সূর্যশিশির 

১.

গগনবিদারী চিৎকারে কেঁপে উঠে রসন ভিলা। সুমনা চিৎকার শুনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে পা মচকে পড়ে গেলেন। পুনরায় উঠে দাঁড়ালেন। তার কনিষ্ঠ কন্যা রিনি তখনো চিৎকার করছে। তিনি হুড়মুড়িয়ে রিনির কাছে পৌঁছালেন। 

“আম্মা, আপা…” রিনির গলা বুজে এলো। সুমনা জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন, রূপা ব্লে’ড দিয়ে ক্রমাগত হাত-পায়ে আ`ঘাত করছে। তিনি শিউরে উঠে বললেন, ”ও রূপা…রূপারে। এমন করিস না। ও রূপা? মা গো। ও রূপা…”

রূপার কোনো ভাবান্তর নেই। তার শুকনো ওষ্ঠদ্বয় বিরতিহীনভাবে বলছে, “আমি অরুনিকা, আমি অরুনিকা, আমি অরুনিকা…”

সুমনার চোখেমুখে মেয়েকে হারানোর তীব্র ভয়। তিনি উৎকন্ঠিত হয়ে রিনিকে বললেন, “তোর বাপরে কল দিয়ে বল তাড়াতাড়ি এসে তালা খুলতে।” 

রিনি ছুটে নিচ তলায় গেল। 

সুমনা কয়েকবার দরজায় লাথি দিয়ে আবার জানালার কাছে এলেন। মেয়েকে অনুনয় করে বললেন, ” ও রূপা? তুই যা চাস তাই হবে। মা আমার, একটু শোন। ও মা…আমি তোকে আর বকব না, মারব না। তুই যা বলবি তাই করব…”

রূপা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চুলে ঢাকা তার মুখের অর্ধাংশ। চোখ দুটি থেকে যেন র/ক্ত ঝরছে। 

সে গাঢ় গলায় বলল, ”আমায় ঘর থেকে বেরোতে দিবেন তো আন্টি?”

সুমনা বললেন, ”দেব, দেব মা…দেব। তুমি ব্লে’ডটা রেখে দাও।”

”আমি রূপা? না অরুনিকা?’

”তুমি অরুনিকা।” সুমনার কণ্ঠে আতঙ্ক।

রূপা হাসল। ব্লে`ডটি পাশে রেখে বলল, “আপনি কাঁদবেন না আন্টি। এই যে দেখুন, আমিতো শুধু চামড়ায় ব্লে/ড চালিয়েছি।”

রূপা দুই হাত, পা সামনে মেলে ধরল। টুপটুপ করে র`ক্ত পড়ছে মেঝেতে। রূপার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে না, সে কোনোরকম যন্ত্রণা অনুভব করছে! দৃশ্যটি দেখে সুমনার মাথা ভনভন করে ওঠল। তিনি দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। 

 

বছরখানেক আগে।

ভ্যাপসা গরমে অরুনিকার হাঁসফাঁস লাগছে। সে উপরদিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল, ”তুই নামবি রূপা? আর কতক্ষণ এই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকব?”

রূপা দুটো আম ছুঁড়ে দিল। অরুনিকা ওড়নার আঁচল পেতে আম দুটো সংগ্রহ করে দ্বিগুণ জোর গলায় বলল, ”এভাবে চুরি করা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। ধরা পড়লে বেঁধে রেখে দেবে।”

রূপা বলল, “তোর মুখটা বন্ধ রাখ মা। নয়তো সত্যিই ধরা পড়ব।”

অরুনিকা কপালের ঘাম মুছল। গরমের তেজে কোনো পক্ষীও নেই চারপাশে। আছে শুধু সে আর তার উড়নচণ্ডী বান্ধবী। রূপার কথায় এখানে আসাই উচিত হয়নি। কোচিং থেকে বের হয়েছে সেই কোন প্রহরে! এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাসার সবাই টের পেয়ে গেছে। অরুনিকা মুখ গুমোট করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যে রূপা গাছ থেকে নেমে এলো। 

শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে বলল, ”এমন পেঁচামুখী হয়ে আছিস কেন? হাসলে কী তোর টাকাপয়সা ফুরিয়ে যাবে?”

”কয়টা বাজে খেয়াল আছে? বাসায় গিয়ে এখন কী বলব?” 

”একটু না হয় বকবে। আমার মা-বাবার মতো তো বুকে পাড়া দিয়ে রাখবে না।”

অরুনিকা সজল নয়নে তাকাল। রূপার মুখটা দেখে মুহূর্তে তার সকল চিন্তা উবে গেল। 

সে আদুরে গলায় বলল, “আম খেতে কোথায় যাবি চল।”

 

দুজন কলেজের মাঠে শুয়ে আকাশ দেখছে। তারা সদ্য এইচএসসি পাস করেছে। পড়াশোনায় অরুনিকা মেধাবী হলেও রূপা তার উল্টো। রূপা বলল, ”কয়দিন পর এডমিশন। কিছুই তো পরা হয়নি।”

”পড়াশোনাটা একটু কর। আমাদের কিন্তু একসাথে ভার্সিটিতে পড়ার কথা।”

”তুই কোনো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়েই চান্স পাবি। যেটা আমার জন্য রূপকথা।”

”তুই পড় না রূপা। আমার জন্য হলেও পড়।”

”ওই বাসায় পড়াশোনা সম্ভব না। জানিসই তো।”

অরুনিকা চুপসে গেল। রূপা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “আম চুরি নিয়ে তো অনেক জ্ঞান দিলি। এখন তো সব আম তোর পেটেই গেল রাক্ষুসী।”

অরুনিকা হাসল। রূপা কাৎ হয়ে শুয়ে বলল, “অরু?”

”বল না।”

”আবিরের সাথে ব্রেকাপ করেছি।” 

অরুনিকা চট করে উঠে বসল। অবাক হয়ে বলল, “কী? এক সপ্তাহও তো হলো না রিলেশনশিপে গেলি!”

”প্রেমিকগুলো ভীষণ কতৃত্ব ফলায়। ভালো লাগে না এসব।”

”এটাই কারণ? নাকি আমার জন্য?”

”তোর জন্য কেন হবে?”

”তুই জানিস।”

রূপা দমভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ”গত চারদিন তোর সাথে এক দন্ডও কথা হয়নি। আমি আমার অবসরটুকু তোর সাথে কাটাতে চাই। অন্য কারো সাথে না। আমি আর কখনো প্রেম করবো না রে অরু।”

”তুইতো আবিরকে ভালোবাসতি।”

”তোর থেকে কম।”

“তবুও…”

কথার মাঝে আটকে দিয়ে রূপা বলল, “তোকে সময় দেইনি বলে কি তুই কাঁদিসনি?”

অরুনিকা আরক্ত হয়ে উঠল। ছয় বছরের বন্ধুত্বে কখনো কথা না বলে দুজন একদিনও কাটায়নি। হুট করে যখন দুইদিনের ছেলের জন্য রূপা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, সত্যিই সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। পড়াশোনায় মন বসেনি, সারাক্ষণ কেঁদেছে। কিন্তু রূপা কী করে এই খবর জানল? সে বলল, ‘ তুই কী করে জানলি?”

‘আমার মনে হলো, অনুভব করলাম।’

গভীর এক ভালোবাসার চাদরে অরুনিকা ডুবে গেল। সে রূপাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমরা কখনো প্রেম করব না, বিয়েও করব না।’

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

২.

বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সুমনার রাগান্বিত কণ্ঠ ভেসে এলো, ”আজকে তুই ঘরে ঢুকবি না কু’ত্তার বাচ্চা। এতক্ষণ কোন লাংয়ের কাছে ছিলি?”

রূপা সুমনাকে এক নজর দেখে দুই তলায় উঠে গেল। সুমনার রাগ এবার অন্তরীক্ষ ছুঁয়ে ফেলল। কত বড় বুকের পাটা, অবজ্ঞা করে চলে গেল! তিনি পিছু পিছু রূপার রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ইতিমধ্যে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে৷ সুমনা জানালার কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ”গতরে এতো তেজ কীসের তোর? বাপটা যে একা একা এই গরমে কাজ করতেছে সেই খেয়াল আছে?”

রূপা প্রতুত্তরে বলল, ”এই বাড়িতে তো শুধু একা আমি থাকি না৷ তোমার আরো দুটো মেয়ে আছে, দুটো ছেলে আছে। প্রতিদিন আমাকেই কেন হোটেলে গিয়ে আব্বাকে সাহায্য করতে হবে? অন্যরাও যাক।”

”তো এখন কি আমার মেয়েরা ব্যাঠাদের মাঝে গিয়ে হোটেলে কাজ করবে? হাহ?” সুমনার কণ্ঠে তেজ। 

রূপা অভিমানী চোখে তাকাল। বলল, ”আমিও তো মেয়ে আম্মা।”

”তোরে কোনদিক দিয়ে মেয়ে মনে হয়? এতো কথা বাড়াস না তো মা। যা, হোটেলে যা। এখন কাস্টমার আসার সময়, ভীড় হবে। তোর বাপ একা সামলাতে পারবে না।”

“কিছু খেতে দাও। এরপর যাচ্ছি।”

”হোটেলে যা আছে খেয়ে নিস। ঘরে থেকে আর সময় নষ্ট করিস না।”

”হোটেলের খাবারে অনেক তেলমশলা থাকে। গ্যাসের সমস্যা হয়।”

”আজ খেয়ে নে। কাল থেকে কোথাও গিয়ে সময় নষ্ট করিস না। বাড়ি থেকে খেয়ে এরপর হোটেলে যাবি। আশিক, আরমান কোচিংয়ে যাবে। আমি নিয়ে যাচ্ছি। এসে যেন দেখি তুই চলে গেছিস। আমি কিন্তু তোর বাপরে কল দিয়ে জানব তুই গেছিস নাকি।”

 

সুমনা চলে গেলেন। রূপা জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। পড়ন্ত বিকেলের নরম বাতাস কায়া স্পর্শ করতেই বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। এতোগুলো বছর অতিক্রান্ত হলো তবুও কেন বক্ষে এতো পীড়া লাগে? তার শ্রান্ত চোখদুটো বুজে আসছে বার বার। সে চোখমুখে পানি ছিটিয়ে জামাকাপড় পালটে নিল। ক্ষুধায় পেটের ভেতর গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে৷ এতো ক্ষুধা নিয়ে হোটেলের খাবার খেতে হবে!

 রূপা একবার ভাবল, “আম্মাতো এখন ভাইদের নিয়ে কোচিংয়ে চলে যাবে৷ আমি বরং খেয়ে নেই।”

পরক্ষণে বাড়ির দুটো সিসি ক্যামেরার কথা মনে পড়তেই সেই ইচ্ছে দমিয়ে ফেলল।

রসন ভিলা থেকে বের হয়ে কল করল অরুনিকাকে। 

ফোনের ওপাশে শোনা গেল কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠটি, ”মেরেছে?”

”তাড়া ছিল আম্মার। তাই ভালো করে বকতেও পারেনি।” ফিক করে হাসল রূপা। অরুনিকা ফোনটি আরো শক্ত করে কানের সাথে চেপে ধরল। বলল, ”খেয়েছিস?”

”বাজারে যাচ্ছি। হোটেলে গিয়ে খাব।”

”তোর না গ্যাসের সমস্যা। সারাক্ষণ বুক ব্যথা করে।”

”খেতে তো হবে ভাই। তোর কী খবর? আংকেল বকেছে?”

”কথা ঘুরাবি না। তুই বাসায় খেয়ে এরপর হোটেলে যা।”

রূপা বলতে ইতস্তত বোধ করছে৷ তবুও বলল, ”আম্মা মানা করছে।”

”এরা আসলে তোর বাপ-মা? নাকি কুড়িয়ে এনেছে তোকে?”

”কী জানি!” কথাটি হালকাভাবে নিল রূপা।

”কোনো রহস্য তো নিশ্চয়ই আছে। তোর বাকি ভাইবোনদের চোখে হারায় আর তুই যেন চক্ষুশূল। এই বৈষম্য কেন? আমি বড় হয়ে এই রহস্য উদঘাটন করব দেখিস।”

”করিস। এখন রাখছি, ফ্রি হয়ে মেসেজ দেব।”

”শোন, হোটেলের খাবার খাবি না৷ দশ মিনিট অপেক্ষা করিস।”

”কিছু পাঠাস না, অরু, শোন… ”

অরুনিকা কল কেটে দিয়েছে। সূর্যাস্তের সময় তখন। আকাশের অবস্থা ভালো নয়, রাতে কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। রূপা ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। হঠাৎ গলির মুখে আবিরের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। রূপার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়৷ বুকজুড়ে একটা উতলা ঢেউ অনুভব করে। আবির সময় না নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করল, ”কোন দোষে আমার সাথে এমন করছ?”

”আমি তোমার সাথে স্বস্তিবোধ করি না এটাই কারণ।”

”কেন? আমি কী করেছি? তোমার গায়ে হাত দিয়েছি? নাকি কোনো অশ্লীল আচরণ করেছি?”

”তুমি বুঝবে না। আমার পথ ছাড়ো।”

”আমি অবুঝ না রূপা। ব্রেকাপের কারণ তোমার হিংসুটে বান্ধবী। এতো হিংসে তার মনে!”

রূপা রেগে গেল, ”অরুকে নিয়ে এভাবে কথা বলবে না।”

”আমি মিথ্যে কী বলছি? অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। তোমাদের সম্পর্ক অস্বাভাবিক। বন্ধুত্বকে বন্ধুত্বের জায়গায় রাখো। নয়তো জীবনেও সুখী হবে না।”

আবিরের কণ্ঠ থেকে রাগ ঝরে ঝরে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে, সে রাগ ঝাড়ার পরিকল্পনা করেই এসেছে। 

রূপা আবিরকে এড়ানোর চেষ্টা করে, ”তুমি আমাকে সুখ শেখাতে এসো না। পথ থেকে সরো।”

রূপা চলে যেতে উদ্যত হতেই আবির বলল, “বান্ধবীর মন রাখতে ভালোবাসা ছেড়ে দিবে? তুমি কি আমায় ভালোবাসো না রূপা?”

”বাসি না।”

রূপার নিষ্ঠুর জবাবে সে রাগে ধৈর্যহারা হয়ে গেল। বলল, ”অরুনিকাকে বাসো? ও’কে বিয়ে করবে? তোমরা কী সমকামী? লোকে সত্যি বলে?” 

রূপা ঘুরে আবিরের সোজাসুজি এসে দাঁড়াল। বলল, ”তোমার বাবা আর তুমি একজন আরেকজনকে নিজেদের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসো তাই না?” 

হঠাৎ এমন প্রশ্নে অবাক হলো আবির। বলল, ”হ্যাঁ।”

”তাহলে তোমরা কি সমকামী?” 

”কথার প্যাঁচে ফেলতে চাইছো? তাহলে মাথায় ঢুকিয়ে রাখো, আমার বাবা ছেলের জন্য বউ খুঁজছে। বউকে তৃতীয় ব্যক্তি ভেবে হিংসে করছে না।”

রূপা থতমত খেয়ে গেল। বলার মতো কিছু পেল না। আবির বলল, ”সম্পর্ক যত বাড়ে সময় তত কমে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তার মানে এই না ভালোবাসা কমে যাবে। আমি কখনোই তোমাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি ছিলাম না। তোমাদের একে-অপরের বন্ধুত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো আমি জানি। বরং একদিন অন্য কেউ সত্যিকার অর্থেই তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে তোমাদের জীবনে আসবে।”

”অভিশাপ দিচ্ছ?”

”যদি তাই ভাবো তবে তাই। আমি তোমাকে আর কখনো আমার মুখ দেখাব না।”

আবির রাগে গজগজ করতে করতে স্থান ত্যাগ করল। রূপা ঠায় সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। দৈবাৎ আকাশ ফুঁড়ে বজ্রপাত হতেই চমকে ওঠল সে। 

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৩.

হোটেলে খরিদ্দারদের উপচে পড়া ভিড়। সন্ধ্যার সময়টুকু হোটেল ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক। দিনমজুর শ্রেণীর লোকেরা আহার করতে আসে। বয়স্ক ও বেকার লোকেরা আসে আড্ডাবাজি করতে। রূপা ভিড় কাটিয়ে প্রথমে হেঁশেলে গিয়ে ঢুকল। বারেক মিয়া পুরোদমে রান্না করছেন। রূপাকে দেখে বললেন, ”তোর কি আক্কেল জ্ঞান নাই? কই ছিলি?”

রূপা ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বলল, ”আশেপাশেই।”

বারেক গামছা দিয়ে কপালের ঘর্ম মুছে বললেন, ”মাংস বসাইছি খেয়াল রাখিস৷ বেসিনে প্লেটগুলো রাখা, জলদি ধুয়ে রাখ৷ আমি গিয়ে দেখি কী অবস্থা।”

”জি আব্বা।”

মাংসের ঝোলে তেলের পরিমাণ দেখে রূপার গা রি রি করে ওঠল। তেলের দাম কমে গেল নাকি! 

কিছুক্ষণের মধ্যে সুজন প্লেট নিতে এলো। বারো-তেরো বছরের কিশোর সুজন ‘সুমনা হোটেলে’ কাজ করছে মাস তিনেক ধরে। রূপার সাথে তার সখ্যতা দেখার মতো। সুজন প্লেটগুলো হাতে নিয়ে রূপার নিকটে এসে চাপাস্বরে বলল, ”ওস্তাদ, কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে।”

রূপা চুলার আগুন কমিয়ে দিয়ে বলল, ”কী হলো আবার?”

”বেইন্নাবেলা দোকানে সন্ত্রাস আইছিলো।”

রূপা আঁতকে উঠল, ”কী বলিস! কেন?”

‘চান্দা নিতে আইছিলো। কম হইলেও পাঁচ হাজার টেকা দেওন লাগবো। কাকার কাছে এক হাজার টেকা আছিল। হাতেপায়ে ধইরা কইছে রাইতে আইয়া বাকি টেকা নিতে।’

”এই পাড়াতেও চাঁদাবাজি শুরু হয়ে গেল! বাজারের অন্য দোকানিরা কিছু বলেনি?”

”না, সবাই চান্দা দিছে। সন্ত্রাসদের যে নেতা হে কার নাকি ভাতিজা লাগে। সবগুলা হাতে ছু’রি নিয়া আইছিলো।”

 

রূপার ললাটজুড়ে দৃশ্যায়িত হয় চিন্তার ভাঁজ। ৯৯৯-এ কি কল করা উচিত? বারেক সুজন সুজন বলে চেঁচাচ্ছেন। সুজন চলে যাওয়ার পূর্বে বলল, ”ওহ ওস্তাদ কইতে মনে নাই। তোমার গালপেরেন বাইরে খাড়ায়া আছে।”

”তুই এটা এখন বললি! শালা বদমাশ।” মুহূর্তে রূপার মাথা থেকে চাঁদাবাজরা মিলিয়ে গেল। সে সুজনকে ঠেলে তুরন্ত হোটেলের বাইরে গিয়ে দেখে অরুনিকা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে কালো বোরকা, চোখমুখ নিকাবে ঢাকা। বাজারে যতবার তার চরণ পড়েছে নিজেকে আগাগোড়া বোরকা দিয়ে আবদ্ধ করে তবেই এসেছে। অরুনিকার হাতে টিফিনবাক্স দেখে রূপা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। 

এই ভালোবাসার জন্য একটা কেন শত প্রেমিক ত্যাগ করা যায়। রূপাকে দেখে অরুনিকা তেড়ে এলো, ”আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি? তোর চামচারে আমি কখন বলছি গিয়ে খবর দিতে। তা না করে আমার সাথে ফ্লার্ট করছিলো।”

রূপা হেসে টিফিনবাক্সটি নিয়ে বলল, ”সুজন ফ্লার্ট করছে! কী বলে?”

‘তুই হাসছিস! ও আমাকে বলল, ওস্তাদ তো মাইয়া আমি হইলাম পোলা আমনে আমার লগে প্রেম করেন। আমনেরে আমি বড় হইয়া বিয়া করমু।”

”’অল্প বয়সে পেকে গেছে। আমাকে বলে, তুই নাকি আমার গার্লফ্রেন্ড।”

অরুনিকা আরেকটু কাছে এসে গলা খাঁদে নামিয়ে বললো, ”আর তুই আমার বয়ফ্রেন্ড। চল আমরা পালিয়ে যাই।”

”হুরর! ফাজলামো বন্ধ কর৷ রাতবিরেতে বাজারে চলে এলি যে বাসার কেউ দেখেনি?”

”মা সিরিয়াল দেখে। পাপা বাসায় নাই। দারোয়ান যদিও আসতে দিচ্ছিল না। অনেক অনুরোধ করে আসতে হয়েছে।”

”বেহুদা কষ্ট করলি। এখন বাড়ি যা। বাজারে অনেক মানুষ। কখন কার কু-নজর পড়ে ঠিক নাই৷ রিক্সা ডেকে দিচ্ছি।”

অরুনিকা আরো কিছুক্ষণ থাকতে চেয়েছিল। রূপা জোর করে তাকে রিক্সায় তুলে দেয়। সে চায় না অরুনিকা এখানে থাকুক। এখানকার লোকজন খুব একটা সুবিধের না।

রূপা হেঁশেলে টিফিনবাক্সটি লুকিয়ে রেখে খরিদ্দারদের প্রতি যত্নশীল হয়৷ যে যা অর্ডার করে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত করে নিয়ে আসে। 

রূপা যখন ছয় বছরে পদার্পণ করে তখন থেকে সে এই হোটেলের কাজে নিয়োজিত। ব্যবসার খুঁটিনাটি তার নখদর্পনে। রাঁধুনি হিসেবেও চমৎকার। বারেক মিয়ার রান্না অতিরিক্ত তেলমশলা যুক্ত হলেও, রূপার রান্না সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হয়। নিজের অজান্তেই বহুদিন ধরে বুকে একটি স্বপ্ন লালন করে চলেছে , একদিন শহরের সবচেয়ে বড় রেস্টুরেন্টটির মালিক হবে সে। 

”এ ভাই এক কাপ চা দেন।”

রূপা ছুটে চা বানাতে যায়। এরই মধ্যে বারেক এসে বললেন, ”ও মা, ডাল তো শেষ। ভাতও শেষের পথে।”

 

রাত এগারোটায় ফুরসত মিলে তার। টিফিনবাক্স নিয়ে চেয়ারে বসতেই কিছু ছেলেপেলে এসে প্রবেশ করে হোটেলে। তাদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে রূপা খেতে শুরু করল। ছেলেগুলো চেয়ারে না বসে এলোমেলো হয়ে যে যেখানে পারে বসে পড়ে। কেউ বা শুয়ে পড়ে বেঞ্চির উপর। 

তাদের ব্যবহার দেখে সে আন্দাজ করে, এরাই চাঁদাবাজ, সুজনের ভাষায় সন্ত্রাস। বারেক মিয়া চার হাজার টাকা নিয়ে এলে ছেলেগুলোর মধ্য থেকে একজন বলল, ”সারাদিন অপেক্ষা করাইলেন কাকা, জরিমানা হাজারখানেক না দিলে হয়?”

বারেক মিয়া যেন ব্যাটারি চালিত পুতুল! যেভাবে চালানো হয় সেভাবেই চলে। কোনো প্রতিবাদ না করে কথামতো সঙ্গে সঙ্গে আরো এক হাজার টাকা যোগ করে দিলেন। তিনি ভয়ে কাবু হয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে দিবেন!

রূপা মনে মনে হাসল। 

খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলে ভ্রু কাঁটা ছেলেটি ডেকে বলল, ”এই ছেলে, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।”

রূপা হাত ধুয়ে টিফিনবাক্স পরিষ্কার করল। এরপর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এলো। ভ্রু কাঁটা ছেলেটি প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বলল, ”এটিটিউড দেখাচ্ছিস দেখি! নাম কী?”

”রূপা।”

”মেয়ে নাকি?” ছেলেটি অবাক হলো। রূপা কিছু বুঝে উঠার আগে তার মাথার ক্যাপ টেনে খুলে ফেলল। রূপার লম্বা চুলের খোঁপা দেখে ছেলেটি নিশ্চিত হলো, এটি মেয়ে! ততক্ষণে বাকি ছেলেগুলোর নজরেও সে চলে আসে। ভ্রু কাঁটা ছেলেটি জহুরি চোখে রূপার আপাদমস্তক দেখে বলল, ”শরীরে তো কিছুই নাই। সামনে পিছনে সব সমান। মনেই হয় না যে মেয়ে।”  

সবগুলো ছেলের ঠোঁটে বিশ্রি হাসি ফুটে ওঠে। পেছন থেকে একজন বলল, ”ছুঁইয়া দেহেন হীরা ভাই। থাকতেও পারে।”

ছেলেটির নাম হীরা! হীরা হাত বাড়াতেই রূপা সরে যায়। এই ঘটনা নতুন নয়। প্রতিদিনই বুলিংয়ের শিকার হয় সে৷ লম্বায় তরতর করে বাড়লেও, স্বাস্থ্য লম্বা অনুযায়ী খুব একটা ভালো নয়। এতে তার সমস্যা নেই, সমস্যা সমাজের। 

হীরা বারেককে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনার দোকানে নাকি কাস্টমারদের অনেক ভিড় হয়। এটাই কারণ ? মেয়ে দিয়ে ব্যবসা করেন?”

কথাটি শুনে রূপার কর্ণকুহরে ভোঁভোঁ শব্দ শুরু হয়। সমাজের নিচু শ্রেণীর কিছু লোক কানাঘুঁষা করলেও সরাসরি কেউ এভাবে বলেনি! 

বারেক মিনমিনে সুরে বললেন, ”এমন কিছু না।”

রূপা মেঝে থেকে ক্যাপ তুলে মাথায় পরে নিল। এসব লোকদের যত এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো। সে চুপচাপ ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বসল। রূপাকে নিয়ে চাঁদাবাজদের আসর জমে উঠছিল না বলে, কোনো এক ভাইয়ের বউ তাদের আলোচনার মূখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। গা গুলিয়ে উঠার মতো অশ্লীল কথাবার্তা! রূপা আড়চোখে হীরাকে দেখে। নারী দেহ নিয়ে মন্তব্য করছে আর হো হো করে হাসছে। ছিঃ! এই অসভ্যকে সে আর কখনো দেখতে চায় না, কখনো না! 

বের হওয়ার সময় ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালো হীরা। রূপার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবল। বলল, ”মনে হচ্ছে, আমাদের আবার দেখা হবে।” 

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৩.

হোটেলে খরিদ্দারদের উপচে পড়া ভিড়। সন্ধ্যার সময়টুকু হোটেল ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক। দিনমজুর শ্রেণীর লোকেরা আহার করতে আসে। বয়স্ক ও বেকার লোকেরা আসে আড্ডাবাজি করতে। রূপা ভিড় কাটিয়ে প্রথমে হেঁশেলে গিয়ে ঢুকল। বারেক মিয়া পুরোদমে রান্না করছেন। রূপাকে দেখে বললেন, ”তোর কি আক্কেল জ্ঞান নাই? কই ছিলি?”

রূপা ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বলল, ”আশেপাশেই।”

বারেক গামছা দিয়ে কপালের ঘর্ম মুছে বললেন, ”মাংস বসাইছি খেয়াল রাখিস৷ বেসিনে প্লেটগুলো রাখা, জলদি ধুয়ে রাখ৷ আমি গিয়ে দেখি কী অবস্থা।”

”জি আব্বা।”

মাংসের ঝোলে তেলের পরিমাণ দেখে রূপার গা রি রি করে ওঠল। তেলের দাম কমে গেল নাকি! 

কিছুক্ষণের মধ্যে সুজন প্লেট নিতে এলো। বারো-তেরো বছরের কিশোর সুজন ‘সুমনা হোটেলে’ কাজ করছে মাস তিনেক ধরে। রূপার সাথে তার সখ্যতা দেখার মতো। সুজন প্লেটগুলো হাতে নিয়ে রূপার নিকটে এসে চাপাস্বরে বলল, ”ওস্তাদ, কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে।”

রূপা চুলার আগুন কমিয়ে দিয়ে বলল, ”কী হলো আবার?”

”বেইন্নাবেলা দোকানে সন্ত্রাস আইছিলো।”

রূপা আঁতকে উঠল, ”কী বলিস! কেন?”

‘চান্দা নিতে আইছিলো। কম হইলেও পাঁচ হাজার টেকা দেওন লাগবো। কাকার কাছে এক হাজার টেকা আছিল। হাতেপায়ে ধইরা কইছে রাইতে আইয়া বাকি টেকা নিতে।’

”এই পাড়াতেও চাঁদাবাজি শুরু হয়ে গেল! বাজারের অন্য দোকানিরা কিছু বলেনি?”

”না, সবাই চান্দা দিছে। সন্ত্রাসদের যে নেতা হে কার নাকি ভাতিজা লাগে। সবগুলা হাতে ছু’রি নিয়া আইছিলো।”

 

রূপার ললাটজুড়ে দৃশ্যায়িত হয় চিন্তার ভাঁজ। ৯৯৯-এ কি কল করা উচিত? বারেক সুজন সুজন বলে চেঁচাচ্ছেন। সুজন চলে যাওয়ার পূর্বে বলল, ”ওহ ওস্তাদ কইতে মনে নাই। তোমার গালপেরেন বাইরে খাড়ায়া আছে।”

”তুই এটা এখন বললি! শালা বদমাশ।” মুহূর্তে রূপার মাথা থেকে চাঁদাবাজরা মিলিয়ে গেল। সে সুজনকে ঠেলে তুরন্ত হোটেলের বাইরে গিয়ে দেখে অরুনিকা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে কালো বোরকা, চোখমুখ নিকাবে ঢাকা। বাজারে যতবার তার চরণ পড়েছে নিজেকে আগাগোড়া বোরকা দিয়ে আবদ্ধ করে তবেই এসেছে। অরুনিকার হাতে টিফিনবাক্স দেখে রূপা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। 

এই ভালোবাসার জন্য একটা কেন শত প্রেমিক ত্যাগ করা যায়। রূপাকে দেখে অরুনিকা তেড়ে এলো, ”আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি? তোর চামচারে আমি কখন বলছি গিয়ে খবর দিতে। তা না করে আমার সাথে ফ্লার্ট করছিলো।”

রূপা হেসে টিফিনবাক্সটি নিয়ে বলল, ”সুজন ফ্লার্ট করছে! কী বলে?”

‘তুই হাসছিস! ও আমাকে বলল, ওস্তাদ তো মাইয়া আমি হইলাম পোলা আমনে আমার লগে প্রেম করেন। আমনেরে আমি বড় হইয়া বিয়া করমু।”

”’অল্প বয়সে পেকে গেছে। আমাকে বলে, তুই নাকি আমার গার্লফ্রেন্ড।”

অরুনিকা আরেকটু কাছে এসে গলা খাঁদে নামিয়ে বললো, ”আর তুই আমার বয়ফ্রেন্ড। চল আমরা পালিয়ে যাই।”

”হুরর! ফাজলামো বন্ধ কর৷ রাতবিরেতে বাজারে চলে এলি যে বাসার কেউ দেখেনি?”

”মা সিরিয়াল দেখে। পাপা বাসায় নাই। দারোয়ান যদিও আসতে দিচ্ছিল না। অনেক অনুরোধ করে আসতে হয়েছে।”

”বেহুদা কষ্ট করলি। এখন বাড়ি যা। বাজারে অনেক মানুষ। কখন কার কু-নজর পড়ে ঠিক নাই৷ রিক্সা ডেকে দিচ্ছি।”

অরুনিকা আরো কিছুক্ষণ থাকতে চেয়েছিল। রূপা জোর করে তাকে রিক্সায় তুলে দেয়। সে চায় না অরুনিকা এখানে থাকুক। এখানকার লোকজন খুব একটা সুবিধের না।

রূপা হেঁশেলে টিফিনবাক্সটি লুকিয়ে রেখে খরিদ্দারদের প্রতি যত্নশীল হয়৷ যে যা অর্ডার করে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত করে নিয়ে আসে। 

রূপা যখন ছয় বছরে পদার্পণ করে তখন থেকে সে এই হোটেলের কাজে নিয়োজিত। ব্যবসার খুঁটিনাটি তার নখদর্পনে। রাঁধুনি হিসেবেও চমৎকার। বারেক মিয়ার রান্না অতিরিক্ত তেলমশলা যুক্ত হলেও, রূপার রান্না সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হয়। নিজের অজান্তেই বহুদিন ধরে বুকে একটি স্বপ্ন লালন করে চলেছে , একদিন শহরের সবচেয়ে বড় রেস্টুরেন্টটির মালিক হবে সে। 

”এ ভাই এক কাপ চা দেন।”

রূপা ছুটে চা বানাতে যায়। এরই মধ্যে বারেক এসে বললেন, ”ও মা, ডাল তো শেষ। ভাতও শেষের পথে।”

 

রাত এগারোটায় ফুরসত মিলে তার। টিফিনবাক্স নিয়ে চেয়ারে বসতেই কিছু ছেলেপেলে এসে প্রবেশ করে হোটেলে। তাদের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে রূপা খেতে শুরু করল। ছেলেগুলো চেয়ারে না বসে এলোমেলো হয়ে যে যেখানে পারে বসে পড়ে। কেউ বা শুয়ে পড়ে বেঞ্চির উপর। 

তাদের ব্যবহার দেখে সে আন্দাজ করে, এরাই চাঁদাবাজ, সুজনের ভাষায় সন্ত্রাস। বারেক মিয়া চার হাজার টাকা নিয়ে এলে ছেলেগুলোর মধ্য থেকে একজন বলল, ”সারাদিন অপেক্ষা করাইলেন কাকা, জরিমানা হাজারখানেক না দিলে হয়?”

বারেক মিয়া যেন ব্যাটারি চালিত পুতুল! যেভাবে চালানো হয় সেভাবেই চলে। কোনো প্রতিবাদ না করে কথামতো সঙ্গে সঙ্গে আরো এক হাজার টাকা যোগ করে দিলেন। তিনি ভয়ে কাবু হয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে দিবেন!

রূপা মনে মনে হাসল। 

খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলে ভ্রু কাঁটা ছেলেটি ডেকে বলল, ”এই ছেলে, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়।”

রূপা হাত ধুয়ে টিফিনবাক্স পরিষ্কার করল। এরপর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এলো। ভ্রু কাঁটা ছেলেটি প্যাকেটটি হাতে নিয়ে বলল, ”এটিটিউড দেখাচ্ছিস দেখি! নাম কী?”

”রূপা।”

”মেয়ে নাকি?” ছেলেটি অবাক হলো। রূপা কিছু বুঝে উঠার আগে তার মাথার ক্যাপ টেনে খুলে ফেলল। রূপার লম্বা চুলের খোঁপা দেখে ছেলেটি নিশ্চিত হলো, এটি মেয়ে! ততক্ষণে বাকি ছেলেগুলোর নজরেও সে চলে আসে। ভ্রু কাঁটা ছেলেটি জহুরি চোখে রূপার আপাদমস্তক দেখে বলল, ”শরীরে তো কিছুই নাই। সামনে পিছনে সব সমান। মনেই হয় না যে মেয়ে।”  

সবগুলো ছেলের ঠোঁটে বিশ্রি হাসি ফুটে ওঠে। পেছন থেকে একজন বলল, ”ছুঁইয়া দেহেন হীরা ভাই। থাকতেও পারে।”

ছেলেটির নাম হীরা! হীরা হাত বাড়াতেই রূপা সরে যায়। এই ঘটনা নতুন নয়। প্রতিদিনই বুলিংয়ের শিকার হয় সে৷ লম্বায় তরতর করে বাড়লেও, স্বাস্থ্য লম্বা অনুযায়ী খুব একটা ভালো নয়। এতে তার সমস্যা নেই, সমস্যা সমাজের। 

হীরা বারেককে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনার দোকানে নাকি কাস্টমারদের অনেক ভিড় হয়। এটাই কারণ ? মেয়ে দিয়ে ব্যবসা করেন?”

কথাটি শুনে রূপার কর্ণকুহরে ভোঁভোঁ শব্দ শুরু হয়। সমাজের নিচু শ্রেণীর কিছু লোক কানাঘুঁষা করলেও সরাসরি কেউ এভাবে বলেনি! 

বারেক মিনমিনে সুরে বললেন, ”এমন কিছু না।”

রূপা মেঝে থেকে ক্যাপ তুলে মাথায় পরে নিল। এসব লোকদের যত এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো। সে চুপচাপ ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বসল। রূপাকে নিয়ে চাঁদাবাজদের আসর জমে উঠছিল না বলে, কোনো এক ভাইয়ের বউ তাদের আলোচনার মূখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। গা গুলিয়ে উঠার মতো অশ্লীল কথাবার্তা! রূপা আড়চোখে হীরাকে দেখে। নারী দেহ নিয়ে মন্তব্য করছে আর হো হো করে হাসছে। ছিঃ! এই অসভ্যকে সে আর কখনো দেখতে চায় না, কখনো না! 

বের হওয়ার সময় ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালো হীরা। রূপার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবল। বলল, ”মনে হচ্ছে, আমাদের আবার দেখা হবে।” 

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৫.

রসন ভিলা বহু পুরনো বাড়ি। ঠিক কত বছরের পুরনো রূপার জানা নেই। বাড়িটির কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। নিচ তলা বাদে দুই তলা ও তিন তলা পুরো খালি৷ দুই তলার এক কোণে ছোট করে একটা রুম করে দিয়েছেন বারেক। সেখানেই রুপার নিবাস৷ বাড়ির সম্মুখপানে এক কাঠার মতো জায়গায় ছোট পরিসরে বাগান করা হয়েছে৷ রুমি আর রিনি বাগানের পরিচর্যা করে। তবে বাড়িটি তাদের নিজের নয়। অতীতে সুমনা ও বারেক নতুন বিয়ে করে এক রুম ভাড়া নিয়েছিলেন। একদিন বাড়িওয়ালা হুট করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এরপর থেকে তারা এখানে আছে। এই এতো বছরে কেউ এই জায়গার দখল নিতেও এলো না। রূপা মাঝেমধ্যে ভাবে, যদি বাড়িটা কখনো তাদের ছেড়ে দিতে হয় কোথায় যাবে? সাতজন সদস্যের সংসার। শহরে ভাড়া দিয়ে থাকা তো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া ভাড়াটিয়া হয়ে থাকা মানে মালিকের নানারকম শর্ত বহন করা! এর পূর্বেই টাকা সঞ্চয় করে নিজেদের একটা জায়গা করে নেয়া উচিত। কিন্তু সুমনা বা বারেকের সেই চিন্তা একেবারে নেই। তারা এমনভাবে থাকে যেন এটাই তাদের বাড়ি, বাপ-দাদার ভিটা! রূপা গলায় গামছা ঝুলিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বাগানের ফুলগাছে সেচনীর সাহায্যে পানি দিচ্ছে রুমি। 

রূপা পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভালো করে পানি দে। কয়দিন ধরে দেখছি গাছগুলো কেমন শুকিয়ে থাকে।’

রুমি না তাকিয়ে রূঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তোর কাজে তুই যা আপা। আমার কাজ আমি ঠিকভাবে করতে পারি।’

রূপা গামছাটা গলা থেকে নিয়ে কোমরে বেঁধে বলল, ‘তোকে গতকাল গলির মুখে রাজন মিয়ার পোলার লগে আলাপ করতে দেখলাম। কী চলছে তোদের?’

এবার রুমির টনক নড়ে। সে ঘাবড়ে যায়।পনেরো বছরের কিশোরী রুমি সদ্য প্রেমে পড়েছে। প্রেমের শুরুতেই ধরা পড়ে যাবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। আম্মা জানলে মার একটাও মাটিতে পড়বে না। কিন্তু রূপার সামনে দূর্বলতা প্রকাশ করার মেয়ে সে নয়। মুখ গম্ভীর করে  ফিরে তাকাল। 

বলল, ‘কী চলবে? এমনি কথা বলেছি।’

রূপা সন্দিহান চোখে রুমিকে আগাগোড়া দেখল। রুমি এক হাত দিয়ে অন্য হাত বার বার স্পর্শ করছে। তার দৃষ্টি অস্থির। রূপা নিশ্চিত, রুমি প্রেম করছে৷ 

সে বলল, ‘মাত্র এইট পাস করলি। এখনি এসব কী? তাছাড়া রাজন মিয়া নিজে বদমাশ তার পোলাপানও বদমাশ। ব্রেকাপ করবি নয়তো আমি আম্মারে সব বলে দেব।’

হুমকি দেয়াতে রুমি ছ্যাৎ করে ওঠল, ‘আম্মারে বলবি? বল, যা। তোরে আম্মা চার আনা দাম দেয়? তোর কথা জীবনেও বিশ্বাস করবে না।’

‘না করলে নাই। আমার বলা আমি বলব।’

‘তুই প্রেম করস নাই?’ 

‘কই করতে দিলি? তখন তো আম্মারে তোরাই বললি। আর আমি প্রতিদিনই মার খাই, বকা খাই, গালি শুনি। তোর জন্য কিন্তু নতুন হবে৷ আমি সুযোগ দিচ্ছি। রাজন মিয়ার পোলার সাথে আর চলিস না। এই পোলা তোর বান্ধবী পিংকির সাথেও লাইন মারে। খোঁজ নিলেই জানতে পারবি। এখন গাছে পানি ঢাল, যা। সামনে থেকে সর।’

রূপা রুমিকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। এই ধাক্কাটার জন্য প্যাচপ্যাচ করে কেঁদে মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করবে রুমি। রাতে বাড়ি ফিরলেই সুমনা এসে রূপার কানের কাছে ক্যাচক্যাচ করবে। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। রুমিকে ধাক্কা মেরে চলে আসতে পেরেছে এতেই খুশি সে। 

রূপা মনে মনে রাতের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিল, ‘হোটেল থেকে খেয়ে বাড়ি ফিরে দৌড়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেব। আম্মা মশার মতো জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভনভন করে ঠিক একসময় চলে যাবে।’

রূপার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। মনটা ফুরফুরে আজ। সবকিছু ভালো লাগছে। অরুনিকার সাথে দেখা হলে আরো ভালো অনুভব হতো৷ কিন্তু আজ অরুনিকা খালার বাসায় চলে যাবে৷ খালার নাকি মেয়ে হয়েছে। 

 

রূপা হেঁশেলে ঢুকে বিস্মিত হলো। অরুনিকা আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে। বারেক মিয়ার সাথে জমিয়ে আলাপ করছে। রূপা অবাক কণ্ঠে বলল, ‘তোর না কোথায় যাওয়ার কথা। যাসনি?’

রূপার চমকে যাওয়া দেখে অরুনিকার আনন্দ হচ্ছে৷ বললো, ‘যাব তো কিন্তু বিকেলে। পাপা আর মা আন্টির মেয়ের জন্য গিফট কিনতে গেছে। ভাবলাম, এই সুযোগে তোকে দেখে যাই।’

‘ভালো করেছিস। আমাকে তো চমকে দিলি তুই।’

বারেক গদগদ হয়ে দুজনের কথার মাঝে ঢুকে গেলেন , ‘মা জননীরে কখন থেকে বলছি কিছু খেতে। কিছুই খায় না। বলে, রূপা আসলে খাব।’

রূপা বলল, ‘ও বাইরের খাবার খায় না আব্বা৷ তুমি বাড়ি যাও। আম্মা যেতে বলছে। আমি দুপুরের সব রান্না সেড়ে ফেলব। আযানের সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়।’

বারেক যাওয়ার আগে অরুনিকাকে বললেন, ‘আসি মা জননী? রূপা তুই কিছু খেতে দিস।’

অরুনিকা মাথা কাত করে বলল, ‘আসেন আংকেল।’

বারেক মিয়া চোখের আড়াল হতেই অরুনিকা রূপাকে বলল, ‘আংকেল অনেক ভালো।’

রূপা আলগা করে হাসল। অরুনিকা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভাবল। এরপর বলল, ‘কিন্তু বোকা।’

রূপা হাতে পেয়াজ ও ছুরি নিয়ে বলল, ‘আম্মা যা বলে তাই করে। নিজের জ্ঞানে চলতে পারে না, বেশিই সরল। নয়তো মানুষ হিসেবে সৎ। এখন কী খাবি বল?’

‘কোক খেতে ইচ্ছে করছে।’

রূপা পেয়াজ কাটতে কাটতে বলল, ‘তুই বোরকাটা খোল আর অপেক্ষা কর। আমি নিয়ে আসছি। ক্যাশ কাউন্টারে সুজন থাকবে। কিছু দরকার পড়লে বলিস। ভুলেও বের হবি না।’ 

অরুনিকা দুই ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘সুজনকে পাঠা। তুই যাচ্ছিস কেন? তুই এখানে থাক।’

‘আমি পাঁচ মিনিটে চলে আসব। সুজন গেলে বিশ মিনিট লাগিয়ে দিবে। তুই বস। বাজারেই তো।’

‘আচ্ছা যা।’

রূপা যাওয়ার পরপরই অরুনিকার মনে হলো, দুজন একসাথে গিয়েই কিনতে পারতো। এই সুযোগে রূপার সাথে বাজারটাও হাঁটা হয়ে গেল। কখনোই তো পুরোটা বাজার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অরুনিকা দ্রুত নিকাব পরে দৌড়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল। 

রূপা নেই। নিমিষে উধাও! সুজন পেছন থেকে ডাকল, ‘এই যে নাইকা, কই যান?’ 

‘রূপা কোনদিকে গেছে?’ 

‘কুক আনতে গেছে? তাইলে ডাইনে গিয়া এক্কেবারে শেষ মাথাত যান। তাইলে পাইবেন।’

অরুনিকা কোনদিকে যাচ্ছে না দেখেই সুজন একজন খরিদ্দারকে সিগারেট দিতে নতজানু হলো। 

 

অরুনিকা ডান দিকে হাঁটতে শুরু করে। তার গ্রাম্য পথের মতো বাঁকা ভ্রু জোড়ার ঠিক নিচে থাকা কাজল কালো আঁখিদ্বয় উৎসুক হয়ে চারপাশ দেখছে। এটি বৃহৎ বাজার। মাছ, সবজি, আসবাবপত্র, জামাকাপড় সবকিছু এখানে আছে। হোটেলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। 

হীরা ক্যারাম খেলায় মগ্ন। পরপর বারোটা সিগারেট শেষ করে তেরো নাম্বার সিগারেটটি দুই ঠোঁটের মাঝে রাখল। ক্যারামবোর্ডের জায়গা থেকে দশ ফুট দূরত্বে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা বসেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘিরে রেখেছে তাকে। বাচ্চাদের হৈচৈ কানে লাগছে খুব। হীরা চাঁদাবাজি করে যা পেয়েছিল সব প্রায় শেষের দিকে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ভাগ্য সহায় হচ্ছে না। যখন যেখানে যাচ্ছে বাজিতে বার বার হেরে ফিরছে। এরকমটা কখনো হয়নি। আজকে হারলে পকেট একেবারে শূন্য হয়ে পড়বে। চিন্তায় কপালের রগগুলো দপদপ করছে তার। দুই দলই সমান সমান পয়েন্ট নিয়ে শেষ ধাপে আছে।  

হাওয়াই মিঠাই দেখে অরুনিকা সেদিকে এগিয়ে এলো। বহুদিন পর হাওয়াই মিঠাই দেখল সে। ছোটবেলায় খুব খাওয়া হলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে খাওয়াটা কমে গিয়েছে। তাছাড়া খুব একটা দেখাও যায় না। সে হাওয়াই মিঠাই কেনার আগ্রহ প্রকাশ করল, ‘মামা, আমাকে একটা দিন।’ 

মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনে হীরাসহ বাকি তিনজন খেলোয়ার ও ক্যারামবোর্ডের আশেপাশে থাকা সবগুলো ছেলে ঘুরে তাকায়। বাজারের এ পাশটায় জুয়া খেলা, হাঙ্গামা, রাজনীতি চলে। আবাসিক হোটেলও আছে। টাকা ঝাড়লেই রাতে মেয়ে পাওয়া যায় সেখানে। বস্তির বাচ্চাকাচ্চা এদিকে এলেও কোনো নারী আসে না। খেলার টান টান উত্তেজনা চলছে তাই তারা দৃষ্টি সরিয়ে খেলায় মনোযোগ ধরে রাখল। 

বাচ্চাগুলোকে ওমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরুনিকার মায়া হলো। মিঠাইওয়ালাকে বলল, ‘সবগুলো বাচ্চাকে একটা করে দিন। টাকা আমি দিচ্ছি।’

হীরা আবার তাকায়। মেয়েটার কথাবার্তা পরিষ্কার, সুন্দর! তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে আরাম লাগছে। সে সিগারেট ফেলে আঙুলের সাহায্যে স্ট্রাইক দ্বারা গুটিতে আঘাত করে। আশ্চর্যভাবে একসাথে তিনটে গুটি পকেটে পড়ে গেল! এতক্ষণ কিছুতেই হচ্ছিল না। বার বার লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছিল! 

সবগুলো বাচ্চার হাতে হাওয়াই মিঠাই দিয়ে মিঠাইওয়ালা বলল, ‘একসো বিস টেকা অইল।’

‘দাঁড়ান দিচ্ছি।’

হীরা তৃতীয়বারের মতো তাকাল। স্ট্রাইক ঘুরে তার দিকে এসেছে। সে দ্রুত স্ট্রাইক দিয়ে গুটিতে আঘাত করে। পকেটে আরো দুটো গুটি পড়ে। পরপর স্ট্রাইক গ্রহণের সুযোগ পেতে থাকে সে।

অরুনিকা নত হয়ে ব্যাগ থেকে টাকা নিতে গেলে বার বার নিকাব তার ডাগর চোখ দুটি ঢেকে ফেলে। এতে টাকার হিসাব করতে সমস্যা হয়। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন পারল না অধৈর্য হয়ে নিকাব তুলে ফেলল। ঠিক সেই মুহূর্তে হীরা লাল গুটি পকেটে ফেলে দিল। চিৎকার করে ওঠে তার দলবল। হীরা হেসে চতুর্থবারের মতো ফিরে তাকায়। চিৎকার শুনে তাকাল অরুনিকাও। মুহূর্তে তার কৃষ্ণকায় হরিণী মায়াবী চোখের ছত্রছায়ায় আটকে গেল হীরা। 

 

অরুনিকা মিঠাইওয়ালাকে টাকা দিয়ে নিকাবে ঢেকে ফেলল তার সুন্দর মুখশ্রী। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল অঘটন। হীরার নজর তীরের বেগে ভেদ করে হৃদয়। বুকের ভেতর কিছু একটা হাট করে খুলে যায়। মিষ্টি ঘ্রাণের ছোঁয়া লাগে নাকে। 

বোধহয় হাওয়াই মিঠাইয়ের ঘ্রাণ। অরুনিকা উলটো ঘুরে দ্রুত হাঁটতে থাকে। রূপা কোথায়? ব্যাগের ভেতর ফোন ভাইব্রেশন হচ্ছে। 

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৬.

হেঁশেলে অরুনিকাকে না পেয়ে রূপা ক্যাশ কাউন্টারে এলো। তার চোখেমুখে উদ্বেগ স্পষ্ট। 

বুকের ভেতর দুশ্চিন্তা দলা পাকিয়ে আছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সুজনকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘সুজন, অরুনিকা কোথায়? ভেতরে না ছিল।’

 

সুজন বললো, ‘ওস্তাদ, নায়িকা তো তোমারে খুইজা বাইর হইয়া গেল।’

 

রূপা খিটখিট করে ওঠলো, ‘আমাকে খুঁজে গেছে মানে কী? ওদিকে তো আমি ওরে দেখলাম না।’

 

রূপাকে রাগতে দেখে সুজন ঘাবড়ে যায়। কথা বলতে গিয়ে দেখে শব্দ বেরোচ্ছে না। রূপা টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে বললো, ‘হা করে আছিস কেন? কথা বল, কোনদিকে গেছে?’

 

সুজন ঢোক গিলে বললো, ‘আমা…আমারে জিগাইলো রূপা কোনদিকে গেছে? আমি কইলাম ডাইনে গেছে। এরপরই গেল গা।’

 

রূপা দুই হাত কোমরে রেখে বললো, ‘বলতো ডান কোনদিকে?’

 

প্রশ্ন শুনে সুজন স্তব্ধ হয়ে গেল। ডানবাম নির্দেশনাতে সে সবসময় ভুল করে। রূপার কড়া দৃষ্টি তার রক্তে শীতলতা বয়ে দিচ্ছে। সে আঙুল তুলে ডানদিক ইঙ্গিত করলো। সঙ্গে সঙ্গে গালে থাপ্পড় পড়ে। সেকেন্ড কয়েকের জন্য চারিদিক ঝাপসা মনে হয় সুজনের। রূপা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো চেঁচিয়ে বললো, ‘এটা ডান নাকি বাম? আমি বাম দিকে কোক আনতে গিয়েছিলাম। তোরে কতবার আমি ডান-বাম শেখাব? এজন্য কাস্টমারদের সাথেও কতবার  ঝামেলা হলো। এরপরও তোর শিক্ষা হয় না।’

 

সুজন কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ‘তুমি যেমনে দিয়া গেলা আমি ওইডাই কইছি। খালি বাম না কইয়া ডাইন কইছি।’

 

‘তাহলে অরুনিকা যখন অন্যদিকে যাচ্ছিলো ওরে বললি না কেন?’

 

‘দেহি নাই তো। তহন কাস্টমার আইছিলো।’

 

রূপা আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলো না। বেরিয়ে পড়লো অরুনিকার খোঁজে। মেয়েটা যতবার বাজারে এসেছে বাইরে ঘুরার জন্য চুকচুক করেছে। এবার সেই সুযোগ লুফে নিল। বিপদ না ঘটিয়ে থামবে না। ডান দিকে বদমাশ ছেলেদের আড্ডাখানা৷ গেল তো গেল ওদিকেই গেল! 

 

পকেট থেকে ফোন বের করে অরুনিকাকে কল করলো। ফোন ধরছে না! রূপা টের পেল বুকের ভেতরে অস্থিরতা নামক পোকাটা ধীরে ধীরে ব্যথা দিতে শুরু করছে। যেন খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হৃদয়টা। কী হলো অরুনিকার? কল দিতে দিতে সামনের দিকে ছুটছে সে। তার দৃষ্টি অসহিষ্ণু, কাতর। বাজারের শেষ মাথায় অবস্থিত আবাসিক হোটেলটির সামনে এসে দাঁড়াতেই অরুনিকার সাড়া মেলে।

 

‘হ্যালো?’ অরুনিকার কণ্ঠ।

 

রূপা যেন ধুধু মরুভূমির মাঝে দৈবাৎ পানির কোয়া পেল, ‘অরু…অরু কই তুই? তোরে না বের হতে না করছিলাম। এখন কই তুই?’ 

 

‘পাপা কল করছিলো। আমি রিক্সায়, বাসায় যাচ্ছি।’ ওপাশ থেকে রিক্সার বেলের টুং-টুং শব্দ শোনা যাচ্ছে।

 

রূপা হাফ ছেড়ে বাঁচে। দমভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, ‘সাবধানে যা৷ তোর কোক আমি খেয়ে নিচ্ছি। গলা শুকিয়ে গেছে।’

 

‘খেয়ে নে। বাড়ির কাছে চলে এসেছি, রাখছি।’

 

‘আল্লাহ হাফেজ।’

 

_

হীরা ঝিম ধরে বসে আছে চেয়ারে। সে ভাবনায় মগ্ন। আকাশজুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ; দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ। তার একনিষ্ঠ সঙ্গী দুলালের উপস্থিতিতে সে সম্বিৎ ফিরে পেল। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো, ‘ মেয়েটির নাম কী? কোথায় থাকে? বাসার ঠিকানা এনেছিস?’

 

দুলাল দুই হাত তুলে হীরাকে শান্ত হতে বলে। এরপর বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বললো, ‘ভাই, ভাবি বিরাট বাড়ির মাইয়া। আমি একদম পিছু পিছু গেছি। একবারের জন্যেও চোখের পলক ফালাই নাই। ভাবির নাম অরুনিকা চৌধুরী। আইএ পাস করছে। ভাবির বাপে ভারসিটিতে ইংরেজি পড়ায়, মা হইলো ডাক্তর। ভাবির একটা বড় ভাই আছে। ভাই কানাডা সিটিজেন পাইছে। র’চত্বরের চার নাম্বার গলির সাদা রঙের ছয় তলা বাড়িটা ভাবির বাপের। তিন তলায় ভাবিরা থাকে। বাকি সব ফ্লেট ভাড়া দিয়া রাখছে। গ্রামেও নাকি বিরাট জমিদারি আছে। ভাবিদের গ্যারেজে দুইটা গাড়ি। তাও ভাবি কেন বোরকা পইরা এই বাজারে ঘুরঘুর করলো হেইডাই বুঝতাছি না। আবার রিক্সা দিয়া বাড়িত গেল৷ শুনলাম, হেরা নাকি ধর্মকর্ম মানে ভালো। ভাবির বাপ চরম রাগী। এই কামডা তোমার জন্য মেলা কঠিন হইবো হীরা ভাই।’

 

হীরার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। সে চুলে চিরুনির মতো হাত চালিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘ হয়ে যাবে কাজ। এইবার আব্বাও আমার উপর খুশি হয়ে বাড়িতে যেতে বলবে।’

 

‘তাইলে তো তোমার জন্যে এইটা আসলেই বড় কাজ।’

 

‘মাস শেষ হতেই দেখবি আব্বা আম্মার সাথে আবার এক ছাদের নিচে আছি। তুইও থাকবি সাথে।’

 

‘এইডাই যেন হয় হীরা ভাই। খালাম্মার রান্ধা ছাড়া জীবনটা কেমন নিরামিষ হইয়া গেছে। যা ই খাই মাটি লাগে।’

 

বছর দেড়েক পূর্বে কাজকর্ম না করায় হীরাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, বাবার পকেট কেটে সিগারেট কেনা ছিল তার নিত্যকার ঘটনা। বাবা সেসব ছাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন পারলো না বের করে দিলো। বহুবার সে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে; বাবা অনুমতি দেয়নি। বখাটেপনা আগে থেকে থাকলেও চাঁদাবাজিটা বাড়ি থেকে বের হয়েই শুরু হয়েছে।

জীবন ঝুঁকি নিয়ে চাঁদাবাজি করতে প্রথম প্রথম ভয় হলেও ধীরে ধীরে সে ভয় কাটিয়ে সন্ত্রাস হয়ে ওঠে৷ এখন দিনদুপুরে খুন করতেও হাত কাঁপে না। একবার চাঁদাবাজি করে অনায়াসে সারামাস পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দেয়। 

 

হীরা দুলালকে নিয়ে বাজারের একটি বিল্ডিংয়ে দুই রুমের বাসা ভাড়া নেয়। বাজার থেকে র’চত্বর খুব কাছে। র’চত্বরে বাসা ভাড়া নেয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই। এখান থেকেই অরুনিকাকে জয় করে নিতে হবে। এরই মধ্যে দুলাল হাড়ি পাতিল নিয়ে ফিরলো৷ হীরা বললো, ‘কী আজব! এখনো তো তোর ভাবি ঘরে আসেনি। হাড়ি পাতিল নিয়ে এলি কেন?’

 

‘হোটেলের খাওন খাইতে খাইতে সারাটাদিন বাথরুমে দৌড়াই। এইযে ব্লেন্ডার নিয়া আসছি। তুমি বাজার কইরা আনো আমি আজকে নিজে রাইন্ধা খামু।’

 

হীরা হাসলো। পাতিল হাতে নিয়ে বললো, ‘তুই রাঁধবি?’

 

‘হাইসো না ভাই। বড় জ্বালা নিয়া কিনে আনলাম। তুমি বাজার করে নিয়া আসো। আমি ভাত বসাই।’ 

 

হীরা বেশ আগ্রহ নিয়ে বাজার করতে বের হয়।

মুরগি কিনতে গিয়ে ঘটনাচক্রে দেখা হয় রূপার সাথে। রূপা হোটেলের জন্য মুরগি নিতে এসেছে। হীরাকে দেখে সে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই দেখা হয়েছে! রূপা দ্রুত নিজের দৃষ্টি সংযত করে। 

 

হীরা রূপার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে বললো, ‘চাপিলা মাছ, দেখা হয়ে গেল তো আমাদের।’

 

রূপা হীরাকে এড়িয়ে মুরগিওয়ালাকে বললো, ‘মামা, আমাকে তিনটে মুরগি দিবেন ২ কেজি করে।’

 

সাথে সাথে হীরাও বললো, ‘আমাকে মামা তিন কেজির একটা দিবেন। চার কেজি হলে আরো ভালো। মাংস যেন বেশি থাকে। আমার আবার হাড্ডি ভালো লাগে না।’ 

 

হীরা হেসে রূপার আরো কাছে এসে দাঁড়ায়। রূপা বিরক্তি নিয়ে তাকালে সে রূপাকে চোখ মারলো। তাদের উচ্চতা প্রায় কাছাকাছি। মাত্র দুই ইঞ্চির তফাৎ। হীরা ক্ষীণ সুরে রূপার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা তোমার সাইজ কত?’

 

রূপা দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়। হীরা ফিক করে হেসে ওঠলো। রূপা কিড়মিড় করে বললো, ‘বেশি বার বাড়বেন না। সবসময় আমি ছেড়ে দেব না।’

 

হীরা নাটকীয় ভঙ্গিতে হাসলো। বললো, ‘ওবাবা! কী করবে? মারবে?’

 

রূপা দূরে সরে দাঁড়ায়। রাগে তার ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু সে কিছু করতে চায় না। চার বছর আগে বাজারে ভেজাল করতে গিয়ে তাদের হোটেলের খুব ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতির মুখোমুখি আর সে হতে চায় না। দ্রুত মুরগি নিয়ে চলে যায়। হীরা একটা কাগজ কুড়িয়ে সেটা মুড়িয়ে রূপার পিছনে ছুঁড়ে মারলো।

 

চলবে….

(দুলাল চরিত্রটিকে দুই মেশালি ভাষায় কথা বলতে দেখে কেউ বিব্রত হবেন না৷ চরিত্রটিই এমন।)

 

সূর্যশিশির 

৭.

কালবৈশাখীর ঝড়ে থরথর করে কেঁপে উঠে রহিম মিয়ার চালাঘর। অরুনিকার খালু মঞ্জু তিনটে ছাতা নিয়ে সেদিকে ছুটে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে রহিম মিয়ার পুরো পরিবারকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন তিনি। জানালার পাশে বসে উক্ত দৃশ্যটির স্বাক্ষী হলো অরুনিকা। সে তার খালুকে ছোট থেকেই খুব সম্মান করে, এই ঘটনার পর হৃদয়ের ভক্তি আরো বেড়ে গেল। অরুনিকা ঘর থেকে বেরোনোর জন্য উদ্যত হতেই খুব কাছে কোথাও বজ্রপাত হয়। সে চমকে উঠে জানালার বাইরে তাকায়। বিজলির আলোয় চোখের পর্দায় দৃশ্যায়িত হয় সেই মানুষটির মুখ! সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। লজ্জায়, আড়ষ্টতায় টেনে দিলো জানালার পর্দা।

হীরা বাইরের মেঠোপথে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ধরে রেখেছে কালো রঙের ছাতা। মনে হলো এদিকওদিক কিছু খুঁজছে। কী খুঁজছে? অরুনিকার মনে প্রশ্নটি ঘুরপাক খেতে লাগলো। খালার বাড়ি শহর থেকে বেশ দূরের একটি ছোট গ্রামে৷ এখানে এসেছে আজ তিনদিন। প্রতিটি মুহূর্তে যে ছেলেটির অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বক্ষের হাড়ে হাড়ে লটকে ছিল সে ছেলেটি আজ এতো কাছে! কী জন্য এসেছে এখানে? আমার জন্য? অরুনিকা টের পেল তার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। সম্মোহনী একটা অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। সে থম মেরে চেয়ারে বসে রইলো।

চোখ বুজলেই হীরার মুখখানা ভেসে ওঠে। তার ললাটজুড়ে ছড়ানো চিকচিকে চুল, রুক্ষ ঠোঁটে রাখা সিগারেট, আর চোখের চাহনি; দৃশ্যটা মনের ক্যানভাসে সন্তপর্ণে আটকা পড়েছে। অরুনিকা আবার সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে চায়! সে দ্রুতবেগে পর্দা তুলে দিলো। কিন্তু একি! কোথায় সে? চারপাশে খুঁজেও মানুষটির দেখা পেল না। সত্যি কি এসেছিল? নাকি সবটাই দৃষ্টিভ্রম? 

