গ্রামের নাম আনন্দপুর

পর্ব :: ৪১

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

হঠাৎ করিডোর দিয়ে কারো হেঁটে আসার পায়ের আওয়াজ। সুরাইয়া বেগমের বুক মোচড় দিয়ে উঠে। ঠিক সেদিনের মতো। ঠিক সেই অভিশপ্ত রাতের মতো, ! আজ কার খুন করতে বেড়িয়েছে সে , ! কে তার শিকার হতে চলেছে ,! পায়ের আওয়াজ টা সুরাইয়ার রুমের খুব কাছাকাছি চলে আসে। এসে ঠিক তার দরজার সামনে থেমে যায়। সুরাইয়া বেগমের হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে। তখনই দরজার উপাস থেকে কেউ একজন বলে উঠে।

– আজ আমি মারতে আসিনি। এসেছি সাবধান করতে। ভুলে যা সেই রুমের রহস্য, ভুলে যা সেইদিন যা দেখেছিলি। তোর চাক্ষুসতাই কিন্তু তোর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে রে সুরাইয়া ,! আর কত , !

সুরাইয়া বেগমের বুকের হৃদস্পন্দন ধুকপুক শব্দ নিস্তব্ধ ঘরে প্রতিফলিত হচ্ছে। সুরাইয়া বেগম এক পা, দু পা করে পিছিয়ে যাচ্ছেন। তার গাল বেয়ে এই শীতের রাতে ঘাম বেয়ে পড়ছে। হঠাৎই তিনি তার কাঁধে হাত দেন। তার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। ধপ করে ফ্লোরে তার দেহ লুটিয়ে পড়ে। জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়া নারী তার হাত নামিয়ে নেয়। ছায়ার চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। ছায়া নারী ধীরে ধীরে সড়ে যায় জানালার ওপাস থেকে।

সুরাইয়া বেগমের অচেতন দেহ ফ্লোরে পড়ে আছে। কাঁধে ডান হাত, তার পাশে ফ্লোরে পড়ে আছে একটা অর্ধেক লাল বর্ণের ঔষধ স্মরৃদ্ধ ইনজেকশন। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিও চলে যেতে থাকে। তার পায়ের বুট জুতোর আওয়াজ নিম্ন থেকে নিম্ন হয়ে একসময় মিলিয়ে যায় বাতাসের মাঝে। এই মাঝরাতে কে মারলো তাকে ইনজেকশন , ? কে ছিলো সেই ছায়া নারী , !

 

 

 

দিথীর রুম। শীতের সকালের শুভেচ্ছা জানাতে জানালা দিয়ে ঘরে বয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা বাতাস। পড়ার টেবিলে সোয়েটার গায়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে দিথী। বিছানায় বসে তারই বই পড়ছে সামিহাও। সামিহা আর দিথী এক বয়সী। দিথী ভেবেছিলো সামিহা তার চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু না। ইন্টারের পর সামিহা আর পড়াশোনা করেনি। আর দিথী এবার অনার্স প্রথম বর্ষে। সামিহা ইন্টার পাশ করার পর সংসারের হাল ধরার জন্য প্রাইভেট পড়াতো। দিথীর ছোট সৎ ভাই নিবিড় কেও সেই প্রাইভেট পড়িয়েছিলো, আর এখনো পড়াচ্ছে তবে এখন বড় বোন হিসেবে।

দিথীর অনার্সের বই নেড়েচেড়ে একটু পড়ার চেষ্টা করছে সে। এই বছরে তো আর সে কলেজে এডমিট হতে পারবেনা। তাই এই বছর গ্যাপ দিয়ে পরের বছর অনার্সে ঢুকবে ।

দিথী বইয়ের উপর থেকে নজর সড়িয়ে সামিহার দিকে নজর ফিরিয়ে বলে।

– নিপার যে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনেছ আপু , ?

– হ্যা। কাল শুনলাম। রাতে নাজিয়া আন্টি বললো। আর আপু বলছো কেনো। তুই/তুমি করেই বলতে পারো। আমরা তো সমবয়সী বের হলাম আজ , !

– আরে না না সমস্যা নাই। আমি এতোদিন তোমাকে আপু বলে ডেকে আসছি‌। আজ হঠাৎ তুই,তুকারি করলে কেমন কেমন জানি লাগবে। (একটূ থেমে ধীর গলায়) শাহারিয়া যে কবে তার বাসায় বিয়ের কথা বলবে , !

– ওর সাথে কথা হয়না তোমার , !

– কাল রাতে হয়েছে। প্রতি রাতেই হয়। কিন্তু,

– একমিনিট, একমিনিট। আমিও তো তোমার সাথে ঘুমাই। কোনো রাতে তো দেখলাম না কথা বলতে , !

– আসলে, আসলে আমি বারান্দায় গিয়ে কথা বলি। ঘরে যদি তোমার ঘুমের সমস্যা হয়, তাই , !

– আমি ঘুমাইলে কেউ যদি আমাকে ধরে পুকুরে ফেলে দিয়ে আসে তাও আমার ঘুম ভাঙবে না।(মৃদু হেসে) আর তোমার ঐ ধীর কন্ঠের আওয়াজ , ! সে টা তো আরো দূরের কথা , !

– তারপরও আরকি। (একটু থেমে) নিপাও ভাগ্য করে একজনকে পাইছে। রায়হানকে পাইছে। কম ভালোবাসে নাকি একজন আরেকজনকে , !

– শাহারিয়াকে কী তুমি কম প্রেমিক পুরুষ বলছো নাকি , ! যতটা শুনেছি তোমাদের ভালোবাসার কথা, রাজরাণীর মতো রাখবে তোমায়। দেখিও ,!

– না না, তা না। নিপাকে বিয়ের কথা নিপাও তার ফ্যামিলিকে বলেছে আর শুনেছি রায়হান তার বাবাকে মানিয়ে তারপর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। কিন্তু এদিকে শাহারিয়াকে দেখো‌। ও হয়তো এখনো ওর বাবা-মায়ের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথাই বলেনি।

– হয়তো বলেছে, কিন্তু তুমি জানো না, ! (একটু থেমে মুচকি হাসি দিতে দিতে) ও বুঝেছি,!  শীতকাল তো,! আমাকে দিয়ে কী আর তোমার রাতের উষ্ণতা মিটবে ,! (বলেই এদিক ওদিক তাকাতে থাকে সামিহা)

খানিকটা লজ্জা পায় দিথী।

– যাও,! কীসব বলো , !

তখনই তানিয়া ঘরে প্রবেশ করে। হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে ৩ কাপ চা আর কিছু বিস্কুট। তানিয়া এসে দিথীর পড়ার টেবিলের সাইডে ট্রে টা রাখতে রাখতে বলে‌।

– কী নিয়ে এতো লজ্জা পাওয়া হচ্ছে শুনি , !

– না না। তেমন কিছুনা আপু ,! (দিথী)

– জানো আপু, ! দিথীর না(দিথী ইশারা দিয়ে সামিহাকে না করতে থাক) দিথীর না জামাই লাগবে, !

– এখনি জামাই , ! পড়াশোনা আর করবে না ও ? (ট্রে থেকে সামিহা আর দিথীর হাতে চা তুলে দিতে দিতে)

– আরে না আপু। তুমি ওর কথা শুনিও না। আসলে আমি নিপার বিয়ের কথা বলছিলাম।

– এই নিপাটা আবার কে , ? কাল নাজিয়া আন্টিকে এই নিপা নামের কারো কথা বলতে সুনলাম সামিহাকে (সামিহার সাথে বিছানায় বসতে বসতে বলে তানিয়া)

– ওর জামাইয়ের বোন , ! (দিথীকে দেখিয়ে কথাটা বলেই চায়ে চুমুক দেয় সামিহা)

– আপু , ! থামো প্লিজ , ! আর বলিও না,! (দিথী)

– দিথী রিলেশন করে নাকি , ! (দিথীর দিকে ফিরে তাকিয়ে) সত্যি নাকি দিথী,?

– না মানে আপু , ! (একটু থেমে) ঐ আরকি, !

– না না মজা না। সিরিয়াস করে বলো। সত্যি রিলেশন করো , ?(তানিয়া সিরিয়াস মুডে কথাটা বলে)

হঠাৎ তানিয়ার সিরিয়াস মুডে এই কথা বলতে শুনায় দিথী বলে।

– হ্যা আপু। তবে বেশি না, ১ মাসের রিলেশন আমাদের , !

– তুমি কী তার সাথে ডেটে গেছিলা বা কোন ঘনিষ্ঠ সময় কাটাইছিলা , ? সত্যি সত্যি বলিও কিন্তু , !

– ন,না আপু। ও তো আমার শুধু একবার কাঁধে হাত দিয়েছিলো। তাছাড়া ও আমাকে কখনোই স্পর্শ করেনি। (একটু থেমে) কেনো আপু, !

– ২৭ শে ডিসেম্বর মানে আসুভের বিনাশ তোমাকে কুমারী থাকা অবস্থায় করতে হবে‌। আমি আরো ভাবলাম রিলেশনে আছো। নিজের কুমারীত্ব হারিয়েছো নাকি আবার। এখনকার যুগের ছেলেমেয়েরা তো বিয়ের আগের ঘনিষ্ঠতা টাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।

– না, না আপু। এমন কিছুই হয়নি আমাদের মাঝে। ও তো উল্টো আরো দেখাই করেছে হাতে গোনা ২-১ বার আমার সাথে‌। এসব কিছুই হয়নি।

– তাইলে সমস্যা নাই। (একটু থেমে স্বাভাবিক মুডে) আচ্ছা সেসব বাদ দেও। চা টা কেমন হয়েছে বলো। সিলেটি স্টাইলে চা বানিয়েছি আজ আমি , !

– তাই তো বলি অন্যান্য দিনের চায়ের থেকেই আজকে এতো ডিফারেন্স কেনো , ! (সামিহা)

– ভালো হয়নি চা টা , !

– না না। চা তো দারুণ হয়েছে। এরকম স্বাদের চা প্রথম খেলাম। (দিথী)

– কখনো আমাদের সিলেটে আসিও। আমি সাতরঙা চা বানিয়ে খাওয়াবো তোমাদের , ! (বলেই চা-য়ে চুমুক দেয় তানিয়া)

– আচ্ছা আপু। (দিথী)

– হ্যা বলো।

– তুমি যে বলছিলা তোমার স্বামী, মেয়ে নিয়ে আমাদের পড়ে একদিন বলবা। কী হয়েছিলো তাদের , ! (একটু থেমে) না মানে তুমি যদি এখন বলতে চাও, তাইলে বলো। পরে বললেও সমস্যা নাই।

দিথীর কথা শুনেই এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তানিয়া। চায়ের কাপ টা হাতে নামিয়ে বলতে শুরু করে‌।

– এই অভিশপ্ত সময়কে ছেড়ে আমিও চেয়েছিলাম স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। সবার মতো আমিও এক স্বামী, সংসার নিয়ে বাঁচতে। কিন্তু এই অভিশপ্ত সময়, আমাকে আশা দেখিয়েও কেড়ে নিয়েছে। তুষারের সাথে আমার সিলেটে পরিচয়। ও আর আমি একসাথে চাকরি করতাম। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, তারপর ভালোবাসা।

বিয়ে করি আমরা দু’জন। ও আমার সবটুকু অতীত জেনেও আমাকে নতুন বাঁচার আশা দেখিয়েছিলো। বছর পেড়িয়ে ঘর আলো করে আমার ফাইজা আসে। সেও তার বাবার মতো সুন্দর হয়েছিলো। বাবার পাশ টায় গিয়েছিলো সে। মা, মা বলে ডেকে ডেকে সারা ঘর মাথায় তুলতো ও। আমাদের সংসার,সময় যেন আমার কাছে ইহকালের জান্নাত স্বরূপ ছিলো। খুব ভালোভাবেই যাচ্ছিলো আমাদের পরিবার। কিন্তু এই আসুভে, আসুভে আমার থেকে সব কেড়ে নেয়।

গাড়িতে করে আমরা শ্রীমঙ্গল যাচ্ছিলাম। তখনই এক রড ভর্তি ট্রাকের সাথে আমাদের প্রাইভেট কারের এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। তুষার আর, আমার ফাইজার শরীরে রড ঢুকে তারা এক যন্ত্রনা দায়ক মৃত্যুকে বরণ করে। (কাঁদো কাঁদো হয়ে) আমার ফাইজা আমার কোলে ছিলো।  ওর শরীরে,মাথায় রড বিঁধে আমার চোখের সামনেই ছটফট করতে করতে মারা যায়। আমি মা হয়েও তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। তাকে, আমার তুষারকে। বাঁচাতে পারিনি। আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে ও। ও আমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে‌। ওকে তুমি ছাড়বেনা দিথী। ওকে, ওকে তুমি কঠিন থেকে কঠিনতর মৃত্যু দিবে। ওকে ছাড়বেনা একদম।

দিথী চেয়ার ছেড়ে উঠে তানিয়ার পাশে গিয়ে বসে। তানিয়ার এমন অসহায় আত্মসমর্পণ, সে আগে কখনো দেখেনি। তানিয়া হঠাৎ কেঁদে ফেলায় তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে শান্ত করতে থাকে।

– কান্না করিওনা আপু। আমি, আমি অবশ্যই সবকিছুর প্রতিশোধ নিবো।(একটু থেমে টেবিলের খোলা বইগুলোর দিকে তাকিয়ে) অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে ওর সাথে আমার। ওকে সব কিছুর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সবকিছুর ,!

 

আঙিনায় কাঁঠাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আসুভে। সে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে গাছের উপর এক বিরক্তি সূচক ঘুষি মারে। সিন কাট হয়।

 

 

 

আঙিনায় দাঁড়িয়ে লায়লার সাথে কথা বলছেন শিউলি বেগম। রান্না বান্না আজ কী করতে হবে সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বিয়ের জন্য আত্মীয় স্বজনরা বাড়িতে আসতে শুরু করবে। তখন কোথায় কীভাবে সামলাবে সেসব লায়লাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কুয়াশা কমেছে। হালকা রোদ উঠেছে। বাড়ির আশেপাশের গাছে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক বেড়েছে।

মতিন মেম্বার বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন। পাঞ্জাবির হাতার বোতাম গুলো এক হাত দিয়ে লাগাচ্ছেন। শিউলি বেগম লায়লাকে রান্না ঘরের দিকে পাঠিয়ে চলে আসতে থাকেন মতিন মেম্বারের দিকে। মতিন মেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে তার পাঞ্জাবির হাতা নিজে নিয়ে লাগিয়ে দিতে থাকেন। বলেন

– ঠিকমতো বোতাম ডাও লাগাইতে পারেনা। কেমন মরদ কও দি এহন ,!

– আমিইতো লাগাইতে পারতাম। তুমিই আইয়া নিজে ধরলা।

– হইছে আর কইতে হইবো না। (একটু থেমে) কার্ডের ডিজাইন আমি পছন্দ করমু। তুমি কয়েকটা ডিজাইন শৈশবের হাতে দিয়া বাড়িত পাঠায় দিবা। বুজ্জো , !

– আইচ্ছা। দিমু নে।

– আর দেশি গরু নিয়ো। বিদেশি ডি নিতে যাইয়ো না আবার। ২ ডাই তো নিবা তাই না , ?

– হ। একটা দিয়া কী এতো লোক কাভার দেওয়া সম্ভব। দুইডা লাগবো।

– লগে খাসি কিন্না আনবা না খাসির কাঁটা গোস্ত আনবা ,?

– খাসিই নিয়া আমু। গোস্তের ক্ষেত্রে দাম বেশি পড়বো।

– আইচ্ছা। আর হুনো। পোলাওয়ের চাল সুগন্ধি দেইখা নিয়ো। আর তেলের লঘে ঘি ও লইয়ো। পোলাও ঘি দিয়ে রান্না হইবো। আর খাওয়ার শেষে দইয়ের ব্যবস্থা করতে হইবো। তুমি দইয়ের দোকানে ঐ হিসাবে অর্ডার দিয়া আইয়ো। আগে ভাগে অর্ডার না দিলে তহন একলগে এতো বেশি দই দোকানদার দিতে পারবো না। কইবা বিয়ার আগের দিন মানে ১৩ তারিখ আইয়া দিয়া যাইতে।

– আইচ্ছা কমু নে।

– আর প্যান্ডেলের লোক কবে আইবো।

– আইজ যাইয়া কইতে হইবো। প্যান্ডেল কই করবা।

মতিন মেম্বারের কথা শুনে আঙিনার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতে শিউলি বেগম বলে।

– এইহানে গায়ে হলুদের স্টেজ হইবো। এইহানে সুন্দর সুন্দর ছোট ছোট লাইট ব্যবহার করবো। পুরা বাড়িও এমন কইরা লাইট দিয়া সাজাইবো। আর খাওয়া দাওয়ার প্যান্ডেল বাড়ির পিছনের বাগানের সাইডে যেই বড় ফাঁকা যায়গাডা আছে। ঐহানে করবো।

– আইচ্ছা আইচ্ছা। আমি ডেকোরেশনের লোকরে সব কইয়া দিমু নে।

– হ। এহন যাও। দুপুরে তো মনে হয় খাইতে আইতে পারবা না। ঐদিকেই খাইয়া নিয়ো।

বলেই ঘরের দিকে চলে যেতে শিউলি বেগম।

– আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। আত্মীয়-স্বজন গো জানাইছো ? দাওয়াত দিছো ?

– কার্ডই তো তুমি এহনো রেডি করো নাই।

– ও হ। তাও তো কথা। আমি এহনি গন্জে যাইয়া মহসিনের দোকান থে কয়েক ডিজাইনের কার্ড পাঠাইতাছি। তুমি পছন্দ কইরা তাড়াতাড়ি কইয়া দিয়ো‌। আমি সব কইয়া রাখমু কী লেখতে হইবো না হইবো। বিকালের মইধ্যে ছাপানো কার্ড সবার ঠিকানায় পাডায় দিতে হইবো।

– আইচ্ছা দিয়ো। (একটু থেমে) তয় আমি ভাইয়ারে কইয়া দিছি কাইল রাইতেই। ওরা আইজ বিকালেই আইয়া পবড়ো।

– সায়েমগোরে জানায়াও দিছো , ? মিলি, পায়েল গোরেও ফোন দিতা। ওগোরেও ফোনেই জানাইতা‌।

– ফোন দিছিলাম। তোমার বইনের শরীর খারাপ। আর পায়েল মিলিগো পরীক্ষা চলতাছে। ওরা বলে আইতে পারবোনা।

– ও হ। আমারেও কইছিলো। সুলতানা নাকি অসুস্থ। আইচ্ছা সায়েম রা বিকালে আইতাছে। ওগো লাইগা রুম পরিস্কার কইরা রাইখো। সবাই আইতাছে তো ওগো, না ?

– হ। তুমি এহন যাও তাড়াতাড়ি। মেলা কাম বাকি এহনো। মেহমান সোদর সবডি আওয়া ধরলে তহন আর দিক দিশা পামু না। তুমি যাও‌। ঐদিককার কাম সামলাও।

– আইচ্ছা আইচ্ছা যাইতাছি‌। নিপারে কইয়ো বাইরে না যাইতে। ঘরে বইয়া যত প্রেম করার করুক।

– ঐডা তোমারে আর কইতে হইবো না। যাও এহন।

মতিন মেম্বার চলে যেতে থাকেন আঙিনা পেড়িয়ে গেটের দিকে‌। শিউলি বেগম শাড়ির আঁচল কাঁধে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে ঘরের দিকে চলে যান। রোদের তাপ বাড়তে শুরু করেছে। মনে হয় আজকে ভালোই গরম পড়বে। গাছে থাকা পাখিটাও রোদ পোহানোর জন্য আঙিনার এক কোনে তার ডানা মেলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। বেশ কয়েকদিন পর রোদের দেখা। মিষ্টতায় ভরা রোদের দেখা ,!

 

 

 

সুরাইয়া বেগমের চোখ খুলছে। তার বিছানার সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সবাই। বিছানায় তার আরেক পাশে ভেজা চোখ নিয়ে বসে আছে আলিশা। সবাই এক নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কোন শিকার কে অনেক গুলো শিকারি মিলে দেখছে। সুরাইয়া বেগম তার ডান চোখ খুলে ফেলেন। মাতাল চোখে একবার আলিশার দিকে ফিরে তাকান। তারপর একবার মাথা ঘুরিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়ানো বাড়ির সকল সদস্যদের দেখেন। তিনি উঠে বসতে চেষ্টা করেন। আলিশা তাকে ধরে। রায়হানও হাত এগিয়ে দেয়। সুরাইয়া বেগমকে উঠে বসায় দুজন ধরে। আলিশা ভেজা চোখ মুছে তার মা’কে বলে।

– ম,মা। তোমার কী হয়েছিলো। তুমি ফ্লোরে এভাবে কেনো পড়েছিলে ? আর, আর এই খালি ইনজেকশন,!(একটা ইনজেকশন তাকে দেখিয়ে) এটা তোমার পাশে কেনো ছিলো মা।

– তুমি কেডা , ! আর, আর আমারে মা কইতাছো ক্যান।

সুরাইয়া বেগমের নিস্পাপ চাহনি আর কথা শুনে উপস্থিত সবাই হতবাক হন। একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারপর সুরাইয়া বেগমের দিকে আবার তাকান। আলিশার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে এক হাত দিয়ে তার চোখ মুছে আবার সুরাইয়া বেগমের হাত ধরে। বলে।

– আ,আমি তোমার মেয়ে। আমি আলিশা। চিনতে পারছোনা আমায় , !

সুরাইয়া বেগম এক নেশাক্ত চোখে আলিশাকে আপাদমস্তক দেখে। তারপর মাথা নেড়ে বলে।

– না। তোমারে আমার চিনা চিনা লাগতাছে না। তুমি কেডা। আর, আর এরা(হাত দিয়ে বাড়ির বাকি সদস্যদের দেখিয়ে) এরা আমার দিকে এমনে চাইয়া আছে ক্যা। এরা কেডা , !

– মা, তুমি। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না , ! আমি তোমার আলিশা। তুমি আমাকে মা বলে ডাকতে। আমি আলিশা।

– তোমার (আলিশার গালে হাত দিয়ে)  তোমার চেহারা মেলা সুন্দর। তুমি কেন মিছা কথা কইতাছো। তোমার মা কেডায়। আমি, আমি তো তোমার মা না। আমার (মাথায় হাত দিয়ে) আমার মাথা খুব ব্যাথা করতাছে। আমার, আমার কিছু মনে পড়তাছে না। আমি কে। আমি এহানে (চারপাশের দেয়ালে তাকিয়ে) এতো বড় বাড়িতে কী করতাছি !

আলিশা কাঁদো কাঁদো হয়ে রায়হানের দিকে তাকায়। বলে।

– ভাইয়া। মা এসব কী বলতেছে। মা আমাকে চিনতে পারছেনা কেনো। ভাইয়া, ভাইয়া কিছু একটা করোনা। মায়ের কি হয়েছে।

– তুই থাম। (সুরাইয়া বেগমের পাশে বসে) ফুফু। ফুফু আমি রায়হান। আমাকে চিনতে পারছো , ?

– তুমি,। না। তোমারেও আমার চিনা চিনা লাগতাছে না। তুমি কেডা বাবা, ! (আলিশার দিকে ফিরে) ও ভালো মাইয়া। ওরা কেডা, আর আমারে এহানে ক্যান আনছে , ! মাইয়া তোমারে দেখতে শুনতে ভালো ঘরের মাইয়া মনে হয়। আমারে আমার বাড়িত দিয়া আহো। আমার, আমার এগোরে দেইখা কেরম জানি লাগতাছে , ! (বলেই আলিশার কাছাকাছি চলে যান সুরাইয়া)

– অয় অভিনয় করতাছে। ওর আইজ চোখের চিকিৎসা। অয় নতুন অভিনয় বাইর করছে (নজরুল সাহেব)

– বাবা, তুমি থামো তো। ফুফু,

– আমার গায়ে হাত দিবানা পোলা। আমার, আমার গায়ে হাত দিবানা। (বলেই আলিশার কাঁধের পিছনে নিজের মুখ লুকাতে থাকেন সুরাইয়া বেগম)

– আচ্ছা সরি। তুমি আমার ফুফু হও। আমি, আমি তোমার,

– তুই সর তো। (রায়হানকে সড়িয়ে দিয়ে) ডাক্তার, এদিকে আহো‌। অর চোখের কী হইছে না হইছে দেহোতো‌। এয় আমারে জ্বালায় মারতাছে‌।

– কিন্তু বাবা,

– তুই চুপ কর। সুরাইয়া নতুন বাহানা শুরু করছে। তুই, আর তোমরা সবাই। বাইরে যাও‌। এহন ডাক্তার অর চোখ দেখবো। কী চিকিৎসা করার করবো। বাইরে যাও।

– ম,মামা। আমি মায়ের সাথে থাকি ,!

– না। সবাই বাইরে যাইবো। যাও বাইরে যাও। কী হইলো শুনোনাই , ? যাও, (ধমক দিয়ে)

আলিশা ভয় পেয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। সে আস্তে করে বিছানা থেকে নামতে থাকে। সুরাইয়া বেগম তাকে যেতে দিতে নারাজ।

– ও ভালো মাইয়া, তুমি যাইয়োনা। এই খারাপ লোক, এই খারাপ লোকরে দেইখা আমার ডর করতাছে। তুমি যাইয়োনা। (আলিশার কাপড় ধরে তাকে থামিয়ে দিতে থাকে সুরাইয়া। নজরুল সাহেব বাকি সবাইকে ঘর থেকে বের করে দেন। আলিশার হাত ধরে জোরে হেঁচকা টান মেরে বিছানা থেকে নামান।

– ও ভালো মাইয়া তুমি যাইয়ো না। ভালো মাইয়া,

আলিশাকে জোর করে ধরে দরজা থেকে বের করে দেন নজরুল সাহেব। তারপর ২ জন নার্স আর ডাক্তারকে ভিতরে রেখে দরজা জোরে শব্দ করে বন্ধ করে দেন। আলিশা এসে রায়হানকে ধরে কাঁদতে থাকে। রায়হানেরও যেনো কিছু করার নেই। সেও এক হতাশা মুখ করে আলিশার মাথায় হাত বোলাতে থাকে। তার বাবার এই রুপ টা খুব খারাপ। যখন কিছু করবেন বলে ঠিক করেন। তার জেদ, তিনি ঐটা করবেনই।

দরজার বাইরে আলিশা আর রায়হানের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সাথী, শাহেদ, সাদিক, সুমনা বেগম, আর আঁখি। তখনই ভিতর থেকে সুরাইয়া বেগমের কান্না মিশ্রিত আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে।

– এই তোমরা কেডা। এই মাইয়া। আমারে ছোবানা। আমার, আমার হাত কেন বানতাছো। আহ, হাতে ব্যাথা পাইতাছি। হাত ছাইড়া দাও আমার , ! (একটু থেমে) এই লোক, এই লোক এইডা কী হাতে নিয়া আমার দিকে আগাই তাছে , ? আমার চোখে হাত দিয়েন না। আঁআআ,(জোড়ে চিৎকার দিয়ে) আমার চোখ, ও ভালো মাইয়া, আঁ, আমার চোখ, আল্লাহ,

– চুপ থাক বান্দির বাচ্চা, চুপ থাক ( নজরুল সাহেবের এই কথা আর তার সাথে সাথেই চড়, থাপ্পরের আওয়াজ আসতে থাকে ঘরের ভিতর থেকে)

আলিশা এসব শুনতে পেয়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে।

– আমার মা’কে ছেড়ে দাও। আমার মায়ের চোখে অনেক ব্যাথা। মা ব্যাথা পাচ্ছে খুব। মা’কে ছেড়ে দাও।

– ও আল্লাহ, আঁ,আমার চোখ তুইলা ফেল্লোরে, আল্লাহ,

সুরাইয়া বেগমের চিৎকার শুনার সাথে বাইরে দাঁড়ানো সবার যেন ধৈর্য্যর বাধ ভেঙ্গে যায়। সবাই  একসাথে দরজা ধাক্কাতে থাকে। ভিতর থেকে মাইর আর চিৎকারের আওয়াজ আসতে থাকে। আলিশা কাঁদতে শুরু করে দেয়। কাজের মেয়ে আঁখিরও‌ চোখে দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে এমন অমানবিক নির্যাতন দেখে। রায়হান আর চুপ থাকেনা। জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে বলতে থাকে।

– বাবা, বাবা দরজা খোলো। দরজা খুলো নয়তো আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকবো , বাবা ,

রায়হানের কথা গুলা বলার পর পরই সুরাইয়া বেগমের চিৎকারের আওয়াজ কমে যেতে থাকে। বাইরে থেকে সবাই দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। হঠাৎ নজরুল সাহেব দরজা খুলেন। আলিশা দৌড়ে নজরুল সাহেবের পাশ দিয়ে তার মায়ের দিকে চলে যায়। নজরুল সাহেবের চোখে মুখে ছিলো এক ক্ষান্ত হওয়ার ছাপ। এক প্রশান্তির আভাস। যেনো তিনি কোন মহৎ কাজ করেছেন। রায়হানের খুব রাগ উঠছিলো। মন চাচ্ছিলো তার বাবাকে মারতে। কিন্তু সে তার রাগ কন্ট্রোল করে। এসব যে হবে এটা যেন আগে থেকে জানাই ছিলো রায়হানের।

আলিশা দৌড়ে যায় তার মায়ের কাছে। তার মায়ের হাত দুটো খাটের উপরের সাথে বাঁধা। পা দুটো নার্স ধরে আছে। তার ডান চোখ দিয়ে অনবরত রক্ত পড়ছে। আলিশা এক জোড়ে চিৎকার দেয় ” মা,” বলে।

রায়হান তার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে ভিতরে আসে। বাকিরাও দৌড়ে তার পিছু পিছু আসে। এসে দেখে আলিশা তার মায়ের গলা ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছে। তার মায়ের ডান চোখের যায়গা পুরো গর্ত হয়ে ছিলো , ! আর গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিলো সেখান থেকে। অর্থাৎ, এতোক্ষণ সুরাইয়া বেগমের ডান চোখ জীবন্ত অবস্থায় তুলে ফেলেছেন নজরুল সাহেব। গালে, গলায় চড়, থাপ্পড়ের দাগ।

আঁখি ওড়না মুখে দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠে। রায়হান চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার চোখের কোন থেকে পানি গাল বেয়ে পড়ে। সাথী এমন কিছু দেখার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি শাহেদের বুকে তার কান্না লুকান।

সুরাইয়া বেগম এক ধীর নিম্ন কাপো কাপো গলায় আলিশাকে বলতে থাকে।

– ভ,ভালো মাইয়া। ওরা, ওরা আমার চোখ টা তুইলা নিলো ভালো মাইয়া। আমার, আমার অনেক ব্যাথা করতাছে। আমি আর সহ্য করতে পারতাছি না ভালো মাইয়া। আর সহ্য করতে পারতাছি না,!

সুরাইয়া বেগমের বাম চোখ ছলছল করছে। একপাশের গাল বেয়ে পানি বেয়ে পড়ছে আরেকপাশের গাল বেয়ে রক্ত। কতটা পাষণ্ড হলে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের জীবন্ত অবস্থায় চোখ তুলে নিতে পারে , !

 

নজরুল সাহেব ঘরের ভিতরে আসেন। এতোক্ষণ হয়তো তিনি হাত ধুতে গেছিলেন। ঘরে এসে এক কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বলেন।

– এই ঘরে সুরাইয়া একলা থাকবো। বাইরে থেইকা তালা দেওয়া থাকবে এই রুম। সুরাইয়া পাগল, ও যখন তখন কারো উপর হামলা কইরা দিবো। সবাই বাইর হও এখন। অনেক নাটক হইছে।

কথা শুনেই আলিশা তার মায়ের শরীর থেকে মাথা উঠায়। ছলছল চোখ নিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে।

– আমি থাকবো আমার মায়ের সাথে। দেখি কে আমাকে মায়ের কাছ থেকে সড়ায় , !

নজরুল সাহেব একটু ভ্রু কুঁচকে তাকান। বলেন‌

– কী বললি আবার বলতো , !

বলেই বিছানার উপরের খুঁটির কাঠ টা ধরে ভেঙ্গে মুহুর্তের মধ্যেই তেড়ে আসতে থাকে আলিশার উপর। সাথে গিয়ে শাহেদ, সাদিক তাকে আটকায়। রায়হান আলিশার সামনে এসে দাঁড়ায়। রায়হানের চোখের লাল হয়ে গেছে রাগে। ছলছল রাগ চোখ নিয়ে তার বাবার মাথার কাছে যায়। কপালে কপাল লাগিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে।

– খুব বেশি বেশিই করতেছো কিন্তু তুমি। সামনে বিয়ে। আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করিওনা, যেন,

বাকি কথাটা বলতে গিয়ে রায়হান থেমে যায়। নজরুল হাতের খুঁটি টা জোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারেন। আর চলে যেতে থাকেন ঘর থেকে। রায়হান রক্ত লাল রাগান্বিত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে নজরুল সাহেবের যাওয়ার পথে। তখনই বিছানায় হাত দিয়ে দাপাদাপি করতে থাকেন সুরাইয়া বেগম। সবাই দৌড়ে যায় সুরাইয়া বেগমের কাছে। সুরাইয়া বেগম এক হাত দিয়ে তার গলা চেপে ধরেছেন আরেক হাত দিয়ে বিছানায় দাপাদাপি করছেন।

যেন‌ তার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। সবাই সেদিকে গেলেও ডাক্তার আর নার্স রা দরজার দিকে পা বাড়ায়। রায়হান সুরাইয়া বেগমের এমন অবস্থা দেখে সাথে সাথেই ডাক্তারের দিকে দৌড়ে যায়। ডাক্তার পালিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড়াতে যাবেই তখনই রায়হান তার কলার ধরে নেয়। তার দিকে ফিরে তার লোহার মতো শক্ত হাত দিয়ে এক কষে থাপ্পর বসায় ডাক্তারের গালে। রাগের গলায় বলে।

– কী হয়েছে ফুফুর। বল। ফুফু এমন কেনো করতেছে,!

– নজরুল ভাইয়ে উনারে একটা গলার চামড়া ছিল্লা যাওয়ার ঔষধ খাওয়াইছে। এরলাইগা।

– বাবা, ! বাবা আর কত অত্যাচার করবে ফুফুর উপর , ! তাড়াতাড়ি ঐটা কমার ঔষধ বাইর কর। তাড়াতাড়ি বাইর কর।

– আমার, আমার ধারে ঐডার জ্বালা কমানোর ঔষধ নাই,!

ডাক্তার কথাটা বলার সাথে সাথে রায়হান এক হাত দিয়ে ডাক্তারের গলা চেপে ধরে উপরে তুলে ধরে। ডাক্তারের হাওয়ায় ভাসতে থাকা পা ছড়াছড়ি করছে। রায়হান দাঁতে দাঁত চেপে বলে‌

– দিবি কী না।

– এ,এহনি দিতাছি। আ,আমারে ছা,ছাড়েন।

সাথে সাথেই ডাক্তার গলা ছেড়ে দেয়। ডাক্তার ফ্লোরে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে একটা ইনজেকশন বের করে তার ব্যাগ থেকে। তাড়াতাড়ি গিয়ে সুরাইয়া বেগমের হাতে ইনজেকশন টা পুশ করেন। সুরাইয়া বেগমের ডান চোখের যায়গা দিয়ে রক্ত পড়ে বিছানা বালিশ ভিজে গিয়েছে। ডাক্তার তাড়াতাড়ি সেখানে ব্যান্ডেজ করতে ধরে। কাপো কাপো গলায় বলে।

– আমি, আমি ইনজেকশন দিয়া দিছি। এহন গলার ব্যাথা কমবো। আমি চোখের ড্রেসিং কইরা দিতাছি। চোখের রক্ত পড়াও বন্ধ হইবো।

আলিশাকে ধরে কিছুটা দূরে নিয়ে যান সাথী। আলিশা খুব কাঁদছে। তার মায়ের এতো এতো যন্ত্রনা দেখে তার খুব কান্না পাচ্ছে। রায়হান সবার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করে।

– এই রুমে আলিশা তার মায়ের সাথে থাকবে। কেউ যদি আলিশাকে সড়াইতে আসে। বাড়িতে কিন্তু আগুন লাগে যাবে বলে দিলাম। আগুন, !

 

বলেই ঘর থেকে হনহন করে বেড়িয়ে যায় রায়হান। তার পিছু পিছু সাদিকও বেড়িয়ে যায়। সুমনা গিয়ে সুরাইয়া বেগমের পাশে বসেন। আজ সুরাইয়া বেগমের এই হাল দেখে তার প্রতি মায়া হচ্ছে। এই মানুষটাকে কতই না দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি,! আঁখি চলে যায়। ঘরে শুধু রয়ে যায় শাহেদ, সাথী, সুমনা বেগম আর ডাক্তার। আলিশা সাথীর কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। হঠাৎ বাড়ির মাঝে যেন এক ঝড় বয়ে গেলো। এখন বাড়িটা শান্ত হলেও, ঝড়ের ক্ষত খুবই বিষাক্ত রূপে ধরা দিলো আলিশা আর সুরাইয়ার কাছে ,!

 

 

 

পরন্ত বিকেল। মেম্বার বাড়ি। আঙিনায় একটা চেয়ার আর একটা টেবিল। চেয়ারে বসে আছেন শিউলি বেগম। টেবিলে অনেক ডিজাইনের কার্ড। সেগুলো একে একে দেখছেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাসিমের পরিবর্তে আসা শৈশব দাস। সেই এখন মেম্বারের সাথে চলাফেরা করে। টুটুল তো জেলে বন্দি। মেম্বারের কাজে কামে সাহায্য করার জন্য তো কাউকে লাগতো। তাই শৈশব নামের এক ছেলেকে তিনি তার সাথে রেখেছেন। শিউলি বেগম একের পর এক কার্ড দেখছে আর পাশে সড়িয়ে রাখছে। বিরবির করে বলছে।

– এইসব কী কার্ড আনছোস যে শৈশব। একটাও পছন্দ হয় না।

– আরো আছে চাচি। এইলন। (তার হাতে থাকা এক ব্যাগ থেকে আরো এক বান্ডিল কার্ড বের করে টেবিলে রাখে শৈশব)

– এতোডি , ! মাগো মা , ! দেখতে দেখতে তো ঐদিকে নিপার বিয়া হইয়া নাতি নাতনি আইয়া পড়বো ,!

– শিউলি, ! কার নাতি নাতনির কথা বলছিস রে , !

শিউলি বেগম আওয়াজটা চিনতে পারেন। শৈশবকে হাত দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে দেখেন তার ভাই সায়েমরা বাড়ির গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে। শিউলি বেগম উঠে দাঁড়ান। অনেক দিন পর তার ভাইয়ের দেখা। শৈশব এগিয়ে যায় তাদের লাগেজ ধরতে। শিউলির বড় ভাই সায়েম। সাথে এসেছে তার বউ মৌসুমী আর দুই ছেলে মেয়ে ইকরা আর আফাজ। দুইজনই জমজ। আফাজ ইকরার থেকে এক মিনিটে বড় খালি। দুইজনেই নিপার সমবয়সী। শিউলি বেগম এগিয়ে যান তাদের দিকে।

– আরে ভাইজান, তোমারা। কেমন আছো?

– এইতো আছি রে। তুই কেমন আছিস। খোঁজ খবর তো নিস না।

– না মানে ভাইজান ফোন দিলে ইকরা আর আফাজ রে ছাড়া তো আর তোমারে পাওয়া যায় না। (ইকরা আর আফাজের দিকে তাকিয়ে) তোমরা কেমন আছো আম্মাজান আর আব্বাজান রা, !

– এইতো ফুফু ভালো আছি। (ইকরা)

– শৈশব, ব্যাগ ডি নিপার পাশের রুমে গিয়া দিয়া আয়। (আফাজ আর ইকরার দিকে তাকিয়ে) বড় হইয়া গেছো মেলা তোমরা। হেই ছুডু কালে দেখছিলাম তোমাগো , !

– তোর মেয়েটাও তো বড় হয়ে গেছে। একেবারে আকিকার পর বিয়ের দাওয়াত খেতে এলাম। আহা এমন বোন কার কয়জন পায়।

– ভাইয়া,!

– মজা করলাম রে। চল ভিতরে চল।

– ইকরা তোমার হাতের ব্যাগটা আমারে দাও।

– না না ঠিক আছে ফুফু।

– আরে দাও দাও।

ব্যাগ টা হাতে নিয়ে তাদেরকে বারান্দায় উঠান। সায়েম বলতে থাকে।

– ঐদিকে আরো রুম বাড়াইছিলি পরে তোরা তাই না ,!

– হ ভাইজান। ঐদিকে পড়ে আরো ৩ ডা ‌রুম উঠাইছে। (ঐযে ঐদিকে বেসিন। হাত মুখ ধুইয়া নাও। আমি তোমাগো ঘরে ব্যাগ ডি রাইখা আই।

– ফুফু নিপা কোথায় , ! (ইকরা)

– এই ঘরে আছে(একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে) যাও গিয়া কথা কও।হয়তো জামাইয়ের লগে আলাপ করতাছে এরলাইগা তোমরা যে আইছো তার কোন খোঁজ খবর নাই।

– চল চল, দেখি নিপু দুলাভাইয়ের সাথে কী কথা বলে,! (আফাজ বলে। আফাজ একটু চঞ্চল। তবে ইকরা শান্ত।)

– আস্তে যাও। পরে শব্দ শুইনা টের পাইয়া যাইবো। হা হা হা হা।

 

আফাজ আর ইকরি চুপিচুপি চলে যায় নিপার রুমের দিকে। সায়েম সাহেব চলে যান হাত মুখ ধুতে বেসিনের দিকে। ইকরা,আফাজ দের মা মৌসুমীকে নিয়ে ঘরের দিক এগোতে থাকেন শিউলি।  বলতে থাকেন।

– ভাইয়া তোমারে কেমন জ্বালায় হ্যা ,! দেইখা তো মনে হয় ভালোই জ্বালায় হা হা হা।

মৌসুমী বেগমও তার সাথে হেঁসে উঠেন। চলে যেতে থাকেন শিউলি বেগমের সাথে।

 

নিপার রুম। কানে ফোন ধরে কার সাথে কলে কথা বলছে নিপা। বুঝার বাকি নেই যে ওপাশের লোকটা রায়হান। নিপা কথা বলছিলো জানালার দিকে মুখ করে বিছানায় বসে।  ইকরা আর আফাজ দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে। দুইজনেই মিটিমিটি হাসছে। ছোটবেলায় অনেক দুষ্টু ছিলো এই তিনজন। ইকারারা যখন এখানে বেড়াতে আসতো তিনজন মিলে পাড়া বেড়াতো আর সাথে ছিলো নানারকম দুষ্টামি। সেই কত নালিশ আসতো তখন এদের ৩ জনকে নিয়ে,!

ইকরা আর আফাজ গিয়ে চুপচাপ নিপার পিছনে দাঁড়ায়। মুচকি মুচকি হাসছে তারা। নিপা ধীর গলায় কথা বলছে। তাই তারা সব কথা স্পষ্ট করে শুনতে পায় না। তাও কিছু কিছু কথা তাদের কানে আসে। নিপা বলছিলো।

– আচ্ছা এখন রাগ কমাও। মাথা ঠান্ডা করো। (একটু থেমে) না না। এখন বাসায় আসতে হবেনা। বিকালে মামাদের আসার কথা। আর এ কয়দিন একটু সবুর হয়না ,! বিয়ের পর যত ইচ্ছা মন ভরে দেখিও।

ইকরা আর আফাজ শুনে সেই কী হাঁসি। মুখে হাত চেপে হাসছে তারা। নিপার তো দিন দুনিয়া সব ভুলে ফোনে ডুব দিছে। নিপার কথা আবার শুনা যায়।

– আচ্ছা আমি তোমাকে একটা পাপ্পি দিচ্ছি। তুমি এখন মাথা ঠান্ডা করো। ঠিক আছে , ! উম্ম্মাহ,

আফাজ আর হাঁসি ধরে রাখতে না পেরে জোরে হেঁসে উঠে। ইকরাও আফাজের পর পর হাসতে শুরু করে। হঠাৎ কারো হাসি শব্দ পেয়ে নিপা তৎক্ষণাৎ ফোন নামিয়ে নেয়। পিছনে ফিরে দেখে তার বজ্জাত দুই বন্ধু আসছে। এক রাগ আর হাঁসি মিশ্রিত চেহারা নিয়ে সে আফাজদের দিকে তাকায়। এদিকে দু’জন হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়ে। ইকরা ভঙ্গি করে হাত টাকে ফোন বানিয়ে বলতে থাকে।

– আচ্ছা তুমি আর রাগ করিও না আমি তোমাকে একটা পাপ্পি দিচ্ছি, উম্মাহ হা হা হা হা।

– তোরাও না , !

– দাঁড়া দাঁড়া হেসে নিতে দে আমাদের একটু।

নিপা এক লজ্জা মিশ্রিত অভিমানি চেহারা করতে থাকে। ফোনটা উঠিয়ে কল টা কেটে পাশের টেবিলে রাখে।

– আর ৩ টা দিন তোদের তর সহেনা , আরে প্রেম রে , ! যখন তুই আমাদের সাথে ঘুরতি তখন বলতি ‘আমি জীবনেও প্রেম করবো না’ আর এখন সেই ‌কিনা লাভ ম্যারেজ করতেছিস হ্যা, হা হা হা (ইকরা)

– তুইও লাভ ম্যারেজ ই করবি। আমিও বলে রাখলাম।

– না না বাপু। আমি লাভ আর প্যায়ারের মধ্যৈ নাই। আমি পিওর সিঙ্গেল থেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসবো। (বলেই হাসি থামাতে চায়। কিন্তু তারপরও হেসে ফেলে ইকরা)

– আফাজ ভাইয়া। কেমন আছো , !

– আমি আবার ভাইয়া হইলাম কবে থেকে , ! তুই আর আমি না দোস্ত ছিলাম।

– অনেক দিন পর দেখাতো। তাই , ! চল বাইরে গিয়ে আঙিনায় গল্প করি।

– হ্যা হ্যা। আফাজ চল ওর প্রেম কাহিনী শুনি, হি হি হি।

– আমি তোর থেকে ১ মিনিটে বড়। আমাকে ভাইয়া বলবি ভাইয়া,!

– ১ মিনিট আগে হইছিস বলে কী মাথা কিনে নিছিস নাকি। আমি তোকে ভাইয়া বলতে পারবোনা,!

– ছোট বেলার তোদের দুইজনের এই দ্বন্দ আর গেলো না মাবুদ ,!

নিপার কথা শুনে আবার তিনজনই হেসে উঠে। তারা দিন পান্ডব একখানে হইলে আর কথাই নাই। শুরু করে দিবে গল্প আর দুষ্টামি।

ঘর থেকে বাইরে যেতে থাকে নিপা, আফাজ আর ইকরা। বেশ খুনসুটি করতে করতে যেতে থাকে তারা তিনজন। টেবিলের উপর থাকা ফোনটাতে একটা মেসেজ আসে। রায়হান বোধয় মেসেজ করে বলেছে যে সে কী কল প্রদান করিবে , ! নাকি বিয়ের পরই কল কল খেলিবে , !

 

 

 

একটা রুম। উপরে লাল রঙের লাইট জ্বলছে। রুমের অনেক টা যায়গাই এই কম পাওয়ারের লাইটের আলোয় অস্পষ্ট। ঘরে লাইটের ঠিক নিচে বড় স্টেচার দেখা যায়। উপরে খন্ডিত কিছু মাংস। দূরে একটা টেবিল আর চেয়ার। টেবিলে একটা প্লেটে খাবার সজ্জিত করছে একটা মেয়ে। মেয়েটার বয়স বেশি নয়, ১৮/১৯। মেয়ের খোলা চুল গুলো হালকা হাওয়ায় দুলছে। তারমানে বোঝা যায় রুমে ফ্যান চলছে। হয়তো এখন রাত। রুমের এক কোনার একটা বেসিন থেকে হাত ধুচ্ছেন এক ব্যাক্তি।

তারপর পাশে থাকা তোয়ালেতে হাত মুছেন। ঘুরে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকেন সেই চেয়ার টেবিলের দিকে। মেয়েটা টেবিলের উপর প্লেটে কিছু সজ্জিত করছে। টেবিলের উপর একটা সাদা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। লোকটা টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা সড়ে যয়া। লোকটা চেয়ারে বসে। প্লেটের দু সাইডে থাকা কাঁটা চামচ আর ছোট্ট ছুরি হাতে নেয়। প্লেটে থাকা খাবার কেটে কেটে খেতে থাকে। মেয়েটা আর লোকটা। কারো মুখই দেখা যায় না। লোকটা খেতে খেতে বলে।

– জীবন্ত জিনিসও খাইতে দারুন ছিলো। টুকরা টুকরা করার পর ভিতরের জিনিসটাও দারুন ,!

– হ্যা স্যার। ঠিক বলেছেন। (একটু থেমে) আরো কিছুটা লাগবে ,!

– না না। আর লাগবে না। একটু পানি টা এনে দাও।

লোকটা বলার পর পরই মেয়েটা হেঁটে হেঁটে চলে যায় পানি আনতে। মেয়েটার পড়নে এক স্লিভ পাতলা শাড়ি।

লোকটা প্লেটে করে কোন স্বাধারণ খাবার খাচ্ছিলো না,! খাচ্ছিলো একটা কাঁচা মানব মস্তিষ্ক,! ছোট্ট ছুরি দিয়ে এটাই কেটে কেটে মুখে তুলছিলো সে,! তার প্লেটে সজ্জিতো ছিলো আরো ৩ টা মানব চোখ,! একটা বড়, আর বাকি ২ টো তুলনামূলক প্রথম চোখটার থেকে ছোট। লোকটা কাঁটা চামচ দিয়ে একটা চোখ তুলেন। মুখে নিয়ে নেন। ‘কচমচ কচমচ’ শব্দ আসতে থাকে তার মুখ থেকে। মেয়েটা তার টেবিলে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। আদেও তা পানিও ‌ছিলোই না। ছিলো এক গ্লাস গরম তাজা ঘন রক্ত। দূরে দেখা যায় অনেক গুলো কাটা হাত পা পড়ে রয়েছে। কিছু হাত পা পচে গলে হাড়েও রুপ নিয়েছে। লোকটা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

– তুমি খাবেনা , ! তুমিও নাও , !

বলেই আরেকটা চোখ কাঁটা চামচ দিয়ে গেঁথে মেয়েটার জন্য এগিয়ে দেয়। মেয়েটা হেলে সেই চোখ টা মুখে তুলে নেয়। ‘কচমচ কচমচ’ শব্দ আসতে। তখনই পাশের রুম থেকে ভেসে আসে এক কিছু বাচ্চা মেয়ের চিৎকার,! যেই চিৎকারে মিশে ছিলো বাঁচার আকুতি, পরিবারের কাছে ফিরার আকুতি।

লোকটার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা বলে।

– দাঁড়ান স্যার। পাশের রুম থেকে আরেকটা আনছি ,!

বলেই টেবিলের পাশে থাকা এক বড় ধারালো চাপাতি হাতে নেয় মেয়েটা।

 

চলবে ,

 

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৪২

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

লোকটা কাঁটা চামচ দিয়ে একটা চোখ তুলেন। মুখে নিয়ে নেন। ‘কচমচ কচমচ’ শব্দ আসতে থাকে তার মুখ থেকে। মেয়েটা তার টেবিলে এক গ্লাস পানি এনে দেয়। আদেও তা পানিও ‌ছিলোই না। ছিলো এক গ্লাস গরম তাজা ঘন রক্ত। দূরে দেখা যায় অনেক গুলো কাটা হাত পা পড়ে রয়েছে। কিছু হাত পা পচে গলে হাড়েও রুপ নিয়েছে। লোকটা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

– তুমি খাবেনা , ! তুমিও নাও , !

বলেই আরেকটা চোখ কাঁটা চামচ দিয়ে গেঁথে মেয়েটার জন্য এগিয়ে দেয়। মেয়েটা হেলে সেই চোখ টা মুখে তুলে নেয়। ‘কচমচ কচমচ’ শব্দ আসতে। তখনই পাশের রুম থেকে ভেসে আসে এক কিছু বাচ্চা মেয়ের চিৎকার,! যেই চিৎকারে মিশে ছিলো বাঁচার আকুতি, পরিবারের কাছে ফিরার আকুতি।

লোকটার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা বলে।

– দাঁড়ান স্যার। পাশের রুম থেকে আরেকটা আনছি ,!

বলেই টেবিলের পাশে থাকা এক বড় ধারালো চাপাতি হাতে নেয় মেয়েটা। নিয়ে ফিরে চলে যেতে থাকে। হেঁটে হেঁটে সেই রুমের বেসিনের আগে থাকা এক দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজার উপরের কিছুটা অংশটা গ্লাসের ছিলো আর নিচের অংশ টা কাঠের। মেয়েটা এক হাতে চাপাতি ধরে আরেক হাত দিয়ে দরজা খুলে। ভিতর থেকে আসা কান্নার শব্দ গুলো আরো দিগুন বেরে যায়। মেয়েটা ভিতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। ভিতর থেকে তার পায়ের চলার শব্দ শোনা যায়। তারপর তার কথা ভেসে আসে ভিতর থেকে।

– উশশ, একদম আওয়াজ নয়। যেই আওয়াজ করবে, তারই (একটু থেমে) এই পরিনতি হবে, হা হা হা হা

এক বাচ্চা মেয়ের আত্মচিৎকার ভেসে আসে ভিতর থেকে। গরু জবাই দিলে যেমন রক্ত থেমে থেমে বের হওয়ার সময় শব্দ হয় ঠিক সেই শব্দ ভেসে আসে। চাপাতি দিয়ে কোপানোর ‘খাচ খাচ’ শব্দ দরজার গ্লাস গুলোকেও যেনো কাপিয়ে দিচ্ছে। রক্ত ছিটকে এসে পড়ে দরজার উপরিভাগের গ্লাসের উপর। ভিতরের সব কান্নার আওয়াজ যেন নিমিষেই মিলিয়ে যায় বাতাসে। কিছুক্ষণ পর সব ক্ষান্ত। ভিতর থেকে কোন আওয়াজ আসেনা। একদম নীরব, নিস্তব্ধ পরিবেশ। হঠাৎ পায়ের হাই হিলের আওয়াজ ভেসে আসে দরজার ভিতর থেকে। দরজাটা খুলে ভিতর থেকে বের হয় মেয়েটা।

এক হাত ছিলো রক্ত মাখা চাপাতি। আরেক হাতে ধরে ছিলো এক বাচ্চা মেয়ের মাথার চুল। গলা থেকে কাঁটা সেই মাথা হতে টুপ টুপ করে ফ্লোরে রক্ত বেয়ে পড়ছে। ছোট্ট মাথাটার চোখ গুলো খোলা। মুখে আঁচড়ের দাগ। মেয়েটা সেই মাথাটাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে স্টেচারের দিকে। খোলা দরজা দিয়ে সেই ভিতরের কিছু মেয়েদের দেখা যায়। ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিলো তারা। প্রত্যেকেরই বয়স ৮-১০ এর মধ্যে। এই বয়স টাই যেন তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ,!

 

 

 

রাত গভীর। মেইন রোড। রোডের দু পাশে গাছের সংখ্যা কম। কিছুটা দূরে দূরে একেকটা গাছ। যায়গাটা ফুলবাড়ী উপজেলার। এখান থেকে দূর দূর অব্দি কোন গ্রামের কোন ঘর দেখা যায় না। দুইজন মধ্যবয়সী ছেলে হেঁটে আসছে ‌রাস্তার সাইড ধরে। জোছনা রাত। কুয়াশা হালকা দেখা গেলেও মারাত্মক ঠান্ডা। কিছুক্ষণ পর পর বয়ে যাওয়া বাতাস শরীরের ভিতরের অন্ত্র গুলো পর্যন্তও যেন কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দুই জন ছেলের নাম লালু আর সালু। এরা সেই দুজন চোর। যারা সেই রাতে ফয়সালের মৃত্যু দেখেছিলো গাছের আড়াল হতে। সেদিনের পর থেকে তারা সবধরনের চুরি, ছিনতাই বাদ দিয়ে ভালো পথে পা বাড়িয়েছে। দিনাজপুর শহরে এক বড় ফার্নিচারের দোকানে তারা কাজ করে এখন। বাড়ি আনন্দপুরেই‌। দিনাজপুর শহর থেকে গ্রামে পায়ে হেঁটে ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত্রির হয়ে যায়। রাস্তা দিয়ে একটা নাইট কোচ সাঁই করে চলে গেলো। মাঝ রাতের দিকে এই নাইট কোচ ছাড়া আর যাবেই বা কী ,! জোছনা রাত হওয়ায় চারপাশ তাদের কাছে বেশ ভালোই দৃশ্যমান। গায়ে শাল জড়ানো দু’জনের। লালুর হাতে টর্চ লাইট। কিন্তু জোছনা রাত যেহেতু। আশেপাশের সব বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে তাই সে লাইট জ্বালায় নি। সালুর হাতে একটা ঝোলা ব্যাগ। সেখানে ফার্নিচারের দোকানের কাজের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আছে। তারা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর দুজন দুজনার সাথে গল্প করছে। বলছে পরবর্তী তে এই উপার্জনের টাকা দিয়ে তারা কী কী করবে। কবে বিয়ে সাদী করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ দূর থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন ভেসে আসে। তারা দুজন চকিতে সামনে রাস্তার দিকে চেয়ে তাকায়। দূর থেকে লাল-নীল আলো জ্বলে পুলিশের গাড়ি আসছে‌। একটা না তিন তিনটে।

লালু আর সালু সাথে সাথেই রাস্তার পাশের ঝোপে গা ঢাকা দেয়। ছোট থেকে চোর থাকায়, ভালো হওয়ার পরও পুলিশ দেখে লুকানোর অভ্যাস টা তাদের আর গেলো না। পুলিশের গাড়ি গুলো কিছুটা কাছাকাছি আসাতে তারা বুঝতে পারে যে এগুলো এমনি পুলিশ না। এরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িকে প্রটেকশন দেওয়ার পুলিশ। মাঝের গাড়িটা মন্ত্রীদের বড় গাড়ির মতো। আর সামনে পিছনে দুটো পুলিশ ভ্যান। লালু আর সালু ভাবে তাদের এভাবে লুকিয়ে থাকা উচিত নয়। তারা তো এখন আর চুরি-চামারি করে না। পরে তখন এভাবে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় যদি তাদের ধরে ফেলে তখন পুলিশ ভাববে তারা খারাপ কিছু করার জন্য এখানে লুকিয়ে ছিলো। তারা ঝোপ থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মাথা উঠাতে যাবেই তখনই হঠাৎ রাস্তার বিপরীত পাশ থেকে একটা বাইক ছুটে আসতে থাকে। বাইকের উপর এক কালো জ্যাকেট আর হেলমেট পড়া ব্যাক্তি।

তারা কেনো জানি আবার ঝোপে মাথা লুকায়। বাইক টা অনেক গতিতে ছিলো। পুলিশের গাড়ি গুলোও তার কাছাকাছি চলে এসেছে। আর মাত্র ৩০ হাত বাকি সংঘর্ষ হওয়ার জন্য। পুলিশের ভ্যান হর্ণ দিতে থাকে। তখনই বাইকার তার বাইক টাকে একদম দক্ষ স্টান্ট ম্যানের মতো রাস্তায় ড্রিফ করে ঘুরিয়ে ব্রেক করায়। তার শরীর একদম রাস্তার কাছাকাছি এসেও লাগেনা। তখনই সে তার কাঁধ থেকে এক শুটার গান বের করে সামনের পুলিশের গাড়ির এক চাকায় নিশানা করে গুলি চালায়। গাড়ির চাকা ফেটে যায়।

ড্রাইভার হঠাৎ আক্রমণ বুঝতে না পেরে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অনেক গতিতে থাকা পুলিশ ভ্যান টি রাস্তা থেকে আঁকাবাঁকা চলে উল্টে রাস্তা থেকে ছিটকে পাশের ক্ষেত খামারে গিয়ে পড়ে। মন্ত্রীর গাড়ির ড্রাইভারের চোখ সেদিকে যেতেই এক গুলি এসে তার বুকে লাগে। এবং তাকে গুলি করার সাথে সাথেই বাইকার মন্ত্রির বুকে নিশানা করে একে একে ৫ টা গুলি চালায়। মন্ত্রি গাড়ির ড্রাইভারের গুলি লাগায় সে স্টেয়ারিংয়ের উপর মাথা রেখে দেয় অমনি মন্ত্রির গাড়িটা আঁকাবাঁকা চলতে শুরু করে।

বাইকার তার বাইক ঘুরিয়ে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই চলে যেতে থাকে। আর ঠিক সেসময় বাইকার দুটো বল জাতীয় জিনিস ছুরে মারে মন্ত্রীর গাড়ির দিকে। মন্ত্রীর গাড়ির বেশি গতিতে থাকায় আর আঁকাবাঁকা চলতে থাকায় রাস্তার পাশের এক মোটা গাছের সাথে এসে সজোরে ধাক্কা মারে। বল জাতীয় জিনিস গুলো গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের দিকেই আসতে থাকে। পিছনের পুলিশ ভ্যান এখনো সবকিছু বুঝে উঠতে পারেনি‌। যেন চোখের পলকেই সব ঘটে যাচ্ছে তাদের সামনে। তারা গাড়ি থামাতেই যাবে তখনই দুইটা বল জাতীয় জিনিস গড়িয়ে এসে তাদের গাড়ির নিচে পড়ে আর সাথে সাথেই এক বিকট বিষ্ফোরণ। অনেক দূরের কেউ একজন ক্ষেতে রাতের অন্ধকারে কাজ সাড়তে বসেছিলো। তার কানে পর্যন্ত এসে ধাক্কা খায় বিস্ফোরণের শব্দ। চেয়ে দেখে দূরে থাকা মেইন রোডের দিকে। এক আগুন সহ ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। সাথে সাথেই যেন তার শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেলো এই বীভৎস বিষ্ফোরণ দেখে।

 

এদিকে লালু আর সালুর গায়েও আগুনের আঁচ লেগেছে। তারা ঝোপ থেকে লাফ দিয়ে পাশের ক্ষেত বাড়িতে গড়িয়ে পড়ে প্রাণ নিয়ে দৌড়াতে থাকে। আজ রাত যে তাদের কাছে এতো ভয়ংকর রুপ নিয়ে ধরা দিবে তা তারা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি‌। আর যদি তখন রাস্তায় উঠে পড়তো। নিশ্চিত তাদের সেই বাইকারের গুলিতে প্রাণ হারাতে হতো।

রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পুলিশের গাড়ি থেকে কিছু আহত পুলিশ বেড়িয়ে দেখে এই জলন্ত আগুন কে। হয়তো তারা তাদের সারা কর্ম জীবনেও এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ দেখেনি। তাদের শরীর আগুনের ঝাঁঝ এসে পড়েছে। প্রকৃতি আজ শান্ত। শুধু নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে দেখছে মানুষ মানুষকে মারার তান্দবলিলার ভয়াবহতা,!

 

 

 

মেম্বার বাড়ি। এক শীতের সকাল। তবে কুয়াশার দেখা নেই। হালকা মিষ্টি রোদ গাছের পাতা ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাটিতে এসে পড়ছে। শিউলি বেগম রান্না ঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হলেন। চলে গেলেন ঘরের দিকে। বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে ভিতরে আসলো রিয়াদ আর তার ভাবি মায়া। রিয়াদ তার মায়া ভাবিকে ধরে ধরে বাসায় প্রবেশ করলো। শিউলি বেগম ঘর থেকে কিছু একটা নিয়ে আঙিনায় নেমে রান্না ঘরের দিকে যাবেন ঠিক তখনই তাদের দেখতে পান। হাসি মুখ করে বলে উঠেন।

– আরে মায়া, লগে রিয়াদও। কী খবর তোমাগো ,!

রিয়াদ মায়াকে ধরে ধরে আঙিনার মাঝখান টায় আসে। তার পড়নে পুলিশ ড্রেস। মায়ার পরনে শাড়ি। মায়া বলে।

– এইতো চাচি আছি আলহামদুলিল্লাহ।

– বাবু আইতাছে নাকি ,! মিষ্টি কই ,!

– এইতো আর ২-১ মাস। তারপরই।

– আগের থেইকা মেলা গুলুমুলু হইছো তুমি। হ্যা। এই ফুলমতি, আঙিনায় দুইডা চিয়ার নিয়া আয়তো।

– না না চাচি। আমি চলে যাবো‌। মায়া ভাবি নিপাকে দেখতে আসতে চাইলো তো। আর ভাইয়াও আজকে স্কুলে গেছে। তাই আমিই নিয়ে আসলাম। (রিয়াদ)

– ভালো করছো। মায়া সেই কত্তদিন থেইকা আমাগো বাড়িত আহেনা ,! রাগ কইরা আছে নাকি আবার আমাগো উপর,!

– না না চাচি। কী যে বলেন। বাসার কাজ এর মধ্যে বাইরে বের হওয়ার সময়ই হয়ে উঠে না।

– হ। আমারও এদিক মাইয়াডার বিয়া, আর বাড়িত কামে কাজে  মেলাদিন হইলো বাইর হওয়া হয়না। (একটু থেমে) আচ্ছা ঐযে ফুলমতি চিয়ার আইনা দিতাছে। তোমরা বও। আমি এই মশলার ডিব্বা ডি লায়লারে দিয়া আই।

বলেই রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো ‌শিউলি বেগম। ফুলমতি দুইটা চেয়ার নিয়ে বারান্দা থেকে নামতে ছিলো। রিয়াদ আস্তে করে ফুলমতিকে ডেকে বলে।

– শুন, দুইটা না। একটা আন। আমি চলে যাবো এখনি।

ফুলমতি একটা চেয়ার বারান্দাতেই রেখে দেয়। আর শুধু একটা চেয়ার হাতে আঙিনায় নেমে আসে। এসে মায়ার কাছে দেয়। মায়া বসে। তার পাশে সাইডে দাঁড়িয়ে থাকে রিয়াদ। ফুলমতি চলে আসে ঘরের দিকে। শিউলি বেগম রান্না ঘর থেকে বের হন। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে গিয়ে দাঁড়ান মায়ার সামনে। বলেন।

– রাতুল কেমন আছে , !

– এইতো আছে ভালোই। ইদানিং তো আমাকে বাড়ির কোন কাজে হাত দিতে দেয়না। কিছু করতে গেলে উল্টা আরো বকা দেয়।

– ভাগ্য কইরা একটা জামাই পাইছো, বুজ্জো। এইসময় জামাইয়ের পাশে থাকা অনেক দরকার। আমার নিপা হওনের সময়ও তোমাগো মেম্বার সাব আমারে কোন কাম করতে দিতো না। খালি ঘরে বসায়া রাখতো। একটু পর পর খাওন নিয়া আইতো। খাইতে না চাইলে জোর কইরা বকা দিয়া খাওয়াইতো। বকা কী আর হেই সময় কম খাইছি আমি, !

– হ্যা চাচি। এইসময় খাইতে গেলেও কেমন জানি লাগে। বেশি খাইতে মন চায় না।

– হ। (একটু থেমে) দাঁড়াও নিপারে ডাক দিতাছি। মাইয়াডার ২ দিন পর বিয়া। এহনো পইরা পইরা ঘুমাইতাছে মনে হয়। (ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে) নিপা, এ নিপা, তোর মায়া ভাবি আইছে। বাইরে আয়। (মায়াদের দিকে ফিরে) মাইয়াডা এহনো বাচ্চাই রইয়া গেলো বুজ্জো না , ! কাইল রাইত বাহান ধরছে বলে আমার লগে ঘুমাইবো। এতবড় ছেরিরে তহন আমি কাইল নিয়া ঘুমাইছি। তোমাগো চাচা আর আমাগো মেহমানের এক পোলা তহন আলাদা ঘরে ঘুমাইছে। শশুর বাইত যাইয়া যে কী করবো মাইয়াডা ,!

– মায়ের কাছেই তো সন্তানেরা আবদার করবে। আর কয়দিন পর চলে যাবে। এজন্য এখন একটু আপনাদের কাছে কাছে থাকতে চায় আরকি।

– হ। হেরলাঈগা তো তোমাগো চাচারে বুঝায়া-সুঝায়া আফাজের লগে ঘুমাইতে কইলাম। তোমাগো চাচা তো আমারে ছাড়া ঘুমাইতে নারাজ , !

– বয়স হইলেও ভালোবাসা কমেনি যে , !

– হ, আর কইয়োনা। বুড়ার ভালোবাসা আর কমেনা। (একটু থেমে) দেখছো। নিপারে যে ডাক দিছি কোন হুঁশ আছে , ! খারাও। (বাড়ির দিকে ফিরে) ইকরা মা, ও ইকরা মা, নিপারে একটু পাঠাও তো। বেলা অনেক হইছে। ওরে কও আর ঘুমাইতে হইবো না।

ইকরা নিপার ঘর থেকে হন হন করে বের হতে হতে বলে।

– ফুফু, নিপা তো (একটু থেমে) ওয়াশ (একটু থেমে) রুমে গেছে। (ইকরা পুলিশ রিয়াদকে দেখেই তার কথার আওয়াজ কমিয়ে থেমে থেমে বলে। এক নজরে চেয়ে থাকে রিয়াদ আর মায়ার দিকে‌। শিউলি বেগম ওকে উদ্দেশ্য করে আবার বলেন।

– কিরে। নিপা কই গেছে , ?

– ফু-ফু। ও,ও তো ও-য়া-শ-রু,(বাকি কথাটা টুকু আর শিউলি বেগম দের কান অব্দি পৌছায় না। ইকরা পুলিশ দেখলে ভয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারেনা। এখনো ও এক নজরে রিয়াদ আর মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়াদ আর মায়াও ওর দিকে তাকিয়ে ওকে দেখছে। দুই পক্ষ দুই পক্ষকে নিশ্চুপ ভাবে দেখছে। বাড়িতে পিনপন নিরবতা নেমে আসে। শিউলি বেগম একবার রিয়াদ,মায়াদের দিকে তাকাচ্ছেন তো একবার ইকরার থ হয়ে যাওয়া মুখটা দেখছেন। তখনই বারান্দার একপাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বারান্দার গ্রিল দরজার সামনে দাঁড়ায় নিপা। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিরবতা ভাঙিয়ে বলে।

– মা। আমারে, আমারে ডাকছিলা।

তার কথায় সবার ঘোর ভাঙে। মায়া নিপার দিকে তাকায়। শিউলি বেগমও নিপার দিকে তাকায়। কিন্তু রিয়াদ ইকরার দিকেই তাকিয়ে আছে। মলিন চোখে নয়। ভ্রু কুঁচকে। ইকরার দিকে একটা পুলিশ এভাবে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে ঐ পুলিশ টা তার কথায় বেজার হয়েছে। ইকরার ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। সে দৌড়ে পিছন ফিরে যেই রুম থেকে এসেছিলো সেই রুমে চলে যায়। রিয়াদ ইকরার এমন হঠাৎ দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া দেখে কোন মানেই বুঝতে পারেনা। সে আবার হাসি মুখ নিয়ে নিপার দিকে তাকায়। কথা বলতে থাকে। নিপাও হাসি মুখে তাদের সাথে কথা বলতে বলতে বারান্দা থেকে নেমে আঙিনায় যায়।

এদিকে ইকরা দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। সে যেই ঘরে ঢুকেছে সেই ঘরের দরজা আর বারান্দার দরজা একদম সোজা। আর একদম সেই বরাবরই আঙিনায় রিয়াদ, মায়ারা দাঁড়িয়েছে। ইকরা দরজা লাগিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে বুকে হাত দেয়। বাপরে বাপ। পুলিশ দেখলে কেনো যে তার এতো ভয় লাগে। বুকটা এখনো ধুপ ধাপ করতেছে। আর পুলিশ টাও একদম এক নজরে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন পুলিশটা ইকরার উপর একপ্রকার রাগই করেছে। বাপরে বাপ। সব পুলিশ গুলাই কী এমন রাগ মুখো হয় ,! ইকরা ঘুরে দরজা দিকে মুখ করে। দরজা হালকা খুলে দেখতে থাকে সেই পুলিশ রিয়াদকে। না। এখন আবার হাসিমুখেই কথা বলছে। ইকরা দরজার আড়াল হতে পা থেকে মাথা অব্দি রিয়াদকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। রিয়াদ শিউলি বেগম দের দিকে মুখ করে ছিলো। তাই তার কাঁধের পাশ টা দরজার আড়াল হতে দেখা যাচ্ছিলো। ইকরা নিচ থেকে চোখ বোলাতে বোলাতে উপরে উঠায়। বিরবির করে বলতে থাকে।

– পায়ে বুট জুতা, পুলিশ ইউনিফর্মের প্যান্ট।(একটু থেমে) হাতে একটা হাত ঘড়ি। বাব্বাহ, হাতে বেশ লোমও আছে দেখছি। (একটু থেমে) ওরে বাবা, ঐটা হাতের মাংসপেশি না বেলুন। এতোটা ফুলে আছে,! ঐ হাত দিয়ে আমাকে একটা থাপ্পর মারলেই তো আমি এপার থেকে ওপারে পারাপার হয়ে যাবো। (একটূ থেমে) হমম, মুখে দাগ নেই। চোখের ভ্রু গুলা ঘন কালো। যাক এটা সুন্দর আছে। (একটু থেমে) চুলের কাটিং ভালোই। পরিপাটিও বেশ। (তখনই হঠাৎ রিয়াদ কথা বলতে বলতে এদিকে ফিরে তাকায়। ইকরা সাথে সাথে ভয় পেয়ে দরজার আড়াল থেকে সরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজায় হেলান দিয়ে আবার বুকে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলতে থাকে।

– দেখে ফেলছেরে , ! এখন যদি ঘরে এসে আমাকে এ্যারেস্ট করে নেয়, !(একটু থেমে) না না। আমাকে কেনো এ্যারেস্ট করবে। আমি কী কোন চোর নাকি। তারপরও বেশ ভয় লাগছে। বাকি সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলে। কিন্তু আমার দিকে তাকালে রাগ মুখেই তাকায়। না না। এই পুলিশ যখন তখন ঘরে আসে আমাকে বকা দিতে পারে। আমি যাই বাপু জানালার দিকে। এই পুলিশ গুলা খালি আমার সামনেই সবসময় পড়ে। যানে যে আমি পুলিশ দেখলেই ভয়ে পালাই। তাও খালি আমার সামনেই তাদেরকে পড়তে হবে।

বলেই ঘরের বিছানার দিকে চলে যায় ইকরা। ছোট থেকেই পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনলে বা কোন পুলিশ দেখলে ভয়ে ছুটোছুটি করা শুরু করে দেয় সে। কীসের জন্য ভয় পায় তা সে নিজেও জানে না। তাও খালি ভয় পায়। রিয়াদ ঐদিকে ওর এমন আচরণ দেখে কী না কী মনে করছে কে জানে ,!

 

 

 

খাঁন বাড়ি। সুরাইয়া বেগমের রুম। বিছানায় শুয়ে আছেন সুরাইয়া বেগম। মাথায় সাদা রঙের কাপড়ের জলপট্টি। পাশে বিছানায় বসে আছে আলিশা। বিছানার আরেকপাশে এক চেয়ার বসে আছেন এক মধ্যবয়সী নারী। চেহারা উজ্জ্বল বর্ণের। দেখতে ভালো ঘরের মেয়ে মনে হয়। চেহারায় শান্ত-শিষ্ট একটা ভাব আছে। পরনে একটা থ্রি পিস। আর তার উপরে সাদা এপ্রোন। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা। বাম চোখের ভ্রু এর মাঝে একটা ছোট্ট কাঁটা দাগ। মেয়েটা সুরাইয়া বেগমের প্রেশার চেক করছে। তার পাশে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে রায়হান। সুরাইয়া বেগম ঘুমিয়ে আছেন। ডান চোখের কোটরে ব্যান্ডেজ করা। কাল চোখ তুলে নেওয়ার ব্যাথা থেকে রাতে জ্বর আসে। তারপর থেকেই তিনি ঘুমিয়ে আছেন। শরীরের তাপমাত্রা খালি বেড়েই চলেছে। সুরাইয়া বেগমের প্রেশার চেক করা মেয়েটার নাম সোনালী। ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করছে। এই বছর টা পেড়োলেই সে কলেজ থেকে একজন পরিপূর্ণ ডাক্তার হয়ে বেড়োবে। রায়হান সকাল সকাল কোন ডাক্তারের খোঁজ না পেয়ে সোনালীকেই নিয়ে এসেছে।

খাঁন বাড়ির ৪ বাড়ি পর তাদের বাসা। বড়লোক না তারা। একটা কাঁচা খড়ের ঘর তাদের। তার মা নেই। সোনালীর র বাবা আর তার এক চাচারা থাকে তাদের সাথে সেখানে। সোনালীর বাবা বিছানায় পড়েন নি। বয়স হলেও এখনো মাঠে কৃষক হিসেবে ফসল ফলানোর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

সোনালী কিছুক্ষণ পর প্রেশার চেক করার প্যাড টা খুলে নিতে থাকলো। খুলতে খুলতে বললো।

– খালার তো প্রেশার লো।(একটু থেমে) কাল রাতে খাবার খায়নি ?

– না। মা তো কাল বিকাল থেকেই যে ঘুম দিয়েছে এখনো উঠেনি।

– অনেক রক্ত বেড়িয়ে গেছে চোখের কোটর দিয়ে‌। সেইজন্য শরীর অনেক দূর্বল। প্রেশারও অনেক লো।(আলিশার দিকে তাকিয়ে) জ্বর কখন আসছিলো ?

– কাল রাতে। হঠাৎ মায়ের শরীর কাঁপতে শুরু করে। তারপর গাঁয়ে হাত দিয়ে দেখি অনেক জ্বর এসেছে।

– হুমম। চোখের ব্যাথার জন্যই হয়তো জ্বর টা এসেছে। (একটু থেমে) আচ্ছা আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি। ঐগুলা, (রায়হানের দিকে ফিরে) রায়হান ভাই, এই ঔষধ গুলা একটু সময় মতো খাওয়াইয়ো। কেমন ,!

রায়হান মাথা নেড়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। সোনালী তার ছোট্ট প্যাড খাতায় কিছু ঔষধ লিখে দিতে থাকে। লিখতে লিখতে বলে।

– আলিশা, তুমি নাকি কী বলছিলে তোমার মায়ের স্মৃতি শক্তি বলে চলে গেছে নাকি কী হয়েছে যেন, ?

– হ্যা আন্টি। মাকে কাল সকাল বেলা ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখি। পরে যখন উঠিয়ে বিছানায় শোয়াই, জ্ঞান ফিরে, তখন আমাদের কেউকে চিনতে পারছিলো না। এমনকি আমাকেও না , !

– তার আগের রাতে কিছু কী হয়েছিলো ?

– না আন্টি। আমি আর মা ঠিকঠাক ভাবেই শুয়ে পড়ি। আমি তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর যে কি হয়েছে তা তো জানিনা। (একটু থেমে) তবে হ্যা। মায়ের মাথার পাশে একটা খালি বড় ইনজেকশন পড়ে ছিলো। এই,(বিছানার পাশের একটা বক্স থেকে বের করে) এই যে দেখো।

সোনালী ইনজেকশন টা হাতে নেয়। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে থাকে। একটু পর অবাক হয়ে বলে।

– এটা তো পশু চিকিৎসায় ব্যবহার করা সিরিজ। এইটা দিয়ে গরু, ছাগল দের ভ্যাটেনারির চিকিৎসক রা ঔষধ পুশ করেন। এইযে দেখো নিডল মানে সুই টা কতো মোটা ,!

ইনজেকশনের নিডল টা আলিশাকে দেখায় তারপর ঘুরিয়ে রায়হানকে দেখায়।

– আসলেই তো। কাল বিষয় টা খেয়াল করিনি। ইনজেকশনের নিডল টা মোটা। (রায়হান)

– হ্যা। আর ইনজেকশনের ভিতরে কী কোন ঔষধ ছিলো? নাকি খালি ছিলো , ?

– আমি খালিই পেয়েছিলাম আন্টি। ভিতরে ২-১ ফোঁটা লাল রঙের ঔষধ লেগে ছিলো। তবে এখন নেই। আমি আমার হাতে বের করে ঔষধের ফোঁটা গুলা দেখেছিলাম তো,!

– তুই হাতে বের করতে গেলি ক্যানো ? এখন তোর আন্টিকে দেখানো যাইতোনা ঐটা ,? (রায়হান)

– আচ্ছা বাদ দাও রায়হান ভাই। ওটার দরকার নেই। তবে ইনজেকশন যেহেতু বলছো।(একটু থেমে) হয়তো তিনি নিজে অথবা কেউ তাকে এটা পুশ করেছিলো। আর এটার ভিতরে স্মৃতি ভুলানোর কোন ড্রাগ মিশানো ‌ছিলো , !

– কে সেটা মা’কে পুশ করবে। ঘরে তো আমি আর মা ছাড়া কেউ ছিলামই না।

সোনালী ঘরের চারপাশ তাকাতে থাকে। তাকাতে তাকাতে জানালার দিকে চোখ যায় তার। জানালটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলে।

– জানালাটা কী রাতে খোলা থাকে ,?

– হ্যা। মা বন্ধ করতে দেয় না। তার নাকি দম বন্ধ লাগে জানালা বন্ধ থাকলে। এইজন্য সবসময় জানালা খোলাই থাকে।

– তাইলে হয়তো কেউ ইনজেকশন টা জানালা দিয়ে তাকে মেরেছে। নাইলে জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তোমার মায়ের শরীরে পুশ করেছে। তুমি আর তোমার মা ছাড়া যদি ঘরে আর কেউ না থাকে তাইলে হয় এভাবে নয় তোমার মা নিজে তার শরীরে এটা পুশ করেছেন ,!

সোনালীর কথা শুনে আলিশা মুখ গোমড়া করে বলে।

– মা কেনো এমনটা করলো ,! মায়ের যে একয়দিন ধরে কী হচ্ছে ,!

– আচ্ছা সেসব বাদ দাও। (রায়হানের দিকে ফিরে) রায়হান ভাই, এইখানে ঔষধ গুলো আমি লিখে দিছি। কোন সমস্যা হবেনা। (আলিশার দিকে ফিরে) আর খালাকে ঠিক মতো খাইয়ে দিস তুই কেমন , ! খালার শরীর থেকে কিন্তু অনেকটা রক্ত বেড়িয়েছে চোখের কোটর থেকে। (রায়হানের দিকে ফিরে) বেদানা, আঙুর, আপেল, এগুলা বেশি বেশি খাওয়াবার চেষ্টা করিও। রক্ত যেটুকু বেড়িয়েছে সেটার কভার দিতে এগুলো লাগবে। আর একটু পর ডাক দিয়ে খালাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খাবার খাইয়ে দিয়ো‌। তরল খাবার দিয়ো। সুজি,সাবু, কিংবা স্যুপ এসব দিয়ো। আমি বিকালে কলেজ থেকে এসে আরেকবার খালাকে দেখে যাবো‌। ঠিক আছে,!

– আচ্ছা আন্টি। (আলিশা)

সোনালী তার সাথে আনা ছোট ব্যাগ টায় প্রেশার মাপার প্যাড আর বাকি জিনিস যেগুলো এনেছিলো সেগুলো ঢুকাতে থাকে। আলিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

– সামনে তো তোর পরীক্ষা তাই না , ! খালার পাশে থাকিস সবসময়। আর পড়তেও বসিস। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু।

– জী আন্টি। (আলিশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়)

সোনালী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগ হাতে চলে যেতে থাকে রুম থেকে। রায়হানও পিছু পিছু যেতে যাবে তখনই আলিশা রায়হানকে ফিসফিসিয়ে ডেকে বলে।

– আন্টিকে কিছু দিয়ে দিয়ো। কলেজ যাওয়ার আগে আমাদের এখানে আসে সময় দিলো যে।(একটু থেমে) আমি এখানে আছি।

– তোকে আর ওসব বলতে হবেনা। আমি জানি।

ফিসফিসিয়ে বলেই রায়হান রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।

 

করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে সোনালী। রায়হান পিছু পিছু তাড়াতাড়ি হেঁটে হেঁটে আসছে। এসে তার পাশে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে বললো।

– চ,চাচা কেমন আছে,!

– আব্বা আছে ভালোই। দুইদিন আগে জ্বর থেকে উঠলো। এখন আবার সর্দিকাশি ধরছে।

– হ্যা। একয়দিন ধরে ঠান্ডা অনেক পড়ছে। (বলেই সোনালীর হাতে কিছু টাকা গুজে দিলো রায়হান। বললো)

– কলেজে যাওয়ার সময় কিছু খেয়ে নিস।

– না না রায়হান ভাই। লাগবেনা এগুলো। আমি কী এখানে টাকার জন্য খালাকে দেখতে আসছি ,! খালা আমাদের ছোট বেলায় কত কোলে পিঠে করে নিয়ে বেড়িয়েছে। খালার জন্য এইটুকু সাহায্য করতে পারা আমার জন্য সৌভাগ্যের। এটা লাগবেনা।

– তারপরও। তুই বাইরে কিছু খেয়ে নিস। এটা ধর তোর খাবার টাকা হিসাবেই দিলাম। ভাই হয়ে বোনকে একটু দিতে পারিনা ,!

– তারপরও,

– তুই রাখ। কলেজে যা। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ডাক্তার তো হয়েই গেছিস। চাচা অনেক খুশি তোকে নিয়ে। চাচার মুখ উজ্জ্বল কর।

– কিন্তু ভাই আমি কীভাবে টাকা নেই বলো,!

– আমি ভাই হয়ে তোকে দিলাম রে পুচকি। তুই রাখ তো।

তারা দুজন কথা বলতে বলতে করিডোর পেড়িয়ে অন্দরমহলে চলে আসে। রায়হান অন্দরমহলের মাঝে দাঁড়িয়ে তাকে বিদায় জানায়। সোনালী বলে।

– গেলাম ভাই।

– আচ্ছা। ঠিকঠাক মতো কলেজে যাইস।

 

সোনালী অন্দরমহলের মূল ফটকের দিকে এগিয়ে যায়। রায়হান ফিরে ঘরের দিকে চলে যেতে থাকে। তখনই অন্দরমহলের দরজা দিয়ে এক যুবক প্রবেশ করে। সেই যুবকের সাথে সোনালীর কিছুটা চোখাচোখি হয়। দুইজনই দুইজনকে দেখে। তারপর সোনালী স্বাভাবিক ভাবেই চোখ নামিয়ে নিয়ে চলে যায় অন্দরমহলের মূল ফটক পেরিয়ে। যুবক ছেলেটা ঘুরে সোনালীর যাওয়াটাকে দেখে। তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে সামনে দিকে এগোয়। রায়হান ঘরের দিকে যেতে গিয়ে দেখে আরো কেউ এসেছে। রাফসান এসেছে। তার বড় ভাই রাফসান।

রাফসান হাতে এক লাগেজ টেনে টেনে এসে অন্দরমহলের মাঝখানে দাঁড়ায়। রায়হান, রাফসানকে দেখে কিছুটা খুশি হয়। রাফসান লাগেজ টা রেখে এসে রায়হানের সামনে দাঁড়ায়। রায়হান তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলে।

– কেমন আছো ভাইয়া।

– আছি কোনরকমে। বিয়ে সাদীর কাহিনী হঠাৎ শুনতেছি যে,! এতো তাড়াতাড়ি ক্যান হ্যা,!

– না মানে ভাইয়া,! (এদিক ওদিক তাকাতে থাকে রায়হান)

– বুঝছি। আর বলতে হবেনা। মা কোথায়।

– মা উপর তলায় আছে। তুমি গিয়ে দেখা করে আসো।

– আচ্ছা। আর শোন,

বলতে গিয়েও থেমে যায় রাফসান। দেখে রায়হানের ফোনে একটা কল এসেছে। রায়হান রাফসানকে ইঙ্গিতে একটু সময় চেয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকে অন্দরমহলের ফটকের দিকে। রাফসানও আর কিছু বলেনা। ও লাগেজের হাতল ধরে চলে যেতে থাকে উপর তলার সিঁড়ির দিকে।

অন্দরমহলের উপরের ঝাড়বাতি টার একটা ছোট্ট লাইট নিম নিম করে জ্বলছে। জ্বলতে জ্বলতে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো বাতির জীবন রেখার সমাপ্তী ঘটেছে ,!

 

 

 

– চল না। মাত্র তো ২-৩ সপ্তাহের ব্যাপার।

– মা যেতে দিবেনা। মা’কে না জানায় গেলে মা রাগ করবে আরো বেশি।

– আচ্ছা কেনো যেতে দিবেনা তুই আমাকে বল। আমি তো যাচ্ছি তোর সাথে,! কোন তো সমস্যা হবে না।

–  আপনি মায়ের সাথে কথা বলেন স্যার। মা’কে বলেন এটা। মা আমার কথা শুনবেনা,!

–  আচ্ছা দে তুই ফোন দিয়ে আমাকে ধরায় দে। আমি কথা বলতেছি।

–  আচ্ছা ঠিক আছে। দেখেন মা কী বলে।

বলেই পকেট থেকে ফোন বের করে তার মায়ের নাম্বারে কল দিলো আহনাফ। শাহারিয়া ফ্লোরে পায়চারি করছে। নিপার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাই আজ রাতে সে রওনা দিবে। শুধু সে না, আহনাফের টিকিটও কেটে রেখেছে। এখন নাকি সে যাবেনা। তার মা বলে তাকে যেতে দিবেনা। আহনাফ কল দিয়ে ফোনটা শাহারিয়ার কাছে এনে দেয়। শাহারিয়া ফোন টা ধরে কানে উঠায়। ওপাস থেকে আহনাফের মা ভারি কন্ঠে বলেন।

– হ্যালো। হ্যা বাবা। বল।

– আন্টি আসসালামুয়ালাইকুম। আমি আহনাফের স্যার বলছিলাম।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম বাবা। তুমি আহনাফের স্যার ,!(একটু থেমে) ও চাকরির স্যার। হ্যা বলো।

– আন্টি আমি আহনাফকে নিয়ে একটু আমাদের দেশের বাড়িতে বিয়ে খেতে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। আপনি যদি একটু অনুমতি দিতেন ,!

– হ্যা অবশ্যই বাবা। নিয়ে যাও। তোমাদের গ্রামও ঘুরে আসুক। ছেলেটা তো এই চাকরি আর ঘর ছাড়া কোথাও বেরই হয়না। একটু ঘুরে আসুক গ্রাম থেকে।

– জ্বী আন্টি। (একটু থেমে) আন্টি তাইলে আজ রাতেই আমরা আনন্দপুরে রওনা দিবো। ও বাসায় গিয়ে সব ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিবে।

– দাঁড়াও বাবা। কোথায় যাওয়ার কথা বললে ,?

– আ, আনন্দ পুর। কেনো আন্টি কিছু,

– নিয়ে যেওনা ওকে সেখানে। ওকে নিয়ে যেওনা। ও আমার সাথেই থাকুক। তুমি গিয়ে বিয়ে খেয়ে এসো বাবা।

– কিন্তু আন্টি আমার কথাটা শুনুন তো। আমি, আর আহনাফ মাত্র ২ সপ্তাহ থাকবো সেখানে।‌ তারপর আবার চলে আসবো।

– না বাবা। ওকে নিয়ে যেওনা। ওকে, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। ওর বিয়ে খাওয়ার শখ আমি বের করছি। (কিছুটা রাগান্বিত হয়ে)

– আন্টি, আন্টি। একটু ঠান্ডা হোন। ওর সাথে তো আমি যাচ্ছি। আর ওতো এখন আর স্বাধারণ কেউ নয়। একজন পুলিশ। ওর কোন সমস্যাই হবেনা। আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। ও একদম সেইফ থাকবে। ওর সেইফ থাকার দাঁয়িত্ব আমি নিচ্ছি। কিচ্ছু হবে না তার। আপনি শুধু যাওয়ার অনুমতি টা দিন প্লিজ,!

– আমার ওকে নিয়ে ভয় হচ্ছে বাবা। ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। ও,

– আন্টি কিছু হবেনা। আমি একজন স্পেশাল ফোর্সের অফিসার আছি তার সাথে। আপনি চিন্তা মুক্ত থাকতে পারেন। (একটু থেমে) ওকে তাইলে নিয়ে যাই আন্টি ,!

– এখন তুমি যা ভালো মনে করো বাবা। শুধু আমার আহনাফ ঠিক থাকলেই হলো ,!

– ওর কিচ্ছু হবেনা আন্টি। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।

– আচ্ছা বাবা।

– ঠিক আছে আন্টি রাখলাম।

শাহারিয়া ফোন কেটে দিয়ে একটা ছোটখাটো লাফই দিয়ে ফেললো। আহনাফকে হাসি মুখে বলতে লাগলো।

– দেখছিস। মানিয়ে নিলাম কীভাবে।

– স্যার আপনি পারেনও ভালো। কিন্তু স্যার। একটা কথা বলি,?

 

শাহারিয়া হাসিমুখে বলে।

– হ্যা বলো বলো।

– আপনি আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এতো করছেন যে ,!

– তোমার কী যেতে মন চাচ্ছেনা ,?

– না আমার মন চাচ্ছে। কিন্তু তারপরও আপনি খুব উচ্ছসিত যে,! এরজন্য জিগালাম।

শাহারিয়া আহনাফের পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলে।

– দুই দুইটা বিয়ে খাইতে যাইতে কী তোর মন চাইবে না ?

– দুইটা বিয়ে ,? বিয়ে বলে শুধু আপনার বোনের ,?

– সাথে আমারো।

– আপনারো ?

– হ্যা। মা-বাবাকে জানাইনি

– আন্টি-আঙ্কেল না জানলে তখন কেমনে কী ,?

– আমি ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা করবো। আমার ছোট থেকেই ইচ্ছে আমি একরকম ধুমধাম বিয়ে না করে ইসলামিক তরিকায় ঘরোয়াভাবে বিয়েটা করে নিবো। (একটু থেমে) তোর ভাবিও জানেনা যে আমি আমাদের বিয়েটাও সেড়ে ফেলবো গিয়ে। হঠাৎ তাকে সারপ্রাইজ দিবো বুঝছিস ,!

– আপনার বোনের বিয়ে ধুমধাম করে দিচ্ছেন। আর আপনার বিয়েটা এমন ঘরোয়া ইসলামিক ভাবে,! বিষয়টা কেমন জানি লাগতেছে।

– আমি নিজে পাপ করতে চাইনা। মা-বাবাকে নিপার বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে দিতে বললেও ওরা শুনবেনা। নিপাও মানতে চাইবে না। তাই তাদের ক্ষেত্রে তো কিছু করতে পারবোনা। কিন্তু আমি আমার নিজের বিয়েটা ইসলামিক তরিকায় ঘরোয়াভাবেই করবো। তাদেরকে পাপ থেকে সড়াতে পারিনি বলে কী নিজে পাপ করবো ? (একটু থেমে) জানিস তোর ভাবির গায়ে শুধু একবার আমি হাত দিয়েছি। পরনারীর গায়ে ঐ প্রথম ছোঁয়া ছিলো আমার। তাও কাঁধে। আমি চেষ্টা করি ফোনে কম কথা বলতে ওর সাথে। বিয়ের আগে এখন সব গুনাহ হিসেবে আমাদের আমল নামায় লিখা হচ্ছে। কিন্তু বিয়ের পর তখন প্রেম করলে উল্টো সওয়াব হবে আমাদের বলতে পারিস। আমি একটু ধার্মিকভাবে চলার চেষ্টা করি ছোট থেকেই। অন্যদের মানা করার পরও না শুনলে আমার এখন কিছু করার নাই তবে নিজের ক্ষেত্রে সবকিছু ধার্মিক পন্থায় মিটিয়ে নিবো আমি।

– স্যার। আপনার এই রুপ আমি প্রথম দেখলাম। সবাই কিনা গায়ে-হলুদ, অনুষ্ঠান করে বিয়ে করে। আর আপনি কিনা।

– হ্যা। আমি এমনই। তুই একয়দিনে আমার কাছের মানুষে পরিণত হয়েছিস বিধায় তোকে মন খুলে সব বল্লাম। ইবাদত লোক চক্ষুর আড়ালে করতে হয়। সবাইকে বলে ঢোল পিটিয়ে না। এতে নেকি তো দূরের কথা উল্টো আরো পাপ হবে। (একটু থেমে) আচ্ছা চল। এখন সব গুছায় রেডি করতে হবে। তুই তোর কাপড় গুলা বাসা থেকে নিয়ে আয়। আজ রাতে ট্রেন।

– আচ্ছা স্যার।

দুইজনেই সোফার রুম থেকে ভিতরের রুমের দিকে চলে যায়। ২ দিন বাদে বোনের বিয়ে। কাল সকালে পৌঁছে যাবতীয় কাজে তাকে হাত দিতে হবে। শিউলি বেগম আজকেই সকালের ট্রেন ধরে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু সকালের টিকিট না পাওয়ার রাতের ট্রেনে যাচ্ছে তারা।

 

 

 

রাবেয়া বেগম বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আহনাফের মা। বয়স হয়েছে অনেক। মুখে বার্ধক্যের ছাপ। চামড়া কিছুটা জড়ো জড়ো হতে ধরেছে মুখের।

বিছানা থেকে নেমে হেটে হেটে বেলকনির দিকে এগিয়ে যান তিনি। ব্যালকনির গ্রীল ধরে চেয়ে আছেন বাইরে। সময়টা বিকাল। দূরের মেঘ গুলো হলদে বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে।

 

মন তার মানতে চাইছে না। আহনাফকে যেতে দিতে বলে কী তিনি ঠিক করলেন ,! কেনো আনন্দপুর নামটা এতো বছর পর ভেসে উঠছে তার চারপাশ থেকে,! আহনাফ বললো, তার স্যার বললো, ঐদিন একজনের মুখে শুনলো আনন্দপুরে ঘটা মার্ডার কেস গুলোর কথা।

বিশটা বছর ধরে যন্ত্রনা গুলো পুশে রেখেছেন মনে। অতীত টাকে ভুলে আহনাফকে নিয়ে বাকিটা জীবন সুখ শান্তিতে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এখন তার শেষ বয়সে এসে কেনো আবার ডায়রীর সেই অতীত পাতা গুলো জেগে উঠতে শুরু করেছে ,!

রাবেয়া বেগম ছলছল চোখ গুলো হাত দিয়ে মুছেন। এক বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলতে থাকেন।

– আহনাফকে যেতে দেওয়া আমার একদম উচিত হয়নি। আশরিফকে ও নিয়ে গিয়েছে।‌ এই ২০ বছর, এই ২০ বছরে আমার আশরিফ না জানি কী অবস্থায় আছে। এখন যদি আহনাফকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়,!( একটু থেমে কাঁদো কাঁদো হয়ে) ও নিষ্ঠুর। ও আমার এই ছেলেকেও কেড়ে নিবে,! আমার কোল খালি করে দিবে । ও আহনাফকে চিনতে পারলে আর ফেরত আসতে দিবে না। আর দিবেনা,!

কাঁদতে কাঁদতে বেলকনির গ্রিল ধরে বসে পড়তে থাকেন রাবেয়া বেগম।

 

চলবে ,

 

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ) 

পর্ব :: ৪৩

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

বিশটা বছর ধরে যন্ত্রনা গুলো পুশে রেখেছেন মনে। অতীত টাকে ভুলে আহনাফকে নিয়ে বাকিটা জীবন সুখ শান্তিতে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এখন তার শেষ বয়সে এসে কেনো আবার ডায়রীর সেই অতীত পাতা গুলো জেগে উঠতে শুরু করেছে ,!

রাবেয়া বেগম ছলছল চোখ গুলো হাত দিয়ে মুছেন। এক বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলতে থাকেন।

– আহনাফকে যেতে দেওয়া আমার একদম উচিত হয়নি। আশরিফকে ও নিয়ে গিয়েছে।‌ এই ২০ বছর, এই ২০ বছরে আমার আশরিফ না জানি কী অবস্থায় আছে। এখন যদি আহনাফকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়,!( একটু থেমে কাঁদো কাঁদো হয়ে) ও নিষ্ঠুর। ও আমার এই ছেলেকেও কেড়ে নিবে,! আমার কোল খালি করে দিবে । ও আহনাফকে চিনতে পারলে আর ফেরত আসতে দিবে না। আর দিবেনা,!

কাঁদতে কাঁদতে বেলকনির গ্রিল ধরে বসে পড়তে থাকেন রাবেয়া বেগম।

 

 

 

পড়ন্ত বিকেল। সূর্যি মামা আকাশ থেকে নেমে পড়েছে। রোদ নেই। শুধু দিনের কুসুম কোমল আলো ফুটে আছে এখনো‌। মেম্বার বাড়ি। মেম্বার বাড়ির বাইরে এক আঙিনা রয়েছে। আঙিনাটা রাস্তা আর বাড়ির দেওয়ালের মাঝে। এই আঙিনা তেই ঐদিন রায়হানরা তাদের গাড়ি রেখে ভিতরে প্রবেশ করেছিলো। আঙিনাটায় একটা গাড়ি আর কিছু মোটরসাইকেল রাখার উপযোগী যায়গা রয়েছে। আঙিনার একপাশে মেম্বার বাড়ির দেওয়াল। আরেকপাশে রাস্তা। একদম দুই ধারকে একত্রে লাগানো আঙিনা বলা যায় এটাকে। আঙিনায় বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে একটা বাঁশের খুঁটি আর বেত দিয়ে বানানো বসার যায়গা। তার কিছুটা পাশে একটা বড় জলপাই গাছ। আর তার পাশে বাড়িতে প্রবেশ করার গেইট।

বসার যায়গায় বসে গল্প করছে তিন পান্ডব। নিপা,ইকরা আর আফাজ। নিপার পরনে একটা ফরমাল স্বাধারণ থ্রী পিস। ইকরার পড়নে একটা গোল জামা। আর আফাজের পড়নে একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার। আঙিনায় আরো ছোট ছোট কিছু ছেলে মেয়ে খেলছে আর দৌড়াদৌড়ি করছে। ওরা নিপাদের আত্মীয় দের সাথে এসেছে। আফাজ আর ইকরাকে নিপা রায়হানকে কাছ থেকে পাওয়া সেই চিঠি গুলো পড়ে শোনাচ্ছে। বিকেল বেলা। তাই রাস্তা দিয়ে গরু, ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছে কিছু গৃহস্থের মানুষ। সাইকেল চলে গেলো একটা রাস্তা দিয়ে।

নিপা চিঠিটা পড়া শেষ করলো। ইকরা আর আফাজ বেশ উদ্দিপ্ত চিঠি শোনার পর। ইকরা হাসৌজ্জল মুখে বলে।

– দুলাভাই কিন্তু দারুন লেখতে পারে। দেখছিস কত সুন্দর করে চিঠি গুলা লিখছে ,!

– দুলাভাই কি কবি সাহিত্যিক নাকি আবার ? কবি সাহিত্যিক না হইলে নিশ্চিত সাহিত্য রচনা পড়ে নিয়মিত। সেইজন্য এতো সুন্দর করে লিখছে। (আফাজ)

– হয়তোবা। আমি তো প্রথম প্রথম চিঠি গুলা পড়ে কী যে ফিদা হইছি,! চিঠির কথা গুলার মধ্যে দারুন গভীরতা আছে কিন্তু।

– হ্যা। তা ঠিক। তুই পরে চিঠি দিসনি দুলাভাইকে ?

– দিয়েছিলাম তো। কিন্তু আমার মাথায় কী আর এতো শব্দ বাক্যের খেলা আসে,! যা পারছি, লেখে দিছি,! আর জানিস,

নিপার কথা থামিয়ে দেয় সেখানকার এক ছোট বাচ্চা। বয়স ৭ কী ৮। সে নিপার কামিজ ধরে টানতে থাকে। এক মলিন মুখ নিয়ে চেয়ে বলে।

– আন্টি, আন্টি,। আমি, আমি ওই যে জলপাই গুলা আছে। ঐগুলা খাবো।

– একটা লাঠি বা কিছু বড় দেখে নিয়ে আসো। পেড়ে দিচ্ছি ,! (তার কিছুদূরে খেলতে থাকা তার বড় ভাই(১২) কে উদ্দেশ্য করে) এই আতিক। একটা বড় লাঠি নিয়ে আয়না। তোর বোন জলপাই খাবে।

– আমি লাঠি কই পাবো। (আশেপাশে দেখে) দেখো কোন লাঠি-শটা কিচ্ছু নাই।

– তাইলে দেখ না কোন ছোট পাথর বা ইটের টুকার পাস কী না ,!

– উমম, দাঁড়াও। (বলেই ছোট্ট আতিক আঙিনায় চিরুনি তল্লাশি করতে থাকে। ছোট ইট-পাথর খোঁজার জন্য।

এদিকে ছোট্ট মেয়েটা নিপার কামিজ ধরে টানতেই আছে। নিপা বসার যায়গাটা থেকে নেমে দাঁড়ায়। মেয়েটার হাত থেকে তার কামিজ ছোটায় আস্তে করে। আফাজ, ইকরা রাও নামে। কিছুক্ষণ পর ছোট্ট আতিক একটা পাথর নিয়ে আসে। এসে নিপার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে।

– এই নাও আন্টি। এটা ছাড়া আর কিছুই পাইনি আঙিনায়।

– সকাল সকাল নিশ্চয়ই লায়লা ঝাড়ু দিয়ে সব ফেলে দিছে। (গাছের দিকে মুখ করে) ইকরা দেখতো বড় জলপাই কোন ডালে। একটা পাথরই আছে খালি।

– ঐ টায় মার। ঐ থোকা টায় আছে ৬-৭ টার মতো।

নিপা হাত দিয়ে সেদিকে নিশানা করে। করে ছুরে মারে পাথর টাকে। কিন্তু পাথর টা কিছু পাতায় লেখে দূরে গিয়ে রাস্তায় পড়ে।

– এই দেখ,এই দেখ। জলপাই কই আর ও মারে কই ,! (ইকরা)

– আমি কী শুটার নাকি যে সবসময় আমার নিশানা ঠিকঠাক লাগবে ,!

– তোর দাঁড়া কিছু হবেনা। দে তোর পায়ের জুতাটা খুলে দে। (ইকরা)

– জুতা দিয়ে কী করবি ?

– ঐটা ফিকে মারবো। ঐ বড় থোকার সব গুলা জলপাই পড়ে যাবে।

– তোর জুতাটা মার। আমার টা আমি দিবো না। গাছে তখন লাগে থাকবে, আর আমি খালি পায় বেড়াই হ্যা,!

– না না লাগবেনা। উল্টা আমার জুতা হালকা। ঐটা ‌লাগে থাকবে। তোর জুতা মোটা আর ভারি আছে। ঐটা জলপাই গুলাতে লাগলে জলপাই ও তো পড়বে। আর জুতাও লাগবেনা। তুই দে তো।

– পড়ে লাগে থাকলে তুই গাছে চড়ে আমার জুতা পেড়ে দিবি।

– আগে লাগুক তো। লাগলে দুলাভাইকে ফোন দিবো দুলাভাই আসে নামাবে। তাইনা আফাজ, হি হি হি।

– ভাই ডাকবি ভাই। (আফাজ)

– তুই দূরে সড়। তোর সাথে কথাই বলবো না আমি। (মুখ ভেংচে) ভাই-ডাকবি-ভাই, হুঁ। (নিপার দিকে ফিরে) দে তো জুতাটা। তুই বেদোব হয় যাইতেছিস দিন দিন। টিম লিভারের কথা শুনিস না ,!

– হইছে আমার টিম লিডাররে। (পা তুলে একটা জুতা খুলে ইকরাকে এগিয়ে দিয়ে) ধর। জুতা গাছে লাগলে তোর খবর আছে।

– দেখা যাবেনে। এখন তুই দেখ(গাছের দিকে ফিরে এক চোখ বন্ধ করে আরেক হাতে জুতা তুলে) আমার নিশানা,!

বলেই জুতাটা জোরে ফিকে মারে গাছের একদম উঁচুতে থাকা জলপাইয়ের থোকার ডাল টার দিকে। জুতাটা সেই ডাল টায় তো লাগেই নি। উল্টো ডালের পাশে কিছু পাতা ছুঁয়ে গিয়ে পড়ে রাস্তা দিয়ে বাইক চালিয়ে আসতে থাকা রিয়াদের মুখের উপর। রিয়াদ গতিতে থাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় শক্ত মাটিতে বাইকসহ উল্টে পড়ে। ইকরা সাথে সাথে ভয় পেয়ে যায়। দাঁত দিয়ে আঙুল কামড়াতে কামড়াতে বলে।

– শ্যাষ রে শ্যাষ, ইকরা তুই শ্যাষ। পুলিশের মুখে জুতা মারলি ,! ধরতে পারলে ডিরেক্ট এইবার ফাঁসি দিয়ে দিবে। আমি নাই বাপু ,!

বলেই এক দৌড়ে বাড়ির গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায় ইকরা। এদিকে রিয়াদের দিকে এগিয়ে যায় নিপা, আফাজ সহ বাকি ছোট ছোট কেচেরি পাখি মানে বাচ্চা গুলা। রিয়াদকে ধরে উঠাতে থাকে নিপা আর বাইক সড়িয়ে দিতে থাকে আফাজ।

ইকরা এদিকে বাড়ির মেইন গেইটটা একটু মেলে আড়াল হতে দেখতে থাকে তাদেরকে। মুখে ভয়। কপালে ভাঁজ, আঙুল কামড়াতে থাকে দাঁত দিয়ে। রিয়াদকে ধরে ধরে আস্তে আস্তে দাড় করায় নিপা। আফাজ বাইকটাকে উঠিয়ে দাঁড় করায়। রাস্তার সাইডে বাইকটাকে স্ট্যান্ড করিয়ে রাখে।

নিপা রিয়াদের শরীরের বালু গুলো ঝেড়ে দিতে থাকে‌। আফাজও এসে হাত লাগায়। রিয়াদ কোথাও হয়তো ব্যাথা পেয়েছে। মুখে সেই ছাপ স্পষ্ট। নিপা তার কাপড় ঝেড়ে দিতে দিতে বলে‌।

– সরি রিয়াদ ভাই। আমাদের এক মেহমান গাছ থেকে জলপাই পাড়তে গেছিলো। আর জুতাটা এসে তোমাকে লাগছে।

– একটু দেখে শুনে ফিকবা না ,! এখন যদি আমার যায়গায় যদি কোন বড় মানুষ নাইলে বয়স্ক মানুষ থাকতো। তাইলে কী হইতো ,!

– সরি ভাইয়া। (কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে রিয়াদের হাতের কনুইয়ের দিকে নজর যায় নিপার) ইশশ, হাত টাও ছিলে গেছে দেখছো ,! এই ইকরাকে আজকে পায় নেই। ওর খবর আছে। (আশেপাশে তাকিয়ে) কই গেছে ও ,! পালাইছে না ,! ঘরে যাই তারপর বুঝাইতেছি ,!

গেইটের আড়াল থেকে নিপার কথা শুনে আরো ভয় পায় ইকরা। তার নজরে রিয়াদের হাতের ছিলে যাওয়া যায়গাটাও তখন নজরে পড়ে। রাস্তাটা শক্ত ছিলো। গতিতে বাইক চালায় আসতেছিলো এইজন্য হাতের কনুইয়ের অনেকটা ছিলে গেছে। রিয়াদের চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে যায়গাটা অনেক জ্বলতেছে। শীতকালে কাঁটা ছিঁড়ার কি যে ব্যাথা ,!

ইকরার কেমন যানি লাগতে থাকে। তার জন্য মানুষ টা ব্যাথা পাইলো। আর তেমন রিয়েক্টও করেনি ও নিপার উপর। এতো ব্যাথা পাওয়ার পরও ধীর গলায় নিপাকে স্বাভাবিক কথা গুলা বলেছে। না না। কাজ ‌টা ঠিক হয়নি তার। ইকরা দরজা আড়াল থেকে বাড়ির ভিতরের দিকে যেতে থাকে। লায়লা তখনই একটা বড় গামলায় মাছের ময়লা নিয়ে যাচ্ছিলো। ইকরার সাথে একটুর জন্য ধাক্কা লাগেনি তার। লায়লা অবাক হয়ে ইকরার ছুটে বাড়ির ভিতরে যাওয়া দেখে।

ইকরা বাড়ির ভিতরের আঙিনায় চলে আসে। বাড়ির ভিতরে কী পরিমাণ লোকজনের ভিড় ,! আত্মীয়-স্বজন, সাথে তো কিছু আরো পাড়া প্রতিবেশীরাও এসেছে। বাড়িতে হৈ হৈ রৈ রৈ অবস্থা। ইকরা দৌড়ে বারান্দার সিঁড়ির দিকে যায়। বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে ছিলো ফুলমতি। ইকরা বারান্দার সামনে গিয়ে ফুলমতিকে হনহন করে বলতে থাকে‌।

– ফুলমতি আপু। আপু ফার্ট এইড বক্সটা একটু নিয়ে আসো তো।

– তোমার কিছু হইছে নাকি ,? না নিপা আপার কিছু হইছে ,!

– না না আমাদের কারও কিছু হয়নি। হয়েছে তো উনার ,!

– কার ,?

– তুমি বুঝবানা। একটু তাড়াতাড়ি এনে দাও না বক্স টা ,!

– আচ্ছা খারাও। আনতাছি।

বলেই ভিতরে শিউলি বেগমের ঘরের দিকে চলে যায় ফুলমতি। এদিকে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির বাকি লোকজনের কোলাহল দেখতে থাকে ইকরা। রান্না ঘরের সামনে জটলা করে আছে অনেকে। মেহমান দিয়ে বাড়ি একদিনের মধ্যেই ভরে গেলো,!

ফুলমতি ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে বেড়িয়ে আসে। ইকরা তাড়াতাড়ি সেটা নিয়ে দৌড়ে যায়। ফুলমতি এসবের কিছুই বুঝতে পারেনা। তার আর নিপার কিছু না হইলে কার কী হইলো ,! ফুলমতির মনে কৌতুহল জাগে। সেও নিচে নেমে জুতা পড়ে যেতে থাকে তার পিছু পিছু।

 

ইকরা বাড়ির গেইট দিয়ে বেড়িয়ে দৌড়ে ছুটে যায় রিয়াদ দের দিকে। রিয়াদের ছিঁলে যাওয়া যায়গার বালু আস্তে আস্তে ঝেড়ে দিচ্ছিলো নিপা। পাশে বাইক দার করানো। ইকরা দৌড়ে এসে নিপার পাশে দাঁড়ায়। হনহন করে বলে।

– সড় সড়। তুই সড়।

নিপাকে এক প্রকার ঠেলেই সড়িয়ে দেয় ইকরা।

– তুই কই গেছিলি এতোক্ষণ,! দেখছিস ভাইয়ার কতটা ছিলে গেছে ,!  তুই-একটু-দেখে,(বাকিটা আর বলেনা নিপা। দেখে ইকরা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বক্সটা বাইকের উপর রেখে খুলে সেটা থেকে তুলা আর স্যাভলন লিকুইড বের করছে। রিয়াদও কিছু বলেনা। চুপচাপ দেখতে থাকে। ইকরা ছিপি খুলে হালকা লিকুইড দিয়ে তুলা ভিজিয়ে নিয়ে হেলে রিয়াদের হাতের কনুই থেকে উপর পর্যন্ত ছিঁলে যাওয়া যায়গাটা আস্তে আস্তে পরিষ্কার করছে থাকে। ফু দিতে থাকে। কাঁটা যায়গায় ডেটলের ছোঁয়া পেয়ে জ্বালা পোড়া করতে থাকে রিয়াদের হাত। রিয়াদ চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইকরা হাতের যায়গাটা পরিষ্কার করতে করতে আড়চোখে রিয়াদের মুখের দিকে তাকায়। রিয়াদের চোখ বন্ধ করে সহ্য করার বিষয়টা দেখে সে মনে মনে ভাবতে থাকে।

– পুলিশদেরও ব্যাথা হয়,! হয়তো হয়। শীতের দিনে এতোটা ছিলে গেছে। ব্যাথাতো একটু হবেই,! আমার এরকম টা করে মোটে উচিত হয়নি।

 

ভাবতে ভাবতেই ধীরে ধীরে তুলা দিয়ে ডেটল লিকুইড আরো কিছুটা নেয়। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে পরিষ্কার করে ছিলে যাওয়া যায়গাটা। নিপা, আফাজরা চুপচাপ দেখছে। ছোট বাচ্চাদের কিছু এখানেই নিপাদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে আর কিছু খেলতে চলে গিয়েছে আঙিনায়।

যায়গাটা পরিষ্কার করার পর উঠে দাঁড়িয়ে বক্স থেকে ওয়ান টাইম কিছু ব্যান্ডেজ বের করে। এসে লাগিয়ে দিতে থাকে হাতে ছিলে যাওয়া যায়গাটায়। কয়েকটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বক্সে সব জিনিস ঢুকিয়ে রাখতে থাকে। রিয়াদ তার হাত টা উঠিয়ে একবার দেখে। তারপর ইকরা দিকে একবার দেখে। ইকরা আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার বক্সে জিনিস গুছিয়ে রাখতে মন দেয়। রিয়াদ ধীর গলায় বলে।

– জলপাই গুলো আরেকটু বড় হোক। তখন আমিই গুলির নিশানা দিয়ে জলপাই পেড়ে খাওয়াবো‌। ততদিন অন্তত (একটু থেমে) এভাবে জুতা ফিকে মেরোনা।

– আপনি তো পুলিশ। আপনার এই সবল দেহের ব্যাথা তো, আপনার কাছে কিছুই না। (রিয়াদের দিকে না তাকিয়েই বলে ইকরা)

– হমম, পুলিশ বলেই কী মানুষ প্রজাতি থেকে বাদ পড়ে গেলাম নাকি ,! ব্যাথা তো (হাতের ব্যান্ডেজ অংশটা দেখতে দেখতে) একটু আধটু হয়ই।

– এরপর থেকে সবসময় চারপাশ নজর রেখে বাইক চালাইয়েন। নাইলে(বন্ধ বক্সটা বাইকের উপর থেকে হাতে নিয়ে আড়চোখে একবার তাকিয়ে) চোর যখন তখন হামলা করে আপনাকে পরাস্ত করে দিবে।

রিয়াদ, ইকরা কথা শুনে একটা হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে তার দিকে তাকায়। ইকরা বক্সটা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকে রাস্তা পেড়িয়ে বাড়ির দিকে। তখনই রিয়াদ জোরে সোরে বলে উঠে।‌

– আস্তে যাও সামনে সাইকেল।

সাথে সাথেই ইকরা দাঁড়িয়ে যায়। তার সামনে দিয়ে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক লোক সাইকেল নিয়ে চলে যায়। সাইকেল নিয়ে ইকরাকে পেড়িয়ে লোকটা পিছু মুখ ঘুরিয়ে বলতে থাকে।

– দেইখা শুইনা রাস্তা পাড় হও মাইয়া। নাইলে তো এহনি সাইকেলের লগে বাড়ি খাইতা ,! (বলতে বলতে সাইকেল নিয়ে চলে যেতে থাকেন সেই লোকটা।

ইকরা এখনো একদম ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মাঝে। পা দুটো তার কাপছে। রিয়াদ তার বাইকে উঠে। বাইকের সাইড গ্লাসটা ঠিক করে দিতে দিতে ইকরাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

– নিজেও সাবধানে চলো। পুলিশ রা যথেষ্ট সচেতন। (একটু থেমে) পরবর্তীবার রাস্তা পাড় হওয়ার সময় নিশ্চয়ই আমি থাকবো না তোমাকে এলার্ট করার জন্য,! বি কেয়ার ফুল, হ্যা ,!

বলেই রিয়াদ বাইক স্টার্ট করে। চলে যেতে থাকে রাস্তা দিয়ে। ইকরা এখনো রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে রিয়াদের চলে যাওয়া টাকে দেখছে। এই লোকটা এমন কেনো ,! সবার থেকে আলাদা ,! তার কথা গুলো এখনো কানে বাজছে ইকরার। সে চোখ বুজে মাথা নিচু করে ফেলে। এদিকে নিপা, আফাজ রা একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভিতরের দিকে চলে যেতে থাকে। সন্ধ্যা নামবে একটু পর। ইকরার ভিতরে কেমন এক অন্য অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। রিয়াদ যে তার মনে দাগ কেটে গেলো, এই দাগের ব্যান্ডেজ কী সে করতে আসবেনা ,!

সে আবার মাথা উঠিয়ে রিয়াদের যাওয়ার রাস্তাটার দিকে তাকায়। রাস্তাটা এখন ফাঁকা। কিন্তু তার মনের রাস্তায় ঠিকই কারো বিচরণ করার অনুভূতি সে টের পাচ্ছে। এরকম অনুভুতির স্বাদ আগে কখনোই পায়নি। ইকরা মাথা নিচু করে এক লজ্জা মাখা মুচকি হাসি হেসে ধীর পায়ে চলে যেতে থাকে বাড়ির দিকে। কোলে ধরে রেখেছে বক্সটাকে। ময়নার বাসায় যেনো নতুন পাখি এসেছে। ময়না তাই খুশি। কিন্তু সে বুঝছেনা সে কেনো এতোটা খুশি। হয়তো এটাই তাদের সীমান্তহীন নতুন কিছুর সূচনা ,!

 

 

 

সন্ধ্যা নেমেছে। চারপাশের আলো নিভতে ধরেছে। গ্রামের কাঁচা রাস্তার পাশে এক ছোট্ট দোকান। মুদির দোকান তবে ছোট টিনের তৈরি ঘর। দোকান টার আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই। তবে দোকান থেকে কিছুটা দূরে। প্রায় ১০০ হাত দূরে কয়েকটা কাঁচা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। দোকানে সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট মেয়ে। বয়স ৮ কী ৯। পড়নে একটা জামা আর ছোট প্যান্ট। হাতে বালি লেগে আছে হালকা। হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট। ছোট্ট মেয়েটা ৫ টাকার নোট টা দোকানদার মফিজ মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মলিন গলায় বলতে থাকে।

– চাচ্চু। আমারে ঐ চককেট টা দাও।

– ঐডার দাম ১০ টাহা। তুই তো দিছোস ৫ টাহা। যা বাড়িত যাইয়া তোর মায়ের থে আরো ৫ টাহা নিয়া আয়।

– চাচ্চু, মায় জানেনা যে আমি এইহানে আইছি। তুমি আমারে ঐডা দাও। আমি পড়ে আব্বারে নিয়া আইয়া টাকা দিয়া দিমু।

– না না। তোর আব্বায় এমনিতেই মেলা বাকি রাইখা গেছে। তুই অন্য কিছু নে।

মেয়েটার কিছুটা মন খারাপ হয়। সে দোকানে একপাশে ঝুলিয়ে রাখা চিপসের দিকে তাকায়। ভালো করে বেশ খানিকক্ষণ দেখে বলে।

– চাচ্চু আমারে ঐ কার্টুন চিপ টা দাও।

– এইহানে সব চিপস ১০ টাহা কইরা। তুই বাড়ির যাইয়া আরো ৫ টাহা নিয়া আয়। যা,।

একটু ধমকের সুরেই দোকান দার মফিজ মিয়া টাকা টা তার দিকে এগিয়ে দেয়। ছোট্ট মেয়েটা টাকাটা হাত বাড়িয়ে নেয়। মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বাড়ির দিকে গুটি গুটি পা ফেলে আসতে থাকে। সারাদিন বাড়িতে খুঁজে ও এই  ৫ টাকাই সে পেয়েছে। ওর মা ওকে চকলেট, চিপস এসব কিনে দেয় না। আবদার ধরলে বকে। চিৎকার করে প্রতিবারই বলে ” দুই বেলা ভাত জুটেনা। আর মাইয়া আছে চকলেট,চিপস লইয়া,! ”

ছোট্ট মেয়েটা প্রতিবারই তার মায়ের কাছ থেকে বকা খায়। আর আজ দোকানদার চাচ্চুও তাকে বকা দিলো। ওর মুখ এখনো বিষন্নতায় ছেয়ে আছে।

দূরের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানের সুর ভেসে আসে। মেয়েটা এখনো ধীর পায়ে আস্তে আস্তে তার বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। দোকান থেকে কিছু দুরে থাকা কাঁচা ঘর গুলোর মাঝেই তার বাড়ি। সে যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল করে একটা অটো এসে তার পাশে থেমেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। একটা কালো হাত মোজা পড়া মেয়ের হাত বেড়িয়ে আসে। হাতে বড় বড় দুইটা চকলেট বার। মেয়েটার মুখের বিষন্নতা নিমেষেই উবে গিয়ে হাসির ফোয়ারা ঝড়তে থাকে। অটোর ভিতরে ছিলো এক বোরখা পড়া নারী।

ছোট্ট অবুঝ মেয়েটা সেই চকলেট গুলো হাতে নেয়। এক হাসিখুশি চেহারা নিয়ে বোরখা পড়া মেয়েটার দিকে তাকায়। বোরখা পড়া মেয়েটা তাকে হাত দিয়ে ভিতরে ডাকতে থাকে। আরো ৩ টা চকলেট বারের লোভ দেখাতে থাকে। ছোট্ট মেয়েটা আরো চকলেট দেখে হাসতে থাকে। সে অটোতে উঠার জন্য পা বাড়ায়। ভিতরে থাকা মেয়েটা তাকে ধরে অটোতে উঠিয়ে নেয়। অটো চলতে শুরু করে।

ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নিয়েছে বোরখা পড়া মেয়েটা। ছোট্ট মেয়েটার হাতে অনেক চকলেট। আর ওর চোখ মুখে হাসির ছটা। হঠাৎ বোরখা পড়া মেয়েটা এক সাদা রুমাল দিয়ে বাচ্চা মেয়েটার মুখ চেপে ধরে। বাচ্চা মেয়েটার হাত থেকে চকলেট গুলো পড়ে যায়। পা জোরে জোরে ছড়াতে থাকে। হাত দিয়ে মুখের উপর থেকে রুমাল সড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকে। বোরখা পড়া মেয়েটা আরো জোরে চেপে ধরে ছোট্ট মেয়েটাকে। বাচ্চা মেয়েটা শরীর বেঁকিয়ে যায়। সামনে থাকা ড্রাইভার তার লুকিং গ্লাস দিয়ে পিছনের সেই ভয়াবহ চিত্র দেখছিলো। তার চোখে মুখেও ফুটে উঠেছিলো এক ভয়ের ছাপ।

কিছুক্ষণ পর বাচ্চা মেয়েটার হাত পা নাড়ানো থেমে যায়। বোরখা পড়া মেয়েটা সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার পা গুলো ধরে উল্টো করে ধরে বাচ্চা মেয়ের অচেতন দেহটাকে। পায়ের তালু ধরে উঁচিয়ে অটোর ছাদের লোহার সাথে রেখে বাচ্চা মেয়েটার পায়ের খুশবু নিতে থাকে। পায়ের নরম মাংসপেশিতে একটা ছোট্ট কামড় ও বসিয়ে দেয়। বোরখা পড়া মেয়েটার মুখের উপর কাপড় ছিলোনা। তবুও তার মুখটা আমরা দেখতে পাইনা।

অটোটা কিছু কাঁচা বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যায়। কাঁচা বাড়ির ভিতর থেকে রাস্তায় বেড়িয়ে আসে এক শাড়ি পড়া প্রাপ্ত বয়স্ক নারী। অটোটা তার পাশ দিয়েই চলে যায় অজানা গন্তব্যে।  প্রাপ্তবয়স্ক নারীর শাড়িটা পুরোনো। কিছু যায়গায় হালকা ছিঁড়া। শাড়ির আঁচল কাঁধে দিতে দিতে তিনি বলতে থাকে।

– মাগরিবের আযান দিয়া দিছে হ্যা, মাইয়াডা এহনো বাড়িত নাই। (একটু থেমে)  আবার মনে হয় মফিজের দোকানে গ্যাছে। অর আইজ আমি ঠ্যাং ভাইঙ্গা ঘরে ঝুলায় রাখমু। ঘর থেইকা প্রতিদিন টাকা নিয়া যাবি, আর কেমন খালি দোকানের জিনিস খাইবি,! তোর খাওয়া আইজ আমি বাইর করতাছি।

বলেই রাস্তার পাশে থাকা এক গাছের ঠাল জাতীয় লাঠি হাতে নিয়ে রাগান্বিত হয়ে দোকানের দিকে হনহন করে হেঁটে যেতে থাকেন।

 

 

 

এক বদ্ধ রুম। চারপাশে অন্ধকার। মাঝখানে একটা সাদা টিউব লাইটের আলো উপর থেকে পড়ছে। কিছু কম্পিউটার এর সামনে বসে রয়েছে এক যুবক। চোখে চশমা। হাত দিয়ে টাইপিং করে করে কম্পিউটারে কোডিং করছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে সে একজন হ্যাকার। তবে তার গায়ে থাকা শার্টে একটা কালো লোগো আর্ট করা। যেই লোগো টা রন্জুর হুডিতেও আর্ট করা ছিলো।

হঠাৎ রুমের দরজা খুলে কেউ ভিতরে প্রবেশ করে। বাইরের আবহ দেখে বোঝা যায় যে সেই লম্বা করিডোরের চারপাশে থাকা একটা রুমই হলো এটা। একটা লোক হেঁটে হেঁটে ভিতরের দিকে আসে। দরজা লাগিয়ে দেয়। হ্যাকার হালকা মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে অন্ধকারে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– রন্জু স্যার ,?

