করে।

– স্যার আজকে তো আমাদের বাংলালিংকের অফিসে যাওয়ার কথা ছিলো। আপনি সকালে অফিসে আসলেনও না। কলও করলেন না।

– আসলে আহনাফ, আমার কাল রাতে জ্বর আসছিলো তো। সকালে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিলো। তাই তোমাকে আর কল দেইনি। 

– এখন আপনার শরীরের অবস্থা কেমন স্যার ,?

– এখন দুপুরে ঔষধ নেওয়ার পর থেকে এখন একটু ভালো আছি। (একটু থেমে) তুমি এইসময় এলে যে , !

– ন, না মানে স্যার। রন্জুর বিষয়ে আরো কয়েকটা ফাইল দিতে এসেছিলাম। (বলেই তার কাঁধের ব্যাগ টা খুলে হাতে নিয়ে সেখান থেকে কয়েকটা ফাইল বের করে শাহারিয়ার হাতে দেয় আহনাফ। শাহারিয়া সেগুলো হাতে নেয়। নিয়ে ফাইলের কভার গুলোতে চোখ বুলাতে থাকে। আহনাফ ব্যাগের চেইন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সোফা থেকে। শাহারিয়াকে বলতে থাকে।

– স্যার আমি এখন যাই তাইলে ,।

– চলে যাবা এখনি ? 

– হ্যা স্যার। বাসায় মা কে বলে এসেছিলাম যে ফাইল গুলো আপনার হাতে দিয়েই ফিরে যাবো। এখন যেতে দেরি হলে তখন চিন্তা করবেন তিনি।

– ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে যাও। আন্টিকে আমার সালাম দিও

– আচ্ছা স্যার। আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম 

আহনাফ উঠে চলে যেতে থাকে। দরজা খুলে বেড়িয়ে যায় সে। যাওয়ার সময় দরজাটা লাগিয়ে যায়।

শাহারিয়া ফাইল গুলো টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। বই পড়ার মুড টাই একপ্রকার ‌চলে গিয়েছে তার। শাহারিয়া চলে যায় কিচেনে। 

এক মগ কফি হাতে বেড়িয়ে আসে কিচেন থেকে। এসে তার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। তার ব্যালকনি ফাঁকা না, গ্রিল দেওয়া সামনে। শাহারিয়া গ্রীল ধরে দাঁড়ায়। ধোঁয়া ওঠা কফিতে এক চুমুক দেয়। ৬ তলার উপর থেকে রাতের ঢাকা বেশ সুন্দর দেখা যায়। দূরদূরান্তের আলো গুলো ছোট্ট ছোট্ট হয়ে তার কাছে এসে ধরা দেয়। শাহারিয়ার তখনই মনে হয় বাড়ি থেকে আসার পর আর কল দেওয়া হয়নি তাঁদেরকে। মা’কেও কল দেওয়া হয়নি‌। শাহারিয়া পকেট থেকে ফোন টা বের করে। মায়ের নাম্বার টা কন্ট্রাক্ট লিষ্ট থেকে খুঁজে বের করে কল দেয়। ফোন কানে উঠিয়ে উপরের কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি দেওয়া চাঁদের দিকে তাকায়।

 

শিউলি বেগম বারান্দার ডায়নিং টেবিলে খাবার রেডি করছেন। তার সাথে তাকে সাহায্য করছে ফুলমতি। লায়লা রান্না ঘরে আছে। আশেপাশে কুয়াশা যেন একদম জেঁকে বসেছে। শিউলি বেগম ‌শাড়ির উপরে ২ টা সোয়েটার পড়েছেন এই ঠান্ডা থেকে বাঁচতে। তখনই ঘর থেকে ফোন রিং হওয়ার আও আওয়াজ আসতে থাকে। শিউলি বেগম ডায়নিং টেবিলের পাশ থেকে দাঁড়িয়ে হাঁক দিয়ে বলেন

– নিপা, ও নিপা, ফোন ডা বাজতাছে ধরতাছোস না ক্যান , ? এ নিপা,

– চাচি অয় মনে হয় ওয়াশরুমে গেছে।

– ওফফ মাইয়াডা যে কী করে না। মা ফুলমতি। তুই একটু এদিক টা দেখ। তোর চাচা আইয়া পড়তে পারে। আমি যাইয়া দেহি কেডায় টেলিফোন দিছে।

– আইচ্ছা চাচি।

 

শিউলি বেগম শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরের ভিতরে ঢুকেন। গিয়ে বালিশের পাস থেকে ফোন টা উঠিয়ে রিসিভ করে কানে লাগান। বলতে থাকেন।

– হ্যালো। 

– হ্যালো মা। আসসালামুয়ালাইকুম

– ওয়ালাইকুমুস সালাম বাজান। তুই যে গেলি একটা ফোনও করলি না , ! কহন পৌছাইলি, ঠিকঠাক মতো গেছোস কি না। আমাগো চিন্তা হয়না , ! পৌছাইয়া ফোন দেসনাই ক্যা , ?

– না মানে মা। আমাদের ট্রেন ছাড়ছিলো সন্ধ্যা ৬ টায়। আর ননস্টপ ইনটার সিটি ট্রেন ছিলো তো। তাই কোথাও থামে নাই আর রাত আড়াই টার দিকে ঢাকায় কমলাপুর স্টেশনে নামায় দিছে। আমি ভাবলাম এতো রাতে তোমাদের কল দিয়ে ডিসটার্ব করাটা হয়তো ঠিক ‌হবেনা। তাই ভাবলাম সকালে কল করবো। পড়ে তখন সকালে উঠে অফিসের জরুরি ডাকে যাইতে হইছিলো আর পড়ে ফোন দেওয়ার কথাটা ভুলেই গেছি।

– হ ভুলবিই তো। বিয়া কইরা পড়ের দিন সকালে উইঠা কইবি এইডা কেডা,! তোর ভুলা স্বভাব টা কবে যাইবো কতো মোরে।

– এইতো চলে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে। হিহিহি।

– তো কেমন আছোস ক। অফিসে পড়ে কিছু কইছিলো নাকি ঐ নাসিমের কেস টা লইয়া ? 

– না না কিছু বলেনি। উল্টা আরো নতুন কেস দিছে। (একটু থেমে) আর আজকে একটু জ্বর আসছে মা, একটু কাশিও ধরছে।

– হ, ধরবোই তো। তোরে কয়বার কইছিলাম ট্রেনের জানালা খুইলা এই কুয়াশার বাতাস খাইস না। তাও যেমন খুলতে গেছিলি অহন বুঝ।‌(একটু থেমে) ঔষধ খাইছোস ? 

– হ্যা মা। দুপুরে খাইছিলাম। জ্বর এখন নাই। কিন্তু কাশি আছে। গলা খুসখুস করে।

– বাসক পাতা আর তুলসী পাতা বাইট্টা যেই রস টা বাইর হইবো ঐডা খাইতে হইবো তোরে এহন। তুই এহন শহরের মধ্যে এসব গাছ কই পাবি,। এহানে থাকলে তোর বিলকিস মামিগো বাড়ির গাছ থেইকা লইয়া আইতাম। (একটু থেমে) তো এহন রাতের খাবার কী খাইছোস ? 

– এইতো মা। একটু পর বের হবো বাইরে। কিছু একটা খেয়ে নিবো। 

– হ এই অসুখ শরীর লইয়া বাইরের পঁচা খাবার খাইয়া আরো পেটের ব্যামো ধরা। বুয়া আহেনাই আইজ ?

– বুয়াকে অনেক আগেই বাদ দিয়ে দিছি মা। খালি খালি ছুটি কাটাইতো। 

– ভালো করছোস। এহন বিয়া সাদি ডা করবি না নাই ? এমনে আর কতদিন কষ্ট করবি ? প্রতিদিন বাইরের পঁচা খাবার খাইতে খাইতে তো তহন বড় কোন অসুখ বাধাইয়া লাইবি। আর আমার কী নাতি নাতনির মুখ দেহনের সৌভাগ্য হইবো ? তুই যেমনে চিরকুমার থাকার শপথ লইছোস। তাতে তো মনে হয়না এই জনমে আমি আমার নাতি নাতনিগো মুখ দেখবার পারুম , ! 

– আরে মা, কিযে বলোনা তুমি। (একটু থেমে) পাত্রি আমি দেখে রাখছি। এখন তুমি নিপার বিয়ে ঠিক করো আগে। ওর বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি আমার বিয়ে টা সাড়ে ফেলতে পারে।

– হায় হায়, ! আমার বিয়া বিমুখ পোলাডার মইধ্যে এতো পরিবর্তন ,! তো সেই মাইয়াডা কেডায় যে তোর মন নিয়া ভাইগা গেছে হ্যা , ! 

– না মানে মা,!

– হইছে বুজ্জি। শরম পাইতে হইবো না। মায়েরা সন্তানগো সব বুঝে। নিপা যেইদিন আইয়া কইলো তুই ওরে বাইকে না উডাইয়া দিথীরে উডাইছিলি ঐদিনি বুইজ্যা গেছিলাম আসল কেস টা কী , ! 

– আরে মা, তুমি দেখি সব জানো।

– তো আমি না জানলে কেডায় জানবো।‌ দিথী মাইয়াডাও ভালা আছে। নম্র, ভদ্র। আর হের বাপের লগেও তোর বাপের ভালা মিল। তোর সেটিং হইতে কোন সমস্যা হইবোনা। এহন ক নিপার বিয়া নিয়া কিছু ভাবছোস ? মাইয়াডারো তো বিয়া দেওয়ার বয়স হইছে।

– উমম, আচ্ছা তোমার জানা মতে ওর কী কারো সাথে রিলেশন আছে ?

– রিলেশন আবার কিতা ?

– রিলেশন মানে সম্পর্ক মা। সম্পর্ক। 

– তো বাংলায় কইতে পারোস না , ! হ সম্পর্ক আছে। আছে বলতে ভালা রকমেরই আছে।

– ছেলেটার নাম কি ? 

– ঐযে তোর নজরুল চাচার পোলা রায়হান আছে না , ? অয়।

– রায়হান , ! ছেলেটা তো ভালোই। ঐদিন আমি আসার সময় কথা বলছিলাম। বেশ ভালোই লাগলো আমার কাছে। আর ওদের ফ্যামিলিরও ভালো সুনাম আছে সমাজে। বড় ব্যবসাও আছে।

– হ। তো এলা তোর মত কী ? এই পোলাডার লগেই অর হাঙ্গা দিমু ? 

– হাঙ্গা আবার কী মা , ! কীসব যে বলো কিছুই বুঝিনা।

– আরে বেক্কেল ছেড়া হাঙ্গা মানে বিয়া সাদি। বেশি শহরে থাকলে এরমই হয়।

– ছেলেটা আমার মতে ভালোই। বাবার সাথে কথা বলে দেখো। বাবা কী বলে।

– তোর বাপের আরো আলাদা মত আছে নি, ! আমি যা কমু হেইডার অর মত। (একটু থেমে) এহন আমি কী কইতাছি হেইডা হুন।

– হ্যা বলো।

– তোর ঘরে রাইস কুকার আছে ? 

– হ্যা আছে। কিন্তু ভাত কী দিয়ে খাবো , !

– ঘরে আলু আর গাজর আছে ? 

– হ্যা আলু সবসময়ই থাকে। আর গাজর কালকে আনছিলাম। ফ্রিজে আছে

– এহন তুই ১ পট চাউল চড়ায়া দে। আর রাইস কুকারের উপরের পাটে আলু ছিলা দিবি আর গাজরের উপরের অংশ ডা ছেইচা গাজর দিয়া দিবি। আর লগে ডিম ও দিয়া দিবি দুইডা। 

– তারপর ? 

– তারপর আর কী। আলু ভর্তা কইরা নিবি। আর গাজর ভর্তা কইরা নিবি।

– গাজর আবার ‌কীভাবে ভর্তা করে ?

– ঐ আলুর মতোই আউলাইয়া পেঁয়াজ, মরিচ কুচি দিয়া দিবি।ব্যাস।

– আচ্ছা ভাতের সাথে দুইটা ভর্তা খেয়ে ‌নিলাম। আর ঐ ডিম দুইডার কী করবো ? 

– খাওয়া দাওয়া শেষ কইরা নিচে যাবি। যাইয়া দোকান থেইকা ভালো তরল দুধ কিনবি। যেইডা ভালো ঐডা লইবি। আধা কেজির গুলাই লইস। তারপর রাইতে ঘুমাইতে যাওনের আগে সিদ্ধ ডিম দুইডা আর আধা কেজি দুধ সবটুকু খাইয়া ফেলবি। একটুকুও রাখবিনা। তোর শরীর অহন দূর্বল। এইডি খাইলে দেহে বল পাইবি। কী কইছি বুজছস ? 

– হ্যা মা বুঝে গেছি। খেয়ে নিবোনে সব। (একটু থেমে) তোমরা খাওয়া দাওয়া করছো ? 

– না তোর বাপে অহনো আহে নাই গন্জ থেইকা। ইদানিং এতো ইলেকশন নিয়া দৌড়াদৌড়ি করতাছে। ঐ যে সকালে বাইর হইবো সারাদিন ঐদিকে থাকবো। কোনদিন দুপুরে খাইতে আহে তো কোনদিন নাই। তারপর হেই রাইত কইরা আইয়া খাইয়াই ঘুম। বউ,মাইয়া কিরাম আছে হেই খোঁজ খবর লইয়ার টাইম ডাও হের থে নাই। এমনেই কী আমি আর তোর বাপেরে ছেচা দেই। (একটু থেমে) তুই অহন যা। আমি যা যা কইছি সব কর। তাড়াতাড়ি খাইয়া ঘুমায়া পড়িস। রাত জাগিস না আইজ আর। ঠিক আছে , ?

– আচ্ছা মা ঠিক আছে। ভালো থাকিও। আসসালামুয়ালাইকুম।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম বাপ।

শাহারিয়া ফোন টা কান থেকে নামিয়ে নেয়। এদিকে কথা বলতে বলতে পুরো মগের কফি যে কখন শেষ করে ফেলছে সেই হুঁশ আর নাই। আর মা’ও যখন ফোন করে কথা বলতে শুরু করলে আর থামার নাম নিশানাই নাই। সৎ মা’ও যে অন্যের সন্তান কে নিজের সন্তানের মতো করে দেখতে পারে তার জলন্ত উদাহরণ শিউলি বেগম। শাহারিয়াকে তিনি শুধু পেটেই ধরেননি। তাছাড়া শাহারিয়ার প্রতি তার আদর,স্নেহ, শাসন কোনটারই যেন কমতি নেই তার। 

শাহারিয়া চাঁদের দিকে চেয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে চলে যেতে থাকে ঘরের ভিতরে। মা তাকে অনেক কাজ দিয়েছেন। সব দ্রুত শেষ করতে হবে তাকে। এদিকে আবার কেসের ফাইলও চেক দিতে হবে। এইজন্যই মনে হয় সিঙ্গেল থাকা পাপের চেয়েও বড় শান্তি যোগ্য অপরাধ মনে হচ্ছে তার কাছে। আগে ভাগে বিয়েটা করে ফেললে এতক্ষণে বউ নিশ্চয়ই তার উষ্ণ শীতল ভালোবাসা দিয়ে শাহারিয়ার জ্বর তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতো , ! 

 

 

২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৯৬,

কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের আজান পড়েছে। চারপাশে সূর্যের আলোকিত অধ্যায় শেষে ঘন কালো অন্ধকার নেমে এসেছে। তাসনুবা এখন যে বাড়িতে থাকে অর্থাৎ তার শশুর বাড়িতে কোন কারেন্টের লাইন নেই। তাই রাত হলে আলোর একমাত্র উৎস তাদের কাছে মোমবাতি আর কেরোসিন তেল দিয়ে জ্বালানো কুপ। তাসনুবার শশুর বাড়িতে ৩ টা রুম। দক্ষিণে একলা রুম টায় থাকেন তার শশুর আর শাশুড়ি। আর এদিকে পূর্বের দুটো ঘরের একটাতে থাকে সে আর ছেলে নোমান আর পাশের ঘর টায় থাকে তার শারীরিক প্রতিবন্ধী স্বামী সোহেল। আশেপাশ অন্ধকার।‌ জঙ্গলের মধ্যে বাসাটা হওয়ায় ঝিঁঝিঁ পোকার সহ আরো নানা পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। আজ জোছনা পড়েছে। চারপাশ হালকা হালকা দেখা যাচ্ছে জোছনার আলোয়। তাসনুবা তার ৮ বছর বয়সী ছেলে নোমান কে ঘুম পাড়িয়ে রেখে তার ঘর থেকে বের হতেই যাবে। তখনই দেখে তার শশুর আর শাশুড়িমা একটা ‌শাল দুজনে ঢাকা নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে জঙ্গলের কোথাও থেকে দৌড়ে আসলেন। এসে উঠোনে উঠে তাদের ঘরে গেলেন। হঠাৎ এভাবে আসতে দেখে তাসনুবা বেশ ভয় পেয়ে যায়। অন্ধকারের মধ্যে এমন ভাবে জঙ্গলের ভিতর থেকে তারা দুজন আসলেন যেনো মনে হলো কোন অশরিরী আত্মা আসলো। তাসনুবা ঘরের দরজার কপাটের আড়াল হতে তাদের ঘরের দিকে নজর দেয়। কিন্তু তাদের ঘরের অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। হঠাৎ তারা দুজন সেই ঘর থেকে বের হয়ে একদম অদ্ভুত ভঙ্গিতে জঙ্গলের দিকে দৌড়ে ফিরে যান। হঠাৎ এমন কিছু দেখে তাসনুবা্য মনে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়। আসার সময় তাদের হাতে কিছু একটা দেখেছিলো সে। কিন্তু যাওয়ার সময় তাদের হাতে সেই জিনিসটা ছিলো না। তাসনুবা ঘরের ভিতরে আসে। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নেয়। মোমবাতির আলোতে তার মসৃন চেহারাটা অনেক সুন্দর ভাবে ফুটে উঠছিলো। সে আস্তে আস্তে ধীর পায়ে তার ঘর থেকে বের হয়। জঙ্গলের দিকে তাকায়। দেখে কাউকে দেখা যাচ্ছে নাকি। কিন্তু না। কেউ নেই। সে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গায়ে একটা সাদা শাড়ি। শাড়ির আঁচল ফ্লোরে পড়ে আছে। সাদা শাড়ি গায়ে মোমবাতি নিয়ে তাসনুবাকে দেখে এক ভয়ংকর সুন্দরি মনে হচ্ছে। যেন সেই কোন আত্মা। নিতে এসেছে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ। কিন্তু না সে আত্মা নয়। মানুষই।

তাসনুবা তার শশুর শাশুড়ির রুম টায় প্রবেশ করে। এই রুমে আগে সে কখনোই আসেনি। এই ৮ বছরের বিয়ের সংসারে কখনোই না। সবসময় রুমে হয় তার শাশুড়ি নয় শশুর থাকতেন। তারা কেউ কেন জানি তাসনুবাকে এই রুমটায় ঢুকতে দিতেন না। রুমটায় প্রবেশ করার সাথে সাথেই তার নাকে এক অন্যরকম গন্ধ আসতে থাকে। শরীরে হতে থাকে এক আলাদা অনুভূতি। সে মোমবাতির আলোয় দেখে। বিছানা একপাশে আছে। আরেক পাশে কিছু বড় বড় আলমারি। দেখে মনে হচ্ছে খুব দামী। কিন্তু এই গরীব সংসারে এমন আলমারি কোথা থেকে এলো , !

তাসনুবার চোখ যায় বিছানার উপর। একটা মাঝারি আকৃতির বক্স। সাইজে কোন বইয়ের সমান হবে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। মোমের আলোয় ঘরের আংশিক অংশ আলোকিত হতে থাকে। তাসনুবার ভয় হচ্ছে। যদি তাকে তার শশুর, শাশুড়ি ধরে ফেলে তো, ! 

কিন্তু তার মনের কৌতুহলের কাছে সবকিছুই নগন্য এখন। সেই বিছানার সামনে এসে দাঁড়ায়। বক্স টা দেখে ভাবতে থাকে। “আরে এটাই তো তারা দুজন হাতে করে নিয়ে জঙ্গল থেকে দৌড়ে আসলো” 

সে বক্স টা হাতে নেয়। কাঠের বাক্স। সামনে একটা ফুটো করা। সে হাত দিয়ে চেষ্টা করে বক্সটা খোলার। কিন্তু না এটা খুলছেই না। সে মোমবাতির আলোয় দেখে বক্সটার সামনের ফুটোটার আগে বৃদ্ধাঙ্গুলির ছবি দেওয়া। সে তৎক্ষণাৎ কিছু না ভেবেই ফুটোটায় তার বৃদ্ধাঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয় এবং সাথে সাথেই বক্সটা খুলে যায়। সে বিছানায় বক্সটা রাখে। হাটু গেড়ে বিছানায় সামনে ফ্লোরে বসে। পাশে মোমবাতিটা বিছানায় ভালোভাবে দাঁড় করায়। বক্সটার উপরের ঢাকনা উঠিয়ে দেয়। বক্সটা খোলার পর একটা চিরকুট দেখতে পায় সে। চিরকুট টা হাতে নেওয়ার পর দেখতে পায় তার নিচে একটা আংটি। সে আংটিটার দিকে মন না দিয়ে চিরকুট টা খোলে। মোমের আলোয় চিরকুটের লেখা স্পষ্ট হতে শুরু করে তার কাছে। এটা কারো হাতের লেখা চিরকুট। চিরকুটে লেখা ছিলো।

” আদরি আসুভে হলো এক শয়তানি শক্তির প্রতীক। এই আসুভেকে যে বা যারা পৃথিবীতে আনতে পারবে সে বা তারা হয়ে যাবে অমর। পেয়ে যাবে অবিনশ্বর শয়তানি শক্তির প্রদীপ। আসুভে এর মাধ্যমে তারা পুরো পৃথিবীতে কালোজাদু শক্তি দিয়ে রাজত্ব করতে পারবে। এই আসুভে যারই গর্ভে জন্ম নিবে। তাকে সাবধানে রাখো। কারণ তার একটু ক্ষতি মানেই আসুভের ক্ষতি। আসুভেই হবে এই পৃথিবীর কালোজাদুর সবচেয়ে বড় ‌শক্তি উৎস। রাজত্ব কায়েম করবে পুরো মানব জাতির উপর। পুরো পৃথিবীর উপর। ,”

 

বাকি চিরকুট টা পড়ার আগেই হঠাৎ তাসনুবা কিছু একটা অনুভব করতে থাকে। হ্যা। সে তার গর্ভে কিছু একটাকে অনুভব করছে। এবং সেটা ধীরে ধীরে তার গলা দিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। তাসনুবার‌ গলা ব্যাথা শুরু হয়। চিরকুট টা হাত থেকে পড়ে যায়। সে তার হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে। সেটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে আসছে। তাসনুবা ব্যাথা সহ্যা করতে পারেছেনা। তাসনুবা চিৎকার করতেও পারছেনা। তার গলা হঠাৎ অস্বাভাবিক ভাবে বড় হতে থাকে। সে আর ব্যাথা নিতে পারছে না। হঠাৎ বক্সে থাকা আংটিটা জ্বলে উঠতে থাকে।

 

চলবে ,,,,,

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৩

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

” আদরি আসুভে হলো এক শয়তানি শক্তির প্রতীক। এই আসুভেকে যে বা যারা পৃথিবীতে আনতে পারবে সে বা তারা হয়ে যাবে অমর। পেয়ে যাবে অবিনশ্বর শক্তির শয়তানি  প্রদীপ। আসুভে এর মাধ্যমে তারা পুরো পৃথিবীতে কালোজাদু শক্তি দিয়ে রাজত্ব করতে পারবে। এই আসুভে যারই গর্ভে জন্ম নিবে। তাকে সাবধানে রাখো। কারণ তার একটু ক্ষতি মানেই আসুভের ক্ষতি। আসুভেই হবে এই পৃথিবীর কালোজাদুর সবচেয়ে বড় ‌শক্তির উৎস। রাজত্ব কায়েম করবে পুরো মানব জাতির উপর। পুরো পৃথিবীর উপর। ,”

 

বাকি চিরকুট টা পড়ার আগেই হঠাৎ তাসনুবা কিছু একটা অনুভব করতে থাকে। হ্যা, সে তার গর্ভে কিছু একটাকে অনুভব করছে। এবং সেটা ধীরে ধীরে তার গলা দিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। তাসনুবার‌ গলা ব্যাথা শুরু হয়। চিরকুট টা হাত থেকে পড়ে যায়। সে তার হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে। সেটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে আসছে। তাসনুবা ব্যাথা সহ্যা করতে পারেছেনা। তাসনুবা চিৎকার করতে যেয়েও করতে পারছেনা ব্যাথায়। তার গলা হঠাৎ অস্বাভাবিক ভাবে বড় হতে থাকে। সে আর ব্যাথা নিতে পারছে না। হঠাৎ বক্সে থাকা আংটিটা জ্বলে উঠতে থাকে। তাসনুবার মুখ উপরের দিকে উঠে যায়।

এক সাদা ধোয়া তাসনুবার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকে। মুখ দিয়ে বের হয়ে সেই আংটিটার মধ্যে চলে যেতে থাকে। আংটিটাও ধীরে ধীরে প্রজ্বলিত হয়ে উঠতে থাকে। তাসনুবার ভিতর থেকে সম্পূর্ণ একটা ধোঁয়ার কুন্ডুলী বের হয়ে সেই আংটির ভিতরে চলে যায়‌। তাসনুবা মাথা নিচু করে ফেলে। আড়াল চোখে দেখে আংটিতে এক ছোট্ট তলোয়ার খচিত হয়ে গেছে তার ভিতর থেকে বের হওয়া সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী টা দিয়ে।

তাসনুবা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আশপাশের নিরব পরিবেশের মাঝে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ দেওয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাসনুবা হাত দিয়ে তার মুখের ঘাম মুছতে থাকে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। তখনই হঠাৎ জঙ্গলের দিকটা থেকে কারো পায়ের আওয়াজ আসে তার কানে। শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটলে ঠিক এই শব্দটাই হয়। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে কেউ বা কারা ঘরের এদিকটায় আসছে। তাসনুবা তাড়াতাড়ি করে ফ্লোরে পড়ে যাওয়া কাগজ টা উঠায়। উঠিয়ে সেটা আলাদা হাতে নিয়ে বক্সটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। এক হাতে বক্স আর সেই ছোট্ট কাগজ আর আরেক হাতে মোমবাতি হাতে দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে থাকে তার শশুর-শাশুড়ির রুম থেকে। বেড়িয়ে যাওয়ার সময় তার পায়ের ধ্বনি প্রতিফলিত হতে থাকে নিশ্চুপ সেই ঘর টাতে।

 

দিথীর চোখ খুলে যায়। তার মুখ ঘামের ফোঁটায় তলিয়ে গিয়েছে। তার নেওয়া জোরে জোরে নিঃশ্বাস ভরের নিশ্চুপ আবহাওয়ার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই শোনা যাচ্ছে। দিথী কম্বল থেকে হাত বের করে তার মুখের উপরের ঘাম মুছতে থাকে। পাশে মুখ ঘুরিয়ে দেখে সামিহা এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দিথী হাত বাড়িয়ে পাশের ছোট্ট টেবিল টা থেকে এলার্ম ঘড়িটা হাতে নেয়। ৪ টা ১১ বাজে। ফজরের আযান দিতে আরো সময় আছে। দিথী নিজেকে স্বাভাবিক করে সামিহার বিপরীতে ফিরে পাশ কাত হয়ে শুতে। গালের নিচে দু হাতের তালু রেখে ভাবতে থাকে আজকের স্বপ্নের বিষয়ে। কারণ স্বপ্নে দেখা সেই আংটিটা এখন তার কাছে আছে। “এই আংটির মধ্যে এখনো কী সেই সাদা ধোঁয়ার মতো জিনিসটা আছে ? থাকতে পারে। বক্সটা যখন খুলেছিলাম তখন আমার হাতেও আংটিটা ঠিক স্বপ্নের মতোই জ্বলজ্বল করছিলো।

এসব কী হচ্ছে আমার সাথে, ! হঠাৎ করে ধারাবাহিকভাবে দেখতে থাকা তাসনুর সেই স্বপ্ন, আর বাস্তবেও একটা আংটি সহ বক্স পাওয়া। আবার সেটা সামিহার দাদুর হাত থেকে , ! সামিহার দাদু কী এসব বিষয়ে জানতেন ? তিনিও চলে গেলেন। এখন আমি এসব প্রশ্নের উত্তর কার কাছ থেকে পাবো , ? (একটু থেমে) হ্যা , সামিহার দাদুর কথা যদি সত্যিই হয়, তাহলে কেউ আসবে। কেউ আসবে এই আংটিটার খোঁজে। নিশ্চয়ই তার কাছে এসব কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে এই দুঃস্বপ্নের আঁধারের সঠিক ব্যাখা। ” ভাবতে ভাবতেই তার চোখ দুটি আবার লেগে আসতে থাকে। যেন আবার সেই অসম্পূর্ণ ঘুম টা টাকে টানছে।‌ চোখের পাতা গুলো ভারী হয়ে যেতে থাকে। দিথী ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। পুরো ঘর আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। 

 

 

টেবিলের উপর এলার্ম ঘড়িটা বেজে উঠে। তাতে সেট করে থাকা সকাল ৭ টার এলার্ম ঘন্টা বাজছে। হাত বাড়িয়ে সেই এলার্ম ঘড়িটা বন্ধ করলো শাহারিয়া। কম্বলের নিচ থেকে মাথা বের করে শরীর মোড়াতে থাকে সে। উঠে বসে বিছানায়।‌ ঘুম ঘুম সরু চোখ গুলো জানান দিচ্ছে অপূর্ণ ঘুমের। হাই তুলে কম্বলের ভিতর থেকে পা বের করে শাহারিয়া। বেশ ভালোই ঘুম হয়েছে তার। শারীরিক অসুস্থতার ভাব টাও চলে গেছে। মায়ের কথা তাইলে কাজে দিয়েছে। শাহারিয়া বিছানা থেকে উঠে চলে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

 

৩০ মিনিট পর,

 

গামছা হাতে গোসল খানা থেকে বেড়িয়ে আসে শাহারিয়া। পড়নে একটা তোয়ালে। হাতে আরেকটা তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায় সে। ঘুমের ভাব একদম সম্পূর্ণ কেটে গেছে গোসলের পর। তোয়ালে পড়া অবস্থায় বিছানায় বসে শাহারিয়া। মাথা মুছে ভিজা তোয়ালে টা হাতে নিয়ে নিজে নিজেই কথা বলতে থাকে।

– কাল রাতে মা’কে দিথীর কথা বলে দিলাম। এখন মা কী ভাববে , ! লজ্জার মাথা খেয়ে ফেলছি ভাববে। আর তারপরও বলে দেওয়াতে ভালোই হইছে। বিয়েটাও তাড়াতাড়ি এরেন্জ করে ফেলবে তারা। হিহিহি। (একটু থেমে) নিপার জন্য ঠিক করা ছেলেটাও মন্দ না। কী জানি নাম ওর , হ্যা। রায়হান। ছেলেটা দেখতে শুনতে বেশ ভালোই আছে বলা যায়। বিবাহ উপযোগী। এখন নিপার টা তাড়াতাড়ি হয়ে গেলে বাচি। নিজেও করে ফ্যামিলি প্ল্যানিং শুরু করে দিবো। হা হা হা হা। (একটু থেমে) ও একমিনিট। দিথীকে বিয়ে করে তো ঢাকায় নিয়ে আসবো আমি। ওকে নিয়ে কী এই দুই রুমের ফ্ল্যাটে থাকা যাবে , ! না না। নতুন বাড়ি নিতে হবে। হ্যা, ঐযে রেডিমেট বাড়ি গুলো থাকে না। ঐগুলা কিনে নিতে হবে।

এইখানে দিনের বেলায় যখন তখন গ্যাস নাই, পানি নাই। এর চেয়ে ভালো নিজের একটা রেডিমেট বাড়ি হোক। না থাকবে কোন সমস্যা। কিন্তু এখন কথাটা হইতেছে যে ঢাকায় তো সব বিল্ডিং। এইখানে এমন বাড়ি ‌কী পাওয়া যাবে , ! (বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে করতে) উমম, আচ্ছা সিলেটের শ্রীমঙ্গলে বাড়ি কিনলে কেমন হয় , ! মনোরম পরিবেশে ঠান্ডা আবহাওয়ায় পাহাড়ি জনপদের মধ্যে এক স্নিগ্ধ শীতল সকাল আর তার সাথে দিথীকে পাশে জড়িয়ে ধরে সূর্যোদয় দেখা। আহাহাহা , এটাই তো জীবন। আমাকে শ্রীমঙ্গলেই বাড়ি কিনতে হবে। আর এটাই ফাইনাল। তার আগে নিপার বিবাহের বন্দোবস্ত শেষ করে ফেলি। ওর পরেই আমার সিরিয়াল। হিহিহি।”

এক হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে বেড রুম থেকে ট্রাউজার আর টি শার্ট পড়ে বেড়িয়ে যায় শাহারিয়া। ২ সপ্তাহ হলো জিম যাওয়া হয়নি। শরীরে মেদ জমতে শুরু করে দিবে যে তখন। তাই এখনকার গন্তব্য সকালের হালকা নাস্তা সেরে জিম যাওয়া। বডি তো অক্ষুন্ন রাখতে হবে তাই না , ! “নাহলে পড়ে তখন দিথী বলবে যুবক বয়সে ভুড়ি বাড়িয়ে বসে রয়েছি বিয়ের জন্য। হা হা হা ” হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় শাহারিয়া।

 

 

টিনের চালে কবুতর দের বেড়ানোর শব্দ। বাক-বাকুম, বাক-বাকুম‌ শব্দে চারিধার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মায়ার ঘুম ভাঙ্গে। কবুতর গুলো তাদেরই। সকাল হলেই টিনের চালের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াবে আর বাক-বাকুম ডাক পাড়বে। মায়া ধীরে ধীরে উঠে বসে। তাকে রাতুল এখন আর বিছানার সাইডে শুইতে দেয় না। তাকে দেয়ালের পাশ টায় শুতে দিয়ে রাতুল নিজে শোয় সাইডের দিকটায়। রাতুলের ভাষ্য একটাই, মায়া সাইডে ঘুমালে যদি রাতে পড়ে যায়। সে কারণে সে দেয়ালের পাশ টায় ঘুমাবে। মায়া উঠে বসে চারদিক তাকিয়ে ‌দেখে বেলা হয়েছে অনেক। পাশে তাকিয়ে দেখে রাতুল নেই। উঠে গিয়েছে তার আগেই, কিন্তু তাকে ডাকেনি। সে হাই তুলতে তুলতে উপরে ঘড়ির দিকে তাকায়। 

– ওমা। ৯ টা বেজে গেছে , ! আজ এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি , ! কাল রাতে রাতুলের গল্প আবৃত্তি শুনতে গিয়েই এই হাল। (একটু থেমে উৎসুক হয়ে) আরে , ! রিয়াদ তো থানায় যাবে। ওর নাস্তা , ? ছেলেটা নিশ্চয়ই আজ আমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে না খেয়ে গেছে‌। রাতুলও না , ! আমাকে একটা ডাক দিবেনা , ? 

বলেই শাড়ি ঠিক করতে করতে বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হয় মায়া। তখনই ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে রাতুল। হাতে নাস্তা সজ্জিত ট্রে। মায়া রাতুলকে এসব হাতে আসতে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। রাতুল এসে ট্রে টা বিছানার পাশের টেবিল টায় রাখে। রেখে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা গামছা টায় হাত মুছতে মুছতে বিছানায় বসে। মায়া তাকে উদ্দেশ্য করে অবাক কন্ঠে বলে।

– তুমি এসব কখন বানালে , ? আর, আর তুমি যখন উঠলে আমাকে একটা ডাক দিতে পারলেনা , ! রিয়াদ বেচারা না খেয়েই থানায় চলে গেলো। 

– কে বলছে না খেয়ে গেছে ? আমি নাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলাম। ও খেয়ে তারপর গেছে। ফজরের নামাজ পড়ার পর তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। আমার ঘুম আসছিলো না। তাই আমি কিছুক্ষণ পর উঠে আঙিনা ঝাড়ু, নাস্তা বানানো সব করে ফেলেছি। আচ্ছা সেসব কথা বাদ দেও। আসো, চলো ফ্রেশ হয়ে নিবে চলো। 

– তুমি নাস্তা করেছো , ? 

– তোমাকে রেখে কী আমি খেতে পারি , ! (মায়ার নাকের অগ্রভাগে এক আলতো ছোঁয়া দিয়ে।) চলো, ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর একসাথে নাস্তা করবো।

মায়া টেবিলের দিকে তাকায়। দেখে ট্রেতে একটা বাটিতে সেমাই রাখা, আরেক বাটিতে দই-চিড়া, তার পাশে দুটো কলা, একটা সিদ্ধ ডিম, আর এক গ্লাস দুধ। 

– এতো গুলো কীভাবে খাবো আমি, ! আমার পক্ষে এতো খাওয়া সম্ভব না। আর সকাল বেলা ডিম, দুধ, দই-চিড়া এসব , ! আমার এগুলো খেতে ভালো লাগে না রাতুল।

– ভালো না লাগলেও খেতে হবে মায়া। তোমার এখন পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে ৩ বেলাই। ডাক্তার রুটিন করে দিয়েছে। মনে রেখো, তোমার শরীরে যথাযত পুষ্টি মানেই আমাদের আগত সন্তানের সুস্থ, স্বাভাবিক থাকা,।

– কিন্তু রাতুল, ! 

– কোন কিন্তু না জান। চলো ফ্রেশ হয়ে নিবে চলো। সময়মতো খাবার খেতে বলেছেন কিন্তু ডাক্তার সাব। চলো।

মায়া কিছু বলেনা। ছোট বাচ্চাদের মতো মুখ গোমড়া করে রাখে। তার এসব খাবার ভালো লাগে না। তারপরও রাতুল তাকে না খাইয়ে ছাড়বেও না। রাতুল মায়ার হাত ধরে তাকে ধীরে ধীরে নামাতে থাকে বিছানা থেকে। বিছানা থেকে নামিয়ে রাতুল নিজ হাতে মায়ার শরীরের শাড়ি ঠিক করে দেয়। মায়ার কিছুটা লজ্জা লাগছিলো। কিন্তু নিজেরই স্বামী তার শাড়ির কুচি আর আঁচল ঠিক করে দিচ্ছে তাতে একটু লজ্জার পাশপাশি ভালোলাগাও কাজ করছিলো। রাতুল তার কাপড় ঠিক ঠাক করে দিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে নিয়ে যেতে থাকে ঘর থেকে। মায়াও এক হাত দিয়ে রাতুলের হাত ধরে, আরেক হাত দিয়ে শাড়ি কুচি টেনে ‌ধরে রুম থেকে ২ কদম সিড়ি বেয়ে নিচে নামে। বাইরের সুন্দর নির্মল আবহাওয়া, তার পাশপাশি রাতুলের মতো একটা নির্ভরতার ছায়ায় নিজেকে পেয়ে দারুন খুশি লাগছে তার। প্রশান্তির সুদ্ধ নির্মল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তার মনে, ! 

 

 

খাঁন বাড়ি। করিডোর দিয়ে হেঁটে অন্দরমহলে আসলেন সুরাইয়া বেগম। খাঁন বাড়ির সবগুলো চরিত্রকে সহজ ভাবে আপনাদের কাছে আবার তুলে ‌ধরি। বাড়ির প্রধান কর্তা হলেন রায়হানের দাদা আব্দুল ওহাব খাঁন। তিনি বিছানায় পড়েছেন অনেক দিন হলো। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে নজরুল খান, মেজো ছেলে শাহেদ খান, আর ছোট মেয়ে সুরাইয়া বেগম। নজরুল খান এর পত্নী হলেন সুমনা বেগম। তাদের দুই ছেলে, বড় ছেলে হচ্ছে রাফসান। সে ঢাকায় আছে বর্তমান। সেখানে তাদের পারিবারিক পোল্ট্রি ব্যবসার দেখা শোনা করছে সে। আর ছোট ছেলে রায়হান। সেও ঢাকাতেই ব্যবসা দেখা শোনা করতো।

১ মাস হলো গ্রামে এসেছে একটু অবসর সময় কাটাতে। আব্দুল ওহাবের দ্বিতীয় ছেলে শাহেদের পত্নী সাথী খাতুন। তাদের এক ছেলে। নাম সাদিক খান। আর আব্দুল ওহাবের ছোট মেয়ের নাম সুরাইয়া। তার বিয়ে হয়েছিলো মাহবুর নামে একজন আইনজীবীর সাথে। তিনি ৮ বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সুরাইয়া বেগম আর মাহবুরের এক মেয়ে। নাম আলিশা রহমান। সুরাইয়া বেগম তার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এই খান বাড়িতেই থাকেন তার মেয়ে আলিশার সাথে। আলিশা আর ২ মাস পর এসএসসি পরীক্ষা দিবে। তো আবার ফিরে আসি ঘটনায়,

সুরাইয়া বেগম করিডোর দিয়ে হেঁটে অন্দরমহলে আসলেন। তিনি খুবই নিশ্চুপ স্বভাবের। সবসময় একলা থাকতে পছন্দ করেন। সবসময় ঘরে থাকেন। সেলাইয়ের কাজ করে সময় কাটান। যদিও তার ভাইয়েরা তাকে খাওয়ায়। তাও তিনি সেলাইয়ের কাজ করেন। খুব দরকার ছাড়া তিনি ঘর থেকে বের হন না। এখন বেড়িয়েছেন আঁখির কাছে যাওয়ার জন্য। বাড়ির বড় ঘড়িটায় দুপুর ১২ টা বাজার ঘন্টা বাজতে লাগলো। তিনি অন্দরমহল দিয়ে হেঁটে রান্না ঘরের দিকটায় যান। দেখেন আঁখি রান্না করছে দুপুরের। তিনি ভিতরে যান। এক সরল গলায় বলেন।

– আঁখি,। তোকে আমি খুঁজতেছি।

আঁখি রান্না করতে করতে পিছনে একবার ফিরে, তারপর সামনে ফিরে বলে। সুরাইয়া বেগম আবার বলে

 – শোন, আমার আর আলিশার কাপড় গুলো ধুয়ে দিস তো। ঘরে রাখা আছে।

 – আইচ্ছা খালাম্মা। হইয়া যাইবো।

বলেই করাইতে ভাঁজতে থাকা পিঁয়াজ,মরিচ বেরেস্তাতে হলুদ দিতে থাকে আঁখি। সুরাইয়া বেগম পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন। আঁখি  ছোট্ট গুঁড়া মসলা উঠানোর চামচ দিয়ে ২ চামচ হলুদ দেয়। সাথে সাথেই সুরাইয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে বলতে থাকেন

– আয় হায়। এতো হলুদ দিছিস ক্যান। হলুদ দিবি তুই হাফ চামচ।

– কিন্তু খালাম্মা এইডা তো চা-চামচ না। এইডা ছোট্টো মসলা উঠানোর চামচ। এইডা দিয়া ২ চামচ হলুদই দিতে কইছে সুমনা আফায়।

– ও বললেই হইলো। তুই হলুদ উঠা। জানিস হলুদের কী দাম। কাঁচা হলুদ এক কেজি ২০০ টাকা। ঐটা ভাঙানির খরচ তো আরো আছেই। হলুদ সবসময় কম ব্যবহার করবি। হলুদ উঠায় রাখ।

– কিন্তু এইডাতো দিয়া দিছি।

– নাড়িস তো আর নাই। নাড়ার আগেই উঠায় রাখ। জিনিস পত্রের দাম দিন দিন বাড়েই যাইতেছে। আর এ এদিকে বেশি বেশি ব্যবহার করতেছে।

 

তখনই রান্না ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান সুমনা বেগম। তিনি কঠোর স্বরে বলেন।

– কী হইছেরে আঁখি , ?

সুরাইয়া বেগম সুমনার কথার আওয়াজ শুনে চুপচাপ হয়ে সাইডে সড়ে যান। আঁখি বলে।

– আফা, সুরাইয়া খালায় কয় হলুদ কম ব্যবহার করতে। আপনি যেই পরিমান অনুযায়ী দিতে কইছেন ঐ অনুযায়ীই দিছি। তারপরও,!

সুরাইয়া বেগম আঁখির দিকে ফিরে বলে।

– ওকে বল যে বাপের বাড়ি থেকে আনে তারপর রান্নায় দিতে‌। আমার ভাইয়ের টাকা গুলা এইভাবেই নষ্ট করতেছে। ভাইয়াও নেহাতই ভালো। নাইলে তো, হুঁ।

 

সুমনা বেগমকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলেন সুরাইয়া বেগম। সুমনা বেগম নিজের রাগ কে কন্ট্রোল করেন। তিনি জানেন এই পাগল মহিলার কথার উত্তর দিতে গেলে বাড়িতে রিতিমত একটা ঝগড়াই লেগে যাবে। সুমনা বেগম সহ বাড়ির সবাই তাকে পাগলই মনে করেন। সবসময় একঘুরে হয়ে থাকা,যখন বের হয় তখন এসে চটাং চটাং কথা শুনিয়ে যায়। এসব ব্যবহারের কারণে তাকে বাড়ির সবাই একপ্রকার পাগল মনে করেই ইগনোর করে। তিনি আবার খুব কৃপণও। সব জিনিস কম কম করে ব্যবহার করতে বলেন, নিজে একটা কাপড় অনেক দিন পড়েন। অন্যজনকেও পড়তে বলেন। এছাড়াও আরো অনেক অনেক সমস্যা তার। তাই তাকে দেখতে পারেন না সুমনা বেগম। বাকিরাও তাকে ইগনোর করে চলে। তবে সুরাইয়া বেগমের মেয়ে আলিশার সাথে বাড়ির সবার সম্পর্কই ভালো। সবাই আদর, স্নেহ করে তাকে। এমনকি গম্ভীর স্বভাবের সুমনা বেগমও আলিশার সাথে বেশ হাসিখুশিই কথা বলেন।

সুরাইয়া বেগম রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর সুমনা বেগম রান্না ঘরে ঢুকেন। দুপুরের রান্নাতে তিনিও হাত লাগাতে থাকেন আঁখির সাথে। 

 

 

মেম্বার বাড়ি। বারান্দার ডায়নিং টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন মতিন মেম্বার। তার পাশে দাঁড়িয়ে তার কিছু লাগবে কি না তা দেখছে ফুলমতি। এখন সময় দুপুর দেড়টা। গরম পড়েছে বেশ ভালোই। রোদের তাপ আজ গায়ে লাগার মতো। শিউলি বেগম রান্না ঘর থেকে একটা তরকারির বাটি নিয়ে বের হয়ে আসেন। আঙিনা পেড়িয়ে বারান্দায় উঠে ডায়নিং টেবিলে রাখেন। রেখে ফুলমতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

– শোন ফুলমতি। আমি এহানে তোর চাচার লগে খারাইতাছি। তুই যাইয়া গোসল দিয়া আয়। লায়লার গোসল মনে হয় শ্যাষের দিকে। তুই যা। আমি তোর চাচারে খাওয়াইয়া তারপর গোসল দিতে যামু।

– আইচ্ছা চাচি। 

ফুলমতি চলে যেতে থাকে গোসল খানার দিকে‌। শিউলি বেগম গিয়ে মতিন মেম্বারের পাশে দাঁড়ান। মতিন মেম্বার বলতে থাকেন

– এতো বেলা হইয়া গেছে এহনো গোসল দেও নাই ক্যা , !

– তোমার লাইগা। তুমিই তো আইতে দেরি করলা।

– আমার লগে তোমার গোসলের সম্পর্ক কী বুঝলাম না।

– তুমি আইবা। আমারে গোসল করাইয়া দিবা।

– হ। ঐ রং ধংয়ের বয়স কী অহনো আছে নি। (বলেই মুখে এক নলা ভাত তুলে নেন মতিন মেম্বার)

– আমাগো বয়স তো গেছে। পোলা মাইয়াডির বয়স যে যাইতাছে ঐদিকে খেয়াল কী তোমার আছে , ? খালি তো পরছো ইলেকশন লইয়া। ঐদিকে তোমার পোলা হইয়া গেছে বড়, মাইয়ার বিয়ার বয়স হইয়া গেছে। তোমারে কী সব খুইলা কওন লাগবো নাকি এহন, ! 

– ন,না। থাক। তোমার মুহের আবার ঠিক-ঠিকানা নাই। কী কইতে কী কইয়া লাইবা তহন। (একটু থেমে এক নলা ভাত মুখে দিয়ে) তো এহন কী ওগো বিয়া সাদি দেওয়ার কথা কইতাছো , ! 

– নাহ ,! আমারে বিয়া দিতে কইতাছি তোমারে। বুইড়া খাডাস একটা। (তরকারির বাটি থেকে তরকারি তুলে দিয়ে ধীর গলায়) ঐযে নাজমুল খান আছেনা, ! ঐযে তোমার আব্বার বন্ধু আব্দুল ওহাব এর পোলা নাজমুল। অর পোলা রায়হান বিজনেস করে। মেলা বড় ব্যবসা আছে ওগো ঢাকায়। গরু, মুরগি, মাছ এইসবের বড় বড় খামার আছে ওগো কম্পানির। ঐ রায়হান রে তোমার মাইয়া পছন্দ করে। 

– হ্যাঁ , ! কী কও, ! আমার মাইয়া পছন্দ করে ? (একটু থেমে স্বাভাবিক হয়ে) অবশ্য পোলাডা খারাপ না। আদব কায়দা ভালাই। দেখা হইলে অর বাপের মতোই সম্মান, শ্রদ্ধা করে ভালাই। ব্যবসাও ভালো ওগো।(একটু থেমে)  কথাবার্তা আগানো যায়,! (মুখে ভাতের নলা তুলেন মতিন মেম্বার)

– হমম। পোলার জাত-বংশও ভালো। পোলাডাও ভালো। আবার নিপার লগে সম্পর্কও আছে। তাইলে কী কও। এহানেই দিবা , ! 

– তোমার মাইয়ার কী মত , ! 

– আমার মাইয়া তো আগে থেইকাই এক ঠ্যাংয়ে খারা।

– আর তোমার , ! 

– আমার মতের আরো দাম আছেনি তোমার ধারে হ্যা , ! রাইতে যহন কই এহন ঘুমামু ছাড়ো,! তহন কই মতের দাম দাও , ! 

 

কথা শুনেই মতিন মেম্বারের কাশি উঠে যায়। শিউলি বেগম মিটিমিটি করে হাসতে হাসতে এক গ্লাস পানি মুখের সামনে ধরেন। মতিন মেম্বার গ্লাস টা হাতে নিতে চান। কিন্তু শিউলি বেগম তার হাতে গ্লাস টা না দিয়ে নিজ হাতে পানি খাইয়ে দিতে থাকেন তাকে। হঠাৎ এমন কথা বলাতে হাসতে গিয়ে কাশি উঠে গেছে। শিউলি বেগম পানি খাইয়ে দিতে দিতে মতিন মেম্বারের পিঠে হাত দিয়ে ঘষতে থাকেন যেন কাশি টা থেমে যায়। 

পুরো গ্লাসের পানি শেষ করার পর মতিন মেম্বারের কাশি থামে। নাকে-মুখে ঝাল উঠে যাওয়ায় চোখ দিয়ে পানিও বের হয়ে গেছে। মতিন মেম্বার স্বাভাবিক হতে হতে বলেন

– খাওয়ার সময় হাসির কথা কইবানাতো। সবসময় খালি মজা। 

– আচ্ছা আচ্ছা। এহন শান্তি কইরা খাও। (মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে) তো তোমার কী মত, ? 

– দেও। ভালোই আছে। এহন ওরা সম্মন্ধ লইয়া আইলেই তারিখ পাকা করতাছি।

– সত্যি, ! আমার গুলুমুলু জামাই টা,। উম্মাহহ , (মতিন মেম্বারের গালে এক বড় চুমু খেয়ে) আমি এহনি যাইয়া নিপারে কইতাছি,! (বলেই হনহন করে নিপার রুমের দিকে চলে যান শিউলি বেগম)

– ২ মাইয়া-পোলার বিয়ার বয়স হইছে তাও শিউলি বেগমের ছেলেমানুষী এহনো গেলো না, (বলেই ভাতের নলা মুখে দেন তিনি) আইজ লিপি বাইচা থাকলে, শাহারিয়ার বিয়ার খবরে অয়ও এমন খুশি হইতো ,। খুব খুশি হইতো, ! (বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মতিন মেম্বার। লিপি তার প্রথম স্ত্রীর নাম। অর্থাৎ শাহারিয়ার মায়ের নাম। তাদের প্রেম করে বিয়ে হয়েছিলো। অনেক ভালোবাসতেন তাকে মতিন। কিন্তু সবকিছুই এক মুহুর্তেই হারিয়ে যায় এক ঝড়ের আগমনে। নিজ হাতে যত্নে সাজানো তাশের ঘর ছোট্ট একটা ভুলে ধুলোয় মিশে যায় সঙ্গে সঙ্গে। পরিসমাপ্তি ঘটে এক অবলোকন অধ্যায়ের,! তবে এখনো ডায়রির পুরোনো পাতায় সেটা জীবন্ত হয়ে আছে। জীবন্ত হয়ে আছে প্রতিশোধের জলন্ত আগুনের উৎস হয়ে, ! 

 

 

নীলগিরি জঙ্গলের মাঝের পুরনো রাস্তা। একসময় এই রাস্তাই ছিলো একমাত্র রাস্তা যেটা দিয়ে এই আনন্দ পুরে যাওয়া আসা করা যেতো। আনন্দ পুর গ্রাম টা প্রাচীন আমল থেকেই এক ঘন জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম ছিলো। মাঝখানে গ্রাম টা ছিলো এবং এর চারপাশে গোল করে ছিলো নীলগিরি জঙ্গল। বৃটিশ আমলে এই গ্রামের মধ্যে যাওয়া আসা করার জন্য ৬ কিলোমিটার জঙ্গল কেটে তৈরি করা হয় পাকা রাস্তা। এই রাস্তাটা এখনো রয়ে গেছে কালের বিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে। 

সময়টা বিকাল। দুজন বোরখা পড়া মেয়ে রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে আসছে। তাদের পিছনে প্রায় ৩০০ হাত দূরে গ্রামের কিছু দোকান দেখা যাচ্ছে। তারমানে মেয়ে দুটো গ্রাম থেকেই এই রাস্তা হয়ে মেইন রোডে যাওয়ার জন্য উঠেছে। মেয়েদুটোর মুখ ঢাকা। দু’জনেই বার বার চারপাশে তাকাচ্ছে। হেঁটে কিছুটা সামনে আসার পর মেয়ে দুজন রাস্তার মাঝেই দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে মুখের উপর থেকে বোরখার কালো কাপড় টা সড়ায়। আমরা দেখতে পাই মেয়ে দুইটা সামিহা আর দিথী। তারা অনেকটা পথ হেঁটে এসে হাঁপিয়ে উঠেছে। তারা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে মুখের ঘাম মুছতে থাকে। দিথী বলে‌।

– আরেকটু সামনে চল। আমাদের স্বপ্নে দেখা সেই জঙ্গল বেষ্টিত রাস্তাটা এটাই। আর আমরা যদি ভুল না করি তাহলে আরো কিছুদুর সামনে আমরা তাসনুবার শশুর বাড়ি দেখতে পাবো।

– কিন্তু আমরা তো স্বপ্নে দেখতাম তাসনুবার ঘরে ১৯৯৬ সালের ক্যালেন্ডার ঝোলানো।‌ আর এই রাস্তা, গ্রামের মানুষ সব অপরিচিত ছিল। তারমানে আমরা ১৯৯৬ সালের এই যায়গাটাকে স্বপ্নে দেখতাম। (একটু থেমে) তোর কী মনে হয় এখানে ১৯ বছর পরও সেই বাড়িটা থাকবে।

– এখন বাড়িটায় কেউ না কেউ তো থাকবেই। চল। পরে দেরি হয়ে যাবে। আর এই জঙ্গলেই যদি সন্ধ্যা নেমে যায় তখন তো মুশকিল। 

– আচ্ছা চল।

তারা দুজনেই আবার পা বাড়াতে থাকে। বিকেল সময়। আছরের আযান দিয়েছে হয়েছে অনেকক্ষণ। দিথী এখনো সেই জোশেই আছে। সে যাবে আর দেখবে তাসনুবার বাড়ি। দেখবে তাসনুবা এখনো বেঁচে আছে কী না। এদিকে সামিহার মনে ভয় হচ্ছে। তারা একলা দুইটা মেয়ে এমন নির্জন জঙ্গলে যদি হারিয়ে যায়। তখন কী হবে ? তারা বাসাতেও‌ জানিয়ে আসেনি। হারিয়ে গেলে তখন , ! 

