অলকানন্দা

১.
“আমার স্বামী ছোট বাচ্চাদের মাংস খায়। ও বুবু শোনেন বুবু আমার স্বামী ছোট বাচ্চাদের মাংস খায় যে। হি হি হি।”

বলেই খপ করে মাহার হাতটা ধরলো সাদা এলোমেলো শাড়ি পরনে এক মহিলা। চুলগুলো জমাট বাঁধা, মুখের একপাশ দিয়ে লালা বেরুচ্ছে। ঈষৎ কালচে বদনের রঙ। ছিপছিপে পাতলা গড়নে শরীর। আহা! কি বিভৎস!
“আল্লাহ!” বলে চিৎকার করে উঠলো মাহা। তার হাতটা খামচে ধরেছে পাগলী। মাহার আকস্মিক চিৎকারে চা কিনা ফেলেই সেদিক পানে দৌড়ে এলো চৈতি। লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। চৈতিকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো মাহা।

“চৈতি, চৈতি আমাকে বাঁচা। দেখনা আমার হাতটা খামচে ধরেছে। আর কিসব বলছে।”

পাগলীটা হু হা করে হেসে উঠলো। তবে মাহার হাতটা ছাড়লোনা। বিকট হাসি থামিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।
“ও বুবু, আপনার বিপদ আছে যে। আমার স্বামী মেয়েদের মাংসও খায় যে।”

চৈতি এগোনোর চেষ্টা করলো তাদের দিকে। পাগলী চৈতির দিকে ফিরে ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
“এই একদম কাছে আসবিনা।”

ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো মাহা। খামচির কারণে ফর্সা হাত রক্তে ভরে যাচ্ছে। মাহা কান্নামাখা সিক্ত গলায় চৈতির দিকে ফিরে বললো,
“দোস্ত বাঁচা আমাকে। অনেক ব্যথা পাচ্ছি হাতে।”

চৈতি কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। আশেপাশে লোকজন কম। চায়ের দোকানের মালিক দেখেও এগিয়ে আসছেন না। ব্যাপারটা বোধহয় উনার কাছে অনেকটা স্বাভাবিক। আশেপাশে নিজেদের গাইডকে খুঁজলো চৈতি। গাইডও পাশে নেই। হঠাৎ করেই আ আ চিৎকার।

চা বাগানের চৌকিদার একটা মোটা লাঠি নিয়ে তেড়ে এসে পাগলীকে আঘাত করেছে। পাগলী নিচে ছিটকে পড়লো। চৌকিদার খাজার শক্তপোক্ত শরীর। ইয়া বড় গোফ। পরনে লুঙ্গি, শার্ট আর উপরে কালো চাদর। মাহা ছাড়া পেতেই চৈতিকে জড়িয়ে ধরলো। আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে দূরে। শীতকাল হওয়ায় ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারদিকে। পাগলী উঠে তেড়ে আসতে চাইলো চৌকিদারের পানে। চৌকিদার আবার আঘাত করলো পাগলীর শরীরে। পাগলী চা বাগানের মাটিতে গড়িয়ে চিৎকার করছে। মাহা আর চৈতি ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। পাগলীর দিকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চৌকিদার এগিয়ে এলেন তাদের দিকে। শুদ্ধ বাংলায় বললেন,
“আপনাদের গাইড কোথায়?”

মাহা তখনো ভয়ে কাঁপছে। চৈতি মাহাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমরা ঠিক জানিনা। উনি অনেকক্ষণ হলো একটা কাজ আছে বলে গিয়েছেন।”
“আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে। একে তো পর্যটক তার উপরে মেয়ে মানুষ মালনীছড়া কতটা ভয়ংকর জানেন।”

চৌকিদারের ধমকে দুজনেই কেঁপে উঠলো। চাদরে ঢাকা মুখ চৌকিদারের। বয়স আটত্রিশ না আটান্ন ঠাউর করা দায়। কালো কুচকুচে বদন। হাতটা পেশিবহুল। হাতে মোটা লাঠি। চৈতির মনে হলো গ্রিক মাইকোলজির কোনো অজানা শোষক রাজা যেন এই চৌকিদার।
“আপনারা কোন হোটেলে…

চৌকিদার বলতে বলতেই পাগলী তেড়ে এলো চৌকিদারের পানে। মুখভর্তি লালা মিশ্রিত থু থু নিক্ষেপ করলো চৌকিদারের মুখে। চৌকিদারের চোখ দুটো হিংস্র হয়ে উঠলো।

” শু*রের বাচ্চা। খা*কির বেটিরে..

বলে পুরুষালী শরীরের জোরে মোটা লাঠি দ্বারা আরেকটা আঘাত করলো পাগলীর শরীরে। চোখের সামনে এসব নজির দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে চৈতি। মাহারও কান্না থেমে গিয়েছে।

২.

পাগলী আবার মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। একবার উঁচু কাঁপা গলায় বললো,
“তোর মুখে আমি মুতি রে খাজা।”

একটা অশ্লীল, উচ্চারণে অযোগ্য গালি দিলো চৌকিদার। মুখের নিক্ষিপ্ত থুতুটা কালো চাদরের প্রান্ত দিয়ে মুছে আবার মাহাদের পানে তাকালো চৌকিদার। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা কাক কা কা করে দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। চৌকিদার বললো,
“চলুন আপনাদের রিকশা করে দেই। কোন হোটেলে উঠেছেন?”

চৈতির কেনো জানি আসল তথ্য দিতে ইচ্ছে করলোনা। সে কাঁপা গলায় বললো,
“হোটেল ফরচুন। আর আমাদের গাইড?”
“আরে রাখেন আপনার গাইড। ঐ বেটা ভাগছে। এমন অনেক ঘটনা আছে। টাকা নিয়ে গাইড ভাগে। কালো, লম্বা মতন ছিলোনা ছেলেটা?”
“হুম।”
“মানিক্কায় হবে। সে এমনই। আপনারা চলেন। এখানে আর থাকাটা সুবিধাজনক না।”

শীতকালের বিকেল। ঠিক বিকেল না আর কিছুক্ষণ পর আকাশ চিড়ে অন্ধকার নামবে। হৃদপিণ্ডে হিম লাগানো অন্ধকার। চা বাগানের চারিপাশটা কেমন জানি নির্জন, নিরব। শীতকালে পর্যটক এমনিতেও কম থাকে। তবে এতোটা কম হবে চৈতি, মাহা কখনো ভাবেনি। তারা যখন চৌকিদারের পিছনে আসছিলো তখন পাগলী চিৎকার করে বলছে,
“লম্বা বুবু তোর বিপদ। অনেক বিপদ।”

লম্বা গড়ন মাহার। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। চৈতি মাহা থেকে দুই, তিন ইঞ্চি খাটো। মাহা কুঁকড়ে আছে ভয়ে। হাত থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে ধরে আছে সে।
“পাগলীর কথায় কিছু মনে করবেন না। মাথা খারাপ মানুষ। উল্টাপাল্টা বকে। স্বামী ছিলো দাগী আসামী। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এরপর থেকেই এমন পাগলামি করে।”
বলে হাসার চেষ্টা করলেন চৌকিদার। যা অনেকটা বিভৎস দেখালো।

রিকশায় উঠে বসলো চৈতি আর মাহা। রিকশা চলছে মাজার রোডের দিকে। মাহা চুপ করে চৈতির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠছে সে। চৈতি একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। সকালেও কতটা খুশি ছিলো তারা! চোখ বুজে সকালের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলো চৈতি।

৩.
সিলেটে পৌঁছে হোটেল মুসাফিরে উঠেছে আতিয়া জামান চৈতি আর মাহা হোসেন। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে দুজনে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদে সেরা বান্ধবী যুগল বলে বেশ খ্যাতি তাদের। সিলেটে আসার পিছনে যদিও একটা কারণ আছে তবে সেটা স্বীকার করতে চায়না মাহা। চৈতি জানে মাহা তার প্রিয় অচেনা মানুষটার সাথে দেখা করতেই সিলেট এসেছে। সেই বহু আকাঙ্খিত মানুষ। গত ছয়টা মাস ধরে যার কথা মাহার মুখে শুনতে শুনতে পাগল হওয়ার উপক্রম ছিলো চৈতির।

“আমরা কোথায় যাচ্ছি আজ?”

চৈতির প্রশ্নে মাহা মিষ্টি হেসে বলে,
“লাক্কাতুরা চা বাগান তারপরে মালনীছড়া।”
“খুব খুশি মনে হচ্ছে আপনাকে? হুম? ব্যাপার কি?”
“ব্যাপার কিছুই না।”

চৈতির অদ্ভুত তাকানোতে মাহা আবার লাজুক হেসে বললো,
“ও বলেছে পরশুদিন দেখা করবে আমার সাথে।”
“বাহ্বা, তাই আমাদের লাজুকলতা এতো লজ্জা পাচ্ছে বুঝি?”
“চৈতি, ভালো হবেনা কিন্তু। কেন লজ্জা দিচ্ছিস।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো চৈতি। মাহাটা না বড্ড লাজুক।

বেলা বারোটায় সকল ক্লান্তি ঘুচিয়ে দুজনে মিলে রওনা দিলো লাক্কাতুরার পথে। তাদের সিলেটি বান্ধবী রুমানা খুব করে বলেছিলো তার বাসায় উঠতে তবে তারা হোটেলেই উঠেছে। রুমানার মা অসুস্থ হওয়ায়ও সেও ওদের সাথে সিলেট এসেছিলো। আজ ঘুরতে আসতে পারেনি বলে বার কয়েক মাফও চেয়েছে। হালকা কুয়াশা চারদিকে। এখনো সাদা, ধূঁয়াটে কুয়াশা কাটেনি। রিকশা করে লাক্কাতুরা যাওয়ার পথে দুইপাশে ঘন সবুজ চায়ের বাগান। টিলা গুলোর উপরে স্তরে স্তরে সাজানো চায়ের বাগানে কাজ করছে কত মানুষ।

লাক্কাতুরা পৌঁছে গেট দিয়ে ঢুকার সময় কয়েকটা কিশোর বয়সী ছেলে চাঁদাবাজি করে। তাদের কিছু টাকা দিয়ে পরে ঢুকতে হয়।

“দেখলি চৈতি কেমন বেয়াদব ছেলেগুলো। ওদের কাছে কোনো কার্ড আছে! আমরা কেন টাকা দিবো ওদের?”
“তবুও তোর ঝগড়া করাটা ঠিক হয়নি।”
“তুই সারাজীবন ভীতুই থাকবিরে চৈতি।”
“হ্যাঁ, আর আপনি সাহসী মহারাণী।”
“তা অবশ্য বলতে পারিস। আমি মাইন্ড করবোনা।”

মাহার কথার ধরনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে চৈতি। আজ দুজনে গোলাপি রঙের উপর নীল ডোরাকাটা থ্রি-পিছ পড়েছে। উপরে নিয়েছে কাশ্মীরী চাদর। মাহাকে বেশি সুন্দর লাগছে বলাই বাহুল্য। সাদা ফর্সা বদনের রঙ। লম্বাও অনেক। সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। চৈতি অনেকটা হলুদ ফর্সা। মাহার মতন আগুন সুন্দরী না হলেও বেশ মায়াবী।

“আপা, গাইড লাগবো?”

লাক্কাতুরা ঘুরার সময় পিছন থেকে বলে উঠে একজনে।
“এই মাহা শুন?”
“কি?”
“মালনীছড়ায় শুনেছি অনেক প্যাঁচানো পথ। গাইড নিয়ে নেই?”

ছেলেটার আড়ালে কথোপকথন চালিয়ে আড়াইশত টাকায় গাইড ঠিক করে নিলো তারা। মালনীছড়া এক অসাধারণ জায়গা। মাঝে মেঠোপথ। দুইপাশে কাঠবাগান। রাবার বাগান। অদ্ভুত রাবার সংগ্রহ করার কৌশল । যেদিকে তাকায় কেবল চা বাগান আর চা বাগান। মাহা আর চৈতি অবাক নয়নে উপভোগ করলো সেই অপরূপ দৃশ্য। সবুজের সায়রে ভেসে বেড়ালো দুজনে। ছবি তুললো।

“এই চৈতি ঐ যে কেমন দু টুকরো কাপড় পরে চা পাতা তুলছে মহিলারা। এদের লজ্জা করেনা?”
“এসব বলতে নেই। এরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এই কাপড়কে বলা হয় ফতা। এসব পোশাকই ওদের সংস্কৃতি।”
“তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।”

মাহা, চৈতি যখন প্রকৃতি উপভোগে ব্যস্ত তখন সুযোগ বুঝে গাইড ছেলেটা বললো,
“আপা, আমি একটু আসতেছি।”
“মানে কই যাবেন আপনি। আমরা আরো ঘুরবো তো।”

মাহার উচ্চকণ্ঠ। ছেলেটা কাচুমাচু হয়ে বলে,
“ইয়ে মানে একটু..

ইঙ্গিত ধরতে পেরে চৈতি বলে,
” মাহা যেতে দে।”

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও ছেলেটার খোঁজ নেই। মাহা তো পুরো রাগে গজগজ করছে। চৈতি তখন চা আনতে গেলো পাশের দোকান থেকে। তারপর……

হঠাৎ থেমে যায় চৈতিদের রিকশা। মাহা ঘুমিয়ে পড়েছে চৈতির কাঁধে। চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। রোডের ধারে হালকা সোডিয়াম বাতির আলোয় মাহার মুখটা দেখে বুকটা কু ডেকে উঠলো চৈতির। কি হতে যাচ্ছে সামনে!

(চলবে কি?)

#অলকানন্দা
#পর্ব-১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

#অলকানন্দা
#পর্ব-২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪.
“মানুষের মাংস খাবেন বুবু? খুব মজা! দেখেন বুবু দেখেন লাল লাল তরতাজা মাংস। এত স্বাদ! একটু খান না বুবু। কচি মানুষের মাংস। একটু মুখে দেন না বুবু।”

সাদা এলোমেলো শাড়ি পরনে পাগলীটা দু হাতে কয়েকটা মাংসের টুকরো নিয়ে এগিয়ে আসছে মাহার দিকে। তার মুখের একপাশ দিয়ে মানুষের তরতাজা রক্ত মিশ্রিত লালা পড়ছে। চোখ দুটো ভয়ানক লাল। হঠাৎ একহাত থেকে মাংসের টুকরো গুলো ফেলে খপ করে হাত ধরে ফেললো মাহার। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পা থেমে গিয়েছে তার। গলায় আওয়াজ নেই। পাগলী হু হা করে হেসে এক টুকরো মাংস জোর করে মাহার মুখে ঢুকিয়ে দিলো
“আল্লাহ!” বলে চিৎকার করে উঠলো মাহা। হন্তদন্ত হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো চৈতি। মাহা ভয়ে কাঁপছে। ফর্সা মুখ ঘামে একাকার।
“এই কি হয়েছে তোর?”
“পা পা পা…নি।”

মাহার কণ্ঠ কাঁপছে। পাশের টি-টেবিলের উপর থেকে পানির জগ তুলে কাঁচের গ্লাসে পানি ঢাললো চৈতি। ভোরবেলা। বাইরে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাকি সব নিরব। কাঁচের গ্লাসে পানি পড়ার আওয়াজটাও কত ভয়ানক শুনালো যেন। অদ্ভুত সম্মোহনী আওয়াজ। যা বর্ণনা করা যায় না। কেবল অনুভব করা যায়। যে আওয়াজে শরীর ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠে। কেমন যেন সম্মোহীত হয়ে দুজনেই গ্লাসে পানি পড়ার আওয়াজ শুনছিলো এমন সময় ক্রিং ক্রিং ক্রিং।

হাতটা কেঁপে উঠলো চৈতির। কাঁচের গ্লাসটা ছিটকে পড়লো নিচে। আঁতকে উঠলো দুজনেই। চৈতি হন্তদন্ত হয়ে নিচে বসে গেলো। মাহা তখনো খাটে হেলান দিয়ে বসে। হাঁড় কাঁপানো শীতের মাঝেও তার কপালের দুইপাশ বেয়ে সূক্ষ্ম ঘামের রেখা বেয়ে যাচ্ছে।
“ইস! গ্লাসটা ভেঙে গেলো। এটার আবার জরিমানা দিতে হবে।”
চৈতির কন্ঠে হতাশা। অতঃপর ভাঙা গ্লাসের টুকরোগুলো উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। কলিং বেল বেজে চলেছে। মাহা ভয় ঝেড়ে বললো,
“কে… কে এসেছে? চৈতি?”
“তুই বস। আমি দেখছি। তুই জগ থেকে পানি খেয়ে নে। রুমানার আসার কথা ছিলো।”
“আচ্ছা।”

কাঁচের গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো চৈতি। ওদের রুমটা ছোট। দুই বেডের। পাশাপাশি দুই বেড। মাঝে ছোট টি-টেবিল। তারউপরে একটা ল্যাম্পসেড। নীল রঙা দেয়াল। দেয়ালে কতক ছবি টানানো। একটা অর্ধবৃত্ত আঁকা। মাহা তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ছবিটা জানি কেমন। চতুস্তল কালো রঙের মাঝে সাদা অর্ধবৃত্ত।
“টুকি।”

রুমানার ডাকে বাস্তবে ফিরে মাহা। কাঁধ সমান চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত। চুলগুলো ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করে সে বলে,
“আন্টি কেমন আছেন?”
“ভালো।”

বলতে বলতে মাহার বেডে বসে রুমানা। চামড়ার খয়রী ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখে পাশে। চৈতি বসেছে তার বেডে। মাহা সামনে আসা চুলগুলো সরাতে নিজের বামহাতটা কম্বলের নিচ থেকে বের করে চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো আবার। প্রথমে খেয়াল না করলেও এবার বিষয়টা চোখ এড়ালোনা রুমানার।
“টুকি, তোর হাতে এসব কিসের লালদাগ?”

আবারো কেঁপে উঠছে মাহার হৃদপিণ্ড। কাঁপা শরীরটা বিছানায় হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো সে। মাহার এমন রিয়েকশন দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে রুমানা। কালো রঙা মুখে ঈষৎ সন্দেহের আভাস।
“টুকির কি হয়েছে রে কোকিল?”

রুমানার প্রশ্ন চৈতির কাছে। হলদে গাঁয়ের রঙে অভূতপূর্ব মায়াবতী চৈতি। তেমনই অভূতপূর্ব, হৃদপিণ্ড থমকে দেওয়া কন্ঠ তার। তার উচ্চারিত শব্দগুলো কানে কেমন যেন গানের মত শোনায়। তাই তাকে কোকিল বলে সম্বোধন করে রুমানা। এমন অদ্ভুত নাম প্রথমে অপছন্দ ছিলো তার। তবে সময়ের পরিক্রমায় মানিয়ে নিয়েছে।

৫.
“মালনীছড়ায় এক পাগলী ধরেছিলো। হাতে খামচি দিয়ে একাকার করে ফেলেছে হাতটা।”
“আল্লাহ বলিস কি?”

আঁতকে উঠলো রুমানা। মাহার অবাক দৃষ্টি তার দিকে।
“রুৎবা পাগলী যাকে ধরে সে কিছুদিনের মধ্যে হয়তো মারা যায় নয়তো গায়েব হয়ে যায়।”
“আবোল তাবোল বলিস না। বর্তমান যুগে এসবও হয়!”

চৈতির কন্ঠে অবিশ্বাস। এমন অদ্ভুত কথা যেন সে ইহজন্মেও শুনেনি। মাহা হেলান দিয়ে ছিলো খাটে। তন্মধ্যে কেঁপে উঠলো সে।
“বিশ্বাস করছিস না তো। শাহিনূর খালাও এরকম করতো জানিস।”
“কাহিনী কি খুলে বলতো?”
চৈতির প্রশ্নে তার দিকে ফিরে রুমানা। লালচে বাদামী চাদরটার একপ্রান্ত হাতের মুঠে পুরে বলে,
“পাগলীর স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সেই ২০১২ র দিকে। তখনকার সময় সিলেটি সিরিয়াল কিলারের ১০১ খুনের খবর তোদের মনে আছে?”
“হুম, শুনেছিলাম বোধহয়। মাতব্বর না কি যেন নাম ছিলো?”
“মাতব্বর শরীফ। পুলিশের মতে মাতব্বর শরীফ সেই সিরিয়াল কিলার। এখনো জেল হাজতে আছে। উপযুক্ত প্রমাণ মেলেনি তাই ফাঁসিও কার্যকর হচ্ছেনা। তবে আমার কি মনে হয় জানিস?”
“কি মনে হয়?”
“শরীফ চাচাকে ফাঁসিয়ে ব্যাপারটা সাময়িক ধামাচাপা দিয়েছে পুলিশ। যদিও তারপর থেকে ছিন্ন পা আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। জানিস শরীফ চাচা লোকটা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।”
“পাগলী কি উনার স্ত্রী?”
“হুম। কত সুন্দর সংসার ছিল দুজনের। রুৎবা চাচিও ভালো মানুষ। আমাদের মাজার রোডের সবাই একনামে চিনতো তাদের। গলির মোড়ে চা পান বিক্রি করতো দুজন মিলে।”
“স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই এমন হয়ে গিয়েছেন মহিলা?”
“না। একটা ছেলে ছিলো ফয়সাল নামে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো সিলেট ইমপেরিয়াল কলেজে। ছেলেটা জাফলংয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে চোরাবালি তে ডুবে প্রাণ হারালো। তখন থেকেই আধপাগলা মতন হয়ে গেছিলেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কিসব আবোল তাবোল বকতেন। চাচা কতবার শিকল পড়ায় রাখছেন! চাচাকেও পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেন। তারপর থেকে মালনীছড়ায় থাকেন রুৎবা পাগলী।”
“শাহিনূর খালার ব্যাপারটা কি?”
“শুধু যে শাহিনূর খালা তা না রুৎবা পাগলী এখন পর্যন্ত যার হাতই ধরেছেন সেই গায়েব হয়ে গেছে। মালনীছড়ায় স্থানীয় কেউ ভয়ে তার কাছে যায়না। তার ছোঁয়া অশুভ। শাহিনূর খালাকে ছোঁয়ার কিছুদিনের মাথায় আগুন পাহাড় থেকে পোড়া দেহ পাওয়া গেছিলো তার। পরে আবার….

মাহা বারেবারে কেঁপে উঠছে। চৈতি চোখের ইশারায় রুমানাকে থামতে বললো। এমনিতেই মাহার অবস্থা খারাপ। রুমানা থতমত খেয়ে চুপ করে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় বললো,
” ধুর। আমি মজা করছি আর তোরা বিশ্বাস করে নিলি? কেমন ভয় দেখালাম বল?”

হু হা করে হাসার চেষ্টা চালালো রুমানা। চৈতিও ঈষৎ হাসিতে যোগ দিয়ে বললো,
“তুইও না রুমানা। এভাবে কেউ ভয় দেখায়?”
“তোরা তো বাড়িতে আসলি না। চাচি তোদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠিয়েছে।”

বলে খাবারের বক্সগুলো খয়রী রঙা চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করলো রুমানা।
“টুকি, তোর না গরুর মাংস খুব পছন্দ? দেখ চাচি লাল লাল করে বেশি ঝাল দিয়ে ভুনা করে দিয়েছে? খেয়ে দেখ।”

৬.

বলেই খাবারের বক্সটা মাহার সামনে ধরলো রুমানা। মাহা একবার মাংসের বক্সটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকানোর সাহস পেলোনা। যা খেয়েছিলো রাতে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। মুখ চেপে ধরে বিছানা থেকে উঠে দৌঁড়ে বাথরুমে চলে গেলো মাহা। ঘটনাটা এতটা দ্রুত ঘটলো যে উপস্থিত কারোই মাথায় আসেনি হচ্ছে কি। যখন ধ্যান ভাঙলো দুজনের তারাও পিছনে ছুটে বাথরুমের দিকে এগুলো। মাহা বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে বাথরুম। আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কেমন ঘিনঘিনে ব্যাপার। রুমানা, চৈতি কেউই ভিতরে প্রবেশ করলোনা। পানির কলটা ছেড়ে দিয়েছে মাহা। আস্তে আস্তে বাথরুমটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

মাহা যখন বেরুলো বাথরুম থেকে তখন অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে দুজোড়া নেত্র। মাহা চোখের ভাষা পড়েও প্রতুত্তর না করে নিজের বেডে বসে পড়েছে। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার মুখ। চৈতি, রুমানা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার। মুখ খুললো রুমানা।
“টুকি, ঠিক আছিস?”
“হুম।”
“শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
“না। মাথা ঘুরাচ্ছে একটু।”
“খাবারটা খেয়ে নে। ভালো লাগবে।”

আঁতকে উঠলো মাহা। নিজের চমকিত ভাবটা লুকিয়ে বললো,
“মাংস খেতে ইচ্ছে করছেনা। আর কিছু এনেছিস?”
“হুম। সবজি ভাজি আছে।”

তিনজনে মিলে খাওয়া সেরে নিয়েছে। মাঝে কোনো কথাই হয়নি। কেমন যেন শ্মশানঘাটের মতো নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে হোটেল মুসাফিরের ৩০৩ কক্ষে। নিরবতা ভাঙলো চৈতি।
“আজকে খাসিয়া পল্লী ঘুরে এলে কেমন হয়?”

রুমানা প্রতুত্তরে বললো,
“ঘন্টা দুয়েকের পথ। টুকি জার্নি করতে পারবে? শরীর দুর্বল তো ওর।”
“পারবো। আমারও খাসিয়া পল্লী দেখার ইচ্ছে।”

সকল ক্লান্তিকে, ভয়কে ঘুচিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে মাহা। আদোও কি এতো সহজে স্বাভাবিক হওয়া যায়? মানুষ মৃত্যুকে কখনো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনা। এই পৃথিবীতে মৃত্যু চরম সত্য। মৃত্যুর ভয় একবার মানুষকে ঝেঁকে ধরলে তা ছাড়ানো দায়। চাইতেও কিংবা না চাইতেও অদ্ভুত খেলার জটিল অংশে গুটি মাহা। চৈতি, মাহা সব হলো নামের খেলা। নামে পরিচয়, নামে বিনাশ। কিছু খেলা বড় করুণ। ভাগ্য অলৌকিক ভাবে সব মিলিয়ে দেয়। খেলা রচনাকারী যাদের নিয়ে খেলছে সে কি জানে তার গুটি তাকে নিয়ে খেলছে? এটা একটা বিস্তৃত মাঠে অদেখা চোরাবালির মতন। মাঠের এপাড়ের লোক আর ওপাড়ের লোক দুজনেই স্থান বদলাচ্ছে। চোরাবালির অতলে কে হারায় দেখার বিষয়। চিকচিকে চোরাবালির প্রেমের দহন যন্ত্রণা। চোরাবালির প্রেমে পড়লে তাতে ডুবতে হয় অতলে। গভীর থেকে গভীর অতলে। সেই অতল থেকে সৃষ্টি হয় নতুন গল্প, নতুন প্রেক্ষাপট। যা অহর্নিশের মধ্যভাগের মতন খা খা। নিশ্চল। বড় নিশ্চল।

খাসিয়া পল্লীতে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?

(চলবে)…

অলকানন্দা
#পর্ব-৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৭.
“আমাকে জিজ্ঞেস করছে গলায় কি হয়েছে?”
“কি বললি?”
“বলেছি ঠান্ডা জনিত সমস্যা।”
“ঠিক আছে।”

কথোপকথনটা চললো রুমানার আড়ালে। সুবানঘাট থেকে লেগুনায় করে রুমানা, মাহা আর চৈতি চলেছে প্রকৃতিকন্যা জাফলং এর পথে। ঘননীল আকাশ। দুইপাশে সারি সারি সবুজেঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় থোকায় থোকায় আপনমনে বিন্যস্ত মেঘের কুন্ডলী। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বহমান পিয়াইন নদী। নদীর পানির অদ্ভুত শব্দ কানে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছলছল ছলছল। দিগন্ত থেকে দিগন্তে উড়ে বেড়াচ্ছে নাম না জানা অজানা পাখির দল। আহা! কিচিরমিচির কিচিরমিচির আওয়াজ। সে আওয়াজে কি অদ্ভুত মায়া। আকাশচুম্বী পাহাড়গুলোর বুক চিড়ে বয়ে চলেছে অবিরাম জলধারা। মাহা, চৈতি অবাক নয়নে, পুলকিত মস্তিষ্কে উপভোগ করছে সে দৃশ্য। বেলা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। নদীর উপরে কুয়াশারা জমাট বেঁধেছে। আকাশে মেঘ আর তটিণী-র উপরে কুয়াশার মেলা যেন একই সূত্রে গাঁথা। মাহা ভুলে গেলো সকল মৃত্যু চেতনা, ভুলে গেলো অজানা আতঙ্ক। তার মন প্রকৃতির প্রেমে পুলকিত। রুমানার কাছে এসবই পুরাতন। তাই হয়তো ঢাকা শহরে বড় হওয়া মাহা আর চৈতির মতো তার মন অজানা অনুভূতিতে পুলকিত, শিহরিত হচ্ছেনা। তার রক্তে রক্তে অজানা কোনো স্রোত বয়ে বেড়াচ্ছেনা।
“অভূতপূর্ব।”

গানের সুরের মতো শুনায় চৈতির কন্ঠ। তার কোমড় সমান চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে বাতাসে। কালচে সবুজ কুর্তিটায় বেশ মানিয়েছে তাকে। রুমানা অবাক নয়নে চেয়ে আছে।
“কি রে কি দেখিস?”
“তুই অনেক সুন্দর রে কোকিল।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো চৈতি। তার হাসির শব্দ ঝংকার তুললো পিয়াইন নদীর আনাচে কানাচে।
“তোর টুকির মতন অমন আগুন সুন্দরী রেখে শেষে আমাকে ধরেছিস?”
“টুকি সুন্দর। তবে তুই সুন্দর, মায়াবতী। তোর মুখে কি যেন আছে রে কোকিল।”
“তোর যত আজগুবি কথা।”

মাহা চুপ করে উপভোগ করছে সবকিছু। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। সবুজ সায়রে ডুবিয়ে দিয়েছে নিজেকে। পাশাপাশি বসে মাহা, চৈতি। সামনা সামনি বসে রুমানা। লেগুনাটা তাদের রিজার্ভ করা। আর মানুষ নেই তাতে। লেগুনার পাশ ঘেঁষে চলে গেলো একটা বাইক। বাইকে দুজন মানুষ বসে। চৈতির মনে হলো কেমন অবাক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। তবে ভাবনাটা মাথা থেকে ঝরে ফেললো সে।
“টুকি? চুপ কেন? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
“না, ঠিক আছি।”

নিরবতা। শো শো করে শীতল বাতাস বইছে। ঠান্ডা হাড় কাঁপানো অদ্ভুত হাওয়া যেন মনে প্রভাব ফেলে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনজনে চলেছে মনোমুগ্ধকর এক গন্তব্যে। লেগুনা চলছে আপন গতিতে। গাড়িতে বসে দুইপাশের সৌন্দর্য দেখা যেন বিস্ময়কর এক অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের পাশে নদী। অপর পাড়ে গজারিবন, সুপারীবনের মেলা।
“একটা গান শুনাবি? মাহা?”

রুমানার মনে হলো সে কিছু ভুল শুনেছে। মাহার দিকে ফিরে সে বললো,
“কি বললি? আবার বলতো?”

চৈতির ইশারায় কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেলো মাহা। লেগুনার ছোট দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
“কোকিলকে বলেছি একটা গান শুনাতে।”
“তাই বল। হ্যাঁ রে কোকিল। একটা গান শোনা প্লিজ।”

চৈতি অন্য মেয়েদের মতো ন্যাকা নয়। গানের গলা ভালো বিধায় অনেকেই গান শুনতে চায় তার কাছে। সেও আপনমনে শোনায়। কোনো বাহানা নেই তার মাঝে। চলন্ত লেগুনা তখন অতিক্রম করছে একটা বিস্তৃত সবুজ মাঠ। বাতাসে গানের নাচন শুরু হয়ে গেলো।

আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্পো বলো কাকে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ী
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ী

আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার চোখ বেধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি
তুমি মায়ের মতই ভালো
আমি একলাটি পথ হাটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা
তুমি নাও না কথাখানি
তোমার কিসের এতো তাড়া
সে রাস্তা পার হবে সাবধানি

তোমার গায়ে লাগেনা ধুলো
আমার দু-মুঠো চাল চুলো
তোমার গায়ে লাগেনা ধুলো
আমার দু-মুঠো চাল চুলো
রাখো শরীরে হাতে যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ী
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী

আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ী
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী

হুম হুম………………

৮.

এতটা আবেগ নিয়ে কখনো কোকিলকে গান করতে শুনেনি রুমানা। এতোটা আবেগ। কার জন্য এতো আবেগ! চোখ বুজে গান সেরে তখনো পল্লব খুলেনি চৈতি।
“এতটা গভীর হয়ে কার জন্যে গান করলি বলতো?”
“তেমন কেউ নেই।”
“সত্যি তোর কোনো ভিনদেশী তারা নেই?”

বলে হেসে দিয়েছে রুমানা। সাথে যোগ দিয়েছে মাহাও। নিচে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলো চৈতি। আছে কি তার কোনো ভিনদেশী তারা?

পথিমধ্যে একবার লেগুনা বিগড়ে গিয়েছিলো। দু’ঘন্টার জার্নি। চারঘন্টায় সেরেছে তারা। জাফলং পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন বিকেল সাড়ে তিনটে।
“এটা কোনো কথা! জাফলং ঘুরবো কখন আর খাসিয়া পল্লী ঘুরবো কখন। পুরা মজাটার বারোটা বাজিয়ে দিসে।”

রুমানার কন্ঠে বিরক্তি।

“থাক বাদ দে।”
“কি বাদ দিবো টুকি। এটা কোনো কথা বল। আমার শহরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা তোরা দেখতে পারবিনা।”

মাহা, চৈতি চুপ করে আছে। আপাতত তারা ভারতের মেঘালয় ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন জাফলং দেখতে ব্যস্ত। রঙ, বেরঙের পাথর চারপাশে। নদীর স্বচ্ছ পানির ভেতরে অপরূপ পাথুরে ঝলকের খেলা।
তিনজনে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে সব। তবে পেট তো আর কথা মানেনা। জানান দিলো খাদ্য দরকার তাদের।
“ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর। নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে সর্বপ্রথম খাবো। তারপর ঘুরবো। কি বলিস টুকি,কোকিল?”
“আচ্ছা।”

ছোট একটা ডিঙি দিয়ে স্বচ্ছ জলধারা পাড়ি দিলো তারা। কত রকমের পাথর নদীর গহীনে। নদীর এপাড়ে হরেক রকম খাবার নিয়ে বসেছে উপজাতি গোষ্ঠী। রুমানা ডিঙি থেকে নেমে দৌড়ে গেলো সেদিক পানে।
“আরে পাগলী আস্তে। তোর খাবার কেউ ছিনিয়ে নিবেনা।”

কে শোনে কার কথা। চৈতির কথা তোয়াক্কাই করলোনা রুমানা। রুমানার এহেন কান্ডে হেসে উঠলো দুজনে।

৯.
একটা টেবিল দখল করে খাওয়াও শুরু করেছে রুমানা। মাহা আর চৈতিও খেলো। ডিম ভোনা, আলুর ভর্তা, ডাল আর ভাত। নদীর তীরে অস্থায়ী পেন্ডেলে বসে খেতে ভালোই লাগলো তিনজনের। বিল দেওয়ার সময় একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটলো। চৈতির মনে হলো হুন্ডারে থাকা লাল হুডী পরনে একজনকে দেখেছে সে। বিষয়টাকে এখন আর হেলায় ফেলায় নিলোনা চৈতি। অদ্ভুত ভয় ঝেঁকে ধরেছে তাকে। তবে তা প্রকাশ করলোনা সে। অটো করে খাসিয়া পল্লী ঘুরবে তারা। একটা অটো রিজার্ভ করে তাতে উঠে বসলো তিনজনে।
“আমি যখনই খাসিয়া পল্লী আসি আমার অনেক ভালোলাগে। এতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তারা। মনে হয় যেন অন্য এক জগৎ এই খাসিয়া পল্লী।”

রুমানা স্থানীয় মানুষ। ঘুরে বেড়ানোটাই স্বাভাবিক। তবে অটো যখন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো তখন দুইপাশের পানক্ষেত আর সুপারি ক্ষেত দেখে কেমন ভয় ভয় লাগছিলো চৈতির। তার নানি বলতো পানক্ষেতে নাকি জ্বীন থাকে। জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। একটু উপর নিচ হলেই তারা মেরে ফেলে। হলদে সাদা মুখটা লালচে হয়ে উঠলো। কেউ তা লক্ষ্য করেনি। রুমানা আপন মনে বলছে।
“এটা হলো খাসিয়াদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কি সুন্দর না তাদের বাড়িঘর?”

সত্যিই অনেক সুন্দর। দুতালা পুরানো দিনের রঙ বেরঙের বাড়ি। অসাধারণ কারুকার্যময়। পুরানো ধাঁচে তৈরি। ভয়টা একটু ঘুচলো চৈতির। লোকালয়ে তারা এখন।
“দেখ টুকি এটা হলো খাসিয়াদের গীর্জা।”

হরেকরকম রঙের কাপড় পরা দুয়েকজন চ্যাপ্টা নাকের খাসিয়াও দেখা গেলো ততক্ষণে। নারীতন্ত্র খাসিয়া সমাজের নারীদের দেখলে মনে হয় একেকটা রাণী। তাদের ভাব গাম্ভীর্যই অন্যরকম।

অটো থামাতে বললো রুমানা।
“তোদের একটা চা বাগানে নিয়ে যাবো। একটু ভিতরে। হেঁটে যেতে হয়। পাশে তেজপাতা, গোলমরিচ আর কমলা ক্ষেতও আছে। কি রে টুকি মন ভালো হলো?”
“খুউব।”

অটো থামিয়ে তারা চললো খাসিয়া পল্লীর পাশে চা বাগানের ভিতর। কথা বলতে বলতে কিছু দূর আগাতেই তিনজন খাসিয়া পুরুষ পথ রুখে দাঁড়ালো তাদের। বাঁধা পেয়ে অবাক হলো তিনজনেই। তাদের ভাষার কিছুই বুঝলোনা তারা। কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর একজন খাসিয়া নারী এগিয়ে এলেন। রুমানার সাথে কথা বললেন তিনি। তার কথার সারমর্ম এই যে,
“তাদের খাসিয়া একলোক চায়ের বাগানের পাশে এক গাছে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন দুদিন আগে। তার বউ, বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অতঃপর কয়েক টুকরা শরীরের অংশ পাওয়া গিয়েছে তাদের।”

আবারও ভয় ঝেঁপে ধরলো মাহাকে। শরীর কাঁপছে তার। যেকোনো সময় পরে যেতে পারে সে।
“রুমা…রুমানা এখান থেকে চল।”

অতিশীঘ্রই খাসিয়া পল্লী ত্যাগ করলো তারা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হাঁড় কাঁপানো শীত পড়েছে চারদিকে। লেগুনায় চৈতির কাঁধে মাথা দিয়ে বসে মাহা। মনটা আবার বিষিয়ে উঠেছে তার। হঠাৎই লেগুনাটা থেমে গেলো। তখন……

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১০.
“আপারা, লেগুনা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের নামতে হবে।”

শীতের রাত। মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে সেই কখন। পিয়াইন নদীর পাড় ঘেঁষে বিস্তৃত পিচ ঢালা রাস্তা। লোকজন একেবারে নাই বললেই চলে। দুয়েকটা যানবাহন চলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। যেন আপন গতিতে মত্ত তারা। অপরপাশে সুপারিবাগান আর গজারিবাগানের বিস্তৃত মেলা। এমন হাঁড় কাঁপানো আধার কালো রাতে লেগুনা চালকের এহেন কথা অনেকটা বজ্রাঘাতের মতো ঠেকলো তিনজন তরুণীর কানে। এদিকে মাহার অবস্থা খারাপ।
“মানে কি! ঠাট্টা করেন আমাদের সাথে। মাঝরাস্তায় কোথায় পাবো গাড়ি?” খেঁকিয়ে উঠলো রুমানা।

লেগুনা মালিক নির্বিকার। তার কিছুই এসে যায় না। এটা স্পষ্ট। লেগুনা মালিকের পীড়াপীড়িতে অগত্যা নামতে হলো তাদের। মাহাকে ধরে রেখেছে চৈতি। সুপারি বাগানের পাশে রাস্তার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তিনজন। রাগে গজগজ করছে রুমানা। তারপর যা ঘটলো সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। লেগুনা ঠিকই আছে। তাদের নামা মাত্রই ছোঁ মেরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো তা। গাড়ির ড্রাইভারকে ওরা কেউ দেখেনি। মোটা একটা কালচে খয়রী চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ছিলো লোকটা।
“দেখলি কারবার। এটা কেমন ফাইজলামি। গাড়ি তো ঠিকই আছে!”

চৈতির বজ্রাহত কন্ঠস্বর। এমন কান্ড সে ইহজন্মে দেখেনি।
“টুকি? ঠিক আছিস?”
“হুম।”
“কি করবো এখন!”

রুমানার আক্ষেপে জবাব দেয় চৈতি। সে অনেকটা দৃঢ়চেতা, ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। কোন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় ভালো করে জানা আছে তার।
“চল হাঁটা শুরু করি। কোনো না কোনো গাড়ি পেয়ে যাবো।”
“তাই করতে হবে। তবে টুকি হাঁটতে পারবে তো? এই টুকি হাঁটতে পারবি?”
“হ্যাঁ।”

মুখে বললেও মাহার ভিতরে বিন্দুমাত্র হাঁটার শক্তি নেই। তা বুঝেই তার একটা হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো চৈতি।

আধারকালো রাত। আকাশে আলোর ছিটেফোঁটা নেই। হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারদিকে। পাশের বন থেকে ভেসে আসছে হরেকরকম ডাক। তিনজন তরুণী হেঁটে চলেছে। তিনজন থাকলেও মন থেকে তারা যেন একা। সামনে রুমানা মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাহা। অপরপাশে তাকে ধরে চৈতি। দু একটা ট্রাক মাঝেমাঝে অতিক্রম করছে তাদের। পিয়াইন নদীর পাশ ঘেঁষে যে পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের অনেকটা দানবের মতো লাগছে। অথচ আলোতে তারা কত সুন্দর! হাঁটতে হাঁটতে চৈতির মনে হলো পিছনে কেউ বা কারা আছে। কেন মনে হলো সে জানেনা। বার দুয়েক পিছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায়নি সে। তবে স্পষ্ট শুকনো পাতার খচখচ আওয়াজ শুনেছে। পিচ ঢালা রাস্তার পাশটায় শীতকালীন শুকনো পাতা ভরে আছে। তাতে পা লাগলেই খচখচ আওয়াজ তুলে। মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেয় চৈতি। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে কখন মাহা রাস্তায় উঠে পড়েছে সে খেয়াল হয়তো কারো নেই। সামনে একটা ছোট টঙ দোকান দেখা যাচ্ছে। তাতে কিছু মানুষের ভিড়। এমন সময় চৈতি পাশে তাকিয়ে দেখলো মাহাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিতে উদ্যত হচ্ছে ভয়ংকর বড় একটা ট্রাক।
“চৈতি”

বলে চিৎকার করে উঠলো চৈতি। বাম হাতে হেঁচকা টানে সরিয়ে আনলো তাকে। ট্রাক ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে চলে গেছে। বুকটা ধকধক করে উঠলো তিনজনেরই। রাস্তার পাশে টঙ দোকানের লোকেরা এসে ততক্ষণে ভিড় জমিয়েছে। চৈতির চিৎকার পৌঁছেছিলো তাদের কান পর্যন্ত। মাহা ভয়ে তখনো ঠকঠক করে কাঁপছে। এটা কি নিছকই এক্সিডেন্ট নাকি বড় কোনো প্রহসন! মাহাকে জড়িয়ে ধরলো চৈতি। রুমানাও ঠিক কি ঘটেছে তা জানতে না পেরে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে। উপস্থিত লোকগুলো ভিষণ ভালো। একটা লেগুনার ব্যবস্থা করে দিলো তাদের। তবে একটা কিন্তু রয়ে যায়। চৈতি মাহাকে কেন চৈতি বলে সম্বোধন করলো?

১১.

হোটেল মুসাফির। ছোটখাটো ছিমছাম হোটেল। ভিতরটা বেশ পরিপাটি আর গোছানো। হোটেলে পৌঁছেছে প্রায় একঘন্টা হলো। রুমানা পাশে বসে আছে। মাহা খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে। বিগত সময়গুলোতে যা ঘটে গেলো তাতে কারো মুখেই কোনো বুলি ফুটছেনা। নিরবতা ভাঙলো রুমানা।
“তোরা আজ রাতেই আমার বাড়ি যাবি। ফাইনাল!”

চৈতি মিইয়ে যাওয়া সুর নিয়ে বললো,
“তা কি করে হয়? আন্টি তো অসুস্থ। তাছাড়া..
“আর একটা কথা বললে তোদের দুটোর দাঁত ভেঙে দিবো আমি। এখন যাবি মানে এখন যাবি।”

রুমানা উড়নচণ্ডী মানুষ। হুটহাট রেগে যাওয়ার বাতিক আছে। অনেকটা পাগলাটেও বটে। একবার যা বলে দেয় মানে দেয়। তা অনেক চেষ্টা করেও কেউ পরিবর্তন করাতে পারেনা। তাই তো ভার্সিটিতে সকলে তাকে ক্ষেপাটে রুমা বলেই সম্মোধন করে। যদিও ডাকটা দেয় আড়ালে। এদিকে চৈতির কথার শোনার প্রয়োজনবোধ করলোনা রুমানা। চামড়ার খয়রী রঙা ব্যাগ থেকে নিজের কালো পার্সটা বের করলো। তাতে মোবাইল রাখে।
“হ্যালো, মা। আমি আসছি। সাথে চৈতি আর মাহাকেও নিয়ে আসছি।”

ওপাশের কথা শোনা গেলোনা। ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে মাহা আর চৈতিকে তোয়াক্কা না করেই তাদের ব্যাগ গোছানো শুরু করেছে রুমানা। মাহা বুঝলো এই মেয়ে আজ ক্ষেপেছে। ওর সাথে আজ না গিয়ে উপায় নেই।

হোটেল মুসাফির থেকে সব পাঠ চুকিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে মাজার রোডের পাশে। রাস্তাটা অনেক সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। ঢাকা শহরের মতো কোনো ইলেকট্রিক তার নেই, ইলেকট্রিক খুঁটি নেই। দেশে একখণ্ড বিদেশ যেনো। এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের কাশ্মীরী চাদরটা আরো গভীর ভাবে শরীরে জড়িয়ে নিলো চৈতি। মাহার একটা হাত রুমানার হাতে নিবদ্ধ। তখনই ট্যাক্সি নিয়ে এলো জিদান।
“রুমাপু, এই শীতের রাতে এভাবে না খাটালেও পারতি। উঠে বস।”

গাড়িতে উঠে বসলো তিনজনে। জিদান রুমানার চাচাতো ভাই। এবার সিলেট কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। রুমানা অবশ্য একা। ভাই-বোন নেই। বাবাও নেই। সে আর তার মা, তার চাচা-চাচি, তাদের ছেলেমেয়ে জিদান, জিমা একত্রে থাকে রুমানাদের বাড়িতে। বাবা মতিউর ছিলেন বড় ব্যাংকার। অঢেল সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন রুমানার নামে। মেয়ে যখন থেকে পাড়ি জমিয়েছে ঢাকা তখন থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রুমানার মা। অগত্যা রুমনাকে হরহামেশাই ঢাকা সিলেট যাতায়াত করতে হয়। চৈতি এসব ভাবতে ভাবতেই একটা দুতালা বাড়ির সামনে এসে থামলো ট্যাক্সি। অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট নয়। তবে বিশাল বড় জং ধরা একটা লোহার গেট। গেটের একপাশে একটা বাগানবিলাস গাছের উপরের অংশ বেরিয়ে। পুরোটাই বাইরে কেবল গোড়াটা ভিতরে। সেই গাছ হলুদ টিমটিমে লাইট দিয়ে সাজানো। গেটের অপরপাশে টিমটিমিয়ে জ্বলছে একটা সাদা বাতি৷ তার থেকে অপর পাশটা অর্থাৎ বাগানবিলাস গাছের দিকটাই বেশি আকর্ষণীয়।

১২.

“আমার বাড়িতে তোদের স্বাগতম।”

এতক্ষণে মাথা ঠান্ডা হয়েছে মেয়েটার। হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো মাহা আর চৈতি। এই মেয়ে যা রাগী!

“এই যে বাড়িতে নিয়ে আসলি। আর আমরাও খালি হাতে চলে এলাম। কি একটা বেয়াদবি কান্ড বলতো। আন্টি কি ভাববেন?”

মাহার কথা শুনে হা হা করে কতক্ষণ হাসলো রুমানা।
“আরে গর্দভের দল। বান্ধবীর বাসায় আবার এত ফর্মালিটি কিসের! আমার মা তোদের মতো ব্যাকডেটেড না। আজাইরা কথাবার্তা।”

এহেন কথার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কি উত্তর দেওয়া যায় বুঝে পেলোনা মাহা। মাঝে ছোট একটা খালি জায়গা। জিদান ততক্ষণে দৌঁড়ে চলে গেছে ভিতরে। বাড়ির ভিতরে দুতালায় উঠার সিঁড়ি। ছোটখাটো ছিমছাম বাসা। অদ্ভুতরকম সুন্দর। রুমানা গটগট আওয়াজ তুলে হেঁটে যাচ্ছে ভিতরে। মাহা আর চৈতি তার পিছুপিছু। তাদের হাতে লাগেজ। বেশি ভারী না তাই মাহার টানতে তেমন কষ্ট হচ্ছেনা।

রুমানার চাচি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে চৈতির মনে হলো হাসিটা কৃত্রিম। দুতালায় পাশাপাশি তিনটা রুম। সুন্দর করে সাজানো, গোটানো, পরিপাটি। সামনে খোলা বারান্দা। বারান্দার পাশে একটা আমগাছ। সামনে বাড়িঘর থাকলেও পিছনে বিশাল জঙ্গল। কোনার রুমটায় অর্থাৎ আমগাছের পাশের রুমটায় মাহা আর চৈতিকে থাকতে দিয়েছে রুমানা। অপরপাশের টা রুমানার ঘর। রুমানার মা ঘুমিয়ে আছেন বিদায় তাকে আর বিরক্ত করেনি তারা।

ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নিচে যখন তিনজনে খাবার খেতে আসলো তখন রাত সাড়ে এগারোটা। রুমানার চাচি বসে আছেন খাবার নিয়ে। খাবার শেষে মাহা, রুমানা চলে গেলেও রয়ে গেলো চৈতি। পানি খেতে খেতে কানে এলো রুমানার চাচি বলছেন,
“পেয়েছেটা কি? রাত বিরাতে মানুষ নিয়ে হাজির হয়। আমি ওর কিনা গোলাম! আশ্রয় দিয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে?”
তখন ভেসে এলো একটা পুরুষালি কন্ঠ।
“আহ্, সেতু। শুনতে পাবে।”
“পেলে পাক। ভাইজান সবকিছু এই হতচ্ছাড়া মেয়েটার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। উনার তো ছেলে নাই। তুমি তার ভাই হয়ে কি একটুও তার সম্পত্তি পাওনা হওনা?”

আর কিছু শুনতে পেলোনা চৈতি। মাহা ডাকছে। মানুষের কত রূপ! অবশ্য কাকে কি বলবে সেও তো একই পথের যাত্রী।

পরদিন সকালটা কেটে গেলো আড্ডায় আড্ডায়। বিকালে রুমানা তার মাকে নিয়ে চেকাপে বেরিয়েছে। রেডি হচ্ছে চৈতি আর মাহা। মাহাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো চৈতি। এতোদিনের অবসান শেষ। এবার সামনে আসতে চলেছে সেই ফোনের অপরপ্রান্তে কথা বলা পুরুষটা। মাহা বিরসমুখে চৈতির পানে তাকিয়ে বললো,
“কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“ভালোবাসার পরীক্ষায় কোনো ঠিক বেঠিক নেই।”
“তবুও…
” হুস। যা হচ্ছে হতে দে। আমি পিছনেই থাকবো। লেট দ্যা গেম বিগিন।”

কি খেলা খেলছে দুজনে? কি পরিণতি হবে সেই খেলার? নাকি তারাই কোনো খেলার শিকার!

(চলবে)……

#অলকানন্দা
#পর্ব-৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১৩.
“এই যে মিস? এই সিট টা আমার।”
“তো?”
মেয়েটার এমন নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখে সার্থকের মেজাজ চড়ে গেলো। আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে তো। একে তো উচিত জবাব দিতেই হয়।
“তো মানে! আমার সিট থেকে উঠুন।”
“সামনের সিট খালি আছে ঐখানে গিয়ে বসুন।”

আবারো হলদে ফর্সা মেয়েটার এমন নির্লিপ্ত উত্তর দেখে যারপরনাই ভরকে গেলো সার্থক। এতটা বেয়াদব মেয়ে সে কখনো দেখেনি। এর সাথে কথা বলার আর কোনো মানে নেই। মেয়েটা অতিশয় অদ্ভুত! অগত্যা নিজের কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে সামনের সিটে বসে পড়লো সার্থক। মেয়েটা উদাস মনে এক নজর তাকালো সার্থকের দিকে। লম্বা সুঠামদেহের অধিকারী সার্থক, মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল, আর একটা খাড়া নাক। অদ্ভুত কালো মণি যুক্ত দুখানা চোখ। মেয়েটা কতক্ষণ তার দিকে তাকিয়েই রইলো। নাইকের ট্রাউজার, পায়ে ক্যাজুয়াল স্নিকার্স আর কালো হুডি পরনে সে । হাতে একটা ঘড়ি। ফর্সা হাতটায় বেশ মানিয়েছে। মেয়েটা কতক্ষণ যাবত তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যে তার ঘড়িতে কি দেখছে ভেবে পেলোনা সে। সার্থক বার দুয়েক তাকালো ঘড়ির দিকে। আদোও কিছু আছে কিনা রহস্যময়ী তা উন্মোচনের বৃথা চেষ্টা যাকে করলো। তবে আফসোস কিছুই খুঁজে পেলোনা সে। ফোন বেজে উঠলো তার।

“হ্যালো, ডক্টর ফায়রাজ সার্থক স্পিকিং।”

ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভেঙেছে হলদে ফর্সা মেয়েটার। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কেবিনে আর কেউ নেই। তারা দুজনই মুখোমুখি বসে। মেয়েটার চোখ জানালা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে দূরান্তে। পাহাড় আর পাহাড় ঘেরা চারপাশ। ট্রেন চলার সাথে সাথে পাহাড়গুলোও যেন চলছে। সময়টা বিকেল। শীতের কুয়াশারা চাদর বিছিয়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আকাশের তিনটে রঙ দেখা যাচ্ছে। উপরে হালকা নীল। একটু নিচে কুয়াশার ধূসর, মেঘেদের সাদা আর চিরায়ত নীলের একটা মিশ্রণ রঙ। আরো একটু নিচে ঐতো পাহাড় ঘেঁষে কেবল ধূসর আর ধূসর রঙের ছড়াছড়ি। পাখিরা চলেছে নীড়ে। মেয়েটাও ফিরছে তার নীড়ে।

কথা শেষে সার্থক আড়চোখে তাকালো মেয়েটার পানে। হলদেটে ফর্সা গাঁয়ের রঙ, কোমড় সমান চুল বোধহয়। চুলগুলো কুঁকড়া ছেড়ে রাখা। গাঁয়ে বেগুনি আর পানপাতা রঙের বাটিকের থ্রি-পিস। উপরে একটা কাশ্মীরী চাদর। ঠিক যেন চিরায়ত কোনো বাঙালি মেয়ে। সার্থক তার ঠোঁট জোড়া দিয়ে আলতো করে উচ্চারণ করলো,
“অলকানন্দা।”

ঝকঝক শব্দ তুলে ট্রেন চলেছে রাজধানীর পথে। সার্থক খেয়াল করেনি, সময় হিসাব করেনি কেবল পলকহীন তাকিয়ে ছিলো হলদে সাদা, কুঁকড়া চুলের, অহংকারী মেয়েটার দিকে।
“কিছু বলবেন?”
“না, মানে।”

মেয়েটার এহেন হঠাৎ প্রশ্নে থতমত খেয়েছে সার্থক। কি জবাব দিবে খুঁজে পেলোনা সে। এই প্রশ্নটা এত কঠিন কেন! এনাটমির জটিল ক্লাসগুলোও তো এতটা কঠিন না!
“না, মানে কি? কি দেখছিলেন তাকিয়ে তাকিয়ে?”

এবার খানিকটা বিরক্ত হলো সার্থক। মেয়েটা যথেষ্ট ত্যাড়া। তাই সেও ত্যাড়া জবাব দিলো,
“আমার চোখ আমি যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে তাকাবো।”
“না, তাকাবেন না।”
“অদ্ভুত মানুষ তো আপনি। আমা….

তখনই ফোন বেজে উঠলো মেয়েটার। ঝগড়াটা জমে উঠেছিলো। সত্যি বলতে সার্থকের ভালোও লাগছিলো। মেয়েটার কন্ঠ অভূতপূর্ব। এতটা সুন্দর কন্ঠ শুনতে সে হাজার বার ঝগড়া করতে রাজি।

১৪.
নাম্বারটা দেখেই অপরাধবোধ জেগে উঠলো মেয়েটার। ফোনের রিংটোনটা তখনো বেজে চলেছে,
“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে….

“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। রেজওয়ান ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, মাহা। তুমি কোথায় এখন?”
“ট্রেনে আছি। ভাইয়া চৈতির কোনো খবর পেয়েছেন?”
“সিলেটে পুলিশ ফোর্স কাজ করছে। দেখি কি হয়।”
“আমার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে রেজওয়ান ভাইয়া। আমি আসলে কিছু মনে করতে পারছিনা।”
“তোমার কোনো দোষ নেই মাহা। যা হবার ছিলো তাই হয়েছে। একটা কথা বলোতো চৈতি মূলত কোথায় গিয়েছিলো?”
“আমার মনে পড়ছেনা ভাইয়া। আমার কিছুই মনে পড়ছেনা।”
“আচ্ছা, থাক। তুমি ঢাকা আসো। তারপর কথা হবে। সাবধানে এসো।”

এএসপি রেজওয়ান চৌধুরীর সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলো মাহা। সব কেমন অদ্ভুত আর প্যাঁচানো লাগছে তার। সামনের ছেলেটা ফায়রাজ না কি নাম কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। মাথাটা সবুজ রঙা সিটে হেলান দেওয়া। চোখদুটো বন্ধ। তার ঝাঁকড়া চুলগুলো ট্রেনের ঝাঁকুনির তালে তালে কপালে চলে এসেছে। সুদর্শন হলে কি হবে! এক নাম্বারের বেয়াদব ছেলে! মুখটা কুঁচকে বাইরের দিকে তাকালো মাহা। তার আসলে কিছুই মনে পড়ছেনা। সিলেট কেন এসেছিলো তাও মনে নেই। রুমানা বলছিলো সে আর চৈতি নাকি একসাথে সিলেট এসেছে প্রায় তিনদিন। চৈতি মেয়েটা মাহার বেস্টফ্রেন্ড। আগুন সুন্দরী। কাঁধ সমান চুল। লম্বায়ও অনেক। পাঁচফুট সাতের কাছাকাছি। আর সে তুলনায় মাহা একটু খাটো। চৈতির থেকে দুয়েক ইঞ্চি কম তার উচ্চতা। মাহা আর চৈতি নাকি একসাথে সিলেটও ঘুরেছে। রুমানা আরো কি কি বললো। চৈতিকে নাকি কোন পাগলী হাতে খামছি দিয়েছে, চৈতির নাকি ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো। মাহা নাকি বাঁচিয়েছে। আরো কত কি! মাহা নিজেও মুখে হ্যাঁ, হ্যাঁ করলেও বাস্তবিক অর্থে তার কিছুই মনে পড়ছেনা। কালরাতে যখন ঘুমিয়েছিলো জাহানারা ইমাম হলের তার ঘরটায় তখন মাথায় কেবল ঘুরছিলো আগামীকাল পরীক্ষা। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা। সে চোখ খুললো একটা ছেলের আওয়াজে।
_________________

“আপু? আপু? ঠিক আছেন?”

চোখের পাতা এতটা ভারী লাগছে মনে হচ্ছে কেউ যেন একশমণের ভারী দুটো বস্তু রেখে দিয়েছে মাহার চোখে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। প্রথমে যখন চোখ খোলার চেষ্টা করলো তখন তা পারলোনা সে। চোখটা বন্ধ হয়ে গেলো তার। এবার মনে হলো মাথাটা কারো কোলে। কন্ঠস্বরটা পরিচিত।
“মাহা, এই মাহা। এই কোকিল? কোকিল?”

রুমানার কন্ঠ এটা। অবচেতন মস্তিষ্ক ধরে ফেলে পরিচিত আওয়াজটা। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় মাহা। আশেপাশে কৃত্রিম আলোর ছড়াছড়ি। এটা কি কোনো রাস্তা? মাহাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে রুমানা বলে,
“ঠিক আছিস? কোকিল?”

মাথাটা ধরে উঠে বসে মাহা। একটা পিচঢালা রাস্তায় বসে আছে সে। সামনে বিস্তৃত মাঠ। পাশে দু’তালা একটা বিল্ডিং। সময়টা বোধহয় রাত। অন্ধকার চারপাশে। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে। পাশে উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে চারজন অপরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে।
“আমি এখানে?”

১৫.
মাহাকে ধরে দাঁড় করায় রুমানা। ঘরে নিয়ে যায় তাকে। সোফায় বসলে পানি খেতে দেন একজন মহিলা। অনেকটা রুমানার মতোই দেখতে। এটা কি রুমানার মা? বাকি একজন মহিলা, একটা ছোট মেয়ে। কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে। আরেকটা কিশোর বয়সী ছেলে। মাহা কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে স্বস্তি লাগছে এই ভেবে যে রুমানা আছে।
“আমার কি হয়েছিলো রুমানা?”
“আমি বিকালে তোদের বলেই তো আম্মুকে নিয়ে চেকআপে গেলাম। তারপর ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। জিদান বললো তোরা নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিস। আমিও গিয়ে দেখলাম দরজা ভিতর থেকে লক। তাই আর তোদের বিরক্ত করিনি।”
“এখন কয়টা বাজে?”
“এখন তো রাত সাড়ে তিনটা।”
“আমি রাস্তায় কিভাবে…কিছুই তো বুঝতে পারছিনা!”
“ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ তোর একটা চিৎকার ভেসে এলো কানে। আমি বাইরে এসে দেখি তুই নিচে পড়ে আছিস। আর জিদান তোকে ডাকছে!”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার মাথাটা অনেক যন্ত্রণা করছে রুমানা।”

বলেই মাথাটা চেপে ধরলো মাহা। রুমানা তার পাশে বসে। এতকিছু হয়ে গেলো অথচ চৈতি নিচে নামেনি। ব্যাপারটা অনেকটা খটকা লাগলো রুমানার। সবাইকে রেখে দৌড়ে উপরে গেলো সে। না, চৈতি কোথাও নেই! সারাবাড়ি মাথায় তুলে ফেললো রুমানা। “টুকি, টুকি কোথাও নেই!”

মাহা ঘাবড়ে গিয়েছে অনেকটা। কোথায় গেলো চৈতি। এতকিছুর মাঝে ঘাড়ের চিনচিন ব্যথাটা তোয়াক্কাই করেনি মাহা।

তারপর কতকিছু ঘটে গেলো। মাহা তার বাবার বন্ধুর ছেলে এএসপি রেজওয়ানের সাথে কথা বললো। সিলেট পুলিশ স্টেশনে ব্যাপারটা অবগত করা হলো। কেটে গিয়েছে দুইদিন। মাহার ভাই মাহিন ফোন করে জানিয়েছে বাবা অসুস্থ। তাই সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে মাহা। কি হচ্ছে! কেন হচ্ছে! চৈতি কোথায় কিছুই বুঝতে পারছেনা মাহা। পুলিশ তাকে বেশি জিজ্ঞেসাবাদ করেনি। রেজওয়ান ওদের সাথে কথা বলেছেন। তাছাড়া জিদান নাকি নিজ চোখে দেখেছে মাহা নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছে। তার ডাকও তোয়াক্কা করেনি সে। বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাই পুলিশও ব্যাপারটা সাময়িক তাই ধরে নিয়েছে। ইনভেস্টিগেশন চলছে। রুমানার মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় একাই ঢাকা ফিরছে মাহা।

________________

মেয়েটা কি ভাবে এত! সেই কখন থেকে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। সার্থক বাইরে তাকিয়ে দেখে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। দেখার মতো কিছুই নেই। মেয়েটার কন্ঠটা ভয়ংকর সুন্দর। আবার শুনতে মন চাইছে তার। কি বলে কথা শুরু করা যায়! নিজের কর্মকাণ্ডে নিজেই অবাক ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। কানাডা থেকে এমবিবিএস, এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করে দেশে এসেছে সে। কত মেয়ে দেখেছে জীবনে! এমন অনেক মেয়েও আছে যারা তার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চায়। কখনো তাদের জন্য তো এমন লাগেনি তার! তাহলে আজ কেনো! এই সাধারণ মেয়েটা, হলদে ফর্সা মেয়েটা। পরনে বেগুনি আর পানপাতা রঙা থ্রি-পিস। কি আছে মেয়েটার মাঝে! ইজ ইট লাভ এট ফার্স্ট সাইট? কি অদ্ভুত ব্যাপার! ডক্টর ফায়রাজ সার্থক তার জীবনের আটাশ বসন্ত পাড় করলো। ঊনত্রিশ তম বসন্ত আসতে চললো আর সে কিনা একটা গম্ভীর, অহংকারী মেয়ের প্রেমে পড়েছে! নিজেকে ইচ্ছে মতো কষে মনে মনে দুয়েকটা চড় মারলো সার্থক। এটা কখনো সম্ভব না। মাহা তাকিয়ে আছে বাইরে আর সার্থক আড়চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এমন সময় হঠাৎ থেমে গেলো ট্রেনটা। কতক্ষণ নিরবতা। অতঃপর আওয়াজ ভেসে আসছে,

“ডাকাত! ডাকাত!”