_

রাত বাজে দুটো। ঝড় হাওয়ার তাণ্ডবে গাছপালা ভেঙে পড়ছে। বিদ্যুৎ নেই ঘন্টাখানেক ধরে। রূপা দ্বিতীয় তলার ঈশান কোণে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। বৃষ্টির পানির ছিটা এসে লাগছে চোখেমুখে। এতে অবশ্য তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলো, কেউ আছে নাকি। এরপর অতি সাবধানে পুরু, শুকনো ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে রাখলো পাতলা কাগজে মোড়া ধূমপানের উপকরণবিশেষ। 

 

মাঝেমধ্যে লুকিয়ে সিগারেট টানার কু-অভ্যাস রয়েছে তার। এ খবর কাকপক্ষীর দৃষ্টিগোচরেও নেই। তবে অরুনিকা বহুবার প্রশ্ন করেছে, তোর ঠোঁট দিন দিন কালো হচ্ছে কেন রে? 

 

রূপা প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ থেকেছে। অরুনিকা বন্ধুর ঠোঁট আগের রঙে ফিরিয়ে আনার জন্য কোরিয়ান, জাপানিজসহ পাঁচ-ছয়টি দেশের লিপবাম এনে দিয়েছে তাতেও ঠোঁটের উন্নতি হলো না। কী করে হবে? যদি প্রতিদিন সিগারেট নামক নেশায় পুড়তে থাকে ঠোঁট! রূপা ধোঁয়া ছেড়ে চোখ বুজলো। বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে৷ আকাশের হুংকারে বারংবার প্রকম্পিত হয়ে উঠছে ধরণী। পরিবর্তন হয় না শুধু তার মুখের প্রতিক্রিয়া। সে খুব ছোটবেলা থেকে ঝড়ের তাণ্ডব, বজ্রপাত, ভূমিকম্প সব সহ্য করে এসেছে নীরবে, একা। 

 

আবহাওয়া কিছুটা শান্ত হয়ে এলে রূপা শার্টের পকেট থেকে ফোন বের করলো। অরুনিকাকে ভীষণ মনে পড়ছে। আজ সারাদিন কথা হয়নি। কল দিতে গিয়ে মাথায় এলো, যদি ঘুমে থাকে তাহলে তো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। সে ফোনটা আবার রেখে দেয় বুকপকেটে। ঠিক তখনই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠলো। অরুনিকা কল করেছে! রূপা সিগারেট ফেলে কল রিসিভ করে।

 

‘এতো রাতে জেগে আছিস! ব্যাপার কী?’ পা দুটো টানটান করে বসলো সে। 

 

অরুনিকা ছোট করে বললো, ‘এমনি।’ 

 

‘এমনি কী? কী করছিলি?’

 

‘কিছু না।’

 

রূপা আগ্রহান্বিত হয়ে বললো, ‘গলার আওয়াজ বিলাইয়ের মতো হয়ে আছে দেখি! কিছু বলবি?’

 

অরুনিকা দাঁত নখ দিয়ে খুটছে। রূপা কান খাড়া করে রেখেছে। ওপাশ থেকে অরুনিকা মিনমিনে সুরে বললো, ‘দোস্ত?’ 

 

‘শুনছি, বল।’

 

‘শোন না।’

 

‘বল না রে মা।’ রূপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

অরুনিকা বুকের কাছে বালিশ টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে ডাকলো, ‘দোস্ত?’

 

‘এই তুই ফোন রাখ।’

 

‘রাগ দেখাচ্ছিস কেন? বলছি তো।’

 

রূপা আবার চেয়ারে বসলো। অরুনিকা জানালা দিয়ে একবার বাহিরটা দেখলো। তারপর ঢোক গিলে বললো, ‘রূপা, রূপারে…’ 

সে থামলো। তারপর বললো, ‘আমার মনে হচ্ছে আমার খুব কঠিন অসুখ করেছে। ম’রেটরে যাবো। নয়তো পা’গল হয়ে পাগলাগারদে থাকবো।’ 

 

‘এসব কী ধরনের কথা! জ্বর-টর বাঁধিয়েছিস?’

 

‘না, না ওমন কিছু না। অন্য অসুখ, একদম আলাদা।’

 

রূপা চিন্তায় পড়ে গেল। বললো, ‘কেমন? কোথায় যন্ত্রণা হয়? পরিষ্কার করে বল।’

 

‘আমি নিজেও জানি না কোথায় অসুখ করেছে। শুধু অনুভব করতে পারছি, আমার ভীষণ অসুখ।’ 

 

রূপা ভাবলো। এরপর সাবধানে প্রশ্ন করলো, ‘কারো প্রেমে পড়েছিস?’ 

 

সঙ্গে সঙ্গে অরুনিকার ফকফকে গাল দুটো গোলাপি রঙ ধারণ করে। বুকের ভেতর অনুভূতির তরঙ্গ খেলে যায়। সে ফোন কানের সাথে চেপে ধরে বললো, ‘জা…জানি না।।’

 

রূপা হাসলো। অরুনিকা কখনো কারো প্রেমে পড়েনি। বরং প্রেম নিয়ে সবসময় সমালোচনা করেছে। কে সেই সু-পুরুষ যার প্রেমে অরুনিকা পড়লো। প্রেমে পড়ে মেয়েটার কণ্ঠই পরিবর্তন হয়ে গেছে! রূপা প্রবল উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলো, ‘ছেলেটা কে? কোথায় দেখেছিস?’ 

 

‘চিনি না। জানিস রূপা, মানুষটা কেমন করে যেন তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমি না…আমি ওই তাকানোটাই ভুলতে পারছি না। কিছুতেই না।’ 

 

রূপা নিজেও কেমন বাঁধভাঙা আনন্দ অনুভব করছে৷ অরুনিকা প্রেমে পড়েছে! সে সামনের খোলা জায়গাজুড়ে পায়চারি করতে করতে বললো, ‘কোথায় দেখেছিস সেটা বল আগে। আমি খুঁজে বের করে তোর সামনে নিয়ে আসবো। 

 

‘তোদের বাজারে দেখেছি। তোকে খুঁজতে গিয়ে।’

 

রূপার ঠোঁটের হাসি নিমিষে উধাও হয়ে গেল৷ দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কোনদিকে দেখেছিস?’

 

অরুনিকা সেদিনের ঘটনা খুলে বলে। ছেলেটি ক্যারাম খেলছিল উল্লেখ করতেই রূপা অজানা আতঙ্কে ঘাবড়ে গেল। বাজারের পশ্চিম দিকে জুয়া খেলা চলে। জুয়া খেলার জের ধরে প্রতিদিন চলে হাঙ্গামা। ভালো ছেলে নিশ্চয়ই জুয়া খেলবে না। বহুবার পুলিশ এসে এসব পোলাপানদের ধরে নিয়ে গেছে। সেখানে আবার কাকে ভালো লাগলো অরুনিকার? 

 

ওপাশ থেকে অরুনিকা অনবরত বলছে , ‘হ্যালো, রূপা? রূপা? হ্যালো…’

 

রূপা ভাবনা থেকে বেরিয়ে বললো, ‘ছেলেটা দেখতে কেমন?’

 

‘চুলগুলো সুন্দর, কপালে ছড়িয়ে ছিল। ফর্সা দেখতে।’ 

 

‘ঠিক আছে।’

 

রূপার হঠাৎ চুপসে যাওয়াটা টের পেরে অরুনিকা বললো, ‘কী হয়েছে ? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলি যে।’

 

সে মিথ্যা বললো, ‘আম্মা ডাকছে।’ 

 

‘এতো রাতে ডাকছে! বিপদ হলো নাকি?’ 

 

রূপা এক হাতে ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বললো, ‘গিয়ে দেখি। রাখ এখন।’ 

 

সে কল কেটে আরেকটা সিগারেট ধরালো। কে সেই মানুষ! দেখতে নিশ্চয়ই সুন্দর হবে। অরুনিকা সৌন্দর্যকে খুব বেশি মূল্য করে। কিন্তু যদি ভালো ছেলে না হয়? রূপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। ঠিক তখন হাট করে খুলে যায় সামনের বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠার জানালা। রূপা ধড়ফড়িয়ে ওঠে। জানালার ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটি ভরাট পুরুষ কণ্ঠ, ‘দেশ তো উন্নতির জোয়ারে ভাসছে। মেয়ে মানুষ সিগারেট টানে!’

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৮.

রূপা দ্রুত জ্বলন্ত সিগারেট হাতের মুঠোয় চেপে ধরে, সঙ্গে সঙ্গে হাতে অসহ্য জ্বালাতন অনুভব হয়। তবুও সে মুঠো খুললো না। যে গোপন অভ্যাস কাকপক্ষীও জানলো না তা কোন পুরুষ জেনে গেল? 

কণ্ঠটির মালিক এবার উঁকি দিলো। মুখটি চিনতে পেরে কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল রূপা। অপর মানুষটিও অবাক হলো। বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো, ‘রূপা না?’ 

 

রূপা কিছু না ভেবেই বললো, ‘রূপা! রূপা কে? আমার নাম সুইটি।’

 

লোকটি চোখের চশমাটি ঠিক করে আরো গভীরভাবে রূপাকে পর্যবেক্ষণ করলো। রূপা পালানোর জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই লোকটি হইহই করে ওঠলো, ‘এই…এই দাঁড়াও। তুমিই তো রূপা।  মিথ্যে বলছো কেন? সিগারেট টানছিলে আবার মিথ্যা বলাও হচ্ছে! আমি কালই তোমার বাবার কাছে যাবো।’

 

রূপা বাম হাত দ্বারা কপাল চাপড়ে ফিরে তাকালো। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বললো, ‘বিশ্বাস করুন স্যার, আমি আজই প্রথম সিগারেট হাতে নিলাম। একটু টেস্ট করে… ‘

 

স্যারের তীক্ষ্ণ চাহনির সামনে দাঁড়িয়ে রূপা বাকিটুকু আর বলতে পারলো না। সে চোখ নত করে অপরাধী সুরে বললো, ‘মেয়ে মানুষ হয়ে সিগারেট টেস্ট করার কথা ভাবাও উচিত হয়নি। আমার ভুল হয়ে গেছে, স্যার। আব্বাকে বলবেন না প্লিজ।’

 

কথা শেষ করে রূপা আড়চোখে তাকায়। চশমার  সুরক্ষায় থাকা বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটির মালিকের নাম বখতিয়ার ফাইয়াজ। নবম-দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন একটি স্বনামধন্য কোচিংয়ের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে ফাইয়াজের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। তখন ফাইয়াজ মাস্টার্স করছিল। পাশাপাশি কোচিং-এ পড়াতো। নিয়মিত কোচিং-এ না যাওয়ার জন্য, না পড়ার জন্য প্রায় প্রতিদিন রূপাকে শাস্তি দিয়েছে সে। 

 

ফাইয়াজ রূপার মুঠো করা হাতের দিকে তাকিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো, ‘হাতের মুঠো খুলো।’

 

রূপা মুঠো খুলতেই মুচড়ে যাওয়া সিগারেটটি মেঝেতে পড়ে। সিগারেট দেখে ফাইয়াজ চোখমুখ বিকৃত করে বললো, ‘লজ্জাজনক, খুবই লজ্জাজনক! আর কখনো যেন হাতে সিগারেট না দেখি। যাও, রুমে যাও।’

 

রূপা এক ছুটে নিজের ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো, ফাইয়াজ একা একা কিছু বলছে কিন্তু ঠিক কী বলছে শোনা যাচ্ছে না! সে বিরক্ত হয়ে দেয়ালে কপাল ঠুকে বিড়বিড় করে, ‘এই উটকো ঝামেলা আবার কোথা থেকে উড়ে এলো, উফ!’

 

পরদিন রূপা জানতে পারলো, ফাইয়াজ এখন থেকে তাদের প্রতিবেশী। বাড়ির মালিক বহুদিন ধরে লন্ডনে আছে। এতগুলো বছর বাড়িটি বন্ধ থাকায় রূপা ধরে নিয়েছিল এখানে আর কেউ আসবে না। শান্তিতে বসে সিগারেট টানার দিন শেষ ভাবনাটা মনে হানা দিতেই আক্ষেপে তার মেজাজ চড়ে যায়। সে হনহনিয়ে বাজারের দিকে রওনা দেয়। 

_

পা বাজারের মাটি স্পর্শ করতেই অরুনিকার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। রূপা হোটেলে না গিয়ে সোজা পশ্চিম দিকে এগিয়ে যায়। ক্যারাম খেলার ঘরটি টিনের। মালিকের নাম শফিক; ধূর্তবাজ লোক। সকালবেলা ক্যারামবোর্ড গুছিয়ে রেখে চা বিক্রি করে। খেলা শুরু হয় দুপুর বারোটায়। বেশিরভাগ সময় একটা পনেরো-ষোল বছর বয়সী ছেলে ঘরটির দায়িত্বে থাকে৷ যখন যারা খেলে তাদের নাম লিখে রাখে। শফিক ফিরলে হিসাব বুঝায়। 

রূপা গিয়ে দেখে শফিক নেই। ছেলেটি বসে আছে। সে একটা চেয়ার টেনে বসে বললো, ‘ কি রে মাছুম কেমন আছস? দিনকাল কেমন যায়?’

 

‘আর কইও না রূপাবু। বাজারের কোন শয়তানগুলা জানি কয়দিন পর পর পুলিশরে খবর দেয়। পুলিশের ডরে থাকতে থাকতে কইলজাডা শুকায়া যাইতাছে।’

 

রূপা পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো, ‘অন্যখানে কাজ নিলেই তো পারিস।’

 

‘এইডা কেমনে হইবো কও? শফিক কাকার মতো এতো টেকা আর কে দিব?’ মাছুমের মুখভর্তি পান। যখন কথা বলে চারদিকে থুথু ছিটকে পড়ে। রূপা একটু সরে বসলো।

 

‘তোর শফিক কাকা তো ঠিকই নিজেরটা বুঝে। দূরে থেকে নিজেকে রক্ষা করে আর তোরে দোকানে বসিয়ে নিজের ব্যবসা চালায়।’

 

মাছুম আপনমনে পান চিবুচ্ছে। সে জবাব না দেয়াতে রূপা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলো, ‘শুনলাম, দোকানে নাকি মদটদও রাখিস?’

 

মাছুম কৃত্রিম হাসলো। বললো, ‘এইডা ডাহা মিচা কথা৷ মদ রাখুম কেন? চোর, ডাহাইত, সন্ত্রাস -মন্ত্রাস সব আইয়া ক্যারাম খেলে এর লাইগগাই পুলিশ আয়।’

 

রূপা চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে বললো, ‘ওহ আচ্ছা।’

 

মাছুম আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি এই বেলা এইহানে কেন? কোন দরকার আছিলো?’ 

 

রূপা মাথার ক্যাপ ঠিক করতে করতে বললো, ‘তোর রূপাবুরে একটা হেল্প করতে পারবি?’ 

 

‘যদি পারার মতো কও তাইলে তো করমুই।’

 

রূপা রয়েসয়ে ধীরেসুস্থে বললো, ‘কয়দিন আগে একটা বদমাশ হোটেলে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করছে। বিল দিতে যখন বললাম বলে, কাল বিল দেব। এরপর আর কোনো দেখা নাই। শুনছি, তোদের এখানে নাকি ক্যারাম খেলছে। তুইতো সবার নাম লিখে রাখিস৷ যদি নামটা জানতে পারতাম ভালো হতো। তুই যদি চিনিস আরো ভালো হয়।’ 

 

মাছুম স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘আইচ্ছা আমি শফিক কাকা আইলে বলমুনে তোমার কথা।’

 

‘এখন দরকার রে ভাই। তুই আমারে হেল্প কর। বিনিময়ে তোর রূপাবু তোরে দুপুরে ফ্রি তে খাওয়াবে। তোর যা ইচ্ছে তুই তা নিয়ে খাবি।’ 

 

রূপা কথাটি বলে ঠোঁট টিপে হাসলো। মাছুমের খাবারের প্রতি প্রচণ্ড লোভ। টোপ নিশ্চয়ই গিলবে। তাই হলো! খাবারের কথা শুনে মাছুমের চোখ দুটি চকচক করে ওঠে। সে শীঘ্রই টেবিলের ড্রয়ার খুলে কাঙ্খিত খাতাটি বের করে বললো, ‘কুনদিন আর কুনসময় খেলছে এইডা আগে কও।’

 

‘পোলাপান খেলতে তো সবসময় দুপুরে আসে। কিন্তু গত রবিবার সকালেও নাকি এখানে মানুষজন ছিল? তখনই বদমাশটা খেলছে।’

 

‘হ, হ। ওইদিন সকালেও হইলো। এরা কাকার কাছের লোকজন। দাঁড়াও বাইর কইরা দিতাছি।’

 

মাছুম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে রবিবারে লেখা নামগুলোতে পৌঁছায়। উপরের অংশে পাশাপাশি চারজনের নাম লেখা। রূপা নামগুলো এক নজর দেখে বললো, ‘জিতছে কোন দুজন?’ 

 

মাছুম অঙ্গুলিনির্দেশে দুজনের নাম দেখালো। রূপা নাম দুটো পড়ে – হিরণ ও দুলাল। অরুনিকার যাকে ভালো লেগেছে সে হিরণ নাকি দুলাল?

 

রূপা বললো, ‘দুজনের মধ্যে কাউকে চিনিস?’ 

 

‘না গো রূপাবু। হেইদিনই দেখলাম খালি।’

 

‘আচ্ছা বলতো, দুজনের মধ্যে সুন্দর কে?’ 

 

মাছুম কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ‘দুইজনই দেখতে ফরসা। তয় লম্বা বেশি এইযে হিরণ, এই বেডা।’

 

রূপা অনেকক্ষণ হিরণ নামটার দিকে চেয়ে রইলো। এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘এদের মধ্যে কেউ যদি আবার আসে আমাকে খবর দিস। আর দুপুরে খেতে চলে আসিস।’

_

চারিদিকে যেন অন্ধকার সমুদ্রের ঢেউ। অন্ধকার পেরিয়ে কিছুতেই আলোর রেখা ধরা দিচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে মাথা ব্যথায় বিষিয়ে ওঠেছে৷ তবুও হিরণ নামের মানুষটিকে কীভাবে দ্রুত খুঁজে বের করা যায় সেই উপায় মাথায় আসছে না৷ যতক্ষণ না ছেলেটিকে খুঁজে বের করতে পারবে ততক্ষণ অবধি শান্তি মিলবে না রূপার। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে অপরাহ্নের রান্না শেষ করে। 

যোহরের নামায শেষ হতেই হোটেলে ভিড় লেগে যায়। বারেক, রূপা, সুজন ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজ নিজ দায়িত্বে। এই ফাঁকে খরিদ্দারদের সাথে মাছুমও এসে খেয়ে গেল। মাছুম যে বিনা পয়সায় খেয়েছে বারেক মিয়াকে টের পেতে দিল না রূপা।

 

তিনটা’র দিকে যখন ভিড় হ্রাস পেল তখন হীরা আর দুলাল এসে প্রবেশ করে হোটেলে। তারা এমনভাবে এসে বেঞ্চিতে বসে যেন এলাকার চেয়ারম্যান এসেছে। বারেক মিয়া রূপাকে ইশারা দিলেন, যা-ই হয়ে যাক এদের সাথে যেন সে তর্কে না যায়।

 

রূপা টেবিল পরিষ্কার করছিলো। বারেকের ইশারাকে সম্মান করে অন্যদিকে সরে যায়। এরা দুজন গত তিনদিন ধরে প্রতিদিন দুই বেলা এসে খেয়ে যাচ্ছে। টাকা দেয়ার কথা বারেক মিয়া তো বলেনই না রূপাকেও বলতে মানা করেছেন। 

 

হীরা আয়েশি ভঙ্গিতে বসে রূপাকে ডাকলো, ‘ও চাপিলা মাছ, আজ কী রান্না হলো?’

 

রূপা ফিরেও তাকালো না। সে জগে পানি ভরছে৷ সুজন বললো, ‘মাছ, গোস্ত, ভত্তা, ডাইল সব আছে। কী খাইবেন কন?’ 

 

হীরা সুজনকে কাছে টেনে এনে প্যান্টের চেইন খুলে দিয়ে বললো, ‘গরুর মাংস আছে?’ 

 

সুজন চোখমুখ বেজার করে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। প্যান্টের চেইন লাগিয়ে বললো, ‘হ আছে।’ 

 

হীরা ঘার ঘুরিয়ে দুলালকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুই কী খাবি?’

 

দুলাল মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘গরুই।’

 

বারেক সুজনকে নিয়ে খাবার বাড়তে হেঁশেলে গেলেন। বাটিতে গরুর মাংস পরিবেশন করে সুজনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘সাবধানে নিয়ে যা।’

 

সুজন দরজার কাছে এসে সবার অগোচরে এক দলা থুথু ফেললো বাটিতে। এরপর আঙুল দিয়ে মিশিয়ে হীরা আর দুলালের সামনে নিয়ে রাখলো।

 

রূপা গিয়ে বসে ক্যাশ কাউন্টারে। হীরা এক লোকমা খেয়ে রূপার দিকে তাকায়। রূপা তাকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছে। সবসময়ই এমন করে। দুলাল খেতে খেতে বললো, ‘ভাই এইডা মাইয়া নাকি পাত্তর? ডেইলি কত কথা কন, কিছুতেই ভাঙে না, মচকায়ও না।’

 

হীরা এক ঢোক পানি খেয়ে বললো, ‘এরে দেখলেই মন চায় গলায় ঝুলিয়ে ঢোল বাজাই।’

 

দুলাল, হীরা একসঙ্গে হেসে ওঠলো। দুলাল বললো, ‘তয় ভাই, এর লগে এক রাইত থাকার অনেক শখ। এমন বাঘিনী মাইয়া আমি দুইটা দেখি নাই।’

 

‘হবে…হবে। সবুর কর, সুযোগ পেলেই শখ মিটে যাবে।’

 

হীরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে বারেক মিয়াকে বললো, ‘কাকা, বড় মেয়ের বিয়ে দিবেন কবে?’

 

তার উদ্দেশ্য কথা দিয়ে রূপাকে উত্তেজিত করে দেয়া। সে দেখতে চায় কতক্ষণ…কতদিন এই মেয়ে চুপ থাকে। 

 

বারেক বললেন, ‘আরো কয়টা বছর যাক।’

 

‘এখনই তো শরীরের কোনো ঠিক নাই। তক্তার মতো দেখতে। কয়েক বছর পর তো বুড়ি হয়ে যাবে। আপনার কাকা জলদি মেয়ের বিয়ে দেয়া উচিত। রিক্সাওয়ালা, ল্যাংড়া, কানা যা পান তুলে দেন।’

 

বারেক শূন্য চোখে রূপার দিকে তাকালেন। রূপা আড়চোখে নিজের পিতাকে দেখে। মানুষটার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে কী আছে? অসহায়ত্ব? নাকি অনুরোধ? লোকে তাকে যত যা-ই বলুক এই মানুষটা কখনো প্রতিবাদ করে না, হয়তো কখনো করবেও না। তার কাছে হোটেল রক্ষা করাটাই বড়। 

 

বারেক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন, ‘ভাগ্যে যখন আছে তখন এমনি হয়ে যাবে।’

 

‘হয়ে যাবে এটা কেমন কথা? দেখেন কাকা, আপনার মেয়ে তো দেখতে শুনতেও ভালো না। মেয়ের মতোও না, ছেলের মতোও না। মোটা একটা জিন্স, মোটা একটা শার্ট পরে ঘুরঘুর করে। এরকম মেয়ের বিয়ে দিতে দেরি করা মানে অনেক বড় বোকামি। আপনি আমাদের যত্ন করে খাওয়ান আমাদের একটা কৃতজ্ঞতা আছে না? আপনি বললে আমি আপনার মেয়ের জন্য উপযুক্ত ছেলে খুঁজে দেবো। কী বলেন?’

 

বারেক প্রত্যুত্তরে বলার মতো কথা খুঁজে পেলেন না। রূপাকে অভিমানে অন্যদিকে ফিরে থাকতে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট করছে৷ 

 

হীরা বাপ-মেয়ে দুজনকেই চুপ থাকতে দেখে অধৈর্য হয়ে পড়ে। সে এবার আরো গভীরে চলে আসে, ‘তাছাড়া রূপার শরীরে তো কিছুই নাই। সামনে-পেছনে সব সমান। খালি হাড্ডি। এমন মেয়েরে কি আপনি বিয়ে করতেন? মজা পাইতেন? আপনার মেয়ের তো কোনো সাইজই নাই। এখন তবুও বয়স কম বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। বয়স বাড়লে কিন্তু আর চালানো যাবে না।’

 

রূপার শরীরে যেন বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ে। কান্নারা একযোগ হয়ে আটকে পড়ে গলায়। কেউ কীভাবে কোনো জন্মদাতাকে তার মেয়ে নিয়ে এমন কথা বলতে পারে? আর সেই জন্মদাতাকেও দেখো, কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! তার এক চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে দ্রুত সেই জল মুছে ঢকঢক করে পানি  খেল।

 

এতো বড় কথা বলার পরও যখন বারেক মিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না দুলাল হীরাকে গুঁতো দিয়ে ইঙ্গিত করে সেই কথাটা বলতে। হীরা খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করলো। সরু চোখে চারপাশ দেখে বললো, ‘কাকা মেয়েটারে একবার আমার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েন। দুলালের যদি ভালো লাগে পরদিনই বিয়ের ব্যবস্থা করে…’

 

থাপ্পড়ের শব্দ শুনে চমকে ওঠে রূপা। বারেক মিয়া হীরাকে থাপ্পড় মেরেছেন! হীরা ডান গালে এক হাত রেখে রক্তবর্ণ চোখে তাকায়। বাইরে থেকে কয়েকজন মানুষ দৃশ্যটি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে।

 

আকস্মিক ঘটনায় দুলাল হতভম্ব হয়ে গেল। হীরা ক্রোধে – আক্রোশে ‘শু’য়োরের বাচ্চা’ বলে এক হাতে বারেক মিয়ার বুকের পাঞ্জাবি খামচে ধরে, অন্য হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ছু’রি  বের করলো। রূপা দ্রুত ক্যাশ কাউন্টারের উপর দিয়ে লাফিয়ে নেমে আসে। হীরা ছু’রি ব্যবহার করার পূর্বে রূপা তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। হীরা ধাক্কা সামলাতে না পেরে দুটো বেঞ্চি নিয়ে মেঝেতে উল্টে পড়ে। বেঞ্চি পড়ার বিকট শব্দ শুনে হোটেলের সামনে মানুষের ভিড় জমে যায়।

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৯.

ফাইয়াজ কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে রাস্তায় মানুষজনের ভিড় দেখে একপাশে বাইক থামালো। তার মাথায় হেলমেট। হেলমেট পরা অবস্থায় সে ভিড় ঠেলে ‘সুমনা হোটেলের’ সামনে এসে দাঁড়ায়। হীরা তখন হিংস্র রূপ ধারণ করেছে। সে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ছু’রি নিয়ে তেড়ে আসে রূপার দিকে। রূপা বারেক মিয়াকে সরিয়ে দুটো জগ তুলে নিলো হাতে। হীরা কাছে আসতেই জগ দিয়ে তার রেগে থাকা বিকৃত মুখ বরাবর আঘাত করে৷ ঠিক তখনই হীরার ছু’রিটি রূপার কাঁধে সৃষ্টি করে গভীর ক্ষত।

 

সঙ্গে সঙ্গে র’ক্তের স্রোত নামে। রূপা ব্যথায় আর্তনাদ করে দুই কদম পিছিয়ে গেল। চোখের পলকে দূর্ঘটনাটি ঘটে যায়, ফাইয়াজ প্রথমে বুঝে উঠতেই পারে না এখানে ঠিক কি হচ্ছে!

 

রূপার দেয়া আঘাতে হীরার নাক ফেটে র’ক্ত বেরিয়ে আসে। সে অনামিকা আঙুলে নাক ছুঁয়ে র’ক্তের স্পর্শ অনুভব করে। নিজ নাকের রক্তে রাঙা আঙুল দেখে হয়ে ওঠে আরো ক্ষুব্ধ। 

পুনরায় বিশ্রী গালিগালাজ করে ছু’রি নিয়ে তেড়ে এলে ফাইয়াজ দ্রুত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

 

সাবধানতার সঙ্গে হীরার দুই হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে বললো, ‘দিনদুপুরে হাতে ছু’রি নিয়ে কীভাবে কাউকে আঘাত করতে পারো তুমি? হাত নামাও।’ 

 

হীরার চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে। সে কিড়মিড় করে বললো, ‘শু’য়োরের বাচ্চা সর এখান থেকে।’

 

গালি শুনে ফাইয়াজের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল।

র’ক্তে শুরু হলো তীব্র মিছিল। সে নোংরা গালিগালাজ ঘৃণা করে। ফাইয়াজ কৌশলে হীরার হাত মুচড়ে ধরে ছু’রি ছিনিয়ে নিলো, ছুঁড়ে মারলো দূরে। 

 

হীরা হাতাহাতি করে নিজেকে ছাড়িয়ে ফাইয়াজের শার্টের কলার ধরতে এলে ফাইয়াজ শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে তার গালে থাপ্পড় মারলো। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বললো, ‘ ইডিয়ট!’

 

দুলাল নিজের বিস্ময়তা কাটিয়ে উঠতে পারছে না! বিস্ময়ের সাথে এবার মনে জেঁকে বসে ভীতি। এসব কি হচ্ছে? এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। সে পিছাতে পিছাতে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেল।

 

হীরা কিছুতেই থেমে যাওয়ার ছেলে নয়। সে তার হৃদয়ে অনুভব করছে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। বিধ্বস্ত হীরা দুই হাতে বেঞ্চি তুলে নেয় ফাইয়াজের উপর ছুঁড়ে মারার জন্য। ডাঙায় উঠা মাছের মতো ছটফট করছে সে। বারেক মিয়া এবার এগিয়ে এলেন। ফাইয়াজ ও বারেক দুজন একসাথে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। 

 

বাজার কমিটির চারজন সদস্য এসে প্রবেশ করে হোটেলে। দুজন দ্রুত হীরাকে চেপে ধরে। টেনে নিয়ে যায় বাইরে। পিছু পিছু দৌড়ে বেরিয়ে যায় দুলাল। হীরা শেকল পরা শেয়ালের মতো ছটফট করছে। বার বার বলছে , ‘দেখে নেব, সব কয়টাকে দেখে নেবো। পুঁতে দেবো মাটির সাথে। শু’য়োরের বাচ্চারা।’

 

বাকি দুজন সদস্যের মধ্যে একজনের নাম কামরান। তিনি বারেক মিয়াকে বললেন, ‘কী হইছে এখানে? এতো কিসের ঝামেলা হা?’

তার কর্কশ কণ্ঠ। যেন দোষ বারেক মিয়ার। 

 

বারেক কিছু বলার আগে ফাইয়াজ বললো, ‘দিনদুপুরে একটা অসভ্য ছেলে ছুরি নিয়ে হাঙ্গামা করছিল আর আপনারা তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে ধমক দিয়ে ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন করছেন?’ 

 

কামরান ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। গম্ভীর সুরে বললেন, ‘কে আপনি?’

 

‘দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক।’

 

ফাইয়াজের দৃঢ়তা ও চোখমুখের ভঙ্গি দেখে কামরান আর কথা বাড়ালেন না। এ ধরনের লোকেরা নীতির কথা বলে বেশি! তিনি বারেক মিয়াকে বললেন, ‘সন্ধ্যায় বৈঠকখানায় আসবেন স্বাক্ষীসহ।’

 

রূপা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার  এক হাত আহত স্থানে চেপে ধরা। রক্তপাত কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। বৈঠকখানায় যেতে হবে শুনে রূপা ভড়কে যায়, সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বাজার কমিটির সদস্যদের সাথে হীরার ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মতো। এরা বাজারের দায়িত্বে থাকলেও সবকটা স্বার্থপর। ন্যায়বিচারের থেকে ক্ষমতাকে বেশি মূল্যায়ন করে। অসহায়দের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। 

 

এখন যদি চক্রান্ত করে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়! তখন এতো বড় সংসার কীভাবে চলবে?

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকায় রূপা কুঁকড়ে ওঠে। ছলছল নয়নে বারেক মিয়ার দিকে চেয়ে থাকে। এই ভয়েই বারেক মিয়া কখনো প্রতিবাদ করেননি। নিশ্চয়ই এখন তিনি কামরান নামক মানুষটির হাতেপায়ে ধরবেন অথবা দরজা বন্ধ করে কাঁদবেন! মানুষটা তো এমনই। 

 

কিন্তু রূপাকে অবাক করে দিয়ে বারেক জোর গলায় বললেন, ‘স্বাক্ষী প্রমাণসহ সন্ধ্যায় চলে আসবো। বেজন্মাটাকেও বলবেন যেন স্বাক্ষীসহ উপস্থিত থাকে।’

 

কামরান আশ্চর্য হয়ে গেলেন। গম্ভীরমুখে একবার ফাইয়াজ আরেকবার বারেককে দেখলেন। এই লোকটার উপস্থিতি কি বারেকের এতো সাহসের কারণ? নয়তো বারেক তো কখনো গলা উঁচিয়ে কথা বলে না! তিনি প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে নিজ সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে যান। হীরার চিৎকার তখনো ভেসে আসছে। পাগলা কুকুরের মতো চেঁচাচ্ছে সে!

 

ফাইয়াজ শার্টের কলার ঠিক করে পিছনে ঘুরে তাকালো। রূপাকে একনজর দেখে বারেক মিয়াকে বললো, ‘মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। দ্রুত জায়গাটা পরিষ্কার করতে হবে। রক্তপাত হচ্ছে।’

 

কথা শেষ করেই বেরিয়ে পড়ে। ক্ষুধায় পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। 

 

বারেক গলার গামছা রূপার কাঁধে চেপে ধরে বললেন, ‘তোর রঞ্জন মামার দোকানে চলে যা। আমি জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে আসতেছি। যা।’

_

র’ক্ত শার্ট বেয়ে প্যান্ট অবধি চলে এসেছে। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো চিৎকার করে কাঁদতো অথবা এতো র’ক্ত দেখে বেহুশ হয়ে যেত। রূপা দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করছে। সে ধীরে ধীরে রঞ্জন দত্তের ফার্মেসীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ফাইয়াজ বাইক নিয়ে বাড়ির দিকে চলেই যাচ্ছিলো। রূপাকে এই তীব্র রোদের মাঝে আহত অবস্থায় একা হেঁটে যেতে দেখে বাইক ঘুরিয়ে নিলো। রূপা ফার্মেসী অবধি পৌঁছাতেই ফাইয়াজও পৌঁছে গেল। দুজনের চোখাচোখি হলেও কেউ কোনো কথা বললো না। ফাইয়াজ বাইকেই বসে রইলো। 

 

রঞ্জন বই পড়ছিলেন। রূপাকে দেখে চট করে উঠে দাঁড়ান। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, ‘ কাঁধে কী হলোরে মা ? এতো রক্ত বেরোচ্ছে! এদিকে আয়।’

 

ফাইয়াজ পেছন থেকে বললো, ‘গুন্ডাপুন্ডাদের সাথে মারামারি করেছে। একটু ভালো করে দেখুন, ক্ষত হয়তো গভীর।’

 

রঞ্জন রূপাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে বসালেন। রূপার পরনের শার্টের বোতাম গলা অবধি লাগানো। সবসময় এভাবেই পরে। যতই গরম পড়ুক গলা অবধি বোতাম লাগিয়ে রাখবেই। 

 

রঞ্জন ক্ষত পরিষ্কারের সরঞ্জাম নিয়ে শার্টের প্রথম বোতামটি খুলতে চাইলে রূপা আটকায়। 

সে বোতাম খুলতে সংকোচবোধ করছে। 

 

ফাইয়াজ হেলমেট খুলে চুলগুলো হাতে নাড়াচাড়া করে নিলো। চুল ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। বার বার বলার পরও যখন রূপা শার্টের প্রথম বোতামগুলো খুলছিল না তখন ফাইয়াজ বললো, ‘চিকিৎসায় এতো লজ্জা কীসের? আর দুই তিনটে বোতামই তো। এইতো আমারও খোলা। এতে আমার কি সর্বনাশটা হয়ে গেল?’

 

রূপা চোখ তুলে তাকায়। মনে মনে বুলি আওড়ায়,  ‘আরে ব্যাঠা তুই সামনে থেকে চলে গেলেই তো আমি বোতাম খুলি। সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলছে?’ 

 

মুখে বললো, ‘লজ্জা না স্যার। অভ্যাস নেই তাই অস্বস্তি হচ্ছে।’ 

 

ফাইয়াজ বললো, ‘আংকেল এক কাজ করুন, শার্টের ওই অংশটা কেটে ফেলুন।’

 

রূপার মাথা ভনভন করছে। চোখ দুটি বার বার বুজে আসছে৷ 

ফাইয়াজের কথামতো রঞ্জন কেঁচি দিয়ে ক্ষত স্থান থেকে শার্টের একাংশ কেটে ফেলেন। এরপর ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘ক্ষত তো খুব গভীর! সেলাই লাগবে মনে হচ্ছে।’

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

১০.

নিজের হাতজোড়া ঘাড়ের কাছে ঠেকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন সুমনা। বারেক মিয়া চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি তেড়ে এসে বললেন, ‘তুমি থাকতে হোটেলে ভেজাল লাগে কী করে? এখন বিচার বসবে, লোকে জরিমানা চাইবে হয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে তখন এই এতগুলো বাচ্চার মুখে কী দেবে? এইটা একবারও মনে আসেনি?’

 

রিনি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো। উঁকি দিয়ে বাবা-মা’কে দেখছে। বারেক সুমনাকে অগ্রাহ্য করে রিনিকে বললেন, ‘তোর আপা কি উপরে?’

 

রিনি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক বুঝালো। বারেক দ্বিতীয় তলায় যেতে চাইলে সুমনা পথরোধ করে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ঝামেলাটা যদি না হতো মেয়ের কাঁধ সেলাই করতে এতগুলো টাকা গচ্ছা যেত না। তোমার কি বিবেকবুদ্ধি নাই? তুমি একজন ব্যবসায়ী হয়ে কী করে সন্ত্রাসদের সাথে তর্কে যাও?’

 

বারেক শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘ওরা তোমার মেয়েকে নিয়ে কেমন নোংরা কথা বলেছে জানো তুমি?’ 

 

‘কী করেছে? হা? কী করেছে? না হয় কয়টা কথাই বলেছে। কথাতে কী এসে যায়? মেয়ে হলে তো কত কথাই শুনতে হয়। আমরা কি শুনিনি?’

 

বারেক সুমনার সাথে তর্ক করার মতো সাহসী নন। এটা ভয় নয়, অন্ধ প্রেম। যেদিন সুমনা তাকে পাওয়ার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে অজানা শহরে পাড়ি জমিয়েছিল সেদিন থেকে সুমনা যা বলেন তাই জীবনের লক্ষ্য ধরে নেন। 

 

তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘মেয়েটা আহত  সেই খেয়াল নেই, কত টাকা খরচা গেল সেই চিন্তা তোমার! তোমারই তো রক্ত সুমনা…তোমার জোয়ানকালের চুলগুলো রুমি, রিনি পায়নি, রূপাই কিন্তু পেয়েছে। দেখেও কি মায়া হয় না?’ 

 

সুমনা তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারলো না। অল্প সময় চুপ থেকে বললো, ‘মায়া…মায়া হবে না কেন? মেয়ে তো পালছি, পেলে বড় করছি। কয়দিন পর বিশে পা দিবে৷ এতো বড় কি মায়া ছাড়া হইছে?’ 

 

বারেক বুঝতে পারেন, সুমনাকে কিছু বলে লাভ নেই। সে যা ভাবতে চায়, বলতে চায় তাই ভাববে, বলবে। কারো কথায় পরিবর্তন হওয়ার মানুষ সে নয়। তিনি চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গেলেন। রূপা শুয়ে ছিল, বারেককে দেখে উঠে বসলো। বললো, ‘আব্বা, আমার ফোনটা হোটেলে….’

 

বারেক শার্টের পকেট থেকে ফোন বের করে বললেন, ‘ক্যাশ কাউন্টারে ছিলো। অরুনিকার কল আসছিলো, সুজন ধরছে।’

 

আজ অরুনিকার ফেরার কথা ছিলো। রূপা ফোন নিয়ে দ্রুত কল লিস্টে যায়। শেষ কল অরুনিকার। তিন মিনিটের মতো কথা হয়েছে! নিশ্চয়ই সুজন সব বলে দিয়েছে। ফোনে চার্জ ১%। এখুনি বন্ধ হয়ে যাবে। রূপা এক হাতে ফোন চার্জে লাগিয়ে বললো, ‘দোকানের জিনিসপত্র সব গুছাইছেন আব্বা?’

বারেক বিছানার এক কোণে বসে সরল গলায় বললেন, ‘গুছিয়েই আসছি। তুই ঔষধ খেয়েছিস?’

 

‘হুম। হোটেল কি বন্ধ করে দিছেন?’ 

 

বারেক বিপন্ন গলায় বললেন, ‘এখন বন্ধ। সন্ধ্যার পর দেখি কি হয়।’

 

‘ওই ছেলে কি আর আসছিলো? ‘

 

‘না, আসে নাই।’

 

বাবা-মেয়ের মাঝে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। ভাষার ভান্ডারে যেন বলার মতো কিছুই নেই। 

রূপা জানালার বাইরে তাকাতেই বারেক রূপার দিকে তাকালেন। রূপার লম্বা চুলগুলো কাঁধের এক পাশে রাখা। চুলের অবস্থা করুণ। আগা লাল, রুক্ষ। বারেক বললেন, ‘মাথায় একটু তেল দিতি।’ 

 

রূপা তাকিয়ে হাসলো। বললো, ‘তেল দিতে ভালো লাগে না। কেমন ভার ভার লাগে।’

 

‘দিয়ে অভ্যাস করলে ভালো লাগবে।’ 

 

রূপা মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা দেব।’ 

 

‘আমি যাই, গোসল করতে হবে। তুই একটু ঘুমিয়ে নে।’

 

বারেক চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রূপা বাইরে বেরিয়ে এলো। ঘন্টাখানেক শুয়ে-বসে থেকেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে। কতদিন বাসায় থাকতে হয় কে জানে! 

 

দ্বিতীয় তলার ফাঁকা অংশজুড়ে হাঁটতে থাকে রূপা। তার পরনে ট্রাউজার ও ফতুয়া। তখন সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। আকাশে কমলা রঙের ছোঁয়া। সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে এসেছে। 

 

রূপা হাঁটতে হাঁটতে রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়ালো। পাশের বিল্ডিংটি এক তলার। দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে দূরত্ব বড়জোর দুই হাতের। চিলেকোঠার জানালা খোলা। হুট করে ফাইয়াজ চলে আসে। রূপা অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। ফাইয়াজ প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়ালো। বললো, ‘ একটু আরাম বোধ হচ্ছে?’ 

 

রূপা চোখ নত করে বিনয়ের সঙ্গে বললো, ‘আগের চেয়ে ভালো। ধন্যবাদ স্যার।’ 

 

‘ধন্যবাদ কেন?’

 

‘দুপুরে আপনি না আসলে আরো খারাপ কিছু হতে পারতো।’

 

ফাইয়াজ মৃদু হাসলো। তারপর বললো, ‘আচ্ছা ওইযে লোকটা কি জানি বৈঠকখানা বলছিল, কখন যেতে হবে?’

 

রূপা অবাক হয়ে তাকায়৷ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আপনিও যাবেন?’

 

‘যাবো না? আমিও তো জড়িত।’

 

কথাটি শুনে রূপা মনে মনে সাহস পায়, শক্তি পায়। হোটেল হারানোর আতঙ্কটা মুহূর্তে উবে  যায়। ফাইয়াজ গেলে নিশ্চয়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে৷ তার পাশে কেউ একজন তো থাকবে! 

 

রূপা প্রফুল্লচিত্তে বললো, ‘সন্ধ্যার পর বললেও আটটা বেজে যাবে৷’

 

‘তাহলে সাতটা ত্রিশে বের হলেই হচ্ছে?’

 

‘জি।’

 

ফাইয়াজ সৌজন্যমূলক হেসে চলে গেল। 

 

রূপা নিজের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে! যেন সিঁড়ি ভেঙে কেউ ছুটে আসছে। এতো জোরে কে ছুটছে? রূপা উৎসুকভাবে তাকিয়ে রইলো।

 

অরুনিকা! তার চোখমুখে উৎকণ্ঠা। বেণী থেকে কিছু চুল ছুটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চোখেমুখে।  রূপা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। অরুনিকা রূপার কাছে এসে ‘দোস্ত’ বলে জড়িয়ে ধরে। 

 

তার বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। রূপা অরুনিকার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো, ‘ইশ! এমন পাগলা ঘোড়ার মতো কেউ ছুটে!’

 

অরুনিকা মুখ তুলে তাকালো। তার চোখ দুটো ভীষণভাবে আহত! কে জানে সুজন কী বলেছে! সুজনের আবার বাড়িয়ে বলার স্বভাব। রূপা বললো, ‘আরে মাত্র তিনটে সেলাই লাগছে। এখন ঠিক আছি আমি। সুজন তোরে কি বলছে?’ 

 

অরুনিকা কিচ্ছুটি বললো না। সে রূপার কাঁধ থেকে ফতুয়া সরিয়ে ক্ষত কতটুকু দেখার চেষ্টা করে। রূপা আহ করে উঠতেই দ্রুত ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘কার সাথে লাগছিলি তুই? কোন বাপের ব্যাঠার এতো সাহস?’

 

রূপা রসিকতা করে বললো, ‘হায় হায় বাপের নামটা তো জানা হয়নি।’ 

 

‘মজা করবি না একদম। তিনটা সেলাই লেগে গেছে, কি সিরিয়াস ব্যাপার! তুই কি করছিলি? তোর হোটেলে কি ব’টি ছিল না? কো’প দিয়ে মাথাটা আলাদা করে দিতি বে’জন্মাটার। তা না করে মার খেয়ে এলি!’

 

‘ওরে আমার মাস্তান রে। তোর কথা শুনলেই তো স’ন্ত্রাস-পন্ত্রাস দৌড়ে পালাবে।’ 

 

অরুনিকা রাগী চোখে তাকায়। বললো, ‘তোর মুখ দিয়ে যে কেমনে হাসি বের হচ্ছে! সুজন যখন বললো, তোর কাঁধ কে’টে ফেলছে…’

 

অরুনিকার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। রূপা দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘ওরে খালি আবার সামনে পাই!’ 

 

তারপর কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বললো, ‘মাত্র তিনটে সেলাই লাগছে। ছোট ক্ষত। সুজনের কথা কখনো বিশ্বাস করবি না। ও বানিয়ে কথা বলে।’

 

অরুনিকা ফের রূপাকে জড়িয়ে ধরলো। রূপা অরুনিকাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে অনুভব করলো বাম হাত ব্যথায় অবশ হয়ে আছে৷ বাম কাঁধে ক্ষত হওয়াতে বাম হাতটা তোলা যাচ্ছে না। 

 

সে এক হাত দ্বারা অরুনিকার পিঠ জড়িয়ে ধরে বললো, ‘এখন সব শেষ। খারাপ সময় ভুলে যাওয়াই ভালো। আয় বসে সূর্যাস্ত দেখি।’

 

দুটো চেয়ার পাশাপাশি রেখে অরুনিকা বললো, ‘যা ই বলিস রূপা, কেউ তোকে এতো বড় আ’ঘাত দিয়ে আমার মুখোমুখি হবে না ব্যাপারটা আমার হজম হচ্ছে না। তুই ওদের ঠিকানা জানিস?’ 

 

‘কি করবি? গিয়ে পি’টাবি?’ 

 

‘দরকার পড়লে তাই করবো। পি’টিয়ে চামড়া তুলে বাথরুমের পাপস বানিয়ে রাখবো।’ 

 

রূপা সশব্দে হেসে ওঠলো। বললো, ‘আরে এসব বখাটে ছেলেপেলের কী ঠিকানা আছে? কই থেকে আসছে আল্লাহ জানে। হুট করে এসে হাঙ্গামা শুরু করে দিলো।’

 

রূপা হীরার ঠিকানা জানা সত্ত্বেও লুকিয়ে গেল। বললে অরুনিকা ঠিক চলে যাবে। বিপদ ঘটিয়ে তবেই থামবে৷ কি দরকার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ঝুঁকি নেয়ার। 

 

সূর্যাস্তের কমলা রঙ ছড়িয়ে পড়েছে ধরণীতে। সৃষ্টি করেছে এক মায়াবী জগৎ। অপরূপ সৌন্দর্য ! রূপা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোর সাথে সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে ছিল। পূরণ হয়ে গেল।’ 

 

রূপার কথা শুনে অরুনিকার মন গলে। সে আকাশের দিকে তাকায়। ইতিমধ্যে কমলা রঙ তাদের মুখশ্রী ছুঁয়েছে। অরুনিকা বিভ্রম নিয়ে বললো, ‘আমার খুব ইচ্ছে তোর সাথে সূর্যোদয় দেখার।’

 

রূপা তাকালো। আক্ষেপের সুরে বললো, ‘আমরা আজও একসাথে থাকিনি!’ 

 

অরুনিকা চেয়ার নিয়ে রূপার পাশ ঘেঁষে বসে। তার ডান বাহু দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ একদিন থাকবো। রাত জেগে মুভি দেখবো, চাঁদ দেখবো। তোকে শাড়ি পরাবো, আমি শাড়ি পরবো। অনেক ছবি তুলবো। সূর্যোদয় দেখে এরপর ঘুমাবো। আর এই সবটাই হবে কাশ্মীরে।’ 

 

‘তাই যেন হয়।’

 

‘তাই হবে রূপা।’

 

পশ্চিমাকাশে অল্প অল্প করে ডুবে যাচ্ছে গোধূলির আবিরে রাঙা অস্তয়মান লাল সূর্য।  প্রকৃতিতে নেমে আসছে রহস্যময় অন্ধকার। দুই সখি পাশাপাশি বসে বিভোর হয়ে চেয়ে আছে।  বন্ধুত্বের ঊর্মিছন্দায় ভেসে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।

 

_

হীরা একটার পর একটা সিগারেট টানছে। সদ্য কেনা জিনিসপত্র ভাংচুর করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে ঘরে। রাগে তার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। 

তিনটে মানুষ তাকে এভাবে আঘাত করলো! হীরা সামনে থাকা জগটি লাথি দিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলে।

 

তার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে দুলাল। জগ দেয়ালে বারি খেতেই বিকট শব্দ হয়৷ সেই শব্দে কেঁপে উঠে সে। দুলাল যতবার হীরার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে ততবার থাপ্পড় খেয়েছে। এখন আর কথা বলার দুঃসাহস নেই।

ঘর থেকে বেরোবারও সাহস নেই। এদিকে ক্ষুধায় পেটের ভেতর গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না!

 

হীরা প্যাকেটের শেষ সিগারেটটিতে আগুন ধরাতে ধরাতে বললো, ‘ওই খান** ঝি আর ওর বাপরে যদি আমার পা না চাটাই আমি এক বাপের পুত না!’ 

 

দুলাল একটু দূরে সরে বললো, ‘আর ওই চশমাওয়ালা বেঠা?’

 

হীরার চোখদুটো জ্বলে ওঠে। সে কিড়মিড় করে বললো, ‘ওর সব খবর এনে আমারে দিবি। কু’ত্তার বাচ্চারে আমি জ’বাই দেব।’

 

দুলাল মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘জি ভাই।’

 

কলিং বেল বাজছে। দুপুরের ঘটনার পর অনেকে এসেছে স্বান্তনা দিতে বা উসকে দিতে৷ বার বার এ ও আসায় হীরা ভীষণ বিরক্ত৷ কলিং বেলের শব্দ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। দরজার ওপাশে যেই থাকুক তাকে যা ইচ্ছে তাই বলে দেয়ার উদ্দেশ্যে হীরা দরজা খুলতে এলো। 

 

দরজা খুলে সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। হাতের সিগারেট দ্রুত লুকিয়ে ফেললো।

 

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা হামিদুর রহমান। যার উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত! হীরা নত হয়ে হামিদুরের পা ধরে সালাম করলো। হামিদুর তীক্ষ্ণ চোখে হীরার আপাদমস্তক দেখে বললেন, ‘তোমার নাক, কপাল ফুলে আছে কেন?’

 

হীরা নিশ্চুপ। দুলাল দৌড়ে এসে হামিদুর রহমানকে সালাম করলো। হামিদুর দুলালকে এড়িয়ে হীরাকে বললেন, ‘শুনলাম মাস্তানি করে বাপের সম্মান বাড়াচ্ছো! সত্যি নাকি?’

 

এবারও হীরা উত্তর দিলো না। হামিদুর রুমের ভেতরটা এক নজর দেখে বললেন, ‘ব্যাগ গুছাও। আগামী সপ্তাহে তোমার বিয়ে।’

 

হীরা বিনাবাক্যে দ্রুত ব্যাগ গুছাতে শুরু করে।

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

১১.

মনের মতো অবাধ্য, বেপরোয়া আর দুটো নেই। এতো করে বুঝানো হলো, তবুও কথা শুনলো না। ঠিক ফুসলিয়ে আবার বাজারে নিয়ে এলো! অরুনিকা নিকাবে নিজের মুখশ্রী ভালো করে ঢেকে নিলো। 

 

নতুন বোরকা পরেছে যেন রূপা চিনতে না পারে। 

তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, সেই মানুষটিকে দেখার! এখনো বুকের অভ্যন্তরে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হয়, অস্থিরতা হয়। এই অনুভূতিকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। উপেক্ষা করতে গেলেই হাঁসফাঁস লাগে।

গত তিন মাসে অগণিত বার মানুষটির খুঁজে বাজারে এসেছে। চতুর্পাশে চোখ বুলিয়েও, পুরো বাজার তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার সাক্ষাৎ মিলল না।

 

প্রতিবারই রূপার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছে।শেষবার রূপা হুমকি দিয়ে বললো, ‘আরেকবার ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা যদি করিস, একেবারে কথা বলা বন্ধ করে দেব।’

 

অরুনিকা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে না আসার, পারলো না! মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সে। যত চেপে ধরে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তত বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ কেমন যন্ত্রণা? 

 

সে ভাবে, ‘একটা মেয়ে মানুষ কী করে এক দেখায় কাউকে এতোটা পছন্দ করতে পারে? আচ্ছা সে মানুষটার কি আমাকে ভালো লাগেনি? ভালো লাগলে নিশ্চয়ই আমায় খুঁজতো।’

 

অভিমানে অরুনিকার হাঁটার গতি শ্লথ হয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এবারই শেষ। আজ যদি দেখা না পায় আর কখনো মানুষটাকে খুঁজবে না। দরকার পড়লে ঘুমের ট্যাবলেট খাবে। খেয়ে দিনভর ঘুমাবে।

 

ক্যারাম খেলার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই পেছন থেকে কেউ একজন হাত টেনে ধরলো। অরুনিকা চমকে ওঠে। অস্পষ্ট করে উচ্চারণ করলো, ‘রূপা!’

 

রূপা অরুনিকাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। অরুনিকা শুরুতে ভয় পেয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলো। মুখ গোমড়া করে বললো, ‘তোর কাছে কি জাদুর প্রদীপ আছে? বাজারে এলেই টের পেয়ে যাস। ধুর!’

 

রূপা না তাকিয়ে কঠিন সুরে বললো, ‘মুখটা বন্ধ রাখ।’

 

রূপা শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে। পথচারী, দোকানদাররা উৎসুক হয়ে তাদের দেখছে। অরুনিকা যতই নতুন বোরকা পরুক, গত তিন মাসে এতোবার বাজারে এসেছে, দোকানদাররা তার হাঁটা দেখলেই চিনে যায় মানুষটা আসলে কে!

 

অরুনিকা উৎসুক জনতার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। চিনে ফেললো নাকি? 

 

রূপা অরুনিকাকে হেঁশেলে এনে ছেড়ে দিলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, ‘তুই কি ধরেই নিয়েছিস আমার কথা শুনবি না? আমার কথার দাম নাই?’

 

অরুনিকা নিকাব তুলে চেয়ারে বসলো। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। সুজন এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। অরুনিকা গ্লাস হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। সন্দেহ নিয়ে বললো, ‘এতে কি থুথু আছে?’ 

 

সুজন তাৎক্ষণিক জিভ কাটে। মাথা ছুঁয়ে বললো, ‘আল্লাহর কিরা, নাই। তুমি হইলা আমগো রূপাবুর নায়িকা, তোমার পানিতে ছেপ দিমু? জীবনেও না। মায়ের কিরা, বাপের কিরা,  দেই নাই। যদি পারতাম জমজম কোয়ার পানি আইনা পত্তিদিন খাওয়াইতাম তোমারে।’

 

রূপা চেঁচিয়ে ওঠলো, ‘সুজন যা এখান থেকে।’

 

আচমকা চিৎকার শুনে অরুনিকার হাত কেঁপে ওঠে। পানি ছিটকে পড়ে বোরকার উপর। সে দ্রুত চেপে বসলো। পানি খেলো না। রূপার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার পর বাজার বৈঠকখানায় বখাটে ছেলেটি আসেনি। সে নাকি একেবারে চলে গিয়েছে। তাই আর বিচার সভাও হয়নি। তখন সুজন জানালো, তার কুকীর্তির কথা! 

এরপর থেকেই সে হোটেলে এলে সুজনের হাতে কিছু খায় না। রূপা দিলে তবেই খায়। 

 

সুজন চলে গেল।

 

অরুনিকাকে চুপচাপ দেখে রূপা পূর্বের সুরেই বললো, ‘মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন? বল, আমার দাম নাই? কমে গেছে?’

 

অরুনিকা অপরাধী সুরে বললো, ‘সরি।’

 

‘সরিটরি শুনতে চাই না। তুই বল কবে ওখানে যাওয়া বন্ধ করবি?’

 

‘আমিতো চেষ্টা করি। পারি না।’

 

‘এই শোন, তোর আর বাজারেই আসতে হবে না।’

 

অরুনিকা অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো। ভেজা কণ্ঠে বললো, ‘তোর হোটেলে আসবো না আমি? কোচিং, বাসা আর এই হোটেল ছাড়া আমার আর যাওয়ার জায়গা আছে? আমারতো আর কোনো বন্ধু নেই। একা লাগলে তোর কাছে চলে আসি। তোর এটা সহ্য হচ্ছে না? আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস!’

 

রূপা অধৈর্য হয়ে বললো, ‘তুই তো শুধু হোটেলে আসিস না, অন্যদিকে চলে যাস।’

 

অরুনিকা কিছু বললো না। রূপা অরুনিকার পাশে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘এতগুলো বছর আমাকে বুঝিয়ে এলি। একসময় তুই অবুঝ হয়ে যাবি, তোকে আমার বুঝাতে হবে ভাবিনি।’ 

 

অরুনিকা অভিমানী সুরে বললো, ‘কী করেছি আমি?’

 

‘তুই দুই-তিন দিন পর পর বোরকা পরে একটা আবাসিক হোটেলের সামনে ঘুরঘুর করিস। যে হোটেলে নিম্নশ্রেণির কিছু মেয়ে বোরকা পরেই নোংরামি করতে আসে। বাজারের লোক কানাঘুঁষা করে। তোর পাপা জানলে কী হবে? তুই এইটা একবারও ভাবিস না? আংকেল বাসায় বেশি থাকেন না বলে সেই সুযোগে এমন ভুল করে বেড়াবি? তুই একটা সুন্দর, শিক্ষিত, গর্বিত বংশের মেয়ে। তোর এই কাজ সাজে? আবার বহুবার নিকাব তুলে বসে বসে বাদামও চিবিয়েছিস। কেউ বিরক্ত করেনি?’

 

‘না তো। আমি কারো গায়ে কাদা না ছুঁড়লে আমার গায়ে কেন কেউ ছুঁড়বে?’

 

অরুনিকার চোরা চাহনিতেই বোঝা যাচ্ছে, সে বহুবার বখাটেদের কুরুচিপূর্ণ আচরণের শিকার হয়েছে৷ কিন্তু রূপার কাছে স্বীকার করবে না। সব সহ্য করে হলেও সেই ছেলেকে বের করবে! 

 

রূপা বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না। 

 

রূপাকে হতাশ হতে দেখে অরুনিকা বললো, ‘এবার সত্যি আর যাবো না। মানুষটাকে আর খুঁজবো না।’ 

 

রূপার চোখেমুখে ঔজ্বল্য প্রকাশ পায়। তবুও সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘সত্যি?’

 

‘আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি রে রূপা।’ তার অশ্রুসিক্ত চোখ।

 

রূপার ভীষণ মায়া হয়। সে চেয়ার টেনে অরুনিকার সোজাসুজি বসে বললো, ‘জানিস, আমারও ইচ্ছে হয় তোর মানুষটাকে দেখার। কে সে? যে এক পলকে এতোটা মায়ায় জড়িয়ে নিলো! এক পলকে প্রেম হয়ে গেল! আমার এলাকায় এক মেয়ে ছিল, রং নাম্বারে এক ছেলের কণ্ঠ শুনেই প্রেমে পড়ে যায়। লজ্জায় নিজ থেকে দুই সপ্তাহ কল করেনি। এরপর যখন করলো, ফোন বন্ধ পায়। দুই বছর অপেক্ষা করে, প্রতিদিন নাম্বারটাতে ফোন দিত। কখনো খোলা পায়নি। মানুষের মন, অনুভূতি কত অদ্ভুত হয়! কেউ মুহূর্তে প্রেমে পড়ে, কেউ সারাজীবন এক ছাদের নিচে থেকেও প্রেমে পড়ে না।’

 

‘কে এক ছাদের নিচে থেকেও প্রেমে পড়েনি?’

 

রূপা কপাল চুলকে বললো, ‘ফেসবুকে একজন নিজের জীবন কাহিনি শেয়ার করছে ওখানেই পড়েছি।’

 

অরুনিকা ছোট করে বললো, ‘ওহ।’

 

‘এখন বল, সত্যি আর খুঁজবি না?’ 

 

‘সত্যি খুঁজবো না। আগের মতো তীব্র অনুভূতিটাও পাই না, ফিকে হচ্ছে সব।’

 

এই কথা শুনে রূপা খুশি হয়ে গেল। নিজের উরু চাপড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘তাহলে তো ভালোই হচ্ছে। আর আগেই বলছি জুয়া খেলে এমন ছেলে ভালো হবে না। আল্লাহ ভালোর জন্যই আর তোদের মুখোমুখি করেনি। তোর জন্য শুদ্ধ ছেলে প্রয়োজন। আগাগোড়া সম্পূর্ণ শুদ্ধ হতে হবে।’

 

‘যদি পেতাম আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে শুদ্ধ করে দিতাম।’

 

রূপার ঠোঁট থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে গেল। সে ক্যাটক্যাট করে বলে উঠলো, ‘এমন ন্যাকামিমার্কা কথা আমার সামনে একদম বলবি না। তোর বয়স কত?’

 

অরুনিকা থতমত খেয়ে বললো, ‘উনিশ।’

 

‘কিন্তু কথা তো বলছিস চৌদ্দ, পনেরো বয়সী মেয়েদের মতো। ভালোবাসা দিয়ে শুদ্ধ করতে গিয়েই তো মেয়েগুলো বাঁশ খায়। শোন, একেবারে ভুলে যা। যেহেতু ফিকে হচ্ছে সব। তুইও ফিকে হতে দে। ইচ্ছে করে ভাবনায় আনবি না।’ 

 

অরুনিকা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘আচ্ছা।’

 

রূপা গ্লাস ধুয়ে জগ থেকে নতুন করে পানি নিয়ে এসে বললো, ‘তারপর পড়াশোনার কী অবস্থা? শেষ? না আছে?’