 

২০ মিনিট পর

বেশ অনেকক্ষণ ধরেই হাঁটছে দুজন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার উপক্রম। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা নীড়ে ফিরে আসছে। দিথী উৎসুক হয়ে এখনো এগিয়েই যাচ্ছে সেদিকে। সামিহার ভয় এখনো হচ্ছে। আর দিথীও কেমন। সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে তাও তার কৌতুহলী মন মানছে না , ? সামিহা দিথীকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতেই যাবে। তখনই সে দেখে কিছু দূরে একটা পুরোনো লতাপাতায় আচ্ছাদিত ঘর দেখা যাচ্ছে রাস্তার পাশে। আগাছা জন্মে ঘরের দেওয়াল সবুজ রঙের হয়ে গিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক বছর থেকেই পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বাড়িটা। বাড়িটা দেখতে পেয়েই দিথী তাড়াতাড়ি পা চালাতে থাকে। সামিহার কেন যানি মন মানছে না। তার মনে হচ্ছে বাড়িটায় গেলে তাদের ক্ষতি হবে। এদিকে উপর সূর্য ডোবার লাল আভায় আকাশ ছেয়ে গিয়েছে‌। এখন সেই বাড়িতে গেলে ওখানেই তো রাত নেমে আসবে। তখন তারা এতো লম্বা পথ ফিরে যাবে কী করে , ! সাথে কোন টর্চ ও আনেনি তারা।

সামিহার আর মন মানে না। সে দিথীকে বলে।

– চল ফিরে যাই। রাত নেমে আসতেছে। একটু পরই মাগরিবের আযান দিয়ে দিবে। আমাদের হাতে কিন্তু লাইটও নাই যে রাত হলে পথ দেখে দেখে বাড়ি ফিরতে পারবো। 

দিথীর থেকে কোন প্রদুত্তর আসে না। উল্টো দিথী আরো জোরে জোরে পা চালিয়ে বাড়িটার দিকে যাচ্ছে। তারা বাড়িটার খুব কাছেই চলে এসেছে। সামিহা দিথীকে আবার বলতে থাকে।

– চল নারে বোন। আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ বাড়ি চল। (দিথীর হাত ধরে) চল প্লিজ।

সামিহা যখনই দিথীর হাত ধরলো তখনই এক ঠান্ডা অনুভূতি হতে শুরু করলো তার। যেন কোন বরফে হাত দিয়েছে সে। দিথী তার চলার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। সামিহাও পিছু পিছু আসতে থাকে তার। বারবার দিথীকে ডাকছে ফিরে যাওয়ার জন্য। দিথীর হাত ধরে টানছে। এবং এভাবে করতে করতে তারা বাড়িটার একদম সামনে এসে যায়। সূর্য পশ্চিম প্রান্তে অনেকটা ডুবে গিয়েছে। চারপাশ গাছ গাছলিতে ভরা তাই অন্ধকার দৃশ্যমান হতে থাকে। দিথী ঠিক বাড়িটার সামনে এসে একদম থেমে যায়। দিথী বাড়িটার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। সামিহা গিয়ে দিথীর কাঁধে হাত রাখে। বলতে থাকে‌।

– দিথী তুই ফিরে যাবি ? দেখ, আমার কিন্তু এখন রাগ হচ্ছে। তুই না গেলে কিন্তু আমি নিজে একলাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। 

দিথী চুপচাপ। কোন উত্তর নেই। সামিহা এবার কড়া গলায় বলে।

– দিথী। আমি কিন্তু সিরিয়াস। তুই যাবি , ? তুই না গেলে থাক আমি চলে যাই। 

বলেই সামিহা যেতে থাকে। দিথীকে ছেড়ে সামনে ৪-৫ কদম এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ এক মোটা কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে।

– আগে তোমার কাছে থাকা সেই আংটিটা তো দিয়ে যাও সাবিনা, ! 

সামিহা গলা টা শুনেই দাঁড়িয়ে যায়। এ গলাটাতো দিথীর না। উল্টো এই গলাটাও তার কাছে পরিচিত পরিচিত লাগছে। সামিহা পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে দিথী এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে এখনো বোরখার কালো কাপড় দেওয়া। সামিহা উৎসুক গলায় বলতে থাকে।

– সাবিনা কে , ? এখানে তো তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই দিথী ,!

– তুইই সাবিনার পুনর্জন্ম। এখন বল সেই আংটিটা কোথায় (এক ভারী কন্ঠে)

– পুনর্জন্ম মানে ? তুই কী বলছিস কিছুই বুঝছিনা। আর কোন আংটির কথা বলছিস তুই ? ঐ টা ? যেটা জ্বল জ্বল করে ? ঐটা তো বাসায়।

– তার মানে তুই আংটিটা দিবিনা তো ? 

– আমি কখন বললাম। আমি দি,

সামিহার কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই তার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। সে দেখে দিথীর‌ হাত পা হঠাৎ উল্টো হয়ে গেছে। দিথী মাথা তুলে সামিহার দিকে ফিরে তাকায় এবং সাথে সাথেই মুখের উপর থেকে বোরখার কাপড় টা সড়ে যায়। বোরখার ভিতরে ছিলো এক নর কঙ্কাল। যার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিলো। সামিহা দিথীকে এমন হতে দেখেই এক জোড়ে চিৎকার দেয়। সে দৌড় দেয় সেখান থেকে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে। তখনই আমরা দেখি সেই দিথী রুপি বোরখা পরিহিত নরকঙ্কাল টাও উল্টো হাত পা নিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসতে থাকে।

অন্ধকার নামতে থাকা অবস্থায় সেই বিভৎস জিনিসটাকে দেখে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। সামিহার দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ রাস্তার এক খানাখন্দে পা মচকে পড়ে যায়। সে বিভৎস জিনিসটা এসে সামিহার পিছনে থামে যায়। সামিহা নিজেকে রাস্তার সাথে শোয়া অবস্থায় হাত দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। তখনই সেই বিভৎস জিনিসটা থেকে এক কালো ধোঁয়া বের হয়ে সামিহার দেহের ভিতর ঢুকে যেতে থাকে। সামিহা জোড়ে এক আত্মচিৎকার দেয়। তার আত্মচিৎকারে আশপাশের গাছের পাখি গুলো উড়ে চলে যেতে থাকে। এতো জোরে চিৎকার দিচ্ছে যেন আরেকটু হলেই তার কন্ঠনালি ছিঁড়ে যাবে। কালো ধোঁয়া টুকু ধীরে ধীরে সম্পূর্ণটাই তার ভিতরে চলে যায়। সামিহা উবুড় হয়েই রাস্তায় পড়ে যায়। তার‌ পিছনে থাকা বিভৎস জিনিসটাও সাথে সাথেই গায়েব হয়ে যায়। চারপাশ নিরব হয়ে উঠে। গাছের কোন পাতা পড়ারও শব্দ পাওয়া যায় না। প্রকৃতি একদম নিশ্চুপ, শান্ত হয়ে যায়।

 কিছুক্ষণ পর সামিহা হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে থাকে। একদম স্বাভাবিক ভাবে উঠে দাঁড়ায় সে। এতোক্ষণ যেন কিছুই হয়নি তার সাথে। তখনই সামিহা তার মুখের উপর থেকে বোরখার কালো কাপড় টা সড়ে যায়। তার চোখ গুলো ছিলো একদম লাল। এবং তৎক্ষণাৎ তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক রহস্যময় হাসি,! 

 

চলবে ,,,,,

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৪

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

[১৮+ রেড এলার্ট 🛑]

 

সামিহা জোড়ে এক আত্মচিৎকার দেয়। তার আত্মচিৎকারে আশপাশের গাছের পাখি গুলো উড়ে চলে যেতে থাকে। এতো জোরে চিৎকার দিচ্ছে যেন আরেকটু হলেই তার কন্ঠনালি ছিঁড়ে যাবে। কালো ধোঁয়া টুকু ধীরে ধীরে সম্পূর্ণটাই তার ভিতরে চলে যায়। সামিহা উবুড় হয়েই রাস্তায় পড়ে যায়। তার‌ পিছনে থাকা বিভৎস জিনিসটাও সাথে সাথেই গায়েব হয়ে যায়। চারপাশ নিরব হয়ে উঠে। গাছের কোন পাতা পড়ারও শব্দ পাওয়া যায় না। প্রকৃতি একদম নিশ্চুপ, শান্ত হয়ে যায়।

 কিছুক্ষণ পর সামিহা হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে থাকে। একদম স্বাভাবিক ভাবে উঠে দাঁড়ায় সে। এতোক্ষণ যেন কিছুই হয়নি তার সাথে। তখনই সামিহা তার মুখের উপর থেকে বোরখার কালো কাপড় টা সড়ে যায়। তার চোখ গুলো ছিলো একদম লাল। এবং তৎক্ষণাৎ তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক রহস্যময় হাসি,! 

 

 

চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। বাসায় সামিহা নেই। এই খবর শেফালীর মুখ থেকে শোনার পর পরই একটা টর্চ হাতে বেড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় দিথী। সামিহা হঠাৎ বিকেল থেকে কোথায় উধাও হলো, ! বাসায় অন্তর সাহেবও নেই। থাকলে তার সাহায্যে সামিহাকে খুঁজতে বের হতো দিথী। 

হাতে এক টর্চ নিয়ে শেফালী পাশ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে যায় দিথী। মনে দুঃশ্চিন্তা। হঠাৎ করে আসা স্বপ্ন, এক অদ্ভুত আংটি, তার মধ্যে আবার সামিহার উধাও হওয়া। দিথী গিয়ে বাড়ির মেইন দরজা টা খোলার সাথে সাথেই দেখে সামিহা বাইরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে বোরখা নেই। স্বাভাবিক কাপড়। দিথী সামিহাকে এভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে একটূ চমকেই উঠে। দিথী গিয়ে সামিহার সামনে দাঁড়ায়। সামিহা মুখ তোলে। সামিহার চোখ ভেজা। দিথী তার কাঁধে হাত রেখে বলে।

– কী হয়েছে আপু। তুমি কাঁদছো কেনো ,? আর তুমি কোথায় গিয়েছিলে , ? রাত নেমে এসেছে। জানো কত চিন্তা হচ্ছিলো তোমার জন্য , ! 

সামিহা চোখ মুছতে মুছতে বলে।

– আ,আমি একটু আমার দাদুর কবরের কাছে গিয়েছিলাম। দাদুর কথা, দাদুর কথা খুব মনে পড়ছিলো। 

– যাওয়ার সময় তুমি কাউকে বলেও যাবানা,! এদিকে কত চিন্তা হচ্ছিল আমাদের , ! আসো ভিতরে আসো।

 

সামিহার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে থাকে দিথী। সামিহাও তার সাথে যেতে থাকে। চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। মাগরিবের আযান শেষ হয়েছে মিনিট ৩০ আগে‌।  ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর ঠান্ডা বাতাস মিলে এক শীতের আবহ তৈরি করে ফেলেছে।

 

সামিহাকে সাথে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে দিথী। নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে। তার পাশে দিথীও বসে‌। তার হাতে হাত রেখে বলে। 

– আমি দেখলাম তুমি বিকেলে ঘুমাচ্ছো। তাই চলে গেলাম নিপাদের বাসায়। কিন্তু পরে এসে দেখি তুমি ঘরে নেই। শেফালীকে ডেকে তোমার কথা জিগ্যেস করি। সেও বলে তোমাকে সে কোথাও যেতে দেখেনি। তুমি যাওয়ার আগে একবার বলে যাবেনা আমাদের , ! 

– আচ্ছা বাবা সরি। আর হবেনা। এরপর থেকে কোথাও গেলে জানিয়ে যাবো।

– হয়েছে আর সরি বলতে হবেনা। তুমি এখানে থাকো। আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।

বলেই সামিহার পাশ থেকে উঠে যায় দিথী। ঘর থেকে বের হয়ে যায় নাস্তা আনতে। সামিহা এক স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। দিথীকে শেষ মেষ উল্টোপাল্টা বুঝাতে পেরেছে সে‌। হঠাৎ তার শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠতে থাকে। তার চোখ গুলো উল্টে যেতে থাকে। তারপর তার ভিতর থেকেই এক গম্ভীর আওয়াজ কেউ বলে।

– আংটিটা কোথায় রেখেছিস বল।(একটু থেমে) কী হলো বলছিস না কেন , ?  তাড়াতাড়ি বল,!

তখনই আবার সামিহার কন্ঠে সামিহার অবচেতন শরীর বলে‌।

– ও,ঐ। ঐ টেবিলের পাশের ছোট কলম বক্স টায় আছে‌। 

 

তখনই সামিহা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। রোবটের মতো এগিয়ে যায় টেবিল টার দিকে। গিয়ে বক্সটা নিয়ে বক্সের সবকিছু টেবিলে উপুড় করে ঢেলে দেয়। তখনই সেগুলোর মধ্যে থেকে চকচক করতে থাকে আংটিটি। সামিহার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক শয়তানি হাসি। সেই সেই আংটিটাকে হাতে নেয়। বলতে থাকে। 

– এইটাই একমাত্র আসুভের মৃত্যু। এইটাকে ধ্বংস করা মানে আসুভের মৃত্যুকে ধ্বংস করা। হা হা হা হা

– কী হয়েছে আপু , ? 

হঠাৎ পিছন থেকে দিথীর কথা শুনতে পেরে সামিহা চমকে উঠে। আর সাথে সাথেই হাত থেকে আংটিটা ফ্লোরে পড়ে যায়। গড়িয়ে গিয়ে দিথীর পায়ের সামনে পড়ে। দিথীরও চোখ এড়ায় না সেই আংটিটা। দিথী এক হাতে নাস্তার ট্রে টা ধরে আরেক হাত দিয়ে হেলে সেই আংটিটা হাতে তুলে। ট্রে টা বিছানায় রাখতে রাখতে বলে।

– এই আংটিটা তুমি কোথায় পেলে আপু, ! 

তখনই সামিহার উল্টে যাওয়া চোখ স্বাভাবিক হতে থাকে। সামিহার ফিরে দিথীর দিকে তাকায়। আর একটু নার্ভাস হয়ে আমতা আমতা করে বলে।

– ইয়ে মানে। (একটু থেমে) পরসুদিন এই আংটিটা আমি ঘুম থেকে উঠে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখি তো। তাই ভাবলাম এটা হয়তো তোমারই হবে। তাই রেখে দিয়েছিলাম তোমাকে দেওয়ার জন্য। আর এখন তোমাকে দেওয়ার জন্যই সেটা বক্স থেকে বের করলাম। এই আরকি। আর কিছু না।

– ও তাই বলো। নেও নাস্তা গুলো খেয়ে নাও। 

সামিহা ধীরে ধীরে এসে বিছানায় বসে। দিথী গিয়ে তার পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসে। চেয়ার ঘুড়িয়ে সামিহার দিকে মুখ করে বলতে থাকে। 

– জানো আপু। এই আংটিটা না আসলেই আজব। দেখো কেমন উজ্জ্বল আলো বেড়োচ্ছে আংটিটা থেকে। আর ডিজাইন টাও কেমন অদ্ভুত। এরকম অদ্ভুত আংটি আগে আমি কখনো দেখিনি। 

– হ,হ্যা। হ্যা আসলেই অদ্ভুত ।(একটু নার্ভাসের সহিত উত্তর দেয় সামিহা।

– আচ্ছা আপু তুমি নাস্তা খাও। আমি একটু আংটিটা পড়ে দেখি।

– না না। এটা পড়োনা।

– কেনো , ! পড়লে সমস্যা কোথায়, ! 

– না মানে এটা পড়লে তোমার পড়ার মনযোগ নষ্ট হবে। বারবার মন আংটির উজ্জ্বল আলোর দিকে চলে যাবে না। তাই বলছি আরকি। 

– না না সেসব কিছুই হবে না। এই আংটিটা পড়লে শরীরের ভিতর আমি অনেক শক্তি অনুভব করি। আর এই শক্তি টা দিয়ে যদি আমার কঠিন এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে পারি তাড়াতাড়ি, ! তাহলে তো আমার জন্য অনেক ভালো হয়। তাই আরকি একবার ট্রাই। 

বলেই আংটিটা পড়তে যায় দিথী। তখনই সামিহা হাত বাড়িয়ে তাকে নিষেধ করতে থাকে। 

– না না পড়িও না ঐ আংটি। দাঁড়াও পড়িও না।

সামিহার কথা বলার মাঝেই দিথী আংটিটা পড়ে নেয়। পড়েই বলতে থাকে 

– এইবার তাড়াতাড়ি এসাইনমেন্ট গুলো শেষ করে ফেলি।

বলেই দিথী তার চেয়ার ঘুড়িয়ে টেবিলের দিকে মুখ করে বসে। এদিকে সামিহার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ।‌ দিথী টেবিলের দিকে ফিরে বই খাতা নাড়ছে তখনই হঠাৎ সে তার মধ্যে কিছু একটা অনুভব করে। এবং সাথে সাথেই সে আড়চোখে সামিহার দিকে। তাকায়। হঠাৎ যেন দিথীর কী একটা হয়ে যায়। সে সামিহার দিকে না ফিরেই বইয়ের পেইজ ওল্টাতে ওল্টাতে বলে।

– সামিহার দেহে প্রবেশ করে তুই খুব বড় ভুল করে ফেলেছিস। সময় আছে নিজে থেকে সামিহার দেহকে ছেড়ে দে। নয়তো কিন্তু আমাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

তখনই সামিহার ভিতর থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠ বলতে থাকে‌

– ন,না। না আমি সামিহার দেহ ছেড়ে যাবো না। কিছুতেই,কিছুতেই যাবো না।

– কথা শুনবিনা তো , ! 

বলেই দিথী চেয়ার ঘুড়িয়ে তার সামনে এসে বসে। সামিহার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। ভয়ে তার দেহ কাঁপছে। তখনই হঠাৎ দিথীর হাতের আংটিটা জ্বলে উঠতে শুরু করে। পুরো রুমের লাইট বন্ধ হয়ে যায়। দরজা আপনি আপনি লেগে যায়। সামিহা তা দেখে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে না করতে থাকে। দিথী সেই আংটিটাকে সামিহার দেহের দিকে ধরে। এবং সাথে সাথেই এক সোজা আলোক রশ্মি বেড়িয়ে সামিহার দেহ এফোড় ওফোড় করে দেয়। সামিহা এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে। তার শরীর অনেক জোরে জোরে কাপতে শুরু করে। তার মুখ থেকে এক কালো ধোঁয়া বেড়োতে থাকে। আর সেটা বেড়িয়ে গিয়ে ঘরের দেয়ালের এক ফুটো দিয়ে বেড়িয়ে যায়। আর সাথে সাথেই সামিহা অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে যায়। আংটির আলোক রশ্মি কমে যেতে থাকে। ঘরের লাইট জ্বলে উঠে। দিথীর হাতের আংটির আলো খুবই সূক্ষ্ম হয়ে আসে‌। দিথী এক নাগাড়ে সামিহার অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে আছে। 

 

ঘরের দরজা খুলে যায়। সাথে সাথেই নাজিয়া বেগম আর শেফালির দৌড়ে আসে দিথীর রুমে। এসে দেখে সামিহা অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে আর দিথী তার মাথায় হাত বোলাচ্ছে। নাজিয়া বেগম গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলেন।

– কী হয়েছে কী সামিহার। ও এভাবে চিৎকার করছিলো কেনো , ? এই শেফালী যা গিয়ে পানি নিয়ে আয়। মেয়েটা মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। জলদি যা।

– এহনি যাইতাছি খালাম্মা।

শেফালী দৌড়ে চলে যায় পানি আনতে। নাজিয়া বেগম বিছানায় বসে বলেন।

– দিথী ,! কী হয়েছিল রে ওর , ?

– তেমন কিছু না মা। ও হঠাৎ হঠাৎই এমন চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ও আমাকে আগেও এই বিষয়ে বলেছিলো। তুমি চিন্তা করিও না।

– আমি তো ওর চিৎকার শুনেই ভয় পেয়ে গেছি। ভাবছি কি না কি হইলো আবার মেয়েটার।

তখনই শেফালী এক গ্লাস পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। দিথী তার হাত থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে কিছুটা হাতে ঢেলে সামিহার মুখে ছিটিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরতে থাকে সামিহার। দিথী তাকে ধরে আস্তে আস্তে উঠিয়ে বসিয়ে দিতে থাকে‌। বলে

– আপু,! তুমি ঠিক আছোতো। এখন কেমন ফিল করেছো আপু।

সামিহা তার এক হাত দিয়ে মাথা চিপতে চিপতে ধীর গলায় বলে।

– আমার, আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। 

– আচ্ছা আমি মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছি। তুমি ভালোভাবে বসো। (নাজিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে) ছোট মা। তোমরা যাও। তেমন বড় কিছুই হয়নি। আমি ওকে দেখে নিচ্ছি।

– আচ্ছা ঠিক আছে। তবে কিছু লাগলে শেফালীকে ডাক দিস। আমি ঐদিকে তরকারি বসায় আসছি। তরকারির যে কী অবস্থা ঐদিকে। (বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলেন নাজিয়া বেগম। তার পিছুপিছু শেফালীও চলে যায়। সামিহার পাশে বসে থাকে দিথী। সে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলে। 

– তুমি কোথায় গিয়েছিলে আপু, ? আর কেন গেছিলে ? 

– আমি, আমি তোমাকে সাথে নীলগিরি জঙ্গলের রাস্তাটায় গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এক বাড়ির সামনে যাওয়ার পর দেখি ওটা তুমি নও। অন্যকেউ। আর তারপর আমি দৌড়ে পালিয়ে আসতে গিয়ে পড়ে যাই। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।

– এই আংটিটাই হয়তো নিতে এসেছিলো সেই আত্মা। (সামিহার দিকে তাকিয়ে) জানো আপু। এই আংটিটা কোন বিশেষ আংটি। এটা পড়া অবস্থায় কোন অসুভ শক্তি সামনে থাকলে আমি যেন নিজের মধ্যে অনেক শক্তি আর বুদ্ধিমত্তার অনুভব করি। একটু আগেও যখন আংটিটা পড়েছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো আমার মধ্যে আমি কাউকে ফিল করতে পারছি। যে তোমার মধ্যে থাকা অসুভ আত্মা সম্পর্কে আমাকে জানান দেয়। আর তারপর আমি তোমার মধ্যে থেকে সেই অসুভ আত্মাকে বের করে তোমাকে স্বাভাবিক করে তুলি।

– আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা। এসব, এসব যাই হচ্ছে সবই কেমন জানি আমার কাছে ভালো ঠেকছে না। দিথী, আমাদের কিছু হয়ে যাবে নাতো আবার , ! 

দিথী সামিহার কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়। উঠে পায়চারি করতে থাকে। বলে

– যতদিন না পর্যন্ত তোমার দাদুর ভাষ্য অনুযায়ী কেউ আসছে আমাদের আর এই আংটির খোঁজ করতে। ততদিন এইসব আমাদের অজানাই থেকে যাবে। শুধুই অন্ধকারে ঢিল না মেরে সেই আগন্তুকের অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। 

 

সামিহা কিছু বলে না। তার শরীর দূর্বল। সে মাথা নিচু করে নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। আর দিথী দেখতে থাকে তার হাতের আঙুলে থাকা সেই উজ্জ্বল আংটিটা।‌ যেন আংটিটা তারই জন্যে বানানো। সেই যেন এর উত্তরাধিকারী, ! 

 

 

খাঁন বাড়ির পুরোনো দেয়াল ঘড়িতে রাত ৯ টা বাজার ঘন্টা বাজতে লাগলো। পুরো অন্দরমহলে সেই ঘন্টা পড়ার শব্দ প্রতিফলিত হচ্ছে। অন্দর মহলের ডান পার্শ্বে থাকা সোফা গুলার মধ্যে একটায় বসে রয়েছেন রায়হানের বাবা নজরুল সাহেব। হাতে পত্রিকা আর সামনের টেবিলে রাখা অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ। সবাই সকাল সকাল খবরের কাগজ পড়লেও তিনার অভ্যাস হলো রাতের বেলা তা পড়া। সাথে এক কাপ চাও না হলে যেন তার জমে না। দেশের বিভিন্ন যায়গায় কী ঘটলো না ঘটলো সেই ঘটনা জানার জন্যেই প্রতিরাতে এইসময় খবরের কাগজের সঙ্গ দেওয়া হয় তার।

 সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে রায়হান। পড়নে নীল জ্যাকেট,আর ট্রাউজার। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বাবার পাশের সোফায় গিয়ে বসলো সে। এখন বাড়ির নারীরা রাতের রান্না করাতে ব্যস্ত। আর শাহেদ, আর তার ছেলে সাদিক বেড়িয়েছে গোডাইনে। আজ রাতে ২ ট্রাক ফিড আসার কথা তাই। রায়হান গিয়ে তার বাবার পাশে বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। কোন কথা বলেনা। কিছুক্ষণ পর নজরুল সাহেব চোখ আড়ালে করে বুঝতে পারেন রায়হান বসে আছে। তিনি খবরের কাগজ না নামিয়েই বলেন

 – কিছু বলবি রায়হান , ! 

 – না মানে বাবা ,! তোমার পড়া কী শেষ হয়েছে , ! 

 – তুইও পড়বি নাকি আবার,? (খবরের কাগজ মুখ থেকে কিছুটা সড়িয়ে) তুই আবার কবে থেকে খবরের কাগজে ঢু দেওয়া শুরু করলি , ! 

 – না মানে বাবা তা নয়। আসলে,

 – হ্যা বল। এতো আমতা আমতা করতেছিস ক্যান , ! 

 – না মানে বাবা আমার বিয়ের বিষয়টা , ! 

কথা শুনে নজরুল সাহেব খবরের কাগজ টা পুরোটা নামিয়ে ভাজ করে টেবিলের সাইডে রাখেন। বলেন।

– আমি তো তোকে বলেছি দিবো বিয়ে। তাহলে , ?

– না মানে বাবা, (একটূ থেমে) আমি তাড়াতাড়িই বিয়েটা সাড়তে চাই। সম্মন্ধ নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। তাই আরকি, ! (এক হালকা মলিন চেহারা নিয়ে নজরুল সাহেবের দিক তাকায় রায়হান। তারপর আবার মুখ নামিয়ে নেয়)

– তো কে সেই মেয়ে। যাকে বিয়ে করার তোর এতো তাড়া , ! (বলেই চায়ের কাপে অবশিষ্ট অর্ধেক চা টুকু খাওয়ার জন্য মুখে তুলেন নজরুল সাহেব)

– আমাদের গ্রামের মেম্বার আছে না , ! মতিন মেম্বার। তার একমাত্র মেয়ে নিপার সাথে বাবা। 

কথাটা শুনেই সাথে সাথেই কাশি উঠে যায় নজরুল সাহেবের। রায়হান চায়ের কাপ টা ধরে তার হাত থেকে নিয়ে পাশে রাখে। নজরুল সাহেব অবাক হয়ে আবার বলেন।

– কার সাথে বিয়ে করার কথা বলতেছিস , ? 

– ব,বাবা মেম্বারের একমাত্র মেয়ে নিপার সাথে। ক,কেন কোন সমস্যা, ! 

নজরুল সাহেব চুপ হয়ে যান। কোন উত্তর দেন না। রায়হান আবার বলে।

– বাবা, চুপ হয়ে গেলে যে।

– এই বিয়ে সম্ভব না। কিছুতেই না।

– কিন্তু কেন বাবা, ! নিপা অনেক ভালো মেয়ে। তাদের পরিবারও নিচু গ্রেডের না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি নিপাকে ভালোবাসি, ! 

নজরুল সাহেব মাথা নামিয়ে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে থাকেন। বলেন

– তুই জানিস যে ওর ভাই গোয়েন্দা , ! আমাদের ফিড কারবারির বিষয় টা জানতে পারলে কী হবে সেটা বুঝছিস তো , ! 

নজরুল সাহেবের কথার মাঝেই তার সোফার পাশে এসে দাঁড়ান সুমনা বেগম। তিনিও এদের কথা শুনতে থাকেন। রায়হান বলে।

– হ্যা জানি। আর আমি সব যেনে শুনেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। (একটু থেমে) আর ওর ভাই তো আর আমাদের ফার্মের তল্লাশি নিতে যাবেনা তাই না। আরো উল্টা আমাদের ফিডের গোডাউনে রেড দেওয়ার আগেও সে কয়েকবার ভাববে। কারণ গোডাইন টা তার বোন জামাইদের। (একটু থেমে) আর বাবা। তুমি কিন্তু ঐদিন আমাকে কথা দিয়েছিলে যে আমি যেখানে চাইবো তুমি আমায় বিয়ে দিবে। তো এখন কেন দ্বিমত করছো। 

 

নজরুল সাহেব উত্তেজিত হয়ে বলেন।

– তুই বিষয় টা বুজছিস না। এখানে অনেক ব্যাপার স্যাপার আছে।(একটু থেমে ধীর গলায়) দেখ, তুই আমার ছেলে। একজন বিজনেস ম্যানের ছেলে। তোর জন্য যেকোনো মেয়ে এনে দিতে পারবো। কিন্তু এই গ্রামের কাউকে আমি আমার পুত্র বধূ হিসেবে চাই না। আরো বিশেষ করে মেম্মার বাড়ির কেঊ কে তো আরো না।

– আমি কিচ্ছু জানিনা। তুমি হয় আমাদের বিয়ে নিজের সম্মতিতে দিবে। নাহলে (একটু থেমে মুখ ঘুরিয়ে) নাহলে কিন্তু আমি নিপাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হবো। 

 

কথাটা শুনেই একপ্রকার নজরুল সাহেবের মাথায় রাগের আগুন চড়ে যায়। তিনি চুপচাপ থাকেন। নিজেকে শান্ত করতে থাকেন। ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ে মস্তিষ্ক ঠান্ডা করতে থাকেন। সুমনা বেগম এখনো দাঁড়িয়েই আছেন। তিনি কোন কথা বলেননা। তাদের ৩ জনের মাঝেই বিরাজ করে পিনপন নিরবতা। শুধু অন্দরমহলের ঘড়ির কাঁটা নড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই শুনতে পাওয়া যায় না। 

কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে নজরুল সাহেব বলে উঠেন। 

– আমি রাজি। 

কথাটা শুনেই রায়হানের চোখে মুখে মুহূর্তেই হাসির ছটা ফুটে উঠে। সে কিছু বলতেই যাবে তখনই নজরুল সাহেব বলেন।

– তবে তোকে এখন থেকে এখানেই, এই গ্রামে থেকেই সব ব্যবসার দেখভাল করতে হবে। এই নর্থ যোনের পুরো কভার তোকে একা নিজ হাতে করতে হবে। ঢাকায় শুধু রাফসান থাকবে। আর ঐদিক টা ও সামলাবে। (রায়হানের দিকে ফিরে) কাজের দিকে মনযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। পারবি , ! 

– সব পারবো। যা যা বলেছো সব শর্তে আমি রাজি। আর আমাদের মুরগির ফিডের ব্যাপার টাও আমি টপ সিকিউরিটিতে রাখবো। (একটূ থেমে হাস্যেজ্জল মুখ নিয়ে) সম্মন্ধ নিয়ে আমরা কবে যাচ্ছি , ! 

– পরসুদিনই। (বলেই নজরুল সাহেব সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান। তিনি চলে যেতেই নিবেন তখনই রায়হান বলে।

– বাবা, ! 

নজরুল সাহেব রায়হানের ডাকে তার দিকে ফিরে তাকান। রায়হান তাকে জড়িয়ে ধরে।

– সরি বাবা। আমি রাগের মাথায় তোমার সাথে তর্ক করে ফেলেছি। আমি কথা দিচ্ছি আমাদের ব্যবসার কোন ক্ষতি হবেনা। তুমি শুধু আমার উপর ভরসা রেখো। তোমার এই ছেলে আর যাই হোক। সবকিছু ভেবে চিন্তে তারপরই সিদ্ধান্ত নেয়। আমার উপর রাগ করে থেকো না, ! 

নজরুল সাহেব একটা মুচকি হাসি দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলতে থাকেন।

– তোকে খুব আদর করে বড় করেছি আমি। তাই তোর চাওয়া কোন কিছুতেই শেষ পর্যন্ত ‘না’ কথাটা বহাল পারিনা। আমার হাঁটু ভেঙ্গে দিস তুই বারবার। চল উপরের তালায় যাই তোর দাদুকে দেখতে। 

– চলো বাবা। 

তারা দুই বাপ-বেটা মিলে চলে যেতে থাকে সিড়ির দিকে। সুমনা বেগম এখনো সেই সোফার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে যেন কোন রিয়েকশনই নেই। তার ছেলের বিয়ে, তার মতামত টাও একবার জিগ্গেস করেনি কেউ। তিনিও একদম স্বাধারণ ভাবেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘরের দিকে চলে যান। সোফার‌ পিছনেই করিডোরে সম্মুখে দাঁড়িয়ে রায়হান আর নজরুল সাহেবের সব কথা শুনছিলেন এতক্ষণ সাথী খাতুন। তিনিও মনে মনে বেশ খুশিই হন। আলিশার মুখে তিনি শুনেছেন নিপার কথা। মেয়েটার বর্নণা শুনে তার বেশ মনেও ধরেছে। আজ সেই মেয়েটারই এই খান বাড়িতে পুত্র বধূ হিসেবে আসার কথাতে তিনি খুশি। তিনি এক হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে চলে যেতে থাকেন করিডোর দিয়ে তার ঘরের দিকে। 

নজরুল সাহেব যতই রায়হানকে রাগ দেখান না কেন। তিনি সেই রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না। তার বড় ছেলে রাফসানের প্রতিও তার এতোটা মায়া অথবা টান নেই যতটা রায়হানের প্রতি আছে। এককথায় তিনি নিজের সাধ্যের মধ্যে সবটুকু দিয়েই রায়হানকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে চান। তবে নিপার ক্ষেত্রে প্রথমে যে কেনো না করলেন তিনি , ! হয়তো এমনিই। নয়তো রইতে পারে কোন গহীন রহস্য , ! 

 

 

এক লম্বা করিডোর। করিডোরের দুই পাশেই সাড়ি সাড়ি রুম। করিডোরের উপরে জ্বলছে একের পর এক লাইট। করিডোরে প্রবেশ করে হেঁটে আসতে থাকে এক ব্যাক্তি। পায়ে কালো বুট পড়া। কালো ফরমাল প্যান্ট। গাঁয়ে হুডি। তার শরীরের প্রচ্ছদ দেখেই বোঝা গেলো যে সে রন্জু। তার চেহারা আমাদের দেখানো হয় না। তার বুট জুতো পায়ে হেঁটে চলার আওয়াজ নিস্তব্ধ করিডোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা রুমের সামনে থামে। রুমের ভিতর থেকে একটা আওয়াজ আসছে। সে রুমটার দিকে ফিরে দাঁড়ায়।‌ ভিতর থেকে কোন মেয়ের গোঙানির আওয়াজ আসছে।‌ ভেসে আসছে এক মেয়ের সুখচিৎকারের আওয়াজের প্রতিধ্বনি। রন্জু তার হাত রাখে দরজার সামনে থাকা ফিংগার প্রিন্ট আনলক সিস্টেমের উপর। সাথে সাথেই খুলে যায় দরজাটি। রন্জু তৎক্ষণাৎ ভিতরে প্রবেশ করে আর দেখতে পায় এক ছেলে মেয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি। ছেলে আর মেয়ে কেউই রন্জুর উপস্থিতি টের পায়নি তাদের সুখের সাগরে ডুবে থাকার কারণে। হঠাৎ ছেলেটা দরজার দিকে তাকায় আর দেখে রন্জু দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথেই সে মেয়েটাকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে দূরের দেওয়ালের দিকে উল্টো হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে পাশের টেবিল থেকে একটা কাপড় নিয়ে মুছতে থাকে। মেয়েটা বিছানায় পড়ার সাথে সাথেই একটা বাজে ভাষায় গালি দেয় সেই ছেলেটাকে। আবার পরমুহূর্তেই যখন সে রন্জুকে দেখে সাথে সাথেই সে বিছানার চাদর জড়িয়ে নেয় তার শরীরে। রন্জু দূরে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

– তোদেরকে এসব করার জন্য আমি পালি হারামির দল , ! কী শুরু করছিলি এসব তোরা , ? 

দূরে দাঁড়ানো ছেলেটা মাথা ঘুড়িয়ে বলতে থাকে।

– সরি দাদা। ভুল হইয়া গেছে। মাইশার কোন দোষ নাই। আমিই ওরে এইসব করতে কইছিলাম , ! 

– বাব্বাহ , ! (একটু থেমে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে) কয়দিন আগে যে একটার নির্মম মৃত্যু দেখলি তারপরও কী তোদের শিক্ষা হয়না মাদার*** ,? (ঝাড়ি দিয়ে) 

– না মানে দাদা। আর হইবো না। প্লিজ দাদা। আমাগোরে ছাইড়া দেন। (দেওয়ালের ওপাশে ফিরেই কথা গুলো করুণ সুরে বলে ছেলেটা) 

– এই মেয়ে , ! তোর কি মরন সামনে দেখেও গরম কমেনা , ! সারাজীবন তো মাঘি ছিলি। মরার আগে কই তওবা করবি। তা না করে আমাদের লোকদের সাথেই শুরু করে দিলি , ! তোদের কী লজ্জা নাই রে , ! 

– লজ্জা দিয়া কী হইবো সাব , ! দেহের মজাই তো আছল মজা। আপনেও আইবেন নাকি , ! আহেন , ! নওয়াজ আর আপনে একলগে মোরে সুখ দেন আর নিজেরাও লন , !(ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বুকের উপর থেকে চাদর সরিয়ে)  কিরে নওয়াজ। এদিকে আয়। ঐসব স্যার আমি বহুত দেখছি। এহানে মুখ দিয়া সততা দেহাইলেও ঐ দুই ডোজ দেওয়ার লাইগাই তোগো বস আবার টাকা দিয়া লাগাইতে যাইবো। এর চেয়ে ভালা তোগো বসরে ক ফ্রিতে মাল পাইতাছে। খাইয়া জীবন ধন্য করতে। 

ওর কথা শুনেই ছেলেটা ভয় পেয়ে যায়। সে দেয়ালের পাশ থেকে এপাশে ফিরে। আর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার মেয়েটার দিকে তাকায় আরেকবার রন্জুর দিকে তাকায়। হাত দিয়ে নিষেধ করতে থাকে আর কিছু না বলার জন্যে। কিন্তু মেয়েটা আরো তার এমন ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে বলে।

– কী রে ,। তুই ভয় ক্যান পাইতাছোস‌। আয়। আরে তোর বসও আইবো। কষ্ট পাইসনা যে মজা ভাগ করতে হইতাছে বইলা। (রঞ্জুর দিকে ফিরে) কিরে মাদার*** । তোরে কী আরো যাইয়া মুখে তুইলা খাওয়ায় দিতে হইবো নাকি , ! (রন্জু মাথা নিচু করে তার দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে করে নেয়। ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। ঐদিকে ছেলেটা খালি ভয় পাচ্ছে। সে হাত দিয়ে মানা করছে কথা বলার জন্য। মেয়েটা তারপরও বলে

– তোগো রন্জু দাদার মনে হয় একটু দেরি তে দাঁড়ায় তাইনা। সমস্যা নাই আমার হাতই যথেষ্ট অর মতো কয়ডা রন্জূর জিনিস দা,,

কথা শেষ হওয়ার আগেই রন্জু তার পকেট থেকে পিস্তল বের করে তার মুখে একের পর এক গুলি চালাতেই থাকে। মেয়েটা চিৎকার করার সময় টুকুও পায়নি। রাউন্ডের পর রাউন্ড গুলি করতে করতে তার পুরো মুখ গুলির অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে ভরে যায়। রক্ত ছিটকে পড়ে পুরো ঘর টায়। ছেলেটা কিছু বলতেই যাবে তখনই রন্জূ বন্দুক মেয়েটার দিক থেকে ছেলেটার দিকে নিয়ে তার লিঙ্গ বরাবর অজস্র গুলি চালাতে থাকে। ছেলেটার দেহ ধপ করে পড়ে যায় ফ্লোরে। রক্তে ভেসে যায় পুরো ফ্লোর আর বিছানার সাদা চাদর। রন্জুর বন্দুকের গুলি শেষ হয়ে যায়। বন্দুকের হাত নামিয়ে ফেলে সে। তারপর এক হাত দিয়ে তার ঠোঁটের পাশে ছিটে আসা রক্ত মুছে দরজার দিকে ঘুরে। ততক্ষণে তার ২ জন লোক সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলো। রন্জু তাদের ভিতরে আসতে বলে ইশারায়। তারা দুজন বন্দুক ধারী এসে তার সামনে দাঁড়ায়। রন্জু বলে।

– লাশ দু’টোকে জঙ্গলের ভিতরের দিকটায় ফেলে দিবি। আর আরেকটা কথা। সবাইকে জানিয়ে দিবি। যে এরপর থেকে কেউ যদি কোন বেইশ্যার সাথে করা তো দূর যদি ছুঁয়েও দেখে তাইলে তার লিঙ্গ কেটে রাস্তার কুকুর কে খাওয়ানো হবে‌।(একটু থেমে ঝাড়ি দিয়ে) কী বলেছি বুঝতে পেরেছিস ? 

– জ,জ্বী স্যার অবশ্যই। সবাইকে জানিয়ে দিবো।

– আমি গেলাম। পুরো রুম আমার ক্লিয়ার চাই ১৫ মিনিটের মধ্যে। আন্ডার্সট্যান্ড , !

– ও,ওকে স্যার। হয়ে যাবে।(একটু থেমে) আর স্যার। আপনি তো জার্নি করে এলেন। রেষ্ট নিবেন না ,! 

– তোমাদের যা কাজ দিয়েছি তাই করো। কোন কথা বলবেনা।

– ও,ওকে স্যার।

রন্জু বেড়িয়ে যায় ঘরটা থেকে। লোক দুইটা ঘরে ঢুকে। ভিতরে পড়ে থাকা দুইটা লাশের মৃত্যু দেখে তাদের গাঁয়ের লোম শিউরে উঠার পরিক্রম। তারা এক ঢোক গিলে একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর কাজে লেগে পড়ে লাশ সড়ানোর আর রুম ক্লিন করার। মেয়েটার লাশ টার একটা চোখ ছিটকে এসে পড়েছিলো ফ্লোরে। সেই চোখটাই জানান দিচ্ছে যে কী পরিমাণ কর্দমাক্ত বিবেগ আর মন নিয়ে বেঁচে ছিলো সেই মেয়েটা , ! 

 

 

খাঁন বাড়ির রায়হানের রুম। বেশ সিম্পল তার রুমের অভ্যন্তরীণ কাঠামো। রুমের ঠিক মাঝ বরাবর কাঠের এক সুন্দর বিছানা। সেখানে শুয়ে রয়েছে রায়হান। বিছানার বাম পার্শ্বে মাথার দিকটার সাথে লাগানো অবস্থায় রয়েছে একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলে একটা পানির গ্লাস রাখা আর তার পাশেই একটা টেবিল ল্যাম্প। সেই ছোট্ট টেবিল টার কিছুটা দূরে একটা ডেসিন টেবিল। বিছানার ডান পার্শ্বের দেওয়ালে একটা বড় কাঠের ওয়্যারড্রব। রুমের সাথেই এটাচ গোসল খানা। রুমের বারান্দা ব্যালকনি টা রুমের ডান পার্শ্বে। ব্যালকনি তে যাওয়ার দরজা টা সম্পূর্ণ গ্লাসের। এখন তার উপরে পর্দা ফেলানো। 

বিছানায় কম্বল এর উষ্ণ আলিঙ্গন নিচ্ছে রায়হান। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। কম্বলের নিচে একটা কোলবালিশও রয়েছে তার টেম্পোরারি সঙ্গী হিসেবে। হঠাৎ পাশের টেবিলে রাখা তার ফোন টা বেজে উঠে। ফোন টা কিছুক্ষণ ধরে বাজতেই থাকে‌। রায়হানের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ঘুম অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে ফোন টা রিসিভ করে কানে লাগায় রায়হান। সে একবারো দেখেনি যে কে ফোন দিয়েছে। সে ঘুম ঘুম গলায় বলে‌।

– হ্যালো।

তখনই ওপাস থেকে একজন মেয়ে কন্ঠ ভেসে আসতে থাকে। তার ভয়েস শুনেই তৎক্ষণাৎ রায়হানের ঘুম একপ্রকার উড়েই যায়। সে চোখ খুলে ফেলে। কানে ফোন টা হাতে ধরে উঠে বসতে থাকে। রায়হান কিছু বলেনা অপর পাশের মেয়েটাকে। মেয়েটা গড় গড় করেই কিছু একটা বলতেই থাকে তাকে। রায়হান ঘুম ঘুম ভাব টা একদম কেটে গিয়েছে কলের ওপাশের মেয়ের কথা শুনে। মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে তো বলেই যাচ্ছে। রায়হানের নিজের উপর কিছুটা রাগ উঠতে থাকে‌। সে নিজের হাতের আঙ্গুল মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। মেয়েটা কিছুক্ষণ বকবক করে শেষে কী জানি একটা কথা বলে‌। রায়হান এইবার শুধু মেয়ে টার কথার উত্তর দেয়। 

– ওকে।

এবং সাথে সাথেই ওপাস থেকে ফোনটা কেটে যায়। রায়হান ফোনটাকে কান থেকে নামায়। তার মনে কী যেন একটা হয় আর সে ফোনটাকে আছাড় মারার জন্য হাত উঠায়। আবার কিছু একটা মনে করে আছাড় মারেনা। সে ফোনটাকে পিছনে বিছানার উপরে ছুড়ে ফেলে উঠে যায় বিছানা থেকে। তার চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার মন মেজাজ সব খারাপ হয়ে গেছে। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ব্যালকনির দরজার উপর থেকে পর্দা সড়িয়ে দেয় রায়হান। পর্দা সরিয়ে দিয়ে গ্লাসের দরজা খুলে ব্যালকনিতে যায় সে। ব্যালকনির উপরে ছাদ রয়েছে। বারান্দা টা বাড়ির বডির থেকে সামনের দিকে বাড়িয়ে করা। আগেকার দিনের বাড়ি তো তাই আরকি এমন। ব্যালকনি তে গ্রিল দেওয়া নেই। রায়হান গিয়ে ব্যালকনির রেলিং ধরে চারপাশ দেখে‌।

আকাশ অন্ধকার প্রায়। দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। হয়তো সারারাতই এমন বৃষ্টি পড়েছিলো। সে এক হাত বাড়িয়ে উপর থেকে পড়া ২-১ ফোঁটা পানি নেয়। পানিটা বেশ ঠান্ডা। এমনিতেই শীত কাল। তার উপর আবার হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি। ঠান্ডা বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। দূর থেকে এক ঠান্ডা বাতাস এসে রায়হানের পুরো শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। রায়হানের মুখে ক্ষীণ সময়ের জন্য হলেও ফুটে উঠে এক মিষ্টি হাসি। যেন শীতের ঠান্ডা বাতাস এসে তাকে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার উপস্থিতির কথা ,! 

 

 

তানিয়া কিচেন থেকে নাস্তার ট্রে নিয়ে বের হয়ে আসে। হাতের ট্রে তে হরেক রকমের নাস্তা। শীতের কিছু পিঠা বাইরে থেকে কিনে এনেছে, আর বাড়িতে বানানো হালকা কিছু নাস্তা। বেড রুমে প্রবেশ করে তানিয়া। ব্যালকনি থেকে হেঁটে বেড রুমে ঢুকে কানিজ, অর্থাৎ তানিয়ার সেই প্রিয় বান্ধবী। তানিয়া এসে বিছানায় নাস্তার ট্রে টা রাখে। রেখে কানিজ কে উদ্দেশ্য করে বলে।

– বাইরে আজ অনেক ঠান্ডা তাইনা , ! 

– হ্যা রে অনেক। নাস্তা নিয়ে এসেছিস, ! (বিছানায় বসে কানিজ। একটা ছোট্ট চিতই পিঠা তুলে মুখে দেয়। তানিয়া নাস্তা গুলো রেখে পায়চারি করতে করতে ব্যালকনির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গাঁয়ের সোয়েটারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ব্যালকনির বাইরের মেঘলা উজ্জ্বল দিনের দিকে চেয়ে থাকে সে। কানিজ খেতে খেতে পিছন থেকে বলে উঠে। 

– কবে যাচ্ছি আমরা আনন্দ পুরে , ? 

কানিজের প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে তানিয়া। কিছুক্ষণ পর মুখ ফুটে বলে

– পরসুদিন রাতে ট্রেনে উঠবো। (একটু থেমে বাইরের দিকে আনমনে চেয়ে) আচ্ছা কানিজ।

– হুমম,

– বইটা অনুযায়ী আমরাই তো সেই লোক তাইনা , ! যাদের ২৪ বছর পর সেই আনন্দ পুরে ফিরে যাবার কথা , ?

– হ্যা অবশ্যই।  আমরাই তো তারা। বইয়ের ভাস্য অনুযায়ী তুইই সেই পথপ্রদর্শক হিসেবে তাদের কাছে যাবি।

– হ্যা সেটা তো বুঝলাম। (বির বির করে)কিন্তু তো বইয়ে বলা হয়েছে ২ জন যাবে, ! আসলে তো যাচ্ছি ,,

 

তানিয়ার কথার মাঝেই কানিজ বলে

– কি রে। কি বিরবির‌ করতেছিস , ? 

– ন,না। তেমন কিছু না। (কানিজের দিকে ফিরে) আচ্ছা সেই বইটাকে এনেছিস তো মনে করে ? 

– হ্যা অবশ্যই , ! দাঁড়া বইটাকে বের করছি। 

বলেই বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা একটা লাগেজের মধ্যে বইটাকে খুঁজতে থাকে কানিজ। কানিজ কে আগে ভাগেই সবকিছু নিয়ে নিজের বাসায় চলে আসতে বলেছে তানিয়া। এইখানে ২ দিন থেকে তারপর একসাথে রওনা দিবে আনন্দ পুরের উদ্দেশ্যে। 

কানিজ কিছুক্ষণ খোঁজার পর বইটা খুঁজে বের করে। বইটা একটা ব্যাগের ছোট্ট পলিব্যাগের ভিতর মুড়িয়ে লাগেজের ভিতরে রেখেছিলো‌ সে। কানিজ ‌সেই বইটাকে পলিব্যাগ থেকে বের করে। বের করে তানিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়।

 বইটার কভার সহ ‌পেইজ‌ গুলো ছিলো অনেক অনেক পুরোনো। দেখে এমন মনে হচ্ছে যেন কোন প্রাচীন সভ্যতার কোন নিদর্শন। তানিয়া বইটাকে হাতে নেয়। নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে ব্যালকনির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বইটার নাম বড় বড় করে খোদাই করে লেখা “আদরি আসুভে”। তানিয়া সেই বইটাকে এক হাতে নিয়ে ব্যালকনির ওপাস থেকে আসা সূর্যের আলোর উপর ধরে। বলতে থাকে।

– মুখোশধারীর মুখোশ খুলার দায়িত্বও আমার কাঁধে দিয়ে দেওয়া হলো,! আর কতো , ! (একটু থেমে) আর আফসোস করেই বা কী লাভ। যখন এটাই আমাকে আমার নরমাল লাইফে ফেরত যেতে দেয়নি। আমার সব প্রিয় জিনিস গুলোকে ছিনিয়ে নিয়েছে একের পর এক,! তাকে তার পাওনা তো মিটিয়ে দিতেই হবে,! সুদে আসলে মিটিয়ে দিতে হবে , ! 

