গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১

 

“আম্মা, বাড়িওয়ালা আঙ্কেল ফোন দিলেন বাসা ভাড়ার জন্য। তুমি ওনাকে ভাড়া দাওনি?”

 

“নাহ্। দেওয়া হয়নি। তুই চিন্তা করিস না, আমি বলে বুঝাই দেবনে ওনারে।”

 

“সমস্যা নেই। আমি আঙ্কেলকে আসতে বলেছি। টাকা নিয়ে যাবেন সন্ধ্যায়।”

 

“আমাকে জিজ্ঞেস না কইরা আসতে বললি ক্যান?”

 

“ভাড়া তোমাকে দিয়ে দিলাম না! আবার জিজ্ঞেস কী করবো! আসলে দিয়ে দিও।”

 

“ভাড়া কয়দিন পর দিলে কী হয়! পাঁচ তারিখেই দিতে হইবো এমন কোন কথা আছে? বেশি খাইস্টা বাড়ি ওয়ালা। মানুষ একমাসের ভাড়া আরেক মাসে দেয়। মাস শেষ হলে ভাড়া পাইলেই তো হইলো। তা না অগ্রীম ভাড়া নিতে হইবো।”

 

“এখন কোথাও মাস শেষে ভাড়া দেওয়ার নিয়ম নেই আম্মা। সবাই এডভান্সই নেয়। আর মাসের শুরুতেই নেয়। কিন্তু তোমার হঠাৎ কী হলো?”

 

“টাকা নাই।”

 

“টাকা নাই মানে? পাঁচ তারিখেই তো পনেরো হাজার তোমার হাতে দিলাম। দশ হাজার বাসা ভাড়া। আর গ্যাস, কারেন্ট বিলসহ সপ্তাহের বাজার খরচ মিলিয়ে পনেরো হাজার টাকা তোমার হাতে দিয়েছি না? টাকা কই গেল?”

 

দেলোয়ারা বেগম মুখ ভার করে কাপড় ভাঁজ করতে থাকেন। আতিয়া উত্তরের অপেক্ষায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

“আম্মা, কথা বলো।”

 

“কী বলবো! তোর কোন খবর আছে পরিবারের? তিনমাস আগে আয়েশার জামাই ব্যবসায় লস খাইলো। কী করছিস ছেলেটার জন্য? বোনটা আসলো না তোর কাছে সাহায্যের জন্য।”

 

“কী কথার কী উত্তর দিচ্ছ! খলিলের কিছু হয়নি। আমি খোঁজ নিয়েছি। আয়েশা তো কিছু না হতেই চোখের পানি ঝরায়। খলিল কোথায় জানি টাকা খাটাতে চায়। তাই ধার চেয়েছিল। ধার দেওয়ার টাকা কই আমার? তাছাড়া এসব জুয়া মনে হয় আমার। এখন বলো ভাড়ার টাকা কী করেছ ?”

 

“খাইছি তোর টাকা! খাইছি আমি।!আল্লাহ মরণ দেয় না ক্যান আমার! মাইয়ার কাছে এমনে টাকার হিসাব দেওয়ার চাইতে গলায় দড়ি দেওন ভালো। আল্লাহ আমার কপাল এমন করছে যে মাইয়ার কামাই খাইতে হয়। এত মানুষ মরে, আল্লাহ আমারে চোখে দেখে না! মাইয়া চাকরির টাকার গরম দেখায়, ভুইল্লা গেছে এই চাকরি তারে তার বাপ দিছে। এমনে এমনে হয় নাই।”

 

আতিয়া বুঝে যায় মা সঠিক কথা বলবে না। এসব বিলাপ কান্নাকাটির আড়ালে টাকা কোথায় কী করেছে তার সঠিক হদিস আর পাওয়া যাবে না। নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে আতিয়ার। কেন মায়ের কাছে এতগুলো টাকা দিতে গেল! মায়ের এই টাকা নষ্ট করার স্বভাব তো ওর জানা। তবে এইবার আতিয়াও কঠোর হবে।

 

আতিয়াদের বাড়িওয়ালা এই বাড়িতে থাকে না। ছোটো ছোটো দুই ইউনিটের এই পাঁচতলা বাড়িটিতে শুধু ভাড়াটিয়ারা থাকেন। বাড়িওয়ালা সোবহান মোল্লা সাহেব সপ্তাহে সপ্তাহে এসে ঘুরে দেখে যান। ভাড়া ওঠান, ভাড়াটিয়াদের কোন অভিযোগ থাকলে শুনেন। সময়ে সময়ে ভাড়াটিয়াদের শাসন করেন, খবরদারি করেন। এই বাড়িতে মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা থাকেন। যাদের আয় সীমিত, কিন্তু সমাজে সম্মান আছে। প্রতিটি ইউনিট খুবই ছোটো। ছয়শো স্কয়ার ফিটের এই বাসায় দুটো ছোটো ছোটো রুম। একটা রুমের সাথে এক চিলতে বারান্দা, যাতে একসাথে দু’জন মানুষ দাঁড়াতে পারে না। আর ছোট্ট একটা বসার ঘর। রান্নাঘরটা এতই ছোটো যে কুটা বাছা করতে হলে বসার ঘরের দিকে মুখ করে বসতে হয়। দুই রুমের একটায় আতিয়া একাই থাকে। আগে আয়েশা আর আতিয়া একসাথে থাকতো। এখন আয়েশার বিয়ের পর আতিয়া একাই থাকে, আলোকে সাথে রাখেনি। আরেক রুমে মা দেলোয়ারা বেগম, ছোটো মেয়ে আলোকে নিয়ে থাকেন। আতিয়ার ছোটো ভাই আশিক থাকে বসার ঘরে। বসার ঘরে কোন সোফা সেট নেই। চারটে আরএফএলের প্লাস্টিকের চেয়ার আর ছোটো একটা হার্ডবোর্ডের টেবিল আছে যা ডাইনিং টেবিল, পড়ার টেবিল দুই কাজেই ব্যবহার হয়। একপাশে একটা সিঙ্গেল খাট রাখা, আশিক সেই খাটেই ঘুমায়। একটাই কমন বাথরুম, সেটার বসার ঘরের পাশেই।

 

আয়েশার বিয়ের পর দেলোয়ারা বেগম ইনিয়ে বিনিয়ে রুমটা আশিককে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। আতিয়া আগের মতো হলে হয়তো ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন আতিয়া অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। নিজেকে আর ব্যবহার হতে দিতে ভালো লাগে না। দেলোয়ারা বেগম মেয়ের এই পরিবর্তনে খুশি হন না। আতিয়াকে সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দেন, আজ যে আতিয়া চাকরি করতে পারছে এটা ওর বাবারই বদৌলতে। 

 

আতিয়া চুলটা টাইট করে বেঁধে গালে পাউডার দেয়। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক বুলায়। চোখে একটু কাজলও দিয়েছে। নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হয়। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হলেও চামড়ায় এখনো বলিরেখা পড়তে শুরু করেনি। চামড়া টানটান আছে। মাথায় এখনো ঘন-কালো চুল।গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। কারও প্রেয়সী হওয়ার সময় আতিয়ার পেরিয়ে যায়নি। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকদিন তো একা ছিল। আবার বিয়ের কথা যে মাথায় আসেনি তা নয়। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের কারও যেন আর আগ্রহই ছিল না আতিয়ার বিয়ের ব্যাপারে। আতিয়াও লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারেনি। 

 

দেলোয়ারা বেগম বিলাপ করার ফাঁকে মেয়ের রেডি হওয়া দেখে। ওনার কথার খোঁচায়ও আতিয়া নিরুত্তাপ দেখে একটু হতাশ হন। ভেবেছিলেন আতিয়া নরম হয়ে যাবে। বাড়ি ভাড়ার টাকাগুলো আসলে তিনি মেঝো মেয়ে আয়েশার স্বামী খলিলকে দিয়েছেন। দিন তিনেক আগে খলিল বাসায় এসেছিল। আতিয়া তখন ডিউটিতে ছিল। খলিল কাগজপত্র সাথে নিয়ে এসেছিল। একটা স্কিমের কথা বুঝিয়েছে দেলোয়ারা বেগমকে।

“গোল ২০২৫” নামক এই স্কিমে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখলে তার তিনগুণ লাভ সহ ফেরত দিবে। যেমন এক লাখ টাকা রাখলে দেলোয়ারা বেগম তিনলাখ পাবেন!

 

খলিল এতকিছু বোঝালো যে দেলোয়ারা বেগম লোভে পড়ে যান। তবে এক লাখ টাকা তিনি কই পাবেন! এত টাকা ওনার নাই। খলিল তখন বুদ্ধি দেয়, যা আছে তাই দিতে। খলিলের কাছেও বেশি নেই। তবে শাশুড়ির টাকার সাথে নিজের টাকা মিলিয়ে একলাখ টাকা সে স্কিমে দিবে। স্কিমে শাশুড়ির নামই থাকবে। লাভ আসলে টাকা ভাগ করে নিবে। লাভের এক লাখ সহ শাশুড়িকে পুরো দুই লাখ দিবে খলিল। এক লাখ নিজে রাখবে। এরপর আর না করতে পারেননি দেলোয়ারা বেগম। আগে আতিয়া বেতন পেলে টাকা পয়সা সব ওনার কাছে রাখতো। গত ছয়মাসে মেয়েটা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ভাড়া আর বাজারের টাকা হিসেব করে হাতে দেয়। আগের মতো দেলোয়ারা বেগমের হাতে টাকা থাকে না। নিজের মতো খরচও করতে পারেন না।

 

নিজের জমানো এগারো হাজার, আতিয়ার দেওয়া পনেরো হাজার আর এক জোড়া স্বর্ণের কানের দুল খলিলের হাতে তুলে দেন দেলোয়ারা বেগম। কতগুলো টাকা পাবেন। তখন বড়ো এক জোড়া কানপাশা বানাবেন। আতিয়ার বাবা জীবিত থাকতে টুকটাক এসব শখ পূরণ করতে পেরেছিলেন। এখন আর পারেন না। আতিয়া যখন বেতনের টাকা হাতে দিতো তখন টুকটাক সৌখিন জিনিসপত্র কিনতেন। আতিয়া রাগ করলেও কিছু বলতে পারতো না। কিন্তু ইদানীং কার মন্ত্রণায় যেন আতিয়ার পরিবর্তন হচ্ছে।  কোন পুরুষের পাল্লায় পড়েছে কিনা কে জানে। বিয়েশাদি করতে চাইছে মনে হচ্ছে। আলোর বিয়ে, আশিকের চাকরির আগে আতিয়া বিয়ে করলে বিপদে পড়তে হবে।

 

আতিয়া জুতোয় পা গলানোর আগে মায়ের দিকে ফিরে বলে, “আম্মা, সন্ধ্যায় বাড়িওয়ালা আসলে ভাড়া দিয়ে দিও। না দিতে পারলে কী বলবে আমি জানি না।”

 

“তোর সমিতি থেকে টাকা তুলে দিয়ে দে না। তোর হাতে নাই কিছু?”

 

“সমিতি থেকে আমি কোন টাকা তুলবো না। সুদ আমাকে টানতে হয়। আমার হাতে কোন বাজে খরচের টাকা নাই। আমি গেলাম।”

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ২

 

আতিয়া হাঁটতে শুরু করেছে। কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এই চিকন গলি থেকে সেগুনবাগিচা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া সহজ নয়। কম করে হলেও চল্লিশ মিনিট হাঁটতে হবে। আতিয়া গলি থেকে কাঁটাবনের অপজিট পর্যন্ত হেঁটে আসে। তারপর বাসে করে মৎস ভবনের সামনে এসে নামে। দশ টাকা দশ টাকা বিশ টাকায় যাতায়াত। সকাল আটটায় ডিউটি শুরু। সাড়ে সাতটার ভেতর না বের হলে দেরি হয়ে যায়। সকালের খাবারটা তাই টিফিন বক্সে নিয়ে নেয়। 

 

নাস্তা বলতে ঠান্ডা ভাত, আর আগের দিনের তরকারি। হসপিটালের ওভেনে বক্সটা গরম করে ডিউটির এক ফাঁকে খেয়ে নেয়। মিলিনিয়াম জেনারেল হাসপাতালে নার্স হিসেবে আতিয়ার চাকরির বয়স সাত বছর হতে চললো। আতিয়ার বাবা হামিদ আলী এই হাসপাতালেরই এমএলএস পদে কর্মরত ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হওয়ায় হাসপাতালের ইউনিয়ন লিডারদের সাথে ওনার ভালো পরিচয় ছিল। শুনতে হাস্যকর শোনালেও সক্রিয় ইউনিয়ন করা কর্মকর্তা কর্মচারীরা এসব হাসপাতালে সবচেয়ে প্রভাবশালী। তাদের কাছে ডাক্তাররাও নস্যি। কোন রোগীর সিট প্রয়োজন! কেবিন লাগবে! ভর্তি হতে হবে! এই সবকিছুই একসময় তারা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। এই চাকরিটা আতিয়া বাবার চেষ্টাতেই পেয়েছে।

 

আতিয়া বিয়ের সময় ডিগ্রি পাস পড়ছিল। বিয়ে হয়েছিল খুচরা ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসায়ী শফিকের সাথে। পুরান ঢাকার নববাপুরে দোকান ছিল শফিকের। আয় রোজগার ভালোই ছিল। আতিয়াকে তখন বাইরে কোন কাজ করতে হয়নি। জীবন তখন অনেক বেশি সুন্দর ছিল। নবাবপুরের গলির ভেতর দুই কামরার সেই সংসারে আতিয়ার স্বর্গ ছিল। শফিক ভালো স্বামী ছিল। আতিয়ার যত্ন করতো। যদিও শফিকের বাবা মা আর ছোটো ভাই আতিয়াদের সাথেই থাকতো। তবু তা আতিয়ার নিজের সংসার মনে হতো। সেই সংসারের কর্ত্রী যে ছিল আতিয়া। আজ যখন মায়ের বাড়ির সিংহভাগ খরচ সেই বহন করে। তবু যেন এই সংসার তার নয়! পরিবারের ভালোমন্দ কোন বিষয়ে মতামত দিতে গেলে মা বিরক্ত হয়। বোন ঝগড়া করে। ভাইতো থেকেও নেই। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। সময়ে সময়ে ঘরে ফিরে দুটো খেয়ে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে কাজ খুঁজে। যদিও অনার্স শেষ করেছে দুইবছর হতে চললো। এখনো কোন কাজকর্ম করে না। কী কাজ খোঁজে আতিয়া বোঝে না। আতিয়া চেষ্টা করেছিল হাসপাতালে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু অনার্স শেষ করা ভাই পিয়নের পদে কাজ করবে না। ইদানীং আতিয়ার বড্ড ক্লান্ত লাগে। নিজেকে একটা মেশিন মনে হয়। তাদের হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এটিএম মেশিন যেন। মাস শেষে যে যার প্রয়োজন মতো টাকা বের করে নিয়ে চলে যায়। মেশিন দাঁড়িয়ে থাকে একাকী!

 

বিয়ের সময় আতিয়ার বয়স ছিল বিশ বছর। বিয়ের দুই বছরের মাথায় গর্ভবতী হয়েছিল আতিয়া। গর্ভের সন্তানের যখন সাত মাস বয়স, তখন স্বামী শফিক নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এই হাসপাতালেই এসেছিল আতিয়া। সে সময় আতিয়া বাসে উঠতে পারতো না। বাসে উঠলেই বমি আসতো। যাওয়ার সময় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও সিএনজি পায় না শফিক। বাধ্য হয়ে আতিয়াকে নিয়ে রিকশায় ওঠে। অর্ধেক পথ ভালোভাবেই এসেছিল। রাস্তায় জ্যাম থাকায় রিকশাওয়ালা উল্টো পথে রিকশা ঘুরিয়ে দেয়। আতিয়া বারবার মানা করছিল। কিন্তু রিকশাওয়ালা বলছিল, কিছু হবে না। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে একটা বাস এসে রিকশায় ধাক্কা মারে! শফিক বাসের দিকেই বসা ছিল। শেষ মুহূর্তে আতিয়াকে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেয় শফিক। আতিয়া প্রাণে তো বেঁচে যায়। কিন্তু সেই এক দুর্ঘটনায় ওর সাজানো জীবন একমুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। 

 

শফিক আর রিকশাওয়ালা স্পট ডেড। বিস্ময়কর ভাবে আতিয়া অন্য কোথাও আঘাত পায়নি। শুধু পেটে প্রচন্ড আঘাত লাগায় অনাগত সন্তান পেটেই মারা যায়। সাতটা মাস যাকে একটু একটু করে নিজের ভেতর বড়ো করছিল, তাকে একটু ছুঁয়ে দেখার ভাগ্যও হয় না আতিয়ার। দুর্ভাগ্য যেন সেদিন থেকেই আতিয়াকে একটু একটু করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এখন শফিকের সেই দোকান আতিয়ার শ্বশুর আর দেবর চালায়। শফিকের মৃত্যুর পর ওনারা আতিয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন আগ্রহ আর দেখাননি। আতিয়ার বাবা চেষ্টা করেছিল দেবরের সাথে আতিয়ার বিয়ে দিয়ে ও বাড়িতে পাঠানোর। কিন্তু  আতিয়া রাজি ছিল না। তারপরও হামিদ আলী আতিয়ার শ্বশুরের কাছে এই প্রস্তাব রাখেন। বিনিময়ে শাশুড়ি আতিয়াকে ফোন দিয়ে শাপশাপান্ত আর গালিগালাজ করেন। এক ছেলেকে খেয়ে আরেক ছেলের দিকে হাত বাড়ানোর জন্য ডাইনি অপবাদও জুটে যায়। শ্বশুর বাড়ি ফেরার পথ চিরতরেই বন্ধ হয়ে যায় আতিয়ার। এরপর কিছুদিন দুই পরিবারের বেশ ঝগড়াঝাটি চলে। আতিয়ার মা দেলোয়ারা বেগম আর বাবা হামিদ আলী শফিকের দোকানের কিছু অংশ, আতিয়ার বিয়েতে দেওয়া তিন ভরি গয়না, ব্যবহারের ফার্নিচার, কাপড়চোপড়  আর নগদ এক লাখ টাকা ফেরত আনার চেষ্টা দফায় দফায় করেন। অবশেষে অবস্থা হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেলে দুই পরিবারকে নিয়ে গণ্য মান্য ব্যক্তিরা বসেন। শেষমেষ সিদ্ধান্ত হয়, দুই বছর আতিয়াকে খাইয়েছে, পড়িয়েছে শফিকের পরিবার। তার খাওয়া খরচ বাবদ ঐ এক লাখ খরচ হয়ে গিয়েছে! আতিয়ার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে। আর সেই যে দুই বছর আতিয়া সংসারের সমস্ত কাজ করলো, রেঁধে বেড়ে খাওয়ালো। সেই বাবদ কতটা টাকা জমেছে। একটা কাজের লোক রাখলেও মাসে পাঁচ হাজার করে লেগে যায়। দুই বছরেও কী লাখ টাকার কাজ আতিয়া করেনি!

 

অবশেষে বাবার বাড়ির তিন ভরি গয়না, ব্যবহারের কিছু কাপড়, একটা মেলামাইন বোর্ডের ওয়ারড্রব ও আয়না ফেরত আসে আতিয়াদের বাড়ি। বিয়ের শাড়ি যেহেতু শফিকের পরিবার দিয়েছে, তাই সেগুলো আর ফেরত আসে না। গয়নাগুলো দেলোয়ারা বেগমের কাছেই ছিল। এবার আয়েশার বিয়েতে সেই গয়না থেকে দেড়ভরির গলার চেইন আর কানের দুল জোড়া দেলোয়ারা বেগম বের করে দিয়েছিলেন। আতিয়া তখন কিছু বলে পরিস্থিতি খারাপ করেনি ঠিকই, কিন্তু বিয়ের আয়োজন শেষে ওর হাতের দেড় ভরির চুড়ি জোড়া কই তা দেলোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করেছিল। সেই একই রকম বিলাপ, আর এলোমেলো কথায় সেই চুড়ি জোড়ারও আর কোন হদিস পায়নি আতিয়া। তবে আয়েশার বিয়েতে মায়ের গলার মোটা চেইন দেখে চুড়িগুলো কই গিয়েছে তা অবশ্য আন্দাজ করতে কষ্ট হয়নি।

 

আজ যেন আতিয়াকে অতীত পেয়ে বসেছে। বাবা হামিদ আলী একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন আতিয়াকে নার্সিং ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিয়ে। হামিদ আলীর ইউনিয়ন লিডার পরামর্শ দেয় ডিগ্রি পাস দিয়ে মেয়ে কোন ভালো কাজ পাবে না। হাসপাতালে চাকরি পেতে হলে তিনবছরের ডিপ্লোমা নার্সিং কোর্স থাকতেই হবে। পরে বিএসসি করে নিবে। আতিয়ার বয়স বাইশ না হওয়ায় আতিয়া তখন প্রাইভেটে ডিপ্লোমা কোর্সো ভর্তি হতে পারে। তিনবছর পর বাবা ইউনিয়ন লিডারদের ধরে বেঁধে, অনুরোধ করল আতিয়ার চাকরির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই তিন বছরে আতিয়া বুঝেছে জীবন কত কঠিন। মানুষ অবিবাহিত মেয়েকে মাথায় করে রাখে। কিন্তু বিধবা, ডিভোর্সি মেয়ের উপর যেন চরম বিরক্তি ভর করে। চাকরিতে না ঢুকে আতিয়ার উপায় ছিল না। আতিয়ার বিয়ের চেষ্টা যে হামিদ আলী আর দেলোয়ারা বেগম করেননি তা নয়। কোথাও যৌতুকে হতো না। কোথাও বরের আগের ঘরের স্ত্রী সন্তান সব বর্তমান আছে। কোন কোন পাত্রের বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। তারপরও একসময় একজন পাত্র মোটামুটি সবমিলিয়ে ভালো মিলে যায়। হাসপাতালেরই অন্য এক এমএলএসের ছেলে। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় তালাক হয়েছে। বয়সও বেশি ছিল না। আতিয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার একসপ্তাহের মাঝে এই সুস্থ পাত্র মারা যায় একদম হঠাৎ করেই। কাজ থেকে ফিরে শরীর খারাপ লাগছিল বললো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে সব শেষ। আতিয়ার নাম বদনাম হয়ে যায়। এরপর হামিদ আলী বিয়ের চেষ্টা বাদ দিয়ে মেয়ের চাকরির চেষ্টায় মন দেন। আতিয়া চাকরিতে ঢোকার আগেই মৃত্যু বরণ করেন হামিদ আলী। অবধারিতভাবে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে আতিয়ার উপর। হামিদ আলীর মৃত্যুর কারণে তার পরিবারের প্রতি কর্তৃপক্ষের মায়া হয়। তাই আতিয়ার চাকরিটা সহজেই হয়। 

 

বাবা মারা যাওয়ার পর আতিয়া সত্যিই তার মাথার উপরের ছাদখানা হারিয়ে ফেললো। আতিয়া বুঝতে পারে পরিবারের কেউই তাকে খুব একটা পছন্দ আর করে না। একমাত্র ছোটো বোনটা একটু আধটু মায়া করে। আর সবাই কেমন দূরত্ব বজায় রাখে। এমনকি মা দেলোয়ারা বেগম পর্যন্ত! ভীত, নরম সরম ধরনের মেয়ে আতিয়া কখনোই ছিল না। পরিবারের বড়ো মেয়ে বলে মায়ের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সংসারের কাজকর্ম ধরেছে সেই বারো তেরো বছর বয়সে। তেল, লবনের হিসেবে সে মায়ের চেয়েও পাকা ছিল। গুছিয়ে ঘর করার মতো ঘরণী মেয়েই আতিয়া। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় তো সন্তানদের নিয়ে অতি আহ্লাদ নেই। আতিয়া কলেজের পড়ালেখার পাশাপাশি তাই বাজার করা শিখেছে। দৌড়ে লোকাল বাসে উঠতে তার কখনোই কারও হাত প্রয়োজন হয়নি। রাস্তা পার হওয়ার সময় ভীত হরিণীর মতো কারও বাহু জড়িয়ে ধরার আকাঙ্খা হয়নি। তবু একজন সঙ্গী তো বীরপুরুষেরও লাগে। হাত ধরে রাস্তা পার হতে নয়। জীবন পাড়ি দিতে গিয়ে একা একা মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়। এই যেমন এই রাস্তাটুকু। একা হাঁটতে গেলে যেন শেষ হয় না। মনে হয় সঙ্গে যদি কেউ থাকতো। কথা বলতে বলতে বহুদূর চলে যেতে আতিয়ার ক্লান্ত লাগতো না। 

 

হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে চলে আসে। এই সময় বাসে ফাঁকা সিট পাওয়া মুশকিল। দাঁড়িয়ে যেতে হবে। অফিসগামী মানুষদের ভীড়ে বাসে তিল ঠাঁই নাই অবস্থা। আতিয়া হিজাব পরে থাকতে পারে না। মাথা ব্যথা করে। বোরখার সাথে তাই লম্বা ওড়ানা গায়ে মাথায় পেঁচিয়ে নেয়। এরপরও বাসের ধাক্কাধাক্কির এই সময়টুকু নিজেকে পুরোপুরি বাঁচিয়ে চলতে পারে না। ভীড়ের ভেতর সুযোগ পেলেই কেউ না কেউ ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আগে প্রতিবাদ করতো। কিন্তু দেখে কেউ এগিয়ে আসে না। এমনকি বাসের মহিলারও না। একদিন তো এক বয়স্ক মহিলা নিজের ছেলের পক্ষ নিয়ে ঝগড়াই লাগিয়ে দিলেন। ওনার কথার সারমর্ম ছিল, ভালো মহিলা হলে মুখ ফুটে গায়ে হাত দেওয়ার কথা বলতে পারতো না। ভালো মহিলারা এসব বলে না, বরং নিজেকে সামলে রাখে। আতিয়া ভালো মহিলা হতে পেরেছে কিনা জানে না। তবে এখন নিজেকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে চলে। রাস্তাঘাটের এসব ছোঁয়াছুঁয়ি তো কিছু না। আসল লড়াই তো চলে পরিচিত মন্ডলে। 

 

হাসপাতালে ঢোকার মুখে জমিলা সিস্টারের সাথে দেখা আতিয়ার। আয়েশার বিয়ের সময় এই সিস্টারের কাছ থেকেই বিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা আসল আর একশো করে সুদ টানতে হয়। জমিলাকে দেখেই আতিয়া বুঝে যায় কী চায় জমিলা।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ৩

 

জমিলা আপাকে এগিয়ে আসতে দেখে চোখ দিয়ে ইশারা করে আতিয়া। জমিলা দাঁড়িয়ে যায়। খাতায় নাম সাইন করে ঘড়ি দেখে আতিয়া। সাতটা পঞ্চাশ বাজে। ডিউটি শুরু হতে এখনো দশ মিনিট বাকি।

 

“আপা, চলেন ছাদে যাই। এখানে কথা বলতে পারবো না।”

 

“চল।”

 

ছাদের সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ব্যাগে হাত দেয় আতিয়া। ব্যাগে তিন হাজার আছে। গতকাল ডিউটি থেকে যাওয়ার সময় টাকাগুলো তুলে একটা টিস্যুতে পেঁচিয়ে নিয়েছিল। আজ এত সকালে টাকা তোলার সময় পাবে না বলে টাকা গতকাল তুলেছে। গত ছয় মাস ধরে একটু একটু করে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাচ্ছে। এই টাকা জমিলা আপার ধারের টাকা না। এই টাকা অন্য কাজের। ধারের বিশ হাজারের বারো হাজার আর সুদের বারোশত টাকা এই ছয়মাসে শোধ করা হয়েছে। বাকি টাকা আগামী চার মাসে নিয়ম করে দিয়ে দিবে।

 

জমিলা আপার আরেক পরিচয় তিনি সাংগঠনিক লোক। মানে বারো রকম কাজে আপা আছেন। ইউনিয়ন করেন, ইনচার্জ, আবার বিয়ে-শাদির ঘটকালিতেও আছেন। এই হাসপাতালের অনেকেরে বিয়ের পাকা কথাতে আপার হাত আছে। আতিয়ার জন্য এর আগের বারও পাত্র আপা ঠিক করেছিলেন। দুর্ভাগ্য বিয়ের আগেই ছেলে মারা যায়। লজ্জা, সংকোচ ভেঙে আবার আপার কাছেই বিয়ের জন্য পাত্র দেখে দিতে বলে আতিয়া। নিজের মাকে বলতে কেমন জানি লাগে। যে মা নিজেই বোঝে না যে মেয়ের একজন সঙ্গী দরকার, তাকে নিজ থেকে কী বলবে! 

 

হাসপাতালে আতিয়ার তেমন কোন বন্ধু বান্ধব নেই। কোন এক আজব কারণে সবাই আতিয়াকে এড়িয়ে চলে। যাদের সাথে সম্পর্ক ভালো, তারাও কেউ বন্ধু শ্রেণির নয়। তাদের সাথে দৈনন্দিন কথা শেয়ার করা যায়, কিন্তু মনের কথা নয়। এই যে আতিয়া বিয়ে করতে চায়, এই কথা শুনলে কিছু সহকর্মী মহিলা আর পুরুষ যে তামাশা করবে! আতিয়া তাই আপাকে অনুরোধ করেছে কাউকে কিছু না বলতে। রোজকার ঘন্টা আটেকের ডিউটিতে নানা রকম রোগীর ঝামেলা, রোগীর আত্মীয় স্বজন সামলানো, কর্মক্ষেত্রের পলিটিক্স, রোস্টার নিয়ে সমকর্মীর সাথে মান অভিমান কথা কাটাকাটি আর বাড়িতে গিয়ে মা, ভাই বোনের ঠান্ডা শীতল আচরণে আতিয়া অস্থির। মানুষ কত কথা বলে যে, নারী কামাই করলে তার আর সঙ্গী লাগে না। যে নারী মানসিক ভাবে শক্ত হয় তাদের জন্য একা একা জীবন পাড়ি দেওয়া কঠিন কিছু না। কিন্তু সব নারীর কঠিন মন কি পাথর হয়! কিছু কঠিন মন তো শুধু সময়ের আঘাতে আর পৃথিবীর শীতলতায় জমে যাওয়া মোম মাত্র। যে মোম কারও ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শে আবারও গলে যেতে অস্থির থাকে। কামাই করার জন্য বাড়তি একটা হাত পেতে নয়, একটু ভালোবাসার স্পর্শ পেতেই মরিয়া আতিয়া। ইদানীং শফিকের সাথে কাটানো সেই দুই বছর বড়ো পীড়া দেয়। বালিশে এপাশ ওপাশ করতে করতে শফিকের চওড়া বুকের ওমে কাটানো সেই রাতগুলো ভীষণ রকম মনে পড়ে। কী হতো যদি শফিক সেদিন মারা না যেত। কত সুন্দর একটা জীবন ছিল আতিয়ার। কোল জুড়ে হয়তো এতদিনে দুটো সন্তান থাকতো। চাল, ডাল তেল, নুনের হিসেবের বাইরে আর কোন চিন্তা থাকতো না। রাতে শফিক যখন দোকান থেকে ঘরে ফিরতো, ভাত বেড়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসতো। রাতে দু খিলি পান মুখে নিয়ে দু’জন বাচ্চাদের ভবিষ্যতের আলাপ করতো। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় চিন্তা করতো। কখনো একটু খুনসুটি হতো, কখনো আদর সোহাগ। এসব ভাবলে রাতগুলো বড়ো দীর্ঘ আর নিঃসঙ্গ মনে হয় আতিয়ার। যে শরীর একবার পুরুষের ছোঁয়া আর ভালোবাসা পেয়েছে, তার জন্য এসব ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়।

 

সময় ঘড়ি টিকটিক করে জানাচ্ছে আতিয়ার বয়স হয়ে যাচ্ছে। নিজের একটা সংসার, একটা মায়াবী পুতুল কোলে পেতে হলে এখন নিজেকেই সঙ্গীর খুঁজে নিতে হবে। আতিয়া তাই লজ্জা ভেঙে জমিলা আপার দারস্থ হয়। এই তিন হাজার টাকা আপার ফিস। পুরোটা না অবশ্য। দুই হাজার ফিস, আর এক হাজার টাকা খোনারের তাবিজের জন্য। জমিলা আপার বাড়ি নোয়াখালী অঞ্চলে। সেই অঞ্চলে যারা তাবিজ, পানি পড়া, জাদু টোনা কাটানোর জন্য বিভিন্ন উপায় হাতে নেন তাদের খোনার বলা হয়। জমিলা খালা আতিয়ার দোষ কাটানোর জন্য খোনারের কাছ থেকে তাবিজ এনে দিচ্ছেন। এই তাবিজের গুণে আতিয়ার মন্দ ভাগ্য কেটে যাবে! তবে স্বামীর দীর্ঘায়ু পেতে চাইলে আরও শক্তিশালী উপায় লাগবে। তারজন্য খরচ বেশি। সেই টাকাও আতিয়া জমাচ্ছে। আপাততঃ তাবিজ নিয়ে কপালের দোষ কাটুক! মানুষের মন বড়ো বিচিত্র জিনিস। যখন মন দুর্বল হয়ে যায়, তখন এমন তাবিজ কবজ, পানি পড়ার মতো জিনিসে শক্তি খুঁজে বেড়ায়। কুফরি, শিরক, অন্ধবিশ্বাস সবকিছুর উর্ধ্বে চলে যায়। না হলে আতিয়া অশিক্ষিত মেয়ে নয়। ডিগ্রি পাস করেছে, নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফ বিষয়ে আলাদা করে তিনবছর ডিপ্লোমা করেছে। কথাবার্তায় পরিষ্কার শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করে। পরিপূর্ণ রুচিশীল মহিলা মনে হওয়া আতিয়ার মনেও রয়েছে অন্ধবিশ্বাসের বসবাস।

 

“আতিয়া, আটটা বেজে গেলরে। দেরি করাইস না। সাত তালায় উঠতে আরও পাঁচ মিনিট লাগবো আমার।লিফটে যে ভীড়। তুই বললি সকালে টাকা নিয়া যাইতে, তাই সকাল সকাল আইসা হাজির হইছি।”

 

“আপা, ব্যাগের ভেতরের চেইনে টিস্যু দিয়ে পেঁচিয়ে  রাখছি টাকা। এমন তো হওয়ার কথা না। টিস্যু আছে, টাকা নাই।”

 

“চুরি হইছে?”

 

“কাল টাকা তুলে সোজা বাড়িতে গিয়েছি। তখনও টাকা ছিল। সকালে ব্যাগ সাবধানে কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে আসলাম।”

 

“চুরি খালি বাসে, রাস্তায় হয় নাকি রে। একসময় ঘরের বাস্তুসাপও কালসাপ হইয়া যায়। দুধ দেওয়া মালিকেরে দংশন করে। সকালে বাইর হওয়ার সময় টাকা গুইনা বাইর হইছস?”

 

“না। সময় পাই নাই। বাসা ভাড়া নিয়ে আম্মার সাথে লাগলো। বাসা ভাড়া, কারেন্ট বিল, আর বাজারের টাকাসহ পনেরো হাজার টাকা কী করছে জবাব দেয় না। এলোমেলো কথা কয়। আর তো আছে চোখের পানি। সবকথার শেষ কথা এই চোখের পানি। মায়ের চোখের এক এক ফোঁটা পানি নাকি একা একটা কবরের আজাব হবে দোজখে। আচ্ছা আপা সন্তানের চোখের পানির জন্য এমন কোন কিছু নাই। মাঝেমাঝে কিছু মানুষ যে সন্তানের চোখ দিয়ে পানি না রক্ত বাহির করে, তার কোন বিচার নাই।”

 

“থাক আতিয়া থাক। এসব কথা কইছ না। আল্লাহ নারাজ হইবো। মায়েরে নিয়া এমনে কইতে হয় না। হামিদ আলী চাচা আসলে চাচীরে বেশি তোলা তোলা রাখছিল। তখন টাকা পয়সা হাতে আছিল। ইউনিয়ন করতো, রাজনীতির বাড়তি পয়সা আছিল হাতে। রোগীদের কাছ থেকে ডেইলি বকশিস পাইতো। চাচীও খরচ কইরা অভ্যাস। এখন বুঝে না। মনে করে তুই চাইপ্পা চুইপ্পা টাকা দেস। তোর যে খালি ত্রিশ হাজার টাকা বেতন। এইটা বুঝে না।”

 

“তোমার কাছেও নালিশ করছে না? কবে ফোন দিছে?”

 

“এই তো এক মাস আগে। কইলো তুই হিসাব কইরা টাকা দেস। সেই টাকার আবার হিসাব নেস। থাক, বাদ দে। তোরে কইতে চাই নাই। মনে কষ্ট পাবি কইরা। আইজ কথায় কথায় মুখ থেইক্কা বাহির হইয়া গেল।”

 

“আপা, দশ হাজার বাসা ভাড়া। চারজন মানুষের খাওয়া খরচ হিসাব কইরা বিশ হাজার খরচ করি। আর দশ থেকে তোমার ধার শোধ দেই দুই হাজার একশো। সমিতিতে দেই এক হাজার। বাকি বোনের বেতন, আম্মার ঔষধ খরচ, আর বাস ভাড়া দিয়ে কী থাকে বলো? নিজের জন্য এতদিন একটা টাকা জমাই নাই। একটা ভালো জামা কিনি না ছয় মাসে একবার। কাজ করি, বেতন নিয়ে বাড়িতে যাই। কোন শখ নাই, কোন আহ্লাদ নাই। এরপরও যদি মানুষের কাছে গিয়ে গিয়ে এসব বলে তাহলে কই যাই। আল্লাহ আমার চোখের পানি শুকিয়ে ফেলছে। কাঁদতে জানলে এই জীবনের দুঃখে এক সাগর চোখের পানি হতো।”

 

“আমি যাই, ফোন আসতেছে ওয়ার্ড থেইক্কা।।নে তাবিজ রাখ। টাকা পরে দিস যা। দুধে ধুইয়া তাবিজটা কোমরে বাঁধবি, না হইলে গলার চেইনে দিবি। বালা মুসিবত কাটবো। যাই, মন খারাপ করিস না।”

 

হাতের মুঠোয় তাবিজটা নিয়ে এই একাকি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেয় আতিয়া। মানুষের সামনে নিজেকে বেশ শক্তিশালী দেখায়। অথচ একাকী হৃদয় তার আপনজনদের দেওয়া আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। চোখের কোল ঘেঁসে নেমে আসা পানির স্রোত ওড়নার আঁচল দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। কান্না গিলে পা বাড়ায়। মেট্রোন ফোন দিচ্ছে। এখনি ওয়ার্ডে যেতে হবে। সময় নেই। আজ বাসায় গিয়ে একটা বোঝাপড়া করতে হবে।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয় 

পর্ব ৪

 

সকালে যখন আতিয়ার ব্যাগ থেকে টাকাটা সরায়, আলোর তখন ভীষণ ভয় লাগছিল। কিন্তু কী করবে, রাতুলের জন্মদিন আগামীকাল। রাতুলের জন্য গিফট কিনতে হবে, কেক কিনতে হবে। ওর জন্মদিনে রাতুল কত বড়ো একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। দামি একটা আঙটি গিফট করেছে আড়ং থেকে। রাতুল অবশ্য জামা কিনে দিতে চেয়েছিল। আলোই দেয়নি। জামা লুকিয়ে রাখা যাবে না। কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। আঙটি লুকিয়ে রাখা সহজ। তাছাড়া আসল মুক্তা, রূপা এসব হুট করে বোঝা যায় না। বললেই হবে নিউমার্কেট থেকে কেনা!