(চলবে)……

#অলকানন্দা
#পর্ব-৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১৬.
“প্লিজ, আমাকেও আপনার সাথে নিয়ে যান। একটু সাহায্য করুন।” মাহার কাতর সুর।

অন্ধকার চারপাশে। দুইধারেই জঙ্গলে আবৃত। সার্থক ট্রেনের দরজা দিয়ে নিচে নেমে এসেছে। চারপাশে আহাজারি। ডাকাত হামলা করেছে ট্রেনে। এখনো তাদের বগিতে আসেনি। তবে আসতে কতক্ষণ! মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। সার্থকের অনেক ইচ্ছে করছিলো আশেপাশের বগিতে থাকা মানুষদের সাহায্য করতে। তা সম্ভব নয়। প্রত্যেক বগির দরজার সামনে ডাকাতের সদস্য দাঁড়িয়ে। তাদের বগিটা সবার শেষে। এই বগিতে মানুষও কম। এখনো ডাকাতের দল এদিকটায় আসেনি।

“কি ভাবছেন? একটু সাহায্য করুন।”

মাহার করুন কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে সার্থকের।কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় মেয়েটাও তার পিছন পিছন এসেছে। সার্থক বুঝতে পারছে এভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা তার। তবে এখানে থাকলেও কি! সে তো কাউকে সাহায্য করতে পারবেনা! উল্টো জীবন হারাবে।
“আমাকে একটু নামিয়ে দিন।”

আবারো মাহার কন্ঠ। ট্রেনের দরজাটা অনেক উঁচুতে। সার্থক লাফিয়ে নেমে গেলেও থ্রি-পিস পরনে মাহা তা পারছেনা। সার্থকের মাথায় আসছেনা কি করে নামাবে। এদিকে বেশিক্ষণ থাকাটাও বিপদ।
“আপনার হাত দিন।”

নির্লিপ্ত ভাবে বলে সার্থক। যদিও মাহার এই অপরিচিত ছেলেটার সাথে যেতে ভয় লাগছে তবুও ডাকাতের থেকে সম্ভ্রম হারানোর চেয়ে তা অনেকটা ভালো।
“কি হলো হাতটা দিন।”

আবছা আলো এদিকটায়। বগির ভিতরের হলুদ বাতির আলোর ছিটে কিছুটা আসছে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে হাতটা বাড়িয়ে দিলো মাহা। সার্থক ধরে টান দিবে এমন সময় তাদের দেখে ফেললো দুজন ডাকাত।
“ওস্তাদ ঐ যে, ঐ যে। দুইডা পোলা মাইয়া।” হইহই করে উঠলো দুজনে।

মাহা ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে চাচ্ছে কেবল এবার যেন বেঁচে যায়। হঠাৎ একটা হেঁচকা টানে তাকে কোলে তুলে নিলো সার্থক। ট্রেন প্রায় মাটি থেকে এক মিটার উঁচুতে। ভয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে নিলো মাহা। এই বুঝি তার জানটা গেলো। অতঃপর তা হয়নি। শূন্যে ভাসছে সে। কারো উষ্ণ বুকের আওয়াজ আসছে তার কানে। ধুকপুক ধুকপুক।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘেরা চতুর্দিক। আশেপাশে কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। মাঝদিয়ে চলে গিয়েছে একটা রেলপথ। সেই রেলপথ ধরে মাহাকে কোলে নিয়ে ছুটছে সার্থক। তাদের পিছনে ছুটছে দুজন ডাকাত। মাহা ট্রেনে থাকাকালীন একনজর তাকিয়ে ছিলো। বিশাল দানবীয় শরীরের আকার। হাতে দাউদাউ করছে মশাল। আরেক হাতে বর্শা। পিছন থেকে হইহই আওয়াজ ভেসে আসছে। সেদিকে কান নেই সার্থকের। সে বুকের মাঝে একটা অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।

বিপত্তি ঘটলো এবার। একটা পাথরে পা লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মাহা ছিটকে পড়ে পাশে। দূরে মশালের আলো আর হাসির শব্দ ভেসে আসছে। দুটো নয় কয়েকজোড়া মশাল। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মাহা। এবার কি তবে সব শেষ!

১৭.
পাথরের ঘষায় পা ছিলে গিয়েছে সার্থকের। দূরে ডাকাতের দল দৌড়ে আসছে। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে কয়েক জোড়া মশাল। সামনে সরু ট্রেনের রাস্তা। দুইপাশে বন। নিজের কথা এখন ভাবছেনা সার্থক। ভাবছে মেয়েটার কথা। মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে বোধহয়। অন্ধকারেও বুঝতে পারছে সার্থক। মেয়েটা ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে। কি করা যায়! হাতে সময় আছে কয়েক সেকেন্ডেরও কম। নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো সে। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। সে দৌড়ে গেলো মাহার পানে। শক্ত করে ডান হাতটা আঁকড়ে ধরলো তার। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হাতটা মনে হলো অনেক ভরসার। আবারো হেঁচকা টানে মাহাকে নিয়ে দৌড়ে বাম দিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়লো সার্থক। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটাকে হয়তো সে কোলে নিতো। এমুহূর্তে পায়ের কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা। সার্থকের কালো হুডির একটা পাশ গাছের সরু ডাল লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে। তার মাশালগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে। ডক্টর ফায়রাজ সার্থক এভাবে পালাবে কখনো কল্পনাও করা যায়না। তাহলে এর পিছনে কারণ কি! মাহার হাতটা তখনো শক্ত করে ধরে রাখা। পিছনে আর কেউ আসছেনা এখন। জঙ্গলের অনেকটা গভীরে চলে এসেছে তারা। হরেকরকম ডাক ভেসে আসছে চারদিক থেকে। জঙ্গলের উত্তরাংশ থেকে ভেসে আসছে পেঁচার ডাক। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাহা। ভয়ে এবার কান্নাই করে দিলো। হঠাৎ বাঁধায় থমকে দাঁড়িয়েছে সার্থক। এত ক্ষণ কারো মুখেই কোনো কথা ছিলোনা।
“কি হয়েছে?”

সার্থকের নরম কন্ঠস্বর। এবার ফুঁপিয়ে উঠলো মাহা। নিকষকালো আঁধার ঠেলে উড়ে গেলো দু’একটা বাদুড়। অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো মাহার। আশেপাশের জঙ্গল, বড় বড় গাছপালা। সবকিছু দেখে কেমন মাথা ঘুরাচ্ছে তার। ডালপালায় ভরা চারদিক। আবার কিছু বাদুড়ের দল উড়ে যাওয়ার শব্দ হতেই সার্থক কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহা। ঠকঠক করে কাঁপছে সে। শরীরটা বরফের চেয়েও বেশি ঠান্ডা।
“আমা….আমার ভয় লাগছে।”

সার্থকের একটা হাত চলে গেলো মাহার মাথায়। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে।
“ওরা, ওরা কি আসছে?”
“না, এখন বোধহয় আর আসছেনা। তুমি টেনশন করোনা।”

নিস্তব্ধতা। অজানা জঙ্গল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে অজানা, অচেনা ছেলের বুকে মাথা রেখে একটা ভরসা খুঁজে পাচ্ছে মাহা। শক্ত বুকটা। অনেক চওড়া। কি সুন্দর ঘ্রাণ শরীরে। কি সম্মোহনী ঘ্রাণ! ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা। মাহা ভুলে গেলো সকল কিছু। সবকিছু। অন্ধকারের মাঝেও চোখে ছেয়ে গেলো আরেক অন্ধকার। ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের শক্ত বুকের মাঝেই ঢলে পড়লো সে। যেন নিজেকে সঁপে দিলো সেই ফর্সা রঙা, অদ্ভুত কালো মণির ছেলেটার কাছে। মেয়েটাকে বুকে লুটিয়ে পড়তে দেখে ভরকে গেলো সার্থক।

১৮.

আঁধারে ছেয়ে আছে চারিদিক। কোথায় কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। একটা সরুরাস্তা। মাহা রাস্তাটা ধরে হেঁটে চলেছে। পরনে নীল রঙের একটা গোলজামা, কালো লেগিংস আর কালো জ্যাকেট। তার কুঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। সে হাঁটছে আর হাঁটছে। জায়গাটা কোথায়? কেবল অন্ধকার। পাশে কে যেন হাতটা দৌড়ে এসে আঁকড়ে ধরলো।
“মাহা, এই মাহা।”
চৈতির আওয়াজ না এটা। হুম, চৈতিরই তো! তার পাশে হাঁটছে। পরনে তার মতোই কাপড়। খিলখিলিয়ে হেসে কি যেন বলছে! মেয়েটা সত্যিই অনেক সুন্দর। হঠাৎ মাহার কন্ঠস্বর।
“সিলেট যাবি?”

নিজের কাঁধ সমান চুলগুলোকে দুলিয়ে দুলিয়ে দৌড়ে সামনে চলে গেলো চৈতি। চৈতি লম্বা বিদায় তার সাথে দৌড়ে পারছেনা মাহা। তাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। চিৎকার করে প্রশ্ন করলো,
“কিরে বল?”

দৌড়াতে দৌড়াতেই পিছনে তাকালো চৈতি। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“যাবো তো। অবশ্যই যাবো।”

হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো চৈতি। তারপর…..

তারপর আবার অন্ধকার। একটা পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটছে মাহা। হাঁটছে আর হাঁটছে। এখন আবার ঘাষে ঢাকা এবড়ো থেবড়ো পথ। পা বোধহয় খালি তার। পায়ে লাগছে শিশির বিন্দু। আলোর দেখা পাওয়া গেলো এবার। দূরে। ঐ তো দূরে আলোর দেখা মিলেছে। আবার আশপাশটা আলোকিত হয়ে গেলো। মাহার হাঁটা থামেনি। সে চলছে। আলোর দেখা মিলতেই জামা পাল্টে গেলো তার। গেরুয়া রঙের থ্রি-পিস। উপরে মনিপুরী শাল। হাতে বড় ট্রলি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সে। আশেপাশে কত মানুষ! হকারদের ডাক। পাশে এক লোক হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করছে। অপরপাশে আরেকজন ভুট্টা বিক্রি করছে। একটা ছোট ছেলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। বুরকা পরা তার মা তাকে কোলে নিয়ে বলছে,
“না, না। বাবা, কাঁদেনা। কাঁদেনা।”

বারেবারে ঘড়ি দেখছে মাহা। চৈতি কোথায়! মেয়েটা সবসময় লেট!
“এই শসা। শসা। পাঁচ টাকা পিস। লবণ, মরিচ দিয়ে শসা।”

হাক ছাঁড়তে ছাঁড়তে পিছন দিক দিয়ে চলে গেলেন এক হকার। আর কতক্ষণ পড়েই ট্রেন ছেড়ে দিবে। কোথায় চৈতি! মোবাইলটা বের করলো মাহা। এমন সময় কে যেন পিছন থেকে চোখ চেপে ধরলো তার।
“এসবে চলবেনা। কানে ধর।”

চৈতি মুচকি হেসে কানে ধরলো। তবে নিজের না মাহার। মেয়েটা এতো দুষ্টু!

একটা ট্রেনের কেবিন। ছিমছাম সুন্দর ফার্স্ট ক্লাস কেবিন। ছোট ঘরটা। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যাত্রাপথ বোধহয় সিলেট। চিরায়ত ঢাকা শহর ছাড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো মাহার। চৈতি পাশে বসে সমান তালে বকবক করে যাচ্ছে। মাহাও বলছে। কি বলছে মনে করতে পারছেনা। তবে সে বলছে। অনেক কথা বলছে। বাইরে হালকা রোদ। একটা ঠান্ডা হিমেল হাওয়ার ছড়াছড়ি। মনিপুরী সাদা আর কালোর মিশ্রণে শালটা নিজের সরিয়ে আরেকটু জড়িয়ে নিলো মাহা। অনেককিছু হচ্ছে। কি হচ্ছে খেয়াল নেই। তবে হচ্ছে। ট্রেন চলছে। ঝালবুট খাচ্ছে মাহা, চৈতি। ঐ তো দূরে একটা নদী। আচ্ছা, নদীটার নাম কি? কি সুন্দর নদীটা। ছলছল পানি। মাহা কি একটা নাম দিবে? নামটা যদি হয় “উদাসমনা স্রোতস্বিনী?”

আরো কত কি বাইরে। কত গাছপালা! কত দালান কোঠা। ঐতো দেখা যায় কৃষকেরা মাঠে কাজ করছে। পাশে বসে চৈতি। অনেক কথা বলছে দুজনে। অনেক গল্প! কি গল্প! শুনতে পাচ্ছেনা কেন মাহা! একটা শব্দ কানে বাজলো।
“অদলবদল।”

অনবরত সেই শব্দটাই উচ্চারণ করছে মাহা। চৈতি হেসে বলছে,
“কি রে আজ থেকে তুই তো চৈতি!”

মাহা, চৈতি কেন হতে যাবে? মেয়েটা সেই কখন থেকে বলছে চৈতি শুন। এই চৈতি এটা। এই চৈতি ঐটা। আর মাহা তাকে মাহা বলে সম্বোধন করছে। দুজনেই আবার হেসে লুটিয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন! আবার অন্ধকার। একটা রাস্তা। এটা তো সেই রাস্তা যেটাতে হাঁটছিলো মাহা। চৈতি নাই। ট্রেন নাই। কান্না করা বাচ্চাটা নাই। ভুট্টা বিক্রেতা নাই। হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা নাই। শসা বিক্রেতা নাই। কেবল মাহা। একা। চারপাশে অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক ফোঁটা আলো নেই। এবার চিৎকার করে উঠলো মাহা। আবার চিৎকার করতে যাবে এমনি একটা শক্ত হাত মুখ চেপে ধরলো তার। একটা উষ্ণ স্থানে সে। কোথ থেকে যেন তবলার তাল ভেসে আসছে। নাকি এটা কারো বুকের শব্দ!

(চলবে)…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১৯.
আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো মাহা। শূন্যে ভাসছে সে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। আশপাশে অন্ধকার। তড়িৎ গতিতে চোখ বন্ধ করে আবার খুললো সে। সে কারো কোলে! মস্তিষ্ক সচল হচ্ছে তার। এতক্ষণ তাহলে যা দেখেছিলো সব স্বপ্ন ছিল। সরু রাস্তা, চৈতি, ট্রেন, ভূট্টা ওয়ালা, হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা, শসা বিক্রেতা, ছোট বাচ্চাটা সব স্বপ্ন ছিল! তাহলে এতটা বাস্তব লাগলো কেন!
“আমরা কোথায়?”

অনেক কষ্টে কম্পিত ঠোঁট জোড়া দিয়ে প্রশ্নটা করে মাহা। সার্থক তাকে কোলে নিয়ে একটা বৃহৎ গাছের পিছনে লুকিয়ে আছে। চতুর্দিকে আঁধার। তখন হঠাৎ করেই মেয়েটাকে অজ্ঞান হতে দেখে ভরকে যায় সার্থক। দূর থেকে শুকনো পাতা আর ডাল-পালার শব্দ শুনেই বুঝতে পারে কেউ হয়তো আসছে এদিকটায়। আবারো মেয়েটাকে কোলে তুলে এলোমেলোভাবে জঙ্গলের আরো গহীনে প্রবেশ করে সে।
“কি হলো বলুন?”
“চুপ। কথা না। আশেপাশে মানুষ আছে।”

ভয়ে আবারো সিটিয়ে গেলো মাহা। একেবারে লেপ্টে গেলো সার্থকের বুকের মাঝে। হঠাৎ মনে হচ্ছে তার শীত লাগছেনা কেন! অতঃপর ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে তার গায়ে ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটার কালো হুডিটা। আর ছেলেটার গায়ে পাতলা একটা টি-শার্ট! অনেকটাই অবাক হয়েছে মাহা। মাহার শীত দূর করতে তবে কি ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটা এই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে নিজের হুডি খুলে দিয়ে দিয়েছে! হঠাৎ কান্না পেলো মাহার। বরফ শীতল কপোলের উপর চোখের উষ্ণ ধারা প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। নিজেকে দমাতে পারছেনা মাহা। মা মারা যাওয়ার পর এতটা কখনো তাকে নিয়ে কেউ ভাবেনি। রুমানা আর চৈতিও না!

মাহার হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠার শব্দে তার মুখে দিকে তাকালো সার্থক। এই তো কিছুক্ষণ আগে যখন সে এলোমেলো পথ পাড়ি দিচ্ছিলো তখনই দেখে মেয়েটা তার কোলে ঠকঠক করে কাঁপছে। আর কিসব যেন বিড়বিড় করে বলছে। নিজেকে থামিয়ে সেখানে বসে কালো হুডিটা খুলে মেয়েটার গাঁয়ে পরিয়ে দিলো সার্থক। যদিও মেয়েটার গাঁয়ে হুডিটা অনেক বড় হয়েছে। অহংকারী, কুঁকড়া চুলের, হলদে ফর্সা শরীরে তার বৃহৎ হুডিটা কল্পনা করেই হাসি পেলো সার্থকের। যদিও সময়টা হাসির নয়। অতঃপর আবার পায়ের শব্দে এই বড় গাছটার পিছনে আশ্রয় নিয়েছে সে। ডাকাতের দল তো এতদূর আসার কথা না! তাহলে কি এটা জঙ্গলে বসবাসরত আদি বাসিন্দাদের পায়ের আওয়াজ! মেয়েটা এত কাঁদছে কেন!
“প্লিজ। একটু চুপ করো।”

সম্বোধনটা আপনি থেকে কখন যেন তুমিতে চলে গিয়েছে। অবশ্য সার্থকেরও দোষ নেই। মেয়েটা তার থেকে বয়সে অনেক ছোটই হবে।
“আরে! তুমি এমন ভাবে কান্না করছো কেন! আজ রাতটুকু একটু কষ্ট করো। আমি আছি তো!”

সার্থক জানেনা সে এই কথাটা কেন বললো। বলতে ইচ্ছে করেছে তাই বলেছে। মনে কথা চাপিয়ে রাখতে সে পারেনা।
“আমি আছি তো!”

বাক্যটা শুনে নিজের অজান্তেই কান্না থেমেছে মাহার। চেনা নেই, জানা নেই ট্রেনে দু’ঘন্টার জার্নিও তারা একসাথে করেনি। ঝাঁকড়া চুলের, ফর্সা ছেলেটা। অদ্ভুত কালো চোখের মণিওয়ালা ছেলেটা বলছে,
“আমি আছি তো!”

কই বাবাতো কোনোদিন মা মারা যাওয়ার পর বলেনি, “আমি আছি তো!”

“বাবা!” শব্দটা উচ্চারণ করেই মাহার মনে পড়লো সে তো বাবার জন্য ঢাকা ফিরে যাচ্ছিলো। মাহিন, তার সৎ ভাই ফোন দিয়ে বলেছিল বাবা হসপিটালে! কেমন আছেন বাবা? সার্থকের বুকে লেপ্টে কথাগুলো ভাবছিলো মাহা। সার্থকের চোখ, কান তখন ঘুরাঘুরি করছে আশেপাশে।

২০.
পশ্চিমদিক আর উত্তর কোনের দিকে খসখস আওয়াজ হচ্ছে। এটা কোনো প্রাণীর আওয়াজ নয়। মানুষের পায়ের আওয়াজ।
“আপনি আমাকে নামিয়ে দিন। আমি হাঁটতে পারবো। আমার এভাবে ভালো লাগছেনা।”

মেয়েটা এত কথা বলে কেন। জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও আজাইরা কথা না বললে মেয়েজাতের হয়না!
“চুপ! আর একটা কথা না।”
“আজব তো! এভাবে কথা বলছেন কেন আপনি!”
“এই মেয়ে চুপ। দয়াকরে চিৎকার করোনা। আশেপাশে কয়েকজন আছে। যারা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। ধরতে পারলে চিবিয়ে খাবে। তুমি কারো খাবার হতে চাও, মেয়ে?”

এহেন কথাবার্তায় থতমত খেলো মাহা। চিবিয়ে খাবে মানে কি! সে কি খাবার বস্তু নাকি যে চিবিয়ে খাবে। অন্ধকারে মুচকি হাসলো সার্থক। মেয়েটা তো অনেক ভীতু। ভয়ে আবারো লেপ্টে গেলো তার বুকের সাথে। হঠাৎ পিঠে একটা দাঁড়ালো কিছু ঠেকলো সার্থকের। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো সে। দৌড় দিতে পারলোনা। আশপাশ ঘিরে ফেলেছে হারিকেন হাতে কয়েকজন মানুষ। সবার হাতে বর্শা। এত স্ট্রেস নিতে না পেরে আবারো জ্ঞান হারায় মাহা। সার্থক স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে আলোয় সয়ে আসছে তার চোখ। না, এদের দেখে তো আদিবাসী মনে হচ্ছেনা। এদের সবার পরনে সাদা লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত, সাদা ফতুয়া আর কোমড়ে, মাথায় গামছা বাঁধা। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। তাদের মধ্য থেকে একজন লোক এগিয়ে আসলেন। শুদ্ধ ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন,
“আপনারা কি হারিয়ে গেছেন বাবু?”

বাংলা শুনবে আশা করেনি সার্থক। নিজেকে সামলে উত্তর দিলো,
“জ্বি।”
“আমি কানু। সাঁওতাল উপজাতি। আমরা সবাই রাতে জঙ্গল পাহাড়া দেই। পাশেই আমাদের গ্রাম।”

ভরসা খুঁজে পেলো সার্থক। যদি আজ রাতটা কোনোভাবে কাটানো যেতো।
“আমাদের আজ রাতটুকু আশ্রয় দিতে পারবেন?”

কনু হঠাৎ করেই কিছু বললোনা। তাদের ভাষায় কিছু পরামর্শ করে নিলো।
“আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী আছেন?”
“হ্যাঁ।”

মিথ্যা বললো সার্থক। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটা বারেবারে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। একটু পানি পান করানো প্রয়োজন। তাছাড়া রাত এখনো অনেক বাকি। সারারাতে নির্ঘাত মেয়েটার জ্বর চলে আসবে।
“আপনারা কি মুসলমান বাবু?”
“জ্বি, আমরা মুসলমান।”
“ঠিক আছে। চলুন বাবু। কিছুদূর হাঁটলেই আমাদের গ্রাম। আপনার বিবির কি হয়েছে?”
“আসলে ও একটু ভয় পেয়েছে।”

সাঁওতাল উপজাতিদের সাথে মাহাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে সার্থক। হারিকেনের হালকা আলোয় আলোকিত হয়েছে চারপাশ। বিশাল বড় বড় গাছপালা। কত প্যাঁচানো ডালপালা! মাটিতে জমেছে শীতকালীন শুকনো পাতার দল। তাদের উপর লেপ্টে আছে শীতের শিশির ফোঁটা। এক-দুটো বাদুড় ঝুলছে কয়েকটা গাছে। হঠাৎ মাহার মুখের দিকে তাকিয়ে হৃদপিণ্ডের একটা স্পন্দন মিস করলো ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। হারিকেনের আলোয় অভূতপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে। হালকা ঠোঁট জোড়া কাঁপিয়ে কি যেন উচ্চারণ করছে মেয়েটা। অনেক পাতলা মেয়েটা। কিছু কি খায়না নাকি। একেবারে তুলোর মতো। এতক্ষণ যাবৎ কোলে নিয়ে রেখেছে সার্থক তার একটুও কষ্ট হচ্ছেনা। একটুও না।

২১.
অবশেষে জঙ্গল পেরিয়ে লোকালয়ের দেখা মিললো। পাহাড়ি উপত্যকায় ছোট জনপদ। মাটির ছোট ছোট ঘর। প্রত্যেক ঘরের সামনে মশাল জ্বলছে। সামনে মাঝারি আকৃতির একটা মাঠ।
“আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি?”

কানুকে প্রশ্ন করে সার্থক।
“আমাদের প্রধানের কাছে, বাবু। তিনি অনুমতি না দিলে আমরা আপনাদের জায়গা দিতে পারবোনা।”

অন্যান্য মাটির ঘর থেকে এই ঘরটা তুলনামূলক বড়। চারপাশে কলাপাতার বেড়া দেওয়া। সুন্দর, ছিমছাম, পরিষ্কার বাড়ি। সাঁওতালরা পরিষ্কার জাতি বলে জানতো সার্থক। তারা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। আজ নিজ চোখে দেখেও নিলো। ছয়জনের একটা দল কানুরা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই হাঁক ছাড়লো কানু। সার্থকও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে। ধুতি, ফতুয়া পরনে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ ব্যাক্তি। ঘরের দুপাশে বড় বড় মশাল জ্বলছে। সার্থক খেয়াল করলো সাঁওতাল পুরুষ সকলের হাতেই উল্কার ছাপ।

বৃদ্ধ এসে এক নজর তাকালেন তার দিকে। অতঃপর নিজেদের ভাষায় কানুর সাথে কথা চালালেন। তাদের ভাষার নাম সান্তালী ভাষা। অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত মুন্ডা উপপরিবারের একটি ভাষা, এবং হো এবং মুন্ডারি ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের বসতে দেওয়া হলো বাঁশের তৈরি মাচায়। এত এত পুরুষের মাঝে মাহাকে রাখতে ভালোলাগছেনা সার্থকের। সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে। একটা চিনচিনে রাগে মাথার একদিকটা ব্যথা করছে তার। হুডির ক্যাপটা মাহার মাথায় তুলে দিলো সে। যতটা আড়াল করা যায়। সে বসেছে ডানপাশে। বামপাশে বসেছে কানুদের দলের সবাই। মাঝে একটা রাজকীয় মেহগনি কাঠের চেয়ারে বসেছেন সাঁওতাল প্রধান।

কানু দাঁড়িয়ে বললো,
“বাবু, উনি হলেন আমাদের প্রধান। জগত মুর্মু।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেসে বৃদ্ধের দিকে তাকালো সার্থক। এত নাটকের কি আছে শীতের রাতে। এতগুলো ঘর আছে এখানে। একটা রাতের জন্য একটা ঘর দিলে কি এমন হয়ে যাবে! বিরক্ত লাগছে তার। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে গেলো না অজ্ঞান হলো আল্লাহই জানেন।

জগত মুর্মু সান্তালী ভাষায় কি যেন বললেন কনুকে। কানু মুখটা কাঁচুমাচু করে বললো,
“বাবু, আপনারা কি সত্যিই স্বামী-স্ত্রী?”
“জ্বী।”

একবার তো বললোই। বারবার বলার কি প্রয়োজন। অদ্ভুত লোকজন। আবারো সবার মাঝে নিজেদের ভাষায় কথোপকথন চললো।

“বাবু, আপনারা যে স্বামী-স্ত্রী তার প্রমাণ আছে কি?”
“আজব তো! আমরা কি কাবিননামা নিয়ে ঘুরবো নাকি!”

রেগে গেলো সার্থক। এখানে আসাটাই উচিত হয়নি। এসব পরীক্ষার চেয়ে ভালো ছিলো জঙ্গলে রাত কাটানো।
“দয়াকরে রাগবেন না, বাবু। এমন অনেক মানুষই আছেন যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। আমরা তো না জেনে আপনাদের জায়গা দিতে পারিনা। আপনারা স্বামী-স্ত্রী নাও তো হতে পারেন।”

এসব কোলাহলে জেগে উঠলো মাহা। চোখ খুলে আলোর তীক্ষ্ণতায় আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। আস্তে আস্তে আবার চোখ মেললো। সার্থক কারো সাথে, না না কাদের সাথে ঝগড়া করছে। আশেপাশে তাকিয়ে আরো অবাক হয়ে গেলো মাহা। এটা তো জঙ্গল না লোকালয়!

“দেখেন বাবু। আপনারা তো বিবাহিত তাহলে আবার বিয়ে করতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নেই?”
“বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন? আমার কথা কি বিশ্বাস হয়না আপনাদের?”
“বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের কথা না বাবু। আমরা আপনাদের চিনিনা। এভাবে আপনাদের রাত কাটাতে দিলে আমাদের দেবতা রুষ্ট হবেন।”
“তাহলে আমাদের কি করতে হবে এখন?”
“আমাদের এখানে একজন হুজুর আছেন। আমাদের জাতির নয়। আমাদের সাথেই থাকেন। তিনি এসে আপনাদের বিয়ে পড়াবেন।”

সার্থক হা করে কথাগুলো গিললো। এতটা ফ্যাসাদে সে কখনো পড়েনি। স্তম্ভিত হয়ে কেবল একটা শব্দই শুনলো মাহা। “বিয়ে!”

শব্দটা মৌমাছির ডাকের মতো কানের চারপাশে বাজছে তার। সে ছটফট করছে নামার জন্য। বিয়ে মানে! সে কেনো অজানা, অচেনা কাউকে বিয়ে করবে!

(চলবে)…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
২২.
মাহাকে ছটফট করতে দেখে সার্থক তাকে ফিসফিসিয়ে বললো,
“প্লিজ, তুমি এমন নড়াচড়া করোনা।”
মাহার মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সে উঁচু গলায় কথা বলতে নিয়েও নিজেকে সামলালো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমাকে নামিয়ে দিন।”

মাহাকে নামিয়ে দিতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। সাথে সাথেই সার্থকের হাতটা জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থক তাকে ধরে পাশে বসিয়ে দিলো।
“আপনি কি বাবুর স্ত্রী আছেন?”

কানুর কথার কিছুই বুঝলোনা মাহা। সে অবাক হয়ে তাকালো সার্থকের দিকে। সার্থক অসহায় চোখে কিছু একটা ইশারা করছে। মাহা কিছুটা বুঝতে পেরে বললো,
“জ্বি।”

সার্থক যেন এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
“দেখুন ও যেহেতু বলে দিয়েছে নিশ্চয়ই আপনাদের আর কোনো সমস্যা নেই?”
“মাফ করবেন বাবু। আমাদের প্রধান যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার উপরে আমরা কিছুই বলতে পারবোনা।”
“মানে!”

কানু জবাব দেওয়ার আগেই দেওয়ান চলে এলেন। বয়সে হয়তো সাঁওতাল প্রধানেরও বড় হবেন। পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। ওদের একজনই তাকে আনতে গিয়েছিল। এসেই জগত মুর্মুর সাথে কুশল বিনিময় করলেন তিনি। এতগুলো পুরুষের সামনে নিজেকে অনেকটা অসহায় লাগছে মাহার। তার ওড়না কোথায় পড়েছে সে জানেনা। গাঁয়ে পানপাতা আর বেগুনি রঙের বাটিকের থ্রি-পিস উপরে সার্থকের কালো হুডিটা। যা মাহার হাঁটু ছুঁই ছুঁই । ডানপাশে একটা মাচায় বসে আছে সে পাশে ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটা। সাঁওতাল প্রধান নিজের আসনে বসলেন। দেওয়ান অপরপাশে কানুদের সাথে বসলেন। একবার তাকালেন মাহা আর সার্থকের পানে। সাঁওতাল প্রধান সান্তালী ভাষায় কিছু বলতেই বিয়ে পড়ানো শুরু করেন দেওয়ান। মাহা মাথা নিচু করে কাঁদছে। এ কেমন পরিস্থিতি!
“আপনার নাম?”
দেওয়ান সার্থকে জিজ্ঞেস করলেন।
“খন্দকার ফায়রাজ সার্থক।”
“বাবার নাম?”
“খন্দকার ফিরোজ ফারহান।”

এবার মাহাকে ইশারা করলেন তিনি। নাম জানতে চাচ্ছেন। মাহা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সার্থক কোনো জবাব দিতে পারলোনা। সে তো মেয়েটার নাম জানেনা।
“মা, আপনার নাম?”

কোনো জবাব দিলোনা মাহা। দেওয়ান জগত মুর্মুর দিকে তাকালেন। জগত মুর্মু কনুকে সান্তালী ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করতেই সে সার্থককে বললো,
“আপনার বিবি কাঁদছেন কেন? তিনি কি বিয়ে করতে চান না?”
“আসলে…

কি জবাব দিবে সার্থক! এ কেমন পরিস্থিতি!
“আমার নাম মাহা। মাহা হোসেন। বাবা আজাদ হোসেন।”

দেওয়ান এবার সার্থককে জিজ্ঞেস করলেন,
“দেনমোহর কত দেওয়া হবে?”

এবারো জবাব দিলোনা সার্থক। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। আশেপাশের সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আজ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করেনি সে। আর আজ কিনা তাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হচ্ছে! দেওয়ান নিজের মতো একটা দেনমোহর দিয়ে দিলেন। কবুল বলার সময় বুক ফেটে কান্না আসছিলো মাহার। চেনা নেই, জানা নেই একটা অজানা ছেলের সাথে সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো!
তাদের একটি মাটির ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘরটা জগত মুর্মুর বাড়িতেই। একটু আগে এসে একজন মহিলা খাবারও দিয়ে গেলেন। ঘরের এককোনায় কাঠের দরজার দিকটায় একটা মোমবাতি জ্বলছে। সারা ঘর জুড়ে কেবল ছোট একটা কাঠের চৌকি। পাশে একটা কাঠের টেবিল। সেখানে আপাতত খাবার ঢেকে রাখা। চৌকির একপাশে বসে নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদছে মাহা। সার্থক দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছটায়। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো,
“প্লিজ কাঁদবেন না।”

তুমি বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। ছোট মেয়েটার জীবনই সে নষ্ট করে দিলো। মেয়েটার হয়তো মনের মানুষও আছে।

২৩.
মাহা তার কথায় কর্ণপাত করলো কিনা কে জানে। চুপচাপ কাঁদতে কাঁদতে চৌকির একপাশে শুয়ে পড়লো।
“দেখুন আমি নিজের ইচ্ছেতে কিছুই করিনি। আসলে ব্যাপারটা যে এমন গোলমেলে হয়ে যাবে ধারণা ছিলোনা আমার। আমি যদি স্বামী-স্ত্রী পরিচয় না দিতাম তারা হয়তো আমাদের চরিত্রে আঙুল তুলতো। তাছাড়া এই শীতের রাত জঙ্গলে কাটানোর চেয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে মিথ্যা বলে তাদের কাছে যদি কোনো সাহায্য পাই। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন…

কথাটা বলতে বলতেই পিছু ফিরে তাকালো সার্থক। মাহা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো সে। গাঁয়ে তার পাতলা একটা টি-শার্ট। শীতল বাতাস বইছে চারদিকে। তবুও যেন শীত লাগছেনা তার। আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ভোর হয়ে যাবে। পায়ের কাটা স্থানটায় জ্বলছে। আবারো পিছনে ফিরে তাকালো সার্থক। মাহা অপরদিকে ফিরে শুয়ে আছে। মোমবাতির আলোয় কুঁকড়া চুলগুলো জ্বলজ্বল করছে। বড় ক্লান্ত লাগছে সার্থকের। ঘরে বসার মতো কিছুই নেই। দাঁড়িয়েও থাকতে পারছেনা। বাধ্য হয়ে ছোট চৌকিটার একপাশে গিয়ে বসলো সার্থক। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরে ঘুমের দল নেমে এসেছে। মাহার পাশেই শুয়ে পড়লো সে।

মুরগ ডাকছে দূরে। টিনের চালে শিশির পড়ার টুপটুপ মোলায়েম শব্দ। বাইরে জ্বলজ্বলে মিষ্টি রোদ। বন্য তরুলতার মাতোয়ারা ঘ্রাণ ভেসে আসছে নাকে। চোখ মেলে তাকায় মাহা। উঠে বসেই অবাক হয় সে। তার পাশে একটা ছেলে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটার ঝাঁকড়া চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। ফর্সা কপালটা কুঁচকে রেখেছে সে। যেন একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা। কি স্নিগ্ধ! কি পবিত্র! আচ্ছা? মাহা তো এতদিন জানতো ঘুমন্ত মেয়েরা সুন্দর। তবে কি সে ভুল! ঘুমন্ত ছেলেরাও অনেক সুন্দর হয়। আজ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতোনা মাহা। হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো সার্থক। চোখ দুটো হালকা লাল। ঘুম হয়তো হয়নি ঠিক মতো। মাহাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সার্থক জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবেন?”

মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো মাহা। আজ এই লোকের কারণেই একটা অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে সে। কি হতো সত্য বললে! উঠে বসে নিজেকে কিছুটা সময় দিলো সার্থক। মাহা উঠে জানালার পাশটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
“মাহা? মাহা না আপনার নাম?”

কোনো জবাব দিলোনা মাহা। সার্থক জবাব না পেয়ে বললো,
“দেখুন মাহা। গতরাতে যা ঘটেছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমাদের দুজনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ভালো হবে যদি আপনিও এটি ভুলে যান। আর আমিও।”
“আমি বাড়ি ফিরতে চাই।”

নির্লিপ্ত কন্ঠ মাহার।

২৪.
মোবাইল, ব্যাগ সবকিছু ট্রেনে ফেলে এসেছে মাহা। সার্থকের মোবাইলটা অবশ্য তার পকেটে। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক নেই। দরজায় টোকা পড়তেই খুলে দিলো মাহা। ইনি তো কালরাতের মহিলাটাই। হাসিমুখে খাবারের প্লেটের দিকে ইশারা করে নিতে বললেন তিনি। পরনে ‘ফতা’। সাঁওতাল নারীরা এমন দু টুকরো কাপড়েরই পোশাক পরেন। উপরে একটা শাল। হাতে রূপার বালা, কানে ঝুমকা। হাতে করে একটা খয়রী রঙের শালও নিয়ে এসেছেন তিনি। মাহার দিকে এগিয়ে দিলেন তা। মহিলার এতটুকু আপ্যায়নে খুবই খুশি হলো মাহা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা মনের দিক থেকে অনেক ভালো। তারা অনেকটা সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে যা বাঙালির বড়ই অভাব।
“আপনি কি একটু বাইরে যেতে পারবেন?”
“যাচ্ছি।”

কোনো প্রশ্ন না করেই বেরিয়ে গেলো সার্থক। কালো হুডিটা খুলে শালটা ভালোভাবে গাঁয়ে জড়িয়ে নিলো মাহা। হুডিটা থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। এই ঘ্রাণটা ঐ ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটার। মাহার গাঁয়েও তো লেগে আছে সে ঘ্রাণ!
“আপনার কি হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”

ভেতরে প্রবেশ করলো সার্থক। তাকে কালো হুডিটা ফিরিয়ে দিলো মাহা।
“কালকে রাতের ঘটনাটুকু বাদে অনেকটুকু সাহায্য করেছেন আমার। দয়াকরে আমাকে স্টেশন অবধি পৌঁছে দিন। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।”

কালো হুডিটার হাতের একটা দিক ছিঁড়ে গেছে। তবুও তা গাঁয়ে জড়ালো সার্থক। চেন লাগাতে লাগাতে বললো,
“আপনি খেয়ে নিন। কানুর সাথে কথা হয়েছে। এখান থেকে আধাঘন্টা হেঁটে গেলেই বাজার। বাজার থেকে লেগুনা করে স্টেশন যেতে পনেরো কি বিশ মিনিট লাগতে পারে।”
“আমি এখন কিছু খেতে চাইনা।”

অনেকটা রাগ নিয়েই কথাটা বললো মাহা। হলদে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠলো নিমিষেই। নাকটা একটু ফুলে উঠলো। কুঁকড়া চুলগুলো খোঁপা করেছে সে। এলোমেলো কয়েকটা অবাধ্য চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাহার সারা কপাল জুড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের মাহার চুলগুলোর প্রতি বড় হিংসে হচ্ছে। হচ্ছে মানে হচ্ছে! কেন হচ্ছে তার কোনো উত্তর নেই তার কাছে।

গ্রামটা সুন্দর। তবে বাড়ি ফেরার তাড়নায়, বাবা কেমন আছেন তা জানার জন্য অস্থির মাহা সেসব খেয়ালই করেনি। লেগুনা তাদের স্টেশন নামিয়ে দিয়ে গেছে। রাজধানীর ট্রেন চলে আসবে কিছুক্ষণ পরেই। একটা স্টিলের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে মাহা আর সার্থক। নিরবতা বিরাজ করছে তাদের মাঝে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে সার্থকের। একটু পানি পান করা প্রয়োজন। মাহাকে রেখে যেতেও পারছেনা। ঢাকা পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত মাহা তার দায়িত্ব। আর স্টেশনেও ট্রেন থামে কেবল মিনিট তিনেকের জন্য।
“আমি একটু পানি খাবো।”

মাহার কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকায় সার্থক। কতক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি।”

ট্রেন ততক্ষণে হুইসেল বাজাতে বাজাতে স্টেশনের দিকে ছুটে আসছে। সেদিকে খেয়াল নেই সার্থকের। যতক্ষণে স্টেশনে ফিরলো সার্থক ততক্ষণে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ। বুঝতে আর বাকি রইলোনা মাহা ইচ্ছে করেই তাকে পানি আনতে পাঠিয়েছিলো। তার সাথে ঢাকা ফিরতে চায়না সে। পানির বোতলটা হাতে নিয়েই বেঞ্চে বসে পড়লো সার্থক। বিড়বিড় করে বললো,
“আর কি তোমার সাথে আমার কখনো দেখা হবে? অলকানন্দা?”

(চলবে)……

#অলকানন্দা
#পর্ব-৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

২৫.
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে মাহা। হাতে একটা টাকাও নেই। স্টেশন মাস্টার যেন টিকিট না ধরেন তাই ট্রেন থেকে নেমে লুকিয়ে বাইরে এসেছে। মাথায় কিছুই ঢুকছেনা মাহার। কেন সে সিলেট গিয়েছিলো! এটা এক গভীর ধোঁয়াশা তার কাছে। স্টেশনের সামনে লোহার গ্রিলের ধারে দাঁড়িয়ে সে। তার মনে হচ্ছে এখানে সে এর আগেও এভাবে দাঁড়িয়েছিলো। কারো জন্য অপেক্ষা করছিলো। উফ্! আর ভাবতে পারলোনা মাহা।
“আফা, ভুট্টা নিবেন?”

নীল চ্যাকের লুঙ্গি, সাদা ময়লাটে শার্ট। গলায় গামছা আর হাতে ভুট্টার প্যাকেটের থলি। মধ্যবয়স্ক একজন লোক। মাহার মনে হচ্ছে এই লোককে তো সে আগে দেখেছে। কোথায় দেখেছে!….
হ্যাঁ। স্বপ্নে দেখেছে। একটা সরু রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটার পর এমনই একটা রেলওয়ে স্টেশন। সেখানেই তো ছিলো এই লোকটা।
“ও আফা। নিবেন নাকি?”

লোকটার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে মাহার। হকচকিয়ে সে বলে,
“না, না। নিবোনা।”

লোকটা বিরক্ত নিয়ে তাকালেন। অতঃপর বিড়বিড় করতে করতে অন্য দিকে চলে গেলেন। আশপাশে অনেক মানুষজন। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে তার বাবাকে। মাহাদের বাড়ি হাজারীবাগ। কুলাল মহল জামে মসজিদের পাশে। বাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি নিবে? নাকি মেডিকেলে যাওয়ার জন্য? বাবা কোন ওয়ার্ডে আছেন তাও তো জানেনা সে। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে শরীরও নেতিয়ে পড়েছে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে মাহা। রেলস্টেশনের বাইরে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। চিরচেনা শহরটাকেও অচেনা লাগছে তার। এতটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে মাহা কখনো ভুগেনি। সবাই বলে সে বুদ্ধিমতী। সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। আজ কি তবে তার মাথায় জ্যাম ধরেছে!
“মাহা?”

নিজের নাম শুনে পিছনে ফিরে মাহা। ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এএসপি রেজওয়ান। চোখে কালো সানগ্লাস। রোদে ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে।
“রেজওয়ান ভাইয়া!”

মাহার দিকে এগিয়ে এলো রেজওয়ান। ঘামে একাকার অবস্থা তার। যদিও শীতল বাতাস বইছে চারদিকে।
“তোমাকে সেই সকাল থেকে স্টেশনে খুঁজে যাচ্ছি আমি। সারারাত তোমার মোবাইল বন্ধ ছিলো কেন?”
“আসলে আমাদের ট্রেনে ডাকাত হামলা করেছিলো। পরে….

তখনই ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। মাহা চুপ করে গেলো নিমিষে। কপাল একটু কুঁচকিয়ে ফোনটা ধরে রেজওয়ান। কথা বলার সময় চোখমুখ শক্ত হয়ে যায় তার। ফোনটা রেখে দিয়ে পকেট থেকে রুমালটা বের করে সে। কপালের দুপাশের ঘাম মুছে। মাহা রেজওয়ানের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি সিলেট-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেনে আসছিলে না, মাহা?”
“হুম।”

রেজওয়ানের মুখে বিস্ময়। আটাশবছর বয়সী এএসপি রেজওয়ান কি মনে মনে একটু ভয় পেলেন? আবার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে একটা ছোট স্বস্তির নিঃশ্বাস কি বেরিয়ে এলো তার!
“আচ্ছা, চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। গাড়িতে উঠে বসো।”
“রেজওয়ান ভাইয়া? বাবা কেমন আছেন?”
“আংকেল, ভালো আছেন। বিপি হাই হয়ে গিয়েছিলো। এখন তোমাদের বাড়িতেই নিয়ে আসা হয়েছে।”

রেজওয়ানের পিছন পিছন গিয়ে গাড়িতে বসলো মাহা। স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার সময় বুকটা চিনচিন ব্যথা করেছে তার। কালো হুডি পরা ঝাঁকড়া চুলের, কালো মণির ছেলেটাকে মিথ্যা বলে ঢাকা পালিয়ে এসেছে সে। ছেলেটা কি করছে এখন! আর কি কখনো দেখা হবে তাদের!
“মাহা?”
“হুম।”
“আমি বিকেলে তোমাদের বাসায় একবার যাবো। আমাকে একটু খুলে বলবে গতকাল কি কি হয়েছিল ট্রেনে। আর তুমি কি করে ফিরলে ঢাকা।”
“আপনি চাইলে আমি এখনই বলতে পারি ভাইয়া।”
“না, এখন তুমি ক্লান্ত। বাসায় যাও। রেস্ট করো।”

মাহা মাথা নিচু করে রাখলো।

২৬.
রেজওয়ানকে সে ছোট থেকে চিনে। অনেকটা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মানুষ। মাহার খুবই পছন্দ এই লোকটাকে। বড় ভাইয়ের মতো প্রতিটা সময় মাহার পাশে আছে রেজওয়ান। রেজওয়ান মোবাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে মাহার হলদে ফর্সা মুখটা, লাল হয়ে যাওয়া নাকটা দেখছে। কতদিন পর দেখলো এই প্রিয় মুখ। মাসে একবারো দেখা পাওয়া যায়না। প্রতিদিন কি একনজর দেখার জন্য সাভার ছুটে যাওয়া সম্ভব! মেয়েটা কেন বুঝেনা!

“রেজওয়ান ভাইয়া?”
“কিছু বলবে মাহা?”

মাহার আকস্মিক ডাকে থতমত খেলেও নিজেকে সামলে নিলো রেজওয়ান।

“চৈতির কোনো খবর পাওয়া গেছে?”
“এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।”
“আমার খুবই টেনশন হচ্ছে। ও কোথায় গেলো!”
“চিন্তা করোনা তুমি। সিলেট পুলিশ কাজ করছে।”

বাইরে রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয় মাহা। কত মানুষ! কত ব্যস্ততা তাদের! কেবল বাবার জন্যই বাড়িতে যাচ্ছে মাহা। নয়তো সে যেতোনা। এই পৃথিবীতে যার মা নেই তার কেউই নেই। সৎ মানুষ কখনো আপন হয়না। কথাটা হাড়ে হাড়ে বুঝে মাহা। বাবাও বদলে গেছেন। খরচ দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ। একটু ভালোবাসা, একটু স্নেহের কাঙাল যে মাহা।

মাঝারি আকৃতির বিল্ডিংয়ের সারি। মাহাদের বাড়ি মেইন রোড থেকে ভিতরে। পুলিশ গাড়িটা ঢুকবেনা সেখানে। গাড়িটা থামতেই মাহা নেমে গেলো গাড়ি থেকে। রেজওয়ানকে কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো সে। মাহা গাড়ির পাশটায় দাঁড়িয়ে।
“চলো। তোমাকে বাসায় এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“আচ্ছা।”

মাহা, রেজওয়ান পাশাপাশি হাঁটছে। দুইপাশে গাদাগাদি করে বিল্ডিংয়ের সারি। মাঝে পাকা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরেই হাঁটছে তারা। রেজওয়ানের বাড়ি থেকে মাহাদের বাড়ির পথ দশ মিনিটের। পথিমধ্যেই পড়ে। বাড়ি অতিক্রম করার সময় রেজওয়ান বললো,
“মা, তোমাকে দেখতে চেয়েছিলেন।”

রেজওয়ানের কথায় তার দিকে মুখ তুলে চায় মাহা। আবার মাথাটা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সে বললো,
“কালকে আন্টির সাথে দেখা করে আসবো।”

আর কোনো কথা নেই। সকাল প্রায় দশটা বাজে। রাস্তার পাশে দুয়েকটা দোকান খুলেছে। দুয়েকজন মানুষের আনাগোনা। পাঁচতলা বিল্ডিংটার সামনে আসতেই দুজনেই থামলো।
“মাহা, তোমাকে কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”
“জ্বি।”
“চৈতির মিসিংয়ের ব্যাপারটা একটা ধোঁয়াশা। তারউপর কালরাতের ট্রেনের ঝামেলা। তোমাকে জিজ্ঞেসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে পুলিশ স্টেশনে। তুমি ভয় পাবেনা। আমি আছি। যা সত্য তাই বলবে। আমি এখন একটা কাজে যাবো। এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেও। আমি বিকেলে আসলে ঠান্ডা মাথায় সব বলবে।”
“ভাইয়া, বাবাকে কিছু বলবেন না দয়াকরে। আমি যতটুকু জানি বলার চেষ্টা করবো।”
মাহার কাতর কন্ঠ।
“তুমি টেনশন করোনা। আংকেল কিছুই জানবেন না।”
“আপনিও বাসায় চলেন?”
“ঐ যে বললাম জরুরী কাজ আছে। এখন যাওয়া সম্ভব না। আসি তাহলে।”
“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ, ভাইয়া।”

রেজওয়ান ফিরতি পথে হাঁটা দিয়েছে। বুকটা অসম্ভব কাঁপছে তার। তার মাহাপরী যে বড্ড সুন্দরী! ভয়ার্ত হলদে ফর্সা মুখটায় ঠান্ডা বাতাসে তিরতির করে কাঁপা লাল টকটকে নাক। কুঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা কপালময়। চোখটায় কি যে মায়া!

মাহা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। মাহাদের নিজেদের বাড়ি। তারা থাকে চারতলার ডানপাশে। মাহা আর রেজওয়ান কি জানে? চারতলার বামপাশের বারান্দা থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। বিশেষ করে রেজওয়ানের দিকে!

২৭.
কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুললেন দিনা হোসেন। মাহাকে দেখে কপাল কুঁচকালেন তিনি। মাহা মলিন হাসলো। তা দেখেও যেন না দেখার ভান করলেন তিনি। কিছু বললোনা মাহা। সব সয়ে গেছে তার। চারবছর বয়সে মাকে হারিয়ে অনেকটা অনাদরেই বড় হয়েছে সে। ড্রইংরুমের উত্তর দিকে রাখা ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে মাহার সৎ ভাই মাহিন। মাহার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। অপরপাশে দিয়া। মাহার সৎবোন। বয়স দশ বছর। দিনার মা আমিনা এখানেই থাকেন। তিনিও বসে খাচ্ছিলেন।
“আপু, কেমন আছো?”

মাহিন জিজ্ঞেস করতেই তাকে বিকট সুরে একটা ধমক দিলেন দিনা।
“চুপ! খাবারের সময় কিসের কথা। চুপচাপ খাও।”

মায়ের এমন ধমক খেয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলোনা মাহিন। দিয়া এমনতেও মাহাকে পছন্দ করেনা। আমিনাও চুপচাপ খাচ্ছেন।

মাহা কাউকে কিছু না বলেই বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এদের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই তার নেই।
“দেখছো মা। কি তেজ! একটা কথাও না বলে চলে গেলো!”
“তোর জামাই আহ্লাদে মাথায় তুলছে। দামরা মাইয়া এটারে নাকি পড়াতে হইবো। বিয়ার বয়স শেষ। কেডা করবো বিয়া?”
“উনি আমার কথা শুনেন। মাস শেষে কতগুলা টাকা দেন একাউন্টে। ছেলে মেয়ে দুইটা বড় হইতাছে সেই খেয়াল নাই। উনি আছেন মাহা মা নিয়া। কই দুইদিন ধইরা হসপিটালে। গাঁধার মতোন তো আমিই খাটলাম। আজ আইলো উনার মা!”

মাহা সবই শুনেছে। জবাব দেওয়ার ইচ্ছা জাগলেও জবাব দিলোনা সে। শরীর ক্লান্ত, মন ক্লান্ত। বাবার সাথে আগে দেখা করা প্রয়োজন। গত কয়েকটা দিন ধরে কি পরিমাণ ঝড় তার উপরে বয়ে যাচ্ছে সেই কেবল জানে! আজ যদি মা বেঁচে থাকতো!

__________________

চিরচেনা শহরে পা রেখেই মনটা একটু ভালো হলো সার্থকের। বিশ্বের সবচেয়ে অযোগ্য শহরের মাঝে ঢাকা নাকি একটি। এই অযোগ্য স্থানটাই যে সার্থকের প্রিয়। ভিষণ প্রিয়। তার খয়েরী টয়োটা এলিয়ন গাড়িটা রাস্তা দিয়ে চলছে আপনগতিতে। গুলশান আবাসিক এলাকার দিকে গন্তব্য। মাথাটা পিছনে হেলান দিয়ে বসেছে সার্থক। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসা মুইংচিন। চাইনিজ নাগরিক। কানাডায় সার্থকের সেক্রেটারি ছিল। দেশে আসার সময়ও সাথে এসেছে সে। মুইংচিন পয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তাকে দেখলে মনে হয় তার বয়স কেবল বিশ। সার্থক কে পিছনে মাথা হেলিয়ে বসে থাকতে দেখে মুইংচিন বলে,
“সাতক। টুমি কি অনেক টায়ার্ড?”
“হুম।”

গম্ভীর শোনায় সার্থকের গলা। মুইংচিন কিছু না বলেই সামনে ফিরে যায়। সার্থক এমনিতে খুবই হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ংকর। অনেক কষ্ট করেও কন্ট্রোল করা যায়না। সার্থকের রাগের প্রথম ধাপ গুরুগম্ভীর ভাব। দ্বিতীয় ধাপ বড় ভয়ংকর! রেগে সব তছনছ করে দেয় সার্থক। মুইংচিন শান ধর্মাবলম্বী। মাৎসু দেবীর পূজারি সে। মনে মনে দেবীর কাছে সার্থকের জন্য প্রার্থনা করে সে। এতো বছর ধরে ছেলেটার সাথে পরিচয়। বাবা-মা হীন সার্থকের জন্য বড়ই মায়া হয় তার।

(চলবে)…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-১০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
২৮.
“বাবা।”

আজাদ হোসেন শুয়ে আছেন খাটে। শরীরটা নেতিয়ে আছে তার। শুকিয়ে রোগা হয়ে গিয়েছেন অনেকটা। মাহা বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো। একদম শিয়রের কাছে। ডান হাতটা মাথায় বুলিয়ে আস্তে করে ডাকলো,
“বাবা?”

চোখ খুলে তাকালেন আজাদ সাহেব। মলিন হাসি দিয়ে মেয়ের মুখটা ছুঁলেন। চোখ ভিজে উঠলো তার। মেয়েটার যে এই পৃথিবীতে তাকে ছাড়া আর কেউ নেই।
“মাহা মা।”

ভিজে উঠা সিক্ত গলায় নিজের নাম শুনে ; অশ্রুর দলকে থামাতে ব্যর্থ হয় মাহা।
“বাবা”

বলেই কেঁদে দেয় সে। এই পৃথিবীতে সে যে বড্ড একা। কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দেন আজাদ সাহেব।
“মা না আমার। কাঁদেনা মা।”
ছেঁচকি তুলতে তুলতে মাহা বলে,
“আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে! বাবা।”

আজাদ সাহেব একটু উঠে মেয়ের কপালে চুমু খান। আরো ফুঁপিয়ে উঠে মাহা।
“আহ্লাদ শেষ হইলে ঔষুধ খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।”

দরজায় দাঁড়িয়ে খেঁকিয়ে উঠেন দিনা। মাহাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেন আজাদ সাহেব। চোখটা হালকা বুজে গম্ভীর গলায় বলেন,
“মাহা, তুমি অনেক জার্নি করে এসেছো। যাও রেস্ট করো।”

মাহা কিছু না বলেই বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার ঘরটা এখন মাহিনের। বারান্দার পাশে ছোট একটা স্টোর রুম ছিলো। সেখানে তার জিনিসপত্র রেখে দিয়েছিলেন দিনা। একটা চৌকি পেতে রাখা। মাঝে মাঝে বাসায় আসলে এই ছোট ঘরটাতেই সবটা সময় কাটে মাহার। কি অদ্ভুত! এই যে তার হাতে ব্যাগ নেই, মোবাইল নেই। একবার তো কেউ জিজ্ঞেস করলোনা এসব কোথায়! একবারও কেউ জানতে চাইলোনা তার কেন আসতে দেরি হলো! এমনকি বাবাও না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহা। এই পৃথিবীর এতিম সন্তানগুলোই কেবল বুঝে মা আসলে কি। ড্রয়িং রুমের বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে পুরনো একটা জামা গাঁয়ে দিয়ে চৌকিতে শুয়ে পড়ে মাহা। শরীর ক্লান্ত, মন ক্লান্ত, মস্তিষ্ক ক্লান্ত।

________________

একটা বিশাল বড় মাঠ। চারদিকে ঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের পাশেই নদী। মাহা একটা সাদা শাড়ি পরেছে। একেবারে ধবধবে সাদা শাড়ি। তার কুঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা সারা পিঠময়। মিঠা রোদে ঝলমল করছে তার চুলগুলো। মাঠের দুপাশে সাদা ফুলের বাগান। মাহা মুগ্ধ নয়নে চারপাশ দেখছে। হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এলো মাহার কানে। মাহা হন্তদন্ত হয়ে তাকাচ্ছে চারপাশে। কার আওয়াজ। এতোটা করুণ! কার আর্তনাদ! আবার আওয়াজটা ভেসে এলো কানে। মাহার নাম ধরেই তো চিৎকার করছে। মাহা ছুটে যাচ্ছে শব্দের উৎসের দিকে। একটা বিস্তৃত নদী। নদীর মাঝামাঝি একটা মেয়ে। পানিতে ডুবে যাচ্ছে সে। পরনে নীল শাড়ি। মাহাকে দেখে চিৎকার করলো,
“মাহা, মাহারে। বাঁচা। আমাকে বাঁচা। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। শরীরটা ভিষণ জ্বলছে আমার।”

এটা তো চৈতি! তার প্রিয় বান্ধবী আতিয়া জামান চৈতি! মাহা লাফ দিলো নদীতে। সে তো সাঁতার জানেনা! তবুও ভাসছে কিভাবে! কাছাকাছি যেতেই নদীর গহীনে তলিয়ে গেলো চৈতি। মাহা সেখানে পৌঁছাতে পারলোনা। তার আগেই তার মুখ চেপে ধরলো একজোড়া কালো হাত। টেনে নিয়ে গেলো নিজের সাথে। ঘাড়ে একটা বিষ পিঁপড়ে কামড়ানোর মতো ব্যথা পেলো মাহা। ভিষণ জ্বলছে ঘাড়টা ভিষণ। কালো হাতদুটোতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো মাহা। নদীতেই ভেসে বেড়াতে লাগলো উদভ্রান্তের মতো। হঠাৎ….

হঠাৎ নৌকা নিয়ে এগিয়ে আসছে এক যুবক। সাদা পাঞ্জাবি পরনে ফর্সা মতন লোকটা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। অদ্ভুত কালো চোখের মণি। কি মায়াময় তার চেহারা। নৌকাটা ভরা হলুদ রঙা ফুলে। কি সুন্দর ফুল! চোখ ধাঁধিয়ে, মন নাড়িয়ে দেওয়া সৌন্দর্য।

২৯.
এই মায়াবী পুরুষটাকে তো মাহা চিনে। ফায়রাজ সার্থক। গুরুগম্ভীর যার কন্ঠস্বর। এই সুরটাও তো মাহা চিনে। খুব করে চিনে। মাহার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক অভূতপূর্ব হাসি। মনের সুখে নিজেকে বিলিয়ে দিলো নদীর ঝলমলে পানিতে। এবার তো ডুবে গেলেও তার শান্তি। উঁহু, না তো। মাহা ডুবলো নাতো। একজোড়া বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে নিলো বুকে। একেবারে বুকের মাঝে। ফিসফিসিয়ে বললো,

“তোমার মরণ হওয়ার আগে আমার মরণ হোক। এই বুকটা ঝাঁঝড়া করে দিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারবেনা। আমার বুকটাকে শেষ করতে পারলেই তুমি ছাড়া পাবে, অলকানন্দা।”

অতঃপর নৌকাটা চলতে লাগলো। দূর-দূরান্তে। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটার বুকে মাথা দিয়েই আবারো চোখ বুজলো মাহা। এই তো তার স্থান। পরম সুখের স্থান। এই স্থানে মরলেও মাহার কোনো দুঃখ নেই।

“আপু, আপু। এই মাহা আপু?”

ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাহা। কোথায় সে। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মাহা। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে। মাহিন খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিকন গড়ন। মুখে কৈশোরের ছাঁপ। মাহাকে হতভম্ব হয়ে চারপাশ তাকাতে দেখে মাহিন জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি ঠিক আছো?”
“হুম।”
“মা, খাবারটা পাঠালেন। তুমি খেয়ে নাও।”

বলে চৌকিতে খাবার রাখলো মাহিন। তার আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। মাহা আপুকে অনেক ভালোলাগে তার। কতটা আদর করে তাকে। মায়ের ভয়ে কথা বাড়ায়নি মাহিন। চুপচাপ বেরিয়ে এলো। মাহার একদম খেতে ইচ্ছে করছেনা। তবুও হাত ধুঁয়ে কয়েক লোকমা ভাত খেলো। মাথাটা বড্ড ধরেছে। কফি প্রয়োজন। হলে থাকলে হয়তো নিজেই বানিয়ে খেতো। নিজের বাড়িতেও যেন শ’খানেক বাঁধা তার। কালো রঙের ওড়নাটা মাথায় দিয়ে ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে এলো মাহা। দুপুর গড়িয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে সে। ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছেন দিনার মা। দিনা সোফায় বসে দিয়ার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। মাহাকে দেখে মুখ বাঁকালেন দিনার মা। মাহা দেখেও না দেখার ভান করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

ছাদে যাওয়া প্রয়োজন।

৩০.

বামপাশের ফ্ল্যাটে থাকে দিনার বড় ভাইয়ের পরিবার। মাহা সিঁড়ি দিয়ে উঠবে এমন সময় তাকে পিছু ডাকলো এশা। দিনার ভাইঝি।
“আরে মাহা আপু যে! কেমন আছো?”

মলিন হাসলো মাহা। হাসি মুখে জবাব দিলো,
“হুম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো।”
“ছাদে যাচ্ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“যাক ভালোই হলো। চলো আমিও যাবো।”

মাহা না করতে পারলোনা। তার একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে। একা শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। এশা মাহার চেয়ে লম্বা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এবার প্রথম বর্ষে পড়ছে। শ্যামলা গাঁয়ের রঙ। মায়বী চেহারা। করুনাময় কখনো কাউকে অসুন্দর করে পৃথিবীতে পাঠান না। তারই দৃষ্টান্ত এশা। দীঘল কালো হাঁটু ছাড়িয়ে চুল তার। মায়াময় চেহারার দিকে একবার কেউ তাকালে দ্বিতীয়বার তাকাতে বাধ্য। হালকা শীত পড়েছে। শীতল মিষ্টি হাওয়া বইছে চারদিকে। ছাদের এককোনায় পেতে রাখা দোলনায় দোল খাচ্ছে মাহা। এশা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কথায় কথায় এশা বললো,

“আপু? খবরে দেখালো সিলেট থেকে আসার পথে ট্রেনে নাকি ডাকাতের দল হামলা করেছিল। পাঁচজন মেয়ে নিখোঁজ। দুইজনকে মেরে ফেলেছে। যাত্রীদের সকল টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে ডাকাতের দল।”

এশার কথায় চমকে তার দিকে তাকালো মাহা। নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
“ভয়াবহ ব্যাপার!”
“আর বলতে। আমার তো মেয়েগুলোর জন্য কষ্ট হচ্ছে আপু। নির্ঘাত তাদের শয্যাসঙ্গী করার জন্য নিয়ে গেছে। যুবতী মেয়েগুলোকে বেছে বেছে ধরে নিয়েছে। ”

মাহা জবাব দিলোনা। আজ হয়তো সেও সেই মেয়েদের দলে থাকতো। যদি না সার্থক তাকে সাহায্য করতো! আচ্ছা, এভাবে না বলে চলে আসাটা কি ঠিক হয়েছে মাহার!
“মাহা?”

রেজওয়ান এসেছে। ইউনিফর্ম নেই গাঁয়ে। একটা সাদা টি-শার্ট আর কালো টাউজার পরনে। পকেটে হাত গুঁজে রাখা। এশা মাথা নিচু করে নিলো। তার শ্যামলা চেহারায় লজ্জার আভা। রেজওয়ানকে দেখে উঠে দাঁড়ালো মাহা। রেজওয়ান এগিয়ে এসেছে মাহার দিকে।
“তোমাদের বাসায় গেলাম। আন্টি বললো তুমি ছাদে। তাই ছাদে এলাম।”

অতঃপর সে তাকালো এশার পানে। কপাল কুঁচকে বিরক্তির সুরে আবার বললো,
“তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে মাহা।”
“জ্বি, বলুন ভাইয়া।”

পরে মাহার মনে পড়লো এখানে এশা উপস্থিত। ওর সামনে তো সব কথা খুলে বলতে পারবেনা। এশা তখনও দাঁড়িয়ে। মাহা কিভাবে এশাকে চলে যেতে বলবে বুঝতে পারছেনা। রেজওয়ানই বললো,
“তুমি একটু বাসা থেকে ঘুরে এসো এশা। আমার কিছু জরুরি কথা আছে মাহার সাথে।”

এশা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো। তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কি? তার মনটা বারেবারে বলে উঠলো কি ‘আপনি অনেক খারাপ’?