– জ্বি। আমিই।

– স্যার আসুন। (একটু থেমে) আমি সেইরকম অনেক ওষুধ ফর্মুলা খুঁজেছি যেটা দিয়ে দেহের ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ করা যায় আর একই সাথে দেহের মস্তিষ্ককে হিপনোটাইস করে দীর্ঘ দিন কন্ট্রোলে রাখা যায়। পাইনি। অনেক দেশি-বিদেশি ঔষধ ফার্মাসিউটিক্যালস এর ওয়েবসাইট হ্যাক করে ভিতরে ঢুকে দেখেছি। কিন্তু এরকম কোন ফর্মুলার খোঁজ পাইনি। (একটু থেমে) এখন কী করবো স্যার।

– হুমম, যেহেতু পাওনি তার মানে এই ঔষধ এখনো কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি।

– হ্যা স্যার। আর এমনিতেও এখন পৃথিবীতে শতভাগ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে এমন কোন ঔষধ তৈরি হয়নি। তাই পাওয়া তো অসম্ভবই স্যার।

– আচ্ছা বাদ দেও এখন। এই নাও (একটা মেমরি কার্ড এগিয়ে দিয়ে) এটার ভিতরে কী কী আছে সেটা বের করো।

– ওকে স্যার। এখনি দেখছি।

যুবক ছেলেটা মেমরি কার্ড টা রন্জুর হাত থেকে নিয়ে হেলে টেবিলের নিচে থাকা কয়েকটা ডেস্কটপের মধ্যে একটায় ইনপুট করে। তারপর উঠে আবার সোজা হয়ে বসে।

তারপাশে হাতের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে রন্জু। রন্জুর এমন চুপচাপ থাকাটা ছেলেটার মনে ভয়ের সৃষ্টি করে। না যানি কখন তার উপর বেজার হয়ে বাকিদের মতো তারও অর্গাম রন্জু খুলে নেয়।

ছেলেটা ডেস্কটপে সেই মেমরি কার্ডের ফোল্ডারের ভিতর যায়। ভিতরে কিছু ভিডিও ক্লিপস রাখা। ছেলেটা একটা ভিডিও প্লে করতে চায়। তখনই ইরর লেখা উঠে। এবং পাসওয়ার্ড চায়। রন্জু কম্পিউটার স্ক্রিনে এমন দেখে শব্দ করে বলে উঠে।

– কী হলো ,!

– স,স্যার। মেমরির ফাইল ইনক্রিপ্ট অবস্থায় আছে। পাসওয়ার্ড ছাড়া খুলবে না। (নার্ভাস হয়ে)

– তোমার মনে হয় জীবনের প্রতি মায়া নেই। তাই হ্যাকার হয়েও বলছো পাসওয়ার্ড এর জন্য ফাইলে ঢুকা যাচ্ছে না। হ্যা ,!

– র,রন্জু স্যার। আমি, আমি চেষ্টা করতেছি। আমি চেষ্টা করে দেখতেছি ফাইল গুলোর পাসওয়ার্ড ব্রেক করার।

রন্জু কথাটা শুনেই ঘুরে চলে যেতে থাকে দরজার দিকে। ছেলেটার ভয় হতে থাকে। এই রন্জু কখন কী করে কেউ বুঝতে পারেনা। যদি তাকে গুলি করে দেয়,! ছেলেটার ঠোঁট কাঁপছে ভয়ে। রন্জু দরজার কাছ অব্দি যেয়ে পিছনে না ঘুরেই বলতে থাকে‌।

– ১ ঘন্টা। মাত্র ১ ঘন্টার মধ্যে আমার ই-মেইলে ভিডিও গুলা চাই। (এক গম্ভীর গলায়)  নাহলে কী ‌হতে পারে, তা হয়তো আমাকে এক্সপ্লেইন করে বলা লাগবেনা ,!

– স,সরি স্যার।‌ আমি এখনি পাসওয়ার্ড ব্রেক করতে শুরু করছি। এখনি করছি। (বলেই তাড়াতাড়ি কম্পিউটারের সামনে ফিরে পাসওয়ার্ড ব্রেক করার জন্য কোডিং করতে থাকে ছেলেটা। দরজা খুলে রন্জু বেড়িয়ে যায়। ছেলেটার মনে ভয় তাও কমেনি। কারণ তার কক্ষেও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। তাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলে রন্জু কখন এসে তার মাথার খুলি উড়িয়ে দিবে তা সে টেরও পাবেনা হয়তো,!

 

ছেলেটার কক্ষ থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে রঞ্জু। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো তার দুই গার্ড। তারাও রন্জুর সাথে হাঁটতে থাকে। রন্জু বলে।

– তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করার ব্যবস্থা করো। আর আমি চার দিন আসবোনা এখানে। এই চারদিনে ডেলিভারি বন্ধ থাকবে। কাজ চালু থাকবে। আর প্রতিদিন ৪ ব্যাগ প্রোডাক্ট রেডি থাকতে হবে।

– ও,ওকে স্যার। সব হয়ে যাবে। (একটু থেমে) স্যার। আপনি কোথায় যাচ্ছেন।তা কী জানতে পারি ,!

কথা শোনার সাথে সাথেই রন্জু হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে ফিরে। লোকটা ভয়ে পিছিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।

– স,সরি স্যার। ভ,ভুল হয়ে গেছে।

রন্জু আবার সামনে মুখ করে চলতে থাকে। সেই ‌লোকটাও‌ চলে আসতে থাকে তার সাথে সাথে। করিডোরে তাদের চলার শব্দ প্রতিফলিত হতে থাকে।

 

 

 

রাত ৯ টা। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। চারিদিকে কোলাহল। প্ল্যাটফর্মে প্ল্যাটফর্মে ‌লোকজনদের ভিড়। ৪ নাম্বার প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে আহনাফ আর শাহারিয়া। আহনাফের কাঁধে একটা ব্যাগ। পড়নে ফুল হাতা শার্ট, ব্লু জিন্স প্যান্ট। শাহারিয়ার পরনে সোয়েটার, আর কালো জিন্স প্যান্ট। তাদের ট্রেন ৯ টা ১৫র। প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে তারা তাদের বগি খুঁজছে। শাহারিয়ার মনযোগ সেদিকে থাকলেও আহনাফের মনযোগ অন্য কোথাও। সে আনমনে শাহারিয়ার পিছু পিছু হাঁটছে। আজ বাসা গিয়ে কাপড় গোছানোর সময় তার মা তাকে আসতে বাঁধা দেন। বেশ কথা কাটাকাটিও হয়। ততটাও না। তারপর হয় খানিকক্ষণ। আহনাফ এমন কথা কাটাকাটি করতো না যদি না তার মা ফোনে সম্মতি প্রদান করেও বাসায় গিয়ে আবার বাঁধা দিতো। তার মা’কে রুমে নিয়ে গিয়ে বুঝায় তার এক খালা। কিছুক্ষণ পর সেই খালা রুম থেকে বেড়িয়ে এসে বলেন ভিন্ন কথা। বলেন আনন্দ পুরে আশরিফ নামের কাউকে পেলে তার খোঁজ খবর যেন নিয়ে আসে। কিন্তু সে এখন এই আশরিফ নামের কাউকে কই খুঁজতে যাবে,! সে তো এই প্রথম বার সেখানে যাচ্ছে। তারউপর সেখানকার কিছু চেনা জানাও নেই তার। আহনাফের মাথায় কথা গুলো বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ এই আনন্দপুর যাওয়া নিয়ে মায়ের এতো রিয়েকশন তার সাথে আবার আশরিফ নামের কারো খোঁজ পেলে খবর ‌আনা। বিষয়টা কেমন যেনো এলোমেলো লাগতে থাকে তার কাছে। তখনই শাহারিয়া তার ভাবনার ঘোর ভাঙিয়ে দিয়ে বলে।

– এইযে। এই হচ্ছে আমাদের “ট” বগি। এতোটা পিছনে সিট ফেলছে, খুঁজতে খুঁজতেই অবস্থা খারাপ।

– হ,হ্যা স্যার। অনেক পিছনে সিট‌।

আহনাফের কথা শেষ হতেই শাহারিয়া ট্রেনে উঠে পড়ে, আহনাফও তার পিছুপিছু উঠে পড়ে বগির হাতল ধরে।

ভিতরে কিছু সিটে যাত্রী এসেছে। কিছু সিটে আবার আসেনি। তারা মাঝখানের যায়গাটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে তাদের সিটে বসে। জানালার পাশ টায় আহনাফ বসে। তারপাশে শাহারিয়া। শাহারিয়া চারপাশ কিছুক্ষণ দেখে তার বাড়িতে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিতে থাকে। আহনাফ চেয়ে আছে জানালা দিয়ে বাইরে। মনে নানা প্রশ্নের জটলা। তার উপর রন্জুর কেস। এতসব কিছু কীভাবে নিবে সে ,!

ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাওয়া যায়। ট্রেন চলতে শুরু করে। আহনাফ তার ফোনটা বের করতে যায় পকেট থেকে। তখনই জানালার বাইরে থেকে একটা মোড়ানো কাগজ এসে তার কোলে পড়ে। সে বাইরে তাকিয়ে দেখে কোন বোরখা পরিহিত মহিলা সেটা তার দিকে ছুরে মেরেছে। সেও হন হন করে হেঁটে ট্রেনের সাথে ট্রেনের গতিতে হেঁটে চলেছে। আর হাত দিয়ে ইশারা করে বলছে সেই কাগজ টা খোলার ‌জন্য। আহনাফ কাগজ টার দিকে তাকায়। তার কোল থেকে মোড়ানো কাগজের বল টা হাতে নেয়। আর তখনই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কোন মহিলাই আসছেনা। সে ট্রেন থেকে মাথা বের করে পিছনে তাকায়। দেখে মহিলটা একদম সোজা হয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দুটি ঠিক ‌আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকি মুখে কালো কাপড় দেওয়া।

আহনাফ সাথে সাথে ভিতরে বসে। হঠাৎ এমন কিছু হবে তার ধারনাতেই ছিলো না। পাশে চেয়ে দেখে শাহারিয়া অন্য এক যাত্রীর সাথে আলাপে মশগুল। সে কাগজ টা হাতে নেয়। ট্রেন জোরে চলতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসের বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ট্রেনের ঝকঝক ঝকঝক শব্দ বাড়তে থাকে, মুখে এসে লাগতে থাকা বাতাস তার সামনের চুল গুলোকে উড়িয়ে ‌দিচ্ছে। সে কাগজ টা খুলে ফেলে।

কাগজে বড় বড় করে লাল কালি দিয়ে লেখা ছিলো।

” দিথীর সাথে দেখা করো। সে তোমাকে তোমার অনেক প্রশ্নের উত্তর আর তার সাথে, তোমার প্রতি রাতে দেখা আজব স্বপ্নের কারণও বলে দিবে। একদম দেরি করো না কিন্তু,

ইতি,

তোমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী”

 

চলবে ,

 

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৪৪

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

সে ট্রেন থেকে মাথা বের করে পিছনে তাকায়। দেখে মহিলটা একদম সোজা হয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দুটি ঠিক ‌আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকি মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা।

আহনাফ সাথে সাথে ভিতরে বসে। হঠাৎ এমন কিছু হবে তার ধারনাতেই ছিলো না। পাশে চেয়ে দেখে শাহারিয়া অন্য এক যাত্রীর সাথে আলাপে মশগুল। সে কাগজ টা হাতে নেয়। ট্রেন জোরে চলতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসের বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ট্রেনের ঝকঝক ঝকঝক শব্দ বাড়তে থাকে, মুখে এসে লাগতে থাকা বাতাস তার সামনের চুল গুলোকে উড়িয়ে ‌দিচ্ছে। সে কাগজ টা খুলে ফেলে।

কাগজে বড় বড় করে লাল কালি দিয়ে লেখা ছিলো।

” দিথীর সাথে দেখা করো। সে তোমাকে তোমার অনেক প্রশ্নের উত্তর আর তার সাথে, তোমার প্রতি রাতে দেখা আজব স্বপ্নের কারণও বলে দিবে। একদম দেরি করো না কিন্তু,

ইতি,

তোমার এক শুভাকাঙ্খি”

চিরকুট টা পড়ার সাথে সাথেই আহনাফের চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। তার মুখের ভঙ্গিমাই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সে কতটা অবাক হয়েছে। সে কাগজ টা সাথে সাথে মুড়িয়ে হাতের মুঠোয় রাখে। পাশে চেয়ে একবার শাহারিয়ার দিকে তাকায়। শাহারিয়া এখনো অন্য এক যাত্রীর সাথে আলাপে মশগুল। আহনাফ কাগজ টা হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে জ্যাকেটের পকেটে রাখে। বাইরের জানালার দিকে তাকায়। সজোরে পিছনে ছুটে যাচ্ছে গাছ পালা, মাঠ। আহনাফ গলায় এক ঢোক গিলে। বিরবির করে বলতে থাকে।

– কে ছিলো ঐ বোরখা পরিহিত মহিলাটা,? তিনি আমার স্বপ্নের বিষয়ে কীভাবে জানলেন ? আমি তো আমার স্বপ্নের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিনি। এমনকি মা, খালাদেরও না। তাইলে ,! আর এই দিথী টাই বা কে ? (একটু থেমে) বড় কোন গোলমাল আছে এইখানে। সব বিষয় গুলো গিয়ে সেই আনন্দপুরেই ঠেকছে কেনো ? এই আনন্দপুরে নিশ্চই কিছু লুকিয়ে আছে। এই সবকিছুর উত্তর আমাকে বের করতে হবে। আমাকে বের করতেই হবে ,!

 

ট্রেন হুঁইসেল বাজিয়ে চলে যেতে থাকে এক ছোট্ট ব্রিজের উপর দিয়ে। দূরে গোল সাদা চাঁদ উঠেছে আকাশে। জোছনা রাত। দৃশ্যটা মনোরম,!

 

 

 

এক বদ্ধ ঘর। ঘরে লাল আলো জ্বলছে। একটা স্টেচার রাখা রুমের মাঝখানটায়। স্টেচারে একটা ছোট্ট মেয়ের উলঙ্গ দেহ। এটা সেই মেয়েটাই, যাকে বিকালে কোন এক বোরখা পরিহিত নারী কিডন্যাপ করে এনেছিলো। মেয়েটার গলা কাঁটা। বুকের চারপাশ রক্ত দিয়ে ভিজে গেছে। একটা পা সম্পূর্ণ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা। স্টেচারের পাশে একটা ছোট্ট কাঠের টেবিল। টেবিলে একটা বড় কাঠের মোটা টুকরো। সেই টুকরোর উপর ছোট্ট মেয়ের কাঁটা পা রাখা। সেটা থেকে মাংস আলাদা করছে এক মেয়ে। হাতে ধামা (মাংসের দোকানে মাংস কাটার জন্য কসাই রা যেই অস্ত্র ব্যবহার করে)। ধামা এক হাত দিয়ে উপরে তুলে সজোরে কোপ দিচ্ছে পায়ের হাঁড়ের সাথে লেগে থাকা মাংস পিন্ডের উপর। বলা যায় রানের যায়গাটার উপর। মেয়েটার পড়নে একটা হালকা গোলাপি শাড়ি। শাড়ির একপাশ থেকে আরেকপাশে স্পষ্ট দেখা যায়। এতোটাই হালকা। হাতাকাটা ব্লাউজ। হাতের নখে গোলাপী নেইলপলিশ দেওয়া। পায়ে হাই হিল।

ছোট্ট মেয়েটা পায়ের রানের মাংস গুলো কেঁটে টুকরো টুকরো করে একটা পাত্রে রাখলো সে। আর বড় লম্বা পায়ের হাড় টাকে স্টেচারে রেখে দিলো। কাঁটা মাংসের পাত্র টা হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘরের এক কোণে থাকা একটা গ্যাসের চুলার পাশে রেখে আসলো। সেখান থেকে এসে স্টেচারের পাশে দাঁড়ালো। এক হাতে ছোট্ট মেয়ের দেহ টা আর আরেক হাত দিয়ে মেয়েটার মাথার চুল ধরে জোরে টানতে লাগলো। সে চাইছিলো এভাবে অর্ধ কাটা গলা সহ মাথাটাকে দেহ থেকে টেনে আলাদা করতে।

কিন্তু মাথাটা দেহ থেকে ছুটছিলো না। সে এবার হেলে দেহ টাকে কনুই দিয়ে চেপে ধরে মাথাটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছুটাতে থাকে। মাথার অংশের সাথে লেগে থাকা গলার হাড় গুলো মটমট করে ভেঙে যায়। ছোট্ট মেয়েটার মাথার চুল গুলো ধরে এক হেঁচকা এক টান দেয়। সাথে সাথেই মাথাটা আলাদা হয়ে তার হাতে ঝুলতে থাকে‌। শাড়ি পড়া মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। ছোট্ট মেয়ের মাথাটা নিয়ে এতোক্ষণ যেখানে পায়ের মাংস কাটছিলো সেখানে যায়। গিয়ে মাথাটাকে মোটা কাঠ টার উপর রাখে। ছোট্ট মেয়েটার দেহ ছাড়া মাথাটার চোখ গুলো এখনো আধখোলা ছিলো। মুখে কিছু দাগ আর বালি লেগে আছে‌।

শাড়ি পড়া মেয়েটা একটা চা চামচ উঠায় কাঠের পাশে থাকা একটা স্টিলের বক্স থেকে। চা চামচের সমতল অংশটা চোখের কোটারের সাইড দিয়ে প্রবেশ করিয়ে চারপাশে ঘুরিয়ে এক জোরে টান মেরে চোখ উঠিয়ে ফেলে। চোখের সাথে একটা রগ জুলছিলো। মেয়েটা রগ টা হাত দিয়ে চোখ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিয়ে চোখ টাকে একটা বাটিতে রাখে। ঠিক একই ভাবে আরেকটা চোখের কোটরের সাইড দিয়ে চামচ ঢুকিয়ে চামচ টা ঘুড়িয়ে এক হেঁচকা টান মারে। চোখ টাকে তুলে নেয়। সে যেন এই কাজ গুলো করতে দারুন আনন্দ পাচ্ছে। এটাই যেন তার সুখ ,!

মাথাটাকে উল্টো করে ধরে। ধামাটা নিচ থেকে উঠায়। উঠিয়ে থামার পিছনের মোটা ভারি অংশ টা দিয়ে ছোট্ট মাথার উপর এক জোরে বারি মারে। সাথে সাথে মাথাটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়। হাড়ের ছোট,ছোট কিছু টুকরো ফ্লোরে পড়ে যায়। ভিতর থেকে জিহবা, গালের মাংস, মগজ সব এলোমেলো হয়ে বেড়িয়ে আসে মাথা থেকে। বেড়িয়ে মোটা কাঠ টার উপর পড়ে। শাড়ি পড়া মেয়েটা মগজ টাকে ধরে মোলায়েম ভাবে মাথার বিভিন্ন রগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে চোখ যেই বাটিটায় রেখেছিলো সেখানে রাখে। ভাঙ্গা মাথার খুলিটাকে স্টেচারের উপর ফেলে দেয়। বাটি হাতে নিয়ে চলে যেতে থাকে ঘরের কোণে থাকা গ্যাসের চুলার দিকে। চুলায় ফ্রাই প্যান আগে থেকেই বসানো ছিলো। মেয়েটা এসে বাটিটা চুলার পাশে রেখে ফ্রাই প্যানে তেল দেয়। অনেকটা তেল দেয়। তেল দিয়ে অর্ধেক প্যান ভর্তি করে ফেলে। চুলার জাল বাড়ায়। তেল গরম হতে থাকে।

তখনই সেই বদ্ধ ঘরের দরজা খুলে যায়। বাইরে থেকে এক সাদা আলো ভিতরে ঢুকছে। তারমানে এই রুমে ঢুকার দরজার বাইরে এক উজ্জ্বল সাদা আলো জ্বলছে। একটা লোক প্রবেশ করে সেখান দিয়ে। লোকটা প্রাপ্ত বয়স্ক। মুখ দেখা যায় না। লোকটা এসে এই বদ্ধ রুমের আরেকটা দরজা খুলে। দরজা খুলে মাথা ঢুকিয়ে ভিতরে উঁকি দেয়। সেই দরজার ভিতরে ছিলো অনেক বন্দি ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা। তারা লোকটাকে দেখেই কান্না শুরু করে দেয়। লোকটা মাথা বের করে নেয়। দরজাটাকে লাগায় না। হালকা টেনে ভিড়িয়ে দেয়। তখনই ফুটন্ত তেলে কিছু ভাজার আওয়াজ আসতে থাকে। লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে দূরে থাকা শাড়ি পড়া মেয়েটা কিছু ভাঁজছে। লোকটা কিছু বলে না। যেই দরজা সে খুলেছিলো একটু আগে সেটার পাশে একটা বেসিন লাগানো। সে বেসিনের সামনে গিয়ে হাত, মুখ ধুতে থাকে।

এদিকে মেয়েটা ফ্রাই প্যানে ডুবো তেলে মগজ ভাজছে। তেলের বুদবুদ গুলোর মাঝে আরো কিছু টুকরো টুকরো মাংসও ছেড়ে দেয় মেয়েটা।

 

কিছুক্ষণ পর,

হাফ ফ্রাই করে মগজ আর টুকরো টুকরো করা মাংস গুলো উঠিয়ে নেয় তেল থেকে। একটা প্লেটে সাজাতে থাকে খাবার গুলোকে। এদিকে লোকটা হাত মুখ ধুয়ে এসে সেই ঐদিনকার টেবিল টায় বসেছে। গুনগুন করে গান গাইছে। তার মনে যেন ভীষণ সুখ ,!

শাড়ি পড়া মেয়েটা দুটো সুন্দর প্লেট হাতে এগিয়ে আসতে থাকে লোকটার দিকে। লোকটা খাবার আর তার সাথে মেয়েটার দিকে লোভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে‌। মেয়েটা হয়তো সুন্দরী কেউ, তাই জন্য এরকম লোভ দৃষ্টিতে লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছে‌। মেয়েটা এসে টেবিলে প্লেট দুটো রাখে। দুটো প্লেটেই ছিলো কিছু টুকরো টুকরো হাফ ফ্রাই করা মাংস আর একটা করে চোখ। চোখ গুলো কাঁচা ছিলো। আর মগজ টা ছিলো এক প্লেটে। মেয়েটা মগজ টাকে ছোট ছুরি দিয়ে কেটে দু ভাগ করে। এক ভাগ উঠিয়ে দেয় লোকটার প্লেটে। আরেক ভাগ তার নিজের প্লেটে রাখে। লোকটা মেয়েটার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। মেয়েটা চেয়ার টেনে লোকটার পাশে বসে। লোকটার মুখের দিকে এগিয়ে একটা ছোট্ট কিস করে। লোকটা কিস করার পর যেন আরো খুশি হয়ে উঠে। সে খুশিতে খাবার খেতে শুরু করে। ছোট্ট ছোট্ট মাংস গুলো কাঁটা চামচ দিয়ে বিঁধে নিজে আলতো করে কিছুটা কামড় দেয়। আর বাকিটা মেয়েটার দিয়ে এগিয়ে দেয়। মেয়েটা সেটা চুমু দিয়ে খেয়ে নেয়। তাদের বয়সের মাঝে পার্থক্য হলেও, একে অপরের প্রতি টান দেখে বেশ অনেক কিছুই ধারনা করা যায়। তখনই তাদের কিছুটা পিছনে থাকা সেই আধ খোলা দরজা থেকে এক বাচ্চা ছেলে বেড়িয়ে আসে। ছোট ছেলে, বয়স হয়তো হবে ৬-৭। এসেই ঘরের মধ্যেকার এমন ভিতকর পরিবেশ আর তার সাথে দূরে পড়ে থাকা কিছু মাথা খুলি আর রক্ত দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে চিৎকার দিতে থাকে। ছুটোছুটি করতে থাকে। ঘরের মধ্যে দৌড়ে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। “আম্মু আম্মু” বলে ডাকতে থাকে তার মা’কে। খুঁজতে থাকে তার মা’কে।

হঠাৎ দৌড়াতে দৌড়াতে সে থেমে যায়। তার গলা দিয়ে বেড়োনো আওয়াজ টাও এক “গর গর” আওয়াজ করে থেমে যায়। একটা ছুরির অগ্রভাগ বেড়িয়ে ছিলো তার গলা দিয়ে। ছোট্ট ছেলেটার মুখ দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে। ফ্লোরে ধপ করে পড়ে যায় তার দেহ টা। একটা ছুরি তার কাঁধ দিয়ে প্রবেশ করে গলা ভেদ করে বেড়িয়ে ছিলো। ছুরিটা ছুরে মেরেছিলো সেই শাড়ি পড়া মেয়েটা। ছেলেটার গলায় হাত দিয়ে ফ্লোরে দাপাদাপি করতে থাকে। তার শরীর টা বেঁকে যায়। এক যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু হয় তার। তখনই এক আনন্দের হাসিতে মেতে উঠে খাবার খেতে থাকা দুজন। যেন তাদের কাছে এটা খুবই আনন্দের বিষয়। মজার বিষয়। কোন এক মায়ের কোল খালি তাদের কাছে মহানন্দের বিষয়,!

 

 

 

একটা ঘর। ঘরের মাঝে এক গোল বল। বলের মধ্যে আহনাফ আর শাহারিয়াকে দেখা যাচ্ছে। তারা ট্রেনে করে যে আসছে সেই সিন দেখা যাচ্ছে গোলক টার মাঝে। ঘরের চারপাশ অন্ধকার। শুধু এই বল জাতীয় জিনিস টা থেকেই আলো বেড়িয়ে ঘরকে আলোকিত করেছে। গোলকের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে আসুভে অর্থাৎ সুমু, ছওতার মানে সেই তাসনুবার শশুর। যে আসুভেকে এই পৃথিবীতে এনেছে। আর হনুফা বেগমের আত্মা। তাকে দেখতে বিভৎস লাগছে।

আসুভে বলে উঠে।

– চতুর্থ পুনর্জন্মও আনন্দ পুরে চলে আসছে। ওকেও দিথীর মা পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা কী করবো ,! আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই আমার শক্তি ফিরে পাওয়ার সময়। কিন্তু এর আগে যদি ওরা আমার ক্ষতি করে। তখন,!

– আমাকে কী বলছিস। তুই তানিয়ার এতোটা কাছে থেকেও আসল আংটিটা নিয়ে আসতে পারলিনা। আর এখন আমাকে বলতে এসেছিস,!

– দাদু আমি কীভাবে কী করতাম। আমি তো বুঝতেই পারিনি যে তানিয়া সবকিছু আগে থেকেই বুঝতে পারবে,!

– রিতু কে মারার কী দরকার ছিলো,? ওকে তুই গুম করে ফেলতি। তা না করে রিতুকে মেরে ‌রিতুর বাসাতেই রেখে এসেছিস। তোকে দিয়ে যদি একটা কাজও ঠিক মতো হয়।

– আমি কী করবো। দিথী আর তানিয়াকে মারার কী কম চেষ্টা করেছি। সবসময়ই তো দিথীর মা এসে তাদের বাঁচিয়ে নেয়।

– এই দিথীর মায়ের যদি দেহের সাথে সাথে আত্মাটাও নিয়ে নিতি সেদিন। তাইলে আজ ও আমাদের কাজে বাঁধা দিতে আসতোনা।(একটু থেমে) এতো গুলা বছর কষ্ট করে এসে শেষে কি না আমাদের ভুলেই তরী ডুববে ,! না। এ হতে দেওয়া যায় না।

– শাহারিয়া নামের ছেলেটা তো আসছে। ও তো এসে দিথীকে বিয়ে করবে। তখন দিথীর কুমারীত্ব নষ্ট হবে আর সে তখন কিছু করতেও পারবেনা।

– এতোটাও সহজ না। দিথী যদি শাহারিয়াকে সব বুঝিয়ে বলে আর বিয়ের পরও মিলিত হওয়া থেকে দুজন দুজনকে সামলিয়ে রাখে তাইলে দিথী কিছুতেই তার কুমারীত্ব হারাবে না। আর শাহারিয়া যে সে মানুষ না। ও খুব ধৈর্য শীল। ও ঠিকই নিজেকে কয়েকটা দিন কন্ট্রোল করতে পারবে। তুই ঐসব না ভেবে নতুন কিছু ভাব। (একটু থেমে) দিথীর ঘরের সামনেও সাদা পাওডার দেওয়া। চাইলেও ভিতরে যেতে পারবি না। সব দিক দিয়ে আটকে ফেলছে আমাদেরকে।

– দিথী কী কখনোই বেড়োয় না নাকি ঘর থেকে,! যখন বের হবে তখন আক্রমণ করবো।

– ওর মা, ওকে স্বপ্নে আগেই সব দেখিয়ে দেয়। নাইলে ঐদিন তো হনুফা ঠিকই তানিয়ার দেহে ভর করে গেছিলো দিথীকে মারতে‌। পারলো কই ,!

– তাইলে এখন করণীয়,!

– সামনে নিপার বিয়ে। সেসময় অনেকক্ষণ দিথী তার বাড়ির বাইরে থাকবে। নিপাদের বাসা, তারপর ঐ বরদের বাসা এগুলোর মধ্যেই ও থাকবে। তখন একসাথে তুই আর হনুফা হামলা করবি। হনুফার থেকে বেঁচে গেলেও যেন তোর হাতে মারা পড়ে, এমন পরিকল্পনা নিয়ে যেতে হবে আমাদের। বুঝেছিস ,?

– আমি তাইলে বাইরে যাবো ,!

– হ্যা। তবে যেদিন বিয়ে হবে সেদিন। তার আগে দরকার ছাড়া বেড়োবি না। ওরা যখন তখন তোর কোন ক্ষতি করে দিতে পারে। খুব সাবধান ,!

– বুঝেছি। এখন তাইলে আমাদের টার্গেট হলো নিপার বিয়ে। তাইতো ,! (হনুফা)

– হ্যা। নিপার বিয়ে। এই বিয়ের হবে দিথীর মৃত্যুর কারণ। ওর আনন্দ, আমরা নিমেষেই মৃত্যুর ছায়ায় ছেয়ে যাবে। কেউ বাঁচাতে পারবেনা ওকে কেউ না , হা হা হা হা

ঘরের তিনজনই এক পিশাচ রুপি হাসি হেসে উঠে। ঘরের দেওয়াল গুলো কাঁপতে থাকে সেই শব্দে। আসলেই কী এই বিয়ে দিথীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে,!

 

 

 

পুব দিগন্তের সূর্যের আলো এসে পড়লো বিছানায়। খোলা জানালা দিয়ে মিষ্টি এক বাতাস ঘরে ঢুকছে। দূরে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সুরাইয়া বেগমের ঘরের খোলা জানালা যেন এক সুন্দর সকালের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করছে। এই নিদারুণ সুন্দর আবহাওয়ার মাঝে সুরাইয়া বেগমকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছে আলিশা। বেশ ভালো গল্প আবৃত্তি করতে পারে ও। সুরাইয়া বেগম মনযোগ দিয়ে তা শুনছেন।

মুখে হয়তো অনেকদিন পর কিছুটা ভালোলাগার অনুভূতি ফুটে উঠেছে। সুরাইয়া বেগম বালিশে হেলান দিয়ে রয়েছেন। তার পাশে বসে “আমি পদ্মজা” বইটি পড়ে শোনাচ্ছে আলিশা। বইটা আলিশার ভীষণ ভীষণ প্রিয়। তাই সে তার প্রিয় বইটিকেই তার মা’কে পড়ে শোনাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। আলিশার পিঠে কিছুটা আর বাকিটা রোদ বিছানায় সুরাইয়া বেগমের পায়ের উপর এসে পড়েছে। সুরাইয়া বেগমের চোখে এখনো ব্যান্ডেজ, কাল ঔষধ খাওয়ায় শরীরের দূর্বলতা কিছুটা কমেছে তার। বেশ উৎসাহের সহীত মনযোগ দিয়েই গল্প আবৃত্তি শুনছেন তিনি।

ঘরে প্রবেশ করলো সোনালী। মানে সেই মেয়েটা, যে কাল সকালে সুরাইয়া বেগমের চেকাপ করে দিয়েছিলো। পড়নে ঠিক কালকের ড্রেস গুলোই। থ্রী পিসের উপর এক সাদা এপ্রোন, আর চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা। ডান কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। সোনালী এসে পড়ার টেবিলের সামনে হতে চেয়ার টা নিয়ে বিছানার পাশে বসে। চেয়ারের শব্দে আলিশা আর সুরাইয়া বেগম নজর আর মনযোগ সোনালীর দিকে যায়। আলিশার বইটা কিছুটা নামিয়ে সোনালীকে বলতে থাকে।

– ও আপু তুমি। বসো। রায়হান ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে ,!

– না হয়নি। হয়তো বাইরে গিয়েছে। (একটু থেমে) আর কাল সন্ধ্যায় একবার এসে দেখে যেতে চেয়েছিলাম‌। কিন্তু তখনই বাবার জ্বর টা আবার বেড়ে গেলো। জানোই তো বাবার সেবা করার মতো আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাই আসতে পারিনি আর পরে।

– না না। সমস্যা নাই আপু। তুমি যখন ফ্রি থাকবে, তখন এসে একটু মা’কে দেখে যেয়ো। তাইলেই হবে।

– বই পড়ে শোনাচ্ছিলে না তোমার মা’কে,! (কাঁধের ব্যাগ থেকে প্রেশার মাপার প্যাড গুলো বের করতে করতে সোনালী বলে)

– হ্যা। বই পড়ে শোনাচ্ছিলাম। যাতে মায়ের মন টা একটু ভালো হয়।

সুরাইয়া বেগম একবার আলিশার দিকে ফিরে অবাক পানে চেয়ে তার কথা শুনছে তো একবার সোনালীর দিকে ফিরে অবাক হয়ে তার কথা গুলো শুনছে। সোনালি প্রেশার মাপার প্যাড গুলো সুরাইয়া বেগমের হাতে পড়াতে যায়, তখনই সুরাইয়া বেগম হাত উঠিয়ে নেয়।

– আমার হাত ছোবানা মাইয়া। আমার হাত, হাত ছোবানা। (কিছুটা কাপো কাপো গলায় বলে আলিশার দিকে ফিরে চায় সুরাইয়া বেগম। আলিশা, সোনালীকে ইশারায় আশস্ত করে সুরাইয়া বেগমকে বলে।

– মা। উনি ভালো ডাক্তার। উনি তোমার প্রেশার মাপতে এসেছেন।

কথা শুনেই একবার সোনালীর দিকে ফিরে তাকায় সুরাইয়া বেগম। তাকে ভালোভাবে দেখে তারপর আবার আলিশার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেন।

– ভ,ভালো ডাক্তার।

– হ্যা মা।

– কিছু হইবোনা তো আমার ,!

– না মা। কিচ্ছু হবেনা। তুমি হাত টা দাও।

সুরাইয়া বেগম হাত টা রাখেন। সোনালী প্যাড টা পড়িয়ে প্রেশার মাপতে শুরু করে। আলিশার দিকে না তাকিয়েই বলে।

– কাল রাতে খালা ওষুধ গুলো ঠিকঠাক মতো খেয়েছিলেন ,?

– হ্যা। আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছি।

– খালা আজ বেশ সুস্থ বোঝা যায়। ওষুধ গুলো ঠিকঠাক মতো দিয়ো। তাড়াতাড়ি আবার আগের মতো হয়ে যাবেন।

– আন্টি,(একটু থেমে ধীর গলায়) মায়ের স্মৃতি শক্তির বিষয় টা ,!

– ওটা ,! ওটা নিয়ে চিন্তা করোনা। আগে উনি ফিজিক্যালি সুস্থ হোন। তারপর আমি হসপিটাল নিয়ে গিয়ে ভালো কোন সাইকোলজিষ্ট ডাক্তার দেখিয়ে নিবোনে।

– আচ্ছা আন্টি।(একটু থেমে সোনালীর কাজ দেখতে দেখতে) ভাইয়ার বিয়ের দাওয়াত পাইছো ,!

– হ্যা। নজরুল চাচা দিয়েছেন। বাড়িতে বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছিলেন।

– ওহহ। চলে আসিও সবাই।

– হমম দেখা যাক। আব্বার শরীরটা আর খারাপ না হইলেই হয়।

– নানুভাইয়ের কী হয়েছে ?

– ঐযে বললাম। জ্বর, মাথা ব্যাথা। কয়দিন আগে সাড়ছিলো। কাল বিকালে আবার ধরছে। (প্রেশার প্যাড হাত থেকে খুলতে খুলতে) প্রেশার ঠিক আছে এখন। কাল রাতে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করাইছো যে। এইজন্য এখন ঠিকঠাক আছে।

(বলতে বলতে প্রেসার প্যাড খুলে ভাজ করতে থাকে সোনালী)

– যাক, তোমার একদিনের ওষুধ মায়ের শরীরে অনেক কাজে দিছে। (আলিশা)

– হ্যা। তারপরও আজ আরো নতুন কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। এটা এখন থেকে আগের গুলোর সাথে নিয়মিত সময় করে খাওয়াইয়ো। (একটা ছোট প্রেসক্রিপশন লেখে দিতে থাকে সোনালী)

– আচ্ছা আন্টি।

এদিকে সুরাইয়া বেগম হা করে দু’জনের দিকে তাকাচ্ছে আর তাদের কথা শুনছে।

সোনালী প্রেসক্রিপশন কাগজ প্যাড থেকে ছিঁড়ে আলিশার দিকে এগিয়ে দেয়। আলিশা কাগজ টা নিয়ে দেখতে থাকে। সোনালী ব্যাগে সবকিছু ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আলিশা বলে উঠে।

– বসো। ভাইয়া আসুক।

– না রে‌। আজকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে কলেজে (হাত ঘড়ি দেখতে দেখতে) আজ পরীক্ষা আছে।

– ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে যাও তাইলে। ঠিক ভাবে পরীক্ষা দিয়ো।

– আচ্ছা গেলাম তাইলে আমি। (সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে) খালা, গেলাম।

সুরাইয়া বেগম কিছু বলেন না। শুধু চুপচাপ হাবাগোবার মতো সোনালীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।

সোনালী বের হয়ে যায় ঘর থেকে। আলিশা তার মায়ের হাত ধরে তাকে নাড়িয়ে দিয়ে বলে।

– মা, আমির আর পদ্মজার ভালোবাসার বাকি টা শুনবেনা ,! এদিকে ফিরো। আমি বাকিটা পড়ে শোনাচ্ছি। তুমি শোনো।

সুরাইয়া বেগম আলিশার কথা শুনে তার দিকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দিতে দিতে বলে‌

– হ্যা কও ভালো মাইয়া। বাকি গল্প ডাও কও।

আলিশা পড়তে শুরু করে। বেশ আনন্দের সহীতই ও পড়তে থাকে। সুরাইয়া বেগম আবার আগের মতো আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকেন আলিশার গল্প আবৃত্তি।

 

সোনালী করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অন্দরমহলে আসে। অন্দরমহলে কেউ নেই। চারপাশ এমন মানবশূন্য ফাঁকা দেখে সোনালী একটু অবাকই হয়। সে অন্দরমহলে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখতে থাকে, তখনই তার চোখ যায় উপরে দোতলায় করিডোর বারান্দার দিকে। রায়হানের বড় ভাই রাফসান সেখানে দাঁড়িয়ে, নিচে ঠিক তার দিকেই দেখে আছে।  রাফসানের চাহনি তার ভালো ঠেকেনি। সে রাফসানের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে চলে যেতে থাকে অন্দরমহলের মূল ফটকের দিকে। বেড়িয়ে বাইরে চলে যায়। উপরে দাঁড়িয়ে থাকা রাফসান একটা ছোট্ট মুচকি হাসি হেসে চলে যেতে থাকে তার ঘরের দিকে।

 

 

 

মেম্বার বাড়ি। রোদের ঝিলিক এসে পড়ছে আঙিনায়। আঙিনায় বেশ লোকজনের সমাগম। ছোট বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি। ডেকোরেশনের লোক গুলোও এসেছে। বাড়ি সাজাতে শুরু করেছে। কাল গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদের স্টেজ বানানোর যায়গাটা ঝাড়ু দিচ্ছে ফুলমতি। স্টেজ কেমন হবে, কোথায় কী লাইট লাগানো হবে তার নির্দেশনা দিচ্ছেন নিপার মামা সায়েম সাহেব। কাল গাঁয়ে হলুদ তাই আজ অনেক মেহমানদের আসার কথা। সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন রান্না ঘরে শিউলি বেগম, লায়লা আর সাথে আরো কিছু মহিলা।

আঙিনার সাইডে তিনটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে নিপা,আফাজ আর ইকরা। তিনজনের হাতে চায়ের কাপ আর সামনে একটা ছোট টেবিলে নাস্তা। আফাজ আর নিপা গল্পে মশগুল। বাড়ির কোলাহল, বাচ্চাদের খেলাধুলার আওয়াজ, সবকিছুই যেন ইকরার কান পর্যন্তই। মাথায় যে ঘুরছে তার অন্য কিছু, মনের পাড়ায় কাউকে সে খুঁজে ফিরছে বারংবার। চায়ে একটা ছোট্ট চুমুক, সাথে এক ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস। বাড়ির দরজার দিকে তাকালো ইকরা। না, সে আসেনি। বারবার মনে হচ্ছে, এইবুঝি সে এলো। ধুর, এতো ওর কথা ভাবছে কেনো ইকরা,! কাল বিকালের ঘটনা টার পর থেকে মাথায় খালি ঐ কথা, ঐ দৃশ্য টাই ঘুরছে। বাসায় এতো কোলাহল থাকার পরও তার কাছে বাসাটা সম্পূর্ণ নীরব, নিস্তব্ধ। আকাশের সূর্য আজ তাড়াতাড়ি উঠলেও ইকরার মনের আঁধার তা কাটাতে পারেনি। কেনো সে বারবার তাকে খুঁজে ফিরছে সবার মাঝে ,! জানেনা। সে কিছুই জানেনা। ধুরর, তার কিছুই ভাল্লাগছেনা। ইকরা চায়ের কাপ টা জোরে টেবিলের উপর রাখলো।

নিপা, আফাজ আর আঙিনায় থাকা বাকি সবাই হঠাৎ শব্দে এক দৃষ্টে ফিরে ইকরার দিকে তাকালো‌। সব একনিমিষেই চুপচাপ। ইকরা চারপাশ চেয়ে কিছুটা নার্ভাস হয়। সে চায়ের কাপ টা আবার হাতে নিয়ে আস্তে করে টেবিলের উপর রাখে‌। বাকিরা আবার তাদের কাজে আর কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে যায়। নিপা, আফাজ আবারো গল্পে মশগুল হয়ে পড়ে। ইকরা বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিয়ে বাড়িতে এসে যেনো ও পড়ে গেলো অন্য কারো মনে। না না সে পড়েনি। তার মনে কেউ পড়ে গিয়েছে। পা পিছলে ধপাস করে পড়েছে। রিয়াদ হয়তো কাল রাস্তায় না। বাইক নিয়ে তার মনপাড়ায় পড়ে গিয়েছে।

 

ইকরা দুই হাত কোলে গুঁজে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে আসে। জলপাই গাছের নিচেই সেই বাঁশ দিয়ে বানানো বসার যায়গাটা। ইকরা গিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে পড়ে সেখানে। এদিকটায় সূর্যের আলো নেই গাছের জন্য। তাই যায়গাটা ঠান্ডা। ইকরা বসে রাস্তার দু পাশে চেয়ে দেখে। না কেউ নেই। থেকেও যেনো নেই। সে যাকে খুঁজছে সেই যে নেই। তাকে আজ সকাল থেকে একটা বার খুব দেখতে মন চাইছে ইকরার। খুব করে তার কন্ঠ শুনতে মন চাইছে ,!

ইকরা এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তার দিকে চেয়ে তাকায়‌। দেখে কেউ আসছে। না রিয়াদ না। শাহারিয়া আর একটা ছেলে আসছে তার সাথে। শাহারিয়াকে সে ভাইয়া বলে ডাকে। অনেকদিন পর দেখেও চিনতে ভুল করেনি সে। তার মুখে হালকা এক মৃদু হাঁসি ফুটে উঠে।

শাহারিয়া আর আহনাফ রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে একে অপরের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে। ইকরা হাত নেড়ে তাদের ইশারা করে। কিন্তু শাহারিয়া তা দেখেনি। ইকরা ভাবলো নেমে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলা যাক। মন টা যদি একটু ভালো হয়। শাহারিয়া তাকে নিপার মতোই অনেক আদর আর স্নেহ করে। ইকরা বাঁশের বসার যায়গাটা থেকে নেমে জুতো পড়ে। পড়েই শাহারিয়াদের দিকে তাকায়, নিমেষেই তার মুখের হাঁসি যেন উবে যায়। একটা মেয়ে হাতে এক ছুরি নিয়ে শাহারিয়ার ঠিক পিছন থেকে দৌড়ে আসছে। শাহারিয়া আর ছেলেটা একে অপরের সাথে কথা বলছে, তাই তারা পিছনে লক্ষ্য করেনি। মেয়েটা শাহারিয়া ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ায়। ছুরি টা দিয়ে আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হয়। ইকরা তা দেখে জোরে এক চিৎকার দিতে যাবেই তখনই কেউ একজন পিছন থেকে তার মুখ চেপে ধরে।

 

চলবে ,

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৪৫

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

ইকরা বাঁশের বসার যায়গাটা থেকে নেমে জুতো পড়ে। পড়েই শাহারিয়াদের দিকে তাকায়, নিমেষেই তার মুখের হাঁসি যেন উবে যায়। একটা মেয়ে হাতে এক ছুরি নিয়ে শাহারিয়ার ঠিক পিছন থেকে দৌড়ে আসছে। শাহারিয়া আর ছেলেটা একে অপরের সাথে কথা বলছে, তাই তারা পিছনে লক্ষ্য করেনি। মেয়েটা শাহারিয়া ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ায়। ছুরি টা দিয়ে আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হয়। ইকরা তা দেখে জোরে এক চিৎকার দিতে যাবেই তখনই কেউ একজন পিছন থেকে তার মুখ চেপে ধরে। মেয়েটা ছুরি টা দেহে ঢুকিয়ে দিতে যাবেই তখনই তার হাত থেমে যায়। মেয়েটা ছুরি দিয়ে শাহারিয়াকে নয়, আহনাফকে আঘাত করতে এসেছিলো।

হাতের দিকে মেয়েটা চেয়ে দেখে, তার হাত আহনাফের পিঠের ২ ইঞ্চি সামনেই থেমে গিয়েছে। সে মুখ তুলে তাকায়। দেখে তার হাতের কবজি পিছনে না ফিরেই শাহারিয়া বাম হাত দিয়ে ধরে ফেলেছে। মেয়েটা কিছু বুঝে উঠবার আগেই শাহারিয়া ঘুরে তার মুখে ঘুষি মারতে উদ্যত হয় আর তখনই মেয়েটার ভিতর থেকে এক কালো ধোঁয়া বেড়িয়ে যায় আর মেয়েটা তার দেহ ছেড়ে দেয়। আহনাফ তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে ধরে। শাহারিয়া মেয়েটার হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে ফেলে দেয়। আহনাফ মেয়ের অচেতন দেহ টা ধরে উদ্যত হয়ে শাহারিয়াকে বলে।

– স্যার, স্যার এ কে ? আমাদের পিছনে কবে আসলো। আর আপনি হঠাৎ তার হাত ধরে তাকে মারতে গেলেন যে ,!

– তোমাকে মারতে এসেছিলো ও। এই যে এই ছুরি (হাতের ছুরিটা দেখিয়ে) এটা আরেকটু হলেই তোমার পিঠ ভেদ করে পেট দিয়ে বেড়োতো।

 

ইকরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবটুকু দেখে। এবং তখনই সে তার মুখের উপর ফাঁকা অনুভব করে। সে দেখে এখন তার মুখ কেউ চেপে ধরে রাখেনি। সে পিছন ফিরে তাকায়। দেখে এক ১৭-১৮ বছর বয়সী মেয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে ছুটে পালাচ্ছে। ইকরার এসব কিছুই বোধগম্য হয় না। সে আর দেরি না করে শাহারিয়া, আহনাফ দের দিকে ছুটে যায়।

 

আহনাফ হাঁটু গেঁড়ে মেয়েটার দেহের অর্ধেকাংশ ধরে আছে। মেয়েটার কোমড় থেকে বাকিটা শরীর রাস্তায়। শাহারিয়া চারপাশে চেয়ে দেখে কেউ রাস্তায় বা আশেপাশে ঘটনাটার সময় ছিলো কী না। দেখে আশপাশে কেউ নেই। তবে কেউ একজন তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। শাহারিয়া ভালোভাবে মেয়েটাকে খেয়াল করে দেখে। দেখে যে সেটা ইকরা। তার ইকরাকে চিনতে বেশি সময় লাগেনি। ইকরা তাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। হাঁটুতে হাত দিয়ে হেলে হাঁপাতে থাকে। শাহারিয়া বলে উঠে।

– ইকরা তুই ,!

– হ,হ্যা ভাইয়া। ভাইয়া এই মেয়েটা কে? কেনো মারতে আসছিলো ?

শাহারিয়া কিছু বলতে যাবেই তখনই মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসতে থাকে। মেয়েটার চোখের পাতা, দুই ঠোঁট নড়ে উঠতে থাকে। শাহারিয়া কিছু বলার আগেই ইকরা মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসা দেখে মেয়েটার পাশে গিয়ে হেলে বসে। মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসে। সে উঠে বসে। মাথা এক হাত দিয়ে ধরে বলতে থাকে।

– এইডা কোন যায়গা ,! মুই এইঠে কী কচ্ছিনু ,!

– কী বলতেছে স্যার ও ,!

– এইটা উত্তরের বেশিরভাগ মানুষের প্রচলিত ভাষা। (মেয়েটার সামনে হেলে) তুমি আমাদের মারতে আসছিলে কেনো ?

– মুই ,? মুই কুনঠে মারিবা আসিনু। মুই তো ধানবাড়িত কাম কচ্ছিনু। হঠাৎ ক এক বাতাস আসে মোর শরীরত লাগিল। তারপর আর কিছু ফম নাই।

– মানে ,? মানে তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি যে আমাদের মারতে আসছিলা এইটা তুমি নিজেই জানোনা ,? (শাহারিয়া)

– মুই কিতায় তুমহাক মারিবা যাম বাহে,! মুই তো এই বাউ ডাক( আহনাফকে দেখিয়ে) এই বাউ ডাক চিনুও না।

– এইযে (একটা ছুরি দেখিয়ে) এইটা দিয়ে তুমি ওকে আঘাত করতে যাচ্ছিলা। ভাগ্গ্যেস আমি সময় মতো ধরে নিছিলাম। নাইলে তো,

– তুমরা কী কহচেন এইলা। মুই কিছু করুনি। মোক ছেড়েদাও।

– স্যার। কী করবেন এখন ,! (এক মলিন মুখ নিয়ে শাহারিয়ার দিকে তাকায় আহনাফ)

– ভাইয়া, মনে তো হয় কেউ মনে হয় মেয়েটাকে বশ করে কিছু করছে। মেয়েটার হাত ধরার পর পরই কি যানি একটা কালো ধোঁয়া শরীর থেকে বেড়িয়ে গেছিলো।

– বশ ,? কে যানে। আমার কাছে এসব কুসংস্কার বিশ্বাস হয় না।

– ছেড়ে দাও মেয়েটাকে। দেখো তোমাকে দেখে কেমন ভয় পাচ্ছে খালি,!

– আহনাফ, মেয়েটাকে ছেড়ে দে। বিয়ে বাড়ি, ঝামেলা বাড়ানো ঠিক না।

আহনাফ মেয়েটার দুই হাতের কব্জি এতক্ষণ ধরে ছিলো। শাহারিয়ার আদেশ পেয়ে হাত ছেড়ে দেয় সে। মেয়েটাকে ধরে উঠায় ইকরা। তার কামিজের বালি ঝেড়ে দিতে থাকে। বলতে থাকে।

– বিয়ে বাড়ি, এইজন্য বাঁচে গেলি হ্যা। নাইলে রিয়াদকে বলে আমি তোকে সোজা গারদে পুরে দিতাম ,!

– না না বাপু। মোক ছেড়ে দাও। মুই নিজেও জানুনা মুই কি করিবা এইঠে অইচ্চিনু।

– যা। হয়তো তোর দোষ নাই। কিন্তু যদি থাকে। তাইলে বুঝিস কিন্তু,! একদম (একটা ঘুষি উঠায় ইকরা মেয়েটার মুখ বরাবর)

– মাইরেন না মোরে,! মোরে মাইরেন না ,!

– ইকরা ছেড়ে দাও। চলে যাক মেয়েটা।

ইকরা হাত নামিয়ে নেয়। মজা করেই সে মারার ভঙ ধরছিল। মেয়েটাকে ছেড়ে দেয়। মেয়েটা ভয়ে হনহন করে চলে যেতে থাকে রাস্তা দিয়ে। একটু পর পর ভয়ার্ত মুখ নিয়ে ফিরে তাকায় আর তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে পালাতে থাকে।

 

শাহারিয়া লাগেজের হাতল ধরে ইকরা। সবাই আবার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। শাহারিয়া মাঝ দিয়ে হাঁটছে। ইকরা আর আহনাফ দুই পাশে। শাহারিয়া বলতে থাকে।

– কবে আসলি ,!

– এইতো ভাইয়া। ১ দিন হইলো।

– নিপা কই ,! কানতেছে নাকি আবার ,!

– নাহহ! কান্না তো দূর, উল্টা আরো হাসিখুশিতে মেতে আছে।

– পছন্দের মানুষকে যে বিয়ে করতেছে। ঐজন্য। (একটু থেমে) ও ভালো কথা। রিয়াদ কে তুই কেমনে চিনলি ? আসলিই তো বলে ১ দিন আগে। তাতে গ্রামের পুলিশের ওসির নাম জানে ফেলছিস ,!

– বাসায় আসছিলো তার ভাবিকে নিয়ে। তখন দেখছি‌।

– ওহহ। (একটু থেমে) আফাজ আসেনাই ,!

– বাসায় আঙিনায় বসে আছে। (একটু থেমে) ছেলেটা কে ভাইয়া ,!

– ও ? ও আহনাফ। আমার বন্ধু।

 

কথা বলতে বলতে বাড়ির গেটের সামনে চলে আসে সবাই। ইকরা, শাহারিয়ার কথা আহনাফের কানে এলেও মাথায় চলছিলো একটু আগের ঘটনাটা। মেয়েটা কেনো তাকে মারতে আসলো,? আবার জ্ঞান ফিরার পর বলতেছে ও কিছু জানেনা, মনে নাই। গ্রামে পা রাখতে না রাখতেই তার উপর আক্রমণ,! কে করালো আক্রমণ,?

গেইট দিয়ে আগে ভিতরে ঢুকে ইকরা। তারপর শাহারিয়া। সবার পিছনে ছিলো আহনাফ। সে ঢুকতে যাবেই তখনই তার চোখ পড়ে কিছুদূরে থাকা রাস্তার সাইডের এক বড় গাছের দিকে। গাছের আড়াল থেকে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলো এক মেয়ে। বয়সটা ১৭-১৮ এর মতো। আহনাফ তার নজর নামিয়ে নেয়। সব কিছু সন্দেহ জনক লাগলেও এখন কিছু করা যাবেনা তার। সেও ভিতরে ঢুকে যায়। সেই গাছের আড়ালে থাকা সুমু অর্থাৎ আসুভের চোখে মুখে ছিলো বিরক্তি সূচক শব্দ। এক ছোটখাটো ঘুষি মেরে বসে সে সেই গাছে,!

 

 

 

দুপুর ১২ টা। সূর্যের রোদ ঠিক মাথার উপর। গরম আজ ভালো রকমেরই পড়ছে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ। ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে হেঁটে মেইন গেটের দিকে যাচ্ছে সোনালী। অর্থাৎ সেই মেয়েটা, যে সুরাইয়া বেগমের চিকিৎসা করে দিয়েছিলো। সোনালীর পরীক্ষা শেষ। ক্যাম্পাসে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে আড্ডায় মজলেও সোনালী চুপচাপ ভাবেই ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা হয়েছে মোটামুটি। আরেকটু ভালো করা যেতো। তাই নিজের মধ্যে একটা আফসোস কাজ করছে তার।

মেইন রোডের সাথেই এক পাশে মেডিকেল কলেজের গেইট। গেইট দিয়ে বেড়িয়ে আসলো সোনালী। গেইটের বাইরে তেমন কোলাহল কিংবা শিক্ষার্থী নেই। দূরে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। আর তার সামনে দাঁড়ানো কিছু মানুষ। এরা ছাড়া রাস্তার দু পাশে আর কেউ নেই। রাস্তার এই পাশ টায় মেডিকেল কলেজ আর বিপরীত পাশটায় ফসলি মাঠের প্রান্তর। মেইন রোডের দু পাশেই ইয়া বড় বড় গাছ। একটা বড় ট্রাক চলে গেলো রোড দিয়ে। সোনালী বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। তাই সে অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। রাস্তায় এখন লোকাল বাস, বড় বড় ট্রাক চলে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে দু একটা। এখান থেকে আনন্দ পুর গ্রাম বেশ দূর। অটোতে ৪৫ টাকা ভাড়া। যেতেও ১ ঘন্টার মতো লাগে। আজ এই সময়টায় অটোও দেখা যাচ্ছে না। সোনালী দুই হাত গুজে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্যাম্পাস থেকে এখনো বাকি শিক্ষার্থীরা বেড়োয়নি। সোনালীর বন্ধু বান্ধব নেই। তাই সে পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই একলা একলা বেড়িয়ে পড়েছে।

একটা বাইক রোড থেকে গতি ধীর করে রাস্তার সাইডে আসতে থাকে। বাইক টা এসে ঠিক সোনালী সামনে থেমে যায়। সোনালী এটাতে একটু অবাক হয়। বাইকের ছেলেটা মাথার হেলমেট খুলে। সোনালী দেখে ছেলেটা রাফসান, রায়হানের বড় ভাই। রাফসান হেলমেট বাইকের হ্যান্ডেলে রেখে একটা সান গ্লাস পড়ে নিতে থাকে চোখে। গায়ে সাদা ফুল হাতা শার্ট, নিচে কালো জিন্স প্যান্ট। রাফসান চোখে সানগ্লাস পড়ে বাইকের লুকিং গ্লাসে নিজের চুল গুলো ঠিক করে নিতে থাকে। সোনালী তার কাজ-কর্ম গুলো চুপচাপ দেখছে। রাফসান থেকে কোন কথা না আশায় তাদের মধ্যেকার নিরবত ভাঙিয়ে সোনালীই বলে উঠে।

– আপনি ,!

সোনালীর কথা শুনে চুল ঠিক করা বাদ দিয়ে তার দিকে ফিরে বলে।

– অন্য কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন নাকি ,?

– না না। তা না। (একটু থেমে ধীর গলায়) হঠাৎ আপনাকে দেখলাম তো, তাই ,!

– ওহহ, আমি একটু গেছিলাম দিনাজপুর শহরে‌। কাজ ছিলো‌। এখন বাড়ি ফিরার সময় দেখি আপনি দাঁড়িয়ে আছেন রোড সাইডে। তাই আরকি। (একটু থেমে) উঠুন।

– কোথায়,!

– আমার পিছনে, বাইকে।

– না না আমি অটো নিয়ে চলে যেতে পারবো।

– আরে উঠুন। আমিও তো বাসার দিকেই যাচ্ছি।

সোনালী কিছু উত্তর দেয় না। বাইকেও উঠে না। রাফসানের নজর তার মোটেও ভালো ঠেকেনি আজ সকালে। আর এখন সেই রাফসানের সাথেই বাইকে যাওয়া ,! না সোনালীর মন সায় দেয় না এতে। তখনই এক অটো আসতে থাকে শহরের দিকের রাস্তাটা হতে। সোনালী হাত বাড়িয়ে ডেকে অটোটাকে থামতে বলে। আটোটা ব্রেক করতে করতে কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়। তারপর থামে। সোনালী আড়চোখে রাফসানকে একবার দেখে চলে যেতে থাকে অটোর দিকে।

হেঁটে হেঁটে চলে আসে অটোর কাছে। অটোর ভিতরে ঢু দিয়ে দেখে পিছনের তিন সিটে দুই বুড়াবুড়ি বসা। মাঝের তিন সিট আর ড্রাইভারের দু পাশের সিট ফাঁকা। সে গিয়ে উঠে বসে পড়ে মাঝের সিটে। অটোটা চলতে শুরু করে। রাফসান মুখ দিয়ে “চ” সূচক বিরক্তি শব্দ বেড়িয়ে বাইকের হ্যান্ডেলে হাত দেয়। বাইক স্টার্ট করে। চলে যেতে থাকে অটোর পিছু পিছু।

 

সোনালী অটোর মাঝের সিটে বসে উপরের প্লাস্টিকের হাতল ধরে আছে। নজর, অটোর পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ি-ঘোড়ার দিকে। তখনই সে দেখে রাফসান ধীর গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে অটোর পাশে চলে আসছে। অটোর সাথে একই গতিতে চলতে থাকে পাশাপাশি। রাফসান একবার সামনে তাকিয়ে রোড দেখে তো একবার অটোর দিকে তাকিয়ে সোনালীকে দেখতে থাকে। সোনালীর তার নজরে অস্বস্তি বোধ হতে থাকে‌। সে মুখ ফিরিয়ে বিপরীত পার্শ্বে তাকায়। ফসলি মাঠ দেখতে থাকে। তবে সে বুঝছিলো রাফসান এখনোও অটোর পাশপাশি গতি কমিয়ে আসছে। আর রাফসানের নজর কোথাও তাও তার বুঝতে বাকি রয় না। সে সাদা এপ্রোন টা ভালোভাবে ঠিক করে দিতে থাকে কামিজের সাথে সাথে। নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে ওড়না ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর আবার বাইরের দিকে চেয়ে ফসলি মাঠ দেখতে থাকে। এমন মুখোশ্রী করতে থাকে সে রাফসানকে দেখেও দেখেনি। রাফসান শিস দিতে থাকে। কীসব যেন বলতেও থাকে। তবে বাতাসের আর রাস্তার গাড়ির শব্দে তা সোনালী স্পষ্ট শুনতে পায় না।

রাফসানের ফোন বাজতে থাকে। রাফসান বাইকের হ্যান্ডেল বাম হাত ধরে ডান হাত দিয়ে ফোন বের করতে থাকে। ফোন বের করে রিসিভ করে কানে ধরে। কথা বলতে থাকে‌। তখনই তার পিছনে এক বড় ট্রাক চলে আসে, হর্ণ দিতে থাকে। এক হাতে বাইক ধরা, অটোর পাশপাশি থেকে রং সাইডে থাকা, কানে ফোন, পিছন ট্রাকের হর্ণ। বড় এক ঝামেলায় পড়ে যায় রাফসান। সে ফোনটা ঘাড় বেঁকিয়ে কাঁধ দিয়ে চেপে ধরে ডান হাতটা বাইকের হ্যান্ডেলে রাখে। জোরে বাইক চালিয়ে সামনে চলে যেতে থাকে। অটোটা সাইড দেয়, বড় ট্রাক টাও চলেই যায়। সোনালী মুখ ঘুড়িয়ে দেখে রাফসান চলে গেছে। সে যেন একপ্রকার হাফ ছেড়ে বাঁচে। রায়হানের সাথে তার সুন্দর ভাইবোনের সম্পর্ক। রায়হানকে বড় ভাই হওয়ায় সে কিছু সরাসরি বলতেও পারছেনা। রাফসানের এরকম খারাপ নজর দেওয়া তার কাছে অস্বস্তিকর লাগে।

সোনালী হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। সাড়ে ১২ টা বেজে গিয়েছে। সে তার মুখোমুখি বসা দুই বুড়াবুড়ীকে একবার দেখে আবার নজর দেয় বাইরে। গাছ পালা ছুটে যাচ্ছে। দূরের মাঠে কৃষকদের ধান কাটাকাটির উৎসব। হালকা রোদ। দৃশ্যটা সুন্দর,!

 

 

 

সাথী বেগমের রুম। সাথী আর আলিশা বিছানায় বসে আছে। জানালা দিয়ে দিনের আলো ঘরে ঢুকছে। বিছানায় একপাশে পড়ে আছে একটা ছুরি, একটা ছোট্ট বাটিতে পেয়ারার অগ্রভাগের কাঁটা কালো অংশ। একটা স্টিলের বড় বাটিতে হাত দিয়ে পেয়ারা মাখাচ্ছেন সাথী। তার পাশে বসে আছে আলিশা। সময়টা এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ভাত খেয়েছে তারা, হলো অনেকক্ষণ। হঠাৎ পেয়ারা খেতে মন চাইলো তাই পুকুরের পাশে থাকা পেয়ারা গাছ থেকে কয়েকটা পেয়ারা তুড়ে এনেছিলো তারা। সেগুলো কেঁটে এখন মাখাচ্ছে। মসলা দেওয়ায় পেয়ারার সাদা অংশের রং বদলে হলদেটে হয়েছে। সাথী বেগম মাখানো শেষ করে একটা টুকরো মুখে তুলে চেখে দেখেন।

– হমম, সব ঠিকঠাক। নে আলিশা, এবার খেয়ে দেখ।

আলিশাও দু টুকরো পেয়ারা মুখে তুললো। মুখের ভঙিমা দেখে মনে হচ্ছে টকের সাথে ঝাল, মিষ্টির কম্বিনেশন। আলিশা খেতে খেতে বলতে থাকে।

– উমম, জিরার স্বাদ টা আগে মুখে আসতেছে। তারপর ঝাল আর পেয়ারার টক,মিষ্টি ভাব টা। দারুন হয়েছে।

– এভাবে করে এরপর থেকে পেয়ারা মাখাবি। (মুখে এক টুকরো দিয়ে) দারুণ এক মজা পাবি।

– হমমম, (খেতে খেতে) আচ্ছা সাদিক ভাইয়া কই,?

– সাদিক তো গেছে তোর শাহেদ মামার সাথে। কেন ?

– সাদিক মামাকে সকালে বলেছিলাম ফুল আর পার্টি স্প্রে আনতে। মামার তো তারপর থেকে আর দেখাই নাই।

– কী করবি এগুলা দিয়ে ?

– কেনো, বিয়েতে দিবো। ওরা আমাদের পার্টি স্প্রে দিয়ে মুখ ভরায় দিবে, আর আমরা কিছু করবোনা ? বাকিরা কিছু না করলেও আমি করবো।

– করিস। (একটু থেমে) তোর মা ঐদিকে উঠে নাকি কান দিস। পরে উঠে তোকে খুঁজে না পাইলে ভয় পাবে।

– মা এখন একদম ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে‌। একদম ছোট বাচ্চাদের মতো করে আমাকে জড়ায় ধরে ঘুমায়। সকালে আগে ভাগে উঠে আমাকে আস্তে আস্তে জাগায় দিতে থাকে। ভালো মাইয়া, ভালো মাইয়া বলে ঘর মাথায় তুলে।

– স্মৃতি শক্তি হারাইছে সাথে সাথে মানসিক ভাবেও হয়তো ভারসাম্য হারিয়েছে। তোকে ছাড়া তো কাউকে নিজের সাথে ঘেষতেও দেয় না।

– হ্যা। সেই সক্কাল সক্কাল উঠছে। আমি নামাজ পড়লাম। তখন বিছানায় হেলান দিয়ে চেয়ে চেয়ে আমাকে দেখলো। নামাজ শেষ করে উঠলাম তারপর আমাকে কাছে ডাকে বসাইলো। তারপর যে আমি বসলাম আর উঠতে দেয় নাই। এখন এই ভাত খায় ঘুমাইলো।

– তোকে ভরসা করে। সেদিন সকালে জ্ঞান ফিরার পর থেকে তুই যে তার সেবা যত্ন নিছিলি এইজন্য তোকে ভরসা করতেছে।

– মায়ের স্মৃতি শক্তি যে কবে ফিরে আসবে ,! (এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে) মায়ের ঐদিন কার চিৎকার গুলো এখনো ভুলতে পারতেছি না। (রাগে দাঁতে দাঁত চেপে) মামা, না মামা না। নিষ্ঠুর পাষাণ একটা। আমার মায়ের চিৎকার, আমাদের কথা, কিছুই তাকে আটকাতে পারলো না। জীবন্ত অবস্থায় আমার মায়ের চোখটা তুলে নিলো। উনি কী আদেও মানুষ ,? ছিঃ,

– মন খারাপ করিস না। তোর এই মামা এমনি। বিয়ের পর এই বাড়িতে আসার পর থেকেই দেখছি। উনি যা করবেন বলে যেদ ধরেন তা করেই ছাড়েন। ভালোর খুব ভালো আবার কারো কাছ থেকে আঘাত অসম্মান পাইলে তাকে নিজ হাতে শাস্তি না ‌দিয়ে থামেন না।

আলিশা ধীর গলায় বলে,

– মা সুস্থ হোক একটু। আমি মাকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।

– কোথায় যাবি তুই,?

– জানিনা। কিন্তু এই বাসায় আমি মা কে থাকতে পারবোনা। মামা, আমার মা’কে মেরে ফেলতেও দু বার ভাববেনা। আমি সন্তান হয়ে বসে বসে নিজের মায়ের মৃত্যু দেখবো নাকি ,! (কেঁদে ফেলে আলিশা)

– আরে আরে কাঁদছিস কেনো ,! এমন কিছুই হবেনা। (আলিশার পাশে এগিয়ে বসে তার মাথা নিজের কাঁধে রেখে) আমরা আছি তো। রায়হান আছে। এমন কিছুই হবে না।

– জানো মামিমা। মা আমায় সবসময় বাকিদের সাথে মিশতে না করতেন। বলতেন সবাই আমার আর মায়ের ক্ষতি চায়। কেনো বলতেন এসব। আমরা দুজন এইবাড়ির কার কী করেছি বলোতো,;

– আরে আরে কাদিস না। আমি, তোর শাহেদ মামা, রায়হান ভাই আমরা কেনো তোদের ক্ষতি চাইবো। তোর মা হয়তো নজরুল মামা কথা বলেছে। তুই কাদিস না।

– আমি মা’কে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। মা একটু খালি সু্স্থ হোক। এই বাড়িতে আর থাকবো না। আর না।

– আচ্ছা সে দেখ যাবেনে। তুই এখন চোখের পানি মুছ। এতো বড় একটা মেয়েকি কখনো কাঁদে হ্যা ,! কাঁদলে লোকে কী বলবে বল ?

আলিশা সাথী বেগমের বুকে মুখ লুকায়। তার ভিতর থেকে অনেক কান্না আসতে থাকে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। চোখের সামনে তার মায়ের উপর এমন অত্যাচার তাকে যে শক্ত রাখতে পারছেনা। তাসের ঘরের মতো সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে শুধু,!  সাথী আর কিছু বলেন না। তিনি আলিশাকে আলিঙ্গন করে তাকে শান্ত করতে থাকেন। পিঠে হাত বুলিয়ে স্বাভাবিক করতে থাকেন।

 

 

 

পরন্ত বিকেল। মেম্বার বাড়ি যেন রূপ নিয়েছে কাজের ইস্তাম্বুলে। পুরো বাড়ি ছোট ছোট লাইট দিয়ে সাজানো। বাড়ির সামনের রাস্তায় দুই দিকে ২০০ মিটার করে সাজানোর কাজে হাত দিয়েছে ডেকোরেশনের লোকেরা। শেষ মুখে দুই প্রান্তেই বিয়ে বাড়ির গেইট প্রস্তুত। এখন শুধু গেইট থেকে মেম্বার বাড়ি পর্যন্ত রঙিন কাপড়ের ছাওনি আর নানা রংয়ের আলো লাগানো বাকি। ডেকোরেশেনের লোক গুলো তড়িঘড়ি করে কাজ করছে। কিছুক্ষণ পরই মাগরিবের আযান দিয়ে দিবে। তার আগেই রাস্তার সাজানোর কাজ শেষ করতে হবে। বাড়ির ভিতরে সাজানো, গায়ে হলুদের প্যান্ডেল, খাওয়ার প্যান্ডেল বানানো শেষ। সারাদিন সেগুলোই করছিলো ডেকোরেশনের লোক গুলো। গ্রামের মেম্বারের একমাত্র মেয়ের বিয়ে। ধুমধাম করে হবেনা তা কী হয় ,!

আহনাফ হেঁটে হেঁটে আসছে আর চারপাশের ডেকোরেশনের লোকদের কাজ দেখছে। বাড়িতে অনেক ভিড়। লোকজন, আত্মীয়-স্বজন দিয়ে বাড়ি ভরা। শাহারিয়াও আসার পর থেকে ডেকোরেশনের লোকদের সাথে কাজে লেগেছে। সব দেখা শুনা করছে। তাই আহনাফ নিঃসঙ্গ হয়ে একলা একলা ঘুরছে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার বিয়ে বাড়ির প্রবেশ গেটের সামনে চলে আসলো। দারুন ভাবে সাজিয়েছে এই গেইট টা। অনেক বড় করে করেছে গেইট টা। মাঝখান টায় শুভ বিবাহ লেখাটার রং বদলাচ্ছে, তার পাশে নানা রংয়ের লাইট জ্বলছে। দারুন লাগছে দেখতে। আহনাফ বিয়ে বাড়ির গেইট পেড়িয়ে আরেকটু হেটে সামনে আগায়। বিকেল বেলা, তাই মাঠে কোন কৃষক নেই। রাস্তা দিয়ে সাইকেল ‌চলে যাচ্ছে দু-একটা। রাস্তার সাইডে দাঁড়িয়ে ফসলি মাঠের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে আহনাফ। দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে।

সকালের বিষয় টা তাকে খুব ভাবিয়ে তুলছে।

– কেউ আক্রমণ করতে আসলো, আবার পরে বলছে সে আমাকে চিনেও না। আমাকে মারতে যে আসছে তাও জানেনা। স্বপ্নের সেই তাসনুবা,সাবিনা,রাফি,সিহাব ওরা কারা। আচ্ছা দিথী নামের মেয়েটাই বা কে ? সে কী এসব কিছুর উত্তর জানে ? সেই কাগজে তো তাই লিখা ছিলো। এখন দিথীকে কীভাবে খুঁজে বের করি ? এই গ্রামের তো ও কিছুই আমি চিনি না। শাহারিয়া স‌্যারকে বলবো ? শাহারিয়া স্যার তো এখন কাজে ব্যাস্ত। বিরক্ত হতে পারেন।

আহনাফ সবকিছু ভেবেও কোন কুলকিনারা করতে পারেনা। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিয়ে বাড়ির গেইটের দিকে মুখ করে তাকায়। দেখে কিছু গ্রামের মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। বিয়ে বাড়ির গেইট টা পাড় হয়ে আসতে থাকলো তারা। একে অপরের সাথে গল্প করছে। হয়তো বিয়ে বাড়ি কেমন সাজানো হয়েছে তা দেখতে এসেছিলো। তার কী তাদের ডাকা উচিত ? ডেকেই দেখা যাক। কী হয়। চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো আর কোন পথই বের হবেনা।

আহনাফ রাস্তার ধার থেকে হেঁটে হেঁটে মেয়েগুলোর কাছে যায়। মেয়েগুলো কী বিষয় নিয়ে যানি কথা বলছিলো আর হাসছিলো। ৩ জন মেয়ে ছিলো সেখানে। আহনাফ এগিয়ে যায়। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একটু নার্ভাসের সহীত বলে।

– এ,এইযে শুনছেন। একটু কথা বলা যাবে কী ,!

মেয়েরা একেঅপরের সাথে হাসতে হাসতে আসছিলো হঠাৎ আহনাফের কথায় থেমে যায়। আহনাফের কথার উত্তর দেয় মাঝে থাকা এক মেয়ে।

– হ কন।

– আমি এই গ্রামে নতুন এসেছি। (একটু থেমে) আচ্ছা এই গ্রামে দিথী আর আশরিফ বলে কী কাউকে আপনারা চিনেন ? বা এই নামে, এই গ্রামে কী কেউ আছে ,?

মাঝের মেয়েটা বলে,

– আশরিফ নামের তো কাউরে চিনি না। তয় দিথী আপুরে চিনি। কেন আপনার কী দরকার হের লগে ? দিথী আফার কিন্তু বয়ফ্রেন্ড আছে,! (বলেই তিনজন আবার হেঁসে উঠে। ডান পাশেরজন হাসতে হাসতে বলতে থাকে)

– আরো যেই সেই বয়ফ্রেন্ড না কিন্তু আবার। গোয়েন্দা বয়ফ্রেন্ড। ঢাকায় থাহে। আপনে দিথী আফার পিছে ঘুরতে গেলে হের বয়ফ্রেন্ড কিন্তু আপনারে কী করবো, তা আমরাও কইতে পারিনা (বলেই আবার তিনজন হো হো করে হেঁসে উঠে)

– আসলে আপনারা যা ভাবছেন তা না। হয়তো দিথী নামের যিনি আছেন উনি আমার বড় আপু কিংবা ছোট বোন হবেন। আমি উনার সাথে কিছু সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

– বোন ,! বাপরে। এক নিঃশ্বাসে বোন কইয়া ফেল্লেন ,!

– জ্বী উনি আমার বোনই হবেন হয়তো। আমিও ঢাকা থেকে এসেছি। বিয়ে বাড়িতে যার বিয়ে হচ্ছে তার ভাই আমার স্যার হন।

– আপনে শাহারিয়া ভাইয়ার লগে আইছেন ?

– হ্যা। আমি উনার সাথেই আসছি।

– তাইলে উনারে যাইয়া জিগান দিথী কেডা। কইয়াও দিবো। দেহাও করাইয়া দিবো। হা হা হা হা

– জ্বী ঠিক বুঝলাম না।

– এতো ভোলা বানতাছেন ক্যান ,! দিথী আফার বয়ফ্রেন্ড যে শাহারিয়া ভাই হেইডা আপনে জানেন না ,! যত্তসব মাইয়া মাইনষের লগে কথা কওয়ার ছুতা খুঁজে। এই চল তো মিনা,মণি। পোলা মানুষ খালি মাইয়া দেখলেই সব ভুইলা যায়। চল,

 

বলেই এক প্রকার ভাব দেখিয়েই চলে যায় তিন মেয়ে। তাদের কথা আহনাফের গায়ে লাগেনি। আহনাফ এখনো আগের যায়গায় থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখে অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট।

– দিথী শাহারিয়া স্যারের গার্লফ্রেন্ড। শাহারিয়া স্যার তো আবার বিয়েও করার জন্য এসেছে। (একটু থেমে) এসব কী হচ্ছে। সব কিছু এমন ভাবে মিলেও মিলছেনা কেনো ,? আমাকে দেখা করতে হবে দিথী আপুর সাথে। যেভাবেই হোক। আজ রাতে স্যার ফাঁকা হলে তাকে বলবো। এমন ভাবে বললো যাতে স্যার রাগ না করেন।

বিরবির করে বলেই আহনাফ তার হাতের তালুতে আরেক হাত দিয়ে ঘুষি মারে। রাস্তার মধ্যেই হেঁটে হেঁটে পায়চারি করতে থাকে। দূরের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসে। চারপাশ একদম অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। শুধু বিয়ে বাড়ির গেইটে লাগানো লাইট গুলা রাস্তার এদিক টা কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে‌। আর গেইটের ভিতর দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে ২০০ মিটার করে করা ছাওনিতে লাগানো লাইট গুলো জ্বলে উঠে। এক সুন্দর টানেলের মতো তৈরি হয় রাস্তার এদিক টা থেকে বাড়ি পর্যন্ত।

আহনাফ ভাবে এখনি বাড়ি না। পড়ে বাড়ি যাবে। এখন এদিকে থেকেই একটু আফরিনকে কল দেওয়া যাক। আসার সময় আফরিনকে একটা ছোট ফোন দিয়ে এসেছিলো সে। বলেছিলো দরকার হলে ফোন দিতে‌। কিন্তু আফরিনের দরকার না হলেও আহনাফের এখন দরকার পড়েছে। দরকার পড়েছে তার কন্ঠ শুনে মন শীতল করার। আহনাফ তার স্মার্টফোন টা বের করে। আফরিনের নাম্বারে কল দিয়ে কানে তুলে। এক সুন্দর হাসির মাধ্যমে কথোপকথন শুরু। পায়চারি করতে থাকে আর আফরিনের সাথে কথা বলে একটা সুন্দর সময় কাটাতে থাকে।

পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুব দিয়েছে‌। হালকা লাল আভা দেখা যাচ্ছে শুধু। তার মাঝে কিছু পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরে যাওয়ার ঠিকানা খুঁজছে।

 

 

 

সুরাইয়া বেগমের রুম। রাতের বেলা। তাই রুমে লাইট জ্বলছে। সুরাইয়া বেগম বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছেন। দুপুরে খাওয়ার পর যে ঘুম দিয়েছিলেন এখনো উঠেননি। ঘরে আলিশা নেই। জানালা খোলা। জানালার বাইরে অন্ধকার। হঠাৎ সেই অন্ধকারের মধ্যে দৃশ্যমান হয় এক মেয়ের ছায়ামুর্তি। মেয়েটার গায়ে বোরখা। ঘরের আলোয় তার চোখ গুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। জানালা দিয়ে সেই মেয়েটা সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। তারপর একটা ইনজেকশন হাতে নিয়ে জানালার গ্রিল পেড়িয়ে সুরাইয়া বেগমের শরীরে পুশ করার চেষ্টা করে। একটুর জন্য তার হাত পৌঁছাচ্ছে না। তখনই সে করিডোর দিয়ে কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। সাথে সাথেই হাত টা বের করে নিয়ে জানালার ওপাস থেকে সড়ে যায়। ঘরে প্রবেশ করে আলিশা। হাতে একটা স্যুপে বাটি। বাটিটা বিছানার পাশের টেবিলে রাখে আলিশা। বিছানায় বসে তার মাকে ঘুম থেকে জাগাতে থাকে।

 

হয়তো আজ আলিশা সময় মতো আশার কারণেই তার মা বেঁচে গেলো। নইলে হয়তোবা আজই তার মা মৃত্যুর দিকে আরেক পা এগিয়ে দিতো। হয়তোবা ,!

 

 

 

মেম্বার বাড়ির ভিতরের আঙিনা। লোকজন দিয়ে একদম ভরা। রান্না ঘরের কিছুটা পাশেই গায়ে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে। পুরো বাড়ি নানা রঙয়ের আলোয় ঝলমল করছে। বারান্দার গ্রিল গুলাও ছোট ছোট লাইট দিয়ে আলোকিত করা। আঙিনায় আত্মীয় স্বজন রা একে অপরের সাথে গল্প করছে, কথা বলছে।

 

রাত এখন ৯ টা। নিপা দের রুমে হাতে মেহেদী মাখছে নিপা। রুমের দরজা লাগানো। যখন তখন যে সে ঢুকে পড়তেছে।  দিথীরাও ঘরের ভিতরে। নিপার হাতে মেহেদি দিচ্ছে তানিয়া। এদিকে আবার ইকরাও বলে মেহেদী মাখবে। তাই ইকরাকে‌ মেহেদী মাখিয়ে দিচ্ছে তানিয়ার বান্ধবী কানিজ। সামিহাও দিথীর হাতে মেহেদি দিচ্ছে। আর শুরু করেছে গল্পের আসর। ঘরে শুধু তারা মেয়েরাই। আর কেউ নেই ঘরে। নিপা মেহেদী মাখতে মাখতে বলে।

– দিথী, ভাইয়ার সাথে দেখা হইছে তোর ,?

– না, হয়তো কাজে ব্যাস্ত। আমার কথা বাদ দে‌। তুই বল আজকে কয়বার রায়হানের সাথে কথা বলছিস ?

– আ,আমি ,? আজ একবারও না।

– ইশশ্, কী মিথ্যুক হ্যা,! আমি তখন ঘরে আসে দেখছি ও কথা বলতেছিলো (ইকরা)

– দুই দিন পর বিয়ে তাও তোদের কথা বলার শখ মিটে না হ্যা ,! কি রে নিপা ,! বাসর রাতে যত ইচ্ছা কথা বলিস,! (দিথী)

– না না আপু, বাসর রাতে কী আর ওরা কথা বলবে ,! ওদের তো তখন ,! (ইকরা)

– চুপ ইকরা। একদম লজ্জা শরম নাই তোর।

– হইছে হইছে। এখন যা লজ্জা পাওয়ার পা। কিন্তু বিয়ের পর দিন যখন আসবি তখন আমাদেরকে বাসর রাতের গল্প শুনাইতে হবে কিন্তু,! (দিথী)

– দিথী,! তুই এতো পঁচা হইলি কবে থেকে ? আগে কত চুপচাপ আর লাজুক ছিলি। এখন বাসর রাতের গল্প শুনতে চাস ,!

– আরে আরে শুনোনা নিপা। দিথী তো তোমার আগে বিয়ে করতে চাইছিলো। ও তো দিনরাত খালি বলে কবে শাহারিয়া ওকে বিয়ে করবে, কবে বাবু হবে ,! (তানিয়া)

– আমি কখন বাবু হওয়ার কথা বললাম আপু ,! আমি তো শুধু বলছি বিয়ে করবো ,! (বলার সাথে সাথেই জিহ্বা কামড়িয়ে চুপ হয়ে যায় দিথী। ওর কথা শুনে সবাই হেসে উঠতে থাকে‌।

– এইযে এইবার চোর চুরির কথা শিকার করছে। আচ্ছা চিন্তা করিস না। ভাইয়াকে বলবো তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নিতে। কেমন ,! (নিপা)

– বুঝছো নিপা,! এইবার একটু শীত বেশি পড়ছে তো ,! তাই দিথীর লেপ,কম্বল দিয়ে উষ্ণতা মিটছে না। বিয়েটা এইজন্যই তাড়াতাড়ি করে নিতে চাচ্ছে ও।  (তানিয়া)

– আপু,! কী বলছো এসব ,!

– ঠিকই তো বলছি। আর তাছাড়া তোমাদের বয়স টা কিন্তু আমরা পাড় করে আসছি, হ্যা,! কোন বয়সে কিসের চাহিদা হয় তা কিন্তু আমার ভালো করেই জানা ,! (বলেই আড়চোখে দিথীর দিকে তাকায় তানিয়া)

– হ্যা যা ভাবছো তাই। এবার খুশি,!

– দিথীর আসলেই বিয়ের জন্য মাথাটা একদম গেছে। জিনিয়া আসেনি আজকে। নাইলে ও জানতো আর আমি জানতাম দিথী কতটা লাজুক আর চুপচাপ ছিলো , হা হা হা হা (নিপা হাসতে থাকে)

– হাসতেছিস না ,! হাসতে থাক। দেখিস তোর আগে আমি বেবি নিবো। (দিথী).

– তা তো এমনিতেও বুঝা যাচ্ছে। হিটে আসছিস তুই , হা হা হা হা

– ছিঃ নিপা, তুইও বদ হয়ে গেছিস,! তুইও আগে ভালো ছিলি ,! (ইকরা)

– বিয়ের আগে সবাই বদ হয়ে যায় ,! এখন কার জামাই এই বদ গুলারে সোজা করতে পারে সেইটাই দেখার বিষয় ,! (তানিয়া)

– বাপরে বাপ, কানিজ আপু, চলোতো আমরা যাই। এখানে সবাই কী পঁচা পঁচা কথা বলতেছে (সামিহা)

– নিপা ধরতো সামিহাকে, ওরো বিয়ে দিয়ে দেই‌। কেমন বলতেছে আমরা পঁচা কথা বলি। (দিথী)

– ঠিকই তো। এসব কী কথা বলছিস তোরা। আমি ভালো মেয়ে। আমি এসবে নাই বাপু,! (সামিহা)

– নিপা, এখন সামিহারও বিয়ে দিয়ে দিলে দেখবি আমাদের আগে ও মা হয়ে বসে আছে, হা হা হা হা (দিথীর কথায় রুমের সবাই হেসে উঠে। সামিহা বেশ লজ্জা পায়।)

– আচ্ছা হইছে হইছে এখন বাদ দেও। তোমাদের দুইজনের বফ আছে, ঐজন্য ফিলিং হয় আর ঐদিকে সামিহারও যখন বিয়ে হবে তখন ঔ এমন হয়ে যাবে তোমাদের মতো ,! (তানিয়া)

– একদমই না আপু। আমি এদের মতো এতো পঁচা কখনোই হবো না ,!

– ওরে আমার লক্ষী খলিফা রে , হা হা হা হা

– চুপ দিথী, কীসব বলিস, লুচু হয়ে যাচ্ছিস দিন‌ দিন,! (নিপা)

– হ্যা, আমি এখন লুচু না, বিয়ের পর বাসর রাতের গল্প শুনাইস, তখন দেখি কে আসল লুচু ,!

– আচ্ছা হইছে হইছে, এখন থামো। নিপা, তোমার হাতে মেহেদি লাগানো ‌শেষ। এখন খেয়েদেয়ে ঘুমায় পড়ো। কাল সকালে উঠতে হবে। গায়ে হলুদের অনেক রীতিনীতি আছে গ্রামে। সেগুলো পালন করতে হবে।

– আচ্ছা আপু। (হাতের দিকে তাকিয়ে) বেশ সুন্দর হয়েছে আপু ডিজাইন টা।

– আমারো শেষ,(কানিজ)

সবার তাড়াতাড়ি শেষ হওয়া দেখে দিথী সামিহার দিকে তাকায়,

– কীরে সামিহা, আর কতক্ষণ,!

– এইতো আর একটু সময় লাগবে।

– সবগুলা ফার্স্ট আর এই সামিহাটাই ‌স্লো।

– আসল কাজে ঠিকই তাড়াতাড়ি করবে ,

– যেমন তুই। রায়হান বাসর ঘরে আসার আগেই , হা হা হা হা আর বললাম না,(দিথী)

– আমার মজা নেওয়ার বদলা ভাইয়া নিবে দেখিস ,!

– উরি বাবা,উরি বাবা ভয় পাইছি। তোর ভাইয়া দেখায় দোক এটাই তো আমি চাই ,! হা হা হা‌ হা।

– তানিয়া আপু চলো, এই দিথীর মাথা একদম গেছে। ও দেখিও লুকায় লুকায় আবার আমার বাসর ঘরে ঢুকে পড়বে।

– ঢুকে একটু বান্ধবীর সিন ই দেখলাম, ক্ষতি কী তাতে হা হা হা হা (জোরে জোরে হাসতে থাকে দিথী)

– আমি যাই তো। নাইলে এর মতো আমিও পাগল হয়ে যাবো (বলেই নিপা বিছানা থেকে নেমে পড়ে। নেমে চলে যায় দরজা খুলতে। দিথী তখনই বলে উঠে ,

– আরে দাঁড়া, ওড়না ঠিক করতে দে।

– ভাইয়াকে পাঠায় দিতেছি। আসে ঠিক করে দিবেনে। (বলেই দরজা খুলে বেড়িয়ে যায় নিপা)

– এই সামিহা, ওড়না টা দিয়ে দে তো। বাইরে অনেক মানুষ। দরজা খুলে রেখে পালাইছে ডায়নিটা আমার।

সামিহা পাশে থাকা ওড়নাটা দিথীর উপর কোনমতে দিয়ে দেয়। এদিকে তানিয়া, কানিজ আর ইকরা রাও বেড়িয়ে যায়। ইকরা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলো, হয়তো ভাবছিলো অন্য কিছুর কথা।

ঘরে এখন শুধু দিথী আর সামিহা। দিথী বেশ বোর হতে থাকে। সবার শেষ এখনো তার শেষ হয়নি। এদিক পেটে খিদাও লেগেছে। নিপারা হয়তো খেতে চলে গিয়েছে। ওরা সবাই এক হাতে মেহেদি লাগিয়েছে আর এদিকে দিথী দু হাতেই লাগাচ্ছে। এজন্যই সবার থেকে দেরি হচ্ছে তার।

 

বেশ কিছুক্ষণ সময় পেড়িয়ে যায়,

 

সামিহা দিথীর হাতে মেহেদীর শেষ ফোঁটা টা দিয়ে বলে।

– নে, মেহেদী দেওয়া শেষ।

– এতোক্ষণে হইলো তোর হ্যা। এদিকে আমার অবস্থা খারাপ।

– আমি কী করবো। তুই বললি দুই হাতে দিতে, আমিও দিলাম। এখন দিতে সময় তো লাগবেই।

– যা আমার জন্য খাবার নিয়ে আয়। আমার পেটে এদিকে খুদায় ব্যাথা করছে ,! (কিছুটা বাচ্চাদের মতো হয়ে বলে দিথী)

– যাইতেছি যাইতেছি। আমি গিয়ে তোর জন্য খাবার নিয়ে আসতেছি। তুই বাইর হইস না।

– আচ্ছা, তাড়াতাড়ি যা।

সামিহা মেহেদী টা রেখে চলে যায় ঘরের বাইরে। দিথী এদিকে দুই হাত উঁচিয়ে ধরে বসে আছে‌। তার খুব খিদে পেয়েছে। সেই দুপুরে খাবার খেয়েছিলো। বিকাল থেকেই এখানে। নাস্তাও করা হয়নি গল্পে মশগুল থাকায়। এখন পেট আর মানছেনা। খিদায় পেটে বাঘ,হাতি, গন্ডার দৌড়াচ্ছে।

 

১৫ মিনিট পর,

খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকে নিপা। এক হাতে মেহেদি লাগানো আরেক হাতে প্লেট। নিপা এসে প্লেট টা বিছানায় বসে থাকা দিথীর সামনে রেখে দেয়। বলে।

– কীরে, তুই আসলিনা যে‌। আমি তোকে খুঁজলাম, কিন্তু পাইলাম না। এজন্য তোর জন্য খাবার নিয়ে এলাম।

– সামিহা কই, ওরে আমি খুন করে জেলে যাবো।

– কেনো কেনো কী হইছে ,?

– আমি সেই কতক্ষণ আগে ওকে পাঠাইছি খাবার আনতে। আর ও নাই।

– সামিহাকে তো দেখলাম টেবিলে। খাইতে বসছে ও‌।

– ভাগ্যেস তুই আমার কথা মনে করছিলি।

– আচ্ছা নে এখন খা, আর পানিটা,

নিপার কথা মাঝেই তার ফোন বাজতে শুরু করে। সে বিছানা থেকে গিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। দেখে রায়হান ফোন দিয়েছে। নিপা ফোনটা নিয়ে ইশারায় দিথীকে বলে খেয়ে নিতে ও বাইরে আছে। বলেই ফোন হাতে নিপা বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। দিথী ওকে মাথা নেড়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দিয়ে তার সামনে থাকা প্লেটের দিকে ফিরে তাকায়। প্লেটে ভাত ছিলো, মাংস, ডাল, ভাজি আর সালাত। দিথী খাবার দেখে মহা খুশি। ও খাওয়ার জন্য হাত বাড়ায় তখনই দেখে ও দুই হাতে মেহেদি লাগানো। এখনো তা শুকায় নি। ও খাবে কীভাবে এখন ,!

দিথীর চোখ ভিজে যায়। খিদা ও একদম সহ্য করতে পারেনা। নিপাদের সাথে কিছুক্ষণ আগে বড় বড় কথা বলা দিথী এখন একদম বাচ্চা শিশুর মতো চোখ দিয়ে পানি ফেলছে। সামনে খাবার, পেটে প্রচন্ড খিদে, তাও সে খেতে পারছেনা। এতোক্ষণ ধৈর্য ধরে হাতে মেহেদি মেখে এখন তা নষ্টও করতে চাচ্ছেনা। দিথীর গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। তখনই দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো শাহারিয়া। কারো ফুঁপিয়ে কাদার শব্দ তার কানে আসাতে সাথে সাথেই সে দাঁড়িয়ে যায়। “নিপা কাঁদছে নাকি ?” শাহারিয়া এই ভেবে নিপার রুমের অর্ধেক খোলা দরজাটা পুরো খুলে দেখে ঘরে দিথী বসে আছে। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শাহারিয়া তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকে। এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে। দিথীর পাশে বসে ‌তার চোখের পানি তড়িঘড়ি করে মুছে দিতে দিতে বলে‌।

– কী হয়েছে তোমার,! কাঁদছো কেনো ,!

দিথী কিছু বলেনা। বাচ্চাদের মতো করে শাহারিয়ার দিকে এক নিষ্পাপ চাহনিতে তাকিয়ে থাকে।

– কী হলো বলো। শরীর খারাপ লাগছে,! কোথাও ব্যাথা করছে,! কী হয়েছে তোমার, আমায় বলো‌।

– আ,আমার। আমার খুব খিদে পেয়েছে,!

– এইযে খাবার। কাদিও না। বাড়ি ভরা মানুষ, তোমাকে কাঁদতে দেখলে কী বলবে তখন ওরা।

– আ,আমার হাতে মেহেদি। আমি খাবো কীভাবে,!

– আরে বোকা, কাঁদে না আর। আমাকে আগে বলবা না। দাঁড়াও আমি হাত টা ধুয়ে তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।

শাহারিয়া বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। প্রত্যেক ঘরেই বিছানার পাশে একটা জগ আর গ্লাস রাখা। এই ঘরেও তাই। শাহারিয়া গিয়ে বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিল থেকে জগ আর গ্লাস টা নিয়ে আসে। গ্লাসে পানি ভর্তি করে বিছানার সমান  যায়গাটায় রাখে। আর জগ নিয়ে বেড়িয়ে যায় হাত ধুতে। কিছুক্ষণ পর ঘরে এসে দিথীর পাশে বসে। হাতের অতিরিক্ত পানি ঝেড়ে নেয়। এক হাত দিয়ে প্লেট ধরে উঠিয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে ভাত মাখিয়ে ছোট্ট নলা করে। তারপর দিথীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। দিথী তাড়াতাড়ি মুখ বাড়িয়ে নলাটা মুখে নিয়ে নেয়। খেতে থাকে তৃপ্তি ভরে। চোখের পাতা এখনো ভেজা তার। আরেক নলা এগিয়ে দেয় শাহারিয়া।  মুখে নিয়ে নেয় দিথী। শাহারিয়া খাইয়ে দিতে দিতে বলতে থাকে।

– বাসায় এতো কাজ, তোমার সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময়ই পাইনি আজ। অথচ দেখো, তুমি আমাদের বাসায় আসছো তা আমি জানিই না।

– তুমি খেয়েছো ?

– না আমি খাইনি। মাত্র গোসল করে আসলাম।

(বলেই শাহারিয়া আরেক নলা ভাত দিথীকে খাইয়ে দেয়।)

– তুমিও আমার সাথে খাও।

– আমি ,! না আমি পরে খেয়ে নিবো। তোমার খিদা লাগছে বেশি। এগুলা ভাত তোমারই লাগবে।

– না, এতোগুলো খেতে পারবোনা। শেষে নষ্ট হবে। আমি খিদা সহ্য করতে পারিনা। কিন্তু আবার একসাথে বেশিও খেতে পারিনা। তুমিও খাও।

– আচ্ছা আমি নিচ্ছি। তুমি আগে এই নলাটা নাও।

– না এটা তুমি নিবা। তারপরের টা আমি।

দিথীর ছোট বাচ্চার মতো আবদার শুনে শাহারিয়া এক মুচকি হেসে বলে,

– আমার পাগলি টাও না,! খালি আবদার করে ,!

(বলেই শাহারিয়া এক নলা ভাত মুখে নেয়। তারপর আরেক নলা ভাত উঠিয়ে দিথীর মুখে দিয়ে দেয়। দিথী খেতে থাকে। শাহারিয়া প্লেট টা বিছানায় রেখে আরেক হাত দিয়ে দিথীর ওড়নাটা ঠিকঠাক করে দেয়। আরেকটু হলেই ওড়নাটা গা থেকে পড়ে যেতো। দরজা খোলা। বাইরে লোকজনের কোলাহল। তাই পড়ে যাওয়ার আগেই গলার দুইপাশে ভালো ভাবে ওড়ানটা দিয়ে আবার ভাতের প্লেট টা হাতে নিলো। এক নলা ভাত আবার তাকে খাইয়ে দিতে গেলো, সে মাথা দিয়ে ইশারা করে শাহারিয়াকে এটা খেতে বললো। শাহারিয়া এটা মুখে নিয়ে আরেক নলা দিথীকে খাইয়ে দিলো। দিথী বলে,

– সামিহা তখন ভালোভাবে ওড়ানাটা না ‌দিয়েই চলে গেছিলো। আমার হাতে মেহেদি তাই আমি ঠিক করতে পারিনি।

– সমস্যা নাই। (একটু থেমে আরে নলা দিথীর মুখে দিয়ে) আর আমরা ১৬ তারিখ বিয়ে করছি।

কথাটা শুনেই যেন দিথীর সর্বাঙ্গ শিউরে উঠে। হঠাৎ এমন খুশির খবর পাবে ভাবতেই পারেনি সে। তার চোখে মুখের ভাষাটাই টাই বলে দিচ্ছে সে কতটা অবাক আর খুশি হয়েছে। মুখের ভাত শেষ করে বলে।

– সত্যি,!

– হ্যা। ১৬ তারিখ। তবে এমন ভাবে না। ঘরোয়াভাবে, ইসলামিক শরিয়া মোতাবেক।

– হোক যেমন ভাবে হওয়ার। আমি শেষ পর্যন্ত তোমায় পাচ্ছি, আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে ,!

– বাব্বাহ ,! একয়দিনে আমার জন্য তাইলে তোমার অনেক ভালোবাসা জন্মেছে ,!

এক নলা ভাত মুখে নিয়ে একটা সুন্দর হাসৌজ্জল মুখ করে দিথী। দিথী যে কতটা খুশি ভিতরে ভিতরে, তা ও নিজে বলে বোঝাতে পারবেনা। তবে শেষ পর্যন্ত ওদের সম্পর্ক টা হালাল সম্পর্কে রুপান্তরিত হচ্ছে। এটা তার আর শাহারিয়া, দুজনের জন্যই খুশির বিষয়।

 

আহনাফ খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠেছে। হাত মুছে সে বারান্দা দিয়ে হেঁটে হেঁটে তারা যেই রুমে ব্যাগ রেখেছিলো সেই রুমের দিকে যাচ্ছে। তখনই সে দেখে এক রুমের সামনে ছোটখাটো একটা জটলা করে রেখেছে লোকজন। সে ভাবলো হয়তো পাত্রী দেখতে আসছে তাই বেশি ভাবলো না আর সেটা নিয়ে। সে সেই জটলা পাড় করে হেঁটে যাওয়ার সময় খেয়াল করে দরজার সামনে দাঁড়ানো সবাই একদম চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই তাদের মাঝে। ওর কাছে বিষয়টা কেমন আজব লাগে, বউ দেখতে আসছে আর কথাবার্তা নাই। সে দরজার সামনে করা জটলাটার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। দেখে বিয়ের বউ নিজে দাঁড়িয়ে ঘরে কিছু দেখছে। সে সাথে সাথে একটা ছোট খাটো লাফ দেয় দেখার চেষ্টা করে ঘরে কী এমন হচ্ছে। তখনই দেখতে পায় তার স্যার একটা মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে আর সবাই দরজার পর্দার আড়াল হতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। আহনাফের লাফালাফি দেখে শিউলি বেগম তার শার্ট ধরে দাঁড় করিয়ে আঙ্গুল দিয়ে চুপচাপ থাকতে বলে। ফিসফিসিয়ে বলে।

– শব্দ কইরোনা। চুপচাপ দেহো।

– আন্টি,

– ইশশশ, একদম চুপ থাহো ছেরা, ও তুমিতো মনে হয় আমার বাজানের বন্ধু। একদম চুপচাপ দেহো তোমার বন্ধু কেমনে তোমার ভাবিরে খাওয়াইয়া দিতাছে, আর গল্প করতাছে। এই সুন্দর সিন নষ্ট কইরোনা। (ফিসফিসিয়ে বলেন শিউলি বেগম)

আহনাফ অবাক চোখে তাদের সাথে হেলে আড়াল হয়ে তাকায়। দরজার সামনে এই ছোট খাটো জটলা করেছিলো সামিহা, তানিয়া, কানিজ, নিপা, ইকরা, আফাজ, শিউলি বেগম ও আরো কিছু বয়স্ক মহিলা। দেখে তো মনে হচ্ছে তারা আগে থেকেই জানতো যে এরকম কোন সিন তারা দেখতে পাবে।

আহনাফ তাদের ঠিক মাঝখানে মাথা ঢুকিয়ে, উঁকি দিয়ে দেখতে থাকে। শাহারিয়া একটা মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে। এটাই কী তাইলে দিথী ? শেষমেষ সে এই মেয়েকে পেয়েই গেলো। তখনই হঠাৎ আহনাফের চোখের সামনে ভাসতে থাকে স্বপ্নের সেই সিন গুলো। সব সিন গুলো না। শুধু তাসনুবার সিন গুলো। তখনই হঠাৎ তার মুখ থেকে শব্দ করে বেড়িয়ে আছে

– তাসনুবা ,!

 

কথাটা শুনেই চকিতে দিথী দরজার দিকে তাকায়, শাহারিয়াও দিথীর হঠাৎ অবাক হয়ে তাকানো দেখে পিছনে ফিরে দরজার দিকে তাকায়। হঠাৎ দিথী আর শাহারিয়া ফিরে তাকানোয় দরজার সামনে এক জনের উপর আরেকজন হেলে থাকা সবাই হড়মুড় করে উঠতে যায়। আর একসাথে উঠতে গিয়ে দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ধপাস করে সবাই ফ্লোরের উপর পড়ে যায়। একেকজন একেকজনের উপর পড়ে এক প্রকার বিল্ডিংয়ের ধ্বংস্তুপের মতো হয়ে গেছে দরজার সামনের অবস্থা। দিথী আর শাহারিয়া কিছুই বুঝে উঠে না। আহনাফ পড়েছে এক মেয়ের উপর আর তার দেহের উপর পড়ছে শিউলি বেগম। শিউলি বেগম বিরক্তির সুরে বলতে থাকেন

– আমারে কোলে লইয়া হুইয়া থাক এহন। কত সুন্দর মুহুর্তডা নষ্ট কইরা দিলো। (এক বুড়ি মহিলাকে টেনে আহনাফের উপর ফেলে দিয়ে) ল এইডারেও ল।

 

চলবে ,

 

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৪৬

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

আহনাফ তাদের ঠিক মাঝখানে মাথা ঢুকিয়ে, উঁকি দিয়ে দেখতে থাকে। শাহারিয়া একটা মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে। এটাই কী তাইলে দিথী ? শেষমেষ সে এই মেয়েকে পেয়েই গেলো। তখনই হঠাৎ আহনাফের চোখের সামনে ভাসতে থাকে স্বপ্নের সেই সিন গুলো। সব সিন গুলো না। শুধু তাসনুবার সিন গুলো। হঠাৎ তার মুখ থেকে শব্দ করে বেড়িয়ে আছে

– তাসনুবা ,!

 

কথাটা শুনেই চকিতে দিথী দরজার দিকে তাকায়, শাহারিয়াও দিথীর হঠাৎ অবাক হয়ে তাকানো দেখে পিছনে ফিরে দরজার দিকে তাকায়। হঠাৎ দিথী আর শাহারিয়া ফিরে তাকানোয় দরজার সামনে এক জনের উপর আরেকজন হেলে থাকা সবাই হড়মুড় করে উঠতে যায়। আর একসাথে উঠতে গিয়ে দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ধপাস করে সবাই ফ্লোরের উপর পড়ে যায়। একেকজন একেকজনের উপর পড়ে এক প্রকার বিল্ডিংয়ের ধ্বংস্তুপের মতো হয়ে গেছে দরজার সামনের অবস্থা। দিথী আর শাহারিয়া কিছুই বুঝে উঠে না। আহনাফ পড়েছে এক মেয়ের উপর আর তার দেহের উপর পড়ছে শিউলি বেগম। শিউলি বেগম বিরক্তির সুরে বলতে থাকেন

– আমারে কোলে লইয়া হুইয়া থাক এহন। কত সুন্দর মুহুর্তডা নষ্ট কইরা দিলো। (এক বুড়ি মহিলাকে টেনে আহনাফের উপর ফেলে দিয়ে) ল এইডারেও ল।

বুড়ি মহিলা এসে আহনাফের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শিউলি বেগম, সেই বুড়ি মহিলা আর আহনাফ, এই তিনজনের ভার সইতে না পেরে আহনাফের নিচে পড়া মেয়েটা কুকিয়ে উঠে।

– শিউলি, সর আমার উপর থে। পোলাডারেও সরা। আমার কোমড় গেলো গা রে,

– মর, তুইও মর। সবডি মিল্লা সুন্দর মুহুর্তডা নষ্ট কইরা দিলি।

বলেই আহনাফের উপর থেকে উঠে যান শিউলি বেগম। বুড়ি মহিলাটাকে টেনে উঠায় ইকরা। আহনাফ অবস্থা ছিলো দেখার মতো। বুড়ি মহিলাটা ঠোঁটে মেখেছিল লিপস্টিক, বুয়া বয়সে মনে হয় ভিমরতি ধরছিলো। এখন সেই লিপস্টিকের ঘষা আহনাফের গালে লেগে একদম মাখামাখি অবস্থা,! ইকরা তো তাই দেখে হো হো করে হেঁসে উঠে। আহনাফ উঠে দাঁড়ায়। বাকিরা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে আহনাফের মুখ দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। শাহারিয়া আর দিথীও মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। শিউলি বেগম আহনাফকে তার দিকে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। তারপরই হঠাৎ আহনাফের যেই গালে লিপস্টিক নেই সেই গালে শিউলি বেগম তার ঠোঁট ঘষে দিতে থাকে। ইকরা তো এই দেখে পেট চেপে হাসতে হাসতে শেষ। আহনাফ এক নিস্পাপ চাহনি দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সবাই তাকে দেখে কী যে হাসি। শিউলি বেগম হাসতে হাসতে বলতে থাকে।

– লও, আইজ তোমার লগে আমি ঘুমামু। রাইতে কই কই লিপস্টিকের ছোঁয়া দিমু টেরও পাইবানা হা হা হা হা।

সবাই তা শুনে আরো হেঁসে উঠে। দিথী তো মুখ চেপে হাসতে থাকে। মুখে ভাত, জোরে হাসতে গেলে শাহারিয়ার মুখ মাখামাখি হয়ে যাবে ভাত দিয়ে। তানিয়া হাসি কিছুটা থামিয়ে আহনাফের হাত ধরে বলতে থাকে।

– যাও ভাই, মুখটা ধুয়ে আসো। আর হাসাইয়ো না , ( বলেই মুখ চেপে হাসি থামাতে গিয়েও জোরে হেঁসে উঠে তানিয়া)

আহনাফ পা চালিয়ে হনহন করে যেতে থাকে বেসিনের দিকে। কী এক হাসির পাত্রে পরিণত হয়ে গেলো মুহুর্তের মধ্যেই ,!

 

ঘরে ইকরা, তানিয়া নিপা, সামিহা, কানিজ আর শিউলি বেগম ঢুকে। বাকিরা চলে যায় যে যার রুমে। সবাই এসে বিছানায় পাশে সাড়িবদ্ধ ভাবে দাঁড়ায়। হাত গুজে নিপা শাহারিয়াকে বলতে থাকে।

– ভাইয়া, দাও না আর দুই নলা খাইয়ে। কত সুন্দর করে তখন খাইয়ে দিচ্ছিলে ,!

– হ্যা, দাও দাও। আরেকটু দেখি ,! (ইকরা)

– তোরা গেলি এখান থেকে ,!(শিউলি বেগমের দিকে তাকিয়ে) আর মা ,! তুমিও এদের সাথে মিলে আছো ,!

– তো কী হইছে ,! সবাই মিল্লা সিনেমা দেখতাছে আর আমি হাত গুইজা বইসা থাকুম নি ,!

দিথী শিউলি বেগমের দিক থেকে ফিরে এক ধীর গলায় শাহারিয়াকে বলে,

– আর খাবোনা আমি। পেট ভরে গেছে। তুমি বাকিটা খেয়ে নাও।

– দাঁড়াও তুমি, আমি হাত ধুয়ে মুখ মুছে দিচ্ছি।

বিছানা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলে রাখে প্লেট টা। পাশে এক ছোট বাটি ছিলো, সেখানেই পানি ঢেলে হাত ধোয় শাহারিয়া। হাত ধুয়ে এসে দিথীর মুখ আলতো করে মুছে দিতে থাকে। মুছে দিয়ে আবার গিয়ে হাত ধুয়ে নিজের মুখ মুছে। শিউলি বেগম সহ সবাই হাত গুজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। দিথী তাদের এমন ভাবে তাকিয়ে দেখা দেখে কিছুটা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে। মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।

শাহারিয়া নিজের হাত ধুয়ে এসে দিথীর পাশে দাঁড়িয়ে শিউলি বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– মা, গামছাটা,!

– কুত্তায় নিছেগা।

কথা শুনে সবাই মুখ চেপে হাঁসি আটকায়। দিথী ধীর গলায় শাহারিয়াকে বলে উঠে।

– ওড়নার এক পাশ টায় হাত মুছে নাও ,!

– ওহোহোহোহো (সবাই একসাথে মজার ছলে বলে উঠে)

– এইতো, এইবার মাইয়া লাইনে আইছে। (শাহারিয়ার দিকে ফিরে) ল, তোর বউয়ে গামছা দেহায় দিছে। এইবার হাত মুছবি না মুখ মুছবি মোছ ,! (শিউলি বেগম)

নিপাও শিউলি বেগমের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দুষ্টু ভঙিমায় বলে উঠে,

– না না মা,! পড়ে তখন যদি ওড়নাটা গা থেকে পড়ে যায় ,!

– দেখলে দেহোক ,! বিয়া সাদি তো করবোই দুইডা দিন পর ,!

এইবার শাহারিয়া একটু বেশিই লজ্জা পায়। দিথীর দিকে ফিরে ধীর গলায় বলে।

– তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেও। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। (বলেই চলে যেতে উদ্যত হয় শাহারিয়া, তখনই শিউলি বেগম বলে উঠে)

– আমারে কবি না বাজান ,! নাইলে কিন্তু আমি দেরি কইরা উডমু, হ্যা,! হা হা হা হা

সবাই হাসতে থাকে। শাহারিয়া তাদের দিকে ফিরে ঠোঁট চেপে এক মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকে ঘর থেকে। শিউলি আবার হো হো করে হাসতে হাসতে বলেন,!

– শরম পাইছে অয় , হা হা হা হা

– চাচি আপনিও না ,! (এক লাজুক গলায় বলে মাথা নিচু করে দিথী)

– ওহোহো। আমি ,! আর এতক্ষণ ধইরা যে তোমরা রং ধং করতাছিলা। তার বেলায় ,! হ্যা ,!

দিথী মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। তানিয়া হাঁসি থামিয়ে বলে উঠে।

– চাচি, আপনি ভারি মজার মানুষ,!

– একটু আধটু মজা না করলে কী হয় কও ,! জীবন ডাই তো দুইদিনের।

– হ্যা চাচি। (একটু থেমে) আচ্ছা চাচি, আমরা এখন তাইলে যাই ,!

– এতো রাইতে কই যাইবা ,?

– বাসায় চাচি।

– না না না। থাকো তোমরা। এতো রাইত কইরা যাওয়া লাগবোনা। (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) রাইত সাড়ে ১০ টা বাজে। রাইত বিরাইতে তোমরা মাইয়া মানুষ রা, তাও আবার একলা,! আইজ রাইত এহানেই থাইকা যাও‌।

– চাচি, বাসায় দিথীর মা একলা আছেন। আর দিথীর বাবার তো কয়েক দিন আগে গুলি লেগেছে‌। আপনি তো সবকিছু জানেনই। কোনসময় যদি আমাদের প্রয়োজন হয় আরকি ,!

– তাও ঠিক। আচ্ছা হুনো শাহারিয়া তোমাগোরে ছাইড়া আহুক। একলা একলা যাওয়ার থে ও লগে গেলে তোমরা সেইফ থাকবা।

– না না চাচি। সমস্যা নাই। আমি যতক্ষন আছি,! ততক্ষণ আশাকরি কিছুই হবে না।

– কেন কিছু হইবো না,! বউমা কী আমার মারামারি জানোনি ,! কেউ আইলে ডিসুম ডিসুম দিয়া দিবা, হ্যা ,! হা হা হা।

– আসলেই ডিসুম ডিসুম দিয়ে দিবো। আপনার ছেলের থেকে কিন্তু কম মারামারি পারিনা ,!

– আরে বাপরে,! তাই নাকি ,! (নিপা)

– সময় হইলেই বুঝবি,!

দিথীর কথা গুলো কিছুটা বেখাপ্পা লাগে নিপার কাছে ,! তবে বাকিরা সেটা হয়তো মজা হিসেবেই নিয়েছে। তারপর শিউলি বেগম বলে উঠেন।

– আচ্ছা আচ্ছা হইছে। আইজ অনেক মজা হইলো। এহন হাসাহাসি বাদ। দিথী মা, যাওয়ার সময় কেউ আইলে ডিসুম দিয়া দিয়ো। আর সাবধানে যাইয়ো। কাইল কিন্তু দুপুরের আগেই আইয়া পইরো‌। ৩ ডার দিকে গায়ে হলুদ করার কতা।

– আচ্ছা চাচি।

– আইচ্ছা সাবধানে যাইয়ো।

দিথী, তানিয়া, সামিহা, কানিজ রা চলে যেতে থাকে।

তাদের চলে যাওয়ার পর শিউলি বেগম নিপাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– তাড়াতাড়ি হুইয়া পর। কাইল সকাল সকাল উঠা লাগবো।(ইকরার দিকে তাকিয়ে) ইকরা, তোর মা’রে ডাক দে। অনেক রাইত হইছে।

– আইচ্ছা ফুফু।

বলেই ঘর থেকে চলে যায় ইকরা। শিউলি বেগম বিছানা ঝাড়ার জন্য বিছানা ঝাড়ুটা ঘরের কোন থেকে নিয়ে আসেন। এসে বিছানা ঝাড় দিতে থাকেন। নিপা গিয়ে দাঁড়ায় ডেসিন টেবিলের সামনে। আয়নায় মুখশ্রী টা একবার দেখে। সারাদিন অনেক মজা মস্তি হয়েছে। কাল তো আরো হবে। মুখের তৈলাক্ত ত্বক নিয়ে সে ঘুমাতে পারে না। তাই একটা ক্রিম নিয়ে মুখে মাখতে থাকে। ভালো ভাবে ম্যাসাজ করে মাখার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক স্মাইলি ফেইস করে।

 

 

 

গভীর রাত। দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক শোনা যায়। মেইন রোড। মেইন রোডের পাশেই একটা গুদামঘর। একটা বড় কন্টেনার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে গুদাম ঘরের সামনে। ট্রাকে মালামাল রোড করা হচ্ছে। ট্রাকের কিছু দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যাক্তি। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে দু একটা পাথর বোঝাই ট্রাক আর নাইট কোচ সাঁই করে চলে যাচ্ছে। শীতের রাত। চারপাশে দারুন কুয়াশা। আঁধারে দাঁড়ানো লোকটার গায়ে জ্যাকেট পড়া। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে কিছু একটা ভাবছে। হাতে থাকা জলন্ত সিগারেট টা মুখে নিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে আবার নামিয়ে দিলো। কুয়াশার মাঝে তার নাক-মুখ থেকে বেড়িয়ে আশা ধোঁয়া উপরে উঠে মিলিয়ে গেলো। তখনই শুনতে পাওয়া যায় ট্রাকের কন্টিনারের দরজা লাগানোর শব্দ। একটা ছেলে এগিয়ে আসে সেদিক থেকে। এসে আঁধারে দাঁড়ানো লোকটার পাশে দাঁড়ায়। এক ধীর নিম্ন গলায় বলে।

– স্যার। গাড়ি ফুল লোড।

– লোড করা হয়ে গেছে,?

– জ্বী স্যার।

– সব জিনিস ঠিকঠাক মতো আছে তো,!

– হ্যা স্যার। সব ঠিকঠাক।

– ওকে। গাড়িতে উঠে বসো। তারপর যা করা লাগবে তা নিশ্চয়ই তোমার জানা ,?

– ইয়েস স্যার। কাজ হয়ে যাবে।

– ওকে।

হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে ছেলেটা টা ট্রাকের দিকে।

এদিকে ধুমপান করতে থাকা লোকটা নিজের ফোন বের করে। ফোনের ডিসপ্লের ওয়াল পেপারে একটা মেয়ের ছবি ভাসছে। কিন্তু দূর থেকে কুয়াশার মধ্যে সেই মেয়ের মুখশ্রী স্পষ্ট নয়। লোকটা ফোনে একজনের নাম্বার উঠায়। উঠিয়ে কল দেয়। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর অপর পাশের ব্যাক্তি ফোন উঠায়। আঁধারে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটা ফোনে বলতে থাকে‌।

– বর্ডারে গাড়ি পাঠাচ্ছি। (একটু থেমে) সব মাল ঠিকঠাক আছে‌।  পেমেন্ট ব্যাংকে করে দিবেন। (একটু থেমে) ওকে ঠিক আছে‌। রাখলাম।

লোকটা কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নেয়। সিগারেট মুখে তুলে এক লম্বা টান দেয়। কন্টিনার ট্রাকে হেডলাইট জ্বলে উঠে। ট্রাক টা স্টার্ট হয়। হেডলাইটের আলোতে আঁধারে থাকা ‌লোকটার কোমর থেকে নিচের শরীর দৃশ্যমান হয়। কালো এক জিন্স প্যান্ট, আর হাতে এক দামী ঘড়ি। বেশ বড়লোক মনে হচ্ছে লোকটাকে।

কন্টিনার ট্রাক টা চলতে শুরু করে। মেইন রোডের উপর উঠে। গতি বাড়িয়ে চলে যেতে থাকে কুয়াশা ভেদ করে। এদিকে আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা আবার সিগারেটে এক ‌লম্বা টান দেয় ,!

 

 

 

কাকডাকা ভোর। শীত এসেছে তার শক্তি সম্বল নিয়ে মানব জাতিকে কাঁপিয়ে দিতে। মেম্বার বাড়ি। এখন সময় ভোর ৬:৩০। চারপাশে দারুন কুয়াশা। বাড়ির অনেক মেহমান রা উঠে গেছে সকাল সকাল। কেউ কেউ বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ধুচ্ছে। কেউবা আঙিনার মাঝখান টায় কিছু খরকুটো একত্রে করে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছে। ডিসেম্বর মাস। তাই শীতে প্রকোপ একটু বেশিই।

নিপার ঘর। বিছানায় শুয়ে আছে শুধু নিপা। বাকিরা কখন যে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেড়িয়েছে খোঁজ নেই। নিপার গায়ে লেপ। ঘরের জানালা খোলা। সেই জানালা দিয়ে মৃদু দিনের আলো এসে পড়ছে ঘরের মেঝেতে।

ঘরে ঢুকলেন শিউলি বেগম। শাড়ির উপর গাঁয়ে চাদর দিয়েছেন শীত নিবারণ করতে‌। এসে বিছানায় বসেন। তার চোখমুখ কিছুটা ফোলা। হয়তো রাতে ঘুমান নি ঠিক মতো। বাইরে যতই তিনি সবার সাথে মজ মাস্তি করে কথা বলেন না কেনো। ভিতরে ভিতরে তো ঠিকই মেয়ে চলে যাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে।  শিউলি বেগম নিপার কাঁধ ধরে হালকা নাড়াতে থাকেন। বলতে থাকেন।

– নিপা,! এ নিপা,! ওঠ মা। সকাল হইয়া গেছে হেই কখন। ওঠ মা, ওঠ।

নিপা একপাশ ফিরে ছিলো‌। শিউলি বেগমের নড়িয়ে দেওয়াতে ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠে। নড়ে চিত হয়ে শুতে। শিউলি বেগম হাত দিয়ে নিপার মুখের উপর থেকে চুল গুলো সড়িয়ে দেন । মেয়েটার মলিন মুখশ্রী। সাদা ত্বক আর তুলতুলে গাল। একদম ঠিক ছোট বেলায় যেমন ছিলো, আজো তেমন। দেখতে দেখতে মেয়েটা যে কখন বড় হয়ে গেলো। আজ বাদে কাল নাকি এই পুঁচকে মেয়েটার বিয়ে,! শিউলি বেগম হাত দিয়ে নিপার ঘুমন্ত মুখের গাল গুলোতে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দেন। ছোট বেলায় নিপা সকাল সকাল সবার আগে উঠে তাকে ডাকতো। ছোট বেলার সেই মিষ্টি গলায় প্রতিদিন সকালে “মা উঠো সকাল হয়ে গেছে,!” কথাটা খুব ভালো লাগতো শিউলি বেগমের। তিনি না উঠলে তার গাল ধরে টানতে টানতে বলতো। “এ আমার গুলুমুলু মা,! উঠো,! আমার খিদা লাগছে,! ”

কালের পরিক্রমায় সেই দিন গুলো হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই মিষ্টি মেয়েটা এখনো তার কাছে সেই ছোট্ট নিপাই রয়ে গেছে। শিউলি বেগম চোখের পানি মুছেন শাড়ির আঁচলে‌। নিপার মলিন মুখ খানা ধরে বলতে থাকেন।

– আমার মিষ্টি মাইয়াডা,! কত তাড়াতাড়ি বড় হইয়া গেলো কও,! মা’রে ছাইড়া যাবিগা এহন ,! মা কিন্তু অনেক কানমু। (একটু থেমে চোখ মুছতে মুছতে) সব মাইয়ারই তো যাইতে হয় একদিন না একদিন। তোরে যাইতে দিতে আমার একদমই মন চাইতাছে না‌। তুই চইলা গেলে এই বাড়ি ঘর কে মা মা কইয়া মাথায় তুলবো ক ,! (মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে) দোয়া করি। সুখী হ। আর, আর আমারে একটা ছোট্ট সুন্দর নিপা আইনা দিবি। হ্যা,! ঠিক তোর মতই সুন্দর,!

বলেই চোখের পানি মুছতে থাকেন শিউলি বেগম। এতক্ষণ হেলে থাকায় তার চোখের কিছু পানি নিপার গালে পড়েছিলো। কথা গুলা হয়তো ঘুমন্ত নিপার কানে যায়। নিপা ঘুম ঘুম চোখ মেলে দেখে তার মা তার মাথার পাশে বসে শাড়ি দিয়ে চোখ মুছছেন। নিপা তাড়াতাড়ি উঠে বসে। ঘুম ঘুম চেহারা তার মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে বলে।

– মা, মা কী হইছে তোমার।

নিপার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া বুঝতে পারেননি শিউলি বেগম। তিনি নিপার কথা শুনে সাথে সাথে চোখ মুছতে থাকেন। স্বাভাবিক ভান ধরে ফিরে তাকান তার দিকে। নিপা আবার বলে উঠে।

– মা তুমি কানতাছো ক্যান ,! কেউ কী, কেউ কী কিছু কইছে তোমারে ,!

– ক,কই নাতো। আমি কই কানতাছি। (চোখ ভালোভাবে হাত দিয়ে মুছে) তুই ঐসব বাদ দে। উঠ তাড়াতাড়ি। আইজ তোর গাঁয়ে হলুদ।

– মা, তুমি কথা ঘুরাইয়ো না। আমি স্পষ্ট দেখছি তুমি কানতাছিলা। কী হইছে, কেন কানতাছিলা তুমি ,!

শিউলি বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে নিপার গালে পড়া পানির ফোঁটা টা মুছে দেন। ধীর গলায় বলেন।

– মা হ। বুঝতে পারবি ,!

বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ান শিউলি বেগম। চলে যেতে থাকেন দরজার দিকে। হঠাৎ এমন কথা শুনে নিপা কিছুই বুঝতে পারেনা। শিউলি বেগম দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন।

– ইকরারে পাডায় দিতাছি, অর লগে চইলা আহিস। আইজ সকাল সকাল গোসল করতে হয়।

বলেই বেড়িয়ে যান ঘর থেকে। নিপার ঘুম উঠে গিয়েছে। চোখ মুখ পরিচ্ছন্ন। শিউলি বেগমের কথার মানে সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার মা যে কিছু একটা তার থেকে লুকিয়েছেন তা ঠিকই বুঝেছে নিপা। নিপা হাই তুলতে থাকে। কাল রাতে শুতে শুতে ১১ টা বেজে গিয়েছিলো। এমনিতে সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। কিন্তু আজ দেরি শুয়েছে আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হলো। ইকরা ঘরে প্রবেশ করে। এসে খুশি খুশি গলায় নিপার পাশে বসে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলতে থাকে।

– কীরে, তুই এখনো বিছানা থেকেই নামিস নাই ,! ঐদিকে পাড়া প্রতিবেশী চলে আসছে হলুদ বাটার জন্য। চল চল গোসল করে নিবি চল।

নিপা ধীর গলায় উত্তর দেয়,

– মায়ের কী হয়েছে রে। একটু আগে আমার পাশে বসে কাদছিলো। আমি উঠে জিগ্গেস করতেই এড়িয়ে গেলো।

– চাচির মন খারাপ সকাল থেকেই। সারারাত মনে হয় ঘুমায় নাই। চোখ মুখ ফোলা ফোলা দেখলাম।

– হঠাৎ মায়ের কী হলো আবার।

– আরে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে। তুই আজ বাদে কালই চলে যাবি। তাই হয়তো মন খারাপ। (একটু থেমে চটপটে হয়ে) চল এখন। ঐদিকে গরম পানি করে দিছে গোসল করে নিবি চল।

– এতো সকাল সকাল,!

– বিয়ের পর ঐ রোজ সকাল সকালই গোসল করা লাগবে তখন ,!