 

আলো এইবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ষোল, সতেরো বছর বয়সী মেয়েদের কত রকম শখ থাকে। সাজগোছ, জামাকাপড়, ঘুরতে যাওয়া, বন্ধু বান্ধবের সাথে সিনেমা দেখা, আড্ডা দেওয়া। অথচ আলোর সেসব কিছু করার উপায় নেই।  সাত বছর আগে বাবা হামিদ আলী যখন মারা যায়, আলো তখন সবে ক্লাস ফোরে উঠেছে। বাবার মৃত্যুর পর প্রথমে বাসা পাল্টানো হলো। তারপর স্কুল। সবচেয়ে কম খরচে কোথায় পড়ালেখা করানো যায়, আলোর বড়ো আপা আতিয়া সেটাই খুঁজে বের করলো। ভালো জামা কেনা শুধু ঈদের জন্য বরাদ্দ হলো। জুতো এক ঈদে কিনলে,  অন্য ঈদে কেনা হয় না। চুড়ি, কানের দুল কোন কিছুই মন মতো কেনা হয় না। আলো একটু বড়ো হলে আতিয়া, আয়েশা আর আলো ঘুরেফিরে একই ভালো জামাগুলো পরেছে। তবে আতিয়া খুব গাঢ় রঙ পরে না। বিধবা আর বয়স হয়েছে বলে একটু হালকা রঙ পরে। আলোর আবার উজ্জ্বল রঙ পছন্দ। আয়েশারও তাই ছিল। কিন্তু বিয়ের পর যখন তখন আয়েশার কাপড়গুলো পরতে পারে না। আয়েশা শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় নিজের ভালো জামা, জুতো সব নিয়ে গিয়েছে। এত হিংসুক আয়েশা। খালি বাবার বাড়ি থেকে এটা সেটা বের করার তালে। কিন্তু এক পয়সা খরচ করতে রাজি না। আলো তাই আয়েশার চেয়ে আতিয়াকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তারপরও সেই বোনের ব্যাগ থেকে টাকা সরায়। না সরিয়েও উপায় নেই। স্কুলের বেতনের বাইরে হাত খরচ কিছু পায় না বললেই চলে। অথচ একটা ভালো ছেলে পটাতে হলেও টাকা লাগে। আয়েশা তো তিন বোনের ভেতর সবচেয়ে সুন্দর। তাই ঠিক প্রেম করে ছেলে ঝুটিয়ে নিয়েছে। টাকা পয়সার সমস্যা, বাবা নাই এগুলো নিয়ে আয়েশা আপার শ্বশুর বাড়ি গাইগুই করলেও মেনে নিয়েছে। কিন্তু আলো তো অত সুন্দর না। শ্যামলা রঙের মেয়ে। শুধু প্রেম দিয়ে কি ছেলে পাবে! মাঝেমাঝে রাতুলের জন্য একটু টুকটাক খরচ না করলে রাতুল তো মনে কষ্ট পাবে।।বিশেষ করে জন্মদিনে। রাতুলের বিভিন্ন বন্ধুর জন্মদিন যায়, আর রাতুল শোনায় কার গার্লফ্রেন্ড মোবাইল গিফট করেছে, কার গার্লফ্রেন্ড ব্রান্ডের পারফিউম গিফট করেছে!

রাতুল তো আর জানে না আলোর এসবের সামর্থ্য নেই।

 

রাতুলের সাথে আলোর পরিচয় ফেসবুকে। তারপর দেখা, আর প্রেম। ফেসবুকে আলোর ছবি দেখে আলোর লাইফস্টাইল নিয়ে কেউ ধারণাও করতে পারবে না। একটা কল্পনার স্বপ্নরাজ্য তা আলোর। তাই পরিবারের কাউকে নিজের ফেসবুকে রাখেনি। পরিবারের সাথে যে টুকটাক ছবি ফেসবুকে দেয়, সেগুলোও কোন অনুষ্ঠানে তোলা। ওদের প্রেম হয়েছে সবে সাত মাস। ডেটিং এ যায় লুকিয়ে। এখনো বান্ধবীদের সাথেও পরিচয় করায়নি রাতুলের। একবারে বিয়ে পর্যন্ত না যাওয়ার আগে করাবেও না। কেউ রাতুলকে কিছু বলে বিভ্রান্ত করুক, তা আলো চায় না। তাই তো রাতুলের জন্মদিনের জন্য টাকা জোগাড় করতে হন্যে হয়ে গিয়েছে। রোজই আপার ব্যাগ ঘাটছিল। কিন্তু একশো, দুইশোর বেশি আপা ব্যাগে কিছু রাখে না। এর ভেতরও কখনো দশ, কখনো বিশ করে সরিয়ে পাঁচশো টাকা হয়েছে। স্কুলের পরীক্ষা ফি এর কথা বুঝিয়ে মায়ের কাছ থেকে নিয়েছে পাঁচশো। আর আজ একদানে আপার ব্যাগ থেকে তিন হাজার। সত্যি বলতে এই তিন হাজার টাকা না নিলে কাল রাতুলকে মুখ দেখাতে পারতো না।

 

দেলোয়ারা বেগম চিন্তায় শেষ। খলিলকে এতোগুলা টাকা দিয়েছে শুনলে আতিয়া বাড়ি মাথায় তুলবে। মেজো মেয়ে আয়েশাকে ফোন দেয় দেলোয়ারা বেগম। 

 

“হ্যালো, আয়েশা। কেমন আছস? মায়ের কথা মনে পড়ে না। বিয়া হইছে বইল্লা বাপের বাড়ি ভুইল্লা যাবি?”

 

“আম্মা, ঢং কইরো না। এই কয়দিন আগে বাপের বাড়ি আসলাম বড়ো মুখ করে। কী হইলো? বাপ না থাকলে কি আর বাপের বাড়ি থাকে! বাপ না থাকলে শ্বশুর বাড়িতেও সম্মান থাকে না। আজ আমার আব্বা থাকলপ কয়টা টাকার জন্য এমনে কথা শুনতে হইতো না। তোমাদের জামাই কত কষ্ট পাইলো। আমার শাশুড়ি কত কথা শুনাইলো। এরপর কি যখন তখন বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বলা যায়। খোঁটা দিয়ে শেষ করবে শাশুড়ি। আর মেয়ে একটা তো আজীবনের জন্য তোমার কাঁন্ধে আছে। আরেকটাও চলে আসার কথা ভাইবো না। তওবা করো।”

 

“সেসময় হাতে টাকা আছিল না। তাই দিতে পারি নাই।কিন্তু দুইদিন আগেই তো খলিল বাসায় আসলে ওরে টাকা দিলাম। নগদ বিশ হাজার, স্বর্নের তিন আনার কানের দুল। সব মিলায়ে প্রায় ৪০ হাজারের মতো। তোরে কয় নাই?”

 

“না তো। আমাকে তো কিছু বলে নাই। আচ্ছা রাতে আসলে জিজ্ঞেস করবো নে। ধন্যবাদ আম্মা। তুমি জানো না, কত কথা শুনলাম এই জন্য।”

 

“এত কথা কেন শুনবি? প্রেম করে বিয়ে কইরা আবার কথা কেন শুনাইবো? প্রেম করার সময়ই তো জানতো তোর বাপ নাই। যখন তখন টাকা চাইলে দিতে পারবো না। এখব শোন। খলিলের কাজ হইয়া গেলে দশ হাজার আমারে দিয়া যাইতে কইছ। আইজ না হোক এই সপ্তাহে দিয়া গেলে হইবো।”

 

“কী বলো আম্মা। টাকা নিতে না নিতেই ও ফেরত দিবে কোত্থেকে? সময় লাগবে তো।”

 

“সব দেওন লাগবো না। খালি দশ হাজার। বাসা ভাড়ার টাকা। আতিয়া জানে না খলিলরে টাকা দিছি। বাড়ি ওয়ালা আইলে বাসা ভাড়া দেওন লাগবো।”

 

“তোমার বড়ো মাইয়া কিন্তু এখনি বদলে গেছে আম্মা। অথচ আব্বা মারা যাওয়ার পর যখন এই চাকরি তারে দিছে, তখন এই জন্য দিছে যে সে আমাদের দায়িত্ব নিব। তার পিছনে তোমাদের কম যায় নাই। একবার পড়ালেখা করিয়ে বিয়া দিলা। টাকা নগদ দিছে আব্বা এক লাখ। গয়না দিছে তিন ভরি। ফার্নিচার দিছে। জামাই খাইয়া যখন ফিরে আসলো, আবার প্রাইভেটে নার্সিং এ পড়াইলো আব্বা। ওর চাকরির জন্য জায়গায় জায়গায় তদবির করলো। টাকা দিলো। ওর জন্য যা করছো তুমি আর আব্বা, কলিজা কাইট্টা দিলেও তো তা শোধ হইবো না। অথচ দুইদিন চাকরি করতে না করতে সে ভাব নেয় কত। বাসা তার ইনকামে চলে এই ভাব নেওয়ার আগে ভাবতে পারে না আজ সে চাকরি করে কার জায়গায়! কার সাহায্যে! ওর মতো এত টাকা আর কারও পিছনে খরচ হয় নাই। আমার বিয়াতে চল্লিশ হাজার টাকা দিতে ওর কলিজা ছিঁড়ে গেল। আমি তো সব বুঝছি। হিংসা করে আমাকে। খলিলকেও বলছি আপা থাকা অবস্থায় বাসায় না যাইতে। শেষে আমার সংসারে নজর দিলে আমার সংসারও বরবাদ হয়ে যাইবো।”

 

“আল্লাহ মাফ করুক। আসলে আমিও বুঝি জোয়ান মাইয়া। বাইচ্চা কাইচ্চা নাই। আবার ঘর সংসার করতে চায়। কিন্তু আমরা তো ওর বিয়ার চেষ্টা কম করি নাই। ওর পোড়া কপাল। বিয়া দেওনের আগে পোলা গেল মইরা। একবার জামাই মরছে, পেটে বাচ্চা মরছে। আরেকবার বিয়া ঠিক করার পর সুস্থ পোলা হার্ট অ্যাটাক করছে। এরপর তো আর কেউ বিয়ার জন্য আগাইলোই না। কিন্তু ও ভাবে আমরা ওর কামাই খাইতে চাই, তাই ওর বিয়া দেই নাই। মেয়েটার মইধ্যে এই শোকর নাই যে আমরা পরিবার ওরে জায়গা না দিলে কই যাইতো। এখনো মাথাত বিয়ার ভুত আছে। তোর আব্বার হাসপাতালের জমিলা সিস্টাররে ধরছে একটা পোলা ঠিক করে দিতে। চিন্তা কর। এইটা চিন্তা করে না একটা ভাই এখনো দাঁড়ায় নাই। ছোটো বোনের বিয়া দিতে হইবো। আমার কথা তো বাদই দিলাম।”

 

“এখনো বিয়া করার শখ যাই নাই! আমার বিয়া দেইখা নতুন করে ভুত মাথায় উঠছে আমি বুঝছি। আম্মা, তুমি যাই কও আমি খলিলরে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাব না। জামাই দাওয়াত দিলে এমন দিনে দিবা, যেদিন আপা নাইট ডিউটিতে থাকে। আপাকে বইলো এই বয়সে যে তার অতীত জেনেও তাকে বিয়া করতে চাইবো, সে আসবো তার কামাই খাইতে। আর এমন ব্যাটা বাড়িতে ঢুকলে তোমাদের কপাল পুড়বো কইলাম। ভালোয় ভালোয় আলোর বিয়া আগে দাও। আর পড়ায়ে কাজ নাই। এসএসসি দিলেই বিয়ার চেষ্টা লাগাও।”

 

আয়েশার ফোন রেখে দেলোয়ারা বেগম টাকার চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য চিন্তা করতে বসেন। যত দিন যাচ্ছে,  বড়ো মেয়ে আতিয়ার সাথে ওনার সম্পর্ক জটিল হয়ে যাচ্ছে। কেন জানি স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়ের উপর মায়া আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলেছেন। ভাবতে চান না। তবু আর দশজনের জথায় ওনারও মনে হয় আতিয়া অপয়া। আতিয়া যতদিন ছিল না, ওনার ঘরে সুখ সমৃদ্ধি ছিল। আতিয়া ফিরে এসে একে একে সব গিলে নিয়েছে। যে কথাটা একসময় আতিয়ার শাশুড়ি বলেছিলেন। সেই কথাটা এখন দেলোয়ারা বেগমেরও মনে হয়। তবে চিন্তা হলো ভাড়ার টাকা কী করবেন। আপাততঃ বাড়ি ওয়ালার কাছে এক সপ্তাহের সময় নিয়েছেন। খলিল এর ভেতর দিয়ে দিলেই হলো। বাজারটা না হয় এই সপ্তাহে শাক সবজি দিয়ে চালাবেন। আগামী সপ্তাহে আতিয়া আবার বাজারের জন্য দুই হাজার টাকা দিবে। মাছ, মুরগী কিছু তখন কেনা যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি নিজেও শুধু শাক ভাত খেতে পারেন না। সবসময় ভালো রেঁধে, ভালো খেয়ে অভ্যাস। এখন এত পাই পাই হিসেব করে খেতে ওনার কষ্ট হয়। বিরক্ত মুখে রান্না চড়ান। আজ বুটের এর ডাল দিয়ে পাট শাক রান্না করবেন। সাথে মরিচ পোড়া। এই দিয়ে দুই বেলা চলতে হবে। একটু সকালের জন্যও রাখতে হবে। আতিয়া ডিউটিতে যাবার সময় নিয়ে যাবে। মনে মনে তিনিও ঠিক করেন, আতিয়া এসে আবার টাকা পয়সা নিয়ে কিছু বললে, তিনিও ছেড়ে দিবেন না। মেয়েকে মনে করিয়ে দিতে হবে,কার জোরে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। বারবার কান্নাকাটি করে লড়াই জিতবেন না। এবার মুখে মুখেই উচিত জবাব দিবেন। 

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ৫

 

আতিকার আজ কাজে মন বসেনি। মনে মনে যত দোয়া পড়া যায় পড়েছে। ব্যাগের সবকিছু উল্টেপাল্টে দেখেছে বহুবার। কাজে ভুল হয়েছে। সহকর্মীর সাথে ঝগড়া হয়েছে। নিজের হতাশা রাগ ঝেড়ে ফেলেছে রোগীর লোকের উপর। এক রোগীর স্বজন, বার বার জিজ্ঞেস করছিল”ডাক্তার কখন আসবে?”

আতিয়া প্রথমে একবার বলছে, “রাউন্ড শুরু হলে আসবেন।”

 

এরপরও যখন কয়েকবার আসলেন, তখন একটা ঝাড়ি দিয়ে দিলো। রোগীর স্বজন তো রেগে গেলেন। বলেই ফেললেন, “এমন ভাব করছেন যেন বিনা পয়সায় হাসপাতালে আছি। প্রাইভেট হাসপাতালে এত টাকা দিয়ে যদি রাগ দেখতে হয় তাহলে তো হবে না।”

 

সেই রোগীর স্বজন আবার প্রভাবশালী ছিলেন। তিনি ঘটনা অফিসে জানালেন। আতিয়াকে অফিসে ডেকে নিয়ে সাবধান হতে বলা হলো। সেই স্বজনের কাছে ক্ষমাও চাইতে হলো। এমনিতে নিরীহ রোগী আর তাদের লোকজনকে কতদিন কত বিষয়ে রেগে কথা বলেছে কিছু হয়নি। আর আজ সামান্য বিষয়ে অফিস পর্যন্ত তলব হবে ভাবতে পারেনি আতিয়া। আতিয়া শারীরিক অসুস্থতার বাহানায় এই যাত্রায় অফিস থেকে সহজে ছাড়া পেল।

 

আশিক আজ প্রথম বেতন পেল। গত একমাস বেশ খাটুনি গিয়েছে। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত, টানা দশ ঘন্টার ডিউটি। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতো। ভাগ্য ভালো বসুন্ধরা থেকে কাঁঠাল বাগানের দূরত্ব বেশি নয়। বাসায় কাউকে বলেনি এই কাজের কথা। আগে নিজে করে দেখতে চেয়েছে কাজটা করতে কেমন লাগে। একটা শপে, শপ এসিস্ট্যান্ট এর কাজ নিয়েছে আশিক। অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখন এই কাজ করছে। আগের মতো ‘দোকানে কাজ করা ছেলে’ বলে মনে হওয়া দিন নেই। ব্রান্ডের শপগুলোয় তো রীতিমতো স্মার্ট, শুদ্ধ কথা বলতে পারে, শিক্ষিত এমন ছেলেমেয়েদের রিক্রুট করা হয়। আশিকের অনার্স শেষ হয়েছে। চাকরির চেষ্টাও করছে। বড়ো বোন আতিয়া চেয়েছিল হসপিটালে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু পিয়নের কাজ আশিক করতে পারবে না৷ প্রাইমারি নিয়োগ পরীক্ষার রিটেন দিলো। ভাইবার পর চাকরিটা যদি হয়ে যায়, সবকিছু অনেক সহজ হবে। কিন্তু ঢাকা শহরে প্রাইমারি নিয়োগ হওয়া কঠিন। আশিক তাই বাবার দেশ নোয়াখালী দিয়েছে জেলা হিসেবে। চাকরি হলে নোয়াখালী চলে যেতে হবে। ওখানে সেই ছোটোবেলায় যেত। এখন কারও সাথে যোগাযোগও নেই। মায়ের বাড়ি ঢাকাতেই। মানে সেই ছোটোবেলায় নানা নানী সব ছেড়ে ঢাকার পাকাপোক্ত বাসিন্দা হয়েছেন। গ্রামে নানার বাড়ি বলতে এখন কিছু নেই। 

 

এই চাকরিটা আশিক বাধ্য হয়ে নিয়েছে। হাত খরচ চালানো মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। বড়ো বোন আতিয়ার আয়ে সংসার চলছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কোন গতি নেই। আতিয়া বাবা হামিদ আলীর মতো চালু নয়। বাড়তি পয়সা রোজগারের পথ ওর জানা নেই। বাড়তি পয়সা আয়ের নানা পথ জানতে হয়, শুধু চাকরির পয়সার উপর নির্ভর করে চলা যায় না এই শহরে। এই বিষয়টা আশিক বুঝলেও মা দেলোয়ারা বেগম যে বোঝেন না তা জানে আশিক। মা ভাবেন একই হাসপাতালে কাজ করে স্বামী ভালো চালাতে পারলে, মেয়ে কেন পারে না! বোনের সাথে খুব বেশি সখ্যতা নেই আশিকের। হয়তো বয়সের পার্থক্যের জন্য! তবে বোনের উপর অযথা সবার অভিমান ওকে পোড়ায়। ঘরোয়া কুট কাঁচালি ওর ভালো লাগে না বলে, মা বোনদের ঝামেলা ও এড়িয়ে যায়। তবে ওর সাথে কেউ আতিয়ার বদনাম করতে আসলে ও আতিয়ার দিকটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে। আতিয়ার সাথে ভাইবোন সবারই বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি। আতিয়ার জন্মের পর আরও দুটো ছেলে হয়ে মারা যায় দেলোয়ারা বেগমের। প্রায় দশ বছর পর আশিকের জন্ম হয়। এরপর আয়েশা আর আলো আসে। আশিক তাই দেলোয়ারা বেগমের খুবই আদরের ছেলে। এই যে চাকরিবাকরি হচ্ছে না, তাতেও দেলোয়ারা বেগম কঠিন কোন কথা শোনান না। দুপুরে আশিক খেতে গেলে যা থাকে, তাই দিয়ে গুছিয়ে আদর করে খাওয়ায়। ভালো খাওয়াতে পারছে না বলে আফসোস করে। মায়ের এই মমতাময়ী রূপের জন্য আশিক চাইলেও মাকে কিছু বলতে পারে না। তবে মাঝেমাঝে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করে। 

 

আজ বেতনের ষোল হাজার টাকা হাতে নিয়ে মনটা ভালো হয়ে যায়। যদিও দশঘন্টা কাজ করে ষোল হাজার বেতন কিছু না। তবুও বেকার ছেলের জন্য  অনেক কিছু। তাছাড়া এই দোকানে কাজ করে আশিকের ভালো লেগেছে। রকমারি জিনিসের দোকান। পারফিউম, কসমেটিকস, মেয়েদের কানের দুল,চুলের ব্যান্ড সহ সাজসজ্জার জিনিস আছে। একপাশে বাচ্চাদের জামাকাপড় আর খেলনাও রাখা। আশিকের কাজ দোকানে আসা লোকজনকে জিনিস দেখানো। আশিকের সাথে আরেকজন কাজ করে। দোকানের মালিক মিসবাহ শরীফ, আশিকের মিসবাহ ভাই বেশ ভালো মানুষ। ক্যাশের সামনে বসে থাকেন। কর্মচারী কম, ছোটভাই হিসেবেই দেখেন। আশিকের বন্ধু হাসানের বড়ো ভাই মিসবাহ ভাই। হাসানের মাধ্যমেই এই দোকানে আসা, কাজ নেওয়া। যদিও শুরুতে লজ্জা লাগছিল। বন্ধুর ভাই মালিক মানে বন্ধুও মালিক। হঠাৎ করে বড়ো ভাই আর বন্ধুর সাথে মালিক ভৃত্যের সম্পর্কে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। কাজটা করবে কী করবে না দ্বিধায় ছিল। দ্বিধা কাটিয়েছেন মিসবাহ ভাই। এত ভালো ব্যবহার করেন যে আশিকের অস্বস্তি চলে গিয়েছে।  টাকাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে আশিক। এই টাকায় কী কী করা যায় ভেবে ফেলে। আট হাজার মায়ের হাতে দিবে। মা খুশি হবে অনেক। দুই হাজার আতিয়াকে। আলো আর আয়েশাকে এক হাজার করে দিবে। ওরা ওদের পছন্দে কিছু কিনবে। যদিও আয়েশা এক এ মানবে বলে মনে হয় না। ওর চাওয়ার অভ্যাসটা বেশি। মনে করে হেসে দেয় আশিক। আর চার হাজার টাকা নিজের কাছে রাখবে। হাত খরচ।

 

আতিয়ার দিনটাই আজ খারাপ ছিল। তীব্র রোদে মেইনরোড থেকে বাসায় হেঁটে এসে আরও তেতে যায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বিরিয়ানির গন্ধ নাকে ধাক্কা দেয়। বাজার হয়নি। বাসায় বিরিয়ানি আসলো কই থেকে! আতিয়া দেখে সবাই খেতে বসেছে। আজ ওর ওভারটাইম ছিল। একবারে রাত আটটায় আসার কথা। কিন্তু মন ভালো ছিল বা বলে অসুস্থতার কথা জানিয়ে শেষ মুহূর্তে ডিউটি পাল্টে নিয়েছে অন্য সহকর্মীর সাথে। যদিও এরজন্য আরেকদিন ঐ সহকর্মীর ওভারটাইম করে দিতে হবে। হাসপাতালে আপাততঃ সিস্টার সংকট চলছে। সিস্টারদের তাই ঘুরেফিরে ওভারটাইম করতে হচ্ছে। 

 

আতিয়াকে এই মুহূর্তে আশা করেনি দেলোয়ারা বেগম। মেয়ে আয়েশা আর জামাই খলিলকে ফোনে ডেকে এনেছেন। আশিক প্রথম বেতনের টাকা এনে মায়ের হাতে দিয়েছে। দিয়ে বলেছে “আম্মা, এই আট হাজার আপনার। আপনার যা মন চায় খরচ কইরেন।” 

 

এই এক কথায় দেলোয়ারা বেগম আপ্লূত হয়ে গিয়েছেন। স্বামী হামিদ আলী বেঁচে থাকতে হঠাৎ হঠাৎ এভাবে এক দুই হাজার টাকা এনে হাতে দিতেন। আর বলতেন নিজের মন মতো কিছু খরচ করতে।বহুদিন পর কেউ এভাবে দিলো। তাও আবার আট হাজার! তিনি ঠিক করলেন আজ সবাইকে নিয়ে বিরিয়ানি খাবেন। আতিয়া যেহেতু রাতে আসবে, আতিয়ার বিরিয়ানি তাই তুলে রাখবেন। আলো বলে গিয়েছিল এসএসসির আগে স্কুলে ছুটির পর বাড়তি কোচিং করাচ্ছে সবাইকে। সেটাও ফ্রি। তাই কোচিং শেষে আসতে দেরি হবে। আলোও তাই বাসায় নেই।ওর বিরিয়ানিও তুলে রাখতে হবে। আয়েশা, খলিলকে নিয়ে আতিয়া থাকা অবস্থায় রাতে বাসায় আসবে না। তাই এই দুপুরেই তাদের জরুরি ভাবে আসতে বললেন। আশিক নিজে গিয়ে সবার জন্য কাচ্চি বিরিয়ানি আর সেভেন আপ নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে আমোদ করে বসতে না বসতেই আতিয়ার আগমন। আয়েশা মায়ের দিকে তাকায়। দেলোয়ারা বেগম চোখের ইশারা করেন। সবই খেয়াল করে আতিয়া। দেলোয়ারা বেগম বলেন,

 

“তুই না রাতে আসবি বলে গেলি। তাই তোকে ছাড়া বসে গেলাম। দুপুরে আসবি যে একটা ফোন দিয়ে জানাবি না! যা মুখ হাত ধুয়ে আয়। তোর জন্যও বিরিয়ানি আছে। আমি সবার জন্য আনাইছি বিরিয়ানি।”

 

“তুমি আনাইছ! টাকা কই পাইলা আম্মা? আমার এত কষ্টের টাকা বাসা ভাড়া আর বাজারের জন্য দিলাম। সেই টাকা তুমি কী করছো সকালে তার হদিস দিতে পারো নাই। অথচ আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা দিয়া তোমরা আমার আড়ালে আনন্দ উত্সব করো! আমাকে বললা সমিতি থেকে টাকা তুলে বাসা ভাড়া দিতে। অথচ  এখানে লুকিয়ে বিরিয়ানি, সেভেন আপ খাইতেছ। ভাবছো আমার তো ওভারটাইম চলে। আমি তো আাসায় আসবো না। সত্যি তোমাদের দেখলে জোঁকও লজ্জা পাবে আম্মা। এমনে একটা মানুষের  রক্ত চুষে জোঁকও খায় না। ভাড়ার টাকা গায়েব করে সুখ হয় নাই যে ব্যাগেও হাত দিতে হইলো? না বইলা ব্যাগ থেকে টাকা নেওয়াকে চুরি বলে জানো তো?”

 

“তুই এইভাবে কথা বলতেছিস ক্যান? আমি তোর ব্যাগ থেইক্কা টাকা নিছি? ঐ কয় টাকা নিছি তোর ব্যাগ থেইক্কা? কত লাখ টাকা রাখছোস তোর ব্যাগে? শুনছোস আশিক? তুই না খালি বোনের হইয়া আমারে বুঝাস। আমি যেন মাথা ঠান্ডা রাখি। দেখ তোর বইনের কথা। আমি বলে টাকা চুরি করছি। ঐ আতিয়া টাকা খালি তোর একার আছে? এই বিরিয়ানির টাকা আমার ছেলে দিছে।”

 

“আম্মা, আমি তোমারে চোর বলি নাই। কিন্তু আমার ব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা চুরি গেছে। কেউ না কেউ টাকা না নিলে টাকা তো উড়ে যায় নাই। প্রথমে আমার গয়না তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে আয়েশাকে দিলা। তোমার গলায় চেইন বানালা। বাড়ি ভাড়ার পনেরো হাজার কাকে দিছ তুমি জানো। আমি তো একটা মানুষ। তোমরা আমাকে এই ভাবে ব্যবহার করো।”

 

“আপা, আমরা কেউ তোর টাকা নেই নাই। আর তোর কষ্ট হয় আমি বুঝি। কিন্তু তুই যেটা বলছিস, খুব খারাপ কথা বলতেছিস। বাসা ভাড়ার বিষয় হলে আমরা সমাধান করবো। আম্মা, তোমকে যে আট হাজার দিলাম সেখানে আর কত আছে? সাত হাজার আছে না? আমাকে দাও, আমি আর তিন হাজার মিলিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। তারপরও আপা তুই আমাদের আর চোর বানাইস না।”

 

আতিয়া অবাক মুখে তাকিয়ে থাকে। একমুহূর্তের জন্য বোঝে না, ঠিক কী হচ্ছে। সে কী আসলেই খুব বেশি বলে ফেলেছে!

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ৬

 

(সাতদিনের লম্বা গ্যাপের জন্য দুঃখিত)

 

“আপা আসেন আসেন। কী দেখবেন আপা?” দোকানের ছেলেটা এগিয়ে যায়, ক্যাশে বসে থাকা লোকটার ইশারায়।

 

“না কিছু দেখবো না। একজনের কাছে এসেছি। আশিক কি এই দোকানে কাজ করে?”

 

“জ্বি। আপনের কী হয়?”

 

“আমার ছোটো ভাই।”

 

“আসসালামুয়ালাইকুম আপা। এইদিকে আসেন। আমি মিসবাহ। এই দোকান আমাদের।” বিল কাউন্টারের সামনে থেকে আতিয়াকে ডাক দেয় মিসবাহ।

 

“ওয়ালইকুম সালাম। না আসলে আশিককের সাথে একটু কথা বলতে আসলাম।”

 

“সমস্যা নাই বসেন। ও তো বাসায় খেতে গিয়েছিল। খাওয়া শেষে আমাদের দোকানের কিছু মালামাল নিয়ে আসার কথা। চলে আসবে এখুনি। আপনি বসেন।”

 

মিসবাহ দোকানের অন্য ছেলেটাকে ইশারায় কিছু আনতে বলে। আতিয়া মানা করে ওঠে,

 

“না না কিছু লাগবে না। কিছু খাব না। আমি ডিউটি থেকে সরাসরি এখানে আসলাম। বাসায় গেলে হয়তো আশিককে পেতাম না। হয়তো খেয়ে বের হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে। সেজন্য এখানে আসা।”

 

“কোন বিপদ আপদ হয়নি তো? দোকানে চলে আসতে হলো, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না! ফোন দিতে পারতেন তো। কিছু মনে করবেন না। সমস্যা থাকলে আমাকে খুলে বলেন। দেখি কী করতে পারি।”

 

“না সেই রকম কিছু না। আসলে বিষয়টা পারিবারিক। বাসায় কথা বলা সহজ হবে না ভেবে দোকানে আসলাম। ফোনে বলার চেয়ে সামনাসামনি কথা বলা ভালো মনে হলো।

 

আতিয়া অনেক অস্বস্তি নিয়েই দোকানে এসেছে। সেদিন বিরিয়ানির টাকা নিয়ে জবাবদিহি করে সে নিজেই যেন সবার কাছে খারাপ হয়ে গিয়েছে। আয়েশার স্বামী খলিল খাওয়া রেখে উঠে গিয়েছিল। আয়েশাও বোনকে দু’চারটা কথা শুনিয়ে দিয়ে খলিলের সাথে চলে গিয়েছে। মা দেলোয়ারা বেগম তো মৃত স্বামীকে ডেকে ডেকে কান্নাকাটি করে মেয়েকে একগাদা অভিশাপ দিলেন। আশিকও খায়নি। আতিয়া এত হতভম্ব হয়েছে যেন সমস্ত অপরাধ তার। টাকা হারিয়েছে তার দোষ। টাকা হারানোর কথা বাসায় বলেছে সেটাও তার দোষ। কেউ খেতে পারেনি সেটাও তার দোষ। তারচেয়েও খারাপ হলো রাতের বেলা যখন আয়েশা ফোন করে দেলোয়ার বেগমকে বললেন খলিলের থেকে থেকে বমি হচ্ছে। আতিয়া নাকি খলিলের খাওয়ায় নজর দিয়েছে! 

 

“আম্মা, এত গরমে বিরিয়ানি খেয়েছে। গরমে হয়তো বিরিয়ানি টকে গিয়েছে। তাই ফুড পয়জনিং হইছে। বমি হচ্ছে সেজন্যে। বমি, পেট খারাপ বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য হইছে, কারও নজরে না। আয়েশা লেখাপড়ায় তো গোল্লা আছিল। তাই সহজ কথাও মাথায় ঢুকে না।”

 

“তোর পায়ে পড়ি আতিয়া। আর কারও জীবন খাইছ না। তোর জামাই, বাইচ্চা, বাপ সব খাইছস। ভাই-বোনগুলারে আর খাইচ না। আয়েশার সংসারে অশান্তি তোর লাইগ্গা।”

 

“আমার জন্যে আয়েশার সংসারে অশান্তি! আমি আয়েশার সংসারে কী করছি? বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কোনদিন ওর শ্বশুরবাড়িতে পর্যন্ত যাই নাই। একটা কথা বললেই হইলো!”

 

তারপরও কথা কাটাকাটি চলে। দেলোয়রা বেগম আতিয়ার সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছেন। আতিয়াও আর মান ভাঙাতে যায়নি। বাসা ভাড়া আশিক দিয়ে দিয়েছে। আর বাজারের জন্য দিয়েছে দুই হাজার। আতিয়া মানা করেনি। কেননা এমুহূর্তে বারো হাজার বাড়তি খারচ সে করবে না। ধারের সুদ টানা অনেক কষ্ট। কিন্তু এই বারো হাজারের জন্য বারো ভুতের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। বাসার সবাই এমন ভাব করছে যেন আতিয়া এতদিন কিছুই করেনি। মায়ের স্বভাবের সাথে আতিয়া পরিচিত। তাই কিছু মনে করছে না। কিন্তু নিজে মনে মনে ঠিক করেছে আশিকের সাথে কথা বলবে। প্রথম আয় করে সবার জন্য কিছু করতে চাইলো। আর সব এভাবে নষ্ট হলো। বাসায় তো কথা বলতে পারে না সহজ ভাবে। সুযোগও পায় না। তাই দোকানে আসা। সামনাসামনি দুটো কথা বলবে।

 

“জুস নেন। এই যে। আপনার নাম তো জানি না?”

 

“আতিয়া আমার নাম। আপনি আবার জুস আনালেন কেন?”

 

মিসবাহ একটা জুসের গ্লাস এগিয়ে রেখেছেন। আতিয়া আসলেই ক্লান্ত। ডিউটি শেষে বাসে করে কারওয়ান বাজার সিগন্যালে নেমে এপথটুকু হেঁটে আসতেই ঘেমে-নেয়ে গিয়েছে। টিস্যু নেই। ওড়নার আঁচল দিয়েই ঘাম মুছছিল আর ভাবছিল। মিসবাহ খেলায় করেছেন বলেই হয়তো চায়ের বদলে জুস আনিয়েছে। দোকানের একজন কর্মচারীর বোনের জন্য যে দামী জুস আনাতে পারে, সে লোক নিঃসন্দেহে ভদ্রলোক। এই জুসগুলোর দাম আতিয়া জানে, গ্লাস প্রতি একশো ষাট থেকে একশো আশি। আগে বসুন্ধরা আসলে কেনাকাটা করার চেয়ে এসব হাবিজাবি খাওয়ার শখ ছিল বেশি। এখন বসুন্ধরা আসে না বছর হলো। মনের সব রঙ যেন তার মতোই মলিন হয়ে গিয়েছে!

জুস মুখে দিয়ে আতিয়ার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। কোন ফলের জুস বুঝতে পারছে না। তবে বেশ লাগছে।

 

“চাকরি করেন মনে হয়। কোথায় কাজ করেন?”

 

“আমি মিলেনিয়াম হাসপাতালে আছি। নার্সিং পেশায় আছি।”

 

“ভালো ভালো। মানুষের সেবা করা পূণ্যের কাজ। অনেক পরিশ্রমের পেশা আপনাদের। আমার আব্বাকে নিয়ে দশদিন হাসপাতালে ছিলাম ওয়ার্ডে। তখন কাছ থেকে খেয়াল করলাম যে গণ ওয়ার্ডে এত রোগী। আপনারা ঠিকমতো বসে পানি খাওয়ারও সময় পান না।”

 

আতিয়ার মন ভালো হয়ে যায়। হাসপাতালে কাজ করে শুনলেই আগে মানুষ নেগেটিভ কথা বলে। কে কবে কোথায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে হেনস্তা হলেন তার বয়ান থাকে। আর ডাক্তার, সিস্টারদের ব্যবহার নিয়ে তো সমালোচনা কখনোই শেষ হয় না। কথা সব ভুল তা নয়। বরং সত্যি সেবাদানকারী পেশায় সবাইকে আরও সহনশীল হতে হবে। আতিয়া নিজেও ব্যক্তিগত হতাশা রোগীর লোকজনের উপর ঝেড়ে ফেলে।

 

“ভাই। আমি উঠি। আশিক আসতে মনে হয় দেরি হবে। আপনার সময় নষ্ট করলাম। বাসায় যাব।”

 

“আর কিছুক্ষণ বসতে পারেন। আমাদের সমস্যা নেই। দুপুরে এই সময় কাস্টোমার থাকে না। লাঞ্চের সময় তো। চারটা থেকে আবার লোকজন হয়। আপনার বাসা কই?”

 

“আমাদের বাসা কাঁঠালবাগানে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। গলির ভেতরে।”

 

“আচ্ছা। তাহলে তো মায়ের বাসার কাছাকাছি থাকেন। ভালো ভালো।”

 

“আমি মায়ের সাথেই থাকি। আমার স্বামী মারা গিয়েছেন। আমি বিধবা।”

 

“আমি দুঃখিত। আসলে বুঝে বলিনি।”

 

মিসবাহ বিব্রত হয়ে যায়। আসলে এই জন্য হুটহাট কথা বলা ঠিক না।

 

“না কোন সমস্যা নাই। আপনি তো আর জানেন না। আচ্ছা যাই। শুনেন আশিক এলে বলার দরকার নাই আমি এসেছিলাম। আবার চিন্তা করবে শুধু শুধু। রাতে বাসায় গেলে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।”

 

আতিয়া বের হয়ে যায়। কী মনে করে মিসবাহও দু মিনিট পর দোকান থেকে বের হয়ে দূর থেকে আতিয়াকে লক্ষ্য করে। আতিয়ার কালো বোরখার সাথে কমলা ওড়না পেঁচিয়ে পড়েছে। উজ্জ্বল কমলা রঙ তাই দূর থেকে নজর কাড়ে। রাস্তায় নেমে রাস্তা পার হয় আতিয়া। মিসবাহও একটু দূরত্ব রেখে পার হয়।

 

আতিয়া রিকশার সামনে গিয়ে দরদাম করে। দাম বনে না। আর কোন রিকশাকে জিজ্ঞেস না করে হাঁটতে শুরু করে। মিসবাহর খুব ইচ্ছে করে একটা রিকশা ডেকে আতিয়াকে উঠিয়ে দিয়ে বলে, “ভাড়াটা আমি দেই প্লিজ। আপনি বাসায় যান।”

 

কিন্তু লোকলজ্জায় কত কিছুই আমাদের বলা হয় না। 

 

আশিক ফিরে প্রায় রাত দশটায়। ঐ দিনের ঘটনার পর আশিক একটু রাত করেই বাসায় আসতো। আতিয়া ক্লান্ত থাকে, তাই রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আশিক বাসায় এসে খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। সকালে আতিয়া যখন ডিউটিতে যায় তখন ঘুমিয়ে থাকে। আতিয়া কাজে যাওয়ার আরও বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে নাস্তা করে দোকানে চলে যায়। আতিয়া তাই কথা বলারই সুযোগ পায় না। আজ আশিক তাড়াতাড়িই আসলো। আতিয়াও আজ বসে ছিল। রাত বেশি হলেও আশিকের সাথে কথা বলেই ঘুমাবে ঠিক করেছিল।

 

” আশিক, তোর সাথে কথা ছিল।”

 

“আমারও। তুই মিসবাহ ভাইকে চিনিস আপা?”

 

“তোর দোকানের মালিক? না আজই দেখা হলো। তোর খোঁজে গিয়েছিলাম। ওনাকে বললাম আমার কথা না বলতে। আমি হঠাৎ দোকানে গিয়েছি শুনলে তুই চিন্তা করবি।”

 

“আপা, মিসবাহ ভাই তোকে বিয়ে করতে চায়। বিয়ে করবি?”

 

আতিয়ার মুখে কথা সরে না।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ৭

 

“আমাকে কে কী করতে চায়? বিয়ে! বিয়ের কথা তিনি তোকে বলেছেন? ওনার সাথে দেখা হলো, কথা হলো আজই প্রথম। তাও মিনিট পনেরো বিশ মিনিটের জন্য। এর মাঝে তিনি কি দেখে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন? তাছাড়া ওনার এখনো বিয়ে হয়নি? ওনার তো বয়স হয়েছে, সামর্থ্যও আছে, ব্যবসায়ী মানুষ। আমি তো ওনাকে সংসারী লোক ভেবেছি। আমি শুনেছি তিনি দোকানের আরেকটা ছেলেকে বলছিলেন মেয়েকে কোচিং থেকে আনতে যাবেন। আশিক, তুই আমার সাথে ফাইজলামি করতেছিস তাই না?”

