প্রিয় স্যারে কথা

আশরাফুল ইসলাম বকুল

 

প্রিয় স্যার সামসুর রহমান, যদিও তিনি আমার স্কুলের স্যর নন। কুমারখালী শহরের প্রাণকেন্দ্রে | প্রাচীন একটি পাবলিক লাইব্রেরি আছে, সেই ছোট্টবেলা থেকেই আজ পর্যন্ত নিয়মিত ওখানে গিয়ে বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়ি। ওই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসাবে দীর্ঘ দিন বিনা বেতনে দায়িত্ব পালন করেছেন স্যর সামসুর রহমান।

তিনি হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন বিকাল পাঁচটায় বাইসাইকেল চালিয়ে আসতেন লাইব্রেরিতে। পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করতেন।

ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-গরম-শীত কোনও কিছুই পাত্তা দিতেন না। আমি তাঁকে কোনও দিন লুঙ্গি বা ফুল প্যান্ট পরতে দেখিনি, আজীবন পরতেন সাদা পাজামা ও পাঞ্জাবী। স্যরের চেহারা ছিল খুবই সুন্দর। ফর্সা, বয়সের কারণে মাথার চুল সাদা, মুখের ভাষা চমৎকার—কারও প্রতি কোনও দিন রাগ করে জোরে কথা বলতে দেখিনি। ছিলেন চিরকুমার। প্রচণ্ড শীতে দেখেছি, স্যর একটি শাল গায়ে দিয়ে কাটিয়ে দিতেন। আবার প্রচণ্ড গরমে বিদ্যুৎ চলে গেলে স্যর লাইব্রেরির বারান্দায় চেয়ারে বসে তালের হাতপাখা দিয়ে বাতাস খেতেন। মাঝে-মধ্যে দৈনিক সংবাদে আমার লেখা প্রকাশ হলে আগেই সেটা পড়তেন স্যর। আমাকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেখলে বলতেন, ‘বকুল, তোমার লেখা সংবাদে দেখলাম, ভাল লিখেছ।’

সারের প্রশংসা শুনে খুশি হতাম। তাঁকে ডাকতাম মামা বলে। শহরের অনেকেই তাঁকে মামা বলেই ডাকেন । বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আক্তার হোসেনও সারকে মামা বলেই ডাকতেন। লাইব্রেরিতে বসে তিনি স্যরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। পাশ থেকে শুনতাম ।

কুমারখালী শহরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্যরকে বিশেষ ভূমিকা নিতে দেখেছি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ করতেন। রাত নয়টার পর লাইব্রেরি বন্ধ

করে গণমোড় সংলগ্ন সেন স্টুডিওতে গিয়ে

বসতেন। ওই স্টুডিওর মালিক বিশ্বনাথ সেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেই সুবাদে ওখানে আসতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম জোয়ার্দার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী জোয়ার্দার ও নিমাই কুণ্ডু। স্যর নিজে মুক্তিযোদ্ধা না হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর সম্পর্ক। সারের কাছ থেকে কুমারখালীর মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস জেনেছি। আমাকে ভালবাসতেন সন্তানতুল্য ।

কুমারখালী শহরবাসীর কাছে স্যর গভামামু বলে পরিচিত ছিলেন। কেন চিরকুমার ছিলেন, এ বিষয়ে যাব না। একদিনের একটি ঘটনার কথা বলে শেষ করব।

সেদিন সন্ধ্যার পর লাইব্রেরির দোতলায় রিডিংরুমে ঢুকে টেবিলে ছড়ানো দৈনিক পত্রিকার দিকে নজর দিচ্ছি। সার তখন মন খারাপ করে বসে আছেন তাঁর আসনে। আস্তে করে আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘বকুল, তুমি কি সাইকেল চোরদের চেনো?’

স্যরের কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যর, কী হয়েছে বলুন তো?’ সার বললেন, ‘গতকাল নিচতলা থেকে তালা লাগানো অবস্থায় সাইকেলটি চুরি হয়ে গেছে।

দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর আগে কেনা সারের সাইকেলটি চুরি হয়েছে জেনে খুব কষ্ট পেলাম সারকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বললাম, স্যর, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দেখছি।’

কুমারখালী শহরের সন্দেহজনক অনেক চোরকে ডেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বললাম, ফেরত দিতে হবে সারের সাইকেলটি।

কিন্তু কেউ চুরির কথা স্বীকার করল না। পরবর্তী সময়ে নতুন একটি সাইকেল কিনে। নেন স্যর।

সেদিন সংবাদ পেলাম, স্ট্রোক করে মারা গেছেন তিনি। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে ছুটে গেলাম প্রিয় মানুষটাকে শেষবারের মত একবার দেখতে। তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম অসংখ্য মানুষের ভিড়। দলমত নির্বিশেষে সবাই এসেছেন স্যরকে শ্রদ্ধা জানাতে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না কেউ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।