– ধুর, সকাল সকাল যতসব আজেবাজে কথা বার্তা তোর।

– হ্যা আমি আজেবাজে কথাই বলি। এখন তুই নাম। ঐদিকে পানি ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

নিপা ওড়ানটা গায়ে দিয়ে হাই তুলতে থাকে‌। বিছানা থেকে দু পা নামায়। জুতো পড়ে নেয়। নেমে দাঁড়িয়ে কামিজ ঠিক করে আয়নার সামনে একবার নিজেকে দেখে। তারপর চলে যেতে থাকে ইকরার সাথে।

 

৩০ মিনিট পর।

 

আঙিনায় বড় বড় উরুন-গাইন (গ্রামে বাটাবাটি বা পিষার জন্য ব্যবহৃত এক ধরনের কাঠের তৈরি হাতল আর পাত্র) নিয়ে আসা হয়েছে। সেটা আঙ্গিনার মাঝখান টায় রাখা গ্রামের কিছু বয়স্ক মহিলারা এসেছে। তারা কিছু কাঁচা হলুদ গাইনে দিয়ে হালকা পানির ছিটা দেয়।  উরুন উঠিয়ে কাঁচা হলুদের গায়ে আঘাত করতে থাকে, বাটতে থাকে। চারপাশে গোল করে আরো কিছু মহিলারা কাঁধে কাধ মিলিয়ে গীত গাইছে। গ্রামীণ বিয়ে বাড়ির গাঁয়ে হলুদের এই দৃশ্যটা স্বাভাবিকই বটে,!

 

ঘরে নিপাকে শাড়ি পড়ানো শিখাচ্ছেন ইকরার মা মানে নিপার মামি আর শিউলি বেগম। নিপা শাড়ি পড়া যানে না। বিয়ের পর তো তাকে শশুর বাড়িতে শাড়ি পরেই বেশিরভাগ সময় থাকতে হবে। শিউলি বেগম নিপার কোমরে শাড়ির কুচি ধরানো শিখাচ্ছে। আর নিপার মামি নিচে শাড়ির কুচি কীভাবে ঠিক করে তা দেখাচ্ছে। নিপা মনযোগ দিয়ে দেখছে। শাড়িটা কমলা রঙের। ‘গায়ে হলুদ’ এর শাড়ি পড়বে দুপুরের দিকে। বিকাল ৩ টায় ‘গায়ে হলুদ‌’।

নিপাকে শাড়ি ঠিক মতো পড়ানো হয়ে গেলে শিউলি বেগম বলতে থাকেন।

– দেখছোস কেমনে শাড়ি পড়তে হয় ,! এমনে কইরা সবসময় পড়বি‌।

– শাড়ির কুচি ঠিক করা অনেক ঝামেলার।

– তোর ধারে ঝামেলার। আস্তে আস্তে ঠিক হইয়া যাইবো। এহন এই শাড়ি পইড়া আইজ দুপুর পর্যন্ত থাকবি, বুজছোস। শাড়ি কীভাবে সামলাইতে হয় তার ট্রেনিং নে অহন।

– শিউলি, ঐদিকে তো হলুদ বাটা শুরু হয়ে গেছে। ওকে বাইরে নিয়ে যাও‌। হলুদ বাটা দেখুক।

– আয়, আমার লগে আয়। বাইরে হলুদ বাটতাছে মহিলারা। গীতও দিতাছে।

নিপার হাত ধরে শিউলি বেগম নিয়ে যেতে থাকেন দরজার দিকে। দরজা খুলে দুজন বাইরে বেড়িয়ে আসে। ইকরা হলুদ বাটা মহিলাদের ওখানে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিলো। নিপাকে দেখে একহাতে ফোন ধরে আরেক হাত দিয়ে ইশারায় ডাকতে থাকে। মুখে হাসি। নিপাও চলে যেতে থাকে শাড়ি ধরে। মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। এই প্রথম ‌শাড়ি পড়েছে তাই একটু আনকম্ফর্টেবল ফিল করছে‌। ধীর পায়ে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে যায় ইকরার দিকে। হালকা রোদ উঠেছে। আঙিনায় সেই রোদের ঝিলিক পড়ছে। ইকরার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নিপা। ইকরা বলতে থাকে।

– শাড়ি পড়া নিপাকে তো আরো বেশি সুন্দর লাগতেছে রে,!

– ভিডিও করতেছিস নাকি ,!

– হ্যা।

তখনই এক মহিলা এসে নিপাকেও টানতে টানতে তাদের সাথে গীত গাইতে নিয়ে যায়। ইকরা মিটিমিটি হেঁসে নিপাকে তাদের দিকে ঠেলে দেয়। নিপাকে মহিলারা ধরে তাদের সাথে দাঁড় করায়। কাঁধে হাত দিয়ে গীত গাইতে থাকে। আর মাঝে থাকা দুজন উরুন দিয়ে গাহিনে কাঁচা হলুদ বাটতে থাকে। এটাকে সকাল বেলায় কনের বাড়ির অন্যতম সুন্দর দৃশ্য বললেও ভুল হবেনা। মহিলাদের পাশে দাড়িয়ে ইকরা, আফাজ বিষয় টা দারুন ভাবে উপভোগ করছে আর মুঠোফোনে স্মৃতি হিসেবে জমিয়ে রেখে দিচ্ছে। বারান্দার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নিপাকে তাঁদের সাথে আনন্দিত হতে দেখে এক সুন্দর মুচকি হাসি ফুটে উঠে শিউলি বেগমের মুখে ,!

 

 

 

সকাল ১১ টা। খাঁন বাড়ি। সুরাইয়া বেগমের ঘরে যথারীতি কালকের মতো আজও আলিশা তার মা’কে গল্প পড়ে শোনাচ্ছে। জানালা দিয়ে রোদ ঢুকেছে ঘরে। রাত আর ভোরে জম্পেশ কুয়াশা থাকলেও দিনে তা মলিন সূর্যের তেজে‌। সুরাইয়া বেগম বালিশে হেলান দিয়ে গল্প পড়া শুনছে। আজ আলিশা তাকে নতুন এক বই পড়ে শোনাচ্ছে। বইয়ের নাম ‘মায়ামৃগ’। কিছুদিন হলো বইটা কিনার। নিজে পড়ে এর স্বাদ গ্রহণ করে এখন সুরাইয়া বেগমকে তা পড়ে শোনাচ্ছে আলিশা।

 

ঘরে ধীর পায়ে প্রবেশ করলেন সাথী। আলিশা আর তার মা বইয়ের গল্পে ডুবে থাকায় সেদিকে খেয়াল করে নি। সাথী হেঁটে হেঁটে ফ্লোরের মাঝে দাঁড়িয়ে আলিশাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।

– আলিশা,!

ডাক শুনে চকিতে তার দিকে ফিরে তাকায় আলিশা। সুরাইয়া বেগমও ফিরে তাকান। আলিশা প্রদুত্ত্যরে বলে।

– হ্যা মামিমা।

– রায়হানদের সাথে ও বাড়িতে যাবি না ? গাঁয়ে হলুদে ?

– আজকে গাঁয়ে হলুদ নাকি ,? (একটু থেমে) ও হ্যা, বিয়ের আগের দিনই তো হয়। কালই ভাইয়ার বিয়ে তারমানে,!

– হ্যা কালই বিয়ে। দিন তারিখ কী দিন দিন ভুলে যাচ্ছিস নাকি আরো ,?

– ও ভালো মাইয়া। (সাথী কে দেখিয়ে) ও কেডা ,? (সুরাইয়া বেগম)

– ও ? ও আমার মামি। আর তোমার ভাবি। (সাথির দিকে ফিরে) কাল বিয়ে, অথচ দেখো বাড়িতে কোন বিয়ের আবহই নাই। যেন বাড়িটা গম্ভীর হয়ে আছে‌।

আলিশার কথা শুনে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় সাথী বেগম বলেন

– বাড়িটা সেই প্রথম থেকেই গম্ভীর আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। আলো ছিলোই বা কবে,!

– কিছু বললা মামিমা ,!

– ন,না না। তেমন কিছুনা। আচ্ছা শোনো। তুমি কী এখন যাবা রায়হানের সাথে ও বাড়িতে ?

– ভাইয়ার সাথে কে কে যাচ্ছে ?

– সাদিক যাবে, রাফসান হয়তো যাবেনা। ও গেছে দিনাজপুর শহরে। আর তোমার মামা যাবে আর সুমনা মামি।

– কোন মামা যাবে ? ঐ পিশাচ টা ? (কিছুটা শক্ত গলায়)

– আরে না না। নজরুল আর রাফসান একসাথে দিনাজপুর শহরে গেছে। শাহেদ মামা যাবে তোমার। মানে আমার জন।

– ও তাইলে ঠিক আছে। আমিও যাবো রায়হান ভাইয়াদের সাথে। কিন্তু আমার তো হলুদ শাড়ি নাই ,!

– হলুদ শাড়ি তো কন্যাকে পড়তে হয়। তুমি অন্য রংয়ের শাড়ি পড়লেও হবে। (একটু থেমে) শাড়ি পড়তে পারো তো ?

– হ্যা পারি পারি। স্কুলের ফেস্টিভ্যালে শাড়ি পড়েই গেছিলাম। (একটু থেমে) আচ্ছা তাইলে মামিমা তুমি আমায় একটা শাড়ি পছন্দ করে দাও,! দাঁড়াও আমি শাড়ি গুলা বের করছি। (বলেই বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হয় আলিশা, তখনই তার হাত শক্ত করে ধরে ফেলে সুরাইয়া বেগম। হেলান দেওয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসতে থাকেন। বলেন।

– তোমরা কই যাইতাছো ,! আমিও যামু তোমাগো লগে,! (বাচ্চাদের মতো আবদার করে)

আলিশা তার মা’কে হঠাৎ কী বলবে বুঝে পায় না। সে এক মলিন মুখ নিয়ে সাথী বেগমের দিকে তাকিয়ে মাথা দিয়ে ইশারায় বলতে থাকে “কী করবো? ”

সাথী আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে এসে একটা চেয়ার নিয়ে বিছানার পাশে বসেন। বলতে থাকেন।

– সুরাইয়া, ও এমনি বাইরে যাচ্ছে একটু। ওর হাত টা ছেড়ে দাও।

– না না আমিও যামু। ভালো মাইয়া যেহানে যাইবো আমিও সেহানে যামু।

– কী করবো এখন ,? (সাথী বেগমকে উদ্দেশ্য করে আলিশা বলে)

সাথী বেগম উঠে দাঁড়ান। গিয়ে আলিশার পাশে বিছানায় বসেন। ধীরে ধীরে তাকে বলতে থাকেন।

– ওরা যাবে দুপুরের দিকে। এই ধর দেড়টা-দুইটার দিকে। তুই সুরাইয়াকে ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়ায় দিস। এমনিতেও সকাল সকাল উঠছে‌। ঘুমায় যাবে এমনিতে খাওয়া দাওয়ার পর। বুঝছিস ?

– আচ্ছা।

– তোমরা কী কথা কইতাছো,! আমিও হুনমু ,! (সুরাইয়া বেগম)

– না না মা। তেমন কিছুনা। আমি, আমি মামিমাকে বলেছিলাম যে আমি যাবোনা, আমি তোমার সাথেই থাকবো।

– হ, তুমি যাইয়োনা। তুমি, তুমি আমার পাশে বহো। আমার লগেই থাহো। আর আমারে গল্প পড়াইয়া শুনাও।

– আচ্ছা মা। আলিশা উঠে গিয়ে বিছানার ধার থেকে মাঝখানের দিকটায় বসে। বসে বই খুলে। বই পড়ে শুনানোর আগে বলে।

– মা, তোমার চোখ টা কী এখনো ব্যাথা করে ,!

– ভালো মাইয়া, আমারে মা কও ক্যা ,! তোমার মা কী নাই ,? তোমার মা, তোমার মা কী মইরা গেছে ,? ( বলেই ছোট বাচ্চাদের মতো টুপটুপ করে চেয়ে থাকে সুরাইয়া বেগম। আলিশা একবার সাথী বেগমের দিকে তাকায় তারপর সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে।

– মনে করো তাই। তোমাকে মা ডাকলে কী তোমার খারাপ লাগে ,?

– না, আমার হুনতে খারাপ লাগেনা। কিন্তু, কিন্তু তোমার মতো একটা সুন্দর আর ভালো মাইয়ার মা নিশ্চয়ই ভালো কেউ হইবো। এরলাইগা কইতাছিলাম তোমার আসল মা কই।

– আছে, আমার সামনে বসে। (একটু থেমে) চোখটার ব্যাথা কী এখন কমেছে ?

– চ, চোখ। চোখটা আমার একটু একটু ব্যাথা করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, মনে হয় চোখের ভিতরে কিছু পচপচ করতাছে। যহন পচপচ কইরা উডে। তহন,তহন খুব ব্যাথা লাগে।

আলিশা তার মা’কে কিছু না বলে এক মলিন মুখ নিয়ে সাথী বেগমের দিকে চায়। সাথী বেগম কিছু বলেনা। আলিশা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সাথী বেগমকে বলে উঠেন।

– আমি দুপুরে খাওয়ার পর তোমার রুমে যাবোনে। তখন ওখান থেকে রেডি হয়ে বেরোবো‌।

– আচ্ছা।

বলেই সাথী বেগম বিছানা থেকে উঠে পড়েন। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকেন ঘর থেকে। সুরাইয়া বেগম একদৃষ্টে চেয়ে তার চলে যাওয়া দেখে। তখনই আলিশা তাকে ডাক দেয়।

– মা, গল্প শুনবেনা।

– গল্প ,! হ গল্প শুনাও। তুমি অনেক ভালো গল্প কও ভালো মাইয়া। আমার অনেক ভালো লাগে।

– আচ্ছা আচ্ছা। তাইলে শুনো। (বইটা উঁচিয়ে ধরে) ফ্লোরা আর টোটো নেমে পড়ে হীরাকান্ত দ্বীপে। চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু গাছ। দূরে বড় সবুজ পাহাড় দেখা যায়। ফ্লোরা টোটোর রশি ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। ফ্লোরা হয়তো ভেবেছে সে গফুরের কাছ থেকে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু এই অচেনা দ্বীপ কী তাকে এনে দিবে বাঁচার রাস্তা ? নাকি সে ভুল করে সেই শত্রুদের আস্তানাতেই এসে পড়লো,

 

সুরাইয়া বেগম এক আগ্রহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে আলিশার দিকে। গল্পটা শুনছে মন দিয়ে। তার কাছে মনে হচ্ছে যেন সে নিজেও চলে গিয়েছে সেই হীরাকান্ত দ্বীপ টায়, তবে গফুরের থেকে বাঁচতে নয়, এক অভিশপ্ত জীবন থেকে বাঁচতে ,!

 

 

 

রাশেদ দের বাসা। আয়ান আর রাশেদ সেজেগুজে রেডি ‘গায়ে হলুদের’ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। এখন সময় দুপুর ১ টা। শাহারিয়া তাকে তাড়াতাড়িই চলে আসতে বলছিলো। দুপুরের খাবার ওখানে খেতে বলছে। তাই আয়নকে নিয়ে রেডি হয়েছে সে। আয়ান বাসায় সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। এখন একটু অনুষ্ঠানে গেলে যদি বাচ্চা ছেলেটার মন ভালো হয়। আয়ান পড়েছে একটা নীল প্যান্ট আর হলুদ শার্ট। দুটোই তার মা কিনে দিয়েছিলো ঈদে। মায়ের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে কাপড় দুটোই। তাই অন্য কাপড় গুলো ছেড়ে এটাকেই সে বেছে নিয়েছে পড়ার জন্য। রাশেদ পড়েছে একটা ফরমাল প্যান্ট আর ফরমাল নীল শার্ট। রাশেদের বাবা-মা ঘরে আছেন। তারা দুজনেই বিছানায় পড়েছেন। রাশেদ একলা হাতে সব সামলাতে পারে না তাই এক মেয়েকে রেখেছে তাদের দেখা ‌শোনার জন্য। ছেলে মানুষ হয়ে ঘর সংসার সাথে উপার্জন সবদিকটা সে সামাল কীভাবে দিবে,! মেয়েটার নাম শম্পা। বয়স ১৮ এর মতো হবে। মেয়েটা এতিম।

রাশেদ আর আয়ান রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরোলো। আধাপাকা ঘর তাদের। রোডের সাথে লাগানো। আঙিনায় নেমে রাশেদ আয়ানকে বলে।

– মামা, তুমি নিপা আন্টিদের বাসাতো চিনো তাই না ,?

– নিপা আন্টি ? ঐ যে চেয়ারম্যানের বাসাটা ?

– না না। মেম্বার দের বাসা।

– হয়তো চিনি। (একটু থেমে) ঐদিকে অনেক দিন থেকে যাইনি তো।

– ও আচ্ছা তাইলে তুমি গিয়ে রাস্তায় দাঁড়াও। আমি তোমার শম্পা আন্টিকে সব বুঝিয়ে আসছি।

– আচ্ছা মামা।

ছোট্ট আয়ান হাঁসতে হাঁসতে ছুটে চলে যায় বাড়ির গেটের দিকে। গেট পেরিয়েই রাস্তা। মনমরা আয়ানের অনেক দিন পর দুরন্তপনা দেখে রাশেদের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।

শম্পা বেড়িয়ে আসে রাশেদের বাবা মায়ের রুম থেকে। বারান্দা থেকে নেমে আঙিনায় এসে রাশেদ সামনে দাঁড়ায়। রাশেদ তাকে দেখে তার দিকে ফিরে তাকায়। শম্পার চোখ নিচে। রাশেদকে গুরুজনই মানে বলা যায়। সেই রাতে রাশেদ তাকে রেলস্টেশনে মানুষ রুপি কুকুরদের হাত থেকে বাঁচিয়ে এইখানে আশ্রয় দিয়েছে‌। তাই এখন একপ্রকার রাশেদকে সে তার গার্জিয়ানই মানে।

রাশেদ তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলে।

– এখনো ভয় কাটেনি তোমার ,!

– ন,না। মানে হ। আমার ভয় কাটছে। (একটু থেমে) চাচা,চাচিরে খাবার খাওয়াইয়া দিছি‌। আমি কী এহন গোসলে যাইতে পারি ,!(নিম্ন গলায় ধীরে ধীরে ভদ্রতার সহীত বলে শম্পা)

– হ্যা যাও। আর শোনো।

– হ কন।

– তোমাকেও নিয়ে যেতাম কিন্তু তখন বাবা-মা বাসায় একলা থাকতো। তাই তুমি থাকো। আমি আর আয়ান যেয়ে ঘুরে আসি। কাল নিজে শাহারিয়া ভাই আমায় দাওয়াত দিয়েছে। না গেলে তখন খারাপ দেখাবে।

রাশেদের কথা শুনে মাথা নিচু করে নিম্ন গলায় শম্পা বলে,

– আচ্ছা ঠিক আছে যান।

– আমি ওখান থেকে গন্জে যাবো একটু। আশার সময় তোমার জন্য নাড়ু আর গরম গরম জিলাপি নিয়ে আসবো।

 

মেয়েটা সাথে সাথে মাথা উঠিয়ে অবাক পানে, রাশেদের দিকে চেয়ে তাকায়। বলে।

– আ, আপনে কেমনে জানেন যে আমি জিলাপি পছন্দ করি,!

– তুমিই ঐদিন বলেছিলে। (একটু থেমে) আচ্ছা এখন গোসলে যাও‌। গোসল দিয়ে এসে বাবা-মায়ের পাশে বসে থেকো কেমন ,?

– আ, আইচ্ছা,! (মাথা নিচু করে ধীর গলায় উত্তর দেয় শম্পা)

রাশেদ তার দিকে চেয়ে এক মৃদু হাঁসি দেয়। তার মাথার চুলে লেগে থাকা একটা ছোট্ট কাগজের টুকরা হাত দিয়ে সড়িয়ে দেয়। মেয়েটা কিছুক্ষণের জন্যও চমকে উঠেছিল। রাশেদ তাকে দেখলো কাগজের ময়লা টুকরো টাকে‌। তারপর ফেলে দিয়ে এক হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে চলে যেতে থাকে বাড়ির গেইটের দিকে। শম্পা আঙিনার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। এক পানে চেয়ে আছে রাশেদের যাওয়ার পথে‌। রাশেদের সাথে কথা বলতে গেলে কেমন যানি ভয় ভয় লাগে তার। হয়তো পুরুষ মানুষ যে তাই, নয়তো রয়েছে অন্য কোন কারণ। তার খোলা উসকোখুসকো চুল গুলো হালকা বাতাসে নড়ে উঠে‌।

 

আয়ান রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রোদ্রজ্জল দিন। মাথার উপর তাপে ভরা জলন্ত সূর্য। রাস্তার পাশে মাঠে কাজ করা মানুষ গুলো দুপুরে খাবার খেতে আলি পথ ধরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে এক অটো আসতে থাকে। দুরন্ত আয়ান চারপাশের গাছের পাখিদের দেখছে‌। আর হাত নাড়িয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। অটোটা এসে ঠিক তার সামনে থেমে যায়। অটোতে বসে ছিলো ঠিক সেই বোরখা পড়া মহিলাটা।

আয়ান অটোটাকে গুরুত্ব না দিয়ে গাছের ডালে বসে থাকা দুই পাখিকে উদ্দেশ্য করে ছোট এক ঢিল ছুড়ে মারে। পাখি দুটি উড়ে যায়। অটোর ভিতর থেকে মেয়েটা দুটো বড় চকলেট বার দেখায় আয়ানকে। আয়ান বলতে থাকে‌।

– আমি চকলেট খাবোনা আন্টি।

– কোথায় যাচ্ছো এখন ?

– মামার সাথে যাচ্ছি গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে। (একটু থেমে) তুমি যাবানা ?

– হ্যা। আমিও যাচ্ছি। চলো। উঠো আমার সাথে।

– হ্যা চলো। এমনিতে যে রোদ আন্টি। গরম লাগতেছে আমার খুব।

আয়ান উঠে পড়ে অটোতে। বোরখা পড়া মেয়েটা তাকে তার কোলে বসিয়ে নেয়। নিয়ে অটো ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

– চলো।

অটো ওয়ালা অটো চালু করে চলে যেতে থাকে। আয়ান অটো চলতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠে।

– আন্টি, আন্টি দাঁড়াও। মামা আসেনি তো। মামা আসুক।

– আমি তোমার আন্টি আছিনা। কিছু হবেনা। (একটু থেমে) তুমি অনেক ঘেমে গেছো আয়ান। দাঁড়াও ঘাম মুছে দিচ্ছি।

বলেই মেয়েটা এক সাদা রুমাল বের করে ব্যাগ থেকে। বের করে সেটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ সেটা দিয়ে আয়ানের মুখ চেপে ধরে। আয়ান জোরে জোরে হাত পা ছুড়তে থাকে। মেয়েটা আয়ানকে জাপ্টে চেপে ধরে। এতো জোরে চেপে ধরে যে আয়ান ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে।  আয়ান নিজেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না তার। আয়ানের হাত পা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যায়। হাত পা নাড়ানো থেমে যায়। মেয়েটা রুমাল সড়িয়ে আয়ানের মুখটা দেখে। আয়ানের শরীরটাকে সামনে ধরে তার গাল টা হালকা চেটে এক আলতো কামড় দেয়। তারপর আয়ানের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে বলে।

– অনেক দিন ধরে তোকে টার্গেটে রাখছিলাম। তোর গাল গুলো খাওয়ার লোভ আর ধরে রাখতে পারলাম না রে। আজ তোর এই নরম গাল গুলো আগে কাটবো। (আলোতো করে আয়ানের গালে কামড় দিয়ে) এগুলা এতো নরম আর সফট। (গাল গুলোর ঘ্রাণ নিয়ে) আহাহা,  এবার আর আগের গুলোর মতো মেরে কাটবো না। একদম, একদম জ্ঞান ফিরে আসার পর কাটবো। হ্যা, হা হা হা হা ,!

 

চলবে ,

 

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৪৭

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– আন্টি, আন্টি দাঁড়াও। মামা আসেনি তো। মামা আসুক।

– আমি তোমার আন্টি আছিনা। কিচ্ছু হবেনা। (একটু থেমে) তুমি অনেক ঘেমে গেছো আয়ান। দাঁড়াও ঘাম মুছে দিচ্ছি।

বলেই মেয়েটা এক সাদা রুমাল বের করে ব্যাগ থেকে। বের করে সেটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ সেটা দিয়ে আয়ানের মুখ চেপে ধরে। আয়ান জোরে জোরে হাত পা ছুড়তে থাকে। মেয়েটা আয়ানকে জাপ্টে চেপে ধরে। এতো জোরে চেপে ধরে যে আয়ান ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে।  আয়ান নিজেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না তার। আয়ানের হাত পা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যায়। হাত পা নাড়ানো থেমে যায়। মেয়েটা রুমাল সড়িয়ে আয়ানের মুখটা দেখে। আয়ানের শরীরটাকে সামনে ধরে। তার গাল টা হালকা চেটে এক আলতো কামড় দেয়। তারপর আয়ানের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে বলে।

– অনেক দিন ধরে তোকে টার্গেটে রাখছিলাম। তোর গাল গুলো খাওয়ার লোভ আর ধরে রাখতে পারলাম না রে। আজ তোর এই নরম গাল গুলো আগে কাটবো। (আলোতো করে আয়ানের গালে কামড় দিয়ে) এগুলা এতো নরম আর সফট। (গাল গুলোর ঘ্রাণ নিয়ে) আহাহা,  এবার আর আগের গুলোর মতো মেরে কাটবো না। একদম, একদম জ্ঞান ফিরে আসার পর কাটবো। হ্যা, হা হা হা হা ,!

চলে যেতে থাকে অটোটা। দিনের উজ্জ্বল আলোর মাঝেও যেন এক খন্ড আঁধার চলে যাচ্ছে কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে।

 

রাশেদ বাড়ির দরজা দিয়ে বেরোলো। শম্পার সাথে কথা বলতে বলতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। রাশেদ বের হয়ে দেখে বাড়ির সামনের রাস্তায় আয়ান নেই। রাশেদ ভালোভাবে চারপাশ দেখতে লাগলো ঘুরে ঘুরে। না, আয়ান নেই। রাশেদ তেমন একটা অবাক হয়না। বিরবির করে বলে।

– আয়ান আবার একলা একলা চলে গেলো নাকি ,!

তখনই তার চোখ যায় রাস্তায়। ঐযে দূরে একটা অটো চলে যাচ্ছে। রাশেদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে।

– হাসিবুল চাচাদের কেউ দাওয়াত দিছে মনে হয়। ওরাই হয়তো অটোতে করে যাওয়ার সময় আয়ানকে নিয়ে গেছে। আয়ান একবার হাঁক দিয়ে বলবেও না যে ওদের সাথে ও যাচ্ছে। (একটু থেমে) ছোট মানুষ। এতো বুঝ জ্ঞান তো হয়নি। আচ্ছা সমস্যা নাই। গেছে যেহেতু যাক। অন্য কোথাও তো আর যায়নি। ঐ বিয়ে বাড়িতেই গেছে‌।

বলেই রাশেদ হাঁটা ধরে। মাথার উপর রোদের তাপ প্রখর। চোখ কুঁচকে মাথা নিচু করে রোদের ঝিলিক থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে রাশেদ। চারপাশের ফসলি মাঠ দেখতে দেখতে চলে যেতে থাকে মেম্বার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

 

 

 

দিথীদের বাড়ি। দিথীর রুমে সাজছে সামিহা, কানিজ, তানিয়া আর দিথী নিজে। ঘরের দরজা বন্ধ করা। দিথী আর সামিহা শাড়ি পড়েছে। কানিজ আর তানিয়া থ্রী পিস। তারা শাড়ি আনেনি। আর তারা কী জানতো যে এখানে এসে বিয়ে বাড়িতে যাবে। তারা তো আসুভের জন্য এসেছে। তাই শাড়ি আনা হয়নি তাদের।

দিথী আর সামিহা পড়েছে গাঢ় কমলা রঙের শাড়ি। শাড়ির আঁচল টা হালকা সবুজ রঙের। ব্লাউজ ও আঁচলের রঙের সাথে মিলিয়ে পড়েছে তারা। দিথী গিয়ে ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। শ্যামলা দিথীকে কমলা শাড়িতে দারুন মানিয়েছে। দিথী আয়নায় দেখে শাড়ির আঁচল ঠিক করতে থাকে। কুচি গুলোও দেখে নিতে থাকে ঠিকঠাক আছে কি না। সামিহা এসে দিথীর পাশে দাঁড়ায়। পাশাপাশি না, দিথীর থেকে একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে। নাইলে পাশাপাশি দাঁড়ালে হাত লেগে-টেগে যাবে। সামিহা ত্বক দিথীর থেকে ফর্সা। সামিহা দিথীর থেকে হালকা একটু খাটো। দিথী লম্বা। আয়নায় প্রতিচ্ছবি টাও ঠিক তেমনি পড়েছে‌। সামিহার মুখ গোলগাল। গলুমলুও বলা যায়। তবে দিথী মুখশ্রী গোলগাল না। দিথী ডেসিন টেবিলের সামনে থাকা এক বক্স থেকে লিপস্টিক বের করে‌। গোলাপি ঠোঁটে লিপস্টিক না দিলেও চলতো। তাও হালকা একটু লিপস্টিকের ছোঁয়া না দিলে যেন তার কাছে সাজটা অসম্পূর্ণ লাগছিল।

 

কানিজ বিছানায় বসে পায়ে জুতো পড়ছে। সে জুতো পড়তে পড়তে তার পাশে বসে থাকা তানিয়াকে বলতে থাকে‌।

– আচ্ছা কালকে ও বাড়িতে ঐ ছেলেটা কে ছিলো ,? দিথীকে যে তাসনুবা বলে ডাকলো ,?

কথা শুনে সামিহা ফিরে তাকায়। একটু গোমড়া মুখে বলে।

– হ্যা আপু। ঐ ছেলেটাই তো আমাদের সব মজা নষ্ট করে দিছিলো‌।

দিথী আয়না থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলতে লাগলো।

– কিন্তু ও কিভাবে জানলো যে আমি তাসনুবার পুনর্জন্ম,? (আয়নার দিক থেকে ফিরে) এই কথাটা তো শুধু আমরা চারজন আর রাশেদ ভাই ছাড়া কেউ জানেনা ?

– রাশেদ কী বাইরে গিয়ে সবাইকে বলে বেড়াইলো নাকি আবার আমাদের পূনর্জন্মের কথা গুলা ,? (কানিজ)

– ও কেন বলে বেড়াইতে যাবে। (একটু থেমে অবাক হয়ে) একমিনিট, একমিনিট। চারজনের পুনর্জন্ম হওয়ার কথা ছিলো। তারমধ্যে আমরা ৩ জনকে পেয়েছি। তাসনুবার পুনর্জন্ম দিথী, সাবিনার পুনর্জন্ম সামিহা আর রাফির টা রাশেদ। কিন্তু এখনো সিহাবের টা কিন্তু আমরা পাইনি ,! (তানিয়া)

– তারমানে কী ঐছেলেটাই ,

– সিহাবের পুনর্জন্ম। (সামিহা)

– ওর বয়স টাও কিন্তু রাশেদ কিংবা আমাদের মতই মনে হচ্ছিলো। (একটু থেমে) কিন্তু ঐ ছেলেটাকে তো এর আগে এই গ্রামে দেখিনি ? কাল রাতে ঐ বাড়িতেই ওকে প্রথম দেখলাম।(দিথী)

– তোমাদের গ্রামের না ও ? (তানিয়া)

– না তো‌। আমাদের গ্রামের না ছেলেটা। ছোট থেকে এই গ্রামে বড় হয়েছি। গ্রামের সবাই আমাদের কমবেশি চেনা। চেনা না হলেও একবার না একবার দেখা। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে একদম নতুন লাগলো‌। কথার ভঙিমাও গ্রামীয় না‌।

– কিন্তু এটা কীভাবে হতে পারে‌। যাদের পুনর্জন্ম হবে তাদের বাবা-মা বা তাদের একজন কে এই গ্রামের বাসিন্দা হতেই হবে। স্থায়ী বাসিন্দা। (একটু থেমে) হয়তো তার বাবা কিংবা মা এখান কার। আর ও ছোট থেকে গ্রামের বাইরে ছিলো‌। এখন আবার গ্রামে ঘুরতে আসছে বড় হওয়ার পর।

– হমম। এমনটা হতেও পারে‌। চতুর্থ পুনর্জন্মকেও আমাদের দরকার নাকি আপু ,? (দিথী)

– হ্যা, অবশ্যই। চারজনকেই লাগবে আসুভের ধ্বংসের জন্য।

– ছেলেটাকে আজকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। (কানিজ)

– না না। এখন বিয়ে বাড়ি চলতেছে। এর মাঝে এসব বিষয় নিয়ে টানাটানি ঠিক হবেনা। যতদূর আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা শাহারিয়াদের কোন আত্মীয়র ছেলে। বিয়ের আগে এসব নিয়ে কথা বলা যাবেনা। আর (দিথীর দিকে তাকিয়ে) শাহারিয়াও দিথীকে তাদের আত্মীয় বা পরপুরুষের সাথে আলাদা করে কথা বলাটাকে ভালো চোখে দেখবেনা। নিপাদের বিয়ে টা পেরোক। আর শাহারিয়া তো কাল বললো তোমাকেও নাকি বলে বিয়ে করবে ১৬ তারিখ। তোমাদেরও বিয়েটা পেরোক‌। তারপর এসব নিয়ে শাহারিয়াকে বুঝিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলতে হবে। (তানিয়া)

– হ্যা। আমারো তাই মনে হয়। এখন এসব জিনিস টানা ঠিক না। আমাদের হাতে আরো সময় আছে‌। ৪র্থ পুনর্জন্মকেও পেয়ে গেছি। ধীরে সুস্থে পা ফেলে আগাইতে হবে। নাইলে তখন আসুভের চক্করে দিথী আর শাহারিয়ার মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হবে। (কানিজ)

– যা ভালো মনে করো। তবে আমার কাছে আসুভের থেকেও বড় ও(শাহারিয়া)। আমি আসুভের জন্য এদিকে বিসর্জন দিতে রাজী না।

– তোকে দিতেও হবে। লায়লী হয়ে গেছিস একেবারে। মজনু ছাড়া কিছু বুঝিস না।(একটু থেমে জুতা পড়তে পড়তে) তাড়াতাড়ি জুতো পড় বেড়োতে হবে। (সামিহা)

– তোর ভাগ্যে একটা মজনু পড়ুক। তারপর দেখি তুই কী করিস। সাধু বাবা সাজে গেছে ,!

– হইছে হইছে থামো। ঘড়িতে দেখো কয়টা বেজে গেছে। ঐদিকে আমাদেরকে আগেভাগে যাইতে বলছিলো চাচি। তাড়াতাড়ি বের হও। নাইলে পড়ে তখন হলুদ দেওয়া শুরু হয়ে যাবে।

দিথী তানিয়ার কথা শুনে ঘড়ির দিকে চেয়ে তাকায়। ২ টা ৪০ বেজে গেছে। ৩ টার দিকে গাঁয়ে হলুদ শুরু হওয়ার কথা‌। দিথী বিছানায় বসে। বসে জুতো পড়তে থাকে। হীল জুতো‌। তবে হাই হীল না। মেডিয়াম হীল। এমনিতেও লম্বা। তারউপর হীল পড়তে গেছে মেয়েটা। তালগাছ হওয়ার স্বপ্ন জাগছে মনে হয়।

জুতো পড়া হয়ে যায় তার। সবাই রেডি বেড়োনোর জন্য। দিথী তার পার্স ব্যাগ টা সাথে নেয়। সামিহা গিয়ে দরজা খুলে। সবাই বের হতে থাকে ঘর থেকে। দারুন রোদ। হেঁটে হেঁটে গেলে ঘেমে চটচটে হয়ে যাবে তারা। তাই ভাবলো রাস্তায় গিয়ে অটো নিবে। এমনিতেও হেঁটে হেঁটে গেলে গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর গিয়ে মেম্বার বাড়ি পৌছোবে তারা।

 

 

 

সেই অটোটা। যেটায় করে আয়ান কে নিয়ে যাচ্ছিলো বোরখা পড়া মেয়েটা। সেটা চলতে চলতে মেম্বার বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। সামনে ছাওনি দেওয়া রাস্তা শুরু। বোরখা পড়া মেয়েটার বুক হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠে। তাকে যেতে হলে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। নাইলে পিছনে ফিরে চলে যেতে ধরলে রাশেদ দেখে ফেলবে‌। না। পিছনে ব্যাক যাওয়া যাবেনা। এই বিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই তাড়াতাড়ি যেতে হবে তাদের। অটোটা বিয়ে বাড়ির জন্য সাজানো গেইটের আগে দাঁড়ানো। সামনে থেকে ছাওনি দেওয়া সাজানো রাস্তা শুরু। মেম্বার বাড়ি পাড় হয়ে আরো কিছুটা রাস্তা ছাওনি দেওয়া। তারপর আরেকটা বিয়ে বাড়ির সাজানো গেইট দিয়ে বেড়িয়ে যেতে হবে। এইটুকু রাস্তাই শুধু তাদের জন্য চ্যালেন্জ। বোরখা পড়া মেয়েটা অটো ওয়ালাকে বলে।

– খুব জোরে টান দিবা। অনেক লোকজন দাঁড়িয়ে থাকবে মেম্বার বাড়ির আঙিনায়। ঐখানে আরো জোরে যাবা। যদি আমি ধরা পড়ি তোমার বউ, সন্তান কেউই বাঁচবে না কিন্তু,! তাড়াতাড়ি যাও‌

অটো ওয়ালা মাথা নাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে সম্মতি জানায়। অটোর হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে। গিয়ার দিয়ে দেয়। অটো চলতে শুরু করে। উপরে বিয়ে বাড়ি লেখা গেইট দিয়ে প্রবেশ করে‌। মেয়েটা আয়ানকে বুকের মধ্যে ঝাপটে চেপে ধরেছে। মাথাটা বুকের মাঝে রেখেছে যাতে কেউ তার চেহারা দেখে চিনতে না পারে। নিজের মুখে বোরখার কালো কাপড় ঠিকঠাক করে দিয়েছে। তার চেহারা দেখেও যাতে কেউ চিনতে না পারে‌।

অটোটা তুলনামূলক দ্রুত চলছে আগের থেকে। মেয়েটা চাক্ষুস নজরে চেয়ে আছে সামনের দিকে। মনে মনে বলছে “আঙিনায় যেন কেউ না থাকে, আঙিনায় যেন কেউ না থাকে”

অটোটা বাড়ির খুব কাছে এসে গেছে আর ১০ হাত দূরে মেম্বার বাড়ি। মেয়েটা বাড়ির বাইরের আঙিনায় তাকায়। সাথে সাথে তার অক্ষি কোটর যেন এক পুর্নিমার চাঁদের মতো বড় বড় হয়ে যায়। আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে শাহারিয়া আর রিয়াদ। দুইজন একে অপরের সাথে কথা বলছে। দুইজনেই আইনের লোক। তার উপর শাহারিয়া আরো গোয়েন্দা। ধরা পড়লে একদম শেষ। তখনই হঠাৎ অটো হার্ড ব্রেক করে থেমে যায়। একটা বাচ্চার ছোট খাটো চিৎকার শোনা যায়। শাহারিয়া,রিয়াদ দুজনেই ফিরে তাকায় অটোটার দিকে। মেয়েটার বুক কাঁপতে শুরু করে। বাড়ি আর মাত্র ৫-৬ হাত সামনে। হঠাৎ অটো থেমে যাওয়ার মেয়েটা অটো ওয়ালাকে কিছু বলতে যাবে তখনই দেখে রাস্তায় খেলতে থাকা একটা বাচ্চা অটোর সামনে দিয়ে দৌড় দিছিলো। চলন্ত অটো ব্রেক না করলে বাচ্চার উপর দিয়ে চলে যেতো। বাচ্চাটা ভয়ে চিৎকার দিয়েছিলো। একটা ১৪-১৫ বছর বয়সী ছেলে এসে ছোট বাচ্চাটাকে মারতে মারতে নিয়ে যায় বাড়ির দিকে। অটো ওয়ালার হাত কাঁপছে। শাহারিয়া আর রিয়াদ এখনো অটোর দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটা পিছনের সিট থেকে কাপো কাপো কন্ঠে বল উঠে।

– য,যাও।

অটো ওয়ালা গাড়ির গিয়ার ফুল করে দেয়। অটোটা এক ঝাকুনি দিয়ে জোরে ছুটতে থাকে। শাহারিয়ারা এখনো তাকিয়ে দেখছে অটোটাকে। অটোটা তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ভিতরের মেয়েটা আড়চোখে দেখে রিয়াদ আর শাহারিয়া তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অটোটা মেম্বার বাড়ি ক্রস করে। মেয়েটা অটোর সাইড লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখে রিয়াদ আর শাহারিয়া আবার নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করেছে। মেয়েটা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আরেকটু হলে ধরাই পড়ে যেতো। হঠাৎ আবার অটোটা কষে ব্রেক করে। এইবার অনেক জোরে ব্রেক করায় মেয়েটা সামনের গ্রীলে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। মেয়েটা উটে আবার সিটে বসে হনহন করে বললো,.

– কী হলো আবার। এতো জোরে ব্রেক করলে কেন ,?

– ম্যাডাম। এক বাচ্চা অটোতে ধাক্কা খাইছে ,! (ভয় ভয় কন্ঠে বলে অটোওয়ালা। মেয়েটার ভিতর টা যেন আবার মোচড় দিয়ে উঠে। সে তাড়াতাড়ি তার হাত ব্যাক থেকে দুইটা চকলেট বার বের করে অটোওয়ালাকে দেয়। হনহন করে বলে‌

– তাড়াতাড়ি এগুলা ওকে দিয়ে চুপ করাও। তাড়াতাড়ি যাও‌

– এহনি যাইতাছি ম্যাডাম। বলেই অটোওয়ালা অটো থেকে নেমে ছেলেটাকে উঠায়।

 

শাহারিয়া আর রিয়াদ আঙিনা থেকে বিষয় টা লক্ষ্য করে। তাদের কাছে জিনিসটা অস্বাভাবিক ঠেকে। রিয়াদ শাহারিয়াকে বলে,

– আবার কারো গায়ের উপর উঠায় দিলো নাকি ,!  এই অটো গুলা কী দেখে শুনে চলতে পারেনা। একটু আগেই একটা ছেলেকে মারতে মারতে থামলো। এইবার নিশ্চিত কাউকে লাগায় দিছে।

– যেয়ে দেখতো‌।

– আচ্ছা দাঁড়া।

বলেই রিয়াদ এগিয়ে যায় সেদিকে।

 

অটোর সামনে পড়া বাচ্চাটার কান্না থামছেই না। নাক, মুখ ফেটে গেছে অটোর সাথে ধাক্কা খেয়ে। অটো ওয়ালা চকলেট গুলো দেখিয়ে ছেলেটার কান্না থামাচ্ছে। এদিকটায় আর লোক না থাকায় কেউ এগিয়ে আসেনি। তখনই মেয়েটা লুকিং গ্লাস দিয়ে চেয়ে দেখে রিয়াদ এগিয়ে আসছে পিছন থেকে। সাথে সাথেই সে আয়ানকে তার কোলে ঠিক ভাবে নেয়। আয়ানের মাথা তার কাঁধে রাখে। যাতে মুখ দেখা না যায়। এক হাত আয়ানের পিঠে দিয়ে চুপচাপ নিচের দিকে তাকায়।

রিয়াদ চলে আসে। অটোর সামনে গিয়ে অটো ওয়ালার পাশে দাঁড়ায়। ধমক দিয়ে বলতে থাকে।

– এই, তুই একটু আগেই একটারে লাগাই দিতি। এখন আবার আরেকটারে লাগাইছিস ,? (ছোট ছেলেটার দিকে তাকিয়ে) নাক-মুখও ফাটায় ফেলছিস। (অটোওয়ালার শার্টের কলার ধরে দাড় করিয়ে) কীরে। এতো তাড়া কিসের তোর হ্যা ,! অটো সহ জেলে ঢুকার শখ হইছে নাকি ,!

– স,স্যার। অটোতে রুগি আছে। এরলাইগা তাড়াতাড়ি হসপিটালে লইয়া যাইতাছিলাম।

– কোন রুগি আছে দেখা আমারে। আয়। (কলার ধরে টানতে টানতে অটোর পাশে এসে দাঁড়ায়। ভিতরে দেখে এক বোরখা পড়া মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে সিটে বসে আছে। রিয়াদ রাগের সুরে বলে।

– কই তোর রুগী,? কই (চড় থাপ্পড় দিয়ে) মিথ্যা বলার আর যায়গা পাইস না ,!

মেয়েটার বুক ধরফড় করে কাঁপছে। হঠাৎ সে ভারি গলায় বলে উঠে।

– স,স্যার। মোর পোলাডা অসুস্থ। ডাক্তারের ধারে লইয়া যাইতে হইবো। আমিই কইছিলাম ড্রাইভার ভাইরে জোরে চালাইতে।

 

কথা শুনে রিয়াদ রাগের চোখ নিয়েই মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটার হ্রদপিন্ড যেনো কেঁপে উঠে। রিয়াদ বলতে থাকে।

– তাই বলে সামনে দেখে চালাবে না ,? এই দেখেন (অটোর সামনে পড়া ছোট ছেলেটাকে এনে) নাক মুখ ফাটায় ফেলছে ওর,!

– স্যার। ছোট পোলা। হয়তো অটোর সামনে দিয়া দৌড় দিছিলো। এরলাইগা বাড়ি খাইছে অটোর লগে। (একটু থেমে) আমাগোরে ছাইড়া দেন স্যার। (কাঁধে থাকা আয়ান পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে) পোলাডার কাইল রাইত থেইকা মেলা জ্বর। জ্বরে পোলাডা হাত-পা নাড়াইতে পারতাছে না। আমাগো উপর একটু দয়া করেন। ড্রাইভার ভাই ডারে ছাইড়া দেন। অয় এরপর থেইকা দেইখা শুইনা গাড়ি চালাইবো।

রিয়াদ মেয়েটার কথা শুনে একবার অটো ড্রাইভারের দিকে তাকালো একবার মেয়েটার দিকে তাকালো। অটো ড্রাইভারের চোখ মুখে ছিলো ভয়। রিয়াদ কড়া গলায় অটো ড্রাইভারের দিকে ফিরে বলে।

– রুগী আছে বলে ছেড়ে দিলাম। এরপর যদি কোনদিন দেখছি জোরে অটো চালায় কারো গায়ের উপর তুলে দিতে।(হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অটোওয়ালার মুখের কাছে এনে) একদম অটো চালানো শিখায় দিবো,!

বলেই অটোওয়ালার কলার ছেড়ে দেয় রিয়াদ। অটোওয়ালা তার শার্ট টেনে ঠিক করে। রিয়াদ সে নাক-মুখ ফাটা ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে যেতে থাকে। অটো ড্রাইভার চকলেট বার গুলো অটোর বোরখা পড়া মেয়েটার হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসে। অটো চলতে শুরু করে। মেয়েটা হাত দিয়ে মুখের উপর থেকে বোরখার কালো কাপড় টা সড়িয়ে দেয়। আয়ানের অচেতন দেহটাকে সামনে এনে ধরে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকে। তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক রহস্যময় হাসি,!

 

রিয়াদ ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে আসে শাহারিয়ার কাছে। শাহারিয়া ছোট ছেলেটাকে দেখেই অবাক হয়ে বলতে থাকে।

– ছেলেটার তো নাক-মুখ ফেটে গেছে রে ,! তুই অটো টাকে যেতে দিলি কেনো ,!

– আরে অটোর ভিতর রুগি ছিলো‌। তাই তাড়াতাড়ি চালাচ্ছিলো। (একটু থেমে) বাদ দে সব। (ছেলেটার দিকে তাকিয়ে) ছেলেটা আলমগীর চাচার মনে হয়। (ছেলেটার মাথ হাত বুলিয়ে দিতে দিতে) তোমার বাবার নাম আলমগীর না,?

– হ। আমার, আমার আব্বার নাম আলমগীর। (কিছুটা কান্নার সুরে বলে ছেলেটা)

– আচ্ছা কাদিও না। আমি নয়নকে বলে দিচ্ছি তোমাকে ডাক্তারের কাছ থেকে ড্রেসিং করায় আনতে। (উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দূরে থাকা এক পাঞ্জাবি পড়া লোককে উদ্দেশ্য করে) এই নয়ন, এদিকে আয়।

নয়ন দৌড়ে আসতে থাকে। সেও কিছু ছোট ছেলে মেয়ের সাথে কি নিয়ে যানি কথা বলছিলো। নয়ন এসে রিয়াদের সামনে দাঁড়ায়। রিয়াদ বলে।

– ওকে নিয়ে যায় ড্রেসিং করায় আনো। আর আলমগীরকে চিনো তো ?

– কোন আলমগীর, স্যার ?

– দক্ষিণ পাড়ার আলমগীর। ঐযে ওর মেয়েটা যে ধরা খাইলো‌ একটা ছেলের সাথে। ঐ আলমগীর। এইটা ঐ মেয়েটারই ছোট ভাই। ড্রেসিং করিয়ে ওদের বাসায় দিয়ে আসিও।

– আচ্ছা স্যার ঠিক আছে।

বলেই ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে চলে যেতে থাকে নয়ন। রিয়াদ তাদের যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে। এতক্ষণ তো বলাই হয়নি এ বাড়ির কথা। রায়হান রা এসেছে। জাম গাছের নিচে আঙিনায় থাকা সাজানো গাড়ি টা ওদেরই। শাহারিয়া আর রিয়াদের পরনে পাঞ্জাবি। শাহারিয়া ধূসর রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে আর রিয়াদ পড়েছে কালো।

রিয়াদ ফিরে তাকায় শাহারিয়ার দিকে কথা বলার জন্য। তখনই দেখে আরেকটা অটো আসতেছে। সে দূর থেকে দেখতে পায় অটোতে কারা আছে। রিয়াদ শাহারিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে‌।

– ঐ দেখ। তোর পরী আসতেছে ,!

– কোন পরী ,! (বলেই পিছনে ফিরে তাকায় শাহারিয়া। অটোটা এসে ঠিক তাদের পাশেই থামে‌। অটো থেকে সবার আগে পা বাড়িয়ে নামে দিথী। শাহারিয়ার চোখ যেন থেমে গিয়েছিলো তার উপর। এই প্রথম দিথীকে শাড়িতে দেখলো সে। আহা,! সৌন্দর্য মনে হয় এটাকেই বলে। দিথীকে আজ যেন সে নতুন আঙিকে চিনলো। দিথী নেমে যাওয়ার পর বাকিরাও নামে। রিয়াদ এক মুচকি হাসি দিয়ে শাহারিয়ার কাঁধে হাত রাখে। শাহারিয়ার ঘোর ভাঙে। সে কিছুটা লজ্জাই পায় বটে। তানিয়ারা তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো। দিথী তানিয়া দের ছেড়ে এসে শাহারিয়ার পাশে দাঁড়ায়। তার হাতে নিজের হাত গুজে দেয়। শাহারিয়া হঠাৎ দিথীর স্পর্শ পেয়ে চকিতে তার দিকে ফিরে তাকায়। দিথী এক মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকে নিয়ে চলে যেতে থাকে বাড়ির দরজা দিয়ে ভিতরের দিকে। পিছন দাঁড়িয়ে এক পাশে রিয়াদ আর একপাশে তানিয়া,সামিহারা ঠোঁট চেপে হাসছিলো আর এদের কান্ড দেখছিলো। তখনই বাড়ির ভিতর থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। তারমানে গাঁয়ে হলুদ শুরু হয়ে গেছে। রিয়াদ আর তানিয়ারাও পা বাড়ায় বাড়ির দরজার দিকে। ভিতরে চলে যেতে থাকে‌।

 

স্টেজ টা বেশ বড় করেই করা হয়েছে। আঙ্গিনার এক পাশ টায় স্টেজ, মাঝে ফাঁকা আর তারপর বারান্দায় উঠার জন্য দু’কদম সিঁড়ি। আঙিনায় বেশ লোকজনের সমাগম ঘটেছে। দিথী শাহারিয়ার হাতের মাংসপেশির ওখানে হাত দিয়ে ওকে ধরে ভিতরে নিয়ে আসে। বাকিরাও পিছু পিছু এসেছে। স্টেজে একটা সুন্দর ডিজাইনের সোফা। সোফায় বসে আছে রায়হান আর নিপা। রায়হান এক সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। গলার দিকে সুন্দর কারুকাজ করা। নিপা পড়েছে এক হলুদ শাড়ি আর কমলা ব্লাউজ। মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। তাদের সামনে একটা টেবিল। টেবিলে হরেকরকমের মিষ্টান্ন, আর হলুদের ছোট ছোট বাটি। নিয়ম অনুযায়ী শিউলি বেগম আর মতিন মেম্বার গাঁয়ে হলুদের স্টেজে উঠলেন আগে। বাকিরা পিছু পিছু উঠলো। কিছু ছোট বাচ্চারাও উঠেছে সাথে। ইকরা, আফাজ, এক বয়স্ক মহিলা আর ছোট ছোট বাচ্চারা গিয়ে দাঁড়ালো রায়হানের পাশে। আর আলিশা, সাদিক, শাহেদ সাহেব আর সুমনা বেগম দাঁড়িয়েছেন নিপার সাইডে। বড় বড় সাউন্ড বক্স ২ টায় গান বাজতে শুরু করলো,

 

গতরে হলুদ লাগাইয়া কন্যারে,

সাজাও গো বধূর সাজ দিয়া,

আতর, গোলাপ লাগাইয়া কন্যারে,

সাজাও গো বধুর সাজ দিয়া,

 

শিউলি বেগম রায়হানকে মিষ্টি খাওয়ালেন চামচ দিয়ে, তারপর খাওয়ালেন নিপাকে। হলুদের ছোট বাটিটা থেকে কিছু হলুদ নিয়ে রায়হানের গালে কিছুটা টা দিয়ে বাকি বেশিরভাগ অংশটা নিপার গালে আর নাকে মাখিয়ে দিলেন। হাসতে থাকলেন। পর্যয়াক্রমে তারপর মতিন মেম্বার দুইজনকে মিষ্টি খাওয়ান‌। হালকা হলুদ নিয়ে দুইজনের গালে লাগিয়ে দেন। নিপার পাশে দাঁড়ানো শাহেদ সাহেব আর সুমনা বেগম পর্যায়ক্রমে হলুদ লাগান। গানের সাউন্ড বাড়ানো হয়। ইকরা, আফাজ, আলিশারা স্টেজ থেকে হলুদের একটা একটা করে ছোট বাটি নিয়ে নেমে যায়। শিউলি বেগম দুইটা বাটি নিয়ে নেমে যান। বাকিরাও নেমে দাঁড়ান। গান বাজতে থাকে

,

,

আজকে যে খুশি তে নাচে দুলহানিয়া,

পাড়া-প্রতিবেশী ঘরেতে আসিয়া,

নাচে যে চুমকি আর নাচে ফুলবানিয়া,

হলুদে নাচিবে আঙ্কেল আর আন্টিরা,

 

তখনই নিচে সবাই একে অপরকে হলুদ মাখিয়ে দিতে থাকে। ইকরা হলুদের বাটি নিয়ে খুঁজতে থাকে, রিয়াদকে। হঠাৎ শিউলি বেগম আহনাফকে নিয়ে গানের তালে তালে নাচতে থাকেন।

 

,

,

নাচের তুমি এসো গো কাছে,

তোমাকে আজ কিছু বলার আছে,

দিল ডান্স মারে বুকের ভিতরেএএএএএ,

কণ্যা যে বধু সাইজা,

কণ্যা যে বধু সাইজাছেএএএ

রে আজ তারে ফ্যান্টাসটিক লাগিতাছে,

 

শিউলি বেগম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আহনাফকে নাচাতে থাকে‌। আহনাফ কিছু বুঝে না উঠে ডান্স স্টেপ না পেরে শিউলি বেগমের সাথে শিউলি বেগম যা করতেছে তাই সে করতেছে‌। বাড়ি সবাই তাদের এ নাচ দেখে যে কী হাঁসি,! আরো কিছু মহিলা এসে শিউলি বেগমের সাথে যোগ দেয়। আহনাফের মুখ হলুদ মাখিয়ে হলদে করে ফেলে। তার সাদা পাঞ্জাবি যেন হলুদ লেগে হলুদ পাঞ্জাবী হয়ে গেছে। বাকিরাও গানের তালে তালে হাত তালি দিতে থাকে আর আহনাফের সাথে সেই মহিলাদের কাপল ড্যান্স দেখতে থাকে। দিথী গিয়ে স্টেজে উঠে নিপা আর আফাজ গিয়ে রায়হানকে নামায়। সবাই মিলে একেকজনকে হলুদ দিতে থাকে। রায়হানও নিপার হাত ধরে তাদের সাথে যোগ দেয়। নিপা ডান্স স্টেপ পারেনা তাও কোনমতে সে রায়হানের সাথে তাল মিলায়। তার খুব হাঁসি পাচ্ছিলো এতে।

এদিকে আলিশা, আফাজের পিছে ছুটছে তাকে হলুদ দেওয়ার জন্য। হয়তো আফাজ তাকে বেশি করে হলুদ মাখাইছিলো। এখন তার বদলা নেওয়ার জন্য আফাজকে দৌড়ের উপর রেখেছে সে। ইকরা হলুদ দিতে দিতে রিয়াদকে দেখতে পায়। রিয়াদ, শাহারিয়া আর কানিজ সাইডে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইকরা সেদিকে চলে যায়। কানিজকে একটু হলুদ দিয়ে শাহারিয়াকে দিতে যায়। শাহারিয়া তো একদৌড়ে ছুট। ইকরা তো নাইলে তার মুখে হলুদ মাখিয়ে শেষ করে দিবে। কানিজও বাকিদের সাথে হলুদ মাখামাখিতে চলে যায়। ইকরা পেয়ে যায় রিয়াদকে একা। বুক কেমন যানি করছে।

সে রিয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রিয়াদের গালে হলুদ দিতে যাবেই তখনই রিয়াদ ইকরার হাতে থাকা বাটিটা নিয়ে ইকরাকেই হলুদ মাখিয়ে দেয়। ইকরার কপালে আর গালে বেশখানিকটা হলুদ লাগায় রিয়াদ। যখন রিয়াদ তার গালে ছোঁয়া দিলো তার চোখ গুলো প্রায় বুজে এসেছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সে হলুদ টা মেখেই লজ্জায় দৌড়ে চলে যায় বাকিদের মাঝে। এদিকে শাহারিয়া সব হলুদ থেকে বেঁচে এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে হলুদে মাখামাখি হতে একদমই চাইছিলো না। তখনই কোথা থেকে যেন দিথী দৌড়ে আসলো‌। দিথীর মুখ হলুদ দিয়ে ভরা। তাই শাহারিয়া হঠাৎ দেখায় দিথীকে চিনে উঠতে পারেনি। দিথী দৌড়ে এসে শাহারিয়ার বুকের উপর ইচ্ছে করে ধাক্কা খায়। শাহারিয়া হঠাৎ ধাক্কা পাওয়ায় চমকে উঠে। সে মুখ উঠিয়ে তাকায় আর সাথে সাথেই দিথী তার গালের সঙ্গে শাহারিয়ার গাল ঘষা লাগায়। তারপর আরেক গালেও তার গাল ঘষে সব হলুদ শাহারিয়ার দুই গালে লাগিয়ে দেয়। শাহারিয়া বুঝতে পারে যে এটা দিথীই। দিথীর নিঃশ্বাস চিনতে সে ভুল করেনি।

শাহারিয়া দিথীর হাতের বাটিটা থেকে হলুদ নিয়ে তার গালে মাখাতে যায় তখনই দিথী তার হাত ধরে নিজের গাল থেকে সড়িয়ে তার গলায় লাগিয়ে দেয়। শাহারিয়ার হলুদ ভরা হাত যেন সে গলাতেই স্পর্শ করাতে চাইছিলো। শাহারিয়া দিথীর গলায় হলুদ মাখিয়ে হাত নামায় আর সাথে সাথে দিথী শাহারিয়াকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এক অন্যরকম অনুভুতি সাগরে যেন ডুবে গিয়েছিলো শাহারিয়া। এমনভাবে এতক্ষণ দিথী সব অঙ্গভঙ্গি করছিলো  যে শাহারিয়ার নিজেকে কন্ট্রোল রাখাটাই মুশকিল হয়ে গেছে। দিথীর এই দুষ্টু চাহনির মানে কী ,! ধুর কীসব ভাবছে ও। ভাবতো না। দিথীর দুষ্টু চাহনী তাকে ভাবাচ্ছে। মেয়েটা আসলেই তাকে খুব কাছে করে পেতে চায় ,!

মেম্বার বাড়ির হলুদ বিকেল দারুনভাবে কাটতে থাকে। সবাই মিলে আঙ্গিনায় আনন্দ করতে থাকে। আনন্দ পুর গ্রামের এই আনন্দ টারই যেন এতোদিন কমতি ছিলো। এখন তা পূরণ হয়েছে। পরন্ত বিকেল, তাই সূর্য একপাশে যেয়ে আলো দিচ্ছে। আলোর তেজও কম। আলো গুলো এসে পড়ছে স্টেজের দিকে। স্টেজে তো কেউ নেই। বউ,বর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। সব আঙিনায় গানের তালে তালে নাচছে আর হলদে বিকেল কে রঙিন আলোয় রাঙাচ্ছে,!

 

 

 

আয়ানের চোখ খুলে। সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে উপরে একটা ফ্যান ঘুরছে। সে চারপাশে তাকায়। দেখে রুমটায় লাল আলো জ্বলছে। সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা স্টেচারে বাঁধা অবস্থায়। তার দুই হাত স্টেচারের দুই কোনে আর দুই পা স্টেচারের দুই কোনে বাঁধা। সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে। সেই মেয়েটা দাড়িয়ে আছে। যে বোরখা পড়ে তাকে অজ্ঞান করেছিলো। এখন মেয়েটার পড়নে জিন্স আর গাঁয়ে শার্ট। মেয়েটা একটা ছুরি আর চাপাতি (মাংসের দোকানে মাংস কাটার জন্য ব্যবহার করা অস্ত্র) একটা আরেকটার সাথে ঘষছে। আয়ান ভয়ে ভয়ে মেয়েটাকে বলতে থাকে।

– আ,আন্টি। আন্টি তুমি আমাকে এ কোথায় নিয়ে এসেছো,! আমি বাড়ি যাবো। আমার এখানে ভয় করছে।

আয়ানের কথা গুলো শুনে মেয়েটা তার দিকে চেয়ে তাকায়। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে এক শয়তানি হাসি। মেয়েটা চাপাতি টা রেখে ছুরি টা নিয়ে আয়ানের দিকে এগিয়ে যায়‌। আয়ান ছুরি দেখে ভয় পায়। সে চিল্লিয়ে বলতে থাকে।

– মামা, আন্টি আমাকে মারতে আসতেছে। মামা, আমাকে বাঁচাও মামা,! (বলেই কাঁদতে থাকে আয়ান)

মেয়েটা এসে স্টেচারের পাশে দাঁড়ায়। বলতে থাকে।

– আয়ান ,! চিল্লায় কোন লাভ হবেনা ,! রুমটা সাউন্ড প্রুফ। এই রুমের সাউন্ড, বাইরে যায়না ,! (বলেই একটা পিশাচ হাঁসি দিতে থাকে)

– আন্টি, আন্টি আমাকে ছেড়ে দাও। তোমার কথা আমি কাউকে বলবো না। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও ,!

– এখনি ,! তা তো হয়না আয়ান বাবা। দাঁড়াও। তোমার গালের মাংস টা একটু টেস্ট করে দেখি আগে।

বলেই এক হাত বাড়িয়ে তার মাথা টা ধরে। ছুরিটাকে গাল বরাবর রেখে আয়ানের দিকে চেয়ে এক মুচকি হাসি দেয়।

– আম্মু, আ, আমার গাল টা ছেড়ে দাও, আম্মু,

মেয়েটা ছুরি দিয়ে আয়ানের গালের অনেকটা মাংস কেটে নেয়। আয়ান স্টেচারে ব্যাথায় মাথা নাড়াচ্ছে। কাঁদছে। চিৎকার করছে। তার গাল দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। কাঁচা মাংসটা হাত দিয়ে তুলে মুখে পুরে নেয় মেয়েটা। ‘কচর মচর’ আওয়াজ আসে মুখ থেকে। আয়ান মাথা বারবার নাড়াচ্ছে গালের মাংস কেটে নেওয়ায় মুখ নাড়িয়ে চিৎকারও ঠিকমতো করতে পারছেনা। মেয়েটা আয়ান মাথাটা শক্ত করে তার কাছে মুখ এনে বলে।

– অনেক স্বাদ তো তোর মাংসে। গালের মাংস তো মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই গলে গেলো,!

– আ,আমাকে। আমাকে ছেড়ে দেও না আন্টি। আমি বাড়ি যাবো। আম্মু, (বলে চিৎকার দিয়ে উঠেই কাঁদতে থাকে আয়ান)

– কী আম্মু আম্মু লাগাইছিস,! হইছিস তো একটা নষ্টার পেটে। (একটু থেমে) আর আম্মু আম্মু করতেছিস কেন এরকম করে ? তোর মরা মা কী তোরে বাচাইতে আসবে নাকি ,! তোর মা মাগি ছিলো মাগি।(ধীর গলায়) বলতো তোর মা কী ছিলো,!

আয়ান চুপ করে থাকে তার চোখ দিয়ে অজোর ধারায় পানি পড়ছে। গালের ব্যাথা তার সাথে তার মায়ের মৃত্যু নিয়ে বাজে কথা শুনে তার ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছিলো।

– কীরে ,! বলিস না ক্যান,! তোর মা ছিলো এক নষ্টা আর তুই হইলি নষ্টার সন্তান। (একটু থেমে) তোর মাও মরছে। তোর বাপও মরছে। তুই বাঁচে থাকে কী করবি রে ,!

আয়ান শব্দ করে কেঁদে উঠে। নিশ্পাপ ছোট বাচ্চাটার মুখ দেখেও মায়া হয়না মেয়েটার। মেয়েটা তাড়াতাড়ি গিয়ে চাপাতি টা নিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছে সে রাগান্বিত হয়ে আছে। মেয়েটা এসে আয়ানকে কর্কশ গলায় বলতে থাকে।

– বল তোর মা একটা নষ্টা। বল ,! বল নাইলে কিন্তু তোর হাত কেটে ফেলবো।

আয়ান কিছু বলে না। তখনই মেয়েটা চাপাতি উঠিয়ে সজোরে আয়ানের কাঁধে কোপ মারে। আয়ান চিৎকার করে উঠে।

– আম্মু, আঁ,

তার সম্পূর্ণ হাত তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রক্তের পিচকারি বেড়িয়ে আসে কাঁধ থেকে। কিছু রগ লেগে ছিলো ছোট্ট হাতটা কেটে ফেলার পরও। সেগুলো একটান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। ছোট হাতটা উঠিয়ে ধরে দাঁত দিয়ে এক কামড় দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খেতে থাকে মেয়েটা। যেন মাংস খেলে তার মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। ছোট্ট শিশু আয়ান ছটফট করছিলো স্টেচার টার মধ্যে। তার চিৎকার ভরা কান্নায় ঘর ভারি হয়ে উঠেছে। তখনই মেয়েটা চাপাতি টা দিয়ে তার ডান পায়ের মাংসপেশিতে কোপ দেয়। আয়ান কুকিয়ে উঠে। ” আম্মু, আম্মু’ বলে চিৎকার করতে থাকে। এক কোপে হাড় না কাঁটায়, চাপাতি টা উঠিয়ে আরো জোরে দুই তিন কোপ দিতে থাকে। যেন কোন কসাই মাংসের হাড় কাটছে। আয়ানের দেহ থেকে পা ছুটে যায়। আয়ানের চিৎকার কানে এসেও যেন মেয়েটার কিছু হচ্ছেনা। মেয়েটার হাতে নখ ছিলো বড় বড়। এক হাত দিয়ে আয়ানের মুখ টা ধরে ডান চোখের অক্ষিকোটরে সজোরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে চোখ টা উঠানোর চেষ্টা করে। আয়ান জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে।

– আন্টি আমার চোখটা ছেড়ে দাও। আ, আন্টি, আমার চোখটা তুলে নিয়ো না আন্টি, আম্মু, আ,

এক জোড়ে টান দিয়ে আয়ানের ডান চোখটা তুলে নেয় মেয়েটা। সাথে সাথে মুখে নিয়ে এক কামড় দেয়। ছোট চোখে হঠাৎ জোরে কামড় দেওয়ার চোখটা ফেটে কিছু অংশ বেড়িয়ে আসে মুখ থেকে। জুলতে থাকা চোখের অবসিষ্টাংশ নুডুলসের মতো করে সুরুত করে টেনে মুখে নিয়ে নেয় মেয়েটা। “কচমচ কচমচ’ করে চাবাতে চাবাতে বলে।

– চোখ চোখ দেখি খুব, খুব মজার। উনার খাওয়া লাগবেনা। আরেকটাও আমিই খাই।

বলেই আবার ঝাপটে আয়ানের মাথা চেপে ধরে বাম চোখের কোটরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে চোখ তুলে নিতে থাকে মেয়েটা। আয়ানের গলা ভেঙ্গে গেছে চিৎকার করতে করতে। ভাঙা গলায় শেষ আকুতি করতে থাকে বাচ্চা ছেলেটা।

– আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা আন্টি, আন্টি তোমার পা ধরতেছি আমাকে ছেড়ে দাও, ও আম্মু, আমাকে বাচাও আম্মু, না, চোখটা ছেড়ে দাও, না,

এই চোখ টাও এক হেঁচকা টান দিয়ে কোটর থেকে বের করে নেয় মেয়েটা। সাথে সাথে মুখে পুরে নিয়ে চাবাতে থাকে। বেশ আনন্দের সহীত খেতে খেতে বলে।

– খুব চিল্লাইতেছিস না,! তোর মুখ টাকে আমি টেনে ছিঁড়ে যদি না ফেলছি,! দাঁড়া।

বলেই হাত দুটা গায়ে পড়া শার্টের কাপড় মুছে। চিৎকার করতে থাকা আয়ানের দিকে চেয়ে এক শয়তানি হাসি দিয়ে বলে‌।

– আয়ান, তোকে তোর মায়ের কাছে পৌঁছে দেই ,! ওখানে গিয়ে তোর নষ্টা মা আর খুনি বাপের সাথে থাক। কেমন,!

বলেই এক হাত দিয়ে আয়ানের মুখের উপরের চোয়াল ধরে আরেকহাত দিয়ে মুখের নিচের চোয়াল ধরে খুব জোরে টেনে আলাদা করতে থাকে।আয়ান মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারে না। শরীর ঝাপটাতে থাকে। ব্যাথায় শরীর বেঁকিয়ে যায়। মেয়েটা অনেক শক্তি দিয়ে মুখের দুই চোয়াল টানতে থাকে। একপর্যায়ে মুখের হাড় গুলো মটমট করে ভাঙার আওয়াজ আসে। গালের অবশিষ্ট মাংস ছিঁড়ে যায়। গলা দিয়ে রক্ত ছিটকে আসতে থাকে। মেয়েটা এক জোরে চিৎকার দিয়ে দুই চোয়াল টান দেয় আর সাথে সাথে মট মট করে বাকি হাড় গুলো ভেঙ্গে চোয়াল থেকে মাথা, শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে। পিচকারির মতো রক্তে বেড়িয়ে আসতে থাকে। শরীর টা জবাই হওয়া মাথা বিহীন মুরগির মতো ছটফট ছটফট করতে থাকে। রক্তে মেয়েটার গায়ের শার্ট ভিজে গিয়েছে। হাতে লেগে থাকা রক্ত টোপ টোপ করে ফ্লোরে পড়ছে। মেয়েটা হাত উঠিয়ে মুখের উপর থেকে চুল গুলো সড়িয়ে কানের পাশে রাখে। বলতে থাকে।

– হাতে দারুন শক্তি হইছে আমার। হাত দিয়ে চোয়াল ছিঁড়ে দিতে পারছি। (একটু থেমে) খুব আম্মু আম্মু করতেছিলি না,! মুখটাই টেনে আলাদা করে দিছি। এইবার চিল্লা ,! (হাতে লেগে থাকা রক্ত চাটতে চাটতে) তবে তোর চোখ গুলো খাইতে দারুন ছিলো। রক্তটাও একদম গরম। গরম রক্ত এভাবে চেটে খাওয়ার মজা যে কী ,! আহা, অমৃত, অমৃত ,

বলতে বলতে মেয়েটা চলে যেতে থাকে আরেকটা রুমের দিকে। যেখানে অনেক গুলো বাচ্চা কিডন্যাপ করে এনে রাখা। হাতের রক্ত চাটতে চাটতে মেয়েটা বলে।

– দেখি। আমার তো আরো খিদা বাড়ে গেলো। আরেকটা খাইতে হবে মনে হয়। এইবার ছেলে না। এইবার মেয়ে খাইতে হবে। মেয়েদের রক্ত গরম না হইলেও স্বাদ আছে দারুন,! হা হা হা হা।

মেয়েটা পিশাচ হাঁসি হাসতে হাসতে সেই রুমের দরজা খুলে ভিতরে চলে যায়। ভিতরে সবাই জরোসড়ো হয়ে বসেছে। মেয়েটা ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

 

স্টেচারে পড়ে থাকে ক্ষতবিক্ষত আয়ানের দেহ। তার মা-বাবা তো মরেছে তাদের কৃতকর্মের জন্য। তারা যা করেছিলো সেই ফলই তারা ভোগ করেছিলো। কিন্তু আয়ানের কী দোষ ছিলো ,! কেনো তাকে তার বাবা মায়ের থেকেও নিষ্ঠুর, নৃশংস মৃত্যু বরণ করে নিতে হলো ,! মৃত্যু কারো কাছে প্রতিশোধ, কারো বা কাছে খেলা, আনন্দ, সুখ। মৃত্যুর মুখে থাকা ছটফট ব্যাক্তিটিকে দেখেই তাদের মনের লালসা যেন পূর্ণ হয়। ছোট্ট আয়ান কী জানতো যে তাকেও কারো মনের লালসা পূরণের জন্য জীবন দিতে হবে ,! ছোট্ট অবুঝ ছেলেটা তার মায়ের কিনে দেওয়া শেষ কাপড় টা পড়েই শেষ নিঃশ্বাস ফেললো। এখনো সেই ছোট্ট শার্ট প্যান্টে লেগে আছে তার উষ্ণ গরম রক্ত। লেগে আছে তার শেষ সময়ের কিছু চিৎকার, আর্তনাদের পরিচ্ছেদ,!

 

চলবে ,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৪৮

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– দেখি। আমার তো আরো খিদা বাড়ে গেলো। আরেকটা খাইতে হবে মনে হয়। এইবার ছেলে না। এইবার মেয়ে খাইতে হবে। মেয়েদের রক্ত এতোটা গরম না হইলেও স্বাদ আছে দারুন,! হা হা হা হা।

মেয়েটা পিশাচ হাঁসি হাসতে হাসতে সেই রুমের দরজা খুলে ভিতরে চলে যায়। ভিতরে সবাই জরোসড়ো হয়ে বসেছে। মেয়েটা ভিতরে ঢুকে দরজা জোরে শব্দ করে লাগিয়ে দেয়।

 

স্টেচারে পড়ে থাকে ক্ষতবিক্ষত আয়ানের দেহ। তার মা-বাবা তো মরেছে তাদের কৃতকর্মের জন্য। তারা যা করেছিলো সেই ফলই তারা ভোগ করেছিলো। কিন্তু আয়ানের কী দোষ ছিলো ,! কেনো তাকে তার বাবা মায়ের থেকেও নিষ্ঠুর, নৃশংস মৃত্যু বরণ করে নিতে হলো ,! মৃত্যু কারো কাছে প্রতিশোধ, কারো বা কাছে খেলা, আনন্দ, সুখ। মৃত্যুর মুখে থাকা ছটফট ব্যাক্তিটিকে দেখেই তাদের মনের লালসা যেন পূর্ণ হয়। ছোট্ট আয়ান কী জানতো যে তাকেও কারো মনের লালসা পূরণের জন্য জীবন দিতে হবে ,! ছোট্ট অবুঝ ছেলেটা তার মায়ের কিনে দেওয়া শেষ কাপড় টা পড়েই শেষ নিঃশ্বাস ফেললো। এখনো সেই ছোট্ট শার্ট প্যান্টে লেগে আছে তার উষ্ণ গরম রক্ত। লেগে আছে তার শেষ সময়ের কিছু চিৎকার, আর্তনাদের পরিচ্ছেদ,!

 

 

 

পূর্ব দিক থেকে সূর্য মামা উঁকি দিতে শুরু করেছে। কুয়াশার পারদ ভেঙে আলো ছড়িয়ে পড়ছে ধরিত্রীর মাঠ,ঘাট, প্রান্তরে। শীতার্ত পৃথিবীকে এই উষ্ণ শীতল ছোঁয়াই যেন আরো রঙিন আঙ্গিকে সাজিয়ে তুললো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে নিপা। নতুন সকালের সূর্যের মতোই আজ তারও নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে। আজ নিপার বিয়ে। যেই মানুষটিকে নিয়ে সে জন্ম জন্মান্তর কাটানোর কথা ভাবতো আজ সেই মানুষটি তার হতে চলেছে। তার শাড়ির আঁচল পেতে চলে এক নতুন মানুষের হাতের ছোঁয়া। নিপার ঠোঁটে একটা নির্মল হাঁসি ফুটে উঠলো। চোখ, মুখ হাসৌজ্জল। প্রত্যেকটা মেয়েই চায় তাদের পছন্দের মানুষটির সাথে জীবনের সুন্দর আর শেষ সময়ে নির্ভরতার‌ ছায়া পেতে। আজ সেই মানুষটির তার হতে চলেছে, জীবনের এক দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আসছে তার প্রিয়তম। নিপার মন সেই নতুন ছায়ার আলিঙ্গন পেতে দারুন উচ্ছসিত।

ঘরে ঢুকলো ইকরা। নিপাকে বিছানার এক কোনে বসা অবস্থায় দেখতে পেলো‌। জানালার সামনে মুখ করে আছে সে। ইকরা গিয়ে নিপার পাশে বসলো। নিপার কাঁধে হাত রাখলো। নিপা ফিরে তাকায়। ইকরাকে এক নজর দেখেই আবার বাইরে সূর্যোদয়ের দিকে তাকায় নিপা। বলতে থাকে‌।

– দেখ ইকরা। আজকের সকাল টা কত সুন্দর ,!

– কই, আমার কাছে তো আগের মতোনই লাগতেছে।

– ধুর তুই এসব বুঝবিনা। (বলেই আবার হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো নিপা)

– আজ এতো তাড়াতাড়ি নিজে থেকেই উঠলি যে ,!

নিপা জানালার পাশ থেকে ফিরে উত্তর দেয়,

– আজ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ছোট বেলায় খুব আনন্দের দিন গুলোতে যেমন তাড়াতাড়ি উঠে পড়তাম, মনে একটা আলাদা ভালোলাগা কাজ করতো, আজও ঠিক তেমনটাই করতেছে।

– তুই আছিস এদিকে আনন্দ নিয়ে, আর ঐদিকে চাচি মন খারাপ করে রান্না ঘরে বসে আছে। মা বললো আজ সকাল সকাল বলে কান্নাও করছিলো।

কথা শুনেই নিপা ভ্রু কুঁচকে বলে‌

– কেনো ,! মায়ের কী হইলো আবার।

– তুই আজকে চলে যাবি‌। মন তো খারাপ হওয়ারই কথা। (একটু থেমে) রান্না ঘরে তোর মা আছে দেখা করে আয়।

– আমি মা’কে গিয়ে কী বলবো,!

– আমি কী জানি।

– মা’কে আমি খুব কম কাঁদতে দেখছি‌‌। আগে যখন কাঁদতো আমি গিয়ে শান্ত করতাম। কিন্তু আজ তো, আজ তো মা আমার জন্য কাঁদছে। কী বলে আমি শান্ত করবো মা’কে ,!

– যা, এমনিই কথা বলে আয়।

– তুই কথা বলছিলি ?

– আমি একলা কী বলবো।

– বাবা কোথায় ?

– চাচা তো গেছে শাহারিয়ার সাথে গন্জে। কী বলে বাদ আনা ছিলো ঐটা আনতে গেছে।

– বাবা থাকলে বাবাকে পাঠাইতাম মায়ের মন ভালো করতে। বাবা,ভাইয়া দুইজনেই বাইরে গেছে।

– আচ্ছা বাদ দে, চল নাস্তা করে আসি।

– তুই নাস্তা করিস নি ?

– না, আমি তো একটু আগেই উঠলাম মাত্র। চল, পিঠা বানাইছে আজকে অনেক। সাথে চমচমও আছে। চল।

– কালকে মিষ্টি খাইতে খাইতে আমার অবস্থা খারাপ। এখন আরও চমচম,! না বাপু আমি পারবনা।

– আচ্ছা তুই চল, তোকে খাইতেই হবে না। আমিই খাবো।

 

নিপা কিছু বলতে যাবেই তখনই ঘরে শিউলি বেগম প্রবেশ করেন। হাতে নাস্তার ট্রে। মুখ হাসৌজ্জল। নিপা তা দেখে বেশ অবাক হয়। শিউলি বেগম এসে নিপা, ইকরাদের পাশে বিছানায় বসে‌। হাসিমুখে বলতে থাকে‌

– কী করতাছো মাইয়ারা ,!

– মা, তুমি,!

– কেন, তোর জামাইরে চাইছিলি নাকি অহন ,! কাইল সকাল থেইকা উইঠা তো আগে জামাইডারই মুখ দেখবি। আইজ আমার ডাই দেইখা মন ভরা। (একটু থেমে) লও নাস্তা। খাইয়া নাও। আইজ বাড়িত মেলা কাম। মেহমান-সদোর আইজ অনেক আইবো। ঐদিক সামাল দেওয়া লাগবো আমারে। ( একটু থেমে নিপার দিকে ফিরে) কীরে নিপা, তুই এহনো মুখ ধোস নাই ,? বাসি মুখে বইসা আছোস‌। তাড়াতাড়ি যাইয়া মুখ ঢুইয়া আয়।

শিউলি বেগমের হাসি মুখে বলা কথাগুলো ইকরা আর নিপা দুইজনকেই অবাক করছে। তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর আবার শিউলি বেগমের দিকে তাকায়। নিপা বলে।

– মা, তুমি ঠিক আছোতো ,!

– আমার আবার কী হইবো ,! (দুষ্টু হাসি দিয়ে) যা হওয়ার তা তো তোর হইবো। মুরগিরে শিয়ালের হাতে তুইলা দিমু আইজ‌। তারপর মুরগি বুঝবো কত ধাইনে কত চাইল।

– মা,! কী কও এইসব।

– কী কইছি এইডা সময় হইলে বুঝবি। এহন তাড়াতাড়ি যাইয়া মুখ ধুইয়া আয়। নাইলে কিন্তু রায়হানরে ফোন দিমূ‌।

– দেও। রায়হান আমার কী করবে আসে‌‌।

– আইবো তো রাইতে, তহন দেহিস কী করে‌। এহন তাড়াতাড়ি যা‌। ঐদিকে আমারে আবার রান্নাঘরের ঐদিক যাইতে হইবো।

– আইচ্ছা আইচ্ছা যাইতাছি‌।

নিপা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। শিউলি বেগম কথা বলতে থাকে ইকরার সাথে। নিপা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে শিউলি বেগম বেশ হাসিখুশিতেই আছেন। নিপা আর কিছু বলেনা। সামনে ফিরে চলে যেতে থাকে ঘরের বাইরে। শিউলি বেগম আর ইকরা দুইজন কথা বলতে থাকে আর হাসতে থাকে।

 

 

 

রিয়াদ তার রুম থেকে বেরোলো। ৯ টে বেজে গেছে। কুয়াশা কমতে শুরু করেছে, রোদ এসে পড়েছে আঙিনায়। রিয়াদের পরনে পুলিশ ড্রেস। থানায় যেতে হবে তাকে। গিয়ে শুধু নয়নদের কাজ বুঝিয়ে দিয়েই চলে আসবে। এখন হাতে তেমন কোন কেস নেই। তাই চাপ কম। রিয়াদ আঙিনায় নেমে শার্টের হাতা মোড়াতে মোড়াতে মায়া,রাতুলদের ঘরের দিখে মুখ করে বলতে থাকে,

– ভাইয়া, ভাবি, আমি গেলাম।

বলেই চলে যেতে উদ্যত হয় রিয়াদ, তখনই রাতুল তাদের ঘর থেকে বের হয়। হয়ে রিয়াদকে পিছু ডেকে বলে।

– রিয়াদ, নাস্তা করছিস ?

রিয়াদ থেমে পিছু ফিরে তাকায়‌। বলে,

– না ভাইয়া, বাইরে খেয়ে নিবো।

– বাইরে ক্যান খাবি। আমি নাস্তা বানাইছি। আয়। খায়ে তারপর যাবি।

– আমার যে দেরি হয়ে যাইতেছে এদিকে।

– হোক দেরি। নিজে থানার ওসি, তোর আবার দেরি আর তাড়াতাড়ি আছে নাকি ,! আয়, নাইলে তোর ভাবি উঠে যদি শুনে, তুই খায় যাস নাই। আমার খবর করে দিবে।

– হ, ভাবির বকার ভয়েই তো তুমি আমারে নাস্তা খাওয়াইতে ডাকতাছো। নাইলে আমার ভাইয়ের আবার কবে আমার উপরে দরদ হওয়া শুরু করলো,!

– বেশি পাকনা পাকনা কথা পড়ে কইস, তাড়াতাড়ি আয়।

রিয়াদ হেঁটে হেঁটে রাতুল দিকে এগিয়ে আসে। রাতুল তাকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকে। রাতুলের সাথে রান্না ঘরের ঐদিক যেতে যেতে রিয়াদ বলে,

– ঐ বাড়িতে কখন যাবা ?

– কোন বাড়ি ?

– আরে মেম্বার বাড়ি, নিপার বিয়েতে কখন যাবা ?

– এইতো দুপুরের দিকে বাইর হবো। ক্যান ?

– আমি দুপুরে বাড়ি আসে কাপড় পড়ে তারপর যাবো ঐদিকে।

– তো যাইস।

– তোমাদের ঘরের চাবি দাও। আমার সব কাপড় তো তোমাদের ঘরের আলমারিতে।

– চাবি,! না চাবি তোর নেওয়া লাগবেনা। আমরা তোর জন্য থাকবো। তুই আসলে তারপর একসাথে বাইর হবো‌।

– ভাবিরেও নিয়া যাবা নাকি,!

– তো ওরে কী একলা বাড়িতে ফেলে যাবো ,! কীসব বলতেছিস তুই, রিয়াদ।

– না মানে ওখানে যতলোক হবে আজকে। আর ভাবি তো অসুস্থ।

– তোর ভাবির চিন্তা তোরে করা লাগবেনা। আমি আছি কী করতে‌। (একটু থেমে) আজকে তো তোর থানা না গেলেও হইতো।

– কিছু ফাইল চেক দিতে হবে‌। আর বাকি কাজ নয়নকে বুঝায় দিয়ে চলে আসবো।

– নে, ভিতরে ঢুক। (রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রাতুল বলে)

– আমি এখানে বসে খাবো ,! আমি তো ড্রেস পড়ছি। তুমি আমাকে প্লেটে উঠায় দেয় আমি ঘরে চলে যাই।

– ক্যান, এখানে বসে খাইলে কী হবে।

– আমি পিড়ায় কেমনে বসবো। তুমি আমাকে প্লেটে উঠায় দাও, আমি ঘরে যায় খাই।

রাতুল একটা প্লেট নিয়ে এক পাত্র থেকে সেমাই উঠিয়ে দিতে থাকে প্লেটে। আর সাথে কিছু মুড়ি আর ফ্লাক্স থেকে একটা কাপে চা ঢেলে দিতে থাকে।

রিয়াদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। ওর ভাইয়া খালি কীভাবে হঠাৎ শিক্ষক থেকে রাঁধুনি হয়ে গেলো‌। রাতুল প্লেট আর চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। রিয়াদ সেগুলো হাতে নেয়। রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যেতে থাকে তার ঘরের দিকে। রাতুল রান্নাঘরেই এক পিড়ায় বসে এক কাপে ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে নেয়। গরম গরম ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দিয়ে সকালের ঘুম ঘুম ভাব টাকে কাটাতে থাকে।

 

 

 

গ্রামের কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দু পাশে ফসলি মাঠ। মাঠে কৃষকদের দেখা নেই। ধান কেটে স্তুপ আকারে রাখা হয়েছে মাঠের বিভিন্ন যায়গায়। এখন শুধু সেই ধান গুলোকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পালা।

রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে সোনালী। পড়নে থ্রী পিসের উপর সাদা এপ্রোন। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা, আর ডান কাধে ঝোলানো এক ব্যাগ। সময় এখন ১১ টা। আজ পরীক্ষা নেই। কলেজে গিয়ে শুধু কিছু নোটস আর বই নিয়ে চলে আসবে সোনালী। মাথার উপর এখন রোদ্রের তাপ তেমন একটা নেই। আকাশ সাদা মেঘে ঢাকা। আপাতত দূর দুরান্ত পর্যন্ত কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। সোনালী আপন মনে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। বাতাসে মুখের উপরে কিছু চুল এসে পড়ে। হাত দিয়ে চুল গুলোকে কানের পাশে সড়িয়ে দেয়।

তখনই দেখা যায় এক বাইক আসছে তার পিছন থেকে। বাইক টা বেশ ভালো রকম গতিতেই ছিলো। বাইক চালকের মাথায় হেলমেট পড়া। গায়ে জ্যাকেট। সোনালী রাস্তার পাশ ধরে চলছিলো। বাইক টা এসে একদম সোনালীর সামনে হার্ড ব্রেক করে। সোনালী আনমনে থাকায় হঠাৎ তার সামনে বাইক ব্রেক করা দেখে চমকে উঠে। সে বাইক আর বাইকের মানুষটাকে দেখে। বাইকারের মুখে হেলমেট পড়া তাই সে চিনতে পারেনা এই লোকটা কে। সোনালী ধীর কন্ঠে বলে উঠে।

– ক,কে আপনি।

তখনই বাইকার তার মাথার উপর থেকে হেলমেট খুলে ফেলে‌। সোনালী দেখে বাইকার টা আর কেউ নয় রাফসান। অর্থাৎ রায়হানের বড় ভাই। সোনালী রাফসানকে দেখার সাথে সাথেই কিছুটা বিরক্ত হয়ে বাইকের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে সামনে। হঠাৎ এভাবে আসায় সে ভেবেছিল কে না কে‌। এখন দেখে রাফসান। রাফসানের চাহনি, নজর কোনটাই তার কাছে ভালো লাগে না। এমন করে দেখে যেন কোন দিন মেয়েই দেখেনি।

রাফসান বাইকটা স্ট্যান্ড করে রেখে বাইক থেকে নামে‌। তাড়াতাড়ি হেঁটে আসতে থাকে। হেঁটে এসে সোনালীর ঠিক সামনে গিয়ে তার রাস্তা থামিয়ে দাঁড়ায়। সোনালী বেশ বিরক্ত হয় এবার। সে রাফসানকে কয়েকটা কথা শোনাবার জন্য কিছু বলতেই যাবে, তখনই রায়হান এক হাটু গেড়ে হেলে বসে এক গোলাপ ফুল তার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে‌

– I love you সোনালী।

সোনালী এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। রাফসান তাকে প্রপোজ করছে ? এই ছেলেটাই তো সেদিন অটোতে যাওয়ার সময় শিশ বাজিয়েছিলো‌। তার প্রতি খারাপ নজর দিয়েছিলো। হঠাৎ সোনালীর ভাবনার ঘোর ভাঙিয়ে দিয়ে রাফসান আবার বলে।

– আমি তোমাকে ভালোবাসি সোনালী। অনেক অনেক ভালোবাসি।

– মজা করছেন আমার সাথে ?

– নিজের প্রিয়তমার সাথে ভালোবাসা নিয়ে মজা করার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই সোনালী।

সোনালী এইবার বেশ বিরক্ত হয়ে বলে‌।

– আপনি সড়েন আমার সামনে থেকে। আমার এইসব মজা একদমই ভালো লাগেনা।

– আমি মজা করছিনা সোনালী। সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। (বলেই গোলাপ ফুল টা আরো উঁচু করে ধরে মাথা নিচু করে রাফসান)

সোনালী কিছু বলতে যায়, কিন্তু বলেনা। নিজের রাগ টাকে দমিয়ে নিয়ে রাফসানের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে। রাফসান মাথা উঠিয়ে দেখে সোনালী নেই। পিছন ফিরে দেখে সোনালী হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। রাফসান উঠে দাঁড়ায়। হনহন করে সোনালীর দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে সোনালীর এক হাত ধরে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সোনালীর চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে ও রাফসানের প্রতি কতটা বিরক্ত। রাফসান তার হাতের উল্টো পিঠে এক চুমু দেয়। সোনালী সাথে সাথেই হাত টেনে নিয়ে এক জোড়ে থাপ্পড় মারতে উদ্যত হয়। কিন্তু কী ভেবে যানি আর মারেনা সে। রাফসান বলতে থাকে।

– তুমি মারো আর যাই করো‌। আমার শুধু তোমাকেই লাগবে সোনালী। তুমি একবার ভাবো। রাণীর মতো থাকবে আমার সাথে তুমি। আমাদের টাকা-পয়সা, বাড়ি, গাড়ি কী নেই। (সোনালী এক হাত ধরে অনুরোধ সূচক মুখ ভঙ্গী করে) তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই সোনালী।

সোনালী হাত হেঁচকা টান দিয়ে নামিয়ে নেয়। বলতে থাকে।

– আমি সারাজীবন কুমারী থেকে যাবো তবুও আপনার মতো কোন পুরুষের সাথে বিবাহ কেন, (একটু থেমে দাঁতে দাঁত চেপে) কোন প্রেমের সম্পর্কও গড়বো না।

বলেই রাফসান কে পাশ কাটিয়ে হনহন করে চলে যেতে থাকে সোনালী। রাফসান উঠে ভালোভাবে দাঁড়ায়। পিছন ফিরে সোনালীর চলে যাওয়া দেখতে থাকে। সোনালী বড় বড় পা ফেলে হনহন করে চলে যাচ্ছে। রাফসান এক হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে। তার মুখশ্রী নিমেষেই রাগান্বিত হয়ে উঠে। হাতে থাকা ফুল টা উঠিয়ে এক পলকে তাকিয়ে থাকে। বলতে থাকে।

– ভালোভাবে বললাম। তুই শুনলি না। এরপর যা হবে (সোনালীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে) তার জন্য তুই নিজে দায়ী থাকবি‌। নিজে,!

বলেই ফিরে চলে যেতে থাকে তার বাইরে দিকে। ফুলটাকে রাস্তার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। গিয়ে বাইকে উঠে। বাইক স্টার্ট করে সে যেই রাস্তা দিয়ে এসেছিলো সেই রাস্তা দিয়ে চলে যেতে থাকে।

 

 

 

মেম্বার বাড়ির পাকা গোসল খানা। দুপুর বেলা। পাত্রী মানে নিপাকে গোসল করাতে এনেছে শিউলি বেগম আর ইকরার মা মানে নিপার মামি। বিয়ের দিন বলে পাতালের পানি দিয়ে গোসল করতে হয়। এইটা বলে এদের বিয়ের গোসলের রীতি। এরজন্য টিউবওয়েল থেকে পানি চেপে দুই বড় বালতি পানি এনে রাখা হয়েছে গোসল খানায়। নিপার বুক থেকে হাঁটুর নিচ অব্দি কাপড় দিয়ে ঢাকা।

নিপার মামি নিপার মাথায় মগ দিয়ে পানি ঢালতে শুরু করে করে বালতি থেকে। নিপার গাঁয়ে পানি পড়ার সাথে সাথে সে কেঁপে উঠে। তাড়াতাড়ি করে বলতে থাকে‌।

– আরেবাপরে‌। এই, এই পানি তো অনেক ঠান্ডা।

– টিউবওয়েলের পানি যে। তাই।

– ক্যান যে বিয়েতে এই পানি দিয়ে গোসল করতে হয়। মা তুমি একটু গরম পানি করতা আমার লাইগা।

– চুপ ছেড়ি‌। হুনোস নাই বিয়ার দিন টিওবওয়ের নাইলে কুয়ার পানি দিয়া গোসল দেওয়া লাগে। (বলেই শিউলি বেগম এক ছোট্ট শরীর ঘষার জালি তে সাবান মাখাতে থাকে। নিপা দুই হাত দিয়ে গা চেপে ধরে ঠান্ডায় কাঁপছে। শিউলি বেগম সাবান ঘষে নেওয়ার পর সেই নরম জালি টা নিয়ে উঠে দাঁড়ান। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে দেন। এসে নিপার এক হাত টান দিয়ে সোজা করেন। হাত ঘষে দিতে থাকেন সেই নরম জালি দিয়ে।

– আরে আরে মা কী করতাছো ,! (একটু থেমে) আস্তে ঘষো ,! ব্যাথা পাইতাছি।

– তোরে আমি ধরিনা মেলাদিন ধইরা। যহনই গোসলে পাডাই আইয়া দূই ফোডা পানি গাঁয়ে লাগাইয়া ঘরে দৌড় দেস। আইজ চুপচাপ থাকবি‌। ঠিকমতো শরীর ঘইষা দিমু। শরীরে মইলা থাকবো না।

– আমি কী এহনো ছোট আছি,! (একটু থেমে ) মা আস্তে দাও। শরীরের চামড়া ছিলা যাইতাছে।

– তোর চামড়া দিয়া আমি ডুকডুকি বাজামু। চুপ থাক। (বলেই নিপার গাল, পিঠ ঘষে দিতে থাকেন। নিপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। শিউলি বেগম শরীরের উপরের ভাগ ঘঁষে দেওয়ার পর মৌসুমী মানে নিপার মামিকে বলতে থাকেন।

– দেও দেও, পানি ঢালো অহন।

– আপনি সামনে আছেন। (পানির বালতি আর মগ শিউলি বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে) আপনিই ঢালে দেন‌।

– আইচ্ছা দাও। (শিউলি বেগম মগ থেকে পানি উঠিয়ে নিপার মাথায় ঢালতে থাকে। পানি গাঁয়ে পড়া সাথে সাথেই নিপা লাফালাফি করতে থাকে। শিউলি বেগম হনহন করে বলতে থাকেন‌।

– চুপচাপ খাড়া এক যায়গায়। (বলেই আরেক মগ পানি উঠিয়ে ঢালতে থাকেন। নিপা আবার গাঁয়ে পানি পড়ার সাথে সাথেই লাফাতে থাকে। শিউলি বেগম বলে উঠেন)

– এই মাইয়ার বলে বিয়া দিমু আমি, হ্যা। এই মাইয়া গোসল দিতে গেলে এহনো লাফায়। শশুর বাড়ি যাইয়া যে কী করবো আল্লাহ মাবুদ যানে। (একটু থেমে) নিপা, আমার শাড়ি ভিজতাছে কিন্তু,! চুপচাপ কইরা দাঁড়া একখানে‌ (বলেই নিপাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করায় শিউলি বেগম। নিপা হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি মুখের পানি মুছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকে।

– ম,মা। তুমি একটু আস্তে পানি ঢালতে পারোনা,! এমনিতে, এমনিতেই ঠান্ডা পানি। তারউপর আবার নিঃশ্বাস নিতে পারিনা।

– তোর নিঃশ্বাস লওয়াও লাগবো না। শরীরে কত মইলা জমা কইরা রাখছিলি এতোদিন দেখছোস ,!

– থাকুক ময়লা। আমার ঠান্ডা লাগতেছে। আমি ঘরে গেলাম।

– দাঁড়া। শরীর মুছাই দেই আগে। (গামছা হাতে নিয়ে নিপার শরীরের পানি মুছে দিতে দিতে) বুজ্জো ভাবি, নিপারে এই শেষ গোসল দিয়া দিলাম। তারপর তুইলা দিমু ছাগল রে কসাইয়ের হাতে।

– মা, আমি ছাগল ,!

– নাইলে কী ,! ম্যা ম্যাই তো করোছ সবসময়। (একটু থেমে ধীর গলায়) ভাবি। তুমি একটু উঁকি মাইরা দেহোতো বারান্দা আর আঙিনায় কেউ আছে নি। (নিপার দিকে ফিরে) গোসল দেওয়ার পর থেইকা শাড়ির পড়ার আগ পর্যন্ত বউরে কাউরে দেহাইতে নাই‌। তুই চুপচাপ এহন ঘরে যাবি‌। আমি ইকরার হাতে খাওন পাঠাইয়া দিমু। খাইয়া চুপচাপ ঘরের ভিতরে থাকবি। বুজছোস কী কইছি ,!

– আ, আইচ্ছা মা।

– তেমন কেউ নাই শিউলী। আঙিনা প্রায় ফাঁকা। দূরে ডেকোরেটরের লোক কাজ করতেছে। তুমি ওকে আমার হাতে দাও। আমি তাড়াতাড়ি ওকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।

– হ লও‌। (নিপার দিকে তাকিয়ে) ঘরে গিয়ে কম্বলের ভিতরে ঢুকবি। ঠান্ডা যাইবো গা।

 

মৌসুমী বেগম নিপাকে নিয়ে চলে যান গোসলখানার বাইরে। গোসল খানাটা বারান্দায় একপাশে। বেসিনের সাইটেই। শিউলি বেগম ওদের দুজনকে বের করে দিয়ে সামনে এগিয়ে দরজা চাপিয়ে দেন। তারপর ফিরে এসে টেপ ছেড়ে দেন। হাত, পা ধুতে থাকেন। নিজে নিজে বিরবির করে বলতে থাকেন।

– মাইয়াডা লাফালাফি কইরা আমার শাড়ি ভিজায়া লাইছে দেখছো ,! মাইয়াডা কবে বড় হইবো কও দি। দুইদিন পর নিজে একটারে পয়দা কইরা কেমনে যে সামলাইবো ,! (একটু থেমে হাত ধুতে ধুতে) শাড়ি তো ভিজ্জাই গেছে। এই ভিজা শাড়িতে আর বাইরে যাওন ঠিক হইবোনা। আমিও গোসল ডা দিয়া দেই।

বলেই ঝরনা হাতল ঘুরিয়ে গোসলের ঝরনা ছেড়ে দেন শিউলি বেগম। ঝরনার পানি এসে তার উপর পড়ার সাথে সাথে কাপো কাপো ঠোঁটে বলতে থাকেন।

– ও বাবাগো। পানি দেহি বহুত ঠান্ডা। (একটু থেমে) তাড়াতাড়ি একটা ডুব দিয়া বাইরাইতে হইবো। নাইলে বাপু আমি জইমা যামু। নিপার বাহে থাকলে তাও হইতো। একলা একলা বেশিক্ষণ গতর ধওন যাইবো না।

বলেই শাড়ির আঁচল সব খুলে দিতে থাকেন বুকের উপর থেকে। ঝরনার পানি শরীরে পড়তেছে। নিজেও লাফাইতে থাকেন গোসল করতে করতে। বুকে হাত দিয়ে ঝরনার পানির নিচ থেকে সড়ে দাঁড়িয়ে সাবান দানির কাছে যান। সাবান মাখানো কাপড় দিয়ে শরীর ঘষে আবার ঝরনার পানির নিচে আসেন। আবার লাফাইতে থাকেন। যেন এক নিপা ঘরের ভিতর আরেক নিপা লোকান্তরে। নিপা যে এই স্বভাব তার নিজের মায়ের থেকে পাইছে, তা আর বাকি জনগনের বোঝার বাকি রইলো না।

আর আপনারা কী দেখতেছেন। মাইয়া মানুষ গোসল করতাছে আর মন দিয়া পড়া শুরু করেছেন,! মাইয়া মানুষের গোসল দেখলেই শরীলে ভাব আইয়া পড়ে তাইনা ,! যান, পরের পার্ট পড়েন।

 

 

 

রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো রায়হান। তার পিছুপিছু রুমে প্রবেশ করলো আরো ৩ জন ছেলে। ছেলে তিনজন তার কলেজ ফ্রেন্ড। তিনজনের নাম পারভেজ, হাবিব আর ইমতিয়াজ। রায়হান রুমে ঢুকেই লাইট আর ফ্যান এর সুইচ টিপে অন করে দিলো। তিনজন ছেলে ঘরে ঢুকে চারপাশ দেখতে দেখতে বিছানায় গিয়ে বসলো। রায়হান তার রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। সেও গিয়ে তাদের সাথে বিছানায় বসলো। তিনজনের মধ্যে একজন বলতে থাকে।

– বুঝছিস পারভেজ, রায়হানের রুম আর রায়হান দুইজনেই আগের মতোই আছে। একদম বদলায়নি। (হাবিব)

– রায়হান ঠিকই বদলাইছে। ওকে বলতো আমরা কলেজে থাকতে কী সংঘ বানাইছিলাম ,! (পারভেজ)

– কোন সংঘ ? কীসের সংঘ? (অবাক হয়ে বলে রায়হান)

– দেখছিস। বলছিলাম না ভুলে গেছে‌। আরে আমরা ৪ জন চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা করছিলাম। চিরকুমার সংঘ যে বানাইলাম। (একটু থেমে) তোর আর মনে থাকবেই বা কী করে। তুই তো আরো প্রেম করে বিয়ে করতেছিস।(হাবিব)

– সেই যে আমরা সিরাজগঞ্জ চলে গেলাম। তারপর এই প্রথম ও খবর দিলো। তাও আবার কি ,! বিয়ের দাওয়াত। (ইমতিয়াজ)

– রায়হান। ভাই তুই না একসময় বলছিলি মেয়েরা ছলনাময়ী। তুই না বলছিলি বিয়ে না, চিরকাল কুমার থাকবি। আর তুইই কিনা চিরকুমার সংঘের হেড হয়ে প্রেম করে বিয়ে করতেছিস ,! লাইক সিরিয়াসলি,! (পারভেজ)

– আরে আমিও বিয়েটা করতাম না। কিন্তু তোদের ভাবি এতো সুন্দর,! এতো সুন্দর,  যে আমি গলে গেলাম।

– এই যায়গাতেই তো পুরুষ রা হেরে যায়। এই মেয়েরা তার রুপে পাগল করে দিয়ে আমাদের দিয়ে তাদের খুশি হাসিল করে নিয়ে শেষ, তারপর আর খোঁজ পাওয়া যায় না।

– আরে না। নিপা ওরকম মেয়ে না। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। ওর ব্যবহার আচার অনেক উঁচু মানের। (রায়হান)

– ইমতিয়াজ, ভাই তুই আমারে ধর। রায়হানের মুখ থেকে এসব কী শুনতেছি।

– ওর কথা বাদ দে। এতোদিন ধরে যে প্রেম করছে সেটার খবর পর্যন্ত আমাদের জানায় নি। (রায়হানের দিকে তাকিয়ে) তোদের প্রেম কত বছরের ?

– উমম, এইতো ১ মাসের মতো হবে।

– হাবিব, বুঝছিস। মেয়েটা রায়হানকে পুরা পাগল বানায় ফেলছে। মাত্র এক মাসের প্রেমে বিয়ে করতেছে আমাদের রায়হান ,! মানে তুই বিষয় ডা বুঝতেছিস ,! আমাদের রায়হান কী পরিমাণ বদলাইছে ,!

– আজকে যদি ও বিয়ের দাওয়াত টা না দিতো তাইলে তো জানতেই পারতাম না যে রায়হান আমাদের চিরকুমার সংঘ থেকেও অবসর নিছে।

– ঐসব চিরকুমার সংঘ বাদ দে। তোরাও ভালো পাত্রী দেখে বিয়ে করে ফেল। একলা একলা কী দিন কাটে এমনে ,! (রায়হান)

– এই রায়হানই আমাদের কলেজে থাকতে বলছিলো একলা চলতে, কারো উপর ভরসা না করতে। আমরা ওর কথা শুনে মেয়েদের উপর থেকে ভর্সা হারাইছি। এখন দেখি ও নিজেই আমাদের বুঝাইছে ‘কারো’ কথাটার মধ্যে ও নিজেও সামিল।

– বাদ দে ঐসব। ও বিয়ে করছে মনে হয় কয়েকদিনের জন্য। বাপের কী কম টাকা আছে নাকি। মাসে মাসে একটা বউ হবে। নাকিরে রায়হান।

– বাল,! আমার নিপাই প্রথম নিপাই শেষ।

– ইশশ্,! প্রেম কী জমছে রে ওদের ,! (একটু থেমে) আচ্ছা ভাই যা, বাদ দিলাম সেই সব বিষয়। এখন বল, তুই বাইর হবি কখন ? মানে বরযাত্রী যাবে কখন ?

– এইতো সন্ধ্যার দিকে। পোনে পাঁচ টা বা ৬ টার দিকে বাসা থেকে বের হবো।

পারভেজ তার হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। তারপর রায়হানের দিকে ফিরে বলে।

– এখন তো ৫ টা ৩ বাজে। তুই রেডি হবি কখন ! আর তোর রুম সাজাবে না ? মানে বাসর রাত সাজাবে না ?

– রুম সাজাবার লোকদের আসার কথা। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো।

– আর তোর শেরওয়ানি কই। যেইটা পড়ে বিয়ে করতে যাবি ?

– ঐটা চাচ্চু আনতে গেছে। হয়তো রাস্তায় আছে।

– হাতে আর মাত্র ১ ঘন্টা। এরমধ্যে রেডি হইতে পারবি ?

– কলেজের দিনে পরীক্ষা শুরু হইতো ১০ টায় আর আমি ঘুম থেকেই উঠতাম ৯ টা ৫০ এ। কারেন্টের গতিতে রেডি হবো। ঐটা কোন ব্যাপারই না।

– এখন কী তুই কলেজের পরীক্ষা দিতে যাইতেছিস নাকি। ধীরে সুস্থে সাজাইতে হবে তোকে। নাইলে তখন বউ বলবে বর পছন্দ না, বিয়ে করবো না।

– আমি যদি শুধু আন্ডারপ্যান্ট পড়েও যাই তাও নিপা আমাকে বিয়ে করবে।

– তাইলে আজকে ঐটা পড়েই যা। ইতিহাসের পাতায় নাম লেখা।

(বলেই হেঁসে উঠে তিনজন। তখনই ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসে। ওপাশ থেকে শাহেদ সাহেবের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। রায়হান তার বন্ধুদের বলে‌

– ঐযে চাচ্চু মনে হয় চলে আসছে। তোরা বস, আমি দেখতেছি।

(বলেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় রায়হান। হেঁটে হেঁটে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজা খুলে। দরজার ওপাশে থাকা শাহেদ থাকে একটা মাঝারি সাইজের বক্স হাতে ধরিয়ে দেয়। বলতে থাকে।

– তাড়াতাড়ি পরে রেডি হয়ে নে। ভাইজান কিন্তু বলছে ৬ টার আগেই বের হবে।

– কয়টা গাড়ি যাবে ?

– ২ টা। গ্রামের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাবো। ২ টার বেশি গাড়ির দরকারও পড়বে না। তুই এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে আয়।

– কে কে যাবে।

– সুরাইয়া তো যাইতে পারবেনা। সাথীকে বললাম আমাদের সাথে যাইতে। ও বলতেছে ওর কমড়ের ব্যাথা বলে সকাল থেকে বাড়ছে‌। এইজন্য আলিশা, সাদিক, ভাবি, ভাইজান আর তুই আমি। আর পাশের ২-৩ টা বাড়ি থেকে যাবে কয়েকজন। এই আরকি।

– ওহহ, আচ্ছা ঠিক আছে আমি রেডি হয়ে নিচে যাচ্ছি।

– হ্যা, তাড়াতাড়ি আয়।

শাহেদ সাহেব চলে যান দরজার সামনে থেকে। রায়হান ঘরের দরজা লাগিয়ে ভিতরে চলে আসে। ৩ জন একে অপরের সাথে কথা বলছিলো‌। তাদের মাঝে বিছানায় বক্সটা রেখে বলতে থাকে।

– এইখানে আমার শেরওয়ানি টা আছে। দেখ‌।

– এতো বড় বক্স ক্যান ?

– আরো যানি কী কী আছে।

তিনজন মিলে বক্সের উপর থেকে কসটেপ খুলতে থাকে। বক্সের উপরের পারদ খুলে ফেলে। তারপর বক্সটা উল্টো করে ধরে বিছানার উপর। সব জিনিস বিছানায় বের হয়ে যায়। একটা শেরওয়ানির প্যাকেট। আতর, রুমাল, কাঁধে দেওয়ার জন্য একটা কাপড়, আর বরের টুপি। বাকিসব সাইডে রেখে শেরওয়ানির পাকেট টা খুলতে থাকে তারা। রায়হান বিছানার পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে। তারা তিনজন পাকেট খুলে শেরওয়ানি টা বের করে। ধূসর রঙের শেরওয়ানি টা। অনেক কারুকাজ করা। বেশ ভারিও। হাবিব অবাকের সুরে বলতে থাকে।

– অনেক সুন্দর তো রে,! কত নিছে ?

– ১৫ হাজার।

তিনজনই চকিতে রায়হানের দিকে ফিরে তাকায়। পারভেজ বলে।

– ১৫ ,!

– হ্যা। ঢাকা থেকে অর্ডার দিয়ে বানানো। ডিজাইন আমি সিলেক্ট করে দিছিলাম আগেই‌। তারপর আজকে ডেলিভারি দিলো। চাচ্চু এইটাই রিসিভ করতে দিনাজপুরে গেছিলো।

– আমারে পার্ট টাইম জবের মাসিক স্যালারি ১৬। আর ও শেরওয়ানিই পড়তেছে ১৫র ,! ভাবা যায় ,! (পারভেজ)

– বিজনেস ম্যান হইছে এখন। টাকা তো এখন রায়হানের হাতের ময়লা ,! (ইমতিয়াজ)

– আরে না। বাবাই তো বলতেছিলো এতো দামের না নিতে। কিন্তু আমি বিয়ে তো জীবনে একবারই করবো। একটু প্রিমিয়াম জিনিস দিয়ে না করলে কী হয় ,! নিপার বিয়ের শাড়িটাও আমিই কিনে পাঠাইতে চাইছিলাম। ও নিজেই না করছে। ওর বড় ভাই বলে ঢাকা থেকে বিয়ের শাড়ি নিয়ে আসবে।

– সব বড়লোকদের কারবার বাপু ,!

– আচ্ছা তোরা থাক। আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি। তারপর রেডি হয়ে একসাথে বেরোবো।

– আচ্ছা। যা তাইলে।

রায়হান একটা তোয়ালে হাতে নিয়ে চলে যেতে থাকে গোসলখানার দিকে। হাবিব বিছানা থেকে উঠে বেলকনির দিকে যায়। বেলকনির দরজা খোলার চেষ্টা করে, কিন্তু খুলতে পারেনা। রায়হানকে উদ্দেশ্য করে হাঁক দিয়ে বলতে থাকে।

– রায়হান, ব্যালকনির গ্লাসের দরজাটা কীভাবে খোলে রে ,!

– মাঝখানে একটা সবুজ রঙের গর্ত আছে। ঐটায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে আঙ্গুল নিচের দিকে নামা,! (বাথরুমে দরজায় ঢুকতে ঢুকতে রায়হান বলে)

হাবিব গর্ত টা দেখতে পায়। একদম আঙ্গুল এর সাইজের। সে কথা মতো আঙ্গুল ঢুকিয়ে নিচের দিকে করে। বেলকনির দরজার লক খুলে যায়। হাত দিয়ে গ্লাস ডোর দুইটাকে খুলে দিয়ে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। বেশ ভালোই বাতাস আসছিলো‌। ঐ দূরে সূর্য ডুব দিচ্ছে। নিচের ফুলের বাগান থেকে ফুলের সুবাস। একটা বড় গাছ আছে ব্যালকনি ঘেঁষে। গাছের ছায়ায় পড়েছে ব্যালকনির বারান্দা টা। একটা সুন্দর মন ভালো করার মতো যায়গা। হাবিব রেলিং ধরে চারপাশ মাথা বাড়িয়ে দেখতে থাকে। এখান থেকে পিছনের পুকুরের কিছু অংশও দেখা যায়। একটা মনের মতো কমপ্লিট বাড়ি বললেও ভুল হবেনা এটাকে ,!

 

 

 

রাতের আঁধার নেমেছে হয়েছে অনেকক্ষণ। মেম্বার বাড়ি এই আঁধারের মধ্যেও এক ঝোনাকি পোকার মতো ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি করছে নানা রঙের আলোয়। অনেক মেহমান রা এসেছে। গাঁয়ে হলুদের স্টেজ টার উচ্চতা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। ঐটার ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। ওখানে এসে বর বসবে। এদিকে বাড়ির পিছনের বড় প্যান্ডেলেও রেডি। সেখানে বরযাত্রীরা খেতে বসবে। পুরো বাড়ি বরকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত। বাড়ির বারান্দার গ্রীল গুলোতেও ছোট ছোট নানা রঙের লাইট লাগানো হয়েছে।

নিপার রুম। নিপা বিছানায় বসে আছে বউয়ের সাজে। তার রুম টাও সাজানো। বিছানায় বিভিন্ন ফুল দেওয়া, চারপাশের দেওয়ালও নানা রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো। নিপার গাঁয়ের গহনা লাইটের আলোয় ঝিলিক ফেলছে। গা ভর্তি গহনা তার। লাল বেনারসীর সাথে গহনা গুলো দারুন মানিয়েছে তাকে। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। তার একপাশে বসে আছে ইকরা আর জিনিয়া। জিনিয়া এতোদিন তার মামা বাড়ি গিয়েছিলো। তাই এতোদিন আপনারা তাকে কোন পর্বেই দেখেননি। আজ সকালে সে এসেছে মামা বাড়ি থেকে। আর এসেই তার বান্ধবীর বিয়েতে উপস্থিত।

নিপার আরেকপাশে বসে আছে দিথী আর সামিহা। ইকরা খয়েরী রঙের একটা লেহেঙ্গা পড়েছে। দিথী আর সামিহার পড়নে শাড়ি। দু’জন আজ গাঁয়ে হলুদের থেকেও বেশি সেজে এসেছে।

নিপাকে পার্লারে নিয়ে যায়নি তারা। পার্লার থেকে একজনকে বাসায় এনেছিলো। এনে হালকা মেকআপ করেছে শুধু। নিপা এমনিতেই দারুন সুন্দরী। তার প্রাকৃতিক গরন টাই মেকআপের থেকে অনেক বেশি ফুটে উঠে। তারপরও হালকা মেকআপ করানো হয়েছে তাকে। নিপার মাথা নিচু করে বসে আছে। মুখে এক চিলতে হাসি। মাথায় ঘোমটা। তার পাশে বসে থাকা দিথী তাকে বলে।

– কীরে দোস্ত। এতো মুচকি মুচকি হাসতেছিস ক্যান ,! শরম পাইতেছিস নাকি,!

– পাবেনা একটু ,! আজকে না ওর বিয়ে। তার চেয়ে বড় কথা। আজকে তো ওর বাসর। (ইকরা)

– শোন নিপা। কালকে যখন আসবি, তখন আমাদের কিন্তু তোর বাসর রাতের কাহিনী শুনাইতে হবে,! (দিথী)

– ধুরর, কীসব বলতেছিস তোরা। (নিপা)

– ইশশ আমার লজ্জাবতীরে। সবার আগে বিয়ে করতেছিস আবার লজ্জায় মুখ লাল করে ,! (ইকরা)

– তোরা দুইটা খুব পাজি হইছিস।

– একটু আধটু হওয়া লাগে বুঝছিস। এখন মজা না নিলে কখন নিবো ,! যখন তোর ৩-৪ টা বেবি হবে তখন ,! (দিথী)

– তোরা একটু চুপ করলি ,! (একটু থেমে) এমনিতেই আমার মনে কেমন যানি ভয় ভয় লাগতেছে ,! তার উপর শুরু করছিস তোরা ,! (নিপা)

– দেখছো ইকরা। বউ আমাদের ভয় পাওয়া শুরু করে দিছে,! হ্যা। (দুষ্টু স্বরে) ভয় পায়না জান। ভয় পায়না,!