 

“আপা, রেগে যাচ্ছ কেন? মিসবাহ ভাই বিয়ের কথা বলেন নাই।”

 

“তাহলে তুই বললি কেন তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান। আমাকে নিয়ে মশকরা করিস! আমি তোর খোঁজে দোকানে গিয়েছিলাম। তোদের কী মনে হয়, এখন আমি রাস্তা ঘাটে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে ফিরি! বিয়ের জন্য আমি এত পাগল হয়ে গিয়েছি যে একজনের বৌ বাচ্চা থাকলেও তার গলায় ঝুলে পড়বো! সেরকম হলে বহু আগেই করতাম। অনেক মানুষ প্রস্তাব দিয়েছে। আলাদা ঘর নিয়ে ওঠাবে বলেছে। কিন্তু আমি না সতীনের সংসার করবো, না কারও সতীন হবো। মনে কষ্ট পেলাম রে আশিক।”

 

“আরে তুমি তো কান্নাকাটি শুরু করলা। আসলে আমারই কথাটা গুছিয়ে বলা হয় নাই। শোন শোন, মিসবাহ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল ঠিক, কিন্তু তালাক হয়ে গিয়েছে। এরপর ভাইয়ের বিয়ের জন্য অনেকদিন থেকে ওনার পরিবার চেষ্টা করছিল। তিনি রাজি ছিলেন না। ওনার একটা মেয়ে আছে। মেয়েকে নিয়েই জীবন কাটাতে চান বলতেন। তোমার সাথে বিয়ের কথাটা মারুফ তুলেছে। মারুফ মিসবাহ ভাইয়ের ছোটোভাই, আমার বন্ধু। মিসবাহ ভাই নাকি মারুফের কাছে তোমার খোঁজ খবর নিয়েছেন। মানে কতদিন হলো বিধবা, সন্তান আছে নাকি। তোমাকে বিয়েশাদি আর দেয়নি কেন! এসব। মারুফের তাই মনে হলো মিসবাহ ভাইয়ের তোমাকে পছন্দ হয়েছে। আমাকে মারুফ জিজ্ঞেস করলো তোমার বিয়ের কথা ভাবি নাকি আমরা। ভাবলে সে বাড়িতে কথা বলবে।”

 

“তোরা দু’জন বাচ্চা বাচ্চা মানুষ কী কথা বললি না বললি তার উপর ভিত্তি করে এভাবে বলে ফেললি যে আমাকে বিয়ে করতে চায়! এমনিও তো কৌতূহল থেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। বিধবা মহিলা, ডিভোর্সি মহিলা শুনলে মানুষের অনেক কৌতূহল হয়। কী করে, কিভাবে জীবন চলে এসব। কিন্তু ঐ আগ্রহ পর্যন্তই। তোর মিসবাহ ভাইও আলাদা কিছু না। বিয়ে করতে হলে সবাই কমবয়সী, সুন্দরী মেয়ে, অবিবাহিত মেয়ে খোঁজে। তা ছেলের যত নাম্বার বিয়ে হোক, আর বয়স যতই হোক। আর ওনার তো অবস্থা ভালো। নিজের ব্যবসা আছে। আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন!”

 

“তোর আগ্রহ থাকলে বল। মারুফ বাসায় কথা বলে দেখুক। না হলে না হবে। মিসবাহ ভাই লোক খারাপ না।”

 

“লোক খারাপ না হলে তালাক হলো ক্যান?”

 

“কেন মহিলাদের দোষে তালাক হতে পারে না। শুনেছি ওনার স্ত্রী অন্য একজনকে পছন্দ করে ঘর ছেড়েছেন। মেয়েকেও সাথে নেয়নি।”

 

না করে দিবে ভেবেও না করতে পারে না আতিয়া। লোকটাকে খারাপ মনে হয়নি। কিন্তু পনেরো মিনিটে কী আর কাউকে চেনা যায়! বহু জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়েছে। এখানে তো কোন কিছু আশা করাও হাস্যকর। কিন্তু হাতের বাজুতে বাঁধা তাবিজের কথা ভেবে কেন জানি মনে একটা শান্তি আর বিশ্বাস  আসে। জমিলা আপা বলেছিলেন এই তাবিজে কপালের ফাঁড়া কেটে যাবে। দেখাই যাক না কী হয়।

 

“জানি না। দেখিস উল্টো পাল্টা কথা বলে তোর চাকরির না সমস্যা হয়। আমি দোকানে গিয়েছিলাম তোর সাথে কথা বলতে। এত রাত করে বাসায় আসিস কেন? শরীর খারাপ করবে। আর আমার উপর মনে কষ্ট রাখিস না। আমি জানতাম না বিরিয়ানির টাকা তোর দেওয়া। ভুল বুঝেছি। আসলে সকালে আম্মা পনেরো হাজার টাকা নষ্ট করছে সেই কথা শুনে গেলাম। তারপর হাসপাতালে গিয়ে দেখি ব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা নাই। এরপর অফিসে রোগীর লোক অভিযোগ করছে, সেখানে আবার স্যার কথা শোনালেন। সবমিলিয়ে মাথা খারাপ ছিলরে। মনে কষ্ট নিস না। আর বাসা ভাড়া, বাজার খরচ দিছিস বলে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

 

“ধন্যবাদের কী আছে! তুমি তো সবসময় দাও। এই টাকা তো খরচের জন্যই দিয়েছিলাম আম্মাকে। ভেবেছিলাম তোমাদের তিনজনের হাতেও এক হাজার করে করে দেব। কিন্তু এখন হাতে শুধু নিজের হাতখরচ আছে। আর টাকা নাই। তবে তোমার টাকা কই হারালো বুঝলাম না। আম্মা টাকা কাকে কী জন্য দিয়েছে আমিও জানি, তুমিও জানো। কিন্তু ব্যাগের তিন হাজার গেল কই!”

 

“সেটা তো আমারও কথা। বাসে নিলে তো চেইন খোলা, না হলে ব্যাগ কাটা থাকতো। টিস্যু পেঁচানো ছিল। টিস্যু আছে, টাকা নাই। আর আমাদের তুই কত দিতে পারবি। একটা মাত্র ভাই। বোনেরাই তো আগে নেব। তারপর ভাইয়ের বৌ।”

 

বহুদিন পর দুই ভাইবোন লম্বা সময় গল্প করে। দেলোয়ারা বেগম একবার এসে দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু বলেন না। আতিয়ার সাথে আশিকের এত ভাব ভালোবাসা কেন জানি ওনার ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ আড়ি পেতে শুনলেন কী আলাপ করে দু’জন। আশিক আতিয়ার বিয়ের কথা ভাবছে দেখে রাগ হয়। আশিককে বেকুব মনে হয়। দুইটাকা ইনকাম করতে না করতে ছেলে ভাবছে ঘরের সব দায়িত্ব ও নিতে পারবে! আতিয়ার ত্রিশ হাজার বেতনেই যেখানে টানাটানি হয়। সেখানে আশিকের ষোল হাজারে কী হবে! ভেবেছিলেন আতিয়ার সাথে আশিকও আয় করা শুরু করলে একটু আরাম আয়েশের মুখ দেখবেন। কিন্তু তাও বোধহয় কপালে নেই!

 

না আতিয়া ওনার নিজেরই মেয়ে। তারপরও আতিয়ার প্রতি কেন জানি একটা ক্ষোভ দেলোয়ারা বেগমের। আতিয়ার জন্মের পর আরও দুই সন্তান হয়েছিল দেলোয়ারা বেগমের। একজন জন্মের তিনদিন পর মারা যায়। আরেকজন তিন বছর বয়সে হঠাৎ জ্বরে দুইদিনের মাথায় মারা গিয়েছিল। তখন আতিয়ার কোন দোষ ওনার মনেও আসেনি। কিন্তু বহুদিন পর ওনার মনে হয় আতিয়া অপয়া, তাই ওনার দুটো সুস্থ ছেলে মারা গিয়েছে। আশিকের জন্মের পর তাই চোখে চোখে রাখতেন। বড়ো আদরের ছেলে। আতিয়া যাকে ভালোবাসে, বা যে আতিয়াকে ভালোবেসে তার কাছাকাছি থাকে তারই কেন জানি ক্ষতি হয়। আতিয়ার নানী এত আদর করতেন আতিয়াকে। তিনিও দুম করে ঘুমের ভেতর হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলেন। আতিয়া ওনার সাথেই ঘুমাতো। একদম সুস্থ সবল মানুষ ছিলেন। আতিয়াকে তাই বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। সেখান থেকেও দু’বছর না যেতে বিধবা হয়ে ফিরে আসলো। আতিয়া আসার পর আতিয়ার বাবা হামিদ আলী মারা গেলেন। কাউকে এসব বললে দেলোয়ারা বেগমকে খারাপ বলবেন। বলবেন মা হয়ে মেয়েকে এমন চোখে দেখেন। কিন্তু সবাই ই তো বলে আতিয়া অপয়া। এখন আতিয়ার আয়েই সংসার চলে তাই না চাইলেও আতিয়াকে চোখের সামনে মেনে নিতে হয়। কিন্তু মনটা ধুকপুক করে। আতিয়ার জন্য অন্য কোন সন্তানের ক্ষতি হয় তাই ভেবে ভয় পান। ছেলের ভালো চাকরি হয়ে গেলে আতিয়াকে কর্মজীবী হোস্টেলে উঠে যেতে বলবেন ভাবেন। আতিয়ার একার আর কত টাকা লাগবে চলতে! মাসে মাসে ওনার হাতে বাকি টাকা দিয়ে যাবে আতিয়া। তিনি ছেলের সংসারে থাকবেন খাবেন। ছোটো মেয়েটাকেও একটা বিয়েশাদি দিবেন। তখন আয়েশাও জামাই নিয়ে যখন তখন বেড়াতে আসতে পারবে। সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার আগে আতিয়া বিয়ে করুক তা তিনি চান না। আতিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে বিপদে পড়বেন। তখন কী আর আতিয়া এই সংসার দেখবে! নিজের সংসারে ব্যস্ত থাকবে। 

 

বহুদিন পর ভালো ঘুম হয় আতিয়ার। একটা সুন্দর স্বপ্নও দেখে শাড়ি পরে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছে। ও একা নয়, তার সাথে একজন লোকও আছে। লোকটা আগে নৌকায় উঠেছে। স্বপ্নে চেহারাটা কার বোঝে না আতিয়া। কিন্তু নৌকায় ওঠার সময় লোকটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আতিয়াও সহজ ভাবে বাড়ানো হাত ধরে নৌকায় পা রাখে। ঘুমের ভেতরও হাসে আতিয়া। স্বপ্নের রেশ রয়ে যায় ঠোঁটের কোণে।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ৮

 

রাতুলের সাথে আজ বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাওয়ার কথা আলোর। মিরপুর এক পর্যন্ত আলোর পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে রাতুলের সাথে যাবে। কিন্তু পথে যোগাযোগ করতে মোবাইল লাগবে। আসা যাওয়া করতে টাকা লাগবে। ফেসবুকে আলোর ছবিগুলো ভাই আশিকের ফোনে তোলা। অল্প টাকার চাইনিজ ফোন হলেও ছবি আসে ভালো। এই ফোনটা পাওয়া গেলে ভালো হতো। ছবি তুলতে পারতো। এতদিন তো রাতুলের সাথে ক্লাসের বাইরে দেখা করেছে। বলেছে সামনে বোর্ডের পরীক্ষা তাই বাসা থেকে ফোন আনতে দেয় না, সময় নষ্ট করবে বলে। ডেটিং ও করেছে আশেপাশে ফাস্টফুডের দোকানে। ইদানীং রাতুল বাইরে ঘুরতে চাওয়ার চাপ দিচ্ছে। ওর সব বন্ধুরা নাকি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রুম ডেট করে। আশুলিয়া, পূর্বাচল কত দূরে দূরে ঘুরতে যায়। আর আলো ওকে এতটুকু বিশ্বাস করে না যে ওর সাথে সামান্য পার্কে যেতে চায় না !

এসব কথায় আলো নরম হয়ে যায়। প্রেম করতে গেলে ডেটিং তো করতেই হবে। আজকের দিনটা তাই ঠিক করেছে ঘোরার জন্য। বাসায় বলেছে বন্ধুরা নিজেরা নিজেদের বিদায় দিবে আজ। তাই হালকা খাওয়া দাওয়া হবে। মায়ের কাছ থেকে অনেক খুঁজে দুইশো টাকা পেয়েছে। কিন্তু এই টাকায় কী হয়! আসা যাওয়াতেই শেষ। আলোর আরও টাকা দরকার! 

 

এমনিতেই জন্মদিনের উপহার যে রাতুলের খুব একটা পছন্দ হয়নি বুঝেছে আলো। যদিও রাতুল কিছু বলেনি। চার হাজার টাকার একহাজার গেলো কেক এ। ঘড়ি কিনলো উনিশশো টাকা দিয়ে। রাতুল একবার বলেছে ও ব্রান্ডের জিনিস ছাড়া পরে না! বাকি দুশো টাকা টুকটাক খরচে লেগেছে। মোমবাতি কিনেছে, রেস্টুরেন্টের একটা কর্ণার সাজানোর জিনিস কিনেছে। রাতুল বন্ধু বান্ধবরা তাদের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে এসেছিল। আলো কাউকে নেয়নি। সে যে ধনী ঘরের মেয়ে না এটা এখনই রাতুলকে বোঝাতে চায় না। তাই বান্ধবীদের সাথে নেয়নি। কেউ যদি বলে দেয়! আলো রাতুলকে আগেই বলেছিলো ও ট্রিট দিবে। এক হাজার টাকার বাজেটও করেছিল। কিন্তু মানুষ হয়ে গেল সাতজন। আর বার্গার, কফির বিল আসলো একুশশো টাকা। আলো এমন ভাব করলো যে ও বাড়তি টাকা পার্সে ঢুকাতে ভুলে গিয়েছে। নিজের এক হাজার টাকা বের করে দিয়েছে, বাকিটা রাতুল দিয়েছে। 

 

এরপর আলো ভেবেছে আবার সুযোগ পেলে কিছু টাকা সরিয়ে রাতুলকে ওর টাকা দিয়ে দিবে। কেননা মনে হচ্ছে রাতুলের ওকে সন্দেহ হয়েছে। ইদানীং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলোর পারিবারিক অবস্থার কথা জানতে চায়। বাড়ি নিজেদের কিনা! ভাই কী করে! বাবা ছাড়া সংসার কিভাবে চলে! আলো অবশ্য বলেছে বড়ো বোন ডাক্তার, হাসপাতালে চাকরি করে। ভাইয়ের দোকান আছে বসুন্ধরায়, আরেক বোনের বিয়ে হয়েছে, দুলাভাই বড়ো ব্যবসায়ী। রাতুলকে বেশি ভাবার সুযোগ দিতে চায় না আলো। একবার প্রেম জমে গেলে কে এত ভাববে। আর কোন রকমে বিয়ে করতে পারলে কথাই নাই। বিয়ে হয়ে গেলে বাকি সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। বোন কী করে, ভাই কী করে তাতে তখন কী আসবে যাবে। আলো তখন রাতুলদের পাঁচ তলা বাড়ির মালকিন হয়ে যাবে। এই ঘুপচি ঘর থেকে তখন মুক্তি!

 

সমস্যা হলো ডেটিং এ যেতেও পয়সা লাগে। সেদিনের সেই তিন হাজার টাকা চুরি নিয়ে বাসায় কম কান্ড হয়নি। মা আর বোনের কথা বলাবলি বন্ধ। ভাগ্য ভালো আলো বাসায় ছিল না। ওকে কেউ সন্দেহও করেনি। তবে সাবধানে তো থাকতে হবে। আর পাঁচশোটা টাকা যদি ম্যানেজ করতে পারতো আজকের দিন নিশ্চিত হওয়া যেত। আলো পা টিপে টিপে ভাই আশিকের প্যান্টের কাছে যায়। আশিক বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। দশটার আগে উঠবে না। মা গিয়েছে সবজি আর টুকটাক সদাই-পাতি আনতে। বাসায় এখন আলো একা। ভাবে ভাইয়ের  প্যান্টের পকেটে কিছু নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এখন তো ভাইয়াও চাকরি করে। টাকা না পেয়ে খুঁজলে এমন ভাব করবে ও কিছু জানে না। 

 

কপাল ভালো আলোর। মানিব্যাগে ভাঁজ করা দেড় হাজার টাকা পেয়ে যায়। খুচরোগুলো আর নেয় না।পুরোটা নিবে, না শুধু পাঁচশো নিবে ভাবে। কিন্তু মনকে বুঝ দেয়, এই টাকা তো পকেটমার নিতে পারতো, ছিনতাইকারীও নিতে পারতো। ও বোন হিসেবে নিলে সমস্যা কী! বড়ো ভাইয়ের আয়ে ছোটোবোনের সামান্য অধিকার থাকবে না! তাছাড়া ভাইয়া তো ওদের এক হাজার করে দিতেই চেয়েছিল। বাড়ি ভাড়া দিতে না হলে তো এই টাকা ও এমনিই পেত। একদিক থেকে ভাবলে ওটা ওরই টাকা। মূল দোষ তো মায়ের। মা কেন আপার দেওয়া বাড়ি ভাড়ার টাকা নষ্ট করলো!

 

রাতুলের আলাদা কোন রুম নেই। কামরাঙ্গী চরে এই বাড়িটা ওদের নিজেদের ঠিক। তবে জায়গার পরিমাণ খুব কম। দুই শতক জমিতে তিনতলা বাড়ি। নিচের তলায় দোকান আর গুদামঘর। দোতলায় রাতুলরা থাকে। তিনতলায় দুই ইউনিটের ছোটো দুই বাসা ভাড়া দেওয়া। রাতুলের তিন বোন দুই ভাই। রাতুল সবার ছোট। বড়ো ভাই বিয়ে করেছে কিছুদিন হলো। মেজো ভাই এর বিয়ে হয়নি এখনো। বড়ো দুই ভাই নিচে দোকান করে, গুদামঘর চালায়। রাতুলের বাবা ওয়াশার পিয়ন ছিল। অবসরের পর পাওয়া টাকা, আর জামনো টাকা মিলে জায়গা কিনে এই বাড়ি করেছে। বড়ো বোনের বিয়ে হয়েছে ভালো পরিবারে। অবিবাহিত দুই বোন আছে। একজন ডিগ্রিতে পড়ে, আরেকজন অনার্স শেষ করেছে। বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে।  রাতুলরা দুই ইউনিটে মিলিয়ে দোতলায় থাকলেও এত মানুষের জায়গা হয় না। এক রুমে বাবা মা থাকেন। আরেক রুমে বড়ো ভাই ভাবি। একরুমে দুই বোন একসাথে থাকে। বসার ঘরে বিছানা পেতে রাতুল আর মেজোভাই এর থাকার ব্যবস্থা। বসার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বোর্ড বসিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এখানেও একটা রুমের মতো সিঙ্গেল খাট বসানো হয়েছে। মেহমান আসলে রাতুলের জায়গা হয় এখানে। একপাশে ওয়ারড্রব আছে। মেজো ভাই আর রাতুল কাপড়চোপড় রাখে। 

 

বসার ঘরের এক কোণায় স্ট্যান্ড দেওয়া প্লাস্টিকের একটা আয়না ঝোলানো আছে। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সেই আয়নার সামনেই রেডি হয় রাতুল। আজ আলোকে নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাবে। আলো অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকে। দেখতে অতটা ভালো না হলেও স্মার্ট আছে। পরিবারের সবার অবস্থা ভালো। এমন মেয়ের সাথে প্রেম করা লসের কিছু না। ভাইদের সাথে দোকানে কাজ করতে আগ্রহী নয় রাতুল। অনার্স শেষ প্রায়। বাবা চেষ্টা করছে সরকারি অফিসের কোথাও যদি ঢোকানো যায়। ঘুষের টাকা শ্বশুর পক্ষ থেকে নিবে। মেয়ের খুশির জন্য এতটুকু তো বাবা মা করতেই পারে। রাতুলের সরকারি চাকরি হলে তো তাদেরই লাভ। আলোর অবস্থা শুনে মনে হচ্ছে আট দশ লাখ টাকা দেওয়া ওর পরিবারের জন্য কঠিন কিছু হবে না। যদিও বাবা নেই এটা একটা সমস্যা। আর মেয়ে বেশি ভীতু। সারাদিন পরিবারের ভয়ে অস্থির থাকে। ফোনটাও আনে না সাথে। আরেকটু পটালে কাজ হয়ে যাবে। আর বেশি সমস্যা মনে হলে একবারে বিয়ে করে ফেলবে। কিন্তু নিজের বড়ো ভাইবোনদের বিয়ে হওয়ার আগে ওর বিয়ে করাটা সহজ না। না হলে বিয়ে করে ফেলে রাখলে খারাপ হতো না। তখন আলোকে শ্বশুর বাড়িতে তুলে আনানোর জন্য আলোর পরিবারেরই মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সে সময় সুযোগ বুঝে টাকা দাবি করলেই হবে। মানিব্যাগ দেখে রাতুল। পাঁচশো টাকা আছে। ঐ দিন শুধু শুধু এক হাজার টাকা খরচ হলো। আলো টাকা দিতে পারবে না জানলে বন্ধু বান্ধব সাথে নিতো না। একটু খরচ হচ্ছে প্রেম করতে। সমস্যা নাই সামান্য ইনভেস্ট করতেই হয়।

 

আশিক রেডি হয়ে দোকানের জন্য বের হয়। মাসের সবে মাঝামাঝি অথচ পকেটে আছে আর হাজার দেড়েক টাকা। এই টাকায় মাসের বাকিটুকু হাত খরচ চালাতে হবে। আজ ফোনটাও সাথে নেই। আলো চেয়ে নিলো। বন্ধু বান্ধবের সাথে ছবি তুলবে বললো। নিক, ছোটোবোন। কিছু তো দিতে পারে না। একদিন ফোন চাইলে দেওয়াই যায়। দোকানে ঢোকার আগে এক কাপ চা খেতে গিয়েও খায় না আশিক। থাক অপ্রয়োজনে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। টাকা হাতে থাকুক।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ৯

 

মিসবাহ শরীফ। পরিবারের বড়ো ছেলেরা যেমন হওয়া উচিত, তেমনই। ভাইবোনদের ভালোবাসেন। মায়ের আদেশ নিষেধ মেনে চলেন। মিসবাহ শরীফের বাবা জামিল শরীফও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। রাতদিন দোকানেই পড়ে থাকতেন। নিজের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। আর ছিলেন ভোজনরসিক। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকার পরও সাবধান হননি। ফলাফল কিডনি ড্যামেজ!

 

ডায়ালাইসিস যাদের করতে হয় একমাত্র তারাই বলতে পারেন কী পরিমাণ শারীরিক ও আর্থিক কষ্ট আসে নিয়মিত সপ্তাহে দুইদিন বা তিনদিন ডায়ালাইসিস করতে করতে। জামিল শরীফ সাহেবের ক্রিয়েটিনিন বেড়ে গিয়েছিল, ডায়ালাইসিস করতে হতো সপ্তাহে তিনদিন। প্রথম দিকে টানা অনেকদিন কিডনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেই সময় মিসবাহর বাকি ভাইবোনেরা ছোটো। মাকে সাথে নিয়ে বাবার জন্য সমস্ত ছোটাছুটি মিসবাহ একাই করেছেন। চিকিৎসার পেছনে জলের মতো টাকা খরচ হয়েছে। নিয়মিত ডায়লাইসিস করা স্বচ্ছল পরিবারের জন্যও সহজ না। 

সংসার, ব্যবসা, বাবা সবকিছুর হাল ধরতে হয় তাই মিসবাহকেই। এবং ধরতে পারেনও। ভাইবোনদের কাছে ধীরে ধীরে বাবার জায়গাতেই বসেন। বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার অসমাপ্ত দায়িত্বগুলোও নিজের কাঁধে তুলে নেন। দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ভাইকে পড়িয়েছেন। মেজো ভাই হামিদকে টাকাপয়সা দিয়ে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ছোটো ভাই হাসানকেও চেষ্টা করছেন ভালো কোথাও চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে। বসুন্ধরার এই দোকান নিজের চেষ্টায় দাঁড় করিয়েছেন মিসবাহ। আকারে ছোটো হলেও আয় বেশ ভালো। বাবার পুরানো ব্যবসা দেনায় জর্জরিত ছিল। তা বিক্রি করে সামান্য কিছু পুঁজি নিয়ে শুরু করা মিসবাহর ব্যবসা লাভের মুখ দেখেছে। কামরাঙ্গিচরে নিজেদের পৈতৃক দোতলা বাড়িতেই থাকে মিসবাহর পুরো পরিবার। মায়ের ইচ্ছায় একান্নবর্তী পরিবার ধরে রেখেছে সবাই।

 

দোকান বন্ধ করে হিসেবনিকেশ করে বাসায় আসতে আসতে রাত এগারোটার বেশি বাজে মিসবাহর। মা জাহানারা সুস্থ থাকার সময় মিসবাহর জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকতেন। এখন নিয়মিত পারেন না। রাত জাগলে প্রেশার বাড়ে। আর মেয়ে পলিনও জেগে থাকে দাদী জেগে থাকলে। তখন সকালে স্কুলে নিতে সমস্যা হয়।তাই মিসবাহই বলেছে খাওয়া নিয়ে বসে থাকতে না। হটবক্সে খাবার রেখে দিতে। খাবার গরমও থাকবে, ও নিজে নিয়ে খেয়েও নিতে পারবে। 

 

হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে মিসবাহ। আজ রান্না হয়েছে ব্রয়লার মুরগী ভুনা, ফুলকপি ভাজি, আর মসুরের ডাল। ব্রয়লার মুরগী মিসবাহর পছন্দ না। কিন্তু বাচ্চারা পছন্দ করে, তাছাড়া বড়ো সংসারে দেশি মুরগী কিনতে হলে অনেকগুলো করে কিনতে হবে। বাচ্চারা আর মা ঝাল কম খেতে পারে বলে ঝালও কম দেওয়া।।  ঝাল ভুনা হলে তাও ভালো লাগতো। ঝাল কমের, কয়েক জ্বাল পড়া বাসি মুরগী তাই খেতে ইচ্ছে করে না। সবজি আর ডাল মেখেই খেতে থাকে মিসবাহ। জাহানারা বেগম উঠে আসেন। ছেলের সাথে নিরিবিলি একটু কথা বলবেন। সকাল হলেই তো হইচই।

 

“আম্মা, ঘুমান নাই?”

 

“খালি ডাইল আর সবজি দিয়া খাইতাছস! মেজো বৌরে কইলাম একটা ডিম একটু ভুনা কইরা রাখতে। তুই মুরগী খাবি না জানে তো। ডাকতাছি আমি। কিছু কইলেই তো একশোখান বাহানা দিবো। একটা ডিম ভুনা করতে এমন কী কষ্ট! দুপুরেই কইছি মিসবাহ মুরগী খাইবো না। একটু মাছ কইরো। তখন কইলো রাতে ডিম কইরা দিবো। সেটাও না দিয়া যাইয়া শুইছে। আমি রেহানারে এখনি ডাকতাছি।”

 

“থাক আম্মা। বাদ দেন। এত মানুষের রান্নাবান্না করে। নিজের বাচ্চা ছোট। পলিন ছোট। সবাইরে দেখাশোনা করে। সবার পছন্দ মতো রাঁধবো এত সময় কই। খাইতাছি, এত কিছু লাগে না রাতে। এমনিও দোকানে ভাজাপোড়া খাওয়া হয় বেশি। রাতে হালকা খাওয়াই ভালো।”

 

“হালকা খানা, আর আরাম কইরা না খাইতে পারার মাঝে পার্থক্য আছে। আমার বয়স হইছে। শরীরে বল নাই। তোর দেখাশোনা, পলিনের দেখাশোনা। কিছুই আমি আর করতে পারি নারে বাপ।”

 

“যা করেন তাই যথেষ্ট আম্মা। পলিন ঘুমাইছে না। রাত দশটার পর আর টেলিভিশন, ফোন দিয়েন না। রাত জাগে আর সকালে স্কুলে যাইতে চায় না।”

 

“এইগুলা বাপ মায়েরে দেখতে হয়। দাদা দাদী আদর করে। শাসন করলে নাতি নাতনি কদ্দুর মানে!”

 

“আমি শাসন করতে গেলে তো অভিমান করে। সারাদিন থাকি ব্যস্ত। শাসন করতে গেলে গুছিয়ে কথা বলতে পারি না আম্মা। ছয় বছরের মেয়ে, কিন্তু কথা বলে কেমন পাকনা পাকনা দেখেন না আম্মা। আপনারাও যদি ওরে না দেখেন নষ্ট হয়ে যাবে।”

 

“নষ্ট হওয়া রক্তে থাকলে এমনিই নষ্ট হইবো।”

 

“আম্মা, পলিনের শরীরে আমার রক্ত।”

 

“তার মায়ের রক্তও আছে। মার গুণে কন্যার পরিচয়। বাদ দে এসব কথা তুলতে চাই না। যা বলতে বসছি তা বলি। তোর বিয়া দিতে চাই। তোর যত্নের প্রয়োজন। পলিনের মায়ের আদর শাসন প্রয়োজন। অনেক না না করছস। আমি না থাকলে তুই কামাই করে ঘরে আনবি, কিন্তু খাবি বাসি, পাতিলের তলারটা। পুরুষের যত্ন করতে ঘরের মহিলা লাগে। শুধু কামাই করলে হয় না। আর পলিনরে কে দেখবো? ওরে গড়ে পিঠে নিতে মা দরকার।”

 

“নতুন মা এসে পলিনকেই যদি শত্রু ভাবে আগে? পলিনকে কষ্ট দেয়! এই ভয়েই আর আগাতে ইচ্ছে করে না আম্মা। একজন তো আমার মানসম্মান সব শেষ করে দিয়ে চলে গেল।”

 

“সব তো একরকম না। দেখেশুনে আনবো। একটু কম বয়সী অসহায় ঘরের মাইয়া আনলে নরম হইয়া থাকবো।”

 

মিসবাহ হেসে দেয়। “আম্মা, পায়রাও কিন্তু কমবয়সী মেয়ে ছিল। তখনও আপনি বলেছেন কমবয়সী অল্প শিক্ষিত মেয়ে নরম সরম হয়ে থাকবে। থাকছে?”

 

“ওর তো চরিত্র খারাপ আছিল।”

 

“সেটাই চরিত্র ভালো খারাপ হইতে কম বয়সী, বেশি বয়সী, কম শিক্ষিত, বেশি শিক্ষিত এসব ব্যাপার না। পায়রা কোনদিন সংসারে মন দেয় নাই। আমার কথা বাদ দেন, আমি না হয় বয়সে তার চেয়ে বেশি বড়ো ছিলাম, আমাকে তার পছন্দ হয়তো হয় নাই। টান হয় নাই। কিন্তু বিয়ের তিন বছর পর একবছর বয়সী মেয়েকে রেখে কিভাবে পুরানে প্রেমিকের হাত ধরে চলে গেল! এসব মনে হলে আর বিয়েশাদি করতে মন চায় না।”

 

“ঠিক আছে। একটু বয়সী কারও সাথে বিয়া দি তোর বাপ। কিন্তু বয়স্ক মাইয়ার চেহারা ভাইঙ্গা যায়। আর বাইচ্চা কাইচ্চা হয় না যদি। একটা পোলার মুখ দেখবি না?”

 

“চল্লিশ বছর বয়স চলে। এখন আর এত রূপবতীর শখ নাই। আর কে বললো চেহারা ভাঙে! এগুলো মনের ভাবনা। আজ আমি একটা মেয়ে দেখছি। আমার দোকানে কাজ করে যে ছেলে আশিক। তার বোন আতিয়া। চৌত্রিশ, পঁয়ত্রিশ বছর বয়স। বিধবা। দেখতে শুনতে ভালো আছে। এমন কেউ হইলে চিন্তা করে দেখবো।”

 

“কই দেখলি? দোকানে আসছিল? বিধবা বিয়া করবি? বাচ্চা কাচ্চা আছে? অপয়া হয় যদি।”

 

“না ছেলেমেয়ে নাই। আর পয়া, অপয়া কী আম্মা! আব্বা মারা যাওয়ায় কী আপনি অপয়া হয়ে গিয়েছেন! আব্বার কিডনি নষ্ট হয়েছে, মারা গিয়েছেন। এই মেয়ের স্বামী এক্সিডেন্ট করে মারা গিয়েছে। কোনটাতেই কারও হাত নাই।”

 

জাহনারা বেগম চুপ করে যান। আগে কখনো মিসবাহ এভাবে বলে নাই। তবে মিসবাহর এই তুলনা ওনার ভালো লাগে না। কোন মেয়ে খোঁজ খবর নিতে হবে ভাবেন তিনি।

 

পলিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। মেয়েটার সাথে দিনদিন দূরত্ব হচ্ছে। পলিন দাদীর সাথেই ঘুমায় বেশিরভাগ সময়। যেদিন মিসবাহ বাসায় থাকেন, সেদিন নিজের কাছে নিয়ে আসেন। প্রায় এটা সেটা  হাতে করে কিনে আনেন। রুম ভর্তি খেলনা। কিন্তু পলিন এক খেলনা দিয়ে বেশিদিন খেলতে চায় না। আবার নতুন বায়না করে। মিসবাহও আব্দার মেনে নেন। মেয়ের সাথে গল্প করা, সময় দেওয়া এই জিনিসগুলো হয় না বলে, তার ঘাটতি খেলনা দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করেন। এই বয়সী বাবা মেয়ের সম্পর্ক কত নির্মল হওয়ার কথা।।অথচ কেমন একটা বাধো বাধো। হয়তো পায়রার কথা মনে পড়ে বলে। কিছুদিন আগে পায়রাকে দেখেছিলেন বসুন্ধরা শপিং মলে। পায়রা বলেছিল সে সুখে আছে। কেননা যেখানে সে আছে সেখানে তার ভালোবাসা আছে। মিসবাহর কাছে নাকে সেই ভালোবাসা পায়রা কোনদিনও পায়নি। মিসবাহ নাকি পরিবারের বড়ো ভাই, আর মায়ের ছেলেই হয়ে ছিলেন। কোনদিন পায়রার ছিল না!

 

পায়রা কি সত্য বলছে! আজ যেভাবে সে মাকে পয়া অপয়ার ব্যাখ্যা দিলো। এই ঘটনা জীবনে প্রথম। আসলেই তো মা পায়রাকে শাসনে যখন রাখতেন, তখন তা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি। এটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। মিসবাহর সাথে তিন বছরে তিনদিনও পায়রা ঘুরতে যেতে পারেনি। বারো বছর বয়সের পার্থক্যটা কাটানোর জন্য হয়তো যে সময় দেওয়ার দরকার ছিল। তার কিছুই দিতে পারেননি। ব্যবসা গোছানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বাড়িতে কী হচ্ছে খবর রাখেননি। রাতে নিয়ম করে পায়রাকে কাছে টেনেছেন। আর এটাই যথেষ্ট ভেবেছেন। কোনদিন পায়রাকে নিয়ে একটা সন্ধ্যা কাটানো হয়নি। তাই হয়তো পায়রা বলেছে মিসবাহর সাথে কখনো কোন মনের টান অনুভব করেনি! যদি জীবন আরেকবার গোছানোর সুযোগ পান, পুরনো ভুলগুলো আর করবেন না। তাই ভাবে মিসবাহ।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১০

 

“আতিয়া, বয় তোর সাথে দুই মিনিট কথা আছে।”

 

“আম্মা, ডিউটির সময় হইছে। কী বলবা? বাজারের টাকা রাতে এসে দিব।”

 

“তোর খালি মনে হয় আমি তোকে টাকার জন্য আওয়াজ দেই শুধু! এইখানেই আসলে মহিলা আর পুরুষের পার্থক্য। পুরুষ কামাই করে রাজা হয়, আর দুই হাতে খরচ করে। পয়সার হিসাব নেয় না। আর মহিলা কামাই করলে হয় *শ্যা।  পাই পয়সার হিসাব চায়। কদ্দূর দিলো, কদ্দূর পাইলো!”

 

“ছিঃ! কথার ছিরি দেখ তোমার। আমারে বে** বল্লা!”

 

“তোরে বললাম কই! এটা তো কথার কথা।।

 তোর গায়ে টানোস ক্যান! কিন্তু এটা তো সত্য যে তুই সংসারে দুইটা টাকা দিয়া এমন ভাব নেস যেন তোর দয়ায় চলি। আমার চার ছেলেমেয়ের মাঝে সবচেয়ে বেশি খরচ তোর জন্য করছি। পড়াইছি, বিয়া দিছি, বিধবা হইয়া আসার পর চার বছর বসে বসে খাওয়াইছি। তোর এই চাকরিও তোর বাপের জন্য পাইছস। সে হয়তো ভাবছে সে মরে গেলে তুই সবাইরে দেখবি। তোর বাপ বেঁচে থাকতে আমার দিন আলাদা ছিল। তখন বুঝি নাই কোনদিন এমন সময়ও আসবো। এইজন্য মানুষ মাইয়ার কামাই খাইতে চায় না। আমার কপাল খারাপ যে তোর জন্মের পর দুইটা পোলা হইয়া মারা গেল। আশিকটার বয়স কম। বাকি সবারই তোর থেকে বয়স কম। আইজ তুই বড়ো না হইয়া আশিক বড়ো হইলে আমার এসব কথা বলা লাগতো না। সে নিজেই বুঝতো। বোনদের বিয়া দেওয়ার আগে, একটা ছোটো ভাই থাকলে তার গতি করার আগে নিজের কথা ভাবতো না। এই সংসারে বহু পুরুষ আছে যারা ভাইবোন, বাপ মারে দেখতে গিয়া আর বিয়াশাদী করে নাই। তারা দুঃখী না। ভাইবোন, মা বাপের জন্য করতে পাইরা তারা সুখী। এই সুখ আল্লাহ সবার কপালে দেয় না। দিলেও সবাই কদর করতে জানে না। খালি নিজেরটা ভাবে।”

 

আতিয়া বাসে ওঠার জন্য কাঁটাবন সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে। বাস এগিয়ে আসছে। আজ শনিবার ভীড় কম। ধাক্কাধাক্কি নেই। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আতিয়া তাবিজটা বাইরে ছুঁড়ে মারে। যেই তাবিজটা জমিলা সিস্টার দিয়েছিল, আতিয়ার বিয়ে না হওয়ার ফাঁড়া কেটে যাওয়ার জন্য!

 

আলোর মনটা ফুরফুরে। রাতুলের সাথে ভালোই মজা করেছে। রাতুলের এক হাজার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ায় যে রাতুল খুশি হয়েছে তা বোঝে আলো। যদিও শুরুতে নিতে চায়নি, ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল। পরে নিয়ে পকেটে ঢুকায় রাতুল। সনি সিনেমা হলে একটা সিনেমাও দেখেছে তারা। অন্ধকার হলের সুযোগ নিয়ে রাতুল একটু দুষ্টুমিও করেছে। আলো লজ্জা পেলেও মানা করেনি। প্রেম করতে গেলে এসব নাকি চলে। ওর বান্ধবীরাই বলেছে। তাছাড়া আজ নয়তো কাল ওদের বিয়ে হবেই। তাই সংকোচ থাকলেও রাতুলকে মানা করতে পারেনি।

 

মিসবাহ, হামিদ, হাসান তিন ভাই। বোন মোনা, হাসানের বড়ো আর হেলেন সবার ছোটো। মেজোভাই হামিদ নিজের  চাকরিবাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। হাসানকে চাকরিতে ঢোকানোর চেষ্টা করছে মিসবাহ। আপাততঃ হাসান মুক্ত পাখি। সংসারের দায়িত্ব, কর্মের চাপ কিছুই নেই। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে বড়ো ভাইয়ের দোকানে বসে। অন্য সময় ক্লাস আর বন্ধুদের আড্ডায় সময় কাটে। মা জাহানারার সাথে হৃদ্যতা, সখ্যতা থাকলেও হাসান বা হামিদ কেউ মিসবাহ আর ছোটো বোন হেলেনের মতো নয়। মানে সবকাজে মায়ের অনুমতি নেওয়া, মাকে জানিয়ে সব কাজ করার মতো ছেলেমেয়ে তারা নয়। মায়ের কাছে বেশি আদরের ছেলে তাই মিসবাহ আর ছোটো মেয়ে হেলেন। হাসান আর হামিদের মতো বোন মোনাও নিজের মতো থাকে। আজ তাই জাহানারা হাসানকে জরুরি তলব করায় হাসান অবাকই হয়। বাইরে থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়েই মায়ের রুমে যায় না হাসান। বরং ভাইজি, ভাতিজার সাথে খেলে। তারপর আস্তে ধীরে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে। আজও তাই করছিল। তখন হামিদের স্ত্রী রত্না আসে ছোটো মেয়ে  পরীকে কোলে নিয়ে।

 

“হাসান, আম্মা তোমারে সেই সন্ধ্যা থেইক্কা খোঁজ করে। ফোন ধরো না ক্যান বাইরে থাকলে?”

 

“ফোনে সমস্যা করতেছে। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ডিসপ্লে গেল। ফোন রিসিভ হয় না। কী হয়েছে ভাবী? কোন সমস্যা?”