 

অরুনিকা পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে বললো, ‘একদম ঠিকঠাক।’

 

‘সারাজীবন এভাবে পড়াশোনাকে ভালোবাসবি। যাই হোক ছাড়বি না।’ 

 

‘তুই আর পড়াশোনা আমি কখনোই ছাড়ব না।’

 

রূপার হাসি আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। হাসির মধ্যেই যেন তার সব সৌন্দর্য। সে বললো, ‘আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারবি? হোটেলে নতুন ডেকোরেশন হচ্ছে, দেখে যেতি।’

 

_

মধ্যাহ্নে বারেক, সুজন, রূপা বাড়িতে খেতে এলো। হোটেলে কাজ চলছে বলে রান্নাবান্না করা হয়নি।

 

রুমি তখন স্কুল থেকে ফিরে। তার চেহারা ক্ষুব্ধ, ভীষণ বিরক্ত। রূপা উঁকি দিয়ে দেখে, রুমি কাঁধের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। জুতা জোড়া খুলে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। রূপা খেতে খেতে গলা উঁচিয়ে বললো, ‘কি রে, এতো রেগে আছিস কেন?’

 

রুমি কটমট করে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। রূপা জানে রুমি তাকে কিছুই বলবে না তবুও জিজ্ঞাসা করলো। না বললে নাই। কিন্তু সত্যিই রুমিকে খুব রাগী দেখাচ্ছে। কোনো সমস্যা হলো নাকি! রূপা সুমনাকে ডেকে বললো, ‘আম্মা, দেখো তোমার মেয়ের কি হইছে।’

 

সুমনা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্কুলে মাইরটাইর লাগছে মনে হয়। রুমি…রুমিরে?’

 

সুমনা দরজার সামনে যেতেই রুমি ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। 

রূপা সরল গলায় বললো, ‘তবুও খোঁজ নিতে সমস্যা কী? আর ওরে আমি সেদিন রাতে দেখলাম, কোচিং থেকে বের হয়ে রিক্সা করে অন্যদিকে চলে গেছে। বাসায় এসে বলছে কোচিংয়ে বেশি পড়াইছে। দিনকাল তো ভালো না। ওরে সামলাও। ও আমার কোনো কথাই শুনে না। তিন মাসে তিনটা মেয়ে খু’ন হয়ে গেছে। একা একা যেদিকসেদিক যেন চলে না যায়।’

 

বারেক খাওয়ার মাঝে বললেন, ‘মেয়েগুলোর খু’নী কি একজন?’

 

‘আমারতো তাই মনে হয় আব্বা। খু’নের ধরন তো একই।’ 

 

‘তুইও সাবধানে চলাফেরা করিস। কি যে হচ্ছে দেশটার!’

 

‘জি আব্বা।’

 

রিনি এসে রূপার পাশে বসলো। ধীর কণ্ঠে বললো, ‘আপা, চকলেট?’

 

রিনির দাঁতে পোকা। সুমনার কড়া নিষেধ, রিনিকে চকলেট দেয়া যাবে না। রূপা মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে নিয়ে আসে। বার বার ছোট বোন কিছু আবদার করলে কি না করা যায়? রূপা সবার আড়ালে পকেট থেকে চকলেট বের করে রিনির হাতে তুলে দেয়।

 

সুমনা রুমিকে তখনো ডাকছেন। অবশেষে রুমির জবাব এলো, ‘যাও তো আম্মা, গোসল করবো।’

 

এরইমধ্যে আশিক, আরমানও স্কুল থেকে ফিরে। দুজনে কেবল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সুমনার অনেক বড় সংসার, অনেক দায়িত্ব। তিনি দৌড়ে যান ছেলেদের হরলিক্স প্রস্তুত করতে। এরপর গোসল করিয়ে ঘুম পাড়াবেন, কোচিংয়ে নিয়ে যাবেন। কত কাজ! এতো কাজ করতে দেখে রূপা নিজের অভিযোগগুলো ভুলে যায়। মানুষটা তো কম কষ্ট করে না!

 

গোধুলি লগ্নে কোচিং শেষে নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ে বাড়ি ফিরছিলো অরুনিকা। শহরের সবচেয়ে বড় ব্রিজে গাড়ি উঠতেই লক্ষ্য করলো, একটা ছেলে বাইক নিয়ে ঠিক তাদের গাড়ির পেছন পেছন আসছে। সে আরো ভালো করে দেখে, হা হয়ে গেল। তীব্র অনুভূতির ঝাঁকুনিতে স্তব্ধ হয়ে গেল। অবশ হয়ে এলো হাত-পা। 

 

সেই মানুষটা! কালো পাঞ্জাবি, কালো সানগ্লাস পরে বাইক নিয়ে ছুটে আসছে। দৃশ্যটি অরুনিকার তপ্ত মরুর বুকে নিয়ে এলো এক পশলা বৃষ্টি! 

 

সে কিছু না ভেবেই ড্রাইভারকে বলে উঠলো, ‘আংকেল, গাড়ি থামান।’

 

চলবে….

 

সূর্যশিশির 

১২.

চলন্ত গাড়ি সহসা থেমে যাওয়াতে বাইকটিও থেমে গেল। অরুনিকা নিঃশ্বাস আটকে থম মেরে বসে রইলো। গাড়ি থেকে বের হওয়ার দুঃসাহস তার নেই। তার চোখের পলক পড়ছে দ্রুত, ঠোঁটে লজ্জামিশ্রিত হাসি।

 

ড্রাইভার অশোক কর্মকার ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘কোনো দরকার ছিল মামনি?’

 

অরুনিকা দ্রুত নিজের মুখের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করে বললো, ‘না, না কাকা।’

 

অশোক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। দরকার না থাকলে গাড়ি থামাতে বললো কেন?

 

অরুনিকা বিব্রতবোধ করে। সে দ্রুত মাথায় হাত রেখে অসুস্থতার ভান করে বললো, ‘হুট করে মাথাটা কেমন করছিল। ‘

 

অশোক পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাড়ি ফিরতে আর একটু পথ বাকি। এখানে থাকার চেয়ে, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেয়াটা ভালো হবে।’

 

অরুনিকা পানির বোতল নিয়ে এক ঢোক পানি খেল।

অশোক যদি কোনোভাবে পিছনে থাকা বাইকওয়ালার উপস্থিতি আঁচ করতে পারেন সোজা অরুনিকার বাবাকে গিয়ে বলবেন। অরুনিকা এই ঝুঁকি নেয়ার সাহস পাচ্ছে না৷ আরো কিছুক্ষণ এখানে থাকলে মানুষটি অশোকের নজরে চলে আসবে। তার থেকে চলে যাওয়া উত্তম। সে বাধ্য হয়ে বললো, ‘জি কাকা। বাসায় চলুন।’

 

অশোক গাড়ি স্টার্ট দিতেই অরুনিকা পিছনে ফিরে তাকায়। সে আছে!

গাড়ি চলতে শুরু করলে বাইকটিও চলতে শুরু করে। অরুনিকার অন্তঃকরণে বসন্তের কোকিল ডেকে ওঠে। শুধু তার নয়, মানুষটিরও তাকে ভালো লেগেছে! নয়তো কি তার পিছু নিত? 

 

কিন্তু মাঝের এতগুলো দিন কোথায় ছিল? প্রশ্নটি মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই অরুনিকার কপালে ভাঁজ পড়ে। যদি ভালোই লেগে থাকে, এতদিন কেন এলো না? ভাবতে ভাবতে সে উদাস হয়ে গেল।

 

গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামলো। অরুনিকা গাড়ি থেকে নেমে পিছনে ফিরে দেখে, চারপাশে সুনসান নীরবতা। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই, মানুষ নেই। তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। আবার হারিয়ে গেল না তো!

 

সে আকুল হয়ে দুই কদম এগিয়ে গেল। দেখা পেল কাঙ্খিত বাইকটির। রাস্তার পাশের এক সরু গলিতে বাইকটি রাখা। 

 

অরুনিকার ঠোঁটে আবারও হাসি ফুটে ওঠে। তার বারান্দা থেকে গলিটি স্পষ্ট দেখা যায়। সে দ্রুত ছুটে গেল রুমে। ব্যাগ বিছানায় রেখে তড়িঘড়ি করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আযান। দিনরাত্রির মিলন মুহূর্তে অরুনিকা ও তার মনের মানুষটির দ্বিতীয়বারের মতো চোখাচোখি হয়। 

 

মানুষটি এক হাত নাড়িয়ে অরুনিকাকে কিছু একটা বলতেই অরুনিকা লজ্জা পেয়ে রুমে চলে এলো। মানুষটি, মানুষটি বলতে আর ভালো লাগছে না৷ এবার নাম জানা প্রয়োজন। অরুনিকার ভীষণ মন চাইছে গিয়ে বলতে, ‘এইযে মনচোরা যুবক, আপনার নাম কী?’

 

অরুনিকা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রূপাকে কল করতে উদ্যত হতেই আজিজুরের কণ্ঠ ভেসে এলো। তিনি অরুনিকাকে ডাকছেন। 

 

অরুনিকা অবাক হয়। এই অসময়ে পাপা বাসায়! 

সে ফোন রেখে আজিজুরের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।

 

আজিজুর নিজ রুমের ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার ক্ষুদ্ধ চেহারা। অরুনিকা আসার সময় ড্রয়িং রুমে তার মা সেলিনাকে মুখভার করে বসে থাকতে দেখেছে। কী হলো? পরিবেশ  এতো থমথমে কেন? 

 

অরুনিকা আজিজুরের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘পাপা ডাকছিলে?’

 

আজিজুরের দৃষ্টি বাইরে নিবদ্ধ। তিনি মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বললেন, ‘তোমার ফোন নিয়ে আসো।’

 

অরুনিকা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে চুপচাপ ফোন আনতে গেল। ড্রয়িং রুম পেরোনোর সময় সেলিনাকে চাপা সুরে প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে মা? পাপা রেগে আছে কেন?’

 

সেলিনা টু শব্দটিও করলেন না। দেরি হচ্ছে তাই অরুনিকা আর কথা বাড়ালো না। সে ফোন নিয়ে আজিজুরের রুমে এলো। ব্যথিত কণ্ঠে বললো, ‘আমি কি কোনো ভুল করেছি পাপা?’

 

আজিজুর অরুনিকার হাত থেকে ফোনটি নিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়৷ আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল অরুনিকা। সেলিনা শব্দ শুনে ছুটে আসেন। আজিজুরের উপর চেঁচিয়ে উঠেন, ‘বাড়ি এলে তোমার এটা-ওটা ভাঙতেই হয়?’

 

অরুনিকার ‘আমার ফোন’ বলে অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে। আজিজুর সেলিনাকে অগ্রাহ্য করে অরুনিকার দিকে তাকালেন। চোখে রাগ অথচ শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘রুমে যাও। পড়াশোনায় মন দাও।’

 

অরুনিকার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে সে। কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন বললো, ‘কেন এমন করলে? আমি কী করেছি? এভাবে আঘাত কেন দিলে পাপা?’

 

আজিজুর তিরস্কার করে বললেন, ‘সামান্য ফোন ভাঙাতে এতোটা আঘাত লেগে গেল! আর তুমি যে আমার সম্মান নিয়ে নোংরা আবাসিক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকো তখন আমার সম্মানে আঘাত লাগে না?  মনের আঘাত বড় নাকি সম্মানের?’

 

অরুনিকা এই কথায় চমকে গেল, থেমে গেল কান্না। আজই শপথ নিলো আর যাবে না আর আজই কি না পাপা সব জেনে গেল! সে আড়চোখে সেলিনাকে দেখলো। সেলিনার চাহনি যেন বলছে, এবার আমার আর কিছু করার নেই। 

 

আজিজুর বললেন, ‘ওই মেয়ের সাথে মেশার পর থেকেই তোমার অধঃপতন শুরু হয়েছে। বহুবার নিষেধ করার পরও মিশেছো। এখন এমন অবস্থাতে এসেছো যে মুখে বলার মতো না। আমার মেয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখন মানুষ সন্দেহ করে! এই দিনও আমাকে দেখতে হলো!’

 

লজ্জায় অরুনিকার পা দুটি শক্তি হারাচ্ছে। কে তার চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করলো যে আজিজুর এতোটা রেগে আছেন! মাথাটা কেমন ভার লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্যাপারটা সত্যিই খুব ঘোলাটে হয়ে গেল। প্রথমেই রূপার বারণ শোনা উচিত ছিল। 

 

আজিজুর আচমকা সেলিনাকে ধমকে বললেন, ‘মেয়েকে বলো সামনে থেকে যেতে।’

 

অরুনিকা ভয়ে কেঁপে ওঠে। সে রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। সেলিনা কোনো এক গোপন অভিমান থেকে বললেন, ‘চাইলেই আদর করে বুঝাতে পারতে। একটাকে তো রাগের জন্যই হারিয়েছো।’

 

আজিজুর সেলিনার কথাকে এবারও উপেক্ষা করলেন। বললেন, ‘কাল সকালে নতুন দারোয়ান আসবে। কোচিং-এ যখন যাবে সাথে তুমিও যাবে। আমি যেন আর না শুনি, তোমার মেয়ে আবার ওই মেয়ের সাথে দেখা করেছে বা ওই মেয়ে এখানে এসেছে।’

 

সেলিনা কিছু বললেন না। চুপচাপ শুধু শুনে গেলেন। 

_

 

বারেক মিয়া ঘুম থেকে উঠতেই সুমনা এসে তার পায়ের কাছে বসলেন। ভারী শান্ত দেখাচ্ছে তাকে। মাথায় তেল দিয়ে সুন্দর করে বেণী করেছে। বারেক প্রশ্ন করলেন, ‘কিছু বলবা নাকি?’

 

সুমনা দরজার বাইরে ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি দেখলেন। তারপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তোমার মেয়ের জন্য প্রস্তাব আসছে। ভালো ঘর, ভালো ছেলে।’ 

 

‘ রূপার জন্য?’

 

সুমনা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললেন, ‘আরে না। রুমিরে পছন্দ করছে।’

 

বারেক অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘তোমার কথাতে তো মনে হচ্ছে, তুমি রাজি। কিন্তু রুমির বয়স কত খেয়াল আছে? মাত্র পনেরো। এসএসসি পাস করেনি এখনো।’

 

‘তুমি আছো তোমার বয়স নিয়ে। কয়দিন পরই তো ষোল হয়ে যাবে। আর ভালো ছেলে কি সবসময় পাওয়া যায়?’

 

সুমনার অতি আগ্রহ দেখে বারেক বেশ অবাক হলেন। রুমি-রিনিকে সুমনা চোখে হারায়। এতো দ্রুত বিয়ে দিতে চাচ্ছে! কোন পাত্র সুমনার মন জয় করে নিলো! বারেক প্রশ্ন করলেন, ‘পাত্র কে?’

 

সুমনা হাসলেন। আরেকটু কাছে এসে ঠোঁট টিপে বললেন, ‘তোমারও অনেক পছন্দের ছেলে। ওইযে সৈয়দ বাড়িতে থাকে, ফাইয়াজ। সোনার টুকরো ছেলে একটা। রুমির বর হবে কয়দিন পর। কী ভদ্র, কী নম্র! ভালো চাকরি করে। বেতনও অনেক । আমাদের মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে।’

 

বারেক ফাইয়াজের নাম শুনে আরো অবাক হলেন। যে কেউ নির্দ্বিধায় বলবে, ফাইয়াজ লাখে একটা ছেলে। আচার-আচরণ, চলাফেরা ইতিমধ্যে এলাকাবাসীর মন কেড়েছে। তার ব্যক্তিত্ব, গম্ভীরতা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, গুছানো কথাবার্তা যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। এ গলি, ও গলির কিছু মেয়ে ফাইয়াজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছুদিন আগে এক মেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। ফাইয়াজ বিয়েতে রাজি না হওয়ায় মেয়েটি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এসব কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে শোনা। বাড়ির পাশে থেকেও সত্য নাকি বারেক জানে না। 

 

তিনি বললেন, ‘ফাইয়াজ কি নিজে প্রস্তাব দিল?’

 

সুমনা একটু নিভলেন। বললেন, ‘না।’

 

থেমে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘বড় বোন প্রস্তাব নিয়ে আসছে। ফাইয়াজের অভিভাবক তো ওর বড় বোনই। বোন যা বলে তাই করে। ওসব তুমি ভেবো না।’

 

‘ফাইয়াজের মতো ছেলে নিজের অর্ধেক বয়সী মেয়েকে বিয়ে করবে বলে আমার মন বলে না৷ ভালো করে জেনে নাও। এরপর কথাবার্তা আগাও। এমন ছেলে জামাই হিসেবে পেতে আপত্তি কোনো বাবাই করবে না। কিন্তু মেয়েটাকে আরেকটু বড় হতে দেয়া উচিত। তোমার মেয়ে রাজি হবে নাকি সেটাও দেখো। এরপর আমি যা বলার বলবো। আর বড় মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে মেজোটাকে দেয়া কি ঠিক হবে?’

 

রূপার কথা আসায় সুমনা রেগে গেলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তেজ নিয়ে বললেন, ‘এই ছেলেরে আমার পছন্দ হইছে দরকার পড়লে রিনির সাথে বিয়ে দেব। তাও আমার ঘরের জামাই বানাবো। আর তোমার বড় মেয়েরে কে বিয়ে করবে? ও সংসার সামলাতে পারবে? হোটেল সামলানো আর সংসার সামলানো কি এক জিনিস? হোটেলের কাজই ওর জন্য ঠিক আছে। ওইটাই করতে দাও।’

 

বারেক বিড়বিড় করেন, ‘এতোই যখন পছন্দ হইছে নিজে বিয়ে করে নাও না।’

 

সুমনার ভ্রু দুটি বেঁকে গেল। বললো, ‘কী বললা?’

 

বারেক চট করে গামছাটা গলায় ঝুলিয়ে ‘কিছু না’ বলে বেরিয়ে গেলেন। সুমনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী যেন বললো!

_

কিছুদিন হলো অনলাইনে অর্ডার নেয়া শুরু করেছে রূপা। হোটেলে ডেকোরেশনের কাজ চলছে বিধায় রান্নাবান্না বন্ধ। কিন্তু তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্ডার ছিল। এক কাস্টমারের জন্মদিন আজ। সে দশ জনের কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার করেছে।

 

তাই সন্ধ্যা হতেই রূপা রান্না শুরু করে। রাত নয়টায় পৌঁছে দিতে হবে। সে দ্রুত কাজ করছে। ফাঁকে ফাঁকে অরুনিকাকে মেসেজ করে। একবারও রিপ্লাই পেল না। রিপ্লাই না পেয়ে কিছুটা অবাক হলেও তেমন পাত্তা দিলো না। এমন সময় সাধারণত অরুনিকা পড়াশোনা করে। রূপা ভাবলো, রাতে ফ্রি হয়ে কল করবো। ততক্ষণে অরুনিকাও কল করতে পারে। 

 

সে নিজের কাজে মনোনিবেশ করে। 

 

কিছুক্ষণ পর ফাইয়াজের কণ্ঠ শুনতে পেল। সে আগ্রহবশত চামচ হাতে নিয়ে হেঁশেল থেকে উঁকি দিয়ে দেখে ফাইয়াজ হোটেলের চারপাশ দেখতে দেখতে সুজনকে কিছু বলছে। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকানো। সবেমাত্র কর্মস্থল থেকে ফিরেছে। ইদানীং দেরি করে ফিরে। কে জানে কেন! রূপা সরে যাওয়ার পূর্বেই ফাইয়াজ দেখে ফেললো। এখন ডেকে জ্ঞান দিবে!

 

ফাইয়াজ সঙ্গে সঙ্গে ডাক দিলো , ‘এই মেয়ে শুনো।’

 

রূপা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো, ‘জি স্যার।’

 

ফাইয়াজ এগিয়ে এলো, ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে। তার বক্তব্য শুরু হওয়ার আগে রূপা দ্রুত বললো, ‘স্যার আপনার যা বলার পরে শুনবো। এখন যাই? রান্না পুড়ে যাবে।’

 

‘কীসের পরে কথা? তুমি নাকি পড়াশোনা আর করবে না? পড়াশোনা কি ছাড়ার জিনিস? জীবনের মানে জানো? তুমি যদি নিজের…’ 

 

‘প্লিজ স্যার পরে শুনবো।’

 

ফাইয়াজকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল রূপা। ফাইয়াজ থতমত খেয়ে যায়। সে রূপাকে দিতে চাওয়া উপদেশগুলো আপাততের জন্য হজম করে আবার ক্যাশ কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। 

 

হোটেল নতুন করে ডেকোরেশন করায় একদম নতুন লাগছে। সে সুজনকে প্রশ্ন করলো, ‘দোকান তো মনে হচ্ছে বন্ধ। রান্না হচ্ছে কেন?’

 

সুজন কান চুলকাতে চুলকাতে বললো, ‘কাচ্চি বিরিয়ানি রান্ধে। নেটে অর্ডার নিছে।’

 

ফাইয়াজ হাতঘড়ি দেখে পকেট থেকে পাঁচশ টাকার নোট বের করে বললো, , ‘রান্না হলে আমার বাসায় এক বক্স পাঠাতে বলবি।’

 

‘অর্ডারের হিসাবমতো রান্ধে স্যার। আরো দুইজনের তো হইবো না।’

 

রূপা স্যার ডাকায় সুজনও তাকে স্যার ডাকে। ফাইয়াজ টাকাটা সুজনের সামনে রেখে বললো, ‘আমিও অর্ডার করলাম। রাত দুটো বাজলেও সমস্যা নেই।’

 

কথা শেষ করেই ফাইয়াজ বাইক নিয়ে চলে যায়। 

 

সুজন রূপাকে টাকা দিয়ে ফাইয়াজের অর্ডারের কথা বলে। রূপা টাকাটা নিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল। প্রতিদিন ফাইয়াজ কিছু না কিছু তাদের দোকান থেকে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে যে রান্নাগুলো সে করে। হয়তো অন্যান্য রেস্টুরেন্ট থেকে স্বাস্থ্যকর বলেই! তাই বলে মাসে মাসে বাইরের খাবারের পিছনে এতো টাকা ব্যয় করবে! 

_

 

সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশে বারেক দোকানে এলেন। তখন রূপা বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। 

বাজারের প্রতিটি হোটেলে খবর চলছে। আজ মাসের উনত্রিশ তারিখ মানে আরেকটি খু’ন হবে। পূর্বের তিনটি খু’ন মাসের উনত্রিশ তারিখই হয়েছে। খু’নের সাথে এই তারিখের কি সম্পর্ক কেউ জানে না। শুধু সবাই এইটুকু আন্দাজ করতে পেরেছে, অজ্ঞাত খু’নি উনত্রিশ তারিখই খুন করে। খুনি রীতিমতো দেশের মানুষ ও দেশের আইনের সাথে চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তে আছে। সে একটি নির্দিষ্ট তারিখে খু’ন করে তবুও কেউ তাকে ধরতে পারে না। তৃতীয় খু’নের সময় চারিদিকে টহল দিয়েও খু’নিকে ধরা সম্ভব হয়নি। খু’ন হওয়ার মিনিট কয়েক পর পুলিশ টের পায় কেউ খু’ন হয়েছে। ততক্ষণে খু’নি গা ঢাকা দিয়েছে।

 

বারেক রূপাকে বাঁধা দিয়ে বললেন, ‘আজ ঊনত্রিশ তারিখ, বের হোস না। দেশের অবস্থা তো জানিস।’

 

রূপা সাইকেলের তালা খুলতে খুলতে বললো, ‘

রাত এগারোটার আগে খু’নি বের হবে না আব্বা। আপনি এতো চিন্তা করবেন না। এখন সাতটা পঁয়ত্রিশ বাজে। আমি আটটা ত্রিশের মধ্যে চলে যাবো। আবার ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরে আসবো। সব মিলিয়ে বেশি হলে দশটা বাজবে।’

 

‘আমি যাচ্ছি। তোর যেতে হবে না। আমাকে ঠিকানা দে।’

 

রূপা বারেক মিয়ার দিকে তাকালো। অনলাইনে যে অর্ডারগুলো আসে তার টাকা বারেক নেন না। তিনি রূপাকে বলেছেন, এই টাকা যেন সে রাখে। রূপাও এটা চেয়েছিল। সে অর্থ সঞ্চয় করতে চায়। নিজের জন্য কিছু করতে চায়। আজকের অর্ডারটির জন্য ভালো অংকের টাকা পাবে। এই টাকা তার স্বপ্ন পূরণের অংশ। সে কিছুতেই অর্ডার ক্যান্সেল করবে না। আবার পায়ে ঘা হওয়া বারেক মিয়াকেও এত দূরে সাইকেল নিয়ে যেতে দিতে পারে না৷ 

 

রূপা বললো, ‘পায়ের সমস্যা নিয়ে সাইকেল কীভাবে চালাবেন? বাসও তো চলে না। রিক্সা-সিএনজি দিয়ে গেলে আর লাভই থাকবে না।’

 

‘না থাকলো লাভ।’

 

‘লাভের জন্যই তো এতো কষ্ট! জেদ করবেন না আব্বা। আমাকে যেতে দিন। আমি যাবো আর আসবো। আর সড়ক দিয়েই তো যাবো। নিরিবিলি জায়গা দিয়ে তো যাচ্ছি না।’

 

বারেক কিছুতেই অনুমতি দেয়ার সাহস পাচ্ছেন না। তিনি বললেন, ‘সুজনকে নিয়ে যা তাহলে।’

 

‘এতজনের খাবার আবার সুজন! এটা সাইকেল আব্বা, ঠেলাগাড়ি না।’

 

রূপা সাইকেল নিয়ে বের হয়। বারেক পেছন থেকে বললেন, ‘অর্ডারে কত টাকা আসে বল আমি তোকে দিচ্ছি।’

 

‘শুধু তো টাকাটাই সব না। যদি না যাই একটা মেয়ের জন্মদিনের আনন্দ নষ্ট হবে। আপনি চিন্তামুক্ত থাকেন। আমি যাব আর আসব।’

 

রূপা বারেকের কথা শুনলো না। দীর্ঘ পথের যাত্রার জন্য বেরিয়ে গেলো। বারেক বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে পান। মেয়েটার বিপদ না হয়!

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

১৩.

ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় সবকিছু কেমন যেন জন্ডিস জন্ডিস লাগছে, যা-ই চোখে পড়ে, সবই হলদে। রূপা নিজ এলাকা ছেড়ে সাইকেল নিয়ে কোলাহলপূর্ণ শহরে প্রবেশ করল। এখানকার ল্যাম্পপোস্টর আলো আবার সাদা। চতুর্দিক ফকফকে লাগে। দুই দিকে বড় বড় বিল্ডিং, শপিংমল, হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজ। সামনে-পিছনে, ডানে-বামে বিভিন্ন গাড়ি। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধ্যানে মগ্ন৷ এই শহরে মানুষের থেকে যেন গাড়ি বেশি। রূপা রাস্তার এক পাশ ধরে চলছে। হঠাৎ ট্রাফিক জ্যাম লেগে যায়। কোনো চিপাচাপা জায়গাও নেই সাইকেল নিয়ে যাওয়ার মতো। সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তিতে তার কপালে গুটি কয়েক ভাঁজ সৃষ্টি হয়। এই জ্যামের ভয়ে, প্রথমে ভেবেছিল হাইওয়ে রোড দিয়ে নয়াবাড়ি পৌঁছাবে; কিন্তু ওদিকে এক-দুটি চলন্ত গাড়ি সবসময় দেখা গেলেও সাইকেল নিয়ে রাতের বেলা চলাচল করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া তাকে হাইওয়ে রোড অবধি যেতে হলে বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। রোডটির একাংশও বনের ভেতরে পড়েছে। বহুবার সে বনের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করেছে, কিন্তু আজকের মতো অশুভ দিনে এতোটা দুঃসাহস দেখানো উচিত হবে না।

 

পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর জ্যাম ছুটল। রূপা সাইকেল নিয়ে হাওয়ার বেগে ছুটতে শুরু করে। এই মুহূর্তে সে নিজেকে রাজকন্যা আর সাইকেলটিকে পঙ্খীরাজ ঘোড়া ভেবে নিয়েছে। 

 

সাইকেলের বেগ দেখে অনেকেই গ্রীবা ঘুরিয়ে ভীষণ কৌতুহল নিয়ে রূপাকে এবং তার সাইকেলরূপী পঙ্খীরাজ ঘোড়াকে দর্শন করছে। 

 

রাত আটটা ত্রিশ মিনিটে নয়াবাড়ি এসে পৌঁছাল সে। দেড় ঘন্টার রাস্তা চল্লিশ মিনিটে পাড়ি দিয়ে রূপা আনন্দিত৷ পরবর্তী ধাপ হলো, বাড়ি খুঁজে বের করা। সে ফোন বের করে মেসেঞ্জারে গেল। পুনরায় খরিদ্দারের ঠিকানায় চোখ বুলিয়ে নিল। সেখানে লেখা – 

নাম: রাহাতি মণি।

ঠিকানা: নয়াবাড়ি, বি ব্লক। রোড নাম্বার: ৬, বাসা নাম্বার: ৭৮। 

ফোন নাম্বার: ০১৭********

 

রূপা ফোন পকেটে রেখে একজন পথচারীকে ডেকে বলল, “একটু শুনবেন, প্লিজ।”

 

পথচারী উৎসুক হয়ে দাঁড়াল। রূপা বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইল, “বি ব্লকটা কোনদিকে বলতে পারবেন?”

 

পথচারী অঙ্গুলিনির্দেশে একটা রাস্তা দেখিয়ে বলল, “ওই রাস্তা ধরে বামে যাবেন।”

 

রূপা হাস্যমুখে বলল, “আচ্ছা, থ্যাংক ইউ।” 

 

সে মিনিট বিশেক সাইকেল নিয়ে হাঁটার পর কাঙ্খিত ছয় নাম্বার রোডের আটাত্তর নাম্বার বাড়িটি খুঁজে পেল। রোডের শেষ প্রান্তের পুরনো, জীর্ণশীর্ণ এক তলা বাড়িটিই রাহাতি মণির। 

 

বাড়ির সামনে তিনটে কুকুর শুয়ে আছে। রূপাকে দেখে দু’টো কুকুর ঘেউঘেউ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তৃতীয় কুকুরটি তখনও শুয়ে ছিল। রূপা কুকুর অথবা কুকুরের চিৎকার কোনোটাই ভয় পায় না। তাই সে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এল। কাছে আসতেই কুকুর দু’টো চিৎকার থামিয়ে কুঁই কুঁই করতে লাগে। শুয়ে থাকা কুকুরটিও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। 

 

রূপা সাবধানে প্রথম কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তোরা কি বন্ধু? একসঙ্গে থাকিস?”

 

কুকুরগুলো প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে লেজ নাড়িয়ে অন্যদিকে চলে যায়। রূপাও আশা করেনি জবাবের। বোবা প্রাণী বলবেই বা কী! 

 

সে বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখল, গেইটটি হাট করে খোলা। রূপা গেইটে শব্দ করল। ভেতর থেকে সাড়া মিলল না। বেশ কয়েকবার শব্দ করার পর, একজন মধ্য বয়স্কা মহিলা বেরিয়ে এল। রূপা তৎক্ষনাৎ হেসে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, আমি বারিধি রেস্টুরেন্ট থেকে এসেছি। একটি অর্ডার ছিল।”

 

রূপার কথা শুনে মহিলা অদ্ভুতভাবে তাকালেন। বললেন, ” কীসের অর্ডার? কে দিল? কী নিয়া আসছো?”

 

মহিলার প্রতিক্রিয়া দেখে রূপা অপ্রস্তুতবোধ করল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “জন্মদিন উপলক্ষে রাহাতি মণি নামে একজন দশ জনের কাচ্চি অর্ডার করেছিলেন। আমাকে এই ঠিকানা দেয়া হয়েছিল।”

 

মহিলা উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বাসার অভ্যন্তরে থাকা কাউকে গমগমে গলায় বললেন, “দেখছ কারবার? সংসার চলে না আর তোমার মাইয়া বন্ধুবান্ধবদের খাওয়াতে কাচ্চি অর্ডার দিছে। আমি চাইলেই শুধু টাকা নাই। কী যে পেটে ধরছিলাম!”

 

এসব কথাবার্তা কেউ বাইরের মানুষের সামনে উচ্চারণ করে? রূপার হাঁসফাঁস লাগে, অস্বস্তিতে পড়ে যায়৷ 

 

ভেতর থেকে পাল্টা জবাব এল, “ওর টাকা ও কি করবে ওর ব্যাপার। তুমি এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”

 

মহিলা প্রতিত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না। অপ্রসন্ন মুখে রূপার দিকে তাকালেন৷ প্রশ্ন করলেন, “টাকা কী দিয়ে দিছে? “

 

রূপা ঠোঁটে হাসি ধরে রেখেই বলল, “কিছু বাকি।”

 

“কত বাকি?”

 

“১৬৫০ টাকা।”

 

“ওহ, আচ্ছা। তুমি বরং এখানে অপেক্ষা করো, মণি কেনাকাটা করতে গেছে। চলে আসবে।”

 

রূপা বিনীতভাবে বলল, “অনেক দূর থেকে এসেছি, অপেক্ষা করলে রাত হয়ে যাবে। যদি…”

 

তাকে কথার মাঝে আটকে দিয়ে মহিলা বিরস বদনে বললেন, “বাসায় এতো টাকা নাই। তুমি অপেক্ষা করো।”  

 

রূপাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মহিলা হনহনিয়ে বাসার ভেতর চলে যায়। রূপা হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সাইকেল এক পাশে রেখে তার উপর হেলান দিয়ে দাঁড়াল। তারপর মণির নাম্বারে কল করল। বের হওয়ার আগে মণিকে জানিয়েছিল, সে পার্সেল নিয়ে আসছে।

তবুও মেয়েটা কেনাকাটা করতে চলে গেছে! অন্তত টাকাটা বাসায় রেখে যেত। হয়রানির মানে কী?

 

সে বেশ কয়েকবার কল করেও মণিকে পেল না।

কল যায় কিন্তু রিসিভ হয় না৷ ফোন সাইলেন্ট বোধহয়। 

 

এরইমধ্যে মণির চার-পাঁচ জন বন্ধু বান্ধব এসে পৌঁছায়। দুটো মেয়ে, তিনটে ছেলে। তারা এমনভাবে রূপার দিকে তাকায় যেন বিচিত্র কিছু দেখছে। রূপা সেসব তোয়াক্কা করল না। সে পুনরায় মণিকে করল৷ এবারও রিসিভ হলো না। 

মশার যন্ত্রণায় এখানে টিকে থাকাও যাচ্ছে না৷ ছেলেমেয়ে গুলো ভেতরে যেতেই রূপা সাইকেল নিয়ে গেইটের নৈকট্যে এসে দাঁড়াল। এখানে মশা কম।

 

মুহূর্তখানেক পর বাসার ভেতর থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এসে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “তখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, কাউকে দরকার ?”

 

“রাহাতি মণির জন্য অপেক্ষা করছি।”

 

“কোনো দরকার ছিল?”

 

“জি, উনার একটা অর্ডার ছিল।”

 

“কী অর্ডার করেছে?” ছেলেটির চোখেমুখে কৌতুহল। বয়স বিশ কী একুশ হবে!

 

রূপার কথা বলতে বিরক্ত লাগছে৷ কিন্তু কিছু করার নেই। যেহেতু ছেলেটি খরিদ্দারের বন্ধু, টাকা না পাওয়া অবধি সহ্য করে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। রূপা বলল, “কাচ্চি বিরিয়ানি।” 

 

ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, ” কাচ্চি অর্ডার করেছে! আর আমাদের কিনা বলল, নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াবে। কি মিথ্যুকরে বাবা! আজ আসুক, আচ্ছামত ধোলাই দেব।”

 

রূপা কিছু বলল না। ছেলেটি বলল, “আচ্ছা ওয়েট, আপনার কণ্ঠটা মেয়েদের মতো… আপনি মেয়ে?”

 

এতোক্ষণে খেয়াল হলো সামনে থাকা মানুষটি মেয়ে! রূপা দায়সারাভাবে বলল, “জি।”

 

ছেলেটি হেসে বলল, “বুঝতেই পারিনি। আপনি ভেতুরে আসুন না, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

 

“সমস্যা নেই। এখানেই ভালো লাগছে।”

 

“আন্টি কি আপনাকে ভেতরে যেতে বলেননি? মেয়ে মানুষ রাতের বেলা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আসুন ভেতরে আসুন।”

 

রূপা দৃঢ় কণ্ঠে জানাল, “আমি অচেনা মানুষদের মাঝে স্বস্তিবোধ করি না।”

 

“আপনি তো আচ্ছা ঘাড়ত্যাড়া। আচ্ছা, থাকুন।” 

 

ছেলেটি বাড়ির অভ্যন্তরে চলে গেল। হয়তো রূপাকে বখাটে ভেবে যাচাই করতে এসেছিল। 

 

_

অন্যদিন মহ্নরগরিতে রাত বাড়লেও আজ যেন দ্রুত রাত বাড়ছে। ছয় নাম্বার রোডটিও এই মুহূর্তে জনমানবহীন হয়ে ওঠেছে৷ কিছুক্ষণ আগে এক – দুটো মানুষ ছিল। এখন সবাই নিজ নিজ ফ্ল্যাটে অবস্থান করছে। শুধু রূপা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে রইল একা একা।

 

বারংবার সে রাহাতি মণিকে কল করছে। মেয়েটা রিসিভ করছে না। কী হলো তার?

 

হঠাৎ ফোন বেজে ওঠল। বারেক মিয়া কল করেছেন! রূপা ঠোঁট কামড়ে ভাবল, রিসিভ করবে নাকি। সাত-পাঁচ ভেবে রিসিভ করেই বলল, “এইতো আব্বা, চলে আসছি। চিন্তা করবেন না।” 

তারপর কল কেটে দিল, বারেককে কোনো বাক্য উচ্চারণের সুযোগ অবধি দিল না। বারেক বেশ কয়েকবার কল করলেন, রূপা রিসিভ করল না। 

 

রাত দশটা বিশে আটাত্তর নাম্বার বাড়ির সম্মুখে একটি সাইকেল এসে থামল। সাইকেলে থাকা লোকটি রূপাকে দেখে অবাক হলো। এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে? এখানে কী করছেন?”

 

রূপা বিরক্তি নিয়ে বলল, “সেটা আপনাকে কেন বলব?”

 

লোকটি বলল, “আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আমাকে বলবেন না কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”

 

রূপা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। খরিদ্দারের বাড়ির লোক তাই আবারও তাকে ধৈর্য ধরতে হবে৷ সে কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলল, “রাহাতি মণির একটি অর্ডার ছিল। তার জন্য দেড় ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি। অথচ তার আসার নাম নেই।” 

 

সে যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত তা তার চেহারা দেখে ও কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে।

 

“মণি ফিরেনি এখনো? ও তো বিকেলে বেরিয়েছিল, এখনো কেন ফিরেনি?” বলতে বলতে লোকটি উদগ্রীব হয়ে ওঠল।

 

রূপা বিরস মুখে বলল, “আমি কী জানি?”

 

লোকটি রূপাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “পার্সেলটি আমাকে দিন। আপনার টাকা বাকি আছে? থাকলে বলুন কত বাকি? আমি দিচ্ছি।”

 

মুহূর্তে রূপার চোখমুখে ছড়িয়ে পড়ে জেল্লা। সে তুরন্ত পার্সেলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল, “১৬৫০ টাকা বাকি।”

 

লোকটি সতেরো’শ টাকা দিয়ে বলল, “ভাংতি নেই। পরেরবার মণি কিছু অর্ডার করলে পঞ্চাশ টাকা কেটে নিয়েন।”

 

রূপা অত্যন্ত নম্রভাবে বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”

 

লোকটি চলে যেতেই রূপা প্রফুল্লচিত্তে টাকাটা মানিব্যাগে রেখে অরুনিকাকে কল করল। ওপাশ থেকে ভেসে এল, “…সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”

এই কয়েকটি শব্দ রূপার কাছে অপ্রত্যাশিত!

অরুনিকা কখনো ফোন বন্ধ রাখে না। রূপা উৎকণ্ঠিত হয়ে বার বার চেষ্টা করতে থাকল, দূর্ভাগ্যবশত বার বারই ফোন বন্ধ পেল। কী হচ্ছে তার সাথে? 

 

সে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল, প্রথমে অরুনিকার কাছে যাবে। পাব্লিক রোড দিয়ে গেলে দেরি হবে। তাছাড়া অরুনিকার বাসা হাইওয়ে রোডের কাছাকাছি। তাই সে হাইওয়ে রোড দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রোডে ওঠার পূর্বমুহূর্তে থামল। ভাবল, যাওয়া ঠিক হবে নাকি! 

 

চারপাশে তখন সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে একটা দুটো গাড়ি দেখা যাচ্ছে৷ ঢাকা হরতাল বলে ঢাকাগামী কোনো গাড়ির সাক্ষাৎ মিলছে না। 

 

অরুনিকার ফোন কেন বন্ধ? সেই দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত হওয়ায় রূপার সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হলো না। সে হাইওয়ে রোড ধরে এগোতে থাকে।

 

একসময় সে বনের কাছাকাছি চলে এল। বনের মধ্যখান দিয়ে হাইওয়ে রোড চলে গেছে বহুদূরে। বনে প্রবেশ করার মিনিট পাঁচেক পর সে দূর থেকে দেখতে পেল, কালো পোশাকে আবৃত কিছু একটা বাম পাশের ঘন ঝোপ থেকে ডান পাশে ছুটে গেল। রূপা চমকে ওঠে৷ সে থেমে যায়। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন বেড়ে যায়। পিছনে তাকিয়ে দেখে, কোনো গাড়ি আসছে নাকি। নির্জনতাকে ভেঙে একটা ট্রাক এগিয়ে আসছে। 

 

ট্রাকটি কাছে আসতেই সে ট্রাকটিকে অনুসরণ করতে শুরু করল। তার পরিকল্পনা, সে ট্রাকটির পিছু নিয়ে বন পেরোবে। একা বন পেরোবার সাহস হচ্ছে না। কিন্তু শীঘ্রই তার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। ক্ষীণ আলোর রোডটিতে তাকে একা ফেলে ট্রাকটি চলে গেল দূরে। ট্রাকের গতির সাথে কি আর সাইকেলের গতি পারে? ট্রাকটি তার থেকে যখন অনেকটা দূরে তখন বন থেকে একটি তেজস্বী আলো এসে পড়ে চোখেমুখে। সঙ্গে সঙ্গে রূপা সাইকেলের ভারসাম্য হারিয়ে, সাইকেলসহ উল্টে পড়ল সামনে।

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

১৪.

সৃষ্টিকর্তার সহায় যে বড় বিপদ হয়নি। যেহেতু সে রাস্তার এক পাশ দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল,  উল্টে যাওয়ার পর অর্ধেক শরীর রাস্তায় বাকি অর্ধেক মাটিতে পড়ে। তাই মাথায় আঘাত লাগেনি। তবে হাতে-পায়ে চোট পেয়েছে। বাম পায়ের চোটটা বেশ ভালোই যন্ত্রণা দিচ্ছে। রূপা উঠতে গিয়ে টের পেল, তার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরটা ভীষণ দূর্বল লাগছে। ডান পায়ে শক্তি নেই। কষ্ট করে হলেও রূপা সাইকেলটি তুলল। মাটি থেকে ফোন তুলে দেখে ডিসপ্লে ফেটে গেছে অনেকটা৷ মানিব্যাগ, মানিব্যাগ কোথায়? রূপা অস্থির হয়ে এদিকওদিক মানিব্যাগ খুঁজতে থাকল। ওইতো, ঝোঁপের কাছে। 

সে মানিব্যাগ পকেটে রেখে সাইকেলের ওপর উঠে বসল। উত্তুরে হাওয়া জোরালো ভাবে বইতে শুরু করেছে। নিরিবিলি রাস্তায় তখন শুধুই রূপা। তার পায়ে ভীষণ ব্যথা, সাইকেল চালাতে ভীষণ পীড়া লাগছে। সে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। 

 

সাইকেল নিয়ে মিনিট দশেক হাঁটল। এবার পাকা রাস্তা ছেড়ে ডান পাশের বনে থাকা চিকন কাঁচা রাস্তাটি ব্যবহার করতে হবে। এই রাস্তা শর্টকাট রাস্তা হিসেবে অনেকেই ব্যবহার করে। তবে রাস্তাটি বনের ভেতরে হওয়াতে ভয় রূপাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। সে অলৌকিক কিছু নাকি সিরিয়াল কিলারের ভয় পাচ্ছে, বুঝতে পারছে না।

 

হাতেপায়ে যে আঘাত রূপা পেয়েছে এই মুহূর্তে আবার ঘুরে যাওয়াও অসম্ভব। তার দ্রুত ফির‍তে হবে৷ রূপা বিসমিল্লাহ বলে, বনের ভেতরে পা রাখল।

 

কাঁচা রাস্তার দুই পাশজুড়ে সারি সারি সুউচ্চ গাছ। শোঁ শোঁ শব্দে উঁচু সেই গাছের ছোট-বড় পাতার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে বইছে হাওয়া।

শোনা যাচ্ছে অচেনা পাখি, ব্যাঙের ডাক এবং ঝিঁ ঝিঁ পোকার গুঞ্জন। সাথে আরেকটি শব্দও যেন শুনতে পেল রূপা। তাৎক্ষণিক তার হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। ভয়ে অসার হয়ে এলো দেহ। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করল, “অশরীরী বলতে কিছু নেই রূপা। কেউ তোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না। সবটাই মনের ভয়। আর আজ যদি সিরিয়াল কি’লার এখানে থাকে তবে ধরে নে তোর আয়ুই এতটুকু ছিল। জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছিস, মৃ’ত্যু তোর জন্য মুক্তি। সামনে হাঁটতে থাক। তোর কোনো ভয় নেই।” 

নিজেকে আশ্বস্ত করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল রূপা। 

 

সামনের পথটা অন্ধকারে ঢাকা। সে পকেট থেকে ফোন বের করে টর্চ জ্বালাতে গিয়ে দেখে, ফোনের ডিসপ্লে ফেটেছে শুধু, ভেতরের কোনো ক্ষতি হয়নি৷ সে টর্চ জ্বালিয়ে এগোতে থাকল সামনে। মৃত্যুকে গ্রহণ করার সাহস থাকলে বক্ষে, কোনো কিছুতেই আর ভয় হয় না। এখন রূপারও ভয় লাগছে না। এই রাস্তা দিয়ে সে বহুবার আসা-যাওয়া করেছে। পথ চেনা। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বনের শেষ প্রান্তে চলে আসে। তখন নরম বা সরস কোনো জিনিস কাটার বা দাঁত দিয়ে কামড়ানোর শব্দ শুনতে পায়। সে থমকে দাঁড়াল। বাম দিকে টর্চ ধরে কিছু দেখতে পেল না। শব্দটা কোথা থেকে আসছে? খোঁজার ইচ্ছে বা ধৈর্য্য কোনোটাই হলো না। সে আঁধার ঘেরা বন পশ্চাতে রেখে উঠে আসে চাকচিক্যময় রোডে। 

 

আর কিছুক্ষণ হাঁটলে অরুনিকার বাসার রাস্তা ধরতে পারবে। খুব কাহিল লাগছে। রূপা পায়ের উপর ভর দিয়ে বসল, দশ মিনিট বিশ্রাম নিলো। তারপর অরুনিকার নাম্বারে বেশ কয়েকবার কল করল। এখনো ফোন বন্ধ! সে উৎকণ্ঠা নিয়ে পুনরায় হাঁটতে শুরু করল। রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে সে অরুনিকার বাড়ির সামনে পৌঁছায়। গেইটে শব্দ করলে একজন দারোয়ান গেইট খুলল। নতুন মুখ! এর আগে তাকে রূপা দেখেনি। এতো রাতে রূপাকে দেখে দারোয়ান চোখমুখ বিকৃত করে জানতে চাইল, “কারে চান?”

 

অরুনিকার বাবা আজিজুর বাসায় থাকলে রূপা ভেতরে যায় না৷ তাই সে প্রথমে জিজ্ঞাসা করল, “আজিজুর আংকেল বাসায় আছেন?”

 

“হ, বাসায়। তারে দরকার?”

 

‘আজিজুর বাসায়’ তথ্যটি শ্রবণ করে রূপা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারল, বাসায় কোনো সমস্য হয়েছে হয়তো! সে দারোয়ানকে পুনরায় প্রশ্ন করল, “অরুনিকা কি বাসায় আছে?”

 

দারোয়ান নামটা চিনতে পারল না এমন একটা ভান ধরে বলল, “অরুনিকা এই বাড়িত থাহে?”

 

রূপা বলল, “জি, আজিজুর আংকেলের মেয়ে।”

 

“ওহ, হে তো বাসাতই। সইন্ধ্যেবেলা দেখলাম।”

 

“এরপর আর বের হয়নি?” রূপা নিশ্চিত হতে চাইছে, অরুনিকা বাসায় আছে কি না৷ দারোয়ান বলল, “না৷ আইচ্ছা, আপনে এতকিছু জিগাইতেছেন কেরে?” দারোয়ান তাকে সন্দেহ করছে।

 

রূপা কী বলবে, কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আজিজুর আংকেল তাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। এই মুহূর্তে বাড়ির ভেতর গেলে তুফান শুরু হবে। সে দারোয়ানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, “আপনি কি নতুন দারোয়ান? “

 

“জ্বে না। আজকে রাইতের জন্যে আমি এইহানে আছি। কালকা নতুন দারোয়ান আইব। আমগোর বংশে কোনো দারোয়ান নাই। স্যার কইছেন দেইখা…”

 

রূপা তার পুরো কথা না শুনে গেইটের সামনে থেকে সরে গেল৷ সে নির্বাক হয়ে ভাবছে, হঠাৎ দারোয়ান পরিবর্তন হচ্ছে কেন? বাবা-মেয়ের মাঝে কি আবার বাকযুদ্ধ হয়েছে? তা না জানা অবধি শান্তি মিলবে না৷ অরুনিকার রুমের বারান্দার সম্মুখ বরাবর রাস্তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রূপা। এক টুকরো পাথর নিয়ে ছুঁড়ে মারল রুমের ভেতর। সঙ্গে সঙ্গে অরুনিকা বেরিয়ে এলো। ল্যাম্পপোস্টের নিচে রূপাকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না সে৷ তার হৃদয় জানত, ফোন বন্ধ পেলে রূপা ঠিক চলে আসবে। তবে আজকের রাতটা মোটেও শুভ নয়।  

 

অরুনিকাকে দেখে রূপা গলা জোর বাড়িয়ে বলল, “তোর ফোন বন্ধ কেন? কী হয়েছে?”

 

অরুনিকা ইশারায় চুপ হতে বলল। তারপর রুমের ভেতর ছুটে গিয়ে, একটা কাগজ হাতে নিয়ে ফিরে এলো। সঙ্গে একটা কলমও নিয়ে এসেছে৷ সে দ্রুত কিছু একটা লিখে সেই কাগজটা ভাঁজ করে রূপার দিকে ছুঁড়ে মারল। 

 

কাগজটির ভাঁজ খুলে রূপা পড়ল – 

“পাপা, আমার ফোন ভেঙেছে। উনি জেনে গেছেন আমি বাজারে যাই। উনার পরিচিত কেউ আমাকে আবাসিক হোটেলের সামনে দেখেছে৷ এজন্য পাপা আমাকে অনেক অপমান করেছেন। তোর সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছেন। বরাবরের মতোই উনার ধারণা তোর জন্য আমি এরকম হয়েছি। কিছুদিন বাবা বাড়িতে থাকবে আমাদের দেখা হবে না। চিন্তা করিস না আমার জন্য, আমি সুযোগ পেলেই তোর কাছে আসব। মা’র ফোন দিয়ে মেসেজ দেব। তুই বাবার সামনে আসিস না। অনেক খারাপ কথা বলবে, আমার সহ্য হবে না। আমি তোর কথা শুনলে, বাজারে ঘোরাঘুরি না করলে আজ এমন হতো না৷ আমি সরি দোস্ত। আমার জন্য সব হচ্ছে। আর এতো রাতে বের হয়েছিস কেন? আর কখনো এতো রাতে আসবি না। আজকের মতো একটা বিপদসংকুল রাতে তুই বাইরে! এখুনি বাড়ি ফিরবি। গলিতে ঢুকবি না, বাজার দিয়ে যাবি। লাভ ইউ, গুড নাইট।”

 

এরকম ঘটনা তাদের বন্ধুত্বের পর বহুবার ঘটেছে৷ রূপা কাগজটি বুকপকেটে রেখে অরুনিকাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল।

বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল সামনে৷ অরুনিকা বাসায় এতে সে নিশ্চিন্ত। যতক্ষণ রূপাকে দেখা গেল নির্নিমেষ লোচনে চেয়ে রইল অরুনিকা। সেই সাথে একটা প্রশ্ন তাকে ভাবিয়ে তুলল, রূপা সাইকেলে না চড়ে হেঁটে কেন যাচ্ছে?

ডেকে জিজ্ঞাসা করতেও পারল না। উসখুস লাগছে। কালই সে যেভাবে হোক রূপার কাছে যাবে।

 

রূপা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হতেই অরুনিকার স্মরণ হলো, সেই ছেলেটিকে যে সে পেয়েছে তা রূপাকে জানানো হয়নি। ধুর!

 

_

দুশ্চিন্তায় বারেকের হৃদগতি বেড়ে গেছে৷ তিনি বার বার রূপাকে কল করেছেন, রূপা কল রিসিভ করেনি। তিনি আকাশসম উদ্বেগ নিয়ে দোকানের সামনে মস্তকে হাত রেখে বসে আছেন। 

 

রূপার নয়াবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল সে বিষয়ে বারেক অবগত। তার বেশি কিছু জানেন না৷ তাই মেয়ের সন্ধানে বেরোতেও পারছেন না। তিনি ফোন নিয়ে আবার কল করলেন। রিংটোন শোনা যাচ্ছে! তিনি পিছনে ফিরে দেখেন রূপা চলে এসেছে৷ রূপাকে ধমকাতে যাবেন তখনই দেখলেন, রূপা খুঁড়িয়ে হাঁটছে, তার জামাকাপড়ে ময়লা। হাতে নজর পড়ে, হাতের চামড়াও ছিঁড়ে গেছে!

 

বারেক অস্থির হয়ে প্রশ্ন বললেন, “এভাবে হাঁটছিস কেন? হাতে এসব কী করে হলো? জামাকাপড়েও মাটি লেগে আছে!” 

 

রূপা একপাশে সাইকেল রেখে বলল, “সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, অন্ধকার ছিল তাই খেয়াল করিনি। এখন আবার এটা নিয়ে বিলাপ করবেন না আব্বা৷ আমি ঠিক আছি, বাসায় যাচ্ছি।”

 

“বাসায় পরে যাবি, আগে ডাক্তারের কাছে চল। কী করে এসেছিস তুই? আমার কথা কেন শুনিস না?”

 

“এখন আবার ডাক্তার কেন? এইটুকুই তো।’

 

বারেক রূপার বাহু চেপে ধরে জোর করে ফার্মেসীতে নিয়ে গেলেন। ক্ষতগুলো পরিষ্কার করে, ব্যথার ঔষধ নিয়ে তারপর বাসায় ফিরলেন। 

 

সুমনা রূপার অবস্থা দেখে উদগ্রীব হয়ে বললেন, “ওমা! এসব কী করে হলো? আবার কী করেছে তোমার মেয়ে?”

 

রূপা কিছু বলার আগে বারেক বললেন, “সাইকেল নিয়ে বের হয়েছিল, আমিই এক জায়গায় পাঠিয়েছিলাম। পথে এক্সিডেন্ট করেছে। “

 

তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান রূপার অনলাইনে অর্ডার নেয়ার বিষয়টা। যদি সুমনা এই খবর জানে, তাহলে রূপার এই টাকাও নিতে চাইবে। 

 

বারেক মনেপ্রাণে চান, রূপা নিজের জন্য কিছু করুক। নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক, নিজের জন্য অর্থ সঞ্চয় করুক। এতগুলো মানুষের জন্য ছোট থেকে নিজের সবকিছুই ত্যাগ করে এসেছে। এমনকি এই বাড়িটাও রূপার! অথচ সে-ই এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট, চিলেকোঠার রুমটায় থাকে। আর বাকিরা থাকে খোলামেলা বড় রুমগুলোতে৷ এতো এতো অন্যায়ের মাঝে এইটুকু পুণ্য বারেক করতে চান। রূপা তো তারই রক্ত।

 

রূপার অবস্থা দেখে সুমনা নরম হলেন। তার ভীষণ মায়া হয়। তিনি বললেন, “একটু দেখেশুনে চলাফেরা করতে পারিস না? কী অবস্থা করেছিস দেখ। এখনতো তোকেই ভুগতে হবে।”

 

রূপার মাথা ভনভন করছে। ঘুমালে ভালো লাগবে। সে ভ্রুকুটি করে বলল, “আমি যাই, ঘুমাব।”

 

“আগে ভাত খা। বাপ-মেয়ে বস, ভাত বাড়ছি আমি।” 

 

“আমি এখন খাব না৷ ভালো লাগছে না।”

 

বারেক কপট রাগ নিয়ে বললেন, ” অবাধ্যতা ভালো না রূপা। মা বলছে, চুপচাপ বসে পড়।”

 

বারেকের নাটকীয় রোষাগ্নি চেহারা দেখে রূপা টেবিলে বসল। সুমনা ভাত বেড়ে দিতে দিতে বললেন, “খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেন? পা কি মচকে গেছে?”

 

রূপা হাত ধুতে ধুতে ছোট করে বলল, “হুম।”

 

“ব্যথা করে?”

 

“সে তো করবেই।” রূপা উত্তর দিচ্ছে দায়সারাভাবে। 

 

সুমনা ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো নিয়ে এসে রূপাকে বললেন, “বাম পা’টা চেয়ারের উপর রাখ।”

 

রূপা চকিতে তাকাল। বলল, “কেন?”

 

“বরফ লাগালে ব্যথা কমবে ফোলা ভাবটা যাবে৷”  তারপরই গমগমে গলায় বললেন, “এতো কথা বলছিস কেন তুই? সব কথার উত্তর দিতে হবে?”

 

রূপা বিস্মিত নয়নে বারেকের দিকে তাকাল। বারেক ইশারা করলেন, রাখতে৷ রূপা পা রাখল। সুমনা তার পায়ের ফোলা অংশে বরফ মর্দন করতে করতে বললেন, “রাত-বিরেতে এদিকওদিক যাওয়ার কী দরকার?” তারপর বারেকের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, “আর তুমি এতো রাতে কেন পাঠাতে গেলে? আজ উনত্রিশ তারিখ জানো না তুমি? ও যে ফিরে আসছে এটাই আমাদের কপাল৷ আর কত বোকামি করবে? বয়স তো কম হলো না।”

 

বারেক প্রতিত্ত্যুরে কিছু বললেন না৷ সুমনা রুমি-রিনি জন্মানোর আগ অবধি এভাবেই রূপাকে ভালোবাসতেন, যত্ন নিতেন। রূপার কিছু হলে বারেককে বকাবকি করতেন। বহুদিন পর সেই দৃশ্যটা দেখতে পেরে বারেক মনে মনে হৃষ্ট৷ 

 

বরফ মর্দন করা শেষে রূপা খেতে উদ্যত হতেই সুমনা বললেন, “আঙুলের চামড়া তো উঠে গেছে, ঝোল মেখে ভাত খেতে পারবি? জ্বলবে না?”

 

“চেষ্টা করব।” সুমনা পায়ে বরফ মর্দন করে দেয়াতে রূপার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পায়ের ব্যথা চলে গেছে৷ তার কণ্ঠ নেমে এসেছে খাঁদে। 

 

সুমনা পাতিল নিয়ে এনে টেবিলের উপর রাখলেন। রূপার ভাতের প্লেটে দিলেন মাছের সবচেয়ে বড় টুকরোটি৷ তারপর ভাত মাখিয়ে রূপার মুখের সামনে ধরলেন। রূপা হতবাক। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, দৃশ্যটি স্বপ্ন লাগছে। মা শব্দটা তার কাছে কখনোই অসাধারণ হতে পারেনি। বুঝ হওয়ার পর থেকে মায়ের আদর পাওয়া হয়নি। সবসময় গঞ্জনাই সইতে হয়েছে। সুমনাকে এখন তার মায়ের মতোই লাগছে৷ সে হা করল। কয়েক লোকমা খাইয়ে হঠাৎ সুমনা বললেন, “রূপা, তোর কি আমার উপর অনেক রাগ?” 

 

রূপা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সেকেন্ড দুয়েক পর কোনোমতে বলল, “না আম্মা। কোনো রাগ নেই।”

 

সুমনা হঠাৎ কান্না করতে শুরু করলেন। রূপা চমকে গেল। বলল “কী হলো আম্মা, কাঁদছো কেন?” 

 

সুমনা চোখের জল মুছে বললেন, “তুই বুঝবি না।”

 

“বললেই তো বুঝি৷ আমি কী ছোট রয়েছি?”

 

সুমনা আরো দুই লোকমা খাইয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে। বলতে গেলে, পালিয়ে গেলেন। 

 

রূপা বারেককে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে আব্বা?”

 

বারেকও কিছু বললেন না৷ বা হয়তো বলতে চাননি।

 

রূপা নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তার মন এখন ভালো। অরুনিকা নিরাপদে আছে, আবার মা বহু বছর পর আজ তাকে খাইয়ে দিল৷ তবে অনেকগুলো প্রশ্ন মানসপটে ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে। বনে কী ছিল ওটা? সুমনা হঠাৎ পালটে গেলেন কেন? কেনই বা কাঁদলেন?

_

পরদিন রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পূর্বে রূপা খেয়াল করল, মানিব্যাগে পাঁচশ টাকা কম!

সে হন্নে হয়ে খুঁজেও মানিব্যাগ বা রুম কোথাও টাকাটা পেল না। 

 

তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, সাইকেল থেকে পড়ার সময় মানিব্যাগও পড়ে গিয়েছিল। তখন হয়তো টাকাটা পড়ে গেছে। এখন হাইওয়ে রোডে গেলে যে টাকাটা পাবে তার সম্ভাবনা নেই। রূপার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। পাঁচশ টাকা তার কাছে অনেক! 

 

কিন্তু আসল চমক ঘটে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে। সে  রুমের সামনে একটা খাম পেল। খুলে দেখে সেখানে পাঁচশ টাকার নোট! বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল রূপা। এই টাকাটাই কি তার? তবে কে রেখে গেল?

মাথায় এলোমেলো চিন্তা নিয়ে সে বাজারে এসে শুনে, হাইওয়ে রোডের বনে রাহাতি মণি নামে একজনের লা’শ পাওয়া গেছে! 

 

রাহাতি মণির লাশ, খু’নী আর পাঁচশ টাকার নোটের মধ্যে কী কোনো সূক্ষ্ম সংযোগ রয়েছে?

 

চলবে…

(প্রতি রবিবার ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার পর নতুন পর্ব আপলোড হবে, ইনশাআল্লাহ।)

 

সূর্যশিশির 

১৫.

বেলা তখন দশটা। রূপা হেঁশেলে প্রবেশ করতেই বারেক রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ” তুই হেঁশেলে আসতে গেলি কেন? একটা দিন বিশ্রাম নেয়া যায় না?”

 

রূপা অপ্রসন্ন মুখে বলল, “রুমে ভালো লাগে না।” পরপরই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, “এখনো নাকি মুরগি আনেননি। টাকা দেন নিয়ে আসি।”

 

“তোকে আনতে হবে না। সুজনকে পাঠাব। ও নিয়ে আসবে। তুই বাসায় গিয়ে বিশ্রাম কর।”

 

“বসে থাকতে ভালো লাগে না। এখানেই থাকি।” রূপার চোখেমুখে বিরক্তি। কণ্ঠে অনুরোধ। 

 

“টিভি দেখ গিয়ে। তোর ফোন আছে না?