 

 

আনন্দ মোহন কলেজ মাঠ। আকাশ এখনো মেঘলা। তবে বৃষ্টি থেমেছে। এখনো মাঝে মাঝে দখিন হাওয়া এসে দেহে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে যাওয়ার দুষ্টু চেষ্টা করছে। লোকে লোকারণ্য পুরো মাঠ। লোকের কোলাহল আর উত্তেজনা মিলিয়ে একদম বিচ্ছিরি এক অবস্থা। জনসভার টাইট সিকিউরিটি দায়িত্ব পড়েছে আশেপাশের সকল লোকাল থানার উপর। রিয়াদের থানার উপরেও পড়েছে এর গুরু দায়িত্ব। মন্ত্রী আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন।‌

স্টেজ বানানো হয়েছে মাঠের উত্তর দিকটায়। আর স্টেজের সামনে লোকের যেন একপ্রকার ঢল পড়েছে‌। স্টেজের সামনের চেয়ার গুলোতে বসেছেন সব গন্য মান্য ব্যাক্তি বর্গ। আর স্টেজের উপরে বসার যায়গা রাখা হয়েছে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, আর গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বারের জন্য। মতিন মেম্বার, চেয়ারম্যান সাব অন্তর সাহেবও সেখানে উঠে বসেছেন। মাঠের লোকারণ্যের সামনের দিকটায় আছে রায়হানের বাবা, চাচারা। আর রায়হান রা এদিকে শৃঙ্খলা বজায় রাখার দিকটায় পুলিশের সাহায্য করছে। তখনই কলেজের সাথে লাগানো রোডে এসে পৌঁছায় মন্ত্রীর গাড়িবহর। মন্ত্রীর আসার খুশিতে আনন্দের ঢল পড়ে তার সমর্থকদের মধ্যে। টপ সিকিউরিটির মধ্যে দিয়ে তার চারপাশে একটা বডিগার্ডের বেড়া তৈরি করে সব লোকদের সাইড দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্টেজের দিকে।

তাকে স্টেজে উঠিয়ে দিয়ে কিছু বডি গার্ড চলে যায়। আর ২ জন বডি গার্ড তার সাথে সাথেই স্টেজে উঠে তার বসার আসনের দু পাশে দাঁড়ায়।‌ পুরো জনসভায় লোকদের উচ্ছাসের মাঝে উপস্থাপক মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। মন্ত্রীর দলের কিছু সুনাম করে তারপর মন্ত্রীকে বক্তব্য প্রদান করার জন্য আহ্বান জানায় উপস্থাপক। মন্ত্রী তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। মাইকে কথা বলার জন্য সেদিকটায় এগিয়ে যেতে থাকেন। তখনই আমরা দেখতে পাই কলেজের ভিতরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে এক লোক। পড়নে কালো জ্যাকেট। হাতে হাত মোজা, এবং মুখে মুখোশ। এক হাতে এক সূটকেস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে সেই লোকটি। তার চলার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে সে খুবই সাবধানের সহীত যাচ্ছে।

মন্ত্রী গিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়ান। তার দু’পাশে দাঁড়ায় কালো চশমা পড়া তার দু’জন বডি গার্ড।‌ তিনি মাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করতে থাকেন উপস্থিত তার সমর্থকদের সাথে। এদিকে সেই মুখোশ পড়া ব্যাক্তিটি সুটকেস হাতে কলেজের ছাদে চলে আসে। কলেজ ভবন একটাই। আর কলেজ ভবনের ঠিক সামনেই কলেজের বড় মাঠ ‌টা। লোকটা এসে ছাদের একদম কিনারায় দেওয়ালের পাশে দাঁড়ান। তার সেখান ‌থেকে মন্ত্রীকে বেশ ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছিলো। মন্ত্রী সাহেব তার ভাষণ শুরু করেছেন।

এদিকে ছাদের কিনারে হাঁটু গেড়ে বসেন সেই মুখোশ পরিহিত লোকটি। বসে তার সুটকেস টা খোলেন। ভিতর থেকে কিছু পার্টস বের করে একসাথে জোড়া লাগাতে থাকেন। ঐদিকে মন্ত্রীর কথায় বারবার তার সমর্থকেরা উচ্ছসিত হয়ে উঠছে। মন্ত্রীর মুখেও এরজন্য এক হাসি ফুটে উঠে। এদিকে মুখোশ পড়া ব্যাক্তিটি তার সূটকেস থেকে বের করা সব পার্টস গুলো একসাথে যুক্ত করে একটা স্নাইপার বানিয়ে ফেলে (স্নাইপার হলো এমন এক ধরনের বন্দুক যা দিয়ে অনেক দূর থেকে নিশানা ঠিক করে বিনা শব্দে ‌গুলি করা যায়) মুখোশ পড়া লোকটা নিশানা ‌ঠিক করতে থাকে। তাক করে একদম মন্ত্রীর বাম বুক বরাবর।

মন্ত্রী এখনো সবার উদ্দেশ্যে খুব জোশের সাথেই বক্তব্য দিতে থাকেন। মুখোশ পড়া ব্যাক্তি টা ট্রিগারে আঙ্গুল আনে। নিশানা মন্ত্রীর বাম পাশের ঠিক হার্ট এর ঠিক মাঝবরাবর। মুখোশ পড়া ব্যাক্তিটা ট্রিগার চেপে দেয় আর তখনই দিথীর বাবা অন্তর সাহেব মন্ত্রীর কানে কানে কিছু একটা বলতে চলে আসেন ফলে মন্ত্রী সড়ে যান আর গুলিটা এসে তাকে লাগে। 

 

চলবে ,,,,,

 

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৫

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

মুখোশ পড়া লোকটা নিশানা ‌ঠিক করতে থাকে। তাক করে একদম মন্ত্রীর বাম বুক বরাবর। মন্ত্রী এখনো সবার উদ্দেশ্যে খুব জোশের সাথেই বক্তব্য দিতে থাকেন। মুখোশ পড়া ব্যাক্তি টা ট্রিগারে আঙ্গুল আনে। নিশানা মন্ত্রীর বাম পাশের ঠিক হার্ট এর ঠিক মাঝবরাবর। মুখোশ পড়া ব্যাক্তিটা ট্রিগার চেপে দেয় আর তখনই দিথীর বাবা অন্তর সাহেব মন্ত্রীর কানে কানে কিছু একটা বলতে চলে আসেন ফলে মন্ত্রী সড়ে যান আর গুলিটা এসে তাকে লাগে। সাথে সাথেই মুখোশ পড়া ব্যাক্তিটা ভয় পেয়ে যায়। চারপাশে হইহুল্লোড় পড়ে যায়। মন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো দুইজন গার্ড তাকে প্রটেক্ট করতে করতে স্টেজ থেকে নামিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। দিথীর বাবা সেখানেই পড়ে যান। গুলিটা তার ডান হাতের মাংসপেশিতে লেগেছিলো।

মতিন মেম্বার আর রাতুল মাষ্টার মিলে দিথীর বাবার দেহ টা তুলে নিতে থাকে। চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মানুষ আতংকিত হয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে। রিয়াদ সহ বাকি কনস্টেবল রা কলেজের ছাদ উদ্দেশ্য করে গুলি চালাতে থাকে। মুখোশ পড়া ব্যাক্তিটা সড়ে দাঁড়ায়। দৌড়ে কলেজের ছাদের বিপরীত অংশের রেলিংয়ের দিকে যায়। কলেজের পিছনে একটা ছোট্ট পুকুর রয়েছে। আর পুকুর আর কলেজের মাঝে রয়েছে একটা রাস্তা। সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ২ জন মুখোশ পড়া ব্যাক্তি। ছাদের উপর থেকে মুখোশ পড়া ব্যাক্তি টা স্নাইপার আর সুটকেস ব্যাগ টা ছুড়ে মারে তাঁদের দিকে। সেই লোক দুটো সেগুলো ক্যাচ করে দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। ছাদের উপর থাকা মুখোশ পড়া ব্যাক্তিটা সিঁড়ি ঘরের দিকে দৌড়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে চলে যেতে থাকে। তার যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিলো সে খুব আতঙ্কিত।

এদিকে লোকজন দিকবিদিক না দেখে ছুটোছুটি করছে। কিছু মানুষ তো এই ছুটোছুটিতে পদদলিতও হয়ে গেছে। সব মানুষ দৌড়ে কলেজ গেট দিয়ে বাইরে ছুটে যাচ্ছে। মন্ত্রীকে তার দুই বডিগার্ড কোন এক সেইফ যায়গায় নিয়ে যায়। এদিকে রিয়াদ, রায়হান আর কিছু কনস্টেবল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। তাদের সবারই হাতে বন্দুক। ছাদের দরজা খুলে তারা ছাদে প্রবেশ করে আর বন্দুক সামনে তাক করে খুঁজতে থাকে সেই বন্দুকধারীকে। চারপাশে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছাদের মধ্যে। এদিকে মেঘলা আকাশ থাকায় কিছুক্ষণ পর পর ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। পুরো ছাদ খোঁজার পরও তারা কোন লোক কেই খুঁজে পায়না। তারা আবার ছাদের মাঝখান টায় চলে আসে। রিয়াদ তার ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে নিচের কমিশনারের কাছে বার্তা পাঠায়। 

– হ্যালো, হ্যালো। আমি রিয়াদ বলছি। উপরে কোন বন্দুকধারীকে আমার খুঁজে পাইনি। নিচে দেখুন। বন্দুকধারী হয় ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে নাহলে বিকল্প রাস্তা দিয়ে নেমে গিয়েছে। ওভার, ওভার। 

 

রায়হান রিয়াদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বাতাস তাদের দুজনের চুল গুলোকে বেশ ভালো রকমই উড়াতে থাকে। রায়হান বলে।

– সেই বন্দুকধারী কীভাবে পালাতে পারে রিয়াদ , ! 

– আমার তো মনে হয় ছাদের পিছন থেকে লাফ দিছে। তাছাড়া আর পালানো তার পক্ষে সম্ভব না। তুই আমি তো সিঁড়ি দিয়েই আসলাম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলে ঠিক ধরা পরতো। 

– ঐদিকে চেয়ারম্যান সাবের গায়ে গুলি লাগছে। চল নিচে যাই। 

– চল। ছাদে কোন কিছুই নাই। খুনিও নাই। কোন প্রমাণও নাই।

 

তারা একে একে চলে যেতে থাকে সিড়ি ঘরের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে থাকে। ছাদ হয়ে পড়ে আবার নিশ্চুপ, নিরব। শুধু কিছুক্ষণ পর পর বয়ে চলা বাতাসের শব্দ শো শো করে কানে আসে,!

 

 

শাহারিয়ার রুমের দরজা খুলে কেউ একজন। দরজা খোলার পর আমরা দেখি শাহারিয়া আর আহনাফ বাইরে থেকে ঘরের ভিতরে ঢুকছে। ভিতরে প্রবেশ করেই লাইট জ্বালিয়ে দেয় শাহারিয়া। আহনাফ গিয়ে সোফায় বসে। শাহারিয়া তার জ্যাকেট খুলতে থাকে। তারা গিয়েছিলো বাংলালিংকের অফিসে। ঐদিক থেকে ফিরতে ফিরতেই বিকাল হয়ে গেছে। শাহারিয়া গিয়ে আহনাফের পাশে বসে। বসে বলে‌।

– যার খোঁজে গেলাম সেই দেখি উধাও, ! 

– হ্যা স্যার। আমরা ভেবেছিলাম তার কাছ থেকে কিছু ক্লু পাওয়া যাবে। কিন্তু দেখি সেই ২ দিন ধরে গায়েব। এখন কী করবো স্যার , ! 

– কী আর করার। ফাইল দেখে পরবর্তী কেস গুলা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বের করতে হবে রন্জুর কোন ভুল। আর ভুল গুলো খুঁজে বের করতে পারলেই সেগুলো ধরে ধরে আমরা রন্জু অব্দি পৌঁছে যাবো। 

– হ্যা স্যার। তাই করতে হবে।

শাহারিয়া সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– চল। 

– কোথায় স্যার , ? 

– শ্রীমঙ্গলে যাবো। বাড়ি দেখতে। 

– বাড়ি দেখতে ? কীসের বাড়ি স্যার ,? 

– চলো তুমি। রাস্তায় সব বলবোনে। লাঞ্চ টাও বাইরে করে নিবো। (বলেই অন্য একটা জ্যাকেট পড়ে নিতে থাকে শাহারিয়া। আহনাফও অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে জানে না কেন যাচ্ছে তারা। কেসের বিষয়ে না অন্য কোন কারণে। শাহারিয়া আবার বলে।

– আমাদের ফিরতে ফিরতে কিন্তু রাত হবে। তোমার মা আবার তোমাকে খুঁজবে না তো , ? 

– না না স্যার। মা’কে আমি বলেছি আজ একটু কেসের কাজে বিজি থাকবো। ফিরতে রাত হতেও পারে‌। মা চিন্তা করবে না। 

– আচ্ছা তাইলে চলো বেড়িয়ে পড়ি। নিচে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলেও এসেছে হয়তো এতক্ষণে। গাড়ি দিয়ে সর্টকার্ট রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে‌। বেশি সময়ও লাগবে না। চলো।

বলেই শাহারিয়া বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে দাঁড়ায়। আহনাফও তার পিছনে দাড়ায়। শাহারিয়া ঘরের লাইট অফ করে দিয়ে আহনাফ কে নিয়ে বেড়িয়ে যায়। দরজা ভালো করে লক করে দেয়। ঘরের ভিতর আবার ছেয়ে যায় নিস্তব্ধতা।

 

 

দিথী আর সামিহা বসে আছে তার বাবার পাশে। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার তার বাবার কাঁধ থেকে গুলি বের করে ব্যান্ডিজ করে গিয়েছেন। অন্তর সাহেব এখন ঘুমাচ্ছেন। মুখে বয়সের ভাজ পড়েছে। এই বয়সে গুলির ক্ষত। তারউপরের শীত কাল। এইসময় ক্ষত যে কতটা যন্ত্রনা দায়ক, ! 

দিথী তার বাবার হাত ধরে রয়েছে। যখন গুলি লাগা অবস্থায় তার বাবাকে বাড়িতে দিয়ে যায় পুলিশের কনস্টেবলরা তখন খুব কেঁদেছিলো দিথী। তার বাবা যে তাকে অনেক আদর করে‌। বাবার এরকম অবস্থায় একমাত্র মেয়ের কান্না করাটাই স্বাভাবিক। দিথীর চোখের পানি এখন শুকিয়ে গিয়েছে। তার বাবার হাত ধরে নিজেকে শান্ত করেছে সে। কিছুক্ষণ পর শেফালী অন্তর সাহেবের ঘরে প্রবেশ করে। এসে দিথীর কাছে এসে হেলে ধীর গলায় বলে।

– আপামনি। চলেন খাইয়া নিবেন। বিকাল ৩ ডা বাইজ্জা গেছে। সামিহা আফামনি তো এহানেই আছে‌। খালাম্মা আপনেরে ডাকতাছে খাওনের লাইগা। আহেন।

– তুমি যাও শেফালী। আমি পড়ে খাবো।

 

শেফালী সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সামিহাকে ইশারায় বলে দিথীকে মানানোর জন্য। সামিহা দিথীর পাশেই বসে ছিলো। সে দিথীর কাঁধে হাত রেখে ধীর গলায় বলে।

– যা বনু। কিছু একটা মুখে দে‌। আমি তো বাবার সাথে এখানে আছিই। যা খেয়ে নে। (শেফালীর দিকে তাকিয়ে) শেফালী, ওকে নিয়ে যা। 

শেফালী দিথীকে ধরে উঠাতে থাকে ধীরে ধীরে। নিয়ে যেতে থাকে ঘর থেকে। সামিহা এতক্ষণ বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসেছিলো। এখন সে চেয়ার ছেড়ে বিছানায় উঠে। অন্তর সাহেবের মাথার পাশে বসে‌। অন্তর সাহেব উপর কাঁথা টা টেনে ঠিকঠাক করে দিতে থাকে‌।

 

 

জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছেন সাথী খাতুন। এই চার দেয়ালের মাঝেই তাকে সারাটা দিন থাকতে হয়। তার জানালা টা দক্ষিণ মুখি। জানালা ‌দিয়ে বাড়ির পিছনের পুকুরের অর্ধেক অংশ দেখা যায়। পরন্ত বিকেলে মৃদু বাতাস বয়ে আসে পুকুরের জল ছুঁয়ে। সেই হালকা মৃদু বাতাসে সাথী বেগমের চুল গুলো হালকা নড়ে উঠে। ঘরে প্রবেশ করে আলিশা। এসেই বিছানা বসে। আনমনে চেয়ে থাকা সাথীর ঘোর ভাঙিয়ে বলে।

– কী করো মামিমা , ! 

আলিশার কথা শুনে পিছনে ফিরে তাকান সাথী। দেখেন আলিশা এসেছে। এই একটা মেয়েই যা তার সঙ্গ দেয় মাঝে মধ্যে। নাহলে একাকিত্বই তাকে সবসময় ঘিরে রাখে। সাথী পিছনে ঘুরে ভালোভাবে বসেন। কোলে মাথার বালিশ টা নিয়ে বলেন।

– স্কুল থেকে কখন আসলি , ! 

– এইতো মামিমা এসে গোসল করে খাবার খেলাম। জানো মামিমা ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হইছে , ! 

– হ্যা শুনেছি। নিপা নাম বোধহয় মেয়েটার। 

– হ্যা মামিমা। নিপা আপুকে আমি কলেজে দেখেছি। আদব কায়দা বেশ ভালোই। দেখতেও মাশাআল্লাহ। একদম তোমার মতো। ভাইয়ার চয়েস আছে বলতে হবে , ! 

– হ্যা তা মন্দ বলিস নি। রায়হান সবসময় দেখে শুনেই সব পদক্ষেপ নেয়। আর নজরুল ভাইও তার কথা ফেলতে পারেন না। (একটু থেমে) তোর পরীক্ষা কবে , ! প্রিপারেশন কেমন ? 

– এইতো মামিমা ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি শুরু। প্রিপারেশন মোটামুটি। 

– মোটামুটি কেন , ? গল্পের বই এখন না পড়ে স্কুলের বই গুলাতেও একটু মনযোগ দে।

– আচ্ছা মামিমা ঠিক আছে।(একটু থেমে উৎসুক হয়ে) আচ্ছা মামিমা, তোমার আর শাহেদ মামারো কী প্রেম করে বিয়ে হয়েছিলো , ! 

– হ্যা আমাদেরও পছন্দ করেই বিয়ে হয়। তোর মামা তো প্রতিদিন রাতে আমার বাসায় এসে জানালা দিয়ে আমার সাথে দেখা করতো। তখনকার সময় গুলা খুব মিস করি রে।

– মামার সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে হয়েছিলো , ? আর (একটু লাজুক হয়ে) বিয়ের কথাটা কে আগে বলেছিলো, তুমি না মামা , ! 

– তোর মামা আর আমি একই কলেজে পড়তাম। সেখান থেকেই পরিচয়। তারপর বন্ধুত্ব, ধীরে ধীরে সেটা ভালোবাসায় রূপ নেওয়া। তারপর বিয়ে। তোর মামা তো তোর নানুর সামনে ভয়ে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেনি। তোর নানু খুব কড়া ছিলো আগে। তার কথার উপর বলে কেউ কথা বলতে পারতো না। উনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেন পুরো বাড়ি বলে ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকতো।

– তাহলে তখন তোমাদের বিয়ের বিষয়টা তাকে কে বললো‌। তিনি রাগ করেননি, ?

– তোর মামা ভয়ে বলতে পারবেনা ভেবে আগেই গোপনে বিয়েটা সেরে ফেলে। বিয়ে সম্পর্কে তখন শুধু আমার বাড়ির লোকেরাই জানতো। পরে তখন তোর মামা বিয়ের কথা তোর নানুকে বলে। রাগ করেছিলো বলে অনেক। পড়ে আবার মানেও নিছিলো। তারপর থেকেই এই সংসারে আসা। 

– নানুর মতোই এখন নজরুল মামাও হইছে মনে হয়। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে। আমার তো নজরুল মামার সামনে যাইতেও ভয় করে। (একটু থেমে) জানো মামি। তোমার যেমন চোখের নিচে একটা ছোট্ট তিল আছে‌, তেমনি নিপা ভাবির গালেও একটা ছোট্ট তিল আছে‌। দেখতে তোমার মতো ফর্সা আর সুদর্শন। ভাবি আসলে ভাবির সাথে আমি অনেক গল্প করবো। 

– আচ্ছা যখন সে আসবে তখন করিস। (একটু থেমে ধীর গলায়) তোর মা ভাত খাইছে , ? 

– হ্যা মা খাইছে। এখন কাপড় সেলাই করতেছে।

– তোর মা’কে বলতে পারিস না, সেলাই করার কী দরকার,! তার ভাইরা তো আছেই।

– বলি তো। কিন্তু মা তখন আরো উল্টা আমাকেই ঝাড়ি মারে।

– তোর মা’কে বলিস নতুন বউ আসার পর সুমনা আপার সাথে তর্ক না করতে। পরে তখন ঝগড়া বাধে যাবে, আর নতুন বউ সেসব দেখলে কী ভাববে বলতো, ! 

– আচ্ছা আমি মা’কে সব বুঝিয়ে বলবোনে।

– আসরের নামাজ পড়েছিস , ?

– ইয়ে মানে মামিমা , (মাথা চুলকাতে চুলকাতে আলিশা এদিক ওদিক তাকাতে থাকে)

– একটু পরে মাগরিবের আযান দিয়ে দিবে। আর তুই এখনো আসরই পড়িস নি , ! যা গিয়ে অযু করে আয়। নামাজ পড়া একদম ছাড়বিনা।

– আচ্ছা মামিমা যাচ্ছি।(একটু গোমড়া মুখ করে উঠে চলে যেতে থাকে আলিশা।

– অযু করে এখানেই আসিস একসাথে মাগরিবের টাও পড়ে নিবি।

– আচ্ছা ঠিক আছে মামিমা। 

আলিশা চলে যায়। ঘর আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। সাথী ধীর পায়ে বিছানা থেকে নামতে থাকেন। বিছানার সাইডে শাহেদ সকালে কাপড় খুলে রেখে গিয়েছে। নিচে নেমে সেগুলো ভাঁজ করতে শুরু করেন। ভাঁজ করে কাঠের আলমারিটা খুলে সেগুলো ঢুকিয়ে রাখেন। শাহেদের গায়ের শার্টে লেগে থাকা গায়ের গন্ধও তার ভালো লাগে‌। সারাদিন শাহেদের অনুপস্থিতি একটু হলেও সাথীর মনে কষ্ট দেয়। তবে রাতে বাড়ি ফিরলে তাদের মধ্যে আবার ভালো ভাব হয়ে যায়। শাহেদ যে তাকে খুব যত্নের সাথে আগলে রাখেন ,! হয়তো বয়স একটু হয়েছে তবুও সাথীর প্রতি তার ভালোবাসাটা আগের মতোই রয়ে গেছে , ! 

 

 

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন। চারদিকে লোকের কোলাহল। শীতের সময়, তাই জাফলং আর পাহাড় চূড়া দেখতে আসা পর্যটকদের চাপ একটু বেশিই থাকে রেলস্টেশনে। হকারের ডাক, চারপাশে মানুষের ভিড়, তার মাঝেই একটা ট্রেনের স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার হুইসেল। 

রাতের কুয়াশার মাঝে স্টেশনের সামনে এসে দাড়ালো একটা প্রাইভেট কার। কার থেকে দরজা খুলে নামলো তানিয়া, কানিজ আর সুমু। কারের ড্রাইভার নেমে পিছনের ডিক্কি থেকে তাদের লাগেজ বের করে দেয়। তানিয়া হাতে হ্যান্ড পার্স আর ফোন, কানিজের হাতে শুধু ফোনটা। আর সুমুর কাঁধে একটা ব্যাগ। স্কুল ব্যাগের মতো দেখতে কিছুটা। তবে সেটাতে তার যাবতীয় দরকারি জিনিসপত্র রাখা। তাদের নামিয়ে দিয়ে প্রাইভেট কার টি ভাড়া নিয়ে চলে যেতে থাকে। কানিজ লাগেজের হাতল ধরে সেটা টেনে তানিয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে।

– তুই বললি যে দুইদিন পর রওনা দিবো। তাইলে আজ হঠাৎ করেই যাওয়ার প্ল্যান করলি যে , ! 

– কারণ হাতে আর বেশি সময় নেই। আর তার চেয়ে বড় কথা তাদেরকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাই আগে ভাগে যাওয়ার পরিকল্পনা। চল ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। 

কানিজ আর কিছু বলেনা। তানিয়া স্টেশনের ভিতরে ঢুকে পড়ে‌। তার পিছুপিছু আসতে থাকে কানিজ আর সুমু। তাদের ট্রেন রাত ৯ টার। এখন বাজে সাড়ে ৮ টা। 

তারা প্ল্যাটফর্মে চলে আসে। তাদের ট্রেন ৩ নং প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ৩ নং প্ল্যাটফর্মে গিয়ে উঠে পড়ে সুবর্না এক্সপ্রেস এ। গিয়ে বসতে থাকে তাদের সিটে। ট্রেন ছাড়তে হাতে এখনো সময় আছে। তবুও তারা আগে ভাগেই ট্রেনে উঠে বসে। একসাথে পাশাপাশি ৩ টা সিটের টিকিট কেটেছিল তানিয়া। তারা পাশাপাশি বসে পড়ে। জানালার পাশে তানিয়া, মাঝে কানিজ আর সাইডে বসেছে সুমু। কানিজ ফোন চিপছে। সুমুও তাই। যেহেতূ ট্রেন ছাড়তে আরো ১৫ মিনিট বাকি। কিন্তু তানিয়া জানালা দিয়ে বাইরে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে আছে। চেয়ে আছে আনমনে। বুকের ভিতর কিছুটা ভয় হচ্ছে। তবুও ভয়কে জয় করে এক অসুভ শক্তির বিনাশ করার টার্গেট কে তাকে ফুলফিল করতেই হবে , ! 

 

 

২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৯৬

 

ম্যাচ দিয়ে হারিকেন জ্বালালো তাসনুবা। পুরো ঘরের আঁধার কিছুটা হলেও কমিয়ে দিলো হারিকেনের লাল শিখা। আলোর তীব্রতাটা কমিয়ে দিলো তাসনুবা। পাসেই তোর ছোট্ট ছেলে নোমান ঘুমিয়েছে। হারিকেনের মৃদু আলোর সামনে বক্সটা রাখলো তাসনুব। সেই বক্সটা যেটা সে তার শশুর শাশুড়ির ঘর থেকে পেয়েছে। সেই ছোট্ট চিরকুট কাগজ টা হারিকেনের সামনে নিয়ে গেলো। মৃদু আলোয় শুধু কাগজের লেখা গুলো আর তাসনুবার মলিন মুখ খানা দৃশ্যমান হয়েছে। তাসনুবা আর তার ছেলে নোমান এক ঘরে আলাদা ঘুমায়। আর তার স্বামী সোহেল আলাদা রুমে ঘুমায়। তাসনুবা সেই কাগজের অক্ষরে অক্ষরে ডুবে যেতে থাকলো। পড়তে শুরু করলো প্রতিটি লাইন। যতই সে পড়ে এগোচ্ছিলো ততই তার কপালের ভাঁজ চওড়া হতে শুরু করলো। প্রত্যেকটা লাইন পড়ে পড়ে যেন তার ভয়ের মাত্রা দ্বিগুণ হচ্ছে। এই ডিসেম্বরের শীতের মাঝেও তার গাল বেয়ে ঘাম পড়ছে।

তার হাত কাঁপতে শুরু করে। তার আর সাহস হচ্ছেনা বাকিটা পড়ার। আসুভে সম্পর্কেই কিছু লেখা আছে সেই কাগজে। তার ভিতরেই যে আসুভে বেড়ে উঠছে এটা জানার পর তার ভয়ের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। আর মাত্র নিচের ৩ লাইন বাকি। সেটুকু পড়াও সাহসে কুলাচ্ছেনা। তাসনুবা বেশ সাহসী মেয়ে। তবুও এখন তার সবটুকু সাহস যেন গলে পানিতে পরিণত হয়েছে। না তাকে বাকিটুকুও পড়ে শেষ করতে হবে। সে বাকিটুকু পড়ার জন্য চোখ কাগজ টার উপর রাখতেই হঠাৎ তার কান একটা শব্দ ভেসে আসে। সে চকিতে ফিরে তাকায় দরজার দিকে। কেউ যেন তার দরজার ঠিক সামনে পায়চারি করছে। তাসনুবা ঢোক গিলে‌।

এতোরাতে এই জঙ্গলবেষ্টিত বাড়ির মধ্যে কে তার দরজার সামনে পায়চারি করছে। না না। কে না। কারা। বাইরে দুজনের চলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একবার দরজার এপাস থেকে পায়চারি করে ওপাস যাচ্ছে তো একবার ওপাস থেকে পায়চারি করে এপাস। তাসনুবার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। এমনিতেই সে কাগজ টা পড়ে ভয় পেয়েছিলো। তার মাঝে মাঝরাতে তার ঘরের সামনে কারো চলার আওয়াজ।

হঠাৎ আওয়াজ আসা বন্ধ হয়ে যায়। বাইরে জোছনা পড়েছে। আর দরজার নিচ দিয়ে ইঞ্চি এক ফাঁকা রয়েছে। সেই জোছনার আলোয় ইঞ্চি এক ফাঁকার মাঝে সে দেখতে পায় ২ জোড়া পা ঠিক দরজার দিকে মুখ করে দরজার সামনে দাড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে তো দাঁড়িয়েছেই। একদমই নড়ছেনা। তাসনুবার ভয় হচ্ছে। “বাইরে কোন অসুভ আত্মা দাঁড়িয়ে নেই তো , ! না না। আমাকে স্বাভাবিক হতে হবে। ভয় পেলে চলবে না।” ভেবেই হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে চিরকুটের বাকি তিন লাইন পড়ার জন্য চিরকুট টা হারিকেনের মৃদু আলোর সামনে ধরে।

“যার ভিতরে আসুভে বেড়ে উঠবে। সে একদম শেষ সময়ে এই বিষয়ে জানতে পারবে। তখন হয়তো তার কিছু করার থাকবে না। তবে সে যদি তার আশেপাশে বেষ্টিত অসুভ জগত থেকে বের হয়ে কোন আলোর জগতে পা রাখে। তবেই তার ভিতরের আসুভেকে সে ধ্বংস করতে পারবে। ”

চিরকুটের এই শেষ ৩ লাইন পড়ে তাসনুবার মনে কিছুটা আশার আলো জাগে‌। তারমানে সে যদি এই অভিশপ্ত আনন্দ পুর থেকে কোন মতে বেড়িয়ে যেতে পারে তবেই সে তার ভিতরের সেই খারাপ জিনিসটাকে ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু সে বেড়োবে কী করে , ! তার শশুর, শাশুড়ি আর সোহেল তো তাকে বেড়োতে দিবে না। 

” হ্যা। ভাইয়া। ভাইয়াই একমাত্র পারবে আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে। কিন্তু ভাইয়া পরবর্তীতে যে আর কবে আসে , ! ”

মনের আক্ষেপ টানতে টানতেই হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে সেই দুইজন মানুষের কথা ভেসে আসে। গলার স্বর দুটো তাসনুবার খুব চেনা। আরে এটা তো তার শশুর শাশুড়িরই গলা। সে তাদের কথার মাঝে আসুভে শব্দ টা স্পস্ট শুনতে পায় বিছানায় বসে। তার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। 

“আসুভে নিয়ে তারা কী কথা বলছে , ? আমাকে জানতেই হবে।” মনে মনে ভেবেই ধীরে ধীরে বিছানার মশারী থেকে নিচে পা নামায় তাসনুবা। নামিয়ে জুতো পড়তে থাকে। তার বিছানার নিচেও হয়তো ছিলো কিছু। যার জ্বল জ্বল দুটি চোখ তাসনুবার পায়ের আড়াল হতে দেখা যাচ্ছিলো। তাসনুবা বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে ধীর পায়ে শব্দ না করে যেতে থাকে। তার বুকের ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে। নিস্তব্ধ ঘরে তার হার্টের ধুক ধুক শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তাসনুবা গিয়ে কাঠের দরজায় কান পাতে। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছিলো তার দুই শশুর শাশুড়ির কষ্ঠ। তারা খুব গম্ভীর ভাবে কথা বলেন। তবে আজ তাদের গলার স্বরের গম্ভীরতা কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তাসনুবা কান পাতার পরই শুনতে পায় তাদের কথা। তারা বলছিলো।

– এতোবছর পর তাহলে সেই দিনটা এসেই গেলো হনুফা , ! কাল আমাদের বিজয়ের দিন। আসুভে এসে আমাদের করে দিবে মরনোত্তর। আমরা হয়ে যাবো অনেক শক্তির মালিক , ! 

– হ্যা জনাব। তাসনুবার জীবন রেখাও শেষ মেষ কালই শেষ হচ্ছে। কাল, কাল আমাদের জন্য সর্গীয় সময়। আসুভের জন্ম যেন আমাদের সম্পূর্ণ বিজয়, ! 

 

কথা গুলা শুনেই তাসনুবা আঁতকে উঠে , ! কালই আসুভের জন্ম লগ্ন , ! এখন সে কী করবে , ! কাল যদি তার ভাইয়ারা না আসে তাহলে সে কীভাবে পালাবে , ! আর না পালাতে পারলে তো, ! 

“না না। আমাকে যেভাবেই হোক পালাতে হবে। (হাত দুটো বুকের উপর রেখে মুখ উপরে করে) প্লিজ আল্লাহ, কাল যেন আমার ভাইয়া আসে। এই অসুভ শক্তির জন্মকে যেনো আমরা আটকাতে পারি। আল্লাহ সাহায্য করো আমাদের। সাহায্য করো, ! 

মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তাসনুবা। 

বাইরে সেই দুইজন চলে গিয়েছে। কোন কথার আওয়াজ কিংবা পায়ের শব্দ শোনা যায় না। তাসনুবা এসে বিছানায় উঠে। মশারি ভালো ভাবে ঠিক করে দেয়। হারিকেনের আলো সে বন্ধ করতে পারছেনা। বার বার মনে হচ্ছে আলো বন্ধ করলে এই বুঝি তার উপর কেউ আক্রমণ করবে। তাসনুবা তার ছোট্ট ছেলে নোমান কে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে থাকে‌। সে এই বিষাক্ত জীবন কখনোই চায়নি। তার শশুর শাশুড়িই সোহেলের খুশির জন্য তাসনুবাকে আত্মার মাধ্যমে তাদের বসে নিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে। তাসনুবা চেয়েছিলো এক সপ্নিল জীবন। এক রঙিন সুতোকাটা ঘুড়ির মতো আকাশে উড়তে। কিন্তু তার জীবন থমকে গেছে। থমকে গেছে তার রূপ জৌলুসের কারণে। কেনো সে কুৎসিত হলোনা, ! আজ কুৎসিত হলে কখনোই সে সোহেলের ভোগের বস্তু হতো না। এইরকম কঠিন পরিস্থিতিতে তার পড়তে হতো না। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে তাসনুবার। হয়তো কাল তার ভাইয়া না আসলে আর পরসুদিনের সূর্যোদয় সে দেখতে পাবেনা। হেরে যাবে সে এক অসুভ শক্তি আর ভাগ্যের কাছে। মনে মনে সে আল্লাহর কাছে চায়। 

” হে আল্লাহ, আমার যদি কাল মৃত্যু হয়ে যায়। সেই অসুভ শক্তির যদি জন্ম হয়ে যায়। সেটা যেন তার শক্তিকে ব্যবহার করতে না পারে। আমার যেন আবার পুনর্জন্ম হয়। আমি যেন পরের জনমে ফিরে আসি এই অসুভ শক্তি বিনাশ হয়ে। এই জনমে থাকা সবকিছুর অপূর্ণতা যেন পরবর্তী জন্মে পূর্নতা পায়, ! ”

 তার চোখ থেকে পড়া পানি গুলো বাষ্প হয়ে যেতে থাকে। মনের কঠিন আকাঙ্ক্ষা গিয়ে জমা হতে থাকে বক্সের সেই আংটির মধ্যে। বক্সটার হালকা খোলা ঢাকনার মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসতে থাকে আলোর সেই শক্তিশালী শিখা। তাসনুবার চোখ গুলো লেগে আসতে থাকে। এতো ভয়ের মধ্যেও যেন ঘরের কোন এক ভারি আবহাওয়া তাকে ঘুমের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। তাসনুবার দু চোখ ভরে ঘুম নামে। তাসনুবার এক হাত রয়ে যায় তার আদরের ছোট্ট ছেলে নোমানের ঘুমন্ত দেহের উপর। হয়তো এটাই তাসনুবার এই জনমের শেষ ঘুম। পরবর্তী ঘুমের রাত কী আদেও এই জন্মে সে পাবে , ! 

 

পরের দিন সকালে,

 

দিনের সূর্য টা আজ বেশ ঝলমল করছে। শেষ দিনের সকাল হয়তো এমনিই হয়। বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে এক হতাশাচ্ছন্ন মুখ নিয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে তাসনুবা। মনে হাজার আক্ষেপ, না পাওয়ার তাড়না। তৎক্ষণাৎ আবার মনে শান্তনা সূচক বাক্য হিসেবে জেগে উঠে ” মানুষ তার এক জন্মে যা চায়, সবকিছুই কী পায় , ?” হয়তো পায়না। আর এই তাসনুবার কাছে এটাই হয়তো বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তার বিশ্বাস। পরজনমে সে আবার আসবে এই আনন্দ পুরে। হয়তো প্রজা কিংবা রাণী রুপে। বিনাশের করবে সেই দোসর দের। ভালোবাসবে এক রাজপুত্রকে। আর এক সুন্দর মিলন ঘটাবে তার পূর্ব জনমের সব অপুর্ণনার পুর্নতাকে , ! 

তাসনুবার মুখে এক ছোট্ট মলিন হাসৌজ্জল রুপ ফুটে উঠে। হঠাৎ তার কানে আসে গাড়ি থামার আওয়াজ। সে সাথে সাথেই চমকে উঠে। তার বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। তার ভাইয়ারা কী তাহলে আসছে , ? তার মরে যাওয়া ইচ্ছে গুলো কি আবার জীবিত হবে , ! 

বাসায় কেউ নেই। তার ছোট্ট ছেলে নোমানও নেই। সকাল বেলা উঠে কাউকে দেখতে পায়নি তাসনুডা। তাসনুবা উঠে দাঁড়ায়। গেইট দিয়ে কারো বাসার ভিতরে প্রবেশ করার আওয়াজ। তাসনুবার বুকের ধুকপুকানি ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। যেন এখনি তার হ্রদপিন্ড টা লাফাতে তার থেকে বেড়িয়ে যাবে। কিছু মানুষ হেঁটে বাড়ির আঙিনার দিকে আসছে। এবং হঠাৎই তাসনুবা সেই মানুষগুলো কে দেখে এক দৌড়ে তাদের দিকে ছুটে যায়। তার মনে যেন আক্ষেপ ঘুচে এক খুশির বন্যা বয়ে যায়। তার ভাইয়া রাফি এসেছে। সে গিয়ে রাফির উপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে।

রাফি হঠাৎ তাসনুবাকে এমন হতে দেখে কিছুটা অবাকই হয়ে যায়। রাফিকে জড়িয়ে ধরে “ভাইয়া ভাইয়া” বলে প্রায় কেঁদেই ফেলে তাসনুবা। রাফিও তাকে আর ছাড়িয়ে দেয় না। সেও তার ছোট্ট আদরের বনু টাকে আগলে রেখে শান্ত করতে থাকে। সাবিনা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সে তাসনুবাকে রাফির থেকে ধীরে ধীরে ছাড়াতে থাকে। তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে রাফির বন্ধু সিহাব আর সিহাবের ছোট্ট ১২ বছরের বোন তনু। 

সাবিনা তাসনুবাকে শান্ত করায়। বারান্দার খুটির পাশে তাকে বসায়। রান্নাঘরে যায়, গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে তাসনুবাকে খাইয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। তাসনুবা পানিটা এক ঢোকে খেয়ে শেষ করে ফেলে। তারপর কিছুটা শান্ত হয়। এখনো সে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। তার বড় ভাই রাফি তার সামনে বারান্দায় বসে। তার কাঁধে হাত রেখে বলে।

– বনু, তুই ঠান্ডা হ। কী হয়েছে আমাদের বল। (একটু থেমে) শশুর বাড়ির কেউ কিছু তোকে বলেছে ? তোর গায়ে হাত দিয়েছে ? কী হয়েছে আমাদের বল।

তাসনুবা ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলে।

– ভ,ভাইয়া। ভাইয়া। আগে আমাকে কথা দেও। আমি যা বলবো তা নিছক অসম্ভব ভেবে উড়িয়ে দিবেনা। আমি যা বলবো সবই সত্যি। আর ঐদিন যে ঐরকম দেখেছিলে মনিটরে। সেটাও একটা প্রমাণ আমার এই কথার। প্লিজ তোমরা আমার কথা গুলোকে অবিশ্বাস করোনা। 

রাফি, তাসনুবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। বলে।

– তুই যা বলবি নিশ্চয়ই সত্যি বলবি। আর এমনিতেও তোর ক্ষেত্রে আগে যা হয়েছে সব অস্বাভাবিকই ছিলো। তুই বল।

 

তাসনুবা বলতে শুরু করে। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব। আসুভে কী, আসুভে কেন, আসুভে দিয়ে তার শশুর, শাশুড়ি কী করতে চায় সব বলতে থাকে। তার ভাই রাফি, তার বান্ধবী সাবিনা, তার ভাইয়ের বন্ধু সিহাব আর সিহাবের ছোট্ট বোন তনু সব শুনতে থাকে আর অবাক হতে থাকে। এসব কিছুই যেন কোন গল্পের মতো। তবুও এসবই এখন তাদের সামনে বাস্তব। তাসনুবা কিছুক্ষণ কথা বলার পর বারান্দা থেকে উঠে দৌড়ে তার ঘরে রায়। গিয়ে সেই বক্স টা আর সেই ছোট্ট চিরকুট টা নিয়ে আসে।

বারান্দায় বসে সেই বক্স টা খুলে। এখনো সেই আংটিটা থেকে উজ্জ্বল আলো বেড়োচ্ছে। আর সেই চিরকুট টাও রাফি পড়ে। এসব কিছু তাদের মন বিশ্বাস করতে চাচ্ছেনা। কিন্তু যা যা প্রমাণ তারা তাদের স্ব-চোখে দেখতে পাচ্ছে তাও তো অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। রাফি আর সাবিনা বুঝে যায় সবকিছু। তাসনুবাও যখন ৮ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে চলে আসছিলো তখন তাসনুবাকে দেখে মনে হচ্ছিলো তাসনুবা তার নিজের কন্ট্রোলে নেই। যেন তাকে কোন কিছু বস করেছিলো।

 তাসনুবা সবকিছু বলে শেষ করে। তার সামনে দাঁড়ানো ৪ জনেরই সব বিশ্বাস হয়ে যায়। তাদের মনেও ভয় উঁকি দিতে থাকে। একে সকালে তাসনুবা ঘুম থেকে উঠে কাউকেই দেখতে পায়নি। তার উপর কাল রাতে তাসনুবার শশুর শাশুড়ির বলা সেই কথা গুলো। তারা তাড়াতাড়ি সেই বাড়ি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাফি সেই বক্স টাকে আর চিরকুট টাকে ১২ বছরের ছোট্ট মেয়ে তনুর হাতে দেয়। আর বলে তার কাঁধে থাকা ঝোলায় ঢুকিয়ে রাখতে। ছোট্ট মেয়ে তনুও তাই করে সে তার কাঁধ থেকে ঝোলা টা নামিয়ে সেটাতে আগে বক্সটা ঢুকায়। তারপর চিরকুট টা ঢুকিয়ে সেটার চেইন লাগিয়ে যখনই কাঁধে নিলো সাথে সাথেই তাদের কানে ভেসে আসলো কারো পায়ের আওয়াজ।‌ কেউ মেইন গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে হেঁটে হেঁটে বাড়ির সামনের দিকটায় আসছে। তাসনুবা ভয়ে রাফির পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। সাবিনাও ভয়ে রাফির ভাই সিহাবের হাত ধরে নেয়। তাদের মধ্যে হয়তো অন্য কোন সম্পর্ক ছিলো। 

হেঁটে হেঁটে আঙিনার সামনে এসে দাঁড়ায় তাসনুভার শশুর শাশুড়ি। তাদের দেখেই সবাই ভয় পেয়ে যায়। রাফি জোরে চিৎকার দিয়ে বলে।

– আমাদের যাওয়ার রাস্তা থেকে সড়ে যান। নাহলে ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি। 

তার কথা শুনেই তারা দুজন হাসতে থাকে। যেন তারা আরো উল্টো মজা পাচ্ছে এদের কথায়‌। তখনই রাফি ফিসফিস করে তাসনুভাকে বলে।

– আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকিস বনু। একদম হাত ছাড়বি না। 

তাসনুবা কিছু বলতে যাবে, তখনই তার মুখে ফুটে উঠে এক বেদনার ছাপ। আর সে চিৎকার দিয়ে উঠে। রাফি পিছন ফিরে তাকায়। দেখে তাসনুবার প্রসব বেদনা উঠেছে। রাফি কী করবে বুঝতে পারে না। সাবিনাকে বলে তাসনুবাকে ধরতে। সাবিনা এসে তাসনুবাকে ধরে। ছোট্ট মেয়ে তনুও এসে তাসনুবাকে ধরে‌। ধরে দাঁড় করাতে থাকে কোনরকমে। তখনি রাফি আর সিহাব দৌড়ে গিয়ে হামলে পড়ে সামনে থাকা সেই দুইজনের উপর।

তারা হঠাৎ আক্রমণে থতমত খেয়ে যায়। রাফি আর সিহাব দুজন মিলে সামনের দুজনকে নিয়ে ছিটকে পরে বাড়ির প্রাচীর দেওয়ালে পাশে থাকা শুকনো ডালপালার স্তুপের উপর। সেই সুযোগে সাবিনা আর ছোট্ট মেয়েটা ধারধরি করে তাসনুবাকে নিয়ে যেতে থাকে গাড়ির দিকে‌। তাসনুবা ব্যাথায় আর্তনাদ করছে। সাবিনা তাকে শক্ত করে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। এদিকে সেই দুজন মানে তাসনুবার শশুর শাশুড়ির দেহেও বেশ শক্তি তারা দুজন রাফি আর সিহাব কে তাদের লম্বা নক দিয়ে আঁচড় দিতে থাকে। ঘায়েল করার চেষ্টা করে‌। রাফি আর সিহাবও থামার পাত্র নয়। তারাও সমান তালে লড়ে যেতে থাকে যতক্ষণ না তাসনুকে সাবিনারা গাড়িতে তুলতে পারছে। রাফি উঠে দাঁড়িয়ে পাশে থাকা এক ইটের টুকরা তুলে একজনের হাতে এক জোড়ে আঘাত করে। সাথে সাথেই তার হাত ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। ঐদিকে সাবিনারা তাসনুবাকে গাড়িতে উঠিয়ে ফেলে।

সাবিনা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকে রাফি আর সিহাবকে। তারা দুজন কোনমতে সেই পিশাচ রুপী মানুষ দের হাত ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে ছুটে আসতে থাকে গাড়ির দিকে। সাবিনা দ্রুত এসে গাড়িতে উঠে বসে। আর আহত শরীর নিয়ে রাফি আর সিহাবও দ্রুত গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট করে দেয়। পিছন পিছন সেই দুজন মানুষ রুপি পিশাচ বেড়িয়ে আসে বাড়ির গেইট দিয়ে। দেখে গাড়ি নিয়ে তারা ছুটে পালাচ্ছে। তখনই তাসনুবার শাশুড়ি হনুফা বেগমের হাত পা গুলো উল্টো হয়ে যেতে থাকে। এবং অস্বাভাবিক এক পিশাচের রুপ নিয়ে দৌড়ে ছুটে যেতে থাকে সেই গাড়ির দিকে। রাফি গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসেছে। সে সাইড গ্লাস দিয়ে দেখে এক অস্বাভাবিক জিনিস উল্টো ভাবে ছুটে তাদের গাড়ির পিছন পিছন আসছে। রাফি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। 

 

 নিস্তব্ধ লতাপাতায় ঘেরা নীলগিরি জঙ্গল। জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে সই করে ছুটে চলে গেলো একটা প্রাইভেট কার। গাড়ির ভিতরে সামনের সিটে বসে রয়েছে রাফি আর সিহাব। তাদের দুজনের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। রাফি স্টেয়ারিং হুইল শক্ত করে ধরেছে। সেই সময় তাদের সাথে ধস্তাধস্তিতে তার চোখের পাশ আর ঠোট একটু কেটে গিয়েছে। রক্ত বের হচ্ছে। পিছনের সিটে মাঝে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে তাসনুবাকে, আর তার ডান পাশে বসেছে সাবিনা আর বাম পাশে সেই ছোট্ট মেয়ে তনু।  তাসনুবা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। সাবিনা তাকে কোলে শুইয়ে দিয়ে তার হাতে নিজের হাত গুলো ঘসছে। তাসনুবার পায়ের দিকে বসে থাকা তনুর চোখে মুখেও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তাসনুবা ব্যাথায় চিৎকার দিচ্ছে। সাবিনা, রাফিকে উদ্দেশ্য করে বলে

 – ভাইয়া, প্লিজ আরো তাড়াতাড়ি চালাও। তাসনুর অবস্থা ভালো না।  

রাফি লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে পিছনে তাসনুবার সেই আর্তনাদ করা মুখ টার দিকে চায়। ছোট থেকে বড় হতে দেখা তার আদরের ছোট্ট বোন টা কত কষ্ট পাচ্ছে। রাফির ভিতর টা পুরে যাচ্ছে তাসনুবার এমন অবস্থা দেখে। সে শুধু পারছেনা চিৎকার করে কাঁদতে।‌

রাফি গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। যে করেই হোক এই এলাকা থেকে তাদেরকে বের হতেই হবে। নাহলে যে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। রাফির আঁচড় কাটা, মাটি লেগে থাকা গাল বেয়ে এই শীতের সময়েও ঘাম বেয়ে পড়তে থাকে। সে বারবার সাইড গ্লাস দিয়ে দেখছে যে তাদের পিছনে সেই আদ্ভুদ জিনিসটা আসছে কি না। কিন্তু না, পিছনে কাউকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। তখনই আমরা দেখতে পাই গাড়ি যেই পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে সজোরে চলছে সেই পিচ ঢালা রাস্তায় গাড়িটা থেকে তরল কিছু পড়ে যাওয়ার দাগ দেখা যাচ্ছে। তারমানে গাড়ির তেলের ট্যাঙ্কার কেউ ফুটো করে দিয়েছে। হয়তো‌ তাদের ২ জনেরই কাজ এটা। যখন তাসনুবারা বাড়ির ভিতরে ছিলো তখন হয়তো এই কাজ করেছে।

গাড়িটা সজোরে চলে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যেকার রাস্তাটা দিয়ে। একটা বড় মোটা বট গাছ। সেটাকেও পিছনে ফেলে ছুটে চললো গাড়িটা। তখনই আমরা দেখতে পাই সেই বটগাছের পিছন থেকে একজন বেড়িয়ে আসছে। গাঁয়ে, চোখে মুখে শাল জড়ানো। দেখে আর বুঝার বাকি রইলো না ইনি তাসনুবার শশুর। তিনি এসে একটা দিয়াশালাই এর কাঠি বের করেন। সেটা জ্বালিয়ে সেই রাস্তায় পড়ে থাকা তেলের লাইন টার উপর ফেলে দেয়। সাথে সাথেই লাইন অনুযায়ী ছড়িয়ে পড়তে থাকে আগুন। আগুন ছড়িয়ে সেই লাইন অনুযায়ী চলে যেতে থাকে গাড়ির পিছু পিছু। তিনি আবার সেই জঙ্গলের ভিতরের দিকটায় দিকে চলে যেতে থাকেন।

সিহাব তার নজর গাড়ির সাইড লুকিং গ্লাসের দিকে নিয়ে যায়। আর দেখে একটা আগুনে জলন্ত শিখা রাস্তা দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে ঠিক তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। সে সাথে সাথেই তার পাশে বসে থাকা রাফিকে বলে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে। পিছনের সিট থেকে প্রসব বেদনা উঠা তাসনুবার চিৎকার , আর্তনাদ বেড়েই চলছে। তার মাঝে তাদের পিছনে ছুটে আসা আগুন। এ যেন এক অভিশপ্ত পরিস্থিতি ,! আগুন টা তাদের গাড়ির খুব কাছে চলে আসে। আরেকটু হলেই তাদের গাড়িতে আগুন ধরে যাবে। তাসনুবার চিৎকার আরো বেড়েই চলেছে। রাফি প্রাণপণে চেষ্টা করছে এই গ্রাম থেকে বেড়িনোর। হঠাৎ গাড়ির পিছনের সিটের বাম দিকের দরজাটা আপনা আপনিই খুলে যায় এবং একটা অদৃশ্য শক্তি সেই ১২ বছরের মেয়ে তনুকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে বাহিরে ফেলে দেয়। তনু চলন্ত গাড়ি থেকে ছিটকে জঙ্গলের লতাপাতা গুলোর উপর গিয়ে গড়িয়ে পড়ে আর সাথে সাথেই গাড়িটাতে আগুন লেগে যায়। তনুর গড়িয়ে পড়ার যায়গা থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর পরই এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে সেই গাড়িটার। গাড়ির ছাদ উড়ে গিয়ে পড়ে এক গাছের উপরিভাগে এবং জলন্ত আগুনের শিখা সহ গাড়িটা গিয়ে সজোরে আছড়ে পড়ে এক মোটা গাছের গুঁড়ির সাথে‌। হঠাৎ এই বিকট শব্দে আশেপাশের গাছের পাখি গুলো উড়ে যেতে থাকে। পরিসমাপ্তি ঘটে এক আশার আলো দেখেও অভিশপ্ত জীবন থেকে বের হতে না পারা তাসনুবার জীবন অধ্যায়ের। হয়তো শেষ আত্মচিৎকার টাও করতে পারেনি তার ভাই-বান্ধবীরা। তখনই আমরা দেখতে পারি সেই চাঁদর গায়ে জড়ানো বৃদ্ধ টা মানে তাসনুবার শশুর গাছের গুঁড়ির পিছন থেকে সামনে আসছে। এসে জলন্ত গাড়ির পিছনের দিকের একটা দরজা খুলে। ভিতরে জ্বলতে থাকা তাসনুবার দেহ থেকে একটা বাচ্চা সন্তান বের করে আনে। যেন মাত্রই জন্ম হয়েছে সেই বাচ্চাটার,! লোকটা সেই ছোট্ট বাচ্চাটাকে তার শালের চাদর দিয়ে ভালোভাবে পরম যত্নে জড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকে জঙ্গলের ভিতরের ‌দিকটায়। হাসতে থাকে এক আনন্দের হাসি। এদিকে সেই জলন্ত গাড়িটা থেকে পিছনে কিছুদূরে আমরা দেখতে পাই সেই ১২ বছর বয়সী মেয়ে তনুর অচেতন হয়ে পড়ে থাকা দেহ ,!