ছাদের দক্ষিণ দিকে বেতের চেয়ার সাজিয়ে রাখা। সেখানে পাশাপাশি বসলো তারা। কিছু্ক্ষণ নিরবতা।
“চৈতির ব্যাপারটা আমাকে একটু খুলে বলোতো মাহা।”
_________________

গুলশানের এক বহুতল বিল্ডিং। দুইতালা আর তিনতালা মিলিয়ে ডুপ্লেক্স বাসাটা সার্থকের। রাজকীয়ভাবে সাজানো সবটা। এখন সব তছনছ। ড্রয়িং রুমের সবগুলো শো-পিছ ভাঙা। নিজের ঘরে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে আছে সার্থক। সার্থকের বন্ধু লুবান, সেক্রেটারি মুইংচিন আর বোন নিভা, বোন জামাই রবার্ট। সবার মুখই চিন্তিত। সার্থক এতো রেগে আছে কেন!

“আমাকে তুমি কষ্ট দিলে অলকানন্দা!”

ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করলো সার্থক। মেয়েটার কতবড় সাহস! সার্থক কে মিথ্যা বলে! এই ফায়রাজ সার্থক কে! ঘুমের ঘোরেই মাথার দুপাশের শিরা দুটো ফুলে উঠে সার্থকের।

(চলবে)

#অলকানন্দা
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১১

৩০.
“আগামীকাল আমার পরীক্ষা। আগেরদিন খুব টেনশন নিয়ে ঘুমুতে গিয়েছিলাম। রুমানা কে তো চিনেন ভাইয়া?”
“হুম।”
“রুমানার ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা পিচঢালা রাস্তায়। সেই সাথে কিছু অচেনা মুখ। রুমানার মুখে শুনলাম আমি নাকি সিলেট বেড়াতে এসেছি। চৈতির সাথে। রুমানাও ট্রেনে আমাদের সাথে এসেছিলো। দেরি হওয়ায় ও অন্য বগিতে ছিল। বিশ্বাস করুন ভাইয়া আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না!”
“স্ট্রেঞ্জ!”
চিন্তিত দেখালো রেজওয়ানের মুখ। মাহা একজন মেধাবী মেয়ে। সব সময়ই ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে জানে। ওকে এই প্রথম এতটা বিচলিত হতে দেখলো রেজওয়ান। ও যতটুকু জানতো ছুটিতে চৈতির সাথে সিলেট গিয়েছিলো মাহা। মায়ের মুখে শুনেছিলো সে। কা কা করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো এক ঝাঁক দাঁড়কাক। রেজওয়ান সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তারপর?”
“যতক্ষণে বুঝলাম সেটা রুমানাদের বাসা ততক্ষণে জানতে পারলাম চৈতি নিখোঁজ। এত রাতে কোথায় গেলো কেউ বলতে পারছিলো না। মেইনগেটে তালা ছিলো। তারপরই সকালে আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম ভাইয়া।”

৩১.
বলেই মাথা নিচু করলো মাহা। পরেরটুকু জানা আছে রেজওয়ানের। মাহার ফোন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে গিয়েছিলো তার অবাধ্য হৃদপিণ্ড। যখন প্রাণপাখিটার কাঁপা কাঁপা ভীতু স্বরের, সিক্ত গলায় ভিজা আওয়াজটা শুনলো! অবাধ্য হৃদয়ের কম্পন বন্ধ হবার উপক্রম প্রায়। রুদ্ধশ্বাসে কেবল বেরিয়ে এসেছিলো একটা বাক্য।
“আমি আছি তো, মাহা।”

কল্পনার ভাসমান জগৎ থেকে বেরিয়ে রেজওয়ান প্রশ্ন করলো,
“গতকাল কি ঘটেছিলো?”
“তখন বোধহয় সন্ধ্যা। হঠাৎ ট্রেন থেমে গেলো। দুইপাশে ঘন জঙ্গল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কেন কি হলো! গুঞ্জন ভেসে এলো ডাকাত, ডাকাত। আমার সাথে একজন ছিলেন তিনি ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে গেলেন। আমিও তার পিছুপিছু ছুটলাম। ততক্ষণে চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। তার সাথে জঙ্গলের দিকে দৌড় শুরু করলাম এলোমেলোভাবে। সামনে একটা সাঁওতাল বসতি। সেখানে রাত কাটিয়ে ভোরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ট্রেনে করে।”

সার্থকের কথাটা ইচ্ছে করেই বলেনি মাহা। বলতে ইচ্ছে করছেনা। যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ঘটেছিলো সেটা ভুলে যাবে সে। একদম ভুলে যাবে। ঘাড়ে চিনচিন ব্যথাটা বেড়েছে আবার। ডান হাতটা উঠিয়ে ঘাড়ে হালকা ম্যাসেজ করলো মাহা। ব্যথাটা হঠাৎ হঠাৎ হয়। আস্তে আস্তে মাথায় ছড়িয়ে পড়ে।
“তুমি ঠিক আছো? মাহা।”

ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিলো মাহা। মলিন হেসে বললো,
“আমি ঠিক আছি।”

রেজওয়ানের খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করতে,
‘তিনি টা কি কোনো ছেলে ছিলো?’

মুখে চলে আসলেও নিজেকে সংযত করলো রেজওয়ান। নিরবতা। ঢাকার বিকেলগুলো অবশ্য নিরব হয়না। দূর থেকে বাস, ট্রাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। হিম শীতল হাওয়া বইছে। মাথার উপরে দাঁড় কাকের দল উড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকটায় কাকের আনাগোনা আজকাল বাড়লো কিনা!

“রুমানা ঢাকা আসবে কবে?”
“ওর মা অসুস্থ। বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরবে।”
“সিলেট পুলিশ তোমাদের সবাইকেই তো জিজ্ঞেসাবাদ করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“রুমানার সাথে আমার একবার কথা বলা প্রয়োজন মাহা। তুমি আমার পরিচিত তাই এই কেসটায় আমি ইনভলভ হচ্ছি। নয়তো এটা সিলেট পুলিশের অধীনে। যতক্ষণ না পর্যন্ত চৈতির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কেসটায় আমি সরাসরি কিংবা অফিশিয়ালি ইনভলভ হতে পারবোনা। তবে ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ইনভেস্টিগেট করবো। নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।”

৩২.
“মাহা?”

রেজওয়ানের মুখপানে তাকালো মাহা। হলদে ফর্সা মুখটা, ভারী নেত্রপল্লব, কুঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারামুখে। মাথায় কালো ওড়না দেওয়া। এমন বিষণ্ণতায়ও কি মায়াবী লাগছে প্রাণপাখিটাকে! ধক করে রেজওয়ানের বুকটা। বেসামাল নিজেকে সামলাতে বারকয়েক শুকনো গলায় কাশলো সে। তখনই বিচলিত দেখালো মাহার মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পানি খাবেন, ভাইয়া?”
“না, না। আজ আমি উঠি।”

বলেই দাঁড়িয়ে গেলো রেজওয়ান। ডানহাতটা গুঁজে দিলো পকেটে।
“ভাইয়া, চৈতিকে ফেরত পাবো তো? ওর বাবা অসুস্থ মানুষ। মুন্সিগঞ্জে ওর ফুফুর বাসায় থাকেন। নিজে চলাফেরা করতে পারেন না। ওর ফুফুর সাথেও তো ওর সম্পর্ক ভালো না। ওর ফুফু চেয়েছিলেন ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে। মেয়েটা কতটা যুদ্ধ করে এতটুকু এসেছে আমি দেখেছি ভাইয়া। ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।”

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো মাহা। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মাহার কান্না যে সহ্য হয়না রেজওয়ানের!
“প্লিজ মাহা। তুমি কেঁদোনা। আমি আছি তো। আমার সর্বাত্মক চেষ্টা আমি করবো।”

বলেই ছাদ থেকে গটগট শব্দ তুলে প্রস্থান করলো রেজওয়ান। বুকটায় জ্বালা করছে ভিষণ!

____________________

অন্ধকারে ছেয়ে গেছে ধরা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের মাঝে যেন নিজের জীবনটা খুঁজে পায় মাহা। তার ভালোবাসার মানুষগুলো সবসময় তার থেকে দূরে সরে যায়। বুঝ হওয়ার আগেই মা চলে গেলেন। বাবা ছিলো আপন। সেই বাবাও পর হয়ে গেলো। চৈতি মেয়েটা ছিলো মাহার অসুন্দর, এলোমেলো জীবনের আলোর দিশা। এক ফোঁটা হাসতো না মাহা। সেই মাহাকে খিলখিল হাসি শিখিয়েছে চৈতি। পরিচয়টা আড়াই বছরেরও কম। সেই তো কিছুদিন আগে এডমিশন কোচিংয়ে লম্বা মতন মেয়েটাকে দেখে অহংকারী ভেবেছিলো সে। মেয়েটা যখন ঘুষি মেরে মিনহাজের নাক ফাটিয়ে দিলো তখন তো রীতিমতো তাকে ভয় পেতো মাহা। ঠান্ডা স্বভাবের, নিরবে বসে থাকা মাহা কিনা বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলো বাচাল, স্বাধীনতাপ্রেমী চৈতির! দুজন তো চান্সও পেলো একজায়গায়। সমাজবিজ্ঞান অনুষদে সবাই ভিষণ অবাক হতো তাদের বন্ধুত্ব দেখে। সবার মনে বোধহয় একটাই প্রশ্ন,
“তেলে জলেও মিশ খায়?”

এই চৈতির জন্য মাহা কত কথা শুনেছে দিনার। সবকিছু ছাপিয়ে ছিলো তাদের বন্ধুত্ব। সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুটা আজ চারদিন ধরে নিখোঁজ। আর মাহা কিছুই করতে পারছেনা! কিছুই না! দেয়ালে হেলান দিয়ে নিচে বসে পড়লো মাহা।
“আমার জীবনের প্রিয় মানুষগুলোই কেন হারিয়ে যায়, আল্লাহ? আমার জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন?”

আবারো চোখে নেমে এলো জল। ঠান্ডা কপোলে উষ্ণ জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই জল মুছিয়ে দিতে কেউ কি আসবে?

৩৩.
“হ্যালো, আংকেল?”
“আমি তোমার দিনা আন্টি।”
“আন্টি একটু মাহাকে দেন। ইমার্জেন্সি।”

আজাদ সাহেবের ফোনে হঠাৎই সকালে ফোন এসেছে রেজওয়ানের। মাহা কে চাচ্ছিলো সে। দিনা মুখ বাঁকিয়ে প্রায় মোবাইলটা ছুড়ে দিলেন মাহার পানে। মনটা এমনিতেই খারাপ মাহার। সে সাথে মাথাব্যথা। রেজওয়ান অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“হ্যালো, মাহা?”
“জ্বি।”
“একটা খারাপ সংবাদ আছে।”

কি খারাপ সংবাদ! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মাহার। মাহা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি…কি খারাপ সংবাদ?”
“গতকাল বিকালে সিলেট আগুন পাহাড় থেকে একটা ছিন্ন পা পাওয়া গেছে। সেটা আজ ঢাকা মর্গে পৌঁছেছে। তুমি কি একবার এসে শনাক্ত করে যাবে? আরো কিছু জিনিসপত্রও পাশে পাওয়া গেছে।”

বিদ্যুৎ চমকানোর ন্যায় শব্দ হচ্ছে মাহার আশেপাশে। শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে। বোকা মন বারেবারে বুঝ দিচ্ছে। উঁহু, ঐটা চৈতি নয়। ঐটা চৈতি হতেই পারেনা! মস্তিষ্ক মানছেনা। সে যে যুক্তিতে বিশ্বাসী। আবেগ তার বড্ড অপ্রিয়।

“হ্যালো, মাহা। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? আমিই আসতাম তোমাকে নিতে। এখানে এখন আমাকে থাকতে হবে। তুমি চলে এসো।”
“আমি আসছি ভাইয়া।”

যে পোশাক পরনে ছিল তা পরেই রওনা দিলো মাহা। ড্রয়িং রুমে টিভিতে সংবাদ দেখাচ্ছে,
“২০১২ সালের ন্যায় খুন আবারো। প্রায় পাঁচ বছর পর একই রকম শরীরবিহীন পা উদ্ধার করলো সিলেট পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের আগুন পাহাড়ে। গতকাল বিকেলে একজন স্থানীয় উপজাতি সর্বপ্রথম বিষয়টি অবগত করেন সিলেট পুলিশকে। পা টি নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকা মর্গে। কার শরীরের অংশ তা এখনো জানা যায়নি। পুলিশ এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আমাদের সাথে যুক্ত হচ্ছেন……

খবর শোনার সময় এখন নয়। দৌড়ে নিচে নেমে একটা রিকশা নিলো মাহা।

রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই বুকটা কেঁপে উঠছে মাহার। এই শীতেও তরতর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে তার কপালের দুপাশ দিয়ে। ওড়না দিয়ে কপাল মুছলো সে। একটাবারের জন্যও চৈতির ফুফু কোনো খোঁজ নেন নি। সেই যে মাহা একবার জানিয়েছিলো সিলেট থাকতে ফোন দিয়ে। এরপর আর কোনো খবর তিনি নেন নি। দায়সারা উত্তর ছিলো তার,
“কোনো ব্যাটার সাথে ভাগছে মনে হয়।”

জ্যামে আটকে গেলো রিকশা। ভিষণ বিরক্ত লাগছে মাহার। ঢাকার জ্যামকে মাহা মন থেকে ঘৃণা করে।

গাড়ি করে হসপিটাল যাচ্ছে সার্থক। জ্যামে বসে থেকে গাড়ির জানালা খুলে দেয় সে। পাশে তাকিয়েই চমকে উঠে প্রথমে। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে আবার তাকায় সেদিকপানে। হলদে ফর্সা, কুঁকড়া চুলের, অহংকারী মেয়েটা। বারেবারে কপালের ঘাম মুছতে ব্যস্ত। বেশ চিন্তিত তার মুখ। সার্থক তাকিয়ে আছে। একধ্যানে, প্রাণভরে দেখছে সে। যানজট ভালো লাগছে তার। ভিষণ ভালোলাগছে। হঠাৎ..

হঠাৎ মেয়েটা চলে গেলো। রিকশাটা হারিয়ে গেলো শতগাড়ির মাঝে। বুকটা কেঁপে উঠলো সার্থকের। এই মেয়েটাকে আবার হাতের কাছে পেলে নির্ঘাত তুলে আছাড় দিবে সে। মুইংচিন সামনে থেকে লক্ষ্য করছিলো তাকে,
“কি ডেখো সাটক?”
“কিছুনা, মুইংচিন।”
“টোমারে আজ জরুরি ডাকালো। পা পাওয়া গেসে।”
“হুম।”

গম্ভীর হয়ে গেলো সার্থকের মুখ। হাসপাতালে জরুরিভাবে ডাকানো হয়েছে তাকে। দেড় বছর পর আবারো সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফের খুনের ধরনের মতো খুনের ঘটনা ঘটলো। এটা কি করে সম্ভব? মাতব্বর শরীফ তো জেলে! তাহলে কে ঘটাচ্ছে এসব? কেন ঘটাচ্ছে?

(চলবে)

#অলকানন্দা (আজকের পর্বটা নিজ দায়িত্বে পড়ে নিবেন। কেউ যদি মর্গ, মর্গের বর্ণনা এসবে ভয় পান, তাহলে আমার পরামর্শ থাকবে পর্বটি স্কিপ করার।)
#পর্ব-১২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৩৪.
মর্গ। হিমশীতল কনকনে ঠান্ডা যুক্ত গাঁ ছমছমে এক জায়গা। দু’তালার এককোনায় ঘরটা। দুপাশে রুগীদের ওয়ার্ড পেরিয়ে মাঝ বরাবর সরু এক রাস্তা। তারপর হাতের ঠিক ডানদিকে এই লাশঘর।

শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আছে মাহার। ভয় সে পাচ্ছেনা। তবে থেমে থেমে গাঁ কাঁপুনি দিয়ে উঠছে তার। ওড়না দিয়ে কপালের ঘামের বিন্দুগুলো আবার মুছে নিলো সে। সামনে ইউনিফর্ম পরনে রেজওয়ান এবং ডাক্তার ওয়াসিফ। এই তো কতক্ষণ আগে মাহা পৌঁছেছে হাসাপাতালে। আর তখনই…..

________________

রিকশা থেকে নেমে ঝটপট ভাড়া মিটিয়ে যেই হাসপাতালের গেট দিয়ে ডুকবে অমনি রেজওয়ান এগিয়ে এলো মাহার পানে। প্রচুর ভিড়। সাংবাদিক এবং তাদের ক্যামেরা ম্যানদের ঠাঁই হচ্ছেনা স্থানটায়। এএসপি রেজওয়ানের পিছুপিছু তারাও চলে এলো সেখানে।
“মাহা, চলো।”

বলেই মাহার হাত আঁকড়ে ধরলো রেজওয়ান। দুজন কনস্টেবলও রয়েছেন। তারা যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন আমজনতা আর সাংবাদিকদের ভিড়টাকে ঠেলে দিতে। কোনো ক্রমেই পেড়ে উঠছেন না। এত পুরুষের মাঝে নিজেকে অসহায় লাগছে মাহার। এর মাঝে আবার হাত আঁকড়ে ধরেছে রেজওয়ান। কেমন যেন লাগছে মাহার। সবাই উপচে পড়ছে তাদের উপরে। রেজওয়ান এক ধমক দিলো। কাজ হয়নি। এতো এতো ফ্ল্যাশ, ক্যামেরা। সব তাক করা হচ্ছে মাহার উপরে। ভিড় ঠেলে যেই না একটু সামনে এগুলো মাহা আর রেজওয়ান অমনি একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন,
“আপনি কি পা শনাক্ত করতে এসেছেন? আপনার সাথে ভিক্টিমের কি সম্পর্ক?”
নীল শার্ট পরা একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,
“সিলেটের এই ঘটনার সাথে ২০১২ সালের ঘটনার সম্পৃক্ততা রয়েছে। আপনার কি ধারণা?”
“আপনি কি ভিক্টিমের পূর্ব পরিচিত?”
“ভিক্টিম কি ছেলে না মেয়ে?”
“আপনার কি এই খুনের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে?”
“এএসপি রেজওয়ান কি আপনার পূর্ব পরিচিত?”

এমন সব প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিলো মাহা। মাথা থেকে কালো ওড়নার ঘোমটা খুলে গেলো তার। ঝরঝর করে সারা পিঠময় ছড়িয়ে পড়লো কোঁকড়া চুলগুলো। হলদে ফর্সা মায়াবী মুখের কাছে বিষণ্ণতাও যেন হার মানছে। হঠাৎ রেজওয়ানের হাত থেকে মাহার হাত ছুটে গেলো। ব্যাপারটা এতো বেড়েছে যে পুলিশও ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। সাংবাদিকদের পাশাপাশি আছে উৎসুক জনতার ভিড়। গেটের বাইরেই এমন ভিড়। ভিতরে পুলিশ কাউকে আপাতত ঢুকতে দিচ্ছেনা।

৩৫.
হতবিহ্বল হয়ে পড়লো মাহা। ভিড়ের মাঝে মনে হলো কোনো পুরুষ নিজের নিম্ন অংশ দিয়ে ইচ্ছে করে মাহার পিছনে স্পর্শ করছে। গা ঘিনঘিন করে উঠলো মাহার। হঠাৎ একটা হাত যেই না মাহার শরীরের সামনের অংশ স্পর্শ করবে অমনি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠলো মাহা। রেজওয়ানের ডাকও সে শুনতে পাচ্ছে। মাহা মাহা করে নাম ধরে ডাকছে। শত অপবিত্র হাতের মাঝে একটা পবিত্র হাত আঁকড়ে ধরলো মাহার ডানহাত। মাহা তখনও চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কেবল মনে হলো সে সামনে এগুচ্ছে। একটা পবিত্র শরীরের বেস্টনি তাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ঘ্রাণটা তো মাহার বড্ড পরিচিত। আপন আপন একটা ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণের লোকটাকে তো মাহা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। খুব ইচ্ছে ছিলো চোখ মেলে দেখবে। যখন তাকালো তখন সে হাসপাতাল গেটের ভিতরে। সামনে রেজওয়ান মলিন মুখে দাঁড়িয়ে।
“আমাকে ক্ষমা করো মাহা। হঠাৎ হাতের বাঁধন টা আলগা হয়ে গেলো!”

মুখ খুলে স্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারছেনা মাহা। কাঁপা কাঁপা সুরে প্রশ্ন করলো,
“আমাকে….আমাকে এখানে কে দিয়ে গেলো ভাইয়া?”
“এখানের একজন ডাক্তার। ফায়রাজ সার্থক।”

সার্থক নামটা শুনে বুকের ধুকপুক ধুকপুক করা যন্ত্রটা যেন থেমে যাচ্ছিলো আপনমনে। শরীরে অদ্ভুত অনুভূতি। মাহা কেন জানেনা। পিছন ফিরে তাকালো একবার। মানুষটার পিছনের অংশ দেখতে পেলো সে। পায়ে সু, কালো প্যান্ট আর ডাক্তারদের সাদা এফরন গায়ে। গটগট করে হেঁটে চলে যাচ্ছে নিষ্ঠুর টা!

__________________

“মাহা?”

ধ্যান ভেঙে বাস্তবে ফিরলো মাহা। চলে এসেছে তারা। উপরে সাদা বোর্ডে লাল রঙের হরফে স্পষ্ট লেখা,”মর্গ”। লেখাটার দিকে তাকিয়ে গায়ে কেমন যেন একটা কাঁপুনি দিয়ে উঠলো মাহার। রেজওয়ান আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি ভয় পাচ্ছো? মাহা?”
“না…..না, ভাইয়া।”

কাঁপা সুরে উত্তর দিলো মাহা। দরজাটা খুলে দিতেই ভিতরে প্রবেশ করলো তারা। একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগলো মাহার। ঘরটা অন্ধকার। হিম শীতল। সারি সারি লাশ রাখা। সবগুলোর উপরে সাদা কাপড়। ঘরটা মোটামুটি বড়। একপাশের দেয়াল ঘেঁষে তৈরি লাশ রাখার ফ্রিজ। মাহা চোখ, মুখ বন্ধ করে হেঁটে যাচ্ছে ওদের পিছুপিছু। অবশেষে কাঙ্খিত স্থানে এসে পৌঁছালো তারা। কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। মাহার অদ্ভুত কারণে ভয় লাগছেনা। কেন এমন হচ্ছে মাহা জানেনা। মন প্রাণ দিয়ে চাইছে শরীরের অংশটুকু যেন চৈতির না হয়। হলুদ টিমটিমে একটা বাতি জ্বলছে স্থানটার উপরে। বেডের মতন শক্ত পাটাতনের উপরে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। রেজওয়ান, মাহা দাঁড়িয়েছে বামপাশে। ডাক্তার ওয়াসিফ ডানপাশে। পঞ্চাশোর্ধ বয়সের প্রবীণ, অভিজ্ঞ ডাক্তার তিনি। আসার সময় কি কি যেন বলছিলেন রেজওয়ানকে। মাহা শুনেনি। চশমাটা ঠিক করে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন ডাক্তার ওয়াসিফ। আস্তে আস্তে বললেন,
“এমন ঘটনা কি করে আবার পুনরাবৃত্তি হলো তাই নিয়েই টেনশনে আছি মিঃরেজওয়ান। এমন কত শরীরের অংশ দেখেছি তবে সম্পূর্ণ শরীর আজোও মিসিং!”
“আমারও একই চিন্তা ডাক্তার ওয়াসিফ।”

কথা বলার মাঝেই সাদা কাপড়টা উপরে উঠিয়ে দিলেন ডাক্তার ওয়াসিফ। মাহা এতক্ষণ নিরব দর্শক ছিল। ছিন্ন পায়ের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো মাহার। পাগলের মতো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো সে। উড়ু থেকে ছিন্ন একখানা পা। উরুর দিকটায় লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে।

৩৬.
বুড়ো আঙুলের পাশটায় কাটা দাগ। এটা তো চৈতির পায়ের মতো! কনিষ্ঠা আঙুলের পাশটায় একটা লাল তিল।
“চৈতিরে…

বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মাহা। বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে তার। এটা তো চৈতির পা! বিশ্বাস হচ্ছেনা মাহার। ডাক্তার ওয়াসিফ তাকালেন রেজওয়ানের দিকে। রেজওয়ান আঁকড়ে ধরলো মাহাকে। আস্তে আস্তে বললো,
“কাম ডাউন মাহা। এখনো ডিএনএ টেস্ট বাকি। এটা তো কেবল প্রাথমিক শনাক্তকরণ। কেঁদো না প্লিজ।”
“ভাইয়া এটা চৈতিই। আমার চৈতির পা এটা ভাইয়া।চৈতিরে। চৈতি!”

মাহার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। স্থান, কাল ভুলে গেছে মাহা।
“মিঃরেজওয়ান, আপনি ওকে নিয়ে বাইরে যান। আকস্মিক শকটা ও হয়তো নিতে পারছেনা।”

জ্ঞান হারালো মাহা।

_________________

একটা সবুজ পাহাড়। চারপাশে সবুজে আবৃত। বিভিন্ন রকম ডাক ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। মাহা দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের এক কোনায়। তার পরনে একটা লাল টকটকে শাড়ি। শিফন শাড়িটার আঁচল উড়ছে হিমেল বাতাসে। স্নিগ্ধ বাতাসে মনে দোলা দিচ্ছে অদ্ভুত ভালোলাগা। হঠাৎ…..

আবার একটা চিৎকার। যেমনটা ছিলো আগের মাঠে। মাহার নাম ধরে ডাকছে কেউ। মাহা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। এপাশ ওপাশ খুঁজতে লাগলো সে শব্দের উৎস। কি করুণ ডাকটা। বাঁচতে চাওয়ার আকুতি, মিনতি সে কন্ঠে। মাহা অবশেষে খুঁজে পেয়েছে সে কন্ঠ। নীলকন্ঠ। বিষাক্ত কন্ঠ। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে একটা বড় খাদ। চৈতি একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলে আছে। পাহাড়ের গায়ে লাগোয়া শুকনো ডালটা। মাহাকে দেখে করুণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমাকে বাঁচাবি না মাহা?”

মাহা জবাব দিতে পারলোনা। কি মায়াবী চোখ মেয়েটার। মাহা হাত বাড়ালো চৈতির দিকে। চৈতি একটা হাত এগিয়ে দিলো মাহার দিকে। একটু। আর একটু হলেই তো চৈতি ছুঁয়ে ফেলবে মাহার হাত। তখনই…..

তখনই ডালটা ভেঙে গেলো। চৈতি তলিয়ে গেলো খাদের গহীনে। কেবল ভেসে এলো একটা ডাক,
“মাহারে…

সেই নীলকন্ঠের পিছনে যেই না মাহা ঝাঁপিয়ে পড়বে ঠিক তখনই কেউ আঁকড়ে ধরলো মাহার হাত। একেবারে বুকের মাঝে নিয়ে গেলো। তার উষ্ণ ঠোঁটের পরশ দিলো মাহার কপালে। স্পর্শটা সত্যিই অনুভব করলো মাহা। খুব করে অনুভব করলো। অতঃপর ঝাঁকড়া চুলের মানবটা খুব করে বকলো তাকে। মাহা চুপ করে শুনছে। ভালোলাগছে তার। খুব ভালো লাগছে। তার বুকের স্পন্দন গুণতে ভালোলাগছে।
_______________

“এই মাহা? মাহা।”

রেজওয়ানের ডাকে অবচেতন মস্তিষ্ক সচেতন হয়ে উঠলো মাহার। ভারী চোখ দুটো খোলার চেষ্টা করলো সে। মস্তিষ্ক সচল হতেই চোখ খুলে গেলো তার। মনে পড়লো বিগত কথাগুলো। পা, পা টা তো চৈতির।

হাতের স্যালাইন ছিঁড়ে ফেললো মাহা। তরতর করে রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। রেজওয়ান তৎক্ষনাৎ হাত চেপে ধরলো তার। অসহায় কন্ঠে বললো,

“এসব কেমন পাগলামি মাহা? এমন জানলে আমি তোমাকে কখনোই এখানে আসতে বলতাম না। তুমি না বুঝদার। কেন অবুঝের মতো করছো মাহা?”

মাহার মনে হলো ও নিজের মাঝে নেই। এই মুহুর্তে সে চৈতিকে দেখতে চায়। মর্গে গেলে কি খুঁজে পাবে? নাকি সিলেটের আগুন পাহাড়?
“ভাইয়া প্লিজ আমাকে ছাড়েন। আমি চৈতির কাছে যাবো। প্লিজ ভাইয়া।”

বলেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো মাহা। সবার কাছে শক্ত মনের এএসপি রেজওয়ানও যেন অসহায় হয়ে পড়ে এই মেয়েটার সামনে। তার প্রাণপাখিটার সামনে। মাহার পাগলামি বাড়ছে। উঠে বসার চেষ্টা করছে সে। হঠাৎ একটা ভারী পুরুষালি কন্ঠ ধমক দিলো তাকে।
“একদম চুপচাপ বসুন। কোনো নড়াচড়া করবেন না।”

পরিচিত কন্ঠের এমন ধমকে কেঁপে উঠে দরজার পানে তাকালো মাহা। সার্থক দাঁড়িয়ে। গলায় স্টেথোস্কোপ। গায়ে সাদা এফরোন, ভিতরে সাদা শার্ট। মাহা স্থির হয়ে বসে রইলো। মাথা নিচু হয়ে গেলো তার। রেজওয়ান উঠে হাত মেলালো ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের সাথে। মলিন হেসে বললো,
“মেয়েটা এমন কেন করছে ডক্টর?”

সার্থক, মাথা নিচু করে রাখা মাহার পানে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
“হঠাৎ ধাক্কাটা নিতে পারেন নি। তাছাড়া পেশেন্টের শরীর প্রচুর দুর্বল। ঠিক মতো ঘুমান না, খাওয়া দাওয়া করেন না। তাই এমন হচ্ছে।”
“ওকে সুস্থ করে তুলুন ডক্টর ফায়রাজ।”

ইউনিফর্ম পরনে এএসপি রেজওয়ানের এমন আকুতিতে রাগ লাগছে সার্থকের। কেন লাগছে সে জানেনা। এই আকুতিতে কিছু একটা আছে। সেটা কি কোনো অধিকারবোধ?

(চলবে)….

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৩৭.
“আপনি চিন্তা করবেন না মিঃ রেজওয়ান। মিস মাহা সুস্থ হয়ে যাবেন।”

চেহারায় যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে কথাটা বললো সার্থক। এই মুহূর্তে নিজের রাগ সে প্রদর্শন করতে চাচ্ছেনা। রেজওয়ান আস্বস্ত হলো কিনা তার চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই। রেজওয়ান এগিয়ে গেলো মাহার কাছে। পাশে রাখা চেয়ারে বসে বললো,

“মাহা, আমি একটু আসছি। কিছুক্ষণের ভিতরই ফিরে আসবো। প্লিজ তুমি শান্ত হয়ে থেকো। তুমি না ব্রেইভ্ গার্ল?”

মাহা মাথা নিচু করে রেখেছে। আস্তে করে মাথাটা ডানদিকে দুলালো একবার। অতঃপর স্থান ত্যাগ করলো রেজওয়ান। সম্পূর্ণ সময় ধরে মাহা এবং রেজওয়ানকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। রেজওয়ান বেরিয়ে যেতেই মাহার পাশে এসে বসলো সে। হাতটা টেনে নিলো আলতো করে নিজের কাছে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে কিছুটা। কেঁপে উঠলো মাহা। হাতের রক্ত পরিষ্কার করতে করতে সার্থক বললো,
“আপনি কি সবসময় এমন পাগলামি করেন মাহা?”

মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুখ দিয়ে কোনো কথাই আসছেনা তার। হাত কাঁপছে রীতিমতো। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। সার্থক আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।

“আমার সাথে একদম জেদ দেখাবেন না মাহা। আমি অফিসার রেজওয়ান নই। এখানকার কর্তব্যরত একজন ডাক্তার আমি। আশা রাখছি একজন ডাক্তারের সাথে কিরকম ব্যবহার করতে হয় সেই শিক্ষা আপনার পরিবার আপনাকে দিয়েছে?”

বুকটায় হঠাৎ একটা পিঁপড়ের কামড় অনুভব করলো মাহা। বিষ পিঁপড়া। দলে দলে কামড়ে চলেছে তার বুকে। হাত পরিষ্কার শেষে উঠে দাঁড়ালো সার্থক। গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে। একবার পিছু ফিরে তাকায়নি! তাকালে হয়তো দেখতে পেতো তার অলকানন্দার ছলছল দুটি নেত্র।

কিছুক্ষণ বাদে একজন নার্স এলেন। হাতে স্যুপের বাটি। মাহাকে নিজ হাতেই খাইয়ে দিলেন তিনি। মাহা অবাক হলো অনেকটা। নার্সের এতো ভালো ব্যবহারের পিছনে কার হাত রয়েছে বুঝতে অসুবিধা হলোনা তার। নার্স ওর হাতে ইনজেকশন পুশ করার কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমেরা এসে জড়ো হলো তার চোখে। ঘুমের দুনিয়ায় পাড়ি জমালো মাহা। মাহা কি জানে এতটা সময় তার পাশে বসে ছিলেন ডক্টর ফায়রাজ সার্থক? এই যেমন এখনো বসে আছেন। দ্বিতীয়বারের মতো মাহার কপালে চুমু এঁকে দিলো সার্থক। মেয়েটাকে কি সে ভালোবেসে ফেললো তবে? এই যে কালো সালোয়ার কামিজ পরনে হলদেটে ফর্সা মেয়েটা। কোঁকড়া চুলের হৃদয় দুলানো মেয়েটার কি প্রেমে পরে গেলো সার্থক। অবাধ্য জীবনে কি শান্তির পরশ হবে মেয়েটা? মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে সার্থক বললো,

“তুমি আমার পবিত্রা, অলকানন্দা।”

দূর থেকে তাদের লক্ষ্য করছে নেকড়ের চেয়েও ধারালো দু’খানা চোখ। একেবারে পর্দার আড়াল থেকে। দুজনের মধ্যে একজন ব্যাক্তির প্রতি তার ভিষণ রাগ। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
“কে বাইরে?”

সার্থকের গলার আওয়াজ পেয়ে সরে গেলো সে। নারী! এই পৃথিবীতে একমাত্র নারীই পুরুষকে ধ্বংস করতে পারে। আবার এই নারীই কোনো ধ্বংসের তান্ডবে মাতোয়ারা পুরুষ কে নিজের ছোঁয়ায় পবিত্র করতে পারে। ভালোবাসা এ এক গভীর কুহক। এই কুহকে ডুবে নিজের সত্তাও ভুলে যায় অনেকে। কিন্তু অতীত! অতীত তাকে ফেলে দেয় দোটানায়। এক গভীর দোটানায়।

৩৮.
এসপি প্রলয় চ্যাটার্জীর জরুরি তল্লবে হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে রেজওয়ান। এখানে উপস্থিত আছেন আরো দুই চৌকস পুলিশ অফিসার। এএসপি শাওন ও মোবারক। প্রলয় চ্যাটার্জী ভেতরে প্রবেশ করতেই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো তিনজন। মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের চেহারায় কাঠখাট্টা ভাব। চুলগুলো ছোট করে কাঁটা। এই বয়সেও যথেষ্ট ফিট তিনি। ইউনিফর্মে তাকে দেখলে অনেক নব্য পুলিশ অফিসারেরই ঘাম ছুটে যায়। বিশাল কাঁচের টেবিলের বামপাশের চেয়ারে বসলেন তিনি। রেজওয়ান সহ বাকিদের বসতে বললেন তার বিপরীতে রাখা তিনটা চেয়ারে। সকলে চেয়ারে বসতেই রেজওয়ানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন প্রলয়। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“মেয়েটা কি শনাক্ত করতে পেরেছে?”
“জ্বি, স্যার। কিন্তু বাকি জিনিসগুলো দেখানোর আগেই ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যায় ফলে দেখানোর আগেই অজ্ঞান হয়।”
“মাহা হোসেন তো আপনার পূর্ব পরিচিত?”
“জ্বি।”

ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালের একপাশ ঘষলেন প্রলয়। এটা তার মুদ্রাদোষ।

“অফিসার্স। এই শরীরের অংশ প্রাপ্তির ঘটনাকে কোনো ভাবেই হেলায় ফেলায় নেওয়া যাবেনা। ২০১২ সালে এমনই এক ঘটনার স্বাক্ষী হয়েছিলো সারা বাংলাদেশ। পিবিআই, সিআইডি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ একযোগে কাজ করেছিলো তখন। প্রয়াত স্যার আজিজ এই ঘটনার মূল তদন্তে ছিলেন। স্যারের নেতৃত্বে অবশেষে অপরাধী কে ধরতে সক্ষম হই আমরা। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কেস এগুচ্ছে না। কোর্টের শুনানির আগের দিন আজিজ স্যারের বাসায় আগুন ধরে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সব। প্রাণ হারান স্যার আজিজ সহ তার পরিবার।”

মোবারক প্রশ্ন ছুঁড়েন,
“স্যার সব প্রমাণ কি আজিজ স্যারের কাছে ছিল? কিভাবে মারা যান তিনি?”
“সে সম্পর্কে আজও আমরা জানিনা। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ফলে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সন্দেহভাজন কোনো কিছুই ছিলোনা। তাই এই ঘটনাকে এক্সিডেন্ট হিসেবে ধরে নিয়েছে আদালত।”

শাওন মাঝে প্রশ্ন করলো,
“স্যার এমনও তো হতে পারে। এটা পরিকল্পিত?”
“হতেও পারে অফিসার শাওন। কিন্তু এরপর থেকে খুনের ঘটনা আর ঘটেনি।”

রেজওয়ান চুপচাপ সব শুনছিলো। সে প্রশ্ন করলো,
“স্যার এখন আমাদের প্রথম পদক্ষেপ কি?”
“দেখুন মিঃ রেজওয়ান। মাহা হোসেন আপনার পূর্ব পরিচিত। তাছাড়া সর্বপ্রথম মিসিং কেসে আপনার সাথেই তিনি যোগাযোগ করেন। অর্থাৎ কেসটায় সর্বপ্রথম ইনভলভ আমরা হয়েছি। আপাতত সিআইডি কিংবা অন্য কোনো ব্রাঞ্চ কে আমি এর সাথে যুক্ত করতে চাচ্ছিনা। মিঃরেজওয়ান আপনি, শাওন এবং মোবারক আপনাদের তিনজন কে নিয়ে একটি বিশেষ দল গঠন করা হবে। আপনাদের আন্ডারে থাকবেন ১০০ জন পুলিশ সদস্য। আমি আশা রাখছি এই ঘটনার মূল অপরাধীদের আমরা শনাক্ত করবোই।”
“সিলেট পুলিশের সহযোগীতাও প্রয়োজন পড়বে স্যার।”
“অবশ্যই। আমি যোগাযোগ করেছি। তারা সাহায্য করবেন আপনাদের।”
“স্যার লাশটা আতিয়া জামান চৈতির কিনা তা আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে।”
“ভিক্টিমের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করুন।”
“করেছি স্যার। চৈতির বাবা এবং ফুফু আর কিছুক্ষণের মাঝেই হাসপাতালে পৌঁছে যাবেন।”
“ভেরি গুড রেজওয়ান। তাহলে আপনারা কাজে লেগে যান। এই ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারলে অনেক বড় শিকলের সন্ধান মিলবে বলে আমার ধারণা।”

শাওন, মোবারক কেবিন ত্যাগ করলো। রেজওয়ান বের হওয়ার আগেই তাকে ডাকলেন প্রলয়।
“মিঃ রেজওয়ান?”
“জ্বি, স্যার।”
“আপনাকে নিয়ে আমি আশাবাদী মিঃ রেজওয়ান। এই ঘটনা বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। কিংবা ঝড়টা হচ্ছে আমাদের অজান্তে। আমরা টের পাচ্ছিনা। বহু মানুষের জীবন এর মাঝে জড়িয়ে আছে। মাত্র কিছুক্ষণের মাঝেই মিডিয়াতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে এই ঘটনা। আমাদের যা করার শীঘ্রই করতে হবে।”
“আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো স্যার।”

বলেই বেরিয়ে গেলো রেজওয়ান।

৩৯.

মর্গের রাস্তা কোনদিকে মনে করতে পারলোনা মাহা। সে কোন তলায় আছে তাও তার ধারণার বাইরে। শুধু মনে আছে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো চৈতি তাকে ডাকছে। চৈতির কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তাই আবার স্যালাইন ছিঁড়ে মর্গের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সে। চৈতির সাথে তার কথা বলা খুব প্রয়োজন। হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে মেঝেতে। সেই খেয়াল তার নেই। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেদিকে খেয়াল নেই। এটা কয় তালা? দুতালা নাকি তিন। কোথায় মর্গ! উফ! মাথাটা চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে পাগলের মতো নামছে মাহা।

“নার্স, এই কেবিনের পেশেন্ট কোথায়?”

রক্ত লাল চোখে প্রশ্ন করলো সার্থক। একটু আগে মাত্র বাইরে বেরিয়ে ছিলো সে। আর এসে দেখে মাহা নেই!
“কি হলো বলুন? আপনাদের কাজের প্রতি এত অনীহা কেন আমাকে বলতে পারবেন? মেয়েটা মানসিক ভাবে সুস্থ না। আপনাকে দায়িত্বে রেখে গেলাম। মেয়েটা কোথায় চলে গেলো তা আপনি জানেনও না!”

নার্স নাজমা যারপরনাই অবাক হচ্ছেন। এতটা বছরে কখনো হাসিমুখ ছাড়া সার্থক কারো সাথে কথা বলেনি। সবসময় সুন্দর ভাবে কথা বলেছে। বড় বড় ভুল হলেও বুঝিয়ে দিয়েছে। আজ একটা মেয়ের জন্য এতটা অস্থির তিনি কেন হচ্ছেন? মেয়েটা কি অনেক স্পেশাল কেউ? মুখ খুলে কিছু বলবে তার আগেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো সার্থক। ফ্লোরে রক্তের ফোঁটা তার চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। রক্তের ফোঁটার সূত্র ধরেই সামনে এগুচ্ছে সে। কপালে ভাঁজ। তার ব্রাশ করে রাখা ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো। অদ্ভুত কালো চোখের মণি দুটো লালবর্ণ।

সরু রাস্তা ধরে এগুচ্ছে মাহা। একটা সরু কন্ঠে চৈতি ডাকছে তাকে। চৈতির সরু ডাক ভেসে আসছে। মাহাকে কি যেন বলতে চায়। খুব জরুরি কথা। মাহাও এগিয়ে যাচ্ছে। শুনতে যে তাকে হবেই! এই তো মর্গের দরজা। উপরে সাদা বোর্ডে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা,”মর্গ”।

“আমি আসছি চৈতি।”

বলে মর্গে প্রবেশ করার আগেই তাকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক। পাগলামি শুরু করলো মাহা। তাকে যে ভিতরে যেতেই হবে। চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হলো তার।
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দেন। আমাকে ভিতরে যেতে দেন।”
“চৈতি ডাকছে আমায়।”
“এই চৈতি। আমি আসছি।”

সার্থক আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
“মাহা, শান্ত হন।”

শক্ত, সামর্থ্যবান সার্থকও যেন পেরে উঠছেনা মাহার সাথে। কোনো দৈব শক্তিতে তাকে ভর করেছে যেন। সার্থকের হাত হালকা আলগা হতেই……

(চলবে)…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪০.
সার্থকের হাত আলগা হতেই তার বুকে নিজের পিঠ দিয়ে ধাক্কা দিলো মাহা। আকস্মিক ধাক্কাটা সামলিয়ে উঠতে পারলোনা সার্থক। পিছিয়ে গেলো কিছুটা। মাহা মর্গের দরজাটা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার সমস্ত চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ওড়নাটাও শরীরে নেই। হাতে রক্তের মাখামাখি। হলদেটে ফর্সা মুখটা লালবর্ণ ধারণ করেছে। উন্মাদের মতন আচরণ করছে মাহা। কাজল কালো চোখে অদ্ভুত আকুতি। ছলছল করছে নেত্র যুগল। নিজেকে সামলিয়ে মাহাকে আবার আঁকড়ে ধরলো সার্থক।

“মাহা, আমার অলকানন্দা। আমার বুকটা ঝাঁঝড়া করে দাও। তবুও এমন পাগলামি করোনা। আমার যে কষ্ট হয়।”

নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে মাহা। সার্থকের কথাগুলো আদোও তার কানে গিয়েছে কিনা সন্দেহ! ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে মাহার গালে চড় বসিয়ে দিলো সার্থক। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে মাহা। বামহাতটা গালে দিয়ে অশ্রু মিশ্রিত চোখে সার্থকের দিকে তাকালো সে। সার্থক কিছু বলবে তার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মাহা। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। মনের সব কষ্ট গুলোকে অশ্রু হিসেবে বের করার বৃথা চেষ্টা যেন। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো মাহা। দেয়ালে মাথা হেলিয়ে কেঁদে যাচ্ছে একমনে।
“চৈতি। চৈতি রে। আল্লাহ। আমার আপন মানুষগুলোকে তুমি কেন কেড়ে নাও আল্লাহ।”

সার্থক অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। অতঃপর নিজেও বসে পড়লো মাহার পাশে। পাশ থেকে কালো ওড়নাটা উঠিয়ে হাতে নিলো। ওড়নাটা আলতো করে দিয়ে দিলো মাহার উপরে। মাহা ভুলে গেলো সকল বাঁধা। ঝাঁপিয়ে পড়লো সার্থকের বুকে। এই বুকটা কি একান্তই নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছে মাহা? মাহার উষ্ণ অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে সার্থকের সাদা শার্ট। একেকটা অশ্রুর ফোঁটা কাঁটার মতো বিঁধছে বুকটায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সার্থক আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তার অলকানন্দা কে। এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো কি? কেটে গিয়েছে সহস্র বছর, সহস্র মাস, সহস্র ঘন্টা। ঘোরের মাঝেই ছিলো দুজনে। একসময় ঘোর কাটলো সার্থকের। মাহা তার বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সার্থক নিজের নরম ঠোঁট দুটোর উষ্ণ ভালোবাসা দিলো মাহার কপালে। অতঃপর কোলে তুলে নিলো তাকে। একেবারে মিশিয়ে ফেললো বক্ষে। হেঁটে যাওয়ার পথে মানুষজন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের। চার বছর হয় হসপিটালে জয়েন করেছে সার্থক। এই চারবছরে কোনো দিন কোনো নারী পেশেন্টের সাথে অতিরিক্ত কথা পর্যন্ত বলেন নি ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। তাহলে আজ? কে এই মেয়ে? এই মেয়ের প্রতি এতটা টান কেন ডক্টর ফায়রাজের?
হসপিটালের প্রতিটা স্টাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সার্থক কে দেখে মুইংচিন দৌড়ে এলো তার কাছে। মাহার দিকে একবার তাকালো সে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“সাতক, মেয়েটা কে?”

প্রথমে জবাব দিলোনা সার্থক। মুচকি হাসলো একটু। অতঃপর হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমার পবিত্রা।”

মুইংচিন কি বুঝলো কে জানে। আরেকবার হাসিরা এসে ধরা দিলো তার মুখে। তার ছোট ছোট চোখ দুটো হাসির কারণে আরো ছোট হয়ে গেলো। কুঁচকে উঠলো চোখের দুপাশ। সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করলোনা সার্থক। সে নিজের মতো হেঁটে চলে গিয়েছে দূরে। বহুদূরে।

৪১.
“জানেন জিনিয়া ম্যাডাম, সার্থক স্যার একটা মেয়ের জন্য কি যে চোটপাট দেখাইলো। মেয়েটার মাথায় সমস্যা। কেমন পাগলামি করে। ঐ মেয়েরে আবার স্যার কোলেও নিছে।”

ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম। সার্থকের সহকর্মী। নার্স নাজমার কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো জিনিয়া। অদ্ভুত সুরে বললো,
“সার্থক আর কোলে?”
“ইয়েস, ম্যাডাম।”
“আপনি যে কি বলেন না নাজমা আপা। এটাও পসিবল!”
“সত্যি বলছি ম্যাডাম। বিশ্বাস না হলে আপনি অন্যদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে কতক্ষণ নাজমার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো জিনিয়া। বিগত তিনটা বছর ধরে সার্থকের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ার চেষ্টায় আছে জিনিয়া। সার্থক কোনোভাবেই তার ডাকে সাড়া দেয়নি। মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই অজানা মেয়েটাকে দেখার ইচ্ছে পোষণ করলো জিনিয়া। যে মেয়ে পাথরের বুকে ফুল ফুটায় তাকে তো একবার দেখতেই হয়!

_________________

“অফিসার মোবারক আপনি একটা টিম নিয়ে সিলেট যাবেন। সিলেট পুলিশের সাথে কথা বলে আগুন পাহাড় সহ আশেপাশের জায়গা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবেন। আশা করছি কোনো সূত্র আমরা পাবোই।”
“ঠিক আছে মিঃ রেজওয়ান। ভিক্টিমের পরিবার কি হসপিটালে পৌঁছেছে?”
“জ্বি। আমি বের হবো এখনই। দ্রুত হসপিটালে যাওয়া প্রয়োজন।”

প্রয়োজনীয় কথা বলা শেষে থানা থেকে বের হয়ে গেলো রেজওয়ান। প্রাণপাখিটার জন্য মন কেমন করছে তার।

“স্যার, আমার একটু সমস্যা হয়েছে বাসায়।”

কনস্টেবল মুন্সিকে ফোন দিয়ে এসব কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো রেজওয়ানের। যথাসম্ভব ঠান্ডা সুরে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,
“আপনি আমায় না বলে চলে গেলেন কেনো মুন্সি সাহেব?”
“স্যার, আপনি তো বড় স্যারের কার্যালয়ে আসলে অনেকক্ষণ থাকেন। এমন কি রাতও হয়ে যায়। আর আমার বাসা থেকে হঠাৎ ফোন করলো…
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি আপনার কাজ শেষ করে পরে আসুন।”
“সালাম স্যার।”

গাড়ি নিয়ে নিজেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রেজওয়ান।

রাস্তায় জ্যাম নেই তেমন। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রেজওয়ানের মনটা বোধহয় উড়ে চলে গেছে তার প্রাণপাখির কাছে। একটা ফোন করেও কোনো খোঁজ নেয়নি সে। মাহা কি রেগে আছে তার প্রতি? হঠাৎ মনের মানসপটে ভেসে উঠলো সেই হলুদ ফর্সা মায়াবী মুখটা। কোঁকড়া চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে আছে। মোহিত করা অক্ষি যুগল। ভারী ভারী নেত্রপল্লব। আর সুর! কি মনোমুগ্ধকর! কি অভূতপূর্ব গলার সুর। সৃষ্টিকর্তা কি সমস্ত মিষ্টতা মেয়েটার গলায় দিয়েছে? রেজওয়ানের এখনো মনে পড়ে। তখন মাহার বয়স কত! তের কি চৌদ্দ। কি অভূতপূর্ব বীণা বাজাতো মাহা। প্রতিদিন ভোরে মাহাদের ছাদে লুকিয়ে থাকতো রেজওয়ান। মাহা যখন এলোমেলো চুলে মন খুলে ছাদের একপাশে বসে বীণা বাজাতো, কি মনোমুগ্ধকর লাগতো তার!

কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে জোরে ব্রেক কষতে হয় রেজওয়ানকে। সামনে মানুষের জটলা বেঁধেছে।
“স্যার, স্যার।”

একটা বৃদ্ধ লোকের ডাকে গাড়ি থেকে নামলো রেজওয়ান।
“কি হয়েছে চাচা?”
“মাইয়াটার হাতে ছুরি দিয়া ফোস দিছে পরে মোবাইল লইয়া ছিনতাইকারী ভাগছে স্যার।”
“দেখি সাইড দেন।”

উঁচু গলায় বললো রেজওয়ান। ইউনিফর্ম পরনে পুলিশ অফিসার দেখে মানুষ জন সরে জায়গা করে দিলো। সাথের বৃদ্ধ লোকটা বললেন,
“এই স্যারেরে সাইড দেন আফনারা, সাইড দেন।”

লাল থ্রি পিস পরনে একটা মেয়ে বাম হাতে ডান হাতের কব্জিতে চেপে ধরে রাস্তায় বসে আছে।
“আপনি ঠিক আছেন ম্যাডাম?”

রেজওয়ানের প্রশ্নে মুখ তুলে মেয়েটা।

৪২.
দিনার ভাগিনী এশাকে দেখে খানিকটা অবাক হয় রেজওয়ান। মাহাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে মেয়েটা। শ্যামলা গাঁয়ের বর্ণ। দীঘল কালো হাঁটু সমান চুল।
“এই তুমি এশা না?”

নিজের প্রিয় মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে কান্নাগুলো বেরিয়ে আসে স্পষ্ট ভাবে। কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায় এশা। রেজওয়ানের কষ্টই লাগে দেখে।
“আচ্ছা, কান্না করোনা। উঠে দাঁড়াও।”
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় এশা। হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে তার। ছুরির টানে অনেকটা কেটেছে বোধহয়।

“হাত থেকে রক্ত পড়ছে তো। চলো আমি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।”

ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রেজওয়ান বললো,
“এভাবে তামশা না দেখে মেয়েটাকে একটু সাহায্য করলেও তো পারতেন আপনারা!”

এশা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে। রেজওয়ান এশাকে ইশারায় আসতে বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এশা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো তার পিছুপিছু। রেজওয়ান গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে বসলো। এশা বসলো তার পাশে। বিড়বিড় করে বললো,
“হাত কেটে যদি আপনার পাশে বসা যায় তাহলে আমি এমন একশবার নিজের হাত কাটতে রাজি রেজওয়ান।”

________________

ঘুমন্ত মাহার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে সার্থক। কি মায়বী তার অলকানন্দা! কোঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।
“মেয়েটা কি স্পেশাল কেউ? ডক্টর ফায়রাজ?”

জিনিয়ার প্রশ্নে তার দিকে একবার তাকায় সার্থক। অতঃপর চোখ ফিরিয়ে আবার মাহার পানে তাকিয়ে বলে,
“হয়তো।”
“তা সেও কি ডক্টর?”
“কেন?”
“না, মানে ডক্টর ফায়রাজ তো আর সাধারণ কাউকে ভালোবাসবে না। মেয়েটা কে দেখে বয়সে আপনার থেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। মেয়েটা কি মেডিকেল স্টুডেন্ট? কোন মেডিকেলে পড়াশোনা করে?”
“ওর নাম মাহা। মাহা বলে ডাকলেই খুশি হবো ডক্টর জিনিয়া। তাছাড়া ডক্টর রা কি শুধু ডক্টরদেরই প্রেমে পড়ে?”
“না, না। আমি তো তা বলিনি?”

গলা উঁচিয়ে বললো জিনিয়া। খয়েরী চুলগুলো পোনিটেল করা। লেডিস শার্ট এবং জিন্স পেন্টের উপরে ডাক্তারী এফরন। সাদা ফর্সা গাঁয়ের রঙ। চেহারায় দাম্ভিকতা।
“আস্তে কথা বলুন ডক্টর জিনিয়া। একজন পেশেন্ট এখানে ঘুমাচ্ছে।”

সার্থকের কথায় থমথমে হয়ে উঠলো জিনিয়ার মুখটা। কিছু না বলেই স্থান ত্যাগ করলো সে।

“ভালোবাসার গহীনে তুমি আমাকে টেনেই নিলে অলকানন্দা!”

শীতের রেশ কাটছে ধীরে ধীরে। বসন্তের আগমন ঘটবে ধরণীতে। নির্জীবতা কে দূরে ঠেলে দিয়ে সজীব হয়ে উঠবে ধরণী। গাছে গাছে গজাবে নতুন পাতা। রঙিন ফুলে মুখরিত হবে চারপাশ। নতুন প্রেমের হাওয়া লাগবে মনে। ঊনত্রিশ বছর শেষে শুষ্ক মরুভূমি তে এবার কি ফুটবে ফুল? ছড়িয়ে দিবে তার সৌরভ?

(চলবে)….

।#অলকানন্দা
#পর্ব-১৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪৩.
“তুমি তাহলে ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে বাসায় চলে যেও এশা। আমার একটু জরুরি কাজ আছে।”

ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এশার হাতের কাটা অংশ ব্যান্ডেজ করা হচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে মেয়েটা। পাশে রেজওয়ান। এশা আদোও রেজওয়ানের কথা শুনেছে কিনা সন্দেহ। কাটা স্থানটায় স্যাবলন লাগাতেই এক চিৎকার দিলো সে। সহ্য করতে না পেরে কেঁদেই দিলো এবার। নার্স রুনা বিরক্ত হলেন। এমন চিৎকার, চেঁচামেচি করা রোগী তার বড্ড অপছন্দ। পাশে ইউনিফর্ম পরনে পুলিশ দেখে চেয়েও ধমক দিতে পারছেন না তিনি। তাই নরম গলায় বললেন,
“এতো চিৎকার করবেন না।”

এশা তার টানা টানা ছলছল চোখে একবার তাকালো রেজওয়ানের দিকে। তার চোখগুলো যেন চিৎকার করে বলছে,
“এই পুলিশ একটু আমার হাত ধরলে কি হয়! একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে কি হয়!”

মুখে নিস্তব্ধতা। রেজওয়ান তখন ফোনে ব্যস্ত। চোখ তুলে তাকানোর আগেই এশা নিজের চোখ ফিরিয়ে নেয়। এক তরফা ভালোবাসায় সত্যিই অনেক কষ্ট। নিরবে চোখের পাশ ঘেঁষে বেয়ে পড়ে অশ্রু। এই অশ্রুর মূলে কে? হাতে জ্বালা নাকি রেজওয়ান? নার্স ব্যান্ডেজ করে চলে গিয়েছেন। ছোট বেডটায় বসে এশা। হাঁটু বিস্তৃত চুলগুলো এলোমেলো।
“চলো তোমাকে রিকশা করে দিই।”

এশা কোনো প্রতুত্তর করলোনা। মনে কথা কি মুখে বলা যায়? হাসপাতালের গেটের সামনে থেকে এশাকে রিকশা করে দিলো রেজওয়ান। রিকশায় উঠে মাথা নিচু করে বসে রইলো এশা। রেজওয়ান ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বললো,
“এখন জরুরি কাজ আছে আমার। নয়তো আমিই দিয়ে আসতাম তোমাকে। আর ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো আমি। তুমি চিন্তা করোনা।”
“আচ্ছা।”

অভিমান ভাঙলো তবে। এই কয়েকটা লাইনই মন ভরিয়ে দিলো যেন। মুচকি হাসিটা বিস্তৃত হলো ঠোঁটে। শ্যামল মায়াবতীর রূপ দেখার জন্য রেজওয়ানের সময় কই? সে তো তার প্রাণপাখিতে মত্ত!

“কই আমার মাইয়া কই? আল্লাহ গো।”

চৈতির ফুফুর আহাজারিতে হাসপাতাল কেঁপে উঠছে। চৈতির বাবা জামান সাহেব অসুস্থ মানুষ। চেয়ারে চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। রেজওয়ান প্রথমে একটু থতমত খায়। চৈতির ফুফুর এহেন আচরণ ও আশা করেনি। যতদূর জানতো চৈতির ফুফু তো চৈতিকে সহ্যই করতে পারেনা। আর এখন এমন দেখাচ্ছে যেন চৈতি উনার নিজেরই মেয়ে। রেজওয়ান বসলো জামান সাহেবের পাশে। আস্তে করে বললো,
“চাচা।”

মাথা তুললেন জামান সাহেব। চোখ দুটো গর্তে ডেবে আছে। রোগা, ফর্সা শরীর। বড় দাঁড়ি। এককালে এই লোক অনেক সমৃদ্ধশালী ছিলেন দেখেই বুঝা যায়। রেজওয়ানের হাতে দুটো ফাইল। ফাইল খুলে একটা সদ্য তোলা ছবি দেখালো সে। একটা নুপুরের ছবি। সাদা গোল্ডের নুপুর। শুধু একটা চিকন চেন। একপাশে একটা লাভ আকৃতির ডিজাইন। ছবিটার দিকে শব্দহীন কয়েক পলক চেয়ে রইলেন জামান সাহেব। অতঃপর দু’হাতে মুখ ঢেকে নিরবে অশ্রু ঝড়ালেন তিনি। রেজওয়ান জিজ্ঞেস করলো,
“চাচা, নুপুরটা কি চৈতির?”

জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লেন জামান। নিজেকে সামলিয়ে সিক্ত গলায় বললেন,
“নুপুর টা আমার চৈতির। আমিই উপহার দিয়েছিলাম।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। সে বুঝতে পারছে জামান সাহেবের মন অবস্থা ভালোনা। কিন্তু কিছু কথা না জিজ্ঞেস করলেই নয়।

“আপনার শেষ কবে কথা হয় চৈতির সাথে?”
“বিশ কি বাইশ দিন আগে।”
“ঠিক আছে। আপনি বসুন। কিছুক্ষণের মাঝেই ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ডাকা হবে আপনাকে।”
“আমার চৈতি? আমার চৈতির কি হয়েছে ইন্সপেক্টর সাহেব?”

৪৪.
অসহায় বাবার আকুতিতে কিছুই বলতে পারলোনা রেজওয়ান। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আপনি বসুন। আমি আসছি।”

চৈতির ফুফু রেহানা। নিজের মতো বিলাপ করেই যাচ্ছেন। দোষগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনি মাহার কাঁধেই ফেলতে চাচ্ছেন। রেজওয়ান মহিলার বিলাপে কর্ণপাত না করে বেরিয়ে এলো।

দুতালায় যাওয়া প্রয়োজন। এশাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসার সময়ই চৈতির ফুফু আর বাবার সাথে দেখায় হয়ে গিয়েছিলো রেজওয়ানের। এতোটা সময় হয়ে গেছে! এত চেষ্টা করেও দুতালায় যাওয়ার সুযোগ পেলোনা সে।

ঘুমিয়ে আছে মাহা। রেজওয়ান ঘুমন্ত মাহার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা এত মোহনীয় কেন? সার্থক ইনজেকশন নিয়ে ভিতরে ঢুকে বিরক্ত চোখে রেজওয়ানের দিকে তাকালো। মিঃ রেজওয়ান কেন এভাবে তার অলকানন্দার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? কেন? বুকে জ্বালাময়ী অনুভূতি অনুভব করছে সার্থক। সেও কি তবে হিংসুটে হয়ে গেলো?
“মিঃ রেজওয়ান?”

একধ্যানে মাহার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো রেজওয়ান। সার্থকের ডাকে ধ্যান ভাঙে তার। কিছুটা বিব্রতবোধ করছে সে। বিব্রতবোধ কাটাতে হালকা হেসে বলে,
“ডক্টর ফায়রাজ, মাহার কি অবস্থা এখন?”

মাহার কাছে এগিয়ে আসে সার্থক। একটা অধিকারবোধ থেকে হাত ধরে তাতে ইনজেকশন পুশ করে। তুলা দিয়ে স্থানটায় হালকা ঘষে বলে,
“পেশেন্ট মানসিক ট্রমার ভিতর আছেন। চৈতি মেয়েটার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না সহজে। নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। যার ফলস্বরূপ প্রেশার হাই হয়ে উন্মাদের মতন আচরণ করছেন তিনি।”
“আমারই ভুল ডক্টর ফায়রাজ। আমার ওকে মর্গে নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি।”
“আমরা যারা প্রতিনিয়ত এসব দেখে আসছি তারা যত সহজে জিনিসটাকে গ্রহণ করতে পারবো একজন সাধারণ মানুষ তা পারবেনা মিঃ রেজওয়ান। আমার মনে হচ্ছে পেশেন্টের এসবের উপর ভয়ানক রকমের ফোবিয়া আছে।”

রেজওয়ান আর কিছু বললোনা। একবার তাকালো মাহার ঘুমন্ত মুখপানে। সার্থক নিজের রাগ চেপে গেলো। মেয়েটাকে একবার নিজের করে পেলে হৃদয়ের ভিতরে রেখে দিবে। যেন অন্য কেউ তাকে ছুঁতে না পারে, দেখতে না পারে।
“ভিক্টিমের পরিবারবর্গ এসেছে কি ইন্সপেক্টর রেজওয়ান?”

আবার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে রেজওয়ানের। এবার কিছুটা বিরক্ত হয় সে। সার্থক আর রেজওয়ানের মাঝে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। দুজন দুজনের উপরে বিরক্ত। শুধু প্রকাশে নমনীয়তা।

“জ্বি। ভিক্টিম চৈতির বাবার ডিএনএ টেস্ট করা হবে।”

নিরবতা। দুজনই অপরজনের উপস্থিতি পছন্দ করছেনা। ঘুমন্ত মাহার মুখপানে একমনে তাকিয়ে থাকতে চাচ্ছে। নিজের প্রেয়সীর সাথে একান্তে সময় বিনিময় করতে চাচ্ছে। অঘোষিত লড়াইয়ে কে হবে বিজয়ী?
কেটে গেলো সহস্র সময়। ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। মোবারক ফোন করেছেন। ফোন হাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে বেরিয়ে গেলো সে।

ঈষৎ হাসলো সার্থক। এগিয়ে গেলো মাহার পাশে। ধপ করে বসে পড়লো পাশের চেয়ারটায়। হাত বুলিয়ে দিলো মাহার মাথায়।

“তুমি তো একান্তই আমার।”

৪৫.
“বলুন, মিঃ মোবারক।”
“মিঃ রেজওয়ান, আমি টিম নিয়ে সিলেটের পথে বেরিয়ে পড়েছি। শাওনের কথা ছিলো সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফ এর সাথে জেলে গিয়ে কথা বলার।”
“পারমিশন নিয়েছেন?”
“প্রলয় স্যারের পারমিশন নেওয়া হয়েছে। তবে বিপত্তি অন্য জায়গায়?”
“একটু খুলে বলুন মিঃ মোবারক।”
“শাওন এই কেসটায় আমাদের সাথে থাকতে পারবেন না মনে হচ্ছে। উনার ওয়াইফ সন্তান সম্ভবা। কিছুদিনের ছুটি নিতে চাচ্ছেন।”
“উনি কথাটা প্রলয় স্যারের সামনে বলেন নি কেন?”
“স্যারকে সবাই ভয় পায়। বুঝতেই তো পারছেন।”
“এখন করনীয়?”
“মিস তাজ আমাদের সাথে যোগ দিবেন।”
“কথাটা কি স্যারকে জানানো হয়েছে?”
“না, এজন্যই আপনাকে কল করা। আপনি কি কাইন্ডলি স্যারকে একটু রাজি করাতে পারবেন?”