মেয়েরা সারাদিন বাসায় বসে থেকে ফোনে কত কী দেখে, নাটক, ছবি, গান, ড্রেমা…” বারেক সঠিক নামটা মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে হতেই বললেন, “ড্রামা…ড্রামা। হারুনের মেয়েটা ফোন নাকি রাখতেই চায় না৷ দিনরাত ড্রামা দেখে। এজন্য হারুনের কত আফসোস। তুই দেখতে পারিস না? তাহলেই তো সময় কেটে যায়। “

 

রূপা হাসল। বর্তমান সময়ে, সন্তানরা ফোনে যেন সময় না দেয় সেজন্য বাবা-মায়েরা বকাবকি করে৷ আর তার বাবা বলছে, ফোনে ড্রামা দেখে অবসর কাটাতে। 

 

রূপা বলল, “আচ্ছা, যাচ্ছি। কিন্তু বিকেলে চলে আসব।”

 

তারও ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। পায়ে মৃদু যন্ত্রণা লেগেই রয়েছে৷ দাঁড়িয়ে থাকা বা হাঁটা দুটোই এখন পীড়াদায়ক। 

 

ফাইয়াজের বাড়ির পথ পেরোনোর সময় রূপার রাতের কথা স্মরণে এলো। ফাইয়াজ স্যারের অর্ডারটা বাকি ছিল! তাকে টাকা ফেরত দেয়া উচিত। 

 

গেইটের দ্বার ঠেলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করেই ফাইয়াজের বোন জেসমিন বখতিয়ারকে দেখতে পেল। তিনি সেচনী দ্বারা টব গাছে পানি ঢালছেন। 

 

তিন মাস অতিক্রান্ত হলো বখতিয়ার পরিবার এখানে এসেছে। অথচ রূপা একবারও তাদের দেখতে আসেনি। আজই তার প্রথম আগমন।

 

বাড়ির সামনের উন্মুক্ত অংশজুড়ে বিভিন্ন গাছ। ফুল গাছ সংখ্যায় একটু বেশি। প্রায় বারো বছর পর রূপা এই বাড়িতে প্রবেশ করল। যদিও তাদের বাসার ছাদ থেকে বাড়িটি দেখা যেত। তবে কাছ থেকে দেখতে অন্যরকম লাগছে! 

চারপাশ পরিপাটি। 

 

রূপাকে দেখে জেসমিন অবাক হলেন। সবিস্ময়ে  বললেন, “রূপা না?”

 

রূপা ওষ্ঠে হাসি ধরে রেখে মাথা নাড়াল। 

 

জেসমিন সেচনী রেখে এগিয়ে এসে বললেন, “এতগুলো দিন হলো এলাম, তোমার বাড়িতেও অনেকবার গেলাম কিন্তু তোমার সাথে আর সরাসরি দেখা হয় না৷ এইটুকু মেয়ে অথচ কত ব্যস্ত থাকো তুমি!” জেসমিন এমনভাবে কথা বলছেন যেন রূপা তার জনম জনমের চেনা। 

 

রূপা বলল, “আম্মার মুখে আপনার কথা শুনেছি। অনেকবার দেখেছিও, কখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি।”

 

“এইতো কথা হলো। চলো ভেতরে চলো।”

 

রূপা তুরন্ত বলল, “না… ” সম্বোধন করার মতো কিছু না পেয়ে তার কথা আটকে গেল। 

 

জেসমিনের বয়স চল্লিশের উর্ধ্বে। তিনি আবার সুমনাকে চাচি বলে ডাকেন। অথচ দুজনই প্রায় কাছাকাছি বয়সের। তাই রূপা দ্বিধায় পড়ে যায়, জেসমিনকে আপা ডাকবে নাকি আন্টি?

 

জেসমিন বললেন, “কীসের না? প্রথম এসেছো, একটু বসবে না? ভেতরে চলো।”

 

জেসমিন হাতে ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভেতরে৷ 

 

রূপা বাড়ির ভেতরে ঢুকে ড্রয়িংরুমের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমের তিন পাশ জুড়ে বইয়ের তাক, যা ছাদ ছুঁয়েছে; তাতে শত শত বই। মাঝে কাঠের নান্দনিক সোফা। দেয়ালে ঝুলানো কৃত্রিম লতাপাতা, পুরনো দেয়াল ঘড়ি। 

 

রূপা অবাক নয়নে চারপাশ দেখছে৷ তা খেয়াল করে জেসমিন বললেন, “আমি আর ফাইয়াজ বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি। দুজনে মিলে সাজিয়েছি। এখানে সব আমাদের প্রিয় বই। তুমি বসো না।”

 

রূপা সোফায় বসল। তার প্রথমে অস্বস্তি হলেও এখন ভালো লাগছে৷ মানুষটা সত্যিই অমায়িক। 

 

জেসমিন প্রশ্ন করলেন, “এখন বলো কী খাবে?” 

 

“না, না আ…” রূপা পুনরায় আটকে গেল। রুমি-রিনি আপা ডাকে যেহেতু তারও আপাই ডাকা উচিত। কিন্তু স্যারের বড় বোনকে আপা ডাকতে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ হচ্ছে৷ সে ম্যাডাম ডাকার সিদ্ধান্ত নিল। বলল, “না ম্যাডাম, কিছু খাব না৷ আমার স্যারের কাছে একটু প্রয়োজন ছিল। আজ তো শুক্রবার, উনি হয়তো বাসায় আছে।”

 

জেসমিন অবাক হয়ে বললেন, “আমাকে ম্যাডাম বলছ কেন? আর স্যারই কাকে বলছো?”

 

“যখন ক্লাস টেনে ছিলাম, কোচিংয়ের ষোলতম ব্যাচে ফাইয়াজ স্যার ইংলিশ টিচার ছিলেন।” 

 

জেসমিন হাসিতে মাখামাখি হয়ে বললেন, “কয়েক মাস ব্যাচে পড়িয়েছিল এজন্য এতবছর পর এসেও স্যার ডাকতে হবে? ভাইয়া বলবে। আর আমাকে ভুলেও আর ম্যাডাম বলবে না। আপা বলে ডাকবে। আমার একটু বয়স বেশি, তাতে কী! যেহেতু তোমার ছোট বোন আমার ভাইয়ের বউ হবে, তোমাকে তো আপাই ডাকতে হবে।”

 

রূপা চকিতে তাকাল। বলল, “ছোট বোন? মানে রুমি?” 

 

রূপার প্রতিক্রিয়া দেখে জেসমিন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বললেন, “হ্যাঁ, তুমি জানো না?”

 

রূপা বাকহারা হয়ে গেল। তার বোনের বিয়ে আর সে জানে না! রূপা কোনোরকমে বলল, “না।” থামল, ঢোক গিলল। তারপর বলল, “কবে বিয়ে?”

 

জেসমিন অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইলেন। বড় বোন নাকি একই বাড়িতে থেকে ছোট বোনের বিয়ের খবর জানে না! এ তো অভূতপূর্ব ঘটনা! তিনি বললেন, “সুমনা চাচির সাথে তো কথা হলো। বিয়ের দিন তারিখ সোমবারে দুই পরিবার একসঙ্গে বসে ঠিক করব। ওদিনই ফাইয়াজ রুমিকে আংটি পরিয়ে আসবে। তুমি জানো না ভেবে অবাক হচ্ছি। সত্যিই জানো না? চাচি বলেনি?”

 

রূপার মনের গগনে ঘনীভূত হয় ঘন মেঘ। এই খবরটাও তার মা তাকে দিল না! সে তো বাহিরের কেউ না, পরিবারেরই বড় মেয়ে৷ তাছাড়া রুমি এতো ছোট! স্যারের সাথে বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি। কী করে এই বিয়ে হতে পারে?

 

রূপা বলল, “সকালে বের হই, রাতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। বলার সুযোগ পায়নি হয়তো।”

 

‘ও, আচ্ছা তুমি বসো। আমি আসছি।” রূপার বিব্রত কায়া দেখে জেসমিন আর কথা বাড়ালেন না৷ 

 

রূপা ঠায় বসে ছিল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ফাইয়াজ এলো ড্রয়িংরুমে। সে রূপাকে দেখে কোনো রকম ভাব-প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ধীর পায়ে নিজের মতো হেঁটে চলে গেল বারান্দায়৷ 

 

রূপা পিছু পিছু গিয়ে নরম সুরে ডাকল, “স্যার?’

 

ফাইয়াজ দুই হাত এদিকওদিক নাড়িয়ে বলল, “বলো।”

 

রূপা মানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে ফাইয়াজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আপনার টাকাটা।”

 

ফাইয়াজ নিজস্ব নৈপুণ্যতায় ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। সময় নিয়ে রূপার হাতের টাকাটা দেখল। এরপর বলল, ” আমি কিছু অর্ডার করেছিলাম! অথচ তুমি তা না দিয়ে টাকা ফেরত দিচ্ছো?” কণ্ঠটা কাঠকাঠ লাগল। 

 

রূপা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “সরি স্যার। আপনি যখন অর্ডার করেছিলেন, তখন আমার রান্না শেষের দিকে ছিল। আলাদা করে আবার করার সময় পাইনি।”

 

ফাইয়াজ সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, “তা আমার দেখার বিষয় না। যখন অর্ডার করেছি তখনই তোমার ম্যানেজারের না করা উচিত ছিল। কিন্তু সে করেনি। যদি করত, আমি অন্যখানে অর্ডার করতাম। আমাকে সারারাত ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা করতে হতো না। অপেক্ষা করেও কিন্তু যা চেয়েছি তা পাইনি। টাকা ফের‍ত দিতে এসেছো। স্ট্রেঞ্জ!” 

 

ফাইয়াজের কথাতে রূপার অপরাধবোধ হয়৷ সে সুজনকে বলেছিল, আর কোনো অর্ডার না নিতে৷ কিন্তু সে ঠিক নিয়েছে। ফাইয়াজ স্যার এখন যা বলছেন ঠিক বলছেন। তিনি ক্ষুধার্ত ছিলেন সারারাত! রূপা অপরাধী সুরে বলল, “সরি স্যার।” 

 

“কীসের সরি? এভাবে তুমি বিজনেস করবে? কাস্টমারদের হয়রানি করে? এরকম চললে, তোমার বিজনেস লাটে উঠবে। এবার তুমি আমার হয়রানির ক্ষতিপূরণ দাও।”

 

রূপা থতমত খেয়ে বলল, “ক্ষতিপূরণ?”

 

“হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণ।”

 

রূপার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে আতঙ্কিত হলো। স্যার কি ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা চাইবে? ক্ষতিপূরণ তো টাকাই হয়! নিশ্চয়ই কানে ধরাবে না অথবা স্কেল নিয়ে এসে বলবে না, হাত পাতো দেখি!

টাকাই চাইবে! রূপা বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

 

ফাইয়াজ সেচনী হাতে নিয়ে বলল, “ক্ষতিপূরণ না দিলে কিন্তু আমি পুলিশের কাছে যাব, তোমার নামে মামলা করব।”

 

“কিহ?” ঝড়ের গতিতে শব্দটি রূপার মুখ থেকে নিঃসৃত হলো। 

 

“যা শুনেছো ঠিক শুনেছো। তুমি আমাকে সারারাত অপেক্ষা করিয়েছো। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে যেতেও পারতাম। আল্লাহর রহমতে অনেক বড় বিপদ হতে গিয়েও হয়নি।” ফাইয়াজ গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলছে।

 

রূপা কৈফিয়ত দেয়ার সুরে বলল, “আমি গতকাল এক্সিডেন্ট করেছি। তাই পারিনি। বিপদ তো আর বলেকয়ে আসে না স্যার।”

 

“খবরটা রাতেই পেয়েছি। এখন তো ঠিক আছো? পায়ে নাকি বেশি ব্যথা পেয়েছো? এখন হাঁটতে পারো? একটু হেঁটে দেখাও তো।”

 

রূপা বাধ্যের মতো হেঁটে দেখাল। সে ফাইয়াজকে ভয় পায় না কিন্তু মান্য করে। নাকি একটু ভয়ও পায়? 

 

ফাইয়াজ মনোযোগ দিয়ে রূপার হাঁটা দেখল। বলল, “এখনো পায়ে ভালো করে ভর দিতে পারছ না। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। টাকাটা ফেরত দিতে হবে না। সুস্থ হয়ে আমার বিরিয়ানি পাঠিয়ে দিও।”

 

মুহূর্তে মত পরিবর্তন! রূপা বলল, “ক্ষতিপূরণ তাহলে লাগবে না?”

 

ফাইয়াজ ভ্রুকুটি করে বলল, “দিতে চাও নাকি?”

 

রূপা দ্রুত বলল, “একদমই না।” 

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

১৬.

“তোর পাপা বারান্দায় বসে আছে।”

অরুনিকা বাসা থেকে বের হওয়ার পায়তারা করছিল। সেলিনার কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। সেলিনা বুকের কাছে দুই হাত ভাঁজ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অরুনিকা দ্রুত নিজের অভিব্যক্তি সামলে বলল, “তাতে আমার কী? আমি কি কোথাও যাচ্ছি? হাঁটছিলাম একটু।”

 

বাক্য শেষ করেই সে নিজের রুমে চলে এলো। পিছু পিছু এলেন সেলিনা। রুক্ষ কণ্ঠে বললেন, “তোমার পাপা বাসায়, দয়া করে আমাকে আর অশান্তি দিও না।”

 

অরুনিকা বিছানায় বসে বলল, “কী করলাম আমি?”

 

“তুমি আবার বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিলে। এমনটা করো না। গতকাল রাতে তোমাকে এতো বকলো, ফোন ভাঙল তবুও তোমার শিক্ষা হয়নি। একদিনও পার হয়নি অথচ তুমি বেরিয়ে যেতে চাচ্ছো। এটা মনে রেখ, যদি একবার বের হও তোমার পাপা আর ঢুকতে দিবে না বাসায়।”

 

অরুনিকা তির্যকভাবে তাকায়। বলল, “ভাইয়ার মতো?” 

 

সেলিনা ক্ষনিকের জন্য থমকালেন। তারপর বললেন, “জানোই যখন, নিজেকে শুধরে নাও।”

 

“ভাইয়া কোনো দোষ করেনি মা আর আমিও কোনো দোষ করিনি।”

 

সেলিনা ফুঁসে উঠলেন, “চুপ করো। বাজারে ভালো মেয়েরা চলাফেরা করে না। আর অর্ণবকে নিয়ে তোমার কিছু বলতে হবে না, ভাবতেও হবে না। সে দোষ করেছে নাকি করেনি সেটা আমাদের বিষয়। তুমি নিজেরটা ভাবো, বুঝেশুনে চলাফেরা করো। দয়া করে বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করো না। তোমার পাপা যেন আমাকে কথা না শোনায়। আমি তার ক্রোধের মুখোমুখি হতে চাই না।”

 

সেলিনা গজগজ করতে করতে চলেই যাচ্ছিলেন, অরুনিকা বলল, “তুমি ইস্ট্যাবলিশ হয়েও পাপাকে এতো ভয় পাও কেন?”

 

সেলিনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। নিম্ন কিন্তু ভারী সুরে বললেন, “ভয় পাই না, তোমার পাপাকে আমি ভালোবাসি। আমি চাই না এই বয়সে এসে তোমার পাপা উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ুক।”

 

সেলিনা প্রস্থান করলেন। অরুনিকা থ মেরে বসে রইল কিয়ৎক্ষণ। সপ্তাহখানেক পর রমযান মাস। আর ঈদের পর তার ভার্সিটি এডমিশন। এখন তাকে অষ্টপ্রহর বই নিয়ে থাকা উচিত। অথচ সে পড়তে পারছে না। পড়তে না পারার অপারগতা তাকে আরো বেশি বিষিয়ে তুলছে। রূপার খোঁজ নিতে হবে। রূপার সাথে কথা বললেই মন শান্ত হয়।

 

অরুনিকা ড্রয়িং ও ডাইনিং রুম খুঁজে সেলিনাকে পেল না। সে তার বড় ভাই অর্ণবের রুমে গিয়ে দেখে, সেলিনা সেখানে আনমনা হয়ে ফুলদানি পরিষ্কার করছেন। সে রুমের বাহির থেকে কোনোরকম ভূমিকা ছাড়া বলল, “তোমার ফোনটা দাও মা।”

 

সেলিনা ফুলদানি পরিষ্কার করতে করতে শান্ত সুরে বললেন, “ফোন কেন?” 

 

“দরকার আছে।”

 

“রুমে গিয়ে পড়তে বসো।”

 

অরুনিকা রুমের ভেতর প্রবেশ করে অনুনয় করে বলল, “প্লিজ মা, রূপার একটু খোঁজ নিতে দাও। তারপর আমি সারাদিন পড়ব।”

 

সেলিনা ফুলদানিটা রেখে অরুনিকার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। বললেন, “কী হয়েছে ওর যে, একদিন খোঁজ না নিলে…”

 

অরুনিকা তাৎক্ষণিক কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “গতকাল রাতে আমার ফোন বন্ধ পেয়ে বাসার সামনে এসেছিল। তখন দেখলাম, কেমন করে যেন হাঁটছে। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করতে চাই, ওর কী হয়েছে। দাও ফোনটা, প্লিজ। রিকুয়েষ্ট করছি।”

 

মমতাময়ী মায়ের মায়া হয় সন্তানের প্রতি। সেলিনা সচেতন হয়ে আজিজুরের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেন। কখন না তার আবির্ভাব ঘটে! তিনি ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে বললেন, “সময় এক মিনিট। যা বলার আমার সামনে বলবে।”

 

অরুনিকা চোখমুখ কুঁচকে বলল, “এটা কোন ধরনের সন্দেহ মা! আমি কি অপরাধ করছি? আর এক মিনিটে কী কথা বলব?”

 

“তাহলে কথা বলতে হবে না৷ গিয়ে পড়তে বসো।” সেলিনা নিজের শর্তে দৃঢ়।

 

অরুনিকা ব্যথাহত, স্তিমিত চোখে চেয়ে রইল মুহূর্তখানেক। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “ঠিক আছে, দাও।”

_

বাড়ি ফিরে নীরবে নিজের রুমে শুয়ে আছে রূপা৷ সে যে বাড়ি ফিরেছে সুমনার নজরে পড়েনি। রূপার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে আছে। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। রুমির বিয়ের কথাবার্তা এতো দূর এগিয়ে গেল আর বড় বোন হয়ে সে কিছুই জানে না! এই ব্যাপারটা তার কাছে দূর্বিষহ ঠেকছে। চেপে রাখা অভিমান ভয়ংকর হয়, এক সেকেন্ডের জন্যও শান্তি দেয় না৷ তাই রূপা বিছানা ত্যাগ করে নিচ তলায় নেমে আসে। সুমনার রুমে গিয়ে দেখল, সুমনা একটা ফটো হাতে নিয়ে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। রূপা অবাক হলো। সবিস্ময়ে ডাকল, “আম্মা।”

 

সুমনা ধড়ফড়িয়ে ওঠলেন। দ্রুত ফটোটি আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেললেন৷ রূপার অবাকের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। সুমনা চোখের জল মুছে বললেন, “তুই কখন এলি? দোকানে না গিয়েছিলি?”

 

রূপা মন্হর গলায় বলল, “আব্বা জোর করে পাঠিয়ে দিলো।”

 

সুমনা স্বাভাবিক হওয়ার ছল করলেন। হাতের ফটোটি আলমারির ভেতর রেখে বললেন, “ভালো করেছে। আজ বিশ্রাম নে। কিছু খাবি?”

 

মায়ের হঠাৎ পরিবর্তন, তার কান্না, অজ্ঞাত ফটো লুকিয়ে ফেলা – ব্যাপারগুলো রূপার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু সেসব নিয়ে প্রশ্ন করার সময় এখন না। সে যা বলতে এসেছে তা বলার প্রস্তুতি নিয়ে বলল, “কিছু কথা ছিল।”

 

সুমনা পূর্বের ঝাড়া বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “কী কথা? বল।”.

 

রূপা এক হাতে গ্রীবা ম্যাসাজ করতে করতে বলল, ” রুমিকে নাকি সোমবার পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে?”

 

সুমনার হাত থেমে গেল। তিনি রূপার চোখে চোখ রেখে বললেন, “কে বলল?”

 

সুমনার প্রতিক্রিয়া দেখে রূপা দ্বিধায় পড়ে গেল, যে খবরটি শুনল সেটি আদৌ সত্য কি না তা নিয়ে অন্তঃকরণে সংশয় সৃষ্টি হলো। বলল, “ফাইয়াজ স্যারের টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম, তখন উনার বোন বলল। সত্য না?”

 

“কীসের টাকা?” সুমনার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়।

 

“স্যার কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার করেছিলেন। সময়ের জন্য করে দিতে পারিনি তাই টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম।” 

 

সুমনা হইহই করে উঠলেন, “সেকি! তুই ফাইয়াজের থেকে টাকা নিয়েছিস? খবরদার আর নিবি না৷ তোর বোনের জামাই হবে কয়দিন পর।”

 

তাহলে যা শুনেছে তা সত্য! রূপার বুকে উথলে ওঠে অভিমান। নিজের অভিমান প্রকাশ করতে গিয়েও প্রকাশ করতে পারল না। হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমাকে তো জানাওনি তাই টাকা নিয়েছি। এরপর থেকে আর নেব না।”

 

সুমনা গদগদ কণ্ঠে বললেন, ” তোর এখন কত কাজ, বোনের বিয়ে বলে কথা। সোমবারে ওরা আসবে৷ ওদিন কিন্তু হোটেল বন্ধ থাকবে৷ বাসায় রান্না হবে। সব কিছু তোকে করতে হবে।”

 

“ঠিক আছে।” রূপা অন্যবেলা হলে ঝাঁঝ নিয়ে কথা বলতো, কিন্তু এই মুহূর্তে পারছে না৷ হেতু, গতকাল রাতে সুমনার দেয়া স্নেহার্দ ও ভালোবাসা। 

 

রূপা রুম ছেড়ে বেরোতে গিয়ে আবার ফিরে তাকাল। বলল, “রুমি কি রাজি? মানে, ওদের বয়স পার্থক্য তো অনেক। বিয়ে নিয়ে রুমি কী বলে?”

 

“ও কী বলবে? আমরা যা সিদ্ধান্ত নেব, তাই হবে৷”

 

বুকপকেটে ফোন বেজে ওঠল। রূপা পকেট থেকে ফোন নিয়ে দেখে “আন্টি” দিয়ে সেভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছে। নিশ্চয়ই অরুনিকা কল করেছে! 

 

রূপা দ্রুত পায়ে ছাদে চলে আসে৷ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে অরুনিকার কণ্ঠ – 

 

“তুই গতকাল পা টেনে টেনে হাঁটছিলি কেন?”

 

তার সোজাসাপটা প্রশ্ন! রূপা রাতে অনেক চেষ্টা করেছে ঠিক হয়ে হাঁটার, পারেনি। অরুনিকার নজরে পড়েই গেছে৷ সে অকপটে মিথ্যে বলল, “পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। এখন ঠিক আছি।”

 

“কখন হয়েছিল? “

 

“গতকাল বিকেলে।”

 

“মিথ্যে বলছিস কেন?”

 

রূপা থতমত খেয়ে গেল। বলল, “মিথ্যে হবে কেন?”

 

“তুই বিকেলে ব্যথা পেলে সাইকেল নিয়ে আসতি না। হয় রিক্সা দিয়ে নয়তো হেঁটে আসতি। যেহেতু সাইকেল ছিল সাথে, তুই আমার এলাকায় আসার আগে ঠিকই ছিলি, ব্যথা পাসনি। পথে কিছু হয়েছে৷”

 

রূপা মাথায় হাত দিয়ে কৌতুক করে বলল, “ওরেব্বাস! এতো ট্যালেন্ট নিয়ে ঘুমাস কী করে?”

 

“যা বলেছি, উত্তর দে৷ তারপর বলছি, কীভাবে ঘুমাই।”

 

“আরে তোদের যে অন্ধকার গলি, ওখানে পড়ে গিয়েছিলাম৷ এটা নিয়ে এতো কাহিনি করার কী আছে?”

 

“তুই বাজার রেখে অন্ধকার গলি দিয়ে আসতে গেলি কেন?”

 

“ভুল হয়েছে মা, ক্ষমা করে দে।”

 

অরুনিকা নিভল, “এখন ঠিক আছিস?”

 

“হ্যাঁ, পারফেক্ট আছি। এখন তুই আমাকে বল, তুই কেমন আছিস? আন্টি কোথায়?”

 

অরুনিকা আড়চোখে সেলিনার দিকে তাকাল। রূপাকে বলল, “আমি ভালো আছি৷ মা পাশে।”

 

“পাহারা দিচ্ছে নাকি? মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তোর বান্ধবী না বয়ফ্রেন্ড। যেভাবে তোর বাপ-মা…”

 

“শোন, রাখছি। আমি ভালো আছি। আল্লাহ হাফেজ।”

 

রূপা কিছু বলার আগেই অরুনিকা কল কেটে দিল। 

 

_

রবিবার। আজিজুর ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছেন। দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে অরুনিকা। রূপা বৃহস্পতিবার রাতে এসেছিল, বারান্দা থেকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে – এই খবর দারোয়ান আজিজুরকে দিয়েছিল। তারপর আজিজুর অরুনিকাকে অর্ণবের রুমে স্থানান্তর করেছেন। অরুনিকার রুমে দিয়েছেন তালা। তিনি মনেমনে ফন্দি আঁটছেন অরুনিকাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার। রূপার সাথে অরুনিকার মেলামেশা আর সহ্য করতে পারছেন না।

 

কলিং বেল বেজে ওঠল। আজিজুর গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “এই সেলিনা…দেখো তো কে এসেছে।”

 

সেলিনা দরজা খুলে দেখেন ডেলিভারি ম্যান দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় ক্যাপ, হাতে পার্সেল। মুখ ঢেকে রাখা মাস্কে। ডেলিভারি ম্যান নম্র কন্ঠে বলল, “আপনি কি অরুনিকা চৌধুরী?”

 

সেলিনা বললেন, “না, আমার মেয়ে অরুনিকা।”

 

“উনাকে একটু ডেকে দিবেন? উনার একটা পার্সেল ছিল।”

 

“ও তো ঘুমাচ্ছে! আপনি আমার কাছে পার্সেল দিন।”

 

ডেলিভারি ম্যানকে বিব্রত হতে দেখা যায়। তার দৃষ্টি অসহিষ্ণু। পরক্ষণে শান্ত হয়ে এগিয়ে দিল পার্সেল। সেলিনা জানতে চাইলেন, “পেমেন্ট বাকি?”

 

“না ম্যাম।”

 

“আচ্ছা, আসুন।” 

 

তিনি দরজা বন্ধ করে পার্সেল নিয়ে অরুনিকার রুমে রাখলেন। ড্রয়িংরুমে আসতেই আজিজুর প্রশ্ন করলেন, “কে এসেছিল?

 

“ডেলিভারি ম্যান৷ অরুনিকা কিছু অর্ডার করেছিল।”

 

“কী অর্ডার করেছে?”

 

“এসব নিয়েও এখন প্রশ্ন করবে? তুমি জানো না ও সর্বক্ষণ কিছু না কিছু অর্ডার করে।”

 

আজিজুর আর কথা বাড়ালেন না।

 

অপরাহ্নে অরুনিকা জাগ্রত হয়ে ড্রেসিং টেবিলে পার্সেল দেখে অবাক হলো। অলস ভঙ্গিতে হাই তুলল। পাপা কি ফোন গিফট করেছে? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই সে ধড়ফড়িয়ে ওঠে পার্সেল খুলল। কিন্তু ফোনের বদলে এক জোড়া নুপুর আর একটা চিরকুট পেল। অরুনিকা ভীষণভাবে চমকাল। চিরকুট খুলে দেখল তাতে লেখা –

 

মনোহারিনীকে একটিবার ছাদে আসার অনুরোধ রইল।

 

ইতি, 

হিরণ মজুমদার।  

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

১৭.

কে এই হিরণ মজুমদার? তাদের বিল্ডিংয়ে তো এই নামে কেউ নেই। অরুনিকার কপালে সৃষ্টি হয় গুটি কয়েক ভাঁজ। সে চিরকুটটি হাতে নিয়ে থম মেরে বসে রইল অনেকক্ষণ। পার্সেলটি রুমেই বা কে রাখল? অরুনিকা সংশয় কাটাতে চিরকুটটি ড্রয়ারে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে সেলিনাকে প্রশ্ন করল, “মা, রুমে পার্সেল কে রেখেছে?”

 

“তুই কিছু অর্ডার করিসনি?” 

 

অরুনিকা দ্বিধায় পড়ে যায়। কীরকম উত্তর দেয়া সমীচীন হবে আন্দাজ করতে পারছে না৷ সেলিনা জহুরি চোখে তাকালেন। বললেন, “ডেলিভারি ম্যান দিয়ে গেল। এটা তোর পার্সেল না?”

 

অরুনিকা অম্লানবদনে বলল, “হু আমারই। ডেলিভারি আরো এক সপ্তাহ পর পাওয়ার কথা ছিল, তাই অবাক হয়েছি। আচ্ছা, তুমি কাজ করো। পাপা কোথায়?”

 

“একটু বের হয়েছে। চলে আসবে। কোথাও যাওয়ার কথা ভেবো না।”

 

“একটু ছাদে যেতে চাই।”

 

“ছাদে কেন?”

 

“রুমে দমবন্ধ লাগছে। এতো বেঁধে ফেলো না আমাকে, প্লিজ। ছাদে অন্তত যেতে দাও।” 

 

“আটকাচ্ছি না। শুধু প্রশ্ন করেছি। টি-শার্ট পরিবর্তন করে সালোয়ার কামিজ পরে যাও।”

 

“ঠিক আছে।”

 

অরুনিকা রুমে এসে পোশাক পরিবর্তন করে, থ্রিপিস পরে নিলো। সে পুনরায় চিরকুটটি হাতে নিয়ে দেখল, অবাক হলো। মনে মনে আওড়াল, “চৌধুরী বাড়ির ছাদে চলে আসার মতো সাহস দেখিয়েছো তুমি, যে সাহস রূপাও কখনো করেনি। তোমাকে না দেখা অবধি আমার শান্তি নেই।”

 

অরুনিকা বের হতেই সেলিনা দারোয়ানকে কল করে বললেন, অরুনিকা বাহিরে যেতে চাইলে যেন না দেয়া হয়। আজ যদি অরুনিকা বের হয়, আজিজুর তাকে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলবে। 

 

তখন গোধূলী লগ্ন। পাখিরা আকাশে হুটোপুটি খাচ্ছে। তা দাঁড়িয়ে দেখছে হিরণ। তার লম্বা গড়ন। পরনে কালো শার্ট এবং কার্গো প্যান্ট। মাথায় গ্রে শেড কটন হ্যাট। অরুনিকা ছাদে পৌঁছে সোজাসাপটা প্রশ্ন করল, “ছাদে কী করে এলেন?”

 

হিরণ ঘুরে দাঁড়াতেই অরুনিকা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে উত্তুরে হাওয়া বইতে লাগল। সেই তীক্ষ্ণ চোখ, ললাটে ছড়িয়ে থাকা চিকচিক করা চুল! যে মানুষটা এতদিন তার শয়নেস্বপনে ছিল সেই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষটা আজ তার সামনে! অরুনিকা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল।

 

হিরণ মৃদু সুরে বলল, “সাত-সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তোমার দুয়ারে এসেছি।”

 

কথাটি কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই অরুনিকা হৃদয় চঞ্চল হয়ে ওঠল। সে বিভ্রম নিয়ে বলল, “আপনি আমাকে চিনেন?”

 

“চিনি। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকে চিনি।”

 

অরুনিকা বাঁধভাঙা আনন্দ অনুভব করে। বুকজুড়ে একটা উত্তাল ঢেউ খেলে যায়। মানুষটা এমনভাবে চেয়ে আছে, এমনভাবে কথা বলছে যেন তাদের হাজার বছরের চেনা-পরিচয়। অরুনিকার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনো রকমে বলল,  “কেন ডেকেছেন?” 

 

“দেখতে ইচ্ছে করল তাই।” তার অকপট স্বীকারোক্তি। 

 

অরুনিকা সু-নয়নে তাকাল। হিরণের জোড়া ভ্রুয়ে আটকে গেল চোখ। সে বলল, “ভয় হয়নি? যদি আমি আমার পাপা অথবা মা’কে নিয়ে আসতাম?”

 

“না, হয়নি। কাউকে দেখতে চাওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ না?”

 

অরুনিকা বিব্রতবোধ করছে। এমনভাবে সাক্ষাৎ ঘটবে সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। হিরণ এতো সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে, মনে হচ্ছে না এটা তাদের সরাসরি প্রথম দেখা৷ তার খুব লজ্জা করছে৷ সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই হিরণ বলল, “প্রতিদিন বিকেলে এখানে অপেক্ষা করব৷”

 

অরুনিকা না ফিরেই প্রশ্ন করল, “যদি না আসি?”

 

“জীবনভর অপেক্ষা করব।”

_

সকাল থেকে সুমনা ও রুমির মধ্যে বাকবিতন্ডা লেগে আছে৷ আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে শোনার পর থেকে রুমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।  ঘরের বেশকিছু জিনিসপত্র ভাংচুর করেছে। সে এখন বিয়ে করতে চায় না। সুমনা রুমির চুলের মুঠি ধরে পিটিয়েছেন; রেখেছেন ঘরবন্দী করে। তার দৃঢ় প্রত্যয়, রুমির বিয়ে ফাইয়াজের সাথেই হবে৷  

 

রূপার এসব ভালো লাগছে না৷ বিয়ে সারাজীবনের ব্যাপার। এভাবে জোর করে পনেরো বছরের মেয়েকে একজন সাতাশ-আটাশ বছরের পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়ার কী মানে? সুমনা বিকেলে তন্দ্রাঘোরে গেলে, রূপা রুমির রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। রুমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফ্লোরে বসে আছে। ফোপাঁচ্ছে। রূপা পালঙের এক কোণে বসে লঘু সুরে ডাকল, “রুমি?’

 

রুমি মুখ তুলে তাকাল। সে বিধ্বস্ত। তার এলো কেশ ছড়িয়ে আছে মুখজুড়ে। রূপা বলল, “জোর করে তোর বিয়ে দিতে পারবে না।  বাল্য বিবাহ রোধে পুলিশ আছে৷ দরকার পড়লে আমি পুলিশ নিয়ে আসব।”

 

রুমি কিচ্ছুটি বলল না। রূপা রুমির সামনে বসে বলল, “দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না৷ আমি স্যারের সাথে কথা বলব। স্যার এতোটা অবিবেচক হবে না৷ উনি বুঝবেন, নিজেই বিয়ে ভেঙে দিবেন।”

 

“তুই যা আপা।” বলল রুমি।

 

রূপা রুমির মাথায় হাত রাখতেই রুমি এক ঝটকায় হাতখানা সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোর কোনো সাহায্য আমার প্রয়োজন নেই।”

 

“সবসময় জেদ দেখানো ভালো না। আমিতো তোরই বোন, বড় বোন। কেন এমন করিস?” 

 

রুমি চিৎকার করে উঠে, “আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুই যা আপা, প্লিজ যা।”

 

রুমি এখন অশান্ত হয়ে আছে৷ তার সাথে কথা না বাড়ানোই মঙ্গল। অগত্যা রূপা বেরিয়ে এলো।

রেস্টুরেন্টে গিয়ে বারেককে বলল, “আব্বা, কথা ছিল।”

 

বারেক খরিদ্দারদের থেকে টাকা সংগ্রহ করে বললেন, “রুমির সম্পর্কে হলে বলার দরকার নেই। রুমি ওর মায়ের মেয়ে, ওদেরটা ওরা দেখুক। আমার কোনো মূল্য নেই এখানে। আমার অনুমতি ছাড়া সুমনা যা মন চায় করছে। করুক।” বারেকের কণ্ঠে স্পষ্ট অভিমান। তিনি মেয়ের বাপ হয়েও জানতেন না, আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে তার ঔরসের সন্তানকে দেখতে। 

 

রূপা বলল, “কিন্তু রুমি তো রাজি না। এখন রুমির পাশে আমরা যদি না দাঁড়াই আর কে দাঁড়াবে? যদি রাগে-অভিমানে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে?”

 

বারেক কাষ্ঠ গলায় বললেন, “আগামীকাল আসুক পাত্রপক্ষ, তাদের সাথেই কথা হবে।”

 

“ফাইয়াজ স্যার কীভাবে রুমিকে বিয়ে করতে চাইছেন! উনি কি রুমির বয়স জানেন না?” রূপা কিছুতেই ফাইয়াজের ব্যক্তিত্বের সাথে তার এই সিদ্ধান্ত মিলাতে পারছে না।

 

বারেক উপহাস করে বললেন, “তার শিক্ষা-দীক্ষা হাঁটুতে নেমে এসেছে।”

 

কথাটি কেন যেন রূপার গায়ে বিঁধল। ফাইয়াজ স্যার কি সত্যি এতোটা বিবেকহীন?

 

সে মাথার ক্যাপ খুলে সুজনের কাছে গিয়ে চাপাস্বরে বলল, “আজ ফাইয়াজ স্যার এসেছিল?”

 

সুজন থালাবাসন পরিষ্কার করছিল। পানির কল চালু থাকায় রূপার প্রশ্নটি তার কুর্ণকুহরে পৌঁছায় না৷ সে দুই চোখ ছোট ছোট করে বলল, “কী কইলা?”

 

রূপা পানির কল বন্ধ করে বলল, “ফাইয়াজ স্যারকে দেখেছিস?”

 

“না, স্যার তো আইজ কিছু কিনতে আয় নাই৷” 

 

“আসলে আমাকে ডাক দিস।”

 

“কেরে? কুনু দরকার আছিলো? “

 

রূপা সুজনের মাথায় টোকা দিয়ে বলল, “সব তোকে বলতে হবে? কাজ কর।” 

 

রূপা হেঁশেলে গিয়ে ঢুকল। যাই হয়ে যাক, কাজকর্ম বন্ধ করা যাবে না৷ 

 

সে বাড়ি ফিরে রাত বারোটায়। অরুনিকার সঙ্গে তার প্রতিদিন সকালে একবার কথা হয়। যতক্ষণ অরুনিকা কথা বলে ততক্ষণ সেলিনা তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই তাদের মধ্যকার অনেক কথা আদান-প্রদান করা সম্ভব হয় না। 

 

রূপা ফোন চার্জে লাগিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সারাদিনের কথাগুলো বলার মতো কেউ না থাকলে, বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়ে থাকে৷ এইযে রূপার এখন মনে হচ্ছে, তার বুকের ওপর পুরো পৃথিবীটা উঠে বসে আছে৷ সে মধ্যরাত অবধি এপাশ-ওপাশ করল। কিছুতেই ঘুম এলো না। ঘুমন্ত শহরজুড়ে তখন শুধু বেওয়ারিশ কুকুররা ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাঁকডাক করছে। মাঝেমধ্যে রূপারও নিজেকে বেওয়ারিশ মনে হয়! যার কোনো দাবিদার নেই। কেন এমন মনে হয়?

 

রাতের শেষ প্রহরে তন্দ্রামত লেগেছিল মাত্র, তখন ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এলো কানে। রূপা তড়াক করে উঠে বসল। তার বাড়ির সামনে ইঞ্জিনের শব্দ কেন আসবে? সে দরজা খুলে দেখে বাড়ির গেইটের সামনে মোটরসাইকেল নিয়ে বসে আছে একজন৷ তার মাথায় হেলমেট। দেখে মনে হচ্ছে, কারো জন্য অপেক্ষা করছে। 

 

রূপা উচ্চকণ্ঠে বলল, “কে ওখানে?”

 

লোকটি চকিতে তাকায়। রূপা আরেকটু এগিয়ে দেখে রুমি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে লোকটির দিকে এগোচ্ছে। তার হাতে ব্যাগ৷ রূপা চমকে ওঠে। রুমি কোথায় যাচ্ছে? হাতে ব্যাগ কেন? সে কি পালাচ্ছে?

 

রূপা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করল, “রুমি…রুমি। কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া।”

 

ততক্ষণে রুমি মোটর সাইকেলে উঠে পড়েছে। রূপা চিৎকার করে ডাকল, “আম্মা, আব্বা রুমি পালাচ্ছে।”

 

তারপর সে তাড়াহুড়ো করে সাইকেলে চড়ে বসে। মোটর সাইকেলটি শব্দ তুলে বিদ্যুৎ বেগে জায়গা ত্যাগ করে। 

 

চলবে…

(কপি করা নিষেধ।)

 

সূর্যশিশির 

১৮.

বাতাসের সঙ্গে সাঁ সাঁ ধ্বনি তুলে ছুটছে রূপার সাইকেল। তার সাইকেল থেকে মোটর সাইকেলটির দূরত্ব অনেক। সে বুদ্ধি করে রোড ছেড়ে গলি ধরে এগোতে থাকে সামনে। রঙ-বেরঙের দালান পাহারা দেয়া রাত জাগা প্রহরীরা মধ্যরাতে একটি মেয়েকে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালাতে দেখে অবাক হয়ে গেল। উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল। রূপার মাথায় ক্যাপ না থাকায় তার লম্বা চুলের ঝুঁটি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে একজন নারী; শুধুমাত্র বেশভূষা পুরুষ মানুষের।

 

মিনিট দশেক পর গলি ছেড়ে রোডে আসতেই তার পাশ কেটে মোটরসাইকেলটি চলে যাচ্ছিল, রূপা দ্রত জুতা খুলে ছুঁড়ে মারল। বলল, “রাজন মিয়ার পোলা তোরে আমি চিনে ফেলছি।”

জুতাটি সোজা গিয়ে রুমির পিঠে বারি খেল। 

 

মোটর সাইকেলটি নিমিষে রোডের শেষ প্রান্তে চলে যায়। রূপা পিছু নেয়ার মতো আর শক্তি পেল না। পিছু নিয়েও কোনো উপকার হবে না।  সে ছেলেটিকে চিনতে পারেনি! আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে মাত্র! যদি সত্যি রাজন মিয়ার ছেলে হয় চিনে ফেলার ভয়ে অবশ্যই রুমিকে নিয়ে ফিরে আসবে। তবে যদি অন্য কেউ হয়? মোটর সাইকেলটিও যেন খুব দামী মনে হলো! এলোমেলো চিন্তায় বিভোর হয়ে রূপা পাড়ায় ফিরে আসে।

 

পাড়ার মোড়ে বারেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বারেক তাকে দেখে হনহনিয়ে হেঁটে এসে ব্যস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, “ধরতে পারিসনি?”

 

রূপা নিরাশ ভঙ্গিতে বলল, “না।”

 

রাতের শেষ প্রহরে রূপা ও বারেক বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসে। 

সুমনা বিধ্বস্ত অবস্থায় দুই ছেলে ও ছোট মেয়েকে নিয়ে গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আঁচল মুখে চেপে ধরে রেখেছেন। বাপ-মেয়েকে শূন্য হাতে ফেরত আসতে দেখে তিনি বাড়ির ভেতর গিয়ে প্রবেশ করলেন।

 

বারেক ও রূপা বাড়ির অভ্যন্তরে এলে, সুমনার গলা থেকে ছিটকে আসে চাপা আর্তনাদ, “রুমি এটা কী করল? আমাদের সম্মানের কথা একটাবার ভাবল না!”

 

বিপর্যস্ত সুমনাকে স্বান্তনা দেয়ার মতো ভাষা নেই রূপার। 

বারেক দূর্বল পায়ে চেয়ার টেনে বসলেন। তার চেহারা অন্ধকারচ্ছন্ন। ঘরের মেয়ে কোনো ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া মানে সমাজে সম্মান হারানো, মাথা হেঁট হওয়া। আগামীকাল এই খবর রটে গেলে তাদের জীবন দূর্বিষহ হয়ে ওঠবে। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন। ভীষণ অসুস্থবোধ করছেন। বুকে চাপ অনুভব হচ্ছে। 

 

সুমনা রূপার দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললেন, “তোর বোন কই গেল রে রূপা?”

 

রূপা বলল, “শান্ত হও আম্মা। কেঁদো না।”

 

সুমনা মাথা চাপড়ে বললেন, “কী করে শান্ত হব হ্যাঁ? কী করে শান্ত হব আমি? আগামীকাল যখন সবাই জানবে আমার মেয়ে পালিয়েছে, আমার এই বাচ্চাগুলোর কী হবে? তোর বাপ দোকানে বসলে প্রতি মুহূর্তে মানুষ কথা শুনাবে। সমাজ আমাদের, আমার নিষ্পাপ ছোট ছেলেমেয়েদের উচ্ছিষ্ট বানিয়ে রাখবে। আমি কী করব? রুমিকে এতো আদর করলাম, সবচেয়ে বেশি দিলাম তবুও এমন করল৷ বাবা-মায়ের কথা ভাবল না! এতোটা নিমকহারাম, এতোটা!”

 

রূপা মুখ ফসকে বলে ফেলল, “তুমিও তো ওর কথা ভাবোনি। জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছো।”

 

সঙ্গে সঙ্গে সুমনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। কিছু বুঝে উঠার পূর্বে বসা থেকে উঠে রূপার চুলের মুঠি ধরে বললেন, “খুশি হয়েছিস না? খুশি তো হবিই। তোর ভাগের সব রুমিকে দিয়েছি। আজ তো তোর খুশির দিন। তোর উৎসবের দিন। তুই খুশি হবি না তো কে হবে?”

 

রূপা ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠল। কোনোরকমে বলল, “আমি তোমাদের কথা সবসময় ভেবেছি আম্মা। কখনো ক্ষতি চাইনি। ছাড়ো আমার চুল।”

 

সুমনা ছাড়লেন না। রাগে-দুঃখে তার শরীর কাঁপছে, শরীর কিড়মিড় করছে। চোখ দুটি অস্বাভাবিক লাল। তিনি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে মানুষ খু’ন করা তার বাঁ হাতের কাজ। 

 

বারেক সুমনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। তীব্র প্রতাপ নিয়ে বললেন, “কিছু হলেই তুমি রূপার গায়ে হাত তুলো কেন? তোমার আদরের মেয়ে তোমার ভুলের জন্য তোমার মুখে চুনকালি দিয়ে পালিয়েছে। এখন সেই চুনকালি মাখা মুখ নিয়ে জীবন কাটাও।”

 

সুমনা দপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন। বাঁধ ভাঙা ঝর্ণার মতো হুহু করে কেঁদে ওঠলেন। রূপার মাথা ভনভন করছে ব্যথায়। সে অন্যদিকে গিয়ে বসল।

 

বারেক সুমনার পাশে বসে মৃদু স্বরে বললেন, “তুমি কাঁদলে কী করে হবে? আমি কতটা দূর্বল মনের তুমিতো জানো। কত সহজে ভেঙে পড়ি। এই পরিস্থিতি তো তোমাকেই সামাল দিতে হবে।”

 

বারেক কথা বলছেন থেমে থেমে। তার বুকের ব্যথাটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সুমনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাদের পাপের শাস্তি এটা তাই না?”

 

বারেক কিচ্ছুটি বললেন না। একসময় আবেগের তাড়নায় তিনিও সুমনাকে নিয়ে পালিয়ে এই শহরে এসেছিলেন। যদি এখনের বোধটা যৌবনে হতো, পালিয়ে বিয়ে করার মতো ভুল করতেন না। শেষ অবধি চেষ্টা করতেন পরিবারকে মানানোর। 

তিনি চুপচাপ একপাশে বসে রইলেন। আশিক-আরমান সোফায় শুয়ে পড়ে। 

 

হঠাৎ সুমনা কান্না থামিয়ে দৌড়ে দুই তলায় উঠে গেলেন। আকস্মিকতায় উপস্থিত সবাই চমকাল। পিছু নিলো সুমনার। সুমনা তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করলেন রূপার ব্যাগ। ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় ঢুকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখেন, বাকিরাও চলে এসেছে। তিনি সতর্কতার সঙ্গে চারপাশে চোখ বুলিয়ে ব্যাগ রূপার হাতে দিয়ে বললেন, “তুই এখুনি রিনিকে নিয়ে কোথাও চলে যাবি। রুমি যখন ফিরবে তখন তোরা ফিরবি।”

 

বারেক চিৎকার করলেন, “কী বলছো?”

 

সুমনা বললেন, “আমি ফাইয়াজের বাসায় বলব, ওদের নানি গুরুতর অসুস্থ তাই ওরা তিন বোন গ্রামে গেছে। আমি চাই না কেউ জানুক, রুমি পালিয়েছে।”

 

“কিন্তু আমাদের তো নানা-নানি কেউ নেই।” বলল রূপা।

 

সুমনা খরখরে গলায় বললেন, “নানি থাকতেই হবে কেন? আমি টাকা দিচ্ছি। তুইতো কত জায়গা চিনিস। যেকোনো কোথাও গিয়ে পড়ে থাক। রুমিকে পেলে আমি কল করব, তখন তোরা চলে আসবি। তিন বোন একসঙ্গে পাড়ায় ঢুকবি।”

 

রূপার ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। সে বলল, “পাগলামি করছো আম্মা। ওরা তো প্রশ্ন করবে, তিন বোনই কেন গেল? তোমরা কেন যাওনি?”

 

সুমনা এই কথায় থমকালেন। একটু ভেবে বললেন, “তাহলে আমরা সবাই যাব। আমি আর তোর বাপ, আরমান- আশিককে নিয়ে একদিন পর ফিরে আসব। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলব, তোদের নানি অসুস্থ, উনি তিন নাতনিকে ছাড়তে চায়নি। তাই রেখে আসছি। এটাই ভালো হবে।” 

 

সুমনা কারো মতামত না শুনে উন্মাদের মতো নিজের রুমের দিকে ছুটে গেলেন। বারেক ও রূপা বাকহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সুমনা সম্মানের ভয়ে পাগলের মতো আচরণ করছেন। তিনি নিজের মধ্যে নেই। রুমি কার সাথে গেল? কার পাল্লায় পড়ল? সেই চিন্তা সুমনার নেই। তার শুধু চিন্তা সম্মান হারানোর।

 

কিছুক্ষণ পর তিনি বোরকা পরে আরেকটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। ততক্ষণে বাকিরা নিচ তলায় নেমে এসেছে। সুমনা বারেককে একটা শার্ট দিয়ে তাড়া দিলেন, “এটা তাড়াতাড়ি পরো। “

রূপা বিরক্ত হয়ে বলল, “আম্মা তুমি পাগলামি করছো। সমাজের ভয়ে চোরের মতো পালাব কেন?”

 

সুমনা সশব্দে রূপার গালে থাপ্পড় বসালেন। রূপা থাপ্পড় খেয়েও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আরো মারো, যত ইচ্ছে মারো। কিন্তু তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক না। তুমি অতিরিক্ত করছো, পাগলামি করছো।”

 

“হারামির বাচ্চা, তুই বুঝতেছিস না কেন? মানুষ যদি জানে ঘরের মেয়ে নাগর নিয়ে ভাগছে, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব? পথেঘাটে সব জায়গায় মানুষ কথা শুনাবে।” 

 

সুমনা ভুল বলেননি। এই খবর একবার ছড়িয়ে গেলে তাদের পুরো পরিবারের মানসিক শান্তি সমাজের মানুষ নষ্ট করে দিবে। কিন্তু সুমনার বিপর্যস্ত অবস্থায় করা পরিকল্পনা কতটুকু কাজে দিবে?

 

রূপা বলল, “আচ্ছা, আমরা চলে গেলাম। এরপর যদি কখনোই রুমিকে না পাই? তখন কী এই পাড়ায় ফিরতে হবে না? কতদিন রিনিকে নিয়ে বাইরে থাকব?”

 

“তখন বলব, রুমি মরে গেছে৷ গ্রামে কবর দিয়ে আসছি।” 

 

রূপা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল। সুমনা রাগে-দুঃখে এতোটাই বিমূঢ় হয়ে আছেন যে তাকে চেনা যাচ্ছে না। তিনি কীসব বলছেন?  

 

বারেক এই পরিকল্পনার প্রতিবাদ করলেন। তিনি এভাবে পালাতে পারবেন না। আগামীকাল ফাইয়াজ, তার পরিবার ও পাড়ার গণ্যমান্য দুজন ব্যক্তিকে নিয়ে আংটি পরাতে আসবে। এসে যদি শুনে, রুমি বাড়ি নেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ঠিক; কিন্তু তাই বলে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই লুকোচুরি খেলা খেলবেন? কক্ষনো না। তিনি সাফ করে জানিয়ে দিলেন, “আমি তোমার এই ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে নাই।”

 

উত্তেজিত সুমনা মুহূর্তে বারান্দায় রাখা ব’টি নিজের গলায় ধরে বললেন, “তাহলে সকাল হওয়ার আগে আমার ম’রে যাওয়া ভালো।”

 

বারেক আঁতকে ওঠলেন। রূপা চিৎকার করল, “কী করছো আম্মা!”

 

আশিক, আরমান ও রিনি ভয়ে কাঁদতে শুরু করে।

 

বারেক সাবধান করে বললেন, “সুমনা, ব’টি নামাও। গলায় লেগে যাবে।”

 

“আমি যা বলি শুনো, নয়তো আমি…”

 

“যা বলবে তাই হবে৷ তুমি ব’টি নামাও।”

 

অগত্যা বাধ্য হয়ে তারা সুমনার পরিকল্পনা মেনে নিলো। 

ভোর হতে হতে পুরো পরিবার ত্যাগ করে রসন ভিলা।

 

এই পুরো দৃশ্যটি চিলেকোঠার রুম থেকে অবলোকন করল ফাইয়াজ। 

 

চলবে…

 

(কপি করা নিষেধ।)

 

সূর্যশিশির 

১৯.

অরুনিকা মোহে আবিষ্ট। সর্বক্ষণ হিরণকে নিয়ে ভাবছে আর ক্ষণে ক্ষণে দেখছে দিবাস্বপ্ন। হিরণের প্রতিটি কথা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

বিকেলের অপেক্ষায় সে অধৈর্য্য, কাতর। ছটফটানির জন্য সারাদিন পড়াশোনাও হয়নি। গতকাল অপরাহ্ন থেকে ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। যখনই পড়তে উদ্যত হয় হিরণের মুখ থেকে নিঃসৃত শব্দগুলো কর্ণকুহরে বাজতে থাকে।  

হৃদয়জুড়ে এখন একটাই স্লোগান, “হিরণ, হিরণ, হিরণ —”

এমতাবস্থায় কী করে হবে পড়াশোনা?

 

অরুনিকার অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে সেলিনা বললেন, “কী ব্যাপার? এতো অস্থির হয়ে আছো কেন?”

 

এহেন প্রশ্নে অরুনিকা প্রথমে চমকে গেলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে অকপটে বলল, “রূপা কল রিসিভ করল না বলে চিন্তা হচ্ছে।”

 

সেলিনা ভ্রুবক্র করে বললেন, “প্রতিদিনই কথা হতে হবে এমন কোনো কথা আছে? এতো ঘনিষ্ঠতা ভালো না। তোমার এই অতিরিক্ত টান আমার ভালো লাগে না। পড়াশোনা করো মন দিয়ে, ভালো জায়গায় চান্স পেতে হবে।”

 

অরুনিকা অংক বই নিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, যাও এখন। আমি পড়ছি।” 

 

“কিছু প্রয়োজন হলে ডাক দিও।”

 

সেলিনা চলে যাচ্ছিলেন, অরুনিকা বলল, “মা শুনো, পাপা কি বিকেলে বাসায় থাকবে?”

 

“থাকবে তো৷ কোনো দরকার?”

 

“বিকেলে হাঁটতে যেতে চাই ছাদে। বই নিয়েই যাব।”

 

“এখন পড় মন দিয়ে৷ তাহলে আমি ব্যবস্থা করে দেব।”

 

রাস্তার পাশে পাশাপাশি তিনটি আবাসিক হোটেল। নামগুলো হচ্ছে — তিলোত্তমা, সোহাগি ও সুবর্ণা। এগুলোতে খুব সস্তায় রাত কাটানো যায়৷ পরিবেশ খুব নোংরা। তিলোত্তমা ও সোহাগিতে প্রবেশ করলে বোটকা গন্ধ লাগে নাকে৷ সুবর্ণা মোটামুটি পরিষ্কার। সেখানেই উঠেছে রূপার পরিবার। দুপুরের খাবার কিনতে হোটেল থেকে বের হয় রূপা। রাস্তার বিপরীত পাশে অনেক দোকানপাট এবং কাঁচাবাজার৷ 

যতদূর চোখ যায় উঁচুনিচু বিল্ডিং৷ এখানে কোন সবুজ নেই, নির্মল হাওয়া নেই, বুক ভরে শ্বাস নেয়ার কোন সুযোগ নেই। রূপার ভীষণ হাঁসফাঁস লাগে।

 

চারপাশ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও ব্যস্ত হয়ে উঠে খাবারের দোকানগুলো, ফুটপাতের ভাসমান হোটেলগুলো। সেখানকার পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন। তবুও মানুষ এই হোটেলগুলোতে খাচ্ছে। দাম কম হওয়াতে, খাবারের মান ও পরিবেশ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, প্রশ্ন তুলে না।

একটা রেস্টুরেন্টে ডাল-ভাত কিনতে প্রবেশ করে রূপা। সেখানে অনেক মানুষ আনাগোনা করছে। সুমনা বলে দিয়েছেন, আশিক-আরমানের জন্য ডিমের ঝোল নিতে আর বাকিরা ডাল-ভাত খাবে। রূপা নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে রিনির জন্যও ডিমের ঝোল নিয়ে নিলো। 

 

তিনটি ডিম দেখে সুমনা বললেন, “তিনটে কেন?”

 

রূপা বলল, “রিনি তো আশিক-আরমানের থেকেও ছোট। ওর সামনে বড় ভাইয়েরা ডিম খাবে তখন কষ্ট পাবে না? তাই আরেকটা এনেছি। চিন্তা করো না, তোমার টাকায় আনিনি।”

 

“তুই টাকা কোথায় পেয়েছিস?”

 

“আমি কী কাজ করি না যে, টাকা থাকবে না?”

 

সুমনা দুটো ডিম রেখে বাকি ডিমটি ঝোলসহ পলিথিনে বেঁধে দিয়ে বললেন, “এটা ফের‍ত দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে আসবি। এক মেয়ে তো মুখে কালি মাখিয়ে পালিয়েছে, আরেক মেয়েকে এতো আদরের দরকার নেই। যা, ফেরত নিয়ে আয়।”

 

রূপা নিজের রাগ সংবরণ করতে পারল না। উচ্চস্বরে বলল, “আম্মা, অনেক করেছো, এখনো করছো। তোমার পাগলামিতে আমরা অতিষ্ঠ, এবার চুপ হও। রিনিকে ডিমটা খেতে দাও।”

 

সুমনা তেজপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, “তুই আমাকে হুকুম করছিস? তোর ভাত খাই আমি, হা?”

 

রূপা বলল, “আমারই খাও৷ আমি না থাকলে আব্বা ওই রেস্টুরেন্টের টাকায় তোমাদের ভরণপোষণ করতে পারত না৷ কারো পড়াশোনাও হতো না। “

 

সুমনা বিস্ফোরিত নয়নে বারেকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার মেয়ে কী বলছে? আমরা নাকি ওর ভাত খাই! খোঁটা দিচ্ছে আমাদের। এরপরও তুমি চুপ করে বসে থাকবে?”

 

বারেক তেজশূন্য গলায় বললেন, “কখন খোঁটা দিলো? আর রূপা তো ঠিকই বলেছে। ভুল কোনটা?”

 

সুমনার চোখ ফেটে জল নামল। তিনি খুবই সংবেদনশীল এবং আবেগপ্রবণ গোছের মানুষ। কথায় কথায় কান্না করার অসীম ক্ষমতা আছে তার। 

কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি তো এখন উচ্ছিষ্ট। জীবনটা সংসারের জন্য বরবাদ করলাম। এখন আমার কোনো মূল্য নেই। এতো মানুষ মরে আমি মরি না কেন!”

 

রূপার করুণা হলো। যে কারো কান্না তার হৃদয়কে কাতর করে তোলে৷ সে সুমনাকে জাপটে ধরে নরম সুরে বলল, “আমি তোমাকে খোঁটা দেইনি, আম্মা। সব মেয়ে তো একরকম হয় মা। রুমির থেকে আমি কি আলাদা না? এমন তো হতেই পারে, একদিন রিনি তোমার গর্বের কারণ হলো। ও অনেক ছোট। রুমির রাগটা ওর উপর চাপিও না। আমরা তোমাকে মূল্য দেই বলেই, তোমার কথাতে রাতারাতি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। তুমি ঠিক নাকি বেঠিক সেসব তোয়াক্কা করছি না। তুমি যা চাইবে তাই হবে। যা বলবে তাই করব।”

 

সুমনা কিছু বললেন না৷ তবে ভেতরে ভেতরে রূপার প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা অনুভূত হয়।

যে ভালোবাসা এতকাল দেখানো হয়নি, সে ভালোবাসা আজও দেখানোর প্রয়োজনবোধ হচ্ছে না। তিনি তখনো কাঁদছেন। রূপা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলল, “কান্না থামাও।”

 

সুমনা উঠে বাথরুমে চলে যান গোসল করতে। গোসল সেড়ে বের হতেই বারেক হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, “এখন কী করবে? এই অশান্তি তো আর সহ্য হচ্ছে না। দোকানটাও বন্ধ এখন।”

 

সুমনা কর্কশ গলায় বললেন, “ফাইয়াজের বোনকে কল করে বলেছি, আম্মা অসুস্থ তাই রাতেই গ্রামে চলে এসেছি। ফেরার পর আংটি পরানো হবে। প্রথমে একটু গাইগুই করেছেন তারপর মেনে নিয়েছেন। এখন মেয়েকে খুঁজে বের করো। তোমার বড় মেয়েকে বলো, যেভাবে হোক, যেখান থেকেই হোক রুমিকে নিয়ে আসতে।”

 

বারেক অবাকচিত্তে বললেন, “রূপা কোথায় পাবে?”

 

সুমনা নিশ্চুপ। রূপা খাওয়াদাওয়া সেড়ে বেরিয়ে গেল।

 

সোহাগি হোটেলের দ্বিতীয় তলার চৌত্রিশ নম্বর রুমে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে রুমি। মাস দেড়েক আগে উচ্চ মধ্যবিত্ত, সুদর্শন এক ছেলের সাথে তার ফেসবুকে পরিচয় হয়। সাত দিনের মাথায় পূর্বের প্রেমিককে ধোঁকা দিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা। সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হয়।

 

বিয়ের কথাবার্তা চলছে শুনে প্রেমিক পারভেজ প্রস্তাব দিয়েছিল, “চলো, পালিয়ে যাই।”

 

রুমি বলেছিল, “পালাব কেন? তুমি তোমার বাসায় বলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে।”

 

“আমি সবেমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। বাবা এখন বিয়ে দিতে রাজি হবে না। হুট করে তোমাকে নিয়ে বাসায় উঠব। তখন বাবা বাধ্য হবে তোমাকে মেনে নিতে আর বিয়ে দিতে। বোঝার চেষ্টা করো, এছাড়া আর অপশন নেই।”

 

রুমিকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখে পারভেজ তাকে বুকে চেপে ধরে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বলল, “তোমাকে ছাড়া আমার বাঁচা সম্ভব নয় রুমি। তুমি আমার ধ্রুব, তুমিই আমার জীবনের শুভ। পালিয়ে গেলে, আমার বাবার সুনাম নষ্ট হবে। কিন্তু আমি সেসবের কেয়ার করি না। বাবার সম্মানের থেকেও তুমি মূল্যবান। যদি সম্ভব হতো, এখুনি প্রস্তাব নিয়ে যেতাম, বিশ্বাস করো আমাকে।”

 

অগত্যা রুমি পালানোর ব্যাপারটাকে সমর্থন করে এবং সেই অনুযায়ী পালিয়ে এসে এই হোটেলে ওঠে। 

 

“খুব মন খারাপ?” পারভেজের গলা।

 

রুমি চমকে তাকাল। ভাবনায় এতোটা ডুবে ছিল যে, দরজা খোলার শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি। 

 

সে বলল, “এতক্ষণ লাগে আসতে? আমি ভয় পেয়েছিলাম।”

 

পারভেজ বিরিয়ানির প্যাকেট টেবিলে রেখে বলল, “ভেবেছিলে তোমাকে রেখে পালিয়ে গেছি?”

 

রুমি অপ্রতিভ হয়ে ওঠল। সে সত্যি তাই ভেবেছিল। পারভেজ রুমির পাশে বসে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “তুমি আমার সুখ। সুখ এখানে রেখে আমি আর কোথায় যাব?”

 

রুমি লজ্জা পেল৷ সরে যেতে চাইলে পারভেজ আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “সকালেও এমন করেছো। শুধু দূরে সরে যেতে চাও। আমার ছোঁয়া কি ভালো লাগে না? বিরক্তবোধ করো?”