বলেই সবাই হেসে উঠে।  নিপা বলে উঠে।

– আরে আমি সেই ভয়ের কথা বলতেছি না। আমার মন টা কেমন যেন করছে। হঠাৎ করেই কেমন যেন লাগতেছে।

– হইছে বাপ। আর কথা ঘুরাইস না। আসল কথা বলযে তোর বাসর রাতের জন্য ভয় লাগতেছে। (বলেই দিথী জোরে জোরে হাসতে থাকে)

– জিনিয়া, দেখছিস এইটা বলে আমাদের দিথী‌। যেই দিথীর সামনে হালকা একটু লুচু কথা বললে লজ্জা পাইতো সেই দিথী আজকে এইসব বলে। (নিপা)

– ঐতো। প্রেমে পড়ছে তোর মতো। (জিনিয়া)

তখনই বাইরে থেকে কোলাহল শোনা যায়। গাড়ি থামার শব্দও শোনা যেতে থাকে। “বর এসেছে, বর এসেছে” কথায় বাইরের পরিবেশ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ইকরা উৎসুক হয়ে বলতে থাকে‌।

– ঐদিকে মনে হয় বর চলে আসছে। সামিহা, তাড়াতাড়ি পার্টি স্প্রে নিয়ে আসো। (বিছানা থেকে উঠে যেতে যেতে) আমার টাও এনো‌।(বলেই হনহন করে বাইরে চলে যায় ইকরা। তার পিছুপিছু দৌড় লাগায় জিনিয়াও। দিথীর পাশ থেকে সামিহাও উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে তাদের পিছু পিছু চলে যায়। তবে দিথী যায় না। সে নিপার সাথে আরো যেন কী কথা বের করে। রুম থেকে সবাই চলে যায়। শুধু থেকে যায় নিপা আর দিথী। দুইজনেই কথা বলতে থাকে একে অপরের সাথে। আর হাসতে থাকে।

বাড়ির আঙিনায় থাকা সবাইও একে একে চলে যেতে থাকে বাইরের দিকে। বর আসছে সেদিকে দেখতে। ইকরা আর সামিহারা আগে ভাগেই দৌড় লাগিয়েছে। তারা গিয়ে বরের গেইট আটকিয়ে টাকা নিবে। বরের গেইট আটকানোর কথা বাড়ির বাইরের আঙিনায়। তাই সেদিকেই সবাই গিয়েছে। আঙিনা যেন মুহুর্তের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায়। তখনই হঠাৎ এক মেয়ে নিপার রুমের দরজার বাইরে অন্ধকার থেকে উদয় হয়। হাতে এক ‌লম্বা ছুরি। মেয়েটা দৌড়ে নিপাদের রুমের ভিতর ঢুকে। জোরে শব্দ করে মুহূর্তের মধ্যেই ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

 

চলবে ,

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৪৯

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– ঐদিকে মনে হয় বর চলে আসছে। সামিহা, তাড়াতাড়ি পার্টি স্প্রে নিয়ে আসো। (বিছানা থেকে উঠে যেতে যেতে) আমার টাও এনো‌।(বলেই হনহন করে বাইরে চলে যায় ইকরা। তার পিছুপিছু দৌড় লাগায় জিনিয়াও। দিথীর পাশ থেকে সামিহাও উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে তাদের পিছু পিছু চলে যায়। তবে দিথী যায় না। সে নিপার সাথে আরো যেন কী কথা বের করে। রুম থেকে সবাই চলে যায়। শুধু থেকে যায় নিপা আর দিথী। দুইজনেই কথা বলতে থাকে একে অপরের সাথে। আর হাসতে থাকে।

বাড়ির আঙিনায় থাকা সবাইও একে একে চলে যেতে থাকে বাইরের দিকে। বর আসছে সেদিকে দেখতে। ইকরা আর সামিহারা আগে ভাগেই দৌড় লাগিয়েছে। তারা গিয়ে বরের গেইট আটকিয়ে টাকা নিবে। বরের গেইট আটকানোর কথা বাড়ির বাইরের আঙিনায়। তাই সেদিকেই সবাই গিয়েছে। আঙিনা যেন মুহুর্তের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায়। তখনই হঠাৎ এক মেয়ে নিপার রুমের দরজার বাইরে অন্ধকার থেকে উদয় হয়। হাতে এক ‌লম্বা ছুরি। মেয়েটা দৌড়ে নিপাদের রুমের ভিতর ঢুকে। জোরে শব্দ করে মুহূর্তের মধ্যেই ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। ঘরের ভিতর থেকে আর কোন আওয়াজ আসেনা। পিনপন নিরবতা। বাইরের বরযাত্রীর গাড়ির শব্দ আর কোলাহল মৃদু ভাবে শোনা যায় শুধু। তখনই হঠাৎ দরজার ভিতর থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া যায়। যেন কেউ ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছে। কেউ ধাক্কাধাক্কি করতেছে‌।‌ ঘুষি মারতেছে। এবং তখনই হঠাৎ ছুরি চালানোর শব্দ। কারো মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে কেউ ছুরি চালাচ্ছে। গোঙানির শব্দ পাওয়া যায়। অনেক বার ছুরির ‘কচাত কচাত’ শব্দ পাওয়া যায়‌। মাটিতে কোনো দেহের ধপ করে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ হয়। হাত দিয়ে মাটিতে দাপাদাপি করারও আওয়াজ আসতে থাকে। হঠাৎ আবার পিনপন নিরবতা। কোন শব্দ নেই। চারপাশের প্রকৃতি যেন একদম থেমে গিয়েছে। গাছের পাতাটাও যেন থমকে গিয়েছে সময়ের সাথে সাথে।

ঘরের দরজা খুলে যায়। দিথী কাঁধে এক মেয়ের লাশ নিয়ে ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটা আর কেউ নয়। সেই মেয়েটাই, যে ছুরি হাতে ভিতরে ঢুকেছিলো। দিথীর চোখে মুখে রক্তের ছিটে, এক হাত দিয়ে মেয়ের লাশ টা কাঁধে ধরে আছে আরেক হাতে সেই লম্বা ছুরিটা। সেখান থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে ফ্লোরে। দিথী ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে বিছানায় বসে থাকা নিপার দিকে তাকায়। নিপার চোখ মুখে ঘোর আতঙ্ক। চোখ যেন পুর্নিমার চাঁদের মতো বড় বড় হয়ে আছে। দিথী নিপার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকায়। ধীর গলায় বলতে থাকে।

‘ যা দেখেছিস, সব ভুলে যা। বাইরে রায়হানরা এসেছে। তোকে এই রকম আতঙ্কে দেখলে ওরা অন্য কিছু ভাববে। (একটু থেমে) আমি এই লাশ টা কোন একখানে ফেলে দিয়ে আসি। আর, আর রক্ত গুলো। (নিপার দিকে ফিরে তাকিয়ে) মা এসে পরিস্কার করে দিবে। ভয় পাসনা একদমই। ভয় পেলি, তো হেরে গেলি,! ‘

বলেই দরজার সামনে থেকে হেঁটে গিয়ে বারান্দা থেকে নামে‌। লাশের ঝুলতে থাকা হাত আর ছুরি থেকে এখনো ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে। দিথী বারান্দা থেকে আঙিনায় নামে। নেমে চারপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে রান্নাঘর আর বাড়ির দেওয়ালের মাঝে যেই ছোট্ট গলি আছে, যেটা দিয়ে পিছনের প্যান্ডেল আর বাইরের দিকে যাওয়া যায়, সেদিকটায় পা বাড়ায়। সেদিকের ঘন অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যেতে থাকে।

 

নিপার শরীর ভয়ে কাঁপছে। এতোক্ষণ ও কী দেখলো এসব। দিথী ,! না না। দিথী এটা কীভাবে করতে পারলো। তখনই হঠাৎ তার নজর যায় ফ্লোরের দিকে‌। ফ্লোরের রক্ত গুলো নিজে থেকেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। নিপা ভয়ে পিছিয়ে যায়। তার বুকের হ্রদকম্পনের আওয়াজ নিস্তব্ধ ঘরে প্রতিফলিত হচ্ছে। সব রক্ত গুলো একদম গায়েব হয়ে যায়। ঘরের সবকিছু আগের মতো হয়ে যায়। কেউ দেখলে যেন বলবেই না এই ঘরে একটু আগেই একটা খুন হয়েছে। নিপা কাপো কাপো হাতে বিছানার পাশের টেবিলের দিকে হাত বাড়ায়। একটা জগ আর একটা খালি গ্লাস ছিলো। সে তাড়াতাড়ি জগ থেকে গ্লাস টায় পানি ঢেলে নিয়ে এক ঢোকে সম্পূর্ণ টা খেয়ে ফেলে। তার মুখের ঘাম গুলো মুছতে থাকে হাতে থাকা রুমাল দিয়ে। তখনই তার চোখ যায় হাতের উল্টো পিঠে। এক ফোঁটা রক্ত পড়ে আছে। হয়তো দিথী যখন মেয়েটাকে মারছিলো তখন ছিটকে এসেছে। নিপা তাড়াতাড়ি করে রুমাল টা দিয়ে রক্ত টাকে মুছে ফেলে।

এক হাত বুকে দিয়ে চোখ বন্ধ করে। নিজের মস্তিষ্ক কে ঠান্ডা করতে থাকে। তার এখন প্যানিক হওয়া যাবেনা। বরযাত্রীর লোকজন এসেছে। তাদের সামনে একদমই নার্ভাসনেস আনা যাবেনা। নিপা চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নেয়। ধীরে ধীরে সেই শ্বাস ছাড়ে। কলেজের এক স্যারের দেওয়া টোটকা। মাথা প্রেশারে থাকলে কিংবা প্যানিক করলে এভাবে মস্তিষ্ককে ঠান্ডা করতে হয়। নিপা মন থেকে একটু আগে ঘটা সমস্ত ঘটনা মুছে ফেলতে চেষ্টা করে। বিরবির করে বলতে থাকে।

‘কিচ্ছু হয়নি নিপা। কিচ্ছু হয়নি। তুই একদম রিল্যাক্স থাক। কিচ্ছু হয়নি’

 

বাড়ির বাইরের আঙিনা। রাস্তা থেকে আঙিনায় আসার যায়গাটাতে একটা লাল ফিটা বেঁধেছে সামিহা, জিনিয়া মিলে। বরযাত্রীরা গাড়ি থেকে নামছে। তারা দুজন তাড়াতাড়ি হাত চালাচ্ছে যাতে ঠিকমতো গেট ধরতে পারে। বরযাত্রী হেঁটে হেঁটে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। লাল ফিতার এপাশে দাঁড়িয়ে পড়ে ইকরা, সামিহা আর জিনিয়া। তাদের পিছনে দাঁড়িয়েছে কনে পক্ষের বাড়ির বাকি লোকজন আর আহনাফ, আফাজরা। তবে শিউলি বেগম, মতিন মেম্বার, রিয়াদ আর শাহারিয়ারা বাড়ির পিছনের প্যান্ডেলে আছে। করে নিচ্ছে তাদের শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি।

ইকরারা মিষ্টি, আর ফলের রসের গ্লাস একটা ট্রেতে করে নিয়ে দাঁড়িয়েছে। বর যাত্রীর লোকেরা এসে ফিতার সামনে দাঁড়ায়। সবার সামনে ছিলো রায়হান। গায়ে নতুন শেরওয়ানি, মাথায় টোপর, আর মুখে এক সাদা রুমাল ধরে আছে। তার এক পাশে তার দুই বন্ধু হাবিব আর ইমতিয়াজ। আরেকপাশে তার চাচাতো ভাই সাদিক আর আরেক বন্ধু পারভেজ। তবে নজরুল সাহেব আর সুমনা বেগম এখনো গাড়িতেই বসে আছেন। তারা যেন চাচ্ছিলেন এসব ঝামেলা শেষ হওয়ার পর যখন গেইট ছেড়ে দিবে তখন বেরোবেন।

ইকরা হাসি মুখে একটা মিষ্টি কাঁটা চামচে গেঁথে রায়হানের দিকে এগিয়ে দেয়। রায়হান মুখের রুমাল টা সড়িয়ে মিষ্টি টা মুখে নিয়ে নেয়। ইকরার পাশে দাঁড়ানো সামিহাও একটা মিষ্টি চামচে গেঁথে সাদিকের দিকে এগিয়ে দেয়। সাদিকও রায়হানের মতো সরল সোজা ভাবে মিষ্টি টা মুখে নিতে যায় তখনই সামিহা মিষ্টি টা টেনে নেয়। আবার মিষ্টির চামচ টা এগোয়। সাদিক খাওয়ার আগ মুহূর্তে আবার টেনে নেয়। এবার আবার এগোয় তখনই সাদিক সামিহার হাত ধরে মিষ্টি টা নিজের মুখে পুরে নেয়। খেতে খেতে হাসতে থাকে সামিহাকে দেখিয়ে দেখিয়ে। সামিহা চোখ সরুসরু করে তার দিকে অভিমানের সুরে চেয়ে থাকে। এদিকে বিয়ের ভিডিও করতে আসা ক্যামেরা ম্যান লাল ফিতার সাথে ঘেঁষে খুঁটির সাথে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষের সব কার্যকলাপ রেকর্ড করছে। ইকরা রায়হানের দিকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয়। রায়হান অর্ধেক গ্লাস খেয়ে বাকিটা আর খায় না। ইকরা গ্লাস আর প্লেট তার পিছনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধের হাতে দিয়ে সামনে তাকায়। বলতে থাকে।

– এবার আসল কাহিনী। ২৫ হাজার দেন। নাইলে গেইট ছাড়বো না।

তখনই সামিহা ইকরার পেটে গুঁতো দিয়ে তার কানের কাছে এসে বলে।

– এই, খালি ২৫ ক্যান। ডবল বল ডবল।

– না না ২৫ না। ৫০ হাজার দেন।

রিয়াদের পাশে দাঁড়ানো বন্ধু দুটো ৫ টাকার কয়েন হাতে নিয়ে তাদের সহ সবাইকে দেখিয়ে ইকরার হাতে ধরিয়ে দেয়। ইকরা চোখ বড় বড় করে সেই কয়েন গুলো আবার ছেলেটার হাতেই ফিরিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ বলে।

– আচ্ছা কয়েন নিবানা। তাইলে দাঁড়াও নোট দিচ্ছি।

বলেই পকেট থেকে ৫ টাকার নোট বের করে ইকরার দিকে এগিয়ে দেয়। ইকরা বলে।

– খালি ৫ না। ৪ টা শূন্য সহ পাঁচ অংকের টাকা লাগবে।

– আচ্ছা শুনো। এই নাও ৫ হাজার। আর গেইট ছেড়ে দাও। (বলেই হাবিব একটা ৫ হাজার টাকার নোট ইকরার দিকে এগিয়ে দেয়। রায়হান মুখে রুমাল চেপেছে ভালোই হয়েছে। নাইলে এদের কান্ড কারখানা দেখে তার খালি হাসি পাচ্ছে।

ইকরা বলে,

– ৫ না। আমাদের ৫০ হাজার লাগবে। নাইলে আজকে সারারাত এইখানেই দাঁড়ায় থাকতে হবে।

– আচ্ছা যাও, আরো ৫ হাজার বাড়ায় দিলাম। এই নাও ১০ হাজার।

– না, সাথে আরো ৪০ হাজার যোগ করে তারপর দেন।

রায়হান হেলে হাবিবের কানে কানে বলে‌,

– দিয়ে দে না।

– আমি কই পাবো এতো গুলা।

– কী মিস্টার, কী ফিসফিস করতেছেন। আমাদের ৫০ লাগবে মানে ৫০ই। নাইলে গেইট ছাড়া হবেনা। (সামিহা)

– আচ্ছা এই নাও, আরো ১০। এইবার তো ছেড়ে দাও‌। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করতেছে।

– না না না। (রায়হানের দিকে তাকিয়ে) দুলাভাই,! আপনি দেন। ওরা কথা শুনতেছে না।

রায়হান কী করবে বুঝে পায় না। বিয়ে করতে এসেও নানা ঝামেলা‌। রায়হান এক হাত দিয়ে রুমাল ধরে আরেক হাত দিয়ে মানিব্যাগ বের করে। বের করে হাবিবকে দেয়। হাবিব সেখান থেকে আরো কিছু ৫শ টাকার নোট বের করে গুনতে থাকে। তখনই ইকরা সব টাকা হাবিবের হাত থেকে হাতিয়ে নেয়। হাবিব আচমকা হাতিয়ে নেওয়ার বোকা বনে যায়। ইকরা হাতে টাকা গুলো নিয়ে সামিহাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

– এই দে দে , কাঁচিটা দে।

সামিহা একটা ফুল লাগানো কাঁচি প্লেটে করে রায়হানের দিকে এগিয়ে দেয়। রায়হান কাঁচি টা নিয়ে লাল ফিতা কেটে ফেলে। সবাই মিলে হাত তালি দিতে থাকে। তখনই সামিহা আর ইকরা মিলে পার্টি স্প্রে ছিটিয়ে দিতে থাকে বর পক্ষের উপর। বর পক্ষের হয়ে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কোথা থেকে জানি আলিশা বের হয়ে আসে। আলিশা একা আর এদিকে ২-৩ জন। আলিশা তাদের উপর দিতে গিয়ে কে জানি তারই মুখে অনেকটা পার্টি স্প্রে মেরে দৌড় দেয়। আলিশা আর কিছু না দেখতে পেয়ে পার্টি স্প্রে প্রতিপক্ষের উপর মারতে গিয়ে তারই পাশে দাঁড়ানো রায়হানের বন্ধু হাবিবের মুখে মেরে দেয়। হাবিব তো হঠাৎ নিজ দেশের আক্রমণে থতমত খেয়ে মুখ ভরিয়ে ফেলে ফোম দিয়ে। দারুন মজা হয় দুই পক্ষের মধ্যে। বরকে রাস্তা ফাঁকা করে দেওয়া হয়। রায়হানের উপর তেমন স্প্রের ফোম পড়েনি। সে আর তার বন্ধুরা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।

এদিকে গেইট ছেড়ে দিতে দেখায় গাড়ি থেকে নামেন রায়হানের বাবা-মা, সুমনা বেগম আর নজরুল সাহেব। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যান বাড়ির দিকে।

 

বরকে বসানো হয় স্টেজে। তার দু পাশে তার বন্ধুরা আর সাদিক বসেছে। শাহারিয়া আর বাকিরা যারা পিছনের প্যান্ডেলে ছিলো তারাও সামনে চলে আসে। আঙিনা আবার হৈ হৈ রৈ রৈ অবস্থায় পরিনত হয়। মতিন মেম্বার, শিউলি বেগমরা সুমনা আর নজরুল সাহেবের সাথে কুশন বিনিময় করতে থাকেন আঙিনায়। বাকি আত্মীয় স্বজন রাও বরযাত্রীদের সাথে কথা বলতে থাকে। বেশ সুন্দর একটা পরিবেশ।

নিপার ঘরে ইকরা, সামিহা আর জিনিয়াদের দেখতে পাওয়া যায়। তারা গেইট ধরার সময় কী কী করলো তা নিপাকে বলে শোনাচ্ছে। নিপা শুনছে আর হাসছে। নিপার পাশে বসে টাকা গুলা গুনছে ইকরা।

রান্না ঘর আর বাড়ির দেওয়ালের মাঝের গলিটার অন্ধকার এখন লাইটের আলোয় কেটেছে। আত্মীয়-স্বজন, মেহমান দের পদচারণায় মুখরিত এখন যায়গাটা। দিথী হেঁটে হেঁটে সেই গলি দিয়ে বাড়ির ভিতরের আঙিনায় আসে। গায়ে এখন শাড়ি নয়, থ্রী পিস পড়া। মাথার চুল ভিজা, মুখের মেকআপ এখন নেই। দিথীর মুখশ্রী ছিলো একদম গম্ভীর। সে হেঁটে হেঁটে গিয়ে বারান্দায় উঠে। বারান্দার নানা যায়গায় খন্ড খন্ড হয়ে আত্মীয়রা গল্প করছিলো। সে গিয়ে দাঁড়ায় নিপার দরজার সামনে। বাকিরা নিপার দিকে ফিরে থাকায় তাদের মুখ ছিলো দরজার বিপরীতে। কিন্তু নিপার মুখ ছিলো দরজার দিকে। তার মুখ এখন হাসৌজ্জল। দিথীর দরজার আড়াল হতে নিপার দিকে তাকায়। নিপার চোখ তৎক্ষণাৎ দরজার আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসা দিথীর মুখয়বের দিকে যায়। মুহুর্তের মধ্যেই তার মুখের হাঁসি যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। দিথী তার এক আঙ্গুল ঠোঁটে রেখে চুপ থাকার ইঙ্গিত করে। নিপা ভয়ে ভয়ে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। দিথী তখনই সড়ে যায় দরজার আড়াল থেকে। নিপা আবার তার মুখের মুড চেন্জ করে হাসৌজ্জল করে। আর সামিহা, জিনিয়ার কথা শুনতে থাকে।

দিথী বারান্দা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যায় বারান্দার শেষ মাথায় থাকা রুমটার দিকে। রুমটা ফুলমতির। আর এদিকটায় কেউ আসবেও না।

দিথী গিয়ে রুমটার দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। তারপর দরজা লাগিয়ে দেয়। হেঁটে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে। তাকিয়ে নিজের মুখের অবয়বকে দেখতে থাকে। গম্ভীর মুখখানা একদম শুকনো হয়ে আছে‌। দিথীর তার গালে হাত দেয়। দেখে মুখের কোথাও কিছু লেগে আছে কী না। দেখে কিছু নেই লেগে। সে লাশটা ফেলে দিয়ে গোসল করে তারপর এবাড়িতে এসেছে। তার চোখ, মুখে রক্তের ছিট পড়েছিলো। গোসল ছাড়া এবাড়িতে সে কীভাবে আসতো।

দিথী ডেসিন টেবিলে রাখা একটা ক্রিম উঠিয়ে দেখতে থাকে। স্বাধারণ ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম। ক্রিমের প্যাকেটের ছিপি খুলে হাতে হালকা ক্রিম নিয়ে মুখে মাখতে থাকে। ভালোভাবে মুখে মেখে নিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে। তারপরও আয়নার পাশ থেকে হেঁটে বিছানার দিকে যায়। বিছানার পাশেই ফ্যানের সুইচ। ফ্যান টা ছেড়ে রেগুলেটর ঘুড়িয়ে ফুল স্পিড করে দেয়। উঠে বসে বিছানার মাঝ খান টায়। মাথার চুল গুলো হাত দিয়ে ভালোভাবে ছেড়ে দেয় বাতাসে। যাতে ভিজে চুলের পানি গুলো তাড়াতাড়ি শুকোতে পারে‌। তারপর বসে বসে এক হাত দিয়ে আরেক হাতের নখ খোঁচাতে থাকে। মনটাকে শান্ত আর নির্মল করতে থাকে।

 

২০ মিনিট পর,

 

বরযাত্রীর সবাইকে বাড়ির পিছনে করা বড় প্যান্ডেলে খেতে বসানো হয়েছে। আর এদিকে বরদেরকে স্টেজেই খাবার সাজিয়ে দেওয়া হবে। রায়হান চুপচাপ বসে আছে। তার পাশের বন্ধুরা আর চাচাতো ভাই একে অপরের সাথে গল্প করছে। রায়হানের মন চাইছে একবার গিয়ে নিপাকে দেখে আসতে। কিন্তু বর স্টেজ ছেড়ে উঠে বউকে দেখতে গেলে লোকজন কী ভাববে সেই ভেবে আর যাচ্ছেনা। তখনই দেখে দুইটা মেয়ে একটা বড় মেলামাইনের প্লেটে। বড় বলতে ইয়া বড়। সেই বড় প্লেটে করে আস্ত একটা রান্না করা খাসি নিয়ে তাদের স্টেজের দিকে আসছে। তা দেখেই রায়হানের পাশে বসা বন্ধুরা এক দৃষ্টে সেদিকে চেয়ে দেখতে থাকে। আস্ত রান্না করা খাসিটা এনে তাদের সামনে রাখা হয়। খাসিটার মাথা নেই এখন। পায়ের অর্ধেক কাটা। আর বাকিটা বাবুর্চির দাঁড়ায় রান্না করিয়ে নেওয়া।

খাসি থেকে মুখ উঠিয়ে সামনের দিকে তাকায় তারা। দেখে আস্ত গোটা ৫-৬ টা রোষ্ট করা মুরগি তাদের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। রায়হানের বন্ধুরা খাসিকে ছেড়ে সেদিকে লালুস দৃষ্টি দেয়। যেই মেয়ে গুলা সার্ভ করছে সেগুলোও দারুন সুন্দরী। রায়হানদের সামনে আরো এনে দেওয়া হয় বাসমতী চালের পোলাও। দারুন সুঘ্রাণ বেড়িয়েছে সেটা থেকে। সবকিছু তাদের সামনে রেখে মেয়ে গুলো চলে যায়। রায়হানের বন্ধুরা এক প্রকার হামলেই পড়ে খাবারের উপর। রায়হান ধীরে ধীরে খাচ্ছে। তার সামনে এতো সব খাওয়া দেখেও মন তার পড়ে আছে নিপার কাছে। বারবার চোখে হারাচ্ছে তাকে। তারপরও জোর করে খাবারে দিকে মন বসাতে থাকে রায়হান।

 

এদিকে দরজার আড়াল থেকে আঙিনায় স্টেজে বসা রায়হানদের দেখছিলো ইকরা, সামিহা আর জিনিয়া। তিনজনই কিছুক্ষণ দেখার পর এসে নিপার পাশে বিছানায় বসে। নিপাকে বলতে থাকে।

– তোর জামাইয়ের তো দেখি খাইতে খাইতে হাঁসফাঁস উঠে গেছে রে।

– ওর জামাইয়ের হাঁসফাঁস উঠলেও পাশে বসা বন্ধু গুলা রাক্ষসের মতো খাইতেছে। বাপরে বাপ।

নিপা কিছু বলেনা। শুধু তাদের দুজনের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসে।

তখনই সেই মেয়ে গুলো যেগুলো রায়হান দের খাবার পরিবেশন করতেছিল তারা খাবার নিয়ে নিপার রুমে ঢুকে। তাদেরকেও একটা বড় প্লেটে খাবার দেওয়া হয়। যাতে একসাথে নিপার সাথে তার বান্দবীরাও খেতে পারে। ইকরা আর বাকিরা বিছানায় তেমন করে যায়গা করে দেয়। ইয়া বড় প্লেট টা রেখে মেয়েগুলো চলে যায়। হয়তো ডেকোরেটরের লোক তারা। ইকরা একটা ছোট পাত্র আর পানির জগ দিয়ে সবার হাত ধুইয়ে নিচ্ছে। হাত ধুইয়ে নিতে নিতে ইকরা নিপাকে বলে।

– এই, দিথী কইরে ,! ওকে তো দেখতেছি না।

কথা শুনেই নিপার মুখের হাসি উড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,

– ম, মনে হয় বাইরে কোথাও আছে।

– এখন খাবার খাওয়ার সময় ও নাই। নিশ্চিত তোর ভাইয়ের সাথে ঐদিকে আছে‌।

– হ,হয়তোবা।

– হইছে নে এখন, শুরু কর।

ইকরা বিছানায় উঠে বসে। মাঝে বসেছে নিপা। আর দুই পাশে বাকি তিনজন। তৃপ্তি ভরে খেতে থাকে তারা খাবার গুলো।

 

বাড়ির পিছনের খাওয়ার প্যান্ডেল। বরযাত্রী খুব বেশি একটা আসেনি। তাই এক টিপেই সবাইকে ভালোভাবে খাওয়ানো যাচ্ছে। ডেকোরেটরের লোকেরা খাবার, মাংস উঠিয়ে উঠিয়ে দিচ্ছে। আফাজও হাত লাগানোর জন্য এসেছে এদিকটায়। সে একটা পানির জগ হাতে নিয়েছে। আর ঘুরে ঘুরে দেখছে যে কার পানি শেষ হয়েছে বা কার পানি লাগবে। সবাই খেতে বসেছে এখানে। রায়হানের বাবা-মা রাও। আফাজ সবার সামনে দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। ক্যামেরা ম্যান ক্যামেরা নিয়ে একপাশ টায় ভিডিও ধারণ করতেছে। যার সামনেই ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই আস্তে খাওয়া শুরু করতেছে। ক্যামেরা ম্যান খাওয়ার সময় সামনে এসে দাঁড়ালে যে কী একটা বিরক্তি লাগে তা তাদের মুখশ্রীতেই স্পষ্ট। আফাজ হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় আলিশা কে। আলিশা বসেছে একদম কোনায়। আফাজ চলে যায় আলিশার দিকে।

 

আফাজ এসে আলিশার গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে থাকে‌।‌ আলিশার একদম শেষ কোনে বসেছে। তার পাশ একটা ছোট মেয়ে আর তারপর একটা বুড়ি মহিলা। তারমানে আলিশার সাথে কথা বলতে তার এখন তেমন একটা অসুবিধা হবেনা। আফাজ পানি ঢেলে দেওয়ার সময় আলিশা তাকে খেয়াল করেনি তেমন একটা। আফাজ শব্দ করে তাকে বলে উঠে।

– মাংস লাগবে ,? (মুখ ঘুরিয়ে) রহমান ভাই, এদিকে মাংস নিয়ে আসিয়েন তো।

আলিশা খেতে খেতে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে।

– না,না। আমি আর খেতে,(থেমে গিয়ে অবাক হয়ে) আপনি,! আপনি এখানে কী করছেন ?

– যাক, চিনতে পেরেছেন তাইলে ,!

– আপনাকে আবার চিনবো না,! কালকে এক দলা হলুদ আমার মুখে মেরে পালিয়েছিলেন। আপনাকে আমি অনেক চেষ্টা করেও হলুদ লাগাতে পারিনি।

– না মানে, আমি ভাবলাম সবাই তো আপনাকে কম কম মাখাচ্ছিলো। তাই আরকি আমি একটু বেশিই মাখিয়ে দিয়েছিলাম।

– তাই বলে এতোটা বেশি,!

তখনই মাংসের লোক চলে আসে। বড় পাত্র থেকে মাংস তুলতে থাকে। আফাজ বলে‌।

– হাড় ছাড়া গুলো দিয়েন।

লোকটা মাংস উঠিয়ে দেয় আলিশার পাতে। দিয়ে চলে যায়। আফাজ বলে।

– আর কিছু কী লাগবে ,!

– না না। আর কিছু না। বেশি খেতে পারিনা আমি।

– রান্না কেমন হয়েছে ,! আমিও আজ রান্নায় হাত লাগিয়েছিলাম।

– হমম, দারুন হয়েছে। (একটু থেমে) ভাইয়াদের যে দেখছি না। তারা খাবেনা ?

– রায়হান দুলাভাইয়ের কথা বলতেছো ,!

– হ্যা। ভাইয়া কই।

– দুলাভাইদের তো স্টেজে খাবার দেওয়া হয়েছে। ওখানেই খাচ্ছে।

– ওহহ,(একটু থেমে খেতে খেতে) জানেন, আজকে কে জানি আমার মুখ স্প্রে ফোম দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। আমি গেট ছেড়ে দেওয়ার পর পরই পার্টি স্প্রে মারতে এসেছিলাম, তখনই কে জানি এমনটা করে। তাকে দেখতেই পাইনি। যদি ধরে ফেলতাম না,! ওর মুখটা আমি স্প্রে করে একদম ভরিয়ে ফেলতাম।

– দেখোনি তাকে ,!

– না দেখতে পাইনি। কখন যে স্প্রে করে দিয়ে কই পালাইলো। (আফাজের দিকে ফিরে) ঠিক আপনার মতো। কালকে এমন করে হলুদ মাখিয়ে পালিয়েছিলেন আপনি। আপনার কোন ভাইই এই কাজ টা করছে। আমি নিশ্চিত।

– কিন্তু আমার তো ভাই নাই। একটা বোন আছে‌।

– তাইলে ঐ বোনটা করছে। আমার মুখ একদম ভরিয়ে দিছে।

 

আফাজ আলিশা দিকে থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ভাবতে থাকে।

– ঐ মেয়েটা তাইলে এই ছিলো ,! আমি তো দিতে গেছিলাম দুলাভাইকে। এ সামনে আসে দাঁড়ায় সব নিজের মুখে নিয়ে নিছে,! নোক। আমার কী ,! (বলেই জিহবা কামড়ে মুচকি হাসি দেয় আফাজ। আলিশার দিকে ফিরে বলে,

– আচ্ছা তুমি খাও, আমি ঐদিক টা একটু দেখে আসি কারো পানি লাগবে কি না।

– আচ্ছা ঠিক আছে যান।

আফাজ আলিশার দিকে থেকে ফিরে চলে যেতে থাকে। মুখে এক চিলতে দুষ্টু হাসি।

 

বেশ কিছুক্ষণ পর,

 

আঙিনায় দাঁড়িয়ে একজনের সাথে গল্প করছেন নজরুল সাহেব। পাশেই দাঁড়ানো তার পত্নী সুমনা বেগম। স্টেজে বসে রায়হানও এখন তার বন্ধুদের সাথে গল্পে মজেছে। শিউলি আর মতিন মেম্বার এসে নজরুল সাহেবের পাশে দাঁড়ান। তাদের দেখে নজরুল সাহেব গল্প থামিয়ে ফিরে তাকান। বলতে থাকেন।

– আপনাদেরকেই খুঁজছিলাম বেয়াই। বউমা কে যে দেখালাম না। বউমা কী ঘরে আছে ?

– হ বেয়াই সাব। নিপা ঘরেই। দেখবেন, চলেন ভিতরে।

– না না। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে, কুয়াশা পড়ছে। বিয়ের শুভ কাজ টা যদি সেড়ে ফেলা যেতো।

– হ হ অবশ্যই। ঐযে কাজি সাব আইসা বইসা আছেন। (আঙিনার সাইডে বসে থাকা কাজি সাহেবকে দেখিয়ে বলেন মতিন মেম্বার।

– তাইলে বউমাকে নিয়ে আসেন। বিয়েটা পড়ায় ফেলোক উনি।

– অবশ্যই অবশ্যই (শিউলি বেগমের দিকে তাকিয়ে) শিউলি, যাও তোমার মাইয়ারে নিয়া আহো। (নজরুল সাহেবের দিকে ফিরে) চলেন বিয়াই সাব। কাজির সাহেবের ঐদিকে যাই।

বলেই নজরুল আর সুমনাদের নিয়ে কাজির দিকে যেতে থাকেন মতিন মেম্বার।

 

শিউলি বেগম ঘরে প্রবেশ করেন। হনহন করে বলতে থাকেন,

– নিপা, নিপা ওঠ। ঐদিকে যাইতে হইবো।

নিপাকে ধরে বিছানা থেকে নামায় ইকরা আর সামিহা। নিপার শাড়িটার ওজন খুব। নতুন শাড়ি পড়তেছে তাও আবার এটা দারুন ভারি। তাই অস্বস্তি বোধ করছে। নিপা নেমে দাঁড়ায়। শিউলি বেগম আর ইকরা দেখতে থাকে সাজ সব ঠিকঠাক আছে কিনা। নিপার মাথায় ঘোমটা দিয়ে দেন শিউলি বেগম। নিয়ে যেতে থাকেন আঙিনার দিকে।

 

বারান্দা থেকে নামে নিপা। তার একপাশে শিউলি বেগম, আরেক পাশে ইকরা। পিছু পিছু আসছে সামিহা আর জিনিয়া। রায়হান তার বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো, হঠাৎ তার চোখ পড়ে নিপার দিকে। লাল বেনারসী শাড়ি, গা ভর্তি গহনা, যেন নতুন এক নিপাকে দেখছে সে। তার চোখের পলকই পড়ছে না। মুখ দিয়ে মৃদু আওয়াজে বেড়িয়ে আসে ” মাশাআল্লাহ,”

 

রায়হানের পাশ থেকে তার বন্ধুরা সড়ে যায়। রায়হানের পাশে বসানো হয় নিপা কে। রায়হান এখনো এক নজরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে নিপার দিকে। হঠাৎ নিপা তার পায়ে দুম করে কিল দিয়ে তার ঘোর ভাঙায়। রায়হান নিচে তাকিয়ে নিপার হাতটা দেখে তারপর আবার নিপার দিকে দেখে নিপা চোখ দিয়ে ইশারা করে সামনে তাকাতে বলে। রায়হান সামনে ফিরে তাকায়, দেখে তার বাবা-মা, আঙিনার বাকিরা সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইকরা আর সামিহারা তো মুখ চেপে হাসছে। রায়হান শরম পায়। সে মাথা নামিয়ে নিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।

মতিন মেম্বার বলে উঠেন।

– তো বিয়াই সাব, বিয়ের কাজ শুরু করি নাকি ,!

– হ্যা অবশ্যই।

– কাজি সাব, বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।

কাজি এসে স্টেজের সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে। স্টেজ টা নিচু করা, চেয়ারে বসলে একদম সমান সমান হয়। কাজী সাহেব চোখে চশমা পরে নেন। তার টালি খাতায় কিছু একটা লেখেন। তারপর বলতে শুরু করেন,

– নজরুল খানের ছোট ছেলে রায়হান খানের সাথে মির্জা মতিনে একমাত্র কন্যা সুবাইতা নুরান নিপার বিবাহের দেনমোহর ১ কোটি ১ লাখ ১ টাকা ধার্য করিয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতেছে। (একটু থেমে) রায়হান বাবা, বলো কবুল

রায়হান একবার নিপার দিকে তাকায়, নিপা লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে, মাথায় ঘোমটা। রায়হান নিপার দিক থেকে নজর সড়িয়ে কাজি সাহেবের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,

– কবুল।

– নিপা মা, বলো কবুল,

নিপা অনেক লজ্জা পায়। আড়চোখে রায়হানের দিকে একটু তাকিয়ে মাথা নিচু করা অবস্থায় মৃদু গলায় বলে,

– কবুল।

চারপাশ মুহুর্তেই ” আলহামদুলিল্লাহ” ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। এক নতুন জীবন শুরু হয় দুই ভিন্ন আত্মার। নিপা রায়হান একে অপরের দিকে তাকায়। নিপা কিছুক্ষণ তাকিয়ে লজ্জায় নজর নামিয়ে ফেলে। তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুই জনেই এই মিলনে অনেক খুশি এবং উৎফুল্ল।

কাজি সাহেব দোয়া ধরেন। সবাই হাত তুলে দোয়া করতে থাকে এই নবদম্পতির জন্য। কাজি সাহেব দোয়া পড়তে থাকেন এবং এই দুই আত্মায় সুখি, সমৃদ্ধ জীবন কামনা করতে থাকেন। সবাই তা অনুকরণ করতে থাকে। ইসলামিকে বিয়ের এক অন্যতম সুন্দর মুহুর্ত।

 

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে এসব দেখতে থাকে দিথী। বারান্দায় কেউ নেই এখন, সবাই আঙিনায় বর বউয়ের ঐদিকে চলে গিয়েছে। দিথী নিপা আর রায়হানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার মুখশ্রী ছিলো গম্ভীর। চোখে ছিলো অন্য এক সত্তার আভাস।

 

সবাই একত্রে ‘আমিন’ বলে হাত উঠিয়ে চুমু খেয়ে নেয়। দোয়া শেষ। কাজি সাহেব উঠে যান চেয়ার থেকে। নজরুল সাহেব আর মতিন মেম্বার কোলাকুলি করতে থাকেন। রায়হান, নিপার হাত ধরে আছে। পাশ ফিরে তার বন্ধুদের সাথে কথায় মজেছে। নিপা নিচে তাকিয়ে রায়হানের হাত ধরাটাকে দেখে। তার মুখ এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।

 

নজরুল সাহেব কোলাকুলি করার পর বলতে থাকেন।

– তো বিয়াই, আপনার মেয়েকে তাইলে এখন নিয়ে যাই ,!

– ও তো এহন থেইকা আপনাগো বাড়ির মাইয়া। অবশ্যই নিয়া যাইতে পারেন।

– বাবা রায়হান, নিপাকে নিয়ে নেমে এসো।

নজরুলের আদেশ পেয়ে নিপার হাত ধরে তাকে আগে স্টেজ থেকে নামায়। তারপর সে নিজেও নামে‌।

নিপার হাত ধরে তাকে নিয়ে নজরুল-সূমনা দম্পতি আর তার শশুর শাশুড়ির সামনে দাঁড়ায়। শিউলি বেগমকে দেখে নিপা গিয়ে জড়িয়ে ধরে। শিউলি বেগম আর এবার অভিনয়ের পারদে কান্না থামিয়ে রাখতে পারেন না। কেঁদে উঠেন। নিপারও তার মায়ের কান্না দেখে কান্না পায়। ও এতোক্ষণ মজে ছিলো প্রেমের টানে‌। এখন যখন বুঝতে পেরেছে তাকে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে তার বুক টা খা খা করে উঠে। শিউলি বেগম কাঁদতে কাঁদতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তাকে ছাড়িয়ে গাল গুলো ধরে বলতে থাকেন,

– ভালোভাবে থাকিস মা। রায়হান, তোর শশুর শাশুড়ি সবাইরে মান্য কইরা চলিস‌।

– মা, তুমি কাদিও না। আমি, আমি নাইলে ও বাড়ি যাবো না।

– পাগলী মাইয়া আমার। এসব কথা কয় না। (কপালে চুমু দিয়ে) মাঝে মাঝে তোর এই মা’ডার লগে একটু দেহা করতে আহিস। (বলেই জড়িয়ে ধরেন শিউলি বেগম। মতিন তার চোখের চশমা খুলে চোখের পানি মুছতে থাকে। বাবার কাছে মেয়েরা রাজকন্যার থেকেও বেশি। ছোট থেকে অনেক আদরে বড় করেছেন নিপাকে তিনি। আজ মন কাঁদছে। নিপাকে চলে যেতে দিতে তার মন একদম চাইছে‌ না। নিপা তার মা’কে ছেড়ে এসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। মতিন খুব করে কান্না আটকাতে চাইলেও পারেন না। নিপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন‌

– সুখী হ মা। সুখী হ।

শাহারিয়া এসে দাঁড়ায় মতিন মেম্বারের পাশে, সে এতোক্ষণ পিছনের প্যান্ডেলে ছিলো। সে এদিকে মাত্র আসলো। নিপা তার বাবাকে ছেড়ে তার ভাইয়ার কাছে আসলো। শাহারিয়া খুব শক্ত থাকার চেষ্টা করে‌। চোখ ছলছল করছে। নিজের আপন বোনের মতো ছোট থেকে স্নেহ দিয়েছে নিপা কে। আজ তারও মন খুব কাঁদছে। শাহারিয়া হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে থাকে‌। নিপা এসে তার সামনে দাঁড়ায়। নিপার হাত হাত রেখে শাহারিয়া বলে‌।

– সবসময় রায়হানের সাথে সাথে থাকবি। একলা বাড়ি থেকে বের হবিনা কেমন ,! আমরা তো আছিই। কাদিস না। (একটু থেমে) ভালো থাক, সুখি হ।

রায়হান এসে নিপার পাশে দাঁড়ায়। নিপা এখনো কাঁদছে। রায়হান নিপাকে ধরে তাকে সামলায়। বলতে থাকে।

– আমি সবসময় দেখে রাখবো ওকে। অনেক সুখে থাকবে ও।

– চলো চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে। (মতিন মেম্বারের দিকে ফিরে) বিয়াই সাব, আমরা আসি তাইলে।

মতিন চোখের পানি মুছে বলতে থাকে‌

– আসেন, (হাত দিয়ে ইশারা করে নজরুল কে নিয়ে বাইরে চলে যেতে থাকেন মতিন।

রায়হানও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিপার কাঁধে হাত রেখে তাকে নিয়ে যেতে থাকে‌। নিপা হেলান দিয়েছে রায়হানের বুকে‌। পিছুপিছু আসতে থাকে রিয়াদ, শাহারিয়ার, শিউলি বেগম ও বাকি সবাই।

 

বরযাত্রীরা গাড়িতে উঠে পড়েছে। নিপা রায়হান বাড়ির প্রাইভেট কার টায়। আর বাকি বরযাত্রী আর বাড়ির লোক ২ টা মাইক্রোয়। নিপা গাড়ির ব্যাক গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তার মা-বাবাকে দেখে। তার মা খুব কাঁদছে। শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। নিপার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে সামনে ফিরে। ‘কেনো মেয়েদের এ বাড়ি ছেড়ে, বাবা-মা’দের ছেড়ে চলে যেতে হয় ,?’ বারবার এ প্রশ্ন তার মাথায় আসলেও উত্তর যে তার অজানা। গাড়ি চলতে শুরু করে। নিপা পিছনে আবার তাকিয়ে তার বাবা,মা,ভাইদের একটি বার দেখে। তারপর আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। তারা তাকে বিদায় জানাচ্ছে। রায়হান নিপাকে আরো কাঁদতে দেখে তাকে সোজা করে বসায়। নিপার মাথাটা নিজের বুকে রেখে জড়িয়ে ধরে নিপাকে। সে এইসময় মেয়ে আর মেয়ের বাড়ির সবার মনের অবস্থা বুঝে। এইসময় নিপার দরকার একটু নির্ভরতার আলিঙ্গন। রায়হান নিপাকে বুকে জড়িয়ে রেখে মাথায় হাত বোলাতে থাকে‌। নিপা এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গাড়ি চলে যায় কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে, কুয়াশার চাদর ভেদ করে।

 

বাড়ির ভিতরে চলে আসে সবাই। শিউলি বেগম একদম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। সারাদিন হাসি, খুশিতে মজে থাকা সেই শিউলি বেগম এখন একদম নিশ্চুপ, গম্ভীর। ইকরা, সামিহারাও কেঁদেছিলো তখন। তারা এখন চোখ মুছতে মুছতে আঙিনা থেকে ঘরের দিকে যাচ্ছে। বারান্দার কাছে এসে দাঁড়িয়ে যায় শিউলী বেগম আর মতিন। রিয়াদ, শাহারিয়াদেরও মন খারাপ। শিউলি বেগম ধীর গলায় গম্ভীর মুখে বলেন।

– তোমরা সবাই আত্মীয়-স্বজন গুলারে নিয়া খাইয়া লও । আমি একটু একলা থাকতে চাই। (একটু থেমে শাহারিয়ার দিকে তাকিয়ে) বাড়িত তো এতো মেহমানের ঘুমানোর যায়গা হইবোনা। বাজান তুই, আফাজ আর তোর বন্ধুডা মিল্লা আইজকার রাইত ডা রিয়াদ গো বাড়ি গিয়া থাক,!

– সমস্যা নাই চাচি। আমি ওদেরকে নিয়ে যাচ্ছি খাওয়া দাওয়ার পর। (রিয়াদ)

এদের কথা শুনে বারান্দা থেকে ইকরা নেমে দাঁড়ায়। এসে শিউলি বেগমকে বলে।

– আফাজ আর শাহারিয়া ভাইয়া কই ঘুমাবে ফুফু ,!

– রিয়াদ গো বাড়িত। (ধীর গলায় বলেই শিউলি বেগম বারান্দা দিয়ে উঠে চলে যান ঘরের দিকে। ইকরা উৎসুক হয়ে বলে।

– ভাইয়া আমিও তোমাদের সাথে যাই ,!

– তুই আমাদের সাথে যায় কী করবি ,! আমি আর আফাজ তো ঘুমাবো রিয়াদের সাথে। তুই মেয়ে মানুষ, ওখানে যায় কী করবি ,!

শাহারিয়ার কথা শুনে ঘোর ভাঙে ইকরা। ইশশ, রিয়াদের বাসায় ও এমনি এমনি ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবছিলো‌। এখন শুনতেছে ঘুমাইতে যাইতেছে‌। ইকরা লজ্জায় দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে বারান্দায় উঠে যায়। রিয়াদ আর শাহারিয়া কিছুই বুঝতে পারেনা। ওরা একে অপরের দিকে চেয়ে আবার ইকরার যাওয়ার দিকে চায়। পিছনে এক আত্মীয়ের কথায় দুইজন ফিরে তাকায়। লোকটা জানতে চাচ্ছিল যে খাওয়ার প্যান্ডেল কী পিছন ? শাহারিয়া ‘হ্যা’ বলে উনাকে সহ বাড়ির বাকি আত্মীয় স্বজন, আর আঙ্গিনার প্যান্ডেলের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা আহনাফকে নিয়ে খেতে চলে যায় বাড়ির পিছনের দিকে‌।

 

 

 

গাড়ি বহর এসে থামে খাঁন বাড়ির গেটের সামনে। বাড়ির প্রাইভেট কার আর দুটা মাইক্রো নিয়ে গিয়েছিলো তারা। প্রথমে কার আর একটা মাইক্রো নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও পড়ে লোক বেশি হওয়ায় আরেকটা মাইক্রো আনা হয়।

 

গাড়ি থেকে সবাই নামছে। নেমে খাঁন বাড়ির লোকজন খান বাড়িতে ঢুকে আর বাকিরা যে যার বাড়ির দিকে চলে যেতে থাকে। দারুন ঠান্ডা পড়েছে। রাত এখন সাড়ে ১০ টা বাজে। গ্রামে শীতের সময় সাড়ে ১০ টা মানেই অনেক রাত।

 

অন্দরমহলের ভিতরে প্রবেশ করে রায়হান আর নিপা। নিপা এই প্রথমবার খাঁন বাড়িতে আসলো। এর আগে কখনোই বাড়ির ভিতরে আসা হয়নি তার। চোখের পানি নেই এখন। গালেই কিছু বের হওয়া পানি শুকিয়েছে‌। নিপা চারপাশ দেখতে থাকে রায়হান কাঁধ থেকে মাথা তুলে‌‌। উপরের ঝাড়বাতি টা জ্বলছে। অন্দরমহলের একপাশে ডায়নিং টেবিল, একপাশে সোফা। সোফার পাশ দিয়ে একটা করিডোর চলে গিয়েছে‌। ডান পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি বেঁকে উপরে উঠে গিয়েছে উপরের তলায় যাওয়ার জন্য। রায়হানদের প্রবেশ করার পর পরই অন্দরমহলে প্রবেশ করে আলিশা। সে তাড়াতাড়ি রায়হানদের সামনে এসে দাঁড়ায়। রাস্তা থামিয়ে বলতে থাকে।

– ভাইয়া দাঁড়াও, ভাবিকে তুমি এখন আমার হাতে তুলে দাও। আমি ভাবিকে নিয়ে ঘরে যাবো।

– কেনো,! আমি থাকতে তুই ,

রায়হানের কথা থামিয়ে আলিশা আবার বলে।

– বাসর ঘরে আগে আমি ভাবিকে ঠিক মতো বসিয়ে ঠিকঠাক করে আসবো। তারপর তুমি আসবা। তুমি এখন চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসো।

বলেই নিপার হাত ধরে টেনে রায়হানের কাছ থেকে একপ্রকার ছিনিয়েই নেয় আলিশা। নিপাকে সাথে নিয়ে চলে যেতে থাকে সিড়ি দিয়ে উপরে। রায়হান গিয়ে বসে সোফায়, তার বন্ধুরাও অন্দরমহলে প্রবেশ করে। রায়হানকে সোফায় বসে থাকতে দেখে সেদিকে তার কাছে‌ যায়। গিয়ে বসে গল্প করতে থাকে। এদিকে তখনই রান্না ঘর থেকে এক গ্লাস দুধ নিয়ে উপরের তলায় যেতে থাকে আঁখি, মানে খাঁন বাড়ির কাজের মেয়েটা।

বাড়িতে একে একে ঢুকে নজরুল সাহেব, সুমনা বেগম আর শাহেদ। সবাই যেন বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথেই আবার গম্ভীর মুখশ্রী ধারণ করে। চুপচাপ যে যার ঘরের দিকে চলে যেতে থাকে। এই বাড়িটা যেন এক গম্ভীরাচ্ছন্ন বাড়ি।

 

বেশ খানিকক্ষণ কেটে যায়,

 

আলিশা উপর তলার করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। আনমনে গুনগুন করছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবেই তখনই দেখে রায়হান সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। যাক, রায়হানকেই সে ডাকতে এসেছিলো এখন দেখছে সে নিজেই উঠে আসছে। রায়হানের বন্ধুরা গেস্ট রুমে চলে গিয়েছে ঘুমানোর জন্য। তাদের বিদায় দিয়েই রায়হান আসলো।

রায়হান করিডোর উঠার সাথে সাথেই তার হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে আলিশা। রায়হান বলতে থাকে‌

– আরে আস্তে আস্তে, পড়ে যাবোতো‌।

– যাও পড়ে। ঐদিকে ভাবি তোমার জন্য অপেক্ষা করতেছে, চলো তাড়াতাড়ি।

 

দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় দুজন। তারপর আলিশা রায়হানের হাত ছেড়ে দিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বলে‌।

– আঁখি, আমি আসছি। তুই বের হ।

আলিশার কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে দেয় আঁখি। রায়হানকে দেখেই চলে যেতে থাকে পাশ কাটিয়ে। আলিশা রায়হানের হাত ধরে টেনে বলে‌

– ভাইয়া, ভিতরে সব বন্দোবস্ত করে রাখছি। বেষ্ট অফ লাক,(বলেই মুখ চেপে হাসতে থাকে আলিশা)

– হইছে যা। পাকা বুড়ি একটা ,!

আলিশা দৌড়ে চলে যায়। রায়হান তার যাওয়ার পানে চেয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। ঘরের চারপাশে চোখ যেতেই দারুণ অবাক হয় সে। পুরো ঘর সাজানো, দেয়ালে দেয়ালে ছোট ছোট রঙ বেরঙের কাগজ কেটে সাজানো হয়েছে। বিছানার দিকে চোখ যায় রায়হানের। পুরো বিছানা ফুল দিয়ে সাজানো। বিছানার মাঝে বসে আছে ঘোমটা দেওয়া নিপা। নিপার সামনে বিছানায় লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ শেইপ আর্ট করা। রায়হান এসব দেখে বেশ ইমপ্রেস হয়। সে ফিরে দরজা লাগিয়ে দেয়।

 

হেঁটে হেঁটে বিছানার কাছে আসে‌। বিছানায় বসে‌। নিপাকে তখন সে চোখে হারাচ্ছিলো, কিন্তু এখন তো নিপা সামনেই বসে আছে। যত ইচ্ছা তত দেখতে পারবে এখন থেকে সে নিপাকে। নিপা মাথা নিচু করে ঘোমটা দেওয়া ছিলো‌। রায়হান পা তুলে বিছানায় বসে। নিপার মনে হালকা ভয়, মুখে মুচকি হাঁসি। রায়হান গলা ঝেড়ে নিপার সামনে বসে বলতে থাকে।

– চাঁদ টা দেখি মেঘের আড়ালে,! চাঁদের আলো কী আজ এই গরীব বামণ পাবেনা ,!

– নিজের হাতে মেঘ সড়িয়ে দিলেই তো হয়।

– ও হ্যা, মেঘ তো আবার চাঁদকে আগলে রাখতে চায়। দেখি, আমি সেই মেঘের ক্ষুদ্রতম খন্ড হতে পারি কিনা,!

বলেই নিপার মাথার উপর থেকে ঘোমটা টা সড়ায় রায়হান। নিপা মাথা তুলে এক মিষ্টি হসৌজ্জল মুখ নিয়ে রায়হানের দিকে তাকায়। রায়হান এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে নিপার দিকে। নিপা তার নজর নামিয়ে নেয়। রায়হান নিপার হাত ধরে। নিপা কিছুটা আঁতকে উঠে‌। রায়হান তার হাতে একটা ছোট্ট চুমু খায়। বলতে থাকে।

– আমি অনেক ভাগ্যবান যে তোমার মতো একজনকে পেয়েছি‌। তোমার মনের মণিকোঠায় দিয়ো আমায় একটু ঠাই ,!

নিপা রায়হানের কথা শুনে মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। তার খুব লজ্জা লাগছে‌। এই রাতে মেয়েদের মনে ভয় আর লজ্জা দুটোই অত্যাধিক বেড়ে যায়, নিপার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। নিপা চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকে। রায়হানও তাকে কী বলবে বুঝে পায় না। সে বুঝতে পারছে নিপা মনে মনে একটু ভীত সন্ত্রস্ত,! নিপার মনটাকে তার অন্যদিকে ঘুরাতে হবে। রায়হান বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলে উঠে।

– গান শুনবে,!

নিপা নয়ন তুলে তাকায়। বলে‌।

– তুমি গান পারো ,!

– ঐযে আলমারির পাশে গিটার টা দেখতে পাচ্ছো, ঐটা আমারই।

– গিটারও আছে তোমার,!

– হ্যা। আমি কলেজের দিন গুলোতে গান গেয়ে অনেক পুরস্কারও পেয়েছিলাম।

– তো, কই। আমাকে তো একদিন গান গাইয়ে শোনালেনা।

– এই রাতে তোমাকে শোনাবো, তাই আগে বলিনি এই কথা।

– আচ্ছা শোনাও তাইলে একটা গান। দেখি আমার বরের গানের গলা কেমন।

– অবশ্যই, তবে এখানে না।

– তাইলে কোথায়,!

– ব্যালকনিতে চলো। আজ জোছনা রাত। সুন্দর আবহাওয়ায় গানে গানে বেশ জমবে।

– আচ্ছা তাইলে চলো। তবে,

– তবে কী ,!

– আলিশা আমাকে এক গ্লাস দুধ দিয়ে গেছে।(লজ্জায় নজর নিচে করে) বলছে তোমাকে খাওয়াতে।

– আলিশাটা এতো পেকে গেছে না,! কী আর বলবো।

 

নিপা টেবিল থেকে ঢাকনা নামিয়ে রেখে দুধের গ্লাস টা হাতে নেয়। নিয়ে নিজের সামনে গ্লাসটা ধরে বলে,

– কাছে এসো।

– কী,! (রায়হান চকিতে তার মুখ তুলে তাকায়)

– না মানে গ্লাসের দুধটা আমার নিজের হাতে বলে তোমাকে খাইয়ে দিতে হবে। তুমি তো দূরে বসে আছো‌। কীভাবে খাওয়াবো।

রায়হান, নিপার ধীর কন্ঠী আওয়াজে বুঝতে পারে আসলেই নিপা ভয় ভয় মনে আছে। রায়হান কিছুটা এগিয়ে বসে‌। নিপা গ্লাসটা রায়হানের মুখের সামনে ধরে। রায়হান চুমুক দিয়ে খেতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে, সে ধীরে ধীরে খাচ্ছে আর নিপার দিকে তাকিয়ে আছে‌। নিপার লজ্জায় হাসি পাচ্ছে। তার ঠোঁট দুটো তো তাই জানান দিচ্ছে।

 

পুরো গ্লাসের দুধ খেয়ে ফেলে রায়হান। গ্লাস টা পাশের টেবিলে রেখে দেয় নিপা। সে সামনে ফিরে একটু ইতস্তত বোধ করতে থাকে। বলে,

– রায়হান,!

– হ্যা বলো।

– গহনা গুলা খুব ভারি লাগতেছে আমার কাছে। আনইজি ফিল হচ্ছে। (নজর তুলে রায়হানের দিকে নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে) গহনা গুলো খুলে রাখি ,!

– হ্যা রাখো। সমস্যা নাই। খুলে পাশের টেবিল টায় রেখে দাও।

 

নিপা নিজের হাত দুটো পিছনে কাঁধে নিয়ে খুলতে থাকে গহনা গুলো। এই নতুন ডিজাইনের গহনা সে প্রথম পড়েছে।‌ আগে কখনো পড়া হয়নি তার। রায়হান বসে বসে নিজের হাতের রেখা দেখার ভান করছে। সে করবে টাই বা কী। নিপার দিকে তাকিয়ে থাকলে নিপা শরম পাচ্ছে আর তখন তারও শরম লাগছে। এভাবে করে কী হয় হ্যা,!

এসব ভাবতে ভাবতে সে দেখে এখনো নিপা গহনা খুলে উঠতে পারেনি। রায়হান এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাঁটুর বলে দাড়ায়। এগিয়ে গিয়ে নিপার মাথা হেলিয়ে দিয়ে তার কাঁধ থেকে গহনাটার জয়েন্ট টা খুলে দিতে থাকে‌। নিপার কাঁধে আর পিঠে রায়হান হাতের ছোঁয়া লাগছিলো। নিপা চোখ বন্ধ করে চুপচাপ ছিলো। সে তো ভাবছিলো এই বুঝি রায়হান তাকে নিয়ে তার উপর শুয়ে পড়বে। কিন্তু না। রায়হান তেমন কিছুই করেনি। সে গহনার জয়েন্ট টা খুলে সড়ে বসে। নিপা নিজে নিজে তার কানের দুল আর হাতের চুড়ি গুলো খুলে। পায়ের নুপুর গুলো খুলতে যায়, তখন রায়হান বলে,

– ওগুলো থাক। চলো ব্যালকনিতে যাই।

– আচ্ছা।

নিপা আর রায়হান বিছানা থেকে নামে। রায়হান গিয়ে আলমারির পাশ থেকে তার গিটার টা হাতে নেয়। ব্যালকনির দরজার লক খোলাই ছিলো। তবে দরজা ভিড়ানো ছিলো। নিপা গিয়ে দু হাত দিয়ে ব্যালকনির দরজা মেলে দেয়। বাইরে হালকা ঠান্ডা বাতাসও করছে। তখনই সে হঠাৎ চমকে উঠে। কারণ ঘরের লাইট অফ হয়ে গেছে। সে তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে তাকায়। দেখে ঘরে মেইন লাইট অফ করে দিয়ে একটা ছোট ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে রায়হান। রায়হান সুইচ বোর্ডের ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। বললো।

– ভয় পেয়েছো,!

নিপা মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইঙ্গিত দেয়। রায়হান একটা সৌজন্যমূলক হাঁসি দেয়। নিপা রায়হানের দিক থেকে ফিরে ব্যালকনির ভিতরে যায়। ব্যালকনিতে দুইটা চেয়ার ছিলো‌। বেতের তৈরি চেয়ার। বসার যায়গায় ফোম দেওয়া। নিপা গিয়ে ব্যালকনি বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায়। দূরের আকাশ দেখতে থাকে‌। কুয়াশার রাতেও তারাদের ঝলমলিয়ে উঠা ঠিকই ধরা দিচ্ছে তার চোখে এসে‌। রায়হান এসে ব্যালকনির একটা চেয়ারে বসে। গিটারের তারের মধ্যে আঙুল দিয়ে একটা সুন্দর টান দেয়। নিপা ফিরে তাকায়। রায়হান হাত দিয়ে ইশারা করে বসতে বলে‌। নিপা গিয়ে বসে পড়ে আরেকটা চেয়ারে। চেয়ার দুটো প্রায় মুখোমুখিই করা বলা যায়। জোছনা রাত, চারপাশে ক্ষীণ কুয়াশা আর নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। রাত যে এতো সুন্দর আগে তা কখনো উপলব্ধি করেনি নিপা। রায়হান বলে উঠে‌।

– কোন গান শুনবে বলো। আজ তোমার পছন্দেরই গান গাই একটা।

নিপা রায়হানের দিকে ফিরে তাকায়। মলিন গলায় বলে।

– আমার তেমন কোনো পছন্দের গান নেই। তুমি তোমার ইচ্ছে মতো একটা গান ধরো ,!

– আচ্ছা তাইলে ঠিক আছে। আমি ঐ গান টাই ধরি ,! তুমি শুধু এই সুন্দর রাতের মাঝে গানটা উপভোগ করতে থাকো, কেমন,!

– কোন গান টা ,!

– এটা,!

 

বলেই রায়হান গিটারে সুর তুলতে থাকে‌। রায়হানের গিটার বাজানোর দিকে চেয়ে দেখে নিপা। রায়হান আঙ্গুল দিয়ে গিটার তারের মাঝে সুর তুলতে তুলতে গান ধরে,

 

আমার স্বপ্ন তুমি,

ওগো চিরদিনের সাথী,

আমার স্বপ্ন তুমি,

ওগো চিরদিনের সাথী,

 

তুমি সূর্য ওঠা ভোর আমার,

আর তারায় ভরা রাতি

আমার স্বপ্ন তুমি,

ওগো চিরদিনের সাথী,

 

আমি তোমার ছায়া,

তোমার আকাশ নীলে আমি,

স্নিগ্ধ মেঘের মায়া।

তোমায় কাছে পেয়ে,

পৃথিবী তে, কে আর সুখী,

বলো আমার চেয়ে ?

তোমায় কাছে পেয়ে

হাতের আড়াল দিয়ে বাঁচাও,

ঝড়ের মুখে বাতি,

 

আমার স্বপ্ন তুমি,

ওগো চিরদিনের সাথী,

তুমি সূর্য ওঠা ভোর আমার,

আর তারায় ভরা রাতি,

আমার স্বপ্ন তুমি,

ওগো চিরদিনের সাথী,

 

রায়হান থামলো। নিপার এক চিলকে নয়নে তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ রায়হানের দিকে। এই গান যেন এই রাতের ভুবনে তাকে অন্য দুনিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলো। হারিয়ে ফেলেছিলো সে নিজেকে। রায়হানের গলা তো দারুন সুন্দর।

নিপার এক নয়নে চেয়ে থাকা দেখে রায়হান বলে উঠে ,!

– কেমন ছিলো ,! অনেক দিন পর আবার গান ধরলাম। কতটা যে ভালো করতে পেরেছি,

– অনেক ভালো। তুমি এতো দিন আমাকে বলোনি কেনো যে তুমি এতো ভালো গান পারো ,! (একটু থেমে মুখ ঘুরিয়ে আকাশ পানে চেয়ে) জানো, আমার নিজে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছেনা আমি এতো সুন্দর একটা জীবন পেয়েছি ,! এই সুন্দর জীবন ছেড়ে, তোমায় ছেড়ে আমি কখনোই যেতে চাইনা। কখনোই না।

– আরেকটা গান ধরি ,! এখন যেহেতু রাত, থালার মতো আকাশ থেকে জোছনা দিচ্ছে ছাই রঙা চাঁদ, তার সাথে এই গান টা দারুন যাবে।

নিপা আকাশ পান থেকে মুখ ঘুরিয়ে রায়হানের দিকে চায়। এক সুন্দর হাসি দিয়ে সম্মতি জানায়।

রায়হান গিটারের তারের বেড়াজালে সুর তুলে। গান ধরে,

 

এই রাত তোমার আমার,

ওই চাঁদ তোমার আমার,

শুধু দুজনের,

এই রাত তোমার আমার,

ওই চাঁদ তোমার আমার,

,

,

এই রাত শুধু যে গানের,

এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের,

কুহু কূজনের,

এই রাত তোমার আমার,

,

,

তুমি আছো আমি আছি তাই,

অনুভবে তোমারে যে পাই,

শুধু দুজনের,

এই রাত তোমার আমার,

ওই চাঁদ তোমার আমার,

 

রায়হানের গান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নিপা একটা সুন্দর হাসি দিয়ে হাততালি দিতে থাকে। রায়হান গিটার টাকে নামিয়ে ব্যালকনির গ্রিলের গায়ে হেলান দিয়ে রাখে। নিপাকে এতো খুশি দেখে তার দারুন লাগছে। এই সুন্দর হাসিটাই যে সে চেয়েছিলো তার গানের প্রতিদান হিসেবে।

 

নিপা রাতের এতো সুন্দর সময়ে রোমান্টিক গান শুনে নিজের মধ্যেও এক নতুন আকাঙ্ক্ষা সঞ্চালনের আভাস পায়। তার মন চাইতে থাকে এক উষ্ণ আলিঙ্গন পেতে। সে দেখে রায়হান দূরের আকাশের চাঁদের দিকে একপানে চেয়ে আছে। সে তো মেয়ে। নিজের মুখে কীভাবে নিজের ভাব সে প্রকাশ করবে। বুঝে পায় না কিছুই।

রায়হান চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিপার মুখখানা কল্পনা করছে চাঁদের পৃষ্ঠে। একপ্রকার ভাবনার জগতেই হারিয়ে গিয়েছে সে। তখনই হঠাৎ নিপার কথায় তার ঘোর ভাঙ্গে।

– রায়হান। আমার খুব ঠান্ডা লাগছে।

রায়হান নিপার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখে নিপা দাঁড়িয়ে দুই হাত নিজের বুকের উপর জড়িয়ে ধরে আছে। রায়হানের হুঁশ ফিরে। সে তো এই সুন্দর আবহাওয়ার ভুলেই গেছিলো বাইরের ঠান্ডা বাতাসে নিপার ঠান্ডা লাগতে পারে। রায়হান উঠে দাঁড়ায়। পড়নের শেরওয়ানি এখনো তাকে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করায় এই কথাটা আগে তার মাথায় আসেনি। রায়হান গিয়ে নিপার সামনে দাঁড়ায়। বলে।

– চলো ঘরে চলো। কাল আবার গান শুনাবো কেমন ,!

কথা শেষ হওয়া মাত্রই নিপা তাকে জড়িয়ে ধরে। বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে নিজের মুখ লুকায়। রায়হান এতোক্ষণ অন্য জ্ঞানে থাকায় নিপার বিষয় টা সে বুঝতে পারেনি। তবে এখন নিপার এই হঠাৎ জড়িয়ে ধরা তাকে অনেক কিছুতেই বিনা বাক্যে সম্মতি প্রদান করার মতো। রায়হান নিপাকে দাঁড় করায় ঠিক করে। দেখে নিপার দু চোখ কিছুটা ছলছল করছে। জোছনা আলোয় তা ভালো ভাবে পরিস্কার হয়ে রায়হানের কাছে ধরা দিচ্ছে। রায়হান নিপার গাল দুটো ধরে, তার চোখে চোখ রেখে ধীর গলায় বলে।

” লিখেছি তোমায়,

আমার মায়ায়,

বেঁধেছি তোমায়,

প্রণয় রেখায়,

উড়ে যেতে চাও , ?

উড়ে যাও,

নীড় হারা পাখি ,!

তোমায় যে রেখেছি নয়ন জ্বলে বাঁধি,!!

 

শো শো করে বাতাস বয়ে যায়। নিপার শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে। নিপা রায়হানের দিকে এক পলকে চেয়ে থাকে। রায়হানের কথা গুলো যেন তার মরুভূমির মনে এক পশলা বৃষ্টি হিসেবে ধরা দেয়। রায়হান নিপার মুখের উপর উড়ে আসা চুলগুলোকে সড়িয়ে কানের পাশে রাখে। গাল দুটো আলতো করে ধরে। ধীর গলায় বলে উঠে।

“ভালোবাসি তোমায় স্রোতোসিনী, অনেক অনেক ভালোবাসি ,” বলেই নিপার দু ঠোঁটে নিজের দু ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। দূরের গাছে থাকা দুটো পেঁচা তাদের দিকে অকপটে চেয়ে থাকে। দূরের জোছনা দেওয়া চাঁদ ধীরে ধীরে এক খন্ড মেঘের আড়ালে চলে যেতে থাকে। রায়হান চুমু খেয়ে নিপার মুখ খানা সামনে আনে। চেয়ে দেখতে থাকে তাকে। দূরের চাঁদের জোছনার আলো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ার আগে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যায় নিপার ভিজে থাকা দুই ঠোঁটকে। নিপার চোখে এক নতুন আবেশ। চোখের পাতা গুলো সরুসরু হয়ে আসে তার। রায়হানও নিজেকে তার মধ্যে মিশিয়ে দিতে চায়। আলতো কোলে তুলে নেয় নিপাকে। নিপা তার সরু সরু নেশাক্ত চোখ নিয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হানও তার চোখ নিপার চোখ থেকে সড়াচ্ছে না। নিপাকে কোলে নিয়ে ব্যালকনি থেকে রুমে প্রবেশ করে। রুমে হালকা ডিম লাইটের মৃদু আলোয় বিছানার অবয়ব বুঝতে বেগ পেতে হয়নি রায়হানের। বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায় রায়হান। ধীরে ধীরে হাত দুটি নামিয়ে আলতো করে বিছানায় রাখে নিপার তুলার মতো নরম দেহটাকে। নিপার কোমড়ের উপর থেকে কিছুটা শাড়ি সরে গিয়েছিলো। পেটের কিছুটা সাদা অংশ দারুন ভাবে আকৃষ্ট করছিলো রায়হানকে। রায়হানও চলে যায় এক অচেনা ঘোরে। হাত শেরওয়ানির বোতায় গুলো খুলতে থাকে। নিপা এক সরু নয়নে চেয়ে আছে রায়হানের দিকে। সে যেন রায়হানকে নিয়ে এক অগভীর সমুদ্রে ডুবে যেতে চায়। সাঁতরে উঠতে চায় অন্য এক সত্তার তীরে। রায়হান শেরোয়ানি খুলে ছুড়ে ফেলে ফ্লোরে। গায়ে সাদা গেঞ্জি। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে পড়ে। নিপার পায়ে থাকা নুপুর গুলো খুলে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে‌।

 

ঘরের ডিমলাইটের আলোয় দুটো আত্মার মিলন বেশ অস্পষ্ট অবয়ব হিসেবে ধরা দেয়। ঘর ভরে উঠে দুই মিলিত সত্তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে। বাইরের ঠান্ডা প্রকৃতিও যেন ঘরের এই উষ্ণতার পারদকে কমাতে পারেনি। হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে থাকে কিছু সুখের শব্দাভাস।

 

চলবে ,

 

 

গল্প:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫০

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায় রায়হান। ধীরে ধীরে হাত দুটি নামিয়ে আলতো করে বিছানায় রাখে নিপার তুলার মতো নরম দেহটাকে। নিপার কোমড়ের উপর থেকে কিছুটা শাড়ি সরে গিয়েছিলো। পেটের কিছুটা সাদা অংশ দারুন ভাবে আকৃষ্ট করছিলো রায়হানকে। রায়হানও চলে যায় এক অচেনা ঘোরে। হাত দিয়ে শেরওয়ানির বোতায় গুলো খুলতে থাকে। নিপা এক সরু নয়নে চেয়ে আছে রায়হানের দিকে। সে যেন রায়হানকে নিয়ে এক অগভীর সমুদ্রে ডুবে যেতে চায়। সাঁতরে উঠতে চায় অন্য এক সত্তার তীরে। রায়হান শেরোয়ানি খুলে ছুড়ে ফেলে ফ্লোরে। গায়ে সাদা গেঞ্জি। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে পড়ে। নিপার পায়ে থাকা নুপুর গুলো খুলে ছুড়ে ফেলে‌ ফ্লোরে।

 

ঘরের ডিমলাইটের আলোয় দুটো আত্মার মিলন বেশ অস্পষ্ট অবয়ব হিসেবে ধরা দেয়। ঘর ভরে উঠে দুই মিলিত সত্তার উষ্ণ নিঃশ্বাসে। বাইরের ঠান্ডা প্রকৃতিও যেন ঘরের এই উষ্ণতার পারদকে কমাতে পারেনি। হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে থাকে কিছু সুখের শব্দাভাস।

 

 

 

পূর্ব দিগন্ত হতে সূর্য বেড়িয়ে আসতে থাকে। আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধরিত্রীর মাঠ-ঘাট-প্রান্তরে। পাখির কলাতান শুনতে পাওয়া যায়।

 

বিছানায় ঘুমিয়ে আছে রায়হান। উবুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহের উপর জড়িয়ে আছে সাদা কম্বল। গোসলখানার দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে নিপা। গায়ে এক হালকা শাড়ি, মাথার ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে আলতো করে মুছতে মুছতে এগিয়ে যায় ব্যালকনির দরজার দিকে। ব্যালকনির দরজা খুলে দিতেই দিনের আলো এসে পড়ে তার মলিন মুখে। হাত দিয়ে সেই আলোকে মুখে পড়া হতে আটকাবার ব্যার্থ চেষ্টা করে সে।

 

ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়ায়। চারপাশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। হালকা মৃদু কুয়াশা পড়েছে। দিনের আলো সেই কুয়াশার পারদ ভেদ করে তার চোখের পাতায় লেগে থাকা জলের ফোঁটায় এসে চিকচিক করছে। রেলিংয়ে হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকায় নিপা। দেখে তার শাশুড়ি মা বাগানের ফুলের গাছ গুলোয় পানি দিচ্ছেন। হয়তো বাগান করা তার শখ। আর বাগান টাও তাঁর নিজেরই। নিপা তা দেখে এক স্মাইলি ফেইস করে। ব্যালকনিতে থাকা বেতের চেয়ার গুলোর একটা টেনে সেটায় বসে। চুল গুলোকে হাত দিয়ে সামনে নিয়ে তোয়ালে দিয়ে পানি মুছতে থাকে।

 

ব্যালকনি আর বিছানা প্রায় সমান সমান। ব্যালকনির খোলা দরজা থেকে আলো এসে পড়ে রায়হানের মুখে। চোখের বন্ধ পাতা গুলো নড়েচড়ে উঠে। চোখের পাতা মেলে রায়হান, ঝাঁপসা কিছু অবয়ব ধরা দেয় তার চোখে। ধীরে ধীরে সেই ঝাঁপসা অবয়ব তার স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে তার কাছে। নিপা বসে আছে ব্যালকনিতে। ব্যালকনির এক সাইড ধরে জারুল গাছ টার একটা ডাল উঠে গেছে। সেই ডালের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলো এসে ব্যালকনিতে বসে থাকা এক রমনীর উপর পড়ছে, তারপর সেই ছায়া সমৃদ্ধ আলোর ঝিলিক এসে তার ঘুম ঘুম চোখে ধরা দিচ্ছে। রায়হান সরু সরু চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। নিপা তার চুল গুলো সামনে করে নেওয়ায় তার পিছনের কোমর ও পিঠ একদম উদ্যম। ঘাড় থেকে দু ফোঁটা পানি নিপা পিঠি বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। রায়হানের যেন হিংসে হতে থাকে সেই পানির ফোঁটার উপর। কেন সে নিপার দেহের উপর দিয়ে পড়লো,! রায়হান শোয়া হতে উঠে বসতে থাকে‌। সাদা কম্বল টা কোলে পড়ে যায় গা থেকে। বুকের লোম আর মাংস পেশী গুলো যেন দিনের আলোতে আরো উজ্জ্বল রুপ নিয়েছে। আড়মোরা ভাঙতে ভাঙতে হাত দুটো একসাথে উপরে তোলে রায়হান। তার মুখ থেকে বেড়োনো শব্দ পেয়ে নিপা পিছন ফিরে তাকায়। দেখে রায়হান উঠে পড়েছে। নিপার চোখ আটকে যায় রায়হানের বুকের মৃদু লোম গুলোর উপর। দেখেই তার শরীর শিউরে উঠতে থাকে। কাল রাতে এই লোম গুলো তার শরীরে লেগে এক স্বর্গ সুখ পেয়েছিলো সে। কাল রাতে কথা মনে পড়তেই মনে লজ্জা জেঁকে বসে। নিপা এক লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে সামনে তাকায়।

 

রায়হান বিছানা থেকে নামে। মন তো চাইছে ব্যালকনিতে গিয়ে নিপার সাথে একটু সুন্দর সময় কাটাতে। আজকে বাইরের প্রকৃতিও দারুন লাগছে। অনেকদিন পর সকালে সূর্যের দেখা মিলেছে। হয়তো এই আলোটা নতুন, বার্তা বইয়ে দিচ্ছে নতুন কিছুর। রায়হান ধীর পায়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায়। নিপার হঠাৎ কী জানি মনে হওয়ায় সে পিছন ফিরে তাকায়। দেখে রায়হান বিছানা থেকে নেমেছে। তার দিকেই আসছে। নিপা সৌজন্যমূলক হাঁসি দেয়। তার নজর রায়হানের পুরো শরীরের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পড়ার সাথে সাথেই যে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়। হাতের দুই তালুতে মুখ লুকায়। পিছনে দাঁড়ানো রায়হান এতে কিছুটা অবাক হয়। তখনই নিপা ধীর মিষ্ট গলায় বলে উঠে।

– রায়হান,! যাও কাপড় পড়ো আগে ,!

রায়হান নিচের দিকে তাকায় দেখে তার দেহে বিন্দুমাত্র সুতো অবশিষ্ট নেই। ভুলেই গিয়েছে সে কাল রাতের কথা। নিচে তাকানোর পর মনে আসতেই মাথা চুলকাতে থাকে। লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলতে থাকে‌।

– ওপসস,! আসলে আমি ভুলেই গেছিলাম বিষয় টা।

বলেই বিছানার চাদর টা টেনে নিজের দেহের সাথে জড়িয়ে নেয় সে। নিপা হালকা আড়চোখে পিছনে রায়হানের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে। দেখে রায়হান চাদর টাকে টেনে শাড়ির মতো পড়তেছে। দেখেই তার মুচকি হাসি বেড়িয়ে আসে। রায়হানকে এবার দেখতে জম্পেস লাগছিলো। নিপার বেতের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। চুল গুলো সামনে থেকে পিছনে দিয়ে ঘুরে চলে যেতে থাকে রায়হানের দিকে।

 

রায়হান চাদরের এক কোণকে শাড়ির আঁচলের মতো করে ডান কাঁধে ফিকে মারে। নিপার এসে তার সামনে সামনি দাঁড়ায়। রায়হানকে দেখে মুখে হাত চেপে হেঁসে ফেলে। রায়হান দুই হাত নিজ কোমড়ে দিয়ে নিপার হাঁসি দেখতে থাকে। নিপা হাসা থামিয়ে রায়হানের বুকে একটা ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে বলে।

– যাও, গোসল দিয়ে এসো। আমি কিন্তু সকাল সকাল উঠে গোসল করে ফেলছি। এবার তোমার পালা।

রায়হান পাশ ফিরে দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে তাকায়। দেখে ৭ টা ২৫ বাজে। রায়হান নিপার দিকে ফিরে তার এক হাত ধরে হেঁচকা টানে তাকে নিজের বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। নিপা নিজেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকে। এই বিশাল দেহির সাথে সে নিতান্তই নগন্য। নিপা বলে উঠে।

– ছাড়ো। তুমি এখন নাপাক। আমি গোসল দিয়ে আসছি না। যাও আগে গোসল দিয়ে এসো, তারপর আমায় ছুবে।

– চলোনা একসাথে গোসল করি।

নিপা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায়। একই সাথে অবাকও হয় আবার লজ্জাও পায়। তার মুখের ভঙিমা তো তাই বলছে।

– না না। কী বলছো এসব,! আমি যেতে পারবো না। তুমি একলা যাও‌।

– চলো না,!

– না বলছিনা ,! যাও,!

রায়হান নিপাকে ছেড়ে দেয়। নিপা তার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে পিছন ফিরে ব্যালকনির দিকে তাকায়। বলতে থাকে।

– তাড়াতাড়ি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসো। আজ ও বাড়িতে যেতে হবে।

– কেনো ?

– কেনো আবার ,! এটাই তো নিয়ম। (একটু থেমে) যাও তাড়াতাড়ি গোসল করো। তারপর একসাথে নিচে যাবো‌।

– আচ্ছা ম্যাডাম। জো আপকি মার্জি ,!

বলেই গোসল খানার দিকে যেতে উদ্যত হয় রায়হান। তখনই তার তোয়ালে নেওয়ার কথা মনে পড়ে। নিপাকে উদ্দেশ্য করে বলে‌।

– তোয়ালেটা ,!

নিপা তোয়ালেটা নিয়ে রায়হানের দিকে ফিরে। তোয়ালেটা দেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় তখনই সে দেখে রায়হানের সাথে জোরাজুরি করার সময় রায়হানের দেহ থেকে সাদা চাদর টা পড়ে গিয়েছে, আর রায়হানের দেহ এখন একদম খোলা,উদ্যম। নিপা সাথে সাথেই লজ্জা পেয়ে আবার ব্যালকনির দিকে ফিরে তাকায়। নিপার আরো লজ্জা পাওয়া দেখে রায়হান বুঝতে পারে তার গা আবার ফাঁকা। রায়হান একটা মুচকি হাসি হেঁসে বলতে থাকে।

– আমি ভিতরে যাই। তারপর তোয়ালেটা দরজার সামনে এসে দিয়ে যেও কেমন ,!

নিপা ব্যালকনির দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকা অবস্থাতেই মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়।

রায়হান চলে যায় গোসল খানার দিকে। গোসল খানা রুমের ভিতরেই। এটাচ যাকে বলে আরকি।

 

গোসল খানায় ঢুকে পড়ে সে। ভিতরের আয়নায় নিজের মুখশ্রী দেখতে থাকে। চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে থাকে। তখনই দেখে তার গালে গলায় লিপস্টিক লেগে আছে। বুঝতে বাকি রইলো না, এটা সব কাল রাতের ফলাফল। রায়হান একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে মুখ ধুতে শুরু করে। মুখের পানির ঝাপটা দিতে থাকে দু হাত দিয়ে।

তখনই গোসল খানার দরজায় কড়া নারার আওয়াজ। সাথে এক মৃদু গলার স্বর।

– তোমার তোয়ালে টা,!

রায়হান পিছন ফিরে তাকায়। বুঝতে পারে নিপা গোসল খানার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান গিয়ে দরজা পুরোটা মেলে দেয়। নিপা অন্যদিকে ফিরে তোয়ালের হাতটা বাড়িয়ে রেখেছিলো। রায়হান ঠোঁট কামড়ে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে নিপার তোয়ালে ধরা হাতটা হেঁচকা টান মেরে তাকে গোসল খানার ভিতরে নিয়ে আসে। নিপাকে ভিতরে নেওয়ার সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিপার বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। গোসল খানার মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান দরজা লাগিয়ে তার দিকে ফিরে। নিপার মুখে ছিলো এক লজ্জা মিশ্রিত ভয়। রায়হান ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার দিকে। নিপা এক পা দু পা করে পিছিয়ে যেতে থাকে। তখনই রায়হান হাত বাড়িয়ে ঝরনা ছেড়ে দেয়। ঝরনার পানি এসে নিপার গায়ে পড়তে থাকে। হঠাৎ ঝরনার পানি তার উপর পড়ায় সে কিছুই বুজে উঠতে পারে না। হাত দিয়ে মুখের উপর পড়তে থাকা পানি আটকাবার ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকে। রায়হান ভিজতে থাকা নিপার শাড়ির আঁচল টা ফেলে দেয় ফ্লোরে। নিপা ভয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে তখনই বুঝতে পারে তার পিঠ দেওয়ালে এসে ঠেকেছে। রায়হান এগিয়ে এসে। তার মুখের উপর থেকে চুল গুলো সড়িয়ে কানের দিক রাখে। ঝরনার পানি এখন তার গাঁয়ের উপরও এসে পড়ছে। নিপা ঘাড় ঘুরিয়ে একপাশে করে নেয়। রায়হান সাদা ধবধবে চামড়ার ঘাড়ে পানির ফোঁটা বিন্দু বিন্দু ফোঁটা পড়তে দেখে। বেশ লোভ হয় তার। জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে মুখ বসায় সে। নিপাও আর বাঁধা দেয় না। দুজনের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে।

গোসল খানাটা ভিতর দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করা ছিলো আর মাঝে ছিলো এক কাঁচের দেয়াল। নিপাকে সেই কাঁচের দেয়ালের উপর ফেলে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রায়হান। ঝরনার পানিতে ভিজতে থাকা নিপার দেহ কাঁচের দেয়ালের সাথে লেপ্টে যায়। রায়হান তাকে দেয়ালের সাথে পিছন থেকে চেপে ধরে তার ঘাড়ে চুমু খেতে থাকে। ঝরনার পানি পড়ছে দুজনের উপর। সকালের সেই ঠান্ডা পানি যেন তাদের গাঁয়ে পড়ে মুহুর্তেই উষ্ণ হয়ে নিচে পড়ছে। নিপা আর রায়হানের ঘন নিঃশ্বাসে কাঁচের দেয়াল ঝাপসা হয়ে যায়। সেই ঝাঁপসা দেয়ালে মাঝ দিয়ে দেখা যায় দুটো অবয়বের মিলনমেলা ,! মিষ্টি কিছু সুখ শব্দ ভেসে আসতে থাকে কাঁচের দেয়ালের অপর প্রান্ত হতে ,!

 

 

 

মেঘলা আকাশের মতো গম্ভীর মুখ করে ঘরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দিথী। বিছানায় বসে সামিহা, কানিজ আর তানিয়া তার দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সকাল থেকেই মুখে একপ্রকার কুলুপ এঁটেছে দিথী। কোন কথাই বলছেনা। ঘরের দরজা মেলানো। জানাল আর দরজা দিয়ে বাইরের আলো এসে ঘরে পড়ে ঘরকে আলোকিত করেছে। তাদের মধোকার নিরবতা ভেঙ্গে সামিহা বলে উঠে।

– দেখছো আপু। এভাবেই কাল রাত থেকে চুপচাপ হয়ে আছে ও। কিছুই বলতেছে না। তাই তোমাদেরকে ডাকে আনলাম।

সামিহার কথা শুনে তানিয়া চিন্তিত হয়। সামিহার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দিথীকে বলতে থাকে।

– দিথী, কী হয়েছে তোমার। এমন গম্ভীর হয়ে বসে আছো কেনো,! (তানিয়া)

– আচ্ছা ও কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেনি তো রাতে ,! (কানিজ)

– এমন কিছু তো হওয়ার কথা না। এই ঘরে আসুভে ঢুকতে পারবেনা। তার কোন জাদু শক্তিও এখন নেই। কোন স্বপ্নই সে দিথীকে দেখাতে পারবেনা।

– সামিহা, দরজাটা বন্ধ করে দে।

হঠাৎ দিথীর মুখ থেকে কথা শুনে তিনজনই দিথীর দিকে চেয়ে থাকে। দিথী দেয়ালের দিকে মুখ করে হাতের উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের এক প্রান্তে। সামিহা মুখ দিয়ে তানিয়াকে ইশারা করে বলে ‘কী করবো,?’

তানিয়া শব্দ করে বলে,

– যাও লাগিয়ে দিয়ে এসো।

সামিহা বিছানা থেকে নেমে যায় দরজার দিকে। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে বিছানার দিকে আসতে থাকে। দেখে দিথী দেয়ালের পাশ থেকে ফিরে পড়ার টেবিলের সামনে থাকা একটা চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসেছে। সামিহা আর দিথীর সামনে দিয়ে গিয়ে বিছানার আরেক প্রান্তে উঠার সাহস পায় না। দিথীর এমন মুখশ্রী দেখে তার নিতান্তই ভয় লাগছে। সামিহা তানিয়ার পাশেই বসে পড়ে। তানিয়া বলতে শুরু করে।

– তোমার কী হয়েছে দিথী ,! কাল আমি আর কানিজ ছিলাম বাড়ির পিছনের প্যান্ডেলে। তুমি আর সামিহা তো ছিলে নিপার কাছে। কিন্তু সামিহা বলতেছে তোমাকে নাকি পরে আর ওরা দেখেনি ,! শাহারিয়ার সাথে বলে গেছিলে। (একটু থেমে) শাহারিয়ার সাথে কী তোমার কোন মনোমালিন্য হয়েছে ,!

– না। (একটু থেমে মুখ তুলে তানিয়াদের দিকে চেয়ে) আমি যা যা বলবো তা একটু মন দিয়ে শুনিও আপু। একটাও অবিশ্বাস করোনা।

দিথীর হঠাৎ এমন কথায় তানিয়া, সামিহারা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে। তারপর দিথীর দিকে ফিরে বলে।

– কী হয়েছে তোমার দিথী ,! কোন সম,

– না। কোন সমস্যা না।

– আসুভে কী তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো,! আমরা তো পিছনে ছিলাম। তুমি যদি একলা শাহারিয়ার সাথে থেকেই থাকো তাইলে তো আসুভে সেই সুযোগ টা নিতে চাইবে। কোন খারাপ কিছু কি,

– না, ওটা আসুভে ছিলোনা।

– কোনটা,!

দিথী তানিয়াদের দিকে মুখ তুলে তাকায়। গম্ভীর গলায় বলা শুরু করে।

– শোনো তাইলে,

” তুমি আর কানিজ আপু বাড়ির পিছনে ছিলে। সামিহা, ইকরা সহ আরো কয়েকজন বান্ধবীর সাথে আমি নিপার সাথে ছিলাম। সবাই হাসিখুশিই কথা বার্তা বলছিলাম। তখনই বরযাত্রী চলে এলো। ঘরে থাকা সবাই দৌড়ে চলে গেলো সেদিকে। আঙিনা, বাড়ি মুহুর্তেই যেন সব ফাঁকা হয়ে যায়। আমি নিপার সাথে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম, হাসাহাসি করেছিলাম। তখনই হঠাৎ আমাদের ঘরের দরজা জোরে বন্ধ করার শব্দে আমাদের ঘোর ভাঙে। সামনে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে লম্বা একটা ছুরি হাতে নিয়ে, ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়েছে। মেয়েটার বয়স হবে ১৮ কী ১৯। নিপা আর আমার মুখের হাসি নিমেষেই যেন উধাও হয়ে যায়। মেয়েটা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। (তানিয়ার দিকে ফিরে) মনে আছে তানিয়া আপূ, তুমি আমায় বলেছিলে আসুভে একলা পেলে আমার উপর আঘাত করতে পারে। তাই এমন কোন পরিস্থিতিতে আমি পড়লে যেন চিৎকার করে উঠি, সবাইকে ডাকা শুরু করি ,! কিন্তু না। মেয়েটা আমাকে মারতে আমার দিকে এগোয়নি। (একটু থেমে) বরংচ নিপাকে মারতে নিপার দিক এগিয়েছিলো ,!

দিথীর মুখ থেকে কথাটা শোনার সাথে সাথেই তানিয়া আর সামিহারা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়‌। তারপর দিথীর দিকে তাকিয়ে বলে,

– বলো কী ,! তারপর !

– নিপার হয়তো কাল বিয়ে নয়, জানাজা পড়তে হতো যদি ঐসময় আমি না থাকতাম। মেয়েটার ছুরিটা নিপার গলা ঢুকার ২ ইন্চি আগেই থেমে যায়। আমি সেই মেয়ের হাত ধরে ফেলি। মেয়েটা রাগান্বিত হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দিয়ে আবার নিপার উপর আক্রমণ করতে যায়।

– তারপর,!

– আমি ওকে বুঝিয়ে দেই যে আমি কে ,! (এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে) ওর মৃত্যু হয়তো আমার হাতেই লেখা ছিলো ,! (একটু থেমে) আমি সাথে সাথেই তার সঙ্গে ফাইট করতে লেগে যাই। আশ্চর্যজনক কথা হচ্ছে সেও ট্রেইনড কোন কিলার ছিলো। তার আর আমার মাঝে তুমুল মারামারি হয়, ধস্তাধস্তি হয়। এবং এক পর্যায়ে তাকে আমার কাছে হার মানতেই হয়। ছুরি টা তার হাত থেকে নিয়ে তার শরীরে যে কত বার বিধে দিয়েছি তা গণনার বাইরে।

– দ,দিথী ,! তুমি কি নিজের হুঁশে আছে ,! (চিৎকার করে) তুমি কাল খুন করেছো ঐ বাড়িতৈ ,!

– হ্যা। করেছি খুন। খুন না করে কি নিজের প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে বিয়ের সাজে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখতাম ,! তার বাঁধা নতুন স্বপ্ন শুরুর আগেই নিঃশেষ করে দিতাম ,?

– ল,লাশ টা কই ফেলছিস তুই ,! (ভয় ভয় কন্ঠে সামিহা বলে)

– লাশ টা কাঁধে করে নিয়ে আমি সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। গন্তব্য ছিলো নীলগিরি জঙ্গল। জানিনা আমার কী হয়েছিলো,! নিজের মাঝে অন্য এক সত্ত্বাকে অনুভব করতে পারছিলাম। আমার মাথায় তখন খালি এই কথাটাই ঘুরছিলো ” আমার সামনে অন্যায় আর পাপীদের কোন ক্ষমা নেই” আমার মাঝে একই সাথে কাউকে মেরে ফেলার অনুশোচনাও হচ্ছিলো। দোটানায় পড়ে গিয়েছিলো আমার মস্তিষ্ক। (একটু থেমে) আমি তখন রাস্তা দিয়ে লাশ কাঁধে করে হেঁটে যাচ্ছিলাম। বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ বিয়ে বাড়িতে যাওয়ায় রাতের আকাশ আর তার মাধে চলে যাওয়া কাঁচা রাস্তা, দুটোই শুনশান আর নিরব ছিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর আমি একটা মিনি ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। ট্রাকে সবজি ছিলো। হয়তো গ্রাম থেকে সবজি বোঝাই করে তা শহরে নিয়ে যাচ্ছিলো বিক্রির জন্য। মিনি ট্রাকের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে রাস্তার পাশে বসেছিলো। আমি নিঃশব্দে গিয়ে লাশটাকে সেই গাড়ির মধ্যে ফেলে দিয়ে আসি। এক পাতা পরিমাণও শব্দ হয়নি তাতে। (একটু থেমে) লাশ রেখে বাসায় ফিরি। ঐ মেয়েটাকে মারার সময় ছিটকে আসা রক্ত দিয়ে আমার চোখ মুখ ভরে ছিলো। বাসায় এসে গোসল খানায় গিয়ে গোসল করি। রক্ত মাখা শাড়ি বদলে অন্য জামা পড়ে আবার ও বাড়িতে যাই। গিয়ে নিপাকে একবার দেখেই ফাঁকা এক ঘরে গিয়ে নিজের গোসল করার চিহ্ন অর্থাৎ ভেজা চুল গুলো শুকাই।

– কিন্তু তুই যদি একজনকে নিপার ঘরে মেরে থাকিস, তাইলে পড়ে আমরা গিয়ে কোন রক্তের দাগ পেলাম না ক্যানো।

– মা মুছে দিয়েছিলো। (মুখ তুলে চেয়ে) আমি ঘরের মধ্যে মায়ের আত্মার উপস্থিতি বেশ ভালো ভাবেই টের পেয়েছিলাম।

– তুমি সেই মেয়েটার সাথে ফাইট করলে কীভাবে,! আর ঐ কিলার যে ফাইটের ট্রেইনিং নিয়েছিলো তা তুমি কীভাবে বুঝলে,! (তানিয়া)

কথা শুনেই দিথী তানিয়াদের দিকে একবার চায়, তারপর আবার নজর নিচের দিকে করে বলে।

– তোমরা হয়তো জানো যে আমি এই আনন্দপুরে আছি ২ বছর ধরে। ৫ বছর বয়স থেকেই আমি আমার নানু বাসা রংপুরে ছিলাম। সেখানেই বড় হয়েছি। সেখানকার স্কুলে আমি মার্শাল আর্ট শিখেছি। কুংফুতে আমার ব্লাক বেল্ট ও আছে। (বলেই আড়চোখে তানিয়ার দিকে তাকায় দিথী)

– তুমি এসব যানো ,! আগে কেনো আমাদের বলোনি তাইলে ,!

– কখনো তেমন পরিস্থিতি হয়ে উঠেনি। আর তোমার কেউ এই বিষয় নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস ও করোনি।

 

সবার মাঝেই নেমে আসে পিনপন নিরবতা। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকতে থাকা শো শো বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। তানিয়া, কানিজ , সামিহা হতবাক। দিথীর সম্পর্কে শুনে, কাল রাতের ঘটনার বর্ণনা পেয়ে তারা যেন এক প্রকার বাক রুদ্ধ। কী বলবে। কিছুই যে তাদের মুখ দিয়ে বেড়োচ্ছে না। তখনই হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। তানিয়া চকিতে দরজার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ মৃত্যুর গল্প শুনে তাদের মনে একপ্রকার ভয়ই জেঁকে বসেছিলো। তাই হঠাৎ কারো কড়া নাড়ার শব্দ তাদের কাছে যেন আঁধার রাতের কালকুঠুরি হিসেবে ধরা দিয়েছে। তানিয়া কাপো কাপো গলায় বলে।

– ক,কে ওখানে ,!

– আফামনি, আমি শেফালী। খালাম্মায় আপনাগো লাইগা নাস্তা পাডাইছিলো। হেই গুলা লইয়া আইছি।

তানিয়া, সামিহারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তানিয়া বললো।

– সামিহা যাও, দরজাটা খুলে দিয়ে এসো।

সামিহা নেমে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে খাবারের ট্রে নিজ হাতে নিয়ে সামিহার সাথে কথা বলতে থাকে। কিন্তু সবই যেন অস্পষ্ট বাক্য হিসেবে দিথীর কানে ধরা দেয়। তার মস্তিষ্ক যেনো এখনো দোটানায় ভুগছে। চেয়ারে বসে থাকা দিথী নিজের হাতের দিকে তাকায়। এই হাত দিয়ে কাল সে ঐ মেয়েটাকে মেরেছে। তার অনেক অনুশোচনা হচ্ছে এই বিষয়ে। মন মল্লিকা যেন গম্ভীর সাগরের অতলে হারিয়েছে। দিথীর মুখশ্রী আবার কালো হয়ে যায়। মন খারাপের মেঘে ছেয়ে যায় তার মুখ,! এই খুন যে তাকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে,! শান্ত, স্বল্পভাসী দিথী কিনা একটা মেয়েকে খুন করলো ,!

 

 

 

– বলতাছি তো আমি আয়ানরে লইয়া যাই নাই।

– না চাচা। আপনিই নিয়ে গেছিলেন। আপনাদের অটো যাচ্ছিলো রাস্তা দিয়ে। আমি দেখেছি।

– কিন্তু মঈনুল তো অটো নিয়া ভাড়া মারতে বাইর হইছিলো। ঐদিন আমরা আমাগো অটোতে কইরা গাঁয়ে হলুদে যাই নাই। পায়ে হাইট্টা গেছি।

রাশেদ রক্ত লাল চোখে জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে

– আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। আপনি গিয়েছিলেন। আমার আয়ান কোথাও,! ওকে আমার কাছে ফেরত দিন। এখুনি ফেরত দিন ,!

– গলা নামাইয়া কথা কও রাশেদ। আমার বাড়িতে আইসা আমারে ধমকাইতেছো,!

– হ্যা হ্যা ধমকাচ্ছি। আপনি আমার আয়ানকে ফেরত দেন। আমার আয়ানকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন বলুন। (কাঁচা বাড়ির দুয়ারের দিকে তাকিয়ে) আয়ান, আয়ান, আমি তোকে নিতে আসছি, আয়ান,

– কী আয়ান আয়ান শুরু করছো ,! তোমারে না একবার কইলাম আয়ানরে আমরা লইয়া যায় নাই। ক্যান তুমি আরো কথা বাড়াইতাছো,!

রাশেদ হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার সামনে। হাত জোড় করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে থাকে,

– হাসিবুল চাচা, আমার আয়ান যদি আপনাদের কাছে থাকে প্লিজ আমাকে দিয়ে দিন। ওকে আমি সেদিন থেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। প্লিজ আয়ানকে দিয়ে দিন।

লোকটার মুখের ভঙি বদলে যায়। রাগান্বিত চেহারা নিমেষেই মলিন হয়ে যায় রাশেদের কান্নাভেজা মুখ দেখে। তিনি রাশেদের হাত দুটো ধরে বলতে থাকেন।

– রাশেদ, আমরা আসলেই আয়ান রে লইয়া যাই নাই। মঈনুল অটো লইয়া ভাড়া মারতে গেছিলো। হয়তো অন্য কেউ সেই অটোতে কইরা আয়ানরে কোথাও নিয়া গেছে। (একটু থেমে) আয়ান আমারে দাদু বইলা সম্মোধন করতো। একটা মা হারা ছোট পোলাডারে আমরা ক্যান নিতে যামু। আমাগো স্বার্থ কী এইহানে কও তুমি,!

রাশেদ ছলছল চোখ নিয়ে লোকটার দিকে মুখ তুলে তাকায়। হাসিবুল চাচার মুখশ্রীই বলে দিচ্ছিলো আয়ানকে নিয়ে তিনি কিছু করেননি। উল্টো আয়ানের জন্য তারও চিন্তা হচ্ছে। রাশেদ কান্নায় ভেঙে পড়ে।

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শম্পা আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। রাশেদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাকে ধরে উঠাতে থাকে। কাঁচা খরের বাড়ির আঙিনায় রাশেদের এ যেন এক অসহায় আত্মসমর্পণ। শম্পা রাশেদকে ধরে কোনমতে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে থাকে। পিছনে দাঁড়ানো লোকটারও চোখ ছলছল করছে। সে করবেই বা কী, সকাল সকাল হঠাৎ কোন কিছুর জন্য তাকে দায়ী করানো হলে সে নিজেকে ভুল না প্রমাণ করে আর করতোই বা কী ,!  লোকটা চোখের পানি মুছে ঘরের দিকে চলে যায়। আকাশের সূর্য ধীরে ধীরে মাথার উপরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

 

 

 

নিপার ঘর। নিপা আর রায়হান এ বাড়িতে এসেছে হলো কিছুক্ষণ। নিপার পড়নে একটা সবুজ শাড়ি। রায়হানের পড়নে একটা জিন্স প্যান্ট আর ফুল হাতা শার্টা। দিথী, সামিহারাও এসেছে এখানে। তবে তানিয়া, কানিজ রা আসেনি।

বিছানায় বসেছে নিপা আর রায়হান। আর বিছানার সামনে কয়েকটা চেয়ার নিয়ে বসে ইকরা, শিউলি, আফাজ, সামিহা, দিথী আর শাহারিয়া। গল্পে মজেছে সবাই। কিছুক্ষণ পর পর সবাই আবার একসাথে হেসেও উঠছে। দিথীও কিছুটা হাসার চেষ্টা করছে তাদের সাথে। শাহারিয়া তার পাশের চেয়ারেই বসা। এক পলক তার দিকে চেয়ে আবার গল্পের দিকে মন দেয়।

তখনই গল্প করতে করতে হঠাৎ নিপা মুখ চেপে হাঁচি দিয়ে ফেলে। রায়হান তৎক্ষণাৎ তার রুমাল বের করে এগিয়ে দেয় তার দিকে। নিপা রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে থাকে। এসব দেখেই সামিহা বলতে থাকে।

– দেখছেন চাচি ,! মাইয়ারে ঠিক জামাইয়ের হাতেই তুইলা দিছেন। (একটু থেমে রায়হানের দিকে তাকিয়ে) দেখছেন কতো কেয়ার করে ,!

– দেখতে হইবো না জামাইডারে কেডা চয়েজ করছে ,! (বলেই আড়চোখে নিপার দিকে তাকান শিউলি বেগম। সকাল সকাল নিপাদের দেখে তার মন ভালো হয়ে গেছে‌। তাই আবারো আগের মতো মজে উঠেছেন হাস্যোরসে। নিপার শিউলি বেগমের কথা শুনে মাথা নিচু করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে। তখনই ইকরা বলে উঠে।

– চাচি। বুজছেন গোসল খানায় বেশিক্ষণ গোসল করলে আর খালি গায়ে এই শীতের সময় বেশিক্ষণ থাকলে, ঠান্ডা একটু আধটু লাগারই কথা।

ইকরার কথা শুনেই সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। রায়হানও মাথা নিচু করে লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। এদিকে নিপার গাল লজ্জায় লাল টুসটুসে হয়ে গেছে‌। ও পাড়তেছে না কিছুতে মুখ লুকাইতে, পারতেছেনা কিছু বলতে। মাথা নিচু করে আড়চোখে রায়হানের দিকে তাকায়।দেখে রায়হানও আড়চোখে এতোক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো। চোখে চোখ পড়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসতেছে। নিপা মনে মনে বিরবির করে বলতে থাকে।

‘ খুব হাঁসি পাইতেছে না ,! আজকে বাড়ি চলো,! তারপর তোমার হাসি বের করতেছি ,!’

শিউলি বেগম তখনই বলে উঠেন।

– হইছে হইছে আমার মাইয়াডারে তোমরা ছাইড়া দাও। অয় এমনিই লাজুক, আরো তোমাগো কথায় বেশি কইরা লজ্জা পাইতাছে।

– ফুফু, একজনের বিদাই তো দিয়ে দিলে। আরেকজনের কথা কী ভুলে গেলে ,! দিথীরও তো ঠান্ডা লাগাবার জন্য একটা মানুষ চাই ,! (বলেই মুখ চেপে হাসতে শুরু করে ইকরা)

দিথী এসব শুনে তাড়াতাড়ি মাথা নামিয়ে একটা দুষ্টু চাহনি নিয়ে শাহরিয়ার দিকে তাকায়। শাহারিয়া থতমত খেয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে লজ্জাভরা মুখখানা লুকাতে থাকে। শিউলি বেগম বলতে থাকেন,

– আমার পোলা মাইয়া দুইডাই হইছে লাজুক। অবশ্য দুইডার লাইগা যেমন কদু তেমন লাউও পড়ছে ,! হা হা হা হা

সবাই শিউলি বেগমের কথা শুনে জোরে হেসে উঠে। ঘরে যেন মুহুর্তেই একটা আনন্দঘন হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

 

আহনাফ বারান্দা দিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে তার ঘরের দিকে যাচ্ছিলো। তার ভাবনার বিষয় যে দিথীর সাথে কথা বলা আর আশরিফ কে খুঁজে বের করা নিয়ে, তা আর আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না। হঠাৎ হাসাহাসির শব্দ তার কানে আসতেই সে নিপার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। পর্দার আড়াল দিয়ে দেখে বেশ অনেকেই ভিতরে আছে। হঠাৎ তার মনে একটা জিনিস জেগে উঠে ,!

” আচ্ছা এখানে তো অনেকেই আছে। এদেরকে আশরিফের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয় ,! (একটু থেমে) এখন তো তারা আড্ডায় মেতে আছে। বলাটা কী ঠিক হবে ,! না। এইবার একবার বলেই দেখি। যদি এখানকার কেউ আশরিফ নামের কাউকে চিনে থাকে,!”

 

ভেবেই আহনাফ সাথে সাথে ঘরে প্রবেশ করে ফেলে। সবাই হাসাহাসির মাঝে আহনাফকে দেখে হাসার পরিমাণ কমাতে থাকে। শাহারিয়া বলে।

– আরে আহনাফ তুই ,! আয় বস।

– না স্যার, আমি ঘরে চলে যাবো আবার। শুধু একটা বিষয় জানতে এসেছিলাম।

– হ্যা বল।

– কথাটা সবাইকে বলতে এসেছিলাম। মানে গ্রামের একটা বিষয় নিয়ে জানার ছিলো। (একটু থেমে) তাই কেউ যদি এই বিষয় নিয়ে আমাকে একটু তথ্য দিতেন, খুব ভালো হতো ,!

– হ্যা বলো। আমরা সবাই ছোট থেকেই এই গ্রামে আছি। (রায়হান)

– দুলাভাই আমি তো বাইরের।(ইকরা)

– ও হ্যা তুমি বাইরের। তাছাড়া আমরা সবাই এখানকার। (আহনাফের দিকে তাকিয়ে) বলো কী জানতে চাও ,! (রায়হান)

– আচ্ছা আপনারা কী আশরিফ নামের কাউকে চিনেন ,! মানে এই গ্রামে আশরিফ নামের কেউ কী কখনো ছিলো ,!

– আশরিফ ,? এটা আবার কে ? (দিথীর দিকে ফিরে) তুমি চিনো ? (শাহারিয়া)

– না তো।

– বাজান, আশরিফ নামের তো কাউরে চিনিনা। তয় আশফিক নামে একটা পোলা আছে উত্তর পাড়ায়। কিন্তু হেয় তো ছোট। ১০ বছর বয়স মাত্র। (শিউলি বেগম)

– আশরিফ ,! উমম, নাম টা যেন কোথাও শুনেছি,! (মাথা চুলকাতে চুলকাতে রায়হান বলে)

– কোথায় শুনেছেন ভাইয়া,! একটু, একটু মনে করার চেষ্টা করেন,! (উৎসুক হয়ে আহনাফ বলে)

কিছুক্ষণ ভাবার পর রায়হান হঠাৎ বলে উঠে,

– হ্যা , ! মনে পড়েছে। আশরিফ বলে তো আমার বাবা আমাকে ছোট বেলায় ডাকতো। আমার নাম আশরিফ ছিলোনা। কিন্তু বাবার মুখ থেকে অনেক বার শুনেছিলাম আমাকে আশরিফ বলে ডাকতে। পরে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টা এড়িয়ে যেতেন।

 

চলবে ,

 

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫১

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– আচ্ছা আপনারা কী আশরিফ নামের কাউকে চিনেন ,,! মানে এই গ্রামে আশরিফ নামের কেউ কী কখনো ছিলো ,,!

– আশরিফ ,,? এটা আবার কে ? (দিথীর দিকে ফিরে) তুমি চিনো ? (শাহারিয়া)

– না তো।

– বাজান, আশরিফ নামের তো কাউরে চিনিনা। তয় আশফিক নামে একটা পোলা আছে উত্তর পাড়ায়। কিন্তু হেয় তো ছোট। ১০ বছর বয়স মাত্র। (শিউলি বেগম)

– আশরিফ ,,,! উমম,,, নাম টা যেন কোথাও শুনেছি,,,! (মাথা চুলকাতে চুলকাতে রায়হান বলে)

– কোথায় শুনেছেন ভাইয়া,,! একটু, একটু মনে করার চেষ্টা করেন,,! (উৎসুক হয়ে আহনাফ বলে)

কিছুক্ষণ ভাবার পর রায়হান হঠাৎ বলে উঠে,

– হ্যা ,,, ! মনে পড়েছে। আশরিফ বলে তো আমার বাবা আমাকে ছোট বেলায় ডাকতো। আমার নাম আশরিফ ছিলোনা। কিন্তু বাবার মুখ থেকে অনেক বার শুনেছিলাম আমাকে আশরিফ বলে ডাকতে। পরে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টা এড়িয়ে যেতেন।

– তোমাকে আশরিফ বলে ডাকতো ,,? (নিপা)

– হ্যা। ছোট বেলায় মাঝে মধ্যে বাবা আমায় এই নামে ডাকতো। (একটু থেমে) এই ধরো তখন আমার বয়স ৮-৯ ছিলো। (আহনাফের দিকে তাকিয়ে) এখন আমাকে আশরিফ ধরতেও পারো আবার না ধরতেও পারো। কারণ আমার বার্থ সার্টিফিকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স, কোথাও আশরিফ নামটা নেই।

– তার মানে তুমিই আশরিফ ,,! (বিরবির করে বলে আহনাফ)

– কিছু বললে ?

– ন,না ভাইয়া। তাইলে হয়তো অন্য গ্রামের আশরিফের কথা বলছে।

– কে বলছে ,,?

– আ,আমার এক বন্ধু।‌ ও বলছিলো আশরিফ নামে কারো খোঁজ পাইলে জানাইতে।

– ওহহ। না আমাদের গ্রামে তাইলে কোন আশরিফই নেই। আর আমাকে যে আশরিফ বলে ডাকে তা শুধু আমার বাড়ির লোকেরা মাঝে মাঝে শুনেছে আর আজ তোমরা শুনলে। ছোট বেলায় আমি কোন বন্ধুকে এই কথা বলিনি। হয়তো তোমার বন্ধু অন্য কোন আশরিফকে খুঁজছে।

– হয়তো,,,! আ, আচ্ছা আমি যাই তাইলে। আপনারা গল্প করুন।

– আরে না তুইও আয়,,,! বস। (শাহারিয়া)

– না মানে স্যার একটু পার্সোনাল কাজ ছিলো। পরে আমি আসবো ,,!

– আচ্ছা ঠিক আছে।

আহনাফ হনহন করে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। হঠাৎ আহনাফ কেনো আশরিফ নামের কাউকে খোঁজা শুরু করলো তা ঠিক শাহারিয়ার বুঝে আসলো না। তবে আহনাফের চেহারা দেখে সে বুঝেছে আহনাফ কিছু একটা তাদের থেকে লুকিয়ে গেছে।

দিথী হাত দিয়ে শাহারিয়াকে নাড়িয়ে দিতেই তার ঘোর ভাঙ্গে। দিথী মৃদু গলায় বলে,

– কী হলো ,,! চুপচাপ হয়ে গেলে যে।

– ন,না কিছুনা। (রায়হানের দিকে ফিরে হাসিমুখে) রায়হান,,! ছোট বেলায় তুমি আনন্দনগর প্রাইমারি স্কুলেই পড়েছিলে তাই না ,,!

– হ্যা। এখান থেকেই তো আমার পড়ালেখার যাত্রা শুরু।

– নিপাও এখান থেকেই পড়াশোনা শুরু করেছে। আর এখন ক,,,,,,,

কথার মাঝে ঘরে প্রবেশ করে মতিন মেম্বার। শিউলি বেগম হঠাৎ তাকে দেখে একটা মজার কথা বলে উঠেন। সাথে সাথেই রুমের সবাই হাসতে থাকে। মতিন মেম্বারও হাসতে হাসতে গিয়ে শিউলি বেগমের পাশের চেয়ারে বসে। আবার আড্ডা আলাপ চলতে থাকে। শাহারিয়া বাইরে থেকে হাসতে থাকলেও মনে মনে আহনাফের কথা গুলো মিলাচ্ছিলো। ভাবছিলো,

“আহনাফ ঐদিন দিথীকে তাসনুবা বললো, আর আজ আশরিফের খোঁজ করতে আসলো,,? ও এদের কে কেনো খুঁজতেছে ,,! ওর সাথে আমার একান্ত ভাবে কথা বলা উচিত ” তখনই শিউলি বেগম শাহারিয়াকে উদ্দেশ্য করে আরেকটা হাসির কথা বলেন। সবাই শাহারিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। শাহারিয়াও হাসিমুখ করে বিষয়টার সাথে তাল মিলিয়ে নিতে থাকে। ঘরের পরিবেশ আবার সুন্দর হাসি খুশি হয়ে যায়।

 

 

 

বাড়ির বাইরের আঙিনা। জলপাই গাছের নিচে বানানো বাঁশের বেত দিয়ে বসার যায়গাটায় বসে পা দুলাচ্ছে আলিশা। পড়নে কমলা শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ। হাতে কিছু কাঁচের চুড়ি। সময়টা এখন প্রায় দুপুর। আকাশের রোদ কিছুক্ষণ পর পর মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে মাটি ছুঁয়ে আমার পেঁজা তুলোর মতো মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। আঙিনা তাই কিছুক্ষণ পর পর রদ্রৌজ্জল আবার কিছুক্ষণ পর পর মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। প্রকৃতির এই রুপটাকে দারুন ভাবে উপভোগ করছে আলিশা। রাস্তা দিয়ে দুটো সাইকেল চলে গেলো। দূরে মাঠের কৃষকেরা দুপুরের খাবার খেতে ফসলি খেতের আলির মাঝে গোল হয়ে বসেছে। এক শাড়ি পড়া নারী খাবারের গামলা আর পানির জগ নিয়ে তাদের দিকে যাচ্ছে।

 

বাড়ির দরজা দিয়ে বাইরে আঙিনায় বেড়িয়ে এলো আফাজ। পড়নে ট্রাউজার আর টিশার্ট। একহাত পকেটে ঢুকিয়ে আরেক হাত দিয়ে ফোনে ফেসবুকে স্ক্রল করছে সে। আলিশা চারপাশে প্রকৃতির মোহ-মায়া নিচ্ছে। আফাজ কে সে খেয়াল করলেও ফিরে তাকায়নি। বসার যায়গাটার উপর জলপাই গাছের ছায়া পড়েছে। তাই কিছুক্ষণ পর পর মেঘের আড়াল বেড়িয়ে আশা রোদ আলিশার গায়ে পড়ছে না। আফাজ ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আঙিনার মাঝখান দিয়ে বসার যায়গাটার দিকে আসে। ফোনের দিকে নজর থাকায় চারপাশে থাকা মানুষ সম্পর্কে অবগত নয় সে। বসার যায়গাটার সামনে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ তার কী জানি মনে হওয়ায় সে মুখ তুলে তাকায়। দেখে একটা মেয়ে বসে আছে‌। আরে এটা ঐ মেয়েটা না ,,! যেটাকে সে হলুদ বেশি মাখিয়ে দেওয়ায় তাকে দৌড়ানি দিয়েছিলো ,,! কাল তো এই মেয়েটার মুখেই সে ভুল করে স্প্রে ফোম দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলো। আফাজ বলে উঠে।

– তুমি ,,,!

– হ্যা। আমিই। কেন চিনতে পারেন নি আগে ,,!

– চিনতে পেরেছি। কিন্তু তুমি এখানে যে,,,! আমি তোমার ভাইয়া ভাবির সাথে তোমাকে না দেখায় ভাবলাম তুমি আসোনি,,!

– আমাকে মনে রেখেছেন তাইলে ,,!

– না মনে রেখে পারি ? গাঁয়ে হলুদের দিন যেই দৌড়ানি টা দিয়েছিলে না আমায়,,! (কোমড়ে হাত দিয়ে শরীর মোড়াতে মোড়াতে) এখনো শরীর ব্যাথা করতেছে।

– কেন,? শরীর কেন ব্যাথা করতেছে ? আমি আপনাকে লাঠি-সটা দিয়ে মাইর দেই নি ,,!

আফাজ কিছুটা হেসে বলে।

– অনেকদিন পর দৌড়েছি তো‌। তাই শরীর ব্যাথা করতেছে। (একটু থেমে) তা তোমাকে ঘরে দেখলাম না যে ,,! এখানে একলা একলা বসে বসে কী করছো ,,!

– মেঘ দেখি। চারপাশের মানুষদের দেখি। (আফাজের দিকে ফিরে) আপনার এসব ভালো লাগেনা ,,!

– গ্রামে আসলে কার না ভালো লাগে বলো। শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী দশা থেকে সবুজ গ্রাম অনেক ভালো ভালো। (একটু থেমে) কিন্তু তুমি তো এখানেই থাকো মানে গ্রামেই থাকো। তোমার কাছে তো এগুলো পরিচিত দৃশ্য,,!

– মোটেই না।

– কেনো,,!

– বলছি। বসুন আপনি। (বলেই কিছুটা সড়ে বসে আফাজের জন্য বসার যায়গা করে দেয়। আফাজও তেমন কিছু না ভেবেই উঠে বসে। ফোনটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকায়। তাদের মাঝে দূরত্ব এখন কিছুটা মাত্র। এই ধরুন ১ স্কেল,,,!

আলিশা বলে,

– আপনাদের মতো আমাকেও ঘরে বন্দী থাকতে হয় ,,!

– কেনো ? গ্রামেও চার দেয়ালের মাঝে বন্দী দশার প্রচলন আছে নাকি ,,!

– গ্রামের আর শহরের বলতে ভিন্ন কিছু আছে নাকি,,! দুইটারই আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে। শুধু যারা ঘরের মধ্যে বন্দী তারাই তা উপলব্ধি করতে পারেনা।

– শহরে আমার আম্মু নাহয় ভয়ে বাইরেই যেতে দেয় না। শহরে ছিনতাই, কিশোর গ্যাং এসব আছে বলে। কিন্তু গ্রামে ,,!

– কয়দিন আগে এখানে ঘটা সিরিয়াল মার্ডার গুলো সম্পর্কে শুনেননি ,,! আর তারপরও তার আগে থেকেই আমাকে বের হতে দেয় না বাড়ির কেউ। বড় মামাদের আদেশ, ঘরের কোন মেয়ে মানুষ কোন দরকার ছাড়া বাইরে বেরোবে না। তাই শুধু স্কুল ছাড়া আমার আর তেমন একটা বের হওয়া হয়না।

– আনন্দমোহন এ পড়ো?

– হ্যা। হাই স্কুল ভবনটায় আমাদের ক্লাস রুম।

– কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?

– এইবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী।

– মানে সামনের ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষা দিবা ,,!

– হ্যা।

– প্রিপারেশন কেমন ? সাইন্স নিছো না কমার্স ,,!

– সাইন্স। (একটু থেমে) এই সাইন্স নেওয়া টাই আমার ভুল হয়েছে। এতো এতো পড়া ,,! আর কী বলবো।

– তোমার বড় হয়ে কী হওয়ার ইচ্ছে ,,?

– মা তো বলেছে আমাকে ডাক্তার বানাবে।

– মায়ের কথা বাদ দাও। এমনিতে তোমার কী ইচ্ছে,,! তোমার মনে কোন ইচ্ছে জাগে না যে আমি এই হবো, আমি ঐ হবো ,,?

– আমার তো মন করে আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো।

– ইঞ্জিনিয়ার,,,! কেনো কেনো,,,!

– ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাড়ি বানাবো।

– ও , সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ,,!

– এটাকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বলে ,,?

– হ্যা। (একটু থেমে) তাইলেও তো তোমাকে সাইন্স নিয়েই পড়তে হতো,,!

– তারপরও ,,,! আমার এতো পড়া ভালো লাগে না। (একটু থেমে) আচ্ছা আপনি কিসে পড়েন ?

– আমি ,,? আমি রংপুর পলিটেকনিক এ পাওয়ার টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে ডিপ্লোমা করতেছি। এখন ৬ষ্ঠ সেমিস্টার রানিং।

– ওহ,,,

– তুমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে তোমাকেও ডিপ্লোমা করতে হবে আমার মতো। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিপ্লোমা।

– ডিপ্লোমায় কী অনেক পড়া থাকে ,,!

– ক্লাস যত বাড়বে, পড়ার পরিমাণও বাড়বে। এতে ভয়ের কিছু নেই। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য তোমাকে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।

– হমম,,

– আচ্ছা হঠাৎ মেয়ে হয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার শখ যাগলো কেনো ,,!

– কেনো মেয়েরা কী হতে পারেনা ,,!

– না, পারে। তবুও এমন ইচ্ছে খুব কম দেখেছি। আমাদের পলিটেকনিকেও মেয়ে শিক্ষার্থী খুব কম। মেয়েরা এসব ক্ষেত্রে ইন্টারেস্ট কম দেখায়। সেইজন্য আরকি বলছি।

– আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমার আর মায়ের জন্য একটা ইয়া বড় বাড়ি বানাবো। তারপর সেখানে আমি আর মা একসাথে থাকবো।

– ডু প্লেক্স বাড়ি ,,!

– হ্যা। অনেকটা তেমনই। মা আর আমি মিলে অনেক আনন্দে থাকবো সেখানে। (বেশ উৎফুল্ল হয়ে কথা গুলো বলেই আলিশা। আফাজ হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে বলে।

– তোমার মা’কে দেখলাম নাতো,,! কালকেও দেখিনি, আজও দেখলাম না। উনি কী এসেছিলেন এ বাড়িতে ?

আলিশার হসৌজ্জল মুখ কিছুটা নেতিয়ে যায়। ধীর গলায় বলে,

– মা অসুস্থ। বাসায় আছে।

– ওহ,,, আন্টির কী হয়েছে ,,!

আলিশা আসল কথা খুলে বলে না। শুধু বলে,

– এমনিই, শরীর খারাপ আরকি।

– ওহ,, (একটু থেমে) তোমার কী শাড়ি পড়তে বেশি ভালো লাগে ,,?

আলিশা হাসিমুখ করে বলে,

– হ্যা। শাড়ি পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। (আফাজের দিকে ফিরে কৌতুহলী মন নিয়ে) কেনো বলুন তো,,!

– না মানে ছোট মেয়ে, গায়ে হলুদে শাড়ি পড়তে দেখলাম আবার আজও, তাই বললাম আরকি।

– ও, আমার সবসময় শাড়ি পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় বড় মামারা পড়তে নিষেধ করেছে। তাই বাইরে গেলেই শুধু পড়ি। (উৎসুক হয়ে আফাজের দিকে ফিরে) কালও পড়ে আসতাম। কিন্তু বড় মামা ধমকে বারণ করে দিলো। তাই লেহেঙ্গা পড়ে এসেছিলাম।

– কেনো বারণ করলো ,,?

– বললো এতো লোকের মাঝে আমি বলে শাড়ি সামলাতে পারবোনা। কিন্তু আমি শাড়ি খুব ভালোভাবে গুছিয়ে সামলাতে পারি। স্কুলের ফাংশনে শাড়ি পড়ে নেচেও ছিলাম। আমার সবচেয়ে পছন্দের পোশাক হলো শাড়ি, তার সাথে রেশমি বা কাচের চুড়ি, আর মেহেদী রাঙ্গা হাত। দারুন লাগে এই কম্বো টাকে।

– সাথে খোঁপায় একটা জবা ফুল ,,! (আলিশার দিক তাকিয়ে) একদম পারফেক্ট বাঙালি নারী লাগবে তোমায় ,,!

– দারুন বলেছেন তো ,! এরপর আমি জবা ফুলও দেবো খোঁপায়। (একটু থেমে হঠাৎ গোমড়া মুখ করে) কিন্তু বড় মামি তো তার বাগান থেকে ফুল ছিঁড়তে দেবে না।

– আমি আমাদের বাসায় গেলে ওখান থেকে নিয়ে আসবো। আমাদের বাসায় জবা, গাঁদা আর সূর্য মুখি ফুলের গাছ আছে।

– সূর্য মুখী ফুল সবসময় সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে, তাইনা ?

– হ্যা। রাত হলে কিছুটা নেতিয়ে পড়ে, কিন্তু সকাল হলেই সূর্য যে প্রান্তে থাকে সে দিকে তারা মুখ টা ঘুরিয়ে নেয়। এইজন্যই তো নাম হয়েছে সূর্যমুখী।

– বড় মামির বাগানে এই ফুলটা নেই তো। তাই দেখিনি।

– আমি বাড়ি গেলে ওখান থেকে নিয়ে আসবো।

– আচ্ছা নিয়ে আসিয়েন তো ,,! আমি ফুল গুলো আমার খোঁপায় গুঁজে দিবো। অনেক মজা হবে ,,,!

আলিশা এক সুন্দর হাসি মুখ নিয়ে দূরের প্রান্তরে তাকায়। আফাজ তার দিকে ফিরে তাকায়। মেয়েটা ছোট হলেও বেশ শৌখিন। নিজেকে সৌন্দর্য মন্ডিত করতে তার মনে হয় খুব ভালো লাগে। আলিশার কানে থাকা একটা ছোট দুলও আফাজের চোখে পড়ে। দেখে যেন আলিশা এক পূর্নাঙ্গ পরিনত নারী মনে হচ্ছে। দক্ষিণা হাওয়া এসে দুজনের মুখে ঝাপটা দিয়ে চলে যায়। গাছের পাতা গুলো বাতাসে মৃদু দোল খায়। গাছের ডালে থাকা পাখির কিচিরমিচির শব্দ, আর বয়ে যাওয়া বাতাসের শো শো শব্দে আলিশা উপরে মুখ তুলে তাকায়। গাছের ডালে থাকা পাখির বাসা টাকে দেখতে থাকে। তবে আফাজ দেখতে থাকে আলিশা কে। নিজের অজান্তেই একটা ছোট্ট সুন্দর হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁটে। সেও মুখ তুলে তাকায় গাছের ডালে থাকা পাখির বাসাটার দিকে। দুটো বড় পাখি এসে বাচ্চা শিশু পাখি গুলোকে খাবার দিচ্ছে। দৃশ্যটার সৌন্দর্যতা নিচে বসে থাকা দুই নরনারী বেশ ভালো ভাবেই উপভোগ করে ,,,!

 

 

 

বিকেল বেলা। রিয়াদ তার থানায় বসে ফাইল দেখছে। আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরবে সে। রাতুল বলেছে তাড়াতাড়ি যেতে। তাই কাজ গুলো সব সেড়ে নিচ্ছে। তখনই হঠাৎ থানার দরজা হুড়মুড়িয়ে খুলে ভিতরে আসে রাশেদ। চোখ মুখ কান্না ভেজা। যেন এক অবহেলিত পথিক স্বরুপ সে আবর্তিত হয়েছে। রিয়াদ হঠাৎ ঘটনায় হকচকিয়ে যায়। সে উঠে দাঁড়ায়। পাশের রুম থেকে বাকি কনস্টেবলরা মাথা বাড়িয়ে এই রুমে উঁকি দেয়। রিয়াদ বলে,

– কী হয়েছে রাশেদ। তোমার এই অবস্থা কেনো ,,!

রাশেদ দ্রুত এসে রিয়াদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক নাগাড়ে বলতে থাকে।

– রিয়াদ ভাই, রিয়াদ ভাই আমার আয়ান কোথাও নাই‌। সব যায়গায় খুঁজছি। কোথাও তারে পাইনা।

– আয়ান ,,! ওর আবার কী হইছে ?

– গত পরসুদিন থেকে আমার আয়ান নাই,,! পুরা গ্রাম আমি খুঁজছি। আয়ানরে কোথাও পাই নাই‌। রিয়াদ ভাই, রিয়াদ ভাই আপনি কিছু একটা করেন ,,! (বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে রাশেদ)

– শান্ত হও রাশেদ। (মাথা উঁচিয়ে হাঁক দিয়ে) নয়ন,,,, নয়ন,,,, এক গ্লাস পানি এনে দেতো !

সঙ্গে সঙ্গে নয়ন পাশের রুম থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে উপস্থিত হয়। রিয়াদ রাশেদকে বসতে বলে। নিজেও বসে পড়ে। নয়ন পানির গ্লাস টা টেবিলে রেখেই পাশের রুমে চলে যায়। রাশেদ চোখের পানি মুছতে থাকে। পানির গ্লাস টা হাতে নিয়ে এক ঢোকে পুরোটা শেষ করে গ্লাসটা টেবিলে রাখে। রিয়াদ ধীর গলায় বলতে থাকে।

– তুমি শান্ত হও। ধীরে সুস্থে আমায় প্রথম থেকে বলো কী হয়েছিলো ,,?

রাশেদ হাত দিয়ে চোখ,মুখের পানি মুছতে থাকে। কান্না থামায়। বলতে থাকে প্রথম থেকে সবকিছু। রিয়াদ মনযোগী শ্রোতা হয়ে সবটুকু শুনছে। পাশের রুমের দরজার আড়াল থেকেও কে জানি কথা শুনতে থাকে তাদের। শুধু ছায়াটা বোঝা যায়, তবে লোকটা কে তা দেখা যায় না।

রাশেদ সবটুকু বলে শেষ করতেই আবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে। রিয়াদ বলতে থাকে,

– আচ্ছা তুমি শান্ত হও। এমনভাবে ভেঙে পড়লে তো হবে না। তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।

– আয়ান না জানি কী অবস্থায় আছে। আমার মন মানছে না রিয়াদ ভাই। প্লিজ কিছু একটা করেন।

– হুমম,,,(একটু থেমে) তুমি যেহেতু বললে হাসিবুলদের অটোতে তাকে শেষ বার দেখেছো। মানে দেখোনি সেটা তোমার আন্দাজ বা সন্দেহ, তাই সেখানেই আগে খোঁজ নিতে হবে।

– আমি আজকে সকালেই তাদের বাসা গেছিলাম। হাসিবুল চাচা এই কথা অস্বীকার করে। বলে তার ছেলে মঈনুল নাকি অটো নিয়ে বের হইছে। রিয়াদ ভাই, ভাই আপনি ঐ মঈনুল কে ধরেন। ও নিশ্চিত আমার, (কাঁদতে কাঁদতে) আমার আয়ানরে কোথাও নিয়ে গেছে ,,!

– আচ্ছা তুমি শান্থ হও। আমি সম্পূর্ণ বিষয়টা দেখছি। মঈনুল কেও আমি ধরবো। বাকিদেরও খবর করবো। তুমি শান্ত হও।

রাশেদ কিছুটা চুপচাপ হয়। আয়ান হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ায় সে কাঁদতে কাঁদতে একদম পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। রিয়াদ তাই তাকে আগে শান্ত আর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। সে রাশেদের মনের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। তাই সে এখন কোন চাপ বা প্রেসার  রাশেদের উপর দিতে চাচ্ছেনা। রিয়াদ মাথা উঠিয়ে হাঁক দিয়ে ডাকতে থাকে,

– নয়ন,,,, নয়ন,,,,

সাথে সাথে পাশের রুম থেকে নয়ন হনহন করে চলে আসে। এসে রাশেদের পাশে দাঁড়ায়। রিয়াদ তাকে বলতে থাকে,

– শোন, হাসিবুল চাচার ছেলে মঈনুল এখন কোথায় আছে, কী করতেছে আমাকে সব আপডেট এনে দে। কী বললাম বুঝছিস ?

– ইয়েস স্যার। হয়ে যাবে। (বলেই স্যালুট প্রদর্শন করে চলে যেতে থাকে কনস্টেবল নয়ন। রিয়াদ আবার তার ফাইল চেকাপের উপর মনযোগ দেয়। রাশেদ মাথা নিচু করে তার সামনের চেয়ারে বসে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাইরে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। দূর মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসে। থানার জানালা দিয়ে দূরে ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল আভা বেশ ভালো ভাবেই ধরা দেয়।

 

 

 

আহনাফ তার ঘরে আছে। ঘর টা ঠিক তার নয়, শাহারিয়ার। শাহারিয়া আর সে একসাথেই থাকে। তার চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ। আশরিফ যে রায়হানই এটা তার অবিশ্বাস হয়নি। কিন্তু আশরিফের সাথে অর্থাৎ রায়হানের খবর তার মা কেনো নিয়ে যেতে বললো ,,! আশরিফকে কী তিনি চিনেন ,,!

আহনাফের মাথার উপর প্রশ্নের ভার ধীরে ধীরে বাড়ছেই। সে মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু সূত্র মিলানোর চেষ্টা করে। যা তার মাথায় উদয় হয়েছে। কিন্তু না‌, কিছুতেই সে কিছুর সাথে মিলাতে পারছেনা। তার মন বলতে থাকে, ‘এখন তার মা’কে একটা ফোন দেওয়া দরকার। আশরিফকে সে পেয়ে গেছে এটা তো জানাবেই তার পাশাপাশি আশরিফকে তার মা কীভাবে চিনলো, কেন আশরিফের খোঁজ তার কাছে চাইলো এসবও তার জানতেই হবে।’

আহনাফ তার ফোন বের করে। কল দেয় তার মায়ের নাম্বারে। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর তার মা ফোনটা রিসিভ করে। ওপাস থেকে কথা ভেসে আসে,

– আহনাফ,,,! বাবা তুই ঠিক আছিস তো ,,? কোন সমস্যা হয়নাই তো ?

– কীসের সমস্যা মা,,! কোন সমস্যাই হয়নাই। তুমি কেমন আছো ?

– আছি বাপ, কোনমতে। তুই?

– আমি ভালো। (একটু থেমে) শোনো, আমি একটা কথা বলার জন্য তোমাকে কল দিলাম।

– কী কথা ? বল।

– আমি আশরিফকে পেয়ে গেছি।

কথাটা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শুনেই যেনো রাবেয়া বেগমের শরীরের মৃত স্নায়ু গুলো জেগে উঠে। শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। চোখ চন্দ্র পৃষ্ঠের মতো বড় গোলাকার আকৃতি ধারণ করে।

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কোন প্রতিউত্তর না পাওয়ায় আহনাফ কিছুটা চিন্তিত হয়, বলে।

– মা, মা আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ,,? মা,,!

– আশরিফ কেমন আছে বাবা ,,! ওকে তুই কোথায় পেলি ? (উৎসুক, উৎফুল্ল হয়ে রাবেয়া প্রশ্ন ছুড়ে দেন আহনাফের দিকে)

– ভালো আছে। আর আমি যে স্যারের বোনের বিয়ে খেতে এসেছিলাম, ঐ বিয়েটা আশরিফ আর স্যারের বোন নিপার ছিলো।

– আশরিফের বিয়ে ,,! তুই আশরিফের বিয়ে খেতে গিয়েছিস ,,? (রাবেয়া জিজ্ঞাসু কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আহনাফের দিকে)

– হ্যা। আমি তাঁদেরই বিয়ে খেতে এসেছিলাম। আচ্ছা মা তুমি কেনো আশরিফের খোঁজ করছো,,? তার সাথে তোমার সম্পর্ক কী ?