বিরক্ত হলো রেজওয়ান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বাইরে। ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে রেজওয়ান বললো,
“আমি বললে জিনিসটা খারাপ দেখায় ইন্সপেক্টর মোবারক। এসপি স্যার খুবই ভরসা করে আমাদের তিনজনকে নিযুক্ত করেছেন। তাছাড়া বিপদটা কত গভীর সেটা হয়তো আপনিও উপলব্ধি করতে পারছেন। আমরা এখন রুখে না দাঁড়ালে পুনরায় ২০১২ দেখতে হবে আমাদের। হাহাকার, আহাজারি থাকবে চারপাশে।”
“বুঝতে পারছি মিঃরেজওয়ান। তবে কাইন্ডলি আপনি যদি স্যারকে বলে দেন। তাহলে স্যার শাওন কে ছুটি দিবেন। উনার ওয়াইফের কন্ডিশন ভালোনা। বিদেশ নেওয়া প্রয়োজন। মিস তাজ তো দক্ষ পুলিশ অফিসার। আপনি একটু বিষয়টা দেখেন মিঃ রেজওয়ান।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। অতঃপর বললো,
“ঠিক আছে। আমি দেখছি।”

জুনিয়র অফিসার প্রদীপকে কল করলো রেজওয়ান,
“হ্যালো, প্রদীপ?”
“ইয়েস স্যার।”
” ডিএনএ টেস্ট করা শেষ হয়েছে?”
“না, স্যার। সময় লাগবে। ভিক্টিমের পরিবার আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে।”
“ঠিক আছে। আমি আসছি।”

রেহানার আহাজারি কমেছে কিছুটা। রেজওয়ান কে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
“ঐ মাইয়া কই, স্যার?”
“কোন মেয়ে?”
“যার জন্য আমার চৈতি মরলো। মাহা?”

রেহানাকে ধমক দিলেন জামান।
“কি শুরু করলি রেহানা? চুপ কর।”
“ভাইজান, আপনে আমারে চুপ করতে বলেন? আপনে তো নিজেও জানেন চৈতি ঐ মাইয়ার লগেই সিলেট গেছিলো। সব দোষ ঐ মাইয়ার ভাইজান। আমি ছাড়তাম না। কেস করমু। ক্ষতি পূরণ চাই আমার। কত বড় ক্ষতি হইয়া গেলো ভাইজান?”

বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। এতক্ষণে রেজওয়ানের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হলো। চৌকস মস্তিষ্ক বুঝে গেলো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লোভেই এই নাটক তবে। গম্ভীর সুরে সে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি এতটা সিউর কি করে যে মাহা এর সাথে যুক্ত?”

ভড়কালেন রেহানা। ভীতু চেহারায় বললেন,
“মানে?”
“মানে আপনি হয়তো যুক্ত আছেন কাজটার সাথে। মাহা যদি কিছু করে থাকে তাহলে মাহার সাথে আপনিও যুক্ত আছেন।”
“কিসব আবোল তাবোল বলছেন স্যার! আমি কেমনে যুক্ত থাকবো?”
“এখন আবোল তাবোল লাগছে কেন? আপনি তো পুলিশ না তাহলে আপনি বুঝলেন কি করে অপরাধী কে? ধরাই যায় আপনিও অপরাধী?এইজন্যই সবটা জানেন। অপরপক্ষের সাথে মনোমালিন্যের কারণে দায় চাপাতে চাচ্ছেন।”

স্তব্ধ হয়ে গেলো রেহানা। বুঝতে পারলো চৌকস লোকের সামনে সে নিতান্তই শিশু। সব আহাজারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। রেজওয়ান আর কথা বাড়ালোনা। এগিয়ে গিয়ে জামান সাহেবের পাশে বসলো আবারো।

________________

ঘুমের মাঝে মনে হচ্ছে একটা শক্ত হাত। একটা শক্ত হাত গলা চিপে ধরেছে মাহার। সে চিৎকার……

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪৯.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাহা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একমনে। কোনো অনুভূতি নেই, কোনো অভিব্যক্তি নেই। নির্বিকার মানবী। বসন্ত এসেছে নির্মল ধরায়। হালকা হাওয়া বইছে। সাঁই সাঁই করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে চলন্ত গাড়ি। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। গমগমে আওয়াজ, চেঁচামেচি, গাড়ির হর্নের শব্দ, হকারের
হাঁক দেওয়ার শব্দ, শিশুর কান্নার শব্দ,কাকের কা কা, মানুষের কথাবার্তা। সব মিলিয়ে একত্রিত হয়ে তৈরি করেছে এক ঝিমঝিম শব্দ। শব্দের রয়েছে নিজস্ব বলয়। অদৃশ্য এক বলয়। সেই বলয়ের কারণেই হয়তো মাহার কানে অদ্ভুত এক আওয়াজ ভেসে আসছে। পিছন পিছন একটা কালো হাইস অনেকক্ষণ যাবত আসছে। অর্ধজাগ্রত, জীবন উদাসী মাহা হয়তো তা খেয়ালও করেনি। নিরব হলো রাস্তা। জনমানবশূন্য রাস্তায় প্রবেশ করতেই পিছন থেকে দ্রুত বেগে ধেয়ে আসলো গাড়িটা। কিছু বুঝে উঠার আগেই টেনে নিয়ে গেলো ভিতরে। মাহার ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর প্রতিবাদ করতে চাইলো খানিকটা। জুতসই হলোনা। জ্ঞান হারালো মাহা।

_________________

হসপিটালের বড় ঘড়িটা টং টং করে শব্দ করে উঠলো। জানান দিচ্ছে রাত বারোটা ছুঁয়েছে সময়। আজ দিনটা অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে রেজওয়ানের। ইন্সপেক্টর তাজের সাথে ইনভেস্টিগেশন নিয়ে আলোচনা সহ নানা কাজ। ডক্টর ওয়াসিফের সাথে একটু আলোচনা প্রয়োজন। হাসপাতালের নিচতলায় ফরেনসিক ল্যাব। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে পশ্চিম পার্শ্বে কিছুদূর হাঁটতে হয়। এদিকটায় নিরব। জুতোর সাথে টাইলস লেগে হাঁটার দারুণ শব্দ হচ্ছে। ঠক ঠক ঠক। ফরেনসিক ল্যাবের দরজাটা সাদা রঙের। কাঁচের তৈরি। দরজা খোলাই। দরজার বাইরে রেজওয়ানকে দেখে হাঁক ছাড়লেন ওয়াসিফ।
“আসুন, মিঃ রেজওয়ান।”

বহু জিনিসপত্রে সাজানো গোছানো, ছিমছাম ঘর। কেমিক্যাল, পরীক্ষা করার যন্ত্র। ছুরি, হাতুড়ি সহ নানা জিনিস। একটা টেবিলে চৈতির ছিন্ন পা এবং অপরপাশে উদ্ধারকৃত আলামতসমূহ। রেজওয়ান পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
“ডিএনএ রিপোর্ট আসতে কতদিন সময় লাগতে পারে? ডক্টর?”
“আরো পাঁচদিনের মতো লাগবে ।”

ল্যাবে তাদের ছাড়াও আরো দুইজন উপস্থিত। মোহাম্মদ জুলফিকার। সে ইন্টার্নি করছে আর ডক্টর মিনহাজ। দীর্ঘক্ষণ চৈতির পা পর্যবেক্ষণ করলেন ডক্টর ওয়াসিফ। অতঃপর বললেন,
“আপনাকে জরুরি একটা কথা বলার ছিলো মিঃ রেজওয়ান।”
“জ্বি, বলুন।”
“আপনি আমার সাথে আসুন।”

ডক্টর ওয়াসিফের পিছু পিছু ফরেনসিক ল্যাবের ভিতর আরেকটা দরজা দিয়ে ছোট একটা ঘরে ঢুকলো দুজনে। ঘরের একপাশে তিন থাকের ওয়ারড্রবের মতো ফ্রিজ। ঘরের তিনভাগের দুইভাগ ফ্রিজ। অপরদিকে কাঠের তৈরি থাক। তাতে কেমিক্যাল ভরপুর শতখানেক কাঁচের কৌটা। সেখানে ডুবিয়ে রাখা লাশের চোখ, হৃদপিণ্ড, কিডনি সহ অন্যান্য অঙ্গাণু। ঘরের মাঝে একটা কাঠের পুরানো টেবিল। ওয়াসিফ ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন।
“আপনাকে কিছু দেখাতে চাচ্ছি মিঃ রেজওয়ান। আশা রাখছি আপনার ইনভেস্টিগেশনে তা সাহায্য করবে।”

রেজওয়ান কিছুই বললোনা। বর্তমানে হাতের কাছে যা পাবে তাই অনেক। একটা ক্লু। কেবলমাত্র একটা ক্লুর সন্ধান চাচ্ছে রেজওয়ান। বর্তমানে সে এবং তার টিম এমন পর্যায়ে আছে তাতে কি রেখে কি করবে বুঝা দায়। কি থেকে কি শুরু করবে! সন্ধ্যার দিকে ইন্সপেক্টর মোবারকের সাথে কথা হয়েছিলো তার। ঘটনা স্থান বারবার খুঁজেও কোনো তথ্য মোবারক পাননি।

৫০.

অন্ধকার ঘর। কেমন স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। মাহার জ্ঞান ফিরলো। কিন্তু আকস্মিক অন্ধকারে মস্তিষ্ক ধাক্কা অনুভব করলো। আলোর সন্ধান চায় সে। দুর্বল, ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢুকরে উঠলো মাহা। চিৎকার করলো পাগলের মতন। কেউ আসেনা, কেউ না। পিছনে কিসের পাটাতন মাহার জানা নেই। তাতে হেলান দিলো মাহা। কানে ভেসে এলো ব্রিটিশ এক্সেন্টে আওড়ানো কিছু বুলি। কি বলছে বুঝতে পারছেনা মাহা। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। মাহার মনে হলো এমন ঘটনা তার সাথে আগেও ঘটেছে। এবং সেটা দেজা ভ্যু নয়। এরকম বন্দী অবস্থায় ছিলো সে। আধা জাগ্রত, আধা অবচেতন মাহা মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলো তীব্রভাবে। তাতে জোড়ালো চিনচিন ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। মাহার সেদিকে খেয়াল নেই। আবছা স্মৃতিগুলোকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা চলছে যে! স্মৃতিকে বারবার মনে করতে থাকলে স্মৃতিটি যে নিউরোনে সংরক্ষিত আছে, সেটার সিন্যাপ্স বারবার আন্দোলিত হয়। যত বেশী সিন্যাপ্স আন্দোলিত হবে, সেই স্মৃতি তত শক্তিশালী হবে। মাহার ক্ষেত্রে তা হচ্ছেনা। সিন্যাপ্স আন্দোলিত হচ্ছে তবে কিছু মনে পড়ছেনা। মাথায় দু হাত চেপে ধরে আবার চিৎকার করে উঠলো মাহা। এবার মস্তিষ্কে জোর চালালো না। পিছনে শক্ত পাটাতন হয়তো এটা দেয়াল তাতে মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখ বুজে গেলো তার। নিউরোন আন্দোলিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। মাহার মস্তিষ্কের কিছু নিউরোন চাইলেও সম্পূর্ণরূপে আন্দোলিত হতে পারছেনা। কিছু একটা যেন ধরে রেখেছে তাদের। চোখ বুজলো মাহা। ফিরে গেলো কিছুদিন পূর্বে।

_______________

বিকেলে বাইরে বের হয়েছিলো মাহা, চৈতি। পরের ঘটনা অন্ধকারে ছেয়ে আছে । চোখের সামনে আবছা অন্ধকার। মাহার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে কেউ। আশেপাশে জঙ্গল। দূরে বিশাল বিশাল পাহাড়। বড় একটা মেহগনি গাছের পিছনে লুকিয়ে মাহা। বারেবারে তার নাম ধরে চিৎকার করছে কেউ। কান খাড়া করলো মাহা। এই আওয়াজ তো চৈতির! গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এলো সে। দূরে শিয়াল ডাকছে। হুক্কা হুয়া। গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো মাহার। সে এগিয়ে গেলো সামনে। অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। মাহা হাঁটছে। কাঙ্ক্ষিত ডাক থেমে গেলো। মাহার মুখ পিছন থেকে শক্ত করে কেউ ধরেছে। ছটফট করছে মাহা। ছাড়াতে পারছেনা। টানতে টানতে কেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভিতরে। কাঠের ঘর। একটা হারিকেন জ্বালানো কেবল। তাকে ঘরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরে দিয়ে দরজা আটকে দিলো পুরুষালি রুক্ষ হাত। মাহা অনবরত চিৎকার করছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে। না কেউ খুলছেনা। বদ্ধ জায়গায় অসম্ভব খারাপ লাগে মাহার। ক্লস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত মাহা কোনোদিন মানতে চায়নি তার কোনো বিষয়ে ফোবিয়া থাকতে পারে। একসময় শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। অতঃপর সব অন্ধকার।

যখন জ্ঞান ফিরালো তখন বোধহয় বাইরে গভীর রাত। নিশুতি রাতের কান্না ভেসে আসছে। হরেকরকম প্রাণীর ডাক ভেসে আসছে বাহির থেকে।
মাহা ঘরে দুজন মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করলো। বাইরে একটা হারিকেন জ্বলছে। সেই আবছায়া আলোর ছিটেফোঁটা ভিতরে প্রবেশ করছে কেবল। ব্রিটিশ এক্সেন্টে একজন লোক কি যেন বলছে। তার পাশে বিশালদেহী আরেকজন। বিদেশি লোকটার নীল চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। মাহা চিৎকার করার আগেই তার ঘাড়ে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলো লোকটা। মাহা একটা সূক্ষ্ম জ্বালা অনুভব করছে ঘাড়ে। মনে হচ্ছে ঘাড়ের ভিতর, শিরা দিয়ে রক্ত চলাচলের পাশাপাশি সুঁইও চলাচল করছে।

৫১.
সুঁইগুলো চলাচলের সময় যেন একটা করে তীক্ষ্ণ আঘাত করে যাচ্ছে ঘাড়ে। নির্দিষ্ট জায়গায়। মাহা অর্ধচেতন হয়ে পড়লো। বিদেশি লোকটাকে দেখা যাচ্ছেনা। মাহা বুঝে গেলো। কারণ অন্ধকারে নীল জ্বলজ্বলে চোখ দেখা যাচ্ছেনা। মাহা কাঠের ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বুজা তার। হঠাৎ খেয়াল করলো বিশালদেহী লোকটা নিজের একটা হাত এগিয়ে তার শরীরে স্পর্শ করতে চাচ্ছে। ধারালো দাঁতে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মাহা। লোকটা চিৎকার করে উঠেছে। কাঠের ঘরের দরজা খোলা। মাহা সবকিছু ভুলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড় দিলো প্রাণপণে। নিজের অস্তিত্বের লড়াই, নিজের সম্ভ্রম বাঁচানোর লড়াইয়ে জয়ী হলো মাহা। পিছনে লোকটা দৌড়ালেও এখন নেই। জঙ্গল পেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠে গেছে সে। তারপর আবার দৌড়। পরে কি হলো মাহা জানেনা। যখন চোখ খুললো মাহা তখন পাশে পেয়েছে রুমানাসহ তার বাড়ির মানুষদের।

___________________

বর্তমান, অতীত মিলে একাকার। মাহা এখন কোথায় আছে জানেনা। মনে হলো প্রিয় একটা পুরুষালি হাত তার গালে নরম করে চাপড় মারছে। নরম কন্ঠে তাকে ডাকছে। মাহার চোখ খুলতে ইচ্ছে করছেনা। উষ্ণ বুকে মাথা দিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে সহস্র দিন, সহস্র মাস, সহস্র বছর। সার্থক একহাতে মাহাকে বুকে নিয়ে অপর হাতে ড্রাইভ করছে। মাহার মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো সে। একটা ফোন পেয়েই এই রাস্তায় ছুটে এসেছিলো। ঘুমের মাঝেই কি যেন বিড়বিড় করছে মাহা। সার্থক আবার চুমু খেলো। এই মেয়েটাকে পারলে বুকের ভিতরেই রেখে দিতো সে। বিশাল আকাশে চাঁদ উঠেছে। হাওয়া বইছে মৃদু। মাহার দুচোখের পাশ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ছে। সার্থক শুষে নিলো তা। মাহার কানে কানে বললো,
“তোমার সকল কষ্টগুলো আমার।
আমার সকল সুখগুলো তোমার।”

মাহা অবচেতন অবস্থায় আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। মাথা ঠেকিয়ে দিলো সার্থকের চওড়া বুকে। সার্থকের ঠোঁটে ঈষৎ হাসির রেখা দেখা দিলো কি?

চাঁদের সাথে মেঘেদের অবাধ খেলা হচ্ছে আকাশে। কখনো কখনো দুষ্টু মেঘের দল ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। কখনো বা সরে যাচ্ছে। যেমনটা মাহার চুলগুলো তার সাথে করছে। খোলা কোঁকড়া চুলগুলো কখনো তার মুখ ঢেকে দিচ্ছে কখনোবা সরে যাচ্ছে। সার্থক চাঁদের পানে তাকালো একবার। আবার তাকালো তার অলকানন্দার দিকে। মুচকি হাসি উপচে করলো গম্ভীর মুখটায়। আবার চাঁদের পানে তাকিয়ে সে বললো,
“এই যে মেঘেরা আমার চাঁদ বেশি সুন্দর।”

মেঘের দল রাগ করলোনা। আকাশের চাঁদটাকে ঢেকে দিলো তারা। যেন বুঝিয়ে দিলো,
“হুম। তোমার চাঁদ বেশি সুন্দর ছেলে।”

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৫২.
“উরুর দিকে ক্ষতটা দেখছেন মিঃ রেজওয়ান?”
“হুম।”

ছোট রুমের রেফ্রিজারেটর এর ভিতর থেকে বহু পুরানো ফ্রোজেন একখানা পায়ের খন্ড বের করলেন ডক্টর ওয়াসিফ। গ্লাভস পরিহিত হাতে সেটা নিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। সাদা পলিথিনে মোড়ানো পায়ের খন্ডটা পর্যবেক্ষণ করার কালেই মুখ খুললেন তিনি।

“এটা ২০১২ সালের শেষের দিকে প্রাপ্ত। হবিগঞ্জে একটা আবর্জনা স্তূপ থেকে। ক্ষতগুলো দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?”

ডক্টর ওয়াসিফের এমন হেয়ালি তে বিরক্ত রেজওয়ান। বহুদিনের পুরানো শরীরের খণ্ডাংশ। তারউপর হালকা বরফের আস্তরণ। এখানে কি কোনো ক্ষত আদোও বিদ্যমান! আর তা থাকলেও সেটা কি রেজওয়ান বুঝতে পারবে! সূক্ষ্ম ক্ষত নিয়ে তো তার ধারণা থাকার কথা না। মোবাইলটাও কাজ করছেনা। মায়ের সাথে কথা হয়নি আজ। মাহার খোঁজও তো নেওয়া হলোনা। কপালে বিরক্তির দুই তিনটা রেখা ফুটে উঠলো রেজওয়ানের।

“চুপ করে আছেন যে মিঃ রেজওয়ান ?”
“ডক্টর আপনি খোলাসা করে বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম।”
“সূক্ষ্ম পরিবর্তন মিঃ রেজওয়ান , সূক্ষ্ম পরিবর্তন।”

আশ্চর্য লোক। রাত সাড়ে বারোটা ছুঁইছুঁই। রাস্তার পাশ থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। নিরবতার মাঝে অদ্ভুত শুনাচ্ছে সে আওয়াজ। ডক্টর ওয়াসিফের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে নির্ঘাত ধমক খেতো রেজওয়ানের কাছে। কিন্তু রেজওয়ান নিজের মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে। বর্তমানে একটা ক্লু মানেও অনেককিছু। রেজওয়ানকে নিরব দেখে আলতো হাসলেন ডক্টর ওয়াসিফ। গলা উঁচিয়ে ডাক দিলেন,
“জুলফিকার, নিয়ে এসো।”

নিরবতা। কুকুরের ডাক থেমে গিয়েছে রাস্তায়। শুরু হয়েছে নিশুতি রাতের কান্না। অদ্ভুত, বিচ্ছিন্ন সে আওয়াজ। এই আওয়াজ বর্ণনা করা যায়না, বিশ্লেষণ করা যায়না। কেবল অনুভব করা যায়। রাতের গভীরে কান পেতে শুনতে হয়। কখনো কখনো তারও প্রয়োজন নেই। সেই সুর আপনা-আপনি ধরা দেয় শ্রোতার কানে। ক্যাড়ক্যাড় আওয়াজ করে কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো জুলফিকার। নিশুতি রাতের কান্নার বিশাল ব্যাঘাত ঘটালো সে। হাতের উপরে একটা কাঁচের ট্রে। তাতে চৈতির পায়ের খন্ড। ছিপছিপে গড়নের ছেলেটার শরীরে এত শক্তি দেখে খানিক অবাক হলো রেজওয়ান। নির্লিপ্ত জুলফিকার পায়ের খন্ডাংশ রেখে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো রেজওয়ান। ঘোর ভাঙলো ডক্টর ওয়াসিফের কন্ঠে।
“এদিকে খেয়াল করুন মিঃ রেজওয়ান ।”

অবাক হলো রেজওয়ান। খানিকটা হকচকিয়ে গেলো বোধহয়। নিজেকে ধাতস্থ করে তাকালো ছোট টেবিলটার পানে।

“ক্ষত দুইটা কিন্তু সামান্য মিঃ রেজওয়ান।”
“মানে?”
“ফ্রোজেন খন্ডটার দিকে খেয়াল করুন। উরুর দিকে কাটা দেখে মনে হচ্ছে আঁকা বাঁকা।”

অতঃপর সামান্য হেসে ওয়াসিফ বললেন,
“ছন্নছাড়া ক্ষত।”

হাসিটা খেয়াল করেছে রেজওয়ান। এই লোকের সাথে মাত্র কিছুদিনের পরিচয় রেজওয়ানের। সবাই বলে ডক্টর নাকি পাগলাটে ধরনের লোক। তবে কাজ করার সময় তেমন কোনো পাগলাটে রূপ দেখেনি রেজওয়ান। এখন লোকের কথাগুলোই সঠিক মনে হচ্ছে রেজওয়ানের। এই ডক্টরের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে।
“রাত বাড়ছে ডক্টর। হেয়ালি না করে একটু খুলে বলুন।”

বিরক্তির প্রকাশ না চাইতেও বেরিয়ে এলো খানিকটা।
“ধৈর্য রাখুন মিঃ। চাকুরীতে নতুন। আপনার পেশায় ধৈর্য বড়ই প্রয়োজন।”

এমন অপ্রকৃতস্থ কথাবার্তা ভিষণ অদ্ভুত ঠেকলো রেজওয়ানের কানে। মানুষ কত ভিন্ন প্রাণী। চোখের সামনে বিরাজমান কিছুদিনের পরিচিত ডক্টর ওয়াসিফকেও ভিন্ন ঠেকছে রেজওয়ানের নিকট।

৫৩.
“নতুন প্রাপ্ত খন্ডখানা এককোপে কাটা। কোনো ধারালো জিনিস দিয়ে দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ধরুন ছুরি কিংবা চাপাতি। কিন্তু ফ্রোজেন খন্ডখানা সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে কাটা। কোনো সিরিয়াল কিলার অতন্ত্য যত্নের সহিত কেটেছেন। আঁকাবাঁকা, ছন্নছাড়া ভাবে নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন হয়তো।”

এবার ভালোভাবে তাকালো রেজওয়ান। সত্যি! তাইতো! কিন্তু তার কাছে বোধগম্য হলোনা সম্পূর্ণ বিষয়।
“তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন মাতব্বর শরীফের সাথে নতুন প্রাপ্ত পায়ের খন্ডের কোনো সম্পর্ক নেই?”
“সেটা তো বলতে পারছিনা। কে বা কারা ঘটাচ্ছে এই বিষয় উন্মোচন করার দায়িত্ব আপনার। আমার মনে হচ্ছে খুন দুইটা করেছেন ভিন্ন ব্যাক্তি। দুইটা কেটেছেনও ভিন্ন ব্যাক্তি।”

হেয়ালিগুলো বড্ড অদ্ভুত ঠেকলো রেজওয়ানের কানে। ক্লু খুঁজতে এসে আরো জটলা বেঁধে গেলো যেন। ডক্টর ওয়াসিফ কে আর প্রশ্ন করলোনা রেজওয়ান। উনি সবকিছুতেই হেয়ালি করেন। তার প্রশ্ন তো থেকে যায়। দুইখুন যদি দুই ব্যাক্তি করে থাকে তাহলে কে তারা? মাতব্বর শরীফ কি দোষী না! কারা করছে এসব। আরো শতশত প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে রেজওয়ানের। কি উত্তর সেসব প্রশ্নের!

_______________

গুলশানের বহুতল বিল্ডিংয়ে সার্থকের ডুপ্লেক্স বাসা। মাহাকে কোলে নিয়ে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। বোন নিভা বসে আছে সোফায়। দুইজন গৃহ পরিচারিকা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন। একজন ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। অপরজন হাতে ট্রে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নিভার দিকে। গাড়িতে থাকতেই ফোন করে সার্থক বলেছিলো মেইন দরজা খুলে রাখতে। তাই বিশাল কাঠের দরজা খুলে রেখেছিলো নিভা। একটা মেয়েকে সার্থকের কোলে দেখে চমকে গেলো সকলে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সার্থকের দিকে। নিভা কিছু বলারও সুযোগ পেলোনা। সার্থক হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। পিছুপিছু এলো নিভাও। নিজের খাটে মাহাকে আলতো করে শোয়ালো সার্থক। আস্তে করে উষ্ণ ভালোবাসার পরশ দিলো ঠোঁটে। সরে পাশে বসতেই দরজায় হালকা টোকা পড়লো। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে ইশারা করলো শব্দ না করতে। নিভা আস্তে আস্তে প্রবেশ করেছে ঘরে। সার্থকের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মেয়েটা কে ভাইয়া?”

ভোরের সূর্য উঠার মতো হাসির রেখার সন্ধান মিললো সার্থকের ফর্সা মুখে। ঝাঁকড়া চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে সার্থক বললো,
“আমার বিশেষ একজন।”
“আমার ভাবী বুঝি?”
“ধরে নেও তাই।”

নিভার মুখেও হালকা হাসি। পরক্ষণেই চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে ওর?”
“একটু দুর্বল। নাহারকে গিয়ে বলো স্যূপ করতে,
সাথে আনারের জুস।”
“তোমার জন্য?”
“আমার জন্য এক মগ কফি।”
“ঠিক আছে।”

ঘুমন্ত মাহার হলদে বর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো নিভা। সার্থক কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে মাত্র বেরিয়েছে। গোঙাচ্ছে মাহা। তোয়ালেটা সোফায় ফেলে রেখে মাহার দিকে দৌড়ে গেলো সার্থক। মাথায় স্পর্শ করে দেখলো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। ভেতর কেঁপে উঠলো সার্থকের। পরিচারিকা খাবার দিয়ে গিয়েছে ক্ষণিক পূর্বে। টি টেবিলে ঢেকে রাখা।

৫৪.
বাথরুম থেকে একবালতি কুসুম গরম পানি নিয়ে এলো সার্থক। জ্বর মেপে দেখলো প্রায় ১০৪° ফারেনহাইট! চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা দেখা দিচ্ছে সার্থকের মুখে। মেয়েটাকে এখন ঔষধ খাওয়ানো প্রয়োজন। একটা পাতলা কাপড় দিয়ে মাহার সারা শরীর মুছিয়ে দিলো সে। মাহার মুখে পানি হালকা করে ছিটিয়ে দিলো। আলতো করে নরম করে চাপড় মারলো গালে। ডাকলো,

“মাহা, এই মাহা। আমার রাণী। উঠো।”

কিন্তু মাহার জ্ঞান ফিরছেনা। চিন্তারা এসে ভিড় জমাচ্ছে সার্থকের মাথায়। স্বামী হিসেবেই মাহার কাপড় পাল্টে যথাসম্ভব শালীনতার সাথে নিজের টাউজার আর টি-শার্ট পরিয়ে দিয়েছে সার্থক। দ্বিতীয়বার পানির ছিঁটা দিতেই আলতো করে চোখ খুললো মাহা। এই জগৎ দুনিয়ার কিছুই হয়তো সে বুঝতে পারছেনা। সার্থক প্রায় জোর করেই স্যূপটুকু খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো মাহাকে। তারপরই মাহা ঘুমে বিভোর। কফিটা নিয়ে নিজের বিশাল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সার্থক। আকাশে চাঁদ এখনো ঝকঝক করছে। হালকা হিমেল হাওয়া বইছে। দূর থেকে ভেসে আসছে হাসনাহেনার ঘ্রাণ। মৃদু হেসে কফিতে চুমুক দিলো সার্থক। আজ সবকিছুই ভালোলাগছে তার।

চিরপরিচিত ঘর, বারান্দা সবকিছু যেন মুখরিত হয়ে আছে। এই জড়বস্তুগুলোর মাঝেও আনন্দের ছড়াছড়ি। বহুদিন বাদে যেন তাদের আপনকেউ ফিরে এসেছে তাদের মাঝে। সাদা কম্বলে অর্ধশরীর ঢাকা মেয়েটার পানে বারান্দা থেকেই ফিরে তাকালো সার্থক। নিজের পোশাকে প্রেয়সীকে দেখতে অনন্যময়ী লাগছে তার কাছে। কোঁকড়া চুলগুলো বালিশের দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হলদে মুখে ভয়াবহ বিষণ্ণতা। কিসের যেন কষ্ট। কি চলে যাওয়ার বেদনা। সার্থক বিড়বিড় করে বললো,
“আমার রাণী। আমার রাজপ্রাসাদে আর কোনো দুঃখ থাকবেনা তোমার। কোনো কষ্ট তোমায় ছুঁতে পারবেনা অলকানন্দা।”

কফির কাপটা টি-টেবিলে রেখে খাটের দিকে এগিয়ে এলো সার্থক। টি-শার্ট খুলে উন্মুক্ত বুক নিয়ে বিছানায় শরীর হেলিয়ে দিলো। মাহাকে টেনে নিলো বুকে। ঠিক হৃদপিণ্ড যেদিকটায় থাকে সেদিকে। মাহাও বোধহয় শক্ত আশ্রয় খুঁজে পেলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। সার্থক মাহার এলোমেলো চুলে চুমু খেলো। অতঃপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহার কোঁকড়া চুলের অরণ্যে।

_________________

“আমাদের কাজে যদি ব্যাঘাত ঘটে?”
“ঘটবেনা।”

তারপরের কথোপকথন গুলো হলো ইংলিশে। একজন বললো ব্রিটিশ এক্সেন্টে অপরজন মিশ্র।
“তুমি এতোটা সিউর কিভাবে?”

লম্বা, ফর্সা ছেলেটা হাসলো। হেসে বললো,
“এত সহজ সবকিছু? এত বছরের রাজ্য ছেড়ে রাজা কোথায় যাবে! তাছাড়া আসক্তি বড়ই খারাপ রোগ, আলবার্ট।”

সামনে থাকা যুবকটার কথায় আলতো হাসলো আলবার্ট নিজেও। সত্যিই তো! এত সহজ সবকিছু! ঘরটা নিরব। ঢকঢক আওয়াজ হচ্ছে কেবল। নিরবে মদ্য পান করছে দুই মানব। বাইরে যত রাত বাড়ছে ততই নিশুতি রাতের কান্নাও গাঢ় হচ্ছে। মানব দুজন যতই বলুক তারা ভয়ে নেই। বিষয়টা ভুল। উভয়ের মনেই শঙ্কা। ভয়ংকর শঙ্কা। আস্তে আস্তে শঙ্কাগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে কড়া নেশার প্রকোপে। কিন্তু আবার তো ফিরবে তারা!

(চলবে)….

#অলকানন্দা
#পর্ব-১৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৫৫.
কারো বুকের ধুকপুক আওয়াজে ঘুম ভাঙলো মাহার। মাথাটায় প্রচুর ব্যথা করছে। চারিদিক ধোঁয়াশার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। থেমে থেমে স্পষ্ট হয় সব। নিজের পাশে সার্থক কে দেখে যারপরনাই অবাক হয় মাহা। দুর্বল স্বরে চিৎকার করে উঠে। মাহার চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সার্থক। সারারাত ঘুম হয়নি। মাথা ভারী লাগছে তার। উঠে বসে ডান হাতটা এগিয়ে জ্বর মেপে নেয় মাহার। কমে এসেছে দেখে শান্তি পায় সে। মাহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। হলদে মুখটা কি যে আদুরে লাগছে! সার্থকের ইচ্ছে করছে গালে একটু আদর দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নেয় সে।
“আ..আমি কোথায়?”
দুর্বল কন্ঠ মাহার। সার্থক সামান্য হেসে বলে,
“তোমার স্বামীর বাড়ি।”
“মানে?”
“আমি তোমার স্বামী। এটা আমার বাসা।”
“আমি এখানে কিভাবে?”
“বড্ড প্রশ্ন করো তুমি মাহা। চলো ফ্রেশ হয়ে নেও। ব্রেকফাস্ট করে ঔষধ খেতে হবে।”

নিজের দিকে তাকিয়ে আরো অবাক হলো মাহা। তার গাঁয়ে এসব কি! এটা তো ছেলেদের টি-শার্ট আর টাউজার। চিন্তিত, ক্লান্ত, দুর্বল স্বরে সে প্রশ্ন করে,
“আমার গাঁয়ে এসব কেন?”
“আমি তোমার স্বামী মাহা। আমি পরিবর্তন করে দিয়েছি।”

মাহা স্তব্ধ হয়ে আছে। এমন অকপট সত্যের উত্তরে কি বলবে সে। কোনো ভাষা তো খোঁজে পাচ্ছেনা! হঠাৎ তড়িৎ গতিতে সজাগ হয় মস্তিষ্ক। বাবা! বাবা তো আর নেই! মাহার একমাত্র আপন মানুষটাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মাহা কি নিয়ে বাঁচবে। অশ্রুরা এসে ভিড় জমালো মাহার নয়নে। মাহার কান্নার শব্দে ভরকে যায় সার্থক।

“এই কান্না করছো কেন তুমি? আমি সত্যি তোমার সাথে কিছু করিনি মাহা।”

মাহার কান্না থামছেনা। সার্থকের বুকে যে ব্যথা হচ্ছে।
“প্লিজ মাহা কেঁদো না। আমাকে বলো আমি কি কিছু করেছি?”

মাথা নাড়ায় মাহা।
“আপনার কোনো দোষ নেই সার্থক। আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে গতকাল। বহুদূরে।”

মাহার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। নিজেকে সামাল নেওয়া দায়। সার্থক বুকে আগলে নেয় মাহাকে। মাহাও যেন আশ্রয় খুঁজে পায়।

________________

“মাহাকে তার মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হোসেন ভাই মারা গেছেন।”
“কি!”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় রেজওয়ান। খুব রাতে বাড়ি ফিরেছিলো ছেলেটা। তাই সাবিনা বেগম ছেলেকে কোনো কথা বলেন নি। তিনি তো জানেন রেজওয়ান কতটা চায় মাহাকে। নাস্তা খেয়েই রেজওয়ান ভেবেছিলো মাহার সাথে দেখা করতে যাবে। মায়ের মুখে এসব শুনে নাস্তা খাওয়া হলোনা তার। দাঁড়িয়ে গেলো সে। ছেলেকে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সাবিনা বেগম বললেন,
“নাস্তা করে যা।”

অসহায় চোখে মায়ের পানে তাকালো রেজওয়ান। মা কি বুঝেনা রেজওয়ানের ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে! সে আর কথা বাড়ায় নি। চুপচাপ পাশে রাখা ওয়ালেট আর রিভলবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে । সোজা পথে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই মাহার বাড়ি। রেজওয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় চারতলায়। কিন্তু হতাশ হয় । দরজায় তালা দেওয়া। মাহার কাছে তো মোবাইলও নেই। কোথায় গেলো মেয়েটা!

৫৬.
“ভাইয়া?”

এশার কন্ঠে পিছু ফিরে রেজওয়ান। শ্যাম বর্ণের মেয়েটার ভীতু চাহনি। বিচলিত কন্ঠে রেজওয়ান প্রশ্ন করে,
“মাহা, মাহা কোথায় গিয়েছে? জানো?”
“আমি সঠিক বলতে পারবোনা ভাইয়া। গতকাল ফুপি আপুকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।”
“মগের মুল্লুক নাকি! একটা জলজ্যান্ত মানুষ কে তার নিজের বাসা থেকে বের করে দিলো। আর তোমরা বসে বসে দেখছিলে। এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কি করে হও তোমরা!”

ধমকে উঠলো রেজওয়ান। এশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয় মানুষটার মুখে এমন ধমক শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় এশা। মাথার চুলগুলো আলতো টেনে নিজেকে সামলায় রেজওয়ান। এমনিতেই সকাল থেকে মন মেজাজ বিগড়ে আছে। কিছু না বলেই নিচে নেমে আসে । চারতলায় একটা মেয়ে যে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে খেয়াল কি আছে তার!

পুলিশ স্টেশনে ইনভেস্টিগেশনে মন নেই রেজওয়ানের। কোথায় খুঁজবে মাহাকে ! এদিকে কেসের তদন্ত। মোবারক জানিয়েছেন সিলেটে তিনি কোনো ক্লু খুঁজে পাননি। ফিরে আসবেন আগামীকাল। এদিকে স্যার সময় দিয়েছেন এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহের ভিতর একটা রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন এসপি প্রলয়। বিভিন্ন চ্যানেল, নিউজ পেপারে লেখালেখি হচ্ছে এই ব্যাপারে। আতঙ্কিত দেশের মানুষজন।
“আসবো মিঃ রেজওয়ান ?”
“আসুন। মিস তাজ।”

তাজ ভিতরে এসে বসলেন। হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলেন রেজওয়ানের দিকে।
“এটা ২০১২ সালের তদন্তের ফাইল।”

রেজওয়ান বিস্মিত হয়ে বলে,
“কোথায় পেলেন?”
“পেয়েছি। কোনো এক সূত্রের মাধ্যমে। সম্পূর্ণ নয়। আংশিক তদন্তের বিস্তারিত আছে। ভিক্টিমের ডিএনএ রিপোর্ট আসতে দেরি হবে। আমাদের উচিত মাতব্বর শরীফের সাথে সেলে দেখা করা।”
“আমিও এই কথাই ভাবছিলাম মিস তাজ। ঘটনার কত সময় পেরিয়ে গেলো। অথচ আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই।”

তখনই ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। একটা অপরিচিত নাম্বার।
“হ্যালো কে?”
“ভাইয়া, আমি মাহা।”
“মাহা, কোথায় তুমি? আন্টি এমন একটা কাজ করলো! তুমি আমাদের বাসায় চলে আসোনি কেন? এখন কোথায় তুমি?”
“আমি নিরাপদ আছি, ভাইয়া। চিন্তা করবেন না। বাবাকে কোথায় কবর দিয়েছে?”

অশ্রুসিক্ত গলায় বলে উঠলো মাহা।

“তোমাদের গ্রামে। নারায়ণগঞ্জ। কোথায় তুমি মাহা?”

“ভাইয়া, আপনি তো জানেন এই ঢাকা তে আমার আপন বলতে কেউই নেই। আপনাকে আমি আমার বড় ভাইয়ের স্থানে বসিয়েছি ছোট থেকেই। আপনি কি একটু গুলশান আসতে পারবেন। কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।”
“আমি আসছি।”

ল্যান্ডলাইনের ফোন দিয়ে রেজওয়ান কে কল করেছিলো মাহা। মাত্রই গোসল করে বাইরে এসেছে সে। সার্থকের ঘরটা ভিষণ বড়। দেয়ালে লাল রঙা কারুকাজ। রাজকীয় খাট, ওয়ারড্রব, পাশে বিশাল বুকশেলফ। ছিমছাম, পরিপাটি ঘর।

“কার সাথে কথা বলছিলে মাহা?”
“রেজওয়ান ভাইয়া।”

রেজওয়ান নামটা শুনেই চরম বিরক্ত হলো সার্থক। অজানা কারণে রেজওয়ান কে বিরক্ত লাগে সার্থকের কাছে। চরম বিরক্তি লুকিয়ে স্নিগ্ধ চোখে মাহার পানে তাকালো সার্থক। কি অপরূপ তার অলকানন্দা! লাল টকটকে থ্রি পিসে কি যে মায়াবী লাগছে। মাথায় তোয়ালে প্যাঁচানো। সার্থক কে এমন গভীর চোখে তাকাতে দেখে লজ্জা, অস্বস্তি ঘিরে ধরে মাহাকে। দীর্ঘ সময় কান্নার ফলে চোখ দুটো টকটকে লাল তার।

৫৭.
“ভাবীকে নাস্তা খাওয়াবেনা ভাইয়া?”

নিভার হাসিমাখা কথায় ঘোর ভাঙে সার্থকের। মাহা যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হলো।
“নিভা। ঘরে আসো।”

ঘরে ঢুকে নিভা। সোনালী চুলের বিদেশি রমনী। দেখে বুঝার উপায় নেই এই মেয়েটা কে। কারণ সার্থকের সাথে কোনো মিল নেই তার। সার্থক তার গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“মাহা, ও আমার বোন। নিভা।”

মাহা কি বলবে বুঝে পেলোনা। লোকটা সেই কখন থেকেই মাহার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেন মাহা তার কতদিনের পরিচিত। আচ্ছা, মাহার তো এই পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়েটা তার সার্থকের সাথে হয়েছে। এই কথাটাও সত্য। সার্থকের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে তাকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়। মাহা যদি মেনে নেয় তাহলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে!

“চলো ভাবি। নাস্তা করবে।”

মাহা জানেনা কেন। তবে সে তাকালো সার্থকের পানে। সার্থক মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই সে বাইরে বেরিয়ে এলো নিভার সাথে। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। উপরে দুইটা রুম আর বিশাল বারান্দা। একরুমে তালা দেওয়া। অপরটা সার্থকের। বারান্দায় হরেকরকম ক্যাকটাস গাছ লাগানো। দুয়েক রকম ফুল গাছও আছে। দুইটা বেতের চেয়ার। মাঝে টেবিল। সম্পূর্ণভাবে দেখার সুযোগ হয়নি মাহার। নিভার সাথে নিচে চলে এলো সে। টেবিলে বসে আছে তিনজন পুরুষ। মাহা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই নিচে নেমে এলো সার্থক। মাহার হাতটা আলতো করে ধরে বললো,
“চলো।”

সাহস পেলো মাহা। ডাইনিং টেবিলে সার্থক নিজের পাশে বসালো মাহাকে। রুটি, জেল, স্যূপ, গরুর মাংস, সবজি ভাজি হরেকরকম খাবারে সাজানো টেবিল। নিভা মুইংচিন কে দেখিয়ে বললো,
“ভাবি, মুইংচিন ভাইয়ার সেক্রেটারি। উনি চীনের বাসিন্দা। শান ধর্মাবলম্বী।”

ছোট ছোট চোখ আর চাইনিজ চেহারা বিশিষ্ট মুইংচিনের পানে তাকালো মাহা। বয়সে তো অনেক বড় হবেন মুইংচিন। মাহা কি বলে সম্বোধন করবে। ভাবনার মাঝেই মুইংচিন বললো,
“বাবি, আপনি আমাকে মুইংচিন বলেই দাকবেন।”

আদো আদো বাংলা বুলি। ভালোলাগে শুনতে। মাহা মাথা নাড়লো। নিভা এবার রবার্টকে দেখিয়ে বললো,
“ভাবি, ও আমার হাসবেন্ড। রবার্ট। রবার্ট ড্যানিয়েল নাইট। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।”
“হ্যালো, বাবি।”

রবার্টের কথায় হালকা হাসলো মাহা। এবার সার্থক বললো,
“আর ও হচ্ছে আমার বন্ধু লুবান।”

শ্যামলা বর্ণের বলিষ্ঠ পুরুষ লুবান। মাহা সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাবি।”

বিভিন্ন কথার মাঝেই নাস্তা খাওয়া শেষ হলো সকলের। রবার্ট, লুবান বাইরে বেরিয়ে গেলো। নিভা, মুইংচিন রয়ে গেছে বাসায়। মাহা শান্ত হয়ে বসে আছে। কোথায় যাবে এখন! সার্থকের ঘরে কি!

“মাহা?”

সার্থকের ডাকে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাহা। মাথা নিচু করে বলে,
“জ্বি?”
“আমার সামনে কখনো মাথা নিচু করে রাখবেনা মাহা। রাণীর মতো মাথা উঁচু করে থাকবে। ঘরে চলো।”

বলেই আর দাঁড়ালো না সার্থক। হনহনিয়ে উপরে চলে যাচ্ছে সে। মাহাও চললো পিছুপিছু। দুজন পরিচারিকা দূর থেকে তা দেখে মিটিমিটি হাসছেন।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো সার্থক। মাহা কিছুক্ষণ আগে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে।

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-২০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৫৮.
“পরিস্থিতি যেমনই ছিলো আমাদের বিয়েটা হয়েছে এটা সত্য। আমরা একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি মাহা। আমার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে, ভালোবাসা এসবে আমার আগ্রহ ছিলোনা কোনোকালেই। বিশ্বাস করো মাহা এটা পবিত্র বন্ধনের শক্তি কিনা জানিনা তবে তোমার জন্য আমার মনে অদ্ভুত একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। এটা কি ভালোবাসা নাকি আমার মোহ তাও আমার জানা নেই। শুধু মনে হয় তোমাকে আমার চাই। যে করেই হোক চাই। আচ্ছা, আমরা কি এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে পারিনা?”

বাইরে নীল দিগন্তের দিকে তাকিয়ে একটানা কথাগুলো বললো সার্থক। এখন তার কিছুটা হালকা লাগছে। মাহা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ। সেও এটাই ভাবছিলো। বিয়েটা যখন হয়েই গিয়েছে তাহলে একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। মাহা তো নিজেও অস্বীকার করতে পারেনা তার মনে একটু হলেও সার্থক জায়গা করে নিয়েছে। নয়তো ঝাঁকড়া চুলের মায়াবী চোখের এই ছেলেটার জন্য তার মন কেমন করে কেন! এই পৃথিবীতে সবাই তো তাকে ছেড়ে চলে গেলো। প্রথমে মা, পরে চৈতি। গতকাল বাবা! আপন বলতে কেউ তো আর নেই। সার্থকের বাড়িতে একটু স্থান হয়েছে। সেই সাথে আপন একটা মানুষ যদি পাওয়া যায় তাহলে একটা সুযোগ দিলে ক্ষতি কি! মাহা যখন ভাবনায় মত্ত তখন সার্থক তার দিকে ফিরে বললো,
“মাহা, আমাকে একটা সুযোগ দাও।”

অদ্ভুত আকুতি সার্থকের কন্ঠে। মাহা সার্থকের চোখে চেয়ে বললো,
“আমাদের বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি চাই।”

বহু কষ্টে আড়ষ্টতা ভেঙে এই কথাটা বলে মাহা চুপ করে গেলো। সার্থক নিজের উত্তর পেয়ে গিয়েছে। মুচকি হাসলো সে। ফোন বের করে কল করলো মুইংচিন কে।

“হ্যালো, মুইংচিন কাজী ডাকানোর ব্যবস্থা করো।”

ওপাশে কি বললো শোনা গেলোনা। তবে লজ্জায় মাহার গাল দুটো লাল হয়ে যাচ্ছে। সে সাথে বুকে চিনচিন ব্যথা। বাবা! আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন! নিজের কষ্ট ভুলতে চতুর্দিক অবলোকন করতে শুরু করলো মাহা। বিরাট বারান্দা। ছোটবড় টবে নানা রকম ক্যাকটাস গাছ। কয়েকটা ক্যাকটাস গাছে আবার ফুলও ফুটেছে। সাদা আর বেগুনি রঙের। অভূতপূর্ব দেখতে। সার্থক মুইংচিনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মাহা ঘুরে ঘুরে দেখছে চারপাশ। ছোট ছোট ক্যাকটাস গুলো দেখতে ভিষণ সুন্দর। একটা হলুদ অলকানন্দার গাছ। সবুজ থোকায় থোকায় হলদে ফুলগুলোকে ভিষণ সুন্দর লাগছে। একটা মাছের অ্যাকুরিয়ামও আছে। তাতে কালো রঙের অদ্ভুত কয়েকটা মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাহা যারপরনাই অবাক। সার্থক অপরদের থেকে একেবারে ব্যাতিক্রম। মানুষ বাগানে লাগায় গোলাপ, ডালিয়া এসব। আর এই উদ্ভট লোক ক্যাকটাস লাগিয়ে রেখেছে। তাছাড়া মাহা অ্যাকুরিয়ামে গোল্ড ফিশ, গাপ্পি, অ্যাঞ্জেল ফিশ, ফ্লাওয়ারহর্ন ফিশ পছন্দ করে। কত সুন্দর লাগে দেখতে। মাহারও একটা গোল্ড ফিশ ছিলো। কিন্তু এখানে অ্যাকুরিয়ামে কালো কালো কিসব মাছ রাখা। মাহা বিরক্ত হলো খানিকটা। পাশে একটা অদ্ভুত ক্যাকটাসের মতো তবে ক্যাকটাস না এমন একটা গাছ দেখতে পেলো মাহা।

৫৯.
মাহা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে গেলো তাদের। কিন্তু তার আগেই ওর হাত টেনে নিজের হাতে পুরে নিলো সার্থক। চোখেমুখে উৎকন্ঠা। মাহা ভয় পেলো খানিকটা।
“এসব গাছে কখনো হাত দিবেনা।”
“কেন?”
“এই যে এখন যে গাছে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলে এটা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ।”

মাহা নিজের গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে সার্থকের পানে। কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। হলদে ফর্সা মুখটা কি যে আদুরে লাগছে। সার্থকের ইচ্ছে করছে টুপ করে খেয়ে ফেলতে কিংবা গালে একটু আদর দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমন করলো সে। ভারী পুরুষালি কন্ঠে বললো,
“তুমি জানো ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ কি?”

মাহা মাথা নাড়লো। যার অর্থ মাহার জানা নেই।
“ঠিক আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে গাছটার দিকে।”

মাহা আগামাথা কিছুই বুঝলোনা। সার্থক কি বুঝাতে চাচ্ছে! মাহা কিছু বলবে তার আগেই তার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলো সার্থক। মাহা চুপ করে গেলো। সার্থক চোখের ইশারা করলো ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ গাছগুলোর দিকে তাকাতে। মাহা সেদিকে তাকাতেই আৎকে উঠলো। গাছগুলো এতক্ষণ মুখবন্ধ করে শান্ত অবস্থায় ছিলো। হঠাৎ একটা মৌমাছি উড়ে আসতেই হা করে ধারালো কাঁটা বের করে খপ করে মৌমাছিটাকে নিজের ভিতর নিয়ে নিলো একটা ভেনিস ফ্লাইট্র্যাপ ট্রি। ঘটনাটা ঘটেছে খুবই দ্রুত। মাহা এখানো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মৌমাছির জায়গায় যদি তার আঙুল থাকতো! ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠছে তার।
“দেখেছো। এরা কত ভয়াবহ।”

মাহার খুব বলতে ইচ্ছে করছে এতো ভয়াবহ গাছ বাড়িতে রাখার কি প্রয়োজন! যে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। কিন্তু মুখে কিছুই বললোনা। এ বাড়িতে এসেছে একদিনও হয়নি এখনই যদি সে অধিকার দেখাতে শুরু করে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাছাড়া বাড়িঘর দেখে বুঝাই যায় সার্থক অনেক বড়লোক। ধনী লোকদের এমন অদ্ভুত ইচ্ছে থাকে। যা মাহা প্রতিনিয়ত টিভি, ফেসবুকে দেখে আসছে। মাহাকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে সার্থক বললো,
“এসব গাছ আমার বাগানে রাখার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা। কানাডায় আমার ছোট একটা ক্যাকটাস বাগান ছিল। সেই অনুযায়ী এখানেও করি। মুইংচিন আমাকে এই ট্র্যাপ গাছ তিনটি উপহার স্বরূপ দিয়েছে। তারমতে এই ফ্লাইট্র্যাপ ট্রি আমাকে সবসময় সতর্ক রাখবে। গোপন শত্রুর কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। ও এতো শখ করে দিলো আমি তাই আর ফেলতে পারিনি।”

সার্থক বলে চললো একটানা। মাহা জানেনা কেন তবে সার্থকের তার কাছে সাফাই দেওয়ার বিষয়টি ভিষণ উপভোগ করেছে সে। কখনো কেউ তো এভাবে তার কাছে সাফায় দেয়নি। কারো জীবনে মাহা কোনো সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলোনা। তাহলে আজ সামনে দাঁড়ানো এত সুদর্শন, স্মার্ট লোকটা তার কাছে সাফাই গাইছে কেন! মাহা কি সত্যিই তার বিশেষ কেউ?
“মাহা শুনছো?”
“হুম?”
“তুমি কি রাগ করেছো?”
“উঁহু।”
“আমি আজই এই গাছগুলো অন্যজায়গায় রাখার ব্যবস্থা করাবো।”
“সেসবের প্রয়োজন নেই সার্থক। আপনি প্লিজ এতোটা বিচলিত হবেন না।”

মাহার কথায় খানিক আস্বস্ত হয় সার্থক। বাইরে হালকা রোদ উঠেছে। খোলা বারান্দা হওয়ায় দুয়েকটা চড়ুই পাখি ভিতরে ঢুকে নিচে বসে রোদ পোহাচ্ছে।

৬০.
সার্থক হঠাৎ করেই টাউজারের পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করলো। মাহার দিকে তাকিয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার হাতটা একটু দাও মাহা।”

সার্থকের আড়ষ্ট ভঙ্গির এমন ডাকে মাহাও লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে বাম হাত এগিয়ে দিলো সে। সার্থক মাহার অনামিকা আঙুলে একটা ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দিলো। কতক্ষণ সেদিকপানে তাকিয়ে বললো,
“আমাদের যাত্রা শুরুর চিহ্নটা তোমার আঙুলে পরিয়ে দিলাম মাহা। কখনো এই আংটিটা খুলো না।”

সার্থক হাত ছেড়ে দিয়েছে। মাহা তাকিয়ে রইলো আংটিটার দিকে। একধ্যানে। শুরু হলো কি তবে একটা আঁধার আলোর খেলার?
“ভাইয়া? ভাবিকে একটু ছাড়ো এবারে। আমাদের সাথেও গল্প করার সুযোগ দাও। নাকি তোমার বউকে শুধু তুমি নিজের কাছেই রাখবে?”

নিভার কথায় মুচকি হাসলো সার্থক। নিভা মজার ছলে সার্থকের মনের কথাটাই বলেছে। সার্থক সত্যিই পারলে মাহাকে সারাক্ষণ নিজের কাছেই রাখতো। নিভা এবার মাহাকে বললো,
“ভাবি, চলো আমার ঘরে। তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি।”

মাহা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। নিভা মেয়েটাকে তার কাছে ভালোই লেগেছে। হাসোজ্জল থাকে সবসময়। কথায় অনেক মাধুর্য। মাহার সাথে হয়তো আজই প্রথম পরিচয়। অথচ এমন ব্যবহার করছে যেন বহুদিনের চেনাজানা। সার্থকের ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো সে। মাহা তার পানে তাকিয়ে আছে। হয়তো অনুমতি চাচ্ছে। নিভার সাথে যাবে কি যাবেনা। সার্থক মাহাকে কিছু বললোনা। নিভার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার ঘরে বসে গল্প করো তোমরা।”
“আচ্ছা, ভাইয়া।”

ঘরে বসে অনেকটা সময় গল্পে গল্পে কাটলো মাহার। নিভা প্রচুর কথা বলে। মাহা স্বল্পভাষী মানুষ। দুয়েকটা উত্তর দেওয়া আর কথা জিজ্ঞেস করা ছাড়া সে বিশেষ কিছুই বলতে পারলোনা। একসময় ঘুমিয়ে গেলো মাহা।

________________

চারপাশে অন্ধকার। একটা রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছে মাহা। আশেপাশে বিশাল জঙ্গল। চৈতির চিৎকার হঠাৎ কানে বেজে উঠলো মাহার। মাহা দিকবিদিকশুন্য হয়ে খুঁজতে শুরু করলো চৈতিকে। তবে নেই। চৈতি নেই।

হাঁটছে মাহা। হাঁটতে হাঁটতেই ফোন বেজে উঠলো তার। সেই পুরানো স্মার্টফোন টা। একটা কল এলো। চৈতি কথা বলছে। কি বলছে জানেনা মাহা। তারপর….

তারপর আর মনে নেই। অন্ধকার আর অন্ধকার। মাহার ঘুম ভাঙলো সার্থকের ডাকে। নরম সুরে ডাকছে,
“মাহা, এই মাহা উঠো।”

মাহা তখনও চোখ বুজেছিলো। হঠাৎ সার্থকের ঠোঁটজোড়ার অস্তিত্ব নিজের কপালে অনুভব করতেই লজ্জা পেলো মাহা। সার্থক এখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাহার কি যে লজ্জা লাগছে! তার গাল গুলো বোধহয় লাল হয়ে যাচ্ছে। এতোক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলেও এবার ঘুমের ভান করে আছে মাহা। সার্থকের এহেন কাজে তার যে ভিষণ লজ্জা লাগছে। এখন সে কি করে সার্থকের সামনে মুখ দেখাবে।

সার্থক আবার মাহাকে আলতো করে নরম সুরে ডাকলো,
“মাহা, এই মাহা উঠো।”

মাহা মনে মনে বললো,
“উঠবোনা ডাক্তার। আপনি এখানে থাকা অবস্থায় চোখ খোলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-২১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৬১.
কাকের মতো সরু মুখ, মাথায় গজানো অনেকগুলো হরিণের ন্যায় শিং। সাদাকালো ছবিটায় অদ্ভুত মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট একটা প্রাণী। নখগুলো বড় বড়। নখগুলো লাল, ঠোঁটও লাল। একটা জঙ্গলের ভিতর স্থির হয়ে বসে প্রাণীটা। দেখে মনে হচ্ছে শিকারের জন্য ওৎ পেতে আছে। পূর্ণিমার রাত। প্রাণীটার পিছনে কালো আঁধারে ঢাকা জঙ্গল। আকাশে বৃহদাকার চাঁদ। মাহা একধ্যানে তাকিয়ে ছবিটা দেখছে। গাঁ হঠাৎ শিউরে উঠলো তার। দুতালায় বদ্ধ ঘরটার পাশে দেয়ালে টানানো ছবিটা। নিচে ছোট করে কি যেন লেখা। মাহা কাছে এগিয়ে গেলো পড়তে।
“ওয়েনডি……

আর পড়তে পারলোনা মাহা। ঘরে ফোন বাজছে। সময়টা বিকেল। দুতালায় আপাতত কেউ নেই। সেসময় মাহাকে ডেকে তুলে বেরিয়েছে সার্থক। মাহার হঠাৎ খেয়ালে এলো সে তো রেজওয়ান কে গুলশান আসতে বলেছিলো বিকালে। রেজওয়ান কে মাহা নিজের বড় ভাই হিসেবে মানে। আপন না হোক ছোট থেকেই অনেক সাহায্য করেছে তাকে। বিয়ের মতো এত বড় একটা সময়ে রেজওয়ান উপস্থিত থাকলে খানিক বল পাবে মাহা, প্রথমে ভেবেছিলো বাইরে দেখা করবে। পরে ভাবলো বিয়েতে তার পক্ষেরও কেউ থাকা দরকার। বাবার মৃত্যুর শোক ভুলানো কঠিন। আশ্চর্যভাবে সার্থক পাশে থাকলে মাহা সব ভুলে যায়। কষ্ট লাঘব হয় তার। তখন মনে এসে ভিড় করে একরাশ লজ্জা। ছবিটার লেখা আর পড়তে পারলোনা সে। এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে। কিন্তু তার আগেই ল্যান্ডফোন বেজে থেমে গিয়েছে। নিভার সাথে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলো মাহা। ঠিকানা নেওয়া প্রয়োজন। এই জায়গাটা যে গুলশান তাই জানতোনা সে। সার্থকের মুখে শুনেছে। তাই রেজওয়ান কে বলেছিলো গুলশান আসতে। কিন্তু সকালের পর আর কোনো খবরই ছিলোনা রেজওয়ানের। মাহা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামলো। নিভা, সার্থক, মুইংচিন কাউকেই খুঁজে পেলোনা। একজন বৃদ্ধ বয়সী পরিচারিকা রাজকীয় সোফার পাশে রাখা ছোট টেবিল গুছিয়ে রাখছিলেন। তার কাছে এগিয়ে গেলো মাহা। নরম কন্ঠে বললো,
“শুনছেন?”

বৃদ্ধ পরিচারিকা জবাব দিলেন না। তার পরনে একটা কালো ঢোলা পোশাক। একেবারে পা পর্যন্ত। সাদা উড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। শান্ত, অবিচল তার ভাবভঙ্গি। মাহা পিছন থেকে আবার ডাকলো,
“আন্টি, একটু প্রয়োজনীয় কথা ছিলো।”

এবারেও বৃদ্ধ মহিলা চুপ। তখনই সদর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো লুবান। মাহার মাথা, চুল সবকিছু লাল উড়না দিয়ে ঢাকা। মাহা জানেনা কেন তবে লুবান কে পছন্দ হয়নি তার। কেমন যেন দৃষ্টি। কিভাবে যেন তাকিয়ে থাকে। এই দৃষ্টিতে মাহা খুঁজে পায় লোলুপ হায়নাদের দৃষ্টি। লুবান কথা বলার সময় বারবার তার বুকের দিকে তাকিয়েছিলো সকালে। ব্যাপারটা তার চোখ এড়ায়নি। কিন্তু সার্থক হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো বিধায় নিজেও মুখে হাসি রেখেছে। বড়ই অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। লুবান মুখে হাসি ফুটিয়ে মাহার দিকে এগিয়ে এলো। বৃদ্ধা ততক্ষণে সে স্থান ত্যাগ করেছেন। বাড়িটা বিশাল বড়। নিচে ড্রয়িং রুমটা বৃহৎ।
“ভাবীজান? কোনো প্রয়োজন আপনার?”

বলেই ঈষৎ হাসলো লুবান। এমন ডাক শুনে ভড়কে গেলো মাহা। মাথা নিচু করে বললো,
“না।”
“যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে বলবেন ভাবীজান। সার্থক না থাকলেও আমি আছিতো। আপনার সব প্রয়োজন পূরণ করে দিবো। তাছাড়া….

লুবানের কথায় ব্যাঘাত ঘটালো নিভা।
“লুবান ভাইয়া। ঘরে যান। আপনার জন্য একটা পার্সেল আসছে।”
“হুম, যাই।”

লুবান প্রস্থান করার আগে মাহার বুকের দিকটায় আবার তাকালো। গাঁ গুলিয়ে আসছে মাহার। এমন লোকের সাথে এবাড়িতে কি করে থাকবে সে!

৬২.
“নিভা আপু?”
“জ্বি, ভাবী?”
“উনি কোথায়?”
“কে? সার্থক ভাইয়া?”
“হুম।”

নিভা মুচকি হাসলো। আস্তে করে বললো,
“তোমার উনি কেনাকাটা করতে গিয়েছে। বিয়ের দিনে বউ মানুষ বেনারসি না পরলে বড্ড বেমানান দেখায়। আমি বলেছিলাম কাউকে পাঠাতে। কিন্তু ভাইয়া মানেনি।”

নিভা বয়সে মাহার থেকে অনেক বড়। তাই মাহা তাকে আপু বলেই ডাকে। নিভা ততক্ষণে সোফায় গিয়ে বসেছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই ড্রয়িং রুম। সেখানে রাজকীয় কায়দায় ডিজাইন করা সোফা রাখা। দামী আসবাব, উপরে ঝালরে সজ্জিত অসম্ভব সুন্দর ঘর। নিভা সোফায় বসে নিজের সোনালী চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,

“ভাবী, বসো। একটু গল্প করি।”

মাহা বসলো।
“আপু, এই জায়গার ঠিকানাটা কি একটু দেওয়া যাবে?”

মাহার কথায় খানিক অবাক হলো নিভা। তৎক্ষনাৎ অবাক ভাব কাটিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“অবশ্যই দেওয়া যাবে। কোনো প্রয়োজন ছিলো?”

একটু কেমন যেন শুনালো নিভার গলা।
“না, মানে। আমার একজন পরিচিত আসবেন।”
“সার্থক ভাইয়ার পারমিশন নিয়েছো?”
“মানে?”
“আসলে ভাইয়া বাইরের মানুষ বাড়িতে বেশি একটা এলাউ করেনা।”
“উনি আমার খুবই কাছের একজন বড় ভাই। আমার বিয়েতে আমার পক্ষ থেকেও কেউ একজন থাকা উচিত। তাই আর কি….