 

“কী হয়েছে সেটা কী আমাকে বলবে আম্মা! আমি তো মোনা আপা বা হেলেন না। আমি হলাম তার অপছন্দের ছেলের অপছন্দের বৌ।”

 

ভাবীর কথায় অবাক হয় না হাসান। রত্না ভাবী সহজ করে কোন উত্তর দিতে পারেন না। কথার ভাষা মুহুর্তে পরিবর্তন করেন। এই এখানে এমন কথা বললেন। আবার শাশুড়ির সামনে গেলে আরেক রকম হবে। স্বামীর সামনে আরেক রকম। ভাবীকে না ঘাটানোই উত্তম। ভাতিজা পরশ আর ভাতিজি পলিনকে বলে,

“চাচ্চু, তোমরা কিন্তু গুটি পাল্টাবে না। আমি এসে আবার খেলবো ছক্কা।”

 

হাসান বের হয়ে যেতেই পরশকে ধমকে নিয়ে যায় রত্না। পলিনের সাথে পরশ বা পরীর বেশি মাখামাখি তার ভালো লাগে না। মা ভালো না যে মেয়ের, তার সাথে নিজের বাচ্চাদের বেশি মিশতে দিতে নেই। তাছাড়া পলিন, পরশ আর পরীর আদরে ভাগ বসাচ্ছে। পলিনের মায়ের সাথে পলিনকে পাঠিয়ে দিলে কী হতো! উল্টো সবাই যেন বেশি বেশি আহ্লাদ করে। ভাসুর মিসবাহ তো পারলে বাসাকেই খেলনার দোকান বানিয়ে ফেলেন। অথচ যত দিচ্ছে মেয়ে তত ত্যাড়া হচ্ছে। রোজ নতুন নতুন আব্দার। শাশুড়িও মানা করে না। বরং পরশ আর পরীর জন্য খেলনা না কিনে পলিনের পুরনোগুলোই দিতে বলেন।

কেন! তার ছেলেমেয়ে কি রাস্তার ছেলেমেয়ে যে অন্য বাচ্চা যেগুলো আর খেলবে না সেসব দিয়ে খেলতে হবে! পলিনের কোন খেলনা তাই ছেলেমেয়েকে ছুঁতে দেয় না রত্না। কিন্তু রোজ সন্ধ্যায় হাসান এসে সব বাচ্চাদের নিয়ে হইচই বসায়। দেবরকে কিছু বলতেও পারে না। ছোটো মেয়েকে তাও খাওয়ানোর বাহানা দিয়ে মাঝেমাঝে নিয়ে যান। ছেলেকে তো নিতে পারে না। ভাবছে এই সময় পরশের জন্য একজন মাস্টার রেখে দেবে। পড়ানোর বাহানায় এই রোজকার মাতামাতি বন্ধ হবে। যদিও পাঁচ বছরের ছেলের জন্য মাস্টার রাখতে দিতে শাশুড়ি রাজি হবেন কিনা কে জানে। স্বামী হামিদকে বলেই ম্যানেজ করতে হবে।

 

সবাই চলে গেলে একা বসে থাকে পলিন। চাচী যে ইচ্ছে করে পরশকে নিয়ে গেল বোঝে পলিন। ওর রাগ লাগে চাচীর উপর। কিন্তু পরশ মায়ের উপর রাগ করে না। এই যে এখন ওকে নিয়ে গেল, ওর মন খারাপ হলো ঠিকই। কিন্তু  ওর মা ওকে রুমে নিয়ে এত আদর করবে যে পরশ মন খারাপ ভুলেই যাবে। পলিন কেন ভুলতে পারে না! সবাই ভাবে ও শুধু শুধু জিদ করে, রাগ করে। কিন্তু রাগ ভাঙাতে তো কেউ জানে না! ছোটো চাচ্চু একটু আদর করেন ঠিক। কিন্তু সারাদিন বাসায় থাকেন না। বাবাকে পলিন পায় খুবই অল্প সময়। সেসময়ও বাবা শুধু ভারী ভারী কথা বলে। পড়তে বলে। ক্লাসের রেজাল্ট খারাপ কেন তাই জন্য বকে। এখন তো টিচারও রেখেছে। দাদী বাসার কাজ কর্ম নিয়ে চাচীর সাথে ব্যস্ত থাকে। স্কুলেও পলিনের বন্ধু কেউ নেই। ওর আম্মু নাকি খারাপ। তাই অন্য মেয়েদের আম্মুরা ওর সাথে মিশতে মানা করে দিয়েছে। সবাই বলে ওর আম্মু খারাপ। পলিন এই আটবছরে ওর আম্মুকে কখনো দেখেনি। তবে জানে ওর আম্মু আসলেই খারাপ। না হলে এতদিনেও ওকে কখনো দেখতে আসেনি! পলিনের আবার রাগ ওঠে। লুডু খেলার বোর্ডটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে পলিন।

 

“আম্মা, ডাকছেন?”

 

“হ। তোরে ফোনেও পাই না। বাসায় আসলেও মায়ের রুমে একটা উঁকি মারোস না। একটা তো বিয়া কইরা বৌ আইনা মারে ভুইল্লা গেছে। তুই তো বিয়ার আগেই ভুলছস। যা বড়োছেলেটা আমার ছিল। সেটারও মাথা খারাপ করার ফন্দি করছস।”

 

“আম্মা, কোন সমস্যা? কী হইছে?”

 

“তুই তোর কোন বন্ধুর বিধবা বইনের সাথে মিসবাহর বিয়া দিতে চাস? তোর এত বড়ো সাহস? আমি থাকতে তুই ভাইয়ের বিয়া দিবি? আমি কি মইরা গেছি!”

 

“কী বলেন এসব! আমি খালি জিজ্ঞেস করছি ভাইয়ার ইচ্ছে আছে নাকি। থাকলে আপনাকে জানাতাম। তারপর তো সব সিদ্ধান্ত আপনার।”

 

“আমার সিদ্ধান্ত এখনি শোন। না না না। আমি কোন দুইবার জামাই খাওয়া অপয়া মেয়ের সাথে মিসবাহর বিয়া দিমু না। আমি সব খোঁজ নিছি। পেটের বাচ্চা, জামাই সব খাইছে। আরেক পোলার লগে বিয়া ঠিক হইছিল সে পোলাও হুদাই মরছে। সুস্থ বাপটাও মরছে ধুম কইরা। এখন মাইয়া করে নার্সের চাকরি। বয়সও হইছে মেলা। তুই দুনিয়াতে আর মাইয়া পাস নাই? শোন মিসবাহর বিয়া আমি দিমু। দেখেশুনে দিমু। মরলে না হলে তোর বাপরে কী জবাব দিমু! সে আমারে কইবো না, জাহানারা আমার পোলা মাইয়াগো বিয়া তুমি দেখে দিতে পারলা না!”

 

“এই প্রশ্ন আব্বা এমনিও করবে আম্মা। কারণ সবার বিয়েই দিয়েছেন। ভালো কোনটা হয়েছে? মিসবাহ ভাইয়ের প্রথম বিয়ে আপনি দেন নাই? রত্না ভাবীকে নিজে পছন্দ করে আনছেন। এখন ভাবীর বেয়াদবি আর তর্কের জন্য হামিদ ভাইয়ের উপর রাগ দেখান। বেচারা নিরীহ লোক। না বৌকে শাসন করতে পারে, না মাকে। মাঝে নিজে যাঁতাকলে পিষে। মোনা আপা কেন আপনার উপর রাগ? এত করে পড়তে চাইলো শুনলেন না। এইচএসসি পাশ না করতে এত ভালো ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে দিলেন। শ্বশুর বাড়ির চৌদ্দগুষ্ঠী সামলে আপার আর লেখাপড়া হলো না। হেলেনটা ভালো আছে কারণ হেলেন এই ছেলে নিজে পছন্দ করছে। বুদ্ধিমান মেয়ে, বুঝেছে লেখাপড়া ওর ঘিলুতে ঢুকবে না। আর আপনার ভরসায় থাকলে বিয়ে হবে মার্কামারা। সুন্দরী হওয়ায় কাজের কাজ এটাই হয়েছে যে ভালে পরিবারের একটা ছেলে পটাতে পারছে। সেই জামাই নিয়ে আপনারই কী আদিখ্যেতা।”

 

“হাসান তুই একটা বেয়াদব হইতেছস দিনকে দিন। প্রেম করতাছস না? মাইয়া কে? তোর বন্ধুর আরেকটা বইন নাকি? পট্টি পড়াইতেছে তোরে। হাভাইত্তা বন্ধুর আর তার বইনেরা তোরে জাদু করছে।”

 

“আশিকের বড়ো বোনকে আমি জীবনে একবার দেখছি। ছোটো বোনকে আজ পর্যন্ত দেখি নাই তবে বাচ্চা মেয়ে। মেজো বোনের বিয়েও হয়ে গিয়েছে। ওদের অবস্থা একসময় ভালো ছিল আম্মা। বাবা মারা যাওয়ায় এখন একটু খারাপ আছে ঠিক। কিন্তু বোনদের দিয়ে খারাপ পট্টি পড়ানোর দরকার নাই। নার্সের চাকরি খারাপ পেশা তো না। আর পয়া অপয়া এসব কুসংস্কার। বয়সেও মিসবাহ ভাইয়ের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোটো আছে। আর আশিকও ভালো ছেলে।।আজ না হয় কাল তার ভালো চাকরি হবে। কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে ভাইয়ার দোকানে কাজ করে কামাই করে। এরা সম্মান পাওয়ার যোগ্য। অসম্মান না।”

 

হাসান রুম থেকে বের হয়ে গেলেও জাহানারা শান্ত হোন না। হাসান যাই বলুক। এমন মেয়ের সাথে তিনি মিসবাহর বিয়ে দিবেন না মানে দিবেন না।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয় 

পর্ব১১

 

মিসবাহ উসখুস করছে। আবার এভাবে মেয়ে দেখায় সে আগ্রহী  নয়। তবু মায়ের জোরাজোরিতে আসতে হলো। যে মেজোবৌ রত্নার সাথে মা উঠতে বসতে সারাদিনে তিনবার অন্তত বিবাদে জড়ান, আজ সেই রত্নার মামাতো বোন আয়নাকে দেখতে আসলেন।

 

রত্নার মামাতো বোন আয়নার বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে টিকতে পারেনি বলে সংসার করতে পারেনি। আয়নার নিজের পছন্দের বিয়ে ছিল বলে শুরুতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। একটা ছেলেও হয়েছে সেই সংসারে। কিন্তু প্রথম প্রথম টুকটাক চড় থাপ্পড় দিলেও দিনে দিনে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। একসময় সংসার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয় আয়নার প্রাক্তন স্বামী। উল্টো বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসার চাপ দিতো। সইতে না পেরে একসময় বাবার বাড়িতে জানায় আয়না। মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে আসে আয়নার বাবা মা। ভেবেছিলেন এতে বদ জামাই শিক্ষা পাবে। কিন্তু আয়নার বর যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। আয়নাকে নিয়ে যাওয়ার পরপরই নতুন বিয়ে করে। কিছুদিন মামলা মোকদ্দমা চলে কিন্তু ভালোবেসে বিয়ে করায় কাবিন ছিল অল্প টাকার। আয়নার স্বামীর তাই তালাক নিতে বেগ পেতে হয়নি। ছেলে সালমানের কথা ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়নি আয়না। একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ায় আয়না। কিন্তু পরিবারের চাপাচাপিতে বিয়ে করতে রাজি হতেই হয়েছে। জাহানারা বেগমের আয়নাকে পছন্দ হয়েছে। রত্নার মতো মুখরা মনে হয়নি। ঠান্ডা স্বভাব। একটা বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় এমনি নরম হয়ে আছে।

 

“মিসবাহ, তুই যেমন চাইছিস তেমন মাইয়া না? দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ খারাপ না। ছেলেও নানাবাড়িতে থাকবো। আমি আগেই কথা কইছি। পলিনের দেখাশোনা করবো, তোর দেখাশোনা করবো। মাঝেমাঝে বাপের বাড়ি আইসা পোলারে দেইখ্খা যাইবো।”

 

“ছেলে তো ছোটো। মায়ের জন্য কান্নাকাটি করবে না?”

 

“পলিন করে কান্দন? আর করলেও নানা নানী আছে, দেখবো তারা।”

 

“পলিনের মা যখন চলে যায় ওর বয়স মাত্র এক বছর। তাও মাকে কম খোঁজে নাই। ওকে সামলাতে কষ্ট হয়নি?”

 

“সামলাইছি তো তাই না? সালমানরেও তার নানা নানী সামলাবো। তুই আবার পোলা নিবি কইছ না। দুনিয়ার অশান্তি হইবো। বারো ঘরের বারো বাইচ্চা কাইচ্চার ক্যাচাল। রত্নাও রাজি না বোনপুতরে নিতে। এরাও রাজি এই শর্তে। তোর আর সমুইস্যা কী!”

 

“রত্না তো পারলে পলিনরেও তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। নিজের দুই সন্তান ছাড়া ও আর কাকে চোখে দেখে! আমি কিছু বলি না মানে এই না যে আমি দেখি না, বুঝি না। আচ্ছা আমি এখন বাইর হবো।”

 

“মিসবাহ, হুদাই অশান্তির কথা ভাবিস না। পোলা মানুষ দুদিন কাঁদবো এরপর ঠিক হইয়া যাইবো। ওর নানা নানী বোর্ডিং স্কুলে দিয়া দিবো। ছুডি মুডিতে বাড়িত আইলে মা আইসা একবেলা দেইখা যাইবো। আমরা তো পাষাণ না। কিন্তু পোলা নিয়া সাথে গেলে সেই পোলার খরচা তোর কাঁধে আইবো। পলিনরেও তখন আয়না সময় দিবো না। নিজের পোলা নিয়া অস্থির থাকবো।”

 

“আম্মা, জানি না কী বলবো। চিন্তা করে দেখি।”

 

“এত চিন্তার তো কিছু নাই। আগামী শুক্রবার বিয়া পড়ানোর ব্যবস্থা করি। এতো আয়োজনের কিছু নাই। ঘরে ঘরে দুই পরিবারের মানুষজন মিলা বসবো। কাবিন করে বৌ নিয়া আসবো।”

 

“আম্মা, একটু সময় নেন। এত তাড়াহুড়ো কিছু নাই। পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে পারছেন, এখন পনেরোদিন পারবেন না! আমি ভাবি একটু।”

 

“কই যাস? আইজ মার্কেট বন্ধ না?”

 

“আমার বন্ধু আলিফ মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করছিল। দেখতে যাব যাব করে সময় পাই নাই কাল। আজ একবার দেখে আসি।”

 

মিসবাহ সেই কলেজ জীবন থেকে মোটরসাইকেল চালায়। তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানো যায়, নিজের মতো চলাফেরা করা যায় বলে বাইক তার সবসময় পছন্দ। বাইক স্টার্ট দিয়ে আয়নার কথা ভাবতে থাকে মিসবাহ। হ্যাঁ মেয়েটা খারাপ নয়। কিন্তু কেন জানি মন থেকে একটা সম্মতি আসছে না। ছোটো ভাই হাসান আর তার বন্ধু আশিকের খুব ইচ্ছে ছিল মিসবাহ যেন আতিয়ার সাথে একবার কোথাও বসে, কথা বলে।।মিসবাহরও আগ্রহ ছিল। কিন্তু মা বেঁকে বসলেন, আর আশিকও ইতস্তত করে জানালো তার বোন নাকি বিয়ে করবে না বলে গোঁ ধরেছে। মায়ের ব্যাপারটা মিসবাহ বোঝে। কিন্তু আতিয়ার বিষয়টা বুঝলো না। আতিয়ার বিয়ে না করতে চাওয়ার পিছুটান কি তার পরিবার!

 

ফলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় মিসবাহ। বন্ধুর জন্য ফল নেওয়া দরকার। থরে বিথরে সাজানো লাল, হলুদ, সবুজ ফলগুলো দেখতে কী ভালো লাগে। পাশেই ফুলের ছোট একটা দোকান। নানা রঙের ফুলগুলো দিয়ে কী সুন্দর বুকে সাজানো। মিসবাহ ফল কেনে, প্রতি সপ্তাহেই কিনে। কিন্তু এই জীবনে ফুল কেনা হয়নি বললেই চলে। কখনো ফুল কেনার মানুষ ছিল না, কখনো মানুষ থাকলেও মন ছিল না। সাংসারিক দায়দায়িত্বে ভালোবাসা দিবস, ফাল্গুন, বৈশাখ কবে পার হয়ে গিয়েছে টেরই পায়নি। ফাল্গুনে হলুদ, ভালোবাসা দিবসে লাল, পহেলা বৈশাখে লাল সাদা পাঞ্জাবি পরে কারও হাত ধরে হাঁটা হয়নি। কারও  বাচ্চামি বায়না মেটাতে কখনো বৈশাখী মেলায় যাওয়ার হয়নি। কাঁচের চুড়ি দেখে বাচ্চাদের মতো কারও বাড়িয়ে দেওয়া হাতে একটার পর একটা চুড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়নি। একটা গোলাপ কিনে প্রিয়তমার জন্য তপ্ত রোদে অপেক্ষা করা হয়নি। আর এই সময়নষ্ট করা অযথা আবেগের জন্য মিসবাহর মনও আগে কখনো পুড়েনি।

 

এই চল্লিশ বছর বয়সে এসে মিসবাহর মনে হয়, এই অযথা পাগলামিগুলোরও প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে মাঝেমাঝে হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে কিছু বেহিসাবি খরচ করার। চল্লিশ বছর বয়সে এসে চোখ বন্ধ করলে আনন্দময় কোন স্মৃতিটা মিসবাহর চোখে ভাসে! 

কিছুই না। মিসবাহ কখনো সাগর দেখতে যায়নি, কখনো পাহাড়ে ওঠা হয়নি। কখনো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকার স্বাস্থ্যঝুঁকির বয়ান দিতে দিতে আগুনগরম চটপটি আর ঝাল ফুচকা খাওয়া হয়নি। সময়ের আগেই মিসবাহ পরিণত হয়েছে। দায়িত্বশীল ছেলে হয়েছে। ভালো ব্যবসায়ী হয়েছে। এর মাঝেই সুখ খুঁজেছে। আর সুখী ছিলও। কিন্তু এখন কেন সব ফাঁকা লাগে! আজ এই মুহুর্তে যদি ও ট্রাকের নিচে চলে যায়, আর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। চোখ বন্ধ করার আগে ওর মনে হবে সমস্ত জীবনটা শুধু করেই গেল। দুদন্ড বসে ঝিরিয়ে নেওয়ার ছলেও একটু কী উপভোগ করা হলো!

 

হাসানকে দেখে সে। কলেজ থেকে স্টাডি ট্যুরে যায়। বিভিন্ন দিবসে সেজেগুজে বাইরে যায়। গিটার বাজায়, গলা ছেড়ে গান গায়।।পঁচিশ বছর বয়সী হাসানের ভেতর পঁচিশ বছরের মিসবাহকে খুঁজে পায় না। পঁচিশ বছরের মিসবাহ তখন ব্যবসা দাঁড় করাতে খেটে চলছে। স্টাডি ট্যুর তখন তার কাছে অজানা নাম। বিয়ের পর পায়রা খুব বলতো হানিমুনে যাবে। মা জাহনারা খুবই বকাঝকা করেছিলেন শুনে। মিসবাহও সায় দেয়নি। সাগর দেখতে গিয়ে হাজার টাকা জলে ফেলার কোন মানে হয় না। সেই তো পানি। এ আর দেখার কী আছে। তার বদলে সে টাকায় সোনার একটা চেইন কিনলে ভবিষ্যতের সম্পদ হবে। মিসবাহর টাকার সমস্যা ছিল না। তাই কক্সবাজার যাওয়ার বদলে পায়রাকে একটা সোনার চেইন এনে দিয়েছিল। পায়রাও আস্তে আস্তে এসব আবদার করা বন্ধ করে দেয়। আর মিসবাহর তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথাও ছিল না। এখন বছরে বিভিন্ন ছুটিছাঁটায় হামিদকে নিয়ম করে বৌ বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে যেতে দেখে। এখানে আম্মার জোর গলায় বাঁধা দেওয়া টের পায় না। পেলেও হামিদ আর রত্না তা পরোয়া করে না। ফেসবুকে তাদের হাসিখুশি ছবি দেখতে ভালোই লাগে মিসবাহর। এমন একটা ছবি তো তার আর পায়রারও থাকতে পারতো!

 

“স্যার, আটশো সত্তর হইছে।”

 

“ঠিক করে ওজন করছো মিয়া?”

 

বিক্রেতার ডাকে বাস্তবে ফেরে মিসবাহ।

 

“হ।”

 

ফল স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় মিসবাহ। গন্তব্য মিলেনিয়াম হাসপাতাল। বন্ধু ভর্তি আছে সেখানেই।

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১২

 

মিলেনিয়াম হাসপাতালের নার্সদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক রয়েছে। বয়স ও পদ অনুযায়ী কেউ আকাশী রঙের শাড়ি পরেন, কেউ সালোয়ার কামিজ। বুকের কাছে ঝোলানো ব্যাজে নাম লেখা থাকে। মাথায় সাদা টুপি ক্লিপ দিয়ে লাগাতে হয়। চুলে সিম্পল খোঁপা।

 

এই হাসপাতালটা শহরে বেশ জনপ্রিয়। দীর্ঘদিন সুনামের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে বলে রোগীর চাপ বেশি। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ব্রাদার, এমএলএস আর পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংখ্যাও কম নয়। চেহারা খুব মন কেড়ে না নিলে এত নার্সের ভীড়ে আলাদা করে কাউকে মনে রাখার কথা নয়। কিন্তু আতিয়ার ছিমছাম রূপ যে প্রথম দিনই মিসবাহর নজর কেড়েছিল। প্রথম যেদিন বন্ধুকে দেখতে আসে, দশতলায় রুম নাম্বার খোঁজার ফাঁকে নার্স স্টেশনে দেখতে পায় আতিয়াকে। একমনে খাতায় কী যেন লিখছে। প্রসাধনী বিহীন সাধাসিধা মুখটায় যেন রাজ্যের বিষণ্নতা। আসেপাশে কী হচ্ছে তাতে আতিয়ার সামান্য মনোযোগ নেই। শেষ বিকেলের আলো করিডর জুড়ে। আতিয়ার মুখ সেই আলোয় আবারও মিসবাহর চোখে অন্যরকম মায়াবী হয়ে দেখা দেয়। এগিয়ে গিয়ে কথা বলে না মিসবাহ। অথচ এরপর মিসবাহ এই নিয়ে তিনদিন হাসপাতালে আসলো। আর ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে আতিয়াকে ঠিকই আবিষ্কার করে নিলো প্রতিদিনই। নিজের কাছে নিজেই যুক্তি দিয়েছে বন্ধুকে দেখতে আসে। রোজই কিছুটা সময় দোকান থেকে নিয়ম করে বের হয়। বন্ধুর পাশে কিছুক্ষণ বসে। তারপর আতিয়াকে খুঁজে বের করে দূর থেকে দেখে চলে যায়। 

 

আকাশী নীল শাড়িতে পরিপাটি আতিয়াকে চমৎকার লাগে মিসবাহর। পরিশ্রম করায় মেদহীন শরীর আতিয়ার। সেদিন দোকানে জবুথবু অবস্থায় দেখেছিল আতিয়াকে। এখানে কর্মক্ষেত্রে সপ্রতিভ আতিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয় মিসবাহ। আতিয়ার শাড়ির কুচি কী নিখুঁত! এভাবে শাড়ি পরতে কারও নাকি কুঁচি ধরতে সাহায্য করতে হয়! পায়রা এটাই বলতো মিসবাহকে। পায়রার শাড়ি এলোমেলো হয়ে থাকতো। কোথাও যাওয়ার আগে মিসবাহকে অনুরোধ করতো শাড়ির কুঁচি ধরতে, না হলে ওর কুঁচি পিছলে যায়। মিসবাহর তখন এসব আদিখ্যেতা মনে হতো। পায়রার শাড়ি উঁচুনিচু হয় থাকতো পায়ের কাছে। আতিয়ার তো কেউ নেই। তাহলে ওর শাড়ি এমন টানটান কী করে! নিজে নিজেই হয়তো এমন পরিপাটি শাড়ি পরতে শিখে গিয়েছে। তবু মিসবাহর বড়ো শখ হয়, আতিয়ার পায়ের কাছে বসে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে। আতিয়া হাসে বড়ো কম। চোখ জোড়ায় রাজ্যের বিষণ্ণতা। মাঝেমাঝে করিডরে কাজের মাঝে ক্লান্ত আতিয়াকে আবিষ্কার করেছে মিসবাহ। সেসময়গুলো  মিসবাহর ইচ্ছে করেছে দুইকাপ চা হাতে নিয়ে সামনে যায়। দশ তলার উপর উদ্দাম বাতাসে করিডরের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আতিয়ার সাথে চা খেতে বড়ো শখ হয় মিসবাহর। কিন্তু ভাবনা আর আগায় না।

 

আজও চোখ জোড়া ইতিউতি আতিয়াকে খোঁজে। বন্ধু রিলিজ পেয়ে যাবে কাল। আর কোন বাহানায় হাসপাতালে আসা হবে না। বাড়িতেও আয়নার সাথে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। তবু আতিয়ার কী অমোঘ  আকর্ষণে পড়লো মিসবাহ! 

 

“কাউকে খোঁজেন?”

 

নারী কণ্ঠের ডাকে চমকে ওঠে মিসবাহ।

 

“আতিয়া না আপনি? ভালো আছেন? এখানেই চাকরি করেন তাহলে!”

 

নিজের অপ্রস্তুত ভাব লুকাতে মরিয়া মিসবাহ।

 

“জ্বি এখানেই কাজ করি। আপনার বন্ধুর কেবিন তো এদিকে না। কাউকে খোঁজেন?”

 

“আমার বন্ধুর কথা জানেন?”

 

“জ্বি আপনি কেবিনে ঢোকার সময় দেখেছি। পরে জানলাম রোজই আসেন বন্ধুকে দেখতে। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”

 

“জ্বি, জ্বি ধন্যবাদ। আপনি এখানে আছেন মনে থাকলে খুঁজে বের করতাম। হাসপাতালে পরিচয় কেউ থাকলে সুবিধা। মানে জরুরি দেখাশোনার জন্য ভালো।”

 

“আপনার বন্ধুর দেখাশোনায় কোন গাফলতি হচ্ছে না হাসপাতাল তরফ হতে। তিনি তো রিলিজও পাচ্ছেন।”

 

“জ্বি জ্বি। এই হাসপাতালের তো এমনিতেই ভালো সুনাম আছে। আপনাদের মতো দক্ষ লোকজন সেবা দিচ্ছেন।”

 

আতিয়া হেসে দেয়। মিসবাহকে গত দু’দিন ধরেই লক্ষ্য করেছে আতিয়া। দূর থেকে ওকে অনুসরণ করে মিসবাহ। এরপর কিছু না বলে চলে যায়। যদিও বিয়ে নিয়ে সমস্ত আশা ও বাদ দিয়েছে। তবুও দূর হতে কারও নজর ওকে অনুসরণ করছে, আর সে নজরে কোমলতা আছে, স্নেহ আছে ভেবে ভালো লাগে আতিয়ার। রোজকার কামার্ত পুরুষের ভয়াল নজর দেখে অভ্যস্ত আতিয়ার এই নজরে মনে অজানা শিহরণ হয়।

 

মিসবাহও আতিয়াকে আজ প্রথম হাসতে দেখলো। হৃদয় থেকে উঠে আসা হাসিরও এক অন্য রকম গুণ আছে। জটিল পরিস্থিতিও সহজ করে দিতে পারে। হৃদয়ের বরফ গলাতে পারে। এক আশ্চর্য জাদুর প্রদীপের মতো হাসি না বলা অনেক কথা বলে দেয়। জটিল সমীকরণ সহজ করে তুলে। মিসবাহ আবিষ্কার করে আতিয়ার হাসি বড়ো সুন্দর। 

 

দিন কেটে যায়। ক্যালেন্ডারের হিসেবে দুই সপ্তাহ শেষ। মিসবাহ দোকানের হিসেব দেখছে। মনটা ফুরফুরে। এমন সময় ফোনে কল আসে। আননোন নাম্বার দেখে রিসিভ করে মিসবাহ।

 

“হ্যালো।”

 

“আসসালামু আলাইকুম।”

 

রিনরিনে নারী কণ্ঠে অবাক হয় মিসবাহ। পরিচিত কারও কণ্ঠ নয়। তবুও চেনা চেনা লাগে।

 

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছিলেন?”

 

“জ্বি, আমি আয়না।”

 

একমুহূর্ত থমকে যায় মিসবাহ। আয়না! রত্নার মামাতো বোন! যার সাথে মা জাহনারা বেগম বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছেন। আয়না নাম্বার কোথায় পেল! মা দিয়েছেন! যেহেতু মিসবাহ এখনো বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না, পিছলে যাচ্ছে। তাই হয়তো আয়নাকে কথা বলতে বলেছেন। কিন্তু না, এটা হওয়ার কথা না। মিসবাহর মা যতই মরিয়া হোন, মিসবাহর সাথে বিয়ের আগে আয়নাকে এত কাছাকাছি আসার সুযোগ কখনোই দিবেন না। বরং বিয়ের পরও নানা নিয়ম কানুন আর বাহানা করে স্বামী স্ত্রীকে দূরে দূরে রাখার মানুষ মা। মায়ের মতে ছেলে স্ত্রীর বেশি কাছাকাছি গেলে পরিবার থেকে দূরে হয়ে যায়। আর মিসবাহকে তিনি পরিবার থেকে দূর করতে চান না।

 

“হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন?”

 

“জ্বি জ্বি। কী ব্যাপার আয়না, ফোন দিলেন যে। কোন সমস্যা?”

 

“না সমস্যা না। মানে একটু কথা বলতাম। যদি আপনি অভয় দেন। আর আমি যে ফোন দিয়েছি রত্না বা খালাম্মাকে বলবেন না প্লিজ। ফোন দিয়েছি শুনলে অনেক কথা শুনতে হবে আমাকে আমার বাড়িতে।”

 

“তাহলে ফোন দিলেন কেন?”

 

“মনকে সামলাতে পারি না। কেমন নিষ্ঠুর আর অসহায় লাগে সারাক্ষণ। মনে হলো আপনি আমার কষ্ট হয়তো বুঝবেন বললে। আপনার আম্মা একটু আগে জানালেন আগামী শুক্রবার আপনারা আসবেন। হয়তো সেদিনই কাবিন হবে। আমার বাসায় সবাই এত খুশি যে কিছু বলে পরিস্থিতি খারাপ করতে চাই না। এমনিতে নিজের পছন্দে বিয়ে করে কম ভুগিনি। নিজের পরিবারকেও ভুগিয়েছি। তাই তাদের উপর কথা বলার সাহস বা শক্তি কোনটাই আর নাই।”

 

মনে মনে চমকে যায় মিসবাহ। শুক্রবার বিয়ে মানে! আম্মা একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! এই বাড়াবাড়ি মিসবাহর আর ভালো লাগে না। সে এখন আর কমবয়সী ছোকরা কেউ না যে তার সিদ্ধান্ত বাবা মা নিবেন। রীতিমতো মধ্যবয়সী পুরুষ। কিন্তু আয়নার সমস্যাটা কোথায় জানা দরকার। আয়নাও যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে, তাহলে বিষয়টা সহজেই সমাধান হয়ে যাবে। আজ বিকেলে আতিয়াকে নিয়ে বেড়িবাঁধের কাছে যাওয়ার কথা। ওখানে ঘন্টা হিসেবে নৌকায় ঘোরা যায়। আতিয়াই কথায় কথায় বলেছে ওর খুব ইচ্ছে নৌকায় ঘুরবে। কোনদিন এসব করা হয়নি মিসবাহরও। তাই অজানা টানে আজ দ্রুত হাতের কাজ শেষ করছে। ঘড়ি যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। চারটা বাজতে দেরি নেই। এর মাঝেই আয়নার ফোন। কিন্তু আয়নার কথাগুলোও শোনা প্রয়োজন।

 

“বলুন আয়না। কী বলতে চান। আমি শুনছি। আপনার কি অন্য কাওকে পছন্দ?”

 

“না না কী বলেন! এসবের মাঝে আমি আর নেই। একবার তো নিজে ভালোবেসে বিয়ে করে দেখেছি। এসব প্রেম ভালোবাসায় সুখ নেই।”

 

“সুখ আসলে কোথায় আয়না! আমি তো পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। সুখপাখির দেখা তো পাইনি। আমার তো মনে হলো জীবনে প্রেমের অভাবেই হয়তো এই সুখপাখির দেখা কখনো পাওয়া হয়নি।”

 

“বিয়ের পর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বিয়ের আগেই প্রেম করতে হবে কথাটা বোধহয় ভুল। দায়িত্ববান আর অনুভূতিশীল মানুষ হলে প্রেম যেকোন সময় হতে পারে। কিন্তু মুখ ভর্তি প্রেমের আলাপ, আর অন্তর ভর্তি বিষ নিয়ে থাকা দায়িত্বহীন মানুষকে জীবনে জড়ালে যে কী পরিমাণ ভুগতে হয়, তা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।”

 

“তা হলে অন্য আর কী সমস্যা?”

 

“আমি এখন আপনার আম্মাকে খালাম্মা বলেই বলি। বিয়ের আগে আম্মা বলতে লজ্জা লাগে।”

 

“জ্বি বলেন। আম্মা কোন লেনদেনের কথা বলেছে?”

 

“লেনদেনের কথা তো আগেই হয়েছে। রত্না আপা জানিয়েছেন। আব্বা আম্মার এসবে কোন আপত্তি নাই। তারা আমার একটা ভালো বিয়ে চান। আমি আগে না চাইলেও এখন চাই। কারণ বুঝতে পারছি যত দিন যাচ্ছে আমি গলগ্রহ হয়ে যাচ্ছি ভাইদের। কাল আব্বা আম্মা মারা গেলে, ভাই ভাবিদের অনুগ্রহ আর দয়ায় কাজের মানুষের মতোই জীবন কাটাতে হবে। আমার স্কুলের বেতন আর কয় টাকা। নিজের একটা সুন্দর সংসার হোক আমিও তাই চাই।”

 

“আম্মাকে আমি এসব টাকা পয়সা লেনদেনের কথা বলতে নিষেধ করেছিলাম।”

 

“থাক ওসব নিয়ে খালাম্মাকে কিছু বলবেন না। না চাইলেও আব্বা আম্মা দিতেন। ডিভোর্সি মেয়ের জন্য এই খরচ করতে হবো ওনারা জানেন।”

 

“আমিও ডিভোর্সি পুরুষ।”

 

“দুটো তো এক না সমাজে। আসলে আমি এই জন্য ফোন দেই নাই। আপনার নাম্বার গোপনে যোগাড় করেছি একটা অনুরোধ করতে। কারও কাছে জোর গলায় নিজের একটা আর্জি জানানোর জোর নাই। শেষমেশ আপনার কাছে সাহস করে ফোন দিলাম। আপনিও তো এক সন্তানের পিতা। আমার ছেলেটাকে আমার সাথে গ্রহণ করেন প্লিজ। ওরা ওকে বোর্ডিং এ পাঠিয়ে দিবে। ছেলেকে নেওয়ার জন্য যেন কোন চাপ না দেই তা খালাম্মা আগেই জানিয়েছেন। রত্না আপাও নিষেধ করেছেন। তাই কেউ আমার ছেলের জন্য বিয়েটা ভাঙুক চায় না। আমি কোন উপায় না পেয়ে আপনাকে অনুরোধ করতে ফোন দিয়েছি। আমাদের সাথে রুমে রাখা লাগবে না। বাসার যেকোন জায়গায় ওর জন্য একটা খাট পেতে দিলে হবে। বা বসার ঘরে ফ্লোরিং করে থাকবে। আমার ছেলেটা খুব নরম সরম ঠান্ডা। কোন দুষ্টুমি করবে না। করলে আমি নিজে শাসন করবো। পলিনের কোন অযত্ন হবে না। স্কুলের বেতনও আপনার দেওয়া লাগবে না। আমার স্কুলের চাকরির বেতন থেকে আমি কিছুটা জমাতাম, আর আব্বা এফডি করে দিয়েছেন কিছু টাকা। সেখান থেকেই ওর পড়ালেখা চলবে। আপনি শুধু ওকে আমার কাছে রাখার অনুমতি দেন। প্লিজ প্লিজ। আর রাজি না হলেও বিয়েটা ভাঙবেন না প্লিজ। আমি অনুরোধ করায় বিয়ে ভেঙে গিয়েছে জানলে বাড়িতে বিরাট অশান্তি হবে।”

 

আয়নার ফোন রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মিসবাহ। এ কী পরিস্থিতিতে ফাঁসলো। একজন ওর সাথে সংসার হচ্ছে ধরেই নিয়েছে, আরেকজনকে সে নিজে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে একটু একটু করে। দুজনের কারও সাথেই খারাপ কিছু হোক চায় না মিসবাহ।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১৩

 

আতিয়া ডিউটি শেষে আজ বাসায় যায়নি। বাসায় আগেই জানিয়েছে যে আজ ওভারটাইম আছে, ফিরতে দেরি হবে। আতিয়া সোনিয়ার সাথে তার হোস্টেলে আসে। রুমে ঢুকে ব্যাগ খোলে আতিয়া। নিউমার্কেট থেকে ছয়শো টাকা দিয়ে কেনা এই ব্যাগটা সাইজে বেশ বড়ো। ব্যাগের বয়স হয়েছে দুইবছর। টিফিন বক্স, টুকটাক জিনিসপত্র সহ অনেককিছুই আঁটে বলে এ-ই ব্যাগটাই আতিয়া সবসময় ব্যবহার করে। আজ টিফিন বক্স আনেনি। হসপিটালে খাওয়া আছে বলেছে। যদিও মা দেলোয়ারা বেগম বলেছিলেন টিফিন বক্স নিতে, ভালো খাওয়া হলে বরং প্যাকেট বাসায় নিয়ে আসতে। কিন্তু বুঝিয়েছে আজ কোন অনুষ্ঠান নাই, বরং ওটি রুমের দায়িত্ব আছে। ওটি শেষে অপারেশন রুমে কাজ করা সবাইকে বিরিয়ানি দেয় না বরং ভাত, ডাল, মুরগী বা রুই মাছ দিবে খেতে। এগুলো এত ভালো কিছু না। রাত পর্যন্ত রাখলে বরং টক হয়ে যাবে।

 

আতিয়া আজ ব্যাগে টিফিন বক্সের বদলে যত্ন করে ভাঁজ করা শাড়ি ঢুকিয়েছে। এই শাড়িটা নতুন। মিসবাহ উপহার দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে দামি শাড়ি। হাওয়াই মিঠাই রঙের জামদানিতে রূপালি সুতোর কাজ। আড়ং থেকে কেনা। কত টাকার শাড়ি কে জানে! এত দামি উপহার নিতে ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল আতিয়ার। কিন্তু মিসবাহর পিড়াপিড়িতে নিয়েছে। না এখনো তারা একে অপরকে ভালোবাসি বলেনি। এই বয়সে এসে এসব আবেগমাখা কথা বলতে দু’জনই লজ্জা পায়। তাদের কথাগুলো দৈনন্দিন খোঁজ খবরেই সীমিত। কিন্তু দিনদিন তার পরিধি বাড়ছে। ভোরে মিসবাহ আসতে না পারলেও ডিউটি শেষে ঠিকই হাসপাতালের অপজিট রাস্তায় বাইক নিয়ে হাজির হয়। আতিয়া লাজুক মুখে বাইকের পেছনে গিয়ে বসে। 

 

“আচ্ছা, আপনি আসেন কেন? আমি তো বাসেই যেতে পারি। রোজ রোজ দোকান ফেলে আসলে আপনার ক্ষতি না?”

 

“আধাঘন্টার বিরতি ক্ষতির কিছু নাই। কাজের ফাঁকে আগেও বিরতি নিতাম। তখন অন্য দোকানি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম। এখন বরং ভালো হলো। একটা পার্ট টাইম কাজ পেলাম।”

 

“পার্সোনাল পাঠাও ড্রাইভার হতে চান?”