আহনাফের এসব প্রশ্নে যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ে রাবেয়া বেগমের মাথায়। তিনি আহনাফকে কি উত্তর দিবেন ? কিছুই যে তিনি বলতে পারবেননা আহনাফ কে। আহনাফ তার মা’কে চুপ থাকতে দেখে আবার বলে,

– মা, চুপ করে আছো কেনো ? বলো। আশরিফ কে ? তুমি তাকে কী করে চিনো ?

– বাবা, আশরিফ তোর বন্ধু হয়। ওর মায়ের সাথে আমার পরিচয় ছিলো।

– তাই বলে তুমি আশরিফকে এভাবে খুঁজবে? না না। নিশ্চয়ই তুমি কিছু লুকোচ্ছো আমার থেকে। বলো মা। আশরিফ আসলে কে ? বলো মা প্লিজ বলো।

– বাবা, বাবা আমি তোকে বলতে পারবোনা। তুই, তুই আর এই প্রশ্ন টা আমাকে কখনো জিগাবিনা। কখনোই না। (তারপরই ফোনের ওপাশ থেকে রাবেয়া বেগমের কান্না ভেসে আসে)

– মা, মা তুমি কাঁদছো ক্যানো,,! হ্যালো মা ,,!

আহনাফ ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দেখে তার মা ফোনটা কেটে দিয়েছে। তার মা এমন কেনো করছে ? আশরিফের কথা শুনে উচ্ছসিত হলো, আবার কিছু তাকে বলতেও চাইছেনা, কাঁদছে। এসবের মানে কি। তখনই তার চোখ যায় দরজার পর্দার আড়ালে, কেও একজন দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। আহনাফ শব্দ করে বলে উঠে,

– কে ওখানে ,,!

তৎক্ষণাৎ ছায়ামুর্তিটি সড়ে যায়। আহনাফ তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দরজা দিয়ে মুখ বের করে বাইরে তাকায়। দেখে দূরে বারান্দায়, পিড়ায় বসে আছেন শিউলি বেগম। আর তার মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে ফুলমতি। তাছাড়া আর কেউ নেই। আহনাফ চারপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে আর কাউকে না পেয়ে ছায়াটাকে নিছক মনের ভুল ভেবে নিজ ঘরে প্রবেশ করে ফেলে। দরজা লাগিয়ে দেয়।

তখনই তার ২ রুম পড়ের রুমটার দরজা খুলে যায়। শাহারিয়া দরজার হাতল ধরে এক নাগাড়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকে, এক বার নজর আড়াআড়ি ভাবে ফেলে দু পাশে চায়, তারপর আবার ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

 

 

 

নিপা ব্যালকনির রেলিং ধরে চারপাশ দেখছে। হাতে ধোঁয়া ওঠা চা। পরনে এখন প্লাজু আর হাফ হাতা গোলাপী রঙের মেয়েদের টি শার্ট। মাঝে ইংরেজীতে বড় বড় করে লেখা LOVE। রায়হানের সাথে এবাড়িতে ফিরেছে বিকেল বেলায়। এখন রাত। বাইরের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ টা নিপার দারুন লাগছে। কিছুক্ষণ পর পর ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আকাশ মেঘলা। মনে হয় আজ রাতে বৃষ্টি নামবে। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায় ‌শুধু। নিচে একদম অন্ধকার। শুধু বাড়ির মেইন গেইটের আলোর কিছুটা প্রতিফলিত অংশ এদিকে এসেছে। তা দিয়ে জোছনা রাতের মতো উজ্জ্বলতা সৃষ্টি হয়েছে বাগানের উপর।

রায়হান বলেছিলো সে না ফিরা পর্যন্ত নিচে না যেতে। আর আলিশা কিংবা আঁখি মানে কাজের মেয়েটা ছাড়া আর কারো ডাকে দরজা না খুলতে। তাই নিপা এখন শাড়ি বদলে প্লাজু আর টি শার্ট পড়েছে। এসব সে ওবাড়িতেও পড়তো, যখন শাহারিয়া বা কোন ছেলে মানুষ থাকতো না। এখন পড়লো কারণ সে থ্রী পিস আনতে ভুলে গিয়েছে। কিছু শাড়ি এনেছিলো ব্যাগে করে আর দুই সেট অন্য কাপড়। সেই দুই সেটের মধ্যে এক সেট এখন তার গাঁয়ে।

হঠাৎ দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া যায়। নিপা কিছুটা চমকে উঠে। সে পিছন ফিরে তাকায়। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই ব্যালকনি থেকে ঘরে আসে। কাপটা বিছানার পাশের টেবিলে রেখে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে,

– কে ,,!

– ডাকাত ,,!

– তাইলে ঘরে ঢুকতে হবে না বাইরেই থাকো ,,!

– কেনো গো ,,! একটু কী মন ডাকাতি করতে দেওয়া যায় না ,,!

– না যায় না। মন অলরেডি ডাকাতি হয়ে গেছে। আপনি আসতে দেরি করে ফেলছেন।

– আচ্ছা তাইলে অন্য কিছু ডাকাতি করবো। দরজাটা খুলে দাও ,,!

– আগে বলো কীসের উপর তোমার নজর পড়ছে ? কী ডাকাতি করতে চাও ,,!

– তোমাকে,,!

– আমিও কাল ডাকাতি হয়ে গেছি। (বলেই আর হাসি ধরে রাখতে পারেনা নিপা। জোরে হেঁসে ফেলে। দরজার ওপাশ থেকে রায়হানও হাসতে থাকে। নিপা দরজা খুলে দেয়। রায়হান দরজা খুলার পর পরই নিপাকে দেখে। মেয়েটাকে আজকে দেখতে ঠিক ১৬-১৭ বছর বয়সী কিশোরীর মতো লাগছে। এ কাকে বিয়ে করলো সে,,! তার রুপের এতো প্রকারভেদে তো রায়হান বার বার হাবুডুবু খাচ্ছে। দরজা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিপা। হাঁসি এখন থামিয়েছে। তবে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা এখনো এটা বুঝতে পারেনি রায়হান মুর্তির মতো থমকে কেনো গেলো,,! নিপা রায়হানের চোখের সামনে হাত দিয়ে ইশারা দিলে বলল ,,!

– এই,,! কী হলো তোমার,,!

– ঘরে কী আমার সুবা আছে ,,?

– না সেও ডাকাতি হয়ে গেছে , হা হা হা!

হাসতে থাকা নিপার মুখের মায়ায় যেন রায়হান আবার প্রেমে পরে যায়। এমন অর্ধাঙ্গিনী থাকলে কী জামাইয়ের আর কারো উপর নজর যায় ,,! দিনে রাতে খালি ক্রাসই খাইতেছে সে নিপার উপর।

 

নিপা, রায়হানের হাত ধরায় সে ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসে। নিপা, রায়হানকে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে নিজেই তার হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর দরজাটা লাগিয়ে দিলো।

 

রায়হানের পড়নে একটা কালো জ্যাকেট। নিচে জিন্স প্যান্ট। ঘরের মাঝখান টায় রায়হানকে দাঁড় করায় নিপা। রায়হান বেশ ঘেমে গিয়েছে দেখে নিপা যায় সুইচ বোর্ডের কাছে। বলে,

– ফ্যান ছেড়ে দিচ্ছি।

– রেগুলেটর কমিয়ে রাখো।

– আচ্ছা।

নিপা ফ্যান ছেড়ে স্পিড মেডিয়াম দিয়ে রাখে।

রায়হান তার গাঁয়ের জ্যাকেটের চেইন খুলে। তারপর জ্যাকেট খুলতে ধরে, নিপাও পিছন থেকে জ্যাকেট ধরে তার দেহ থেকে খুলতে সাহারা করে। জ্যাকেটের ভিতরে একটা ফুল হাতা ফরমাল গেঞ্জি পড়ে ছিলো রায়হান। গেন্জিটা টাইট হয়ে তার গায়ের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। রায়হানের দেহের অবয়ব বেশ ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছিলো। বিশাল দেহি রায়হানের চওড়া বুক আর হাতের মাংসপেশি দ্বয় দেখেই যেন নিপা মনে মনে ভয় ও পায় আবার আকর্ষণ বোধও করে।

 

নিপা এক নজরে চেয়ে আছে তার দিকে। রায়হানের জ্যাকেট টা এখনো তার হাতেই। রায়হান একটু এগিয়ে ডেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। তার চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে থাকে। ডেসিন টেবিলের আয়নাতেই দেখতে পায় পিছনে কিছু দূরে দাঁড়ানো নিপা তার জ্যাকেট হাতে নিয়ে তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে। রায়হান ধীর গলায় বলে,

– কী দেখছো ,,!

রায়হানের কথায় ঘোর ভাঙে নিপার। লজ্জা পেয়ে নজর নামিয়ে নেয়। মুখখানা লাল হয়ে আছে। রায়হানের জ্যাকেট টা বিছানার উপর ভালোভাবে মেলে দিতে থাকে সে। রায়হান আয়নায় নিপার লজ্জা পাওয়া দেখে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে।

 

রায়হান নিজের চুল গুলো ঠিক করে এসে নিপার পাশে দাঁড়ায়। নিপা জ্যাকেট ভাঁজ করে উঠেই রায়হানকে হঠাৎ দেখে প্রায় চমকেই উঠে। বলে,

– তুমিও না। হঠাৎ হঠাৎ চলে আসো,,!

বলেই নিপা জ্যাকেট টা নিয়ে যায় আলমারির দিকে রাখতে। রায়হান বিছানায় বসে। বসে তার পায়ের মুজা গুলো খুলতে থাকে। নিপা আলমারির দরজা খুলে জ্যাকেট টাকে রাখার জন্য। তখনই পিছন থেকে রায়হান বলে,

– সুবা ,,!

নিপা ফিরেই তাকায়। আর সাথে সাথে এক জোড়া মুজা এসে তার মুখের উপর পড়ে। নিপা প্রথমে বুঝেনি রায়হান কী ফিকে মেরেছে। পরে হাতে নিয়ে দেখার সাথে সাথে “ইইইই” করতে করতে মুজা গুলো বিছানার দিকে ছুঁড়ে মারে। বলে,

– রায়হান,,,! এসব কী ,,!

– আমি তো তোমাকে দিলাম রাখতে।

– তাই বলে মুখে ছুড়ে মারবে।

– আচ্ছা তাইলে আসো, এসে হাতে নিয়ে যাও। (বিছানা থেকে মুজা গুলো হাতে নিয়ে) নাইলে আবার মুখে ছুড়ে মারবো কিন্তু,,!

– ইইইই,,, রায়হান। তুমি বদ হয়ে গেছো।

– একটু আধটু বদ হইতে হয়। আসো। নাইলে এই মারলাম কিন্তু ফিকে ,,!

– দাঁড়াও দাঁড়াও,,! আসতেছি।

বলেই জ্যাকেট টা আলমারির ভিতরে রেখে দিয়ে রায়হানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিপা। হাত বাড়িয়ে বলে।

– দাও এবার।

সাথে সাথেই রায়হান তার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে তার কোলে বসিয়ে নেয় নিপা কে। হাতের মুজা গুলো ফ্লোরে ফেলে দেয়। নিপা রায়হানের কোলে বসে বলতে থাকে।

– এইজন্য কাছে ডাকতেছিলা ,,!

– মনে করো তাইই ,,!

 

বলেই নিপার নরম গাল গুলো আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে। এক দৃষ্টিতে নিপার দিকে চেয়ে দেখতে থাকে। নিপা রায়হানের এমন দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ চোখাচোখি করে থাকতে পারে না। চোখ নামিয়ে নেয়। লজ্জায় তার গাল দুটো লাল টসটসে হয়ে গেছে। রায়হান তার নাকের অগ্রভাগে একটা ছোট্ট ছোঁয়া দিয়ে বলতে থাকে।

– তুমি এতো সুন্দর কেনো বলোতো,,! মানে আমি তোমাকে একেকবার একেকরুপে দেখে যাস্ট থমকে যাই। তোমার এই রূপের রহস্য কী ,,!

নিপা কী উত্তর দিবে।সে লজ্জায় লাল, মন চাচ্ছে রায়হানের কোলে মুখ লুকাতে। রায়হান আবার বলতে থাকে‌

– আমি অনেক ঘুরেছি। ঢাকা, বান্দরবান, সিলেট, রাজশাহী প্রায় সব যায়গায়। কিন্তু তোমার মতো আমি দ্বিতীয়টা পাইনি ,,! আচ্ছা তুমি কি দিয়ে তৈরি হ‌্যা ,,! প্রথম প্রেমের দিন যেমনটা দেখেছিলাম আজ তার থেকেও বেশি সুন্দর। আমার তো মন চাচ্ছে তোমার এই সুন্দর দুই নয়নের দিকে সারাজীবন একপলকে চেয়ে থাকতে। ডাগর ডাগর চোখ গুলো বারবার আমায় কাছে টানে জানো ,,,!

 

বাইরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকতে শুরু করে। সে বাতাসে নিপা খোলা চুল গুলো মৃদু উড়ছে।

রায়হান ব্যালকনির দরজা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি অবলোকন করে। তারপর আবার সামনে ফিরে নিপার মুখশ্রীর দিকে তাকায়। চোখাচোখি হতেই আবার নিপা নজর নামিয়ে ফেলে। নিপার এক গাল হাত কিছুটা উঁচিয়ে ধরে রায়হান। বলে,

– বৃষ্টি হয়ে নামতে রাজী,

যদি তুমি আমার ভূপৃষ্ঠ হও ,,,!

 

নিপা এবার দারুন লজ্জা পায়। রায়হান নিপাকে কোলে নেওয়া অবস্থাতেই হঠাৎ বিছানায় শুয়ে পড়ে। হঠাৎ শুয়ে পড়ায় নিপা উঠে যেতে না পেরে রায়হান বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নিচে রায়হান, উপরে নিপা। রায়হানের বুকের উপর শুয়ে মাথা তুলে রায়হানের দিকে একবার তাকিয়েই আবার মাথা নামিয়ে ফেলে নিপা। রায়হান বলতে থাকে।

– এভাবে চিরকাল বুকে মাথা রেখে থেকো,,! আমি তোমায় এক রাজ্য ভালোবাসা কুড়িয়ে এনে দেবো,,!

নিপা কিছু বলেনা।সে রায়হান বুকে মুখ লুকায়। তখনই বাইরের বাতাসের বেগ বেড়ে যায়। একফোঁটা,দু ফোঁটা করে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। দূরে বড় এক বাজ পড়ার শব্দ হয়। সাথে সাথেই নিপা রায়হানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রায়হান নিপার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে আগলে ধরে রাখে। হঠাৎ রুমের কারেন্ট চলে যায়। গ্রামে একটু ঝড় বৃষ্টি নামলেই কারেন্ট উধাও। নিপা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় রায়হানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রায়হান উঠতে চায়, তখনই নিপা বলে উঠে,

– যেওনা তুমি, আমার ভয় করছে।

– হা হা হা। ভয়ের কী আছে। আমি আছি না।

এই “আমি আছি না” কথাটাই যেন সব মেয়েদের নির্ভরতার এক যায়গা। এই কথা সঙ্গীর মুখ থেকে শোনা মানে শত শত যুদ্ধ, খারাপ শক্তির মাঝেও ‌নিজেকে সুরক্ষিত মনে করা।

 

রায়হান বলে,

– আমি কাল ঢাকা যাবো।

নিপা রায়হানের কোল থেকে মাথা তুলে। বলে,

– কেনো ,,?

– আমাদের ব্যবসায়ীক কাজে একটু যেতে হবে। হয়তো কাল ফিরতে পারবোনা। পরসু ফিরবো। এই একটা দিন তুমি সাবধানে থেকো,,!

– আমার আবার কী হবে ,,?

– আমার তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়। তুমি কাল আমি যাওয়ার পর থেকে একদম নিচে যাবানা। এমনকি ঘর থেকেও বেরোবা না। আমি আঁখিকে বলে যাবো তোমার যখন যা লাগবে তুমি ওকে বলবে। অথবা আলিশাকে বলবে। তাছাড়া তুমি কারো সাথে তেমন কথা বলবে না। ঠিক আছে ?

– তা ঠিক আছে। কিন্তু কেনো,,?

– আমি পড়ে তোমায় সব বুঝিয়ে বলবো। আর কাল রাতে যদি ঝড় বৃষ্টি হয় বা তুমি যদি একলা ঘুমাতে ভয় পাও তাইলে আলিশা নাইলে আঁখি, এই দুজনের একজনকে তোমার সাথে নিয়ে ঘুমাইয়ো। আঁখি ভালো মেয়ে। মা মরার পর ছোট থেকেই এখানে বড় হয়েছে। ওর সাথে ঘুমালে কিচ্ছু হবেনা। তাছাড়া আলিশাকেও বলতে পারো তোমার সাথে ঘুমানোর জন্য।

– আচ্ছা ঠিক আছে।(ধীর মৃদু গলায়)

– আমি কাল সকালে তোমাকে নিয়ে দিনাজপুর শহরে যাবো। তোমার প্রয়োজনীয় কাপড়, কসমেটিকস আর একটা ফোন কিনে দিবো। ছোট ফোনটা ও বাড়িতে রেখে এসেছো ভালো হয়েছে। আমি নতুন ফোন আর সিম কিনে দিবো। তুমি এইটাই চালাবে। কেমন ,,!

– আচ্ছা। (ধীর গলায় বলে নিপা। রায়হান তাকে নিচে যেতে আর বাকিদের সাথে মিশতে কেনো মানা করলো তা তার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। সে যেন রায়হানের বুকের উপর থেকেও হারিয়ে গেছে ভাবনার রাজ্যে। তখনই বাইরে একটা বড় বিজলী চমকিয়ে উঠে। সেই আলোতে নিপা আর রায়হান একে অপরকে দেখে। চোখাচোখি হয়। নিপা মাথা উঁচিয়ে ছিলো রায়হানের বুকে। রায়হান হাত দিয়ে দিয়ে নিপাকে আরে উঁচুতে উঠিয়ে নেয়। নিপা কিছুই বুঝতে পারেনা। তখনই সে সামনে তাকায় আর রায়হান তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। আচমকা রায়হান চুমু দেওয়ায় প্রথমে নিপা বাধা দিতে থাকে। তখনই রায়হান তাকে আদর করে আগলে নিয়ে তার মধ্যে প্রেরনা জাগাতে থাকে। বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসে। নিপার ‌শরীরে ঠান্ডা লাগতে থাকে। ঠান্ডায় গা শিউরে উঠতে থাকে। রায়হান তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে আরো গভীরে চুমু খেতে থাকে। নিপা ধীরে ধীরে রায়হানের আগুনে উত্তপ্ত হতে থাকে। নিজের মধ্যেই কোন এক নতুন কিছুর আভাস পেতে শুরু করে। সেও নিজেকে দিয়ে দেয় রায়হানের কাছে। রায়হান নিপাকে নিজের বুকের উপর রেখে আদর করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ রায়হান নিপাকে ছাড়িয়ে দিয়ে তাকে নিজের পেটের উপর বসায়। নিপা কিছুই বুঝতে পারেনা হঠাৎ রায়হান কী করছে। তখনই বাইরে এক বিজলী চমকে উঠে। তার আলোতে সে দেখে রায়হান তার গায়ের টিশার্ট নিজ হাতে খুলে দিচ্ছে। নিপাও নিজের গাঁয়ের টিশার্ট বাকি অর্ধেক খুলে ফেলে। সে রায়হানের উপর থেকে নেমে বিছানায় বসে। দুই হাত দিয়ে নিজ বুকের উপর চেপে ধরে রাখে। রায়হান নিজের গায়ের ফুল হাতা গেঞ্জি খুলতে থাকে। নিপার ঠোট দুটো কাঁপছে। জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রায়হান নিজের গেন্জি খুলে ছুড়ে মারে ফ্লোরে। আর নিপাকে ধাক্কা মেরে শুইয়ে দেয় বিছানায়। নিজেও তার উপর শুয়ে পড়ে।

 

বাইরের বৃষ্টিতে কিছু পাখি এসে ব্যালকনির রেলিংয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যেন বৃষ্টির ঠান্ডা ফোঁটা ফোঁটা পানির মাঝে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে দুই নরনারীর মিলনকে, উষ্ণতায় ভরা আলিঙ্গনকে। পাখিরা যেন রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিষয়টাকে দারুন ভাবে উপভোগ করছে । তখনই এক পানির ঝাপটা রেলিংয়ে এসে পড়ায় পাখি গুলো উড়ে চলে যায়।

ঘরের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসে, এই বৃষ্টি মুখর আঁধার রাতে নতুন দুনিয়ায় বিচরণ করা দুই নরনারীর মৃদু চিৎকার,,,!

 

 

 

গাইবান্ধা পুলিশ চেকপোস্ট। হাইরোডের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ চেকপোস্ট এর একটা দল। রোডের দুই পাশে সোজা গাছের সাড়ি। আর চারপাশে মাঠ, প্রান্তর। বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিজলী চমকিয়ে উঠছে। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ গুলো একটার পর একটা গাড়ি চেক করছে আর ছেড়ে দিচ্ছে। তাদের কাছে খবর আছে এই রোড দিয়ে আজ বিদেশি মদের চালান যাওয়ার কথা। তাই এই গভীর বর্ষনের রাতে ঠান্ডা বাতাসের মাঝেও তাদের কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

 

একটা কন্টেনার ট্রাক চেক করার পর সেটার সামনে থেকে বেরিগেট তুলে দেয় কনস্টেবল রা। কন্টেনার ট্রাক টা চলে যায়। তার পিছনে থাকা একটা প্রাইভেট কার এসে সামনে দাঁড়ায়। পুলিশ কনস্টেবলরা বেরিগেট নামায়। চেক করতে থাকে। এই চেকপোস্টে মূল অফিসারের দায়িত্ব থাকা ওসি ইমরান গাড়ির ড্রাইভারকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে থাকে। হাতে ছাতা। বৃষ্টির পানির ঝাপটায় হাঁটু থেকে প্যান্টের নিচের অংশ ভিজে চিপচিপে হয়ে গেছে। তখনই আমরা দেখতে পাই প্রাইভেট কারের পিছনে দাঁড়ানো লম্বা গাড়ি বহরের জ্যামের মাঝে সেই মিনি ট্রাক টাও আছে। যেটায় দিথী লাশ ফেলে দিয়েছিলো। এবং সেটা এই কারের ঠিক পিছনেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।

 

ওসি ইমরান প্রাইভেট কারে তেমন সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে ছেড়ে দেন। কনস্টেবলরা সামনের বেরিগেট তুলে দেয়। প্রাইভেট কারটি চলে যায়। তারপর সামনে এসে দাঁড়ায় সেই মিনি ট্রাকটি। পিছনে উপরে মোটা প্লাস্টিকের ছাওনি দেওয়া যাতে ভিতরের কাঁচা সবজি নষ্ট না হয়ে যায়।

মিনি ট্রাকটা এসে বেরিগেটের সামনে দাঁড়ায়। ড্রাইভার তার গাড়ির দরজার সাইডের গ্লাস নামায়। ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওসি ইমরান মাথা এগিয়ে বলে,

– গাড়িতে কী আছে ?

– স্যার, কাঁচা সব্জি।

– কোথা থেকে আসতেছে এইটা ?

– স্যার দিনাজপুর থেইকা। কাল রাইতে রওনা দিছি।

– কী কী সব্জি আছে যে কাল রাত থেকে এখনো ভালো অবস্থায় আছে ,,?

– স্যার কিছু খোলা আলুর বস্তা আর গাজর আছে গাড়িতে।

– আর কিছু নাই তো,,!

– না স্যার। কি কন। আমি হালাল উপায়ে টাকা ইনকাম করি। আমার গাড়িতে কিছু পাইবেন না। চাইলে চেক করাইতে পারেন।

– হুমম,, বুঝেছি। এই মনির,সামাদ। গাড়ির পিছনের লোহাটা নামিয়ে দেখো তো কী আছে ,,?

– স্যার আসলেই চেক করবেন ,,! এই বৃষ্টির মাঝে আলু আর গাজরে পানি ঢুকলে তো পচতে শুরু করবো। ঢাকা যাইয়া পৌছাইতে পৌছাইতে তো আমার সব মাল নষ্ট হইয়া যাইবো স্যার।

– হোক তোর নষ্ট। উপর মহলের আদেশ, কোন গাড়ি চেক ছাড়া পাড় হইতে পারবেনা।

– স্যার, স্যার একটু আমার উপর রহম করেন। ওগোরে কন লোহাডা পু্রাডা না নামাইতে। এমনিতে উপরে উইডা প্লাস্টিক সড়ায়া দেখতে। নাইলে যে আমার,,,,,,,,,

তার কথার মাঝে পিছন থেকে কনস্টেবলের আওয়াজ ভেসে আসে।

– স্যার ,,! লাশ ,,,!

হঠাৎ এই কথা শুনে ওসি ইমরান চমকে উঠেন। চকিতে মুখ ফিরিয়ে হকচকিয়ে বলেন ,,

– কী বললা ?

– স্যার গাড়িতে লাশ আছে। দুই টা লাশ ,,!

– কীহ,,,! সবজি বোঝাই গাড়িতে দুই,দুইটা লাশ ,,,!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

গল্প :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫২

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

(১৮+ নীল এলার্ট 🔵)

 

– না স্যার। কি কন। আমি হালাল উপায়ে টাকা ইনকাম করি। আমার গাড়িতে কিছু পাইবেন না। চাইলে চেক করাইতে পারেন।

– হুমম,, বুঝেছি। এই মনির,সামাদ। গাড়ির পিছনের লোহাটা নামিয়ে দেখো তো কী আছে ,,?

– স্যার আসলেই চেক করবেন ,,! এই বৃষ্টির মাঝে আলু আর গাজরে পানি ঢুকলে তো পচতে শুরু করবো। ঢাকা যাইয়া পৌছাইতে পৌছাইতে তো আমার সব মাল নষ্ট হইয়া যাইবো স্যার।

– হোক তোর নষ্ট। উপর মহলের আদেশ, কোন গাড়ি চেক ছাড়া যাইতে পারবেনা।

– স্যার, স্যার একটু আমার উপর রহম করেন। ওগোরে কন লোহাডা পু্রাডা না নামাইতে। এমনিতে উপরে উইডা প্লাস্টিক সড়ায়া দেখতে। নাইলে যে আমার,,,,,,,,,

তার কথার মাঝে পিছন থেকে কনস্টেবলের আওয়াজ ভেসে আসে।

– স্যার ,,! লাশ ,,,!

হঠাৎ এই কথা শুনে ওসি ইমরান চমকে উঠেন। চকিতে মুখ ফিরিয়ে হকচকিয়ে বলেন ,,

– কী বললা ?

– স্যার গাড়িতে লাশ আছে। দুই টা লাশ ,,!

– কীহ,,,! সবজি বোঝাই গাড়িতে দুই,দুইটা লাশ ,,,! (সামনে ফিরে ড্রাইভারের দিকে রক্তরাঙা চোখে) এই তোর হালাল উপায়ে ইনকাম তাই না ,,! বের হ গাড়ি থেকে। (বেড়িগেটের দিকে ফিরে) এই সুমন, সিফাত একে গাড়ি টেনে হেঁচড়ে বের করো। এখুনি।

বলেই ওসি ইমরান গাড়ির পিছনের অংশেথ দিকে চলে যেতে থাকেন। বেড়িগেটের দুই কোনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই কনস্টেবল এসে ড্রাইভারের কলাড় ধরে টেনে গাড়ি থেকে নামায়। ড্রাইভার হাত জোড় করে তাদের বলতে থাকে।

– আমারে ছাইড়া দেন। আমি কিছু করিনাই।

 

ওসি ইমরান গাড়ির পিছনের অংশে এসে দাঁড়ান। দূরে বিজলী চমকিয়ে উঠে। গাড়ির পিছনের মাল বহনকারী অংশের মধ্যে অর্ধেক ছিলো কাঁচা সব্জি। আর অর্ধেক অর্থাৎ পিছনের অংশটুকু ছিলো ফাঁকা। সেই খানেই দুইটা লাশ পড়ে আছে‌। একদম পাশাপাশি। দুইটাই মেয়ের লাশ। দুইটারই বয়স ১৮-২০ এর মধ্যে। উবুর হয়ে থাকা মেয়েটাকে চিনা না গেলেও তার পাশে ক্ষতবিক্ষত দেহের চিত হয়ে থাকা মেয়েটা ছিলো দিথীর হাতে প্রাণ হারানো সেই মেয়েটা। গাড়ির পিছনের লোহাটা নামানো হয়। ওসি ইমরান দুইটা ক্ষতবিক্ষত মেয়ের লাশ দেখেই আঁতকে উঠেন। মেয়েদের দেহ থেকে রক্ত বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে ট্রাক থেকে নিচে পড়ছে। রাস্তার অনেকাংশই রক্ত মাখা পানি দিয়ে লাল হয়ে যায়। ওসি ইমরান পিছনে থাকা দুই কনস্টেবলকে বলতে থাকে।

– এই লাশ গুলোকে তাড়াতাড়ি নামাও। সদর হাসপাতালে ফোন দাও। এম্বুলেন্স পাঠাতে বলো।

– ওকে স্যার।

ওসি ইমরান তাদের আদেশ দিয়েই চলে আসতে থাকেন গাড়ির সামনের অংশের দিকে। আকাশের বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। শো শো করে বৃষ্টির সাথে বাতাসও বইছে। পানির ঝাপটা এসে পড়ে ওসি ইমরানের মুখে।

ওসি ইমরান গাড়ির সামনের দিকে চলে আসেন। ট্রাকের হেডলাইট দিয়ে সামনের রাস্তা ভালোই আলোকিত হয়েছে। সেখানে গাড়ির ড্রাইভারকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুই কনস্টেবল। ওসি ইমরান রাগান্বিত হয়ে সেদিকে হেঁটে যান। ড্রাইভারের সামনে দাঁড়িয়ে তার গালে কষে এক চড় মারেন। ড্রাইভার গালে হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলে।

– স্যার, আমি কিছুই জানিনা। আমি নির্দোষ স্যার।

– দুইটা লাশ নিয়ে যাইতেছিস আরো বলিস নির্দোষ,,! (কনস্টেবলদের দিকে তাকিয়ে) ওকে তাড়াতাড়ি থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। কমবয়সী মেয়েদের খুন করে লাশ পাচার করে,,,! ওর সাহস কত্তবড় ,,,!

– স্যার আমি সত্যিই জানিনা লাশ গুলা কার। স্যার আমারে ছাইড়া দেন। স্যার। (কাঁদতে কাঁদতে ড্রাইভার বলে)

– সুমন,শিফাত,, ওকে নিয়ে যাও।

– স্যার আমারে ছাইড়া দেন। আমার পরিবার না খাইয়া মরবো স্যার,,! স্যার,,,!

– এইসব কাহিনী বহুত শুনছি। জেলে যা। তারপর তোর পরিবার আমি বাইর করতেছি। এই, তুই দিনাজপুরের কোন গ্রাম থেকে মাল নিয়ে আসতেছিস ? (একটু থেমে) কী রে বল ,,? কোন গ্রাম থেকে আনতেছিস ?

– স্যার, স্যার আনন্দপুর গ্রাম থেইকা।

– আনন্দপুর,,,,! (কনস্টেবল দের দিকে তাকিয়ে) নিয়ে ওকে। এখুনি আমার চোখের সামনে থেকে ওকে নিয়ে যাও,,,!

কনস্টেবলরা ড্রাইভার টাকে নিয়ে চলে যেতে থাকে। ড্রাইভার লোকটা আহাজারি করতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে তাকে ছেড়ে দিতে বলতে থাকে।

 

গাড়ির পিছন থেকে দুই কনস্টেবল হেঁটে সামনে আসে। ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওসি ইমরানকে বলতে থাকে।

– স্যার। সদর হাসপাতালে ফোন দিয়ে এম্বুলেন্স পাঠাইতে বলছি।

– গুড। এখন শোনো। উপজেলা থানায় যোগাযোগ করে খবর নাও দিনাজপুরের আনন্দপুর গ্রাম কোন থানার আন্ডারে পড়ে। আর সেই থানার ওসির সাথে কন্ট্রাক্ট করার জন্য নাম্বার, ই-মেইল যা পারো সংগ্রহ করে আমাকে জানাও। বুঝতে পারছো ,,!

– ইয়েস স্যার। হয়ে যাবে।

– হুমম। এখন হাইওয়ে থানায় কল দিয়ে আরেকটা টিম পাঠাতে বলো। আমরা লাশের দায়িত্বে থাকবো। আর ওরা আসে বাকি গাড়ি গুলা চেক করে ছেড়ে দিবে। (পিছন ফিরে সাড়িবদ্ধ গাড়ি গুলোকে দেখে) নাইলে জ্যাম কয়েক কিলোমিটার লেগে যাবে।

– ওকে স্যার। এখুনি বলছি।

কনস্টেবল ছাতা হাতে সাইডে সরে গিয়ে ফোন দিতে থাকে। ওসি ইমরান এক দৃষ্টে ট্রাকের পিছনে দাঁড়ানো গাড়ির সাড়ির দিক তাকিয়ে থাকে। আকাশে বিজলী চমকিয়ে উঠে, চারপাশ আলোকিত হয়ে আবার অন্ধকারে তলিয়ে যায়। এরপর শুধু অবিরাম বর্ষনের আওয়াজ কানে এসে ধাক্কা খেতে থাকে,,,!

 

 

 

৩ দিন পর,,,,

১৮ই ডিসেম্বর ২০২০

 

দিনের বেলা। বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ একটু আধটু রোদের দেখা মিলছে। তবে তা কিছুক্ষণ পর পর আবার মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। দূরের আকাশ দেখে মনে হচ্ছে হয়তো বিকালের দিকে এদিকে বর্ষণ করবে সেই মেঘ গুলো।

 

কাঁচা রাস্তা। দুইপাশে সাড়িবদ্ধ হয়ে চলে গেছে গাছ। সোনালী কলেজ যাচ্ছে। পড়নে খয়েরি রঙের থ্রি পিস, তার উপরে সাদা এপ্রোন। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা। এক কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ আরেক হাতে মোড়ানো ছাতা। রাস্তা কিছুটা কর্দমাক্ত। তাই ধীরে ধীরেই চলতে হচ্ছে তাকে। হাত ঘড়ি উঠিয়ে দেখে এখন সময় ১১ টা ৩। সোনালী আনমনে গুনগুন করতে করতে হাঁটছে। বৃষ্টি বাদলের দিন গুলো তার বেশ লাগে। মন-মেজাজ এইসময় তার বেশ উৎফুল্ল থাকে। সামনে দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বৃষ্টি নামতে পারে এই ভয়ে কেউ মাঠে কাজ করতে আসেনি। হঠাৎ সোনালী তার পিছু পিছু কারো হাঁটার আওয়াজ পায়। সে থেমে যায়। পিছন ফিরে তাকায়। দেখে একটা জিন্স আর কালো ফুল হাতা শার্ট পড়া ছেলে। চোখে সানগ্লাস। হাতে সিগারেট। সোনালীর চিনতে বাকি রইলো না তাকে। এ যে রাফসান। আজও তার পিছুপিছু আসছে ,,! সোনালীর মুড বদলে যায়। হাসিখুশি মুখ নিমেষেই রাগের ছায়ায় মিলিয়ে যায়। সোনালী সামনে ফিরে যতটা সম্ভব জোরে হাঁটার চেষ্টা করে। রাফসান তার থেকে ৩-৪ হাত দূরেই। রাফসান আনমনে সিগারেট টানছে আর সোনালীকে পিছন থেকে পরখ করছে। রাফসানও তার চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। এবং একসময় সে সোনালীর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। সোনালী পাশ ফিরে তাকায় না। সে ঠিকই খেয়াল করতে পেরেছে রাফসান ঠিক তার পাশে হাঁটছে। রাফসান বলতে থাকে,,

– কোথায় যাও সুন্দরী,,,!

সোনালী কোন উত্তর দেয় না। রাফসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,

– রাগ করছো নাকি আমার উপর ,,! এই জান ,,! কী হলো কথা বলছোনা ক্যানো ,,!

সোনালী কোন উত্তর দেয় না। তার মুখ জলন্ত সূর্যের মতো খালি ফুলেফেঁপে উঠছে। রাফসান সোনালীর কাছ থেকে আবার উত্তর না পেয়ে সে হঠাৎ সোনালীর হাত ধরে ফেলে। সোনালী রাফসানের এমন কাজ দেখে হতবাক। দুইজনই দাঁড়িয়ে যায়। রাফসান সোনালীর হাত ধরে ধীরে ধীরে বলতে থাকে,

– চলোনা জান পার্কে ঘুরতে যাই ,,!

– ঐ মুখ দিয়ে আমাকে জান বলবেন না ,,! (রাগের গলায়)

– আরে আরে ,,! রাগ করতেছো ক্যানো ,,! চলো না। যাই বাইক রাইডে। আমি বাইক চালাবো। তুমি পিছন থেকে আমাকে শক্ত করে ধরে থাকবে।

– মরে গেলেও যাবোনা।(দাঁতে দাঁত চেপে)

– হে হে হে। তেজ খুব তোমার তাই না ,,! ভালো। তেজ থাকা ভালো। নাইলে কখন সুরুত করে কারো খাবার হয়ে যাবা ,,(হাসির ভঙিমায়) টেরও পাবানা।

– আমার হাত ছাড়ুন। আপনার ভাই, বাবা সবাই ভালো আপনি এমন নষ্ট ক্যানো ,,!

– আমি নষ্ট ,,! (সোনালীর মুখের কিছুটা কাছে এসে মাতাল সুরে) আমার নষ্টামির আর দেখলেই বা কী ,,! (সোনালীর মুখের চুল গুলা হাত দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে) চলো বিয়ে করে ফেলি,,!

– মরে গেলেও না। ছাড়ুন আমার হাত। ছাড়ুন নাইলে কিন্তু চিৎকার করবো,,!

– চিৎকার করলেই কী তোমাকে কেই বাচাইতে আসবে নাকি ,,! (একটু থেমে সোনালীর গালের কাছে গিয়ে ধীর গলায়) তুমি আমার বউ হয়ে যাও,,! বাড়ি গাড়ি, ধন সম্পদ সব তোমার নামে করে দিবো। পায়ের উপর পা তুলে খাবা,(সোনালীর কাঁনের লতিতে নাক দিয়ে ঘষে) আর আমাকেও খাওয়াবা।

– সরেন। (ধাক্কা মেরে রাফসানকে সড়িয়ে দিয়ে) আরেকবার যদি আমার সাথে এমন করেছেন ,,! তবে কিন্তু আমি ,,!

– কী করবে ,,! বাবাকে বলে দেবে ,,! বাবা উল্টো তোমাকে আমার বউ হওয়ার প্রস্তাব দিবে। (একটু থেমে) তখন হবে আমার বউ ,,? হ্যা ! হা হা হা

সোনালী হ্যাচকা টান মেরে নিজের হাত রাফসানের থেকে ছাড়াতে চায়। কিন্তু রাফসানের সবল দেহের সাথে সে পেড়ে উঠে না। রাফসান সোনালীর ছুটোছুটি দেখে মজা পাচ্ছে। মাতাল চোখে তাকে দেখছে। সোনালী একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলে,

– খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এবার,,! আমাকে ছেড়ে দিন নাইলে কিন্তু আমি ধাক্কা দিয়ে আপনাকে রাস্তায় ফেলে দিবো ,,!

– ধাক্কা তো আমিও দিতে পারি,,! শুধু পার্থক্য এটাই হবে যে তোমার ধাক্কায় কিছু হবেনা, আর আমার ধাক্কায় (ধীর গলায়) এই রাস্তাটাই তোমার আমার জন্য বেডরুম হয়ে যাবে।

সাথে সাথেই সোনালী রাফসানের মুখের উপর থুথু দেয়। রাফসানের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সাথে সাথেই সে তার হাত ছেড়ে দিয়ে জোরে এক থাপ্পর মারে তার গালে। আবার থাপ্পড় মারে তার আরেক গালে। রাফসানকে দেখে মনে হচ্ছে সে মাতাল হয়ে আছে। সে নেশা করে এসেছে। সোনালীর গালে, কানে একের পর এক থাপ্পর মারে। সোনালীর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে। একটা পর্যায়ে রাফসান থাপ্পড় দেওয়া থামিয়ে দিয়ে সোনালীর মুখের গাল গুলো চেপে ধরে তার মুখ খানা উঠায়। তার দিকে এক চোখে চেয়ে থেকে বলে,

– বিয়ে তোকে করতেই হবে সোনালী,,! হয় নিজের ইচ্ছায় করবি ,,! নয় তো ,,!

বলেই আরেক হাত দিয়ে সোনালীর স্তন চেপে ধরে, সোনালীর ঠোঁটে চুমু দেয়। ছোট্ট একটা চুমু খেয়েই তাকে ছেড়ে দেয়। সোনালী দুই পা পিছিয়ে গিয়ে নিজের গাঁয়ের ওড়না ঠিক করতে থাকে। হাত দিয়ে ঠোঁট মুছতে থাকে। তার চোখে পানি। ইচ্ছে করছে এখনি আত্মহত্যা করে মরে যেতে। তার দেহকে রাফসান কলুষিত করেছে। তাকে খারাপ কিছুর আভাস দিয়েছে। রাফসান তখনি একটা শয়তানি মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

– বুঝে গেছিস তো কী হবে ,,,!

বলেই সে যেই রাস্তা দিয়ে এসেছিলো সেটা দিয়েই চলে যেতে থাকে। তার বেড়ানোর মধ্য ছিলো মাতাল, নেশাগ্রস্ত হওয়ার আভাস। সোনালী কাঁদতে থাকে। নিজের গাঁয়ের কাপড় ঠিক করতে থাকে। ওর ঠোঁটের কোণ আর নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রাফসান খুব জোরে জোরে চড় গুলো মেরেছিলো তাকে। সোনালী মাটিতে পড়ে থাকা তার ব্যাগটা হাতে উঠায়। বাড়ির রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে যায় সে একা একা। দূরের কালো মেঘ গুলো গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসে আনন্দ পুরের দিকে।

 

 

 

আনন্দপুর থানা। থানার একটা রুম, যেই রুমে সিজন ১ এ পাওয়া লাশ গুলো পোস্টমর্ডেম করার জন্য রাখা হতো সেই রুমটা। দুইটা হসপিটালের বেড। দুইটাতেই শুইয়ে রাখা হয়েছে সেই ৩ দিন আগে মিনি ট্রাক থেকে পাওয়া দুটো লাশকে। লাশের দেহ পচতে শুরু করেছে। তাই রুমে বেশ ভালো রকমই লাশ পঁচা গন্ধ ছড়িয়েছে। লাশের পোস্ট মর্ডেম করার জন্য থানায় এসেছেন এক ডাক্তার। নাম রোকেয়া সুলতানা (২৪)।তিনি মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক পড়ে একটা লাশের বর্ডির একটা অংশ চেক করছেন। দূরেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ ড্রেস পরিহিত রিয়াদ। রিয়াদেরও মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। কিছুক্ষণ চেকাপ করার পর রোকেয়া সোজা হয়ে দাঁড়ায়। হাতে থাকা লাশের মাংসের স্যাম্পল টা এনে দুইলাশের বেডের পাশের এক সাদা টেবিলে রাখে। রিয়াদ বলে উঠে,

– কাজ শেষ ,,?

রোকেয়া পিছন ফিরে তাকায়। বলে,

– হ্যা।

– মৃত্যুর কারণ জানা গিয়েছে ? মানে দুইজনেরই ?

– হ্যা জানা গেছে‌। (টেবিলে মাংসের স্যাম্পল রেখে হেঁটে এসে রিয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে) দুইটা মেয়েকে দুই ভাবে মারা হয়েছে।

– যেমন ,,?

– ঐ যে প্রথম বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটা (দিথীর হাতে খুন হওয়াটা) ঐটাকে কেউ অনেক আঘাত করে মেরেছে। ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। তবে খুনি শুধু এক যায়গায় আঘাত করে ক্ষান্ত হয়নি। পুরো শরীরে আঘাত করেছে। যার কারণে তার মৃত্যু হয়। আর পাশের মেয়েটা (যেটা অজ্ঞাত) ঐটাকে আবার গুলি করে মারা হয়েছে।

– গুলি করে ?

– হ্যা। দুটো গুলি করা হয়েছে তার পেটে‌। দুটো গুলিই খুব কাছ থেকে করা হয়েছে। এই ধরুন। (রিয়াদের পেটের কাছে হাত নিয়ে দেখিয়ে দিয়ে) এখান থেকে বন্দুক ধরে গুলি চালানো হয়েছে।

– কীভাবে বুঝলেন ?

– কারণ তার দেহে কোন গুলিই নাই। বন্দুক কাছে থাকায়, সেটা থেকে বের হওয়া গুলি তার দেহ ভেদ করে বেড়িয়ে গেছে। একখানেই দুটো গুলি করা হয়নি। একটা বুকের হ্রদপিন্ডে করা হয়েছে আরেকটা পেটের মাঝে।

– খুব নিষ্ঠুর,,! আচ্ছা ধস্তাধস্তি হওয়ার কোন চিহ্ন নেই লাশ দুইটার গাঁয়ে ?

– প্রথম টার গায়ে এমন চিহ্ন পাওয়া গেছে। ধস্তাধস্তি হওয়ার সময় তার দেখের কাপড় নখ লেগে ছিঁড়েছে। তবে দ্বিতীয় লাশটা, অর্থাৎ গুলি খাওয়া লাশটার গায়ে কোন ধস্তাধস্তির চিহৃ আমি পাইনি।

– লাশ দুটোকে কতদিন আগে খুন করা হয়েছে ?

– ৪ দিন আগে। প্রায় একই সময়ে দুটো লাশের খুন হয়েছে।

– একই সময়ে ?

– হমম। আর দ্বিতীয় লাশ টা, মানে গুলি যেটায় লেগেছে, সেই মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিলো।

– হোয়াট ,,,! প্রেগন্যান্ট,,?

– হ্যা। দেহের মধ্যেকার ভ্রণের মাথা ছেদ করে গুলি বেড়িয়ে যায়। মানে বলতে পারেন যে যেই তাকে গুলি করেছে সে ঠিক পেটে থাকা ভ্রুণকে উদ্দেশ্য করেই গুলিটা চালিয়েছে।

– বিষয়টা দেখি আস্তে আস্তে পেঁচিয়ে যাচ্ছে।

– হ্যা। তবে প্রথম টা প্রেগন্যান্ট ছিলোনা। তার দেহে রেপ করারও কোন চিহ্ন নেই।

– দ্বিতীয় টায় রেপ করার চিহ্ন আছে ?

– দ্বিতীয়টায় ও নেই। তবে সে প্রেগন্যান্ট ছিলো। এইটুকুই জানতে পেরেছি।

রিয়াদ ফ্লোরে পায়চারি করতে করতে রোকেয়া হতে কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়। উপরে মুখ করে ভাবতে থাকে। বিরবির করে বলে

” ৪ দিন আগে মারা গেছে ,,! (পিছন ফিরে মেয়েটাক উদ্দেশ্য করে) আচ্ছা ৪ দিন আগে কয়টার দিকে মানে দিনে না রাতে মারা গেছে এরা দুইজন ?

কথা শুনে রোকেয়া তার হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় দেখে তারপর বলে,

– এই ধরুন রাতের দিকে। রাত ৭ টা থেকে ১১ টার মধ্যে।

– ৭টা থেকে ১১ ,,! (বিরবির করে) ঐসময় টায় তো আমরা সবাই বিয়ে বাড়িতে ব্যাস্ত ছিলাম। (লাশ দুইটার দিকে ফিরে তাকিয়ে) মেয়ে দুইটা তো আমাদের গ্রামের না। এমনকি হরিশপুর গ্রামেরও না। তবে ,,,,,!

তখনই রিয়াদ তার পিছন থেকে নয়নের কন্ঠ শুনতে পায়,

– স্যার। মঈনুলের লোকেশন ট্রেস করা গেছে।

কথা শুনেই রিয়াদ পিছন ফিরে তাকায়। ৩ দিন আগে থেকে মঈনুল উধাও। রিয়াদের ধারনা ভয়ে সে গা ঢাকা দিয়েছে। রিয়াদ নয়নকে বলে,

– ওর লোকেশন কোথায় পাওয়া গেছে ,,!

– স্যার দিনাজপুর শহর থেকে বাইপাসে ১২ কিলোমিটার দূরে একটা পরিত্যাক্ত রাসায়নিক কারখানায়।

– এতো দূরে ,,! (নয়নের দিকে তাকিয়ে) তাড়াতাড়ি থানার গাড়ি বের করো। উপজেলা থানা অফিসে ফোন দিয়ে বলো আমাদের কিছু ফোর্স দিতে। এখনি বেড়োতে হবে আমাদের।

– ওকে স্যার। (নয়ন হনহন করে চলে যায়।

রিয়াদের চিন্তিত হয়ে যায়, অস্থীর হয়ে পড়ে। এতোদিন কোন কেস ছিলোনা। আর এখন আসছে তো আসছে একসাথে অনেক গুলা আসছে। রিয়াদ পিছনে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা রোকেয়া নামের মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– আপনি এখানেই থাকুন। লাশ থেকে আরো কোন তথ্য পেলে আমাকে জানাবেন। কেমন,,!

– ওকে।

রোকেয়ার কথাটা রিয়াদের কান পর্যন্ত যাওয়ার আগেই সে রুম থেকে প্রস্থান করে। রোকেয়া রিয়াদের এতো ব্যস্ততা দেখে ঠোঁট উল্টিয়ে নিজে নিজে বলে,

– তথ্য তো সব দিয়েই দিলাম। আর কই পাবো ,,!

বলেই রোকেয়া হেঁটে হেঁটে গিয়ে লাশ দুইটার পাশে থাকা একটা চেয়ারে বসে। হ্যান্ড পার্স টা থেকে নিজের ফোন বের করে ফেসবুক স্ক্রল করতে থাকে। পায়ের উপর পা দিয়ে আরাম করতে থাকে। পাশে বেড গুলায় পড়ে থাকে দুটো মেয়ের বিভৎস চেহারার লাশ।

 

 

 

মেম্বার বাড়ি। বারান্দা দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে দিথী। পড়নে থ্রি পিস। মাথার ভেজা চুল দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে সে গোসল খানা থেকে বেড়িয়েছে। এখন ভর দুপুর। আঙিনায় সূর্যের তীব্র রোদ পড়েছে। একটু আগের আকাশ বৃষ্টির জানান দিলেও এখন রোদ।

শাহারিয়া আর দিথীর বিয়ে হয়েছে হলো ২ দিন। শাহারিয়ারাই প্রস্তাব নিয়ে গেছিলো দিথীর বাড়িতে। দিথীর বাবা বিছানায় পড়েছেন। তার মেয়েদের বিয়ের চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়ে যাওয়ার উপক্রম, সেই সময়ে এরকম ভালো প্রতিষ্ঠিত ছেলের বাড়ি হতে প্রস্তাব যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতোন। তার উপর যখন শুনেন তার মেয়ে আর শাহারিয়ার সম্পর্ক আছে আগে থেকেই, তিনি মন থেকে খুশি হন। শেষমেষ তার মেয়েটা সুখী হবে। সুন্দর সংসার পাবে। শুক্রবার রাতে শাহারিয়ারা প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো। সেদিনই রাতে কাজী ডেকে ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয় তাদের। শাহারিয়া ঠিক যেমন ভাবে চেয়েছিলো আরকি‌।

আজ রবিবার। ২ দিন হলো দিথী এবাড়িতে এসেছে। তানিয়া, শাহারিয়া আর শিউলি বেগমকে আসুভে সম্পর্কে সব খুলে বলেছেন। তবে শুধু শাহারিয়ার প্রথম মায়ের মৃত্যুর রহস্য যে এটার সাথে জড়িয়ে আছে সেটা বলেনি। এড়িয়ে গেছে সে। তাছাড়া সব এখন শিউলি বেগম আর শাহারিয়া জানে। শাহারিয়ার কাছে এসব কুসংস্কার মাত্র। তবে শিউলি বেগম সব বিশ্বাস করেছেন। তাই শাহারিয়াকে বিয়ের পরও দিথীর সাথে একরুমে রাত কাটাতে দেননি। শাহারিয়া আহনাফের সাথে আলাদা ঘরে শোয়। আর দিথী ঘুমায় শিউলি বেগমের সাথে।

 

ফিরে আসি বর্তমানে,

দিথী তার ধোঁয়া কাপড় গুলো হাতে নিয়ে আঙিনায় নামে। আঙিনার দড়িতে সেগুলো শুকাতে দিয়ে তার চুল গুলো মেলে দিয়ে রোদের নিচেই একটু ঝেড়ে নেয় গামছাটা দিয়ে। যাতে অতিরিক্ত পানিটা এখানেই পড়ে যায়।

আঙিনা থেকে বারান্দায় উঠে আসে। হেঁটে হেঁটে শিউলি বেগমের রুমে না ঢুকে সোজা শাহারিয়ার রুমের দিকে চলে যায়। দরজা আলতো ফাঁক করে দেখে, শাহারিয়া বিছানায় বসে একটা খাতার পৃষ্ঠায় কীসের যানি সমীকরণ মিলাতে ব্যাস্ত। গোয়েন্দা মানুষ। এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দিথী তা দেখে একটা মলিন হাসি হেসে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। শাহারিয়া মুখ ফিরিয়ে দেখে দিথী এসেছে। দিথী এসে দাঁড়ায় বিছানার পাশের ডেসিন টেবিলে। এই রুমটা আগে ছিলো শিউলি বেগমের। তাই ডেসিন টেবিল আছে। দিথী ডেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। তার ওড়নাটা পিছন থেকে গলায় ঝোলানো। অর্থাৎ ওড়নার দুই প্রান্ত সামনে ঝুলছে আর তার বুক আড়াল করছে। শাহারিয়া আবার তার সমীকরণ মিলানোয় মন দেয়। দিথী তার খোলা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে থাকে ডেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। বলতে থাকে।

– কী করছো খাতায়।

– মিলানোর চেষ্টা করছি।

– কোন কেস নিয়ে ?

– না।

– তবে ?

– আহনাফের বিষয়ে।

– আহনাফ তো তোমার সাথেই এসেছে। তোমার বলে বন্ধুও।

– আমার অধীনে কাজ করে।

– ওহহ,, কী হয়েছে ওর। কী মিলাচ্ছো ওকে নিয়ে ?

– ওর পারিবারিক বিষয়। (একটু থেমে) ওসব বাদ দাও। মা কোথায় ?

– শাশুড়ি মা গোসল খানায় ঢুকলেন।

– তুমি গোসল দিয়ে আসলে তাই না ,,! (একটু থেমে) আমাকেও গোসল করতে হবে। গরম লাগতেছে।

– কোন গরম ,,!

– মানে ?

– মানে বলতেছি শরীরের গরম না আবহাওয়ার গরম ?

– তানিয়া আপুর কথা ভুলে গেছো ,,! বলছে না ২১ তারিখের আগে না।

দিথী ডেসিন টেবিলের দিকে মুখ করেই মিটিমিটি হাসতে থাকে। শাহারিয়ার কাছে বিষয়টা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও দিথীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ লাগছে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে সুস্বাদু খাবার রাখা আছে, কিন্তু সে চাইলেও খেতে পারছেনা। শাহারিয়া বলে,

– আজকে রান্না কী হয়েছে ?

– আজ ? আজ ডাল, ছোট মাছ ভুনা, আর আলুর ভাজি।

– খাঁটি বাঙালি খাবার। একয়দিন মাংস খেতে খেতে মুখের স্বাদই যেন উঠে গেছিলো। ভালোই হয়েছে এসব রান্না করেছে।

– মা’কে আজ রান্না ঘরে যেতে দেয়নি।

– তারমানে তুমি করছো ,,!

– হ্যা। তো কে করবে ,,! নতুন বউ বলে কী সবসময় ঘরে ঢুকে থাকবো নাকি ,,! আর ঘরে ঢুকে একলা একলা কী করবো যদি মানুষ টাই না থাকে সাথে ,,?

– আবার ,,!

দিথী মুচকি হেসে বলে,

– সরি সরি। আমি ভুলে যাই আপুর কথা গুলা।

– ‌বাবা বাসায় নাই ?

– না, আহনাফ কে নিয়ে সকালে বেড়িয়েছেন।

– ওকে নিয়ে আবার কোথায় গেছে ,?

– কে জানে। ওকে আর নতুন যে একটা ছেলে এসেছে ঐযে শৈশব নাম, ওকেও নিয়ে গেছে।

– বাবার আর কাজ নাই। নিশ্চয়ই আহনাফকে নিয়ে ঘুরতে বের হইছে।

– তো কী করবে। তুমি তো সেই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর ঘর থেকেই বের হওনাই। তোমার মতো সবাই ঘর পাগলা নাকি ,,! (বিরবির করে) ঘরে বউ থাকলে তাও একটা কথা,,!

– আমার গ্রামে ঘুরে সময় নষ্ট করার থেকে ঘরে বসে কাজ করতে বেশি ভালো লাগে।

– ঢাকা যাই, তারপর দেখবো কেমন কাজ পারো।

কথাটা শুনেই শাহারিয়া আড়চোখে দিথীর দিকে তাকায়। দিথী হেসে ফেলে। গামছাটা বিছানার কোনে রেখে দেয়। শাহারিয়া বলে,

– একয়দিনে অনেক দুষ্ট হয়ে গেছো দেখতেছি ,,!

দিথী ঠোঁট চেপে হাসে। ডেসিন টেবিলে রাখা ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম টা উঠিয়ে কিছুটা হাতে বের করে মুখে মাখতে থাকে। দিথী একটু শ্যামলা। তাই নিজের মুখে সবসময় ক্রিম মেখে কিছুটা কৃত্রিম উজ্জ্বল করার চেষ্টা করে। ক্রিম মাখতে মাখতে দিথী কথার প্রসঙ্গ ঘুড়িয়ে বলে।

– ঢাকা কবে যাচ্ছি,,!

– তুমি বললে এখনি।

– ও হ্যা ,, ২৭ তারিখের আগে তো যেতেও পারবো না।

– এই কথাটাই তোমাকে দিনে ১০ বার মনে করায় দিতে হয়। (একটু থেমে খাতায় কিসব লেখতে লেখতে) বাই দা ওয়ে, আমরা তো ঢাকা যাচ্ছিনা।

– হ্যা এখন তো যাবোনা।

– এখন না। ২৭ তারিখের পরেও তো যাচ্ছিনা।

শাহারিয়ার কথা শুনে দিথী কিছুটা অবাক হয়। আয়নার দিকে থেকে মুখ না ফিরিয়েই ভ্রু কুঁচকে বলে,

– কেনো ,,!

– আমরা তো শ্রীমঙ্গল যাবো।

– ওখানে কেনো যাবো আমরা ,,?

শাহারিয়া গলার স্বর একটু নরম করে বলে,

– তোমার জন্য বাড়ি কিনেছি ওখানে। তাই।

দিথীর চোখ মুখ উজ্জ্বল উচ্ছসিত হয়ে উঠে। আয়নার দিক থেকে চকিতে শাহারিয়ার দিকে ফিরে বলে,

– সত্যি,,,!

– হমম সত্যি।

– কবে কিনলে ,,?

– এখানে আসার আগেই।

– সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছো তাইলে আমাদের সংসারের জন্য, তাইনা ,,!

– অনেকটা তেমনি বলতে পারো। তবে এখনো সংসার গোছানো বাকি। মেয়ে মানুষ ছাড়া কী পুরুষ মানুষ একলা সংসার গোছাতে পারে ,,!

দিথী কথাটা শুনেই একটা মুচকি হাসি দেয়। বিছানার এক প্রান্তে পা না তুলেই বসে। বলে,

– আমি তো রেডি হয়েই আছি আমাদের সংসার আর জীবন সুন্দর করে গোছানোর জন্য।

শাহারিয়া কিছু বলেনা। খাতার দিকে চেয়ে থেকেই ছোট একটা হাসি দেয়। দিথী নিজের হাতের মেহেদী দেখতে থাকে। মেহেদী দেখতে দেখতে শাহারিয়ার দিকে হাত গুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

– সুন্দর না ,,!

– ঐদিন যে আকিয়েছিলে ,,!

– হ্যা ঐদিনের গুলাই। এখনো উঠে নাই।

– মেহেদী পাতা বেঁটে লাগালে বেশ কয়েকদিন থাকে। এইজন্য।

দিথী চুপ হয়ে তার হাত উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে। শাহারিয়ার সম্পূর্ণ মনযোগ খাতায়। কখনো একটা বিন্দু আঁকছে, কখনো এটার সাথে দাগ টেনে আরেকটা বিন্দু মিলাচ্ছে, কখনো আবার আরেকটা বিন্দু কাঁটছে। দুজনের মাঝেই নেমে আসে নিরবতা। শুধু উপরে ফ্যান চলার শো শো শব্দ। দিথী শাহারিয়াকে চুপচাপ থাকতে দেখে বোর হতে থাকে। সে চুপচাপ ভাবতে থাকে কীভাবে শাহারিয়ার মুড ঘুড়িয়ে তার দিকে আনা যায়।

 

কিছুক্ষণ দুইজন চুপচাপ থাকার পর দিথী বলে,

– এই,

– হমম।

– দেখোনা আমার কাঁধে কী যেনো পড়ছে।

– কাঁধে ,,? কাঁধে আবার কী পড়লো ,,?

– সেটাই তো দেখতে বলতেছি।

– আচ্ছা দাঁড়াও।

– দাঁড়াতে পারবো না।

– আরে ঐটা কথার কথা। তুমি বসো।

বলেই হাতের কলম টা খাতায় রেখে খাতা বন্ধ করে দেয়। দিথী তার পা তুলে বিছানায় উঠে শাহারিয়ার পাশে বসে। শাহারিয়া হাঁটুর বলে উঠে অর্ধেক দাঁড়িয়ে দিথীর পিছনে যায়। দিথী তার কাঁধের চুল গুলো হাত দিয়ে সড়িয়ে একপাশে করে দেয়। মাথাটাও হেলিয়ে নেয়। শাহারিয়া হাত দিয়ে দিথীর কাঁধে স্পর্শ করতেই দিথীর অন্তরাত্মা যেন লাফিয়ে উঠে। কী ঠান্ডা হাত ,,! শাহারিয়া দিথীর কাঁধের ভালো ভাবে ঘঁষে বলে,

– কই , ! কোন কিছু নাই তো ,,!

– তুমি সামনে আসো।

– কেনো ?

– সামনে আসতে বলছি আসো।

– কী যে হইতেছে তোমার বাপু ,,!

শাহারিয়া হাঁটুর বলে হেঁটে এসে দিথীর সামনে আসে। দিথী বলে,

– বসো এইবার।

দিথীর সামনে বসে শাহারিয়া। দিথী এবার বলে,

– আমার গলা থেকে বুকে কী জানি বেরাচ্ছে দেখোতো ,,! মনে হয় কোন পোকা আমার গাঁয়ে পড়েছে ,,!

– একবার বলো পিঠে, একবার বলো গলায়, পড়ছে কোথায় ঠিক করে বলো।

– গলা আর বুকের উপরেই, দেখোনা একটু। আমার কেমন জানি লাগতেছে। পোকাটা ছোটো।

– উফফ,, দেখতেছি।

শাহারিয়া বসা হতে হাঁটুর বলে অর্ধেক দাঁড়ায় দিথীর সামনে। দিথীর কাছে এসে তার গলায় দেখতে থাকে। দিথী মাথা একপাশে হেলিয়ে রেখেছে। শাহারিয়া তার গলায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, তখনই দিথী তার ওড়না গা থেকে টেনে ফেলে দেয়। বলে,

– ওড়না আমার গলায় থাকলে পোকা পাবা কি করে। আরো কাছে এসে দেখো।

– তুমি কী করতেছো আমি কিছু বুজতেছিনা।

– বুঝা লাগবেনা তোমার। তুমি কাছে এসে দেখো। আমার শরীরে পড়ার কথা তোমার, সেই যায়গায় পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তোমার তো হিংসে হওয়া দরকার,,! নাও দেখো আমার গলা থেকে ঐটা কোথায় গেলো ,,!

– কী যে হইতেছে মাবুদ,,,!

শাহারিয়া তার মুখ এগিয়ে দেখতে থাকে দিথীর গলায়। না, কিছুই নেই। শাহারিয়া হাত দিয়ে তার গলার আশপাশ টা ঝেড়ে দেয়। দিথী বলে,

– তুমি আরো কাছে আসো তো।

দিথীর এই কথায় এইবার শাহারিয়া বুঝতে পারে। দিথী শাহারিয়ার থেকে তার গলায় চুমু খেতে চাইছে। কিন্তু পরে ও উত্তেজিত হয়ে গেলে তখন তো অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে। “এই দিথীর যে কী হইলো ,,! জানে যে এই কয়দিন দূরে থাকতে হবে তাও নিজ থেকে কাছে ডাকে। ” মনে মনে বিরবির করতে থাকে শাহারিয়া।

 

শাহারিয়া আর কাছে না আসায়, থেমে যাওয়ায় দিথী বুঝতে পারে রে শাহারিয়া তার মতলব ধরতে পেরেছে। শাহারিয়া তার থেকে সড়ে যেতে যাবেই তখনই পাশে থাকা ওড়নাটা শাহারিয়ার কাঁধের পাশে দিয়ে দুই প্রান্ত ধরে টেনে টেনে শাহারিয়াকে তার কাছে টানে। দিথী তাকে একদম কাছাকাছি আনে, দুইজন দুজনের দিকে চেয়ে আছে। এক দৃষ্টে। দিথী আর তার ঠোঁটের দুরত্ব মাত্র কয়েক আঙ্গুল। দিথী ধীর গলায় বলে,

– একটা চুমু তো পেতে পারি আমি তোমার থেকে। কেনো বুঝোনা তুমি ,,!

– চুমু খেলে যদি,,,,,,

– চুমু খেলে কিছু হবে না। আমার ঠোঁট দুটো তোমার নরম ছোঁয়া দিয়ে ভিজিয়ে দাও ,,! প্লিজ ,,!

– মেয়েরাও বায়না ধরে ,,!

– ধরে ধরে ধরে ,,! শুধু একটা গভীর চুমু খাও আমাকে। আমার ভিতরে আকাঙ্ক্ষা একটু হলেও মিটিয়ে দাও ,,!

দিথীর চোখ কিছুটা ছলছল করছে। শাহারিয়া কিছু বলতে যাবেই তখনই দিথী তার মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়। মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বলে “আর কোন কথা নয় ,,!”

ধীরে ধীরে নিজের হাতটা শাহারিয়ার মুখের উপর থেকে সড়িয়ে নিতে থাকে। তার দিকে আরো এগিয়ে যায়। শাহারিয়ার নিচের ঠোঁটে দিথীর প্রথম ছোঁয়া পড়ে। নিচের ঠোঁট টা হালকা চুষে দুই ঠোঁটে গভীর ভাবে চুমু খেতে থাকে। শাহারিয়া আর নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারেনা। সেও দিথীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া শুরু করে। গভীর ভাবে চুমু খেতে থাকে তাকে। দিথীর বুকের ভিতরে যেন এক পশলা বৃষ্টি নেমে আসে। কিছুটা ভয় হলেও সে বিষয়টাকে দারুন উপভোগ করে। শাহারিয়ার পিঠ আঁকড়ে ধরে। নখ বসে যায় কিছুটা তার পিঠে। শাহারিয়া খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে চুমু খাচ্ছে। তার পিঠে গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দিথী আর শাহারিয়া দু’জনেই হাঁটুর বলে দাড়ায়। দুজন দুজনকে নিজের করে নিতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর শাহারিয়া দিথীকে ছাড়িয়ে নিতে তাকে আলতো করে ধাক্কা দেয়। দুইজনেই বিছানার দুই কোনে পড়ে। দিথী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। তার বুক খানা বারাবার উঠা নামা করছে। তার ভিজা ঠোঁট থেকে এক ফোঁটা লালা টোপ করে তার পায়ে পড়ে যায়। শাহারিয়ার ঠোঁট দুটোও ভিজে একাকার। দিথী শাহারিয়ার দিকে এক দুষ্টু চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজের জিহ্বা বের করে তার ঠোঁটে থাকা সব রস টুকু টেনে মুখে নিয়ে নিতে থাকে। দিথীর চাহনি যেন শাহারিয়াকে আহ্বান করছে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বলছে এসো, নিয়ে নাও, সব নিজের করে নাও। শাহারিয়ারও মন করছে দিথীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে নিজেকে সঁপে দিতে, কিন্তু তখনই তার মনে তানিয়ার কথা ভেসে উঠে। তাঁদের দুজনের মিলন সম্ভব নয়। শাহারিয়া নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। দিথী এখনো নিজের জিহ্বা দিয়ে তার নিজের ঠোঁটের লালা চেটে নিচ্ছে। একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় শাহারিয়াকে কাছে আশার ইঙ্গিত দিতে থাকে। শাহারিয়া চাইছিলো তানিয়ার কথা উপেক্ষা করে দিথী দিকে যেতে। তাকে দিথীর দুষ্টু চাহনী খুব টানছে,, খুব খুব টানছে,,!

সে ধীরে ধীরে দিথীর দিকে এগোতে থাকে। দিথীর মুখ থেকে বের হয় কিছু আহ্বান সূচক ইংরেজি শব্দ। শাহারিয়া পাগলপ্রায় হয়ে যায়। সে দিথীর উপর ঝাপিয়ে পড়তে যাবেই তখনই ঘরের দরজা খুলে যায়। শাহারিয়া আর দিথী চকিতে সেদিকে তাকায়। দেখে শিউলি বেগম এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছেন। শিউলি বেগম দিথীর গাঁয়ে ওড়না না দেখে আর তার ভিজে থাকা ঠোঁট দেখে সব বুঝে যান। তাড়াতাড়ি ভিতরে আসতে থাকেন। শাহারিয়া নিজেকে কন্ট্রোল করে নিয়ে বিছানার আরেক প্রান্তে চলে গিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে। শিউলি বেগম দিথীর পাশে এসে দাঁড়ান। দিথী এখন কিছুটা লজ্জা পায়। সে ওড়না টেনে বুকের উপর দিতে থাকে। শিউলি দিথীর কাঁধে হাত রেখে হাসৌজ্জল মুখে বলেন,

– কী ,,! আর কয়ডা দিন সহ্য হয়না ,,! হ্যা ,,! আমি না আইলে তো এতোক্ষণে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লাইগা যাইতো ,,!

শাহারিয়া অন্যদিকে মুখ করে হাত দিয়ে তার ঠোঁট মুছতে থাকে। দিথীর ঠোঁট এখনো ভিজা। শিউলি বেগম তার শাড়ির আঁচল দিয়ে দিথীর ঠোঁট মুছে দিতে থাকেন। বলেন,

– আইজ থেইকা তোমাগো বাড়ির ভিতরে দেখা দেখিও বন্ধ। মাগো মা ,,! চুমু খাইছো ভালো কথা, তাই বইলা সবকিছু করা লাগবো ,,! দিথী, তুমি এহন থেইকা এই ঘরে আর আইবানা। বুজ্জো আমার কতা ,,!

দিথী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। শিউলি বেগম তা দেখে একটু মুচকি হাসেন, তারপর আবার কন্ঠ কঠিন করে শাহারিয়াকে বলতে থাকেন,

– আর তুইও, ঐ ঘরে কহনো আবিনা। কি কইছি হুনছোস ,,!

শাহারিয়া বেশি লজ্জা পেয়েছে, তাই তো দিথী এখনো মাথা তুলে তাকিয়ে থাকলেও সে মাথা নিচু করে অন্যদিকে ফিরে আছে। সেও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। শিউলি বেগম বলেন,

– এহন তাড়াতাড়ি গোসলে যা। গোসল কইরা সোজা ডায়নিং টেবিলে আবি। তাড়াতাড়ি যা।

শাহারিয়া ধীর গলায় বলে,

– এখনি যাচ্ছি মা। (বলেই বিছানা থেকে নেমে কোনমতে আলনা থেকে একটা লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে যায় সে। শিউলি বেগম তার বেড়িয়ে যাওয়ার পর পরই হাসতে থাকেন। দিথীও ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে। শিউলি বেগম হাসতে দিথীর মাথায় টোকা দিয়ে বলেন,

– ক্যান, একটু সহ্য করোন যায় না ,,! আর তো কয়েকটা দিন মাত্র,,!

– তাও মা,, ! আমার একলা একলা থাকলে কেমন জেনো লাগে ,,!

– হইছে , আমি সব বুঝি। তোমাগো বয়স পাড় কইরা আইছি আমি। এহন ‌তাড়াতাড়ি যাও, তোমার শশুর আব্বায় খাইতে আইবো। শাহারিয়াও গোসল দিয়া আইতাছে। ভাত বাড়ো।

– ওর বলে খিদা লাগছিলো, কি রান্না হইছে জিগাইছিলো।

– অর ভাতের খিদা লাগছিলো। আর তুমি অরে ভাত না খাওয়াইয়া ,,,,,,,,,! থাক আর কইলাম না। লও আমার লগে।

দিথী এবার বেশ লজ্জা পায়। মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে শিউলি বেগমের হাত ধরে বিছানা থেকে উঠে। চলে যেতে থাকে ঘরের বাইরে। ঘর আবার নিশ্চুপ, নিরব হয়ে যায়। শুধু বিছানায় জড়ো হয়ে থাকা চাদর আর খাতা কলম পড়ে থাকে।

 

 

 

নিপা ঘরে পায়চারি করছে। পড়নে থ্রি পিস। হাতে ফোন। এখন দুপুর। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ২ টা ৫ বেজে গেছে। রায়হান আজ সকালে বেড়িয়েছে। বলেছিলো দুপুর হতে হতে চলে আসবে। কিন্তু ফিরার কোন নাম ঠিকানা নেই। নিপার খুব পানি তৃষ্ণা পেয়েছে। বিছানার পাশের টেবিলের জগটার পানিও শেষ। এদিকে বার বার নিচে থাকা আঁখির ফোনে ফোন দিচ্ছে তাও আঁখি ফোন তুলছে না। গলা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে আছে তার। নিপা কিছু বুঝে উঠে না তার এখন কী করা উচিত ,,! আলিশার ফোন নেই। নাইলে ওকে ফোন দিতো। পেটে খিদেও লেগেছে। নিপা বিরক্ত হয়ে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারে। হেঁটে হেঁটে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে নিজেই যেয়ে পানি খেতে হবে। আর আঁখিকেও ডাকতে হবে। কিন্তু রায়হান তো তাকে বাইরে যেতে মানা করেছে। এদিকে সেই শুক্রবারের দিন যেদিন রায়হান ছিলোনা সেদিন রাতে এই দরজার ওপাস থেকে এক পুরুষ কন্ঠ পেয়েছিলো সে। লোকটা কিছুক্ষণ পায়চারি করে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন তার তৃষ্ণার্ত পীড়িত দেহ আর মানছেনা। তাকে পানি খেতেই হবে। তখনই তার মনে পড়লো। সকালে রায়হান যাওয়ার সময় বলেছিলো যে বাড়ির সব ছেলেদের সাথেই সে যাচ্ছে। তারমানে তো বাড়িতে এখন শুধু মেয়েরা ছাড়া আর কেউ নেই। তাইলে কী এখন তার নিচে যাওয়া উচিত,,! গলা যে আর মানছেনা। দু ফোঁটা জল গলায় না গেলে যে সে ছটফট করতে থাকা প্রাণ টাও আর রইবে না,,! নিপা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বাড়িতে আর কোন পুরুষ নেই, মানে কোন বিপদও নেই। সে চুপচাপ নিচে নেমে রান্না ঘর খুঁজে পানি খেয়ে নিবে। আঁখিকে না পেলেও হবে, শুধু পানি দিয়ে গলা ভিজাতে পারলেই সে ক্ষান্ত।

সিদ্ধান্ত ঠিক করার সাথে সাথেই সে বিছানায় থাকা তার ওড়নাটা গাঁয়ে দিয়ে দেয় ভালোকরে। বিছানায় থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে যায় সে।

 

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে নিপা। পুরা বাড়ি গম্ভির। দেয়ালে ঝুলে থাকা বড় দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। নিপা পা টিপে টিপে সিঁড়ি থেকে অন্দরমহলে নামে। চারপাশে ঘুরে দেখতে থাকে। এতো নিস্তব্ধতার সম্মুখীন সে আগে কখনো হয়নি। যেনো কোন ভুতুড়ে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। ওকে এখন রান্না ঘরটা খুঁজতে হবে। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সোফার পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার করিডোরের দিকে নজর যায় তার।

বিরবির করে বলে। ” রান্না ঘর ঐদিকে নাকি ,,?”

ভেবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সেদিকে। করিডোর টা ছিলো সুরাইয়া বেগমের রুম আর স্টোর রুমে যাওয়ার। এই দুইটা রুম ছাড়া এই লম্বা করিডোর টায় আর কিছুই নেই। নিপা ধীর পায়ে করিডোরের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাথে সাথেই তার হ্রদয়টা যেনো কেঁপে উঠে। করিডোরের ভিতরে একটা দরজা পাশে কি জানি কালো একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। নিপার ঢোক গিলে। সে চিৎকার করেনা। তবে তার গাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। সে আর দু পা ধীরে এগিয়ে ভালোভাবে দেখে বুঝে যে না, সেটা কোন কালো ভূত বা জ্বীন না। একটা বোরখা পরিহিত নারী। যেই নারী একটা রুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভিতরে দেখছে। নিপার মনে এখন ভয় দূর হয়ে সন্দেহ জেঁকে বসে। মনে মনে ভাবতে থাকে, ” এই মেয়েটা আবার কে ,,? কারো দরজার আড়াল দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কেনো ,,! (একটু থেমে) আমাকে বিষয় টা দেখতেই হবে।”

নিপা খুব ধীরে নিঃশব্দে পা ফেলে করিডোরে ঢুকে পড়ে। এগিয়ে যেতে থাকে মেয়েটার দিকে। মেয়েটার পিঠের পার্শ দেখতে পাচ্ছিলো সে। পুরো শরীর কালো বোরখায় ঢাকা। নিপা খুব সাবধানে হেঁটে হেঁটে এসে ঠিক মেয়েটার পিছনে এসে থেমে যায়। ধীরে ধীরে তার হাত এগিয়ে দেয় বোরখা পড়া মেয়েটার দিকে। এবং একটা পর্যায়ে মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে দেয়। বোরখা পড়া মেয়েটা তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠে পিছনে ফিরে তাকায়। ঘরের ভিতর থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ আসে। নিপা বোরখা পড়া মেয়েটার দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে। মেয়েটার মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিলো। নিপা এক হাত দিয়ে জোর করে বোরখা পড়া মেয়েটার মুখের উপর থেকে কালো কাপড় টেনে নামায়। মেয়েটার চেহারা দেখার সাথে সাথেই নিপা অবাক হয়ে যায়। বলে উঠে,,

– আঁখি তুই ,,,!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৩ (১ম ভাগ)

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

নিপা খুব ধীরে নিঃশব্দে পা ফেলে করিডোরে ঢুকে পড়ে। এগিয়ে যেতে থাকে মেয়েটার দিকে। মেয়েটার পিঠের পার্শ দেখতে পাচ্ছিলো সে। পুরো শরীর কালো বোরখায় ঢাকা। নিপা খুব সাবধানে হেঁটে হেঁটে এসে ঠিক মেয়েটার পিছনে এসে থেমে যায়। ধীরে ধীরে তার হাত এগিয়ে দেয় বোরখা পড়া মেয়েটার দিকে। এবং একটা পর্যায়ে মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে দেয়। বোরখা পড়া মেয়েটা তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠে পিছনে ফিরে তাকায়। ঘরের ভিতর থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ আসে। নিপা বোরখা পড়া মেয়েটার দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে। মেয়েটার মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিলো। নিপা এক হাত দিয়ে জোর করে বোরখা পড়া মেয়েটার মুখের উপর থেকে কালো কাপড় টেনে নামায়। মেয়েটার চেহারা দেখার সাথে সাথেই নিপা অবাক হয়ে যায়। বলে উঠে,,

– আঁখি তুই ,,,!

– হ,হ আফা আমি। (কাপো কাপো কন্ঠে)

– তুই এখানে কী করতেছিস ,,! এটা কার রুম ,,!

– এ,এইডা সুরাইয়া খালাম্মার রুম।

নিপা উঁকি মেরে দরজার পর্দার আড়ালে একটা মহিলাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে। বলতে থাকে,

– উনি সুরাইয়া ,,?

– হ, ঐডা সুরাইয়া খালাম্মা। আলিশার মা।

– ও আলিশার আম্মু। (পর্দা দিয়ে একটা ছোট্ট উঁকি মেরে আবার আঁখির দিকে চেয়ে) কী হইছে উনার ,,!

– শ,শরীর খারাপ।

– ওহ,, (একটু থেমে) আর তুই এখানে কী করতেছিস। আর এমন কালো বোরখা পড়ে আছিস কেন ?

– না মানে আমি বড় খালাম্মার লগে একটু বাইরে গেছিলাম। আর বড় খালাম্মার আদেশ বাইরে গেলে বোরখা ছাড়া বাইর হওয়া যাইবো না।

– শাশুড়ি মা’র কথা বলছিস ,,?

– হ। বাইরে থেইকা আইয়া খালাম্মা উপরে গেলো আর আমি রান্না ঘরের দিকে যাইতাছিলাম তহনই এই করিডোর থেইকা কিছু আওয়াজ পাই। আওয়াজ টা এই রুম থেইকাই আইতাছিলো। আমি এরলাইগা চুপি চুপি দেখতে আইছিলাম কীসের শব্দ। ঘরের পর্দা ডা সড়ানোর আগেই আপনে আমারে চমকাইয়া দিলেন।

– কিন্তু ঘরের মহিলাটা তো ঘুমাচ্ছে।

– হ ঘুমাইতাছে বইলাই তো দেখতে আইছিলাম কোন চোর বা অন্য লোক আইলো নাকি ঘরে।

নিপা ঘরের পর্দা সড়িয়ে ঘরের ভিতর টা ভালো করে দেখে। বলে,

– কই, ভিতরে তো কেউ নাই। তুইও না,,! মনে হয় ভুল শুনছিস। (একটু থেমে) আর তোর ফোন কই ,,! আমি কতক্ষন থেকে ফোন দিতেছি ধরিস না ক্যান ,,?

– ফোন ডাতো আমার ঘরে রাইখা বাইরে গেছিলাম। আমার ফোন ডা বড় খালাম্মায় দেখলে রাগারাগী কইরা ফালায়া দিবো।

– তাই বলে এতোক্ষণ বাইরে থাকবি ,,! এদিকে ঘরের জগে পানি নাই। আমার গলায় এক ফোঁটা পানি পড়ে নাই। পেটে খিদাও লাগছে। রায়হানও নাই। কী যে বেকায়দায় পরছিলাম আমি ,,!

– রায়হান ভাইয়ায় চইলা আইবো ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই।

– তুই এখন চল, আমার গলায় পানির স্রোত না বইলে আমি এখনি মরে যাবো। তাড়াতাড়ি চল রান্নাঘরের দিকে।

– হ লন।

আঁখি বোরখা পড়া অবস্থাতেই চলে যেতে থাকে নিপার সাথে করিডোর দিয়ে। করিডোরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তাদের পায়ের আওয়াজ। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সেটা।

 

 

 

দুপুরের রোদ এখন মাথার উপর। ধীরে ধীরে তেজ বাড়াচ্ছে আবার মেঘের আড়ালে নেতিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘটা করে বাতাস বইছে। গাছের পাতা গুলো নড়ে না উঠলে যেন বোঝাই যায়না যে বাতাস আছে। গাছের ডালে থাকা পাখিটা কিছুক্ষণ পর পর কিচিরমিচির কলতান তুলছে।

 

দুটো কাঁচা বাড়ি। একদম সামনাসামনি বাড়ি দুটো। মাঝে আঙ্গিনা। বাড়ির দেওয়াল বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি, উপরে টিনের বদলে ধানের খড় দেওয়া। ফ্লোর কাঁচা মাটি লেপ্টে বানানো। বাড়ি দুটোর সামনে একটু বাড়ানো বারান্দাও আছে। সেটাও মাটি দিয়ে লেপ্টে তৈরি করা। তার উপর খড়ের ছাউনি। একটা বাড়ি সোনালী দের। আর ঠিক সামনাসামনি থাকা অপর বাড়িটা সোনালীর চাচার। সোনালী দের বাড়িটায় দুটো রুম। একটায় সোনালী থাকে, আরেকটায় তার বাবা। দুটো রুমের একটা বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো। আরেকটার ভিতর থেকে।

 

সোনালীর বাবা রহিম মিয়া বাসায় আসলেন। পড়নে লুঙ্গি আর একটা সাদা গেঞ্জি। কাঁধে গামছা। বয়স হয়েছে বেশ। গালের দাড়ি গুলো পেকেছে, মাথার চুল গুলোও সাদা সাদা। তবুও কৃষি কাজের প্রতি তার ঝোঁক যেন কমছেই না। হাতের কোদাল টা আঙিনায় রেখে তার বাড়ির বারান্দা টায় উঠলেন। কাঁধে থাকা গামছাটা দিয়ে মুখ, গলার ঘাম মুছে বারান্দার রশিতে ভালোভাবে মেলে দেন। মেলে দিতে দিতে একজনের নাম ধরে ডাকতে থাকেন।,

– রুপা ,,,,, রুপা,,,,,,

তাদের বাড়ির সামনাসামনি থাকা অপর বাড়িটা হতে বেড়িয়ে আসে ১৫-১৬ বছর বয়সী একটা মেয়ে। পড়নে পুরোনো এক গোল জামা। রুপা এসে আঙিনা পেড়িয়ে সোনালী দের বাড়ির বারান্দায় উঠে। রহিম মিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– চাচা আমারে ডাকছিলা ,,!

– হ, সোনালী কই ,,! কলেজ থেইকা আহেনাই ,,!

– আফায় তো আইজ কলেজে যাওনের লাইগা বাইর হইছিলো কিন্তু পরে আবার আধা ঘন্টা পর বাড়ি আইয়া পড়ছে। আইয়া যে ঘরের ঢুইকা দরজা লাগাইছে, এহনো খুলে নাই।

– কস কী ,,! ওর আবার কী হইলো।

– জানি না চাচা। তয় চোখ,মুখ ভিজা আছিলো।

রহিম মিয়া কিছুটা চিন্তিত হন। হনহন করে সোনালীর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। সোনালীর ঘরের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলেন,

– সোনালী,,,, মা সোনালী ,,,,, কী হইছে মা তর ,,,!

 

ঘরের ভিতরে সোনালী বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে ছিলো। বালিশে তার লুকানো মুখটা তার বাবার কন্ঠ শুনে বালিশ থেকে উঠে। পাশ ফিরে বলতে থাকে,

– জ্বী আব্বা।

– তুই ঘরে ঢুইকা দরজা বন্ধ কইরা আছোস ক্যান মা ,,! তোরে কেউ কিছু কইছে ,,!

সোনালী তার চোখের পানি মুছতে থাকে। গলা ঠিক করে বলতে থাকে,

– না বাবা, কিছু হয়নাই। তুমি রূপারে কও খাওন বাইরা দিতে। খাইয়া লও তুমি।

– আমি পরে খাইতাছি। আগে ক কী হইছে তোর ,,! মন খারাপ ?

– হ আব্বা।

– কী নিয়া ,,! তোর মায়ের কথা মনে পড়তাছে ,,!

সোনালী চোখ থেকে বের হওয়া আরো দু ফোঁটা পানি হাত দিয়ে মুছে। বলে,

– আব্বা তুমি খাইয়া লও। আমি একটু একলা থাকতে চাই।

– ক্যান মা। আয় একলগে ভাত খাই।

– তুমি খাও আব্বা। আমি পরে খামু। (বলেই আবার বালিশে মুখ লুকায় সোনালী। ডুকরে ডুকরে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে।

রহিম মিয়া দরজা ধাক্কানো থামিয়ে দেন। ফিরে রুপার দিকে তাকিয়ে বলেন,

– সোনালীরে কী কেউ কিছু কইছে ,,!

– না চাচা। আফায় তো সকালের নাস্তা খাইয়া সুন্দর মতোনই বাইর হইয়া গেলো। তারপর যে কি হইছে জানিনা।

– মা মরা মাইয়াডা আমার। মনে হয় ছোট বেলার মায়ের কথা মনে পড়ছে। এরলাইগা মন খারাপ কইরা বইসা আছে।

– হ চাচা।

– আইচ্ছা তুই খাওন বাইরা দে। খিদা লাগছে। কয়ডা ভাত খাইয়া আবার আমারে ঐদিকে যাওয়া লাগবো।

– আইচ্ছা চাচা, আপনে ঘরে বন। আমি আনতাছি।

– বাইরেই দে। বারান্দায় পাটি বিছায়া এহানেই দে। ঘরে গরম করে।

– আইচ্ছা ঠিক আছে চাচা।

বলেই রুপা দৌড়ে রহিম মিয়ার ঘরে ঢুকে। কিছুক্ষণ পর একটা শীতল পাটি হাতে বাইরে বেড়িয়ে আসে। এসে বারান্দায় পাটি বিছিয়ে দেয়। রহিম মিয়া বসে পড়েন সেখানে। রুপা চলে যায় রান্না ঘরের দিকে বাকি খাবার আনার জন্য। রহিম মিয়া তার আশপাশে ভনভন করা মাছি গুলোকে হাত দিয়ে তাড়িয়ে দিতে থাকেন। তার মনটাও একটু গোমড়া হয়ে যায়। সোনালীর হঠাৎ করে এমন ঘরে দরজা লাগিয়ে একলা থাকাটা তাকে ভাবিয়ে তুলে। রুপা খাবার নিয়ে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। রহিম মিয়ার সামনে খাবার গুলো রেখে তার প্লেটে বেড়ে দিতে থাকে। দূরে গাছে থাকা পাখি গুলো উড়ে যায় খাবারের খোঁজে। মৃদু রোদ আবার ঢাকা পড়ে এক ছোট্ট পেঁজা তুলোর আড়ালে।

 

 

 

দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নিলখাইট্টা নামের একটা যায়গা। সময়টা বিকেল। একটা লম্বা চলে যাওয়া আধা পাকা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুরাতন রাসায়নিক কারখানা। এই রাস্তা টা রাসায়নিক কারখানার পাশ দিয়ে চলে গেছে চিরোলডাঙ্গা নামে একটা গ্রামের দিকে। জং ধরা লোহার কারখানার এঙ্গেল গুলাকে দেখে একটা ভৌতিক কারখানা বললেও ভুল হবেনা। এই কারখানার আশেপাশে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত কোন জনবসতি নেই। ২৭ বছর আগে এক দূর্ঘটনার পর থেকে এই রাসায়নিক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে নির্জন এই এলাকায় ভুতুড়ে যায়গা হিসেবে পরিচিত পায় এটা। রাস্তার পাশে গা ঘেঁষে লাগানো এই কারখানাটা ছাড়া আর কোন কিছু নেই। চারপাশে শুধু ফসলি মাঠ। বিকেলের মেঘলা আকাশে চারপাশ মৃদু অন্ধকারাচ্ছন্ন।

 

দূর থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখা যায়। গাড়িটার রং অস্পষ্ট। ধীরে ধীরে সেটার অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠে আমাদের কাছে। গাড়িটা পুলিশের গাড়ি। বুঝতে বাকি রইলো না যে এখানে রিয়াদ রা আছে। দূরে বাজ পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। শো শো করে বাতাস বইছে। যেন কোন আগাম ঝড় আসার বার্তা জানিয়ে যাচ্ছে।

গাড়িটা কারখানার সামনে এসে তার গতি কমায়। কারখানার বড় দরজাটার সম্মুখে গাড়িটা থামে। গাড়ির সামনের দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে রিয়াদ। চোখে থাকা সানগ্লাসটা খুলে পুলিশ ইউনিফর্মের শার্টে ঢুকিয়ে রাখে। এমনিতেই শীতকাল, তার উপরে এমন ঠান্ডা বাতাস গায়ের লোম দাড় করিয়ে দিচ্ছে। রিয়াদ গাড়ি থেকে নামার পর আরো কয়জন কনস্টেবল নামে গাড়ি থেকে। রিয়াদ ধীর পায়ে হেঁটে কারখানার বড় গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায়। কোমড়ে দুই হাত দিয়ে উপরে তাকায়।  কালো গেট খানার উপরে জং ধরা লোহার সাইনবোর্ডে লেখা “সানলাইট কেমিক্যাল কোং লিঃ” স্থাপিত ১৯১৭। বেশ পুরোনো কারখানা টা। তাছাড়া এখনকার কারখানা গুলোর বডি ইট পাথরের তৈরি হলেও পুরোনো এই কারখানার বিল্ডিংয়ের সবটুকু কাঠামো লোহা আর এঙ্গেল দিয়ে তৈরি। কারখানাটার চার পাশে দেওয়া সুউঁচু প্রাচীরটা শুধুমাত্র ইট পাথরের তৈরি। রিয়াদের পাশে এসে দাঁড়ায় বাকি কনস্টেবলরা। রিয়াদ তার ডান পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবল নয়নকে বলতে থাকে,

– এই কারখানার পাহারাদার কই ,,?

– স্যার এই কারখানায় কোন ওয়াচ ম্যান থাকতে চায় না। রাত হলেই বলে এটা ভূতের আস্তানা হয়ে যায়। দিনের বেলাতেও এটার পাশ দিয়ে এই রাস্তায় কোন লোক চলাচল করেনা। দেখেন এখানকার আবহাওয়া কত খারাপ। মনে হইতেছে ঝড় উঠবে কিছুক্ষণ পর। অথচ আমার এই রাস্তায় ঢুকার আগেও রোদ দেখে আসছি।

– মানুষের মন মেজাজ আর আবহাওয়া, বদলাতে দুই সেকেন্ডও লাগেনা। দরজা খুলার ব্যবস্থা করো।

– জ্বী স্যার।

নয়ন আর কিছু কনস্টেবল রা দরজার হাতল ধরে খোলার চেষ্টা করে, কিন্তু দরজা আগে থেকেই খোলা অবস্থায় ছিলো। কনস্টেবলরা দরজাটা খুলে রিয়াদকে ইশারায় দেখায়। রিয়াদ তার কোমর থেকে পিস্তল বের করে সবাইকে ইশারায় এলার্ট হয়ে নিতে বলে। কনস্টেবল রাও তাদের বন্দুক হাতে নেয়।

 

ভিতরে চলে আসে সবাই। চারপাশের পরিবেশে কেমন একটা গোমট গোমট ভাব। প্রাচীরের দেওয়ালে সবুজ শেওলা জমে পুরো দেওয়াল সবুজাভ হয়ে গেছে। চারপাশে বড় বড় এসিড রাখার লোহার জং ধরা ট্যাংকি। রিয়াদ আর কনস্টেবলরা ধীর পায়ে কারখানাটার মূল কাঠামোর সামনে চলে আসে। কারখানাটা দোতলা। রিয়াদ ধীর গলায় বাকিদের বলে,

– তোমার ছড়িয়ে পড়ো‌ পুরো কারখানায় চিরুনি তল্লাশি নাও। মঈনুল এখানেই আছে। তবে, তবে ওকে কিন্তু আমাদের জীবিত ধরতে হবে। কেউ ভুল করেও ওর উপর গুলি চালাবে না। বুঝতে পেরেছো ,,!

– ওকে স্যার।

– মুভ।

সব কনস্টেবলরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। রিয়াদ তার পিস্তল টা উঁচিয়ে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সহিত এগিয়ে যায় সামনে। চারপাশে একটা ভারী গন্ধ বয়ে যাচ্ছে বাতাসে। গন্ধটা শুধু কারখানার ভিতরেই। বাইরে থাকতে তারা এই গন্ধটা পায় নি। কিছু কনস্টেবল দোতলাতেও চলে যায়। সিড়িটাও লোহার তৈরি। জং ধরা সিঁড়িটি তাদের পদধ্বনিতে কেঁপে উঠে।

 

দুই প্রাচীরের মিলিত হওয়া একটা কোন। আবর্জনার স্তূপ চারপাশে। বাজে দুর্গন্ধটা হয়তো এখান থেকেই ছড়াচ্ছে। মঈনুল ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। মুখে তার হালকা দাড়ি, পড়নে একটা লাল গেন্জি। হ্যাংলা পাতলা গড়নের মঈনুলের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। তার পা গুলো পচে থাকা ময়লার মধ্যে দেবে গেছে। মঈনুল ফোনের অপর পাশের থাকা কাউকে বলতে থাকে,

– আফা, আমারে এইহান থেইকা নিয়া যান। এইহানে আমি থাকতে পারমুনা।

– আর মাত্র কয়েকদিন। এরপর আমি এসে তোকে নিয়ে যাবো।

– না আফা। এইহানে রাইত হইলে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। নুপুর পইড়া একটা সাদা কাফনের কাপড় পড়া লাশ ঘুইরা বেড়ায়। আমি এইহানে থাকতে পারমুনা। আমারে এইহান থেইকা নিয়া যান।

– বললাম তো আর কয়েকটা দিন। তুই চুপচাপ সেখানে থাক। বাইরে আসলে পরে তখন ধরা পড়ে গেলে জেলের ভাত খাইস ,,!

– আফা আমি জেলে যামু, তাও এইহানে থাকমু না। রাইতের বেলা কাইলকা লাইন ধইরা সাদা কাফনে মোড়ানো লাশদের এইহানে ঢুকতে দেখছি। চেহারা কী বিভৎস,,,! আফা প্লিজ আমারে লইয়া যান।

– চিন্তা করিস না। আমরা তোকে নিতেই আসছি। (কথাটা মঈনুল তার পিছন থেকে শুনতে পায়। আর সাথে সাথে তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে দেয় কেউ জেনো। মঈনুল ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকায়। আর সাথে সাথেই একটা চিৎকার দিয়ে ফোন মাটিতে ফেলে দেয়। দেখে রিয়াদ তার মাথায় বন্দুক ধরেছে। মঈনুল কিছু বলতেই যাবে তার আগেই রিয়াদ তার কলাড় ধরে ফেলে এক হাত দিয়ে। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলে,

– তুই ,,! তোকে তো আমার চিনা চিনা লাগতেছে। (একটু থেমে) তুই ঐ ছেলেটা না যে ঐদিন অটোতে করে একটা বাচ্চাকে ধাক্কা দিয়ে নাক মুখ ফাটায় ফেলছিলি ,,!

– হ স্যার। আমিই ঐ লোকটা। স্যার, স্যার আমারে ছাইড়া দেন। আমার কোন দোষ নাই ,,!

– দোষ নাই হ্যা ,,! (এক জোড়ে থাপ্পড় দিয়ে) আয়ান কই বল। বল আয়ান কই ,,!

মঈনুল গালে হাত দিয়ে ভাঙা গলায় বলতে থাকে,

– স্যার আমি আসলেই জানিনা। আমি নির্দোষ।

– তুই নির্দোষ,,! আর এইটা আমাকে বিশ্বাস করা লাগবে ,,! (জোড়ে আরেকটা থাপ্পড় দিয়ে) আমাকে বাধ্য করাইস না তোর মাথায় গুলি চালাইতে। বল আয়ান কোথায়। তুই ওকে কোথায় লুকায় রাখছিস ,,!

– স্যার, স্যার ঐ আফায় আয়ানরে তুইলা নিছিলো। তারপর কী করছে আমি জানিনা স্যার। আমি সত্যিই এরপর আর কিছু জানিনা।

– কোন আফা,,! এই কাজের সাথে তোর সাথে আর কে কে জড়ায় আছে ,,! বল তাড়াতাড়ি নাইলে কিন্তু তোর মাথা এখনি ফুটা করে দিবো।

– স্যার, (হেলে রিয়াদের পা ঝাপটে ধরে) স্যার আমি সত্যিই নির্দোষ। আমার বউ বাচ্চারে ঐ আফা কিডন্যাপ কইরা আমারে দিয়া এই কাজ গুলা করাইছে। সত্যি আমি জানিনা ঐ আফা আয়ানরে নিয়া কই রাখছে, কী করছে। আমারে ছাইড়া দেন স্যার। আমি নির্দোষ।

– আমার পা ছাড়। তাড়াতাড়ি আমার পা ছাড়। তোর মতো অনেক গল্পবাজ দেখছি আমি। পা ছাড়,,,,,,

লাথি মেরে মঈনুল কে ছিটকিয়ে দেয় রিয়াদ। মঈনুল কিছুটা দূরে ডিগবাজী খেয়ে পড়ে। মঈনুল সাথে সাথেই উঠে দৌড় লাগায়।

– এই, এই থাম। থাম নাইলে কিন্তু আজকে আমার হাতে তুই মরবি। থাম,,,,,

মঈনুল দৌড়ে প্রাণপনে পালাতে থাকে। রিয়াদ তার পিছু ধাওয়া করে। পথে থাকা একটা ছোট লোহার রেক ফেলে দেয় মঈনুল। রিয়াদ সেটার উপর দিয়ে লাফ মেরে দৌড় দেয়। সামনে থাকা কিছু প্লাস্টিকের খালি রাসায়নিকের কন্টিনার গুলো দৌড়াতে দৌড়াতে ফেলে দিয়ে যায় মঈনুল। রিয়াদের দৌড়ের গতি কিছুটা কমে যায়। কারণ একটা কন্টিনার থেকে কিছু রাসায়নিক মাটিতে পড়ে গেছিলো আর সেটা থেকে ধোঁয়া উঠেছিলো। সে কোনমতে সেটাকে পাশ কাটিয়ে দৌড়াতে থাকে মঈনুলের পিছু পিছু।

মঈনুল গেইটের খুব কাছাকাছি চলে আসে। আর ১০-১২ হাত দূরেই কারখানা থেকে বের হওয়ার গেইট। রিয়াদ পিছন থেকে চিৎকার করে তাকে ডাকছে। তাকে থামতে বলছে। কিন্তু মঈনুল প্রাণপনে ছুটছে। তখনই হঠাৎ মঈনুলের সামনে দুই কনস্টেবল এসে তাকে জাপটে ধরে ফেলে। রিয়াদ দৌড়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মঈনুল হাত জোড় করে কনস্টেবলদের বলছিলো তাকে ছেড়ে দিতে। কাঁদো কাঁদো মুখখানা যেন রিয়াদের কাছে বিষের মতো লাগে। হাঁপাতে থাকা রিয়াদ। রাগান্বিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বলতে থাকে,

– খুব পালাবার শখ তাই না ,,,! খুব শখ ,,! ( বলে সাথে সাথেই মঈনুলের ডান পায়ের পাতায় গুলি চালায় রিয়াদ। মঈনুল চিৎকার দিয়ে উঠে। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। হাত দিয়ে পা চেপে ধরে জোড়ে জোড়ে চিৎকার দিতে থাকে।

– এইবার দেখি কেমন দৌড়াইতে পারিস ,,,! বল আয়ান কই ,,! দেখ আয়ানের যদি কিছু করছিস তো তোর শরীর গুলি করে ঝাঝড়া করে দিয়ে এখানেই কিন্তু আমি পুঁতে ফেলবো। তাড়াতাড়ি বল আয়ান কোথায়।

– আঁ,,,,,,, আমি বললাম সত্যি জানিনা স্যার। সেই আফায় আয়ানরে নিয়া গেছে স্যার। ঐ আফায় ছোট ছোট বাইচ্চাগো ধইরা নিয়া যায়। তারপর কি করে আমি জানি না স্যার। আঁ,,,, আমার পা,,,,,,

– চুপ থাক। নিজের উপর থেকে দোষ সড়াইতে কাহিনী বানাইতেছিস এখন ,,,! আমি শেষ বারের মতো বলতেছি। আয়ানকে কোথায় রাখছিস সত্যি সত্যি বল। নাইলে কিন্তু এই আমি নিশানা করলাম, সঠিক ঠিকানা না দিলে এখানেই তোর লাশ পড়বে। (পিস্তল তুলে ঠিক মঈনুলের কপাল বরাবর ধরে। মঈনুল হাত দিয়ে না করতে থাকে রিয়াদকে। তার চোখে মুখে প্রচন্ড ভয়। মঈনুল তার দুই হাত তুলে কাপো কাপো গলায় বলতে থাকে,

– স্যার, ঐ মাইয়া ছোট বাচ্চাগো মাংস খায় স্যার। আমি কিছু জানিনা। আমি শুধু তার লগে কাম করতাম স্যার। আমি আমার ছোট মাইয়ার কসম খাইয়া কইতাছি। আয়ানরে ঐ মাইয়া কই নিয়া গেছে, কী করছে আমি জানিনা।

– কোন মেয়ে। ওর নাম কী ,,?

– স্যার ঐ মাইয়ার নাম, ঐ মাইয়ার নাম ,,,,,,,,,

সাথে সাথেই ৩ টা পরপর গুলির আওয়াজ। ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মঈনুলের দেহ। রিয়াদ আর কনস্টেবলরা চকিতে মুখ তুলে গেইটের দিকে তাকায়। দেখে এক কালো জ্যাকেট পড়া, কালো জিন্স পড়া মাথায় হেলমেট দেওয়া মেয়ে গুলি চালিয়েছে। রিয়াদ সাথে সাথেই তার বন্দুক তুলে গুলি ছুড়ে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা তৎক্ষণাৎ বাইরে বেড়িয়ে যায়। রিয়াদ চিৎকার করে হন্তদন্ত হয়ে বলে,

– ধরো ওকে, ও যেন পালাতে না পারে,,,,,,

দুইজন কনস্টেবল দৌড়ে ছুটে যায় সেদিকে। রিয়াদ তাড়াতাড়ি মঈনুলের দেহের কাছে যায়। তার দেহ টা উবুড় হতে সোজা করায়। গুলি গুলো একদম মঈনুলের পেটে এসে বিধেছিলো। একহাত দিয়ে সেখানে চেপে ধরে রাখা মঈনুলের প্রাণ পাখিটা এখনো জীবিত ছিলো। রিয়াদ তার গালে হাত দিয়ে তাকে নাড়িয়ে দিতে থাকে,

– মঈনুল, মঈনুল বলো কে সেই মেয়েটা ,,,!

– স,স্যার। আমার ছোট মাইয়াডা, আর, আর আমার বউডারে বাঁচান স্যার। ওগোরে ,ওগোরে অয় মাইরা ফেলবো স্যার। মাইরা, ফেলবো,,,,,,,,,

– মঈনুল, মঈনুল কথা বলো। মঈনুল।

 

মঈনুল মারা যায়। তার শরীর থেকে বের হওয়া গরম তাজা রক্ত ভিজে মাটিতে জেঁকে বসে। তার খোলা চোখ গুলো এক নাগাড়ে উপরে গগনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়াদ তার হাত দিয়ে মঈনুলের খোলা চোখ গুলো বন্ধ করে দেয়।

কনস্টেবলরা এসে উপস্থিত হয়। রিয়াদ মাথা তুলে তাকায়। কনস্টেবলরা হাঁপাতে থাকে। রিয়াদ কিছুটা ধীর গলায় বলে,

– মেয়েটা কই ,,!

তারা চুপচাপ,

– কী হলো মেয়েটা কই ,,!

– স,স্যার। মাইয়াডা বাইক নিয়া আইছিলো। বাইক চালাইয়া দ্রুত কাইটা পড়ছে।

– তোমাদের হাতে গুলি ছিলোনা ,,!

– ছ,ছিলো স্যার।

– তাইলে গুলি করোনি কেনো ,,! (জোড়ে চিৎকার দিয়ে) তোমাদের কী আমি মেয়েটার চেহারা দেখতে পাঠাইছিলাম ,,,,,!

– নাম মানে স্যার, গুলি নিশানা অনুযায়ী লাগেনাই ,,,!

 

রিয়াদের রাগ হচ্ছিলো। প্রচন্ড পরিমানে রাগ হচ্ছিলো কনস্টেবলদের উপর। রিয়াদ নিজের রাগ টাকে কিছুটা কন্ট্রোল করে উঠে দাঁড়ায়। কনস্টেবল দের পাশে এসে দাঁতে দাঁত চেপে রক্ত চক্ষু নিয়ে বলে,

– তাড়াতাড়ি লাশ টাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। মাটিতে যেনো এক ফোঁটা রক্ত না পড়ে থাকে ,,!

– ও,ওকে স্যার। এখনি হয়ে যাবে।

রিয়াদ লম্বা লম্বা পা চালিয়ে গেটের দিকে যায়। কনস্টেবলরা তাড়াতাড়ি বাকিদের ডাক দিয়ে লাশটাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে থাকে।

 

রিয়াদ কারখানার গেইট দিয়ে বের হয়ে গাড়ির সামনে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। রাগে তার মাথা গজগজ করছে। একটা মেয়ে কিনা তার চোখের সামনে দিয়ে একজনকে মেরে হাওয়া হয়ে গেলো ,,!

“কে এই মেয়েটা ,,! গ্রামের কেউ ,,? বাচ্চাদের মাংস যদি আসলেই মেয়েটা খায়, তাইলে কী আয়ানেরও ,,,,,, না না। এমন কিছুই হয়নি। কিছুই হয়নি।” ভেবে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে রিয়াদ। দূরে বজ্রপাত হয়। শব্দ কানে আসে লাগতেই রিয়াদ সেদিকে ফিরে চায়। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন বাড়িঘর নেই। যেদিকে তাকায় খালি ফসলি মাঠ আর মাঠ। আবার দূরে এক যায়গায় বজ্রপাত হয়। সেই চিত্র এইবার সচোখে দেখে রিয়াদ। প্রকৃতি যেন যতই সুন্দর ততই ভয়াবহ। ধীরে ধীরে অন্ধকার নামছে। সূর্য হয়তো ডুবে গিয়েছে অর্ধেক। চারপাশ মেঘে ঢাকা আকাশে কোথাও সূর্যের অস্তিত্ব না পাওয়া গেলেও চারপাশের আলো কমে যাওয়াটা তো সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। রিয়াদের চুল গুলো বাতাসে উড়ছে, শার্টের হাতা বাতাসে নড়ছে। তখনই রিয়াদের কানে ভেসে আসে সুদুরের কোন মসজিদের মাগরিবের আযান। আযানের শব্দটা খুবই মৃদু। এতেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা লোকালয় থেকে কতটা দূরে। এক ফোঁটা,দু ফোঁটা করে বৃষ্টি নামে। রিয়াদ হাত বাড়িয়ে চেক করার চেষ্টা করে। হ্যা আসলেই বৃষ্টি নামতেছে। রিয়াদের মন মেজাজ এখন কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। সে একটা জোরে হাঁক দিয়ে ভিতরের কনস্টেবলদের বলে,

– তাড়াতাড়ি লাশ টা নিয়ে বাইরে আসো। বৃষ্টি নামছে ,,,,!

বলেই গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসে রিয়াদ। বজ্রপাত আরো বেড়ে যায়। কারখানাটাকে এখন এই মুহুর্তের মধ্যেই দেখতে আরো ভয়ংকর লাগছে। এমনিই কী লোকজন এই রাস্তা দিয়ে দিন,রাত কোন সময়ই চলাচল করে না ,,,! রিয়াদ গাড়ির ভিতরে বসে দরজা লাগিয়ে দেয়। গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে একটা বৃষ্টির গান ছেড়ে দেয়। বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। চারপাশ বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে। সন্ধ্যা নেমেছে। ভিতরে রিয়াদ সিটে গা লেলিয়ে দিয়ে বৃষ্টির গান উপভোগ করতে থাকে। মন মেজাজ কে শান্ত করতে থাকে।

 

 

((((( ৫৩ পর্বটা ২ ভাগে বিভক্ত। এইটা ১ম ভাগ। ২য় ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে))))

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৩ (১ম ভাগ)

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

উপন্যাস :: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৩ (২য় ভাগ)

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

(১৮+ বেগুনী এলার্ট 🟣)

 

((পর্বটা ২ ভাগে বিভক্ত। এইটা ২য় ভাগ। ১ম ভাগ পড়ে তারপর এটা পড়ুন। ১ম ভাগের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে))

 

বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। চারপাশ বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে। সন্ধ্যা নেমেছে। ভিতরে রিয়াদ সিটে গা লেলিয়ে দিয়ে বৃষ্টির গান উপভোগ করতে থাকে। মন মেজাজ কে শান্ত করতে থাকে।

 

 

 

রাত সাড়ে ৯ টা। মেম্বার বাড়িতে সবাই খাবার খেতে বসেছে বারান্দার ডায়নিং টেবিলে। বিকেলের দিকে বৃষ্টি হওয়ার আবহাওয়া অনেক ঠান্ডা। তার সাথে এমনিতেও শীত কাল। কুয়াশা পড়েছে কিছুটা। বারান্দার লাইটের আলোয় সেই কুয়াশার অবয়ব স্পষ্ট

 

খাবার টেবিলে খেতে বসেছে মতিন মেম্বার,আহনাফ,ইকরা, আফাজ আর ইকরা আফাদ দের বাবা-মা। মতিন মেম্বার দেড়িতে বসেছেন। তবে বাকি আগেভাগেই বসেছে। তাদের খাওয়া শেষের দিকে। দিথী আর শিউলি বেগম খাবার টেবিলে কারো কিছু লাগবে কি না তা দেখছে। ফুলমতি আর লায়লা রান্না ঘরে। রাতে খাওয়ার জন্য দুধ জাল দিচ্ছে। সবাই এদিকটায় থাকলেও শাহারিয়া এখনো ঘরে।

 

মতিন মেম্বার বাদে বাকি সবার খাওয়া হয়ে যায়। তারা উঠে যেতে থাকে। এঁটো প্লেট গুলো দিথী একযায়গায় থাক করে রাখে আর শিউলি বেগম তাদের নিয়ে চলে যায় বেসিনের দিকে। তারা বেসিনে হাত ধুবে। দিথী তাদের যাওয়ার পর মতিন মেম্বারের পাশে এসে দাঁড়ায়। দেখে আর কিছু দিতে হবে কি না। দিথী ধীর গলায় বলে,

– আব্বা, আরেকটু ভাজি দেই ,,?

– হম দেও।

দিথী ভাজির বাটিটা হাতে তুলে চামচ দিয়ে ভাজি তুলে দেয় মতিন মেম্বারের পাতে। মতিন মেম্বার বেশ তৃপ্তি সহকারেই খেতে থাকে। দিথী বলে,

– রান্না কেমন হয়েছে আব্বা ,,!

– রান্না,,? রান্না অনেক ভালো হইছে। একদম শিউলি বেগমের লাহান। আমি শিউলি বেগম ছাড়া আর কারো হাতের রান্না খাইতাম না। কিন্তু তোমার হাতের রান্না একয়দিন খাওয়ার পর এখন তোমার আর শিউলি বেগমের হাতের রান্না ছাড়া কারো রান্না আমি খামু না। (এক নলা ভাত মুখে দিয়ে) তোমার রান্না একদম আমার শিউলি বেগমের লাহান। সব পারফেক্ট, খাওয়ার সময় একদম কব্জি ডুবাইয়া খাওয়া যায় ,,! হে হে হে।

দিথী হাসৌজ্জল মুখ করে মতিন মেম্বারের কথা গুলো শুনে।

 

শিউলি বেগম এসে দাঁড়ায় মতিন মেম্বারের পাশে। বলতে থাকে,

– কী নিয়া আলাপ করতাছো তোমার ,,!

– এইতো, তোমার বউমারে কইতাছিলাম অর হাতের রান্না ঠিক তোমার লাহান সুন্দর।

– ঐডা তো হইবোই। দেখতে হইবোনা বউমা ডা কার ,,!

– তুমিও খাইতে বহো।

– না আমি পড়ে খাইতাছি। আগে যাইয়া তোমার বান্দর পোলাডারে নিয়া আই। সবাই খাওয়া শেষ কইরা উডলো এহনো অর কোন নাম খবর নাই। সবসময় যে ঘরে বইয়া করে ডা কি আল্লাহ ই জানে।

– বুজছো বউমা ,, পোলাডারে গোয়েন্দা বানাইলাম‌। এহন পোলা ঐ কেস নিয়াই পইড়া থাহে। ঢাকায় একলা একলা ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে কী না করে কিছুই আমরা জানিনা ঠিকমতো। তুমি ওর লগে যাওয়ার পর ওরে টাইম মতো খাওয়াইয়ো বুজ্জো। পোলাডা আমার শান্ত-শিষ্ট আছে। তোমার কথা সুন্দর মতো মাইনা নিবো।

– হ, হইছে তোমার আর কওয়া লাগবো না। তাড়াতাড়ি খাওন শেষ করো। (দিথীর দিকে ফিরে) মা, তুই একটু এনে থাক। আমি ওরে ডাকতে গেলাম।

– জ্বী আচ্ছা মা।

শিউলি বেগম চলে যান বারান্দা দিয়ে হেঁটে হেঁটে শাহারিয়ার রুমের দিকে। দিথী শিউলি বেগমের যাওয়ার পান থেকে মুখ ঘুরিয়ে মতিন মেম্বারের দিকে ফিরে তাকায়। বলে,

– আব্বা, আরেকটা ডিম নেন।

– না না। আমি এতো খাইতে পারুম না। ঐডা রাইখা দাও, শাহারিয়ায় খাইবোনে।

– আব্বা ওর জন্য আছে। আপনি নেন।

– না না বউমা আর দিওনা। খাইতে পারমুনা অতো,,! (একটু থেমে খেতে খেতে) বুজোই তো, এহন আমাগো বয়স হইছে। এহন আর আগের মতো টানতে পারি না। তয় যহন শিউলি বেগমের সাথে আমার বিয়া হইছিলো হেইসময় আস্ত খাসি একলাই খাইয়া ফেলছিলাম ঐবাড়ির দাওয়াতে যাইয়া। তোমার শাশুড়ি তো তহন মুখের উপরে কইয়াই দিলো আমি যেমন খাইতে পারি কোনদিন না হেরেই রাইন্ধা খায়ালাই, হে হে হে,,,

দিথী হাসি মুখে বলে,

– মা আগে থেকেই অনেক মজার মানুষ ছিলেন তাই না আব্বা ,,!

– হ, ঐডা আর কইতে ,,! দিন রাইত আমারে হাসাইয়া মারতো। এহন তাও একটু কম মজা করে। কিন্তু আগে, ওর সামনে তুমি না হাইসা দাড়াইতেই পারবা না।

– হ্যা, মা অনেক মজার মানুষ। (একটু থেমে) আব্বা এখানেই হাত ধুয়ে নেন।

– না না। আমি বেসিনে যাইয়া হাত ধুইতাছি। তুমি, শিউলি বেগম আর শাহারিয়া রে লইয়া খাইতে বইয়া পড়ো।

– আচ্ছা আব্বা।

মতিন মেম্বার খাওয়া শেষ উঠে দাঁড়ান। এটো হাত দিয়ে চেয়ার থেকে বের হতে হতে বলেন,

– লায়লা, ফুলমতি ওরা খাইছে ,,?

– ওরা রান্না ঘরে খাচ্ছে আব্বা। মা ওদের ওখানেই খেতে খেতে দুধের কাছে থাকতে বলেছে। রান্না ঘর ফাঁকা থাকলে পড়ে যদি আবার বিড়াল-টিরাল ঢুকে।

– ও হ। তাও ঠিক। আচ্ছা তোমরা খাইয়া লইয়ো।

– আচ্ছা আব্বা।

মতিন মেম্বার চলে যেতে থাকেন বারান্দার শেষ প্রান্তে থাকা বেসিনের দিকে। দিথী মতিন মেম্বারের এঁটো প্লেট টা বাকি এঁটো বাসনের সাথে রেখে দেয়। বিরবির করে বলে,

– যাই গামছাটা দিয়ে আসি।

বলেই যখনই যেতে উদ্যত হবে তখনই তার হাত পিছন থেকে ধরে ফেলে শিউলি বেগম। দিথী পিছন ফিরে তাকায়। দেখে শিউলি বেগম আর শাহারিয়া এসেছে। শিউলি বেগম বলেন,

– তুমি তোমার ডারে ধরো। আমি আমার ডার দিকে যাইতাছি।

দিথী একটা মুচকি হাসি দিয়ে শাহারিয়ার দিকে তাকায়। শাহারিয়ার দিথীর সাথে চোখাচোখি হতেই সে লজ্জায় মাথা নিচু করে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। শিউলি বেগম চলে যান বারান্দায় থাকা গামছাটা নিয়ে বেসিনের দিকে।

 

শাহারিয়ার সামনে একটা ভালো পরিস্কার প্লেট রাখে দিথী। সেখানে পানি ঢেলে দিতে থাকে। শাহারিয়া হাত ধোয়। দিথী বলে,

– এতক্ষণ ঘরে কী করতেছিলা ,,!

– অফিস থেকে কিছু ফাইল আমার নিতে হইতো। ঐগুলার কপি পিডিএফ করে নিতেছিলাম অফিসের একজনের থেকে।

– ঐটা রাতে করতে পারতা না ? এখানে সবাই খাইতে বসলো। তোমাকে খুঁজলো, তুমি নাই।

– আমি গ্রামে আসলে রাত জাগতে পারি না। এমনিতেও যে শীত। রাত জাগে যেন কাজ না করতে হয় এইজন্য আগে ভাগেই করে ফেললাম।

দিথী প্লেটের পানিটা একটা পাত্রে ঢেলে তারপর আবার শাহারিয়ার সামনে দেয়। ভাত তুলে দিতে থাকে তার প্লেটে। গরম ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত গুলো শীতের রাতে খাওয়ার রুচিটাকে যেন বাড়িয়ে দেয়। শাহারিয়া লবণ খায় ভাতের সাথে তাই ছোট্ট লবণের বাটিটা থেকে এক চিমটি লবণ নিয়ে প্লেটের সাইডে রাখে। দিথী ভাত দেওয়া শেষ করে তরকারি উঠিয়ে দিতে থাকে। শাহারিয়া বলে,

– কী কী রান্না করছো,,!

– এইতো ডিম ভুনা, শিম আলুর ভাজি,  গাজর ফুলকপির সবজি আর ডাল।

– অনেক কিছুই দেখি আছে রাতের মেনুতে ,,!

– সব নিজ হাতে রান্না করছি। এখন খেয়ে বলো কেমন হইছে।

– এইটা গাজর, ফুলকপির সবজি ,,!

– হ্যা।

– আগে এই তরকারি খাওয়া হয়নি কখনো। দেখি আমার বউয়ের নতুন পদ কেমন ,,,!

বলেই মুখে ভাতের নলা তুলে খেতে থাকে শাহারিয়া। তার মুখের ভঙিমাই বলে দিচ্ছিলো তরকারির স্বাদ তার ভালো লেগেছে। দিথী তা দেখে এক মুচকি হাসি দিয়ে তার সামনের পানির গ্লাস টায় পানি ঢেলে দিতে থাকে।

শাহারিয়া আরো দু নলা ভাত মুখে তুলে। সে শুধু খেয়েই যাচ্ছে। দিথী তার গায়ের ওড়না ঠিক ঠাক করতে করতে বলে,

– রান্না কেমন হইছে বললানা যে ,,! (সে জানে শাহারিয়ার ভালো লেগেছে, তাও তার মুখ থেকে সে কথাটা শুনতে চায়)

– রান্না নিয়ে কোন কথা হবেনা। বেষ্ট, বেষ্ট। শিম আমি এমনি কম খাই, তবে তোমার হাতের রান্না খেয়ে এখন শিম আমার ফেভারিট হয়ে গেছে।

– বাব্বাহ ,,! এতো প্রশংসা,,! আমি তো গলে যাবো ,,!

– যাও গলে,,! তারপর তোমাকেও আমি খেয়ে নিবো।

– আচ্ছা খাইয়ো। নাও আরেকটা ডিম নাও।

– না না, এতো দিও না। খাইতে পারবোনা।

– কী বলো। এখন কী তুমিও বলবা আব্বার মতো যে বয়স হইছে বলে টানতে পারি না ,,!

– না না তেমন না বিষয়টা। তোমার আর মায়ের খাওয়া এখনো বাকি তাই,,,,,,,

– তুমি যেনো ২ টা ডিম খেতে পারো সেই হিসাবেই আমি রান্না করছি। এখন নাও। (শাহারিয়ার পাতে আরেকটা ডিম তুলে দেয় দিথী)

– আমার পাতে দুইটা ডিম আগে থেকেই হিসাব করে রাখছো ,,! আমার বউ দেখি আমার খাবারেও অনেক যত্নবান ,,!

– হবোনা ,,! তোমার হাতের মাসল দেখো ,,! খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো না করলে, পুষ্টি ঠিকমতো শরীরে না গেলে যে তোমার বডি টা নষ্ট হবে।

– ও কিছু হবেনা। বডি কি আর একদিনে বানিয়েছি যে একদিন কম খাইলে ঐটা নষ্ট হয়ে যাবে।

– তাও। (একটু থেমে) ঢাকায় থাকতে জিমে যেতে ,,?

– হ্যা। যাওয়া হয়। শুধু এই গ্রামে আসলেই ঘরে ওয়ার্কআউট আর দৌড়ানো ছাড়া ব্যায়ামের কিছু নাই।

– তাও তো তুমি ঐ সারাদিন টা ঘরেই বসে থাকো। দৌড়াইলা আর কখন

– হে হে হে। এখন একটু কাজ পড়ছে তো ঐজন্য। নাইলে ঠিকই সকাল বেলা ফজর পড়ে আমি দৌড়াতে বের হই। আচ্ছা ওসব বাদ দেও। চেয়ার টা টেনে আমার সাথে বসে পড়ো।

– না না। আমি পড়ে মায়ের সাথে খেয়ে নিব।

– মায়ের সাথে তখন আরেকবার খাইয়ো, এখন আমি তোমাকে খাইয়ে দেই।

দিথী আর না করলো না। শাহারিয়া নিজে থেকে তাকে খাইয়ে দিতে চেয়েছে। এতে তারও উচিত কো-অপারেট করা। দিথী পাশে থাকা একটা চেয়ার টেনে শাহারিয়ার দিকে মুখ করে বসে। শাহারিয়া এক নলা ভাত উঠিয়ে দিথীকে খাইয়ে দেয়। দিথী মুখ বাড়িয়ে নলাটা মুখে নিয়ে খেতে থাকে। শাহারিয়া বলে,

– ঝাল আজকে একদম ঠিক ঠাক হইছে। বিয়ের দিনের রান্নায় ঝাল কম দিছিলো। তবে আজ ঠিক ঠাক।

– তুমি যে ঝাল বেশি খাও। এইজন্য তোমার কাছে ঐদিন কম লাগছে।

শাহারিয়া আরেক নলা ভাত দিথীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। দিথী মুখ বাড়িয়ে তা মুখে নিয়ে নেয়। শাহারিয়া বলে,

– তোমাকে ভাত খাইয়ে দিতে না, আমার একটা আলাদা প্রশান্তি কাজ করে মনে।

– তাই ,,!

– হ্যা। মনে হচ্ছে নিজের মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছি ,, হি হি হি।

দিথী দুম করে শাহারিয়া পায়ের মাংসপেশিতে একটা কিল বসিয়ে দেয়। শাহারিয়া বলে,

– সরি সরি মজা করলাম।

দিথী খেতে থাকে। খেতে খেতে তরকারির বাটি হাতে নিয়ে বলে,

– আরেকটু সবজি দেই ,,!

– হ্যা দাও। রান্না তো সেই করেছো। খেতে দোষ কী ,,!

দিথী হাসৌজ্জল মুখ করে আরো কিছুটা সবজি উঠিয়ে দেয়।

 

খাওয়া শেষ শাহারিয়ার। শেষ ভাত টুকুও দিথীকে খাইয়ে দিয়ে নিজ আঙ্গুল গুলো চেটে পুটে নিতে থাকে। দিথী নিজের মুখের ভাত খেতে খেতে বলে,

– জামাইয়ের আমার রান্না তাইলে পছন্দ হইছে।

– হ্যা হ্যা অবশ্যই। (একটু থেমে) আচ্ছা তুমি থাকো, আমি হাত ধুতে গেলাম।

– এখানেই ধুয়ে নাও। ঐদিকে যাওয়ার দরকার নেই।

বলেই দিথী গ্লাস টা উঠিয়ে শাহারিয়ার হাতে পানি ঢেলে দিতে থাকে আস্তে আস্তে। শাহারিয়া হাত ধুয়ে দিথীর মুখ মুছিয়ে দেয়, আবার হাত ধুয়ে নিজের মুখ মুছে নেয়। দিথী এঁটো প্লেট পানি সহ টেনে একটু দূরে সড়িয়ে রাখে। দুইজনেই এখনো চেয়ারে বসে আছে।‌ শাহারিয়া বলে,

– মা গামছাটা কোথায় রাখলো। মনে হয় ঘরে নিয়ে গেছে।

– হয়তো। তুমি এখানে মুছো। (বলেই দিথী তার ওড়নার একটা পাশ‌ শাহারিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়। শাহারিয়া একটা ঠোঁট চাপা হাসি দিয়ে দিথীর ওড়নার এক পাশে হাত আর মুখ টা মুছে নেয়। তখনই শিউলি বেগম আঙিনা থেকে একটা ট্রে হাতে বারান্দায় উঠেন। ট্রেতে কয়েকটা দুধের গ্লাস। বারান্দার ডায়নিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে ট্রে টা টেবিলে রেখে বলেন,

– খাওয়া শেষ অর ,,! এই লও তোমাগো দুইজনের লাইগা দুই গ্লাস দুধ।

– মা, একটা গ্লাস দাও। (দিথী)

– একটা,,! ক্যান ,,!

– একটাতেই হয়ে যাবে আমাদের।

শিউলি বেগম বুঝতে পারেন কথাটার মানে। তিনি একটা গ্লাস রেখে ট্রে টা হাতে নেন। এই গ্লাসে সর বেশি ছিলো, শাহারিয়া দুধের সর পছন্দ করে। তাই তিনি শাহারিয়ার জন্য বেশি সর দিয়ে আলাদা গ্লাসে দুধ এনেছেন। শিউলি বেগম ট্রে টা নিয়ে চলে যেতে যেতে বলতে থাকেন,

– গ্লাস টা এইহানেই রাইখা দিয়ো। আমি আইসা নিয়া যামু।

 

শিউলি বেগম চলে যান। শাহারিয়া হাত দিয়ে তার মাথার চুল গুলো ঠিক করে। ঠিক করতে করতে বলে,

– গরম নাকি খুব ?