মাহার নরম সুর। নিভা মুচকি হেসে বললো,
“এই ভাবী। রাগ করলে। আমি এমনি বলেছি।”

অতঃপর ঠিকানা বললো নিভা। মাহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরে উঠে এলো। একা থাকার অভ্যাস তার আছে। সেই সাথে অবাধ স্বাধীন মেয়ে মাহা। সার্থকের রুমে প্রবেশ করে রেজওয়ান কে কলো দিলো সে।
“হ্যালো, হ্যালো মাহা তুমি ঠিক আছো? আমাকে ক্ষমা করো মাহা। তখন আসছি বলেও আসতে পারিনি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ পড়ে গিয়েছিলো। চিন্তা করোনা মাহা। আমি এখন গুলশান আসছি। যেখানেই থাকোনা কেন! তোমায় আমি উদ্ধার করবো মাহা। আমার বাসায় থাকবে তুমি।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো সারলো রেজওয়ান। মাহা তাকে থামিয়ে বললো,
“বিচলিত হবেন না ভাইয়া। আমি ঠিক আছি। আজ জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি, ভাইয়া। আপনি উপস্থিত থাকলে আমি বল পাবো। আপনাকে ছোট থেকেই বড় ভাই মেনে আসছি।”

রেজওয়ান চিন্তায় পড়ে গেলো খানিকটা। কিসের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত! কি করতে চলেছে মাহা!
“তুমি কিসের কথা বলছো মাহা?”
“আপনাকে ঠিকানা জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি আসুন ভাইয়া। তারপর না হয় বিস্তারিত বলবো।”
“ঠিক আছে।”

ঠিকানা বলে ফোন কাটতেই ঘরে ঢুকলো সার্থক। গাঁয়ে কালো রঙের শার্ট। ডেনিম প্যান্ট। ঝাঁকড়া চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। গালে হালকা দাঁড়ি। মাহা একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। অবচেতন মস্তিষ্ক না চাইতেও ভাবছে, কেন সার্থক তাকে মেনে নিচ্ছে! কেন তাকে আশ্রয় দিচ্ছে? ওর মতো এতিম, চালচুলোহীন মেয়েকে সার্থকের মতো এতো বড় মাপের একজন প্রতিষ্ঠিত ডক্টর কেন বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইছে? এটা কি তবে করুণা? শেষ পর্যন্ত মাহা কারো করুণার পাত্রী হলো! শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে মাহার দিকে এগিয়ে এলো সার্থক। শপিং ব্যাগগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো,
“বেশি কিছু কিনতে পারিনি। তোমারও মন ভালোনা। এসব ভালোলাগবে না। একটা লাল বেনারসি আর কিছু গহনা এনেছি। কষ্ট করে একটু পরবে? মন না চাইলে দরকার নেই।”

সার্থকের গম্ভীর, ভারী সুরটা নরম, আকুতিভরা ঠেকলো মাহার কানে।

৬৩.
“ঠিক আছে। কিন্তু আমি শাড়ি পরতে পারিনা।”

হাসি ফুটে উঠলো সার্থকের মুখে। চুলগুলো ডানহাতে পিছনে ঠেলে বললো,
“নিভা পরিয়ে দিবে।”

রাত হয়ে এসেছে। সোফায় বসে আছে রেজওয়ান। এত বড় বাড়িতে মাহা কি করে এসেছে ভেবে পেলোনা রেজওয়ান। কলিং বেল চাপতেই একজন তরুণী সদর দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তার পরনে পুলিশ ইউনিফর্ম। তরুণী কিছু না বলেই সরে দাঁড়িয়ে তাকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে। সোফায় বসার কথা বলে কোথায় যেন চলে গেলো। পাঁচ মিনিট যাবত সোফায় বসে আছে সে।
“জ্বি, আপনি কার সাথে দেখা করতে এসেছেন?”

নিভার প্রশ্নে রেজওয়ান বললো,
“একটু মাহাকে ডেকে দিন।”
“আপনি একটু অপেক্ষা করুন। ভাইয়া, ভাবী আর কিছুক্ষণ পরেই নিচে নামবে।”

কথায় যেন দাম্ভিকতা ফুটে উঠলো। রেজওয়ান চুপ করে বসে আছে। ভাবী মানে! কিসের ভাবী!

আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমে মানুষ বাড়ছে। রবার্ট, মুইংচিন, লুবান, নিভা, দুইজন পরিচারিকা, তিনজন পুরুষ কাজের লোক। মুইংচিন কিছুক্ষণ আগেই কাজী নিয়ে এসেছে। ঝালরের আলোয় ঝকঝক করছে চারপাশ। রবার্ট, লুবান কুশল বিনিময় করেছে রেজওয়ানের সাথে। সেও করেছে। কিন্তু কিছুই তার চৌকস মস্তিষ্কে ঢুকছেনা। হচ্ছে কি এসব! মোবাইলেও চার্জ নেই। এসব ভাবনার মাঝেই লাল টকটকে শাড়ি পরে হালকা সাজে সার্থকের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো মাহা। রেজওয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন বউ সাজে মাহাকে সে কতরাত স্বপ্ন দেখেছে হিসেব নেই! মাহার হাত ধরে সার্থক হাসিমুখে রেজওয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালো। বউ সাজে মাহার পাশে সার্থক কে দেখে অনেক অবাক হয়েছিলো রেজওয়ান।
“খুব খুশি হয়েছি মিঃ রেজওয়ান । আপনি এসেছেন। মাহার তরফ থেকেও তো কেউ থাকা প্রয়োজন ছিল। আপনি বড় ভাই হয়ে না হয় থাকলেন। কি বলো মাহা?”

মাহা মাথা নিচু করে বললো,
“জ্বি?”

রেজওয়ান অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। বিয়ে! তাও সার্থকের সাথে! কোনো কিছু বলার সুযোগই পেলোনা সে। চোখের সামনে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে অন্যের হতে দেখে বুকটায় অসহনীয় ব্যথা করছে রেজওয়ানের। মাহা! যদি তুমি জানতে আমি তোমায় ঠিক কতটা ভালোবাসি! আমি তোমায় পেলাম না মাহা। আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে! উপরে হাসিখুশি দেখালেও ভিতরে ভিতরে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে রেজওয়ান। সার্থকের ঠোঁটে ঈষৎ হাসি।

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-২২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৬৪.
রেজওয়ানের গলা দিয়ে খাবার নামলোনা। হরেকরকম খাবারে সুসজ্জিত টেবিল। গোশতের বহু আইটেম। তাছাড়া দেশি, বিদেশি বিভিন্ন লোভনীয় খাবার। মাহা সার্থকের পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে। আসলে মাহা বুঝতে পারছেনা তার কি বলা উচিত। খাবার টেবিলে নিভা, রবার্ট, মুইংচিন, লুবান বসে। তারা তাদের মতো কথা বলে যাচ্ছে। হাসি – তামাশা করছে। রবার্ট বাংলা জানেনা। তাছাড়া সে কথা কম বলে। খুবই অল্প। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে তার বাড়ি। সাদা ফর্সা গাঁয়ের রঙ। গোল্ডেন রঙের চুল, ব্লু চোখ। বাংলায় কথা বলতে পারেনা রবার্ট। ইংরেজিতে মত বিনিময়ে অভ্যস্ত সে। কিন্তু মাহার সাথে কথা হলেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে রবার্ট। রেজওয়ানের চোখ পড়লো মাহার দিকে। মাথায় শাড়ির আঁচল। লাল টকটকে শাড়িতে কি যে অপরূপ লাগছে হলদে ফর্সা মেয়েটাকে! আচ্ছা, মাহা তো এখন অন্যকারো বউ! রেজওয়ানের কি পাপ হবে ওর দিকে তাকালে?
“মিঃ রেজওয়ান? খাচ্ছেন না যে? খাবার মজা হয়নি?”

সার্থকের প্রশ্নে রেজওয়ান বলে,
“না, না। আসলে আমার এখন খাওয়ার মুড নেই।”
“তা বললে হবে? আপনি মাহার বড় ভাইয়ের মতো। ওর বিশেষ দিনে একটু খাওয়া দাওয়া না করলে হবে? একটু পায়েস অন্তত খান।”
“হুম।”

পায়েসের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছে রেজওয়ান। ভাগ্যটা এতটা নির্মম না হলেও পারতো! লুবান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে। মাহা খেয়াল করেছে। অদ্ভুত লাগছে তার। রেজওয়ানের সাথে আলাদা একটু কথা বলা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ব্যস্ততায় তা সম্ভব হয়নি। অনেকটা ঘোরের মাঝেই কবুল বলেছে মাহা। সার্থক যদিও বেহায়ার মতো প্রথমবারেই গড়গড় করে কবুল বলে দিয়েছে। ঘরে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিলো তখন। মাহার কি যে লজ্জা লাগছিলো! নিভা তো হাসতে হাসতে বলেই ফেললো,
“ভাইয়া, তোমার বউকে কেউ ছিনিয়ে নিচ্ছেনা।”

সার্থক মুচকি হেসেছিলো তখন। বেহায়া লোক!

“লুবান? তোর সাথে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা ছিল?”

লুবান থাই স্যূপ খাওয়া থামিয়ে বললো,
“কি কথা?”
“তোকে কয়েকমাসের জন্য কানাডা যেতে হবে?”
“হঠাৎ?”
“আছে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ।”

৬৫.

লুবান আর কোনো শব্দ করেনি। চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। মাহা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। যাক লুবানের থেকে রেহাই পাবে সে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গিয়েছে। রেজওয়ানের প্রস্থান করার সময় হয়ে এলো। মনটা মানছেনা। মনকে কড়া করে বকে শক্ত করলো রেজওয়ান। সোফা থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালো রেজওয়ান।

“আসি, মাহা।”

মাহাও রেজওয়ানের সাথে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। রেজওয়ান অনেক চেষ্টা করছে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতে।

“রেজওয়ান ভাইয়া?”
“হুম, মাহা। কিছু বলবে?”
“আপনার সাথে কথা বলার তো সুযোগই পেলাম না আমি। আপনাকে অনেক কথা বলার আছে ভাইয়া।”
“আমারও কিছু প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন মাহা। আজতো সম্ভব না। তুমি কি আমার সাথে দেখা করতে পারবে?”
“আমি চেষ্টা করবো। যদি সম্ভব হয় কল করে জানাবো আপনাকে। সার্থক.. সার্থক খুবই ভালো ভাইয়া। আমার মতো এতিম, অসহায় মেয়েকে সহায়তা করেছে ও। কয়জনে করে এমনটা।”

রেজওয়ান মনে মনে বললো,
“তুমি যদি আমাকে একটা সুযোগ দিতে মাহা। আকাশের চাঁদটা তোমার পায়ে এনে রাখতাম আমি।”

মুখে বললো,
“সার্থক খুবই ভালো ছেলে, মাহা। তুমি ভালো থাকলেই হলো।”
“আমি আপনাকে আমার বড় ভাইয়ের মতো দেখে এসেছি ভাইয়া। আন্টিও আমাকে অনেক স্নেহ করেন। বাবা, চৈতিকে হারিয়ে এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা হয়েছি আমি। আপনাকেই কেবল একজন ভালো বন্ধু, গুরুজন হিসেবে মেনে এসেছি। আমার অনেক কষ্ট ভাইয়া। আমি কখনো কাউকে বুঝাতে পারবোনা। আমার জন্য একটু দোয়া করবেন ভাইয়া।”

মাহা অশ্রুসিক্ত চোখে বলে উঠলো। হলুদ ফর্সা মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। বাবা ও বাবা, চৈতি রে..
সবার কথা মনে পড়ছে তার!

“প্লিজ, মাহা। কেঁদোনা। দোয়া করি সুখী হও। ভালো থেকো। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে স্মরণ করবে মাহা। আমি যে অবস্থায় পারি, যেভাবে পারি তোমাকে সাহায্য করবো।”

৬৬.

বলেই প্রস্থান করলো রেজওয়ান। একবারের জন্যও পিছু ফিরে চাইলোনা। বহু উৎকন্ঠা নিয়ে সার্থকের ঘরে বিশাল খাটের উপর বসে আছে মাহা। নিভা কিছুক্ষণ আগেই বসিয়ে দিয়ে গেলো তাকে। সার্থক কি আজ নিজের অধিকার চাইবে? মাহার তো সময় প্রয়োজন। মনের অবস্থাও ভালোনা। সদ্য বাবা হারিয়ে মনের গভীরে ক্ষত হয়ে আছে। গভীর ক্ষত। তাছাড়া পবিত্র সম্পর্কে জড়ালেও এত তাড়াতাড়ি কি নিজেকে কারো অধীনে ছেড়ে দেওয়া যায়? ঘরে নীল আলো জ্বলছে মিটিমিটি। এসির টেম্পারেচারটা বোধহয় কম। নয়তো এতো শীত লাগার কথা না! রীতিমতো কাঁপছে মাহা। গাঁয়ে লাল টকটকে শাড়ি। সার্থকের দেওয়া। বহু কল্পনা শেষে ঘরে ঢুকলো সার্থক। হাত থেকে রোলেক্স ঘড়িটা খুলতে খুলতে এগিয়ে এলো মাহার কাছে। মাহার বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। মাহার পাশের টেবিলে ঝুঁকে ঘড়িটা রাখলো সার্থক। নিস্তব্ধতা চারপাশে। শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। সার্থক ঝুঁকেই তাকালো মাহার পানে। আস্তে আস্তে বললো,
“চেঞ্জ করোনি যে? যাও চেঞ্জ করে আসো।”
“হু…হুম।”

মাহা কোনোমতে উঠেই সোফার উপরে রাখা একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছে। অনেকটা সময় পর নীল রঙের সুতি একটা থ্রি পিস পরে বাইরে বের হলো মাহা। সার্থক পাঞ্জাবি পরিবর্তন করে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়েছে। অপরপাশটা খালি। মাহা বুঝলো ঐটা ওর জন্যই। সেও চুপচাপ শুয়ে পড়লো পাশটায়। ঘুম আসছেনা। কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছে তার।
“মাহা?”
“হুম?”
“তুমি কি আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে মাহা?”

কেমন যেন করুণ আকুতি সার্থকের কন্ঠে। মাহার কি হলো সে নিজেও জানেনা। একছুটে সার্থক কে জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থক হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহার কোঁকড়া চুলে। মাহা চোখ বুজে সার্থকের বুকে মাথা দিয়ে আছে।

“মাহা?”
“হুম?”
“আমার জীবনটা অনেক অন্যরকম। আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতো আমি বেড়ে উঠেনি মাহা। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছি প্লেন দূর্ঘটনায়। অতঃপর খালামণির কাছে মানুষ হয়েছি। আমার বড় হওয়া, বেড়ে উঠা, ডাক্তারি পড়াশোনা সবই কানাডাতে। নিভা আমার খালাতো বোন। খালামণির মৃত্যুর পর আমি অনেক ভেঙে পড়ি। তখন নিভা, রবার্ট মিলে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশে আসবে। আমিও পরিবেশ পরিবর্তন করে একটু ভালো থাকবো। তারপর কানাডা ছেড়ে, নিজের শহর ছেড়ে চলে আসি বাংলাদেশে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সার্থক। অতঃপর আবার বললো,
“আমি খুব একা মাহা। আমার পৃথিবীটা খুব ছোট। বিশ্বাস করো সেদিন যখন তোমাকে প্রথম ট্রেনে দেখলাম। আমার পৃথিবী থমকে…

বলতে বলতেই মাহার মুখের দিকে তাকালো সার্থক। মাহা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। সার্থক হালকা হেসে চুমো খেলো মাহার কপালে। চোখ বুজলো সেও৷

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৬৭.
মাহা এই বাড়িতে এসেছে আজ পনেরো দিন। এই পনেরো দিনে ঘটে গিয়েছে অনেককিছু। লুবান কানাডা চলে গিয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে খুবই অসভ্য একটা কাজ করে গিয়েছে সে। আল্লাহ সহায় ছিলো বলে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলো মাহা। এই তো সাতদিন আগে। সার্থক বাসায় নেই। উপরতলায় বাড়ির মানুষ বেশি একটা আসেনা। বাগান, অদ্ভুত মাছ, টিভি আর বই। এভাবে কাটছে মাহার দিন। নিভা মাঝেমধ্যে উপরে আসলে যা একটু কথা হয়। সার্থকের বিশাল একটা বইয়ের সংগ্রহশালা আছে। সেই যে মাহা সেদিন অদ্ভুত একটা প্রাণীর ছবি টানানো দেখেছিলো দেয়ালে সেই ছবিটার পাশেই দরজাটা ছিলো। তালাবদ্ধ। প্রথমদিন মাহা ছবিটায় লেখা নাম খেয়াল করতে পারেনি। দ্বিতীয়দিন সে যখন আবার দেয়ালে তাকালো ছবিটা সেখানে নেই। নিভাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো এমিলিন ছবিটা পরিষ্কার করা কালে ভেঙে ফেলেছেন। এমিলিন হলেন সেই বৃদ্ধা কাজের মহিলা। যিনি মাহার সাথে কথা বলেন নি। সার্থকের কাছে মাহা জিজ্ঞেস করেছিলো এই তালাবদ্ধ ঘরে কি আছে। সার্থক কিছু না বলেই তার হাত ধরে ঘরের সামনে নিয়ে চলে আসে। অতঃপর দরজাটা খুলে দিতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মাহা। সারাঘরের দেয়াল জুড়ে বইয়ের থাক। দেশ-বিদেশের হরেকরকম বই। ঘরের মাঝে একটা টেবিল রাখা। টেবিলের চারপাশে চারটা চেয়ার। সার্থক নিজের ঝাঁকড়া চুলে হাত চালিয়ে মন কাড়া হাসি দিয়ে বলেছিলো,
“বুঝলে মাহা। আমার বই সংগ্রহের বড় শখ। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় যে বই পছন্দ হয়েছে তাই কিনে এনেছি।”

মাহা হালকা গলায় বলেছিলো,
“বাংলায় লেখা বই আছে তো?”
“তুমি আমাকে ঠিক কি মনে করো বলোতো? কানাডায় বড় হয়েছি মানছি। তাই বলে আমি বাংলা সাহিত্য পড়বোনা?”

এদিকে আসো। ঘরের ডানদিকটায় মাহাকে টেনে নেয় সার্থক। মাহা তাকিয়ে আছে সার্থকের হাতে ধরে রাখা নিজের হাতটার দিকে। পরিচয় হলো বেশিদিন তো না। অথচ লোকটা এতো আপন করে নিলো তাকে? এই লোকটা এতো ভালো কেন! ঝাঁকড়া চুলের মানবটাকে কে বলেছিলো এতো ভালো হতে!

“এই যে ম্যাডাম দেখুন।”

শরৎচন্দ্র, বিভূতি-ভূষণ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ সবার বই সারি সারি করে রাখা সেখানে। কি যে সুন্দর লাগছে দেখতে! মাহার হাতটা ছেড়ে ঘরে থাকা বড় কাঁচের জানালাটা খুলে দিলো সার্থক। আলোর দলেরা মুহূর্তেই এসে ভিড় জমালো ঘরে। জানালার পাশে সার্থকের পাশে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিচে রাখা ফুলদানিতে পা লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মাহা। সার্থক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। মাহার ব্যথার চেয়ে বেশি লজ্জাই লাগছে। তখনো চোখমুখ কুঁচকে রেখেছে মাহা। সার্থক উদ্বিগ্ন গলায় পায়ে হাত দিয়ে বললো,
“মাহা? এই মেয়ে বেশি লেগেছে?”

মাহা তখন কি যে বলেছিলো। খেয়াল নেই। তবে লজ্জা পেয়েছিলো খুব। সার্থক কোলে করে ঘরে নিয়ে এসেছিলো তাকে। সেই থেকে মাহার অবাধ বিচরণ সেই লাইব্রেরি ঘরে। পছন্দের বইগুলো হাতে পেয়ে শোক কাটিয়ে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পায় মাহা।

৬৮.
তেমনই একদিন। এক ম্লান দুপুরে ভালো লাগছিলোনা মাহার। সার্থক জরুরি কাজে হসপিটাল গিয়েছে। মাহা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে কিছু মুহূর্ত কাটালো। আগামীকাল লুবান চলে যাবে। মাহার শান্তি লাগছে খুব। লুবানের দৃষ্টি খুব জঘন্য। লাইব্রেরিতে ঢুকে শরৎচন্দ্রের “পরিণীতা” বইটা হাতে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায় মাহা। মনটা আজ বড়ই উদাস লাগছে। বাবা মারা যাওয়ার পর কবর যিয়ারত করার ভাগীদারও মাহা হতে পারেনি। নিজেকে হঠাৎ করেই নিজের কাছে নিকৃষ্ট লাগছে তার। কেমন মেয়ে! বাবার কবর পর্যন্ত যিয়ারত করা তার ভাগ্যে নেই! আকাশে কয়েকটা চড়ুই উড়ে বেড়াচ্ছে। কি যে সুন্দর লাগছে। নিচে ছোট একটা মাঠ। যদিও মানুষজন এদিকে বেশি একটা আসেনা। মাঠের পাশে একটা ছোট পুকুর। পুকুরের চারপাশে গাছপালা। হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দে ভাবনা বন্ধ হয় মাহার। তড়িৎ গতিতে পিছনে ফিরে আঁতকে উঠে মাহা। দরজা লাগিয়ে লুবান দাঁড়িয়ে। বৃহদাকার শরীর।
“আপ..আপনি!”

কালো মুখে বিদঘুটে হাসে লুবান। আস্তে আস্তে মাহার কাছে এগিয়ে আসে সে। ব্যাঙ্গ করে বলে,
“কি করবো ভাবি? আপনি তো আমার সামনে ধরা দেন না।”
“মানে?”

ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে মাহার। কি বলবে! কি ভাববে কোনো ঠাউর সে করতে পারছেনা। মাহার একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে লুবান।
“প্লিজ, আপনি…আপনি এমন করছেন কেন। আমাকে যেতে দিন।”

মাহার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। কি শব্দ তৈরি করবে ঠাউর করতে পারছেনা তার বাকযন্ত্র। মাহার পরনে সবুজ রঙা থ্রি-পিস। মাথায় উড়না। হলদে ফর্সা মুখটায় চিন্তার রেশ। মাহার হাত থেকে বইটা নিয়ে নিচে ফেলে দিলো লুবান। অতঃপর মাহার মাথা থেকে সবুজ উড়নাটা খুলে নিলো একটানে।
“এসব কি দিয়ে রাখেন ভাবি। আপনার কোঁকড়া চুলগুলো তো ভিষণ সুন্দর।”

মাহা চিৎকার করে উঠলো একবার। দ্বিতীয়বার চিৎকার করার সুযোগ পেলোনা সে। তার মুখ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো লুবান। বিরক্তিতে চোঁ শব্দ করে বললো,
“কি যে করেন না ভাবি। আপনার নাগর তো হাসপাতালে। এখানে হাজার চিৎকার পারলেও সে আসবেনা।”

মাহা এবার কান্নাই করে দিলো। এদিকে লুবান খারাপ স্পর্শ করছে তার ঘাড়ে, শরীরে। মাহা চিৎকার করবে সে শক্তি তার নেই। মুহূর্তেই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো মাহা। নিজের পবিত্র শরীরে অপবিত্র স্পর্শে মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। পাশে ছোট টেবিলে একটা টেবিলল্যাম্প রাখা। ধস্তাধস্তি করে লাভ হবেনা মাহা জানে। বৃহদাকার লুবানের সাথে সে কোনো ক্রমেই পারবেনা। আস্তে করে ডানহাতে তুলে নিলো টেবিলল্যাম্পটা। লুবান যখন মাহার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়াতে ব্যস্ত তখনই পিছন থেকে তার মাথায় ল্যাম্পটা দিয়ে জোরে আঘাত করলো মাহা। ভিষণ চমকে মাথার পিছনের অংশটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে একটা খারাপ গালি মাহার উদ্দেশ্যে ছুঁড়লো লুবান। মাহা ততক্ষণে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। পিছন ফিরে দৌড়ানোর একপর্যায়ে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো মাহা। তাকাতে হলোনা আর।

৬৯.
মন আপনা-আপনি বুঝে গেলো লোকটা কে। আঁকড়ে ধরলো মাহা নিজের আপন মানুষটাকে। সার্থক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ। হাতে থাকা শপিং এর প্যাকেটগুলো পরে গেলো নিচে। নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে?”

শক্ত তার কন্ঠ। মাহা কিছু বলার আগেই লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো লুবান। আর কোনো কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলোনা সার্থক। মাহাকে ছাড়িয়ে লুবানের দিকে তেড়ে গেলো সে। মুখ বরাবর ঘুষি লাগিয়ে এলোপাতাড়ি মারলো লুবানকে। লুবানের মত শক্তপোক্ত শরীরও সার্থকের শক্তির সামনে পেরে উঠছেনা। লুবান একবার মুখ খুলে বলেছিলো,
“সার্থক, একটা মেয়ের জন্য তুই তোর এতদিনের বিশ্বস্ত বন্ধুটার উপর..

আর কিছু বলার আগেই একটা ঘুষি পড়লো তার মুখে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে নিভাসহ রবার্ট, মুইংচিন, এমিলিন, পরিচারিকা কয়েকজন ছুটে এলো উপরে। নিভা ঝগড়া থামালো দুজনের। সেদিন রাতেই বাড়ি ত্যাগ করেছে লুবান। মাহা এতকিছুর পরে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলো এমিলিনের মুখের হাসি দেখে। যেখানে সবাই উদ্বিগ্ন সেখানে তিনি এতো খুশি কেন! প্রশ্নটা আজো ভাবায় মাহাকে।

_______________

মিস তাজের দেওয়া ফাইলটা অনুসন্ধান করে বারবার সিলেটের দিকেই ইঙ্গিত পেয়েছে রেজওয়ান। যদিও কাজকর্মে অনেকটা উদাসীন হয়ে উঠেছে সে। এইতো একটু আগেও প্রলয় তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন। সে একমাসের সময় চেয়েছে। দীর্ঘদিনের ভালোবাসা হারিয়ে কি করে কাজ মন দিবে রেজওয়ান! এত সহজ সবকিছু!

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭০.
বাগানের অলকানন্দা গাছটা ভিষণ সুন্দর। সবুজের মাঝে থোকায় থোকায় কি সুন্দর ফুলগুলো ফুটে আছে। মাহা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে নির্ণিমেষ। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সার্থক ঘরে ল্যাপটপে কাজ করছে। হয়তো কোনো দরকারি কাজ। মাহা বিরক্ত করেনি। ওদের সম্পর্কটা এখন বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে। মাহা আসলে বুঝেনা তার মন কি চায়। নিজের অনুভূতি নিয়ে নিজেই সন্ধিহান। ছোটবেলা থেকেই একাকী ছিল তার জীবন। মাহা যখনই যাকে ভালোবেসেছে সেই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ভালোবাসতে বড্ড ভয় মাহার। অবচেতন মন হয়তো কবেই সার্থকের মায়ায় আটকে গিয়েছে। লম্বা চওড়া মানুষটা, ঝাঁকড়া চুলগুলোতে হাত দেওয়ার বড়ই বদঅভ্যাস। যখন কথা বলে মুখে গাম্ভীর্য রেখেই হাসে। মাহার কি যে ভালোলাগে। আশপাশের মানুষের সাথে মাহার খুব একটা পরিচয় নেই। তাছাড়া এই বহুতল ভবনে সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। প্রতিবেশীর খবর নেওয়া তারা খুব একটা পছন্দ করেনা।
“মাহা।”

সার্থকের ডাক শুনে ঘরে ছুটে এলো মাহা। সার্থক ল্যাপটপ পাশে রেখে ডানহাতটা মাথার উপর রেখে শুয়ে আছে।
“কি হয়েছে আপনার?”
“আমাকে এককাপ কফি করে দিতে বলো।”

সবসময়ের মতো উৎফুল্ল শুনালোনা সার্থকের সুর। মাহার সাথে কথা বলার কালে সার্থক নরম সুরে কথা বলে। এমনভাবে যেন একটু জোরে কথা বললেই মাহা ভয় পাবে। মাহা একছুটে নিচে রান্নাঘরে চলে এলো। যদিও সে খুব একটা রান্নাঘরে আসেনা। এমিলিন ছিলেন রান্নাঘরে। মাহা কফি খুঁজে পাচ্ছিলোনা। সে বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পায়নি এমিলিনের কাছে। হতাশ হয়ে নিজেই খোঁজ করছিলো। তখনই আরেক পরিচারিকা মেরি তার হাতে কৌটা বের করে দিলো। মেরি মেয়েটা কানাডিয়ান। নিভার মুখে শুনেছিলো মাহা। যদিও সে বেশি একটা নিচে নামেনা। উপরেই সময় কাটে তার। মাহা কফি বানিয়ে উপরে চলে এলো। সার্থক তখনো মাথার উপর হাত রেখে শুয়ে। মাহা ডাকলো,
“শুনছেন? সার্থক। আপনার কফি।”

সার্থক উঠলোনা। মাহা আবার ডাকলো। বাইরে খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালাটা আটকানো প্রয়োজন। ঘর ভেসে যাচ্ছে পানিতে। সাদা টাইলস পানিতে ছেয়ে যাচ্ছে। মাহা কফির কাপটা রাখলো পাশের টেবিলে । নীল রঙা উড়নাটা টেনে মাথায় দিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলো জানালার কাছে। তবে তা হলোনা। সার্থক তার ডানহাত টেনে ধরেছে। অজানা কারণেই কেঁপে উঠলো মাহা।
“আপনার কফি পাশে রাখা।”

সার্থক শুনলোনা সেসব কথা। একটানে মাহাকে নিজের বুকের উপর নিয়ে এলো। মাহা আজ নতুন কোনো সার্থক কে দেখছে। যার চোখে তৃষ্ণা। কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা। মাহা উঠে যেতে চাইলে তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক।
“কি..কি করছেন আপনি?”
“শসস্।”

মাহার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হলো তাকে। সার্থকের কপালের উপরে চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত। দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। দমকা হাওয়ায় জানালার কপাট নড়ছে। সার্থক ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,
“প্লিজ, মাহা। আজ তোমাকে আমার ভিষণ প্রয়োজন।”

মাহা মুখে কিছুই বললোনা। নিরবতা সম্মতি ভেবে সার্থক ডুব দিলো মাহার মাঝে। প্রিয়তমার নরম অধর নিজের অধরে ডুবিয়ে দিয়ে একাকার হয়ে গেলো দুজনে। বাইরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছে। ভিতরে নিজেদের মাঝে উন্মাদনায় মত্ত দুটো দেহ। তাদের মাঝেও উষ্ণতার ঝড় বইছে।

৭১.

রাতেরবেলা সবাই খেতে বসেছে। রবার্ট, মুইংচিন, নিভা, সার্থক এবং মাহা। রবার্ট বরাবরই কম কথার মানুষ। মুইংচিন নিজের আদো আদো বাংলায় কথা বলে। মাহার খুব মিষ্টি লাগে শুনতে। সার্থক, মাহা সামনাসামনি বসেছে। একান্ত মুহূর্তের পরে মাহা একবারের জন্যও সার্থকের সামনে যায়নি। সার্থক মাহার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। চোখাচোখি হতেই চোখ টিপলো সে। মাহা হতভম্ব হয়ে গেলো। এই ডাক্তার যে এতটা বেহায়া তার জানা ছিলোনা। মাহা দ্রুত মাথা নামিয়ে খাওয়ায় মন দিলো। নিভা সবই খেয়াল করেছে।

“কি ভাইয়া? আজ এতো খুশি কেনো তুমি?”

সার্থক মাহার মুখপানে তাকিয়ে বললো,
“আমার বসন্ত এসেছে বুঝলে নিভা।”
“বসন্ত তো সে কবেই এসেছে, ভাইয়া।”

নিভার বোকা প্রশ্নে সার্থক হাসলো। অতঃপর বললো,
“আমার বসন্তের ফুল আজকেই ফুটেছে।”

মাহা দ্রুত টেবিল ছেড়ে উপরে চলে এলো। ডাক্তারের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আবোল তাবোল বকছে খালি। টেবিলে হাসির রোল পড়ে গেলো। দূর থেকে কেউ একজন সেদিকে তাকিয়ে রইলেন অগ্নিচোখে। হাসিতে বড্ড গাঁ জ্বালা করছে তার। মাহা ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটা। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ায় হালকা শীত পড়েছে। বাইরে ফকফকা চাঁদের আলো। মাহা নিজেদের একান্ত মুহূর্তের কথাগুলো ভেবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠছিলো। তার হলুদ ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। লুবান যাওয়ার পর থেকে মাহা বেশ ভালো আছে এ বাড়িতে। একে একে মনে পড়ছে ফেলে আসা অতীত দিনগুলো। এই একুশ-বাইশ বছরের জীবনে কতকিছু দেখেছে সে। ছোটবেলা মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবার বিয়ে করলেন। ছোট মাহা ভেবেই নিলো আসন্ন মহিলা সত্যিই তার আরেক মা। কিন্তু এক গাছের ফল কি আর অপর গাছে জোড়া লাগে! সৎমায়ের ব্যবহারে দিনদিন আবেগশূন্য হয়ে পড়ছিলো মাহা। স্কুলে কোনো বন্ধু-বান্ধবী নেই। একেবারে একা জীবন মাহার। কলেজেও তাই। বাবা আদর করতেন লুকিয়ে। সৎ মাকে ভয় করতেন কিনা! মাহা জানতো তার বাবা তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। রেজওয়ানের বাবা আর মাহার বাবা বন্ধু ছিলেন। রেজওয়ান আসতো প্রায়ই মাহাদের বাসায়। মাহাকে টুকটাক সাহায্য করতো। মাহাও তাকে নিজের বড় ভাইয়ের মতোই দেখে। এতকিছুর পরেও মনে আপনজনের খাতাটা ছিল শূন্য। এমন কেউ ছিলোনা যে মাহাকে বুঝবে। মাহা যার সাথে নিজের সমস্তটা তুলে ধরতে পারবে। একটা মানুষ। একটা মনের মানুষ। একটা আপন মানুষ। ভার্সিটি কোচিং করা কালে চৈতির সাথে পরিচয়। কি মিষ্টি মেয়েটা। মাহার মনে হলো সে একটা বোন পেয়েছে। একটা ভালো বন্ধু পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অর্থনীতি বিভাগে চান্স পাওয়ার পর থেকে জীবনটা অনেক বদলে গিয়েছিলো মাহার। যদিও বন্ধুমহল সীমিত। তবুও খুবই ভালো সময় কাটছিলো তার। পরে কি যেন হলো। আবছা স্মৃতি। মাহার মনে আছে তাদের পরীক্ষা শেষ হলো। ফোনে কারো সাথে খুব কথা হতো। কার কথা হতো! তার না চৈতির! তারপর মাহা যখন চোখ খুললো নিজেকে আবিষ্কার করলো রুমানাদের বাসার সামনে। কি করে এলো! কেন এলো! কিভাবে এলো! কোনো কিছুই মাহার মনে নেই। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন আসে ঘুমালে। সেগুলো বাস্তব না কল্পনা মাহা জানেনা।

৭২.

অতঃপর ঘটে গেলো কত ঘটনা। অনাঙ্ক্ষিত বিয়ে, চৈতির মৃত্যুর খবর, বাবার মৃত্যুর খবর, সৎ মায়ের দোষারোপ। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কি হলো তা মাহার খেয়াল নেই। কিন্তু যখন চোখ খুললো তখনই কারো বুকে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। এতটা আপন কখনো কাউকে লাগেনি। লোকটার মায়ায় পড়েছে মাহা। মনের ভিতরে ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাখা। মাহা তুই প্রেমে পড়েছিস। ডাক্তারকে তুই ভালোবাসিস। মাহা চিন্তায় পড়লো তার মতো চালচুলোহীন মেয়েকে কি মেনে নিবে এত বড় মাপের মানুষটা! মাহার মনে দ্বিতীয় ভয় সে ভালোবাসলেই তো দূরে চলে যায় আপনজনেরা। মাহার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সার্থক স্বীকৃতি দিলো তাকে। পরিস্থিতি, মন, মস্তিষ্ক সব ভাবনায় মত্ত হয়ে মাহাও সায় দিলো সে সিদ্ধান্তে। মানুষটার ভালোবাসায় পড়েছে মাহা। কখনো এতটা আপন কাউকে মনে হয়নি। এতটা নিজের কাউকে মনে হয়নি। শুধু এই ঝাঁকড়া চুলের মানুষটাকে নিজের মনে হয় মাহার। এই পৃথিবীতে মাহার একমাত্র আপনজন। তাই তো আজও সেই মানুষটার একান্ত ডাকে সাড়া না দিয়ে মাহা পারেনি। এসব ভাবতে ভাবতেই মাহার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নিরব অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। আল্লাহর কাছে খুব করে চাইলো মাহা। এই মানুষটা যেন সবার মতো হারিয়ে না যায়। এত কষ্ট মাহা সইতে পারবেনা। মাহার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই মানুষটাকে মাহার চাই। সারাজীবনের জন্য চাই।

হঠাৎ তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সার্থক। ঘাড়ে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিতে দিতে বললো,
“ভালোবাসি, অলকানন্দা।”

মাহাকে নিরব দেখে নিজের দিকে ফিরালো সার্থক। মাহার চোখ-মুখ লাল। কেঁদেছে বোধহয়। বুকটা ছেৎ করে উঠলো তার। কোনো কি অপরাধ করে ফেলেছে সার্থক। এভাবে মাহাকে কাছে টেনে নেওয়াতে মাহা কি খুশি না! সার্থক আজ প্রচুর মানসিক পীড়ায় ছিল। মাহার সান্নিধ্যে তা কেটে গিয়েছে অনেকটা। সে কি কোনো ভুল করে ফেললো! থমথমে গলায় সার্থক বললো,
“আমি কি কোনো ভুল করে ফেলেছি মাহা? আমি ক্ষমা চাচ্ছি তবুও দয়াকরে তুমি কেঁদোনা। আমি..

মাহা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। মুখের কথা মুখেই রইলো। হাতটা চলে গেলো মাহার মাথায়। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সার্থক জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে বউ?”

মাহা ভেঙে আসা গলায় বললো,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি সার্থক। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না আপনি। আমার সব ভালোবাসার মানুষ গুলো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে সার্থক।”

সার্থক হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহার মাথায়। তারও চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কি?

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭৩.
রেজওয়ান আজ এসেছে মাতব্বর শরীফের সাথে দেখা করতে। মাতব্বর কে সেলে রাখা হয়েছে। সাধারণত ফাঁসি প্রাপ্ত আসামিদের এই সেলে রাখা হয়। চারিদিকে অন্ধকার। ছোট একটা ঘর। আলো-বাতাসের বালাই নেই। রেজওয়ান ভিতরে প্রবেশ করবেনা। দাগী আসামি পাশাপাশি সিরিয়াল কিলার। রেজওয়ানের যথেষ্ট সাবধানী হয়ে কথা বলতে হবে। শিকের এপাড়ে রেজওয়ান ওপাড়ে মাতব্বর। তিনি আছেন কিংবা থেকেও নেই। নিঃশ্বাসের শব্দও আসছেনা।
“মাতব্বর সাহেব।”

এপাড় থেকে ঢাকলো রেজওয়ান। জেলার সাহেব আসতে চেয়েছিলেন। রেজওয়ান মানা করে দিয়েছে। রেজওয়ান আবার ডাকলো।

“আমি জানি, আপনি জেগে আছেন। সাড়া দিন মাতব্বর সাহেব।”

নিস্তব্ধতা। রেজওয়ান আরো দুবার ডাকলো। কাজ হয়নি। এবারে কৌশলী হলো রেজওয়ান।

“মিসেস রুৎবা। মিসেস রুৎবা আপনার স্ত্রী না মাতব্বর সাহেব?”

এবার খানিকটা গোঙানির শব্দ ভেসে এলো কানে। রেজওয়ান আবার বললো,
“ফয়সাল। আপনার ছেলে। সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র ছিলোনা? চোরাবালি তে ডুবে মারা গেলো? মাতব্বর সাহেব? আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করেনা?”

অন্ধকার থেকে ভেসে এলো কুঁকড়ে যাওয়া, ভিতু একখানা সুর। আঁতকে উঠলো রেজওয়ান। কেমন অশরীরীর ন্যায় হৃদ কাঁপানো সুর।
“না।”
“কেন?”
“চাইনা।”

উঁচু গলার আওয়াজ। রেজওয়ান হাল ছাড়লোনা। আপাতত তার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। মাহা, চৈতির মোবাইল, কল ট্রেক করেও কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন কখনো হয়নি রেজওয়ানের। এই অল্প দিনের ক্যারিয়ারে প্রতিটা কেস অল্প সময়ে খুবই দক্ষতার সাথে সমাধান করেছে সে। হাতে সময় আর মাত্র পাঁচদিন। প্রলয়ের কাছ থেকে একমাস সময় নিয়েছিলো রেজওয়ান। ছুটে গিয়েছিলো সিলেট। সেখানে মাতব্বর শরীফের এক চমকপ্রদ অতীত সামনে এসেছে তার। রুৎবা পাগলীর কথাও শুনে এসেছে। কিন্তু বিগত কয়েকদিন যাবত পাগলীকে পাওয়া যাচ্ছেনা! স্ট্রেঞ্জ! যে বা যারা এই ঘটনার পিছনে আছে তারা জানলো কি করে রেজওয়ান সিলেট যাবে? তার যাওয়ার একদিন আগে থেকেই রুৎবা গায়েব। রুমানার বাড়ি ভালো করে ইনভেস্টিগেশন করা হয়েছে। সন্দেহভাজন কোনো কিছুই পায়নি। একদিকে প্রেয়সী হারানোর শোক অপরদিকে দায়িত্ব। অথৈ সাগরে পড়েছে রেজওয়ান। টুকটাক সন্ধান চালাতে চালাতে হাতের একমাস প্রায় শেষের দিকে চলে এলো। শেষ সুযোগটা নিলো রেজওয়ান। গণমাধ্যমগুলোতে বারবার ছিন্ন পা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ২০১২ এর ন্যায় পরপর অনেক ছিন্ন অংশ না পাওয়া যাওয়ায় সাময়িক ধামাচাপা পড়েছে খবরটা।
“চলে যান। চলে যান। কাউকে চাইনা আমার।”

মাতব্বর শরীফের ভয়ানক চিৎকারে ধ্যান ভাঙে রেজওয়ানের। দাগী আসামিদের ক্ষেপাতে নেই। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তারা ভয়াবহ হয়ে উঠে।
“আপনি শান্ত হোন। আমি আপনার বন্ধু।”

হা হা। হাসির জোয়ার বয়ে গেলো। গগন কাঁপানো, হৃদয়ে অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতির হাসি। হঠাৎ থেমে গেলো সে হাসি। গম্ভীর হলো সুর।
“চলে যান। আমি খারাপ। খুব খারাপ।”
“আমি জানি আপনি খারাপ নন মাতব্বর সাহেব।”
“চলে যান। চলে যান।”
“আজ যাচ্ছি। আবার কিন্তু ফিরবো আমি।”

রেজওয়ান কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। সে আবার আসবে। আর কোনো রাস্তা তো হাতে পাচ্ছেনা। মাতব্বর শরীফের মনে একটা ছাপ সৃষ্টি করেছে কেবল। ভিতরে ঢুকা বাকি!

৭৪.
আজ আবার এশার সাথে দেখা হলো রেজওয়ানের। মাহা চলে যাওয়ার পর থেকে তাদের বাড়িতে রেজওয়ান আর যায়নি। ইচ্ছে জাগেনা। যার জন্য যেতো সেই তো নেই। এশা মেয়েটা রাস্তায় বসে আছে। চোখ-মুখ বিধ্বস্ত তার। রেজওয়ান জরুরি ফোনে কথা বলবে বলে গাড়িটা থামিয়েছিলো। তখনই মেয়েটাকে দেখতে পেলো সে। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। এশা মাথা নিচু করে পায়ে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
“এই তুমি এশা না?”

এতদিন পর। এতটা দিন পর প্রিয় মানুষটার আওয়াজে হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ হারে। সেই সাথে জড়ো হচ্ছে একগুচ্ছ অভিমান। মাথা নুইয়েই রইলো এশা। রেজওয়ান বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কথা বলছোনা কেন? তুমি এশা?”
“হু।”

আস্তে করে বলে এশা। চোখে, মুখে ব্যথার ছাপ।
“এখানে এভাবে বসে আছো কেন?”
“চোর আমার ব্যাগ নিয়ে গেছে। দৌড়াতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছি।”

এশার স্বীকারোক্তি। রেজওয়ান অবাক না হয়ে পারলোনা। দুনিয়ার সব চোর কি খালি এই মেয়েটার থেকে চুরি করে। স্ট্রেঞ্জ! এর আগেরবারেও এমন হয়েছিলো।
“হাঁটতে পারবে?”
“তাহলে কি এখানে বসে আছি?”

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো এশা। রেজওয়ান অবাক না হয়ে পারলোনা। এতটুকু একটা মেয়ে আর তার সাথে তেজ দেখাচ্ছে! এএসপি রেজওয়ানের সাথে। আশ্চর্য!
“পায়ে বেশি ব্যথা পেয়েছো? হসপিটাল নিতে হবে?”

এশা মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। আচ্ছা লোকটা কি অবুঝ? বুঝেনা কিছু? এই লোক কি করে এতবড় পুলিশ অফিসার হলো বুঝে পায়না এশা। সে কি নিজে থেকে বলবে নাকি। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি অসুস্থ। আমাকে হসপিটাল নিয়ে যান! বেকুব!

“এই মেয়ে কথা বলো।”
“হু”

রেজওয়ান আর কথা বাড়ালোনা। একটানে এশাকে দাঁড় করালো। কিন্তু ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো এশা। চোখ মুখ খিঁচে রইলো।

“বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
“হু।”

এই মেয়ে কি হু হা ছাড়া কথা জানেনা! অদ্ভুত! কথা না বাড়িয়ে এশাকে কোলে তুলে নিলো রেজওয়ান। মেয়েটা অসুস্থ। রেজওয়ানের কাছে দায়িত্ববোধ সবার আগে। এশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রেজওয়ানের পানে। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা নোনতা জল গড়িয়ে পড়েছে তার। বিড়বিড় করে বললো,
“ভালো যদি নাই বাসেন তবে কেন মায়া বাড়াচ্ছেন?”

৭৫.
নিজের ক্যাম্পাস, নিজের হল, নিজের ক্লাসরুম। আপন আপন ঘ্রাণ সর্বত্র। মাহা প্রাণভরে শ্বাস নিলো। দীর্ঘদিন পর প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরেছে সে। সাথে রুমানা আছে। কিন্তু নেই কেবল চৈতি। খানিকক্ষণ আগেই সার্থক মাহাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। অনেক তো হলো বাড়িতে থাকা। আজ প্রায় দুমাস যাবত মাহা সার্থকের বাড়িতে আছে। ঘরে থাকতে আর ভালোলাগছিলোনা তার। তাই সার্থকই তাকে আবার ক্লাস শুরু করার কথা বলে। মাহাও দুরুক্তি করেনি। এভাবে বন্দি জীবন কাটাতে তারও ভালোলাগছেনা। রুমানা পাশে আছে। এটা সেটা বলছে। টুকটাক কথা বলছে। মাহার গানের গলা ভালো। তাই তাকে কোকিল বলে ডাকে রুমানা। চৈতিকে ডাকতো টুকি বলে। কিন্তু টুকি তো আর নেই। রুমানারও খুব খারাপ লাগছে। ক্লাস করার পর বুকটা ফাঁকা লাগছে মাহার। এই ভার্সিটিতে আসার পর থেকে চৈতি তার বেস্ট ফ্রেন্ড। আজ সেই ভালো বন্ধুটা সাথে নেই। যেদিকে তাকায় মাহা কেবল তারই স্মৃতি। মাহা দিশেহারা হয়ে উঠলো। দম বন্ধ লাগছে তার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে মর্গ, চৈতি, ছিন্ন পা। না, আর নিতে পারছেনা মাহা। রুমানা সব খেয়াল করে বললো,
“তোর কি খারাপ লাগছে কোকিল?”
“আমি, আমি বাড়ি ফিরবো রুমানা।”

বলেই নিজের মোবাইলটা রুমানার পানে বাড়িয়ে দিলো মাহা। কাতর কন্ঠে বললো,
“একটু সার্থককে কল করে আসতে বল। আমার কষ্ট হচ্ছে।”

ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সার্থক। মাহা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। সার্থক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
“কি হয়েছে তোমার? মাহা। বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

মাহা সার্থক কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে সার্থক।”

মাহা জ্ঞান হারালো।

চলবে…

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭৬.
একটা রাস্তা। আলো-আঁধারে নির্মিত। দেখতে অনেকটা কংক্রিটের রাস্তার মতোই। দুপাশে গাছগাছালির হিড়িক। মাথার উপরে আকাশের কোনো রং নেই। নেই মানে নেই। কিংবা থাকলেও সেটা কি রং মাহা ঠাউর করতে পারছেনা। মাহা হাঁটছে। কখনো কড়া রোদে তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কখনোবা অনেক অন্ধকারে মনে হচ্ছে মাহা তলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই চৈতির প্রতিচ্ছবি। কি সুন্দর মুখের গঠন! চুলগুলো ভিষণ সুন্দর। গাঁয়ে লালচে শাড়ি। উদাসীন হয়ে হাঁটছে রাস্তায়। মাহার চোখের কাছেই আবার মনে হয় যোজন যোজন দূরে। মাহা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। খুব জরুরি কথা আছে তার চৈতির সাথে। মাহা ডাকলো “চৈতি”। কিন্তু সে আওয়াজ শোনা গেলোনা। অতঃপর মাহা আবার ডাকার চেষ্টা করলো। গলায় মনে হচ্ছে কেউ দড়ি বেঁধে দিয়েছে। কোনো আওয়াজ বের হচ্ছেনা। বাকযন্ত্র শব্দ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ভুলে গিয়েছে। মাহা বহু চেষ্টা করেও মনে করতো পারলোনা কি করে শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। কি করে ভাষাকে প্রকাশ করতে হয়। কষ্ট হচ্ছে তার। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। কি আশ্চর্য! সে কথা বলা, শব্দ উচ্চারণ করা ভুলে গিয়েছে! আলোর তীব্রতা বেড়ে গেলো বহুগুণে। কানে বাজলো একটা সুর। মাউথ অর্গানের সুর। খুব পরিচিত মনে হলো সুরটা। কয়েকবার এই সুর শুনেছে সে। আবার অন্ধকার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর একটা বালুচরে নিজেকে আবিষ্কার করলো মাহা। দূর-দূরান্তে কেবল বালু আর বালু। হালকা সোনালি রঙের বালুতে চিকচিক করছে চারদিক। এবারও চৈতি দাঁড়িয়ে। দূরে। মুখটা অস্পষ্ট। মাহা এগিয়ে গেলো তার দিকে। হাত বাড়াতে চাইলো। তবে চৈতি দূরে চলে গেলো আবার। হঠাৎ ক্ষীণ সুর ভেসে আসছে মাহার কানে।
“মাহা? কেমন আছিস?”

মাহা কোনো কথা উচ্চারণ করতে পারলোনা। সে তো কি করে শব্দ উচ্চারণ করে বাক্য বলতে হয় তা ভুলে গিয়েছে। চৈতি মৃদু হাসলো। আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছিস?”

এবারে মাহা চুপ। এবার রেগে গেলো চৈতি। অদ্ভুতভাবে তার দেহ পরস্পর থেকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে মাথা, পরে হাত, পরে পা। ঐ যে মাহা যেমন ছিন্ন পা দেখেছিলো তেমন একটা পা মাহার দিকে ছুটে আসছে। চৈতির ছিন্ন মাথা হাসছে। মাহা ভয়ে চুপসে আছে। পা টা মাহার কাছাকাছি চলে এসেছে। মাহা দৌড় দিলো। পিছু ফিরে চাইলোনা আর। কিছুক্ষণের জন্য পা টা উধাও হয়ে গিয়েছে। মাহা থেমে একটু শ্বাস নিবে তখনই চতুর্দিক থেকে চৈতির পা গুলো তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। একেবারে কাছে আসতেই মাহা চিৎকার করার চেষ্টা করলো। এবার বাকযন্ত্র নিজের আগের রূপে ফিরে এসেছে। মাহার চিৎকার মাহা শুনতে পেলো। সেই সাথে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মাহা। তড়তড় করে ঘামছে সে। পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছে সার্থক। কিছু বলার চেষ্টা করছে। মাহা তো শুনতে পাচ্ছেনা! হঠাৎই সার্থক জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহা নিজেকে ধাতস্থ করলো এবার।

৭৭.

আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো মাহা। পরিচিত ঘ্রাণটা নাকে যেতেই সজাগ হলো নিউরন। কেঁপে উঠলো বুক। মনে হচ্ছে তার আর কোনো ভয় নেই। মানুষটা আছেনা পাশে! যে মাহার মন, মস্তিষ্ক, হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছে ধীরেধীরে। মাহাও পরম নির্ভরতায় জড়িয়ে ধরলো সেই ব্যাক্তিটাকে। সার্থক চুমু খাচ্ছে মাহার এলোমেলো চুলে। গলার সুর নরম করে বললো,
“ভয় পেয়েছিলে?”
“ভিষণ।”
“কিসের ভয় মাহা? আমি আছি তো।”
“হুম।”

মাহার বাঁধন শক্ত হলো আরো। হঠাৎই নিভার শব্দে দুজন দুদিকে সরে বসলো। নিভা দরজার বাইরে থেকে প্রশ্ন করলো,
“ভাইয়া আসবো?”
“হুম, আসো।”

নিভা ভিতরে ঢুকে একনজর তাকালো মাহার পানে। সোনালী চুলগুলোকে কানে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
“তুমি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে ভাবি। এখন শরীর কেমন?”
“ভালো।”
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তায় জ্বলে উঠছে সোডিয়াম লাইটগুলো। আবাসিক এলাকার আশপাশ নিরব। নিস্তব্ধ। নিভা সার্থক কে নিজের কাছে ডাকলো।
“ভাইয়া, একটু শুনবে?”

মাহা খাটে হেলান দিয়ে বসে। সার্থক অবাক হলো খানিকটা। নিভার কাছে এসে বললো,
“কোনো জরুরি কথা আছে কি নিভা?”
“ভাইয়া, জিনিয়া আপু এসেছে।”
“জিনিয়া! মানে ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম। আমার কলিগ?”
“হুম।”

সার্থক নিভার পানে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ এতরাতে এখানে কি ঐ মেয়ের। সার্থক মাহার দিকে তাকালো একবার। অতঃপর নিভাকে বললো,
“তুমি যাও।”
“ভাইয়া, উনি তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন।”
“হুম, যাও। আমি আসছি।”

গুরুগম্ভীর শোনালো সার্থকের গলা। মাহার খেয়ালে এসব নেই। ও খাটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। মাথাটা ভিষণ যন্ত্রণা করছে। সার্থক মাহার পাশে বসলো। মাহা নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিলো সার্থকের কাঁধে। সার্থক মাহার হাতটা টেনে ধরে চুমু খেলো তাতে।
“তুমি আরেকটু ঘুমাও। আমি একটু আসছি।”

মাহা অপর হাতে আঁকড়ে ধরলো সার্থকের বাদামি টি-শার্ট। এই অল্প সময়েই মাহার সকল নির্ভরতা সার্থক। মাহার চোখে মুখে ভয়। সার্থক মাহার সমস্ত মুখে আদর করলো। অতঃপর মুখে বললো,
“এই যাবো এই আসবো সোনা। একটু থাকো। আমি নিভাকে ডেকে দিচ্ছি।”

আলগা হয়ে এলো শার্টের আঁকড়ে ধরা বাঁধন। সার্থক বেরিয়ে যেতেই নিভা ঘরে প্রবেশ করলো হাসিমুখে।

_________________

“কি প্রয়োজন?”
“তোমাকে।”

ভণিতা ছাড়াই বলে ফেললো জিনিয়া। সার্থক পাশের সোফায় বসে বললো,
“তাই নাকি!”

কন্ঠে কৌতুক তার। যেন জিনিয়ার কথায় খুব মজা পেয়েছে সে। পায়ের উপর পা তুলে তা নাচাচ্ছে সার্থক। জিনিয়াকে ভালো করেই চিনা তার।
“ঝেড়ে কাশো। কি প্রয়োজনে এসেছো?”
“প্রয়োজন তো বললামই। তোমাকে চাই।”

সার্থক উঠে এসে জিনিয়ার সামনে দাঁড়ালো। ডানহাতটা চেপে ধরলো জিনিয়ার গালে। মুখে হাসি দিয়ে বললো,
“আবার বলো তো জিনিয়া।”

জিনিয়া বহুকষ্টে বললো,
“তোমাকে।”

সার্থকের হাত আরো শক্ত হলো এবার। জিনিয়ার অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। সার্থক হাত শক্ত অবস্থায় রেখেই বললো,
“এতটুকুতেই কষ্ট হচ্ছে জিনিয়া?”

জিনিয়া জবাব দিতে পারলোনা। সার্থক ছেড়ে দিলো জিনিয়ার গাল। এমিলিন দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সার্থক ডাকলো,
“এমিলিন।”

এমিলিন কাছে এলেন। সার্থক জিনিয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
“ম্যাডামের জন্য জুস নিয়ে এসো।”

এমিলিন কিছু না বলেই চলে যেতে নিলে সার্থক জিনিয়াকে প্রশ্ন করলো,
“তা কি খাবে সরি পান করবে জিনিয়া? রুহ আফজা নাকি কমলার জুস?”

জিনিয়ার কি হলো কে জানে উঠে দাঁড়ালো সে। পাশ থেকে ব্যাগটা নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
“চলে যাচ্ছো যে?”

জিনিয়া কোনো প্রতুত্তর করেনি। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে হাসলো খানিকক্ষণ। অতঃপর গম্ভীর হয়ে তাকালো এমিলিনের দিকে।

“ম্যাডামের জন্য স্যূপ করো এমিলিন।”

এমিলিন রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আর সার্থক চললো নিজের অলকানন্দার কাছে।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৭৮.
মুইংচিন খুবই ব্যস্ত। চাইনিজ হওয়ার সুবাদে চীনের প্রতি দুর্বলতাটা তার বেশি। সুদূর চীন থেকে কিছু উপহার এসেছে তার জন্য। সেগুলো ড্রয়িং রুমে মাটিতে বসে খুলছে সে। পাথরের কয়েকটা মূর্তি এসেছে। একটা কাঙ্ক্ষিত মূর্তি হাতে পেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। মূর্তির পায়ের কাছটায় নিজের হাত বুলিয়ে অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করলো মুইংচিন। হাসলো কতক্ষণ আপনমনে। হাসলে তার চোখের দুপাশে ভাঁজ পড়ে। চোখ দুটি ছোট হয়ে আসে। তখনই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো মাহা। গত দুদিন যাবত সার্থক হাসপাতাল যায়না। ছুটি নিয়েছে। মাহাকে আদরে আদরে ভুলিয়ে দিয়েছে সকল যন্ত্রণা। মাহার হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় এতটা সুখও কি তার কপালে ছিলো! সার্থক কাজ করছে ঘরে। তাই মাহা ভাবলো সার্থকের জন্য কফি করবে। যে ভাবা সে কাজ। নিচে নেমে এলো সে। মুইংচিন কে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো তার পানে। কাকের মতো সরু মুখ, মাথায় গজানো অনেকগুলো হরিণের ন্যায় শিং। সাদাকালো ছবিটায় অদ্ভুত মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট একটা প্রাণী। নখগুলো বড় বড়। নখগুলো লাল, ঠোঁটও লাল। এমন উদ্ভট একটা মূর্তি মুইংচিনের হাতে দেখে খানিক অবাক হলো মাহা। মনে করার চেষ্টা করলো এমন মূর্তি কিংবা ছবি কোথায় যেন দেখেছে সে। মাহাকে সামনে দেখতে পেয়ে থতমত খেলো মুইংচিন। মাহার পিছন থেকে কেউ একজন চোখ রাঙাচ্ছে তাকে। তাই তৎক্ষনাৎ বাক্সের ভিতরে ভরে ফেললো সে মূর্তিটা। ভয়ে হাত কাঁপছে তার।
“আপনার হাতে কি মুইংচিন?”
“কিছুনা।”

মাহা বিষয়টা আর ঘাটালোনা। কেউ যদি প্রশ্ন করলে কিছু বলতে না চায় বারবার তাকে একই কথা জিজ্ঞেস করা মাহার অপছন্দ। কি মনে করে পিছনে ফিরলো মাহা। এমিলিন দাঁড়িয়ে। মাহা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এমলিন আজো তার কাছে রহস্য। কফি বানানো কালে হঠাৎই পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহার অবচেতন মন সায় দিয়ে উঠলো “এটা তোর একান্ত আপনজন”। মুচকি হাসলো মাহা। এবারে আরো সাহসী হলো জড়িয়ে ধরা হাত। তীব্র দুষ্টুমি করার আগেই মাহা ধরে ফেললো সে হাত।
“উফ্! কি শুরু করেছেন আপনি? বাড়ি ভর্তি মানুষ। দেখে ফেলবে কেউ।”
“কেউ দেখবেনা।”

সার্থকের মায়াময় নেশা জড়ানো কন্ঠ। এবারে চরম অবাধ্য হলো সার্থক। মাহাকে সামনে ফিরিয়ে অধর টেনে নিলো নিজ দখলে। ঘটনার আকস্মিকতায় মাহা হতভম্ব। কারো পায়ের শব্দে মাহাকে ছেড়ে দিলো সার্থক। মাহা চোখ রাঙিয়ে তাকালো সার্থকের পানে। হাঁপানো স্বরে বললো,
“আপনি চরম অসভ্য।”
“বউয়ের কাছে এই পৃথিবীর সব পুরুষ অসভ্য। নয়তো….

তাড়াতাড়ি সার্থকের মুখ চেপে ধরলো মাহা। এই লোক যা পাঁজি। নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কিছু বলে লজ্জায় ফেলবে তাকে। সার্থক হাসলো। মাহা অভিভূত হয়ে দেখছে সে হাসি। হাসলে কি সুন্দর লাগে লোকটাকে। সার্থক আবারো টুপ করে আদর দিলো মাহার হলদেটে ফর্সা গালে। মাহা লজ্জা পেয়ে মুখ লুকালো সার্থকের বুকেই। হা হা করে হেসে উঠলো সার্থক।

এত আনন্দ! এত খুশি! সহ্য করা দায়। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে কারো।

৭৯.
“ভাইয়া এটা পাবলিক প্লেস।”

নিভার কন্ঠ পেয়ে মাহাকে নিজের থেকে মুক্ত করতে বাধ্য হলো সার্থক। রবার্ট কে নিভার পাশে দেখে লজ্জা পেয়েছে মাহা। সার্থক হাসছে। মাহা কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে।
“নিজের বাড়ি আবার পাবলিক প্লেস নাকি, নিভা! আমার বউ আমি রোমান্স..

মাহা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সার্থকের টি-শার্ট। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“থাক, তোমার ভাবি লজ্জা পাচ্ছে। বাকিটা আর বললাম না।”

সবাই হেসে উঠলো একসাথে। রবার্টের মতো মুখচোরা লোকের মুখে হাসি। রবার্টের চোখগুলো কেমন যেন চেনা চেনা।

________________

প্রলয় ঠাস করে ফাইলটা টেবিলে রাখলেন। তার সামনে তাজ, মোবারক আর রেজওয়ান দাঁড়িয়ে। তাদের দেওয়া একমাস সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখনো কেস যেমন ছিলো তেমনি। সময়ের ব্যবধানে মিডিয়াতেও ধামাচাপা পড়েছে ছিন্ন পায়ের খবর। প্রলয় কঠিন কন্ঠে বললেন,
“তোমাদের মতো এতো বাহাদুর অফিসারদের কাছে আমি এমনটা আশা করিনি। ফাইলটাতে বারবার তোমরা মাতব্বর শরীফকে কেন টেনে আনছো! তিনি তো সেলে আছেন। ডিএনএ রিপোর্ট বলছে এটা চৈতি নামক মেয়েটার পায়ের খন্ড। মাহা হোসেনের অফিসিয়াল কোনো জবানবন্দি নেই ফাইলে। ভিক্টিম যে বাসায় উঠেছিলো সিলেট। সে বাসায় খোঁজ করা আগেই উচিত ছিলো তোমাদের। এতটা ইরিসপন্সিবল কি করে হলে তোমরা। স্পেশালি রেজওয়ান তোমার কাছে তো আমি এটা আশা করিনি। আসল অপরাধীদের কোনো চিহ্নই তোমরা খুঁজে পেলেনা! স্ট্রেঞ্জ!”

রেজওয়ান মাথা নত করে বললো,
“স্যার, আর কিছুদিন সময় প্রয়োজন। মাতব্বর শরীফের সাথে আমি আরেকবার দেখা করতে চাই। তিনি এ ব্যাপারে জানেন। আমার মনে হচ্ছে।”
“মনে হয়, মনে হচ্ছে এসব কথা পুলিশের মুখে মানায় না। উপর মহল থেকে চাপ আসছে। ২০১২ আমরা ফিরে পেতে চাইনা। আমি তোমাদের উপর থেকে দায়িত্ব উঠিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ কে দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। এভাবে তো হয়না। আর মাহা হোসেনের একটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট প্রয়োজন।”

রেজওয়ান বলে উঠলো,
“স্যার, আমি মাহা হোসেনের স্টেটমেন্ট নিয়েছি। ও এখন অসুস্থ। ওকে চাপ না দিলে….
“স্টেটমেন্ট কি অফিসিয়াল ছিলো মিঃ রেজওয়ান?”

রেজওয়ান মাথা নত করে বললো,
“নো স্যার।”
“মাহা হোসেন কি আপনার ব্যাক্তিগত পরিচিত মিঃ রেজওয়ান?”
“জ্বী।”
“মাহার আরেকটা অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট নিতে হবে।”
“স্যার, আমাদের আর কিছুদিন সময় দিন।”

তাজ এবং মোবারকও সেই অনুরোধ করলেন। প্রলয় খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন,
“ওয়েল, এক সপ্তাহ সময় পাবেন আপনারা। তারপর কেসটা গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করবো আমি।”
“ওকে স্যার।”

৮০.

একযোগে বলে উঠলো তিনজনে। রেজওয়ান চাচ্ছে সে নিজে থেকে এই ঘটনার একটা বিহিত করতে। নয়তো মাহাকে প্রচুর হয়রানির শিকার হতে হবে। রেজওয়ান কেসটায় ছিল বলে মাহা রক্ষা পেয়েছে। নয়তো মাহার রিমান্ড হতে পারতো। রেজওয়ান চায়না তার প্রিয় মানুষটা কষ্ট পাক। হোক বিয়ে। রেজওয়ানের প্রিয় মানুষ তো মাহা। এতগুলো বছরের ভালোবাসা কি আর দু-তিন মাসের ব্যবধানে কমে যাবে!
_____________

“ব্যবসায় বিরাট লোকসান দেখা দিচ্ছে। এমন করলে তো হবেনা। আমরা বিপদের মুখে পড়তে পারি।”
“রাজার এমন উদাসীন মনোভাব সবাইকে ভাবাচ্ছে। কি ব্যবস্থা করা যায়!”
“পথের কাঁটা উপড়ে ফেলা যায়।”
“উঁহু, ক্ষতি আমাদের।”
“হুম। রাগের কথা আর নাই বা বলি। সবকিছু ধ্বংস করে দিবে।”
“তার কাছে সেই কাঁটাই ফুল।”
“ফুলটা আমাদের গিনিপিগ।”

একযোগে হেসে উঠলো চারজন ব্যাক্তি। কথোপকথন হয়েছে ইংলিশ ব্রিটিশ এক্সেন্টে।

(চলবে)….