 

রুমি বলল, “না, না। ভুল বুঝছো। শুধু লজ্জা পাচ্ছি।” 

 

“খেয়ে নাও, তারপর লজ্জা ভাঙাচ্ছি।” 

 

রুমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে। সে বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাবার চেষ্টা করল, “এই হোটেলটা খুব নোংরা৷ আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তোমার বাড়িতে কবে নিয়ে যাবে?”

 

পারভেজ রুমির গাল আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল, “আরেকটা দিন সহ্য করো৷ আগামীকাল আমরা বিয়ে করব। তারপর থেকে শ্বশুরবাড়ি থাকবে।”

 

“আজ কেন বিয়ে করছি না?”

 

“বিয়ে করতে তো স্বাক্ষী প্রয়োজন। আমার যে দুজন বন্ধুর আসার কথা ছিল, তারা কক্সবাজার ঘুরতে গেছে৷ কাল ফিরবে, আমাদের বিয়ের স্বাক্ষী হবে।”

 

রুমি কিছু বলল না। পর পুরুষের সঙ্গে এই প্রথম তার নির্জনাবাস। সে লজ্জিত, হৃদয় কাঁপছে ক্রমাগত; তীব্র গতিতে কাঁপুনি হচ্ছে। 

 

মাঝেমধ্যে মনে একটা প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে, “পারভেজের মতো ধনী ছেলে এরকম নোংরা হোটেলে উঠল কেন?” 

 

যদিও অনুভূতির তাড়নায় প্রশ্নটি মনে শক্ত করে গেঁড়ে বসতে পারছে না। রুমি বলল, “তুমি খাবে না?”

 

পারভেজের ফোন বেজে ওঠে৷ স্ক্রিনে কলদাতার নাম দেখে সে রুমিকে বলল, “তুমি খাও। আমি আসছি।”

 

পারভেজ হোটেলের বাইরে এসে কল ঘুরিয়ে অপর প্রান্তের কাউকে ক্রোধ নিয়ে বলল, “শুয়ো′রের বাচ্চা, তোরে বলি নাই কল না দিতে!”

 

অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসার পর পারভেজ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। আশেপাশের মানুষ বিরক্তি নিয়ে তাকায়, তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।

 

রূপা পারভেজের মুখের ভাষা শুনে এগিয়ে আসল।

বলল, “এইযে, শুনুন।”

 

পারভেজ পাত্তা দিলো না। রূপা আবার ডাকল।

 

পারভেজ চোখমুখ কুঁচকে গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। 

 

রূপা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলল, “আপনার গালিগালাজ শুনে মানুষ বিরক্ত হচ্ছে৷ দয়া করে অন্য কোথাও গিয়ে ফোনে কথা বলুন।”

 

পারভেজ স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। বোধ হতেই দ্রুত হেঁটে চলে গেল হোটেলের ভেতর৷ রূপা কিছু বুঝতে না পেরে শ্রাগ করে ঠোঁট উল্টাল।

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

২০.

ছাদের দরজা পর্যন্ত ছুটে এসে থমকে দাঁড়াল অরুনিকা৷ হাতে তার জীববিজ্ঞান বই। উঁকি দিয়ে দেখল, হিরণ বসে আছে, তার কোলে গিটার; সে অন্যমনস্ক। মাঝেমধ্যে গিটারে টুংটাং ধ্বনি তুলছে। 

অরুনিকা ভাবল, ” লোকটা গিটার বাজাতেও পারে!”

সে মন্হরগতিতে হেঁটে ছাদে গেল। তার চোখ বিদ্ধ বইয়ের পৃষ্ঠায়, প্রতিটি ইন্দ্রিয় সজাগ হিরণের জন্য। হিরণ তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। 

 

তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “অবশেষে এসেছো। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”

 

অরুনিকা বই থেকে চোখ তুলে অবাক হবার ভান ধরে বলল, “আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?”

 

হিরণ বলল, “এরইমধ্যে গতকালের কথা ভুলে গেছো?”

 

অরুনিকা মনে করার নাটক করে বলল, “ওহ, মনে পড়েছে। কিন্তু আমি আপনার জন্য আসিনি। আপনার কথা আমার মনেই ছিল না।”

 

“তাহলে কেন এসেছো?”

 

“হাঁটতে। আর এইযে দেখছেন না বই হাতে। খোলা হাওয়ায় পড়াশোনা করতে এসেছি।”

 

হিরণ হাসল। বলল, “আচ্ছা, পড়ো।” 

 

অরুনিকা বইয়ে মনোনিবেশ করল। সে বইয়ের অক্ষরের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক কিন্তু চোখের পর্দায় অক্ষরগুলো নেই, হিরণের মুখ। সে ভাবল, “বেশি দাম্ভিকতা দেখিয়ে ফেললাম নাকি!”

 

হিরণের সাড়াশব্দ না পেয়ে পিছনে ফিরে তাকাল। হিরণ তাকিয়ে আছে। অরুনিকা বই বন্ধ করে বলল, “আপনি ছাদে কী করে আসেন?”

 

হিরণ বলল, “চার তলায় উঠেছি, সাবলেট।”

 

অরুনিকা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইল। হিরণ এই বিল্ডিংয়েই থাকে! সে ভেতরে ভেতরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। হিরণের সঙ্গে কথা বলার প্রবৃত্তির সামনে নকল দাম্ভিকতা আর টিকতে পারল না। 

 

সে বলল, “আপনি এখানে থাকেন!”

 

হিরণ মাথা ঝাঁকাল। পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে বলল, “এটা তোমার জন্য।”

 

অরুনিকা চকলেট পছন্দ করে না। তবুও আজ চকলেট পেয়ে সে খুব খুশি হলো। হাত বাড়িয়ে বলল, “আপনি আমাকে খুঁজে পেলেন কী করে?”

 

পারভেজ হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করল। তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে রুমি হাত থেকে গ্লাস রেখে বলল, “কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?”

 

পারভেজ দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে বলল, “বাইরে তোমার বোনকে দেখেছি।”

 

রুমির মুখ থেকে ছিটকে বের হলো, “রূপা আপা?”

 

“আর কে হবে? ডাকাত মহিলা। পিছু নিয়ে এখানে চলে এসেছে। এই জায়গা ছাড়তে হবে, দ্রুত চলো।”

 

“দাঁড়াও, বোরকা পরতে দাও।”

 

রুমি বোরকা পরতে পরতে বিড়বিড় করে, “আপা আঠার মতো লেগে থাকে আমার সাথে, অসহ্য।”

 

পারভেজ রুমিকে নিয়ে তুরন্ত সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। 

রুমি ব্যথা পেয়ে বলল, “উফ! আস্তে হাঁটো।”

 

তাদের পলায়নের গতি দেখে হোটেলের অনেকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তারা দুজন সোহাগি থেকে বের হয়ে এলো। যখন গেইট পার হতে যাবে, তখনই বারেক মিয়াকে দেখে তারা আঁতকে ওঠল। দুজন শীঘ্রই গেইটের অন্যপাশে লুকিয়ে পড়ল। 

বারেক দৌর্বল্য পায়ে একটা টং দোকানে গিয়ে বসলেন চা খেতে। 

 

পারভেজ রিক্সা আনতে যেতে চাইলে রুমি বলল, “তোমার বাইক কোথায়?”

 

পারভেজ বলল, “এক ভাই নিয়েছে।”

 

রুমি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলল, “কেন দিতে গেলে? আমাদের তো প্রয়োজন এখন।”

 

“এখন এসব বলার সময় না। তুমি দাঁড়াও, আমি রিক্সা নিয়ে আসছি।”

 

পারভেজ রিক্সা নিয়ে আসলে, দুজন রিক্সায় করে বারেকের পাশ কেটে চলে যায় অন্যদিকে।

 

পরদিন। বারেক, সুমনা তাদের দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে এসেছে শুনে জেসমিন তাদের বাড়িতে আসল৷ 

সুমনা জেসমিনকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে দুঃখী কণ্ঠে বললেন, “আম্মা শয্যাশায়ী। তিনটা মেয়েকে আসতেই দিলেন না। জীবন-মৃত্যুর দোটানায় থাকা মানুষটার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আর যেতে ইচ্ছে করেনি। তাই মেয়েদের রেখে এসেছি। দোকানটার জন্যই আমাদের আসতে হয়েছে। নয়তো আমরাও থেকে যেতাম। ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেল যে, তখনই জানাতে পারিনি।”

 

জেসমিন হাস্যমুখে বললেন, “এতো অস্থির হবেন না। পাশেই তো আছি। রুমি আসলে তখনই আংটি পরানো হবে৷ আপনার আম্মার রোগটা কী?”

 

সুমনা মান-সম্মানের ভয়ে এতোটাই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন যে অকপটে বলে ফেললেন, “ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজে আছে। দোয়া করবেন। এজন্যই মেয়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়েও তাকে মায়ের কাছে রেখে এসেছি। শেষ ইচ্ছেটা তো আর ফেলে দেয়া যায় না।”

 

“আল্লাহ উনার সহায় হোক।”

 

সুমনা বলল, “তুমি বসো আমি চা বানিয়ে আনি।”

 

“প্রয়োজন নেই চাচি। আমি কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি।”

 

“তা বললে কী হয়? তুমি বসোতো।”

 

সুমনা রান্নাঘরে চলে যায়। তাৎক্ষণিক জেসমিনের চোখমুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক! সুমনার কথাবার্তাও এলোমেলো, আলগা ভাব। কিছু একটা লুকাচ্ছে যেন! 

অদ্ভুতভাবে গতকাল সকাল থেকে ফাইয়াজও উধাও। জেসমিন ফাইয়াজকে না পেয়ে ভয় পেয়েছিলেন। পরে শুনলেন, রুমিও বাড়িতে নেই। 

তিনি পুর্নবার কল করলেন ফাইয়াজের নাম্বারে। 

বন্ধ!

 

সূর্য দিগন্তে হেলে পড়েছে। নদীর পাড়ে বসে উদাস নয়নে দিগন্ত দেখছে রূপা। তার পাশে রিনি। অরুনিকার সঙ্গে দুইদিন যাবৎ কথা হয় না৷ কিছুক্ষণ আগে অন্যজনের ফোন থেকে আন্টির নাম্বারে কল করেছিল, কিন্তু তিনি বললেন, অরুনিকা রুমে নেই, ছাদে। রূপার নিজেকে খুব একা লাগছে। এই মুহূর্তে সূর্যটাই বড় আপন মনে হচ্ছে৷ সূর্যের হলুদ রঙ ধীরে ধীরে হলুদ থেকে কমলা, কমলা থেকে টুকটুকে লাল হয়ে গিয়ে নানা রঙের বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে দিগন্তে হারিয়ে যায়। রূপা বিস্ময়বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে অস্তমিত সূর্যের দিকে। একসময় নেমে আসে সন্ধ্যা। রিনি বিরক্তবোধ করে বলল, “বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না আপা।”

 

রূপা অনুনয়ের সুরে বলল, “বোন আমার, আরেকটু থাক। হোটেলের রুমে দম বন্ধ লাগে।”

 

“আমি ঘুমাব। এখানে থাকব না।” রিনির চোখ জলে টলটল করছে। বাবা-মা ছাড়া থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে। 

 

বাধ্য হয়ে রূপা রিনিকে নিয়ে হোটেলে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। উঠে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলো অপ্রত্যাশিত এক মুখের। ফাইয়াজ প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত রেখে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে! 

রূপার পিলে চমকে ওঠল। তার হঠাৎ মনে হয়, কোথায় যেন বিনা মেঘে পরপর বজ্রপাত হচ্ছে! সে হতবিহ্বল হয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। কিছু বলল না।

 

ফাইয়াজ সোজাসাপটা বলল, “আমার জীবনে আমি অনেক কষ্ট করেছি। এমন কোনো শুভ মুহূর্ত নেই যা সময়মতো সহজে হয়েছে। কিছু কিছু চাওয়া পূরণ হতে গিয়েও হয়নি, কখনোই হয়নি। একসময় আমার অপ্রতিরোধ্য জেদ সৃষ্টি হলো, আমার সকল ভালো মুহূর্ত আমি যেভাবে হোক নিজের করে নেব, হারাতে দেব না। তোমার বোন পালিয়েছে তাতে আমার সমস্যা নেই। বিয়ে তো রুমিকে করছি না, তোমাকে করছি। তাহলে তুমি কেন চোরের মতো পালাতে গেলে?”

 

ফাইয়াজ উত্তরের অপেক্ষায় থাকল না। 

রূপার হাতটা টেনে নিয়ে মধ্যমা আঙুলে আংটি পরিয়ে দিয়ে বলল, “বাড়ি চলো।”

 

রূপার হৃদয় জুড়ে এক তীব্র কাঁপুনি শুরু হয়। আকস্মিকতায় সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। কী হচ্ছে, কী হলো, কেন হলো, তার মাথায় ঢুকছে না৷ সে হাতের আংটিটার দিকে তাকাল।

 

চলবে…

 

 

 

 

সূর্যশিশির 

২১.

জেসমিন জড়ীভূত হয়ে বসে আছেন। ফাইয়াজকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা তার অনেকদিনের। পড়াশোনা শেষ হোক, চাকরি হোক, ইত্যাদি ইত্যাদি — বলতে বলতে অনেকগুলো বছর গড়িয়েছে। তারপর একদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাল, “বাসা পরিবর্তন করার পরই বিয়ে করব।” 

 

এখানে আসার পর রুমিকে পছন্দ হয় জেসমিনের। মেয়েটার বয়স কম ঠিক কিন্তু দেখতে শুনতে বিয়ের উপযুক্ত মেয়েই মনে হয়। ফাইয়াজের সঙ্গে খুব মানায়। ফাইয়াজের যে ঘরোয়া মেয়ে পছন্দ তা জেসমিনের অজানা নয়। রুমিও অনেকটা তাই।

 

নেহাৎ কথার ছলে একদিন জেসমিন বলেছিলেন, “বারেক চাচার মেয়েকে একটু দেখো তো। আমার খুব ভালো লেগেছে।”

 

ফাইয়াজ সেদিন কিছু না বললেও পরদিন বলেছিল “দেখেছি। কথা বলে দেখো।”

 

ফাইয়াজ বিয়ের জন্য প্রথম আগ্রহ দেখিয়েছিল! জেসমিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে তাৎক্ষণিক সুমনার সঙ্গে কথা বললেন। সুমনাও সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেন। অতঃপর দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হতে থাকে, আংটি পরানোর দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলে দুজন মিলে। সুমনার যেন একটু বেশি তাড়াহুড়ো ছিল। জেসমিন বলেছিলেন, “চাচার অনুমতি তো নেয়া হলো না।”

 

সুমনা তখন বললেন, “আমি যা বলব তাই হবে৷ তোমরা আসো, সবাই মিলে বিয়ের দিন ঠিক করি।”

 

বেশ কিছু মাস যাবৎ ফাইয়াজের সঙ্গে জেসমিনের নিয়মিত কথা হয় না৷ তাই তাদের পাত্রী নির্বাচনের ভুল বোঝাবুঝিটা খুব শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়ায়। জেসমিন ফাইয়াজকে জানান, “সোমবারে আংটি পরাতে যাব। মানসম্মান নষ্ট করে আগেরবারের মতো কোথাও আবার চলে যেও না।”

 

ফাইয়াজ তখন অভয় দিয়ে বলেছিল, “নিশ্চিন্তে থাকো। যাব না কোথাও।”

 

এইটুকুই ছিল বিয়ে নিয়ে তাদের কথপোকথন!

 

সোমবার প্রাতঃকালে যখন ফাইয়াজকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না, জেসমিন ভেবেছিলেন আবার হয়তো ফাইয়াজ বিয়ে না করার জন্য পালিয়েছে। আতঙ্কে জেসমিনের চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়৷ মেয়ে বাড়িতে কী বলবেন, কী বলবেন ভেবে যখন রসন ভিলায় এলেন, দেখতে পেলেন বাসায় তালা লাগানো! তখন অবাক হলেও নিজের অজান্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন।

 

এখন দেখছেন, অন্য কাহিনি। ফাইয়াজ রূপাকে ভেবে বিয়েতে রাজি হয়েছিল! ওরকম শার্ট-প্যান্ট পরে দোকানদারি করা মেয়ে মানুষকে ফাইয়াজের পছন্দ হবে ঘূনাক্ষরেও ভাবেননি জেসমিন। 

 

তিনি গম্ভীরমুখে বললেন, “ভুল তো তোমার। নাম কেন উল্লেখ করোনি? ” 

 

ফাইয়াজ কণ্ঠে উত্তাপ নিয়ে বলল, “আমি কী করে জানব, একটা স্কুলে পড়া মেয়ের সঙ্গে আমার বোন আমার বিয়ে ঠিক করবে? কী করে ভাবলে আমি এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করব?”

 

ফাইয়াজ অনেকক্ষণ ধরে তেজ দেখাচ্ছে। জেসমিন এবার গলার স্বর বাড়িয়ে বললেন, “রূপা তোমার পছন্দের সঙ্গে মিলে না। তাই আমি ভুলেও কল্পনা করিনি তুমি রূপাকে বিয়ে করতে চেয়েছো। আমাকে আসামী বানিয়ে জেরা করা বন্ধ করো।”

 

ফাইয়াজ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকাল। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রূপা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে! আংটি খুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, “ভুল বুঝছেন, আমার সাথে নয় রুমির সাথে আপনার বিয়ে। আমি কখনো আপনাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবিনি। এই কথাগুলো আমাকে অস্বস্তি দিচ্ছে, লজ্জা দিচ্ছে।”

 

ফাইয়াজ আংটিটি জেসমিনের সামনে রেখে, উঠে চলে যেতে উপক্রম হয়। জেসমিন পিছন থেকে বললেন, “আমি কি রূপার জন্য প্রস্তাব দেব আবার?”

ফাইয়াজ দায়সারাভাবে বলল, “প্রয়োজন নেই।”

 

জেসমিনের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়! আরো কয়েক বছর বিয়ে না করার অজুহাত পেয়ে গেল ফাইয়াজ! ভুলটা যদি না হতো!

 

রসন ভিলাতেও ইতিমধ্যে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে৷ রূপা ডাইনিং রুমে বসে আছে মধ্যমণি হয়ে। সে তখনো ঘোরের মধ্যে আছে৷ ফাইয়াজের কথাগুলো সারাক্ষণ কানে বাজছে।

 

সুমনা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন, “তো তুই আসতে গেলি কেন? বলেছিলাম না, রুমি আসলে আসতে।”

 

রূপা বলল, “জেনেই তো গেছে রুমি পালিয়েছে আর হোটেলে থেকে কী হবে?”

 

সুমনা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, “ফাইয়াজ সব জেনে গেছে, নাকি তুই বলেছিস? সত্যি করে বল।”

 

রূপা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “আমি কেন বলব আম্মা? স্যার আমাকে খুঁজে বের করেছেন।”

 

মা-মেয়ের কথার মাঝে অন্য প্রসঙ্গ টেনে খোশ মেজাজে বারেক বললেন, “ফাইয়াজ এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করতেই পারে না। আগেই সন্দেহ হয়েছিল৷ এবার রূপাকে বিয়ে দিয়ে শান্তিতে মরব।”

 

সুমনা হাতের স্টিলের গ্লাস মেঝেতে ছুঁড়ে মেরে বললেন “রুমি পালিয়েছে শুনে ওরা রং পাল্টেছে। রুমির জন্যই প্রস্তাব দিয়েছিল এখন বলছে রূপাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল! এসব মিথ্যা কথা। ভণ্ড পরিবার! কই থেকে এসেছে তাও জানি না। আমি ওখানে রূপার বিয়ে হতে দেব না।”

 

বারেক প্রতিবাদ করলেন, “বাজে কথা বলো না। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে! যদি নতুন করে প্রস্তাব নিয়ে আসে বিয়ে দিতে আপত্তি কী?”

 

“আছে আপত্তি। যে ঘরে ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে ঘরে বড় মেয়েকে আমি দেব না।”

 

“রুমি তো মুখে কালি দিয়ে পালিয়েছে৷ এই কালিমাখা মুখ কেউ দেখার আগে রূপার সাথে ফাইয়াজের বিয়েটা দিয়ে দাও।”

 

এ কথাতে সুমনার ভাব-ভঙ্গি পরিবর্তন হলো। 

 

বললেন, “যদি বিয়ে না দেই ওরা কী সবাইকে বলবে রুমি পালিয়েছে?”

 

সুমনার উদ্বিগ্নতা বুঝতে পেরে বারেক সুযোগ নিলেন, “বলতেই পারে। তারচেয়ে চলো চুক্তি করি, আমরা রূপাকে দেব। সবাই জানবে, রূপার সাথে ফাইয়াজের বিয়ে হচ্ছে সেই দুঃখে রুমি নানাবাড়ি চলে গেছে। ভালো না?”

 

মাথামোটা সুমনার মাথায় যে নাটকীয় ব্যাপার স্যাপার প্রভাব ফেলে তা বারেক জানেন। সুমনার চিন্তিত মুখ দেখে তিনি পুর্নবার ইন্ধন দিলেন, “এটাই ভালো হবে। শ্বশুরবাড়ির মান সম্মান রক্ষার্থে হলেও ওরা রুমির পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখবে৷ তুমি ভেবে দেখো।”

 

সুমনা কিছু বলার পূর্বে রূপা বলল, “আমি বিয়ে করব না আব্বা।”

 

বারেক বললেন, “কেন করবি না? তুইতো আর ছোট না। ফাইয়াজ ভালো ছেলে। সমস্যা কী?”

 

রূপা কাতর স্বরে বলল, “স্যারকে আমি স্যার হিসেবেই দেখি। সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষ। আমার জন্য ব্যাপারটা খুব পীড়াদায়ক।”

 

বারেক রূপার নিকটে এসে বসলেন। বললেন, “পারিবারিকভাবে যখন বিয়ে হয় কেউ কি কাউকে চিনে? চিনে না। তবুও বিয়ে হয়৷ এখন থেকে স্যার না ভেবে, অন্যকিছু ভাবতে হবে। যদি প্রস্তাব নিয়ে আসে আমি কিন্তু হ্যাঁ বলে দেব। তোর অন্য কোনো পছন্দ থাকলে এখুনি বল। নয়তো ফাইয়াজকেই বিয়ে করতে হবে।”

 

“পছন্দ নেই আব্বা। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই না…ও আম্মা আব্বাকে বুঝাও। আমি চলে গেলে দোকান চলবে? আব্বা একা পারবে?”

 

বারেক বললেন, “তোর মাকে উস্কে দিয়ে কাজ নেই। বাবা-মার সম্মান বাড়ে মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিলে। রুমিকে খুঁজতে হবে, তুই আর চিন্তা বাড়াস না৷ ফাইয়াজ প্রস্তাব নিয়ে আসুক, আমরা তোকে তার হাতে তুলে দেব। কী বলো রূপার মা?”

 

সুমনা জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে ভেতরের রুমে চলে গেলেন৷ 

 

রূপা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তার বিয়ে করতে না চাওয়াটা যে পরিবারে অশান্তি ডেকে আনবে তা স্পষ্ট!

 

রূপা বলল, “সংসার আমাকে দিয়ে হবে না। এটা ভুল হবে।”

 

বারেক রূপার কথা অগ্রাহ্য করে বললেন, “কোনো ভুল না। দেখিস মা, তুই অনেক সুখী হবি। তোর কপালে অনেক সুখ আছে, অনেক।” 

 

তিনি রূপার কপালে চুমু খেলেন। অস্বস্তিতে রূপার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এটা কী করে হতে পারে!

 

চলবে…

(ছোট মনে হলে দুই-তিন দিনের পর্ব জমিয়ে পড়ুন। আমি নিয়মিত লিখতে পারি না হাতের অসুস্থতার জন্য। তবুও লিখছি আপনাদের জন্য।)

 

সূর্যশিশির 

২২.

সূর্য তখন মাথার উপর। তাপপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রচন্ড গরমের কারণে  প্রাণহানিও ঘটছে। রূপা কপালের ঘাম মুছে বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেল। গরমের তীব্রতা তার শরীর জ্বালিয়ে দিচ্ছে৷ এতো গরম কখনো পড়েনি! সে হন্য হয়ে খুঁজছে রাজন মিয়ার ছেলে নয়নকে। রাজন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে শুনল, নয়ন তার নানার বাড়িতে৷ তাই রূপা সেদিকেই যাচ্ছে। 

বোতল রেখে রূপা দুই হাতে সাইকেলের হাতল ধরে, প্যাডেলে পা রাখে। চোখের পলকে চলে যায় দূরে। গন্তব্য সানাদপুর। ত্রিশ মিনিটের পথ।

 

সানাদপুর পয়েন্টে এসে একজন পথচারীকে ডাকল রূপা। পথচারী দাঁড়ালে রূপা প্রশ্ন করল, “হামদু মিয়ার বাড়ি কোনটা?”

 

পথচারী দক্ষিণে ইঙ্গিত করে বলল, “ওইযে কলা গাছগুলো দেখা যাচ্ছে, ওইখানে।”

 

রূপা হেসে বলল, “ধন্যবাদ চাচা।”

 

হামদু মিয়ার টিনের বাড়ি। বাড়ির উঠান নিরিবিলি।

রূপা সাইকেল এক জায়গায় রেখে হাঁকল, “কেউ আছেন?”

 

কোনো সাড়াশব্দ নেই। পুর্নবার সে ডাকল, “আছেন কেউ?”

 

একজন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা কুঁজো অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “কেলা আইছে?”

 

রূপা বলল, “নয়ন কি এখানে আছে?”

 

বৃদ্ধা চোখ পিটপিট করে রূপাকে দেখে বললেন, “হেয় তো বাজারে ক্যারাম খেলে।”

 

“গতকাল কি বাড়িতে ছিল?”

 

“আছিল তো। হারাদিন হুক্কা টানে আর ঘুমায়। তুমি কেলা? হেরে খুঁজো কোন কামে?”

 

রূপা ভাবল, “তাহলে কি নয়নের সঙ্গে রুমি যায়নি! তাহলে কার সাথে গেল?” 

 

মুখে বলল, “ওর কাছে টাকা পাই সেটা নিতে আসছিলাম। আমি তাহলে যাই।”

 

রূপা ঘুরে দাঁড়াবার উদ্যোগ নিতেই বৃদ্ধা বললেন, “বইতা না?”

 

রূপা স্নিগ্ধ হাস্যে বলল, “না। আসছি।”

 

বাজার অবধি যাবার প্রয়োজন পড়ে না রূপার। পথেই নয়নের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে গেল। রূপাকে দেখে নয়ন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে এগিয়ে আসল। রূপা এবার নিশ্চিত হলো নয়নের সঙ্গে রুমি যায়নি অন্য কারো সঙ্গে গেছে! তবে কে সে?

 

নয়ন রূপাকে দেখে বলল, “এখানে কী করিস?”

 

রূপা বলল, “তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।”

 

নয়ন চোখ ছোট ছোট করে রেখেছে। সে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল। 

রূপা আন্দাজে বলল, “রুমির সঙ্গে যে তোর প্রেম ছিল সেটা আমি জানি। ব্রেকাপ হয়ে গেল কেন?”

 

নয়ন মাটিতে থুথু ফেলে বিকৃত স্বরে বলল, “তোর বোন একটা বারো’ভা’তারি! আমার সাথে চিট করছে। বড়লোকের খোকা পেয়ে, ছোট থেকে দেখে রাখা এই নয়নরে ভুলে গেছে৷”

 

রূপা খামচে ধরে নয়নের শার্টের কলার। বলল, “মুখ সামলে রাখ। ভদ্রভাবে কথা বল।”

 

নয়ন তাচ্ছিল্য করে হাসল। 

রূপার হাত সরিয়ে স্বগতোক্তি করল, “শালি!”

 

রূপা কোনোমতে রাগ সংবরণ করে শুকনো গলায় বলল, “রুমির বয়ফ্রেন্ডকে চিনিস?”

 

নয়ন সিগারেট ধরিয়ে সরু চোখে তাকাল। বিশ বছরের তরুণ সে, রূপার সমবয়সী। এসএসসি দেয়ার পর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে; আর পড়াশোনা করেনি। 

বলল, “হঠাৎ রুমির বয়ফ্রেন্ডের খোঁজ করিস কেন?”

 

“দরকার আছে। চিনলে বল।”

 

“না, চিনি না। তুই সাকিব ভাইয়ের জিম সেন্টারে খোঁজ নিতে পারিস। ওখানে যেতে দেখেছি অনেকবার।”

 

রূপা নিরাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷ সাইকেলের সিটে উঠে বসতেই নয়ন বলল, “ব্যাপারটা কী?”

 

রূপা প্রতিত্ত্যুরে কিছু বলল না৷ প্যাডেলের ঘূর্ণি তোলে নয়নের থেকে অনেক দূরে চলে গেল।

 

হিরণ-অরুনিকার ছাদে সাক্ষাৎ-এর চতুর্থ অপরাহ্ন আজ। হিরণ সহসা আবদার করে বসল, “তুমি কি আমাকে তুমি করে সম্বোধন করবে?”

 

চোখেমুখে উড়াউড়ি করা অবাধ্য চুলগুলো কানে গুঁজে অরুনিকা বলল, “চেষ্টা করব।”

 

“তুমি কি সারাদিন পড়ো?”

 

“না। সারাদিন কে পড়ে?”

 

“বিল্ডিংয়ের সবাই বলাবলি করে তাই বললাম।”

 

“ভুল শুনেছেন৷ পড়ি তবে অতিরিক্ত না৷ আপনি প্রতিদিন ভার্সিটিতে যান?”

 

“যেতে হয়। পড়াশোনার অনেক চাপ।”

 

“ভার্সিটিতে বন্ধুবান্ধব কেমন?”

 

“মোটামুটি।”

 

“মেয়ে বন্ধু আছে?” কথাটি বলে আড়চোখে তাকাল অরুনিকা। 

 

হিরণ আড়মোড়া ভাঙার ভান ধরে বলল, “না। মেয়ে মানুষে আমার এলার্জি৷ কথা বলতে পারি না৷”

 

অরুনিকা দুই হাতে বুকের কাছে ভাঁজ করে বলল, “আমার সাথে তো ঠিকই বলেন।”

 

“তুমি করে বলার কথা ছিল কিন্তু।”

 

অরুনিকা হেসে বলল, “সময় দিন।”

 

“চেষ্টা তো করো। তুমি তো তুমি বলছোই না।”

 

“আচ্ছা, এখন বলছি, মেয়ে মানুষে এলার্জি অথচ আমার সাথে তো প্রতিদিন কথা বলছো।”

 

হিরণ বুকের বাম পাশে এক হাত রেখে বলল, “তোমার মুখে তুমি শব্দটা এত শ্রুতিমধুর! আবার বলবে?”

 

অরুনিকা হাসল। হিরণ বলল, “তুমি বিশেষ তাই পারি।”

 

“বিশেষ” শব্দটি অরুনিকার মনে আনন্দের ঢেউ নিয়ে আসে। হিরণের সঙ্গ, হিরণের প্রতি মায়া তার শরীরজুড়ে, মনজুড়ে ক্রমে শিকড় গেঁড়ে বসছে। 

 

হঠাৎ অরুনিকার মনে পড়ল, রূপা দুইদিন যাবৎ কল করে তাকে পাচ্ছে না। পরে সে অনুরোধ করা সত্ত্বেও সেলিনা ফোন করার অনুমতি দেন না। আজিজুর চৌধুরী সবসময় বাসায় থাকায় অরুনিকা মায়ের সঙ্গে তর্ক করার সাহসও পায় না৷ 

 

অরুনিকা বলল, “আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে?”

 

হিরণ উৎসাহ নিয়ে বলল, “কেন করব না? অবশ্যই করব৷ একবার শুধু বলো।”

 

অরুনিকা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে গেল। সে নিজের খুশি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। বলল, ” আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান মানুষটা হচ্ছে আমার বন্ধু। জীবনের প্রতিটি গোপন কথা ও জানে৷ আমরা দুজন দুজনকে যেভাবে বুঝি, অন্য কেউ তেমন করে বুঝে না৷ আমার প্রাণ ও, ওর প্রাণ আমি।” 

 

অরুনিকার চোখেমুখে একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে। 

হিরণ বলল, “ছেলে নাকি মেয়ে বন্ধু?”

 

অরুনিকা সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল, “অবশ্যই মেয়ে বন্ধু।”

 

“আমাকে কী সাহায্য করতে হবে?”

 

“আমার ফোনটা ভেঙে গেছে। দুইদিন কথা হয়নি ওর সাথে। তোমার ফোন দিয়ে কল করতে পারি?”

 

হিরণ তাৎক্ষণিক ফোন বের করে দিয়ে বলল, “শিওর।”

 

হিরণের হাত থেকে ফোন নিয়ে রূপার নাম্বার ডায়াল করে অরুনিকা। কল যাচ্ছে…

 

অরুনিকা হিরণকে বলল, “আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি।”

 

সে ভাবল, “আজ রূপাকে হিরণের সম্পর্কে সব বলব। ওদের দুজনের সাক্ষাৎ করিয়ে দেব। রূপার নিশ্চয়ই হিরণকে পছন্দ হবে! হতেই হবে।”

 

উত্তেজনায় অরুনিকার কণ্ঠনালি কাঁপছে।  

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

২৩.

পিচঢালা রাস্তা, দুই পাশে সারি সারি গাছ৷ রূপা দ্রুতবেগে এগোচ্ছে৷ গরমের জন্য তার মাথায় ক্যাপ নেই, চুল ঝুঁটি করে রাখা; গায়ে লঘু বেগুনি রঙের বড় সাইজের টি-শার্ট। নিজ মনে যখন রুমি আর অরুনিকার কথা ভাবছিল তখন দৈবাৎ রাস্তার বিপরীত দিক হতে ফাইয়াজের বাইকটিকে আসতে দেখল। কালো রঙের বাইকটি নিত্যদিন দেখা দেয়, তাই চিনতে অসুবিধে হলো না। কালো শার্ট পরিহিত ফাইয়াজের চোখে আজ চশমা নেই। নিজের অজান্তে রূপার সাইকেলের গতি হ্রাস পেল। 

 

পাশ কেটে যাবার সময় ফাইয়াজ এমনভাবে রূপাকে দেখল, যেন শত্রুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছে।  রূপা পিছনে ফিরে নিজ মনে আওড়াল, “আজব!” 

 

অন্যদিকে মনোনিবেশ করায় সাইকেলের ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছিল, রূপা দ্রুত সামলে নিলো।

 

তখনই বেজে ওঠল ফোন। রূপা সাইকেল এক পাশে দাঁড় করিয়ে কোমরের লেদারের ব্যাগ থেকে ফোন বের, স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে অবাক হলো।

রিসিভ করল, “হ্যালো?”

 

ওপাশ থেকে ভেসে এলো প্রবল ভাবাবেগ, “রূপা!”

 

রূপার বুক ছলাৎ করে ওঠে। ফোন শক্ত করে কানের সঙ্গে ধরে বলল, “তোকে ফোনে পাই না কেন? ছাদে কী করিস? আন্টি কী ফোন দেয় না? তোকে কত কি বলার আছে জানিস? আর একদিন পার হলে কথার চাপেই মরে যেতাম।”

 

অরুনিকা চাপাস্বরে বলল, “তোকেও অনেক কথা বলার আছে। মা ফোন দেয় না। পাপা পরের সপ্তাহ চলে যাবে সিঙ্গাপুর তখন আমরা আবার প্রতিদিন দেখা করব। কেমন আছিস তুই?”

 

“আর বলিস না, রুমি কার সঙ্গে যেন পালিয়ে গেছে!”

 

“কী!” অরুনিকা চমকে গেল। বলল, “কবে?”

 

“গত পরশু৷ এখন রুমিকেই খুঁজছি, রাস্তায় আছি।”

 

“এখন তাহলে রাখি?”

 

“না রাখতে হবে না৷ পরে আবার কখন না কখন কথা হয়। আমি সানাদপুর থেকে বের হয়ে রাস্তার একপাশে সাইকেল রেখে গাছের গুঁড়িতে বসলাম। কেমন আছিস? ঠিকমতো পড়াশোনা করছিস?”

 

অরুনিকা অপাঙ্গে হিরণকে এক পলক দর্শন করে বলল, “দোস্ত, আমি সেই মানুষটাকে পেয়েছি।”

 

রূপা সবিস্ময়ে বলল, “কোন মানুষ?”

 

অরুনিকা কপাল কুঁচকে বলল, “ওইযে, বাজারে দেখেছিলাম। ওর নাম হিরণ মজুমদার। আমাকে খুঁজে বের করে, আমাদের বিল্ডিংয়েই উঠেছে।”

 

রূপা উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে বলল, ” তখন থেকে তোর পিছু নিয়েছে?”

 

রূপার আতঙ্কিত গলার স্বর শুনে অরুনিকা বলল, “তেমন কিছু না৷ ছেলেটা অনেক ভালো আর ভীষণ সুন্দর। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ফিজিক্স নিয়ে পড়ে৷ ভদ্র, মার্জিত বাচনভঙ্গি। চারদিন ধরে প্রতিদিন আমাদের কথা হয়৷ জানিস, খুব সুন্দর গিটারও বাজায়৷ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি দোস্ত।” 

 

ফিসফিসিয়ে সাবধানে বলল অরুনিকা। 

 

রূপা বলল, “ফিসফিস করে কথা বলছিস কেন? রুমে তুই?”

 

“না ছাদে। হিরণের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ওর ফোন দিয়েই তোকে কল করেছি।” 

 

রূপা তড়িৎগতিতে নাম্বারটা পুর্নবার দেখল। কে এই হিরণ মজুমদার? রূপার খুব অস্থির লাগছে। 

সে বলল, “এতোই মিশে গেছিস যে ফোন দিয়ে দিলো! এতো কথা বলবি না, আমি আগে ছেলেটাকে দেখব।”

 

অরুনিকা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, “তোর খুব পছন্দ হবে৷ পাপা চলে যাবার পর আমি মিট করিয়ে দেব।”

 

“না, না। এত দেরি কে করবে? আমি আজই আসব।”

 

“এখন তো চলে যাবে। তুই বরং হিরণকে কল দিয়ে বাহিরে দেখা করে নে। আমি ওকে বলে দেব।”

 

“মিট করবে?”

 

“আমি বলব। আমার বিশ্বাস, আমার কথা রাখবে।”

 

“আচ্ছা। বলে দিস তাহলে, রাতে আমি কল দেব।”

 

“ঠিক আছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা। দ্রুত আর সাবধানে বাড়ি যা৷ রুমি নিজেই ফিরে আসবে দেখিস।”

 

“তাই যেন হয়৷ রাখছি তাহলে। আমি কিন্তু রাতে এই নাম্বারে কল দেব।”

 

“আচ্ছা। আমি বলে দিচ্ছি।”

 

অরুনিকা কল কেটে ফোনটা হিরণের হাতে দিয়ে বলল, “আমি আরেকটা অনুরোধ করতে চাই।” 

 

হিরণ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “করো না।”

 

“আমার বন্ধু তোমাকে দেখতে চায়। কেউ আমার নতুন বন্ধু হলেই ও দেখতে চায়, সেই মানুষটা কেমন। আমাকে খুব ভালোবাসে তো তাই কেয়ারিং বেশি। যদি তোমার সমস্যা না হয়, দেখা করবে?”

 

হিরণকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা গেল৷ অরুনিকা বলল, “জোর করছি না। তোমার ইচ্ছে।”

 

হিরণ কিছু একটা ভাবার নাটক করে বলল, “উম! এক শর্তে তোমার বন্ধুর সাথে দেখা করব।”

 

অরুনিকা হেসে বলল, “শর্ত! কী শর্ত?”

 

“তোমার সুন্দর হাসির একটা ছবি তুলতে দিতে হবে।”

 

অরুনিকার ঠোঁটের কোণের হাসি প্রসার লাভ করল। বলল, “আচ্ছা, তুলুন।”

 

“এতক্ষণ তো তুমি বলছিলে, এখন আবার আপনি কেন?”

 

“সরি। তুলো।”

 

অরুনিকা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। হিরণ ফোনের ক্যামেরা ধরে বলল, “স্মাইল।”

 

অরুনিকা হাসার সঙ্গে সঙ্গে হিরণ সেই দৃশ্যটি ক্যামেরায় বন্দী করে নিলো। অতঃপর বলল, “কোথায়, কখন দেখা করতে হবে?”

 

“রাতে তোমাকে কল করে জানাবে।”

 

হিরণ আশ্চর্য হয়ে বলল, “আমার ফোনে কল করবে?”

অরুনিকা মাথা ঝাঁকাল। 

হিরণ বলল, “এমন বন্ধুত্ব আমি আর দুটো দেখিনি।”

 

জেসমিনের পঙ্গু স্বামী আর ভাই নিয়ে সংসার৷ একমাত্র ছেলে নটরডেম কলেজে, হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। স্বামী ইশতেহার মাহবুব একজন ফ্রিল্যান্সার। দূর্ঘটনায় পা হারানোর পর অনেক অভাবে দিন কাটলেও, ফাইয়াজের বড় হওয়া আর ইশতেহার ফ্রিল্যান্সার হওয়াতে তাদের দিন পাল্টেছে। তাদের জীবনের গল্পটা এখন যতটা সুন্দর, স্বাভাবিক তার থেকেও করুণ ও অস্বাভাবিক ছিল অতীতে। জেসমিনের হৃদয়চক্ষু বধির নয়, সে মানুষ বাছাইয়ে পটু। ফাইয়াজের বেলাতেই যে কীভাবে ভুল হয়ে গেল!

 

রূপাকে বাড়ি যেতে দেখে জেসমিন দ্রুতপদে এগিয়ে এসে ডাকলেন, “রূপা?”

 

রূপা থমকে দাঁড়াল। জেসমিন গেইট খুলে অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললেন, “ভেতরে আসো, কিছুক্ষণ কথা বলি।”

 

রূপা ভেতরে ভেতরে অপ্রস্তুত হয়ে গেল৷ পুনরায় প্রস্তাব নিয়ে রসন ভিলায় গেলে এই বাড়িতে তার বিয়ে হবে!

রূপা কিছু বলার আগে জেসমিন তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গিয়ে গেইট বন্ধ করে দিলেন। 

 

পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে৷ সন্ধ্যা হওয়াতে বাড়ি ফিরছে তারা৷ 

জেসমিন রূপাকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে বললেন, “তুমি কিছুক্ষণ আমার সামনে বসে থাকবে?”

 

রূপা খুব অবাক হলো। জেসমিনকে খুব আবেগী লাগছে! 

মুখফুটে কিছু বলল না।

 

জেসমিন মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার ঝুঁটিটা খুলবে?”

 

রূপা ভাবল, “খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাত্রীর চুলের গোছা মোটা আর লম্বা নাকি দেখতে ডাকল নাকি?”

 

জেসমিন যেন রূপার মনের কথা টের পেয়ে গেল। 

তিনি বললেন, “না খুললে সমস্যা নেই।”

 

বিনয়ী, আন্তরিক মিষ্টি মুখের জেসমিনকে অগ্রাহ্যের স্পর্ধা রূপার কোমল হৃদয়ের নেই।

সে ঝুঁটি খুলতেই, চুল ছড়িয়ে পড়ে পৃষ্ঠদেশে। 

 

জেসমিন সুনয়নে রূপাকে দেখে বুঝতে পারলেন ফাইয়াজের রূপাকে পছন্দ করার কারণ। 

তিনি রূপার পাশে বসে বললেন, “তোমার মুখের গঠন আমার আম্মার মতো। কপাল আর ভ্রু একইরকম।”

 

রূপা বলল, “আপনার আম্মার ছবি দেখার আগ্রহ হচ্ছে।”

 

“দেখাব। তুমি বসো, আমি ছবি নিয়ে আসছি।”

 

চলবে…

(একেক লাইন লিখতে অনেক সময় নিতে হয়৷ তাই দেরি হয়ে যায়।)

 

সূর্যশিশির 

২৪.

জেসমিন ফ্রেমসহ একটি ছবি নিয়ে এলেন। রূপার হাতে দিয়ে বললেন, “এইযে আমার আম্মা।”

 

রূপা ফ্রেমটি হাতে নিয়ে দেখল, জামদানি পরিহিতা হাস্যজ্বল কিশোরীর মতো মায়াবী এক প্রাপ্তবয়স্ক নারী ফুল বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। তার মায়াবী মুখ, নিখুঁত ঠোঁট, ডাগরডোগর চোখ — সাদাকালো ছবিতেও তার সৌন্দর্য ঠিকরে বের হচ্ছে৷ রূপার রূপ কখনো এই নারীর ধারেকাছেও না। তবে হ্যাঁ, ভ্রু আর কপালের দিকে সাদৃশ্য রয়েছে বটে। রূপা বলল, “ভীষণ সুন্দর।”

 

জেসমিন হেসে বললেন, “হ্যাঁ, খুব সুন্দর।” 

 

তিনি রূপার হাত থেকে ফ্রেমটি হাতে নিয়ে ছবিতে হাত বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন, ” আমার যখন আঠারো বছর বয়স তখন আম্মা আমাকে একা করে চলে গেল। ফাইয়াজের বয়স দুই বছর ছিল। আমি নিজের সন্তানের মতো কোলেপিঠে করে ফাইয়াজকে বড় করেছি। বলা হয়নি, আমার আব্বা ফাইয়াজের জন্মের আগে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তখন ফাইয়াজ আম্মার পেটে। আমরা দুই ভাইবোন মানুষের লাঞ্ছনা – বঞ্চনা সহ্য করেছি, সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি টিকে থাকতে। অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য স্কুল বলো বা কলেজ, ভার্সিটি, সব জায়গায় ফাইয়াজ প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা ভোগ করেছে৷ সেটা প্রেমঘটিত হোক, বন্ধুত্ব বা অন্যকিছু, প্রত্যাখ্যান ছিল ওর প্রতিদিনকার সঙ্গী। “প্রত্যাখ্যান” শব্দটা ওর জন্য ভীষণ বেদনাদায়ক। বিষণ্ণ হয়ে পড়ে, রেগে যায়। সহ্য করতে পারে না। যদিও দিন পাল্টেছে, এখন সব জায়গায় ফাইয়াজ মুগ্ধতা ছড়িয়ে বেড়ায়। তবুও ওই শব্দটার প্রতি ওর খুব রাগ রয়ে গেছে৷  তুমি ফাইয়াজকে কেন ফিরিয়ে দিয়েছো রূপা? তুমি কি কাউকে ভালোবাসো, তোমার কোনো চাহিদার কমতি আছে ওর মধ্যে? আমাকে বলো।” 

 

জেসমিন এমন কিছু প্রশ্ন করবেন রূপা ভাবেনি৷ সে কিয়ৎক্ষণ অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে রইল। জেসমিন অপেক্ষা করছেন উত্তরের। রূপা বলল, “কাউকে ভালোবাসি না। কখনো কোনো চাহিদা ছিল না আমার। আমি কখনো বিয়ের কথাই ভাবিনি। আর উনাকেও প্রত্যাখ্যান করিনি…শুধু —”

 

রূপার কণ্ঠ থেমে গেল। জেসমিন আগ্রহ নিয়ে নির্নিমেষ লোচনে চেয়ে আছেন। রূপা বলল, “এতদিন জেনে এসেছি স্যারের সঙ্গে আমার ছোট বোনের বিয়ের কথা চলছে, হুট করে উনি আমাকে আংটি পরিয়ে দিয়ে বললেন, উনি আসলে আমাকে বিয়ে করছেন মানে আমাকে পছন্দ করেছিলেন। এমন অবস্থায় আমার রিয়েক্ট করা কি স্বাভাবিক না? আমি ইচ্ছে করে কষ্ট দেইনি। আমি ওই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অতীতের কোনো ব্যথায় আঘাত লাগবে জানলে হয়তো অন্যরকম ব্যবহার করতাম।”

 

রূপা এমনভাবে কৈফিয়ত দিচ্ছে যে জেসমিন মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না৷ 

রূপার এক হাত ধরে বললেন, “তাহলে ফাইয়াজকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি নেই? আমি তোমার বাসায় যাব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে?”

 

রূপা কোনো অভিব্যক্তি দেয়ার পূর্বে ফাইয়াজ এসে ঢুকল ড্রয়িংরুমে। রূপা সচকিত হয়ে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হয়। একটা ভিন্ন স্বাদের অনুভূতি ভুঁইফোঁড়ে বেরোনোর মতো হঠাৎ জেগে উঠল রূপার বুকের ভেতর। ছেলেদের মতো পোশাক পরে, চুল ঝুটি অথবা খোঁপা করে ঘুরে বেরানো মেয়েটাকে খোলা চুলে দেখে না চাইতেও ফাইয়াজ সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে দেখল৷ তারপর অত্যন্ত শান্তভাবে রূপাকে পিছনে রেখে চলে গেল ভেতরের রুমে।

 

জেসমিন ফিসফিসিয়ে বললেন, “প্রস্তাব নিয়ে যাব?”

 

রূপা কী বলবে ভেবে পায় না! সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। 

জেসমিন তা উপলব্ধি করে বললেন, “তোমাকে দুইদিন সময় দিলাম৷ এর মধ্যে জানাবে।”

 

বলেই হাসলেন তিনি৷ রূপা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল৷ 

জেসমিন বললেন, “তুমি বসো। আমি তোমার জন্য চা করে আনি। তারপর আবার গল্প করব।”

 

“না, না…আমি যাই। সন্ধ্যা হয়েছে।”

 

“আরে বসো। রং চা নিয়ে আসছি৷ আমি শুনেছি, তোমার রং চা পছন্দ। যাচ্ছি আমি। তুমি কিন্তু কোথাও যাবে না।”

 

জেসমিন দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন৷ রূপা সোফায় হেলান দিয়ে বসল। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে৷ সে আরেকটু আরাম করে বসে চোখ বুজল।

 

জেসমিন চা বানিয়ে আবিষ্কার করলেন, রান্নাঘরে কেক নেই৷ ইশতেহার হয়তো নিয়েছে৷ তিনি কম্পিউটারে কাজ করতে করতে কেক অথবা বিস্কুট খেতে পছন্দ করেন৷ জেসমিন নিজের রুমে যেতেই রান্নাঘরে ফাইয়াজ আসল। ফ্রিজ থেকে দুটো আপেল, আরেকটা ডালিম নিয়ে দেখল, পাশে রং চায়ের কাপ! জেসমিন আর সে দুধ চা খায়। ইশতেহার চা পছন্দ করে না। তাহলে এটা নিশ্চয়ই রূপার জন্য। ফাইয়াজ লবণের কৌটা নিয়ে সেখান থেকে তিন চামচ লবণ চায়ে ঢেলে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল৷ 

 

জেসমিন চা, কেক, বিস্কুট, ডালিম, আপেল, আঙুর — বাসায় যা যা ছিল সব ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে এসে দেখলেন, রূপা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্যানের তীব্র ঘূর্ণিতে রূপার চুল উড়ছে। জেসমিনের মায়া হয় ডাকতে। তিনি সেন্টার টেবিলের উপর ট্রে রেখে ফ্যানের বাতাস আরো বাড়িয়ে দিলেন৷ রূপা গভীর ঘুমে মগ্ন। 

 

ভেতর থেকে ফাইয়াজের কণ্ঠ এলো, “আপা, চা দাও।”

 

জেসমিন বললেন, “আসছি।”

 

মনে মনে ভাবলেন, “রূপা যেহেতু ঘুমে চা রেখে তো লাভ নেই৷ উল্টো ঠাণ্ডা হয়ে খাবার অযোগ্য হয়ে যাবে৷ তার চেয়ে বরং দুধ মিশিয়ে ফাইয়াজকে দিয়ে দেয়াই ভালো হবে।”

 

তিনি রং চায়ে দুধ মিশিয়ে ফাইয়াজের রুমে গেলেন। ফাইয়াজ সবেমাত্র ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। 

 

জেসমিন চা দিয়ে কপট রাগ নিয়ে বললেন, “পরেরবার থেকে নিজে বানিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করবি। আমি আর পারব না।”

 

ফাইয়াজ চোখ তুলে বলল, “হঠাৎ কী হলো?”

 

“দেখ, আমি তোর দাসী না৷ আমার বয়স হচ্ছে, তোর ফরমায়েশ খাটা আর সম্ভব না৷ তুই অন্য ব্যবস্থা কর।”

 

“ঠিক আছে, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য কাজের লোক নিয়ে আসব। সে ফরমায়েশ খাটবে।”

 

“তা হবে না। বাহিরের মানুষ আমার বাড়িতে আমি রাখব না। আমার এসব ভালো লাগে না।”

 

“কী চাচ্ছো সরাসরি বলো।”

 

“একটা বউ।”

 

জেসমিন আড়চোখে তাকালেন ফাইয়াজের অভিব্যক্তি দেখতে৷ 

ফাইয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তুমি বরং দুলাভাইকে বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে আসো।”

 

জেসমিন রাগার নাটক করে বললেন, “কী বললি!”

 

ফাইয়াজ হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। 

দ্রুত মুখ থেকে চা ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বলল, “বিয়ে করব না বলে চায়ে এতো লবণ দিতে হবে? এটা কোন ধরণের অত্যাচার শুরু করলে আপা?”

 

জেসমিন অবাক হয়ে বললেন, “লবণ কেন দিতে যাব?”

 

ফাইয়াজ চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, ” তাহলে কী দিয়েছো?”

 

“চিনি আর দুধ দিয়েছি।”

 

“তুমি খেয়ে দেখো।”

 

জেসমিন চায়ে চুমুক দিয়ে চোখমুখ বিকৃত করে ফেললেন৷ 

বললেন, “সত্যিই তো লবণ! বোধহয় চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছি। ভাগ্যিস, রূপা খায়নি। নয়তো মেয়েটা আমার সম্পর্কে কী ভাবত!”

 

ফাইয়াজ চকিতে তাকাল। 

বলল, “এটা রূপার চা?”

 

“হ্যাঁ। সারাদিন অনেক কষ্ট করে মেয়েটা, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর ডাকিনি। খাবার নষ্ট করাও তো ভালো না৷ তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”

 

ফাইয়াজ বলার মতো আর ভাষা খুঁজে পেল না।

অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে নিজেকেই পড়তে হয়; কথাটির যথাযথ প্রমাণ পেল আজ।

 

জেসমিন বললেন, “তুই বস, আমি আবার নিয়ে আসছি।”

 

ফাইয়াজ শব্দহীন পায়ে ড্রয়িংরুমে আসল। নিদ্রায়মাণ রূপার ঘাড় বাঁকা হয়ে আছে। ফাইয়াজের খুব অস্থিরবোধ হয়। ইচ্ছে করে, রূপাকে নরম বিছানায় নিয়ে রাখতে। সেখানে আরামে ঘুমাক। এতো কেন ঘুরে বেড়ায় মেয়েটা?

সে ধীর পায়ে হেঁটে রূপার নিকটে এসে দাঁড়াল।

যখনই ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে ঘাড় ঠিক করতে যাবে তখনই চোখ খুলল রূপা। চোখের সামনে ফাইয়াজের মুখ দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল।

 

ফাইয়াজ সঙ্গে সঙ্গে কাঠিন্যপূর্ণ গলায় বলল, “এটা কি তোমার ঘুমানোর জায়গা? নিজের বাড়ি নেই? অন্যের বাড়িতে না বলেকয়ে ঘুমিয়ে পড়াটাও এক ধরনের অসভ্যতা। যাও, নিজের বাড়ি যাও।”

 

ফাইয়াজের হুঁশিয়ারি গলা শুনে জেসমিন ছুটে আসলেন। রূপার চোখ নিমিষে ছলছল করে ওঠে।

ফাইয়াজ পুনরায় তাড়া দিলো, “যাচ্ছো না কেন? দ্রুত যাও।”

 

জেসমিন ধমকে উঠেন, “এটা তোমার কী ধরনের ব্যবহার ফাইয়াজ? এভাবে বলছো কেন?”

 

ফাইয়াজ জেসমিনের দিকে ফিরে বলল, ” হয় তুমি বলো নয়তো তুই বলো, একেকবার একেক সম্বোধন নাটক লাগে। আর এইযে…তুমি আর কখনো অন্যের বাড়িতে এভাবে ঘুমিয়ে পড়বে না৷”

 

রূপা দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে ছেড়ে বেরিয়ে যায়। জেসমিন পিছন পিছন এসে ডাকলেও সে থামল না। এক ছুটে নিজের বাড়িতে চলে গেল৷ ফাইয়াজ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল পূর্বের স্থানে।

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

২৫.

তীব্র রাগ নিয়ে রুষ্ট নয়নে জেসমিন ঘুরে তাকালেন। ফাইয়াজের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতাপ নিয়ে বললেন, “আমার ইচ্ছে করছে, থাপ্পড় দিয়ে তোমার গাল লাল করে দেই। এটা তোমার কেমন রূপ? কেন তুমি এমন করলে? তুমিতো এমন নও, কীসের বোধ তোমাকে এমন বানাল? রূপা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাহলে তাকে এড়িয়ে চলো, এমন ব্যবহারের কারণ কী? আমার শিক্ষা কোথায়? কেউ কতটা ক্লান্ত থাকলে এভাবে ঘুমিয়ে পড়ে তুমি জানো না?”

 

ফাইয়াজের চোখ বিদ্ধ সেন্টার টেবিলে। সে নিজেও নিজের আচরণে হতবিহ্বল হয়ে গেছে। জেসমিন বললেন, “তুমি রূপাকে সরি বলবে, নয়তো আমি এই বাড়ি ছেড়ে যেখানে ইচ্ছে চলে যাব।”

 

এবারও ফাইয়াজ প্রতিত্ত্যুরে কিছু বলল না। জেসমিন আক্ষেপের সুরে বললেন, “আমি তোমাকে চিনতে পারছি না ফাইয়াজ! তুমি কী করে কাউকে অকারণে কষ্ট দিতে পারো? তোমার মতো বিজ্ঞ মানুষ এমন কী করে করল?”

 

ফাইয়াজ নিশ্চুপ! অপমানে দগ্ধ হয়ে যাওয়া রূপার থতমত মুখশ্রী মানসপটে ভাসছে! রূপা দৈবাৎ চোখ খুলে ফেলায় সে ভড়কে গিয়েছিল। দূর্বলতা প্রকাশের ভয়ে নিজের অজান্তে তার রুঢ় আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

 

জেসমিন তাচ্ছিল্যের চোখে কতক্ষণ ফাইয়াজকে দেখে ড্রয়িং রুম থেকে প্রস্থান করলেন। ফাইয়াজ ধীর পায়ে রূপা যেখানে ঘুমাচ্ছিল সেখানে গিয়ে বসল। নিজের স্বকীয়তা এভাবে বিসর্জন হয়ে যাচ্ছিল! রূপা কতটা কষ্ট পেল! ফাইয়াজ হাতের দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরল।

 

বন্য ঘোরার মতো রূপাকে নিজের রুমে ছুটে যেতে দেখে সুমনা পিছু নিলেন। রূপা বিছানায় বসে দুই হাতে মুখ ঢাকল। বুকের ভেতরটা অপমানের জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছে। সে বার কয়েক ঢোক গিলল। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

 

মনে মনে ভাবল, “মরে যাব তবুও এই লোককে আমি বিয়ে করব না। কখনো না।”

 

“কী হলো তোর?”

 

মুখ থেকে হাত সরাতেই রূপার চোখমুখের বিষণ্ণতা সুমনার দৃষ্টিগোচর হয়। তবুও আদর করে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। 

রূপা চুল খোঁপা করতে করতে বলল, “কী হবে?”

 

“চুল খোলা রেখে এভাবে ছুটে এলি কোথা থেকে?”

 

সুমনার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে রূপা বলল, “নয়নের সঙ্গে রুমি যায়নি। নয়ন ওর নানার বাড়িতে।”

 

“তাহলে কার সঙ্গে গেল?”

 

“খুঁজতে হবে। যে ছেলেটার সঙ্গে রুমির কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছিল সেই ছেলেটাকে নয়ন চিনে না তবে অনেকবার সাকিব ভাইয়ের জিম সেন্টার নাকি দেখেছে। ওখানে খোঁজ করতে গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি গেইট বন্ধ। কাল আবার যাব।”

 

“তুই ছেলেটার নাম জানিস?”

 

“না।”

 

” তাহলে খুঁজবি কী করে?”

 

“জানি না, কিন্তু চেষ্টা করব।”

 

“আচ্ছা, খেতে আয়। খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”

 

এই আহবানে রূপা হাসল। সুমনা দেখেও না দেখার ভান করে জায়গা ত্যাগ করলেন। রূপা ফোন চার্জে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শৈশব থেকে এই অবধি কত কি হয়ে গেল তার সাথে! সব সহ্য করেছে। আর আজ কি না একজনের কটু কথায় মন খারাপ করছে! রূপা নিজেকে নিজে বুঝাল। 

 

গোসল সেড়ে খেয়েদেয়ে ঘুমাল। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠল রাত এগারোটায়৷ স্বপ্নে বিশ তলা এক বিল্ডিং থেকে পড়ে যাচ্ছিল সে! রূপা পানি খেয়ে গলা ভেজাল।

উদাস নয়নে জানালার বাহিরে চেয়ে থেকে কত কী ভাবল! যখন অরুনিকার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না হয় তখন সে খাতায় নিজের মনের কথাগুলো, প্রশ্নগুলো লিখে, নিজে পড়ে, ভেবে তারপর ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। 

আজও তাই করতে বসে। 

 

আজ সে লিখল —

 

রাহাতি জান্নাতের খু’ন যেখানে হয়েছে সেখানে কে ছিল? 

এখনো কেন মনে হয় জঙ্গলে আমাকে কেউ দেখছিল?

পাঁচশো টাকার নোট কে ফেরত দিয়ে গেল? ওখানে আর কে ছিল? 

সেই মানুষটা কী করে চিনল আমার বাড়ি? 

রুমি কার সঙ্গে পালাল? এখন কী অবস্থায় আছে?

ফাইয়াজ স্যার আমাকে পছন্দ করে থাকলে এমন ব্যবহার কেন করল? সেদিন আমার রিয়েক্ট করা কি স্বাভাবিক ছিল না?

অরুনিকার হিরণ মজুমদার কে? কেন বুকের ভেতরটায় এতো অস্থিরবোধ হয়? 

 

রূপা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর নিজের মতো বানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল, পারল না; ব্যর্থ হলো। 

 

সে ভাবল, “অরুনিকা থাকলে ভালো হতো। ও যেকোনো কিছু নিজের মতো আন্দাজ করে বলে দিয়ে শান্ত করে দিতে পারে। কবে দেখা হবে আবার!”

 

অরুনিকার শূন্যতায় ভীষণ অসহায়বোধ করে রূপা। 

 

চার্জ থেকে ফোন খুলে বিকেলে কল আসা নাম্বারে কল করে। প্রথম কল না ধরলেও, দ্বিতীয় কলের সময় ওপাশ থেকে বলল, “কে বলছেন?”

 

রূপা বলল, “হিরণ মজুমদার?”

 

“জি। আপনি কে?”

 

“অরুনিকার বন্ধু।”

 

“ওহ আচ্ছা। বাহিরে আছি আমি, কিছুক্ষণ পর কল করছি।”

 

“ঠিক আছে।”

 

রূপা কল কেটে দিয়ে কপাল কুঁচকাল৷ কণ্ঠটা পরিচিত পরিচিত! কথাবার্তা সাবলীল, মার্জিত। অরুনিকার সঙ্গে এই ব্যাপারটা মিলে। বাকি কী কী মিলে সেটাই দেখতে হবে। রূপা ফোন রেখে যখনই উঠতে যাবে, ফোনে টুং করে শব্দ হলো।

 

সে ফোন নিয়ে দেখল অচেনা নাম্বার থেকে একটা বার্তা এসেছে। বার্তাটি হলো, সরি! 

 

রূপা সঙ্গে সঙ্গে উক্ত নাম্বারে কল করল। ফোনের মালিক কল কেটে দিলো। রূপা পুনরায় কল দিলো, এবার ফোন বন্ধ পেল! 

সে আনমনে বিড়বিড় করল, “অদ্ভুত!”