– কী ?

– দুধ টা ?

– না তেমন গরম না। কুসুম কুসুম। (গ্লাস টা হাতে নিয়ে) এখান থেকে তুমি অর্ধেক খাবে, আমি অর্ধেক খাবো, কেমন ,,!

– ঠিক আছে

বলেই শাহারিয়া হাত বাড়িয়ে দেয় গ্লাস টা নেওয়ার জন্য, কিন্তু দিথী মাথা নাড়িয়ে না বলে। শাহারিয়া ভেবেছিলো হয়তো দিথী আগে খাবে। কিন্তু না। দিথী চেয়ার টা টেনে শাহারিয়ার একদম কাছকাছি হয়ে বসে।  দিথী গ্লাসটা হাতে নিয়ে শাহারিয়ার মুখের দিকে আনতে থাকে। তারমানে দিথী নিজ হাতে শাহারিয়াকে খাইয়ে দিবে,,,!

শাহারিয়াও তার মুখের সামনে আসা গ্লাসে চুমুক দেয়। দিথী ধীরে ধীরে তাকে গ্লাস থেকে দুধ খাওয়াতে থাকে। শাহারিয়াও ধীরে সুস্থে খেতে থাকে। খেতে খেতে আড়চোখে দিথীর দিকে তাকায় সে, দিথী এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এই দৃষ্টি দেখে শাহারিয়ারই ভয় হতে শুরু করে। দুপুরেও এই দৃষ্টির ফাঁদে সে পড়েছিলো। মায়ের সামনে লজ্জা পেতে হয়েছে তাকে। শাহারিয়া তাই সামনে গ্লাসের দিকে নজর দিয়ে ধীরে ধীরে খেতে থাকে। শাহারিয়ার ঠোঁটের কোন থেকে এক ফোঁটা দুধ পড়ে যায় তার প্যান্টে।

কিছুক্ষণ পর দিথী গ্লাস টা নামায় শাহারিয়ার মুখ থেকে। এতোক্ষণ ধরে মাত্র অর্ধেক খাইয়েছে সে শাহারিয়াকে। শাহারিয়া বলতে থাকে,

– কুসুম গরম ছিলো। ধীরে ধীরে খাইয়েছো ভালোই হয়েছে। (বলেই সে দিথীর দিকে তাকায়। দিথী গ্লাসটা তার মুখের সামনে নেয়। শাহারিয়া যেখান টা দিয়ে খেয়েছিলো সেখান টায় একটা ছোট্ট কিস করে। করেই চুমুক দিয়ে খেতে থাকে ধীরে ধীরে। আর এক নজরে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। শাহারিয়ার বুকের ঢিবঢিব আওয়াজ বাড়তে থাকে। এ যেন ঝড় আসার আগের মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। দিথী বাকি দুধ টুকু খেয়ে নেয় তাড়াতাড়ি। গ্লাস টা টেবিলে রাখে। রেখে আবার শাহারিয়ার দিকে ফিরে তাকায়। শাহারিয়ার বুক টা যেন লাফিয়ে উঠে। তার চাহনীর গভীরতা এতোটাই, যেন সে পা ফসকালেই ডুবে যাবে। শাহারিয়া আমতা আমতা করে বলে,

– আ, আচ্ছা আমি তাইলে যাই। র,রাত হয়েছে অনেক। ঘুমিয়ে পড়তে হবে।

বলেই সে উঠতে উদ্যত হবে সাথে সাথেই দিথী তার হাত ধরে জোড়ে টেনে বসায়। শাহারিয়াও বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়ে। শাহারিয়া দিথীকে দেখে ঘামছে। তার মনে হচ্ছে এই বুঝি দিথী তার উপরে হামলে পড়লো। শাহারিয়া হাত দিয়ে তার মুখে লেগে থাকা সর মুছতে যায়, তখনই ‌দিথী তার হাত ধরে ফেলে।‌ তার হাত নামিয়ে দিয়ে দিথী তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে এসে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় শাহারিয়ার কাছে। শাহারিয়া তার চোখের গভীরতায় যেন এই পা ফসকে ডুবে গেলো,,,! দিথী ধীরে ধীরে হেলে তার মুখ খানা শাহারিয়ার মুখের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। শাহারিয়ার বুকের ঢিবঢিব আওয়াজ এই নিস্তব্ধ, নিরব পল্লীতে ঘন্টার মতো আওয়াজ তুলছে। দিথী শাহারিয়ার ঠোঁটের কাছাকাছি চলে আসে। দিথীর ঘন ঘন গরম নিঃশ্বাস গুলো শাহারিয়া উপলব্ধি করতে পারছিলো। দিথী শাহারিয়ার ঠোঁটের একদম কাছাকাছি চলে আসে। শাহারিয়ার ঠোঁটের উপরে লেগে থাকা দুধের সড় গুলো আলতো করে জিহ্বা দিয়ে চেটে নিতে থাকে। শাহারিয়ার যানি কেমন এক আলাদা অনুভূতি হচ্ছিলো। দিথী শাহারিয়ার ঠোঁটে থাকা সবটুকু দুধের সড় চুষে নেয়। চুষে নেওয়ার পর শাহারিয়ার নিচের ঠোঁট খানায় একটা ছোট্ট কামড় দেয়। দিয়ে চুষে নিতে থাকে। শাহারিয়ারও ইচ্ছা করছিলো দিথীর ঠোঁট গুলোকে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে, কিন্তু দিথী নিজেই তাকে সেই সুযোগটা দেয়নি। কিছুক্ষণ পর দিথী শাহারিয়ার দুই ঠোঁট ভিজে লিকলিক করে দিয়ে তার চেয়ার টায় বসে। জিহবা দিয়ে নিজের ঠোঁটের উপর লেগে থাকা থাকা দুধের সড় টাও খেয়ে নেয়। গোলগোল দিথীর চোখ গুলো যেন শাহারিয়াকে জিগ্গেস করছিলো তার কাছে এই নতুনত্বের স্বাদ কেমন লেগেছে। শাহারিয়ার বুক এখনো কাঁপছে। সে ঢোক গিলে মাথা নিচু করে ফেলে। বলে,

– আমি ঘুমোতে গেলাম।

বলেই শাহারিয়া চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরের দিকে যেতেই ধরবে এমন সময় দিথী শাহারিয়ার হাত ধরে নেয়। শাহারিয়া ভয়ে ভয়ে দিথীর দিকে ফিরে তাকায়। দিথী চেয়ারে বসা হতে উঠে দাঁড়ায়। শাহারিয়ার কাছাকাছি আসে। শাহারিয়ার কানের সামনে তার মুখ এনে বলতে থাকে।

– রাতে সবাই ঘুমানোর পর এখানে এসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।

কথাটা শুনেই চোখ বড় করে শাহারিয়া দিথীর দিকে মুখে তুলে তাকায়। দিথী তার জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে দিতে দিতে চোখের ভাসায় বুঝিয়ে দেয় ও কী চাইছে। শাহারিয়া ধীর গলায় বলে,

– কিন্তু ২১ তারিখের আগে,,,,,,,

দিথী শাহারিয়ার মুখ চেপে ধরে। মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইঙ্গিত দেয়। বলে,

– আমি পারছিনা এতোদিন অপেক্ষা করতে। তোমাকে ছাড়া আমার ভিতর টা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। তুমি প্লিজ এসো।

বলেই ছলছল চোখ নিয়ে দিথী মাথা ঝাঁকায়। শাহারিয়া কী বলবে ভেবে পায় না। সে দিথীর হাত টা তার মুখের সামনে থেকে সড়ায়। দিথীর সাথে আরো ক্লোজ হয়ে দাঁড়ায়। তার খুব কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বলে,

– আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। একটু সবুর করো। আমি ছেলে হয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করেছি। তুমি প্লিজ আমার সাথে কো-অপরেট করো। ২১ তারিখের পর তখন আমি দিন রাত শুধু তোমার হয়ে থাকবো। শ্রীমঙ্গলে গিয়ে সেই বাড়িতে আমাদের বাঁধা দেওয়ার কেউ থাকবে না। (একটু থেমে) বিয়ে করেছি। হালাল সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি। তোমার ইচ্ছে আমি অবশ্যই মিটাবো দিথী। শুধু একয়টা দিন একটু সবুর করো। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। (বলেই দিথীর কপালে একটা ছোট্ট চুমু এঁকে দেয় শাহারিয়া। ধীর গলায় আবার বলে,

– গুড নাইট ,,,

বলেই দিথীকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে থাকে ঘরের দিকে। দিথী অভিমানি মুখ নিয়ে বসে পড়ে চেয়ারে। তার কেনো যানি শাহারিয়াকে দেখলেই খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে। দিন-দুনিয়া সবকিছুর কথাই সে তখন ভুলে যায়। দিথী দুধের গ্লাস টা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে আর মুখ গোমড়া করে বসে থাকে।

এতোক্ষণ ধরে দিথী আর শাহারিয়ার সব সিন কারবার দরজার আড়াল হতে দেখছিলেন শিউলি বেগম। তিনি চাচ্ছিলেন না তাঁদের সুন্দর সময়টা নষ্ট করতে। এখন শাহারিয়া চলে যাওয়ায় তিনি খালি ট্রে হাতে বেড়িয়ে আসেন দরজার পর্দার আড়াল হতে। এসে দিথী সামনের চেয়ার টা, যেখানে এতোক্ষণ শাহারিয়া বসে ছিলো সেটায় বসেন। বসে মাথা নিচু করে থাকা দিথী কাঁধে হাত রাখেন। দিথী চকিতে মুখ তুলে তাকায়। দেখে শিউলি বেগম এসেছে। দিথী সোজা হয়ে বসে। শিউলি বেগম হাসি মুখে বলতে থাকেন,

– এই আমার পোলা আর তোমাগো মেম্বার, এরা প্রথমে এমনে ধৈর্য ধরলেও পড়ে ঠিকই আসল যায়গায় ছক্কা মাইরা দিবো। ছোট থেইকা আমার পোলারে আমি চিনি। অয় একদম গেছে তোমার শশুরের দিকে। এতো মন খারাপ করার কিছুই নাই তো। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন

– মা, তারপরও কেনো জানি আমার ওর মাসল, ওর শরীর দেখে খুব আকর্ষন হয়। মন চায় ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়ি।

– সময় কী কেউ নিয়া যাইতাছে ,,! এদিকের বিষয়ডা মিটাও, তারপর যহন ঢাকা যাইবা তহন তো তোমাগোরই হারাদিন রাইত, তহন আর তোমাগোরে বাঁধা দেয় কেডা ,,!

দিথী মুচকি হাসি দিয়ে তরকারি আর ভাতে ঢাকনা দিয়ে দিতে থাকে। শিউলি বেগম বলেন,

– পোলা মাইয়া কিন্তু পরিকল্পনা কইরা লইয়ো। অবশ্য তোমার মাথায় ভূত চড়লে ঐসবের খেয়াল থাকবো না। পোলায় আমার ঠিক সব ম্যানেজ কইরা লইবো।

– মা,, তুমিও না ,,!

– কি ,,! এহন লজ্জা পাইতাছো ক্যান ,,! এতোক্ষণ তো ঠিকই আমার বাজানের মুখের দুধ চাইটা খাইয়া নিলা ,,! কী ভাবছো আমি দেহি নাই ,,! হা হা হা হা। এই শিউলি বেগমের চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না ,,!

– তুমি সব দেখছো এতোক্ষণ,,!

– তো কী ,,! খারাও আমিও আইজ এই টেকনিক ব্যবহার করমু। এক গ্লাস দুধ আইজ তোমার শশুর আব্বা আর আমি একলগে খামু,,,! হা হা হা

দিথীও শিউলি বেগমের সাথে হেঁসে উঠে। দুইজনেই মজার মজার খুনসুটি করতে করতে টেবিলের সব কিছু ঠিকঠাক করতে থাকে।

বাইরে কুয়াশার মধ্যে থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। আর মাঝে মাঝে দূরে বাজ বাজ পড়ার শব্দও কানে আসে।

 

 

 

লাল আলোর নিচে বদ্ধ ঘরে খাবার টেবিলের সামনে বসেছে সেই মেয়েটা আর লোকটা। খাবার টেবিলে দু’জনের দুই প্লেটে রান্না করা মানুষের মাংস, মগজ আর একটা একটা করে ছোট ছোট চোখ রাখা। লোকটা আর মেয়েটা ছোট ছুরি দিয়ে কেটে কেটে কাঁটা চামচ দিয়ে সেগুলো খাচ্ছে। খেতে খেতে মেয়েটা বলে উঠে।

– আজকে সকালে কী হয়েছে জানো ,,!

– কী ,,!

– আঁখি বোরখা পড়ে গিয়েছিলো সুরাইয়ার রুমের সামনে। নিপা এসে ওকে ধরে ফেলছে।

– তখন ,,!

– তখন আরকি। নিপা কী জানে নাকি আমাদের আর সুরাইয়ার বিষয়ে। জানলে তো আঁখিকে ঐ বোরখা পড়া মহিলা ভেবে মারতে শুরু করে দিতো ,,! হা হা হা।

– আঁখি আর আলিশা ছাড়া নিপা কারো সাথে কথা বলেনা।

– হয়তো ঘরের লোক মানা করেছে ,,!

– রায়হান ,?

– আমি কি জানি,,! ওসব বাদ দাও। এখন বলো আজকের চোখ টার টেস্ট কেমন ,,!

– হমম, ভালোই। নতুন শিকারে বের হইছিলা নাকি,,! না আগের গুলাই ,,!

– এইটা মঈনুলের মেয়েটার চোখ। মাদার*** আরেকটূ হইলেই সব বলে দিতো রিয়াদ দের কে।

– কী বলো কী ,,! তারপর,,!

– তারপর আর কি, আমি ভাগ্যিস সময় মতো পৌছাইছিলাম। নিশানা করছিলাম ওর নিচের দিকটায়, যেন যন্ত্রনায় ছটফট করে মরে, কিন্তু গুলি গিয়ে লাগলো তল পেটে, তবুও গুলি লাগার সাথে সাথেই মনে হয় মরছে। একসাথে ৩ টা গুলি চালাইছি। বাঁচা তো দূর উল্টা আরো গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে করতে মরছে।

– ওর বউ আর মেয়ে আমাদের কব্জায় আছে না ,,!

– হ্যা। পাশের রুমটায় ওর বউ আছে। আর ওর মেয়েটার চোখ,মগজ তো তুমিই এখন খাচ্ছো।

– ও। ওর মেয়েটাকেই কাটছো নাকি আজকে ,,!

– হ্যা। মজা আছে না ,,!

– হ্যা। মাংস টা সফট, টেন্ডার নেস টা দারূন ,,!

– একটা ফুড ব্লগিং চ্যানেল খুলো তাইলে,,! যেমন জুসি আর টেন্ডার বলতেছো ,,! বাকি ব্লগার দের তো ভাত মারার ধান্দা ,,!

– তুমিও না ,,! আমি তো সত্য যেটা ঐটাই বললাম। মাংসটা আসলেই টেন্ডার।

– হইছে। এখন খাও। (একটু থেমে) আর ঐ মেয়েটার কী করবো ,,?

– কোনটা ?

– ঐযে মঈনুলের বউ।

– বড়দের খাওয়া তো অনেক দিন আগেই ছেড়েছি। ওর মাংস আমি খেতে পারবোনা।

– মাংস কে খেতে বলছে। (ধীর গলায়) যৌবনের টান কী তোমার কমে গেছে নাকি ,,!

লোকটা চকিতে ফিরে তাকালো। বললো,

– তুমি জানো যে মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ আমার আর নেই। তাও এ কথা কেনো বলছো ,,!

– ও রিয়েলি ,,! কোন টান নেই ,,!

– না নেই।

– ওকে। লেটস সি।

বলেই মেয়েটা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে থাকে ঘরের এক কোনে থাকা রান্নার চুলার দিকে। লোকটা বলে,

– কোথায় যাচ্ছো।

– দেখতে থাকো।

মেয়েটা এসে চুলার পাশে থাকা আরেকটা টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। তার পড়নে এখনো বিকেলের পোশাক গুলোই আছে। কালো জ্যাকেট, আর কালো জিন্স প্যান্ট।

মেয়েটা দুটো ড্রিকংসের গ্লাস নামায়। মানে যেগুলোতে করে মদের বারে লোকেরা মদ খায় সেগুলো। ড্রিংকসের গ্লাস গুলো পাশপাশি রেখে টেবিলের পাশে থাকা অনেক গুলো কাঁচের বোতল থেকে একটা বোতল হাতে নেয়। বোতল টা কালো রঙের। মেয়েটা বোতলের কট (কাঠের ছিপি) টা মুখ দিয়ে খুলে ফেলে দেয়। দিয়ে বোতল থেকে গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে থাকে। কাঁচের গ্লাস লাল রঙের পানি দিয়ে অর্ধেক ভর্তি হয়ে যায়। মেয়েটা দুই গ্লাসে অর্ধেক অর্ধেক করে নিয়ে বোতলটাকে টেবিলে রাখে। তারপর তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়ানো কিছু বের করে। মোড়ানো কাগজ খুলে সেখান থেকে ট্যাবলেট জাতীয় কিছু বের করে, একটা ওয়াইনের গ্লাসে ফেলে দেয়। ট্যাবলেট টা গ্লাসে তলায় গিয়ে ঠেকে। বুদ বুদ বের হতে থাকে সেটা থেকে। ট্যাবলেট নিমেষেই ওয়াইনে ভেঙে মিশে যায়।

মেয়েটা গ্লাস দুটো হাতে নিয়ে উল্টো ফিরে এগিয়ে যেতে থাকে লোকটার দিকে। লোকটা এখনো কাটা চামচ দিয়ে মাংস তুলে খাচ্ছে প্লেট হতে। মেয়েটা গিয়ে লোকটার পাশে দাঁড়ায়। লোকটা তার নজর না উঠিয়েই বলে,

– কী ,,!

– এপাশে ফিরো।

– কেনো ,,?

– ফিরতে বললাম ফিরো।

লোকটা মাথা তুলে দেখে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা দুটো গ্লাসে ওয়াইন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়েটা বলে।

– চেয়ার ঘুড়িয়ে আমার দিকে ঘুরে বসো।

লোকটাও তাই করে। যেন সে রোবট আর এখন তার মালকিনের কথা সব মেনে মেনে চলছে। মেয়েটা যেই গ্লাসে ঔষধ মিশিয়ে ছিলো সেটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। লোকটা যেন তা দেখে আরো খুশি হয়। হয়তো সে ওয়াইন মানে মদ খুব পছন্দ করে। লোকটা তাড়াতাড়ি সেই গ্লাস থেকে ওয়াইন টা ঢোক ঢোক করে খেয়ে নিতে থাকে। মেয়েটা তা দেখে তার ঠোঁটের কোনে একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে তার হাতের ওয়াইন টা টেবিলে রাখে। লোকটা তার গ্লাসের সম্পূর্ণ ওয়াইন টা খেয়ে শেষ করে মাথা ঝাঁকায়। মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা তার কালো জ্যাকেটের চেইন খুলতে থাকে। লোকটা মাথা তুলে তাকায় মেয়েটার দিকে। মেয়েটা তার গা থেকে জ্যাকেট টা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। জ্যাকেটের ভিতরে তার শুধু ব্রা* ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। মেয়েটা লোকটার হাত থেকে খালি ওয়াইনের গ্লাস টা নিয়ে রেখে দেয় পাশের টেবিলে। লোকটা মেয়েটাকে দেখে এক ঢোক গিলে। তার চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে থাকে। মেয়েটা তার গ্লাসের ওয়াইন টা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে লোকটার দিকে এগোতে থাকে। বলে,

– কী বলছিলে যেন ,,! মেয়েদের প্রতি তোমার কোন টান নেই ,,!

 

লোকটা ঝাপসা চোখে কিছু দেখতে পায়না। সে মাথা ঝাঁকায়। তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। মেয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কোলে উঠে বসে। বসে তার হাতে থাকা ওয়াইন টা নিজে এক চুমুক খায়। তারপর গ্লাসের সেই পাশ টা দিয়ে লোকটাকে খাওয়ায়। বলে,

– জান, এখনো টান পাচ্ছো না ,,! (এক হাত দিয়ে লোকটার মাথার চুলে বুলি কেটে দিতে দিতে) নেও ,, খাও। সবই যে তোমার।

লোকটা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটার হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ফেটে যায়। লোকটা মেয়েটার গলায় নাক ডুবিয়ে চুমু খেতে থাকে। তার বুকে, গলায়, সব যায়গায় হাত দিয়ে আদর করে দিতে থাকে। মেয়েটাও তার সাথে তাল মিলায়। তাকে হাত দিয়ে আদর করলেও সে তার মুখ দিয়ে সুখ শব্দ বের করে লোকটার উত্তেজনা বাড়াতে থাকে। লোকটা পাগল প্রায় হয়ে গিয়ে মেয়েটাকে আরো বেশি আদর করতে থাকে। এবং একটা পর্যায়ে সে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। মেয়েটা ফ্লোরে চিত হয়ে শুয়ে ফোপাতে থাকে। তার জোরে জোরে উঠানাম করা বুক যেন লোকটাকে আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলছিলো। লোকটা তার দেহের বস্ত্র খুলতে থাকে। মেয়েটার মুখে ফুটে উঠে এক রহস্যময় দুষ্টু হাসি। লোকটা তার গায়ের সবগুলো কাপড় খুলে ছুড়ে মারে পিছনে। আর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটার উপর।

 

তাদের দুইজন থেকে কিছুটা দূরে অর্থাৎ যেখানে মেয়েটা কাঁচের বোতল থেকে গ্লাসে ওয়াইন ঢেলেছিলো সেখানে দেখা যায় একটা স্মার্ট মোবাইল ফোন রাখা। সেটায় ভিডিও চালু করা ছিলো। লোকটা, মেয়েটার সাথে যা যা করছিলো সব কিছু সেখানে রেকর্ড হচ্ছিলো। পুরো রুম মেয়ের সুখ চিৎকারে ভারি হয়ে উঠে। মেয়েটা যতই সুখ চিৎকার করছে লোকটা ততই বেশি উত্তেজিত হয়ে তার খায়েশ মিটাচ্ছে।

 

 

 

– আমাদের এখন কী করা উচিত। বিয়ের দিন কোথা থেকে এক মেয়ে এসে আমাদের সব প্ল্যান নষ্ট করে দিলো। নাইলে তো ঐদিনই দিথীর মৃত্যু হতো। (আসুভে)

– দিথীর মৃত্যু এতো সোজা না, দেখিস নি মেয়েটাকে কত নিষ্ঠুর ভাবে মেরে ফেলছে ঐদিন,,!

– তাইলে এখন আমরা কী করবো। দিন ঘনিয়ে আসছে। দিথীর কিছু একটা না করতে পারলে তখন আমার শক্তি,,,! (আসুভে)

– শাহারিয়াও নিজের ধৈর্য্য ধরে রাখছে। যেখানে দিথী নিজে উত্তেজিত হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায় সেখানে শাহারিয়া এরকম,,,,! আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ। নাইলে এতো কিছু অনুকূলে থাকার পরও আমরা কিছু করতে পারছিনা।

– হনুফা কই গেছে ?

– ও ? ওর তো আমি কিছুই বুঝতেছিনা। থাকতে বলছি দিথীর কাছে কাছে। ও যে এখনো এতো রাতে কী করে ঐদিকে কে জানে। এমনিতে বিয়ের পর মেম্বার বাড়িও সাদা পাউডার দিয়ে বন্ধ করে দিলো। নাইলে হনুফাই তো এই দুইদিনে ওকে শেষ করে দিতো।

– এখন তাইলে আমাদের করনীয় কি। এভাবে হাত গুটায় বসে থাকলে তো হবে না।

তখনই ঘরে একটা কালো ধোঁয়া ঢুকে। ঘরের মাঝের কাঁচের বলের মতো আকৃতির জিনিসটা থেকে বের হওয়া আলোতে সেই কালো ধোঁয়া টাকে স্পষ্ট দেখা যায়। এবং সাথে একটা গলার স্বর ভেসে আসে,

– আমি চলে এসেছি ,,!

– হনুফা,,,,! এই তোর আশার সময় ,,! আসুভে এখন মানুষ, ওর জৈবিক চাহিদা আছে, ওর খাবারের খিদা আছে। আর তুই এতো রাত করে বাড়ি ফিরতেছিস ,,! আসুভের খাবার বানা ‌তাড়াতাড়ি যা ,,!

– আমি আসুভের খাবার বানানো আর দিথীকে সহজে মারার জন্য একজনকে নিয়ে এসেছি ,,!

– মানে ,,! তুই কাকে আনছিস ,,! আর দিথীকে সে সহজে মারতে পারবে এটা কীভাবে এতো জোর দিয়ে বলছিস ?

– কারণ সে দিথী এখন যেখানে থাকে সেখান কারই একজন। সাথে সে ভালো রান্নাও করতে পারে। তাই আমাদের আসুভের খাওয়ার সমস্যাও হবেনা ,,!

– কে সে হনুফা ,,! (আসুভে)

– এই দেখো ,,!

বলেই কালু ধোঁয়া আকৃতির মানুষ মানে হনুফা তার হাত দিয়ে ঘরের দরজার দিকে দেখতে বলে। তান্ত্রিক আর আসুভে দরজার দিকে ফিরে তাকায়। ঘরের দরজাটা খুলে যায়। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে। সেই বাজ পড়ার আলো এই অন্ধকার ঘরকে পর্যন্ত আলোকিত করে তুলছে। তখনই দেখি ছাতা হাতে একটা মেয়ে এসে বারান্দার উঠে। ছাতা টা মাথা থেকে নামিয়ে বন্ধ করে বাড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখে। তান্ত্রিক আর আসুভে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা কে সেটা দেখার জন্য। মেয়েটা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। সাথে সাথেই বাইরে এক বড় বজ্রপাত হয়, আর সেই আলো ঘরের খোলা জানালা আর মেয়েটার পিছন থেকে এসে ঘরকে আলোকিত করে তুলে খানিকক্ষণের জন্য। সেই আলোতে আসুভে আর তান্ত্রিক চেয়ে দেখে মেয়েটা আর কেউ নয় মেম্বার বাড়ির কাজের মেয়ে লায়লা। লায়লা আসুভে আর তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময় হাসি দেয়।

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৪

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– কে সে হনুফা ,,! (আসুভে)

– এই দেখো ,,!

বলেই কালু ধোঁয়া আকৃতির মানুষ মানে হনুফা তার হাত দিয়ে ঘরের দরজার দিকে দেখতে বলে। তান্ত্রিক আর আসুভে দরজার দিকে ফিরে তাকায়। ঘরের দরজাটা খুলে যায়। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে। সেই বাজ পড়ার আলো এই অন্ধকার ঘরকে পর্যন্ত আলোকিত করে তুলছে। তখনই দেখা যায় ছাতা হাতে একটা মেয়ে এসে বারান্দার উঠে। ছাতা টা মাথা থেকে নামিয়ে বন্ধ করে বাড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখে। তান্ত্রিক আর আসুভে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা কে সেটা দেখার জন্য। মেয়েটা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। সাথে সাথেই বাইরে এক বড় বজ্রপাত হয়, আর সেই আলো ঘরের খোলা জানালা আর মেয়েটার পিছন থেকে এসে ঘরকে আলোকিত করে তুলে খানিকক্ষণের জন্য। সেই আলোতে আসুভে আর তান্ত্রিক চেয়ে দেখে মেয়েটা আর কেউ নয় মেম্বার বাড়ির কাজের মেয়ে লায়লা। লায়লা আসুভে আর তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময় হাসি দেয়।

তান্ত্রিক অবাক হয়ে বলে,

– তুমি লায়লা না ,,! মেম্বার বাড়ির কাজের মেয়ে ,,!

– হ, আমি লায়লা।

– ভিতরে আসো ভিতরে আসো। বৃষ্টিতে আসতে কষ্ট হয়নি তো ,,! (হনুফা)

– না আফা, তেমন কষ্ট হয়নাই‌। তয় জঙ্গলের রাস্তা ডা দিয়া আওনের সময় ডর করতাছিলো। কী ভূতুড়ে পরিবেশ বাবাগো বাবা ,,! (বলতে বলতে লায়লা ঘরের ভিতরে আসে। আসুভে আর তান্ত্রিক এখনো অবাক পানে চেয়েছিলো লায়লার দিকে। লায়লা ভিতরে আসার পর পরই হনুফা তার হাতের ইশারায় দরজা লাগিয়ে দেয়। লায়লা তার চুলের খোঁপা খুলে চুল গুলো ঝাড়তে থাকে। হয়তো আসার সময় মাথায় বৃষ্টির পানির ছিটে পড়েছে। তান্ত্রিক গম্ভীর মুখ নিয়ে হনুফার দিকে তাকায় বলে,

– কিন্তু ও আমাদের হয়ে কেনো কাজ করবে ? এতে ওর স্বার্থ কী ?

– ওর মুখ থেকেই শুনে নাও ,,! (লায়লার দিকে ফিরে) কিরে লায়লা ,! তুই ক্যান আমাগো লগে কাম করতে চাস ,,!

লায়লা তার চুল মেলে দিতে দিতে বলে ,

– আমি দিথী আফার মতো মেলা সোনার গহনা পড়তে চাই। শিউলি চাচির ধারেও অনেক গহনা আছে, কিন্তু আমার মতো গরীবের এই গহনা পড়ার শখ হইলেও সামর্থ্য নাই। আইজ হনুফা আফা আইয়া আপনাগো বিষয়ে আমারে সব খুইলা কইছে। আমি জানিনা কেমনে হনুফা আফা আমার মনের কথা যাইনা লাইলো। কিন্তু জানছে ভালাই হইছে। এহন আপনাগো কাজ কইরা দেওনের পর আসুভে আপায় তার শক্তি ফিরা পাইবো তারপর আমারে অনেক গুলা সোনার গহনা দিয়া দিবো। ব্যাস ,,!

লায়লার এমন নির্দিধায় কথা বলা দেখে আসুভে আর তান্ত্রিক একে অপরের দিকে তাকায়, তারপর আবার লায়লার দিকে ফিরে বলে,

– দিথী কিন্ত কুংফু কারাতে জানে। ওর সাথে তুমি শক্তিতে পারবা ,,!

– কী কন এইসব। আমার শক্তি নাই তো কী হইছে ,,! (হাত দিয়ে নিজের মাথা দেখিয়ে দিয়ে) এইডা তো আছে। এইডা দিয়া এমন চাল চালমু পাখিরে ফাঁদে ধরা দিতেই হইবো। ভুইলা যাইয়েন না আমি ঐ বাড়ির কাজের মাইয়া। রান্নাঘর কিন্তু আমাগো দহলে থাহে ,,!

কথাটা শুনেই তান্ত্রিক বেশ ইম্প্রেস হয়। আসুভের দিকে ফিরে বলে,

– মেয়ে চঞ্চল আছে,,!

– হমম।

– লায়লা,,! আসুভের জন্য কী কী খাবার আনছো ওরে দাও ,,! ওর খিদা লাগছে তো।

– ও হ,,! খারান আমি টিফিন বাটিডা লইয়া আহি। ছাতার লগে ঐডাও বারান্দায় রাইখা আইছি।

বলেই দরজার দিকে ফিরে লায়লা, হনুফা তার হাতের ইশারায় দরজা খুলে দেয়। লায়লা দরজার কপাট পাড় হয়ে বারান্দায় যায়। হেলে কিছু একটা হাতে নিয়ে আবার ঘরে ঢুকে পড়ে।

 

বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। শো শো করে বাতাস বইছে। জঙ্গলের মধ্যেকার বাড়ি এইটা। আশেপাশের গাছ পালা গুলোর বাতাসে দোল খাওয়া আকাশের বিজলী চমকানোর আলোতে ঠিকই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

লায়লা টিফিন বাটি হাতে ঘরে প্রবেশ করে। হনুফা তার হাতের ইশারায় দরজা আবার লাগিয়ে দেয়। লায়লা টিফিন বাটিটা নিয়ে আসুভের পাশে দাঁড়ায়। আসুভে কিছুটা আনকম্ফর্টেবল ফিল করছিলো। একটা কাজের মেয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ভাবতেই যেন তার কেমন গা গুলিয়ে আসছে। লায়লা আসুভের পাশেই মেঝেতে বসে পড়ে। মেঝেতে খড় বিছানো ছিলো। লায়লা টিফিন বাটি খুলতে থাকে। সেখান থেকে তিনটে বাটি আলাদা আলাদা করে রাখে। একটা বাটিতে ছিলো ভাত, আরেকটায় ছিলো একটা অর্ধেক কাঁটা ডিম আর ঝোল, আরেকটায় ছিলো গাজর ফুলকপির সবজি টা। লায়লা আসুভের কামিজ টেনে বলে,

– বন আফা। খাইয়া লন।

আসুভে টান দিয়ে তার কামিজ লায়লার হাত থেকে ছাড়ায়। আসুভে মুখ ভেংচি দিয়ে বসে পড়ে লায়লার পাশে। ভাতের বাটিটা হাতে নিয়ে সেটা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান নেয়। দেখছিলো ভাত গুলো ভালো আছে কি না। ঘ্রান নিয়ে সেই ভাতে ভাজি আর অর্ধেক কাঁটা ডিম টা উঠিয়ে নেয়। তার চোখে মুখে ছিলো বিরক্ত। কেনো জানি ও লায়লার কাছাকাছি থাকতে বিরক্ত বোধ করছিলো। আস্তে আস্তে খেতে শুরু করে আসুভে। আসুভে এখন মানুষ। মানুষের যেসব চাহিদা আছে সব তার মধ্যেও এখন আছে। আর এটা পূরণ করার ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে গেলো তারা লায়লাকে পাওয়ার পর। তবুও আসুভের কাছে লায়লাকে সহ্য হয়না। আসুভের খাওয়ার মাঝে তার পাশে বসে থাকা লায়লা বলে উঠে,

– দিথী আফায় এডি রান্না করছে। ডিমও হিসাব কইরাই রানছিলো। আমার ভাগের ডিম থেইকা আমি অর্ধেক কাইটা আপনার লাইগা রাইখা দিছি।

কথাটা শুনেই আসুভের কাশি উঠে যায়। লায়লা আসুভে পিঠ ঘষে দিতে যায় কিন্তু আসুভে বাঁধা দেয়। হনুফা একটা পানির বোতল নিয়ে আসুভের সামনে দৃশ্যমান হয়। আসুভে মানে সুমু পানির বোতল টা হাতে নিয়ে সেখান থেকে পানি খেয়ে নিতে থাকে। পানি খাওয়া শেষ করে বোতল টা পাশে রেখে তার পাতে থাকা ডিম টা উঠিয়ে যেই তরকারির বাটিতে ছিলো সেটায় রেখে দেয়। মুখে ছিলো চরম বিরক্তির আভাস। লায়লা তা দেখে হাসিমুখে বলে,

– ও আপনের ডিম পছন্দ না ,,! আচ্ছা তাইলে আমিই খাইয়া লই। (ডিম টা উঠিয়ে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে) বেকার বেকার ডিমডারে এতোটা রাস্তা আনলাম। আগেই খাইয়া লইতাম তো বেশি মজা পাইতাম।

পাশে বসে ভাত চিবোতে থাকা সুমু মানে আসুভে এসব কথা শুনে লায়লার দিকে থেকে মুখ কিছুটা ফিরিয়ে ভাত খাওয়াতে মনযোগ দেয়।

 

তান্ত্রিক পায়চারি করছে ঘরের মেঝেতে। বাইরের ঝড় বৃষ্টির বেগ আগের থেকে বেড়েছে। তান্ত্রিক একটা দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দেয়ালের দিকে মুখ করে বলে,

– লায়লা ,,!

লায়লা আসুভের ভাত খাওয়া দেখছিলো। তান্ত্রিকের কথায় তার ঘোর ভাঙ্গে। সে তান্ত্রিকের দিকে মুখ উঠিয়ে বলে,

– হ কন ,,!

– তাইলে কালকে থেকেই তোমার কাজে তুমি লেগে পড়ো ,,! সময় কিন্তু আমাদের হাতে কম। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি করতে হবে।

– কাইলকাই বিষ খাওয়াইয়া মাইরা ফেলমু ,,!

– বিষ তুমি সবার খাবারে দিবে না। সুযোগ বুঝে যেই প্লেট বা বাটিতে দিথী খাবার খাবে সেটায় বিষ ঢেলে দিয়ে আসবে। (একটু থেমে) হনুফা,,! ওকে বিষের শিশি টা দিয়ে দে।

– এখনি দিচ্ছি। (বলেই কালো ধোঁয়া টা আসুভের পাশ থেকে গায়েব হয়ে যায়। তারপর কিছুক্ষণ পর লায়লার পাশে দৃশ্যমান হয়। লায়লা এতে কিছুটা চমকে যায়। হনুফা বলে,

– ভয় পাইয়ো না। আমিই। (শিশিটা বাড়িয়ে দিয়ে) নেও,, ! নিয়ম কইরা ৩ বেলা দিথীর খাবারে মিশাবা।

লায়লা শিশিটা হাতে নেয়। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

তান্ত্রিক দেয়ালের দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলে।

– আর মাত্র কয়েকটা দিন। সব আমাদের পরিকল্পনা মতো এগোলে আগামী ২১ তারিখ অমাবস্যার রাতে আসুভে তার সব শক্তি ফিরে পাবে। আর আমরা হয়ে উঠবো অবিনশ্বর শক্তির মালিক। হা হা হা হা,,,!

তার ভয়ংকর হাসিতে পুরো ঘর কেঁপে উঠে। দুই হাত উপরে তুলে তান্ত্রিক হাসছিলো। আসুভে মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে ফিরে তাকায় তান্ত্রিকের দিকে। লায়লা আর হনুফাও ভয় ভয় মুখ নিয়ে সেদিকে তাকায়। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বিজলী চমকানোর আলো এসে ঘরকে মুহুর্তের মধ্যেই ভৌতিক রাজপ্রাসাদে রুপ দেয়। দূর থেকে ভেসে আসে আকাশ ভাঙ্গা বড় বড় বজ্রপাতের শব্দ।

 

 

 

রাতের আঁধার তলিয়ে যায় সকালে এক নতুন অরুনোদয়ে। প্রান্তরের এক সীমারেখা হতে গোল জলন্ত থালার মতো সূর্য উঠতে থাকে নীল আকাশে। চারপাশ আলোকিত হতে থাকে। পাখ-পাখালি গুলো বেড়িয়ে পড়ে তাদের খাবারের উদ্দেশ্য। এ যেন ধরিত্রীর বুক চিরে উঠা এক জলন্ত হ্রদপিন্ড।

 

মেম্বার বাড়ি। শিউলি বেগমের রুমে ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম মাখছে দিথী। সকাল সাড়ে ৭ টা বাজে। কিছুক্ষণ আগেই উঠলো সে। উঠে খালি মুখ ধুয়ে আসলো। সকাল সকাল মুখে ক্রিম দেওয়া তার রেগুলার রুটিনের মধ্যেই পড়ে। সেও চায় তার শ্যামল ত্বক সাদা ধবধবে করতে। কিন্তু যেই রং জন্ম থেকেই তার ছিলো সেটা সে কী করে চিরতরে মুছে ফেলবে। কিছুক্ষণ পর তো ঐ আবার মুখখানা শ্যাম বর্ণেই বর্ণিত হবে।

ইকরা ঘরে প্রবেশ করে। তার চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে বেশ উৎফুল্ল, উদ্দীপ্ত। সে এসে দিথীর পিছন থেকে দুই কাঁধে হাত রেখে টুকি দিয়ে বলে,

– ভাবি ,,!! কী করো ,,!

– এইতো একটু আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম।

– হ্যা দেখো দেখো, কয়দিন পর তো ঢাকায় গেলে আয়নায় মুখ দেখারো সময় হবেনা তোমার। ভাইয়ার সাথে রোমান্স করতেই ব্যাস্ত থাকবা।

– চুপ থাক পাজি।

– আমাকে চুপ করিয়ে লাভ নাই। আমি আজকে সকালে সব শুনছি। তুমি কালকে ভাইয়ার সাথে কী কী করছো ,,! রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে চাইছিলা হ্যা ,,!

দিথী অবাক হয়ে ইকরার দিকে ফিরে। বলে,

– মা সব বলে দিছে ,,!

– না না আমাকে বলেনি। ঘরে ফুফাকে বলতেছিলো। আমি দরজার আড়াল থেকে সব শুনে নিছি ,,! হি হি হি,,!

– এখনি আমি মা’কে বলেদিবো। কেমন লুকায় লুকায় শুনছিস ,,!

– না না ভাবি ,,! এমন করিও না ,,! ফুফু তখন মা’কে বলে দিলে মা মারবে আমাকে।

– তাইলে প্রমিস কর এই কথা আর কাউকে বলবি না।

ইকরা মুখ কিছুটা গোমড়া করে। বলে,

– বলবো না।

– প্রমিস তো ,,!

– হ্যা।

দিথী ইকরার গোমড়া মুখ দেখেই হেঁসে ফেলে। তাকে নিয়ে বিছানায় বসে। হাসতে হাসতে বলে,

– তুই তো দেখি আসলেই ভয় পাইছিস ,,! আরে না আমি মা’কে কেনো বলতে যাবো। পাগল নাকি। এমনি এমনিই তোকে ভয় দেখাচ্ছিলাম।

– তাইলে আমি এখন সবাইকে বলে বেড়াই কাল রাতের কথা ,,! (উৎসুক হয়ে)

– আমিও তোর মা’কে বলে দেই তুই রিয়াদের প্রেমে পড়ছিস ,,! চল দুইজন এক সাথে বলে বেড়াই ,,!

– ভাবি,,! তুমি কীভাবে,,,,,,

– এইভাবেই তো তোর ভাইয়ের প্রেমে পড়ছিলাম আমি। আমি না বুঝলে কে বুঝবে ,,! (বলেই ইকরাকে একটা চোখ টিপ দেয় দিথী)

– ভাবি ,,! তুমিও ,,,!

– হ্যা ,,! আমিও।

– প্লিজ তাইলে রিয়াদের কথাটা কাউকে বলিও না। আমিও তোমার কথাটা কাউকে বলবো না।

– এইতো লাইনে আসছিস এইবার।

– আচ্ছা শোন ঐসব বাদ দাও, আমি তোমায় যেকথা বলতে আসছিলাম, (হাসিমুখে) চলোনা নিপাদের ওখানে ঘুরতে যাই ,,!

– নিপাদের বাসা ,,! মানে ওবাড়িতে ?

– হ্যা। চলোনা যাই ভাবি। প্লিজ। ওদের বাড়ি বলে অনেক সুন্দর। অনেক বড় লোক বলে ওরা। চলোনা যাই।

– আমি এইসবের পারমিসন দিতে পারবোনা বাপু। তুই তোর ফুফুকে গিয়ে বল।

– তুমি বলো না প্লিজ ,,!

– আ্যস ,,! আমি বলে তখন বকা খাই। তুই যাবি তুই বল।

– তোমাকেও তো নিয়ে যাবো।

– তারপরও। আমি এসব কথা মা’কে বলতে পারবো না। মা এখন সকাল সকাল কী না কী মুডে আছে ,,! তুই গিয়ে বল।

– আচ্ছা তাইলে তুমি এখানেই বসো। আমিই বলতেছি ফুফুকে।

বলেই ইকরা বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা দিয়ে বের হতে যাবেই তখনই ওপাস থেকে আশা শিউলি বেগমের সাথে একটুর জন্য তার সংঘর্ষ ঘটতে ঘটতে থেমে যায়।

– আরে আরে আস্তে যাবি তো। এহনি সব উল্টাই দিতি। ছোড বাচ্চাগো মতো এমন দৌড়াদৌড়ি করতাছোস ক্যান ,,!

– ও ফুফু ও ফুফু। আমি আর ভাবি নিপাদের বাসা যাই ,,! খালি নিপাকে একবার দেখেই চলে আসবো।

– তুই আগে যা, বিছানা ব। আমার হাতের পায়েশ ডি রাখতে দে। আরেকটু হইলেই পায়েশ দিয়ে সকাল সকাল গোসল কইরা লাইতি তুই।

বলেই ইকরাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ান শিউলি বেগম। ইকরা এসে বসে পড়ে বিছানায়। শিউলি বেগম বিছানার পাশের টেবিলে ট্রে টা রাখে। দিথী বলে,

– মা, সকাল সকাল আপনি পায়েশ রান্না করতে গেলেন কেনো। আমাকে ডাক দিতেন।

– আমি রানছি তো কী হইছে। আমার পায়েশ কী মজা না,,!

– না না মা। কী বলেন। আপনার রান্নার টিপস দিয়ে আমি রান্না করে কাল ওর আর আব্বার কাছ থেকে প্রশংসা পাইছি। আপনার রান্না নিয়ে প্রশ্ন উঠার কোন চান্সই নাই। (একটু থেমে ধীর গলায়) না মানে আমি আপনাকে একটু সাহায্য করতাম আরকি।

– তুমি হেইসময় ঘুমাইতাছিলা। তোমারে ডাইকা আমি কাজে নিমূ ,,! আমাকে কী বেকুবে পাইছে ,,! অমন শাশুড়ি হইতে চাইনা মুই। (পায়েশের একটা বাটি উঠিয়ে দিথীর হাতে দিয়ে) লও। গরম গরম পায়েশ খাও। সকাল সকাল মন ডাই চাঙ্গা হইয়া যাইবো ,,! ঠিক আমার মতোন ,,! হা হা হা

দিথী পায়েশের বাটি হাতে নেয়। শিউলি বেগম আরেকটা পায়েশের বাটি ইকরার দিকে এগিয়ে দেন। ইকরা বাটিটা হাতে নিয়েই উৎসুক হয়ে বলতে থাকে।

– ও ফুফু। আমরা যাই প্লিজ ,,!

– আগে খা। পড়ে কইতাছি।

ইকরা কথা শুনেই তাড়াতাড়ি পায়েশ খাওয়া শুরু করে। দিথী পায়েশ মুখে তুলার আগে তা নাকে দিয়ে গন্ধ নেয়। গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথে ভ্রু কুঁচকে পায়েশের দিকে তাকায়। মুখ দিয়ে বিরবির করে কিছু বলে পায়েশে ফুঁ দেয়‌। দিয়ে চামচ দিয়ে উঠিয়ে খেতে থাকে।

 

বারান্দা দিয়ে মুখ ধুয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলো আফাজ। তখনই শিউলি বেগম দের রুমের ভিতর হতে ইকরা আর শিউলি বেগমের কথা তার কানে আসে। সে দাঁড়িয়ে যায় দরজার সামনে। পর্দা সড়িয়ে দেখে ইকরা, শিউলি বেগম আর দিথী পায়েশ খাচ্ছে। সেও ঘরে ঢুকে পড়ে। ইকরা এক নাগাড়ে বাহানা করেই যাচ্ছে। শিউলি বেগম টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়েশ খাচ্ছেন আর তার বাহানা শুনছেন। আফাজকে ঘরে ঢুকতে দেখেই শিউলি বলে উঠেন,

– ও আফাজ আইছো। তোমারে খুঁজতে গেলাম তহন শুনি উডোনাই।

– জ্বী ফুফু মাত্রই উঠে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলাম।

– এহন ঐ যে চেয়ার ডা আছে। ঐডা টাইনা বহো। আর এই লও। (ট্রে থেকে একটা পায়েশের বাটি উঠিয়ে তার দিকে এগিয়ে দেন শিউলি বেগম। আফাজ হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে। ইকরা আবার শিউলি বেগমকে বলতে থাকে।

– ও ফুফু। বলোনা। আমি ভাবিকে নিয়ে ওবাড়িতে যাই ,,!

– কোন বাড়ি ,,? (আফাজ)

– নিপা আপুর শশুর বাড়ি। ভাইয়া, তুইও চল আমাদের সাথে। ৩ জন মিলে যাবো।

– ঐ বাড়িতে ,,! ঠিক আছে যাওয়া যাবে।

– ফুফু। এইনাও ভাইয়াও এখন যাবে। প্লিজ এইবার অনুমতি দাও।

– হমম,,, এতোক্ষণ এইডাই ভাবতাছিলাম দূইডা মাইয়া মানুষরে একলা ছাড়া কী ঠিক হইবো ,,! এহন যদি আফাজ লগে যায় তাইলে ঠিক আছে। যাইতে পারোস।

– ভাবি , ভাবি। চলো রেডি হয়ে নেই। ফুফু যাইতে বলছে।

– এহনি যাবি নাকি। ঘড়িতে দেখছোস কয়ডা বাজে,,! এতো সকাল সকাল কেউ কারো বাইত্তে যায় ,,! বেলা বারুক। সাড়ে ১০ টা ১১ টার দিকে যাইস। কারো বাইতে সকাল, দুপুর আর রাইত মানে খাওয়ার সময় গুলাতে যাইতে নাই। তুই দরকারের খাতিরে গেলেও ঐ বাড়ির সবাই এই জিনিসটা বুঝবো না। সবার মানসিকতা তো আর এক না। (শিউলি বেগম)

– উমম,,, আচ্ছা তাইলে ১১ টার দিকেই বের হবো। (দিথীর দিকে তাকিয়ে) ভাবি, তুমি কী পড়ে যাবে ,,! আমি কিন্তু শাড়ি পড়ে যাবো।

কথাটা শুনেই চকিতে আফাজ ইকরার দিকে তাকায়। ইকরা উল্টো দিকে মুখ করে থাকায় সে আফাজকে দেখেনি। আফাজের মনে পড়ে যায় আলিশার কথা। আলিশার সৌখিনতার কথা। তার চোখে ভেসে উঠে আলিশার মুখ খানা। কানে বাজতে থাকে তার সেই কথা গুলো। ” আমার শাড়ি পড়তে খুব ভালো লাগে। শাড়ি, সাথে মেহেদী হাতে কাঁচের চুড়ি।”

– আর খোঁপায় এক খানা জবা ফুল (বিরবির করে বলে আফাজ। আলিশা মেয়েটার ব্যাক্তিত্বটা সবার থেকে আলাদা হয়ে আফাজের চোখে সেদিন ধরা দিয়েছে। মেয়েটার চঞ্চলতা, সৌখিনতা সবই আফাজের মনে দারুন ভাবে জেঁকে বসেছে। আফাজের মুখে একটা ছোট সুন্দর হাসি ফুটে উঠে। আজ ও বাড়িতে গেলে সেই চঞ্চল মেয়েটার সাথে দেখা হবে। ভাবতেই আফাজের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠে।

ঘরে গল্প করতে থাকে ইকরা আর দিথী। শিউলি বেগম পায়েশের ট্রে নিয়ে বেড়িয়ে যান। আফাজ পরে থাকে আলিশার স্মৃতি রোমন্থনে,,!

 

 

 

বদ্ধ ঘর। উপরের লাল আলোর তীব্রতা কমেছে জানালা দিয়ে ঢোকা দিনের আলোর ভিড়ে। মেয়েটা তার চোখ খোলে। নিজেকে আবিষ্কার করে ফ্লোরে শোয়া অবস্থায়। সে উঠে বসতে থাকে। শরীরে ব্যাথা। বসতে বসতে কোমরে হাত দিয়ে “আহ্” শব্দটি বেড়িয়ে আসে তার মুখ থেকে। চারপাশে তাকায়। কাল সে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো নাকি,,! পরক্ষনেই সে নিজের দিকে তাকায়। দেখে এক সুতো কাপড়ও তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। এবং তখনই তার মনে পড়ে যায় কাল রাতের ঘটনা। কাল রাতে তো সে লোকটার সাথে মিলিত হয়েছিলো,,,! মনে পড়তেই তার শরীরের লোম গুলো শিউরে উঠে। পাশে চেয়ে দেখে তার গায়ের কাপড় গুলো পড়ে আছে। সারারাত সে মজমাস্তিতে থাকায় কখন যে ফ্লোরেই লোকটার সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি।

মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে থাকে। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের বুক জড়িয়ে ধরে এগিয়ে যায় ফ্লোরে পড়ে থাকা কাপড় গুলোর দিকে। এক হাত বুক থেকে সড়িয়ে হেলে ফ্লোরে পড়ে থাকা তার কাপড় গুলো হাতে নেয়। নিয়ে উলঙ্গ দেহ নিয়েই হেঁটে হেঁটে রান্নার টেবিলের দিকে যেতে থাকে। রান্নার চুলা রাখার টেবিল টার পাশেই মদের বোতল সাড়ি সাড়ি করে রাখা। এটা মূলত আলাদা আরেকটা টেবিল। মেয়েটা মদের বোতল রাখা টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুটো মদের বোতল পাশপাশি রাখা। সেই বোতল গুলার পেছনে থাকা মোবাইল টা হাতে নেয় মেয়েটা। হাতে নিয়ে দেখে এখনো ভিডিও চালু আছে। সে ভিডিও অফ করে ভিডিওটাকে সেভ করে। পুরো ৯ ঘন্টা টাইমলাইন হইছে ভিডিওটার। টেবিলটার পাশেই একটা চেয়ার ছিলো। মেয়েটা সেই চেয়ার টেনে সেটায় বসে পড়ে। হাতের কাপড় গুলো কোলে রেখে মোবাইল টাকে দুই হাতে ধরে। ভিডিওটা প্লে করে। আঙ্গুল দিয়ে টেনে ঠিক সেই সময়টায় নিয়ে যায় যখন লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছিলো। মেয়েটা সেখানটায় প্লে করে ফোনটাকে কাত করে দুই হাতে ধরে। ফোনের ভলিউম ফুল বাড়িয়ে দেয়। নিজের করা কুকির্তি নিজেই দেখতে থাকে। ফোন থেকে ভেসে আসে তার সুখ চিৎকার, মিলিত হওয়ার শব্দ। মেয়েটা তা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। নিজের ঠোঁট কামড়ে এক দুষ্টু চাহনী দিয়ে দেখতে থাকে ভিডিওটা। ভিডিওটা আরেকটু টেনে দেয় আঙ্গুল দিয়ে। এতে ফোন থেকে তার চিৎকার আরো জোরে ভেসে আসতে থাকে। লোকটার এই পর্যায়ে নিজেও খুব উত্তেজিত ছিলো। মেয়েটা ভিডিওটা দেখতে দেখতে বলে,

– এইবার ঘুঘুকে ফাঁদে ফেলছি। মজা তুইও পাইছিস, আমিও পাইছি। কিন্তু তুই এই সাময়িক মজার জন্য যে কত কিছু হারাবি,,,! তা খালি দেখতে থাক। (একটু থেমে মুচকি হাসি দিয়ে) এটা তো কেবলমাত্র শুরু। পিকচার আভি বাকি হ্যা মেরি জান ,,,! হা হা হা

 

পুরো ঘর মেয়েটার পিশাচ হাঁসি আর ফোন থেকে বেরোনো তাহার সুখাত্মচিৎকারে কাঁপতে থাকে। ফোন থেকে মেয়েটার আত্মচিৎকার ধীরে ধীরে বাড়ে। এমন মনে হচ্ছে যেন লোকটার উত্তেজনা আরো বেড়েছে। যৌবনের সব শক্তি যেন তার গাঁয়ে এসে জেকে বসেছে। তারপরই হঠাৎ ফোন থেকে মেয়েটার চিৎকার আসা থেমে যায়। পতন হয় রাজার সাম্রাজ্য তার নিজ রাণীর অভ্যন্তরে ,,,!

 

 

 

অন্দরমহলের মূল ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো আফাজ, ইকরা আর দিথী। ভিতরে ঢুকতেই প্রথমেই তাদের চোখ যায় উপরের ঝুলতে থাকা বড় ঝাড়বাতি টার দিকে।

বেশ কিছুক্ষণ বাইরে দারোয়ানের সাথে ভুল বোঝাবুঝি ও কথা কাটাকাটি হয় তাদের। ইকরা জোর দেখিয়ে বাড়ির ভিতরে আসতে চাচ্ছিলো কিন্তু দারোয়ান পরিচয় ছাড়া ভিতরে ঢুকতে দিবেনা। ইকরাও তার পরিচয় দিবে না। এই নিয়ে বেশ বাকবিতন্ডা হয় ইকরা আর দারোয়ানের মাঝে। পরে আফাজের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। আফাজ তাদের পরিচয় দেয় আর ইকরাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে আসে। প্রথমে তারা ইকরার জেদ টাকে নিছক মজা ভেবে কিছু বলেনি। কিন্তু পড়ে যখন দারোয়ান উত্তপ্ত কথার ফুলঝুরি বের করে তখন আফাজ আর দিথীদের মাথা খুলে। তারা এতোক্ষণ যেটাকে মজা ভাবছিলো দারোয়ান সেটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে।

 

বাড়ির অন্দরমহলের ভিতর প্রবেশ করে ফেলে তিনজনই। দিথী ততটা অবাক হয়ে না দেখলেও আলিশা আর আফাজ বেশ অবাক হয়েই চারপাশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। অন্দরমহলের নিজের কার্পেট টার ডিজাইন। হাতের ডান পাশে বসার সোফা। বামে পার্স্বে ডায়নিং টেবিল। যেন কোন এলাফি দরবার। দিথী ততটাও অবাক হয়নি কারন সে এর আগেই তার বাবার সাথে এখানে এসেছে।

রান্না ঘর থেকে ধোঁয়া প্লেটের থাক হাতে নিয়ে বের হয় আঁখি। অন্দরমহলে ৩ অপরিচিত মানুষ দের দেখে সে হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। হাতের প্লেট গুলা ডায়নিং টেবিলে রেখে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অবাক স্বরে বলতে থাকে,

– আপনেরা কেরা ,,! ভিতরে আইলেন কেমনে ,,!

– তুমি এ বাড়ির সেই কাজের মেয়েটা না ,,! (দিথী)

– হ আমি কাজের মাইয়া। আপনারা কারা। কারে চান ?

– আমরা নিপার বাবার বাড়ি থেকে আসছি। (আফাজ)

– ও আপনেরা ঐ বাড়ির লোক ,,! আমি না চিনতেই পারি নাই। আহেন আহেন বহেন এইহানে। (সোফায় বসতে বলে আঁখি)

– না না ঠিক আছে। আমরা নিপার সাথে দেখা করতাম একটু। ও কই ,,?

– নিপা আফায় তো উপরে। নিজের ঘরে। আহেন আমি আপনা গোরে লইয়া যাইতেছি।

আঁখি তাঁদের সামনে সামনে চলে যেতে থাকে। দিথী, ইকরা তার পিছুপিছু সিঁড়িতে উঠে। আফাজ চারপাশে নয়ন ঘুড়িয়ে খুঁজে ফিরছে সেই চঞ্চল মেয়েটিকে ,,! চোখে হারাচ্ছে একজনকে ,,! চারপাশে তাকে খুঁজতে খুঁজতে বাকিদের সাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।

 

ঘরে গল্প করছে নিপা আর আলিশা। দুইজনেই বিছানায় বসে কী নিয়ে জানি কথা বলতেই হাসিতে লুটোপুটি খেতে থাকে। নিপা হাসতে হাসতে আরেকটা কথা বলে আবার দুই জনে বিছানায় হাসিতে লুটোপুটি খেতে থাকে। তখনই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ আসে তাদের কানে। নিপা তার হাঁসি থামিয়ে দিতে দিতে বলে।

– কে ,,!

– আফা ,,! আমি আঁখি।

– ও আঁখি তুই ,,! (আলিশার দিকে ফিরে) ঐ যে ঔ আসছে। ওকেও বলি কথাটা, হাসতে হাসতে পড়ে যাবে।

– হ্যা যাও ভাবি।

নিপা বিছানা থেকে উঠে নিচে নামে দাঁড়ায়। ওড়নাটা গাঁয়ে কোনমতে দিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলেই দেখতে পায় আঁখিদের সাথে দিথী আর ইকরাও আছে। নিপার চোখ মুখ খুশিতে বড় বড় হয়ে যায়। দিথীকে জড়িয়ে ধরে। দিথীও তাকে জড়িয়ে ধরে। নিপা তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলে,

– এতোদিন পর দেখা করতে আসলি ,,!

– এইতো আসবো আসবো করে আর আসাই হয়না।

নিপা দিথীর কথা শুনেই তার পাশে থাকা ইকরাকে আলিঙ্গন করে।

 

সবাই ঘরের ভিতরে চলে আসে। নিপা দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে ইকরা আর দিথীকে নিয়ে বিছানায় বসে। দিথীর যে বিয়ে হয়ে গেলো সেখানে সে যেতে পারেনি। বসার সাথে সাথেই সেই প্রসঙ্গ তুলে তারা কথা বলতে থাকে। ইকরা তো তাদের কথা থামিয়ে দিয়েই বলতে থাকে কাল রাতে দিথী আর শাহারিয়ার ঘটনা। দিথী তার মুখ চেপে ধরতে গেছিলো কিন্তু নিপা বাঁধা দেওয়ায় সে পারেনি। আলিশা সব ভর ভর করে বলে দেয়। আর তা শুনেই সে কী হাসি নিপার। দিথী অভিমানি সরু সরু চোখ নিয়ে ইকরার দিকে তাকায়। ইকরা হাসতে হাসতে নিপাকে বলে তাকে বাঁচাতে নাইলে ভাবি ওকে মাইর দিবে।

 

তিনজনের মধ্যে দারুন খুনসুটি হতে থাকে। আঁখি তাদের হাসাহাসি দেখে নিজে নিজেই বিরবির করে বলে,

– মেলা দিন পর আলাপ করতাছে,,! এরলাইগা এতো হাসি খুশি। আমি যাই , এগো লাইগা নাস্তা নিয়া আহি।

বলেই দরজা খুলে বাইরে চলে যায় আঁখি।

 

আফাজ ঘরের চারপাশ দেখতে দেখতে হেঁটে হেঁটে বিছানার এক পাশে চলে আসে। তখনই দেখে আলিশা বিছানার কোনে বসে আছে। চেয়ে আছে ব্যালকনির বারান্দার দিকে। এইতো আফাজ যাকে খুঁজছিলো তাকে পেয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটা এমন চুপচাপ হয়ে আছে কেনো ,,! আফাজ ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে আলিশার পাশে বসে। আলিশা কিছুটা চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকায়। বলে উঠে,

– আপনিও এসেছেন ,,!

– হ্যা। আমিও আসছি। (একটু থেমে) মন খারাপ তোমার ,,!

– না না। ভাবির বান্ধবীরা এসেছে। ভাবি এখন তাদের সাথে গল্প করছে। আমি কার সাথে গল্প করবো। তাই চুপচাপ বসে আছি।

– ওহহ,,! (একটু থেমে) এইটা রায়হান দুলাভাইয়ের রুম ,,?

– হ্যা। এটা দুলাভাই আর ভাবির রুম। (একটু চুপচাপ থাকার পর) চলেন আমরা ব্যালকনিতে যাই। ওরা এখানে গল্প করুক (বলা মাত্রই আলিশা আফাজের হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে যেতে থাকে ব্যালকনির দিকে। আফাজ এই প্রথম এক নতুন স্পর্শ পেলো। এই স্পর্শে অনেক গভীরতা আছে। অনেক টান মিশ্রিত মোহ-মায়া আছে। আফাজের কাছে যেন পৃথিবী ধীর গতির হয়ে গিয়েছিল। সে শুধু এক পানে চেয়েছিলো আলিশার হাত ধরার দিকে।

আলিশা তাকে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে আসে। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। আফাজ যেন একদম থমকে গেছে। হাতটা যতক্ষন মেয়েটা ধরেছিলো ততক্ষণ যেন ও অন্য ঘোরে চলে গিয়েছিলো। তখনই আলিশার কথায় সে সামনে তাকায়। আলিশা রেলিং ধরে চারপাশ দেখছিলো। বলছিলো।

– সুন্দর না ,,!

– কী ,,!

– বেলকনির প্লেসিং টা। দেখেন নিচে কত সুন্দর ফুলের বাগান। এই বাগান টার কথাই আমি সেদিন বলেছিলাম আপনাকে। এইটা বড় মামির বাগান। এটা থেকে আমাদের ফুল ছিঁড়তে দেয় না। ঐযে দেখেন‌‌ ঐ বড় গাছ টার ডালে চড়ুই পাখির বাসা। ডিম দিয়েছে। আর কয়েক দিন পর বাচ্চা ফুটবে। (একটু থেমে ধীর গলায়) আমিও যখন বাড়ি বানাবো তখন এমন একটা বারান্দা রাখবো। যেটায় দাঁড়িয়ে আমি আর আমার উনি দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করবো।

শেষের কথাটা যেন কেমন লাগে আফাজের কাছে। সে কিছু বলতেই যাবে প্রতি উত্তরে তখনই আলিশা উৎসুক হয়ে বলে,

– আপনি বই পড়েন ,,?

– ক, কেমন বই ,,?

– এই ধরুন গল্পের বই, ফিকশনাল বই ,,!

– পড়া হয় মাঝে মাঝে। কেনো ,,!

– আমার কাছেনা অনেক গল্পের বই আছে। আমি সেগুলো পড়ি আর মা’কেও  পড়ে শোনাই। দেখবেন আমার বই গুলাকে ,,!

– দেখাও।

– চলেন তাইলে আমার সাথে।

বলেই আবার আফাজের হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে আলিশা। আফাজের কাছে আবার যেন পৃথিবী থমকে যায়। চারপাশে কী হয় না হয় কিছুই তার মস্তিষ্ক ধারণ করেনা। তার সব ধ্যান ধারণা চলে যায় আলিশার হাত ধরার দিকে। এক নয়নে চেয়ে থাকে সে সেদিকে।

 

আলিশা বড় সিঁড়ি বেয়ে আফাজকে নিয়ে নামছে। হালকা মাতাল হাওয়ার কিছু লাল,কমলা কাপড় দুলছে। তার কাছে মনে হচ্ছে আলিশা আর সে যেন এক নতুন জগতে ছুটে বেড়াচ্ছে। চারপাশে মেঘ, আর তারা সিঁড়ি বেয়ে নেমে ছুটছে এক সীমাহীন প্রান্তরের দিকে। যেখানে দুনিয়াবি সকল কিছু থেমে যায়, শুধু থামেনা ভালোবাসার পরশমণি,,,!

 

আলিশা আফাজকে নিয়ে তাদের ঘরে চলে আসে। ঘরে সুরাইয়া বেগম ঘুমাচ্ছিলেন। আফাজ এখনো ঘোরে ছিলো যার কারণে সে ঘরে যে তৃতীয় কোন ব্যক্তি ঘুমিয়ে আছে তা বুঝতে পারেনি। আলিশা তাকে নিয়ে তার বইয়ের সেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আফাজের হাত ছেড়ে দিয়ে বই গুলার দিকে দেখিয়ে বলে,

– দেখুন। আমার কত্তগুলা বই ,,! এই সব বই গুলা আমি আমার পকেট খরচের টাকা থেকে জমিয়ে কিনেছি। কিছু কিছু বই অবশ্য ভাইয়া আমাকে জন্মদিনে গিফট দিয়েছিলো।

– এইসব বই তোমার,,!

– হ্যা। আমার পছন্দের লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তবে এখন তার সাথে ইলমা বেহরোজ আপুর লেখাও আমার পছন্দ লাগে। ইলমা আপু বের হওয়া দুইটা বই আমার সংগ্রহে আছে। এইযে একটা “আমি পদ্মজা” আরেকটা “মায়ামৃগ”

– সৌখিন মেয়েটা দেখি বই প্রেমিও ,,!

– ধরে নেন তাই ,,! (একটু থেমে) ও আপনাকে তো আরেকটা জিনিস দেখানোই হয়নি। আমি অনেক ভালো আর্ট করতে পারি। আসুন আমার সাথে।

বলেই আলিশা আবার আফাজের হাত ধরে টানতে টানতে তাকে ঘরের আরেক পার্শ্বে নিয়ে আসে। এখানে ছিলো তার পড়ার টেবিল। পড়ার টেবিলটা বিছানার পাশপাশি। আলিশা আফাজকে পড়ার টেবিলের সামনে নিয়ে দাড় করিয়ে বইয়ের থাকের মাঝ থেকে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। আফাজ তার দুই হাত কোলে রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে আলিশার কাজকর্ম। আলিশা কিছুক্ষণ খোঁজার পর একটা ড্রয়িং খাতা বের করে বই গুলোর মাঝ থেকে। ড্রয়িং খাতাটা অন্যান্য লেখার খাতা থেকে আকারে বড় ছিলো। আলিশা ড্রয়িং খাতাটা আফাজের সামনে খুলে দেখাতে থাকে। আফাজ ভেবেছিলো এমনিই হয়তো মেয়েটা ড্রয়িং করে, কিন্তু যখন সে ছবি গুলোর দিকে তাকায় তার চোখ কে যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। ছবি গুলো স্কেচ করে তার উপর রং তুলির টান দেওয়া হয়েছে। ছবির ডিটেইলিং আর ব্যাকগ্রাউন্ড যেন কোন প্রফেসনাল আর্টিস্টের মতো। আফাজ নিজে নিজে পেইজ উল্টিয়ে দেখতে থাকে। অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বলে,

– এ, এই গুলা তোমার আর্ট ,,!

– হ্যা ,,! কেনো পছন্দ হয়নি আপনার ,,!

– সত্যিই তোমার আর্ট ,,!

– হ্যা। আমি আর্ট করেছি। আমার আর্ট করতেও দারুন ভালো লাগে। যখন‌ আমার মন ভালো থাকে তখন আমি আর্ট করতে বসে যাই।

– এতো ভালো আর্ট কীভাবে করলা ,,! তুমি ড্রয়িং স্কুলে ভর্তি হয়েছিলা ,,!

– নাতো ,,! আমার এমনিতেই আর্ট হয়ে যেতো। বই আর সৌখিনতার দিকে ঝোঁকের আগে আমি এই আর্ট নিয়েই সবসময় পড়ে থাকতাম। ছোট বেলায় আর্ট করার জন্য আমি স্কুল থেকেও অনেক পুরস্কার পেয়েছিলাম।

– তোমার আর্টের হাত তো অনেক সুন্দর। বড় হয়ে তো তুমি ভালো চিত্রকার হতে পারবে।

– না না। আমি বড় হয়ে ইন্জিনিয়ার হবো। আর মায়ের জন্য ইয়া বড় একটা বাড়ি বানাবো। আমি আমার মনের বাড়িটার ছবিও এঁকেছি এখানে। দাঁড়ান দেখাচ্ছি।

আলিশা পেইজ উল্টিয়ে খুঁজতে থাকে। এদিকে আফাজের এখনো বিশ্বাস হয়ে উঠেনি এগুলা আলিশার হাতের আর্ট করা। মেয়েটা সবে মাত্র এসএসসি দিবে। তাতেই এতো ভালো ড্রয়িংয়ের হাত,,! আফাজের ঘোর ভাঙে আলিশার কথায়। আলিশা বলে,

– এই দেখুন।

আফাজ দেখে ড্রয়িং বুকে আঁকা সেই ছবিটার দিকে। একটা রাজ প্রাসাদের মতো বাড়ি। তার এক পাশে বাগান, গাছ, এমনকি গাছের ডালে ছোট পাখির বাসাটাও আঁকা। আফাজের মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে

– ওয়াও ,,! আসলেই অনেক সুন্দর,,,!

– আমার ছবি দেখে এই প্রথম কেউ সুন্দর বললো। ভাইয়া আর মা’কে দেখালে তার ঠিক মতো দেখতই না। শুধু আমাকে বকাঝকা করতো। বলতো এসব ছেড়ে পড়তে বস। কিন্তু আমার পড়াশোনা ভালো লাগে না। আমার ড্রয়িং, গল্পের বই পড়া এগুলো অনেক ভালো লাগে।

আফাজ কিছু বলে না। সে এখনো ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছবিটার সৌন্দর্য টা দেখছে। আলিশা আবার হাসি মুখে বলে উঠে।

– এইটা আমার সবচেয়ে পছন্দের ড্রয়িং বুক। আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের চিত্র গুলো এখানে এঁকে রেখেছে। এটা আমি আপনাকে গিফট দিলাম। আপনি এই প্রথম আমার আর্টের প্রশংসা করেছেন। এই খাতাটা আজ থেকে আপনার।

– সত্যি আমাকে দিয়ে দিবে ,,!

– হ্যা সত্যি। যে আমার ড্রয়িং এর এতো প্রশংসা করেছে তাকে যে এটা ছাড়া বিনিময়ে আর দেওয়ার কিছুই নেই ,,!

কথাটা যেন কেমন ঠেকে আফাজের কাছে। আফাজ কিছু বলতেই যাবে তখনই আলিশা বলে।

– আমার স্পেশাল ছবিটা আপনাকে দেখাই দাঁড়ান। (খাতার পেইজ উল্টে একদম শেষ পেইজে নিয়ে যায়। বলে,

– এইযে দেখুন। এই ছবিটা ঐদিন আপনাদের বাড়ি থেকে এসে এঁকেছিলাম।

আফাজ ছবিটার দিকে তাকায়। ছবিটায় ছিলো একটা মেয়ে। তার পড়নে শাড়ি। হাত রাঙা মেহেদীর রঙে। হাতে কাঁচের চুড়ি। দুই হাত দিয়ে মেয়েটা তার এক পাশের কানের দুল ধরেছে। খোঁপায় একটা লাল জবা ফুল গুঁজে দেওয়া। এবং মেয়েটার পিছনেই দাঁড়ানো একটা ছেলে। সাদা পাঞ্জাবি পড়া সেই ছেলেটা মেয়েটার দুই কাঁধে হাত দিয়ে মেয়েটার সাথে হাসছে। আর মেয়েটার মুখেও হাসি। যেন কোন সুখি দম্পতির প্রতিচ্ছবি। আফাজ ছবিটা দেখেই আলিশার দিকে ফিরে। বলে,

– মেয়েটার সবকিছুই তো তোমার সাথে মিলে যায় ,,!

– আমি নিজেকেই নিজে রঙতুলির আঁচড়ে উপস্থাপন করেছি।

– ও তারমানে মেয়েটা তুমি। (একটু থেমে) আর পাশের ছেলেটা,,!

আলিশা একটু চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ধীর গলায় বলে,

– আমার উনি,,,!

আফাজ আবার ছবিটার দিকে তাকায়। দেখতে থাকে ভালো করে। তখনই আলিশা আমতা আমতা করে বলে,

– দ,দাঁড়ান আমি আপনাকে একটা বই এনে দেখাচ্ছি। বইটার গল্পটা শুনলে নিশ্চয়ই আপনার অনেক ভালো লাগবে।

বলেই আফাজের পাশ থেকে ছুটে বুক শেলফের দিকে চলে যায় আলিশা।

আফাজ ছবিটাকে দেখতে থাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে। দেখতে দেখতে হঠাৎ তার চোখ মুখ বড় হয়ে যায়। সে শাড়ি পড়া মেয়েটার পাশের ছেলের ছবি টাকে দেখতে থাকে। মুখে চাপ দাড়ি। মাথার চুল গুলো সুন্দর আঁচড়ানো। আর ,,! আর ঠোঁটের নিচে ছোট্ট কালো তিল ,,,!

আফাজ সাথে সাথে মুখ তুলে তাকায়। এটা যে তার প্রতিচ্ছবি,,,! আফাজের হ্রদকম্পন বেড়ে যায়। সে আবার ছবিটার দিকে তাকায়। ছেলেটা মেয়েটার কাঁধে হাত দিয়ে রেখেছে। ছেলেটার হাতে থাকা ঘড়িটা সোনালী রঙের। আফাজ তার হাত উঠায়, দেখে ঠিক সেইম টু সেইম। যেন তার হাতের ঘড়িটার রঙতুলি ভার্সন। আলিশা তাকে ঐদিন ঐখানে বসে এতোটা পর্যবেক্ষণ করে ফেলেছে ,,! তার ঠোঁটের নিচের তিল টা পর্যন্ত দেখেছে ,,! অথচ সে বুঝতেই পারেনি। আলিশা তো এই ছেলের ছবিটাকে বললো ওর উনি। তারমানে আলিশা ওকে ,,,,,,! না। আর ভাবতে চায়না আফাজ। ও চায়না তার এই ধারনা ভুল হোক। আলিশা তার ছবি এঁকেছে নিজের প্রতিচ্ছবির পাশে ,,! হয়তো তাদের চেহারা আর ছবির চেহারায় মিল নেই। কিন্তু ছবির বাকি বৈশিষ্ট্য কথা বলছে। বলছে যে এটা আলিশা আর তারই প্রতিছবি। তখনই তার ঘোর ভাঙিয়ে দিয়ে আলিশা এসে দাঁড়ায় তার পাশে। আলিশা বলতে থাকে।

– এইযে এই বইটা আমার সবচেয়ে পছন্দের। বইটার নাম “শেষ বিকেল”। বইটার গল্পটা না আমার সবচেয়ে ভালো লাগে।

– এটা তোমার সবচেয়ে পছন্দের বই ,,!

– হ্যা। এখন‌ তো আপনারা চলে যাবেন। তাই পুরোটা আবৃত্তি করে শোনাতে পারছিনা। তবে গল্পের মূলভাব টা বলছি। গল্পের নায়িকার নাম অপরুপা আর নায়কের নাম শেহওরান। নায়ক নায়িকা, দুইজনে দুজনাকে প্রথম দেখায় ভালো না বাসলেও নিজেদের মধ্যে তারা নতুন অনুভূতির জানান পায়। দ্বিতীয় দেখায় তারা দুইজনেই দুইজনকে উপলব্ধি করতে পারে। ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু তারা কেউ কাউকে বলে না, প্রকাশ করে না। এবং এক সময় গল্পের নায়ক চলে যায় শহরে। বেশ অনেকদিন কেটে যায়। মেয়েটা এখনো বিয়ে করেনি। সে অপেক্ষায় ছিলো শেহওরানের আসার। এবং সে একদিন দেখে শেহওরান ফিরে এসেছে। এবং এসে তাকে নিয়ে নদীর তীরে যায়। তখন শেষ বিকেল। শেহওরান তার ভালোবাসার কথা বলে অপরুপাকে। অপরুপা অনেক খুশি হয়েছিলো। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো‌। শেহওরান সেই শেষ বিকেলেই তার হাতে আংটি পড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে তাদের বিয়ে হয়। দুইটা সুন্দর বাবুও হয়। গল্পের শেষ দিকটায় তারা বৃদ্ধা কালে পৌঁছে যায়। তবুও তারা শহরের সবকিছুর কোলাহল ছেড়ে সেই নদীর তীরে যায়। সময়টা শেষ বিকেল ছিলো। বৃদ্ধা অপরূপা তার বৃদ্ধ শেহওরানের কাঁধে মাথা রেখে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে থাকে। আর বলে “শেষ সময়ের সঙ্গি হিসেবেও তোমাকে পাওয়া, আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। ভালোবাসার সঙ্গাটাকে তুমি আমায় নতুন ভাবে চিনিয়েছো। কাঁধে কাঁধ রেখে সংগ্রাম করতে শিখিয়েছো। দু’জন এক সমুদ্র অপেক্ষা করার পর দুজনাকে পেয়েছিলাম। তোমার ভালোবাসা সেই শেষ বিকেলে যেমনটা ছিলো আজও ঠিক তেমন টাই রয়ে গেছে। তুমি কথা দিয়েছিলে আমার হাত ছাড়বে না। আজও ছাড়োনি।  ভালোবাসি তোমায় শেহওরান। যেমন সত্য এই শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত,  তেমন সত্য আমি তোমায় ভালোবাসি। অনেক অনেক ভালোবাসি।”

– তারপর ,,!

– গল্প শেষ (ধীর গলায় বলে আলিশা)

– গল্পটা সুন্দর ,,!

– হ্যা। গল্পটা আমার অনেক ভালো লাগে। বিশেষ করে অপরুপার বলা শেষের ডায়লগ গুলো আমার মন ছুঁয়ে গেছে। (একটু থেমে) এই বইটাও আমি আপনাকে দিলাম। সময় করে পড়বেন কিন্তু ,,!

– এইটাও ,,! আচ্ছা ঠিক আছে। সময় করে পড়বো একদিন।

তখনই আফাজের চোখ যায় বিছানায় শুয়ে থাকা এক মহিলার উপর। চোখে ব্যান্ডেজ। আফাজ অবাক হয়ে বলে,

– উনি কে ,,?

– উনি ? উনি আমার মা। (হাসৌজ্জল মুখে)

– উনি অসুস্থ ,,?

– হ্যা। ঐযে ঐদিন বললাম। মা অসুস্থ থাকার কারণে আসতে পারেনি।

– চোখে কিছু হয়েছে ,,?

– হ্যা। চ,চোখের অপারেশন হয়েছে। (কিছুটা কম্পিত গলায়)

– ওহহ,,

– নিন বইটা। (আলিশা হাসি মুখ নিয়ে বইটা আফাজের দিকে এগিয়ে দেয়। আফাজ বইটা হাতে নেয়। বইটা খুলে দেখার জন্য টেবিলে রাখে। বইয়ের মলাট উল্টাতে যাবেই তখনই আলিশা বলে,

– এখন খুলিয়েন না। একদম যখন পড়বেন তখন খুলিয়েন।

– কেনো,,!

– না মানে আমাদের ম্যাম বলতো গিফট দেওয়া বই পড়ার আগে এমনি খুলে দেখতে নেই।

– ওহহ,, আচ্ছা তোমার বা,,,,,,,,

তখনই আফাজের ফোন বেজে উঠে। আফাজ বইটা ড্রয়িং বইয়ের উপর রেখে তার পকেট থেকে ফোন টা বের করতে থাকে। বাইরের হালকা রোদ জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। সেই আলোয় আলিশার মুখশ্রী বেশ উজ্জ্বল। সে হাসি মুখ আফাজের দিকে তাকিয়ে আছে।

আফাজ ফোনটা বের করে রিসিভ করে। কানে তুলে। ওপাস থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ ভেসে আসে।

– কই তুই ,,?

– আমি নিচে আসছি। কেনো,,?

– দিথীর বাবা বলে কথা বলতেছেনা। শরীর বলে অনেক খারাপ হইছে ,,!

– কী বলিস ,,! হঠাৎ করেই ?

– হ্যা। তুই তাড়াতাড়ি আয়। আমরা নিচে নামে সোফার দিকটায় দাঁড়ায় আছি।

– আচ্ছা আমি এখনি আসতেছি।

আফাজ ফোনটা নামায়। আলিশার মুখের হাসি তখনই উবে গিয়েছিলো যখন সে ফোনের অপর প্রান্ত হতে এক মেয়ের গলার আওয়াজ পেয়েছিলো। একটু কাপো কাপো কন্ঠে বলে,

– য,যদি কিছু মনে না করেন, এ,একটা কথা বলি ,,!

আফাজ আলিশার দিকে ফিরে তাকায়। বলে,

– হ্যা বলো।

– ক,কে ফোন দিয়েছিলো,,! (ধীর গলায়)

– এখন ,,? আমার বোন‌। ইকরা। ঐযে তোমার ভাবির সাথে যে শাড়ি পড়া মেয়েটাকে দেখলে না ? ও।

– ওহ,,, (একটু থেমে) কী বলছিলো ?

– বলতেছে দিথী মানে আরেকটা যে মেয়ে এসেছিলো ওর বাবার নাকি অসুখ বেড়ে গেছে। সেইজন্য ওরা চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজে না পেয়ে ফোন দিয়েছে।

আলিশার কিছুক্ষণের জন্য হাসি ফিরে পাওয়া মুখটা আবার নিমেষেই মলিন হয়ে যায়। আঁধার জমা মেঘ নামে তার মুখশ্রীতে। আফাজ, আলিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– তাইলে আজ গেলাম ,,!

– চলে যাবেন,,!

– হ্যা ঐযে বললাম দিথীর বাবার অসুখ বেড়েছে। ঐখানে যেতে হবে।

– দ,দিথী কী আপনার ব,বউ হয় ,,! (কাপো কাপো গলায়)

– আরে না পাগলি। কী বলো। আমার ভাবি উনি। ভুল করে তোমার সামনে নাম ধরে বলে ফেলছি। আমার কোন বউ, প্রেমিকা কিচ্ছু নেই। খাঁটি সিঙ্গেল আমি।

আলিশার মুখ আবার হাসি খুশিতে ছেয়ে যায়। সে বলে ,

– সত্যি,,!

– হ্যা। একদম সত্যি। আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নাই। বেষ্টফ্রেন্ড ও ছিলোনা। তবে নতুন একটা হয়েছে ,,!

– কে সে ,,! (ধীর গলায়)

আফাজ আলিশা দিকে চেয়ে হাসি মুখে বলে,

– তুমি। তুমি আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড। এইযে দেখো আমাদের কত সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে এই দু দিনে। আমি একটা খাঁচায় বন্দী পাখি হয়ে আরেক খাঁচায় বন্দী পাখিকে বন্ধু বানিয়েছি। শুধু বন্ধু না। বেষ্ট বন্ধু।

আলিশার মুখ নিমেষেই হাসির ছটায় আলোড়িত হয়ে উঠে। আলিশা বলে,

– আবার আসবেন। আর এলে অন্দরমহল থেকে হাতের ডান দিকের করিডোর ধরে এগিয়ে আসবেন। আর প্রথম রুম মানে এটায় চলে আসবেন। আমি সবসময় এই চার দেয়ালের আবদ্ধ ঘরে থাকি। (ধীর গলায়) আসবেন কিন্তু,,!

– এরপর আবার গ্রামে আসলে অবশ্যই। কাল চলে যাবো রংপুরে। এরপর কতদিন পর যে এখানে আসি তার ঠিক নেই।

– কালই চলে যাবেন ,,! (কিছুটা মন খারাপ হয় আলিশার)

– হ্যা। কাল চলে যাবো। তবে ভেবো না। আমি আমার ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে না আসলেও এক বিকেলে এসে তোমায় জবা আর গাঁদা ফুল দিয়ে যাবো। খোঁপায় পড়ার জন্য।

– সত্যি,,,! আমি অপেক্ষায় থাকবো। আমি সেদিন আবার শাড়ি পড়বো। বাসার কে কি বলে বলুক। আমি শাড়ি পড়ে লাল কাঁচের চুড়ি পড়ে আপনার হাতে আমার খোঁপায় ফুল পড়িয়ে নিবো। তারপর আমরা এক সাথে ঘুরতে বেড়োবো। শেষ বিকেলে ছায়ার নীড় আকাশের বুকে আমি, লাল রঙা স্বপ্ন আঁকব,,,! (একটু থেমে ধীর গলায় আফাজের দিকে চেয়ে) থাক না কিছু সোনালী ইচ্ছে ,,! আপনার আর আমার ,,!

কথাটার গভীরতা আফাজ বুঝতে পেরেছে। আলিশাও তাকে ভালোবাসে। সে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে তার ভালোবাসার কথা। আফাজের কি ছেলে হয়ে তার নিজের ভালোবাসার কথাটা জানিয়ে দেওয়া উচিত নয়,,! হ্যা উচিত। তার ইচ্ছেও ডানা মেলতে চাইছে। বার বার তার মনে উঁকি দিয়ে বলছে আলিশাকে ভালোবাসার কথাটা বলে দিতে।  দু’জন দু’জনার হওয়া থেকে তার আর মাত্র একধাপ দূরে। আফাজ মনে সাহস জমায়। তার কিছুটা ভয় হচ্ছিলো। আলিশা তার চোখের দিকে এক সোনালী রোদের আভার মতো তাকিয়ে ছিলো। আফাজ এক বড় শ্বাস নেয়। আলিশার দুই হাত ধরে। আলিশা দুই চিকচিকে নয়নে চেয়ে দেখে আফাজ তার হাত ধরেছে। আফাজ তার হাত দুটো ধরে উঁচু করে। বলে,

– আলিশা, আমি,,,,,,,,,,,,,,,,

তখনই আফাজের ফোন বেজে উঠে। সাথে সাথেই আফাজ তার ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসে। সে সাথে সাথেই আলিশার হাত ছেড়ে দেয়। আলিশা এতে কিছুটা ব্যাথিত হলেও সে তার ঠোঁটের মুচকি হাসির আড়ালে তা লুকায়।

 

আফাজ ফোন রিসিভ করে কানে তুলে। বলে,

– সরি রে আমি বেরই হচ্ছিলাম। (ওপাস থেকে ইকরার রাগান্বিত চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আসে) তোরা বাড়ি থেকে বেরও হয়ে গেছিস ,,! আচ্ছা আমি আসছি।

আফাজ তার ফোন টা নামিয়ে পকেটে ঢুকায়। আলিশার দিকে তাকিয়ে বলে।

– গেলাম। আবার হয়তো কোন এক বিকেলে দেখা হবে। (বলেই আফাজ হন্তদন্ত হয়ে চলে যেতে থাকে। আলিশা আফাজের এমন হঠাৎ চলে যাওয়াটা বুঝে উঠতে পারে না। তার কাছে কেয়ন জানি সব অসম্পূর্ণ লাগছে। তখনই সে দেখে আফাজ ড্রয়িং বূক আর বইটা নিতে ভুলে গেছে। সে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে ডাকতে থাকে আফাজকে,

– দাঁড়ান,,! (বলেই আফাজের রেখে যাওয়া ড্রয়িং বুক আর বইটা হাতে নিয়ে দৌড়ে ছুটে যায় সেদিকে

দরজা দিয়ে বের হয়ে দেখে আফাজ করিডোর দিয়ে হন হন করে ছুটে যাচ্ছে। আলিশা আবার জোড়ে ডাক দেয়,

– এইযে শুনছেন ,,! একটু দাঁড়ান‌।

আফাজ আলিশার ডাক শুনতে পায়। সে দাঁড়িয়ে যায়। আলিশা দৌড়ে আফাজের দিকে এগিয়ে যায়। আফাজ করিডোর থেকে বেড়োনোর শেষ প্রান্তে ছিলো। আলিশা আফাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

– আপনি, আপনি এগুলো ফেলে গিয়েছিলেন ,,!

– ওহো,,,! তাড়াহুড়ো তে নিতেই ভুলে গেছি। (সেগুলো হাতে নিয়ে) থ্যাংকস আলিশা। গেলাম আমি হ্যা ,,!

বলেই হন হন করে করিডোর থেকে অন্দরমহল দিয়ে চলে যেতে থাকে আফাজ। আলিশা জোরে হাঁক দিয়ে বলে,

– শেহওরান ,,! আবার আসবেন কিন্তু,,,!

বলেই মুখ চেপে হাসতে হাসতে করিডোর দিয়ে দোড়ে ঘরের দিকে যেতে থাকে। আফাজ তার ছবির মানে টা ঠিকি ধরতে পেরেছে। আর নিশ্চয়ই আফাজও তাকে ভালোবেসে। ঐসময় ফোন টা না বাজলে আফাজ তাকে ভালোবাসার কথাটাও বলে ফেলতো।

আলিশা এসে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়, তবে ঘরে ঢুকে না। তার বার বার আফাজের নিজে থেকে তার হাত ধরার কথাটা মনে হতে থাকে। সে লজ্জা পায়। দুই হাত দিয়ে দরজার পর্দার আড়ালে মুখ লুকায়। বিরবির করে বলে,

– শেহওরান, তুমি প্লিজ এসো ,,! তোমার হাতে ফুল পড়িয়ে নিতে যে আমার আর তর সইছে না ,,! আমাকে তোমার ভালোবাসার কথা বলবেনা ,,! আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো শেহওরান। একসাথে হাতে হাত রেখে শেষ বিকেল টাকে আমাদের অনুভূতির আবেশে স্নিগ্ধ শীতল করার জন্য,,,! তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো ,,,!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৫

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

আলিশা এসে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়, তবে ঘরে ঢুকে না। তার বার বার আফাজের নিজে থেকে তার হাত ধরার কথাটা মনে হতে থাকে। সে লজ্জা পায়। দুই হাত দিয়ে দরজার পর্দার আড়ালে মুখ লুকায়। বিরবির করে বলে,

– শেহওরান, তুমি প্লিজ এসো ,,! তোমার হাতে ফুল পড়িয়ে নিতে যে আমার আর তর সইছে না ,,! আমাকে তোমার ভালোবাসার কথা বলবেনা ,,! আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো শেহওরান। একসাথে হাতে হাত রেখে শেষ বিকেল টাকে আমাদের অনুভূতির আবেশে স্নিগ্ধ শীতল করার জন্য,,,! তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো ,,,!

বলেই পর্দার আড়ালে মুচকি হাসিতে মেতে উঠে আলিশা। তার মন বাগানে নতুন ভ্রমোরের বিচরণ সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে। একটা নতুন আবেগ, নতুন কিছু জন্মেছে আফাজের জন্য তার মনে। আলিশার কাছে আজকের দিনটা হয়তো স্বপ্নের চেয়েও বেশি রঙিন হয়ে ধরা দিয়েছে।

হঠাৎ তার কাঁধে কেউ হাত রাখে। আলিশা ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে নিপা দাঁড়িয়ে আছে। আলিশা তো খানিকক্ষণের জন্য কী ভয় টাই না পেয়েছিলো। আলিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বলে,

– ও ভাবি তুমি ,,! আমাকে তো ভয় পাইয়ে দিছিলে।

– হ্যা আমিই। পর্দার আড়ালে মুখ লুকিয়ে কী বিরবির করতেছিলি ,,!

আলিশা মাথা নিচু করে ফেলে। আমতা আমতা করে বলে,

– ক,কই। কিছুনা তো।

– আমাকে ঐসব বলে পার পাবিনা। বল কী বিরবির করতেছিলি ,,!

– এ,এমনিই আরকি ভাবি। তেমন কিছুনা।

– প্রেম করিস কারো সাথে ,,,?

আলিশা মাথা নেড়ে না সূচক ইঙ্গিত দেয়। ধীর গলায় বলে,

– না।

নিপা সরু সরু চোখ নিয়ে আলিশার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। বলে,

– তাইলে কাকে আসার কথা বলতেছিলি ফুল নিয়ে ,,!

– ক,কেউ না ভাবি। ত, তুমি হয়তো ভুল শুনছো।

– আফাজকে ভালোবাসিস ,,?

আলিশা কথাটা শোনার সাথে সাথেই চকিতে মাথা তুলে নিপার দিকে তাকায়। তার মুখে অবাক আর লজ্জা দুইটার সম্মিলিত আবেশ। ও লজ্জা পাচ্ছিলো কারণ ও প্রেম জিনিসটার প্রতি স্পর্শকাতর। আর অবাক হচ্ছে এটা ভেবে যে নিপা কী করে জানলো।

নিপা আলিশার এমন মুখোশ্রী দেখে আবার বলে,

– কী ,,! আফাজকে যে যাওয়ার সময় শেহওরান বলে ডাকলি। আর একটু আগে পর্দার আড়ালে মুখ লুকায় শেহওরানকে আসতে বললি,,! এই শেহওরানের কেস টা কী রে ,,! তুই কী আফাজকে শেহওরান বলে ডাকিস ,,!

আলিশা কী বলবে খুঁজে পায়না। তার ভয়ও হচ্ছে লজ্জা বোধও জাগছে। নিপা তার কন্ঠ কঠিন করে বলে,

– আচ্ছা আমাকে বলবি নাতো,,! আমি আজকেই তোর ভাইয়াকে সব জানিয়ে দিবো। তারপর তোর ভাইয়া কী করবে সেটা সে জানে। (বলেই চলে যেতে উদ্যত হয় নিপা। আলিশা সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ধরে ফেলে। ধরেই ঘরের ভিতর টেনে নিয়ে যেতে থাকে। বিরবির করে বলে,

– ভাবি তুমি কিছু বলিও না। ভাইয়া আমাকে মেরে ফেলবে যদি এসব কথা শুনে। তুমি ঘরে আসো আমি তোমায় সব বলছি।

– এইতো ভালো মেয়ের মতো কথা। চল। দেখি তোদের আসল কাহিনীটা কী ,,!

নিপাও আলিশার টানটানিতে বাঁধা না দিয়ে তার সাথে ভিতরে চলে যায়। আলিশা নিপাকে ঘরের ভিতরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

 

আলিশা বসেছে বিছানায়। তার মা এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তার মায়ের পায়ের দিক টায় কিছু ফাঁকা যায়গা ছিলো সেখান টায় সে বসেছে। আর নিপা একটা চেয়ার টেনে ঠিক বিছানার কাছে আলিশার সামনে মুখোমুখি হয়ে বসেছে। তাদের দুজনের মধ্যে নেমে আসে নিরবতা। আলিশা লজ্জা পাচ্ছিলো কথা গুলা বলতে। নিপা সেই বিষয় টা বুঝতে পেরে নিজেই প্রথমে বলা শুরু করে,

– কতদিনের প্রেম,,?

আলিশা মাথা উঠায়। বলে,

– আমরা প্রেম করিনা তো।

– তাইলে ,,?

আলিশা মাথা নিচু করে। ধীর গলায় বলে,

– উনি আজ জানতে পেরেছেন যে আমি উনাকে ভালোবাসি।

– আফাজ তোকে ভালোবাসে না ,,!

– বাসে।

– কবে থেকে তোর আফাজের প্রতি ফিলিং আসতে শুরু করে,,!

– গায়ে হলুদের দিন থেকে নতুন কিছুর আভাস পাই আমার মনে। সেদিন যখন তোমরা আনন্দে মেতে ছিলে তখন উনি আমায় এক দলা হলুদ মাখিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলেন। আমি উনার পিছু নেই। উনার পিছনে দৌড়াতে থাকি হলুদ মাখাবার জন্য। তখনই একজনের পায়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে ধরেছিলাম নিচে কিন্তু একটুর জন্য উনার পিঠে গিয়ে পড়ি। আরেকটু জোড়ে দৌড়ালে হয়তো দুজনই মাটিতে পড়ে যেতাম।

– এখান থেকেই শুরু ,,!

– হমম। এরপর বিয়ের দিনও আরেক কান্ড ঘটে। আমি পার্টি স্প্রে দিতে গিয়েছিলাম গেইট ছাড়ার পর, তখন উনি এসে আমার মুখে স্প্রে করে দৌড়ে পালান। আমি প্রথমে বিষয়টা বুঝিনি। ভেবেছিলাম অন্য কেউ দিয়েছে। পরে যখন খেতে বসি তখন উনি এসেছিলেন আমার কাছে। তখন উনার কথা আর মুখের ভঙিমায় ধরতে পারি যে কাজ টা উনার।

– তারপর ?

– সেদিন যখন আমরা ওবাড়িতে গেলাম। তখন বাইরে জলপাই গাছের নিচে বসার যায়গাটায় বসে আমাদের অনেক কথা হয়। উনার সাথে কথা বলার সময় আমার কেমন যানি লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো উনার সাথে আমার শত জনমের সম্পর্ক। উনি আমার খুব কাছের কেউ। তবে আমি আমার দূর্বলতা উনাকে বুঝতে দেইনি। ভেবেছিলাম যদি উনি আমাকে ভালো না বেসে থাকেন, তাহলে তো আমার ভালোবাসার মূল্যই নেই তার কাছে। (একটু থেমে) আমি আমার সব পছন্দের জিনিস গুলোকে আর্ট করতাম। রঙতুলি দিয়ে সুপ্ত স্বপ্ন গুলোকে রঙিন করতাম। তোমাকে যেই ড্রয়িং খাতাটা দেখিয়েছিলাম না ,,! সেটায় আমি উনার আর আমার ছবি আঁকি। উনাকে আর আমাকে আমি কল্পনায় যেমনটা ভাবি ঠিক তেমন করে ফুটিয়ে তুলি সাদা কাগজের মাঝে। উনি আমার সৌখিনতা দেখে বলেছিলেন আমার খোঁপায় একটা জবা কিংবা গাঁদা ফুল থাকলে বলে বেশি সুন্দর লাগবে। আমিও ছবিটায় আমার খোঁপায় একটা জবা ফুল এঁকে দেই। উনার ব্যক্তিত্ব, উনার কথার ভাঁজ আমার কাছে দারুন লাগে। আমি উনার ব্যক্তিত্ব দেখেই উনার প্রেমে পড়েছি। (বলেই আলিশা তার মুখ নামিয়ে নেয়)

– তাঁরপর তুই জানলি কীভাবে যে ঔ তোকে ভালোবাসে ,,!

– আজ যখন তোমরা কথা বলছিলে ,,! তখন আমি উনাকে হাত ধরে নিচে নামিয়ে আনি। আমি খেয়াল করেছিলাম, যখন আমি উনার হাত ধরে উনাকে সিঁড়ি বেয়ে নামিয়ে আনছিলাম তখন যেনো উনি উনার মধ্যে ছিলেনই না। উনি যেনো কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। এক নজরে তাকিয়ে ছিলেন আমার হাত ধরার দিকে। আমারো মনে হচ্ছিলো আমি উনার হাত ধরে নামালেও উনি যেন নিজ ইচ্ছায় নিচে নামছিলেন। যেন উনি আমার সাথে এভাবেই অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিতে চাইছিলেন। (একটু থেমে) উনাকে ঘরে নিয়ে আসি। আমার বই গুলো দেখাই। উনি বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখেন। তারপর উনাকে আমার ড্রয়িং খাতাটা দেখাই। সব ছবির ভিড়ে আমার উদ্দেশ্য ছিলো আসল ছবিটাকে তাকে দেখানোর। যদি তিনি ছবিটা চিনতে পারেন তবে আমি একদম নিশ্চিত হতাম তিনি আমাকে ভালোবাসেন। তাই আমি সেই ছবিটা বের করে দিয়ে নিজে থেকেই সরে যাই। গিয়ে বুকশেলফের এদিকটায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি উনার মুখভঙ্গি। আর কিছুক্ষণ পর যখন উনি উনার হাত ঘড়ি টা উঠিয়ে মিলিয়ে দেখছিলেন তখনই আমি একদম শিওর হয়ে যাই তিনি ছবির মানে টা ধরতে পেরেছেন। এবং তিনিও আমাকে ভালোবাসেন। আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের বইটা হাতে নিয়ে তার কাছে যাই। বইটায় দুটো চরিত্র ছিলো অপরূপা আর শেহওরান নামে। আমি অপরুপা আর শেহওরান চরিত্রে উনাকে আর আমাকে উপলব্ধি করতাম। বইতে একটা রোমান্টিক ডায়লগ ছিলো। যেটায় অপরুপা বলেছিলো “ভালোবাসি তোমায় শেহওরান। অনেক অনেক ভালোবাসি”। আমি উনাকে পুরো ডায়লগটা আর সাথে ভালোবাসি শেহওরান বলি।

– তারমানে তুই ইনডাইরেক্টলি ওকে প্রপোজ করে ফেলছিলি ,,!

– হ্যা। আমি নিজেই নিজের ভালোবাসা জানাতে চেয়েছিলাম। তবে বুঝোই তো। মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না। তাই আমার প্রিয় বইটার আশ্রয় নেই। গল্প পড়ে শোনাবার নাম করে উনাকে ডায়লগের মতো করে প্রপোজ করি।

– ও তারপর কিছু বলেনি,,!

– হয়তো বুঝতে পারেনি বিষয়টা। তবে পড়ে যখন উনি বললেন কাল চলে যাবেন তখন আমার মন খারাপ হয়েছিলো। আমার মন খারাপ দেখে উনি বলেন আমার খোঁপায় ফুল পড়িয়ে দিতে উনি আসবেন। কোন এক শেষ বিকেলে আমাদের সম্পর্ক রঙিন হবে। হাতে হাত মিলিয়ে চলবো আমরা দুজন। আমিও ঘোরে চলে গিয়ে এরপর কিছু কথা বলে ফেলি‌। এই কথা গুলোই হয়তো তিনি বুঝতে পারেন। (উৎসুক হয়ে) তারপর জানো ভাবি, উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকেন। আমিও আমার ভয়টাকে মনগহীনে লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। উনি আমার হাত ধরেন। হাত উঁচিয়ে ধরে বলতেই যাচ্ছিলেন আমি তোমাকে ভালোবাসি তখনই তাকে তার বোন ফোন করে। (গোমড়া মুখে) তিনি আর পুরোটা বলতে পারেন নি। একদম তীরে এসে, আমাদের তরী ডুবে।

– সত্যি,,! ও তোর হাত ধরছিলো,,!

– হ্যা ভাবি। আমার বুকে তোলপাড় উঠে গেছিলো সেই সময়। আমি ভেবেছিলাম উনি প্রপোজ করার সাথে সাথেই আমি উনাকে জড়িয়ে ধরবো। কিন্তু, (মাথা নিচু করে) কিন্তু কিছুই হলোনা ,,!

– আচ্ছা চিন্তা করিস না। ও তো বলছে যে ও আবার আসবে। তখন ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরিস। জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলবি। শেহওরান,, আমি তোমাকে ভালোবাসি,,,,!

– আস্তে বলো ভাবি,,! মা জেগে যাবে ,,!

– ওপসস,,! তোর রোমান্টিক কাহিনী শুনতে শুনতে আমিও রোমান্টিক মুডে চলে গেছিলাম, হি হি হি।

– ভাইয়া বাসায় আসুক, তারপর রোমান্টিক মুডে যাইয়ো।

– তোর ভাইয়ার সামনে,,,! না না। আমার ভয় লাগে। ও এমনিতেই খুব বেশি রোমান্টিক।

– হ্যা জানি তো ,,! তোমার কী আর ঠান্ডা এমনি এমনিই লাগছিলো ,,! (বলেই জিহ্বা কামড়ে চুপ হয়ে যায় আলিশা)

– আলিশা ,,! পেকে গেছিস কিন্তু তুই খুব,,,!

– আচ্ছা আচ্ছা ভাবি আর বলবোনা। (একটু থেমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) দুপুর হয়ে গেছে। ভাইয়াদের চলে আসার কথা।

– হ্যা। আমিও যাই। ঘরের বিছানা গুছাইতে হবে। সবাই মিলে যেই আড্ডা দিচ্ছিলাম,,! ঘর-দোরের অবস্থা খারাপ। (বলেই নিপা উঠতে যাবে তখনই তার চোখ পড়ে সুরাইয়া বেগমের উপর। নিপা বলে,

– উনিই তোর মা,,!

– হমম (ধীর গলায়)

– উনার চোখে কী হয়েছে ,,! কোন অপারেশন ,,!

– তেমন কিছুনা ভাবি। এমনিই আরকি। তুমি যাও। (ধীর কর্কষ গলায়)

– আলিশা, কী হইলো হঠাৎ তোর ,,! একটু আগেই তো বেশ আনন্দের সহীত কথা বলছিলি ,,! এখন হঠাৎ ,,!

– মায়ের চোখ তুলে ফেলছে ঐ নজরুল নামের পিশাচ টা। (দাঁতে দাঁত চেপে)

নিপা যেন আকাশ থেকে পড়ে। অবাক কন্ঠে হন্তদন্ত হয়ে বলে,

– চোখ তুলে ফেলছে মানে কী ,,!

– হাত দিয়ে মায়ের জ্ঞান থাকা অবস্থায় চোখ তুলে ফেলেছে ঐ শয়তান টা।

– এই, ! তুই মজা করতেছিস ,,! কেউ কীভাবে কারো চোখ তুলে নিতে পারে ,,!

– কেউ না নিতে পারলেও ঐ নজরুল কু** বাচ্চাটা নিছে।

– আলিশা ,,,! মুখের ভাষা ঠিক কর। নাইলে কিন্তু আমার হাতে মার খাবি।

– হ্যা,(কাঁদতে কাঁদতে) এখন তুমিও বলো যে আমি খারাপ। তুমি এই বাড়ির কিছু জানোনা। কে কেমন মস্তিষ্কের এগুলা কিছুই বুঝবানা। ভাইয়া কী এমনি এমনিই তোমায় নিচে আসতে নিষেধ করছে ,,!

– আরে আরে কাঁদছিস কেনো। আমি তোর ভালোর জন্যই বললাম। মুখের ভাষা এভাবে খারাপ করা ঠিক না। (চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে আলিশার পাশে বসে) কাঁদিস না। তুই হয়তো শশুর আব্বাকে ভুল বুঝতেছিস।

– কোন ভুল না ভাবি। তুমি আর কিছুদিন থাকো। সব দেখতে পাবে। মায়ের স্মৃতি শক্তি হারানোর পিছনেও নিশ্চিত ও পিশাচটার হাত আছে। ও আমার মা’কে মেরে ফেলতে চায়।

– আচ্ছা আচ্ছা সব ঠিক আছে। আমি তোর কথা মেনে নিলাম। এবার তো কান্না থামা। ছোট বাচ্চার মতো কাঁদলে কী হবে ,,! কাদিস না আর।

– ভাবি, ভাবি আমি একটু একা থাকতে চাই। তুমি প্লিজ আমাকে একা ছেড়ে দাও।(চোখের পানি মুছতে থাকে আলিশা)

– আচ্ছা তুই কান্না থামা। আমি চলে যাচ্ছি। ভুল হয়েছে মা আমার। কান্না থামা।

আলিশা চোখ মুছতে থাকে। নিপা বুঝে উঠে না আলিশার হঠাৎ কি হলো। কীসব চোখ উঠায় নেওয়ার কথা বলতেছে আবার কাদতেছে। কী যে হইলো হঠাৎ করে ,,!

নিপা উঠে দাঁড়ায়। আলিশার দিকে একবার তাকিয়ে চলে যেতে থাকে। আলিশা গিয়ে তার মায়ের মাথার পাশে বসে। নিপা যেতে যেতে আড়চোখে একবার সুরাইয়া বেগমের ঘুমন্ত দেহটাকে দেখে আরেকবার মুখ ঘুরিয়ে ঘরের আলমারিটাকে দেখে। এক পলক দেখেই চলে যায় ঘরের বাইরে।

আলিশা তার মায়ের ঘুমন্ত দেহের পাশে বসে ফোপাতে থাকে। চোখের পানি মুছতে থাকে। তার মায়ের শরীরে কাঁথা ঠিকমতো উঠিয়ে দেয়।

 

 

 

পরন্ত বিকেল। আছরের আযান দিয়েছে হলো অনেকক্ষণ। কৃষকেরা মাঠ থেকে আলি পথ ধরে বাড়ি ফিরছে। কাঁধে লাঙ্গল।আকাশ কিছুটা মেঘলা। চারপাশে দিনের আলো খুব যে আছে তা নয়। মৃদু বাতাস বইছে মাঝে মাঝে। শীতের মাঝেও যেন বর্ষাকালের আবহ।

 

দিথী, ইকরা আর আফাজ কাঁচা রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছে। তারা নিপাদের বাড়ি থেকে দিথীর সাথে তার বাবা বাড়িতে গিয়েছিলো। দিথীর বাবা আজ একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে গেছিলেন। দিথীরা যতক্ষনে গিয়ে পৌঁছায় ততক্ষণে ডাক্তার, দিথীর বাবাকে চেকাপ করছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ চেকাপ করার পর দিথীর পরিবারকে নির্ভয় দেন। তেমন সিরিয়াস কিছুই হয়নি। গুলি লাগার ফলে বৃদ্ধ শরীরের গুপ্ত রোগ গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর সেটারই প্রতিফলনে দিথীর বাবা অচেতন হয়ে গিয়েছিলো। দিথীরা থাকতে চেয়েছিলো। দিথীর মা আর তানিয়ারা তাকে নির্ভয় দিয়ে মেম্বার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মেয়েটার নতুন বিয়ে হয়েছে। এখানে বাবার পাশে থাকলে সে আরো ভেঙে পড়বে। তাই সেখান থেকে ভালো সে শাহারিয়ার কাছে থাক। নিজেকে শক্ত করুক।

 

দিথী চুপচাপ হাঁটছে। আফাজের মন বেশ ভালো। সে চারপাশে দেখছে আর দিথীর পাশ ধরে হাঁটছে। ইকরা বারবার আফাজের হাতে থাকা বই আর ড্রয়িং বুক টাকে দেখছে আর হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছে যে এগুলা আফাজ পেলো কোথা থেকে। কিন্তু সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। তাদের তিনজনের মধ্যে পিনপন নিরবতা। সামনেই কিছুটা দূরে পাকা মেম্বার বাড়ি দেখা যাচ্ছে। একটা সাইকেল চলে গেলো তাদের তিনজনের পাশ দিয়ে। আলিশা একটু উৎসুক হয়ে বলে উঠে।

– আফাজ। তুই ঐগুলা কোথায় পেলিরে ,,!

– কোন গুলা ?

– ঐযে হাতের ঐ গুলা। বই আর কী কী যেনো ,,! কে দিলো তোকে এইসব ?

– এই গুলা ? এই গুলা আমাকে আলিশা দিছে।

– আলিশা ? কে ও ?

– ঐ যে নিপাদের বাড়িতে যে ওর ছোট ননদ টা আছে না। ঐটা।

– ওহহ। (একটু থেমে) এমনি এমনিই দিছে না কেড়ে নিছিস ?

– আমি কেড়ে নিতে যাবো কেনো ? এমনিই দিছে।

– ওগুলা কী সব তোকে দিছে না ঐখান থেকে আমাকে আর দিথী ভাবিকেও কিছু দিতে বলছে ?

– এগুলা শুধু আমাকে গিফট দিছে ও।

– গিফট ? কোন হিসাবে ও তোকে এগুলো গিফট দিলো ?

– পরে বলবো তোকে। এখন বাসায় চল।

– না না। তুই এখনি বল। নিপার ননদ কেনো তোকেই শুধু গিফট দিলো ? আমাকে আর দিথী ভাবিকে কেনো না ?

– কারণ আমি ,,,,,,

কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় আফাজ। ইকরা বলে,

– হ্যা বল। তুই কী ?

– কিছুনা। বাসায় পড়ে একদিন তোকে বলবোনে। এখন সামনে তাকা। একবার সাইকেলের সাথে ধাক্কা খাইতে খাইতে বাঁচে গেছিলি মনে আছে ?

– কোনসময় ?

– ঐযে একটা পুলিশকে হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে যে বাড়ির দিকে আসতেছিলি। ভাগ্যেস পুলিশ টা তোকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে সাবধান করে দিছিলো। এখন তো একটু রাস্তা ঘাট দেখে শুনে চল। (একটু থেমে) সামনে তাকা। কথা বলিস না।

দিথী তাদের দুইজনের কথা চুপচাপ শুনছে। সে মনমরা হয়ে আছে। ছোট থেকেই যেই বাবার আদর স্নেহে সে বড় হয়েছে সেই বাবার শরীর আজ এতোটাই খারাপ যে অর্ধেক শরীর প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। দিথী মন খারাপ করে বারবার তার বাবার কথা ভাবছে।

 

তারা বাড়ির সামনের আঙিনাটায় চলে আসে। দিথী আর আফাজ বাড়ির গেইটের দিকে যায় কিন্তু আলিশা সেদিকে যায় না। সে যায় জলপাই গাছটার পাশে থাকা বসার যায়গাটার দিকে। আফাজের ঐ কথাটা বলার পর থেকে বারবার খালি মাথায় ঐ রিয়াদের বিষয় টাই ঘুরছে।

আলিশাকে বসার যায়গাটার দিকে যেতে দেখে আফাজ বলে উঠে,

– কীরে তুই ঐদিক কই যাইতেছিস ?

– আমি এখানে একটু বসবো। তোমরা ভিতরে যাও।

– ভাত খাবিনা ? খিদা লাগেনাই ?

– না। তুই আর ভাবি ভাত খায় নে যা।

আফাজ আর কথা বাড়ায় না। দিথীর পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আর আলিশা বাইরের বসায় যায়গাটায় বসে পা দুলাতে থাকে।

 

আঙিনা ঝাড়ু দিচ্ছিলো ফুলমতি। আফাজ আর দিথীকে আসতে দেখে সে হেলা হতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দিথী আর আফাজ তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে বলে উঠে,

– ভাবি। চাচার অবস্থা এহন কেমন ,,?

– আছে কোনরকম। তবে বেশি একটা ভালো না। (একটু থেমে) মা কই ?

– চাচি আপনাগো লাইগা খাওন লইয়া অপেক্ষা করতে করতে একটু আগেই উইঠা ঘরে ঘুমাইতে গেলো। জানেনই তো চাচি বিকালে ঘুমায়। তয় আমারে কইছিলো আপনেরা আইলে তারে ডাক দিতে আর তরকারি গুলা গরম করতে। খারান আমি চাচিরে ডাক দিতে যাইতাছি।

– না থাক। মা ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আমার খিদা নাই। আফাজকে ভাত দিয়ে দে। ও খেয়ে নিক।

– আপনে খাইবেন না ! চাচি যে পড়ে আমারে বকবো।

– কিছু হবেনা। মাকে আমি বলে দিবো। তুই আফাজকে ভাত দে।

– আইচ্ছা, ঠিক আছে।

দিথী চলে যায় ফুলমতির সামনে থেকে। তার পিছুপিছু হেঁটে হেঁটে আফাজও যেতে থাকে। তখনই ফুলমতি আফাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– ভাইজান, আপনে বেসিন থেইকা হাত মুখ ধুইয়া টেবিলে গিয়া বহেন। আমি তরকারি গরম কইরা আনতাছি।

আফাজ মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দিয়ে বলে,

– আচ্ছা।

আফাজ চলে যেতে থাকে আঙিনা থেকে বারান্দার দিকে। দিথী বারান্দা দিয়ে উঠে সোজা শিউলি বেগমের রুমে চলে যায়। ও তো এখন শিউলি বেগমের সঙ্গেই থাকে। তাই সেই রুমেই গেলো।দিথীর বাড়িতে ওদের ভাত খাইতে বলেছিলো। দিথীও বলেছিলো আফাজ আর ইকরাকে ভাত খেয়ে নিতে। কিন্তু ওরা রাজী হয়নি। এমনিতেই রুগির বাড়ি। তার মধ্যে রুগির অবস্থাও বেশি ভালো না। তাই তারা আরো বেশি ঝামেলা বাড়াতে চায়নি। তবে তারা আতিথেয়তা পেয়েছে। নাস্তা, ফল খাইয়ে তবেই তাদের আসতে দেওয়া হয়েছে।

 

দিথীকে শিউলি বেগমের রুমে ঢুকতে দেখে বারান্দায় গামছা দিয়ে মুখ মুছতে থাকা শাহারিয়া। সে বেসিনের এদিক টায় ছিলো। শাহারিয়ার কাছে দিথী যেন প্রাণহীন দেহের মতো লাগছিলো। কেমন ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে সে হেঁটে ঘরে গেলো। দিথী ঘরে ঢুকার পর বারান্দায় উঠে আফাজ। আফাজ দেখতে পায় শাহারিয়াকে। শাহারিয়া আফাজকে ইশারায় বলে “দিথীর কী হয়েছে ?”

আফাজও ইশারায় উত্তর দেয়‌, ” ও বাড়িতে যে তার বাবা অসুস্থ এজন্য।”

শাহারিয়া বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলো। দিথীরা ওবাড়ি থেকে নিজের বাড়ি যাওয়ায় সেখান থেকে তানিয়া শিউলি বেগমকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো যে দিথী তার বাবার অসুস্থতার কারণে এ বাড়িতে আসছে।

 

আফাজ চলে আসতে থাকে বেসিনের এদিকে। শাহারিয়াও এগিয়ে যায়। পাশপাশি আসতেই শাহারিয়া তাকে গামছাটা দিয়ে দেয়। বলে,

– দিথী ভাত খাইছে ?

– না। আমাদের খেতে বলছিলো। আমরা ভাত খাইনি তবে নাস্তা খাইছিলাম। কিন্তু ভাবি নাস্তাও খায়নি।

– আচ্ছা তুই হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বস আমি ফুলমতিকে বলছি খাবার বাড়তে।

– ফুলমতিকে ভাবি বলছে আঙিনায়।

– ওহ,, আচ্ছা তাইলে তুই হাত মুখ ধুয়ে খাইতে বস। আমি দেখি দিথীর মন ভালো করা যায় কী না ,,!

– আচ্ছা ভাইয়া।

আফাজ শাহারিয়ার হাত থেকে গামছাটা নিয়ে চলে যেতে থাকে দিথী যেই রুমে ঢুকেছে অর্থাৎ শিউলি বেগমের রুমে।

শাহারিয়া রুমের সামনে এসে পর্দা সড়িয়ে উঁকি দেয়। প্রথমে নজর দেয় বিছানার দিকে। দেখে শিউলি বেগম দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে ঘুমুচ্ছেন। চারপাশে নজর ঘুড়িয়ে দেখতে থাকে শাহারিয়া। তখনই দেখে ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে দিথী। আয়নাটা সোজা দরজা বরাবর। শাহারিয়া ঘরে প্রবেশ করে। দিথী শাহারিয়ার বিপরীত দিকে মাথা নিচু কথে মুখ করে থাকায় শাহারিয়া যে ঘরে ঢুকেছে তা টের পায়নি। শাহারিয়া ঘরে ঢুকেই আস্তে করে দরজাটা ভিড়িয়ে দেয়। দিয়ে ধীর পায়ে পায়ে দিথীর দিকে এগিয়ে যায়। যাওয়ার সময় শিউলি বেগমের দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখে যে তিনি আবার উঠে গেলেন নাকি। কিন্তু না। তিনি ঘুমাচ্ছেন।

শাহারিয়া গিয়ে দিথীর পিছনে দাঁড়ায়। তখনই সে বুঝতে পারে দিথী ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। খুবই নিঃশব্দে কান্না। তাই শাহারিয়া দরজা ওখানে দাঁড়িয়েও বুঝতে পারেনি।

শাহারিয়া দিথীর পাশে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে দিথীর কাঁধে হাত দেয়। দিথী কিছুটা চমকে উঠেই তার দিকে ফিরে তাকায়। শাহারিয়া কে দেখে বলে,

– তুমি,,!

– ইশশ,,, আস্তে কথা বলো। মা উঠে যাবে। (ফিসফিসিয়ে বলে শাহারিয়া দিথীর কাঁধ আরো শক্ত করে ধরে ধীর গলায় বলে,

– কাঁদছো কেনো,,! বাবার কথা মনে পড়ছে,,!

দিথী হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। শাহারিয়া দিথীর মুখের উপরের চুল গুলো কানের পাশে রেখে বলে,

– কান্না করিও না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

– ডাক্তার বলেছে বাবার গায়ে যেই গুলিটা লেগেছিলো, ওটায় বিষ ছিলো। শরীরে অনেক যায়গায় এজন্য এফেক্ট করছে। আর, আর বুকের ব্যাথাটাও বলে বেড়েছে বাবার। প্রেশার হাই। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা।

– কিচ্ছু হবেনা। (একটু থেমে) এভাবে কাদিও না। লোকজন দেখলে বলবে ছোট বাচ্চার মতো কাদতেছে।

দিথী ছলছল চোখ নিয়ে শাহারিয়ার দিকে তাকায়। বলে,

– বাবার কিছু হয়ে যাবেনা তো,,!

– না না। আঙ্কেলের কিচ্ছু হবেনা‌। (একটু থেমে) ডাক্তার কী বলছে?

– উনি তো বলেছেন শরীরে যাওয়া বিষের জন্য বারবার ঔষধ গুলোর পার্স্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এইজন্য বাবা আজ কথা বলতে পারেননি অনেকক্ষণ। অচেতন হয়ে ছিলেন।

– আচ্ছা তুমি এখন কান্না করিও না। তোমাকে কান্না করতে দেখলে একদম মানায় না। বউটা আমার সবসময় কতো হট মুডে থাকে। আর এখন কান্না করতেছে।

– সবসময় কী মানুষ এক মুডে থাকে নাকি। (চোখের পানি মুছতে থাকে দিথী)

– না থাকলে মুড আনতে হয়। কিন্তু এভাবে কান্না করতে দেখলে আসলেই তোমাকে ছোট বাচ্চা লাগে। এই ছোট বাচ্চাটা কয়েকদিন পর যখন মা হবে তখন তার বাবু গুলাকে কীভাবে সামলাবে হ্যা ,,!

– তখন কার টা তখন দেখা যাবে।

– আচ্ছা চোখের পানি মুছো। আমাকে গালে একটা পাপ্পি দাও।

– আমার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। পরে দেই ,,!

– না আমার এখনি লাগবে। এখনি দাও।

– মা আছে।

শাহারিয়া পিছনে বিছানার দিকে তাকায়। আবার দিথীর দিকে ফিরে বলে,

– মা ঘুমাচ্ছে। একটা দাও। তুমি একটা গালে দিলে আমি তোমাকে একটা কপালে দিবো।

– সত্যি দিবাতো ,,!

– হ্যা দিবো। তবে তুমি যদি এখন ভাত খাও তাইলে দিবো। আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো। দুপুরে কিছু খাওনি, এখন বিকেল। শরীর খারাপ করবে তখন।

– আমার ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি ভাত খাবো না।

– না না। এভাবে বললে তো হবেনা। ভাত না খেলে আমিও তোমাকে চুমু দিবো না।

– ভাত না খেয়ে অন্য কিছু খাই ,,! আমার না এখন একদমই ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না।

– আচ্ছা তাইলে ফ্রিজে পায়েশ থাকতে পারে। ওটা খাও।

– পায়েশ ,,! আচ্ছা।

– এখন একটা গালে দেও ,,!

– উঁহু,,! খাওয়ার পর।

– দিলে কী হয় ,,!

দিথী শাহারিয়ার পাশ হতে ফিরে সামনাসামনি দাঁড়ায়। তার কাঁধে দুই হাত দিয়ে বলে,

– এখন না দিলে কী করবা।

– না দিলে তোমাকে ,,, তোমাকে অন্য মুডে নিয়ে যাবো।

– কোন মুডে ,,!

– কাল রাতে যেই মুডে ছিলা ,,! আমার মুখের উপর থেকে তো সবটুকু দুধ খেয়ে নিছিলা কাল।

– কাল খেয়েছি। আজ খাওয়াবো।

– মানে ,,!

– আজ রাতে তুমি আমার ঠোঁটের উপরের সর খাবে। (শার্টের কলার ধরে কাছে নিয়ে) কী,,! পারবেনা,,!

– না মানে,,! আমার শরম করতেছে এখনি। ত,তখন কীভাবে পারবো ,,,!

– তুমি ছেলে হয়েও শরম পাও ,,! এদিকে আমি মেয়ে হয়ে দিব্যি সবটুকু আদায় করে নিতে পারি। এতো শরমের কী আছে হ্যা ,,!

– তারপরও। মাঝে মাঝে তোমার ঐরকম চাহনী দেখলে বুকের ভেতরটা খালি কাঁপাকাপি করে।

– তোমার বুকের ভেতর কেমন কাঁপাকাপি করে, তা শ্রীমঙ্গলে গিয়ে ছুটাবো।

– নির্যাতন করবে আমার উপর ,,!

– কঠিন থেকে কঠিনতর।

– এখন একখানা মিষ্টি কিছু দিয়ে আমার গাল টা লাল করে দাও ,,!

– তোরা দুইডা এইহান থে না গেলে আমি উইডা তোগো দুইডার গাল থাপরাইয়া লাল করুম ,,!

হঠাৎ শিউলি বেগমের কথা শুনে দিথী আর শাহারিয়া দুজন দুজনকে ছেড়ে দেয়। দুইজনেই শিউলি বেগমের দিকে তাকায়। দেখে শিউলি বেগম যেভাবে শুয়ে ছিলেন এখনো সেভাবেই আছেন। শাহারিয়া আর দিথী কী ভুল কিছু শুনলো ,,! শাহারিয়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে দিথীর দিকে ঠোঁট উল্টিয়ে ইশারা করলো। যেন দুজনেরই কিছু বুজে আসেনা। তখনই আবার শিউলি বেগমের কন্ঠ ভেসে আসে,

– তোরা দুইডা এহান থে যাবি না আমি উঠমু ,,! কাঁচা ঘুমডা থেইকা উডাইস না কইলাম ,,!

দিথী আর শাহারিয়া বুঝে যায় যে শিউলি বেগম জেগে আছেন। সাথে সাথেই শাহারিয়া দিথীর হাত ধরে টেনে তাকে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।

ঘরে আর কোন শব্দ শুনতে না পেয়ে শিউলি বেগম দেয়ালের দিক থেকে ফিরে তাকান। দেখেন ঘর ফাঁকা। তারমানে দুই পাখি ফুরুত করে পালাইছে। শিউলি বেগম আবার যেপাশে শুয়ে ছিলেন ওপাশে ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকেন। বিরবির করে বলেন,

– এই দুইডা যহনই একলগে হয় খালি পরিবেশ গরম কইরা দেয়। কত সুন্দর ঘুমডা ধরছিলো। এই দুইডার লাইগ্গা ঘুমডা ভাইঙ্গা গেলো ,,!