 

চলবে ,,,,,

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৬

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

জলন্ত গাড়ির পিছনের দিকের একটা দরজা খুলে। ভিতরে জ্বলতে থাকা তাসনুবার দেহ থেকে একটা বাচ্চা সন্তান বের করে আনে। যেন মাত্রই জন্ম হয়েছে সেই বাচ্চাটার,! লোকটা সেই ছোট্ট বাচ্চাটাকে তার শালের চাদর দিয়ে ভালোভাবে পরম যত্নে জড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকে জঙ্গলের ভিতরের ‌দিকটায়। হাসতে থাকে এক আনন্দের হাসি। এদিকে সেই জলন্ত গাড়িটা থেকে পিছনে কিছুদূরে আমরা দেখতে পাই সেই ১২ বছর বয়সী মেয়ে তনুর অচেতন হয়ে পড়ে থাকা দেহ। পুরো জঙ্গল যেন শান্ত হয়ে যায়। শুধু পোড়ার আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ পাওয়া যায় না। দিনের সূর্য টারও তেজ কমে যায়। বাতাসে ফুলের গন্ধের যায়গায় বয়ে যাচ্ছে শুধু মানুষ পোড়ার গন্ধ। 

 

দিথীর চোখ খুলে যায়। তৎক্ষণাৎ সে উঠে বসে। বসে জোরে জোরে হাপাতে থাকে। স্বপ্নে তাসনুবাদের মৃত্যু দেখতে পাবে তা সে কখনোই ভাবেনি। হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে পুরোটা খেয়ে ফেলে দিথী। তার জোরে জোরে নেওয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ নীরব নিস্তব্ধ ঘরে প্রতিফলিত হচ্ছে। সে তার বুকে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করতে থাকে‌। পাশে চেয়ে দেখে নিবিড় আর সামিহা ঘুমাচ্ছে। অন্তর সাহেব এক রুমে একলা থাকতেন আগে। নাজিয়া বেগম আর নিবিড় আলাদা রুমে আর দিথী আর সামিহা থাকতো আলাদা রুমে।  কিন্তু অন্তর সাহেবের গুলি লাগায় আজ তার সাথে শুয়েছেন নাজিয়া বেগম। আর তাই নিবিড় আজ শুয়েছে তার ২ বোন সামিহা আর দিথীর সাথে। নিবিড় ছোট। ক্লাস ৬ এ পড়ে। তাই দিথী আর সামিহাও তাকে তাদের সাথে শুতে দিতে দ্বিমত করেনি। দিথী নিবিড় আর সামিহার গায়ে কম্বলটা ভালোভাবে টেনে দিয়ে শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে শুয়ে হাত দুটো ভাঁজ করে গালের নিচে রাখে সে। আংটিটা সে ঘুমানোর আগে হাত থেকে খুলে বক্সে ঢুকিয়ে রেখেছে। একটু মাথা উঁচু করে দেখতে লাগলো বক্স টা তার যায়গা মতো আছে কিনা। হ্যা বক্স টা ঠিকঠাক মতো আছে। সে আবার মাথা নামিয়ে বালিশে রাখলো। মনে তার নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কে এই তাসনুবা। কেনই বা তার স্বপ্ন দিথী দেখছে। আর আজকে তাসনুবার মৃত্যু। তার সেই জলন্ত দেহ থেকে এক বাচ্চার জন্ম। এসব কীভাবে হতে পারে , ! দিথীর মাথা কাজ করছেনা।

হঠাৎ সে অন্য কিছু একটা ভাবতে থাকে। এবং সাথে সাথেই তার চেহারার মলিনতা রৃঢ়টায় ছেয়ে যায়। তার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো সে খুব রাগান্বিত। চোখ বন্ধ করে রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করে সে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে বালিশের উপর ঘুষি মারে। যেন কারো উপর তার খুব রাগ হচ্ছে। তখনই নিবিড় ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠে। দিথী সতর্ক সূচক দৃষ্টি নিয়ে আস্তে করে মাথা ঘুড়ায়। দেখে নিবিড় ঘুমের মধ্যে সামিহাকে তার মা ভেবে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। দিথী আবার মাথা নামায়। শান্ত করতে থাকে নিজেকে। ভাবতে থাকে কিছু একটা। তখনই দূর থেকে ভেসে আসে ফজরের আযান। দিথীর মনযোগ আযানের দিকে যায়। ভাবনা 

 ছেড়ে সে নামাজ পড়ার জন্য উঠে বসে। তার মুখে এখনো সেই রাগান্বিত ভাব টা কিছুটা বিদ্যামান। সে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে মাথা নিচু করে ফেলে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে। আযান শেষ হতেই ঘর আবার ছেয়ে যায় নিস্তব্ধতায়। কিছুক্ষণ পর শোনা যেতে থাকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। 

 

 

খাঁন বাড়ি। দোতলা থেকে বেঁকে ডান দিক দিয়ে নেমে যাওয়া সিঁড়িটা দিয়ে কথা বলতেছে বলতে নিচে নামছেন নজরুল সাহেব আর তার ছোট ভাই শাহেদ খান। বিজনেস নিয়ে তারা কথা বলছেন। নিচে অন্দরমহলের বাম পার্শ্বে ডায়নিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন সাথী। রান্না ঘরে আছেন সুমনা বেগম। আর রান্না ঘর থেকে জিনিস আনা নেওয়া করছে আঁখি। নজরুল আর শাহেদ সাহেব কথা বলতে বলতে এসে ডায়নিং টেবিলে বসে। এতক্ষণ শাহেদ, সাথীকে খেয়াল করেননি।‌ সাথী তার প্লেটে পরোটা উঠিয়ে দিতে যাবেন তখনই শাহেদ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেন সাথী পরোটা দিচ্ছে। তিনি উৎসুক হয়ে বলেন।

– সাথী ,! তুমি এখানে কি করছো , ? তোমাকে না ডাক্তার একদম কাজ করতে নিষেধ করেছে , ? 

– কই তেমন তো কিছুই করছিনা। একটু খাবারই পরিবেশন করছি। আর আমার সবসময় ঘরে থাকতে ভালো ‌লাগেনা। এই নেও মাংস। 

শাহেদের পাতে মাংস তুলে দেন সাথী। শাহেদ আর কিছু বলেন না। তিনি আর নজরুল আবার নাস্তা খেতে খেতে একে অপরের সাথে গল্প নিয়ে পড়ে। আলিশা করিডোর দিয়ে বেড়িয়ে ডায়নিং টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে। তাকে দেখে সাথী চেয়ার টেনে ‌দেন। বসতে বলেন। আলিশা চেয়ারে বসে। সাথী বেগম বলেন।

– আজ শুক্রবারের দিন এতো সকাল সকাল উঠলি যে , ? 

– আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙ্গে গেলো মামিমা ,।

– আচ্ছা ভেঙেছে যেহেতু নাস্তা খেয়ে যেয়ে পড়তে বস। সামনে পরীক্ষা। প্রিপারেশন ভালো করে নে। 

– ওকে মামিমা। 

সাথী তাকে একটা প্লেটে করে পরোটা আর মাংস উঠিয়ে দেন। দিয়ে তার পাশেই দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন।

– তোর মা উঠছে ? 

– না। মা এখনো ঘুমাচ্ছে। 

– আচ্ছা তাইলে তুই নাস্তা করে তোর মায়ের জন্য নাস্তা নিয়ে যাইস। আর পরোটা লাগবে , ? 

– না মামিমা। এগুলোই হবে। 

আলিশা মজা করেই সকালের নাস্তা খেতে থাকে। সে স্বাধারণত এতো সকাল সকাল উঠে না। তাও আজ হঠাৎ উঠাতে সাথী একটু অবাকই হন। রায়হান এখনো উঠেনি। ওর ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়। সাথী আরো ২ পিছ পরোটা শাহেদের পাতে তুলে দেন। সবাই সকালের নাস্তা খেতে থাকে। 

 

 

আনন্দপুর গ্রামের চৌরচক। গ্রামের মধ্যেকার একটা গোলচক্কর বললেও ভুল হবে না। এটা গ্রামের মধ্যে বিন্দু। এই গোলচক্করের মাঝখানে আছে একটা কৃত্রিম ঝর্ণা। একটা মাছ আঁকা। সেটার মুখ থেকে পানি বের হয়ে উপরে উঠে আবার সেই মাছের উপরেই পড়ছে।  প্রায় ৪০-৪৫ বছর আগে রাজার আমলে এটা নির্মিত হয়।  এই চৌড়চকের চারদিকে আগে ছিলো অনেক দোকানপাট। কিন্তু এখন বেশিরভাগ দোকানপাট গন্জে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। এখানে রয়ে গেছে ২-১ টা মুদির দোকান আর ১৫-২০ টা শাকসবজি, মাছের দোকান। গ্রামের কৃষকরা তাদের ক্ষেতে ফলানো সবজি, পুকুরে ধরা মাছ এখানে বিক্রি করতে নিয়ে আসে সকালের দিকে। এই চৌড়চকের চারদিকে চলে গেছে ৪ টা রাস্তা। ১৯ শতকের দিকে ৪ টা রাস্তা গ্রামের পাড়া গুলোয় যাওয়ার পথ ছিলো। এখনো আছে। তবে দুইটা। এই দুইটা পথ দিয়ে উত্তর পাড়া আর দক্ষিণ পাড়ায় যাওয়া যায়। আর বাকি দুটো রাস্তার মধ্যে পূর্ব দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা নীলগিরি জঙ্গল হয়ে মেইন রোডে উঠেছে‌। এইটাই প্রাচীন কালে এক মাত্র রাস্তা ছিলো গ্রাম থেকে বের হবার। আর পশ্চিম পাশের রাস্তা টা চলে গেছে পশ্চিম পাড়া হয়ে মেইন রোডের দিকে। আগে পুরো গ্রাম টাই জঙ্গল ঘেরা ছিলো। আর গ্রাম টা ছিলো জঙ্গলের ঠিক মাঝখান টায়। নীলগিরি জঙ্গলের পথ টাই ছিলো তখন এই গ্রামে আসা কিংবা গ্রাম থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ। কিন্তু এখন এই গ্রামের অর্ধেক জঙ্গলই মানুষেরা কেটে ফেলেছে। আর বসতবাড়ি নির্মাণ করেছে‌। আর পড়ে তখন পশ্চিম পাড়া দিয়ে মেইন রোডে যাওয়ার রাস্তা করেছে। চৌরচকের সবজির দোকানে এখন ভিড় একটু কম। আশেপাশে লোকজনের কোলাহল কিছুটা কম অন্য দিনের চেয়ে। আজ শুক্রবার। তাই গন্জে হাট ‌বসেছে। তাই গ্রামের চৌরচকে আজ লোকজন কম।

 একটা অটো আসতে থাকে পশ্চিম পাড়ার রাস্তা দিয়ে। মেইন রোড হতেই এই অটোটা আসছে। অটোটা এসে চৌরচকের গোলচক্করের একপাশে থামে‌। অটোটা থেকে নামতে থাকে তানিয়া, কানিজ আর সুমু। সবার গায়ে শীতের পোশাক। ট্রেন দিনাজপুর স্টেশনে থেমেছে সকাল সাড়ে ৯ টায়। 

 কানিজ অটো থেকে লাগেজ টা নামিয়ে ভাড়া পরিশোধ করে দেয়। অটোটা গোলচক্কর ঘুরে আবার যেই রাস্তা দিয়ে এসেছিলো সেটা দিয়ে চলে যেতে থাকে‌। সুমু এখনো ফোন চাপছে‌‌। কানিজ হেটে তানিয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। দেখে তানিয়া এক দোকানের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। দোকানটা ছিলো সবজির দোকান। আর দোকানে ছিলো রাশেদ। রাশেদ ২ দিন হলো কামারের কাজ টা ছেড়ে এই চৌরচকে সবজির দোকানে কাজ নিয়েছে।‌ তানিয়ার ঘোর ভাঙে কানিজের কথায়। কানিজ তার কাঁধে হাত রেখে বলে।

 – কী হয়েছে তোর ,! এভাবে ঐদিকে তাকিয়ে আছিস কেনো ? 

 – ঐ যে ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছিস না ? ওকে আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি ওকে চিনি।(কানিজের দিকে তাকিয়ে) ও আমার, ও আমার খুব পরিচিত কেউ,! 

 – তোর ভুল হচ্ছে কোথাও। ছেলেটার বয়স দেখ‌। ২০-২১ হবে বৈকি। আর তুই তো সেই ২৪ বছর থেকে এই গ্রামে পা রাখিস নি। তাহলে চিনা চিনা কেনো লাগবে, ? 

 – তারপরও, (তানিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তখনই পিছন থেকে সুমু বলে)

 – ম্যাম। আমরা এখন কোথায় উঠবো , ? এই গ্রামে তো বলে আপনি কয়েকদিন থাকবেন। আপনার কোন আত্মীয়র বাসা আছে এখানে ?

 কথাটা শুনেই তানিয়া আর সুমু কিছুটা চিন্তিত হয়। কানিজ সুমুকে বলে।

 – আত্মীয় তো নেই এখানে।

 – তাহলে আমরা কোথায় উঠবো ম্যাম, ! এই রকম গ্রামে তো আবাসিক/অনাবাসিক হোটেল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।  

 

 তানিয়া কিছুই বলেনা। তাদের মধ্যে নেমে আসে নিরবতা। কিছুক্ষণ পর কানিজ বলে।

 – আচ্ছা কারো বাসায় আমরা এই কয়েক সপ্তাহের জন্য ভাড়া থাকলে কেমন হয় ,? মানে যাদের পাকা বাড়ি আছে আরকি। তাদের কাছে ভাড়ায় থাকবো। কয়েক সপ্তাহেরই তো ব্যাপার। (একটু থেমে) না মানলে টাকার এমাউন্ট বাড়িয়ে বলবো। 

 – আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে। আগে হামিদুল দাদুর কাছে যেতে হবে আমাদের। উনার কাছ থেকে ঐ আমানত টা নিয়ে আসতে হবে। 

 – হামিদুল দাদুর ওখানে আগে যাবি তাইলে , ? (একটু থেমে) রাস্তা মনে আছেতো তাদের বাড়ি যাওয়ার, ? 

 – হ্যা। আমার মনে পড়তেছে সবটুকু। (উত্তর পাড়া যাওয়ার রাস্তার দিকে হাত দেখিয়ে) এই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে আমাদের। সামনেই একটা বড় বট গাছ আছে। তার থেকে কিছুটা দূরেই তাদের বাড়ি। 

 – শিওর ‌তোর মনে আছে , ? পড়ে আবার উল্টা পাল্টা বাড়িতে নিয়ে যাইস না আবার।

 – আরে সত্যি আমার মনে আছে। তাড়াতাড়ি চল

 

তানিয়া আগে আগে যেতে শুরু করে। তার পিছুপিছু কানিজ লাগেজের হাতল ধরে যেতে থাকে। আর কানিজের পিছু পিছু আসতে থাকে সুমু। সুমু হা করে চারপাশ দেখছে আর হাটছে। গ্রাম হয়তো এমনি সুন্দর হয়। সকাল বেলা আজ কুয়াশা কম। তাই দূরের সিনারিও বেশ ভালো ভাবেই চোখে ধরা দিচ্ছে। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা মাঠ। মাঠে মাঠে ফসল কাটার ধুম পড়েছে কৃষক দের মাঝে। দূর আকাশে উড়ে যাচ্ছে শীতকালে বাংলাদেশ ঘুরতে আসা বিদেশি কিছু পাখি। এক মনোরম দৃশ্য, ! 

 

 

এক কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দু ধারে গাছ। তবে গাছের পরিমাণ কম। এক গাছ থেকে আরেক গাছের দূরত্ব ৬-৭ হাত। আকাশ মেঘলা। কাল থেকে রাত হলেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামছে। সকাল বেলা বৃষ্টি না পড়লেও আকাশ মেঘলা থাকছে। ঐ দূরে কিছু কালো মেঘ ভেসে চলে যাচ্ছে। হয়তো সেগুলোই রাতে বর্ষন করেছিলো। এখন আবার পালিয়ে অন্য কোথাও ভিজিয়ে দিতে যাচ্ছে তাদের শীতল ধারা দিয়ে। কুয়াশা নেই। তবে ঠান্ডা বাতাস বইছে ভালো রকমই। বাতাসে গাছের পাতা গুলোও দোল খাচ্ছে। 

কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেটে আসছে নিপা আর রায়হান। নিপার পরনে আজ বোরখা। তবে মুখের উপর থেকে কালো কাপড় উঠানো। মেঘলা আকাশের মেঘ ধূসর রঙের হলেও নিপার মুখখানি উজ্জ্বল ফর্সা বর্ণের। তাইতো বোরখা পড়ায় মনে হচ্ছে এক জান্নাতি হুর যেন হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের মেঠোপথ ধরে। নিপার পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে রায়হান। পড়নে ধুসর রঙের ফরমাল প্যান্ট আর জ্যাকেট। নিপার কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ।

 রায়হান তার হাতে থাকা ময়ুর পালক দিয়ে নিপার মুখে ছুইয়ে দিচ্ছে। আর নিপা সাথে সাথেই দুম করে রায়হানের কাঁধে কিল বসিয়ে দিচ্ছে। নিপার নরম তুলতুলে হাতের কিল খেতে রায়হানের ব্যাথা তো দূর আরো উল্টো মজা লাগছে। নিপাকে বিরক্ত করতেও ভালো লাগে তার। আর নিপার হাতের নরম মার খাওয়ার জন্য তো তার দুষ্টুমিটা আরো বেড়ে যায়। বারবার রায়হান নিপার মুখে পালক দিয়ে সুরসুরি দেওয়ায় এবার বেশ বিরক্ত হয় নিপা। সে বিরক্তির সুরে বলত থাকে।

 – রায়হান, ! থামোতো। ইসসস, আমার সুরসুরি পছন্দ না।

 – বিয়ের আগে যা ডিসটার্ব করার করে নেই। নাইলে তো পড়ে তখন আদর ছাড়া ডিসটার্ব করার সময়ই পাবো না মিস।(বলেই নিপার কাঁধে তার কাঁধে দিয়ে আলতো করে এক ধাক্কা দেয় রায়হান।)

 – হইছে যাও। ঢং। ( নিপার কথা শেষ হতেই রায়হান আবারো তার মুখে পালক দিয়ে সুরসুরি দেয়। নিপা বিরক্ত হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়। বিরক্তি নিয়ে বলে) 

 – রায়হান থামোতো। আমার ভালো লাগছে না কিন্তু। 

 – আচ্ছা আচ্ছা সরি। আর করবো না। 

 – বারবার সরি বলতেছো কিন্তু তারপরও আবার এমন করতেছো। 

 – আচ্ছা এইবার একদম সরি। আর করবো না। এইযে পালক ফেলে দিলাম। 

নিপা হনহন করে চলে যেতে থাকে দ্রুত। তার ফর্সা গাল গুলো রাগে লাল হয়ে গিয়েছে। রায়হান দৌড়ে তার কাছে আসে। এসে তার সাথে চলতে চলতে বলে।

– সরি গো,! আর হবেনা,!

– …………

– বললাম তো সরি। প্লিজ রাগ করিওনা। (বলেই তার কাঁধ ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে। বলে) আমার স্রোতস্বিনীর এমন রাগান্বিত ঝড়ে যে মাঝি ডুবে যাবে,! প্লিজ আর রাগ করিও না, ! 

– হুঁ। তুমি বারবার আমাকে বিরক্ত করো কেনো , ? 

– তোমার এই (গাল গুলো আলতো করে ছুঁয়ে) লাল টুসটুসে টমেটো গুলা দেখা দেখার জন্য। 

– হইছে ঢং (লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলে নিপা) 

– আচ্ছা সুবা। 

– হমম,

– তোমায় তো আগে কখনো বোরখা পড়তে দেখিনি। আজ হঠাৎ ,!

– কেনো খারাপ লাগছে দেখতে ? 

– না না। উল্টো আরো সুন্দর লাগছে আগের থেকে। তবে হঠাৎ বোরখা পড়লে যে, তাই জিগ্গেস করলাম।

– আজ তো দিনাজপুর শহরের দিকটায় যাবো। আর আমি গ্রাম থেকে বাইরে বের হলে বোরখা পড়েই বের হই। গ্রামের সবাই আমাকে বোন বা মেয়ের চোখে দেখলেও বাইরের মানুষ আমাকে সেই চোখে দেখেনা। তাই আরকি বোরখা পড়েছি। (একটু থেমে) আচ্ছা তুমি নামাজ পড়োনা ? 

– আমি,? না মানে (মাথা চুলকাতে চুলকাতে) অনেক আগে পড়তাম। এখন পড়া হয়না।

– আজকে শুক্রবার না , ? আজ থেকে নামাজ ধরবা। নিয়মিত নামাজ পড়বা। 

– আজকেই ? কিন্তু আমি তো গোসল করিনি। আর দিনাজপুর শহর থেকে আসতে আসতে তো দুপুর ১২ টা বেজে যাবে। 

– গোসল করোনি ? আর তুমি না গোসল করা অবস্থায় আমাকে ধরতে আসছো ? যাও। (ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয় রায়হানকে) 

– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা ঐদিক থেকে তাড়াতাড়ি আসি। তারপর গোসল করে আমি নামাজে চলে যাবো।(বলেই এসে আবার নিপার হাত ধরে রায়হান) 

– হ্যা তাই করিও। (একটু থেমে) আর তুমি তো অন্যান্য দিনও নামাজ পড়ে নিতে পারো। বেশিরভাগ সময়ই তো ফাঁকা থাকো। নামাজ পড়তে তো বড়জোর ২০ মিনিট লাগবে। তাইলে নামাজ পড়োনা কেন ? 

– না মানে , (মাথা চুলকাতে চুলকাতে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে রায়হান)

– না মানে কী ? তুমি পাক থাকো না ? 

– ইয়ে মানে (চোখ এদিক ওদিক করতে করতে) বেশিরভাগ সময় না, ! 

– তুমি এতো বড় হইছো আর পাক থাকো না , ! ছিঃ রায়হান, ! দূরে সড়ো আমার থেকে , ! 

– না মানে আমি পানি নেই। তবে অন্য কারণে পাক থাকিনা , ! (মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে রায়হান) 

– অন্য কারণ , ? অন্য কী কারণ ? 

– আমি বলতে পারবোনা। আমার, আমার শরম করতেছে (বলেই নিপার কাঁধে মুখ লুকায় রায়হান। রায়হানকে আবারো ছিটকিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় নিপা) 

– যাও, দূরে যাও‌, ! ছিঃ। তুমি পঁচা হয়ে গেছো রায়হান , ! 

– বিয়ের পর তো তুমি থাকবে। তখন আর কোন কিছু করবো না। প্রমিস, ! তখন তোমার সাথে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়বো। 

– তুমি এখন আমার থেকে দূরে সড়ো। ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে। নাহলেতো , ছিঃ, ! পঁচা রায়হান, ! 

(বলেই আগে আগে হেঁটে চলে যেতে থাকে নিপা। রায়হান দৌড়ে গিয়ে আবার তার পাশে আসে। বলতে থাকে) 

– আর করবো না। বিয়ে পর্যন্ত সবুর করবো। প্লিজ রাগ করিও না, ! 

– সত্যি আর করবানা তো , ! 

– সত্যি বলতেছি। তিন সত্যি। 

– আজকে বাসা আসে গোসল দিয়েই নামাজে যাবা। আর আজ থেকে নামাজ ধরবা। আমি কিন্তু ফোন দিবো। নামাজ পড়ছো কী পড়োনাই। 

– আচ্ছা আচ্ছা রাণী সাহেবা দিয়েন। (নিপার কাঁধে হাত দিয়ে) বিয়েটা হোক একবার। তাইলেই এই সিঙ্গেল অভিশপ্ত জীবন থেকে বাঁচি। 

– তুমি আবার আমার কাঁধে হাত দিছো , ! দূরে সড়ো। যতদিন না বিয়ে হচ্ছে। তুমি, তুমি আমাকে ছুবেও না। 

বলেই নিপা আগে আগে চলে যেতে থাকে। রায়হান পিছন থেকে তাকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে যেতে থাকে। 

– নিপা , নিপা আর করবো না। সরি নিপা , নিপা শোনোতো, ! 

এক অভিমানি পাখির অভিমান ভাঙাতে তার পিছু ডাকতে ডাকতে যাচ্ছে এক প্রেমিক পাখি। রায়হানের কথায় তো নিপার রাগ পরবর্তীতে ভেঙে যাবে। কিন্তু রায়হান তো এখন লজ্জা পেয়ে গেছে। নিপা তার সম্পর্কে কি না কি ভেবে নিছে। সে তো নিজে কিছু করেনা। এখন স্বপ্নযে তাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলো স্বপ্নকে দোষ দিবে কে , !

 

 

একটা খরের কাঁচা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো তানিয়া, কানিজ আর সুমু। বাড়িটার ভিতরে যেতে চায় তানিয়া, তখনই কানিজ বলে।

– তুই কী শিওর যে এটাই হামিদুল দাদার বাসা , ? 

– হ্যা। আমার মনে আছে। এটাই তার বাসা। চল ভিতরে যাওয়া যাক।

তারা তিনজন বাড়ির টিনের বানানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে। বাড়ি আঙিনায় ২ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আর একজন বয়স্ক নারী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন একে অপরের সাথে। তানিয়ারা ধীরে ধীরে হেঁটে তাদের দিকেই এগিয়ে যায়। আশেপাশে গাছপালা আছে কিছু। কাঁঠাল গাছ, আম গাছ। গাছের ডালে এক পাখি বাসা বেঁধেছে। তার ছানা হয়েছে। সেগুলোর ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা দখিনা হাওয়া।‌

তানিয়ারা বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই ৩ জনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কানিজ তাদের সম্মোধন করে।

– আসসালামুয়ালাইকুম। 

সেই তিনজনের মধ্যে থেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বলতে থাকেন 

– ওয়ালাইকুমুস সালাম।(একটু থেমে তানিয়াদের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে) তোমাগোরে তো এই গেরামে আগে কহনো দেখছি বইলা তো মনে হয় না। তোমরা কেরা , ? 

– জ্বী ভাই, আমরা হামিদুল দাদুর খোঁজে এখানে এসেছিলাম। উনি কী বাড়িতে আছেন , ? 

তানিয়ার কথা শুনে তারা তিনজন একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর অবাক হয়ে তাদের মধ্যে একজন লোক বলেন।

– হামিদুল চাচায় তো আরো ২ দিন আগে গত হইছেন। 

 

কথাটা শুনেই যেনো তানিয়ার বুকের ভিতর টা কেঁপে উঠলো। এতো দূর যার জন্য আসা সেই নাই , ! তার আমানত, ! সেটা, সেটা কোথায় , ! 

কানিজ উৎসুক হয়ে বলে।

– মারা গেছে মানে , ? 

– মারা গেছে মানে মারা গেছে। হঠাৎ কইরা হার্ট অ্যাটাক আইছিলো তার। বাপ-মা হারা নাতনি ডারে রাইখা মরলো, ! 

 

তানিয়া উৎসুক হয়ে বলে।

– উনার বাড়িতে উনার সাথে আর কে কে থাকতো , ?

– ঐতো কইলাম। হামিদুলের নাতনি আছিলো একটা। নাম সামিহা না, ! (তার পাশের বৃদ্ধ মহিলার দিকে তাকিয়ে)

– হ সামিহাই। 

– ঐ সামিহাই আছিলো তার লগে। সামিহার বাপ-মা কেউ নাই। হেরা সেই অনেক দিন আগেই মইরা গেছে।

 

কথা শুনেই তানিয়ার মন ভেঙ্গে যেতে থাকে। হাতে আর মাত্র কয়েকটা সপ্তাহ। আর এই সময়ই হামিদুল দাদুর মারা যাওয়া। “আচ্ছা উনি কী সেই বক্স টা ঘরে রেখে গিয়েছেন ?” মনে এই কথা আসার পর পরই তানিয়া উৎসুক হয়ে বলে।

– আচ্ছা আমরা কী তার ঘর সার্চ করতে পারি , ? 

– আপনেরা সার্চ করবেন , ? আপনেরা কেডা , ? 

– আমরা ডিবি পুলিশ। 

তানিয়ার মুখে এমন উত্তর শুনে কানিজ আর সুমু চোখ বড় বড় করে তানিয়ার দিকে তাকায়। ওরা এতোটাই অবাক হয়ে গেছে যে ওদের মুখ ও মেলে গেছে।‌ তানিয়ার ওদের এমন অবাক চেহারা দেখে হাসি পাচ্ছিলো। কিন্তু ও হাসি আটকিয়ে, সোজা হয়ে কড়া গলায় বলতে থাকে। 

– আমাদের কে বাসা সার্চ করতে দিন। আমাদের কাছে ওয়ারেন্ট আছে‌।

– কিন্তু সার্চ করবেন কিল্লাই , ! হেয় তো খুন হয়নাই। সবার সামনে হার্ট অ্যাটাক কইরা মরছে হেয়।

– তারপরও আমাদের কাছে খবর আছে যে তাকে মারা হয়েছে। তাই আমরা রুম সার্চ করতে চাই। আপনারা সড়ে দাঁড়ান। ইন্সপেক্টর কানিজ, সুমু তোমরা আমার সাথে চলো।

 

বলেই আগে আগে এগিয়ে যেতে থাকে তানিয়া। কানিজ, সুমু যেনো আকাশ থেকে পড়লো‌। ওরা আর ইন্সপেক্টর , ? 

তানিয়া ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে যাবেই তখনই তিনজন লোকের মধ্যে একজন বলে উঠে।

– সার্চ কী করবেন ম্যাডাম। ঘরে তো কিছুই নাই। শুধু খাট পইড়া আছে। বাকি সব সামিহা লইয়া গেছে লগে কইরা। 

 

কথাটা শুনেই তানিয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ জমে। অবাক হয়ে তৎক্ষণাৎ ঘরের দরজা খুলে দেখে আসলেই ভিতরে শুধু একটা ঘুন খাওয়া বিছানা পড়ে আছে। বিছানার উপর বালিশ তোশক পড়ে আছে। তাছাড়া ঘরে আর তেমন কিছুই নেই। তানিয়া ঘর থেকে মাথা বের করে তাদের ৩ জনকে উদ্দৈশ্য করে বলে। 

– ঘরের জিনিসপত্র গুলা কোথায় ? 

– ঘরে তো তেমন কিছু আছিলোই না। আর দরকারি জিনিসপাতি সামিহা লইয়া গেছে লগে কইরা। 

– আচ্ছা এই সামিহা টা কে ? তখন থেকেই ওর নাম বলে যাচ্ছেন।(সুমু)

– সামিহা, হামিদুল চাচার নাতনি। এহন গ্রামের চেয়ারম্যান গো বাড়িত থাহে।

তানিয়া দরজার সামনে থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলতেই থাকে‌।

– চেয়ারম্যানদের বাসায় কেনো ? নিজের দাদু মারা যাওয়ার পর পরই এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো অন্যের বাড়ি থাকতে , ? এ কেমন নাতনি , ! 

– আরে না নিজে যায়নাই। চেয়ারম্যান সাব হেরে নিজের মাইয়া বানাইয়া লইয়া গেছে। আমাগো চেয়ারম্যান সাব অনেক ভালা। তার মহানুভবতার একটা নিদর্শন ধইরা লইতে পারেন এইডারে। 

– এতো ভালো চেয়ারম্যান, ! (কানিজ)

– হ। আর এমনিতেও একটা অবিবাহিত জোয়ান মাইয়া এই একলা বাড়িতে কী নিরাপদ থাকতো , ? আপনারাই কন, ! 

– তাও ঠিক। আচ্ছা তো এই চেয়ারম্যানের বাসা কই। মানে কই থাকে এই চেয়ারম্যান,?

– এইতো এই বাড়ি থেইকা বাইর হইলে তার ৫ বাড়ি সামনেই যে পাকা বাড়িডা দেখতে পাইবেন। ঐডাই চেয়ারম্যান সাবের বাড়ি। 

– ওহ,। আচ্ছা ধন্যবাদ। আমরা পরবর্তীতে আরো দরকার হলে আপনাদের ডেকে নিবো। 

– জে আইচ্ছা ম্যাডাম।

তানিয়ারা বাড়ির আঙিনা থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে‌। দরজা খুলে বাইরে বেড়োনোর সাথে সাথেই তানিয়া আর হাসি দমিয়ে রাখতে পারে না। হো হো করে হেসে উঠে‌। তার এমন হঠাৎ হাঁসি দেখে কানিজ আর সুমু অবাক হয়। তারা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলতে থাকে।

– কী হইলো তোর , ? এমন পাগলের মতো হাসতেছিস কেন , ? 

– আগে তো বাড়িটার সামনে থেকে দূরে চল। ভিতরের লোক শুনতেই পাইলে আমাদেরকেই ডিবি পুলিশের হাতে ধরায় দিবে হা হা হা হা।

তারা আস্তে আস্তে সামনে এগোতে থাকে। তানিয়া এখনো হেসেই যাচ্ছে। কানিজ আর সুমু কিছুই বুঝতে পারছেনা। হামিদুল দাদুর বাড়ি থেকে কিছুটা এগোনোর পর তানিয়া ধীরে ধীরে হাসি থামায়। কানিজ জিগ্গেস করে ।

– এমন হাসতেছিস কেন , ! তোর উপর আবার ভূত-টূত ভর করলো নাকি আবার , ! 

– তোদের ঐসময়কার চেহারা মনে পড়লে এখনো আমার হাঁসি চলে আসতেছে, হে হে হে।

– আমরা কী করলাম , ! 

– ঐযে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাইলি না, ! ঐসময় টা। হা হা হা।

– হইছে হাসা বাদ দে। আমরা তো অবাক হবোই। হঠাৎ করে বলিস আমরা নাকি ডিবি পুলিশ। আমি আরো ভাবতেছি এই জীবনে এতো দৌড়াদৌড়ি করে কনস্টেবল এর চাকরিটাই পাইলাম না আবার ডিবি পুলিশ, ! 

– হইছে হইছে বাদ দে। আর মনে করাইস না। এতো হাসি, এতো হাসি অনেক দিন পর হাসলাম। 

 

তখনই সুমু তাদেরকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলতে থাকে।

– ম্যাম। এটাই মনে হয় চেয়ারম্যান দের বাসা , ! 

সুমুর কথাতে তারা দুজনেই সামনে তাকায়। দেখে তারা কথা বলতে বলতে অন্তর সাহেবের বাসার গেটের সামনে চলে এসেছে। গেইটের চারপাশ প্রাচীর দেওয়া। গেইট টাও বেশ সুন্দর। শহুরে বাড়ি গুলোর মতো সুন্দর ডিজাইন করা। গেইটের উপরে লেখা “নিকুঞ্জ ভিলা” 

তারা দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। সামনে বড় আঙিনা তারপর বাড়ির রুম গুলো। তারা তিন জন শান্ত ভাবে ভিতরের দিকে আসতে থাকে। বাড়িটা বেশ শান্ত। চুপচাপ। কোন মানুষেরই সাড়া নেই। তানিয়ারা ভিতরের দিকটায় আসার পর আঙিনার মাঝখানে দাঁড়ায়। তানিয়া আওয়াজ দিয়ে ডাকতে থাকে।

– বাড়িতে কেউ আছেন , ? হ্যালো ,! কেউ কী আছেন , ? 

– কেডা , ? (বাড়ির ভিতর থেকে আওয়াজ আসে এক মেয়ে কন্ঠের)

তানিয়ারা উত্তর দিতে যাবেই তখনই অন্তর সাহেবের বাড়ির কাজের মেয়ে শেফালী হাতে ঝাড়ু নিয়ে বারান্দার দু-কদম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এগিয়ে আসতে থাকে তানিয়াদের দিকে। তানিয়ারা তো ভয় পেয়ে যায়। ঝাড়ু নিয়ে তাদেরকে তাড়াইতে আসতেছে নাকি , ! 

 

– কেডা আপনেরা, ! 

– আ,আমরা , ? আমরা ডিব,(কানিজের মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে তানিয়া বলে)

– আমরা বাড়ি ভাড়া নিতে আসছি,। কোন রুম কী ফাঁকা আছে , ?

– চাচায় তো এই বাড়ি ভাড়া দেয়নাই। আপনেরা ভাড়া থাকবেন কেমনে তাইলে , ! 

– কে আসছে রে শেফালী, ? (ভিতর থেকে নাজিয়া বেগম হাঁক দিয়ে বলতে থাকেন)

– চাচি ভাড়াটিয়া আইছে , ! 

– ভাড়াটিয়া ? কিসের ভাড়াটিয়া, ! (বলতে বলতেই ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসেন নাজিয়া বেগম। হাত মুছতে থাকেন শাড়ির আঁচল দিয়ে। এসে তানিয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন

– তোমরা কারা , ! ঠিক চিনলাম না তোমাদের, ! 

– আন্টি আসলে আমরা এই গ্রামে নতুন এসেছি। গ্রাম নিয়ে আমাদের রিসার্চ করে একটা রিপোর্ট বানাতে হবে। আমার এক বান্ধবী আমাকে এই গ্রামটা সাজেস্ট করলো। বললো আনন্দ পুর নাকি বেশ ভালোই যায়গা এই রিসার্চ করার জন্য। তাই চলে এলাম। কিন্তু এখানে কোন আবাসিক/অনাবাসিক হোটেল নেই থাকার জন্য। তাই ভাড়া বাড়ি খুঁজছি। এখানে কী ২-৩ সপ্তাহের জন্য ভাড়া থাকা যাবে , ? 

তানিয়ার একনাগাড়ে এতো গুলা কথা নাজিয়া বেগমের বুঝতে একটু সময় লাগে। তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলেন।

– আমাদের ২ টা গেষ্ট রুম আছে। বিছানা পত্র, ফার্নিচার সব রেডি করা। তোমাদের ৩ জনের থাকতে কোন অসুবিধা হবে না।‌

– হ্যা আন্টি ২ টা রুম আমাদের চলে যাবে। জ্বি, আন্টি কত ভাড়া দিতে হবে ,! 

– না না ভাড়া দেওয়া লাগবে না। গ্রাম নিয়ে প্রতিবেদন বানাবা, আমাদের গ্রামের পরিচিত বাড়বে। ভাড়া দিতে হবে না। তোমরা আমাদের মেহমান। মেহমানদেরকে কীভাবে বাড়ি ভাড়া দেই বলো, ! 

– কিন্তু আন্টি ,।  

– কোন কিন্তু না। তোমরা এই খানে যতদিন না তোমাদের রিসার্চের কাজ শেষ হচ্ছে ততদিন আমাদের মেহমান। তোমাদের আংকেল অসুস্থ। আংকেল যদি শুনে আমি তোমাদের থেকে ভাড়া নিছি আমাকে অনেক বকবে। তোমাদের আংকেল সবসময় অতিথিদের যত্নের সাথে আপ্যায়ন করতে বলছে। আসো ভিতরে আসো। শেফালী , গেস্টরুম খুলে লাগেজ টা নিয়ে যা। 

– আন্টি আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, ! 

– আরে ধন্যবাদের কিছুই নাই। আসো বেঞ্চে বসি। শেফালী, তুই লাগেজ ঘরে রাখে রান্না ঘরে রাইস কুকারের সুইচ টা চালু করে দিস।

– আইচ্ছা আফা। (শেফালী লাগেজ টা হাতে নিয়ে চলে যেতে থাকে বাড়ির দিকে। মনে মনে সেও নাজিয়া বেগমের এমন ব্যবহার দেখে দারুণ খুশি। এক অহংকারী, রাগী, খারাপ ব্যবহার করা নাজিয়া বেগমকে যেন দিথী মুহুর্তেই বদলে দিয়েছে। হয়তো ঐ নিবিড়ের পেটে বিষ যাওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে শুধরে নিয়েছেন। বদলে ফেলেছেন তার মানসিকতা। শেফালীর মুখে এক হাসৌজ্জল চেহারা ফুটে উঠে‌। সে লাগেজ নিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ে। ভিতরের দিকে চলে যায়।

তানিয়া, কানিজ,সুমু এসে বসে বাড়ির সামনের আঙিনার সাইডে থাকা বেঞ্চে। নাজিয়া বেগম একটা চেয়ার টেনে বসেন। আঙিনার এদিকটায় ফুল গাছের টব আছে। তাই এক সুবাসিত বাতাস নাকে আসে।। উপরে বড় এক আম গাছও আছে। 

নাজিয়া বেগম বলেন।

– তোমাদের বাসা কী দিনাজপুরেই ? 

– না আন্টি। আমার বাসা রংপুরে। থাকি সিলেটে। আর এরা দুইজনও সিলেটের বাসিন্দা। (তানিয়া বলে)

– ওহহ। সিলেটে আমার এক দুঃসম্পর্কের ভাই থাকে। এখন যোগাযোগ হয়না তেমন একটা। 

– ওহহ ,(একটু থেমে) আচ্ছা আন্টি সামিহা কোথায় ? (কানিজ)

– সামিহা , ? ও আর দিথী তো একটু বাইরে গেছে। আসলে হইছে কি, তোমার আংকেলের গায়ে না কাল গুলি লাগছে। কিছু ঔষধ লেখে দিছিলো ডাক্তারে। সেই ঔষধ গুলাই দুই বোন আনতে গেছে। বাড়িতে আর কোন পুরুষ মানুষও নাই যে আনতে পাঠাবো। এইজন্য দুই বোন গেছে।(একটু থেমে অবাক হয়ে) সামিহাকে তোমরা চিনো , ? 

– হ্যা আন্টি। ওই তো আমাদের এই গ্রাম সম্পর্কে বলছে। তাই না সুমু।(এক মিথ্যা হাঁসি দিতে দিতে সুমুর দিকে তাকায় কানিজ। সুমুও তার সাথে সম্মতি দিয়ে বলে।

– হ,হ্যা আপু। সামিহা আপুই বলেছে এই গ্রামের কথা।

তখনই হঠাৎ তানিয়ার মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করে উঠে। সে চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে মাথা চিপে ধরে। সে সহ্য করতে পারছেনা। তার এমন হঠাৎ মাথা ব্যাথায় কানিজ আর সুমুও অবাক হয়। তারা তাকে ধরতে এগিয়ে যায়। তানিয়া দুই হাত দিয়ে তার মাথা শক্ত করে চেপে ধরে।

 

 

দিথী আর সামিহা বাড়ি ফিরছে অটোতে করে। গ্রামের কাঁচা রাস্তার মাঝে অটো এগোচ্ছে। কাল রাতে হালকা বৃষ্টি হওয়ার রাস্তায় কিছু ছোট ছোট খানা খন্দ তৈরি হয়েছে। তাই অটোটা মাঝে মাঝে দোল খাচ্ছে। গ্রামের অটো গুলা সম্পর্কে তো আপনারা জানেনই। ড্রাইভারের সাথে দুইজন বসা যায়। তারপর একদম অটোর শেষের সিটে ৩ জনের বসার যায়গা থাকে। আর মাঝের দিকে ৩ জনের বসার যায়গা থাকে। পিছনের আর মাঝের ৩ জন একে অপরের মুখমুখি হয়ে বসে‌। সিট গুলো এভাবেই থাকে। 

দিথীরা বসেছে মাঝখান টায়। সাইডে সামিহা, মাঝে দিথী, আর দিথীর সাইডে বসেছে এক বোরখা পরিহিত মহিলা। পিছনের তিন সিটে বসেছে এক প্রাপ্ত বয়স্ক লোক আর ছোট ছোট দুইটা ছেলে। হয়তো মহিলা আর লোকটারই বাচ্চা তারা। ফ্যামিলি সহ গন্জে গিয়েছিলো এখন বাড়ি ফিরছে। দিথী আর সামিহা একে অপরের সাথে গল্প করছে। শাহারিয়ার সাথে দিথীর কীভাবে দেখা হওয়া, কীভাবে সম্পর্কের শুরু এসব নিয়ে।

ড্রাইভারের পাশে একজন বসেছে সামনে। আকাশ মেঘলা। একটু আগে সূর্য দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন হঠাৎই আবার মেঘলা ধূসর বর্ণের মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। দূরে কোথাও বজ্রপাত পড়ার শব্দ শোনা যায়। বাতাস বইছে ভালো রকমই। হয়তো বৃষ্টি নামবে। হঠাৎ তাদের থেকে ২০০ হাত দূরে দেখা যায় যে একটা ধানের বস্তা বোঝাই ট্রাক্টর এদিকেই এগিয়ে আসছে। এই কাঁচা রাস্তাটা এমনিতেই ছোট। দুটো অটো পাশপাশি যেতে কষ্টকর হয়ে যাবে। সেখানে একটা বড় মাল বোঝাই ট্রাক্টরকে সাইড কীভাবে দিবে অটো , ! 

হঠাৎই অটো ড্রাইভারের হাঁক ‌শোনা যায়। সে জোরে চিৎকার দিয়ে সামনে থেকে আসা ট্রাক্টরকে থামতে বলছে। কিন্তু ট্রাক্টর টা খুব দ্রুত গতিতে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এই কাঁচা রাস্তাতেই যেন ট্রাক্টর টা ১০০ কিলো স্পিড তুলে ফেলেছে। অটো ওয়ালা হর্ণ দিতে থাকে। মাথা বের করে চিৎকার করে থামতে বলতে থাকে। অটো ড্রাইভারের এমন হঠাৎ চিৎকারে দিথী সহ বাকি যাত্রী রা অবাক হয়ে দেখতে থাকে কি হয়েছে। ট্রাক্টর টা খুব কাছে চলে এসেছে। বাতাসের গতিতে যেনো এগিয়ে আসছে‌। অটোর ড্রাইভার দেখেন ট্রাক্টর টায় কোন ড্রাইভারই নেই। অটো ড্রাইভার জোড়ে চিৎকার দিতে থাকে।

ট্রাক্টর টা খুব কাছে চলে আসে। অটোর বাচ্চারা কান্না কাটি শুরু করে দেয়। এবং অটোটাকে ধাক্কা দিতে যাবেই তার ঠিক আগ মুহূর্তে দিথী আর সামিহাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় তাদের পাশে বসা সেই বোরখা পড়া মহিলাটা এবং তৎক্ষণাৎ এক বিকট সংঘর্ষ ঘটে অটোর সাথে ট্রাক্টর টার। এক বিকট আওয়াজে আশেপাশে পাখি গুলো উড়ে যেতে থাকে। দিথী সামিহা গড়িয়ে গিয়ে পড়ে রাস্তার পাশের ধানক্ষেতে। ট্রাক্টর টা অটোটাকে একদম পিষে ফেলে দূরে গিয়ে রাস্তা থেকে পাশের ধানক্ষেতে পরে গিয়ে ৪-৫ টা ডিগবাজি খেয়ে থামে‌। ট্রাক্টরের সামনের অংশটা একদম ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ট্রাক্টরের উপরে থাকা ধানের সব বস্তা ছিরে পুরো রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। পুরো প্রকৃতি একদম শান্ত হয়ে যায়। একটু আগে ঘটা এক প্রলয়ংকারি ঘটনার সাক্ষী থাকা পাখিটাও যেন উড়ে চলে যায় কোন অজানা গন্তব্যে। রাস্তার পাশে ধানের ক্ষেতের কর্দমাক্ত মাটি থেকে উঠে দাঁড়াতে থাকে দিথী আর সামিহা। তারা যেন বাকরুদ্ধ। তারা উঠে আসা রাস্তায়।

আকাশে বিজলী চমকিয়ে উঠে। বৃষ্টি নামতে শুরু করে। সামিহা পিষে যাওয়া অটোটার মধ্যে মানুষ গুলোর খন্ড খন্ড মাংস দেখেই চিৎকার করে উঠে দিথীর কাঁধে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দিথীও আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারছেনা। বৃষ্টির পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটা এসে দিথীর চোখের পাতায় পড়ে। বৃষ্টির পানিতে ভেসে রক্ত গুলো এসে তাদের পায়ের পাতা ছুঁয়ে জানিয়ে দিয়ে গরম তাজা রক্ত কতটা উষ্ণ হয়। দিথী মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তে থাকে। কিছু খন্ড বিখন্ড হয়ে থাকার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন যুবতী। আশপাশ একদম শুনশান, ফাঁকা। এ যেন এক নির্মম পরিস্থিতি, ! 

 

 চলবে ,,,,,

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৭ (১ম ভাগ)

লেখক :: মির্জা সাহারিয়া

 

{বিশেষ দ্রষ্টব্য:: আজকের পর্ব টা খুব মনোযোগ দিয়ে ধীরে সুস্থে পড়বেন। এই পর্বে অনেক রহস্যের খোলাসা হবে‌। তাড়াহুড়ো করে পড়লে সবকিছুই মাথার উপর দিয়ে যাবে। পর্বটা ২ ভাগে বিভক্ত। এইটা ১ম ভাগ। ২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে}

 

রাস্তার পাশে ধানের ক্ষেতের কর্দমাক্ত মাটি থেকে উঠে দাঁড়াতে থাকে দিথী আর সামিহা। তারা যেন বাকরুদ্ধ। তারা উঠে আসে রাস্তায়। আকাশে বিজলী চমকিয়ে উঠে। বৃষ্টি নামতে শুরু করে। সামিহা পিষে যাওয়া অটোটার মধ্যে মানুষ গুলোর খন্ড খন্ড মাংস দেখেই চিৎকার করে উঠে দিথীর কাঁধে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দিথীও আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারছেনা। বৃষ্টির পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটা এসে দিথীর চোখের পাতায় পড়ে। বৃষ্টির পানিতে ভেসে রক্ত গুলো এসে তাদের পায়ের পাতা ছুঁয়ে জানিয়ে দিয়ে গরম তাজা রক্ত কতটা উষ্ণ হয়। দিথী মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তে থাকে। কিছু খন্ড বিখন্ড হয়ে থাকার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন যুবতী। আশপাশ একদম শুনশান, ফাঁকা। এ যেন এক নির্মম পরিস্থিতি, ! 

 

 

– কী হয়েছে তোমার , ? খুব মাথা ব্যাথা করছে ? (নাজিয়া বেগম)

– তানিয়া,! হঠাৎ কী হলো রে তোর। তানিয়া,! (কানিজ)

 

হঠাৎ তানিয়া তার মাথা থেকে হাত সড়ায়। তার চোখ ছলছল করছে। তানিয়ার মাথা ব্যাথা টা এখন একদম উধাও কিন্তু এখন সে যা স্মৃতিভ্রম দেখলো। সেটার তাকে একদম স্তব্ধ করে দিয়েছে‌। কে সেই দু’জন মেয়ে ? যাদের মরতে মরতে বেঁচে ফিরতে সে এখন দেখলো ? 

তখনই কানিজ তানিয়ার হাত ধরে নাড়িয়ে দেয়। বলে

– তানিয়া, তুই ঠিক আছিস তো ? 

– আ,আমি। আমি ঠিক আছি। ঠিক আছি। 

– কী হয়েছিলো তোমার ? মাথা কী খুব ব্যাথা করছিলো? 

 

নাজিয়া বেগমের কথা শুনেই তানিয়া এক মলিন মুখ নিয়ে তার দিকে তাকায়। নাজিয়া বেগম আবার বলেন

– হয়তো তোমরা জার্নি করে এসেছো। তাই মাথা ব্যাথা করছে। ঘরে যাও‌। গিয়ে রেস্ট নেও। 

তানিয়া হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। কানিজ কিছু বলতে যাবেই তখনই উপরের মেঘলা আকাশ থেকে এক ফোঁটা, দু ফোঁটা করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। হঠাৎ বৃষ্টিতে তানিয়ারও সেই ঘোর টা কিছুটা কেটে যায়। তারা বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায়। নাদিয়ার বেগম হাঁক দিয়ে শেফালীকে বলতে থাকে আঙিনার কাপড় গুলো উঠাতে। সুমু তাড়াতাড়ি ঘরের ঐদিকে দৌড়ে যায়। কানিজ ও ঘরের দিকে যেতে থাকে। নাজিয়া বেগম কাপড় উঠাবার জন্য চলে যেতে ধরবেন তখনই তানিয়া তাকে বলে। 

– আচ্ছা আন্টি, দিথীর পড়নে কী লাল গোল জামা আর সামিহার পড়নে কী সবুজ থ্রি পিস ছিলো , ? 

 

তানিয়ার এমন হঠাৎ কথায় থেমে যান নাজিয়া বেগম। তিনি তানিয়ার কাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি তানিয়া দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলেন।

– হ্যা। ওরা তো তাই পড়ে বেড়িয়েছিলো। কিন্তু, তুমি জানলে কী করে , ?

 

নাজিয়া বেগমের থেকে আরো উল্টো প্রশ্ন ফিরে পাওয়ায় তানিয়া কিছুটা নার্ভাস হয়ে যায়। বলে‌।

– ন, না মানে। আমরা, আমরা এমন দুইজনকে গন্জের দিকেই যেতে দেখেছিলাম তোহ। ত,তাই আরকি বললাম। 

– ওহহ। আচ্ছা এখন ভিতরের দিকে যাও। বৃষ্টি জোরে নামতে শুরু করেছে। চুল গুলো ভিজলে তখন আরো মাথা ব্যাথা করবে। (তানিয়ার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে যেতে) কী যে মরনের বৃষ্টি নামা শুরু করছে এই দুইদিন থেকে, ! আল্লাহই জানে, ! 

বলতে বলতে নাজিয়া বেগম চলে জান আঙিনার দড়িতে ঝুলতে থাকা কাপড় গুলো উঠাতে। 

তানিয়া মাথা উঁচিয়ে উপরের দিকে তাকায়। ধূসর মেঘ ভেঙে নিচে নেমে আসছে বৃষ্টির ধারা। হালকা বাতাসে শরীরের ভিজে যাওয়া অংশ গুলোর লোম শিউরে উঠছে। তানিয়ার খোলা চোখের উপর এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ে। তানিয়া সাথে সাথেই চোখ পাতা খোলা-বন্ধ করতে থাকে। বৃষ্টির সেই পানির ফোঁটা তার চোখের মধ্যে থাকা আবেগের জলরাশিকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে যেতে থাকে তার গাল বেয়ে। তানিয়া হাত দুটি মেলে দিয়ে উপভোগ করতে থাকে প্রকৃতির এই শ্রাবণ্য রূপসীকে। হালকা বাতাস এসে তার চুল গুলো উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে। বয়সের ভার দেহের অভ্যন্তরে পড়লেও, বাইরের মুখশ্রী বলছে তার ভিন্ন কথা। এখনো যেন তার যৌবন, কিশোরী মেয়ের মতোই সমুজ্জল , ! 

 

 

দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো শাহারিয়া। পড়নে নীল পাঞ্জাবি, আর কালো জিন্স প্যান্ট। মাথায় টুপি। জুমার নামাজ শেষ করে বাসায় ফিরলো সে। ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়েই ফ্যানের সুইচ ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসে গা এলিয়ে দিলো। বাইরে আজ রোদ উঠেছে। মসজিদে মুসল্লিদের ভিড়। সবমিলিয়ে বেশ গরম লাগছে তার। ফ্যানের নিচে সোফায় বসে পাঞ্জাবির উপরের দুই বোতাম খুলে দিয়ে বাতাসকে তার দেহের সংস্পর্শে আসার আরো ভালো সুযোগ করে দিলো সে। বাইরের গরমের মধ্যেও ঘরের ফ্যানের বাতাস এখনো যেন শীতের মৃদু উপস্থিতি টের পাইয়ে দিচ্ছে। শাহারিয়া বাতাস খেতে থাকে আরাম করে। তখনই তার চোখ যায় টেবিলের উপরে রাখা একটা ফাইলের উপর। ফাইলে কভারে লেখা ছিলো “Black Ranju Case No: 3796”

শাহারিয়া উঠে ভালোভাবে বসে। ফাইল টা হাতে নিয়ে খুলে ফেলে। সে অবাক হয় রন্জুর ফাইলের কেস নাম্বার টা দেখে। ৩ হাজার ৭’শ ৯৬ টা কেস রঞ্জুর নামে? এতো গুলা কেইস ফাইল ঝুলছে তার নামে কিন্তু এখনো তার কোন হদিস ই বের করতে পারেনি পুলিশ , ! 

শাহারিয়া ফাইল টা খুলে। দেখে ফাইলের ডেট এক মাস আগের। আর এটাই রন্জুর কেস নিয়ে করা শেষ ফাইল। এরপর আর কোন ফাইলই আসেনি তার নামে‌। 

” রন্জু কী আরো বড় কোন প্লান সাজাচ্ছে নাকি নতুন কোন দাও মারার জন্য ,? ” ভাবতে ভাবতেই শাহারিয়া ফাইল টা পড়া শুরু করে। ফাইলে ছিলো রন্জুর লাস্ট কেস টার বিবরণ। 

‘লাস্ট কেসে সে দৌলতদিয়া পতিতালয় থেকে সব পতিতা নারীকেই কিডন্যাপ করেছে। আর সেইখানকার পতিতালয়ের মূল মানে সর্দারনিও তার পর থেকেই লাপাত্তা। পুলিশের ধারণা সর্দারনিকেও রন্জূ নিয়ে গিয়েছে‌। এখন সেই পতিতালয় চলমান আছে এক নতুন সর্দার্নির দ্বারা। যে আগের সর্দানির মায়ের পেটের আপন বোন। ‘

 

শাহারিয়া সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতে ফাইল নিয়ে পায়চারি করতে থাকে রুমের মধ্যে। 

– আগের সর্দারনি যাওয়ার পর আবার নতুন সর্দারনির আগমন, ! এই সর্দারনি আবার আগের সর্দারনির বোনও হয়। উমম,(শাহারিয়া ভাবতে থাকে) আচ্ছা একমিনিট, বর্তমান সর্দারনি রন্জুর সাথে মিলে তার বোনকে সড়িয়ে দেয় নি তো ,! হমম। এমনটা হতে পারে। তাতে তারই লাভ। দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লীর সর্দারনি হতে পারবে এতে সে। আর টাকা তো রিতিমত বৃষ্টি পড়বে তার উপর। এই সর্দারনিকেই ধরতে হবে। নিশ্চিত ও রন্জুর সাথে মিলে আছে এবং তার কাছে রন্জুর হদিশ পাওয়া যাবে। (পায়চারি করতে করতে) কিন্তু একটা যৌনপল্লির সর্দারনির নাগাল পাওয়া তো এতোটা সহজ না, ! হুমম, আমাদের প্ল্যান করে তারপর যেতে হবে। আর তা আজকেই। আজ শুক্রবার। আজ অফিস আদালত বেশিরভাগ ছুটি। আজ সেই যৌনপল্লীতে কাস্টমারদের ভিড় থাকবে ভালো রকমই। আর এই ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে সর্দারনির নাগাল পাওয়া অন্য দিনের থেকে তুলনামূলক সহজ হবে। আমাদের এই সুযোগ টাই ব‌্যবহার করতে হবে। আহনাফকে একটা কল দেই। 

বলেই ফাইল টা টেবিলের উপর ছুড়ে দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে থাকে শাহারিয়া। আহনাফের নাম্বার বের করে তাকে কল দেয়। কিছুক্ষণ রিং হয়। আহনাফ ফোন টা ধরে। তারপর তাদের কথোপকথন।

– হ্যালো আহনাফ, ! কোথায় তুমি, ! 