 

“রাইডার চাইলে অবশ্যই।”

 

লাজুক মুখে হাসি আতিয়া। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায় যে মাকে কথা দিয়েছিল আর নতুন জীবনের কথা ভাববে না। অন্ততঃ ভাইবোনগুলোর গতি না হওয়া পর্যন্ত ভাববে না। কিন্তু মন আর মস্তিষ্ক দুই আলাদা পথে চলে। এখনি বয়স পঁয়ত্রিশ। এই সময় জীবন গুছিয়ে না নিলে আর কখনোই গোছানো হবে না। ওর অবস্থা হবে সায়মা দিদির মতো। সায়মা দিদি সিস্টার ইনচার্জ ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলের কথা ভেবে আর বিয়েশাদি করেননি। ছেলে বড়ো হয়ে বিদেশে চলে যায়। একসময় বেদেশি এক মেয়ে বিয়ে করে সেখানেই সেটেল্ড হয়ে যায়। নাতি নাতনিদের দেখার সৌভাগ্যও সায়মা দিদির হয়নি। দীর্ঘদিনের একাকিত্বে শরীরে অসুখ বাসা বেঁধেছিল। শেষের দিকে দিদি প্রায় মৃত স্বামীর স্মৃতিচারণ করতেন। আতিয়াকে বলতেন, একটা বয়সের পর আসলে সন্তান, মা বাবা শুধু নয় বরং একজন সঙ্গীরও প্রয়োজন হয়। না শুধু  শারীরিক চাহিদার সঙ্গী নয়, বরং মানসিক চাহিদার জন্যও সঙ্গী প্রয়োজন। সঙ্গী খাবে বলে তখন রাঁধতে মন চায়। একা একা তখন পোলাও বিরিয়ানি দূর ডাল ভাতটাও আর নিজের জন্য প্রতিবেলায় তৈরি করতে মন চায় না। দিনশেষে বিছানায় গিয়ে সারাদিনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা কারও সাথে বলতে মন চায়। কথাগুলো না হলে বুকের ভেতরই গুমরে মরে। অসুস্থতায় কপালে প্রিয়জনের কুঁচকানো চামড়ার অমসৃণ হাত তখন অপরিসীম শান্তি যোগায়। দিদি আতিয়াকে বলতেন একসময় আতিয়ার মা বেঁচে থাকবেন না, ভাইবোনগুলোর নিজের সংসার হবে। তখন আতিয়া নিজের জন্য একা নিজেকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবে! ঝগড়া করার জন্য হলেও একজন সঙ্গী লাগে। রোজকার নিত্যকার অশান্তিও মানুষকে বাঁচার জন্য জ্বালানি দেয়। সায়মা দিদি হয়তো এসবের অভাবেই ফুরিয়ে গিয়েছিলেন। কিডনি ড্যামেজে অকালেই মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর পর ছেলে এসে জায়গা জমি বিক্রি করে একবারে টাকাপয়সা নিয়ে চলে গিয়েছিল। মায়ের কবরে গিয়ে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলেছিল কিনা তা আর জানা হয়নি। সায়মা দিদিকে দেখেই মূলত একাকিত্বের ভয় জাঁকিয়ে বসেছিল আতিয়ার মনে। তার তো নিজের সন্তানও নেই। সত্যি সত্যি সে একসময় সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে না তো! মা দেলোয়ারা বেগম মিসবাহর কথা জানতে পারলো ভাববেন আতিয়া স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের জীবন যৌবন নিয়ে ভেবেছে। কিন্তু আতিয়া তো বোঝাতে পারবে না যে তার চাহিদা শুধু শারীরিক নয়, বরং নিজের মতো করে নিজের একজন মানুষকে পাওয়ার। আর এই চাওয়াটা তো অপরাধ নয়।

 

কাঁঠালবাগানের ঢালের মুখেই নেমে যায় আতিয়া। বাকি পথটুকু হেঁটে যায়। কোন এক অজানা অস্বস্তিতে বাসার সামনে পর্যন্ত মিসবাহকে নেয় না। কার কাছে যেন ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। অথচ আতিয়া বাচ্চা মেয়ে নয়, মিসবাহও পরিণত মধ্যবয়সী একজন। তবু কিশোর কিশোরীর মতোই স্বল্প সময়ের জন্য লুকিয়ে চুরিয়েই প্রেম করছে যেন! যেই প্রেম এখনো নিজেরাই নিজেদের কাছে স্বীকার করেনি। তবু সেই প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে আর স্বীকৃতি পেতে দু’জনই মরিয়া। আতিয়াকে নামিয়ে দিয়ে মিসবাহও বসুন্ধরায় নিজের দোকানে ফিরে যায়। রোজকার এই বিশ পঁচিশ মিনিটের জন্য আতিয়া সারাদিন মান অপেক্ষা করে থাকে। বন্ধু তেমন কেউ নেই যার সাথে মিসবাহকে নিয়ে নিজের অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে পারে। আশিককেও জানায়নি এখনো। ভাইয়ের সাথে এসব কথা বলতে লজ্জা লাগে। আজ প্রথম একসাথে বেড়াতে যাচ্ছে। বেড়িবাঁধে যাবে। নৌকায় মিসবাহর সাথে ঘুরবে বলে এই প্রস্তুতি নিয়ে আসা। চিন্তা আর উত্তেজনায় কাজে ভুল হয়েছে বারবার। তবু ভীষণ ভালো লাগছে। মেট্রনের বকাও আজ গায়ে লাগেনি। আতিয়ার বয়স যেন এক ঝটকায় দশবছর কমে তরুণী হয়ে গিয়েছে। এই শাড়ি কই পরবে তা নিয়ে একটু চিন্তায় ছিল। হাসপাতাল থেকে সেজেগুজে বের হলে সবার চোখে পড়বে আর মায়ের কানে যাবেই। কেননা হাসপাতালের পুরনো কর্মীদের সাথে বাবার বদৌলতে মায়ের আগে থেকে পরিচয় আছে। তারাই নিজ উদ্যোগে মাকে ফোন দিয়ে গরম গরম ঘটনা জানিয়ে দিবে। এতদামি শাড়ি, ঘুরতে যাওয়া এসব দেখে মা দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে অশান্তি শুরু করবেন। আতিয়া আর বিয়ে করতে আগ্রহী নয় ভেবে মা ইদানীং ভালো মেজাজে আছেন! মাকে আতিয়া অপরাধী  করতে পারে না। স্বার্থপর ভাবতে পারে না। স্বামীহারা, কোন রকম আয়হীন একজন মহিলার জায়গায় আতিয়া থাকলে আতিয়াও হয়তো এমনই ভাবতো। কর্মক্ষম, আয় করা সন্তানকে তখন ছাড়তে চাইতো না। নিজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাই হয়তো মানুষকে এমন বানিয়ে দেয়।

 

সোনিয়া মেয়েটা ভালো। আতিয়ার চেয়ে অনেক ছোট। মাত্রই জয়েন করেছে হাসপাতালে। বয়স বাইশ তেইশ। এখনো বিয়েশাদি হয়নি। হোস্টেলে থাকে। আতিয়া আড়ালে নিয়ে অনুরোধ করতেই খুশিমনে আতিয়াকে নিয়ে এসেছে রুমে। এখন আগ্রহ নিয়ে আতিয়াকে রেডি হতে সাহায্য করছে। তেমন কোন সাজগোছের জিনিস আতিয়ার নেই। কাজল, ক্রিম, পাউডার আর লিপস্টিক। এই আতিয়ার সাজের জিনিস। সোনিয়া এটাসেটা সাজের জিনিস বের করে দেয়।

 

“সোনিয়া, বোন এত কিছু লাগবে না। আমি এগুলো আগে লাগাইনি। এখন লাগালে নিজেরই আজব লাগবে। তুমি শুধু আমাকে একটু ফেসপাউডার দাও।”

 

“আপু আপনি চুপচাপ বসে থাকেন তো। আপু এত সুন্দর শাড়ির সাথে একটা সুন্দর ব্লাউজ বানাতেন।”

 

“শাড়িটা ভাঁজই খোলা হয়নি। আচ্ছা সাদা ব্লাউজে কি মানাবে না বোন?”

 

“মানাবে আপু। চুল ছেড়ে রাখবেন না আপু?”

 

“না খোঁপাই ভালো। চুল ছাড়তে লজ্জা লাগে। সোনিয়া কাউকে আজকের গল্প করো না বোন। জানোই তো আমি সেজেগুজে কারও সাথে বেড়াতে গিয়েছে শুনলে সবাই কেমন পেছনে উল্টাপাল্টা কথা বলবে।”

 

“আপু আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। আর আপনি ঘুরতে যাচ্ছেন এতে মানুষের এত জ্বালা কেন হবে। সবার কাহিনি জানি। যেগুলো ঘরে বৌ জামাইয়ের সার্টিফিকেট ঝুলিয়ে অন্য কলিগদের সাথে পরকীয়া করে। সেগুলোরই এসব বিষয়ে নাচানাচি বেশি।”

 

“থাক বাদ দাও। ওরা তো আর একলা না। সংসার আছে, বাচ্চা কাচ্চা আছে। ওদের তাই সংসারের বাইরে দুইনম্বরি করারও লাইসেন্স আছে মনে করে। যত নজর আমার মতো মধ্যবয়সী একা মহিলাদের দিকে। আমরা কারও সাথে হাসলেও নটি বেটি হয়ে যাই। কারও সাথে ঘুরতে গেলে আমাদের চরিত্র খারাপ হয়ে যায়। ওদের ধারণা একা মহিলাদের কোন মান ইজ্জত নাই। আমি এদের ভয় পাই।”

 

“ভয় পাওয়ার কিছু নাই আপু। আপনি হবু দুলাভাইয়ের সাথে নিশ্চিন্তে ঘুরতে যান। দাঁড়ান তো আপু। দেখি আপনাকে। মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ, আমিই তো নজর ফেরাতে পারছি না আপু। এত সুন্দর লাগছে।”

 

আতিয়া নতুন বৌয়ের মতো মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিচে নামে। হাতে শুধু ছোটো একটা পার্স। বোরখা, বড়ো ব্যাগ সব সোনিয়ার হোস্টেল রুমে রেখে এসেছে। যাওয়ার সময় পাল্টে যাবে। মিসবাহ বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আয়নার ফোনে যদিও তার মনোজগৎ সামান্য এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তবু রিনঝিন কাঁচের চুড়ির শব্দে ধ্যান ভাঙে। সামনে দাঁড়ানো আতিয়াকে দেখে একমুহূর্তের জন্য থমকে যায়। এই আতিয়া যেন অন্য কেউ। মাথায় ঘোমটা দেওয়ায় কেমন বৌ বৌ মনে হচ্ছে। 

 

“আতিয়া আমাকে বিয়ে করবে?”

 

আর এক মুহূর্ত দেরি করে না মিসবাহ। ঘাড় নেড়ে সায় দেয় আতিয়া।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১৪

 

আলো আজ আবার একটা কাজ করেছে। টাকা না, মায়ের একটা সোনার আঙটি চুরি করেছে। এবার অল্পতে পোষাবে না। পাঁচ ছয় হাজার টাকার মামলা। এত টাকা আতিয়া বা আশিক কারও ব্যাগে পাবে না। রাতুলের বন্ধুরা তাদের গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে রিসোর্টে যাচ্ছে। রাতুলের ইচ্ছে আলোও তার সাথে যাবে। আলোর আপত্তি নেই। আলো আগে কখনো দামি রিসোর্টে যায়নি। আতিয়ার সাথে আতিয়ার হসপিটাল থেকে আয়োজিত পিকনিকে দু’বার গিয়েছে। তবে সেগুলো আসলে কম খরচের পিকনিক স্পট, রিসোর্ট না। রিসোর্ট নাকি খুব সুন্দর। রাতুল বলেছে এসি রুম আছে, সাথে সুন্দর বাথরুম আর তাতে বাথটাবও আছে। সুইমিং পুলে নেমে গোসল করা যায়। রিসোর্টের ভেতরেই মিনি চিরিয়াখানা, ফল, ফুলের বাগানসহ কী নেই! আলোর মন তো তখন থেকেই নাচছে। একেকটা রুমের ভাড়া নাকি দশ পনেরো হাজার! রাতে থাকবে না তারা। সকালে যাবে, সন্ধ্যায় আসবে। বাসায় বলেছে বোর্ড পরীক্ষার আগে স্কুল থেকে র‍্যাগ ডে হবে। দেলোয়ারা বেগম অবশ্য বলেছেন,

 

“কয়দিন আগেই না তোদের বিদায় দিলো! আবার কী বিদায়! দুইদিন পর এসএসসি পরীক্ষা।”

 

“এবার পিকনিকের মতো হবে আম্মা। আমরাই খাওয়া দাওয়া নাচ গানের আয়োজন করবো।”

 

“এত কিসের নাচ গান বুঝি না। বোর্ডের পরীক্ষার আগে মানুষের পড়তে পড়তে নাকের পানি চোখের পানি এক কইরা ফালাই। তোদের দেখি নাচ, গান খানাপিনা শ্যাষ হয় না। আমি কোন চান্দামান্দা দিতে পারুম না।”

 

“ক্যান পারবা না? যাই বলি পারবা না পারবা না করো। এখন তো ভাইয়াও কামাই করে। তোমার হাতে আট হাজার টাকা দিছে মাসের শুরুতে।”

 

“তোরোও এক হাজার দিছে না? কী করছস! জুতা কিইন্না নষ্ট করছস। আর আমার আট হাজারও তোদের পেটেই গ্যাছে। এই যে মুরগী রাঁধছি, সেইটা বিনা পয়সায় আসছে? আতিয়ার টাকা দিয়া ঘর ভাড়া, কারেন্ট ভাড়া দিছি। আশিকের টাকা বাজার করতে খরচ হয়। জিনিসের দাম জানছ?”

 

“যাই চাই, তাই এমনে মানা করো। এক জোড়া ভালো জুতা ঈদ ছাড়া কিনে দাও না। জামার কথা বাদই দিলাম।”

 

আলো ঘ্যানঘ্যান করলেও দেলোয়ারা বেগম নরম হন না। আশিকের কাছে টাকা চাইলে আশিক দুইশো দেয়, আর আতিয়া একশো। তিনশো টাকায় কী হয়! একটা ভালো টপসও হবে না। রাতুল বারবার বলেছে সুইমিং এর জন্য আলাদা কাপড় নিতে। আলোর মেজাজ খারাপ হয়। ইদানীং আশিকও মানিব্যাগে টাকা কম রাখে। শেষবার পাঁচশো টাকা হারানোর পর অনেক মন খারাপ করেছে। যদিও বলেছে টাকা হারিয়ে গিয়েছে। চুরি হয়েছে বুঝতে পারেনি। দু’দিন আলো ভয়ে ভয়ে ছিল, কিন্তু যখন দেখলো হারানো টাকা নিয়ে ওকে কোন প্রশ্ন করা হয়নি, তখন নিশ্চিন্ত হয়েছে। আজ বাসায় মেজোবোন আয়েশা এসেছে অনেকদিন পর। আতিয়া আর আয়েশার ভেতর ঠান্ডা যুদ্ধ চলে বলে আতিয়া বাসায় থাকলে আয়েশা স্বামী খলিলকে নিয়ে আসে না। আজ আতিয়া বাসায় আসতে দেরি হবে শুনে মাকে দেখতে এসেছে। মা অন্য ঘরে শুয়ে আয়েশার সাথে গল্প করছে। আলমারির চাবিটা বালিশের নিচেই পেয়ে যায়। আলমারি খুলে কাপড়ের নিচ থেকে ছোটো বাক্সটা বের করে। দেলোয়ারা বেগমের গয়নাগাটি এই বক্সেই রাখা। মা একদিন বলেছেন আতিয়া আর আয়েশার জন্য যা করার করেছেন। আশিক বিয়ে করলে নিজের বৌয়ের গয়না নিজেই দিবে। এখানে যে টুকটাক গয়না আছে সেগুলো তিনি আলোর বিয়েতে দিবেন। তাই আলোর মনে হয় কোন চুরি করছে না। এগুলো তো তারই হবে একসময়। চেইন ওঠাতে গিয়েও সাহস হয় না। এত দামি জিনিস বিক্রি করতে পারবে না, ভয় লাগে। তারচেয়ে ছোটো একটা আঙটি নিলেই ভালো। আপাততঃ কাজ চলে যাবে।

 

আঙটি নিয়েই ব্যাগ গুছিয়ে বের হতে যায়,

 

“আম্মা, কোচিং এ গেলাম। গেট লাগাও।”

 

“যা। দরজা টাইন্না যা। আর রাইত করবি না।”

 

আলো ধুপধাপ নিচে নেমে হাঁটা দেয়। কোথায় বিক্রি করা যায় আঙটি তাই ভাবছে। এই আঙটি ব্যাগে রাখা যাবে না। দ্রুত বিক্রি করে টাকা নিতে হবে। তারপর রাতুলের সাথে শপিং এ যাবে। রিসোর্টের খরচ রাতুলই দিবে। কিন্তু রিসোর্টে পরার জন্য ভালো পোশাক কিনবে। সাজের জিনিস কিনবে। রাতুলের বন্ধু বান্ধবদের গার্লফ্রেন্ডরা খুব টিপটপ। রাতুল বারবার বলে দিয়েছে, তার গার্লফ্রেন্ডকে যেন সবার চেয়ে সেরা লাগে।

 

আতিয়া বিয়ের জন্য  হ্যাঁ তো বলে দিয়েছে। কিন্তু এখন লজ্জায় মাথা তুলে মিসবাহর দিকে তাকাতে পারছে না। মিসবাহ নৌকা দরদাম করে ঠিক করছে। নৌকায় উঠে আতিয়াকে ইশারায় নৌকার কাছে আসতে বলে। আতিয়া নৌকায় পা দিতে কেমন দুলে ওঠে। ভয় পেয়ে সরে যায় আতিয়া। আগে কখনও নৌকায় ওঠা হয়নি।

মিসবাহ হাত বাড়িয়ে দেয়,

 

“আসো ভয় নাই হাত ধরো।”

 

“শক্ত করে ধরে রাখো। আমি সাঁতার জানি না।”

 

“বোকা হাঁটু পানি এখানে। ডুববে না। আর ডুবলেও আমি আছি।”

 

দু’জন দু’জনের অজান্তেই তুমি করে বলতে শুরু করেছে। মিসবাহর হাত ধরে নৌকায় উঠে আসে আতিয়া। মনে পড়ে এমনই একটা স্বপ্ন দেখেছিল একদিন। সেদিন হাত ধরা পুরুষটির চেহারা বোঝা না গেলেও আজ বুঝতে পারছে সে মিসবাহই ছিল!

নৌকা চলতে শুরু করেছে। নদীর মিষ্টি বাতাসে মাথার ঘোমটা পড়ে যায় আতিয়ার। মিসবাহ হাত দিয়ে খোঁপাটা খুলে দেয়। আতিয়া বাঁধা দিতে গেলে বলে,

 

“খোলা চুলে দেখিনি কখনো। থাকুক না এভাবে।”

 

আতিয়ার একমাথা কালো চুলে আজ শ্যাম্পু করেছিল। চুলের ধরন বেশ ভালো আতিয়ার। এখনো বয়সের সাদা দাগ লাগেনি। ঝরঝরে চুলগুলো বাতাসে ওড়াউড়ি করছে। কয়েকগাছি চুল বারবার এসে পড়ছে মুখের উপর। মিসবাহ মুগ্ধ হয়ে দেখে। ঘন ভ্রু, দীঘল পাপড়ির বড়ো বড়ো চোখ, আর উজ্জ্বল ত্বকের আতিয়াকে কী ভীষণ সুন্দর লাগে মিসবাহর। পায়রাও সুন্দরী ছিল, সুন্দরী আয়নাও। কিন্তু তাদের কারও সৌন্দর্য যেন এমন হৃদয়ে কাঁপন তোলার মতো লাগেনি কখনো। এ কি শুধুই মায়া আর ভালোবাসার খেলা! হয়তো আতিয়াকে মন থেকে ভালোবাসে ফেলেছে বলেই আতিয়াকে সাধারণের মাঝেও অসাধারণ লাগে মিসবাহর। এমনটা আর কারও জন্য অনুভব করেনি এই চল্লিশ বছরেও। হয়তো আর করবেও না। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় মিসবাহ। আয়নার ভালোর জন্য একটা ব্যবস্থা মানবিক দিক থেকেই করবে। কিন্তু বিয়ে যদি করতে হয় তবে আতিয়াকেই করবে। আয়নাট ব্যাপারটা ঠিক করে তবেই আতিয়াকে বিয়ে করতে হবে। আপাততঃ আতিয়াকে আয়নার কথা কিছু বলে পরিবেশটা নষ্ট করতে চায় না মিসবাহ।

 

“আতিয়া।”

 

“জ্বি।”

 

“আমি তোমার বাসায় লোক পাঠাবো। তোমার বাসায় মুরুব্বি তো তোমার আম্মা শুধু তাই না?”

 

“মিসবাহ তোমাকে একটা কথা বলা হয় নাই।”

 

“কী কথা?”

 

“আমার চাকরিটা খুব দরকার।”

 

“তোমাকে চাকরি ছাড়তে হবে তো বলিনি। হ্যাঁ আমার মা রাগারাগি করবেন। আগের দিনের মানুষ তো। কিন্তু তুমি সামলাতে পারবে না?”

 

“সমস্যা আমার মা নিজে। চাকরি আমার নিজেরই আর করতে ভালো লাগে না। চাকরি করা কোনদিনও আমার স্বপ্ন ছিল না। সারাজীবন শুধু একটা ঘর চেয়েছি। গুছিয়ে সংসার করতে আমার খুব ভালো লাগতো। আজ হাসান বেঁচে থাকলে আমাদের সংসারের তেরো বছর চলতো, আমার বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে এখন স্কুলে পড়তো। বিশ্বাস করো আমি এই জীবনটাই চেয়েছি। দুটো মায়া মায়া সন্তান আর একজন ভালো জীবনসঙ্গী। ঠিক যেন একটুকরো চাঁদের হাট। পৃথিবীটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। আমি হঠাৎ গৃহিণী থেকে ঘরের একমাত্র আয় করা সদস্য হয়ে গেলাম। আমার চাকরিটা আমার পরিবারের চলার অবলম্বন। অন্ততঃ যতদিন আমার ভাইবোনগুলো দাঁড়িয়ে না যায়। আর এখানেই আমার আম্মার ভয়। আম্মা ভাবেন আমি আবার বিয়ে করলে আমার শ্বশুর শাশুড়ি আর চাকরি করতে দিবে না। দিলেও আমার চাকরির টাকা আমি আর বাবার বাড়িতে দিতে পারবো না। আমি আপনার কাছে খালি এইটুকু চাই যে আমি যেন প্রতিমাসে মায়ের হাতে বাড়ি ভাড়া আর বাজার খরচের জন্য বিশ হাজার তুলে দিতে  পারি। আমি মন থেকে চাই তোমার সংসারটা করতে। স্বামী সন্তান নিয়ে একটু সুন্দর জীবন কাটানোর বড়ো শখ আমার।”

 

টলমল চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আতিয়ার। ঠোঁটগুলো কান্না আটকাতে কাঁপতে থাকে। মিসবাহর কী যেন হয়। দু হাতে মুখখানি তুলে গভীর মমতায় চুমু এঁকে দেয় আতিয়ার ঠোঁটে। যেন শুষে নিতে চায় আতিয়ার সমস্ত কষ্ট আর কান্না। 

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১৫

 

পুরনো আঙটি, ক্ষয়ে গিয়ে দুই আনা চার রত্তির মতো আছে। তবে পুরনো স্বর্ণ আর রিসিট না থাকায় আলো পেলো মাত্র সাত হাজার টাকা! অবশ্য সাত হাজারও আলোর জন্য বিশাল ব্যাপার। শপিং এর জন্য তিন হাজার রেখে, বাকি চার হাজার কলেজ ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে ফেললো। ব্যাগের ভেতরে একদম নিচের দিকে সেলাই খুলে নিয়েছিল আলো। সেই ছেঁড়া জায়গা দিয়ে টাকা ঢুকিয়ে আবার সেলাই করে দিয়েছে। কালো সুতো আর সুঁই সাথে করেই নিয়ে এসেছিল। রাতুলের সাথে গিয়ে প্রথমেই এক হাজার টাকা দিয়ে একটা পার্টি ব্যাগ কিনেছে। এত দামি ব্যাগ আলো এর আগে কখনো ব্যবহার করেনি। মা আর বোনেরা কখনো পাঁচশো ছয়শোর উপর ব্যাগের জন্য খরচ করেনি। বাকি দুই হাজার দিয়ে সুইমিং করার জন্য টপস আর প্যান্ট নিয়েছে। লিপস্টিক আর ফাউন্ডেশনও নিয়েছে।  হাতে বাকি থাকা পাঁচশো টাকা আর খরচ করেনি। রিসোর্টে গেলে হাতে কিছু রাখা দরকার। 

 

বাসায় ফিরে দেখে ধুন্ধুমার কান্ড। মেজো আপা আয়েশা আর মা দেলোয়ারা বেগম গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করছেন। আপার স্বামী খলিল দুলাভাইও আপার সাথে তাল মিলিয়ে চেঁচামেচি করছেন। 

 

বিষয় হলো খলিল, শাশুড়ি দেলোয়ারা বেগমের কাছ থেকে ধার নেওয়ার আগে বলেছিল কয়েকমাসের ভেতর লাভ সহ লাখ টাকা ফেরত দেবে। মাস পেরিয়ে গেল, কিন্তু এখনও খলিলের টাকা দেওয়ার খবর নেই। দেলোয়ার বেগম গত কয়েকদিন ধরেই মেয়ে আয়েশাকে এই বিষয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। দেলোয়ারা বেগমের ইচ্ছে ছিল টাকাগুলো পেলে স্বর্ণকারের দোকানে যাবেন। এক জোড়া কানপাশা বানাবেন। স্বর্ণের দাম হুহু করে বাড়ছে। আর দাম কমার কোন সম্ভবনাও নেই। এখনো ছোটো মেয়ের বিয়ে বাকি। ছেলের বিয়েতেও কিছু না হোক একটা চেইন অন্ততঃ দিতে হবে। নিজের জন্য সোনার কিছুই তখন থাকবে না। কানপাশাটা তাই নিজের জন্য বানিয়ে রাখতে চান। আজ যখন হঠাৎ আয়েশা বাসায় আসে, দেলোয়ারা বেগম খুশি হয়ে যান। ধরেই নিয়েছেন আজ আয়েশাকে নিয়ে যাওয়ার সময় খলিল টাকা নিয়ে আসবে। আশিকের দেওয়া টাকা থেকে মেয়ে জামাইয়ের জন্য ভালো বাজার করিয়েছেন। মুরগী, মাছ দুটোই রেখেছেন দুপুরের আয়োজনে। কিন্তু এই বিদায়বেলায় যখন খলিল আর আয়েশা টাকাপয়সার কথা কিছু পরিষ্কার না করে চলে যেতে উদ্যত হয়, তখন মুখ ফুটেই টাকার কথা তোলেন দেলোয়ারা বেগম।

 

“খলিল, বাবা টাকাটা পাইলে খুব ভালো হইতো। জানোই তো আতিয়া আগের মতো টাকা পয়সা দেয় না। আশিকের বেতন কত! ডাক্তার দেখামু, টেস্ট করুম। টাকা পয়সা হাতে নাই।”

 

কণ্ঠে দরদ আর অসহায়ত্ব এনে বলেন দেলোয়ারা বেগম।

 

“আতিয়া আপা টাকা দেয় না ক্যান? খোঁজ খবর করেন আম্মা। কোন ব্যাটার পাল্লায় পড়ছে নাকি! বহুত ভাদাইম্মা লোক থাকে, এমন একা মহিলাগো কামাই খাইতে প্রেম ভালোবাসার কথা কইয়া ফুসলায়। আপা তো কয়দিন আগেও বিয়া বইতে অস্থির আছিল। আপনে কইলে খোঁজ নিয়া দেখি।”

 

“সেরকম কিছু মনে হয় না বাবাজি। ঐ লোন টানে দুইটা। আয়েশার বিয়ার সময় লোন নিয়েছে, সেই লোনও টানতে হয়।”

 

“ইসস, কয় টাকা খরচ হইছে আমার বিয়াতে যে বছর ধইরাও লোন শোধ হয় না! সব বানানো কথা। দেখ গে কারে কারে দেয়, না নিজের জন্যে জমায়।”

 

“আইচ্ছা আতিয়ার লগে কথা কমু নে। অখন খলিল বাবা, তোমার কাছে যেটা পামু তা দিয়া যাও।”

 

“আম্মা, টাকা থাকলে আপনার এইভাবে চাওয়া লাগতো না। নিজেই দিতাম। আপনার মেয়েরে খাওয়াইতাছি, আর টাকা কয়টা কী!”

 

“তুমি না কইলা মাস ঘুরতে লাভ সহ টাকা আমার হাতে দিবা।”

 

“কইছিলাম তো। কিন্তু যে স্কিমে টাকা দিছি, তা পুরাই লস হইছে। কিছু পাই নাই।”

 

“এটা কী কও! আমি তোমারে নগদ দিলাম পঁচিশ হাজার, কানের সোনার দুল দিলাম। চার আনির দুলের দামও পঁচিশ আসে। আমারে তুমি বলছো লাভ সহ  লাখ টাকা দিবা।”

 

“বলছিলাম তো। আর আপনেই পুরানো স্বর্ণ বিক্রি করতে গিয়া দেখি সব খাদ। পনেরো হাজারও পাই নাই। আপনের টাকার সাথে নিজে আরও ষাট হাজার দিছি স্কিমে। সব পানিত গেছে। সেটা কি চাইছি আপনের কাছে?”

 

“আমার কাছে ক্যান চাইবা? তোমার টাকা তুমি কেমনে লস করছো তুমি জানো। আমারে আমার পঞ্চাশ হাজার দিয়া দাও। এই টাকা আমার জান পানি করা টাকা। টাকা তোমারে ফেরত দিতেই হইবো।”

 

“না দিলে কী করবেন? মামলা করবেন? আপনের মেয়ের কাবিন একলাখ টাকা না? একবারে কাবিনের টাকা হাতে দিয়া মাইয়া দিয়া যামু বেশি উল্টাপাল্টা কথা কইলে।।শাশুড়ি বইল্লা সম্মান দিতাছি।”

 

আয়েশা ভয় পেয়ে যায়। খলিল যেমনই হোক, তাকে ভালো রেখেছে। শ্বশুর বাড়িতে টাকা পয়সা অপরিমিত না থাকলেও, টানাটানি নাই। মায়ের জন্য ঝামেলা করে নিজের সংসারে অশান্তি চায় না। আর এই টাকা যে খলিল ফেরত দিবে না তা আয়েশা আগেই জানতো।।টাকা খলিল ব্যবসায় লাগিয়েছে। আর খলিলের ব্যবসা ভালো হওয়া তো আয়েশারই লাভ। স্কিমের বাহানা না করলে এই টাকাগুলো বাবার বাড়ি থেকে নিতে পারতো না। বাবা বেঁচে নাই। বড়োবোন আতিয়ার সাথে সম্পর্ক ঠান্ডা। ভাই আজ বাদে কাল বিয়ে করলে আর চিনবে না। মা বাঁচবে কয়দিন। আর বাঁচলেও কী! মা তো আয়েশাকে চালাবে না। মাই চলে ছেলেমেয়ের আয়ে। আতিয়ার মতো লেখাপড়াও নেই যে চাকরি করে খাবে। তাই স্বামীর পক্ষ নেওয়াই সর্বোত্তম ভাবলো আয়েশা।

 

আলো বাসায় ভয়ে ভয়ে ঢুকে দেখে মা, বোন, দুলাভাই সব হইচই করছে। নিম্ন আয়ের বাসা। এখানে অভিজাত এলাকার মতে একজনের ঘরের তামাশায় আরেকজন খিল দেয় না।বরং এগিয়ে এসে মজা নেয়। এখানেও তাই উত্সাহী মানুষজন আসর জমিয়েছেন। কেউ দেলোয়ারা বেগমের পক্ষে তো কেউ আয়েশার পক্ষে। কেউ কেউ দু’জনকেই থামতে বলছেন। 

 

আলো আতিয়া আর আশিককে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলে। 

 

আলোর ফোন দেখে আতিয়া ভয় পেয়ে যায়। ভেবেছে কেউ কিছু দেখে ফেললো কিনা। পরে আলোর কথা শুনে স্বস্তি পায়। এমন কিছু যে হবে ও আগেই জানতো। টাকা পয়সা নিয়ে খলিল সুবিধার না সে আগেই জানে। বিয়ের সময় থেকে ধাপে ধাপে ভালো টাকাই বের করেছে। তবু বোনটা ভালো আছে দেখে কিছু বলেনি। আয়েশা যদিও ওকে পছন্দ করে না। ভাবে আতিয়া সবসময় কড়া কড়া কথা। খলিলকে বিয়ে করতে চাওয়ার সময়ও আতিয়া বাঁধা দিয়েছিল। তখন দেলোয়ারা বেগমও ভেবেছেন আতিয়া আয়েশাকে হিংসে করে। খলিল দেলোয়ারা বেগমের আদরের জামাই। কিন্তু স্বার্থে আঘাত লাগলে সবাই রূপ পরিবর্তন করে। বিশেষ করে যেখানে সবাই স্বার্থপর। 

 

“আতিয়া, কার ফোন? কোন সমস্যা?”

 

“মিসবাহ্, আমাকে আগে হোস্টেল নিয়ে যান।।কাপড় পাল্টাবো। এত সেজেগুজে বাড়ি যেতে পারবো না।।আমার বোন আর বোনের স্বামী এসেছে বাসায়। একটু পারিবারিক ঝামেলা। বাসায় যাওয়া দরকার।”

 

“আচ্ছা চলো। চিন্তা করো না। এখন তুমি আমার আমানত কিন্তু। কোন সমস্যা হলে জানাবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার বাসায় লোক পাঠাবো।”

 

আয়েশা আর দেলোয়ারা বেগমের ঝগড়া থামাতে আশিক বাসায় চলে এসেছে। এর মাঝে আতিয়াও এসে পৌঁছায়। শাড়ি পাল্টে নিয়েছে সোনিয়ার হোস্টেলে। মুখের সাজগোজও ধুয়ে ফেলেছে। এখন দেখে মনে হচ্ছে আতিয়া হাসপাতাল থেকেই এসেছে। সারাদিন খুশিমনে কাটানোর পর বাসায় ঢুকে এই অবস্থা দেখে মন তিতা হয়ে যায়।

 

“আম্মা থামো। আয়েশা তুইও থাম। খলিলরে নিয়ে বাসায় যা। টাকা দেওয়া লাগবে না যা।”

 

দেলোয়ারা বেগম তেড়ে উঠেন, “এই তুই লাগবো না বলিস ক্যান। আমার টাকা।”

 

“আমার টাকা আম্মা। আমার কষ্টের টাকা। আমার মৃত স্বামী শাহীনের দেওয়া কানের দুল। যেই দুল তুমি তোমার কাছে সাবধানে রাখবে বলে আজ থেকে তেরো বছর আগে নিয়ে গিয়েছিলে।”

 

আয়েশা খলিলের সাথে চলে গিয়েছে। আতিয়ার কথার পর ঝগড়া আর বেশিদূর আগায় না। দেলোয়ারা বেগম জিদ দেখিয়ে ভেবেছেন আতিয়ার টুকটাক আঙটি চেইন যা ওনার কাছে আছেন তা ভাব দেখিয়ে ফেরত দিবেন। বাকিগুলোতো ভেঙে এটা সেটা বানিয়ে ফেলেছেন। চুড়িগুলো আছে, তবে দুইভরির চুড়ি দিয়ে দেওয়ার মতো মন হয় না, যতই জিদ থাকুক। কিন্তু জিনিস বের করে দেখেন একটা আঙটি নেই। অল্প কিছু জিনিস, এর ভেতর একটা জিনিস না থাকলে তা চোখে পড়বেই। রাত দুপুরে আবার হইচই শুরু করেন দেলোয়ারা বেগম।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১৬

 

“আলো, আঙটি তুই দেখছস?

 

“না ভাইয়া। আর তুমি আমারে এই কথা জিগাইলা ক্যান? আম্মার আঙটি আমি আলমারি খুইল্লা ক্যান নিমু? কোন অনুষ্ঠান হইলেও তো আম্মা আমারে স্বর্ণের কিছু পরতে দেয় না, হারিয়ে ফেলুম ভাইব্বা।”

 

“গত কয়েক মাসে টাকা হারাইতাছে অল্প বিস্তর। আজ স্বর্ণ হারালো। ঘটনা কী বুঝলাম না। তোকে জিগ্যেস করলাম কারণ বাসায় তো সকাল থেকে আমি, আতিয়া আপা কেউ ছিলাম না। তুই, আম্মা, আর আয়েশাই ছিলি।”

 

দেলোয়ারা বেগম বলেন, “আশিক তোর কি মনে হয় টাকা পয়সা ঘরের মানুষ সরাইতেছে?”

 

“আমার খটকা লাগে আম্মা। বাইরের কেউ কে আসছে বাসায় যে আলমারি খুইল্লা খালি আঙটি নিবো? কোন বুয়াও নাই। আর বাইরের চোর চুরি করলে একটা দুইটা জিনিস কেন নিব কও? নিলি সব নিব। এত ভদ্র চোর কই আছে যে চেইন, বড়ো কানের দুল এসব নেয় নাই, শুধু ছোটো আঙটি নিছে। এর দুই কারণ এতটুকু টাকাই দরকার। আর তার একসাথে বেশি কিছু নেওয়ার সাহস নাই।”

 

বলে আলোর দিকে তাকায় আশিক। আলো চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখার। কিছুতেই স্বীকার করবে না। ভাইয়া যাই বলুক আলো নিরীহ চেহারাই করে রাখবে ভাবে। বেশি রাগ দেখালে বরখ উল্টো সন্দেহ করবে।

 

“আয়েশা আপা নেয় নাই তো? আপা তো বাসায় আসলেই গয়নার কৌটা খুইল্লা সব বাইর করে।আয়নার সামনে পরে।”

 

দেলোয়ারা বেগম ভ্রু কুঁচকায়। কথা মিথ্যা না। এই অল্প কয়টা গয়নার উপর আয়েশার ভালো টান বোঝে দেলোয়ারা। বাসায় আসলে বের করে এটা সেটা পরে। যাওয়ার আগে অনেক সময় জোর করে বলে দেলোয়ারা বেগম খোলায়। না হলে আয়েশা এমন ভাব করে যেন গয়না খোলার কথা মনেই নাই। আশিকও আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু আলোকে চোখে চোখে রাখতে হবে ভাবে। আতিয়া তো বরাবরের মতোই বিরক্ত। তবে আশিকের কথায় বোনকে নিয়ে একটু সন্দেহ হয়। তার তিন হাজার টাকাও বাসা থেকেই হারিয়েছে নিশ্চিত আতিয়া। আলোর দিকে আসলেই কারও নজর রাখা হয় না। নিজের মতো বড়ো হচ্ছে। মাথার উপর বাবার আদর, শাসন নেই। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের অনেক রকম আব্দার থাকে, আহ্লাদ থাকে। আলোর সেগুলো জানানোর জায়গা নেই।  বলার জায়গা নেই। বাবার যে স্নেহ, ভালোবাসা আতিয়া পেয়েছে তার মতো না হলেও কিছুটা আশিক আর আয়েশাও পেয়েছে। কিন্তু আলো কিছুই পেতে পারেনি। বাবা যখন মারা যায় আলোর বয়স তখন সবে দশ বছর। আতিয়া আড়ালে আশিকের সাথে কথা বলে ঠিক করো বোনটার সাথে একটু কথা বলা দরকার। দু’জনেরই মনে হচ্ছে হাত টানের অভ্যাসটা আলোরই হয়েছে। কিশোরী সুলভ এটা সেটা কেনার জন্য হতে পারে। কিন্তু বাসায় আলোর দামি কিছু আতিয়ার নজরে পরে না। আলো কোচিং এ থাকলে জিনিসপত্র ঘেটে দেখতে হবে কী কী আছে। তাদের মা দেলোয়ারা বেগম নিজেই অসচেতন। আলো কোন একটা বিপদ ঘটিয়ে ফেলার আগেই দেখতে হবে বিষয়টা। রাতে ঘুমানোর আগে দেলোয়ারা বেগমের কাছে আসে আতিয়া।

 

“আম্মা, আলমারির চাবি নিজের সাথেই রাখবা। স্বর্ণের যে দাম বাড়ছে, এই কয়টা জিনিস গেলেও লাখ টাকার ব্যাপার।”

 

আতিয়ার কথায় দেলোয়ারা বেগম মাথা নেড়ে সায় দেন। বলেন, “তোর কি মনে হয় আয়েশা নিছে?”

 

“না আম্মা। আয়েশা বড়ো চাহিদা রাখার মেয়ে। যা চায় বড়ো চায়। যেমন টাকার কথা আমি জানতাম যে খলিল কোনদিন ফেরত দিব না। আর আয়েশাও জানতো তার স্বামী একটা বাহানা দিয়া টাকা বাহির করতেছে। তাও সে আটকায় নাই, কারণ এখানে সে নিজের লাভ দেখছে। তবে চুরির অভ্যাস নাই। আর ও নিলে মোটা চেইন নিতো, টলটলে আঙটি না।”

 

“তোর কার কথা মনে হয়?”