বলেই চুপচাপ পাশে থাকা একটা কোলবালিশ টেনে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যেতে থাকেন শিউলি বেগম।

 

বাইরে এখনো বসে আছে ইকরা। পড়নের লাল শাড়িখানা এখনো গায়ে আছে। সে পা দোলাতে দোলাতে সেই বিকেলের কথা ভাবছিলো। সেইদিন এই গাছের জলপাই পাড়তে গিয়ে সেই মানুষটার উপর জুতা পড়ে যায়। হয়তো পরে ইকরার ব্যবহারে তেমন কিছু মনে করেনি রিয়াদ। সেদিনের বিকেল টা যেন এক শুভ্রতার ছোঁয়া হয়ে তাকে ছুঁয়ে দিয়েছিলো। আজও ইকরা সেই রাস্তায় তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে দু একটা সাইকেল চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামবে একটু পরই। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরছে। মেঘলা আকাশ হওয়ার সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারছেনা ইকরা। তখনই সে দেখে একটা বাইক আসছে সেই রাস্তা দিয়ে। ইকরা সেটাকে নিছক মনের ভ্রম ভেবে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু বাইকটা কাছাকাছি আসতেই তার হ্রদপিন্ডের ধুকপুকানি বেরে যায়। এটা তো রিয়াদ। ইকরা তার চোখ দুই হাত দিয়ে ঘষে আবার তাকায়। দেখে সত্যিই এটা রিয়াদ। এটা কোন ভ্রম নয়। রিয়াদ বাইক নিয়ে মেম্বার বাড়ির আঙিনায় ঢুকে। ইকরার বুকের স্পন্দন আরো বেড়ে যায়। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আযান। চারপাশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। রিয়াদ বাইকটা মেম্বার বাড়ির আঙিনায় দাঁড় কড়িয়ে বাইক থেকে নামে। দেহে এখনো পুলিশের পোশাক। ইকরা আগে পুলিশকে ভয় পেতো। কিন্তু এই পুলিশ তার মনের ভয় তো দূর আরো উল্টো সুখের হৃদস্পন্দন হিসেবে ধরা দিয়েছে। রিয়াদ বাইক থেকে নেমে চারপাশ তাকাতে থাকে। ইকরা একদম মুর্তির মতো থমকে গেছে। সে এক ফোঁটাও নিজেকে নাড়াতে পারছেনা। তখনই সে দেখে রিয়াদ তার দিকে এগিয়ে আসছে। ইকরা ঢোক গিলে। বুকের ভিতর ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজেই চলেছে। যেন এই বুঝি হ্রদপিন্ডটা লাফাতে লাফাতে তার দেহ থেকে বের হয়ে আসবে।

রিয়াদ এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ইকরা তার দিকে এক পলকে চেয়ে আছে। রিয়াদ তার চোখের সামনে হাত নাড়ে। কিন্তু না ইকরা যেনো কোন ঘোরে চলে গিয়েছে। রিয়াদ শব্দ করে বলে উঠে,

– এইযে ,,! শুনছো ,,! এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো ,,!

রিয়াদের কথা শুনেই যেন ইকরা তার ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসে। বলে,

– ক,কই নাতো।

 

 

 

চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। চারপাশে সুউঁচু গাছ আর গাছ। দেখে মনে হচ্ছে এক ঘন বনাঞ্চল। দূর থেকে মাগরিবের আযানের শেষ কিছু বানী ভেসে আসছে। চারপাশ এতোটাই ঘন যে মনে হচ্ছে এখানে সন্ধ্যা না। রাত নেমেছে। উপরে গাছের পাতার ঘনত্ব এতোটাই যে যেখানে দিনের কড়া রোদ থাকলেও আলো মাটিতে এসে পড়তো না, সেখানে এই সন্ধ্যে যেন রাত হয়ে নেমেছে।

একটা মেয়ে প্রাণপনে ছুটছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। বারবার দৌড়াতে দৌড়াতে পিছনে ফিরে দেখছে আর দৌড়াছে। মেয়েটাকে ধাওয়া করছে একটা ছেলে। সেও তড়িৎ গতিতে দৌড়ে মেয়েটাকে ধরার চেষ্টা করছে। চারপাশের অন্ধকারে সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে। মেয়েটা তাও দিকবিদিক না দেখেই দৌড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে বলছে,

– বাঁচাও,,,,,! কেউ আছো ,,,,,,! প্লিজ আমাকে ওর হাত থেকে বাঁচাও,,, হেল্প মি,,,,,,,! হেল্প,,,,,,!

মেয়েটা চিৎকার করতে করতে বাতাসের বেগে ছুটছে।‌ ছেলেটা পিছন থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে  চিৎকার করে মেয়েটাকে বলছে,

– ঐ দাড়া,,,! নাইলে কিন্তু ধরা পাইলে তোকে যানে মেরে ফেলবো ,,,,,! দাঁড়া বলতেছি ,,,!

মেয়েটা দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ এক গাছের সাথে বেকায়দায় ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে মাটিতে থাকা খরকুটোর উপর। ছেলেটা দৌড়ে এসে মেয়েটার সামনে থামে। হেলে হাঁটুতে হাত দিয়ে হাঁপাতে থাকে।

মেয়েটা ছেলেটাকে দেখে খুব ভয় পায়। হাত দিয়ে টেনে টেনে নিজের দেহটাকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। হয়তো গাছের সাথে ধাক্কা খাওয়ার কারণেই হয়েছে। ছেলেটা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মেয়েটা হাত দিয়ে টেনে টেনে নিজেকে পিছিয়ে নিতে নিতে বলে,

– প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দাও,,,! আমাকে ছেড়ে দাও ,,! আমি তোমার সব কথা শুনবো,,,!

– রাখ তোর কথা ,,! এতোক্ষণ ধরে আমারে দৌড়াইতে লাগলো ক্যান,,! আগেই বলছিলাম না। চুপচাপ আমার কথা শুন ,,,,! এখন যেমন শুনিস নাই এখানেই তোর বাসর হবে।

– প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও। আমার ভুল হয়ে গেছে‌। আমি বাড়ি যাবো ,,!

– যাবি। অবশ্যই যাবি। কিন্তু এই রাফসানের খায়েশ মিটানোর পর ছাড়া পাবি। খুব তেজ দেখাইছিলি না ,,,! এখন তেজ কই গেলো ,,! এখন চটাং চটাং কথা বল ,,! কীরে বলনা ,,! তোর সাথে আজকে আমার এখানেই বাসর হবে। এই সুন্দর প্রকৃতির লতাপাতার মাঝে ,,,! হা হা হা হা,,!

– প্লিজ রাফসান,,! আমার দিকে এগিও না। আমি কিন্তু নিজেকে শেষ করে ফেলবো‌। আমার দিকে আর এগিও না।

– তোরে ব্যবহার করার পর আমি নিজেই তোকে উপরে পাঠাবো। চিন্তা নট বেবি ,,,!

বলেই রাফসান তার শার্টের বোতাম খুলতে থাকে। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে চারপাশে ফিরে বলতে থাকে,

– প্লিজ হেল্প ,,,,,,! কেউ আমাকে বাচাও ,,,! আমি কারো ভোগের পাত্র হতে চাই না ,,,! কেউ আছো ,,,,,! আমাকে বাচাও ,,,!

– তোর চিৎকার শুধু এই আমার কান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

বলেই রাফসান শার্ট খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটার উপর। মেয়েটা তাকে বাঁধা দিতে থাকে। কিন্তু বিশাল দেহি রাফসানের কাছে সে মাত্রই নগন্য। রাফসান মেয়েটার শরীরের কাপড় টেনে ছিঁড়তে থাকে। মেয়েটা বারবার চিৎকার করে সাহায্যের আকুতি করতে থাকে। রাফসান মেয়েটার পুরো শরীরের কাপড় খুলে ফেলে। তাকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে তার কিছুটা পাশে থাকা নরম গাছের পাতার স্তুপের দিকে ছুঁড়ে ফেলে। মেয়েটা দুই হাত দিয়ে নিজের বুক জড়িয়ে ধরে রাফসানের কাছে আকুতি মিনতি করতে থাকে। রাফসান নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলে মেয়েটার উলঙ্গ দেহটার উপর দুই-তিনটা জোরে কোপ মারে। মেয়েটা ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। রাফসান বেল্ট পাশে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটার উপর। ঝাপিয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর পরই মেয়েটা এক গগন বিদারি চিৎকার দিয়ে উঠে। গাছে গাছে থাকা পাখি গুলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যেতে থাকে সেই চিৎকারের তীব্রতায়। যন্ত্রনাদায়ক কান্নার আওয়াজে জঙ্গলের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৫৬ (১ম ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

(বোনাস পর্ব 🟢)

 

রাফসান মেয়েটার পুরো শরীরের কাপড় খুলে ফেলে। তাকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে তার কিছুটা পাশে থাকা নরম গাছের পাতার স্তুপের দিকে ছুঁড়ে ফেলে। মেয়েটা দুই হাত দিয়ে নিজের বুক জড়িয়ে ধরে রাফসানের কাছে আকুতি মিনতি করতে থাকে। রাফসান নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলে মেয়েটার উলঙ্গ দেহটার উপর দুই-তিনটা জোরে কোপ মারে। মেয়েটা ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। রাফসান বেল্ট পাশে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটার উপর। ঝাপিয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর পরই মেয়েটা এক গগন বিদারি চিৎকার দিয়ে উঠে। গাছে গাছে থাকা পাখি গুলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যেতে থাকে সেই চিৎকারের তীব্রতায়। যন্ত্রনাদায়ক কান্নার আওয়াজে জঙ্গলের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।

 

 

 

– এইযে ,,! শুনছো ,,! এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো ,,!

রিয়াদের কথা শুনেই যেন ইকরা তার ঘোর থেকে বেড়িয়ে আসে। বলে,

– ক,কই নাতো।

– আমি স্পষ্ট দেখলাম এতোক্ষণ একদম স্ট্যাচুর মতো বসে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে।

– না মানে ,,,!

ইকরা আর কিছু বলে না। সে সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেলে। রিয়াদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ইকরাকে আপাদমস্তক দেখে। একটু পর এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

– আজকে তোমাদের দাওয়াত আমাদের বাড়িতে।

রিয়াদের কথা শুনেই ইকরা চকিতে মাথা তুলে তাকায়। হনহন করে বলে,

– কেনো ,,? কীসের দাওয়াত,,!

– এমনিই আরকি। ভাইয়া বললো এসে তোমাদের বলতে। মেম্বার বাড়ি আর আমাদের কাজি বংশের সম্পর্কের গভীরতা অনেক ভালো। মাঝে মাঝেই একে অপরকে দাওয়াত দিয়ে আমাদের মাঝের সম্পর্ক টাকে আরো মজবুত করি। আর তোমারাও এসেছো অনেক দিন পর। কাল চলে যাবে। শাহারিয়াও এখন বাসায় আছে। কয়েকদিন পর ঔ বউ নিয়ে চলে যাবে। এইজন্য ভাইয়া বললো আজ রাতেই তোমাদের আপ্যায়ন করবে। (একটু থেমে নমনীয় গলায়) আফাজ কোথায় ,,!

– আপনি আফাজকে চিনেন ,,!

– হ্যা। ওকে, তোমাকে, তোমার বাবা-মা সবাইকে চিনি। সেই ছোট বেলায় কতো আসতা। আর যখন এই বাড়িতে আসতা তখন আমাদের বাসাতেও বেড়াইতে যাইতা। এখন হয়তো মনে পড়তেছেনা। সেই ছোট বেলার কথা, মনে না থাকাই স্বাভাবিক।

– ওহহ,, আফাজ ভিতরে আছে।

– ভিতরে,,? আচ্ছা তাইলে আমি ভিতরে গিয়ে কথা বলি। তুমি এখানেই থাকবা নাকি ,,! (চারপাশে তাকিয়ে) অন্ধকার হয়ে আসতেছে তো।

– এখনি বাড়ি যেতাম আরকি। (বলেই বসার যায়গাটা থেকে নেমে দাঁড়াও। রিয়াদও তাকে একবার দেখে চলে যেতে থাকে বাড়ির ভিতরের দিকে।

 

ফুলমতি আঙিনা আর রান্নাঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো। সুইচ গুলো বারান্দায়। সে সুইচ অন করে দিয়েই বারান্দা থেকে নেমে চলে যেতে থাকে রান্নাঘরের দিকে। বারান্দার ডায়নিং টেবিলে দিথী আর শাহারিয়া বসা। শাহারিয়ার হাতে পায়েসের বাটি। সে চামচে করে দিথীকে পায়েশ খাওয়াচ্ছে। আর দুজন গল্প করছে। রিয়াদ আঙিনায় চলে আসে। হেঁটে হেঁটে বারান্দার সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়েই সে বারান্দায় ডায়নিং টেবিলে বসা শাহারিয়া আর দিথীকে দেখতে পায়। শাহারিয়াকে দেখেই বলে,

– কী রে কী খবর ,,!

শাহারিয়া দিথীর সাথে কথা বলতে থাকায় আগে রিয়াদকে খেয়াল করেনি। রিয়াদের ডাকে সে বারান্দার দরজার দিকে ফিরে তাকায়। দেখে রিয়াদ আসছে। শাহারিয়া তাকানোর সাথে সাথেই দিথীও ফিরে তাকায়। শাহারিয়া বলে,

– আরে তুই ,,! আয় বস।

রিয়াদ তার পায়ের জুতো খুলতে থাকে। জুতো খুলে বারান্দায় উঠে আসে। রিয়াদের পিছু পিছু ইকরাও এসেছিলো। তবে ইকরা আঙিনাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।

 

রিয়াদ বারান্দায় উঠে। ডায়নিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে। শাহারিয়া বলে উঠে,

– তোর তো কোন খোঁজখবরই নাই। ঐযে বিয়ে বাড়ির পর পালাইলি তারপর আর দেখা নাই তোর।

– আরে আর বলিস না। বিয়ে বাড়িও শেষ হইছে আর সাথে সাথে আমার কেসও আসে হাজির। তাও আরো একটা না। দুইটা। না দুইটা কীসের তিনটা। দুইটা মার্ডার কেস আর একটা মিসিং রিপোর্ট।

– লাশ পাওয়া গেছে নাকি আরো ,,!

– হ্যা। দুইটা লাশ। লাশ দুইটাই মেয়ের। লাশ গুলা আবার আমরা ধরি নাই। ধরছে গাইবান্ধা জেলা পুলিশ।

– গাইবান্ধা জেলা পুলিশ,,,! কী বলতেছিস মাথায় ঢুকতেছেনা। লাশ যদি ওরা ধরে তো কেস তো ওদের হওয়ার কথা।

– এই গ্রাম থেকে মিনি ট্রাকে করে একটা লোক দুইটা লাশ নিয়ে ঢাকা পালাইতে গেছিলো বলে। মাঝখানে চেকপোস্টে ধরা খাইছে। তখন বলছে যে ও বলে আনন্দ পুর থেকে আসতেছে। তারপর আমার থানায় কেস ট্রান্সফার করে দিলো।

– কেমন লাশ ,,! নতুন কোন সিরিয়াল কিলিং,,?

– না। মজার কথা হইতেছে যে লাশ দুইটা, মানে যেই মেয়ে দুইটার লাশ উদ্ধার হইছে ঐ দুইজনের কেউই এই আনন্দপুর কিংবা হরিশপুরেরই না। বাহিরা লোক।

– এই দুই গ্রামের কেউ না ,,!

– না। কেউ না। লাশ দুইটাকে আরো এক ভাবে না। আলাদা আলাদা ভাবে মারছে। একটারে গুলি করছে। আরেকটা ছুরি দিয়ে কী যে বীভৎস করে মারছে ,,! কী আর বলবো তোকে।

– দুইটার মারার পদ্ধতি আলাদা ,,!

– হ। আবার যেইটারে গুলি করছে ঐটা ৭ মাসের গর্ভবতী ছিলো। একটা গুলি পেটের ভ্রুণের মাথা ছেদ করে বের হইছে আরেকটা বুকের হ্রদপিন্ড ছেদ করে।

কথা গুলা শুনে দিথী একটু আনকম্ফর্টেবল ফিল করতে থাকে। তার চেহারায় তা স্পষ্ট। সে মাথা নিচু করে ফেলে যাতে শাহারিয়া, কিংবা রিয়াদ কারো নজরে বিষয়টা না পরে।

 

– লাশ গুলা এখন কই ,,?

– আমি আজকে সকালেই ঐগুলাকে সদর হাসপাতালে পাঠায় দিছি। লাশের গন্ধে থানায় থাকা যাইতেছে না। লাশে আর কোন এভিডেন্সও নাই। বেকার রাখে থানা নোংরা করার কোন মানেই হয়না।

– অনেক দিন হইলো নাকি লাশ গুলা মরার ,?

– হ্যা রে। দুইটা মেয়ে আবার কোন সময় মারা গেছে জানিস ,,! নিপার যেদিন বিয়ে হইতেছিলো ঐদিন রাতে। আমার তো কিছু গরবর লাগতেছে। দুইটা মেয়েকে কী কেউ ঐ রাতে এই গ্রামে এনে মারলো না কী হইলো কিছুই বুঝতে পারতেছি না।

কথাটা শুনার সাথে সাথেই দিথীর কাশি উঠে যায়। শাহারিয়া পায়েশের বাটিটা টেবিলে রেখে দিথীর মুখে পানির গ্লাস তুলে দেয়। দিথী তার নজর নিচের দিকে রেখে পানি খেয়ে নিতে থাকে। রিয়াদ শাহারিয়া আর দিথীর এমন সুন্দর মিল দেখে বলে,

– ভালোই তো মহব্বত আছে তোদের দুইজনের ,,!

– তুই বিয়েটা কবে করবি ঐটা বল। তুই আমি সেইম ব্যাচ। আমি বিয়ে করে ফেল্লাম আর ঐদিকে তুই এখনো কোন মেয়ে পটাইতে পারলি না।

– আরে মেয়ে পটায় আর কী হবে। ভাইজান-ভাবি বলছে কোন লাভ ম্যারেজ না। হইলে এরেন্জ ম্যারেজ হবে নাইলে কুমার থাকতে হবে।

– কুমারই থাক তাইলে।

– হ্যা। আমি আর সালমান খান তো ভায়রা ভাই। দুইজনেই বিয়ে করবো না।

– করিস না।

শাহারিয়া দিথীর মুখ থেকে গ্লাস টা নামায়। ধীর গলায় তাকে বলে,

– ঠিক আছো তুমি ,,!

– হমম। (ধীর গলায়)

শাহারিয়া আবার রিয়াদের দিকে ফিরে বলে,

– আমি আজকেই দিথীকে নিয়ে চলে যাইতাম। কিন্তু ও বলে ২১ তারিখ যাবে। এইজন্য থাকে যাইতেছি। অবশ্য এইবার গ্রামে শীত কালে বেশি থাকা হইলো। আগে কখনো এতোদিন থাকা হয়নাই।

– হ্যা,,( একটু থেমে উৎসুক গলায়) ওহো,,! আমি তো যেইজন্য আসছিলাম আরকি। আজকে তোদের দাওয়াত আমাদের বাসায়। ভাইয়া চলে আসতে বলছে।

– কীসের দাওয়াত।

– আরে নতুন বউ তোদের বাড়িতে, ইকরা-আফাজ রা আসছে। ওদের বাবা-মাও আছে। এতোজনকে কি আবার একসাথে পাওয়া যাবে ,,! ভাইয়া ভাবছিলো আফাজরা মনে হয় আরো কিছুদিন থাকবে। এখন শুনতেছি কাল চলে যাবে। এইজন্য আজকেই দাওয়াত।

– রিয়াদ ভাই। আমি তো এই গ্রামেরই। (দিথী)

– আগে আমার বোন ছিলা। এখন যে বোন থেকে ভাবিতে পদোন্নতি পাইছো। এই উপলক্ষেই দাওয়াত।

শাহারিয়া রিয়াদের কথা শুনে দিথীর দিকে ফিরে বলতে থাকে,

– হ্যা। আমাদের দুই বংশের সম্পর্ক সেই দাদার আমল থেকেই অনেক ভালো। একে অপরের বাড়িতে আপ্যায়ন করার প্রচলন তখন থেকেই। কোন উপলক্ষ লাগে না। এমনিই দাওয়াত দেই আমরা একে অপরকে, তাইনা রিয়াদ।

– হ্যা। এইটা একপ্রকার সৌহার্দ্য বলা যায় আরকি।

– হমম। (দিথীর দিকে ফিরে) এই বাড়িতে বউ হয়ে আসছো। আরো অনেক কিছু দেখতে পারবা। আব্বা এমনি এমনিই ৫ বার মেম্বার হয়নাই।

– দোস্ত চাচি কই। দেখতেছিনা যে ,,!

– মা’তো মনে হয় ঘরে ঘুমাইতেছে। (দিথীর দিকে ফিরে) উঠছিলো কী তখন ,,!

– না।

– তাইলে এখনো ঘরে ঘুমাইতেছে।

– চাচা নাই বাসায় ,,!

– না। আব্বা গন্জে গেছে। সামনে ইলেকশন। ঐ মিটিং করে বেড়াইতেছে।

– আফাজ কই। ছোট বেলায় তো আমাদের বাড়ি যায় অনেক খেলতে। এখন এতোদিন পর আসছে আর ওর দেখা সাক্ষাৎ নাই।

– একটু আগেই ভাত খায় ভিতরে গেলো।

– আপনি আফাজকে চিনেন কী করে ,,! আর ঐযে বললেন ছোট বেলায় আপনাদের বাড়িতে যেতো,খেলতো। কিন্তু ওকে তো বাইরে খেলতে দেখিনি আমি কখনো। (বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইকরা বলে)

– হ্যা যাইতো তো। তোমরা তো এই ৭-৮ বছর হইলো আসোনা গ্রামে। আগে তো ঘনঘন আসতা। তখন অবশ্য ছোট ছিলা। ৬ বছর ছিলো তখন, নারে,,! (শাহারিয়ার দিকে ফিরে)

– হ্যা। তখন ঐরকমই হবে।

ইকরাকে দেখিয়ে রিয়াদ বলে,

– এ আর নিপা, এরা দুইজন আমাদের বাড়ি যায় খালি রান্না রান্না খেলতো। আফাজ খেলতে চাইতো না ওকে জোর করে নিতো। আফাজকে মেয়েদের জামা পড়াইতো। হা হা হা। কী যে মজা হইতো তখন। আমি আর (শাহারিয়াকে দেখিয়ে) তুই দূর থেকে গুলটি মারে ওদের মাটির খেলনা ভাঙে দিতাম আর তখন এদের কি কান্না ,,,! এই ইকরা তো খালি আফাজকে মারতো। এরা গাছের পাতা গুলাকে তরকারি বানায় রান্না করে দিতো আফাজকে। আফাজ সত্যি ভাবে খায় ফেলতো। তারপর যে কী ইকরার দুরুম,দুরুম কিল ঘুষি,,,! হা হা হা। ছোট বেলায় (ইকরাকে দেখিয়ে) এ অনেক দুষ্ট ছিলো।

– হ্যা। আর আমাদের নামে খালি তোর মা’কে যায় বিচার দিতো। আমরা বলে ওদের হাড়ি পাতিল ভাঙচুর করছি। ইকরার কী চোখ রাঙানি তখন,,! বাপরে বাপ ,,! ছোট বেলায় বহুত চঞ্চল ছিলো।

– আমি এসব করছি ,,! কখন করলাম ,,! আমার তো কিছুই মনে পড়তেছে না। (ইকরা)

– তখন তুই ছোট। এই ৬ কী সাড়ে ৫ বছর হবে। ঐসময় কার কথা মনে থাকার কথা না। (রিয়াদের দিকে তাকিয়ে) এখন তো খুব ভদ্র হয়ে গেছে। চঞ্চলামি করে না।

– হইছে কিছুটা। ঐদিন তো গাছ থেকে জলপাই পারতে যায় আমারই এক্সিডেন্ট করে দিছিলো। আমি তো তখন চিনতেই পারি নাই যে এইটা ইকরা। পড়ে তখন চাচির কাছ থেকে শুনি যে ঐটা ইকরাই। চঞ্চলামি ঠিকই আছে। তবে ঐ নিপা আর আফাজের সামনে। তিন পান্ডব একসাথে হইলেই হইলো। আর কিছু লাগেনা তখন ওদের।

– সরি ঐদিন আমি জানে বুঝে জুতাটা ফিকে মারিনি। (গোমড়া মুখে ইকরা বলে)

– হ্যা জানি তো। ঐটা এমনিই একটা ছোট দূর্ঘটনা ছিলো। (শাহারিয়ার দিকে ফিরে) তো চাচিকে একটু ডাক দে। পড়ে তখন বলবে আমাকে বলেনাই।

– মা’কে বলে না গেলে তোরে তখন ধবল ধোলাই দিবে। হি হি হি। বলে যা। (ইকরার দিকে তাকিয়ে) মা’কে একটু ডাক দিয়ে উঠা তো। আমি গেলে দিবে মাইর। তখন একটুর জন্য মাইর দেয় নাই। কাঁচা ঘুম নষ্ট করলে মায়ের মাথা গরম হয়ে যায়।

– আমি যাইতাছি ভাইজান। (বলেই আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা ফুলমতি বারান্দায় উঠে চলে যায় শিউলী বেগমের ঘরের দিকে)

শাহারিয়া রিয়াদের সাথে আরো গল্পে মশগুল হয়ে পড়ে। গল্প করতে থাকে। আর দিথীকে চামচ দিয়ে পায়েশ খাওয়াতে থাকে। ইকরা চুপচাপ বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এদের কথা শুনছে। মনে করার চেষ্টা করতেছে যে ছোট বেলায় কী আসলেই যে এতো চঞ্চল ছিলো ,,!

 

ফুলমতি ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। এসে ডায়নিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

– ভাইজান, চাচি তো ঘরে নাই।

– তাইলে মনে হয় উঠছে। দেখ ওয়াশরুমের ঐদিক যাইতে পারে।

বলে যখনই শাহারিয়া সেদিকে তাকায় দেখে শিউলি বেগম বেসিনে হাত মুখ ধুচ্ছেন। এতক্ষণ এরা গল্পে মেতে থাকা সেদিকে খেয়ালই করেনি। শিউলি বেগম হাত মুখ ধুয়ে বারান্দার রশিতে ঝুলতে থাকা গামছাটা হাতে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এদিকে এগিয়ে আসতে থাকেন।

 

শিউলি বেগম এসে রিয়াদের পাশে দাঁড়ান। শাহারিয়া আর দিথী চুপচাপ হয়ে যায়। শিউলি বেগম গামছাটা একটা খালি চেয়ারের মাথায় রেখে কোমরে হাত দিয়ে চেয়ে থাকেন শাহারিয়া আর দিথীর দিকে। বলেন,

– বুজ্জো রিয়াদ,,! আমি আমার পোলা আর বউমার জ্বালায় আইজ বিকালে শান্তি কইরা ঘুমাইতেও পারলাম না। এই দুইডা পাখি যে ফুটুর ফুটুর করা ধরছে, আমার ঘুম না ভাইঙ্গা আর কই যায়।

– কীরে, তোরা নতুন দম্পতি ভালো কথা। একটু দেখে শুনে রোমান্স করবি না ,,! চাচিকে বিরক্ত করিস ক্যানো ,,! (মজার ভঙিতে রিয়াদ বলতে থাকে)

– হইছে হইছে ছাইড়া দাও। রেডি থাহো চাচা হইয়ার লাইগা। এই দুইডা যা শুরু করছে ,,! আমারে নাতি নাতনির মুখ না দেহাইয়া মনে হয় মরতে দিবো না।

শিউলি বেগমের কথা শুনে শাহারিয়া একটু বেশিই শরম পায়। সে অন্যদিকে চেয়ে দেখতে থাকে। আর দিথী মুচকি মুচকি হাসতেছে।

রিয়াদ বলে,

– আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে চাচি। প্রেম করে বিয়ে তো। একটু আধটু একরম হয়ই। (একটু থেমে) ও চাচি, আপনারেই খুঁজতে ছিলাম এতোক্ষণ। আজকে আমাদের বাসায় দাওয়াত। চাচারে তো পাইলাম না। আপনারেই বলে যাই।

– তোমার চাচা তো খালি সারাদিন গন্জে যাইয়া ঘাঁটি গাইড়া বইয়া থাকে। বাড়ির কোন হদিশ হের আছে নি ,,! (একটু থেমে) আইচ্ছা আমুনে। এই পাখি দুইডারে লমু না রাখমু।

– নিয়া আইসেন। ফাঁকা বাড়ি পাইলে তখন তো আরো এদের সুবিধা।

রিয়াদের মজা নেওয়া দেখে শাহারিয়া কী বলবে খুঁজে পায়না। সুযোগ পাইছে। বন্ধু কী আর মজা না নিয়ে থামে ,,!

 

রিয়াদ বলে,

– আচ্ছা চাচি তাইলে আমি যাই এখন ,,! আপনি সবাইরে নিয়া চলে আসিয়েন ,,!

– আইচ্ছা। আমি তাইলে যাই সাঁজতে। মেলাদিন পর বাইরে যামু। না সাইজ্জা যাওয়া যাইবো না।

– চাচি রুপের আগুন থেকে বাঁচতে পারবেনা একটু শিশুও,,,! হা হা হা হা (হাসতে থাকে রিয়াদ। শিউলি বেগমও হাঁসতে হাঁসতে চলে যান ঘরের দিকে। রিয়াদ হাসতে হাসতে উঠে পড়ে চেয়ার থেকে। শাহারিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– যাই তাইলে রে ,,! চলে আছিস ভাবিকে নিয়ে।

– তুই খালি বিয়ে টা কর। তোর মজা নেওয়ার জন্য আমি অবশ্যই আসবো।

– আচ্ছা আচ্ছা আছিস। কখন চুপচাপ বিয়ে করে বসে থাকবো টেরও পাবিনা।

– গুপ্তচর পাঠাবো। তাও তোর বিয়ের পর আমি মজা নিবোই নিবো।

রিয়াদ হাসতে হাসতে বারান্দা থেকে নামে। দুইজন একসাথে যেমন সিরিয়াস থাকে তেমনি মজাও কম করেনা। ছোট বেলার বন্ধুত্ব। এরকম একটু আধটু হাসি তামাশা মাঝে মাঝে করেই তারা

 

শাহারিয়া বাটির বাকিটুকু পায়েশ দিথীকে খাইয়ে দিতে থাকে। আর কথা বলতে থাকে। রিয়াদ আঙিনায় নেমে চলে যেতেই থাকে, তখনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ইকরা বলে উঠে,

– শুনুন,,,!

রিয়াদ ডাক শুনে দাঁড়িয়ে যায়। ইকরা বারান্দা থেকে নেমে দৌড়ে রিয়াদের দিকে যেতে থাকে। রিয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে,

– আমি কী আপনার সাথে এখন যেতে পারি ,,! না মানে যদি আপনার আপত্তি না থাকে ,,!

বুকের উতলা ঢেউ সইতে না পেরে গড়গড় করে বলে ফেলে ইকরা। রিয়াদ কিছুটা অবাক হয় এতে। তারপরও বলে,

– ঠিক আছে, চলো।

ইকরার মুখ খুশিতে ছেয়ে যায়। সে রিয়াদের পাশাপাশি হয়ে চলে যেতে থাকে তার সাথে বাইরে।

 

এদিকে শাহারিয়া দিথীকে খাইয়ে দিতে দিতে বলে,

– ইকরা, রিয়াদেক ভাইয়া না ডেকে শুনুন কেনো বললো ,,!

– ডাল মে কুছ তো কালা হ্যা ,,!

– এই তুমি হিন্দি জানো ,,!

– হা। বিলকুল। মে হিন্দিকা মাস্টার হুঁ,,,! (বলেই ভাব নিয়ে বসতে থাকে দিথী।

 

রিয়াদ আর ইকরা বাইরে চলে আসে। আকাশ লাল আভায় ছেয়ে গেছে। চারপাশ বেশ অন্ধকার। কাঁচা রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে দুই একটা সাইকেল আর কয়েকজন মানুষ বাজারের ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যারা দিন আনে দিন খায় তারা সারাদিনের করা উপার্জন দিয়ে বাজার করার জন্য গন্জের দিকে পা বাড়িয়েছে।

 

রিয়াদ এসে তার বাইকের সামনে দাঁড়ায়। বাইকে উঠে বসে পা দিয়ে স্টান্ট টা উঠায়। ইকরাকে বলে,

– উঠো।

– আমি ,,!

– হ্যা উঠো। নাইলে পায়ে হেঁটে যাবা নাকি ,,!

ইকরার বুক আবার কাঁপতে শুরু করে। সে বাইকের এক স্ট্যান্ডে পা রাখে। এক হাত দিয়ে রিয়াদের কাধ ধরে। তার হাত কাঁপছে। সে কী যে করছে নিজেও বুজতেছে না। ওর শরীর নিজে নিজেই যেন চাইছে রিয়াদের কথা পালন করতে। ইকরা উঠে বসে বাইকের পিছনে। একপাশে দুই পা রেখে এক হাত রিয়াদের কাঁধে রাখে। রিয়াদ বলে,

– ঠিক মতো বসছো তো ,,!

– হমম।

– আমাকে ভালোভাবে ধরো নাইলে কিন্তু পড়ে যাবে। কাঁচা রাস্তা। খানাখন্দের অভাব নাই।

ইকরা রিয়াদের কথা শুনে কিছুটা কাছ ঘেঁষে বসে। রিয়াদের কাধ শক্ত করে ধরে। আরেক হাত নিজের কোলে রাখে। বলে,

– এবার চলুন। আমি পড়বোনা

– আচ্ছা ঠিক আছে।

রিয়াদ বাইক স্টার্ট দিয়ে দেয়। বাইক চলতে শুরু করে। ইকরার ভয় লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি সে পড়ে গেলো। ইকরা সাথে সাথেই আরেক হাত দিয়ে রিয়াদের আরেক কাঁধ শক্ত করে ধরে। বাইক চলতে থাকে কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে। বাইকের হেডলাইট জ্বালায় রিয়াদ। লাল গোধূলির আকাশে নিচে দুই খাঁচা ছাড়া পাখি একসাথে হয়ে যাচ্ছে। হালকা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে ইকরার মুখে। তার দারুন লাগছে। নিজের মনে ঠাঁই দেওয়া মানুষটাকে ও ছুঁতে পেরেছে। তার সাথে পাশাপাশি বসে আছে। এই অনুভূতি যেন ব্যাখাতিত নয়। এই অনুভূতি মন থেকে সারা শরীরের স্নায়ুতে স্নায়ুতে আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইকরা তার মুখে মুচকি হাঁসি ধরে রাখে। বাইক চলে যেতে থাকে রিয়াদদের বাড়ির দিকে।

 

 

 

একটা কাঠের স মিল। এখানে গাছ মাড়াই করে তার ছাল ছাড়ানো, কাঠ সাইজ করে কাঁটা আর সেটার মসৃণতা ফিরিয়ে আনার কাজে ব্যস্ত গুটি কয়েক কর্মী। বিভিন্ন মেশিনের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে কাটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ গুলো।

 

কারখানার এক প্রান্তে কাঠের উপর থেকে হাত যন্ত্র টেনে টেনে কাঠকে মসৃণ করছে লালু আর সালু। অর্থাৎ সেই দুই চোর। চোর বললে ভুল হবে। তারা এখন ভালো কাজেই আছে। হালাল উপার্জন করছে। এই কাঠ কারখানাতেই তারা কাজ করে। কারখানা টা দিনাজপুর শহরের ফার্নিচার পল্লির এদিকটায়।

 

লালু একবার ছোট হাত মেশিন টাকে তার দিকে টানছে তারপর সালু একবার তার দিকে টানছে। এতে করে কাঠের উঁচু নিচু অংশ গুলো কেঁটে ছোট মেশিনটার উপর দিয়ে বেড়িয়ে আসছে। লালু কাজের দিকে মনযোগ দিয়ে থাকলেও সালুর মন অন্যদিকে। সে একটু পর পর দরজার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। লালু কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে যে সালুর মন কাজে নেই। লালু বলে উঠে,

– এই সালু, ঠিক করে ধরে জোড়ে টান দে। এদিকটায় তো বেশি এবড়োথেবড়ো।

সালু কথা টা শুনেই লালুর দিকে তাকায়। লালু যেভাবে বলে সেভাবে করতে থাকে। করতে করতে বলে,

– তুই কী একটা জিনিস খেয়াল করছোস ,,!

– কী ,,!

– আমাগো উপর কেউ নজর রাখতাছে।

– আমাগো উপর ,,! ক্যান ? আমরা কী করছি ,,!

– আমরা কিছু করিনাই। আমাগো চোখ করছে। দুই দুইবার আশ্চর্য সব ঘটনা দেখছে। (একটু থেমে মেশিন টানতে টানতে) আমার কী মনে হয় জানোস লালু,,,!

– কী ,,!

– কেউ মনে হয় বুঝতে পারছে যে আমরা হেই দুইদিন ঘটনা গুলা দেখছিলাম।

– কে বুঝবো। কেউই তো আছিলো না।

– আছিলো। পরের ঘটনা ডায় কিছু পুলিশ বাইচ্চা ছিলো। যতই দূরে গাড়ি নিয়া উল্টায় থাহুক। ওরা পুলিশ। ওগো চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না।

– তুই কেমনে বুঝলি যে কেউ আমাগো উপর নজর রাখতাছে ,,!

– দরজার দিকে দেখ।

লালু মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। আবার সালুর দিকে ফিরে বলে,

– কই ,,! কিছুই তো নাই।

– দরজার কোনে দেখ। নিচের দিকে।

লালু আবার ফিরে তাকায়। দেখে একজন মানুষের জুতার অগ্রভাগ দেখা যাচ্ছে দরজার আড়াল থেকে। লালু সামনে ফিরে তাকিয়ে বলে,

– কেউ আমাগো উপর আসলেই নজর রাখতাছে ,,!

– তো আমি এতোক্ষণ তোরে কী বুঝাইতাছিলাম ,,! (একটু থেমে মেশিন টানতে টানতে) শোন,, কেউ তরে এইসব বিষয় নিয়া জিগাইতে আইলে কবি ‘আমি কিচ্ছু জানিনা। মাহাজনের ধারে কাম করি, টাকা নিয়া বাইত যাই। কই কী হইছে না হইছে তা আমরা কিছুই জানিনা। বুজছোস ,,!

– জ্বী সালু ভাই। কাউরে কিছু কমুনা।

– হমম। এহন কামে মন দে। মাহাজন আমাগোরে এতো কথা কইতে দেখলে আবার আইয়া দুইডা কথা হুনাইয়া যাইবো।

– আইচ্ছা।

লালু আর সালু কাজে মনযোগ দিতে থাকে। কারখানার শব্দে স্বাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেলেও এখানকার কর্মচারীদের কাছে এইটা পান্তা ভাত। তাদের যেন কিছুই হয়না এই কঠোর শব্দ দূষণে। বাতাসে উড়তে থাকা কাঠের কনা চলে যায় এক্সাস্ট ফ্যান দিয়ে কারখানার বাইরের জগতে।

 

 

 

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন:: ২(মুখোশ)

পর্ব:: ৫৬ (২য় ভাগ)

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া 

(বোনাস পর্ব 🟢)

 

 

– হমম। এহন কামে মন দে। মাহাজন আমাগোরে এতো কথা কইতে দেখলে আবার আইয়া দুইডা কথা হুনাইয়া যাইবো।

– আইচ্ছা।

লালু আর সালু কাজে মনযোগ দিতে থাকে। কারখানার শব্দে স্বাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেলেও এখানকার কর্মচারীদের কাছে এইটা পান্তা ভাত। তাদের যেন কিছুই হয়না এই কঠোর শব্দ দূষণে। বাতাসে উড়তে থাকা কাঠের কনা চলে যায় এক্সাস্ট ফ্যান দিয়ে কারখানার বাইরের জগতে।

 

 

 

রাতুলদের ঘর। বিছানার সামনে একটা ডায়নিং টেবিলে ভাত খাচ্ছে শাহারিয়া, দিথী, শিউলি বেগম আর আহনাফ। এই টেবিল টা রিয়াদের ঘরে ছিলো। আজ এই ঘরে আনা হয়েছে খাওয়ানোর জন্য। বিছানায় বসে আছে ইকরা, আফাজ, আর তাদের বাবা-মা। তারা খেয়ে উঠলো একটু আগেই। টেবিলে ৬ জনের বেশি বসা যায় না। তাই শিউলি বেগমই বললেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে খেতে বসার কথা। আফাজরা যেহেতু মেহমান, তাই তাদেরকেই আগে বসিয়ে দিলেন শিউলি বেগম। এখন তাদের খাওয়া হয়ে যাওয়াতে নিজেরা বসেছেন। তরকারি তুলে দিচ্ছে রিয়াদ আর মায়া। মায়াকে বসে থাকতে বলেছিলো রাতুল। কিন্তু মায়ার জেদ ও খাবার পরিবেশন করবেই। একে তো ওকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেয়নি রাতুল। ও আর রিয়াদ মিলেই সব রান্না করেছে। এখন আবার মায়াকে বসিয়ে রেখে ওরা পরিবেশন করবে এটা মায়া একদমই মানবে না। সেইজন্য সেই খাবার পরিবেশন করছে। রাতুল তাই বিছানায় বসে ইকরার বাবা মায়ের সাথে গল্পে মেতেছে। ইকরার বাবা মায়ের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো। ইকরার মা রাতুলের সম্পর্কে খালা হন। আপন না। বলা যায় দুঃসম্পর্কের খালা। আফাজ আর বাবা-মাকে গল্প করতে দেখেছে বিছানার এক পাশে চুপচাপ বসে থাকা ইকরা। সে একদমই নিশ্চুপ। তার মন চাইছিলো একটু ঘর থেকে বেড়িয়ে আঙিনায় যেতে। এখানে এভাবে চুপটি মেরে বসে থাকতে ওর একদমই ভালো লাগছে না।

ইকরা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ডায়নিং টেবিলের পাশে দাঁড়ানো মায়ার দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলতে থাকে,

– মায়া আপু ,, একটু শুনোতো।

– আমাকে বলছো ,,! হ্যা বলো‌।

– এদিকে আসো একটু। (বলেই মায়ার হাত ধরে ঘরের দরজার দিকে নিয়ে গেলো ইকরা। বাকিরা খেতে খেতে কথা বলছিলো তাই তারা এদিকে খেয়াল করেনি। তবে রিয়াদ দেখেছিলো বিষয় টা।

ইকরা দরজার সামনে এনে মায়াকে বলতে থাকে।

– আপু, তুমি উনার ভাবি তাইনা ,,!

– কার ,,? রিয়াদের ,,? হ্যা আমি ওর ভাবি। ক্যানো ?

– আচ্ছা উনি কী এই ঘরেই থাকেন স্বাধারণত ? নাকি অন্য ঘরে ঘুমান।

– রিয়াদ এই ঘরে থাকে না। আমি আর তোমার ঐযে ভাইয়াটা দেখতেছো গল্প করতেছে, ও থাকি।

– ওহহ,, তাইলে উনার মানে রিয়াদ এর রুম কোনটা ,,!

– নাম ধরে বলিও না। রিয়াদ শুনতে পাইলে দিবে মাইর। ভাইয়া বলো ভাইয়া।

– তুমি বলো না উনার রুম কোথায়।

– ঐ যে সামনের ঘর টা দেখতে পাচ্ছো,,! ঐটা রিয়াদের রুম। কেনো কোন দরকার,,!

– আমি একটু ঐ রুমে গিয়ে একলা থাকতে চাচ্ছিলাম। আমার গল্প গুজব ভালো লাগছে না।

– ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে যাও। দরজায় এমনি ছিটকিনি লাগানো। ঐটা খুলে ওখানে গিয়ে বসে থাকো।

– আচ্ছা আপু।

বলেই ইকরা ঘরে থেকে বেড়িয়ে যায়। মায়া আবার খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে থাকে কারো কিছু লাগবে নাকি।

 

রিয়াদ আর রাতুলদের বাসা দুইটা বাড়ির মতো বলা যায়। মানে রুম একটা আঙিনার একপাশে আরেকটা ঠিক সামনাসামনি আরেকপাশে। মাঝে আঙিনার দূরত্ব। আগে এক পাশের রুমে রিয়াদ আর রাতুলের বাবা-মা থাকতো। আরেক পাশের রুমটায় রিয়াদ আর রাতুল থাকতো। তারপর তাদের বাবা-মা মারা যায়। অনেকদিন পর রাতুল বিয়ে করে। তারপর রাতুল আর মায়া ও রুমে থাকে। আর রিয়াদ এই রুমে।

 

ইকরা এসে রিয়াদের রুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে। রুমটা পাকা না। রঙিন টিনের তৈরি ঘর। উপরের টিনও রঙিন। তাদের পাকা বাড়ির কাজ চলতেছে আঙিনার একপাশে। ইকরা রুমে ঢুকেই চারপাশে দেখতে থাকে। রুমের মাঝখানে একটা খাট। তার পাশে একটা টেবিল। তার পাশে একটা আলমারি আর আলনা। এইগুলাই। ব্যাচেলর মানুষ। ঘরে আর কিছুই নাই। ইকরা এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়ায়। বিছানার দিকে চেয়ে দেখে বিছানা অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। রিয়াদের কিছু কাপড় পড়ে আছে বিছানায়। চাদর ও জড়োসড়ো হয়ে পড়ে আছে। ইকরা বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কোমরে হাত দিয়ে বলতে থাকে,

– বিছানার অবস্থা দেখছো,,! এইখানে কোন মানুষ থাকে না গরু ছাগল থাকে ,,! (জিহ্বা কামড়ে) ওপসস ,,, জামাইকে গরু ছাগল বলে ফেললাম,,! তাতে কী ,,! আমার জামাই। আমি যা ইচ্ছা বলবো।

বলতে বলতে ইকরা বিছানা থেকে রিয়াদের কাপড় গুলো হাতে নিতে থাকে। পুলিশের শার্ট টাও বিছানায় পড়ে ছিলো। সে শার্ট টা হাত নিয়ে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখতে থাকে। বলে,

– পুলিশের শার্ট টাও এভাবে ফেলে রাখছে ,,! কালকে পড়ে যাবে না ,,!

বলেই শার্ট টা ভাঁজ করার চিন্তা করে সে। তখনই তার কী জানি মনে হতেই সেই শার্ট টাকে মুখের কাছে আনে। চোখ বুজে ঘ্রান নিতে থাকে প্রাণভরে। ঘ্রান নিয়েই শার্ট টাকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে ফেলে। বলতে থাকে,

– এভাবে করেই যদি জড়িয়ে ধরতে পারতাম উনাকে ,,! (একটু থেমে ধীর গলায়) প্রিয় মানুষের গাঁয়ের গন্ধ যেন হাজারো পারফিউমের থেকেও বেষ্ট ,,,!

বলেই শার্টে মুখ লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে ইকরা। শার্ট টাকে বিছানা মেলে রাখে। মেলে দিয়ে শার্টের হাতা গুলো ভাঁজ করতে থাকে। তখনই শার্টের পকেটে সে হাত দেয়। পকেট থেকে বের করে একটা কাগজ। কাগজ টা খুলে। পড়তে থাকে ভিতরের লেখা গুলা। সম্পূর্ণ টা পড়া হয়ে গেলে বিরবির করে বলতে থাকে,

– এই কেস ফাইল গুলাও কী পকেটে নিয়ে ঘুরতে হবে ,,! এগুলা থাকবে থানায়। পকেটে তো থাকবে আমার জন্য লেখা লাভ লেটার। এসব কাগজ আমার জামাইয়ের পকেটে যায়গা পাবেনা হুঁ,,!

বলেই কাগজ টাকে ফেলে দেয় ইকরা। শার্ট টাকে ভাঁজ করতে থাকে। তখনই আবার জিহবা কামড়ে বলতে থাকে,

– যদি কোন দরকারি কাগজ হয় ,,! না বাপু। পরে যদি জানতে পারে যে আমি ফেলেছি। আমাকে মেরে তক্তা বানায় ফেলবে।

বলেই পিছন ফিরে ফ্লোরে পড়ে থাকা কাগজ টা উঠিয়ে আগের মতো ভাঁজ করে শার্টের পকেটে রেখে দেয়। ভাঁজ করা শার্ট টা বিছানার এক পাশে রাখে। তারপর দেখে প্যান্ট পড়ে আছে। সে প্যান্ট টাও উঠায়। ভাঁজ করে। করে পাশে শার্টের উপর রেখে দেয়। সে আবারো যখন কাপড় নিতে যায় তখনই সে হাত দিয়ে উঠায় কাপড়ের মধ্যে থাকা রিয়াদের আন্ডার প্যান্ট টাকে। উঠিয়ে এক হাত ধরেই মুচকি হেঁসে ফেলে ইকরা। বিরবির করে বলতে থাকে,

– এটাও এভাবে ফেলে রেখে গেছে। যদি কোন অন্য মেয়ে দেখে নিতো তখন কী হতো ,,! আমার জামাইয়ের জিনিস আমি কাউকে দেখতে দিবো না।

বলেই সেটাও ছোট্ট করে ভাঁজ দিয়ে রেখে দেয় পাশে থাকা ভাঁজ করা কাপড় গুলোর উপর।

বিছানা থেকে বাকি কাপড় গুলোও হাতে নিয়ে ভাঁজ করে করে রাখতে থাকে। বেশ অনেক কাপড়ই ছিলো ওখানে। ইকরা তো একটা লম্বা বিল্ডিং বানিয়ে ফেলছে এদিকে ভাঁজ করা কাপড় গুলো দিয়ে। সব ভাঁজ করা হয়ে গেলে সে দুই হাত কোমরে দেয়। দিয়ে ভাঁজ করা কাপড়ের থাক এর দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,

– কতদিন থেকে যে খালি কাপড় খুলে খুলে এভাবে ফেলে রাখছিলো,,,! এইগুলা দেখবে কে। ওর ভাবি তো প্রেগন্যান্ট। উনাকে কী আর ওর ভাই ঘর থেকে বের হতে দিবে। নিজের বিয়ের কোন খোঁজ খবরই নাই ,,! (জিহবা কামড়ে) বিয়ে হয়নি ভালোই হইছে,,! এই চিকনা এখন আমার। এর উপর শুধু এই ইকরা খানমেরই হক আছে ,,!

বলেই বুক ফুলিয়ে ভাব নিতে নিতে হেঁসে ফেলে ইকরা। হাসতে হাসতে কাপড় থাক গুলো হাত দিয়ে তুলে টেবিলের সামনে থাকা একটা চেয়ারের উপর রাখে।

বিছানার উপর উঠে চাদর ঠিকঠাক করে দিতে থাকে। ইকরার পড়নে এখনো সেই শাড়িটাই আছে যেটা পড়ে সে নিপার শশুর বাড়িতে গিয়েছিলো। কাপড় বদলানোই হয়নি তার। বিছানার চাদর টেনে টুনে ঠিক করে দিয়ে বালিশ গুলাকে মাথার দিকে গুছিয়ে রাখে। বিছানা থেকে নেমে বিছানা ঝাড়ু খুঁজতে থাকে। চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় বিছানা ঝাড়ুটাকে। আলমারি আর পড়ার টেবিলের মাঝের কোণটাতে ছিলো সেটা। ইকরা সেই বিছানা ঝাড়ুটা এনে বিছানা ঝাড় দিয়ে দিতে থাকে। ঝাড় দিয়ে নিচে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কোমর থেকে গুজে রাখা আঁচল টা খুলে দেয়। ঝাড়ুটা যায়গা মতো রেখে এসে বিছানার সামনে দাঁড়ায়। দুইহাত কোমরে দিয়ে বিরবির করে বলতে থাকে,

– একদম ঠিকঠাক। বিছানা এরকম রাখতে হয় সবসময়। দেখতে একটা সৌন্দর্য লাগবে। অবশ্য তার বিছানা গুছানোর লোকটাই তো নাই। আমিও বিয়ের আগেই ওকে জামাই বানিয়ে গুছিয়ে দিলাম।

বলতে বলতে বিছানার পাশের টেবিলের দিকে চোখ যায় ইকরার। টেবিলে একটা বড় ছবি রাখা ছিলো। ছবিটা দেয়ালে টাঙ্গানোর মতো বড় ছবি। কিন্তু সেটা টেবিলে বইয়ের থা’কে হেলান দিয়ে রাখা ছিলো। ইকরা ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছবিটা রিয়াদের। ছবিতে ও পুলিশি ড্রেসে মাথায় টুপি পড়ে তাকিয়ে আছে ইকরার দিকে। ছবিতে রিয়াদকে একটু বেশিই ইয়াং লাগছে। তারমানে হয়তো ছবিটা রিয়াদের প্রথম পুলিশের জয়েন করার দিন তোলা। ছবিটার সামনে টেবিলের উপর পুলিশি টুপি আর লাঠি টাও রাখা ছিলো। ইকরা টেবিল থেকে পুলিশি টুপি টা হাতে নেয়। ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখে সেটা নিজের মাথায় পড়ে নেয়। টেবিল থেকে লাঠিটাও হাতে নেয়। নিজেকে দারগান্নি ভাবতে থাকে। বুক ফুলিয়ে ভাব নিয়ে লাঠি একহাতে ঘোরাতে ঘোরাতে ছবিটাকে বলতে থাকে,

– এইযে মিষ্টার রিয়াদ। আপনাকে আমরা পুলিশ পদে চাকরি দিয়েছি। কিন্তু আপনি তো চোর বেরোলেন। দিনে দুপুরে একজনের মন চুরি করে পালিয়ে গেলেন ,,! আমরা একজন বিশ্বস্ত অফিসার হিসেবে আপনাকে থানার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু না। আপনি অপরাধ করেছেন। চুরি করেছেন। ডাকাতি করেছেন। (কান্নার ঢং করে) এখন না জানি সেই অবুঝ মেয়েটা তার মন কোথায় কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছে,,! (কঠিন গলায়) আমি এর ঘোর বিচার করবো। তোমাকে ,,! না সরি, আপনাকে একজন মেয়ের মন চুরি ও তার মনের ঘরে ডাকাতি করার অভিযোগে আজীবন আমার মনের জেলে আটকে রাখার হুকুম দেওয়া হলো। আপনার জন্য এরচেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই হতে পারে না। দা কেস ইজ ক্লোস ,,,!

বলেই আর হাসি ধরে রাখতে পারেনা ইকরা। হাসতে হাসতে পাশে বিছানায় বসে পড়ে। হাসতে হাসতে বলে,

– পুলিশ থেকে উকিল, উকিল থেকে জজ ,, হা হা হা। কত কিছু হয়ে গেলাম এর মধ্যেই,,,!

ইকরা হাসতে হাসতে তার লাঠিটা টেবিলে রাখে। ধীরে ধীরে হাঁসি থামায়। কিন্তু আবার কথা গুলো মনে পড়তেই হাঁসি বাঁধা না মেনেই আবার বেড়িয়ে আসছে।

 

বেশ কিছুক্ষণ পেড়িয়ে যায়। ইকরা টেবিলে থাকা একটা কলম দিয়ে সেখানকার একটা কাগজে কী জানি লিখছিলো। লেখা শেষ হতেই কলমটা নিপ লাগিয়ে সেটা কলম দানিতে রাখে। রেখে কাগজ টা একবার পড়ে দেখে। পড়ে দেখা হয়ে গেলে মুচকি মুচকি আবার হাসে। কাগজ টাকে ভাঁজ করতে থাকে। ছোট্ট করে ভাঁজ করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। গিয়ে চেয়ারে থাকা ভাঁজ করা কাপড় গুলোর মধ্যে থেকে শার্ট টা বের করে। সেটার পকেটে কাগজ টা ঢুকিয়ে রেখে আবার ভাঁজ করা থাকের মধ্যে রেখে দেয়। তখনই পিছন থেকে কারো কথার আওয়াজ,

– তুমি ,,! তুমি এখানে কখন আসলা ,,!

ইকরা কথা শুনেই সোজা হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে রিয়াদ দরজার সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়াদ দরজার ভিতরে‌ রুমে ঢুকে। বিছানার দিক দেখে বলতে থাকে,

– বিছানা কে গোছাইলো ,,!

– আমি গুছিয়েছি।(ধীর গলায় বলে ইকরা)

– আর বিছানায় থাকা কাপড় গুলা ,,! ওগুলা কই ,,!

– এ,এইযে এখানে ভাঁজ করে রেখেছি।

– তুমি আরো ভাঁজ করতে কেনো গেলে ,,! (গলা নরম করে) ঘরে একলা থাকি। ঘর সবসময় অগোছালো হয়ে থাকে এজন্য। ভাবি আগে গুছায় দিতো। এখন আমিই নিষেধ করছি। ভাইয়া বলছে ভাবিকে টোটালি রেস্টে রাখতে। তাই কোন কাজই তাকে করতে দেই না।

কথা বলতে বলতে রিয়াদ ইকরার প্রায় সামনে এসে যায়। ইকরা কিছুটা ভয় পাচ্ছে। রিয়াদ হাসিমুখে ইকরার সামনে হতে বিছানায় বসে। ইকরাকে বলে,

– বসো। দাঁড়িয়ে আছো ক্যানো ,,!

ইকরাও এসে বসে পড়ে বিছানায়। রিয়াদ বলতে থাকে,

– ঐসময় মায়া ভাবিকে কী জানি বলে বের হইলা। আমি ভাবছি এমনিই মনে হয় বের হইছো। এখন দেখি আমার ঘরে।

– হমম। (ধীর গলায়)

– সিঙ্গেল মানুষ। ঘর-দোর একটু এলোমেলো থাকেই। তুমি মনে হয় বাড়িতে থেকে কলেজে যাও। এইজন্য। হোস্টেলে থাকলে দেখতা সিঙ্গেল দের ঘর কতোটা অগোছালো থাকে।

– আমি সবসময় আমার রুম গুছিয়ে রাখি। (ধীর কন্ঠে মাথা নিচু করা অবস্থায় বলে ইকরা)

– আমার এইসব ভালো লাগে না। এইগুলা যতদিন বিয়ে না করবো এমনেই থাকবে। বিয়ের পর তখন দেখা যাবে। বউ যদি গুছায় তাইলে তো হইলোই। আর যদি আমার মতো এমন অগোছালো স্বভাবের হয়,,! তাইলে ঐ যেই লাউ হেই কদু।

– আমি অগোছালো স্বভাবের না।

– হ্যা তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বিছানা একদম টান টান করে গুছাইছো। কাপড় ভাজ করে রাখছো। তুমি সবসময় গোছানো জিনিস পছন্দ করো।

– হমম,,

– ভয় পাচ্ছো নাকি আমাকে ,,! আফাজের কাছ থেকে শুনলাম একটু আগে তুমি বলে পুলিশ দের ভয় পাও ,,!

– ছোট থেকেই।

– ওহোহো। আমি জানতাম না। (একটু থেমে) এখন আমি পুলিশ হইছি বলে আমাকেও ভয় পাইতেছো ,,!

– না মানে বিষয় টা ঠিক তেমন না।

– তাইলে,,!

– আপনার হাতের ক্ষত টা সেড়েছে ,,!

– হাতের টা ,,! (হাত দেখে) হ্যা কমছে।

– ঐদিনের জন্য সরি। আসলে আমি ইচ্ছে করে জুতোটা আপনার দিকে মারিনি।

– ও। এইবার বুঝলাম। এইজন্য ভয় পাচ্ছো ,,! আরে বোকা, আমি তোমার বড় ভাইয়ার মতো। আমি কিছু মনে করিনি।

কথাটা শুনেই ইকরা মুখ তুলে তাকায়। সে তৎক্ষণাৎ বলে,

– অন্য কিছু হতে পারেন না আমার ,,!

– অন্য কিছু,,? আমি সম্পর্কে আর কী হতে পারি তোমার,,! (একটু থেমে) আঙ্কেল হইলে কেমন হয় ,,! (বলেই হাসতে থাকে রিয়াদ। ইকরা চুপচাপ। সে হাসছে না। রিয়াদ ইকরাকে চুপচাপ দেখে হাসি থামিয়ে বলে,

– কিছু হয়েছে তোমার ,,! আনকম্ফর্টেবল ফিল করছো ,,!

– আপনি লাভ ম্যারেজ করবেন না এরেন্জ ম্যারেজ,,! (মাথা নিচু করা অবস্থায় বলে ইকরা)

– হঠাৎ এই কথা ,,!

– বলুন না।

– আমি এরেন্জ ম্যারেজ করবো। ভাইয়া ভাবি বলে দিছে তারা যেই মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিবে আমাকে তাকেই বিয়ে করতে হবে। পছন্দ হোক আর না হোক। নাইলে বলে দিছে চিরকাল কুমার থেকে জীবন কাটাইতে। ঐযে বিকেলে বললাম না সালমান খান আর আমার মধ্যে মিল আছে এদিক দিয়ে। দুইজনেরই বিয়ে হচ্ছে না ,,! হা হা হা।

– আপনার ভাই ভাবি যার সাথে বিয়ে করতে বলবে আপনি তার সাথে করবেন,,,!

– হ্যা। অবশ্যই। আমার ভাইয়া ভাবি নিশ্চয়ই আমার জন্য খারাপ মেয়ে আনবে না। আমি তাদের পছন্দ করা যেকোনো মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী।

– যদি সেই মেয়েটা আমি হই ,,! (মাথা তুলে চেয়ে) তবে ,,!

হঠাৎ ইকরার এই কথার জন্য অপ্রস্তুত ছিলো রিয়াদ। সে কিছুটা নার্ভাস হয়ে যায়। বলে,

– তুমি তো আমার বোন। তোমাকে কেনো ভাইয়া আমার পাত্রী হিসেবে ঠিক করবে ,,!

– বলুন না। যদি উনারা আমাকে আপনার পাত্রি হিসেবে ঠিক করে, করবেন আমায় বিয়ে ,,! (এক শুভ্র চিকচিকে পলকের সহিত কথা গুলো বলে ইকরা)

রিয়াদ কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না। এমন অবস্থায় সে আগে কখনো পড়ে নি। সে ভাবতে থাকে কী বলবে। রিয়াদকে চুপ করে থাকতে দেখে ইকরা বলে,

– আমাকে কী আপনার পছন্দ হয়না ,,! আমি কী দেখতে এতোটাই খারাপ,,!

– না না। তা হতে যাবে কেনো। তুমি তো সুন্দর। তোমার মতো কাউকে বউ হিসেবে পাওয়া, ভাগ্যের ব্যাপার। (শেষের কথাটা বলতে গিয়ে রিয়াদের কিছুটা গলা লেগে আসে)

– তাইলে বলুন, আমাকে যদি আপনার ভাই ভাবি পছন্দ করে, তাইলে আমাকে বিয়ে করবেন আপনি ,,! (একটু থেমে) সত্যি সত্যি বলবেন কিন্তু,,!

– আ, হ্যা করবো। করবো। (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে রিয়াদ)

– সত্যি করবেন ,,!

– হ, হ্যা। করবো। কিন্তু,,,,,,,,

রিয়াদের কথার মাঝেই হঠাৎ ইকরা তাকে জড়িয়ে ধরে। রিয়াদ এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সে গলার ঢোক গিলে। ইকরা যেন নিজের মধ্যে নেই। সে যে একটা মেয়ে আর মেয়েরা যে এভাবে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে না। তা তার মস্তিষ্ক বুঝতে চাইছেনা। বার বার তার সকল ইন্দ্রিয় রিয়াদের ছোঁয়া পেতে চাইছে। ইকরা রিয়াদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

– আমি আমার অনার্স পরীক্ষা শেষ করে আমার বাবাকে নিয়ে আপনাদের বাসায় আসবো। (একটু থেমে কাপো কাপো গলায়) আ,আপনার আর আমার ব,বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।

বলেই ইকরা গাঁ ছেড়ে দেয় রিয়াদের উপরেই। রিয়াদ ইকরার এমন হঠাৎ গাঁ ছেড়ে দেওয়া দেখে কিছুই বুঝতে পারেনা। সে ইকরাকে নাড়িয়ে দিয়ে ডাকতে থাকে।

– ইকরা,, এই ইকরা,,!

কিন্তু না। ইকরার কোন সাড়া নেই। মেয়েটার হঠাৎ কী হলো। রিয়াদ ইকরাকে শক্ত করে কোলে জড়িয়ে ধরে বিছানা হতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ঘুরে সামনে ফিরে বিছানার কাছে এসে ইকরাকে শুইয়ে দেয়। দেখে ইকরা জ্ঞান হারিয়েছে। রিয়াদের মাথায় টেনশন চেপে যায়। একটা কম বয়সী মেয়ে এভাবে তার রুমে শুয়ে থাকতে দেখলে যে কেউ যেকোনো কিছু ভেবে নিবে। রিয়াদ সঙ্গে সঙ্গে বিছানার পাশের টেবিলে থাকা জগ হতে হাতে পানি নেয়। বিছানায় ইকরার পাশে বসে হেলে ইকরার মুখে পানির ছিটে দিতে থাকে। দেখে ইকরার কোন সাড়া নেই। রিয়াদ তার দুই আঙ্গুল মেয়েটার নাকের কাছে নিয়ে যায়। না শ্বাস তো চলছে। তার মানে বেঁচে আছে। রিয়াদের বুকের লাফানো টা যেন একটু কমে। সে আবারো কিছুটা পানি হাতে নিয়ে ইকরার পাশে হেলে তার মুখে ছিটিয়ে দেয়। ইকরার চোখের পাতা নড়ে উঠতে থাকে। রিয়াদের যেন প্রাণ পাখি ফিরে আসে। সে যেন দম আটকে ফেলেছিলো ইকরার এই অবস্থা দেখে। ইকরা ধীরে ধীরে চোখের পাতা মেলে। সে সব কিছুই কেমন যেন ঝাঁপসা দেখতে পাচ্ছিলো। তখনই রিয়াদ খেয়াল করে ইকরার নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। হ্যা ওটা রক্তই ,,! রিয়াদ সাথে সাথে তার পকেট থেকে রুমাল বের করে বিছানায় উঠে গিয়ে ইকরা মাথা তার পায়ের মাংসপেশীতে রাখে। রেখে তার নাক থেকে বেড়োনো রক্ত মুছে দিতে থাকে। ইকরা ধীরে ধীরে রিয়াদের কোলে নিজেকে ঘনিষ্ঠ করে নিতে থাকে। বিরবির করে বলতে থাকে,

– আমার মাথাটা কেমন যেন করছে ,,! আমার মাথাটা, মাথাটা খুব ব্যাথা করছে।

– একটু শান্ত থাকো। তোমার, তোমার নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।

ইকরা ভয় পেয়ে যায়।সে উঠতে চেষ্টা করে। রিয়াদ তাকে ধরে বলে,

– উঠিও না। আমি তোমার নাকে রুমাল ধরে রাখছি। রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে। তুমি একটু প্লিজ মুখ দিয়ে শ্বাস নাও।

– আমার, আমার নাক দিয়ে রক্ত কেনো পড়ছে ,,! আগে তো কখনো এমন হয়নি।

– জানিনা ক্যানো।‌ তবে তুমি একটু শান্ত থাকো। নাক থেকে রক্ত পড়াটা বন্ধ হোক।‌ তারপর উঠো।

ইকরাও আর কিছু বলেনা। সেও চুপচাপ শুয়ে থাকে রিয়াদের কোলে। রিয়াদে তার নাকে রুমাল আলতো করে চেপে ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইকরা চোখ তুলে রিয়াদের দিকে তাকাতেই রিয়াদ তাকে চোখের ইশারায় আস্বস্ত করে। যেন বলে “কিচ্ছু হবেনা তোমার প্রিয়,,,!”

 

বেশ খানিকক্ষণ পর,

 

ইকরা উঠে বসে। রিয়াদ রুমাল টা টেবিলের উপর রাখে। ইকরা বসে তার শাড়ি ঠিক করতে থাকে। সে যখন রিয়াদের কোলে শুয়ে ছিলো তখনই নড়া চড়াতে শাড়ি কিছুটা নড়ে গিয়েছিলো। সে কিছুটা লজ্জাও পায়। রিয়াদ পানির জগ থেকে এক গ্লাসে পানি ঢেলে ইকরার দিকে এগিয়ে দেয়। ইকরা এক লজ্জা মাখা মিষ্টি মুখ নিয়ে রিয়াদের দিকে তাকায়। গ্লাস টা হাতে নেয়। পানিটা খেয়ে নিতে থাকে। রিয়াদ তার শাড়ির আঁচলটা কাঁধে ভালোভাবে টেনে ঠিক করে দিতে থাকে। যেনো তারা দুইজনই স্বামী-স্ত্রী। ইকরার কোমরে রিয়াদের আঙুলের স্পর্শ লাগতেই ইকরার যেন পুরো শরীর শিউরে উঠে। ইকরা ধীরে ধীরে পানি খেতে থাকে। যেনো রিয়াদ যে তার আঁচল টা পিঠে হতে ভালোভাবে দিয়ে দিচ্ছে তা না থামায়। কিছুক্ষণ পর রিয়াদ তার শাড়িটা একদম ঠিকঠাক করে দেয়। ধীর গলায় ইকরাকে বলে,

– এবার ঠিক আছে। এখন বাইরে যেতে পারো।‌

ইকরা পানির গ্লাস টা মুখ থেকে নামায়। রিয়াদ গ্লাসটা ইকরার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে দেয়। দিয়ে সামনে তাকায়। দেখে ইকরা বিছানা হতে উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে নিজের শাড়িটা দেখতে দেখতে বলে,

– ঠিক আছে তো সবকিছু ,,!

– হ্যা।

– পিছনে ,,! (বলেই ইকরা ঘুরে দাঁড়ায়)

– হ্যা এদিকেও ঠিক আছে।

তখনই বাইরে থেকে রাতুলের ডাক শোনা যায়,

– রিয়াদ ,,! বাইরে আয়। ওরা চলে যাইতেছে।

– হ্যা ভাইয়া যাচ্ছি।

বলেই রিয়াদ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। ইকরার মন খারাপ হয়ে যায়। ওকে চলে যেতে হবে। আবার কতদিন পর যে তাদের দেখা হবে তা তার জানা নেই। মন গহীন থেকে যেন এক কষ্ট মিশ্রিত চাপা কান্না বেড়িয়ে আসতে চায়। সে এক ছলছল নয়ন নিয়ে এসে রিয়াদের সামনে দাঁড়ায়। তার হাত নিজের হাতে তুলে ধরে। ধীর গলায় বলে,

– প্লিজ আমার অনার্স পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করিও ,,! আমি আবার ফিরে আসবো। প্লিজ থাকিও।

– আমি,আমি অপেক্ষায় থাকবো।

রিয়াদের এই কথাটায় ইকরা মনে সাহস পায়। তার মনে হতে থাকে যেনো  সে পুরো এক রঙিন দুনিয়া পেয়ে গিয়েছে। তার প্রিয় মানুষের তরফ থেকে সম্মতিসূচক বার্তা পেয়েছে। এর চেয়ে খুশির কিছুই যেন তার কাছে নেই। কিছুই নেই। সে রিয়াদকে আবার জড়িয়ে ধরে। রিয়াদও এবার তার হাত দুটো উচিয়ে ইকরাকে জড়িয়ে ধরে। এই প্রথম কোন মেয়ের সাথে তার আলিঙ্গন। বুকে নতুন কিছুর আভাস পাচ্ছে সে। এই অনুভূতি টা সম্পূর্ণই নতুন। এটাকেই কী ভালোবাসা বলে ,,! হয়তোবা। তবে এর আগে রিয়াদ হয়তো কাউকে ভালোবাসেনি বলে এই অনুভূতির জানান পায়নি। ইকরা তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। একটা মেয়ের কী আলিঙ্গন এতোটাই গভীর হয় ,,! পুরো শরীর যেন উষ্ণতায় ভরা।‌ তার প্রত্যেকটা স্নায়ু যে ইকরাকে আরো গভীর করে পেতে চাইছে। রিয়াদ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইকরাকে। ইকরা বুঝতে পারে রিয়াদের ভিতর টা। সে তে রিয়াদের বুকেই মাথা রেখে আছে। রিয়াদ তার থেকে লম্বা। ইকরা তার বুক বরাবরই। রিয়াদের বুকের ভিতর থেকে সে নতুন কিছুর আওয়াজ পাচ্ছে। হয়তো এটাই রিয়াদের গুপ্ত কুঠুরি। যেটার খোলা দরজায় ইকরাকে সে যতনে রেখে দিবে ,,!

 

– রিয়াদ, ওরা চলে ,,,,,,,,

মায়া ভাবি কথাটা ‌বলতে গিয়েও থামিয়ে দেয়। মায়া ভাবির কথা রিয়াদ আর ইকরার কানে আসতেই তারা দুজন দুজনকে ছেড়ে দেয়। মায়া ভাবি প্রচন্ড অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। ইকরা আর রিয়াদ দুইজন দুইজনকে ছেড়ে পাশাপাশি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছে। মায়া ভিতরে এগিয়ে এসে দুজনার সামনে দাঁড়ায়। মুখের কাছে হাত নিয়ে অবাক স্বরে বলতে থাকে,,

– রিয়াদ,,,, ইকরা ,,,! আমি ভুল কিছু দেখলাম না তো,,,! তোমরা একে অপরকে,,,,,,,,

– ভাবি আসলে ,,

ইকরা রিয়াদকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

– আমি রিয়াদকে ভালোবাসি।

রিয়াদ নয়ন তুলে তাকায় ইকরার দিকে। মায়া যেন আকাশ থেকে পড়লো এ কথা শুনে। সে কি বলবে তা ভেবে উঠতে উঠতেই ইকরা আবার বলে,

– আমি রিয়াদকে বিয়ে করতে চাই। ওর সাথে একসাথে থাকতে চাই। (বলেই মাথা তুলে মায়ার দিকে তাকায় ইকরা)

মায়া যেন বাক হারা হয়ে গেছে। সে এসেছিলো এদের দুজনকে নিতে আর এসেই হঠাৎ এই কথা ,,! কী বলবে এখন সে ,,! তখনই ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেন শিউলি বেগম। হাতে তালি দিতে দিতে মৃদু হাসতে হাসতে এগিয়ে আসেন।

ইকরা কিছুটা ভয় পায় এবার। তার ফুফু এখানে কেনো আসলো ,,! ইকরা মাথা নিচু করে নেয়। শিউলি বেগম মৃদু হাসতে হাসতে মায়ার কাঁধ ধরে দাঁড়ান। বলেন,

– কী মায়া, তোমার দেবর রে আমার ভাতিজির হাতে তুইলা দিবানি ,,!

শিউলি বেগমের কথা শুনেই ইকরা আর রিয়াদ চকিতে মাথা তুলে তাকায়। তারা ভেবেছিলো শিউলি বেগম এমনিই হাসতে হাসতে ভিতরে আসছিলেন কিন্তু না। তিনি দেখি ডিরেক্ট প্রস্তাব নিয়ে হাজির। শিউলি বেগম তাদের অবাক মুখ খানার দিকে চেয়ে বলতে থাকেন,

– কী ভাবছো ,,! আমি কিছুই জানিনা,,! জানালা দিয়া সব দেখছি খাড়ায় খাড়ায় আমি আর মায়া। তোমাগো দুইজনের মধ্যে যেহেতু কেউই ডিরেক্ট প্রপোজ করোনাই এরলাইগা মায়ারে সাইডে ডাইকা ওরে সব শিখাইয়া দিয়া ঘরে পাঠাইলাম। এইডা দেখতে যে ভালোবাসার কথাডা কে আগে কয়। আর ইকরা কইয়া দিছে। তারমানে বিয়া লাগবো ,,,,! তাই না মায়া ,,! (বলেই মায়া আর শিউলি বেগম হাসতে থাকে। ইকরা আর রিয়াদ এসব দেখে যেনো বোকাবনে যায়। তারা একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে আবার শিউলি বেগমের দিকে ফিরে তাকায়। শিউলি বেগম বলতে থাকেন,

– আমি ইকরার বিষয়ে অর বাপ মায়ের লগে কথা কমুনে। আর মায়া, তুমি বুজাইবা রাতুল রে। এই দুই পাখিরে এক ঘরে করা লাগবো যে ,,! হা হা হা,,!

– ঠিক বলছেন চাচি। রিয়াদ কিনা ইকরার শাড়ি ঠিক করে দিচ্ছিলো,,,! আমি তো দেখেই বেহুঁশ,,! হা হা হা,,!

ইকরা রিয়াদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শিউলি বেগম আর মায়ার হাসাহাসি দেখছে। তারাও দুইজন মুচকি হাসি দিয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। হঠাৎ কী থেকে কী যে হয়ে গেলো ,,! তবে যা হয়েছে দুই আত্মার সম্মতিতেই হয়েছে। অত গুরুতর তো কিছু না। রিয়াদ খালি কোলে নিয়েছে, এই আরকি।

 

তখনই বাইরে থেকে রাতুলের ডাক ভেসে আসে,

– এই তোমরা বের হইলা ,,! এরা যে চলে যাবে কালকে। তাড়াতাড়ি ঘুমাইতে হবে। আসো তাড়াতাড়ি।

 

শিউলি বেগম ডাক শুনে হাঁসি থামান। মায়াকে বলেন,

– থামো থামো,, আর হাইসো না। চলো, আমাগোরে এহন আগাইয়া দাও।

– হ্যা চাচি চলেন। অনেকদিন পর মন খুলে হাসলাম,,!

– ফুফু ,,! আমি উনার সাথে বাইকে করে যাই ,,! (ইকরা)

– যা। কাইল তো যাবিই গা। আবারো ১-২ মাস পর দেহা হইবো আল্লাহ বাচাইলে। যা তোরা বাইকে যা আমরা হাইটা আইতাছি।

শিউলি বেগমের থেকে অনুমতি পেয়েই ইকরা হাসি মুখে রিয়াদ কে বলে,

– চলেন আমরা বের হয়ে পড়ি।

– দাঁড়াও চাবিটা নিয়ে নেই।

 

রিয়াদ আর ইকরা বাইকে উঠে পড়ে। রাতুল আর বাকিরা বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। রাতুল বলে,

– আস্তে ধীরে যাইস। জোড়ে চালাইস না আবার।

– আচ্ছা ভাইয়া। তোমরা আসতে থাকো। আমি যাই।

– ইকরা, রিয়াদরে শক্ত কইরাই ধরিস ,,! নাইলে রাস্তায় গড়াইয়া কইত্তে কই পড়বি টেরও পাইবিনা ,,,!

শিউলি বেগমের কথায় উপস্থিত সবাই হেঁসে উঠে। ইকরা শুধু এক হাত উঠিয়ে রিয়াদের কাঁধে রাখে। এখানে তার বাবা-মাও আছে তাই সে বেশি কাছাকাছি বসেনি। একটু দুরত্ব রেখে বসেছে। রিয়াদ বাইক স্টার্ট দেয়। বাইক চালিয়ে বের হয়ে যায় বাসার গেইট দিয়ে।

 

বাইক নিয়ে রাস্তায় উঠে রিয়াদ। বাইক চালিয়ে চলে যেতে থাকে কাঁচা রাস্তার মাঝ দিয়ে। ইকরা সাথে সাথেই রিয়াদের খুব কাছাকাছি হয়ে বসে। যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসা যায় সে তারচেয়েও বেশি ঘনিষ্ট হয়ে বসার চেষ্টা করে। রিয়াদ বলে,

– এতো কাছে এলে যে আমায় আমি হারিয়ে ফেলবো,,!

– ফেলেন। আপনি আমি হারিয়ে যাই ,,! কেউ তো নেই।

রিয়াদ একটা মুচকি হাসি হাসে। জোছনা রাত। আকাশের গোল থালার মতো চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে রাতের আকাশ হতে। দূরের তারাকারাজিও ঝলমলিয়ে উঠছে। হালকা কুয়াশা। রাস্তায় কেউ নেই। একদম ফাঁকা। দুই পাশে হালকা দূরত্বে থাকা সাড়ি সাড়ি গাছ গুলো পিছনে চলে যাচ্ছে। ইকরা এইবার রিয়াদের কাধ থেকে হাত সরিয়ে রিয়াদের শরীর জড়িয়ে ধরে। রিয়াদের কাঁধে মাথা রাখে। পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

– আপনার শরীর অনেক গরম ,,,! আমার তো মন চাইছে এখানেই জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাই ,,!

– আরে না না। পড়ে যাবে তখন।

– আচ্ছা ঘুমাবো না। তবে আপনার শরীর ধরে গরম ছোঁয়া নেবো।

– শীত লাগছে নাকি ,,!

– হমম কিছুটা।

– তাইলে জড়িয়ে ধরে রাখো। গরম বলে লাগছে আমার শরীর।

 

ইকরা রিয়াদের দেহটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার দেহের ঘ্রান নিতে থাকে প্রাণ ভরে। একটু আগেও তার স্বপ্ন ছিলো রিয়াদের গায়ের ঘ্রান খুব কাছ থেকে নেওয়ার। আর স্বপ্নটাও তার পুরন হয়ে গেলো। আর আদর করে জড়িয়েও ধরতে পারলো।

ইকরা গুন গুন করে গান গাইতে থাকে। রিয়াদ তার গুন গুন গান শুনে ধরে ফেলে গান টাকে। রিয়াদ বলে,

– গান টা তোমার পছন্দের,,!

– এই রোমান্টিক আবহে শুধু এই গান টাই যায়।

– হমম তাও ঠিক।

– গান টা একটু আমার জন্য গাইবেন,,!

– আমি তো গান পারিনা ,,!

– তাও শুধু আমার জন একটু ধরুন না গান টা ,,! প্লিজ ,,!

– ওকে ,, দেখি চেষ্টা করে,,!

 

জোছনা রাতের এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের মধ্য দিয়ে কাঁচা রাস্তায় চলে যাচ্ছে একটা বাইক। হালকা বাতাসের ঝাপটায় ইকরার চুল গুলো উড়ছে। দূরের কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে ঘন হচ্ছে। রিয়াদ গান ধরে,

– এই রাত তোমার আমার,,,,

ঐ চাঁদ তোমার আমার ,,,!

শুধু দুজন,,,!

 

রিয়াদ থেমে যায়। বলে,

 

– এই তিন লাইন ছাড়া আর জানিনা।

– তিনটে লাইনই বেশ সুন্দর করে গেয়েছেন আপনি,,!

– সত্যি,,!

– হ্যা। (বলেই রিয়াদকে আরো চেপে জড়িয়ে ধরে ইকরা)

– কাল তো চলে যাবে তাই না ,,!

– হমম। (ধীর গলায়)

– সকালের ট্রেন,,!

– হমম,, ৭ টার ট্রেন আমাদের।

– আমি দেখি আসতে পারি কিনা। ভাবিকে বলতে হবে সকাল সকাল তুলে দেওয়ার জন্য।

– আপনি আসিয়েন। আমি রেলস্টেশনে আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো।‌

– আচ্ছা ঠিক আছে তাইলে আসবো।

– আমরা কবে বিয়ে করছি ,,!

– এইতো তোমার অনার্স পরীক্ষার পর।

– কিন্ত আমার যে এখনি বিয়ে করতে মন চাইছে। আপনাকে এভাবেই সারারাত জড়িয়ে ধরে থাকতে মন চাইছে ,,!

– থেকো। তবে বিয়ের পর ,,! হি হি হি।

– আমরা সবার আগে ও বাড়িতে পৌছাবো তাই না ,,!

– হ্যা। কেনো,,!

– কিছুনা। এমনিই। আপাতত তো আপনাকে জড়িয়ে ধরে থাকতেই আমার ভালো লাগছে‌।

– কী যে বলছো কিছুই বুঝতেছিনা।

– বুঝা লাগবে না আপনার।

ইকরা মনে মনে ভেবে রাখে ওবাড়িতে পৌছাবার পর রিয়াদকে সে চুমু খাবে। তার ভিতরে এই ইচ্ছটা খুব ডানা ঝাপটা ঝাপটি করছে। রিয়াদ বিষয়টা বুঝতে পেরেছে কিনা সেটা সে জানেনা। তবে ওখানে নামার পর সে তার দুই ঠোঁট গভীর আলিঙ্গনের সহীত ভিজিয়ে নিবে এটাই তার এখনকার লক্ষ্য। তার কেনো যেনো আজ আজব আজব সব ‌ইচ্ছে জাগছে। শরীর নিজে থেকেই রিয়াদকে কাছে টানছে। কেনো যে তার এসব হচ্ছে এটা আজ অজানা তার ডায়রিতে,,,!

 

বাইক হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে যায় কুয়াশা ভেদ করে। দূরে থাকা আকাশের চাঁদও যেন ধীরে ধীরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। ইকরা রিয়াদের পিঠে মাথা রেখে গুন গুন করে গান গাইছে। আর উপভোগ করছে এই জোছনা রাতের স্নিগ্ধতায় তার প্রিয়তমকে। তার মন বারবার বলছে এই সময়টা যেন থমকে যায়। রিয়াদ আর সে যেন মিলিত হয়ে যায় এক অসীমতার প্রান্তরে। হঠাৎই তার মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া গান বলে উঠে ,,

” এই পথ যদি না শেষ হয় ,,! তবে কেমন হতো তুমি বলোতো ,,,!

যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,,,! তবে কেমন হতো তুমি বলোতো ,,,,! ”

 

 

 

আসুভে, তান্ত্রিক আর হনুফা কিছু নিয়ে একে অপরের সাথে গল্প করছিলো। রাত এখন গভীর। আজ বৃষ্টি নেই। তাই আশপাশের গাছের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বেশ ভালোই শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শিয়ালের দল বেঁধে ডাকা-ডাকির শব্দও কানে আসছে। জঙ্গলের মাঝের কোন বাড়িতে থাকা মানে এক কথায় পশুপাখিদের সঙ্গে থাকা।

 

ঘরের দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ আসে। হনুফা বলে উঠে,

– মনে হয় লায়লা আসছে।

– হ্যা। দরজা খুলে দে।

হনুফা হাত দিয়ে ইশারা করে। আর দরজা খুলে যায়। লায়লাই ছিলো দরজার অপর পাশে। হাতে একটা টিফিন বাটি। লায়লা ঘরের ভিতরে চলে আসে। হনুফা হাতের ইশারায় দরজা বন্ধ করে দেয়। তান্ত্রিক বলে,

– আজ এতো দেরি হলো যে ,,!

– আইজ আমরা রাতুল ভাই গো বাড়িত দাওয়াত খাইতে গেছিলাম। ঐহান থেইকা বাড়ি আইয়া সবার ঘুমানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগছে। এরলাইগা আইজ একটু দেরি।

– আসুভের খাবার এনেছিস ,,!

– হ। এইযে।(হাতের টিফিন বাটিটা তুলে দেখায় লায়লা)

– দে, ওকে খাবার দে।

বলেই তান্ত্রিক উঠে দাঁড়ায়। হনুফা আসুভের পাশেই বসে আছে। আসুভের পড়নে লায়লার একটা জামা। আজ সকালে এসে লায়লা দিয়ে গেছিলো দুপুরের খাবারের সাথে। লায়লা গিয়ে আসুভের পাশে বসে। টিফিন বাটি ‌খুলতে থাকে। আসুভে আজ বিরক্ত হয়না। সে এখন নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে লায়লার সাথে। সে নরম গলায় বলে,

– কী এনেছিস আজকে ,,!

– পোলাও, আর গরুর মাংস। লগে আলু ভাজিও আছে।

তিনটা বাটি খুলে আসুভের সামনে রাখে। আসুভের খিদা পেয়েছিলো বেশ। তাই সে লায়লার দিকে একবার দেখে পোলাওয়ের বাটিটা হাতে তুলে নেয়। মাংসের বাটি থেকে এক পিছ মাংস উঠিয়ে নেয়। হনুফা নিজে আত্মা হলেও ললুভ দৃষ্টি নিয়ে খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। লায়লা আসুভের পাশেই বসে আসুভেকে দেখছে। আসুভে মাংস তুলে নিয়ে ভাজির বাটিটা টেনে সামনে নেয়। সেখান থেকে ভাজি উঠাতেই যাবে, তখনই দাঁড়িয়ে থাকা তান্ত্রিক কর্কশ গলায় বলে উঠে,

– থেমে যা আসুভে, ঐ বাটির তরকারিতে বিষ মেশানো আছে ,,,,!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৭

লেখক:: মির্জা শাহারিয়া

 

– কী এনেছিস আজকে ,,!

– পোলাও, আর গরুর মাংস। লগে আলু ভাজিও আছে।

তিনটা বাটি খুলে আসুভের সামনে রাখে লায়লা। আসুভের খিদা পেয়েছিলো বেশ। তাই সে লায়লার দিকে একবার দেখে পোলাওয়ের বাটিটা হাতে তুলে নেয়। মাংসের বাটি থেকে এক পিছ মাংস উঠিয়ে নেয়। হনুফা নিজে আত্মা হলেও ললুভ দৃষ্টি নিয়ে খাবার গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। লায়লা আসুভের পাশেই বসে আসুভেকে দেখছে। আসুভে মাংস তুলে নিয়ে ভাজির বাটিটা টেনে সামনে নেয়। সেখান থেকে ভাজি উঠাতেই যাবে, তখনই দাঁড়িয়ে থাকা তান্ত্রিক কর্কশ গলায় বলে উঠে,

– থেমে যা আসুভে, ঐ বাটির তরকারিতে বিষ মেশানো আছে ,,,,!

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আসুভে,হনুফা,লায়লা চকিতে মুখ তুলে তাকায় তান্ত্রিকের দিকে। তারা যেনো এ কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো। তান্ত্রিকের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে হনুফা আর আসুভে দেখতে থাকে লায়লাকে। তাদের চোখে আগুন সমান রাগ। লায়লা ভয় পায়। সে ইতস্তত হয়ে বলে,

– আ,আমি। আমি কিচ্ছু জানিনা আফা। আমি তো কড়াই থেইকাই তুইলা আনছিলাম।

তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তান্ত্রিক ধমক দিয়ে বলে উঠে,

– চোপ,,! বিশ্বাসঘাতক, নিমোক হারাম। আমাদের সাথে গুটিবাজী করতে চেয়েছিলি তুই ,,! এই হনুফা। ওকে বেঁধে ফেল। ও যেন পালাতে না পারে।

– আশ্চর্য। আমি, আমি কিছু করিনাই। আমি বিশ্বাসঘাতক হইতে যামু ক্যান। হনুফা আফা, আফা আমারে ছাইড়া দেন। আমি তো নিজেই এই ভাজি খাইয়া তারপর উডাইছি। এইহানে বিষ থাকলে আমি তো মইরা যাইতাম ,,!

– তুই মিথ্যে বলছিস। এই হনুফা, থামলি ক্যান।ওকে বেঁধে ঘরের কোণে ফেলে রাখ। আমাদের সাথেই মিশে আমাদেরকেই কেমন মারতে চেয়ছিলো ও ,,!

– সত্যি কইতাছি। আমি, আমি বিষ মিশাই নাই। আপনারা কইলে আমি এহনি ভাজি ডা আপনাগো সামনে খাইয়া দেখতাছি ,,!

বলেই হনুফার থেকে নিজের হাত ছাড়াতে থাকে লায়লা। কিন্তু হনুফা শক্ত করে ধরে রাখায় সে হাত ছুটোতে পারেনা। তান্ত্রিক কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,

– সত্যি ভাজি খাইতে পারবি তো এখন ,,!

– হ, আমি সত্যিই খাইয়া দেহামু। হনুফা আফা, আমি ব্যাথা পাইতাছি। আমার হাত ছাইড়া দেন।

– হনুফা, ছেড়ে দে ওর হাত। দেখি ও ভাজিটা নিজে খায় কি না।

হনুফা তান্ত্রিককের আদেশ পাওয়ার সাথে সাথেই লায়লার হাত ছেড়ে দিয়ে তার পিছন থেকে গায়েব হয়ে যায়। আবার সামনে দৃশ্যমান হয়। ভাজির বাটিতা তার দিকে এগিয়ে দিতে থাকে। বলে,

– নে খা। দেখি কেমন খাইতে পারিস ,,!

লায়লা ভাজির বাটিটা কাছে টেনে নিয়ে সেখান থেকে ভাজি উঠায়। একদম নিশ্চিন্তে, স্বাভাবিক ভাবেই সে ভাজি টা হাতে তুলে। তার কাছে যেনো এই ভাজি আসলেই বিষমুক্ত মনে হচ্ছিলো। তান্ত্রিক, আসুভে, হনুফা এক নজরে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। লায়লা তাদের দিকে চোখ না দিয়ে মুখের সামনে ভাজি তুলে। মুখে দিতেই যাবে তখনই তান্ত্রিক বলে উঠে,

– থাম,,,,!

সাথে সাথেই আসুভে থেমে গিয়ে তান্ত্রিকের দিকে চেয়ে তাকায়। আসুভে আর হনুফাও মাথা তুলে তাকায় তান্ত্রিকের দিকে। তান্ত্রিক বলে,

– সত্যি তুই ঐ বাটিতে বিষ মিশাশ নি ,,?

– কসম, আমি সত্যি কোন বিষ মিশাই নাই। আমি তো দিথী আফার পায়েশে আইজ সকালে মিশাইছিলাম। তাছাড়া আর কোথাও মিশাই নাই।

– সরি তো ,,!

– হ। আমি এইযে আসুভে আপার মাথা ছুইয়া,,,,

আসুভের মাথায় হাত দিতেই আসুভে তার হাত ছিটকিয়ে সড়িয়ে দেয়। লায়লা হাত নামায়। আবার তান্ত্রিকের দিকে চেয়ে বলে,

– আসলেই আমি কিছু মিশাই নাই।

– তুই যদি দিথীর পায়েশে বিষ মিশায় থাকিস, তাইলে আজকে দিথী মরলো না ক্যান ,,! (হনুফা কর্কশ গলায় বলে উঠে)

– আমি কী জানি। আমার কাম ছিলো দিথী ভাবির বাটিতে মিশানোর, আমি মিশাইছি। দিথী ভাবি খাইছেও। তাইলে তারপরও ক্যান বিষ কাম করে নাই হেইডা আমি কেমনে কমু ,,!

– দিথী সেই পায়েশ টা খেয়েছিলো ,,!

– হ্যা। আমি জানালার বাইরে থেকে দেখছি। দিথী পায়েশ টা খেয়েছিলো। আর মুখে তুলার আগে কি যেন করছিলো পায়েশের উপর। আমি ফুঁ দিতে দেখছি ওকে। (হনুফা)

– তাইলে গাধি ফুঁ দিয়ে যে খাইতে দেখছিস এই খবর আমাকে দিছিলি ,,! আমি তোকে কী কাজে রাখছিলাম,,?

– স,সরি। ভুল হয়ে গেছে ,,! (মাথা নিচু করে মৃদু গলায়)

– হ্যা। এখন তো বলবিই এই কথা। আমার রাগ উঠাইস না কিন্তু আর হনুফা। তোকে কাজ দিছি তুই কাজ ঠিকঠাক মতো করবি আর খবর আনে দিবি। অথচ তুই আমাকে কোন খবরই দিস না ,,!

– আর হবে না। (মাথা নিচু করে) মাফ করে দেন‌।

– ধুর ,,! আমার আর কিছুই ভালো লাগতেছে না। নিশ্চিত দিথীর মা ওকে সাহায্য করছে। (আসুভের দিকে তাকিয়ে) তুই যে ক্যান দিথীর মা’কে মারার সময় তার আত্মা টাকে ছেড়ে দিলি আমার বুঝে আসেনা। সব যায়গায় যায় এখন বিপত্তি বাধাইতেছে ঐ মহিলা। বিয়ের দিন কইথেকে এক মেয়ে পাঠাইলো, আমরা মারতে পারলাম না। কয়বার দিথীকে মারার চেষ্টা করছি, তাও ও আসে বাঁচায় দিছে। দেখ আমি বলে রাখতেছি ও আমাদের কখনোই সফল হতে দিবে না। হয় আগে ওকে ধ্বংস করতে হবে নাইলে আসুভে, তুই তোর এই পৃথিবীতে শক্তি ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন বাদ দে। এই মানুষ হয়েই থাকে যা ,,! (বিরক্ত হয়ে) যাই পরিকল্পনা করতেছি সব ভেস্তে দিতেছে,,! ধ্যাত ,,!

– আমি এখন কী খাবো ,,! (ধীর গলায় আসুভে মানে সুমু বলে)

– আমার মাথাটা খা। এটা খায় শেষ করে দে, তারপর আমিও হনুফা হয়ে যাই।

আসুভে মুখ গোমড়া করে মাথা নিচু করে ফেলে। তান্ত্রিক বিরক্ত হয়ে ঘরে পায়চারি করতে থাকে। লায়লাও মন খারাপ করে বসে আছে। হনুফা একবার ঘরের এক যায়গায় উদয় হইতেছে তো আবার গায়েব হয়ে অন্য যায়গায় আসতেছে। তান্ত্রিক কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকেন। নিজের চড়ে থাকা মেজাজ টাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন। ঘরে থাকে কিছুক্ষণ পিনপন নিরবতা। বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর তান্ত্রিক আসুভের দিকে না ফিরেই পায়চারি থামিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে ধীর গলায় বলেন,

– ঐযে পোলাও আর মাংসটা আছে, ঐ দুইটা খেয়ে নে। এই দুইটায় কোন বিষ নাই।

আসুভে তান্ত্রিকের কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়। তারপর আবার নজর ঘুড়িয়ে লায়লার দিকে তাকায়। লায়লা হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। আসুভে পোলাওয়ের বাটিটা হাতে তুলে। সেখানে আগেই তুলে রাখা এক পিচ মাংস দিয়ে খেয়ে নিতে থাকে। লায়লা ভাজির বাটিটার ঢাকনা লাগিয়ে দিয়ে রেখে দেয়। হনুফা ললুভ দৃষ্টি নিয়ে একবার আসুভের মুখের কাছে উদয় হইতেছে তো আরেকবার ঘরের অন্য প্রান্তে। হনুফা যেন এখন সবসময় মজার মুডে থাকতেছে। ও যেন প্রত্যেকটা মুহূর্তকে মজার করে রাখার চেষ্টা করতেছে। একবার গিয়ে আসুভে সামনে উদয় হয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো হাঁ করছে খাওয়ার জন্য। আসুভে ভাতের নলা তার মুখে দিতে গেলেই তখনই তারা দুজনের খেয়ালে আসে যে হনুফা তো কালো ধোঁয়া। ভাত কীভাবে খাবে ও। হনুফাও দুঃখ চেহারা করে ঘরে ছুটোছুটি করতে থাকে‌। লায়লা এদের দুইজনের কর্মকান্ড দেখে বেশ মজা পাইতেছে। এদিকে তান্ত্রিক ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছে। থুতনিতে ঝুলে থাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দেয়ালের দিকে একপানে চেয়ে আছেন তিনি।

 

দূর থেকে ভেসে আসে কিছু জীবজন্তুর ডাকাডাকির আওয়াজ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বেড়েছে। মাঝে মাঝে কিছুটা বাতাস এসে গাছের পাতা গুলোকে নাড়িয়ে শব্দ করে চলে যাচ্ছে। জঙ্গল মানেই যেন প্রাকৃতিক শব্দের ছড়াছড়ি।

 

 

 

ট্রেনের বগির ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ আর শাহারিয়া। সিটে বসেছে আফাজ, ইকরা, ও তাদের বাবা-মা। সময়টা এখন সকাল। চারপাশ কুয়াশা ঢাকা। সকাল ৭ টার ট্রেন। এইজন্য বেশ সকাল সকালই স্টেশনে আসতে হয়েছে তাদের। শাহারিয়া হাত ঘড়ি উঠিয়ে দেখে ৬ টা ৫৬ বাজে। মানে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিবে। রিয়াদ কিছু খাবার পানি আর হালকা নাস্তার প্যাকেট আফাজ আর ইকরার হাতে দেয়। বলে,

– রাস্তায় লাগবে। (একটু থেমে) আর শোন, জানালা দিয়ে হাত, মাথা বের করিস না। কয়দিন আগে একজন চলন্ত ট্রেনে দরজায় ঝুলতছিলো তখন একটা সিগন্যাল খুঁটির সাথে ধাক্কা খায় ছিটকে ট্রেন থেকে পড়ে গেছে। আর অমনি স্পট ডেড। এই তোরা আসার কয়েকদিন আগের ঘটনা। এইজন্য মাথা, হাত জানালা দিয়ে বের করিস না। সাবধানের মাইর নাই। কখন সিগনাল খুটির সাথে লেগে যাবে টেরও পাবিনা।

– আচ্ছা ভাইয়া।

– আঙ্কেল,আন্টি। রংপুরে আফাজরা নেমে যাবে তাইনা।

– হ্যা বাবা। আমার ভাইটা অসুস্থ। এইজন্য আমি আর তোমার আঙ্কেল সৈয়দ পুর যাচ্ছি। (আলিশা আফাজকে উদ্দেশ্য করে) ওরা রংপুর স্টেশনেই নেমে যাবে। কাল থেকে ক্লাস শুরু। তাই আজকে একটু বাসায় গিয়ে প্রিপারেশন নোক।

– ওহ,,, হ্যা ভালোই হইছে। নাইলে তখন জার্নি করে সৈয়দপুর থেকে আসে কাল ক্লাস করতে পারবেনা।

 

ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। অর্থাৎ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। শাহারিয়া বিদায় নিয়ে নিতে থাকে আঙ্কেল, আন্টির থেকে। রিয়াদ আফাজ আর ইকরাকে বলে,

– আফাজ, আবার আছিস। এইবার আসলে বেশি দিন থাকবি কিন্তু। যায় ভালো করে পড়িস। (ইকরা দিকে মুখ ফিরিয়ে) ভালো করে পড়িও। আমি আসবো তোমাদের বাসায় একয়দিনের মধ্যে। ভালো করে অনার্স টা দাও, তারপর বাকিটা, কেমন ,,!

– আচ্ছা। (মিষ্টি গলায় বলে ইকরা)

শাহারিয়া সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। রিয়াদও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজন একসাথে চলে যেতে থাকে বগির গেইটের দিকে। ট্রেন ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে। শাহারিয়া আর রিয়াদ ট্রেন থেকে নেমে পড়ে প্লাটফর্মে। ট্রেন চলে যেতে থাকে হুইসেল বাজিয়ে। গতি ধীরে ধীরে বাড়িয়ে প্লাটফর্ম ছেড়ে যায়।

 

প্লাটফর্মে এখন কোলাহল তেমন টা নেই। দূরে কয়েকটা চায়ের দোকান ছাড়া বাকি সব দোকান বন্ধ। এইটা সকালের প্রথম ট্রেন ছিলো। তাই তখনও স্টেশন পুরোদমে চাঙ্গা হয়ে উঠেনি।

শাহারিয়া রিয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

– কী দেখতেছিস অমন করে, ট্রেন তো চলে গেছে।

– না মানে দেখছিলাম আরকি ট্রেন টার যাওয়া টাকে। ট্রেনে থাকা মানুষটা যে একদিনে আমার অনেক কাছের হয়ে গেছে রে ,,! (ধীর গলায় বলে রিয়াদ)

রিয়াদের এমন ধীরকন্ঠী মলিন গলা শুনে শাহারিয়া তার কাঁধে হাত রাখে। বলে,

– কী রে ,,! তুই হঠাৎ এমন বাত্তির মতো ফিউজ হয়ে গেলি ক্যান,,! নতুন কিছু চলতেছে নাকি মনের ভিতর ,,!

– কেউ দৌড়ে দৌড়ে আমার মনের বাগানে ফুল তুরতেছে রে,,! (বুকের বা পাশে হাত উঠিয়ে) আমি ফিল করতে পারতেছি ,,!

– মামা,,,! কেস টা কী ,,! কিছুই তো বুঝতেছিনা,,?

রিয়াদ বুক থেকে হাত নামিয়ে শাহারিয়ার দিকে ফিরে। বলে,

– চল যাইতে যাইতে বলতেছি। এখানে দাঁড়ায় বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে।

– তোর কিছুই আমার ভালো ঠেকতেছে না ,,! (কানের কাছে গিয়ে) কারো প্রেমে পড়ছিস নাকি ,,!

– হ্যা।

– আরে মাম্মা,,! তাইলে তাড়াতাড়ি চল। পুরা কাহিনী আমারে শুনতে হবে। চল চল। (বলেই রিয়াদের হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে শাহারিয়া। রিয়াদও মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে তার সাথে যেতে থাকে। বাইক স্টেশনের বাইরে পার্ক করে রাখা। সেদিকটায় যাচ্ছে তারা দুজন। শাহারিয়া উচ্ছসিত রিয়াদের নতুন প্রেম সম্পর্কে জানার জন্য। এদিকে রিয়াদ কিছুটা ব্যাথিত, কারণ তার একদিনের মধ্যে প্রিয় হয়ে উঠা মানুষটা আজ চলে গেছে। তবে তাতে কি। ও আর কয়েকদিনের মধ্যে ওদের বাসা গিয়ে দেখা করে আসবে। বিয়ে তো করতেছেই আর ২-৩ মাস পর। যাওয়া-আসা চালু রাখা লাগবেনা ,,,!

স্টেশন চত্বরে  মানুষের পদধূলি পড়তে শুরু করেছে। কুয়াশার চাদরে চারপাশ ঢাকা। কিছু কিছু লোক প্ল্যাটফর্মের সামনে বসে দাঁত মাজছে। হয়তো তারা এই স্টেশনেই থাকে।

 

 

 

নিপা ঘর গুছাচ্ছে। একটু আগেই রায়হান বেড়িয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় রায়হান সহ বাড়ির বাকি ছেলেরা বেড়োয় তাদের দিনাজপুর শাখা অফিসে যাওয়ার জন্য। এখানে তাদের ফিড মিল আর গোডাউন আছে। প্রতিদিন গিয়ে কাজ দেখাশোনা আর ম্যানেজারের কাছ থেকে বস্তার হিসাব নিতে হয়। দুপুর ২ টার দিকে আবার সব ছেলেরা বাসায় ফিরে আসে। এইসময় টায় নিপা ঘরে হয় আলিশাকে ডেকে নিয়ে গল্প করে, নয়তো আঁখিকে ডেকে গল্পের আসর জমায়। তবে আলিশা আঁখি ওরা দুইজনই সকাল ১০ টার পর আসে। এরমধ্যে আলিশাকে বলে তার মা’কে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হয় আর আঁখিকে রান্নাঘরের দিকটা একটু দেখতে হয়। এই ৯ টা থেকে ১০ টা নিপাকে একলা একলাই ঘরে থাকতে হয়। এই সময়টায় সে ঘর গুছায়, রায়হানদের কাপড় গুলো স্ত্রী করে রাখে, ঘর দোর একদম ক্লিন রাখে। তবে আজকে কেনো জানি তার ঘরে মন বসছে না। নিচে যেতে মন চাইছে। তবে তার যে ছোট্ট একটা কারণও আছে। সে নিচে গিয়ে সুরাইয়া বেগমকে দেখতে চায়। এই দুইদিন যখন গিয়েছিলো তখন তো ঘুমিয়ে ছিলো। এখন হয়তো নাস্তা খাচ্ছে ঘরে।

 

নিপা ঘরদোর সাফ করে হাতে ফোনটা নেয়। নিয়ে গাঁয়ে ওড়ানাটা দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় বাইরে থেকে। তার পড়নে এখন একটা হলুদ থ্রী পিস। নিজেকে আরেকবার দেখে নিয়ে পা বাড়ায় নিচে যাওয়ার জন্য। উপরের করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগোতে থাকে সে। দু পাশে গুটি কয়েক রুম। তবে সেগুলোর সামনে জুলছে ইয়া বড় বড় মরচে ধরা তালা। ঘরের দরজা গুলোর ডিজাইন দেখেই বোঝা যায় এই বাড়ির কর্তা কতটা সৌখিন ছিলেন। রায়হানের কাছ থেকে নিপা জানতে পেরেছে যে এই বাড়িটা তার দাদুর তৈরি। তার দাদু এককালে এই অংশের জমিদার ছিলেন। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর তিনি ব্যবসায় হাত দেন। আর তারপর থেকেই খাঁন বাড়ি ব্যবসা কেন্দ্রিক হয়ে উঠতে থাকে। সবাই ব্যবসার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিতে থাকে।

নিপা চারপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে যায় নিচে নামার সিঁড়ির দিকে। উপরের তলায় শুধু রায়হান-নিপা আর নজরুল-সুমনা দম্পতি থাকেন। নজরুল সাহেবের ঘর সিঁড়ি সামনে দিয়ে চলে যাওয়া করিডোরের দিকে। নিপা সেদিকে একবার তাকিয়েই সিঁড়ির হাতল ধরে নিচে নামতে থাকে। বাড়ি একদম নিশ্চুপ। দূরে ঝুলতে থাকা দেওয়াল ঘড়িটার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই কানে আসছেনা। নিপা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। চারপাশ তাকিয়ে দেখতে থাকে। তখনই দেখে রান্নাঘর থেকে ধোয়া প্লেটের থাক হাতে বের হলো আঁখি। সেই প্লেট গুলো নিয়ে গিয়ে ডায়নিং টেবিলের উপর রাখলো সে। আঁখি নিপাকে দেখেনি। নিপাও একদম ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলো চুপচাপ। আঁখিকে সে ডাকেনি। আঁখি চলে যায় আবার রান্নাঘরের দিকে। নিপা সেদিক থেকে নজর সড়িয়ে হাতের বাম দিকে চলে যাওয়া করিডোরে দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই করিডোরেই আলিশাদের রুম। নিপা হেঁটে হেঁটে করিডোরের দিকে যেতে থাকে। তখনই তার কানে একটা শব্দ এসে ঠেকে। সে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে একটা বোরখা পড়া মহিলা সিঁড়ি থেকে নামলো। বোরখা পড়া মহিলাটা নিপার দিকে ফিরে তাকায়। নিপা চিনতে পারে। এটাতো তার শাশুড়ি,,! মানে সুমনা বেগম। সুমনা বেগম তার মুখে কালো কাপড় উঠিয়ে দিয়ে কোন কথা না বলেই চলে যেতে থাকে অন্দরমহলের দরজার দিকে। নিপা আশ্চর্য হয়। তার দিকে ফিরে তাকালো অথচ একটা টু শব্দ করলো না। নিপাই নিজে থেকে যেচে বলে উঠে,

– মা, কোথাও যাচ্ছেন ,,!

সুমনা বেগম কথার উত্তর না দিয়েই চলে যায়। যেন তিনি কথাটা শুনেও শুনেননি। নিপা কিছুই বুঝতে পারেনা। সুমনা বেগম বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে চলে যান বাইরে। নিপা আর সেদিকে তাকিয়ে থাকে না। বিরবির করে বলে,

– কী আজব মানুষ, কথার উত্তর না দিয়েই চলে গেলো ,,?

নিপা হাঁটা ধরে করিডোরের দিকে। করিডোরে একটু পর পর দূরত্বে কিছু ছোট ছোট টেবিল রাখা। টেবিলে নানা মানুষের আদলে বানানো মূর্তি রাখা। এই রকম মূর্তি পুরো বাড়িতেই আছে। ছোট ছোট টেবিলে করে রাখা সব করিডোরেই। রায়হানের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল এটা তার দাদার মূর্তি। তার দাদা নিজের মূর্তি বানাতে দিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম হলেও মুর্তির প্রতি টার কেমন একটা জানি টান ছিলো।

 

নিপা এসে দাঁড়ায় আলিশার রুমের দরজার সামনে। পর্দা হাত দিয়ে সড়িয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ভিতরে সুরাইয়া বেগম বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তার পাশে বসে ছিলো আলিশা। আলিশার হাতে একটা বাটি। সে বাটি থেকে স্যুপ উঠিয়ে তার মা’কে খাওয়াচ্ছিলো। নিপাকে ঘরে আসতে দেখে তার দিকে ফিরে তাকায় আলিশা আর সুরাইয়া বেগম। সুরাইয়া বেগম কেমন যেন ম্যারম্যারা হয়ে ছিলেন। যেন দেহে প্রাণ থেকেও নেই। আলিশা নিপাকে দেখেই বলে উঠে,

– ও ভাবি তুমি। আসো বসো।

– হমম আমি। মা’কে কী খাওয়াচ্ছিস ,,! (একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে নিপা বলে)

– এইতো ভেজিটেবল স্যুপ। সোনালী আন্টি বলছে খাওয়াতে। এতে নাকি শরীরে শক্তি বাড়বে। (বলেই আরেক চামচ উঠিয়ে সুরাইয়া বেগমকে খাইয়ে দেয় আলিশা। সুরাইয়া বেগম এখন একদম সোজা দেওয়ালের দিকে একনজরে চেয়ে আছেন। যেন কোন এক মৃত লাশ তিনি। চোখ আধখোলা। নিপা বলে,

– তোর মা আমার কী হবে যেনো ,,!

– আমিও তো জানিনা। সম্পর্কের বিষয়ে আমি কাঁচা।

– আচ্ছা তাইলে আমি আন্টি করেই বলি তোর মা’কে। আজ রাতে ও আসলে ওর থেকে জেনে নিবো কী বলে ডাকা লাগবে তোর মা’কে।

– ও কে ?

– ঐ তোর দুষ্টু ভাইটা।

– ওহহ। হ্যা ভাইটা তো আমার বহুত দুষ্টু।

– আজকে স্কুল যাবিনা ,,!

– না আজও জাবোনা। ক্লাস হয়না এখন তেমন একটা।

– কে বলছে তোকে ,,! আর দুই মাস পর পরীক্ষা, আর এখন বলে ক্লাস হয়না। (একটু থেমে) না যাওয়ার ছুতা খুজতেছিস তাই না ,,!

– না ভাবি। সত্যিই তেমন একটা ক্লাস হয়না।

– যা গিয়ে গোসল করে নে। স্কুল যাবি আজ।

– না ভাবি। আমার যেতে মন চাইছে না। আমি তোমার কাছে পড়তে বসবো। স্কুল যেতে আমার একদম ভালো লাগে না।

– ক্যান ? স্কুল তোকে কী করছে ?

– আমার কোন বন্ধু নাই স্কুলে। চুপচাপ গিয়ে আবার চুপচাপ ক্লাস করে চলে আসতে আমার ভালো লাগে না। তোমার কাছে আজকে পড়তে বসবো আমি। স্কুল যেতে বলিও না প্লিজ ,,!

– ও ভালো মাইয়া। এইডা কেডা। (হাত তুলে নিপাকে দেখিয়ে আলিশাকে বলে সুরাইয়া বেগম)

– মা, ও আমার ভাবি। আমার ভাইয়ার বউ। ঐ যে রায়হান ভাইয়া আছেনা,,! ঐযে ভালো ভাইয়াটা, ওর বউ।

– ওহহ,,, (ধীর মিনমিনে গলায় বলে আবার এক নাগাড়ে সোজা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকেন সুরাইয়া বেগম।

 

আলিশার স্যুপ খাওয়ানো শেষ হয়। বাটি হাতে নিয়ে বিছানার আরেক পাশ হতে দাঁড়িয়ে হেঁটে এসে নিচে নামে ও। নেমে নিপার পাশে দাঁড়িয়ে জুতা পড়তে পড়তে বলে,

– ভাবি, তুমি একটু এখানে থাকিও। আমি বাটি টা রেখে হাত ধুয়ে আসতেছি।

– আচ্ছা।

– আমার একটু দেরিও হতে পারে। ওয়াশরুমেও যাবো একটু। প্লিজ এখানেই থাকিও। মা তোমাকে কিছু বলবে না। তোমাকে দেখে চিল্লাবেও না। মায়ের এখন ঘুম ধরছে। দেখোনা চোখ গুলো কেমন সরু সরু হয়ে আসছে। সেই সকাল বেলা উঠছে।

– আচ্ছা ঠিক আছে তুই যা, আমি আছি।

– আচ্ছা ভাবি।

বলেই আলিশা বাটি হাতে চলে যায় ঘর থেকে। নিপা মাথা ঘুরিয়ে দেখে আলিশার চলে যাওয়াটাকে। আলিশা যাওয়ার পর নিপা ঘরের চারপাশে তাকায়। ঘরটাকে ভালো করে দেখতে থাকে। দেখে কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে চেয়ার টা টেনে একদম বিছানার সাথে কাছাকাছি হয়ে সুরাইয়া বেগমের সামনে বসে। সুরাইয়া বেগম একটা বালিশে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। পেট পর্যন্ত কাথা ঢাকা দেওয়া। সুরাইয়া বেগমের একটা হাত কাঁথার বাইরে ছিলো। হাতের চামড়া কিছুটা জড়ো জড়ো হয়ে এসেছে। নিপা আরেকবার পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে দরজার দিকটা। তারপর সামনে ফিরে। সুরাইয়া বেগমের হাত টা ধরে। সুরাইয়া বেগম সোজা দেওয়ালের দিক থেকে নজর নিপার দিকে নেন। নিপার হাত থেকে নিজের হাত টেনে নিয়ে আবার আগের যায়গা মতো পাশেই রাখেন। নিপা একটা হাসৌজ্জল মুখ করে। করে চারপাশ নজর দিয়ে দেখতে দেখতে বলে,

– ঘরটা অনেক সুন্দর।

সুরাইয়া বেগমের থেকে কোন উত্তর আসেনা। তিনি আধমরার মতো করে একপানে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিপা চারপাশ তাকিয়ে হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকায়। বলে,

– অভিনয় খুব ভালোই করেন আপনি ,,! তাই না ,,!

কথাটা শুনেই সুরাইয়া বেগমের চোখের মণি অস্থীর হয়। কিছুটা কাপতে থাকে তার চোখ। তবে তবুও তিনি এক নাগাড়ে চেয়ে আছেন সামনের দেওয়ালে। নিপা আবার হাসৌজ্জল মুখে বলে উঠে,

– আপনি যে পাগল না, আপনার যে স্মৃতিশক্তি হারায় নি তা আর কেউ জানোক আর না জানোক, আমি জানি।

সাথে সাথেই সুরাইয়া বেগম চকিতে নজর ঘুড়িয়ে নিপার দিকে তাকান। নিপা মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। মুখ এখনো সদা হাসৌজ্জল। সুরাইয়া বেগম এখনো অস্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। নিপা তার গলা কঠিন করে বলে,

– কেনো করছেন এসব ,,! এতে আপনার স্বার্থ কী ,,!

তখনই সুরাইয়া বেগমের মুখ থেকে কথা বের হয়ে আসে,

– তুমি কেমনে জানলা যে ,,,,,,,

– আপনি পাগল না, তাই তো ,,! (সুরাইয়া বেগমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে নিপা। সুরাইয়া বেগমের চোখ মুখে ভয়। নিপা আবারো হাসৌজ্জল মুখ নিয়ে বলে,

– আলমারির ভিতরে কী আছে ,,?

– ক,কোন আলমারি ,,? (কম্পিত কন্ঠে সুরাইয়া বেগম বলেন)

– ঘরে কিন্তু একটাই আলমারি আছে। (কঠিন কন্ঠে) আলমারিতে কী আছে ,,? আপনি আলমারিতে ঐদিন কী খুঁজছিলেন,,?

– ক,কোন দিন ,,? আ,আমি। আমি কিছুই খুঁজি নাই। (বলেই চোখের নজর ঘুড়িয়ে নেয় সুরাইয়া বেগম। নিপার আবার বলে,

– আমি যেদিন আঁখিকে এই ঘরের দরজার সামনে ধরি, সেদিন আলমারিতে আপনি কী খুঁজছিলেন,,?

কথাটা শুনেই সাথে সাথেই নিপার দিকে ফিরে তাকান সুরাইয়া বেগম‌। অবাক বড় বড় চোখ নিয়ে চেয়ে বলেন,

– ত,তুমি কেমনে জানলা,,,!

– সেদিন আঁখির ভাষ্যমতে সে কোন আওয়াজ পেয়েছিলো এই ঘর থেকে। আর তারপর সে বোরখা পড়া অবস্থায় দেখতে চলে আসে। কিন্তু আমি ওর দেখার আগেই ওকে ধরে ফেলি, আর ওর চমকে উঠার সাথে সাথেই এই ঘর থেকে একটা কিছু শব্দ আসে। (একটু থেমে ধীর গলায়) আলমারির দরজা লাগাচ্ছিলেন আপনি, তাই না ,,!

সুরাইয়া বেগমের চোখ মুখে ভয় স্পষ্ট, তিনি এক ঢোক গিলেন। গাল বেয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছে। নিপা আবার বলে,

– আপনি আলমারির দরজাটা লাগিয়ে ফেললেও দরজা থেকে চাবির গোছাটা সঙ্গে নিতে ভুলে যান। আমি যখন আঁখির সাথে কথা বলতে বলতে ঘরে উঁকি মারি তখন আপনাকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখলেও আলমারির দরজায় লেগে থাকা চাবির গোছা আমার দৃষ্টি গোচর হয়নি,,,! (একটু থেমে) আর কালকে যখন আমি আলিশার সাথে কথা বলছিলাম তখনও কিন্তু আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন না ,,! ঘুমের ভান ধরে ছিলেন। কী,,! আমি ঠিক বলছিতো ,,!

সুরাইয়া বেগম ভয়ে কাঁপছেন। এক ঢোক গিলে কাপো কাপো গলায় বলেন,

– ক, কিন্তু তোমারে তো দেখলে স্বাধারণ মাইয়া মনে হয়। এতো কিছু, এতো কিছু তুমি কেমনে বুঝলা ,,!

– হ্যাহ ,,! আমি হয়তো দেখতে শুনতে চুপচাপ, কিন্তু তার সাথে প্রখর দৃষ্টি সম্পন্নও ,,! এই গুন টা আমার বাবার। হয়তো বাবা গোয়েন্দা হতে পারেননি। কিন্তু আমি আর ভাইয়া, ঠিকই গুনটা পেয়েছি। ভাইয়া এখন গোয়েন্দা। তবে আমি গুপ্ত গোয়েন্দা। মানুষকে বাইরে থেকে দেখে জাজ করতে নেই,,! ভিতরে ভিতরে কিন্ত সে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে ,,! আর এয়নিতে ছোট বেলায় আমি আমাদের তিন পান্ডব গোয়েন্দার লিডার ছিলাম। ইকরা, আফাজ আমি তিন কিশোর গোয়েন্দা,,,!

– ত,তুমি আসলেই গোয়েন্দা,,,!

কথাটা শুনেই নিপা ছোট্ট হাসি দেয়। মুখের উপরে আসা চুল গুলো কানের পার্শ্বে নিয়ে রাখে। বলে,

– এই রুপ টা শুধু রায়হান জানে, তবে তাও ক্ষুদ্র পরিসরে। আমিও যদি ইচ্ছে করতাম গোয়েন্দা পুলিশ কিন্তু হতেই পারতাম,,! কিন্তু আমার মা চায়নি। (একটু থেমে) এখন বলুন। কী এমন আলমারিতে ছিলো যার জন্য ঐদিন আপনি আলমারি খুলেছিলেন,,!

– ত,তুমি খালি আলমারিতে ঐদিন চাবির গোছা দেইখাই কেমনে বুঝলা যে আমি পাগল না,,,!

নিপা ঠোঁট চেপে হাসে। বলে,

– একজন মানুষ স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে আর সেই মানুষটাই পরিস্থিতি বুঝে আলমারি খুলেছে। আবার কারো উপস্থিতি টের পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তা লাগিয়ে দিয়ে আবার শুয়েও পড়েছে ,,! এই ঘটনাটাই আমার মনে সন্দেহ জন্ম দেয়। আর তারপর আমি আঁধারে ঢিল ছুড়ে মারার মতো আপনাকে বলে ফেললাম এখন, যে আপনি স্মৃতি শক্তি হারিয়ে পাগলের অভিনয় করছেন কি না ,,! সাথে সাথেই আপনার এমন অবাক, অস্থীর চোখ আমাকে উত্তর দিয়ে দিয়েছে। (একটু থেমে) কেনো করছিলেন অভিনয় ,,? কী ছিলো ঐ আলমারিতে ,,!

– নিজের আর আলিশার জীবন বাঁচানোর লাইগা এইসব আমারে করাই লাগতো।

– আমিতো আলিশার মুখ থেকে শুনেছি আপনাকে কেউ ইনজেকশন দিয়ে পাগল করেছিলো। ও বলে সকালে আপনাকে আর একটা ইনজেকশনের সিরিজ ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখেছে। আসলে হয়েছিলো টা কী বলুন তো ,,! আর এই বাড়িটাই এতো গোমট স্বভাবের ক্যানো ,,? রায়হান আমাকে নিচে আসতে দেয় না। বাড়ির শুধু আলিশা আর আঁখি ছাড়া আর কারো সাথে মিশতে দেয় না ,,! ক্যানো ? আর আসলেই কী আপনার চোখ কেউ উঠিয়ে নিছে ,,? নাকি সেটাও কোন অভিনয়ের অংশ ,,!

– আমার চোখ সত্যিই ও হারামির বাচ্চা তুইলা নিছে। বিশ্বাস হয়না তোমার ,,! এই দেখো ,,! দেখো,,! (বলেই চোখের ব্যান্ডেজ তুলতে যান তখনই নিপা তাকে থামিয়ে দেয়। বলে,

– থামেন। আগে আমাকে এটা বলেন যে কেনো আপনার চোখ কেউ তুলে নিছে ,,? আর আমি কাল আলিশার কাছে শুনেছিলাম আমার শশুর নাকি এই কাজ করেছে। উনি কেনো এমনটা করতে যাবেন ,,?

– এই চোখ যে তার সবকিছু দেখছে। এই চোখের উপরে অর অনেক রাগ। অয় আরেকটু হইলে ঐদিন আমার দুই চোখই তুইলা নিতো।

– কিন্তু কেনো ? আপনি কী এমন দেখছেন যে উনি আপনার চোখ পর্যন্ত তুলে নিতে দু বার ভাবেন নি ,,? উনি তো আপনার ভাই হয় ,,?

– সৎ ভাই। অয় আমার সৎ ভাই। অয় আর শাহেদ এক মায়ের আর আমি অন্য মায়ের। অয় আমারে কখনো সহ্য করতে পারতো না।

– আমার দাদা শশুর কয়টা বিয়ে করেছিলেন ?

– জমিদার গো বিয়ার অভাব হয়না। মনে করো আমিই হতভাগা। যে এই খান বাড়িতে জন্মাইছি ,!

– আচ্ছা তাইলে এটা বলুন আপনি আলমারিতে কী খুঁজছিলেন ঐদিন ?

– খুঁজি নাই। আমি, আমি আমার এক মাইয়ার স্মৃতি হাতড়াইয়া দেখতাছিলাম। (কাপো কাপো গলায় কথাটা বলেই সুরাইয়া বেগমের চোখ ছলছল হয়ে আসে)

– মানে বুজলাম না। আলিশা তো আপনার সাথেই থাকে। ওর স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোর জন্য আলমারি কেনো খোলা লাগবে ?

– আমার দুই মাইয়া ছিলো। আলিশা বড়। ছোটডারে, (কাঁদো কাঁদো হয়ে) ছোটডারে অয় মাইরা ফেলছে ,,!

– কে মেরে ফেলছে,,!

– নজরুল। ঐ নরখাদক পিশাচ টা।

– নরখাদক,,! (অবাক হয়ে কথাটা বলে নিপা)

– না, আমি। আমি কিছু কইনাই। তুমি, কিছু শুনো নাই। চইলা যাও এহান থে। চইলা যাও। ও জানতে পারলে তোমারেও মাইরা ফেলবো। ও পারেনা এমন কিছু নাই। রায়হানরে নিয়া আলাদা হইয়া যাও। এই পরিবারের কালো অধ্যায় সম্পর্কে জানার চেষ্টা ভুলেও কইরো না। ভুলেও না।

– এই পরিবারে কী কালো অধ্যায় রয়েছে ? আর আমার শশুর নরখাদক? মানে উনি মানুষের মাংস,,,,,

বাকি কথাটা বলার আগেই নিপার মুখ চেপে ধরেন সুরাইয়া বেগম। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন,

– এই মুখ দিয়ে এই কথা বাইর কইরো না,,! দেওয়ালেও কান আছে।

নিপা অস্থির হয়ে আছে। তার কৌতুহল আরো বেড়ে গিয়েছে। সে হন্তদন্ত হয়ে আবার বলে,

– আপনার স্বামী কোথায় ,,? উনি আপনাকে নিতে আসেন না ক্যানো ,,?

– ওরেও ওরা মাইরা ফেলছে,,! (কাঁদতে কাঁদতে) আমার আয়েশা, আমার স্বামী দুইজনরেই ওরা খুন করছে।

– কারা ওরা। আমার শশুরের সাথে আর কে কে আছে? (হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে নিপার। কাপো কাপো গলায় বলে উঠে)

– র, রায়হানও কী,,,,,

– না না। ও নাই এসবের লগে। এই বাড়িতে রায়হান, শাহেদ আর আঁখি। এই তিনডা মানুষ ছাড়া বাকি কেউ ভালো না। তুমি রায়হানরে নিয়া চইলা যাও এহান থে।

কথাটা শুনে যেন কিছুটা শান্ত হয় নিপা। তার মনে যেন ক্ষানিক্ষনের জন্যও আঁধার কালোই মেঘে এসে জমেছিলো। তবে রায়হান এসবের সাথে নেই শুনে সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে তার মন মরুভূমিতে নেমে গিয়েছে। নিপা আবার বলে,

– আপনার স্বামীর কী হয়েছিলো ? আমাকে পুরোটা বলুন। আমি, আমি কথা দিচ্ছি আমি কাউকে বলবো না।

সুরাইয়া বেগম নিপার হাত ধরে। ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে থাকে। বলতে শুরু করে প্রথম থেকে,

“আমি আব্বার অনেক আদরের ছিলাম। আমার আব্বা এই গ্রামে জমিদার থাকলেও তার চরিত্র ভালো ছিলো না। অনেক বিয়া করছিলো আমার আব্বায়। কিন্তু আমরা তিনজন ছাড়া উনার আর কোন সন্তান নাই। আমার জন্মের পর থেইকা আমারে নানি বাড়ি পাঠাইয়া দেন উনি। ঐহানেই ছোট থেইকা বড় হইছি। পড়াশোনা করছি। ঐহানের একজনের লগে আমার বন্ধুত্ব হয়। নাম মশিউর। আস্তে আস্তে আমাগো বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হয়। অয় আর আমি দুইজনেই কলেজে আইন নিয়া পড়ছিলাম। আমরা আমাগো সম্পর্ক ডারে বিয়ে পর্যন্ত নিয়া যাই। আমাগো বিয়া হয়। রেজিস্ট্রি বিয়া। বিয়া হওনের পর এই বাড়িতে আইসা আব্বারে জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। আমরা এই বাড়িতে আওয়ার পর পরই নজরুল আমার উপর অনেক খেইপা যায়। কারণ মশিউর আইনজীবীর চাকরি পাইছিলো। আইনজীবীর লগে আমি বিয়া করছি শুইনা অয় অনেক রাগ দেহাইছিলো। তয় আব্বা মাইনা নিছিলো। তহন আব্বা জমিদারি ছাইড়া ব্যবসায় হাত দিছে। নজরুলও আব্বার লগে যোগ দিছে। আমরা যহন আইছিলাম তহন এইহানে এক রাইত থাহি। তুমি যেমন কৌতুহলী, আমিও অমন ছিলাম। রাইতের বেলা হঠাৎ পাওয়া সেই শব্দ ডা খুঁজতে যাইয়া আবিষ্কার করি এক গোপন কুঠুরির। আর সেই কুঠুরিতে যাইয়া আমি যা দেখছি আর শুনছি,,! তা, তা আমি জীবনেও ভুলতে পারমুনা।

– কী দেখেছিলেন সেখানে,,! কী ছিলো সেই গোপন কুঠুরিতে ,,!