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮১.
আজ বহুদিন পর রেজওয়ান মাহার সাথে দেখা করতে এসেছে। এভাবে না বলে আসাটা হয়তো ঠিক হয়নি। সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেল বাজাতে শঙ্কিত রেজওয়ান। এতটা দিন পর মেয়েটার সাথে দেখা করবে। সাথে মিস তাজও রয়েছেন। মূলত একটা অফিসিয়াল জবানবন্দির জন্যই এখানে আসা। চাইলেই মাহাকে পুলিশ স্টেশনে ডাকা যেত। কিন্তু রেজওয়ান যে চায়না তার প্রিয় মানুষটা কষ্ট পাক। তাই সাথে করে মিস তাজকে নিয়ে এসেছে রেজওয়ান। কলিং বেল বাজানোর আগে কতক্ষণ বেলটার পানে তাকিয়ে রইলো রেজওয়ান। মিস তাজ অবাক হলেন। এই কয়েকদিনের পরিচয়ে এতটা আনমনা রেজওয়ান কে কখনো দেখেননি তিনি। সাথে করে দুইটা ক্যাটবেরি চকলেট নিয়ে এসেছে রেজওয়ান। মিস তাজ এমন কখনো দেখেন নি। অফিসিয়াল জবানবন্দিতেও কেউ কারো জন্য উপহার নিয়ে যায় জানা ছিলোনা তার।
“হোয়াট আর ইউ থিংকিং, রেজওয়ান?”

তাজের প্রশ্নে খানিক থতমত খেলো রেজওয়ান। কলিং বেল চেপে বললো,
“নাথিং, মিস তাজ।”

তাজ খুশি হতে পারলেন না। তার চৌকস মস্তিষ্ক বলছে,”সিউরলি দেয়ার ইস এ মাইস্ট্রি হেয়ার। ইস ইট এ মেটার অফ লাভ?” মুখে কিছুই বললেন না তিনি। কাঠের দরজা খুলে দিলো মেরি। পুলিশের পোশাক পরিহিত দুজন ব্যাক্তিকে দেখে প্রথমে খানিক বিচলিত হয়েছিলো তার চোখ। বিষয়টা চোখ এড়ায়নি তাজের। পরক্ষণেই হাসি ফুটে উঠলো মেরির মুখে। পরিচারিকা মেরি পরিচিত মুখের সন্ধান পেয়ে স্মিত হাসলো। স্মিত হাসলো বাইরে দাঁড়ানো দুজন ব্যাক্তিও। মেরি নিজের ইংরেজি বুলিতে আপ্যায়নের সুরে বললো,
“প্লিজ, আপনারা ঘরে আসুন।”

সোফায় বসতে বলে মেরি দাঁড়ালো পাশে।
“কি নিবেন স্যার,ম্যাম? চা, কফি না জুস?”
“বিচলিত হবেন না মিস মেরি। আপনি একটু মাহাকে ডেকে দিন।”

রেজওয়ান আলতো সুরে বললো।
“জ্বি, স্যার ডেকে দিচ্ছি। ম্যাম আর ডক্টর স্যার উপরেই আছে।”

সার্থকও তবে বাড়িতে আছে? রেজওয়ান ভেবেছিলো এসময় সার্থক হয়তো হাসপাতালে থাকবে। রেজওয়ানের যে সার্থক আর মাহাকে একসাথে দেখলে কষ্ট হয়! মাহা নিচে নেমে এলো পিছনে সার্থক। মাহার গাঁয়ে হালকা বেগুনি রঙের বাটিক থ্রি-পিস। হলদে ফর্সা গাঁয়ে ভিষণ মানিয়েছে। রেজওয়ান জানে মাহার বাটিক থ্রি-পিস খুব পছন্দের। গত ইদেও মাহাকে দুটো থ্রি-পিস উপহার দিয়েছিলো রেজওয়ান। যদিও নিজে দেয়নি। মাকে দিয়ে মাহার হাতে দিয়েছিলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেজওয়ান। এ ব্যাপারটাও চোখ এড়ায়নি তাজের। চার জোড়া চোখ একে অপরের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হলো একে অপরের সাথে। বহুদিনের পরিচিত মানুষের দেখা হলো আবার। সার্থক, মাহা এসে বসলো সোফায়। একদম পাশাপাশি।
“কেমন আছেন রেজওয়ান ভাইয়া? আপনি একটাবারের জন্যও কল দেননি আমায়?”

অনুযোগ মাহার কন্ঠে। রেজওয়ান স্মিত হাসলো।
“চৈতির কেসটায় অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি মাহা।”

চৈতি। কর্ণকুহরে নামটা যেতেই সার্থকের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহা। চোখমুখে অদ্ভুত ভয়। সার্থক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
“মিঃ রেজওয়ান সেই যে আপনি এসেছিলেন আমাদের বিয়ের দিন। এরপর তো আপনার আর দেখাই নেই। বোনের খবরটাতো অন্তত নিতে পারতেন?”

৮২.
বিরক্ত হলো রেজওয়ান। এমনিতেই অদ্ভুত কারণে সার্থক কে পছন্দ না তার। তারউপর কথায় কথায় বোন, বোন আর বোন। রেজওয়ান জবাব দেওয়ার আগেই সার্থক আবার আওড়ালো,
“কি পান করবেন বলুন? চা, কফি না জুস?”

কিছু একটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বিচলিত হলো একজোড়া চোখ। উঁহু, একজোড়া নয় দুইজোড়া বোধহয়।
“কি হলো বলুন?”

সার্থকের বিচলিত কন্ঠস্বর। মিস তাজ জবাবে বললেন,
“কফি। কফি খেতে পারি?”
“সিউর।”

বলেই রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো সার্থক। গলা উঁচিয়ে ডাক লাগালো এমিলিন কে। এমিলিন চিরচেনা গম্ভীর রূপে বেরিয়ে এলেন।
“চারকাপ কফি।”

এমিলিন শুনলেন। অতঃপর আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন।
“ডক্টর সার্থক আমরা আজ একটা বিশেষ কাজে এখানে এসেছি।”

রেজওয়ানের সুরটা গম্ভীর শোনালো। সার্থক চিরচেনা ঠোঁট বাঁকানো হাসি দিয়ে বললো,
“জ্বি, কি সাহায্য করতে পারি মিঃ রেজওয়ান?”

এবারে মাহার দিকে তাকালো রেজওয়ান। নিজের হাত দুটো সামনে এনে একসাথে মুঠোয় ভরে বললো,
“মাহা আমরা আজ তোমার একটা অফিসিয়াল জবানবন্দি নিবো।”
“আমার!”

অবাক কন্ঠে বিস্মিত সুরে আওড়ালো মাহা। সার্থক মাহার ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে বললো,
“অবশ্যই, মিঃ রেজওয়ান। জিজ্ঞেস করুন।”
“ভাইয়া, সেদিন তো আমি আপনাকে সবকিছু খুলে বলেছি একবার।”
“মাহা, সেদিনের ব্যাপারটা অফিসিয়াল ছিলোনা। তাছাড়া ডিএনএ ম্যাচ হয়েছে। পায়ের খন্ডাংশটা চৈতিরই।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই মাহার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঝিমঝিম করছে মাথা। খানিকক্ষণ নিষ্কলুষ স্তব্ধ নয়নে মাহা তাকিয়ে রইলো রেজওয়ানের পানে। নিজের কি অভিব্যাক্তি প্রকাশ করবে ভেবে পেলোনা। সার্থক আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো মাহার মাথায়। কানের কাছে গিয়ে আলতো করে বললো,
“শান্ত হও, সোনা। আমি আছিতো।”

ভরসা পেলো মাহা। চৈতি নামক মেয়েটা মাহার জীবনে অনেকাংশ জুড়ে ছিলো। তার মৃত্যুর খবর আজ চূড়ান্ত ভাবে পেলো মাহা। মন কাঁদছে তার। বাঁধ ভাঙা কান্না। মাহার কিছু মনে নেই। তবে মাঝেমাঝেই অবচেতন মস্তিষ্কে প্রশ্ন উঠে,
“সে কি দায়ী?”

সেই চিন্তা মাহাকে ঘুমাতে দেয়না। সার্থকের বুকে মাথা দিয়ে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মাহা। হঠাৎ হঠাৎ তার ভয় হয়। মনে হয় চৈতির দেহের খন্ডগুলো আছে। আশেপাশে আছে। শূন্যে ভাসছে। তাকে ডাকছে। মাহা তখন ভয় পায়। বিচলিত হয়ে যায়। কামড়ে জখম করে দেয় সার্থকের বুক। সার্থক সব মাথা পেতে নেয়। ঘুমঘুম চোখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাহাকে। মাথায়, চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কখনোবা চূড়ান্ত ভালোবাসা দেয়। তখনই পাগলামি থামে মাহার। শান্ত, তৃপ্ত, ক্লান্ত মাহা ঘুমিয়ে পড়ে সার্থকের বুকে। সার্থক আর ঘুমায় না। চেয়ে থাকে নিজের অলকানন্দার দিকে। ভাগ্যের কাছে প্রশ্ন করে, “কেন এতো অদ্ভুত তার জীবন?” সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ছিলোনা সার্থক। হঠাৎ করেই মনের একটা অংশ সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করে,
“হে রক্ষাকর্তা। আমার মাহাকে তুমি ভালো রেখো।”

৮৩.
“মাহা, তুমি ঠিক আছো?”
“জ্বি, ভাইয়া।”
“তুমি যতটুকু জানো ততটুকু আবার খুলে বলো আমাদের।”

সার্থকের হাত আঁকড়ে ধরে আবার সেই পুরানো স্মৃতি একে একে তুলে ধরলো মাহা। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো সেই স্মৃতির পাতা। শেষটুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাহা। কয়েক ফোঁটা অশ্রু নেমে গেলো কপোল বেয়ে। মাত্র আড়াই-তিন মাসের ব্যবধানে বিপুল পরিবর্তন এসেছে তার জীবনে। সার্থক নামক মানুষটা তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখিয়েছে। একসময় মরণ চাওয়া মাহা এখন বাঁচতে চায়। নিজের একান্ত মানুষটার সাথে বাঁচতে চায়। কফি নিয়ে এলো এমিলিন। টি-টেবিলে রেখে স্থান ত্যাগ করলো নিজের। সার্থক আবার পরিস্থিতি হালকা করতে রেজওয়ানের হাতে কফি তুলে দিতে দিতে বললো,
“আপনারা কফিটা একটু টেস্ট করে দেখুন। এমলিন খুব ভালো কফি বানায়।”

বুকে রক্তক্ষরণ নিয়ে কফি হাতে নিলো রেজওয়ান। চোখ শুধু বারেবারে যাচ্ছে ডানহাতে মাহার হাত আঁকড়ে ধরা সার্থকের হাতের দিকে। তখন মুইংচিনের ঘর থেকে গান ভেসে এলো,

“You come out at night
That’s when the energy comes
And the dark side’s light
And the vampires roam
You strut your rasta wear
And your s/u/i/c/i/d/e poem
And a cross from a faith that died
Before Jesus came
You’re building a mystery
You live in a church
Where you sleep with voodoo dolls
And you won’t give up the search
For the ghosts in the halls
You wear sandals in the snow
And a smile that won’t wash away
Can you look out the window
Without your shadow getting in the way?
You’re so beautiful
With an edge and charm
But so careful
When I’m in your arms
‘Cause you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
You woke up screaming aloud
A prayer from your secret God
You feed off our fears
And hold back your tears, oh
Give us a tantrum
And a know-it-all grin
Just when we need one
When the evening’s thin
You’re a beautiful
A beautiful ….. up man
You’re setting up your
Razor wire shrine
‘Cause you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah, you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
Ooh, you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Yeah you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
Yeah, you’re working
Building a mystery
Holding on and holding it in
Oh, yeah, you’re working
Building a mystery
And choosing so carefully
You’re building a mystery”

কানাডিয়ান শিল্পী (Sarah McLachlan) এর গানটায় হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটালো সকলের সকল ভাবনার। সার্থক গলা উঁচিয়ে বললো,
“মুইংচিন জরুরি মিটিং হচ্ছে এখানে গান বন্ধ করো।”

থেমে গেলো গান। শুরু হলো আবার ভাবনা। ভয়, ঈর্ষা, কাতরতা, ভালোবাসা, রুক্ষতা, নিষ্ঠুরতা একই ছাদের নিচে কত অনুভূতির সমাহার!

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-২৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৪.
রেজওয়ান আজ আবার মাতব্বর শরীফের সাথে দেখা করতে এসেছে। এ কেমন গোলকধাঁধায় পড়লো সে নিজেও জানেনা। কোনো ক্লু নেই। কোনো সাক্ষ্য, প্রমাণ নেই। সবচেয়ে বড় অবাক করা ব্যাপার হলো মাহার ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা। স্ট্রেঞ্জ! একটা মানুষ কি করে সবকিছু ভুলে যেতে পারে? কথাটা তো মাথায় খেলেনি। মাহাকে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। কোনো ভালো সাইকোলজিস্ট। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অন্ধকার সেলের সামনে এসে দাঁড়ায় রেজওয়ান। সেদিনের মতো শিকের এপাড়ে রেজওয়ান আর ওপাড়ে মাতব্বর শরীফ।
“মাতব্বর সাহেব?”

কোনো আওয়াজ এলোনা। কিছুক্ষণ চুপ রইলো রেজওয়ান। আবার ডাকলো,
“মাতব্বর সাহেব আমি জানি আপনি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন।”

কোনো আওয়াজ নেই। কেবল নিকষ কালো অন্ধকারে নিশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ। চৌকস রেজওয়ান বুদ্ধি খাটালো এবারে। মিথ্যার প্রশ্রয় নিতে হয়েছে যদিও।
“আপনার ওয়াইফ তো ভিষণ কষ্টে আছে মাতব্বর সাহেব। আপনার ইচ্ছে জাগেনা তার সাথে দেখা করতে?”

এবারে গোঙানির আওয়াজ ভেসে এলো। গুরুগম্ভীর গোঙানি। রেজওয়ান বুঝলো হয়তো কাজ হচ্ছে,
“আপনি আমাকে সাহায্য করুন মাতব্বর সাহেব। আমি আপনাকে সাহায্য করবো। আমি জানি আপনি নির্দোষ। দোষী কে একবার ধরিয়ে দিন। আমি প্রমিজ করছি একটা স্বাধীন জীবন আপনাকে উপহার দিবো আমি৷”
“আমি মুক্ত আকাশের নিচে শ্বাস নিতে চাই।”

অতন্ত্য ক্ষীণ, গুরুগম্ভীর সুরে বলে উঠলেন মাতব্বর শরীফ। রেজওয়ান যেন মরুভূমির বুকে জল খুঁজে পেলো। হাতে সময়ও কম। ঘটনার পিছনের ঘটনা উদঘাটন করতে সে সব করতে রাজি।
“আপনি আমাকে খুলে বলুন। কেউ কি আপনাকে ফাঁসিয়েছে? কি কি জানেন আপনি ২০১২ সম্পর্কে?”
“আমাকে একবার সিলেট নিয়ে যেতে হবে।”
এ বড় অবান্তর আবদার। একজন দাগী আসামিকে রেজওয়ান কি করে সিলেট নিয়ে যাবে! সে কি চাইলেই সব সম্ভব! কিন্তু কেসটারও তো একটা বিহিত প্রয়োজন।
“এটা কি আপনার শর্ত হিসেবে ধরে নিবো আমি?”
“হয়তো তাই।”
“আপনি আমাকে কিছুই বলবেন না?”
“বলবো। কিন্তু আমি সিলেট যেতে চাই।”
“ঠিক আছে। আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।”

রেজওয়ান স্থান ত্যাগ করলো। ভিষণ অস্থির লাগছে তার। প্রলয় চ্যাটার্জিকে কি বলবে সে!

এই নিয়ে তিন তিনবার। এশা রাস্তায় বসে আছে। আজকে বেচারির গলার চেন টান দিয়ে নিয়ে গিয়েছে ছিনতাইকারী। গলায় টান লাগায় দাগ বসে গেছে। শ্যামলবরণ বলেই বুঝা যাচ্ছেনা। ফর্সা হলে হয়তো লালচে দাগটা স্পষ্ট বুঝা যেতো। কনস্টেবল মুন্সি গাড়ি ড্রাইভ করছিলো। পাশে রেজওয়ান বসে ফাইল চেক করছে। হঠাৎ গাড়ি থামাতে মুন্সির দিকে জিঘাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রেজওয়ান। ফাইল হতে মুখ তুলে সামনে চায়নি। সোজা চেয়েছে মুন্সির দিকে। মুন্সি চিন্তিত মুখে বললো,
“স্যার, সামনে ভিড়।”

রেজওয়ান সামনে তাকায় এবার। সত্যিই ভিড়। ফাইল রেখে নেমে যায় গাড়ি থেকে। পুলিশ ইউনিফর্ম পরিহিত রেজওয়ান কে দেখে সরে যায় মানুষজন। রাস্তার পাটাতনে গালে হাত দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে ক্রন্দনরত মুখে বসে আছে এশা। রেজওয়ান ভেবে পায়না। পাশ থেকে একজন বলে উঠে,
“মাইয়াডার গলার ছেন লইয়া ভাগছে ছিনতাইকারী।”

রেজওয়ান কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছেনা। এই দেশের সব ছিনতাইকারী কি খালি এই মেয়েটাকেই চোখে দেখে। রেজওয়ান কে সামনে দেখে ছলছল চোখে তাকালো শ্যামবতী। অতঃপর ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। রেজওয়ান এগিয়ে গিয়ে আঁকড়ে ধরলো এশার হাত। গাড়ির কাছে এসে মুন্সিকে বললো,
“মুন্সি, পানির বোতলটা দাও।”
“জ্বি, স্যার।”

মুন্সি পানির বোতল দিতেই রেজওয়ান নিজের হাতে নিলো বোতলটা। এতক্ষণ কেউই কারো সাথে কথা বলেনি।
“নাও।”

রেজওয়ান বলতে দেরি আর সে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পান করতে দেরি হয়নি এশার। বেচারি অতিদ্রুত করতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেললো এবারে। বিষম খেয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা। রেজওয়ান বিরক্ত হলো এবারে। মায়াও হলো মেয়েটার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর কাশি থামলো এশার। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সে।
“একটা কথা বলো তো তুমি। রাস্তায় কিভাবে চলো? এই নিয়ে তিনবার তোমার সাথে এমন হলো। বুঝিনা আমি ছিনতাইকারীগুলোও কি শুধু তোমায় খালি চোখে দেখে? বেশি লেগেছে?”

৮৫.

‘আপনার সাথে দেখা আমার এমন অদ্ভুত সময়েই কেন হয় বলুন তো! আপনি একটা যাচ্ছে তাই। এই পুলিশ, ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে যদি আপনার দেখা পাওয়া যায় তাহলে আমি রোজ রোজ ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে রাজি। আপনি তো বোকা পুলিশ। আপনি কিছুই বুঝেন না।’ মনে মনে কথাগুলো আওড়ালেও মুখে বলার সাহস নেই এশার। তাই নিচুসুরে বললো,
“বাড়ি যাবো।”

গাড়িতে উঠে বসতেই নিরবতা চললো কিছুক্ষণ। অতঃপর এশা প্রশ্ন করলো,
“মাহা আপু কোথায় এ ব্যাপারে কিছু জানেন? ফুপি তো আংকেল মারা যাওয়ার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ। বাড়িতে ফেরেননি। মাহা আপু সেই যে সেদিন বেরিয়ে গেলো। আপুর সাথে কোনো যোগাযোগই হয়নি আমার।”
“মাহা বিয়ে করে নিয়েছে।”

নির্বিকার উত্তর রেজওয়ানের। কথাটা বলেই ফাইলে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টায় সে। এদিকে বিস্ময়ে হা হয়ে আছে এশা।

নিচতলায় বেশি একটা আসা হয়না মাহার। বেশিরভাগ সময়টাই কাটে উপরে। বাগান, ফুল, ক্যাকটাস, লাইব্রেরি। মাঝেমাঝে নিভার সাথে গল্প বেশ সময় কেটে যায় মাহার। যদিও কিছুদিন বাদে মাহার পরীক্ষা। আর সার্থক! মানুষটা একটা আস্ত পাগল। বাড়িতে থাকলে মাহাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়না। বসিয়ে রাখে চোখের সামনে। একদিন মাহা প্রশ্ন করেছিলো,
“কি দেখেন বলেন তো এমন করে তাকিয়ে?”
“আমার পৃথিবীকে।”

সার্থকের অকপট উত্তর। মাহা লজ্জায় দৌড়ে বারান্দায় চলে এসেছিলো। লোকটা একটা পাগল! আজ মাহা নিচে নেমে এসেছে। হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো এতদিন তো বাড়িতে এসেছে। নিচটা একদিনও ঘুরে দেখা হয়নি। কেবল নিভার ঘরে গিয়েছিলো কয়েকবার। বিশাল ড্রয়িংরুম। পাশে রান্নাঘর। ড্রয়িংরুম থেকে বেডরুমগুলোতে প্রবেশ করতে হয় ছোট ছোট শামুক, ঝিনুকে নির্মিত বড় পর্দা পেরিয়ে। মেরি, এমিলিন কিংবা কোনো পরিচারিকাকেই নিচে খুঁজে পায়নি মাহা। নিভা বসুন্ধরা কমপ্লেক্সে গিয়েছে শপিং করতে। মাহাকে নিতে চেয়েছিলো। মাহার ভালোলাগছিলোনা বলে যায়নি। পর্দা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে মাহা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো আশপাশ। দামি দামি কারুকাজ। প্রাচীণ বিভিন্ন মূর্তি, সু পিস দিয়ে সুন্দর করে সাজানো বাড়ির প্রতিটি কোণা। হঠাৎ একটা ঘর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখে ঘাবড়ে গেলো মাহা। ঘরটা একেবারে কোণায়। মাহা এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলো সে ঘরে, রবার্ট একটি কনিক্যাল ফ্ল্যাক্স থেকে অন্য একটি কনিক্যাল ফ্ল্যাক্সে কি যেন মিশাচ্ছে। সেখান থেকেই ধোঁয়ার সৃষ্টি। এছাড়াও ফ্লাস্ক.এইচবেইন্ডস,স্টক,স্পেকট্রোফটোমিটার, বিকার, ফানেল, ব্যুরেট ইত্যাদি দিয়ে ভরে আছে ঘরটা। রবার্টের নজরে পড়তেই রবার্ট তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো মাহার পানে। মাহা ভয় পেয়ে গেলো খানিকটা।
“What do you do outside this room? Come in.”

ভিতরে ঢুকার আহ্বান জানালো রবার্ট। সাথে মিষ্টি করে হাসলোও। রবার্টের এমন রূপ এই প্রথম দেখলো মাহা। অদ্ভুত ঠেকলো তার নিকট। রবার্টকে সে মুখচোরা হিসেবেই ধরে নিয়েছে। চুপচাপ থাকে। কথা বলেনা। ফিরে তাকায়ও না। তাহলে আজ এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন। মাহা আড়ষ্ট হয়ে আরেকটু উঁকি দেয়।

৮৬.

একটা বড় আকারের ইঁদুর রাখা খাঁচার ভিতরে। মাহা আর কিছু দেখার আগে রবার্ট আবার বললো,
“What happened? Why don’t you come in? Are you scared? Don’t be afraid. I will not do anything to you. Come on, come on.”

অধৈর্য্য শোনালো রবার্টের গলা। মাহা কি করবে বুঝতে পারছেনা। এমন সময় পিছন থেকে কেউ চোখ রাঙালো রবার্ট কে। ভয়ানক ভয় দেখালো। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো রবার্টের। কাউকে সে ভয়৷ ভিষণ ভয় পায়। চুপসে গেলো রবার্ট। মাহা ভিতরে প্রবেশ করার আগেই কেউ আঁকড়ে ধরলো তার হাত। নরম কোমল হাত। মাহা হাতের দিকে তাকিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে এমিলিন। মাহা কিছু বুঝে উঠার আগেই এমিলিন টেনে নিয়ে এলো তাকে। ড্রয়িং রুমে এসে ছেড়ে দিলো মাহার হাত। মাহা এমিলিনের কর্মকাণ্ডে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
“ম্যাম, ডক্টর স্যার আপনাকে ডাকে।”

মেরি ক্ষীণ হেসে বললো। মাহা হতভম্বের ন্যায় উপরে উঠে এলো। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে সত্যিই সে বুঝতে পারেনা। এই বাড়িটা একটা ধোঁয়াসার রাজপ্রাসাদ। বেডরুমে ঢুকার সাথে সাথে সার্থক কোথ থেকে দৌঁড়ে এসে মাহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মাহা অবাক। মাহা কিছু বলার আগেই তার ওষ্ঠদ্বয় সার্থকের অধীনে চলে গেলো। দীর্ঘ সময় পর মাহাকে ছেড়ে আবার জড়িয়ে ধরলো সার্থক। সার্থকের হাত পা কাঁপছে। অন্যদিন হলে হয়তো লজ্জা পেতো মাহা। আজ পেলোনা।
“কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেন আপনি?”
“মাহা”

গম্ভীর কন্ঠ সার্থকের।
“আমি তোমাকে ভিষণ ভালোবাসি, মাহা।”

বলেই মাহার চুলে মুখ ডুবালো সার্থক। এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলে পাখি চলে যাবে নীড় ছেড়ে। দূরে। বহুদূরে। তা কি কখনো হতে দিবে সার্থক? নিজের অলকানন্দা কে কি কখনো নিজের থেকে দূর করে দিবে? সার্থক পারবেনা। কখনো পারবেনা। আবারও আর্দ্র ভালোবাসায় সিক্ত হলো গৃহে বিদ্যমান দুটো প্রাণ। একজন সর্বোচ্চ ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইলো নিজের প্রাণপাখিকে। অপরজন সিক্ত ভালোবাসায় লজ্জার খোলসে আবৃত হচ্ছে আবার কখনো সাহসী হয়ে উঠছে।

(চলবে)…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৭.
“তুমি যা বলছো ভেবে বলছো তো রেজওয়ান? তুমি একটা দাগী আসামি কে নিয়ে সিলেট যেতে চাও!”

প্রলয় চ্যাটার্জী ভিষণ অবাক হয়েছেন। অবাক হলে তিনি আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসেন। সেই সাথে মিঃ সম্বোধনটাও করেন না।
“স্যার, আমি যা বলছি ভেবে বলছি। আমাকে একটা সুযোগ দিন।”
“এই নিয়ে কতবার তো একই কথা বললে। এটাই কিন্তু তোমার শেষ সুযোগ রেজওয়ান। এরপরে আমি কেসটা সিআইডি কে হস্তান্তর করবো। তুমি ড্রা/গের কেসটা দেখবে। এই কেস নিয়ে এখন মিডিয়ায় বেশি মাতামাতি নেই। এটা সিআইডি আস্তে ধীরে সলভ করুক।”
“স্যার, তাহলে কি আমি সুযোগটা পাচ্ছি?”
“মিঃ রেজওয়ান তোমায় আমি ভরসা করি। তবে এটাই শেষ।”

রেজওয়ান কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। অতঃপর বেরিয়ে এলো বাইরে। মুন্সিকে বললো,
“জেলখানায় যাবো একটু।”

অন্ধকার ঘরে কথা হচ্ছে দুজন মানব-মানবীর। তেজস্বী মানবী যেন সবটা জেনেও এই মানুষটার সামনে অপারগ। ভালোবাসা কি এতই শক্তিশালী! এতটা তেজস্বী মেয়েকেও বদলে দেয়।
“আগামীকাল সিলেট যাবে। সাথে কড়া পাহারা থাকবে। প্লিজ তুমি কিছু করতে যেও না। নির্ঘাত ধরা পড়বে।”

বাঁকা হাসলো সামনের মানুষটা। এ যেন বাঘকে বলা শিকার করোনা। মানবী কিছুটা কষ্টমাখা গলায় বললো,
“তুমি কি আমায় কোনোদিনও বুঝবেনা? এতটাদিন তোমাকে এত সব ইনফরমেশন দিচ্ছি। তুমি কি বুঝতে পারোনা? আমি তোমাকে ভালোবাসি?”

হা হা করে হেসে উঠলো অন্ধকার মানব। অতঃপর গম্ভীর সুরে বললো,
“কেন? আমি খারাপ জানোনা? একজন দেশরক্ষী হয়েও আমার মতো অপরাধীর সাথে তোমার এতো সখ্যতা মানায় না। এই মুহূর্তে আমি ঠিক কি করতে পারি তুমি নিশ্চয়ই তা জানো?”
“আমি সব মেনেই তোমাকে ভালোবাসি।”
“একটু জুস খাবে?”

ঘাবড়ে গেলো অন্ধকার মানবী। কষ্টমাখা গলায় বললো,
“তুমি খুব খারাপ। খুব।”
“আমি তো তা জানি।”

মানবী বেরিয়ে গেলো। অন্ধকার মানব সোফায় বসে মাউথ অর্গান বাজাতে ব্যস্ত। সেই সাথে ছক কষে নিলো আগামীদিনের। বাঁকা হাসলো আবারও। যে কাজটা সে করে সে কাজটা তার ভিষণ প্রিয়। পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাকে এই কাজ থেকে ফেরাতে পারবেনা। ভোরের দিকে মাতব্বর শরীফকে নিয়ে রেজওয়ান রওনা দিলো সিলেটের পথে। কাকপক্ষীও এই খবর জানেনা। সাথে আছেন পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তা। দুটো গাড়ি। সবাই ছদ্মবেশে আছে। মাতব্বর শরীফকে ভয়ানক লাগছে দেখতে। এতদিনপর বাইরের আলো গাঁয়ে লাগায় কুঁকড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এত আলো সহ্য হচ্ছিলোনা তার। এখন সয়ে এসেছে অনেকটা। বড় বড় দাঁড়ি। লালচোখ। কতটা ভয়ানক লাগছে তাকে দেখতে! স্বয়ং পুলিশ কর্মকর্তারাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। মুন্সির রাগও হলো নিজের স্যারের উপর। কি দরকার দাগি আসামির কথা শোনার! স্যার কি বোকা? গাড়ি চলছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে। হঠাৎ থেমে গেলো গাড়ি। স্থানটা নির্জন। দুপাশে জঙ্গল। রেজওয়ান প্রশ্ন করলো,
“কি ব্যাপার মুন্সি? গাড়ি থামালে কেন?”
“স্যার, সামনের গাড়ি থেমে গেছে।”

৮৮.

সামনের গাড়িতে মাতব্বর শরীফ রয়েছেন। রেজওয়ান তৎক্ষনাৎ বের হওয়ার জন্য গাড়ির দরজা খুলতেই ধোঁয়ায় ভরে গেলো চারপাশ। কাঁদুনে গ্যাসের দাপুটে প্রভাবে চোখ জ্বলছে সবার। রেজওয়ান সময় নষ্ট না করে জলদি বের হলো। পিস্তল হাতে নিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই তার বাম হাতে গুলি করলো কেউ। লাল রঙের তরল গলগল করে বের হচ্ছে। রেজওয়ান অসহায় হয়ে বুজে আসা চোখে কেবল দেখলো মাতব্বর শরীফকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন। এরপরের ঘটনা রেজওয়ান জানেনা।

রেজওয়ানের জ্ঞান ফিরলো দিন দুয়েক পর। ততদিনে সারাদেশে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। “পুলিশের ব্যর্থতায় নিখোঁজ হলেন সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফ”। প্রলয় চ্যাটার্জীসহ অন্যান্য বড় কর্মকর্তাদের উপর উপরমহল থেকে চাপ আসছে। সারাদেশে থমথমে পরিবেশ বিদ্যমান। আবার সেই ২০১২ কেউ দেখতে চায়না। রেজওয়ানের উপর অনেকটা ক্ষিপ্তও তিনি। কি দরকার ছিল একজন দাগী আসামি কে বাইরে আনার! প্রলয় চ্যাটার্জীকে দেখে উঠে বসার চেষ্টায় রেজওয়ান। সাথে আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন।
” আপনি অসুস্থ মিঃ রেজওয়ান। উঠার চেষ্টা না করাই ভালো।”
গম্ভীর গলায় বললেন প্রলয়। রেজওয়ান ভয় পাচ্ছে।
“আপনি যে কাজটা করেছেন তা একদম ঠিক করেননি রেজওয়ান।”

হাতের ব্যথা নিয়েই উঠে বসলো রেজওয়ান। প্রলয় এবার গুরুগম্ভীর সুরে বললেন,
“একটা দাগী আসামি গায়েব। গত দুদিন যাবত মিডিয়া, মন্ত্রী পরিষদ সব জায়গা থেকে চাপ আসছে আমার উপর। আমি আপনাকে ভরসা করেছিলাম রেজওয়ান। আপনি ভরসার অবমাননা করলেন। আজ থেকে আগামী ছয়মাসের জন্য আপনাকে বরখাস্ত করা হলো। নোটিশ শীঘ্রই পৌঁছে দেওয়া হবে আপনাকে।”

কথাটুকু সেরেই বেরিয়ে গেলেন প্রলয় চ্যাটার্জী। এই ভয়টাই পাচ্ছিল রেজওয়ান। ভিতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। আশার আলো দেখতে পেয়েও আবার সেই তিমিরেই তলিয়ে গেলো যেন।

মাহার পরীক্ষা আজ শেষ। এখন হাতে কিছুদিন ছুটি রয়েছে। মাহা ভেবেছে সার্থককে বলবে তাকে যেন একবার নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যায়। কত মাস পেরিয়ে গেলো। বাবাকে দেখা হয়না! বুকটা কেঁপে উঠে মাহার। বাবার কবর যিয়ারত করার জন্য ছটফট করে মন। সার্থক অনেক সুখে রেখেছে মাহাকে। মাহার একাকী জীবনে অপার্থিব সুখের সন্ধান দিয়েছে। মাহা মাঝে মাঝে ভাবে, “আচ্ছা, এতো সুখ তার কপালে সইবে তো! সে তো যাকে ভালোবাসে সেই হারিয়ে যায়। সার্থকও কি তবে….

আর ভাবতে পারেনা মাহা। ঝাঁকড়া চুলের মায়াময় মুখটা না দেখে মাহা বাঁচবে কি করে! মানুষটা যাদু জানে। এই কয়েকটা মাসে কত আপন করে নিয়েছে তাকে। তবে একটা ব্যাপার বড্ড বেমানান। রবার্ট বেশি একটা মাহার সামনে আসেনা। সার্থক বলেছে রবার্টের আশেপাশে বেশি না যেতে। সাইন্টিস্টদের মাথায় নাকি ঝামেলা থাকে। মাহার কাছে বড় অদ্ভুত ঠেকে এই রহস্যময় বাড়িটা। সিঁড়ি দিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে উপরে উঠছিলো মাহা। হঠাৎই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। কিছু বুঝে উঠার আগেই….

(চলবে)….

#অলকানন্দা
#পর্ব- ৩১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৯.
কিছু বুঝে উঠার আগেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে পড়ে গেলো মাহা। লাল রঙা তরলে ছেয়ে যাচ্ছে সবুজ রঙের কৃত্রিম গালিচাটা। মাহার চোখ বুজে আসছে। কেবল দেখতে পাচ্ছে কেউ একজন খুব চিৎকার করে তার দিকে ছুটে আসছে। মাহা বিরবির করে,
“সার্থক”
অতঃপর চোখ দুখানা বুজে যায় তার। সার্থক সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। প্রিয়তমার এহেন রূপে সার্থক ভীত, হতভম্ব। দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে অলকানন্দার বুকে। হৃৎস্পন্দন কেমন পরীক্ষা চালায়। মাথা তুলে নিজের সাথে মিলিয়ে ধরে, চিৎকার করে উঠে,
“এই প্রাণপাখি। চোখ খুলো, সোনা। চোখ খুলো অলকানন্দা।”

এত বছরের অভিজ্ঞ একজন ডাক্তার হয়েও কি ছেলেমানুষী আবদার। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে সার্থক। মস্তিষ্ক বলছে,”বোকা মানব এই মুহূর্তে নারীদেহটি হাসপাতালে না নিলে ছেড়ে চলে যাবে এই জগৎসংসার।” সার্থক চিৎকার করে দুরুক্তি করে। “না, না আমার অলকানন্দা আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা। কোথাও না।” সার্থকের গগনবিদারী চিৎকারে নিভা, এমিলিন, মেরি, মুইংচিন, রবার্ট সহ অন্যান্য সব পরিচারক, পরিচারিকা দৌড়ে আসে বিশাল হল রুমটায়। চোখ কপালে উঠে সকলের। কৃত্রিম সবুজ গালিচায় র’ক্তের স্রোত বয়েই চলেছে। সার্থক পাগলের মতো প্রলাপ বকছে। হিতাহিতজ্ঞান সত্যিই লোপ পেয়েছে তার। নিভা চিন্তাগ্রস্থের ন্যায় দৌড়ে আসে সার্থকের পানে।
“ভাইয়া, কি হয়েছে ওর?”

সার্থক রক্তলাল চোখে তাকায় নিভার দিকে। নিভা চুপসে যায়। সংকুচিত হয়। এই চোখের মানে অজানা নয় তার। বিধ্বংসী সে নজর। নিভা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। কেউ আগাবার সাহস পায়না। সার্থক কারো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার তোয়াক্কাও করেনা। কোলে উঠিয়ে প্রাণভোমরা কে নিয়ে চলে হাসপাতালে। ও নেগেটিভ র’ক্তধারী মাহার শরীর থেকে প্রচুর র’ক্তক্ষরণ হয়েছে। সার্থক দুদণ্ড বসে থাকেনি কোথাও। পাগলের মতো র’ক্তের সন্ধান করেছে। অবশেষে ডক্টর ওয়াসিফের ছেলের দুব্যাগ র’ক্তে মাহার বিপদ কেটেছে খানিকটা। সারারাত সার্থক মাহার পাশেই বসেছিলো। ভোরের আলো ফুটছে পূর্বদিগন্তে। নাম না জানা পাখির কলকাকলি কানে ভাসছে। ছিমছাম কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সার্থক সাদা বেডে পড়ে থাকা মলিন ঘুমন্ত মুখটার পানে চেয়ে আছে নির্নিমেষ। এই মেয়েটাই যে তার সব। তার হৃদয়ের একচ্ছত্র রাণী। তার মনোরাজ্যের সিংহাসনের অধিকারিণী। সার্থকের অলকানন্দা।
সার্থক ভেবেছিলো মাহা প্রেগন্যান্ট। গত কয়েকদিনের গতিবিধি নতুন অতিথি আগমনের জানান দিচ্ছিলো যেন। ভেবেছিলো প্রেগ্ন্যাসি কিট দিয়ে পরীক্ষা করতে বলবে মাহাকে। আজ হাসপাতালে এসে সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মাহা প্রেগন্যান্ট নয়। শরীর দুর্বল, প্রেশার লো। ডাক্তার ওয়াসিফই গতকাল মাহার অপারেশন করেছেন। মাথায় গভীর আঘাত পেয়েছে মেয়েটা। যান্ত্রিক ফোনটা বেজে উঠছে একটানা। হাসপাতালের নিস্তব্ধতা ভেদ করে যা ভিষণভাবে কানে লাগছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করলো সার্থক।
“ডক্টর ফায়রাজ আপনি আমার কেবিনে আসুন।”
“জ্বি, ডক্টর।”
ঘুমন্ত মাহার কপালে একটা আর্দ্র চুমু খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সার্থক। গন্তব্য ডক্টর ওয়াসিফের কেবিন।
“আসবো?”
মাহার সিটি স্কেনটাই মনোযোগের সাথে দেখছিলেন ডক্টর ওয়াসিফ। ডক্টর ওয়াসিফ নিউরোলজি, গাইনেকোলজি দুই বিভাগেই সমান পারদর্শী। সেইসাথে ডিএফএম ডিগ্রিধারী। অসাধারণ তার মেধাশক্তি। ডাক্তারি সেক্টরে আসার পর জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত তিনি ডাক্তারি পড়ায় ব্যয় করেছেন। দিন, দুনিয়া সংসার ভুলে কেবল সময় দিয়েছেন এই ডাক্তারি জগতের পিছনে। সার্থকের ডাকে সেদিকপানে তাকিয়ে ভিতরে প্রবেশের নির্দেশ দেন।

৯০.
“বসুন ডক্টর ফায়রাজ।”
“মাহার ব্রেন কন্ডিশন কেমন ডক্টর?”
“এখন কিছুটা ঠিক আছে। তবে আমি এমন কেস এর আগে কখনো দেখিনি ডক্টর ফায়রাজ। ওর ব্রেনের কিছু নার্ভস অদ্ভুত ঠেকছে আমার কাছে। তারা নিশ্চল আবার সচলও। বিষয়টা খুবই জটিল। আমার ধারণা ওর শরীরে এমন কোনো তরল পদার্থ পুশ করা হচ্ছে যার ফলে ওর নার্ভস নিশ্চল হয়ে পুনরায় সচল হয়ে উঠছে। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা ডক্টর ফায়রাজ। আপনার স্ত্রী কি বিগত কয়েকমাসের ঘটনা মনে রাখতে পারছে?”

হঠাৎই একটা কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সার্থকের। মাথার দুপাশে শিরাগুলো দপদপ করে ফুলে উঠে। হাত মুঠো করে নিজেকে শান্ত করে সার্থক। গম্ভীর অথচ শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“পুশ করা হচ্ছে মানে?”
“আমার ধারণা তরলটা কিছুঘন্টা পূর্বেও আপনার স্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে।”

এবারে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে সার্থকের। আসছি বলে বেরিয়ে পরে ডক্টর ওয়াসিফের কেবিন থেকে। নার্স নাজমা ফোন করলেন ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুমকে। জিনিয়া কিছুদিনের ছুটি নিয়েছে। হাসপাতালে তার আসা হয়না গত দুদিন যাবত।
“হ্যালো, ম্যাডাম।”
“জ্বি, নাজমা আপা বলুন।”
“ম্যাডাম স্যারের ওয়াইফের অপারেশন হয়েছে গতকাল রাতে। খুবই ক্রিটিকাল সিচুয়েশন ছিল। এখনও আই.সি.ইউ তে ভর্তি।”
“কোন স্যার?”
“সার্থক স্যার”
“হোয়াট!”
বিস্মিত হলো জিনিয়া।
“কি হয়েছে?”
“মাথা ফেটে গেছে।”
“এখন কেমন আছে?”
“কিছুটা ভালো।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আজ রাখছি নাজমা আপা।”
“ওকে, ম্যাডাম।”

ফোনটা কেটে দেয় জিনিয়া। নাজমা ভেবেছিলেন হয়তো একটু বাহ্বা বা উপহার পাবেন খবর চালানের জন্য। তার কিছুই হলোনা। মনঃক্ষুণ্ন হলো নার্স নাজমার। ডক্টর জিনিয়া পরিবর্তন হয়ে গিয়েছেন। অনেকটা পরিবর্তন চোখে পড়ে।

_____________

সারাদিনেও মাহার অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সেই আই.সি.ইউ তে সাদা বেডটায় কতশত যন্ত্রপাতির ভিড়ে শুয়ে আছে মাহা। সার্থক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার হলদে ফর্সা মুখমণ্ডলের দিকে। বুকটা খচখচ করছে বেদনায়। মাথায় রাগ চড়ে আছে। আজ তবে হোক একটা ধ্বংসলীলা। মাহার মুখে অজস্র চুমু খেয়ে একটা জরুরি কাজে বাইরে বেরিয়ে যায় সার্থক।
অন্ধকার ঘর। চারদিকে কেবল দেয়াল। ছোট একটা দরজা। ঘরে ডুকতেই নাকে লাগে তীব্র গন্ধ। কি বিদঘুটে সে গন্ধ! এমন নিকষ কালো আঁধারে জ্বলে উঠে একটা টিমটিমে হলদে লাইট। নীল চোখের ফর্সা এক মানবকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ব্যথায় আর্তনাদ করছে মানবটি। তার সামনে কাঠের চেয়ারে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে আছে এক ছায়ামানব। গুরুগম্ভীর তার নিস্তব্ধতা, গাঁ ছমছমে তার বাঁকা হাসি। নীল চোখের মানব বারকয়েক শুকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজানোর চেষ্টা চালায়। সে ব্যর্থ। জিহ্বাও যে শুকিয়ে আসছে। এই পৃথিবীর গুটিকয়েক মানুষ জানে সামনের মানুষটা ঠিক কতটা নির্মম! তার হৃদপিণ্ডখানা টেনে ছিঁড়ে বের করে নিলেও অবাক হবেনা সে। মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে ছায়ামানব। তরতর করে ঘামছে নীল চোখের মানব। দেখা যাক কি বিধ্বংসী খেলা হয় আজ।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯১.
ওয়েন্ডিগো হলো একটি পৌরাণিক প্রাণী বা অশুভ আত্মা যা কানাডার পূর্ব উপকূলীয় বন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সমভূমি অঞ্চল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট লেক অঞ্চল এবং কানাডা, অ্যালগনকুইয়ান-পারিবারিক ভাষার বক্তা হিসাবে আধুনিক জাতিতত্ত্বে গোষ্ঠীভুক্ত এর আশেপাশে অবস্থিত ফার্স্ট নেশনসের লোককাহিনী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ওয়েন্ডিগোকে প্রায়শই একটি নরক আত্মা বলা হয়, কখনও কখনও মানুষের মতো বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণী হিসাবে চিত্রিত করা হয়, যা মানুষের উপর ভর করে। ওয়েন্ডিগো অতৃপ্ত লোভ/ক্ষুধার অনুভূতি, অন্য মানুষকে নরখাদক করার উপায়, সেইসাথে এর প্রভাবে যারা পড়ে তাদের হত্যা করার প্রবণতাও আছে। এই আত্মা এক অতৃপ্ত আত্মা। যা মানুষের ভিতরে বিদ্যমান নরপশুটাকে জাগিয়ে তুলে। তাকে বিধ্বংসী করে তুলে। ওয়েন্ডিগো হায়নার চেয়েও ধারালো। কখনো নিজের শিকারকে সে ছেড়ে দেয়না। ছায়ামানব। সে ওয়েন্ডিগোর মতো ধারালো কিংবা তার চেয়েও বেশি। মাউথ অর্গান বাজানো শেষে নীল চোখের ব্যাক্তিটার সামনে এসে দাঁড়ায় ছায়ামানব। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি। বহুদিন শিকার হত্যা না করার তৃষ্ণা। নীল চোখের মানব কাঁপা কাঁপা সুরে ব্রিটিশ এক্সেন্টে বলে,
“এবারের মতো দয়া করো। শেষ একটা চান্স দাও। আমি কখনো ঐ ভুল করবোনা। কখনো না।”
হা হা করে হেসে উঠে ছায়ামানব। শত কাকুতি মিনতি তাকে কাবু করতে পারেনা। একজন নারী ছোট ঘরটার দরজায় বারেবারে নিজের সঙ্গীর প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছেন। আটকানো দরজাটা খোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে ছায়ামানবের যে মনে দয়া নেই, মায়া নেই। সে তো ধ্বংসের রাজা। ছুরি দিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে গলায় একটান দেয়। গলগল করে বেয়ে পড়ছে লাল তরল। ছটফট করতে থাকে নীল চোখের মানুষটা। একটা মুরগের গলা কাঁ’ট’লে যেমন ছটফট করে ঠিক তেমন। বাইরে নারীর চিৎকার বাড়ে দ্বিগুণ হারে। একসময় থেমে যায় ভিতরের আর্তনাদ। সে সাথে থেমে যায় বাইরের আর্তনাদ। বহুদিনের অভস্ত্য হাতে ধারালো ছু’রি চলে ব্রিটিশ মানবের দেহে। বহু আকাঙ্ক্ষিত কাজটা করতে পেরে সাময়িক স্বস্তি পায় ছায়ামানব। অতঃপর…. স্বাদ গ্রহণ করে ভিন্ন কিছুর।

কেটে গিয়েছে একটা মাস। মাহা এখন অনেকটাই সুস্থ। গুলশানের ফ্ল্যাটে গড়েছে নিজ সংসার। ঘরের প্রতিটা কোণায় কোণায় তার বিচরণ। ল্যাব ঘরটা এখন আর নেই। সেখানে ঠাঁই পেয়েছে কতগুলো খাঁচা। খাঁচায় বন্দী হরেকরকম বিদেশি পাখি। লং টেল প্যারাডাইস, সালফার ক্রেস্টেড ককাটেল, মং প্যারাকিট,ওয়াক্সউইং, ইনকা টার্ন, ইডার, জাভা, চ্যাটারিং লরি, পার্লে কুনুর আরো কত পাখি! একজোড়া লাভ বার্ডও রয়েছে। কি যে সুন্দর দেখতে! নিভার আচরণে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। চুপচাপ থাকে। কালো রঙের জামা পরে সবসময়। মাহার সাথেও বেশি একটা কথা বলেনা। উদাস তার ভঙ্গি। মাহা হাসপাতাল থেকে ফিরে শুনেছে রবার্ট নাকি কিছুদিনের জন্য ইংল্যান্ডে গিয়েছে। হয়তো তাই নিভার মন খারাপ থাকে। মাহা প্রথম কয়েকদিন চেষ্টা করেছিলো নিভার সাথে হাসিখুশি কথা বলতে। তবে নিভা যেন কোনো পাথর। বাইরে ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। মাহা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। দৃষ্টি বাইরে বৃষ্টির দিকে। হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মাহা চিনে এই স্পর্শ। তার একান্ত প্রিয় মানুষটার স্পর্শ। মাহার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে তাতে চুমুক দিলো সার্থক।
“কি করছেন? আমার এঁটো তো।”
“হুম।”
“কি হুম? রাখেন এটা। আমি কফি করে এনে দিচ্ছি।”
“মিষ্টতা কোথায় পাবো আমি?”
“চিনি দিবো তো।”

সার্থক মুচকি হেসে মাহাকে নিজের দিকে ফিরালো। নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বললো,
“তুমি বড্ড অবুঝ মাহা।”
মাহা জানেনা কেন! তবে এই লোকটাকে তার পৃথিবীর সবচেয়ে আপন একজন মনে হয়। একান্ত নিজের। মাহা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। দুয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। সার্থক মাহার অগোছালো চুলে ভালোবাসার পরশ দিলো।
“আমাকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাবেন?”
“প্রশ্ন নয় আদেশ করবে রাণী।”
মনের উদাসীনতার মাঝেও যেন হাসি পায় মাহার। লোকটা এমন কেন!
“কালকে নিয়ে যাবেন?”
“দেখি হসপিটালে যোগাযোগ করে। ছুটি পেলে নিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা।”
নিস্তব্ধতা। বাইরে এক পশলা বৃষ্টি। সার্থকের বুকে মাথা দিয়ে আছে মাহা। এত শান্তি কেন এই বুকটায়!

৯২.
চাকরি থেকে রেজওয়ানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আজ একটামাস যাবত রেজওয়ান ঘরে বসে। অন্ধকারে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এত এত তিরস্কার সত্যিই আর নিতে পারছেনা রেজওয়ান। বেলা চারটা ত্রিশ। প্রতিদিনের মতো কলিং বেল বেজে উঠলো। সাবিনা বেগম দরজা খুলে দিলেন। তিনি জানেন কে আসবে। প্রতিদিনের মতো আজো এশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“আসো ভিতরে আসো।”
সোফায় এসে বসে দুজনে। হাতের ব্যাগটার দিকে নজর যায় সাবিনা বেগমের। গত পনেরোটা দিন যাবত এই মেয়েটা কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে আসছে রেজওয়ানের জন্য। প্রথম যেদিন খিচুড়ি আর কালা ভুনা করে নিয়ে এসেছিলো সাবিনা বেগম হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কার জন্য?”। এশা মাথা নিচু করে আস্তে করে বলেছিলো,”আপনার ছেলের জন্য।” মেয়েটা কষ্ট পাবে বলে সাবিনা বেগম বলেন না। রেজওয়ান তো এসব খাবার মুখেও তুলেনা। এশা খাবার নিয়ে আসে এত আশা নিয়ে। সাবিনা বেগম যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। শ্যামবতী মেয়েটার মুখে ভিষণ মায়া।
“আন্টি, আমি আজ আপনার জন্য আর আপনার ছেলের জন্য একটু হাঁসের মাংস, চালের রুটি করে নিয়ে এসেছি। খেয়ে বলুন না আন্টি কেমন হয়েছে।”
বলতে বলতেই বাটিগুলো মেলে সাবিনার সামনে তুলে ধরলো এশা। খুব সুন্দর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। সাবিনা বেগম রুটি ছিঁড়ে হাঁসের মাংস তার ভিতরে পুরে মুখে দিলেন। এক কথায় অসাধারণ স্বাদ। ঝাল হাঁসের মাংস আর রুটি এত মজা! তিনি আগে কত খেয়েছেন এমন কখনো খান নি। পুরো তিনটে রুটি, অর্ধেক বাটি হাঁসের মাংস খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন সাবিনা। তিনি একটু ভোজনরসিক বটে। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
“তুমি তো চমৎকার রান্না করো মেয়ে।”

এশা একটু লজ্জা পেলো যেন। হবু শাশুড়ীর প্রশংসা প্রত্যেক হবুবউয়েরই ভালোলাগে। হায় হায়! কিসের হবুবউ আর কিসের শাশুড়ী! বোকা পুলিশ তো কিছুই বুঝেনা। আর এখন তো বিরহে দিন পাড় করছেন তিনি।
“আপনার ছেলের ভালোলাগবে তো আন্টি?”
“তুমিই না হয় ওর ঘরে গিয়ে খাবারটা দিয়ে এসো।”
“আমি?”
“হুম, রেজওয়ানের খাবারটা দিয়ে আসো তো মা। আমি একটু পাশের বাসায় যাবো।”

সাবিনা চাচ্ছেন এশাকে সুযোগ দিতে। তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। এশা একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে রেজওয়ানের দরজার সামনে দাঁড়ালো। নক করবে কি করবেনা! বুকটা ধুকপুক করছে তার। কতদিন বোকা পুলিশটাকে দেখা হয়না! দরজায় নক করেই ফেললো এশা। ভিতর থেকে গম্ভীর কন্ঠ,
“মা, বিরক্ত করো নাতো।”
প্রিয় কন্ঠ! কতদিন বাদে শুনলো এশা। বুকটা এখনো অশান্ত।
“আমি, আমি এশা।”
“কি চাই?”
“আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলাম।”
“খাবোনা এখন। তুমি যাও।”
“প্লিজ, একটু খান। আমি অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য হাঁসের মাংস আর চালের রুটি করে নিয়ে এসেছি। আপনার অনেক পছন্দের না?”
“বিরক্ত করো নাতো।”
“এমন করছেন কেন? একটু খেলে কি হয়?”
এশা নাছোড়বান্দা। আজ একনজর লোকটাকে দেখতে তার মনটা ছটফট করছে। কি করে বুঝাবে সে। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো রেজওয়ান। বিধ্বস্ত দশা। এলোমেলো চুল, পরনে একটা নীল টি-শার্ট আর শর্টস। এশা একধ্যানে তাকিয়ে আছে। তার মনে অবাধ্য সব ইচ্ছে জাগছে। রেজওয়ান ধমকে উঠলো,
“এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?”
“ইয়ে মানে”
“থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব মেয়ে। প্রতিদিন কি নাটক শুরু করেছো তুমি? আমার যা একটু সম্মান অবশিষ্ট আছে তাও ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছো?”
“না মানে..
“একদম চুপ। কি ভেবেছো আমি কিছু বুঝিনা? আর মা তোমাকে বাড়িতে জায়গা দেয় কেন! প্রতিদিন খাবার রান্না করে নিয়ে আসছো। আশেপাশের মানুষ দেখছেনা। আমার সম্মান শেষ করে কি মজা পাচ্ছো তুমি?”
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”
“আমি ভুল বুঝছি। আমি? আর এসব কেন আনো আমার জন্য!”
কথাটা বলেই এশার হাতে থাকা খাবারের প্লেটটা নিচে ফেলে দিলো রেজওয়ান।
“কাজটা আপনি ঠিক করেন নি মিঃ রেজওয়ান।”
ছলছল চোখে কথাটা বলে দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো এশা। সাবিনা সিঁড়িতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এই মেয়ে কি হয়েছে তোমার?”
জবাব না দিয়েই দৌড়ে পালায় এশা। রেজওয়ান ঠাস করে নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ আগে প্রলয় চ্যাটার্জি ফোন করেছিলেন। কিছু কটু কথা শুনিয়েছিলেন। সেই রাগ এশার উপর দেখালো রেজওয়ান।

৯৩.
কতক্ষণ যাবত এক নাগাড়ে কলিং বেল বেজেই চলেছে। মেরি দরজা খুলে দিলো। সামনে একজন বিদেশি লোক দাঁড়িয়ে। মেরিকে দেখে কুশল বিনিময় করলো লোকটা। ব্রিটিশ এক্সেন্টে বললো,
“কেমন আছো মেরি?”
“ভালো, আলবার্ট। প্লিজ আপনি ভিতরে আসুন।”

আলবার্ট সোফায় এসে বসলো। মুইংচিনও এসে বসেছে পাশে। বহুদিনের পরিচয় তাদের। মুইংচিনের চেহারাটা মলিন। আলবার্ট সোফায় হেলান দিয়ে মেরিকে বললো,
“এক কাপ কফি পেলে মন্দ হয়না মেরি। সাথে বিশেষ…
“ডক্টর স্যারের নিষেধ আছে।”
“ওকে, তাহলে কফিই নিয়ে আসো।”

কথাটা বলে মুইংচিনের দিকে তাকালো আলবার্ট।
“কি মুইংচিন উদাস কেন?”
“কেন টুমি জানোনা?”
“উফ্, তোমার এই ভাঙা ভাঙা বাংলা বেশ শোনায় কিন্তু মুইংচিন।”
“মজা করোনা আলবার্ট।”
“সরি, সরি।”

দুহাত উপরে তুলে বললো আলবার্ট। নিভা কালো একপোশাক জড়িয়েছে সারা গাঁয়। ঘর থেকে বেশি একটা বাইরে বের হয়না সে। আলবার্টের কন্ঠস্বর শুনে হলরুমের সোফার কাছটায় এসে দাঁড়ালো নিভা।
“কেমন আছো নিভা?”
“খুব ভালো। পৃথিবীর সমস্ত সুখের ঊর্ধ্বে আছি আমি।”
“এই তুমি কি রাগ করলে?”
“না তো। তোমাদেরই তো সময়। আমরা তো জলে ভেসে আসছি।”
“আহা, রাগ করছো কেন? আমি কি তা বলেছি?”

মেরির মুখে আলবার্টের আসার খবর শুনে খানিকটা চিন্তিত হলো সার্থক। আচ্ছা, সে কি একটু শান্তি পাবেনা! দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত মাহার মুখপানে চাইলো সার্থক। কি নিষ্পাপ! কি পবিত্র! নিয়তি কেন এমন অদ্ভুত খেলায় নেমেছে? সার্থক তো বেশ ছিলো নিজের ছন্নছাড়া জীবনে। এখন যে সার্থকের বাঁচতে ইচ্ছে জাগে। একটু ভালো থাকার ইচ্ছে জাগে। সুন্দর একটা সংসার গঠনের ইচ্ছে জাগে। ফ্রেশ হয়ে এসে বেডরুমের দরজাটা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে নিচের দিকে পা বাড়ালো সার্থক।

চলবে…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯৪.
“যেভাবে এসেছিলে সেভাবেই চলে যাও।”

সার্থকের এমন থমথমে গলায়, বলা কথায় আলবার্ট সোফায় আরেকটু হেলান দিয়ে বসে। হাত দুটো একত্র করে নাড়ায় কতক্ষণ। মুখে হাসি।
“ভয় পেলে?”
আলবার্টের কন্ঠ। সার্থক পায়ের উপর পা তুলে বসেছে। পা নাড়াচ্ছে ছন্দে ছন্দে। কৌতুক সুরে বলে,
“আমি?”
“কেন? তুমি ভয় পাওনা?”
“সেটা তো আমার চেয়ে ভালো তোমার জানার কথা।”
“এখন তো সময় পাল্টেছে।”
“বাঘ শান্ত হয়ে বসে আছে বলে লেজে পা দিতে এসোনা। নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে কি মজা পাবে বলোতো?”
“তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো।”
সার্থক উঠে একদম আলবার্টের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। খানিক ঘাবড়ানো ভাবটা প্রকাশে আনলোনা আলবার্ট। সার্থকের মুখে বাঁকা হাসি। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কিছু একটা বলতেই আলবার্ট উঠে বেরিয়ে গেলো। আর কখনো এখানে আসবেনা বলে মনস্থির করেছে সে। মুইংচিন, নিভাসহ সকলেই চলে গিয়েছে নিজ ঘরে। রাজার রাজত্বে বাঁধা দেওয়ার বুদ্ধি, ক্ষমতা, শক্তি কোনোটাই তাদের নেই। সার্থক চললো তার অলকানন্দার কাছে।
________________

“এশা, মা। এসব আবার কোন ধরনের কথাবার্তা? হুট করে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে? তোমার খালামনির সাথেই বা কখন কথা বললে? মনিরা আমাকে এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি কেন? তাছাড়া তোমার গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি এখনো।”
“আমি খালামনিকে না করেছিলাম, বাবা। আমি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চাই।”
“সিদ্ধান্ত কি ফাইনাল করে ফেলেছো?”
“জ্বি, বাবা।”

এশা অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালো বিদেশে। রেজওয়ান খুবই অনুতপ্ত। সে বুঝতে পারছে মেয়েটির সাথে এরকম অশোভন আচরণ করা ঠিক হয়নি। তবে ততোদিনে পাখি নীড় ছেড়ে পালিয়েছে বহু দূরে। আজ রেজওয়ান এসেছিলো এশার সাথে কথা বলতে। এশার মায়ের কাছে জানতে পারলো এশা দেশে নেই। খালার কাছে চলে গিয়েছে। রেজওয়ান জানেনা কেন হঠাৎ করেই এশা নামের শ্যামবতী, এলোকেশী মেয়েটা তার ভাবনায় এতো আসছে। কেন?

চার বছরের সুখের সংসার সার্থক আর মাহার। সার্থক কখনো মাহাকে কোনোকিছুর কষ্ট দেয়নি। মাহা যেমন চেয়েছে, যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই সব হয়েছে। মাহা মাঝে সৎ মা দিনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তিনি সাফ মানা করে দিয়েছেন মাহার সাথে তার, তার ছেলেমেয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। মাহা যেন কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে দিনার সামনে না যায়। সেদিন সার্থকের বুকে মাথা রেখে খুব কেঁদেছে মাহা। এই জীবনে আপন বলতে শুধু এই একজনই রইলো তবে। বাকি সবাই তো চলে গিয়েছে যোজন যোজন দূরে। নিভার আচরণে পরিবর্তন ঘটেছে অনেকটা। সে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। রঙিন জামা পরিধান শুরু করেছে। মাহার সাথে সেই আগের মতোই হাসিখুশি ভাবে কথা বলে। অদ্ভুতভাবে লুবান আর রবার্ট যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। মাঝেমাঝে মনে হয় তাদের কোনো অস্তিত্বই কোনোকালে ছিলোনা এই গুলশানের বাড়িটায়। রুমানা এসেছিলো এই বাসায় কয়েকবার। বান্ধবীর এতো সুন্দর সুখের সংসার দেখে কত দোয়া করলো পাগলীটা। মাহা চিরপরিচিত সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। হাতে একটা সাদা খাম। তাতে সার্থকের জন্য বিশেষ কিছু অপেক্ষা করছে। বহু চেষ্টার ফল।

৯৫.
মাহা জানে এখনই সার্থক এসে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরবে। ঠিক তখনই মাহাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সার্থক। মানুষটা সত্যিই পাগলাটে। মাহা অনুভব করছে প্রিয় পুরুষের স্পর্শ। বিস্তৃত বারান্দায় টবে লাগানো চার পাঁচেক অলকানন্দা ফুলের গাছ। চাঁদের মিহি আলোয় হলুদ রঙটা অভূতপূর্ব লাগছে। মাহা সেদিকপানে তাকিয়ে বলে,
“আপনার জন্য একটা উপহার আছে।”
“কি উপহার?”

মাহা নিজেকে ছাড়িয়ে সার্থকের মুখোমুখি হলো। চাঁদের আলোয় সবুজ রঙা বাটিক থ্রি-পিস পরনে, নাকে নাক ফুল পরা হলদে ফর্সা মুখটা অপূর্ব লাগছে সার্থকের কাছে। টুক করে গালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দিলো সে। মাহা বিরক্ত হয়ে বলে,
“উফ্, আপনিও না।”
“কি?”

দুই ভ্রু নাচিয়ে মজার ছলে জিজ্ঞেস করে সার্থক। মাহা সার্থকের বুকে মাথা রেখে শুধায়,
“দুষ্টু। আপনি ভিষণ দুষ্টু। যে আসবে সেও হয়তো আপনার মতোই দুষ্টু হবে।”
মাহার মাথায় হাত বুলানো থেমে যায় সার্থকের। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কি বললে?”
“কই কি বললাম?”
“কে আসবে?”
মাহা হাতে থাকা খামটা এগিয়ে দেয় সার্থকের নিকট। সার্থক খানিক অবাক হয়ে খামটা হাতে নেয়।
“কি আছে এতে?”
“খুলে দেখুন।”
দুটো লাল দাগ দেখে অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে সার্থক। হতভম্ব, বিস্ময়ে হা হয়ে একবার হাতে থাকা জিনিসটায় আরেকবার মাহার পানে চায় সার্থক।
“আমি বাবা হবো?”
“হুম”

লজ্জায় কিঞ্চিৎ লাল হয় মাহার কপোল। টুপ টাপ করে দু’খানা ভালোবাসার পরশ মাহার গালে এঁকে দেয় সার্থক। অতঃপর কোলে উঠিয়ে ঘুরায় অনেকক্ষণ। সার্থকের বাম চোখের কার্ণিশ বেয়ে পড়ে একফোঁটা নোনাজল। অন্ধকারের রাজা, দুঃখের রাজার সাথে হয়েছে আলোর রাণীর মিলন মেলা। প্রকৃতি কি সইবে এই অসম সম্পর্ক?