 

বাহিরে বাতাস হচ্ছে৷ এতো গরমে এই বাতাস মরুভূমিতে হঠাৎ বৃষ্টি আসার মতো। রূপা ছাদের কর্ণারে গিয়ে দাঁড়াল। তার পরনে মেয়েদের ট্রাউজার আর ফতুয়া! অরুনিকা উপহার দিয়েছিল। সব কাপড় ভেজা থাকায় বাধ্য হয়ে পরেছে।

 

আবার ফোনে বার্তা আসল। এখনের বার্তাটি হলো, সুন্দর!

রূপা দ্রুত কল দিলো, এবারও কল কেটে দিলো। দ্বিতীয় কলে ফোন বন্ধ পেল।

 

রূপা নাম্বারটিতে মেসেজ দিলো, “আরে ভাই, কে তুমি?”

 

মিনিটখানেক পর প্রতিত্ত্যুর এলো, “বেয়াদব।”

 

রূপা লিখল, “সাহস থাকলে কল করুন।”

 

তাৎক্ষণিক জবাব আসল, “আমার সাহসিকতা সম্পর্কে আমি অবগত। অন্যকে দেখানোর কোনো অভিলাষ নেই।”

 

“আপনি পুরুষ নাকি মহিলা?” 

 

এরপর আর জবাব এলো না৷ রূপা কল করে নাম্বারটি ব্যস্ত পেল। বেশ কয়েকবার কল করে যখন বুঝতে পারল, তাকে ব্লক করা হয়েছে; তার ওষ্ঠে হাসি ফুটল। অজানা মানুষটিকে চেনার স্পৃহা জাগল চিত্তে।

 

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাতাস উপভোগ করার পর হিরণ কল করে।

 

কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল, “কোথায়, কখন দেখা করতে চান বলুন।”

 

রূপা বলল, “আগামীকাল সকাল দশটায়, বাসানপুরের লেকে।”

 

“পৌঁছে যাব।”

 

“রাখছি তাহলে।” 

 

রূপা কল কেটে ঠায় দাঁয়িয়ে রইল৷ কণ্ঠটা এতো চেনা! 

হিরণ ফোন কেটে মাথা চুলকাতে শুরু করে৷ কার সাথে যেন গলার স্বরটা সাদৃশ্য! কিন্তু কার সাথে তা বুঝতে পারছে না। 

 

চলবে…

(সাত পর্ব রেগুলার দিতে অনেক শ্রম গেছে, কষ্ট গেছে৷ আজ সেই ধারাবাহিকতা শেষ হলো। এখন থেকে গল্প শনিবার ও মঙ্গলবার দেব।)

 

সূর্যশিশির 

২৬.

সকাল নয়টা। রূপা তুরন্ত হাতে হোটেলের রান্নাঘর সামলাচ্ছে। দশটায় হিরণের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হবে। বাসানপুরের লেকে যেতে লাগবে পনেরো মিনিট। তাই সে নয়টা চল্লিশে বের হবে।

হোটেলে খরিদ্দারদের উপচে পড়া ভীড়।তিন-চারদিন পর হোটেলের কার্যক্রম শুরু করায়  বাজারের মানুষ আগ্রহ নিয়ে হোটেলের ভেতর ঢুকছে। রূপারা সবসময়ই বাজারের আলোচনার মধ্যমণি এখন আবার নতুন গসিপ শুরু হয়েছে।

 

পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়িয়েছে, এলাকার সবচেয়ে ভদ্র, শান্ত, সুদর্শন পুরুষ ফাইয়াজ বখতিয়ার রূপাকে বিয়ে করতে চেয়েছে কিন্তু রূপার মা ভেবেছিল রুমির জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে৷ এটা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়৷ যখন ভুল ভাঙল তখন রুমি অভিমান করে নানারবাড়ি চলে যায়, রূপা বিয়ে করতে অস্বীকার জানায়। এলাকার আনাচে-কানাচেতে এখন এই আলোচনা চলছে। রূপার মতো মেয়ে ফাইয়াজের মতো পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করেছে কোন দুঃখে? এ নিয়ে রূপার আফসোস না হলেও সমাজের মানুষের আফসোস করতে করতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ এসব নিয়ে আলোচনা করতেও অনেকে হোটেলে খেতে আসছে। এতে বারেক বা রূপার ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা যা সত্য তাই বলছে। 

বারেক সঙ্গে এটাও বলেছেন, “আজ না হোক কাল। আমার রূপার ফাইয়াজের সঙ্গেই বিয়ে হবে৷”

 

রূপা বুঝে না, কোন আত্মবিশ্বাসে বারেক এ কথা বলেছেন! সে রান্না সম্পন্ন করে গামছায় হাত মুছে হাঁফ ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তখনই সুজন রান্নাঘরে চারটা পরোটা নিয়ে এসে বলল, “ওস্তাদ, পরোটার সঙ্গে এক প্লেট গরুর মাংস লাগব।”

 

“নিয়ে যা।”

 

“চাচায় কইছে তুমি লইয়া যাইতা। স্পেশাল কাস্টমার।” 

সুজন দাঁতকপাটি বের করে হেসে পরোটাগুলো রেখে চলে যায়।

 

রূপা এতে বিরক্তবোধ করে। ভাবল, “কী এমন কাস্টমার যার জন্য তাকেই প্লেট সাজিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”

 

রূপা যত্ন সহকারে পরোটা ও গরুর মাংস প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে নিলো। তার পরনে ধূসর রঙের শার্ট, মম জিন্স, মাথায় ক্যাপ। তারপর রান্নাঘর প্রস্থান করে খরিদ্দারদের ভীড়ে এসে বলল, “চারটা পরোটা আর গরুর মাংস কার?”

 

ভীড় থেকে একজন হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গে রূপা  হৃৎস্পন্দন টের পেল৷ মুহূর্তকালের জন্য হলেও সে থমকে গেল। অতঃপর অত্যন্ত শান্তভাবে হেঁটে গিয়ে ফাইয়াজের সামনে প্লেট রাখল। না চাইতেও ফাইয়াজের দিকে তাকাল। ফাইয়াজ তাকিয়েই ছিল৷ 

 

রূপা পেশাদার গলায় বলল, “আর কিছু প্রয়োজন?”

 

ফাইয়াজ পরোটা ছিঁড়ে শান্ত স্বরে বলল, “ঠান্ডা পানি আছে?”

 

রূপা বলল, “জি আছে। আপনি বসুন আমি নিয়ে আসছি।”

 

ফাইয়াজের হাত লেগে টিস্যুর বক্স পড়ে যায়৷ রূপা নত হয়ে তোলার সময় খেয়াল করল, ফাইয়াজের ডান পায়ে ছয়টা আঙুল। বক্সটি পুর্নবার টেবিলে রেখে, ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল এনে টেবিলে রাখলে পেছন থেকে একজন মধ্যবয়স্ক চাচা মশকরা করে বললেন, “কি রে রূপা, জামাইরেই খালি ঠান্ডা পানি খাওয়াবি, আমাদেরও দে৷ যে গরমডা পড়ছে!”

 

রূপার কান ঝাঁঝাঁ করে ওঠল৷ অপ্রস্তুত হয়ে ফাইয়াজের দিকে দৃষ্টি বিদ্ধ করে দেখল, ফাইয়াজের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে মন দিয়ে খাচ্ছে।

 

রূপা গ্রীবা ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বলার চেষ্টা করল, “কে জামাই? কী বলছেন?”

 

চাচা হেসে বললেন, “ও আল্লাহ! চেতস কেন? আমরা কি কিচ্ছু জানি না?”

 

রূপা আবার ফাইয়াজকে এক পলক দেখল। ফাইয়াজ পূর্বের অবস্থানেই আছে। রূপা আর কথা বাড়াল না৷ এই ধরনের মানুষগুলো যা চায় বলবেই, আটকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। 

 

সে রান্নাঘর থেকে ফোন নিয়ে এসে বারেককে বলল, “আসছি আব্বা৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে যাব। সাইকেল কোথায়?”

 

বারেক বললেন, “বাসায়৷ সাবধানে যাস।”

 

রসন ভিলায় এসে সাইকেল নিয়ে বেরোতেই সুমনার হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয় রূপা। কোথায় যাচ্ছিস? কেন যাচ্ছিস? এখন হোটেলে কাস্টমার বেশি থাকবে এখন কীসের বাহিরে যাওয়া — বিভিন্ন প্রশ্ন! রূপা জবাব না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। পিছন থেকে সুমনা জুতা ছুঁড়ে মারলেন। রূপা তাৎক্ষণিক হেসে ফেলল। সুমনার জুতা ছোঁড়ার দৃশ্য তার খুব পছন্দের!

 

বাসানপুর লেকে মানুষের সমাগম। নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে নৌকাভ্রমণ সারছে তারা। প্রিয়জন, বন্ধু, স্বজন নিয়ে অনেক নগরবাসী এখানে ঢুঁ মারে। বদ্ধ জলাশয়ে নৌভ্রমণের স্বাদ নেয়। রূপা সাইকেল এক পাশে রেখে গাছের ছায়ায় বসে হিরণের নাম্বারে কল করল, প্রথমে রিসিভ হলো না।

 

দ্বিতীয় কলে হিরণ রিসিভ করে বলল, “সরি, দেরি করার জন্য৷ আরেকটু অপেক্ষা করুন। পথে আছি।”

 

রূপা বলল, “আচ্ছা, আসুন। আমি লেকের পাশে অপেক্ষা করছি।”

 

হিরণ ফোন কেটে বাইকে উঠে বসল। অদ্ভুত কারণে তার যেতে ইচ্ছে করছে না৷ কিন্তু অরুনিকার মন জয় করতে হলে তাকে যেতেই হবে। সেও দেখতে চায়, সেই মেয়ে কে যার জন্য সে সর্বক্ষণ অস্থিরবোধ করছে। হিরণ পাঁচ মিনিটের মাথায় বাসানপুরের লেকে চলে এলো।

 

চতুর্দিকে তাকিয়ে অনেকগুলো সুন্দর মুখশ্রীর মেয়ে দেখতে পেল। 

হিরণ ভাবল, “অরুনিকার বন্ধু নিশ্চয়ই এদের মধ্যেই কেউ হবে৷”

 

সে কল করল রূপার নাম্বারে। 

 

রূপা কল রিসিভ করে বলল, “এসেছেন?”

 

“জি। আপনি কোথায় আছেন?” 

 

“লেকের উত্তর দিকে আমি, শিমুল গাছের নিচে।”

 

“দাঁড়ান, আসছি আমি।”

 

হিরণ উত্তরে এসে দেখে মানুষে চারপাশ গিজগিজ করছে। বেশিরভাগই যুগল। ছুটির দিন হওয়াতে মানুষ বেশি৷ হিরণ আবার কল করে প্রশ্ন করল, “আপনি কোন রঙের জামা পরেছেন?”

 

“ধূসর রঙের শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। মাথায় সাদা ক্যাপ আছে।”

 

রোদের কারণে হিরণ চোখ ছোট ছোট করে রেখেছে। তার কপালের চামড়া কুঁচকানো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে তাকাতেই চোখ দুটি রূপাকে দেখে ভস্ম হয়ে গেল। হিরণ স্তব্ধ হয়ে গেল, বাকহারা হয়ে গেল। রূপা হ্যালো, হ্যালো করছে। মাথায় আসমান ভেঙে পড়ার মতো অনুভব করছে সে৷ অরুনিকার বন্ধু রূপা কী করে হয়?

 

হিরণ অস্থির হয়ে কল কেটে আবার কল দিলো, দেখতে পেল, রূপার ফোনই বাজছে! রূপা তাকাতেই হিরণ শীঘ্রই মানুষের ভীড়ে লুকিয়ে পড়ে। তার মস্তিষ্কে ক্রমাগত হাতুড়ি পিটিয়ে কেউ বলছে, “এটা হতে পারে না! এটা হতে পারে না।”

 

সে মানুষের ভীড় ঠেলে উল্টোদিকে দৌড়াতে থাকল। বাইক অবধি এসে দ্রুত বাইক নিয়ে চলে গেল বহুদূরে। অরুনিকাকে বিয়ে না করা অবধি রূপার মুখোমুখি হওয়া যাবে না। তাহলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে!

 

রূপা চুল ছেড়ে ফ্লোরে বসে সিগারেট ফুঁকছে। দুশ্চিন্তা বেশি হলেই সে সিগারেটকে সঙ্গী বানায়৷ এই সিগারেটের অভ্যাস কবে, কী করে হয়েছিল সে ভুলে গেছে৷ শুধু জানে, সিগারেট টানায় একটা অদ্ভুত শান্তি আছে৷ হিরণের ফোন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রূপা অরুনিকার বাসায় কল করেছিল৷ সৌভাগ্যক্রমে অরুনিকা ফোনের নিকটে ছিল৷ রূপা তাকে জানিয়েছে, হিরণ সম্পর্কে। অরুনিকা বলেছিল, রাতে আপডেট দিবে৷ এখন বাজে রাত নয়টা ত্রিশ৷ কোনো কল এলো না।

 

এদিকে জেসমিন ও তার স্বামী ইশতেহার এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে৷ বারেক এই সংবাদ পেয়ে হোটেল বন্ধ করে রূপাকে নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছেন। তারপর থেকে রূপা নিজের রুমে বসে আছে। নিচ তলায় বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে!

 

পরপর এতকিছু ঘটে যাচ্ছে। রূপা কী করবে, কোনদিকে মন দিবে ঠাওর করতে পারছে না। বাড়ির মেয়ের খবর নেই, কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ জানে না। জিম সেন্টারে খোঁজ করেও সেই ছেলের সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি রূপা৷ অন্যদিকে, অরুনিকার হিরণ মজুমদারকে নিয়ে সন্দেহ বেড়েই চলেছে তার। কোনো কিছুর সমাধান হচ্ছে না, শুধু ছটফট করছে আর যা হচ্ছে তা মেনে নিচ্ছে সে।

 

হঠাৎ সুমনা দরজায় কড়া নেড়ে ডাকলেন, “রূপা?”

 

রূপা ধড়ফড়িয়ে উঠে দ্রুত জানালার দিয়ে সিগারেট ফেলে দুটো সেন্টারফ্রুট একসঙ্গে মুখে পুরল। দ্রুত চিবিয়ে ধীরেসুস্থে দরজা খুলতেই সুমনা বললেন, “এতক্ষণ লাগে? কী করছিলি?”

 

রূপা আড়মোড়া ভেঙে বলল, “ঘুমাচ্ছিলাম।”

 

“নিচে চল৷ তোকে ডাকছে।”

 

সাধারণত বিয়ের কথাবার্তায় মেয়েরা থ্রিপিস বা শাড়ি পরে, রূপা ক্ষণিকের জন্য ভাবল, তার কী পরা উচিত। 

বলল, “আম্মা, আমার কি জামাকাপড় পরিবর্তন করতে হবে?”

 

সুমনা বললেন, “না। যেভাবে আছিস সেভাবে যেতে বলেছে।”

 

সুমনার এই বিয়েতে যে আগ্রহ নেই তা পরিষ্কার। সব আগ্রহ বারেকের। রূপা চুল হাত খোঁপা করে নিচে আসল৷ তার কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না৷ ড্রয়িংরুমে পা ফেলে প্রথমে ইশতেহারের মুখ দর্শন করল। এই প্রথম জেসমিনের স্বামীকে সে দেখেছে৷ গম্ভীর চোখমুখের একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ হুইল চেয়ারে বসে আছেন। চেহারার তীক্ষ্ণতা প্রমাণ করে তার ব্যক্তিত্ব কতটা প্রখর। 

 

রূপাকে দেখে ইশতেহার প্রথমে বললেন, “তোমাকে আমি আজ প্রথম দেখলাম৷”

 

রূপা হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমিও আপনাকে আজ প্রথম দেখেছি।”

 

জেসমিন গদগদ কণ্ঠে আহবান করলেন, “আসো রূপা, আমার পাশে এসে বসো।”

 

রূপা জেসমিনের পাশে গিয়ে বসল। অন্যান্য মেয়েদের মতো তার মুখশ্রীতে কোনো উত্তেজনা বা লজ্জা নেই। সে ব্যাপারটাকে খুব শান্তভাবে নিচ্ছে৷ অনেকটা ব্যবসায়িক আলোচনার মতো। 

 

বারেক বললেন, “ফাইয়াজ পাত্র হিসেবে আমার খুব পছন্দের। আমি এবং তোর মা এই প্রস্তাবে রাজি। এখন উনারা তোর সম্মতি চায়। জানিয়ে দে।”

 

রূপার হ্যাঁ, না একটা উত্তরে নির্ভর করছে তার নতুন জীবন। ফাইয়াজ নামের সেই লোকটা স্যারের খোলস থেকে বেরিয়ে স্বামীরূপে ধরা দিবে! ভেবেই রূপা ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠল। একটা তীক্ষ্ণ অনুভূতি পায়ের পাতা থেকে মাথা অবধি ছুটতে শুরু করল। 

 

জেসমিন বললেন, “তুমি রাজি থাকলে আমরা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করব। গতকালের ঘটনার জন্য না করো না। ফাইয়াজকে বিয়ে করে তুমি ঠকবে না৷”

 

গতকাল রূপার রাগ হয়েছিল ঠিক তবে সেটা সকাল হতে হতেই চলে গিয়েছিল। ছোটখাটো ক্ষত ভুলে যাওয়ার অভ্যাস তার আছে৷ তাই বেশিক্ষণ কিছু মনে থাকে না। রূপা বারেকের দিকে তাকাল। তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকা প্রাণবন্ত মানুষটার মুখ চুপসে যাক রূপা চায় না। 

সে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতেই যাবে তখনই মনে পড়ল, অরুনিকা তো এ সম্পর্কে জানে না! 

জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্তে অরুনিকার মত থাকবে না? তা হয় না…কখনোই হয় না।

 

রূপা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে অনুরোধ করে বলল, “ত্রিশ মিনিট সময় দিন প্লিজ। আমি ত্রিশ মিনিটের মধ্যে চলে আসব।”

 

কেউ কিছু বলার আগে রূপা সাইকেল নিয়ে অরুনিকার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। আজ দারোয়ান বা আজিজুর আংকেল যেই সামনে আসুক সে থামবে না। অরুনিকার সঙ্গে সরাসরি বসে কথা বলবে। বারেক পিছন পিছন চিৎকার করে বাহিরে বেরিয়ে এলেন। ফাইয়াজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর কী আসে জানার জন্য পায়চারি করছিল। রূপাকে এভাবে যেতে দেখে আর বারেককে অস্থির হয়ে পিছন থেকে ডাকতে দেখে সে ভাবল, “রূপা কি এবারও আমাকে গ্রহণ করল না? প্রত্যাখ্যান করল?”

 

ভেবেই ফাইয়াজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। 

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

২৭.

গেইটে শব্দ করতেই নতুন দারোয়ান সওয়াব আলী গেইট খুলল। লোকটার বয়স কম। রূপাকে দেখে প্রশ্ন করল, “কে তুমি? কাকে চাও?”

 

রূপা বলল, “আজিজুর আংকেলের মেয়ে অরুনিকা আমার বন্ধু৷ ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”

 

“তোমার নাম কী?”

 

রূপা নিজের নাম বলল না। অন্য নাম বলল “তন্নি।”

 

“দাঁড়াও তুমি।”

 

সওয়াব ফোন বের করে আজিজুরের ফোনে কল করল। অরুনিকার একমাত্র বন্ধু রূপা, তা অজানা নয় আজিজুর চৌধুরীর। দারোয়ান অন্য নাম বললেও আজিজুর বুঝে যাবেন, রূপা এসেছে! তাই রূপা সুযোগ বুঝে গেইটের ভেতর ঢুকে গেল। দারোয়ান হইহই করে পিছু নিলো। রূপা এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।

 

সম্প্রতি অরুনিকার পড়াশোনায় একদম মন নেই তা লক্ষ্য করে সেলিনা রাগান্বিত হয়ে মেয়েকে শাসন করছিলেন। বাহিরে চেঁচামেচি শব্দ আর ক্রমাগত কলিং বেল বাজতে শুনে তিনি দরজা খুলতে যান৷ পিছু পিছু আগ্রহ নিয়ে অরুনিকাও আসল।

 

আজিজুরও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সেলিনাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি চোখমুখে কাঠিন্যতা ধরে রেখে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকল রূপা। অরুনিকা চমকে গেল, খুশি হলো।

 

রূপা আজিজুরকে দেখেই অনুরোধ করে বলল, “প্লিজ আংকেল, রাগ করবেন না। আমি অরুর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলব, খুব জরুরি।”

 

আজিজুর সওয়াবের দিকে তাকাতেই সওয়াব কৈফিয়ত দিলো, “আমি কিছু বুঝার আগেই দৌড়ে ঢুকে গেছে স্যার।”

 

আজিজুর হুংকার দিয়ে বললেন, “সামান্য একটা মেয়েকে আটকে রাখতে পারলে না, এই বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব কী করে নিবে তুমি?”

 

সওয়াব মাথা নত করে বলল, “সরি স্যার।”

 

আজিজুর রূপাকে ধমক দিতে তাকিয়ে দেখলেন ইতিমধ্যে অরুনিকা রূপার সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছে। 

সে আকুতি করে বলল, “প্লিজ পাপা, রূপাকে বকো না। শুধু কথা বলবে। আমাকে শুনতে দাও।”

 

আজিজুর রোষাগ্নি চোখে সেলিনার দিকে তাকালেন, সেলিনা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তোমার পাপা নিষেধ করেছিল রূপার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে৷ তুমি কী করে কথা বলার অনুমতি চাচ্ছো? রূপাকে বলো চলে যেতে।”

 

রূপা বলল, “আমি আপনাদের সামনেই কথা বলব। প্লিজ আন্টি, খুব প্রয়োজন।”

 

অরুনিকা অবাক না হয়ে পারছে না৷ কী এমন কথা বলবে রূপা? এতো আকুতি-মিনতি কেন? হিরণের আপডেট নিতে এসেছে? না, তাহলে তো সবার সামনে কথা বলতে চাইত না। অন্যকিছু হবে।

 

অরুনিকা বলল, “একটু কথা বলতে দাও। তোমাদের সামনেই তো বলবে।”

 

আজিজুর সেলিনাকে ইশারা করে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলেন। সেলিনা সওয়াবকে বলল, “তুমি যাও।”

 

তারপর রূপাকে বললেন, “চলো আমার সঙ্গে।”

 

ড্রয়িংরুমের এক পাশে সিসি ক্যামেরার মতো স্থির হয়ে আছে আজিজুর ও সেলিনা। রূপা এক নজর তাদের দেখে অরুনিকাকে বলল, “তোকে বলার সুযোগ হয়নি, সোমবার ফাইয়াজ স্যারের রুমিকে আংটি পরানোর কথা ছিল। সেই —”

 

কথার মাঝে আটকে দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে অরুনিকা বলল, “ফাইয়াজ স্যার রুমিকে বিয়ে করতে চেয়েছে? কোন রুমি? তোর এলাকার কেউ?”

 

“আমার বোন রুমি৷ আমিও প্রথম অবাক হয়েছিলাম। রুমি এই বিয়েতে রাজি ছিল না। আমার আর আব্বার মতও ছিল না। আম্মা একাই বিয়ে দিতে চাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে রবিবার রাতে রুমি পালিয়ে যায়। কার সাথে যায় জানি না।” 

এ কথা বলে রূপা আড় নয়নে আজিজুর আর সেলিনাকে পরখ করে নিলো। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখল 

 

আজিজুর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। তার মতে, বস্তির মেয়েরা এরকমই হয়! বাবা-মায়ের মুখে কালি মাখিয়ে যার-তার হাত ধরে পালানোই এদের স্বভাব। আর রূপা সেই সমাজেরই মেয়ে।

 

অরুনিকা মুখে এক হাত দিয়ে বলল, “সেকি! পরে?”

 

“আম্মা মান-সম্মানের ভয়ে রাতেই আমাদের নিয়ে দূরের এক আবাসিক হোটেলে উঠে৷ কিছুতেই চাচ্ছিল না কেউ জানুক রুমি পালিয়েছে৷ আম্মা, আব্বা একদিন পর বাড়ি ফিরে সবাইকে বলে, নানু অসুস্থ তাই হুট করে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম৷ আমি, রিনি আর রুমি রয়ে গেছি। আম্মার পরিকল্পনা অনুযায়ী, যতদিন রুমি না ফিরে আমি আর রিনি ফিরতে পারব না। তাই হোটেলেই ছিলাম আমরা। সেদিন বিকেলে নদীর পাড়ে বসে ছিলাম। হুট করে ফাইয়াজ স্যার সেখানে চলে আসে, আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে বলে, আমাকে নাকি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উনার বোন ভুল বুঝে রুমির জন্য প্রস্তাব দিয়েছে৷ এই কথা জানার পর সবাই অবাক হয়। আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়।”

 

অরুনিকার মুখটা অকস্মাৎ হা হয়ে গেল। খুশিতে শরীর ঝিমঝিম করে ওঠল। কোচিং-এ যখন পড়ত, ফাইয়াজ স্যার উনিশ বিশ হলেই শুধু রূপাকেই বকত, শাসন করত, কথা শুনাত, কান ধরিয়ে পাশে দাঁড় করিয়ে রাখত। উচ্চতায় দুজনই লম্বা হওয়াতে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কানাঘুষা হতো৷ সাধারণত অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে সুদর্শন তরুণ শিক্ষক নিয়ে যা হয় আর কি! 

 

সেই কানাঘুষা চার-পাঁচ বছর পর এসে বিয়ের প্রস্তাবে রূপ নিবে তা কী কেউ ভেবেছিল? অরুনিকা উত্তেজনায় রূপার হাত চেপে ধরল। আজিজুর ও সেলিনা মন দিয়ে রূপার বলা বুলি শ্রবণ করছেন। 

 

রূপা বলল, “আমি সেদিন না করি। এজন্য স্যার অনেক রেগে থাকে আমার উপর। আজ স্যারের বোন আর দুলাভাই আবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে বিয়ের। আব্বাও চাচ্ছে, স্যারের সঙ্গেই আমার বিয়ে হোক। এখন আমার উত্তর জানতে চায় সবাই। আমি কীভাবে উত্তর দেই তোকে না জানিয়ে? এতো বড় সিদ্ধান্ত কীভাবে নেব তোর মত ছাড়া?”

 

অরুনিকা রূপার বাহুতে থাপ্পড় দিয়ে বলল, “বেক্কল মেয়ে, কোন সাহসে তুই না করেছিলি?”

 

রূপা আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে৷  

 

অরুনিকা তীব্র উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “দৌড়ে গিয়ে বল, তুই বিয়ে করবি। কিছুতেই যেন এই মাল হাতছাড়া —”

 

অরুনিকা দ্রুত জিভ কাটল। উত্তেজনায় বাবা-মার সামনে কী বলে ফেলছিল! রূপা ও অরুনিকা একসঙ্গে পুর্নবার আজিজুরকে দেখল।

 

অরুনিকা উত্তেজনা দমিয়ে বলল, “গিয়েই হ্যাঁ বলবি, তারপর বিয়ের তারিখ জানাবি। যদি কেউ আমাকে দূর্গেও বন্দী করে রাখে আমি সেই দূর্গ ভেঙে তোর বিয়েতে আসব। এবার দৌড়া।”

 

রূপা উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসা করল, “সত্যি হ্যাঁ বলব?”

 

“যদি না বলিস, আমার ত্রিসীমায় আর আসবি না।”

 

দুই বন্ধু একসঙ্গে হেসে ফেলল। আজিজুরের ভয়ে তারা মেপে মেপে কথা বলছে, হাসছে৷ মনের অনেক কথা বলতে পারছে না। রূপা অরুনিকাকে জড়িয়ে ধরে আজিজুর ও সেলিনাকে বলল, “আসছি আংকেল, আসছি আন্টি।”

 

আজিজুর জবাব না দিলেও সেলিনা বললেন, “তোমার বিয়ের খবর শুনে খুশি হলাম।”

 

দরজার নিকটে এসে রূপা বলল, “স্যারকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবতেই পারছি না আমি।”

 

অরুনিকা বলল, “এখন থেকে ভাবতে হবে। তোদের দুজনকে কী মানাবে রে! ভেবেই আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি।”

 

“আংকেল যাবে কবে?”

 

“আর একদিন। তারপর আমি মুক্ত।” 

 

রূপা আবার অরুনিকাকে জড়িয়ে ধরল।

 

ফিসফিসিয়ে বলল, “হিরণ কেন আমার সঙ্গে দেখা করেনি? কিছু জানালি না তো।”

 

অরুনিকা কিছু বলার আগে সেলিনা পিছনে এসে দাঁড়ালেন। রূপা বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

 

অরুনিকা ড্রয়িংরুমে আসতেই আজিজুর প্রশ্ন করলেন, “কোন ফাইয়াজ? এডুএইডের ইংলিশ টিচার?”

 

অরুনিকা মাথা ঝাঁকাল। আজিজুর ফাইয়াজকে সেসময় খুব পছন্দ করতেন। অরুনিকাকে বাসায় এসে পড়াতেও বলেছিলেন। কিন্তু ফাইয়াজ না করে দিয়েছিল, সে বাসায় পড়ায় না।

 

আজিজুর অবাক সুরে বললেন “ওমন ব্রিলিয়ান্ট নক্ষত্র এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে কেন? ফাইয়াজ দূর্ঘটনায় হাত-পা হারিয়েছে নাকি?”

 

অরুনিকা মুখ গুমোট করে বলল, “রূপাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো না পাপা। স্যার রূপার মাঝের হীরেটা দেখেছে। একদিন তুমিও বুঝবে, রূপা কী!”

 

রসন ভিলার উঠানে বসে বত্রিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছেন জেসমিন, ইশতেহার এবং বারেক। 

অপেক্ষা যে কতটা ধারালো, কত বিচিত্রভাবে সূচের মতো আঘাত করতে পারে দেহে তা ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করছেন বারেক। লজ্জায় তিনি মাথা নত করে রেখেছেন৷ রূপা এভাবে কখনো লজ্জায় ফেলবে কখনো ভাবেননি তিনি। অতিথিদের বলেছেন, আর অপেক্ষা না করতে৷ 

রূপার উড়নচণ্ডী দশার জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। 

 

কিন্তু ইশতেহার বড় ভালো মানুষ। তিনি বলেছেন, “রূপা যখন বলেছে অপেক্ষা করতে, আরো কিছুক্ষণ দেখি। আশা করি, ইতিবাচক কিছুই ঘটবে।”

 

সাঁইত্রিশ মিনিটের মাথায় রূপা বাড়িতে প্রবেশ করল। 

 

বারেক অগ্নি চোখে তাকিয়ে উঁচু গলায় প্রশ্ন করলেন, “কোথায় গিয়েছিলি? কেন গিয়েছিলি?”

 

রূপা কিছু বলার আগে সুমনা বারান্দা থেকে বললেন, “বিয়ের ইচ্ছে নেই সেটা বলে গেলেই পারতি।”

 

বারেক আরো কিছু বলতে উদ্যত হলে ইশতেহার বললেন, “থামুন চাচা। রূপা, তোমাকে প্রশ্ন করব না তুমি কোথায় গিয়েছিলে। তুমি মতামত জানাও।”

 

বারেকের ধারণা রূপা না বলবে। নয়তো হুট করে কী বেরিয়ে যেতো? তিনি অপ্রসন্ন মুখে অন্যদিকে ফিরে বসেন। যখন রূপা বলল, “বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই।” তিনি চকিতে ঘুরে তাকালেন। মুহূর্তে রসন ভিলায় খুশির জোয়ার উঠে গেল। তিন দিন পর রমযান মাসের সূচনা। তাই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয় ঈদের পর। মে মাসের ত্রিশ তারিখ। সেই সঙ্গে এই কথাও হয়, আগামীকাল ফাইয়াজ এসে আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবে। রূপা হুট করেই টের পেল, সে লজ্জাবতী গাছের মতো নুয়ে যাচ্ছে। আগামীকাল ফাইয়াজ হবু বরের পরিচয় নিয়ে সামনে দাঁড়াবে, আংটি পরাবে ভেবে রূপা অদ্ভুত শিহরণ বোধ করল। ভেতরকার মেয়েলি ভাবটা শক্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল৷ রূপা দৃঢ় থাকার চেষ্টা করল।

 

ফাইয়াজ বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। তার চোখমুখ বিবর্ণ। সেসময় ইশতেহার আর জেসমিন আসল। জেসমিন বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

 

ফাইয়াজ মানিব্যাগ খুঁজতে খুঁজতে বলল, “বাহিরে।”

 

“ব্যাগে কত টাকা আছে?”

 

“আছে হয়তো হাজারখানেক।”

 

ফাইয়াজ বের হতে উদ্যোগ নেয়। 

জেসমিন বললেন, “আরো টাকা নিয়ে যাও। বউয়ের জন্য শপিং করে এসো।”

 

ফাইয়াজ থমকে গেল, চমকে তাকাল। তার অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখে জেসমিন, ইশতেহার হেসে ফেললেন।

 

ফাইয়াজ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “বিয়ে হচ্ছে?”

 

জেসমিন বলল, “হ্যাঁ, হচ্ছে৷ মে মাসের ত্রিশ তারিখ।”

 

ফাইয়াজ পূর্বের সুরে বলল, “এবার কি রিনির সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছো?”

 

এই প্রশ্ন শুনে ইশতেহার হোহো করে হেসে উঠলেন।

 

জেসমিন চোখ পাকিয়ে বললেন, “একবার ভুল করেছি বলে কি এখন পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলব? এতো বোকা আমি?”

 

“তাহলে রূপাই?”

 

ফাইয়াজ ইশতেহারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

 

ইশতেহার বললেন, “নিশ্চিন্ত থাকো, এবার পাত্রী ঠিক আছে। রূপা খুশিমনেই সম্মতি দিয়েছে৷”

 

ফাইয়াজ মুহূর্তে চেহারার রঙ পরিবর্তন করে দায়সারাভাবে বলল, “ভালো।” তারপর ভেতরের রুমে চলে গেল। সে মনের উচ্ছ্বাস না দেখালেও জেসমিন সেটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন। 

 

রূপা হোটেলে যেতে গেইট থেকে বের হয়েছে মাত্র, ঠিক তখনই বাইক নিয়ে বের হলো ফাইয়াজ। রূপা অপ্রতিভ হয়ে ওঠল। এই মানুষটা তার হবু বর। স্যার শব্দটা আর মস্তিষ্কে নেই। চারিদিকে হবু বর, হবু বর দেখতে পাচ্ছে।

 

রূপা পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল, ফাইয়াজ ডাকল, “এই মেয়ে, শুনো!”

 

এখনো কথার কী ভার! রূপা আগের মতোই আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, “জি স্যার, বলুন।”

 

ফাইয়াজ বাইকে বসে বলল, “পিছনে বসো।”

 

“কী?”

 

“বাংলা বুঝো না? পিছনে বসতে বলেছি। নাকি সামনে বসতে চাও?”

 

“সে কথা কখন বললাম?”

 

“মুখে মুখে তর্ক করবে না। বেয়াদবি আমার একদম পছন্দ না।”

 

রূপা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। ভাবল, “বেয়াদবির কী বললাম রে বাবা!”

 

“সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? উঠে বসো।”

 

রূপা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ফাইয়াজ আবার বলল, “ভারী অসভ্য তো তুমি! গুরুজনদের কথা শুনতে হয়, শিখোনি?”

 

“এতো রাতে আপনার সঙ্গে কোথায় যাব?”

 

“এর আগে কি এতো রাতে ছেলে মানুষের বাইকে উঠোনি? পাড়ার অখাটে-বখাটে পোলাপানদের সঙ্গে তো ঠিকই ঘুরে বেড়াও। কয়দিন আগে রাত বারোটায় লালনের সঙ্গে বাইকে করে ঘুরোনি? এখন তো বাজে দশটা চল্লিশ।”

 

“সেদিন তো হাসপাতাল গিয়েছিলাম। ওর আম্মাকে রক্ত দিতে। আর —”

 

“আবার তর্ক করছো? চলো, তোমার আব্বাকে বলেই তোমাকে নিয়ে যাব।”

 

রূপা বাইকে উঠে বলল, “বাজার দিয়ে যাবেন না, প্লিজ।”

 

ফাইয়াজ রূপার অগোচরে হেসে বাইক স্টার্ট দেয়।

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

২৮.

নদীরপাড়ের রোড ধরে ফাইয়াজের বাইক চলছে। রূপা দূরত্ব রেখে বসেছে। দুই হাতে পিছনের সিটের শেষ অংশ ধরে রেখেছে যেন পড়ে না যায়। নদীতরঙ্গে এক আলোছায়া মায়াবী রূপ খেলা করছে — তা একাগ্রচিত্তে দেখছে সে। 

ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বাইকের আয়নায় রূপাকে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাইয়াজ বলল, “নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ বসবে?”

 

রূপা সচকিত হয়ে বলল, “না…না স্যার।”

 

ফাইয়াজ বলল, “মাথায় ক্যাপটা দাও।”

 

রূপা নিশ্চিত হতে বলল, “আমারটা?”

 

“এখানে আর কার মাথায় ক্যাপ আছে?”

 

রূপা মাথায় ক্যাপ খুলে বলল, “নিন।”

 

“আমার মাথায় রাখো। চুলগুলো লম্বা হয়ে গেছে, বার বার চোখেমুখে এসে পরছে।”

 

রূপা আলগাভাবে ফাইয়াজের মাথায় ক্যাপ রেখে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ বাতাসে উড়ে যায়। রূপা চিৎকার করে, “আরে আমার ক্যাপ… “

 

ফাইয়াজ দ্রুত ব্রেক কষে। বাইক থামালে রূপা দৌড়ে গিয়ে রাস্তা থেকে ক্যাপ তুলে নিয়ে আসে। 

 

ফাইয়াজ অপ্রসন্ন হয়ে বলল, “মাথায় রাখতে মানে পরিয়ে দিতে বলেছি। আমার মাথা কি কাকের বাসা যে তোমাকে সাবধানে ডিম রাখতে বলেছি! দাও পরিয়ে দাও।”

 

ফাইয়াজ মাথা নত করে। সে এমনভাবে হম্বিতম্বি করে যে রূপা তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারে না, কী বলবে তাও গোছাতে পারে না। সে ক্যাপ পরিয়ে দিলে ফাইয়াজ বলল, “এটাকে ক্যাপ পরানো বলে? সব চুল তো কপালেই রয়ে গেছে।”

 

ফাইয়াজ এক হাতে সামনের চুলগুলো বিপরীত দিকে ঠেলে ক্যাপ পরল। তারপর বলল, “এটাকে বলে ক্যাপ পরানো। শিখে রাখো৷ উঠো এবার।”

 

কিছুক্ষণ পর তারা গন্তব্যে পৌঁছায়। সানমাদ শপিংমলে বাইক পার্ক করে ফাইয়াজ৷ 

 

রূপা প্রশ্ন করল, “আমরা এখানে কেন এসেছি?”

 

ফাইয়াজ বলল, “শপিংমলে মানুষ যে কাজে আসে।”

 

রূপা ভাবল, “এই লোক কী সোজা কথা বলতে পারে না, আশ্চর্য!”

মুখে বলল, “আমিতো কেনাকাটা করব না।”

 

ফাইয়াজ প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে রূপার হাতে ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হয়৷ 

 

শপিংমলের দ্বিতীয় তলায় এসে উত্তর দিলো, “আমার বান্ধবীর জন্য কেনাকাটা করব। বিচ্ছেদও এক ধরনের উৎসব। আর উৎসব উপহার দিয়ে উদযাপন করতে হয়।”

 

রূপার কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো, থমকে দাঁড়াল।

বলে কী এই লোক! বান্ধবী কি প্রেমিকাকে বলছে? বিচ্ছেদের কথা কেন বলল? বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ টানবে?

 

ফাইয়াজ পিছনে ফিরে বলল, “কী ব্যাপার? থামলে কেন?”

 

রূপা কিছু বলল না। সে মোটেও ঈর্ষান্বিত নয়৷ শুধু অবাক হয়েছে এটা ভেবে, ফাইয়াজের প্রেমিকা আছে আর সে উপহার দিয়ে বিচ্ছেদের স্বাদ নিতে চাইছে৷ আজগুবি কাণ্ড!

 

ফাইয়াজ রূপাকে নিয়ে প্রথমে একটি শাড়ির শপে ঢুকল। রূপার পছন্দমতো সেখান থেকে দুটো শাড়ি নিলো। রূপা শপে প্রবেশ করে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল, কী পছন্দ করবে! সে তো জীবনেও শাড়ি পছন্দ করতে শপিংমলে আসেনি। অরুনিকার সঙ্গে এসেছিল। তবে তখন শাড়ি অরুনিকাই পছন্দ করত নিজের জন্য, রূপা শুধু পাশে বডিগার্ড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ফাইয়াজের জোরাজুরিতে দুটো শাড়ি বাছাই করেছে সে। এতো দামী শাড়ি যার সাথে বিচ্ছেদ হবে তাকে দেবে ভেবে রূপার জ্বর জ্বর অনুভূত হচ্ছে৷ 

 

তারপর তারা ঢুকল জুয়েলারি দোকানে। সেখানে ফাইয়াজ নিজে পছন্দ করল এক সেট গহনা। স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করা সিম্পল গহনাটি অসম্ভব সুন্দর। প্রথমবারের মতো রূপার কোনো গহনা ভালো লেগেছে৷ সে বলেই ফেলল, “এটা ভীষণ সুন্দর।”

 

ফাইয়াজ বলল, “পরে দেখবে?”

 

রূপা থতমত খেয়ে গেল, “আমি? না।” 

সে লজ্জা পেয়েছে।

 

ফাইয়াজ একজন কর্মচারীকে ডেকে বলে রূপাকে গহনাটি পরিয়ে দিতে। রূপা প্রতিবাদ করে বলল, “না স্যার। আমি তো এমনি বলেছি।”

 

ফাইয়াজ বলল, “পরলে মেয়ে মানুষকে কেমন লাগে দেখে নিয়ে যাই। আপু, আপনি পরিয়ে দিন।”

 

মেয়েটি রূপাকে বলল, “আপু, শার্টের বোতাম খুলুন৷ প্রথম দুটো।”

 

শপের সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে৷ রূপা ফাইয়াজকে এক পলক দেখলে, ফাইয়াজ ইশারা করে যা বলেছে শুনতে৷ রূপা অনুগতের মতো শার্টের দুটো বোতাম খুলল। 

মেয়েটি রূপার গলায় হারটি পরিয়ে দেয়। কানে দুল পরাতে গিয়ে দেখে ছিদ্র নেই! 

 

রূপা হালকা হেসে বলল, “কান ফোঁড়ানো হয়নি।”

 

মেয়েটি বলল, “যদি ইমার্জেন্সি হয় তাহলে হারটি পরে চুল খোলা রাখতে পারেন৷ দুল ছাড়াই ভালো লাগবে।”

 

রূপা কিছু বলার আগে পিছন থেকে ফাইয়াজ বলল, “চুল খুলে দেখিয়ে দিন।”

 

মেয়েটি চুল খুলতে গেলে রূপা ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার — “

 

“এতো কথা বলো কেন তুমি? যা বলছে শুনো।”

 

মেয়েটি রূপার চুল খুলে হেয়ার ব্যান্ড পাশে রাখে৷ সোজা চুল পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শার্টের জন্য গহনাতে মোটেও ভালো লাগছে না।  তবুও মেয়েটি বলল, “এবার ভালো লাগছে।”

 

রূপা আয়নায় তাকিয়ে বিরক্তিতে কপাল কুঞ্চন করল৷ খুব বিশ্রী দেখাচ্ছে। পরনেও একটা পুরনো শার্ট! 

 

ফাইয়াজ সবার অগোচরে রূপার হেয়ার ব্যান্ডটি লুকিয়ে ফেলে; যেন রূপা চুল বাঁধতে না পারে।

 

গহনা প্যাকিং করার পর রূপা আর মেয়েটি এদিক-ওদিক খুঁজেও ব্যান্ডের হদিশ পায় না৷ মেয়েটি নিজের ব্যান্ড দিতে চাইলে ফাইয়াজ রূপার হাতে ধরে ভারিক্কি গলায় বলল, “সামান্য ব্যান্ডই তো। এর জন্য জরিমানা দিতে হবে না।”

 

বাহিরে এসে রূপা চুল হাত খোঁপা করে নেয়৷ ফাইয়াজ রূপার পায়ের মাপে দুই জোড়া কেডস ক্রয় করে। 

 

রূপা যখন প্রশ্ন করে, “আমার পায়ের মাপে কেন নিচ্ছেন?”

 

তখন ফাইয়াজ বলল, “তোমার পায়ের মতোই ওর পা।”

 

ফেরার পথে হুট করেই সোনালি পাড়ের একটি লাল সুতি শাড়ি ফাইয়াজের খুব চোখে লাগে৷ অদ্ভুতভাবে রূপারও শাড়িটি খুব পছন্দ হয়। কী স্নিগ্ধ! নতুন বউদের কী যে ভালো লাগবে! 

 

ফাইয়াজ এই শাড়িটিও সংগ্রহে নিলো। শাড়িটির ব্লাউজ পিস না থাকায় সে ব্লাউজের দোকানে রূপাকে নিয়ে ঢুকে৷ সুতোর কাজ করা একটি লাল ব্লাউজ রূপার পছন্দ হয়। ফাইয়াজকে ডেকে বলল, “স্যার, এটা ভালো। নিতে পারেন।”

 

ফাইয়াজ ব্লাউজটি দিতে বললে শপের মালিক বলল, “ম্যামের সাইজ?”

 

ফাইয়াজ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “ছত্রিশ।” 

 

রূপা ঠোঁট উল্টে ভাবে, “প্রেমিকার সাইজও জানে!”

 

কেনাকাটার সমাপ্তি টেনে রূপার হাতে সব ব্যাগ দিয়ে ফাইয়াজ বাইকে উঠে বসে৷ রূপা পিছনে বসে দুজনের মাঝে ব্যাগগুলো রাখল। 

 

রাত বাজে বারোটা। দ্রুতই তাদের কেনাকাটা হয়েছে। এই কেনাকাটাগুলো অরুনিকাকে নিয়ে করলে হাঁটতে হাঁটতে জান বেরিয়ে যেত।

রাতের বাতাস বইছে৷ এখন যে গভীর রাত, চারপাশ দেখে বোঝার জোঁ নেই৷ একদিন পর রোজা তাই মানুষের সমাগম আগের থেকেও বেশি। 

 

বাতাসের সাঁ সাঁ ধ্বনি কানে লাগছে। রূপাকে দুই হাতে ব্যাগগুলো ধরে রাখতে হচ্ছে, তাই খোঁপা খুলে গেলেও আর হাত খোঁপা করা সম্ভব হয় না৷ তীব্র বাতাসে লম্বা চুল উড়তে থাকে ঝড়ের মতো। বিপরীত দিক থেকে বাতাস আসলে সব চুল ফাইয়াজের পিঠ, ঘাড়, চোখমুখ স্পর্শ করে৷ রূপা কিছু দেখতে পাচ্ছে না৷ সে বাইক থামাতে বলল, “স্যার, একটু থামুন। চুল ঠিক করব৷ কিছু দেখছি না।”

 

ফাইয়াজ অবহেলার সুরে বলল, “রাত হয়ে গেছে৷ এখন থামানো যাবে না৷ চুপচাপ বসে থাকো।”

 

রূপার মনে হচ্ছে সে এখুনি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। সে মাথা ঝাঁকায় চুল ঠিক করতে। ফাইয়াজ বাইকের গতি বাড়ায়৷ বেড়ে যায় বাতাসের বেগও। চুল উন্মত্ত হয়ে উড়ছে৷ রূপা প্রাণের ভয়ে বাধ্য হয়ে এক হাতে ফাইয়াজের পেট আঁকড়ে ধরে। তাৎক্ষণিক একটা তীব্র সূচালো অস্বস্তি তার সারা শরীরে জাঁকিয়ে বসে৷ 

 

গলিতে এসে বাইকের গতি হ্রাস পায়। রূপার চুল স্থির হয়৷ সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ফাইয়াজকে ছেড়ে দেয়৷ বাড়ির সামনে এসে থামল বাইক৷ রূপা নেমে ব্যাগগুলো বাড়িয়ে দিলে ফাইয়াজ তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আমার কোনো বান্ধবী নেই৷ এগুলো তোমার। আগামীকাল পরো।”

 

কথা শেষ করেই ফাইয়াজ নিজের বাড়িতে প্রবেশ করে, গেইট বন্ধ করে দেয়৷ তার দৃষ্টি অস্থির। বুকের ভেতর কীসের যেন উগ্রতা, ছোটাছুটি! রূপার স্পর্শ জাদুর মতো তার অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দিয়েছে। ফাইয়াজ ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে দেখে জেসমিন ইশতেহারকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে৷ 

 

জেসমিন ফাইয়াজকে দেখে প্রশ্ন করলেন, “কেনাকাটা করতে যাসনি? হাতে কিছু নেই কেন?”

 

ফাইয়াজ কোনো জবাব না দিয়ে রুমে চলে গেল। 

 

ইশতেহার বললেন, “ওর আবার কী হলো। যাও গিয়ে দেখো।”

 

জেসমিন গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে ফাইয়াজের রুমে গিয়ে দেখেন, ফাইয়াজ সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে৷ বাতি জ্বালায়নি। লঘু হলুদ আলোয় রুম তলিয়ে আছে। জেসমিন তার সামনে গিয়ে বললেন, “কী হয়েছে? তোকে না বললাম রূপার জন্য কেনাকাটা করতে।”

 

ফাইয়াজ জেসমিনকে টেনে পাশে বসায়। তার কোলে মাথা রেখে বলে, “করেছি।”

 

“ব্যাগপত্র কোথায়?”

 

“রূপার কাছে?”

 

“কখন দিলি?”

 

“আমরা একসঙ্গে সানমাদে গিয়েছিলাম।”

 

জেসমিন চমৎকৃত হয়ে বললেন, “রূপা গিয়েছিল!”

 

রূপা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে কী যেন ভেবে আবার নিচে নেমে আসল। ধীর পায়ে সুমনার রুমে গিয়ে দেখল, সুমনা শুয়ে পড়েছেন। বারেক এখনো আসেনি। রূপা ডাকল, “আম্মা?”

 

সুমনা মাথা তুলে তাকালেন। রূপা শপিং ব্যাগগুলো আশিক-আরমানের পড়ার টেবিলের উপর রেখে বলল, “ওই বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে।” 

 

অন্যবেলা হলে পাত্রের বাড়ি থেকে কী কী দিয়েছে তা আগ্রহ নিয়ে দেখতেন সুমনা। হয়তো রুমির জন্য রেখেও দিতেন৷ কিন্তু এখন আর দেয়ার মতো কেউ নেই, মনেও কোনো আগ্রহ নেই৷ 

 

তিনি আবার শুয়ে পড়লেন। বললেন, “নিজের রুমে নিয়ে রেখে দে।”

 

রূপা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সুমনার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সুমনা কিছু বললেন না। রূপা আচমকা সুমনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি কী করেছি আম্মা? আমার প্রতি কেন তোমার এতো অবহেলা?”

 

বলতে বলতে তার দুই চোখ ভিজে উঠে। সুমনা কিছু বললেন না। রূপা আবার বলল, “আমাকে কেন ভালোবাসো না? আমি কি তোমার মেয়ে না?”

 

সুমনা কঠিন সুরে বললেন, “না, তুই আমার মেয়ে না।” 

 

“আমিতো তোমারই মেয়ে৷ কেন এভাবে বলছো? আমার কি কষ্ট হয় না? তোমার ব্যবহার আমাকে ভেঙে দেয়। আমার উঠে দাঁড়াতে খুব কষ্ট হয়।”

 

সুমনা রূপার থেকে ছোটার চেষ্টা করেন। রূপা জাপটে ধরে রেখেছে। জন্মদাত্রীর অবহেলা আর সহ্য হচ্ছে না। এই দিনগুলোতে মায়েদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি থাকে৷ আর তার মা নিশ্চল, নিশ্চুপ!

 

সুমনা তেঁতে উঠলেন, “রূপা, ছাড় আমাকে। এসব জড়াজড়ি ভালো লাগছে না। ছাড় বলছি।”

 

রূপা তাও ছাড়ল না। সুমনার পিঠে মুখ লুকিয়ে চাপাস্বরে কাঁদতে থাকল। সুমনা নড়াচড়া বন্ধ করে দিলেন৷ রূপা ভেজা কণ্ঠে বলল, “ও আম্মা, বলো না, কী করলে আমার প্রতি তোমার যে রাগ সেটা চলে যাবে। আমি তাই করব। আমি কি ভুল করেছি একবার বলো, শুধরে নেব।”

 

রুমি চলে যাওয়ার পর যে কান্না সুমনা চেপে রেখেছিলেন, রূপার জোর করে ভালোবাসা নেয়ার চেষ্টায় সেটি বেরিয়ে আসে। তিনি হুহু করে কেঁদে উঠলেন। রূপা আরো শক্ত করে সুমনাকে জড়িয়ে ধরল। সুমনা রূপার দিকে ফিরে তাকে দুই হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই কখনো কোনো ভুল করিসনি, কক্ষনো না। তুই আমার সোনার টুকরো মেয়ে।”

 

ইশতেহারের বুকে তেল মালিশ করে দিতে দিতে জেসমিন বললেন, “শুনছো?

 

ইশতেহার চোখ খুলে বললেন, “বলো।”

 

“ফাইয়াজ, রূপার কাবিনটা আগে করে ফেললে কেমন হয়? রূপার বাবা যখন চাইছে, অনুষ্ঠান করতে পরে করুক। শরীয়া মোতাবেক বিয়েটা পরিয়ে দেই।”

 

“কাবিন করিয়ে তো বাড়িতে আনতে পারবে না।”

 

“সে তো জানি। তবুও একটা শক্ত খুঁটি হলো। ওরা দুজন একসঙ্গে কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। ফেরার পর থেকে কেমন ঝিমিয়ে আছে ফাইয়াজ৷ তুমিতো জানো, অনেক খুশি হলে এরকম করে ও। বিয়েটা হলে অধিকারবোধটা থাকত। আমার মন বার বার বলছে, এই মুহূর্তে বিয়েটা হলে ফাইয়াজ অনেক খুশি হবে।”

 

“আমি আগামীকাল চাচাকে বলব। এখন ঘুমাও।”

 

জেসমিন তেলের বোতল রেখে ইশতেহারের বাহুতে মাথা রেখে বললেন, “রূপাকে তোমার কেমন লাগে?”

 

“ওর চোখে আগুন আছে।”

 

“কীরকম?”

 

“বুঝাতে পারব না৷ অন্য সব মেয়ে থেকে আলাদা। ছেলেদের জামাকাপড় পরলেও, উগ্র বা উশৃংখল নয়। নৈতিকতা আছে৷ কী যেন একটা সম্মোহনী ছাপ আছে! ধরতে পারছি না।”

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

২৯.

রূপা মধ্যরাতে সেলিনার ফোনে কল করেছিল। দুপুরে আংটি বদল হবে। এখন বাজে সকাল দশটা। অরুনিকা স্বীয় রুমে পায়চারি করছে। কীভাবে বের হবে পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷ রূপার এরকম গুরুত্বপূর্ণ দিনে সে থাকবে না তা হতে পারে না। আজিজুর রাতের ফ্লাইটে সিংগাপুর চলে যাবেন৷ তাই ব্যাগ গোছগাছ করছেন৷ 

 

অরুনিকা বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করে বুকে সাহস জমিয়ে আজিজুরকে গিয়ে বলল, “পাপা।”

 

আজিজুর কাজে সচল থেকে বললেন, “বলো।”

 

“একটু বের হতে চাই।”

 

আজিজুরের হাত থেমে গেল। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে এমনভাবে তাকালেন যে অরুনিকা ভড়কে গেল। এখন ভয় পেলে চলবে না, নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। 

অরুনিকা পুনরায় সাহস যুগিয়ে বলল, “আজ ফাইয়াজ স্যার রূপাকে আংটি পরাতে আসবে। আমি যেতে চাই, প্লিজ পাপা।”

 

আজিজুরের হাত ধরে অনুরোধ করার জন্য অরুনিকা এগিয়ে আসলে, আজিজুর হাত তুলে থামিয়ে দিলেন৷ 

বললেন, “যেতে পারবে না। আর এটাও ভেবো না, আমি চলে গেলে তুমি ওই মেয়ের কাছে যেতে পারবে। আমি লোক রেখে যাচ্ছি তোমার সব গতিবিধি শনাক্ত করার জন্য। ওই নোংরা এলাকায় কখনো পা রাখার সাহস করবে না।” 

 

অরুনিকা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল, “আমার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছো?”

 

“হ্যাঁ, তাই। এখন রুমে যাও, পড়াশোনা করো। বাইশ তারিখ ব্র‍্যাকে ভর্তি পরীক্ষা। ভালো করে এক্সাম দিবে। তোমাকে ফার্মেসী নিয়ে পড়তে হবে।”

 

অরুনিকা অবাক হয়ে বলল, “ব্র্যাক! আমি ব্র্যাকে পড়তে চাই না, পাপা।”

 

“আমি তোমার ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেব তাই হবে৷”

 

“পাপা প্লিজ!”

 

আজিজুর ধমকে উঠলেন, “যাও, রুমে যাও।”

 

অরুনিকার চোখ ছাপিয়ে জল নামল। দৌড়ে  ছুটে গেল রুমে। সেলিনা ঘুমিয়ে ছিলেন। চিৎকার শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বেরিয়ে এলেন।

 

এসে বললেন, “কী হয়েছে? চিৎকার করছো কেন?”

 

“তোমার মেয়ে ব্র‍্যাকে পড়বে না বলছে। টাকা তো আমি দেব, তার কী সমস্যা পড়তে?”

 

“জোর করে কি পড়াশোনা হয়? ও যেখানে যে সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে চায়, পড়তে দাও।”

 

“যেটা ভালো হবে আমি সেটাই করছি। মেয়েকে চোখে চোখে রেখো। যদি মেয়ে হাতছাড়া হয়, আমি তোমাকেও ত্যাগ করব।”

 

সেলিনার চোখ সজল হয়ে উঠল। 

তিনি বললেন, “এই কথা বলতে পারলে?”

 

আজিজুর জবাব দিলেন না৷ হতভম্ব সেলিনাকে উপেক্ষা করে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। 

 

অরুনিকা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর একটা সিদ্ধান্তে নিল। সে প্রথমে সেলিনার রুমে গেল। সেলিনার ব্যাগ থেকে ক্রেডিট কার্ড চুরি করে আবার নিজের রুমে চলে আসল। পাসওয়ার্ড তার জানা আছে। রূপার জন্য উপহার কিনতে হবে।

 

অরুনিকা হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি পরল, ব্লাউজ পরল, মনমতো সাজল। তারপর চুপিচুপি রুম থেকে বের হলো। উঁকি দিয়ে দেখল, আজিজুর ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছেন। তাকে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দরজা অবধি যেতে হবে। রূপার কাছে যাওয়ার জন্য এতটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।

 

সে এক হাতে শাড়ির কুঁচি ধরে ভোঁ দৌড় দিয়ে দরজা খুলে দপদপ শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটল যে আজিজুর তৎক্ষনাৎ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারলেন না। যখন হুঁশ ফিরল তিনি পিছন পিছন ছুটেও মেয়ের নাগাল পেলেন না। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নামার সামর্থ্য তার নেই। তাই শীঘ্রই দারোয়ানের নাম্বারে কল করলেন। এখুনি গেইট বন্ধ করতে হবে। দারোয়ান ফোন রিসিভ করল না। আজিজুর রাগে হুংকার দিয়ে উঠলেন। অন্য রুম থেকে দৃশ্যটি দেখলেন সেলিনা। তিনি মেয়েকে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখেও কোনো উদ্যোগ নেননি। সারাজীবন ছেলে-মেয়ে, স্বামীর জন্য করেই গেলেন, কেউই তার মন বুঝল না; মূল্য দিল না।

 

অরুনিকা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে নিচ তলায় এসে হিরণের মুখোমুখি হয়। সে পড়ে যাচ্ছিল, হিরণ ধরল। বলল, “কী হয়েছে? এভাবে ছুটছো কেন?”

 

অরুনিকা পিছনে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, “আজ আমার বন্ধু, রূপার এনগেজমেন্ট। পাপা বের হতে দিচ্ছে না। তাই পালাচ্ছি।”

 

হিরণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো অরুনিকার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো সুন্দর অরুনিকা! সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো! 

 

অরুনিকা দ্রুত পাশ কেটে চলে যায়। হিরণের সাথে পরে কথা বলা যাবে। আগে পালাতে হবে।

দারোয়ান ঘুমাচ্ছিল। হিরণ মাত্র বাহির থেকে আসায় গেইট খোলা। অরুনিকা দৌড়ে বেরিয়ে যায়।

 

পিছন পিছন হিরণ আসল বাইক নিয়ে। রাস্তায় এসে অরুনিকাকে বলল, “চলো, তোমাকে পৌঁছে দেই।”

 

অরুনিকা মিষ্টি করে হাসল। সঠিক সময়ে হিরণ এসেছে। 

সে বাইকে উঠে বসতেই হিরণ বলল, “শক্ত করে ধরো, নয়তো পড়ে যাবে।”

 

অরুনিকা থতমত খেয়ে বলল, “কাকে ধরব?”

 

“আমি ছাড়া কি আর কিছু আছে ধরার মতো? দ্রুত ধরো, আবার তোমার পাপা চলে আসবে।”

 

অরুনিকা পিছনে তাকায়। আজিজুর এখনো আসেননি! উত্তেজনায় তার হাতপা কাঁপছে। কণ্ঠমণি শুকিয়ে আসছে। সে শক্ত করে দুই হাতে হিরণের পেট আঁকড়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে  অদ্ভুত এক ভালোলাগা বুকজুড়ে লুটোপুটি খেতে শুরু করে।

 

পেটিকোট পরে পালঙ্কে বসে আছে রূপা। সুমনা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ মা-মেয়ে ব্লাউজ বিড়ম্বনায় পড়ে হতাশ। ব্লাউজের সাইজ ভুল।

 

রূপা বলল, “আম্মা, আমি শার্ট পরে ফেলি?”

 

সুমনা ধমকে উঠলেন, “শাড়ির সঙ্গে তুই শার্ট পরবি? আরেকবার কথা বলবি, থাপ্পড় দিয়ে দুই গাল ফাটিয়ে দেব। পাত্রীর জন্য কিছু কেনার আগে যে পাত্রীর সাইজ জেনে নিতে হয় তা কি ওরা জানে না? দাঁড়া, আমি এখুনি কল দিচ্ছি।”

 

“এইটুকুর জন্য তুমি কল করবে? কেমন দেখায় না। এরকম করো না।”

 

“তোকে না চুপ থাকতে বলেছি?” 

বলেই সুমনা জেসমিনের নাম্বারে কল করলেন।

 

জেসমিন কল রিসিভ করেই বললেন, “এইতো আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।”

 

“রূপার ব্লাউজ তো বড় হয়ে গেছে৷ ও তো কখনো শাড়ি পরেনি তাই ব্লাউজ নেই৷ আমার ব্লাউজও ওর বড় হয়। আপনাদের বাসায় চৌত্রিশ সাইজের কোনো ব্লাউজ থাকলে নিয়ে আসিয়েন। নয়তো শার্ট-প্যান্ট পরেই বেরিয়ে পড়বে।”

 

“কী বলেন! আচ্ছা দাঁড়ান, আমি ফাইয়াজকে পাঠাচ্ছি। ও তাড়াতাড়ি গিয়ে পরিবর্তন করে নিয়ে আসবে।” 

ফোন কানে রেখেই তিনি ফাইয়াজকে ডাকলেন, “ফাইয়াজ, ফাইয়াজ…কই রে ফাইয়াজ?”

 

ফাইয়াজের কণ্ঠ শোনা গেল, “কী?”

 

“ব্লাউজ বড় নিয়ে এসেছিস বোধহয়। রূপার হচ্ছে না৷ দ্রুত গিয়ে পাল্টে নিয়ে আয়।”

 

তারপর সুমনাকে বললেন, “চুল আচড়ে ছাদে যাচ্ছে, দিয়ে দিয়েন আগেরটা। পরিবর্তন করে আনবে।”

 

সুমনা ফোন রেখে রূপাকে বললেন, “ফাইয়াজ ওদের ছাদে আসছে। ব্লাউজ দিয়ে আসিস, বলে দিস চৌত্রিশ আনতে। আমি দেখি রান্না কতদূর।”

 

সুমনা চলে গেলেন। রূপা প্যান্ট-শার্ট পরে নিল। তখনই ফাইয়াজের ডাক শোনা গেল, “রূপা?”