– আ,আমি। আমি কইতে পারমূনা তোমারে। ওরা জানতে পারলে তোমারেও মাইরা ফেলবো। আমি কইতে পারুম না। (কাঁপতে থাকেন সুরাইয়া বেগম। নিপা নিজের মনের এই কৌতুহল টাকে চাপা দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে আবার বলে,

– আচ্ছা তাইলে এটা বলুন, আপনার স্বামী আর ছোট মেয়েটার কী হয়েছিলো,,!

– আ,আমি পরের দিনই মশিউর রে নিয়া চইলা যাই এহান থে। নজরুল হয়তো বিষয়ডা ধরতে পারছিলো। অয় হয়তো বুঝছিলো যে আমি কিছু যাইনা গেছি। তারপর ৬ ডা বছর পার হইয়া যায়। আলিশা আমার তহন মাত্র হাঁটা শিখছে, অর একটা ছোট বইন হইছিলো। অয়ও অনেক সুন্দর ছিলো। ঠিক আলিশার লাহান। (একটু থেমে) আব্বার শরীরের অবস্থা অনেক খারাপ হইয়া যায়। খবর আহে শেষবারের মতো দেইখা যাওনের। আমার আইতে ভয় করাতছিলো। তাও আব্বায় আমারে অনেক আদর করতো সবার মইধ্যে। এরলাইগা সব ‌ভয় মনে চাইপা আইয়া পড়ি। আব্বায় কথা কওয়া ছাইড়া দিছিলো। আব্বার শরীরের কিছু যাইগা পইচাও গেছিলো। আব্বার এমন অবস্থা দেইখা এইহানেই কয়েকটা দিন থাহার চিন্তা করি। তহনই একদিন রাইতে খবর আহে আমি যা দেখছি তা যেন ভুইলা যাই। আমি এইসব নিয়া মুখ খুললে আমারে জানে মাইরা ফেলবো। আমি ভয় পাইয়া যাই। আমি পরেরদিনই আয়েশা আর আমার স্বামীরে এই বাড়ি থেইকা পাঠায় দেই। আলিশারেও নিয়া যাইতে কইছিলাম, কিন্তু আলিশা আমারে ছাইড়া যাইতে নারাজ। আমিও আব্বারে ছাইড়া যাইতে পারতাছিলাম না। আমি আলিশারে নিয়া থাইকা যাই। পড়েন দিন, (কাঁদো কাঁদো হয়ে) পড়ের দিন খবর আহে আমার আয়েশা আর স্বামীরে রে কেউ গুলি কইরা মাইরা ফেলছে। মাইরা রোডের মইধ্যে ফালায় থুইয়া গেছে। আমি ওগোরে আর শেষ দেহা দেখতে পারি নাই। নজরুল আমারে এই বাড়ি থেইকা বাইর হইতে দেয় নাই। ঐদিন থেইকা আইজ পর্যন্ত বাইরের আলো বাতাস আমি দেখতে পারি নাই। নজরুল ভাবছিলো আমি মশিউররে কইয়া দিছি বিষয়ডা। আর মশিউর আইনের লোক আনতে গেছে। এই ভাইবা, (কাঁদতে কাঁদতে) এই ভাইবা আমার স্বামী আর মাইয়া ডারে ওরা মাইরা ফেলছে ,,!

কথা গুলা শুনে নিপা ঢোক গিলে। এক রাতে কী এমন জিনিস তিনি শুনে নিয়েছিলেন যে তার জন্য স্বামী আর মেয়েকে মেরে ফেলা হলো ,,! নিপা কাপো কাপো গলায় বলে,

– আ,আপনি আলমারিতে,,,,,

– হ আমি আলমারিতে আমার ছোট্ট আয়েশা আর আমার স্বামীর শেষ স্মৃতি গুলা ঐদিন দেখতাছিলাম। খুব মনে পড়তাছিলো ঐদিন ওগো কথা। আমার ছোট্ট আয়েশার বয়স মাত্র ১ বছর আছিলো। অর ছোট ছোট কাপড় গুলার মধ্যে এহনো আমি অর গাঁয়ের ঘ্রাণ পাই। আমার, আমার আয়েশারে পাই ,,!

(বলেই কাঁদতে থাকেন সুরাইয়া বেগম। নিপা তাকে শান্ত করতে থাকে। এই বাড়ির ভিতরে যে এতো নিকষ আলো আঁধার লুকিয়ে আছে তা যেনো কেউ দেখলে বুঝতেই পারবেনা। খাঁন বাড়ির সুনামে পুরো গ্রাম মজমজ করে। লোকের মুখে মুখে খাঁন বাড়ির নাম। কিন্তু এতো দেখা যায় সব মুখোশের খেলা ,,! নিপার কাছে এ যেনো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে,,,!

নিপা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কিছু একটা ভাবতে থাকে। সুরাইয়া বেগমের হাত ধরে হঠাৎ বলে উঠে,

– আচ্ছা আপনাকে কী সত্যিই কেউ পাগল করার ইনজেকশন দিয়েছিলো ,,!

সুরাইয়া বেগম কান্না থামান। চোখ মুছতে থাকেন। বলেন,

– ঐদিন রাইতে আমি আলমারি থেইকা আমাগো সবার একলগে থাহা ছবিডা বাইর কইরা দেখতাছিলাম। ঐদিন রাইতে নজরুল আমারে অনেক জোরে চোখে একটা ঘুষি মারছিলো। আমার চোখ দিয়া রক্ত বাইর হইতেছিলো। আমি ভাবছিলাম হয়তো আমার চোখ গুলা ও যেমনেই হোক নষ্ট করবো। এরলাইগা আমাগো সবার একলগে থাহা ছবিডারে শেষ দেহা দেখতাছিলাম। তহনই হঠাৎ নজরুল আমার দরজার সামনে আইয়া আমারে সাবধান করতে থাহে। এতে আমার সন্দেহ হয়। ও হঠাৎ এই কথা কেন কইতে আইলো এইডা যহন আমি ভাবতাছিলাম তহনই জানালার বাইরে কারো খারানোর আওয়াজ পাই। আমি লগে লগে আড়চোখে ডেসিন টেবিলের আয়নায় দেহি একজন কালো বোরখা পড়া কেউ আইয়া খারাইছে। আমি তৎপর হইয়া যাই। তহনই আয়নার গ্লাসে দেহি বোরখা পড়া মাইয়াডা একটা ইনজেকশন বাইর কইরা হাতে লইতাছে। জানালা ভিতর দিয়া হাত ঢুকাইছে। আমারে গায়ে ফিক্কা মারার লাইগা নিশানা করতাছে। আমি আল্লাহর নাম নিয়া হঠাৎ নিজের হাত টারে কাঁধে দিকে নিতে যাই, তহনই ইনজেকশন টা অয় ছুইড়া মারে। ইনজেকশন ডা আমার হাতের ধাক্কায় নিচে পইরা যায়। আমিও নিজে এমন কইরা নিচে পইড়া যাই যাতে ওরা বুঝে যে আমার গাঁয়ে ইনজেকশন লাগছে। আমি ফ্লোরে পড়ার পর পরই বাইরে নজরুলের চইলা যাওনের আওয়াজ আহে। মাথা তুইলা দেখি জানালাতেও কেউ নাই। আমি ইনজেকশন ডা ফ্লোর থেইকা তুলি। ইনজেকশনে লাল রঙের ওষুধ ছিলো। আমি ঐডা ঘরের এক কোনে পুশ কইরা ফালায় দেই। তারপর আবার নিজে ফ্লোরে শুইয়া পড়ি। খালি ইনজেকশন ডা আমার মাথার পাশে রাইখা দেই যাতে ওরা বুঝে যে আমার গাঁয়ে সত্যিই ইনজেকশন লাগে আর আমি পাগল হইয়া গেছি, স্মৃতি শক্তি হারাইছি।

– এইজন্য আলিশা পড়ের দিন সকালে খালি ইনজেকশন পাইছিলো আপনার মাথার পাশ থেকে।

– হ। ঐদিনই সকালে নজরুল আমার এই চোখটা, চোখটা হাত দিয়ে টাইনা তুলে। আমি তো মনে করছিলাম অয় বুইঝা গেছে যে আমি পাগল হইনাই। এরলাইগা আমার চোখ টাইনা তুলতাছে। আমি তহন খালি আল্লাহরে ডাকতাছিলাম। চোখটা এতো জোরে টান দিয়া তুলছিলো, আমার জান ডা বাইর হইয়া যাইতাছিলো ব্যাথায়। আমি তো ভাবছি আমার জীবন এইহানেই শ্যাষ। পরে ওর কথা শুইনা বুঝি ও ওর রাগ মিটানোর লাইগা আমার চোখ টাইনা তুলছে। ও জানে না যে আমি পাগল না। আমিও আমার অভিনয় চালাইয়া যাই। তুমি কাউরে কইয়োনা যে আমি পাগল না ,,! আমারে মাইরা ফেলোক তাতে আমার কিছু যায় আসেনা, কিন্ত ওরা আমার আলিশারে যদি মাইরা ফেলে,,! আমি, আমি নিজেরে ক্ষমা করতে পারমুনা। কক্ষনো ক্ষমা করতে পারমুনা,,! (বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সুরাইয়া বেগম। নিপা মলিন গলায় বলে,

– আমি, আমি কাউকে বলবো না। কাউকে না।

সুরাইয়া বেগম ছলছল অশ্রু নিয়ে চেয়ে তাকান নিপার দিকে। নিপার হাত ধরে অসহায় গলায় বলেন,

– তুমি আমার মাইয়াডারে নিয়া যাইয়ো তোমাগো লগে ,,! ওরে ভালো কোথাও বিয়া দিয়া দিয়ো ,,! এইহানে থাইকো না। এই নজরুল, এই নজরুল স্বার্থের লাইগা সব ধুলিসাৎ করতেও দুইবার ভাববো না। (হঠাৎ নিপার হাত ধরে করুণ গলায়) তুমি আমারে কথা দাও তুমি আমার আলিশারে নিয়া যাইবা ,,! আমি চাইনা আমার মাইয়াডা এই কাল কুঠুরিতে আটকা পইড়া তার জীবন ডা আমার মতো নরক করুক ,,! ঐযে কাইল অয় একটা পোলার কথা কইতাছিলো না ,,! অয় হয়তো তোমাগো আত্মীয় হয়।

– হ্যা, আমার ফুফাতো ভাই।

– হ, ঐ পোলা যদি আলিশারে সত্যি ভালোবাইসা থাকে তাইলে তুমি ওর লগেই আমার মাইয়াডার বিয়া দিয়ো ,,! অয় নাইলে কোন ভালো গরীব পোলা দেইখা আমার মাইয়াডারে বিয়া দিয়ো। দুই বেলা খাইয়া পইড়া যেন আমার মাইয়াডারে সুখি রাখতে পারে। আমি আর কিচ্ছু চাই না। কিচ্ছু না। আমারে কথা দাও তুমি ,,! আলিশারে তোমাগো লগে লইয়া যাইবা ,,! (কাঁদতে কাঁদতে) মাইয়াডা আমার এইহানে থাকলে মইরাই যাইবো,,!

– আ,আন্টি। আমি কথা দিলাম। ওকে নিয়ে গিয়ে আমি ওর পছন্দের ছেলেটার সাথেই বিয়ে দিবো। আলিশা আমার বোনের মতো। আমি কখনোই চাইবো না যেনো ওর খারাপ হয়।

– তোমার মতো মাইয়া এই বাড়িতে বউ হইয়া আইবো আমি কখনোই ভাবি নাই। ভাবছিলাম নজরুল হয়তো অর নিজের পছন্দ করা কোন চরিত্রহীন মাইয়ারে অর পুত্র বধু করবো। নিজের আধিপত্য বাড়াইবো রায়হানের প্রতি। রায়হানরে যে অয় নিজে বশ করতে পারে না। আমি দেখছি। অয় অর বড় পোলার লগে যতডা কঠিন, রায়হানের লগে তার ছিটাফোটাও নাই ,,! সবসময় রায়হানের প্রতি অয় দুর্বল। এরলাইগা হয়তো অয় এমন কোন মাইয়া আনতো যেইডা দ্বারা রায়হানরে অয় হাত করতে পারতো। কিন্তু না। রায়হান ঠিকই নিজের পছন্দ মতো একটা সুন্দর চান্দের টুকরা বিয়া করছে। রায়হান এইবাড়ির সবার মতো না। অয় আলাদা। রায়হানরে নিজের আঁচলে বাইন্ধা রাইখো। নজরুল কিন্তু সুযোগ খুজবো তোমাগো সম্পর্ক নষ্ট করার। তুমি এইডা হইতে দিও না কহনোই।

– আমি সবসময় রায়হানকে নিজের আঁচলে রাখবো আন্টি। রায়হান আমাকে নিজে থেকে ভালোবেসেছে। (একটু থেমে) আমি বুঝি, ওর ভালোবাসায় কোনো মিথ্যে নেই। কোন অতল গহবর নেই। তাও আমি সবসময় একজন সহযোদ্ধার মতো করে তার পাশে থাকবো। তার কাছে থাকবো।

– হয়তো তুমি না থাকলে, আমার মাইয়াডারে আমি কহনোই এই কালো জগত থেইকা বাইর করতে পারতাম না। আমি চিরকৃতজ্ঞ হইয়া থাকলাম তোমার প্রতি মা ,,! রায়হান ভালো পোলা। অয় এই বাড়ির কোন খারাপ কামের লগেই নাই। ওরে নিয়া আর আমার মাইয়াডারে নিয়া তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো চইলা যাও। (একটু থেমে) আমি প্রেম কইরা বিয়া করছি। এইডা নজরুল সহ্য করে নাই। আলিশাও তোমার এক আত্মীয়ের প্রেমে পড়ছে, এইডাও নজরুল মাইনা নিবো না। আমি জানি রে মা, ভালোবাসা জিনিস টা অনেক স্পর্ষকাতর। এইডা অপূর্ণ থাইকা গেলে সারাজীবন এই দুঃখ চাপা কষ্টের মতো বইয়া বেড়াইতে হয়। তহন আর যাই হোক সুখী হওয়া যায় না। আমি ঐদিন ঐ পোলাডারে দেখছি। ঐদিনও আমি যাইগা ছিলাম। আমি আমার মাইয়াডার মধ্যে যেন আমার কিশোর কাল দেখতে পাইতাছিলাম। পোলাও আমার মাইয়ারে হয়তো ভালোবাসে। আমি ওর চোখ দেইখা বুঝছি। ওর চোখে কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো না। ছিলো প্রকৃত ভালোবাসা। ওরা একলগে জীবন কাটাইতে পারলে অনেক সুখী হইবো মা, অনেক সুখি হইবো ,,!

– আমি আলিশাকে নিয়ে যাবো আন্টি। নিয়ে গিয়ে ওকে আফাজের সাথেই বিয়ে দিবো। আমি নিজেও তো প্রেম করেই বিয়ে করেছি। (একটু থেমে ম্লিন গলায়) ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়া যে আমি আমার একটা মুহূর্তও ভাবতে পারতাম না ,,! বারবার চোখ খালি খুঁজে ফিরতো তাকে,,! (সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে) আমি আমার কথা রাখবো। ওদের দুজনের বিয়ে দিয়ে একটা সুখী জীবন উপহার দিবো ওদের।

– আমি তোমার কাছে ঋণী হইয়া থাকলাম মা ,,! অনেক অনেক দোয়া করি, তুমি আর রায়হান সুখী হও ,,! অনেক সুখী হও ,,!

নিপা সুরাইয়া বেগমের মুখে কিছুটা আনন্দ দেখতে পায়। হয়তো এই আনন্দটা তিনি তার মেয়ের ভবিষ্যত ভেবে পাচ্ছেন। মায়েরা তো সবসময় চায় সন্তানদের একটা ভালো জীবন উপহার দিতে। হয়তো ছোট থেকে আলিশাকে তিনি একঘরে করে মানুষ করেছেন, বাকিদের সাথে মিশতে দেননি। বাহিরা পরিবেশে মিশতে চাইলে বকেছেন, শাসন করেছেন। সেই আলিশা যখন নতুন কারো সাথে মুক্ত পাখি হয়ে উড়তে চায়, একটা ভালো জীবন পাওয়ার দারপ্রান্তে থাকে তখন অবশ্যই তার মা সর্বস্ব দিয়ে হলেও তার মেয়েকে সেই নতুন জীবনে পদার্পণ করিয়েই যাবেন,,,!

 

নিপার মনে আবার উঁকি দেয় সেই প্রশ্ন। কী দেখেছিলেন ঐ রাতে সুরাইয়া বেগম,,! কী শুনেছিলেন তিনি ঐদিন ,,! নিপা সাথে সাথেই প্রশ্ন করে বসে,

– আচ্ছা ঐ রাতে আপনি কী দেখেছিলেন। আমাকে বলুন, আমি কাউকে বলবো না। সত্যি বলছি, কাউকে বলবো না।

– তুমি কৌতুহল দেহাইয়োনা মা ,,! তোমারে আমি এই কালো অধ্যায় সম্পর্কে কইতে পারুম না। নজরুল জানতে পারলে ও তোমারেও মাইরা ফেলবো,,!

– আন্টি, আমি আজকেই রাতে রায়হানকে বলবো এ বাড়ি থেকে আলাদা হওয়ার জন্য। প্লিজ আমাকে বলুন। আমার মন মানছে না। আমি স্বাভাবিক হতে পারছিনা এটা না জানা পর্যন্ত যে কীসের জন্য আপনাকে এতোদিন তারা এইবাড়িতে বন্দী করে রাখলো। আর কোন গুপ্ত কুঠুরিই বা আপনি খুঁজে পেয়েছিলেন,,,!

– আমার ভয় করতাছে মা ,,! আমি, আমি তোমারে কইতে পারমুনা এইসব,,,!

– আচ্ছা তাইলে এইটুকু বলুন, কোথায় সেই গোপন কুঠুরি টা ,,! মানে এই বাড়িতেই না অন্য কোথাও ,,!

– এই বাড়িতে না। এই বাড়ির সীমানার মইধ্যে আছে ঐডা।

– কোথায় ? শাশুড়ি মায়ের বাগানের ওখানে ,,? না কী পিছনে ?

– প, পিছনে। (কাপো কাপো গলায় বলে সুরাইয়া বেগম। তার চোখ গুলো আবারো অস্থির)

– পিছনে তো পুকুর,,!

– আ,আমি। আমি আর কইতে পারমুনা মা ,,! আমারে আর জিগাইয়ো না ,,!

– আচ্ছা আমাকে শুধু এটুকু বলুন যে পিছনে তো পুকুর। তাইলে ঐখানে কীভাবে হইতে পারে ,,!

– প, পিছনের সাতরঙা পুকুর টার।

– হ্যা সাত রঙা পুকুর টার,,! তারপর,,!

– ঐ পুকুর টার পাশে একটা বড় গাছ আছে। ঐ গাছের ,,,,,,,

– কে ওখানে ,,!

নিপার হঠাৎ এই কথায় সুরাইয়া বেগম আর বলতে পারেন না। সাথে সাথেই তিনি নিপার দিকে তাকান। নিপা জানালার দিকে ফিরে আবার চিৎকার করে বলে উঠে,

– কে ওখানে ,,! দাঁড়ান বলতেছি ,,!

– জানালার পাশে কেউ ছিলো ,,! (ভয়ে ভয়ে বলেন সুরাইয়া বেগম)

– হ্যা, একটা ছায়া আমি দেখতে পেয়েছিলাম। (একটু থেমে ধীর গলায়) কেউ আমাদের কথা শুনে নেয়নি তো ,,!

– আল্লাহ,,! মা,, তোমারে আগেই কইছিলাম এইসব জিগাইও না। ওরা এহন জাইনা গেছে। এহন কী হইবো ,,! আমার আলিশার কিছু হইয়া যাইবো না তো ,,! মা তুমি আলিশারে তোমার লগে রাহো। ওরে নিয়া চইলা যাও। ওরা যা কিছু কইরা ফেলতে পারে ,,,!

– শান্ত হোন আন্টি,,! কিছু হবেনা। আপনি আমার উপর ভর্সা করুন। কিচ্ছু হবেনা।

– না, আমার মন মানতাছে না ,,! ওরা যা কিছু কইরা ফেলতে পারে ,,!

তখনই তাদের কানে কারো হেঁটে আসার আওয়াজ আসে। কেউ যেনো হেঁটে হেঁটে করিডোর দিয়ে তাদের রুমের দিকেই এগিয়ে আসছে। সেই পায়ের আওয়াজ চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন ::২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৮

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– কে ওখানে ,,!

নিপার হঠাৎ এই কথায় সুরাইয়া বেগম আর বলতে পারেন না। সাথে সাথেই তিনি নিপার দিকে তাকান। নিপা জানালার দিকে ফিরে আবার চিৎকার করে বলে উঠে,

– কে ওখানে ,,! দাঁড়ান বলতেছি ,,!

– জানালার পাশে কেউ ছিলো ,,! (ভয়ে ভয়ে বলেন সুরাইয়া বেগম)

– হ্যা, একটা ছায়া আমি দেখতে পেয়েছিলাম। (একটু থেমে ধীর গলায়) কেউ আমাদের কথা শুনে নেয়নি তো ,,!

– আল্লাহ,,! মা,, তোমারে আগেই কইছিলাম এইসব জিগাইও না। ওরা এহন জাইনা গেছে। এহন কী হইবো ,,! আমার আলিশার কিছু হইয়া যাইবো না তো ,,! মা তুমি আলিশারে তোমার লগে রাহো। ওরে নিয়া চইলা যাও। ওরা যা কিছু কইরা ফেলতে পারে ,,,!

– শান্ত হোন আন্টি,,! কিছু হবেনা। আপনি আমার উপর ভর্সা করুন। কিচ্ছু হবেনা।

– না, আমার মন মানতাছে না ,,! ওরা যা কিছু কইরা ফেলতে পারে ,,!

তখনই তাদের কানে কারো হেঁটে আসার আওয়াজ আসে। কেউ যেনো হেঁটে হেঁটে করিডোর দিয়ে তাদের রুমের দিকেই এগিয়ে আসছে। সেই পায়ের আওয়াজ চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নিপার শিরদাঁড়া বেয়ে যেন এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। সুরাইয়া বেগম তার কথা থামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে তাকান। নিপাও ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে তাকায়। তাদের যেন এক মুহুর্তের জন্যও দম আটকে আসছিলো। চারপাশের পরিবেশ একদম নিস্তব্ধ। শুধু করিডোর দিয়ে কারো হেঁটে আসার আওয়াজ আসছে। নিপা এক ঢোক গিলে। সে ভয়ে ভয়ে একবার ফিরে সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকায় আবার ফিরে দরজার দিকে তাকায়। শব্দ টা দরজার খুব কাছে চলে এসেছে। সুরাইয়া বেগম ভয়ে নিপার হাত ধরেন। এবং সেই শব্দটা দরজার সামনে এসে থেমে যায়। দরজার পর্দার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে‌। হ্যা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়া ঘর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। নিপা কাপো কাপো কন্ঠে বলে,

– ক,কে ওখানে,,!

সাথে সাথেই একজন ঘরে ঢুকে পরে। নিপা আর সুরাইয়া বেগম তাকেই দেখেই যেন ফোঁস করে তাদের ধরে রাখা দম ছেড়ে দেয়।  সুরাইয়া বেগম ধপ করে আবার হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েন। এতোক্ষণ ধরে ধীর পায়ে আসা মানুষ টা যে আঁখি হবে তা তারা ভাবেনি। তারা ভেবেছিলো হয়তো অন্য কেউ। নিপা আঁখিকে বলে উঠে,

– তুই ,,! এরকম আস্তে আস্তে হাঁটে আসতেছিলি ক্যান ,,?

– আলিশা আফায় কইছিলো যে তার আইতে দেরি হইলে আইয়া একবার এই ঘরে খালাম্মারে দেইখা যাইতে‌। আমি ভাবছি যদি ঘুমাইয়া যায় এরলাইগা ধীরে ধীরে আইছি।

নিপা এক বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

– আলিশা তোকে বলেনি যে আমি এখানে আছি ,,!

– হ কইছিলো। কিন্তু আমি ভাবলাম হয়তো আপনে ঘরে চইলা গেছেন। এরলাইগা একবার দেখতে আইলাম। খালাম্মা কী করে ,,! (বলেই উঁকি দিয়ে দরজার সামনে থেকে সুরাইয়া বেগমকে দেখে আঁখি। সুরাইয়া বেগম আবার এক নজরে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ছিলেন। নিপা তাদের দুইজনকে একবার দেখে আঁখিকে বলে উঠে,

– তুই যা, আমি এখানে আছি।

– আপনে যদি থাকেন তাইলে ভালাই। আমি যাইয়া রান্না বহাই তাইলে। সুমনা খালাম্মা তো বাইরে গেছে। আমারেই আইজ রান্ধা লাগবো।

– আচ্ছা তুই যা। আমি এখানে আছি বললাম তো।

– আইচ্ছা তাইলে আমি গেলাম।

বলেই ছুটে বেড়িয়ে যায় আঁখি। আসার সময় এতো ধীরে ধীরে আসলো আর যাওয়ার সময় এক দৌড়ে ছুট। নিপা দরজার দিকে থেকে ফিরে সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকায়। সুরাইয়া বেগমের মুখে এখনো ভয় ছিলো। তিনি ধীর গলায় বলেন,

– গেছেগা ,,!

– হ্যা। (পিছনে ফিরে দরজার দিকে ভালোভাবে দেখে) চলে গেছে ও। একদম ভয় পাইয়ে দিছিলো আমাদেরকে।

সুরাইয়া বেগম আবার হেলান দেওয়া হতে উঠে বসেন। বসে নিপার হাত ধরে ফেলেন। করুণ অনুনয় করে বলতে থাকেন,

– তুমি আলিশারে লগে নিয়া যাও মা। কেউ আমাগো কথা তহন শুইনা ফেলছে মনে হয়। আমার আলিশার কিছূ একটা হইয়া যাইবো নাইলে।

– মা, মা শান্ত হোন। ( বলেই চুপচাপ হয়ে কিছু একটা ভাবে নিপা। তারপর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বলে উঠে।

– মা,,,! আপনার জানালার বাইরে একটা বড় গাছ আছে তাইনা ,,!

– হ, হ আছে। কিন্তু ক্যান ,,! (কাপো কাপো গলায়)

– আমি বোধহয় গাছের ডাল নড়ার ছায়াটাকে জানালার সাইডে পড়তে দেখেছিলাম।

নিপার কাছ থেকে কথাটা শুনেই সুরাইয়া বেগম জানালার দিকে তাকান। তিনি উতলা, অস্থির। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার বলতে থাকে,

– সত্যি তুমি এই গাছের ছায়া দেখছিলা না অন্য কিছু দেখছো ,,! আমার কাছ থেইকা লুকাইয়ো না কিছু মা ,,! সত্যি কী তুমি গাছেরই ছায়া ডা দেখছিলা ,,!

– হ্যা আন্টি সত্যি। আমি গাছের ছায়াটাকেই মানুষ ভেবে নিয়েছিলাম। ঐযে দেখুন বাতাসে গাছের ডাল নড়লে এখানে পড়া ছায়াটাও নড়া চড়া করে। আমি আসলেই ভুল দেখছিলাম। ঐসময় আমরা দুইজনই ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আর উত্তেজিত ছিলাম। তাই হয়তো এইটাকে দেখেই চমকে গিয়েছিলাম।

সুরাইয়া বেগম নিপার কথাটা শুনে আবার জানালার দিকে তাকান। মুখ ফিরিয়ে নিপার দিকে তাকান। বলেন,

– সত্যি কেউ আমাগো কথা শুনে নাই তো ,,!

– সত্যি মা। আমি আসলেই ভুল দেখছি। (একটু থেমে) আচ্ছা বাদ দেন সেসব। আমি আজকে রায়হানকে রাতে বলবো আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। আর তার সাথে আলিশাকেও নিয়ে যাওয়ার কথা। রায়হান নিশ্চয়ই না করবে না।

– কইয়ো মা। আমার মাইয়াডারে নিয়া যাইয়ো। অর লাইগা আমার দিনরাইত অনেক চিন্তা হয়। মন খালি উতলা হইয়া থাকে। অরে তোমরা নিয়া যাইয়ো।

– হ্যা মা আমি নিয়ে যাবো। (দরজার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে আবার সুরাইয়া বেগমের দিকে মুখ করে) আচ্ছা আন্টি, তাইলে আপনি এখন ঘুমান। আলিশা, আঁখি ওরা যেন আপনাকে সন্দেহ না করে। ওরা যানে এটা আপনার ঘুমের সময়। আপনি ঘুমিয়ে যান।

– আমার ঘুম আইতাছে না মা। আমার খুব চিন্তা হইতাছে,,! (একটু থেমে) তুমি ঠিক ভাবে থাইকো। এইবাড়ির পোলা রা বাড়ি ফিরলে ঘর থে বাইর হইয়ো না ,,!

– নজরুল ছাড়া কী এইবাড়ির আরো কোন পুরুষ খারাপ স্বভাবের আছে ?

– রাফসান আছে। অর নজর ভালা না। অয় হয়তো তোমারে এহনো দেহে নাই। অর নজর, শকুনের নজর। আলিশার লগেও ঘেঁষতে চাইছিলো। রায়হানের ধারে আমার আলিশা বিচার দেওয়ার পর থেইকা অয় আর আলিশার লগে ঘেঁষতে আহে না। রাফসানের লাইগাই বিশেষ কইরা তোমারে নিচে নামতে নিষেধ করছে রায়হান। নিজের বাপের কুকির্তি রায়হান নিজেই জানেনা। নাইলে কবেই তোমারে নিয়া এই বাড়ি থেইকা আলাদা হইয়া যাইতো ,,!

– আচ্ছা মা ঠিক আছে। আমি যখন বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে থাকবে, বিশেষ করে ওর বড় ভাই, আমি নিচে আসবো না। (একটু থেমে) আপনি এখন ঘুমান। একদম টেনশন করিয়েন না। এমনিতেই আপনার শরীর খারাপ। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করেন।

– আইচ্ছা মা। তুমি আলিশারে নিয়া তোমাগো ঘরে যাইয়ো। আমার হয়তো ঘুম আইবো না এতো তাড়াতাড়ি। সন্তানগো চিন্তা মাথায় থাকলে কোন মায়েরই যে চোখে ঘুম আহেনা,,,!

নিপা ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা সূচক ইঙ্গিত দেয়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উঠে পড়ে চেয়ার থেকে। উঠেই সুরাইয়া বেগমের কাছে হেলে বলে,

– বালিশ টা নামিয়ে দেই ,,! শুয়ে পারেন। মাথা ব্যাথা করবে এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে ,,!

– আইচ্ছা নামায়া দেও।

নিপা সুরাইয়া বেগমকে হেলান দেওয়া হতে উঠিয়ে সোজা করে বসায়। বালিশ টা বিছানায় নামিয়ে ঠিক ঠাক করে দেয়। তারপর ধরে আস্তে করে সুরাইয়া বেগমকে শুইয়ে দেয়। সুরাইয়া বেগমের কাঁথাটা বুক পর্যন্ত তুলে দেয়। সুরাইয়া বেগম বলেন,

– যাওয়ার সময় দরজাডা ভিড়ায় দিয়া যাইয়ো ,,!

– আচ্ছা আন্টি। (মিষ্টি গলায় বলে নিপা চেয়ার থেকে বের হয়ে চলে যেতে নেয়, তখনই সে একটু থেমে যায়। বিছানার পাশেই একটা ছোট টেবিল। তারপরই আলিশার পড়ার টেবিল। নিপার পড়ার টেবিলের সামনেই থেমে যায়। ঘুরে পড়ার টেবিলের কাছে আছে। বিরবির করে বলে,

– আলিশা বই গুলাও ঠিক করে রাখেনাই ,,! এভাবে বিদ্যাকে ছড়িয়ে ফেলে রাখলে হয় ,,!

সুরাইয়া বেগম একবার কান বাড়িয়ে নিপার কথা গুলা শুনেন, তারপর আবার জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ আধবোজা করেন। নিপা টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা বই গুলা একত্রে করে টেবিলের এক পাশে রেখে দেয়। দিয়ে আড় চোখে সুরাইয়া বেগমের দিকে তাকায়। দেখে সুরাইয়া বেগম জানালার দিকে মুখ করে আছেন। নিপা তার কোমরের শাড়ি কিছুটা হাত দিয়ে টেনে সড়ায়। তার শাড়ির কোমড়ের ভাঁজ থেকে একটা কলম বের করে। করে ধীরে ধীরে সেটাকে নিঃশব্দে আলিশার পড়ার টেবিলে থাকা কলম দানিতে রেখে দেয়। দিয়ে তার কোমরের শাড়ি টেনে ঠিক করে দেয়। চলে যেতে থাকে ঘর থেকে। যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে ভিড়িয়ে দিয়ে যায়। সুরাইয়া বেগম একরাশ আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন জানালার পানে। তার চোখের কোন থেকে এক ফোঁটা জলরাশি গড়িয়ে পড়ে।

 

 

 

ট্রেনের বগির ভিতরের অংশ। মাঝে মাঝে কয়েকটা ফেড়িওয়ালা হাঁক দিতে দিতে চলে যাচ্ছে বগির মাঝখানের হাঁটার অংশ টা দিয়ে। আফাজ জানালার পাশ টায় বসেছে। বাইরের দিকে এক নয়নে চেয়ে আছে। বাইরে কিছুটা রোদের দেখা মিলেছে। চারপাশে খালি ফসলি খেত আর খেত। সবগুলো দ্রুত গতিতে পিছনে ছুটে যাচ্ছে। আফাজের পাশে বসেছে ইকরা। সে ঘুমিয়ে গেছে। আফাজের মা-বাবা বসেছে তাদের সামনেই, তাদের মুখোমুখি হয়ে। তারাও ঘুমাচ্ছেন। অনেক সকাল সকাল উঠা হয়েছিলো যে ,,! তাই এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন তারা। আফাজ রা শোভন চেয়ার কামড়ার টিকিট কেটেছিলো। বগির একদম মাঝের ৪ টা সিট মুখোমুখি করা থাকে এই শোভন চেয়ারের কামড়ায়। তারা এই ৪ টা সিটেরই টিকিট কেটেছিলো।

 

আফাজা বাইরে চেয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। বারবার আলিশার মুখখানা তার দুই নয়নে ভেসে উঠছে। মন ব্যাথীত হচ্ছে। মন বলছে ফিরে যেতে। আলিশাকে একনজর না দেখলে যে তার মন আর শান্ত হতে চাইছেনা। একটা মেয়েকে সে একয়দিনে এতোটা ভালোবাসে ফেললো ,,! ভালোবাসা তো কয়েক মিনিট বা কয়েক সেকেন্ডও হয়। আফাজের ক্ষেত্রে তা কয়েকদিনে হয়েছে। ভালোবাসা শব্দটা হয়তো আগে আফাজ নিছক ছোট শব্দ মনে করেছিলো। কিন্তু যখন সে কাউকে ভালোবাসলো তখন সে বুঝলো এই শব্দটার মর্ম কতটা গভীর,,,!

না। আর থাকা যাচ্ছেনা। মন কেমন উতলা হয়ে আছে। আফাজ জানালার পাশ হতে নয়ন কামড়ার ভিতরে নেয়। চারপাশে চেয়ে দেখে বেশির ভাগ যাত্রীই গভীর ঘুমে। পাশের ইকরা টাও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আফাজ ইকরার মাথাটা ধরে সোজা করে দেয়। এভাবে ব্যাকা হয়ে ঘুমালে যে তখন আরো ঘাড় বেথা করবে। আফাজের মনে উদয় হয় সেই বইটার কথা। আলিশা যে তাকে বইটা দিয়েছিলো সেইটা। “শেষ বিকেল” নাম বোধহয় বইটার। এখন তো সে একদম ফ্রি। আলিশার কথাও মনে পড়ছে খুব। বইটা এখন পড়া যাক ,,! তাতে যদি একটু মনটা ক্ষান্ত হয়,,!

আফাজ খুব ধীরে সিট থেকে বের হয়। হয়ে তাদের মাথার উপরে লাগেজ রাখার স্ট্যান্ড থেকে তার স্কুল ব্যাগ টা নেয়। চেইন খুলে বইটা বের করে হাতে নেয়। চেইন লাগিয়ে আবার ওটাকে উপরে যায়গা মতো রেখে দেয়। ইকরা যেন না উঠে সেভাবে সাবধান হয়ে এসে আবার সিটে বসে। বইটাকে দুই হাতে ধরে দেখতে থাকে। বইটার মলাটে হাত বুলায়। বিরবির করে বলে,

– শেষ বিকেল। সাবিনাতুল জান্নাত আরা। এই পাঠিকার নাম শোনা হয়নি। হয়তো নতুন।

বলেই বইটা একটু নিচে করে খুলে। উপরে খুললে জানালার বাতাসে পেইজ গুলো উড়োউড়ি শুরু করে দিবে। হাত টা নিচিয়ে নিয়ে বইটার মলাট উল্টায় আফাজ। বইটা খুলার সাথে সাথেই একটা ভাঁজ করা রঙিন কাগজ দেখতে পায় সে। অবাক হয় আফাজ।

– এটা আবার কী ,,!

বলেই বই থেকে সেই ভাঁজ করা রঙিন কাগজ টা হাতে নেয় সে। বইটা বন্ধ করে কাগজ টা খুলতে থাকে। তখনই তার মনে পড়ে যায় কাল সকালের কথা। সে ওখানে বইটা খুলতে চেয়েছিলো কিন্তু আলিশা তাকে বাঁধা দিয়ে বলেছিলো পড়ে খুলতে। তখন সে অযুহাত দিয়েছিলো অন্যকিছুর। এখন তো আফাজ দেখছে আসল কারণ ভিন্ন ,,!

আফাজ কাগজের ভাঁজ খুলে। আরে ,,! এটা তো একটা চিঠি ,,! আলিশা তাকে চিঠি লেখলো নাকি আবার ,,! আফাজ চিঠিটা খুলে ফেলে। হাত টা একটু উঠিয়ে নিয়েছিলো তাই জানালার বাতাসে চিঠির কাগজের কোণটা নুইয়ে আসছিলো। আফাজ চিঠির কাগজ টা একটু নামিয়ে ধরে। পড়তে শুরু করে,,

 

প্রিয় শেহওরান,

 

আপনার আসল নাম জানিনা, তাই শেহওরান বলেই সম্বোধন করলাম। আপনি যখন আমার আঁকা ছবিটা দেখছেন, আমি তখন বুকশেলফের কাছে এসে এই চিঠিটা লিখছি। ভাবছি যদি আপনি ছবিটার সেই দুজনকে চিনতে পারেন তবেই এই বইসহ চিরকুট টা আপনাকে দেবো। হয়তো আপনি চিনতে পেরেছেন। তাই এখন চিরকুট টা আপনার হাতে।

আমি জানি একজন মেয়ে কখনোই একজন ছেলেকে সচরাচর ভালোবাসার কথা আগে জানায় না। প্রেম চিঠিও আগে ছেলেরাই মেয়েকে দেয়। তবে আমি আপনার চিঠি পাওয়ার আগেই নিজেই আপনাকে নিয়ে লিখলাম। আমি জানিনা আপনি আমার কী জাদু কাঠি করেছেন। আপনার ব্যাক্তিক্ত, আপনার কথার ভাঁজ আমার অন্তর এতোটা কাছের করে নিয়েছে যে আমি তা ভাষায় ব্যাক্ত করতে পারছিনা। আপনি কী আমায় নিয়ে কিছু অনুভব করেন ,,! আমি করি। সেদিন ঐ জলপাই গাছের নিচে বসে আপনার সাথে কথায় মশগুল হওয়ার পর থেকে সবসময় আমি আপনাকে অনুভব করি। কল্পনায় আপনাকে আমি আমার আপন কেউ হিসেবে দেখতে পাই। “শেষ বিকেল” বইটার শেহওরান চরিত্রের মতো করেই আপনিও আমার মনে ঢুকে গিয়েছেন। তবে আপনি শেহওরান নন, আপনি আপনিই। গল্পে শেহওরান আগে অপরূপাকে তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের বেলায় আমি জানাবো। আমি কাব্যের মতো করে নিজের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতে পারিনা। তাই নিজের মতো করেই বলি ,,? আমি না আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। কতটা বেসেছি তা নিজেও জানিনা। হয়তো নিজের থেকেও বেশি, এই জগতে থাকা সব অমূল্য রত্নের থেকেও বেশি। হয়তো আপনি ভাবতে পারেন আমি কেমন মেয়ে। এভাবে করে নিজে থেকে ভালোবাসার চিঠি প্রেরণ করেছি,,? ধরে নিন না এটা আমাদের ভালোবাসার একটা অংশ,,! কেনো সবসময় ছেলেদেরই প্রকাশ করতে হবে ,,! মেয়েরাও করুক ,,! থাকনা একটু অন্যরকম, আপনার আমার বেলায়,,!

আপনি কাল চলে যাবেন। আবার কবে ফিরবেন আমি জানিনা। হয়তো আপনিও শেহওরানের মতো অনেক দিন পর ফিরে আসবেন। তবে আমি যে আশা হারাবো, তা কিন্তু না। আমিও আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো। অপরুপা যতটা ছিলো তার থেকেও বেশি। কথায় আছে না, অপেক্ষার ফল বেশি মিষ্টি হয় ,,!

আমার একটা আবদার, আবদার না ধরেন অনুরোধই। যেদিন আপনি আমার জন্য ফুল নিয়ে আসবেন সেদিন আপনি আমার আঁকা ছবিটার মতো এক সাদা পাঞ্জাবি পড়ে আসিয়েন ,,! হাতে থাকবে এক গুচ্ছ জবা আর গাঁদা ফুলের বাহার। আমি সেদিন ঠিক আঁকা ছবিটার মতো করেই লাল টুকটুকে এক শাড়ি পড়বো, কাঁচের চুড়ি পড়বো। হয়তো মেহেদী দিতে পারবোনা, তবুও সেটার দরকার নেই। খোঁপা করে চুল বাধবো। আপনি আসবেন, আমায় আদর কন্ঠে ডাকবেন, আমি দৌড়ে এসে আপনাকে জড়িয়ে ধরবো। অবশ্যই কোন এক শেষ বিকেলে আসবেন। কারণ আমিও চাই আমাদের সম্পর্কটা কোন এক শেষ বিকেলের সূর্যাস্তে রঙিন হোক। আমি আপনার সাথে ডানা মেলে উড়বো সেদিন। কেউ থাকবেনা আমাদের বাঁধা দেওয়ার।

 

আমার ফোন নেই। তাই কল কিংবা মেসেজে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো না। মাঝে মাঝে আমাকে চিঠি লিখবেন। আমিও লিখবো। আমার যদি একটা কবুতর থাকতো, তাইলে সেটার পায়ে আমার চিঠি বেঁধে আপনার উদ্দেশ্য পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার তো কবুতর নেই। আপনি নিপা ভাবির ঠিকানায় চিঠি প্রেরণ করিয়েন,,! আমি ভাবির কাছ থেকে নিয়ে পড়বো। তবে অবশ্যই একলা পড়বো। আমার মানুষটার প্রতিটা অক্ষর খুব মন দিয়ে পড়বো।

আর লেখতে পারছিনা, এমনিতেই আমার হাতের লেখা খারাপ হয়েছে তাড়াতাড়ি লিখতে গিয়ে। আপনি হয়তো এতোক্ষণে ধরে নিয়েছেন আমার আঁকা ছবিটার মানে, আমি দেখতে পেয়েছি আপনি আপনার হাত ঘড়িটা উঠিয়ে মিলালেন। আপনিও তারমানে আমাকে ভালোবাসেন। আপনার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনার জন্য আমার ভেতরটা উতলা হয়ে যাচ্ছে। জানিনা কবে শুনতে পাবো। তবে আমি অপেক্ষা করে যাবো। আসবেন কিন্তু,,! শেষ বিকেলে হারিয়ে যাওয়া, স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। নিঝুম রাতের অন্ধকারে, স্বপ্ন ধরার খেলায়,,! আমি মেলবো না আর স্বপ্নডানা, ঐ নীল মেঘেদের ছোঁয়ায়,,! আমি লিখবো না আর কাব্য কোনো, স্মৃতির ছেঁড়া পাতায়,,!

 

ইতি,

আপনার খুব কাছের কেউ, ছদ্মবেশী নাম অপরুপা।

 

চিঠিটা পড়েই কাগজটাকে বুকে জড়িয়ে নেয় আফাজ। সে বিশ্বাস করতে পারছেনা, এটা আলিশা লিখেছে। মেয়েটা এতোটা ভালোবেসে ফেলেছে ওকে ,,! আফাজ কতটা খুশি হয়েছে ও ব্যাক্ত করতে পারছেনা। আমিও ভাষার অক্ষর দিয়ে তা তুলে ধরতে পারছিনা। একপাক্ষিক ভালোবাসার মানুষটা যখন অন্যপক্ষ থেকে এভাবে প্রেমপত্র পায় সেই মুহুর্ত টা যেন কলমের কালি দিয়ে লেখে বলা দায়। আফাজের খুশিতে আনন্দ অশ্রু বেড়িয়ে আসে। ও সাথে সাথেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাতাস এসে তার মুখে ধাক্কা খেতে থাকে। তার চোখের জল গুলোকে ছিটকিয়ে নিয়ে যেতে থাকে অদূরে। আফাজে কল্পনায় আলিশার সাথে কাটানো সবগুলো স্মৃতি যেনো আবারো উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। আফাজ বলে উঠে,

– আমি কালই ফিরবো তোমার কাছে। কালই। আমি বাবা,মা সবাইকে বুঝিয়ে তোমাকে বিয়ে করে নিবো। তোমার এই ভালোবাসার অপেক্ষা আমি বেশি দিন করাতে পারবোনা। আমি নিজেও যে ধৈর্য ধরতে পারছিনা। মন বলছে যদি ক্ষমতা থাকতো এই ট্রেনটাকে এখনি ছুটিয়ে আবার দিনাজপুর ফিরে যেতাম। কিন্তু আজ যে তা সম্ভব নয়। তবে আমি আসবো। আমি কালই আসবো। কালকেই এসে তোমাকে নিয়ে ভালোবাসার সাগরে তলিয়ে যাবো। সাদা পাঞ্জাবি পড়ে আসতে বলেছো, আমি অবশ্যই পড়বো। তোমায় আমি ফুল দিয়ে সাজাবো। এক পালঙ্ক ফুল নিয়ে পুরা প্রেম রাজ্য তোমায় আমি এনে দিবো। অনেক ভালোবাসি তোমায় অপরুপা, অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।

বলেই চিঠিটা উঠিয়ে চুমু খায় আফাজ। চিঠির মধ্য যেনো সে আলিশার ঘ্রান পাচ্ছে। আলিশার নিজ হাতের ছোঁয়া রয়েছে এই চিঠিটায়। এটাকে আফাজ খুব যত্ন করে রেখে দিবে। তাদের ভালোবাসার প্রথম চিরকুট। তার কাছে এই পৃথিবীর সবকিছুর থেকেও যেনো দামি।

আফাজ চিঠিটাকে ভাঁজ করে বইয়ের মলাট উঠিয়ে রেখে দেয়। বইটা উঠিয়ে চুমু খায়। বইটা নামিয়ে দেখতে থাকে, বিরবির করে বলে,

– কালই আসছি অপরূপা, তোমায় নিয়ে সূর্যাস্তের তীরে ঘুরতে যেতে। প্রস্তুত থেকো কিন্তু ,,,!

 

আফাজ উঠে ইকরাকে পাশ কাটিয়ে সিট থেকে বের হয়। ব্যাগ টা নামায় উপরের স্ট্যান্ড থেকে। ব্যাগে খুব সাবধানের সহিত ঢুকিয়ে রাখে বইটাকে। কারণ বইটার মধ্যে যে তার মহামূল্যবান হীরা রয়েছে, তার প্রিয়তমার হাতের লেখা চিঠিটা রয়েছে।

আফাজ ব্যাগটা স্ট্যান্ডে রেখে এসে সিটে বসে। কালকেই রওনা দিবে, কিন্ত তার জন্য তো টিকিট কাঁটা লাগবে। সে তাড়াতাড়ি তার ফোনটা বের করে। রেল সেবা এপ এ লগইন করে। নেট কিছুটা স্লো। সে খুব উত্তেজিত। টিকিট টা না কাটতে পারলে তখন কীভাবে আসবে সে। বাসের ঠিক নেই। এখন বাস ধর্মঘট চলছে রংপুরে। এইজন্যই তো আজ ট্রেনে যাচ্ছে ওরা।

এপস্ এ বেশ কিছুক্ষণ পর ঢুকতে পারে সে। তাড়াতাড়ি কালকের রংপুর থেকে দিনাজপুর আসার ট্রেনের লিস্ট চেক করতে থাকে।

– সকালের ট্রেন,,, না এটার সব সিট বুক। (একটু থেমে) এইতো একটা আছে। রাজশাহী থেকে দিনাজপুর যাবে। অগ্রগামী কমিউটার। মাঝে রংপুর স্টেশন হয়ে যাবে। সময় যেন কয়টার। (একটু থেমে) ১২ টা। আর পৌছাবো ৪ টায়। হ্যা এটাই নিবো। একদম পারফেক্ট টাইম। বিকেলে গিয়ে নামেই আলিশাদের বাসা চলে যাবো।

বলেই আফাজ সেই ট্রেনের একটা টিকিট কেটে ফেলে। আফাজ এবার যেন শান্ত। মাথার উপর থেকে বোঝাটা নামলো শেষ পর্যন্ত। সে চিন্তায় ছিলো টিকিট পাবে কি না। কিন্তু না পেয়ে গেলো। জানালা বাইরে তাকিয়ে দেখে এদিকটায় মেঘাচ্ছন্ন। বাতাস টাও ঠান্ডা। আফাজ তার হাত ঘড়িটা উঠায়। দেখে সাড়ে ১১ টা বাজে। একটু আগেও জানালার বাইরে রোদ দেখলো সে। এখনি আবার মেঘলা আকাশ। প্রকৃতির রূপ চেনা বড় দায়।

 

আফাজ ফোনটা পকেটে রাখতে যায়। তখনই তার কি জানি মনে আসে। সে ফোনটা ঢুকায় না। উল্টো হেভফোন খুঁজতে থাকে।

– কিন্তু হেডফোন তো ব্যাগে। এখন আবার উঠতে হবে। (বলেই যখনই আফাজ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে যায় দেখে ইকরার হেড ফোনটা ওর গলায় ঝুলছে। মেয়েটা মনে হয় গান শুনতে শুনতে ঘুমাইছে। আফাজ ইকরার ঘুমন্ত মাথাটা একটু উঁচিয়ে ধরে হেডফোনের তার টা তার কাঁধ থেকে বের করে নেয়। ইকরার হ্যান্ড পার্সে তার মোবাইল। সেটার সাথেই হেডফোনের জ্যাক টা এড করা। আফাজ আস্তে করে ইকরার হাত থেকে তার পার্স টা নেয়। নিয়ে চেইন খুলে ফোন থেকে হেডফোন আলাদা করে। চেইন লাগিয়ে আবার আলিশার কোলেই রেখে দেয়।

হেডফোন টা নিজের মোবাইলে ঢুকায়। এই মুড, তার সাথে প্রকৃতির এই আবহাওয়া, একটা গান বেশ শুনতে ইচ্ছে করছে তার। আফাজ ইউটিউব থেকে গান টা সার্চ দিয়ে বের করে। গান টা প্লে করে ফোনটা কোলে রাখে। সিটে গা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে ফেলে। বাইরের ঠান্ডা বাতাস এসে তার সামনের চুল গুলো উড়িয়ে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। দূরে বাজ পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। মেঘলা ঘন নীলচে আকাশের দৃ্শ্য যেন মন কে ঠান্ডা করে। রিফ্রেশ করে নিয়ে যায় অন্য জগতে।

 

আফাজের হেডফোনে গানটি বাজতে শুরু করে। আফাজ চোখ বুঁজে এই নির্মল আবহাওয়ার মাঝে আলিশার প্রেম চিঠি আর গানটাকে একসাথে মিলিয়ে বেশ করে উপভোগ করতে থাকে। গানটি যেন‌ তার বর্তমান ভালোবাসারই প্রতিরূপ,

 

ভাল আছি, ভালো থেকো

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো

দিও তোমার মালাখানি

বাউলের এই মনটারে

 

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

,

,

 

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম

পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম

তেমনি তোমার নিবিড় চলা

মরমের মূল পথ ধরে

 

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

 

 

 

– আফরিন শান্ত হও। তোমার মায়ের কিচ্ছু হবেনা। কাদিও না। আচ্ছা শোনো আমি স্যারকে বলে আসতেছি ঢাকায়। তুমি ভেঙে পড়োনা। তোমার এইসময় শক্ত থাকতে হবে।

– প্লিজ আপনি কিছু করেন, আমার আম্মায় চোখ মেলতাছে না। আমার ডর লাগতাছে ,,! আমার মায়ের কিছু হইলে আমি মইরা যামু। (কাঁদতে কাঁদতে ফোনের অপর প্রান্ত হতে আফরিন বলে)

– তুমি প্লিজ একটু শান্ত হও। আমি, আমি এখনি স্যারকে জানাচ্ছি। আজ রাতের ট্রেনেই ঢাকা ফেরার চেষ্টা করছি। তুমি আর কাদিও না। আচ্ছা তোমার সাথে থাকা নার্সকে ফোন দাও।

কিছুক্ষণ পর ওপাস থেকে আফরিনের বদলে নার্সের কন্ঠ ভেসে আসে। আহনাফ নার্সের কাছ থেকে সবটুকু শুনে। যতই শুনছে সে অস্থীর হচ্ছে। আফরিনের মায়ের শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আহনাফ নার্সকে বলে আফরিনকে শান্ত করাতে। ও আজকেই ঢাকা ব্যাক করবে। নার্স তাতে সম্মতি জানায়। আহনাফ ফোনটা কান থেকে নামায়।

এতোক্ষণ ধরে সে ভাবছিলো আশরিফ আর তার মায়ের কানেকশন কোথায় তা নিয়ে, এখন তার উপর নতুন চিন্তা আফরিনকে নিয়ে। মেয়েটা মা’কে ছাড়া কিছু বুঝেনা। ওর মায়ের কিছু হয়ে গেলে ও যে মানসিক দিক দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে।

আহনাফ বিছানা থেকে নিচে নামে। সে অস্থির, চঞ্চল। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।

 

বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথার চুল ঝাড়ছিলেন শিউলি বেগম। মাত্রই গোসল করে আসলেন তিনি। সময়টা দুপুর। বারান্দার টেবিলে খাবারের বাটি, প্লেট এগুলা ঠিক করছে লায়লা আর ফুলমতি।

আহনাফ ঘর থেকে বের হয়। হনহন করে এসে ডায়নিং টেবিলের সামনে থাকা ফুলমতির পাশে দাঁড়ায়। বলে,

– আপু, আপু শাহারিয়া স্যার কোথায় ? আপনি কী উনাকে কোথাও দেখেছেন,,!

– না ভাই, আমি তো রান্নাঘরে আছিলাম। ঐ যে চাচি খাড়ায়া আছে, উনারে যাইয়া জিগান।

আহনাফ কথাটা শোনা মাত্রই ডায়নিং টেবিলের পাশ থেকে চলে যেতে থাকে শিউলি বেগমের দিকে। শিউলি বেগম দরজা দিয়ে বাইরে দিকে মুখ করে নিজের খোলা চুলের পানি ঝাড়ছিলেন। পড়নে একটা নীল শাড়ি। আহনাফ দ্রুত গতিতে হেঁটে তার দিকে যেতে থাকে। তার মাথায় অনেক কিছুর চিন্তা, আফরিনকে নিয়ে টেনশন। হঠাৎ আহনাফ কিছু একটার সাথে উস্টা খায় আর হুমড়ি খেয়ে পড়ে শিউলি বেগমের গায়ের উপর। অমনি শিউলি বেগম সহ ও ফ্লোরে পড়ে যায়। নিচে শিউলি বেগম, উপরে ও। দুইজনের মুখের মধ্যে মাত্র ৫ আঙ্গুলের দূরত্ব। আহনাফের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে অবাকের চোটে, সে হঠাৎ কীভাবে কিসের সাথে উষ্টা খেয়ে শিউলি বেগমের গায়ের উপর এসে পড়লো কিছুই বুঝতে পারছেনা। এদিকে শিউলি বেগমের মুখ হাসৌজ্জল। তিনি আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছেন। আহনাফ কী বলবে ভেবে পায়না। শিউলি বেগম হাসি মুখে বলে উঠেন,

– তোমার চাচা তো আইজ বাড়িত, আমার উপরে শুইতে চাইলে অন্য সময় আইতা ,,!

আহনাফের অবাক চোখে মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইঙ্গিত দিতে থাকে। সে কী এক ফাঁদে পড়ে গেলো। এখন শিউলি বেগম তাকে নিয়ে আবার মজা উড়াবেন। শিউলি বেগম আবারো বলেন,

– আমার শরীর অনেক নরম না বাজান ,,! ঐদিন তো আমি তোমার উপরে পইড়া গেছিলাম, তুমি মনে হয় মজা পাইছো, এরলাইগা আইজ আমার উপরে পইড়া গেলা হি হি হি।

– আ,আন্টি। আ,আমি ইচ্ছা করে পড়িনি।

– হ ,তুমি তো ইচ্ছা কইরা পড়োনাই ,,! আমিও তো তোমারে টাইনা আবার উপর নিছি তাই না ,,!

– স,সরি আন্টি।

বলেই উঠতে থাকে আহনাফ, শিউলি বেগম হাসতে হাসতে বলতে থাকেন,

– আরেকটু থাহো না হুইয়া, আমার মজা লাগতাছে ,,! হা হা হা

শিউলি বেগম হাসিতে ফেটে পড়েন। আহনাফ উঠে দাঁড়াতে থাকে। এদিকে ততক্ষণে লায়লা আর ফুলমতি চলে এসেছে। লায়লা আহনাফের এক হাত ধরে তাকে উঠতে সাহায্য করে। ফুলমতি শিউলি বেগমকে উঠাতে যায়। তখনই শিউলি বেগম রং ঢং গলায় বলেন,

– আমার ময়না পাখি আমারে না উডাইলে আমি উডমু না ,,! হা হা হা।

– খাড়ান তাইলে চাচারে ডাক দিতাছি।

– না না। ঐডা তো গন্ডার। ঐডার হাত ধইরা কেডা উডে। আমি আমার এই (চোখ দিয়ে ইশারা করে আহনাফকে দেখিয়ে) ময়না পাখির কথা কইছি ,,! হি হি হি।

আহনাফ সাথে সাথে অবাক আর লজ্জায় চোখ মুখ ঘুড়িয়ে নেয়। হাতের কনুইয়ের ব্যাথা পেয়েছে ও। কনুইয়ে হাত চেপে ধরে অন্যদিকে ফিরে থাকে সে। এদিকে ফুলমতি আর লায়লা শিউলি বেগমের সাথেই মিটিমিটি করে হাসতেছে। তখনই বাড়ির বারান্দার দরজার সামনে কথা বলতে বলতে এসে দাঁড়ায় দিথী আর শাহারিয়া। তারা আগে আহনাফকে দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। শাহারিয়া আহনাফকে বলে উঠে,

– কীরে,,! তোর হাতে আবার কী হইলো ,,!

– এ,এইতো স্যার। একটু ব্যাথা পাইছি।

তখনই দিথী দেখে বারান্দায় শিউলি বেগম শুয়ে আছেন। আর মিটিমিটি হাসছেন। দিথী হন্তদন্ত হয়ে বারান্দার ভিতরে চলে আসে,

– আরে মা, আপনি পড়ে গেলেন কীভাবে,,!

– আমার জানেমান আমারে ফালায়া দিছে,,!

– কে ,,! চাচা ?

– না, না, আমি তো আমার নয়া প্রেমিক পাইছি। ঐযে,,! হে হে হে।

দিথী ফিরে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ আমতা আমতা করে বলে,

– আ, আমার কীসের সাথে জানি পা লেগে পড়ে গেছি।

– বুজছো বউমা ,,! জানেমান আমার প্রেমে উষ্টা খাইয়া পড়ছে ,,! হা হা হা!

দিথী আহনাফ আর শিউলি বেগমের দিকে তাকিয়ে সব বুঝতে পারে। শিউলি বেগমকে ধরে উঠাতে থাকে। শাহারিয়া এদিকে দুই হাত কোমরে দিয়ে এদের সিন কারবার দেখতেছে। শিউলি বেগমকে উঠিয়ে দাঁড় করায় দিথী। শিউলি বেগম গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ান। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আহনাফ। শিউলি বেগম হাতে লাগা বালি ঝাড়তে ঝাড়তে শাহারিয়ার দিকে আর ফিরে দিথীর দিকে বলতে থাকে,

– পিছনের বাগানে যাইয়া এহন চুমাচুমির হাট বহাইছো তোমরা হ্যা ,,! তোমরাতো খালি প্রেম পিরিতি নিয়াই পইড়া থাহো ,,! আর আমার এই ময়না পাখি ,,! এয় তো (কোমর দিয়ে আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে) কিছুই বুঝেনা,,!

আহনাফ তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে আবার ফ্লোরে পড়ে যায়। সবাই তা দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। আহনাফ যেন বোকাবনে যায়। হাবাগোবার মতো চেয়ে থাকে শিউলি বেগমের দিকে। শিউলি বেগম হাসতে হাসতে বলেন,

– এই পোলা রে বিয়া কইরা কি করমু হ্যা ,,!  দেহে তো শক্তিই নাই। এক ধাক্কাতেই দেখছো কেমনে ঠাস কইরা পড়লো ,,! হা হা হা! এর চেয়ে আমার গন্ডার মতিনই ভালা ,,! হা হা হা!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

 

উপন্যাস:: গ্রামের নাম আনন্দপুর

সিজন :: ২(মুখোশ)

পর্ব :: ৫৯

লেখক :: মির্জা শাহারিয়া

 

– পিছনের বাগানে যাইয়া এহন চুমাচুমির হাট বহাইছো তোমরা হ্যা ,,! তোমরাতো খালি প্রেম পিরিতি নিয়াই পইড়া থাহো ,,! আর আমার এই ময়না পাখি ,,! এয় তো (কোমর দিয়ে আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে) কিছুই বুঝেনা,,!

আহনাফ তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে আবার ফ্লোরে পড়ে যায়। সবাই তা দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। আহনাফ যেন বোকাবনে যায়। হাবাগোবার মতো চেয়ে থাকে শিউলি বেগমের দিকে। শিউলি বেগম হাসতে হাসতে বলেন,

– এই পোলা রে বিয়া কইরা কি করমু হ্যা ,,!  দেহে তো শক্তিই নাই। এক ধাক্কাতেই দেখছো কেমনে ঠাস কইরা পড়লো ,,! হা হা হা! এর চেয়ে আমার গন্ডার মতিনই ভালা ,,! হা হা হা!

 

সবাই শিউলি বেগমের কথা শুনে আবার হেঁসে উঠে। আহনাফ ধীরে ধীরে ফ্লোর থেকে উঠার চেষ্টা করে। শিউলি বেগম হাসতে হাসতে ফুলমতিকে বলেন,

– ধর ওরে একটু, বেচারা হঠাৎ ঝড় সামলাইতে পারে নাই ,,! হা হা হা

ফুলমতি আহনাফকে ধরে উঠাতে থাকে। আহনাফ তার শরীরের বালি ঝাড়তে থাকে হাত দিয়ে। শাহারিয়া হাসি থামায়। তার স্বাভাবিক মুডে ফিরে যায়। সে জানে তারা এভাবে হাসতে থাকলে শিউলি বেগম আরো তাদের হাসানোর চেষ্টা করবে। তাই সে কথার প্রসঙ্গ ঘুড়িয়ে দেয়। আহনাফকে বলে,

– চল ঘরে চল। গোসল করছিস না আজকে করবি না ? (চারপাশ দেখে) আজকে তো রোদ উঠছে। গোসল টা করে নে।

– স্যার আমি গোসল করছি একটু আগেই। (বলেই হাতের ব্যাথা পাওয়া যায়গাটা ঘষতে থাকে আরেক হাত দিয়ে)

– বেশি ব্যাথা পাইছিস ,,? (ফুলমতিকে উদ্দেশ্য করে) যা তো মা’র ঘর থেকে মুভটা নিয়ে আয়।

– না না স্যার লাগবেনা। আমি ঠিক আছে। আমি আপনার কাছেই আসতেছিলাম একটা কথা বলার জন্য। মাঝখানে যে কীসের সাথে উষ্টা খাইলাম ,,! (বলেই পিছনে ফিরে দেখতে থাকে কীসের সাথে তার পা লেগে গেছিলো তখন। দেখে কিছুই নাই। শাহারিয়া বলে উঠে,

– কী বিষয়ে ?

– স্যার আফরিনের মা খুব অসুস্থ হয়ে গেছে। ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছেন উনি। আজ সকাল থেকে বলে জ্ঞান নাই। আফরিন অনেক কান্না করতেছে। স্যার আমি ঢাকা ফিরে যেতে চাই।

– আফরিন ফোন দিয়েছিলো ?

– হ্যা স্যার। আমি নার্সের সাথেও কথা বলেছি। নার্সও বলছে এই রোগী বেশিদিন বাঁচবে না। স্যার আফরিন ওখানে একলা আছে। ও ওর মায়ের কিছু হয়ে গেলে নিজেকে সামলাতে পারবেনা। আমি স্যার চলে যেতে চাচ্ছি।

– অবস্থা সিরিয়াস যেহেতু যাওয়া দরকার। আচ্ছা তুই যা খেতে বস। খাওয়া দাওয়া করেই আমরা বেড়োবো।

– স্যার এখন কী ট্রেন পাওয়া যাবে ,,? এখন তো দুপুর।

– আমি গাড়ি ম্যানেজ করে নিবো নে। তুই যা খাইতে বস। আর ফুলমতি। তুই একটু ওর ব্যাগ টা গুছায় দে তো বোন।

– আচ্ছা ভাইজান। আমি অহনি যাইতাছি।

বলেই বারান্দা দিয়ে চলে যেতে থাকে আহনাফের ঘরের দিকে। আহনাফ সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে শাহারিয়ার দিকে ফিরে। বলে,

– আচ্ছা স্যার, আমি খেয়ে রেডি হয়ে নিচ্ছি। আপনিও আসেন।

– আমি একটু বাবার সাথে দেখা করবো। তুই যা। লায়লা ওকে টেবিলে নিয়ে গিয়ে ভাত দে।

লায়লা আহনাফের সাথে চলে যেতে থাকে ডায়নিং টেবিলের ওদিক। এখন শুধু বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শিউলি বেগম দিথী আর শাহারিয়া। দিথী তাদের যাওয়ার পথ থেকে নজর ঘুড়িয়ে শাহারিয়াকে বলে,

– আফরিন কে ,?

– ঐযে তোমাকে ঐদিন বললাম না আমাদের মিশনের সময় এক মেয়েকে বাঁচিয়ে ছিলাম। ঐ মেয়েটা।

– আহনাফ ওর জন্য এতো উতলা কেনো?

– এখন আমি কী জানি। থাকতে পারে অন্য কোন ব্যাপার। আচ্ছা বাদ দাও। তুমিও যাও, গিয়ে টেবিলে বসো। একসাথে খেয়ে নেই।

– আচ্ছা চলো।

– না তুমি গিয়ে বসো। আমি একটু বাবার সাথে কথা বলেই আসছি।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

দিথী চলে যায়। শাহারিয়া এগিয়ে গিয়ে শিউলি বেগমকে বলে,

– মা, বাবা কী ঘরে,,!

– না, আমার পেডের ভিতরে। আইজ ডেলিভারি হইবো ,,! হি হি হি!!

– মা এখন মজা করিও না। একটু সিরিয়াস বিষয়। বলোনা, বাবা কী ঘরে ?

– হ। ঘরে বইয়া বই পড়ে। আমারেও যদি একটু পইড়া শুনাইতো তাও হইতো। আইজ পড়ালেহা পাড়িনা বইলা ঐসব রোমান্টিক বই পড়তে পারিনা।

– আচ্ছা আমি বাবাকে বলবোনে তোমাকে গল্প পড়ে শুনাইতে। এখন তুমি ঐদিকে যাও, আহনাফ চলে যাবে ওর খাওয়া দাওয়ার দিক টা একটু দেখো।

– যাইতাছি। তুই তাড়াতাড়ি আইয়া পড়িস, তরকারি ঠান্ডা হইয়া যাইবো এদিক নাইলে।

– আচ্ছা আমি আসতেছি তুমি যাও।

 

শিউলি বেগম চলে যেতে থাকেন বারান্দার একদিকে। আর শাহারিয়া চলে যেতে থাকে অপর দিকে তার বাবার রুমের দিকে।

বাইরে রোদ উজ্জ্বল পরিবেশ। আঙিনায় রোদের ঝিলিক পড়েছে। আঙিনার রশিতে দুটো চড়ুই পাখি এসে বসলো। মনে হয় রোদ পোহাবে তারা।

 

 

 

আনন্দপুরের চৌরচক বাজার। মাঝখানে থাকা মুর্তির চারপাশে চারটা রাস্তা চলে গেছে। আর গোল চক্কর টায় বসেছে বাজার। এই যায়গাটার সাথে আপনারা হয়তো আগেও পরিচিত হয়েছিলেন। যখন তানিয়া, কানিজ রা এসেছিলো।

 

সময়টা এখন সন্ধ্যা। বাজারে লোকের কোলাহল বেশ। এইসময় টা এই বাজারের মূল টাইম বেঁচা কেনার। সারাদিন যা বেঁচা কেনা হয় তার থেকে এই সন্ধ্যার পর বেঁচা কেনা বেশি হয়। টাটকা খেত থেকে তুলে আনা সবজি কৃষক রা এখানে বেচেন।

 

সুমু হেঁটে হেঁটে দেখছে বাজার টাকে। মুখে ওড়নাটা হাত দিয়ে চেপে রেখেছে, যাতে রাশেদ বা তার পরিচয় জানা কেউ তাকে চিনতে না পারে। তান্ত্রিক তাকে বেড়োতে বাঁধা দিয়েছিলো। কিন্তু তার ঐ ঘরে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। তাই বেড়িয়েছে একটু ঘুরা ঘুরি করার জন্য। সে তো এখন একদম স্বাধারণ এক মানুষ। তারও তো বাকিদের মতোই বদ্ধ ঘরে দম আটকে আসে। কিন্তু তান্ত্রিক তাকে যেতে দিতে নারাজ, কারণ যদি দিথী, তানিয়ারা তাকে দেখে তখন যদি তার ক্ষতি করে ফেলে,,!

সুমু হাঁটতে হাঁটতে দেখে রাশেদের দোকান টা বন্ধ। সেদিন যখন তানিয়া,কানিজ দের সাথে এসেছিলো তখন দেখেছিলো রাশেদকে ঐ যায়গায় দোকান নিয়ে বসতে। তবে আজ সেই যায়গাটা ফাঁকা। সুমু হাঁটতে হাঁটতে মুদির দোকান গুলোর দিকে চলে যায়।

আকাশ পরিষ্কার, তাই কিছুটা জোছনা পড়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে বেশ করে। কুয়াশা এখনো তেমন করে পড়তে শুরু করেনি। সুমু্র পড়নে লায়লার একটা গোল জামা। সে হাঁটতে হাঁটতে দোকান পাটের শেষ প্রান্তের দিকে চলে আসে। সে ধীর পায়ে হাঁটছে। অনেকদিন পর বেড়োতে পেরে, খোলা আকাশের নিচে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পেরে তার ভালো লাগছে। সুমু একদম শেষ প্রান্তের প্রাচীরের দেওয়ালের কাছে এসে যায়। শেষ দোকান টা বন্ধ। শাটর লাগানো। সেই দোকানের সামনেই বসে আছে দুই পাগল আর পাগলী। সুমু পাগল পাগলীর ততটা কাছে ছিলো না। সে কিছুটা দূরে থেকে তাদের দেখছিলো। সে আগে কখনো পাগল পাগলিদের একসাথে দেখেনি। তাই সে দাঁড়িয়ে এখন তাদের দর্শন করছিলো।

পাগল টার পাশে বসে রয়েছে পাগলিটা। পাগলির গায়ে একটা ছেড়া শাড়ি। মাথার চুল গুলো উসকোখুসকো। শরীর শুকনা। পাগল টারও শরীরে তেমন একটা মাংস নেই। শরীরের জামাটা ছেঁড়া। তাদের পাশে একটা পুটলি রাখা। রাতের জোছনার আলো এদিক টায় বেশ ভালো রকমই স্পষ্ট। এদিকের শেষ প্রান্তের ২-৩ টে দোকান বন্ধ তাই কোন কৃত্রিম আলো নেই। পাগল টা তার পাগলীর উসকোখুসকো চুল গুলো হাত দিয়ে একসাথে করে বিনুনি করার চেষ্টা করছে। বলছে,

– রাণী,,! তোমার চুল গুলারে আমি বাইধা দেই ,,!

– আমার চুল ,,! দাও ,,! কিন্তু আস্তে বাইন্ধো। আমার ব্যাথা লাগে মাথায়।

– আইচ্ছা। আস্তে কইরাই বানতাছি।

– রাজা, আমি তোমার কোলে ঘুমাই ,,! আমারা না খুব ঘুম পাইতাছে।

– ঘুমাইবা ,,! আইচ্ছা আমার কোলে হুইয়া পড়ো। ঐ যে দেখতাছো আসমানের চাঁদ, ঐডা আমাগো দেখতাছে কিন্তু। তুমি চাঁদরে কইয়া দাও আমাগোরে না দেখতে।

– এই চাঁদ যা, তুই আমারে আর রাজারে দেহোস ক্যা ,,! যা। (পাগল টার দিকে ফিরে) রাজা, অয় তো যাইতাছে না।

– আচ্ছা তুমি আমার কোলে হুইয়া পড়ো। চাঁদ পড়ে এমনিতেই যাইবো গা।

পাগলী টা পাগলের পায়ের মাংসপেশিতে মাথা রাখে। রেখে শুয়ে পড়ে। পাগল টা পাশের টোপলা থেকে একটা ছেঁড়া কাঁথা বের করে। বের করে সেটা তার পাগলীর উপর ঢাকা দিয়ে দেয়। ভালোভাবে টেনে টুনে দিতে থাকে পাগলির গাঁয়ের উপর। পাগলী পাগলের কোলে শুয়ে তার গেন্জির ফুটোতে আঙুল ঢুকিয়ে দেখতে দেখতে ধীর গলায় বলে,

– ও রাজা, আমার খিদা লাগছে। আমি কিছু খামু।

– আমি আইজ দোকানে খাবার চাইতে গেছিলাম। ওরা খাবার দেয় না। ওরা খালি আমাগোরে মারতে আহে।

– আমার পেট বিশাইতাছে। সেই সকাল থেইকা কিছু খাইনাই। ও রাজা, তুই কিছু কর না।

– রাণী, তুই আমার কোলে মাথা রাইখা ঘুমায়া পড়। আমাগোরে তো কেউ খাওন দিবো না। এইভাবেই না খাইয়া আমাগোরে রাইতের পর রাইত পাড় করা লাগবো।

– জানোস রাজা, তুই যহন আইজ সকালে খাওন আনতে গেছিলি না,,! তহন দুইটা বাচ্চা পোলা আইয়া আমারে ইট মারছে। আমার, আমার হাতে ইট লাইগা ছিল্লা গেছে।

– আমারেও দোকানের মাহাজন তাড়ায়া দিছে। আমি খালি কইছিলাম আমারে কিছু খাবার দিতে। তহন দুর দূর কইরা তাড়ায়া দিছে আমারে। তুই আমারে জড়ায় ধইরা ঘুমা রাণী। আমি স্বপ্নে যদি খাওন পাই, তাইলে তোর লাইগা নিয়া আমু। ঠিক আছে ,,!

– আইচ্ছা রাজা। আমার লাইগা আনিস। রাজা, তুই আর আমি জামাই বউ তাইনা ,,!

– ধুর, এসব কয়না, আমার শরম করে।

– আমারো শরম করে,, হি হি হি!

বলেই পাগলীটা পাগলের কোমর জড়িয়ে ধরে তাতে নিজের মুখে লুকায়। পাগলটা পাগলির মাথার চুলে বুলি কেটে দিচ্ছিলো। পাগলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে ঘুম পাড়ানি ছড়া বলতে শুরু করে। তবে তা নিজের মতো করে বানিয়ে।

 

দূর থেকে এসব দেখে সুমুর মন বেশ খারাপ হয়। পাগল পাগলীটা খাবার পায় না। শরীর দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার হয়তো বেশিরভাগ সময় অনাহারে থাকে। সুমু তার গোল জামায় থাকা ছোট্ট পকেট খানায় হাত ঢুকায়। হাত বের করে দেখে একটা ২০ টাকার নোট। লায়লা তাকে দিয়ে গেছিলো কাল রাতে। বলেছিলো যদি কখনো লাগে বাইরে গিয়ে কিছু খাইতে। লায়লা নিজেই অন্যের বাসায় কাজ করে, সেই খান থেকে ও আবার সুমুকে খাওয়ার জন্য টাকা দিছে ,,! ভাবাযায় ,,!

 

সুমু নোট টা হাতে নিয়ে চলে যায় খোলা দোকান গুলোর দিকে। চারপাশে মানুষ বেশ এদিকটায়। সবার হাতেই বাজারের ব্যাগ। সারাদিন খেটে পাওয়া পারিশ্রমিক দিয়ে তারা  এখন পরিবারের জন্য বাজার করতে এসেছে। সুমু একটা মুদির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এই দোকানে ভিড় তেমন একটা ছিলোনা। সুমু দোকানের সামনে গিয়ে দেখতে থাকে কী নেওয়া যায়। একটা লম্বা পাউরুটি তার চোখে পড়ে। সে দোকানদারকে বলে,

– ভাইয়া, ঐটা দিয়েন তো।

– কোনডা, এইডা ?

– হ্যা।

দোকানদার একটা পাউরুটি বের করে দিতে থাকে ঝোলানো পলিথিন থেকে। বের করে এগিয়ে দেয় সুমুর দিকে। সুমু হাতে নেয়। বলে,

– কত এটা ?

– ১৫ টাহা।

– এইটা ১৫ টাকা,,!

– হ, আগে ১০ টাহা ছিলো। এহন ১৫ টাহা হইছে।

– ওহ,,, এইনিন। (২০ টাকার নোট টা দোকানদারের দিকে এগিয়ে দেয় সুমু। দোকানদার টাকাটা রেখে বাকি ৫ টাকা ফেরত দিতে যায়, তখনই সুমু বলে,

– এই চকলেট গুলা কতো করে ,,!

– মি, ম্যাংগো ১ টাকা কইরা।

– আচ্ছা তাইলে এইটা আমাকে ৫ টা দেন।

দোকানদারটা বোয়াম খুলে ৫ টা চকলেট বের করে। করে সুমুর দিকে এগিয়ে দেয়। সুমু রুটির সাথে চকলেট গুলোও হাতে রাখে। দুইহাতে জিনিস ধরায় তার মুখ থেকে ওড়নাটা সড়ে যায়। উজ্জ্বল ফর্সা মুখ খানা দেখে দোকানদার বলে উঠে,

– গ্রামে নতুন আইছো,,!

সুমু কথাটা শুনেই চকিতে তাকায় দোকানদারের দিকে‌। খেয়ালে আসে যে মুখের উপর থেকে ওড়নাটা পড়ে গেছে। সুমু মাথা নাড়িয়ে নার্ভাস হয়ে বলে,

– জ,জ্বী।

– কাগো বাড়িত আইছো ,,!

সুমু থেমে যায়। ও কী উত্তর দিবে। এই গ্রামে তো মেম্বার বাড়ি আর দিথীদের চেয়ারম্যান বাড়ি ছাড়া আর কোন বাড়িই চিনে না সে। ভাবতে থাকে কোন বাড়ির কথা বলা যায়। তখনই দোকানদার বলে,

– মেম্বার বাড়িতে বিয়া খাইতে আইছো,,?

সুমু এটাতেই সম্মতি জানায়। মাথা নাড়িয়ে বলে,

– জ্বী।

– ওহ,, আফাজ, ইকরা গো লগে আইছো নাকি ,,! আফাজ আমার পোলার বন্ধু হয়। তোমারে দেখতেও ওগো মতো ফর্সা লাগতাছে। গ্রামের মানুষ তো আর এতো ফর্সা হইবো না।

– জ,জ্বী। আ,আমি ওদের সাথেই এসেছি।

– ওহহ,, (একটু থেমে) তোমার আর কিছু লাগবো কী ,,?

– ন,না। আর কিছু লাগবে না।

বলেই সুমু সেই দোকানের সামনে হতে চলে যেতে থাকে শেষ প্রান্তের বন্ধ দোকান গুলোর দিকে। আফাজ, ইকরারা কে তা সে নিজেও জানেনা। এদেরকে কখনো দেখেছিলো কি না তাও মনে নাই। এখন যদি সে দোকানদার কে না বলতো তাইলে দোকানদার আরো নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতো।

 

সুমু চলে আসে শেষ প্রান্তের বন্ধ দোকান গুলোর দিকে। পাগল টা এখনো পাগলিকে ঘুম পাড়ানি ছড়া শোনাচ্ছিলো। পাগলীটা পাগলের কোলে শুয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। সুমু এগিয়ে যায় তাদের দিকে। পাগল টা পাগলির দিকে তাকিয়ে থাকায় সে সামনে থেকে আসতে থাকা সুমুকে দেখেনি। সুমু এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। হাঁটু গেড়ে তাদের পাশে বসে। হঠাৎ সুমুকে দেখে পাগলটা একটু চমকেই উঠে। পাগলের চমকে উঠা দেখে পাগলিও মাথা ঘুড়িয়ে তাকায়। পাগল টা বলে,

– এ,এই। তুমি কেডা। আমার রাণী ঘুমাইতাছে। তুমি আইছো ক্যা এহানে ,,!

সুমু তার হাতে থাকা রুটি টা তাদের দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,

– এটা নেন। দুইজন মিলে খেয়ে নিয়েন। আমার কাছে আর টাকা ছিলো না। নাইলে ২টা নিতাম।

পাগলী টা সেই রুটিটা নেয়। নিয়ে পাগলের দিকে ফিরে একটা হাসি মুখ করে। বলে,

– দেখ রাজা, আমাগো লাইগা রুটি আনছে।

– হ। উঠ, চল খাইয়া লই ,,!

পাগলিটা কোল থেকে উঠে বসে। রুটিটা প্যাকেট থেকে বের করে নিজেই দুইভাগ করে। করে এক ভাগ পাগল টাকে দেয়। আরেক ভাগ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকে। তারা যেনো খাবার পেয়ে অনেক খুশি। তাদের মুখের আনন্দ রেখা চওড়া হতে দেখে সুমুর ভিতরে ভিতরে একটা আলাদা প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। অসহায় দের সাহায্য করলে বুঝি এতোটাই শান্তি পাওয়া যায়,,! ভিতরটা যেন তার ঠান্ডা হয়ে আসছে।

সুমু তার চকলেট গুলো থেকে ৪ টা চকলেট তাদেরকে এগিয়ে দেয়। পাগলীটা রুটি ছিঁড়ে খেতে খেতে সুমুর দিকে দেখে। সুমু হাত বাড়িয়ে চকলেট গুলো তাদের দিকে এগিয়ে ধরে রেখেছিলো। পাগলিটা চকলেট গুলোর দিকে একবার তাকায়, একবার সুমুর দিকে তাকায়। বলে,

– এইগুলা আমাগোর,,!

সুমু একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলে,

– হ্যা। তোমাদের।

– দেখছোস রাজা ,,! মাইয়াডা কত্ত ভালা ,,! আমাগোর লাইগা চকলেটও আনছে।

পাগলিটা সুমুর হাত থেকে চকলেট গুলো নেয়। নিয়ে দুটো পাগলটাকে দেয়। আর দুটো নিজের হাতে রাখে। ফিরে সুমুর দিকে তাকায়। হাসি,খুশি মুখে বলে,

– তোমার জামাই কই ,,!

কথাটার জন্য অপ্রস্তুত ছিলো সুমু। তবুও সে মুখে হাসি ধরে রেখেই বলে,

– আ,আমার তো জামাই নেই।

– তোমার জামাই নাই ,,! (পাগলের দিকে ফিরে) দেখছোস রাজা, এতো সুন্দর মাইয়াডার বলে এহনো জামাই হয়নাই ,,! হা হা হা!

– হইবো রাণী হইবো। তুই যেমন আমারে ভালোবাসোস, আমি যেমন তোরে ভালোবাসি, তেমনি ঐ মাইয়ারেও কেউ একদিন ভালোবাসবো।

কথাটা শুনে সুমুর ভিতর টা কেমন যেনো করে উঠে। তাকেও কেউ ভালোবাসবে ,,? কিন্তু কেউ তো তার সাথে মিশতে চাইবেনা। বলবে অশুভ আত্মা আছে ওর সাথে।

– কিন্তু আমার সাথে তো কোন অসুভ আত্মা নেই। আসুভে শুধুই একটা আলাদা আত্মা। সেটা ছাড়া তো আমি একজন রক্ত মাংসের মানুষ।

বিরবির করে বলে সুমু। তার বিরবির করে কিছু বলতে দেখে পাগলীটা বলে,

– তোর আপনজনের কথা মনে পড়ছে ,,! ভালোবাসোস কাউরে,,।

– ন,না। আমার কোন ভালোবাসার মানুষ নেই।

– হইবো। একদিন হইবো। এইযে আমার যেমন রাজা আছে, তোরও একদিন কেউ থাকবো। আমি তোরে দোয়া কইরা দিলাম। তুই অনেক ভালা মানুষ, আমাগোরে খাওন দিছোস। আল্লাহও তোর লাইগা কোন ভালো মানুষ রাইখা দিছে। দেখিস।

সুমু কিছু বলে না। শুধু একটা মুচকি হাসি আনে ঠোঁটে। পাগলিটা ফিরে পাগলটাকে বলে,

– রাজা, তুই আমারে আবার ঘুম পাড়াইয়া দিবি কিন্ত হ্যা ,,! আমি আবার তোর কোলে মাথা রাইখা ঘুমামু।

– আইচ্ছা রাণী। চকলেট গুলা কাইল খামু তাইলে।

– আইচ্ছা। নে এডি। রাইখা দে।

পাগলিটা তার হাতে থাকা দুটো চকলেট পাগলের দিকে এগিয়ে দেয়। পাগলটা তা নিয়ে সেগুলো আর তার কাছে থাকা দুটো চকলেটও পাশের পোঁটলা টার ভিতরে রেখে দেয়। সুমু উঠে দাঁড়িয়ে। তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,

– আমি যাই ,,! তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িও।

– আইচ্ছা। পড়ে আবার আহিস।

বলেই পাগলীটা রুটি দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকে। সুমু চলে যেতে থাকে হেঁটে হেঁটে। তার মনে কিছু নতুন প্রশ্ন জন্মেছে। সে কী একটা সুন্দর জীবন পেতে পারে ,,! যেখানে তার একটা মানুষ হবে, সে তার মানুষ টার সাথে দুঃখ কষ্ট সব কিছু ভাগাভাগি করে নিবে। দিনশেষে তার কোলে মাথা রেখে নিদ্রায় যাবে ,,!

– আমাকে কে বিয়ে করবে। আমি তো খারাপ। আমি তো এক অসুভ আত্মার জন্য জন্মেছি। (একটু থেমে আক্ষেপের সুরে) আমি কী একটা সুন্দর জীবন পেতে পারি না ,,!

 

সুমু চলে এসেছে তাদের জঙ্গলের রাস্তাটায়। এদিকটা নির্জন। শুধু মাথার উপরে গোলগাল চাঁদ খানা জোছনার আলো ছড়াচ্ছে। সেই মৃদু আলোতে তার ছায়াও পড়েছে রাস্তায়। সুমুর পাশে উদয় হয় হনুফা। সুমু তাকে দেখে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,

– তুই ,,!

– হ, আমি। আমারে তোমার ঐ চকলেট টা দিবা। আমি খামু ,,!

– তুই তো আত্মা। তুই এসব খেতে পারবি না।

হনুফা একটু মুখ গোমড়া করে। বলে,

– কালকে তুমি কত সুস্বাদু মাংস দিয়া ভাত খাইলা। কিন্তু আমি খাইতে পারলাম না।

– তুই না আত্মা। তুই আমাদের মতো কিছুই খাইতে পারবিনা।

হনুফা সুমুর পাশে ভেসে থাকে। হাত দুটো একখানে করে অভিমান করে থাকে। তখনই সুমুর মাথায় হঠাৎ কিছু আসে। সে বলে,

– আচ্ছা হনুফা।

– হমম।

– ২১ তারিখ যদি আসুভে আমার দেহে প্রবেশ করতে না পারে তবে কী আমি মারা যাবো ,,!

– না। আসুভে ধ্বংস হইয়া যাইবো যদি ২১ তারিখ অয় তোমার শরীরে না ঢুকতে পারে।

– তারমানে আমি তারপরও বেঁচে থাকবো,,!

– হ। থাকবা। কিন্তু মানুষের মতোই থাকবা। তোমারও মানুষদের মতো একদিন মরতে হইবো।

– সবাইকে তো একদিন না একদিন মরতেই হয়। ঐ যতই আসুভে বা অন্য কিছু হোক। যতই বলুক সে অমরত্ব দিতে পারবে, শেষে গিয়ে ওরও মৃত্যু হবে। অমরত্ব বলতে কিছুই নেই।

– আচ্ছা সেইডা বাদ দাও। এহন কও আমি বাড়ি যাইয়া তান্ত্রিক রে কী কমু ,,?

– তান্ত্রিক তোকে আমার উপর নজর রাখার জন্য পাঠাইছিলো ,,?

– হ। এখন যাইয়া কী কমু ওরে।

– বলবি আমি এমনি ঘুরছি। আর কিছু বলবিনা।

– আচ্ছা। আর কিছু বলমুনা।

সুমু তার হাতে থাকা শেষ চকলেট টা ছিঁড়তে থাকে। হনুফা তা দেখে খালি সুমুর মুখের সামনে ঘুরাঘুরি করতে থাকে। সুমু চকলেট টা মুখে নিয়ে খোঁসা টা হনুফাকে দিয়ে দেয়। ও খোসা টা নিয়েই খেলতে থাকে। সুমু একটা ছোট হাঁসি দিয়ে চলে যেতে থাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

 

জোছনা রাতে রাস্তায় যাচ্ছে এক কিশোরী। তার পাশে যেন চিড়াগ থেকে বেড়োনো জীনের মতো করে হুনফা ঘুরাঘুরি করছে। দুষ্টামি করছে। দৃশ্য টা সুন্দর।

 

 

 

নিপা ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম মাখছে। পড়নে প্লাজু আর মেয়েদের টি শার্ট। ব্যালকনির রেলিং ধরে সেখান টায় একলা একলা দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে রায়হান। খাওয়া দাওয়া শেষ করলো তারা কিছুক্ষণ আগে। রাত এখন হয়েছে বেশ। ১০ টার মতো বাজে।

রায়হান রেলিং ধরে আকাশ দেখতে দেখতে বলে,

– এই সুবা, আসোনা একটু আকাশ দেখি একসাথে।

– না, আজ ঘুমাবো। আমার ঘুম ধরছে।

রায়হান মাথা ঘুড়িয়ে ঘরের দিকে তাকায়। দেখে নিপা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে কী যেনো মাখছে। সে বলে,

– কী মাখছো।

– নাইট ক্রিম।

– ঐটা আরো মাখা লাগে নাকি। আমার পরী এমনিতেই চান্দের টুকরা।

– হুমম বলছে তোমাকে।

– সত্যি,,! তোমাকে এমনিতেই অনেক সুন্দর লাগে। (রেলিংয়ের দিকে ফিরে) রাতের জোছনায় তো আরো সুন্দর,,!

– হইছে ঐসব বাদ দাও। ঘুমাইতে আসো। রাত হইছে অনেক।

– কই অনেক। মাত্র তো (হাত উঠিয়ে ঘড়ি দেখে) ১০ টা ৩ বাজে।

– গ্রামে শীতের সময় এটা মধ্য রাত। বাইরের লোকদের গিয়ে দেখো, অর্ধেক ঘুম দিয়ে ফেলছে এতোক্ষণে। আসো, আমি বিছানা করছি।

– উফফ, বউ টাও ঘুমানোর জন্য এতো উতলা, ভাবলাম একসাথে একটু দাঁড়িয়ে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করবো।

বিরবির করে বলেই ফিরে ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হয় রায়হান। তখনই তার ফোন বেজে উঠে।

– এখন আবার কে ফোন দিলো,,?

রায়হান ফোনটা বের করে হাতে উঠিয়ে দেখা মাত্রই তার চোখ মুখের হাসৌজ্জল প্রতিরূপ যেন উধাও হয়ে যায়। মুহুর্তেই যেন তার মুখ ঘন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়। রায়হান আবার রেলিংয়ের দিকে ফিরে। ফিরে কল টা রিসিভ করে কানে উঠায়। ওপাস থেকে ভেসে আসে এক মেয়ের কন্ঠ। রায়হান চোখ বন্ধ করে রাগান্বিত হয়ে তার কথা গুলো শুনতে থাকে। মেয়েটা কিছু একটা বলেই যাচ্ছে। রায়হান কিছুক্ষণ সেই কথা গুলো শুনে। একটু পর বলে উঠে,

– আমার বিয়ে হয়েছে। আমি এখন বিবাহিত।

তখনই আবার ওপাসের মেয়ে থেকে আরো কিছু কথা ভেসে আসে। মেয়েটা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে। রায়হান দাঁতে দাঁত চেপে সব শুনছে। রেলিংয়ের লোহা টাকে শক্ত করে ধরে নিজের রাগ টাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পর রায়হান বলে,

– ঠিক আছে।

রায়হানরে কানে থাকা ফোনটার ডিসপ্লে জ্বলে উঠে। অর্থাৎ ওপাস থেকে ফোন কেটে দিয়েছে সেই মেয়ে। রায়হান কান থেকে ফোনটা নামায়। মন চাচ্ছে এখনি ফোনটাকে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলতে। রায়হান মোবাইল টাকে জোড়ে চেপে ধরে হাত দিয়ে। তখনই পিছন থেকে নিপার কথা শোনা যায়,

– এই, তুমি কি সারারাত ওখানেই দাঁড়ায় থাকবা ,,,! আমি কিন্তু ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে দিবো। সারারাত ওখানেই ঘুমাইয়ো।

নিপার কথা শুনে রায়হান তার রাগটাকে প্রশমিত করতে থাকে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়তে থাকে। মাথাটাকে ঠান্ডা করে। মুড টাকে আবার আগের মতো করে নিয়ে পিছন ফিরে তাকায়। দেখে নিপা বিছানার বালিশ গুলো যায়গা মতো দিয়ে দিচ্ছে। রায়হান ব্যালকনি থেকে ঘরে আসে। নিপাকে বলে,

– বিছানা হয়ে গেছে ,,!

– তো আমি এতোক্ষণ ধরে কী বলতেছি ,,! আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। শুতো তো তুমি।

– শুইলাম তাইলে ,,!

– তো আমি কী তোমাকে দাঁড়ায় থাকতে বলতেছি ,,! শুতো।

রায়হান বিছানায় শুয়ে পড়ে। নিপা গিয়ে ব্যালকনির গ্লাসের দরজা লাগিয়ে দেয়। পর্দা টেনে দেয়। দিয়ে এসে লাইট বন্ধ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। বিছানার কাছে এসে জুতো খুলে উঠে বসে। রায়হান চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলো। গায়ে একটা ফরমাল গেন্জি। নিপা রায়হানের উপরে কম্বল টেনে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে। নিজের উপরও কম্বল নিয়ে নেয় ঠিক করে। রায়হান নিপার দিকে পাশ ফিরে শোয়। তাকে ধরে টেনে তার কাছে নেয়। নিপা বলে উঠে,

– কী করতেছো,,! আমি তো আছিই,,! পালায় তো যাইতেছি না।

– দূরে কেনো থাকো তাইলে ,,! থাকবা তো কাছে।

– হ্যা কাছেই আছি। এখন ঘুমাও।

– সুবা,,!

– হমম।

– কাল হানিমুনে যাবো।

– কী ,,! কই যাবো ,,!

– হানিমুনে। মানে মধুচন্দ্রিমায়।

– কাল ?

– হ্যা। আমি সকালের টিকিট কেটে রাখছি।

– তো তুমি এখন বলতেছো ,,! আমি তো কিছুই গোছগাছ করিনি।

– ২-৩ দিন থাকবো। কাপড় গুছাইতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

– তাই বলে তুমি আমাকে আগে বলবা না। এখন রাতে বলতেছো।

– ভুলে গেছিলাম গো,,!

– আচ্ছা এখন ঘুমাও তাইলে। সকাল সকালে উঠে সব গোছগাছ করে লাগবে।

বলেই নিপা রায়হানের বিপরীতে পাশ ফিরে শোয়। রায়হান বলে উঠে,

– ওপাসে ফিরলা ,,!

– হমম। আমি এখন ঘুমাবো।

রায়হান এগিয়ে গিয়ে নিপাকে পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরে। বলে,

– আমিও তাইলে আমার কোলবালিশ ধরে ঘুমাবো।

– উমম,,, এতো জোড়ে চেপে ধরিও না। দম বন্ধ হয়ে আসতেছে আমার।

– ওপসস,, সরি। আচ্ছা এইবার আলতো করে ধরলাম।

– এই, কোথায় হাত ঢুকাইছো ,,! হাত বের করো।

– থাক না একটু।

– গেঞ্জি আমার ঢিলা হয়ে যাবে, হাত বের করো।

– আমার বউয়ের গেন্জির ভিতরে হাত দিয়েছি, অন্য কোন মেয়ের গেঞ্জির ভিতরে তো দেইনি। (আরো কাছে জড়িয়ে ধরে) গেন্জি ঢিলা হইলে হোক। আমি গেঞ্জির গোডাউন কিনে আনবো‌।

– হমম, সুযোগ পাইলেই খালি এখানে ওখানে হাত। ছাড়ো এখন।

– থাক না। তোমার শরীর টা অনেক গরম। সাথে অনেক নরম আর তুলতুলে।

– হমম,, এই বলে বলে খালি দুষ্টামি করার চিন্তা।

– না না। আজ দুষ্টামি না। যা হবে সব হানিমুনে গিয়ে হবে।

– হইছে ভালো হইছে। এখন ঘুমাও। আর আস্তে ধরো। এতো চেপে ধরিও না।

– গেঞ্জিটাই খুলে রাখো না

– হমম,, তখন আরো তোমার মাথায় দুষ্টামির ভুত চাপুক।

– না না কিছু হবেনা। কম্বল ঢাকা নিছি তো আমরা দুইজন। তোমার ঠান্ডা লাগবে না। আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবো। গেন্জি টা খুলে রাখো।

– দুষ্টামি করবানাতো।‌

– একদমই না। শুধু তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় যাবো।

নিপা পাশ থেকে চিৎ হয়ে শুতে। উঠে বসে গেন্জি খুলতে থাকে। রায়হানও চিৎ হয়ে শুতে, শুয়া অবস্থায় তার গেন্জি খুলে রাখে।

– তুমি কেনো খুলতেছো। (নিপা)

– দুই দেহের মাঝে কোন বাঁধা থাক, এইটা আমি চাইনা।

 

নিপা শুয়ে পড়ে। রায়হান নিপার দিকে ফিরে শুয়ে বলে,

– আমার দিকে ফিরে শোও।

– শুইলাম, এখন চুপচাপ ঘুমাও।

রায়হানের দিকে পাশ ফিরে শোয় নিপা। রায়হান তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বোজে। নিপাও রায়হানকে জড়িয়ে ধরে তার উপর এক পা তুলে দেয়। রায়হানের শরীরের গরম ভাব টা সে ফিল করতে পারছিলো। তার কাছে মনে হতে থাকে, সেই এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সে তার প্রিয়তমের ছায়া তলে ঘুমোতে পাড়ছে। নিপাও রায়হানের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতে থাকে। পাড়ি দেয় রায়হানের সাথে এক স্বপ্নের রাজ্যে,,,!

 

 

 

এক লম্বা করিডোর। কালো বুট জুতো পড়ে হেঁটে যাচ্ছে এক ব্যাক্তি। পড়নে কালো হুডি, কালো প্যান্ট। করিডোরের উপরে জ্বলছে ছাই রঙা আলোর লাইট। হুডির টুপি টা দিয়ে মুখ অর্ধেক ঢাকা তার। বুঝতে বাকি রইলো না যে এ আর কেউ নয় রন্জু। দা ব্ল্যাক রন্জু। রন্জুর হাঁটার আওয়াজ প্রতিফলিত হচ্ছে পুরো করিডোর জুড়ে।

রন্জু একটা দরজার সামনে এসে থেমে যায়। উপরে বড় করে লেখা ‘কন্ট্রোল রুম’। রন্জু তার হাত বাড়ায়। দরজায় থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সরে আঙ্গুল রাখে। দরজা খুলে যায়। এই করিডোরের সব দরজায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক নেই। কিছু নির্দিষ্ট দরজায় আছে।

 

রন্জু ঘরে প্রবেশ করে। ভিতরের দিকটা অনেকটা সাই-ফাই মুভির সেটের মতো। বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ঢাসা। রন্জুকে দেখে একটা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা একজন লোক উঠে দাঁড়ায়। বলে,

– স,স্যার আসসালামুয়ালাইকুম। আ,আপনি এতো রাতে।

– আমাকে সকালে আসতে দেখছো কোনোসময় ?

– ন,না স্যার।

– তাইলে রাতে দেখে অবাক হচ্ছো কেনো?

– ন,না মানে স্যার হঠাৎ করেই আসলেন তো। কোন সিগনাল না দিয়েই। তাই আরকি।

– একয়দিনে কতদূর কাজ এগিয়েছে ,,? কত পিছ মাল শিপমেন্ট হয়েছে ?

লোকটা বসে পড়ে। কম্পিউটারের দিকে মুখ করে কি বোর্ডে কিছু টাইপ করে। তারপর বলতে থাকে,

– স্যার এ কয়দিনে ৫৬ পিছ ডেলিভারি হয়েছে।

– কেনো ? মোট তো ৬০ জন ছিলো ? আর বাকি ৪ জন কোথায় ?

– স্যার ওরা ছোট বাচ্চা। মানে কিশোরী মেয়ে। ওরা কান্না কাটি করছিলো। বাকি কারোর মধ্যে অনুশোচনা না থাকলেও তাদের মধ্য ছিলো। আর আপনারই তো আদেশ, কেউ পাপ থেকে ফিরে আসলে তাকে গ্রহণ করা উচিত। মাফ করা উচিত। তাই আমি ডাক্তার সিমিন কে ঐ চারজন মেয়েকে কিছু করতে নিষেধ করেছি।

– ওরা কোথায় আছে এখন ,,?

– স্যার ওরা আমাদেরই আস্তানায় আছে। তবে কান্না কাটি করে খুব। খাবার দিলে খায়, কিন্তু কান্নার শব্দ আশা থামেই না প্রায় বলা যায়।

– ওদেরকে কাল ছেড়ে দিবা। চোখ বেঁধে গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে কোন এক শহরে ছেড়ে দিবা। হাতে একটা টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বলবা কিছু করে খেতে। আর কোন খারাপ কাজের সাথে না জড়াতে। যদি জড়ায় তাইলে কিন্তু দ্বিতীয় বার তাদের মাফ করা হবে না।

– জ্বী আচ্ছা স্যার। আমি কালকেই নায়িব কে বলে দিবো ওদের ছেড়ে আসতে।

– হমম। (একটু থেমে) মেমরি থেকে কিছু পাইছিলা ,,?

– জ্বী স্যার। এটা আপনাকে বলতেই যাচ্ছিলাম। আমাদের টেক স্পেশালিস্ট মেমরির ডাটা উদ্ধার করতে পেরেছে। ওখানে শুধু একটা ভিডিও পাওয়া গেছে স্যার।

– হমম যানি। ওখানে ভিডিও থাকার কথা। প্লে করো।

– জ্বী স্যার বুঝতে পারিনি কথাটা।

– বলতেছি ভিডিওটা কম্পিউটারে প্লে করো। ম্যানেজার হইছো, তোমাকে সব ভেঙে বলতে হবে নাকি !

– স,সরি স্যার। আমি এখুনি প্লে করতেছি। আপনি বসেন স্যার।

– আমি এভাবেই ঠিক আছি।

 

কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা লোকটা কম্পিউটারের একটা ফাইলে গিয়ে একটা ভিডিও ফাইল বের করে। বের করে সেটা প্লে করে দেয়। রন্জু বলে,

– সাউন্ড বাড়াও।

– জ্বী স্যার।

লোকটা সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়। রন্জু মনযোগ দিয়ে দেখতে থাকে ভিডিওটা।

 

ভিডিওটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তা খুবই গোপনে করা। হয়তো সর্দারনি তার কোমরের মধ্যৈ ক্যামেরাটা রেখেছিলো।

ভিডিওতে দেখা যায় সর্দানি সহ আরো কিছু মেয়ে আর পুরুষ একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সুড়ঙ্গ টা অন্ধকারে ঠাসা। যেন সেটা মাটির নিচে।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা টা খুলে দেয় পাশে দাঁড়ানো দুইজন রক্ষি‌। সর্দারনি সহ সবাই ভিতরে প্রবেশ করে। ভিতর টা ছিলো কোন এক রাজার মহলের মতো। চারপাশে বড় বড় সাপের মুখ আঁকা। দেয়ালে উর্বর করে সাপের বিশাল দেহ আকা। যায়গাটা বিশাল। বৃস্তিতি অনেক। সর্দানি সহ আরো কিছু মানুষ হেঁটে হেঁটে গিয়ে যায়গাটার দক্ষিণে থাকা বড় দরবার টার সামনে দাঁড়ায়। সেখানে ছিলো এক বড় সিংহাসন। সিংহাসনের মাথায় একটা বড় সাপের মুখ আঁকা। সিংহাসন টা কিছুটা উঁচুতে তৈরি করা। সেখানে বসে আছে একলোক। পড়নে এক ভারি পোশাক। সাপের ছবি আঁকা সেটায়ও। মুখে মুখোশ। তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার দুই পাশে দুই যুবতী মেয়ে পাখা টানছে। চারপাশ প্রখর নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা।‌ সব নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতেই ইয়া বড় বড় বন্দুক। সর্দারনি সহ বাকিরা এসে সেই দরবারে দাঁড়ায়। তাদের দেখে সিংহাসনে বসে থাকা লোকটা বলে,

– সু স্বাগতম সাপেদের রাজ্যে ,,! কেমন লাগছে তোমাদের এখানে এসে ,,!

সর্দানি সহ বাকিরা সবাই ভালো বলে উঠে। তবে তাদের কন্ঠে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তার মানে তারা খুব ভয়ে ভয়ে সেখানে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর দুইজন রক্ষী এক লোককে ধরে আনে। এনে সিংহাসনে বসে থাকা লোকটার পায়ের সামনে ফেলে।

 

রন্জু সাথে সাথেই বলে উঠে,

– থামাও থামাও।

ম্যানেজার ভিডিওটা পজ করে। রন্জু বলে উঠে,

– এ আমাদের লোক না ? ও তো আবরার,,!

– হ্যা স্যার। ও আমাদের লোক।

– এঁকে এরা ধরে ফেলছিলো,,! এইজন্য তো বলি আবরার এতোদিন হলো তাও কেনো ফিরে আসলো না। ও তারমানে ওদের হাতে ধরা পড়ছিলো। এমনিই কী আর এদেরকে নর্থের কিং মাফিয়া বলে ,,! প্রখর বুদ্ধি এদের।

– হ্যা স্যার।

– প্লে করো ভিডিওটা।

ম্যানেজার ভিডিওটা চালু করে।

 

ভিডিওতে দেখা যায় সেই আবরারকে সিংহাসনে বসে থাকা লোকটা এক জোরে লাত্থি দেয়। আবরার সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে এসে নিচে পড়ে। অর্থাৎ যেখানে সর্দার্নিরা দাড়িয়ে ছিলো। লোকটা সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নিচে নামতে থাকে। শরীরে রাজকীয় পোশাক। হাতের আংটিটাতেও সাপের মুখ আঁকা। লোকটা এসে নিচে নেমে দাঁড়ায়। দুই রক্ষী এসে আবরারকে বেঁধে ফেলে। বেঁধে তাকে সোজা করে শুইয়ে ধরে। একজন রক্ষী এক লম্বা তলোয়ার এনে মাথা নিচু করে দাড়ায় রাজকীয় পোশাক পড়া লোকটার পাশে। রাজকীয় পোশাক পড়া লোকটা আবরারকে বলে,

– গুপ্তচর গিরি করতে আসছিলি না ,,! তাও আবার এই জুডাসের আস্তানায়,,! কে পাঠিয়েছে তোকে ,,!

– আ, আমি জানি না।

– জানিস না ,,! হা হা হা!!! তাইলে, মর,,,!

বলেই তলোয়ার উঁচিয়ে ধরে ফ্লোরে শুয়ে থাকা আবরারের গলায় বরাবর এক জোড়ে কোপ দেয়। মাথা ছুটে আলাদা হয়ে গড়িয়ে এসে সর্দারনির পায়ের কাছে পড়ে। সর্দার্নির শরীর কাঁপছে। জুডাস বলে উঠে,

– আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা মানেই মৃত্যু,,! মৃত্যু,,,! হা হা হা!!

এক পিশাচ রুপি হাসি দিতে থাকে লোকটা। পুরো ঘর যেন সেই হাসিতে কাপতে থাকে। আর সেখানেই ভিডিওটা শেষ হয়ে যায়।

 

– আর নাই ?

– না স্যার। আর নাই।

– হমম,, এর নাগাল পাওয়া এতোটা সহজ না। খুব বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে আমাদেরকে।

– এই তাইলে সেই নর্থের কিং মাফিয়া জুডাস ডি ইজারিও ,,!

– হ্যা। এই সে। যার জন্য আমি হয়েছি রন্জু ,,! (ম্যানেজারের দিকে ফিরে ধীর গলায়) কাটা তোলার জন্য নিজেকেও কাঁটা হতে হয়। ওর যম খুব শীঘ্রই আসছে ওর জান কবজ করতে,,! জুডাস ,,! অনেক হিসাব বাকি তোর সাথে আমার ,,! অনেক হিসাব,,,!

 

 

 

নিপার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াটা একপ্রকার স্বাভাবিকই। মাঝেই মাধেই এমনটা হয় তার সাথে। নিপা আস্তে আস্তে পাশ ফিরে শোয়। শুয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় রায়হানের দিকে। কিন্তু তার হাত গিয়ে পড়ে বিছানার উপর। নিপা হাত দিয়ে হস্তিয়ে দেখে আশেপাশে কোন শরীরই নেই,,!

নিপা তার ঘুম ঘুম চোখ খুলে, দেখে রায়হান নেই। সে চারপাশে তাকায়। উঠে বসতে থাকে। তার ঘুম যেন বোমের মতো উড়ে গেছে। রায়হান চারপাশে কোথাও নেই,,! নিপা বিছানার পাশেই থাকা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালায়। কাঁথা টা সড়িয়ে বিছানা থেকে নামে। মাথার দিকে থাকা গেন্জিটা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে। ওয়াশরুমের দরজা খুলে দেখে না। রায়হান এখানেও নেই। ব্যালকনির দিকে তাকায়। দেখে না ব্যালকনির দরজাও ভিতর থেকে লাগানো। সে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত ৩ টা ১০ বাজে। নিপা যেন আকাশ থেকে পড়ে।  এতো রাতে রায়হান কই গেলো ,,!

নিপা তাড়াতাড়ি বিছানায় এসে বসে। তার ফোনটাকে বালিশের পাশ থেকে নেয়। রায়হানের ফোন নেই বালিশের নিচে। তারমানে ফোন নিয়ে গেছে সে। নিপা তাড়াতাড়ি রায়হানের নাম্বার ডায়াল করে। কল দিয়ে কানে উঠায়। তার বুক যেন ধুকধুক করছে। হঠাৎ এভাবে রাতে রায়হান কোথাও চলে যাবে এটা যে তার কাছে আশ্চর্যের থেকেও বেশি আশ্চর্যের।

কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর রায়হান ফোন তুলে। নিপা এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকে,

– এই তুমি কই ,,! এতো রাতে ঘরে ছেড়ে বের হইছো কেনো?

– ও তুমি উঠে গেছো ,,! আমি একটু দিনাজপুর আসছিলাম।

– এতো রাতে দিনাজপুরে কী তোমার,,? রাত ৩ টা বাজে এখন। মজা করতেছো আমার সাথে ?

– আরে না সত্যিই আমি দিনাজপুরে আসছি। শাহেদ চাচ্চুর সাথে বাইকে করে আসছিলাম। এখন আবার বাড়ি যাচ্ছি। হঠাৎ এখানে গেন্জাম লাগছিলো আমাদের শ্রমিকদের মাঝে। তাই এই রাত বিরাতে আসতে হলো।

– তুমি একবার আমাকে বলে যাবানা,,! আমি কতটা ভয় পাইছিলাম জানো তুমি ,,!

– আরে আরে ভয় পাইয়ো না। আমি দেখলাম তুমি গভীর ঘুমে, তাই আর ডাকলাম না। আর তখন যদি তুমি না আসতে দিতা।

– যাইতে তো দিতামই না। কেমন রাত বিরাতে বাইরে যাইতে চাও,,!

– এইজন্যই তোমাকে ডাকিনি। নিজেদের বিজনেস। ক্ষতি হলে আমাদেরই যে হবে সুবা। এইজন্য আরকি আসতে হলো।

– তাড়াতাড়ি আসো।

– এইতো রাস্তায় আছি। বাসাতেই যাচ্ছি।

– হমম আসো।

নিপা ফোন নামায় তার কান থেকে। বাপরে বাপ। এতো রাতে কিনা গোডাউনে চলে গেলো না বলে ,,! একটা বার বলে যাইতে পারতো,,!

– ধুর,,! কিছুই ভালো লাগে না। আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম,,! সারাদিন অফিস করে, এখন মাঝরাতেও সেখানে দৌড়াছে।

নিপা শুয়ে পড়ে। কাঁথা ঢাকা নিয়ে একপাশে ফিরে। তার মনে হঠাৎ উদয় হয় আজ সকালের ঘটনাটা। আজ সকালে যখন সে আর সুরাইয়া বেগম কথা বলছিলো তখন সত্যিই কিন্ত একজন জানালার ওপাশে ছিলো। কালো বোরখা পড়া একজন। সুরাইয়া বেগমের ভয় না কমায় নিপা তখন গাছের নাম করে মিথ্যা বলেছিলো। না বললে তখন যে সে সুরাইয়া বেগমকে সামলাতে পারতোনা। নিপাকে এখন বুঝে শুনে পা ফেলতে হবে। এই বাড়ি যে এমনি এমনিই গম্ভির না তা এখন সে বুঝতে পারছে। তাকে এখন পার্ট টাইম গোয়েন্দা থেকে ফুল টাইম গোয়েন্দা হওয়া লাগবে।

– ইশশ্, যদি আফাজ আর ইকরাও থাকতো ,,! তিন পান্ডব গোয়েন্দা মিলে এই কেস সমাধান করতাম। কতো ভালো হতো ,,! (একটু থেমে) আচ্ছা জানালার বাইরে থাকা ঐ বোরখা পড়া মেয়েটা কি কোনভাবে আমার শাশুড়ি? হইতেও পারে। আমি করিডোরে যাওয়ার আগে ঠিক একই বোরখা পড়ে তাকে বেড়োতে দেখেছিলাম। (একটু থেমে) আচ্ছা আমার চাচা শশুর মানে শাহেদ খানেরও তো বলে একটা বউ আছে। আঁখির কাছ থেকে শুনলাম তিনি নাকি অসুস্থ। এই বাড়িতে আসার পর এই পর্যন্ত আমি তাকে দেখতেই পারলাম না। কাল দেখতে যেতে হবে। (একটু থেমে) ও না না। কাল তো আবার হানিমুনের জন্য বেরোবো আমরা। এই রায়হান টাও হুটহাট করে প্ল্যান করে ফেললো। ও যেই দুষ্টু ,,! ঘরেই কী হানিমুন কম করে নাকি,,! এখন বলে আবার বাইরে ঘুরতে গিয়ে হানিমুন করবে। জামাই খালি আমার দুষ্টামির কথা ভাবে ,,!

বলেই নিপা একপাশ ফিরে শুয়ে শুয়ে রায়হানের সাথে তার সুখকর সময় গুলো ভাবতে থাকে। মাঝে মাঝে লজ্জায় কাঁথা টেনে মুখ লুকায়। কখনও বা হাসতে থাকে সেই কথা গুলো ভেবে।

 

বাইরের গাছে থাকা পাখি গুলো এই মাঝরাতে নিপার হাঁসি শুনে ভাবছে এতো রাতে আবার হাসে কে ,,! নিশ্চিত কোন ভূত হবে ,,!

 

 

 

সকাল বেলা। ব্যালকনি দিয়ে আলো এসে পড়েছে ঘরে। হালকা কুয়াশা। নিপা ব্যাগ গোছাচ্ছে। বড় ব্যাগ খানা বিছানার উপর রাখা। আর তার মধ্যে কাপড় ভাঁজ করে করে করে ঢুকাচ্ছে। নিপাল পড়নে একটা গোল জামা। জামাটা কমলা রঙের। বুকের দিকে কারুকাজ করা। জামাটা দেখেই বোঝা যায় যে বেশ দামি। সকালে গোসল করে উঠে এটাই পড়েছে সে। এটা পড়েই রওনা দিবে। রায়হান আলমারি থেকে কিছু একটা বের করছে। নিপার ব্যাগ গোছানো প্রায় শেষের দিকে। রায়হান আর তার কিছু মুজা ঢুকিয়ে নেয় ব্যাগে। সেদিকেও তো দারুন শীত পড়বে, তখন কাজে দিবে। সকালে উঠে শুনলো হানিমুনে নাকি তারা কক্সবাজার যাবে। কক্সবাজারে উঠবে তবে সেখান থেকে আবার বলে বান্দরবান রাঙ্গামাটি ঘুরতে আসবে। বেশ ভালোই প্ল্যান করে রেখেছে দেখি রায়হান,,,!

 

নিপা ব্যাগ গোছানো শেষ করে। ব্যাগের উপর পার্ট নামিয়ে রেখে চেইন লাগিয়ে দিতে থাকে। তখনই রায়হান আলমারির পাশ থেকে ফিরে বলতে থাকে,

– দাঁড়াও, দাঁড়াও। একটা জিনিস বাদ পড়ছে।

– কী বাদ পড়লো। আমি তো সব দেখে শুনেই ঢুকালাম।

– না না বাদ পড়ছে। আমি আসল জিনিসটাই দিতে ভুলে গেছি। এই যে।

 

বলেই একটা ছোট্ট কাপড়ের ব্যাগে করে একটা বক্স এগিয়ে দেয় নিপার দিকে। নিপা সেটা হাতে নেয়। কাপড়ের ব্যাগ টা থেকে বের করে দেখে একটা ছোট্ট বক্স। হয়তো এটার ভিতরে গহনা বা এমন কিছু আছে। নিপা বলে,

– এখানে কি আছে ,?

– খুলিও না। রেখে দাও। ওখানে গিয়ে দেখিও।

– না আমাকে বলো আগে কী আছে ,,? নাইলে রাখবোনা কিন্তু ব্যাগে।

– খুলিও না। পরে তখন নিজেই বুঝবা যে এখন খোলা তোমার উচিত হয়নি।

– কী এমন জিনিস যে এখন খুলে দেখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে,! আমি এখনি দেখবো।

 

নিপা ছোট্ট বক্সের ঢাকনাটা উঠায়। রায়হান অন্যদিকে ফিরে মাথা চুলকাতে থাকা। নিপা বক্সের ভিতরের জিনিস দেখেই অবাক আর লজ্জা মিশ্রিত মুখ খানা তুলে তাকায় রায়হানের দিকে। দেখে রায়হান অন্যদিকে ফিরেছে। নিপা বলে উঠে,

– এসব কী!

রায়হান নিপার দিকে ফিরে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,

– না মানে হানিমুনে লাগবে ভেবে বিয়ের আগেই কিনে রেখে দিছি।

– তুমি এগুলো বিয়ের আগেই কিনে রাখছো!

– হ্যা।

– এইসব ছোট ছোট ড্রেস। এটাতো বিকিনি! ছিঃ,,! রায়হান তুমি এতো পঁচা,,!

– আরে এখানে ছিঃ করার কী হলো। এটা পড়ে তো তুমি আমার সামনেই থাকবা। পরপুরুষের সামনে তো আর যাচ্ছোনা।

– আরো কথা বলতেছো! এগুলা আমি নিবোন। রাখো এইসব।

 

বলেই বিছানায় ছুড়ে ফেলে নিপা। বড় ব্যাগের চেইন লাগিয়ে সেটা বিছানা থেকে নামিয়ে রাখতে থাকে। রায়হান বলে,

– নিবানা ঐ গুলা ?

নিপা ব্যাগ রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

– একদমই না। ঐসব আমি কিছুতেই নিতে দিবোনা।

– তাইলে কাপড় ছাড়া থাকতে হবে কিন্তু ওখানে গিয়ে! এগুলো তাও একটু সেইফ করতো। এখন তুমি যা ভালো বুঝো। (বলেই রায়হান মুচকি হেসে আলমারির দিকে চলে যেতে থাকে। বলে,

– আমি ভাবলাম তুমি কোন কাপড় ছাড়া থাকলে লজ্জা পাবা। তাই এগুলা আনলাম। এখন দেখি তুমি এগুলাই নিতে চাও না। রেখে দিই তাইলে আমি।

নিপা হনহন করে গিয়ে রায়হানের সামনে দাঁড়ায়। লজ্জা মাখা রাগান্বিত মুখ নিয়ে বলে,

– দেও এটা,,!

রায়হানের হাত থেকে সেই কাপড়ের বক্সটা নেয়। নিয়ে গিয়ে সেটা বড় ব্যাগের চেইন খুলে ঢুকিয়ে রাখে। রায়হান হাসতে হাসতে বলে,

– হানিমুনে গেলে এসব স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমিই বুঝতে চাও না।

 

নিপা লজ্জায় কথা বলতে পারছেনা। সে লজ্জা মাখা রাগান্বিত মুখ খানা নিয়ে চলে যায় ডেসিন টেবিলের আয়নার সামনে দেখে নিতে থাকে সব ঠিকঠাক আছে কী না। রায়হান আলমারি থেকে একটা বোরখা বের করে ছুঁড়ে মারে তার উপর। নিপার মুখের উপর গিয়ে পড়ে ওটা। নিপা চিৎকার করে বলে,

– রায়হান,,,! কী করতেছো,,!

– ওটা পড়ে নাও। বাসে উঠার পর খুলে রেখো। নিচে ভাই আর বাবা আছে। আমি ওদের সামনে দিয়ে তোমাকে বোরখা ছাড়া কখনোই আনতে চাইনা।

– সবার সামনে বোরখা আর রাতের বেলা বিকিনি! (লজ্জা  মাখা রাগের সুরে বলে নিপা)

– এটাই তো নিয়ম জান। যাকে দেখানোর কথা, সবকিছু তাকেই দেখাতে হয়

–  চুপ থাকো তুমি। আর এই নিয়ে কিছু বলবে না।

–  উলে আমার বউ টা লজ্জা পাইছে ,,! (নিপার পাশে দাঁড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে)

–  ছুবেনা একদম,,! তুমি অনেক অনেক দুষ্ট। লুচু একটা,,!

–  বউয়ের কাছ থেকে লুচু ডাকও শুনতে হয়! কিসব দিন আসে গেলো মাবুদ,,!

–  হইছে ঢং বাদ দাও। কাপড় পড়া শেষ তোমার!

– আমি রেডি বেগম সাহেবা। এখন আপনি যদি রেডি থাকেন তবেই বেড়োতে পারি।

– হইছে আর বেগম-টেগম করা লাগবেনা। ব্যাগ টা নাও। আমার বোরখা পড়া শেষ।

– মুখের কালো কাপড় টা উঠায় দেও।

– দিচ্ছি দিচ্ছি। এভাবে করে যদি হানিমুনে রাখো তাও হয়।

– হানিমুন যায় তাইলে আমাকে অন্য মেয়ে দেখতে বলতেছো,,!

– মাইর খাবা মাইর। যাও ব্যাগ নিয়ে বেড়োও।

– হে হে হে! বউ আমার একটুতেই সব বুঝে যায় ,,!

– বুঝা-বুঝি বাদ দাও। বের হও এখন। বাস সাড়ে ৯ টার। এখন ৮ টা ৪৫ বাজে। তাড়াতাড়ি বাইর হও।

রায়হান আর নিপা বেড়িয়ে পড়ে ঘর থেকে। দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। নিপা একদম কালো বোরখা পড়ে মুখে কালো কাপড় উঠিয়ে দিয়েছে। শুধু চোখ গুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না তার।

 

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে তারা দুজন। সোফায় বসে ছিলো নজরুল সাহেব আর রাফসান। আঁখি রান্নাঘরে ছিলো। নিচে নেমে রায়হান এগিয়ে যায় সোফার কাছে। এক হাতে ব্যাগের হাতল ধরেছে অন্য হাতে নিপাকে। রায়হানকে দেখে নজরুল সাহেব আর রাফসান কথা থামিয়ে দেয়। রায়হান বলে,

– আব্বু, আমরা গেলাম।

– কোথায় যাচ্ছিস ,,!

– আজ সকালেই তো বললাম ,,! (একটু থেমে) তোমার বউমাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছি।

– ও আচ্ছা ঠিক আছে যা।

– আমি রওনককে সব বুঝিয়ে দিয়েছি আমার কাজ গুলো। তুমি ওকে বলিও, ও গাড়ির হিসাব দিয়ে দিবে।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

রায়হান নিপাকে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়, তখনই করিডোর দিয়ে বেড়িয়ে আসে আলিশা। দৌড়ে এগিয়ে যায় রায়হান-নিপার দিকে। গিয়ে নিপার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। নিপা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আলিশা এসেছে। আলিশা বলতে থাকে,

– বেড়াতে যাচ্ছো, আর আমাকে বললাও না ভাবি ,,!

– তোর ভাই হঠাৎ করে কাল রাতে আমাকে বললো।

– কোথায় যাচ্ছো, কক্সবাজার,,?

– হ্যা।

– আমার জন্য কি আনবে বলো।

– কি নিবি তুই‌ বল।

– আমি বইতে পড়েছি কক্সবাজারে বলে অনেক শামুক, ঝিনুক দিয়ে তৈরি মালা পাওয়া যায় ,,! ঐগুলা আর একটা বড় টুপি এনো। সুন্দর দেখে।

– আচ্ছা ঠিক আছে। তোর মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস। আমি আর তোর ভাই ২-৩ দিন পরই চলে আসবো।

– ঠিক আছে, ভাইয়া ভাবিকে একলা ছেড়েনা কিন্ত ,,! ভাবি ভালোভাবে যেও ,,! আর মনে করে আমার জন্য ওগুলো এনো ,,।

– আচ্ছা ননদিনী,,!

নিপা আর রায়হানরা অন্দরমহলের দরজা পেরিয়ে চলে যায়। আলিশা অন্দরমহলের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। জোড়ে বলে উঠে ,,

– আল্লাহ হাফেজ ভাইয়া-ভাবি ,,!

নিপা ফিরে তাকায়। দেখে আলিশা হাত দিয়ে তাদের বিদায় জানাচ্ছে। আলিশার মুখে হাসির ছটা। নিপাও হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানায়। উঠে পড়ে প্রাইভেট কারে। এই কারে করেই তারা দিনাজপুর বাস কাউন্টার পর্যন্ত যাবে। নিপা গাড়িতে উঠার পরও জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে আলিশা এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেয়েটার মুখ আজ ভারি মিষ্টি লাগছে ,,! পিচ্চি একটা মেয়ে। এই নাকি আবার প্রেমেও পড়েছে।‌

 

গাড়ি চলে যায়। যাওয়ার পানে চেয়ে আলিশা আরো হাত নাড়ায়। ওর খুব আনন্দ লাগছে। ও কক্সবাজারে কখনো গেলো ঝিনুক আর মুক্তোর মালা নিবে ভেবেছিলো। এখন তার ভাইয়া ভাবি যাচ্ছে। নিশ্চই ওরা নিয়ে আসবে। আলিশা অন্দরমহলের ভিতরে চলে আসে। আবার গম্ভীর গোমট বাড়িটা তার মুখের হাঁসি কেড়ে নেয়। বাড়িটা এখন আবার ফাঁকা ফাঁকা লাগবে এই দুদিন। ভাবির সাথে গল্পও করতে পারবেনা। আলিশার কিছুটা মন খারাপ হয়। অন্দরমহল দিয়ে হেঁটে এসে চলে যায় করিডোর দিয়ে ভিতরে।

 

আলিশার চলে যাওয়াটাকে দেখে নজরুল আবার তার সামনে থাকা রাফসানের দিকে তাকান। কথা বলতে শুরু করেন। রাফসান চুপচাপ শুনছে। এরপর হঠাৎ নজরুল সাহেব বলে উঠেন,

– কাল মাঝ রাতে কোথায় গিয়েছিলি তুই ,,!

 

চলবে ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।