– এইতো স্যার মসজিদ থেকে আসলাম একটু আগে। এখন খেতে বসবো। 

– ও আচ্ছা খাও। আর শুনো। আজ রাতে আমাদের একটা ছোট্ট মিশনে যেতে হবে। খাওয়া-দাওয়া করে তাড়াতাড়ি আমার বাসায় চলে এসো। আর হ্যা, তোমার মা’কে বলে আসবে যে তুমি আজ আমার বাসায় রাত থাকবে। বুঝতে পেরেছো , ?

– ও,ওকে স্যার। আমি খাওয়া শেষ করেই আপনার বাসায় চলে আসবো। (একটু থেমে) আচ্ছা স্যার, রন্জূর বিষয়ে কোন কিছু কী ? 

– হ্যা তার বিষয়েই। আর শোন। তোমার কিছু ফরমাল ড্রেস যেমন ফরমাল সাধারণ শার্ট, গেন্জি নিয়ে আসিও আলাদা করে। ওকে, ! 

– ওকে স্যার আমি নিয়ে আসবো। আমি খেয়েই রওনা দিচ্ছি।

– ওকে ঠিক আছে‌। তাড়াতাড়ি চলে আসিও।

– ওকে স্যার। আসসালামুয়ালাইকুম,

– ওয়ালাইকুমুস সালাম। 

 

শাহারিয়া ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নেয়। তার মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করছে বলা যায়। পতিতালয়ে গিয়ে মেয়ে দেখবে যে সেই জন্য না। রঞ্জুর কেস টা সমাধান করলে তার প্রধান স্যার যে তাকে তারিফ করবে সেটা ভেবে। শাহারিয়া পাঞ্জাবি পড়া অবস্থায় চলে যায় কিচেনের দিকে। তাড়াতাড়ি খেয়ে প্ল্যান সাজাতে হবে তাদেরকে। নামাজে যাওয়ার আগে রান্না-বান্না করে রেখে গিয়েছিল। বাড়িতে মা’কে ফোন দিয়ে স্বাধারণ কিছু রান্না যেনে নিয়ে ওগুলাই করেছে ও। শাহারিয়া রান্নাঘরে যাওয়ার পর পরই সোফার রুম টা শান্ত হয়ে যায়। শুধু কানে আসে উপরে চলা ফ্যানের ‘শোঁ শোঁ’ বাতাসের শব্দ,! 

 

 

মেঘলা আকাশের বৃষ্টি এখন কিছুটা কমেছে। তবে এখনো তার বর্ষন চলমান। দিথী আর সামিহা এক ছাতা হাতে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ির দরজা অব্দি তাদের নামিয়ে দিয়ে গেলো রিয়াদের কনস্টেবল রা। সেই দূর্ঘটনা স্থলে পুলিশ গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তাদের থেকে ঘটনাটা শুনে তাদের গাড়িতে করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে রিয়াদ। দিথী আর সামিহার শরীরে একটা শাল পেঁচানো। সেখানে তারা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। যার ফলে তাদের কাপড় ভিজে চুপচুপে হয়ে গিয়েছিল। রিয়াদ তাদের সম্ভম কিছুটা রক্ষার্থে দুজনকে শাল জড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়।

 

দিথী আর সামিহা বৃষ্টি ভেজা আঙিনা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির বারান্দার সিঁড়ির সামনে দাঁড়ায়। সামিহা ঐরকম খন্ড খন্ড মাংস পিন্ড দেখে কিছুটা মানসিক ট্রমাতেই চলে গিয়েছে‌। সামিহা একদম চুপচাপ কাঁপছে আর নিচের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। দিথী, সামিহার কাঁধে এক হাত দিয়ে তাকে ধরেছে আরেক হাত ‌দিয়ে তাদের মাথার উপরে ছাতা ধরেছে। দিথী নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। ছোট থেকেই এমন মানুষ কাটা, খুন দেখতে দেখতেই তো সে বড় হয়েছে। আবার গেলো কিছুদিন আগে মেইন রোডেও এরকম দুর্ঘটনা দেখলো সে। রক্তারক্তি দেখতে দেখতে তার মানসিক দিক দিয়ে এসব একদম সয়ে গেছে। 

দিথী বারান্দায় সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে নাজিয়া বেগমকে ডাকতে থাকে।

– ছ,ছোট মা, ছোট ম,মা,

তার ডাক শুনে ভিতর থেকে দৌড়ে আসে শেফালী। এসে দেখে সামিহা আর দিথীর অবস্থা। সামিহা এক দৃষ্টে নিচে তাকিয়ে আছে। আর দিথী তাকে ধরে ঠান্ডায় কাঁপছে। তার ঠোঁট, গাল সব ঠান্ডায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, কাঁপছে। শেফালী এসেই হনহনিয়ে বলতে থাকে।

– আরে আফামনি। আপনের কী হইছে,। আর সামিহা আফায় এমন থ হইয়া গেছে ক্যা। 

– ও,ঐ সব পড়ে শুনিস। ছোট মা’কে ডাক দে। স,সামিহাকে ধরতে হবে। 

– খালাম্মায় তো গোসলে গেছে। আপনে দাঁড়ান আমি ধরতাছি। 

 

বলেই বৃষ্টির মধ্যে বারান্দা থেকে নিচে নেমে সামিহাকে ধরতে চেষ্টা করে শেফালী।

– ত,তুই পারবি না। যা, ছোট মা’কে। ছোট মাকে ডেকে নিয়ে আয়। (ঠান্ডায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাপো কাপো ঠোঁট গুলো  দিথীর কথা গুলোকে আটকে দিচ্ছে। 

তানিয়া ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসে। কানিজ আর সুমু ঘুমিয়েছে। বারান্দার ঐদিক থেকে আরো কথার শব্দ তার কানে আসে। সে সেদিকে এগিয়ে যায়। 

দিথী শেফালীকে বলছে যে সে পারবেনা। নাজিয়া বেগমকে ডাকতে। কিন্তু নাজিয়া বেগমও‌ তো গোসল খানায়। তাই শেফালীই সামিহাকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করছে। 

তানিয়া এসে দেখে তাদের তিন জনের এই অবস্থা। তানিয়া তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে যায়। এগিয়ে গিয়ে নিচে নেমে শেফালীকে সড়িয়ে দিয়ে সামিহাকে ধরে। সামিহার যেন তার শরীরের উপর কোন কন্ট্রোলই নেই। সে তার শরীরই ছেড়ে দিয়েছে‌। তানিয়া আর দিথী মিলে সামিহাকে বারান্দায় উঠায়। শেফালী ঐদিকে ছাতা টা ধরে সড়ে যায়। তারা ৪ জনই বারান্দায় উঠে পড়ে। সামিহাকে বারান্দায় রাখা একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয় তারা।

 দিথী এখনো কাঁপছে। তানিয়া বারান্দায় থাকা একটা তোয়ালে দিয়ে দিথীর মাথা মুছে দিতে থাকে। দিথীর ঠোঁট দুটো অনবরত কাঁপছেই। 

 তানিয়া দিথীর মাথা কিছুটা মুছে দিয়ে দিথীর শরীর থেকে শাল টা সড়িয়ে দেয়। তার উপরের জামা টা খুলে দিয়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে দেয়। তোয়ালে টা বড় ছিলো তাই দিথীর পুরো শরীর টায় ভালোভাবেই পেঁচিয়ে দেয় তানিয়া। দিথী কাঁপছে। সে তানিয়ার বুকে মাথা রাখে। তানিয়া তার উষ্ণতা দিয়ে দিথীর ঠান্ডা টাকে কিছুটা প্রশমিত করে দিতে থাকে। তখনই দিথীর যেন হুঁশ ফিরে আসে। সে মাথা উঠায়। দিথীর হঠাৎ মাথা উঠানোর তানিয়া চকিতে তার দিকে তাকায়। দিথী কাপো কাপো কন্ঠে বলতে থাকে।

 – আ, আপনি কে , ?

 – আমি তোমাদের বাসায় নতুন এসেছি। আন্টি বলতে পারো আমায়। 

 – আ,আপনাকে তো গ্রামে আ,আগে কখনো দেখিনি, ! 

 

 দিথী কথাটা বলার পর তাকে তানিয়া আবার বুকে জড়িয়ে ধরে বলে। 

 – তোমার শরীর এখন অনেক ঠান্ডা। একটু উষ্ণ হও। সব খুলে বলছি তোমায়। 

 – কিন্তু,! কিন্তু আপনি কার আত্মীয়, ? ছোট মায়ের , ? ন,না বাবার ? ব,বাবার সব আত্মীয় দের তো আমি চিনি। তাহলে আপনি , ! 

 

তানিয়া ধীর গলায় বলে।

 – আমি তোমার আত্মীয়। আমি তনু, ! 

 – তনু , ! কোন তনু , ? আমিতো, (তখনই দিথীর কাল রাতে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়, দিথীর চোখ মুখ বড় হয়ে যায়। দিথী, তানিয়ার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে)

 – আ,আপনি কী সেই তাসনুবার ভাইয়ের বন্ধুর বোন তনু ? 

 

 তানিয়া মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। 

 – আ,আপনি,। আপনি কেন,

দিথীর কথা থামিয়ে দিয়েই তানিয়া বলে।

– আমি এসেছি সেই বক্সটার খোঁজে। সেই আংটির বক্স, যেটা আমি হামিদুল দাদুর কাছে আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছিলাম।

 

দিথী সাথে সাথেই প্রচন্ড অবাক হয়। বলে।

– আ,আপনিই সে , ? ত,তারমানে আপনার কথাই সামিহার দাদু আমায় বলেছিলো , ?

– হ্যা,। আমিই সে। আচ্ছা আমি তোমাকে বিকালে সবটুকু খুলে বলবো। এখন তুমি কাপড় বদলে নাও। ঠান্ডা বুকে জেকে বসলে তখন তোমারই ক্ষতি হবে। ঘরে গিয়ে গরম কাপড় পড়ে নাও। আমি সামিহার ড্রেস চেঞ্জ করে দিচ্ছি ঘরে নিয়ে। 

– আ,আচ্ছা, (এক মলিন আওয়াজ হিসেবে কথাটা বের হয় দিথীর মুখ থেকে) 

দিথী টাওয়াল পেঁচানো অবস্থায় তার ঘরে চলে যায়। শেফালী আর তানিয়া, সামিহাকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে দিথীর ঘরের দিকে। বাইরের বৃষ্টি এখনো সেই আগের মতোই পড়তে থাকে। মুষলধারে না, খুব অল্প পরিমাণে পড়ছে। তবে আকাশ এখনো আগের মতোই অন্ধকার। বাড়ির পাশের ফুলের গাছের টব গুলোতে ভালোই পানি জমেছে। টবের গাছের অগ্রভাগে ফোঁটা গাঁদা ফুল গুলো এই বৃষ্টির পানিতে গোসল করে যেন আরো স্বচ্ছ আর নির্মল হয়ে উঠেছে। দেখে যেন মনে হচ্ছে এক পবিত্র পরিচ্ছন্ন কিশোরী বৃষ্টিতে ভিজছে আর হাওয়ায় দোল খাচ্ছে,!

 

 

খাঁন বাড়ি। আলিশা তার ঘরে ঢুকলো। তার মা সুরাইয়া বেগম কাপড় সেলাই করছেন সেলাই মেশিনে। সেলাই মেশিন টা বিছানার সামনে রাখা। আলিশা দরজা চাপিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে বিছানায় উঠে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহাওয়া। তাই ঘরে লাইট জ্বালানো। 

আলিশা বিছানায় উঠে জানালার দিকে চলে যায়। বিছানার সাথেই জানালা লাগানো। আলিশা বিছানার পাশে থাকা পড়ার টেবিল থেকে একটা গল্পের বই হাতে নেয়। দুপুরের খাবার খেয়ে আসলো ও মাত্র। আর দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বই পড়াটা তার এক প্রকার শখ। আলিশা বই হাতে নিয়ে জানালার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে পাতা উল্টোটে থাকে। বাইরে বৃষ্টির শব্দের সাথে রোমান্টিক বই পড়া ,! আহা, মজাই মজা। 

আলিশা বই পড়াতে মনোযোগ দেয়। তখনই আলিশা বেগমের মা সুরাইয়া বেগম সেলাই মেশিন চালাতে চালাতে বলেন

– ভাত খাইছোস , ? 

– হ্যা মা। ভাত খেয়ে আসলাম। 

 

আলিশা তার মায়ের কথার উত্তর দিয়েই আবার পড়ায় মন দেয়। তাদের মধ্যে বিরাজ করে নিরবতা। শুধু বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যায়। 

কিছুক্ষণ পর আলিশার ‌মা একটু রুঢ় গলায় বলেন

– নিজের মায়ের তো খোঁজ খবর নিবি না। সারাদিন ঐ সাথীর পিছনেই ঘুরিস। ঐডারেই মা ডাকিস। 

 

সুরাইয়া বেগমের হঠাৎ এমন কথায় আলিশা একটু অবাক হয়। সে বই সড়িয়ে তার মায়ের দিকে তাকায়। বলে।

– কী বলছো মা এসব, ! 

– কী আর কমু, ! আমার মরণ হয়না ক্যা। আমিও যদি তোর বাপের লাহান এই দুনিয়ার ‌থে যাইতে পারতাম তাইলে আর এইসব দেখতে লাগতো না। (একটূ থেমে) নিজের মা’য়ে ঐ সকালের নাস্তাডি ছাড়া আর কিছু খাইছে কী না সেই খোঁজ খবর তো নিবি না। আর আমার হারামী ভাই গুলারে যতই আমি কাপড় সিলাইয়া মাস শেষে হাতে টাকাডা তুইলা দেই না ক্যান। কোনসময় আমারে খাইতে ডাকবো না। ওগোর লগে খাইতে বইলে তাড়ায়া দিবো। (আলিশার দিকে তাকিয়ে) তুইও এহন তোর মা’রে ছাইড়া যা গা। সাথীরে গিয়ে মা ডাক। আল্লাহ এই দুনিয়া থেইকা কবে যে আমারে উঠাইবো এই অপেক্ষায় থাকোন ছাড়া আর তো কোনো উপায় নাই। সব স্বার্থপর, ! ভাই গুলা তো ভাই, নিজের মাইয়াডাও শেষ মেষ , ! 

আর কিছু বলেন না সুরাইয়া বেগম। কাপড় সিলাই করতে থাকেন তাড়াতাড়ি করে। সুরাইয়া বেগমের মুখ থেকে এসব শুনার পর আলিশার চোখে পানি চলে আসে। তার মা তাকে এসব কথা বলতে পারলো , ! তার ভাইয়েরা তাকে খাইতে ডাকেনা কারণ সে  খালি সুমনা বেগমের সাথে তর্কে জড়ায়। একবার তো বাজে ভাসায় সুমনাকে গালি দেওয়ায় নজরুল তাকে চড় ও মেরেছিলেন। 

 

আলিশা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে।

– আমি তো তোমার জন্য ভাত আলাদা তুলে রেখেছি। মামা রাগ করবে বলে তাদের সামনে দিয়ে ঘরে নিয়ে আসিনি। 

– হইছে হইছে থাক। তুই যাইয়া কাইল থে সাথীর লগে থাকিস। অর লগে খাইস , ঘুমাইস। আমি আমার বাকিডা জীবন এই ঘরের মধ্যে থাইকাই পচমু। নিজে সেলাই কইরা মাস শেষে টাকা দেই। তাও আমার লাইগা কয়ডা ভাত ঘরে আনতে দেয়না। (আক্ষেপের সুরে) বোন হিসাবে তো দূর, এক ভাড়া টিয়া হিসাবেও তোর মামা আমারে সহ্য করতে পারেনা। মাঝে মাঝে তো মনে চায় গলায় ফাঁস লাগাই। এই বিষের জীবন আর সহ্য হয়না। (বলেই সেলাই মেশিনে সেলাই করতে থাকা কাপড় টা তুলে হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন। ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে থাকেন ঘরের বাইরে।

নিজের আপন মায়ের মুখ থেকে এসব কথা শুনে আলিশা মনে মনে অনেক আঘাত পায়। তার মায়ের ব্যবহারের জন্যই তো তার ভাইয়েরা তাকে দূর দূর করে তাড়ায় দেয়। আলিশা তার বাবার আদর পায়নি। তার মায়ের কাছ থেকেও এমন ব্যবহার তার পিতা হারার কষ্ট টাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। আলিশা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে‌। তার মা সবসময় তাকে বকেন। আঘাত দিয়ে কথা বলেন। এসব আর তার ভাল্লাগে না। বাইরের বৃষ্টির মনোরম আবহাওয়া যেন একমুহুর্তেই তার কাছে বিষাদের জলধারা হিসেবে নেমে আসে। জানালার দেয়ালে মাথা রেখে ভেজা চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকে আলিশা। বাইরের মেঘরাশিও যেন আলিশার কষ্টে আরো ঘন কালো রুপ ধারণ করে। দূর থেকে আসা দখিনা হাওয়া আলিশার খোলা চুল গুলোকে উড়িয়ে নিতে থাকে। শুকিয়ে দিতে থাকে আলিশার গাল বেয়ে পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলরাশি গুলোকে,! 

 

 

 মেম্বার বাড়ি। ফুলমতি তার রুমে বিছানা হেলান দিয়ে বসে আছে।পাশেই লায়লা ঘুমাচ্ছে। মেম্বার বাড়িতে রুম আছে ৮ টার মতন। তাই প্রথম দিকেই ফুলমতিরা যখন এসেছিলো তখন তাদেরকে এই রুমটা দিয়ে দেওয়া হয়। তারা এই রুমেই থাকে তখন থেকে। একটু আগে আছরের আযান দিয়েছে। বাইরে বৃষ্টি কমেছে। তবে এখনো ঘরের সাথে লাগানো আম গাছের পাতা থেকে দু-এক ফোঁটা পানি ‌টিনের চালে পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। খোলা জানালা দিয়ে ঘরে বয়ে আসছে ঠান্ডা বাতাস। বাড়ির সবাই বিকেল ঘুম দিচ্ছে‌। ফুলমতি হেলান দিয়ে বসে নাসিমের সেই শেষ চিঠি ‌খানা পড়ছে। চিঠিটাকে খুব যত্নের সহিত সংরক্ষণ করে রেখেছে সে। ভালোবাসার মানুষের জিনিস গুলো সবসময় আগলে রাখতে যানে প্রাত্তনেরা। তবে সব প্রাত্তনই যে এক তা কিন্তু নয়, ! 

ফুলমতির মনে পড়ে যায় পিছনের বাগানে বসে তাদের কাটানো বিকেল গুলোর কথা। মধুশ্রীময় সে সময় গুলো তার মনের অন্তরালে মায়া জন্মিয়ে রয়ে গেছে। নাসিমের সাথে শেষ দেখায় তার কথা গুলো এখনো ফুলমতির কানে বাজে। মাঝে মধ্যে মনে হয় এই বুঝি নাসিম ফিরে আসবে। এই বুজি তাকে জড়িয়ে ধরবে। বেশ লাজুক ছিলো নাসিম। প্রথম প্রথম ফুলমতিকে বেশ ভয় পেতো সে। লাজ ভাঙিয়ে আপন করে নেওয়া তার সেই মানুষটাই আজ রাতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছে। ফুলমতি এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিয়তিই তাকে এই যায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। নাসিমের কথা মনে পড়লে তার বেশ খারাপ লাগে, বুকের ভিতর টা কষ্টে চুরমার হয়ে যায়। তবুও সবাই সবার জীবনে তো সবাই সবকিছু পায়না। হয়তো এই না পাওয়ার তাড়না টাই তাকে এক নতুন জগতে এনে ফেলেছে, ! হয়তো কোন একদিন তার আর নাসিমের মিলন হবে। ইহকাল তো পেড়িয়েই গেলো। পরকাল টাই শ্রেয় , ! 

 

 

শাহারিয়া বেডরুমের ডেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল আচড়াচ্ছে। পড়নে একটা ফ্যাকাসে গেঞ্জি আর লুঙ্গি। মাথার চুল গুলো এমন ভাবে আঁচড়াচ্ছে যাতে তাকে দেখতে এক স্বাধারণ দিনমজুর দের মতো লাগে। গালে একটা বড় তিল আর দাড়ি লাগিয়েছে। যাতে এই পোশাকের সাথে সেটা মানানসই হয়। তখনই ঘরের দরজায় কলিং বেল বাজে। শাহারিয়া চলে যায় দরজা খুলতে। 

দরজা খুলে দেখে আহনাফ এসেছে। আহনাফ হঠাৎ শাহারিয়াকে এমন পোশাকে দেখে হকচকিয়ে যায়। সে শাহারিয়ার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলে। 

– ভাই। আপনি কে , ? এইটা ‌না শাহারিয়া স্যারের বাসা, ! 

শাহারিয়া গম্ভীর স্বরে বলে।

– শাহারিয়া স্যার ঘরে ঘুমাইতাছে। আপনে কেডা। 

– আ,আমি ওনার অফিসের লোক। আচ্ছা এইখানে তো আগে স্যার ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। তাইলে আপনি , ? 

– আমি উনার কামের ছেড়ার বউয়ের শালির বইনের চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বইন জামাই,! হা হা হা হা

 

শাহারিয়া আর হাঁসি ধরে রাখতে পারলোন। সে গালের আচুল আর দাড়িটা খুলে বলে। 

– দেখ বেকুপ, এইটা তোরই স্যার হা হা হা হা।

– স্যার, !  এইসব কী সাজছেন ? আমাদের না কোথাও একটা মিশনে যাওয়ার কথা , ? 

– হ্যা। ঐখানে যাওয়ারই প্রিপারেশন। আয় ভিতরে আয়। 

 

আহনাফ ভিতরে ঢুকে। কাঁধে একটা স্কুল ব্যাগ। সে কাধ থেকে স্কুল ব্যাগ টা সোফায় রাখে। শাহারিয়া আবার দাড়িটা ঠিক মতো লাগিয়ে দিতে থাকে। আহনাফ দাঁড়িয়ে বলে। 

– স্যার। আমরা কোথায় যাচ্ছি মিশনে , ? 

– পতিতালয়ে, ! কাউকে বলিস না আবার,!

– স্যার, ! কী বলেন এইসব। আমার মা শুনলে আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে , ! (একটু থেমে) আমি যাবোনা স্যার,! 

– আরে আমরা কী পতিতালয়ে কোন খারাপ কাজ করতে যাচ্ছি নাকি। (গালে দাড়ি লাগাতে লাগাতে শাহারিয়া বলে) 

– তাহলে আমরা কেনো যাচ্ছি , ? পতিতালয়ে তো মানুষ ভালো কিছু করতে যায় না। স্যার, আপনার তো কিছুদিন পর বিয়েই হয়ে যাচ্ছে। এখন আবার কেন এসব যায়গায়। 

 

শাহারিয়া, আহনাফের মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলে।

– মাইন্ড ঠিক কর বুঝলি,! আগেই বলেছিলাম যে মিশনে যাবো। ওখান কার সর্দারনিকে ধরতে হবে। সেজন্যই এই ছদ্মবেশ নেওয়া।

– ও তাই বলেন। আমি আরো কি না কি ভাবলাম। (একটু থেমে) তো এখন আমাকে কী করতে হবে ? 

– তোকে যা যা কাপড় আনতে বলছিলাম আসছিস ? 

– হ্যা স্যার আনছি। 

– আমার বেড রুমে ডেসিন টেবিলের বাম পাশে বাথরুম আছে। গিয়ে চেন্জ করে আয়। আর কোন সমস্যা না থাকলে এখানেই লুঙ্গি দিয়ে চেন্জ করে নিতে পারিস। আমাদেরকে ঠিক ৮ টার মধ্যে মিশন স্টার্ট করতে হবে।

– ওকে স‌্যার। আমি বাথরুমের দিকটাতেই যাচ্ছি। (বলেই সোফার উপর থেকে স্কুল ব্যাগের মতো জিনিসটা নিয়ে সেদিকে চলে যেতে থাকে আহনাফ।

শাহারিয়াও তার পিছু পিছু চলে যায়। নিজের সাজে কী কী কমতি আছে তা দেখার জন্য। আর সেগুলো ঠিকঠাক করার জন্য।‌ 

 

 

চলবে,,

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন : ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৭(২য় ভাগ) 

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

 

– ওকে স‌্যার। আমি বাথরুমের দিকটাতেই যাচ্ছি। (বলেই সোফার উপর থেকে স্কুল ব্যাগের মতো জিনিসটা নিয়ে সেদিকে চলে যেতে থাকে আহনাফ।

শাহারিয়াও তার পিছু পিছু চলে যায়। নিজের সাজে কী কী কমতি আছে তা দেখার জন্য। আর সেগুলো ঠিকঠাক করার জন্য।‌ 

 

 

সন্ধ্যা নেমেছে হয়েছে অনেকক্ষণ। মাগরিবের নামাজ পড়ে মুসল্লিরাও বাড়ি ফিরে গিয়েছে। 

দিথীদের বাসা। কারেন্ট নেই। বিকেলে গিয়েছে এখনো আসেনি। দিথীর রুমে গোল করে বসেছে তানিয়া, কানিজ, সুমু, সামিহা আর রাশেদ। রাশেদকে এখানে ডাকতে দিথীকে বলেছিলো তানিয়া। তাই রাশেদ কেও সে ডেকেছে। অন্ধকার ঘর। বাইরে বৃষ্টি নেই। তবে আকাশে মেঘ আছে। সুমু ফোন চাপছে। বাকি সবাই চুপচাপ করে বসে আছে। দিথী একটা মোমবাতি হাতে ঘরে প্রবেশ করে। মোমবাতির আলোয় ঘরের একাংশ আলোকিত হয়ে উঠে। দিথী এসে সেই মোমবাতিটা মাঝের টেবিল টার রাখে। আর সেও একটা চেয়ারে বসে পড়ে। তানিয়া সুমুকে বলে ফোন সুইচ অফ করে রাখতে। সুমুও তাই করে‌। একটা টেবিল। টেবিলে সেই বক্সটা, আর মোমবাতি। আর তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছে সবাই। মোট ৬ জন। দরজা লাগানো। ঘরের মধ্যে একটা নিশ্চুপ পরিবেশ। টিনের চালে গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির জমে থাকা পানি পড়ার শব্দ আর তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। নিরব পরিবেশ। সবাই মোমবাতির দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর তানিয়া নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠে।

– রাশেদ , ! 

 

রাশেদ মুখ তুলে তানিয়ার দিকে তাকায়। বলে‌। 

– জ্বী বলুন। 

– তুমি প্রতিরাতে এক নির্দিষ্ট স্বপ্ন দেখো তাইনা ?

– ক,কই। নাতো।

– লুকিয়ে রাখার দরকার নেই। তুমি স্বপ্নে যা যা দেখো তা দিথী আর সামিহাও দেখে।

 

রাশেদ একবার দিথীর দিকে তাকায়, তারপর একবার সামিহার দিকে তাকায়। বলে।

– হ্যা দেখি‌। এক আজব স্বপ্ন। ১৯৯৬ সাল, তাসনুবার সংসার, আর,

– আর আসুভে (রাশেদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে) তাই তো , ! 

– জ,জ্বী হ্যা। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন , ? 

– সব বলবো। একে একে সব বলবো। তোমরা শুধু এই মোমবাতির দিকে নজর দিয়ে বসো। এই মোমবাতির উপর থেকে নজর সড়াবে না। কোন প্রশ্ন মনে জাগলে বলে ফেলবে তৎক্ষণাৎ। বুঝেছো  , ? 

– হমম (সবাই একসাথে)

– সবার প্রথমে তোমাদের বলি আসুভে কী আর কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার যুগে এক বড় তান্ত্রিক ছিলেন। তার নাম ছিলো আদরি। তিনি খারাপ শক্তির উপাসনা করতেন। তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন মিশরীয় রাজা গিজা কে মেরে ফেলে মিশর সহ পুরো বিশ্বে রাজত্ব করতে‌। তিনি তার সম্পূর্ণ জ্ঞান ব্যবহার করে সব খারাপ শক্তিকে একত্রিত করে এই আসুভের সৃষ্টি করেন। এই আসুভে ছিলো সব খারাপ শক্তির সম্মিলিত রুপ। যার কারণে এটাকে এযাবত কালের সবচেয়ে শক্তিশালী খারাপ শক্তি বললেও চলে ভুল হবে না। মিশরীয় রাজা গিজা এই বিষয়ে পরবর্তী এক গুপ্তচরের মাধ্যমে জেনে জান‌। এবং এক ভাল তান্ত্রিককে দিয়ে সেই খারাপ তান্ত্রিককে মেরে ফেলেন। আর আসুভেকে এক পাথরে বন্দি করে আকাশের দিকে এক কামানের মাধ্যমে নিক্ষেপ করেন। শেষ হয় আসুভের মিশরীয় অধ্যায়।

– কিন্তু এটা মিশরে সৃষ্টি হলে এই আনন্দ পুরে কীভাবে আসলো, ? আর সেটা তো সেই ভালো তান্ত্রিক বন্দি করে ফেলেন তাইলে, ? (রাশেদ)

– এই উত্তর টাই এখন দিবো। এই আসুভেকে যখন কামানের মাধ্যমে উপরে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো তখন সেটা বায়ুমণ্ডলের এক মধ্যম স্তরে গিয়ে আটকে যায়। এবং সেই বায়ুমন্ডলেই ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই পাথর টার সাইজ ছিলো আমাদের হাতের তালুর সমান। পরবর্তীতে একটা সময় সেই পাথর টা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে বায়ুমণ্ডলে ভাসতে ভাসতে আরেক প্রান্তে চলে আসে। এবং এক পর্যায়ে সেটা বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে নামতে শুরু করে আর এক সময় বৃষ্টির মাধ্যমে নেমে পড়ে এই আনন্দ পুরের নীলগিরি জঙ্গল টায়। 

– তো আসুভে তো বন্দি অবস্থায় ছিলো। আর এই গ্রামের কেউ তো জানতোও না আসুভের সম্পর্কে। তাহলে তার বন্দিবস্থা কীভাবে ছুটলো বা কে ছুটালো ? (সামিহা)

– অনেক অনেক বছর আগে। যখন এই গ্রামে রাজাদের বসবাস ছিলো তখনকার সময়ের কথা। তখন পর্যন্ত ইংরেজরা এই ভারতীয় উপমহাদেশে আসেনি। তাই বিভিন্ন যায়গা বিভিন্ন রাজা দ্বারা শাসিত ছিলো। এই গ্রামেও এক রাজার বাস ‌ছিলো। গ্রামের চৌরচকে যে মাছের ঝর্ণা টা দেখতে পাও এখন, সেই মাছের মুর্তিটা সেই রাজাই নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তী ইংরেজরা সেই মাছের মুর্তিতে ঝর্ণা প্রবাহের ব্যবস্থা করে। আচ্ছা তো আবার আসুভের টপিকে ফিরি। সেই রাজার আমলে একদিন রাতে এক কাঠুরে জঙ্গলে গাছ কাটতে যায়। রাজা গাছ কাটা দেখতে পারতেন না। তাই কাঠুরে রা রাতের আঁধারে গাছ কেটে নিয়ে যেতো। তেমনি করে এক রাতে এক কাঠুরে গাছ কাটতে যায়। সেই সময় আলোর উৎস ছিলো মশাল। সেই মশাল ধরিয়ে কুড়াল দিয়ে গাছ কাটছিলো সেই কাঠুরে। হঠাৎ সেই গাছ কাটার যায়গা থেকে কিছু দূরে একটা উজ্জ্বল জিনিস তার চোখে পড়ে। জিনিসটা এতোটাই উজ্জ্বল ছিলো যে তার ১০-১২ হাত দূর থেকেই সেই আলোটা দেখতে পেয়েছিলো কাঠুরে। কাঠুরে গাছ কাটা রেখে সেদিকটায় যায়। গিয়ে দেখে এক পাথর থেকে বের হচ্ছে সেই আলো। সে গিয়ে যখনই পাথর টা ছুঁয়ে ফেলে তখনই পাথরটা থেকে উজ্জল আলোটা তার ভিতরে প্রবেশ করে ফেলে এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই সেই পাথর থেকে এক কালো ধোঁয়া বেড়িয়ে উপরে উঠে কোথাও একটা উধাও হয়ে যায়। 

– সাদা আলো আবার কালো ধোঁয়া , ? দুই রকম জিনিস কীভাবে বের হলো সেই পাঠর টা থেকে ? (দিথী)

– মিশরের সেই ভালো তান্ত্রিক পাথরে আসুভে কে বন্দি করে তার উপর এক শুভ শক্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিলো। কারণ আসুভে যতক্ষণ না মানুষ রুপে জন্ম নিচ্ছে। ততক্ষন তাকে বিনাশ করা অসম্ভব। তাই তান্ত্রিক তাকে বিনাশ করতে পারেনি আর আসুভেকে বন্দী করতে বাধ্য হয়। আর তান্ত্রিক জানতো এই আসুভে একদিন কারো না কারো হাতে পড়বে। তাই এই ভালো শক্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিলো যাতে আসুভেকে বিনাশ করার প্রক্রিয়া আর পন্থা সেই ভালো শক্তিটা একজন মানুষের ভিতরে প্রবেশ করে করতে পারে। তাই এই পাথরের উপরে থাকা ভালো শক্তি মানে শুভ শক্তিটা সেই কাঠুরের শরীরে চলে যায়। আর পাথরের মধ্যে থাকা আসুভে কালো ধোঁয়া রুপে উন্মুক্ত হয়ে যায় বাতাসে। 

– আসুভে কী তারপর একলা একলাই তাসনুবার শরীরে প্রবেশ করেছিলো ? (সামিহা)

– না। আসুভে সে সময় বাতাসে একদম স্বাধীন ভাবে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। তার দরকার ছিলো কোন খারাপ তান্ত্রিকের সাহায্য। যে, কোন মেয়ের মাধ্যমে তাকে এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করাতে পারবে। তখনকার রাজার আমলে এই গ্রামেও এক খারাপ তান্ত্রিক ছিলো। তার কাছে গিয়ে এই আসুভে ধরা দেয়। এবং মন সংযোগের মাধ্যমে সে কী এবং তার জন্ম হলে সে কী কী করতে পারবে কতটা লাভবান করে দিতে পারবে সেই তান্ত্রিককে তা বুঝায়। তান্ত্রিক রাজী হয়ে যায়। এবং আসুভে তার শক্তির এক ক্ষুদ্র অংশ সেই তান্ত্রিকের দেহে দিয়ে দেয়। আর এই তান্ত্রিক টাই ছিলো তাসনুবার সেই শশুর।

– তাসনুবার শশুর ? কিন্তু তান্ত্রিক টা তো ছিলো রাজার আমলের। সে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কীভাবে বেঁচে ছিলো ? (দিথী)

– কারণ আসুভে তাকে অমরত্ব প্রদান করেছিলো। এর কারণে তার গাঁয়ে সময়ের কোন প্রভাব পড়তো না। তার গাঁয়ে আঁচড় লাগলে তা আপনা আপনিই আবার ঠিক হয়ে যেতো। সে বিয়ে করেছিলো হনুফা নামের এক প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে। হনুফাকেও আসুভে অমর করে দিয়েছিলো। তারপর তাদের ঘরে আসে এক পুত্র সন্তান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই পুত্র সন্তান টা হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী। 

– আর সেই শারীরিক প্রতিবন্ধী পুত্র টাই ছিলো তাসনুবার বর সোহেল ? (দিথী) 

– হ্যা। সেই ছিলো সোহেল। তখন সময়টা ১৯৮৮। সেই তান্ত্রিক, হনুফা আর সোহেল বাস করতো সেই জঙ্গলের রাস্তার পাশে একটা বাড়িতে‌। সেটাও আসুভে তাদের দিয়েছিলো তৈরি করে‌। সেসময় সোহেলের পছন্দ হয় গ্রামের সবচেয়ে বড়লোক। অর্থাৎ মাতব্বরের মেয়ে তাসনুবাকে। তাসনুবা ছিলো অনেক সুন্দরী। তার রুপে পাগল ‌ছিলো গ্রামের প্রত্যেকটা ছেলে। বলা হতো যে এই তাসনুবা নামক হীরাকে বিয়ে করবে, তার জীবন ধন্য। কিন্তু তাসনুবার ভাগ্যে আর কোন ‌রাজপুত্তুর জুটেনি। আসুভের মাধ্যমে তান্ত্রিক, তাসনুবাকে কন্ট্রোল করে নিয়ে আসে তাদের বাসায়। আর বিয়ে দেয় তার ছেলের সাথে। তোমাদের সুবিধার্থে সেই তান্ত্রিক টার নাম টাও বলে রাখি। তান্ত্রিকের নাম ছিলো আগুয়ে।

– আগুয়ে,! এইটা আবার কেমন নাম ? (সামিহা)

– আসুভের দেওয়া নাম ছিলো এটা। এর আগে গ্রামের আর পাঁচটা লোকের মতোই তার স্বাধারণ নাম ছিলো। তখন নাম ছিলো ছওতার আলি। আচ্ছা তারপর কী হলো তা বলি। আসুভেকে এই দুনিয়াতে আনার জন্য কোন মেয়ের গর্ভ হয়ে তাকে জন্ম নিয়ে আসতে হবে। তবে যেই সেই সময় আসুভেকে গর্ভে প্রবেশ করানো যেতো না। ঠিক ৩৩ বছর পর পর একটা নির্দিষ্ট সময় আসতো‌। সেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে গর্ভে প্রবেশ করাতে হতো।  আগুয়ে অনেক বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নির্দিষ্ট কিছু রাশির মেয়েদের মধ্যেই আসুভের জন্ম সম্ভব ছিলো। তাই সেই নির্দিষ্ট মেয়ে সময় মতো খুঁজে না পাওয়ার কারণে আসুভের জন্ম সম্ভব হচ্ছিলো না। তারপরে এভাবেই একের পর এক সাল চলে যায় আর আসে ১৯৯৬ সাল। এই সাল টাই ছিলো আসুভেকে জন্ম দেওয়ার শেষ সাল। এরপর আসুভে আর কখনোই জন্ম গ্রহণ করতে পারবেনা। এবং তার অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আসুভের গর্ভে বেড়ে উঠতে সময় লাগতো ৫ মাস। যা কিনা স্বাধারণ মানুষের বাচ্চার জন্ম সময়ের প্রায় অর্ধেক। তাই আগুয়ে এমন একটা সময়ের মধ্যে আসুভের জন্ম মেয়ে খুঁজতে হতো যাতে আসুভেকে সেই মেয়ে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে জন্ম দিতে পারে। আগুয়ে এবার আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পড়ে। গ্রামের সব মেয়েদের রাশি নির্ধারণ করতে শুরু করে। এবং একটা পর্যায়ে এক মেয়ের রাশি মিলে যায় আসুভের জন্ম দেওয়ার জন্য যেই রাশির দরকার ছিলো তার সাথে। আর সেই মেয়েটা ছিলো তাসনুবার বান্ধবী লিপি। 

– লিপি ? শাহারিয়ার মায়ের নামও তো লিপি , ? শাহারিয়া আমাকে বলেছিলো যে ওর মায়ের মৃত্যুও ১৯৯৬ সালে হয়েছিলো। (দিথী)

– হয়তো সেই লিপিই হবে। তবে এখানে ছিলো কিছু ভিন্ন বিষয়। আগুয়ে যেই দিন লিপিকে কিডন্যাপ করার জন্য ঠিক করে তার একদিন আগেই লিপিকে অন্য কারা যেনো কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। আগুয়ে খুঁজতে শুরু করে কারা লিপিকে কিডন্যাপ করেছিলো। এবং একটা পর্যায়ে সে তাদের নাগালও পেয়ে যায়।একটা আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়ার দল লিপিকে কিডন্যাপ করেছিলো। লিপির হাসবেন্ড মতিনের সাথে সেই মাফিয়াদের কিছু বিষয়ে নিয়ে শত্রুতা ছিলো। আগুয়ে সেই মাফিয়াদের কাছে যায়। তাদের কাছে পরিচয় দেয় এক জাদুকর হিসেবে। বলে এই মেয়ের দেহ তাকে দিয়ে দিতে এটা দিয়ে সে তার পূজা করবে।

প্রথমে মাফিয়ারা দিতে রাজি না হওয়ায় আগুয়ে তাদের এই বুঝ দেয় যে এতে তারাও এক বড় শক্তি পাবে যা দিয়ে তাদের যা ইচ্ছা করতে পারবে। আর যদি তার পুজা টা সম্পূর্ণ নাও হয় তারপরও মেয়েটা মারাই যাবে। আর তারাও তো মেয়েটাকে মারতেই চায়। আগুয়ে তাদের অনেক টাকাও দেয়। টাকা গুলো আসুভের মাধ্যমে সে পেয়েছিলো।  মাফিয়ারা রাজি হয়। শুরু হয় পুজার অন্তরালে আসুভেকে লিপির শরীরে প্রবেশ করানোর যোগ্য। আসুভে লিপির ‌শরীরে প্রবেশ করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর লিপি হঠাৎ জোরে জোরে চিৎকার করতে শুরু করে এবং মারা যায়। আর আসুভেও সাথে সাথে সে দেহ থেকে বের হয়ে যায়।

লিপির শরীর আসুভেকে গ্রহণ করতে পারেনি। গ্রহণ করার মতো উপযুক্ত ছিলোনা তার শরীর। লিপি মারা যাওয়ার পর পরই আসুভে তার দেহ থেকে সবটুকু রক্ত চুষে নিয়ে বের হয়ে আসে। মাফিয়ারা লিপির মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায় তারা সেই মৃত লিপির গলায় ছুরি চালায়। গলা কেটে ফেলে। রক্ত বের হয় মৃদু পরিমাণে। কারণ আসুভে মাথার দিকটা বাদে সবটুকু শরীরের রক্ত চুষে নিয়েছিলো। লিপির অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। আর আসুভেকে জন্ম দেওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

– তারপর, ? (দিথী)

– তারপর আগুয়ে হন্য হয়ে খুঁজা শুরু করে আসুভেকে জন্ম দেওয়ার উপযোগী কোন নারীকে। এবং অনেক খুজার পর যখন সে তার ছেলের বউয়ের রাশি মিলায় তখন দেখে ঘরেই তো তার আসল জিনিস লুকিয়ে আছে। আগুয়ে সেই রাতেই ঘুমন্ত অবস্থায় তাসনুবার দেহে প্রবেশ করায় আসুভেকে। এবং তাসনুবার শরীর উপযোগী হওয়ায় তার ব্যাথাও হয়নি। মৃত্যুও হয়নি। আর তারপরের ঘটনাটা তো তোমাদের সবারই জানা। অনেক চেষ্টা করার পরও আমরা সেই আসুভের জন্মকে আর আটকাতে পারিনি।

– আমরা মানে ? (রাশেদ)

– আমরা মানে আমরা। (হাত দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে) মনে আছে স্বপ্নে তাসনুবাদের গাড়ি থেকে এক ছোট মেয়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলো ? সেই তনুই আমি। আমার ভাইয়া আমাকে তনু বলে ডাকতো। সেই দিনের সেই তনুই আজকের এই তানিয়া।

– তুমিই সেই তনু , ? (একটু থেমে) আর আমরা বলতে কী বলতে চাচ্ছিলে তা বুঝিনি। (সামিহা) 

– আমরা বলতে তোমাদের আর আমাকে বোঝায়। 

– আপনি তো সেদিন ছিলেন কিন্তু আমরা কীভাবে ?

– কারণ তাসনুবা, সাবিনা, সিহাব আর রাফির পুনর্জন্ম হয়েছে। আর তোমরাই হলে তাদের সেই পুনর্জন্মের রুপ।

 

কথাটা শুনেই দিথী, সামিহা, রাশেদ যেনো আকাশ থেকে পড়লো। তারা একে অপরের দিকে তাকায় তারপর বলে।

– আমরা ? 

– হ্যা। তাসনুবার পুনর্জন্ম হলো দিথী, তাসনুবার সেই বান্ধবী সাবিনার পুনর্জন্ম হলো সামিহা, আর রাফির পুনর্জন্ম হলো রাশেদ। 

– কিন্তু আমরা কীভাবে তার পুনর্জন্ম হতে পারি। আর কেনই বা তাদেরই পুনর্জন্ম আমরা হলাম? 

– মনে আছে তাসনুবার মৃত্যুর আগের রাতের কথা গুলো, ? তাসনুবা সৃষ্টিকর্তার কাছে চেয়েছিলো এক পুনর্জন্ম। যাতে সে পরবর্তী জন্মে আসুভেকে শেষ করতে পারে। আর সৃষ্টিকর্তাও সেটা কবুল করে নেন। আর শুধু তাসনুবাই না। সাবিনা, রাফি আর সিহাবেরও পুনর্জন্ম হয়। 

– কিন্তু আমরাই যে তাদের পুনর্জন্ম এটার প্রমাণ কী ? হতে পারে আপনি ভুল করছেন , ?

– না তোমরাই তাদের পুনর্জন্ম। প্রথম এবং বড় প্রমাণ এটাই যে তোমরা তিনজনই সেই স্বপ্ন দেখতে। আর কেউ দেখতো না। আর দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে এটা যে তোমাদের ৩ জনেরই জন্ম হয়েছে আসুভে জন্মের ৪ বছর পরে একই তারিখে। আমি যদি ভুল না করি তোমাদের ৩ জনেরই জন্ম তারিখ ২৭/১২/২০০০ ? 

 

তারা তিনজনই একে দিকে ফিরে তাকায়। তারমানে আসলেই তাদের পুনর্জন্ম হয়েছে, ! 

– অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আজকের পর থেকে তোমাদের সবারই আগের জন্মের সব কথা মনে পড়তে শুরু করবে। (একটু থেমে) দিথী,!

 

দিথী চকিতে ফিরে তাকায় তানিয়ার দিকে। তানিয়া বলে

– তুমিই হলে আসুভের মৃত্যু,! তুমি একমাত্র করতে পারবে আসুভের বিনাশ,!

– কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় আসছেনা আপু। আসুভের তো জন্ম হয়ে গেছে ১৯৯৬ তেই। তাইলে সে এতোক্ষণে তার শক্তি দিয়ে কেন তান্ডব শুরু করেনি ? (সামিহা বলে)

– এইখানেই তো রয়েছে এক টুইস্ট। আসুভে ভেবেছিলো জন্মের পর পরই তার শক্তি সে ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু তা হয়নি। পরবর্তীতে কেনো আসুভে তার শক্ত ফিরে পেলোনা তা নিয়ে আগুয়ে যখন অনুসন্ধান করে তখন সে এই তথ্য খুঁজে পায় যে আসুভের যতদিন না ১৮ বছর পুরণ হচ্ছে ততদিন সে তার পুর্ণ শক্তি ফিরে পাবেনা। 

– কিন্তু আসুভের জন্ম তো ১৯৯৬ এ। তার ১৮ বছর তো ২০১৪ তেই হয়ে যাওয়ার কথা। (রাশেদ)

– এই রহস্য তোমাদের সহজ ভাবে বোঝানোর জন্য আমাকে বেশিদূর না। এই কয়েকদিন আগের কথাই মনে করিয়ে দিলে চলবে। (একটু থেমে) কয়েকদিন আগে তোমাদের গ্রামে একটা মার্ডার কেস চলছিলো মনে আছে ? ঐযে মেরে ফেলে আম বাগানে ফেলে আসতো।

– নাসিম মানে নোমানের কেসের কথা বলছো ? (দিথী)

– হ্যা নোমানের কেসের কথাই বলছি। নোমান কিন্তু তাসনুবা আর সোহেলের ছেলে ছিলো। তোমাদের স্বপ্নে দেখা তাসনুবার সেই ছোট্ট ৮ বছর বয়সী ছেলেটিই এই নোমানই ছিলো। তাসনুবা মানে তার মায়ের মৃত্যু কীভাবে হয় তা নোমান জানতে পারেনি। কিন্তু আসুভেকে সে নিজের বোনের মতো করেই বড় করেছিলো। 

– মানে নুপুর,!(তানিয়ার দিকে চকিতে তাকিয়ে) মানে তার বোনই ছিলো আসুভে ? (দিথী)

– হ্যা। নুপুরই ছিলো আসুভে। কিন্তু সে নিজেও জানতোনা যে সে অসুভ শক্তির আঁধার আসুভে। সে নিজেকে আর পাঁচটা মানুষের মতোই স্বাধারণ মানুষ ভেবে নিয়েছিলো। আর ছোট থেকেও সে এক রক্ত মাংসে গড়া মানুষের মতোই বড় হয়েছে। ১৮ বছর পর সে তার সবটুকু শক্তি ফিরে পেতো। আর অসুভ শক্তিতে রাজত্ব করতো। কিন্তু তার মাঝেই তাকে মেরে ফেলে তারই কলেজের কিছু ছেলে।

– তারমানে তো আসুভের বিনাশ তখনই হয়ে গিয়েছিল ? (রাশেদ)

– না। ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী তাসনুবার পুনর্জন্ম অর্থাৎ দিথীর হাতেই তার বিনাশ ঘটবে। এর মাঝে সে মারা গেলেও নিয়তি তার আবার পুনর্জন্ম করাবে। এবং তাই হয়। তার ভাই নোমানও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে মারা যায়। তারপর ফিরে আসে তার মৃত্যু আর তার বোনের মৃত্যুর খুনের প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু সে তো আর জানতো না তার বোন ছিলো এক অসুভ শক্তি। আর নুপুর অর্থাৎ আসুভের পুনর্জন্মের জন্য দরকার ছিলো তার হত্যাকারীদের মাথা। তার হত্যাকারীদের মাথা দিয়ে এক পুজার মাধ্যমে আগুয়ে নুপুরের পুনর্জন্ম করতে পারতো। আর তাই হয়। নোমান তার আর বোনের হত্যাকারীদের মেরে সেই রুমে রেখে চলে যেতো। তারপর ঘরের  মধ্যে পড়ে থাকা কাঁটা মাথা গুলো কালু জাদুর আত্মাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করতো আগুয়ে। সংগ্রহ করে রেখে দিতো তার কাছে। তারপর যেদিন শেষ হত্যাকারীকে মেরে নোমান তার আর তার বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে ফেলে। সেদিন সেই ঘরে শাহারিয়া আর রিয়াদ নামের দুই ছেলেও‌ ছিলো। তারা যখন সেই লাশ টাকে নিয়ে বের হয় সাথে সাথেই আগুয়ে তার আত্মাদের দিয়ে সেই শেষ মাথাটাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে‌। পুনর্জন্ম করায় নুপুর ওরফে আসুভের। তার সেই কঙ্কাল দেহে জন্মাতে শুরু করে রক্ত মাংস। আর সে এখন স্বাধারণ মানুষের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছে,!

 

 বলেই আড়চোখে কানিজের দিকে একবার তাকায় তানিয়া। তারপর আবার চোখের নজর ঠিক মোমবাতি বরাবর রাখে সে। 

– আচ্ছা আপনি এতো ডিটেইলস এ সবকিছু জানলেন কী করে , ? (দিথী)

– তোমার মা আমায় বলেছে। 

 

 তানিয়ার মুখ থেকে কথাটা শুনেই যেন ঘরের সবাই চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে তানিয়ার দিকে তাকায়। তানিয়া তার নজর মোমবাতি থেকে উঠিয়ে দিথীর দিকে চেয়ে বলে।

– হ্যা। তোমার মা’ই আমাকে এসব বলেছে। জানো তোমার মা কেনো মারা গেছিলো ?