 

রূপা দ্রুত ব্লাউজ নিয়ে বেরোল। ফাইয়াজ পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে লাইট গ্রে স্যুট, পায়ে চামড়ার তৈরি গাঢ় বাদামি রঙের জুতা, হাতে ঘড়ি, চুলে নিউ কাট  — গ্ল্যামারাস পুরুষ! রূপার মাথার ভেতরটা ভনভন করে উঠে। 

 

ফাইয়াজ বলল, “ঝিমিয়ে হাঁটছো কেন? দ্রুত হেঁটে আসো।”

 

রূপা দ্রুত হেঁটে গিয়ে হাতের শপিং ব্যাগটি বাড়িয়ে দিয়ে মিনমিনে সুরে বলল, “চৌত্রিশ।”

 

ফাইয়াজ স্বগতোক্তি করল, “সারাক্ষণ বস্তা পরে থাকলে সাইজ বোঝার সাধ্যি কার!”

 

গতকাল রূপার পছন্দে শাড়ি, রূপার পায়ের মাপে জুতা নিলেও, জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি, সাইজ কত! বাঙালি পুরুষের মন বলে কথা, কোথাও যেন বাঁধছিল! সে ঝটপট আন্দাজে বলে দিয়েছিল৷ ভেবেছিল, মিলবে।

 

ফাইয়াজ ব্যাগ নিয়ে দ্রুতপদে প্রস্থান করল।

 

রূপা ঘোরগ্রস্তের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ নিজের গাল ছুঁয়ে দেখে। সে কখনোই ফাইয়াজের মতো পরিপাটি নয়, গ্ল্যামারাস নয়। তার গালে ব্রনের দাগ, রোদে ত্বক পুড়ে গেছে, উজ্জ্বলতা নেই। লম্বা চুল আর উচ্চতা ছাড়া তথাকথিত সৌন্দর্যের কিছুই নেই। রূপার হুট করেই নিজের সৌন্দর্য নিয়ে আক্ষেপ হয়৷ 

 

সে ভাবল, “ফাইয়াজ স্যারের সঙ্গে আমাকে মানায় না। আমি এই বিয়েটা করলে সারাজীবন হীনমন্যতায় ভুগব। যে হীনমন্যতা কখনো আমার হৃদয়ে আসেনি, সে হীনমন্যতা আজ, এই ক্ষণে চলে এলো। এই বিয়ে করা উচিত হবে না।”

 

কিন্তু সে নিরুপায়। বিয়ে না করেও উপায় নেই। রূপা নিজের ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। উজ্জ্বলতাই কি সব? তার মুখের আকৃতি তো সুন্দর।

সে নিজের প্রতি সন্তুষ্ট প্রকাশের জন্য হাসল। 

 

“রূপা!”

 

রূপা চমকে তাকায়। দরজার ওপাশে অরুনিকা দাঁড়িয়ে আছে! তার সবচেয়ে আপন মানুষটা চলে এসেছে। 

দুই বন্ধু উচ্ছ্বসিত হয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরল। 

 

রূপা বলল, “আমি জানতাম তুই আসবি।”

 

“আমি তোর সব বিশেষ দিনে থাকব, সব দিনে!”

 

“তুই ছাড়া আমার সব বিশেষ মুহূর্ত অপূর্ণ।”

 

অরুনিকা মুখ তুলে বলল, “স্যারকে বাইক নিয়ে কোথায় যেন যেতে দেখলাম। এ সময়ে কোথায় গেছে?”

 

“ব্লাউজ বড় হয়ে গেছে। পরিবর্তন করতে গেছে।”

 

“স্যারকে কী যে সুন্দর লাগছিল!” অরুনিকা খুশিতে গদগদ। 

 

রূপা হেসে অরুনিকাকে বিছানায় বসিয়ে বলল, “তোর স্যারের সঙ্গে রূপাকে একেবারেই মানাচ্ছে না।”

 

অরুনিকা রূপার বাহুতে থাপ্পড় দিয়ে বলল, “যা, স্যারের পাশে একবার দাঁড়িয়ে দেখেছিস? আমি তোদের কল্পনা করতে করতে হাঁপিয়ে গেছি। এতো ভালো লাগে পাশাপাশি। এবার বাস্তবে দেখব।”

 

রূপা হাসল। বলল, “কীভাবে আসলি?”

 

“শাড়ি পরে, সেজেগুজে দৌড়ে বেরিয়ে চলে এসেছি৷ হিরণ বাইকে করে তোদের বাড়ি অবধি দিয়ে গেছে।” 

অরুনিকার চোখমুখ চকচক করছে। চোখে স্পষ্ট  খুশি। পরে বাড়ি ফিরলে কী হবে, সেসব ভাবছে না।

 

রূপা বলল, “হিরণ ভাইয়া কেন দেখা করেনি বলেছে কিছু?”

 

“ওর এক বন্ধু নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। খবরটা শুনে চলে গিয়েছিল। আগামীকাল তুই ফ্রি থাকলে দেখা করবে বলেছে।”

 

“তুই তাহলে বলে দিস, কাল সকালে যেন লেকে আসে। আগে যেখানে আসার কথা ছিল।”

 

“বলব।” অরুনিকা রূপাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি অনেক খুশি। তোর জন্য সবসময় স্যারের মতো কাউকেই ভেবেছি। আর তুই কী না একবার বেঁটে, আরেকবার ল্যাংড়া এসবের সঙ্গে প্রেম করেছিস! আমি জানতাম তোর জন্য কোনটা পারফেক্ট। এবার মিলল তো?”

 

রূপা বলল, “বেঁটে, ল্যাংড়া তো কী? ওরা কি মানুষ না?”

 

“ইশ! তুই সামঞ্জস্যতা বুঝিস না। সমান, সমান হতে হবে না?”

 

“তাহলে তো বলতে হয়, স্যারের সঙ্গে আমার সামঞ্জস্যতা নেই।” 

 

এই পর্যায়ে এসে অরুনিকা রূপার গালে আলতো করে থাপ্পড় বসাল। বলল, “তুই বেশি বুঝিস। এই দেখ, ব্যাগে করে আবার সব মেকাপ প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছি। তোকে আজ মনের মতো সাজাব।”

 

“এই না, আমি এসব মেকাপ-টেকাপ করব না। শাড়ি পরব এই বেশি। আব্বা, আম্মার মন রাখতে পরছি নয়তো এটাও পরতাম না।”

 

“আমার মন রাখতে সাজবি।”

 

রূপা উঠে দাঁড়ায়, “এ তো অবিচার!”

 

“কখনো তোর অপছন্দের কিছু করিনি। আজ আমি সাজাবই৷ এতোকিছু নয়তো কেন বয়ে আনলাম?”

 

রূপা এক হাতে অরুনিকার ব্যাগ সরিয়ে তার কোলে মাথা রাখল৷ প্রসঙ্গ পাল্টে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলল, “অরু, আমি চরম হীনমন্যতায় ভুগছি। স্যার পরে আফসোস করবে না তো?”

 

“এখনো কীসের স্যার, স্যার করছিস? ফাইয়াজ বল৷ স্যার তরুণ না যে মোহে পড়ে বিয়ে করবে৷ নিশ্চয়ই কিছু পেয়েছে তোর মধ্যে। বা তোকে ভালোবাসে সেই কোচিং থেকে।”

 

রূপা অবাক হয়ে তাকাল, “কোচিং থেকে!”

 

“হতেই পারে। বিয়ের পর জিজ্ঞাসা করে নিস। ওহ ভালো কথা, বিয়ে কবে ঠিক হলো?”

 

“মে মাসের ত্রিশ তারিখ।”

 

“এতো দেরি কেন? আরো দেড় মাস!”

 

“আব্বা ধুমধাম করে বিয়ে দিতে চায়, এজন্য।”.

 

চলন্তিকা বাসের পিছনের সিটে বসে আছে রুমি। তার চোখেমুখে মারের দাগ। নিকাব পরেও চোখের আশেপাশে থাকা দাগগুলো আড়াল করতে পারেনি। 

চোখ দুটি জলে ভেজা, ক্লান্ত। ফিরছে নিজের নীড়ে।

 

একজন বৃদ্ধা বার বার তাকে দেখছে৷ একসময় প্রশ্ন করেই ফেললেন, “ও মেয়ে, তোমার চোখে কী হয়েছে?”

 

রুমি কথা বলতে গিয়ে টের পেল তার কথা বেরোচ্ছে না। বাম পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে।

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৩০.

সোনালি পাড়ের লাল শাড়ি, রূপাকে অর্পণ করেছে এক নতুন রূপ। তার ভেতরকার নারীত্বের সৌন্দর্য বিচ্ছুরণ ছড়াচ্ছে। 

 

অরুনিকা নিজের কানে গুঁজে রাখা লাল জিনিয়া ফুল খুলে রূপাকে পরাতে গেলে রূপা বাধা দিয়ে বলল, “কী করছিস? তোরটা কেন দিচ্ছিস?”

 

অরুনিকা ভ্রু-বক্র করে বলল, “তোর, আমার আবার কখন থেকে হলো?”

 

“সেটা বলিনি। আমার এসব পরতে ভালো লাগে না।” বলতে বলতে রূপা হাত খোঁপা করতে লাগল, “আমার খোঁপাই ভালো।”

 

অরুনিকা সজোরে রূপার হাতে থাপ্পড় মারল। রূপা আর্তনাদ করে চুল থেকে হাত সরিয়ে নিল। 

 

বলল, “মারছিস কেন?”

 

অরুনিকা বলল, “একদম খোঁপা করবি না। আজ আমি যা বলব তাই হবে। তুই চুপচাপ বসে থাকবি।”

 

“ভারী মুশকিলে পড়া গেল তো। আচ্ছা, যা ইচ্ছে কর কিন্তু মেকাপ করব না প্লিজ।”

 

“লিপস্টিক আর কাজলটুকু অন্তত দিতে হবে!”

 

অরুনিকা কখনো রূপাকে সাজগোজের ব্যাপারে জোরাজোরি করেনি। তার মন্তব্য হলো, প্রতিটি মানুষেরই ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে। আজ যখন জোর করছে, রূপা কী করে প্রতিবাদ করে!

 

অরুনিকার জন্য হলেও রূপাকে সাজতে হলো। 

 

নিচ তলা থেকে সুমনার হাঁক আসল, “তোদের হলো?”

 

অরুনিকা চেঁচিয়ে বলল, “আসছি আন্টি।”

 

রূপা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার কেশ খোলা, কর্ণে গুঁজে রাখা জিনিয়া ফুল। কী অপরূপ লাগছে! অরুনিকার ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত লাভ করে। সে রূপাকে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। 

বলল, “এবার ফাইয়াজ স্যারের সাথে আমার রূপাকে মানাবে তো?”

 

রূপা আয়নায় দৃষ্টিপাত করল৷ শত শত রাত ক্লান্তি নিয়ে ঘুমানো চোখে প্রথমবারের মতো কাজলের কালি, সিগারেটের বিষাক্ত স্পর্শে ঠোঁটের চারপাশ কালচে বর্ণ ধারণ করা ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, পরনে লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ — সবকিছুতে নিজেকে খুব অচেনা লাগছে! 

সৌন্দর্যের থেকে অচেনা শব্দটাই বেশি মস্তিষ্কে চক্রাকারে পরিভ্রমণ করছে। 

 

ছোটবেলা শাড়ি, ফ্রক, সালোয়ার-কামিজসহ সাজগোজের সকল জিনিসপত্রের প্রতি তার অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একা একা সাজত। চোখেমুখে আঁকিবুঁকি করত। বয়স যখন সাত হলো, সুমনা শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আজ থেকে তুই আমার বড় ছেলে। তোর আব্বার সঙ্গে হোটেলে বসবি, কাজ করবি। কর্মচারীকে বেতন দিয়ে পোষায় না, সংসায় চলে না৷”

 

এই সিদ্ধান্তে বারেক প্রথমে দ্বিমত করলেও পরে নিরুপায় হয়ে মেনে নিলেন৷ রূপা খুব উৎসাহের সঙ্গে জন্মদাতার পাশে দাঁড়াল। কখনো কখনো তার খুব ইচ্ছে করত, রুমির মতো শাড়ি পরতে, সাজতে। সুমনা তা হতে দিতেন না৷ তার এক কথা, “তুই আমাদের ছেলে। পরিবারের দায়িত্ব তোর বাপের যেরকম তোরও সেরকম৷”

 

ধীরে ধীরে সাজগোজের প্রতি, মেয়েদের বাহারি রঙের পোশাকের প্রতি যে তীব্র ঝোঁক তার ছিল, তা ফিকে হলো। শার্ট-প্যান্টে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল রূপা। 

 

“তোকে দেখতে একদম আন্টির মতো লাগছে। যেন জমজ বোন।” 

চমৎকৃত কণ্ঠে বলল অরুনিকা।

 

তার কণ্ঠ রূপার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে। রূপা পুনরায় আয়নায় তাকাল। অরুনিকা ঠিক বলেছে! তার মধ্যে সুমনার চেহারার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

 

আবার সুমনার ডাক আসল, “তোদের এখনো হয়নি?”

 

অরুনিকা গলার স্বর চড়া করে বলল, ” হয়ে গেছে। আসছি।”

 

তারপর রূপাকে বলল, “চল, স্যার তোর জন্য অপেক্ষা করছে।” 

বলেই সে চোখ টিপল। রূপা হেসে ফেলল।

 

অরুনিকা আর রূপা একসঙ্গে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে। রূপার জাদুকরী প্রভাব জেসমিনকে বিমোহিত করে তোলে৷ রূপার সৌন্দর্য এভাবে লুকিয়ে ছিল; ছেলেদের বেশভূষার আড়ালে!

 

রূপা মাথা উঁচু করে ড্রয়িংরুমে ঢুকেছে। সাধারণ মেয়েদের মতো লজ্জা বা জড়তা নেই তার মধ্যে। চোখমুখের প্রতিক্রিয়াও সহজ এবং সাবলীল। শাড়ি পরে হাঁটতে একটু সমস্যা হয়েছে বটে, অরুনিকা সেটা সামলে নিয়েছে। 

 

জেসমিন উঠে এসে রূপার গাল ছুঁয়ে বলল, “ভীষণ সুন্দর লাগছে!” 

সে রূপার গালে আলতো করে চুমু খেল। রূপার অস্বস্তি হয় সেই সঙ্গে আনন্দ। জেসমিন অমায়িক, ছোটদের আদর করতে ভালোবাসে। রূপা মিষ্টি করে হাসল। 

 

ফাইয়াজ তখনো রূপার দিকে তাকায়নি। তার হাতে সংবাদপত্র। সে টের পেয়েছে রূপা এসেছে, তবুও তাকাচ্ছে না। একমনে সংবাদপত্র পড়ছে।

 

জেসমিন রূপাকে টেনে নিয়ে ফাইয়াজের পাশে বসাল। আকস্মিকতায় রূপা আড়ষ্ট হয়ে গেল। ফাইয়াজের চোখ তখনো সংবাদপত্রে। এ অবস্থাতেই সে একটু দূরে সরে বসে। দৃশ্যটি দেখে অরুনিকার কপাল কুঁচকে যায়। 

 

ভাবল, “রূপা বসেছে বলে স্যার সরে গেল কেন?”

 

মুখ ফুটে প্রশ্নটি করতে পারল না। রূপার হবু বর, তার এক সময়ের ইংরেজি শিক্ষক। ওই ব্যাচের সব ছাত্রছাত্রী ফাইয়াজকে ভয় পেত। অরুনিকাও তেমনি একজন৷ এই সম্পর্ক সহজ হতে সময় লাগবে। 

 

সুমনার সঙ্গে প্রতিবেশী দুই-তিনজন মহিলা আসল সেখানে। সুমনা এসেই বললেন, “জেসমিন, তোমার বর কোথায়? আসেনি কেন?”

 

জেসমিন বলল, “কোথায় যেন গেল। বলল, আমরা যেন এখানে থাকি, চলে আসবে।”

 

“কখনো তো বের হয়নি। রাস্তাঘাট চিনবে?”

 

জেসমিন এ কথার জবাব দিতে পারল না। 

সে উদাস হয়ে ভাবে, “সুমনা চাচী ভুল বলেননি। মানুষটা কোথায় গেল?”

 

ফাইয়াজ সংবাদপত্রটি পাশে রেখে বলল, “ভাইয়া কিছু না চিনলেও, চিনে চিনে চলে আসবে।”

 

রূপা ঘাড় ঘুরিয়ে ফাইয়াজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ফাইয়াজ তার দিকে তাকাচ্ছে না। সমস্যা কী লোকটার? রূপা অস্থিরবোধ করে। অধৈর্য্য হয়ে পড়ে।  এতো সাজ কার জন্য? নিজের ভেতরের অনুভূতি টের পেয়ে সে নিজেই অবাক হয়৷ 

মনে মনে নিজেকে শুধায়, “আমি কেন চাচ্ছি স্যার আমাকে দেখুক?”

 

তাদের সম্মুখে রাখা সোফায় অরুনিকা বসে আছে৷ সে মন ভরে ফাইয়াজ আর রূপাকে দেখছে। উচ্চতায় কী দারুণ সামঞ্জস্যতা দুজনের! একেই বলে, দুজন দুজনার জন্য সৃষ্টি! তার হঠাৎ মনে হয়, এই মুহূর্তটার ছবি তুলে রাখা দরকার। 

 

অরুনিকা ব্যাগ থেকে তার ছোট ক্যামেরাটা বের করে বলল, “স্যার, আমি কি আপনাদের কিছু ছবি তুলতে পারি?”

 

জেসমিন পাশ থেকে বলল, “তুমিও ফাইয়াজের স্টুডেন্ট?”

 

“জি আন…” অরুনিকা থেমে গেল৷ ফাইয়াজের বোন হলে তো রূপার আপা হয়, মানে তারও আপা। 

সে বলল, “জি আপা, রূপা আমি একসঙ্গেই পড়েছি।”

 

জেসমিন বলল, “ও। দেখি, আমি সরছি। তুমি ওদের দুজনের ছবি তুলো। আংটি পরানোর আগের মুহূর্তটা ক্যামেরায় তুলে রাখো।”

 

সুমনা প্রতিবেশীদের নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন। অরুনিকা আশকারা পেয়ে বিভিন্ন কোণ থেকে, বিভিন্নভাবে একের পর এক ক্লিক করতে থাকে। ফাইয়াজ বসে থেকে দুই-তিন রকমের পোজ নিলেও, রূপা দুই পায়ের উরুর উপর দুই হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকে বসে আছে ছেলেদের মতো। তার ভাবান্তর নেই৷ 

 

বিরক্ত হয়ে অরুনিকা ধমক দিল, “আরে বেক্কল, ঘোমটা টেনে একটু লাজুক হয়ে বস।”

 

রূপা ঘোমটা টেনে হাসি-হাসি ভাব করার চেষ্টা করে। 

 

অরুনিকা বলল, “হাবলার মতো হাসছিস কেন? ঠিক করে হাস। যেন ন্যাচারাল লাগে।”

 

রূপা সুন্দর করে হাসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। 

 

অরুনিকা নিরাশ ভঙ্গিতে বলল, “তোকে হাসতে হবে না মা৷ চুপচাপ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাক।”

 

ফাইয়াজ অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখে। অরুনিকা রূপার গোমড়া মুখের ছবি বিদ্যুতের গতিতে তুলতে থাকল। পর পর এতো ছবি তুলতে দেখে ফাইয়াজ বলল, “এত ছবি তুলছো কেন? বেশি ছবি তোলা কি ভালো? ক্যামেরাটা রাখো।”

 

জেসমিন পাশ থেকে বলল, “ও মা! এভাবে বলছিস কেন? ও কি এখনো তোর স্টুডেন্ট?”

 

“যে একবার স্টুডেন্ট হয়, সে সারাজীবনের জন্য স্টুডেন্ট আপা।”

 

অরুনিকার বলতে ইচ্ছে করল, “ও তাই নাকি! তাহলে রূপার দিকে নজর পড়ল কেন?”

 

কিন্তু বলল না। থতমত খেয়ে ক্যামেরা রেখে দিল৷ এমন একজনের সঙ্গে তার বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে, যার সাথে কখনো মজা করা তো দূর, হেসেখেলেও কথা বলা যাবে না৷ তাতে অবশ্য তার সমস্যা নেই। রূপার উচ্চতার সঙ্গে মানানসই, সব দিক দিয়ে সুদর্শন, গুণী পাত্র পেয়েছে এতেই সে খুশি। রূপার বিয়ের চিন্তা গেল। এখন আর রূপা বেঁটে, কানা, ল্যাংড়া, বধির এসবের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে প্রেম করবে না। 

 

দুপুর তিনটা। বারেকও বাড়ি ফিরেননি। সুমনা বারেকের নাম্বারে কল করলেন, ব্যস্ত পেলেন। এখন আবার কার সাথে কথা বলছে? কখন থেকে জেসমিন আর ফাইয়াজ বসে আছে! সুমনার অপেক্ষা ভালো লাগে না। মেজাজ চড়ে যায়।

তিনি কোনোমতে রাগ সংবরণ করে জেসমিনকে ডেকে বললেন, “ও জেসমিন, তুমি ফাইয়াজকে নিয়ে খেয়ে নাও। কখন থেকে বসে আছো।”

 

জেসমিন বলল, “এতো তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই চাচী। চাচা আসুক, ফাইয়াজের দুলাভাই আসুক, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা যাবে। বিয়ের মৌসুম মানেই তো খাওয়াদাওয়া।”

 

রূপা আর অরুনিকা রুমির রুমে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছে৷ রূপা অবাক চোখে দেখছে সুমনার ব্যস্ততা৷ সে তো এটাই চেয়েছিল, তার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকুক তার মা৷ কী সুন্দর ছুটে ছুটে কাজ করছে, প্রতিবেশীদের সামলাচ্ছে, হাসছে! 

 

কোনো ভূমিকা ছাড়া অরুনিকা বলল, “স্যার, তোর দিকে তাকাচ্ছে না কেন?”

 

রূপা বিরসমুখে বলল, “কী জানি! এই লোকের মতিগতি আমি বুঝি না।”

 

“ভয় পাচ্ছে হয়তো।”

 

“কীসের ভয়?”

 

“তোর রূপ দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার ভয়।” 

কথন শেষ করে ফিক করে হেসে ফেলল সে।

 

রূপা হেসে বলল, “মজা করিস না!”

 

সুমনাকে রান্নাঘরে যেতে দেখে অরুনিকা দ্রুত বলল, “দাঁড়া, আসছি।”

 

সুমনা বরাবরই অরুনিকাকে আদর করেছেন। তার আলমারিতে রাখা সবচেয়ে দামী যে তিনটে শাড়ি সেগুলো অরুনিকার দেয়া। 

তিনি অরুনিকাকে রান্নাঘরে আসতে দেখেই বললেন, “তোমার ক্ষুধা লেগেছে? খেয়ে নাও।”

 

“পরে খাব আন্টি। তুমি চলো না, রূপার সঙ্গে ছবি তুলে দেই।”

 

“আমি?” সুমনা অবাক হলেন। বললেন, ” ঘেমে-নেয়ে একাকার। এখন ছবি ভালো আসবে না।”

 

“ঘামে কিছু হয় না৷ তুমি চলো, প্লিজ।”

 

অরুনিকা সুমনাকে টেনে নিয়ে গেল রূপার নিকটে। মা-মেয়েকে পাশাপাশি বসিয়ে ছবি তুলল।

রূপার পাশে বসে সুমনা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কখনো এভাবে মেয়ের পাশে তার বসা হয়নি!

 

ফাইয়াজ আর বসে থাকতে পারছে না। অপেক্ষা করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মাথার উপরে ঘোরা ফ্যানের ঘ্যারঘ্যার শব্দ আরো মাথা খেয়ে ফেলছে। তীব্র বিরক্তি নিয়ে সে উঠে চলে যেতেই চাচ্ছিল, জেসমিন আটকে দিয়ে বলল, “এখন যেও না। তোমার দুলাভাই মেসেজ দিয়েছে, সে আসছে।”

 

“কোথায় গিয়েছিল?”

 

“বলেনি। এসে বলবে হয়তো।”

 

বিশ মিনিটের মাথায় ইশতেহার, বারেক ও এলাকার আরো তিনজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এলো। তাদের সঙ্গে টুপি পরা একজন বয়স্ক লোক; দেখতে হুজুরের মতো। 

এসেই বারেক সুমনাকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলেন।

 

ইশতেহার জেসমিনকে বলল, “এখন ফাইয়াজ আর রূপার বিয়ে পড়ানো হবে।”

 

ফাইয়াজ চকিতে তাকাল। জেসমিনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল৷ পাশের রুম থেকে এই কথাটি শুনে, রূপার মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়ল।

 

সে অবাক সুরে অরুনিকাকে বলল, “মানে কী? আজ কেন বিয়ে?”

 

হুবহু প্রশ্ন ফাইয়াজও করল। 

ইশতেহার বলল, “চাচা চান রূপাকে অনুষ্ঠান করে বিয়ে দিতে। তার জন্য উনার সময় দরকার। ত্রিশ মে আসতে এখনো এক মাস আঠারো দিন বাকি। এভাবে বিয়েটা ঝুলিয়ে রেখে তো লাভ নেই। বিয়ে পড়িয়ে দেই, দুজন নিজেদের বাড়িতে থাকো। উঠিয়ে নেয়ার পর একসঙ্গে থাকা যাবে। চাচাও তাই চান।”

 

কথা শেষ করেই ইশতেহার জেসমিনকে এক পলক দর্শন করল। জেসমিন কৃতজ্ঞবোধ থেকে হাসল৷ তার মুখাবয়বে সন্তুষ্টি। সে স্মৃতি রোমন্থন করে পৌঁছে গেল বেশ কয়েক বছর আগের দৃশ্যে৷ 

 

ইশতেহার, জেসমিন তখন যুবক-যুবতী। ইশতেহার প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বলেছিল, “তুমি যা চাও, একবার মুখ ফুটে বলবে, আমি জীবন দিয়ে তা পূরণ করব।”

 

সেদিনের পর থেকে জেসমিনের প্রতিটি ইচ্ছে সে পূরণ করে যাচ্ছে। তেমনি একটা ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে দূর্ঘটনার স্বীকার হয়ে পঙ্গুত্বকে কবুল করেছে৷ 

 

জেসমিন ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি, ইশতেহার বলার পরদিনই বারেককে রাজি করিয়ে ফেলবে বিয়ের জন্য! সে একইসঙ্গে আশ্চর্যান্বিত এবং আনন্দিত। 

 

বারেকের মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে সুমনা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন, “এতো তাড়াহুড়ো কেন করছো? আজই কীসের বিয়ে?”

 

“বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও তো ভেঙে যায়৷ বিয়ে দিয়ে দিলে ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায়। শুধু অনুষ্ঠান করা বাকি থাকে। সমস্যা কী বিয়ে দিতে?”

 

“হঠাৎ কীভাবে বিয়ে হতে পারে?”

 

“তোমার-আমার কি হঠাৎ বিয়ে হয়নি?”

 

“সেটা অন্যরকম ছিল।”

 

“তুমি এখন কথা বলো না। আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজই ফাইয়াজ-রূপার বিয়ে হবে।”

 

“ও তো আমারও মেয়ে। তুমি আমার মতামত ছাড়া কেন বিয়ে ঠিক করেছো? ইদানীং সবকিছুই আমার অনুমতি ছাড়া করে ফেলছো! রাতে গিয়ে জমানো টাকায় ফাইয়াজের জন্য ডায়মন্ডের আংটি নিয়ে আসলে। বাকি ছেলেমেয়েদের চিন্তা তোমার নেই। এখন আবার —”

 

বারেক কথার মাঝে আটকে দিয়ে বললেন, “কথা পেঁচিয়ে সময় নষ্ট করো না। আজকের দিনটাও ভালো। আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে রাজি হয়ে যাও।”

 

সুমনা অবাক না হয়ে পারছেন না। বারেক শেষ বয়সে এসে তার হাত থেকে ছুটে গেছে! সম্প্রতি সবকিছু নিজের মতো করছেন! কিছু শুনছেন না।

 

তর্কবিতর্ক শেষে, বিয়ের সিদ্ধান্তেই সবাই উপনীত হয়। ড্রয়িংরুমে পাশাপাশি বসানো হয় ফাইয়াজ-রূপাকে। প্রথমে আংটি বদল হয়। ফাইয়াজ চোখের কোণ দিয়ে রূপাকে আবছা দেখেছে — ব্যাস এইটুকুই! সরাসরি আর তাকায়নি।

তারপর কাজী সাহেব স্বাক্ষীদের নিয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। নগদ তিন লক্ষ দেনমোহরে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ঘোরগ্রস্তের মতো প্রতিটি মানুষ মুহূর্তটির স্বাক্ষী হয়ে থাকে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বে, দুটি মানুষ এক বিন্দুতে মিলিত হয়। 

 

চলবে…

(দ্রুত লিখেছি। ক্রুটি থাকলে এড়িয়ে যাবেন।)

 

সূর্যশিশির 

৩১.

বিয়ের পর্ব শেষ হতেই নবদম্পতিকে রুমে গিয়ে আলাদা কথা বলতে, একান্ত সময় কাটাতে বলা হয়।

 

ফাইয়াজ বলল, “বাহিরে যেতে চাই।”

 

জেসমিন অবাক হয়ে বলল, “এখন বাহিরে কেন? মাত্র বিয়ে করলি, বউ রেখে কোথায় যাবি?”

 

ফাইয়াজ চোখ তুলে উপস্থিত গুরুজনদের এক পলক দেখল।

কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল, “রূপাকে নিয়ে।”

 

এক গাল হাসি দিয়ে জেসমিন বলল, “দাঁড়া, ব্যবস্থা করছি।”

তারপর বারেককে বলল, “চাচা, ফাইয়াজ আর রূপা ঘুরে আসুক। আপনার অনুমতি আছে?”

 

বারেক বিগলিত কণ্ঠে বললেন, “অনুমতির কী আছে? এখন থেকে তো জামাই আর তুমি রূপার অভিভাবক। যা রূপা, জামাইয়ের সঙ্গে যা।”

 

জামাই শব্দটা রূপার শ্রুতিপথে উদ্ভট লাগছে৷ কোচিংয়ে যখন প্রথমবার ফাইয়াজ ক্লাসে এসে কঠিন গলায় বলেছিল, “প্রথমে বলে রাখি, আমি বেয়াদবি একদমই সহ্য করতে পারি না৷ হাসাহাসি, ফিসফিসানিও আমার পছন্দ নয়৷ এর কোনোটা যদি হয় সোজা ক্লাসের বাইরে বের করে দেব। মনোযোগ দিয়ে সবাই আমার কথা শুনবে, কিছু না বুঝলে প্রশ্ন করবে। বোঝা গেছে?”

 

সেদিন কী সে ভুলেও কল্পনা করেছিল, এই কাঠখোট্টা মানুষটাই তার জীবনসঙ্গী হবে! 

 

সকলের অনুমতিতে ফাইয়াজ রূপাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য সম্পর্কে রূপার ধারণা নেই। সে এখন অপ্রীতিকর অবস্থায় আছে৷ পরনের শাড়ির জন্য সুবিধামতো বসতে পারেনি। সবসময় দুই পা দুইদিকে দিয়ে বসেছে, আজ দুই পা একপাশে রাখতে হচ্ছে! সে এতে অভ্যস্ত নয়।

পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ফাইয়াজের কাঁধে দুই হাত রাখল৷ ফাইয়াজ বলল, “কাঁধে ব্যথা, ধরো না।”

 

“কোথায় ধরব? পড়ে যাব তো।”

 

“আপা তো কোমড়ে ধরে। তুমিও তাই করো।”

বলতে বলতে ফাইয়াজ হেলমেট পরে নিল।

 

অগত্যা রূপাকে তাই করতে হলো। প্রথমে এই ঘনিষ্ঠতা অস্বস্তির ধারালো সূচ হয়ে আঘাত করলেও ধীরে ধীরে তা ভালোলাগায় পরিণত হয়। ফাইয়াজের গায়ের সুগন্ধির প্রখর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। রূপার মাথা ভনভন করতে থাকল। 

এলাকার মানুষেরা প্রথমবারের মতো রূপাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে বিস্ময়ে হতবিহ্বল। কেউ কেউ রসন ভিলার দিকে রওনা হয়, কী হয়েছে জানতে। হঠাৎ এই মেয়ে শাড়ি পরল কেন?

 

চল্লিশ মিনিটের মাথায় নদীর পাশের রোডে এসে বাইক থামাল ফাইয়াজ। রোডের বাম পাশে বিস্তৃত ক্ষেত, ডান পাশে সাহানি নদী৷ নদীর পাড় সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে। নরম বাতাস বইছে।

বাইক রেখে ফাইয়াজ রূপার দিকে তাকাল। হঠাৎ তাকানোতে রূপা অপ্রতিভ হয়ে উঠল, কিঞ্চিৎ লজ্জাও যেন পেল। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের ভাবমূর্তি আড়াল করার চেষ্টা করে।

 

ফাইয়াজ বলল, “চলো, ওদিকে গিয়ে বসি।”

 

ফাইয়াজকে অনুসরণ করে নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় এসে বসে দুজন।  রূপা সহজ আচরণ করতে চাইছে কিন্তু কোনো এক কারণে তার বুকের ভেতরটা অনবরত ঢিপঢিপ করছে৷ রোড দিয়ে মাঝেমধ্যে এক-দুটো গাড়ি যাচ্ছে, আশেপাশে মানুষের আনাগোনা নেই। ফাইয়াজ চশমা খুলে পাশে রেখে চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। 

 

বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, “নদীর ওই পাড়ের যে বাজার, বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আমার বেড়ে ওঠা।”

 

রূপা তাকিয়ে দেখল, নদীর ওপাড়ের বাজারটি অনেকটা দূরে। মানুষগুলোকে ছোট ছোট পিঁপড়ার মতো দেখা যাচ্ছে। ব্রিজ পার হয়ে সেখানে যেতে হয়৷ সে কিছু বলার আগে ফাইয়াজ পুনরায় বলল, “এখান থেকে হেঁটে গিয়ে তোমাদের কোচিংয়ে পড়াতে হতো। মন খারাপ হলেই এখানে, নদীর পাড়ে এসে বসে থাকতাম, কখনো কখনো ক্লান্তির জন্য ঘুমিয়েও পড়তাম। বালিশ হতো আমার দুই হাত। আবার কখনো কখনো প্রচন্ড গরমের জন্য এখানে এসে শুতে হতো৷ বিদ্যুৎ খরচের ভয়ে ফ্যান ছেড়ে ঘুমানোর সাহস হতো না।”

 

রূপা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। 

 

ফাইয়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এখানে এতো ঘুমিয়েছি যে, এই স্থানটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। গত পাঁচ বছরে জীবন পাল্টেছে ঠিকই কিন্তু আমি আজও মাঝেমধ্যে এখানে এসে বসে থাকি। শুধু ঘুমাতে পারি না। ক্যারিয়ার দাঁড় করাতে গিয়ে এখানে এসে অতীতের পুরোটা সুখ খোঁজার সুযোগ হয়ে উঠেনি। আজ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে চাই, হয়তো ঘুমিয়েও যেতে পারি। তুমি অপেক্ষা করবে?”

 

রূপা দ্রুত বলল, “জি স্যার।”

 

স্যার শব্দটা শুনে ফাইয়াজ হেসে ফেলল। রূপার সামনে সে প্রথমবার হেসেছে। আজ সবকিছুই প্রথম, প্রথম হচ্ছে! রূপা শুরুতে থতমত খেয়ে গেলেও পরে বুঝতে পারল, সে নিজের বরকে স্যার বলে সম্বোধন করছে!

রূপা অন্যদিকে ফিরে হাসল। সম্পর্কটা কী সহজ হচ্ছে?

 

ফাইয়াজ স্যুট খুলে পাশে রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আকাশ পরিষ্কার। উদাসী বাতাস কানে, কানে কত কী বলে যাচ্ছে। প্রথমে বলল, “রূপার প্রতি তোমার হৃদয়ের দূর্বলতা কবে থেকে শুরু হয়েছিল, আজ জানিয়ে দাও।”

কিন্তু এখন তো সময় হয়নি! সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বহুদিন পর মাটিতে মাথা রেখেছে, মাথায় ব্যথা লাগছে৷ নিত্যকার অভ্যাস এভাবে পাল্টে গেছে! ফাইয়াজ দুই হাতের তালু রাখল মাথার নিচে।

 

রূপা ফাইয়াজের দিকে চেয়ে আছে। হাতে মাথা রাখতে দেখে তার মনে হলো, ফাইয়াজ তার কোলেই মাথা রাখতে পারত। ভেবেই সে আশ্চর্যবোধ করে। নিজের অজান্তে এ কী হচ্ছে তার হৃদয়ে! কীসের দাবানল ধেয়ে আসছে?

রূপা দ্বিধায় পড়ে যায়। দাতে নখ খুঁটতে থাকল।

 

হঠাৎ ফাইয়াজ বলল, “মাটি শক্ত হয়ে গেছে নাকি আমার মাথা নরম হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না!”

 

রূপা তুরন্ত বলে ফেলল, “আপনি আমার কোলে মাথা রাখতে পারেন।”

 

কথাটা বলেই মনে হয়, “যেচে বলা একদমই ঠিক হয়নি৷ স্যার কী না কী ভাবছে কে জানে!”

 

ফাইয়াজ রূপার দিকে তাকাল৷ রূপার মনে হলো, এখুনি ফাইয়াজ তাকে নানা ধরনের কথা শুনাবে৷ এতে অবশ্য তার সমস্যা নেই। কিন্তু ফাইয়াজ বকল না৷ নিশ্চুপে রূপার কোলে মাথা রাখল। রূপার পায়ে ঝিম ধরে যায়। গা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। 

 

ফাইয়াজ চোখ বুজল। নাকে একটা মেয়েলি ঘ্রাণ এসে লাগছে। প্রতিটি নারী-পুরুষই একজন আরেকজনের নিজস্ব ঘ্রাণ পায়। যেটা সে এ মুহূর্তে পাচ্ছে। ঘ্রাণের ব্যাপারটা এড়াতে সে চোখ বোজা অবস্থায় বলল, “আমার নিজের বাড়ি নেই জানো?”

 

“জানি।”

 

“জেনে-বুঝে রাজি হয়েছো!”

 

রূপা প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। 

 

ফাইয়াজ বলল, “নিজের টাকায় জমি কিনেছি। বাড়ি করতে পারিনি। আমরা দুই ভাইবোন বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও সেসব ভোগ করতে পারিনি৷ বাবার মৃত্যু আমাদের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। এরপর বড় হলাম। গত দুই বছরের চেষ্টায় চাচাদের থেকে বাবার সম্পত্তি উদ্ধার করেছি। খুব দ্রুত সেগুলো বিক্রি করে একটা বাড়ি করব। স্বামী হিসেবে তোমাকে সব জানানো উচিত, তাই জানিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করলাম। আশা করি, ভবিষ্যতে এসব নিয়ে খোঁটা দিবে না। মেয়েদের তো আবার খোঁটা দেয়ার স্বভাব। খোঁটা একদমই সহ্য হয় না আমার।”

 

কথা শেষ করেই ফাইয়াজ অন্যদিকে কাত হয়ে চোখ বুজল। এই স্থানে, এই প্রিয় জায়গায় অর্ধাঙ্গিনীর কোলে মাথা রেখে নদীর স্রোত দেখার সুযোগ হবে কখনো ভাবেনি সে। ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম আলো নদীর পানিকে সোনালী আভায় স্বর্গীয় একটি রূপ দিয়েছে — সেদিকে ছেয়ে থেকে ফাইয়াজ অনুভব করে রূপার প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস।

 

অরুনিকা গলির মুখে এসে দেখে হিরণ তার জন্য অপেক্ষা করছে। 

অরুনিকা এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি যাওনি?”

 

হিরণ ঠিক করে বসে বলল, “একা এতোটা পথ যাবে ভেবে অপেক্ষা করছিলাম। চলো, পৌঁছে দেই।”

 

“চার ঘন্টা অপেক্ষা করেছো!” 

বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে সে।

 

“এটা আর তেমন কী? তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারব।” 

শেষ বাক্যটি হিরণ অরুনিকার চোখে চোখ রেখে বলল।

 

অরুনিকা মুগ্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ হিরণ তার জন্য বসেছিল! এতোটা যত্ন করে তার! 

 

সে হিরণের বাইকের পিছনে বসে বলল, “এক ঘন্টার জন্য কোথাও নিয়ে চলো।”

 

“বাসায় বকবে না?”

 

“এমনিতেও বকবে। তার চেয়ে বরং এক ঘন্টা ঘুরে এরপর বাসায় যাই। আর প্রশ্ন না করে, চলো প্লিজ।”

 

আশকারা পেয়ে হিরণের কায়া জ্বলজ্বল করে ওঠল।

 

সন্ধ্যা পেরিয়েছে সেই কখন, ফাইয়াজ তখনো ঘুমাচ্ছে। রূপা এরমধ্যে সুমনাকে কল করেছিল, অরুনিকার খোঁজ নিতে। অরুনিকা নাকি চলে গেছে। বাসায় গিয়ে কত বকা খাবে ভেবেই সে চিন্তিত!

 

রূপার অস্থিরতায় ফাইয়াজের নিদ্রাভঙ্গ হলো। সে চারপাশ অন্ধকার দেখে বলল, “রাত হয়ে গেছে?”

 

রূপা বলল, “হু। আটটা নয় বাজে।”

 

ফাইয়াজ চমকাল না। স্বাভাবিকভাবেই নিল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “ভার্সিটিতে ভর্তি হবে কবে?”

 

“হব না।”

 

“কেন? অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে তোমাকে। আমার স্ত্রী শুধু এইচএসসি পাস তা হবে না।”

 

রূপা বলল, “পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না।”

 

ফাইয়াজ চট করে উঠে বসে চশমা পরে বলল, “তাহলে কী করবে? টইটই করে ছেলেদের বাইকে করে ঘুরে বেড়াবে আর সিগারেট খাবে? তুমি লাস্ট কবে সিগারেট খেয়েছো বলো তো? আমার বউ সিগারেট খায়, পড়াশোনা করে না! মানুষ জানলে কী হবে? মান-সম্মান থাকবে?”

 

ফাইয়াজের চোখমুখের আতঙ্ক দেখে মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাকে আগের রূপে ফিরে আসতে দেখে রূপা ভড়কে যায়। বলল, “পড়াশোনা করে কী হবে স্যার?”

 

“আমি কী হয়েছি?”

 

“চাকরিজীবী হয়েছেন৷ কিন্তু আমিতো রাঁধুনি হতে চাই। রাঁধুনি হতে গেলে কী অনেক পড়াশোনার প্রয়োজন?”

 

“অবশ্যই প্রয়োজন। তোমার রেজিস্টার নাম্বারসহ, এপ্লাইয়ের জন্য যা যা প্রয়োজন সব আগামীকালের মধ্যে দিয়ে যাবে বাসায়। অশিক্ষিত বউ নিয়ে আমি সংসার করব না।”

 

ফাইয়াজ গা ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে বলল, “এবার চলো, বাড়ি ফিরতে হবে।”

 

ফাইয়াজ হাত বাড়িয়ে দিল রূপার দিকে; ধরে উঠার জন্য। যতই বকুক, শেষ মুহূর্তের যত্নগুলো সন্তর্পণে রূপার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

 

চলবে…

(আগেরদিনের তুলনায় ছোট পর্ব হওয়াতে দুঃখিত।)

 

সূর্যশিশির 

৩২.

অরুনিকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে, কলিংবেল চাপবে নাকি। রাত বাজে নয়টা৷ বিকেল থেকে এতো রাত অবধি সে হিরণের সঙ্গে ঘুরেছে। কীভাবে যে এতোটা সময় পার হয়ে গেল টেরই পেল না সে। প্রতিটি ঘন্টা যেন মিনিটে রূপ নিয়েছিল! দুজন রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল খেতে৷ ফেরার পথে ফোন কেনার কথা মনে পড়ে। হিরণ ফোন কিনে দিতে চেয়েছিল, অরুনিকা জোরাজুরি করে নিজেই ক্রয় করেছে৷ তবে সিম হিরণের ভোটার কার্ড দিয়েই তুলতে হয়েছে। হিরণের উপস্থিতির রেশ এখনো তাকে ঘোরে রেখেছে৷ এই স্বর্গীয় সুখ এতদিন কোথায় ছিল?

 

হাট করে দরজা খোলার শব্দ শুনে অরুনিকা হকচকিয়ে গেল৷ আজিজুর চৌধুরী কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি বললেন, “ভেতরে আসো।”

 

ঝড়ের পূর্বাভাস! অরুনিকা ধীর পায়ে আজিজুরের পাশ কেটে এক ছুটে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। 

 

আজিজুর পিছন পিছন গিয়ে দরজায় শব্দ করে চিৎকার করলেন, “বেয়াদব মেয়ে, দরজা খুলো। এতো অবাধ্যতা তুমি কার থেকে শিখেছো? অরুনিকা…আমাকে রাগিও না৷ দরজা খুলো।”

 

অরুনিকার বুক ধড়ফড় করছে। পাপার চিৎকারকে সে খুব ভয় পায়। কিন্তু আজ কিছুতেই সে বের হবে না৷ বুকে এক হাত রেখে ভাবল, “পাপা, রাত দুটোর ফ্লাইটে চলে গেলেই, বেঁচে যাব৷ তখনই রুম থেকে বের হব, তার আগে না।”

 

সে দ্রুত শাড়ি পরিবর্তন করে৷ আজিজুর দরজার ওপাশে পাগলা ষাড়ের মতো চিৎকার করছেন। 

সহসা অরুনিকার মনে হলো, আজ তারাবির নামাজ ছিল৷ পথে অনেক মুসল্লিদের মসজিদে যেতে দেখেছে তবুও হিরণের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেছে! দ্রুত ফোন নিয়ে রূপার ফোনে বার্তা পাঠাল — রমজান মোবারক দোস্ত।

তারপর অযু করতে গেল৷ ততক্ষণে আজিজুরের চিৎকার, চেঁচামেচি থেমে গেছে। ভাগ্যিস, সেহরির সময় তার মুখোমুখি হতে হবে না।

 

রূপা বাড়ি ফিরতেই সুমনা পিছু পিছু গিয়ে প্রশ্ন করলেন, “কোথায় গিয়েছিলি বরের সাথে?”

 

বেশ শান্ত সুরেই প্রশ্ন করেছেন৷ 

 

রূপা ফোন রেখে বলল, “সাহানি নদীর পাড়ে।”

 

“খেয়ে নে এসে। সেহরির রান্নাবান্না —”

 

রূপা থামিয়ে দিয়ে বলল, “চিন্তা করো না৷ আমি জামাকাপড় পরিবর্তন করে দোকানে যাব। ভোরের আগে ফিরব না।”

 

“তোর বর যদি মানা করে?”

 

রূপা সুমনার দিকে তাকাল। তার দুই চোখে আতঙ্ক। রূপা রান্নাবান্নার দায়িত্ব ত্যাগ করলে কী হবে? তা ভেবে অস্থির হয়ে আছেন তিনি। 

 

রূপা আশ্বস্ত করে বলল, ” আমি শুনব না৷ তুমি এখন যাও, আমি শাড়ি পাল্টাব।”

 

“দোকানে যাবার আগে খেয়ে যাস।”

 

সুমনা চলে গেলেন। রূপা শাড়ি পরিবর্তন করতে গিয়ে, শাড়িতে ফাইয়াজের গায়ের পারফিউমের ঘ্রাণ পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার স্নায়ুগুলো নতুন উদ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সে শাড়িটি নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিল। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে থতমত খেয়ে শাড়ি একপাশে রেখে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। 

 

গেইটের বাইরে এসে বোরকা-নিকাব পরা একটা মেয়েকে দেখতে পায়, ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ বোরকা দেখে মনে হচ্ছে, মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে এসেছে। বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর, মেয়েটি নিকাব তুলল। মানুষটিকে চিনতে পেরে রূপা দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরে বলল, “রুমি!”

 

রুমি রূপাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠল। 

 

রূপা উৎকন্ঠিত হয়ে বলল, “কোথায় ছিলি? তোর এই অবস্থা কেন?”

 

রূপা রুমিকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। রুমি ছাড়ছে না, জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। 

 

রূপা ডাকল, “এই রুমি? বল আমাকে…”

 

রূপা এখনো খেতে আসছে না কেন, দেখার জন্য সুমনা বাহিরে এসে দেখলেন রূপা গেইটের বাইরে কাকে যেন জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি উৎসুক হয়ে এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন, “রূপা?”

 

তাৎক্ষণিক রূপা, রুমি একসঙ্গে তাকাল। রুমিকে দেখে সুমনার চোখ দুটি জ্বলে ওঠে। তিনি অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলেন, “রুমি!”

 

রূপা কিছু বুঝে উঠার পূর্বে তিনি তড়িৎ বেগে গিয়ে রুমির হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন৷ তার চোখেমুখে প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ।

 

রুমি কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আম্মা, আম্মা…আমার কথা শুনো।”

 

রূপা দ্রুত বারেককে কল করল। বারেক রিসিভ করতেই দ্রুত বলল, “আব্বা, রুমি আসছে৷ দ্রুত আসেন।”

 

সুমনা রান্নাঘর থেকে  ভাতের চামচ নিয়ে রুমির চোখেমুখে আঘাত করে বসলেন। রুমি আর্তনাদ করে পড়ে যায়। রূপা দৌড়ে গিয়ে রুমিকে আগলে দাঁড়াল। তার পিঠে চামচের বারি পড়ে।

 

সে চিৎকার করল, “আম্মা, কী করছো? পাগল হয়ে গেছো?”

 

রাগে সুমনার শরীর কাঁপছে। এই কুলাঙ্গার মেয়েকে তিনি সহ্য করতে পারছেন না৷ মনে মনে কবর দিয়ে ফেলেছিলেন, এখন কেন আসল? তিনি রাগে কিড়মিড় করতে করতে বললেন, “নিমক হা’রামের বাচ্চা, আমার বাড়িতে আসছে কেন? এই তুই বেরিয়ে যা৷ কালসাপ… তুই বেরিয়ে যা।”

 

তিনি রূপাকে সহ রুমিকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকেন। 

 

এক পর্যায়ে রূপা অতিষ্ঠ হয়ে ধমকে উঠল, “আম্মা, থামো। আল্লাহর দোহাই থামো।”

 

রুমি জবুথবু হয়ে কাঁদছে৷ আচমকা সুমনার মারের আঘাতে নাক, মুখ দিয়ে রক্ত নির্গত হচ্ছে। রূপার দেখে ভীষণ মায়া হয়, কষ্ট হয়৷ সে রুমিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “কাঁদিস না। চুপ।”

 

“তুই ওরে ছাড় রূপা। আমি ওরে আজ জীবন্ত কবর দেব। কোন কলঙ্ক নিয়ে আসছে আমাদের জন্য?”

 

“এমন নিষ্ঠুরতা করোনা আম্মা। রুমির অবস্থা দেখছো না তুমি!”

 

সুমনা পাষাণের মতো উচ্চারণ করলেন, “ওর অবস্থাতে আমার যায় আসে না৷ ওর লা’শ বাড়িতে এলে আমি খুশি হতাম৷”

 

এ কথা শুনে রুমির কান্নার বেগ বাড়ল। রূপা তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “আম্মা রেগে গেলে কেমন হয়ে যায় জানিসই তো। শুনিস না আম্মার কথা। তুই আমার সঙ্গে রুমে চল।”

 

সুমনা হুশিয়ার করলেন, “খবরদার, তুই ওরে রুমে নিবি না৷ এখুনি বাড়ি থেকে চলে যেতে বল।”

 

রূপা ঘাড় ঘুরিয়ে প্রতাপ নিয়ে বলল, “তুমি চুপ থাকো আম্মা।”

 

তারপর রুমিকে তোলার চেষ্টা করে বলল, “উঠ। রুমে গিয়ে বোরকা খুলে জামাকাপড় পরিবর্তন করে খেয়ে নিবি আগে৷ তারপর সব শুনব।”

 

রুমির হাত-পা কাঁপছে ক্রমাগত। চোখ থেকে জল বেরোচ্ছে৷ সে রূপার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেন ছেড়েই দিলেই অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে৷ 

 

রূপা জানতে চাইল, “ছেলেটার নাম কী?”

 

রুমি তার মনোহর দুটি ভেজা চোখ মেলে রূপার দিকে তাকাল। বলল, “পারভেজ। খুব মেরেছে আপা, খুব…” রুমির গলা বুজে আসল। 

 

রূপার অন্তরে একটা আগ্নেয়গিরি লাভা ছুটতে শুরু করে। তার ফুলের মতো সুন্দর বোনকে দুমড়েমুচড়ে ছিঁড়ে ফেলা পারভেজ কে? কেন সে এরকম করল?

 

রূপা দ্বিতীয় প্রশ্ন করার পূর্বে রুমি বমি করতে শুরু করে। 

ঠিক তখনই সুমনার টনক নড়ে। কিছু সময়ের ব্যবধানে রুমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে রূপার বাহুতে।

 

চলবে…

(বেশি লিখতে পারলাম না। প্রচুর চাপ যাচ্ছে বই নিয়ে, সেইসাথে কিছুদিন পর এক্সাম। এই সপ্তাহে মঙ্গলবার ছাড়া অন্য যেকোনো দিন আরেকটা মাঝারি পর্ব দিয়ে পুষিয়ে দেব, ইনশাআল্লাহ।) 

আমার নতুন বই মায়ামৃগ অর্ডার করার লিংক – 

https://www.facebook.com/100052235867676/posts/712109897206866/?app=fbl

 

সূর্যশিশির 

৩৩.

রুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার কোমল দেহ মানুষরুপী এক পশুর থাবায় ছিন্নভিন্ন। রুমির নিদারুণ যন্ত্রণা দেখে বাকরুদ্ধ পুরো পরিবার।

সারারাত বিলাপ করে এখন মৃতের মতো হাত-পা সোজা করে ঘুমাচ্ছে। রূপা পুলিশকে ব্যাপারটা জানানোর সিদ্ধান্ত নিলে, সুমনা প্রতিবাদ করলেন। আশ্চর্যজনকভাবে, বারেকও তাতে সম্মতি দিলেন। 

তাদের ভাষ্যমতে, পুলিশের কাছে গেলেই ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়বে। এতে রুমির তো কখনো বিয়ে হবে না সেইসঙ্গে বাকি ছেলেমেয়েদেরও সমাজে বেঁচে থাকাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। কেউ মূল্য দিবে না।

 

রুমি যতক্ষণ না জাগে পুরো ঘটনা জানা যাবে না। রূপা নিজের রুমে বসে অপেক্ষা করছে, কখন রুমি জাগ্রত হবে। দুপুর দুটো থেকে ইফতারের আয়োজন শুরু করতে হবে। এখন বাজে সকাল এগারোটা। ফোনকলে রূপার ধ্যান কাটল।

 

অরুনিকা কল করেছে। 

রূপা ফোন কানে তুলেই বলল, “আংকেল চলে গেছে?”

 

অরুনিকা বলল, “হু, চলে গেছে। আজ বিকেলে আসতে পারব না। মা অনেক রেগে আছে।”

 

“আসতে হবে না। ভিডিও কলে কথা বলব। তুই মন দিয়ে পড়ছিস? আগামী মাসে এডমিশন মনে আছে?”

 

“আছে বাবা। এখন শোন, লেকে তোর জন্য হিরণ অপেক্ষা করছে। তুই গিয়ে দেখা করে আয়।”

 

রূপার টনক নড়ল। বিয়ের ঘটনা আর রুমির আগমনে হিরণের সঙ্গে দেখা করার কথা মনেই ছিল না৷ 

 

রূপা দ্রুত কল কেটে সাইকেল নিয়ে লেকের দিকে যায়। আজ লেকে মানুষজন খুব কম। যে কয়জন আছে নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছে। চারপাশে সুনসান নীরবতা। সারারাত জাগার পর সবাই ঘুমাচ্ছে। রূপা হিরণের নাম্বারে কল করল।

 

ওপাশ থেকে হিরণ বলল, “বলুন রূপা।”

 

আজ কণ্ঠস্বরটা অন্যরকম লাগছে! নাকি ঠিকই আছে?

রূপা বলল, “আমি লেকের পাড়ে। আপনাকে তো চিনি না। পরনে শার্ট, গেঞ্জি নাকি পাঞ্জাবি?”

 

“গ্রে রঙের শার্ট। আমি বোধহয় আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।”

 

রূপা ডানে-বামে তাকাল। তারপর পিছনে তাকাল। ধূসর রঙের শার্ট পরা এক সুদর্শন যুবক কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রূপা ধীরকণ্ঠে বলল, “আপনি কি আমার পিছনে?”

 

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ফোন প্যান্টের পকেটে পুরে রূপার দিকে এগিয়ে এসে হাস্যমুখে বলল, “এখন সামনে।” 

 

প্রথম সাক্ষাতেই অরুনিকার জন্য হিরণকে পছন্দ হয়ে গেল রূপার। 

সে প্রত্যুত্তরে বলল, “আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?”

 

হিরণ দুই হাতে চুল ঠিক করতে করতে বলল, “অরুনিকা গতকাল বলেছিল, রূপা এটা পরে, ওটা পরে — রূপা দেখতে এরকম, ওরকম। বেশ কিছুদিন হলো ওর সঙ্গে আমার কথা হয়৷ সারাক্ষণ আপনার কথাই বলে। তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি।”

 

ছেলেটার কথাবার্তা চঞ্চল! 

রূপা বলল, “চলুন, ওদিকে গিয়ে বসি।”

 

দুজন গিয়ে লেকের পাড়ের বেঞ্চে বসল। এক কোণে হিরণ, অন্য কোণে রূপা। 

 

হিরণ সোজা প্রসঙ্গে এসে বলল, “কী কী প্রশ্ন করবেন করুন।”

 

রূপা অবাক হয়ে বলল, “প্রশ্ন?”

 

হিরণ হেসে বলল, “অরুনিকা বলেছে, সে কার সাথে মিশছে সেটা নাকি রূপা খুব যাচাই-বাছাই করে দেখে৷”

 

“তা ঠিক বলেছে। কিন্তু যাচাই-বাছাই তো আড়াল থেকে করব, সরাসরি না।” বলেই হাসল রূপা।

 

“আপনি কোথায় যেন থাকেন?”

 

“সুজাত বাজারের নয় নম্বর গলিতে। আপনার ফাইনাল কবে?”

 

“কিছুদিনের মধ্যে। কিছু খাবেন?” পরক্ষণে জিভ কামড়ে বলল, “সরি, আজ রোজা মনে ছিল না।”

 

“আপনি কি রোজা রাখেননি?”

 

“রেখেছি। আসলে হয় কী, রোজার প্রথম ছয়-সাতদিন মনে থাকে না যে রোজা রেখেছি। যখন বয়স কম ছিল, ভুলে খেয়েই ফেলতাম।”

 

“অরুনিকা তো এখনো ভুলে খেয়ে ফেলে।”

 

“তাই নাকি? ও এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছে।”

 

রূপা পরখ করে হিরণকে দেখছে৷ সুদর্শনের যে সংজ্ঞা তার সবটাই হিরণের মধ্যে আছে। কথাবার্তা শুনে ভালো মনে হচ্ছে। মিশুকও বটে।

 

রূপা বলল, “আপনার গ্রামের বাড়ি?”

 

“যশোরে। এখানে পড়াশোনার সুবাদে থাকা হয়।”

 

“সুজাত বাজারে অরুনিকা আপনাকে দেখেছিল — “

 

“বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারাম খেলতে গিয়েছিলাম।”

 

রূপা গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, “ওখানে বদমাশ ছেলেদের আনাগোনা বেশি। জায়গাটা এড়িয়ে চলবেন।”

 

“সেদিনই শুধু গিয়েছিলাম৷ আমি ভালো করে জায়গাটা চিনিও না।”

 

“খারাপ জায়গা না চেনাই ভালো। আপনারা ভাইবোন কয়জন?”

 

“চার ভাই, দুই বোন।”

 

“যৌথ ফ্যামিলি?”

 

“হ্যাঁ, যৌথ।”

 

“আপনি কত নাম্বার?”

 

“আমি পাঁচ নাম্বার। আমার ছোট একটা বোন আছে।”

 

বেশ কিছুক্ষণ তাদের আলাপ-আলোচনা চলল। 

রূপার প্রাথমিক দেখা শেষ। ছেলেটা খালি চোখে দারুণ। এবার পিছনের খোঁজখবর নিতে হবে। 

 

বলল, “এখন আসি তাহলে, অনেক কাজ বাকি। অরুনিকা ছাদে গেলে, এটা দিবেন।” 

 

একটা কিটক্যাট এগিয়ে দিল; অরুনিকার খুব পছন্দের চকলেট।

 

হিরণ ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল, “অবশ্যই।”

 

রূপা কিছুদূর এসে অরুনিকার ফোনে বার্তা পাঠাল — তোর হিরণকে আমার পছন্দ হয়েছে।

 

তারপর সাইকেলে চড়ে চলে আসল হোটেলে। বারেক গুমোট মুখে বসে আছেন। 

রূপা গিয়ে প্রশ্ন করল, “রুমি জেগেছে?”

 

বারেক বললেন, “জ্বর অনেক। ওর জ্বরটা মাপা দরকার, ডাক্তার দেখানো দরকার।”

 

“চলেন নিয়ে যাই। এভাবে তো মরে যাবে।”

 

“এখন বের করলে মানুষজন দেখবে না?”

 

রূপা বিরক্ত হয়ে বলল, “এতো মানুষজনের কথা ভাবেন কেন আব্বা? ওরা আমাদের খাওয়ায়?”

 

“সমাজ ছাড়া কি বাঁচা যায়?”

 

“অন্তত বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে যেতে দেন।”

 

“রুমির চোখেমুখের দাগ দেখে প্রশ্ন করবে।”

 

“দূরের ডাক্তার নিয়ে আসলেই তো হয়। তারা তো আর আমাদের চিনে না৷ আমি যাচ্ছি।”

 

রূপা আর বারেকের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করল না। সাইকেলে উঠতে গিয়ে পিছনে দেখল, ফাইয়াজ আসছে। সে দাঁড়াল না, চলে গেল।

 

ত্রিশ মিনিটের মাথায় একজন ডাক্তার নিয়ে বাড়িতে আসল৷ ধরা পড়ল, রুমির একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর৷ এরইমধ্যে জেসমিন এলো বাড়িতে।

তার থেকে লুকোনোর কিছু নেই বলে লুকাল না সুমনা।

জেসমিনও পরামর্শ দিল, পুলিশকে জানাতে, সেই ছেলেকে খুঁজে বের করতে৷ রূপা বলল, “রুমি সব বলুক, তারপর আমি যা করার করব।”

 

ইফতারের পূর্ব মুহূর্ত। রূপা সবেমাত্র অবসর পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আযান পড়বে৷ 

তখন সুজন রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল, “ওস্তাদ, দুলাভাই আইছে।”

 

রূপার বুঝতে কিছুটা সময় লাগল, সুজন সম্বোধন স্যার থেকে দুলাভাইয়ে স্থানান্তর করেছে! সে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল৷  ফাইয়াজ সবসময় দরজার বাহির থেকে কথা বলে। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখুনি, একটা মুখ উঁকি দিবে৷ কিন্তু না, উঁকি দিল না। সোজা

রান্নাঘরে ঢুকে গেল। রূপা প্রথমে ভড়কে গেল৷ পরক্ষণেই মনে হলো, লোকটা আর তার স্যার নয়।

 

ফাইয়াজ দুটো ম্যাংগো জুস একটা চেয়ারের উপর রেখে অন্য চেয়ারে বসে বলল, “তোমাদের

ইফতার নাকি সুস্বাদু। অনেক প্রশংসা শুনেছি।”

 

রূপা বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল, “আপনাদের বাসায় তো পাঠানো হয়েছে।”

 

ফাইয়াজ থতমত খেয়ে গেল এই কথায়। ভেতরকার প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দিল না৷ 

বলল, “আমি দেখিনি।”

 

রূপা অ্যাপ্রোন খুলে তাড়া দিয়ে বলল, “দ্রুত যান, আযান পড়ে যাবে।”

 

“দ্রুত কেন যাব?”