 

“কারও উপর দোষ দিতেছি না আম্মা। তবে সত্যি বলতে আমরা কেউ আলোর দিকে নজর দেই না। আলো আসলে কতটুকু কী লেখাপড়া করতেছে সেই জানে। এই বয়সী একটা মেয়ে নিজের মতো বড়ো হইতেছে। ওর সাথে কোচিং এ মাঝেমধ্যে যাইয়ো। আসলে কী প্রাইভেট পড়ে না স্যারের কথা বলে মাসে মাসে দেড় হাজার টাকা অন্য কিছু করে। আর প্রতিদিনই দেরিতে আসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বলে ছুটির পর স্যার ক্লাসেই বাড়তি পড়ায়, সামনে বোর্ডের পরীক্ষা তাই। এইটা আমার বিশ্বাস হয় না। টাকা ছাড়া ফ্রি কোথাও কেউ পড়ায় না এখন আর।”

 

“হইতে পারে। আমার কাছে টাকা চাইয়া হয়রান হলো গত কয়েকদিন। কী জানি বিদায় অনুষ্ঠান আছে। এক হাজার চাইছিল।”

 

“বিদায় অনুষ্ঠান কয়বার হয়! তুমি ওর সাথে যাবা কাল  কী অনুষ্ঠান নিজে দেইখা আসবা।”

 

আলো আড়াল থেকে সবই শোনে। রাগে ওর হাত পা চিড়বিড় করতে থাকে। একটা আব্দার পূরণ করার বেলায় কেউ নাই, আর শাসনের বেলায় সব টনটনে। দুটো টাকা দিতে না দিতে ভাই ওকে নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা করছে। আশিকের উপর রাগ হয়। আশিকই আতিয়া আর মায়ের মাথায় এগুলো ঢুকিয়েছে। কাল রাতুলের সাথে রিসোর্টে আলো যাবেই। বুদ্ধি করে আজকের শপিং এর জিনিসগুলো রাতুলের কাছে রেখেছিল। এগুলো ওর কাছে দেখলে খবরই ছিল। 

 

মিসবাহ আজ বিকেলেই দোকান থেকে বের হয়েছে জানতে পেরেছন জাহানারা। এমনিতে ছেলে কখন কই যায় এত কিছু খোঁজ রাখার মানুষ তিনি নন। আর মিসবাহ তো বাচ্চা ছেলে না। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনার জন্যই ছেলের ব্যাপারে খোঁজ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। বাষট্টি বছর বয়সে এসে চল্লিশ বছর বয়সী ছেলের গতিবিধি লক্ষ রাখতে হবে এটা জাহানারা বেগম কখনো ভাবেননি। তরুণ ছেলে হাসানকে নিয়েও তার এত চিন্তা হচ্ছে না, যতটা মিসবাহর জন্য হচ্ছে। যে বয়সটা আবেগে ভেসে যাওয়ার ছিল, সেই বয়সটা মিসবাহ শতভাগ মা বাবা ভাইবোনের পেছনে দিয়েছে। একুশ বাইশ বছর থেকে বাবার সাথে ব্যবসার কাজ শিখেছে। একসময় বাবার মৃত্যুর পর পুরো ব্যবসা সেই সামলেছে। সময়ের প্রয়োজনে বিয়ে করিয়েছেন ছেলেকে। সেই বিয়ে, বৌ নিয়েও ছেলের অতিরিক্ত কোন আহ্লাদ ছিল না। বরং এই নিয়ে ওনার গর্ব ছিল যে ছেলে স্ত্রৈণ নয়। মিসবাহর প্রথম স্ত্রী পায়েরার চলে যাওয়ার জন্য অনেকে আড়ালে আবডালে স্ত্রী সংসার নিয়ে মিসবাহর উদাসীন, অমনোযোগী থাকা, জাহানারার অতিরিক্ত নাক গলানোকে দায়ী করলেও জাহানারা বরং পুলক অনুভব করতেন যে বড়ো ছেলে মা ছাড়া কিছু বোঝে না। সময়ের সাথে শরীরের শক্তি হারিয়েছেন, আর বাকি সন্তানদের উপর নিয়ন্ত্রণও।মেঝো ছেলের বৌ রত্নাকে পায়েরার মতো শাসনে রাখতে পারেন না। হামিদ, হাসান দুই ভাইও মিসবাহর মতো একান্ত অনুগত নয়। যে ছেলে শুধুই মায়ের বলে যে চাপা একটা অহংকার বিরাজ করতো মনে, আজ তার সেই গর্বের জায়গায় কার যেন আঁচড় পড়ছে। মনে মনে নিজেকে গালি দেন। কেন আগেই উদ্যোগী হয়ে মিসবাহকে বিয়ে করালেন না আবার। দীর্ঘদিন একা থাকাই কাল হয়েছে মিসবাহর। তাজা হরিণের নরম মাংসের স্বাদ পাওয়া সিংহ হয়তো হরিণ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু একটা খেয়ে ক্ষুধা মেটায়। কিন্তু জলজ্যান্ত হরিণ সামনে আসলে তখন তার মোহ কাটানো অসম্ভব হয়ে যায়। সেই মোহের পেছনে ছুটে শিকারের জালে পা দেয়। তেমনই মোহের পেছনে ছুটছে মিসবাহ। জাহানারা মনে মনে বিরক্ত হন। যেই বয়সে মানুষ এসব প্রেম ভালোবাসা করে সেই বয়স মিসবাহ কবেই ফেলে এসেছে। চল্লিশ বছর বয়সে এসে এগুলো যে প্রেম টেম না ভালোই বুঝেন। দীর্ঘদিন একা থাকার ফলে শারীরিক চাহিদার আকর্ষণ এড়াতে পারছে না মিসবাহ। আর এই শরীর একজনেরটা পেলেই হলো। তাই ধরে বেঁধে আয়নার সাথে বিয়েটা দিয়ে দিতে চান। বৌয়ের আদর সোহাগে একরাত কাটালে এসব ডাইনির কথা মাথা থেকে এমনিই চলে যাবে। আয়নার ছেলে আছে, আগের ঘর ভেঙেছে। এই মেয়েকে নিজের নিয়ন্ত্রণেও রাখতে সহজ হবে। এমনই দুর্বল অবস্থায় আছে। 

 

মিসবাহ ঘরে ঢুকে দেখে মা বসার ঘরে বসে তসবি পড়ছেন। মুখটা থমথমে। মিসবাহ পাশে গিয়ে বসে “আম্মা, এখানে বসে আছেন যে?”

 

“তোর অপেক্ষা করি। তোরে তো পাওয়াই যায় না।”

 

“আমি তো প্রতিদিনই বাসাতে ফিরি। পাওয়া যায় না মানে কী!”

 

“এখনো ফিরস ঠিক। কিন্তু কোনদিন আমরা সবাই তোর মন থেইক্কা বাহির হইয়া যামু কে জানে। তখন বাইরে সংসার পাতবি।”

 

“আম্মা এই বাড়ি এত কষ্ট করে গড়ে তুলছি। সংসার করলে এখানেই করবো, নিজের বাড়িতে। বাইরে সংসার পাতবো কেন?”

 

“বাহ! এতদিন কইতি এই বাড়ি আম্মা আপনের। আইজ কস বাড়ি তোর। কোনদিন কইবি সবাই বাহির হন আমার বাড়ি থেইক্কা। এসব পড়াইতেছে কেউ তাই না। নিজের মাইয়ার উপরও কোন টান নাই আর তোর। পলিন পরীক্ষায় খারাপ করসে জানোস।”

 

“সাত বছরের মেয়ে আম্মা। পড়া ধরালেই পড়তে পারবে। রত্না ওর ছেলেটাকে পড়ানোর সময় একটু পড়ালে মেয়েটা বুঝতো। স্যারের কাছে তো পড়তেই চায় না। আর আম্মা, কী কথার কী মানে করেন! আমি বলতে চাইছি সংসার করলে আপনাদের সাথে মিলেমিশেই করবো। এই বাড়ি অবশ্যই আপনের। আমার ভাইদেরও। আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের মুখে উল্টাপাল্টা কথা লইয়া ঘরে অশান্তি আইনেন না।”

 

“পলিনের দেখাশোনা করার জন্য মা দরকার। নটি বেটি না। মা হওয়ার মতো মাইয়া দরকার। মিসবাহ তুই সত্যই শান্তি চাস?”

 

“চাই।”

 

“তাইলে এই শুক্রবারই আয়নার লগে তোর বিয়া দিমু। তুই না করতে পারবি না।”

 

মিসবাহ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। “আম্মা এই শুক্রবার আপনাকে নিয়ে আতিয়ার বাসায় যাব। সামনাসামনি দেখেন। ভালো লাগবে আপনার। নটি বেটি না, পলিনের মা হওয়ার মতোই ভালো মেয়ে। সারাজীবন আপনার কথা শুনেছি। এইবার আমার কথা শুনে দেখেন।”

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ১৭

 

দেলোয়ারা বেগম ফজরের ওয়াক্তে উঠে নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়েন। সেই ঘুম গভীর হয়। সাতটার আগে আর ঘুম ভাঙে না। আতিয়াও একই রুটিন ফলো করে। আশিক আর আলো কখনো উঠে, কখনো না উঠতে পারলে কাজা নামাজ পড়ে নেয়। বাসার সবার তাই সকালের ঘুম ভাঙতে মোটামুটি সাতটা বাজে। আশিক আরও পরে উঠে। আতিয়া ঘুম থেকে উঠে চা বসায়। সকালে চা আর টোস্ট বিস্কুট খেয়ে বের হয়। বক্সে কখনো রাতের ভাত, কখনো রুটি আর আগের দিনের সবজি যা থাকে ঢুকিয়ে নেয়। ডিউটির এক ফাঁকে খেয়ে নেয়। 

 

আজও আতিয়া সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে চা বসিয়েছে। রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে মেইন দরজাটা সামান্য ফাঁকা। অবাক হয়, এত সকালে কে বাইরে গেল! দেলোয়ারা বেগমকে রুম থেকে বের হতে দেখে প্রশ্ন করে,

 

“আম্মা, এত সকালে কে গেল বাইরে? দরজা খোলা ক্যান?”

 

“জানি না। আমি মাত্র উঠলাম। উইঠা দেখি আলো নাই পাশে। আলোরে প্রতিদিন ডাইকা উঠানো লাগে। আজ এত সকালে উঠলো দেইখা অবাক হইছি। আলো কি বাইরে গেছে নাকি?”

 

“এত সকালে না বলে কই যাবে!”

 

কিছুক্ষণের ভেতরই বোঝা যায় আলো বাসা থেকে পালিয়েছে। একটা চিঠিও লিখেছে। পড়ার টেবিলের উপর চিঠিটা গ্লাস দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে গিয়েছে। যাওয়ার আগে আলমারি খুলে বাকি গয়না, দেলোয়ারা বেগমের জমানো পাঁচ হাজার টাকা আর ভাই আশিকের ফোনের সিম খুলে রেখে তার স্মার্টফোনটা নিয়েছে। আতিয়ার রুমে গিয়ে কিছু নেওয়ার সাহস হয় না। আতিয়ার ঘুম পাতলা জানে আলো। নিজের ভালো যে কয়টা জামাকাপড় আছে সেগুলোও নিয়েছে। চিঠিতে অবশ্য জানিয়েছে যে মা বলেছে এই গয়নাগুলোর বেশির ভাগ আলোর বিয়ের জন্য রাখা, তাই নিজের গয়না হিসেবেই সে নিয়ে যাচ্ছে। বোন আতিয়া তো বিধবা সে গয়না দিয়ে কী করবে, মায়ের বয়স হয়েছে, তারও আর গয়না পরার দরকার নাই।।আর ভাই আশিক যখন বিয়ে করবে তখন তার বৌয়ের গয়না শ্বশুর বাড়ি থেকে যৌতুক নিবে। এই সব কারণও আলো চিঠিতে উল্লেখ করে গিয়েছে। চিঠিতে লিখেছে,

 

“আপা, তোমরা সবাই মিলে আমাকে চোর সাব্যস্ত করেছ। কথাটা পুরোপুরি ভুল না। আমি না বলে টুকটাক টাকা পয়সা নিয়েছি ঠিক। কিন্তু নিয়েছি তো নিজের ভাই বোনের কাছ থেকে। কারণ তোমরা নিজেরা নিজ থেকে আমাকে কোন হাত খরচ দাও না। আমি হেঁটে স্কুলে যাই, স্কুল থেকে আসি। বিশটা টাকা রিকশাভাড়া কেউ দাও না। আমার বান্ধবীরা সময়ে সময়ে কত কেনাকাটা করে, আমি পারি না। বেশিরভাগ সময় তোমার কাপড়, আয়েশা আপার কাপড় ধার করে পরা লাগে। আমার গায়ে হয় না। ঢিলা হয়। ঈদে এক জোড়া জুতা দিয়ে তোমাদের আর খবর থাকে না। কানের দুল, চুড়ি, লিপস্টিক কত কিছু লাগে। চাইলেই ঝাড়ি মারো। এভাবে ফকিন্নির মতো কোচিং এ যেতে আমার লজ্জা লাগে। তোমাদের কারও মাথায় আসে না মেয়েটা বড়ো হইতেছে তারে কয়টা টাকা হাতখরচ দেওয়া উচিত। আমার বান্ধবীরা বলে আমি কিপটা। আমি কাওরে বলতে পারি না আমার কাছে টাকা নাই, তাই খরচ করতে পারি না। তোমাদের নামে সবসময় কত বড়ো বড়ো কথা বলি সবজায়গায়। বলি আমার বোন ডাক্তার, হাসপাতালে চাকরি করে, ভাইয়ের বসুন্ধরায় দোকান আছে। আমরা নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকি। এসব না বললে কেউ মিশতে চায় না। ছোটোলোক ফকির মনে করে, বন্ধু হয় না। আমি তাই মিথ্যা বলি।

 

কিন্তু মিথ্যা বললে তো হয় না। দেখাতেও হয়। কিন্তু দেখানোর জন্য টাকা কই? তোমরা কেউ তো কিছু দাও না। তাই সরানো শুরু করলাম। পঞ্চাশ, একশো যা পেতাম। একদিন সাহস করে তোমার তিন হাজার নিয়েছি, আরেকদিন ভাইয়ের পাঁচশো। এরপর দেখলাম এইটা সহজ। এতদিন টুকটাক টাকাই নিয়েছি। আঙটিটা নিতাম না। নিয়েছি কারণ আমার বন্ধুরা সবাই ঘুরতে যাচ্ছে। আমি টাকা চেয়েছি, কেউ দাও নাই। আমি কী করতাম বলো? তাই আঙটি নিয়েছি। তাছাড়া এই আঙটি, গয়না এগুলো তো আমার বিয়ের জন্য রাখা। আমারই জিনিস। 

 

এই আঙটির জন্য তোমরা ঠিক করেছ আমাকে পাহারা দিয়ে রাখবা। তাহলে তো আমি আর এখানে তোমাদের সাথে থাকতে পারবো না। আমি একজনকে ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে থাকবো। সে ভালো ছেলে, ঢাকায় নিজেদের ব্যবসা, বাড়ি সব আছে। কিন্তু একদম খালি হাতে শ্বশুর বাড়ি যেতে কেমন লাগে, তাই গয়নাগুলো নিয়ে গেলাম। টাকাটাও নিলাম, টুকটাক খরচ যদি লাগে। এমনি বিয়ে দিতে গেলে তো তোমাদের আরও বেশি লাগতো। আশিক ভাইয়ার ফোনটাও নিলাম। ভাইয়া মনে করো বোনের বিয়েতে পুরান ফোনটা গিফট দিছ। ফোনে ছবি তুলবো। আমার ভালো কোন ফোন নাই। আর তোমার বিয়ের সময় বৌয়ের গয়না তো শ্বশুর বাড়ি থেকে দিবে তুমি গয়না দিয়ে কী করবা। এগুলো বোনরে দিছ ভাব। আতিয়া আপাও এখন আর গয়না পরে না। আমার জিনিস আমিই নিয়েছি। চোর হলাম কিভাবে?

 

সবশেষে আম্মা, আমার উপর মনে কষ্ট রাইখো না। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তোমাদের দাওয়াত দিব। সবাই এসে আমাকে দোয়া করে যাবা। আর সোনার উপর লোভ রাইখো না। বয়স হলে আল্লাহ খোদার নাম নিতে হয়। 

 

আল্লাহ হাফেজ,

আলো আক্তার।”

 

চিঠি পড়ে আতিয়া হতভম্ব। কাকে বিয়ে করতে গিয়েছে আলো! কার পাল্লায় পড়েছে! এই ষোল বছরের উঠতি  বয়সী মেয়েকে নিয়ে যদি খারাপ পাড়ায় বিক্রি করে দেয় কেউ, তবে কিভাবে আলোর হদিস পাবে আতিয়া! 

দেলোয়ারা বেগম বিলাপ করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ মেয়েকে গালি দেন, কিছুক্ষণ গয়নার জন্য বিলাপ করেন। পরক্ষণেই আবার কমবয়সী মেয়েটা কার সাথে কোথায় গিয়ে কোন বিপদে পড়েছে তাই ভেবে চিন্তায় অস্থির হোন।

 

“আম্মা, কান্নাকাটি কইরো না এখন। খবরদার কাউরে কিছু বলবা না এখন। কিছু বলার দরকার নাই। আমি খোঁজে বের হইতেছি। খোঁজ নিতাছি কোন ছেলের সাথে লাইন করছে। তার আগে যেন কেউ টের না পায়।”

 

আশিক সাবধান করে।

 

“আশিক, পুলিশে জানাবি? কোথাও গেল, কার সাথে গেল। কাল রাতে ওরে এমনে জেরা না করলেই হতো।”

 

“আপা, আলো কিন্তু এত বোকাও না। আমার মনে হয় ও অনেকদিন ধরেই বিয়ে করার কথা ভাবছিল। হুট করে কাল রাতের ঘটনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত না। ভাবছিল আগে থেকেই। কালকের ঘটনায় হয়তো জলদি জলদি এসব করছে। তবে যে ছেলের সাথে গিয়েছে সেই ছেলে তো আকাশ থেকে পড়ে নাই। আমি খোঁজ নিচ্ছি।”

 

আশিক দুপুরের ভেতর খোঁজ নিয়ে বের করে ফেলে আলোর যে ছেলের সাথে সম্পর্ক তার নাম রাতুল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ে। বাড়ি কামরাঙ্গীচর। ঠিকানাও মোটামুটি বের করেছে। ছেলের পড়ালেখা প্রায় শেষ, তবে এখনো কিছু করে না। বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ভাইয়ের সাথে ব্যবসার কাজে সাহায্য করে। কামরাঙ্গী চরে বাড়িটা নিজেদের হলেও অবস্থা যে খুব ভালো তা নয়। অনেকগুলো ভাই-বোন। অবিবাহিত বড়ো ভাই বোন সবই আছে। এই ছেলে আলোকে কিভাবে বিয়ে করবে বুঝতে পারছে না আশিক। করলেও বাড়িতে নিয়ে তুলবে কিভাবে! মনে হচ্ছে আলো রাতুলের সবটা জানে না। ততটুকুই জানে যতটুকু রাতুল জানিয়েছি। সাথে নিজেও আরেকটা চিন্তায় পড়ে, রাতুল কতটুকু জানে আলোর ব্যাপারে। আলো নিজেই চিঠিতে লিখেছে যে সবাইকে বলতো বোন ডাক্তার, ভাইয়ের ব্যবসা আছে, নিজেদের ফ্ল্যাট আছে।।এসব কথা নিশ্চয়ই রাতুলকেও বলেছে! বোনটা নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান ভাবে ততটা আসলে না। বাইরে না দেখালেও মনে মনে চিন্তা ঠিকই হচ্ছে আশিকের। রাতুল যে জায়গাগুলোয় আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় খুঁজে রাতুলকে পায়নি আশিক। আলোর বন্ধুরা জানিয়েছে আজ আলোর রাতুলের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা। কোন একটা রিসোর্টে! ঢাকার আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য রিসোর্ট হয়েছে। কোথায় গিয়েছে আলো! ফিরে আসতে পারবে তো! না সেখান থেকেই হাতবদল হয়ে যাবে!

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব১৮

 

আলোর ভীষণ ভালো লাগছে। এত সুন্দর জায়গায় আগে কখনো আসেনি। যদিও রাতুলের দুই বন্ধুর সাথে আসা মেয়ে দুটো খুব নখরা করছে, বলছে রুম ছোটো, বাথরুম ছোটো বাথটাব নেই, রুম অতটা পরিষ্কার না, খাওয়া ভালো না, সুইমিং পুল ছোটো আরও কত কী!

অথচ আলোর তো সবই ভালো লাগছে। কী সুন্দর সাদা টাইলসের রুম, সাদা টাইলস বসানো বাথরুম। বাথরুমের একটা অংশ গোসল করার জন্য আলাদা করে দেওয়া। গোসল করলে পুরোটা বাথরুম ভিজবে না। তাদের বাসায় একটাই বাথরুম, সেই বাথরুমের  কালো রঙের ফ্লোর সবসময় ভিজে থাকায় কেমন পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এই বাথরুমের চেয়ে আয়তনে অর্ধেক সেই বাথরুমেই কাপড় ধোয়া থেকে সবকিছু করতে হয়। আর এই মেয়েগুলো কী বলে যে বাথরুম ছোটো! আর বিছানাটা কী ঝকঝকে সাদা চাদরে ঢাকা তুলতুলে নরম। গা এলিয়ে দিলে শরীর ঢুবে যায়। আলোর খুব ইচ্ছে হচ্ছে সুইমিং পুলে নামার কিন্তু রাতুলের ইচ্ছায় আগে রুমে আসতে হয়েছে। আলোকে ভীষণ করে কাছে পেতে উতলা হয়ে গিয়েছে রাতুল। আলোও খুব বেশি আপত্তি জানায়নি। রাতুলকে রাগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নেই। থাক আগে রাতুলের সাথে রুমে সময় কাটাক। সবে বেলা বারোটা। বিকেল চারটা পর্যন্ত সুইমিং করা যাবে। এত তাড়ার কিছু নেই। সবাইকে বিদায় দিয়ে রুমে এসে ঢুকেছে রাতুল। বাকিরা সুইমিং এ যাচ্ছে। রাতুল দরজা লাগিয়ে দিয়ে আলোর কাছে আসে। আলোর বয়স সবে ষোল হলেও রাতুলের বয়স প্রায় পঁচিশ। 

 

রাতুল প্রেম ভালোবাসার কথা বলে খুব বেশি সময় নষ্টের ভেতর যায় না। সময় কম, যা করার এই সময়ের ভেতর করতে হবে। রাতুলের অস্থিরতায় কষ্ট হয় আলোর। পূর্ণ বয়সী যুবকের শরীরের ভারে নিষ্পেষিত হতে হতে প্রথম মিলনের স্বাদ উপভোগ করার চেয়ে কেমন যন্ত্রণা হতে থাকে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায়। প্রথম প্রথম এমন কষ্ট হয় শুনেছে। মনকে বোঝায় আলো। 

 

বেলা গড়াতে থাকে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে বেলা তিনটে। আলোর সমস্ত শরীরে কেমন ব্যথা। রাতুল কোন একটা কিছু খেয়েছে বুঝতে পারছে আলো। রুমে এসেই একটা ট্যাবলেট খেয়েছিল। বললো এটা প্রয়োজন। তারপর কেমন পশুর মতো আচরণ। এতোদিনের চেনা রাতুল আর আজকের রাতুলের মাঝে অনেক পার্থক্য। এই রাতুলের মাঝে যেন কোন মায়া মমতা নেই। প্রবল ভাবে পিষে ফেলা আর আঘাত দেওয়ার মাঝেই যেন শারীরিক আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিল রাতুল। থেমে থেমে বারবার ঝড় উঠেছে রিসোর্টের এই নিরিবিলি কামরায়। ঝড় শেষে সাদা চাদরে ছোপ ছোপ লাল রক্ত ঘোষণা দিচ্ছে আলোর কুমারিত্ব হারানোর।

 

“আলো, উঠে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলাও। খেতে যাব। চারটার পর লাঞ্চ কুপন কাজ করবে না। সুইমিং করার সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

 

“আমি মাথা ওঠাতে পারছি না। অনেক রক্ত গিয়েছে।”

 

“আরে না। সাদা চাদর দেখে অনেক রক্ত মনে হচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি গায়ে একটু পানি দিয়ে গোসল দাও। ঠিক হয়ে যাবে।”

 

“আমি একটু শুই। দুর্বল লাগতেছে।”

 

“ধ্যুত! এত দুর্বল হলে কিভাবে হবে। শোনো ছয়টায় কিন্তু বের হয়ে যেতে হবে। আগে তোমাকে তোমার বাসার কাছে নামিয়ে দেব। তারপর আমার বাসায় যাব।”

 

“আমার বাসায়? আমি না তোমাকে বলছি যে বাসায় চিঠি লিখে চলে আসছি আমি।”

 

“আলো, পাগলের মতো কথা বলে না। আমার মেঝো ভাই এখনো বিয়ে করেনি, দুই বোন অবিবাহিত আছে। আমি নিজেই এখনো কিছু করছি না। এই সময় তোমাকে নিয়ে উঠবো কই! তারচেয়ে তুমি বাসায় যাও। বিয়ে তো আমরা করেই ফেলেছি। আমরা এখন নিজ নিজ বাসায় যাই। বাসায় জানাবো। আমার আম্মা, আব্বা তোমাদের বাসায় যাবে। সুন্দর করে তোমাকে তুলে আনবে। এর মাঝে তুমি বাসায় বলে দশলাখের ব্যবস্থা করবা।”

 

“দশ লাখ! কী কও! এত টাকা কী জন্যে?”

 

“আমাদের সংসার করতে হলে আমাকে কামাই করতে হবে না? তোমার স্বামী বেকার থাক চাও তুমি? আমি এই টাকা দিয়ে কোথাও চাকরিতে ঢুকবো। না হলে ব্যবসায় লাগাবো। তারপর তো সব তোমারই।”

 

“দশ লাখ দূর, আমার পরিবার এক লাখও দিতে পারবো না। যা ছিল আমি নিয়ে এসেছি।”

 

“কী আনছো?”

 

“আমার বিয়ের জন্য বানানো গয়না আনছি।”

 

রাতুল উঠে গিয়ে আলোর ব্যাগ হাতে নেয়।

 

“আগে বলবা না! কত ভরি হবে? আরে বোকা এই ব্যাগ এমনে রাখে কেউ। আগেই তো আমার হাতে দেওয়া দরকার ছিল। কয় ভরি গয়না?”

 

“গলার চেইন, কানের দুল, এক জোড়া চুড়ি, দুটো আঙটি। তিন, সাড়ে তিন ভরি হবে।”

 

“মাত্র! আরে আট দশ ভরির নিচে বিয়ের গয়না হয় নাকি!”

 

“আমার মেঝো বোনের বিয়েতে আড়াই ভরি দিয়েছে।।কত সুন্দর বিয়ে হয়েছে। কেন হবে না।”

 

“তোমার ডাক্তার বোন, ব্যবসায়ী ভাইয়ের হাত এত ছোটো কেন! তোমাদের নিজেদেরও তো টুকটাক সম্পদ আছে না?”

 

“রাতুল, রাগ করো না। আমি একটু বাড়াই বলছি বুঝছো। আমার বোন হাসপাতালের নার্স। সেই সংসার চালায়। ভাই দোকানে চাকরি করে। বেতন কম। তবে সামনে বড়ো চাকরি পাবে। পরীক্ষা দিছে ভালো ভালো জায়গায়। ছাত্র ভালো।”

 

রাতুল কথার মাঝে ব্যাগে খুঁজতে খুঁজতে গয়নার পুটলি পায়। গয়না খুলে খুবই হতাশ হয়। সনাতনী সামান্য কিছু গয়না। বিক্রি করতে গেলে ভরিতে আরও কাটা যাবে। পুরো তিনভরির দাম পাবে না। দুই, আড়াই লাখ পেতে পারে।

 

“আলো, এইটা তুমি ঠিক করো নাই। তুমি বাড়িয়ে বললা ক্যান? আর এই গয়নায় কী হবে? শোন এই গয়না আমার কাছে থাক। তুমি আজ বাসায় যাও। দশ লাগবে না। আর পাঁচ লাখের ব্যবস্থা করে ফোন দিও। আমি আব্বা আম্মাকে পাঠিয়ে তোমাকে তুলে আনার ব্যবস্থা করবো।”

 

“আমি এত কিছু বুঝি না। তুমিই তো খালি আদর করার সময় বলতা তোমার কাছে একবারে চলে আসার জন্য। আজ যখন এসেছি তখন এভাবে আমার জীবন নষ্ট করলা। বিয়া করে বাসায় না নিতে পারলে আমার সাথে সম্পর্ক ক্যান করলা। এতক্ষণ আমাকে খামচি দিয়ে, কামড়ে কিছু রাখো না। আমি সব সহ্য করছি। এখন আবার আমার গয়না নিতে চাও। রাখো আমার গয়না রাখো।”

 

“এই মা*গী! ইতরামি করস? তুই নিজে এসে শুয়েছিস আমার সাথে। আমি কোন জোর করছি? এখন আবার বলোস যে আমি তোকে নষ্ট করছি!”

 

“তুমি আমারে গালি দিতে পারলা! জানোয়ারের মতো অত্যাচার করো নাই এতক্ষণ? তোমাকে স্বামী ভেবে সহ্য করছি। এখন তুমি যদি আমাকে  সাথে করে বাড়িতে না নাও আমি সবাইরে বলবো তুমি আমারে ফুসলাইয়া এখানে আনছো। বিয়ে করছো। তারপর জোর করে রেপ করছো। আমার গায়ের দাগ দেখাবো সবাইরে। সবশেষে আমার সাথে থাকা টাকা পয়সা গয়নাও নিয়ে যাইতে চাইতেছ। আমি চিৎকার করে বাইরে সবাইকে বলবো।”

 

রাতুল তাড়াতাড়ি গয়নার পোটলা রেখে দেয়। 

 

“আরে বোকা মেয়ে। আমার বাঘিনী একদম। আমি তোমাকে পরীক্ষা করলাম বোকা। এভাবেই গলায় শক্তি রেখে তেজ রেখে কথা বলতে হবে আমার বাড়িতে গেলে। আমার ভাই বোন,মা, বাবা কেউ তো ছেড়ে কথা বলবে না। সাহস রাখবা হ্যাঁ?” 

 

“সত্যি! আর টাকা চাইলে যে। এত টাকা কিন্তু আমার ভাই বোনের নাই।”

 

“আরে কিছু লাগবে না। তোমার গয়নাও তোমার কাছে রাখো। আমার বাসায় ঢুকার আগে পরবা। নতুন বৌ ভাব আসে যেন। আর আজ কিন্তু আমরা আসলেই বাড়ি যাচ্ছি না। কারণ আজ আমাদের হানিমুন রিসোর্টে। আমরা এইখানেই রাতে থাকবো। ওরা চলে যাবে। তোমারে একটু সারপ্রাইজ দিতে চাইলাম। তুমি তো আমাকে বিশ্বাসই করো না।”

 

“না না বিশ্বাস করি। অবশ্যই করি। না করলে কি তোমার সাথে আসতাম। মাফ করে দাও।”

 

“হ্যাঁ কত কিছু বললা। জানোয়ার নাকি আমি! বৌকো আদর করলে এসব শুনতে হয়।”

 

“আমি অনেক কষ্ট পাইছি।”

 

“আচ্ছা স্যরি। তুমি এখন আস্তে আস্তে উঠে গোসল করে নাও। আমি খেয়ে। আমি তোমার জন্য রুমে খাওয়া নিয়ে আসবো। খেয়ে ব্যথার ঔষধ খেয়ে ফেললে আর ব্যথা থাকবে না।”

 

রুম থেকে বের হয়ে রাতুলের খাওয়ার চিন্তা মাথায় উঠেছে। আগে আলোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই মেয়ে যে নাছোড়বান্দা। সাথে বাড়িতে না নিলে এখানে তামাশা করবে। গয়না আর টাকাগুলো নিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। এই ফকিন্নি মেয়েকে বৌ করে সাথে নিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই রাতুলের নেই।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয় 

পর্ব ১৯

 

আশিক আর আতিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কী করবে। আগে পুলিশের কাছে গিয়ে জিডি করবে,না সরাসরি ঠিকানা মতো রাতুলের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিবে! যদিও আলো চিঠিতে লিখেছে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে সে যোগাযোগ করবে। কিন্তু রাত হয়ে এলো এখনো আলোর ফোন বন্ধ। আর আশিকের খোঁজখবর মতে আজ রাতুল তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কোন এক রিসোর্টে যাবে। আতিয়া ভাবে মিসবাহর সাথে আলোচনা করবে কিনা। কিন্তু মাত্র কয়দিন হলো রাগ অনুরাগের। সম্পর্ক একটা সুন্দর মোড়ে আসার অপেক্ষায় হলেও দু’জনই এখনো দুজনের কাছে ততটা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন আর পরিবার নিয়ে উন্মুক্ত হতে পারেনি। এই সময় আলোর মতো ষোল বছরের মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলতে কেমন বাঁধে। মিসবাহ কী না কী ভাববে আতিয়ার পরিবার আর বোনকে নিয়ে তাই ভেবে ভয় লাগে। তবে মাথার উপর অভিজ্ঞ কেউ থাকারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে ভীষণ করে। আয়েশা আর খলিল তো রাগ করে চলে যাওয়ার পর কথাই বলছে না। আর দেলোয়ারা বেগমও চান না মেজোমেয়ের জামাই খলিল কিছু জানুক। খলিলকে আর ওনাদের নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ দিতে চান না। আর মেয়ে আয়েশার উপর তো রাগ ভীষণ। শেষমেশ আশিকের মাধ্যমে মিসবাহর কাছে খবরটা পৌঁছানোর কথা ভাবে আতিয়া। আশিক জানানোর পর যদি মিসবাহ ওকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানতে চায় তো দ্বিধা ঝেড়ে সব খুলে বলবে।

 

“আশিক, তোর মিসবাহ্ ভাইয়ের সাথে একবার পরামর্শ করবি? ওনারা না ঐ কামরাঙ্গীচরেই থাকেন। তাও অনেক বছর ধরে। ওনাদের তো নিজেদের পরিচিত এলাকা, স্থানীয় মানুষের মতো। হয়তো রাতুলকে তার পরিবারকে চিনবে।”

 

“চিনবে কী আপা। খুব ভালো করেই চিনেন। তাই তো পরামর্শ চাইতে যাই নাই।”

 

“কিভাবে চিনেন?আত্মীয়?”

 

“হ্যাঁ। খুব কাছের আত্মীয়। মিসবাহ ভাইয়ের মেজোভাই হাবিব ভাইয়ের এর শালা রাতুল। হাবিব ভাইয়ের বৌ রত্না ভাবির কথা আমার বন্ধু হাসানের কাছে শুনেছি।।মহিলা নাকি ভারী শক্ত আর ঝগড়াটে। মিসবাহ ভাইয়ের মা পর্যন্ত যার কথার ভাঁজে আর নাটকের সাথে টিকতে পারেন না। অথচ কয়দিন আগে শুনলাম এই অপছন্দের বৌ রত্না ভাবীর মামাতো বোনের সাথে খালাম্মা মিসবাহ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন। সামনেই বিয়ে।”

 

“কী বলিস! তোর মিসবাহ্ ভাই জানে এই বিয়ের কথা? না খালাম্মা নিজে নিজে ঠিক করছেন?”

 

“জানবে না কেন। মিসবাহ ভাইয়ের সাথে হাসান গিয়ে মেয়ে দেখে এসেছে। বিয়ে তো ফাইনাল। হাসান বললো মিসবাহ ভাই কখনও ওনার আম্মার কথা ফেলেন না। এখন তুমি বলো আপা, এই পরিবারের সাথে মিসবাহ ভাই, হাসান ওদের এমন সম্পর্ক সেখানে কিভাবে সাহায্য চাই!”

 

এক মুহূর্তের জন্য আতিয়ার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যদি মিসবাহর বিয়ে ঠিকই হয়ে আর মিসবাহ সব জানেই থাকে তবে তাদের মাঝে সেসব কী ছিল! নৌকার ভেতর সেই ভালোবাসা আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি, মিসবাহর আবেগময় চুম্বন। কোনকিছুই তো একমুহূর্তের জন্যও আতিয়ার কাছে মিথ্যা বা নাটক বলে মনে হয়নি। নাকি আসলেই মা ঠিক বলেন! শরীর আর মনের আবেগে আতিয়া অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই এই বয়সে এসেও মনে করছে কেউ ওকে শুধু  ভালোবেসে জীবনসঙ্গী করতে চাইতে পারে। এর আগে তার জীবনে আসার প্রস্তাব যাদের কাছে পেয়েছে, তাদের সবার চোখের ভাষা আতিয়া পড়তে পেরেছে।কেউ আতিয়ার কাছ থেকে টাকাপয়সা বের করতে চেয়েছে। কেউ শুধুই শরীরী সম্পর্কে টানতে চেয়েছে। বহু বছরের অপেক্ষার পর আতিয়ার মনে হয়েছিল কেউ সত্যি শুধু তাকে ভালোবেসেই হাত ধরেছে। সেই আবেগঘন মুহুর্তে  মিসবাহর চুমোকে তাই একমুহূর্তের জন্যও সুযোগ সন্ধানী কারও স্পর্শ মনে হয়নি। 

 

“তুই নিশ্চিত আশিক?”

 

“কী?”

 

“মিসবাহ্, মানে তোর মিসবাহ্ ভাইয়ের বিয়ের কথা হয়েছে? না তোর বন্ধু হাসানের?”

 

“আরে হাসানের কেন হবে! হাসানের প্রেমিকা আছে, কলেজের জুনিয়র। মিসবাহ্ ভাইয়েরই বিয়ে। একবার তো শুনছিলাম যে শুক্রবার কাবিন হবে।”

 

“আশিক। কারও ভরসা বাদ দে। আমরা চল আগে জিডি করি। থানা থেকেই রাতুলের বাড়িতে খোঁজ নেক।”

 

রাতদুপুরে বাড়ি মাথায় করলো রত্না। তাদের বাড়িতে পুলিশ এসেছে কোন মেয়ের খোঁজে। তার ভাই নাকি কোন মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে বলে মেয়ের পরিবার মামলা করেছে। জাহনারা বেগম বিরক্ত হোন।

 

“রত্না, এখন যাওয়া লাগি ফালাফালি কইরো না। রাইত হইছে দশটার বেশি। সকালে যাইও।”

 

“কী কন আপনে আম্মা। আমার মাসুম ভাইরে কে ফাঁসাইতে পুলিশ পাঠাইছে আর আমি যামু না?”

 

“তুমি গিয়া কী করবা? তুমি কি উকিল না জজ সাব? তোমার কথা পুলিশ ক্যান শুনবো? কিছু একটা তো নিশ্চয়ই করছে,তা না হইলে এমনে এমনে কেউ পুলিশ পাঠাইবো ক্যান! কার মাইয়ার কী ক্ষতি করছে কে জানে।”

 

“কিছু করে নাই আম্মা। এসব শত্রুপক্ষের কাম। টুকটাক রাজনীতি করে। এইগুলা চক্রান্ত।”

 

রত্নার ছটফটানিতে টিকতে না পেরে হামিদ বৌকে নিয়ে বের হয়। মিসবাহ মাথা ঘামায় না। সে আছে অন্য চিন্তায়। আতিয়ার সাথে ঠিকমতো কথা বলার সুযোগই হলো না আজ। আতিয়া কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় ছিল। বললো পরে সব গুছিয়ে বলবে। এরপর খবর নেই। সন্ধ্যা থেকে চেষ্টা করেছে কয়েকবার ফোনে। কিন্তু কথা হয়নি।

 

রত্না ফিরে আসতে আসতে সাড়ে এগারোটা পেরিয়েছে। জাহানারা বেগম আগ্রহ নিয়ে বসে ছিলেন আজ। কী হলো জানার খুব আগ্রহ। 

 

“হামিদ কী হইছে রে? আসলেই কোন মাইয়া নিয়া আইছে?”

 

“জানি না আম্মা। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলো। থানায় ডাকতে পারে। মাইয়ারে খুঁইজা পায় না।”

 

“মিছা কথা আম্মা। মাইয়া কার সাথে ভাগছে কে জানে! মাইয়ার পরিবারের কাছে কোন প্রমাণ নাই যে রাতুলের সাথে কোন সম্পর্ক আছিল। আন্দাজে আমার ভাইরে ফাঁসানোর চেষ্টা। পুরা ধান্ধাবাজ পরিবার। বাপ নাই, মায়ের শাসন নাই। এসবই তো কইরা বেড়ায়।”

 

“মাইয়া কি তোমার ভাইয়ার ভার্সিটির?”

 

“নাহ। সবে নাকি এসএসসি দিব। ষোল সতেরো বছরের মাইয়া। কেমন পাকনা চিন্তা করেন। মাইয়া কে জানেন?”

 

“কে?”

 

“আপনের ছেলে চিনে।”

 

“কেরো হামিদ?”

 

“ভাইয়ার দোকানে কাজ করে যে আশিক। তার ছোটোবোন আলো।”

 

মিসবাহ এতক্ষণ চুপচাপ কথা শুনলেও হামিদের কথায় তড়াক করে উঠে যায়।

 

“আশিকের ছোটো বোন হামিদ?”

 

“জ্বি ভাইয়া।”

 

“খুঁজে পায়নি এখনো?”

 

“শুনলাম তো পায়নি। ফোনও বন্ধ। রাতুল বন্ধু বান্ধব নিয়ে যে রিসোর্টে ছিল আজ পুলিশ ঠিকানা নিয়ে সেখানেই খোঁজ করেছে। কিন্তু রিসোর্ট থেকে বলেছে আলো নামে কেউ রিসোর্টে রাতুলের সাথে যায়নি। ওদের গ্রুপে কোন মেয়েই ছিল না। ওরা কয়েকজন কয়েকজন ছেলেবন্ধু মিলে গিয়েছিল।”

 

জাহনারা বেগম বুঝতে পারেন আলো আতিয়ার বোন।

রত্নাকে সমর্থন করে তাই বলেন।

 

“রত্না ঠিকই বলছো। এইসব পরিবারের মাইয়াগো কাজই হইলো পোলা ধরা। নিজেই কোথাও গিয়ে লুকাইছে যেন রাতুলরে চাপ দিতে পারে। চিন্তা করো এইটুকু মাইয়া, চিঠি লিখে যায় যে শ্বশুরবাড়ি যাইতেছে। কেমন অসভ্য মাইয়া। রাতুল কোন দোষ না করলে ডরাইতে না করবা। আমরা আছি। কিছু হইবো না।”

 

রত্না শাশুড়ির পরিবর্তনে অবাক হলেও খুশি হয়। যদিও রাতুল সত্যি বলছে না মিথ্যা জানে না রত্না। কিন্তু ভাইয়ের মমতায় সে ভাইয়ের পক্ষই নেবে।

 

“হ্যালো, আতিয়া। সারাদিন এতবার ফোন দিলাম ধরো নাই কেন? আলোকে খুঁজে পাচ্ছ না জানালে না কেন?”