– কী হয়েছিলো আমার মায়ের। কী হলো বলো কী হয়েছিলো আমার মায়ের সাথে , ? (কাঁপা কাঁপা গলায় বলে দিথী) 

– তোমার যখন ৪ বছর বয়স তখন তোমার এক জটিল রোগ হয়েছিলো। অনেক বড় বড় ডাক্তার, এই জেলা-ঐ জেলা ঘুরেও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। উল্টো আরো তোমার অবস্থার অবনতি হচ্ছিলো। ডাক্তাররা তো তোমার বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তখনই তোমার মা বুঝতে পারে যে এই অসুখ কোন স্বাধারণ অসুখ নয়। এর পিছন নিশ্চয়ই কোন খারাপ কিছুর হাত আছে। তিনি চলে যান রংপুরে। ওখান কার এক কালোজাদুর উপাসকের কাছে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় জানতে চান। সেই কালোজাদুর উপাসক বলেন তার দেহ সেই অসুভ আত্মা আসুভের উদ্দেশ্য বিলিয়ে দিতে। এতে হয়তো এখন দিথী প্রাণে বেঁচে যাবে। তবে ভবিষ্যতে সেই অসুভ আত্মা আবার দিথীকে মারার চেষ্টা করবে। (দিথীর দিকে তাকিয়ে) তোমার মা’ও তাই করে। সেই কালোজাদুর উপাসকের কথা অনুযায়ী তোমাদের সেই উত্তরের ঘরে উপাসনা করেন। উপাসনার ফলে তার পুরো দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আসুভে তার পুরো দেহটাকে নিয়ে যায়।

ঘরে শুধু পড়ে থাকে রক্ত আর রক্ত। এবং এরপরই তুমি একদম সুস্থ হয়ে উঠো (একটু থেমে) তোমার মা যে শুধু ছোট বেলাতেই তোমাকে বাঁচিয়েছে তা নয়। তোমার মনে আছে যে তোমার ছোট মা তোমায় মেরেছিলো একদিন ? সেদিন যে তার উপরে গরম ফুটন্ত পানির পাতিল পড়ে গিয়েছিলো ? তা কিন্তু নিছক কাকতালীয় ‌ছিলো না। তোমার মায়ের আত্মা সেটা করেছিলো। তোমার ছোট মা একদিন বিশ খাইয়েও তোমাকে মারতে চেয়েছিলো। কিন্তু তোমার মায়ের আত্মা সেই বিশ টা তারই সতিনের ছেলেকে খাওয়ান। শুধু এই নয়, কিছুদিন আগে তোমাদের অটোর সামনের অটোটার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো মনে আছে ? সেই প্রথম অটোটাতে তোমাদের উঠতে বাঁধা দিয়ে নিজে উঠে যাওয়া সেই বোরখা পরিহিত মহিলাটা আর কেউ ছিলোনা। ছিলো তোমার মায়ের আত্মা। পরবর্তীতে ‌এক্সিডেন্টের পর সেই বাসের নিচ থেকে শুধু সেই অটো ড্রাইভারের মৃত দেহ বের করা হয়। আর কোন মৃত দেহ সেখানে পাওয়া যায়নি। (একটু থেমে) আজকেও কিন্ত দূর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে অটো থেকে ধাক্কা দিয়ে তোমাদের বাঁচিয়ে দেওয়া সেই বোরখা পরিহিত মহিলাটা ছিলো তোমার মা। তোমার মা তোমাকে সব সময় বিপদের মুখ থেকে বাঁচিয়ে নেন। আমাকেও সব সময় বিপদ থেকে বাঁচায় আমার ভাইয়া আর (এক মলিন গলায়) আমার ভাইয়া সিহাব, আমার হাসবেন্ড তুষার, আমার ছোট্ট মেয়ে ফাইজা সবাই আমার জন্য মারা গেছে,! আমি তাদের বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু তারা আমাকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে। কারণ আমি ছাড়া তোমাদের এই বিষয়ে কেউ জানাতে পারতো না। আর আমিও তোমাদের দেখতে পারতাম না কখনো। তোমার মা’ও আমাকে কখনো বলেনি তোমার ঠিকানা, তোমার নাম।

তাই তোমায় খুঁজতে একটু দেরি হয়ে গেলো। নাহলে আরো আগেই তোমাকে খুঁজে বের করতাম।(একটু থেমে) আজ আমি তোমাদের এক্সিডেন্টের সবটুকু আমি আমার স্মৃতি ভ্রমে দেখেছি। এই গ্রামে এসেছি বলেই হয়তো দেখতে পেরেছি। এবং শিওর হয়েছি যে আমি যার জন্য এসেছিলাম সেটা তুমিই। (একটু থেমে) তোমার আর আমার উপরে বিপদ গুলো কিন্তু সব এমনি এমনিই আসেনা। এই মাস(ডিসেম্বর)। এই মাসের ২৭ তারিখ অমাবস্যার রাতে আসুভে তার পুর্ন শক্তি ফিরে পাবে। তার ১৮ বছর পূর্ণ হবে। সে এখন কিন্তু আর নুপুর নেই। সে এখন জানে যে সে আসুভে। যতই দিন ঘনিয়ে আসবে ততই সে তার শক্তি ফিরে পেতে শুরু করবে। এখন তার কাছে আছে অন্যের শরীর কন্ট্রোল আর ছদ্মবেশ ধারণ করার শক্তি। 

 

বলেই কানিজের দিকে আবার আড় চোখে তাকায় তানিয়া। কানিজ এবার কিছুটা বুঝতে পারে যে তানিয়া তার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কানিজ আগের মতোই স্বাভাবিক থাকে যাতে তানিয়া কিছু সন্দেহ না করে। দিথীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আজ তার মায়ের পাশে সে বসে ছিলো। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি। যদি বুঝতে পারতো জড়িয়ে ‌ধরে রাখতো। বুক উজাড় করে সবটুকু কষ্ট ‌তার‌‌ মায়ের সাথে সে ভাগাভাগি করে নিতো। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিথী। রাশেদ বলে উঠে। 

– আচ্ছা একটা প্রশ্ন ছিলো আমার। 

– হ্যা ‌বলো। 

– আপনার ভাইদের মানে তাসনুবাদের গাড়ির এক্সিডেন্টের পর আপনি এই গ্রাম থেকে বের হতে পেরেছিলেন কীভাবে ? আর সেই বক্সটা হামিদুল চাচার কাছেই আসলো বা কীভাবে ? 

– সুন্দর ‌প্রশ্ন। এইটারই উত্তর দিতে আসছিলাম আমি। সেদিন এক্সিডেন্ট হয়েছিলো সকাল ১১-১২ টার দিকে। আর সেই রাস্তাটা সেই সময় কার গ্রাম থেকে বের হওয়া বা ভিতরে আসার রাস্তা থাকলেও সেই রাস্তায় লোকজনের চলাচল খুব কম ছিলো। কারণ ছিলো জঙ্গলের নির্জনতা। আমি প্রায় ৫-৬ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম। বিকালের দিকে হামিদুল দাদু সাইকেল করে দুধ বিক্রি করতে যান দিনাজপুরের ঐদিকে। ঐদিনও তিনি সেইজন্য যাচ্ছিলেন ঐ পথ ধরে। গাড়ির ভিতরের জীবন্ত মানুষ গুলো আর গাড়িটা ততক্ষণে পুরে একদম ছাই হয়ে গিয়েছিলো। আগুন সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিভে গিয়েছিলো। হামিদুল দাদু সেই পথ ধরে যাওয়ার সময় আমাকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। দাদু তখন ছিলেন একজন ৪৫ বছর বয়সী লোক বা প্রাপ্তবয়স্ক লোক যাকে বলে আরকি, ঐরকম। তিনি আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে তার বাসায় আসেন। আমার গলায় তখনই ঝোলানো ছিলো সেই ঝোলা ব্যাগ টা। সেই ব্যাগেই ছিলো চিরকুট বই আর (টেবিলের দিকে আঙ্গুল করে বক্স টা দেখিয়ে দিয়ে) এই বক্সটা। দাদু আমার জ্ঞান ফিরান। আমি সবটুকু তাকে খুলে বলি। তিনিও বিশ্বাস করে নেন। কারণ ঐসময় গ্রামেও অনেক অলৌকিক সব ঘটনা ঘটছিলো। আমি তাকে বলি বক্সটা আমানত হিসেবে রাখতে। যদি আমি না ফিরে আসি বা আপনার কিছু হয়ে যেতে ধরে তার আগেই আপনি এই বক্সটাকে কোন যোগ্য হাতে তুলে দিয়েন।

আমি বক্সটা নিয়ে এই গ্রামের বাইরে যেতে পারতাম না। কারণ ভয় ছিলো যদি গ্রামের বাইরে গেলে এই বক্সের ভিতরে থাকা আংটির শক্তি নিঃচিহ্ন হয়ে যায়। তাই আমি আংটি সহ বক্সটা তার কাছে আমানত হিসেবে রাখি। আর “আদরি আসুভে” বইটা নিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাই। দাদুই আমাকে আমার আসল বাসা রংপুরে পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে মা আমাকে পড়ে সিলেটে খালার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। বাড়ির কোন লোকই বিশ্বাস করেনি আমার আর হামিদুল দাদুর কথা। উল্টো তারা ভেবেছে আমার ভাই কোন মেয়েকে নিয়ে বিয়ে করার জন্য পালিয়ে গিয়েছে। তাই তারা বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নেয়। কিন্তু কয়েক বছর যাওয়ার পর যখন আমার ভাই ফিরে আসেনা। তখন তাদের বিশ্বাস হয় যে আমার ভাইয়া, আমার ভাইয়া আসলেই আর নেই। (বলেই এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তানিয়া)

তখনই তাদের মধ্যে থেকে রাশেদ বলে উঠে।

– আচ্ছা তানিয়া আপু, ! 

– হমম। 

– আসুভে তো তাইলে এখন বেঁচে আছে একজন মানুষ হয়ে। সে এখন কোথায় ? তার হদিস আমরা কীভাবে পাবো , ? 

– সে তো এখানেই আছে, ! 

(তানিয়ার মুখ থেকে এই উত্তর সবার মুখে নেমে আসে ভয়ের ছায়া। তাদের মধ্যেই আসুভে আছে , ! কে সে, ! 

ঘরের মধ্যে থাকা একেকজন একেকজনের দিকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। তখনই তানিয়া আস্তে আস্তে মুখ ঘুড়ায় তার বাম পাশে। তার বাম পাশে বসা ছিলো তার বান্ধবী কানিজ। কানিজ ভয় পেয়ে যায়। বাকিরাও সবাই তার দিকে তাকায়। তানিয়ার এমন দৃষ্টি দেখে কানিজ আমতা আমতা করে বলতে থাকে।

– ক,কী হলো তোমাদের। আ,আমাকে। আমাকে এভাবে দেখছো কেনো। (তানিয়ার দিকে ফিরে) দ,দোস্ত। আমি কোন আসুভে টাসুভে না। আমি কানিজ। তোর বন্ধু, !

– হ্যা বন্ধুই তো। মুখোশ পড়া বন্ধু, ! 

– এ,এই। কিসব বলছিস তুই। আ,আমি। আমি তোর বন্ধু কানিজ। 

কানিজের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে তানিয়া বলে।

– কানিজ , ? হমম। কানিজ। তুই তো বলে আমার বন্ধু তাইনা , ! (কানিজের পাশে বসে থাকা সুমুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একটু থেমে কড়া গলায়) সুমু, তুমি ধরা পড়ে গিয়েছো। আসল আসুভে যে তুমি তা আমি খুব ভালো করেই জানি, ! 

 

তানিয়ার কথা বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সুমু একটা বল জাতীয় কিছু টেবিলের উপর জোরে ছুড়ে ফেলে আর সাথে সাথেই সেখান থেকে ধোঁয়া বের হয়ে পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। মোমবাতির আলো নিভে যায়। এবং তখনই দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। সবাই ধোয়াতে কাঁশতে থাকে। ধোঁয়া টা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। দরজা খোলা থাকায় বাইরে থেকে আসা বাতাসে ঘরের ধোঁয়া কেটে যায়। তখনই ঘরের মধ্যে গ্যাস লাইটারের এক ছোট্ট আলোক শিখা জ্বলে উঠে। তানিয়ার হাতে থাকা সেই লাইটারের আলোয় ঘরের আংশিক আলোকিত হয়ে উঠে এবং সেই আলো টেবিলে পড়ার সাথে সাথেই সামিহা হন্তদন্ত চিৎকার দিয়ে বলে উঠে।

– সেই আংটির বক্সটা কই গেলো , ! বক্সটা টেবিলে নেই, ! 

 

চলবে ,,,,,

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৮

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

(( ১৮+ ডেন্জারাস রেড এলার্ট 🛑🛑🛑।

 চিত্রনাট্যের জন্য কিছু এডাল্ট কথা ইউজ করা হয়েছে। পড়লে নিজ দায়িত্বে পড়বেন ))

 

– হ্যা বন্ধুই তো। মুখোশ পড়া বন্ধু, ! 

– এ,এই। কিসব বলছিস তুই। আ,আমি। আমি তোর বন্ধু কানিজ। 

 

কানিজের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে তানিয়া বলে।

– কানিজ , ? হমম। কানিজ। তুই তো বলে আমার বন্ধু তাইনা , ! (একটু থেমে কানিজের পাশে বসে থাকা সুমুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কড়া গলায়) সুমু, তুমি ধরা পড়ে গিয়েছো। আসল আসুভে যে তুমি তা আমি খুব ভালো করেই জানি, ! 

 

তানিয়ার কথা বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সুমু একটা বল জাতীয় কিছু টেবিলের উপর জোরে ছুড়ে ফেলে আর সাথে সাথেই সেখান থেকে ধোঁয়া বের হয়ে পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। মোমবাতির আলো নিভে যায়। এবং তখনই দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। সবাই ধোয়াতে কাঁশতে থাকে। ধোঁয়া টা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। দরজা খোলা থাকায় বাইরে থেকে আসা বাতাসে ঘরের ধোঁয়া একদম কেটে যায়। তখনই ঘরের মধ্যে গ্যাস লাইটারের এক ছোট্ট আলোক শিখা জ্বলে উঠে। তানিয়ার হাতে থাকা সেই লাইটারের আলোয় ঘরের আংশিক আলোকিত হয়ে উঠে এবং সেই আলো টেবিলে পড়ার সাথে সাথেই সামিহা হন্তদন্ত চিৎকার দিয়ে বলে উঠে।

– সেই আংটির বক্সটা কই গেলো , ! বক্সটা টেবিলে নেই, ! 

সামিহার বলার সাথে সাথেই রাশেদ আর কানিজ চকিতে টেবিলের দিকে তাকায়। দেখে আসলেই বক্সটা নেই। রাশেদ ধীর গলায় বলে

– সেই বক্সে তো আংটিটা ছিলো। যেই আংটিটা দিয়ে আসুভের বিনাশ করা যেতো। ও মাই গড । এখন কী হবে , ? 

– ঠান্ডা হও। ঠান্ডা হও‌। বক্সে আংটিটা নেই। আর এইটা ঐ বক্সটাও নয়। এইটা আসল বক্সের আদলে গড়া একটা নকল বক্স ছিলো। 

তানিয়ার মুখ থেকে এই কথা শোনার পর কানিজ, সামিহা, রাশেদ অবাক হয়ে তানিয়ার দিকে ফিরে তাকায়। তানিয়া হাতে ধরে থাকা লাইটার টা থেকে মোমবাতি টা জ্বালিয়ে দেয়। দিয়ে লাইটার টা নিভিয়ে দেয়। কানিজ বলে উঠে।

– আসুভে যে আমাদের সাথেই ছিলো তা তুই আগে বলিস ‌নি কেনো ? আর তুই আমার দিকে অমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিলি কেনো ? 

– বলবো বলবো। সবই বলবো। (দিথীর দিকে তাকিয়ে) দিথী। যাও আসল বক্স টা নিয়ে এসো। 

তানিয়ার কথায় দিথী হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। হেঁটে হেঁটে চলে যায় পড়ার টেবিলের কাছে আর সেখানকার ড্রয়ার থেকে বক্স টা বের করে নিয়ে আসে। দিথীর এমন স্বাভাবিক চলন ফিরন সামিহা, রাশেদ আর কানিজ কে যেনো আরো অবাক করছে। দিথী এসে বক্স টা টেবিলের উপর রাখে। বলে। 

– তানিয়া আপুর কথায় আমি আগেই আসল বক্স টা লুকিয়ে রেখেছিলাম। 

– তুইও তাইলে জানতি যে আসুভে আমাদের সাথেই আছে ? (সামিহা) 

– আসুভে যে আমাদের সাথে আছে তা জানতাম। কিন্তু আসল আসুভে কে তা জানতাম না। (দিথী)

– তুই কীভাবে বুঝলি যে সুমুই আসুভে ? (তানিয়ার দিকে ফিরে কানিজ বলে) 

– তোর মনে আছে ? আমার এসিস্ট্যান্ট রিতু হঠাৎ চাকরি থেকে রিজাইন নিয়েছিলো। যেখানে কিনা তার আগের রাতেও তার সাথে আমার প্রজেক্ট নিয়ে কথা হয়েছিলো। (একটু থেমে) সকাল বেলা যখন অফিস গিয়ে শুনি রিতু চাকরি থেকে রিজাইন নিয়েছে আর তার এক আত্মীয় মানে সুমুকে পাঠাইছে তার পদে, তখনই আমার সন্দেহ হয় এই সুমু মেয়েটার উপর। আমি তৎক্ষণাৎ কিছু বলিনা। আমি সেদিনই বাসায় এসে রিতুর ফোনে কল দেই। রিতু ফোন উঠায় না। পরবর্তীতে তার বাসার বাড়িওয়ালাকে ফোন দিয়ে জানতে পারি রিতুকে কেউ খুব খারাপ ভাবে মেরে ফেলেছে।

শরীরের চামড়া ছিলে ফেলেছে, মুখের এক পাশ পুরো ভেঙ্গে গিয়েছে। আর তার লাশ টাও তার বাড়ির খাটের নিচ থেকে তার কাজের বুয়া বের করেছে। যাতে আমার সন্দেহ আরো বেশি হতে থাকে সুমুর উপর। তবে আমি তখন তাকে সন্দেহ করলেও বুঝতে পারছিলাম না যে সুমুর আসল পরিচয় টা কি ? কিন্তু ‌লাষ্ট যেই দিন সুমু আমার বাসায় আসে সেদিন আমার বেলকনির টেবিলে রাখা বইয়ের পাতা উল্টে “আদরি আসুভে” লেখা পৃষ্ঠা টায় গিয়ে থামে। আর আমার সন্দেহ তখন সত্যিতে পরিনত হয়। আমিও তাকে তখনই ধরি না। সে আসলে কী করতে চায় তা জানার জন্য তাকে আমি আরো সময় দেই।

তার সাথে আরো অভিনয় চালিয়ে যাই। তারপর যখন এখানে পৌঁছাই। দিথীর কাছ থেকে তার সবটুকু কথা শুনি। তাতেই বুঝে যাই ও আংটিটা নেওয়ার জন্যই এসেছে। আমিও তাই ভাবলাম একদম সন্ধ্যায় সবার সামনে তার মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। আর এখন তা করতেই ও বক্স টা নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু পরে যখন ও বক্সটা খুলবে তখন ওর শুধু নিজের উপর রাগ হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না, !

– কিন্তু ও তো তখন আরো রাগান্বিত হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফিরে আসবে‌ ,! (সামিহা)

– হ্যা আসবে। কিন্তু ও তো ওর রুপ আর বদল করতে পারবেনা। আর ছদ্মবেশ ও ধারণ করতে পারবেনা। পুনর্জন্ম হওয়ার পর ওর এই মুখটাই রয়ে যাবে ওর বিনাশ অব্দি। তাই ও আর নিজে আসবেনা আক্রমণ করতে কিংবা আংটিটা নিয়ে যেতে। (একটু থেমে পায়চারি করতে করতে) সামিহার উপর কিছুদিন আগে এক অসুভ আত্মা ভর করেছিলো তাইনা , ! সেই আত্মা কে ছিলো জানো ? (দিথীদের দিকে ফিরে তাকিয়ে) সেই আত্মা ছিলো তাসনুবার শাশুড়ি হনুফা বেগমের আত্মা।

সেই দিথী সেজে সামিহাকে সেই জঙ্গল টায় নিয়ে গিয়ে তার উপর ভর করেছিলো। তবে পরে দিথী আংটিটা তার আঙুলে পড়ে তার দিকে ধরায় আংটির জাদু শক্তি তাকে সামিহার দেহ থেকে বের করে দিয়েছে। (একটু থেমে) আমি এখন একটা সাদা পাউডার এই ঘরের চারপাশে দিয়ে রাখছি। এই দাগ পাড় করে হনুফা কিংবা আগুয়ে কেউই আসতে পারবেনা এই ঘরের মাঝে। তবে আসুভে আসতে পারবে। কিন্তু যেহেতু আসুভে আর তার রুপ বদলাতে পারবেনা সেহেতু তাকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করা থেকে আমরা আটকাতে পারবো। 

– তাইলে আমাদের এবার একজোট হয়ে আসুভের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে , ! তার বিনাশ করতে হবে , ?  (দিথী)

– হ্যা,। এই মাস। অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের ২৭ তারিখ অমাবস্যার রাতে আসুভে তার শক্তি ফিরে পাবে। তার আগেই ওর বিনাশ করতে হবে আমাদের। আর বিনাশ করার মুল শক্তি হলো (টেবিলে থাকা বক্সটা হাতে নিয়ে) এই বক্সের মধ্যে থাকা আংটি, !  

 

 

সুমু রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। চারপাশ অন্ধকার। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার খানা খন্দে পানি জমে আছে‌। তার দৌড়ে যাওয়ায় সেই সব খানা খন্দে পা পড়ছে আর পানি ছিটকিয়ে উপরে উঠছে। চৌরচক পেড়িয়ে সে ঢুকে পরলো নীলগিরি জঙ্গলের রাস্তাটায়। সে থামলো। দাঁড়িয়ে সে হাঁপাচ্ছে। হাতে সেই বক্সটা। তার মুখে হাসি ফুটে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। শেষমেষ এই বক্সের আংটিটা পেয়েই গেলো সে। এখন এই আংটিটাকে ধ্বংস করলেই সে তার মৃত্যুকে ধ্বংস করতে পারবে। 

সুমু পিছনে তাকিয়ে দেখে কেউ তার পিছু নেয়নি তো , ? দেখে না। কেউ নেই। সুমু বক্সটা খুলা শুরু করে। এবং বক্সটা খুলে ফেলে। আর তখনি বক্সের ভিতরে থাকা পোকামাকড় দেখে ভয়ে বক্সটা নিচে ফেলে দেয়। ভিতরে আংটি দেখতে না পেয়ে রাগ উঠতে থাকে‌ তার। মাথা নিচু করে ফেলে‌ সে। চোখ লাল হতে শুরু করে। এক জোড়ে চিৎকার দিয়ে উঠে সে। জঙ্গলের গাছে থাকা পাখি গুলো উড়ে যেতে থাকে। জোছনার চাঁদের আলোর মধ্যেও যেন এক ভয়ংকর রুপ দেখালো আসুভে সেই জঙ্গলের মাঝে, ! 

 

 

একটা প্রাইভেট কার এসে থামে দৌলতদিয়া পতিতালয় এর গলির সামনে। মাইক্রো থেকে নামতে থাকে শাহারিয়া আর আহনাফ। নেমে যাওয়ার পর শাহারিয়া হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি টাকে চলে যেতে বলে। গাড়িটা রিভার্স গিয়ে চলে যেতে থাকে যেই রাস্তা দিয়ে এসেছিলো সেই রাস্তা দিয়ে। শাহারিয়া আর আহনাফ পা চালিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। সামনেই দোকানপাট শুরু। দোকানের আলো এসে পড়ছে গলির রোডের উপর। শাহারিয়ার পড়নে একটা লুঙ্গি, আর এক সাদা ফ্যাকাসে পাঞ্জাবি। দুই-এক যায়গায় ছিঁড়া। গালে দাঁড়ি আর একটা বড় তিল। মাথার চুলের রং সাদা। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। আহনাফ একটা ফরমাল প্যান্ট পড়েছে। আর একটা সাদা শার্ট। দুইজনের পায়েই নরমাল স্যান্ডেল জুতা। তারা রাস্তার দোকানপাট গুলোর অংশ পেড়োতে থাকে হেঁটে হেঁটে। দোকানের সামনে সামনে আলাদা আলাদা করে দাঁড়িয়ে আছে পতিতা গুলো। শাহারিয়া আর আহনাফ তাদের দিকে লক্ষ্য রাখতে রাখতে এগিয়ে যায়। সামনেই পতিতা পল্লীতে ঢুকার গেইট। পতিতা পল্লী টা একটা বস্তীর মতো। টিনের ঘর দিয়ে ভরা। শাহারিয়ারা গেটের খুব কাছেই চলে এসেছে। তখনই দেখে একটা ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে ধরে টেনে টেনে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে দুইজন মহিলা। ১৮ বছর বয়সী মেয়েটা কাঁদছে। তাকে এক প্রকার জোর করেই গেইটের ভিতরে নিয়ে গেলো দুই মহিলা। শাহারিয়া আর আহনাফ দ্রুত গেলো সেদিকে। পতিতা পল্লীর গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো‌। চারপাশে নানারকম খুশবু আর সুগন্ধি ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। সেইসবের ঘ্রান নিতে নিতে তারা এগিয়ে গেলো। গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকার পর একটু ফাঁকা জায়গা। তারপর থেকে টিনের ঘর গুলো শুরু। শাহারিয়ারা ভিতরে ঢুকে গেইটের একটু সামনের একটা মোটা গাছের পিছনে দাঁড়ায়। টিনের ঘর গুলো যেখান থেকে শুরু হবে তার কিছুটা সামনে সেই মেয়েটাকে দাড় করিয়ে  তার সাথে কথা বলছে দুই মহিলা। তাদের কথোপকথন গুলো শাহারিয়ারা শুনতে পাচ্ছিলো। দুই মহিলার মধ্যে একজন মহিলা বলে। 

– এই মাল ডারে সর্দারনির ধারে পাঠাবি আগে না অন্য কিছু করবি ? 

– সর্দারনির ধারেই লইতে হইবো। মাইয়াডা যেমন কান্দাকান্দি শুরু করছে, ! 

– আফা, আমারে ছাইড়া দেন। আমি এইসব কাম করমু না। আমার অসুস্থ মায়ে এসব হুনলে মইরাই যাইবো। আফা রহম করেন আফা। আমারে ছাইড়া দেন। আমারে ছাইড়া দেন। (বলেই কাঁদতে থাকলো মেয়েটা)

– হ। আমগোরে তো পাগলে পাইছে যে তোরে ছাইড়া দিমু। আর তুই না কইছিলি তোর টাকা লাগবো তোর মায়ের চিকিৎসা করার লাইগা। এইহানে তুইই মেলা ইনকাম করবার পারবি। আর মেলা কচি আছোস‌। বেশি না। রাইতে ৩-৪ টিপ মারলেই তোর মায়ের চিকিৎসার টাকা উইঠা আইবো। 

– না না আফা‌। আমি এইসব কাম করুম না। আমি, আমি ভিক্ষা করমু, তাও এসব কাম করুম না।আমারে ছাইড়া দেন। আমি, আমি আপনাগো পায়ে পড়তাছি গো আফা। আমারে ছাইড়া দেন,! (বলেই এক মহিলার পা ধরে কাঁদতে থাকলো মেয়েটা) 

– ল তো। এইডারে সর্দারনির ধারে লই যাই। সর্দারনির হাতে মাইর খাইলে এই মাগির মাথা খুলবো। 

বলেই সেই দুইটা মহিলা সেই মেয়েটাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। তখনই ‌শাহারিয়া আর আহনাফ গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই মহিলাদের পিছে যায়। আর ডাকতে থাকে। 

– আফা, ও আফা, 

কথা শুনেই মহিলা দুইজন সেই মেয়েটাকে নিয়ে থেমে যায়। আর পিছন ফিরে তাকায়। মহিলাদের মধ্যে একজন বলে। 

– কী হইছে, ? আর আপনেরা এহানে একলা ক্যা , ? আপনাগো লগের মাইয়া কই ? 

– না মানে আফা বাইরের ডিরে পছন্দ হইলো না তো। (শাহারিয়াকে দেখিয়ে) আর আমার চাচায় এই প্রথমবার আইলো তো এইহানে। হের কচি জিনিস লাগবো। (আহনাফ বলে)

– কচি ‌জিনিস এহন নাই। সবডি একবার ইউজ করা। ঐডি চলবো , ?

– করিম। আমার কচি ডাই লাগবো। তুই আমারে ঐ মাইয়াডার লগে লাইন কইরা দে। (বৃদ্ধের গলায় আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে শাহারিয়া) 

– চাচা খারাও। আমি কথা কইতাছি। (মহিলা দু’জনে দিকে ফিরে তাকিয়ে) আফা, এইডারে আমার চাচার মনে ধরছে। এইডারে দিয়া দেন এক রাইতের লাইগা। যত চাইবেন আমরা দিমু। 

– কিন্তু, ! (অপর এক মহিলার কথা থামিয়ে দিয়ে আরেক মহিলা বললো)

– ১৫ হাজার ‌লাগবো। তাও এক রাইত না। ২ ঘন্টার লাইগা শুধু। 

– কী কন , ! এতো টাহা, ! আরো মাত্র ২ ঘন্টার লাইগা , ! একটু কমায় রাহোন যায়না , ! (আহনাফ)

– দুইডা মিল্লা একটার ভিতরে হান্দাইবেন। ১৫ হাজার তো কমই কইছি। আর এইডা একেবারে কচি জিনিস। একদম কুমারী। আপনেরাই প্রথম। 

– ভাতিজা রাকিইইইব। এমনে কুমারী কুমারী কইয়া তহন আরো ডেড ফেল মাল দিয়া দিবো না তো , ! (বৃদ্ধ গলায় আহনাফের দিকে তাকিয়ে শাহারিয়া বলে) 

– না না চাচা। কইতাছে যেহেতু কুমারীই হইবো। (মহিলাদের দিকে তাকিয়ে) এডভান্স কত দেওন লাগবো ? 

– এহন দিবেন ১০ হাজার। আর কামের পড়ে ৫ হাজার। 

– এইযে মেডাম হুনেন। মাইয়া যদি কুমারী না হইছে,! তাইলে কিন্তু আপনারে ঘরে নিয়া সারারাইত (দাঁতে দাঁত চেপে) এক্কেরে দিমু, মিছা কতা কওয়ার লাইগা। (বৃদ্ধ গলায় শাহারিয়া বলে) 

– যদি কুমারী না হয় তহন যা মন তাই কইরেন আমাগো লগে। (এক মহিলা আরেক মহিলার দিকে তাকিয়ে) বুইড়ার এক পা কবরে গেছে তাও দম কমেনা , ! 

– শালী তুই ভিতরে আয়। বুইড়ার দম কিরাম তা তহনই বুঝাই দিমু , ! মাগির ঘরের মাগি , ! 

– হইছে হইছে। এহন আমাগো লগে লন। ঘর দেহায় দিতাছি আপনেগোরে , !

– আমারে ছাইড়া দেন আফা। আমি মইরা যামু। এগো হাতে আমারে তুইলা দিয়েন না। আমারে মাইরা ফেলবো হেরা। আমারে ছাইড়া দেন, (বলেই আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে মেয়েটি। মহিলা দু’জন তাকে শক্ত করে ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। 

 

বস্তির সবগুলো ঘর টিনের। আর তার মাঝ দিয়ে চলার ছোট গলি। ৩ জন মানুষ একসাথে যাইতেই কষ্টকর গলিটা দিয়ে। শাহারিয়াদের কে একটা রুমের ভিতর নিয়ে আসে সেই মহিলা দু’জন। রুমের ভিতর টা সাজানো। টিনের রুম হলেও বিছানা, টেবিল সব দামি দামি। চারপাশের দেয়াল ফুল দিয়ে সাজানো। মহিলা দু’জন শাহারিয়াদের উদ্দেশ্য করে বলে। 

– আপনেরা এহানে খারান। আমি মাইয়াডারে সাজাইয়া ঘরে পাডাইতাছি। আর ঐ যে টেবিল দেখতাছেন। ঐহানে কয়েক প্যাকেট আছে। ঐডি ব্যবহার কইরেন। মাইয়া পোয়াতি বানাইয়া রাইহেন না আবার। 

– তাড়াতাড়ি আইসেন। আর সুন্দর হট ডেরেস পড়াইয়েন। যাতে দেইখা একটু ফিলিং আহে আরকি, ! (চাচা ওরফে ছদ্মবেশী শাহারিয়া) 

– এই বুইড়ার আইজ পিনিক উঠছে। মাইয়াডার লাইগা মায়া লাগতাছে। না জানি মাইয়াডার কী অবস্থা করে। চল, (বলেই সেই দুইজন মহিলা মেয়েটাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে রুম টা থেকে। মেয়েটা অনেক কান্নাকাটি করছিলো। ওর মুখ টা দেখে যে কারো মনে মায়া জন্মাবে। শাহারিয়া সেই মেয়েটার দিক থেকে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। 

ওরা তিনজন চলে যায়। আহনাফ গিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আসে। এসে শাহারিয়া কে উৎসুক হয়ে বলতে থাকে। 

– স্যার । কী অভিনয় ডাই না করতাছেন , ! আর স্যার আসলেই কি মাইয়া ডারে আমরা ,,!

– চুপ বেকুব। মেয়েটাকে খাবে। ওর বয়স দেখছিস কতটুকু। চুপচাপ থাক। যেকোনো সময় ওরা চলে আসতে পারে। আর, এই নে (কাঁধ থেকে ঝোলাই টা খুলে আহনাফ কে দিয়ে) এই টা বিছানায় রাখ। 

শাহারিয়ার হাত থেকে ঝোলা টা বিছানায় রাখার সাথে সাথেই কেউ দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। সাথে সাথেই শাহারিয়ারা চকিতে ফিরে তাকালো। দেখলো মেয়েটাকে নিয়ে তারা চলে এসেছে। শাহারিয়া তাড়াতাড়ি করে হাত দিয়ে দাড়ি টাকে ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। যাতে দাড়ি টা উঠে না যায়। মেয়েটাকে একটা হালকা শাড়ি পড়িয়েছে তারা। বাইরে থেকে ‌শরীরের ভিতরে সব ‌অবয়ব‌ বুঝা যাচ্ছে। শাহারিয়া আর আহনাফ তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নেয়। হাতা কাটা ব্লাউজ, আর মুখে হালকা মেকআপ করে দেওয়া মেয়েটার। মেয়েটাকে নিয়ে তারা ঘরে ঢুকে। মেয়েটা এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে ভাবছে হয়তো তার নিয়তিই তাকে এই অবস্থায় এনে ফেলেছে। তাই চুপ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শাহারিয়াদের কাছে এসে দাঁড়ায় তারা। মহিলা দু’জন মেয়েটাকে আহনাফ দিকে ঠেলে দিয়ে বলে। 

– লন আপনেগো মাল। আস্তে ধীরে কইরেন। এইডাই কিন্তু অর প্রথম। (একটু থেমে) আর আমাগো একজন গেটের বাইরে দরজা লাগাইয়া খাড়ায় থাকবো। ২ ঘন্টা হইয়া যাওনের পর আপনেরা ভিতরে যেমনেই থাহেন না কেন। মাইয়াডারে আইয়া টানতে টানতে লইয়া যাইবো। আর যদি আগেই গাড়ির তেল শ্যাষ ‌হইয়া যায়। তাইলে দরজা ধাক্কা দিয়া কইবেন খুইলা দিতে। অয় খুইলা দিবো। 

– আইচ্ছা। অহন ‌আপনেরা যান তো। সময় আমাগো যাইতাছে। চাচা তুমি মাইয়াডারে খোলা শুরু করো। (আহনাফ মেয়েটাকে শাহারিয়ার পাশে দাঁড় করায়)

– আরে খারান। আমরা তো আগে বাইর হই। আইজ এই মাইয়ার কপালে দুঃখ আছে, (বলেই মহিলা দুটো চলে যায় ঘর থেকে। ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়। আর মহিলা দুইজনের একজন বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আরেকজন চলে যায় সেখান থেকে। 

শাহারিয়ার পাশে মেয়েটা দাড়িয়ে আছে। ভয়ে কাপতেছে। মেয়েটা নিজে নিজেই বিছানায় বসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। আহনাফ এসে শাহারিয়ার পাশে দাঁড়ায়। শাহারিয়া আর আহনাফ দু’জনেই মেয়েটার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তাদের দুজনেরই চোখ নিচে ফ্লোরের দিকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে।

– আ, আমারে। আমারে বেশি কষ্ট দিয়েন না। আমি, আমি মইরা যামু। আমার মা’রে আমি শ্যাষ দেখা দেখতে চাই। আমারে বেশি কষ্ট দিয়েন না, ! (বলেই মেয়েটা অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে মুখ তুলে শাহারিয়াদের দিকে তাকায়। সাথে সাথেই মেয়েটা অবাক হয়ে যায়। কারণ যাকে ও চাচা ভেবেছিলো সেই চাচা তার মুখের দাড়ি আর‌ তিল খুলে ফেলতেছে। আর যাকে চাচার ভাতিজা ভেবেছিলো সেই ভাতিজাও শরীরের শার্ট খুলতে শুরু করেছে। আর ঝোলা থেকে কাপড় বের করে অন্য কাপড় পড়ে নিচ্ছে। হঠাৎ এমন‌ কিছু দেখে মেয়েটা ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাপো কাপো কন্ঠে বলে। 

– আ, আপনেরা কারা। আপনেরা ছদ্মবেশে আছিলেন এতক্ষণ , ! 

– হুশশশশ, একদম চুপ। আস্তে কথা বলো। (আহনাফ)

– আপনারা চাচা, ভাতিজা না , ? 

– না। আমরা গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই এর লোক। তুমি ভয় পেওনা। আমরা তোমার প্রতি কোন সুযোগ নিবো না। এই নাও এটা তোমার গায়ের উপর দাও। তোমার শরীর বুঝা যাচ্ছে। (আহনাফ তার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে একটা জ্যাকেট এগিয়ে দেয় মেয়েটার দিকে ) 

– কিন্তু আপনারে এভাবে এমনে কইরা কেন আইছেন , ! 

– আস্তে কথা বলো। দরজার বাইরে কিন্তু একজন দাঁড়ায় আছে। (একটু থেমে কাপড় বদলাতে বদলাতে) আমরা এখানে এসেছি এখান কার সর্দারনিকে ধরতে। তোমার মতো অনেক ভালো মেয়েকে যারা এই খারাপ রাস্তায় নিয়ে আসে তাদেরকে ধরার মিশনে এসেছি আমরা। 

– কিন্তু, ! 

– কোন কিন্তু না। আমরা সব তোমায় খুলে বলছি। আসলে ,

শাহারিয়া কিছু বলতেই যাবে তখনই বাইরে থাকা মেয়েটা দরজায় শব্দ করে বলে।

– কীরে মাগি , ! তোর কোন আওয়াজ নাই ক্যা , ! কোন সমস্যা হইলো নাকি তোর আবার , ! দুই দামড়া লোক যে তোর ভাগ্যে পড়ছে। কিছু আরো কইরা লাইলোনি তোর আবার ,! 

– শিট, ! আমি তো এইদিকটা ম্যানেজ করতেই ভুলে গেছি। শোনো মেয়ে, মেয়ে না। তোমার নাম কী বলো ? তাড়াতাড়ি বলো।

– আফরিন। আমার নাম আফরিন।

– আফরিন তুমি চিৎকার করতে থাকো। এমন ভাবে চিৎকার করো যাতে তারা বুজা পায় যে আমরা তোমার সাথে ওসব করতেছি। আমি তোমাকে আস্তে আস্তে এখনকার সব প্ল্যান বুঝিয়ে দিতেছি। তুমি চিৎকার শুরু করো।

 

দরজার বাইরে,

মহিলাটা বিরবির করে বলতেছে। 

– মাইয়াডার আবার কিছু হইয়া গেলো নি ? অজ্ঞান হইয়া গেছে মনে হয়, দেহি তো,! (বলেই যখনই দরজা খুলতে যাবেই তখনই ভিতর থেকে ভেসে আসতে থাকে আফরিনের সুখ চিৎকার। 

– আহহ , ওহহ, ওমাগো আস্তে দেন। ও আল্লাগোওওও, আহ, আহ , ইশশ, আস্তে দেন কইতাছি। আপনে কই আহেন, আগে চাচায় শেষ করুক তারপর আহেন। ওমাগো , ! ইশশ, ও বাবাগো, ! 

– দিতাছে দিতাছে রে, ! আইজ মাইয়াডারে দিতাছে , ! কান পাইতা আরেকটু হুনি। দুইডা মিল্লা একটারে, ! আয় হায় হায়, ! (বাইরে থাকা মহিলাটা কান পাতে দরজায়। আর শুনতে থাকে সুখ চিৎকার গুলো। আর মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। 

 

২০ মিনিট পর,

 

ঘরের দরজার ‌ওপাস থেকে শব্দ করে আফরিন বলে। 

– আফা, দরজা খুইলা দেন। আমাগো হইয়া গেছে। 

– হায় হায় এতো তাড়াতাড়ি , ! বুইড়ায় খালি মুখে মুখে তেজ দেহাইছে। কামের বেলায় ১৫-২০ মিনিটেই শ্যাষ।

– আফা,! আছেন না নাই , ? চাচা ভাতিজা দুইডারই তেল শ্যাষ। দরজা খুইলা দেন আমি সর্দারর্নিরে যাইয়া বাকি ৫ হাজার টাহা দিয়া আহি। 

– খারা খুলতাছি। 

বাইরে থাকা মহিলাটা দরজা খুলে দেয়। দেখে আফরিন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি অগোছালো। মাথার চুল গুলোও অগোছালো। মহিলাটা বলে। 

– কিরে। মজা তো মনে হয় ভালাই পাইছোস। তোর চিৎকার শুইনা মন ডা কইতাছিলো আমিও যাইয়া তোর লগে যোগ দেই। বুইড়ার দম আছে কইতে হইবো।

– হ। এহন আমারে কন সর্দারনির ঘর ডা কোনদিকে। আমি যাইয়া বাকি ৫ হাজার টাহা হের ধারে দিয়া আহি। 

– এই গলি ধইরা চইলা যাবি। একদম শ্যাষ মাথায় একটা পাকা রুম আছে। হেইডাই সর্দার্নির রুম। যাইয়া সালাম দিবি কিন্তু আগে। 

– আইচ্ছা। (এক মলিন গলায় বলেই চলে যেতে থাকলো সেদিকে। তখনই ঘর থেকে বের হলো দুই শাড়ি পড়া মেয়ে। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। হঠাৎ ভিতর থেকে দুইজন মেয়ে বের হতে দেখে মহিলাটা ভয় পেয়ে বলতে লাগলো।

– এই, তোমরা কেরা। ভিতরে তো আমরা একটা মাইয়া দিয়া আইছিলাম। আরো দুইডা আইলো কইত্তে , ? এই তোমাগো নাম কী , ? 

তখনই শাহারিয়া তার ঘোমটা উঠিয়ে মেয়েলি বলে। 

– আমার নাম চুমকি খাতুন। ভালোবাইসা মাইনষে আমারে চুমকি চামেলি কইয়া ডাকে। উম্মাহ  , ! (বলেই একটা ফ্লাইং কিস দেয় সেই মহিলাটাকে। মহিলাটা চিনতে পেরে যায় যে এটা সেই চাচাই। সে আর কিছু বলতেই যাবে শাহারিয়াকে তখনই শাড়ি পড়া আহনাফ একটা রুমাল দিয়ে মহিলার মুখ চেপে ধরে। মহিলাটা অজ্ঞান হয়ে যায়। আহনাফ মহিলাটাকে সেখানেই গলিতে শুইয়ে দেয়। শাহারিয়া আহনাফকে ইশারা দিয়ে ঘোমটা টেনে নিতে বলে। আহনাফ টেনে নেয়। শাহারিয়া আর আহনাফ জোরে জোরে পা চালিয়ে গলি দিয়ে ছুটে যেতে থাকে আফরিনের পিছু পিছু। কিছুদূর সামনেই আফরিনকে দেখা যাচ্ছে। আফরিন থেমে পিছন ফিরে তাকায়। দেখে শাহারিয়া আর আহনাফ আসছে। আবার সামনে ফিরে এগিয়ে যেতে থাকে। চারপাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের সুখ চিৎকার। ঘড়িতে রাত ১০ টার মতো বাজে। আর এই সময় সব পতিতারা তাদের কাস্টমার নিয়ে বিজি থাকে। তাতে শাহারিয়াদেরও বেশ সুবিধা হচ্ছে। সবকিছু প্ল্যান মোতাবেক এগোচ্ছে।‌ তারা তাড়াতাড়ি হেঁটে হেঁটে আফরিনের পিছু পিছু যেতে থাকে। 

পতিতা পল্লীর শেষ প্রান্ত। এইখান থেকে একটা গেট আছে বাইরে বের হওয়ার। আর গেইটের সাথে লাগানো বাড়িটাই এই পতিতালয়ের সর্দার্নির রুম। রুম টা পাকা করা। আফরিন এসে রুমের সামনে দাঁড়ায়। শাহারিয়া আর আহনাফ এসে দাঁড়ায় তার পিছনে। তার কানে কানে কিছু একটা বলে। আফরিন মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। আফরিন আর শাহারিয়া ভিতরে ঢুকে যায়। আর আহনাফ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে‌। 

 

ভিতরে ফ্লোরে একটা তোশক বিছানো। তার উপর দুই পাশে দুইটা কোল বালিশ রাখা। মাঝখানে বসে আছে একজন মোটা মহিলা। মুখে পান চিবাচ্ছেন। গলায় অনেক পুঁথির মালা। সর্দারনি তার আসন থেকে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে হেঁটে গিয়ে আলমারি খুলে। আলমারি থেকে একটা টাকার বান্ডিল বের করে। বিরবির করে একলা একলা বলতে থাকে। 

– এই মাইসে মেলা টাকা আইছে। এইডিরে ব্যাংকে রাইখা দিয়া আইতে হইবো। এইহানে রাহা ঠিক হইবো না। 

তখন রুমের দরজায় কড়া নেড়ে আফরিন বলে। 

– আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাডাম। এক আফায় আপনেরে টাকাডি দিয়া যাইতে কইছে। 

সর্দারনি টাকার বান্ডিল টা আলমারির ভিতরে ঢুকিয়ে আলমারির দরজা লাগিয়ে দেয়। দিয়ে এসে বসার আসনের পাশে দাঁড়ায়। বলে। 

– আয় ভিতরে আয়। 

আফরিন ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু শাহারিয়া তখনও দরজার পর্দার আড়ালে এমন ভাবে দাড়িয়ে আছে যাতে সর্দারনি তার উপস্থিতি টের না পায়। আফরিন এসে ঘরের মাঝখান টায় দাঁড়ায় সর্দারনির সামনে। শাড়ির কোমরের ভাঁজ থেকে টাকা টা বের করে সর্দারনির হাতে দেয়। সর্দারনি টাকাটা হাতে নেয়। সব একশ টাকার নোট তাই হাতের আঙ্গুলে মুখের থুথু লাগিয়ে টাকা গুলা গুনতে থাকে। আফরিন সর্দারনির সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সর্দারনি টাকা গুলা গুনতে গুনতে বলে। 

– আইজকা তুই নয়া আইছোস না ,? 

– হ ম্যাডাম (মলিন গলায়) 

– কেমন লাগলো , ? প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতে পারে। আস্তে আস্তে ঠিক হইয়া যাইবো। (একটু থেমে) বাকি টাকাডি উর্মির ধারে আছে তাইনা , ? 

– ম্যাডাম উর্মি কেডা। আমি তো তারে চিনি না। 

– ঐযে যারে তোর কাস্টমারের ১০ হাজার দেওয়ার কথা আছিলো ,! অরি নাম উর্মি। 

 

তখনই আফরিন হাত দিয়ে শাহারিয়াকে ভিতরে আসার ইশারা দেয়। আর তখনই শাহারিয়া চোখের পলকে দৌড়ে ঘরের ভিতরে এক লাফ দিয়ে গড়িয়ে হাটু গেড়ে বসে বন্দুক তাক করে ধরে সর্দারনির উপরে। সর্দারনি এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সে ভয় পেয়ে যায়। আফরিন পিছিয়ে যেতে থাকে দরজার দিকে। শাহারিয়া বন্দুক তাক করে ধরে বলে। 

– ইউ আর আন্ডার এরেষ্ট। নিজেকে আমাদের হাতে তুলে দিন। 

– এই রাহেলারে ধরা, এতো সহজ না,!

 বলেই দরজার দিকে দৌড়ে যেতে থাকেন তখনই আফরিন তার কোমরের ভাঁজ থেকে বন্দুক বের করে তার কপাল বরাবর টার্গেট করে ধরে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছিলো না যে সে প্রথম বন্দূক হাতে নিয়েছে। একদম স্ট্রেইট সর্দারনির মাথা বরাবর বন্দুক ধরেছে সে। সর্দারিন তার দুই হাত উপরে তুলে নেয়। আড়চোখে পিছনে শাহারিয়ার পজিশন দেখতে থাকে। আবার সামনে ফিরে আফরিন কে দেখতে থাকে। দেখে আফরিনের হাত কাঁপছে। সে বুঝতে পেরে যায় যে আফরিন ভয় পাচ্ছে। সাথে সাথেই সে হেলে বসে পড়ে আফরিনের পা দুটো ধরে তাকে দরজার সামনে থেকে ফেলে দেয়। আফরিন হঠাৎ আঘাতে কিছু বুঝতে না পেরে পড়ে যায়। আর তৎক্ষণাৎ দরজা দিয়ে বের যায় সর্দারনি। শাহারিয়া চিৎকার করে তার দিকে গুলি ছোড়ে। কিন্তু গুলি দরজায় গিয়ে লাগে। শাহারিয়া তাড়াতাড়ি এসে আফরিনকে ধরে উঠে দাড় করায় আর দৌড়ে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। 

সর্দারনি দরজা দিয়ে নেমেই দেখে আহনাফ তার দিকে বন্দুক তাক করে আছে। সে সাথে সাথে দরজার সাইডে রাখা একটা পানির বালতি জোড়ে চোখের পলকেই ছুড়ে মারে আহনাফের দিকে। আহনাফের হাতে এসে বালতিটা লাগে আর বন্দুক পড়ে যায়। সর্দারনি দৌড়ে বাইরে যাওয়ার গেইট দিয়ে পতিতা পল্লী থেকে বের হয়ে গলির রোড দিয়ে দৌড়াতে থাকে। শাহারিয়া আর আফরিন ঘরের দরজা থেকে বের হয়। ততক্ষণে আহনাফ তার বন্দুক মাটি থেকে উঠিয়েছে। তারাও গেইট দিয়ে বের হয়ে দৌড় দিতে থাকে সর্দারনির পিছু পিছু। তাদের কাছে গুলি চালানোর অর্ডার নেই। তাই সরাসরি তাকে গুলিও চালাতে পারছেনা। সর্দারনি প্রাণপণে ছুটছে। তার কিছুটা দূরে দৌড়ে আসছে শাহারিয়া, আফরিন আর আহনাফ। সামনেই গলির রোডের ৪ রাস্তার মোড়। শাহারিয়ারা দৌড়ে আসছে পূর্বের রাস্তাটা দিয়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে শাহারিয়া তার বন্দুক তাক করতে থাকে সর্দারনির পা বরাবর। গুলি চালাতে যাবেই তখনই চার রাস্তার মাঝখানে সর্দারনি পৌঁছে যায়। আর একটা নীল মাইক্রো দক্ষিণের রাস্তাটা থেকে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। সর্দারনি মাইক্রোটা দেখে ভয়ে আবার শাহারিয়াদের দিকেই ছুটে আসতে যাবে তখনই মাইক্রো থেকে ৪-৫ জন নেমে সর্দারনির মুখ চেপে ধরে মাইক্রোতে উঠিয়ে নেয়। যেন চোখের পলকেই সব ঘটে গেলো। মাইক্রো টা চলে যেতে ধরে তখনই আহনাফ চিৎকার দিয়ে থামতে বলে আর মাইক্রোর চাকা বরাবর নিশানা ঠিক করে। গুলির ট্রিগার যেই চাপ দিতে যাবে তখনই তার উপর শাহারিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। অনেক গতিতে দৌড়াতে থাকায় দুইজনেই পিচ ঢালাই করা রাস্তায় একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়ে ছিটকে যায়। মাইক্রো টা চলে যায় উত্তরের রাস্তাটা দিয়ে। আহনাফ বিরক্তির সাথে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। 

– স্যার আপনি এইটা কী করলেন, ! 

– সরি, সরি। আমিও চাকায় নিশানা ঠিক করতেছিলাম তাই তোমাকে আর লক্ষ্য করিনি আর তোমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছি।

– ড্যাম ইট,! হাতের নাগালে এসেও হাত থেকে বেড়িয়ে গেলো,! 

আফরিন ছুটতে ছুটতে তাদের কাছে এসে থামে। এক হাতে বন্দুক তার। সে হেলে হাঁটতে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে।

– পা, পালায় গেলো কেমনে , ! 

– একটা মাইক্রো আসলো। আর উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলো। শিট, ! 

– ভাইয়া , আপনার তো হাত ছিল্লা গ্যাছে , ! ইশশ (শাহারিয়ার হাত টা ধরতে ধরতে আফরিন বলে। আহনাফও শাহারিয়ার দিকে ফিরে তাকায়। দেখে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে যাওয়াতে হাতের অনেক অংশ ছিলে গিয়েছে। আহনাফ হাত টা ‌ধরে বলতে থাকে। 

– স্যার, ! ইশশ, ! রক্ত বের হচ্ছে তো , ! 

শাহারিয়া উঠে দাঁড়াতে থাকে। আহনাফ আর আফরিন তাকে ধরে, উঠতে সাহায্য করে। শাহারিয়া উঠে দাঁড়ায়। হাতের অনেক অংশ ছিলে গিয়েছে আর বালি লেগে আছে। শাহারিয়া বলে। 

– ঐযে ঐদিকে একটা এপার্টমেন্টের কল দেখা যাচ্ছে। আমি হাত টা ধুয়ে আসি। বালি গুলা আরো জালাচ্ছে যায়গাটাকে। 

– আচ্ছা স্যার। যান। 

– তোমার হাতের কোথায় ছিলে গেছে নাকি , ? 

– না স্যার। আমি তেমন একটাই ব্যাথা পাইনি।

– আচ্ছা তোমরা এখানেই থাকো। আমি হাতটা ধুয়ে আসছি। উফফ। শীতের দিনে এসব ,!

শাহারিয়া চলে যেতে থাকে সেই কল টার দিকে হাত ধুতে। 

 

মাইক্রো এর ভিতরে। 

সামনে একজন মাইক্রো টা চালাচ্ছে। তার পাশের সিটে একজন বসে আছে। ‍আর পিছনে ৪-৫ জন সেই সর্দারনিকে ধরে রেখেছে। একজন একটা রুমালে কিছু একটা মিশিয়ে সেই সর্দারনির মুখের সামনে ধরে। আর সর্দারনি সাথে সাথেই বেহুঁশ হয়ে যায়। তখনই ড্রাইভারের পাশের সিটে যেই লোকটা বসে ছিলো তার ফোন বাজতে থাকে। সে কল উঠায়। ওপাস থেকে একটা ভারি গলা ভেসে আসতে থাকে। মাইক্রোর লোকটি বলে। 

– আসসালামুয়ালাইকুম রন্জু স্যার। ( তারপর ওপাশের লোকের কথা) হ্যা স্যার। সর্দারনিরে আমাদের দায়িত্বে নিয়ে নিছি। পিছন পিছন কারা যেনো সর্দারনিরে ধাওয়া করছিলো। কিন্তু তাদের ধরার আগেই আমরা সর্দারনিরে নিয়ে নিছি। ( তারপর ওপাশের লোকের কথা) হ্যা স্যার অজ্ঞান করে ফেলেছি। ( তারপর ওপাশের লোকের কথা) আচ্ছা স্যার, এখনি আমাদের আস্তানায় তাকে নিয়ে যাচ্ছি। ( তারপর ওপাসের লোকের কথা) ওকে স্যার ওকে, রাখি স্যার। আসসালামুয়ালাইকুম।

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নেয় মাইক্রোর লোকটা। ড্রাইভারকে বলতে থাকে। 

– ফুল স্পিডে চলো। আমাদের তাড়াতাড়ি ‌আস্তানায় যেতে বলছে স্যার।

– ওকে বস, 

বলেই ড্রাইভার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়। গাড়ি সজোরে চলে যেতে থাকে ঢাকার মেইন রোডের মাঝ দিয়ে। 

 

এদিকে শাহারিয়া হাত ধুতে যাওয়ায় আহনাফ আর আফরিন একলা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আফরিনের হাতে হঠাৎ রক্ত দেখতে পায় আহনাফ। সে সাথে সাথেই আফরিনের হাত ধরে বলে। 

– তোমার হাত কীভাবে কাটলো , ! ইশশ তোমারো কত রক্ত বের হচ্ছে , ! ব্যাথা করছেনা , ? (বলেই আহনাফ আফরিনের চোখের দিকে তাকায়। আফরিন এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ও আহনাফের মধ্যে ওর নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। আহনাফ ‌ওর‌ চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলে। 

– হ্যালো, ! কী দেখছো এভাবে , ! 