 

“ওমা, ইফতার করবেন না?”

 

“আমার জানামতে তো রেস্টুরেন্টে খাবার-দাবার থাকে!”  

 

রূপা কিছু বলার আগে বারেক বিশাল বড় প্লেটে ইফতার সাজিয়ে নিয়ে এলেন। ফাইয়াজের সামনে রেখে বললেন, “অসময়ে এলে, বেশিকিছু করতে পারিনি।”

 

এলাহি আয়োজন দেখে ফাইয়াজ এবার অপ্রতিভ হয়ে ওঠল। সে রূপার সঙ্গে প্রথম রোজার প্রথম ইফতার করতে চেয়েছিল মাত্র। এজন্যই আসা৷ নয়তো আসত না৷ 

ইতস্তত করে বলল, “এতকিছুর প্রয়োজন ছিল না আংকেল।”

 

বারেক বিগলিত হেসে বললেন, “এ আবার তেমন কী? রূপা, বাবাজির যা যা লাগে হাতের কাছে এগিয়ে দে। কিছুর কমতি যেন না পড়ে।” 

 

রূপা মাথা ঝাঁকাল। বারেক চলে যেতেই ফাইয়াজ বলল, “এতকিছু কী করে খাব?”

 

“এইটুকু খাওয়া অসম্ভব কিছু না।”

 

ফাইয়াজ হাসল। বলল, “আমার সামনে চেয়ার নিয়ে বসো। এতকিছু আমি খেতে পারব না।”

 

রূপা বলল, “আমার ইফতার আছে। আপনি খান।”

 

আযান পড়ছে। ফাইয়াজ তাড়া দিল, “দ্রুত বসো।”

 

রূপা বসতে না চাইলে ফাইয়াজ হাতে ধরে টেনে বসাল। এক প্লেটে দুজন চুপচাপ ইফতার করল। খাওয়ার মাঝে দুজনের মধ্যে কোনো কথা হলো না৷ 

খাওয়া শেষে ফাইয়াজ বলল, “এতো কম তো পিঁপড়াও খায় না। সারাদিন রাঁধো, খেতে পারো না?”

 

“আমার খেতে ভালো লাগে না।”

 

“কী ভালো লাগে? টইটই করে ঘুরে বেড়াতে?”

 

লোকটার এই একটা খোঁটা দেয়া ছাড়া কী আর কিছু বলার নেই? রূপা কিছু বলল না। ফাইয়াজ বলল, “রুমি নাকি ফিরেছে? কী অবস্থা ওর?”

 

“ভালো না, অনেক জ্বর।” 

 

“কী হয়েছিল জানিও। ছেলেটার নাম-ঠিকানা নিও।”

 

বলতে বলতে সে প্যান্টের পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় পরল। 

বলল, “নামায পড়তে মনে চায় না? এভাবে চলবে?”

 

রূপা মাথা নত করে ফেলল। রোজা রাখলেও সে নামায আদায় করে না৷ এজন্য মাঝেমধ্যে নিজেকে অভিশপ্ত মনে হয়৷ ফাইয়াজ জবাবের আশা না করে বেরিয়ে গেল। 

রূপা অবশিষ্ট খাবার ডাস্টবিনে ফেলে, প্লেট ধুয়ে নিল। 

 

রিংটোনের শব্দ হচ্ছে! রূপা এদিকওদিক তাকিয়ে নিজের ফোন খুঁজল। তার ফোনের রিংটোন তো এরকম না! খুঁজে পেল ফাইয়াজের ফোন! ফোনটি হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে লেখা — তানি।

 

চলবে…

আমার লেখা এডভেঞ্চার জনরার প্রথম থ্রিলার বই ‘মায়ামৃগ’ এর প্রি অর্ডার চলছে। প্রি অর্ডার লিংক —

 

সূর্যশিশির 

৩৪.

ইফতারের মতো স্বর্গীয় আমেজের অনুভূতি পুরোপুরি অনুভব করতে পারছে না অরুনিকা ও তার মা। বাড়ির একমাত্র ছেলের উপস্থিতি নেই, নেই কর্তাও। চারপাশটা বড় ফাঁকা। ইফতারের মাঝে সেলিনার চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। অরুনিকা দেখেও কিছু বলল না। কিছু অনুভূতির মাঝে ঢুকতে নেই। অর্ণবকে মনে করে সেলিনা প্রায়ই লুকিয়ে কান্নাকাটি করেন।

 

মাগরিবের নামায আদায় করে ড্রয়িংরুমের সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে অরুনিকা। অনেকদিন হয়ে গেল ফেসবুকে ঢুঁ মারা হয় না। লগ ইন করতে গিয়ে দেখে, পাসওয়ার্ড ভুলে গেছে। রুমে গিয়ে ডায়েরি থেকে পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে ফেসবুকে লগ ইন করতেই নোটিফিকেশনের শব্দে কেঁপে উঠল সারা ঘর। ফেসবুকে না পেয়ে অনেকে মেসেজ করেছে৷ অরুনিকা সময় নিয়ে প্রত্যেকের রিপ্লাই দেয়। 

 

হঠাৎ মাথায় চাপল, হিরণের আইডি খুঁজে বের করার। প্রথমে ইংরেজি বানানে আইডি খুঁজল, পেল না। তারপর বাংলা বানানে সার্চ করতেই পেয়ে গেল। খুব আগ্রহ নিয়ে আইডিকে ঢুকে প্রতিটি ছবি দেখতে থাকল৷ একটা ছবি চোখে পড়ল, যেখানে হিরণের সঙ্গে আরেকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাগ করা আইডির নাম দুলাল। ছবির উপরে ক্যাপশনে লেখা, প্রিয় বন্ধু। 

দুলাল নামক ছেলেটি দেখতে অদ্ভুত! উচ্ছন্নে যাওয়া অমার্জিত ব্যবহারের নেশাখোরদের মতো। অরুনিকার কেন যেন উদ্ভট অনুভূতি হয়! আরেকটু নিচে গিয়ে হিরণের আরেকটা ছবি দেখে মন ভালো হয়ে গেল। নীল শার্ট পরিহিত অবস্থায় ঠোঁটে প্রাণখোলা হাসি। সে ছবিটা সংরক্ষণ করে ফোনের ওয়ালপেপারে সেট করল।  

 

চল্লিশ মিনিটের মতো স্ক্রল করার পর চার বছর আগের একটা ছবিতে দৃষ্টি থমকে যায়। হিরণের সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি মেয়ে! সঙ্গে অরুনিকার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। সে কমেন্টগুলো পড়ে বুঝতে পারল, মেয়েটা হিরণের প্রেমিকা। তার বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠে কান্না। তীব্র কষ্ট অনুভূত হয়। চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। একটা তীক্ষ্ণ অনুভূতির পীড়নে হাত কাঁপতে শুরু করে। কাঁপা হাতে আরো নিচে গিয়ে সেই মেয়েটির সঙ্গে আরো তিন চারটা ছবি পেল। প্রত্যেকটা ছবিতে একজন আরেকজনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রেখেছে!

 

অরুনিকা আর দেখতে পারছে না। চোখ দুটি জ্বলে যাচ্ছে৷ সে ফোন রেখে দিল৷ মুহূর্তে তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে৷ কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারছে না৷ কেমন দিশেহারা লাগছে!  

 

দিকবিদিকশুন্যের মতো হাতড়ে ফোন নিয়ে দ্রুত হিরণের ফোনে কল করে। প্রথমে রিসিভ না করলেও পরের কলে রিসিভ করে হিরণ বলল, “বলো অরুনিকা?”

অরুনিকা রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল, “এখুনি ছাদে আসো।”

হিরণ ভড়কে গিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

অরুনিকা অন্য হাতের তালুতে চোখের জল মুছে বলল, “আমি অপেক্ষা করছি।” 

বলেই ফোন কেটে দিল৷ তারপর বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটাল যেন সেলিনা মুখ দেখে বুঝতে না পারে সে কান্না করেছে৷ তারপর মাথায় ওড়না টেনে বের হয়ে দেখে সেলিনা নিজের রুমে মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কিছু করছেন। 

 

তখন রাত।

চারপাশের নীরব নিস্তব্ধতায় আকাশের চন্দ্রালোকিত রাতের শোভা চারিদিকে। আকাশে ভেসে বেড়ানো ওই মেঘেদের ছুটোছুটি দেখছে অরুনিকা। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ছুটে আসে হিরণ। অরুনিকা পিছনে ঘুরে তাকায়। হিরণ উদগ্রীব হয়ে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “কিছু হয়েছে? একটু বের হয়েছিলাম তাই আসতে দেরি হয়ে গেল।”

অরুনিকার চোখ ছাপিয়ে নামে জল৷ চোখের পর্দায় পুনঃপুন ভাসছে হিরণের গা ঘেঁষে থাকা মেয়েটির মুখ৷ তার চোখে জল দেখে হিরণের  উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়, সে আরেকটু এগিয়ে আসলে, অরুনিকা পিছিয়ে গেল। হিরণ হতভম্ব! 

 

ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, “আমি কোনো ভুল করেছি?”

 

অরুনিকা ফোনের ছবিটি হিরণের সামনে তুলে ধরে বলল, “তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে আমাকে তো বলোনি।” বলতে বলতে অরুনিকার গলা ভেঙে এলো।

হিরণ প্রথমে স্তব্ধ হয়ে গেলেও পরে কৈফিয়ত দেয়ার সুরে বলল, “ছিল, এখন নেই। তাই বলিনি।”

অরুনিকা দৃঢ় গলায় বলল, “তোমার বলা উচিত ছিল।”

“আমি এসব প্রেমকে ছেলেমানুষি হিসেবে নিয়েছিলাম তাই স্মৃতিতেই ছিল না কিছু। কী করে বলতাম? তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।”

অরুনিকা বলল, “প্রেম ছেলেমানুষি হয়?” প্রশ্নটা করেই ম্লান হাসল। 

ফোনের ছবির মেয়েটিকে আরেক পলক দেখে বলল, “মেয়েটা সুন্দর। নাম কী? এখন সম্পর্ক নেই কেন?”

হিরণ অরুনিকার চোখের জল মুছে দেয়ার জন্য হাত বাড়ালে অরুনিকা আবারও সরে গিয়ে বলল, “আমার চোখের জল মুছতে হবে না৷ যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও।”

হিরণ অসহায়ের মতো চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। অরুনিকা এতো জেদী! 

বলল, “ওর নাম শান্তি। বিয়ে হয়ে গেছে চার বছর আগেই৷ তুমি চাইলে বিয়ের ছবি খুঁজে দেব।”

অরুনিকা তরঙ্গহীন গলায় বলল, “প্রয়োজন নেই।” 

 

হিরণের একজন প্রেমিকা ছিল, তার সঙ্গে পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছে — তা হজম হচ্ছে না অরুনিকার৷ বুকের ভেতর ভয়ংকর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বারংবার৷ ভালোবাসায় এতো যাতনা! তার কণ্ঠমণি শুকিয়ে কাঠ! 

হিরণ আচম্বিত পরিস্থিতিতে পড়ে হতবিহ্বল হয়ে গেছে৷ 

অরুনিকা পাশ কেটে চলে যেতে নেয়, হিরণ চট করে হাতে ধরে ফেলল। 

বলল, “অতীতে মানুষ কত কী করে, আমিও একটা প্রেম করেছি, ভুল করেছি। সেই ভুলের জন্য তোমার অবহেলা সওয়ার মতো মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে পারব না৷ আমাকে অন্য কোনো শাস্তি দাও। তবুও প্লিজ এরকম করো না৷ আমাকে বালুর মতো মাড়িয়ে চলে যেও না।” 

 

তার আকুতি অরুনিকার রাগ-দুঃখকে ভেদ করে হৃদয়কে স্পর্শ করে ফেলল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ইতিমধ্যে আতঙ্কে হিরণের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে৷ হিরণ প্রশ্রয় পেয়ে দুই কদম এগিয়ে এসে অরুনিকার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “আমরা কেউ কাউকে কখনো মনের কথা বলিনি। কিন্তু দুজনই জানি দুজনের হৃদয়ের কথা। যেদিন তোমায় বাজারে দেখেছি সেদিন থেকে তোমাকে ভালোবাসি অরুনিকা।”

 

অরুনিকা চেয়ে আছে৷ তার মাথার ঘোমটা পড়ে গেছে। হিরণ তা সন্তর্পণে তুলে দিয়ে বলল, “প্রথম দেখায় কাউকে এতো ভালোবাসা যায় তোমার সাথে দেখা না হলে জানতাম না। তোমাকে দেখার পর আমি ভালোবাসা চিনেছি৷ আমারর কাছে ভালোবাসা শব্দটা শুধু তোমার জন্য তৈরি। তোমার জন্য এই বিল্ডিংয়ে সাবলেট নিয়েছি। তোমাকে একটু দেখার জন্য বিকেলের অপেক্ষা করি। সন্ধ্যা থেকে পরদিন আসরের আযান অবধি ঘড়ি দেখি। আমাকে ভুল বুঝো না, তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করো না৷”

 

কিছুক্ষণ আগের গুমোট ভাব কেটে যাচ্ছে! অরুনিকার কাছে পৃথিবীটা বড় অচেনা ও সুখের ঠেকছে৷ হিরণের চোখেমুখে তাকে পাওয়ার আকুতি। একটা মেয়ের জন্য এই দৃষ্টি, এই কণ্ঠ খুব আনন্দের, গর্বের৷ মনে মনে গলে গেলেও অরুনিকা কিছু বলল না। পাষাণের মতো হিরণের হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগল সামনে।

 

হিরণ পিছন থেকে বলল, “আমি জানি অরুনিকা, তুমি আমাকে ভালোবাসো। তোমার স্বীকারোক্তির অপেক্ষায় থাকব।”

অরুনিকা মোহগ্রস্তের মতো সিঁড়ি বেয়ে নামে। একটিবারের জন্যও পিছনে ফিরে চাইল না।

 

রুমিকে ঘিরে সুমনা, বারেক, রূপা এবং ফাইয়াজ বসে আছে। রুমির জ্বর কমেছে, কথাবার্তা আগে জড়িয়ে আসত, এখন স্বাভাবিক হয়েছে৷ তার দুই চোখ চলে গেছে কোটরে। গায়ের সোনা রঙে যেন জং ধরেছে। সে সব বলবে বলে সবাইকে ডেকেছে। এখন কিছুই বলছে না।

রূপা তাড়া দিয়ে বলল, “প্রথম থেকে বল, কী হয়েছিল?”

রুমি এক নজর ফাইয়াজকে দেখল। ফাইয়াজ এখানে আসতে চায়নি, বারেক এনেছেন৷ তার মতে, এই পরিবারের শক্ত খুঁটি এখন ফাইয়াজ৷ বড় মেয়ের জামাই মানে বাড়ির বড় পুত্র। তার সব আলোচনায় থাকতে হবে৷ রুমির সর্বনাশ করা সেই প্রতারকের খোঁজ করার দায়িত্বও তার।

 

রুমি চোখ নত করে পারভেজের সঙ্গে পরিচয় থেকে শুরু করে সোহাগি হোটেলে যাওয়া অবধি বলল। 

সুমনার লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে৷ মেয়ের জামাইয়ের সামনে আরেক মেয়ে নিজের কুকীর্তির কথা বলছে৷ বারেক এমন কাজ করবে জানলে তিনি এখানেই আসতেন না। লোকটার আহ্লাদ একটু বেশি! কী দরকার ছিল নতুন জামাইকে আনার!

রূপা বলল, “তারপর হোটেল থেকে কোথায় গিয়েছিলি?”

“ঢাকা।”

রূপা সবিস্ময়ে বলল, “এতো দূর! তারপর? “

“ওখানে গিয়ে আরেকটা আবাসিক, নোংরা হোটেলে উঠে দুইদিন ছিলাম৷ তৃতীয় দিন সকালে উঠে দেখি, পারভেজ নেই৷ সবকিছু নিয়ে চলে গেছে। আম্মার একটা হার নিয়ে গিয়েছিলাম —” কথাটা বলতে গিয়ে ভয়ে রুমির গলা শুকিয়ে আসল।

এই কথা শুনে সুমনা দৌড়ে নিজের রুমে গেলেন। রুমি পালিয়ে যাবার পর থেকে আজ অবধি গহনার বক্স খুলে দেখা হয়নি। তাকে ওভাবে যেতে দেখে  রূপা আন্দাজ করতে পারে, পরে কী ঘটবে! 

সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে রুমিকে বলল, “পারভেজ চলে গেলে তোকে মারল কে?” 

রুমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, “ফোন রেখে গিয়েছিল। সেটা নিতে আবার হোটেলে আসে৷ ব্যাগপত্র বাহিরে রেখে এসে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করে নাস্তা খেতে গিয়েছিল৷ আমার জন্যও নাস্তা নিয়ে আসে। কিন্তু আমি সব বুঝে গিয়েছিলাম৷ ও ফোন নিয়ে বলে, রিচার্জ করতে বাহিরে যাবে৷ আমি সঙ্গে যেতে চাইলে মানা করে৷ আমিও জেদ ধরি সঙ্গে যাব। এটা নিয়ে আমাদের তর্ক হয়। এক পর্যায়ে পারভেজ বুঝতে পারে আমি সবকিছু বুঝে গেছি। আমাকে ঠেলে চলে যেতে চায়, আমি ধরে রাখি, কান্নাকাটি করি৷ আমাকে চুপ করাতে কিল-ঘুষি, থাপ্পড় দেয়৷ চিৎকার করলে হাত-পা ওড়না দিয়ে বেঁধে ফ্লোরে ফেলে চলে যায়। যাবার আগে বিছানার উপর পাঁচশো টাকার নোট রেখে বলে, বাড়ি চলে যেও।” 

 

বলতে বলতে রুমির চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠল৷ ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে আবার তার হাত, পা কাঁপছে। রূপা তার দুই হাত ধরে, পায়ে হাত বুলিয়ে দিল। বলল, “তারপর?”

রুমি বলল, “নয় ঘন্টা পর একজন কর্মচারী আমাকে উদ্ধার করে। আমার অবস্থা দেখে পুলিশের ভয়ে তাড়াতাড়ি করে বাস স্ট্যান্ডে রেখে যায়। যাবার আগে এক বোতল পানি দিয়ে যায়।” 

 

রাগে-দুঃখে রূপার চোখের কার্নিশে জল জমে গেল। রুমিকে মারার দৃশ্যটা তার চোখে কী নির্মমভাবে ভাসছে! 

সে কোনো প্রশ্ন করার আগে ফাইয়াজ বলল, “ঢাকার কোন জায়গায়, কোন হোটেলে উঠেছিলে মনে আছে?”

“জায়গাটার নাম জানি না। হোটেলের নাম নীলাঞ্জনা।” 

“ছেলেটার কোনো ছবি আছে?”

রুমি মাথা ঝাঁকাল৷ বলল, “নেই, ফোন নিয়ে গেছে৷” 

“ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড মনে আছে? মেসেঞ্জারে ছবি পাওয়া যাবে?” 

রুমি তাকাল। বলল, “পাওয়া যাবে।”

ফাইয়াজ রূপাকে ইশারা করলে, রূপা তার ফোন রুমিকে দেয় মেসেঞ্জারে লগ ইন করতে।

রুমি মেসেঞ্জারে লগ ইন করে পারভেজের ছবি বের করে দিল। 

ফাইয়াজ ছবিটি নিজের ফোনে নিয়ে বলল, “তোমার উপর যে অত্যাচার করেছে তা আইন বিরোধী। পারভেজ শাস্তি পাবে। আমি আসছি। রূপা, রুমিকে দেখে রেখো। ওর মানসিক অবস্থা ভালো না, সঙ্গ দিও। আমি পারভেজকে আগামীকালের মধ্যে বের করার চেষ্টা করব।”

 

ফাইয়াজ, বারেক বেরিয়ে যেতেই রূপা দৌড়ে যায় দরজা লাগাতে। দরজা লাগানোর পূর্বে সুমনা তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো তেড়ে গিয়ে রুমির চুলের মুঠি ধরে বললেন, “কু’ত্তার বা’চ্চা, তুই এটা কী করলি? আমার আপার গহনাটাই খুইয়ে আসলি!” 

সুমনার কণ্ঠে কান্না, আক্ষেপ।

 

রূপা অবাক হলো। তার খালা আছে সে জানত না!

রুমি কুঁকড়ে যায়৷ তার আর্তনাদটুকুও স্পষ্ট নয়!

রূপা দ্রুত সুমনাকে টেনে ছাড়িয়ে বলল, “এতদিন ভেবেছি শুধু আমার প্রতি তোমার মায়া নেই। তোমার তো কারো প্রতি মায়া নেই আম্মা।”

 

চলবে…

 

সূর্যশিশির 

৩৫.

রূপা ভেবেছিল, পারভেজের ঘটনাটি অনেক দূর পর্যন্ত এগোবে। কিন্তু পরদিনই এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। ক্ষ ত-বিক্ষ ত অবস্থায় পারভেজের লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাকে কেউ বা কারা নৃ শংসভাবে হ’ত্যা করেছে। বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য৷ পারভেজের আসল নাম বশির। পৃথিবীতে আপন বলতে তার কেউ নেই৷ চোরাচালান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে৷ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে সে জড়িত৷ মিথ্যে পরিচয়ে সুন্দরী মেয়েদের ফাঁসিয়ে নিজের শয্যাসঙ্গী বানানো তার অন্যতম নেশা। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, দ্ব ন্দ্ব থেকে দলের কেউ বশিরকে খু ন করেছে৷ 

ফাইয়াজের থেকে সংবাদটি পাওয়ার পর বিশ্বাস করেনি রুমি। টিভির পর্দায় যখন বশিরের লাশ দেখল তখন বিশ্বাস হলো, ছদ্মবেশী পারভেজ সত্যি খু ন হয়েছে৷ খুশির ঝিলিক ছুটে যায় তার চোখেমুখে। যে উদ্বেগ, মনঃকষ্ট ছিল তা কিছুটা লাঘব হয়ে আসে। সুমনা উচ্ছ্বাসে বিড়বিড় করেন, “আল্লাহ বিচার করছে! আল্লাহ আছে!”

 

পারভেজ নামধারী বশিরকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি রসন ভিলাতে। রূপার সাহায্যে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেয় রুমি; বেরিয়ে আসে সেই কালো দিনগুলো থেকে। আবার স্কুলে যেতে শুরু করে। সে এখন রূপার নেওটা। আপা, আপা ডেকে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। ঘরের কাজকর্মে সুমনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে।

 

দুপুর বারোটা৷ রুমি ঘরদোর গোছাচ্ছে। রূপা আর সুমনা ডাইনিং রুমে বসে আছে। তারা রুমির পরিবর্তন নিয়ে আলাপ করছিল। হঠাৎ রূপা প্রশ্ন করল, “আমার খালা কয়জন আম্মা?”

সুমনা হাত থামিয়ে রূপার দিকে চেয়ে বললেন, “কেন?”

রূপা হাসল। 

“কেন মানে? এমনি জানতে চাইছি।”

“একজন।” তিনি কাঁথা সেলাই করছেন।

“উনি কোথায় থাকেন? নাম কী?”

সুমনা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, “তাহমিনা। মারা গেছে।”

সেদিন রাতে সুমনার হাত থেকে রুমিকে বাঁচাতে গিয়ে তাকেও মার খেতে হয়েছিল। সুমনা কাঁদছিলেন আর বার বার বলছিলেন, আমার আপার গহনা! আমার আপার গহনা! কী করলি তুই? কী করলি তুই? আমার আপার শেষ স্মৃতি…

 

সেদিন থেকে রূপা তার খালা সম্পর্কে জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। নানাবাড়ি অথবা দাদাবাড়ি সম্পর্কে তারা কোনো ভাইবোনই কিছু জানে না। ছোট থেকে শুনে এসেছে, তাদের আপনজন বলতে কেউ নেই। 

কেন নেই?

রূপা প্রশ্ন করতে গিয়েও দমে গেল। তার দৃষ্টি পড়ে সুমনার রুমে থাকা পুরনো স্টিলের আলমারিটির ওপর। কখনো এই আলমারির ভেতরটা দেখার সুযোগ হয়নি তার। প্রয়োজন পড়েনি, আগ্রহও জমেনি। একদিন কী দেখা উচিত? 

নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে গেল রূপা। আলমারির ভেতরে কী আছে সেটা দেখে তার কী লাভ? কেনই বা হঠাৎ এটা মাথায় এলো? রূপা ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়ার জন্য অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে সুমনাকে বলল, “আজ তো ও বাড়ির সবাই আসবে৷ আমি কি থাকব?”

“তুই থাকলে হোটেলের রান্নাবান্নার কী হবে? আমি ওদের দেখব। তুই মাগরিবের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসিস।”

“সেহেরির দাওয়াতও দিয়েছ?”

“হু।”

 

ইফতারে ফাইয়াজ আসেনি। সে কোনো এক জরুরি কাজে নাকি বেরিয়ে গেছে৷ এ কথা শুনে সুমনার কণ্ঠ থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়ে, “ছেলেটার এখনই কাজ পড়তে হলো!” 

জেসমিন বলল, “পাশাপাশি বাড়ি। যেকোনো সময় আসতে পারবে। আপনি এ নিয়ে মন খারাপ করবেন না।”

“সে তো আসতেই হবে। ইশতেহার, তুমি খাচ্ছ না কেন?”

ইশতেহার জোরপূর্বক হেসে বলল, “এতোকিছু আয়োজন করেছেন, সব কি খাওয়া সম্ভব? রূপা কোথায়? “

“ও তো হোটেলে৷”

এ কথা শুনে ইশতেহারের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল৷ সে এক পলক জেসমিনকে দেখল।

 

সারাদিন রোজা রাখার পর শরীর আর চলতে চায় না! ক্লান্তি এসে ভর করে শরীরে। একদমই শক্তি মেলে না। তবুও রূপাকে তারাবির নামাযের পর থেকেই কাজ শুরু করতে হয়৷ রমজান মাসে বাজারের প্রায় সকল দোকানপাট খোলা থাকে। কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীরা, আশেপাশের বিভিন্ন কোম্পানি, ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা সেহেরির সময় খেতে আসে। তাই চাপ বেশি। রান্না শেষ করেই রুপা বাজার থেকে প্রস্থান করল। কাজের চাপে দিনে গোসল করাও হয়নি। গা চুলকাচ্ছে।

প্রেশার ল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। চারপাশ কেমন ঘোলা হয়ে আসছে। রূপা মাথা ঝাঁকায়, দুই হাতে চোখ ঘষে।

 

গলির মুখে আসতেই কিছু কথা তার কানে আসে৷ সে আগ্রহবশত পাশের গলিতে উঁকি দিয়ে দেখে একপাশে বসে তাস খেলছে এলাকার মুরব্বি কয়জন। যিনি উচ্চস্বরে কথা বলছেন, তিনি কলির বাপ নামে এই এলাকায় পরিচিত৷

তিনি বলছেন, “আসিদপুরের হুজুররে চিনেন? তারে ডাইকা আনেন, আমি যেইডা কইলাম চোক্ষের পলকে প্রমাণ কইরা দিব।”

তমরুজ চাচা জবাবে বললেন, “তাইলে আপনে নিশ্চিত হইয়া কইতাছেন, রূপা আর হের বাপে ফাইয়াজরে জাদুটোটকা করছে?”

কলির বাপ বিদ্রুপ করে বললেন, “আপনেরার কী বিবেক নাই? আমার কলির মতো সুন্দর মাইয়ারে ফাইয়াজ বিয়ে করল না, করল কারে? রূপার মতো ছেড়িরে। ফাইয়াজের লগে মানায় এই ছেড়িরে? কি দেইখা বিয়ে করল ওরে? আমি লেইখা দিতাছি, বাপ-ছেড়ি একযোগ হইয়া ফাইয়াজরে জাদু করছে।”

আরেকজন তাল দিলেন, “ঠিকই কইছেন৷”

 

কলির বাপ মাঝের দিনগুলো বড় ছেলের বাড়িতে ছিলেন। আজই নিজের বাড়ি ফিরেছেন। ফাইয়াজ-রূপার বিয়ের খবর শুনে তার আঁতে ঘা পড়ে। কিছুতেই মানতে পারছেন না, তার অনার্স পাস সুন্দরী মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে ফাইয়াজ রূপার মতো রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে পড়ে থাকা, ছেলেদের বেশভূষা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, অ’ভদ্র, উশৃং খল, কু’ৎসিত মেয়েকে বিয়ে করেছে! 

এই কানাঘুঁষা যে শুধু মুরব্বিদের তা নয়, বিয়ের পর থেকে এলাকার আনাচে কানাচে রূপার অযোগ্যতা নিয়ে রমরমা সমালোচনা চলছে। 

ছোট থেকে সে বিভিন্ন কটু কথা, মিথ্যে অপবাদ শুনে বড় হয়েছে। সব কথাই তার চরিত্র নিয়ে, তার বেশভূষা নিয়ে, তার চালচলন নিয়ে হতো। এতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে কারোর জন্য অযোগ্য — এই কথাটি এই প্রথম শুনছে। বুকের ভেতর খুব যন্ত্রণা হয়। ফাইয়াজের সঙ্গে মিশতে পারে না। সবসময় হীনমন্যতায় ভুগে সে। নিজের প্রতি থাকা আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। খুব রাগ হয়, জিদ উঠে।

 

সদ্য আঘাতপ্রাপ্ত ক্ষতে মরিচ লাগালে যেরকম অনুভূতি হয় এখন ঠিক সেরকম জ্বালাপোড়াই হচ্ছে বক্ষস্থলে। সে তো চায়নি তার থেকে সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা জীবনসঙ্গী। তিনটে প্রেম করেছিল, তিনজনই ছিল ক্রুটিযুক্ত। একজন উচ্চতায় ছোট, একজন খোঁড়া, একজন বধির। 

 

হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাড়ি ফেরার পথে এরকম কথা শোনার পর রূপার জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা বেড়ে যায়। বিয়ের প্রতি, ফাইয়াজের প্রতি এক আকাশ রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ নিয়ে সে বাড়ি ফিরে৷ তার চোখেমুখে অমাবস্যার কালো ছায়া। 

 

দ্বিতীয় তলায় উঠেই বুঝতে পারল, রুমে কেউ আছে। এই অসময়ে তার রুমে কে থাকবে! রুমি নাকি?

রূপা সাবধানে দরজা ঠেলে দেখে, ফাইয়াজ বিছানা ঝাড়ছে। 

দরজা খোলার শব্দ শুনে ফাইয়াজ পিছনে ফিরে রূপাকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল, “আম্মা বললেন, তোমার রুমে বসতে৷ এসে দেখি এই অবস্থা! এখানে গরুছাগলও থাকবে না৷”

রূপা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “তাহলে চলে যান।”

 

ফাইয়াজের দৃষ্টি থমকে গেল। রূপা এভাবে জবাব দিল কেন?

রূপা চোখ সরিয়ে নিল। তার নিজেকে খুব বেপরোয়া মনে হচ্ছে৷ আর ফাইয়াজকে মনে হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র খারাপ লোক। সে তোয়ালে, ট্রাউজার, গেঞ্জি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। 

 

ফাইয়াজ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ কেমন আচরণ? রূপা সবসময় তার সামনে নিভে থাকে৷ উঁচু গলায় কখনো কথা বলে না৷ আজ কী হলো? মুখের উপর কেউ কথা বললে মেজাজ চড়ে যায়। আজ সে রাগ করতে চায় না। নিশ্চয়ই রূপার কোনো সমস্যা হয়েছে। জানতে হবে।

 

বাহিরে বাতাস বইছে৷ জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে এসে ঢুকছে বাতাস। ফাইয়াজ পিঠের নিচে বালিশ রেখে পালঙে হেলান দিয়ে বসল। শেষরাতে বৃষ্টি হবে৷ তারই পূর্বাভাস পরিবেশে৷ 

ফ্যানের ঘ্যারঘ্যার শব্দ কানে লাগছে খুব। অনেক পুরনো ফ্যান। গায়ে তেমন বাতাস লাগে না৷ রূপা কী করে যে ঘুমায়! অবশ্য একসময় সে ফ্যান ছাড়াও ঘুমাত৷ পরিস্থিতি সবকিছু পারে। 

 

বাথরুম থেকে বের হয়ে ফাইয়াজকে দেখে রূপা বিরক্তবোধ করল৷ 

রূপাকে বের হতে দেখে ফাইয়াজ ফোন রেখে সোজা হয়ে বসে বলল, “তোমার ইতিহাস এসেছে। ছয় তারিখের মধ্যে ভর্তি হতে হবে।”

রূপা চুল মুছতে মুছতে দায়সারাভাবে বলল, “ঠিক আছে।”

“কিছুদিন বাড়িতে থাকব না।”

রূপা ড্রয়ার থেকে চার্জার বের করে।

ফাইয়াজ গলার স্বর উঁচু করে বলল, “কী সমস্যা তোমার?”

 

রূপা ভয় তো দূরে থাক, জবাবও দিল না৷ ফোন চার্জে লাগিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফাইয়াজ বিস্ময়ে হতভম্ব! মেয়েরা বউ হলে কি সাহসী হয়ে যায়? সে তরতর করে বিছানা থেকে নামে। রূপা তার সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি। বিয়ের এতগুলো দিন পার হলে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অন্তত হয়৷ তাদের মধ্যে কিছুই নেই!

ছাত্রী-শিক্ষক সম্পর্কের রেশ, জড়তা এখনো রয়ে গেছে৷ ফাইয়াজ নিজেকে দায়ী করল, দোষটা হয়তো তারই। সবসময় শিক্ষকের মতো ধমকে-ধমকে কথা বলেছে, তাই হয়তো সম্পর্কে পরিবর্তন আসছে না৷ ফাইয়াজ রুম থেকে বের হয়।

 

উল্টোদিক থেকে বাতাস আসছে। রূপা ছাদের এক কোণে বুকের কাছে দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার ভেজা চুল পিঠজুড়ে ছড়িয়ে। 

বিদ্যুৎ চলে যায়। বৃষ্টির আগমনী বুঝতে পারলেই বিদ্যুৎ চলে যায়, দেশে এ নতুন নয়। রাতের মৃদু আলোয় রূপাকে একটা কালো আবছায়ার মতো দেখাচ্ছে৷ ফাইয়াজ কাছে গিয়ে বুঝতে পারল, রূপা কাঁদছে।

উৎকন্ঠা নিয়ে বলল, “রূপা, কাঁদছ কেন?”

 

রূপা দ্রুত চোখের পানি মুছল৷ ফাইয়াজ তার কাঁধে এক হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে? আমাকে শেয়ার করতে পারো।”

কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে অভিযোগের সুরে রুপা বলল, “আপনি কেন আমাকে বিয়ে করেছেন?”  

ফাইয়াজ থতমত খেয়ে বলল, “তুমি করতে চাওনি?”

“না, চাইনি।”

“কিন্তু করেছ তো।”

“পরিস্থিতি বাধ্য করেছে তাই রাজি হয়েছি। ভেবেছিলাম, সাধারণ বিষয়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সম্পর্কটা বোঝা মনে হচ্ছে। আমি অন্যরকম কাউকে চেয়েছিলাম। আপনার মতো না।”

 

ফাইয়াজ যেন আকস্মিক গুলিবিদ্ধে আহত হলো মাত্র! তাকে রূপার পছন্দ নয়! এজন্যই কি রূপা সবসময় পালিয়ে বেড়ায়? দূরে দূরে থাকে? অথচ সে ভেবেছিল, পূর্বের শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কই তাদের দূরত্বের একমাত্র কারণ। 

 

ফাইয়াজ নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘এজন্য কাঁদছ?’

 

রূপা জবাব দিল না। চাহনি ঘুরিয়ে নিল। যখনই ফাইয়াজকে সে দেখে, হীনমন্যতায় গা গুলিয়ে ওঠে। মানুষের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে।

 

‘তুমি যোগ্য নও….

‘ফাইয়াজের পোড়া কপাল…

‘কোন হুজুর দিয়ে জাদু করেছিস রে রূপা?…

‘তোদের মানায় না…

এমন কত কত কথা মস্তিষ্কে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।

 

এই কথাগুলো কখনো ফাইয়াজের সঙ্গে তার সম্পর্ক সহজ হতে দিবে না৷ ফাইয়াজের সামনে এলেই তার সংকোচ বেড়ে যায়। পীড়া লাগে বুকে।

 

ফাইয়াজ কিছু না বলে দ্রুত পদে জায়গা ত্যাগ করে।

বরাবরই তার অহংবোধ বেশি৷ যে তাকে এক হাত দূরে সরিয়ে দেয়, তাকে সে একশো হাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে৷ সে যে ই হোক। 

ফাইয়াজ চলে যেতেই রূপার বুকের চর ভাঙতে শুরু করে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। 

ফাইয়াজ প্রথমে নিজের বাড়িতে ঢুকল, রুম থেকে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে গলির পথ ধরে মিশে গেল অন্ধকারে। 

রূপার অসহায়বোধ করে। কী করেছে, কী বলেছে, নিজেও বুঝতে পারছে না৷ ফাইয়াজ তার কাছে সূর্য। যার আলো দূর থেকে উপভোগ্য, কাছে যেতে চাইলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে হয়।

 

আজিজুর বাড়ি ছাড়ার দুইদিনের মাথায় অরুনিকা তার নিজের রুমে চলে এসেছে। হিরণের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে৷ এই যে হিরণ তার একটু সাক্ষাতের আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, ডেলিভারি ম্যান সেজে দুই দিন পর পর এটা-ওটা নিয়ে আসে, ব্যাপারটা উপভোগ করে অরুনিকা। দূর্ভাগ্যবশত, হিরণ প্রতিবার ডেলিভারি ম্যান সেজে এসে সেলিনার মুখোমুখি হয়৷ 

কখনো অরুনিকা পার্সেল রিসিভ করতে আসে না। 

বার বার পার্সেল আসায় মায়ের প্রশ্নের তোপে পড়তে হয়েছে। 

তিনি বলেছিলেন, “এতোকিছু অর্ডার করছ কেন?”

অরুনিকা নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিয়েছিল, “খারাপ কিছু তো অর্ডার করি না। বই, চুড়ি, পায়েল, ডায়েরি, ফুল এসবই তো।”

সেলিনা আরো কিছু প্রশ্ন করে থেমে যান। বড় ছেলেকে অতিরিক্ত শাসন করে হারিয়েছেন, তাই মেয়েকে অবাধ স্বাধীনতা দিচ্ছেন। আগের পদক্ষেপ ভুল ছিল তা বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেকে হারিয়ে। এখনের পদক্ষেপও যে ভুল তা প্রমাণ হতে বেশিদিন লাগেনি। 

 

আজ মাসের সাতাশ তারিখ। মা-মেয়ে ঈদের শপিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অরুনিকা আগে আগে নেমে পড়ে। গ্যারেজের কাছাকাছি আসতেই হিরণ কোথা থেকে এসে তাকে জাপটে ধরে গাড়ির পিছনে নিয়ে যায়। প্রথমে  ভয় পেয়ে গেলেও, হিরণকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচে সে।

 

হিরণকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। সে দ্রুত বলে, “কেন এমন করছ? ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম কোথাও তোমাকে পাই না৷ ইমেইলেও মেসেজ করেছি, উত্তর করোনি। ফোনের সিম বন্ধ রেখেছ। আমাকে কেন পাগল করছ?”

অরুনিকা হিরণকে ঠেলে সরাতে চাইলে, হিরণ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার স্পর্ধা দেখে অরুনিকা অবাক হচ্ছে!

কীসের অধিকার খাটাচ্ছে হিরণ? 

 

“দোহাই লাগে, ব্লক খুলো। আমার সাথে কথা বলো। তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।” উদ্ভ্রান্তের মতো বলল সে।

 

অরুনিকার খুব মায়া হয়। কবেই সে হিরণের অতীত মেনে নিয়েছে৷ এবার সামনাসামনি বলতে হবে।

 

পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেলিনা আসছে।

অরুনিকা চাপাস্বরে বলল, “ছাড়ো।”

“ছাড়ব না।”

“মা আসছে।”

“আসুক।”

অরুনিকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, “কী বলছ!”

পায়ের শব্দ নিকটে চলে এসেছে। অরুনিকা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে হিরণকে সরিয়ে দিল। 

তাকে গ্যারেজ থেকে বের হতে দেখে সেলিনা ভ্রুবক্র করে বললেন, “গ্যারেজে কী করছিলে?”

অরুনিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “কিছু না৷ এমনি গিয়েছিলাম।”

“চলো। দ্রুত ফিরতে হবে।”

সে আড়চোখে গ্যারেজে তাকায়। গাড়ির পিছন থেকে হিরণ কাতর নয়নে তাকিয়ে আছে। 

 

“আরেকটু অপেক্ষা করো। দ্রুত তোমার কাছে আমি ধরা দেব।” মনে মনে বলল অরুনিকা।

 

চলবে…

(রিভিশন দেয়ার সময় পাইনি। দ্রুত লিখেছি। ভুল বানানগুলো এড়িয়ে যাবেন।)

 

সূর্যশিশির 

৩৬.

সেহেরির প্রহর দ্রুত পার হচ্ছে; ত্রিশ মিনিট পর ফজরের আযান। এখনো ফাইয়াজ এসে উপস্থিত হয়নি। বারেক-সুমনার প্রশ্নবোধক চাহনিতে ইশতেহার, জেসমিন বিব্রতবোধ করছে। এক পর্যায়ে জেসমিন টেবিল ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে গেল। কল করল ফাইয়াজকে৷ প্রথম তিনটি কল রিসিভ হলো না! জেসমিন দমে না গিয়ে তীব্র রাগ নিয়ে অনবরত কল করতে থাকল। 

 

“হ্যালো, আপা?” ওপাশ থেকে বলল ফাইয়াজ।

সঙ্গে সঙ্গে জেসমিন গর্জে উঠল, “থাপ্পড় মে রে সবকটা দাঁত ফেলে দেব। তোমার কি সময়-জ্ঞান নেই? আজ আসো, তোমার হা ড্ডি ভা ঙ ব আমি।”

 

জেসমিনের মুখে এমন হুমকি-ধমকি  শুনে ডাইনিংরুমের মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করল। ইশতেহার পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে খ্যাঁক করে কেশে বলল, “ছোট ভাই যতই বড় হোক, সে বোনের কাছে ছোটই।”

রূপা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তার পরনে সালোয়ার-কামিজ, মাথা ঢেকে রাখা দোপাট্টায়৷ 

 

ফাইয়াজ চলে যাওয়ার পর রূপা স্তব্ধ নয়নে অনেকক্ষণ ছাদের ঈশান কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। বিদ্যুৎ আসতেই রুমে গিয়ে দেখে ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা শপিং ব্যাগ রাখা। রূপা ব্যাগটা নিয়ে দেখে ভেতরে দুটো কটনের থ্রি পিস আর একটা চিরকুট। সে পালঙ্কে বসে চিঠি খুলে পড়া শুরু করে 

 

রূপা,

তুমি কি জানো মেয়েদের সৌন্দর্য কিসে? 

নারীত্বে। 

ইতি,

তোমার ফাইয়াজ।

 

তোমার ফাইয়াজ — মাত্র দুটো শব্দ অথচ রূপার পুরো পৃথিবী নড়ে উঠে। বুকের সর্বত্র জুড়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে থাকে৷ 

রূপা বেশ কয়েকবার আওড়াল, “তোমার ফাইয়াজ, তোমার ফাইয়াজ, তোমার ফাইয়াজ।”

 

একটি প্রশ্ন আর একটি উত্তর! এতেই যেন ফাইয়াজের কত কথা লুকায়িত! রূপা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চুল খোঁপা করা ; 

ভেজা চুল অভ্যাসবশত কখন যে খোঁপা করে ফেলেছে সেই মুহূর্তটিও স্মৃতিতে নেই। 

বাইরে টিপটপ বৃষ্টি পড়ছে৷ শীতল বাতাস বইছে৷ 

স্পর্শকাতর অন্তস্থলের টানাপোড়েনে রূপা মোহগ্রস্তের মতো নিজের খোঁপা খুলল৷ শপিং ব্যাগ থেকে গোলাপি রঙের সালোয়ার-কামিজ বের করে পরল। আয়নায় তাকাল। অদ্ভুতভাবে, সে পোশাক পরিবর্তন করলেই তাকে অন্যরকম লাগে; যেন অন্য কেউ! রূপা অপলক চেয়ে রইল নিজের দিকে। 

 

“আপা…আপা।” ডাকতে ডাকতে রুমি এসে রুমে প্রবেশ করে। 

হঠাৎ কারো আগমনে রূপা লজ্জা পায়, গুটিয়ে যায়৷

“কী সুন্দর লাগছে!” রুমি উচ্ছ্বসিত হয়ে এগিয়ে আসে। 

রূপা নিজের ভাবমূর্তি লুকোতে বলল, “আম্মা ডাকছে?”

রুমি রূপার প্রশ্ন উপেক্ষা করে রসিকতা করে বলল, “যার জন্য সালোয়ার কামিজ সে তো নেই! এখন কী হবে?”

রূপা কিছু বলল না।

“জামাটা কী সুন্দররে আপা! কবে কিনেছিস?”

“তোর ভাইয়া দিয়েছে।” নির্বিকার কণ্ঠে বলল রূপা।

“ভাইয়ার পছন্দ দারুণ। ঈদের শপিং ভাইয়াকে নিয়ে করব!”

“আচ্ছা করিস৷ এবার চল খেতে যাই।”

 

জেসমিন ফোনে কথা শেষ করে এসে বলল, “আজ দুপুরে ফাইয়াজের অফিস থেকে রাজশাহী যাওয়ার কথা ছিল। জরুরি কাজ পড়ায় নাকি এখনই যেতে হয়েছে।” 

সুমনা বললেন, “রোজার মাসে মধ্যরাতেও কাজ!”

 

জেসমিন জবাবে কিছু বলল না৷ ফাইয়াজের আজ কিছুতেই বেরোনোর কথা না৷ নিশ্চিত ফাইয়াজ মিথ্যে বলছে। রূপার রুমে গিয়েছিল তারপর কী হলো?

সন্দিগ্ধ নয়নে জেসমিন রূপার দিকে তাকাল। 

রূপা অপ্রতিভ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। 

 

দুপুর বারোটা।

রূপা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছে৷ আজ আর শার্ট-প্যান্ট পরেনি। সালোয়ার কামিজ পরে শরীর কেমন নিশপিশ করছে৷ এখুনি রুমে গিয়ে খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু তার অনড় সিদ্ধান্ত, সে এবার নিজের বেশভূষা পরিবর্তন করবে।

তাকে এভাবে বের হতে দেখে সুমনা, রুমি হতভম্ব। রাতে ভেবেছিল, শ্বশুরবাড়ির মানুষ আসায় পোশাক পরিবর্তন করেছে৷ 

হঠাৎ কী হলো? প্রশ্নটি করার পূর্বেই রূপা চলে গেছে।

 

এ গলি, ও গলির মানুষজন বার বার নজর ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে রূপাকে। অনেকে কথা বলতে এগিয়ে এলেও রুপা গ্রাহ্য করল না৷ কলির বাপের মুদির দোকান আছে৷ রূপা প্রথমে তার দোকানে গেল।

কলির বাপ হুক্কা টানছে।

রুপাকে দেখে চিনতে পারলেন না প্রথমে। যখন ঠাওর হলো, কিছু বলার আগেই রূপা নিজের চুলের বেণি সামনে এনে বলল, “আপনার মেয়ের এরকম লম্বা চুল আছে? আমার মতো লম্বা সে? আমার মতো ভালো রাঁধতে পারে? সব উত্তর হচ্ছে, না৷ আমি আমার জায়গায় ঠিক আছি বরং হিসেব করলে আপনার মেয়ের থেকেও বেশি এগিয়ে আছি।”

 

কথা শেষ করেই রূপা জায়গা ছাড়ল। বাজারের সব মানুষের নজর তার দিকে আটকে যায়। যেদিন শাড়ি পরেছিল বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় বাইকে ছিল ;তখন অনেকেই ভালো করে দেখতে পারেনি আবার অনেকে অন্য মেয়ে ভেবেও এড়িয়ে গেছে। আজ সবাই কাছ থেকে দেখছে। নানাজনের নানা কথা, প্রশ্ন –

 

“রূপা না?”

……….

“তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না।”

……….

“জামাই বলছে নাকি পরতে? “

……….

“এইবার চেহারাটার একটু যত্ন নে।”

……….

“ব্যবসা কি চলছে না? বারেক মিয়া মেয়ের জামাকাপড় পরিবর্তন করে কাস্টমার বাড়ানোর চিন্তা করছে?”

 

শেষ কথাটি মিথ্যা এবং অপবাদ হলেও সত্যিকার অর্থে সেদিন কাস্টমার বেড়ে গেল। মেয়ে দেখলেই চুকচুক করা পুরুষদে ভীড় জমে গেল। তাদের আগ্রহের মধ্যবিন্দু হয়ে উঠেছে রূপা৷ বারেককে প্রশ্ন করে, 

 

“আপনার মেয়ের কী হলো?” 

…………

“সে কী এখন থেকে মেয়েদের মতো থাকবে?”

…………

“বিয়েটা দিয়ে ভালোই করেছেন।”

………..

“রূপাকে একটু ডাকেন তো কথা বলি।”

 

বারেক কাউকেই কোনো জবাব দিলেন না। রূপা রান্নাঘরে গিয়ে নিশ্চুপে নিজের কাজ করতে শুরু করে।

সুজন, বারেক বিভিন্ন কাজের জন্য নানারকম প্রশ্ন করেছিল, রুপা কারোরই কথার উত্তর দিল না।

দুপুর তিনটে বাজতেই সে বার বার নিজের অজান্তে তৃষ্ণার্থ কাকের মতো দরজার দিকে তাকাচ্ছিল, প্রতিদিনের মতো যদি আজও ফাইয়াজ আসে।   

ফাইয়াজ প্রতিদিন দুপুরে  অফিস থেকে ফেরার পথে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যেত। কী রান্না করছ? কীভাবে করে? এটা কী দিচ্ছ?… নানা প্রশ্ন করত।

আজ কেউ আসল না, প্রশ্নে প্রশ্নে বিরক্ত করল না!

ইফতারের মুহূর্তেও খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে যাচ্ছিল। বিগত দিনগুলোতে ফাইয়াজ তার সঙ্গে, এই রান্নাঘরে, তার পাশে বসে ইফতার করেছে! আজ জায়গাটা খালি! চব্বিশ ঘন্টাও হয়নি অথচ সে এমনভাবে কাতর হয়ে উঠেছে যেন বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। রূপা ইফতার সম্পন্ন করতে পারল না। হাত ধুয়ে উঠে পড়ল। কল করল ফাইয়াজকে। বেশ কয়েকবার কল করেও পেল না।

 

মে। ২৮ তারিখ।

সামাং পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে একদল আদিবাসী। সংখ্যায় ছয়শতেরও অধিক। প্রধান পেশা কামার৷  শহরে তাদের তৈরিকৃত লোহার বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার্য লৌহজাত সামগ্রী, কৃষি-যন্ত্রপাতি ইত্যাদির কদর অনেক। তারা কম মজুরিতে দিনরাত খেটে কাজ করে। এতে তাদের দুঃখ নেই। পুরো সম্প্রদায় মিলেমিশে বসবাস করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খোলা মাঠে  র‍ঙিন প্রজাপতির মতো সর্বক্ষণ ছুটে বেড়ায়৷ 

 

মে। ২৯ তারিখ।

পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে দুটি হেডলাইন, 

   “সামাং পাহাড়ের আদিবাসীদের উপর

    স ন্ত্রা স দের আক্রমণ।”

   “আজ কার পালা?”

 

চলবে…

(আমি জানি এখন সবাই বলবে, পর্ব ছোট হয়েছে। তাই কমেন্ট অফ রাখলাম৷ পরবর্তী পর্ব বড় করে লিখে কমেন্ট অন করব। একটা বিশেষ মুহূর্ত কাটাচ্ছি, কিছুদিনের মধ্যে সবাইকে জানাব।)

 

সূর্যশিশির 

৩৭.

উনত্রিশ তারিখের আতঙ্ক দেশজুড়ে। স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটির প্রাঙ্গণ শূন্য। পথেঘাটে কোনো মেয়েকে দেখা যাচ্ছে না। আবহ দেখে মনে হচ্ছে, যেন আচম্বিত পৃথিবী থেকে নারী জাতি বিলীন হয়ে গেছে।

ঘরের বাহিরে বলতে শুধু রূপা। সে কাঁচাবাজারে মুরগি কিনতে এসেছে। মুরগিওয়ালা বয়স্ক মানুষ। 

যখন তার বয়স নয় তখন থেকে এই বাজারে মুরগি বিক্রি করছে। এখন তার বয়স পঞ্চান্ন।

মুরগিওয়ালা বলল, “তোরে এহন অনেক সুন্দর লাগেরে রুপা।”

রূপা লজ্জা পেল, ভেতরে ভেতরে মিইয়ে গেল।

“সাবধানে চলাফেরা করিস। দোকান থাইক্যা বাইর হইস না। আইজকের দিনডা কিন্তু ভালা না।”

রূপা জবাবে চুপ রইল।

“পাহাড়ের সবগুলা মানুষ কি মইরা গেছে? খবরটবর দেহার সময় পাইতাছি না “

“অনেকে জীবিত।’

” পুলিশ সন্ত্রাসদের ধরে নাই?”

” শুনছি, চারজনকে ধরছে।”

“পুলিশগুলা যদি আরেকটু আগে যাইত তাইলে এতগুলো লাশ দেখতে হইত না৷ এই ল তোর দশ কেজি মুরগি।”

 

সুজন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। রুপা হাতে ইশারা করতেই সে দৌড়ে আসে। দুজন মুরগি নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকে। মুরগি কাটার আগে একবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল , ফাইয়াজ কল করল কি না!

রূপা গতকাল সারারাত ফাইয়াজকে কল করেছে। 

প্রতিবারই ওপাশ থেকে একটা গলা শোনা গেছে — দুঃখিত, এই মূহর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।

 

দুশ্চিন্তায় টিকতে না পেরে সকালে জেসমিনের কাছে গিয়েছিল। জেসমিন জানিয়েছে, ফাইয়াজের ফোনটা পানিতে পড়ে গেছে। আর পাওয়া যায়নি।

 

মুরগি কাটার মুহূর্তে হঠাৎ রূপার মনে হয় জানালা দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই কেউ একজন সরে যায়। রান্নাঘরের জানালা থেকে একটা সাদা রঙের এক তলা বিল্ডিং দেখা যায়। ছাদের রেলিঙ ধরেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল! রুপা পুনরায় নিজ কর্মে মনোযোগী হয়। 

চোখের কোণ দিয়ে স্পষ্ট টের পায়, কেউ তাকিয়ে আছে! ডান পাশের দেয়ালে একটা ছোট আয়না টাঙানো। সে আয়নায় তাকাল। দেখল, কোঁকড়া চুলের একটা লোক তাকিয়ে আছে৷  গলায় চেইন, ভ্রু কাটা, কানে দুল৷ পিছনে তাকাতেই লোকটা আড়ালে চলে যায়। সমস্যা কী? লোকটা অনুসরণ করছে কেন? এরকম তো আগে হয়নি।

বেশ কিছুক্ষণ ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটে। আছরের আযান পড়তেই লোকটি চলে যায়। রূপা মনে খচখচানি নিয়ে ইফতারের প্রস্তুতি নেয়।

 

বিকেলবেলা ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। দিনটা বড় অশুভ!

সন্ধ্যা হতেই শুরু হয় বজ্রপাত, তীব্র বাতাসের তাণ্ডব। রেস্টুরেন্টে জ্বালানো হয় ব্যাটারিচালিত বাতি। ইফতারে অন্যদিনের তুলনায় খুব কম খরিদ্দার আসে। 

যারা আসে তাদের ইফতার করার মতো ঘর নেই বলেই এই ঝড়ের মাঝেও এসেছে। 

 

ঝড় থামতেই রূপা বাসায় চলে যায়। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে। হৃদয়ে একটা অস্থিরতা। মনে শান্তি না থাকলে কি গায়ে শক্তি থাকে? 

রুমে গিয়েই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। এর মধ্যে অরুনিকা কল করল। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রূপা বলল, ” রমজানে আমি অনেক ব্যস্ত থাকি। প্রতি রোজায় তুই দেখা করতে আসিস। এক সপ্তাহ আগে দেখা করেছি, এখনো আসছিস না কেন?”

অরুনিকা বলল, “মা আসতে দেয় না। তবে আগামীকাল আসব৷ যেভাবে হোক আসব।”

” হিরণ ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেছিস?”

 

অরুনিকা কিছু বলল না। হিরণের যে প্রেমিকা ছিল ব্যাপারটা সে রূপার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। রুপা তার ব্যাপারে পজেসিভ। সাধারণ বিষয়কেও গুরুতরভাবে নেয়৷ তাই এই কথাটা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে৷ কী দরকার রূপাকে চাপ দেয়ার। 

পরমুহূর্তেই অরুনিকা ভাবল, রূপা চাপ নিবে তাই কথাটি লুকিয়েছি নাকি রুপা জানলে হিরণের সঙ্গে কখনো মেনে নেবে না, মিশতে দিবে না সেই ভয়ে লুকিয়েছি?

জবাব না পেয়ে রূপা বলল, ” অরুনিকা?’

অরুনিকা চট করে জবাব দিল, ” না, বলিনি। ও প্রতিদিন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ছাদেও হয়তো যায়, আমি যাই না৷ মা আর আমি বের হলে পিছু নেয়।”

 

অরুনিকা রূপাকে বলেছে, হিরণকে পরীক্ষা করতে কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ বন্ধ রেখেছি। 

রুপা হেসে বলল, “তোর জন্য পাগল হয়ে গেছে৷ আর কত ঘুরাবি?”

“আর ঘুরাব না। আজই বলে দেব।”

“আজ বলার দরকার নেই। ভাইয়ার স্থায়ী ঠিকানা দিতে বলেছিলাম, এখনো দিলি না৷”

”আমার কাছে তো নেই।”

”নিয়ে দে। আমি বের হওয়ার সময়ই পাচ্ছি না, নয়তো যোগাড় করে নিতাম।”

“আচ্ছা, দেব।” অরুনিকার গলা নিভে আসে। 

রুপা বলবে তো হিরণের সঙ্গে তার সম্পর্কের শুরু হবে, ব্যাপারটা ভালো লাগছে না৷ মনের ভেতর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।

রুপা বলল, “অনেক ক্লান্ত লাগছে, ঘুমাব।”

“স্যারের কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”

“ফোন বন্ধ। আপা বলল, উনার ফোন নাকি পানিতে পড়ে গেছে।”

“চিন্তা করিস না। কাজে গেছে চলে আসবে।” 

 

কিছুক্ষণ পর সেহেরির প্রস্তুতি নিতে হবে এই দুশ্চিন্তায় ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমানো গেল না। বেশ কয়েকবার সুমনা এসে ডাকাডাকি করেছেন, “ঘুমিয়ে যাস না যেন দোকানে যেতে হবে।”

রুপা চোখ বোজা অবস্থায় প্রতিবার বলেছে, “ঘুমাচ্ছি না।”

 

বারোতম সময়ে রুপা চিৎকার করে উঠল,  “একটু চুপচাপ শুয়ে থাকতে তো দিবে। দিন রাত শুধু কাজ করব? তোমাদের এই অত্যাচার আমার আর ভালো লাগছে না। যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে মনে চায়।”

সুমনা বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলেন। রুপা ওড়না আর ফোন নিয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে যায়। 

রাস্তায় কাঁদা। সেই কর্দমাক্ত জায়গা মাড়িয়েই রেস্টুরেন্টে গেল। 

 

বাজারে প্রবেশ করতেই এশারের আযান ভেসে আসে। অন্য আট-দশটা মেয়ের মতো রুপাও মাথায় ওড়না টেনে নিল। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকেই সে অবাক হয়ে যায়, চমকে যায়। সামনের বেঞ্চিতে হীরা বসে আছে! দেখতে ভীষণ গুছানো ও পরিপাটি লাগছে। তাকে ঘিরে বসে আছে আরো অনেকে। সামনে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগি কষার প্লেট রাখা।  সে এখানে কী করে? এতদিন কোথায় ছিল? হুট করে কোথায় চলে গিয়েছিল? 

রূপা, হীরার চোখাচোখি হয়। না চাইতেও রুপার ভ্রু দুটি কুঁচকে গেল। চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের রাগ, বিরক্তি। 

 

ক্যাশ কাউন্টার খালি! সুজন, বারেক কেউ নেই৷ রূপা ক্যাশ কাউন্টারে বসল। ও ভাবছে, কী তাণ্ডব নিয়ে এসেছে হীরা? এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে কোনো নোংরা মন্তব্য করলে আমি ছেড়ে দেব না। 

 

হীরা চোখ ফিরিয়ে নিয়েও আবার তাকাল৷ রূপাকে অন্যরকম লাগছে। এতোটাই অন্যরকম যে বার বার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে৷ রূপার রাগী দৃষ্টি, সিঁথি, মাথার অর্ধেক ঘোমটা ; সব মিলিয়ে একটা ব্যাতিক্রম চিত্রের রূপ দিয়েছে — হীরা চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।

 

সুজন বাহির থেকে দৌড়ে এসে দোকানে ঢুকে। রূপা চাপাস্বরে ধমকে উঠল, “দোকান রেখে কোথায় ছিলি?”

“আহুরদ্দিন চাচারে চা দিয়া আইছি।”

” হীরা কখন আসল?”

“তুমি যাওয়ার পরেই।”

“চাঁদার জন্য?”

“এখনো তো কিছু চায় নাই। তহন থাইকা আড্ডাই দিতাছে।”

রুপা দেখে, হীরা স্বাভাবিকভাবেই হাসি-তামাশা করছে। সুস্থ-স্বাভাবিক একটা মানুষ যেভাবে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, ঠিক সেভাবে।  

 

রাত নয়টার দিকে তাদের অবাক করে দিয়ে খাবারের বিল মেটাল হীরা।

যখন সে ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে বলল, “চাচা, বিল কত আসল?”

বারেকের চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে যায়৷ সুজন নিশ্চুপে রান্নাঘরে গিয়ে রুপাকে কথাটি জানায়। রুপা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে হীরা বিল দিচ্ছে! 

হীরার আকস্মিক আগমন এবং স্বাভাবিক আচরণ তার মোটেও ভালো লাগছে না। মনের কোথাও যেন কু গাইছে।

তার কিছুক্ষণ পরই জেসমিনের গলার স্বর শোনা যায়। কান্না করতে করতে রূপা, রূপা বলে ডাকছে।

রূপার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। হুড়মুড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়। 

 

চলবে…

(অনেক গ্যাপ থাকায় গল্পের তাল ধরতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। যতটা সময় নিয়ে এই পর্ব লিখেছি, ততটুকু সময় নিয়ে এর থেকে দ্বিগুণ পর্ব লিখতে পারতাম। আশা করি আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে।)

 

author-avatar

About ইলমা বেহরোজ

ইলমা বেহরোজ। ডাক নাম ইলমা। জন্ম ২০০৩ সালের ১৮ জুলাই। জন্মস্থান নেত্রকোনা হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা সিলেটে। ছোটোবেলা থেকেই গল্প/উপন্যাসের প্রতি ছিল তাঁর ভীষণ ঝোঁক। ক্লাসের ফাঁকে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার কারণে গুরুজনদের তপ্তবাক্যও হজম করতে হয়েছে বহুবার। তবুও এই অভ্যাসকে কখনো বাদ দিতে পারেননি। সমাপ্ত গল্পকে নিজ কল্পনায় নতুনভাবে রূপ দেওয়া ছিল তার অন্যতম শখ। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় গল্পরাজ্যের সঙ্গে পরিচিত হোন। যেখানে সবাই নিজস্ব চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে নিজ লেখাকে আক্ষরিক রূপ দিয়ে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেন। তাৎক্ষণিক নিজের কল্পনায় সাজানো গল্পগুলোকেও লিখিত রূপ দিতে শুরু করলেন। তিনি।

2 thoughts on “সূর্যশিশির

  1. Tania বলেছেন:

    এর পরবর্তী পর্ব আর কি দেওয়া হবে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।