__________

মাতব্বর শরীফ উধাও হওয়ার পর থেকেই যেন ভাটা পড়েছে চৈতির কেস। রেজওয়ান যা একটু তৎপর ছিলো। সিআইডির হাজারো ফাইলের নিচে ধামাচাপা পড়েছে সেই ফাইল। রেজওয়ান পুনরায় কাজে ফেরার পর নতুন কেসগুলোতে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিলো যে আর খোঁজ নেয়নি পুরানো কিছুর। চলছে সার্থক মাহার জীবন। তবে আদোও কি এতো সুখে থাকতে পারবে? অভিমানী এশা আর অনুতপ্ত রেজওয়ানের মিল কি হবে? প্রশ্ন জাগে চৈতি কি করে মাহা হলো? সিলেটে কি ঘটেছিলো? মাহা কেন সব ভুলে গেলো? ছায়ামানব কে? চৈতির সাথে কি ঘটেছে? লুবান, রবার্ট কোথায়? মাতব্বর শরীফকে কে গায়েব করলো? মাহা যেদিন হাসপাতালে ছিলো তাকে কে মারতে চেয়েছিলো? ছায়ামানবকে অভ্যন্তরীণ খবর দেয় কে? মাতব্বর শরীফ ঘটনায় ইনচার্জ আজিজ কি করে আগুন লেগে মারা গেলেন? ওয়েন্ডিগোর সাথে ছায়ামানবের কি সম্পর্ক? সিলেটে মাহার জ্ঞান ফেরার পর কেউ কি ভুল তথ্য দিয়েছে সকলকে? এমিলিনের আসল পরিচয় কি? জুস নিয়ে সকলের এত আতংক কেন? আরো অনেক প্রশ্ন রয়ে যায়।

(চলবে)

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯৬.
মাহার দুইমাস চলছে। এক অদ্ভুত জগতে বিচরণ চলছে মাহার। দেহের ভিতর বেড়ে উঠছে ছোট আরেক দেহ। মানবদেহ! সার্থক একটা পাগল! এখন থেকেই কত যত্ন তার। মাহা আজ বহুদিন বাদে রেজওয়ান আর রেজওয়ানের মায়ের সাথে কথা বলেছে। এটা সত্যি সার্থকের পর যদি আপন কেউ হয় তবে তারাই। রেজওয়ান এখনো বিয়ে করেনি। সাবিনা কত করে বুঝান। বয়স তো নেহাৎই কম হয়নি। ত্রিশ পেরিয়েছে সেই কবে। সাবিনা বৃদ্ধ মানুষ কয়দিনই বা বাঁচবেন। ছেলেকে এত করে বুঝান তিনি। ছেলে নাছোড়বান্দা। তাই মাহার শরণাপন্ন হয়েছেন। এখন মাহা যদি একটু বুঝাতে পারে। রেজওয়ানের সাথে কথা বলা শেষে লাইব্রেরিতে বসে একটা বই পড়ছে মাহা। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটা। এই নিয়ে কতবার পড়েছে মাহা জানেনা। প্রতিবারেই মাহা মুগ্ধ হয়ে বইটি পড়ে।
“দুধের গ্লাসটা যেমন রেখে এসেছিলাম ঠিক তেমনই আছে। খাওনি কেন তুমি?”

বলতে বলতেই মাহার মুখের সামনে দুধের গ্লাসখানা তুলে ধরে সার্থক। মাহা চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে মুহুর্তেই। এই খাদ্য না না খাদ্য না এই অখাদ্যটা মাহার কোনোকালেই পছন্দ নয়। সার্থক কে সে শত বুঝিয়েও পারেনা। জোর করে ফল আর দুধের অত্যাচার চলে তার উপর। গুণে গুণে সকাল, বিকেল, রাতে।
“এভাবে কপাল কুঁচকে থাকলে হবেনা। হা করো।”
“দুধ মজা না।”
“তা কি মজা? চকলেট আর ফুচকা?”
“দেখুন খবরদার আমার প্রিয় খাবার নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।”
“হুম, বুঝলাম। এখন ভদ্র মানুষের মতো হা করো তো মাহা।”

অগত্যা দুধটুকু গিলতেই হলো মাহাকে। এই লোক তাকে না খাইয়ে এক চুলও নড়বেনা সে জানে। কে বলবে সে মাস্টার্স কমপ্লিট করা এক মেয়ে! একেবারে বাচ্চাদের মতো সার্থক মাহাকে আগলে রাখে। বাইরের মাহা খুব শক্ত হলেও এই মানুষটার সামনেই তার যত আবদার, দুষ্টুমি। মাঝেমাঝে নিজেকে ন্যাকা ন্যাকা মনে হয়। আয়নার ওপাশে প্রতিবিম্বটা চিৎকার করে বলে,
“ইস্! ন্যাকামি দেখো এর।”
মাহাও ভেঙচি কেটে বলে, “আমার ন্যাকামির লোক আছে দেখেই করি।” ভাবতে ভাবতেই নিজেকে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় পেলো মাহা। সার্থক কোলে উঠিয়ে নিয়েছে তাকে।
“উফ্! কি করছেন! বই পড়ছিলাম তো।”
“রাত অনেক হয়েছে, বউ। কালকে পড়ো আবার।”
“হুটহাট কোলে তুলে নেওয়াটা আপনার একটা বদভ্যাস বুঝলেন মিঃ।”

বলেই সার্থকের নাকে আলতো নিজের নাকটা ঘষে দিলো মাহা। সার্থক মাহার ঠোঁটে এক উত্তপ্ত চুমু খেয়ে বললো,
“যা চড়ার এখনই চড়ে নেও বউ। কয়েকমাস বাদে আর পারবেনা। আমার মা টা তখন আমার কোলে থাকবে। তখন তো মেয়েকে নামিয়ে নিজেই চড়ে বসে থাকতে চাইবে।”

সার্থকের উত্তপ্ত ভালোবাসা আর এহেনতর কথায় মাহা অবাক না হয়ে পারেনা। বেহায়া লোক! ঠোঁট টা তার ছিঁড়েই ফেলেছে বোধহয়। আহারে!
“রাখেন তো আপনার কথাবার্তা। আপনি জানলেন কি করে মেয়ে হবে? আমার তো ছেলে চাই।”
“উঁহু, মেয়ে চাই।”
মাহা মোচড়ামুচড়ি করছে। যার অর্থ সে আর থাকবেনা সার্থকের কোলে। সার্থক আত্মসমর্পণের সুরে বললো,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। সময় হলেই দেখা যাবে।”
“হুম, আল্লাহ যা দেন।”

৯৭.
“এই মাহা, চলো বাড়ির সামনে সুইমিংপুলটার দিকে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। তোমারও ভালোলাগবে।”

মাহার পায়ে পানি নেমেছে। হাঁটতে কষ্ট হয় ভিষণ। নিভার হাসি মাখা কন্ঠে বলা কথায় মাহা প্রতুত্তর করলো,
“আপু, হাঁটতে কষ্ট হয়। উনিও বাসার বাইরে বের হতে মানা করেছেন।”
“ভাইয়ার কথা ছাড়োতো তুমি। এই সময়ে একটু হাঁটাহাঁটি না করলে চলে? ভাইয়া তোমাকে সারাদিন ঘরে বন্দি করে রাখে।”
“এভাবে বলোনা আপু। উনি বেবিকে নিয়ে একটু বেশিই পজিসিব।”
“একটু হাঁটাহাঁটি তো করাই যায়।”

নিভার জোরাজোরিতে গুলশানের বহুতল ভবনের সামনে সদ্য নির্মিত সুবিশাল সুইমিং পুলটার সামনে হাঁটতে বের হয়েছে মাহা। শরৎকাল চলছে। বিকেলের আবহাওয়া বড়ই স্নিগ্ধ। আকাশে ভাসমান পেঁজা পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘ। মাহা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেই একটা আমগাছের তলায় রাখা বেঞ্চে বসলো। মৃদু বাতাসে মাহার কোঁকড়া চুলগুলো দুলছে। মাথায় অবশ্য উড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। পিঠে মেলে রেখেছে চুলগুলো। নিভা দাঁড়িয়ে আছে সুইমিংপুলের পাশে। হঠাৎ এমিলিন কোথা থেকে পাশে এসে দাঁড়ালো মাহার। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এমিলিন আজো মাহার নিকট এক বৃহৎ রহস্য।
“এই মেয়ে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে?”

এত বছরে এই প্রথম এমিলিনের কন্ঠ শুনে অবাক মাহা। মায়াবী চোখদুটো বড় বড় করে মেলে দেয় এমিলিনের পানে। এমিলিন এসে বসে মাহার পাশে।
“আমাকে কিছু বলেছেন?”
“আশেপাশে আর কি কেউ আছে?”
“না, এত বছরে কখনো আপনি আমার সাথে কথা বলেন নি।”
“আজ বলবো। অনেক কথা বলার আছে তোমায়।”
মাহা চিন্তায় পড়লো খানিকটা। কি এমন বলবেন এমিলিন?
“আমি সার্থকের ছোট খালামনি। কানাডায় আমরা তিনবোন স্বামী, সংসার নিয়ে বেশ ভালোই ছিলাম। সার্থকের মা অর্থাৎ আমার বড়আপা সাজি খুবই ভালো একজন মানুষ ছিলেন। বড়পার বিয়ের কয়েকমাস বাদেই আমাদের বাবা-মা মারা যায়। বড়পা তখন ফারহান ভাইয়ার সাথে কানাডায়। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মুহূর্তেই যেন এতিম হয়ে গেলাম আমরা তিনবোন। আমার বাবা-মা পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। আত্মীয় বলতে আমাদের তেমন কেউই ছিলোনা। বড়পা আমাদের কানাডা নিয়ে গেলেন। আমাদের নিজের কাছে রেখে বিয়ে দিলেন ভালো জায়গায়। মায়ের আসনটা যেন বড়পাকে কবেই দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। মেঝো বু এর মেয়ে নিভা। আমারও একটা ছেলে ছিলো। সার্থকের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। ভালোই ছিলাম আমরা। হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ঘুরতে যাওয়ার পথে প্লেন দুর্ঘটনায় হারিয়ে গেলেন বড়পা, ফারহান ভাই। দশবছরের সার্থকেরও কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। কানাডার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিলো তারা। প্রায় একমাস বাদে উদ্ধার হলো সার্থক। তবে বড়পা আর ফারহান ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেলেন হঠাৎ। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মেঝো বুর বাসায় আমি, আমার ছেলে ইফতি, সার্থক সবাই মিলে থাকবো। ছোটবেলার হাসিখুশি সার্থক কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন একটা অন্ধকার ঘরে নিজেকে আটকে রাখে। রাত হলে চিৎকার করে। বহু ডাক্তার দেখিয়েও এর কোনো বিহিত করা যায়নি। পরে হঠাৎ করেই যেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সার্থক একদম নিরব হয়ে গেলো। মাঝেমাঝে কোথায় যেন হারিয়ে যেতো সে। কানাডায় ডাক্তারি পড়া শুরু করলো একসময়। আমার মেঝ বুয়ের সাথে তার স্বামীর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো। এডওয়ার্ড ভাই ছিলেন খাঁটি কানাডিয়ান। একাধিক নারী সঙ্গ ছিলো তার। তাই মেঝ বু তাকে ডিভোর্স দেন। ডিভোর্সের পর আকস্মিক ভাবে এডওয়ার্ড কে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। খুবই জটিল আর অদ্ভুত পরিস্থিতি তে সময় কাটছিলো আমাদের। সার্থক উচ্চাকাঙ্খী হয়ে উঠে। পার্টি করা, ঘুরে বেড়ানো তার নিত্যদিনের কাজ। অনেক মানুষের আসা-যাওয়া হতো আমাদের বাসায়। যদিও ছোটবেলা থেকেই সার্থক তুখোড় মেধাবী। আমার কেন জানি মনে হতো অসৎসঙ্গে মজেছে সার্থক। আমি বাঁধা দিলাম তাকে। সে আমার কোনো কথাই মানলোনা। লুবান তার অনেক ভালো একজন বন্ধু হয়ে উঠলো। সাথে নিভা, নিভার বর রবার্ট, মুইংচিনও। কিছু একটা করতো তারা। রাতের পর রাত বাড়ি ফিরতো না। এরমাঝে সার্থক ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নি করছে। আমার ছেলে ইফতিও একসময় তাদের সাথে মিশতে শুরু করলো। রাতের পর রাত বাড়ি ফেরার নাম নেই। মেঝো বু হঠাৎ মারা গেলেন। তিনি অবশ্য বিছানায় পড়েছিলেন বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে। হঠাৎ করেই সার্থক বিধ্বংসী হয়ে উঠলো। তাদের একটা কোড ওয়ার্ড হলো জুস। অনেকবারই তাদের মধ্যে এটা নিয়ে কথা হতো। আমার ছেলে ইফতি একদিন গায়েব হয়ে গেলো। আমি আজো জানিনা আমার মানিক কোথায়। আমার মানিক কে যারা গায়েব করেছে তাদের ধ্বংস আমি নিজ চোখে দেখে মরতে চাই। সার্থক…..

মাহা হতভম্বের ন্যায় শুনছিলো কথাগুলো। এটা ঠিক সার্থকের অতীত নিয়ে মাহা কিছু জানেনা। সার্থকও কিছু জানায়নি। মাহা তো সার্থক কে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কি সুন্দর মনের মানুষটা! তাকে ঘিরে এসব কথা শুনতে মাহার ভালোলাগছেনা। তখনই সুইমিংপুলের পাশ থেকে নিভার চিৎকার ভেসে এলো। এমিলিন হয়তো আরো কিছু বলতেন। মাহা সেসব না শুনেই সুইমিংপুলের দিকে অনেকটা দ্রুত গতিতে ছুটে এলো। নিভা সুইমিংপুলের পানিতে পড়ে গিয়েছে।
“মাহা, মাহা আমি শ্বাস নিতে পারছিনা। আমাকে বাঁচাও মাহা।”

৯৮.

মাহা কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এমিলিন দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। শত্রুর ভালোবাসার মানুষের নির্মম পরিণতি তাকে আনন্দিত করছে মনে মনে। তিনি জানেন কি হতে যাচ্ছে। মানুষজন নেই বললেই চলে। এদিকে এবেলায় কেউ আসেনা। নিভা ডুবে যাওয়া অবস্থায় হাতটা বাড়িয়ে দিলো মাহার দিকে। চিৎকার করে বললো,
“আমার হাতটা ধরো মাহা। দয়া করে ধরো।”
মাহার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। এভাবে চোখের সামনে একটা মানুষ কে কিভাবে ডুবতে দিবে সে! নিজের চিন্তা না করেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো নিভার পানে। নিভা হেঁচকা টানে মাহাকে পানিতে ফেলে দিলো। মাহা সাঁতার জানেনা। বারবার চিৎকার করে বলছে,
“আমাকে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন, আপু। আমার বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে।”

মাহা তখন সুইমিং পুলের মাঝে ডুবন্ত অবস্থায় নিজের জীবন বাঁচাতে চাইছে। আর নিভা বাঁকা হেসে সাঁতার কেটে সুইমিংপুলের পাশে বসে মজা নিচ্ছে। সার্থক নিজেকে কি মনে করে? এবারে একবারে সার্থকের কলিজায় হাত দিয়েছে নিভা। জানে মৃত্যু অবধারিত। তবুও শত্রুর সুখ যে তার সহ্য হচ্ছিলো না। হঠাৎ করেই হিংস্র বাঘের ন্যায় ভয়ানক লাল চোখ নিয়ে সাদা এপ্রোন পরনে দৌড়ে আসলো সার্থক। নিভা সার্থক কে সত্যি এখানে আশা করেনি। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। যত যাই হোক জানের মায়া আছে তার। সার্থক ততক্ষণে ঝাঁপ দিয়েছে সুইমিংপুলের পানিতে। নিস্তব্ধ মাহা ততক্ষণে হয়তো বরণ করে নিয়েছে মৃত্যুকে।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৯৯.
মাহাকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। সুইমিংপুলে মাহার ছটফটানির দরুন পেটে চাপ পড়েছে অত্যাধিক। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ভিতরে ডক্টর ওয়াসিফসহ আরো বিজ্ঞ কয়েকজন ডক্টর রয়েছেন। সার্থক একজন সার্জন হওয়ার পরেও ওটিতে যাওয়ার সাহস তার হলোনা। এই দুটো হাতে কত মানুষের বুক চিড়েছে সে। কত ওটি করেছে। কখনো হাত কাঁপেনি। কখনো কোনো দেহের কাঁ’টা ছিঁ’ড়ায় তার কিছুই যায় আসেনি। আজ কাঁপছে সারা শরীর, মন সব। ডক্টর জিনিয়া তাবাসসুম দেশ ছেড়েছে আজ প্রায় বছর দুয়েক হলো। সার্থকের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে জিনিয়াকে তার বড্ড প্রয়োজন ছিলো। খুবই ভালো মানের একজন চিকিৎসক জিনিয়া। মাথায় অহেতুক চিন্তা ভাবনা ঘুরাঘুরি করছে। তীব্র অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে মস্তিষ্কে। পাগলের মতো পায়চারি করছে সার্থক। এমন সময় বেরিয়ে এলেন ডক্টর ওয়াসিফ।
“ডক্টর ফায়রাজ”

ওয়াসিফের ডাকে দ্রুত গতিতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় সার্থক। বহু কষ্টে উচ্চারণ করে,
“আমা.. আমার স্ত্রী কেমন আছে ডক্টর?”
“আপনার স্ত্রী এখন আশঙ্কামুক্ত। তবে..
“তবে কি ডক্টর?”
“আপনার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি। আপনার স্ত্রীর প্রেগ্ন্যাসিতে অনেক কমপ্লিকেশন ছিল। পেটের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ায় ব্লিডিং হয়েছে। তাই…

সাতমাসের বাচ্চাটা এভাবে চলে যাবে ভাবতেই পারছেনা সার্থক। কত স্বপ্ন বুনেছিলো দুজনে। কত আশা ছিলো বাচ্চাটাকে নিয়ে আজ সব শেষ। সব।

“ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছিলো?”
“মেয়ে”

দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে সার্থকের বুক চিড়ে। দ্বিতীয়বারের মতো মাকে হারালো তবে। বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা। কি ভেবেছে সবাই? সার্থকের কলিজায় আঘাত করে পাড় হয়ে যাবে সকলে? শরীর, মন জ্বলছে অনলে। বাঁকা হেসে ঘাড় কাত করে ওয়েন্ডিগো এলো বুঝি! একটা শক্ত কাগজের কার্টুনে ভরে বাচ্চাকে প্যাকেট করে সার্থকের হাতে দেওয়া হয়। বাক্স খুলে একনজর মা টাকে দেখার সাহস হয়নি সার্থকের। দহন, দহন হচ্ছে বুকের মধ্যখানে। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে জাগছে। মাহাকে দুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। তাই আই.সি.ইউ তে রাখা হয়েছে। সার্থক বাইরে থেকে কাঁচের দেয়ালের এপাড় থেকে প্রিয়তমার ক্লান্ত মুখটা দেখলো কেবল একবার। দহনে একটু বৃষ্টি নামলো। অতঃপর বেরিয়ে এলো হাসপাতালের বাইরে। মায়ের দাফন কাজ সম্পন্ন বাকি!

_____________

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বইছে বাইরে। গুলশানের বহুতল ভবনের অদূরে একটা কবরস্থান। একটু আগেই মাত্র একটা সাতমাস বয়সী বাচ্চার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়ছে। বাচ্চার বাবা কবরের পাশটায় মাটির রাস্তায় বসে একধ্যানে কবরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে করছে বিগতদিনের স্মৃতি। এই তো কিছুদিন পূর্বে,

মাহার পেটের উপর থেকে ঢোলা গেঞ্জিটা সরিয়ে টুপটাপ করে দু’খানা চুমু পেটে এঁকে দেয় সার্থক। মাহা এতো লজ্জা পায় সার্থকের এমন বেহায়াপনায়!
“কি যে করেন না আপনি। মুখ সরান। আমার সুড়সুড়ি লাগছে।”

মাহার কথা আদোও সার্থকের কানে গিয়েছে কিনা কে জানে। এবারে হরেকরকম গল্প জুড়ে দিলো পেটে থাকা অবুঝ শিশুটার সাথে।
“মা, বুঝলি তোর আম্মু আস্ত একটা হিংসুটে। মেয়েকে আদর করলেও সহ্য হয়না।”
“আপনি এতো শিউর কি করে মেয়েই হবে? এই চলুন না আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখি কি হবে?”
“না, মাহা। বাচ্চা জন্মের পর একেবারে জানবো আমরা। আমি জানি আমার মা ই আসবে।”
“আপনি ভিষণ পাগলাটে সার্থক।”

সার্থক মাহাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোমারই তো।”
“হুম, আমার। একান্ত আমার। আ.. আ..

মাহা পেটে হাত রেখে চিৎকার করে উঠলো। সার্থক ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এই মাহা ঠিক আছো তুমি? মাহা?”

মাহা চোখ-মুখ খিঁচে সার্থকের ডানহাত টেনে নিয়ে পেটে ছুঁয়ালো। বাবু কিক মারছে পেটে। মাহা চোখ-মুখ খিঁচে বললো,
“বাবার মতোই দুষ্টু হবে। খুব মজা পাচ্ছে মাকে মেরে।”

বলতে বলতেই গলা ভেঙে যায় মাহার। কান্না-খুশির অনুভূতিতে বাকরুদ্ধ সে। সার্থক অবাক হয়ে পেটে হাত ছুঁইয়ে রাখে। বাবু থেমে থেমে কিক করছে। সার্থক মাহার কাঁধে মুখ গুঁজে। দু-তিন ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে।
যেমনটা আজ পড়ছে। সার্থকের চোখের নোনতা অশ্রু আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে ধুঁয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। হিসাব -নিকাশ বাকি অনেক।

১০০.
“এবারের মতো আমাদের ক্ষমা করা যায় না?”

ক্রন্দনরত দুই মানবীর একজন বলে উঠে। সামনে চেয়ারে বসে বাঁকা হাসে ছায়ামানব। ক্ষমা শব্দটাই তো তার অপছন্দ। ভিষণ ভিষণ অপছন্দ।
“আজ একটা পরের জন্য নিজের আপনদের শেষ করে দিচ্ছো! সেই তোমার ধ্বংস ডেকে আনবে..
“শিস্, চুপ!”

মুখে আঙুল দিয়ে ধমকে উঠে ছায়ামানব। ধমকে কেঁপে উঠে সুউচ্চ বিল্ডিং। একজন মানবী জীবন ভিক্ষা চাইলেও আরেকজন নিশ্চুপ। তিনি যেন জানতেন এমন কিছুই হবে। আর কোনো কথা বলার সুযোগ কেউই পায়নি। বাইরে বৃষ্টির তালে তালে খ’ন্ড হতে থাকে আস্ত দুই মানবী। তাদের র’ক্তের একেকটা ছি’টে আনন্দে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে ছায়ামানবের। তান্ডব করতে ইচ্ছে করছে। খুশির তান্ডব।

_________________

মেরির কাছ থেকে মাহার অসুস্থতার কথা শুনে হাসপাতালে ছুটে এসেছে রুমানা, এশা। রুমানার অফিসের কলিগ এশা। বিদেশ থেকে ফিরে পুরানো সকল কিছু ভুলেই সিলেটে একটা কোম্পানিতে চাকুরি করছে এশা। রুমানা এশাকে চিনতো না। পরে কথায় কথায় একদিন পরিচয় হয়। সেই থেকে কোকিল অর্থাৎ মাহার আত্মীয় বিধায় এশাকে যথেষ্ট স্নেহ করে রুমানা। এক দরকারি কাজে আজ ঢাকা এসেছিলো দুজনে। মাহার সাথে দেখা করতে এসেই মাহার হাসপাতালে থাকার খবর পায় তারা। অদ্ভুতভাবে রেজওয়ান একটা কেসের তদন্তে আজ হাসপাতালে এসেছিলো। রুমানাকে হাসপাতালে দেখে অবাক হয় রেজওয়ান। চৈতি কেসের তদন্তে রুমানার সাথে অনেক কথাই হয়েছিলো রেজওয়ানের। রিসিপশনে কথা বলছে রুমানা। তার পাশে নীল থ্রি-পিস পরনে শ্যামবতী একজন কে দেখে থমকে যায় রেজওয়ান। এই কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখার জন্য মন বড়ই ছটফট করতো তার। চোখের পলকে হারিয়ে গেলো দুজনে। রেজওয়ান দৌড়ে রিসিপশনের কাছটায় এসে চারপাশে তাকাতেই দেখে বামদিকের সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে উপরে উঠছে রুমানা আর এশা। রেজওয়ানও তাদের পিছুপিছু ছুটে আসে। উচ্চস্বরে ডাক দেয়,
“রুমানা। এই রুমানা।”

তাড়াহুড়ো করে পিছু ফিরে রুমানা। সাথে এশাও। প্রিয় মানুষটাকে এতো বছর পর সামনে দেখে থমকে যায় এশার পৃথিবী। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক ধুকপুক শব্দটা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজেকে সামলে নেয় এশা। রেজওয়ান রুমানার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
“এত হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছো?”
“আপনি খবর পাননি রেজওয়ান ভাই?”
“কিসের খবর?”
“মাহার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে। বাচ্চাটাও বোধহয় আর বেঁচে নেই।”
“কি!”

বুকটা কেঁপে উঠে রেজওয়ানের। মাহাকে রেজওয়ান ভালোবাসে। এখনো মনের কোণে লুকিয়ে রেখেছে সে ভালোবাসা সযত্নে।
“কোথায় মাহা এখন?”
“২০২ এ”
তিনজনে মিলে ২০২ নং কক্ষে হাজির হয়। মাহাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। হাতে স্যালাইন। আপাতত চার-পাঁচদিন মাহার বিশ্রাম প্রয়োজন। জেগে উঠলেই পাগলামি করবে মাহা। তখন শরীরে চাপ পড়বে তার। যা সার্থক চাচ্ছেনা। মাহার পাশে বসে আছে সার্থক। চোখদুটো লাল। বিগত তিন-চারদিন চোখের পাতা এক করেনি সার্থক। কেবল চেয়ে দেখেছে। নিশ্চুপ হয়ে নিজের অলকানন্দার হলদেটে ফর্সা মুখটা দেখেছে, ভালোবাসার পরশ বুলিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়েছে। মাহা একবারও তাকে বেহায়া পুরুষ বলেনি। একবারও না। কেন বলেনি! কেন? সার্থকের যে কষ্ট হচ্ছে। ভিষণ ভিষণ কষ্ট।
“ভাইয়া?”
রুমানার ডাকে লাল হওয়া নির্ঘুম চোখে পিছনে ফিরে সার্থক। বড্ড ক্লান্ত সে। জীবনযুদ্ধে সে ক্লান্ত। রুমানা, রেজওয়ান আর এশাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। আলতো হাসার চেষ্টা করে তবে তা হয়না। রেজওয়ানের বুকটায় চিনচিনে অসহনীয় ব্যথা শুরু হয়েছে নিস্তব্ধ মাহার মলিন মুখটার পানে তাকিয়ে। এই মেয়ের জন্যই তো নিজের সব সুখ বিসর্জন দিলো সে। তবে আজ কেন মেয়েটার এই দশা!
“ভাইয়া, কোকিল কেমন আছে এখন?”
“কিছুটা সুস্থ।”

ভাঙা গলায় উত্তর দেয় সার্থক। মাহা গভীর ঘুমে। আগামী দু-তিন ঘন্টার পূর্বে ঘুম ভাঙবেনা তার। রুমানা, এশা কতক্ষণ যাবত বসে রইলো মাহার পাশে। রেজওয়ান টুকটাক কথা বললো। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাচ্ছে সে। এতোদিন পর হঠাৎ এশার সাথে দেখা আবার মাহার এমন অবস্থা। অথৈ সাগরে পড়েছে রেজওয়ান। অফিস থেকে জরুরি কল এসেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেজওয়ানের এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।
“রুমানা কোথায় যাবে?”
“আমরা একটু মালিবাগের দিকে যাবো।”

রেজওয়ানের প্রশ্নে উত্তর দেয় রুমানা। তারও মনটা ভিষণ খারাপ।
“আমার সাথে চাইলে আসতে পারো। আমিও মালিবাগের দিকেই যাবো।”
মাহার ঘুমন্ত মুখপানে তাকিয়ে, সার্থকের উদাস চেহারার দিকে তাকালো রুমানা। একটা মানুষ অপর একটা মানুষকে ঠিক কতটা ভালোবাসলে এমন উদাসীন হতে পারে; সেই ব্যাখা রুমানার কাছে নেই। এশা এ সব কিছুর মাঝেই নিরব দর্শক। নিজের অনুভূতি লুকাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে মেয়েটা।
“আমরা তাহলে আজ উঠি সার্থক ভাইয়া?”
“হুম”

কোনোমতে ঘাড় ফিরিয়ে কথাটুকু বলে আবার মাহার পানে তাকালো সার্থক। বিগত একঘন্টা কেবল রেজওয়ানের দুয়েকটা কথায় হু হা জবাব দিয়েছে সার্থক। বাকি পুরোটা সময় একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো নিজের ঘুমন্ত অলকানন্দার পানে। যেন ঘরে অবস্থিত তিন প্রাণীর প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তার। এশা, রুমানা, রেজওয়ান বেরিয়ে পড়লো কেবিন ছেড়ে। এশা, রুমানারও অফিসিয়াল জরুরি কাজ রয়েছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটে যেতে হবে কর্মক্ষেত্রে। রেজওয়ান আলতো করে তাকালো এশার পানে। শ্যামবতী কিশোরী মেয়েটা এখন পরিপূর্ণ রমণী। বিয়ে হয়ে গিয়েছে বোধহয়। চুলগুলো আগের মতোই আছে হাঁটু সমান। গাড়িতে উঠে বসলো তারা। রেজওয়ান নিজেই ড্রাইভ করছে। পিছনে বসেছে রুমানা, এশা। রেজওয়ান কথা বলতে চাচ্ছিলো এশার সাথে। মূলত ক্ষমা চাইতে চাচ্ছিলো এশার কাছে। সুযোগ হয়ে উঠেনি। মালিবাগ আসতেই তড়িঘড়ি করে দুজনে নেমে চলে যায়। রেজওয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের পানে। মাহার জায়গা সারা হৃদয়জুড়ে তবে একটু ফাঁকা জায়গায় বোধহয় নতুন একজন নাম লিখিয়েছে। কিংবা লিখিয়েছিলো অনেক আগেই রেজওয়ান বুঝেনি। সেই নতুনজন কি তবে এশা?

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১০১.
বহুদিন বাদে চৈতির অবয়বের কাউকে দেখছে মাহা। সুবিস্তীর্ণ মাঠ। যেদিকে চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। ধূসর শাড়ি পরনে দূর পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছে চৈতি। মাহা পিছন থেকে চৈতির নাম ধরে ডাকলো। চৈতি থমকে দাঁড়ালো। মাহা দৌড়ে চৈতির কাছে যেতে চাচ্ছে। চৈতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে মাহা পারছেনা। মাহা চৈতিকে ধরতে পারছেনা। হঠাৎ… হঠাৎ সব অন্ধকার। তীব্র আলোয় চোখ মেললো মাহা। চৈতির হাতে লাল টকটকে গোল জামা পরনে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। খুব কান্না করছে বাচ্চাটা। মাহা নিজের পেটে হাত বুলালো। পেট ফুলা না কেন! সার্থকের মতো মুখের আকৃতি আর মাহার গাঁয়ের রঙ বাচ্চাটার। মাহা চিৎকার করে উঠলো। মাতৃ মন বুঝে গেলো বাচ্চাটা তার। মাহা প্রাণপণে দৌড়ে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ার চেষ্টা করলো। এগিয়ে চলেছে। এই তো আরেকটু। না, মাহা পারছেনা তো। কেন! কেন মাহা পারছেনা। মাহার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ। বাচ্চাটা হাত বাড়িয়ে মা, মা করে কাঁদছে। “চৈতি, চৈতিরে আমার বাচ্চা আমাকে দিয়ে দে। আল্লাহর দোহাই লাগে। আমার কলিজাটাকে ছিনিয়ে নিস না। দয়া কর। চৈতি রে।”
কাঁদছে আর ছুটছে মাহা। চৈতি এতো আকুতি মিনতি শুনেও সামনে ফিরে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। মাহা ছুটতে নিবে তাদের পিছু তখনই কেউ একজন আঁকড়ে ধরলো তাকে। মাহা ছটফট করছে। তাকে যে করেই হোক যেতে হবে। তার বাচ্চাটা কাঁদছে। হঠাৎ নাকে এসে ঠেকলো প্রিয় ঘ্রাণ। এটা তো প্রাণপ্রিয় পুরুষটার গাঁয়ের ঘ্রাণ। অবচেতন অবস্থায় মাহা আঁকড়ে ধরলো সার্থক কে। চোখ মেলে তীব্র আলোয় চিৎকার করে উঠলো সে। সার্থক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহা ছটফট করছে।
“সার্থক, সার্থক আমাদের বাচ্চা চৈতি নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছিনা সার্থক। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। আপনি, আপনি তাদের ধরুন সার্থক।”
উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে মাহা। প্রেশার হাই হয়ে স্ট্রোক করার চান্স সর্বোচ্চ। সার্থক শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহাকে। চৈতির মৃ’ত্যুর খবর শোনার পর এমনি পাগলামি করতো মাহা। ম’র্গে ছুটে যেতে চাইতো। কত কত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে মাহাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে সার্থক! তবে আজ? আজ তো সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যাবে মাহা। সার্থক কি করে সামাল দিবে! মাহার ছটফটানি বাড়ছে।
“আপনি কিছু করছেন না কেন? আমার বাচ্চা নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর আপনি নিরব?”
মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সার্থক।
“শান্ত হও মাহা।”
“আমাকে শান্ত হতে বলছেন আপনি! আমার বাচ্চা!”
“বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করো মাহা। সে চলে গিয়েছে।”

‘সে চলে গিয়েছে’ কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মাহা। ছটফটানি কমে গেলো তার। স্থির, নিশ্চল দেহখানা সার্থক কে সঁপে জ্যান্ত লা’শের মতো পড়ে রইলো সে। সার্থক মাহার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একখানা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো সাথে কপালে।
“একটা গল্প শুনবে মাহা?”

মাহা নিরুত্তর। সার্থক উত্তরের আশা না করেই বললো,
“ছোটবেলা থেকে একাই বড় হয়েছি আমি। আমার কোনো ভাই-বোন ছিলোনা। কানাডার প্রতিদিনকার আর্কটিক বরফাচ্ছন্নের শৈত্যপ্রবাহে আমি আনন্দ খুঁজে পেতাম। প্রজাপতি থেকে শুরু করে চিল প্রতিটা প্রাণীকে জানার প্রবল আগ্রহ ছিলো আমার। ছয় বছর পর্যন্ত আমি ছিলাম একটা প্রফুল্ল মেজাজের বাচ্চা। যে সব কিছুতে আনন্দ খুঁজে পায়। সবার সাথে মিশে। হাসি-খুশি থাকে। কারণ তখনো পর্যন্ত আমি সুন্দর একটা পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলাম। বাবা-মায়ের মাঝে কখনো আমি ঝগড়া দেখিনি। আমার বাবা ডক্টর ফারহান। তাকে খুব ভালোবাসতাম আমি। একসময় আমার মা প্রেগন্যান্ট হন। আমি শুনলাম আমার একটা বোন হবে। ছোট আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম সেদিন। বোন আসবে, বোন আসবে করে মাতিয়ে রাখতাম সারাবাড়ি। তবে ভালো সময়গুলো যে জলদি ফুরিয়ে যায়! বাবা-মায়ের মাঝে হঠাৎ প্রচুর ঝগড়া শুরু হয়। মা লুকিয়ে কাঁদতেন। আমি দরজার পিছনে লুকিয়ে থাকতাম যখন বাবা-মা ঝগড়া করতো। বাবা জিনিসপত্র ভাংচুর করতেন। উচ্চ গলায় মাকে বকতেন। বিশ্বাস করো মাহা আমার, আমার খুব কষ্ট হতো তখন। বাহিরের দুনিয়ার সামনে তারা আদর্শ স্বামী-স্ত্রী অথচ… দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আবার বলে,
“আমার বাবার এক কানাডিয়ান নার্সের সাথে খারাপ সম্পর্ক ছিলো। মা সেটা মেনে নিতে পারেন নি। আমি আর মা বাইরে বেরিয়েছিলাম সেদিন। বাসায় ফিরে খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায় দুজন কে হাতেনাতে ধরেন মা। বাবা-মায়ের ঝগড়া শুরু হয়। চিৎকার, চেঁচামেচি, ভাংচুর। একসময় বাবা আমার মাকে ধাক্কা দেন। মা ছিটকে নিচে পড়ে চিৎকার করে উঠেন। র’ক্ত মাহা… পুরো ফ্লোর র’ক্তে ভরে গিয়েছিলো মাহা। আমার.. আমার মা যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিলেন। আ…আমি

কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে সার্থকের। মাহাকে জড়িয়ে রাখা বাঁধন আলগা হতে থাকে। মাহা তা হতে দেয়নি। নিজেই সার্থক কে জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থকও তো বাবা হতো। ওর মনেও তো অনেক কষ্ট হচ্ছে। মাহাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তো সার্থক আছে। সার্থক কে সান্ত্বনা কে দিবে!

১০২.
“আমি পর্দার আড়ালে কেবল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেই র’ক্তের পানে। আমার ছোট বোনটা র’ক্তের পিন্ড হয়ে বের হয়ে আসছে। বাবা ঘাবড়ে গেলেন। অনেকক্ষণ বাদে আমার মাকে হসপিটালে নেওয়া হলো। আমার মা সুস্থ হলেন। বাড়ি ফিরলেন। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন তিনি। যেনো কোনো জীবন্ত লা’শ মাহা। আমার চোখের সামনে আমার পরিবার আস্তে আস্তে ধ্বংস হতে দেখেছি আমি। বাবা দিনের পর দিন বাড়ি ফিরতেন না। মা ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকতেন। একলা আমার সময় কাটতো আকাশ পানে তাকিয়ে। প্রাণবন্ত সার্থক যেন কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রাণহীন সার্থক হয়ে গেলো। আমার দুইখালা কে কানাডা নিয়ে আমার মা ই বিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আসতো মাঝেমধ্যে। তখন বাবা-মা খুবই স্বাভাবিক আচরণই করতো। আমার বাবা আমার মাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। কানাডিয়ান নার্স বিবাহিত ছিলেন। উনার হাসবেন্ড পুলিশে চাকরি করতেন। তাদের অনৈতিক সম্পর্ক জানাজানি হলে ঝামেলায় পড়তে হতো বাবাকে। সেকারণে আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে আমার মাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। আমার জীবনটা খুবই অদ্ভুত কেটেছে মাহা। আমার ছেলেবেলা আমার কাছে এক বিভীষিকা। এই ফায়রাজ সার্থকের মনে একসময় অনেক ক্ষত ছিলো মাহা। তুমি আমার ক্ষতের ঔষধ। আমার অবাধ্য জীবনের বাধ্য সূচনা।”

মাহা অশ্রু মিশ্রিত গলায় শুধালো,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি সার্থক। অনেক ভালোবাসি।”
“যদি কখনো শুনো তোমার ভালোবাসার মানুষটা অপবিত্র?”
“ভালোবাসার মানুষেরা কখনো অপবিত্র হয়না সার্থক।”

সার্থক মলিন হাসে,
“এতো বিশ্বাস করো আমায়?”
“নিজের চাইতেও বেশি।”
“এতো ভালো কাউকে বেসোনা কন্যা।
ভেঙে দিবে তোমার বিশ্বাসের বন্যা।”
“আমি কিচ্ছু জানিনা। বুঝিনা। শুধু জানি আমার ভালোবাসার মানুষটা কখনো কোনো খারাপ কাজ করতে পারেনা।”

বলেই সার্থকের বুকে অশ্রুসিক্ত নয়ন সমেত মুখ গুঁজে দেয় মাহা। সার্থক মাহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে সুরে শুধায়,
“সারা দুনিয়া করলো পর, তুই করলি আপন।
ভয় পাই, আমি ভিষণ ভয় পাই তোর ভালোবাসার কাফন।”

সার্থক আনমনা হয়ে উঠে। বারান্দা দিয়ে দিগন্ত পানে আকাশ দেখে। সিক্ত হয়ে উঠে তার নয়ন। মাহা কি মেনে নিতে পারবে প্রিয় মানুষের অপ্রিয় রূপ?

চলবে…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১০৩.
মাহা অনেকটা সুস্থ এখন। তবে মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছে। আজ একসপ্তাহ যাবত হাসপাতালে রয়েছে তারা। মাহা দু-চোখ বুজতে পারেনা। ঘুম আসেনা তার। মনে হয় কে যেন ডাকছে। দূর হতে হাত বাড়িয়ে, “মা, মা” করে চিৎকার করছে। তখন মাহাও চিৎকার করে উঠে। হাত-পা কাঁপে তার। মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করে। নার্ভসগুলো দপদপ করে। এই যে এখন। মাহা ঘুমিয়ে ছিলো কিছুক্ষণ আগে। রাতে নার্স নাজমা ঘুমের ইনজেকশন দেওয়াতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে মাহা। মাঝরাতের দিকে। হঠাৎ নিজেকে একটা বিস্তৃত উদ্যানে আবিষ্কার করে মাহা। বুকের উপর তুলার পুটলির মতো আদুরে এক মানবশিশু। মায়ের স্তন পান করছে নির্বিঘ্নে। কি আশ্চর্য! মাহা সেই মায়ের ভূমিকায় রয়েছে। হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। দূর হতে দানবাকৃতির বিশাল এক কালো হাত বাচ্চাটাকে মাহার বুক থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাহা চিৎকার করছে। ভিষণ চিৎকার করছে। সব… সব অন্ধকার। নিস্তেজ হয়ে যায় মাহা। একটা বদ্ধ ঘর। চারিদিকে সাদা। ডানে, বামে, উপরে, নিচে। কেবল সাদা। দেয়ালগুলো আস্তে আস্তে ছোট হচ্ছে। চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে। চেপে ধরার চেষ্টা করে মাহাকে। মাহা আবারও চিৎকার করে উঠে। হাতে কি যেন একটা বাঁধা। শিরার মাঝে। একটানে ছিঁড়ে ফেলে তা। গলগল করে লাল তরল বের হয়। তখনই কেউ একজন ছুটে আসে। উদভ্রান্ত মানব। ফিট বডির মানুষটা এই কয়েকদিনে যেন মমির মতো শুকিয়ে গিয়েছে। মুখভর্তি দাঁড়ি। দুটো চোখ লাল রঙা। মাহার হাতটা জলদি করে আঁকড়ে ধরে পরিষ্কার করে দেয় মানুষটা। মাহার ছটফটানি কমে আসে। নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় মানুষটার দিকে। এত ধৈর্য্য কেন এই মানবের? র’ক্ত মুছিয়ে সেই স্থানে পরপর কয়েকটা ভালোবাসার পরশ দেয় সার্থক। নিরব থেকে হাতটা টেনে ধরে বুকের বাঁ পাশে। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
“কিছু অনুভব করো, মাহা?”

মাহা নিশ্চুপ। সার্থক মলিন হাসে। মাহার আদুরে গালটা অপর হাতে টেনে দিয়ে বলে,
“বুঝোনা কিছু? তুমি এতো অবুঝ কেন?”

মাহা নির্লিপ্ত তাকিয়ে রয়। সার্থক মাহার হাতটা আলতো করে বুকের বাঁ পাশটায় চেপে ধরেই আছে। মাহা অনুভব করছে সার্থকের হৃদপিণ্ডের ধুকপুক দ্রুত হচ্ছে। ভিষণ দ্রুত। মাহা আঁতকে উঠে। অস্বাভাবিক হৃদপিণ্ডের গতি। মুখ খুলে সে।
“আপনার.. আপনার কি হয়েছে সার্থক। এতোটা অস্বাভাবিক..
“শসস্”
সার্থক মাহার ঠোঁটের উপর আলতো করে আঙুল রাখে। চুপ হয়ে যায় মাহা। তাকিয়েই রয় কেবল।
“আমার এই হৃদপিণ্ডটা ভিষণ বেহায়া মাহা। একেবারেই অবাধ্য। এই বেহায়া খন্ডটাকে বাঁচাতে হলেও আমার তোমাকে প্রয়োজন। আমি ভিষণ একা মাহা। তুমি জানো বিগত দিনগুলোতে আমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে? আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না, মাহা। আমি খাবার খেতে পারছিলাম না। আমার পৃথিবী থমকে গেছে। আমি ছিটকে পড়েছি আমার পথ থেকে। কেন এলে মাহা? কেন আমার জীবনে এলে? আমার এই এলোমেলো জীবনে কেন তোমার আগমন ঘটলো মাহা? আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। এই সাদা বেডের উপর নির্লিপ্ত আবেগহীন মাহাকে তো আমি চিনিনা। তুমি যতবার যন্ত্রণায় ছটফট করেছো ততবার মনে হয়েছে আমার বুকে কেউ ব্লেড দিয়ে এলোমেলো দাগ কাটছে। আমার কষ্ট হয় মাহা। ভিষণ কষ্ট হয়। আমি কি করবো? আমার তো কেউ নেই। আমি না পারছি সহ্য করতে আর না পারছি দেখতে। তুমি তো সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী। একবার তাকে আমার হয়ে জিজ্ঞেস করবে কেন এলোমেলো আমার জীবন? কেন আর পাঁচটা মানুষের মতো আমি বাঁচতে পারিনা?”

নিজের সমস্ত দুঃখ যেন মুহুর্তে ভুলে যায় মাহা। মানুষটা এত কষ্টে আছে! এতোটা কষ্ট! মুহূর্তের জন্য তার মস্তিষ্ক থেকে বিলীন হয়ে যায় নিজের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সার্থক কে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মাহা। সার্থকের বুকে লাগছে সে কান্না। কিন্তু মাহাকে ইচ্ছে করেই মনের দুঃখগুলো এভাবে বলেছে সার্থক। মাহা বিগত কয়েকদিন যাবত নির্লিপ্ত হয়েছিলো। না কান্না, না হাসি। সম্পূর্ণ আবেগহীন এক মাংসপিণ্ড। ডক্টর ওয়াসিফ সার্থক কে ডেকে নিয়ে বলেছেন মাহার মানসিক কন্ডিশন খুবই খারাপ। ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো প্রয়োজন। মাহাকে কয়েকদিন যাবত হাসপাতালের ভিতরেই অবজারভেশনে রেখেছে সার্থকের এক বন্ধু। আফরান। সে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। অবজারভেশন শেষে বলেছে মাহার ভিতর থেকে বিগত কয়েকমাসের স্মৃতিগুলোকে ভুলিয়ে দিতে হবে। মাহার ভিতরের ইমোশন কে পুনরায় জাগ্রত করতে হবে। নয়তো মানসিক ভারসাম্য হারাবে মাহা।

১০৪.
সার্থক চায় না। এমন কিছু হোক। তার যে মাহাকে ভিষণ প্রয়োজন। তাই তো আজ মাহাকে ইচ্ছে করেই কাঁদালো সার্থক। সে তো জানে তার মাহা তার কষ্ট সহ্য করতে পারেনা। মাহার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় সার্থক। আজ তারা বাড়ি যাবে।
“কাঁদছো কেন তুমি?”
“আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তাই।”
“তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট লাগে জানোনা।”
“আপনাকে আমি অনেক কষ্ট দিচ্ছি, সার্থক। আমি..আমি একটা অপরাধী।”

মাহাকে টেনে নিজের মুখোমুখি করে সার্থক। কেঁদে কেটে হলদে ফর্সা মুখটা লালচে করে ফেলেছে একেবারে। তবে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। সার্থক খানিক হাসে। অভিমান হয় মাহার। লোকটা কত বজ্জাত! মাহা কাঁদছে আর লোকটা হাসছে!
“হাসছেন কেন আপনি?”
“তুমি নিজেকে কেন অপরাধী ভাবছো মাহা?”
“কারণ আমি আপনার যত্ন নিতে পারিনি। আপনি কষ্ট পেয়েছেন।”
“বোকা মেয়ে।”

মাহা আবার আঁকড়ে ধরে সার্থক কে। মুখ গুঁজে দেয় বুকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আস্তে আস্তে মাহাকে এভাবেই সুস্থ করতে হবে। দায়িত্ব সম্পূর্ণটাই এখন তার। আনমনা হয়ে উঠে সার্থক।
“শুনছেন?”
“হুম?”
“আপনার বোন আমার সাথে কেন এমনটা করলো সার্থক? আমি কি দোষ করেছি সার্থক? আমাকে নিভা আপু কেন পানিতে ফেলে দিলেন?”

আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“নিভা মানসিক ভাবে অসুস্থ। নিজের বাচ্চা হবেনা কোনোদিন। তাই তোমার বাচ্চা হবে বিষয়টা সহ্য করতে পারছিলোনা ও। তাই..

মাহা সার্থকের বুকেই মাথা রেখে বসে থাকে। চেনা মানুষগুলোও কত অচেনা। কেবল হিংসার বশবর্তী হয়েই নিভা এই কাজ করেছে? নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনো গল্প আছে? সার্থক তো মাহাকে মিথ্যে বলবেনা। মাহার বিমূঢ় হয়ে রয়। নিভাকে বাড়ি গিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন করবে মাহা। কেন তার সাথে এত অন্যায় করা হলো!

_______________

রেজওয়ান গাড়ি চালাচ্ছিলো। হঠাৎ রাস্তার সামনে জটলা দেখে গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো সে। মনের দৃশ্য পটে ভেসে উঠলো কয়েকটা পুরাতন স্মৃতি। বেকুব মেয়েটা তো প্রতিবারই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। দুনিয়ার সকল চোর আর ছিনতাইকারী তো কেবল ঐ মেয়েটার পিছনেই পড়ে। ব্যাপারটা দুঃখের হলেও মজার মনে হয় রেজওয়ানের। এই মেয়েকেই খালি চোখে দেখে সবাই! ভাবতে ভাবতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে রেজওয়ান। পুলিশ দেখে মানুষজন সরে দাঁড়ায়। রেজওয়ান যা ভেবেছিলো তাই। সেই শ্যামবতীই রাস্তায় বসে। কে যেন ভিড় থেকে বলে উঠে, “স্যার, মাইয়াটার মোবাইল লইয়া ভাগছে এক পোলায়।” অকারণেই হা হা করে হেসে উঠে রেজওয়ান। এশা ভয়ানক চোখে তাকায় রেজওয়ানের পানে। মানুষজন অবাক। পুলিশ অফিসার হাসছে কেন! এশা রাগে নিজের পার্সটা রেজওয়ানের দিকে ছুঁড়ে মারে। তা ধরে ফেলে রেজওয়ান। ভেঙচি দিয়ে অপরদিকে হাঁটা শুরু করে এশা। রেজওয়ানও ছুটে তার পিছুপিছু।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১০৫.
অনেকদিন বাদে গুলশানের ফ্ল্যাটে মাহার দম বন্ধ লাগছে। সে ছিলো সাথে। এই তো পেটের ভিতরে। নিজের জানান দিতো। নিজের অস্তিত্বের জানান দিতো। সে নাই। মাহার বুকটাকে খালি করে পাড়ি জমিয়েছে অজানায়। আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে মাহা আর সার্থক। নিভা নেই বাসায়। মাহার ভিষণ ইচ্ছে ছিলো একবার জিজ্ঞেস করবে কেন এমন করা হলো তার সাথে! এমিলিনও বাসায় নেই। সার্থক কে জিজ্ঞেস করতে সে বললো তারা নাকি কানাডা চলে গিয়েছে। সার্থক কি করে তাদের যেতে দিলো! একটা হত্যা করেও নিভা পার পেয়ে যাবে? সার্থক কি নিজের বোন কে কিছুই বলবেনা? এই নতুন সার্থক কে তো মাহা চিনেনা। মাহা রাগ করে সার্থকের সাথে আর কথা বলেনি। বাড়িতে পুরাতন কর্মচারী কেউই নেই। মুইংচিন, মেরি আরো কয়েকটা পুরুষ পরিচারক। কেউই নেই। একটা নতুন মেয়ে আছে কেবল। নাহার নামে। যদিও মাহা তাকে পূর্বে দেখেছিলো। বছর চারেক আগে। মাহা যখন প্রথম এই বাড়িতে আসে তখন। এরপরে কোথায় যেন হারিয়ে যায় নাহার। বিগত বছরগুলোতে মাহা কখনো নাহার কে দেখেনি। রাজকীয় খাটে হেলান দিয়ে নানাবিধ কথা ভেবে চলেছে মাহা। শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল। ডক্টর বেড রেস্টের নির্দেশ দিয়েছেন। সার্থকের সাথে রাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মাহা। এখন মাত্র উঠে বসলো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তাভাবনা।
“মাহা”

ক্লান্ত সার্থকের সুর। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে মাত্র। হাতে সাদা এপ্রোন। বাসন্তী রঙের শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরনে লোকটাকে প্রানবন্ত লাগছে অনেক। ঝাঁকড়া চুলের মানবটা যেন পুরোদমে স্বাভাবিক। মাহা জবাব দিলোনা। মুখ ঘুরিয়ে ফেললো অপরদিকে। সার্থক বার কয়েক ডাকলো। মাহা সাড়া দেয়নি। সার্থকেও আর ডাকেনি। আলমারি থেকে কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছে। মাহার মনঃক্ষুণ্ন হলো এবার। অভিমান হলো খুব। চুপচাপ মাথাটা হেলিয়ে দেয় বালিশে। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নিশ্চুপ নোনাজল। কিছুক্ষণ বাদেই সার্থক খালি গাঁয়ে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে হাজির হয় মাহার সামনে। মাহা ডান হাত কপালের উপর রেখে শুয়ে আছে। সার্থক খাটের পাশে বসে। মাহা টের পেলেও কোনো সাড়া দেয়নি।
“আমি কি করেছি, মাহা? এমন করছো কেন?”
মাহা নিশ্চুপ।
“তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন?”
আর চুপ থাকতে পারলোনা মাহা। মুখ খুললো এবার। শান্ত, কান্না মিশ্রিত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আপনি জানেন না? আমি আমার বাচ্চা হারিয়েছি সার্থক। আপনি আপনার বোনকে কেন কিছু বলেন নি?”
সার্থক চুপ করে আছে। ‘মাহা যদি তুমি জানতে! সন্তান হারানোর প্রতিশোধ এই সার্থক নেয় কি নেয়নি!’ মনে মনে আওড়ায় সার্থক।
“কি হলো কথা বলছেন না কেন আপনি? জবাব দিন সার্থক। আমার উত্তর চাই।”
চিৎকার করে উঠে মাহা। সার্থক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
“শান্ত হও, মাহা। প্লিজ এমন পাগলামি করো না।”
মাহা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমার উত্তর চাই সার্থক!”
“আমি তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়ার পরই নাকি নিভা, এমিলিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি বাড়ি ফিরে নিভাকে পাইনি। বিশ্বাস করো মাহা। নিভাকে হাতের কাছে পেলে আমি খু’ন করতাম। আমিও তো সন্তান হারিয়েছি।”

মাহা কতক্ষণ সার্থকের বুকে মাথা রেখে কাঁদলো। মানুষটাকে ভুল বুঝেছিলো সে।
“কান্না অফ করো প্লিজ। তোমার ক্রন্দন মুখ আমি সহ্য করতে পারিনা মাহা।”

বলেই মাহার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো সার্থক। মাহা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে কিছুটা। বুকের ভার কমেছে।
“বারান্দায় যাবে?”
“ইচ্ছে করছেনা।”
“তোমার জন্য একটা উপহার এনেছিলাম।”
“কি উপহার?”
“চলো, দেখাচ্ছি।”
বলেই মাহাকে কোলে তুলে নিলো সার্থক। খোলামেলা বৃহৎ বারান্দা। হরেকরকম তরুর মেলা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। বারান্দার মাটিতে পেতে রাখা বিছানায় মাহাকে আলতো করে নামিয়ে দিলো সার্থক। মাহা চোখ বুজে আছে। এত উৎকন্ঠা, চিন্তা সবকিছু ছাপিয়ে আজো সার্থকের কাছাকাছি আসলে মাহা লজ্জা পায়।
“মাহা, চোখ খুলো।”
চোখ খুলেই চোখের সামনে জিনিসটা দেখে ছলকে উঠে হৃদপিণ্ড। একটা বীণা। কতদিন বীণা বাজানো হয়না। গান গাওয়া হয়না। মাহার গানের গলা এতটাই শ্রুতিমধুর যে তার বান্ধবী রুমানা তাকে কোকিল বলে ডাকতো। জীবন ছন্দের আড়ালে আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সেই সুর। সেই গান। মাহার কোলে আলতো করে মাথা রাখে সার্থক। “বাজাবেনা বীণা? তোমার বান্ধবী রুমানার কাছে শুনলাম তুমি নাকি বীণা বাজাতে পারো? আমাকে তো কখনো বলোনি।”
“সময় হয়ে উঠেনি।”
“আজ বাজাবে একটু? একটা গান শুনাবে?”
“এতোদিন পরে। সব ভুলে গিয়েছি। তাছাড়া গলাও তো ভালোনা।”
“উফ্ মেয়ে! আমিই তো।”

সার্থক উঠে মাহার কাছে এগিয়ে দেয় বীণা। মাহা হাত বুলায় বীণাতে। পুরনো স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। মা খুব ভালো বীণা বাজাতেন। ছোটবেলায় মাহা ছাদে মায়ের বীণা বাজানো শুনতো। স্মৃতিগুলো আজ আবছা আবছা।

১০৬.
মন খারাপ। প্রিয় জিনিসটা সামনে পেয়েও সুর তুলতে ইচ্ছে করছেনা।
“মাহা, আমাকে বাজিয়ে শোনাবেনা?”
সার্থকের আকুতি। মাহা ভগ্ন হৃদয়ে আবারও হাতে তুলে নেয় বহুদিনের পুরানো বন্ধুকে। কান্নার ফলে গলা ভেঙে আছে। মাহা চোখ বন্ধ করলো। বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ চিড়ে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। ঝিঁঝির ডাক নেই। নিস্তব্ধতা। মন দুলানো স্নিগ্ধ পবন। বীণার তারে তারে সুর তুলছে মাহা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের,

আমিও পথের মত হারিয়ে যাব
আমিও নদীর মত আসবোনা ফিরে আর
আসবোনা ফিরে কোনদিন

আমিও দিনের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন

মন আমার বাঁধলো বাসা ব্যাথার আকাশে
পাতা ঝড়া দিনের মাঝে মেঘলা বাতাসে।
আমিও ছায়ার মত মিলিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন

যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়
ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙ্গে যায়।

চোখের আলো নিভলো যখন মনের আলো জ্বেলে
একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে।
আমিও সুখের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর…..

শেষের চরণটুকু আর গাইতে পারলোনা মাহা। সে হারিয়ে গিয়েছে। পথের মতো। আর কখনো ফিরে আসবেনা বাবা-মায়ের কোলে। আজ নিজের বাবা-মা, চৈতিকেও খুব মনে পড়ছে মাহার। সার্থক মাহাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো কপালে। চোখের পানি শুষে নিতে নিতে বললো,
“আমি আছি। থাকবো। নিজের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার থাকবো। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবেনা, অলকানন্দা।”

ফিসফিসিয়ে বলা কথা। হয়তো মাহা শুনেছে কিংবা শুনেনি।
“ওকে কোথায় কবর দিয়েছেন সার্থক? আমাকে একবার নিয়ে যাবেন? আমার বুকটা ভিষণ ফাঁকা লাগছে সার্থক।”

_________________

বিছানার সামনেই বড় জানালা। বিছানায় শুয়ে পা দুটো জানালার গ্রিলে তুলে বাইরের বৃষ্টি দেখতে মগ্ন এশা। সেদিন এতো রিয়েক্ট করা বোধহয় ঠিক হয়নি। পুলিশটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনে গিয়েছে কেবল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ভাবা যায় এএসপি রেজওয়ান এশার কাছে ক্ষমা চেয়েছে! ইহা ভারি আশ্চর্য ঘটনা! লজ্জায় লাল হয় শ্যাম দুটো কপোল। এই তো সেদিন….

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১০৭.
“সেই কখন থেকে আপনি আমার পিছন পিছন আসছেন। আপনার সমস্যাটা কি?”
“কোনো সমস্যা নাই। তোমার ব্যাগটা আমার কাছে। এটা নাও।”

বলেই ব্যাগটা এগিয়ে দেয় রেজওয়ান। ‘ওহ্, খালি ব্যাগ ফেরত দিতেই এসেছে আর আমি কত কি…’
মনে মনে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এশা। ব্যাগটা হাতে নেয় সে। দুজনেই দাঁড়িয়ে। কেটে গিয়েছে সহস্র সময়। কোনো কথা কারো মুখে নেই। একজনের মনে সুপ্ত অভিমান আরেকজনের অপরাধবোধ। কিছু বলতে গিয়েও আমতা আমতা করছে রেজওয়ান।
“কিছু বলবেন?”
“না মানে হঠাৎ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলে কেন?”
“দেশে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাই।”
“এখন কোথায় মানে এখন কি কোথাও কর্মরত আছো?”
“হ্যাঁ, সিলেটে একটা কোম্পানিতে আছি।”
“ওহ্, তারমানে সিলেট থাকো এখন? ঢাকায় কতদিন আছো?”
“হুম। থাকবো আর কিছুদিন। আরো কিছু বলবেন?”
“তাড়া আছে?”
“ছিলো একটু।”
“একটা কথা বলতাম মানে আসলে…
” এএসপি রেজওয়ান কে তোতলানো মানায় না। বলুন কি বলবেন। সরাসরি বলুন।”

মেয়েটা আগের চেয়ে অনেকটা বদলে গিয়েছে। কি তেজ কন্ঠে! থতমত খায় রেজওয়ান। দীঘল চুলের শ্যামবতী পরিপূর্ণ নারী। ধারালো যার কন্ঠস্বর। এলোমেলো বেণী করে রাখা হাঁটু সমান চুলগুলোতে।
“তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো, এশা?”
“আশ্চর্য! আমি আপনার উপর রেগে থাকবো কেন?”
“ঐদিনের ঐ আচরণের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত এশা। কাজটা সঠিক হয়নি আমার। তখন এতটা স্ট্রেসের ভিতর ছিলাম।”
“সমস্যা নেই মিঃ রেজওয়ান। আপনি আমার এতোটা কাছের মানুষও নন যে এতটুকু কারণেই আপনার উপর রাগ করা লাগবে। আমার তো সেই ঘটনা মনেও নেই।”
এশার হেয়ালি করা কথাটা যেন তীরের মতো রেজওয়ানের বুকে আঘাত করলো। এই মেয়েটাকে রেজওয়ান ভালোবাসেনা। ভালোবাসা সব ঐ একজনকে ঘিরে। কিন্তু তবুও কেমন যেন একটা টান মেয়েটার প্রতি। রেজওয়ান দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময়। কথা হয়নি দুজনাতে। মৃদু হিমেল বাতাস বইছে।
“আজ তাহলে আসি মিঃ রেজওয়ান। ভালো থাকবেন।”

রেজওয়ান কে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সম্মুখে অগ্রসর হয় এশা। মুখে বিশ্বজয়ী হাসি। এইতো চাচ্ছিলো সে। গত চারটা বছর অনলে পুড়েছে হৃদপিণ্ড। পছন্দের মানুষের কাছে অপমানিত হওয়ার দুঃখ যে ঠিক কতটা। কতটুকু গভীর, কতটুকু জ্বালাময়ী! আহ্! রেজওয়ান যদি তুমি এই অনল বুঝতে। একতরফা ভালোবাসা বুঝতে তাহলে হয়তো স্বয়ং লেখিকারও তোমাদের নিয়ে এত ভাবতে হতোনা। বর্তমানে ফিরে এশা। হঠাৎ করেই ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। বিগত বছরগুলোতে সেই বিদেশি ভাটিতে কেমন করে পড়েছিলো এক এশা জানে আর তার সৃষ্টিকর্তাই জানে। ক্ষমা করবেনা এশা। এত সহজ সবকিছু?

_____________

বাইরে ঘোর অন্ধকার। একটানা বৃষ্টি। কেমন যেন বৃষ্টির শব্দটা। একঘেয়ে। কানে তব্দা লাগানো। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। মনে হয় দূরে কোনো অশরীরী ডাকছে। হাত বাড়িয়ে। গুলশানের বহুতল ভবনের ডুপ্লেক্স বাড়ির বারান্দায় পাগলামি করছে এক নারী। এই ঘোর অন্ধকার রাতে সে কবরে যেতে চাচ্ছে। সার্থক ঝাপটে ধরে আছে মাহাকে। মাহা কোনোমতেই মানতে চাচ্ছেনা। সে এখনই যাবে।
“আপনি একটা পাষাণ। আপনি বাবা হয়ে এমন করছেন! আমি যাবো। এখনই নিয়ে চলুন আমায়।”
“মাহা, শান্ত হও। এতরাতে কবরস্থানে যাওয়া ঠিক হবেনা মাহা। তাও নাহয় যেতাম। বাইরে যে এত বৃষ্টি?”
“আপনি কেন এত বাহানা দিচ্ছেন সার্থক? আপনি, আপনি একটা নিষ্ঠুর।”
“আমি পাষাণ, আমি নিষ্ঠুর। সব মানলাম। একটু শান্ত হও মাহা।”
“শান্ত হতে বলছেন আমায়? আমি কি করে শান্ত হবো? আমার মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমাকে যেতেই হবে।”
“না, তুমি যাবেনা।”
“আপনি আমায় ছাড়ুন। আমি যাবোই। নয়তো আমি আমার জীবন দিবো আজ।”
“মাহা!”

যা কোনোদিন হয়নি তাই হয়েছে আজ। সার্থক মাহার হলদেটে লালচে হয়ে আসা গালটা ছুঁয়ে বলে,
“আমি কি করলাম এটা মাহা। আমি এটা কি করলাম!”