আফরিনের যেন ঘোর ভাঙে। আফরিন বলে কিছু না। আর সাথে সাথেই আহনাফের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। আহনাফ আবার আফরিনের হাত ধরে বলে। 

– ব্যাথা করছেনা এখানে , ? রক্তও তো বেড়িয়েছে অনেক টা। দাঁড়াও আমি রক্ত টা মুছে দিচ্ছি। 

বলেই শাড়ীর ভিতরে পরে থাকা শার্টের পকেট থেকে তার রুমাল বের করে। আস্তে আস্তে করে আফরিনের হাতের রক্ত টুকু মুছে দিতে থাকে। আফরিন এক পলকে চেয়ে থাকে আহনাফের দিকে। আহনাফ খুব যত্ন করে রক্তের যায়গাটার রক্ত মুছে সেখানে তার রুমাল টা বেঁধে দেয়। যাতে আর রক্ত না বের হয়। তারপর আফরিনের দিকে তাকায়। আফরিন‌ নিজের নজর নামিয়ে নেয়। আহনাফ তার কাঁধের ঝোলা‌ ব্যাগ থেকে একটা জ্যাকেট সোয়েটার বের করে আফরিনকে দেয়। বলে।

– এখন এটা পড়ে নাও। নাহলে ঠান্ডা লেখে যাবে। আর (একটু থেমে অন্যদিকে তাকিয়ে) তোমার শাড়িটাও ঠিক ঠাক নেই। খারাপ দেখাচ্ছে। 

আফরিন কিছুই বলে না। ও ওর মাথা নিচু করে আছে। আহনাফ বলে। 

– ও তোমার তো হাতে ব্যাথা। দাঁড়াও আমি জ্যাকেট টা তোমাকে আস্তে আস্তে পড়িয়ে দিচ্ছি। 

আহনাফ জ্যাকেটের চেইন খুলে আফরিন কে পড়িয়ে দিতে থাকে। আফরিন হাত বাড়ায়। আহনাফ ভালো ভাবে পড়িয়ে দেয়। পড়িয়ে দিতে দিতে আহনাফ বলে। 

– তুমি তো আমাদের সাথে পড়ে যাও নি। তাইলে হাত কাটলো কীভাবে , ! 

আফরিন এক মলিন গলায় বলে

– ঘরে সর্দারনি যখন আমাকে ফেলে দিয়েছিলো, তখন দরজার সাইডে লাগানো একটা মরচে ধরা পেরেকে হাত টা লেগে কেটে যায়। 

– মরিচা ধরা জিনিস দিয়ে কেটেছে , ! তাইলে তো ইনফেকশন হতে পারে। তোমার হাতে ভালো করে ডাক্তারের দাঁড়া ওয়াশ করে ব্যান্ডেজ করে নিতে হবে। 

আফরিন ধীরে ধীরে তার মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। আহনাফ একটা মুচকি হাসি দেয় আফরিনের এমন বাধ্যের মতো মাথা নাড়ানো দেখে। সেই মুচকি হাসি টা আর আফরিন দেখতে পায়নি মাথা নিচু করে থাকার কারণে। 

শাহারিয়া হেঁটে হেঁটে তাদের দিকেই আসতে থাকে। দূরের ট্যাপের কলে হাত ধুয়ে হাত ঝাড়াতে ঝাড়াতে আসছে। এখন আরো বেশি জ্বলছে হাত টা। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব জন্ত্রনা হচ্ছে। এমনিতেই শীতের সময়। তারউপর এমন কাটা-ছিড়াঁ। 

শাহারিয়া চলে আসে। আহনাফ তাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শাহারিয়া হাত টা জোরে জোরে নাড়াতে নাড়াতে বলে। 

– ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বলো আমাদের গাড়িটাকে এখানে নিয়ে আসতে। ড্রেসিং করাইতে হবে আমার। খুব জ্বলতেছে। ট্যাপের পানি মনে হয় ময়লা ছিলো। এইজন্য কাঁটা টা ধরছে খুব, ! 

– আচ্ছা স্যার আমি এখনি ফোন দিচ্ছি। 

– আর শোনো।

– জ্বী স্যার , ! 

– অফিসে ফোন করে পুলিশ পাঠাতে বলো। পুরো পতিতালয়ের সবাইকে ধরে যেন জেলে পুরে দেয়। আর মেয়ে কনস্টেবল সহ আসতে বলবে ওদের। 

– ওকে স‌্যার।

আহনাফ ফোন দিতে থাকে সেদিকে। শাহারিয়া হাত নাড়াতে নাড়াতে দেখে আফরিন মাথা ‌নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে‌। আর তার হাতে রুমাল দিয়ে বাঁধা। শাহারিয়া বলে। 

– তোমার হাতও কাঁটা গেছে নাকি ,! তোমাকেও ডাক্তারের কাছ থেকে ড্রেসিং করিয়ে নিবো। 

আফরিন মাথা নেড়ে বলে। 

– আচ্ছা। 

– তোমাদের বাসা কোথায় , ? আর তোমার মায়ের কী হয়েছে ? তখন যে বলছিলে , ! 

আফরিন এক মলিন মুখ করে শাহারিয়ার দিকে একবার তাকায়। তারপর আবার মাথা নিচু করে ম্লান গলায় বলে।

– আমার মায়ের ক্যান্স্যার হইছে ,! ডাক্তারের ধারে চিকিৎসা করাইতে পারিনাই টাকা না থাহার কারণে , ! আইজ কাজ খুজার লাইগা বাইর হইছিলাম। আর তারপর (একটু থেমে) ওরা আমারে ধইরা লইয়া আইলো , ! 

– আচ্ছা মন খারাপ করিও না। তোমার মায়ের চিকিৎসার দিকটা আমি দেখবো। তোমাদের বাসা কোথায় ,? 

– আমাগো বাসা মিরপুরের অলিমিয়ার টেক বস্তিতে। (একটু থেমে) সেইহানেই আমরা থাহি ,! 

– ওহহ, আচ্ছা সমস্যা নাই আমি তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসবো। (একটু থেমে ধীর গলায়) খিদা লাগছে তোমার , ? 

 

আফরিন মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। কিছু বলে না।

– আরে আমি তোমার বড় ভাইয়ের মতো। চলো আমি তোমার হাতের ড্রেসিং করিয়ে তোমার আর তোমার মায়ের জন্য খাবার দিয়ে দিচ্ছি। আর কাল তোমার মা’কে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনবো। ঠিক আছে , ! 

আফরিন মুখ তুলে তাকায়। তার চোখ গুলো ছলছল করছে। যেন একটু হলেই ও কেঁদে ফেলবে। দেখতে একদম ছোটদের মতো কিউট সে। মসৃণ মলিন চেহারায় ছল ছল চোখ নিয়ে শাহারিয়ার দিকে তাকানোয় শাহারিয়া একটু অবাকই হয় প্রথমে। তারপর একটা স্মাইলি ফেইস নিয়ে তাকে বলে।

– কান্না করিও না। তোমার মায়ের কিচ্ছু হবে না। তোমার এই ভাইটা তো আছেই। তাইনা। একদম কাদিও না। 

বলেই আফরিনের কাঁধে হাত রেখে তাকে স্বাভাবিক করতে থাকে শাহারিয়া।

আহনাফ কথা বলা শেষ করে চলে আসে। তাদের গাড়িও চলে আসে চার রাস্তার মোড়ের দক্ষিণ পাশ‌ দিয়ে। তারা এতোক্ষণ এই মোরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তারা একে একে প্রাইভেট কারে উঠে পড়ে। দরজা লাগিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই গাড়ি চলতে শুরু করে। এবং চলে যেতে থাকে উত্তরের রাস্তাটা দিয়ে। কুয়াশা পড়েছে কিছুটা। সেই কুয়াশার মাঝে গাড়িটা যেন এক প্রকার হারিয়েই গেলো , ! 

 

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দক্ষিণের রাস্তাটা দিয়ে ৩ টা নীল রঙের মাইক্রো এসে একে একে পূর্বের রাস্তাটা মানে যেদিক থেকে শাহারিয়ারা দৌড়ে এসেছিলো , সেই পতিতাপল্লি যাওয়ার রাস্তা, সেই রাস্তায় চলে যায়। এবং আবার চৌরাস্তার গলির মধ্যে নেমে আসে নিরবতা আর কুয়াশার চাদর। 

 

 

খাঁন বাড়ি। সাথীদের রুম। রাত হয়েছে বেশ। এখনো ঘরে আসেনি সাথীর স্বামী সাহেদ। সাথী বেগম বিছানায় বসে খোলা জানালা দিয়ে এক পানে চেয়ে আছে বাইরে। আকাশ পরিষ্কার। দূরের আকাশের তারাকারাজি দের বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। সেই দিকেই এক দৃষ্টে চেয়ে আছেন তিনি। রাত সাড়ে দশটা বাজে। সেই যে শাহেদ আর নজরুল সাহেব গল্পে বসেছেন আর কোন নাম গন্ধ নেই ঘরে আসার। সাথী বেগম সারাদিন টা একলা থাকেন। রাত টা তার স্বামীর ছায়ায় কাটাবেন তাও যেন এখন দিবাস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাথী এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দে তার ঘোর ভাঙ্গে। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখেন শাহেদ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। বিছানা আগে ভাগেই রেডি করে রেখেছিলেন সাথী। শাহেদ তার উপরের শার্ট টা খুলে আলনায় রাখলেন। সাথী এসে তার শোয়ার জায়গার চাদর টা একটু টেনে দিতে লাগলেন। শাহেদ শার্ট খুলে লাইটের সুইচের কাছে গিয়ে বলে। 

– লাইট অফ করে দেই , ? 

– লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমাবা নাকি। বন্ধ করে দাও। 

শাহেদ লাইট অফ করে দিলেন। এসে বিছানায় বসে পা মুছনিতে পা মুছে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লেন। সাথী জানালা লাগিয়ে দিতে থাকেন।

– জানালা লাগাচ্ছো কেনো ,! থাকনা খোলা। বাইরে আজ জোছনা পড়েছে সুন্দর,! 

– সব মশা ঘরে ঢুকবে তখন। আজ সারাদিন বৃষ্টি হইছিলো না। যেখানে সেখানে পানি জমে আছে। আজকে মশার উপদ্রব বাড়বে। 

বলেই জানালার কপাট টা লাগিয়ে দেন সাথী। শাহেদের গায়ের উপর ভালো ভাবে কম্বল টা টেনে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়েন। শাহেদের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে কম্বল ভালোভাবে ঢাকা নিয়ে নেন। শাহেদ বলেন।

– তোমার ব্যাথা টা কেমন এখন ? কমতেছে না আগের মতোই। 

সাথী বেগম কম্বলের ভিতরে শাহেদকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে বলেন।

– আগের ‌থেকে কম। (একটু থেমে মলিন গলায়) তুমি সারাদিন কী নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকো , ?  আমি সবসময় একা ঘরে থাকি। একদম ভালো লাগেনা আমার, ! 

– আমাদের বিজনেসের অবস্থা ইদানিং খারাপ যাচ্ছে একটু। কয়দিন আগে আমাদের ফিডের ২ টা ট্রাক দুর্ঘটনায় পড়লো, বাজারে অন্যান্য কম্পানিদের থেকে মার্কেট শেয়ারে আমরা পিছিয়ে পড়তেছি। সবমিলায় ভাইজানের মাথার অবস্থা ঠিক নাই। তার উপরে রায়হান আবার বাহানা ধরছে বিয়ের। কালকে মনে হয় সম্মন্ধ নিয়ে যাবে ভাইয়া। 

– হ্যা। (একটু থেমে) জানো আমার না ইচ্ছা করে তোমার সাথে হাতে হাত ধরে ঘুরতে যেতে, কলেজের দিন গুলোয় আমাকে যেভাবে কবিতা পড়ে শুনাতে সেই রকম করে কবিতা শুনতে। (শাহেদকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে) তোমার উষ্ণ শীতল ভালোবাসা পেতে। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গ দাওনা। 

– এই দেখো কী বলে পাগলীটা। আমাদের ছেলের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কয়দিন পর তুমি তোমার ছেলের বউয়ের শাশুড়ি হবে। এখন কী আমাদের আর সেইসব দিন আছে ,! 

– দিনকাল যাচ্ছে যাক। আর আমি কী বুড়ি হয়ে গেছি নাকি, ! (ধীর গলায় বলেন সাথী)

– তুমি আমার চিরঞ্জীব সঙ্গী। এই গ্রামে তুমি আর ঐ মেম্বারের বউ আছেনা , ? ও। তোমরা দুইজনের বয়স যতই হোক না কেনো লোকজন কেউ বলবে না যে তোমাদের ছেলে মেয়ের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। উল্টো আরো বলবে ভাবি, আপনার বাচ্চা কোন ক্লাসে পড়ে, 3 না 4 , হিহিহি।

– যাও,! তোমার খালি যতসব ঢং, ! 

– ঢং না সত্যি বলছি, ! (সাথীকে আলিঙ্গন করে তার মাথা নিজের বুকের উপর রেখে) তুমি কলেজের দিন গুলোতে যেমনটা সুন্দরী ‌ছিলে , ! আজো ঠিক তেমনটাই আছো। আর এমনটাই থেকো সবসময়। 

সাথীর কপালে একটা ছোট্ট চুম্বন এঁকে দেন শাহেদ। বয়স তাদের হয়েছে বেশ, তবে তাদের মাঝে টান এখনো ঠিক সেই প্রথম দিনের মতোই রয়ে গেছে। শুধু হঠাৎ সাথীর পিঠের মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ায় ৪ মাস থেকে তাকে সম্পূর্ণ ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। তবুও শাহেদ দিনে না পারলেও রাতে তাকে যথেষ্ট সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করেন। রাতের তন্দ্রায় রাজা এসে ঠিকই রাণির মন বাগানের ফুলের সমারোহ এ ফুল তুরে বেড়ায়। আর ডানা মেলে দুই পাখির মতো এক ডুবন্ত সূর্যের আকাশে,! 

সাথী শাহেদের বুকে মাথা রেখে যেন এক আলাদা প্রশান্তি পেয়েছে। চোখ দুটো লেগে আসতে থাকে তার। শাহদের পরম উষ্ণতায় ভরা আলিঙ্গন তাকে এনে দেয় এক মুঠো রঙিন স্বপ্ন, আহ্বান দিতে থাকে এক ঘুমের রাজ্যের রানী হবার , !  সাথী চোখ বুজে ফেলেন। হঠাৎ এক চিৎকার চেঁচামেচিতে তার ঘোর ভাঙ্গে। তিনি চোখ খুলেন। চিৎকার টা আসছে সুরাইয়া বেগমের ঘরের দিক থেকে। হঠাৎ কোন কাঁচের কিছু ভাঙ্গার শব্দ। আর তারপর আলিশার গগন বিদারি “মা,” বলে চিৎকার দিয়ে কান্না। 

 

চলবে ,,,,,

 

  

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৩৯

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– যাও,! তোমার খালি যতসব ঢং, ! 

– ঢং না সত্যি বলছি, ! (সাথীকে আলিঙ্গন করে তার মাথা নিজের বুকের উপর রেখে) তুমি কলেজের দিন গুলোতে যেমনটা সুন্দরী ‌ছিলে , ! আজো ঠিক তেমনটাই আছো। আর এমনটাই থেকো সবসময়। 

সাথীর কপালে একটা ছোট্ট চুম্বন এঁকে দেন শাহেদ। বয়স তাদের হয়েছে বেশ, তবে তাদের মাঝে টান এখনো ঠিক সেই প্রথম দিনের মতোই রয়ে গেছে। শুধু হঠাৎ সাথীর পিঠের মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ায় ৪ মাস থেকে তাকে সম্পূর্ণ ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। তবুও শাহেদ দিনে না পারলেও রাতে তাকে যথেষ্ট সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করেন। রাতের তন্দ্রায় রাজা এসে ঠিকই রাণির মন বাগানের ফুলের সমারোহ এ ফুল তুরে বেড়ায়। আর ডানা মেলে দুই পাখির মতো এক ডুবন্ত সূর্যের আকাশে,! 

সাথী শাহেদের বুকে মাথা রেখে যেন এক আলাদা প্রশান্তি পেয়েছে। চোখ দুটো লেগে আসতে থাকে তার। শাহদের পরম উষ্ণতায় ভরা আলিঙ্গন তাকে এনে দেয় এক মুঠো রঙিন স্বপ্ন, আহ্বান দিতে থাকে এক ঘুমের রাজ্যের রানী হবার , !  সাথী চোখ বুজে ফেলেন। হঠাৎ এক চিৎকার চেঁচামেচিতে তার ঘোর ভাঙ্গে। তিনি চোখ খুলেন। চিৎকার টা আসছে সুরাইয়া বেগমের ঘরের দিক থেকে। হঠাৎ কোন কাঁচের কিছু ভাঙ্গার শব্দ। আর তারপর আলিশার গগন বিদারি “মা,” বলে চিৎকার দিয়ে কান্না। সাথী শাহেদের বুকের উপর থেকে মাথা উঠান। 

– এই, আলিশাদের ঘরে কি যানি হইছে , ! উঠোতো। 

– কই। (একটু থেমে কান পেতে শুনে) ও হ্যা আসলেই। এতো রাতে আবার সুরাইয়া কী শুরু করলো। চলোতো

 

আলিশাদের রুম। নিচের ফ্লোরে পড়ে আছে ছোট ছোট অসংখ্য ভাঙা কাঁচের টুকরো। আর বিছানার ঠিক সামনে সুরাইয়া বেগম একটা ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরো দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। আলিশা তার মায়ের হাত দুটো ধরে তাকে আটকাচ্ছে। মা বলে চিৎকার করছে, কাঁদছে। সুরাইয়া বেগম জোর দেখিয়ে আলিশাকে ধাক্কা দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননা। ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান সাথী, শাহেদ আর তাদের ছেলে সাদিক। ঘরের দরজা দিয়ে সুরাইয়া বেগমের এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে যান শাহেদ আর সাদিক। কাঁচের সাইড দিয়ে গিয়ে সুরাইয়া বেগমকে ধরেন। সাদিক সুরাইয়া বেগমের হাত থেকে ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরো নিয়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। সুরাইয়া বেগম পাগলামি করতে থাকেন। বলতে থাকেন।

– কাঁচ টা ফালায়া দিলি ক্যা। আমারে মরতে দে। আমি মরতে চাই। আমার এই দুনিয়ায় থাকার আর কোন ইচ্ছা নাই। আমারে মরতে দে। 

– মা কে বাঁচাও মামা। মা মরে যাবে । মা কে বাঁচাও। (বলতে বলতে খুব কাঁদতে থাকে আলিশা। আলিশা বিছানার সাইডের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। 

– তোর হইলো টা কী। মাঝে মাঝে তোর এমন মির্গি রোগ কেন উঠে সু্রাইয়া,! শান্ত হ তুই। শান্ত হ। (শাহেদ)

– আমারে মরতে দাও ভাইয়া। আমি তিলে তিলে না মইরা একবারে মরতে চাই। আমার আর যন্ত্রনা সহ্য হয়না। সহ্য হয়না। (বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সুরাইয়া বেগম। শাহেদ তাকে খাটের উপর বসিয়ে দেন। সাথী ভিতরে আসতেই যাবেন তখনই দেখেন করিডোর দিয়ে হেঁটে এদিকেই আসছে নজরুল, সুমনা আর তাদের ছেলে রায়হান। তারা তিনজনই এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভিতরে তাকিয়ে দেখে ঘরের অবস্থা। রায়হান কাঁচের সাইড দিয়ে গিয়ে কাঁদতে থাকা আলিশার পাশে দাঁড়ায়। আলিশা কাঁদতে কাঁদতে রায়হানের কোমড় জড়িয়ে ধরে। রায়হান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে শান্ত করতে থাকে। বলতে থাকে।

– কিচ্ছু হয়নি বনু। তুই কাদিস না। কিচ্ছু হয়নি। 

আলিশা কোন উত্তর দেয়না। সে কাদতেই থাকে। তখনই নজরুল সাহেব দরজার বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে সুরাইয়াকে একবার দেখে আলিশার দিকে ফিরে বলে। 

– তোর মা রাতের ঔষধ গুলা খাইছিলো ? 

– ন,না মামা। ঐগুলা খাওয়াইতে গিয়েই তো এমন করা শুরু করলো মা। (ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আলিশা বলে)

নজরুল সাহেব ঘরে ঢুকতে চান। কিন্তু ফ্লোরে থাকা কাঁচের টুকরো গুলোর জন্য ভিতরে যান না তিনি। তিনি করিডোরের দিকে মুখ করে আঁখি কে হাঁক দিয়ে ডাকতে থাকেন।

– আঁখি,! এই আখি , ! তাড়াতাড়ি একটা ঝাড়ু আর বেলচা নিয়ে আয়। 

নজরুল সাহেবের হাক দেওয়া মাত্রই আঁখি দৌড়ে এসে উপস্থিত হয় দরজার সামনে। 

– ঘরের কাচ গুলো ঝাড়ু দিয়ে সাইড কর। 

– জ্বী খালু জান। এহনি করতাছি। 

বলে ভিতরে ঢুকে দরজা থেকে বিছানা যাওয়ার জায়গার কাঁচ গুলো ঝাড়ু দিয়ে সড়িয়ে নেয় আঁখি। নজরুল সাহেব ভিতরে ঢুকেন। সুরাইয়া বেগমের দিকে এক বিরক্তি সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আলিশাকে বলতে থাকেন।

– ঔষধ গুলা কোথায় , ? 

– ও,ঐ ডেসিন টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আছে,! (ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আলিশা বলে) 

নজরুল সাহেব ডেসিন টেবিলের ড্রয়ার খুলে ঔষধের বক্সটা বের করতে থাকেন। সুরাইয়া বেগম আরো ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছেন তা দেখে। সাদিক আর শাহেদ শক্ত করে ধরে রয়েছেন তাকে। সুরাইয়া বেগম চিৎকার দিচ্ছেন আর কাঁদছেন। আলিশা তার মায়ের এমন অবস্থা দেখে আরো কান্নায় ভেঙে পড়লো। রায়হান আলিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে শান্ত করতে থাকে। ঘরে এ যেন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। 

নজরুল সাহেব বক্স খুলে ঔষধের পাতা থেকে ঔষধ বের করে পাশের ছোট টেবিলে থাকা একটা কাপে পানি ঢেলে সেটা হাতে আর ঔষধ হাতে এগিয়ে যেতে থাকেন সুরাইয়া বেগমের দিকে। সুরাইয়া বেগম একদম পাগলপ্রায় হয়ে হাত-পা ছুঁড়ছেন। শাহেদ আর সাদিক তাকে শক্ত করে ধরে আছেন। নজরুল সাহেব ঔষধ আর পানির কাপ নিয়ে সুরাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন। 

– তাড়াতাড়ি মুখ খোল। ঔষধ গুলা খায় নে। তাড়াতাড়ি। 

– আমি ঔষধ খামুনা। আমি এই ঔষধ খামু না।

– মুখ হাঁ করতে বলছিনা , ! তুই হা করবি না আমি জোর করায় মুখ চেপে খাওয়াবো। 

– তোর এই ঔষধ তুই খা। থুউউ (বলেই নজরুল সাহেবের মুখে থুথু দিয়ে দেন সুরাইয়া বেগম। আর তৎক্ষণাৎ রেগে গিয়ে পানির কাপ টা আরেক হাতে নিয়ে কষে এক চড় বসিয়ে দেন সুরাইয়ার গালে। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেলো ঘরের কারোরই যেন বোধগম্য হলো না। সবাই আরো কিছু বুঝে ওঠার আগেই নজরুল সাহেব দিকবিদিক না দেখে সুরাইয়া বেগমের মুখে ঘুষি মারতে থাকেন। শাহেদ তৎক্ষণাৎ সুরাইয়াকে ছেড়ে নজরুলকে আটকাতে জান। সুমনাও তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসেন নজরুলকে আটকাতে, সুরাইয়ার ঠোঁট আর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। নজরুল সাহেবের শক্ত হাত দিয়ে হঠাৎ জোরে ঘুষি দেওয়ায় নাক মুখ ফেটে গেছে তার। নজরুল সাহেবের শরীরে যেন দানবের শক্তি দুইজনকে ঠেলে রাগের মাথায় এগিয়ে আসছেন সুরাইয়ার দিকে। সু্রাইয়া হাত দিয়ে মুখের উপর আঘাত প্রতিকারের চেষ্টা করেও পারেন না। আরো জোরে দুইটা ঘুষি লাগে তার চোখের সাইডে। আলিশা চিৎকার দিয়ে উঠে। রায়হান সবল দেহী থাকায় তৎক্ষণাৎ তার বাবাকে ধরে ঠেলে ঘরের দরজার দিকে নিয়ে যায়। আলিশা দৌড়ে গিয়ে তার মায়ের আহত দেহ টা ধরে। 

– কী করতেছো এসব তুমি। থামোওও। ফুফু তো মরে যাবে। 

– ও মরুক। ঐ বান্দির বাচ্চার কত বড় সাহস আমার মুখে থুথু দেয়। ওরে তো আমি, ! 

– থামো, ! কীসব শুরু করছো তুমি হ্যা। ঘরে যাও,। আমি বলতেছি ঘরে যাও । 

নজরুল সাহেবের চোখ লাল হয়ে আছে। তিনি একবার রায়হানের দিকে তাকিয়ে তারপর একবার সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন।

– ঔষধ গুলা যেন খায় নেয়। নাইলে এইবার একদম দাঁ দিয়ে কোপায় ওর ভূত আমি ছাড়ায় দিবো। 

বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সুমনা বেগম, নজরুল সাহেবকে নিয়ে যেতে থাকেন ঘরের বাইরে। রায়হান পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে সুরাইয়া বেগম বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়েছেন। তার পাশে শাহেদ, আলিশা, সাদিক গোল করে বসেছেন। সাথী এতক্ষণ ঘরে ধস্তাধস্তির মধ্যে এগোবার সাহস ‌পাননি। এখন নজরুল সাহেব চলে যাওয়ায় তিনিও আস্তে আস্তে পা ফেলে দেওয়াল ধরে ধরে ভিতরে ঢুকেন। আঁখি সব কাঁচ গুলো বেলচায় উঠিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। 

সুরাইয়া বেগমের নাক, মুখ ফেটে রক্ত পড়ছে। বাম চোখের সাইডে শেষের ২ টা জোরে ঘুষি লাগায় সেই চোখের কোন দিয়েও রক্ত বের হচ্ছে। সুরাইয়া বেগম এখন সেন্সলেস। আলিশা তার মায়ের উপর মাথা রেখে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। নিজের মা’কে এভাবে মার খেতে দেখলে আঘাত পেতে দেখলে প্রত্যেক সন্তানের হ্রদয়ে রক্তক্ষরণ হবে এটাই স্বাভাবিক। রায়হান বিছানায় পাশে থাকা টেবিলের জগটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে হাতে হালকা কিছু পানি নিয়ে সুরাইয়া বেগমের মুখে ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরাতে থাকে। সাথী শাহেদকে তড়িঘড়ি করে বলেন

– আমাদের ঘরে ফার্স্ট এইড বক্সটা যায় নিয়ে আসোতো , ! ইশশ। ভাইজান এতো জোরে কেন মারতে গেলো , ! তাড়াতাড়ি যাও। 

শাহেদ হনহন করে ছুটে চলে যান প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স আনতে। রায়হান পানি ছিটিয়ে দেওয়ায় সুরাইয়া বেগমের জ্ঞান ফিরে আসে। তিনি ডান চোখটা পুরোটা খুলেন কিন্তু বাম চোখ টা আর পুরোটা খুলতে পারেননা। হালকা কিছুটা খুলতে পারেন শুধু। তার চোখ ছলছল করছে। আলিশা সুরাইয়া বেগমের জ্ঞান ফিরতে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরে “মা মা” বলে কাঁদতে থাকে। সুরাইয়া বেগমের ডান চোখ থেকে পানি বেয়ে পড়ে যায়। যেন তার বাহ্যিক ব্যাথার থেকে ভিতরের ব্যাথাটা তাকে অনেক আঘাত করছে। যন্ত্রনা দিচ্ছে। 

শাহেদ ফ্রার্স্ট এইড বক্স টা নিয়ে চলে আসেন। সাদিক বিছানার উপরে থাকায় সে সুরাইয়া বেগমের মাথাটা আলতো করে তুলে নিচে একটা বালিশ দিয়ে দেয়। আলিশাকে সাথী বেগম তার মায়ের কাছ থেকে টেনে নিয়ে বিছানার সাইডে যান। তার বুকে আলিশার মাথা রাখেন। হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করাতে থাকেন। রায়হান আলিশার যায়গায় বসে ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলা আর স্যাভলন বের করে রক্ত গুলো মুছতে থাকে। সুরাইয়া বেগমের কোন সাড়াশব্দ নেই। যেন তিনি এক জীবন্ত লাশ। তার চোখের পাশ দিয়ে শুধু জ্বল গড়িয়ে পড়ছে। আর তার চোখ পানিতে ছলছল করছে। রায়হান তার নাক মুখের ফেটে যাওয়া যায়গা গুলোকে পরিষ্কার করে ওয়াইন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়। বাম চোখ টা তিনি ভালোভাবে মেলতে পারছিলেন না। চোখের রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়েছে। তবে চোখের আধ খোলা অংশ দিয়ে ভিতরে দেখা যাচ্ছে তার চোখের অক্ষিকোটরে রক্ত জমাট বেঁধেছে। রায়হান তা দেখেই তৎক্ষণাৎ আর সবার সামনে বলে না।

কাল সুরাইয়া বেগমকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে চোখের বিষয়টা দেখাতে। এখন চোঁখের বিষয়ে বললে আলিশা আরো কান্নায় ভেঙে পড়বে। রায়হান সুরাইয়া বেগমকে ভালোভাবে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। দিয়ে তার বাবার দেওয়া ঔষধ গুলো আর প্যারাসিটামল ঔষধ গুলো নিয়ে সুরাইয়া বেগমের মাথার পাশে বসে। শাহেদ বিছানায় সাইড ‌থেকে উঠে গিয়ে আঁখির দাঁড়ায় একটা প্লাস্টিকের গ্লাস আনায়। কাঁচের গ্লাস আনলে যদি আবারো সেটা দিয়ে সুরাইয়া বেগম কোন অঘটন ঘটান, তাই। শাহেদ সেই গ্লাসে পানি দিয়ে রায়হানের হাতে দেয়। রায়হান সুরাইয়া বেগম কে একটু উঠিয়ে ধরেন। শাহেদ সেই ঔষধ আর পানি গুলো সুরাইয়া বেগমকে খাইয়ে দেন। সুরাইয়া বেগম যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঔষধ খেতে বাধ্য হন। তাকে ওষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় রায়হান। বলে।

– কালকে ডাক্তার এনে দেখিয়ে নিতে হবে চোখটা। হসপিটালে নিয়ে যেতে হলে নিয়ে যেতে হবে। (আলিশার দিকে তাকিয়ে) আলিশা, বনু যা। তোর মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়। অনেক রাত হইছে। কালকে তোকে এক যায়গায় নিয়ে যাবোনে। শুয়ে পড়। 

আলিশা সাথীর কোল থেকে মাথা উঠায়। সাদিক বিছানার উপর থেকে নেমে যায় নিচে। আলিশাকে সাথীও বলেন গিয়ে শুয়ে পড়তে। আলিশা উঠে গিয়ে শুয়ে পড়ে তার মায়ের পাশে। রায়হান ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক মতো পর্যবেক্ষণ করে বলে। 

– চলো সবাই। ফুফু একটু রেস্টে থাকুক। আর আলিশা। তোর মা’কে দেখে রাখিস। কোন দরকার হলে ডাক দিস। ঠিক আছে , ! 

আলিশা মাথা নাড়িয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে। 

– আ, আচ্ছা ভাইয়া।

রায়হান মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দিয়ে চলে যেতে থাকে। সাদিকও তার পিছু পিছু চলে যায়। সাথীকে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে যেতে থাকেন শাহেদ। সাথী যাওয়ার সময় পিছু ফিরে বলেন।

– উঠে একটু দরজাটা লাগিয়ে দিস মা, কেমন ,!

আলিশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। 

সাথী বেগমকে নিয়ে শাহেদ চলে যান। আলিশা উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। দিয়ে লাইট বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় উঠে। বিছানার সাথেই জানালা লাগানো। জানালাটা খোলা। বাইরের চাঁদের জোছনার আলো এসে বিছানায় পড়েছে। ঘরে কয়েল জ্বালানো। তাই মশার ভয় নেই আপাতত। আলিশা তার মায়ের পাশে শুয়ে তার মায়ের উপর কম্বল ভালো ভাবে ঢাকা দিয়ে দেয়। ওড়না দিয়ে তার চোখ মুখের পানি মুছে মাথার উপরের দিকে রেখে শুয়ে পড়ে। তার মা একদম চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। কোন নড়াচড়া সাড়া শব্দ নেই। আলিশা তার মা’কে পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে। খুব আলতো করে সে তার মা’কে ধরে। তার মায়ের শরীরে যে অনেক ব্যাথা। তখনই হঠাৎ তার মা নড়ে উঠে।

আলিশা কিছু বুঝে উঠবার আগেই তিনিও পাশ ফিরে আলিশাকে জড়িয়ে ধরেন। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠেন। তার চোখের পানি গুলো আলিশার কাঁধে পড়ছিলো। ফোঁটা ফোঁটা পানি গুলো যেন জানান দিচ্ছিলো তার মায়ের ভিতরের যন্ত্রনাটাকে। আলিশা তার মায়ের হঠাৎ এমন আচরণ দেখে বেশ অবাক হয়। আলিশা কিছু বলে না। সেও তার মায়ের পিঠে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে। তার মা তার কপালে, গালে চুমু দিতে থাকেন। এমন ভাবে দিচ্ছেন যেন তার সন্তানকে তিনি অনেক অনেক ভালোবাসেন। চুমু দিয়ে আবার আলিশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার কান্নায় যেন ছিলো এক বিষাক্ত অধ্যায়ের আভাস, ! ছিলো এক বুক ভরা ভালোবাসা, জীবন আর সোনালী কিছু সময়কে হারিয়ে ফেলার কষ্ট , ! 

 

 

শীতের সকালে গাছের ডালে এক কোকিলের কুহু কুহু ডাক। ডাকতে ডাকতে পাখিটা উড়ে চলে গেলো। এবং তখনই রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এলেন শিউলি বেগম। তাড়াহুড়ো করে আঙিনা পেড়িয়ে গিয়ে বারান্দায় উঠলেন। নিজের ঘরে গেলেন। ২-৪ টে মসলার প্যাকেট নিয়ে বেড়িয়ে এলেন। তখনই ফুলমতি বারান্দার শেষ মাথায় থাকা সোফার রুম থেকে বের হয়। শিউলি বেগম তাকে দেখেই তাড়াতাড়ি ডাক দেয়। ফু্লমতি প্রায় দৌড়ে ছুটে  আসে। শিউলি বেগম একনাগাড়ে বলেন।

– সোফার ‌রুম পরিষ্কার কইরা নতুন চাদর আর কভার বিছায়া দিছোস তো , ? 

– হ চাচি আম্মা। ঐ ঘরের সব কাম শেষ। 

– তাইলে এহন বাকি ঘর ডির বিছানার চাদর বদলায়া দে। আমি আর লায়লা রান্না ঘরের দিকটা দেখতাছি। জলদি যা। 

– আইচ্ছা চাচিআম্মা।(বলেই শিউলি বেগমদের ঘরে ঢুকে পড়ে ফুলমতি। তখনই নিপা তার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। হাতে কাপড়, শ্যাম্পুর বোতল আর ফেইস ওয়াশ। শিউলি বেগম বারান্দা দিয়ে নামতে যাবেন। তখনই নিপাকে দেখে আবার থেমে গিয়ে বলেন।

– তাড়াতাড়ি যা ছেড়ি। ওরা তো কইছে সাড়ে ১০ টা ১১ ডার দিকে আইয়া পড়বো। তুই তাড়াতাড়ি গিয়া গোসল ডা সাইড়া আইয়া রেডি হ। যা তাড়াতাড়ি। 

– মা, আমি কিন্তু দুইডা ডুব দিয়াই বাইর হইয়া যামু , ! 

– গরম পানি কইরা দিয়া আইছি। সম্মন্ধের লাইগা দেখতে আইবো আর হেয় বলে দুইডা ডুব দিবো , ! পড়ে তহন রায়হান কইবো আমি এই দুইডা ডুব দেওয়া মাইয়ারে বিয়া করুম না। (একটু থেমে) তুই ভালো কইরা গা-গতর ডি ধো তাড়াতাড়ি। যা।

– আইচ্ছা আইচ্ছা যাইতাছি। এহন বাজে কেবল সাড়ে ৯ ডা। এহনি তাড়াহুড়া শুরু কইরা দিছো তুমি। 

– হ। বিয়া ডা তো আমার। আর আমি তোর মাইয়া ,। তাড়াহুড়া সব ‌খালি আমারই। তোর নাই মনে হয় , !  তাড়াতাড়ি যা। 

– যাইতাছি যাইতাছি, ! 

নিপা চলে যায় বারান্দার শেষ মাথায় থাকা গোসল খানার দিকে। শিউলি বেগম বারান্দা থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে চলে যান রান্না ঘরের দিকে। আজ রায়হানরা সম্মন্ধ নিয়ে আসবে। তাই এতো ব্যস্ততা। ঐদিকে মতিন মেম্বার গেছে বাজার থেকে তাজা ফল আর আজকের সকাল সকাল বানানো ভালো মিষ্টি কিনতে। মেম্বারের একমাত্র মেয়ের বিয়ের ব্যাপার। পাত্রপক্ষ যেন তৃপ্তির ঢেকুর তুলে তা দেখা যেন এদের শাস্তি। কোকিল পাখিটা আবার ফিরে এসেছে। এসে রান্নাঘরের পাশের কাঁঠাল গাছটায় বসে কুহু কুহু ডাকতে শুরু করেছে। আজ মেম্বার বাড়ির আনন্দের ব্যস্ততা যেন তার বেশ লাগছে, ! 

 

 

উত্তরা আবাসিক এলাকা। রোড দিয়ে রিকশার বেল আর প্রাইভেট কারের চলাচলের শব্দ। গেইটের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো শাহারিয়া। এই বিল্ডিংয়ের দোতলাতেই সে থাকে। কালো জিন্স, ধূসর শার্ট পড়া শাহারিয়া তার সানগ্লাস টা পড়ে নিলো। গায়ের বডি আবার আগের মতো বানিয়ে নিয়েছে সে। বডি গুলা কাজেও দিচ্ছে। গোয়েন্দাতে কাজ করে। যখন তখন চোরের সাথে ফাইট করতে হয়। তাই শরীর ঐরকম উপযোগী করেছে সে। 

গেট থেকে বের হয়ে রোডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । বারবার হাত ঘড়ি দেখছে আর রোডের দিকে তাকাচ্ছে। যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে সে। বাইরে আজ রোদ পড়েছে ভালোই। সানগ্লাস টা এজন্যই পড়া তার। রোদের তীব্রতা তার পছন্দ না। 

 

কিছুক্ষণ পর একটা রিকশা এসে থামে তার সামনে। রিকশা থেকে নামে আহনাফ। নেমে ভাড়া পরিশোধ করে দিয়ে শাহারিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিকশা ওয়ালা রিকশা নিয়ে চলে যায়। আহনাফের পড়নে নীল রঙের জিন্স, আর একটা টি শার্ট। সে এসে শাহারিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলে।

– স্যার। আজ ডাকলেন যে , ! আজ তো অফিস ছুটি। 

– হ্যা ছুটি। তবে আজ অফিসের কাজে যাবোনা। আফরিনদের বাসায় যাবো। তার মা’কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। (একটু থেমে) কাল রাতে যা দেখলাম। হয়তো উনি ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছেন। শরীরের দূর্বলতা, যায়গায় যায়গায় উঠা টিউমার তো তাই ইঙ্গিত দেয়। 

– ওর তো আবার বাবাও নেই। ওর মায়ের হঠাৎ কিছু হলে তখন , ! 

– আমরা কী মরে গেছি নাকি ,! আমরা দেখবো ওকে। আমি নিজের আপন ছোট বোনের মতো ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবো। সেসব পড়ে কার কথা। এখন কথা হচ্ছে যে আফরিন তার মায়ের বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়াটা দেখে বেশি কষ্ট পাবে। নিজের মধ্যে একটা অভিযোগ কাজ করবে তার। সে কেনো তার মা’কে বাঁচাতে পারলো না। কেনো তার মায়ের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হলো। তাই আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। জানি এখন কিছু করে তার মায়ের জীবন সময় বাড়ানো যাবে না। কিন্তু সে মানসিক দিক দিয়ে তখন আর আগের মতো নিঃশেষ হয়ে যাবে না। (একটু থেমে) চলো। আমি হসপিটালে এপয়েন্টমেন্ট দিয়ে আসছি। 

– হমম চলেন। 

শাহারিয়া পিছন ফিরে হাঁক দিয়ে বলে।

– ড্রাইভার , ! গাড়ি বের করো। 

– প্রাইভেট কারে যাবেন স্যার , ! 

– ওর মা’কে কারে করেই হসপিটালের নেওয়া যাবে তাইলে। আর আমি দুইজন নার্সকে সকাল সকাল ওর বাসায় পাঠায় দিছি। ওরাও যাবে। তাই গাড়িই বের করলাম। 

– ওকে স্যার। 

দাড়োয়ান গ্যারেজ খুলে দেয়। ভিতর থেকে একটা কার বের হতে থাকে। শাহারিয়ারা গিয়ে সাইডে দাঁড়ায়। শাহারিয়া আহনাফকে বলে।

– ঐদিকে আবার আমার বোন মানে নিপার বিয়ের ডেট আজকে পাকা হওয়ার কথা। বিয়ে পাকা হইলে আবার বাড়িতে যাইতে হবে। 

– আনন্দপুরে , ? 

– হ্যা। তুমিও চলো। বেশি না তো ১-২ সপ্তাহের ব্যাপার। ওর বিয়েটা শেষ হলেই চলে আসবো আবার। 

– আমার মা’কে বলতে হবে। উনি তো মনে হয় না আমাকে আনন্দ পুর যেতে দিবেন। 

– আরে কিচ্ছু হবেনা। (একটু থেমে) আচ্ছা আমিই আন্টিকে ফোন দিয়ে বোঝাবো। তুমি তাও চলো। এরকম শহুরে পরিবেশের বিয়ে তো অনেক দেখছো। এবার গ্রাম্য পরিবেশে কেমন করে বিয়ে হয় তাও একটু দেখে আসো। 

– আচ্ছা স্যার দেখা যাক। তবে আপনি ফোন দিয়ে বললে হয়তো মা মানতে পারে। আপনিই একটু বলিয়েন প্লিজ।

– আচ্ছা আমি বলে দিবোনে। চলো গাড়ি চলে এসেছে। 

– ওকে স্যার চলেন।

গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাহারিয়া ড্রাইভিং সিটে বসলো আর আহনাফ তার পাশের সিটে। আজ ড্রাইভার কে ছুটি দিয়েছে কিছু দিনের জন্য। গাড়িটা শাহারিয়াদের বের করে দিয়েই এখন সে তার দেশের বাড়িতে যাবে। 

গাড়িটা চলতে শুরু করে। এবং দেখতে দেখতেই মিলিয়ে যায় কিছুদূর যেয়ে রাস্তার বাকি গাড়ি গুলোর মধ্যে। 

 

 

মতিন মেম্বারের বাড়ির সামনের রাস্তা। দূরের আকাশে হালকা মেঘের ঘনঘটা, আর তার সাথে উত্তুরে হাওয়া গাছের পাতা গুলোকে দোল খাইয়ে দিচ্ছে। রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে একটা প্রাইভেট কার। রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা সাইকেল আগেই দাঁড়িয়ে গেলো প্রাইভেট কার টাকে সাইড দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার আর দরকার পড়লো না। প্রাইভেট কার টা এসে থামলো মেম্বার বাড়ির গেটের সামনে। নামতে থাকলো রায়হান রা। সামনের দুই গেট খুলে বেড়োলেন নজরুল সাহেব আর সুমনা বেগম। পিছনের দুই দরজা খুলে নামলো রায়হান আর আলিশা। রায়হান আজ একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। আলিশার পড়নে একটা লাল গোল জামা। সুমনা বেগম পড়েছেন একটা লালচে বাদামি রঙের শাড়ি, আর নজরুল সাহেব পড়েছেন শার্ট আর ফরমাল প্যান্ট। তিনি এসব ড্রেসেই বাইরে যেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তারা গাড়িটাকে সাইড করে রেখেছে যাতে রাস্তার চলা অন্যান্য কারো সমস্যা না হয়। রায়হান রা গেইট ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ি ঘর আঙিনা আজ বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। দেখে মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো। 

 

তাদের কে আঙিনায় হেঁটে আসতে দেখে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে তাদের দিকে যেতে থাকেন শিউলি বেগম। গিয়েই নজরুল আর সুমনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

– আসসালামুয়ালাইকুম, ! 

– ওয়ালাইকুমুস সালাম বেয়াইন সাহেবা। কেমন আছেন, ? (নজরুল সাহেব)

– এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ।(রায়হানের দিকে তাকিয়ে) রায়হান বাবাজি। কেমন আছো, !

– এইতো আলহামদুলিল্লাহ আন্টি। ভালো আছি। 

– আসো আসো ভিতরে আসো। 

– এই নেন বেয়াই। (৪ টা মিষ্টির প্যাকেটের ব্যাগ শিউলি বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে) মতিন ভাই কই, ! (সুমনা বেগম)

– ঘরেই আছে। আসেন আপনারা। 

তারা একে একে বারান্দায় উঠে আঙিনা থেকে। বারান্দা হয়ে ঘরের দিকে যেতে থাকে। শিউলি বেগম তাদের নিয়ে সোফার রুমে আসে। এসে তাদের বসায়। ৩ টা সোফা একসাথে ছিলো আর ৪ টো সিঙ্গেল সোফা। বড় সোফাটায় সুমনা বেগম আর নজরুল বসলেন। আর সিঙ্গেল দুইটায় রায়হান আর আলিশা। তাদের বসিয়ে দিয়ে বিছানায় বসলেন শিউলি বেগম। মতিন মেম্বারও তখনই ঘরে ঢুকলো। তাকে দেখেই সবাই সম্মান পূর্বক দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। মতিন মেম্বার সালাম গ্রহণ করলেন। সবাইকে বসতে বললেন। তিনি নিজেও এসে বসলেন সিঙ্গেল একটা সোফায়। ঠিক নজরুল সাহেবকে পাশের সোফা টায়। ফুলমতি আর লায়লা তখনই ঘরে হরেক রকমের মিষ্টান্ন আর ফলের প্লেট নিয়ে ঢুকলো। সোফার সামনে থাকা টেবিলে রাখলো। ট্রেতে করে আনা ফলের রসের গ্লাসও টেবিলে রাখলো। সবকিছু রেখে তারা চলে যায়। 

নজরুল সাহেব বলতে শুরু করলেন। 

– আমাদের আগেই আমাদের ছেলে মেয়ে দেখাদেখি, পছন্দ করে ফেলেছে। এখন আমাদের মতামত যাই হোক। তারা এক জন আরেকজনকেই চায়। 

– হ্যা। নিপাও আমাকে বললো। আপনাদের বিষয়েও অনেক কিছু বললো। আপনারা বেশ সুনাম স্মরৃদ্ধ মানুষ এই গ্রামের। আপনাদের পরিবারের ব্যবসায়িক আর সামাজিক অর্জন অনেক। 

– সবই উপর ওয়ালার ইচ্ছা ভাই।(একটু থেমে) তো মেয়ে কোথায়। আনেন দেখি একটু,(রায়হানের দিকে তাকিয়ে) আমার বাবা কার প্রেমে এতোদিন হাবুডুবু খাচ্ছিলো। 

– হেহেহে। শিউলি বেগম। যাও, নিপারে নিয়ে আসো। (মতিন মেম্বার)

– আচ্ছা যাচ্ছি। 

বলেই শিউলি বেগম উঠতে যাবেন, তখনই আলিশা বললো। 

– আন্টি, আমি যাই তোমার সাথে , ! 

– হ্যা আসো। 

আলিশাও শিউলি বেগমের সাথে চলে যায় ঘর থেকে। ঘরে মতিন মেম্বার আর নজরুল সাহেব গল্পের হাট নিয়ে বসেন। ব্যবসায়িক আর সামাজিক গল্প। 

 

নিপা ঘরে বসে আছে। পড়নে একটা সুন্দর লাল শাড়ি। একদমই সাজগোজ করেনি। তারপরও তাকে রাণীর চেয়ে মোটে কম লাগছেনা। দিথী শ্যাম সুন্দর হলেও নিপার উজ্জ্বল ফর্সা বর্ণের। হাতে হালকা চুড়ি পড়েছে। আর ঠোটে খালি হালকা লিপস্টিক দিয়েছে। মাথায় ঘোমটা টেনে বসে বসে রায়হানের কথা ভাবছে সে। তখনই ঘরে প্রবেশ করলো শিউলি বেগম আর আলিশা। ঘরে ঢুকেই নিপাকে শিউলি বেগম বললো।

– চল। তোরে কসাইয়ের হাতে তুইলা দিয়া আহি। 

হঠাৎ শিউলি বেগমের কথা শুনায় কিছুটা চমকে উঠে নিপা। পিছে ফিরে দেখে তার মা আর একটা ১৬-১৭ বছর বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো রায়হানের বোন হবে‌।

 আলিশা তখনই এসে নিপার পাশে বসে। বলে।

– মাশাআল্লাহ। তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে ভাবি , !

 

নিপা মাথা নামিয়ে মুচকি হাসি দেয়। শিউলি বেগম বলেন

– হইছে আর শরম পাওয়া লাগবো না। চল। ওরা তোরে দেখবো।

 

নিপাকে দাঁড় করিয়ে। তার শাড়ি ঠিকঠাক আছে কিনা আলিশা আর শিউলি বেগম মিলে দেখে তাকে নিয়ে যেতে থাকে ঘর থেকে। বারান্দার ডায়নিং টেবিলে লায়লা আর ফুলমতি সব জিনিস আনা নেওয়া আর রেডি করতেছে। বাইরে আকাশের উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে কমছে। সকাল ১১ টা বাজে। তাও যেনো দেখে মনে হচ্ছে বিকাল হয়ে গেছে। 

সোফার রুমে ঢুকে নিপারা। শিউলি বেগম, নিপাকে নিয়ে গিয়ে বসায় রায়হানের পাশের সোফায়। মাথায় শাড়ির আঁচল দেওয়া নিপার। কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছে সে। তার আরেকপাশের সোফাটায় বসেছে আলিশা। নজরুল সাহেব আর সুমনা, নিপাকে পা থেকে উপর পর্যন্ত দেখে। তাদের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছিলো তারাও খুশি এমন বউমা পেয়ে। নজরুল সাহেব বলেন।

– মাশাআল্লাহ, ! ছেলের আমার পছন্দ আছে বলতে হবে‌। দারুণ সুন্দর , ! 

– হ্যা। বেশ সুন্দর। মা তোমার নাম , ? (সুমনা বেগম)

– সুবাইতা নুরান নিপা। (নিচু মাথায় ধীর গলায়)

– বাহ। নামটাও বেশ। (মতিন মেম্বারের দিকে তাকিয়ে) তাইলে বিয়াই। দিন তারিখ ঠিক করি। কী বলেন , ! 

– হ্যা। শুভ কাজে আর দেরি কীসের। (একটু থেমে) সামনের শুক্রবারে হলে কেমন হয় ,! (মতিন মেম্বার)

– উমম, শুক্রবার , ? শুক্রবার একটু বেশি দেরি হয়ে যায় না , ! (একটু থেমে) আজকে ৯  তারিখ না , ! এই সামনের ১৪ তারিখ মানে বুধবার ডেট করি। আসলে শুক্রবারে একটু আমাদের পারিবারিক বিজনেসের জন্য রায়হানকে ঢাকা যেতে হবে তো তাই আরকি।

– ওহহ, আচ্ছা সমস্যা নেই। আর বুধবার , ! হ্যা ঠিক আছে। বুধবারই ফাইনাল। নেন তাইলে। মিষ্টি মুখ করি,!

– হ্যা অবশ্যই , ! তবে তার আগে, এনগেজমেন্টা সেরে ফেলা যাক , ! (সুমনা বেগম)

– অবশ্যই অবশ্যই। 

সুমনা বেগম তার ব্যাগ থেকে একটা আংটির ছোট্ট বক্স বের করেন। সেখান থেকে একটা আংটি বের করে তার পাশের সোফায় বসা রায়হানকে দিয়ে বলেন।

– নে রায়হান। এটা নিপাকে পড়িয়ে দে। 

রায়হান আংটিটা নেয়। নিয়ে নিপার দিকে হাত এগোয়। শিউলি বেগম বলেন।

– হাত আগায় দে মা , ! 

নিপা তার হাত আগায়। রায়হান তাকে আংটি পড়িয়ে দেয়। ঘরে মধ্য আলহামদুলিল্লাহ বাণীতে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হতে থাকে। নজরুল সাহেব, মতিন মেম্বার, সবাই মিষ্টি নেয় সামনের টেবিল হতে। ঘরে এক আনন্দ ময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। নিপা আর রায়হান দুজনেই অনেক খুশি তাদের হালাল সম্পর্কের শুরুর জন্য। নিপা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। রায়হান একটা মিষ্টি তুলে নিপা কে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে যায়। নিপা লজ্জা পায়। আলিশা নিপাকে বলতে থাকে 

– নাও, নাও। ভাইয়া তোমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। লজ্জা পাইয়ো না।

নিপা মিষ্টিতে একটা ছোট্ট বাইট দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে লজ্জায়। আর তাদের ৩ জনের খুনসুটি দেখে হাসছে থাকে ঘরের গুরুজনেরা। এ যেন এক সুখকর মুহুর্ত, ! যা মূল্য দিয়ে পরিমাপ করা যায় না , ! 

 

 

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে দিথী। ঘরে কারেন্ট কাল রাত থেকেই নেই। তাদের উত্তর পাড়ার কারেন্টের খুঁটির তার কাল বিকালে ছিঁড়ে গিয়েছে। এখনো তা ঠিক করেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। বাইরের আকাশে মেঘের ঘনঘটা বাড়তে শুরু করেছে। ঠান্ডা বাতাসও বয়ে যাচ্ছে। দিথীর মন খারাপ। তার মায়ের বিষয় টা কাল শোনার পর থেকেই তার মন খারাপ হয়ে আছে। পূর্ব জন্মের অপূর্ণতা পূরণে সে আবার জন্ম নিয়েছে। কিন্তু আবারো সে মায়ের আদর স্নেহ থেকে দূরে সরে গিয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে। জীবন টা এমন কেনো হলো তার , ! 

– আগের জীবন আমাকে দুঃস্বপ্ন উপহার হিসেবে দিয়েছিলো। এই জন্মে হয়তো সেই দুঃস্বপ্ন আমি নিজ হাতে গড়েছি ,! (বলেই এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দিথী, গ্রীল বেয়ে আকাশ পানে চেয়ে) এই মিশন টা শেষ করে আমি শান্তির নিশ্বাস ফেলতে চাই। একটা সুখের নীড় পেতে চাই। যেই নীড় আমাকে দিবে নির্ভরতা ,! 

হঠাৎ তার কাঁধে কারো হাত পড়ায় দিথী চমকে উঠে। সে পিছনে তাকিয়ে দেখে তানিয়া তার কাঁধে হাত রেখেছে। সে তার দিকে ফিরে বলে।

– ওহ, আপু তুমি ,! আমি আরো ভাবলাম হয়তো আবার আসুভে। (একটু থেমে) এই আসুভেকে বিনাশ করার মিশনে আমরা কবে নামছি ,! কবে এই অধ্যায় থেকে আমরা মুক্তি পাবো ,! 

– কবে আবার। তার বিনাশের পর। সামনের ২৭ তারিখ তার শক্তি ফিরে পাওয়ার সময়। তার আগেই তার বিনাশ করতে হবে আমাদের। 

– আমার আর এসব ভালো লাগছে না। ছোট থেকে এসবের সাথে লড়ে যাওয়া, মা’কে হারানো, নতুন জীবন শুরু করার আগেই আরো বাঁধা,! আমি আর পারছিনা। 

দিথীর মুখ থেকে হঠাৎ একথা শুনে হতাশ হয় তানিয়া। মাথা নিচু করে ফেলে। এক মলিন গলায় বলে। 

– হয়তো তুমি এসবে খুব ক্লান্ত। (একটু থেমে) যাও, আর তোমাকে এসবের সাথে লড়তে হবে না,! 