 

“এই তো জানতে পারলেন। জানতাম জানতে পারবেন।”

 

“আতিয়া কী হয়েছে? তুমি চিন্তায় আছ বুঝতে পারছি। আমাকে আগে জানালে না কেন? সারাদিন পার হয়ে গেল। জানালে আমি একটা ব্যবস্থা করতাম। আলোকে খোঁজার চেষ্টা করতাম। এতটুকু বিশ্বাস নেই আমার উপর?”

 

“বিশ্বাস তো আমার সবসময়ই ছিল। হয়তো আপনার ছিল না। তাই তো বিয়ে করছেন, এত বড়ো সুসংবাদটা জানালেন না। স্যরি আপনার শ্বশুর বাড়ি, শালা সবাইকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম। কিন্তু আমার বোনের জন্য বাধ্য হয়েছি। বাচ্চা মেয়ে কোন বিপদে পড়েছে কে জানে। আমার বোনকে পেয়ে গেলে আপনাদের কোন সমস্যা আর করবো না। মামলাও তুলে নেব।”

 

“তুমি আয়নার কথা বলছো?”

 

“নাম জানতাম না। সুন্দর নাম।”

 

“আতিয়া, ক্ষমা চাইছি। জানি আয়নার বিষয়টা আগেই জানানো উচিত ছিল। আমি তোমাকে জানাতাম।”

 

“কোন বিষয়টা? আয়নার সাথে বিয়ের বিষয়টা? কবে জানাতেন! বিয়ের পর?”

 

“আয়নাকে আম্মা পছন্দ করেছে। তাও জিদের বশে। কিন্তু আমি আম্মাকে স্পষ্ট করে বলেছি আমি অন্য কোথাও বিয়ে করছি না। আম্মার চাপে ঐ বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর কিছু না।”

 

“আপনি কি বাচ্চা ছেলে মিসবাহ্! আপনি নিজেই একটা সাত বছরের মেয়ের বাবা। আপনাকে কেউ জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে!”

 

“জানি আতিয়া, যাই বলবো এখন, তোমার বিশ্বাস হবে না। কিন্তু অনুরোধ করবো বিশ্বাস রাখো। আর আলোর বিষয়টা বলো। পুলিশের সাথে আমি কথা বলছি। বাচ্চা একটা মেয়ে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে। বিপদে আছে ও। ওকে খুঁজে বের করার পর তুমি যা মন চায় বইলো।”

 

আতিয়া ভাবে, মিসবাহর সাথে বোঝাপড়া করার আগে আলোকে খুঁজে পেতে হবে। যতই শক্ত হোক, ছোট্ট বোনটার চিন্তায় কিছু ভালো লাগছে না। রাতুল কিছুতেই স্বীকার করলো না যে আলোর সাথে ওর আজ দেখা হয়েছে। কোথায় গেল বাচ্চা মেয়েটা! কেমন আছে! বেঁচে আছে না নেই! আর ভাবতে পারে না আতিয়া। আজকের রাতটা বড়ো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। পাশের রুম থেকো দেলোয়ারা বেগমের কান্নার করুণ স্বর ভেসে আসছে।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ২০

 

ঢাকার আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ইট পাথরের নগরী ঢাকাতে সবুজের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে। তাই গাজীপুরের ভাওয়াল মধুপুরের সবুজকে কেন্দ্র করে ভালো ভালো রিসোর্ট তৈরি হওয়া শুরু হয়। শুরুতে বিষয়টা ভালোই ছিল। একদিনের জন্য শহরের কোলাহল থেকে দূরে নিজের মতো সুন্দর সময় কাটানো যায়। কিন্তু ভালো মানের রিসোর্টগুলো সবার সাধ্যের ভেতর থাকে না, তাছাড়া সব জায়গায় প্রকাশ্য অনৈতিক কাজগুলো করাও যায় না, তাদের রেপুটেশনের ভয় থাকে। অবৈধ ড্রাগস, নারী, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে থাকা নরনারীদের সুযোগ দেওয়ার সুবিধা এসব কেন্দ্র করে তাই গড়ে উঠতে থাকে মানহীন ফার্মহাউস, ছোটো ছোটো রিসোর্ট। যাদের ক্লায়েন্ট সার্ভিস কেমন তা বিষয় না, তাদের লক্ষ্যই থাকে যারা একটু অনৈতিক কিছুর খোঁজ করে, তাদের জায়গা দিয়ে আয় করা। এসব জায়গাগুলোয় তাই পরকীয়ারত জুটি, অবৈধ সম্পর্কে জড়িত তরুণ তরুণী, কিশোর, কিশোরী, দেহপসারণীদের ব্যবসার উত্তম স্থান হয়ে দাঁড়ায়। 

 

রাতুল আর তার গ্রুপ এই রিসোর্টগুলোয় আগেও এসেছে। টুকটাক ছাত্র রাজনীতিতে জড়ানোর সুবাদে বড়ো ভাইদের বদৌলতে এখানে বেশকিছু রাজনৈতিক গেটটুগেদারে অংশ নিয়েছে, কখনো আনন্দভ্রমণে এসেছে। এখানকার লোকজনের সাথে তাই তার ভালো পরিচয় গড়ে উঠেছে। সেদিন আলোকে রুমে রেখে বের হয়ে এসে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় রাতুল। কী করবে প্রথমে ঠিক করতে পারে না। রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে রাতুলের ভালো বন্ধুত্ব থাকায় তাকেই খুলে বলে। আলোর কাছে মাত্র দশ হাজার আছে জানায়। গয়নাগুলোর কথা চেপে যায়। গয়নাগুলো রাতুলের প্রয়োজন। সনাতনী হলেও বর্তমান বাজার মূল্যে আড়াই লাখ টাকার গয়না প্রায়। 

 

ম্যানেজারকে সেই দশ হাজার টাকা দিতে চেয়ে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার হওয়ার পথ খোঁজে রাতুল। আলোকে সে কিছুতেই বাড়িতে বৌ করে নিয়ে যেতে রাজি নয়। আবার খুন করতেও ভয় পায়। এর আগে রাজনৈতিক মিছিলে টুকটাক মারামারি করলেও খুনী নয়। কাউকে কখনো খুন করার কথা ভাবেনি, সেই সাহসই নেই। ম্যানেজার রাতুলকে আশ্বস্ত করে। সবার আগে রিসোর্টের ওয়েলকাম লাউঞ্জের সিসিটিভির গত পনেরো দিনের সমস্ত ফুটেজ ডিলিট করে। যেন পুলিশ আসলে বলতে পারে  যে সিসিটিভি হঠাৎ ক্রাশ করে সমস্ত ফুটেজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুলের কাছের সিসিটিভি কিছু করে না। যেহেতু আলো সরাসরি রুমে চলে গিয়েছে, তাই পুলের ক্যামেরায় ও নেই। পুলিশ চাইলে সেই ফুটেজ দেখিয়ে দিবে। খাবার ঘরেও আলো আসেনি। ম্যানেজার জানায় আলোকে অন্য ব্যবস্থায় দিয়ে দিবে। তাদের আরও সাইড বিজনেস আছে। দশ হাজার টাকা নেয় না ম্যানেজার। বরং রাতুলকে আরও ত্রিশ হাজার দেয়। যেন পরবর্তীতে বন্ধু বান্ধব কোন ঝামেলা করলে ম্যানেজ করে নিতে পারে।

 

আলোকে দিয়ে অভাবিত ভাবে আরও কিছু টাকা আয় হবে, আবার এই ঝামেলা থেকে এত সহজে ছাড়াও পাবে ভাবেনি রাতুল। খুশি মনেই আলোর জন্য রুমে খাবার নিয়ে যায়। রাতুলের ভালোবাসায় গলে গিয়ে খাবার খেয়েও নেয় আলো। খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঔষধ ড্রিংসে মেশানোই ছিল। চুপচাপ নিজের সমস্ত জিনিস নিয়ে বের হয়ে যায় রাতুল। নিজের বাকি দুই বন্ধু ও তাদের গার্লফ্রেন্ডদের বলে আলো রাগ করে চলে গিয়েছে। কারণ আলো ওর সাথে বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে নিতে রাজি হয়নি। সবার মাঝে কিছুটা অবিশ্বাস আর ভয় দেখতে পেয়ে শাসিয়ে দেয় রাতুল। বলে আলোর কথা ভুলে যেতে। ও চলে গিয়েছে যাক, কোন বিপদআপদ হলে তার দায়দায়িত্ব তারা কেউ নিবে না। তারা স্বীকারই করবে না যে আলো তাদের সাথে ছিল। কেউ এ নিয়ে কথা বললে সবাই একসাথেই  ফেঁসে যাবে। তাই কারওই এ নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। 

এরপর পকেট থেকে টাকা বের করে সবার হাতে পাঁচ হাজার করে বিশ হাজার দেয়। হঠাৎ এতগুলো টাকা  পেয়ে কেউ আর কোন আপত্তি তোলে না। মেয়েগুলো টাকা নিতে চায় না। তারা ভয়ই পেয়ে যায়। কিন্তু রাতুল জোর করেই টাকা দিয়ে দেয়। এরপর আলোর কী হয়েছে জানে না রাতুল। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এতটুকুই স্বীকার করে রাতুল।

 

যদিও রাতুলের এই স্বীকারোক্তি পর্যন্ত আসাটা আতিয়া, আশিকের জন্য সহজ ছিল না। মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় পনেরো দিন। মিসবাহ্ সাথে না থাকলে বোধহয় এই পর্যন্ত আসতে ওদের মাস, বছর পেরিয়ে যেত। হয়তো এইটুকু খোঁজও আর পাওয়া হতো না। পুরো পরিবারের বিপক্ষে গিয়েই মিসবাহ দাঁড়িয়েছে আতিয়ার পাশে। মিসবাহ এতটা না জড়ালে পুলিশও বোধহয় এই কেস নিয়ে এতটা কাজ করতো না। রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করে অন্য কেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতো।

পুলিশ রাতুলের সব বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তারা কেউই আলোকে ভালো ভাবে চিনতো না। তবে সেই এলাকার এক লোকাল কাজী অফিসে আলো আর রাতুলের বিয়ের সাক্ষী হয়েছিল সেই দুই বন্ধু। নাবালিকা মেয়ের বিয়ে পড়ানোর অভিযোগে সেই কাজীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ বেশিরভাগই নষ্ট করে ফেলেছিল ম্যানেজার। কিন্তু করিডোরের ফুটেজের কথা ভুলে গিয়েছিল। সেখানে রাতুলের সাথে একটা মেয়েকে হোটেল রুমে ঢুকতে দেখা গিয়েছে। চেহারা স্পষ্ট না হলেও মেয়েটা আলো বলেই ধারণা করেছে পুলিশ। এরপর মেয়েটা আর রুম থেকে বের হয়নি। রাতুল দুপুরে বের হলেও একা বের হয়েছে, আর ঢুকেছে খাবার নিয়ে। এর কিছুক্ষণ পর একাই ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। তার কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার আর একজন লোক,যে রিসোর্টের স্টাফ না, তারা ধরাধরি করে বোরখা পরিহিত একজনকে নিয়ে যেতে দেখে গিয়েছে। তবে সামনের দিকে না গিয়ে পেছনের সিঁড়ির দিকে গিয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে সেখান দিয়ে নেমে নিচে থাকা কোন পণ্য পরিবাহী কাভার্ড ভ্যানে করে আলোকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

 

এই বড়ো শহরে আলোর বয়সী কত মেয়ে হারিয়ে যায়। প্রভাবশালী পরিবারের না হলে তাদের বেশিরভাগেরই আর কোন হদিস পাওয়া যায় না। তাদের কেউ মারা যায়, কেউ বহু হাত ঘুরে বিক্রি হয়ে যায় পতিতালয়ে। কখনো কখনো পরিবার শেষ পর্যন্ত হদিস পেলেও আর ফিরিয়ে আনে না। সেই অন্ধকার জগতেই মেয়েকে ত্যাগ করে আসে। ম্যানেজার পলাতক। অন্য লোকটা কে তা এখনো জানা যায়নি। রিসোর্টের মালিক এই বিষয়ে তার কোনরূপ সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। ওনার বিরুদ্ধে সরাসরি কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। আলোর খোঁজ তাই এখানেই আটকে আছে।

 

সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। আলো আধাঁরিতে দাঁড়িয়ে চেনা এই ঢাকা শহর কেমন অচেনা লাগে আতিয়ার। সাইন্সল্যাবের এই ফ্লাইওভারটা বেশ বড়ো। চারদিকে বিস্তৃত। চারদিক থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়িগুলোর আসা যাওয়া দেখতে দেখতে দু চোখের কোল ঘেঁষে অশ্রু নামে আতিয়ার। মিসবাহ আতিয়ার হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে।

 

“আতিয়া, এতটুকু যখন জানা গিয়েছে। বাকিটাও জানা যাবে। আলোর খোঁজ পাব আমরা।”

 

“এখন সেই খোঁজ পাওয়ারই ভয় লাগে মিসবাহ। এই যে ও কোথায় আছে আমরা কেউ জানি না। এর মাঝে একটা নির্ভরতা আছে। ও নিখোঁজ এই স্বস্তি আছে। ভয় লাগে এখন খোঁজ পেতে। খোঁজ পেলে ও কোথায় আছে তা কী মেনে নিতে পারবো?”

 

“কেন পারবে না। ও তো সেই জায়গায় নিজের ইচ্ছায় যায়নি। একটা ভুল করেছে বয়স আর আবেগের বশে। তার জন্য শাস্তিটাও তো পাচ্ছে কঠিন ভাবে। এরপর ওকে ফিরিয়ে আনতে পারলে তোমরাও যদি ওকে সহজ ভাবে গ্রহণ না করতে পারো, তবে ও কোথায় যাবে!”

 

“আর যদি ওর খোঁজ এমন জায়গায় পাওয়া যায় যেখান থেকে আর কাউকে ফিরিয়ে আনা যায় না!”

 

“আলো বেঁচে আছে আশা রাখো আতিয়া। মেরে ফেলার কথা না।”

 

পরম নির্ভরতায় মিসবাহর হাতের উপর আরেকটা হাত রাখে আতিয়া।

 

“মিসবাহ, আপনি খুব ভালো মানুষ। আয়নাকে আমি দেখিনি। কিন্তু আপনার কাছে যতটুকু শুনলাম মেয়েটা ভালো। ওর একটা ছেলে আছে, আপনার একটা মেয়ে। আপনাদের দু’জনের বিয়ে হলে একটা পরিবার চমৎকার রূপ পাবে। পলিনও মা পাবে। আয়নার জীবনটাও গুছানো হবে।”

 

“আর তোমার জীবন?”

 

“আমার জীবনটা দেখেছন? আমি আসলে খুব অপয়া একজন। আপনার জীবনের সাথে জড়িয়ে আপনার জীবনটাও কেমন কঠিন করে তুললাম। আমার সাথে পরিচয় না হলে আয়নাকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার হয়ে যেত এরই মাঝে। অথচ এখন আপনার পরিবার কত বিরক্ত আপনার উপর। শুনোন, অনেক করেছেন।রাতুল তো স্বীকারোক্তি দিয়েছেই। বাকি পুলিশ তাদের মতো করে আলোকে খুঁজুক। আপনি আর এসবে না জড়িয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।”

 

“আতিয়া, আগেও বলেছি। আজও বলছি। বিয়ে করবে আমাকে? তুমি চাইলে আজই, এই মুহূর্তে কাবিন করবো।”

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ২১

 

“মিসবাহ, আমি কালও আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কামনা করেছি, আজও করি। কিন্তু আজ এই মুহুর্তে কাবিন কিভাবে করবেন? সেই তো আলোর মতোই হবে বিষয়টা। আলোর বয়স কম ছিল, ও ভুল করেছে। কিন্তু আমরা দু’জনই মধ্যবয়সী পরিণত মানুষ। আমাদের এভাবে পরিবারের মুখোমুখি না হয়ে লুকিয়ে  বিয়ে করা কি মানায়?”

 

“আমার আম্মা মেনে নিবে না আতিয়া। তাছাড়া আমার মেজো ভাইয়ের বৌ রত্নাও হয়তো তোমার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করবে। যতই হোক তার আপন ভাইকে জেলে পাঠানো হয়েছে। এর জন্য তুমি আর আমি ওর কাছে অপছন্দের মানুষ। আমি ভাসুর, আমার সাথে সরাসরি তর্কে না জড়ালেও, তোমাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবে না। পলিনকে আগে ও যা টুকটাক একটু দেখতো। এখন মেয়েটাকে একদম চাচাতো ভাই বোনের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করে। দাদির কাছেই থাকে। কিন্তু সবার শাপশাপান্ত থেকে তোমাকে নিয়ে পলিনের মনেও নিশ্চয়ই সেই রকমই একটা খারাপ ধারণা তৈরি করে নিচ্ছে। মা, রত্না, পলিন সবার বৈরী আচরণ কি তোমার জন্য সহজ হবে?”

 

“তাহলে কাবিন করে কী করবেন? আলাদা রাখবেন আমাকে? একদিন বলেছিলেন নতুন করে আবার জীবন শুরু করার কথা ভেবেছিলেন পলিনের কথা ভেবে। পলিনের মায়ের আদর, শাসন প্রয়োজন আছেন ভেবেছেন। সেই আমি যদি আপনাকে বিয়ে করে ওর মা হওয়ার জায়গাটায় না বসতে পারি, তবে আপনার বিয়েতে পলিনই বা কতটুকু লাভবান হবে? ওর তখন আরও বেশি করে মনে হবে যে আমি সত্যিই ডাইনি। আগে তো ওর মা ছিল না। এখন বাবাকেও ছিনিয়ে নিলাম।”

 

“আপাততঃ। তুমি তোমার মায়ের বাসায় থাকলে। বা আমি আলাদা বাসা নিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে।”

 

“এটা কি কোন সমাধান? আমাকে আলাদা ঘর করে রাখবেন। কিন্তু  বাড়িতে যদি কখনোই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়? একদিন আপনার মায়ের চাপে আপনি আয়নাকে দেখতে গিয়েছিলেন, আরেকদিন হয়তো  আপনার মায়ের চাপে আয়নাকে বিয়ে করে নিজেদের বাসায় তুলবেন! দুটো বৌ রাখার ক্ষমতা আপনার আছে। কিন্তু আমার উপবস্ত্র হওয়ার খায়েশ নেই। মূল বৌকে বাড়িতে রেখে আলাদা ঘর করে আমাকে তোলার প্রস্তাব আগেও পেয়েছি। বিয়ের সার্টিফিকেটের সাথে আমার সকল খরচও দিতে চেয়েছে। কিন্তু কখনোই রাজি হইনি। আমি নিজের সংসার চেয়েছি, সেটা সবাইকে নিয়ে সম্মানের সাথে। কেউ আমাকে উটকো বলতে না পারুক, রক্ষিতা নাম না দেক তাই চেয়েছি। নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে সক্ষম। আমি শুধু একজন জীবনসঙ্গী চেয়েছি। আজ আপনাকে ভালোবাসি বলে ঘুরেফিরে তেমনই কিছুতে রাজি হবো, তা হয় না মিসবাহ। আপনি সিদ্ধান্ত নিন, আজ এই মুহুর্তে। হয় সবার মুখোমুখি হয়ে আমাকে বিয়ে করে বাড়িতে প্রবেশ করার সাহস করবেন। আর না হয় আজকের পর আমাদের আর দেখা না হলো।”

 

“আতিয়া! এসব কী বলো! আমি আয়নাকে ইতোমধ্যে জানিয়েছি যে আমার পছন্দ আছে। হ্যাঁ মেয়েটা কান্নাকাটি করেছে। ভেবেছে ওর ছেলেকে নতুন সংসারে আনতে চেয়েছে বলে আমি বিয়ে করতে না করেছি। কিন্তু আমি বুঝিয়ে বলেছি। আর অন্য সবার সাথে তুমি আমাকে মেলাতে পারো না আতিয়া। আমি বিয়ের নাম দিয়ে গোপনে ঘরে তুলে তোমাকে ভোগ করতে চাইনি। তোমাকে সমাজের কাছে স্ত্রী পরিচয় দিয়েই গ্রহণ করবো। ভোগ করতে চাইলে, টাকার বিনিময়ে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা কম নয়।”

 

“আমি বিশ্বাস করি আপনাকে। তাই এইটুকু চাই যে আপনি আপনার পরিবারের মুখোমুখি হয়ে আমাকে বিয়ে করার কথা স্পষ্ট করে বলবেন। আমিও আমার পরিবারকে জানাবো। জানি হয়তো বিষয়টা সহজ হবে না। কিন্তু সকলকে জানিয়েই বিয়ে করতে চাই। তারপর কাল বাদ আসর আপনি আমার বাসায় বরযাত্রী নিয়ে আসবেন। যদি কেউ আপনার সাথে আসতে রাজি না হয়,আপনি একাই আসবেন। আমার পরিবারেও কেউ যদি পাশে নাও থাকে, আমি একাই বধূ বেশে আপনার অপেক্ষায় থাকবো। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বৌ বেশে কতটা ভালো লাগবে জানি না। কিন্তু আপনার জন্য সাজবো।”

 

“আমি আসবো। অবশ্যই আসবো।”

 

রাস্তার ওপর পাশে আড়ং এর লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। ঝলমল করছে তিনতলা আড়ং এর শো রুম। মিসবাহ আতিয়ার চোখ মুছে দিয়ে হাত ধরে টেনে নেয়। বলে, “চলো বিয়ের শাড়ি কিনে দেই।”

 

“বিয়েতে জামদানী পরবো না।”

 

“তবে?”

 

“আমার খুব শখ লাল টুকটুকে একটা বেনারসী শাড়ি পরার। কখনোই এই শখ পূরণ হয়নি। আমার মৃত স্বামী হাসানের মা আমার জন্য বেগুনি রঙের শাড়ি কিনেছিলেন। তখন বলতে পারিনি লাল চাই। আজ আপনাকে বললাম।”

 

“আমি কিছু চাইতে পারি?”

 

“অবশ্যই। আর হ্যাঁ আপনার জন্য বিয়ের পাঞ্জাবি কিন্তু আমি কিনবো। হয়তো সস্তা হবে। আমার অত টাকা কই। কিন্তু তাই দিতে চাই।”

 

“তোমার ইচ্ছে শিরোধার্য। এবার আমার কথা রাখ। আজ এখন থেকে তুমি করে বলবে, আপনি না। বলবে?”

 

“বলবো।”

 

আতিয়া বাড়িতে ঢুকে দেখে আয়েশা এসেছে। খলিলও আছে কিনা কে জানে! আশিকের সাথে আগেই কথা বলছে আতিয়া। আশিকও ঘরেই বসে আছে।

 

“আপা, হাতে কিসের ব্যাগ এত?”

 

“শাড়ির। আর টুকটাক গয়না।”

 

মিসবাহ জোর করে একজোড়া বালা, গলা আর কানের একটা সোনার জড়োয়া সেট নিয়ে দিয়েছে আতিয়াকে। সোনা ছাড়া নাকি বিয়ে অসম্পূর্ণ লাগে।”

 

“হঠাৎ শাড়ি, গয়না!”

 

দেলোয়ারা বেগমও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ান। এখন ওনার তেজ অনেকটাই কমে গিয়েছে। জলজ্যান্ত মেয়েটা এভাবে হারিয়ে যাবে কখনও ভাবেননি। মা মন তো, এতটাও পাষাণ হতে পারে না। মেয়ের শোকে সোনা হারানোর কষ্ট, আয়েশার স্বামী খলিলের টাকা মেরে দেওয়ার কষ্ট, সবই এখন সামান্য মনে হয়। আজ তাই নিজেই আয়েশাকে ফোন দিয়ে আনিয়েছেন। সন্তানদের জন্য  মনটা কেমন খা খা করছিল।

 

“আতিয়া, কিসের শাড়ি গয়না রে? দামি ব্যাগ দেখা যায়।”

 

“আম্মা, কাল বাদ আসর মিসবাহ ভাই, আপাকে বিয়ে করতে আসবে। শাড়ি, গয়না আপার বিয়ের।”

 

আতিয়ার হয়ে উত্তর দেয় আশিক। আয়েশা হিংসায় জ্বলে যায়, যখন বুঝতে পারে এই মিসবাহ, আশিকের দোকানের মালিক। এবং লোকটা ভালো পরিমাণ টাকা পয়সার মালিক। নিজের হিংসাকে গোপন করতে আলোর কথা তুলেই আতিয়াকে আঘাত করতে চায় আয়েশা।

 

“দেখেছো আম্মা! আমাদের আলোর কোন খোঁজ নাই। বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে আমরা জানি না। আর আপা আছে নিজের চিন্তায়। সেই পরিবারেরই একজনকে বিয়া করতেছে। নিজের মা বোনেই জন্য এইটুকু মায়া নাই তোমার আপা। এত পাষাণ, এত স্বার্থপর। খালি নিজের সুখের কথাই ভাবলা আজীবন। এভাবে কোনদিন সুখী হইবা না।”

 

“নিজের সুখের কথা কে না ভাবে আয়েশা। তুইও ভাবোস। তাই মায়ের টাকা মাইরা দিলেও জামাইয়ের পক্ষ নেস। নিজের পছন্দে বিয়া করছস। টাকা, গয়না সময়ে সময়ে সবই বাইর করছস। আতিয়ারে অভিশাপ দেস ক্যান? তুই যদি সুখী হইতে পারোস, আতিয়াও পারবো।”

 

দেলোয়ারা বেগমের কথায় হতভম্ব হয়ে যায় আতিয়া। মা তার পক্ষ নিবে কেনদিন ভাবেনি আতিয়া। আয়েশাও বিশ্বাস করতে পারে না।

 

“কী বলো আম্মা!”

 

“ঠিকই কই। এই যে আলো নিখোঁজ হইলো। তুইও তো বোন। তুই কী করছস? থানা, পুলিশ, টাকা পয়সা খরচ যা করার এই আতিয়া করছে। নিজের কানের একজোড়া সোনার বালি সম্বল আছিল। সেটাও বিক্রি করছে।”

 

“বাহ্! আম্মা, বড়োলোক জামাই পাওয়ার গন্ধে দেখি আপা এত ভালো হইয়া গেল তোমার কাছে!”

 

“আলো আর তোরে তো সবসময় ভালা পাইছি। কী করছস তোরা? একটা মাইয়া মুখে চুনকালি দিয়ে পলাইয়া গেল। কই আছে কে জানে। সবাই  খোঁজ নিতে আইসা আমাকে ঠেস দিয়া যায়। কয় বাপ মরনের পরে মাইয়া নষ্ট হইয়া গেল, আমি মা হইয়া খেয়াল করি নাই! অথচ আলো আর তোর জন্য করি নাই এমন কী আছে? তুই যে এত বড়ো বড়ো কথা কস, তুই আর তোর জামাই এতদিন আইছস মায়ের কাছে? আসোস নাই ভাবছস ঝামেলাতে না পড়স। এখন ঐ পোলা সব স্বীকার করার পর নিশ্চিন্ত হইছস। তাই আজ ডাকনের পর আসছস। শোন তোদের কারও সাথে আর কোন অশান্তি চাই না আমি। তুই যা পাইতি নিয়া গেছস। আলো যা পাইতো নিয়া গেছে চুরি কইরা। আশিক ছেলে মানুষ। নিজেরটা নিজে কামাই কইরা চলবো। কিন্তু আমার আতিয়া মাইয়াটা কি পাইছে এই সংসারে! আমার শরীর খারাপ লাগে। ঘুমের ভেতর মৃত্যু দেখি, তোদের বাপরে দেখি। আমারে কয় আতিয়ার একটা গতি করতাম আমি। আশিক তোর মিসবাহ্ ভাই যদি আসলেই আমার আতিয়ার ভালা চায়, তাহলে আমার কোন আপত্তি নাই। এইবার মাইয়াটা সুখ পাক।”

 

আয়েশা আর কিছু বলে না। ঝগড়া করার জন্য গলায় জোর আসে না আর। আতিয়া দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। দেলোয়ারা বেগমও আতিয়াকে জড়িয়ে ধরেন। ষাটোর্ধ দেলোয়ারা বেগমের কুঁচকানো চামড়ার হাত দুটো ধরে বড়ো কোমল মনে হয় আতিয়ার। কতদিন, কতদিন মায়ের এই স্নেহর জন্য আকুল ছিল সে। আজ যেন দু’জনের মাঝখান থেকে স্বার্থের পর্দাটুকু উঠে গেল।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ২২

 

আতিয়ার বাসার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র জাহানারা ভিলায়। যদিও রাজকীয় কোন বাড়ি নয়, তারপরও নিজের শ্রমে বাবার জায়গার উপর তিল তিল করে এই বাড়ি দাঁড় করিয়েছে মিসবাহ। এই বাড়ি তাই মিসবাহর রক্তপানি করা রাজবাড়ীই। বাড়ির নাম দিয়েছে মায়ের নামে। জাহনারা ভিলা। তিনভাই এই বাড়িতে একসাথে যৌথ পরিবার হিসেবেই রয়েছে। নিচের তালায় কেউ থাকতে চায় না এখন। বদ্ধঘর গরম, আলো প্রবেশ করে না। তাই নিচে দোকানঘর আর গুদাম করে দিয়েছে। দোতলা পুরোটা নিয়ে মিসবাহর পরিবার থাকে।

 

ছাদের উপর একপাশটা খোলা, আরেকপাশে তিনটি ছোটো রুমের জন্য দুটো কমন বাথরুম আর একটা কমন রান্নাঘর করে রাখা। ভাড়া দেওয়া আছে রুমগুলো। দোকান আর গুদামের লোকজনই পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাড়া আসে সবকিছু মিলিয়ে। তা থেকে তিন ভাই দশ হাজার করে ত্রিশ হাজার রাখে। বাকি বিশ হাজার জাহনারা বেগমের জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছেন মিসবাহ। মাকে যেন নিজের টুকটাক হাতখরচ, দান-খয়রাতের জন্য কোন ছেলের উপর নির্ভরশীল না হয়ে থাকতে হয়। কামরাঙ্গীচরে এখনো ঢাকার মূল অংশের মতো বাড়িভাড়া অতিরিক্ত নয়। বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া সম্পর্কও এখানে অনেকটা ঘরের মানুষদের মতো। তাই বাকবিতন্ডা শুরু হওয়ার পর তাদেরই কেউ কেউ এই রাতেও ঘরে চলে এসেছেন। বয়স্ক মহিলারা জাহনারা বেগমকে সামলাচ্ছেন। কমবয়সী মহিলারা রত্নার পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন। মিসবাহর পক্ষে যেন কেউই নেই! 

জাহানার ফোন দিয়ে বড়ো মেয়ে,ছোটো মেয়েকেও আসতে বলেছেন এই রাতেই। ছোটো মেয়ে হেলেন চলে এসেছে। বড়ো মেয়ে মোনা আসেনি। সবাই জাহনারা বেগমের পক্ষে। কেউই আলোর মতো মেয়ের পরিবার থেকে বৌ আনতে মত দিচ্ছে না। আতিয়া নাকি কোন মতেই এই বাড়িতে আসার যোগ্য না। এতোগুলা মহিলার আক্রমণে মিসবাহর অসহায় লাগে, কোণঠাসা হয়ে পড়ে। হেলেন বলে,

 

“ভাইয়া, আব্বা মারা যাওয়ার পর আপনি আমাদের গার্জিয়ান ছিলেন। আপনার ভালোমন্দ সব সিদ্ধান্ত আমরা আব্বার সিদ্ধান্তের মতো মেনে নিয়েছি। কারণ আপনি পরিবারকে ভালোবাসতেন। আমার তো এখনও বিশ্বাসই হয় না আপনি এই বয়সে বিয়ে করার জন্য এভাবে আম্মার বিপক্ষে দাঁড়াইছেন। আপনি হাসানের বয়সী হলেও মানা যেত। এই বয়সে নিজের পছন্দে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য কেউ এভাবে ঘরে অশান্তি করে!”

 

“হেলেন, তুই, আম্মা সবাই তো চাইতি আমি যেন আবার বিয়ে করি। তুই নিজেও তো নানা প্রস্তাব আনছিস। পলিনের মায়ের দরকার আছে এই কথা তোরা সবাই বলছিস। এখন আমি যঝন নিজেই বিয়ে করতে চাইছি তোরা সবাই আমার বিরুদ্ধে কেন দাঁড়াচ্ছিস! এই জন্য যে আমি নিজে পছন্দ করে কাউকে বৌ করতে চাই? আম্মা আমার জন্য আয়নাকে পছন্দ করেছে। আয়না কি পাত্রী হিসেবে আলোর চেয়ে বেশি ভালো? আয়নার আগে একটা বিয়ে হয়ে ডিভোর্স হয়েছে, একটা ছেলে আছে। তাও আম্মার জিদ আমার আয়নাকে বিয়ে করতে হবে। এই জিদের কারণ কি এটাই যে আয়না আমার নিজের পছন্দ করা মেয়ে না? আমার বয়সে আমি যদি নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চাওয়াটা মানানসই না হয়। তাহলে তোর কি বড়ো ভাইকে এসব প্রশ্ন করা মানানসই?  না আম্মার এত জিদ করা মানানসই।”

 

“ভাইয়া সমস্যা তো ওনার পরিবারে। দেখ ওনার বোনের জন্য রত্না ভাবীর ভাই জেল খাটতেছে। একন যদি তুমি ওনাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসো সবার সাথে সবার অশান্তি হবে। এই বাড়িতে আসার আগেই যে মহিলা মা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। সে বাড়িতে আসলে ঘর ভাগ হবে।”

 

“এই বাড়িতে আগে আমার কোন রা ছিল না দেখে সব শান্তি ছিল। আমি কখনোই কন আওয়াজ তুলিনাই তাই তোদের সবার কাছে ভালো ছিলাম। কেনদিন পায়রাকেও আওয়াজ তুলতে দেই নাই। তাই ওর কাছে ভালো স্বামী হতে পারি নাই। ও আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারে নাই, চলে গিয়েছে ঘর ছেড়ে। একা হয়েছি আমি আর আমার মেয়ে। কিন্তু এসব কারও শান্তি ভঙ্গ করে নাই। তোরা সবাই যার যার জীবনে ভালো আছিস। সবচেয়ে বড়ো কথা রত্নার ভাই নিজের অপরাধে জেল খাটছে। ওর ভাইয়ের উপর ভরসা করে একটা মেয়ে ঘর ছাড়ছিল, আর ও সামান্য টাকার বিনিময়ে কার হাতে মেয়েটাকে তুলে দিলো? আজ আতিয়া আমার উপর বিশ্বাস রাখছে, আমি এই বিশ্বাস নষ্ট করি কিভাবে?”

 

জাহনারা বেগম উঠে দাঁড়ান। ছোটো মেয়ে হেলেনের দিকে তাকিয়ে বলেন, “হেলেন, তোর ভাইরে কইয়া দে কাল বাদ আছর সে আমাদের সাথে গিয়া আয়নারে বিয়া কইরা এই বাড়ির বৌ হিসাবে নিয়া আসবে। আর তা না করলে সংসার আলাদা করুম। আমি আর হাসান, হামিদ আর রত্নার সাথে খামু। মিসবাহ তার বৌ নিয়া আলাদা হইবো। এই ঘরেই আলাদা পাক হইবো আলাদা চুলা বসবো। ঘর ভাগ হইবো। বাড়ি কে বানাইছে বিষয় না। জায়গা আমার স্বামীর। বাড়ির মালিকানা আমার। আমি যেমনে চাইমু সেমনে ভাগ কইরা দিমু। যার লগে থাকুম তারে বেশি অংশ দিমু।”

 

আতিয়া কোন পার্লারে যায়নি। নিজে নিজেই শাড়ি পরেছে। লাল রঙের আলোয় মুহূর্তে কেমন বৌ বৌ মায়া ফুটে উঠেছে চেহারায়। শাড়ি পরে বসে থাকে আতিয়া। হাত আগায় না, কিভাবে কী সাজবে তাও বুঝে না। আয়েশা আর খলিল আসেনি। আশিক ছেলে মানুষ। দেলোয়ারা বেগম রান্নাবান্না দেখছেন। তাদের কারও কাছ থেকে কোন সাহায্য নেওয়া সম্ভব না। আতিয়া একা একা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আর দশটা বৌয়ের চেয়ে তার বৌ সাজাটা কত আলাদা! কোন বান্ধবী নেই সাথে, যারা হাসি তামাশা করে আসর জমাবে। একপাল ছোটোবড়ো কাজিনের দল নেই, যারা স্পিকার ভাড়া করে এনে জোরে গান চালিয়ে দিয়ে বোঝাবে যে এটা একটা বিয়ে বাড়ি। আশিক ওর দু’জন বন্ধু নিয়ে এসে বসার ঘরে কিছু ফুল, ডেকোরেশনের জিনিস দিয়ে সাজিয়েছে। আতিয়ার কাছ থেকে কোন টাকা নেয়নি।

 

রান্নায় দেলোয়ারা বেগমকে কুটাবাছা করে এগিয়ে দিয়েছে আতিয়া। এরপর পাশের বাসার দুই খালা এসে আতিয়াকে উঠিয়ে দিয়েছে। গোসল করে তৈরি হতে বলেছে। গোসলের আগে ওনারাই আতিয়ার গায়ে একটু হলুদ ছুঁইয়ে দিয়েছেন। আয়োজন সীমিত। পোলাও, মুরগী আর গরুর ঝাল মাংস, ডিমের কোরমা করেছেন দশজনের আন্দাজে। মিষ্টি হিসেবে সাগুর পায়েস রান্না করেছেন। নামাজের পরই বরযাত্রী আসার কথা। আতিয়ার কেমন অস্থির লাগছে। মিসবাহর বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে জানে আতিয়া। মিসবাহ ঠিক মতো কথা বলার সুযোগও পায়নি। শুধু গভীর রাতে জানিয়েছিল ও আসবে। জোহরের নামাজের পরই রওনা দিবে ইনশাল্লাহ। 

 

আতিয়ার হাত কাঁপছে। শাড়ির কুঁচি গুলো আজ নিখুঁত হয়ে ভাঁজ হচ্ছিল না। এলোমেলো উঁচুনিচু হয়ে যাচ্ছিল বারবার। মনের অস্থিরতা চলে এসেছে হাতেও। বারবার পিপাসা পাচ্ছে। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে আতিয়া চমকে ওঠে।

 

“আপু,আমরা চলে এসেছি!”

 

আতিয়ার হসপিটালের সিনিয়র স্টাফ নার্স জমিলা সিস্টার আর জুনিয়র সোনিয়া এসেছে। ওদের দুজনকে দেখে আতিয়ার এত ভালো লাগে। বন্ধু বলুক বা বোনের মতো, কর্মক্ষেত্রে এই দু’জনই আতিয়ার খুব কাছের। নিজের বিয়েতে আতিয়া শুধু এই দুইজনকেই নিমন্ত্রণ করেছে।

 

“আপু, মাশাল্লাহ লাল বেনারসীতে কী মানিয়েছে।”

 

“কী আর মানানো। শুধু শাড়িই পরলাম। সাজগোজে হাত আগাচ্ছে না।”

 

“হাত আগানো লাগবে না। তুমি হলে বৌ মানুষ চুপচাপ বসে থাকো। দেখ আমি কিভাবে সাজাই। সেদিনের মতো আজও ভাইয়া তোমার উপর থেকে চোখ সরাতে পারবে না।”

 

জমিলা সিস্টার এসে আতিয়ার হাতে আরেকটা তাবিজ গুঁজে দেন।

 

“দেখছিস আমার হুজুরের তাবিজের গুণ। এক তাবিজে তোর কপালের ফাঁড়া কেটে বিয়ে হচ্ছে। এখন বিয়ের পর দুধে ভিজিয়ে কোমরে এই তাবিজ বাঁধবি। স্বামী বশে থাকবে, দীর্ঘায়ু হবে।”

 

আতিয়া তো ঐ তাবিজ কবেই ফেলে দিয়েছে। মিসবাহ আতিয়ার জীবনে কোন তাবিজের গুণে নয়, বরং স্রষ্টার আশীর্বাদ রূপেই এসেছে। কিন্তু জমিলা সিস্টারকে কিছু বলে না আতিয়া। মনে কষ্ট পাবে সিস্টার।

 

“সোনিয়া, একদম হালকা সাজাবি। মুখ বেশু সাদা করিস না। এত লাল লিপস্টিক দেব না।”

 

“উফ্ চুপ করে বসো। আমাকে সাজাতে দাও। তাজা ফুল এনেছি। তোমার খোঁপায় লাগিয়ে দেব।”

 

আতিয়ার দু’চোখে কাজল টেনে সাজ শেষ করে সোনিয়া। সোনার গয়নাগুলো পরিয়ে দিতেই যেন রুম আলো হয়ে যায়। বৌ সে তো বৌ ই। বিয়ের সাজে এক আলাদা আলো আছে। যেকোন বয়সী, যেকোন নারীকে এই সাজে এক অন্যরকম পরিপূর্ণতা দেয়। আসরের সব আলো যেন বধূ নিজের দিকেই টেনে নেয় এই একটি বিশেষ দিনে।

 

“আপু, মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। এত সুন্দর লাগছে।”

 

দেলোয়ারা বেগম দরজায় এসে দাঁড়ান। 

 

“আতিয়া, তোরে সুন্দর লাগতেছে। মাশাল্লাহ, আল্লাহ তোরে সুখী করুক।”

 

নিজের আঙ্গুল থেকে পুরানো আঙটিটা খুলে আতিয়ার আঙ্গুলে পরিয়ে দেন দেলোয়ারা বেগম।

 

“আম্মা, এইটা কী করেন। এইটা আব্বার স্মৃতি। আপনের হাতেই থাক।”

 

“তোরে কিছু তো দিতে পারলাম না। যা ছিল তোর, সবই তোর কাছ থেকে নিয়ে নিছি আমরা সবাই। এই আঙটিটা দেই। না করিস না।”

 

ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁইছুঁই। সবাই একটু অস্থির।  মনে অমঙ্গল চিন্তা উঁকি মারছে। আশিক বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছে। দোকানের দিকে গিয়ে একটু খোঁজ নেবে ভাবছে। আতিয়া বারবার ফোন দিচ্ছে মিসবাহকে। কিন্তু ফোন বন্ধ পাচ্ছে। হাসানকে ফোন দিয়েছিল আশিক। শুনেছে ছোটো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আতিয়াকে বলে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না বলে একটা বাহানা দিয়ে বের হয়েছে। 

 

“আতিয়া, কী হইলো রে? ফোন ধরে না? মন ঘুইরা যায় নাই তো?”