মাহা নিজের গাল থেকে সার্থকের হাতটা সরিয়ে দেয়। লালচে হয়ে আসে তার চোখ। অভিমানে গাঢ় হয় মুখমন্ডল। তবুও পাগলামি করে মাহা। তাকে যে যেতেই হবে। সার্থক একা হাতে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মাহাকে। ওর অর্ধেক ওজনের মেয়েটার শরীরে আজ যেন কোনো পিশাচের শক্তি ভর করেছে। মাহাকে জোর করে ঘরে নিয়ে এসেছে সার্থক। মাহা পাগলামি করেই যাচ্ছে। তার যেতেই হবে আজ। হঠাৎ করেই বৃষ্টি থেমে গেলো।

১০৮.
হুম, একেবারে হঠাৎ করে। নিস্তব্ধতা চারপাশে। ঘড়ির টিকটিক আওয়াজের মাঝেই ঢং ঢং শব্দ জানান দেয় রাত তিনটা বাজে। মাহার হাতদুটো ওড়না দ্বারা বেঁধে দেয় সার্থক। ছোট টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত সে।
“বৃষ্টি তো থেমেছে। এবার নিয়ে চলুন আমাকে। ও ডাকছে। কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। আপনি না ওর বাবা?”

সার্থক জবাব না দিয়ে একমনে খুঁজে যাচ্ছে ইনজেকশনটা।
“কি হলো জবাব দিন? যাবেন না আপনি? আমি যাচ্ছি তবে। আমার হাত বেঁধে আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারবেন না।”
বলেই উঠে দাঁড়ায় মাহা। ছুটে যায় দরজার কাছে। সার্থকও দৌড় দেয় মাহাকে ধরতে। পিছন থেকে ঝাপটে ধরে মাহাকে।
“ছাড়ুন আমায়। আমি যাবোই।”

চিৎকারে কানে তব্দা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। সার্থক সবক্ষেত্রে কঠিন হলেও মাহার বেলায় সে ধীরস্থির, নরম, কোমল, ধৈর্যশীল, শান্ত।
“চুপ মাহা। আর একটা কথা বললে তুমি আমার মরামুখ দেখবে।”

অসহায় হয়ে আসে লালচে অভিমানী চোখজোড়া। এটা কি শুনালো সার্থক! এতক্ষণের পাগলাটে মাহা যেন একেবারেই শান্ত, নিরব, নিশ্চল। একটা মাংসপিণ্ডে বেস্টিত পাথরে মূর্তি। মাহাকে নিয়ে খাটে বসিয়ে তার হাতে আলতো করে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে সার্থক। নেতিয়ে আসে মাহার চোখজোড়া। কয়েকঘন্টার জন্য অন্ধকার জগতে পাড়ি জমায় সে। ঘুম নেই কেবল সার্থকের চোখে। ভালোবাসা! কি অদ্ভুত এই ভালোবাসা। নরপিশাচকেও মানুষে পরিণত করে দিতে পারে! যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ভালোলাগা, ভালোবাসা ছিলোনা সেই বুকে ভালোবাসার উদ্রেক জাগিয়ে, সবকিছু নিঃশেষ করে কেন পাগলামি করছে জ্বালাময়ী নারী! এ কি তবে কৃতকর্মের ফল? এতটা যন্ত্রণাময়?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আলমারি থেকে নিজের এবং মাহার কিছু কাপড় গুছিয়ে লাগেজে তুলে নেয়। মাহাকে কোনোভাবেই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। পাগলামি করবে। বাচ্চাকে দেখতে চাইবে। তারপর হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক করতে পারে। সার্থক কোনোক্রমেই তা চায় না। তাই তো আজ রাতেই এই শহর ছেড়ে, কৃত্রিমতা ছেড়ে পারি জমাবে সিলেটে। যদিও পিছুটান থাকবে তবুও ভালো থাকবে মাহা। সার্থকের অলকানন্দা। এটা কি তবে গল্পের নতুন অধ্যায় নাকি সমাপ্তির ঘন্টা?

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৪০

১০৯.
মৃদু আলোর ঝলকানি তে ঘুম ভাঙে মাহার। মাথাটা ভনভন করছে। ধপধপ করছে নার্ভস। ভিষণ ব্যথা। মাহা সহ্য করতে পারলোনা। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো সে। সার্থক পাশেই ছিলো। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে ঝিম ধরে। মাহার চিৎকারে সচল হয় মস্তিষ্ক।
“কি হয়েছে মাহা? বেশি ব্যথা করছে?”
“হুম।”

ভারী গলায় সায় দেয় মাহা। মাথায় কয়েকটনের বস্তা রেখেছে কি কেউ? অনেক ভারী লাগছে মাথাটা।
“তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। ব্রেকফাস্ট খেয়ে ঔষধ খাবে।”

ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয় মাহা। সার্থক বিছানায় খাবারের প্লেট হাতে বসে আছে। মাহা এতক্ষণ যাবত খেয়াল করেনি। এই ঘর তো সম্পূর্ণ ভিন্ন! এটা কোথায়? টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মাহা বিছানার কাছে এগিয়ে আসে।
“এটা তো আমাদের ঘর না। আমরা কোথায় আছি, সার্থক?”
“বসো, খাবে।”
“আপনি আমায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।”
“বলবো সোনা। আগে খেয়ে নাও।”
মাহাকে পাশে বসিয়ে রুটি খাইয়ে দেয় সার্থক। অতঃপর ঔষধ।
“এবার বলুন।”
“কেমন উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে চুলগুলো। আমি নারিকেল তেল গরম করে নিয়ে আসি। তুমি বসো চুপচাপ।”

সার্থক বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। চারবছরে মাহা সার্থক কে অনেকটুকুই চিনেছে। নিজে কোনো কথা বলতে না চাইলে সে কথা ওর মুখ হতে বের করা অসম্ভব প্রায়। হঠাৎ চোখ চলে যায় পাশের পর্দা দিয়ে ঢাকা বিস্তর কাঁচের দরজার পানে। মাহা এগিয়ে যায় সেদিকে। দু’হাতে পর্দা সরাতেই কাঁচের দরজা ভেদ করে দেখা মিলে কয়েক সারি পাহাড়ের। মাঝে বয়ে গিয়েছে নীলচে নাম না জানা এক বিস্তৃত নদী। মাহা পুলকিত, উচ্ছ্বসিত। ভুলে গেলো জাগতিক সকল ভাবনা। কাঁচের বিস্তর দরজাটা খুলে বৃহদাকার এক খোলা বারান্দা আবিষ্কার করে মাহা। হিমেল স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। সারি সারি পাহাড়। সবুজের সায়র যেন! দালানটা বেশ উচ্চতায় গড়া। নদীর ছলাৎ ছলাৎ জলের মুগ্ধ শব্দ কানে বাজছে। আকাশে হরেকরকম পাখি। মাহা আনমনা হয়ে যায়। কি সুন্দর প্রকৃতি! রেলিং ধরে অবলোকন করে প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম।
“মাহা, ঘরে এসো।”

সার্থকের আহ্বানে ঘরে ফিরে মাহা। চারিদিক সে ভালো করে পরখ করে এতক্ষণে । অফ হোয়াইট রঙের দেয়ালে ঘেরা ঘর। একপাশে একটা খাট, খাটের পাশে ছোট একটা টেবিল, একটা আলমারি আর গুটিকয়েক আসবাবপত্র। বড়সড় ছিমছাম ঘর। সার্থক একটা বাটিতে নারিকেল তেল গরম করে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি নিচে বসো। আমি খাটে বসে তেল দিয়ে দেই।”
“আচ্ছা”

মাহা টাইলসে নিচে বসে পড়ে। সার্থক বসে খাটে। মাহার কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো, জট লাগানো। বহুদিন চুল আঁচড়ানো হয়নি বোধহয়। কোনোমতে একটা খোঁপা করা। আস্তে করে খোঁপাটা খুলে দেয় সার্থক। কোমড় সমান চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে লহমায়। চিরুনি দিয়ে আস্তে আস্তে চুলের জট ছাড়ায় সার্থক। অতঃপর গরম তেল দু হাতের তালুতে ঘষে অতি যত্নে মাহার চুলে লাগাচ্ছে সার্থক। মাহা চুপ করে অনুভব করছে সময়টা। মস্তিষ্ক ঠান্ডা, মন শান্ত। সার্থক একমনে চুলে তেল মালিশ করে যাচ্ছে।
“আপনি আমাকে দূরে নিয়ে এসেছেন, তাই না?”

কিছুক্ষণের জন্য হাত থেমে যায় সার্থকের তবে পুনরায় সচল হয় হাতদুটো। যেন মাহার কথা শুনেনি সার্থক। মাহার নার্ভস শান্ত রাখার ঔষধ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া দূরে চলে এসেছে তারা। মাহার অস্থিরতাও কমেছে অনেকটা। হয়তো সময়ের সাথে সাথে আরো কমে যাবে সকল অস্থিরতা।

“আমরা এখন সিলেট রয়েছি। এটা আমার বাগান বাড়ি।”
“সিলেট?”
“আমি এখানকার একটা ভালো হসপিটালে জয়েন করেছি। অফারটা অনেকদিন আগেই পেয়েছিলাম। তোমাকে জানানো হয়নি।”

মাহা নিশ্চুপ। দৃষ্টি বারান্দায়। সার্থক মাহার চুলগুলো সরিয়ে ভালোবাসার পরশ একে দেয় মাহার গ্রীবাতে। বহুদিন বাদে সুপরিচিত সেই স্পর্শটা পেয়ে মাহা শিউরে ওঠে। সকল যন্ত্রণা ঠেলে দিয়ে নিজের মাঝে এক অন্য সত্তা আবিষ্কার করে মাহা। যার এই মুহূর্তে একান্ত স্পর্শ প্রয়োজন। বহুদিনের তৃষ্ণার্ত মাহা। আরো গভীর হয় সার্থকের স্পর্শ। বাইরে আসমানের পূর্বাংশে দিবাকর তেজস্বী হচ্ছে। ঘরে থাকা প্রাণদুটিও তেজস্বী হয়ে উঠছে ভালোবাসার দাবানলে।

____________

দরজায় ঠকঠক করছে কেউ। মুইংচিনের গলা,
“সাতক, সাতক। একতু বাইরে আছো। জরুরি প্রয়োজন আছে।”

দুপুর দুটো বাজে প্রায়। সার্থকের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মাহা। আস্তে করে মাহাকে সরিয়ে গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে দরজার কাছে আসে সার্থক। দরজার এপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আসছি। তুমি নিচে অপেক্ষা করো।”
“ওকে।”

ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে সার্থক। মুইংচিন, মেরি, নাহার এই বাড়িতে এসেছে সার্থকের সাথে। পাহাড়ের উপরে দু’তালা ডুপ্লেক্স বাড়ি। আশেপাশে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনো জনবসতি নেই। শুভ্র রঙের বাড়িটা। বাড়ির সম্মুখে বিস্তৃত বাগান।
“ডেভিড দেকা করতে এসেছে সাতক।”
“আমাদের ‘HBP’ এর কি খবর?”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে সার্থক।
“আমি সতিক জানিনা।”
“কোথায় সে এখন?”
“বাইরে বাগানে।”
“আচ্ছা, ভিতরে আসতে বলো।”

বাড়ির ভিতরটা ভিষণ মনোরম। একপাশ ঘেরা কাঁচের দেয়াল। সেখান থেকে দেখা মিলে সারি সারি পাহাড়ের। কাঁচের দেয়াল ঘেঁষেই সোফা রাখা। মাঝে সেন্টার টেবিল। বড়সড় ছিমছাম বাড়িই বলা যায়। জাম্বিয়ার লুসাকা অঞ্চলের বাসিন্দা ডেভিড। বিশালাকৃতির দেহের কৃষ্ণাঙ্গ মানব। ডেভিড মূলত বামপন্থী। জন্মগতভাবে খ্রিস্টান হলেও সে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়। সার্থকের ডানহাত বলা চলে। সার্থক কে গুরু হিসেবে মেনে আসছে ডেভিড সেই ছোটকাল থেকে। বিশ বছরের এই যুবক সার্থকের জন্য প্রাণ দিতে রাজি আর সময় আসলে সার্থকের কথায় প্রাণ নিতেও রাজি।
“কি খবর ডেভিড?”
“গুড, ব্রো।”

আরো কিছু কথা হলো। অতি গোপন কিছু কথা।

১১০.
নিচতলাটা উপরতলার চাইতেও সুন্দর। মাহা ঘুরে ঘুরে দেখছে বাড়িটা। মেরি পাশেই আছে।
“বাড়িটা ভিষণ সুন্দর মেরি।”
“জ্বি, ডক্টর স্যার নিজের মতো সাজিয়েছেন সবটা।”
“কোথায় তোমার ডক্টর স্যার?”
“ডক্টর স্যার জরুরি কাজে বাইরে বেরিয়েছেন ম্যাম। আপনাকে বলেছেন খাবার খেয়ে নিতে।”

মাহা অবলোকন করছে চারপাশ। নিচতলাটা ভিষণ বড়। ঘরের মাঝ দিয়ে ডিএনএ ডাবল হেলিক্স সূত্রের মতো প্যাঁচানো গোল সিঁড়ি উপরতলায় উঠে গিয়েছে। বাড়ির মূল ফটক সেগুন কাঠে নির্মিত। ড্রয়িং রুমটাও বিশাল। দেয়ালে একটা মৃত হরিণের মাথা সাজিয়ে রাখা। যা দেখে খানিক কষ্ট পেলো মাহা। এরকম মৃত প্রাণী ঘরে সাজিয়ে রাখা মাহার পছন্দ নয়।
“ম্যাম, চলুন খেয়ে নিবেন। নয়তো স্যার আমাকে বকবেন।”
মাহারও ভিষণ ক্ষুধা লেগেছে। তাই কোনো দ্বিরুক্তি সে করেনি। খাবার খেয়ে সোফায় বসে মাহা। মাথার যন্ত্রণা কমেছে অনেকটা। তবে মাহার কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই। যার উত্তর কেবল সার্থকের কাছেই রয়েছে। এমন সময় বাইরে হতে একটা করুণ চিৎকার ভেসে এলো। মাহা দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। সাথে মেরি এবং নাহারও। বিস্তৃত অংশজুড়ে বাগান। পশ্চিম কোণে বাগানের দিক হতেই ভেসে আসছে আর্তনাদ। মাহা এগিয়ে যায় সেদিকে। নাহার ও মেরি একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। স্পষ্ট ভয় তাদের চেহারায়। তারাও ছুটে মাহার পিছুপিছু। মাহা বাগানের ভিতর প্রবেশ করে দেখে একজন মালি বয়স চল্লিশ কি পয়তাল্লিশ হাত চেপে বসে আছেন। হাত দিয়ে গলগল করে র’ক্ত পড়ছে। হাফ ছেড়ে বাঁচে মেরি ও নাহার। নাহারের ছিপছিপে পাণ্ডুর মুখে স্বস্তি।
“কি হয়েছে আপনার?”
বিচলিত কন্ঠ মাহার।
“নাহার আপনি একটু ফার্স্ট এইড বাক্সটা নিয়ে আসুন জলদি।”

নাহার বাক্সটা আনতেই মাহা মধ্যবয়স্ক লোকটার হাত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। লোকটা চোখমুখ খিঁচে বসে। হয়তো পুরুষ বিধায় কাঁদতে পারছেন না তিনি।
“ব্যথা কমেছে চাচা?”
কি মায়াময় মেয়েটার মুখ। কি মনোমুগ্ধকর মেয়েটার সুর। হিন্দু সজল দাস যেন দেবী দূর্গার দেখা পেলেন। মুখে কিছু না বললেও অপর হাত দিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। হায়রে নিয়তি! পাপপুণ্যের মিলন ঘটিয়েছে। নিষ্পাপ মেয়েটার জন্য মায়া হলো সজল দাসের। সজল বোবা মানুষ। কথা বলতে পারেন না। মুখে আ আ করলেন। মেরি এবার বিচলিত হয়ে বললো,
“ম্যাম, ঘরে চলুন। বাগানে প্রচুর সাপ আছে। প্লিজ ম্যাম। আপনার কিছু হলে ডক্টর স্যারকে কি বলবো আমি।”
“মেরি তুমি ভিষণ ভয় পাও।”

অতঃপর সজল দাসের দিকে চেয়ে মাহা বলে,
“চাচা, বাড়িতে চলুন। একটু রেস্ট নিয়ে খাবার খাবেন।”

সজল ইশারায় বুঝায় সে ভালো আছে। মাহা যেন চলে যায়। সবাই এতো তাড়া দিচ্ছে। অগত্যা মাহাকে বাড়ির ভিতর ফিরে যেতে হলো। বাগান থেকে একটা লা’শ টেনে নেওয়া হচ্ছে বাড়ির দক্ষিণকোণে। বাগানে অশরীরী আত্মার ন্যায় হাতে ছুরি সমেত বাঁকা হেসে হাঁটছে চীন দেশের শান ধর্মের অনুসারী লোকটা।

(চলবে)….

(

#অলকানন্দা
#পর্ব-৪১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১১১.
সিলেটে আজ বিশদিন পূর্ণ হলো। চারদিকের পরিবেশটা ভিষণ সুন্দর। মাহার অবচেতন মস্তিষ্ক খানিক ভুলে গিয়েছে ‘তার’ কথা। দূরে পাহাড়ে, নীলচে নদীর জলে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে মাহা। আজ সার্থক মাহাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে বাগানে। মালনীছড়া চা-বাগান। কি ভিষণ সুন্দর! যতদূর চোখ যায় সবুজ সায়র। উঁচু-নিচু ঢিবিতে তাজা চায়ের গাছ। বেশি মানুষজন নেই। আকাশে বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস। থম মেরে আছে প্রকৃতি। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে মাহা আর সার্থক। মাহার কেবল একটাই চিন্তা আসছে মাথায়। এমন কিছু কি তার সাথে আগেও ঘটেছিলো! সে কি কখনো মালনীছড়ায় এসেছিলো! এমন কোনো স্মৃতি তো মনে নেই। আনমনে হয়ে আছে মাহা। সার্থক ভিষণ মজা করে চা খাচ্ছে। চা আবার সার্থকের খুবই প্রিয়।
“আনমনে কেন? চা ভালোলাগছে না?”
ধ্যান ভাঙে মাহার। সচকিত হয়ে সার্থকের পানে তাকায় মাহা। মন উদাসীন লাগছে।
“আমার মনে হচ্ছে এর আগেও মালনীছড়ায় এসেছিলাম আমি।”
“হয়তো এসেছো ছোটবেলা কিংবা তোমার দেজা ভ্যুও হতে পারে।”
“এমনটা না। আমার…

“আসসালামু আলাইকুম, ভাইজান। ভালো আছেন?”
শক্তপোক্ত শরীর। ইয়া বড় গোফ। পরনে লুঙ্গি, শার্ট আর উপরে কালো চাদর। চৌকিদার খাজার মুখে হাসি। সার্থকও হেসে জবাব দেয়,
“ভালো আছি৷ তুমি ভালো তো খাজা?”
“আমিও খুব ভালো আছি ভাইজান।”
মাহা অবাক হয়ে খাজার পানে চেয়ে আছে। এই লোকটাকেও তো পূর্বে দেখেছে মাহা!
“তোমার ভাবি।”
মাহাকে দেখিয়ে বলে সার্থক। খাজা হাসে। হাসলে তাকে ভিষণ বিদঘুটে দেখায়।
“ভালো আছেন ভাবি?”
“হু…হুম। আচ্ছা, আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে পূর্বে দেখেছি।”
“হতে পারে অন্য কাউকে দেখছেন। ভাইজান আমি যাই।” লোকটা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে।
ঘুরাঘুরি শেষে বাড়িতে ফিরে আসে তারা। মাহার মাথায় কেবল ঘুরছে একটাই কথা। এসব তো পূর্বেও দেখেছিলো মাহা। কিন্তু স্পষ্ট কিছুই মনে পড়ছেনা কেন! মুইংচিন এখন বেশি একটা মাহার সামনে আসেনা। এ বাড়িতে মুইংচিন, মেরি, নাহার, মালী সজল, ড্রাইভার লতিফ, দারোয়ান দুলাল আর সার্থক, মাহা থাকে। মাঝেমধ্যে ডেভিড আসে। কৃষ্ণাঙ্গ এই পুরুষটাকে মাহার পছন্দ নয়। কেমন করে যেন চেয়ে থাকে। খুবই বাজে দৃষ্টি তার। বাড়ির একপাশে পাহাড় আর অপরপাশে অর্থাৎ দক্ষিণাংশে ঝোপঝাড় সাথে ছোট একটা গ্যারেজ। মেরি বলেছে এই গ্যারেজটা নাকি বহুদিন পুরানো। আজ আকাশে চাঁদ নেই। বারান্দায় পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসে দূরে পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছে মাহা। শো শো কেমন একটা আওয়াজ ভেসে আসছে দূর পাহাড় হতে। সার্থক বাইরে বেরিয়েছে একটু। রুমানার কলে ধ্যান ভাঙে মাহার। আজকাল ভিষণ আনমনে হয়ে যাচ্ছে মাহা। বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর কোনো কিছুই ভালোলাগে না তার। ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকায় মাহা।
“কি রে কোকিল? তোরা সিলেটে শিফট করেছিস?”
“হুম”
“হারামী একবারও বললি না আমাকে। রেজওয়ান ভাইয়ার কাছে শুনলাম।”
“সরি, রুমানা। আমার আসলে কি যে হয়েছে। কিছুই ভালোলাগেনা। তুই কি আগামীকাল একটু আসতে পারবি আমার বাসায়? তোর বাবুটাকে নিয়ে আয়। দেখা হয়নি ওকে।”
“আচ্ছা, দেখি। শরীর কেমন এখন?”
“আছে, মোটামুটি। মনটা খালি উদাসীন লাগে।”
“চিন্তা করিস না। আমি আসবো আগামীকাল। আমাকে একটু তোর ঠিকানাটা মেসেজ করে দে।”
“আচ্ছা”

ঠিকানা মেসেজ করে মোবাইল রাখতেই সার্থকের ডাক।
“মাহা, তুমি কি বারান্দায়?”
“হুম”
“ঘরে এসো।”
ক্লান্ত দেখাচ্ছে সার্থক কে। সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করে মানুষটা। মাহা এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। সার্থক এক লহমায় পান করে পুরো পানিটুকু। পিপাসা লেগেছিল খুব। মেয়েটাকে কিছু না বললেও অনেককিছু বুঝে যায়। মাহা সার্থকের পাশে খাটে বসতেই সার্থক মাহার কোলে মাথা রাখে। মাহাও আনমনে টেনে দিচ্ছে সার্থকের ঝাঁকড়া চুলগুলো। চোখ বুজে সার্থক।
“মাহা”
“হুম”
“আমি যদি কখনো না থাকি তুমি চলতে পারবেনা একা একা?”

হাত থেমে যায় মাহার।
“এসব কি বলছেন আপনি?”
“এমনি বাদ দাও। ঔষধ খাচ্ছো নিয়মিত?”
“কথা ঘুরাবেন না সার্থক। আপনি জানেন না এই পৃথিবীতে আপনাকে ছাড়া আমার আর কেউ নেই? কেন কষ্ট দেন আমাকে?”
“আহা রে। বোকা মেয়ে। আমি মজা করছিলাম রে বাবা।”
“এমন মজা কখনো করবেন না। আমার এমন মজা একটুও পছন্দ না।”
“ওকে, ওকে। এই যে কানে ধরলাম। আর কখনো বলবো না।”

ক্ষান্ত হয় মাহা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। জীবন নামক খেলায় এবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সার্থক। মাহাকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবেনা সার্থকের। তাই যতদিন আছে মাহাকে নিয়েই থাকতে চায় সার্থক। আর কোনো পিছুটান নয়।

১১২.
সূর্যোদয়টা কি যে মনোরম! ধূসর আকাশে লালচে সূর্যের উঁকি! ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে লালচে সূর্যটা। বাগানে হরেকরকম ফুলের ছড়াছড়ি। পরাগ, বেলী, কুঁড়ি, দোপাটি, জবা, চাঁপা, কামিনী, চামেলী, ডালিয়া,গুলবাহার, কাঠ গোলাপ, ড্যাফোডিল, মালতি, টগর, গন্ধরাজ, জুঁই কি নেই বাগানটায়। এক কোণায় সারিতে অলকানন্দা গাছের সমাহার। সবুজের মাঝে থোকায় থোকায় ছড়িয়ে হলদে ফুলগুলো। কাঁচা হলুদ। মাহার গাঁয়ের রঙটাও এমন। সজল পানি দিচ্ছেন বাগানে। বাড়ির সবাই ঘুমে।
“চাচা, ভালো আছেন?”
মাথা নাড়ায় সজল। মাহা মাথার উড়না টেনে সজলের সামনে দাঁড়িয়ে।
“আমাকে দিন আমি পানি দেই।”

না বোধক মাথা নাড়ায় সজল। বাড়িয়ে থাকা হাতটা গুটিয়ে নেয় মাহা।
“আপনি কথা বলতে পারেন না, চাচা?”
এবারও না বোধক মাথা নাড়ায় সজল। আহারে! মাহার বড্ড মায়া হলো সজলকে দেখে। আশেপাশে ঘুরে দেখছে মাহা। স্নিগ্ধ ভোরের দাপটে সবকিছুই যেন অভূতপূর্ব হয়ে উঠেছে। পাহাড়, নদী, বাগান। অপূর্ব! মাহা মুগ্ধ। সবই ভালো তবে কেমন জানি গা ছমছমে লাগে। বিশেষ করে বাড়ির দক্ষিণ দিকটা। হয়তো পুরানো গ্যারেজ আর ঝোপঝাড় আছে বলে। মাহা রান্না বসিয়েছে আজ। সার্থকের পছন্দের খিচুড়ি, গরুর মাংস ভুনা আর বিরিয়ানি রান্নায় ব্যস্ত গৃহিণী। সার্থক উঁকি দিয়ে গিয়েছে দুয়েকবার। মাহা বকে পাঠিয়েছে। মেরি, নাহার সাহায্য করতে চেয়েছিলো। তবে মাহা নাছোড়বান্দা। সব করবে নিজ হাতে। টেবিলে খাবার সাজানোর সময়ই দাড়োয়ান দুলাল এসে জিজ্ঞেস করেন,
“স্যার, রুমানা নামে এক মহিলা আসছেন। ম্যাডামের নাকি পরিচিত।”
“হ্যাঁ। ভিতরে নিয়ে আসো।”

রুমানা আর ওর চার বছরের ছেলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই দৌড়ে মাহাকে জড়িয়ে ধরে রুমানা।
“কেমন আছিস, কোকিল? ইস্ রে, একদম শুকিয়ে গেছিস।”
পাশে ছোট রাতুল দাঁড়িয়ে। মাহা খানিক হাসলো রুমানার কথায়। রাতুল কে কোলে নিয়ে বললো,
“তোমার মা সেই আগের মতোই আছে বাবা।”

সার্থকের সাথে কুশল বিনিময় হয় রুমানার। সোফায় বসে কথায় ব্যস্ত হয়ে গেলো দুই রমনী। সার্থক নিজেই খাবার নিয়ে খেয়ে নিয়েছে। অনেকদিন বাদে হাসোজ্জল দেখাচ্ছে মাহাকে। তাই ওকে আর বিরক্ত করতে চায়নি সার্থক। হাতে সাদা এপ্রন নিয়ে মাহার সামনে হাজির হয় সার্থক।
“মাহা, আমি আসি। আজ একটু ফিরতে দেরি হবে। রুমানা আজ থেকে যাবে কিন্তু!”

জিহবায় কামড় দেয় মাহা। ‘ইস্! গল্প করতে করতে সার্থক কে খাবার দিতেই ভুলে গিয়েছে সে!’ সার্থক খেয়াল করেছে সবটা। অতঃপর মুচকি হেসে বেড়িয়ে পড়ে সে।
“ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। আজ আমি রান্না করেছি। রাতুল বাবা বিরিয়ানি খাবে তুমি?”

কি কিউট বাচ্চাটা! মাহার কথা শুনে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
“আন্টি কি বলছে? আন্টিকে বলো ইয়েস আন্টি। রাতুল খাবে।”

রাতুল চুপ। মাহা কোলে উঠিয়ে নেয় রাতুল কে। রাতুল প্রথমে চুপচাপ থাকলেও আস্তে আস্তে মাহার সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওর। ‘আন্তি এতা কি? আন্তি ওতা কি?’ করে পাগল করে দিচ্ছে মাহাকে। মাহাও মনের আনন্দে জবাব দিচ্ছে। খাবার দাবার সেড়ে নাহারকে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালো রুমানাকে। এখন দুজনে মিলে চা নিয়ে সোফায় বসেছে গল্প করতে। বিকেল ছুঁইছুঁই। রক্তিম আকাশ। পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে। রাতুল সারা হলরুম ঘুরে ঘুরে খেলছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রুমানা বলে,
“টুকিকে ভিষণ মনে পড়ছে রে কোকিল।”
কিছুক্ষণ শান্ত থাকে উভয়েই।

১১৩.
“টুকির বাবা চলে গেলেন বছর দুয়েক আগে। মেয়ের বিচার দেখে যেতে পারলেন না। পুলিশও তো কেসের কোনো অগ্রগতিই করছেনা। রেজওয়ান ভাইয়া কেসটা ছেড়ে দিলো আর কোনো গতিই হলোনা কেসটার। কি সুন্দর মায়াবী ছিলো টুকি। আহারে! ভালো মানুষগুলোই বুঝি আগে চলে যায়।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমানা। মাহাও আনমনে হয়ে আছে।
“মাম্মা, মাম্মা….

হঠাৎ রাতুলের চিৎকারে সচকিত হয় দুজনে।
“কোকিল, রাতুল কই?”
“আব্বু, রাতুল আব্বু কই তুমি?”

দুজনেই পাগলের মতো খুঁজছে রাতুল কে। তবে রাতুল নেই! রুমানা কান্না করে দিলো এবারে। মাহা চিৎকার করে নাহার, মেরিকে ডাকলো। রাতুলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তবে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। প্যাচাঁনো সিড়ির অগ্রমুখের ডানপাশে একটা গলি। এদিকটায় লাইটের আলো কম আসে বিধায় গলিটা সহজে চোখে পড়েনা। দুপাশে সাদা দেয়াল। সম্মুখেও সাদা দেয়াল। তবে ছোট একটা জানালা আছে। একপাশের দেয়ালে একটা ঘরের দরজা। রাতুল ছোট গলিটায় বসে কাঁদছে। মাহা, রুমানা অনেক খুঁজাখুঁজির পর রাতুল কে সেখান থেকে উদ্ধার করলো। ভয়ে কাঁপছে ছেলেটা। রুমানা ছেলেকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছে রাতুল।
“আব্বু, ভয় লাগছে?”
“হু”
“ভয় পেয়োনা। মাম্মা আছিনা।”
“মাম্মা, লক্ত। অনেক লক্ত।”

ভয় পেয়ে আবোল তাবোল বকছে রাতুল। তাই রুমানা আর সেসব কথায় পাত্তা দেয়নি। কোলে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ছেলেকে।
“আজ তবে আসি, কোকিল। ওর বাবা নিতে আসবে।”
“রাতুল কে আমার দেখে রাখা উচিত ছিলো। সরি রে রুমানা। আমার জন্য..
“তুই সব সময়ই বড্ড বেশি বকিস। তোর জন্য কিছুই হয়নি। ছেলেটা হয়েছে দুরন্ত। সব সময় খালি ছুটাছুটি।”

গেট থেকে রুমানাকে গাড়ি অবধি এগিয়ে দেয় মাহা। রুমানার স্বামী অনিক অপেক্ষা করছিলো গাড়ি নিয়ে। রুমানা গাড়ি থেকে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ কৃষ্ণবর্ণের এক লোকের পাশে জিদানের মতো কাউকে দেখলো মনে হলো। তারা মাহাদের বাড়িতে ঢুকছে। জিদান, রুমানার চাচাতো ভাই। কিন্তু জিদান এখানে কি করে! আদোও জিদান তো? নাকি ভুল দেখেছে রুমানা। গাড়ি অনেকদূর চলে এসেছে। তাই সেই ছেলেটিকে আর দেখা হয়নি রুমানার।

____________

“বাচ্চাটাকে মেরে ফেললেই হতো।”
“বোকার মতো কথা বলোনা। প্রাণের ভয় নাই।”
“কতদিন খাওয়া হয়না কাঁচা মাংস। কচি বাচ্চাদের মাংস!”

বলেই আফসোসের সুর তুলে লোকটা। কি বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে!

(চলবে)……

#অলকানন্দা
#পর্ব-৪২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১১৪.
“আপনি আর কখনো মা হতে পারবেন না মিসেস ফায়রাজ।”
আজ মাহার চেক-আপ ছিলো। ডাক্তারের বলা শেষ বুলিটাই কেবল ঘুরছে মাহার মাথায়। মাহা আর কখনো মা হতে পারবেনা! গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে মাহা। মনটা ভিষণ বিক্ষিপ্ত। সার্থক পাশে ড্রাইভিং করছে। ধূসর বর্ণের আকাশ। মন কেমন করে উঠা আকাশের মতিগতি। আজ মাহার সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশেরও বুঝি মন খারাপ? এক নির্জন রাস্তায় গাড়ি থামায় সার্থক। দুপাশে ঘন সুপারি গাছের বাগান। নাম না কত পাখির ডাক ভেসে আসছে! দুজনেই নিরব হয়ে রইলো। সহস্র সময় বাদে মুখ খুলে সার্থক।
“মাহা?”
মাহা আনমনে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। সার্থকের ডাক বোধহয় পৌঁছায়নি তার কানে।
“মাহা, শুনছো?”
মাহার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরালো সার্থক। চোখ দুটো উদাসীন মাহার। নিজের সিট বেল্ট খুলে শক্ত করে মাহাকে জড়িয়ে ধরে সার্থক। কি যে হলো মাহার! কান্নার বাঁধ ভাঙে এবার। জীবনটাই গেলো কাঁদতে কাঁদতে। এখন কান্নারাও হার মেনে গিয়েছে যেন। মাহা ছিল শান্ত, ধীর, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এক মেয়ে। কঠিন পরিস্থিতিও ঠান্ডা মাথায় কাজ করতো মাহা। আর আজ? কেন একজনের জীবনেই এত কষ্ট থাকে! একটু সুখের দেখা পেয়েও সেই সুখ ছোঁয়ার আগেই হারিয়ে গিয়েছে। নির্জনতা ছাপিয়ে আকাশে বাতাসে প্রতিফলিত হচ্ছে মাহার করুণ কান্নার সুর। এক হৃদয় ভাঙার সুর।
“চুপ, মাহা। আর না প্লিজ।”

মাহার কান্না যে সার্থকের সহ্য হয়না। অপারগ হয়ে বলে উঠে সার্থক। মাহার পিঠে হাত বুলায় অভ্যাসমত।
“আমি আর কখনো মা হতে পারবোনা সার্থক। আমি আপনাকে বাবা ডাক শোনার সুখ দিতে পারবো না। আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে সার্থক। আমার জন্য আপনি বাবা ডাক শুনতে পারবেন না।”
“চুপ, মাহা। আমার কিছু চাইনা। শুধু তুমি হলেই চলবে।”
“না, সার্থক। এটা হয়না। আপনি..আপনি আরেকটা বিয়ে করে নিন সার্থক। আমি চলে যাবো দূরে কোথাও।”
“বেশি বলে ফেললে না, তুমি? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি? এতো সাহস তোমার? কোথায় গিয়ে লুকাবে? পৃথিবীর যেই প্রান্তে যাও না কেন আমি সেখান থেকেই খুঁজে বের করবো তোমাকে, মাহা!”

মাহাকে ছেড়ে দিয়ে গর্জে উঠে সার্থক। মাহা হতভম্ব। সার্থক এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে ও কখনো ভাবেনি। সার্থক কোনোদিন মাহার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনা। গাড়িটা খুব দ্রুত চলছে। এমন সামান্য একটা কথায় সার্থক এতটা ক্ষেপে যাবে কল্পনাও করেনি মাহা। এ যেন অন্য সার্থক। এতটা রাগী! সারা রাস্তা আর একটা কথা বলার সাহস হয়নি মাহার।

______________

ঢাকার এক প্রসিদ্ধ বাস স্টেশন। আর কিছুক্ষণ বাদে বাস রওনা দিবে সিলেটের উদ্দেশ্যে। জানালার ধারে সিটে বসে শ্যামবতী এক পূর্ণ বয়স্ক রমনী। গাঁয়ে সাদামাটা হলদে রঙের শাড়ি। হাঁটু সমান চুলগুলোতে সবসময়ের মতো এলোমেলো বেণী। রমনীর চোখদুটো ভিষণ উদাস। আজ আবার বাবা-মাকে ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে পাড়ি জমাবে সিলেটে। সেই সাথে না হওয়া প্রিয় মানুষটাকেও। রেজওয়ানকে এক তরফা ভালোবেসেছে এশা। সেই ছোটবেলা থেকে। তাই তো প্রিয় মানুষটার দেওয়া সামান্য আঘাতই ক্ষত বিক্ষত করেছে এশার হৃদয়কে। পাড়ি জমিয়েছে সুদূর বিদেশে। অপরিপক্ক থেকে পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। পথটা বড়ই কঠিন ছিল। কিন্তু সেই মানুষটা? এতগুলো বছর কেটে গেলেও তিনি বিয়ে করেন নি কেন? ত্রিশের কোঠা পেরিয়েছেন সেই কবে। তবে কিসের এত অপেক্ষা? কার জন্য এত অপেক্ষা? পাখি তো নীড় ছেড়েছে বহুদিন আগে। হুম! মাহা অবুঝ হলেও এশা অবুঝ নয়। নিজের চোখে যে তৃষ্ণা ছিলো সেই তৃষ্ণা সে দেখেছে রেজওয়ানের চোখে। আফসোস! নিজের জন্য নয়। মাহা আপুর জন্য। এই কথাটা এশা কখনো কাউকে বলেনি। হৃদয়ের গোপন তালাবদ্ধ এক কুঠুরিতে যত্ন করে রেখেছিলো এতকাল। মাঝেমাঝে ভিষণ হিংসা হতো মাহা আপুর উপর। গাঁয়ের রঙের জন্যই কি তবে রেজওয়ানের ভালোবাসার রাণী মাহা? পরে আবার নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে সহস্রবার। না, রেজওয়ান এমন মানুষ নন। মাহার বিয়ের খবর শুনে এতটা খুশি হয়েছিলো এশা! এবার বুঝি রেজওয়ানকে আপন করে পাবে তবে। না, সেটাও হয়নি। একবুক ভালোবাসার বদলে মিলেছে এক আকাশ অপমান, অবহেলা আর উপেক্ষা। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে এশার বুক চিড়ে। ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার। হঠাৎ কি মনে করে জানালা দিয়ে পিছনে তাকায় এশা। এটা স্বপ্ন? রেজওয়ান দাঁড়িয়ে। তার গাড়ির সামনে। আশেপাশে কি যেন ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজে চলেছে। ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে এশার বাস। তবে কি এএসপি রেজওয়ান এশাকে খুঁজতে এসেছে? হা হা করে হেসে উঠে এশার অদৃশ্য এক ছায়া। ‘তোমাকে খুঁজতে আসবে? পাগল হলে? তুমি কি হও তার?’ সত্যিই তো এশা তো কিছু হয়না। কিছু না। এশা সন্তপর্ণে চোখের জল মুছে ফেলে। আবারও বাইরে তাকিয়ে রেজওয়ানের প্রায় মিলিয়ে যাওয়া অবয়বটাকে বলে,
“ভালো থাকবেন। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে আমাদের।”

রেজওয়ান হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কেউ কি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললো? রেজওয়ান এখানে এসেছিলো এশার সাথে কথা বলতে। এশার বাড়িতে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই জানতে পারে এশা আজ সিলেট চলে যাচ্ছে। বাস স্টেশনে তাই শেষবারের মতো আবার এসেছিলো ক্ষমা চাইতে। রেজওয়ান নিজেও জানেনা কেন এসব করছে? তবে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে ক্ষমা না পেলে তার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু এশাকে বহু খুঁজেও পেলোনা রেজওয়ান।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৪৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১১৫.
দুদিন যাবত সার্থক মাহার সাথে কথা বলছেনা। সার্থকের এমন অদ্ভুত আচরণে বিস্মিত মাহা। ছোট একটা কথাই তো বলেছে। এত রাগ করার কি আছে! এত বয়সে এসেও এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ কি মানুষ কে মানায়! মাহা তো নিজেও একটা খারাপ পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সার্থক কি একটুও বুঝতে পারছেনা মাহার বর্তমান পরিস্থিতি। দুয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে মাহা। সার্থক কোনো কথারই জবাব দেয়নি। তাই মাহাও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সব সময় এসব অদ্ভুত আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। এই তবে ভালোবাসা! বাগানের এককোণে একটা স্টিলের তৈরি দোলনা রয়েছে। দোলনায় বসে সামনে তাকালে নয়নাভিরাম চমৎকার। দূরে কেবল পাহাড় আর পাহাড়ের সারি। নেশা ধরে যায়। প্রকৃতির মাঝে বিলীন হতে মন চায়। মাহা আনমনে বসে আছে দোলনায়। আজ মন বিষণ্ণ। তাই শত চেষ্টা চালিয়েও প্রকৃতি তে বিলীন হতে পারছেনা মাহা। সার্থক বাসায় নেই। সকালেই বেরিয়ে পড়েছে। নাস্তাও খেয়ে যায়নি। তাই মাহাও খায়নি। মাহা বিষণ্ণ গলায় গুণগুণ করছে রবিঠাকুরের গান,

আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো।
আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝঙ্কারো ॥
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজে নি তা চরম তানে,
নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো ॥
লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না।
জ্ব’লে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস,
জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ……

চরণ পূর্ণ করার আগেই চুপ করে মাহা। কেউ কি পিছনে আছে? বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে কেউ দেখছে কি তাকে? বাতাস বইছে শো শো করে। মাহার হৃদপিণ্ড থমকে আছে অজানা কোনো আতঙ্কে। কেউ কি আছে! মনে হচ্ছে এগিয়ে আসছে মাহার দিকে। একেবারে কাছে। আর একটু হলেই ছুঁয়ে ফেলবে। মাহা হকচকিয়ে যায়। সেই ব্যাক্তি হাত বাড়াচ্ছে। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ…
মাহা পিছন ফিরে চায়। ডেভিড দাঁড়িয়ে। মাহা দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কালো বৃহদাকার দানবের মতো এক প্রাণ দাঁড়িয়ে মাহার সামনে। মাহা নিজের ওড়নাটা মাথায় টেনে দেয়। ডেভিড এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মাহার পানে। মাহা চলে আসতে নিলে ডেভিড পিছু ডাকে,
“এই শুনুন”

কি বিকট আর অদ্ভুতুড়ে গলার সুর। মাহা পিছু ফিরে বলে,
“আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ”

বলেই মাহার সর্বাঙ্গে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয় ডেভিড। মাহা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। বিরক্তি এবং রাগ উভয়ের সংমিশ্রণ হচ্ছে তার।
“আপনি এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার কি বলার কিছু আছে?”
এমন কথায় কিছুটা থতমত খায় ডেভিড। এশিয়ার মেয়েদেরকে তার বরাবরই ভালোলাগে। এই মেয়ে যেমন মায়াবী তেমনই তার দেহের গঠন। হিংস্রাত্মক কামনায় হাত কচলায় ডেভিড। মাহা কোনো উত্তর না পেয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে। এই বাড়ির মানুষগুলো বড়ই বিচিত্র। মেরি, নাহার, মুইংচিন এরা হঠাৎ করেই কোথায় যেন উদাও হয়ে যায়। কি যেন রহস্যময় আবহাওয়া বিরাজ করে চতুর্দিকে। ডেভিড দৌঁড়ে যায় মেরির ঘরে। দরজা আটকে দেয়। মেরি তখন সবে গোসল করে বেরিয়েছে। ডেভিড মেরিকে শক্ত করে জড়িয়ে এক উত্তপ্ত চুমো খায়। তারপর পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরির উপর। মেরি প্রথমে খানিক অপ্রস্তুত হলেও পরে ডেভিডের ডাকে সাড়া দেয়। নিজের কামনা মিটিয়ে যখন ডেভিড ফিরে আসতে চাইলো তখন মেরি জড়িয়ে ধরে ডেভিড কে। ডেভিড এক ঝটকায় সরিয়ে দেয় মেরিকে। প্রত্যেকবারের মতো এবারেও কষ্ট পায় মেরি।
“আমাকে কেন বারবার ব্যবহার করো তুমি? আমি কি দোষ করেছি?”
“চুপ!”
“কেন চুপ করবো আমি!”
মেরি চিৎকার করতে নিলে ডেভিড তার মুখ চেপে ধরে। রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
“তোমরা সাদা চামড়ার মানুষ। আমি সাদা চামড়ার মানুষদের ঘৃণা করি।”
“তাহলে বারবার আমার কাছে কেন আসো?”
“চাহিদা মেটাতে। তুমি আমার ভোগ্যবস্তু।”
“খবরদার ডেভিড। মুখের ভাষা ঠিক করো।”

মেরি কে ছেড়ে দিয়ে হা হা করে হেসে উঠে ডেভিড। মেরির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“মাহা সকল সৌন্দর্যের ঊর্ধ্বে।”

বলেই শার্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায় ডেভিড। পাশে থাকা ফুলদানিটা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে মেরি। মাহা, মাহা আর মাহা। লুবান, রবার্ট, সার্থক সবার কেবল একজনকে নিয়েই কেন এত আগ্রহ! কি আছে এই মেয়ের! এখন আবার ডেভিড যুক্ত হলো। নিভা ঠিকই বলতো মাহা মেয়েটা ধ্বংস ডেকে আনবে। এত বছরের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এই মেয়ের কারণে। যেই ধ্বংসের খেলা শুরু হয়েছে অনেক আগেই এবার সেটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। হুট করেই মাহার প্রতি এক ক্ষোভ জন্ম নেয় মেরির।

১১৬.
“কোকিল রে আমার রাতুল কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!” ফোনের উপারে কথাটা বলেই কেঁদে উঠে রুমানা।
“মানে! কি সব বলছিস রুমানা!”
বিস্মিত কন্ঠস্বর মাহার।
“প্লিজ, মাহা। তুই একটু রেজওয়ান ভাইকে আসতে বল। চব্বিশ ঘণ্টা না হওয়ায় পুলিশ কেস নিতে চাচ্ছেনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহা। অনিক পাগলের মতো সারা শহর খুঁজে এসেছে। কোথাও পায়নি আমার রাতুল কে।”
“শান্ত হ প্লিজ। আমাকে একটু বল কখন হারিয়েছে রাতুল?”
“প্রি-স্কুল থেকে প্রতিদিন অনিকই রাতুলকে নিয়ে আসে। আজকে অনিকের একটু লেট হয় যেতে। গিয়ে দেখে রাতুল নেই। সিকিউরিটি গার্ডও বলতে পারছেনা রাতুল কোথায় গেছে। এখন রাত দশটা আমার মানিক কে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কি করছে, কেমন আছে কিছু জানিনা। পুলিশ স্টেশনে গেলাম তারা কিছুই করছেনা। তুই প্লিজ রেজওয়ান ভাইকে কল করে বল উনি যেন সিলেট পুলিশ স্টেশনে একটু যোগাযোগ করেন।”
“আচ্ছা, তুই টেনশন করিস না। আমি দেখছি কি করা যায়।”

রুমানার কল কেটে রেজওয়ান কে কল দেয় মাহা। রেজওয়ানের মোবাইল বন্ধ। খোলা থাকবে কি করে সে তো এখন ফ্লাইটে। বিশেষ প্রয়োজনে কয়েকমাসের জন্য বিদেশ যাচ্ছে। এদিকে বারবার ফোন দিয়ে মোবাইল বন্ধ পাচ্ছে মাহা। তাই সাবিনা বেগম কে কল করে মাহা। রেজওয়ানের বিদেশ যাত্রার খবর শুনে চিন্তায় পড়ে যায় সে। এখন কি হবে! রুমানার বাড়ির এড্রেস মাহার জানা আছে। তাহলে কি সার্থক কে একবার বলবে নিয়ে যেতে? বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে মাহা। সার্থক কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে হাসপাতাল থেকে। সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে সার্থক।
“শুনছেন?”

কোনো জবাব নেই। মাহার হঠাৎ কি যে হলো। প্রচন্ড রাগে সে বললো,
“রুমানার ছেলে রাতুল হারিয়ে গিয়েছে। আপনি কি আমার সাথে যাবেন? নাকি আমি ড্রাইভার কে নিয়ে চলে যাবো?”
“কি!”
অবাক হয় সার্থক। সেসব দেখার সময় মাহার নেই। ও ওড়না মাথায় পেচিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সার্থকও ছুটলো মাহার পিছুপিছু। কিন্তু মন বলছে অন্য কথা। তবে কি সার্থকের ধারণা সঠিক! যদি এর পিছনে সত্যতা পায় তাহলে কথার খেলাপ করার জন্য ভয়াবহ শাস্তি পাবে সেই ব্যাক্তি।

(চলবে)….

#অলকানন্দা
#পর্ব-৪৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১১৭.
“কোকিল, কোকিল রে আমার রাতুল কই চলে গেলো! আমার মানিক।”

মাহাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো রুমানা। এশা পাশে দাঁড়িয়ে। পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে সে।
“আমার মা মারা যাবার পর এই পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ ছিলোনা। মাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম তুই তো জানিস, কোকিল। আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। অনিক আমাকে রাতুল এনে দিলো। আমার স্বর্গসুখ। আজ কই গেলো আমার মানিক।”

চিৎকার করে কান্না করছে রুমানা। মাহা নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা। সার্থক অনিকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অনিকের মুখ গম্ভীর। চোখেমুখে গভীর বেদনা ভেসে উঠেছে। সার্থক জিজ্ঞেস করে,
“পুলিশকে জানিয়েছেন?”
“জানিয়েছি। প্রথমে তারা অভিযোগ নিতে চাচ্ছিলো না। পরে উপর মহলের সাথে কথা বললাম। তারা বললো সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। এতঘন্টা পেরিয়ে গেলো কোনো খোঁজই তারা দিতে পারছেনা।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিক। ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। রুমানা তো মেয়ে। তাই হাউমাউ করে কান্না করে নিজের বুকের ব্যথা প্রকাশ করতে পারছে। কিন্তু অনিক! বাবা হয়েও সে চাইলেই কাঁদতে পারছেনা। অনিকের যে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সার্থক কেবল চেয়ে আছে। স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। নিজের সন্তান হারিয়ে ঠিক এভাবেই ভেঙে পড়েছিলো সে। সব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলো আপনার চেয়েও আপনজনের সাথে। তা কি হয়! এই জীবন যে সার্থকের জীবন! ‘অ্যা হ্যাপি ফ্যামিলি’ যে সার্থকের জীবনে মানায় না। অনিকের বাবা-মা নেই। রুমানার মতো সেও এতিম। দুজনের সুখী পরিবার যেন রাতুলের আগমনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। আজ কোথায় আছে সেই রাতুল! অজানা! রুমানাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে মাহাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠে সেই পুরানো স্মৃতি। মেয়েটা! ক’ব’রে একা শুয়ে। মাহাকে ডাকছে। মাহাকে ভিষণ প্রয়োজন। মাহা সোফায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তড়িৎ গতিতে সার্থক ধরে ফেলে মাহাকে। রুমানা তখন নিজের মাঝে নেই। এশা এগিয়ে আসে।
“ভাইয়া, মাহা আপুর কি হয়েছে?”
অনিকও চিন্তিত। সার্থক মাহাকে কোলে নেয়।
“প্রেশার ফল করেছে। আমি ওকে নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছি।”

এশা আর বাঁধা দিলোনা। সার্থক একবার রুমানার পানে তাকায়। রুমানার কোনো খোঁজ খবর নেই। বিলাপ করে যাচ্ছে। মাহাকে কোলে নিয়ে অনিকের সামনে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়ায় সার্থক।
“চিন্তা করবেন না মিঃ অনিক। আপনাদের বাচ্চা ফিরে আসবে।”

বলেই বেরিয়ে পড়ে সার্থক। মাহাকে পিছনে শুইয়ে দিয়ে ড্রাইভ করছে সার্থক। অবচেতন মন বারবার বলছে, ‘এটা মেনে নেওয়া যায় না। সন্তান তুমিও হারিয়েছো। মর্ম বুঝতে পারো। কতটা কষ্ট হয় বুঝতে পারো।’
বাড়ি ফিরে মাহার শরীরে ইনজেকশন পুশ করে সার্থক। মাহা গভীর ঘুমে।

১১৮.
“বাচ্চাটা কোথায়?”
“জানিনা”
“সত্যিই জানোনা?”
“না।”
“মিথ্যা বলোনা। আমি মিথ্যা পছন্দ করিনা।”

ছায়া মানবের প্রশ্নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তি নিশ্চুপ।
“চুপ কেন? জবাব চাই আমার!”

টেবিলে ঘুষি দিয়ে চিৎকার করে ছায়ামানব। নিচে বসে থাকা ব্যাক্তি কেঁপে উঠে। এতদিন অন্যের ক্ষেত্রে ছায়ামানবের এই ভয়াবহ রূপ দেখতো ব্যাক্তিটা। আজ দেখছে নিজের বেলায়।
“কি হলো! কথা বলো!”
“আমি কিছু করিনি।”

টেবিলের উপর থেকে নিরবে মাউথ অর্গান তুলে নেয় ছায়ামানব। বাজাতে থাকে পাগলের মতো। অদ্ভুতুড়ে সে সুর! শরীর কাঁপানো, মন ভুলানো সে সুর। মানবদেহে হাজারো বিষ পিঁপড়া ছেড়ে দিলে পিঁপড়াগুলো যখন সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। বিষাক্ত একেকটা কামড়ে দেহে যেমন ব্যথা অনুভব হয় ঠিক তেমন ব্যথা অনুভব হয় মস্তিষ্কে। ব্যাক্তিটা মাথা চেপে ধরে বলে,
“বন্ধ করো। প্লিজ। আমি সব বলছি।”

বাঁকা হেসে মাউথ অর্গান বাজানো বন্ধ করে ছায়ামানব।
“কোথায় বাচ্চাটা?”
“খেয়ে ফেলেছি।”
“হোয়াট!”

অবাক হয় ছায়ামানব। রাগ দমন করা দায় হয়ে পড়ে তার জন্য।
“কেন এমন করলে তুমি!”
“টুমি জানোনা আমি বাচ্চাদের কচি মাং’স বালোবাসি।”
“চুপ!”

ভয়ংকর চিৎকার করে উঠে ছায়ামানব। সামনে থাকা ব্যাক্তিটা আর কিছু বলার সাহস পায়না।
“আমি মানা করেছিলাম না?”

ভয়াবহ নিরবতা চারপাশে। বহুদিন বাদে আবারো তরল গলগলে উষ্ণ রক্তিম পদার্থে রাঙা হয় ছায়ামানবের শরীর। দেহ খন্ড বি’খ’ন্ড করার সময় প্রথম বারের মতো একটু কেঁপে উঠে ছায়ামানব। যেমনটা বাবাকে করার সময় হয়েছিলো। আজ বহুবছর পর বিশস্ত ব্যাক্তিটা কে হত্যা করলো ছায়ামানব।

_____________

মাহা বিষণ্ণ হয়ে থাকে এখন। কয়েকবার রুমানার বাড়িতেও গিয়েছিলো মাহা, সার্থক। রুমানা বদ্ধ উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছে। আজ রাতুল হারিয়ে যাওয়ার পনেরো দিন চলছে। কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি রাতুলের। রেজওয়ান কথা বলেছে সিলেট পুলিশের সাথে। তারা চেষ্টা করছে। হঠাৎ সার্থক বাইরে থেকে এসে বললো,
“মাহা, চলো।”
“কোথায়?”
“পুলিশ স্টেশনে।”
“কেন?”
“রাতুল কে যে অপহরণ করেছে তার সন্ধান মিলেছে। স্কুলের কিছুটা সামনে এক সিসিটিভি থেকে পুলিশ অপরাধীকে শনাক্ত করেছে।”

বাকি কথাগুলো আর শুনেনি মাহা। গাড়িতে করে কখন পুলিশ স্টেশনে পৌঁছালো তা সে নিজেও জানেনা। এশা, রুমানা আর অনিক বসে আছে৷ মাহা রুমানার কাছে ছুটে যায়। রুমানার মুখে আজ খানিক হাসি। রাতুল কে আবার ফিরে পাবে তারা। পুলিশ অফিসার অনিক এবং সার্থক কে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। বাইরে রুমানার পাশে এশা আর মাহা বসে।
“আমার রাতুল কে আবার ফিরে পাবো কোকিল। আমার মানিক আমার বুকে ফিরবে।”

সময় যাচ্ছে। একেকটা সেকেন্ড যেন এক বছরের সমান। অনেকক্ষণ বাদে সার্থক, অনিক বেরিয়ে আসে। অনিকের মুখ রক্তশূণ্য। সার্থকেরও মুখ গম্ভীর। রুমানা দৌড়ে অনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“রাতুলকে ওরা খুঁজে পেয়েছে, অনিক?”

অনিক অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে রুমানার দিকে।
“কথা বলছো না কেন তুমি? আমার রাতুল কই?”

অনিক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুমানাকে। সমাজের সব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে অনিক। রুমানা স্তব্ধ হয়ে যায়। অনিকের মতো ছেলে কাঁদছে!
“আমাদের রাতুল আর আমাদের মাঝে ফিরবেনা রুমানা। তোমার ভাই জিদান সম্পত্তি না পাওয়ার ক্ষোভে আমাদের বাচ্চাটাকে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে রুমানা। আমাদের রাতুল আর নেই।”

রুমানা জ্ঞান হারায়।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৪৫
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১১৯.
সিলেটের আবহাওয়া বড়ই অসহনীয় হয়ে উঠেছে রুমানার কাছে। জিদান তার কলিজাকে মেরে ফেলেছে! কি করে পারলো! এত ছোট একটা বাচ্চাকে মেরে ফেলতে। সম্পত্তির লোভ কি এতটাই তীব্র! অনিক রুমানাকে নিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছে। আজ একমাস হলো। সেদিন জ্ঞান ফিরার পর থেকে রুমানা খুবই পাগলামি করছিলো। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বললেন এখান থেকে দূরে কোথাও রুমানাকে নিয়ে যেতে। তারপরই রুমানাকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমায় অনিক। মাহা এই ঘটনায় খুবই ভেঙে পড়েছে। এই অচেনা শহরে একজন ভালো বন্ধু ছিলো। সেও ছেড়ে চলে গেলো। রাতুলকে যেন মস্তিষ্ক থেকে সরাতেই পারছেনা মাহা। ছোট বাচ্চাটা। কি মায়াবী! দীর্ঘশ্বাস আসে মাহার বুক চিড়ে।

এই বাড়ির ছাদটা ভিষণ সুন্দর। নাহার বাড়ির খেয়াল রাখে। ছাদটা মনোরম করে সাজিয়েছে নাহার। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা। ছাদের মাঝখানে দোলনা রাখা। মাহা প্রায়শই আসে ছাদে। সার্থক বাসায় না থাকলে একাই সময় কাটে মাহার। কখনো ঢাকা থেকে আনা বই পড়ে, কখনো খাঁচায় বন্দী পাখিগুলোর সাথে কথা বলে। বাইরে বের হতে বেশি একটা ইচ্ছে করেনা। ডেভিডের নজর ভালো না। কেমন চোখে যেন তাকায়। সেই লুবানের মতো নোংরা নজর। পড়ন্ত বিকেল। স্বচ্ছ হিমেল হাওয়া বইছে। আকাশটা একদম রক্তবর্ণ। লাল টকটকে হয়ে আছে। কিছু পাখি ফিরছে নীড়ে। মাহা দোলনায় বসে আকাশ পানে চেয়ে আছে। নিজেকে অপয়া মনে হয়। সে যার সংস্পর্শে যায় তারই ক্ষতি হয়। প্রথমে চৈতি, এবারে রুমানা। সার্থককেও বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারেনি। লোকটা দ্বিতীয় বিয়েও করতে চায় না। একবার বলার পরই কতদিন কথা বলেনি। হঠাৎ পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে গা শিউরে ওঠে মাহার। অন্ধকার হয়ে এসেছে। আকাশের রক্তিম আভা সরে কালোর দল হানা দিচ্ছে। মাহা পিছনে না ফিরে উঠে দাঁড়ায়। আজকাল মুইংচিন কে বাসায় দেখা যাচ্ছেনা। খাজা নামের বিশাল দেহী লোক আর ডেভিডের হরহামেশাই চলাচল ঘটে বাড়িতে। মূলত মাহা এ কারণেই বাইরে বের হয়না। ডেভিড কে সুবিধার মনে হয়না তার। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ঝাঁপটে ধরলো মাহাকে। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিশালদেহী মানবটার থেকে কোনো ক্রমেই নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা মাহা।
“অনেকদিন পর পেলাম তোমায়। জানি মৃত্যু আমার হবেই। তোমাকে ছুঁয়ে দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু তারপরও একবারের জন্য হলেও তোমাকে চাই।”

ডেভিড? ডেভিডের কন্ঠস্বর না এটা। মাহা চিৎকার করে উঠে।
“আমাকে ছেড়ে দিন।”

হা হা করে হেসে উঠে ডেভিড। আজ মাহাকে সে কোনোক্রমেই ছাড়বেনা। মাহা নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। তবে বিশালদেহী মানবের কাছে মাহা যে বড়ই অসহায়। মাহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মাহার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়ায় ডেভিড। মাহা শত চেষ্টা করেও তাকে সরাতে পারছেনা। মাহার দুটো হাত ডেভিড ধরে রেখেছে। এক পর্যায়ে মাহা নিজের হাঁটু দিয়ে ডেভিডের গোপনা’ঙ্গে আঘাত করে। ডেভিড একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে মাহাকে ছেড়ে দেয়। ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে তার। মাহা দৌড়ে ছাদের দরজার কাছে যায়। দরজা খোলার কালে ডেভিড দৌড়ে আসে। মাহার উড়না মাটিতে পড়ে আছে। ডেভিড মাহার থ্রি-পিসের হাতাটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো। মাহার উপর প্রবল আক্রমণ করে সে। মাটিতে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ডেভিডের হাত মাহার পায়জামা স্পর্শ করেছে। যেকোনো সময় টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। মাহার মুখ অপর হাত দিয়ে ধরা। মাহা চিৎকার করতে পারছেনা। কেবল গোঙাচ্ছে। তার মন চিৎকার করে বলছে,
“সার্থক। সার্থক কোথায় আপনি? আমাকে রক্ষা করুন সার্থক।”

মাহার ধস্তাধস্তিতে রাগ উঠে যায় ডেভিডের। থাপ্পড় লাগায় মাহার গালে। হলদে ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে উঠে। মাহা আর পারেনা। শরীর ছেড়ে দেয়। আজ হয়তো ও আর নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারবেনা। তখনই ডেভিডের মুখে তীব্র আক্রোশে ঘুষি লাগায় কেউ। মাহার উপর থেকে ছিটকে সরে যায় ডেভিড। লাল টকটকে হয়ে আছে সার্থকের চোখমুখ। মাহা সার্থক কে দেখার সাথে সাথেই জ্ঞান হারায়।

ডেভিড হকচকিয়ে যায়। শরীর নরম হয়ে আসে তার। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। নিজের মৃত্যু নিজের চোখে দেখতে পারছে সে। পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে আঁকড়ে ধরে সার্থক। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“বুক কাঁপলো না একবারও?”

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে ডেভিডের। হঠাৎ সে টের পায় তার গলায় সূক্ষ্ম আঘাত। ছাদের কৃত্রিম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ডেভিড। সার্থক মাহাকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে। জামা পাল্টে দেয় মাহার। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে মাহার ঘুমন্ত মুখমণ্ডলের পানে। মাহার চুলে হাত বুলায়। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে মন চাইছে তার। তার ফুল, তার অলকানন্দা। ডেভিড কি করে পারলো তার ফুলে আঘাত করতে!
“আমি তোমার জন্য আমার সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিবো, অলকানন্দা।”

মাহার কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। একটা ইনজেকশন পুশ করে মাহার হাতে।

__________

ওয়েন্ডিগো এক তীব্র মাংসাশী প্রাণী। নিজের শিকার কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে আহারেই তার সুখ। আজ বহুদিন বাদে মানুষের মাং’স গ্রহণ করে ছায়ামানব। বুক চিড়ে টকটকে লাল হৃদপিণ্ডে কামড় বসায় সে। নিজের শত্রুর মাং’স গ্রহণে সে যে বড়ই মজা পায়।

১২০.
“আমার ডেভিড কোথায়?”

মেরির চিৎকারে ঠোঁটে হাত দিয়ে চুপ থাকতে বলে সার্থক। মেরি আক্রশে ফেটে পড়ে।
“কেন চুপ থাকবো আমি? আমার ডেভিড কে আমার ফেরত চাই।”
“ডেভিডের নাম আরেকবার উচ্চারণ করলে কি যে হবে তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা।”

সার্থকের ঠান্ডা আর শান্ত বুলিতে থমকে যায় মেরি। কোনো কথাই সে আর বলার মতো পায় না। সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ে মাহার উপর।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে মাহা। মাথাটা ভিষণ ভারী লাগছে। সে গতকাল বিকেলে ছাদে দোলনায় বসেছিলো। পরে? পরে কি হলো? কোনোভাবেই মনে পড়ছেনা।
“মাহা, উঠে গেছো। কাল তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। আমি ছাদে উঠে দেখি তুমি দোলনা থেকে নিচে পড়ে আছো।”

সার্থকের কথায় অবাক হয় মাহা। সে নিচে পড়ে গিয়েছিলো? তার তো মনে পড়ছেনা!
“আমার কিছুই মনে পড়ছেনা সার্থক।”
“মনে থাকবে কি করে? জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিলো ম্যাডাম। আমাকে অশান্তিতে রেখে কি মজা পান বলেন তো? আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম জানো তুমি?”

মাহার নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বলে সার্থক।
“যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি স্যূপ নিয়ে এসেছি।”
“হুম”

চলবে….

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।