– মানে ,! আমি না লড়লে তখন কীভাবে কী , ? আর তুমিই তো বলেছিলে যে আমি তাসনুবার পুনর্জন্ম। তাইলে , ! 

তানিয়া এক হতাশাচ্ছন্ন মুখ নিয়ে মাথা তুলে। ধীর মলিন গলায় বলে।

– তুমি আজ থেকে মুক্ত। 

– মুক্ত , ! কিন্তু ,

হঠাৎই দিথীর কথা থেমে যায়, চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। তার মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকে। সে তার মাথা নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়। দেখে তানিয়া তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে , ! সে যেনো তার চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তানিয়া ছুরিটা বের করে আবার সজোরে তার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। দিথীর মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে আসতে থাকে। সবকিছু যেনো তার কাছে অন্ধকার হয়ে যায়। তার চোখের পাতা গুলো ধীরে ধীরে বুজে আসে।

 

চলবে ,,,,,

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৪০

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া 

 

(১৮+ 🟡হলুদ এলার্ট)

 

– আমার আর এসব ভালো লাগছে না। ছোট থেকে এসবের সাথে লড়ে যাওয়া, মা’কে হারানো, নতুন জীবন শুরু করার আগেই আরো বাঁধা,! আমি আর পারছিনা। 

দিথীর মুখ থেকে হঠাৎ একথা শুনে একরাশ হতাশ হয় তানিয়া। মাথা নিচু করে ফেলে। এক মলিন গলায় বলে। 

– হয়তো তুমি এসবে খুব ক্লান্ত। (একটু থেমে) যাও, আর তোমাকে এসবের সাথে লড়তে হবে না,! 

– মানে ,! আমি না লড়লে তখন কীভাবে কী , ? আর তুমিই তো বলেছিলে যে আমি তাসনুবার পুনর্জন্ম। তাইলে , ! 

তানিয়া এক হতাশাচ্ছন্ন মুখ নিয়ে মাথা তুলে। ধীর মলিন গলায় বলে।

– তুমি আজ থেকে মুক্ত। 

– মুক্ত , ! কিন্তু ,

হঠাৎই দিথীর কথা থেমে যায়, চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। তার মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকে। সে তার মাথা নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়। দেখে তানিয়া তার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে , ! সে যেনো তার চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তানিয়া ছুরিটা বের করে আবার সজোরে তার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। দিথীর মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে আসতে থাকে। সবকিছু যেনো তার কাছে অন্ধকার হয়ে যায়। তার চোখের পাতা গুলো ধীরে ধীরে বুজে আসে। নিজের জীবনের শেষ কিছু সেকেন্ড যেন তার কাছে হাতছানি দিচ্ছে। 

হঠাৎই দিথীর চোখ খুলে যায়। এক ছোটখাটো চিৎকার দিয়ে উঠে বসে। নিজেকে আবিষ্কার করে বিছানায় শোয়া অবস্থায়। তার গাল, চোখ, মুখ ঘেমে ভিজে গিয়েছে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে সে। পাশের টেবিলে থাকা পানি ভর্তি গ্লাস টা হাতে নিয়ে এক ঢোকে পুরোটা খেয়ে ফেলে। খেয়ে ফেলেই জোরে হাত টা বিছানার উপর রাখে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে এখন দিন। আবহাওয়াটাও স্বপ্নের মতোই ঠিক মেঘলা। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে ১১ টা ৫ বাজে। এক হাত মাথায় দিয়ে মনে করতে চেষ্টা করে সে। তার মনে পড়েই যায়। ফজরের নামাজ পড়ে সে আর সামিহা আবার ঘুম দিয়েছিলো। কিন্তু আজ সে ঘুমের মধ্যে এমন স্বপ্ন কেনো দেখলো , ? এরকম স্বপ্ন দেখার তো তার কথা নয়। আর তার তানিয়া আপুই বা তাকে কেনো মারতে চাইবে , ! এসব কিছু ভাবতে ভাবতেই দিথীর চোখ যায় দরজার পর্দার দিকে। কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে। কেউ যেন দরজার বাইরে পর্দার আড়াল থেকে তার দিকে নজর রেখেছে। দিথী হাত দিয়ে তার চোখ, মুখের ঘাম মুছে। কামিজ টা ঠিক করে বিছানা থেকে পা নামায়। নিচে নেমে ধীর পায়ে, নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকে দরজার দিকে। বাইরের মেঘলা আবহাওয়া হওয়ায় বাতাসও করছিলো হালকা। বাতাসের ধাক্কায় পর্দাও দুলছিলো। দিথী ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। এখনো সেই ছায়ামুর্তি টা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দিথী হাত বাড়ায় পর্দাটা সড়ানোর জন্য। তার হাত কাঁপছে। তাও মনে সাহস এনে এক হেঁচকা টানে পর্দা টেনে সরিয়ে দেয় সে। দেখে বাইরে তানিয়া দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তার ঘরের দিকে কান পেতে আছে। দিথী কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। বলে।

– আপু , ! তুমি এখানে কী করছো , ? 

তার কথার আওয়াজ শুনে যেন একপ্রকার চমকেই উঠে তানিয়া। চকিতে দিথীর দিকে ফিরে তাকায়। সোজা হয়ে দাঁড়াতে থাকে সে। দিথী তার দিকে তাকিয়ে এক মলিন হাসিমুখ করে বলে। 

– আপু ভিতরে আসো। বাইরে কেনো দাঁড়িয়ে আছো , ! 

– ভ,ভিতরে , ! ন,না থাক। আমি,আমি তো তোমাকে ঘুম থেকেই ডাক দিতেই এসেছিলাম। তুমি তো উঠে গেছো। (একটু নার্ভাস হয়ে) আমি তাইলে যাই হ্যা।

– দাঁড়াও দাঁড়াও , ! কোথায় যাচ্ছো তুমি? ঘরে আসো। তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।

– জ, জরুরি, ? আসছি। একটু পরে। আমি একটু আমার ঘর থেকে ঘুরে আসি।

তানিয়ার উপর দিথীর সন্দেহের মাত্রা বেড়ে যায়। দিথী ভ্র কুঁচকে তাকিয়ে বলে।

– আচ্ছা দাঁড়াও। আমি তোমাকে যেই জিনিসটা দিতে চাইছিলাম সেটা নিয়ে আসি। 

– ক,কী জিনিস , ? 

– ঐযে আংটির বক্সটা , ! ঐটা তোমার ঘরে নিয়ে গিয়ে খুলে দেখবো। যে দিনের বেলাতেও আলো ছড়ায় কি না। 

কথাটা শুনেই যেন একপ্রকার তানিয়ার মুখ হাসৌজ্জল হয়ে উঠে। বলতে থাকে।

– অবশ্যই অবশ্যই। কেনো নয়। আসো তাড়াতাড়ি বক্সটা নিয়ে আমার ঘরে আসো, !

দিথী যেন এবার শিওর হয় যে তার সন্দেহটাই ঠিক। সে মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দিয়ে চলে আসতে থাকে ঘরের ভিতরে। ঘরে চলে এসে তার পড়ার টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। ড্রয়ার থেকে বক্সটা বের করে। টেবিলের উপর রেখে বক্সটা খুলে। আংটিটা বের করে উঠিয়ে দেখতে থাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে পিছনে তাকিয়ে দেখে তানিয়ার দিকে। তানিয়ার চোখে মুখে হাসির ছটা। দিথী ফিরে সামনে তাকায়। আংটিটা তার আঙুলে পড়ে নেয়। পড়েই ঘুরে চলে যেতে থাকে, হাত দুটো পিছনে করে। চোখে মুখে এক চিলতে হাসি। দিথী গিয়ে তানিয়ার সামনে দাঁড়ায়। বলতে থাকে। 

– আংটি চাই না তোমার , ! 

– হ্যা, হ্যা। আংটি চাই , ! 

– এই নাও আংটি (বলেই আংটি পড়া হাত টা ঠিক তানিয়ার কপাল বরাবর তুলে ধরে। সাথে সাথেই এক লম্বা আলোক রশ্মি আংটিটা থেকে বেড়িয়ে তানিয়ার মাথা এফোড় ওফোড় করে চলে যায়। তানিয়া এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে। সাথে সাথেই তার দেহ থেকে এক কালো ধোঁয়া বেড়িয়ে চলে যেতে থাকে বাইরের দিকে। আংটির আলোক রশ্মি কমে যায়। তানিয়ার অচেতন দেহ ধপ করে বারান্দায় পড়ে যায়। দিথী তার হাত নামায়। ঠোঁটের কোনে এক ছোট্ট মুচকি হাসি দিয়ে ঘুরে চলে যেতে থাকে ঘরের দিকে।  পড়ার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আংটিটা আঙ্গুল থেকে খুলে বক্সটায় রাখে। আর বক্সটা ধপ করে বন্ধ করে ফেলে

 

 

হসপিটালের একটা রুমের ভিতরের দৃশ্য। বেডে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে আফরিনের মা’কে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। বেডের পাশে মনিটরে তার হার্টবিট চলার রেখা আর শব্দ শোনা যাচ্ছে। বেডের বাম পাশে একটা চেয়ারে বসে তাকে চেকাপ করছেন একজন ডাক্তার।‌ ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে আফরিন, আহনাফ আর শাহারিয়া। আফরিনের মুখ বিষন্ন। পড়নে এক বাদামী রঙের থ্রী পিস। 

ডাক্তার কিছুক্ষণ চেকাপ করার পর উঠে দাঁড়ালেন। স্টেথোস্কোপ টা ঘাড়ে পেঁচিয়ে বলতে থাকেন। 

– আপনাদের মধ্যে কেউ একজন আমার সাথে বাইরে আসুন। 

 

বলেই ডাক্তার আগে আগে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে থাকেন। শাহারিয়া আফরিনকে তার মায়ের পাশে রেখে আহনাফকে নিয়ে ডাক্তারের পিছু পিছু হসপিটালের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের বেড়োনোর সাথে সাথেই দরজাটা তারা চাপিয়ে দেয়। করিডোর দিয়ে নার্স, রুগির আত্মীয়-স্বজন রা চলাচল করছে। ব্যাস্ততম সময় তাই ভিড় একটু বেশিই। ডাক্তার তাঁদের দিকে ফিরে বলতে শুরু করেন।

– এই রুগির অবস্থা তো ভালো না। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। ইনাকে তো আরো কয়েকমাস আগে এখানে আনা উচিত ছিলো। আর এখন এই শেষ মুহূর্তে হসপিটালে নিয়ে এসে কী লাভ, ! 

– না মানে ডাক্তার সাব, উনি ঐ মেয়েটার মা। উনাদের তেমন পরিস্থিতি ছিলোনা ডাক্তার দেখানোর মতো। আমরাই কাল ওদের সাথে পরিচিত হই। তাই আনতেও দেরি হয়ে গেলো। (একটূ থেমে) উনার হয়েছে টা কী ডাক্তার ? (শাহারিয়া)

– শরীরে ক্যান্সারের বাসা বেঁধেছে। অনেক যায়গায় বড় বড় টিউমার উঠেছে। রুগির অবস্থা এখন একদমই ভালো না। বড়জোর ২-৩ সপ্তাহ আমরা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। তাছাড়াও হায়াত-ময়োতের মালিক আল্লাহ। এর আগেও যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। 

শাহারিয়া আর আহনাফ ডাক্তারের করা শুনে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আফরিন এসব শুনলে তো অনেক কষ্ট পাবে। শাহারিয়া বলে।

– আচ্ছা ডাক্তার, এখানে উনি ভর্তি থাকুক। যতদিন উনার জীবন সময় আছে, উনি এখানেই কাটাক। উনাকে একটা সিঙ্গেল পার্সোনাল বেডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। আর উনার সাথে উনার মেয়েটাও থাকবে। একটু এরকম বেড ম্যানেজ করে দিন প্লিজ। 

– ওকে আমি দেখছি। আর যাওয়ার সময় পেমেন্ট টা রিসিপসনে করে যাইয়েন। 

– ওকে স্যার। আমি করে দিবো। আর স্যার,

– হ্যা বলুন।

– উনার জন্য একটা পার্সোনাল নার্স নিবো আমরা। পাওয়া যাবে এই হসপিটালে ? মানে এমন নার্স কী ফাঁকা আছে ? 

– হ্যা আছে। রিসিপসনে গিয়ে এই বিষয় নিয়ে কথা বলুন। (একটু থেমে) আমি তাইলে আসি , ! 

– হ্যা অবশ্যই, আসসালামুয়ালাইকুম

– ওয়ালাইকুমুস সালাম (চলে যেতে যেতে বললেন ডাক্তার সাহেব। আহনাফ শাহারিয়ার দিকে তাকায় এক হতাশ মুখ নিয়ে। শাহারিয়া বলে।

– স্বাভাবিক হ। ভিতরে আফরিন যেন এই বিষয়ে জানতে বা বুঝতে না পারে। 

– ও,ওকে। 

– চল।

দুইজনে আবার রুমে প্রবেশ করে। আফরিন তার মায়ের বেডের পাশে বসে ছিলো। তাদের রুমে ঢুকতে দেখে উৎসুক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। শাহারিয়ারা কাছে আসতেই বলে। 

– ভাইয়া। আমার মায়ের কিছু হইবো নাতো , ! 

– আ, হবে না। তেমন কিছু হবেনা। তবে তাকে রেষ্টে থাকতে বলছেন ডাক্তার। আর এখানে তোমার মা কে কয়েকদিন ভর্তি রাখতে বলছেন। তুমি এখানেই থাকবা ততদিন তোমার মায়ের পাশে। 

আফরিন কথা গুলো শুনে আবার তার মায়ের পাশে বসে পড়ে। তার মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে। 

– এতোদিন হসপিটালে থাহোনের খরচ তো আমার ধারে নাই , ! আর (শাহারিয়ার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে) মায়ের চিকিৎসার লাইগাও আমি কিছু করতে পারতাছি না ,(তার চোখ গুলো ছলছল করে উঠে। আফরিন মাথা ঘুরিয়ে তার মায়ের দিকে করে নেয়। তার চোখের পানি গুলো তার মায়ের হাতের উপর পড়ছে। শাহারিয়া কিছু বলতে যাবে, তখনই আহনাফ গিয়ে আফরিনের পাশে হেলে তার মাথায় হাত রেখে তাকে শান্ত করতে থাকে। শাহারিয়া বলে।

– তুমি আমাকে ভাই ডেকেছো না , ! এটা আমি আমার ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছি। তুমি এইসব নিয়ে কোন চিন্তা করবে না। তুমি শুধু তোমার মায়ের পাশে থাকবে। তোমার মায়ের জ্ঞান ফিরে এলে তার সঙ্গ দিবে। তুমি শান্ত হও। (একটু থেমে) তোমার মা’কে একটা পার্সোনাল কেবিনে ট্রান্সফার করবে আজকে। সেখানে তুমি তোমার মায়ের সাথে থাকতে পারবে। আর আজকে আহনাফ তোমার সাথে রাতের ডিনার অবদি থাকবে। তোমাকে ডিনার করিয়ে, সব বুঝিয়ে দিয়ে ও বাসা চলে যাবে। তুমি কিছুই নিয়ে চিন্তা বা টেনশন করিও না। তখন তোমারও শরীর খারাপ হয়ে যাবে। 

আফরিন কথা গুলো শুনে মাথা উঠায়। আহনাফ তার পাশেই দাঁড়ানো। আফরিন চোখের পানি মুছতে থাকে তার হাত দিয়ে। কান্না করলে যেন তাকে একদম বাচ্চা সদৃশ লাগে।

 শাহারিয়া তার হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। ১২ টা ৪৫ বাজে। সে আফরিন আর আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে। 

 – চলো লাঞ্চ করে নিবে। দুপুরের টাইম হয়ে এসেছে।(আফরিনের দিকে তাকিয়ে) আর এখনি এখানে নার্স চলে আসবে তাই তোমার মা’কে নিয়ে ভেবোনা। চলো। 

বলেই শাহারিয়া আগে হনহন করে রুমে থেকে যেতে লাগলো। আহনাফ হাত দিয়ে ইশারায় আফরিনকে যেতে বলে। আফরিন তার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছতে মুছতে চলে যেতে থাকে। তার পিছু পিছু পা বাড়ায় আহনাফও। যাওয়ার সময় রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। রুম টা আবার শান্ত হয়ে যায়। শুধু শোনা যায় মনিটরে চলা হার্টবিট রেখা চলার আওয়াজ। 

 

 

খাঁন বাড়ির বড় গেইট খুলে দিচ্ছেন দাড়োয়ান রহিম চাচা। একটা প্রাইভেট কার ঢুকলো ভিতরে। তারপর রহিম চাচা আবার গেইট লাগিয়ে দেন। প্রাইভেট কার টা বাড়ির সামনের ডান পার্শ্বের ফাঁকা যায়গাটায় পার্ক করেন নজরুল সাহেব। সেখানে পাশে ২ টা বাইকও আছে। একটা রায়হানের একটা সাদিকের। বাইক গুলো অনেক সময় দরকার পড়ে দিনাজপুরের ফিড গোডাইনে রাতে যাওয়ার জন্য। আর প্রাইভেট কারটা নজরুল সাহেব শখের বসেই কিনেছেন। যদিও গ্রামাঞ্চলে এরকম নিজস্ব প্রাইভেট কার থাকা কিছুটা বেমানান। তবুও নিজের শখকেই আগে প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল সাহেব।

 গাড়ি পার্ক হওয়ার পর গাড়ি থেকে সবাই নামতে থাকে। রায়হান, আলিশা, সুমনা বেগম সবাই নেমে এক এক করে বাড়ির ভিতরে ঢুকার দরজার উদ্দেশ্য পা বাড়ান। নজরুল সাহেব গাড়ি থেকে নেমে রহিম চাচাকে ডাক দেন। রহিম চাচা হনহন করে তার দিকে ছুটে আসেন। নজরুল সাহেব রহিম চাচাকে উদ্দেশ্যে করে বলেন। 

– গাড়ি টাকে ধুয়ে ফেলো। আর চাকার সাইডের অংশতে কাঁদার ছিটে লেগেছে, ঐগুলা ভালো করে পরিস্কার করে ফেলো।

– জে আইচ্ছা বড় সাহেব। 

নজরুল সাহেব পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা বড় নোট তার দিকে এগিয়ে দেয়। রহিম চাচা বেশ খুশি মনে উৎফুল্ল হয়ে সেটা গ্রহণ করে। হাসি মুখে বলতে থাকে।

– জে স্যার। এহনি সব কাম হইয়া যাইবো। আপনে চিন্তা কইরেন না। 

নজরুল সাহেব চলে যান বাড়ির ভিতরে দরজার দিকে। 

 

অন্দরমহলের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো আলিশা, রায়হান আর সুমনা বেগম। রায়হান সরাসরি উপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। যদিও সে তার বিয়ে ঠিক হওয়ায় বেশ খুশি। তবুও তার একটা জরুরী কাজ মনে পড়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি উপরের দিকে চলে যায় সে। সুমনা বেগমও তার পিছু পিছু উপরের সিঁড়ি ধরেন। সুমনা বেগম সবকিছুতেই চুপচাপ। রায়হানের বিষয়াদিতে তো আরো চুপচাপ। যখন রায়হান তার বাবাকে প্রথম বিয়ে নিয়ে বলে বা কনভেন্স করার চেষ্টা করে তখনও সুমনা বেগম ছিলেন নিশ্চুপ। তার যেনো কোন মতামতই নেই এই বিষয়ে। আজ সম্মন্ধ ঠিক করতে গিয়ে শুধু রায়হান কে এনগেজমেন্টের আংটিটা পড়িয়ে দিতে বলেছেন। তাছাড়া তার মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বের হয়নি। তিনি যেন তাদের সাথে থেকেও নেই। বাসাতেও ঠিক এমনই। তার সাথে রায়হানের বা রায়হান বিষয়ে খুব খুব কম কথা হয়। দরকার ছাড়া একে অপরকে কেউই কথা বলেনা।

আলিশা নিচ তলায় অন্দরমহল থেকে করিডোরের দিকে পা বাড়ায়। সে বেশ উৎফুল্ল, উৎদিপ্ত। তার বড় ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হইছে, সে আনন্দ করবেনা তো কে করবে , ! এক হাসিখুশি মুখ নিয়ে সাথীদের রুমে ঢুকে সে। 

সাথী বেগম জানালার পাশে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে এক পানে চেয়ে আছেন। জানালা দিয়ে পুকুরের অনেকাংশই দেখা যায়। সেদিকেই চোখ তার। আলিশা গিয়ে বিছানায় বসে বলে। 

– মামিমা , ! কী করো , ! 

সাথী বেগমের ঘোর ভাঙ্গে আলিশার কথায়। তিনি তার মাথা উঠিয়ে তার দিকে ফিরে তাকান। ভালো করে বসে বলতে থাকেন। 

– কখন এলি তোরা , ! 

– এইতো মাত্রই। যানো মামিমা। নিপা ভাবিকে আজ আগের থেকেও বেশ সুন্দর লাগছিলো। একদমই সাজুগুজু করেনি। শুধু ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়েছে আরকি। তাছাড়া আর কিছুই দেয়নি বলে। তাও ভাবিকে দারুন লাগছিলো। দাঁড়াও তোমাকে ছবি গুলো দেখাই। (তার ছোট হাত ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে) ভাইয়ার ফোনটা নিয়ে ভাবি আর ভাইয়ার কয়টা ছবি তুলেছিলাম আমি। (ফোন বের করে ছবি গুলোতে গিয়ে) এই যে দেখো।

আলিশা বিছানায় উঠে গিয়ে সাথীকে ছবি গুলো দেখাতে থাকেন। ছবিতে নিপা আর রায়হানকে বেশ দেখাচ্ছিলো। রায়হানের হাসৌজ্জল মুখ থাকলেও নিপার মুখ লজ্জায় লাল ছিলো। 

ছবি গুলো দেখে সাথী বেগম বলতে থাকেন।

– হুমম, সুন্দর আছে। ডেট কবে ঠিক করলো , ? 

– সামনের ১৪ তারিখ। আর একদিন আগে মানে ১৩ তারিখ গায়ে হলুদ। 

– হুমম। বেশ তাড়াতাড়িই সময় ঠিক করে ফেলছে, ! 

– হ্যা। রায়হান ভাইয়ার আব্বু বললো যে শুক্রবার রায়হান ভাইয়া নাকি ঢাকা যাবে। এইজন্য বুধবারই বিয়েটা সেরে ফেলতেছে। 

– রায়হান ভাইয়ার আব্বু মানে , ? তোর তো মামা হয় , ? 

আলিশার হাসৌজ্জল মুখ যেন নিমেষেই উধাও হয়ে এক অভিমানি মুখশ্রি ভেসে উঠে সাথী বেগমের সামনে। মুখ অন্যদিকে দিকে ঘুরিয়ে বলতে থাকে‌।

– যে তার বোনকে শত্রু ভেবে মারতে পারে। (সাথী বেগমের দিকে তাকিয়ে) সে আর যাই হোক আমার মায়ের ভাই হইতে পারে না। তার ক্ষেত্রে আমার মামা তো দূর কোন সম্মানসূচক কথাই বের হবেনা। 

– এসব কী বলিস। নজরুল ভাইয়ের সামনে এভাবে কখনো বলতে যাইস না। উনার কিন্তু মাথা গরম হইলে দিকবিদিক দেখেন না। তুই চুপচাপ থাকিস। (একটূ থেমে) আচ্ছা তোর মায়ের সাথে কাল রাতে তোর কী হইছিলো। মানে কী নিয়ে তোর মা এমন আত্মহত্যাতে সরাসরি চলে যায় , ? 

সাথী বেগমের কথা শুনে আলিশার অভিমানী মুখ নিমেষেই বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। মাথা নিচু করে বলে। 

– কাল রাতে মা খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে গিয়েছিলো। তখন আমি মায়ের ঔষধ গুলো আর পানির গ্লাস নিয়ে তার সামনে যাই। আর ঔষধ গুলা দেখা মাত্রই তিনি আমাকে ধমক দিতে থাকেন। দূরে সড়াতে বলেন সেই ঔষধ গুলাকে। আমি ঔষধ খাওয়াতে জোরাজুরি করায় আমার হাত থেকে গ্লাস টা নিয়ে ভেঙে ফেলেন আর একটা কাঁচের টুকরো উঠিয়ে , (একটু থেমে) তারপর তো বাকিটা , (বলেই এক মলিন মুখশ্রী নিয়ে সাথীর দিকে তাকায় আলিশা। 

– থাক, মন খারাপ করিস না। হঠাৎ যে কী থেকে কী হয়ে গেলো। আর তোর মাও তো আগে এমন ছিলো না। এমনকি বেশ বুদ্ধিমান আর চাক্ষুষ মহিলা ছিলেন তিনি। এই বাড়িতে যখন আমি আসি তার ব্যবহার আমার ভালো লেগেছিল। তবে হঠাৎ করে যে আস্তে আস্তে কী হয়ে গেলো , ! তার স্বামীও মারা গেলো‌। তার , (কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যান সাথী। তাকে থেমে যেতে দেখে আলিশা বলে‌।

– তারপর, ? 

– ত,তারপর, ! তারপর এ,এই অবস্থা। (একটু থেমে) আচ্ছা বাদ দে সেসব কথা। অতীত মনে করলেই তো আর বর্তমান বদলে যাবে না। চল ভাত খেয়ে আসি। দুপুর অনেক হইছে, ! 

– আমরা তো খেয়ে আসছি মামিমা। পেট টইটম্বুর হয়ে আছে। তুমি গিয়ে খেয়ে নাও। 

– ও, আচ্ছা তাইলে আমি খেয়ে আসি। বেশ ক্ষিধা লেগে গেছে আমার। (বিছানা থেকে নামতে নামতে) আর শোন। তোর মায়ের জন্য ভাত নিয়ে যা। আয় আমার সাথে। 

– মা ভাত খায়নি , ! 

– আমাকে তো তোর মা এখন দেখতেই পারেনা। আমি ভাতের প্লেট নিয়ে গেলে যদি আবার রাগারাগী করে‌। তাই আর যাইনি। তোর অপেক্ষাই করতেছিলাম এতক্ষণ। চল আমার সাথে। ভাত নিয়ে যা তোর মায়ের জন্য। (বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে) আর তোর মায়ের চোখটা নিয়ে চিন্তা করিস না। আজকে রায়হান ডাক্তার দেখাবে বলেছিলো‌। সে নিশ্চয়ই দেখাতে নিয়ে যাবে। চল।

 

আলিশা আর কিছু বলে না। সাথী বেগম কে ধরে ধরে নিয়ে যেতে থাকে ঘর থেকে। ঘর মানবশূন্য নিশ্চুপ হয়ে যায়।

 

 

তানিয়ার চোখ খুলছে। তার পাশে উৎসুক হয়ে বসে আছে সামিহা, দিথী আর কানিজ। তখন তার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর তাকে ঘরে নিয়ে আসে কানিজ আর সামিহা মিলে। এনে শুইয়ে দেয় দিথীর বিছানায়। প্রায় বেশকিছুক্ষণ জ্ঞানহীন থাকার পর এখন তার চোখ ধীরে ধীরে খুলছে।

 তানিয়া চোখ পুরোপুরি খুলে‌। তার পাশে বসে থাকা দিথী-সামিহাদের অবাক হয়ে দেখে। তারপর বিছানায় উঠে বসতে চেষ্টা করে। সামিহা আর কানিজ তাকে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করে‌। তানিয়া উঠে বসতেই দিথী এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দেয়। তানিয়া পানির গ্লাস টা তার হাতে নিয়ে দিথীর দিকে একবার আলতো দৃষ্টিতে দেখে তারপর পানি টা এক ঢোকে শেষ করে ফেলে। সামিহা গ্লাসটা টেবিলে রাখে। দিথী এসে সামিহার ঠিক পাশটায় বসে। তানিয়াকে বলতে থাকে। 

 – আপু। তুমি কোথায় গিয়েছিলে কাল রাতে ? 

তানিয়া তার মাথায় হাত রেখে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। চোখের পাতা গুলো বারবার বন্ধ-খোলা করতে থাকে মাতালের মতো। তারপর বলে। 

– আমি, আমি কাল রাতে ঘর থেকে বেড়িয়ে আঙিনায় দাঁড়িয়েছলাম। হ্যা। আঙিনায় দাঁড়িয়েছিলাম। আমার ফোনে নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলো না, তার উপর আমাকে প্রজেক্টের কিছু জিনিস হোয়াটসঅ্যাপ এ পাঠাতে হতো। আমি কাল রাতে আঙিনার কাঁঠাল গাছ টার ঐদিক যেতেই গাছের উপর জ্বল জ্বল করতে থাকা দুটি চোখ দেখতে পাই। ভয়ে দৌড়ে আসতে যাবোই তখনই হঠাৎ আমার পিঠ দিয়ে কী যেন আমার দেহে প্রবেশ করে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। 

– হনুফা ছিলো সেটা। সে তোমার শরীরে প্রবেশ করে আমায় মারতে চেয়েছিলো। ভাগ্যিস আমি সেই স্বপ্নটা আগেই দেখতে পেয়েছিলাম। নাইলে(তানিয়ার দিকে ফিরে) নাইলে আজ আমার জানাজার নামাজ পড়তে আসতো লোকজন। 

– কোন স্বপ্ন ,! কীসের স্বপ্ন , ? 

– তোমায় পড়ে বলবো সব। তুমি এখন রেষ্ট নাও। তোমার শরীরের অনেকটা এনার্জিই হনুফা শুষে নিয়েছে। তোমাকে স্বাভাবিক হতে হবে। 

– আ, আচ্ছা। 

তানিয়াকে শুইয়ে রেখে দিথী উঠে যায়। তানিয়ার পাশে এখনো বসে রয়েছে সামিহা আর কানিজ। 

দিথী উঠে এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। বাইরের মেঘলা আকাশ তার চোখের পাতা শিথিল করে। বেজার মনকে শান্ত করে। তখনই তার চোখ যায় বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে মেইন গেটের দিকে। দেখে গেইট দিয়ে উঁকি দিয়ে দিথীর দিকে তাকিয়ে ছিলো সুমু ওরফে আসুভে। দিথী তাকে দেখে ভয় পায়নি। হাত উঠিয়ে নিজের মধ্যাঙ্গুলি দেখায় আসুভেকে। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তার।

 

 

খাঁন বাড়ি। আলিশাদের রুম। সুরাইয়া বিছানায় শুয়ে আছেন। বাম চোখ আধখোলা আর ডান চোখ পূর্ণ খোলা অবস্থায়। তার পাশে বসে আছে আলিশা। বিছানার সামনে এক চেয়ারে বসে সুরাইয়াকে পর্যবেক্ষণ করছেন এক ডাক্তার। আর ডাক্তারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নজরুল সাহেব। ডাক্তার কিছুক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করার পর উঠে দাঁড়ালো। আলিশা উৎসুক হয়ে ডাক্তারের বাণী শোনার অপেক্ষায় তাকালো। কিন্তু সুরাইয়া বেগম এক জীবন্ত লাশের মতো শুয়ে রইলো। কোন অনুভূতিই যেন নেই তার মাঝে। 

ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে স্টেথস্কোপ যন্ত্র গলায় ঝুলিয়ে নজরুল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

– চোখের অবস্থা ভালো না। চোখে রক্ত জমে রয়েছে। আর আমি যা দেখলাম চোখের মণিতেও অনেক আঘাত লেগেছে। এখন আমি তো সাথে করে তেমন কোন জিনিস আনিনি যে চোখের পাতাটা খুলে ভিতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবো। তবে যা দেখলাম তাতে তাকে হসপিটালে এডমিট করাতে হবে। 

– হসপিটালে ? চোখের চিকিৎসা এখানে হবে না ? 

– হবেনা যে তা বলা যায় না। এখনকার সময়ে ঘরকেই হসপিটাল বানানো যায়। তবে খরচ পড়বে দিগুনেরও বেশি। 

– তা পরুক। এইখানে সকল চিকিৎসা আর চোখ ঠিক করার ব্যবস্থা করেন। এই নজরুল খানের টাকার প্রতি কোন টান নেই। নিজের বোনকে সুস্থ করাবো। তাতে যা লাগবে লাগুক। 

– হ্যা। তাইই, (একটু থেমে) বাই দা ওয়ে, উনার চোখে এমনটা হলো কীভাবে, ? 

– আঘাত পেয়েছে। বাথরুম পড়ে যাওয়ার সময় বাথরুমের কলটা চোখের সাইডে বারি লাগে। (একটু থেমে) রক্তও বেড়িয়েছে অনেক, ! (মাথা নিচু করে নাক টানতে টানতে) আমার দারা আমার বোনের এই কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি দ্রুত কালকেই চোখের ট্রিটমেন্ট শুরু করুন‌। এই রুমেই ট্রিটমেন্ট করুন। 

নিজের মামার মুখ থেকে এই কথা শুনে যে আলিশা আকাশ থেকে পড়লো। তার মামা এতো বড় মিথ্যা কথাটা কীভাবে বলতে পারলো। এইটা কী আদেও তার মায়ের ভাই না কোন মুখোশ রুপি শয়তান , ! 

– ওকে ওকে নজরুল সাহেব। আপনি শান্ত হোন। কালকে এসেই চোখটা ওয়াশ করে, ভিতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবো। তারপর কী করা যায় তাও দেখবো। 

– জ্বী ডাক্তার। চলুন আপনাকে আমি এগিয়ে দেই।

– জ্বী চলুন।

ডাক্তারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ডাক্তারকে নিয়ে চলে যেতে থাকে নজরুল সাহেব। আলিশা যেন কাল আর আজ নজরুল সাহেবের দুই রুপ দেখালো। একই দেহের দুই সত্তার পার্থক্য অবলোকন করলো। সুরাইয়া বেগম আলিশার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকান। আলিশার অবাক হওয়া দেখে বলতে থাকেন। 

– ধীরে ধীরে আরো অনেক কিছু দেখবি , ! অনেক কিছু , ! 

 

 

সন্ধ্যা নেমেছে। আহনাফ এক হাতে কাগজের ঠোঙায় কিছু হালকা নাস্তা আর এক হাতে ফোন চাপতে চাপতে হসপিটালের ভিতরে ঢুকে‌। এখন হাসপাতালের করিডোরে লোকারণ্য কম। সকাল বেলা যা লোকের চাপ ছিলো বাবারে বাবা। চলতে গিয়েই ৪-৫ জনের ধাক্কা খেয়েছিলো সে। 

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সেই বিকেলে বেড়িয়েছিলো নাস্তা আনতে। বিকেল পেড়িয়ে সূর্য অস্ত গেলো তারপর সে হসপিটালে আসতে পারলো। সব হোটেলেই ভিড়। দারুন ভিড়। আশেপাশে হোটেলই মোটে ৪ টা। অনেক ঠেলাঠেলি করে শেষ পর্যন্ত সে নাস্তা গুলা আনতে পেরেছে।

দরজা খুলে কেবিনে ঢুকলো আহনাফ। আফরিনের মা এখনো সেন্সলেস। আজ সকালে যখন তারা আনতে গিয়েছিলো তখন থেকেই সেন্সলেস। আহনাফ তার ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। সে বেডের কাছাকাছি এসে দেখে চেয়ারে বসে আফরিন তার মায়ের পাশেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা বেশ ক্লান্ত। না জানি কতদিন থেকে তার মায়ের জন্য কাজের সন্ধান করে ঘুরে ফিরছিলো। মেয়েটার মুখশ্রী উজ্জ্বল। থুতুনির সাইডে একটা ছোট কাটা ‌দাগ। হয়তো কিছুদিন আগেই কেটেছে। মুখে আর কোন দাগ নেই। ঘুমন্ত অবস্থায় যেন তাকে আরো নিষ্পাপ শিশুদের মতো লাগছে। বন্ধ চোখ গুলো যেন আহনাফের ফোনের প্রতি টান টাকে নিমেষেই হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়। আহনাফ একটা চেয়ার নিঃশব্দে টেনে আফরিনের থেকে কিছুটা ফাঁকা রেখে বসে। সেও বেডে মাথা রেখে আফরিনের দিকে তাকায়। আফরিন চোখ খুললেই যেন তার চোখে আগে চোখ পড়বে। আহনাফের কাল থেকেই কি যানি একটা হয়েছে। অপরিচিত এই মেয়ের মুখশ্রী সে ভুলতেই পারছেনা। সবসময় আফরিনের ভয় পেয়ে মাথা নিচু করা, ছলছল চোখ নিয়ে এক মেঘলা আকাশের মতো তার দিকে তাকানো। সবই যেন তার চোখের পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আহনাফের সাথে তার জাত,পাতের মিল নেই। দুইজনের স্ট্যান্ডার্টও আলাদা। কিন্তু তারপরও কিছু একটা তার মাঝে কাজ করছে আফরিনকে নিয়ে। যা আর অন্য কোন মেয়ের ক্ষেত্রে কাজ করেনি তার। আহনাফ বেডে মাথা রাখা অবস্থায় হাত বাড়িয়ে আফরিনের নরম গাল আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে ছোঁয়। গাল গুলো যেন তুলার চেয়েও নরম। আহনাফের মুখে এক মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। সময়ের কাঁটা চেষ্টা করতে থাকে মুহুর্ত টাকে থামিয়ে দিতে‌। কিন্তু তাও যেন আজ এই দুজনার মাঝে অসহায় , ! 

 

 

একটা লম্বা করিডোর। করিডোরের দু পাশে অনেক গুলো রুমের দরজা চলে গিয়েছে। উপরে লাইট জ্বলছে। একজন কালো বুট জুতো পড়ে হেঁটে আসছে‌। ফরমাল প্যান্ট হ আর হুডির রং কালো দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না যে সে কে, ! 

রন্জুর বাকি দেহ টুকু আমরা দেখতে পেলেও  দেখতে পাইনা তার মুখশ্রী। রঞ্জু হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে করিডোর দিয়ে। হঠাৎ এক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায় সে। দরজার দিকে ফিরে তাকায়। দরজার উপর লেখা ৫০৫। সে দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজাটা আস্তে করে ধাক্কা দিতেই তা খুলে যায়। ভিতরে অপারেশন থিয়েটারের মতো সব যন্ত্রপাতি। তবে পুরো রুম অন্ধকার, শুধু মাঝে এক যায়গায় উপর থেকে সাদা আলো পড়ছে। একজন মেয়ে ডাক্তার বেডে শুয়ে থাকা এক মহিলার দেহ থেকে অর্গাম বের করছে। তার কিছুটা দূরে আঁধারে দুইজন বন্দুক ধারী বন্দুক নিয়ে রুমের সিকিউরিটির দায়িত্ব নির্দিধায় পালন করছে। বেডে শুইয়ে রাখা মহিলাটা আর কেউ নয়। সেই সর্দারনি।

 রন্জু এসে ডাক্তার সিমিনের পাশে গিয়ে হেলে দাঁড়ায়। রন্জুকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে চমকে উঠে ডাক্তার সিমিন। চোখ থেকে গগলস খুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাপো কাপো কন্ঠে বলে। 

– আ, আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। 

– ওয়ালাইকুমুস। কাজ কতদূর , ! 

– এ,এইতো স্যার হয়ে এসেছে। আর শুধু চোখ গুলো নেওয়া বাকি। 

– হুমম। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো। এই মাল গুলো আজই ভেলিভারি হবে। (সিমিনের দিকে তাকিয়ে) ভয় পাওয়া ভালো। এতে শরীর আর দেহ, দুটোই বেঁচে যায়। আর যারা ভয় পায়না তাদের কী হয় ,! 

– এ,এর মতো। এর মতো অবস্থা হয়। (বেডে শুইয়ে রাখা সর্দারনিকে দেখিয়ে কাপো কাপো গলায় বলতে থাকে সিমিন)

– গুড। বুদ্ধিমানদের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ঠ ,!

– জ,জ্বী স্যার। 

– কাজ দ্রুত শেষ করো। তোমার হাতে আর মাত্র ১ ঘন্টা সময় রয়েছে,! কয় ঘন্টা ,? 

– এ,এক ঘন্টা। 

– হুমম। 

রঞ্জু ফিরে চলে যেতে থাকে দরজার দিকে। সিমিন আবার বেডের পাশের চেয়ারে বসে চোখে গগলস পড়ে নিয়ে কাজে হাত দেয়। রঞ্জু দরজার কাছাকাছি চলে আসার পর পিছনে না ফিরেই বলে।

– ওর দেহের অগ্রভাগ থেকে একটা মেমরি কার্ড খুঁজে পাবে। পাওয়া মাত্র আমার রুমে তা পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। 

(রন্জূর হঠাৎ কথা শুনে আবার চকিতে রঞ্জুর দিকে ফিরে তাকায় সিমিন। বলে

– হ,হয়ে যাবে স্যার। হয়ে যাবে। 

রঞ্জু সিমিনের কথা শোনা মাত্রই রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সিমিন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। রন্জুকে সে মারাত্মক ভয় পায়। কাজের একটু এদিক ওদিক হলেই শেষ। নিজের হাতে নিজের কবর খুঁড়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে যাবে তখন তার। 

 

রঞ্জু সেই ঘর থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে করিডোর দিয়ে ফিরে যেতে থাকে। তার হাঁটার মাঝে ছিলো এক নিশ্চিন্তে চলার আভাস, এক চিন্তামুক্ত ভঙ্গিমা। সে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা রুমের ভিতর থেকে কয়েকজন মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। রুমের দরজার উপরে লেখা ৩০৩‌। রঞ্জু সেই রুমের সামনে দাঁড়ায়। দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। এই রুমটা ছিলো আগের রুম গুলোর থেকে বড়ো। পুরো ঘরে উজ্জ্বল আলো। রুমের মধ্যে ছিলো ২৫-৩০ জন মেয়ে। তাদের পাহারা তে ছিলো ৮-৯ জন বন্দুক ধারী রন্জুর লোক। রুমের সবাই কাঁদছিলো না। কাঁদছিলো মাত্র ৪ জন মেয়ে। তারা এখান থেকে বের হবার জন্য কাঁদছিলো। আর বাকিরা ছিলো চুপচাপ। বাকি চুপচাপ মেয়েদের মধ্যে সেই দু’জনও ছিলো। যারা আফরিনকে জোর জবরদস্তি করে সেই পতিতালয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বুঝতে আর বাকি রইলো না, এরা সবাই সেই পতিতালয়েরই নারী। 

রন্জুর উপস্থিতি দেখে সেই ৪ মেয়ে কান্না কিছুটা থামালেও রন্জুকে তারা ভয় পাচ্ছিলো। রন্জু সেই ৪ জন মেয়ের দিকে এগিয়ে যায়। রুমের এক কোনায় তারা ৪ জন ছিলো। বাকি পতিতারা চুপচাপ দেখছিলো কী হয়। রন্জু এগিয়ে গিয়ে সেই ৪ মেয়ের সামনে হেলে বসে। মেয়েগুলো ভয়ে আরো গুটিসুটি হয়ে যেতে থাকে দেওয়ালের কোনে। রন্জু এক ভারি গলায় বলে। 

– এইখানে যে কাঁদা নিষেধ, তা তোমরা জানো না, ! 

– বস আমি বলছিলাম কিন্তু,

রন্জু এক হাত উঠিয়ে তার গার্ডকে থামিয়ে দেয়। মেয়েদের বলে।

– কাঁদছো কেনো , ?

– আ,আমাগোরে ছাইড়া দেন। আমরা এই কামে নিজ ইচ্ছায় আহিনাই। এরা(বাকি চুপচাপ থাকা পতিতা মেয়েদের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) এরা আমাগোরে জোর কইরা লইয়া আইছে এই লাইনে। আমাগো কোনো দোষ নাই। আমাগোরে ছাইড়া দেন, আমাগোরে ছাইড়া দেন, (বলেই মেয়ে গুলো কাঁদতে থাকে) 

– বাড়িতে কে কে আছে ,! (হালকা শীতল গলায়)

– আমার মায়ে নাই, বাপে আমাগোরে ছাইড়া চইলা গেছে। আমার একটা ছোড ভাই আছে। (১ম মেয়ে)

– আমি এতিম। আমার কেউ নাই। (২য় মেয়ে)

– আমি আর ও (তার পাশের একজনকে দেখিয়ে) বইন লাগি। আমাগোরো কেউ নাই। আমরাও এতিম। আমাগোরে ছাইড়া দেন। আমরা বাঁচতে চাই , ! 

রন্জু তাদের কথা শুনে উঠে দাঁড়ায়। চলে যেতে থাকে গেইটের দিকে। তখনই হঠাৎ থেমে এক গার্ডকে মুখ না ঘুরিয়েই বলে‌।

– এই চার জনকে ২০১ এ নিয়ে আসো।

– আমাগোরে ছাইড়া দেন। আমরা এইসব কামে আর কহনো আমুনা। আমাগোরে মাইরেন না। (বলেই সেই মেয়ে গুলো চিৎকার করে কেঁদে উঠে। তারা ভেবেই নিয়েছিল যে তাদের ৪ জনকে আগে মেরে ফেলা হবে। তারা আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকে। রঞ্জু তাদের দিকে ফিরে আর কিছু বলে না। সে দরজা দিয়ে বের হতে যাবেই তখনই চুপচাপ থাকা মেয়েদের মধ্যে এক মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে। 

– এই মাগির দল। তোরা এতো কানতাছোস কিয়ের লাঈগা, ? তোরা নতুন আইছোস শুইনা তোগোরে আগে ভোগ করার লাইগা নিয়া যাইতাছে। তোগোরে মারবো এইডা কেডায় কইছে ,! চুপচাপ যাইয়া যা খাইতে চায় খাওয়াইয়া আয়। আমাগো মতো পতিতারে ধইরা আনছে নাকি মারার লাইগা, ! কেন দেশে কী মানুষের অভাব পড়ছে , ! আসল কথা হইতাছে যে আমাগোরে ভয় দেহাইয়া ভোগ করবো। তো এইহানে ভয় পাওয়ার কী আছে, ! আগেও যা করতাম এহনো তাই করুম। খালি খালি কানের সামনে প্যান প্যান করতাছোস তোরা। যা গিয়া কয়ডা কিক খাইয়া আয়। এইসব রন্জু খালি নামেই আছে, কামে,

বাকি কথাটা বলার আগেই ঘরে পর পর ৪ টা লাগাতার গুলির শব্দ। মেয়েটার ঝাঝড়া মুখ সহ দেহটা ধপ করে ফ্লোরে পড়ে গেলো। তার পাশে থাকা নিঃশ্চুপ মেয়েরাও হঠাৎ এরকম কান্ডে ভয় পেয়ে সামনে তাকায়। দেখে রন্জু দরজার দিকে ফিরা অবস্থাতেই তার এক হাতে বন্দুক সহ ডান দিকে ঘোরানো। ঠিক মেয়েটার বরাবর বন্দুক এখনো তাক করা। বাকি মেয়ে গুলোও এমন মৃত্যু দেখে সাথ সাথেই চিৎকার আহাজারি শুরু করে দিলো। ৪ জন মেয়েকে গার্ড রা ধরে বাইরে নিয়ে যেতে থাকে। ৪ জন মেয়ে খুব কাঁদছে। আগের থেকেও বেশি কাঁদছে। গার্ড দের পা ধরে বলছে তাদের ছেড়ে দিতে‌। গার্ড রা জোর করে তাদের আনতে থাকে। একটা মেয়ে যে বলেছিলো পাশের জন তার বোন হয়। গার্ড তার সাথে পেড়ে না উঠে তার মুখে এক জোড়ে লাথি দেয়। আর সাথে সাথেই মেয়েটা “মা,” বলে চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। বুট জুতো পড়া ছিলো সেই গার্ড তাই মেয়েটার নাক মুখ ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। রন্জু সাথে সাথে ঘার ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। দেখে মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে ফ্লোরে গোঙাচ্ছে। সাথে সাথেই রন্জু চোখের পলকে তার পিঠ থেকে এক চাকু সোজা সেই গার্ডের কপাল বরারব ছুড়ে মারে। ছুরি গিয়ে পুরোটা কপালে ভিতর ঢুকে যায়। গার্ড ধপ করে ফ্লোরে পড়ে যায়। এমন কান্ড দেখে সবাই একদম হতবাক। ঘরে কাঁদতে থাকা সবাই একদম চুপ হয়ে যায়। শুধু ফ্লোরের উপরে ছোট মেয়েটা মুখে হাত দিয়ে গোঙাচ্ছে। মেয়েটা বেশ ছোট। বয়স ১৩-১৪ হবে। রন্জুর ধীর পায়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েটাকে ধরে আস্তে করে উঠে বসায়। মেয়েটার হাত মুখ থেকে সড়িয়ে দেখে মেয়েটার নাক ফেটে গেছে। মুখের ঠোঁট ফেটে গেছে। রন্জুর মাথা যেনো আরো গরম হয়ে যায়। সাথে সাথেই হাতে থাকা বন্দুক টা দিয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা সেই গার্ডের শরীরে লাগাতার গুলি করতে থাকে। গার্ডের শরীর টা কিছুটা নড়ে উঠে থেমে যায়। ঘর শান্ত হয়ে যায়। ছোট্ট মেয়েটাও তার কান্না থামিয়ে দেয়। রন্জু উঠে দাঁড়ায়। বাকি ‌গার্ড দের উদ্দেশ্য করে বলে।

– এই ৪ জনের গাঁয়ে যেনো বিন্দু মাত্র ব্যাথা না লাগে। আর ওর (নাক-মুখ ফেটে যাওয়া ছোট মেয়েটার দিকে আঙুল দিয়ে) ওকে ডাক্তার সিমিনের কাছ থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনো। (একটু থেমে) আর এই দুটো লাশ কে যায়গা মতো ফেলে দিয়ে আসো। এই ৪ জন মেয়ে ব্যাতীত বাকি মেয়েদের প্ল্যান অনুযায়ী যা করার কথা তা করো। 

– ও,ওকে স্যার। (রুমে থাকা সকল গার্ড এক সাথে বলে উঠে) 

রন্জু বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। সেই ৪ জনও এখন কান্না থামিয়ে নিজ থেকেই রঞ্জুর গার্ডদের সাথে করে চলে যেতে থাকে। তাদের কাছে কেমন যেনো লাগলো বিষয় টা। তখনই তাদেরকে যেই গার্ড নিয়ে যাচ্ছিলো সে বলে।

– মেঘ দেখে ভয় পেয়োনা। তার আড়ালে সূর্য হাসে ,!

 

 

রাত হয়েছে অনেক। পাখিরা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। আলিশাদের ঘর। আলিশা ঘুমুচ্ছে। জানালা খোলা। বাইরে থেকে আসা জোছনায় ঘরের একাংশ ‌মৃদু আলোকিত হয়েছে। সুরাইয়া বেগম চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার বাম চোখটা খুব ব্যাথা করছে। সেই চোখ দিয়ে কাল আবছা আবছা দেখতে পেলেও আজ তিনি কিছুই দেখতে পারছেননা। আলিশাকে সেই বিষয়ে বলেননি তিনি। কাল রাতে তিনি তার মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহারও করেছেন। তা নিয়ে এখন বেশ অনুতপ্ত কাজ করছে তার মাঝে। ডান ‌চোখ বেয়ে পানি ‌গড়িয়ে পড়লো। ভিতরে জ্বলতে থাকা কষ্টের আগুনের পাল্লাটা, যেনো দিন দিন আরো ভারি হয়ে আসছে।‌ আলিশাই তার একমাত্র সম্বল, একমাত্র আস্থা। এছাড়া যে তার কাছে সকলকেই মুখোশ ধারী শয়তান মনে হয়। মনে হয় এই বুঝি তার আলিশাকেও তার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিয়ে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত আলিশার দিকে তাকান তিনি। হাত দিয়ে আলিশার শরীরে কম্বল টা ভালোভাবে টেনে দেন। উঠে বসেন বিছানায়। চোখটা অনেক ব্যাথা করছে। মাথার বাম পাশ টা পুরো ব্যাথায় টনটন করছে। হাত দিয়ে ডান চোখের পানি মুছেন সুরাইয়া। উঠে নেমে দাঁড়ান বিছানা থেকে। এগিয়ে যান আলমারিটার ‌দিকে। আলমারির‌ দরজা নিঃশব্দে খুলে ভিতরে এক ড্রয়ার থেকে একটা এলবাম বের করেন। ড্রয়ার টা ‌লাগিয়ে আলমারিটাও‌ লাগিয়ে দেন। এসে বসন বিছানায়। এলবাম টা খুলেন। জোছনার আলোয় ছবি গুলো কিছুটা স্পষ্ট। কিন্তু তার মনে তো এগুলো জীবন্ত এক অধ্যায়। প্রথম ছবিতে সুরাইয়ার কোলে এক বাচ্চা, সুরাইয়াকে বেশ ইয়াং লাগছে দেখতে। তার পাশে দাঁড়ানো তার স্বামী মেহরাব আর তার মেহরাবের হাত ধরে আছে ছোট্ট আলিশা। সেই ৪ জনের সুখি পরিবার আজ শকুনদের নজরে পড়ে ২ জনায় এসে ঠেকেছে। আলিশাকেও হারানোর ভয় হয় তার। তাই আলিশাকে তিনি কারো সাথে মিশতে দেখতে পারেন না। এলবামের পরের পৃষ্ঠা উল্টান। সেখানে এক ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মেহরাব। ছবিটা দেখেই সুরাইয়ার কান্না বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে আসে। ছবিটাকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন সুরাইয়া। এক নিঃশব্দ কান্না। এক হারিয়ে ফেলার কষ্ট, বেদনা। এলবাম টাকে বুক থেকে উঠিয়ে চুমু খেতে থাকেন সুরাইয়া। আবার বুকে জড়িয়ে নেন। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। তার ছায়াকে সে নিজের চোখের সামনে কষ্ট পেতে দেখেছে। নিজ চোখের সামনে রক্তাক্ত হতে দেখেছে। তার চোখের সামনে যেন সবই ভাসছে। কেনো সে জন্ম নিলো এই খান বাড়িতে, ! এক দরিদ্র কুঠুরিতে কেনো জন্ম নিলো না তার। তাহলে হয়তো তার জীবন টা এতো দুর্বীসহ হয়ে উঠতো না। 

হঠাৎ করিডোর দিয়ে কারো হেঁটে আসার পায়ের আওয়াজ। সুরাইয়া বেগমের বুক মোচড় দিয়ে উঠে। ঠিক সেদিনের মতো। ঠিক সেই অভিশপ্ত রাতের মতো, ! আজ কার খুন করতে বেড়িয়েছে সে , ! কে তার শিকার হতে চলেছে ,! পায়ের আওয়াজ টা সুরাইয়ার রুমের খুব কাছাকাছি চলে আসে। এসে ঠিক তার দরজার সামনে থেমে যায়। সুরাইয়া বেগমের হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে। তখনই দরজার উপাস থেকে কেউ একজন বলে উঠে। 

– আজ আমি মারতে আসিনি। এসেছি সাবধান করতে। ভুলে যা সেই রুমের রহস্য, ভুলে যা সেইদিন যা দেখেছিলি। তোর চাক্ষুসতাই কিন্তু তোর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে রে সুরাইয়া ,! আর কত , ! 

 

চলবে ,,,,,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।