 

“জানি না আম্মা। মন ঘুরলেও আর কী করার আম্মা।হয়তো তোমার মেয়ের কপালে লেখা নাই।”

 

মুখে কথাটা বললেও মনে বিশ্বাস করতে বড়ো। কষ্ট হয় আতিয়ার। চোখ জ্বালা করছে। কান্না আটকানোর চেষ্টায় রত আতিয়া দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। নাহ্ মিসবাহ আসবে যেহেতু বলেছে নিশ্চয়ই আসবে। বিশ্বাস হারাবে না আতিয়া।

 

সন্ধ্যা ছয়টা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিটে দশ লাখ একটাকা কাবিনে মিসবাহর সাথে বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পরে আতিয়া। ছোটো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল ঠিকই। মিসবাহর বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছে। ফোনটা পরে ভেঙে গিয়েছে। হাতেও সামান্য আঘাত পেয়েছে। কনুইয়ের কাছে চামড়া ছিলে গিয়েছিল পড়ে গিয়ে। মিসবাহর আঘাত দেখে আতিয়া নিজেই বেঁকে বসেছিল বিয়ে করতে। তার মনে জাঁকিয়ে বসেছে বরাবরের মতোই সেই অপয়া অপবাদের ভয়। তার সংস্পর্শে ভালোবেসে যেই আসে, সে ক্ষণিকের সাথী হয়। মিসবাহ তখন নিজেই পাশে গিয়ে বসে। বলে,

 

“আতিয়া, আমি যদি বলি তোমার কাছে আসব বলে কথা দিয়েছি বলেই আল্লাহ আমাকে আজ জীবন দিলেন। বিশ্বাস করো পিকআপটা যেভাবে আমার দিকে হঠাৎ  এগিয়ে এসেছিল চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখেছি। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছে আমি আমার আতিয়াকে দেওয়া কথা কি রাখতে পারবো না! দৈবাৎ কিভাবে পিকআপের চাকার নিচে মাথা না গিয়ে রাস্তার অন্যপাশে পড়লাম, নিজেও জানি না। শুধু তোমায় কথা দিয়েছিলাম বলেই হয়তো এই জীবনটা আজ উপহার পেলাম। এখন তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে এই জীবন নিয়ে আমি কোথায় যাব। সব হেলায় ফেলে যে আমি তোমার কাছে এসেছি।”

 

এমন করে ভালোবাসার প্রসাদ দিলে, তার ফিরিয়ে তো দেওয়া যায় না। আতিয়াও পারে না।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

পর্ব ২৩

 

আয়োজন সামান্য হলেও সবাই তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে। দেলোয়ারা বেগমের রান্না ভালো। নাহ্ শেষ পর্যন্ত মিসবাহকে একা আসতে হয়নি। বরযাত্রী হয়ে সাথে এসেছে ছোটোভাই হাসান, মিসবাহর দুই বন্ধু, বোন মোনা আর বোনের জামাই হারুন! 

মোনা যে মিসবাহর সাথে আসবে তা কখনোই ভাবেনি মিসবাহ্। ছোটোবোন হেলেন তো পুরোপুরিভাবে এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু মোনা বাসায় এসে সবার বিপরীতে গিয়ে মিসবাহর পক্ষ নেয়। মায়ের জিদ, আর একচেটিয়া সিদ্ধান্তের বলি মোনার নিজের জীবনের কিছু না পাওয়া কষ্ট আছে। না তার স্বামী হারুন খারাপ মানুষ নয়। তবে যখন মোনার বয়স ছিল, সময় ছিল জীবনের সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপভোগ করার তখন হারুন ছিল নিষ্প্রভ। নিজ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কখনোই মোনার জন্য দাঁড়ায়নি। মায়ের উপরও মোনার অভিমান পাহাড়সম। কেননা পড়তে চাওয়া, আরও কিছুদিন পড়ালেখা করার আর্জিগুলো যে মা পাত্তাই দেননি। তাই বিয়ের পর বাবার বাড়ির সাথে একরকম দূরত্বই হয়ে গিয়েছিল মোনার। বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসতো ঠিকই, কিন্তু  নিজের ভালোমন্দ, সাংসারিক আলাপ কিছু নিয়েই কথা বলতো না। মিসবাহ চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আজ থেকে বারো বছর আগে মিসবাহর নিজেরই এতটা শক্তিশালী অবস্থান ছিল না যে বোনের শ্বশুরবাড়ির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবে, বোনকে বিয়ের পরও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তাছাড়া জাহানারা বেগম নিজেই মিসবাহকে এই নিয়ে কিছু করতে দেননি। ওনার কাছে মেয়ের পড়ালেখার আগ্রহের চেয়ে বেয়াই বেয়াইনকে অসন্তুষ্ট না করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

 

এরপর এক সময় হাসানও বোনের অভিমানের কারণ বুঝতে পেরেছে। অবশ্য মেজোভাই হামিদ বরাবরই সাংসারিক বিষয়ে উদাসীন, আর বোন হেলেন নিজের দুনিয়া আর নিজের খুশিতেই লীন। তাই বাবার বাড়ির যে দু’জন মানুষের উপর মোনার নিজস্ব একটা কোমলতা কাজ করে তারা হলো মিসবাহ আর হাসান। সময় গড়িয়েছে, মোনা নিজেই এখন নিজের সংসারের কর্ত্রী। তবু অনেক কিছু করার আর পাওয়ার মন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সকালের মিঠে রোদের স্বাদ তো আর দুপুরের গনগনে সূর্যের আলোতে নেই! সেই বয়সও নেই, সেই আহ্লাদও আর নেই। কিন্তু আজ বড়োভাই নিজের মতো করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর সবাই তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে শুনে মোনা নিজ থেকেই চলে আসে। সবাইকে মনে করিয়ে দেয় বাবার মৃত্যুর পর যদি মিসবাহ স্বার্থপর হতো তবে আজ কারোই নিজের পায়ে দাঁড়ানো হতো না। 

 

“আম্মা যে সংসারের কর্ত্রী হওয়ার সুবাদে বাড়ি ভাগ করার কথা বলছেন, সেই বাড়ির জমি বাবার হলেও বাড়িটা এই ভাই মিসবাহর রক্ত পানি করে কামাই করা টাকায় বানানো। আমাদের দুই বোনের বিয়ে, ভাইদের নিজের পায়ে দাঁড়া করানো এই সবকিছুই এড়িয়ে গিয়ে ভাই নিজের কথা ভাবলে তার প্রথম স্ত্রী পায়রা তাকে ছেড়ে চলে যেত না। ভালো ছেলে, ভালো ভাই হতে গিয়ে ভালো স্বামী হতে পারেনি বড়ো ভাই। আর তাই তো যৌবনের দীর্ঘদিন তাকে একাকিত্ব নিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে। আজ ভাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাই কারও প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই। ভাই নিজের পছন্দে যেকোনো মেয়েকে বিয়ে করার অধিকার রাখেন। আপনারা কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন না। আপনারা কেউ বৌ আনতে না গেলে আমি আর হাসান যাব।”

 

বিয়ে পড়ানো শেষ। সবাই খেয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা সাতটা ছুঁইছুঁই। দেলোয়ারা বেগম রাতের জন্য রান্না বসাবেন কিনা বুঝতে পারছেন মা। দুপুর দুইটায় কাবিন হলে, সন্ধ্যায় বৌ নিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। এখন তো দেরি হলো সবকিছুতেই। আবার নতুন করে রান্না বসাতে বাজার লাগবে। হাতে আছে পাঁচ হাজার মাত্র। বিয়েতে তো কিছু দিতে পারেননি। ভেবেছিলেন বিদায়ের সময় মেয়ে জামাই সালাম করলে এই টাকাটা হাতে দিবেন। এখন এই টাকা খরচ করেই বাজার আনাবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। দশজন মানুষের জন্য মুরগী, ডিম এসব আনাতে হলেও দুই হাজার টাকার খরচ আছে। আশিককে ইশারায় ডেকে রুমে নিয়ে যান। মিসবাহ সবই খেয়াল করে। বসার ঘরেই আছে মিসবাহ। আতিয়ার সাথে বোন মোনা আর আতিয়ার দুই সহকর্মী আছে রুমে।

 

“আশিক, দুই হাজার টাকা দিমু। বাজার কইরা আন আস্তে। রাইতে খাইলে কী দিমু। দুপুরের খানা তো শ্যাষ।”

 

“কী আনবো?”

 

“মুরগী আনবি, আর ডিম। টাকা হইলে কোক আনতে পারোস।”

 

মিসবাহ্ আস্তে উঠে আতিয়ার রুমের সামনে যায়।।মিসবাহকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জমিলা সিস্টার আর সোনিয়া মশকরা করে। তবে মোনা ভাইয়ের চেহারা দেখে বুঝতে পারে জরুরি কিছু।।তাই সবাইকো নিয়ে বাইরে বের হয়। ছোটো বাসা, দুটো মোটে রুম। মোনা ভাবে তাড়াতাড়ি বের হওয়া দরকার। এই কয়জন মানুষেই যেন বাসায় হাঁটার জায়গা নেই। 

 

“ভাইয়া,বের হওয়া দরকার।  আর রাত না করি।”

 

“হ্যাঁ। সবাইকে গুছিয়ে নিতে বল। আর আন্টি, মানে আতিয়ার আম্মাকে আর কোন কিছু করতে মানা লর এখন। তিনি যেন এখন আর কোন রান্নাবান্নার ঝামেলা না করেন।”

 

আতিয়ার পাশে গিয়ে বসে মিসবাহ। আতিয়া লজ্জা পায়। কেন জানি চোখ তুলে তাকাতেও অস্বস্তি ভর করছে। মিসবাহ তার দেওয়া সোনালি পাঞ্জাবিই পরেছে। বয়স চল্লিশ হলেও যথেষ্ট সুপুরুষ মিসবাহ। কানের কাছে অল্প কিছু চুলে পাক ধরলেও তা বয়সের ছাপ বহন করে না, বরং ব্যক্তিত্বে আলাদা শোভা এনে দেয়। একহারা গড়ন, মেদহীন শরীর, আর গড়পড়তার চেয়ে বেশখানিকটা লম্বা মিসবাহকে পাঞ্জাবি, চুড়িদার পায়জায়, আর নাগড়া জুতায় বেশ আকর্ষণী লাগছে। জমিলা সিস্টার আর সোনিয়াও আতিয়ার সাথে মজা করেছে এই নিয়ে, বলেছে দুলাভাই রীতিমতো নায়ক। এই নায়কের জন্য আতিয়াকেও নায়িকা হতে হবে। লজ্জা পেলে চলবে না। কিন্তু আতিয়া তো চোখ তুলেই তাকাতে পারছে না।

 

“আতিয়া, পলিনকে নিয়ে আসতে পারেনি। আম্মা দিলেন না। আমিও জোর করিনি। পলিন ভয় পাচ্ছিল। আতিয়া জানি বিয়ের প্রথম দিন এসব বলা ঠিক না। তোমার কাছে একটা অনুরোধ, তুমি পলিনের মা হওয়ার প্রয়োজন নেই, ওর বন্ধুই হইয়ো। ওকে সৎ মেয়ে হিসেবে দেখো না। মেয়েটা খুব একা। ও হয়তো তোমাকে সহজ ভাবে গ্রহণ করবে না। সবাই ওর মনে একটা ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে তোমাকে নিয়ে। আমি তোমাকে বলছি না তুমি রূপকথার মতো কোন জাদুবলে ওকে নিজের করে নাও বা বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো সব সহ্য করা কোন চরিত্র হও। তেমন জীবনসঙ্গী আমি চাইনি এবার। এর ফল ভালো হয় না। যারা মুখ বুজে সব সহ্য করতে থাকে, তারা হঠাৎ এমন করে পরিবর্তন হয় যে তার ফলাফল ভয়াবহ হয়। বরং তুমি কালোকে কালো, সাদাকে সাদাই বইলো। আমার পরিবারে অনেক কিছুর মুখোমুখি হবে, তুমি তোমার মতো যেখানে যা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন দিও। আমি তোমাকে প্রশ্ন করবো না। একই ভুল আমি দ্বিতীয়বার করতে চাই না। যেখানে তোমার পাশে আমার দাঁড়ানো প্রয়োজন সেখানে আমি অবশ্যই দাঁড়াবো। কিন্তু যদি কিছু অন্যায় করো, তবে শাসন করার অধিকারও আমার আছে জেনো।”

 

“আমি জানি না কতটুকু কী পারবো। চেষ্টা করবো। সহজ না কবুল বলেই একটি সাত বছরের বাচ্চার মা হয়ে যাওয়া। আমার কোন সন্তান নেই। সন্তান পালনের কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবেবসব মেয়েই নতুন করেই মা হয়। কেউ সন্তান জন্ম দিয়ে। কেউবা আমার মতো। আর নতুনভাবে শুরু করা যেকোন কিছুতে ভুল হয়। তা কাজ হোক বা সম্পর্ক। অন্যায় আর ভুলের মাঝে পার্থক্য আছে। যদি আমার অন্যায় হয়, অবশ্যই শাসন করবে। কিন্তু যদি ভুল হয় তবে আমাকে ঠিক করে দিও।”

 

মিসবাহ, আতিয়ার হাতটা হাতে নিয়ে আস্তে একটা চাপ দিয়ে আস্বস্ত করে।

 

“আতিয়া, তেমাকে নিয়ো আজ হোটেলে থাকবো ভাবছি। আমার বন্ধুরা ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটা রুম ভাড়া করতে চাইছে। আমিও তাই ভাবছি। আজকের দিনটা তিক্ততায় শেষ হোক চাই না।”

 

“আমি তো বরং চাই সমস্ত তিক্ততা আজ রাতেই শেষ হোক। এই না বললেন পলিন আমাকে ভয় পাচ্ছে?  আজ প্রথম রাতই যদি আমরা বাড়ি না যাই, ওর এই ভয় পাকাপাকি হবে। ও ধরেই নিবে আমি এসেই ওর বাবাকে ওর কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছি। বরং যা কিছু খারাপের মুখোমুখি হতে হয় আজই হই। একটা সুন্দর রাত তোমার কাছে পাওনা থাকলো। এত বড়ো হোটেলে আমি কখনো থাকি নাই। তবে আজ না। আজ আমরা হোটেলে গেলে তোমার মা, মানে আম্মাও ভালো ভাবে নিবেন না। ওনাকে আরও খেপিয়ে দেওয়ার মানে নেই।”

 

আতিয়ার গৃহপ্রবেশ খুব সাধারণ ছিল। রত্না ছেলেমেয়েদের নিয়ে দরজা দিয়েছে। হেলেন আর পলিন জাহনারা বেগমের রুমেই ছিল। জাহানারা বেগমও রুম থেকে বের হননি। মোনাই শরবত বানিয়ে ভাই ভাবীকে খাইয়েছে। পলিন দাদী আর ছোটোফুপুর রাগ রাগ কথাবার্তার মাঝেই উঠে এসে আড়াল থেকে বাবার পাশে নতুন মাকে দেখেছে। মোনা ডাকলেও দাদীর ভয়ে সামনে আসার সাহস হয় না। মোনার দৃষ্টি অনুসরণ করে নতুন মা আতিয়াও ওর দিকে তাকিয়েছে। ইশারায় কাছে ডেকেছে। পলিনের খুব রাগ হওয়ার কথা। কিন্তু কেন জানি রাগ হয় না। সবাই ভয় দেখিয়ে বলেছে সৎ মা খুবই ভয়ংকর হয়। কিন্তু আতিয়ার চেহারা পলিনের কাছে কেমন কোমল লাগে। মিষ্টি করে হেসেছে ওর দিকে তাকিয়ে। ডাইনির মতো ভয়ংকর একদম মনে হয়নি। এরচেয়ে বেশি ভয় বরং রত্না চাচীকে লাগে, যখন চাচী রেগে থাকেন, মুখটা কেমন রাগে লাল হয়ে থাকে। নতুন মায়ের মুখের লালটা তেমন রাগী লাগছে না। মোনাই পলিনকে কোলে করে নিয়ে এসে আতিয়ার পাশে বসিয়ে দেয়।

 

“পলিন, আমি আতিয়া। আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?”

 

ঘাড় নেড়ে সায় দেয় পলিন।

 

“আমি আজ থেকে তোমার সাথেই থাকবো। আমাকে ঘুমাতে দিবে তোমার সাথে? আমি অনেক গল্প জানি। তুমি গল্প পছন্দ করো?”

 

আবারও ঘাড় নাড়ে পলিন।

 

“গল্প শুনতে হলে তো গল্প করতেও হবে। শুধু ঘাড় নাড়ালে তো হবে না।”

 

বলেই হাসে আতিয়া।এইটুকুতেই আতিয়াকে ভীষণ পছন্দ হয় পলিনের। যদিও এখনো জানে না আতিয়া ভালো না খারাপ! সবাই যে বলে খারাপ! পলিন আবারও মুখ শক্ত করে ফেলে।

 

হেলেন শ্বশুর বাড়ি চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে সাথে করে পলিনকেও নিয়ে গিয়েছে। যদিও মনে মনে পলিনের একটুও যেতে ইচ্ছে করছিল না। বরং নতুন মায়ের সাথে থাকতে কেমন লাগে তা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। বাবার সামনে নিশ্চয়ই নতুন মা মারতে পারতো না। কিন্তু দাদী জোর করে দিয়ে দিলেন, ফুপিও কঠিন কঠিন কথা বলে ওকে নিয়ে গেল। বললো পলিনের ছোটো ফুপু এখনো বেঁচে আছে। বাইরের কেউ এসে পলিনের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, আর ফুপুতা দেখবে, সেটা হবে না। যদিও কে খারাপ ব্যবহার করলো জানে না পলিন!

 

মোনা ভাইয়ের রুমে নতুন চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। হাসান কোথা থেকে অনেকগুলো গোলাপ আর রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে এসেছে। তাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধাগুলো ফুলদানি রেখে খাটের পাশের সাইড টেবিলের উপর রেখেছে মোনা। একটা পানির জগ আর দুটো গ্লাস। প্লেটে ঢেকে রেখেছে হালকা নাস্তা আর ফল। মিসবাহ বোনাের উপর কৃতজ্ঞ হয়ে যায়।

 

“আরে মোনা, হাসান কী করছিস তোরা! এসব লাগবে না।”

 

হাসান ব্লুটুথ  স্পিকারে কিছু রোমান্টিক গান সেট করে দিচ্ছিল।

 

“কী করলাম ভাইয়া। রুমটা সাজানো হলো না।”

 

“যা হয়েছে যথেষ্ট। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

 

মোনা এরই ফাঁকে আতিয়াকে রুমে নিয়ে এসেছে। খাটে বসিয়ে দিয়ে বলে,

 

“ভাইয়া, এই দেখ তোমার বৌকে সুন্দর মতো রুমে এনে দিয়ে গেলাম। এই বার ভাইবোনকে খুশি করে বিদায় করো।”

 

মিসবাহ হেসে পকেটে হাত ঢুকায়। ভালো পরিমাণ বখশিশ পেয়ে ভাইবোন দু’জনই খুশি। মোনা আতিয়াকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেয়।

 

“ভাবী, ভালোই হলো হেলেন পলিনকে নিয়ে গেল। আজকের রাতটা দু’জন একাই থাকো। আমি এখন বাসায় যাব। কাল আসবো ইনশাআল্লাহ। আমার বাসা কাছেই। এমনিতে বাবার বাড়ি কম আসি। তবে এখন তোমার জন্য আসবো।”

 

সবাই চলে যেতেই রুমটা বন্ধ করে দেয় মিসবাহ। কড়া আলোটা নিভিয়ে দেয়। খুব কোমল ভাবে গান বাজছে হাসানের সেট করে দেওয়া স্পিকারে “আজ জানে কী জিদ না কারো…”

 

একরাশ ফুল, সাদা চাদর,আর নরম গান, আর বারান্দা গলে আসা চাদের আলো এইটুকুতেই যেন এক স্বপ্নালোক সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে এই এক চিলতে কামরায়।

 

(চলবে)

 

গোধূলি রাঙা আলোয়

শেষ পর্ব

 

আতিয়ার ছুটি দ্রুত ফুরিয়ে গিয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে সাত দিন ছুটি নিয়েছিল। বিয়ের পরদিন সকালেই রত্না বাচ্চাদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। হামিদও রত্নার সাথে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছে, সেখান থেকেই অফিস করছে। জাহনারা বেগমও ছোটো মেয়ে হেলেনের বাসায় চলে গিয়েছিলেন। ফলে বিয়ের পরদিন থেকেই সংসারটা বলতে গেলে টোনাটুনি আতিয়া আর মিসবাহর ছিল। হাসান বাড়িতে ছিল ঠিকই, তবে সারাদিন বাসায় থাকে না। মিসবাহ যেহেতু দোকানে কম সময় দিবে কয়েকদিন, তাই দোকানের দিকটা হাসান দেখছে। মোনা এসে এসে সময়ে সময়ে দেখে যায় আতিয়াকে, সংসারের কোনটা কোথায় আছে বুঝিয়ে দিয়ে যায়। মিসবাহ বাজার এনে দেয়, আতিয়া নিজের মতো রান্নাবান্না করে। এর মাঝে একদিন বাইরে গিয়েও খেয়ে এসেছে। সংসারের শুরুটা স্বাভাবিক না। তবু মোনার কথাই ঠিক মনে হয় আতিয়ার। মোনা বলে সংসারে একটা মেয়ের জন্য সবার আগে স্বামী, স্বামী পাশে আছে মানে সব আছে। বাকি সম্পর্কগুলো তাকে মানলো কী মানলো না তা তখন আর ততটা কষ্ট দেয় না। তাছাড়া এই বাড়ির মূল কর্তা মিসবাহ। যে যতই অসন্তুষ্ট হোক, মিসবাহর স্ত্রীর সাথে সরাসরি খারাপ ব্যবহার করবে না। হয়তো খোঁচা দিবে, কটু কথা শুনিয়ে বলবে। কিন্তু তারজন্য নিজেদের সম্পর্ক খারাপ করতে না। বিয়ের পরদিন সকালে মোনা বাসায় এসে দেখে আতিয়ার মন খারাপ। মিসবাহও বাসার সবাই চলে যাওয়ায় কেমন বিমর্ষ। তখন আতিয়াকে মোনা বলে,

 

“ভাবী, আমি বয়সে তোমার ছোটো। কিন্তু সংসার করায় তোমার সিনিয়র। তাই দুটো কথা বলি। আম্মা রাগ করে গিয়েছে, রত্না ভাবী রাগ করে চলে গিয়েছে এখন তাদের কিভাবে মান ভাঙাতে হবে! কিভাবে পলিনের মা হতে পারবা তা প্রমাণ করতে হবে! এসব কোনটা নিয়েই চাপ নিও না। কিছু সম্পর্কে এত চাপ নেওয়া, এত ভাবাটাই ভুল। আমার বিয়ে হয়েছে ঊনিশ বছর বয়সে, তখন শুধু চিন্তা করতাম আর ভয় করতাম। শ্বশুরবাড়ির সবার মন রক্ষা কিভাবে হবে তাই নিয়ে অস্থির ছিলাম। কেননা আম্মাও তাই শিখাতেন। সবার মন রক্ষা করে চলতে বলতেন। শাশুড়ি থেকে শুরু করে বাড়ির কাজের লোকটার মন পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা করতাম। এত মন পড়তে গিয়ে যা হলো, সবার মন রক্ষা করতে করতে নিজের মন নাই হয়ে গিয়েছিল। এখন আমি কাউকে খুশী করার চেষ্টা করি না। দেরিতে হলেও বুঝেছি যে আমরা ভাবী প্রেম ভালোবাসা দিয়ে সব জয় করে ফেলবো ভাবলেও এটা ভুল। প্রেম ভালোবাসার সাথে শক্ত ব্যক্তিত্বও লাগে। না হলে ঐ প্রেম ভালোবাসার দাম কেউ দেয় না।”

 

“মোনা, তোমার কথাগুলো কী চমৎকার! তোমার মতো ননদকে ভালোবাসা না দিয়ে পারা যায়?”

 

“আমাকে দাও সমস্যা নাই। যে তোমাকে ভালোবাসা দিবে, তাকে তুমিও দিবা। যে দিবে না, তার ভালোবাসার জন্য উতলা হওয়ার কিছু নাই, লুটানোরও কিছু নাই। অপেক্ষা করো। আগে আমি কেউ রাগ করলে মান ভাঙাতে এমনই পেরেশান হতাম। এখন বলি চুলায় যাক। আমি তো অন্যায় কিছু করি নাই। যখন মান ভাঙার ভাঙবে। তুমিও পেরেশান হইয়ো না যে আম্মার মন কিভাবে জয় করবা। জয় যখন হওয়ার এমনিতেই হবে। এখন তুমি আর ভাইয়া যত বুঝাতে যাবা, তত আম্মা ভাব নিবে। এখন সুন্দর মতো ভাইয়াকে দিয়ে আম্মাকে ফোন দেওয়াও। ভাইয়া আম্মাকে বলুক আসতে। যত রাগই হোক, মায়েরা ছেলে বলতে অজ্ঞান। কিন্তু তুমি ফোন দিয়ে কথা বলতে যেও না। দশটা কথা শোনাবে। তোমারও মন খাট্টা হবে। ভাইয়াকে দিয়েই আম্মা আর হেলেনকে ফোন দেওয়াবা। কয়েকদিন ভাব নিবে এরপর চলে আসবে। আম্মা বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকতে পারে না। হেলেনও যত ভাব নিয়ে আম্মা আর পলিনকে নিয়ে গিয়েছে, ততটাই অস্থির হয়ে দিয়েও যাবে। ও জীবনেও এত কিছু কাঁধে নিবে না। আর রত্না ভাবীর জন্য কিছু করার দরকার নাই। তার ভাই অপরাধ করছে, শাস্তি পাচ্ছে। সে কিসের জোরে রাগ দেখায়! আম্মা আর হেলেন নরম হোক, রত্নাও নরম হবে। এই ঘরবাড়ির অধিকার ছেড়ে দিবে এত বোকা রত্না না। ঠিকই চলে আসবে।”

 

“ধন্যবাদ মোনা। তুমি এসে মনটা ঠান্ডা করে দিলা।”

 

“হইছে হইছে। এখন আমার ভাইটার মন ঠান্ডা করো।এত যুদ্ধ করে প্রেম করে বিয়ে করলো। অথচ কেমন দেবদাসের মতো মুখ করে বসে আছে। তুমি তো ভাবী ভাগ্যবান। বিয়ের পরদিনই কী সুন্দর ফাঁকা বাসা পেয়ে গিয়েছ। কোথায় রোমান্স করবা জামাইয়ের সাথে, তা না! যাও আজ রান্নাবান্না কিছু করা লাগবে না। আমি হাসানকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। দোকানও হাসান দেখবেনে।”

 

***

মিসবাহ প্রতিদিন নিয়ম করে মা, ভাই বোন সবাইকে ফোন দিয়েছে। হালচাল জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু কাউকেই বাড়ি ফিরে আসার জন্য অতিরিক্ত পীড়াপীড়ি করেনি। শুধু বলেছে নিজের  বাড়ি কার উপর রাগ করে ছেড়ে গিয়েছে! তাতে কার কী ক্ষতি হবে! তাই রাগ না করে চলে আসতে।

 

এছাড়া ফাঁকা বাসার আনন্দ পুরোটাই নিয়েছে মিসবাহ আর আতিয়া। আতিয়ার যত্ন আর ভালোবাসায় বুঁদ হয়েছিল মিসবাহ। নিজের প্রথম বিয়েতে পায়রার সাথে বিয়ের পরপরই এতটা কাছাকাছি আসা হয়নি কখনো। সারাদিন সেভাবে কাছে আসার সুযোগই পেত না। কিন্তু এখন যেন এই মধ্যবয়সে এসে প্রেম, বিয়ের এক অন্যরকম পরিপূর্ণতায় ধরা দিয়েছে। আতিয়াকে যখন তখন কাছে টানেতে বাঁধছে না, আতিয়াও মিসবাহর সঙ্গ উপভোগ করছে। যতই মানুষ না না করুক, শরীরের একটা আলাদা ভাষা থাকে। শরীর দিয়ে শরীরের যে ভাব বিনিনয় হয়, তার সাথে মন মিলে গেলে সুখটুকু পরিপূর্ণ হয়। তা সে যে বয়সী মানুষই হোক না কেন। বৃষ্টির ফোঁটা তপ্ত ধরার বুকে পড়লে তা যেমন শুষে নেয় প্রাণভরে, তেমনই ভাবেই মিসবাহর ভালোবাসার আলিঙ্গনে, আহ্বানে সাড়া দিয়েছে আতিয়া।

 

দেখতে দেখতে সাতদিন শেষ। দুপুরের ভাতঘুমের পর হঠাৎ জেগে ওঠা শরীরের পরিপূর্ণ মিলন শেষে পরিতৃপ্তি নিয়ে চোখ বুজে আছে মিসবাহ। তার চওড়া বুকে মাথা রেখে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করে আতিয়া।

 

“মিসবাহ, আলোর আর কোন খোঁজ কি পাব না? কতদিন হয়ে গেল। আর কিছু জানায় না পুলিশ। একবার কি একটু থানায় খোঁজ নিবে?”

 

“আজই নেব। আলো বেঁচে আছে আতিয়া। না হলে এতদিনে লাশ পেতো পুলিশ। এখন শুধু ও কোথায় আছে খুঁজে পেলে ওকে নিয়ে আসা যাবে। তোমার আম্মার জন্য অন্য কোথাও বাসা নিতে হবে। যেখানে কেউ আলোর ব্যাপারে কিছু জানবে না। ও এসএসসি দিবে আগামীবার। নতুন করে জীবন শুরু করবে। কত মেয়েরা স্বেচ্ছায় দুটো টাকার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে। সেখানে আলো তো পরিস্থিতির শিকার। ও কেন পারবে না!”

 

“আলোকে সত্যি ফিরে পাব! তাই যেন হয়। আচ্ছা কাল থেকে আমার ডিউটি। ছুটি কি বাড়াবো? আম্মা, রত্না কেউ তো আসলেন না।”

 

“আমি জানিয়েছি তোমার ছুটি শেষ। দেখি আম্মা আসবেন হয়তো। নরম মনে হলো আজ কথা বলে। আর না আসলেও তোমার ছুটি নেওয়ার দরকার নাই। আমিও দোকানে নিয়মিত বসতে হবে। তোমাকে হাসপাতালে নামিয়ে দেব আমি। ডিউটি শেষে ফোন দিও, বাসায় নিয়ে আসবো।”

 

“আরে ও সমস্যা নেই। আমি একাই আসা যাওয়া করতে পারি।”

 

“তা পারো। কিন্তু আমি আমার বৌকে একটু মোটরসাইকেলের পেছনে বসাতে পারি না বুঝি?”

 

“অবশ্যই পারো।” 

 

****

 

বিকেলে কোন রকম খোঁজ খবর না দিয়ে জাহনারা বেগম নিজ থেকেই চলে এসেছেন। হেলেনের বাসায় আর থাকতে ভালো লাগছিল না ওনার। পলিনকেও নিয়ে এসেছেন। পলিনের পড়ালেখা নষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া পলিন কান্নাকাটিও করছিল। সকালে খেলতে গিয়ে ফুপাতো বোনের পুতুল ভেঙে ফেলার অপরাধে ফুপা ধমক দিয়েছেন সবার সামনে, ফুপি হেলেনও দুটো কথা শুনিয়ে দেন, বলেন যে এই  স্বভাবের জন্য বাবার বাড়িতে জায়গা হয়নি পলিনের। কথাগুলো জাহনারা বেগমেরই ভালো লাগেনি। কিন্তু জামাইয়ের সামনে কিছু বলতেও পারেননি। এই ছোটো জামাই ওনার আদরের। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে জাহনারা বেগমের হঠাৎ আগমনে তিনি শুরুতে খুশি হলেও তিনদিন পর থেকে কেমন বিরক্ত। সুযোগ পেলেই মিসবাহকে নিয়ে সস্তা রসিকতা করছে। অথচ মিসবাহ বিয়ে করেছে, পরকীয়া না! মেয়ের সংসারে অশান্তি হবে বলে কিছু বলতে না পারলেও ছেলের নামে এসব কথা শুনতে ওনার ভালো লাগছিল না। হেলেনটাও কেমন স্বামীর ভালোমন্দ সব কথায় তাল মেলাচ্ছে। ধনী স্বামী পেয়ে চোখে পট্টি পড়েছে। বিরক্ত হোন জাহনারা বেগম। শেষমেশ পলিনকে বকাবকি করায় জাহনারা বেগমের খুবই কষ্ট লাগে। নাতনিটাকে কেউ এমন তাচ্ছিল্য করুক তা তিনি চান না। সৎ মাকে তবু শাসন করা যাবে ভাবেন, কিন্তু ফুপু চাচা চাচী অবহেলা করলে কিভাবে শাসন করবেন। এসব ভেবেই চলে আসেন। হেলেনও মাকে জোর গলায় মানা করে না। জাহানারা বেগম এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। আতিয়া মিসবাহর হাতে শরবত বানিয়ে পাঠায়। কিছুক্ষণ পর রত্নাকে নিয়ে হামিদও বাড়িতে আসে। একটু পর আতিয়া আর রত্নাকে ডেকে নেন জাহনারা বেগম,

 

“শুনো আতিয়া তোমার সাথে আমার কোন শত্রুতা নাই। এই বাড়ির বৌ যখন হইছো তখন মেজো বৌ রত্নার সাথে মিলামিশা থাকবা। তারেও আমি বিষয়টা বুঝায়ে দিব। অন্ততঃ যে কয়দিন আমি বাইচ্চা আছি কেন অশান্তি চাই না। হাসানেরও বিয়া দিমু। মরার আগে পুরা পরিবার একসাথে দেইখ্খা মরতে চাই। আমার মরার পর সম্পত্তি ভাগ কইরা যে যে আলাদা থাইক্কো। কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক নষ্ট কইরো না অনুরোধ থাকলো।  তোমার বইনের কী হইছে না হইছে, রত্নার ভাই কী করছে এসব বিচার কোর্ট কাচারি করবো। ঘরের ভিতর এই নিয়ে অশান্তি চাই না। রত্না, কামকাজ ভাগ কইরা নিবা। হাসানের বৌ আসা পর্যন্ত রান্নার কাজ দুই বৌকে ভাগ কইরা দিমু। আতিয়া তুমি চাকরি করবা কী করবা না তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু রত্নার সাথে সংসারে কাজ ভাগ করতে হইবো। এই নিয়ে কোন ক্যাচাল ঝগড়া চলবো না।”

 

আতিয়া মাথা নাড়ে। অনেককিছুই তার জন্য সহজ হবে না জানে। কিন্তু জীবনে সে কোন কিছুই সহজে পায়নি। আগে তো একাই লড়াই করেছে। এখন তো ওর সাথে মিসবাহ আছে। ইশারায় মিসবাহকে কিছু বলতে না করে।

 

“জ্বি আম্মা, বুঝেছি। আপনি যেভাবে কাজ ভাগ করে দিবেন করবো। আমার ডিউটির আগে পরে সময় মিলিয়ে নেব।”

 

“আমারে দজ্জাল শাশুড়ি ভাইবো না যে তোমারে খাটাইয়া মারুম। আল্লাহর রহমতে কামের লোক আছে। কিন্তু ঘরের রান্ধেন ঘরের বৌয়ের হাত না থাকলে বরকত হয় না। কামের বেটি কাজ আগাইয়া দিব, তুমি রাইন্ধা বাইড়া নিবা। যেদিন দুপুরের যোগাড় দিবা, সেদিন রাইতের খানা রত্না দেখবো। নাস্তার যোগাড় দুইজন মিলামিশা করবা। তোমার পথথম কাজ হইলো পলিনের যত্ন করা। মাইয়াটারে কষ্ট দিবা না। তোমার শত্রু ভাববা না। মনে রাইখো আমার চোখ কান খোলা।”

 

“পলিনকে আমি আদর দিয়ে বড়ো করবো। কিন্তু আমাকে শাসন করার অধিকারও দিতে হবে। না হলে শুধু আদর দিয়ে ওকে আমি মানুষ করতে পারবো না।আমার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমি ওর খারাপ চাইবো না।”

 

পরিশিষ্ট –

 

আতিয়া হাসাপাতালের চাকরিটা আরও দুই বছর করেছিল। এরপর বেশি বয়সে গর্ভধারণ জটিলতার জন্য বেড রেস্টে থাকা প্রয়োজন হওয়ায় স্বেচ্ছায় জব ছেড়ে দিয়েছে। । যদিও মিসবাহ চেয়েছিল আতিয়া চাকরিটা নিয়মিত রাখুক। গর্ভকালীন সময়টা ছুটি নিয়ে নিক, এরপরও প্রয়োজন হলে ননপেইড লিভ নিয়ে আরও ছয়মাস চলতে পারতো। কিন্তু আতিয়া নিজেই ছেড়ে দিতে চাইলো। কখনো কখনো হয়তো প্রায়োরিটি বদলায়। আতিয়া সবসময় সবটুকু সময় দিয়ে গুছিয়ে সংসার করতে চেয়েছে, চাকরি করা ওর স্বপ্নের অংশ ছিলই না কখনো। তাই হয়তো ছাড়তেও মায়া লাগেনি। বরং এখন ওর চাকরি করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আশিকের ভালো একটা চাকরি হয়েছে। সংসার খরচের জন্য আতিয়ার উপর আর নির্ভরশীল নয়। আতিয়া তার জুনিয়র সিস্টার সোনিয়ার সাথে আশিকের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। মা, আশিক আর সোনিয়ার সাথে ভালো আছে। আয়েশা আছে ওর মতোই। কখনো খুব ভালো, কখনো আবার অভিমান। আলোর খোঁজ পাওয়া গেলেও ওকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত রিসোর্টের ম্যানেজার ধরা পড়ে। আলোকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। এরপরের খবর আর জানে না ম্যানেজার। রাতুল ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। সরাসরি পাচারে রাতুলের হাত পাওয়া যায়নি বলে সাজা কম হয়েছে। রত্নার সাথে আতিয়ার সম্পর্ক শীতলই। জাহানারা বেগমের মৃত্যুর পর হয়তো আলাদা হওয়াই নিয়তি। আর পলিন! পলিন কখনো আতিয়াকে বন্ধু হিসেবে দেখে, কখনো মা। তবু তাদের সম্পর্কেও উত্থান পতন আসে। বিশেষ করে যখন বাইরের কেউ পলিনের মাথায় আপন পর বিষয়টা ঢোকায়। তবে এর মাঝেও তাদের মাঝে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মিসবাহও চেষ্টা করছে দু’জনের মাঝে যেন দেয়াল না তৈরি হয়। তবে সামনে এখন আরেক পরীক্ষা। মিসবাহ আর আতিয়ার নতুন সন্তানকে কিভাবে গ্রহণ করে পলিন তাই নিয়ে ভাবছে তারা। দু’জনই চেষ্টা করছে পলিনের ভেতর যেন কোন ইনসিকিউরিটি জন্ম না নেয়। তবে এই তো জীবন, সবকিছু সহজ হয়েও সহজ নয়।

 

(শেষ)

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।